Banner
জীবন দর্শন: ইসলাম, মার্ক্সবাদ, উদারবাদ না মানবতাবাদ — আলমগীর হুসেন

লিখেছেনঃ আলমগীর হুসেন, আপডেটঃ March 14, 2018, 12:00 AM, Hits: 2423

 
 
জীবন দর্শন কী?

জীবন দর্শন, যাকে ইংরেজীতে ‘Philosophy of Life’ কিংবা ‘Worldview’ বলা হয়ে থাকে, তা মূলত মানবজীবন সম্পর্কে আমাদের সামগ্রিক বোঝাপড়া (understanding)। অন্য কথায়, মানবজীবনের বিভিন্ন ক্ষেত্র সম্পর্কে আমাদের ধারণা বা বোঝাপড়া এবং সে ভিত্তিতে জীবন চালনায় আমাদের কর্মকাণ্ড কী হবে, তার সমষ্টিই জীবন দর্শন।

মানবজীবনের চারটি প্রধান ক্ষেত্র রয়েছেঃ (১) ব্যক্তিগত, (২) সামাজিক, (৩) রাজনৈতিক, ও (৪) অর্থনৈতিক। জীবনের এসব ক্ষেত্রগুলোকে আমরা কীভাবে দেখি এবং সে ভিত্তিতে আমরা কী নীতি ও কর্মকাণ্ড গ্রহণ করি – তাই হবে আমাদের জীবন দর্শন।

পৃথিবীতে মূলত ২ ধরনের জীবন দর্শন রয়েছে –

(ক) ধর্মীয় – যেমন ইসলামি, খ্রিস্ট্রিয় ইত্যাদি এবং

(খ) নিঃধর্মীয় – যেমন মার্ক্সবাদ/সমাজতন্ত্র, উদারবাদ, মানবতাবাদ ইত্যাদি।

 

কেন জীবন দর্শন?

প্রথমত, জীবন দর্শন আমাদেরকে জীবন আসলে কী, জীবনের অর্থ কী, ইত্যাদি বুঝতে সহায়তা করে। দ্বিতীয়ত ও সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণঃ জীবন দর্শন পৃথিবীতে আমাদের জীবন চালনার রূপরেখা তথা আমাদের ‘জীবন বিধান’ কী হবে – সেটা নির্দেশিত করে। এবং আমাদের জন্য একটা সুনির্দিষ্ট জীবন বিধানের প্রয়োজন পৃথিবীতে আমাদের সুখ-শান্তি (happiness) বর্ধিতকরণের লক্ষ্যে। সুখ-শান্তি বৃদ্ধির জন্য প্রয়োজন ব্যক্তির জান-মালের নিরাপত্তা, অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি, আত্ম-মর্যাদা ও স্বাধীনতা ইত্যাদি নিশ্চিতকরণ।

 

জীবনের উদ্দেশ্য কী?

একটা সুসংহত জীবন দর্শন নির্ণয় করার জন্য প্রাথমিক প্রয়োজন হলো ‘জীবন কী’ বা ‘জীবনের উদ্দেশ্য কী’– সেটা অনুধাবন করা। জীবনের উদ্দেশ্য দুই ধরনের হতে পারে- ধর্মীয় ও নিঃধর্মীয়।

(ক)  ধর্মীয়: একজন ধার্মিকের জন্য জীবনের উদ্দেশ্য কী সেটা বোঝা খুবই সহজ। ইহুদি, খ্রিস্ট, ইসলাম ইত্যাদি একত্ববাদী ধর্মগুলোর মতে বিশ্ব ও তার অন্তর্গত সবকিছু সৃষ্টি করেছেন ঈশ্বর আজ থেকে প্রায় ৬,০০০ হাজার বছর আগে এবং তা সৃষ্টি করতে ঈশ্বরের সময় লেগেছিল ছয় দিন। পৃথিবীর বুকে আদম ও হাওয়া ছিল প্রথম মানুষ। এবং বিশ্বের অন্যান্য সকল জীব প্রজাতিকে আলাদাভাবে জোড়ায়-জোড়ায় সৃষ্টি করে পৃথিবীর বুকে ছেড়ে দিয়েছেন ঈশ্বর। ঈশ্বর মানুষকে সৃষ্টি করেছেন সৃষ্টির শ্রেষ্ঠ ও একমাত্র বুদ্ধিমান জীব হিসেবে এবং সেইসূত্রে একমাত্র মানুষের হাতে তুলে দিয়েছেন ‘আসমানী কিতাব’ (তাওরাত, বাইবেল, কোরান ইত্যাদি), যাতে তারা একটা সুনির্দিষ্ট বিধান অনুসারে জীবন চালনা করতে পারে।

অন্য কথায়, ঈশ্বর তাঁর আসমানী কিতাবে যা বলেছেন বা নির্দেশ দিয়েছেন, তা অনুসরণ করাই ধার্মিকদের জীবনের উদ্দেশ্য। একজন মুসলমান নামাজ পড়বে, রোজা রাখবে, হজ্জ্বে যাবে ও কোরানের অন্যান্য নির্দেশাবলী পালন করবে আল্লাহর অনুগ্রহ বা সোয়াব কামানোর জন্য, যা অন্তহীন পারলৌকিক জীবনে তার সার্বিক কল্যাণ নিশ্চিত করবে। সেটা ভালমত করতে পারলেই তার পার্থিব জীবন অর্থবহ বা স্বার্থক হবে। একজন ধার্মিকের এর বাইরে আর কোন কিছু চাওয়ার, জানার বা বোঝার আবশ্যকতা নেই।

খ)  নিঃধর্মীয়: যে ধার্মিক নয়, তার জীবনের উদ্দেশ্য কী হবে?

একজন নিঃধার্মিকের জীবনের উদ্দেশ্য কী, সেটা অনুধাবণ করা খুবই কঠিন কিংবা সুনিশ্চিতভাবে সেটা নির্ণয় করা আদৌ সম্ভব কীনা – সে সম্পর্কে সন্দেহের অবকাশ রয়েছে। ব্যাপারটা তলিয়ে দেখা যাক এখানে।

নিঃধর্মীয় জীবন দর্শনে বিশ্বাসীরা প্রধানত বিজ্ঞান বা বৈজ্ঞানিক প্রক্রিয়ায় বিশ্বাসী। এবং বিজ্ঞান ইংগিত দেয় যে, পৃথিবীতে জীবনের উৎপত্তি এক আকস্মিক ঘটনার ফসল মাত্র (result of an accident)। এবং সে আকস্মিক ঘটনাটি হলো আজ থেকে মোটামুটি ১৩.৮ বিলিয়ন বছর আগে ঘটিত বিগব্যাং বা মহাবিস্ফোরণ, যার ফলে এক অসীম ঘনত্ব ও উত্তাপসম্পন্ন নিরতিশয় ক্ষুদ্র শক্তিপিণ্ড বিস্ফারিত হয়ে মহাবিশ্বের সৃষ্টি করে। সেই মুহূর্ত থেকে বিলিয়ন বিলিয়ন বছর ধরে আরও অসংখ্য বিস্ফোরণ ঘটতে থাকে এবং এরূপ এক বিস্ফোরণের ফলস্বরূপ আমাদের সৌরজগতের সৃষ্টি হয় আজ থেকে প্রায় ৪.৫ বিলিয়ন বছর আগে। এবং শুরুতে পৃথিবীসহ সব নক্ষত্র, গ্রহ, উপগ্রহ ছিল জ্বলন্ত গ্যাসপিণ্ড। পরবর্তীতে ক্রমান্বয়ে তাপ নিঃসরণ করে অনেক গ্রহ, উপগ্রহ (যেমন পৃথিবী, চন্দ্র ইত্যাদি) প্রথমে উত্তপ্ত তরল পিণ্ডে এবং আরও ঠাণ্ডা হয়ে পরিশেষে কঠিন উপরিভাগ সম্পন্ন পিণ্ডে পরিণত হয়েছে। পৃথিবীর অভ্যন্তরভাগ আজও উত্তপ্ত ও তরল রয়ে গেছে, যা আজও মাঝে মাঝে লাভা হিসেবে বেরিয়ে আসে পৃথিবীর উপরিভাগে। উল্লেখ্য অনেক গ্রহ, যেমন আমাদেরই সৌরজগতের বৃহস্পতি, শনি, ইউরেনাস, নেপচুন ইত্যাদি, আজও গ্যাসপিণ্ড হিসেবে রয়ে গেছে। সূর্যসহ মহাবিশ্বের নক্ষত্রগুলো আজও জ্বলন্ত গ্যাসপিণ্ডই রয়ে গেছে।

এক কথায়, বিগব্যাং না ঘটলে জীবের বাসযোগ্য এ পৃথিবীর আবির্ভাব হতো না। অন্যদিকে, পৃথিবীর উপরিভাগে এ বিশাল পরিবর্তন ঘটনকালে ব্যাপক রাসায়নিক ক্রিয়া-বিক্রিয়া ঘটে। সেসব রাসায়নিক ক্রিয়া-বিক্রিয়ার অংশরূপে আরেক accident বা আকস্মিক ঘটনা ঘটে, যা সরল জড় পদার্থ থেকে জটিল প্রাথমিক জীবনের সৃষ্টি করে প্রায় ৩.৮ বিলিয়ন বছর আগে। সে প্রাথমিক অতি-সরল জীবসত্তা কোটি কোটি বছর ধরে তিল-তিল পরিবর্তিত ও জটিলতর হওয়ার ফলশ্রুতিতে মানুষসহ আজকের এ অতি-জটিল জীবজগতের আবির্ভাব। পৃথিবীর বুকে আধুনিক মানুষের মতো দেখতে প্রাণীর আবির্ভাব ঘটে আজ থেকে দুই লক্ষাধিক  বছর আগে। পৃথিবীতে আমাদের মত মানুষের বসবাস কম করে হলেও ১০০,০০০ বছর।

আর এটাই যদি পৃথিবীতে আমাদের আগমণের গতিধারা হয়, অর্থাৎ আমরা কেবলই একটা বা কিছু সংখ্যক আকস্মিক ঘটনার বা accident-এর ফসল হই, তাহলে আমাদের জীবনের কোন সুনির্দিষ্ট অর্থ থাকতে পারে না। আকস্মিক ঘটনার আবার কোন অর্থ থাকে কী?

কিন্তু জীবনের যদি কোন উদ্দেশ্য বা অর্থই না থাকে, তাহলে সে জীবনযাপনের কোন মূল্য থাকে না; বেঁচে থাকার কোন অর্থ থাকে না। অল্প কিছু মানুষ পৃথিবীতে বেঁচে থাকার কোন অর্থ খুঁজে পায় না বিধায় আত্মহত্যা করে। কিন্তু ব্যাপক সিংহভাগ মানুষ নিজেকে ধ্বংস করে না, বরং দীর্ঘায়ু জীবনের প্রত্যাশা পোষণ করে – হোক সে ধার্মিক কিংবা নিঃধার্মিক।

তার মানে দাঁড়ায়ঃ জীবনের কোন সুনির্দিষ্ট উদ্দেশ্য না থাকা সত্ত্বেও নিঃধার্মিকরা জীবনকে, পৃথিবীতে বেঁচে থাকাকে, অর্থহীন মনে করে না। ধার্মিক কিংবা নিঃধার্মিক – উভয়েই পৃথিবীতে বেঁচে থাকাকে প্রায় সমান অর্থপূর্ণ মনে করে। বিষয়টাকে ঐতিহাসিক অভিজ্ঞতার প্রেক্ষাপট ও যুক্তিবাদী পর্যালোচনার মাধ্যমে খতিয়ে দেখা যাক।

বৈজ্ঞানিক সাক্ষ্যপ্রমাণ অনুসারে পৃথিবীতে আমাদের মত মানুষের বসবাস কম হলেও এক লাখ বছর। অথচ জীবনবিধান রূপে ব্যবহারের জন্য ঈশ্বর মানুষের কাছে ‘আসমানী কিতাব’ পাঠিয়েছেন মাত্র ৩,২০০ বছর আগে মুসা নবীর মাধ্যমে। তার মানে দাঁড়ায়ঃ কম করে হলেও ৯০,০০০ বছর ধরে আধুনিক মানুষের হাতে স্রষ্টা-প্রদত্ত কোন আসমানী কিতাব বা জীবনবিধান ছিল না। অন্য কথায়, আধুনিক-রূপী মানুষের অস্তিত্বের সিংহভাগ সময় ধরে আমাদের জানার বা বোঝার কোন উপায়ই ছিল না যে, পৃথিবীতে আমাদের বেঁচে থাকার একটা উদ্দেশ্য আছে বা থাকতে পারে। তথাপি মানুষ জীবনের কঠিন যুদ্ধে, তথা বেঁচে থাকার লড়াইয়ে, সামিল হয়েছে – সৃষ্টি করেছে সমাজ, আইন-কানুন, রাষ্ট্র, সাম্রাজ্য। সে আত্মহত্যা করে নি, নিজেকে ধ্বংস করে ফেলে নি।

ধর্মীয় দৃষ্টিতে আসমানী কিতাব প্রেরণ-পূর্ব সময়কালে পৃথিবীতে বসবাসকারী মানুষের জীবনের কোন অর্থ ছিল না বা তা জানার কোন উপায় ছিল না মানুষের। তাহলে সে দীর্ঘসময়ে জীবনের লড়াইয়ে মানুষ কেন সামিল হয়েছিল – ঠিক আসমানী কিতাব পরবর্তি যুগের মানুষের মতই! কেন সৃষ্টি করেছিল সমাজ, রাষ্ট্র, আইন-কানুন, যার ভিত্তিতেই রচিত হয়েছে আজকের এ আধুনিক মানব সভ্যতা?

ওদিকে ধর্ম বলে যে, মানুষ ব্যতিত জীবজগতের আর কোন প্রাণীর জীবনের কোন উদ্দেশ্য নেই; কাজেই তাদের জীবন চালনার জন্য কোন বিধানের প্রয়োজনও নেই। সে কারণেই ঈশ্বর অন্য প্রাণীর জন্য কোন আসমানী কিতাব পাঠান নি। অথচ সে সব প্রাণীও কিন্তু জীবনযুদ্ধে ঠিক মানুষের মতই সামিল হয়, লড়াই করে পুরো জীবনটা ভালোমত বা সুখে কাটিয়ে দেওয়ার জন্য।

তাহলে আমরা দেখছি যে, হোক (১) আজকের নিঃধার্মিক মানুষ, যারা মনে করে জীবন একটা accident-এর ফসল মাত্র যার পূর্ব-পরিকল্পিত কোন উদ্দেশ্য নেই, বা (২) আসমানী কিতাব পূর্ববর্তি মানুষ, যাদের জীবনের কোন সুনির্দিষ্ট উদ্দেশ্য ছিল না, বা (৩) আজকের আসমানী কিতাবধারী ধার্মিক মানুষ, কিংবা (৪) জীবজগতের অন্যান্য প্রাণী – তাদের সকলেই চায় পৃথিবীর বুকে বাঁচতে, সুখে-শান্তিতে ও নির্বিঘ্নে বাঁচতে; প্রত্যেকেই চায় পৃথিবীতে তার জীবন হোক দীর্ঘায়ু। অন্য কথায়, হোক সে ধার্মিক কিংবা নিঃধার্মিক মানুষ অথবা নিম্নশ্রেণীর জীব – সবার মাঝেই পৃথিবীতে সর্বাধিক সময় বাঁচার স্পৃহা বিদ্যমান। মানুষসহ সব প্রাণীর মাঝেই অন্তর্নিহিতভাবে বিদ্যমান জীবনের প্রতি ভালবাসা, পৃথিবীতে বাঁচার প্রতি ভালবাসা, পৃথিবীর বুকে যথাসম্ভব সর্বাধিক সময় কাটানোর উদগ্র বাসনা। এবং জীবজগতের সদস্যদের মাঝে বিদ্যমান এ সর্বজনীন স্পৃহা ও বাসনার মাঝেই আমাদেরকে, বিশেষত নিঃধার্মিকদেরকে, খুঁজতে হবে জীবনের উদ্দেশ্য, বাঁচার অর্থ। জীবনকে, পৃথিবীতে বেঁচে থাকাকে, ভাল লাগে – এবং সে ভাল লাগার মাঝেই নিহিত আমাদের জীবনের উদ্দেশ্য। জীবনের উদ্দেশ্য সম্পর্কে এর বাইরে আর কিছু জানার বা বুঝার উপায় নেই আমাদের। এ সত্যতাটিকে সুন্দরভাবে তুলে ধরেছেন কবি গুরু রবীন্দ্রনাথঃ
মরিতে চাহিনা আমি সুন্দর ভুবনে,

মানবের মাঝে আমি বাচিবারে চাই।

এ বৈচিত্র্যময় ধরণীতে, এ মানুষের মাঝে, সুদীর্ঘকাল বেঁচে থাকার স্পৃহা মানুষের এক প্রবৃত্তিজাত সার্বজনীন বাসনা। এবং আমরা বাঁচতে চাই নির্বিঘ্নে, সুখে-শান্তিতে, স্বচ্ছলতা ও সমৃদ্ধিতে। এসব মৌলিক চাওয়াকে সামনে রেখেই চয়ন করতে হবে আমাদের জীবন দর্শন এবং তার ভিত্তিতেই রচিত হবে আমাদের জীবন বিধান।

 

জীবন দর্শনের ভিত্তি কী হবে?

১৭৮৭ সালে আমেরিকার দ্বিতীয় প্রেসিডেন্ট জন অ্যাডামস লিখেনঃ

“The United States of America have exhibited, perhaps, the first example of governments erected on the simple principles of nature; and… [man] will consider this event as an era in their history.”[1]

অর্থাৎ “যুক্তরাষ্ট্র সম্ভবত বিশ্বের বুকে প্রথম ‘প্রাকৃতিক’ নীতির ভিতিতে সরকার গঠন করেছে এবং [মানুষ] সেটাকে যুগান্তরকারী হিসেবে দেখবে।”

এর প্রায় ছয় দশক পর ১৮৪৪ সালে সমাজতান্ত্রিক জীবন দর্শনের প্রবক্তা কার্ল মার্ক্স লিখেনঃ

“…communism, as fully developed naturalism, equals humanism, and as fully developed humanism equals naturalism”[2]

অর্থাৎ “কমিউনিজম সম্পূর্ণরূপে ‘প্রকৃতিবাদ’ হিসেবে উন্নীত হলে তা মানবতাবাদের সমতূল্য হবে, এবং সম্পূর্ণরূপে মানবতাবাদ হিসেবে উন্নীত হলে প্রকৃতিবাদের সমতূল্য হবে।”

নিঃধর্মীয় সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র-ব্যবস্থার ভিত্তি সম্পর্কে এবং আমেরিকার নিঃধর্মীয় উদার-গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র-ব্যবস্থার ভিত্তি সম্পর্কে মন্তব্য করতে গিয়ে মার্ক্স ও অ্যাডামস দু’জনেই ‘প্রকৃতিবাদ’ তথা ‘প্রাকৃতিক নিয়মের’ ওপর জোর দিয়েছেন। অর্থাৎ উনারা দু’জনেই বলতে চেয়েছেন যে, একটা সুষ্ঠু জীবন বিধান বা সমাজ-ব্যবস্থা গড়ে তুলতে চাইলে তাকে প্রাকৃতিক নিয়ম-নীতির সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ তথা বাস্তবতা-ভিত্তিক হতে হবে। অর্থাৎ একটা সুষ্ঠু ও সফল মানব জীবন দর্শন গঠন করতে হলে, সেটাকে মানুষের মৌলিক প্রকৃতি ও প্রবৃত্তির সাথে মানানসই হতে হবে। নইলে সেটা স্থিতিশীল ও টেকসই হবে না, না হবে মানব কল্যাণবর্ধনে সহায়ক।

 

ইসলামি জীবন দর্শন

মুসলিমদের কাছে ইসলাম হচ্ছে মানবজাতির জন্য স্বয়ং ঈশ্বর মনোনীত একটা ‘পূর্ণাঙ্গ জীবন ব্যবস্থা’ (perfect way of life) এবং কোরান হচ্ছে স্বয়ং ঈশ্বর রচিত ‘পূর্ণাঙ্গ জীবন বিধান’ (complete code of life)। এ প্রসংগে আল্লাহ নিজেই কোরানে বলেছেন-

‘আজ আমি তোমাদের জন্য ধর্মকে নিখুঁত করেছি; তোমাদের উপর আমার কৃপা পরিপূর্ণ করেছি এবং ইসলামকে তোমাদের জন্য ধর্ম হিসেবে চয়ন করেছি।’ (কোরান ৫:৩)

স্বয়ং বিশ্বস্রষ্টা রচিত নিখুত জীবন বিধান কোরানের প্রত্যেকটি বাণীকেই মুসলিমদেরকে অনুসরণ করে চলতে হবে, একটিকেও বাদ দেওয়া যাবে না। আল্লাহ এ প্রসঙ্গে বলেছেন:

আল্লাহ ও তাঁর রসুলকে অস্বীকারকারী যারা আল্লাহকে তাঁর রসুল থেকে পৃথক করে বলে যে, ‘আমরা কিছু অংশ গ্রহণ করি এবং কিছু প্রত্যাখ্যান করি’ এবং যারা একটা মাঝামাঝি পথ অনুসরণ করে – তারা সবাই সমান অবিশ্বাসী এবং আমরা অবিশ্বাসীদের জন্য লজ্জাজনক শাস্তির ব্যবস্থা করেছি।

তোমরা কী আসমানী কিতাবের কিছু অংশ বিশ্বাস কর এবং বাকী অংশ প্রত্যাখ্যান কর? তাদের কি প্রতিফল হবে যারা এ জীবনের জন্য এরূপ ঘৃণাত্মক কাজ করে? শেষ বিচারের দিন তাদেরকে সর্বোচ্চ পীড়াদায়ক শাস্তি দেওয়া হবে। (কোরান ৪:১৫০-৫১)

সুতরাং কোরানের প্রত্যেকটি আয়াতের নির্দেশনাকে পূংখানুপুংখভাবে পালন করার মাঝেই একজন মুসলিমের জীবন বিধান নিহিত। এবার দেখা যাক ইসলাম মানবজীবনের বিভিন্ন ক্ষেত্রগুলো সম্পর্কে কী বলছে? (কোরান ২:৮৫)

 

১) ইসলামে ব্যক্তি

ইসলামে ব্যক্তি, ব্যক্তির অবস্থান ও ব্যক্তির মূল্য কী?

ইসলামে ব্যক্তি হলো আল্লাহর সৃষ্টি এক জীব সত্তা, যে কেবলই কোরানে আল্লাহর নির্দেশিত কর্মকাণ্ড সম্পাদনে নিযুক্ত থাকবে। মানুষ যেমন কম্পিউটার, ঘড়ি, ফোন, টেলিভিশন, রোবট ইত্যাদি উদ্ভাবন করে মানুষেরই নির্দেশিত বিশেষ কর্ম সম্পাদনের জন্য, আল্লাহ মানুষ সৃষ্টি করেছেন ঠিক অনুরূপ উদ্দেশ্যে। মানুষের নিজস্ব কোন স্বাধীনতা নেই, স্বাধীন ইচ্ছা নেই। সে যেন আল্লাহর হাতের পুতুল মাত্র। স্বয়ং আল্লাহই পবিত্র কোরানে বলেছেন যে ব্যক্তির জান ও মাল সবই আল্লাহর এবং তার কাজ শুধুই আল্লাহর পথে যুদ্ধ বা জিহাদ করাঃ

“দেখ! আল্লাহ বিশ্বাসীদের জীবন ও মালামাল সব কিনে নিয়েছেন, কেননা বেহেস্তের বাগান হবে তাদেরঃ – তারা কেবলই আল্লাহর পথে লড়বে, এবং হত্যা করবে ও শহীদ হবে…” (কোরান ৯:১১১)

ইসলামি দৃষ্টিভঙ্গিতে এ জগতে ব্যক্তি যেন আল্লাহর ক্রীতদাস (কেনা গোলাম) মাত্র। তার একমাত্র কাজ হচ্ছে আল্লাহ কর্তৃক কোরানে নির্দেশিত যাবতীয় কর্মকাণ্ড সম্পন্নকরণে, বিশেষত জিহাদে অংশগ্রহণ করে কাফেরদেরকে হত্যায় নিয়োজিত থাকা। এবং জান-প্রাণ দিয়ে তা করলেই সে আল্লাহর অপার অনুগ্রহ বা পুরস্কার পাবে অন্তহীন পারলৌকিক জীবনে। এবং তা করতে গিয়ে নিজ প্রাণ হারালে সে অর্জন করবে শহীদের গৌরব এবং সরাসরি অবতরণ করবে আল্লাহর বেহেস্তে (কোরান ৯:১১১)। অন্য কথায়, একজন মুসলিমের পার্থিব জীবনের সকল কর্ম ও প্রয়াস শুধুই কোরান ও হাদিসের নির্দেশিত পথে উৎসর্গকৃত, এবং এতেই অর্জিত হবে তার ইহজাগতিক ও পারলৌলিক জীবনের প্রকৃত মঙ্গল।

আমরা দেখছি যে, ইসলামে ব্যক্তির নিজস্ব সত্তা মানুষের সৃষ্ট যন্ত্রপাতির সত্তার চেয়েও নড়বড়ে। কেননা আল্লাহ মানুষকে কেবল নিজ হাতে সৃষ্টি করেই তাকে হাতের পুতুল করেন নি, তিনি আবার তাদের জান-মাল কিনেও নিয়েছেন এবং সে প্রক্রিয়ায় মানুষকে দ্বিতীয় দফা তাঁর হাতের পুতুল বানিয়েছেন।

এবং পৃথিবীতে মানুষের যাবতীয় কর্মকাণ্ড আল্লাহর নির্দেশনা অনুসারে হচ্ছে কীনা তার হিসেব রাখার জন্য আল্লাহ প্রত্যেক ব্যক্তির দুই কাঁধে দুইজন ফেরেস্তা রেখেছেন ডায়েরী হাতে। ডান কাঁধের ফেরেস্তা লিপিবদ্ধ করছে তার সমস্ত পূণ্যবাণ তথা আল্লাহর নির্দেশনা অনুসারে কৃত কর্মকাণ্ড; আর বাম কাঁধের ফেরেস্তা লিপিবদ্ধ করছে তার পাপকর্ম, অর্থাৎ আল্লাহর নির্দেশনা-বিরোধী কর্মকাণ্ড। এবং আল্লাহ কিয়ামতের দিন বিশ্বকে ধ্বংস করার পর শেষ বিচারের দিন সব মানুষকে হাশরের ময়দানে দাঁড় করাবেন। সেদিন তার পাপ-পূণ্যের বিচার করা হবে ফেরেস্তা দু’জনের লিপিবদ্ধকৃত পাপের লিপি না পূণ্যের লিপি ভারী সে ভিত্তিতে। যার পাপের লিপি ভারী হবে সে যাবে দোজখে এবং যার পূণ্যের লিপি ভারী হবে সে যাবে বেহেস্তে। ইসলামি দৃষ্টিতে এটাই ব্যক্তির জীবনের মোটামুটি রূপরেখা।

 

(ক) ইসলামে সমাজ ও রাজনীতি

১৭৮৯ সালে ফ্রান্সে সফল বিপ্লব সংগঠিত হওয়ার পর থেকে, বিশেষত ‘মানব ও নাগরিক অধিকার ঘোষণাপত্র’ (Declaration of the Rights of Man and of the Citizen, August 1789) গৃহীত হওয়ার পর থেকে পাশ্চাত্যে ধর্ম ব্যক্তিগত বিষয় হিসেবে বিবেচিত হয়ে আসছে। ধর্ম কেবলই ব্যক্তির নিজস্ব আধ্যাত্মিক পরিপুষ্টি সাধনের নিমিত্তে। সামষ্ঠিক সমাজ ও রাষ্ট্রীয় জীবনে ধর্ম কোন ভূমিকা রাখতে পারবে না। কিন্তু মুসলিম বিশ্বে ইসলামকে সমাজ ও রাষ্ট্রীয় জীবন থেকে পৃথক করা সম্ভব হয় নি। ইরান, তুরস্ক ইত্যাদি মুসলিম দেশগুলোতে ইসলামকে রাষ্ট্রীয় জীবন থেকে পৃথক করার চেষ্টা করা হয়েছে, কিন্তু পরিণামে এ দেশগুলোর সমাজ ও রাষ্ট্রীয় জীবনে ইসলাম আরও শক্তভাবে জেঁকে বসেছে। এর কারণ হচ্ছে, মুসলিমদের কাছে ইসলাম হচ্ছে মানবজাতির জন্য বিশ্ব-স্রষ্টার নির্দেশিত একটি পূর্ণাঙ্গ জীবন বিধান, যার মাঝে অন্তর্ভূক্ত জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্র – ব্যক্তিগত, সামাজিক-রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক। কোরান মানব জীবনের সামাজিক ও রাজনৈতিক ক্ষেত্র সম্পর্কে কী বলে, সেটা খতিয়ে দেখা যাক এখানে।

কোরানের ২৪:৪২ নং আয়াতে আল্লাহ বলেছেন – “হ্যাঁ, আসমান ও জমিনের মালিক একমাত্র আল্লাহ; এবং আল্লাহই হচ্ছেন চূড়ান্ত গন্তব্য”, এবং একই দাবী পুনরাবৃত্ত করেছেন ৩৪:১ নং আয়াতে। কোরানের ৫৭:৫ ও ৬৭:১ নং আয়াতে আল্লাহ নিজেকে আসমান ও জমীনের ওপর একচ্ছত্র আধিপত্যকারী হিসেবেও দাবী করেছেন। ওদিকে পৃথিবীর ক্ষেত্রে আল্লাহ সকল মানবগোষ্ঠীর মধ্য থেকে মুসলমানদেরকে তাঁর প্রতিনিধি চয়ন করেছেন। যেমন –

আল্লাহ তোমাদেরকে তাঁর প্রতিনিধি ও পৃথিবীর উত্তরাধিকারী নির্বাচিত করেছেন।  (কোরান ৬:১৬৫)

যারা বিশ্বাস করে ও ভাল কাজ করে, আল্লাহ প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন তাদেরকে পৃথিবীর শাসনকর্তা বানাবেন… এবং তিনি অবশ্যই তাদের জন্য চয়নকৃত ধর্মকে সুপ্রতিষ্ঠিত করে দেবেন…  (কোরান ২৪:৫৫)

তার মানে দাঁড়ায়, কোরান মতে সমগ্র পৃথিবীর প্রকৃত মালিক বা উত্তরাধিকারী মুসলিমরা এবং আল্লাহ বিশ্ব শাসনের দায়িত্ব তাদের হাতে ন্যস্ত করেছেন। অমুসলিম মালিকানাধীন ও শাসনাধীন পৃথিবীর সকল ভূখণ্ডের প্রকৃত মালিক এবং শাসকও মুসলিমরা। অন্য কথায়, আমেরিকা, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া ও ইউরোপের দেশগুলোর প্রকৃত মালিকও মুসলিমরা; অমুসলিমরা এসব ভূখণ্ডের অবৈধ দখলে রয়েছে। এবং বিশ্বের সর্বত্র ইসলামকে সুপ্রতিষ্ঠিতকরণের মাধ্যমে আল্লাহ অমুসলিমদের অন্যায় দখল থেকে বিশ্বের প্রত্যেক টুকরো ভূখণ্ড মুসলিমদের মালিকানায় ও শাসনে এনে দেবেন বলেও প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন।

 

জিহাদঃ

সমগ্র বিশ্বকে আল্লাহ মুসলিমদের হাতে এনে দেবেন কীভাবে? কীভাবে সম্পন্ন হবে সে কঠিন কাজ? সমগ্র বিশ্বের ওপর মুসলিমদের মালিকানা ও রাজত্ব আল্লাহ নিজ থেকে এনে দেবেন না, মুসলিমদেরকেই কাঠখড় পোড়াতে হবে আল্লাহর সে চূড়ান্ত লক্ষ্য অর্জনের জন্য। প্রিয় বান্দাদের জন্যও বিনামূল্যে আহার এনে দিতে রাজী নন আল্লাহ। আল্লাহর মতে, পৃথিবীপৃষ্ঠের সর্বত্র মুসলিমদের মালিকানা ও রাজত্ব অর্জিত হবে মুসলিমদেরই বাহুবলে, তাদেরই সমরবলে সংঘটিত ‘জিহাদ’ বা ধর্মযুদ্ধের মাধ্যমে, যাতে আল্লাহ সহায়তা দান করবেনমাত্র। জিহাদের প্রকৃত স্বরূপ সম্পর্কে বহু বিতর্ক রয়েছে। অনেকে দাবী করেন যে, জিহাদ হলো নিজ কুপ্রবৃত্তির সাথে লড়াইমাত্র। যারা এমন দাবী করে তাদের নজর দেওয়া উচিত উপরে উদ্ধৃত কোরানের ৯:১১১ আয়াতের দিকে, যা এখানে পুনরাবৃত্ত করা হলোঃ

দেখ! আল্লাহ বিশ্বাসীদের জীবন ও মালামাল কিনে নিয়েছেন, কেননা বেহেস্তের বাগান হবে তাদের। তারা আল্লাহর রাস্তায় যুদ্ধ করবে এবং মারবে ও মারা যাবে – যে প্রতিশ্রুতি আইন, গসপেল ও কোরান দ্বারা আল্লাহর সাথে বাঁধিত।

কোরান মতে, ‘জিহাদ’ হচ্ছে ‘আল্লাহর রাস্তায় লড়াই করা’। আল্লাহর রাস্তায় লড়াই নিজ কুপ্রবৃত্তির বিরুদ্ধে লড়াইয়ের সমতূল্য হতেও পারে। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে – জিহাদ যদি নিজ কুপ্রবৃত্তির সাথেই লড়াই হয়, তা করতে গিয়ে মুসলিমরা অন্যকে মারবে এবং নিজেরাও মারা যাবে কেন ও কীভাবে? এবং জিহাদের চূড়ান্ত লক্ষ্য কী, সে সম্পর্কে আমরা ধারণা পাই কোরান ৮:৩৯ আয়াতটিতে, যা বলে –

“…যুদ্ধ করে যাও তাদের বিরুদ্ধে যতদিন-না ফিতনাহ দূরীভূত হয় এবং কেবলমাত্র আল্লাহর প্রতি ন্যায় ও বিশ্বাস পুরোপুরি ও সর্বত্র সুপ্রতিষ্ঠিত হয়।”  (কোরান ৮:৩৯)

আয়াতটি বলছে জিহাদের চূড়ান্ত উদ্দেশ্য হচ্ছে একমাত্র আল্লাহতে বিশ্বাস তথা ইসলামধর্মকে পুরোপুরি ও বিশ্বের সর্বত্র প্রতিষ্ঠিত করা। এবং বিশ্বের সর্বত্র ও সব মানুষের ওপর ইসলামের কর্তৃত্ব পুরোপুরি প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেলেই পৃথিবী থেকে ফিতনাহ-ফ্যাসাদ সব দূর হয়ে যাবে। সুতরাং আল্লাহর স্বপ্ন হচ্ছে মুসলিমদেরকে সমগ্র পৃথিবীর মালিক ও শাসনকর্তা বানানো, এবং পৃথিবীর সর্বত্র ও সব মানুষের ওপর ইসলামি আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত করা। এবং আল্লাহর সে স্বপ্ন বাস্তবায়িত হবে মুসলিমদের দ্বারা সংঘটিত সহিংস ও রক্তক্ষয়ী জিহাদের মাধ্যমে। এবং মুসলিমরা যখন অমুসলিমদের বিরুদ্ধে জিহাদি যুদ্ধে লিপ্ত হবে, আল্লাহ তাদেরকে সহায়তা করবেন। এ প্রসংগে আল্লাহ বলছেন – জিহাদে লিপ্ত মুসলিমদেরকে সহায়তা করতে আল্লাহ ফেরেস্তা বাহিনী পাঠাবেন, যাদের সহায়তায় মুসলিমরা ১০গুণ অধিক শক্তিশালী শত্রুপক্ষকে পরাজিত করতে পারবে (কোরানে ৮:৬৫-৬৬)।

এ প্রসংগে আল্লাহ আরও বলেছেন –

“মনে আছে তুমি (নবী সঃ) বিশ্বাসীদেরকে বলেছিলে – এটা কি তোমাদের জন্য যথেষ্ট নয় যে, আল্লাহ তোমাদের জন্য ৩,০০০ হাজার ফেরেস্তা পাঠিয়ে সহায়তা করবেন? তোমরা দৃঢ় ও সত্য পথে থাকলে আল্লাহ ৫,০০০ ফেরেস্তা পাঠিয়ে তোমাদের শত্রুদের উপর সাঙ্ঘাতিক হত্যাযজ্ঞ ঘটাবেন।”

(কোরান ৩:১২৪-১২৫)

এবং নবী মুহাম্মদের নেতৃত্বে মুসলিমরা যখন জিহাদ করে ধীরে ধীরে কাফেরদের ভূখণ্ড দখল করে মদীনা-কেন্দ্রিক ইসলামি সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করছিল, আল্লাহ তাতে সক্রিয়ভাবে সহায়তা করছিলেন বলে দাবীও করেছেন। যেমন কোরানে ১৩:৪১ আল্লাহ বলছেন:

“তারা (কাফেররা) কি দেখছেনা যে আমরা (অর্থাৎ আল্লাহ) তাদের নিয়ন্ত্রিত ভূখণ্ড সীমান্তবর্তী অঞ্চল থেকে ধীরে ধীরে হ্রাস করছি? তারা কি মনে করে যে,তারা জিততে পারবে?” (আরও দেখুন কোরান ২১:৪৪)

তার মানে হচ্ছে – আল্লাহর কেরামতিতেই ইসলামের নবী ও তাঁর শিষ্যরা আরবের অবিশ্বাসীদের ভূখণ্ড জয় করতে সমর্থ হচ্ছিল, যার মাধ্যমে মদীনায় ইসলামি সাম্রাজ্যের গোড়াপত্তন ঘটে। কিন্তু আল্লাহর চূড়ান্ত স্বপ্ন হলো সমগ্র বিশ্বে মুসলিমদের রাজত্ব প্রতিষ্ঠা করা। আল্লাহর সে স্বপ্ন বাস্তবায়িত হবে কীভাবে? মুসলিমদের জন্য আল্লাহ সে রাস্তাও বাতলিয়ে দিয়েছেন। বিশ্বকে কব্জাকরণের লক্ষ্যে আল্লাহ মুসলিমদেরকে নির্দেশ দিয়েছেন পৌত্তলিকদেরকে যেখানে পাওয়া যায় সেখানেই হত্যা করতে (কোরান ৯:৫) এবং এভাবে পৌত্তলিকদেরকে নির্মূল করার মাধ্যমে তাদের অধিকৃত ভূখণ্ডে মুসলিম মালিকানা ও শাসন প্রতিষ্ঠিত হবে। অন্যদিকে একেশ্বরবাদী অমুসলিম, যেমন ইহুদি ও খ্রিস্টানদের অধিকৃত ভূখণ্ড কব্জা করার জন্য আল্লাহ নির্দেশ দিয়েছেন যে, মুসলিমরা তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে যাবে যতোক্ষণ-না তারা পরাজিত হয়ে অবমানিত ও বশীভূত অনুভব করবে এবং স্বেচ্ছায় মুসলিমদেরকে বৈষম্যমূলক জিজিয়া কর দেবে (কোরান ৯:২৯)। এভাবে সমগ্রবিশ্বে আল্লাহর প্রত্যাশিত ইসলামি বিজয় ও শাসন অর্জিত হবে।
এবং নবী মুহাম্মদের সময় থেকে মুসলিমরা আল্লাহর নির্দেশত ঠিক সেই কর্ম-প্রণালীই প্রয়োগ করেছে বিশ্বব্যাপী ইসলামি সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে এবং সে অভিযানে তারা ব্যাপক সাফল্য লাভও করেছে, যদিও সমগ্র বিশ্ব বিজয়ের স্বপ্ন আজও সফল হয় নি। তবে প্রচেষ্টা কোন না কোন পন্থায় আজও চালিয়ে যাচ্ছে মুসলিমরা।

ইসলামের রাজনৈতিক রূপরেখা (ব্লুপ্রিন্ট) সম্পর্কে আরও বলতে হয় যে, মুহাম্মদ (সঃ) নবীত্বের পাশাপাশি মদীনায় প্রতিষ্ঠিত নব্য ইসলামি রাষ্ট্রের একচ্ছত্র ও আমৃত্যু শাসকও ছিলেন। মৌলিক ইসলামে যেহেতু নারী নেতৃত্ব হারাম এবং নবীর যেহেতু কোন পুত্র সন্তান ছিল না, তাই তাঁর মৃত্যুর পর বাধ্য হয়েই ইসলামি খিলাফতের দায়িত্ব নবীর পরিবার থেকে বেরিয়ে যায়। অন্যকথায়, নবীর কোন পুত্র সন্তান না থাকায় ইসলামি শাসন ব্যবস্থা বংশানুক্রমিক রাজতন্ত্র হয়ে উঠার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হয়। খিলাফতের নের্তৃত্ব নবীর পরিবার থেকে বেরিয়ে গেলেও তা নবীর সবচেয়ে নিকটাত্মীয়দের মাঝেই সীমাবদ্ধ থাকে –
প্রথমত দুই শ্বশুর (আবু বকর ও উমর), অতঃপর দুই জামাতা (উসমাস ও আলী) ও তারপর নাতী (হুসেন) খলিফা হন। এবং নবীর নিকটাত্মীয় উত্তরসূরীরাও একবার খলিফার পদে অধিষ্ঠিত হলে মৃত্যু পর্যন্ত খিলাফতের একচ্ছত্র শাসক হিসেবে বহাল থাকেন। ইতিহাস আমাদেরকে জানায় যে, যেখানে আমৃত্যু একনায়কতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হবে সেখানে বংশানুক্রমিক রাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হতে বাধ্য। এবং নবীর মৃত্যুর মাত্র তিন দশক পরই ইসলামি শাসন ব্যবস্থায় পারিবারিক রাজতন্ত্র ঢুকে পড়ে নবীর জামাতা ও চতুর্থ খলিফা আলীর মৃত্যুর পর তার পুত্র ইমাম হুসেনের খলিফার পদে আসীন হওয়ার মাধ্যমে। যদিও তা ছিল নামেমাত্র ও স্বল্পস্থায়ী। রাজতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় ইমাম হুসেনের খলিফা পদে আসীন হওয়ার পর মুয়াবিয়া খিলাফতের নেতৃত্ব কেড়ে নিয়ে রাজতান্ত্রিক ধারাতেই উমাইয়াদ ডাইনাস্টি প্রতিষ্ঠা করেন এবং পরবর্তীতে অনুরূপভাবে পরিবারতান্ত্রিক আব্বাসীদ ডাইনাস্টি প্রতিষ্ঠিত হয়।

মোটকথা – আদর্শ ইসলামি শাসন ব্যবস্থা হবে একনায়কতান্ত্রিক এবং পুরুষ উত্তরসূরীর অভাবে অবংশানুক্রমিক ক্ষমতা হস্তান্তর হতে পারে, এবং সুযোগ হলেই (যেমন, যোগ্য পুত্র সন্তান থাকলে) ইসলামি শাসন ব্যবস্থা বংশানুক্রমিক রাজতন্ত্রে উন্নীত হতে পারে।

 

ইসলামি অর্থনীতি

কার্ল মার্ক্স ও অ্যাঙ্গেলস নবী মুহাম্মদের ইসলাম প্রতিষ্ঠার অভিযানকে একটা অর্থনৈতিক সাম্য প্রতিষ্ঠার বিপ্লব হিসেবে দেখতেন। সেটাকে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব বলা না হলেও তাদের দৃষ্টিতে সেটা ছিল মূলত একটা অর্থনৈতিক বৈষম্য প্রসূত সহিংস দ্বন্দ্ব।[3] ওদিকে নবী ছেলেবেলায় চাচা আবু তালিবের ব্যবসার সাথে যুক্ত ছিলেন এবং পরে ধনাঢ্য খাদিজার ব্যবসাকে সফল ও লাভজনকভাবে পরিচালনা করেছিলেন বিধায় পাশ্চাত্যের অনেক পণ্ডিত নবী মুহাম্মদকে মূলত একজন পূঁজিবাদী হিসেবে দেখেন।

প্রশ্ন হচ্ছেঃ এ দু’টো দাবীর মধ্যে কোনটি সঠিক? নবী মুহাম্মদ সমাজবাদী বা সমাজতান্ত্রিক ছিলেন, না পূঁজিবাদী?

১৯৯৯ সালে বিবিসি’র সমীক্ষায় কার্ল মার্ক্স দ্বিতীয় সহস্রাব্দের সেরা চিন্তাবিদ নির্বাচিত হয়েছিলেন। কাজেই নবী মুহাম্মদের আন্দোলন সম্পর্কে মার্ক্স ভুল রায় দেবেন, অর্থাৎ একজন পূঁজিবাদীকে সমাজবাদী বলবেন, তা কী করে সম্ভব? যারা মুহাম্মদকে পূঁজিবাদী হিসেবে দেখেন, তারা ভুলে যান যে, নবীর জীবনে দু’টো অধ্যায় ছিল – প্রথমটা পৌত্তলিক, দ্বিতীয়টা ইসলামি। এবং তিনি পূঁজিবাদী ছিলেন পৌত্তলিক অধ্যায়ে। নবীত্ব গ্রহণের পর তিনি ব্যবসা-বাণিজ্যে ছেড়ে দেন এবং স্ত্রী খাদিজার পূঞ্জীকৃত সম্পদের ওপর ভর করে ইসলামি বিপ্লব সংগঠিত করতে থাকেন। সে পর্বে আমরা এটাও দেখি যে, নবীর ধনাঢ্য শিষ্য আবু বকর তার ধন-সম্পদ দিয়ে দরিদ্র সাহাবাদেরকে সাহায্য করছেন। অন্যকথায়, ইসলামি নবুয়ত গ্রহণের পর মুহাম্মদ পুঁজিবাদী কর্মকাণ্ড পরিত্যাগ করেন। তবে সে পর্বে নবী মুহাম্মদ ও তাঁর শিষ্যদের মাঝে কিছুটা মার্ক্সবাদী নীতি চর্চার ছাপ দেখি, তাঁর দরিদ্র শিষ্যদের সহায়তায় ধনবান শিষ্যদেরকে এগিয়ে আসতে দেখি।

এবং নবী তাঁর শিষ্যদেরকে মদীনায় স্থানান্তরের পর আমরা নবীকে বাণিজ্য-কাফেলা আক্রমণ করে লুণ্ঠিত মালামালের ওপর নির্ভর তাঁর সম্প্রদায়ের জীবিকা নিশ্চিত করতে দেখি। মদীনায় মুসলিম সম্প্রদায় ক্রমাগত শক্তিশালী হয়ে উঠলে নবী আরবাঞ্চলের অমুসলিম সম্প্রদায়গুলোকে একে একে হামলা করে তাদের ধন-সম্পদ করায়ত্ব করতে থাকেন, এবং সে লুণ্ঠিত মালের ওপর নির্ভর করে নবীর মুসলিম সম্প্রদায় জীবিকা নির্বাহ করতে থাকে। কোরানের অষ্টম সুরাটির শিরোনাম হচ্ছে ‘আন-ফাল’, যার অর্থ হচ্ছে ‘গণিমতের মাল’ বা ‘যুদ্ধে লুণ্ঠিত মালামাল’। এ সুরাটিতে আল্লাহ যুদ্ধে লুণ্ঠিত অবিশ্বাসীদের মালামালকে মুসলিমদের জীবিকা নির্বাহের জন্য ‘বৈধ ও উত্তম’ ঘোষণাকরতঃ বলেছেন –

“সুতরাং যুদ্ধে কব্জাকৃত লুটের মাল ভোগ কর, বৈধ ও উত্তম হিসেবে, এবং আল্লাহকে ভয় করো…”  (কোরান ৮:৬৯)।

এবং সুরাটিতে আল্লাহ নির্দেশনাও দিয়েছেন কীভাবে যুদ্ধে লুণ্ঠিত মালামাল মুসলিমদের মাঝে বণ্টন করতে হবে – যার এক-পঞ্চমাংশ যাবে নবীর ও আল্লাহর ভাগে, বাকী অংশ মুসলিমদের মাঝে ভাগ করে দেওয়া হবে। (কোরান ৮:১,৪১)

নবী মুহাম্মদের চর্চাকৃত জীবিকা নির্বাহের এ প্রক্রিয়া পূঁজিবাদী ব্যবস্থার পরিপন্থী, কেননা পূঁজিবাদ চায় ব্যবসা-বাণিজ্যের নির্বিঘ্ন পরিচালনা। অন্যদিকে, মদীনায় নবীর শাসনাধীনে মুসলিম সম্প্রদায়ের জীবিকা নির্বাহের এ প্রক্রিয়া বা অর্থনৈতিক পন্থার সাথে সমাজতান্ত্রিক অর্থনৈতিক প্রক্রিয়ার কিছুটা হলেও মিল রয়েছে, অন্তত বিপ্লবপর্বে। সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের প্রাথমিক পর্বে ধনীদের ধন-সম্পদ কেড়ে নিয়ে জনগণের মাঝে পুনর্বণ্টন করা মার্ক্সবাদী অর্থনীতির একটা বড় লক্ষ্য। সে প্রসঙ্গে ইসলামের নবুয়তী পর্বে নবীর গ্রহণকৃত অর্থনৈতিক পন্থা মার্ক্সবাদী অর্থনৈতিক নীতির কাছাকাছি ছিল। উল্লেখ্য, বিপ্লবপর্বে ধনীক শ্রেণীর উৎখাত ও তাদের ধন-সম্পদ কব্জা করার পর মার্ক্সবাদী সমাজের অর্থনৈতিক প্রক্রিয়া বদলে যেতে বাধ্য। একইরূপে ইসলামেও প্রাথমিক জিহাদী পর্বে অমুসলিম জনগোষ্ঠীর উৎখাত (হত্যা কিংবা মৃত্যুভয়ে ইসলামগ্রহণের মাধ্যমে) ও তাদের ধন-সম্পদ কব্জাকরণের পর মুসলিম সমাজের অর্থনৈতিক প্রক্রিয়াও বদলে যেতে বাধ্য ছিল।

মোটকথা – মুহাম্মদের জীবনের পৌত্তলিক পর্বকে পূঁজিবাদী বলা যেতেও পারে, কিন্তু ইসলামি নবুয়তী পর্বে পদার্পনের সাথে সাথে তিনি পূঁজিবাদ পরিপন্থী হয়ে উঠেন।

এবং নবীর জীবনের শেষ পর্যায়ে যখন পুরো আরব ইসলামের পদতলে এসে গেছে এবং আরবাঞ্চলের বেশিরভাগ মানুষ ইসলাম গ্রহণ করেছে, যার ফলে লুটপাট করার মতো আর কোন জনগোষ্ঠী অবশিষ্ট নেই, তখন আর আগের সেই লুটপাট-ভিত্তিক অর্থনৈতিক পন্থায় চলা সম্ভব হল না। এখন লুটপাটের পেশা ছেড়ে মুসলিমদেরকে হয় চাষাবাদ বা ব্যবসা-বাণিজ্যে তথা পূঁজিবাদী পথে যেতে হবে, নইলে অন্য উপায় বের করতে হবে। এবং আল্লাহ কী করলেন? আল্লাহ সেটা নির্ণয় করেছেন কোরানের ৯:২৮-২৯ আয়াতেঃ

“হে বিশ্বাসীরা! পৌত্তলিকরা সত্যি সত্যি নোংরা; সুতরাং এ বছরের পর আর তাদেরকে কাবায় ঢুকতে দিবে না। এবং তোমরা যদি দারিদ্রের আশংকা কর, আল্লাহ শীঘ্রই তোমাদেরকে ধনবান করে তুলবেন…”

“যারা আল্লাহ ও পরকালে বিশ্বাস করে না এবং আল্লাহর নবী যা নিষেধ করেছেন তা নিষিদ্ধ বিবেচনা করে না – তারা আসমানী কিতাবের মানুষ (খ্রিস্টান ও ইহুদি) হলেও তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে যাও যতদিন-না তারা অবমানিত ও বশীভূত হয়ে স্বেচ্চায় কর প্রদান করবে।”

অর্থাৎ নোংরা পৌত্তলিকদের কাবায় পদার্পন নিষিদ্ধ হওয়ার কারণে মুসলমানদের মাঝে দারিদ্রের আশঙ্কা দিতে পারে। তা পূরণ করার জন্য আল্লাহ আসমানী কিতাবধারী খ্রিস্টান ও ইহুদিদের পরাভূত করে তাদের কাছ থেকে উচ্চহারে কর (জিজিয়া কর) আদায়ের নির্দেশ দিয়েছেন মুসলমানদেরকে।

মুসলিমরা রাষ্ট্রকে দিবে নগণ্য যাকাতমাত্র (উদ্বৃত্ত আয়ের ২.৫%), তাও আজকের যুগে স্বেচ্ছামূলকভাবে। ফলে এর দ্বারা মুসলিম সম্প্রদায় ও রাষ্ট্রের পরিচালনা সম্ভব নয়। অন্যদিকে, মৌলিক ইসলামি তত্ত্বে পৌত্তলিকদেরকে বাঁচতেই দেওয়া হবে না। বাকী থাকে ইহুদি ও খ্রিস্টানরা – যারা অন্তত আল্লাহরই পাঠানো তবে অনিখুঁত ধর্মের অনুসারী। তারা ইসলাম গ্রহণ না করলে তাদেরকে ইসলামি রাজ্যে বাঁচতে দেওয়া যেতে পারে ‘জিম্মি’ বা ‘পরাভূত প্রজা’ হিসেবে, তবে উচ্চহারে বৈষম্যমূলক ‘কর’ প্রদানের বিনিময়ে। এবং তাদের ওপর প্রধানত দুই ধরনের কর আরোপ করা হয়:

       (১) জিজিয়া (বশ্যতা কর)

      (২) খারাজ (ভূমি কর)।

খাইবার ও ফাদাক গোত্রের ইহুদিদের কাছ থেকে নবী উৎপাদিত পণ্যের অর্ধেক (৫০%) কর হিসেবে আদায় করতেন।

কোরানে নির্দেশিত ইসলামি অর্থনীতির রূপরেখা মোটামুটি এটাই, এবং যতোদিন ইসলামি খিলাফতের কর্তৃত্ব আরবদের হাতে ছিল, ততদিন বিশেষত আরব-মুসলিমরা এভাবেই জীবিকা নির্বাহ করেছে।

 

মানবতাবাদ কী?

অধুনা মানবতাবাদ (Humanism) এক নতুন জীবনবিধান হিসেবে পরিচিতি পেতে শুরু করেছে। তবে মানবতাদের একটি বিস্তারিত ও সুনির্দিষ্ট রূপরেখা এখনও দাঁড় করানো যায় নি। বিভিন্নজন বা সঙ্ঘ মানবতাদের নানান সংজ্ঞা দিচ্ছে। যেমন –

(১) মানবতাবাদ হচ্ছে একটা পার্থিব জীবন দর্শন যা যুক্তিতর্ক, নৈতিকতা ও সুবিচারকে ধারণ করে এবং বিশেষত নৈতিকতা ও নীতি প্রণয়নের ভিত্তি হিসেবে অলৌকিকতা ও ধর্মীয় বিশ্বাসকে প্রত্যাখ্যান করে। (উইকিপিডিয়া)

(২) মানবতাবাদ একটা অলৌকিকত্ববিহীন জীবন দর্শন, যা দাবী করে যে ব্যক্তিগত সন্তুষ্টিপূর্ণ নৈতিক জীবনযাপনের সামর্থ্য ও দায়িত্ব রয়েছে মানুষের এবং তা মানবজাতির জন্য অধিকতর কল্যাণ সাধনের প্রয়াস করে। (আমেরিকান মানবতাবাদী সঙ্ঘ)

(৩) মানবতাবাদ একটি গণতান্ত্রিক ও নৈতিক জীবন দর্শন, যা দাবী করে যে মানুষের অধিকার ও দায়িত্ব রয়েছে নিজ জীবনকে অর্থপূর্ণ করে তোলার ও তার গতিবিধি নির্ণয় করার। মানবতাবাদ বিশ্বাস করে যে, মানুষ যুক্তিবাদ ও মুক্তচিন্তা প্রয়োগ করে একটা অধিকতর মানবীয় সমাজ প্রতিষ্টা করার সামর্থ্য রাখে, যার ভিত্তি হবে মানবীয় ও অন্যান্য প্রাকৃতিক গুণাবলী। তা ধর্মীয় নয় এবং বাস্তবতা সম্পর্কে অলৌকিক ধারণা গ্রহণ করে না। (International Humanist and Ethical Union, Minimum Statement)

আমার মতে মানবতাবাদ:  মানবতাবাদ হবে মানব প্রজাতির নিজস্ব চিন্তাভাবনার ভিত্তিতে গঠিত একটি জীবনতত্ত্ব, যা হবে মানবীয় প্রবৃত্তির সাথে যতোটা সম্ভব সামঞ্জস্যপূর্ণ এবং যার লক্ষ্য হবে মানুষের সুখ-শান্তি বর্ধিতকরণ।

আমি এখানে মানবতাবাদের ভিত্তি গঠনে মানবীয় প্রবৃত্তির ওপর বিশেষ জোর দিচ্ছি, কেননা মানুষ যেমন ভাল ও মহৎ কাজ করে তেমনি আবার ভুলও করে; স্বার্থবাদী এবং স্বার্থপরও হয়; মন্দ কাজ, যেমন চুরি, ডাকাতি, হত্যা করতেও সক্ষম। কাজেই মানবতাবাদী জীবন বিধান নির্ধারণে মানুষের ভুল করার, মন্দ ও অন্যায় কাজ করার, এ অন্তর্নিহিত প্রবৃত্তিকে অবশ্যই উপেক্ষা করা যাবে না। মানুষের সততা এবং ভাল ও মহৎ কাজ করার প্রবণতাকে আমরা যেমন উৎসাহিত করব, তেমনি সে ভুল বা অন্যায় করে ফেললে সেটাকে তার অন্তর্নিহিত প্রবণতার অংশ হিসেবেই দেখতে হবে এবং এর সংশোধনী প্রক্রিয়ায় যতোটা সম্ভব মানবিক ও সহনশীল পন্থা গ্রহণ করা উচিত বলে আমি মনে করি। সেটা না করলে আমাদের সমাজ সহনশীল, সুবিচারী ও সভ্য হবে না। এ প্রসঙ্গে মার্ক্সবাদী সমাজতত্ত্ব অতিশয় ভিন্ন। মার্ক্সবাদ মানব প্রবৃত্তির এ দুর্বল ও মন্দ দিকটিকে একেবারেই অসহনশীল দৃষ্টিতে দেখতে চেয়েছে, এবং অত্যন্ত নির্মম ও নিষ্ঠুর প্রক্রিয়ায় ব্যক্তি ও সমাজ জীবন থেকে তা অপসারিত করার ব্যর্থ চেষ্টা করেছে। ফলাফল হয়েছে, মার্ক্সবাদী দেশগুলোতে ব্যাপক নির্মমতা, নিষ্ঠুরতা, এমনকী গণহত্যার চর্চা।

 

উদারবাদ

পাশ্চাত্যে চর্চিত উদারবাদ মার্ক্সবাদের মতই একটা মানবসৃষ্ট বা লৌকিক জীবন বিধান, তবে তা আরও পুরানো। ইউরোপে ‘ইনলাইটনমেন্ট’ যুগে (অষ্টাদশ শতাব্দ) উদারবাদ একটি জীবনবিধান রূপে আবির্ভূত হয় – যার মাঝে ব্যক্তিগত, রাষ্ট্রীয়, অর্থনৈতিক ও বিশ্ব পর্যায়ের নীতিগত ধারণা অন্তর্নিহিত। এবং উদারবাদের পাখায় ভর করেই ঊনবিংশ শতাব্দের দ্বিতীয়ার্ধে মার্ক্সবাদ আরেকটি নিঃধর্মীয় জীবনব্যবস্থারূপে আবির্ভূত হয়। কাজেই উদারবাদ মূলতঃ মার্ক্সবাদের পূর্বসূরী লৌকিক জীবন বিধান, যদিও দুই-এর মাঝে কিছু মৌলিক পার্থক্য বিদ্যমান।

উদারবাদ বিবর্তনশীল; মার্ক্সবাদের মত চূড়ান্ত ও নিখুঁত নয়ঃ  মার্ক্সের মতে সমাজতন্ত্র হচ্ছে একটি নিখুঁত ও চূড়ান্ত জীবন ব্যবস্থা, যে প্রসংগে তিনি বলেছেনঃ

“সমাজতন্ত্র হচ্ছে মানুষ ও প্রকৃতির মাঝেকার এবং মানুষে মানুষে সংঘাতের প্রকৃত সমাধান; অস্তিত্ব ও জীবনের মাঝেকার, পণ্যায়ন ও আত্ম-অভিব্যক্তির মাঝেকার, স্বাধীনতা ও চাহিদার মাঝেকার, এবং ব্যক্তি ও প্রজাতির মাঝেকার দ্বন্দ্বের সত্যিকার সমাধান। এটাই ইতিহাসের সকল প্রহেলিকার সমাধান এবং সে জানে নিজেই সে সমাধান।”

([communism] is the genuine resolution of the conflict between man and nature, and between man and man, the true resolution of the conflict between existence and being, between objectification and self-affirmation, between freedom and necessity, between individual and species. It is the solution of the riddle of history and knows itself to be the solution.)

কার্ল মার্ক্স সমাজতন্ত্রকে একটা নিখুঁত ও পরিপূর্ণ ‘মানবতাবাদী’ জীবন ব্যবস্থা হিসেবেও দাবী করে গেছেন এভাবে –

“কমিউনিজম সম্পূর্ণরূপে ‘প্রকৃতিবাদ’ হিসেবে উন্নীত হলে মানবতাবাদের সমতূল্য হবে, এবং সম্পূর্ণরূপে মানবতাবাদ হিসেবে উন্নীত হলে প্রকৃতিবাদের সমতূল্য হবে।”

কাজেই ইসলামের মত মার্ক্সবাদ নিজেকে একটি পরিপূর্ণ ও নিখুঁত জীবন বিধান হিসেবে দাবী করে। উদারবাদ সেরকম নিখুঁত কিছু নয়। উদারবাদী তত্ত্বের মূলে রয়েছে অব্যাহত পরিবর্তনশীলতার স্পন্দন। আজ থেকে শত বা হাজার বছর আগে আমাদের পূর্বপুরুষেরা যা সঠিক ও মঙ্গলজনক বিবেচনা করতেন, আজ তার অনেক কিছুই ভ্রান্ত ও হানিকর বিবেচিত হয়েছে; আবার আজ আমাদের কাছে যা সঠিক ও মঙ্গলজনক বিবেচিত তার অনেক কিছুই আগামীতে ভ্রান্ত ও অমঙ্গলকর বিবেচিত হতে পারে।

ইসলামের পাশাপাশি মার্ক্সবাদ বা সমাজতান্ত্রিক জীবনব্যবস্থা সম্পর্কে আমরা সবাই মোটামুটি পরিচিত। একটা সামগ্রিক জীবনদর্শন হিসেবে উদারবাদের সাথে আমাদের পরিচিতি কম। পশ্চিমা গণতান্ত্রিক দেশগুলো উদারবাদী ধারায় চালিত, অথচ ইসলামি-মার্ক্সবাদী ভাবধারার বাঙালি সমাজে পাশ্চাত্য মানেই পূঁজিবাদ, পুরো সমাজ ব্যবস্থাটাই পূঁজিবাদ। কখনও কখনও পাশ্চাত্যকে গণতন্ত্র বলা হলেও সেটাকে আমরা পূঁজিবাদী পাশ্চাত্যে সরকার নির্বাচনের হাতিয়ার হিসেবে দেখিমাত্র। প্রকৃতপক্ষে সামগ্রিকভাবে পশ্চিমা সমাজ না গণতন্ত্র, না পূঁজিবাদ। বরং পশ্চিমা সমাজ ব্যবস্থার ভিত্তি হচ্ছে ‘উদারবাদ’, ব্যক্তি স্বাধীনতামুখী একটি অনিখুঁত ও বিবর্তনশীল সমাজ ব্যবস্থা। সে উদারবাদী ব্যবস্থায় পূঁজিবাদ ও গণতন্ত্র ক্রমান্বয়ে অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক বলয়ে গ্রহণকৃত পন্থামাত্র। অন্যকথায়, পূঁজিবাদ ও গণতন্ত্র ইত্যাদি উদারবাদ সমাজ ব্যবস্থার উপরকণ বা অংশমাত্র, সমাজ ও রাষ্ট্র ব্যবস্থার ভিন্ন ক্ষেত্র বা বলয়ে গ্রহণকৃত পন্থামাত্র। বাঙালিদের মাঝে উদারবাদী সমাজব্যবস্থার তাত্ত্বিক দিক সম্পর্কে ধারণা খুবই অস্বচ্ছ বিধায় এখানে তত্ত্বটি সম্পর্কে কিছুটা বিস্তৃত ধারণা দেওয়ার চেষ্টা করা হবে।

 

১) উদারবাদে ব্যক্তি

ক) মানুষ আত্মস্বার্থবাদী:  উদারবাদী ভাবনার একেবারে মূলে রয়েছে মানুষকে আত্মস্বার্থবাদী (Self-interested) হিসেবে বিবেচনা। মানুষ স্বেচ্ছায় যা কিছু করতে চায়, তার প্রত্যেকটিই এক-একটি আত্মস্বার্থ (self-interest/ সেলফ-ইন্টারেস্ট)। আত্মস্বার্থ হতে পারে স্বল্পমেয়াদি, যেমন এখন আমার গান শোনার ইচ্ছা, কিংবা বিকেলে বন্ধুদের সাথে আড্ডা মারার ইচ্ছা বা কাল বিকেলটা বউ বা বান্ধবীকে নিয়ে পার্কে ঘুড়তে যাওয়ার বা সিনেমা দেখার ইচ্ছা। আবার কর্মজীবন (ক্যারিয়ার) দাঁড় করানোর জন্য বছরের পর বছর পড়াশুনা করে যাওয়া একটা দীর্ঘমেয়াদি সেলফ-ইন্টারেস্ট। এ সেলফ-ইন্টারেস্টগুলোই মূলত আমাদের জীবনকে চালিত করে। মানুষের প্রতিটি স্বতঃস্ফূর্ত কর্মপ্রয়াসের মূলে যেহেতু এক-একটা সেলফ-ইন্টারেস্ট কাজ করে, সে ভিত্তিতে মানুষকে আত্মস্বার্থবাদী বা সেলফ-ইন্টারেস্টেড বিবেচনা করা হয় উদারবাদে।

উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, সব আত্মস্বার্থই খারাপ নয়। মানুষ নিজ উদ্যোগ বা স্বেচ্ছায় যেমন অপকর্ম বা দুর্নীতি করে, আবার আত্মসন্তুষ্টির জন্য সে স্বেচ্ছায় নিজ সম্পত্তি দরিদ্রদের মাঝে বিলিয়ে দিতেও পারে। এবং তার সে অপকর্ম বা দুর্নীতি যেমন আত্মস্বার্থ, তার দাতব্যকর্ম তথা আত্মসন্তুষ্টির জন্য নিজ সম্পত্তি জনতার মাঝে বিলিয়ে দেওয়াও আত্মস্বার্থ বিবেচিত। আবার আত্মস্বার্থে সে যখন কর্মজীবন (ক্যারিয়ার) গড়ার জন্য উদ্যমী হয়, তা দেশ ও জাতির জন্য মঙ্গলজনক।

খ) মানুষ প্রজ্ঞাশীল:  উদারবাদের আরেক ভিত্তিমূলক ধারণা হচ্ছে মানুষ ‘প্রজ্ঞাশীল’ (rational) প্রাণী, যার অর্থ মানুষ জীবনের যাবতীয় বিষয়ে যুক্তিতর্ক খাঁটিয়ে বিচার-বিবেচনার মাধ্যমে নিজ নিজ সিদ্ধান্ত নিতে সক্ষম। অবশ্য একইবিষয়ে সবমানুষ একই সিদ্ধান্ত নেয় না। অনেকসময় কোন কোন ব্যক্তি ভুল সিদ্ধান্ত নেয়। তার মানে এমন নয় যে, ওই ব্যক্তি প্রজ্ঞাশীল নয়। সেও প্রজ্ঞাশীল, কেননা তারও আছে বিচার-বিবেচনার ক্ষমতা এবং সে ভ্রান্ত সিদ্ধান্তে পৌঁছেছে বিচার-বিবেচনার মাধ্যমেই, যদিও উক্ত বিষয়ে তার বিচার-বিবেচনা ভ্রান্ত।

গ) মানুষ স্বনির্ভর:  উদারবাদে মানুষের প্রজ্ঞাশীলতা থেকে আসে ব্যক্তির স্বনির্ভরতার ধারণা। প্রজ্ঞাশীল মানুষ জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্র বা বিষয়ে নিজস্ব চিন্তা-ভাবনার মাধ্যমে নিজ-নিজ সিদ্ধান্ত নিতে সক্ষম। কাজেই সে স্বাধীনভাবে নিজ জীবন পরিচালনায় সক্ষম, অর্থাৎ সে স্বনির্ভর (autonomous)। কাজেই উদারবাদে জীবন চালনার জন্য মানুষের প্রয়োজন নেই কোন অলৌকিক বা ঈশ্বর-রচিত জীবন বিধান তথা ধর্মগ্রন্থের, যা মানুষকে অন্ধভাবে অনুসরণ করতে হবে। একইভাবে নিজ জীবন চালনায় অন্য মানুষের মুখাপেক্ষী হওয়ার প্রয়োজনও নেই তার।

ব্যক্তির স্বনির্ভরতার এ ধারনাটি উদারবাদে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, এমনকী উদারবাদ নামটির মাঝে এ ধারনাটির স্পন্দন নিহিত। এবং ব্যক্তির স্বাধীনতা সর্বোচ্চ বর্ধিতকরণ উদারবাদী সমাজ-ব্যবস্থার চূড়ান্ত লক্ষ্য।

 

২) সমাজ/রাষ্ট্র কেন?

মানুষ সামাজিক জীবঃ বলা হয়ে থাকে মানুষ সামাজিক জীব। সে অন্য মানুষের সাথে সম্পর্ক সৃষ্টি করতে চায়। এবং সে কারণেই সামষ্ঠিক সংগঠন, যেমন সমাজ, রাষ্ট্র, সঙ্ঘ-সমিতি ইত্যাদির উৎপত্তি।

তবে মনে রাখতে হবে যে, একজন মানুষ ১০০-২০০ মানুষের সাথে সম্পর্ক গড়তে পারলেই সে সুখী ও সন্তুষ্টিপূর্ণ জীবনযাপন করতে পারে। এবং কোন ব্যক্তির পক্ষে হাজারের অধিক মানুষের সাথে অর্থপূর্ণ সম্পর্ক গড়া সম্ভব নয়। অর্থাৎ জীবনে সুখ ও সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য একজন মানুষের বড়জোর এক হাজার মানুষের সাথে সম্পর্ক গড়াই যথেষ্ট, বাংলাদেশের মত পুরো ১৮ কোটি মানুষের সাথে তার সম্পর্ক গড়ার প্রয়োজন নেই এবং সেটা সম্ভবও নয়।

মানুষ ব্যক্তিগত জীবওঃ  সামাজিক জীব হওয়ার পাশাপাশি মানুষ ব্যক্তিগত জীবও,  কেননা অনেকসময় সে আপন সময় চায়, যখন সে অন্যের উপস্থিতি কামনা করে না; তা তাকে বিরক্ত করে। আবার জীবনের অনেক বিষয়ে সে অন্যের নাক গলানো, এমনকী সম্ভাব্য সাহায্যও কামনা করে না। যতো কঠিনই হোক না কেন, সে নিজেই তার বিহিত করা পছন্দ করে। কাজেই সুষ্ঠু জীবন-যাপনের জন্য ব্যক্তির সামাজিক ও ব্যক্তিগত জীবনের মাঝে ভারসাম্য থাকতে হবে, কিছু কিছু বিষয়ে তাকে গোপনীয়তা চর্চার সুযোগ দিতে হবে।

রাষ্ট্র এক অবাঞ্ছিত প্রয়োজনীয়তা:  উদারবাদে সমাজ বা রাষ্ট্রকে গণ্য করা হয় একটা ‘অবাঞ্ছিত প্রয়োজনীয়তা’ (necessary evil) হিসেবে। কেননা মানুষ যেহেতু স্বনির্ভর তথা সে নিজেই নিজ জীবন পরিচালনায় সক্ষম, সুযোগ দিলে মানুষ রাষ্ট্রকে ট্যাক্স দেওয়া, আইনের কাছে জবাবদিহি করা ইত্যাদি ঝামেলা থেকে অব্যাহতি পেতে চাইবে; এসবে সে জড়াতে চাইবে না। এবং পৃথিবীতে বহু মানুষ আছে, যারা ব্যক্তিগতভাবে ন্যায় পথে চলে। সব মানুষ তাদের মতো চললে পুলিস, কোর্ট-কাচারী ইত্যাদির কোনই প্রয়োজন পড়বে না। কিন্তু সব মানুষ এক নয়। আগেই বলা হয়েছে যে, প্রবৃত্তিগত কারণে কিছু মানুষ অন্যায় কর্মে লিপ্ত হয়, এবং সে কারণেই পুলিস, কোর্ট-কাচারীর প্রয়োজন। কিছু লোক অপকর্মে লিপ্ত হয় বিধায় রাষ্ট্রের সবাইকে পুলিস, কোর্ট-কাচারী ইত্যাদি প্রতিষ্ঠার দায়ভার গ্রহণ করতে হয়। ভাল-মন্দ মিলিয়েই মানুষ – এটা অস্বীকার করার উপায় নেই। আবার কেউ শুধুই ভাল আর কেউ শুধুই মন্দ – এমন কোন বাধ্যবাধকতাও নেই। আজ যে ভাল মানুষ কাল সে মন্দ কাজে লিপ্ত হতে পারে এবং আজকের মন্দ মানুষ একদিন মহৎ ব্যক্তি হয়ে উঠতেও পারে। কাজেই আমাদের সুখ-শান্তিকে বর্ধিত করতে চাইলে, আমাদের জীবন চালনায় বাধা-বিঘ্ন হ্রাস করতে চাইলে, আইনি ব্যবস্থা জরুরী। এ বাস্তবতার প্রেক্ষাপটেই মানব প্রজাতি সৃষ্টি করেছে যাবতীয় সামষ্ঠিক প্রতিষ্ঠান, যেমন সমাজ, রাষ্ট্র, আইনিব্যবস্থা ইত্যাদি। আমরা এসবে জড়াতে চাই না, অথচ সেগুলো আমাদের জীবনযাত্রাকে সহজ, সুগম ও নিরাপদ করে তোলার জন্য সহায়ক – যা আমাদের সুখ-শান্তি ও সমৃদ্ধি বর্ধিতকরণের জন্য প্রয়োজনীয়।

এক কথায়, মানুষের স্বনির্ভর (অটোনোমাস) প্রকৃতি সামষ্ঠিক প্রতিষ্ঠানে জড়ানোর পরিপন্থী, তথাপি সে সমাজ ও রাষ্ট্র ব্যবস্থায় জড়ায় ব্যক্তিগতভাবে লাভবান হওয়ার আশায়। সমাজ ও রাষ্ট্র ব্যক্তির সুখ ও সমৃদ্ধি বর্ধিত করতে সহায়ক হবে এরূপ প্রত্যাশায় সে এসব প্রতিষ্ঠানের অংশ হয়। এখানেও আমরা দেখছি যে, ব্যক্তির আত্মস্বার্থ বড় হয়ে উঠছে। আত্মস্বার্থ বর্ধিত হবে সে প্রত্যাশাতেই ব্যক্তি মানুষ সমাজ, সমিতি, রাষ্ট্র ইত্যাদি সামষ্ঠিক প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলে।

উদারবাদে রাষ্ট্রের উদ্দেশ্যকে সে দৃষ্টিতেই দেখা হয়। উদারবাদী রাষ্ট্রীয় সংবিধানের সর্বপ্রথম প্রবক্তা হিসেবে গণ্য করা হয় দার্শনিক স্পিনোজাকে (১৬৩২-৭৭)। রাষ্ট্র ও ব্যক্তির মধ্যকার সম্পর্কের ব্যাপারে স্পিনোজা বলেন –

“সরকারের পরম উদ্দেশ্য শাসন করা বা ভীতি প্রদর্শনের মাধ্যমে দমন করা নয়, না আনুগত্য আদায় করা, বরং প্রত্যেক ব্যক্তিকে ভীতি থেকে মুক্ত করা যাতে সে পূর্ণ নিরাপত্তা সহকারে চলতে পারে… প্রকৃতপক্ষে সরকারের সত্যিকার লক্ষ্য হবে (ব্যক্তির) স্বাধীনতা নিশ্চিত করা।[4]

সরকারের দায়িত্ব হবে এমন পরিবেশ নিশ্চিত করা যেখানে ব্যক্তি মানুষ নির্বিঘ্নে নিজ নিজ কর্ম-প্রয়াস পরিচালনা করতে পারে এবং বিঘ্নহীনভাবে মতামত ও আকাঙ্ক্ষা প্রকাশ করতে পারে। অনুরূপভাবে রাষ্ট্র বা সরকারের দায়িত্ব সম্পর্কে আইনস্টাইনের মতঃ “কোন রাজনৈতিক সংগঠনের অস্তিত্বের একমাত্র সংগত উদ্দেশ্য হবে ব্যক্তির বাধাবিঘ্নহীন অভিব্যক্তি নিশ্চিত করা।”

উদারবাদ যেহেতু ব্যক্তিকে স্বাধীন বা স্বশাসিত সত্তা বিবেচনা করে, কাজেই স্বশাসিত একটি সত্তার ওপর আরেকটি সত্তার (যেমন রাষ্ট্র বা সমাজ) অতিরিক্ত নিয়ন্ত্রণ চাপানো অযৌক্তিক। ফলে উদারবাদী রাষ্ট্র ব্যক্তির ওপর যতোটা সম্ভব কম প্রভাব খাঁটাবে, অর্থাৎ রাষ্ট্র বা সমাজ ব্যক্তিকে তার জীবন চলায় সর্বাধিক স্বাধীনতা দিবে যতোক্ষণ-না এক ব্যক্তির স্বাধীনতা চর্চা আরেক ব্যক্তির ক্ষতি করে বা তার স্বাধীনতা চর্চাকে ব্যাহত করে। এবং উদারবাদী সমাজের প্রায় দুই শতাধিক বছরের ইতিহাস পর্যবেক্ষণ করলে দেখা যাবে যে, সে সমাজগুলো ব্যক্তির স্বাধীনতা ক্রমেই বর্ধিত করার চেষ্টা করে গেছে ও যাচ্ছে।

স্বাধীনতা ছাড়াও ব্যক্তির অধিকার (মানবাধিকার), সবার জন্য সমান সুযোগ, চিন্তাচেতনার প্রকাশের স্বাধীনতা, এবং বাধাহীনভাবে চিন্তা-ভাবনার বিনিময় নিশ্চিত করা রাষ্ট্রের কাছে উদারবাদের কিছু মৌলিক দাবী।

৩) ব্যক্তি বড় না রাষ্ট্র বড়? আইনস্টাইন বলেছেন, “রাষ্ট্র মানুষের জন্য, মানুষ রাষ্ট্রের জন্য নয়”। তার মানে – রাষ্ট্রের চেয়ে মানুষ (ব্যক্তি) বড়। উদারবাদে রাষ্ট্র মানুষের জন্য সেবাদানকারী দাস সমতূল্য। রাষ্ট্রের দায়িত্ব ব্যক্তি-মানুষের চাওয়া-পাওয়া পুর্তির পথকে সুগম করা। অপরদিকে, রাষ্ট্রের নিজস্ব কোন চাওয়া-পাওয়া নেই, এবং মানুষ রাষ্ট্র বা সমাজের মঙ্গল সাধনের জন্য দায়বদ্ধ নয়।

ইসলাম ও মার্ক্সবাদে প্রভাবিত আমাদের বাঙালি চিন্তা-চেতনায় ব্যক্তিকে সমাজ বা রাষ্ট্রের চেয়েও বড় বিবেচনা করার মত উদ্ভট ধারণা যেন আর কিছুই হতে পারে না। সমাজের চেয়ে ব্যক্তি আবার বড় হয় কীভাবে? আমাদের সমাজে ব্যক্তির কোন কর্মের মূল্যায়ন বা বৈধতার বিচার হয় তা সমাজের মঙ্গলজনক কীনা সেই বিচারে, তা উক্ত ব্যক্তির জন্য মঙ্গলজনক বা আত্মতুষ্টিপূর্ণ কীনা সেটা বিবেচ্য নয় বা হলেও তা গৌণ। আমরা দেখি, কেউ একটু ভিন্ন ধাচের কোনকিছু করলেই ধার্মিক ইসলামি ও মার্ক্সবাদীরা প্রায়শঃ শোরগোল তোলে যে, সে সমাজ বা রাষ্ট্রবিরোধী কাজ করেছে। এবং সমাজ বা রাষ্ট্র যেহেতু আমাদের কাছে সবচেয়ে বড়, কাজেই এমন অপরাধ মারাত্মক বিবেচিত এবং এর শাস্তিও হতে হবে সর্বোচ্চ কঠোর ও দৃষ্টান্তমূলক।

‘ব্যক্তি বড় না সমাজ (রাষ্ট্র) বড়’ প্রশ্নটিকে একটি উদাহরণের মাধ্যমে ব্যাখ্যা করা যাক। মানুষ কম্পিউটার, রোবট ইত্যাদি উদ্ভাবন করে। কেন করে? মানুষের জীবনযাত্রাকে সহজতর, সুখতর ও সমৃদ্ধতর করতে তা চাকরের মত কাজ করে যাবে সে উদ্দেশ্যে। রাষ্ট্রও ঠিক তেমনি মানুষের উদ্ভাবিত একটা কিছু, তা যত ভিন্নই হোক। মানুষ না থাকলে যেমন কম্পিউটার, রোবট ইত্যাদির উদ্ভাবন হবে না, একইভাবে মানুষ না থাকলে সমাজ, রাষ্ট্র বা অন্য যে কোন সামষ্ঠিক সংগঠনের অস্তিত্ব অসম্ভব। কাজেই কম্পিউটার-রোবটের মতই রাষ্ট্রের দায়িত্বও হবে মানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষা পুর্তির পথকে, সুখ-শান্তি বৃদ্ধির পথকে সুগম করা মাত্র। রাষ্ট্রের নিজস্ব কোন চাওয়া-পাওয়া নেই। রাষ্ট্রের যেহেতু কোন প্রাকৃতিক (নিজস্ব) অস্তিত্ব নেই এবং ব্যক্তি-মানুষের সমষ্টিই রাষ্ট্র, কাজেই ব্যক্তিই সেখানে মৌলিক, ব্যক্তিই বড়। রাষ্ট্র ব্যক্তির চেয়ে বড় বিবেচিত হতে পারে না কোন যুক্তিতেই।

অর্থাৎ ব্যক্তির কল্যাণ সাধনের উদ্দেশ্যেই রাষ্ট্র। এবং ব্যক্তি জীবনে কী চায়? ব্যক্তি চায় তার নিজ ইচ্ছা ও চাওয়া-পাওয়া অনুসারে জীবনকে চালনা করতে। তা করতে পারলেই সে সুখী হবে। রাষ্ট্রের দায়িত্ব হবে সে পথকে যতটা-সম্ভব সুগম করামাত্র। অন্য কথায়, রাষ্ট্র ব্যক্তির ইচ্ছেমত জীবন চলার, ব্যক্তির নিজ নিজ কর্মকাণ্ড পরিচালনার পথকে সুগম করবেমাত্র। মোটকথা – রাষ্ট্র ব্যক্তির জীবনচলায় সর্বাধিক স্বাধীনতা নিশ্চিতকরণের প্রয়াস চালাবে মাত্র – যতোক্ষণ-না এক ব্যক্তির স্বাধীনতা চর্চা আরেক ব্যক্তির জীবন চলায় ব্যাঘাত ঘটায়।

 

৪) রাষ্ট্রের দায়িত্বঃ

উদারবাদী রাষ্ট্রের প্রাথমিক দায়দায়িত্বগুলোর মধ্যে রয়েছে (১) ব্যক্তির নিরাপত্তা নিশ্চিত করা, (২) ব্যক্তির স্বাধীনতা বর্ধিত করা, (৩) ব্যক্তির মৌলিক অধিকার বা মানবাধিকার নিশ্চিত করা, (৪) সবার জন্য সমান সুযোগ সৃষ্টি করা, (৫) ব্যক্তির চিন্তা-ভাবনার স্বাধীনতা ও নির্বিঘ্নে মতামত প্রকাশের অধিকার প্রতিষ্ঠা, এবং (৬) বিঘ্নহীনভাবে ব্যক্তির চিন্তা-ভাবনা বিনিময়ের পরিবেশ সৃষ্টি করা, ইত্যাদি।

মত প্রকাশের অধিকার ও ‘চিন্তাভাবনার বাজার’: রাষ্ট্রের উপরোক্ত দায়িত্বগুলোর প্রথম ৪টির মর্মাথ ও গুরুত্ব আমরা সহজেই অনুধাবন করতে পারি। তবে আমাদের ইসলামী-মার্ক্সবাদী ভাবধারার বাঙালী সমাজে – যেখানে রাষ্ট্রই সর্বেসর্বা, ব্যক্তির গুরুত্ব গৌণ – সেখানে সকল ব্যক্তির বা সাধারণ মানুষের মত প্রকাশের গুরুত্ব নেই বা তার গুরুত্ব তেমন অনুধাবিত নয়। কোরান-হাদিসের-শরীয়তের পূর্ণাঙ্গ ও নিখুঁত বিধান অনুসারে একজন সর্বেসরা নবী বা খলিফার ইচ্ছে অনুযায়ী, কিংবা মার্ক্সবাদ অনুসারে রাষ্ট্রযন্ত্রের উচ্চপদে অধিষ্ঠিত উচ্চতর চিন্তাভাবনার ব্যক্তি বা ব্যক্তিবর্গ, যেমন মাও, লেলিন, স্ট্যালিন, ক্যাস্ট্রোর ইচ্ছে অনুসারে দেশ চলবে এবং তাতেই দেশ ও জাতির সর্বোচ্চ কল্যাণ সাধিত হবে। সেখানে যদু, মধু, ফ্যালানিসহ সকল নাগরিকের মতামত প্রকাশের বা মতামত দানের কী দরকার আছে? তা রাষ্ট্রের নির্ঝঞ্জাট পরিচালনায় বরং বিঘ্নই সৃষ্টি করবে।

উল্লেখ্য, বাংলাদেশের মার্ক্সবাদীরা দাবী করতে পারে যে, বাকস্বাধীনতার অধিকারের প্রশ্নে বাংলাদেশে তারাই সবচেয়ে বেশী সোচ্চার, সরকারের সমালোচনায় তারাই সর্বাধিক মুখর। তাদের এ দাবী একেবারেই যথার্থ – বাংলাদেশ-সহ সব গণতান্ত্রিক দেশগুলোতে তারাই মত প্রকাশের অধিকারের ব্যাপারে সর্বোচ্চ সোচ্চার। সেই সাথে তারাই আবার সর্বোচ্চ বর্বরতার সাথে নাগরিকদের মত প্রকাশের অধিকার দমনকারী মাও, স্ট্যালিন, ক্যাস্ট্রোর ও কিমদের মত রাষ্ট্রনায়কদের সবচেয়ে নিবেদিতপ্রাণ ও শক্ত সমর্থক।

মত প্রকাশের অধিকার রাষ্ট্রের প্রত্যেক নাগরিকের মৌলিক অধিকার হিসেবে প্রতিষ্ঠালাভ পাশ্চাত্যের উদারবাদী সমাজের এক বিশেষ অর্জন, যার সূচনা ঘটে ১৭৮৯ সালে বিপ্লবোত্তর ফরাসী সংবিধান প্রনয়নের মাধ্যমে, যা ২ বছর পর আমেরিকান সংবিধানে ও ক্রমান্বয়ে উদার-গণতন্ত্রে উত্তরণের সাথে বাকী পাশ্চাত্য দেশগুলোর সংবিধানেও গৃহীত হয়। উদারপন্থী সমাজে সকলের মতামত প্রকাশের অধিকারের মাঝে দু’টো গুরুত্বপূর্ণ বিষয় বা ভাবনা বিদ্যমান। প্রথমত, উদারবাদে প্রত্যেক ব্যক্তিকে সমান সম্ভাবনার অধিকারী মনে করা হয়, এবং প্রত্যেক ব্যক্তিই জাতীয় অগ্রগতি ও কল্যাণে ভূমিকা রাখার দাবিদার। মতামত প্রকাশ বা বাক-স্বাধীনতাকে মৌলিক নাগরিক অধিকার হিসেবে প্রতিষ্ঠা প্রত্যেক ব্যক্তিকে আত্মমর্যাদা সম্পন্ন ও গুরুত্বপূর্ণ বিবেচিত হওয়ার সুযোগও সৃষ্টি করে। যখন রাষ্ট্রের একজন মাত্র মহানায়ক ও তার পছন্দমত গুরুত্বপূর্ণ পদে বসানো অল্পসংখ্যক লোকের মতামতে দেশ চলে এবং বাকী সবার গলা চেপে ধরা হয়, সেখানে সেই অল্পসংখ্যক উচ্চপদস্থ ব্যক্তিই গুরুত্বপূর্ণ ও আত্মমর্যাদার দাবিদার, বাকীদের না থাকে গুরুত্ব না আত্মমর্যাদা – বড়জোর তারা গদিধারীদের উদ্দেশ্য হাসিলের জন্য উৎপাদনের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহৃত হয় মাত্র।

মতামত প্রকাশ ও বিনিময়ের অধিকার আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে উদারবাদী সমাজে।  তা হচ্ছে, সেখানে নানান বিষয়ে বহুবিধ মতামত উপস্থাপিত হয়, যা এক ‘চিন্তাভাবনার বাজার’ (Marketplace of ideas) সৃষ্টি করে, এবং উপস্থাপিত বহুবিধ মতামতগুলোকে যুক্তিতর্কের ভিত্তিতে যাচাই-বাছাই করে নীতি নির্ধারণ করলেই জাতির জন্য সর্বোচ্চ কল্যাণ ও সন্তুষ্টি অর্জিত হতে পারে বলে মনে করে উদারবাদ।

 

৫) সামাজিক প্রগতিশীলতা (Social Progressivism):

উদারবাদ ‘সামাজিক প্রগতির’ উপর বিশেষ জোর দেয়, যার মূলে রয়েছে এ ধারণা যে, সামাজিক সংস্কার, রীতি-প্রথা, আইন-কানুন, নৈতিকতা ইত্যাদির কোন অভ্যন্তরীণ ও ধ্রুব বা চিরন্তন মূল্য নেই এবং অব্যাহতভাবে সেগুলোর পরিবর্তন, সংস্কার ও সমন্বয় ঘটাতে হবে মানুষের অধিকতর মঙ্গল ও প্রগতির স্বার্থে। এখানে উদারবাদী রাষ্ট্রব্যবস্থা মার্ক্সবাদী সমাজতান্ত্রিক ও ধর্মভিত্তিক রাষ্ট্রব্যবস্থা থেকে ভিন্ন। কেননা সেগুলো হলো চূড়ান্ত ব্যবস্থা, অথচ উদারবাদী সমাজ সর্বদা সংস্কার ও পরিবর্তনের জন্য উন্মুক্ত। আমাদের সমাজে কেউ প্রচলিত রীতিনীতির পরিপন্থী কিছু করলেই যেন আমাদের মাথায় বাজ পড়ে। কিন্তু উদারবাদী সমাজে প্রথা ভাঙ্গা কোন অন্যায় নয় যতোক্ষণ-না তা অন্যে ক্ষতির কারণ হয়, বরং সেখানে প্রথাভঙ্গন অনেকাংশে প্রত্যাশিত, কেননা তা প্রগতি ও অগ্রগতির পথকে সুগম করে।

 

৬) রাজনৈতিক ব্যবস্থা

আগেই বলা হয়েছে উদারবাদে ব্যক্তি স্বনির্ভর বা স্বশাসিত সত্তা হিসেবে গণ্য, অর্থাৎ প্রত্যেক ব্যক্তি পর্যাপ্ত বুদ্ধিমত্তা, প্রজ্ঞাশীল ও নৈতিকতাবোধ সম্পন্ন হিসেবে গণ্য এবং সে নিজ উদ্যোগে সুষ্ঠু জীবন চালনার সামর্থ্য রাখে। তার জীবন চালনায় অন্যের সহায়তা আবশ্যক নয়। কাজেই উদারবাদী রাজনৈতিক ব্যবস্থাও এমন হবে যেখানে প্রত্যেক ব্যক্তির এ মৌলিক সামর্থ্য প্রতিফলিত হয়। এবং সেটা কেবলই সম্ভব সকল নাগরিকের অংশগ্রহণমূলক গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায়। উদারবাদের মৌলিক তত্ত্ব ব্যক্তি স্বাত্যন্ত্রবাদের মূলে ধ্বনিত ভাবনাটি হচ্ছে ‘আমার জীবন আমার, তোমার জীবন তোমার’। কাজেই আমার (বা তোমার) জীবন কীভাবে চালিত হবে তাতে আমার (বা তোমার) পছন্দ প্রতিফলিত হওয়া উচিত। ফলে জনগণ নির্বাচিত গণপ্রতিনিধিমূলক গণতন্ত্র উদারবাদে চয়তকৃত রাজনৈতিক ব্যবস্থা, যেখানে যে প্রতিনিধি বেশিরভাগ নাগরিকের প্রত্যাশাকে বাস্তবায়িত করার প্রতিজ্ঞা করবে, সে গণভোটে নির্বাচিত হবে। এবং উদারবাদী রাষ্ট্র পরিচালিত হবে জনগণের চয়নকৃত একগুচ্ছ আইন তথা একটি সংবিধান দ্বারা। উদারবাদে পূর্ব-নির্ধারিত আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার পাশাপাশি রাষ্ট্র বা রাষ্ট্রনায়কগণ একটি স্বচ্ছ ব্যবস্থাপনাও প্রতিষ্ঠা করবে এবং সীমিত ক্ষমতা চর্চা করবে। উদারবাদের আবির্ভাবে সুপ্রতিষ্ঠিত পূর্ববর্তী শাসনব্যবস্থা, যেমন রাজার স্বর্গীয় শাসনাধিকার, বংশানুক্রমিক রাজতন্ত্র, রাষ্ট্র চালনায় ধর্মের ভূমিকা ইত্যাদি দূরীভূত হয়।

 

৭) অর্থনীতি

একটা রাষ্ট্রের অর্থনৈতিক ব্যবস্থা কী হবে তা নির্ণয় করার জন্য আমাদেরকে দু’টো বিষয় বিবেচনা করতে হবে – (ক) অর্থনৈতিক নীতির মৌলিক উদ্দেশ্য কী? এবং (খ) সে উদ্দেশ্য অর্জনের উৎকৃষ্ট উপায় কী?

সে আলোচনায় যাওয়ার আগে তলিয়ে দেখা দরকার মানুষের জীবনে অর্থনৈতিক আত্মস্বার্থের গুরুত্ব কতটুকু। আগেই বলা হয়েছে যে, মানুষের জীবনের দৈনন্দিন ও দীর্ঘমেয়াদি কর্মকাণ্ড চালিত হয় কিছু আত্মস্বার্থ দ্বারা – যেগুলো সম্পন্ন করার মাধ্যমে প্রত্যেক ব্যক্তি সন্তুষ্টি, সুখ ও সমৃদ্ধি অর্জন করতে চায়। একজন নিঃধার্মিকের জীবনের উদ্দেশ্য ও চাওয়া-পাওয়া সে আত্মস্বার্থগুলো পূর্তির মাঝেই নিহিত। ব্যক্তির আত্মস্বার্থগুলোর মাঝে অর্থনৈতিক আত্মস্বার্থ হচ্ছে সবচেয়ে বড়। অর্থনৈতিক আত্মস্বার্থ পূর্তির জন্য একজন ব্যক্তি তার শিক্ষাজীবন থেকে শুরু করে কর্মজীবনভর যে কী পরিমাণ প্রয়াস ও পরিশ্রম চালায়, তাই প্রমাণ করে অর্থনৈতিক আত্মস্বার্থই ব্যক্তির জীবনের সর্বোচ্চ গুরুত্বপূর্ণ আত্মস্বার্থ। সম্প্রতি আমরা দেখেছি যে, এশিয়া ও আফ্রিকার অনেক দেশের অপেক্ষাকৃত স্বচ্ছল পরিবারের যুবকেরা প্রধানত অধিকতর অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির প্রত্যাশায় জীবন ঝুঁকি নিয়েও ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিতে গিয়ে নৌকাডুবিতে মারা যাচ্ছে।

ক) অর্থনৈতিক নীতির উদ্দেশ্য কী?  ইতোমধ্যে আমরা দেখেছি যে, মূল ইসলামি অর্থনীতির লক্ষ্য হচ্ছে মুসলিমরা অমুসলিমদেরকে চুষে খাবে। সেটা কেবল অন্যায়ই নয়, সে অর্থনীতির চর্চা করে আজকের বিশাল মুসলিম জনগোষ্ঠির ভরণপোষণ অসম্ভব, বিশেষ করে বাংলাদেশের মত মুসলিম প্রাধান্যের দেশগুলোতে। অন্যদিকে মার্ক্সের সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতির বড় লক্ষ্যগুলো হলোঃ

•    সম্পদের পুনর্বণ্টন, অর্থাৎ ধনীদের কাছ থেকে নিয়ে গরীবদের মাঝে ভাগ করে দেওয়া।

•    ব্যক্তি-মালিকানা উৎখাত করা।

•    কেনাবেচার জন্য পণ্য ও মুদ্রা বিলুপ্ত করা।

•    ব্যক্তি রাষ্ট্রের জন্য সামর্থ্য অনুসারে কাজ করবে এবং প্রয়োজন অনুসারে রাষ্ট্র থেকে নেবে।[5]

মার্ক্স এটাও বলেছেন যে, অর্থনৈতিক আত্মস্বার্থ কেবল কোনমতে পেট বাঁচানোর মধ্যে সীমাবদ্ধ এবং সে জন্যে মানুষকে যতটা সম্ভব কমসময় ও প্রয়াস ব্যয় করতে হবে। মার্ক্সের মতে মানুষের জীবনের সবচেয়ে বড় উদ্দেশ্য হবে মননশীলতা চর্চা, কেননা মানুষ মননশীল জীব। অন্যকথায়, মানুষ কোনমতে তার পেটের চাহিদা মিটিয়ে বাকী সময় ও প্রয়াস নিয়োগ করবে কেবলই নিজ আত্মতুষ্টির জন্য মননশীলতার চর্চায়।

কথা হচ্ছে – মার্ক্সের এ অনুসিদ্ধান্ত মানুষের মৌলিক প্রবৃত্তির সাথে কতোটা সামঞ্জস্যতাপূর্ণ?

এটা স্পষ্ট যে, মার্ক্সের অর্থনৈতিক তত্ত্ব ব্যক্তির অর্থনৈতিক আত্মস্বার্থকে খুবই গৌণ করে দেখেছে, বলা যায় একেবারে পদদলিত করেছে। মানুষের জীবনাচারকে মনোযোগ সহকারে পর্যবেক্ষণ ও বিবেচনা করলে আমরা সহজেই নিশ্চিত হতে পারি যে, মার্ক্সের অর্থনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি খুব কম মানুষই ধারণ করে। হাজারে একজন কিংবা বড়জোর শতকরা একজন মানুষ (যেমন ভারতের জঙ্গলে বসবাসকারী সন্ন্যাসীগণ) তার পেটের চাহিদা কোনমতে মিটে গেলেই সন্তুষ্ট হবে এবং নিজেকে মননশীল কর্মে আত্ম-নিয়োগ করবে। মননশীল কর্ম, গবেষণা ইত্যাদিতে আগ্রহ খুবই কম মানুষের। বেশিরভাগ মানুষ কোনমতে পেটের চাহিদা মিটে গেলেই সন্তুষ্ট হয় না, বরং চায় যতোটা-সম্ভব স্বচ্ছল ও সমৃদ্ধ জীবন অর্জন করতে। মানুষের এ স্বভাবজাত প্রবৃত্তির সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ অর্থনৈতিক পরিবেশ সৃষ্টি করা সুখী ও সন্তুষ্টিপূর্ণ সমাজ বিনির্মাণের জন্য অপরিহার্য, কেননা স্বভাবসিদ্ধভাবে মানুষ যা অর্জন করতে চায়, তা করতে না পারলে সে সুখী অনুভব করে না।

পূঁজিবাদী অর্থনীতি:  আগেই বলা হয়েছে, পূঁজিবাদ একটি অর্থনৈতিক তত্ত্ব মাত্র, যার প্রাথমিক লক্ষ্য হচ্ছে সম্পদের প্রবৃদ্ধি তথা সম্পদের পরিমাণ বাড়ানো। পূঁজিবাদের আবির্ভাবের পূর্বে ধারণা ছিল যে, বিশ্বে সম্পদের পরিমাণ মোটামুটি স্থির এবং কারও ধনী হওয়ার একমাত্র উপায় হচ্ছে অন্যকে লুটপাট বা শোষণ করা। সে কারণেই আমরা দেখেছি – পূঁজিবাদী আধুনিক যুগের আবির্ভাবের আগে কোন রাজা বা শাসক শক্তিশালী হলেই সে অন্য রাজা বা ভূখণ্ডকে আক্রমণ ও দখল করে লুট ও শোষণের চেষ্টা করেছে। অথবা নিজ মাল অন্যের কাছে বিক্রির চেষ্টা করেছে কিন্তু অন্যের মাল কিনতে চায় নি। সেটাই সম্পদ পূঞ্জীভূত করার বা অধিক ধনবাদ হওয়ার একমাত্র উপায় ছিল বলে ধারণা করা হত। সে অর্থনৈতিক নীতিকে বলা হতো Mercantilism। মার্ক্সবাদী অর্থনীতি সে ধারণাকে কিছু অংশে ধারণ করে ধনীদের সম্পদ কেড়ে নিয়ে দরিদ্রদের মাঝে পুনর্বণ্টনের মাধ্যমে।

কিন্তু পূঁজিবাদী অর্থনীতির প্রবক্তারা (David Hume, Adam Smith and David Richardo) বললেন যে, না, অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের মৌলিক লক্ষ্য হবে অন্যের সম্পদ লুটপাট না অন্যকে শোষণ করা নয়, বরং সম্পদের প্রবৃদ্ধি। অন্য কথায়, সঠিক অর্থনৈতিক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে সম্পদের প্রবৃদ্ধি অর্জন সম্ভব লুট বা শোষণ না করেও। সঠিক অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড যেহেতু সম্পদের প্রবৃদ্ধি ঘটাতে সক্ষম, কাজেই সেরূপ অর্থনীতিতে কেউ বিনিয়োগ করলে, তার মূলধন (পুঁজি বা ক্যাপিটল)-এর প্রবৃদ্ধি ঘটাও সম্ভব। এটাই পূঁজিবাদী (ক্যাপিটালিস্ট) অর্থনীতির মূলমন্ত্র – যে আমার ধনী হওয়ার জন্য অন্যকে লুটপাট বা শোষণের প্রয়োজন নেই। এবং তাঁরা নিঃসন্দেহে সঠিক ছিলেন। সিংগাপুরের কথা ধরা যাক। দেশটি বাংলাদেশের মতোই ব্রিটিশদের দ্বারা শোষিত হয়েছে আরও এক যুগ অধিককাল। এবং বাংলাদেশের যথেষ্ট প্রাকৃতিক সম্পদ থাকলেও সিংগাপুরের তা নাই বললেই চলে – না খনিজ তেল না সোনা-রূপা, এমনকি সিংগাপুরের মাটিও তেমন উর্বর ও চাষবাসযোগ্য নয়, না আছে দেশটির অন্য দেশকে লুটপাট করে খাওয়ার শক্তি। সিংগাপুরে জনসংখ্যার চাপও বাংলাদেশের তুলনায় অনেক বেশী। অথচ আজ সিংগাপুরের মাথাপীছু আয় পশ্চিম ইউরোপের দেশগুলোর গড় মাথাপীছু আয়েরও বেশী। একইভাবে, ব্রিটিশরা হংকংকে শোষণ করেছে বাংলাদেশ ত্যাগের পর আরও ৫০ বছর, ১৯৯৭ সাল পর্যন্ত। এবং ব্রিটিশদের হংকং ত্যাগের পূর্বে দেশটির অর্থনীতি সিঙ্গাপুরের চেয়েও কিছুটা ভাল ছিল এবং ব্রিটিশদের চলে যাওয়ার পর সিঙ্গাপুরের চেয়ে পিছিয়ে গেছে।

সিঙ্গাপুরের অর্থনৈতিক নীতির মৌলিক লক্ষ্য হচ্ছে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড ও ব্যবসা-বাণিজ্যের পথ সুগম করা। সিঙ্গাপুর সরকার নানান কৌশল ও প্রলোভন সৃষ্টি করছে বিদেশী ব্যবসা-প্রতিষ্ঠানগুলোকে সিঙ্গাপুরে তাদের ব্যবসা খোলানোর জন্য রাজী করাতে। সিঙ্গাপুরের অর্থনৈতিক সফলতার চাবিকাঠি আর কিছু নয়। ঢাকা শহরের মত একটা শহর-রাষ্ট্র সিঙ্গাপুরে শুধু আমেরিকার-ই ৩৭০০ কোম্পানি তাদের ব্যবসায়িক কর্মকাণ্ড চালাচ্ছে। অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড ও ব্যবসা-বাণিজ্যকে সচল ও প্রাণবন্ত রাখতে পারলেই সম্পদের প্রবৃদ্ধি ঘটবে এবং সম্পদের প্রবৃদ্ধি ঘটলেই দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ঘটবে এবং দেশের সমৃদ্ধি বর্ধিত হবে।

এবং অর্থনৈতিক বলয়ে উদারবাদ পূঁজিবাদী অর্থনৈতিক ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে, কেননা তা অন্যের সম্পদ হরণ বা অন্যকে একমুখীভাবে শোষণ না করেও জনগণের কল্যাণ ও সমৃদ্ধি বর্ধিতকরণে সহায়ক অর্থনৈতিক ব্যবস্থা। দ্বিতীয়তঃ উদারবাদ চায় ব্যক্তির স্বাধীনতা ও আত্মস্বার্থের পথকে সুগম করতে। অর্থনৈতিক আত্মস্বার্থ যেহেতু মানুষের সবচেয়ে বড় আত্মস্বার্থ, তা পূর্তির পরিবেশ সৃষ্টি করা রাষ্ট্রের একটি বড় প্রচেষ্টা হওয়া উচিত। এবং উদার পূঁজিবাদী অর্থনৈতিক ব্যবস্থাই প্রত্যেক ব্যক্তির নিজ নিজ অর্থনৈতিক আত্মস্বার্থ অর্জনের জন্য সর্বাধিক সহায়ক ব্যবস্থা।

উদারবাদী চিন্তাধারার একটা বিশেষ দিক হলো, মানুষ যেহেতু স্বভাবসিদ্ধভাবে আত্মস্বার্থবাদী – সে আত্মস্বার্থবাদিতাকে সার্বিকভাবে লাভজনক ফলাফল অর্জনে কাজে লাগানোর চেষ্টা। বলা যায়, মানুষ আত্মস্বার্থবাদী বলেই মানব সমাজ উত্তরোত্তর সমৃদ্ধির পথে ধাবিত হতে পেরেছে। মানুষ যদি আত্মস্বার্থবাদী না হতো, অথবা তাকে যদি নিজ নিজ আত্মস্বার্থ অর্জনের সুযোগ দেওয়া না হয়, তাহলে সে স্বেচ্ছায় কোন কিছুই করতে চাইবে না, যেমন অধিক অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি অর্জনের জন্য কঠিন পরিশ্রম করার স্পৃহা পাবে না। আর সম্পদের প্রবৃদ্ধি বিনা পৃথিবী এতোটা সমৃদ্ধ, সহজ ও সুন্দর হতে পারতো না।

উদারবাদ চৌকস বুদ্ধিমানের মত ব্যক্তির আত্মস্বার্থ পূর্তির সুযোগ সৃষ্টি করেছে। তবে ব্যক্তিকে তা পূরণ করতে হবে সঠিক উপায়ে, বিশেষত অন্যের আত্মস্বার্থ অর্জনের প্রচেষ্টা বা পথকে ব্যাহত না করে। উদারবাদের এ মৌলিক ভাবনাটি ধ্বনিত হয়েছে বহুল পরিচিত তাত্ত্বিক প্রবাদ ‘Live and let live’-এ, যার অর্থ ‘তুমি তোমার মত চলো এবং অন্যকে অন্যের মত চলতে দাও’। মানুষ যেহেতু আত্মস্বার্থের জন্য পরিশ্রম করতে রাজী, করুক সে পরিশ্রম এবং ভোগ করুক তার ফলও, তবে সৎ উপায়ে। এটাই উদারবাদী অর্থনীতির চাবিকাঠি।

উদার পূঁজিবাদী সমাজ ব্যবস্থা অর্থনৈতিক বলয়ে প্রতিযোগিতার পরিবেশ সৃষ্টি করে এবং প্রতিযোগিতা হচ্ছে উৎকর্ষ অর্জনের একমাত্র উপায়। সেখানে রাষ্ট্রের ভূমিকা হচ্ছে সুষ্ঠু প্রতিযোগিতার পরিবেশ সৃষ্টি ও বলবত রাখামাত্র। কেবল সুষ্ঠু প্রতিযোগিতার শর্ত বা নিয়ম ভঙ্গ হলে রাষ্ট্র হস্তক্ষেপ করবে।

উদারবাদীরা চায় রাজারে উন্মুক্ত প্রতিযোগিতা যেখানে আত্মস্বার্থবাদী প্রত্যেক ব্যক্তি নিজ নিজ অর্থনৈতিক লক্ষ্য অর্জনের জন্য পরিশ্রম করবে নিজেরই ভালর জন্যে। ফলে ব্যক্তিগত উদ্যোগেই বাজারে প্রতিযোগিতা সৃষ্টি হবে, যা উৎপাদনে উৎকর্ষ অর্জনে সাহায্য করবে। এভাবে ব্যক্তিপর্যায়ে অর্জিত উৎকর্ষ সামষ্ঠিকভাবে সমাজ বা রাষ্ট্র পর্যায়ে অধিকতর অবদান রাখতে পারে, তথা রাষ্ট্রের উৎপাদনশীলতা বাড়বে। আত্মস্বার্থবাদী ব্যক্তি এভাবে নিজ স্বার্থ অর্জনের মধ্য দিয়েই সমাজ বা রাষ্ট্রের জন্য লাভজনক অবদান রাখবে। কাজেই উদারপন্থীরা পূঁজিবাদ এবং মুক্তবাজার বা মিশ্র অর্থনীতি পক্ষপাতি বা সেগুলোর প্রসার চায়।

 

মার্ক্সবাদী বনাম উদার পূঁজিবাদী অর্থনীতি:

এটা সুস্পষ্ট যে, উৎপাদনের মূল উৎস ব্যক্তি। ব্যক্তির প্রয়াস ও পরিশ্রম থেকেই আসে উৎপাদন। এবং উদার পূঁজিবাদই সৃষ্টি করে উৎপাদনের জন্য স্বেচ্ছায় ব্যক্তির সর্বোচ্চ প্রয়াস ও পরিশ্রমের পরিবেশ, কেননা সেখানে যে যত বেশী প্রয়াস ও পরিশ্রম করবে সে তত বেশী লাভবান হবে। কিন্তু মার্ক্সের সাম্যবাদী(?)[6] অর্থনীতিতে ব্যক্তির কর্মপ্রয়াস ও পরিশ্রমের ফসলের ওপর নিজের কোন হাত নেই। ব্যক্তির প্রয়াসে অর্জিত সম্পদের ওপর কর্তৃত্ব করবে রাষ্ট্র, তথা সর্বেসর্বা রাষ্ট্রনায়ক নির্বাচিত এক বা অল্প সংখ্যক ব্যক্তি। রাষ্ট্রের বা কর্তৃত্বকারীদের কৃপায় সে যা পাবে, তা নিয়েই সন্তুষ্ট থাকতে হবে তাকে। কিন্তু উদারবাদী ব্যবস্থায় ব্যক্তির কর্মপ্রয়াস ও পরিশ্রমের ফসলের ওপর প্রাথমিক কর্তৃত্ব বা নিয়ন্ত্রণ থাকবে ব্যক্তির নিজের। এমনকী কল-কারখানার কর্মজীবিরাও নিজে সিদ্ধান্ত নেবে তারা নিয়োগকর্তা বা মালিকের দেওয়া শর্ত মেনে নেবে কীনা, এবং অধিকতর পছন্দের সুযোগ এলে সে চুক্তিনামার শর্ত অনুযায়ী মালিককে ছাড়তে পারবে। মার্ক্সবাদী সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রে যেখানে উৎপাদিত সম্পদের পুরোটাই রাষ্ট্রনায়কদের হাতে চলে যাবে, উদারবাদে গণপ্রতিনিধিদের স্থিরকৃত আইন অনুযায়ী ব্যক্তি তার নিজস্ব উৎপাদন ও আয়ের অংশবিশেষ রাষ্ট্রকে খাজনা (ট্যাক্স) হিসেবে দেবে, যা সরকার রাষ্ট্রযন্ত্র পরিচালনা (নিরাপত্তা, শিক্ষা ইত্যাদি), জাতীয় উন্নয়ন (রাস্তাঘাট, যোগাযোগ ব্যবস্থা ইত্যাদি) ও সমাজকল্যাণমূলক (বেকার ভাতা, দরিদ্রদের সহায়তা ইত্যাদি) কর্মকাণ্ডে খরচ করবে।

মোটকথা, উদারবাদী রাষ্ট্র ব্যবস্থায় কর্মপ্রয়াস অনুযায়ী ফলাফল ভোগের সুযোগ থাকায় নিজ নিজ ভাগ্য গড়তে ব্যক্তি অধিক প্রয়াসদানের প্রেরণা পায়। কিন্তু মার্ক্সবাদী সমাজে সে সুযোগ না থাকায়, অর্থাৎ ব্যক্তি প্রয়াস ও পরিশ্রমের ফসলের উপর নিজস্ব কর্তৃত্ব না থাকায় অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে সর্বাধিক প্রয়াস ও পরিশ্রম দানের উৎসাহ পায় না সে। ফলে মার্ক্সবাদী সমাজের তুলনায় উদার পূঁজিবাদী সমাজে অধিক উৎপাদন হয় এবং তা উদারবাদী সমাজকে অধিক ধনবান হতে সহায়তা করে। আমরা দেখেছি চীনারা অত্যন্ত কর্মঠ হওয়া সত্ত্বেও মার্ক্সবাদী অর্থনীতি চর্চার চার দশকে তেমন অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি অর্জন করতে পারে নি, অথচ অর্থনীতিকে পূঁজিবাদী ধাঁচে নিয়ে আসার আড়াই দশকের মধ্যেই চীন বিশ্বের এক শক্তিশালী ও দ্বিতীয় বৃহত্তম অর্থনীতিতে পরিণত হয়েছে। ১৯৫২ সালে বিভাজনের সময় উত্তর ও দক্ষিণ কোরিয়ার অর্থনৈতিক অবস্থা একই পর্যায়ে ছিল, অথচ এরপর উত্তর কোরিয়ায় মার্ক্সবাদী ও দক্ষিণ কোরিয়ায় উদার পূঁজিবাদী অর্থনৈতিক পন্থা অবলম্বনের পর দেশ দু’টির অর্থনৈতিক সমৃদ্ধিতে আকাশ-পাতাল ব্যবধান গড়ে উঠেছে। ১৯৪৫ সালে পূর্ব জার্মানির মার্ক্সবাদী অর্থনীতি ও পশ্চিম জার্মানির পূঁজিবাদী অর্থনীতি অবলম্বনের ফলেও অনুরূপ ব্যবধান ঘটেছিল দেশ দু’টির অর্থনৈতিক সমৃদ্ধিতে।

সম্প্রতি সোশ্যাল মিডিয়াতে বাংলাদেশী মার্ক্সবাদী বন্ধুদেরকে কিউবার অর্থনীতির ভুয়সী প্রসংশা করতে দেখেছি, কেননা কিউবার কমিউনিস্ট সরকার প্রত্যেক নাগরিককে চমৎকার রেশন দেয় (মাত্র ১২% দামে)। যদিও এসব বন্ধুদেরকে কিউবা সরকার প্রদত্ত রেশনকে ফুলিয়ে-ফাপিয়ে প্রচারণা চালায়, আসলে প্রাপ্তবয়স্ক ব্যক্তির জন্য মাসপ্রতি রেশনের পরিমাণ ৫টি ডিম, ১ লিটার রান্নার তেল, ০.৫ কেজি স্পাগেটি, ২.৭ কেজি চিনি, ২.৭ কেজি চাল, ৫৭০ গ্রাম কালো ডাল, ৫৭ গ্রাম মিশ্রিত কফি, ০.৯ কেজি মাংস ইত্যাদি। চিনি ও তেল বাদ দিলে, রেশনে কারও সপ্তাহ খানেক টেনে-হেচড়ে পার হতে পারে। যেখানে সাধারণ শ্রমজীবীদের মাসিক বেতন ২০-৩০ ডলার ও পেনশনারদের মাসিক ভাতা ~১০ ডলার, এবং বাজারে ১ কেজি চালের দাম ০.৮ ডলার, ১লিটার দুধের দাম ২.২ ডলার, ১ ডজন ডিমের ১.১ ডলার – সেখানে সাধারণ কিউবানরা যে কী কষ্টে দিন পার করে, তা সহজেই অনুমেয়। বাংলাদেশের কমিউনিস্টদের পূণ্যস্থান কিউবার সাথে তুলনা করা যাক কানাডার সাথে, একটা মোটামুটি সফল উদার পুঁজিবাদী দেশ, যেখানে অধিবাসীরা মাসপ্রতি বেকার ভাতা পায় ৫৪৩ ডলার প্রতি সপ্তাহে (মাসপ্রতি ২০০০ ডলার-এর বেশী)। কানাডায় ১ কেজি দুধের দাম ২.১ ডলার, ১ ডজন ডিমের দাম ৩.৩ ডলার, ১ কেজি চালের ৩.৮ ডলার, ইত্যাদি। কাজেই কানাডার কর্মহীন বেকার মানুষগুলোও কিউবার সাধারণ কর্মজীবী মানুষের তুলনায় অনেক ভাল জীবনযাপন করছে নিঃসন্দেহে।

মোটকথা সঠিক ট্যাক্স ও পূনর্বণ্টন ব্যবস্থার মাধ্যমে সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রের তুলনায় পুঁজিবাদী রাষ্ট্রেও  প্রত্যেক নাগরিকের উৎকৃষ্টতর জীবন-জীবিকা নিশ্চিত করা সম্ভব।

মনে রাখা আবশ্যক যে, মার্ক্স চেয়েছিলেন বিশ্বকে সম্পূর্ণরূপে পণ্য ও মুদ্রামুক্ত করতে, যাতে করে দুনিয়া আদিম যুগের মত মার্ক্সের আদর্শ সমাজে পরিণত হতে পারে। কিন্তু বিংশ শতাব্দের সমাজতান্ত্রিক দেশগুলো (কিউবাসহ) পণ্য ও মুদ্রা উঠিয়ে দেয় নি। পণ্য ও মুদ্রা উঠিয়ে দিয়ে ব্যবসা-বাণিজ্যের সম্পূর্ণ মূলোৎপাটন করলে সে আদর্শ সমাজতান্ত্রিক কিউবার অর্থনৈতিক অবস্থা আরও করুণ হতো।

 

৮) উদারবাদের প্রকারভেদ:

উদারবাদে দু’টো প্রধান ধারা রয়েছে, ১) আদি বা চিরায়ত (classical) উদারবাদ, ও ২) সমাজমুখী উদারবাদ। ধারা দু’টো কেবল সম্পদের পুনর্বণ্টন এবং সেসব ক্ষেত্রে সরকারের হস্তক্ষেপের বিষয়ে ভিন্নমতাবলম্বী। চিরায়ত উদারবাদীরা চায় স্বাধীন ব্যক্তি মালিকানা ও মুক্ত অর্থনৈতিক নীতি। তারা রাষ্ট্রের মাত্রাতিরিক্ত সেবামূলক কর্মকাণ্ডের পক্ষপাতী নন। আইনের সামনে সকলের সমতা এবং বাজারে মুক্ত ও সুষ্ঠু প্রতিযোগিতার সমর্থক তারা। এবং এরূপ প্রতিযোগিতা থেকে উদ্ভূত অর্থনৈতিক অসমতাকে তারা স্বাভাবিক ও গ্রহণযোগ্য প্রতিফল বিবেচনা করে। কিন্তু সমাজমুখী উদারবাদীরা নাগরিকদের মাঝে সম্পদ ও সেবার অধিক সমতামূলক পূনর্বণ্টনের জন্য সরকারের হস্তক্ষেপে বিশ্বাসী। তারা দাবী করে রাষ্ট্র-কর্তৃক সবার জন্য শিক্ষা নিশ্চিত করা, এবং তাদের অনেকের দাবী সরকার ধনীদের থেকে অধিক কর আদায়ের মাধ্যমে বেকার ভাতা, ঘরহীনদের জন্য বাসস্থান ও সবার জন্য চিকিৎসা ইত্যাদি নিশ্চিত করবে। এবং পরীক্ষণ ও অভিজ্ঞতা থেকে দেখা গেছে যে, ধনীদের কাছ থেকে উচ্চতর হারে ট্যাক্স আদায় করে তা বেকার ও দরিদ্রদের দেখভালে ব্যবহার করলে পূঁজিবাদী অর্থনীতির জন্য তা বরং উপকারী হয়, কেননা প্রান্তিক আয়ের এ মানুষগুলো তাদের হাতে শেষ পয়সাটিও বাজারে ব্যয় করে, যা বাজারকে চাঙ্গা রাখে এবং বেকারত্ব কমিয়ে আনে। সেই সাথে ধনীদের কাছ থেকে ট্যাক্স হিসেবে নেওয়া অতিরিক্র টাকা ঘুরে-ফিরে ধনীদের হাতেই ফিরে আসে। ফলে পাশ্চাত্যের উদার পূঁজিবাদী দেশগুলোর প্রায় সবই আজ সমাজকল্যাণমুখী হয়ে উঠেছে।

 

উদারবাদী আন্তর্জাতিকতা:

উদারবাদ নিজেকে একটা বিশ্বজনীন জীবনবিধান হিসেবে দেখে এবং স্বভাবতই চেষ্টা করছে ব্যক্তি, সামাজিক-রাষ্ট্রীয় ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে উদারবাদের ধারণাগুলোকে বিশ্বব্যাপী প্রসারিত করতে।

সামাজিক-রাজনৈতিক বলয়ে উদারবাদী আন্তর্জাতিকতা:  মানবজাতির জন্য উদারবাদের সর্বাধিক মূল্যবান অবদান হচ্ছে মানবাধিকারের ঘোষণা। ১৭৮৯ সালে ফ্রান্সে সফল বিপ্লবের মাধ্যমে সেখানে প্রথম উদারবাদী সাংবিধানিক শাসনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হয় এবং সে সংবিধানের অংশ ছিল মানবাধিকার ঘোষণা। এবং পরবর্তীতে পাশ্চাত্যের দেশগুলো একে একে ধর্মনিরপেক্ষ উদারবাদী গণতন্ত্র গ্রহণ করলে, সে দেশগুলোও ফ্রান্সের সংবিধান প্রায় অপরিবর্তিতরূপে গ্রহণ করে। এবং পাশ্চাত্যের দেশগুলোর সংবিধানের মানবাধিকার ঘোষণা ১৯৪৮ সালে প্রায় অপরিবর্তিতরূপে জাতিসঙ্ঘের সর্বজনীন মানবাধিকার ঘোষণাপত্র হিসেবে গৃহীত হয়। বলে রাখা প্রয়োজন জাতিসঙ্ঘ প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল একটা উদারবাদী আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে।

উদারবাদ মনে করে যে, তার মানবাধিকার ঘোষণাপত্রে উদ্ধৃত অধিকারগুলো সামাজিক, সাংস্কৃতির বা রাষ্ট্রীয় সীমানা নির্বিশেষে সব মানুষের মৌলিক অধিকার, এবং উদারবাদ চায় বিশ্বের সবমানুষের জন্য তা নিশ্চিত করতে। কাজেই উদারবাদের মূলে রয়েছে বিশ্বজনীনতার সুর। ‘ইনলাইটনমেন্ট’ যুগের শুরুতেই উদারবাদী দার্শনিকদের মাঝে আলোচনা ও তর্কে উদারবাদের সে বিশ্বজনীনতার সুর ধ্বণিত হয়।[7] ১৭৯৫ সালে জার্মান দার্শনিক ইমানুয়েল কান্ট রচিত ‘চিরন্তন শান্তি’ (Perpetual Peace) শীর্ষক প্রভাবশালী নিবন্ধটিতে বিশ্ব-পর্যায়ে শান্তি প্রতিষ্ঠার সমস্যা ধ্বণিত হয় এবং তা একটা ন্যায়পরায়ণ, সুবিন্যস্ত ও শান্তিপূর্ণ বিশ্ব-ব্যবস্থা সৃষ্টির প্রাথমিক রূপরেখা উপস্থাপন করে।[8]

শান্তিপূর্ণ বিশ্ব-ব্যবস্থা সৃষ্টিতে উদারবাদের প্রথম দাবী ছিল রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্ব ঘোষণা – যে রাষ্ট্র হবে স্বাধীন ও সার্বভৌম। শক্তিশালী শাসক কর্তৃক দূর্বল শাসককে আক্রমণ করা ছিল ইতিহাসের এক চিরাচরিত ঘটনা। রাষ্ট্র হবে স্বাধীন ও সার্বভৌম – এ ধারনার উদ্ভব ঘটে ১৬৪৮ সালে ইউরোপের ওয়েস্টফালিয়া শান্তিচুক্তির মাধ্যমে, যা ইউরোপে ৩০ বছর চলমান ক্যাথলিক-প্রটেস্টান্ট যুদ্ধ এবং ৮০ বছর চলমান স্পেইন-হল্যান্ড যুদ্ধের সমাপ্তি ঘটায়। চুক্তিটির মূল বক্তব্য ছিল ইউরোপের রাজারা নিজ নিজ রাষ্ট্রীয় সীমানার মাঝে তাদের শাসন সীমিত রাখবে এবং একে অপরকে আক্রমণ করবে না। রাষ্ট্রীয় স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের পাশাপাশি রাষ্ট্রীয় জাতীয়তাবাদ ও দেশপ্রেমের আধুনিক ধারণার সূচনাও সেখান থেকেই।

বিশ্বে শান্তি প্রতিষ্ঠায় রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্ব ঘোষণা নিঃসন্দেহে একটা খুবই উপকারী হাতিয়ার হিসেবে কাজ করেছে, কেননা তা রাষ্ট্রে-রাষ্ট্রে যুদ্ধ কমিয়েছে। কিন্তু উদারবাদীদের মতে কেবল রাষ্ট্রে-রাষ্ট্রে যুদ্ধই বিশ্বে অশান্তির একমাত্র উৎস নয়। বিশ্বে চূড়ান্ত শান্তি স্থাপনের জন্য প্রয়োজন রয়েছে রাষ্ট্রের ভিতরেও নাগরিকদের মানবাধিকার ও সুখ-শান্তি নিশ্চিত করা।

শান্তিপূর্ণ আন্তর্জাতিক পরিস্থিতি সৃষ্টির জন্য উদারবাদীরা অবংশানুক্রমিক ও অস্বৈরাচারী প্রজাতান্ত্রিক গণতন্ত্রীয় রাষ্ট্র গঠনের ওপর জোর দেয়, যা একটা সংবিধান বা আইনশাস্ত্র দ্বারা পরিচালিত হবে। এ প্রসঙ্গে তাদের যুক্তি ছিল যে, নিরঙ্কুশ ক্ষমতাসম্পন্ন কৈফিয়তদানহীন স্বৈরাচারী শাসকরা সহজেই নিজ নাগরিকদের মানবাধিকার লংঘন করতে ও অন্য রাষ্ট্রের সাথে যুদ্ধে লিপ্ত হতে পারে – যা বিশ্বে শান্তিপূর্ণ পরিস্থিতি সৃষ্টির বড় অন্তরায়। কাজেই উদারবাদ প্রথমত দাবী করে গণ-অংশগ্রহণমূলক গণতান্ত্রিক শাসন-ব্যবস্থার, যেখানে সরকারকে জনগণের কাছে তার কর্মকাণ্ডের জন্য জবাবদিহি করতে হবে। এবং দ্বিতীয়ত, উদারবাদ এটাও চায় যে, রাষ্ট্রের সকল ক্ষমতা একহাতে ন্যস্ত করা যাবে না, কেননা এমন সরকার সহজেই অন্য রাষ্ট্রের সাথে যুদ্ধ বাধাতে পারে এবং দেশের ভিতরেও নির্বিচারে নাগরিকের ওপর অত্যাচার নির্যাতন চালাতে পারে। উদারবাদ রাষ্ট্রের সার্বিক ক্ষমতা কয়েকটি পরস্পর নির্ভরশীল রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানের মাঝে ভাগ করার ব্যবস্থা করেছে – যেমন রাষ্ট্রপ্রধান, বিচার-বিভাগ, সংগ্রেস ও সিনেট ইত্যাদির মাঝে। এরূপ সাংবিধানিক বা প্রজাতান্ত্রিক গণতন্ত্রে সরকারের ক্ষমতা দূর্বলকরণ ও ভোটারদের কাছে সরকারের কর্মকাণ্ডের কৈফিয়তদান স্বভাবতই সরকারের জন্য জনগণের অধিকার লংঘন বা আগ্রাসী যুদ্ধে লিপ্ত হওয়া কঠিনতর করে তোলে। ‘উদারবাদী গণতান্ত্রিক সরকার সংকীর্ণ স্বার্থের জন্য একে অপরের সাথে যুদ্ধ করে না’ – মাইকল ডোয়েল-এর এ মতবাদটির আজ অবধি সত্যতা উদারবাদী শান্তি তত্ত্বকে সমর্থন দেয়।[9]

বিংশ শতাব্দীর গোড়ায় ইউরোপে সূচিত প্রথম বিশ্বযুদ্ধ, যা ভয়ঙ্করধরনের মানবজীবন ও ধনসম্পদের ক্ষয়ক্ষতি বয়ে আনে, তা রাষ্ট্রে-রাষ্ট্রে সংঘাত এড়ানোর জন্য নতুন উপায় খুঁজতে উদারবাদী চিন্তাবিদদেরকে জরুরী অবস্থার মধ্যে ফেলে দেয়। এ পর্যায়ে আন্তর্জাতিক স্থিতিশীলতা ও শান্তিপূর্ণ পরিস্থিতি সৃষ্টির লক্ষ্যে উদারবাদীরা রাষ্ট্রীয়ভাবে আইনের শাসন, রাষ্ট্রগুলোর মাঝে পারস্পারিক সম্মানবোধ সৃষ্টিতে পারস্পারিক সহযোগিতা ও নির্ভরশীলতা বৃদ্ধি এবং সেই সাথে আন্তর্জাতিক সংস্থা সৃষ্টিতে মনোযোগ দেয়। সে লক্ষ্যে আমেরিকান প্রেসিডেন্ট উড্রো উইলসনের সুপারিশ অনুসারে ১৯২০ সালে ‘লীগ অব নেইশন্স’ নামে আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান গঠন করা হয় আন্তঃরাষ্ট্রীয় সঙ্ঘাতের মধ্যস্থতার মঞ্চ হিসেবে, এবং দূর্বল রাষ্ট্রকে লাগামগীন আগ্রাসকদের হাত থেকে রক্ষায় সম্মিলিত প্রতিরক্ষা প্রদানের প্রতিষ্ঠান হিসেবে। উদারবাদীরা ভেবেছিল এমন একটি আন্তর্জাতিক সংস্থা শান্তিপূর্ণ ও নিরাপদ বিশ্বপরিস্থিতি সৃষ্টিতে সহায়ক হবে। কিন্তু ১৯৩০-এর দশকে আবার দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের প্রাদুর্ভাব উদারবাদীদের সে প্রত্যাশাকে গুড়িয়ে দেয়।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর আন্তর্জাতিক সম্পর্কে উদারবাদী তত্ত্ব ‘বাস্তবতাবাদ’ (Realism)-এর কাছে হেরে যায়। বাস্তবতাবাদ বলে যে, বিশ্বের অরাজক ব্যবস্থায় রাষ্ট্রগুলো স্বভাবতই আত্মস্বার্থবাদী ও ক্ষমতার বলে পরিচালিত এবং কোন কোন রাষ্ট্র বা রাষ্ট্র-নেতা আন্তর্জাতিক আইন বা নৈতিকতার বাঁধা উপেক্ষা করে নিজ নিজ আত্মস্বার্থের পিছনে ছুটবেই। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ উদারবাদী বিশ্বশান্তির প্রত্যাশায় কাষাঘাত হানা সত্ত্বেও উদারপন্থীরা তাদের জীবনদর্শনকে বিশ্বায়িত করার প্রয়াস অব্যাহত রাখে। আন্তর্জাতিক সহযোগিতা ও বিশ্বশান্তি নিশ্চিতকরণের জন্য দৃঢ়প্রত্যয় নিয়ে ‘লীগ অব নেইশন্স’ পুনর্জন্ম লাভ করে ‘জাতিসংঘ’ হিসেবে। ইউরোপে জন্ম হয় ইউরোপিয় ইউনিয়নের এবং অতি সম্প্রতি আফ্রিকায় প্রতিষ্ঠিত হয় ‘আফ্রিকান ইউনিয়ন’। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ উত্তর যুগে আন্তঃরাষ্ট্রীয় যুদ্ধ কমাতে উদারবাদীরা রাষ্ট্রগুলোর ক্ষমতা লঘুকরণে রাষ্ট্রীয় সার্বভৌমত্বের কিছু অংশকে কোন আন্তর্জাতিক সংস্থা, যেমন জাতিসংঘ, ইউরোপিয় ইউনিয়ন বা আফ্রিকান ইউনিয়ন, ইত্যাদির হাতে হস্তান্তরের দাবী জানায়।

উদারবাদের স্বাধীন সার্বভৌম জাতি-রাষ্ট্রের ধারনা জাতি-জাতিতে, রাষ্ট্রে-রাষ্ট্রে সংঘাত অনেক কমিয়ে এনেছে, বিশেষত দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ উত্তর পৃথিবীতে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর বিশ্বে গণতান্ত্রিক দেশের সংখ্যা গোটা-বিশ থেকে ১২০-এর অধিকে উত্তরণও রাষ্ট্রে-রাষ্ট্রে যুদ্ধের সম্ভাবনা অনেক কমিয়ে দিয়েছে। সহিংসতায় মৃত্যুর হারের হিসেবে (প্রতি লাখে) সমাজতন্ত্রের পতন-উত্তর ১৯৯০-এর দশকের পৃথিবী ছিল ইতিহাসের সবচেয়ে শান্তিপূর্ণ সময়। তবে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের সহিংসতার যুগ পেরিয়ে ২০০০-এর দশকে ইসলামি জিহাদি সহিংসতার জাগরণ পৃথিবীতে শান্তি ও স্থিতিশীলতা নতুন করে হুমকির মুখে ফেলে দিয়েছে।

 

ইউরোপিয় দেশগুলোতে সহিংসতায় মৃত্যুর হারের (প্রতি লাখে) ঐতিহাসিক ডাটা (১৩০০-২০১০ খ্রিস্টাব্দ)।

২০১০ ব্যতিত বাকী ডাটার উৎস – Manuel Eisner(2003) Long-Term Historical Trends in Violent Crime, In Crime and Justice, 30। ২০১০-এর ডাটার উৎস – United Nations Office on Drugs and Crime, Homicide Statistics, 2012)

উদারবাদী পন্থার আলোকে জাতিসংঘ তার ৭৭ বছরের জীবনকালে বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলে বহু আন্তঃ ও অন্তর রাষ্ট্রীয় সঙ্ঘাতে শান্তিরক্ষার ভূমিকা পালন করেছে। লাইবেরিয়া ও বলকান অঞ্চলের সঙ্ঘাতে জাতিসংঘের হস্তক্ষেপ নিঃসন্দেহে গণহত্যা ও জাতিগত নিধন বন্ধে ও শান্তি প্রতিষ্ঠায় সহায়তা করেছে। অন্যদিকে মুসলিম দেশগুলোর অভ্যন্তরীণ সঙ্ঘাতে, যেমন সোমালিয়ায় ও আফগানিস্তানে, জাতিসঙ্ঘের হস্তক্ষেপ প্রচেষ্টা শুধু ব্যর্থই হয় নি, বরং তা সম্ভবত অবস্থার আরও অবনতি ঘটিয়েছে। আপাতঃ দৃষ্টিতে মনে হয় যে, বিশ্ব শান্তি প্রতিষ্ঠায় উদারবাদী ধারণা অমুসলিম বিশ্বে অনেকাংশে কার্যকর, কিন্তু মুসলিম বিশ্বে তা শুধু অকার্যকরই নয় বরং বৈরী প্রতিফল ঘটায়। মানবজাতির ইতিহাস সহিংসতা, সঙ্ঘাত ও রক্তপাতের এক সুদীর্ঘ ইতিহাস। বিংশ শতাব্দে, বিশেষত দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পর পৃথিবীর উত্তরোত্তর গণতন্ত্রায়ন সহিংসতা অনেকাংশে কমিয়ে এনেছে। কিন্তু পৃথিবীর অনেক অগণতান্ত্রিক দেশে অভ্যন্তরীণ সঙ্ঘাত, অত্যাচার ও নির্যাতন বিশ্বকে প্রকৃত শান্তিপূর্ণ ব্যবস্থায় উত্তরণের পথকে বাধাগ্রস্থ করছে। এবং এসব অনাচার ও সঙ্ঘাত নিরসনের জন্য গ্রহণকৃত উদারবাদী পন্থা সর্বত্র সফল হচ্ছে না, বিশেষত মুসলিম দেশগুলোতে।

উপনিবেশ-উত্তর জাতি-রাষ্ট্র ভিত্তিক বিশ্বব্যবস্থার বয়স মাত্র অর্ধ-শতাব্দ মাত্র। যে মানবজাতির দুই লক্ষাধিক বছরের ইতিহাসের প্রায় পুরোটাই সঙ্ঘাত ও হানাহানির খেলা, সে সমস্যা মাত্র অর্ধ শতাব্দে উবে যাওয়ার প্রত্যাশা দূরাশামাত্র। তবুও এ-যাবৎ পরীক্ষিত পন্থাগুলো থেকে এটা মোটামুটি নিশ্চিত করে বলা যায় যে, রাষ্ট্রগুলোর সফল গণতন্ত্রায়ন ও অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি আন্তঃ ও অন্তর রাষ্ট্রীয় সঙ্ঘাত ও অন্যায়-অত্যাচার নিরসনে টিকসই সমাধান আনয়ন করতে পারে।

অর্থনৈতিক বলয়ে উদারবাদী আন্তর্জাতিকতা:  বিশ্বের সব দেশের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি কীভাবে উন্নীত করা যায়, সে চিন্তাধারা ফুটে উঠেছে ১৭৭৬ সালে প্রকাশিত স্কটিশ দার্শনিক ও অর্থনীতিবিদ এ্যাডাম স্মিথের ‘The Wealth of Nations’ রচনায়। স্মিথ দাবি করেন – পারস্পারিক বাণিজ্যের মাধ্যমে রাষ্ট্রগুলো পারস্পরিকভাবে লাভবান হতে পারে। অর্থাৎ রাষ্ট্রগুলো যদি পরস্পরের সাথে ব্যবসা-বাণিজ্যের পথ সুগম করে তথা মুক্ত-বাজার অর্থনীতি গ্রহণ করে, তা রাষ্ট্রগুলোকে পারস্পারিকভাবে লাভবান করবে। এবং উদারবাদ চায় মুক্তবাজার অর্থনীতি বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে দিতে। এবং সে লক্ষ্যে উদারবাদীরা ১৯৪৪ সালে আমেরিকার ব্রেটন উডস-এ বহুজাতিক আলোচনার ভিত্তিতে কয়েকটি আন্তর্জাতিক অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠান, যেমন বিশ্ব ব্যাংক (World Bank), আন্তর্জাতিক অর্থ তহবিল (International Monetary Fund), ও বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থা (World Trade Organization) ইত্যাদি সৃষ্টি করেছে। আন্তর্জাতিক অর্থ তহবিল দুর্যোগের সময়ে আর্থিক সমস্যায় জর্জরিত রাষ্ট্রগুলোকে অর্থনৈতিক সহায়তা দিয়ে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যকে স্থিতিশীল রাখার চেষ্টা করে। বিশ্ব ব্যাংক দ্বিতীয় বিশ্বের পর ইউরোপের ধ্বংসকৃত অর্থনীতিগুলোকে পুনর্সংগঠনের নিমিত্তে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল; এবং পরবর্তিতে তা উন্নয়নশীল দেশগুলোতে বিনিয়োগ, আর্থিক অনুদান ও ঋণ দেওয়ার কাজে নামে। বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থাটি আন্তর্জাতিক ব্যবসা-বাণিজ্য বৃদ্ধির লক্ষ্যে আন্তর্জাতিক শুল্ক কমাতে এবং বাণিজ্যভাবে সংরক্ষণশীল দেশগুলোর অর্থনীতি উন্মুক্তকরণে আলোচনার মঞ্চ হিসেবে কাজ করে। উল্লেখ্য, অনেক দেশ, বিশেষত তৃতীয় বিশ্বের দূর্নীতিতে নিমজ্জিত দেশগুলো কখনও কখনও এসব আন্তর্জাতিক অর্থনৈতিক সংস্থাগুলোর সমালোচনা করেছে, বিশেষত ঋণদানে সংস্থাগুলোর বিশেষ প্রকল্প সম্পাদনে বাধ্যতামূলক শর্ত বাধিয়ে দেওয়াকে কেন্দ্র করে।

যাহোক, এসব আন্তর্জাতিক অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠানগুলো একদিকে উদারবাদের অর্থনৈতিক নীতিগুলোকে বিশ্বায়িত করার কাজে নিয়োজিত। অন্যদিকে জাতিসংঘ নিয়োজিত নীতিগতভাবে উদারবাদের সামাজিক-রাজনৈতিক রীতিনীতিগুলোকে – যার মধ্যে রয়েছে গণতন্ত্র, আইনের শাসন, সুবিচার, মানবাধিকার, সমনাগরিকত্ব, স্বাধীনতা, বাক-স্বাধীনতার অধিকার, স্বায়ত্বশাসন ইত্যাদি – বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য শীর্ষস্থানীয় প্রতিষ্ঠান হিসেবে কাজ করছে। জাতিসংঘের মানবাধিকার সনদ ‘মানবাধিকারের নীতি ও জনগণের সায়ত্তশাসন’ (অনুচ্ছেদ ১) এবং ‘মানবাধিকার ও বিভেদহীনভাবে সকলের জন্য মৌলিক স্বাধীনতা’ (অনুচ্ছেদ ৫৫) উন্নীত করার প্রয়াসে কাজ করে। সনদটি বাক-স্বাধীনতা (অনুচ্ছেদ ১৯) ও ধর্ম বা বিশ্বাসের স্বাধীনতা (অনুচ্ছেদ ১৮) ইত্যাদির প্রসার ঘটাতে কাজ করে। জাতিসংঘ তার সদস্য-দেশগুলোকে তার সার্বজনীন মানবাধিকার ঘোষণার সনদটি সাক্ষর করানোর মাধ্যমে সেসব দেশকে নিজ রাষ্ট্রীয় সীমানার মাঝে মানবাধিকারগুলো নিশ্চিত করতে আইনগতভাবে দায়গ্রস্ত করে। ১৯৬০-এর দশকে উদারবাদীরা বেসামরিক ও রাজনৈতিক অধিকার এবং অর্থনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক অধিকার ইত্যাদির ঘোষণা জাতিসংঘ সনদে অন্তর্ভূক্ত করে। জাতিসংঘ সনদ চায় বিশ্বের সকল মানুষের জন্য মানবাধিকারের একটা সর্বজনীন ও একক মানদণ্ড প্রতিষ্ঠা করতে।

উদারবাদী বেসরকারী সংস্থাগুলো (NGOs), যেমন হিউম্যান রাইটস ওয়াচ ও অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল, ইত্যাদিও উদারবাদী নীতি, যেমন মানবাধিকার, সুবিচার ও স্বাধীনতা, ইত্যাদির প্রসারে পাহারাদার হিসেবে কাজ করে।

 

মানবতাবাদের প্রত্যাশা:

আগেই বলা হয়েছে যে, যদিও আজকাল মানবজাতির জীবনাদর্শ বা ধর্ম হিসেবে মানবতাবাদ-এর নাম ক্রমবর্ধমানহারে ধ্বনিত হচ্ছে, তবে মানবতাবাদের কোন সুনির্দিষ্ট রূপরেখা এ-পর্যন্ত উপস্থাপিত হয় নি। তবে বিশ্বের অন্যতম মানবতাবাদী সংগঠন, আমেরিকান হিউম্যানিস্ট অ্যাসোসিয়েশন, মানবতাবাদের প্রত্যাশার একটি তালিকা উপস্থাপন করেছে, যা মানবতাবাদ সম্পর্কে বর্তমান চিন্তাধারা ও বোঝাপড়া সম্পর্কে আমাদেরকে সামগ্রিক দেবেঃ

•    নিরীক্ষা, পরীক্ষা ও যুক্তিবাদী পর্যালোচনার মাধ্যমে পার্থিব জ্ঞানার্জন। মানবতাবাদীরা বিশ্বাস করে জ্ঞান অর্জন ও উপকারী প্রকৌশল উদ্ভাবনের জন্য বিজ্ঞান শ্রেষ্ঠ পন্থা। আমরা যুক্তিবাদী বুদ্ধিমত্তার মাধ্যমে অর্জিত চিন্তাশীলতা, শিল্পকর্ম ও অভ্যন্তরীণ অভিজ্ঞতাকে মূল্য দেই।

•    মানুষ প্রকৃতির অবিচ্ছেদ্য অংশ ও অনিয়ন্ত্রিত বিবর্তনের ফসল। মানবতাবাদীরা প্রকৃতিকে আত্মজাত গণ্য করে। আমরা আমাদের পার্থিব জীবনকেই সর্বস্ব ও যথেষ্ট মনে করি, এবং বাস্তবতাকে আমাদের প্রত্যাশা ও কল্পনা থেকে পৃথক করি। আমরা আগামী প্রতিদ্বন্দ্বিতাকে গ্রহণ করি এবং ভীতিহীনভাবে অজানার দিকে ধাবিত হই।

•    নৈতিক মূল্যবোধের ভিত্তি হবে অভিজ্ঞতার আলোকে মানবীয় প্রয়োজনীয়তা ও স্বার্থ। মানবতাবাদীরা মানুষের কল্যাণে বিশ্বাসী, যা নির্ধারিত হবে মানুষের অবস্থা, স্বার্থ ও চাহিদার ভিত্তিতে, এবং তার পরিধি হবে বিশ্ব-প্রকৃতি বা তারও বাহির পর্যন্ত। আমরা প্রত্যেক ব্যক্তিকে অন্তর্নিহিত মূল্য ও মর্যাদা সম্পন্ন হিসেবে বিবেচনা করি, এবং জ্ঞানের ভিত্তিতে প্রত্যেকে নিজ নিজ পছন্দ-অপছন্দ চয়নের দাবী রাখে, যা হবে দায়িত্ববোধ ও ব্যক্তি-স্বাধীনতার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ।

•    জীবনের অর্থপূর্ণতা নিহিত মানবীয় আদর্শ চর্চায় অংশগ্রহণের মাঝে। আমরা আমাদের সর্বাধিক উন্নয়ন কামনা করি এবং জীবনকে গভীর উদ্দেশ্যবোধে প্রাণবন্ত করে তুলি, মানব অস্তিত্বের আনন্দ ও সৌন্দর্য্য, লড়াই ও নির্মমতা, এমনকী মৃত্যুর অনিবার্যতা ও চূড়ান্ততার মাঝেও বিস্ময় ও চমৎকারিত্ব খুঁজে পাই। মানবতাবাদীরা মানবীয় সংস্কৃতির সমৃদ্ধ ঐতিহ্যকে ধারণ করে এবং মানবতাবাদী জীবন দর্শন অসময়ে সুখানুভব ও প্রাচুর্য্যের সময়ে উদ্দীপনা যোগানোর পক্ষপাতী।

•    প্রকৃতিগতভাবে মানুষ সামাজিক জীব এবং মানুষ-মানুষে সম্পর্কের মাঝে সে অর্থ খুঁজে পায়। মানবতাবাদীরা পারস্পারিক দায়িত্ব ও উদ্বেগপূর্ণ দুনিয়ার স্বপ্ন দেখে এবং নির্মমতা ও তার প্রতিফল বিহীনভাবে তা অর্জনে সচেষ্ট – যেখানে বিরোধের নিষ্পত্তির চেষ্টা হবে সহযোগিতার মাধ্যমে ও সহিংসতার আশ্রয় না নিয়ে। ব্যক্তি-স্বাধীনতার সাথে পারস্পরিক নির্ভরশীলতার সম্পৃক্তি আমাদের জীবনকে সমৃদ্ধ করে, অপরের জীবনকে সমৃদ্ধকরণে প্রেরণা যোগায়, এবং সকলের জন্য শান্তি, ন্যায় ও সুযোগের আশাবাদ উদ্দীপ্ত করে।

•    সমাজের স্বার্থে কাজ করা ব্যক্তিগত সুখ বর্ধিত করে। প্রগতিশীল সংস্কৃতি কেবলই টিকে থাকার লড়াইয়ের নির্মমতা থেকে মুক্ত হতে, এবং দুঃখ-দুর্দশা লাঘব, সমাজের উন্নতি ও বিশ্ব মানবতার উন্নয়নে কাজ করেছে। আমরা মানুষের অবস্থা ও সামর্থ্যের বৈষম্য কমাতে চাই, এবং প্রাকৃতিক সম্পদ ও মানবীয় প্রচেষ্টার ফসলের ন্যায্য বণ্টন সমর্থন করি, যাতে করে যতোটা সম্ভব অধিক মানুষ ভাল জীবন যাপনের সুযোগ পায়।

মানবতাবাদীরা সকলের মঙ্গলের কথা চিন্তা করে, বৈচিত্র্যে বিশ্বাসী এবং ভিন্ন কিন্তু মানবীয় মতামতধারী সকলকে শ্রদ্ধা করে। আমরা উন্মুক্ত ও ধর্মনিরপেক্ষ সমাজে সকলের সমান মানবাধিকার ও নাগরিক স্বাধীনতা চর্চা বলবৎ করতে কাজ করি, গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার অংশগ্রহণকে নাগরিক দায়িত্ব মনে করি, এবং প্রকৃতির সত্তা, বৈচিত্র্য ও সৌন্দর্য্যকে নিরাপদ ও টেকসইভাবে সংরক্ষণ করাকে পার্থিব দায়িত্ব মনে করি।

সর্বোপরি, জীবনের প্রবাহে সংযুক্ত হয়ে আমরা জ্ঞাত প্রত্যয়ের সাথে এ স্বপ্ন দেখি যে, সর্বোচ্চ আদর্শ অর্জনের সামর্থ্য রয়েছে মানবজাতির। আমাদের জীবনের এবং কেমন পৃথিবীতে আমরা বাস করতে চাই, তার দায়দায়িত্ব শুধুই আমাদের।

জীবন দর্শনের মত বিস্তৃত বিষয়ে এতগুলো জীবনতত্ত্বের পুরো চিত্র এতটা স্বল্প পরিসরে চিত্রিত করা কঠিন। তবে বর্তমান বিশ্বে জীবনের সার্বিক আদর্শের দাবীদার তত্ত্বগুলোর মোটামুটি সারমর্ম আহরণে এ নিবন্ধটি সহায়ক হবে বলে আশা রাখি।

(নিবন্ধটি ১৬ ডিসেম্বর ২০১১ তারিখে ঢাকায় ‘বঙ্গরাষ্ট্র’ আয়োজিত এক আলোচনা সভায় পাঠ করা হয়েছিল। উক্ত সভায় বিভিন্ন বক্তা নিবন্ধটির আলোচনা-সমালোচনা করেন। নিবন্ধটি ‘বঙ্গরাষ্ট্র’ ব্লগে গ্রন্থাগার বিভাগে প্রথম প্রকাশিত হয়েছিল। বর্তমান নিবন্ধটি মূল নিবন্ধ থেকে সম্পাদিত ও পরিবর্ধিত।)

————————

[1] John Adam, A Defence of the Constitutions of the United States of America, 1787

[2] Karl Marx , Private Property and Communism, in Economic and Philosophic Manuscripts of 1844

[3] Hamid Naseem Rafiabadi, Marxism and Islam – A New Perspective, 22 December 2010.

[4] “the ultimate aim of government is not to rule, or restrain by fear, nor to exact obedience, but to free every man from fear that he may live in all possible security… In fact the true aim of government is liberty.”

[5] “From each according to his ability, to each according to his needs” Karl Marks in Critique of the Gotha program (1875)

[6]  সাম্যবাদ-কে প্রশ্ন-চিহ্নায়িত করার কারণ হচ্ছে, সমাজতান্ত্রিক দেশগুলোতে ক্ষেত-খামারের কর্মজীবিরা কোনক্রমেই নেতাদের (মাও সে তুং, লেনিন, স্ট্যালিন, ক্যাস্ট্রো) সমান খাওয়া-পরার সুযোগ পায় নি। সমাজতন্ত্রের ঘনঘটার দিনে চীন-ভিয়েতনামের নেতাদের মত সম্পত্তির অধিকারী হওয়ার কথা উদারবাদী দেশগুলোর নেতারা (প্রধানমন্ত্রী, রাষ্ট্রপতি) স্বপ্নেও কল্পনা করতে পারত না। বরং উদারবাদী দেশগুলোতে নেতাদের থেকে সাধারণ জনতার দূরত্ব খুবই কম, সেখানে মাও সে তুং, লেনিন, স্ট্যালিন, ক্যাস্ট্রো, কিম-রা জনতার কাছে যেন সর্বশক্তিমান ঈশ্বরের মত প্রভাবশালী ও ত্রাস-সৃষ্টিকারী। সর্বোপরি আজকের আধুনিক জগতে সাম্যবাদ তথা সকলের সমান খাওয়া-পরার অধিকার প্রতিষ্ঠা করার প্রত্যাশা অলীক স্বপ্ন মাত্র — সম্ভবত সামষ্ঠিক সমাজের উৎপত্তির পর তা কোনদিনও চর্চা হয় নি, হওয়া সম্ভব না।

[7] Steans J and Lloyd P (2005) Introduction to International Relations, Pearson Education Ltd., Harlow, p. 21

[8] Kant E (1795) Perpetual Peace: A Philosophical Sketch; Available online at http://www.mtholyoke.edu/acad/intrel/kant/kant1.htm; accessed 16 June 2008

[9] Doyle M (1986) Liberalism and World Politics, In American Political Science Review, 80(4),  p. 1151-69

 

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
Archive
 
সাম্প্রতিক পোষ্টসমূহ