Banner
নেপাল ও বাংলাদেশের রাষ্ট্র ( রিপাবলিক) গঠন প্রক্রিয়ার মিল-অমিল — হাবিবুর রহমান

লিখেছেনঃ হাবিবুর রহমান, আপডেটঃ December 16, 2017, 12:00 AM, Hits: 2647

ক. ভুমিকা

আমাদের এই  অঞ্চলে ( দক্ষিণ এশিয়া ) সশস্ত্র গণযুদ্ধ বা  গণঅভ্যুত্থান  হয়েছে  অনেকগুলো। এসব গণযুদ্ধ বা  গণঅভ্যুত্থান কোথাও সফল হয়েছে, কোথাও  ব্যর্থ হয়েছে। কোথাও আবার নির্বাচন গণ অভ্যুত্থান ও গণযুদ্ধ সংগঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা পালন করেছে। তবে সশস্ত্র বিপ্লব বা গণযুদ্ধ অথবা গণ অভ্যুত্থান  শেষে  গণপরিষদ বা সংবিধান  সভার  প্রতিনিধি  নির্বাচন হয়েছে  এবং  সেই  প্রতিনিধিদের নিয়ে সভা ডেকে এক নতুন গঠনতন্ত্র বা সংবিধান রচনা তথা রাষ্ট্রগঠনের পুরো প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয়েছে এবং এরপর রেফারেন্ডাম ডেকে কনষ্টিটিউশন বা সংবিধানের গণ-অনুমোদন নেয়া হয়েছে – এভাবে নিয়ম পদ্ধতি মেনে কোথাও রাষ্ট্রগঠন হয় নাই। এই দিক থেকে নেপালের রাজতন্ত্র উপড়ে ফেলে নতুন রিপাবলিক রাষ্ট্র গঠন আমাদের এ অঞ্চলে সবার চেয়ে ব্যতিক্রম।

একটা গণপরিষদ বা সংবিধান সভার মাধ্যমে নতুন রিপাবলিক গড়া - এই পুরো প্রক্রিয়াটা দুটো ভাগে ভাগ করা যায়।  প্রথম ভাগ হল সশস্ত্র বিপ্লব বা গণঅভ্যুত্থান ঘটানোর পর ক্ষমতা নেয়া। আর দ্বিতীয় ভাগ হল নির্বাচনের মাধ্যমে সংবিধান সভা গঠন করে রাষ্ট্রগঠন সম্পন্ন করা। এভাবে পুরো দুটো প্রক্রিয়ার ভিতর দিয়ে একটা আধুনিক রিপাবলিক রাষ্ট্র গঠন - এই কাজ নেপাল ব্যতীত এই অঞ্চলের আর কোথাও হয়নি। প্রায় সব দেশেই রাষ্ট্রগঠন হয়েছে কোন না কোন ভাবে আপোষ করে, অসম্পুর্ণতা রেখে, ফাঁকি দিয়ে। বেশির ভাগ দেশের ক্ষেত্রেই রাষ্ট্র হয়েছে না কোন সশস্ত্র বিপ্লব করে, না কোন  গণঅভ্যুত্থান ঘটিয়ে। যেমন ভারত বা পাকিস্তানের বেলায় ১৯৪৭ সালে এটা হয়েছে আপোষে, ঔপনিবেশিক শাসকের হাত ধরে, ক্ষমতার হস্তান্তর নিয়ে এক টেবিলে বসে আলোচনা করে। এই আপোষ ধারার সবচেয়ে অসুবিধা বা দুর্বলতার  দিক হল, এতে পুরানো রাষ্ট্রের বহু দায়, জরুরি অবশেষ নতুন রাষ্ট্রের ভিতর ঢুকে যায়। অর্থাৎ রাষ্ট্রের প্রকৃত পরিবর্তন ঘটে না। অবশ্য বাংলাদেশ ব্যতিক্রম। দেশটি  গণঅভ্যুত্থান ও সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের ভিতর দিয়ে জন্ম নিলেও এবং এরপর গণপরিষদ গঠন করে (যদিও প্রশ্নবিদ্ধ ) সংবিধান প্রণয়ন করা হলেও নতুন রাষ্ট্রকে পুরনো উপনিবেশিক রাষ্ট্রের (ব্রিটিশ ও পাকিস্তান) সকল কালাকানুন আর নানান আবর্জনার দায় বয়ে বেড়াতে হচ্ছে। বলতে গেলে পুরনো রাষ্ট্র প্রায় অবিকল বহাল থেকে গেছে।

নাগরিকের রায়ে সংবিধান সভা গঠন করে রাষ্ট্রগঠনের কাজ যে বিশেষ গুরুত্বপুর্ণ অধ্যায় – বিশেষ করে যেখানে ‘কনষ্টিটিউট’ শব্দের অর্থ বুঝে এই অধ্যায় সম্পন্ন করা দরকার – সেটা  এ অঞ্চলে একমাত্র নেপাল যথাযথভাবে সম্পন্ন করেছে। আমরা দেশ স্বাধীন করা বুঝি। কিন্তু এর পরেও রাষ্ট্রগঠন বলে আলাদা অধ্যায় আছে তা খুবই কম রাজনীতিকের কাছে স্পষ্ট। বরং দেশ স্বাধীন মানে সব হয়ে গেছে ভাবি।

ইংরেজি ‘কনষ্টিটিউট’ শব্দের এখানে অর্থ হল ‘গঠন’। হবু রাষ্ট্রের গঠন উপাদান হল নাগরিক-মানুষ। এদের সকলকে ( কাউকে, সমাজের কোন অংশকে শোনা হয় নাই, উপেক্ষায় ফেলে রাখা হয়েছে বা রাখার সুযোগ নেয়া হয়েছে এমন নয়) সাথে নিয়ে এক রাজনৈতিক কমিউনিটি গঠন। জনগণের একসাথে মিলে একটা একক  রাজনৈতিক সত্ত্বা হয়ে ওঠা – এটাকেই ‘কনষ্টিটিউট’ বা গঠন করা বলে। গঠন কাজটা সম্পন্ন হলে পরে এরই লিখিত বা গাঠনিক দলিল হল গঠনতন্ত্র বা ‘কনষ্টিটিউশন’। এখানে আর এক গুরুত্বপুর্ণ বিষয় হল – কনষ্টিটিউশনাল এসেম্বলি বা সংবিধান সভা। এই সংবিধান সভা বা গণপরিষদ আমাদের বহুল পরিচিত পার্লামেন্ট বা সংসদ নয়। এই দুইয়ের গুরুত্বপুর্ণ ফারাক হল, সংবিধান সভার নির্বাচন হয় সংবিধান বা শাসনতন্ত্র প্রণয়নের লক্ষ্যে। শাসনতন্ত্র প্রণয়ন ও অনুমোদন হয়ে যাবার পর ঘোষণা হয়ে গেলে এই পরিষদ চিরদিনের মত বিলুপ্ত হয়ে যায় বা ভেঙ্গে যায়। বিপরীতে পার্লামেন্ট বা সংসদের ভুমিকা এরপর থেকে শুরু হয়। সংবিধান সভা বা গণপরিষদে গৃহীত শাসনতন্ত্র অনুযায়ী  সংসদ  নির্বাচন  অনুষ্ঠিত  ও  সদস্য  নির্বাচন  করা হয়।  এরপর  সংখ্যাগরিষ্ঠরা সরকার গঠন করে, আর নির্বাচিত সদস্যরা সকলে সংসদে বসে ঐ গৃহীত সংবিধান বা শাসনতন্ত্রের অধীনে, সীমায় থেকে আইন প্রণয়ন করে থাকে।

সারকথা হল, রাষ্ট্রগঠনের আগে গণপরিষদ থাকে সর্বেসর্বা। গণপরিষদের মূল কাজ সংবিধান বা শাসনতন্ত্র প্রণয়ন। শাসনতন্ত্র প্রণয়নের পর সংবিধান সভা বিলুপ্ত হয়ে যায়। আর গৃহীত শাসনতন্ত্রের  অধীনে  ও  সীমার  মধ্যে থেকে এবং এর সাথে অ-সাংঘর্ষিক থেকে নতুন আইন প্রণয়ন সংসদের কাজ। এছাড়া গণপরিষদ ও  সংসদের সদস্য কারা হবেন, কত জন হবেন তা সাধারণত এক হয় না। সাধারণত সংবিধান সভার সদস্য সংখ্যা বেশি হয়ে থাকে। কোন বিশেষ পেশা বা সামাজিক গোষ্ঠীকে বিশেষভিত্তিক বাড়তি প্রতিনিধিত্ব দেয়া হতে পারে। যেমন, নারীর আলাদা বাড়তি প্রতিনিধি থাকতে পারে। অথবা পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠি যেমন পাহাড়িদের বাড়তি কিছু প্রতিনিধি নেয়া হতে পারে। কিন্তু  সংসদ নির্বাচনের বেলায় এই বাড়তি আসনগুলো থাকে না।

এ নিবন্ধে আলোচনা করা হয়েছে নেপালে কি প্রক্রিয়ায় এবং কোন রাজনীতি গণতান্ত্রিক সংবিধান প্রণয়ন তথা রিপাবলিক গঠনে মূল ভুমিকা পালন করেছে। পাশাপাশি বাংলাদেশ ভূখণ্ডের জনগণের রিপাবলিক গঠনের আকাংখা কেন পরিণতি পেল না তা সংক্ষেপে তুলে ধরার চেষ্টা করা হয়েছে।

 

ক. নেপাল

The constitution of Nepal, 2072 সংবিধান সভায় গৃহীত হলে ২০১৫ সালের ২৪ সেপ্টেম্বর নেপাল পৃথিবীর সর্বকনিষ্ঠ রিপাবলিক হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। এটা নেপালের ৭ম সংবিধান। অর্থাৎ এর আগে আরও ৬টি সংবিধান প্রণীত হয়েছে। উক্ত ৬টি সংবিধানের মধ্যে ৫টি রাজতন্ত্র বহাল রেখেছিল। এসব সংবিধানে কখনো রাজা একক ও সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী ছিলেন। আবার কখনো রাজাকে ক্ষমতা ভাগাভাগি করতে হয়েছে। তবে এগুলোর কোনটাই প্রকৃত অর্থে গণতান্ত্রিক সংবিধান ছিল না। সংবিধানগুলো হল –

1. Government of Nepal Act, 1948. এটি নেপালের প্রথম সংবিধান যা ১৯৪৮ সালের ১ এপ্রিল থেকে কার্যকর হয়। এই সংবিধানে রাজতন্ত্রের অধীনে থেকে নেপালে প্রথম তবে নিয়ন্ত্রিত সংসদীয় ব্যবস্থা চালু করা হয়। এতে দ্বিকক্ষ বিশিষ্ট আইনসভার সদস্যদের মনোনীত করার একক ক্ষমতা প্রধানমন্ত্রীর হাতে অর্পণ করা হয়। তিনি আইনসভার সদস্যদের সিদ্ধান্ত রদ বা পরিবর্তন করার ক্ষমতাও রাখেন।

2. Interim Government of Nepal Act, 1951. রাজা ত্রিভুবন বীর বিক্রম এ সংবিধান  জারী করেন। এর মাধ্যমে প্রথম সংবিধানের হ্রাস করা রাজার ক্ষমতা পুনরুদ্ধার করা হয়। অর্থাৎ পুনরায় নিরুঙ্কুশ রাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করা হয়।

3. The Constitution of the Kingdom of Nepal, 1959. নেপালের জনগণের আন্দোলনের এক পর্যায়ে রাজা মহেন্দ্র বীর বিক্রম শাহ বিভিন্ন দলের অংশগ্রহণে নেপালের পার্লামেন্ট নির্বাচনের প্রাক্কালে এই সংবিধান  জারী করেন।

4. The Constitution of Nepal, 1962. এটাকে পঞ্চায়েত ব্যবস্থা প্রবর্তনের সংবিধান বলা হয়। এই সংবিধান জারীকালীন সময়ে রাজা মহেন্দ্র বীর বিক্রম শাহ পার্লামেন্ট বিলুপ্ত করেন এবং সকল রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ করেন। এতে স্থানীয় পরিষদ গঠনের ব্যবস্থা রাখা হয় এবং এর মাধ্যমে নিরুঙ্কুশ রাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করা হয়।

উক্ত ৪টি সংবিধানের মধ্যে প্রথম সংবিধান ব্যতীত বাকি সংবিধানগুলোতে রাজাকে একক ও সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী করা হয়েছিল। অবশ্য ক্ষমতার ভাগাভাগি হলেও প্রথম সংবিধানেও জনগণকে কোন ক্ষমতা দেয়া হয়নি।

5. The Constitution of the Kingdom of Nepal, 1990. ব্যাপক গণ আন্দোলনের মুখে রাজা বীরেন্দ্র বীর বিক্রম শাহ পঞ্চায়েত ব্যবস্থা বিলুপ্ত করে এই সংবিধান জারী করতে বাধ্য হন। গণআন্দোলন সংগঠনে নেপালের কমিউনিস্ট দল ও গ্রুপগুলো  অধিক গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা পালন করে। এতে রাজার ক্ষমতা হ্রাস করে সাংবিধানিক রাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করা হয়। এর ফলে বহুদলীয় সংসদীয় সরকার গঠনের পথ উম্মুক্ত হয়। রাজতন্ত্রের অধীনে থেকে প্রধান দুটি দল – নেপালি কংগ্রেস ও সিপিএন(ইউএমএল) অস্থায়ী সরকার গঠন করে। অস্থায়ী সরকারের অধীনে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। ব্যাপক কারচুপির এ নির্বাচনে নেপালি কংগ্রেস জয়লাভ করে সরকার গঠন করে।

ষষ্ঠ ও ৭ম সংবিধান বাস্তবায়নের মধ্যদিয়ে ২৪০ বছরের শাহ রাজবংশের রাজত্বের অবসান ঘটে যা পরবর্তীতে আলোচনা করা হয়েছে। আর রাজতন্ত্র বিলোপ করে রিপাবলিক রাষ্ট্র গঠনে নেপালের যে  রাজনৈতিক  শক্তি  অন্তত  চিন্তা-ভাবনার  দিক  থেকে  এককভাবে   সকলকে  প্রভাবিত  করতে  সক্ষম  হয়েছিল, নেপাল রাষ্ট্রের বিপ্লবী রূপান্তরের মূল চালিকা  শক্তি  ছিল, তাঁরা মাওবাদী কমিউনিস্ট।  অবশ্য যখন রাজতন্ত্রের পতন সন্নিকটে তখন অন্য দলগুলো রিপাবলিক গঠনের দাবিতে সামিল হয়েছিল। নেপালের এখনকার প্রধান তিন রাজনৈতিক দল হল  নেপালি কংগ্রেস, কমিউনিস্ট পার্টি অব নেপাল ইউএমএল (CPN–UML ),  ইউনাইটেড কমিউনিস্ট পার্টি অব নেপাল মাওইস্ট সেন্টার (UCPN-Maoist)। মাওবাদিরা  বাকি  দুই  দলকে  রাজনৈতিক  সংগ্রামের  করণীয়  ও  লক্ষ্য  বিষয়ে   তাদের সাথে সামিল  করতে  সক্ষম  হয়েছিল  যে  আশু কর্তব্য  হল – রাজতন্ত্রের  উৎখাত এবং  একটা  রিপাবলিক  গড়া। মাওবাদিদের  সফলতা  হল  রাষ্ট্রগঠন  ধারণাকে  প্রথমে রাজনীতিকদের  মধ্যে  জনপ্রিয়  করতে পেরেছিল।  ফলে পুরো  জনগোষ্ঠিকে  রাষ্ট্রগঠন  ও  শাসনতন্ত্র প্রণয়নের  কাজের  গুরুত্ব  বুঝানো সহজ হয়েছিল। কেন  এটা  করণীয়  ও  গুরুত্বপুর্ণ   তাও  জনগণের নিকট স্পষ্ট  করতে পেরেছিল।  এভাবে   পুরো  জনগোষ্ঠিকে  তারা  এই  একই  লক্ষ্যে  সামিল  করতে  পেরেছিল। তাই নেপালের রিপাবলিক গঠনের রাজনৈতিক সংগ্রাম বুঝতে ইউনাইটেড কমিউনিস্ট পার্টি অব নেপাল মাওইস্ট সেন্টার-এর রণনীতি ও রণকৌশল এ নিবন্ধে আলোচনা করা হয়েছে।

 

নেপালের রাজনীতিতে ভৌগলিক অবস্থানের প্রভাবঃ

নেপালের  আভ্যন্তরীণ  রাজনীতি  ও  এর  আন্তর্জাতিক  সম্পর্ক  সরাসরি  তার ভূগোলের  সাথে  অর্থাৎ  এটা  ল্যান্ডলকড বা  স্থলবেষ্টিত নেপাল এমন ভুগোল হবার  সঙ্গে  জড়িত।  স্থলবেষ্টিত বলে অন্যদেশ তথা ভারতের  ভিতর  দিয়ে  যাওয়া  ছাড়া  সরাসরি  সমুদ্রে  বা  সমুদ্র বন্দর  ব্যবহারের  কোন  উপায়  তার  ছিল না।  কেননা নেপাল  তিন দিক দিয়ে ভারতের দ্বারা ঘেরা।  উত্তর দিক চীনের সাথে উন্মুক্ত, তবে  সেদিকের পুরোটাই তিব্বত মালভূমির মধ্যে অবস্থিত ও হিমালয় পর্বতমালা দ্বারা  বেষ্টিত। ব্রিটিশ  যুগে এটা  প্রায় অগম্য অঞ্চল ছিল।  ছিল বলতে হচ্ছে কারণ একালের চীন বিপুল বিনিয়োগ ঢেলে নানান অবকাঠামো বিশেষ করে সুদীর্ঘ রেল যোগাযোগ প্রতিষ্ঠা করছে। এখন বহু ঘুরে হলেও শেষে সমুদ্রে পৌছানো সম্ভব।

যাহোক স্থলবেষ্টিত নেপালের সমুদ্র পর্যন্ত পৌছাতে সহজ ও নির্ভরশীল পথ হচ্ছে ভারতের ভিতর দিয়ে এবং ভারতের অনুগ্রহে। এ কারণেই  নেপাল  পড়শি  রাষ্ট্র  ভারতের  সঙ্গে  এক প্রকার  অদৃশ্য  অথচ  ব্যবহারিক–বাস্তবিক  অর্থেই  ঔপনিবেশিক  সম্পর্কে  জড়িয়ে  পড়ে  আছে। ইতিহাস বলে ভারত  যতই  অসংখ্য  রাজার  রাষ্ট্রের  বদলে  সংগঠিত  একক কোন  কেন্দ্রীয়  শাসনের  অধীনে  বড়  রাষ্ট্র  হয়ে  হাজির  হয়েছে  ততই  সেই  একক  ভারত  নেপালকে  স্থলবেষ্টিত  দেশ  হিসেবে  হাজির  করে  সুবিধা  নিয়েছে। নেপাল বাধ্য হয়েছে অধীনতামূলক চুক্তি করতে।  নেপালের  জনগণের  লড়াই  সে  কারণে একই সাথে  নেপালের  ভৌগলিক  অবস্থান  দ্বারা  নির্ধারিত  অধীনতামূলক  সম্পর্ক  থেকে  মুক্তির  লড়াই । তাই নেপালের রিপাবলিক গড়ার আন্দোলন ও মাওবাদীদের রণকৌশল বুঝতে এদিকটাও বিচার করতে হবে।

 

নেপালের অধীনতামূলক চুক্তিগুলো হল-

সুগৌলি চুক্তি ১৮১৬

স্থলবেষ্টিত  অবস্থা  থেকে  বাইরে  চলাচলের  মুক্তি পেতে নেপাল-ভারতের (তৎকালীন বৃটিশ-ভারত) বিরোধ  ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির আমল থেকে।  এই মুক্তি পেতে চাওয়া থেকেই ব্রিটিশ ভারতের  সঙ্গে  নেপালের  যুদ্ধ (এংলো-নেপালিজ যুদ্ধ) ও সংঘাতের  সূত্রপাত। নেপাল ও বৃটিশদের  (ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর) যুদ্ধ  যা এংলো-নেপালিজ  যুদ্ধ  নামে  খ্যাত। যুদ্ধে কোম্পানী  বিজয়লাভ  করে। এই  যুদ্ধ  শেষে বৃটিশদের  সাথে  চুক্তি সাপেক্ষে  বাস্তবে  করদ  রাজ্যের  মত  নেপালকে  সীমিত স্বাধীনতা  মেনে  নিতে  হয়। এই চুক্তির  নাম  সুগৌলি  চুক্তি  ১৮১৬ । এটা নেপালকে “ভাগ করে  নেয়ার  চুক্তি”  বলেও  পরিচিত। কারণ  ঐ  চুক্তি  অনুসারে  নেপালের  প্রায় এক-তৃতীয়াংশ ভুমি – বিশেষত  যেগুলো  কোম্পানীর  চোখে  ষ্ট্রাট্রেজিক  গুরুত্বসম্পন্ন  বলে  মনে  করা  হয়েছিল সে ভুমিগুলো  বৃটিশ-ভারত  নিজের  সাথে রেখে দেয়।

 

নেপাল-ভারত  চুক্তি  ১৯২৩

বৃটিশদের  প্রবল  ক্ষমতা  ও  আধিপত্যের  মুখে নেপালের  রাজা  বৃটিশ  নীতি  সমর্থন  করে  তাদের  খুশি  করার  বিনিময়ে  নিজের  কাজ  উদ্ধারের  রাস্তা  ধরে।   ১৮৫৭ সালের    সিপাহী  বিদ্রোহের  সময় নেপালের  রাজা  ব্রিটিশদের পক্ষে   বিদ্রোহ  দমনে  যোগ  দেয়। এতে  ভীষণ  খুশি  হয়ে  বৃটিশরা দখল  করা  ভুমির  উল্লেখযোগ্য  অংশ ফেরত  দিয়ে  দেয়।  এভাবে  ১৯২১ সালে  প্রথম  বিশ্বযুদ্ধে  বৃটিশ  সরকারকে  নেপালের  রাজার  দেয়া  সমর্থন ও সার্ভিসের  কারণে আরও  কিছু  অঞ্চলের  ছাড় আদায়ের  পরিস্থিতির  উদয়  হয়। । স্বাক্ষরিত  হয় ১৯২৩  সালে  নতুন  তুলনামূলক শিথিল চুক্তি “নেপাল-ভারত চুক্তি ১৯২৩” । সাত  দফার  এই  নতুন  চুক্তিতে নেপালকে  স্বাধীন  দেশ  বলে  মেনে  নেওয়া  হয়।  চুক্তি মতে, নেপাল বৃটিশদের স্বার্থহানি ঘটাতে পারবে না ত বটেই; যাতে তা না ঘটে সেটাও খেয়াল ও তদারকে রাখতে হবে নেপালকেই।  থাকতে  পারবে না  আলাদা  স্বাধীন  কোন  নিরাপত্তা  নীতি। নেপাল  বৃটিশ-ভারতের  ভিতর  দিয়ে  অস্ত্রশস্ত্রসহ যে কোন  মালামাল  আমদানী  করতে পারবে – যতক্ষণ  বৃটিশ-ভারত  মনে  করবে  নেপালের  আচরণ  বন্ধুত্বপুর্ণ  এবং  ভারতের  জন্য  তা  হুমকি  নয়। এই  ছিল  চুক্তির  সারকথামূলক  দিক।


ভারত-নেপাল  মৈত্রী ও বন্ধুত্ব চুক্তি ১৯৫০

১৯২৩ সালের  চুক্তির কার্যকারিতার  মেয়াদ  ছিল ৩১ জুলাই ১৯৫০। বৃটিশরা ১৯৪৭ সালে  ভারত  ছেড়ে  চলে গেলে  স্বভাবতই  চুক্তির  আইনী  দায়  এবং  দায়িত্বের  মালিক  হয়  নেহেরুর  ভারত।  বৃটিশ  সাম্রাজ্যবাদ  নেপালের  সাথে  চুক্তির  ক্ষেত্রে  যে  নীতিগত দিক  অনুসরণ  করেছিল  স্বাধীন  ভারত  সবজায়গায় হুবহু একই নীতি  অনুসরণ  করে।   পুরনো  চুক্তির  নীতিগত  আদলে  নতুন  করে  ১৯৫০ জুলাইতে  ‘ভারত-নেপাল  মৈত্রী ও বন্ধুত্ব চুক্তি’  করা হয়। এবার  চুক্তিতে ছিল  দশটা পয়েন্ট। কিন্তু  সার কথা  একই – “সন্তুষ্টি  বা  ভারতের  নিরাপত্তার”  কথা  তুলে নেপালকে  ভারতের  মুখাপেক্ষি  করে  রাখা।  ভারতের  স্বার্থের  অধীনস্ত হিসাবে নেপালের স্বার্থকে গৌণ করে রাখা।  

 “মৈত্রী চুক্তির” নামে নেপালের স্থলবেষ্টিত দশাকে জিম্মি করে ভারত দাসত্বের চুক্তি চাপিয়ে দিয়েছিল। এ অবস্থা নেপালের জনগণকে প্রচণ্ড ভারত বিরোধী করে তুলেছে। মাওবাদীরাও তাদের ৪০ দফা কর্মসূচিতে ১৯৫০ সালের  চুক্তি  বাতিলের কথা  উত্থাপন করেছিল। তাঁরা  ভারতকে  নিজ  রাষ্ট্রস্বার্থের  বিরুদ্ধে প্রধান  শত্রু  মনে  করত। কিন্তু এই জনপ্রিয় দাবিকে তাঁরা মুখ্য করে সামনে আনে নি।  বরং তাদের রিপাবলিক গড়ার আন্দোলনে ভারতকে পাশে পাওয়ার রণকৌশল অবলম্বন করেছিল।  

 

রাজাকে একা করে বিরোধী রাজনৈতিক শক্তিকে রিপাবলিক গড়ার আন্দোলনে শামিল করার রণকৌশল

মাওবাদীরা ১৯৯৬ সালে সশস্ত্র সংগ্রাম বা গৃহযুদ্ধ শুরু করে যা দীর্ঘ ১০ বৎসর স্থায়ী হয়েছিল। সে সময় নেপালে ক্ষমতার ভাগীদার বা স্টেক হোল্ডাররা ছিল এ রকমঃ এক. রাজতন্ত্রী রাজনীতির সমর্থকরাসহ খোদ রাজা। দুই.  রাজতন্ত্র মানা আইনী দলগুলো মূলত নেপালি কংগ্রেস ও ওর ভাঙা দলছুট অংশ, সিপিএন (ইউএমএল) এবং ছোটখাট নানান কমিউনিস্ট বা লিবারেল দল। সবমিলিয়ে এরা মোট ৭টা দল। তিন. রাজতন্ত্র উচ্ছেদের লক্ষ্যে সশস্ত্র মাওবাদী দল;  চার. স্থলবেষ্টিত নেপালের উপর ছড়ি ঘুরানো ভারত। আর ৫. আমেরিকার নেতৃত্বে পশ্চিমা স্বার্থ। – এভাবে পাঁচটা পক্ষ।

দেখা যায় ২০০৫ সালের প্রথমার্ধ পর্যন্ত এই পাঁচ পক্ষের চার পক্ষই একদিকে এবং মাওবাদীর বিরুদ্ধে জোটবদ্ধ থাকতে পেরেছিল। কিন্তু মাওবাদীরা এক সফল রণকৌশলের মধ্য দিয়ে ঐ চারপক্ষীয় জোটে ভাঙন আনতে সক্ষম হয়। এই চারপক্ষীয় জোট অকার্যকর হয়ে উঠলে তাঁরা নেপালের  রাজনৈতিক দলগুলোকে নিয়ে এক গ্রান্ড এলায়েন্স বা মহাজোট  তৈরি করে। আর ভারত ও যুক্তরাষ্ট্র রাজার পক্ষ ছেড়ে দিয়ে মাওবাদীদের পক্ষভুক্ত হয়ে যায়। অবশ্য ভারত ও যুক্তরাষ্ট্রের জন্য তাদের নীতির কারণেও রাজতন্ত্রের পক্ষ নেয়া যুক্তিসিদ্ধ ছিল না।

২০০১ সালের ২৬ নভেম্বর, নতুন রাজা জ্ঞানেন্দ্র দেশ জুড়ে জরুরি অবস্থা ঘোষণা করেন আর মাওবাদীদের মোকাবোলায় সারা দেশে আর্মি নামিয়ে দেন। মাওবাদী আক্রমণ ক্রমশ বৃদ্ধি পাওয়াতে তা শক্ত হাতে মোকাবিলার পথ ধরেন তিনি। এ ক্ষেত্রে তিনি আমেরিকানদেরকেও হার্ডলাইনের পক্ষে ম্যানেজ করতে সফল হন। তাই তখন অস্ত্রের চালান পাঠাতে আমেরিকানেরা দ্বিধা করে নাই। তখনও তারা পরিস্থিতি সামলানোর ব্যাপারে রাজার উপরেই সব আস্থা রাখতে পারতেছিলেন;  অর্থ, অস্ত্র সামরিক প্রশিক্ষণ দিয়ে যাচ্ছিলেন। আর ওদিকে জনগণ সামলানোর জন্য রাজা জ্ঞানেন্দ্র নেপালী কংগ্রেসের মুরুব্বী কৈরালাকে আর ভরসা করতে পারেন নাই। এ ব্যাপারে শের বাহাদুর দুবেকে বেশি যোগ্য মনে করে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নিয়োগ দেন। আর দুবে নতুন দায়িত্ব হাতে নিয়ে মাওবাদী দমনের পক্ষে প্রচার শুরু করেন। মে মাসে আর্মি প্রথমবারের মত মাওবাদী চেয়ারম্যান পুস্পকমল দাহালসহ চার নেতার ছবি প্রচার করে। কিন্তু মাওবাদীদের অগ্রগতি সম্ভবত বেড়েই চলেছিল। প্রচারণামূলক বহু পদক্ষেপ নিয়েও জনগণকে বুঝ দেয়া যাচ্ছিল না। যতই দিন যাচ্ছিল ততই স্পষ্ট হতে শুরু হয়েছিল রাজা জ্ঞানেন্দ্র ও প্রধানমন্ত্রী দুবে গৃহযুদ্ধ থামাতে পারবে না, শান্তি আনার ক্ষমতা তাদের নেই। আর এটাকে পুঁজি করে সাংবিধানিক রাজতন্ত্রের পক্ষের প্রকাশ্য রাজনৈতিক দলগুলো বিক্ষোভ দেখানোর সিদ্ধান্ত নেয়। রাজা মাওবাদীদের হাতে চ্যালেঞ্জ হয়ে পড়াতে প্রকাশ্য রাজনৈতিক দলগুলোর, যাদেরকে রাজা এতদিন নিজের ক্ষমতার পক্ষে সাফাই গাইবার জন্য ব্যবহার করে এসেছে, কেউ কেউ রাজার কাছে এবার সাফাই গাইবার জন্য বেশি দাম দাবি করে। আবার কেউ কেউ জনগণের সামনে রাজার  মুরোদহীনতা প্রকাশ হওয়াতে আর রাজার পক্ষে থেকে নিজের ভাবমূর্তি নষ্ট করতে চাইছিল না। তাঁরা সংসদে দল বেধে রাজার বিরুদ্ধে বিক্ষোভ দেখানো শুরু করে। এটা চলতে দিলে স্বভাবতই এর সামাজিক মানে হত রাজার আরোও হার, বেইজ্জতি। আর ততই মাওবাদীদের বিজয়। এ অবস্থায় ২০০২ সালের ২২ মে নতুন প্রধানমন্ত্রী দুবে সংসদই ভেঙ্গে দেন যাতে বিরোধীরা সেখানে রাজার বিরুদ্ধে নিন্দার ঝড় না তুলতে পারেন। এরফলে নতুন রাজার সাথে রাজতন্ত্রী সাংবিধানিক দলগুলোর বিরোধ প্রকট হওয়া শুরু হয়।

রাজার আরেকটি কৌশল হল রাজনৈতিক দল এবং নেতাগুলোকে সামলাতে ওদেরি পরস্পরের বিরুদ্ধে প্রতিযোগিতা লাগিয়ে দেয়া। তিনি একেকবার একেক দলকে প্রধানমন্ত্রী বা  মন্ত্রী বানিয়ে অপরের বিরুদ্ধে খেপিয়ে তুলতে থাকেন। এভাবে তিনি ৪টা সরকার গঠন করেন আর ভেঙ্গে দেন। এ ভাবে রাজা এদেরও শত্রু বানিয়ে ফেলেন।

প্রায় সময়ই মাওবাদীরা পুণঃসংগঠিত হয়ে নেবার সুবিধা নিতে এককভাবে যুদ্ধবিরতি পালন করেছে । তবে প্রধান উদ্দেশ্য ছিল জনগণকে মনে করিয়ে দেয়া যে তারা অস্ত্র-পাগল কেউ নয়, তাদের হাতে অস্ত্র শেষ উপায় মাত্র। তাই তারা নিয়মিত প্রচার করে যেত যে, তাদের দাবি রাজতন্ত্র উচ্ছেদ এবং রিপাবলিক প্রতিষ্ঠার ঘোষণা দিলে তারাও অস্ত্র ত্যাগের ঘোষণা দিবে।

২০০৩ সালের শেষাশেষি এসে রাজার সাথে রাজতন্ত্রী সাংবিধানিক দলগুলোর বিরোধ চরমে উঠে। কেউ কাউকে সহ্য করতে পারছেন না। আমেরিকান সেক্রেটারি অব ষ্টেট ক্রিস্টিনা রোকা ২০ ডিসেম্বর ২০০৩ নেপালে এসে প্রকাশ্য দলগুলোর পারস্পরিক খেয়াখেয়ি, ঈর্ষা, পারস্পরিক অনাস্থা-বিরোধ মিটাতে উদ্যোগ নিয়েছিলেন। কিন্তু তিনি ব্যর্থ হন। বস্তুত রোকার এই সফরটা ছিল মাওবাদী বিরোধী রাজতন্ত্রীর পক্ষে ভারত-আমেরিকাসহ চার স্টেক হোল্ডারের সর্বশেষ জোটবদ্ধ অবস্থান। পরস্পর সমন্বয় না করতে পারা, আর অবিশ্বাসের কারণে একসাথে জনগণের সামনে দাড়াতে না পারা, একটা কার্যকর কর্তৃত্ব হতে ব্যর্থ হওয়াটাই তাদের শেষ কথা হয়ে যায়।

এরপরেই পাশার দান উলটে যায়। প্রত্যেকে এরপর রাজার সংসর্গ ত্যাগ করে  কত দ্রুত মাওবাদীদের হাত ধরা যায়, সেই পথ খুজতে প্রতিযোগিতা শুরু করে। যে রোকা চেষ্টা করেছিলেন  রাজতন্ত্রী সাংবিধানিক দলগুলো যেন রাজার সাথে বিরোধে জড়িয়ে না পড়ে, তাঁর এই সফরের পর থেকেই ক্রমশ যুক্তরাষ্ট্র নিজেই উল্টো দিকে অবস্থান নেয়া শুরু করে।

২০০৫ সালে রাজা জ্ঞানেন্দ্র রাষ্ট্রের প্রধান  নির্বাহি মানে প্রধানমন্ত্রীও  হয়ে বসেন এবং জরুরি অবস্থা জারি করেন। এতে নেপালী কংগ্রেস বা কমিউনিস্ট সিপিএন-ইউএমএলের মত রাজতন্ত্রী দলগুলোর জন্যে রাজার  চামচা হয়ে প্রধানমন্ত্রী বা মন্ত্রী হবার যে সুযোগ ছিল তা আর থাকল না। অন্যভাবে বললে, রাজার এই সিদ্ধান্ত রাজতন্ত্রী দলগুলোর জন্য নিয়মতান্ত্রিক দল হিসেবে কার্যকর থাকার শর্ত ও সুযোগ রুদ্ধ করে দেয়া হল। ফলে রাজতন্ত্রী সাংবিধানিক দলগুলো অস্তিত্ব সংকটে পড়ে যায়। এ অবস্থা ভারত এবং যুক্তরাষ্ট্রের দিক থেকে রাজার পক্ষে সমর্থন যুগিয়ে তাকে টিকিয়ে রাখা কঠিন হয়ে যায়। আর ভারত ও আমেরিকার অবস্থান ১৮০ ডিগ্রীতে উল্টো যাবার পিছনে অন্যতম কারণ এটাই।

 ইতোমধ্যে আস্তে আস্তে মাওবাদীদের সম্পর্কে কিছু ইতিবাচক ইঙ্গিত পান রোকা, বিশেষ করে, ভারতীয় পক্ষের (বিশেষত বিশ্ববিদ্যালয়ের একাদেমিকদের) মাধ্যমে আসা খবর। ফলে এসবেরই শেষে একসময় ভারতীয় লজিষ্টিক, যোগাযোগ ব্যবহার করে তিনি মাওবাদীদের সাথে রফা করার দিকে ঝুকে যান।   

অন্যদিকে মাওবাদীরা নিজেদেরকে সকলের কাছে ব্যবহারিকভাবে গ্রহণযোগ্য করতে নিজেদের অবস্থান পরিস্কার করে ফেলেছিল। সরাসরি কাজের কথায় আসার জন্য এসময় মাওবাদীদের সাথে রাজতন্ত্রী সাংবিধানিক দলগুলোর সাথে (মূলত নেপালি কংগ্রেস ও সিপিএন(ইউএমএল) ) ঐক্যের কমন পয়েন্টগুলো কি হতে পারে তা স্পষ্ট করে বলা শুরু করেছিল।  

আইনী দলগুলোর মধ্যে বড়, বিশেষত নেপালী কংগ্রেস আর সিপিএন(ইউএমএল) রাজার উপর সম্পুর্ণ আস্থা হারিয়ে ফেলায় চাইছিল মাওবাদীদের সাথে সম্পর্ক করতে। এক্ষেত্রে ভারতীয়রাও কিছু ভুমিকা রেখেছিল। এসব কিছু মিলিয়ে নতুন রাজনৈতিক মেরুকরণ শুরু হয়। তবে নতুন রাজনৈতিক মেরুকরণে সবচেয়ে নির্ধারক ভুমিকা রেখেছিল মাওবাদীদের নতুন ধরণের রাজনীতি।

কমিউনিস্টদের নিয়ে সাধারণ ধারণা হল, কমিউনিস্টদের রাজনীতি একটা ‘মালিকানা উচ্ছেদ’কেন্দ্রিক রাজনীতি। “সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতি” বলে একটা কিছু, মুনাফার নামে খড়গহস্ত ইত্যাদি হল যার সাধারণ ফিচার। রাষ্ট্র ও শাসনতন্ত্র কী, কেমন হবে তা তাদের আলোচ্য বিষয় নয়।। অন্যদিকে, নেপালের মাওবাদীরা প্রথমত মালিকানা উচ্ছেদকেন্দ্রিক রাজনীতিকে প্রধান করেনি।  দ্বিতীয়ত  এরা সাম্রাজ্যবাদ বা আধিপত্যবাদ রাজনীতির কেন্দ্রবিন্দু করেনি। বরং অদ্ভুতভাবে নতুন রাষ্ট্রগঠন (কনষ্টিটিউট) করার দিকে ছিল এদের মুল ফোকাস। ক্লাসিকাল রাষ্ট্রগঠন, মর্ডান রিপাবলিক গঠন কাজের দিকে ছিল তাদের মনোযোগ। কখনই ভুলে নাই যে তারা রাজতন্ত্র উচ্ছেদ করে একটা রিপাবলিক গড়তে চায় – এটাই ঐ স্তরে তাদের মূল করণীয়। এর সাথে অন্য আর কিছু কাজ যদি আগিয়ে নেয়া যায় সেটা বাড়তি।

মাওবাদী নেতা পুস্প কমল দাহাল আমেরিকার কাছে খুবই আকর্ষণীয় ব্যাক্তিত্ব হয়ে উঠেন। কারণ তিনি রাজতন্ত্র সমূলে উচ্ছেদ চান। কিন্তু এর চেয়েও বড় ঘটনা হল, একটা চিরায়ত রিপাবলিক বৈশিষ্টের রাষ্ট্র গড়ার প্রতি তাঁর অটুট নিষ্ঠা। এটা আমেরিকা যে কমিউনিষ্টদেরকে চিনে অভ্যস্ত সেরকম নয়। যুক্তরাষ্ট্রের কাছে দাহালের দলের আরও বৈশিষ্ট হল এরা সকলকে নিয়ে, সব ধরণের বিভেদমূলক পরিচয় নির্বিশেষে, এর উর্ধে উঠে সকলের সমান রাজনৈতিক অধিকারের সাম্য মর্যাদার রাষ্ট্রের ব্যাপারে দৃঢ়তা দেখানো। ফলে আমেরিকানরা মাওবাদীদের গুরুত্ব দিয়ে মেনে নিতে বাধ্য হয়। সারাংশে বললে, দুটো কারণে যুক্তরাষ্ট্র মাওবাদী অবস্থানকে সমর্থন করতে উৎসাহী হয়েছিলঃ এক, ক্লাসিক্যাল রিপাবলিক রাষ্ট্র গঠন করতে চাওয়া। দুই,  বিভেদমূলক পরিচয়ের উর্ধে সকলকে বলতে দেয়া, কাউকে উপেক্ষায় ফেলে না রাখা এমন ইনক্লুসিভ রাষ্ট্রগঠনের ধারণা হাজির করা। অন্যভাবে বললে, সাধারণত কমিউনিষ্টরা নিজেদের পরিচিত করিয়ে এসেছে অর্থনৈতিক কর্মসুচির ভাবনা দিয়ে। আর ঠিক ততোধিক রাষ্ট্রগড়ার বিষয়টাকে যেন উপেক্ষায় ফেলে রেখে এসেছে। নেপালের মাওবাদীরা  বিষয়টাকে প্রথম উলটে দেখিয়েছেন।

এভাবে আমেরিকার সাথে বোঝাপড়া হওয়াতে বড় বাঁধা সহজেই পার হতে পেরেছিল নেপালের বিপ্লবী রাজনীতি। আমেরিকার সাথে রফা হওয়াতে সহজেই ভারতের সমর্থনও পাওয়া নিশ্চিত হয়ে যায়। শুধু সমর্থন নয়, একেবারে সক্রিয় সমর্থন। এই বাড়তি সক্রিয়তা ভারত না দেখালে, তৎপর  না হলে নেপালের বিপ্লবী রাজনৈতিক পরিবর্তনের সম্ভাবনা যতই পরিপক্ক হয়ে থাক না কেন তা বাস্তব হতে পারা কঠিন ছিল। তবে ভারত সরকারও আমেরিকার গৃহীত নেপালের স্বার্থবিরোধ নিষ্পত্তি মিটাবার ফর্মুলার মধ্যেই নিজের স্বার্থ দেখেছিল।

ভারতের উদ্বেগের দিকটা ছিল মাওবাদী দল শুরুতে যে ৪০ দফা দাবি জানিয়েছিল তাতে স্পষ্ট করে ভারত সম্পর্কে মূল্যায়ন করে বলা হয়েছিল “ভারত নেপালি রাষ্ট্রস্বার্থের প্রধান শত্রু” । আর বিশেষ করে ১৯৫০ সালের ভারত-নেপাল চুক্তিকে দাসত্ব চুক্তি বলে তা রদ করার দাবি করা হয়েছিল। স্বভাবতই এমন খোলাখুলি মুল্যায়ন ভারতের জানা থাকা সত্ত্বেও তারা মাওবাদীদের ঐ বক্তব্যকে প্রধান করে দেখে নাই। সবার আগে রাজতন্ত্র উচ্ছেদ – মাওবাদীদের এই নিষ্ঠা ভারতের উদ্বেগ কমিয়ে দিয়েছে। এক কথায় বললে মাওবাদীদের রাজনৈতিক কৌশল আর অগ্রাধিকার প্রয়োগ সঠিক ছিল।  

ভারতের মাওবাদী রাজনীতি ও আন্দোলন ভারতের সরকারগুলোর কাছে এক বিরাট উদ্বেগজনক মাথাব্যাথা। যদিও ভারতের মাওবাদী আন্দোলনের উত্থানপতন আছে। কিন্তু সবচেয়ে বড় কথা নেপালের মাওবাদীর সাথে এটা নামে এক হলেও, ভারতের মাওবাদ থেকে নেপালের মাওবাদ বৈশিষ্টমূলক ভাবে আলাদা। ভারত দেখেছিল,  নেপালের মাওবাদীরা যদি ক্ষমতায় আসে এবং বহুদলীয় পদ্ধতি, পপুলার ভোট ইত্যাদির ভিতরে থেকে রিপাবলিক গড়ার রাজনীতি করে তবে এই মাওবাদের সাথে ভারতের কার্যকর সম্পর্ক গড়া সহজ এবং ভারতের জন্য খুবই দরকারি। আর ঠিক এর বিপরীতে নেপালের মাওবাদ যদি সশস্ত্র ও মাঠে থেকে যায়, আর যদি তা ভারতের মাওবাদের সঙ্গে মিলে যায় সেটা ভারতের জন্য রাজনৈতিক পরিস্থিতি কঠিন ও জটিল করে তুলতে পারে। মাথার কাছে কিট কিট করা এই সম্ভাবনা থেকে মুক্তিলাভ করেছে ভারত। এটাই ভারতের স্বার্থের দিক থেকে এক বিরাট অর্জন। যদিও আর এক অর্থে নেপালের মাওবাদীরা পরবর্তিতে ভারতের জন্য মাথাব্যাথার কারণ হয়েছে। নেপালকে অধীনস্ত করে রাখা, স্থলবেষ্টিত নেপাল থেকে ফায়দা হাসিল করা – ভারতের এই পড়ে পাওয়া সুযোগ খাওয়া এখন হারাম হয়ে গেছে। সেকথা আলাদা। তবে ঐ কালে, ২০০৬ সালে, ভারতের মাওবাদ থেকে নেপালের মাওবাদের রাস্তা আলাদা হয়ে যায়। অন্তত এটাও একটা কারণ, ভারত আমেরিকার অবস্থানের পক্ষ নিয়েছিল।

নেপাল বিপ্লবে ভারতের নির্ধারক অবদান ছিল, ১২ দফা তৈরির ব্যাপারে সাত দলীয় জোট আর মাওবাদীদের প্রধান নেতাদের মধ্যে সরাসরি মুখোমুখি আলাপের আয়োজক হিসেবে ভুমিকা। এই অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ  সাক্ষাতের পরে বাস্তবত রাজতন্ত্র উচ্ছেদের মঞ্চ তৈরি হয়ে যায়। ২০০৬ সালের ৬ এপ্রিল উভয় পক্ষের মধ্যে চুক্তি সাক্ষর হয়। নেপালের রাজনৈতিক সংগ্রামের ইতিহাসে তাই এইদিন খুবই তাৎপর্যপুর্ণ। এদিন রাজার ক্ষমতার বিরুদ্ধে মাওবাদীরাসহ সব রাজনৈতিক দল ১২দফা চুক্তিতে এক মৈত্রী জোট গঠন ও রাজতন্ত্রের বিরুদ্ধে ওপেন চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিতে সক্ষম হয়। বলাবাহুল্য পরিণতিতে সেটাই রাজার পরাজয়ের কাল হয়ে ওঠে।

রাজার ঘোষণায় সর্বশেষ যে সংসদ ভেঙ্গে দেওয়া হয়েছিল, ১২দফা চুক্তিতে সেই সংসদকে পুণরুজ্জীবিত করা এবং রাজার ক্ষমতার বিপরীতে গণ-অভিপ্রায়, গণ-ইচ্ছার  আধার হিসাবে হাজির করা হয়েছিল। আর এই কাজ সফল হতে হতেই রাজার হাতে ন্যস্ত প্রতিটা ক্ষমতা কেড়ে নিবার প্রস্তাব পাশ করা হয়েছিল ঐ পুণরুজ্জীবিত সংসদ থেকে। এই প্রক্রিয়া শেষে রাজা হয়ে যান নামমাত্র রাষ্ট্রপ্রধান, রাষ্ট্রের সব ক্ষমতা দেয়া হয় সংসদের হাতে। এরপর রাজার বিপরীতে এক অস্থায়ী নির্বাহী ক্ষমতার সরকার গঠন সহজেই সম্ভব হয়।


প্রকাশ্য দল হিসেবে মাওবাদীদের আত্মপ্রকাশ

সাধারণত কোন সশস্ত্র বিপ্লবী দলকে একক কর্তৃত্বে ক্ষমতা দখল করতে দেখা যায়। সেক্ষেত্রে কারো সাথে কোন ক্ষমতা ভাগাভাগি থাকে না। ক্ষমতা দখলের পরে, পুরানা ক্ষমতার বিরুদ্ধে নিজেকেই নতুন ক্ষমতা হিসাবে ঘোষণা আর জনগণের গণ-অভিপ্রায়, গণ-ইচ্ছার  আধার হিসাবে নিজেকে উপস্থাপন করে থাকে। কিন্তু নেপালের  মাওবাদীদের বেলায় তা ছিল এক বিরাট ব্যতিক্রম। প্রথমত, মাওবাদীদেরকে আগেকার রাজতন্ত্র-মানা আইনী রাজনৈতিক দলগুলোকে “রাজতন্ত্র উচ্ছেদের” রাজনীতিক বলে জায়গা দিতে হয়েছিল। এভাবেই এক  নতুন ক্ষমতা, নতুন মেরুকরণ ঘটানো হয়েছিল। দ্বিতীয়ত, তাদেরকে সাতদলের সাথে “বহুদলীয় নীতিতে” অন্তর্বর্তী সরকার বলে রাজার বিকল্প এক ভাগাভাগি ক্ষমতার অংশ হতে রাজি হতে হয়েছিল। এখানে মূল বিষয় ক্ষমতা ভাগাভাগি নয়, বরং একটি  বহুদলীয় রাজনৈতিক ব্যবস্থা মেনে নেয়া যাতে বহু দলের সাথে চলতে হয়, সহ্য করতে হয়।

মাওবাদীদেরকে সশস্ত্রতা বজায় রেখেও সমান্তরালে গণ-আন্দোলনে নেমে আসতে হয়েছিল। তাও ঠিক ঘোষণা দিয়ে নয়, সমর্থন জানিয়ে। কারণ দল তখনও আন্ডারগ্রাউন্ড এ। কিন্তু অন্তর্বর্তীকালীন কোয়ালিশন সরকার ক্ষমতায় এলে বিরাট এক টেকনিক্যাল জটিলতা দেখা দেয়। সাত দলীয় জোটের সবাই প্রকাশ্য রাজনৈতিক দল, কিন্তু মাওবাদীরা অপ্রকাশ্য দল। ফলে সাত দলীয় জোটের সবাই অন্তর্বর্তীকালীন কোয়ালিশন সরকারে সহজেই অংশ নিলেও মাওবাদীরা তা নিতে পারছিল না। আবার আন্ডারগ্রাউন্ড সশস্ত্র দল চাইলেই একবার প্রকাশ্য আর  একবার গোপন দল – এমন করতে পারে না। একবার প্রকাশ্য দল হিসেবে আবির্ভাবের ঘোষণা দিয়ে ফেললে খুব সম্ভবত সে দল আর কখনই আগের অবস্থায় তথা গোপন সশস্ত্র দলে ফিরে যেতে পারেনা। এটা তাদের না বুঝার কিছু ছিল না। ফলে দল প্রকাশ্য করার সিদ্ধান্ত খুবই ভেবেচিন্তে নেয়ার বিষয় ছিল। আবার প্রকাশ্য দল বলে নিজেদের ঘোষণা স্রেফ একটা ঘোষণা নয়। কারণ প্রকাশ্য দল একই সাথে সশস্ত্র থাকে না। অর্থাৎ অস্ত্র ত্যাগ করতে হবে। অস্ত্র ত্যাগ মানে এক অর্থে আসলে নিজের ক্ষমতা ত্যাগ – ফলে খুব সহজ ব্যাপার নয়।

ক্ষমতা কখনও শুন্য থাকতে পারে না, থাকে না। ফলে মাওবাদীরা প্রকাশ্য দল হিসেবে নিজেদের ঘোষণা না দিতেই রাজার ক্ষমতার বিপরীতে সাত দলীয় জোটই পালটা অন্তর্বর্তীকালীন ক্ষমতা ও সরকার গঠন করে বসে গিয়েছিল। শুধু তাই নয় মাওবাদীদের টেকনিক্যাল সমস্যাগুলো কাটাতে সময় লাগার সুযোগ নিয়ে ঐ সাত দলের জোট নিজেরাই মাওবাদীদের উপর এবার নানান শর্ত আরোপ করে যাচ্ছিল, যেহেতু তারাই তখন সরকার। ফলে ব্যবহারিকভাবে নির্দেশ দেয়ার ক্ষমতা তাদের হাতে। আর ঐ সরকার মাওবাদীদের কথা শুনতে, প্রতিনিধিত্ব দিতে আইনগতভাবে বাধ্য নয়। যদিও, একটা বুঝপড়ার প্রতিশ্রুতির বন্ধন আছে যা নানাভাবে ব্যাখ্যা করার সুযোগ যারা ক্ষমতায় থাকে তাদের পক্ষেই কাজ করে থাকে, তারা নিয়ে থাকে।

অস্ত্র ত্যাগ না করা পর্যন্ত সরকারের ক্ষমতায় অংশগ্রহণ করতে পারবে না মাওবাদীরা - এই কথাকে বিরাট শর্ত হিসাবে হাজির করে সাত দলীয় জোট। কারণ হাতে অস্ত্র হাতে থাকা মাওবাদীরা আর অন্যান্য যে কোন রাজনৈতিক দলের চেয়ে সুবিধাজনক উচ্চ আসনে থেকে যায়। অর্থাৎ দলগুলোর অসাম্য তৈরি হয়। ওদিকে অস্ত্র ত্যাগ কার কাছে করবে? সবচেয়ে অবিতর্কিত ও দ্রুত তা ঘটাতে গেলে একমাত্র জাতিসংঘের তদারকিতে তা হতে হবে। এই প্রতিষ্ঠান অভ্যস্ত এবং  আগেই তাদের এমন কাজ বহুবার করায় তাদের তৈরি করা নিয়মবিধি আছে, টেকনিক্যাল খুটিনাটি জানা আছে। আর সর্বোপরি জাতিসংঘের উপর সব পক্ষের একটা আস্থা আছে।  কিন্তু জাতিসংঘের একটা টিম আসা সময় সাপেক্ষ ব্যাপার ছিল। এমন সব বাধা মাওবাদীদেরকে পার হতে হয়েছিল। একাজে চাপ দিতে সময়ে সময়ে মাওবাদীদেরকে সাত দলীয় অন্তর্বর্তিকালীন ক্ষমতা ও সরকারের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক কর্মসুচি দিতে হয়েছে। এককথায় বললে জটিল ও ঝুঁকিপূর্ণ  সময়ের ভিতর দিয়ে মাওবাদীদেরকে যেতে হয়েছে, সিদ্ধান্ত নিতে হয়েছে। এসব ক্ষেত্রে দল ভাঙ্গার সম্ভাবনা থাকে, কিন্তু তাদের দল ভাঙ্গেনি। সবাই একমত হয়েই এসব সিদ্ধান্ত নিতে পেরেছিল।  


অস্থায়ী সংবিধান,২০০৭    

জাতিসংঘের মধ্যস্থতায় সবচেয়ে বড় কাজ হল একটা অস্থায়ী সংবিধান রচনা যা নেপালের ইতিহাসে ষষ্ঠ সংবিধান ভাবা হয়। এক দিকে থেকে এটাকে বলা যায়, কী কী শর্তে ক্ষমতাসীন সাত দলীয় সরকারের সাথে মাওবাদীরা যুক্ত হবে তার ভিত্তি হচ্ছে এই অস্থায়ী সংবিধান। শুধু তাই না মাওবাদীরা সরকারে যুক্ত হয়ে কী কী কাজ সম্পন্ন করবে, এবং কীসের ভিত্তিতে কেন করবে তার দিশা হয়ে দাড়ায় এই অস্থায়ী সংবিধান। যেমন অস্থায়ী সংবিধানে বলা হয় অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান কাজ হল একটা পুর্ণ  সংবিধান রচনা তথা রাষ্ট্র গঠন করা। আর সেই লক্ষ্যে প্রথম কাজ, সংবিধান সভার সদস্য কতজন হবেন, কারা হবেন তা ঠিক করে সেই নির্বাচন আয়োজন করা।

এসব কথাগুলো লিখে একটা অস্থায়ী সংবিধান রচনা করা হয় যা স্বাক্ষরিত হয় ০৮ ডিসেম্বর ২০০৬ সালে, জাতিসংঘের সেক্রেটারি জেনারেলের বিশেষ প্রতিনিধি আয়ান মার্টিনের উপস্থিতিতে। আর স্বাক্ষরের দুই পক্ষ ছিল মাওবাদী দলের প্রতিনিধি এবং  সাত দলীয় জোটের সরকারের প্রতিনিধি।  অর্থাৎ এটাকে “অস্থায়ী কনষ্টিটিউশন ২০০৭” বলা হলেও আসলে এটা হল দুটা পক্ষের বোঝাপড়ার ও ভবিষ্যত কাজের দলিল।


গণপরিষদ গঠন ও সংবিধান প্রণয়ন  

২০০৮ সালে নেপালের প্রথম গণপরিষদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। মোট সদস্য ৬০১ জন। এরমধ্যে নির্বাচিত সদস্য ৫৭৫ জন এবং অনির্বাচিত ২৫জন। আবার নির্বাচিত ৫৭৫ জনের মধ্যে ২৪০ আসনে সরাসরি নির্বাচন হয়েছিল। বাকি ৩৩৫ আসন সংখ্যানুপাতিক হারে অংশগ্রহণকারী দলগুলোর মধ্যে বণ্টন করা হয়েছিল। প্রথম গণপরিষদ নির্বাচনে মাওবাদীরা সবমিলিয়ে পেয়েছিল ২২০টি বা ৩৮% আসন, যেটা সর্বোচ্চ। আর এর সবচেয়ে কাছাকাছি ফল হল ১১৫ আসনলাভকারী  নেপালী কংগ্রেসের।  তৃতীয় হয়েছিল সিপিএন (ইউএমএল)। তাদের আসন সংখ্যা ১০৮টি। চতুর্থ হয়েছিল Madeshi Peoples Right Forum. তাদের আসন সংখ্যা ৫৪টি।

মাওবাদীদের নেতৃত্বে  সর্বদলীয় সরকার গঠিত হয়। কিন্তু ফেডারেল রাষ্ট্রের কয়টা প্রদেশ হবে, প্রদেশের সীমানা কী হবে তা নিয়ে বিরোধ এমন তুঙ্গে পৌছানো হয় যাতে মনে হয় নেপালের প্রধান রাজনৈতিক সমস্যা বা দ্বন্দ্ব সংঘাত ছিল রাজতন্ত্র উৎখাত নয়, প্রাদেশিক সীমানা ঠিক না হওয়া। অথচ নেপালের রাজনীতিতে ফেডারিলজম কী, কেন, কোথায় তা দরকার লাগে এটা অজানা শুধু না, ঠান্ডা বরফ হয়ে থাকা ইস্যু ছিল। কিন্তু ভারত সীমান্ত সংশ্লিষ্ট কিছু সমতলি অংশ কিভাবে প্রদেশে অন্তর্ভুক্ত হবে একটা না দুটোতে, কোন কোন জেলা কোথায় নেয়া হবে, নাগরিকত্বের সংজ্ঞা কী হবে এগুলো এক সাংঘাতিক বিপ্লবী ইস্যু হিসাবে হাজির করতে সক্ষম হয়েছিল। অবস্থা এমন জায়গায় পৌছেছিল ভারত সরকারই এদের বিপ্লবী নেতা। মাধোষী অধ্যুষিত তরাই অঞ্চলের এক নেতা একবার বলেই বসল ভারতকে জামিনদার থাকতে হবে। সব মিলিয়ে এমন পরিস্থিতি তৈরি করা হল যে, প্রথম সংবিধান পরিষদ তার চার বছরের সময়সীমার মধ্যে সংবিধান রচনা শেষ করতে পারল না। তথাকথিত ফেডারিলজমের তর্কে আটকে স্থবির হয়ে থাকা সংবিধান পরিষদ চার বছরের আয়ুসীমা শেষে ২০১২ সালের মে মাসে  আপনি ভেঙ্গে যায়।

তবে ভারত নেপালে  তাদের স্বার্থ রক্ষার উপনিবেশিক পথ অনুসরণ করতে গিয়ে নেপালের প্রধান তিনটা দলের সাথেই সম্পর্ক চরম অবনতিতে নিয়ে ফেলে। প্রথমে মাওবাদীদের সাথে, ফেডারিল্যেজমের তর্ক  উস্কে দিয়েছিল যাতে মাওবাদীরা সংবিধান প্রণয়ন শেষ করতে না পারে। একাজে বাকী দুদলের প্রচ্ছন্ন সমর্থন নিয়েছিল। এতে কেবল মাওবাদীরাই ফেল করে নাই, নেপালের পুরো রাজনৈতিক প্রক্রিয়াই দিশাহীন চরে আটকে যায়। হতাশায় ডুবে যায় পুরো নেপাল। বহু কষ্টে সুপ্রিম কোর্ট থেকে নতুন দিক নির্দেশনা বের করে ২০১৩ সালের নভেম্বরে  দ্বিতীয়বার সংবিধান সভার নির্বাচন আয়োজন করা সম্ভব হয়। এবারের নির্বাচনে মাওবাদীরা মাত্র ৮০ আসন পেয়ে তৃতীয় হয়। নেপালী কংগ্রেস ১৯৬ আসন পেয়ে প্রথম এবং ইউএমএল ১৭৫ আসন পেয়ে দ্বিতীয় হয়।

এবার দাহালের উদ্যোগে প্রধান তিন দল  একমত হয়ে শপথ নেয় যে তারা একজোট হয়ে প্রথম কাজ কনষ্টিটিউশন প্রণয়ন সম্পন্ন করবে। কারণ একটা পুরো জনগোষ্ঠির রাজনৈতিক হতাশায় ডুবে  যাওয়া কী জিনিষ তা সবাই উপলব্দি করে ফেলেছিল। এটা যেন মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরে আসা। ততদিনে এই তিন রাজনৈতিক দলের সাথেই ভারতের সম্পর্ক শেষ। ২০১৪ সালের জানুয়ারীতে দ্বিতীয় গণপরিষদ বা সংবিধান সভার প্রথম অধিবেশন বসে। আর দুবছর শেষ হবার আগেই, ২০১৫ সালের ২০ সেপ্টেম্বর  সংবিধান প্রণয়ন সম্পন্ন হয়ে ঘোষণা হয়ে যায়। গৃহীত সংবিধানের পক্ষে ৫৩৮ জন এবং বিপক্ষে ৬০ জন ভোট দেয়।

 

The Constitution of Nepal 2072

 নতুন সংবিধান জারীর মধ্য দিয়ে নেপাল ফেডারেল ডেমোক্রেটিক রিপাবলিক হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছে। এতে ৩৫টি অধ্যায়, ৩০৮টি অনুচ্ছেদ এবং ৯টি তফসিল রয়েছে। এই  সংবিধানে ৭টি প্রদেশভিত্তিক একটি ফেডারেল শাসন কাঠামোর ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। কেন্দ্রে দ্বিকক্ষ এবং প্রদেশে এক কক্ষ বিশিষ্ট সংসদ থাকবে। দুই কক্ষের একটি প্রতিনিধি পরিষদ এবং অপরটি জাতীয় পরিষদ। জাতীয় পরিষদের মোট ৫৯ সদস্যের মধ্যে ৭ প্রদেশ থেকে ৫৬ জন সদস্য নির্বাচিত হবেন এবং প্রেসিডেন্ট ৩ জন সদস্য মনোনয়ন দিবেন। অপরদিকে মিশ্র নির্বাচন ব্যবস্থায় ২৭৫ আসনের প্রতিনিধি পরিষদ গঠিত হবে। এরমধ্যে ১৬৫ আসনে সরাসরি ভোট হবে। আর ১১০ জন সদস্য নির্বাচিত হবেন বিভিন্ন দলের প্রাপ্ত ভোটের অনুপাতে।

ফেডারেল পার্লামেন্ট প্রধানমন্ত্রী, প্রেসিডেন্ট ও ভাইস প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত করবে। প্রেসিডেন্ট হবেন রাষ্ট্রপ্রধান এবং প্রধানমন্ত্রী সরকার প্রধান। তবে রাষ্ট্রপতির হাতে আলাদাভাবে কিছু কর্ম, কর্তব্য ও ক্ষমতা দেয়া হয়েছে। অন্যদিকে নির্বাহী ক্ষমতা মন্ত্রীপরিষদের হাতে ন্যস্ত করা হয়েছে। সেটা করতে গিয়ে তাঁরা প্রধানমন্ত্রী শব্দটি পর্যন্ত উচ্চারণ করেনি।

সংবিধানে ঘোষণা করা হয়েছে নেপাল হবে বহুজাতির, বহু ধর্মের, বহু বর্ণের এবং বহু ভাষীর রাষ্ট্র। তাঁরা সবাই সংখ্যানুপাতে সংসদে নির্বাচিত হবে। এজন্য সংবিধানে আরও বলা হয়েছে অনগ্রসর, জাতিগত সংখ্যালঘু, ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করে এমন আইন দ্বারা নির্দিষ্ট শর্তে দল ও সংসদ গঠন করতে হবে। তেমনি বৈষয়িক ও সাংস্কৃতিক কোন প্রতিবন্ধকতা যাতে না থাকে তাই  নেপালে উচ্চারিত সকল মাতৃভাষা জাতীয় ভাষা হিসেবে গণ্য করা হয়েছে।  

এ সংবিধান প্রবর্তনের মধ্য দিয়ে হিন্দু রাষ্ট্র নেপাল সেক্যুলার রাষ্ট্রে রূপান্তরিত হয়েছে। সেক্যুলার রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা নিশ্চিত করতে এই সংবিধানে ধর্মীয় ও লৈঙ্গিক সংখ্যালঘুদের প্রতি বৈষম্য নিষিদ্ধ করা হয়েছে। সমকামী, উভকামী ও তৃতীয় লিঙ্গের সুরক্ষার ব্যবস্থা রাখা হয়েছে যা এই অঞ্চলে সম্পূর্ণ ব্যতিক্রম। বলা হয়েছে ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক স্বাধীনতা রক্ষা করা হবে এবং প্রাচীন যুগ থেকে প্রচলিত ধর্ম,  সংস্কৃতি সুরক্ষা দেয়া হবে।

এ সংবিধানে দল ও সংসদে নারী প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করা হয়েছে। যে  ১১০ জন সদস্য বিভিন্ন দলের প্রাপ্ত ভোটের অনুপাতে নির্বাচিত হবেন তার এক তৃতীয়াংশ হতে হবে নারী সদস্য।

সব মিলিয়ে এই সংবিধানে inclusive democracy’র ধারণা প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে যেখানে নাগরিকগণ সার্বভৌম এবং নেপাল রাষ্ট্র ক্ষমতার মালিক।

 

খ. বাংলাদেশ

আমরা বর্তমানে অখণ্ড বাংলার যে অংশের বাশিন্দা সে অংশ ষাট দশকের আগেও পূর্ববাংলা নামে পরিচিত ছিল। পূর্ববাংলাসহ ভারতীয় উপমহাদেশ আধুনিক শাসনতান্ত্রিক ব্যবস্থার সাথে পরিচিত হয় ব্রিটিশ ঔপেনিবেশিক আমলে ব্রিটিশ পার্লামেন্টে তৈরি ১৮৫৮ সালের ভারত শাসন আইন বাস্তবায়নের পর থেকে। এ আইন কিছু সংশোধন করে ১৮৭০ সালে নতুনভাবে ভারত শাসন আইন প্রণয়ন করা হয়। ১৮৯২ সালে ভারতীয় কাউন্সিল আইন পাসের মাধ্যমে সর্বপ্রথম ভারতের সাংবিধানিক ইতিহাসে প্রতিনিধিত্বমূলক সংস্থার জন্ম দেয়। তবে বড় ধরনের শাসন-সংস্কার প্রস্তাব করা হয় ১৯১৯ সালের ভারত শাসন আইনে। এই আইনে দ্বৈত শাসন প্রবর্তন করা হয় যেখানে কোন কোন ক্ষেত্রে ভারতীয়দের আইন প্রণয়নের ক্ষমতা দেয়া হয়। এই আইনে সম্প্রদায় ভিত্তিতে পৃথক নির্বাচনের ব্যবস্থা রাখা হয়। এরপর ব্রিটিশ ভারতের শাসনতান্ত্রিক বিবর্তনের ইতিহাসের গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় ১৯৩৫ সালের ভারত শাসন আইন। এই আইনে কেন্দ্রীয় শাসনের জন্য একটি ফেডারেল সরকার এবং স্বায়ত্তশাসিত প্রাদেশিক সরকার ব্যবস্থা প্রবর্তন করা হয়। দ্বৈত শাসন প্রথা বিলুপ্ত করা হয়। ১৯৩৫ সালের ভারত শাসন আইন ছিল ভারতীয় স্বাধীনতা আইনের ভিত্তি।

তবে এ ভূখণ্ডের জনগণ শাসনতন্ত্র বা সংবিধান প্রণয়ন এবং রাষ্ট্র গঠনের  লক্ষ্যে প্রথমবার গণপরিষদ নির্বাচনে অংশ নেয় ১৯৪৬ সালের মার্চ মাসে ব্রিটিশ ভারতের অখণ্ড বাংলা প্রদেশের অংশ হিসেবে। সম্প্রদায় ভিত্তিতে গণপরিষদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এ নির্বাচনে পূর্ববাংলার জনগণ, প্রধানত মুসলিম জনগোষ্ঠী (৯৬%) পাকিস্তান রাষ্ট্রভুক্ত হবার জন্য মুসলিম লীগের পক্ষে রায় প্রদান করে । ১৯৪৬ সালের নির্বাচনে হিন্দু-মুসলিম বিভক্তি স্পষ্ট হয়ে যায়। এমন অবস্থায় ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রি জন অ্যাটলি ১৯৪৭ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি ঘোষণা দেন যে, ১৯৪৭ সালের জুন মাসের মধ্যে ভারতীয়দের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করা হবে।  এ ঘোষণা বাস্তবায়নের জন্য ভারতের ভাইসরয় হিসেবে লর্ড মাউন্টব্যাটেনকে নিয়োগের সিদ্ধান্তও ঘোষণা করা হয়।  

মাউন্টব্যাটেন ক্ষমতা হস্তান্তরের যে রূপরেখা তৈরি করেন তার বৈশিষ্ট্য ছিল—
•    সংবিধান প্রণয়নের দায়িত্ব ভারতীয়দের নির্বাচিত গণপরিষদের ওপর হস্তান্তর;

•    ভারত অখণ্ড রাখার জন্য আলাপ আলোচনার উদ্যোগ ব্রিটিশ সরকার নেবে না বলে ঘোষণা প্রদান;

•    কোন অঞ্চল ইতোমধ্যে গঠিত গণপরিষদ কর্তৃক প্রণীত সংবিধান গ্রহণে অনিচ্ছুক হলে নতুন গণপরিষদ গঠনের ব্যবস্থা;
বাংলা, পাঞ্জাব, উত্তরপশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ ও বেলুচিস্তানের ক্ষেত্রে হিন্দু-মুসলমানদের মধ্যে বিভক্তির ব্যবস্থা রাখা এবং এই বিভক্তির ভিত্তিতে সীমানা নির্ধারণে একটি সীমানা কমিশন গঠন ইত্যাদি  এবং

•    এসব কার্যাবলী সম্পন্ন হলে ক্ষমতা হস্তান্তর।

কংগ্রেস ও মুসলিম লীগ উভয় দলই মাউন্টব্যাটেন পরিকল্পনা গ্রহণ করে এবং পরিকল্পনা অনুযায়ী ১৯৪৭ সালের ১৮ জুলাই ‘দি ইন্ডিয়ান ইন্ডিপেন্ডেন্স অ্যাক্ট-১৯৪৭’ পাস হয়। এই আইন অনুযায়ী ভারতবর্ষকে ভারত ও পাকিস্তান নামে দুটি স্বাধীন ডোমিনিয়নে ভাগ করা হয়। নতুন সংবিধান প্রণয়ন না হওয়া পর্যন্ত প্রত্যেক ডোমিনিয়নের সরকারসমূহ প্রয়োজনীয় পরিবর্তনসহ ১৯৩৫ সালের ভারত শাসন আইনানুযায়ী পরিচালিত হবে বলে নির্ধারিত হয়। ১৯৩৫ সালের ভারত শাসন আইন প্রয়োজনে পরিবর্তনের ক্ষমতা ১৯৪৮ সালের ৩১ মার্চ পর্যন্ত ব্রিটিশ গভর্নর জেনারেলের হাতে রাখার ব্যবস্থা করা হয় এবং নির্ধারিত হয় এ মেয়াদের পর থেকে প্রয়োজনীয় পরিবর্তন করবে গণপরিষদ বা সংবিধান সভা। জিন্নাহ পাকিস্তান ডোমিনিয়নের প্রথম গভর্নর জেনারেল নিযুক্ত হন। লর্ড মাউন্টব্যাটেন ১৪ আগস্ট করাচিতে উপস্থিত হয়ে ১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট নতুন রাষ্ট্র পাকিস্তানের উদ্বোধন ঘোষণা করেন।

এখানে প্রণিধানযোগ্য, স্বাধীন ভারত ও পাকিস্তান শুধু ব্রিটিশদের প্রণীত ১৯৩৫ সালের ভারত শাসন আইনের অধীনে যাত্রা শুরু করে নাই, ব্রিটিশদের তৈরি যাবতীয় আইনও তার সঙ্গী হয়েছিল, যেসব আইন তৈরি হয়েছিল প্রধানত উপনিবেশের জনগণকে শাসন করার জন্য। কিন্তু নতুন ‘স্বাধীন’ রাষ্ট্রদ্বয়ও ওইসব আইনকে ধারণ করে নিয়েছিল তার নিজ নিজ ‘স্বাধীন’ সত্তায়। অর্থাৎ ব্রিটিশরা যখন ভারত-পাকিস্তানকে স্বাধীনতা দিয়ে গেছে তখন শুধু ১৯৩৫ সালের ভারত শাসন আইন বা ইন্ডিয়ান ইন্ডিপেন্ডেন্স অ্যাক্ট দিয়ে যায় নি, তাদের উপযোগী আইন, বিচার ব্যবস্থাও দিয়ে গেছে। আরও দিয়ে গেছে তাদের অনুসরণ করার শিক্ষা ও শিক্ষা ব্যবস্থা। উপরোক্ত শাসনতান্ত্রিক অভিজ্ঞতা ও আইনগত কাঠামো নিয়েই পূর্ববাংলার জনগণ পাকিস্তান রাষ্ট্রের অন্তর্ভুক্ত হয়।

বাংলাদেশের স্বাধীনতার পূর্ব পর্যন্ত পূর্ব বাংলা ২৩ বছর পাকিস্তান রাষ্ট্র কাঠামোর অংশ ছিল। এই পুরো সময়টা ছিল বস্তুতপক্ষে একটি সংবিধান তৈরি তথা রিপাবলিক গঠনের সংগ্রামের কাল। কিন্তু আমাদের রাজনৈতিক ইতিহাস বর্ণনার সময় অনেকেই সংবিধানের জন্য সেই সংগ্রামের কথা বাদ দিয়ে ক্ষমতাকেন্দ্রিক সংগ্রামের আলোকেই পুরো ঘটনাবলীকে পর্যালোচনা করে থাকেন।

পূর্বেই উল্লেখ করা হয়েছে যে, ১৯৩৫ সালের ভারত শাসন আইনের প্রয়োজনীয় পরিবর্তন সাপেক্ষে গণপরিষদ কর্তৃক নতুন সংবিধান প্রণয়নের পূর্ব পর্যন্ত ১৯৩৫ সালের ভারত শাসন আইনের আলোকেই রাষ্ট্র পরিচালনার বিষয়ে ঐকমত্য ছিল। আরও ঐকমত্য ছিল যে ১৯৪৬ সালের নির্বাচিত সদস্যদের নিয়ে গঠিত গণপরিষদ অথবা নতুন করে নির্বাচিত গণপরিষদ সংবিধান প্রণয়নের কার্য সম্পাদন করবে। প্রসঙ্গত এখানে উল্লেখ্য পাকিস্তান ডোমিনিয়নে ১৯৩৫ সালের ভারত শাসন আইনের অধীনে ১৯৪৬ সালে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে যেসব  সদস্য পরিবর্তীকালে পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত হন তাদের নিয়ে গঠিত হয় পাকিস্তানের প্রথম গণপরিষদ বা সংবিধান সভা। মোট ৭৪ জন সদস্য নিয়ে গণপরিষদের যাত্রা শুরু হয়। পরবর্তীতে এর সদস্য সংখ্যা ৫জন বৃদ্ধি করে ৭৯ তে উন্নীত করা হয়। এর মধ্যে পূর্ব বাংলার সদস্য সংখ্যা  ছিল মোট ৪৪ জন এবং পশ্চিম পাকিস্তানের সদস্য সংখ্যা ছিল মোট ৩৫ জন।  যোগেন্দ্রনাথ মণ্ডলের সভাপতিত্বে করাচিতে পাকিস্তানের প্রথম সংবিধান সভা তথা গণপরিষদের প্রথম অধিবেশন শুরু হয় ১৯৪৭ সালের ১০ আগস্ট এবং শেষ হয় ১৪ আগস্ট।

১৯৩৫ সালের ভারত শাসন আইনের আরেকটি বড় বিষয় ছিল সেখানে একটি ফেডারেল রাষ্ট্র কাঠামোর রূপরেখা, কেন্দ্রের সাথে প্রদেশের সম্পর্ক, কেন্দ্রীয় পরিষদ এবং প্রাদেশিক পরিষদের ক্ষমতার ভাগাভাগির তৈরি করাই ছিল। তাই আশাকরা অসঙ্গত ছিল না যে ১৯৩৫ সালের শাসনতন্ত্রের প্রয়োজনীয় পরিবর্তন সাপেক্ষে সবার কাছে গ্রহণযোগ্য একটি সংবিধান প্রণয়ন হয়তো দুরূহ হবে না। কিন্তু সে আশাবাদ ভুল প্রমাণিত হয়। পাকিস্তানের প্রথম গণপরিষদের ( ব্রিটিশ উপনিবেশিক যুগে নির্বাচিত ) প্রথম ৭ বছরে মাত্র ১৬টি অধিবেশন হয়। এরমধ্যে ১৩টি হয় জরুরি কিছু আইন প্রণয়নের জন্য। যাহোক, প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলি খানের উদ্যোগে প্রথমবারের মতো সংবিধান প্রণয়নের জন্য Objective Resolution  গৃহীত হয়। এই প্রস্তাবে রাষ্ট্রের উদ্দেশ্য হিসেবে ধর্মভিত্তিক ফেডারেল রাষ্ট্র গঠনের প্রস্তাব করা হয়। জনপ্রতিনিধিদের মাধ্যমে রাষ্ট্রের ক্ষমতা চর্চার প্রস্তাবের সঙ্গে মৌলিক অধিকার ও বিচার বিভাগের স্বাধীনতা প্রদানের কথাও বলা হয়। পাকিস্তানের সকল অঞ্চলসমূহকে নিয়ে গঠিত যুক্তরাষ্ট্রের সকল ইউনিটসমূহকে স্বায়ত্তশাসন দেওয়ার প্রস্তাব করা হয়। এই রিপোর্ট পাস হওয়ার পর মূলনীতি নির্ধারক কমিটি গঠন করা হয়। তবে ১৯৫০ সালের ২৮ সেপ্টেম্বর প্রধানমন্ত্রি লিয়াকত আলি খান গণপরিষদে একটি অন্তর্বর্তীকালীন রিপোর্ট পেশ করেন যেখানে ফেডারেল ব্যবস্থাকে দুর্বল করে প্রেসিডেন্টের ক্ষমতা বাড়ানোর প্রস্তাব করা হয়। এতে পূর্ববাংলায় ব্যাপক প্রতিক্রিয়া ও আন্দোলনের শুরু হয়। একই বছরের অক্টোবরে রাজনীতিবিদ, আইনজীবী, সাংবাদিক সমন্বয়ে ‘গণতান্ত্রিক ফেডারেশন সংগ্রাম কমিটি’ গঠিত হয়। কমিটির ডাকে আতাউর রহমান খানের সভাপতিত্বে ৪-৫ নভেম্বর ঢাকায় এক মহাসম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। এই সম্মেলন থেকে মূলনীতি নির্ধারক কমিটির প্রস্তাবের বিপরীতে একটি খসড়া সংবিধানের প্রস্তাব গৃহীত হয়। সেখানে উল্লেখযোগ্য দাবীসমূহ – রাষ্ট্রের নাম হবে পাকিস্তান যুক্তরাষ্ট্র; যার দু’টি অংশ থাকবে, দু’টি প্রাদেশিক সরকার থাকবে। এবং এটি হবে সার্বভৌম সমাজতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র। এই প্রস্তাবনায় বলা হয়, প্রাপ্তবয়স্কদের ভোটে একটি এককক্ষ বিশিষ্ট সংসদ থাকবে। প্রত্যেক নির্বাচনী এলাকার ভোটারদের তাদের সংসদ সদস্যকে সংসদ থেকে অব্যাহতি দেওয়ার ক্ষমতা থাকবে। মন্ত্রীসভা তার কাজের জন্য সংসদের নিকট দায়বদ্ধ  থাকবে। উপরোক্ত খসড়া সংবিধানের প্রস্তাবের পক্ষে ১২ নভেম্বর হরতাল পালিত হয়। এ পরিস্থিতিতে প্রধানমন্ত্রি লিয়াকত আলি খান তাঁর প্রস্তাব প্রত্যাহার করে নেন। পরিবর্তীকালে খাজা নাজিমউদ্দিন সংবিধানের খসড়া চূড়ান্ত করে ১৯৫২ সালে আগস্টে তা গণপরিষদে পেশ করেন। তবে আইন পরিষদে সংখ্যানুপাতে প্রতিনিধিত্বের পরিবর্তে সমান প্রতিনিধিত্বের প্রস্তাবের কারণে পূর্ববাংলার জনগণ তা  মেনে নেয় নি। ১৯৫৩ সালে খাজা নাজিমউদ্দিন-এর স্থলাভিষিক্ত হয়ে বগুড়ার মোহাম্মদ আলী সমগ্র পাকিস্তানকে ২টি ইউনিট হিসেবে ভাগ করার প্রস্তাব দেন  যা ‘মোহাম্মদ আলী ফর্মুলা’ বলে পরিচিত। এ প্রস্তাব দুই অঞ্চলের রাজনৈতিক নেতাদের মধ্যে কিছুটা ভারসাম্য এনে দেয়। এ ফর্মুলায় পশ্চিম পাকিস্তানে ৪টি প্রদেশের প্রস্তাব করা হয়। দুই কক্ষ বিশিষ্ট সংসদের প্রস্তাব করা হয়। উচ্চ কক্ষে ৫টি প্রদেশের সমান প্রতিনিধিত্ব (মোট ৫০ জন ) দেয়ার কথা বলা হয়। নিম্নকক্ষে জনসংখ্যার ভিত্তিতে আসন সংখ্যা ( মোট ৩০০ জন ) নির্ধারণের সুযোগ রাখা হয় এবং উভয়কক্ষে মোট আসন সংখ্যা পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মাঝে সমান রাখা হয়। উচ্চ কক্ষের সদস্যগণ পরোক্ষ এবং নিম্ন কক্ষের সদস্যগণ প্রত্যক্ষ ভোটে নির্বাচিত হবেন। এটাও ঠিক করা হয় যে, রাষ্ট্রপ্রধান যদি এক অংশের হয় তবে প্রধানমন্ত্রী হবেন অন্য অংশ হতে।

মোহাম্মদ আলী ফর্মুলার ভিত্তিতে তৈরি রিপোর্ট ১৯৫৪ সালের ২১ সেপ্টেম্বর গণপরিষদে ২৯-১১ ভোটে গৃহীত হয়। এই রিপোর্টে পাকিস্তানকে ইসলামী প্রজাতন্ত্র  বলা হয়। গণপরিষদের অনুমোদন ছাড়া গভর্নর জেনারেলের অধ্যাদেশ জারীর ক্ষমতা বাতিল করা হয়। মন্ত্রীপরিষদ গঠন ও ভেঙ্গে দেয়ার ক্ষমতা গভর্নর জেনারেলের পরিবর্তে প্রধানমন্ত্রীর কাছে ন্যস্ত করার প্রস্তাব করা হয়। গণপরিষদকে পাকিস্তানের যে কোন অংশের জন্য সাংবিধানিক আইন প্রণয়নের ক্ষমতা প্রদান করা হয়। এতে আরও বলা হয়, এভাবে প্রণীত কোন সাংবিধানিক আইন কোন আদালতে চ্যালেঞ্জ করা যাবে না। ১৯৩৫ সালের ভারত শাসন আইনে ২২০-ক ধারা নামে নতুন একটি ধারা সংযোজন করা হয় যাতে হাইকোর্ট ও ফেডারেল কোর্টের রিট ইস্যু করার ক্ষমতা রাখা হয়। এছাড়া ১৯৩৫ সালের ভারত শাসন আইনের ১০ নং ধারা সংশোধন করা হয় যার ক্ষমতা বলে গভর্নর জেনারেল প্রধানমন্ত্রীকে তাঁর পদ থেকে বরখাস্ত করতে পারত।

গভর্নর জেনারেল গোলাম মোহাম্মদ ১৯৫৪ সালের ২৪ অক্টোবর এক অধ্যাদেশ বলে গণপরিষদ ভেঙ্গে দিয়ে জরুরি অবস্থা জারী করেন। এভাবেই প্রথম গণপরিষদের অপমৃত্যু হয় এবং  ঔপেনিবেশিক প্রভুদের তৈরি একক নিরুঙ্কুশ ক্ষমতা ব্যবস্থা কিছুটা কমানোর চেষ্টা ব্যর্থ হয়ে যায়। পাকিস্তানে শাসনতন্ত্র গড়ার অগ্রগতি ভেস্তে যায় এবং পূর্ববাংলার জন্য তা বিশেষ হতাশার কারণ হয়ে দেখা দেয়।

তবে গণপরিষদ ভেঙ্গে দেওয়ায় পাকিস্তানের ইতিহাসে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ আইনি লড়াই শুরু হয়। সিন্ধুর মুখ্য আদালত অভিমত প্রদান করেন, ১৯৫৪ সালের ৫ম সংশোধনী আইনের মাধ্যমে বৈধভাবে ১৯৩৫ সালের ভারত শাসন আইনের ১০ নং ধারা সংশোধন করা হয়েছে এবং গণপরিষদ কর্তৃক প্রণীত সাংবিধানিক আইনে গভর্নর জেনারেলের সম্মতির প্রয়োজন নেই। কিন্তু ফেডারেল কোর্ট সংখ্যাগরিষ্ঠের মতামতে সিদ্ধান্ত প্রদান করে যে গভর্নর জেনারেলের সম্মতি না থাকাতে গণপরিষদ কর্তৃক প্রণীত সাংবিধানিক আইনসমূহ আইনের মর্যাদা লাভ করে নাই। অর্থাৎ গভর্নর জেনারেলের গণপরিষদ ভেঙ্গে দেয়া আইনসম্মত হয়েছে।       

১৯৩৫ সালের ভারত শাসন আইন এবং ইন্ডিয়ান ইন্ডিপেন্ডেন্স অ্যাক্ট (যা একত্রে পাকিস্তানের অন্তর্বর্তীকালীন সংবিধান হিসেবে বিবেচিত হতো) নতুন করে গণপরিষদ গঠনের কোন বিধান ছিল না। ফলে পাকিস্তানের সাংবিধানিক ইতিহাসে চরম শূন্যতার সৃষ্টি হয়। তবে পাকিস্তানের ফেডারেল কোর্ট গভর্নর জেনারেলকে একটি নতুন গণপরিষদ গঠন করার পক্ষে রায় প্রদান করলে এর অবসান ঘটে।  ১৯৫৫ সালের মে মাসে ৮০ জন সদস্য নিয়ে পাকিস্তানের দ্বিতীয় গণপরিষদ গঠিত হয়। এরমধ্যে ৭২ জন পরোক্ষ ভোটে নির্বাচিত এবং ৮ জন ছিল দেশীয় রাজ্য ও উপজাতি এলাকা থেকে মনোনীত। মোট সদস্যের অর্ধেক অর্থাৎ ৪০ জন পূর্ব অংশের এবং পশ্চিম অংশের ৪০ জন। দলওয়ারী সদস্য সংখ্যা এরূপ – মুসলিম লীগ ২৫ জন, ইউনাইটেড ফ্রন্ট ১৬ জন, আওয়ামী লীগ ১২ জন, ফিরোজ খান নুন গ্রুপ ৩ জন, পাকিস্তান কংগ্রেস ৪ জন, শিডিউল কাস্ট ফেডারেশন ৩ জন, ইউনাইটেড প্রোগ্রেসিভ পার্টি ২ জন এবং অন্যান্য ১৫ জন। উদ্বোধনী অধিবেশন বসে ১৯৫৫ সালের ৭ জুলাই মারীতে। ৮ সেপ্টেম্বর পশ্চিম অংশের সকল প্রদেশকে এক ইউনিট তথা পশ্চিম পাকিস্তান ধরে একটি বিল পাস করা হয় এবং পূর্ববাংলার নাম বদলে পূর্বপাকিস্তান রাখা হয়। ১৯৫৬ সালের ৮ জানুয়ারি সংবিধানের খসড়া প্রকাশ করা হয়। ১৯৫৬ সালের ২৯ ফেব্রুয়ারি .সংবিধান পাস হয়, আর তা কার্যকর হয় ১৯৫৬ সালের ২৩ মার্চ। এভাবে  প্রতিষ্ঠার সুদীর্ঘ ৯ বছর পর পাকিস্তান একটি শাসনতন্ত্র প্রণয়নে সক্ষম হয়। যদিও এটি কার্যকর হওয়ার আড়াই বছরের মাথায় বাতিল করা হয়। ১৯৫৬ সালের সংবিধান পাকিস্তানকে ইসলামী প্রজাতন্ত্র হিসেবে ঘোষণা করে। গভর্নর জেনারেলের স্থলে প্রেসিডেন্ট রাষ্ট্রপ্রধান হন, তবে একজন মুসলমান নাগরিকই কেবল পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট হতে পারবে। এটি ছিল পৃথিবীর অন্যতম দীর্ঘ লিখিত সংবিধান। এ সংবিধানে মৌলিক অধিকারের নিশ্চয়তা ও যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা রাখা হয়। কায়েম করা হয় মন্ত্রীপরিষদ শাসিত সরকার ব্যবস্থা। কেন্দ্র ও প্রাদেশিক সরকারের মধ্যে ১৯৩৫ সালের ভারত শাসন আইনের অনুকরণে ক্ষমতা ভাগ করে দেয়া হয়। নারীদের জন্য ১০টি অতিরিক্ত আসন ১০ বছরের জন্য সংরক্ষিত রাখা হয়। জাতীয় সংসদে পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের জন্য সমান প্রতিনিধিত্ব ( মোট ৩০০ আসন ) রাখা হয়। সুপ্রিম কোর্টকে সংবিধানের রক্ষাকর্তা, ব্যাখ্যাদান ও সংবিধান পরিপন্থি আইন বাতিলের ক্ষমতা দেয়া হয়। ইসলামী বিধি বিধান বিরোধী কোন আইন পাস করার অধিকার আইন সভার ছিল না।

কিন্তু দীর্ঘ ৯ বছরের প্রচেষ্টায় যে শাসনতন্ত্র প্রণয়ন করা হয় তার আয়ুষ্কাল ছিল মাত্র আড়াই বছর। ১৯৫৮ সালের ৭ অক্টোবর তৎকালীন প্রেসিডেন্ট জেনারেল ইস্কান্দার মির্জা সামরিক বাহিনীর সহায়তায় সংসদীয় সরকারকে উৎখাত করে পাকিস্তানে সামরিক আইন জারী করেন। সংবিধান বাতিল ঘোষণা করা হয়। এইভাবে একটি সাংবিধানিক অধ্যায়ের অবসান ঘটে। পাকিস্তান আবার সংবিধান ফিরে পাওয়ার পুরনো সংগ্রামে ফিরে যায়, সঙ্গে পূর্ববাংলাও।

১৯৬০ সালে জেনারেল আইয়ুব খান প্রেসিডেন্ট ইস্কান্দার মির্জাকে দেশ থেকে বের করে দিয়ে নিজেই প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব নেন এবং একটি সংবিধান কমিশন গঠন করেন। কমিশনকে দায়িত্ব দেয়া হয় ১৯৫৬ সালের সংবিধানের ব্যর্থতার কারণ উদঘাটন এবং ভবিষ্যতের সংবিধানের সুপারিশ প্রণয়ন করার। কমিশন পাকিস্তানে সংসদীয় পদ্ধতির সরকার ব্যর্থ হয়েছে বলে রিপোর্ট এবং পাকিস্তানকে একটি ফেডারেল রাষ্ট্র হিসেবে গড়ে তোলার জন্যে শক্তিশালী কেন্দ্রীয় ব্যবস্থার পক্ষে অভিমত দেয়। কমিশন আরও মতামত দেয় যে, পাকিস্তানের জনগণ সেদেশের প্রেসিডেন্ট এবং আইনসভার সদস্য নির্বাচিত করার যোগ্য নয় সেজন্য উচ্চ পদসমূহের নির্বাচনে ভোটদানের ক্ষমতা সীমিত করা উচিৎ। এভাবে কমিশন ‘মৌলিক গণতন্ত্র’-এর তত্ত্ব উপস্থাপন করে। কমিশন প্রেসিডেন্সিয়াল পদ্ধতির সরকার ব্যবস্থার সুপারিশসহ দ্বি-কক্ষ আইনসভার প্রস্তাব করে। পাকিস্তানের এক অংশ থেকে প্রেসিডেন্ট এবং অপর অংশ থেকে ভাইস প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের সুপারিশ করে। এই রিপোর্ট প্রেসিডেন্ট পরীক্ষা নিরীক্ষা শেষে বাতিল করে দেয় এবং সংবিধান প্রণয়নের জন্য অপর একটি কমিটি গঠন করে।

নতুন কমিটির খসড়া প্রণয়ন শেষে প্রেসিডেন্ট ১৯৬২ সালের ১ মার্চ সংবিধান ঘোষণা করেন এবং ৮ জুন থেকে তা কার্যকর হয়। ’৬২ সালের সংবিধানে রাষ্ট্র পরিচালনার ক্ষেত্রে প্রেসিডেন্সিয়াল পদ্ধতির সরকার ব্যবস্থা রাখা হয় এবং প্রেসিডেন্টকে করা হয় অবাধ ক্ষমতার অধিকারী। তিনি আইনসভা ও বিচার বিভাগের এখতিয়ার বহির্ভূত ছিলেন। বিচার বিভাগের ক্ষমতা অতিমাত্রায় সংকুচিত করা হয়। ‘মৌলিক গণতন্ত্র’-এর নামে নির্বাচনী অধিকারও খর্ব করা হয়। কেননা এ সংবিধান অনুযায়ী রাষ্ট্রের নাগরিকগনের সরাসরি ভোটে রাষ্ট্রপতি, জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদ সদস্য নির্বাচিত হতেন না। তাঁরা নির্বাচিত হতেন ইউনিয়ন কাউন্সিলের ৮০ হাজার সদস্যের ভোটে। জাতীয় পরিষদের মোট সদস্য সংখ্যা নির্ধারণ করা হয় ১৫৬ জন। পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তান থেকে ৭৫ জন করে ১৫০ জন, আর মহিলাদের জন্য ৬ টি সংরক্ষিত আসন। প্রাদেশিক সরকারের নির্বাহী করা হয় প্রেসিডেন্ট মনোনীত গভর্নরকে। গভর্নরের সহায়তার জন্য একটা মন্ত্রীপরিষদ ছিল। প্রত্যেক প্রদেশে এককক্ষ বিশিষ্ট আইনসভার ব্যবস্থা রাখা হয়। তবে গভর্নরের সম্মতি ছাড়া আইনসভার বিল পাস হতে পারতনা। মৌলিক অধিকার অংশে বলা হয়েছিল রাষ্ট্র ইসলাম পরিপন্থী কোন আইন প্রণয়ন করতে পারবে না। আর প্রস্তাবনায় ইসলামী সাম্য, স্বাধীনতা, গণতন্ত্র ইত্যাদির কথা ছিল।  আইয়ুব খানের সংবিধান কোন ধরনের গণপরিষদ দ্বারা প্রণীত হয় নি, একদল তথাকথিত বিশেষজ্ঞ এই শাসনতন্ত্র প্রণয়ন করেন।

ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের ১১ দফা আন্দোলন, শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগের ৬ দফা আন্দোলন, মাওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানির গণসংগ্রাম, শ্রমিকদের মজুরির লড়াই ইত্যাদি সব মিলে তৎকালীন পূর্বপাকিস্তানে গণঅভ্যুত্থান সংঘটিত হয়। এতে আইয়ুব খানের  পতন ঘটে এবং জেনারেল ইয়াহিয়া খান ক্ষমতা গ্রহণ করেন। তিনি ঘোষণা দেন যতশীঘ্র সম্ভব প্রাপ্তবয়স্কদের ভোটে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধদের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করা হবে এবং জনপ্রতিনিধিদের কাজ হবে দেশের শাসনতন্ত্র প্রণয়ন। নির্বাচনের জন্য তিনি লিগাল ফ্রেম ওয়ার্ক (এল এফ ও) জারী করেন। এল এফ ও’র প্রধান দিক ছিল ১৯৬১ সালের আদমশুমারি অনুযায়ী আসন বণ্টন এবং সেভাবে জাতীয় পরিষদের ৩০০ আসনের ১৬২ ছিল পূর্ব পাকিস্তানে, আর ১৩৮টি ছিল পশ্চিম পাকিস্তানে। মহিলাদের ১৩টি আসনের ৭টি পূর্ব পাকিস্তানের এবং ৬টি পশ্চিম পাকিস্তানের ছিল। অধিবেশন শুরুর ১২০ দিনের মধ্যে পরিষদ শাসনতন্ত্র বিল নামক বিলের মাধ্যমে শাসনতন্ত্র প্রণয়ন করবে এবং তা করতে ব্যর্থ হলে পরিষদ বাতিল হয়ে যাবে। শাসনতন্ত্র প্রণয়ন করার পর তা প্রেসিডেন্টের অনুমোদনের জন্য পেশ করা হবে। শাসনতন্ত্র অনুমোদনের পূর্ব পর্যন্ত জাতীয় পরিষদ কাজ করবে ‘আইন পরিষদ’ হিসেবে।  শাসনতন্ত্র  বিলে প্রেসিডেন্ট অনুমোদন না দিলে জাতীয় পরিষদ বিলুপ্ত হয়ে যাবে। এল এফ ও’র কোন বিষয়ে ব্যাখ্যা বিশ্লেষণের প্রয়োজন হলে তা করবেন প্রেসিডেন্ট  এবং প্রেসিডেন্টের ব্যাখ্যাই চূড়ান্ত। এ বিষয়ে কোন আদালতে চ্যালেঞ্জ করা যাবে না। প্রেসিডেন্ট এল এফ ও’র যে কোন ধারা সংশোধন বা পরিবর্তন করতে পারবেন এবং এ বিষয়ে জাতীয় পরিষদের হস্তক্ষেপমূলক ক্ষমতা থাকবে না। নির্বাচনকে আওয়ামী লীগ পূর্ব পাকিস্তানের পূর্ণ স্বায়ত্তশাসনের দাবিতে রেফারেন্ডাম হিসেবে ঘোষণা করে অংশ নেয়।  ১৯৭০ সালের ৭ ডিসেম্বর নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলে আওয়ামী লীগ পূর্ব পাকিস্তানের জন্য নির্ধারিত জাতীয় পরিষদের ১৬২ আসনের মধ্যে ১৬০টি আসনে এবং পশ্চিম পাকিস্তানের জন্য নির্ধারিত ১৩৮টি  আসনের মধ্যে ৮১টি আসনে পিপিপি জয়লাভ করে। ফলাফল পশ্চিম পাকিস্তানের শাসক গোষ্ঠীর প্রতিকূলে যাওয়ায় অধিবেশন আহবানের ক্ষেত্রে প্রেসিডেন্ট টালবাহানা শুরু করেন। ১৯৭১ সালের ৩ মার্চ জাতীয় পরিষদের অধিবেশন আহবান করেও পরে তা স্থগিত করা হয়। পূর্ব পাকিস্তান বিক্ষোভে ফেটে পড়ে। ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণের পর থেকে দেশ কার্যত শেখ মুজিবুর রহমানের শাসনাধীনে চলে আসে। এরপর পাকিস্তানের শাসক গোষ্ঠী পর্যাপ্ত সেনা মোতায়নের জন্য আলাপ-আলোচনার নাটক শুরু করে। এ কাজ সম্পন্ন হওয়ার পর ২৫ মার্চ রাতে শেখ মুজিবুর রহমানকে তাঁর বাসভবন থেকে গ্রেফতার করা হয় এবং ‘ অপারেশন সার্চ লাইট’ নামে পশ্চিমা সেনাবাহিনী নির্বিচারে গণহত্যা শুরু করে। বাঙালী সৈন্য, বিডিআর, পুলিশসহ গোটা জাতি প্রতিরোধ শুরু করে। ২৬ মার্চ এম এ হান্নান এবং ২৭ মার্চ জিয়াউর রহমান চট্টগ্রাম বেতার কেন্দ্র থেকে শেখ মুজিবুর রহমানের পক্ষে স্বাধীনতার ঘোষণা পাঠ করেন। শুরু হয় সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধ।

শেখ মুজিবুর রহমান রাষ্ট্রপ্রধান, সৈয়দ নজরুল ইসলাম উপ-রাষ্ট্রপ্রধান এবং তাজউদ্দীন আহম্মদকে প্রধানমন্ত্রী করে প্রবাসী সরকার গঠিত হয়। ১০ এপ্রিল রাতে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহম্মদের ভাষণ প্রচার করা হয়। ১৭ এপ্রিল মুজিবনগরে বাংলাদেশের মন্ত্রীসভার শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠিত হয়। এ অনুষ্ঠানে স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র গৃহীত হয়। এভাবেই বাংলাদেশ তাঁর স্বতন্ত্র সাংবিধানিক একটি প্রক্রিয়ায় প্রবেশ করে। স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রটিতে বলা হয় ’৭০-এর নির্বাচনের মাধ্যমে জনগণ আওয়ামী লীগকে বিপুলভাবে নির্বাচিত করেছিল, কিন্তু প্রেসিডেন্ট প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করে একটি বিশ্বাসঘাতকতামূলক যুদ্ধ শুরু করেন। তৎপ্রেক্ষিতে শেখ মুজিবুর রহমান জনগণের আত্মনিয়ন্ত্রনাধিকার অর্জনের আইনানুগ অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য স্বাধীনতা ঘোষণা করেছেন। সেখানে নতুন রাষ্ট্রের লক্ষ্য-উদ্দেশ্যকে বিবৃত করা হয়েছে এভাবে; “ যেহেতু সার্বভৌম ক্ষমতার অধিকারী বাংলাদেশের জনগণ নির্বাচিত প্রতিনিধিদের প্রতি যে রায় দিয়েছেন, সে মোতাবেক আমরা নির্বাচিত প্রতিনিধিরা আমাদের সমবায়ে গণপরিষদ গঠন করে পারস্পরিক আলাপ আলোচনার মাধ্যমে বাংলাদেশের জনগণের জন্য সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠা করা আমাদের পবিত্র কর্তব্য বিবেচনা করে বাংলাদেশকে একটি সার্বভৌম প্রজাতন্ত্রী রাষ্ট্র ঘোষণা করছি। এতদ্বারা পূর্বাহ্ণে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বাধীনতা ঘোষণাও  অনুমোদন করছি”। এছাড়া এ ঘোষণাপত্রে রাষ্ট্রের আইন প্রণয়নসহ সকল অর্থনৈতিক ও প্রশাসনিক ক্ষমতার অধিকারী করা হয় রাষ্ট্রপ্রধানকে। মূলত মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ে ঐ ঘোষণাপত্রটিই ছিল নতুন বাংলাদেশ রাষ্ট্রের সংবিধান। স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র ১৯৭২ সালের ১১ জানুয়ারী পর্যন্ত বহাল ছিল।

দীর্ঘ নয় মাসের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মধ্য দিয়ে ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশ আনুষ্ঠানিক বিজয় অর্জন করে। ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমান স্বাধীন বাংলাদেশে ফেরত আসেন। ১১ জানুয়ারি তিনি অস্থায়ী সংবিধান আদেশ জারী করেন। এই আদেশের মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধের সময়কালের সরকার ব্যবস্থা পরিবর্তন করা হয়। স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রে রাষ্ট্রপতির কাছে সকল ক্ষমতা অর্পণ করা হয়েছিল। নতুন আদেশে তা পরিবর্তন করে প্রধানমন্ত্রীর কাছে ন্যস্ত করা হয়। রাষ্ট্রপতি সম্পর্কে বলা হয় রাষ্ট্রপতি তাঁর সকল কাজ প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শ অনুযায়ী করবেন। অস্থায়ী সংবিধান আদেশে অপরাপর বিষয়ের সঙ্গে গণপরিষদ বা সংবিধান সভার একটি সংজ্ঞা দেয়া হয়। যার মূল বিষয় ছিল এটা আইনসভা হিসেবে কাজ করবে। ১২ জানুয়ারি শেখ মুজিবুর রহমান রাষ্ট্রপতি পদ থেকে পদত্যাগ করেন এবং প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব নেন।

বাংলাদেশ রাষ্ট্রের সংবিধান প্রণয়নের লক্ষ্যে ১৯৭২ সালের ২২ মার্চ বাংলাদেশ গণপরিষদ আদেশ আইন জারী করা হয় এবং এটিকে ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ থেকেই কার্যকর বলে ঘোষণা করা হয়। এই আইন বলে পাকিস্তান রাষ্ট্র কাঠামোর অধীনে ১৯৭০ সালে নির্বাচিত তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান অংশের জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদের সদস্যদের নিয়ে গণপরিষদ গঠন করা হয়। অর্থাৎ পাকিস্তান রাষ্ট্র কাঠামোর মধ্যে পূর্ব পাকিস্তানের স্বায়ত্তশাসনের দাবীর সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ একটি শাসনতন্ত্র প্রণয়নের জন্য যারা ইয়াহিয়া খানের এল এফ ও’র আওতায় নির্বাচিত হয়েছিলেন, তাদের স্বাধীন বাংলাদেশের জন্য সংবিধান প্রণয়নের দায়িত্ব দেয়া হয়। অন্যদিকে প্রাদেশিক পরিষদের সদস্যরা প্রদেশের আইন প্রণয়নের রায় নিয়েছিলেন,  শাসনতন্ত্র প্রণয়ন নয়। যাহোক, ঐ দুই পরিষদের মোট সদস্য ৪৬৯ জন হলেও ৪৩০ জন সদস্য নিয়ে গণপরিষদের যাত্রা শুরু হয় এবং শেষ অব্দি টিকে থাকেন ৪০৩ জন। এর মধ্যে আওয়ামী লীগ বা সরকার দলীয় সদস্য হলেন ৪০১ জন। অর্থাৎ বিরোধী দলীয় সদস্য ছিলেন মাত্র ২ জন। মৃত্যু, পাকিস্তানের প্রতি আনুগত্য প্রদর্শনের জন্য বহিস্কার এবং দল থেকে বহিষ্কার ইত্যাদি কারণে মোট ৬৬ জন সদস্যের সংবিধান প্রণয়নে অংশ ছিল না। এ হিসাবে ১ কোটিরও বেশি দেশবাসীর সংবিধানে প্রতিনিধিত্ব ছিল না। তাছাড়া, এই আইনে গণপরিষদকে শুধুমাত্র সংবিধান প্রণয়নের দায়িত্ব দেয়া হয়। এর বাইরে কোন আইন প্রণয়নের ক্ষমতা তাদের ছিল না।

একই দিন অর্থাৎ ২২ মার্চ রাষ্ট্রপতি কর্তৃক বাংলাদেশ গণপরিষদ সদস্য (সদস্যপদ বাতিল) আদেশ আইন জারী করা হয়। এতে রাজনৈতিক দলের সংজ্ঞা দিয়ে বলা হয়, যদি কোন গণপরিষদ সদস্য তিনি যে দলের মনোনয়নে নির্বাচিত হয়েছেন সে দল থেকে পদত্যাগ করেন বা দল তাঁকে বহিষ্কার করে তবে তাঁর সদস্যপদ বাতিল হবে এবং এ বিষয়ে কোন আদালতে কোন প্রশ্ন উত্থাপন করা যাবে না।

এ দুটি আদেশ জারীর পরপরই সংবিধান প্রণয়ন প্রক্রিয়া শুরু হয়। ৯ এপ্রিল সংসদীয় দলের নেতা, স্পীকার ও ডেপুটি স্পীকার নির্বাচন করা হয়। ১০ এপ্রিল গণপরিষদের উদ্বোধন করা হয়। ১১ এপ্রিল ড. কামাল হোসেনকে প্রধান করে ৩৪ সদস্য বিশিষ্ট একটি সংবিধান প্রণয়ন কমিটি গঠন করা হয়। ১৭ এপ্রিল গণপরিষদের প্রথম বৈঠক বসে। এ বৈঠকে দেশের বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ ও সংবিধান বিশেশজ্ঞদের কাছ থেকে সংবিধান বিষয়ে প্রস্তাব আহ্বান করা হয়। ৮ মে’র মধ্যে ৯৮টি প্রস্তাব পাওয়া যায়। ১০ জুনের মধ্যে কমিটি খসড়া তৈরি করতে সক্ষম হয়। সংবিধানকে ‘পূর্ণাঙ্গ ও সুন্দর’ করার জন্য ড. কামাল হোসেন ভারত ও ইংল্যান্ড সফর করেন। এছাড়া একজন ব্রিটিশ বিশেষজ্ঞের পরামর্শ গ্রহণ করা হয়। ১১ অক্টোবর খসড়া চূড়ান্ত করা হয়। ১৮ অক্টোবর থেকে গণপরিষদে সংবিধান বিলের ওপর আলোচনা শুরু হয় এবং ৩০ অক্টোবর সমাপ্ত হয়। ৩১ অক্টোবর থেকে ৩ নভেম্বর পর্যন্ত সংবিধানের অনুচ্ছেদওয়ারি আলোচনা চলে। ৪ নভেম্বর সংবিধান বিল পাস হয়। ১৪ ডিসেম্বর গণপরিষদ সদস্যগণ এতে স্বাক্ষর করেন। ১৬ ডিসেম্বরকে সংবিধান প্রবর্তন দিবস ঘোষণা করা হয়।


বাংলাদেশ সংবিধান  ১৯৭২  

এ নিবন্ধে মূল বা অসংশোধিত সংবিধান নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে। বাংলাদেশের সংবিধান এ পর্যন্ত ১৬ বার সংশোধন করা হয়েছে। এতে সরকার ব্যবস্থা পরিবর্তন করা হয়েছে, মূলনীতি পরিবর্তন করা হয়েছে। এসব পরিবর্তন বা তার ফলাফল  নিয়ে এখানে আলোচনার সুযোগ নেই। তবে এটা বলা যেতে পারে মূল সংবিধানে পরিবর্তনের যে ধরনের ব্যবস্থা রাখা হয়েছে তা গণতান্ত্রিক সংবিধানের বৈশিষ্ট্যের সাথে যায় না।

 ১৯৭২ এর সংবিধান  ১১টি অধ্যায়, ১১৫টি অনুচ্ছেদ এবং ৪টি তফসিলে বিভক্ত। এ সংবিধানের প্রধান প্রধান বৈশিষ্ট্য হল-

১. ১৯৭২ এর সংবিধান বাংলাদেশকে গণপ্রজাতন্ত্র হিসেবে ঘোষণা করেছে।

২. এটি বাংলাদেশের জন্য একটি এককেন্দ্রিক সরকারের ব্যবস্থা করেছে।

৩. এই সংবিধান বাংলাদেশে একটি মন্ত্রী পরিষদ শাসিত সরকার ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করেছে।
 ৪. ১৯৭২ এর সংবিধান গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা ও জাতীয়তাবাদের আদর্শকে রাষ্ট্রের মূলনীতি হিসেবে গ্রহণ করেছে।

৫. এই সংবিধান বাংলাদেশের জন্য একটি এককক্ষ বিশিষ্ট আইনসভার ব্যবস্থা করেছে। এটি গঠিত হবে প্রত্যক্ষ নির্বাচনের মাধ্যমে নির্বাচিত ৩০০ সদস্য নিয়ে।

৬. এই সংবিধান অনুযায়ী প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রভাষা হবে বাংলা এবং বাংলাদেশের জনগণ জাতি হিসেবে হবে বাঙালী।

৭. এই সংবিধান অনুযায়ী প্রজাতন্ত্রের সকল ক্ষমতার মালিক জনগণ।   

৯. এই সংবিধানে নাগরিকদের মৌলিক অধিকারের নিশ্চয়তা প্রদান করা হয়েছে। এইসব মৌলিক অধিকারের মধ্যে অন্যতম হল চিন্তা ও বিবেকের স্বাধীনতা, মত প্রকাশের স্বাধীনতা, ধর্ম-বর্ণ-লিঙ্গ ইত্যাদির কারণে কোন প্রকার বৈষম্যমূলক আচরণ থেকে মুক্ত থাকার স্বাধীনতা ইত্যাদি।

১০. এই সংবিধান প্রজাতন্ত্রের সর্বোচ্চ আইন এবং অন্য কোন আইন যদি এই সংবিধানের সহিত অসমঞ্জস হয়, তাহা হইলে সেই আইনের যতখানি অসামঞ্জস্যপূর্ণ, ততখানি বাতিল হইবে।

১১. বাংলাদেশের সংবিধানে একমাত্র বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্র ভাষা করা হয়েছে।  সংবিধানে আরও বলা হয়েছে, বাংলাদেশের জনগণ জাতি হিসাবে বাঙ্গালী বলিয়া পরিচিত হইবেন। এভাবে, বাঙ্গালী ছাড়া অন্য ক্ষুদ্র জাতি গোষ্ঠীর অস্তিত্ব অস্বীকার করা হয়েছে।  

১২. বাংলাদেশের সংবিধানে রাষ্ট্রপতিকে কিছু বিষয়ে ক্ষমতা প্রয়োগের অধিকার দেয়া হয়েছে। কিন্তু কার্যত এসবের কিছুই স্বাধীনভাবে করার ক্ষমতা সংবিধান তাঁকে দেয়নি। যা কিছু তিনি করেন, তার সবই করেন প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শক্রমে।

১৩. যদিও বলা হয়েছে মন্ত্রীপরিষদ যৌথভাবে সংসদের কাছে দায়ী থাকবে, কিন্তু কার্যত গোটা সংসদই দলীয় প্রধান তথা প্রধানমন্ত্রীর কাছে শুধু দায়বদ্ধ নয়, একান্ত অনুগত ও বাধ্যগত হতে সংবিধান অনুযায়ী বাধ্য। প্রধানমন্ত্রী সংসদকে যে ধরনের আইন প্রনয়নের নির্দেশ দিবেন, জাতীয় পরিষদ সে ধরনের আইন প্রণয়ন করতে বাধ্য।

১৪. আদালত স্বাধীন নয়। নিম্ন আদালত পুরোপুরি আইন মন্ত্রণালয়ের নিয়ন্ত্রাধীন। উচ্চ আদালতের বিচারক নিয়োগ ও বরখাস্তের ক্ষমতা চূড়ান্ত বিচারে নির্বাহী বিভাগের হাতে রাখা হয়েছে।  

১৫. সংবিধানের প্রস্তাবনা এবং প্রথম থেকে তৃতীয় অধ্যায় পর্যন্ত পাঠ করলে মনে হবে বাংলাদেশের সংবিধান মোটামুটি একটি গণতান্ত্রিক সংবিধান। এতে রাষ্ট্রের নাগরিকদের জন্য অনেক কল্যাণ আর অধিকারের কথা বলা আছে। কিন্তু সংবিধানের চতুর্থ ভাগ থেকে শেষ পর্যন্ত অর্থাৎ বাস্তবায়ন অংশ নিবিড় ভাবে পড়লে দেখা যাবে এসব কল্যাণ আর অধিকার যাতে কার্যকর করা না যায় তেমন ব্যবস্থাও এ সংবিধানে রাখা আছে।

১৬. সংবিধানে যেসব সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান গঠনের কথা বলা আছে যেমন নির্বাচন কমিশন, মহা হিসাবরক্ষক ইত্যাদি প্রকৃত অর্থে স্বাধীন নয়। বাংলাদেশের নির্বাচন কমিশনের নিরপেক্ষতা প্রশ্নবিদ্ধ, বেশিরভাগ নির্বাচনে নিরপেক্ষ থাকতে পারে নি।   

 

মোটাদাগে বাংলাদেশ ও নেপালের রাষ্ট্র গঠন প্রক্রিয়া এবং গঠিত রাষ্ট্রের  মিল–অমিল

১. গণপরিষদ বা সংবিধান সভা

বাংলাদেশের জনগণ এপর্যন্ত ২ বার গণপরিষদ গঠনের নির্বাচনে অংশ নিয়েছে। প্রথম গণপরিষদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় ১৯৪৬ সালের মার্চ মাসে ব্রিটিশ ভারতের অখণ্ড বাংলা প্রদেশের অংশ হিসেবে। সম্প্রদায় ভিত্তিতে গণপরিষদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এবং এসময় সার্বজনীন ভোটাধিকার ছিল না। আর দ্বিতীয় গণপরিষদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় ১৯৭০ সালের ডিসেম্বর মাসে পাকিস্তানের একটি প্রদেশের (পূর্ব পাকিস্তান) অংশ হিসেবে। এই নিবন্ধের প্রধান আলোচ্য দ্বিতীয় গণপরিষদ যা বাংলাদেশের গণপরিষদ হিসেবে ঘোষণা করা হয়।

পাকিস্তান রাষ্ট্র কাঠামোর অধীনে নির্বাচিত তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান অংশের জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদের সদস্যদের বাংলাদেশের গণপরিষদ গঠিত। এর সদস্য ছিল ৪০৩ জন। মুলত একদলীয় সদস্য দ্বারা এটি গঠিত হয়েছে। কেননা ৪০৩ জন সদস্যের মধ্যে ৪০১ জন ছিল আওয়ামী লীগ দলীয়। বাকি ২ জনের ১ জন ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির ( মোজাফফর ) ও একজন স্বতন্ত্র সদস্য ছিলেন।   

বাংলাদেশের গণপরিষদের একটি অন্যতম বৈশিষ্ট্য হল, এর কোন আইন প্রণয়নের ক্ষমতা ছিল না। মন্ত্রিসভার ওপর কোন নিয়ন্ত্রণ ছিল না, ছিলনা সরকারের ওপর তদারকির ক্ষমতা। এ সময় অধ্যাদেশ জারী করে শাসনকার্য পরিচালনা করা হয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর ইচ্ছাই ছিল আইনের উৎস।

বাংলাদেশের গণপরিষদের আর একটি অন্যতম বৈশিষ্ট্য হল এর সদস্যদের স্বাধীন মতপ্রকাশের অধিকার ছিল না। বাংলাদেশ গণপরিষদ সদস্য ( সদস্যপদ বাতিল ) আদেশ আইন দ্বারা গণপরিষদ সদস্যদের স্বাধীন মতপ্রকাশের পথ রুদ্ধ করা হয়। অর্থাৎ একটি নিয়ন্ত্রিত গণপরিষদ বাংলাদেশের সংবিধান প্রণয়ন করেছে।

নেপালের প্রথম গণপরিষদ সদস্য সংখ্যা মোট ৬০১ জন। এর মধ্যে নির্বাচিত ৫৭৫ জন আর অনির্বাচিত ২৫জন। প্রথম গণপরিষদ নির্বাচনে প্রধান তিন দল যথাক্রমে নেপালি কংগ্রেস পার্টি পেয়েছিল ১১৫ টি আসন ,  কমিউনিস্ট পার্টি অব নেপাল ইউএমএল (CPN–UML ) পেয়েছিল ১০৮টি  আসন এবং ইউনাইটেড কমিউনিস্ট পার্টি অব নেপাল মাওইস্ট সেন্টার (UCPN-Maoist) পেয়েছিল ২২০ টি আসন। আর দ্বিতীয় গণপরিষদ নির্বাচনে নেপালি কংগ্রেস পার্টি পেয়েছিল ১৯৬টি আসন,  কমিউনিস্ট পার্টি অব নেপাল ইউএমএল (CPN–UML ) পেয়েছিল১৭৫টি আসন এবং ইউনাইটেড কমিউনিস্ট পার্টি অব নেপাল মাওইস্ট সেন্টার (UCPN-Maoist) পেয়েছিল ৮০টি আসন। নির্বাচিত ৫৭৫ জনের মধ্যে ২৪০ জন সরাসরি নির্বাচিত এবং ৩৩৫ জন অংশগ্রহণকারী দলগুলোর ভোট প্রাপ্তির অনুপাতে নির্বাচিত হয়েছিলেন।

নেপালের গণপরিষদ ছিল গণ-অভিপ্রায়, গণ-ইচ্ছার  আধার। শাসনকার্য পরিচালনার যাবতীয় আইন প্রণয়নের অধিকারী ছিল নেপালের গণপরিষদ।  সরকার তথা মন্ত্রীপরিষদ গণপরিষদের নিকট জবাবদিহি করতে বাধ্য ছিল। অন্যদিকে আইন দ্বারা গণপরিষদ সদস্যদের স্বাধীনভাবে মত প্রকাশের সুযোগ বন্ধ করা হয় নি।

 

২. সংবিধান

এই নিবন্ধে আলোচিত নেপাল সংবিধান ২০৭২ নেপালের ৭ম সংবিধান। নেপালের প্রথম সংবিধান ১৯৪৮ সালের ১ এপ্রিল এবং সর্বশেষ সংবিধান ২০১৫ সালের ২৪ সেপ্টেম্বর থেকে কার্যকর হয়েছে। এ হিসাবে নেপালের জনগণ সাংবিধানিক ব্যবস্থায় প্রায় ৭০ বছর পার করেছে। এরমধ্যে প্রায় ৬১ বছর ছিল রাজতান্ত্রিক সংবিধানের কালপর্ব।

অন্যদিকে বাংলাদেশ ভূখণ্ডের জনগণ সাংবিধানিক প্রক্রিয়ার আওতায় এসেছে ঔপনিবেশিক আমলে ব্রিটিশদের তৈরি ১৮৫৮ সালের ভারত শাসন আইন বাস্তবায়নের পর থেকে। এ হিসাবে বাংলাদেশের জনগণের শাসনতান্ত্রিক ব্যবস্থার অভিজ্ঞতার বয়স দেড়শতেরও বেশি।

নেপাল সংবিধান ২০৭২ প্রণয়ন ও কার্যকর করতে সময় লেগেছে ৬ বছর। অন্যদিকে বাংলাদেশ সংবিধান ১৯৭২ প্রণয়ন ও কার্যকর করতে সময় লেগেছে মাত্র ১১ মাস।

নেপালের সর্বশেষ সংবিধান গৃহীত হওয়ার পর প্রথম স্থানীয়, জাতীয় এবং প্রাদেশিক পরিষদ অনুষ্ঠিত হয়েছে। রাষ্ট্রের আচরণ কেমন হবে তা দেখার সুযোগ এখনো আসেনি। তবে নির্বাচন কমিশনের নিরপেক্ষতা নিয়ে কোন প্রশ্ন উত্থাপিত হয় নি। সংবিধানে নেপালের সকল জাতি-ধর্ম-বর্ণের সমান মর্যাদা দেয়া হয়েছে, সকল ভাষার স্বীকৃতি দেয়া হয়েছে। সংবিধানে অনগ্রসর, জাতিগত সংখ্যালঘু, ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী ও নারী প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করার ব্যবস্থা করা হয়েছে। তাছাড়া সমকামী, উভকামী ও তৃতীয় লিঙ্গের সুরক্ষার ব্যবস্থা রাখা হয়েছে যা এই অঞ্চলে সম্পূর্ণ ব্যতিক্রম।  

নেপালের সংবিধানে নির্বাহী ক্ষমতা মন্ত্রীপরিষদের হাতে ন্যস্ত করা হয়েছে। এক্ষেত্রে প্রধানমন্ত্রী শব্দটি একবারের জন্যও উচ্চারণ করা হয় নি। অন্যদিকে প্রেসিডেন্ট সাংবিধানিক প্রধান হলেও তাঁর হাতে কিছু ক্ষমতা দেয়া হয়েছে। আইন পরিষদ ও বিচার বিভাগের স্বাধীনভাবে কাজ বিধান করা হয়েছে। তাই বলা যায় এটি একটি গণতান্ত্রিক সংবিধান।

অন্যদিকে বাংলাদেশের সংবিধানে শুধুমাত্র বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্র ভাষা করা হয়েছে,  বাঙ্গালী ছাড়া অন্য ক্ষুদ্র জাতি গোষ্ঠীর অস্তিত্ব অস্বীকার করা হয়েছে। বাংলাদেশের সংবিধানে রাষ্ট্রপতিকে কিছু বিষয়ে ক্ষমতা প্রয়োগের অধিকার দেয়া হয়েছে। কিন্তু কার্যত এসবের কিছুই স্বাধীনভাবে করার ক্ষমতা সংবিধান তাঁকে দেয়নি। যা কিছু তিনি করেন, তার সবই করেন প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শক্রমে।

যদিও বলা হয়েছে মন্ত্রীপরিষদ যৌথভাবে সংসদের কাছে দায়ী থাকবে, কিন্তু কার্যত গোটা সংসদই দলীয় প্রধান তথা প্রধানমন্ত্রীর কাছে শুধু দায়বদ্ধ নয়, একান্ত অনুগত ও বাধ্যগত হতে সংবিধান অনুযায়ী বাধ্য।

এটি একটি চাতুরীতে ভরা সংবিধান। সংবিধানে বলা হয়েছে ক্ষমতার মালিক জনগণ। অথচ প্রয়োগের মালিক প্রধানমন্ত্রী যিনি জনগণের নিকট কোনভাবেই দায়বদ্ধ নন। এতে রাষ্ট্রের নাগরিকদের জন্য অনেক কল্যাণ আর অধিকারের কথা বলা আছে। কিন্তু এসব কল্যাণ আর অধিকার যাতে কার্যকর করা না যায় তেমন ব্যবস্থাও এ সংবিধানে রাখা আছে।

এই সংবিধানে সকল ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত করা হয়েছে প্রধানমন্ত্রীর হাতে। প্রকৃত অর্থে এই সংবিধান দ্বারা প্রধানমন্ত্রী শাসিত সরকার ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। অনুচ্ছেদ ৭০-এর সাথে অনুচ্ছেদ ১৪২ মিলিয়ে পড়লে দেখা যাবে যিনি প্রধানমন্ত্রী তিনি যদি দলীয় প্রধান হন, আর তার দলের যদি দুই-তৃতীয়াংশ আসনে সংখ্যাগরিষ্ঠতা থাকে তবে তিনি সংবিধান সংশোধনের এমন অপরিমেয় ক্ষমতা ভোগ করতে পারবেন যা পৃথিবীর কোন গণতান্ত্রিক দেশের প্রধাননির্বাহী কল্পনাও করতে পারেন না। বস্তুত ১৯৭২ এর সংবিধান পুরোপুরি একটি অগনতান্ত্রিক সংবিধান।

 

৩. জনগণের রাষ্ট্র বা রিপাবলিক

বাংলাদেশের জনগণের একটি রিপাবলিক প্রতিষ্ঠার আকুতি দীর্ঘ দিনের। এর প্রকাশ আমরা যেমন দেখতে পাই ১৯৪৬ সালের নির্বাচনে, তেমনি দেখতে পাই ১৯৭০ সালের নির্বাচনে। এত ত্যাগ-তিতিক্ষা, লড়াই-সংগ্রাম পরেও জনগণের এ আশা পূরণ হয় নি। অথচ শাসকেরা ধোঁকা দিতে নাম দিয়েছে ইসলামিক রিপাবলিক অব বাংলাদেশ বা পিপলস রিপাবলিক অব বাংলাদেশ। একটি জনগণের বা রিপাবলিক গঠন মানে জনগণের একসাথে মিলে একটা একক রাজনৈতিক সত্তা হয়ে ওঠা। সংবিধান প্রণয়নের প্রায় ৪৬ বছর পরেও বাংলাদেশের জনগণ একটি একক রাজনৈতিক সত্তা হয়ে ওঠাতো দূরের কথা নিজেদেরকে আরও বহুভাবে বিভাজিত করেছে।  যেমন আদিবাসী – বাঙালী, বাঙালী-বাংলাদেশী ইত্যাদি।

একটি জনগণের রাষ্ট্র বা রিপাবলিক হওয়ার মৌলিক বৈশিষ্ট্য হল রাষ্ট্র ক্ষমতার মালিক জনগণ। এ রাষ্ট্রে ব্যক্তি তথা জনগণ সার্বভৌম। এ বিচারে বাংলাদেশ রিপাবলিক নয়। কেননা বাংলাদেশ রাষ্ট্রের সকল ক্ষমতা একটি পদ তথা সরকার প্রধানের হাতে ন্যস্ত রাখা হয়েছে। ক্ষমতা চর্চায় আমরা এটাই প্রতিষ্ঠিত দেখতে পাই।

অন্যদিকে অসংখ্য জাতিসত্তার দেশ নেপাল একটি একক রাজনৈতিক সত্তা হয়ে ওঠার পথে অনেকদূর অগ্রসর হয়েছে বলে ধরা যায়। বৃহৎ প্রতিবেশী দেশ ভারতের ( যার সাথে অধীনতামূলক চুক্তি রয়েছে ) নানান অপচেষ্টা ভণ্ডুল করে একটি একক রাজনৈতিক সত্তার দিকে অগ্রসর হচ্ছে নেপাল। যদিও মাধোষি  জনগোষ্ঠীর অসন্তোষ পুরোপুরি দূরীভূত হয়নি। তবে নেপাল যে একটি পলিটিকাল কম্যুনিটি হতে চলেছে তার একটি নিদর্শন দ্বিতীয় গণপরিষদের শেষ দিনে দলীয় প্রধানসহ সকল সদস্যদের একসাথে ফটোসেশন। বাংলাদেশে এ ধরনের ফটোসেশন কল্পনাও  করা যায় না। বিভিন্ন প্রতিবন্ধকতা কাটিয়ে ইতোমধ্যে নেপাল নতুন সংবিধানের অধীনে স্থানীয়, প্রাদেশিক ও ফেডারেল পার্লামেন্টের নির্বাচন অনুষ্ঠান করেছে। নেপালের স্থিতিশীল রাষ্ট্র হওয়ার দিকে এগিয়ে যাওয়ার পথে এটি  বিজয় হিসেবে ধরা হচ্ছে। সংবিধানে পরিস্কারভাবে নেপালের জনগণের সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। রাষ্ট্রের আচরণ গণতন্ত্রসম্মত কি না তা দেখার সুযোগ এখনো আসেনি। আগামি দিনের নেপালের রাজনীতি বলে দেবে  গণতন্ত্রের চর্চা কতখানি সঠিক ও বাস্তবসম্মত হচ্চে। সে পর্যন্ত আমাদের অপেক্ষা করতে হবে।    

  

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
Archive
 
সাম্প্রতিক পোষ্টসমূহ