Banner
ভারত-ইতিহাসের সূত্র সন্ধান — শামসুজ্জোহা মানিক

লিখেছেনঃ শামসুজ্জোহা মানিক, আপডেটঃ August 7, 2023, 12:00 AM, Hits: 892

   

  (রচনাকাল : ১২ অক্টোবর-২৯ নভেম্বর, ১৯৯০ খ্রীস্টাব্দ।)

পূর্বে বিশ্বামিত্রের মত ঋষিগণ মন্ত্র রচনার পাশে রণক্ষেত্রে লড়াই করেছেন। কিন্তু বেদ ও ধর্মগ্রন্থের আয়তন বৃদ্ধি এবং সেই সঙ্গে ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠানের জটিলতা বৃদ্ধিরও সঙ্গে বিভিন্ন পেশার সাথে সংযুক্ত ঋষি ও রাজর্ষির যুগ শেষ হয়েছে। একদিকে ধর্মীয় নিয়ন্ত্রণকে কুলগত বা বংশগত নিয়ন্ত্রণের উপর প্রতিষ্ঠা করার প্রয়োজন, অপরদিকে ধর্মীয় জটিলতা বৃদ্ধি ব্রাহ্মণকে আর সকল পেশা থেকে বিচ্ছিন্ন করেছে।

এইভাবে যোদ্ধা কিংবা রাষ্ট্রশাসক শ্রেণী থেকে ব্রাহ্মণ স্বতন্ত্র হয়ে গেল। উভয়ের মধ্যে ঐক্য রইল। কিন্তু ক্ষমতা, সুযোগ-সুবিধা এবং সমাজ নিয়ন্ত্রণের প্রশ্নে যোদ্ধা ও শাসকের সঙ্গে ব্রাহ্মণের দ্বন্দ্বও দেখা দিল। বিশেষত যুদ্ধের প্রক্রিয়ায় যুদ্ধশক্তি প্রবল হয়ে উঠেছিল। সিন্ধুর কৃষিব্যবস্থা ধ্বংসের সঙ্গে পশুপালন ও যাযাবর শক্তির বিকাশ অনিবার্য ছিল। অনেক পরবর্তীকালে মধ্য এশিয়া থেকে যখন নূতন নূতন অভিযাত্রী দল অরক্ষিত উত্তর-পশ্চিম প্রান্ত দিয়ে উপমহাদেশে প্রবেশ করছিল তখন কৃষি সমাজ অধিকতর হুমকির সম্মুখীন হল এবং সেই সঙ্গে ব্রাহ্মণের নেতৃত্বও।

এই অবস্থায় ব্রাহ্মণকে কৃষি সমাজ সংগঠিত করার উপর সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিতে হল। বস্তুত পশুপালন মূলক যাযাবর জীবনে বেদ-উপনিষদ-পুরাণের কি মূল্য? সুতরাং মানুষ যাতে পশুপালন বৃত্তির উপর বেশী জোর না দেয় সম্ভবত সেই উদ্দেশ্যে গোমাংস ভক্ষণ নিষিদ্ধ করতে হল। অথচ ঋগ্বেদের ৬।১৬।৪৭; ১০।২৭।২; ১০।২৮।৩; ১০।৮৬।১৩-১৪ এবং ১০।৮৯।১৪ ইত্যাদি ঋকগুলি পাঠ করলে বোঝা যায় এই উষ্ণ জলবায়ুর দেশের আর্য এবং ঋষিগণ কি পরিমাণে গোমাংস ভক্ষণ করতেন। গোমাংসের প্রতি ইন্দ্রের লোলুপ দৃষ্টি পাঠকের চোখ এড়ায় না। ১০।৮৬।১৪ ঋক থেকে উদ্ধৃতি দেবার লোভ সংবরণ করতে পারছি না যেখানে ইন্দ্রের মুখ দিয়ে ঋষি বলছেন, “আমার জন্য পঞ্চদশ এমন কি বিংশ বৃষ পাক করে দাও। আমি খেয়ে শরীরের স্থূলতা সম্পাদন করি, আমার উদরের দু’পার্শ্ব পূর্ণ হয়। ইন্দ্র সকলের শ্রেষ্ঠ।”

বোধ করি পনের থেকে কুড়িটি বৃষমাংস ভক্ষণের সঙ্গে ইন্দ্রের শ্রেষ্ঠত্বের সম্পর্ক আছে!
আসলে গোবধ নিষেধের মধ্যে রয়েছে পশুপালন ও কৃষি এই উভয় সংস্কৃতি ও জীবন যাত্রার মধ্যকার দ্বন্দ্বের প্রতিফলন।

*******************************************************

*******************************************************

এটাই তো স্বাভাবিক যে, প্রাচীনত্বের একটা শক্তি আছে। বিশেষত যে প্রাচীন এত উন্নত। তাই যখন হরপ্পা সভ্যতা ভেঙ্গে পড়েছে তখন এই প্রাচীন সভ্যতার স্মৃতি নানানরূপে ভারতীয় চেতনা ও সংস্কৃতিকে অধিকার করে থেকেছে। হয়ত এই স্মৃতি ঐতিহ্যের রূপ ধরে ভারতীয় সভ্য সত্তাকে রক্ষাও করেছে। ভারত পরবর্তীকালেও উন্নত সভ্যতা নির্মাণ করেছে। কতোকগুলি বিচারে তা সিন্ধু-হরপ্পার সমপর্যায়ের না হলেও পরবর্তীতেও গৌরব করবার মত অনেক কিছুই হয়েছে। এবং এই সব কিছুতেই রক্ষা পেয়েছে প্রাচীন ঐতিহ্যের ধারা।

এই ঐতিহ্যকে অস্বীকার করে কেউ ভারতবর্ষে অন্তত ভিতর থেকে কিছু করতে পারে নি। তাই বাহির থেকে তলোয়ারের জোরে ভারতবর্ষ দখল করা যায়। কিন্তু ভারতীয় চেতনা ও ঐতিহ্যকে দখল করা যায় না। পাঁচশত বৎসর এক নাগাড়ে অধিকাংশ ভারত শাসন করেও ইসলাম ভারতের মূল ধারা হয়ে উঠতে পারে নি। ভারতের রাজনীতি, সংস্কৃতি ও চেতনায় ইসলামী ধারা একটি গৌণ ও পার্শ্বস্রোত মাত্র। আওরঙ্গযেবের মত গোঁড়া সম্রাট এবং অসংখ্য ধর্মোন্মাদ মুসলিম শাসকের সমস্ত প্রচেষ্টা ও জবরদস্তি ব্যর্থ করে দিয়ে অমুসলিম ভারতবর্ষ তার সুপ্রাচীন ঐতিহ্য ধরে থেকেছে। কালাপাহাড় দারুণ আক্রোশে মন্দির আর দেবতা-প্রতিমা ভেঙ্গে বেড়িয়েছে। কিন্তু ভারতবর্ষের অন্তরের মন্দির আর প্রতিমা ভাঙ্গবার সাধ্য তার হয় নি।

এই ঐতিহ্যকে সম্পূর্ণরূপে অস্বীকার করে এখানে যে কিছু সেভাবে দাঁড়াতে পারে না এ থেকেও আমাদের বহু কিছু বুঝবার ও শিখবার আছে। এটা আরও স্পষ্ট করে দেখিয়ে দেয় যে, বহিরাগত আর্য আক্রমণ একটা নিছক উপকথা বা মীথ ভিন্ন আর কিছু নয়। যদি এটা বহিরাক্রমণই হত তবে সেই “আর্যরা” যত লক্ষ সংখ্যায়ই আসুক তাদের অবস্থা খুব উন্নত হলে মুসলমানদের মতই হত। যেহেতু তারা ইসলামের মত বাহির থেকে কোন ধর্মীয় ও রাজনৈতিক কেন্দ্রের সম্প্রসারণ হয়ে আসে নি (আমরা যদি ধরেও নিই যে, “আর্যরা” বহিরাগত) সেহেতু তারা এদেশে যবন (আইওনিয়ান), শক, হুনদের মত বিলীন হয়ে যেত। এবং বহিরাক্রমণের স্মৃতিবাহী “আর্য” শব্দটা তাদেরও উত্তরপুরুষসহ সমগ্র ভারতবাসীর নিকট হয়ে থাকত যবন, ম্লেচ্ছের মত ঘৃণার শব্দ মাত্র।

অধ্যায় : ১৩। ব্রাহ্মণের উত্থান ও ভারতীয় সমাজ

ভারত-ইতিহাসের সূত্র সন্ধান

 

গ্রন্থের অনলাইন প্রকাশ উপলক্ষ্যে কিছু কথা

হিন্দুদের আদি ধর্মগ্রন্থ হিসাবে পরিচিত ঋগ্বেদ সংক্রান্ত আমার সকল তত্ত্ব বা ধারণার গোড়াপত্তন হয়েছিল ১৯৯০ সালে লিখিত ‘ভারত-ইতিহাসের সূত্র সন্ধান’ নামক গ্রন্থে। সময়ের বিচারে প্রায় ৩১ বৎসর পূর্বে এটি লিখা হয়। কিন্তু এটি এতকাল অপ্রকাশিত রয়ে গিয়েছিল। রচনার পর এই বইয়ের কোনও প্রকাশক পাই নাই। আসলে ঋগ্বেদ এবং সিন্ধু সভ্যতার মধ্যকার সম্পর্ক বিষয়ে আমার বক্তব্য ছিল এমনই নূতন এবং ভিন্নধর্মী যে, তার সমর্থনে দুই বঙ্গের প্রাতিষ্ঠানিক পণ্ডিত মহলে আমি কাউকেই সেই সময় পাই নাই। স্বাভাবকভাবে এমন বইয়ের প্রকাশকও পাই নাই — দুই বঙ্গেই। সেই সময় একমা্ত্র তরুণ ইতিহাস-গবেষক শামসুল আলম চঞ্চল আমার বক্তব্যের সমর্থনে এগিয়ে এসে উদ্যোগী ভূমিকা নিলে এ বক্তব্য নিয়ে যৌথভাবে আমাদের উভয়ের যাত্রা নূতন করে শুরু হয়। এ বিষয়ে আমি বিভিন্ন জায়গায় আলোচনা করায় এখানে আর এ বিষয় নিয়ে নূতন করে কিছু বলব না।

ঋগ্বেদ এবং সিন্ধু সভ্যতার মধ্যকার সম্পর্ক বিষয়ক এই বইয়ের বক্তব্যকে ভিত্তি করে পরবর্তী সময়ে শামসুল আলম চঞ্চল এবং আমি যৌথ কিংবা একক ভাবে ইংরাজী ও বাংলায় বিভিন্ন বই ও প্রবন্ধ প্রকাশ করায় এবং সময়ের সঙ্গে আমার নিজেরও ধারণাগত কিছু পরিবর্তন হওয়ায় এ বই প্রকাশের আর তেমন কোনও তাড়না আমি অনুভব করি নাই।

বস্তুত ভারতীয় উপমহাদেশের সমাজ ও ইতিহাসের রহস্যের তালা খুলতে চেয়ে আমি প্রধানত ঋগ্বেদকে চাবি হিসাবে ব্যবহার করতে গিয়ে বিস্ময়কর আবিষ্কারের সম্মুখীন হই। এই আবিষ্কারের একটি হচ্ছে সিন্ধু সভ্যতার পতনকালে সিন্ধু সমাজের একটি ধর্মীয় সংস্কার আন্দোলনের ফসল হিসাবে ঋগ্বেদের স্বরূপ উপলব্ধি। সিন্ধু সভ্যতার পতনকালে একটি ধর্মীয় সামাজিক আন্দোলনের গতিধারায় যে হিন্দুদের আদি ধর্মগ্রন্থ ঋগ্বেদ রচিত হয় এবং ঋগ্বেদ রচনার সঙ্গে যে তথাকথিত বহিরাগত বা বৈদেশিক আর্যদের কোনও সম্পর্ক নাই এ কথা এই বইয়ে আমি প্রথম খুব জোরের সঙ্গে বলি। এভাবে পণ্ডিত মহলে এক সুদীর্ঘ কাল ধরে বহুলপ্রচারিত এবং সুপ্রতিষ্ঠিত বহিরাগত আর্য আক্রমণ তত্ত্বকে আমি প্রত্যাখ্যান করি।

এটা ঠিক যে, আমি যখন বইটি প্রথম লিখি তখন পর্যন্ত সিন্ধু সভ্যতার উপর প্রত্নতাত্ত্বিক কাজ যেমন তুলনায় যথেষ্ট কম ছিল তেমন আমার কাছে সেগুলির তথ্যও খুব সামান্য ছিল। সুতরাং আমাকে নির্ভর করতে হয়েছিল প্রধানত ঋগ্বেদের উপর। অর্থাৎ সিন্ধু সভ্যতার সমকালীন সমাজ ব্যাখ্যা করেছিলাম মূলত ঋগ্বেদের উপর নির্ভর করে। সেদিক থেকে দেখলে ‘ভারত-ইতিহাসের সূত্র সন্ধান’ খুব বেশী ঋগ্বেদ নির্ভর। প্রাচীন ভারতীয় উপমহাদেশের সমাজ ও ইতিহাসের সূত্র সন্ধানে সেই সময় আমি মহাকাব্য মহাভারতের উপরও গুরুত্ব দিয়েছিলাম। অবশ্য ঋগ্বেদের মতো ধর্মগ্রন্থের এক ধরনের অপরিবর্তনীয়তা বা অলঙ্ঘনীয়তা থাকায় তার উপর সমকালীন সমাজ বাস্তবতা অনুসন্ধানে যতটা নির্ভর করা যায় মহাভারতের মতো পৌরাণিক কাহিনীর উপর ততটা নির্ভর করা যায় না। এখানে খুব বেশী সতর্ক থাকতে হয়। যাইহোক, সব মিলিয়ে ‘ভারত-ইতিহাসের সূত্র সন্ধান’ আমার জন্য হয়ে আছে বিপুল গুরুত্বের অধিকারী গ্রন্থ। বিশেষ করে ভারতীয় ইতিহাসের কিছু জটিল গ্রন্থি উন্মোচনে যাত্রার ক্ষেত্রে এই অপ্রকাশিত গ্রন্থই ছিল আমার জন্য প্রকৃতপক্ষে প্রথম পদক্ষেপ।

সুতরাং অনেক কাল পরে হলেও অনলাইনে এটা প্রকাশের সিদ্ধান্ত নিলাম। প্রায় একত্রিশ বছর আগে পাণ্ডুলিপি যেভাবে লিখেছিলাম কোনও পরিবর্তন ছাড়া সেটিকে সেভাবেই কম্পিউটারে মুদ্রণ করে অনলাইনে প্রকাশ করা হচ্ছে। বইটির অনেক বক্তব্য বা কথা পরবর্তী সময়ে শামসুল আলম চঞ্চল এবং আমার যৌথভাবে লিখিত ও প্রকাশিত ইংরাজী বই The Aryans and the Indus Civilization এবং বিশেষ করে বাংলা ‘আর্যজন ও সিন্ধু সভ্যতা’র মত বইয়ের অন্তর্ভুক্ত হওয়ায় সেইসব বইয়ে কিংবা পরবর্তী বিভিন্ন লেখায় মনোযোগী পাঠক এতকাল অপ্রকাশিত হিসাবে রয়ে যাওয়া ‘ভারত-ইতিহাসের সূত্র সন্ধান’-এর মূল বক্তব্যের অনেক পুনরুক্তি কিংবা ধারাবাহিকতা খুঁজে পাবেন। তবে একই সঙ্গে খুঁজে পাবেন কিছু ভিন্নতা এবং হয়ত কিছু নূতনত্বও। সেই সঙ্গে তখনকার আমার কিছু ধারণা যে পরবর্তী সময়ে আমি পরিত্যাগ করেছিলাম সেটাও পাঠক বুঝবেন। যেমন পারসীদের ধর্মগ্রন্থ আবেস্তা বা জেন্দ্-আবেস্তা পাঠের সময় আমি ধারণা করেছিলাম যে, সিন্ধু সভ্যতার বৈদিক শক্তি-বিরোধী অংশ ইরান গমনের পর সেখানে একটি ধর্মসংস্কার আন্দোলন সংগঠিত করে, যার ফলে সেখানে আবেস্তা রচিত হয়। কিন্তু অধিকতর অধ্যয়ন এবং অনুধ্যানের মধ্য দিয়ে পরবর্তী সময়ে আমি এই সিদ্ধান্তে পৌঁছাই যে, সিন্ধু সভ্যতার শেষ পর্যায়ে সপ্তসিন্ধু অঞ্চলেই পরস্পর বিরুদ্ধ দুইটি ধর্মসংস্কার আন্দোলন হয় যার ফলে সমান্তরালে রচিত হয় দুইটি পরস্পর বিরুদ্ধ ধর্মগ্রন্থ — ঋগ্বেদ এবং আবেস্তা। এ প্রসঙ্গে ২০০৩ সালে প্রকাশিত শামসুল আলম চঞ্চল এবং আমার যৌথভাবে লিখিত গ্রন্থ ‘আর্যজন ও সিন্ধু সভ্যতা’য় আমার নূতন উপলব্ধি উল্লেখ করেছি। অধিকন্তু সিন্ধু সভ্যতার প্রত্নতাত্ত্বিক আবিষ্কারের অনেক নূতন তথ্য আমার এই গ্রন্থ রচনাকালীন ধারণাতেও অনেক পরিবর্তন ঘটিয়েছে। সেগুলির ছাপ পড়েছে পরবর্তী রচনাগুলিতে। তা সত্ত্বেও সিন্ধু সভ্যতা তথা প্রাচীন ভারতীয় উপমহাদেশের সমাজ ও ইতিহাসের সূত্র অনুসন্ধানের পথে শামসুল আলম চঞ্চল এবং আমার কখনও যৌথ এবং কখনও একক যে যাত্রা সেই যাত্রার শুরুর জায়গাটা হল এতকাল অপ্রকাশিত হয়ে থাকা গ্রন্থ ‘ভারত-ইতিহাসের সূত্র সন্ধান’। সেই যাত্রার মূল্য আমার কাছে অপরিমেয়। এটা শুধু যাত্রা নয়। এর সঙ্গে জড়িয়ে আছে ইতিহাসের সত্য প্রতিষ্ঠার জন্য চঞ্চল এবং আমার উভয়েরই এক দীর্ঘ এবং প্রবল লড়াই। সেই লড়াইয়ের পথে প্রথম পদক্ষেপের স্মারক হিসাবে একত্রিশ বৎসর পর হলেও অনলাইনে ‘ভারত-ইতিহাসের সূত্র সন্ধান’ প্রকাশের সিদ্ধান্ত।

শেষ করার আগে এই গ্রন্থের ‘ভূমিকা’য় যে কথা বলেছি তার পুনরুক্তি করে বলি ‘ভারত-ইতিহাস’ বলতে আমি মোটেই আজকের ভারত-রাষ্ট্রের অন্তর্ভুক্ত অঞ্চলের ইতিহাসকে বুঝাই নাই। বরং সমগ্র ভারতীয় উপমহাদেশ কিংবা ভারতবর্ষ বলতে অনেক ভিন্নতা ও বৈচিত্র্যের মধ্যেও মূলত অভিন্ন সভ্যতা, ইতিহাস ও সংস্কৃতির অধিকারী আসমুদ্র হিমাচল যে ভূমি আমাদের কল্পনায় জেগে উঠে তার ইতিহাসকে বুঝাতে চেয়েছি। সেই ঐতিহাসিক ভারত আজকের রাজনৈতিক ভারতের চেয়ে অনেক অনেক বড়। বিশেষত ‘ভারতবর্ষের ইতিহাসের সূত্র সন্ধান’ ‘কিংবা ভারতীয় উপমহাদেশের ইতিহাসের সূত্র সন্ধান’ এভাবে গ্রন্থের নাম দিলে সেটি নামের উচ্চারণের ক্ষেত্রে ছন্দ পতন ঘটায় বলে মনে হয়েছিল। সুতরাং ছন্দবদ্ধতা তথা শ্রুতিমধুরতা দিতে চেয়েও সংক্ষিপ্তভাবে ‘ভারত-ইতিহাস’ শব্দের ব্যবহার করেছিলাম পাণ্ডুলিপির নামের ক্ষেত্রে। পাণ্ডুলিপির নাম ‘ভারত-ইতিহাসের সূত্র সন্ধান’ সেই একই প্রয়োজনবোধ থেকে অপরিবর্তিত রাখা হল। আমার মনে হয় না তাতে গ্রন্থের নামের নিহিতার্থ বুঝতে পাঠকের কোনও সমস্যা হবে।

লেখক,

২১ আগস্ট, ২০২১

 

        
বিষয়সূচী :

১। ভূমিকা

২। ঋগ্বেদ-সংহিতা

৩। দেবতা ইন্দ্র ও বৃত্রবধ

৪। সিন্ধু সভ্যতা

৫। সিন্ধুর ঈশ্বর এবং ঋগ্বেদের বরুণ

৬। সিন্ধুর জলসেচব্যবস্থা এবং ঋগ্বেদের বৃত্র

৭। মহাভারত ও সিন্ধু সভ্যতা

৮। মহাভারত-যুদ্ধের পটভূমি ও তাৎপর্য

৯। সিন্ধু সভ্যতার পতন ও বৈদিক ধর্মের উত্থান

১০। সিল, চিত্র এবং লিপি প্রশ্ন

১১। আর্য প্রশ্ন

১২। যেন্দ্–আবেস্তা ও ঋগ্বেদ

১৩। ব্রাহ্মণের উত্থান ও ভারতীয় সমাজ

১৪। উপসংহার

 

১। ভূমিকা

প্রথমেই বলা প্রয়োজন যে এই আলোচনায় ভারত বলতে শুধু আজকের ভারত-রাষ্ট্রকে বোঝানো হয় নি, বরং অনেক রাষ্ট্র সমন্বয়ে গঠিত সমগ্র ভারতীয় উপমহাদেশকে বোঝানো হয়েছে। সুতরাং এই আলোচনার উদ্দেশ্য সমগ্র উপমহাদেশীয় ইতিহাসের সূত্র সন্ধান করা।

বহু রাষ্ট্রে, ভাষায়, ধর্মে, জাতিতে ও অঞ্চলে বিভক্ত এই উপমহাদেশে এমন কিছু বৈশিষ্ট্য আছে যা থেকে আমরা বহু বৈচিত্র্য ও বৈপরীত্যের ভিতরেও একটি ঐক্য বা ছন্দ অনুভব করি। ভারতীয় উপমহাদেশের বিশেষ বৈশিষ্ট্যসমূহ সমগ্র উপমহাদেশের সমাজ জীবনে বিভিন্নভাবে প্রতিফলিত। এগুলি উপমহাদেশব্যাপী সমাজ বিকাশে অসমতা, সংঘাত ও জটিলতারও কারণ হয়েছে।

বস্তুত ভারতবর্ষের ইতিহাস সুপ্রাচীন হলেও তার অনেকটাই আজও রহস্যে ঢাকা আছে। এর ফলে ভারতীয় সমাজের বিকাশধারাও অনেকটাই রহস্যমণ্ডিত হয়ে আছে। এই সমাজ বিকাশধারাকে ঠিক মত বুঝতে না পারা অনেক ক্ষেত্রে সুষম সামাজিক বিকাশের পথে বিভিন্ন ধরনের প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে। কারণ বর্তমানের অনেক সমস্যার উৎস অতীতে লুকিয়ে থাকে। তাই অতীতকে বুঝতে না পারলে বর্তমানকে যেমন ভালভাবে বোঝা যায় না তেমন তার সমস্যাগুলিকে সঠিকভাবে মীমাংসার উপায়ও পাওয়া যায় না।

সুতরাং ভারতীয় উপমহাদেশের সমস্ত জাতি ও সমাজের সুস্থ বিকাশের জন্য এই উপমহাদেশের ইতিহাসের নিজস্ব বিকাশধারা ও তার কারণসমূহ বোঝা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এই গুরুত্বের কথা বিবেচনা করেই এই আলোচনার সূত্রপাত। তবে এ প্রসঙ্গে প্রথমে বলে রাখা প্রয়োজন যে, ভারতীয় ইতিহাসের বহু জটিল প্রশ্নের নিরসনের জন্য যে দীর্ঘ আলোচনা ও বিশ্লেষণ প্রয়োজনীয় তার সুযোগ আমরা এখানে পাব না। এখানে লেখকের প্রধান উদ্দেশ্য হল আপাত দৃষ্টিতে বিচ্ছিন্ন ভারতীয় ইতিহাসের বিভিন্ন পর্বের মধ্যে যোগসূত্র খুঁজে বের করে ভারতীয় তথা উপমহাদেশীয় সমাজ বিকাশের বিশেষ ধারাটিকে বোঝার চেষ্টা করা।

হাজার হাজার বৎসরের বিভিন্ন ঘটনা প্রবাহ দ্বারা আজকের উপমহাদেশের যে ইতিহাস রূপ নিয়েছে সেই ইতিহাসের রহস্য ভেদ করার সর্বোৎকৃষ্ট উপায় হল তার অতীত উৎসে উপস্থিত হওয়া যেখানে সভ্যতার প্রাথমিক পর্যায়ে আজকের বিবর্তিত জটিল সামাজিক রূপগুলির আদি ও সরল পূর্বরূপ দানা বাঁধছে। অর্থাৎ আজকের সভ্য সমাজ যখন জন্ম নিচ্ছে বা নিয়েছে সেই দূর অতীত উৎসে পৌঁছতে পারলে অপেক্ষাকৃত সরল এবং আদি অবস্থায় সমাজের গঠন প্রক্রিয়াকে বোঝা সহজ হয়, ফলে পরবর্তী সমস্ত বিকাশ প্রক্রিয়া ও জটিলতাকেও অপেক্ষাকৃত সহজে ধরা যায়।

প্রাচীন ইতিহাস বুঝবার ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় সহায়ক হল লিখিত ইতিহাস বা প্রাচীন দলিলাদি। প্রাচীন ভারতে ইতিহাস চর্চা কম। খুব প্রাচীন কালের সিন্ধু সভ্যতার যেটুকু লিপি পাওয়া গেছে তার পাঠোদ্ধার হয় নি। সুতরাং সবচেয়ে প্রাচীন সাহিত্য হিসাবে আমরা যেটা পাচ্ছি সেটা হচ্ছে বেদ বিশেষত তার সবচেয়ে প্রাচীন অংশ ঋগ্বেদ। বলা বাহুল্য এটা ইতিহাস গ্রন্থ নয়। এটা ধর্মগ্রন্থ। মূলত দেবতাদের উদ্দেশ্যে রচিত বহুসংখ্যক মন্ত্রের সংকলন। দেবতাদের উদ্দেশ্যে রচিত হলেও তা বিশেষ সমাজের মানুষদের দ্বারাই রচিত। সুতরাং এই গ্রন্থে সেই সমাজের বাস্তবতারও কিছু প্রতিফলন অবশ্যই ঘটবে। কাজেই ভারত-ইতিহাসকে বোঝার জন্য আমরা বেদের প্রাচীনতম অংশ ঋগ্বেদের সাহায্য নিতে পারি।

ঋগ্বেদের রচনা কাল নিয়ে বিতর্ক আছে। তবে কিছু সংখ্যক পণ্ডিতের ঝোঁক হল ঋগ্বেদের রচনা কালকে মূলত খ্রীস্টপূর্ব পনের বা ষোল শতাব্দীতে নির্দিষ্ট করার দিকে। আমাদের আলোচনার সুবিধার জন্য আপাতত এই সময়টিকে ধরে নিয়ে অগ্রসর হতে পারি। কাজেই আমরা ঋগ্বেদের সাহায্যে সেই সময়ের সমাজচিত্র পাবার চেষ্টা করতে পারছি।

তারও পূর্বে আছে সিন্ধু সভ্যতার কাল। এক সময় বেদ রচয়িতা আর্যদেরকে ভারতীয় সভ্যতার সূচক মনে করা হলেও সিন্ধু সভ্যতার ধ্বংসাবশেষ আবিষ্কারের পর সেই ধারণা বদলে গেছে। সিন্ধু সভ্যতার জন্ম ও বিকাশ কাল নিয়েও বিভিন্ন মতামত থাকলেও আমরা একটি বিশেষ মত অনুসারে খ্রীস্টপূর্ব ৩০০০ অব্দ থেকে খ্রীস্টপূর্ব ১৫০০ অব্দ পর্যন্ত তার আনুমানিক স্থায়ীত্ব কাল ধরে নিয়ে আলোচনায় অগ্রসর হতে পারি।

ভারত সভ্যতার উৎসে পৌঁছবার জন্য আমরা আর একটি গ্রন্থের সাহায্য নিতে পারি, তাহল মহাভারত। এর যুক্তি হল: তার বর্তমান রূপ যা-ই হোক তার মূল রচনাকাল নগর সভ্যতার প্রাথমিক পর্যায়ে কিংবা তার প্রাক্কালে এমনই মনে হয়। কারণ এখানে আমরা পাই পঞ্চপাণ্ডবের এক স্ত্রীর বিবরণ যা সভ্য সমাজের চিহ্ন নয়। সভ্যতার বিকাশ পুরুষ প্রাধান্য বা পিতৃতন্ত্রকে দৃঢ়বদ্ধ করেছিল। বৃহদায়তনে উৎপাদন এবং জটিল ও বৃহৎ সমাজ বিন্যাসের ফলে অর্থনীতি ও সমাজ নিয়ন্ত্রণ সম্পূর্ণরূপে পুরুষের হাতে চলে যায়। এই অবস্থায় পুরুষ তার সন্তানের উপর পিতৃত্ব নিশ্চিত করতে চেয়ে বহুপতিত্ব বা পলিয়ান্ড্রির বিরোধিতা করবে এটাই স্বাভাবিক। কাজেই মহাভারত পরবর্তীতে যে রূপই নিক তার বীজ বা নিউক্লিয়াস সিন্ধু সভ্যতারও প্রাচীন হওয়া সম্ভব।

সুতরাং আমরা ভারতীয় ইতিহাসের সূত্র সন্ধান করতে গিয়ে তার উৎসের উদ্দেশ্যে যাত্রা করছি। এই যাত্রায় আপাতত আমাদের তিনটি মূল উপকরণ হল ঋগ্বেদ, সিন্ধু সভ্যতার নিদর্শনাদির উপর বিভিন্নগ্রন্থ এবং মহাভারত। এই যাত্রায় আমরা প্রয়োজনে আরও অন্যান্য গ্রন্থ ও তথ্যের সাহায্য নিলেও আপাতত এই তিনটিকেই সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ মনে করছি।

 

২। ঋগ্বেদ-সংহিতা

আমরা প্রথমে ঋগ্বেদ-সংহিতায় প্রবেশ করব। স্বাভাবিকভাবে ঋগ্বেদ পাঠের পূর্বে তার রচয়িতাদের সম্পর্কে আমাদের একটা ধারণা তৈরী হয়ে থাকবার কথা। এই কথাই বহু প্রচলিত এবং প্রতিষ্ঠিতও যে, ভারতবর্ষে বহিরাগত আক্রমণকারী, যাযাবর এবং পশুপালক আর্যরা ঋগ্বেদ রচনা করেছে। সুতরাং এই ধারণা নিয়েই আমরা ঋগ্বেদ পড়তে শুরু করি।

কিন্তু এই ধারণা নিয়ে ঋগ্বেদ পাঠ শুরুর পর আমরা হোঁচট খাই। বস্তুত ঋগ্বেদের যত ভিতরে প্রবেশ করা যায় আমাদের এই সনাতন ধারণাটা ততবেশী ঘা খায় এবং এক সময় ঋগ্বেদের ভিতরের বাস্তবতার আঘাতে চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে যেতে চায়। কারণ এই ধারণার সঙ্গে ঋগ্বেদের সাহিত্য শক্তি ও তার মর্মবস্তু আদৌ মেলে না। ঋগ্বেদ দর্শন বা বিজ্ঞান গ্রন্থ না হলেও তার প্রতিটি মন্ত্রে যে মন নিহিত আছে তা বর্বর কিংবা যাযাবর, অশিক্ষিত বা অর্ধশিক্ষিতেরও হতে পারে তা বিশ্বাস করাই কঠিন হয়ে ওঠে।

দেবতাদের উদ্দেশ্যে স্তুতি কিংবা বিভিন্ন বিষয়ের উপর রচিত মন্ত্রসমূহে যেসব উপমা বা রূপকল্প ব্যবহার করা হয়েছে কিংবা যেসব দর্শন চিন্তা ও জিজ্ঞাসা প্রকাশ পেয়েছে যাযাবর, অর্ধ-যাযাবর এবং অপরিশীলিত মন থেকে সেসব আশা করাই অনুচিত।

এটা ঠিক যে, ঋগ্বেদের মূল পটভূমিই হচ্ছে যুদ্ধ। সুতরাং শত্রুর বিরুদ্ধে যুদ্ধে বিজয়, নিরাপত্তা এবং ধন-সম্পদ লাভ ঋগ্বেদের অধিকাংশ মন্ত্র রচনার প্রেরণা যুগিয়েছে।

কিন্তু প্রশ্ন, যুদ্ধের প্রেরণা থাকলেই কি কোন যাযাবর পশুপালক কিংবা বর্বর হানাদারদের পক্ষে ঋগ্বেদের মত ধর্মগ্রন্থ রচনা করা সম্ভব? তাহলে তো শক, হুন, মোংগলরাও ঋগ্বেদের মত ধর্মগ্রন্থ রচনা করতে পারত। এমন ধরনের যাযাবর কিংবা আক্রমণকারী জনগোষ্ঠী দ্বারা ঋগ্বেদের মত সাহিত্যমূল্যবিশিষ্ট ধর্মগ্রন্থ রচিত হয়েছে পৃথিবীর ইতিহাসে এমন কোনও দৃষ্টান্ত নেই।

বস্তুত শিক্ষা ও সংস্কৃতির সুদীর্ঘ ও অত্যন্ত শক্তিশালী পটভূমি ছাড়া যে ঋগ্বেদের মত গ্রন্থ রচনা অসম্ভব এই সিদ্ধান্তে পৌঁছবার জন্য বৈদিক ভাষা কিংবা ভাষাতত্ত্বে পণ্ডিত হবার কোন প্রয়োজন হয় না। এইটুকু বোঝাই যথেষ্ট যে যুদ্ধরত যাযাবর কিংবা অর্ধযাযাবর জীবনে মানসিক বৃত্তির স্ফূরণের কোন বাস্তব ভিত্তিই থাকে না। সেই সময় যুদ্ধের শক্তি অর্থাৎ যোদ্ধারা হবে সমাজের মূল নায়ক, আর পুরোহিত বা যাদুকরদের কাজ হবে যোদ্ধা নেতৃত্বের অধীনস্থ হয়ে যাযাবর ও বর্বর সমাজের প্রচলিত নিয়মে ধর্মীয় অনুষ্ঠান পালন করা। তার জন্য এত উপমা, সূক্ষ্মতা ও চিন্তার প্রয়োজন এবং অবকাশ কোনটাই থাকে না। ফলে ঋগ্বেদ বহিরাগত, যাযাবর ও যুদ্ধরত সমাজের সৃষ্টি এই যুক্তি টেকে না।

কাজেই এমন একটা সম্ভাবনার কথা মনে হতে পারে যে, ঋগ্বেদের ঋষিরা মূলত স্থানীয় সভ্য সমাজ থেকে আগত যারা বহিরাগত আক্রমণকারীদের অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। কারণ বর্বরদের হাতে সভ্য সমাজ পরাজিত হলেও সভ্যতার সবটা ধ্বংস হয় না। সভ্যতাকে পরাজিত করতেও বর্বরদের অন্তত উন্নত সামরিক প্রযুক্তিকে আয়ত্ত করতে হয়। কারণ গাছের ডাল বা পাথরের হাতিয়ার ধারী বর্বর মানুষের পক্ষে তাম্র বা লৌহাস্ত্রধারী সুসংগঠিত বাহিনীকে মোকাবিলা করাই সম্ভব নয়। অন্যদিকে বিজয়ী হয়ে বর্বররা শুধু সম্পদ লুণ্ঠন করে না সভ্য মানুষদের অনেককে বন্দী বা অধীনস্থ করে সভ্যতারও বহু উপকরণ গ্রহণ করতে বাধ্য হয়।

কিন্তু এই যুক্তির বিপরীতে প্রশ্ন জাগে যে, পরাজিত ও অধীনস্থ মানুষ বিজয়ীর সেবক বা দাস হতে পারে কিন্তু তার কাছ থেকে ঋগ্বেদের মত সৃষ্টি বেরিয়ে আসতে পারে কি? সামান্য কয়েকটি উদ্ধৃতি দিলেই আমরা এই প্রশ্নের উত্তর পাব বলে মনে হয়।

ঋগ্বেদের চিন্তা বা কল্পনা শক্তি বোঝার জন্য ১ মণ্ডলের ১১৩ সূক্তের ১০ ও ১১ ঋক উদ্ধৃত করা যায় :

১০। কত কাল হতে ঊষা উৎপন্ন হচ্ছেন, কত কাল পর্যন্ত উৎপন্ন হবেন। বর্তমান ঊষা পূর্ব ঊষাকে সাগ্রহে অনুকরণ করেছেন, আবার আগামী ঊষাসমূহ এ দীপ্তিমান ঊষাকে অনুকরণ করবেন। ১১। যে মানুষেরা অতি পূর্বকালের ঊষাকে আলোক প্রকাশ করতে দেখেছিলেন তাঁরা এক্ষণে গত হয়েছেন; আমরা এক্ষণে ঊষাকে দর্শন করছি, ভবিষ্যতে যাঁরা ঊষাকে দর্শন করবেন তাঁরা আসছেন।

নিম্নলিখিত ঋকটি গভীর চিন্তা জাগায় : দুটি পক্ষী বন্ধুভাবে এক বৃক্ষে বাস করে। তাদের মধ্যে একটি স্বাদু পিপ্পল ভক্ষণ করে, অন্য ভক্ষণ করে না - কেবলমাত্র অবলোকন করে। (১ মণ্ডল। ১৬৪ সূক্ত। ২০ ঋক)।

১০ মণ্ডল, ৮২ সূক্ত থেকে দুটি ঋক উদ্ধৃত করা যাক :

৩। যিনি আমাদের জন্মদাতা পিতা, যিনি বিধাতা, যিনি বিশ্বভুবনের সকল ধাম অবগত আছেন, যিনি একমাত্র অথচ সকল দেবের নাম ধারণ করেন, অন্য সকল ভুবনের লোকে তার বিষয়ে জিজ্ঞাসাযুক্ত হয়।

৭। যিনি এ সৃষ্টি করেছেন, তাঁকে তোমরা বুঝতে পার না, তোমাদের অন্তঃকরণ তা বুঝবার ক্ষমতা প্রাপ্ত হয় নি। কুজ্ঝটিকাতে আচ্ছন্ন হয়ে লোকে নানা প্রকার কল্পনা করে, তারা আপন প্রাণের তৃপ্তির জন্য আহারাদি করে এবং স্তব স্তুতি উচ্চারণ করে বিচরণ করে।

এই গভীর ও উন্নত চিন্তাকে খাটো করে দেখবার কোন উপায় থাকে কি? কিংবা ধরা যাক ১০ মণ্ডলের ১২৯ সূক্তের কয়টি ঋকের কথা ঃ

১। সেকালে যা নেই তাও ছিল না, যা আছে তাও ছিল না। পৃথিবীও ছিল না, অতি দূরবিস্তার আকাশও ছিল না। আবরণ করে এমন কি ছিল? কোথায় কার স্থান ছিল? দুর্গম ও গম্ভীর জল কি তখন ছিল? ২। তখন মৃত্যুও ছিল না, অমরত্বও ছিল না, রাত্রি ও দিনের প্রভেদ ছিল না। কেবল সে একমাত্র বস্তু বায়ুর সহকারিতা ব্যতিরেকে আত্মা মাত্র অবলম্বনে নিশ্বাস-প্রশ্বাসযুক্ত হয়ে জীবিত ছিলেন। তিনি ব্যতীত আর কিছুই ছিল না।

নিশ্চয় এমন গভীর চিন্তা মনকে নাড়া না দিয়ে পারে না। কিন্তু এখানেই শেষ নয়। ঋষি শেষ দুটি ঋকে যে প্রশ্ন তুলেছেন তা হল সবচেয়ে বিস্ময়করঃ

৬। কেই বা প্রকৃত জানে? কেই বা বর্ণনা করবে? কোথা হতে জন্মিল? কোথা হতে এ সকল নানা সৃষ্টি হল? দেবতারা এ সমস্ত নানা সৃষ্টির পর হয়েছেন। কোথা হতে যে হল, তা কেই বা জানে?

৭। এ নানা সৃষ্টি যে কোথা হতে হল, কার থেকে হল, কেউ সৃষ্টি করেছেন, কি করেন নি, তা তিনিই জানেন, যিনি এর প্রভুস্বরূপ পরমধামে আছেন। অথবা তিনিও না জানতে পারেন।

সৃষ্টির আদি কারণ জিজ্ঞাসা থেকে ঋষি যে স্থানে পৌঁছেছেন কত অসাধারণ চিন্তাশক্তি থাকলেই যে সেটা সম্ভব তা সহজেই অনুমেয়। এ শুধু উন্নত দর্শন চিন্তা নয় তার চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হল একটি ধর্মগ্রন্থে এই ধরনের সন্দেহবাদী দর্শন চিন্তামূলক মন্ত্রকে স্থান দেওয়া।

এই রকম সন্দেহবাদী দার্শনিক জিজ্ঞাসা কি খুব পশ্চাৎপদ কিংবা যাযাবর ও যোদ্ধা সমাজের মাথায় জাগা সম্ভব? অনেক সভ্য সমাজও তো এই ধরনের চিন্তার প্রকাশকেই সহ্য করে না।

ঋগ্বেদের সব মন্ত্র বা ঋকে যে এমন উন্নত চিন্তার প্রকাশ ঘটেছে তা নয়। ঋগ্বেদ ধর্মগ্রন্থ। সুতরাং সেখানে দর্শন বা যুক্তিবিদ্যা আশা করা ভূল হবে। কিন্তু তা সত্ত্বেও ঋগ্বেদের বিভিন্ন মন্ত্রে গভীর চিন্তার যেটুকু প্রকাশ ঘটেছে পাঠকের মনকে অভিভূত করার জন্য সেটুকু যথেষ্ট হবে। বৈদিক ভাষা না জেনেও অনুবাদের মাধ্যমে ঋগ্বেদের শক্তিকে অনুভব করা যায়। তার বক্তব্যের বিন্যাস বা গাথুনি, রূপকল্প এবং উপস্থাপনা ইত্যাদি প্রমাণ করে যে ঋগ্বেদের ভিত্তিমূলে আছে একটি সুউন্নত সভ্যতা।

ঋগ্বেদ পাঠ দ্বারা আমরা একটি দৃঢ় সিদ্ধান্তে পৌঁছতে বাধ্য হই যে, তা পরাধীন বা অধীনস্থ ঋষিদের সৃষ্টি যেমন নয় তেমন বহিরাগত আক্রমণকারী সমাজ থেকে আগত ঋষিদেরও সৃষ্টি নয়। একটি স্বাধীন ও সুউন্নত সমাজের ভিতর থেকে এবং স্বাধীন কণ্ঠ থেকে ঋগ্বেদ স্বতঃস্ফূর্তভাবে উচ্চারিত হয়েছে।

ঋগ্বেদ যে বহিরাগতদের সৃষ্টি নয় এই ধারণা অধিকতর দৃঢ়বদ্ধ হয় যখন দেখা যায় যে, ঋগ্বেদের ঋষিরা বিভিন্ন মন্ত্রে শত্রু হিসাবে যেসব নাম উল্লেখ করেছেন তাদের অধিকাংশকেই বৈদিক বা আর্য  নাম থেকে পৃথক করা যায় না। এখানে একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় বলে রাখা দরকার যে, ঋগ্বেদের ঋষিরা নিজেদের কখনও আর্য বললেও শত্রুদেরকে কখনও অনার্য বলেন নি। অধিকাংশ ক্ষেত্রে শত্রুকে দাস বা দস্যু বলেছেন। কখনও শত্রু হিসাবে পণি নামের উল্লেখ করেছেন। শত্রুদের সম্পর্কে কখনও রাক্ষস শব্দ ব্যবহার করা হলেও তার ব্যবহার কম এবং তা কারও নামের পূর্বে পরিচয় হিসাবে ব্যবহার করা হয় নি। সম্ভবত এটা জঙ্গলী নরখাদকদের সম্পর্কে ব্যবহার করা হত যা যুদ্ধের সময় প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে ঘৃণা প্রকাশের জন্য ব্যবহার করা হয়েছে। ঋগ্বেদে ঋষিরা নিহত বা বিনাশকৃত দাস, দস্যু ইত্যাদি পরিচয়ে বা দেবরহিত, যজ্ঞবিরোধী হিসাবে যেসব শত্রু নাম দিয়েছেন সেগুলির সংখ্যা হবে অর্ধশতের কিছু বেশী। এগুলির মধ্যে ১০।১৫টির মত হল দেবতা ইন্দ্রের প্রতিদ্বন্দ্বী দেবতা বা অসুর কিংবা প্রাকৃতিক শক্তি অথবা বস্তু। বাকীগুলি হল মানুষের নাম যাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধের প্রক্রিয়ায় ঋগ্বেদ রচিত হয়েছে বলে বোঝা যায়।

এখন আমরা স্বাভাবিকভাবেই এই ভেবে অবাক হব যে, যাদের বিরুদ্ধে ঋষিদের যুদ্ধ জয়ের জন্য ইন্দ্র ও অন্যান্য দেবতার সাহায্য ভিক্ষা করে কিংবা যুদ্ধ জয়ের পর আনন্দে ও কৃতজ্ঞতায় দেবতাদের উদ্দেশ্যে মন্ত্রোচ্চারণ সেইসব আর্য শত্রুরা ভিন্ন সমাজ বা দেশের হলে তাদের নামের সঙ্গে এইসব ঋষিরই কারও কারও নামের এত মিল হয় কি করে?

আমরা খুব সংক্ষেপে এই বিষয়ে আলোচনা করতে পারি। ১।১৩০।৮, ৮।৯৬।১৩, ১৪, ১৫ ইত্যাদি ঋকে বৈদিক শত্রু কৃষ্ণের উল্লেখ পাওয়া যায় যাকে ইন্দ্র বধ করেন। অথচ অষ্টম মণ্ডলের ৮৫ ও ৮৭ সূক্তের রচয়িতা হলেন আঙ্গিরস কৃষ্ণ । এই একই মণ্ডলে ৮৬ সূক্ত রচয়িতা হলেন কৃষ্ণের পুত্র বিশ্বকায় ঋষি। দশম মণ্ডলে ৪৪ নম্বর সূক্তের রচয়িতাও হলেন কৃষ্ণঋষি। ইন্দ্র “অর্বুদকে অধোমুখ করে বিনাশ করেছিলেন” (২।১৪।৪ ইত্যাদি)। এদিকে ঋগ্বেদের রচয়িতা ঋষিদের মধ্যে দশম মণ্ডলে আমরা অর্বুদ নামে একজন ঋষিকে পাচ্ছি। ইন্দ্র কবষকে “আনুপূর্বরূপে জলে নিমগ্ন করেছিলেন” (৭।১৮।১২)। অথচ কবষ নামে একজন ঋষি ঋগ্বেদের দশম মণ্ডলে ৩০ থেকে ৩৪ সূক্ত পর্যন্ত সকল সূক্তের রচয়িতা। “যে ইন্দ্র সুখে অশ্বকে বিনাশ করেছিলেন” (২।১৪।৫) সেই ইন্দ্রের স্তুতিতে অষ্টম মণ্ডলে অশ্বসূক্তি ঋষি এবং অশ্বপুত্র বশ-ঋষি মন্ত্র রচনা করেছেন। উপরন্তু অশ্ব দেবতার স্তুতিতেও সূক্ত রচিত হয়েছে। যেমন ১ মণ্ডলের ১৬২ ও ১৬৩ সূক্ত। শ্রুতকেও ইন্দ্র “আনুপূর্বরূপে জলে নিমগ্ন করেছিলেন” (৭।১৮।১২)। ঋগ্বেদের পঞ্চম মণ্ডলে অত্রিবংশীয় ঋষি বসুশ্রুত এবং অত্রির অপত্য ঋষি শ্রুতবিদ এবং অষ্টম মণ্ডলে ঋষি শ্রুতবন্ধু ও শ্রুতকক্ষ ইত্যাদি নাম পাচ্ছি। অর্থাৎ শ্রুত নামটি বৈদিক। ৭।১৮।২০ ঋকে ইন্দ্রকে উদ্দেশ্য করে বলা হচ্ছে “তুমি মান্যমানের পুত্র দেবককে বধ করেছ।” দেবক শব্দটা বৈদিক। অন্যদিকে অষ্টম মণ্ডলের একজন ঋষি হলেন মান্য। মান্যমানের সঙ্গে তফাৎটা সামান্য। ২।১৩।৮ ঋকে ঋষি বলছেন, “হে বহুকর্মকর্তা ইন্দ্র! তুমি হব্য লাভ ও দাসদের নাশের উদ্দেশ্যে নৃমরের পুত্রসহবসুকে বিনাশ করার জন্য বলবতী বজ্রধারার নির্মল মুখ প্রদেশে ওকে প্রদান করেছ, তুমি স্তুতিযোগ্য।” এদিকে ঋগ্বেদের বিভিন্ন মণ্ডলে সূক্ত রচয়িতা ঋষি হিসাবে বসুশ্রুত, প্রভুবসু, বসুমনা, বসুকর্ণ, বসুকৃৎ ইত্যাদি নাম যেমন পাওয়া যাচ্ছে তেমন অষ্টম মণ্ডলে দুইজন ঋষির পিতার নাম সহ পাওয়া যাচ্ছে। তাছাড়া প্রথম মণ্ডলের ১০০তম সূক্তের রচয়িতা বৃষাগিরের পুত্রগণ ঋষিগণের মধ্যে একজনের নাম সহদেব।

এগুলি ছাড়া আরও কয়টি নামের সঙ্গে বৈদিক দেবতার নামের মিল দেখা যায়। ইন্দ্র “গাভী-হরণকারী বল নামক শত্রুর গহবর উদ্ঘাটিত” করেছিলেন (১।১১।৫)। অথচ বহু ঋকে ইন্দ্র, অগ্নি ইত্যাদি দেবতাকে বলের পুত্র বলা হচ্ছে। বল অর্থ শক্তি। অর্থাৎ শব্দটা বৈদিক। ইন্দ্রের সবচেয়ে বড় কীর্তি হিসাবে যে বৃত্রবধের কথা ঋগ্বেদের ঋষিরা বার বার উচ্ছ্বসিত কণ্ঠে উচ্চারণ করেছেন সেই বৃত্রের এক নাম বলা হচ্ছে অহি। বহুবার অহি বধের বর্ণনা দেওয়া হয়েছে। ঋগ্বেদে অহি এক অত্যন্ত ঘৃণিত শক্তির নাম। অথচ এই একই গ্রন্থে বহুসংখ্যক মন্ত্রে ঋষিরা অহির্বুধ্ন্য বা অহির্বুধ্ন্যা নামক এক দেবতার কাছে প্রার্থনা করেছেন। যেমন ৫।৪১।১৬ ঋকে বলা হচ্ছে, “দেব অহির্বুধ্ন্য যেন আমাদের অনিষ্ট না করে শত্রুদের সংহার করেন।” এখন প্রশ্ন অহির্বুধ্ন্য কে? “সায়ণাচার্যের মতে ‘বুধ্ন্য’ শব্দের অর্থ অন্তরীক্ষে জাত, ‘অহির্বুধ্ন্যা’ শব্দের অর্থ অন্তরীক্ষে জাত অহি নামক দেবতা।” (ঋগ্বেদ-সংহিতা, প্রথম খণ্ড। টীকা, পৃষ্ঠা : ৩৭৫)। অর্থাৎ পৃথিবীর অহি ঘৃণিত ও দেবশত্রু হলেও অন্তরীক্ষের অহি পূজনীয়। এটা কিভাবে সম্ভব যে, “অনার্যদের” দেবতার নাম অহি আর এই অহি বা বৃত্রের অনুচরদের বিরুদ্ধে বহিরাগত যে “আর্যরা” যুদ্ধ করছে তাদের দেবতার নাম অহির্বুধ্ন্য বা অন্তরীক্ষের অহি? ইন্দ্র কর্তৃক বিনাশকৃত আর এক শত্রুর নাম রুধিক্রা (২।১৪।৫)। অশ্বরূপ অগ্নি বা সূর্য-এর নাম হল দধিক্রা। শব্দ দুটির নৈকট্য লক্ষণীয়।

ইন্দ্র কর্তৃক বিনাশকৃত বা নিহত আরও কিছু শত্রুনাম উল্লেখ করা যায় যেগুলিকে বৈদিক সমাজের নামের মত মনে হয়। যেমন, বৃহদ্রথ, শুষ্ণ, পণি, পর্ণয়, কুযব, কুয়ব, কুথর, পিপ্রু, রৌহিণ, উরণ, নমুচি, দৃভীক, নববাস্তু, বৃদ্ধ, বৃষশিপ্র, মৃগয়, অহীশূব, বরশিখের পুত্র বৃচীবান, বেতসু, তুগ্র, অংহা, অনর্শনি, বর্চি, শম্বর, শরত, ঔর্ণনাভ, যুধ্যামধি, আর্য অর্ণ, চিত্ররথ ইত্যাদি।

অবশ্য একটা যুক্তি হতে পারে যে, “অনার্য” শত্রুদের নাম সঠিকভাবে উচ্চারণ করতে না পারায় “অনার্য” নামগুলি “বহিরাগত আর্যদের” বৈদিক ভাষায় উচ্চারিত ও লিখিত হওয়ায় এমন অবস্থা হয়েছে। কিন্তু আমরা বৈদিক আর্যদের নামের ক্ষেত্রেও দাস এবং দস্যু শব্দের যে ব্যবহার দেখি তার ব্যাখ্যা কিভাবে দিব? দাস ও দস্যুদের বিরুদ্ধে ইন্দ্র কর্তৃক সাহায্যপ্রাপ্ত হয়ে যুদ্ধ জয়ী যে কয়জন রাজার নাম ঋগ্বেদে বহুবার উল্লেখিত হয়েছে তাদের মধ্যে তিনজনের নাম হল দিবোদাস, সুদাস এবং ক্রসদস্যু। দাস এবং দস্যু শব্দ যদি অনার্য জাতির হয় তবে আর্যরা কেন এই নাম নিবে? যুদ্ধরত আর্যদের পক্ষে বিদেশী ও বিজাতীয় ঘৃণ্য শত্রুদের পরিচয় সূচক নাম গ্রহণ করার কোন কারণ নেই। এটা সম্ভব দীর্ঘকালীন শান্তিপূর্ণ বসবাস ও মিশ্রণের পর। অথচ যখন দাস ও দস্যুদের বিরুদ্ধে দেবতাদের বিশেষত ইন্দ্রের সাহায্য চাওয়া হচ্ছে কিংবা যখন দাস ও দস্যুদের পরাজয় বর্ণনা করা হচ্ছে তখন ঋষিরা দিবোদাস, ত্রসদস্যু, সুদাস ইত্যাদি রাজার জন্য সাহায্য চাচ্ছেন কিংবা তাদেরকে ইন্দ্র কিভাবে সাহায্য করেছেন তা বলছেন। ৭।১৯।৩ ঋকে ইন্দ্রের উদ্দেশ্যে বলা হচ্ছে “হে ধর্ষক! হব্যদাতা সুদাসকে ধর্ষক বজ্রের দ্বারা সমস্ত রক্ষার সাথে রক্ষা কর, যুদ্ধের ভূমি লাভের জন্য পুরুকুৎসের পুত্র ত্রসদস্যু ও পুরুকে রক্ষা কর।” এরপরের ঋকে অর্থাৎ ৭।১৯।৪ ঋকে বলা হচ্ছে, “.... তুমি দভীতির জন্য দস্যু, চুমুরি ও ধুনিকে বজ্রের দ্বারা বধ করেছ।”

দিবোদাস ঋগ্বেদের এক বিখ্যাত যোদ্ধা এবং রাজা। ইন্দ্র “.... দিবোদাসের জন্য শম্বরের নবনবতি পুরী বিদারণ করেছিলেন” (২।১৯।৬, এবং “ইন্দ্র হব্যদাতা দিবোদাসকে শম্বরের পাষাণ নির্মিত শত সংখ্যক পুরী প্রদান করেছিলেন (৪।৩০।২০), ইত্যাদি। ৪।৩০।১৩ ঋকে শম্বরকে বলা হচ্ছে “কুলিতরের অপত্য দাস শম্বর।”

এখন পরাজিত শম্বর হচ্ছে দাস আর বিজয়ী বৈদিক রাজার নাম দিবোদাস। শব্দের অর্থ যাই হোক নাম এবং শব্দের এই মিল কিন্তু আকস্মিক হবার কথা নয়। অর্থাৎ দাস ও দস্যু ইত্যাদি শব্দ এক সময় সমাজে বহু প্রচলিত ছিল যে কারণে বৈদিক আর্য রাজাদের মধ্যে আমরা দাস ও দস্যু সংযুক্ত নাম দেখতে পাই। সম্ভবত যুদ্ধ শুরুর পূর্বে শব্দগুলির তুচ্ছার্থে ব্যবহার ছিল। ফলে পরবর্তীতে দাস ও দস্যু সমগ্র শত্রু সম্পর্কে ব্যবহৃত হচ্ছে। এই দাস ও দস্যুদেরকে যজ্ঞরহিত বা দেবরহিত বলা হচ্ছে। অর্থাৎ বৈদিক ধর্মহীন অর্থে শত্রু হল যজ্ঞরহিত। বৈদিক শক্তির মধ্যে সংঘাত দেখা দিলেও এক পক্ষ অপর পক্ষকে ধর্মহীন অর্থে যজ্ঞরহিত বলে গালি দিয়েছে। এমন কি যখন বসিষ্ঠ ঋষির অনুসারী সুদাস রাজার সঙ্গে বিশ্বামিত্র ঋষি কর্তৃক সংগঠিত পুরু, যদু, অনু, দ্রুহ্যু প্রভৃতি দশ-উপজাতির জোটের যুদ্ধ হয় এবং সেই যুদ্ধে দশ উপজাতির জোট পরাজিত হয় তখন বসিষ্ঠ ঋষি আনন্দ প্রকাশ করে মন্ত্রে বলছেন, “হে ইন্দ্র ও বরুণ! দশজন যজ্ঞরহিত রাজা মিলিত হয়েও সুদাস রাজাকে প্রহার করতে সমর্থ হল না।...” (৭।৮৩।৭)।

এই যেখানে অবস্থা সেখানে দাস, দস্যু ইত্যাদি শব্দ দ্বারা সম্পূর্ণ ভিন্ন জাতির মানুষ বোঝানো হচ্ছে এটা ধরে নেওয়া যায় না। বরং একই জাতি বা ভাষাগোষ্ঠীর মধ্যে সংঘাতের সম্ভাবনাকেই অধিকতর গুরুত্বের সঙ্গে বিচার করার প্রয়োজন দেখা দেয়।

এখন আমরা বৈদিক দেবতাদের মধ্যকার সংঘাতের দিকে দৃষ্টি দিতে পারি। ৪ মণ্ডলের ৩০ সূক্তে কয়েকটি ঋকে দেবতা ঊষার সঙ্গে দেবতা ইন্দ্রের সংঘাত বর্ণনা করা হয়েছে। ঋষি বলছেন, “৯। হে মহান ইন্দ্র! তুমি দ্যুলোকের দুহিতা পূজনীয়া ঊষাকে সংপিষ্ট করেছিলে। ১০। অভীষ্টবর্ষী ইন্দ্র যখন ঊষার শকট ভগ্ন করেছিলেন তখন ঊষা ভীত হয়ে ভগ্ন শকট হতে অবতরণ করেছিলেন। ১১। ঊষাদেবীর চূর্ণীকৃত শকট বিপাশ নদীর তীরে পড়ে থাকল, তিনি দূর দেশে অপসৃত হলেন।”

ঊষা ঋগ্বেদের এক গুরুতপূর্ণ দেবতা। সুতরাং ঊষার সঙ্গে ইন্দ্রের সংঘাতের মধ্যে দুই শক্তিশালী সামাজিক প্রথা এবং গোষ্ঠীর দ্বন্দ্ব প্রতিফলিত হয়েছে। এতে ইন্দ্রের জয় হলেও ঊষা এবং সেই সঙ্গে তার সাথে সম্পর্কিত সামাজিক প্রথা ও গোষ্ঠীকে যে বিনষ্ট করা যায় নি তার প্রমাণ হল ঋগ্বেদ যেখানে বহু মন্ত্রে ঊষা দেবীর স্তুতি করা হয়েছে এবং তাঁর উদ্দেশ্যে কিছু সংখ্যক সম্পূর্ণ সূক্ত রচনা করা হয়েছে।

দেবতা ত্বষ্টার সঙ্গেও ইন্দ্রের বিরূপ সম্পর্ক। “ইন্দ্র ত্বষ্টাকে সামর্থ্য দ্বারা পরাভূত করে তাঁর চমসস্থিত সোম পান করেছিলেন” (৩।৪৮।৪)। এবং “শিষ্ট পালনকর্তা ইন্দ্র, অভিমানী ও সর্বব্যাপীতেজোবিশিষ্ট ত্বষ্টার পুত্রকে বিদীর্ণ করলেন। তিনি গাভীদের আহ্বান করতে করতে ত্বষ্টার পুত্র বিশ্বরূপের তিন মস্তক ছেদন করলেন” (১০।৮।৯)। অথচ ঋগ্বেদেই বলা হচ্ছে, “হে ইন্দ্র! ... ত্বষ্টা তোমার দীপ্তিমান বজ্র নির্মাণ করেছেন” (৫।৩১।৪)। কিংবা “শোভনকর্মা ত্বষ্টা যে সুনির্মিত, হিরন্ময় ও অনেক ধারাযুক্ত বজ্র ইন্দ্রকে দিয়েছিলেন, ইন্দ্র সে বজ্র সংগ্রামে কার্যসাধন করবার জন্য ধারণ করে বৃত্রবধ করেছিলেন এবং বারিরাশি বর্ষিত করেছিলেন” (১।৮৫।৯)। ঋগ্বেদে বহু মন্ত্রে আমরা ত্বষ্টার স্তুতি পাই। ত্বষ্টা শক্তিশালী দেবতা না হলে ঋষি ঋকে এ কথা বলতেন না “হে স্তোতা! ত্বষ্টার ন্যায় ইন্দ্রের স্তুতি প্রদীপ্ত কর” (৩।৩৮।১)। কিংবা ১।১৩।১০ ঋকে বলা হচ্ছে “শ্রেষ্ঠ ও বহুবিধ রূপসম্পন্ন ত্বষ্টাকে এ যজ্ঞে আহ্বান করছি; তিনি কেবল আমাদের পক্ষেই থাকুন।”

অর্থাৎ এইসব ঋক দ্বারা আমরা বৈদিক সমাজের অভ্যন্তরীণ ধর্মীয় ভাঙ্গন ও পরিবর্তনের চিত্র পাচ্ছি। আর এই ধর্মীয় ভাঙ্গন ও পরিবর্তন হল সমাজের ভাঙ্গন ও পরিবর্তনের প্রতিফলন মাত্র যে কারণে এককালের ক্ষমতাবান দেবতা ত্বষ্টাকে ঋষি স্বপক্ষে থাকবার জন্য আবেদন জানাচ্ছেন।

বৈদিক আর্যরা যদি বহিরাগত হত তবে বিদেশের মাটিতে যুদ্ধরত অবস্থায় এই ধরনের সামাজিক ভাঙ্গন ও পরিবর্তন ঘটা সম্ভব হত না। বৈদিক আর্যরা যখন ঋগ্বেদ রচনা করছে তখন তাদের প্রতিপক্ষ এমন এক প্রবল শক্তি ঋগ্বেদের বর্ণনা অনুযায়ীই যাদের আছে বহুসংখ্যক দুর্ভেদ্য নগর এবং বিশাল সেনাবাহিনী। কাজেই এই অবস্থায় বৈদিক আর্যদের মধ্যে সামাজিক আন্দোলন ও বিক্ষোভ ঘটা মানে বৈদিক শক্তির সম্পূর্ণ ধ্বংস হয়ে যাওয়া। অন্যদিকে এই প্রচণ্ড যুদ্ধের অবস্থায় শত্রুর ধর্মের সঙ্গে লেনদেন কিংবা সমন্বয়ের প্রশ্নও ওঠে না। এই মন্ত্রগুলি যাঁরা রচনা করেছেন তাঁদের অনেকের নাম এবং তাঁদের রচিত অন্যান্য মন্ত্র বলে দেয় যে, তাঁরা প্রচণ্ড যুদ্ধকালীন সময়ের ঋষি। যেমন ৪।৩০।৯,১০,১১ ঋকসমূহে ইন্দ্র-ঊষার সংঘাতের বর্ণনা দিয়েছেন যে ঋষি তিনি হলেন বামদেব এবং ৩।৪৮।৪ ঋকে ইন্দ্র-ত্বষ্টার দ্বন্দ্বের বিবরণ যে ঋষি দিয়েছেন তিনি হলেন বৈদিক যুদ্ধের বিখ্যাত ঋষি বিশ্বামিত্র। এঁরা উভয়েই বৈদিক যুদ্ধকালীন বহু সূক্ত ও মন্ত্রের রচয়িতা।

সুতরাং বৈদিক আর্যদেরকে বহিরাগত বলতে হলে দেবতাদের মধ্যকার এইসব সংঘাতকে সপ্তসিন্ধু এলাকায় প্রবেশের অনেক পূর্বে দূর অতীতে তারা যখন মধ্য এশিয়া বা ইউরোপে তাদের আদি বাসভূমিতে ছিল সেই সময়কার সমাজ জীবনের স্মৃতি হিসাবে ব্যাখ্যা দেবার চেষ্টা করতে হয়। কিন্তু সেখানে প্রশ্ন আসবে বিপাশা নদীর তীরে ঊষার বিরুদ্ধে ইন্দ্রের যুদ্ধের (৪।৩০।১১) কী ব্যাখ্যা তবে হবে? কিংবা এই প্রশ্ন দেখা দিবে আর্যরা যদি তাদের আদি বাসভূমির ধর্মীয় জীবনের স্মৃতিই মনে রাখতে পারবে তবে সমগ্র ঋগ্বেদ জুড়ে সপ্তসিন্ধু এবং তার পার্শ্ববর্তী স্থানসমূহ ছাড়া ঋগ্বেদের কোথায়ও সেই আদি বাসভূমির চিহ্নমাত্র কেন নেই?

সুতরা আমরা এই সিদ্ধান্তে পৌঁছতে বাধ্য হই যে, আর্য বা যে নামই দেওয়া যাক বৈদিক শক্তির আদি বাসভূমি হল সপ্তসিন্ধু এবং তার সংলগ্ন অঞ্চল সমূহ। এই কারণেই সপ্তসিন্ধু বৈদিক ঋষিদের স্মৃতিকে তাদের বাসভূমি হিসাবে এভাবে অধিকার করে রেখেছে এবং বাইরের দূরবর্তী ভূভাগের নাম বা চিত্র তাদের স্মৃতিকে এভাবে অধিকার করে থাকে নি। এটা ঠিক যে, কাবুল নদী বা গঙ্গা, যমুনা ইত্যাদি নদীর নামোল্লেখ দ্বারা আমরা বহু বিস্তৃত এলাকায় একটি সমাজের অবস্থান বা সংযোগের ধারণা পেতে পারি। কিন্তু সপ্তসিন্ধু তথা মূলত আজকের পাঞ্জাব ও সিন্ধু যে সমগ্র ঋগ্বেদের মূল ভিত্তিভূমি এটা বুঝতে অসুবিধা হয় না।

অর্থাৎ ঋগ্বেদের পটভূমি হল মূলত সপ্তসিন্ধু অঞ্চলে অনুষ্ঠিত একটি প্রচণ্ড ও যুগান্তকারী গৃহযুদ্ধ। ঋগ্বেদে ঋষিরা দাস, দস্যু, রাক্ষস এবং পণি নামে যে শত্রুদের উল্লেখ করেছেন তারা একই সমাজভুক্ত ঋষিদের প্রতিপক্ষ বা শত্রু মাত্র।

বৈদিক ঋষিরা যাদেরকে দেবতা ইন্দ্র কর্তৃক নিহত বলছেন তারা প্রকৃতপক্ষে বৈদিক পক্ষীয় যোদ্ধাদের দ্বারা নিহত। কিন্তু ঋষিরা কল্পনা করছেন যে, কাজটা যেহেতু ইন্দ্রের কৃপায় বা ইচ্ছায় সম্পন্ন হয়েছে সেহেতু তিনিই তা করেছেন। কাজেই ইন্দ্র কর্তৃক নিহতরা সকলে বাস্তবে গৃহযুদ্ধের বলি যে গৃহযুদ্ধ ঋষিদের দ্বারা ধর্মীয় আবরণ নিয়েছে।

ঋগ্বেদে বর্ণিত যুদ্ধ যে গৃহযুদ্ধ মাত্র তা স্পষ্টতর করার জন্য আমরা পণিদের প্রসঙ্গে খুব সংক্ষেপে আলোচনা করতে পারি। পণিরা ইন্দ্র বা দেবতাদের শত্রু হিসাবে চিহ্নিত। ১।১৮২।৩ ঋকে অশ্বিদ্বয় দেবতাদের উদ্দেশ্যে অগস্ত্য ঋষি বলছেন, “হে অশ্বিদ্বয়! এখানে কি করছ? এখানে কেন আছ? হব্যশূন্য যে কোন ব্যক্তি পূজনীয় হয়েছে তাকে পরাভব কর। পণির প্রাণ বিনাশ কর। আমি মেধাবী ও তোমার স্তুতি অভিলাষী, আমাকে জ্যোতি প্রদান কর।” এর পরের ঋক পড়লেই এই আকুল আবেদন ও স্তুতির কারণ বোঝা যায়। ১।১৮২।৪ ঋকে ঋষি বলছেন, “হে অশ্বিদ্বয়! জঘন্য শব্দ করে কুকুরের ন্যায় যারা আমাদের বিনাশ করতে আসছে, তাদের বিনাশ কর। তারা সংগ্রাম করতে চায়, তাদের মেরে ফেল। তাদের মারবার উপায় তোমরা জান। তোমাদের যারা স্তুতি করে তাদের প্রত্যেক কথা রত্নবতী কর। হে নাসত্যদ্বয়! তোমরা উভয়ে আমার স্তুতি রক্ষা কর।”

কিংবা ৭।৬।৩ ঋক উল্লেখ করা যায় সেখানে ঋষি বৈশ্বানর অগ্নি দেবতার উদ্দেশ্যে প্রার্থনা জানাচ্ছেন, “অগ্নি যজ্ঞরহিত, জল্পক, হিংসিতবাক, শ্রদ্ধারহিত, বৃদ্ধিশূন্য পণি নামক যজ্ঞহীন সে দস্যুদের বিদূরিত করুন, তিনি প্রধান হয়ে অপর যজ্ঞরহিতগণকে হেয় করুন।” অর্থাৎ বোঝাই যায় যে, পণিরা ঋষিদের নিকট অত্যন্ত ঘৃণিত ও শক্তিশালী শত্রু। বহু মন্ত্রে পণিদের বিরুদ্ধে ঘৃণা ও আক্রোশ প্রকাশ পেয়েছে এবং বহু মন্ত্রে পণিদের সংহারের জন্য দেবতাদের নিকট আবেদন করা হয়েছে। ১।১৫১।৯, ৩।৫৮।২, ৪।২৫।৭, ৪।৫১।৩, ৬।১৭।৩, ৬।৫১।১৪, ৮।২৬।১০, ৮।৭৫।৭ ইত্যাদি বহুসংখ্যক ঋকে আমরা এই ঘৃণা ও আক্রোশ কিংবা আবেদন দেখতে পাই।

এ ছাড়া বহুসংখ্যক ঋক আছে যেগুলিতে পণিদের পরাজয় ও লাঞ্ছনার বর্ণনা আছে। যেমন “অঙ্গিরা নামক আমাদের পিতৃগণ মন্ত্র দ্বারা অগ্নির স্তুতি করে বলবান ও দৃঢ়াঙ্গ পণি (নামক অসুরকে) স্তুতি শব্দ দ্বারাই বিনাশ করেছিলেন এবং আমাদের নিমিত্ত মহৎ দ্যুলোকের পথ করেছিলেন” (১।৭১।২। “তিনি (সরস্বতী দেবী) নিয়ত কেবল আত্মচিন্তনকারী দানবিমুখ পণি সংহার করেছেন” (৬।৬১।১) ইত্যাদি।

অথচ এই পণি সম্পর্কেই ৭।১৯।৯ ঋকে সুবিখ্যাত ঋষি বসিষ্ঠ ইন্দ্রের উদ্দেশ্যে বলছেন, “হে ধনবান! তোমার যজ্ঞে আমরাই নেতা ও উকথোচ্চারণকারী, অদ্য উকথ উচ্চারণ করছি ও তোমার হব্যদ্বারা পণিগণকেও ধন দান করছি। আমাদের সখারূপে গ্রহণ কর।”

এই ঋক যিনি লেখছেন তিনি সাধারণ কোনও ঋষি নন। ঋগ্বেদের একজন শ্রেষ্ঠ ঋষি। এবং এটা যখন তিনি লেখছেন তার আগে যে পণিদের পরাজয় হয়েছে তা বোঝা যায়। কারণ এই সূক্তের পূর্বের অর্থাৎ ৭।১৯।৪ ঋকে ঋষি বলছেন, “হে নেতৃদের স্তুতিযোগ্য ইন্দ্র! তুমি সংগ্রামে মরুৎগণের সঙ্গে বহুবৃত্রগণকে বধ করেছ। হে হরিৎযুক্ত। তুমি দভীতির (রাজা) জন্য দস্যু, চুমুরি ও ধুনিকে বজ্রের দ্বারা বধ করেছ।”

কিংবা ধরা যাক পণিদের নেতৃস্থানীয় এক ব্যক্তি বৃবু সম্পর্কে ৬ মণ্ডল, ৪৫ সূক্তে ৩১,৩২, ও ৩৩ যা বলা হয়েছে তার কথাঃ “৩১। গঙ্গার উন্নত কূলের ন্যায় পণিগণের মধ্যে উচ্চস্থানে বৃবু অধিষ্ঠান করেছিলেন। ৩২। আমি ধনার্থী; যিনি আমাকে বায়ুবেগে বদান্যতাপূর্বক সহস্র সংখ্যক ধেনু সত্বর প্রদান করেছেন। ৩৩। আমরা সকলে স্তব করে সহস্র ধেনু প্রদানকারী প্রাজ্ঞ ও সহস্র স্তোত্রভাজন সে বৃবুর নিরন্তর প্রশংসা করছি।”

এখানে আমরা গঙ্গা নদীর নাম পাচ্ছি ঋষি যার উন্নত কূলের সঙ্গে পণি বৃবুর সামাজিক মর্যাদার তুলনা দিচ্ছেন। অর্থাৎ সপ্তসিন্ধু অঞ্চলের ঋষিরা গঙ্গা সম্পর্কে ভালভাবেই জ্ঞাত ছিলেন। আমরা ঋষির উচ্ছ্বাসের কারণও বুঝতে পারছি। কারণ এক হাজার গরু দান স্বরূপ পাওয়া কম কথা নয়।

কিন্তু এখানে আমরা এই প্রশ্নের সম্মুখীন হই যে, সব পণি যদি শত্রু হবে তবে পণিগণের মধ্যে উচ্চস্থানে অধিষ্ঠিত বৃবুর কাছ থেকে দান নিতে হবে কেন? শত্রুর ধন-সম্পদ লাভ বা লুণ্ঠনের বহু চিত্রই তো আমরা ঋগ্বেদে পাই। এই একই ঋষি অর্থাৎ বৃহস্পতির অপত্য শংযু ঋষি এই একই সূক্তে অর্থাৎ ৬ মণ্ডলের ৪৫ সূক্তে শত্রুর বিরুদ্ধে জয় ও শত্রু সম্পদ লাভের উদ্দেশ্যে ইন্দ্রের নিকট প্রার্থনা করে ১২ ঋকে বলছেন “হে ইন্দ্র! তুমি আমাদের স্তোত্র শ্রাবণে প্রসন্ন হলে তোমার অনুগ্রহে যেন আমরা অশ্বগণদ্বারা শত্রুগণের অশ্বসমূহ, উৎকৃষ্ট অন্ন ও গূঢ়ধন (গুপ্তধন) জয় করতে সমর্থ হই।”

কাজেই এই ধরনের ঘটনার ব্যাখ্যা এটাই হতে পারে যে, পণিগণের বৃহৎ অংশ শত্রু হলেও তাদের একটা ক্ষুদ্র অংশ প্রথম থেকেই বৈদিক শক্তির পক্ষে ছিল কিংবা তা না থাকলেও যুদ্ধের শেষ দিকে পণিগণের একাংশের সঙ্গে বৈদিক শক্তির আপোস ও সমঝোতা হয়েছিল। এক সমাজভুক্ত হলে এই ধরনের সমঝোতার সম্ভাবনা থাকে।

যাইহোক, এখন আমরা এই বিষয়ে নিশ্চিত হয়েছি যে, ঋগ্বেদের যুদ্ধ মূলত বহিরাগত এবং স্থানীয়দের মধ্যকার নয়। সুতরাং এখন আমরা যে প্রশ্নের সম্মুখীন হই সেটা হল এই যে, যুদ্ধটা যদি বহিরাগত ও স্থানীয়দের মধ্যকার না হয় তবে এটা কাদের মধ্যে এবং কোন বিষয়কে কেন্দ্র করে সংগঠিত হয়েছিল? এই প্রশ্নের উত্তর পাবার জন্য আমাদেরকে ঋগ্বেদের কেন্দ্রীয় দেবতা বা চরিত্রকে বুঝতে হবে এবং তার ভূমিকার মূল প্রেক্ষিত ও তাৎপর্যও বুঝতে হবে। সুতরাং ঋগ্বেদের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দেবতা ইন্দ্র যার স্তুতিতে ঋগ্বেদের সূক্তগুলির এক চতুর্থাংশ রচিত তার উপর আমাদের মনোযোগ নিবদ্ধ করা যাক।

 

৩। দেবতা ইন্দ্র এবং বৃত্র বধ

ঋগ্বেদ ১০টি মণ্ডলে বিভক্ত। এই দশ মণ্ডলে আছে ১০,৫৫২টি ঋক নিয়ে ১,০২৮টি সূক্ত। এই বিরাট গ্রন্থের যত গভীরে প্রবেশ করা যায় দেবতা ইন্দ্রের গুরুত্ব তত স্পষ্ট হয়।

ইন্দ্রকে বহুগুণে ভূষিত করা হয়েছে। তবে ঋগ্বেদের ঋষিরা অগ্নি, বরুণ প্রভৃতি দেবতা সম্পর্কেও স্তুতিতে অনেক সময় এমনভাবে গুণ আরোপ করেন যে, তখন মনে হয় যেন সেই দেবতাই সর্বশ্রেষ্ঠ কিংবা তিনি একেশ্বর এবং বিভিন্ন দেবতা তাঁরই বিভিন্ন নামকরণমাত্র। বস্তুত ঋগ্বেদে শক্তির যে কোনও প্রকাশের উপর সাধারণত দেবত্ব আরোপ করা হয়েছে। ফলে সব শক্তির মধ্যে একটা ঐক্য বা ছন্দ দেখতে পেয়ে ঋষিগণ কখন কখন কম বা বেশী একেশ্বরবাদী প্রবণতা দ্বারা প্রভাবিত হয়েছেন। তবে এই একেশ্বরবাদী প্রবণতাও অধিকাংশ ক্ষেত্রে ইন্দ্রকে অবলম্বন করেই স্ফূর্ত হতে চেয়েছে।

ঋষিদের কাছে ইন্দ্র শক্তি এবং বিজয়ের প্রতীক। ঋগ্বেদের ঋষি বলছেন “হে ইন্দ্র! তুমি শক্তিমান, বীর ও শত্রু নিহন্তা বলে আমরা তোমার স্তব করি” (৬।৩৫।৫)। “হে পূজনীয় উগ্র ইন্দ্র! .... তুমি সমস্ত ভুবনের রাজা, তুমি শত্রুদের প্রহার কর ও সাধু ব্যক্তিদের স্বস্থানে স্থাপিত কর” (৩।৪৬।২)। “ইন্দ্রের বজ্র অয়োনির্মিত এবং তাঁর হস্তে সম্বন্ধ, তাঁর হস্তে বহুতর বল আছে। যুদ্ধগমনকালে ইন্দ্রের মস্তকে শিরস্ত্রাণ থাকে, তাঁর আজ্ঞা শ্রবণার্থে সকলে তাঁর সমীপে আগমন করে” (৮।৯৬।৩)।

অর্থাৎ ইন্দ্রকে কল্পনা করা হয়েছে সর্বদা বিজয়ী ও অপরাজেয় এক সেনাপতি রূপে। হয়ত বহু প্রাচীন কালের কোনও বিজয়ী গোত্রপতি বা সেনাপতির নামে এই দেবতার নামকরণ হয়েছে। কারণ ঋগ্বেদে তাঁর প্রাচীন ঐতিহ্যের কথা অনেকবার বলা হয়েছে। ৩।৫২।৪। ঋকে বলা হচ্ছে “হে প্রাচীন কাল হতে প্রসিদ্ধ ইন্দ্র!...-” ৬।৩৮।৩ ঋকে ইন্দ্রকে বলা হচ্ছে, “তুমি প্রাচীন ও ক্ষয়রহিত, আমি উৎকৃষ্টতম স্তুতি ও হব্য দ্বারা তোমার স্তব করছি।”

সুতরাং প্রাচীন এক যুদ্ধ দেবতা ঋগ্বেদের গৃহযুদ্ধের কালে এসে নূতন গুরুত্ব ও তাৎপর্য নিয়ে দেখা দিয়েছে বলে মনে হয়। ইন্দ্র অনেক নগর বিদারণকারী কিংবা ধ্বংসকারী এবং শত্রুহন্তা। কিন্তু তার সর্বশ্রেষ্ঠ কীর্তি হল বৃত্রবধ। আমরা ঋগ্বেদে বৃত্রহা বা বৃত্রহন্তা কিংবা বৃত্রবিনাশী হিসাবে ইন্দ্রের বহু বহুবার উল্লেখ পাই এবং দেখতে পাই  যে, এই কীর্তির জন্য ঋগ্বেদের ঋষিরা ইন্দ্রের প্রশংসায় ও স্তুতিতে উচ্ছ্বসিত। এবং একটু লক্ষ্য করলেই আমরা দেখতে পাব যে, বৃত্রবধের সঙ্গে নদীর জলরাশি বা জলস্রোত মুক্তির গভীর সম্পর্ক আছে। যেহেতু বৃত্রবধ ইন্দ্রের সর্বশ্রেষ্ঠ কীর্তি বলে আমাদের কাছে ধরা পড়েছে সেহেতু আমরা প্রধানত এই বিষয়টিকে অবলম্বন করে ঋগ্বেদের রহস্যের আবরণ উন্মোচনের চেষ্টা করব।

তবে এই আলোচনায় যাবার পূর্বে ঋগ্বেদের বিভিন্ন শব্দের অর্থ ও ব্যবহার সম্পর্কে কিছু আলোচনা করে নিলে ভাল হয়। এটা মনে রাখা দরকার যে, কয়েক হাজার বৎসরে ঋগ্বেদের ভাষার সামগ্রিক অর্থ ঠিক থাকলেও তার অনেক শব্দের অর্থ পরিবর্তিত হতে পারে, এমন কি কিছু শব্দের অর্থ হারিয়েও যেতে পারে। এই ধারণা নিয়ে পাঠ করলে অনর্থক গোলোক ধাঁধায় ঘুরতে হবে না। যেমন অনেক সময় অয়স্ নির্মিত বা আয়স নগর বা পুর, কলস বা বজ্রের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। এখন অয়সের অর্থ লৌহ করলে নগর, কলস, বজ্র ইত্যাদি সবগুলিকেই লৌহ নির্মিত বলতে হয়। অর্থাৎ অয়স বা আয়সের অর্থ শুধু লৌহ ধরলে গোটা ব্যাপারটাই অর্থহীন হয়ে দেখা দেয়।

ঋগ্বেদে ইষ্টক বা ইট শব্দের ব্যবহার নেই বলে অনেকের ধারণা বৈদিক আর্যরা পাকা বাড়ী বা বাসগৃহ তৈরী করতে যেমন জানত না তেমন নগরবাসীও ছিল না। কিন্তু অয়স বা আয়স শব্দ দ্বারা যে ইটকেও বোঝানো হতে পারত এমন সম্ভাবনা মাথায় নিলে অনেক বিভ্রান্তিই দূর হয়।

এটা বিস্ময়কর যে, ইন্দ্রের বজ্রকে অয়োময় বা অয়সনির্মিত বলা হয়েছে কিন্তু কখনও তাম্র বা ব্রোঞ্জ নির্মিত বলা হয় নি। ঋগ্বেদে তাম্র বা ব্রোঞ্জের উল্লেখ নেই। এমন কি দধীচির অস্থি দ্বারা বজ্র নির্মাণের উল্লেখও আছে। কিন্তু তাম্র-বজ্রের উল্লেখ নেই। এটা স্বাভাবিক যে, নূতন উপাদান আবিষ্কার বা ব্যবহার হলেও পুরাতন উপাদানও পাশাপাশি দীর্ঘকাল টিকে থাকে। কাজেই তাম্র যুগে যেমন প্রস্তরের অস্ত্রও ছিল তেমন লৌহ যুগে তাম্র ও ব্রোঞ্জের অস্ত্রও নিশ্চয় দীর্ঘকাল পাশাপাশি ছিল। সুতরাং অয়স বা আয়স শব্দের অর্থ যে কোনও কঠিন পদার্থ হতে পারে এমন ধরে নিয়ে অগ্রসর হলে অনেক কিছুর ব্যাখ্যা পাওয়া যেতে পারে। এমনও হতে পারে যে, যে কোনও লালাভ বা উজ্জ্বল কঠিন পদার্থকেই এই শব্দ দ্বারা বোঝানো হত। সুতরাং এটা বোধগম্য হয় যে, ঋগ্বেদের ঋষিরা লৌহ নির্মিত নগরের কথা না বলে ইষ্টক নির্মিত নগরের কথাই বলেছেন।

এই প্রসঙ্গে আর একটি বিষয় আমাদের চিন্তা করা দরকার। তাহল খ্রীষ্টপূর্ব পনের বা ষোল শতাব্দীতে ভারতবর্ষে লোহার আবিষ্কার বা ব্যবহার হয় নি। উপমহাদেশে তখনও তাম্র বা ব্রোঞ্জ যুগ চলছিল। কাজেই আমরা যদি ঋগ্বেদকে সেই সময়ের পূর্বের কিংবা সেই সময়ের রচনা মনে করি তবে তখন অয়স বা আয়স শব্দের অর্থ যে লৌহ ছিল না এটা ধরে নিতে হবে। অর্থাৎ পরবর্তী কালে এই শব্দের অর্থ পরিবর্তন হয়েছে এবং তার অর্থ লৌহ করা হয়েছে।

এখন ধরা যাক পর্বত শব্দটিকে। ঋগ্বেদে আমরা বহুবার এই শব্দের উল্লেখ পাব। যেমন ৪।১৭।৩ ঋকে পাচ্ছি, “শত্রুদের অভিভবকর ইন্দ্র তেজ (আগুন?) ও বজ্র (সশস্ত্র বাহিনী?) প্রেরণ করে পর্বতসমূহকে বিদীর্ণ করেছিলেন।” ২।১৫।৮ ঋকে বলা হচ্ছে, “অঙ্গিরাগণ স্তব করলে ইন্দ্র বলকে বিদীর্ণ করেছিলেন। পর্বতের দৃঢ়ীকৃত দ্বার উদ্ঘাটিত করেছিলেন। এদের কৃত্রিম রোধ সকলও উদ্ঘাটিত করেছিলেন।...”

এখন আমরা যদি পর্বত বলতে শুধু বর্তমান অর্থে পর্বত মনে করি তবে এইসব ঋকের কোনও বাস্তব অর্থ খুঁজে না পেয়ে বিমূর্ত ও প্রতীকীমূলক ধর্মীয় অর্থ করতে বাধ্য হব, ফলে ঋগ্বেদের প্রকৃত অর্থ ও তাৎপর্য খুঁজে পাব না। সুতরাং এটা ধরে নেওয়াই যুক্তিযুক্ত হবে যে, পর্বত বলতে উঁচু এবং প্রাচীর ঘেরা নগর বা দুর্গকেও বোঝানো হয়েছে। তাহলে পর্বতের “দৃঢ়ীকৃত দ্বার” এবং “কৃত্রিম রোধসকলের” অর্থও স্পষ্ট হয়।

এইভাবে আমরা দেখতে পাব মেঘ শব্দের ব্যবহার “হে ইন্দ্র! তুমি মেঘকে বিদীর্ণ করে জলনির্গম মার্গ উন্মুক্ত করেছ, তুমি রুদ্ধ জলসকলকে মুক্ত করেছ; ..” (৫।৩২।১)। ইন্দ্রের বজ্র আর আকাশের বজ্র যেমন সর্বদা এক বস্তু নয় তেমন এই মেঘ আর আকাশের মেঘও সর্বদা এক বস্তু নয়। বস্তুত এইসব ঋকে বর্ণিত মেঘ বলতে আকাশের মেঘ চিন্তা করলে ঋকগুলির কোনও ব্যবহারিক বা ঐতিহাসিক তাৎপর্য থাকে না। বরং এগুলিকে যদি নদীখাত কিংবা জলাধার হিসাবে ধারণা করা যায় তাহলে এইসব ঋকের ভিতর থেকে এক বিরাট ও বিশাল ঐতিহাসিক ঘটনার প্রেক্ষিত উঁকি দেয়।

অর্থাৎ বেদ পাঠের সময় আমাদের মনকে রাখতে হবে সদাসতর্ক এবং সমালোচনামূলক। প্রচলিত অর্থ বা ধারণার কাঠামোয় আটকে না থেকে দুর্বোধ্য বিষয় বা শব্দগুলির বিভিন্ন রকম অর্থ করার চেষ্টা করতে হবে। বিভিন্ন দিক থেকে একটি বিষয়কে বোঝার চেষ্টা করতে হবে। তাহলে দেখা যাবে আমরা বহু রহস্যের জটাজাল ভেদ করতে পারছি। যেমন ধরা যাক সোমরসের কথা।

সোম ঋগ্বেদে এক অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ স্থান অধিকার করে আছে। সোমলতা থেকে সোমরস হয়। দেবতাদের পূজার সময় সোমরস দেবতার উদ্দেশ্যে অগ্নিতে আহুতি দেওয়া হত। এটি ইন্দ্রের খুবই প্রিয় পানীয় বলা হয়েছে। অর্থাৎ এটি ঋষি এবং বৈদিক জনের অত্যন্ত প্রিয় ছিল। সোমলতার সুমিষ্ট রস যেমন পানীয় হিসাবে ব্যবহৃত হত তেমন তা দুধ, দধি ও ক্ষীরে দেওয়া হত মিষ্টতার জন্য। সোমরস মদ হিসাবেও ব্যবহার করা হত। সোম কতখানি জনপ্রিয় ছিল তা বোঝা যায় যখন দেখা যায় যে, বিভিন্ন মণ্ডলে সোমের উপর সূক্ত বা মন্ত্র থাকলেও এবং বিভিন্ন দেবতা বিশেষত ইন্দ্রের স্তুতির সময় বারংবার সোমের উল্লেখ থাকলেও ঋগ্বেদের নবম মণ্ডল গঠিত হয়েছে পবমান সোম দেবতা নামে সোমের স্তুতিতে রচিত সূক্তসমূহ দ্বারা। অর্থাৎ এই প্রিয় খাদ্যের উদ্ভিদের উপর দেবত্ব আরোপ করা হয়েছিল।

স্বাভাবিকভাবেই যে কোন ঋগ্বেদ পাঠকের মনে সোমলতা সম্পর্কে কৌতূহল জাগবে। অথচ বলা হয় যে, বহুকাল আগেই সোমলতা বিলুপ্ত হয়েছে। প্রশ্ন জাগবার কথা যে, এত জনপ্রিয় বস্তু যা সপ্তসিন্ধুর বিশাল অঞ্চলে পূজায় ও আহারে ব্যবহার হত তা কিভাবে বিলুপ্ত হতে পারে? এমন চিন্তাই মনে আসা উচিত যে, নিশ্চয় এই অতি উপাদেয় ও সুমিষ্ট (এবং মাদকও) লতাটি মানুষের দ্বারা রক্ষিত হয়ে আজ পর্যন্তও আছে আমাদের অতি পরিচিত ও প্রিয় এক খাদ্যের উৎস হয়ে কিন্তু যার অতীত অর্থটি হারিয়ে গেছে।

তরাং লতা অর্থে গাছে পেচিয়ে ওঠে এমন উদ্ভিদের ধারণা না করে দুর্বল বা শীর্ণ কাণ্ডাবিশিষ্ট কোনও উদ্ভিদ হতে পারে এমনভাবে চিন্তা করলে ক্ষতি কি? আর তৎক্ষণাৎ যে চিন্তা মনে উঁকি দেয় তা হল সোমলতা এবং ইক্ষু বা আখ একই জিনিস হওয়া সম্ভব।

এই সম্ভাবনার চিন্তা মাথায় নিয়ে ঋগ্বেদের ভিতরে যত অগ্রসর হওয়া যায় তত এই ধারণা দৃঢ় হতে থাকে। “অত্যন্ত মধুর রসবিশিষ্ট সোম” (৩।৫৮।৯), “এর তুল্য সুস্বাদু বস্তু আর কিছুই নেই, এর রস অতি চমৎকার” (৯।৭৮।৪), “হে সোম! তোমার তুল্য মধুর বস্তু কিছুই নেই” (৯।৬৭।১৬), কিংবা “হে অমৃততুল্য সোম!” (৯।১১০।৮) এই কথাগুলি ইক্ষু বা ইক্ষুরস সম্পর্কেও প্রযোজ্য। প্রস্তর দ্বারা নিষ্পেষণ করে সোমলতা থেকে রস সংগ্রহ করা হত। এ সম্পর্কে ১ মণ্ডলের ২৮ সূক্ত বা ৯ মণ্ডলের ৬৬ সূক্ত ইত্যাদি সূক্তে বর্ণনা আছে। বিশেষত ৯ মণ্ডলের ৬৬ সূক্তে সোমলতা নিষ্পেষণ থেকে সোমরস সংগ্রহ ও শোধন পর্যন্ত সমগ্র প্রক্রিয়ার বর্ণনা আছে।

সোমরসের রঙ্ সম্পর্কে বলা হচ্ছে “এর ধারা হরিৎবর্ণ” (৯।৬৬।২৬), আবার কখনও বলা হচ্ছে “শুভ্রবর্ণ সোমরসগুলি ক্ষরিত হতে হতে এবং নানাবিধ স্তুতিবাক্য গ্রহণ করতে করতে উৎপাদিত হলেন” (৯। ৬৩। ২৫), কিংবা “লোহিতবর্ণ সোমরসকে নিষ্পীড়নের দ্বারা প্রস্তুত করা হল” (৯।৮২।১); ইত্যাদি। এটা ঠিক যে, ইক্ষুরস হরিৎ বা পিঙ্গল কিংবা ঈষৎ লৌহিতবর্ণের হয়। তবে রস ক্ষরণের সময় সাদা বা শুভ্র দেখায়। অবশ্য ঋগ্বেদে অধিকাংশ সময় সোমরসের বর্ণকে হরিৎ বলা হয়েছে। টাটকা ইক্ষুরসের বর্ণের সঙ্গে এই বর্ণনা মেলে।

সোমরসকে মাদকও বলা হচ্ছে। যেমন “তোমরা ইন্দ্রের উদ্দেশ্যে মদকর সোম প্রদান কর” (২।১৪।৯), “ হে ইন্দ্র! মদকর সোম সকল তোমায় মত্ত করুক” (৭।২৩।৫), কিংবা “এ আসব মদকর ও চারু, এ মত্ততার জন্য সম্পন্ন হয় (৮।১।২৬); ইত্যাদি।

ইক্ষুরস থেকে প্রস্তুত গুড় দ্বারা সুরা বা মদ তৈরী হয়। কিন্তু ঋগ্বেদে মদ প্রস্তুত প্রণালী বলা হয় নি। হতে পারে যে, ঝোলা গুড়কেও রস বলা হয়েছে। কিংবা হয়ত কাঁচা রস তাল বা খেজুর রসের মত কিছু সময় রেখে তাড়ি বা মদকর করে পান করা হত।

সোমলতার পত্রের বর্ণনাও ইক্ষুপত্রের সঙ্গে মেলে। “বিচিত্র কুশসংযুক্ত” (১।২৩।১৩, ১৪) সোমলতার মত ইক্ষুও বিচিত্র কুশসংযুক্ত। কুশ মানে তৃণ। আসলে বাঁশের মতই ইক্ষু বা আখ এক জাতীয় তৃণ। তাই এগুলির কুশ বা তৃণের মত পত্র। পত্রের বর্ণনা আরও আছে: “হে সোম! তোমার যে দুটি পত্র বক্রভাবে অবস্থিত ছিল তদ্দ্বারা তোমার সর্বাপেক্ষা চমৎকার শোভা হয়েছিল” (৯।৬৬।২) এবং “হে সোম! তোমার চতুর্দিকে লতা অবস্থায় যে সকল পত্র বিদ্যমান ছিল তদ্দ্বারা তুমি সকল ঋতুতে সুশোভিত ছিলে” (৯।৬৬।৩)। আখেরও দুইপাশে দুইটি করে লতার মত পাতা বক্রভাবে শোভিত হয় এবং আখ বর্ষজীবী।

ঋষি আরও বর্ণনা দিচ্ছেন : “এ সোম শৃঙ্গ কম্পিত করেন। এর শৃঙ্গ যূথপতি বৃষভের ন্যায়” (৯।১৫।৪), “এ বেগবান শুভ্র লতাবিশিষ্ট সোম স্যন্দমান রসের পতি হয়ে গমন করেন” (৯।১৫।৫)। ইক্ষুক্ষেত্রে যখন বায়ু প্রবাহিত হয় তখন ঋষির কবি-কল্পনা বাস্তব রূপ নেয় বৈকি! বৃষভের তীক্ষ্ণাগ্র শৃঙ্গের সঙ্গে কেউ যদি বক্র ও তীক্ষ্ণাগ্র ইক্ষুপত্রের মিল খুঁজে পান তবে তাঁকে বোধ হয় মাত্রা অতিক্রমের দোষ দেওয়া যাবে না। বিশেষত যখন বাতাসের দোলায় ইক্ষুপত্র দোলায়িত হয় তখন বৃষভের শৃঙ্গের আন্দোলনের সঙ্গে তার মিল খুঁজে পাওয়া যেতে পারে।

৯।১৫।৫ ঋকের “এ বেগবান শুভ্র লতাবিশিষ্ট সোম” বর্ণনা দ্বারা ইক্ষু কাণ্ডকে চিনতে পারি। মসৃণ এবং সরলের উপমা হিসাবে বেগবান ব্যবহার করা হয়েছে। ইক্ষুকাণ্ড ঠিক তাই। তবে ইক্ষুকাণ্ড সর্বদা শুভ্র নয়। তবে “হরিদ্বর্ণ ও লতা তন্তুর আকারধারী সোম”কে (৯।৯২।১) সহজে চেনা যায়। “সুবর্ণময় পিঙ্গলবর্ণ” এবং “সুন্দর অঙ্গুলিধারী সোম” (৯।১০৭।২১) এই বর্ণনা দ্বারা সোনালী-হরিৎবর্ণের নিটোল, গোলাকার, লম্বা ও সরল যে উদ্ভিদকাণ্ডের চিত্র আমাদের চোখের সামনে ভেসে আসে তাকে ইক্ষুকাণ্ডরূপে চিনতে আমাদের আর কষ্ট হবার কথা নয়।

কিন্তু এখানেই শেষ নয়। ইক্ষুকাণ্ড থেকে যেমন ইক্ষু বা আখ গাছ জন্মায় তেমন অবয়ব বা দেহকাণ্ড থেকে যে সোমলতা জন্মায় সে কথাও ঋগ্বেদে বলা হয়েছে : “হে সোম! তোমার প্রধান উৎপত্তিস্থান স্বর্গের মধ্যে বিদ্যমান আছে। সেখান থেকে গ্রহণপূর্বক পৃথিবীর উন্নত প্রদেশে তোমার অবয়বগুলি নিক্ষিপ্ত হয়েছিল, সে স্থানে তারা বৃক্ষরূপে জন্মিল।” (৯।৭৯।৪)।

সুতরাং আর উদাহরণের প্রয়োজন নেই। অর্থাৎ সোমলতা ইক্ষু নামে আমাদের নিত্য দিনের অজস্র খাদ্যের মিষ্টতার শ্রেষ্ঠ উৎস হয়ে বিদ্যমান আছে। কিন্তু তার সোম নামটির অর্থ বহুকাল পূর্বে হারিয়ে গিয়েছিল। এই অর্থ বিস্মৃতির কারণও নিশ্চয় একটা আছে। সেটাও বোঝা দরকার।

আমরা জানি যে, সোম শুধু সুমিষ্ট রস নয় তা মদও বটে। অর্থাৎ সোমরস থেকে মদ হয়। বেদ-পরবর্তী কালে যখন সমাজে মদপান নিন্দনীয় বা নিষিদ্ধ হল তখন সোমরসের প্রচলিত অর্থ রক্ষা করা বৈদিক ধর্মের জন্যই ক্ষতিকর হয়ে দেখা দিল। হয় বহু প্রশংসিত মদকর সোম বা সুরা পানকে সমাজে বৈধ রাখতে হবে নতুবা এটাকে শুধু দেবতাদের অতীতের ব্যবহৃত পানীয় হিসাবে দেখাতে গিয়ে এর অর্থ বিলুপ্ত করতে হবে। সচেতন ও সংগঠিত প্রয়াস দ্বারা ব্রাহ্মণ শ্রেণী পরবর্তী কালে এই কাজই করেছিল এবং ক্রমেই সোমরসের সঙ্গে অমৃত সম্পর্কিত উপকথা বা পুরাণ-কাহিনী জড়িত করে গোটা জিনিসটিকেই রহস্যের আড়ালে ঠেলে দিয়েছিল। বিশেষত বৈদিক অপৌত্তলিক দেবতাদের পূজা পদ্ধতির অবসানের সঙ্গে যখন তাদের জন্য অগ্নিতে সোমাভিষবের প্রয়োজন ফুরাল তখন সোমের অর্থ বিস্মৃত করা আরও সহজ হল।

আমাদের একথা বোঝা দরকার যে, ঋগ্বেদ অর্থহীন কাব্যচর্চা বা বিমূর্ত ও উদ্দেশ্যহীন মন্ত্র রচনা নয়। এর সৃষ্টির পিছনে ছিল একটা বিশেষ সামাজিক শক্তির নেতৃত্ব ও নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার তাড়না বা তাগিদ যে তাড়না বা তাগিদ সমাজের মূর্ত পরিস্থিতির সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ ছিল। অপরদিকে পরবর্তী কালে এই গ্রন্থ হয়ে দাঁড়িয়েছিল ব্রাহ্মণ ও উচ্চবর্ণের শ্রেণীসমূহের সামাজিক নিয়ন্ত্রণ রক্ষার হাতিয়ার। সুতরাং শুধু কালের প্রভাবে অর্থ পরিবর্তন বা বিস্মরণ যে সম্ভব তাই নয় ধর্মীয় শক্তির প্রয়োজনেও অনেক শব্দের অর্থ পরিবর্তন বা বিস্মরণ ঘটানো হতে পারে। উদ্দেশ্য, ঋগ্বেদের ঘটনার বৈষয়িক ও লৌকিক রূপকে অস্পষ্ট ও অদৃশ্য করে উপকথা ও রহস্যের ধূম্রজাল সৃষ্টি করে তাতে জনমানসকে আবদ্ধ রাখা।

অবশ্য এই ধরনের কারণকে সর্বদা প্রযোজ্য মনে করাটা হবে বিপদজনক। এর ফলে সর্বদা ও সবখানে সচেতন উদ্দেশ্য প্রণোদন আছে ধরে নেওয়ায় সমস্ত চিন্তাপদ্ধতি হবে একপেশে ও ভ্রান্ত। আমাদের এটাও মনে রাখতে হবে যে, যে ঐতিহাসিক প্রেক্ষিতে একটি শব্দ বা ঘটনা সৃষ্টি হয় সেই প্রেক্ষিত শেষ হয়ে যাবার দীর্ঘ সময় পর অনেক ক্ষেত্রেই সেই শব্দ বা ঘটনার অর্থ বা তাৎপর্য মানুষের নিকট গুরুত্বপূর্ণ বা বোধগম্য হয় না, ফলে তা ভিন্ন অর্থ গ্রহণ করতে পারে। এইভাবে একটি ঘটনা বা সত্যকে কেন্দ্র করে অনেক উপকথা বা মীথ সৃষ্টি হয় এবং যতই সময় যায় ততই সেই উপকথা বা মীথ ডালপালা মেলে, পল্লবিত হয়। এক সময় হয়ত সত্যটা উপকথার আড়ালে এমনইভাবে ঢাকা পড়ে যে তখন প্রকৃত সত্যকে আর খুঁজে পাওয়া যায় না। তবু অনেক ক্ষেত্রে নাড়া দিয়ে পল্লবিত উপকথার জটাজাল খসানো যায় এবং বল্মীকের প্রাচীর ভেঙ্গে প্রকৃত ও জীবন্ত বাল্মীকিকে বের করে আনা যায়।

ইন্দ্র ও বৃত্র প্রসঙ্গে আলোচনায় আমাদের উপরের আলোচনা অপ্রাসঙ্গিক মনে হতে পারে। কিন্তু এই আলোচনা আমরা করলাম ঋগ্বেদ অধ্যয়নে আমাদের পদ্ধতি বা দৃষ্টিভঙ্গী নির্ধারণ করবার জন্য। আমরা ঋগ্বেদ বিচারে যে পদ্ধতি নিয়ে অগ্রসর হব সেটি সম্পর্কে পূর্বে স্পষ্ট ধারণা না নিলে পরবর্তীতে অগ্রসর হতে অসুবিধা হতে পারে বোধ করেই আমরা এই আলোচনায় এতখানি সময় দিলাম। সুতরাং এখন আমরা মূল প্রসঙ্গে ফিরতে পারি।

ঋগ্বেদে বৃত্রকে ঘিরে অনেক রহস্যময়তা। আমরা পূর্বেই বলেছি যে, ঋগ্বেদের সর্বশ্রেষ্ঠ দেবতা ইন্দ্রের সর্বশ্রেষ্ঠ কীর্তি হল বৃত্রসংহার। কয়েকটি ঋক থেকে আমরা এই বিষয়ে ধারণা পেতে চেষ্টা করব। প্রথমে ১ মণ্ডলের ৩৩ সূক্ত থেকে কয়েকটি ঋক উদ্ধৃত করা যাক : ৫। হে ইন্দ্র! সে যজ্ঞরহিত ও যজ্ঞানুষ্ঠাতাদের বিরোধীগণ মস্তক ফিরিয়ে পালিয়েছে। হে হর্ষশ্বসম্পন্ন, পলায়নরহিত উগ্র ইন্দ্র! তুমি দিব্যলোক হতে এবং আকাশ ও পৃথিবী হতে ব্রতরহিতদের উঠিয়ে দিয়েছ। ৬। তারা দোষরহিত (ইন্দ্রের) সেনার সাথে যুদ্ধ ইচ্ছা করেছিল; সচ্চরিত্র মনুষ্যেরা (ইন্দ্রকে) প্রোৎসাহিত করেছিল। পুরুষের সাথে যুদ্ধে লিপ্ত নপুংসকেরা যেরূপ পলায়ন করে, সেরূপ  তারা নিরাকৃত হয়ে আপনাদের শক্তিহীনতা জেনে ইন্দ্রের নিকট হতে সহজ পথ দিয়ে দূরে পলায়ন করল। ৭। হে ইন্দ্র! তুমি সেই রোদনকারী বা হাস্যপরায়ণদের অন্তরীক্ষের প্রান্তে যুদ্ধ দান করেছ; দস্যুকে দিব্যলোক হতে এনে সম্পূর্ণরূপে দগ্ধ করেছ এবং সোমাভিষবকারী ও স্তুতিকারীর স্তুতি রক্ষা করেছ। ৮। সেই বৃত্রের অনুচরেরা পৃথিবী আচ্ছাদন করেছিল এবং হিরণ্য ও মণি দ্বারা শোভমান হয়েছিল। কিন্তু সেই শত্রুগণ ইন্দ্রকে জয় করতে পারল না, ইন্দ্র সে বাধকদের সূর্য দ্বারা তিরোহিত করলেন। ৯। হে ইন্দ্র! যেহেতু তুমি মহিমা দ্বারা দ্যুলোক ও ভূলোক সর্বতোভাবে বেষ্টন করে সমস্ত ভোগ করেছ, অতএব তুমি মন্ত্র দ্বারা দস্যুকে নিঃসারিত করেছ; সে মন্ত্র-অর্থ গ্রহণে অক্ষম যজমানদেরও রক্ষা করবার মানস কর। ১০। যখন জল দিব্যলোক হতে পৃথিবীর অন্ত প্রাপ্ত হল না এবং ধনপ্রদ ভূমিকে উপকারী দ্রব্য দ্বারা পূর্ণ করল না, তখন বর্ষণকারী ইন্দ্র হস্তে বজ্র ধারণ করলেন এবং দ্যুতিমান বজ্র দ্বারা অন্ধকার রূপ মেঘ হতে পতনশীল জল নিঃশেষিতরূপে দোহন করলেন। ১১। প্রকৃতি অনুসারে জল প্রবাহিত হল; কিন্তু বৃত্র নৌকাগম্য নদীসমূহের মধ্যে বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হল; তখন ইন্দ্র স্থিরসংকল্প বৃত্রকে অতিবলযুক্ত প্রাণসংহারক আয়ুধ দ্বারা কয়েক দিনে হনন করলেন। ১২। ইন্দ্র ইলীবিশের প্রবল সৈন্য বিদ্ধ করেছিলেন ও শৃঙ্গযুক্ত শুষ্ণকে বিবিধ প্রকারে তাড়না করেছিলেন। হে মঘবন! তোমার যে পরিমাণ বেগ আছে, যে পরিমাণ বল আছে, তদ্দ্বারা যুদ্ধাকাঙ্ক্ষী শত্রুকে বজ্র দ্বারা হনন করেছিলে। ১৩। ইন্দ্রের কার্যসাধণকারী বজ্র (তীক্ষ্ণাগ্র অস্ত্র) শত্রুকে লক্ষ্য করে পতিত হয়েছিল। ইন্দ্র তীক্ষ্ণ ও শ্রেষ্ঠ আয়ুধ দ্বারা বৃত্রের নগরসমূহ বিবিধরূপে ভেদ করেছিলেন; তারপরে তিনি বজ্র দ্বারা বৃত্রকে আঘাত করেছিলেন এবং তাকে সংহার করে আপন উৎসাহ সম্যকরূপে বৃদ্ধি করেছিলেন।

উপরের ঋকগুলি মনোযোগ দিয়ে পড়লেই বোঝা যায় এটা প্রাকৃতিক কিংবা অলৌকিক কোন ঘটনার বর্ণনা নয়। ইন্দ্রের নামে এবং বিশেষ ধর্মীয় বিশ্বাস নিয়ে বৈদিক যোদ্ধারা এমন একদল শত্রুর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করছিল যাদেরকে ঋষি বলছেন বৃত্রের অনুচর, দস্যু এবং যজ্ঞরহিত বা ব্রতরহিত অর্থাৎ বৈদিক ধর্মকর্মহীন। এর সমৃদ্ধ এবং নগরের অধিকারী। কিন্তু বৃত্র কোনও মানুষ নয়, তা জলরোধক। তা ছিল বাঁধ জাতীয় কিছু যা নদীর জলপ্রবাহকে আটকে রেখেছিল। অর্থাৎ নদীর জল উজানে আটকে থাকায় ভাটিতে জল যায় নি। ফলে জলহীন কিংবা ক্ষতিগ্রস্ত যারা তারা এই বাধা অপসারণের জন্য যুদ্ধ করছে, যার সঙ্গে জড়িয়ে গেছে ধর্ম বিশ্বাসও। যারা বৃত্র দ্বারা নদী রুদ্ধ করে রেখেছিল তারা বৃত্রের উপর দেবত্ব আরোপ করেছিল কি করে নি সেই আলোচনা না করেও এটা বলা যায় যে, বৈদিক শক্তি তার উপর দেবত্ব আরোপ করেছিল। সুতরাং বৃত্রকে শত্রুর দেবতা হিসাবে কল্পনা করে তাকে ধ্বংসের প্রয়োজনে তার রক্ষাকারী শত্রু সেনবাহিনীর বিরুদ্ধে লড়াই করতে গিয়ে বৈদিক শক্তি নিজেদের সপক্ষের যুদ্ধ দেবতা হিসাবে ইন্দ্রের কল্পনা করেছিল। ফলে এটা অনেক সময় ঋগ্বেদে উপস্থিত হয়েছে দুই দেবতা বা দেবতা ও অপদেবতার মধ্যে যুদ্ধ হিসাবে।

কিন্তু যতই ধর্মকে জড়ানো হোক মূল বিষয় জলরোধ বা জলনিয়ন্ত্রণ। সুতরাং বৈদিক যুদ্ধের কেন্দ্রীয় ইস্যু হল প্রতিপক্ষের জলনিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা ভেঙ্গে ফেলা। এই বিষয়টিই সমগ্র ঋগ্বেদ জুড়ে অজস্র উপমা, রূপক এবং বর্ণনা দ্বারা অজস্রভাবে বলা হয়েছে। তবে তাতে অনেক সময় এমন সব ধর্মীয় বা দৈব রূপ আরোপ করা হয়েছে যে তার ভিতর থেকে বাস্তব বের করা অনেক সময়ই দুঃসাধ্য হয়ে ওঠে। তবে এইসব ঘটনা বর্ণনার বাস্তব সামাজিক ভিত্তি খুঁজলে মূলত সবটা বোঝা যায়।

প্রতিপক্ষের মূল শক্তি যত দ্রুতই ভেঙ্গে পড়ুক যুদ্ধটা যে দীর্ঘস্থায়ী হয়েছিল তাতে সন্দেহ নেই। এমন কি আমরা যে সূক্ত থেকে উপরে উদ্ধৃতি দিয়েছি সেই সূক্তে বৃত্র ধ্বংস এবং শত্রুর পরাজয়ের বর্ণনা দিয়েও শেষ ঋকে বলা হচ্ছে : “..... যারা আমাদের সাথে বহুকাল যুদ্ধ করছে, সেই শত্রুকাঙ্ক্ষীদেরও তুমি বেদনা ও দুঃখ প্রদান কর” (১।৩৩।১৫)। কাজেই ঋগ্বেদ বিচারের সময় একটি সমাজের দীর্ঘস্থায়ী যু্দ্ধ, ধ্বংস এবং তজ্জনিত তীব্র পারস্পরিক ঘৃণা ও তিক্ততার বিষয়টিকে আমাদের ধারণায় নেওয়া প্রয়োজন।

বৃত্র এবং জলরোধ বা নদীনিয়ন্ত্রণের বিষয়টি অধিকতর স্পষ্ট করার জন্য আমরা আরও কিছু ঋকের সাহায্য নিতে পারি।

৭। হস্ত-পদশূন্য বৃত্র ইন্দ্রকে যুদ্ধে আহ্বান করল, ইন্দ্র তার সানু তুল্য পৌঢ়স্কন্ধে বজ্র আঘাত করলেন; যেরূপ পুরুষত্বহীন ব্যক্তি পুরুষত্ব সম্পন্ন ব্যক্তির সাদৃশ্য লাভ করতে বৃথা যত্ন করে, বৃত্রও সেরূপ বৃথা যত্ন করল; বহুস্থানে ক্ষত হয়ে বৃত্র ভূমিতে পড়ল (১।৩২।৭), “ভগ্নকূল অতিক্রম করে নদ যেরূপ বয়ে যায়, মনোহর জল সেরূপ পতিত বৃত্রদেহকে অতিক্রম করে যাচ্ছে; বৃত্র জীবদ্দশায় নিজ মহিমা দ্বারা যে জলকে বদ্ধ করে রেখেছিল, অহি এখন সে জলের নীচে শয়ন করল” (১।৩২।৮), “স্থিতি রহিত বিশ্রাম রহিত জলের মধ্যে নিহিত, নামশূন্য শরীরের উপর দিয়ে জল বয়ে যাচ্ছে” (১।৩২।১০) “জলের বহন দ্বার রুদ্ধ ছিল, বৃত্রকে হনন করে ইন্দ্র সে দ্বার খুলে দিয়েছেন (১।৩২।১১), “হে ইন্দ্র! যখন সেই এক দেব বৃত্র (ঋষি বৃত্রকে দেব বলছেন) তোমার বজ্রের প্রতি আঘাত করেছিল, তখন তুমি অশ্বপুচ্ছের ন্যায় হয়ে আঘাত নিবারণ করেছিলে; তুমি গাভী জয় করেছ, সোমরস জয় করেছ এবং সপ্তসিন্ধু প্রবাহ ছেড়ে দিয়েছ” (১।৩২।১২)।

“হে মনুষ্যগণ! যিনি অহিকে বিনাশ করে সপ্তসংখ্যক নদী প্রবাহিত করেছিলেন ..... তিনিই ইন্দ্র” (২।১২।৩), “হে মনুষ্যগণ! ..... যিনি সাতটি নদীকে প্রবাহিত করে দিয়েছিলেন ..... তিনিই ইন্দ্র” (২।১২।১২)।

“হে ইন্দ্র! তুমি মেঘকে বিদীর্ণ করে জল নির্গম মার্গ উন্মুক্ত করেছ, তুমি রুদ্ধ জল সমলকে মুক্ত করেছ” (৫।৩২।১)।

“হে ইন্দ্র! তুমি বৃত্র কর্তৃক সমাচ্ছাদিত নদী সকলের প্রকাণ্ড বারিরাশি উন্মুক্ত করেছ; তুমি জলরাশি মুক্ত করেছ। তুমি সে সমস্ত নদীকে নিম্নপথে প্রবাহিত করেছ; তুমি বেগবান সলিলরাশিকে সমুদ্রে নিয়ে গিয়েছ” (৬।১৭।১২)।

এই উদ্ধৃতিগুলি আমাদেরকে বৃত্র সম্পর্কে প্রাথমিক ধারণা দিতে পারে। বস্তুত বৃত্র যেমন ঋগ্বেদের সবচেয়ে বড় রহস্য তেমন তা-ই আবার ঋগ্বেদের রহস্য উন্মোচনের সর্বশ্রেষ্ঠ চাবি। বৃত্র প্রসঙ্গে আমরা ৩য় মণ্ডলে এমন একটি সূক্ত পাই যা আমাদেরকে ঋগ্বেদের সকল রহস্য ও জটিলতার জট খুলতে বিপুলভাবে সাহায্য করে। পরিষ্কার বোঝা যায় এটা বৃত্রসংহার এমন কি যুদ্ধ শুরুরও পূর্বে রচিত মন্ত্র। অন্যান্য ঋষি কর্তৃক রচিত এই ধরনের মন্ত্র এর পর বিভিন্ন মণ্ডলে আমরা দেখতে পাই। তবে প্রথম দিকে এর অবস্থান হওয়ায় এর গুরুত্ব বেশী। কিন্তু তার চেয়েও বড় কথা অন্যান্য সূক্তের তুলনায় এই সূক্তের বক্তব্যের স্পষ্টতা ও বলিষ্ঠতা অনেক বেশী। ইন্দ্রের উদ্দেশ্যে বিশ্বামিত্র ঋষি রচিত এই অসাধারণ সূক্তটির সম্পূর্ণটাই আমরা নীচে তুলে দিচ্ছি :

১। হে ইন্দ্র! বৃত্র বিনাশকর বল লাভের জন্য ও শত্রু সেনার অভিভবের জন্য তোমাকে প্রবর্তিত করছি। ২। হে শতক্রতু! স্তোতাগণ তোমার মন চক্ষু প্রীত করে আমাদের অভিমুখে প্রেরণ করুক। ৩। হে শতক্রতু! আমরা গর্বিত শত্রুদের অভিভবকর যুদ্ধে সমস্ত স্তুতি দ্বারা তোমার নাম কীর্তন করব। ৪। ইন্দ্র সকলের স্তুতিযোগ্য, অপরিমিত তেজবিশিষ্ট এবং মনুষ্যদের স্বামী, আমরা তার স্তুতি করছি। ৫। হে ইন্দ্র! বৃত্রকে বিনাশ করবার জন্য এবং যুদ্ধে ধন লাভের জন্য বহু লোকের আহূত ইন্দ্রকে আহ্বান করছি। ৬। হে শতক্রতু! তুমি যুদ্ধে শত্রুদের অভিভবকারী হও, বৃত্রকে বিনাশ করবার জন্য আমরা তোমাকে প্রার্থনা করছি। ৭। হে ইন্দ্র! যারা ধনে, যুদ্ধে বীরসমূহে ও বলে আমাদের অভিমানী শত্রু তাদের পরাজিত কর। ৮। হে শতক্রতু! আমাদের আশ্রয় দানের জন্য অতিশয় বলবান, দীপ্তিযুক্ত, স্বপ্ননিবারক সোম পান কর। ৯। হে শতক্রতু! পঞ্চজনে যে সকল ইন্দ্রিয় আছে, আমি সেগুলি তোমারই বলে জানি। ১০। হে ইন্দ্র! প্রভূত অন্ন তোমার নিকট গমন করুক, শত্রুদের দুর্ধর্ষ ধন আমাদের প্রদান কর। আমরা তোমার উৎকৃষ্ট বল বর্ধিত করব। ১১। হে শক্র! নিকট অথবা দূর দেশ হতে আমাদের অভিমুখে এস। হে বজ্রবান ইন্দ্র! তোমার যে উৎকৃষ্ট স্থান আছে সেখান হতে এ যজ্ঞে এস।

(৩ মণ্ডল। ৩৭ সূক্ত। ইন্দ্র দেবতা। বিশ্বামিত্র ঋষি।)

মনোযোগ দিয়ে পাঠ করলে এই একটি সূক্ত দ্বারা পূর্ববর্তী বহু সূক্তের রহস্য যেমন উদ্ঘাটিত হয় তেমন পরবর্তী বহু সূক্তও আর দুর্বোধ্য থাকে না। বস্তুত ঋগ্বেদের সূক্তগুলি রচনার কালানুক্রমে বিন্যস্ত না হবার ফলে এই ধরনের সূক্তের গুরুত্ব সহজেই চোখ এড়ায়। যেমন একই ঋষি বিশ্বামিত্র কর্তৃক রচিত এই সূক্তের পূর্ববর্তী সূক্ত অর্থাৎ ৩৬ নম্বর সূক্তটি নিশ্চিতভাবে বৃত্র বিনাশোত্তর কালের রচনা। যাইহোক ৩৭ নম্বর সূক্তটি আমাদের বহু প্রশ্নের উত্তর দেয়। বোঝা যায় যে, এক সময় ইন্দ্র দেবতা অপরিচিত না হলেও কম গুরুত্বপূর্ণ ছিলেন। তাঁকে অর্থাৎ তাঁর পূজা প্রবর্তিত করা হচ্ছে বৃত্র এবং বৃত্রের সঙ্গে সম্পর্কিত শত্রু সেনার ধ্বংসের উদ্দেশ্যে। সূক্তে শত্রুকে ধনে, যুদ্ধে অর্থাৎ সামরিক শক্তিতে এবং বীরত্বে প্রবল এবং গর্বিত বলা হচ্ছে।

এই ওজস্বী সূক্তটিকে আমরা ঋগ্বেদের যুদ্ধ ঘোষণার মন্ত্র বলতে পারি। এবং এটি ঋগ্বেদের রহস্য উন্মোচনের জন্য সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ চাবি। এই একটি সূক্ত দ্বরা রহস্যের বিরাট পর্দা সরে যায় এবং চোখের সামনে প্রায় পৌনে চার বা চার হাজার বৎসর পূর্বের এক যুদ্ধপূর্ব সমাজের দৃশ্য ফুটে উঠতে শুরু করে।

আমরা পরবর্তীতে এই ধরনের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ আরও কিছু ছড়ানো সূক্ত খুঁজে পাব যেগুলি আমাদেরকে বৈদিক যুদ্ধের পটভূমি বুঝতে বিরাটভাবে সাহায্য করে। কারণ স্পষ্টই বোঝা যায় যে, এই সূক্তগুলি বৃত্রবধের পূর্বে এবং বৃত্রবধ কামনায় রচিত। এগুলির মধ্যে ৬।৩৬, ৬।৩৭, ৬।৪৪, ৬।৪৬, ৭।৪৮, ৮।২১ ইত্যাদি সূক্ত বিশেষভাবে উল্লেখ্য। এইসব সূক্তের কোন কোনটিতে যুদ্ধ শুরুর পূর্বেকার দ্বিধা, ভয়, সংশয় প্রতিফলিত। যেমন কণ্বের পুত্র সোভরি ঋষি ৮।২১।৬ ঋকে বলছেন, “হে ইন্দ্র! এ স্তোত্রের সাথে তোমার অভিমুখে তোমারই স্তব করব। তুমি কেন বার বার চিন্তা করছ?” অর্থাৎ ঋষি নিজেদের ভয়, সংশয়, দ্বিধা ও চিন্তাকে দেবতার উপর আরোপ করছেন। ঋষি পরের ঋকে যেটা বলছেন সেটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ : “হে ইন্দ্র! তোমার রক্ষা লাভ করে আমরা নূতন হব। হে বজ্রধারী ইন্দ্র! পূর্বে জানতাম না যে তুমি মহান। সম্প্রতি জেনেছি” (৮।২১।৭)। অর্থাৎ অনেক দ্বিধা-দ্বন্দ্বের ভিতর দিয়েই ইন্দ্রকে পূজ্য বা প্রধান দেবতা হিসাবে গ্রহণ করা বা প্রবর্তন করা হয়েছে। স্বাভাবিকভাবেই এর পিছনে আছে দীর্ঘ দিনের সামাজিক ক্ষোভ, আন্দোলন এবং বহুকিছুর ওলটপালট।

ঋগ্বেদ পাঠ করলে এটা স্পষ্ট হয় যে, বৈদিক আন্দোলন গড়ে উঠতে যেমন দীর্ঘ সময় লেগেছিল তেমন এই আন্দোলন সংগঠিত করতে গিয়ে অনেক ঋষি এবং কিছু রাজর্ষি বা রাজা (সেনাপতি বা প্রশাসক?) অনেক নিগ্রহ ভোগ করেছেন। ১।৫১।৩, ১।১০৬।৬, ১।১১৬।৮, ১।১১৬।২৪, ৮।৫।২৩, ৮।৫।২৫, ১০।৩৯।৯ ইত্যাদি ঋকগুলিতে এইসব পীড়ন এবং তা থেকে দেবতা কর্তৃক উদ্ধারের বর্ণনা পাওয়া যায়। এইসব পীড়ন যে এই ধর্মীয়-সামাজিক আন্দোলনের কারণে তা বুঝতে অসুবিধা হয় না।

বস্তুত, আশ্চর্য মনে হলেও এই বিষয়টি ক্রমেই স্পষ্ট হয়ে ওঠে যে, বৈদিক আন্দোলন ছিল প্রচলিত ধর্ম ও রাষ্ট্রশাসকদের বিরুদ্ধে একটা বিদ্রোহ। অর্থাৎ বেদের যুদ্ধ হল প্রতিষ্ঠিত সমাজ ও রাষ্ট্র ব্যবস্থা ধ্বংসের জন্য বৈদিক ঋষি এবং তার নেতৃত্বাধীন যোদ্ধা ও অন্যান্য সামাজিক শক্তির বিদ্রোহী যুদ্ধ। এই বিদ্রোহের পটভূমি দীর্ঘকাল ধরে রচিত হয়েছে এবং এই পটভূমি রচনায় নেতৃত্বের শক্তি হিসাবে ঋষিদের ভূমিকাই ছিল সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। এর জন্য তারাই সবচেয়ে বেশী মূল্য দিয়েছে। তাদের দীর্ঘ প্রয়াসে গড়ে ওঠা এই আন্দোলন যখন যুদ্ধে রূপ নিয়েছে তখন স্বাভাবিকভাবেই এই যুদ্ধে বিদ্রোহী রাজা বা যোদ্ধারা এসে যোগ দিলেও নেতৃত্ব রয়ে গেছে বৈদিক ঋষিদেরই হাতে।

এই যুদ্ধ কিভাবে একটু একটু করে সংগঠিত হয়ে এক বিশাল যুদ্ধে পরিণত হয়েছে তারও সাক্ষ্য আছে ঋগ্বেদে। এ প্রসঙ্গে ১ মণ্ডলের ১৩৩ সূক্তের কথা উল্লেখ করা যায় যার রচয়িতা দিবোদাসের অপত্য সোভরি ঋষি শত্রুদের নিধনে বিরাট উল্লাস প্রকাশ করে বলছেন, “শত্রুরা যেখানেই একত্রিত হয়েছিল সেখানেই হত হয়েছে। সম্পূর্ণরূপে বিনষ্ট হয়ে তারা শ্মশানের চারদিকে পড়ে আছে “(১।১৩৩।১), “হে শত্রুভক্ষক ইন্দ্র! তুমি হিংসাবতী সেনার মস্তক একত্র করে তোমার বিস্তৃত পদদ্বারা ছেদন করে…” (১।১৩৩।২)।

এই সূক্তে ঋষি যেভাবে শত্রু সংহারে উল্লাস প্রকাশ করছেন তাতে সংগত কারণেই পাঠক এটাকে একটা বিরাট বিজয়ের ঘটনা মনে করবেন। কিন্তু ১।১৩৩।৪ ঋকে যখন ঋষি বলছেন “হে ইন্দ্র! তুমি এরূপ ত্রিগুণিত পঞ্চাশৎ সংখ্যক সেনা নাশ করেছ” তখন হতাশই হতে হয়। কারণ সংখ্যাটা হচ্ছে মাত্র ৫০×৩=১৫০ (দেড়শত)। ঋগ্বেদের বহু সূক্তে যেখানে ৫, ১০ এমন কি ৬০ হাজার শত্রু ধ্বংসেরও বর্ণনা পাই সেখানে মাত্র ১৫০ জন শত্রু সৈন্য নিধনের পর তা নিয়ে এত উল্লাসের কারণ বোঝা কঠিন হতে পারে। কিন্তু একটু চিন্তা করলেই বোঝা যাবে যে, এটি শত্রু সেনার বিরুদ্ধে একটি প্রথম সফল যুদ্ধাভিযানের বিবরণ যে কারণে এই ক্ষুদ্র বিজয়ের মূল্য এত বিরাট হয়ে ঋষির কাছে দেখা দিয়েছে। এই একই সূক্তে পরবর্তী ঋকগুলিতে ঋষি চারদিকের প্রবল শত্রুদের সম্পর্কে যেভাবে আতঙ্ক প্রকাশ করে দেবতা ইন্দ্রের আশ্রয় ও সাহায্যের জন্য মিনতি করেছেন তাতে বোঝাই যায় যে, বৈদিক যুদ্ধ কত ধীরে ও অনিশ্চয়তার মধ্যে একটু একটু করে সংহত হয়ে পরে বিরাট আকার ও প্রচণ্ড শক্তি ধারণ করেছে।

এই আন্দোলন ও যুদ্ধ প্রধানত ধর্মীয় রূপ বা আবরণ নিলেও তার অন্তরালবর্তী প্রেরণা ছিল অবশ্যই বৈষয়িক যার প্রধান কেন্দ্রবিন্দু ছিল বৃত্রবধের নামে প্রচলিত জলনিয়ন্ত্রণব্যবস্থার ধ্বংস সাধন।

কিন্তু প্রশ্ন হল যে, এই জল নিয়ন্ত্রণব্যবস্থাকে কেন ধ্বংস করতে চাওয়া? অর্থাৎ তাহলে সপ্তসিন্ধু অঞ্চলে নিশ্চয় এমন একটা জলনিয়ন্ত্রণব্যবস্থা গড়ে উঠেছিল বৈদিক শক্তি যাকে ধ্বংস করতে চেয়েছিল। সুতরাং আমাদের সম্মুখে এখন যে প্রশ্ন দাঁড়ায় সেটা হল যে, সেই জলনিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থার বৈশিষ্ট্য কি ছিল এবং কেনই বা তার নিয়ন্ত্রণের বিরুদ্ধে এমন প্রচণ্ড সামাজিক বিক্ষোভ যা পরিণতিতে সমগ্র সমাজ ও জাতিকে গৃহযুদ্ধের মধ্যে ঠেলে দিয়েছিল?

এই প্রশ্নের স্পষ্ট উত্তর পাবার জন্য আমাদেরকে সাহায্য নিতে হবে প্রত্নতাত্ত্বিক আবিষ্কারের। অর্থাৎ সিন্ধু সভ্যতার ধ্বংসাবশেষে আবিষ্কৃত তথ্যভাণ্ডার থেকে আমাদেরকে এই প্রশ্নের উত্তর বের করে নিতে হবে। বস্তুত এই বিষয়টি এখন আমাদের নিকট সুস্পষ্ট যে সিন্ধু সভ্যতাই হচ্ছে বৈদিক আন্দোলন ও যুদ্ধের ভিত্তিভূমি এবং ঋগ্বেদ সেই সমাজেরই একটা ফসল। সুতরাং ঋগ্বেদের বিষয়গুলিকে এবং সেই সঙ্গে সিন্ধু সভ্যতার সমাজ ও আনুষংগিক বিষয়গুলিকে বোঝার প্রয়োজনে এখন আমরা সিন্ধু সভ্যতার দিকে দৃষ্টি দিব।

 

৪। সিন্ধু সভ্যতা

বস্তুত সিন্ধু সভ্যতার ধ্বংসাবশেষ আবিষ্কারের পূর্বে ঋগ্বেদের নগর বর্ণনাকে বাস্তবের সঙ্গে মেলানো সম্ভব ছিল না। তবে ধারণা করা হত যে, বহিরাগত আর্যরা স্থানীয় অনার্যদের দুর্গ, নগর বা বসতি ধ্বংস করে সেখানে বসবাস শুরু করে। এমন কি অনেক সময় ঋগ্বেদের বিবরণকে অতিরঞ্জিত ও কাল্পনিক মনে করা হয়েছে। কিন্তু এই শতাব্দীর ২০ এর দশকে সিন্ধু সভ্যতার প্রত্নতাত্ত্বিক আবিষ্কারের পর ঋগ্বেদের নগর বর্ণনার একটা বাস্তব ভিত্তি পাওয়া গেল।

বিভিন্ন প্রত্নতাত্ত্বিক আবিষ্কার দ্বারা এটা এখন প্রমাণিত হয়েছে যে, বর্তমান সিন্ধু ও পাঞ্জাবকে মূল কেন্দ্র করে এক বিশাল ও বিস্তীর্ণ এলাকার উপর প্রাচীন পৃথিবীর এক সুউন্নত নগর সভ্যতা প্রতিষ্ঠিত ছিল। এই সভ্যতার অন্তর্ভুক্ত ছিল সমগ্র সিন্ধু ও পাঞ্জাব, বালুচিস্তানের পশ্চিম প্রান্ত পর্যন্ত সমুদ্রোপকূলবর্তী এলাকা, উত্তর-পশ্চিম সীমান্তের উপত্যকাভূমি, গুজরাটের উল্লেখ্য অংশ বিশেষত উপকূলবর্তী অঞ্চল,  এবং দিল্লীর পূর্বে গঙ্গা-যমুনার মধ্যবর্তী ভূভাগের অন্তত একাংশ। এই বিশাল ভূভাগে এ পর্যন্ত সত্তরেরও বেশী সিন্ধু সভ্যতার নগরের ধ্বংসাবশেষ পাওয়া গেছে।

সিন্ধু সভ্যতার উন্নত রূপটি হরপ্পান সভ্যতা বা সংস্কৃতি নামে পরিচিত। কারণ তার পূর্বে আছে একটি তুলনায় অনুন্নত নগর সভ্যতার স্তর। এই অনুন্নত সভ্যতার স্তরের উপর হরপ্পা সভ্যতার উন্নত নগরগুলি প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।

সুতরাং গুণগত মান এবং আরও কিছু বৈশিষ্ট্যের বিচারে সিন্ধু সভ্যতাকে সাধারণত দুইভাগে ভাগ করা হয়। একটি প্রাক-হরপ্পান স্তর অপরটি হরপ্পান স্তর। হরপ্পান স্তর বা সংস্কৃতির নগরগুলির একটি প্রধান বৈশিষ্ট্য হল তার সোজা, প্রশস্ত রাস্তা, আন্ডারগ্রাউন্ড বা ঢাকাযুক্ত ড্রেন এবং সুপরিকল্পিত নগর বিন্যাস। সিন্ধু অঞ্চলকে কেন্দ্র করেই এই সংস্কৃতির সভ্যতা বিস্তার লাভ করে। সিন্ধু সভ্যতা বলতে এখন সাধারণত এই হরপ্পা সংস্কৃতির স্তরকেই বোঝানো হয়।

এক সময় ধারণা করা হত যে, জন্ম থেকেই হরপ্পা সংস্কৃতির সমস্ত পর্যায় একই রকম। মনে হচ্ছিল যেন একটি নগর সভ্যতা পূর্ণাঙ্গ ও উন্নত নগর পরিকল্পনা নিয়ে জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত প্রায় একইভাবে পাঁচশত বা হাজার বৎসর টিকে ছিল। এর ফলে কেউ কেউ সন্দেহ করতেন যে, সিন্ধু উপত্যকায় উন্নত নগর সভ্যতা তথা হরপ্পা সংস্কৃতি বহিরাগতদের সৃষ্টি। হয়ত সুমের থেকে তারা এই সভ্যতার উন্নত ও পূর্ণাঙ্গ নগর পরিকল্পনার বীজ নিয়ে এসে একটি নূতন নগর সভ্যতা প্রতিষ্ঠা করেছিল। কিন্তু পরবর্তী প্রত্নতাত্ত্বিক অনুসন্ধানসমূহ দ্বারা এটা এখন স্পষ্ট হয়েছে যে, হরপ্পা সংস্কৃতি বা সভ্যতার উদ্ভব পূর্ববর্তী বা প্রাক হরপ্পা সংস্কৃতির ভিতর থেকে ঘটেছে। অর্থাৎ এটা এখন প্রমাণিত যে, সিন্ধুর উপত্যকাকে কেন্দ্র করে যেসব প্রাক-হরপ্পান নগর গড়ে উঠেছিল সেগুলি থেকেই পরবর্তীতে এক নূতন ও সুউন্নত নগর সভ্যতার পরিকল্পনা এবং সেই পরিকল্পনাকে বাস্তবায়িত করার শক্তিও জন্ম নিয়েছিল। এই পরবর্তী সুপরিকল্পিত ও উন্নত নগর সভ্যতা সুদীর্ঘকাল ধরে চারপাশে বিস্তৃত ও প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল।

এই সভ্যতার সময়কাল নিয়ে বিতর্ক আছে। কারণ সিন্ধু সভ্যতার লিপির পাঠোদ্ধার হয় নি। তবে প্রত্নতাত্ত্বিক তথ্যের ভিত্তিতে গঠিত বিভিন্ন মত বিচার করে মোটামুটি খ্রীস্টপূর্ব ৩০০০ হতে খ্রীস্টপূর্ব ২৫০০ অব্দের মধ্যে এই সভ্যতার উদ্ভবের সম্ভাব্য সময় ধরে নিয়ে আমরা আলোচনায় অগ্রসর হতে পারি।

সিন্ধু সভ্যতার দুই প্রধান নগর হরপ্পা ও মহেঞ্জোদাড়ো। হরপ্পা পাঞ্জাবে অবস্থিত। তার চারশত মাইল দক্ষিণে মহেঞ্জোদাড়ো। উভয় নগর প্রায় আয়তাকার এবং হরপ্পা মহেঞ্জোদাড়োর তুলনায় কিছু বড়। উভয় নগরই এক পরিকল্পনায় গঠিত। তবে হরপ্পার তুলনায় মহেঞ্জোদাড়োতে প্রাচীন নগরের ধ্বংসাবশেষ বেশী রক্ষিত হয়েছে। কারণ গত শতাব্দীতে ব্রিটিশ সরকার যখন পাঞ্জাবে রেললাইন বসান তখন রেললাইনের নীচে দেবার জন্য হরপ্পা নগরের ধ্বংসাবশেষ থেকে লক্ষ লক্ষ ইট সংগ্রহ করা হয়।

সুতরাং আমরা মহেঞ্জোদাড়ো থেকেই অনেক বেশী তথ্য পাই। প্রায় এক বর্গমাইল আয়তন বিশিষ্ট মহেঞ্জোদাড়ো খননে অনেকগুলি স্তর পাওয়া গেছে। একই নগর বিন্যাস অনুযায়ী শত শত বৎসর ধরে পুরাতন ঘরবাড়ীর ধ্বংসাবশেষের উপর নূতন করে ঘরবাড়ী উঠেছে এবং সেই সঙ্গে উঁচু হয়েছে রাস্তা, কূপ ইত্যাদিও। মাটির আর্দ্রতা ও বন্যার কারণে নগরের ক্ষয় বেশী হয়েছে। কারও কারও মতে মহেঞ্জোদাড়ো নগর প্রতিষ্ঠার পর অন্তত তিনবার প্রলয়ংকারী বন্যায় নগর বিরাটভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এ ছাড়াও ছিল নিয়মিত বাৎসরিক বন্যা। বন্যায় সর্বত্র পলি জমেছে বিপুল পরিমাণে। ফলে তার সাথে তাল মিলিয়ে নগরকে উঁচু করতে হয়েছে। নগরের যে দৃঢ় প্রাচীর ছিল তা শুধু নগরের সামরিক প্রতিরক্ষার কাজে লাগত না তা বন্যার আঘাত থেকে নগরকে রক্ষার কাজেও লাগত। বস্তুত সিন্ধু সভ্যতার এই সমগ্র সময়কাল ধরে বন্যার প্রভাব এবং পলি জমে ভূমির উচ্চতা বৃদ্ধির কথা আমরা জানতে পারছি। সিন্ধু উপত্যকার মহেঞ্জোদাড়ো এলাকায় মূল ভূমির উপর ৩০ ফুটেরও বেশী উঁচু পলির স্তর জমেছে। এটি খুবই লক্ষণীয় একটি ঘটনা।

মহেঞ্জোদাড়ো নগরের পশ্চিম পার্শ্বে অপেক্ষাকৃত উচ্চস্থানে স্বতন্ত্রভাবে একটি প্রাচীর ঘেরা দুর্গ আছে। সিন্ধু সভ্যতায় সকল উল্লেখ্য নগরের পাশেই এই রকম অপেক্ষাকৃত উচ্চ নগর-দুর্গ লক্ষণীয়। মহেঞ্জোদাড়োর নগর-দুর্গ কৃত্রিম মাটির পাহাড় বা ঢিবির উপর প্রতিষ্ঠিত। মাটি উঁচু করে সমভূমি থেকে দক্ষিণে ২০ ফুট এবং উত্তরে ৪০ ফুট উঁচু মঞ্চ করে তার উপর নগর-দুর্গ নির্মাণ করা হয়েছে। আর হরপ্পা নগরের পশ্চিমে অবস্থিত নগর-দুর্গ সমভূমি থেকে প্রায় পঞ্চাশ ফুট উপরে। উত্তর-দক্ষিণে ৪৬০ গজ এবং পূর্ব-পশ্চিমে ২১৫ গজ বিস্তৃত এই নগর-দুর্গ প্রাচীন কালে কেমন দেখাত সহজেই অনুমেয়। বস্তুত সিন্ধু উপত্যকার নগর-দুর্গগুলির উচ্চতা ও দৃঢ়তা লক্ষণীয়। এখন আমরা অনুমান করতে পারি যে, ঋগ্বেদে এই নগর-দুর্গগুলিকে পর্বত, অদ্রি বা গিরি বলা হয়েছে। অর্থাৎ ঋগ্বেদের পুর হল নগর আর পর্বত এক অর্থে পর্বত হলেও অপর অর্থে নগর-দুর্গ। পাহাড়ের মত বিরাট ঢিবির উপর অবস্থিত আকাশ ছোঁয়া নগর-দুর্গকে প্রাচীন মানুষ পর্বতের সমতুল্য বিশাল, দৃঢ় ও উচ্চ ভেবে পর্বত নাম দিয়ে থাকতে পারে।

আমরা সিন্ধু সভ্যতার উন্নত নগর পরিকল্পনার কথা বলেছি। মহেঞ্জোদাড়ো নগরের চিত্রের দিকে দৃষ্টি দিলে আমরা তার প্রমাণ পাই। ৯ থেকে ৩৪ ফুট প্রশস্ত রাস্তাগুলি উত্তর থেকে দক্ষিণে, পূর্ব থেকে পশ্চিমে চলে গেছে কখনও আধ মাইল পর্যন্ত সোজা সরল রেখার মত। কোথায়ও আঁকাবাঁকা গলি নেই। রাস্তাগুলি পরস্পরকে ৯০ ডিগ্রী কোণ করে অতিক্রম করেছে। রাস্তার দুই পাশে সারিবদ্ধ পোড়া ইটে তৈরী পাকা বাড়ী। বাড়ীগুলি লাগালাগি। সোজা রাস্তাগুলি দ্বারা বিভক্ত হয়ে অনেকগুলি বাড়ী মিলে একটি আয়তাকার ব্লক সৃষ্টি করেছে। দেওয়ালের প্রশস্ততা বা পুরুত্ব এবং অন্যান্য বৈশিষ্ট্য থেকে অনুমান করা হয় যে অনেক বাড়ী ছিল দ্বিতল এমনকি ত্রিতল। বাড়ীগুলির মাঝে উঠান। এ্রবং প্রতিটি বাড়ীতে আছে কূপ, স্নানাগার এবং পায়খানা। বিস্ময়কর হল যে, পায়খানা বা শৌচাগারগুলি থেকে মল পাইপ বা ঢাকা ড্রেন দিয়ে রাস্তার পার্শ্ববতী ঢাকনাযুক্ত প্রণালী বা আন্ডারগ্রাউন্ড ড্রেনে চলে যেত। কিছু শৌচাগারে ইউরোপীয় পদ্ধতিতে বসবার ব্যবস্থাও ছিল বলে আমরা জানতে পারি।

নগরের ময়লা নিষ্কাশন ব্যবস্থা প্রাচীন পৃথিবীর বিস্ময়। রাস্তায় ধারে অবস্থিত সমস্ত ড্রেন ইটে তৈরী অর্থাৎ পাকা। ড্রেনগুলি পাথরের স্ল্যাব বা চ্যাপ্টা ইট দ্বারা ঢাকা থাকত। সেগুলি নিয়মিত পরিষ্কার করা হত। ড্রেন পরিষ্কারের সুবিধার জন্য মাঝে মাঝে ম্যানহোল রাখা আছে। একাধিক রাস্তার ড্রেন যেখানে মিলিত হয়েছে সেখানে আছে গভীর ও প্রশস্ত পিট বা গর্ত। এর ফলে ড্রেনের উপর অতিরিক্ত চাপ সৃষ্টি হত না। ড্রেনগুলি বেয়ে নগরের সমস্ত ময়লা নদীতে গিয়ে পড়ত। এই সমগ্র ময়লা নিষ্কাশন ব্যবস্থা এমনই যে তা নাগরিক পরিবেশকে এতটুকু নোংরা ও দুর্গন্ধময় করতে পারত না। একইভাবে ছিল আবর্জনা ফেলবার নির্দিষ্ট স্থান বা ডাস্টবিন। তাছাড়া সাধারণত প্রতি রাস্তার মোড়ে দুইবাড়ীর মাঝখানে একটু জায়গা করে সেখানে পাকা কূপ বা ইন্দারা ছিল জনসাধারণের ব্যবহারের জন্য। বস্তুত ভারতীয় উপমহাদেশে আধুনিক কালের পূর্ব পর্যন্ত আর কখনই এত উন্নত নগর পরিকল্পনা ও ব্যবস্থাপনা গড়ে তোলা সম্ভব হয় নি।

যদি আমরা মহেঞ্জোদাড়ো নগরের বিবরণ পড়ি এবং তার মানচিত্রের দিকে লক্ষ্য করি তবে মনে হবে এটা একটা মধ্যবিত্ত নগর। গোটা নগরে বিশাল প্রাসদ ও ঝুপড়ির কোন সহাবস্থান নেই। কিছু বড় বাড়ী আছে। এগুলি উচ্চবিত্তের। কিন্তু এগুলি মধ্য বা নিম্নবিত্তের বাড়ীর তুলনায় খুব বেশী অসম নয়। এবং সব বাড়ীই পাশাপাশি গা লাগিয়ে অবস্থান করছে। এটা সুস্পষ্ট যে, সমগ্র নগরে মধ্যবিত্ত বা সাধারণ নাগরিকদের সুযোগ-সুবিধার উপর সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেওয়া হয়েছিল। অর্থাৎ রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক ক্ষমতার উপরও যে তাদের একটা গভীর প্রভাব বা নিয়ন্ত্রণ ছিল এটা স্পষ্ট।

তবে কি নগরে বিরাট প্রাসাদ এবং শাসকদের ভিন্ন অবস্থানের চিহ্ন পাওয়া যায় না? নগরের সংলগ্ন দুর্গই ছিল মূলত ধর্মীয় ও প্রশাসনিক কেন্দ্র এমন একটা অনুমান করবার কারণ আছে। এই নগর দুর্গে আছে একটি বৃহৎ খাদ্য গুদাম। প্রথম দিকে এটা ছিল পূর্ব পশ্চিমে লম্বায় ১৫০ ফুট এবং চওড়ায় ৭৫ ফুট এবং ২৭টি ব্লকে বিভক্ত। কিন্তু পরে এটিকে আরও সম্প্রসারিত করা হয়। নগর দুর্গে ২৩০×৭৮ ফুটের একটি বৃহৎ ভবনের ধ্বংসাবশেষ পাওয়া গেছে। এটি প্রধান শাসকের বাসগৃহ, প্রশাসনিক বাসগৃহ কিংবা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ইত্যাদি যে কোনও একটি হতে পারে বলে অনুমান করা হয়। মহেঞ্জোদাড়োর নগর-দুর্গে সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ বস্তু হল প্রত্নতাত্ত্বিকদের নিকট “গ্রেট বাথ” নামে পরিচিত একটি বৃহৎ সুনির্মিত চৌবাচ্চা। নিখুঁতভাবে ইটে গাঁথা এই চৌবাচ্চার দৈর্ঘ উত্তর-দক্ষিণে ৩৯ ফুট, প্রস্থ ২৩ ফুট, এবং গভীরতা ৮ ফুট। চৌবাচ্চার দুই প্রা্ন্ত দিয়ে দু’টি সিঁড়ি ধাপে ধাপে নেমে গেছে উপর থেকে নীচ পর্যন্ত। নিকটবর্তী কূপ থেকে চৌবাচ্চা ভরার জন্য জল আনা হত। চৌবাচ্চার জল নিঃসারণেরও ব্যবস্থা ছিল। নীচ দিয়ে নলের মত সরু পথ বা ড্রেন বেরিয়ে গেছে যা খোলা এবং বন্ধ করা যায়। এই চৌবাচ্চার চারপাশ ঘিরে যে চত্বর, বারান্দা এবং বহু কামরা বিশিষ্ট ভবন তার আয়তন দৈর্ঘ্যে ১৮০ ফুট এবং প্রস্থে ১০৮ ফুট।

হরপ্পার ধ্বংশাসবশেষ থেকেও যে চিত্র বেরিয়ে এসেছে তাতে প্রততাত্ত্বিকগণ সকলে একমত এবং নিশ্চিত যে হরপ্পা ও মহেঞ্জোদাড়ো এই উভয় নগর ও নগর-দুর্গের পরিকল্পনা প্রায় একই রকম ছিল। বিশেষত হরপ্পার সংস্কৃতির অধীন সিন্ধু সভ্যতার যত নগর পাওয়া গেছে সবখানেই প্রায় একই ধরনের উন্নত নগর পরিকল্পনা এবং নাগরিক স্বাস্থ্য ও সুবিধার উপর সর্বোচ্চ গুরুত্বপ্রদান খুবই লক্ষণীয়। সর্বত্র একই রকম সোজা রাস্তা, আন্ডার-গ্রাউন্ড ড্রেন, কূপ, স্লানাগার। এমন কি বাটখারার ওজনও সর্বত্র এক রকম।

এখন আমরা যে প্রশ্নের সম্মুখীন হই তাহল সিন্ধু উপত্যকার হরপ্পা ও মহেঞ্জোদাড়ো নগর দুটিকে কেন্দ্র করে যারা এমন একটি নগর সভ্যতা গড়ে তুলেছিল তাদের সমাজ কেমন ছিল? কারা এই সভ্যতার শাসক বা পরিচালক শ্রেণী ছিল? এই সভ্যতার অর্থনীতি এবং ধর্ম বিশ্বাসই বা কেমন ছিল?

সিন্ধু সভ্যতার লিপির পাঠোদ্ধার না হলেও খুব ক্ষতি নেই। সিন্ধু সভ্যতার ধ্বংসাবশেষের যেসব প্রত্নতাত্ত্বিক তথ্য আমাদের সম্মুখে আছে সেগুলি থেকেই আমরা এইসব প্রশ্নের উত্তর পেতে চেষ্টা করতে পারি।

আমরা সিন্ধু সভ্যতার সর্বত্র কেন্দ্রীয় পরিকল্পনা, নিয়ন্ত্রণ এবং শৃঙ্খলার অস্তিত্ব যেমন দেখতে পাই তেমন তার পাশে লক্ষ্য করি এই সভ্যতার সমর যন্ত্রের অপেক্ষাকৃত বা তুলনামূলক দুর্বলতা। সমকালীন সুমের বা মিসরের তুলনায় অস্ত্রশস্ত্রের নিম্নমান এবং সংখ্যাল্পতা খুবই লক্ষণীয়। অথচ এই সভ্যতা মিসর বা সুমেরের তুলনায় বহুবেশী বিস্তৃত ও সুশৃঙ্খল।

এটা স্পষ্ট যে, শাসক শ্রেণী প্রধানত বলপ্রয়োগ ও যুদ্ধের উপর নির্ভরশীল ছিল না। অস্ত্র ছিল, যুদ্ধেও ছিল। নিশ্চয় একটা সভ্যতা অস্ত্র এবং যুদ্ধ ছাড়া এত বিশাল এলাকায় বিস্তার লাভ করে নি এবং টিকে থাকতেও পারে নি। আর সর্বত্র নগর প্রাচীন ও নগর-দুর্গের অস্তিত্ব প্রমাণ করে প্রতিরক্ষার গুরুত্ব। কিন্তু এ ব্যাপারে সন্দেহ নেই যে, সমাজ ও রাষ্ট্রের উপর অস্ত্র ও যুদ্ধ তথা সামরিক শক্তির মূল নিয়ন্ত্রণ ছিল না। তা থাকলে এই উন্নত নগর পরিকল্পনা ও প্রযুক্তিবিদ্যার সঙ্গে তাল মিলিয়ে অস্ত্রশক্তিরও বিকাশ ঘটত।

স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন দেখা দেয় এত কেন্দ্রীভূত ও শক্তিশালী এবং বৃহৎ রাষ্ট্র তাহলে কিভাবে এত শতাব্দীকাল টিকে ছিল? একটা শাসন কেন্দ্র ছাড়া তো এটা দাঁড়িয়ে থাকতে পারে না। সেটা কাদের হাতে ছিল?

সাধারণত এই প্রশ্নের উত্তর খোঁজা হয় ধর্মে। মিসর ও সুমেরেও মূলত ধর্মীয় শক্তিই ছিল রাষ্ট্রের মূল শাসক বা নিয়ন্ত্রণকারী শক্তি। মিসরে সর্বোচ্চ ক্ষমতার অধিকারী ফারাওকে বিবেচনা করা হত দেবতা হিসাবে। তার সঙ্গে ছিল অত্যন্ত শক্তিশালী পুরোহিত শ্রেণী। শক্তিশালী সেনাবাহিনী ও প্রশাসনিক আমলাতন্ত্র ছিল ফারাও এবং পুরোহিত শ্রেণীর নিয়ন্ত্রণাধীন।

সুমেরে নগরগুলির শাসক ছিল একজন করে দেবতা যার অছি বা প্রতিনিধি হিসাবে পুরোহিত রাজা শাসনকার্য পরিচালনা করত। অর্থাৎ রাষ্ট্রক্ষমতা ছিল পুরোহিত শ্রেণীর নিয়ন্ত্রণাধীন।

সিন্ধুতেও যদি আমরা তেমন পুরোহিত শাসক বা ধর্মীয় শাসক কল্পনা করি তবে আমাদেরকে নগর বিন্যাস বা সভ্যতায়ও তার প্রতিফলন খুঁজতে হবে। কারণ ধর্ম কোনও বির্মূত বস্তু নয়। ধর্ম তথা ধর্মীয় শক্তির নিয়ন্ত্রণের কিছু বাস্তব দিক থাকে। যেমন মন্দির, প্রতিমা ইত্যাদি। আমরা সুমের ও মিসরে তা পাই।

কিন্তু আমরা হরপ্পা বা মহেঞ্জোদাড়ো কিংবা সিন্ধু সভ্যতার আর কোন নগরে এমন কোন গৃহ দেখি না যেটাকে মন্দির হিসাবে নিশ্চিতভাবে চিহ্নিত করা যায়। কারণ প্রতিমা সংযুক্ত কোন গৃহ পাওয়া যায় নি।

এই সভ্যতায় মূর্তির অভাবও লক্ষণীয়। প্রচুর সংখ্যায় পোড়া মাটির ক্ষুদ্র পুতুল পাওয়া গেছে যেগুলি খেলনা বা পূজার মূর্তি কিংবা এক সঙ্গে দুই-ই হতে পারে। তবে অদক্ষ হাতে কিংবা অযত্নে তৈরী এগুলির মান এত অনুন্নত এবং এগুলি এত ছোট যে, এগুলিকে মন্দিরের প্রতিমা মনে করা যায় না। বিশেষত সিন্ধু সভ্যতার উন্নত কারিগরি দক্ষতা এবং অত্যুন্নত নগর নির্মাণের ক্ষমতাকে যদি বিবেচনায় নেওয়া যায় তবে এই বিষয়ে আমরা অন্তত এই সিদ্ধান্তে পৌঁছতে পারি যে, এই পুতুলগুলি যদি পূজার সামগ্রী হয়েও থাকে তবে তার সঙ্গে রাষ্ট্র শাসক ও সভ্যতার নায়কদের কোন সম্পর্ক ছিল না।

এমন কি সিন্ধু উপত্যকায় প্রস্তর মূর্তিও সামান্য কয়টি পাওয়া গেছে। প্রত্নতাত্ত্বিক মর্টিমার হুইলার সব মিলিয়ে ১১টি মূর্তির বিবরণ দিয়েছেন যেগুলির মধ্যে সবচেয়ে বড়টির উচ্চতা মাত্র  ১৬/ ইঞ্চি। মূর্তিগুলির মধ্যে সবচেয়ে সুন্দর বা আকর্ষণীয় হল এক শ্মশ্রুমণ্ডিত আবক্ষ পুরুষ মূর্তি। চমৎকার এই মূর্তির উচ্চতা মাত্র ৭ ইঞ্চি। মধ্যবয়স্ক, বলিষ্ঠস্কন্ধ, সম্ভ্রান্ত চেহারার এই মূর্তিকে দেবমূর্তি মনে করার কারণ নেই।

ব্রোঞ্জের আরও কমসংখ্যক কয়টি ক্ষুদ্র মূর্তির মধ্যে উল্লেখ করার মত হল একটি নৃত্যভঙ্গিমায় নারী মূর্তি যার উচ্চতা মাত্র ৪/ ইঞ্চি।

সিন্ধু সভ্যতার অসাধারণ স্থাপত্য ও নির্মাণ ক্ষমতার সঙ্গে ভাস্কর্যের সীমাবদ্ধতা বিশেষত মূর্তির এই অভাবকে মেলানো কঠিন। অথচ অনেক পরবর্তীকালে ভারতবর্ষে প্রতিমা ও দেবমন্দিরের ছড়াছড়ি।

ধর্ম শক্তিশালী হলে মন্দির এবং প্রতিমা থাকাই স্বাভাবিক। বিশেষত পুরোহিত শ্রেণী বা ধর্মভিত্তিক শক্তি যদি শাসকগোষ্ঠী হয় তবে জনগণকে নিয়ন্ত্রণের প্রয়োজনে স্বভাবতই সর্বোচ্চ জোর দিবে ধর্মচর্চার উপর এবং ধর্মের কেন্দ্রীয় প্রতিষ্ঠান হিসাবে গড়ে তুলবে বিরাট বিরাট মন্দির এবং সেই সঙ্গে দেব-দেবী মূর্তি যা আমরা সুমের এবং মিসরে দেখতে পাই। কাজেই ধর্মীয় শক্তি তথা পুরোহিত শ্রেণী যে সিন্ধু সভ্যতার মূল নায়ক বা নেতৃত্বকারী শক্তি নয় এমন একটা সিদ্ধান্তের দিকে আমরা এগিয়ে যেতে বাধ্য হচ্ছি।

তবে কি আমরা ধরে নিব যে, সিন্ধু সভ্যতায় ধর্ম ছিল না কিংবা সমাজ ও রাষ্ট্র ছিল সম্পূর্ণরূপে ইহবাদী? সেই প্রাচীন কালে সম্পূর্ণরূপে ইহবাদী বা বস্তুবাদী একটা সমাজ বা রাষ্ট্র এভাবে এতকাল দাঁড়িয়ে ছিল এটা কল্পনা করা অবাস্তব হবে। সুতরাং আমাদেরকে সিন্ধু সভ্যতার ধর্মের ধরনটা খুঁজে বের করতে হবে।

ধর্ম ছিল অর্থাৎ ধর্ম মন্দির বা উপাসনালয় ছিল কিন্তু প্রতিমা অর্থাৎ মূর্তি পূজা ছিল না এমন কি হতে পারে না? হাঁ, এটাই সম্ভব। আর এর একটাই অর্থ, সেটা হল সিন্ধু সভ্যতা ও সমাজের আধিপত্যকারী ধর্ম ছিল নিরাকার একেশ্বরবাদী, পরবর্তী ভারতীয় ধর্মের সঙ্গে যার কোনই মিল নেই।

মূর্তি পূজা একেশ্বরবাদের জন্য বিপদজনক। কারণ এতে প্রধান দেবতা বা ঈশ্বরের সীমাবদ্ধ রূপ ধরা পড়ে। এর ফলে সহজেই তার ক্ষমতার অংশীদার বা প্রতিদ্বন্দ্বী হিসাবে অন্যান্য দেবতার আবির্ভাব ও পূজাও দেখা দেয়।

এখন প্রশ্ন সিন্ধু সভ্যতার প্রধান শক্তি বা নেতৃত্বকারী শক্তি কি একেশ্বরবাদী ও অপৌত্তলিক ধর্মীয় শক্তি বা পুরোহিত শ্রেণী ছিল? এর অর্থ হচ্ছে ইসলামের মত কোনও একেশ্বরবাদী শক্তি একই সঙ্গে সমাজ, ধর্ম ও রাষ্ট্রকে নিয়ন্ত্রণ করেছে কিনা। সেটা হলে আমরা সেখানেও ক্ষমতার অতি কেন্দ্রীভবনের প্রকাশ দেখতে পেতাম। শাসকদের বিরাট প্রাসাদ, মৃত্যুর পর কবর বা স্মৃতিরক্ষার জন্য বিরাট সৌধ এবং স্বৈরতন্ত্রের বিকালের অনিবার্য ফলস্বরূপ যুদ্ধ ও অস্ত্রশক্তির বিরাট বিস্তার। যেহেতু সামাজিক নেতৃত্ব বা শাসক শ্রেণীর ধরন ও চরিত্র অনুযায়ী সভ্যতার নির্মাণ বা বিন্যাস গড়ে ওঠে সেহেতু আমাদেরকে এই সিদ্ধান্তে পৌঁছতে হয় যে, সিন্ধু সভ্যতায় ধর্ম ও রাষ্ট্র এক হাতে কেন্দ্রীভূত ছিল না অথচ যেখানে ধর্ম ছিল একেশ্বরবাদী। অর্থাৎ এটা এমন এক একেশ্বরবাদ যা তুলনামূলকভাবে অনেক উদার ও সহিষ্ণু এবং যা ঠিক নিরঙ্কুশভাবে একেশ্বরবাদীও নয়। অর্থাৎ একজন দেবতা সর্বপ্রধান ছিল, এবং তার অধীনস্থ ছিল অন্যান্য দেবতা তার অধীনস্থ শক্তি হিসাবে কিংবা তার শক্তির বিভিন্ন প্রকাশ হিসাবে। পৌত্তলিকতা বা মূর্তি পূজা না থাকায় এইসব বিভিন্ন দেবতার অস্তিত্ব স্বতন্ত্র রূপ নিয়ে দাঁড়াতে পারে নি। অর্থাৎ বিভিন্ন দেবতার নাম থাকলেও সেগুলিকে সহজেই একেশ্বরের অঙ্গীভূত করে রাখা গেছে।

এখন আমরা বুঝছি ঋগ্বেদে মূর্তিপূজাহীনতার উৎস কোথায় এবং তার ভিতরের একেশ্বরবাদী প্রবণতার উৎসই বা কোথায়। সিন্ধু সভ্যতার ভিতর থেকে একেশ্বরবাদের কাঠামো ভেঙ্গে বহু ঈশ্বরবাদের প্রেরণা নিয়ে তা যাত্রা শুরু করলেও বহু প্রাচীন ধর্মীয় ঐতিহ্যের প্রভাবে প্রথমে তার মধ্যে পৌত্তলিকতা প্রবেশ করতে পারে নি। কিন্তু এই নূতন ধারার অনিবার্য পরিণতি হল পৌত্তলিকতা যা পরবর্তীতে বৈদিক ধর্মে প্রবেশ করেছিল।

এখন আমরা সিন্ধু সভ্যতার প্রধান শাসক শ্রেণীকে অনেকটা চিনতে বা ধরতে পারছি। এটা সেনাবাহিনী কিংবা পুরোহিত শ্রেণী নয়। অর্থাৎ সিন্ধুর প্রধান শাসক শক্তি সেনাবাহিনী বা পুরোহিত শ্রেণী কিংবা সামরিক-পুরোহিত শ্রেণী থেকে না এসে ভিন্ন কোনও শ্রেণী থেকে এসেছে। এর অনুরূপ আমরা আধুনিক গণতন্ত্রে দেখতে পাই। এবং সাথে সাথে আমাদের চোখের সামনে থেকে এক বিরাট রহস্যের পর্দা সরে যায়। আর তখন আমরা বুঝি সিন্ধু সভ্যতার নগরগুলির গণতান্ত্রিক রূপের তাৎপর্য এবং নাগরিক স্বাস্থ্য ও সুযোগ-সুবিধার উপর এত গুরুত্বদানের কারণ। হস্তচালিত শিল্পকে মূল কেন্দ্র এবং কৃষিকে ভিত্তি হিসাবে অবলম্বন করে যে শক্তিশালী কারখানা মালিক, বণিক এবং বিভিন্ন ধরনের বুদ্ধিজীবী ও মধ্যবিত্ত পেশাজীবী সম্প্রদায় গড়ে উঠেছিল তারাই ছিল এই সমাজ ও সভ্যতা তথা রাষ্ট্রের মূল নিয়ন্তা। এই মধ্যবিত্ত শ্রেণীর প্রাধান্যের ফল স্বরূপ নগর বিন্যাসে এতটা ভারসাম্য। আধুনিক পরিভাষা ব্যবহার করলে এই সমাজকে গণতান্ত্রিক পুঁজিবাদী বা গণতান্ত্রিক বুর্জোয়া সমাজ বলা যায় যদিও এই পুঁজি আধুনিক যন্ত্রশিল্প ভিত্তিক নয় বরং অতীতকালের হস্ত্রশিল্প ভিত্তিক।

বস্তুত পরবর্তী কালের ভারতীয় সমাজ ও সভ্যতার অনেক গৌরবময় ঐতিহ্যের মত গণতন্ত্রের ঐতিহ্যও সিন্ধু সভ্যতা থেকে আসা সম্ভব। খ্রীস্টপূর্ব পঞ্চম বা ষষ্ঠ শতাব্দীতে বুদ্ধের জীবনকালে লিচ্ছবি, মল্ল, শাক্য ইত্যাদি যেসব গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্রের অস্তিত্ব দেখা যায় সেগুলি সিন্ধু বা হরপ্পা ঐতিহ্যের ধারাবাহিকতাও হওয়া সম্ভব যা হাজার সোয়া হাজার বৎসরের বৈরী সময় ও পরিবেশের মধ্য দিয়ে আসতে গিয়ে ক্ষয়প্রাপ্ত হয়ে শেষ পর্যন্ত বিলীন হয়েছে।

সিন্ধু সভ্যতার রাষ্ট্রব্যবস্থার রূপ সম্পর্কে বলা কঠিন হলেও আমরা কিছু অনুমান করতে পারি। হতে পারে যে, সিন্ধু সভ্যতার রাষ্ট্রে একটা নিয়মতান্ত্রিক রাজতন্ত্র ছিল যার অধীনে পঞ্চায়েত ধরনের কোনও সংসদ বা প্রতিষ্ঠান ছিল। হয়ত এই সংসদে সমাজের বিভিন্ন স্তরের প্রতিনিধিত্বকারী ব্যক্তিবর্গ সামাজিক ঐক্যমত কিংবা ঐতিহ্যের ভিত্তিতে নির্বাচিত হত। কিংবা এমনও হতে পারে যে, যে নামেই হোক শাসকরা কোনও এক পদ্ধতিতে নির্বাচিত হত এবং তাদের শাসনকাল ছিল মেয়াদী বা সীমিত। বিশেষত এই রকম গণতান্ত্রিক বৈশিষ্ট্য ও প্রবণতাসম্পন্ন সভ্যতার গোড়ার এবং বিকাশের সময়টা সম্পূর্ণরূপে প্রজাতান্ত্রিক এবং গণতান্ত্রিক হবার সম্ভাবনা খুব বেশী। তবে সিন্ধু সভ্যতায় রাষ্ট্রশাসনের সুনির্দিষ্ট পদ্ধতি যা-ই থাক তা যে মূলত গণতান্ত্রিক ছিল এমন একটা সিদ্ধান্তে পৌঁছনো ছাড়া আমরা আর কোনও উপায় দেখি না।

সিন্ধু সভ্যতার জনগণ, বিশেষত নাগরিক সম্প্রদায় রাষ্ট্রের উপর নিয়ন্ত্রণ রক্ষার জন্য নিজেদেরকে কিভাবে সংগঠিত করত সেটাও একটা প্রশ্ন। সে কালে আজকের মত করে রাজনৈতিক দল গড়ে তোলা সম্ভব না হলেও সেটা সেকালের মত করেই গড়ে তোলা সম্ভব ছিল। বিশেষত অতীতের বিভিন্ন সমাজে জনগণকে সংগঠিত ও রাষ্ট্রকে নিয়ন্ত্রিত বা সংযত রাখবার ক্ষেত্রে ধর্মের গুরুত্ব অনেক সময় সবচেয়ে বেশী দেখা যায়। তবে সিন্ধু সভ্যতার নাগরিকতা, সমাজের সহজ-সরল উপযোগবাদের প্রকাশ থেকে আমরা সমাজে বস্তুবাদ বা ইহবাদের শক্তিশালী অস্তিত্বকে অস্বীকার করতে পারি না। সুতরাং ইহবাদী রাজনৈতিক-সামাজিক প্রতিষ্ঠানসমূহের অস্তিত্ব ছিল আমরা এমন অনুমান করতে পারি। হয়ত বিভিন্ন গিল্ড্ বা পেশাজীবীদের সংগঠনগুলি জনমত সংগঠনে ও রাষ্ট্রশাসনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করত। এবং এগুলির পাশেই ধর্ম এবং ধর্মীয় সংঘের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকাও অনুমানসঙ্গত।

বিশেষত একেশ্বরবাদের প্রতিফলন তার সাংগঠনিক কাঠামোতেও ঘটবার কথা। কারণ একেশ্বরবাদ মূলত সামাজিক এককেন্দ্রবাদের ধর্মীয় বা আদর্শিক প্রতিফলন।

সমাজকে একটি কেন্দ্রের মাধ্যমে সংগঠিত তথা ঐক্যবদ্ধ করার প্রয়োজন থেকে একেশ্বরবাদের উদ্ভব। কাজেই একেশ্বরবাদ বহুকেন্দ্রে নিজেকে বিভক্ত না করে নিজের একটি সাংগঠনিক কেন্দ্র তৈরী করে। পোপকে কেন্দ্র করে খ্রীস্টীয় ক্যাথলিক চার্চ বা গীর্জা সংগঠিত হয়েছিল। কিন্তু খ্রীস্ট ধর্মে সমস্ত ক্ষমতা এক হাতে কেন্দ্রীভূত নয়। কারণ যীশু শুধু ঈশ্বরপুত্রই নন ঈশ্বর বিচার দিবস পর্যন্ত স্বর্গ ও পৃথিবীর কর্তৃত্বও তাঁকে দান করেছেন। এর ফলে খ্রীস্টধর্মে এক ধরনের দ্বৈততা থেকেছে, ক্ষমতার বিভাজন থেকেছে। এই কারণে খ্রীস্টীয় একেশ্বরবাদ ঠিক নিরংকুশ একেশ্বরবাদ নয়। এরই বাস্তব প্রতিফলন হিসাবে রাষ্ট্রের সমান্তরালে চার্চ বা গীর্জা বিকাশ লাভ করে যখন এক সময় ইউরোপে রাষ্ট্রকে নিজ নিয়ন্ত্রণে বা অধীনে নিতে পেরেছে তখনও রাষ্ট্র এবং চার্চ একীভূত হয় নি, বরং চার্চ ও রাষ্ট্রের মধ্যে সর্বদা একটা পার্থক্য কম এবং বেশী থেকে গেছে। অর্থাৎ খ্রীস্টধর্ম সামাজিক ঐক্যের প্রতিফলন হিসাবে একটি প্রধান কেন্দ্র তৈরী করে; কিন্তু পাশাপাশি ভিন্ন ও অপ্রধান কেন্দ্রকে বিনাশ না করে রক্ষা করে।

কিন্তু ইসলামের একেশ্বরবাদে ভিন্নতা বা দ্বৈততার সামান্যতম স্থান নেই। তাই এখানে রাষ্ট্র ও চার্চ এক বিন্দুতে কেন্দ্রীভূত। এটা মূলত রাজনৈতিক ধর্ম হওয়ায় রাষ্ট্রশাসকই ধর্মনেতা হিসাবে আত্মপ্রকাশ ও বিকাশ লাভ করে। এখানে তাই রাষ্ট্রের সমান্তরালে মসজিদ বা মোল্লাতন্ত্রের বিকাশের কোনও সুযোগ ঘটে নি। বস্তুত ইসলামে সেনাবাহিনী এবং সেনাবাহিনীকে অবলম্বন করে গড়ে ওঠা রাষ্ট্রই হচ্ছে কেন্দ্রীয় ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান এবং মসজিদ ও মোল্লারা হচ্ছে তার অংশ মাত্র।

তবে হরপ্পা বা সিন্ধুর ধর্মে যে তেমন নিরঙ্কুশ একত্ববাদ ছিল না তা আমরা আগেই বলেছি। তবু তা মূলত একেশ্বরবাদ হওয়ায় আমরা অনুমান করতে পারি যে, তার সাংগঠনিক ঐক্যের রূপ হিসাবে ক্যাথলিক চার্চ ধরনের একটি কেন্দ্রীভূত ধর্মীয় সংগঠন ছিল যা রাষ্ট্র ও অন্যান্য সামাজিক-রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানের পাশে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল।

এই ধর্মীয় সংগঠন দ্বারা দুটি কাজ সম্ভব। একটি হল রাষ্ট্রকে নিয়ন্ত্রণ অথবা সংযত করা, অন্যটি হল শ্রমজীবী ও পশ্চাদপদ জনগণ বিশেষত কৃষক সম্প্রদায়কে নিয়ন্ত্রণ করা যার গুরুত্ব সমাজের উপর তলার শ্রেণীগুলির কাছে খুব বেশী। সুতরাং নাগরিক সম্প্রদায় রাষ্ট্রের সমান্তরালে একটি কেন্দ্রীভূত একেশ্বরবাদী ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানকে লালন করেছে এমন সিদ্ধান্তে আমরা যেতে পারি।

এখন আমরা এই ধর্মের নির্দিষ্ট রূপ চিহ্নিত করার চেষ্টা করি। আমরা মহেঞ্জোদাড়োর নগর-দুর্গে একটি, চৌবাচ্চা দেখেছি যার বর্ণনা আমরা কিছু পূর্বেই দিয়েছি। অনেকে অনুমান করেন যে, এটা নিছক স্নানের জন্য তৈরী না করে ধর্মীয় উদ্দেশ্যে তৈরী করা হয়েছিল। তাঁদের যুক্তি আছে। কারণ আশ্চর্য নিপুণ হাতে তৈরী এই চৌবাচ্চার নিকটবর্তী প্রাচীরের পরই ছিল নদীখাত যেখানে প্রাচীরের সিড়ি বেয়ে অনায়াসে নামা যেত। তাছাড়া ভিতরেও আছে কূপ। সুতরাং নিছক স্নানের প্রয়োজনে এটা তৈরী করবার কথা নয়। বিশেষ করে সিন্ধু সভ্যতার সর্বত্র এত কূপ, স্নানাগার ও জল ব্যবহারের আয়োজন দেখে জল ব্যবহার এবং বিশেষ করে চৌবাচ্চাটির সঙ্গে ধর্মের সম্পর্ক আছে মনে করাই যুক্তিযুক্ত।

যেহেতু আমাদের কাছে ধরা পড়েছে যে, ঋগ্বেদ আগন্তুক হানাদারদের ধর্মগ্রন্থ নয় বরং সিন্ধু সভ্যতার সঙ্গে কোনও না কোনও ভাবে সম্পর্কিত ধর্মীয় সামাজিক-রাজনৈতিক আন্দোলনের প্রকাশ সেহেতু আমরা এখন সিন্ধু সভ্যতার প্রচলিত ধর্মের সূত্র খোঁজার জন্যও ঋগ্বেদের সাহায্য নিব। এটা নিতে গিয়ে আমাদের সামনে আলীবাবার রত্নগুহার দরজা খুলে যায়।

আমরা দেখতে পাই যে, সিন্ধু সভ্যতার ঈশ্বর হলেন ঋগ্বেদের দেবতা বরুণ।


৫। সিন্ধুর ঈশ্বর এবং ঋগ্বেদের বরুণ

ঋগ্বেদে ইন্দ্রের বিপরীতে বরুণ নম্র, ক্ষমাপরায়ণ এবং ন্যায়-নীতিবান দেবতা। বরুণ সমস্ত বিশ্বের অধিপতি এবং জলের স্রষ্টা। ঋগ্বেদে বরুণ সম্পর্কে বলা হচ্ছে : “জগতের ধারক অদিতির পুত্র বরুণ প্রকৃষ্টরূপে জল সৃষ্টি করেছেন। বরুণের মহিমায় নদীসকল প্রবাহিত হয়, এরা বিশ্রাম করে না, নিবৃত্ত হয় না। এরা পাখীদের ন্যায় বেগে ভূমিতে গমন করে” (২।২৮।৪)। “বৃষ্টি যেরূপে যব, শস্য সিক্ত করে সেরূপ অখিল ভুবনের অধিপতি বরুণ সমগ্র ভূমিকে আর্দ্র করেন”(৫।৮৫।৩)। “উগ্র সহস্রচক্ষু বরুণ এ নদীগণের জল দর্শন করেন (৭।৩৪।১০), বরুণ রাষ্ট্রের রাজা, নদীর রূপ, তার বল অবারিত ও সর্বতোগামী” (৭।৩৪।১১)।” এ বরুণদেব সূর্যের পথ প্রদান করেছেন, নদীসকলকে অন্তরিক্ষভব জল প্রদান করেছেন। অশ্ব যেরূপ বড়বার প্রতি ধাবমান হয়, সেরূপ শীঘ্র যেতে ইচ্ছা করে তিনি মহতী রজনীসমূহকে দিবস হতে পৃথক করেছেন (৭।৮৭।১), বরুণের চরসকলের গতি প্রশস্ত, তারা সুন্দর রূপবিশিষ্ট দ্যাবাপৃথিবী সন্দর্শন করে এবং কর্মবান, যজ্ঞধারী, প্রাজ্ঞ কবিগণ যে স্তোত্র প্রেরণ করেন তাও চারদিকে দর্শন করে (৭।৮৭।৩), এ বরুণ দেবের মধ্যেই তিন প্রকার দ্যুলোক নিহিত আছে, তিন প্রকার ভূমি ছয় অবস্থায় এতে অন্তর্ভূত আছে। স্তুতিযোগ্য রাজা বরুণ অন্তরীক্ষে হিরন্ময় দোলার ন্যায় সূর্যকে দীপ্তির জন্য নির্মাণ করেছেন (৭।৮৭।৫), সূর্যের ন্যায় দীপ্ত বরুণ সমুদ্রকে স্থাপিত করেছেন। তিনি জলবিন্দুর ন্যায় শ্বেতবর্ণ, গৌর মৃগের ন্যায় বলবান, গভীর স্তোত্র-বিশিষ্ট, উদকের (জলের) নির্মাতা, পারক্ষম বলযুক্ত এবং সমস্ত সৎপদার্থের রাজা (৭।৮৭।৬), অপরাধ করলেও যে বরুণ দয়া করেন অদীন বরুণের ব্রত সকল যথাক্রমে সমৃদ্ধ করে আমরা যেন তাঁর নিকটেই অনপরাধী হই” (৭।৮৭।৭। “সর্বজ্ঞানী অসুর বরুণ দ্যুলোককে স্তম্ভিত (স্তম্ভযুক্ত) করেছেন, পৃথিবীর বিস্তারের পরিমাণ করেছেন, সমস্ত ভুবনের সম্রাটরূপে আসীন হয়েছেন” (৮।৪২।১); ইত্যাদি।

আমাদের এটা বোঝা দরকার যে, দেবতা বরুণ সম্পর্কে যাঁরা এইসব মন্ত্র রচনা করেছেন তাঁদের সমগ্র ধর্মীয় আন্দোলনের একটি প্রধান লক্ষ্যই ছিল অসুর বরুণ বা জগত সম্রাট বরুণের ঈশ্বর বা সর্বোচ্চ দেবতা হিসাবে অবস্থান ধ্বংস করা। কিন্তু তার পরেও তাঁরা বরুণকে নাকচ করতে পারেন নি। তাঁরা ঐতিহ্যের শক্তির বিরুদ্ধে পুরোপুরি দাঁড়াতে পারেন নি। সুতরাং বৈদিক সংস্কার দ্বারা বরুণের সর্বোচ্চ ক্ষমতা বা নেতৃত্ব ধ্বংস করে ইন্দ্র এবং সেই সঙ্গে বহু দেবতার প্রাধান্য আনা হয়েছে, কিন্তু বরুণকে নির্মূল করা হয় নি। লড়াইটা একেশ্বরবাদের বিরুদ্ধে বহুঈশ্বরবাদের। তাই প্রয়োজনটা তাকে নির্মূল করারও নয় বরং অন্যান্য দেবতার সমান করার। আন্দোলনটা বাইরের সমাজ থেকে হয় নি। যারা এটা করেছে তারাও একই ধর্মীয় ঐতিহ্যের মানুষ। সুতরাং বরুণকে ঈশ্বরের আসন থেকে নামিয়ে দিলেও তার প্রতিও সম্মান জানাতে ভোলে নি।

সমাজ চেতনায় বরুণের প্রভাব সুগভীর থাকায় এবং তা একবারে নষ্ট করা সম্ভব ছিল না বলে ইন্দ্রের সঙ্গে বরুণের সমন্বয়ের অনেক চেষ্টাও হয়েছে। যেমন বলা হচ্ছে, “হে ইন্দ্র ও বরুণ! তোমরা মহান ও মহাধনবিশিষ্ট! তোমাদের একজন সম্রাট আর একজন স্বরাট” (৭।৮২।২); ইত্যাদি।

বরুণ যে এক সময় প্রবল ঈশ্বর ছিলেন তা ঋগ্বেদ থেকে বোঝা যায়। বৈদিক যুদ্ধের এক খ্যাতিমান যোদ্ধা পুরুকুৎসের পুত্র রাজর্ষি ত্রসদস্যুর (তিনি নিজেও বড় যোদ্ধা) রচিত একটি সূক্ত পড়লেও বোঝা যায় যে, এই প্রাচীন দেবতার প্রভাব তখন পর্যন্ত ঋগ্বেদ রচয়িতাদের মনে কত গভীর হয়ে রয়েছে। ৪ মণ্ডলে রাজর্ষি (রাজ+ঋষি) ত্রসদস্যু রচিত ৪২ সূক্তের কয়েকটি ঋক থেকে ঋগ্বেদের ধর্মীয় সংস্কার দ্বারা সঙ্কুচিতক্ষমতা এই প্রাচীন ঈশ্বরের গর্বিত কণ্ঠ শুনতে পাই : “আমি বলবান ও সমস্ত বিশ্বের অধিপতি। আমার রাজ্য দ্বিবিধ। সমস্ত অমরগণ আমার। আমি রূপবান ও অন্তিকস্থ বরুণ। দেবগণ আমার যজ্ঞসেবা করেন। আমি মনুষ্যেরও রাজা (৪।৪২।১), আমি রাজা বরুণ! দেবগণ আমার জন্যই অসূর্য শ্রেষ্ঠ বল ধারণ করেছেন আমি রূপবান ও অন্তিকস্থ বরুণ। দেবগণ আমার যজ্ঞ সেবা করেন। আমি মনুষ্যেরও রাজা” (৪।৪২।২)।

কিন্তু বরুণের এই দম্ভোক্তি ক্ষমতা হারানো একজন নায়কের অসার উক্তি মাত্র। তাই ৩য় ঋকেই তাঁকে বলতে হচ্ছে “আমি ইন্দ্র ও বরুণ…” (৪।৪২।৩)। এবং ঋষি যখন ৭ম ঋকে বলছেন, “হে বরুণ! সমস্ত ভূতজাত তোমাকে জানে। হে স্তোতা বরুণকে স্তব কর। হে ইন্দ্র! তুমি শত্রুগণকে বধ করেছ বলে বিখ্যাত আছ। তুমি বদ্ধ সিন্ধুগণকে উন্মুক্ত করেছ” (৪।৪২।৭) তখন বোঝা যায় যে মুখে বরুণকে যেটুকু স্তুতিই করা যাক আসলে তাঁর সময় ফুরিয়েছে এবং শত্রুবধ এবং বদ্ধ সিন্ধুগণকে মুক্ত করেছেন যিনি এখন সেই ইন্দ্রের সময় এসেছে।

পুরাতন ঐতিহ্যের নাড়ী ছেঁড়া খুব কঠিন। বিশেষত যদি সেই ঐতিহ্য হয় শত শত কিংবা সহস্র বৎসরের কিংবা তারও বেশী সময়ের। সম্ভবত ঋগ্বেদের অন্যতম বিখ্যাত ঋষি বসিষ্ঠের গোত্র খুবই প্রাচীন কাল থেকে সিন্ধুর ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে জড়িত ছিল। কারণ ৭।৩৩।১১ ঋকে ঋষি বসিষ্ঠ অথবা বসিষ্ঠপুত্রগণ ঋষি বলছেন, “আরও হে বসিষ্ঠ! তুমি মিত্র ও বরুণের পুত্র। হে ব্রহ্মণ! উর্বশীর মন হতে তুমি জাত। তখন মিত্র ও বরুণের তেজ নির্গত হয়েছিল, বিশ্বদেবগণ দৈব স্তোত্র দ্বারা পুষ্কর মধ্যে তোমায় ধারণ করেছিলেন।” বোঝা যায় যে, এটা আদি বসিষ্ঠ ঋষি সম্পর্কে বলা হচ্ছে। এখানে প্রসঙ্গক্রমে বলা দরকার যে, ঋগ্বেদে মিত্রকে বরুণের সঙ্গে সংযুক্ত করে বহুবার উল্লেখ করা হয়েছে। এর দ্বারা এটা স্পষ্ট হয় যে, মিত্র বরুণের অধীনস্থ হলেও অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ ছিলেন। যাইহোক বসিষ্ঠের উর্বশীর মানস পুত্র এবং মিত্র ও বরুণের পুত্র হবার যে ব্যাখ্যাই থাক এই বিষয়ে সন্দেহ নেই যে, বরুণ উপাসনার সঙ্গে বসিষ্ঠ গোত্রের সম্পর্ক খুবই গভীর এবং প্রাচীন। আর পুষ্করের ব্যাপারটাও ভাববার মত।

বসিষ্ঠ ঋষির রচিত কয়েকটি মন্ত্র দ্বারা আমরা সেই সময়কার ধর্মীয় আন্দোলনের অন্তর্গত জটিল টানাপোড়েন এবং সময়ের সবকিছু ভাসিয়ে নেওয়া প্রবল স্রোতের কাছে অসহায় আত্মসমর্পণের মর্মবেদনা ইত্যাদি অনেককিছুই অনুভব করতে পারি। ৭।৮৬ সূক্তের কয়েকটি ঋক উদ্ধৃত করা যায়:

১। এ বরুণের জন্ম মহিমাপ্রযুক্ত হয়েছে। ইনি বিস্তীর্ণ দ্যাবা পৃথিবীকে স্তম্ভিত (স্তম্ভযুক্ত) করেছেন, ইনি বৃহৎ আকাশ ও দর্শনীয় নক্ষত্রকে দ্বিধা প্রেরণ করেন। ইনি ভূমিকেও বিস্তীর্ণ করেছেন। ২। আমি কি স্বীয় শরীরের সঙ্গে বরুণের স্তুতি করব? কখন বরুণদেবের সন্নিকট থাকব? বরুণ কি ক্রোধরহিত হয়ে আমার হব্য সেবা সেবন করবেন? আমি সুমনা হয়ে কখন সুখপ্রদ বরুণকে দেখতে পাব? ৩। হে বরুণ! আমি দিদৃক্ষু হয়ে সে পাপের কথা তোমায় জিজ্ঞাসা করছি। আমি বিবিধ প্রশ্নের জন্য বিদ্বান জনের নিকট গিয়েছি। কবিরা (ঋষিরা?) সকলেই আমাকে একরূপ বলেছেন যে, ‘এ বরুণ তোমার প্রতি ক্রদ্ধ হয়েছেন।’ ৪। হে বরুণ! আমি এমন কি করেছি যে তুমি মিত্রভূত স্তোতাকে হনন করতে ইচ্ছা কর! হে দুর্ধর্ষ তেজস্বিন! আমাকে তা বল যাতে আমি ত্বরমান হয়ে নমস্কারের সাথে তোমার নিকট গমন করি। ৫। হে বরুণ! আমাদের পিতৃক্রমাগত দ্রোহ-বিশ্লিষ্ট কর। আমরা নিজ শরীর দ্বারা যা করেছি, তাও বিশ্লিষ্ট কর। হে রাজা! পশুখাদক চৌরের ন্যায়, রজ্জুবদ্ধ গোবৎসের ন্যায়, আমাকে পাপ হতে বিশ্লিষ্ট কর। ৬। হে বরুণ। সে পাপ নিজের দোষে নয়। এ ভ্রম বা সুরা বা মন্যু বা দ্যূতক্রীড়া বা অবিবেকবশত ঘটেছে। কনিষ্ঠকে জ্যেষ্ঠও বিপথে নিয়ে যায়, স্বপ্নেও পাপ উৎপন্ন হয়।”

ঋষি কোন পাপের কথা বলছেন? এ কি দ্রোহের পাপ? পুরাতন পথ থেকে বিচ্যুত হবার কিংবা সনাতন ঈশ্বরের প্রতি বিশ্বাস ও আনুগত্য হারাবার আত্মগ্লানি থেকে কি ঋষির এই আত্মক্রন্দন? এই একই ঋষি ৭।৮৮ সূক্তে বলছেন, “হে বরুণ! আমাদের সে সখ্য কোথায় হয়েছিল? পূর্বকালে যে হিংসারহিত সখ্য ছিল তাই সেবা করছি। হে অন্নবান বরুণ! তোমার মহান ভূতগণের বিচ্ছেদকারী সহস্রদ্বারবিশিষ্ট গৃহে যাব (৭।৮৮।৫), হে বরুণ! যে বসিষ্ঠ নিত্যবন্ধু, যে পূর্বে প্রিয় হয়ে তোমার প্রতি অপরাধ করেছিল, সে তোমার সখা হোক। হে যজনীয় বরুণ! আমরা তোমার আত্মীয়, আমরা পাপযুক্ত হয়ে যেন ভোগ না করি” (৭।৮৮।৬)।

৭।৮৮।৫ ঋকে সহস্রদ্বারবিশিষ্ট গৃহ বলতে ঋষি কি বোঝাচ্ছেন? এটা কি মহেঞ্জোদাড়োর সেই চৌবাচ্চাবিশিষ্ট বিশাল ভবনের কিংবা সেই ধরনের আর কোন ভবনের কথা? ২।৪১।৫ ঋকে আমরা সহস্রস্তম্ভবিশিষ্ট স্থান (গৃহ?)-এর উল্লেখ পাচ্ছি। মিত্র ও বরুণকে একত্রে আহ্বান জানাতে গিয়ে ঋষি গৃৎসমদ বলছেন, “শত্রুতাশূন্য রাজা মিত্রাবরুণ স্থির, উৎকৃষ্ট, সহস্রস্তম্ভবিশিষ্ট এ স্থানে উপবেশন করুণ” (২।৪১।৫)। অবশ্যই এটা দেবমূর্তিহীন বিরাট ও পাকা মন্দির গৃহের বর্ণনা ছাড়া আর কিছু নয়। এই সহস্রস্তম্ভবিশিষ্ট ভবন মহেঞ্জোদাড়ো বা হরপ্পার মত কোন বিরাট নগরের সুবৃহৎ মন্দির ভবন ছাড়া কি হতে পারে?

অর্থাৎ ঋগ্বেদের ঋষিরা সহস্রস্তম্ভ ও সহস্রদ্বার বিশিষ্ট যে পূজা গৃহের উল্লেখ করছেন তা সিন্ধু সভ্যতার গৃহ ছাড়া আর কিছু নয় এবং এটা মূলত বরুণের পূজাগৃহ। আমরা মহেঞ্জোদাড়োতে চৌবাচ্চা সংযুক্ত যে বিশাল ভবন পেয়েছি সেটি এই ধরনের একটি গৃহ। এটা অনুমেয় যে, সিন্ধু সভ্যতার ঈশ্বর বরুণের সঙ্গে ছিল, চৌবাচ্চা বা “গ্রেট বাথ” এবং জলাচারের সম্পর্ক। আমরা বহু পরবর্তী কালেও ভারতবর্ষে পবিত্র পুষ্করিণী দেখতে পাই। এই ধরনের স্থানে পবিত্র জল দ্বারা রাজাদের অভিষেক করা হত। বহু পরবর্তীকালে বরুণ দেবতার আর সব পরিচয় মুছে গেলেও তাঁকে পুরাণ কাহিনীগুলিতে আমরা জলের দেবতা হিসাবে স্বীকৃতি দিতে দেখি। আসলে বরুণের সঙ্গে সিন্ধু সভ্যতার একটি অত্যাবশ্যক ও প্রধান উৎস জলনিয়ন্ত্রণ ও জলসেচের সম্পর্ক অবিচ্ছেদ্য ছিল বলে বরুণ শেষ পর্যন্ত সব হারিয়েও জলের দেবতা হিসাবে বেঁচে থেকেছেন।

বরুণ সিন্ধুর মূলত শান্তিপূর্ণ শিল্প, বাণিজ্য ও কৃষি ভিত্তিক নগর সভ্যতার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ দেবতা বা ঈশ্বর। আমরা ইতিপূর্বে বলেছি যে, সিন্ধু সভ্যতার ধর্ম নিরঙ্কুশভাবে একেশ্বরবাদী তথা নিরঙ্কুশ এককেন্দ্রিক ছিল না। তাই অন্যান্য দেবতার অস্তিত্ব মুছে ফেলা হয় নি। তাহলে সিন্ধুর উন্নত সভ্যতাও গড়ে তোলা সম্ভব হত না। কারণ সে যুগে বিভিন্ন উপজাতির বিভিন্ন দেবতা থাকত। কাজেই এইসব উপজাতিকে এক বৃহত্তর সমাজের অন্তর্ভুক্ত করতে হলে হয় বলপূর্বক বিজয়ীর দেবতা বা ধর্মকে তাদের উপর চাপাতে হত নতুবা তাদের দেবতাকে অধীনতা মূলক স্থান দিয়ে হলেও বৃহত্তর ধর্মীয় কাঠামোর অন্তর্ভুক্ত করে নিতে হত। পরবর্তী পদ্ধতি হল মূলত শান্তিপূর্ণ। এতে ধীর প্রক্রিয়ায় এইসব দেবতা এবং সেই সঙ্গে উপজাতিগুলি স্বাতন্ত্র্য হারিয়ে বৃহত্তর ধর্ম বা সমাজের মধ্যে বিলীন হত। সিন্ধু সভ্যতা সেই অর্থে সমরবাদী ছিল না। কাজেই প্রয়োজনে বিভিন্ন উপজাতি বা সমাজকে বলপূর্বক অধীনস্ত করলেও তাদের দেবতাকে বরুণকেন্দ্রিক ধর্মের বৃহত্তর কাঠামোতে অন্তর্ভুক্ত করেছে এমন সিদ্ধান্তে পৌঁছনোই যুক্তিসঙ্গত। কিন্তু যখন সভ্যতায় সঙ্কট দেখা দিয়েছে, সভ্যতার ধারণ ক্ষমতা ফুরিয়েছে তখন সমাজের বিভক্তি ও ধ্বংসের শক্তিগুলি যেমন প্রবল হয়েছে তেমন সমাজে বেড়েছে ধর্মীয় অন্ধত্ব ও উগ্রতা এবং বিভিন্ন দেবতাকে অবলম্বন করে সামাজিক বিভক্তি ও বিচ্ছেদের প্রবণতা। কাজেই সভ্যতার দেবতা, নগরকেন্দ্রিক সভ্য সমাজের ঐক্যরক্ষাকারী দেবতা হিসাবে বরুণের ভূমিকাও ফুরিয়েছে।

সিন্ধু সভ্যতার মত উন্নত নাগরিক সভ্যতা প্রাচীন পৃথিবীতে আর দেখা যায় নি সেটা যেমন সত্য তেমন এটা আর এক সত্য যে, ভারতবর্ষ আধুনিক যুগে এসে ইউরোপীয় রাষ্ট্র ও সভ্যতার অধীনস্থ হবার পূর্ব পর্যন্ত প্রকৃত অর্থে আর কখন উন্নত কোন নাগরিক সভ্যতা গড়ে তুলতে পারে নি। পরবর্তী কালের নগরগুলি অধিকাংশ ক্ষেত্রে দেখা দিয়েছে গ্রামের সম্প্রসারিতরূপ হিসাবে।

একটি বিষয় আমাদের কাছে নিশ্চিত যে, সিন্ধু সভ্যতার এমন উত্থান ও বিস্তারের পিছনে যে প্রযুক্তিগত মান ও মেধাই কাজ করুক যদি নিশ্চিত ও বিপুল খাদ্যোৎপাদন ব্যবস্থা না থাকত তবে সিন্ধু সভ্যতার এই বিকাশ বা বিস্তার সম্ভব হত না। সুতরাং প্রশ্ন দেখা দেয় সিন্ধুর বিরাট নাগরিক সমাজ ও সভ্যতা লালনের জন্য যে খাদ্যোৎপাদনের প্রয়োজন ছিল তা পূরণ হত কিভাবে? এই প্রশ্নের উত্তর পেতে গিয়ে আমাদেরকে পুনরায় যে প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হচ্ছে তাহল সিন্ধুর কৃষির সঙ্গে জলসেচ এবং নদীরোধক বা বৃত্র, মেঘ ইত্যাদির সম্পর্ক কি ধরনের ছিল?

 

৬। সিন্ধুর জলসেচব্যবস্থা এবং ঋগ্বেদের বৃত্র

সিন্ধু সভ্যতার একটা বৈশিষ্ট্য আমাদের কাছে স্পষ্ট হয়েছে তা হল নিয়মিত বন্যা এবং পলির প্রাদুর্ভাব। আমরা জেনেছি যে, প্রতিষ্ঠার পর হতে ধ্বংস পর্যন্ত মহেঞ্জোদাড়ো নগর অন্তত তিনবার প্রলয়ঙ্করী বন্যা দ্বারা বিধ্বস্ত হয়েছিল যার ফলে প্রতিবার নগরকে পুনর্নির্মাণ করতে হয়। উপযুপরি বন্যা ও জলাবদ্ধতার কারণে শেষ পর্যায়ে মহেঞ্জোদাড়োর চতুষ্পার্শ্বস্থ এলাকা বসবাসের অযোগ্য হয়ে পড়ায় নগরে জনসংখ্যার চাপ বাড়ে। ফলে নগরের পরিচ্ছন্নতা ও বিন্যাস ক্ষতিগ্রস্ত হয়।

হুইলার এমন একটি সম্ভাবনার কথা বলছেন যে, প্রথমত মহেঞ্জোদাড়ো সিন্ধু সভ্যতার প্রধান নগর বা রাজধানী হলেও এই রকম পরিস্থিতিতে তা গুরুত্ব হারায় ফলে চারশত মাইল উত্তর-পূর্বে যেখানে বন্যার প্রকোপ ছিল না সেই হরপ্পায় সভ্যতার কেন্দ্র সরে যেতে পারে

অর্থাৎ এক রাষ্ট্রে এক সঙ্গে দুই রাজধানী হিসাবে হরপ্পা ও মহেঞ্জোদাড়ো ছিল এমন যে ধারণা ব্যাপকভাবে প্রচলিত রয়েছে হুইলার সেটার পুনর্বিবেচনার প্রয়োজন তুলে ধরেছেন। হুইলার যে সম্ভাবনার কথা বলেছেন সেটিই যুক্তিযুক্ত। কারণ এক রাষ্ট্রের দুই রাজধানী থাকলে সিন্ধু সভ্যতার মত সুশৃঙ্খল ও সমধর্মী সভ্যতা নির্মাণ সম্ভব নয়। সেক্ষেত্রে মধ্যযুগীয় স্বৈরতন্ত্রী রাষ্ট্র ও সমাজের কল্পনা করতে হয় যেখানে রাজার সঙ্গে রাজধানী যেত। এইসব রাজধানী প্রকৃতপক্ষে অস্থায়ী সামরিক-প্রশাসনিক শিবিরের মত। কিন্তু সিন্ধু সভ্যতার নগরের ব্যাপার আদৌ তেমন কিছু নয়।

সুতরাং এটিই যুক্তিসঙ্গত যে, রাষ্ট্রের রাজধানী তথা সভ্যতার কেন্দ্র মহেঞ্জোদাড়ো থেকে হরপ্পায় সরে গিয়েছিল। আর এর জন্য হুইলার দায়ী করছেন মহেঞ্জোদাড়োর চারপাশে ক্রমবর্ধমান ধ্বংসাত্মক বন্যাকে। তিনি এই অস্বাভাবিক ও ধ্বংসাত্মক বন্যার কারণ হিসাবে একটি সম্ভাবনার কথা বলছেন তা হল নিম্ন সিন্ধু উপত্যকায় ভূ-পৃষ্ঠের পর্যায়ক্রমিক উচ্চতা বৃদ্ধির ফলে সিন্ধু নদীর অবরুদ্ধ জলপ্রবাহ দ্বারা হ্রদ বা জলাশয় সৃষ্টি। গ্রীষ্মে হিমালয় পর্বতমালার বরফগলা জলরাশি এবং সেই সঙ্গে পাঞ্জাবে যেটুকু বৃষ্টিপাত হত তার জল এই অবরুদ্ধ জলরাশির সঙ্গে সংযুক্ত হয়ে প্রবল বন্যা সৃষ্টি করত যা কখন প্রলয়ঙ্করী রূপ ধারণ করত। হুইলার এই জলাবদ্ধতা এবং বন্যার বিষয়টি আলোচনা করে এটিকে সিন্ধু সভ্যতার বিপর্যয়ের একটি বড় কারণ এবং বিশেষত মহেঞ্জোদাড়ো নগরের পতনের প্রধান কারণ মনে করছেন। তিনি একটি সঠিক বিষয় ধরেছেন যে, সমুদ্রোপকূলের নিকটে বা ভাটিতে সিন্ধু নদীর জলপ্রবাহ রুদ্ধ হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু তা কোন ভূ-প্রাকৃতিক কারণে নয়। এটা হয়েছিল মানুষের দ্বারা। সিন্ধু সভ্যতার সংগঠকেরা নদীমুখে বাঁধ বা নদীরোধক দ্বারা সিন্ধু নদীকে রুদ্ধ করেছিল। ঋগ্বেদ সেই কথাটাই জানায়। ঋগ্বেদের বৃত্র হল সেই নদীরোধক যা সিন্ধুর জলপ্রবাহকে সমুদ্রে পড়তে না দিয়ে উজানমুখী করেছিল এবং তাকে বহুসংখ্যক কৃত্রিম হ্রদ বা জলাধারে সংরক্ষণ দ্বারা এক বিশাল ভূভাগে জলসেচের ব্যবস্থা সম্ভব করেছিল।

ভারতীয় ইতিহাস গবেষক দামোদর ধর্মানন্দ কোসাম্বি বৃত্রকে চিহ্নিত করেছেন নদীর মাঝখানে আড়াআড়িভাবে দেওয়া বাঁধ বা নদীরোধক হিসাবে১০। অর্থাৎ তিনি এটিকে “ড্যাম” বলছেন। এটিকে “এমব্যাঙ্কমেন্ট” বা নদীর পাড় বরাবর বাঁধ বলছেন না। কিন্তু ঋগ্বেদ বৃত্রকে উভয় অর্থেই ব্যবহার করেছে বলে মনে হয়। একইভাবে অহি শব্দকে অনেক সময় বৃত্র অর্থে ব্যবহার করেছে। মাটিতে পড়ে থাকা লম্বমান আঁকাবাঁকা সর্প বা অহির সঙ্গে নদীপাড় বরাবর বাঁধের বেশ মিল আছে।

তখন সিন্ধু উপত্যকায় ছিল সাতটি নদী। ঋগ্বেদে এই সাত নদীকে সপ্তসিন্ধু বলা হয়েছে। ঋগ্বেদ আমাদেরকে জানায় সাত নদীরই বন্ধনের কথা যাকে ইন্দ্রের নামে বৈদিক শক্তি ধ্বংস করেঃ “হে মনুষ্যগণ! যিনি অহিকে বিনাশ করে সপ্তসংখ্যক নদী প্রবাহিত করেছিলেন, যিনি বল কর্তৃক নিরুদ্ধ গোসমূহকে উদ্ধার করেছিলেন, যিনি মেঘদ্বয়ের মধ্যে অগ্নি উৎপাদন করেন এবং যু্দ্ধকালে শত্রুগণকে বিনাশ করেন, তিনিই ইন্দ্র (২।১২।৩), হে মনুষ্যগণ! যিনি সপ্তরশ্মিবিশিষ্ট, অভিষ্টবর্ষী ও বলবান, যিনি সাতটি নদীকে প্রবাহিত করে দিয়েছিলেন, যিনি বজ্রবাহু হয়ে স্বর্গারোহণোদ্যত রৌহিণকে বিনাশ করেছিলেন, তিনিই ইন্দ্র” (২।১২।১২)। “হে সোম! ইন্দ্রের সাথে তোমার বন্ধুত্ব হবার পর ইন্দ্র তোমার সাহায্যে মনুষ্যদের জল প্রবাহিত করেছেন, বৃত্রকে বধ করেছেন, সপ্তাসিন্ধুকে প্রেরণ করেছেন, এবং বদ্ধদ্বার উদ্ঘাটিত করেছেন” (৪।২৮।১); ইত্যাদি।

সমুদ্রে জলস্রোত গমন কেন রুদ্ধ হয়েছিল সেটা বুঝতে এখন অসুবিধা হয় না। এই রুদ্ধ জল দ্বারা সৃষ্ট স্রোতহীন হ্রদ বা জলাশয়ের অস্তিত্ব সম্পর্কে হুইলার আমাদেরকে যা জানাচ্ছেন সেটাও ঋগ্বেদ দ্বারা সমর্থিত হয়। আমরা ইতিপূর্বে বলেছি যে, ঋগ্বেদের সব মেঘ আকাশের মেঘ নয়। অনেক ক্ষেত্রে মেঘের বৈদিক প্রতিশব্দ দ্বারা মেঘ না বুঝিয়ে আবদ্ধ জলাধার বোঝানো হয়েছে। অর্থাৎ প্রতিবন্ধক কিংবা বাঁধ দ্বারা আবদ্ধ হ্রদ বা জলাধার, খাল এবং নদী সহ স্রোতহীন কিংবা নিয়ন্ত্রিতস্রোত সমস্ত জলস্থান বোঝাতেই অনেক সময় মেঘ ব্যবহার করা হয়েছে বলে মনে হয়। অর্থাৎ এক্ষেত্রে আকাশের মেঘের উপমার আশ্রয় নেওয়া হয়েছে। নিম্নলিখিত ঋকগুলি আমাদের ধারণাকে সমর্থন করে :

“অন্ধকার বৃষ্টির ধারা রোধ করেছিল, বৃত্রের জঠরের ভিতর মেঘ ছিল; বৃত্রের দ্বারা নিহিত হয়ে যে জলসমুদয় ক্রমান্বয়ে অবস্থিত ছিল, ইন্দ্র তা নিম্ন ভূ-প্রদেশে প্রেরণ করলেন” (১।৫৪।১০)।

“হে বজ্রযুক্ত ইন্দ্র! তুমি যে বিস্তার্ণ মেঘকে বজ্র দ্বারা পর্বে পর্বে কেটে দিয়েছ, সে মেঘে আবৃত জল বয়ে যাবার জন্য নিম্ন দিকে ছেড়ে দিয়েছ” (১।৫৭।৬)।“তুমি (ইন্দ্র) নদীগণকে পরিপূর্ণ করেছ, মেঘকে ভগ্ন করেছ, বৃত্র কর্তৃক আবৃত জলকে প্রেরণ করেছ” (৪।১৯।৫)। “তুমি নিরুদ্ধ বারিরাশিকে সর্বত্র প্রবাহিত হবার নিমিত্ত বিমুক্ত করেছ। তুমি মেঘের সুদৃঢ় বন্ধন ছিন্ন করেছ…” (৬।৩০।৫) “তুমি স্তোতাগণের জন্য পর্ববিশিষ্ট শত এবং সহস্র জলবিশিষ্ট মেঘকে বিদীর্ণ করেছ” (৮।৬৪।৫); ইত্যাদি।

শেষ ঋক থেকে বোঝা যায় যে, উজান থেকে ভাটি বরাবর নদীগুলির দুইপাশে বাঁধ দ্বারা ঘিরে অসংখ্য হ্রদ বা জলাধার তৈরী করা হয়েছিল যেগুলিতে কৃত্রিম খালের মাধ্যমে বৃত্রদ্বারা নিয়ন্ত্রিত নদীস্রোত প্রবাহিত করা হত।

এইখানে আমাদের সামনে একটি জটিল প্রশ্ন দেখা দেয় তাহল নদীগুলি কি সম্পূর্ণরূপে ড্যাম দ্বারা রুদ্ধ ছিল নাকি এগুলি বর্তমান যুগের মত দ্বারযুক্ত কোন ধরনের ব্যারেজ দ্বারা নিয়ন্ত্রিত ছিল? হয়ত উজানে উপনদীগুলিতে এবং ভাটিতে মূল সিন্ধুর মুখে বিশাল বাঁধ দিয়ে স্রোত রুদ্ধ করা হয়েছিল। কিন্তু এই ধরনের ড্যাম দ্বারা নদী সম্পূর্ণ রোধ করে কি কোন কার্যকর সেচব্যবস্থা বা নদীনিয়ন্ত্রণব্যবস্থা গড়ে তোলা সম্ভব? নদীস্রোত রুদ্ধ হওয়ায় শুধু যে দুই পাশে বিস্তীর্ণ ভূভাগ প্লাবিত হবে তাই নয় সম্ভবত কিছুদিনের মধ্যে পলি সঞ্চয়ের ফলে নদীখাত আর থাকবে না ফলে সৃষ্টি হবে স্থায়ী হ্রদ। এতে কৃষির উদ্দেশ্যও ব্যর্থ হতে পারে। হয়ত পাহাড়ী ছোট নদীতে এই ধরনের ড্যাম দিয়ে ছোট জলাধার নির্মাণ করে তা দিয়ে শুষ্ক ঋতুতে জলসেচ করা যায় কিন্তু সিন্ধু উপত্যকার মত সমতল ভূমিতে এটা কিভাবে সম্ভব?

কোসাম্বি অবশ্য মূল সিন্ধু কিংবা বড় নদীতে বৃত্র দেবার কথা বলেন নি। তিনি ক্ষুদ্র শাখাগুলিতে এই পদ্ধতি দ্বারা কৃষির সম্ভাবনার কথা বলেছেন১১। কিন্তু ঋগ্বেদের বিবরণ অনুযায়ী প্রতিটি নদীই বৃত্রাবদ্ধ হয়েছিল। এবং বৃত্রের প্রসঙ্গ এতবার ও এতভাবে এসেছে যে বিষয়টিকে এত তুচ্ছ মনে হয় না। এটা কোন রকমে শুধু নদীমুখ রুদ্ধ করার ব্যাপার ছিল বলেও মনে হয় না। ঋগ্বেদের বিবরণগুলি আমাদের কল্পনায় অসংখ্য খাল, জলাধার এবং বাঁধের চিত্র নির্মাণ করে। স্পষ্টই বোঝা যায় অত্যন্ত জটিল ও বিশাল এক জলনিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থায় সমগ্র সিন্ধু উপত্যকাভূমি আবদ্ধ হয়েছিল।

এত হাজার বৎসর পূর্বে কি মানুষের পক্ষে আধুনিক কালের কাছাকাছি ধরনের কোন নদীনিয়ন্ত্রণব্যবস্থা বা ব্যারেজ নির্মাণ করা সম্ভব? এ সম্পর্কে ঋগ্বেদ যা বলছে তা থেকে কি তেমন কিছু অনুমান করা যায়? কিছু পূর্বে উদ্ধৃত ৪।২৮।১ ঋকে আমরা দেখেছি যে, তাতে ইন্দ্র সম্পর্কে বলা হচ্ছে যে, তিনি বৃত্রবধ, সপ্তসিন্ধু প্রেরণ এবং “বদ্ধদ্বার” উদ্ঘাটিত করেছেন। এই ধরনের বিবরণ আরও পাই। যেমন, “তিনি (ইন্দ্র) বজ্র দ্বারা নদীর নির্গমন দ্বার সকল খুলে দেন, তিনি অনায়াসে দীর্ঘকাল গন্তব্য পথে নদী সকলকে প্রেরণ করেন” (২।১৫।৩)। “বদ্ধদ্বার” কিংবা “নদীর নির্গমন দ্বার সকল” কি জলপ্রবাহ নিয়ন্ত্রণের জন্য ব্যারেজের জলকপাট বা স্লুস গেটের বর্ণনা? আজ থেকে ৪।৫ হাজার বৎসর পূর্বের মানুষের কাছ থেকে কি আমরা এতটা আশা করতে পারি? অবশ্য সপ্তসিন্ধুকে যাঁরা বাঁধতে পারেন তাঁদের পক্ষে হয়ত এটা সবকালেই সম্ভব। হয়ত আগামী দিনের প্রত্নতাত্ত্বিক গবেষণা এই প্রশ্নের যথাযথ উত্তর দিবে।

আমরা অবশ্য প্রত্নতাত্ত্বিক গবেষণার ফল দ্বারা ঋগ্বেদের একটি বিবরণ সম্পর্কে নিশ্চিত হয়েছি যে, সিন্ধু নদী সত্যিই রুদ্ধ হয়েছিল। যেহেতু সাতটি নদীর মধ্যে ছয়টিই মূল সিন্ধুর উপনদী সেহেতু যদি উপনদীগুলিতে বৃত্র দেওয়া নাও হয় তবু মূল সিন্ধুমুখ রুদ্ধ হওয়ায় স্বাভাবিকভাবে সাতটি নদী ভূমিতে রুদ্ধ হয়েছিল। আমরা সহজেই অনুমান করতে পারি যে, জলপ্রবাহ নিয়ন্ত্রণের ব্যাপক ও বিশাল ব্যবস্থা ছাড়া নদীমুখ বন্ধ করাই সম্ভব নয়। সুতরাং হ্রদ, খাল এবং নদীখাত ইত্যাদি রক্ষা ও নিয়ন্ত্রণের জন্য দৃঢ়, উচ্চ, বিশাল এবং অসংখ্য বাঁধ নির্মাণের প্রশ্ন আসে। ঋগ্বেদ আমাদেরকে বৃত্র বা অহি দ্বারা এইসব বাঁধের অস্তিত্বের কথা জানায়।

ঋগ্বেদের বর্ণনা থেকে আমরা অসংখ্য বৃত্র বা বাঁধ ধ্বংসের চিত্র পাই :

“অপ্রতিদ্বন্দ্বী ইন্দ্র দধীচি ঋষির অস্থি দ্বারা বৃত্রগণকে নবগুণ নবতি বার বধ করেছিলেন”(১।৮৪।১৩)। “হে নেতৃদের স্তুতিযোগ্য ইন্দ্র। তুমি সংগ্রামে মরুৎগণের সাথে বহুবৃত্রগণকে বধ করেছ” (৭।১৯।৪); ইত্যাদি।

সুউচ্চ বাঁধগুলি যে বিশাল ভূভাগের সর্বত্র বিস্তৃত হয়েছিল তা এই বক্তব্য থেকে জানা যায় : “যেহেতু বৃত্র অন্তরীক্ষে উন্নত হয়ে সমুদয় পদার্থকে ব্যাপ্ত করেছিল অতএব ইন্দ্র তার প্রতি বজ্র নিক্ষেপ করলেন” (২।৩০।৩)।

সুতরাং আমরা ঋগ্বেদ দ্বারা সিন্ধু উপত্যকায় এক অত্যন্ত জটিল জলনিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থার সন্ধান পাচ্ছি যার চূড়ান্ত ফলাফল সিন্ধু উপত্যকায় প্রত্নতাত্ত্বিক ও ভূতাত্ত্বিক গবেষণাভিত্তিক অনুমান কিংবা সিদ্ধান্তের সঙ্গে মিলে যায়। অর্থাৎ এই জলনিয়ন্ত্রণব্যবস্থাই সুদীর্ঘ কাল পর বিপুল পলি সঞ্চয়, প্রলয়ঙ্করী বন্যা এবং অন্যান্য সমস্যা সৃষ্টি করে। তবে আমরা এই আলোচনায় পরে যাব। তার পূর্বে আমরা সভ্যতা নির্মাণে এই নদীনিয়ন্ত্রণব্যবস্থার ইতিবাচক ভূমিকা ও ফল আলোচনা করব।

আমরা জানি যে, পাঞ্জাব ও সিন্ধু অঞ্চলে বৃষ্টিপাত খুব কম। এই অঞ্চলে জলসেচের উৎস বর্তমানে মূল সিন্ধু নদীসহ ছয় নদীর জলপ্রবাহ। প্রকৃতপক্ষে সিন্ধু নদী একটি মরুভূমি এবং অর্ধমরুভূমির মধ্য দিয়ে বয়ে গেছে। ফলে সিন্ধু উপত্যকায় কৃষি উৎপাদন মূলত কৃত্রিম জলসরবরাহ ব্যবস্থার উপর নির্ভরশীল।

এই শুষ্ক অঞ্চলে চার বা পাঁচ হাজার বৎসর পূর্বেও বৃষ্টিপাত এখনকার চেয়ে তেমন কিছু বেশী হত না১২। কাজেই সিন্ধু উপত্যকায় ব্যাপক কৃষি উৎপাদনের জন্য সিন্ধু-হরপ্পা সভ্যতার সংগঠকরা নদীনিয়ন্ত্রণব্যবস্থা গড়ে তোলে। এটা একবারে হয়েছিল তা মনে হয় না। সম্ভবত উত্তরে কোন উপনদীকে বৃত্র দ্বারা আবদ্ধ করে এই প্রক্রিয়ার সূচনা হয় যা পরে পর্যায়ক্রমে সম্প্রসারিত হয়েছে।

এই ধরনের নদীনিয়ন্ত্রণব্যবস্থার ফল হয়েছিল বিস্ময়কর ও বিপ্লবাত্মক। এটা ছিল প্রকৃতির অন্ধ ও প্রচণ্ড শক্তির বিরুদ্ধে প্রাচীন মানুষের এক অবিশ্বাস্য দুঃসাহসিক সংগ্রাম এবং সেই সংগ্রামে বিজয় অর্জন। যে যুগে মানুষ প্রকৃতির শক্তিকে ব্যবহার করত সাধারণত প্রকৃতির সঙ্গে তাল মিলিয়ে সে যুগে প্রকৃতির নিয়ম ও রীতির বিরুদ্ধে দাঁড়ানো অবিশ্বাস্য সাহসের ব্যাপার। নদীতীরে বাঁধ দিয়ে এবং খাল কেটে তার জলস্রোত ব্যবহার করা এক জিনিস আর নদীকে অবরুদ্ধ করে তার জলস্রোত দ্বারা দুই তীরবর্তী বিশাল ভূভাগকে জলসেচের আওতায় আনা আর এক জিনিস। এটা শুধু প্রকৃতির বিরুদ্ধে দাঁড়ানো নয় সেই সঙ্গে দেবতা এবং ঈশ্বর সম্পর্কে প্রচলিত সমস্ত ধারণার বিরুদ্ধেও দাঁড়ানো।

এখন আমাদের কাছে স্পষ্ট হয় প্রাচীন ভারতে চার্বাক, লোকায়ত, ইত্যাদি বস্তুবাদী ও নিরীশ্বরবাদী দর্শনের ঐতিহ্য কোনখান থেকে এসেছে। বস্তুত প্রকৃতির উপর এভাবে আধিপত্যকারী এই মানবিক মেধা অনিবার্যভাবে আত্মপ্রত্যয়ী, যুক্তিবাদী এবং সেই সঙ্গে যথেষ্ট পরিমাণে বস্তুবাদী হয়ে উঠতে বাধ্য। তবে এই চেতনাকে মূলত সিন্ধু-হরপ্পা সভ্যতার এই নদী নিয়ন্ত্রণব্যবস্থার ফল মনে করলে ভুল হবে। বরং উল্টোটাই সত্য। সিন্ধু-হরপ্পা সভ্যতায় এই বস্তুবাদী চেতনা একটা দৃঢ়ভিত্তি পেলেও তার সূচনা এবং বিকাশ ঘটেছিল সিন্ধু সভ্যতার হরপ্পা পর্যায়ের পূর্বেই। এই অসাধারণ বস্তুবাদী ও যুক্তিবাদী চেতনার প্রভাবেই সম্ভব হয়েছিল সিন্ধুর নগর পরিকল্পনা এবং সেই সঙ্গে বৃত্রপদ্ধতিতে নদী নিয়ন্ত্রণ ও জলসেচ ব্যবস্থার নীলনকশার উদ্ভব।

ধর্ম মূলত অন্ধ বিশ্বাসমূলক ঐতিহ্য ও প্রথার শক্তিকে অবলম্বন করে দাঁড়ায়। কাজেই এই ধরনের নদীনিয়ন্ত্রণব্যবস্থার সঙ্গে ধর্মীয় শক্তির সম্মিলন বা সমন্বয় অন্তত গোড়ার দিকে কতটা ছিল সন্দেহ। খুব সম্ভবত এই ব্যবস্থার উদ্ভবের প্রাথমিক পর্যায়ে প্রচলিত ধর্ম তাকে বাধাই দিতে চেয়েছিল। কিন্তু সমাজের বিকাশমান প্রযুক্তিগত ও ইহবাদী শক্তির কাছে হার মেনে নিজেকে নূতন পরিস্থিতির উপযোগী করতে গিয়ে বৃত্র-ব্যবস্থাকে নিজের কাঠামোর ভিতর নিয়েছে। এমন একটি ব্যবস্থাকে ধর্মের অন্তর্ভুক্ত করতে কিংবা তার সঙ্গে আপোস করতেও নিশ্চয় প্রয়োজন হয়েছে একটি ধর্মীয় পুনর্গঠনের। অর্থাৎ সিন্ধু-হরপ্পা সভ্যতার নগর পরিকল্পনা এবং নদীনিয়ন্ত্রণব্যবস্থা আমাদেরকে বলে দেয় সমাজের পূর্ববর্তী বহুকিছুর ভাঙ্গন ও পরিবর্তনের মত ধর্মীয় ভাঙ্গন ও পরিবর্তনও। বিশাল আয়তন ব্যাপী নূতন ব্যবস্থার প্রবর্তন করতে গিয়ে নিশ্চয় পুরাতন পৃথিবীর বহুকিছুকেই ওলটপালট করতে হয়েছিল।

সিন্ধু-হরপ্পান সভ্যতার স্থিতি বলা যাক, দ্রুত বিকাশ ও বিস্তার বলা যাক, বন্ধ্যাত্ব ও ধ্বংস বলা যাক সবকিছুর মূল উৎস রয়েছে এই বিচিত্র ও বিশিষ্ট নদীনিয়ন্ত্রণব্যবস্থার মধ্যে যেটাকে ঋগ্বেদের শব্দ ব্যবহার করলে আমরা বৃত্রব্যবস্থা বলতে পারি। এই ব্যবস্থা দ্বারা শেষ পর্যন্ত জলসেচের আওতায় এসেছিল সম্ভবত এক থেকে দেড় লক্ষ বর্গমাইল এলাকার কোটি কোটি একর ভূমি। বর্তমান পাঞ্জাব ও সিন্ধুর সমভূমির মানচিত্রের দিকে দৃষ্টিপাত করলে আমরা এই বিশালতা অনুমান করতে পারি।

এই সমগ্র সেচব্যবস্থার সংগঠন ও নিয়ন্ত্রণের জন্য প্রয়োজন ছিল অত্যন্ত দক্ষ ও উন্নত ব্যবস্থাপনার এবং প্রকৌশল জ্ঞানের। কেবলমাত্র কেন্দ্রীয় পরিকল্পনা ও নিয়ন্ত্রণের অস্তিত্ব থাকলেই এই ধরনের নদীনিয়ন্ত্রণ ও সেচ ব্যবস্থা গড়ে তোলা এবং কার্যকর রাখা সম্ভব। যেহেতু কেন্দ্রীয় পরিকল্পনা ও নিয়ন্ত্রণ ভেঙ্গে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে এই বিশাল ও জটিল নদীনিয়ন্ত্রণ এবং সেই সঙ্গে জলসেচ ব্যবস্থা ভেঙ্গে পড়তে বাধ্য সেহেতু যারা একবার এই নদীনিয়ন্ত্রণব্যবস্থা গড়ে তুলতে পেরেছে সমগ্র সমাজ, রাষ্ট্র ও সভ্যতা সুদীর্ঘকাল সহজে তাদের নিয়ন্ত্রণে থেকেছে।

এই নদীনিয়ন্ত্রণব্যবস্থা সংগঠন ও সংরক্ষণের জন্য ধর্মের ভূমিকা শক্তিশালী হলেও সামগ্রিকভাবে গৌণ বা সহায়ক হবার কথা। বহিঃশক্তির আক্রমণ রোধ ব্যতীত সামরিক শক্তিরও এখানে বিশেষ কিছু করার নেই। সুতরাং আমরা অনুমান করতে পারি যে, এক শক্তিশালী বেসামরিক ও ঐহিক আমলাতন্ত্র, বিশেষত প্রকৌশলী ও প্রযুক্তিবিদদের এক বিশাল বাহিনী গড়ে উঠেছিল। মধ্য পুঁজির মালিক ও বণিকের সঙ্গে এই ধরনের শক্তিশালী কারিগরি-আমলাতন্ত্র বা টেকনো-ব্যুরোক্র্যাসির দৃঢ় ঐক্য ছিল বলে অনুমান করা যায়। এর সঙ্গে দৃঢ়ভাবে সংযুক্ত ছিল ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান ও সেনাবাহিনী এমন অনুমান যুক্তিযুক্ত।

যে শ্রেণী বা শ্রেণীসমূহ সিন্ধু-হরপ্পান সভ্যতার নগর এবং নদীনিয়ন্ত্রণব্যবস্থা গড়ে তুলেছিল তারা ছিল মূলত নাগরিক বা নগরকেন্দ্রিক। যেহেতু এই ধরনের জটিল ব্যবস্থার জন্য উন্নত কারিগরি বিদ্যা, প্রশাসনিক দক্ষতা এবং শিক্ষা বা জ্ঞান অত্যাবশ্যক সেহেতু উন্নত প্রযুক্তি ও মেধার অধিকারী নাগরিক শক্তির নিয়ন্ত্রণ ভাঙ্গা গ্রামীন বা পশ্চাৎপদ শক্তির পক্ষে সম্ভব ছিল না। অর্থাৎ ব্যাপারটা এই দাঁড়ায় যে, কোন পশ্চাৎপদ কিংবা পেশীশক্তির পক্ষে বিশেষত এই জটিল জলনিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থার জাল ভেদ করে ওঠা সম্ভব ছিল না। এটা সম্ভব করেছে সভ্যতার দীর্ঘস্থায়ীত্ব ও স্থিতিশীলতা।

নদীনিয়ন্ত্রণব্যবস্থার ফলে বিশাল এলাকায় সেচ দ্বারা বিপুল জনসংখ্যার জন্য প্রয়োজনীয় খাদ্যোৎপাদন সম্ভব হয়। এর ফলে বহু সংখ্যক নগর গড়ে ওঠে। কোসাম্বির বক্তব্য হল যে, সিন্ধু সভ্যতায় খাদ্যোৎপাদন কম হত যার ফলে নগর সংখ্যা এবং জনসংখ্যা কম ছিল১৩। তাঁর মতে হরপ্পা, মহেঞ্জোদাড়ো ছাড়া আর কোন বড় নগর গড়ে ওঠে নি। তাঁর অপর একটি সিদ্ধান্ত হল যে, সিন্ধু সভ্যতায় লাঙ্গল ছিল না১৪। চাষ হত আঁচড়া দিয়ে। বন্যার জল সরে যাবার পর নরম পলিমাটিতে আঁচড়া দিয়ে উপরটা কিছু আলগা করে দেওয়া হত।

এটা ঠিক যে, সিন্ধু উপত্যকায় বেশী সংখ্যক নগরের ধ্বংসাবশেষ পাওয়া যায় নি এবং বৃহৎ নগর বলতে দুইটিই। সমগ্র সিন্ধু সভ্যতার প্রাপ্ত বসতি নগরগুলির সংখ্যা সত্তরের কিছু বেশী। কিন্তু সিন্ধু উপত্যকায় প্রয়োজনীয় প্রত্নতাত্ত্বিক অনুসন্ধানের ঘাটতি রয়েছে বলেই আমরা জানি। সুতরাং এখনই নগর সংখ্যার স্বল্পতা সম্পর্কে চূড়ান্ত মত দেওয়া যায় না। তাছাড়া সব নগরের ধ্বংসাবশেষ আমরা এত হাজার বৎসর পর নাও পেতে পারি। বন্যা, ভূমিক্ষয়, নদীর খাত পরিবর্তন, লবণাক্ততার দরুণ ক্ষয় ইত্যাদিও আমাদের বিবেচনায় নিতে হবে। অধিক সংখ্যক বৃহৎ নগরের অভাবের কারণ হতে পারে কয়েকটি বিন্দুতে জনসংখ্যার অতিকেন্দ্রীভবনের পরিবর্তে ভারসাম্যপূর্ণ নিবাসন। নগর সংখ্যার প্রশ্নে আর একটি বিষয় আমাদের বিবেচেনায় নিতে হবে যে, প্রাচীন সভ্যতায় সবাই নগরে বাস করত এমন নয়। নিশ্চয় নগরগুলির পাশে ছিল অসংখ্য গ্রাম এবং মাটি বা কাঠখড়ের বাড়ী যেগুলির চিহ্ন এখন থাকবার কথা নয়। এইসব নিকৃষ্ট গৃহের পরিবর্তে উৎকৃষ্ট গৃহের কামনা ঋষিদের অনেক মন্ত্রে প্রকাশ পেয়েছে। বসিষ্ঠ ঋষি প্রার্থনা জানিয়ে বলছেন, “হে রাজা বরুণ! মৃন্ময় গৃহ যেন আমি প্রাপ্ত না হই” (৭।৮৯।১)।

যাইহোক, আমরা এই বিষয়গুলি সম্পর্কে ধারণা লাভের জন্য ঋগ্বেদের সাহায্য নিতে পারি। ঋগ্বেদে আমরা সিন্ধু উপত্যকার সমস্ত নগরের সংখ্যা পাই না। কিন্তু শত্রুর ধ্বংসপ্রাপ্ত, বিদারিত এবং তার নিকট থেকে অধিকৃত কিছু সংখ্যক নগরের হিসাব পাই। পুনরুক্তির সম্ভাবনা এড়াবার জন্য আমরা খুব সতর্কভাবে হিসাব করলেও শত্রুর নগরের হিসাব দাঁড়ায় নিম্নরূপ :

১।৫৩।৮ ঋকে বলা হচ্ছে “…তুমি (ইন্দ্র) অনুচররহিত হয়ে ঋজিশ্বান নামক রাজার দ্বারা চারদিকে বেষ্টিত বঙ্গৃদ নামক শত্রুর শত শত নগর ভেদ করেছিলে।” অর্থাৎ আমরা বুঝব যে, রাজা ঋজিশ্বান বঙ্গৃদের শত শত নগর ভেদ করেছিলেন। কিন্তু সংখ্যা নির্দিষ্ট না করায় আমরা কি অনুমান করব? সুতরাং সবচেয়ে কম সংখ্যা হিসাবে একশত (১০০) ধরা যাক।

৪।৩০।২০ ঋকে বলা হচ্ছে, “ইন্দ্র হব্যদাতা দিবোদাসকে শম্বরের পাষাণ নির্মিত শত সংখ্যক পুরী (নগর) প্রদান করেছিলেন।” ৭।১৯।৫ ঋকে বলা হচ্ছে, “…তুমি নব নবতী পুরী যুগপৎ বিদীর্ণ করেছ, নিবাসের জন্য শততম পুরী ব্যাপ্ত করেছ….।” আবার ৪।২৬।৩ ঋকে বলা হচ্ছে, “আমি (ইন্দ্র) সোমপানে মত্ত হয়ে শম্বরের নবনবতি সংখ্যক পুরী এককালে ধ্বংস করেছি। আমি যখন অতিথিগ্ব দিবোদাসকে যজ্ঞে পালন করেছিলাম তখন তাঁকে শততম পুরী বাসের জন্য দিয়েছিলাম।” আমরা অনুমান করতে পারি যে, উপরোক্ত তিনটি ঋকের বর্ণনাই শম্বরের ১০০ পুর বা নগরের বিভিন্ন বর্ণনা মাত্র। সুতরাং আমরা শম্বরের ১০০ নগরের সংখ্যা ধরব।

৬।২০।১০ ঋকে বলা হচ্ছে, “…তুমি (ইন্দ্র) যজ্ঞ বিঘাতকদের নষ্ট করে পুরুকুৎসকে ধন প্রদান পুনঃসর বজ্রদ্বারা শরতের সপ্তপুরী বিদারিত করেছ…।” অর্থাৎ রাজা পুরুকুৎস শরত নামক ব্যক্তির সাত নগর বিদারণ করেছেন। শরতের এই সাত পুরীকে ঋগ্বেদে শারদপুরী বলা হয়েছে যার ফলে একে অনেক ক্ষেত্রে শরৎকালীনপুরী বা অস্থায়ী পুরী হিসাবে ব্যাখ্যা করা হয়। কিন্তু এই ৭ পুরী শরতের অধীন সাতটি নগরের বর্ণনা মাত্র।

ঋগ্বেদে শত্রুর আরও অনেক নগর অধিকারের বর্ণনা আছে। যেমন, “হে বজ্রধর(ইন্দ্র)! তুমি দুরন্ত মায়াবী পিপ্রুর সুদৃঢ় নগরী সকল বল দ্বারা বিদারিত করেছ” (৬।২০।৭)। সংখ্যার উল্লেখ না থাকায় আমরা এগুলিকে হিসাবে নিব না। তাছাড়া ৬।২৭।৫ ঋকে হরিয়ূপীয়া-র নাম পাচ্ছি। কিন্তু এটিকে নগর হিসাবে উল্লেখ না করায় আমরা এটিকেও হিসাবে নিব না।
সুতরাং আমরা নগর সংখ্যা পাচ্ছি মোট : ১০০+১০০+৭-২০৭টি। এগুলি সবই শত্রুপক্ষের নগরের হিসাব। কিন্তু বৈদিক পক্ষেরও যে নগর ছিল তার নিশ্চিত প্রমাণ আছে ঋগ্বেদে।

আমরা বসিষ্ঠ ও বিশ্বামিত্র ঋষিদ্বয়ের সংঘাতের কথা জানি। বসিষ্ঠ ঋষির পৃষ্ঠাপোষক বা অনুসারী রাজা সুদাসের সঙ্গে বিশ্বামিত্র ঋষির সমর্থক দশ উপজাতি জোটের যে যুদ্ধ হয় তার প্রসঙ্গে বসিষ্ঠ ঋষি বলছেন, “ইন্দ্র নিজ বল দ্বারা ওদের দৃঢ় পুরীসমস্ত এবং সপ্ত প্রকার রক্ষার উপায় তৎক্ষণাৎ বিদীর্ণ করেছিলেন” (৭।১৮।১৩)।

সুতরাং বৈদিক পক্ষেরও দৃঢ় পুরী সমস্ত ছিল। কিন্তু সংখ্যা দেওয়া নেই। কাজেই আমরা অনুমান করব না। আমরা ঋগ্বেদে প্রদত্ত হিসাব অনুযায়ীই পাচ্ছি কমপক্ষে ২০৭টি নগর। প্রকৃত সংখ্যা নিশ্চয় বহু বেশী ছিল।

এবার আসা যাক জনসংখ্যার প্রশ্নে। ঋগ্বেদে জনসংখ্যার কোন বিবরণ নেই। কিছু ক্ষেত্রে পরাজিত কিংবা নিহত শত্রু সৈন্যসংখ্যা দেওয়া আছে। এটা ঠিক যে, ঋগ্বেদের ঋষিদের সব বর্ণনা বা তথ্য বস্তুনির্ভর হবে এমন নয়। আর এটা ধর্মগ্রন্থ হওয়ায় মন্ত্র রচনার সময় বিভিন্ন উপকথাও তাতে ঢুকেছে। এমনও হতে পারে ইন্দ্রের কীর্তি হিসাবে ঋষি এক সূক্তের একই ঋকে যে দুটি ঘটনার বর্ণনা দিচ্ছেন তার একটি সমকালীন ঘটনার বর্ণনা অপরটি হয়ত দূর অতীতের কোন ঘটনার স্মৃতির উপর রচিত। যেহেতু ইন্দ্র প্রাচীন দেবতা সেহেতু ইন্দ্রের নামে অতীতের কোন ব্যক্তি বা গোত্র কর্তৃক অর্জিত কোন ঐতিহাসিক বিজয় ঘটনাকেও ইন্দ্রের কীর্তি হিসাবে বর্ণনা করা হতে পারে। তাছাড়া ঋষি একই ঋকে ইন্দ্র কর্তৃক শত্রু হত্যার যে বর্ণনা দিয়েছেন তাতে একটি নাম হয়ত বৈদিক শত্রু-মানুষের এবং অপরগুলি হয়ত দৈব শক্তি হিসাবে কল্পিত কোন বস্তুর নাম যেমন বৃত্র কিংবা কোন প্রাকৃতিক ঘটনা বা শক্তির নাম যেমন বন্যা, খরা ইত্যাদি।

সুতরাং ঋগ্বেদের তথ্য ব্যবহার করার সময় আমাদেরকে খুব সতর্ক হতে হবে। কিন্তু আমাদের এটা মনে রাখা দরকার যে, ঋগ্বেদ একটি জীবন্ত সামাজিক আন্দোলন দ্বারা সৃষ্ট ধর্মগ্রন্থ হওয়ায় তার মধ্যে যত উপকথা এবং রূপকার্থক বর্ণনাই থাক তাতে মূলত প্রতিফলিত হয়েছে সেই সময় এবং পরিস্থিতির জীবন্ত চিত্র।

উপরন্তু ঋগ্বেদের ঋষিদের যত প্রতিক্রিয়াশীল মনে করা যাক তাঁরা কিন্তু পশ্চাৎপদ ও গ্রাম্য পটভূমির মানুষ ছিলেন না। তাহলে আমরা যেমন ঋগ্বেদের উন্নত ভাষা বা সাহিত্য পেতাম না তেমন পেতাম না বিমূর্ত পূজা পদ্ধতিও। বহুদেবতাবাদী ধর্ম কিভাবে প্রতিমা বা প্রতীক পূজাহীন হতে পারে? সভ্যতার পথে যাত্রা করার সময় প্রতিটি উপজাতি বা গোত্র টোটেম বিশ্বাস এবং বিভিন্ন প্রাকৃতিক ও মানবিক শক্তির প্রতি আনুগত্য প্রদানের চিন্তা থেকে দেবতার মূর্তি কল্পনা করতে শিখেছিল। পশ্চাৎপদ মনে এতটা বিমূর্ত রূপ কল্পনা আসাই সম্ভব নয়।

সুতরাং এটা নিশ্চিত যে, বৈদিক ঋষিরা প্রচলিত একেশ্বরবাদী ধর্মীয় কাঠামো থেকে যেমন এসেছিলেন তেমন অন্তত তাদের মূল অংশ এসেছিলেন উন্নত নাগরিক পটভূমি থেকে। আসলে পুরাতন নগরকেন্দ্রিক পুরোহিত বা ধর্মীয় সম্প্রদায় বিভক্ত হয়ে বৈদিক আন্দোলন সংগঠিত করে। সুতরাং অশিক্ষিত কিংবা অর্ধশিক্ষিত, পশ্চাৎপদ এবং অসংস্কৃত মানুষের মত কল্পনা করা বা কথা বলা তখনও তাঁদের পক্ষে সম্ভব ছিল না। তাই তাঁদের রচনার সম্পূর্ণ না হলেও প্রচুর ঐতিহাসিক গুরুত্ব থাকবে। তবু আমরা আগেই বলেছি যে, খুব সতর্কভাবে বিচার করে আমাদেরকে ঋগ্বেদ থেকে তথ্য নিতে হবে। এই সঙ্গে এইটুকুও যোগ করা যাক যে, কিছু ভুল হওয়া স্বাভাবিক; কিন্তু কিছুই বুঝতে না পারার তুলনায় সত্যের যতটা সম্ভব কাছাকাছি যায় এমন একটা অনুমান করতে পারাও ভাল।

সুতরাং এখন আমরা ঋগ্বেদের তথ্য থেকে তখনকার সপ্তসিন্ধু অঞ্চলের জনসংখ্যার পরিমাণ অনুমান করতে চেষ্টা করব। সেটা আমরা করব সৈন্যসংখ্যার হিসাব দ্বারা। কিন্তু আমরা পূর্বে বলেছি যে, বৈদিক শক্তির সৈন্যসংখ্যা দেওয়া নেই, কিছু ক্ষেত্রে শত্রুসৈন্যের পরাজিত কিংবা নিহত কিছু সৈনিকের সংখ্যা পাওয়া যায়। আমরা সেইগুলিই একত্র করি। তাতে ফল এই দাঁড়ায় :

 

ঋক ১।৫৩।৯ –   সুশ্রবা নামক বাজার সঙ্গে যুদ্ধ করার জন্য যে বিংশ নরপতি ও ৬০,০৯৯ অনুচর এসেছিল তারা ইন্দ্র কর্তৃক পরাজিত হয় -৬০,০৯৯২০
ঐ  ১।১৩৩।৪ -   ত্রিগুণিত পঞ্চাশৎ সংখ্যক সেনা নাশ    - ১৫০
ঐ ৪।১৬।১৩ -   পঞ্চাশৎ সহস্র কৃষ্ণবর্ণ শত্রু বিনাশ (পিপ্রু ও মৃগয়ের?) - ৫,০০০
ঐ  ৪।৩০।১৫ -   দাস বর্চির চতুর্দিকস্থ পঞ্চশত সংখ্যক ও সহস্র সংখ্যক অনুচরদের বিশেষরূপে বধ    -  ১,৫০০
ঐ ৪।৩০।২১ -   দভীতির জন্য ত্রিংশৎ সহস্র সংখ্যক দাসকে হনন - ৩০,০০০
ঐ ৬।২৬।৬ -   পিঠানীকে রজি প্রদান করে এককালে ষষ্টি সহস্র যোদ্ধা বিনাশ - ৬০,০০০
ঐ ৬।২৭।৬ -    যয্যাবতী (হরিযুপীয়া)-র নিকট সমবেত ত্রিংশৎ শত বৃচীবৎ পুত্র এককালে নিধন প্রাপ্ত  - ৩,০০০
ঐ ৮।৯৬।১৩-১৫-   কৃষ্ণের দশ সহস্র দেবশূন্য সেনা বধ

-১০,০০০

_________

১,৬৯,৭৬৯

 

এখানে বলা দরকার যে, এই লেখকের ভুল বশত এক আধটি শত্রুসংখ্যার বিবরণ বাদ পড়তে পারে। সুতরাং বেদের তথ্য নির্ভরযোগ্য হলে এই হিসাব অতিরঞ্জিত নয়। এই হিসাব প্রসঙ্গে আরও বলা দরকার যে, স্পষ্টভাবে বোঝা যায় ঋগ্বেদে শত্রুবাহিনীর বহু হিসাব দেওয়া হয় নি। যেমন ১।৫৩।৮ ঋক থেকে আমরা জানতে পারছি যে, ঋজিশ্বান চারদিক থেকে অবরোধ করে বঙ্গৃদ-এর শত শত নগর ভেদ করেছিলেন। সুতরাং বঙ্গৃদের বিশাল সেনাবাহিনী থাকবার কথা। কিন্তু বঙ্গৃদ সম্পর্কে আর কোন তথ্য আমরা ঋগ্বেদে পাই না। অথবা আমরা দিবোদাস ও শম্বরের মধ্যে প্রচণ্ড যুদ্ধের কথা জানতে পারি। দিবোদাস শম্বরের ১০০ শত “পাষাণ নির্মিত” নগর অধিকার করেছিলেন (৪।৩০।২০)। ৬।২৬।৫ ঋকে শত শত ও সহস্র সহস্র শম্বর সৈন্য বধ, পর্বত (দুর্গ) হতে নির্গত শম্বরকে বধ এবং দিবোদাসের রক্ষা (বিজয়) সম্পর্কে জানতে পারি। কিন্তু শম্বরের সৈন্য সংখ্যার কোন বিবরণ আমাদের সামনে নেই। এই রকম উদাহরণ আরও দেওয়া যায়।
তবে আমরা যে তথ্য পেয়েছি আপাতত তার ভিত্তিতেই অগ্রসর হব। উপরের হিসাবগুলি সবই সশস্ত্র সৈনিকের এমন মনে করাই সঙ্গত। কারণ নিহত বা পলাতক বেসামরিক লোকদের হিসাব এত উৎসাহের সঙ্গে দেবতার উদ্দেশ্যে রচিত মন্ত্রে বর্ণনা করার কারণ নেই। উপরন্তু যুদ্ধটা গৃহযুদ্ধ।

আমরা যে হিসাব পেলাম তা বৈদিক শক্তি বিরোধী সৈনিকসংখ্যার হিসাব। কিন্তু বৈদিক সেনাবাহিনীর সংখ্যা আমরা কিভাবে বের করব? আমরা ধরে নিতে পারি যে, বৈদিক আন্দোলনের পিছনে বিরাট জনসমর্থন ছিল। তবু আমরা ধরে নিই যে সমাজ সমান দুইভাগে বিভক্ত হয়েছিল। একই সমাজভুক্ত হওয়ায় বৈদিক শক্তির সংখ্যাও শত্রুশক্তির তুলনায় খুব কম হবার কথা নয়। সুতরাং আমরা ধরে নিই যে, ঋগ্বেদে বর্ণিত শত্রুসৈন্য সংখ্যার সমান বৈদিক সৈন্যসংখ্যা। অর্থাৎ উভয় পক্ষের সৈন্যসংখ্যা একত্র করলে যে সৈন্যসংখ্যা দাঁড়াচ্ছে তা হল : ১,৬৯,৭৬৯×২=৩,৩৯,৫৩৮।

এখন আমরা এই সৈন্যসংখ্যা থেকে কি পরিমাণ জনসংখ্যার অস্তিত্ব অনুমান করতে পারি? তার আগে আমরা অনুমান করি সৈনিক এবং দেশের জনসংখ্যার আনুপাতিক হার কেমন হতে পারে। অর্থাৎ ১ জন সৈনিকের পিছনে কতজন বেসামরিক লোক থাকতে পারে?

আমরা যদি ১০ জনে ১ জন যোদ্ধা ধরি তাহলে ভারতরাষ্ট্রে প্রায় ৮০ কোটি জনসংখ্যায় ৮ কোটি, পাকিস্তানে ৯ কোটি জনসংখ্যায় ৯০ লক্ষ এবং বাংলাদেশে ১১ কোটি জনসংখ্যায় ১ কোটি ১০ লক্ষ সৈন্যসংখ্যা থাকা দরকার। কিন্তু ১৯৯০ সালের এক হিসাব১৫ অনুযায়ী স্থল, বিমান ও নৌ এই তিন বাহিনী মিলে ভারতরাষ্ট্রের সৈন্যসংখ্যা ১৫ লক্ষেরও কম এবং পাকিস্তানের সৈন্যসংখ্যা ৫ লক্ষের কাছাকাছি। বাংলাদেশের সৈন্যসংখ্যা সেই হিসাবে নেই। তবে তা সম্ভবত এক লক্ষের কিছু বেশী। বোঝা যাচ্ছে জনসংখ্যা অনুপাতে সামরিক রাষ্ট্র পাকিস্তানে সৈন্যসংখ্যা সর্বাধিক। কিন্তু সেটাও ১০ জনে ১ জন এমন কি ১০০ জনে ১ জনও নয়।

হয়ত বলা হবে যে, প্রাচীন যুগে সৈন্য বাহিনীর জন্য এত ব্যয় ছিল না। কিন্তু সিন্ধু উপত্যকার বাস্তবতা বিবেচনা করলে সৈন্যবাহিনী সংগঠন ও লালন অত্যন্ত ব্যয়বহুল মনে হবে। কারণ তামা, এবং ব্রঞ্জ তৈরীর জন্য তামার সঙ্গে মেশাবার টিন সেখানে পাওয়া যেত না। এগুলি আমদানী করতে হত আফগানিস্তান, দক্ষিণ ভারত এবং সামান্য পরিমাণে রাজস্থান ও বালুচিস্তান থেকে। ফলে যুদ্ধাস্ত্র ও বর্ম নির্মাণ ছিল অত্যন্ত ব্যয়বহুল। অন্যদিকে সিন্ধুর শান্তিপূর্ণ কৃষি সমাজের কথা মনে রাখতে হবে। সর্বোপরি জলনিয়ন্ত্রণব্যবস্থা রক্ষণাবেক্ষণে বিপুল জনশক্তি যে সর্বক্ষণ নিয়োজিত রাখতে হত সেটাও আমাদের মনে রাখতে হবে। সুতরাং ১০ জনে ১ জন সৈনিক কোন যুদ্ধনির্ভর পশুপালক সমাজে সম্ভব হলেও সিন্ধু সভ্যতার মত কৃষিভিত্তিক ও নগরকেন্দ্রিক সমাজে যুদ্ধের পরিস্থিতিতেও খুব বেশী হলে ২০ জনে ১ জন সৈনিক ছিল বলে আমরা অনুমান করতে পারি। অর্থাৎ ১ জন সশস্ত্র যোদ্ধার পিছনে নারী, শিশু, বৃদ্ধ, বিভিন্ন পেশায় নিয়োজিত ব্যক্তি ইত্যাদি সব মিলিয়ে আমরা ১৯জন বেসামরিক ব্যক্তির হিসাব করছি। এখন ২০ জনে ১ জন হিসাবে যে জনসংখ্যা বেরিয়ে আসে তা এই:

৩,৩৯,৫৩৮×২০=৬৩,৯০,৭৬০ জন।

আমাদের হিসাব এখনও শেষ হয় নি। আমরা এই হিসাবের প্রথমেই বলেছি যে, ঋগ্বেদে শত্রুসৈন্যের যে সংখ্যা দেওয়া আছে তা যথেষ্ট অসম্পূর্ণ। এবং তাতেও কোন কোন ক্ষেত্রে শুধু শত্রুর নিহতদের সংখ্যা আছে। সুতরাং আমরা খুব সংযত একটা হিসাব ধরে বলতে পারি যে, ঋগ্বেদে যে সৈন্যসংখ্যা দেওয়া হয়েছে প্রকৃত সংখ্যা তার ৩ কিংবা ৪ গুণ হবে। আমরা কমটাই ধরি। তাহলে আমরা উপরে যে জনসংখ্যার হিসাব পেয়েছি তার সঙ্গে ৩ গুণ দিলে যে সংখ্যা দাঁড়ায় সেটাই ঋগ্বেদের যুদ্ধকালীন মোট জনসংখ্যার একটা আনুমানিক হিসাব। সেটা হচ্ছে এই : ৬৩,৯০,৭৬০×৩=২,০৩,৭২,২৮০ জন।

তবে এই সঙ্গে এই কথা যোগ করা দরকার যে, সিন্ধু-হরপ্পা সভ্যতার রাষ্ট্র এক বিশাল এলাকার উপর প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। সম্ভবত যুদ্ধের সময় রাষ্ট্রীয় ঐক্য ভেঙ্গে পড়েছিল। তবু এটি স্বাভাবিক যে, সভ্যতার ভাগ্য নির্ধারক এই যুদ্ধে উভয় পক্ষে চারপাশের বিভিন্ন অঞ্চলের বিরাট সংখ্যক সৈনিক যোগ দিয়েছিল। সুতরাং আমরা সিন্ধু উপত্যকার সমগ্র সৈন্যসংখ্যা থেকে খুব বেশী করে হিসাব ধরে সিন্ধু উপত্যকা বহির্ভূত হিসাবে অর্ধেক সৈন্য বাদ দিব। ফলে জনসংখ্যার হিসাবও অর্ধেক হবে। এই হিসাবেও জনসংখ্যার পরিমাণ এক কোটির উপর দাঁড়ায়।

এটাই সম্ভব যে, বৈদিক যুদ্ধের সময় সিন্ধু উপত্যকায় জনসংখ্যা ছিল এক কোটির ঊর্ধে। এই সংখ্যা ঊর্ধে দেড় কিংবা দুইকোটি পর্যন্ত হতে পারে। আজ থেকে প্রায় চার বা পৌনে চার হাজার বৎসর পূর্বের জন্য এই সংখ্যাকে খুব বেশী মনে হতে পারে। কিন্তু সিন্ধু উপত্যকার উন্নত নগর পরিকল্পনা এবং জলসেচব্যবস্থার শক্তির কথা বিবেচনা করলে এই জনসংখ্যাকে অবিশ্বাস্য মনে হবে না।

এই জনসংখ্যার জন্য প্রয়োজনীয় খাদ্যোৎপাদনের প্রযুক্তিও নিশ্চয় ছিল। কাজেই আমরা এটা বলতে পারি না যে, লাঙ্গল দ্বারা গভীর পদ্ধতিতে চাষ না করে আঁচড়া দিয়ে নরম পলি মাটিতে আলগা পদ্ধতিতে চাষ করা হত। তাহলে এই বিরাট জনসংখ্যার জন্য প্রয়োজনীয় খাদ্যোৎপাদন সম্ভব হত না। এটা ঠিক যে, সিন্ধু সভ্যতার লাঙ্গল এখনও পাওয়া যায় নি। কিন্তু ঋগ্বেদ থেকে আমরা জানতে পারি যে, তখন লাঙ্গল দ্বারাই জমি চাষ হত। যেমন অশ্বিদ্বয় দেবতার উদ্দেশ্যে ঋষি বলছেন, “হে অশ্বিদ্বয়! তোমরা আর্যদের জন্য লাঙ্গল দ্বারা চাষ ও যব বপন করিয়ে অন্নের জন্য বৃষ্টি বর্ষণ করে এবং বজ্র দ্বারা দস্যুকে বধ করে, তার প্রতি বিস্তীর্ণ জ্যোতি প্রকাশ করেছ” (১।১১৭।২১)। ঋগ্বেদে একাধিক স্থানে লাঙ্গলের উল্লেখ করা হয়েছে। লাঙ্গলের বৈদিক শব্দ হিসাবে বৃক (১।১১৭।২১, ৮।২২।৬) এবং সীর (১০।১০১।৩) ব্যবহৃত হয়েছে। ৪।৫৭ সূক্ত থেকে আমরা বলীবর্দসমূহের সাহায্যে ফাল বা ফলাযুক্ত লাঙ্গল দ্বারা কৃষি কার্যের স্পষ্ট বিবরণ পাই।

বস্তুত সিন্ধু সভ্যতার গণতান্ত্রিক ও উন্নত নগর পরিকল্পনা, যুদ্ধশক্তির তথা পেশীশক্তির অপ্রাধান্য এবং স্থিতিশীলতার একটি মূল ভিত্তিই হল, জনসংখ্যা ও নগরবৃদ্ধির সাথে তাল মিলিয়ে দীর্ঘকাল ব্যাপী ক্রমবর্ধমান হারে এবং অপেক্ষাকৃত সহজে বিপুল পরিমাণে খাদ্যশস্য উৎপাদন।

অতীতে উন্নত সভ্যতা নির্মাণের জন্য প্রায় সর্বত্র হিংস্র বলপ্রয়োগ দেখা যায়। এমন কি গণতান্ত্রিক গ্রীসের উন্নত নগর সভ্যতা দাঁড়িয়ে ছিল মূলত বর্বর দাসশ্রমের উপর যা পরবর্তীকালে গ্রীক সভ্যতার প্রভাবে গড়ে ওঠে রোমে ভয়ঙ্কর রূপ নিয়েছিল। কিন্তু সিন্ধুর যুদ্ধশক্তি তুলনায় দুর্বল। এটা ঠিক যে, তার নগরগুলি প্রাচীর ঘেরা। কিন্তু তা মূলত আত্মরক্ষার জন্য এবং সেই সঙ্গে বন্যার বিপদ ঠেকাবার জন্যও। বস্তুত গোটা সভ্যতায় অস্ত্রশস্ত্রের মানে ও পরিমাণে হিংস্র আক্রমণাত্মক ও সমরবাদী রাষ্ট্রের চিহ্ন নেই। এটা অবশ্য আমরা অনুমান করতে পারি যে, সিন্ধু সভ্যতার সেনাবাহিনী আয়তনে যত ক্ষুদ্র হোক তার যুদ্ধ দক্ষতা ও সামরিক শৃঙ্খলা ছিল অত্যন্ত উচ্চমানের। এ ক্ষেত্রেও আমরা সিন্ধু-হরপ্পার নগর পরিকল্পনার যান্ত্রিক ছন্দ, শৃঙ্খলা এবং গতিশীলতা কল্পনা করতে পারি।

সিন্ধু সভ্যতায় দাস ব্যবস্থা ছিল বলে আমরা অনুমান করতে পারি। তবে সম্ভবত তার ব্যবহার ছিল সীমিত। যদি ব্যাপক ও বর্বর দাস শ্রমের উপর সভ্যতা দাঁড়াত তাহলে নগর বিন্যাসে, অস্ত্রে, সামাজিক বৈষম্যের বিভিন্ন চিহ্নে তার প্রকাশ ঘটত। একইভাবে বলা যায় পরবর্তীকালের জাতিবর্ণ প্রথাও সেখানে ছিল না। থাকলে সিন্ধু-হরপ্পা সভ্যতার অস্তিত্বই সম্ভব হত না।

ভারতীয় পরিস্থিতিতে ব্যাপক সংখ্যক মানুষকে দাস করা সম্ভব ছিল না। কারণ চতুর্দিকে রয়েছে পালাবার এবং আশ্রয় নেবার মত ভূ-প্রাকৃতিক পরিবেশ। তাছাড়া বিভিন্ন বিচিত্র গাত্রবর্ণ, দেহগঠন, সংস্কৃতি ও ভাষার জনগোষ্ঠীসমূহের পাশাপাশি অবস্থানের ফলে এখানে খুব বেশী যুদ্ধ নির্ভর হয়ে কোন গোষ্ঠীর পক্ষে উন্নত সভ্যতার নির্মাণ এবং সামাজিক স্থিতিশীলতা অর্জন করা সম্ভব ছিল না। কাজেই এখানে সভ্যতা নির্মাণ করতে হলে শান্তির পথ অন্বেষণ করা সঙ্গত।

এমন ধারণা করবার কারণ আছে যে, নাগরিক সভ্যতা নির্মাণ এবং সিন্ধু উপত্যকায় জলনিয়ন্ত্রণমূলক কৃষিব্যবস্থা সংগঠনে যে বিপুল শ্রমশক্তির প্রয়োজন হয়েছিল তা প্রধানত যুদ্ধ দ্বারা বাইরে থেকে সংগ্রহ না করে সমাজের অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে সরবরাহ দ্বারা পূরণ করতে চাওয়া হয়েছিল। অর্থাৎ জনস্বাস্থ্যের উন্নতি ও জলসংখ্যা বৃদ্ধি দ্বারা শ্রমশক্তির প্রয়োজন পূরণ করা হতে পারে। নগর পরিকল্পনায় আন্ডারগ্রাউন্ড ড্রেন, কূপ, স্নানাগার ইত্যাদির উপর অত্যধিক গুরুত্ব দানের পিছনে যে ধর্মীয় বিশ্বাস বা প্রথাই কাজ করুক তার অন্তর্গত প্রেরণা যে মানুষের স্বাস্থ্য রক্ষা এবং আয়ু বৃদ্ধির সর্বোচ্চ প্রয়োজন থেকে এসেছিল সেই রকমই মনে হয়।

সম্ভবত এই সমাজে শত বৎসর আয়ু মানুষের অনায়ত্ত ছিল না। কারণ ঋগ্বেদের অনেক মন্ত্রে আমরা ঋষিগণকে দেবতাদের কাছে শত বৎসর আয়ু লাভের প্রার্থনা করতে দেখতে পাই। যেমন : “হে অসুর বরুণ! তুমি, দেবতাই হও বা মানুষই হও, তুমি সকলের রাজা। আমাদের শতবর্ষ অবলোকন করতে দাও যেন আমরা প্রাচীনদের উপভুক্ত আয়ু লাভ করতে পারি” (২।২৭।১০)। কিংবা ৩।৩৬।১০ ঋকে ইন্দ্রের নিকট প্রার্থনা জানিয়ে অপর একজন ঋষি (বিশ্বামিত্র)। বলছেন, “আমাদের জীবনের জন্য শত বৎসর প্রদান কর”।

এই সভ্যতায় শ্রমজীবীদের অবস্থা যে, শাসক বা ধনীদের মত উন্নত ছিল না তাতে সন্দেহ নেই। কঠোর শ্রম, দারিদ্র্য ও কষ্ট ইত্যাদিও নিশ্চয় কম বেশী তাদের জীবনে ছিল। কিন্তু তাহলেও অন্যান্য সকল সভ্যতার তুলনায় তাদের জীবন অনেক বেশী সহনীয় বলে মনে হয়।

জলনিয়ন্ত্রণব্যবস্থা দ্বারা সারা বৎসর যেমন কৃষি কার্যের নিশ্চিত ব্যবস্থা সম্ভব হয়েছিল তেমন এর দ্বারা প্রতি বৎসর নদীর ঢলে সৃষ্ট বন্যায়, যা বৃষ্টি দ্বারাও প্রবলতর হত, চারদিকে বিপুল পলি পড়ত। এর ফলে ভূমির উর্বরতা শত শত বৎসর চাষেও হ্রাসপ্রাপ্ত হয় নি।

এর ফল হল অল্পায়াসে প্রচুর পরিমাণ খাদ্যোৎপাদন। এই অব্যাহত ও ক্রমবর্ধমান খাদ্য ভাণ্ডার হাতে মওজুত থাকায় একদিকে যেমন সিন্ধু-হরপ্পান সভ্যতার নম্র ধারায় বিকাশ সম্ভব হয়েছে তেমন এটা তাকে দিয়েছে চারপাশে অব্যাহত বিস্তার ও বিকাশের শক্তি।

একদিকে নাগরিক সভ্যতার প্রভাব অপরদিকে শিল্প ও কৃষির বিপুল উৎপাদন সমগ্র সমাজে ইহবাদ ও প্রভোগবাদ (consumerism) যে কত শক্তিশালী করেছিল তার এক প্রমাণ ঋগ্বেদ। সমাজ ও সভ্যতার চরম সঙ্কট ও অবক্ষয়ের পর্যায়ে রচিত হলেও ঋগ্বেদের কোথায়ও মানব জীবনের জন্য হতাশার কোন সুর নেই। পরবর্তী কালের বিভিন্ন ধর্মীয় তত্ত্বে বৈষয়িক জীবনের প্রতি যে অনীহা বা ঘৃণা এবং ইহজীবনের পরিবর্তে পরলোক বা পরজন্ম চর্চার যে প্রবণতা দেখা যায় ঋগ্বেদে সেসব একেবারে নেই। “যেন আমরা অন্ন, বল ও দীর্ঘায়ু লাভ করতে পারি” (১।১৮১।৯, ১।১৮২।৮, ১।১৮৩।৬, ১।১৮৪।৬, ইত্যাদি) এই প্রার্থনা ও আকাঙ্খার সুর ঋগ্বেদে সর্বত্র ছড়িয়ে আছে। স্বর্গ বিশ্বাস আছে। সেখানে সুখ লাভেরও ইচ্ছা কদাচিত প্রকাশ পায় নি তা নয়। তবে সেটা নিয়ে ঋষিগণ তেমন একটা ভাবতেন বলে মনে হয় না। বস্তুত ঋগ্বেদের ঋষিদের মূল চিন্তা এবং কামনা হল, এই জীবনে সুখ, সম্ভোগ, সম্পদ, উত্তম গৃহ, নিরাপত্তা, পুত্র-পৌত্রদের কল্যাণ, শত্রুর বিরুদ্ধে জয় ইত্যাদি লাভ করা।

এর অর্থ হচ্ছে, যে সমাজ থেকে ঋগ্বেদ উদ্ভূত হয়েছে সকল ধর্মীয় বৈশিষ্ট্য ও প্রভাব সত্ত্বেও তা ছিল যথেষ্ট পরিমাণে ইহবাদী, জীবনবাদী এবং প্রভোগবাদী। এটা ভারতবর্ষের পরবর্তী কালের ইতিহাসের সঙ্গে মেলে না। অবশ্যই এটা ব্যাপক সংখ্যক মানুষের সুদীর্ঘ কালব্যাপী প্রাচুর্যময় কিংবা নিরাপদ, সহজ ও উন্নত জীবন যাপনের অভিজ্ঞতারই ফল। যার ফলে ঋষিগণ পরলোকে বা পরজন্মে সুখ সন্ধান না করে জীবনেই তা সন্ধান করেছেন।

স্বভাবতই আমাদের মনে প্রশ্ন জাগে, এমন একটা উন্নত ও বিস্ময়কর নাগরিক সভ্যতা কিভাবে উদ্ভূত হল? কি তার পটভূমি? কোন সূত্র ধরে আমরা এই পটভূমিতে উপস্থিত হতে পারি?

সিন্ধু-হরপ্পান সভ্যতারও পূর্ববর্তী স্তরে বা প্রাক-হরপ্পান স্তরেই নিশ্চয় এই সভ্যতার পটভূমি রচিত হয়েছিল যার সামান্য কিছু প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন আমাদের সামনে আছে। প্রাক-হরপ্পান পর্যায়ের নগরের ধ্বংসাবশেষ এবং মৃৎপাত্রাদি থেকে আমরা বুঝি যে, এই পর্যায়ও খুব বেশী আদিম কিংবা অনুন্নত ছিল না। সেখানেও ছিল একটা উদীয়মান নগর সভ্যতা। বলা যায় তখন চলছিল পরবর্তী উন্নততর ও সমধর্মী হরপ্পান স্তরে উল্লম্ফনের আয়োজন। কিন্তু এই আয়োজনের কোন লিখিত সূত্র কি আমাদের সামনে থাকা সম্ভব নয়?

আমরা আলোচনার শুরুতেই সভ্যতার পথে আদিম সমাজের অগ্রগমনের এক পর্যায়ের স্মারক হিসাবে মহাভারতকে চিহ্নিত করেছি। হয়ত এটা নগর সভ্যতা প্রতিষ্ঠার কিছু পরের এমন কোন সময়ের ঘটনার উপর রচিত যখন পুরাতন সামাজিক প্রথাগুলি অনেকাংশে বিদ্যমান। আমরা পলিয়ান্ড্রি বা বহুপতিত্বকে তার একটি প্রকাশ মনে করি। সুতরাং সেদিক থেকে এটিকে প্রাক-হরপ্পান সভ্যতার কোন এক পর্যায়ে স্থাপন করা যেতে পারে। বিশেষত মহাভারতের ঘটনাস্থল যখন সিন্ধু উপত্যকা থেকে বেশী দূরে নয় তখন এই সম্ভাবনা আরও বেশী হয়ে দেখা দেয়।

অন্যদিকে সিন্ধু-হরপ্পান সভ্যতার উত্থান ও সম্প্রসারণকে একটা বিস্ফোরণজাত ঘটনা বলে মনে হয়১৬। মনে হয় তা যেন এক বিস্ফোরণ দ্বারা শুরু হয়ে বিস্ফোরণের মত ছড়িয়েছে। এই বিষয়টিও আমাদের চিন্তায় আসে। মহাভারত সে যুগের প্রেক্ষিতে একটি মহাযুদ্ধের ঘটনার উপর রচিত। এমন একটি মহাযুদ্ধের পিছনে যেমন এক বিরাট ও প্রচণ্ড সামাজিক দ্বন্দ্ব ও ওলটপালট ক্রিয়াশীল থাকবার কথা তেমন এই যুদ্ধের ফল শুধু ধ্বংসাত্মক না হয়ে ইতিবাচকও হতে পারে। অর্থাৎ এই রকম যুদ্ধের মধ্য দিয়ে হরপ্পা সভ্যতার সংগঠক-শক্তির উত্থানের সম্ভাবনা উড়িয়ে দেওয়া যায় না। উপরন্তু আমরি ও কোটদিজিতে খনন চালিয়ে প্রাক-হরপ্পান থেকে হরপ্পান পর্যায়ে উত্তরণের সময় অগ্নি দ্বারা প্রাক-হরপ্পান নগর ধ্বংসের প্রমাণ পাওয়া গেছে১৭। সুতরাং বোঝা যায় যে, সিন্ধু-হরপ্পান সভ্যতা ও সংস্কৃতির উত্থান কিংবা প্রসার সম্পূর্ণ শান্তিপূর্ণ উপায়ে হয় নি। সেখানে বিরাট আকারে কোন যুদ্ধ থাকতে পারে।

সর্বোপরি মহাভারতের মধ্যে যত উপকথা ও অযৌক্তিক-অবাস্তব ঘটনার বর্ণনা থাক এটা নিঃসন্দেহে প্রাচীন কালের এক প্রচণ্ড সামাজিক ঘটনার অভিঘাতের ফল। অর্থাৎ মহাকাব্যের সবটা মিথ্যা হতে পারে না। অন্তত এমন একটি যুগান্তকারী ঘটনা ঘটেছিল যা তৎসময়ের প্রেক্ষিতে এক বিরাট ভূভাগের সমগ্র জনসমষ্টির মনকে এমনভাবে ঝাঁকুনি দিয়েছিল যে তার ঢেউ হাজার হাজার বৎসর ধরে প্রজন্মের পর প্রজন্ম অতিক্রম করে মানুষের মনে সঞ্চারিত হয়েছে। এই ধরনের কোন ঘটনা না ঘটলে তা নিয়ে মহাকাব্য লেখবার প্রেরণা কোন কবি পেত না। গুজব বা গালগল্প বেশীদিন টেকে না। যার থাকে না কোন বাস্তব ভিত্তি তাকে যুগ যুগ রক্ষা করার জন্য শেষ পর্যন্ত কোন সামাজিক তাগিদ বা প্রেরণা থাকতে পারে না।

সুতরাং মহাভারতের সমস্ত কাহিনীর ভিত্তিমূলে যে এক প্রচণ্ড আলোড়নকারী ঐতিহাসিক ঘটনার বীজ আছে তাতে সামান্য সন্দেহও নেই। এই ঐতিহাসিক ঘটনার বীজ কিভাবে এবং কোন প্রেক্ষিতে জন্ম নিয়েছিল এবং তার সঙ্গে সিন্ধু সভ্যতার সম্পর্ক আছে কি না এবং তা থাকলে কি ধরনের এইসব প্রশ্নের উত্তর সন্ধানে এবার আমরা মহাকাব্য মহাভারতে১৮ প্রবেশ করব।

 

৭। মহাভারত ও সিন্ধু সভ্যতা

এক সুবিশাল মহাকাব্য মহাভারতের মধ্য থেকে ইতিহাসের উপকরণ বের করা সহজ সাধ্য নয়। তার বেদের মত অলঙ্খনীয়তা বা অপরিবর্তনীয়তা নেই। কারণ তাতে ধর্মীয় উপাদান থাকলেও তা ধর্মগ্রন্থ নয়। ফলে যুগে যুগে তাতে প্রক্ষেপণ দ্বারা পরিবর্তন ও পরিবর্ধন ঘটেছে। তবু তার মূল একটা কাঠামো বা কাহিনী বিন্যাস আছে যার ভিতর থেকে আমাদেরকে প্রয়োজনীয় উপকরণ খুঁজে বের করবার চেষ্টা করতে হবে।

মহাভারত মূলত পঞ্চপাণ্ডব ও কৌরবদের মধ্যকার যুদ্ধ কাহিনী। তার নায়ক হিসাবে আপাতদৃষ্টিতে পঞ্চপাণ্ডবরা উপস্থিত হলেও একটু লক্ষ্য করলে বোঝা যায় যে, এই বিশাল মহাকাব্যের সবচেয়ে শক্তিশালী চরিত্র হলেন কৃষ্ণ। বোঝা যায় অনেক ক্ষেত্রে অন্তরালবর্তী হলেও মহাভারতের যুদ্ধের মূল পরিকল্পক ও সংগঠক হলেন কৃষ্ণ।

সুতরাং আমরা প্রথমে মহাভারতের কেন্দ্রীয় চরিত্র কৃষ্ণের উপর মনোযোগ নিবদ্ধ করব। মহাভারতের ভগবদ্গীতা পর্ব পাঠ করলে বহুদেবতা পূজা ও পৌত্তলিকতা বিরোধী এবং একেশ্বরবাদী এক ধর্মের প্রবক্তাকে চিনতে অসুবিধা হয় না। বোঝা যায় প্রক্ষেপণে এবং পরবর্তী ব্রাহ্মণবাদী মতবাদের সংমিশ্রণ দ্বারা গীতায় অনেক পরিবর্তন ঘটানো হয়েছে। কিন্তু যাঁরা একটা চিন্তার বিকাশের নিয়ম বোঝেন তাঁরা সহজেই ধারণা করবেন যে, গীতায় যা আছে তার সবটা এই ধরনের এক চিন্তার সংগঠকের কথা হতে পারে না।

গীতার মূল তত্ত্ব নির্মাণের জন্য চিন্তার যে অসাধারণ শক্তি এবং গতির প্রয়োজন সেই শক্তি ও গতির অধিকারী ব্যক্তির পক্ষে গোঁজামিল দেওয়া অসম্ভব। জাতিভেদ বা ব্রাহ্মণের শ্রেষ্ঠত্ব কিংবা সন্ন্যাস ও কর্মের সমন্বয় মূলক বক্তব্যের মত বক্তব্যগুলি যে গীতার মূল ভাবপ্রেরণার সঙ্গে খাপ খায় না এটা গীতা মনোযোগ দিয়ে পড়লে বোঝা যায়। বস্তুত গীতায় পরবর্তী কালে আরোপজনিত বেশ কিছু গোঁজামিল ও স্ববিরোধ ধরা পড়ে যা নিয়ে এখানে আলোচনার প্রয়োজন নেই। আমরা যে বিষয়টি উল্লেখ করতে চাই তা হল গীতার একেশ্বরবাদী এবং বিস্ময়কর রকম কর্মবাদী বক্তব্য বেদোত্তর ভারতীয় সমাজ পরিস্থিতির সঙ্গে আর কখনও খাপ খায় নি। এটা ঠিক যে গীতা ও কৃষ্ণের প্রভাব যুগ যুগ ধরে ভারতবর্ষে গভীর হয়ে থেকেছে। যুগে যুগে বহু চিন্তাশীল মানুষ ও সমাজ সংস্কারক জাতিবর্ণবাদ ও বহুদেবতাবাদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করতে গিয়ে কৃষ্ণকে অবলম্বন করেছেন। কিন্তু কৃষ্ণকে ধারণ করার মত সমাজজমি পাওয়া যায় নি বলে কৃষ্ণের তত্ত্বের গভীর প্রভাব থেকে গেলেও তা আর কখনই উপমহাদেশে প্রবল ধারা হিসাবে দাঁড়াতে পারে নি।

ভারতীয় ইতিহাসের কোন জ্ঞাত সময়ে আমরা রহস্যপুরুষ কৃষ্ণকে খুঁজে পাই না। কারণ তিনি আমাদের জানা ঐতিহাসিক যুগের মানুষ নন। কিন্তু আমরা যদি এই কর্মবাদী ও একেশ্বরবাদী ধর্ম প্রবক্তার অস্তিত্বকে সিন্ধু-হরপ্পার সভ্যতার পটভূমির সঙ্গে মেলাতে চাই তবে সেটা বিস্ময়করভাবে মিলে যায়।

বস্তুত সবদিক বিচার করলে কৃষ্ণকে চেনা যায় আমাদের আলোচ্য হরপ্পার সভ্যতার ধর্মের প্রফেট হিসাবে। সিন্ধু-হরপ্পান সমাজে রাষ্ট্র ও ধর্মের পারস্পরিক নৈকট্য ও সংযুক্তির পাশে স্বাতন্ত্র্যের বা দূরত্বের যে অস্তিত্ব আমরা অনুভব করি কৃষ্ণ সেই অস্তিত্বের প্রমাণ।

কৃষ্ণ একেশ্বরবাদী প্রফেট কিন্তু মুসা বা মোহাম্মদের মত সেনাপতি এবং রাষ্ট্রনেতা হন নি। কৃষ্ণ এক মহাযুদ্ধের অন্যতম মূল পরিকল্পক ও সংগঠক। পঞ্চপাণ্ডবের এক পাণ্ডব অর্জুনের রথের সারথী হয়ে যুদ্ধে অংশগ্রহণকারীও। কিন্তু তিনি যুদ্ধে সেনাপত্য করেন নি। কৃষ্ণ পাণ্ডব রাষ্ট্রের অন্যতম মূল স্থপতি। কিন্তু নিজে রাষ্ট্রক্ষমতার ভাগ নিতে চেষ্টা করেন নি। যুধিষ্ঠিরকে ক্ষমতায় আরোহণ করিয়ে তিনি দূরে চলে গেছেন। কিন্তু সন্ন্যাসী হয়ে অরণ্যে যান নি। তিনি ফিরেছেন নিজ সংসারে। কৃষ্ণ একজন প্রফেট। কিন্তু বহু পরবর্তীকালের বুদ্ধ, মহাবীর কিংবা যীশুর মত সংসার ত্যাগী সন্ন্যাসী ছিলেন না। তিনি ছিলেন সংসারী প্রফেট। সংসারী ও বৈষয়িক হয়েও যিনি রাষ্ট্রক্ষমতা এবং বৈষয়িক জীবনের ক্ষুদ্র গণ্ডীর মধ্যে নিজেকে বন্দী না করে বৃহত্তর জীবনের জন্য চিরমুক্ত রেখেছেন এমন এক বিরাট ধর্মনেতা ও কর্মী মানুষকে কেবলমাত্র সিন্ধু-হরপ্পা সভ্যতার ধর্মীয় ও রাষ্ট্রীয় উত্থান প্রক্রিয়ার সঙ্গেই মেলানো সম্ভব।

সুতরাং আমরা ঋগ্বেদে কৃষ্ণের সূত্র সন্ধান করব। কারণ সিন্ধু-হরপ্পা সভ্যতার ধর্ম যদি কৃষ্ণ প্রবর্তিত হয় তবে ঋগ্বেদে শত্রু অথবা মিত্র, মানুষ অথবা দেবতা যে রূপেই হোক তাঁর উল্লেখ থাকবার কথা। ১।১০১।১ ঋক কিংবা ৮।৯৬।১৩-১৫ ঋকসমূহে ইন্দ্র তথা বৈদিক শক্তির শত্রু হিসাবে কৃষ্ণ নামের উল্লেখ পাই। তাঁরা দুইজন যোদ্ধা হতে পারেন যাঁদের বিরুদ্ধে বৈদিক সেনাবাহিনী যুদ্ধ করেছিল। তাছাড়া ঋগ্বেদের মন্ত্রে এক কৃষ্ণের নামোল্লেখ পাই যাঁর পুত্র বিশ্বকায় ঋষি (১।১১৬।২৩)। ঋগ্বেদের মন্ত্র রচয়িতা কৃষ্ণও একজন কিংবা দুইজন ঋষি আছেন। কিন্তু এঁদের কাউকে হরপ্পান সভ্যতার ধর্মের প্রফেট মনে করবার কারণ নেই।

বিষয়টিকে আমরা আর কিছু পরে পুনরায় বিচার করব। এখন আমরা দেখি সিন্ধু সভ্যতার সঙ্গে পঞ্চপাণ্ডবের কোন যোগসূত্র আছে কি না।

বস্তুত আজ আমরা যেভাবে মহাভারতকে পাচ্ছি তার অতীত রূপ তেমন ছিল মনে করার কারণ নেই। যদিও মূল ঘটনায় পরিবর্তনের সম্ভাবনা কম তবে উপস্থাপনায় অনেক পরিবর্তন ঘটেছে এবং সেই সঙ্গে কাহিনীর অনেক বিন্যাসেও। যেমন ধরা যাক ধৃতরাষ্ট্রের স্ত্রী গান্ধারীর গর্ভে একশত পুত্র ও এক কন্যা জন্মাবার কথা। এটা সম্পূর্ণই অবিশ্বাস্য। কিংবা ধরা যাক পঞ্চপাণ্ডবের জন্ম কথা। নামে পাণ্ডুর পুত্র হলেও কেউ তাঁর ঔরসজাত নন। পাঁচ ভাই ভিন্ন ভিন্ন দেবতা পিতার ঔরসজাত। কাজেই আমরা ভিন্ন সম্ভাবনার ব্যাখ্যা করতে পারি।

এমন কি হতে পারে না যে, চরিত্রগুলি মূলত ছিল বিভিন্ন উপজাতি বা গোত্রের প্রতিনিধি এবং এইসব উপজাতি সম্মিলিত হয়ে একটি কনফেডারেসি বা সংযুক্ত রাষ্ট্র গঠন করেছিল? ধৃতরাষ্ট্র হয়ত কোন ব্যক্তির নাম নয়, এই কনফেডারেসি বা সংযুক্ত রাষ্ট্রের প্রধান কিংবা রাষ্ট্রপতির নাম। ধৃতরাষ্ট্রের অর্থও কিন্তু তাই হয় । ধৃতরাষ্ট্রকে অন্ধ বলা হয়। দুর্যোধন, দুঃশাসন ইত্যাদি একপক্ষ অর্থাৎ কৌরব পক্ষের প্রতি তাঁর পক্ষপাতীত্ব কিংবা আনুকূল্যের কারণেও তো তাঁকে প্রথম দিকে স্নেহান্ধ বলা হতে পারে যা কাল ক্রমে তাঁকে বহুপরবর্তী কবিদের কল্পনায় অন্ধে পরিণত করেছে।

এমন সম্ভাবনাও যথেষ্ট যে, এই কনফেডারেসি পরিচালিত হত “অলিগার্কি” বা স্বল্পতন্ত্র অথবা খুব সীমিত পর্যায়ে গণতন্ত্র দ্বারা যার সর্বোচ্চ প্রধান ধৃতরাষ্ট্র হলেও নির্বাহী ক্ষমতার অধিকারী তিনি ছিলেন না। হয়ত প্রধান মন্ত্রী জাতীয় কেউ এই মূল ক্ষমতার অধিকারী হতেন। হয়ত এই ক্ষমতা দুর্যোধনের হাতে চলে গিয়েছিল।

এইভাবে পারিবারিক দ্বন্দ্ব হিসাবে না দেখে একই রাষ্ট্র কিংবা রাষ্ট্র জোটের অভ্যন্তরীণ সামাজিক দ্বন্দ্ব হিসাবে দেখলে আমরা মহাভারতের যুদ্ধের ভিন্ন ও গভীরতর তাৎপর্য খুঁজে পেতে পারি। কোন পারিবারিক দ্বন্দ্ব বা ঘটনা দ্বারা সমগ্র সমাজকে এভাবে নাড়া দিতে পারবার কথা নয়। একই বংশের ভিতরে রাজা বদলের জন্য কেন সেই যুগের এক বিশাল ভূভাগের উপজাতি বা জাতিগুলি সেই সময় ও পরিস্থির বিচারে এক মহাযুদ্ধে জড়িত হবে? অবশ্যই এটা এক তীব্র সামাজিক দ্বন্দ্বের পরিণতি যার প্রস্তুতি চলছিল অনেক কাল ধরে এক বিরাট ও বিকাশমান সমাজ কাঠামোর গভীর অভ্যন্তরে। আমরা অনুমান করতে পারি যে, এই মহাযুদ্ধ দ্বারা সমাজের প্রচলিত ব্যবস্থা ও তার নেতৃত্বের শক্তির পতন ঘটে এবং এক নূতন সমাজ ও তার নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়। এটা সম্ভব যে, এই নূতন শক্তিই পরবর্তী ও উন্নতর সিন্ধু সভ্যতার মূল সংগঠক। মহাভারতের যুদ্ধের মত বিশাল ঘটনার মধ্য দিয়েই বিশালায়তনে সিন্ধু সভ্যতার সংগঠকদের পক্ষে সামাজিক ও রাজনৈতিক কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করা স্বাভাবিক। এত প্রচণ্ড ঘটনার বিস্ফোরণই সম্ভবত সিন্ধু সভ্যতার বিস্ফোরণের মত বিস্তারের শক্তি যুগিয়েছিল। অর্থাৎ নব পর্যায়ে সিন্ধু সভ্যতার উত্থানের পিছনে এক বিরাট সামাজিক-রাজনৈতিক বিপ্লব থাকাই স্বাভাবিক যা কালক্রমে একটি পারিবারিক যুদ্ধ হিসাবে উপকথায় রূপ নিতে পারে।

পলিয়ান্ড্রির সাক্ষ্য থেকে অনুমেয় যে, কৌরব পক্ষের তুলনায় পাণ্ডবরা সভ্যতায় নূতন আগন্তুক বা পরবর্তী পর্যায়ে প্রবেশকারী। হতে পারে যে, তাঁদের এই অপেক্ষাকৃত পশ্চাৎপদ পটভূমির কারণে তাঁদের সামাজিক মর্যাদা তুলনায় কম ছিল। হয়ত ক্ষমতার দ্বন্দ্বে প্রাথমিক পর্যায়ে পিছিয়ে পড়বার এটা একটা প্রধান কারণ। কিন্তু শেষ পর্যন্ত পাণ্ডব পক্ষই বিজয়ী।

কাজেই যদি নবসিন্ধু তথা হরপ্পা সভ্যতার সমাজ ও রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠাতা পঞ্চপাণ্ডব হন তবে এই সভ্যতার ধর্মও হওয়া উচিত তাঁদের ধর্ম যে ধর্ম আবার প্রবর্তিত হওয়া উচিত কৃষ্ণ দ্বারা। সুতরাং এখন আমরা পঞ্চপান্ডবের ধর্মীয় পরিচয় বুঝবার চেষ্টা করব।

মহাভারত থেকে আমরা জানছি যে পঞ্চপাণ্ডব পাণ্ডুর পুত্র হলেও তাঁরা কেউ তাঁর ঔরসজাত নন। জ্যেষ্ঠ যুধিষ্ঠির হচ্ছেন ধর্মের ঔরসজাত। ভীম বায়ুর ঔরসজাত। অর্জুন ইন্দ্রের ঔরসজাত। এই তিনজন পাণ্ডুর স্ত্রী কুন্তীর গর্ভজাত। এবং নকুল ও সহদেব নামে সর্বকনিষ্ঠ দুই পাণ্ডব পাণ্ডুর দ্বিতীয় স্ত্রী মাদ্রীর গর্ভজাত এবং অশ্বিনী কুমারদ্বয় নামক দুই দেবতার ঔরসজাত।

সুতরাং আমরা পঞ্চপাণ্ডবের জন্মবৃত্তান্ত থেকে ঋগ্বেদের প্রধান কয়েকজন দেবতার নাম পাচ্ছি। ইন্দ্র এবং বায়ু এই দুইজনই বৈদিক দেবতা। অশ্বিনীকুমারদ্বয় যে গুরুত্বপূর্ণ বৈদিক যুগল দেবতা অশ্বিদ্বয় নামের রূপান্তর মাত্র তা বুঝতে অসুবিধা হয় না। মহাভারতে ভীমকে যেমন বায়ুর পুত্র বলা হয়েছে তেমন তাকে মারুতের অংশে জন্ম প্রাপ্তও বলা হয়েছে। মারুতকেও বৈদিক দেবতা মরুৎগণের রূপান্তর রূপে সহজেই চেনা যায়।

আমরা কি এই দেবতাদেরকে পাণ্ডবদের জনক হিসাবে চিন্তা না করে উপাস্য দেবতা হিসাবে চিন্তা করতে পারি না? তাহলে এটা সহজবোধ্য হয় যে, পঞ্চপাণ্ডব নামে পাঁচ উপজাতি বা গোত্রের উপাস্য কিংবা তাদের সঙ্গে সংযুক্ত দেবতাদেরকে এইভাবে জন্মদাতায় পরিণত করা হয়েছে।

কিন্তু সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন থেকে যাচ্ছে যুধিষ্ঠিরের ক্ষেত্রে। কারণ বিজয়ী পক্ষের প্রধান এবং নূতন রাষ্ট্রপ্রধান যুধিষ্ঠিরের জনক তথা উপাস্য দেবতার নাম হল ধর্ম। এই নামে কোন দেবতা ঋগ্বেদে নেই। অথচ মহাভারতে ধর্মকে সুরশ্রেষ্ঠ বা শ্রেষ্ঠ দেবতা বলা হয়েছে। এটা কি এই হতে পারে না যে, হরপ্পা সভ্যতার মূল ধর্ম বরুণ পূজা বা বরুণের ধর্ম বোঝাতে ধর্ম ব্যবহার করা হয়েছে? হাঁ, এটাই উত্তর যে, যুধিষ্ঠির তথা রাষ্ট্রের প্রধান উপাস্য দেবতা বরুণকে আড়াল করার জন্য তাঁর পরিবর্তে ধর্ম শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে। বরুণ বিরোধী তথা একেশ্বরবাদ বিরোধী বিজয়ী বৈদিক ঋষিদের উত্তরাধিকারী ব্রাহ্মণরা হরপ্পার ধর্মের প্রভাব মুছে ফেলার জন্য পরবর্তী কালে এইভাবে বরুণের নাম আড়াল করেছে এমন মনে করাই যুক্তিযুক্ত।

এবার আমাদের কাছে মহাভারতের মূল রহস্য উন্মোচিত হচ্ছে। আমরা সিন্ধু সভ্যতার আর একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ সূত্র খুঁজে পেলাম। মহাভারতের সঙ্গে যে হরপ্পা সভ্যতার ঘনিষ্ঠ সংযোগ রয়েছে এই বিষয়ে আমরা মূলত নিঃসংশয় হচ্ছি।

এবার আমরা কৃষ্ণের রহস্য উদ্ঘাটন করতে ঋগ্বেদের দিকে দৃষ্টি ফেরাব। যেহেতু আমরা যুধিষ্ঠিরের উপাস্য দেবতা বরুণকে খুঁজে পেয়েছি, যিনি সিন্ধু-হরপ্পার সর্বোচ্চ দেবতা এবং যাঁর ধর্ম সিন্ধুর রাষ্ট্রীয় ধর্মও, সেহেতু এখন আমরা কৃষ্ণের প্রকৃত বা বৈদিক নামও খুঁজে পাবার আশা করতে পারি। অর্থাৎ এটাই সম্ভব যে, বরুণের ক্ষেত্রে যে কৌশলের আশ্রয় নেওয়া হয়েছে কৃষ্ণের নিরাকারবাদী, একেশ্বরবাদী ও অবৈদিক ধর্মের প্রভাব জনগণের মন থেকে যতটা সম্ভব মুছবার জন্য কৃষ্ণের ক্ষেত্রেও সেই কৌশলের আশ্রয় নেওয়া হয়েছে।

কিন্তু বরুণকে বের করতে পারায় কৃষ্ণের প্রকৃত নাম বের করাও এখন আমাদের জন্য সহজতর হওয়া উচিত। কারণ যে নামেই হোন কৃষ্ণই যদি বরুণ নামে ঈশ্বরের উপাসনা এবং বরুণকেন্দ্রিক ধর্মের প্রতিষ্ঠাতা হন তবে তাঁর নাম অবশ্যই ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত হবে বরুণের সঙ্গে। যেহেতু ঋগ্বেদ বরুণকে বর্জন করে নি সেহেতু কৃষ্ণকেও বর্জন করতে পারবে না।

কিন্তু ঋগ্বেদে আমরা বরুণের খুব ঘনিষ্ঠ যে নাম পাচ্ছি তিনি হলেন দেবতা মিত্র। আমরা ইতিপূর্বে উল্লেখ করেছি যে, ঋগ্বেদে বরুণ ও মিত্রকে বহুসময় একত্রে উল্লেখ করা হয়েছে। মিত্র ও বরুণকে একত্রে স্তুতি করতে গিয়ে মিত্রাবরুণ বলা হয়েছে। মিত্র ও বরুণের উদ্দেশ্যে রচিত কিছু ঋক মিত্রের গুরুত্ব এবং বরুণের সঙ্গে তাঁর সংযুক্তি বা ঘনিষ্ঠতা স্পষ্ট করে। যেমন :

“হে ঋত্বিকগণ! চিরন্তন মিত্রাবরুণের উদ্দেশ্যে প্রশংসনীয় ও প্রবৃদ্ধ পরিচর্যা কর এবং হব্য প্রদানে কৃতনিশ্চয় হও। মিত্রাবরুণ যজমানদের সুখদানের কারণ এবং সুস্বাদু হব্য ভক্ষণ করেন। এঁরা সম্রাট, এঁদের জন্য ঘৃত গৃহীত হয়। প্রতি যজ্ঞেই এঁদের স্তব হয়। এঁদের শক্তি কেউ অতিক্রম করতে পারে না এবং এঁদের দেবত্বে কেউ সন্দেহ করে না” (১।১৩৬।১) “হে স্থূল মিত্র ও বরুণ! তোমরা বস্ত্র ধারণ কর, তোমাদের সৃষ্টি সুন্দর ও দোষ রহিত। তোমরা সমস্ত অনৃত (পাপ বা অন্যায়) বিনাশ কর এবং ঋতের সাথে যুক্ত হও” (১।১৫২।১), “… তোমাদের সন্তান আদিত্য ঋতের পূরণ ও অনৃতের বিনাশ করে সমস্ত জগতের ভার বহন করেন” (১।১৫২।৩)।

“হে মিত্র ও বরুণ! স্তোতৃগণ তোমাদের অনুগ্রহে রাজপদ লাভ করে” (৫।৬২।৩)।

রাষ্ট্রক্ষমতার সঙ্গে মিত্র ও বরুণের গভীর সম্পর্ক প্রকাশ করছে উপরোক্ত ঋকটি।

“হে মিত্র ও বরুণ! তোমরা যজ্ঞভূমিতে যে যজমানকে রক্ষা কর, শোভন স্তুতিকারী সে যজমানের প্রতি দানশীল হও ও তাকে রক্ষা কর। কারণ তোমরা রাজা ও ক্রোধহীন হয়ে ধন ও সহস্র স্তম্ভ সমন্বিত সৌধ ধারণ কর” (৫।৬২।৬)।

উপরোক্ত ঋকে উভয় দেবতাকে রাজা বলা হচ্ছে এবং এখানেও আমরা সহস্র স্তম্ভ সমন্বিত সৌধের বিবরণ পাচ্ছি।

“মিত্র পাপিষ্ঠ স্তবকারীকেও বিশাল গৃহে গমনের উপায় প্রদান করেন, হিংসাকারী সেবকও দেব মিত্রের অনুগ্রহ লাভ করে (৫।৬৫।৪), আমরা যেন সর্বদা মিত্রের প্রশস্ত রক্ষার ভাজন হই, হে মিত্র! আমরা তোমা কর্তৃক রক্ষিত ও নিষ্পাপ হয়ে যেন যুগপৎ বরুণের পুত্র স্বরূপ হই (৫।৬৫।৫), হে মিত্র ও বরুণ! .... আমাদের পরিত্যাগ করো না” (৫।৬৫।৬)। বরুণ কিংবা মিত্র প্রসঙ্গে আমরা কয়েকবার সহস্রস্তম্ভবিশিষ্ট কিংবা সহস্রদ্বারবিশিষ্ট গৃহ, স্থান বা সৌধের উল্লেখ পাই। উপরের ঋকে পাচ্ছি বিশাল গৃহের উল্লেখ। এই ঋকে মিত্রের অনুগ্রহের মাধ্যমে বরুণের অনুগ্রহ লাভের প্রার্থনা লক্ষণীয়।

“ যে মিত্র বরুণ উভয়েই সকলের অধীশ্বর, বারিবর্ষণকারী, দীপ্তিমান ও দেবগণের মধ্যে সমধিক স্তবার্হ” (৫।৬৮।২)।
“হে স্বর্গীয় আদিত্যদ্বয়! তোমরা স্বর্গলোক ও ভূলোকের ধারণকারী, আমি তোমাদের উভয়কে পূজা করছি। হে মিত্র ও বরুণ! অমর দেবগণও তোমাদের স্থায়িকার্য-এর উচ্ছেদ সাধন করতে পারেন না” (৫।৬৯।৪)। “মিত্র ও দাতা বরুণকে হোমের দ্রব্য নিবেদন কর। তাঁরা দুজন রাজার রাজা, তাঁরা কখন অমনোযোগী হন না, তাঁদের ধাম উত্তমরূপে সংধারিত হয়ে অত্যন্ত দীপ্তি পাচ্ছে। দ্যাবা পৃথিবী তাদের নিকট যাচকের ভাবে অবস্থিত আছেন” (১০।৬৫।৫)।

উপরের মন্ত্রগুলি দ্বারা হরপ্পান সভ্যতায় বরুণ ও মিত্র এই উভয় দেবতার সর্বোচ্চ অবস্থান সম্পর্কে সন্দেহ থাকে না। এখন স্বাভাবিকভাবে মনে প্রশ্ন আসে যে, বরুণ ও মিত্র এই উভয়কে একসঙ্গে এমনভাবে উপস্থিত করা হচ্ছে যেন তারা দুইজন এক দেবতার দুই নাম কিংবা দুই ভিন্ন দেবতা যাদের মধ্যে বরুণ প্রধান হলেও অপরজন মিত্র অত্যন্ত শক্তিশালী এবং বরুণের অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ এবং এই উভয় দেবতা অবিচ্ছেদ্য। সুতরাং এখানে আমরা কিভাবে প্রফেট কৃষ্ণকে খুঁজে পাব?

এই প্রশ্নের উত্তরের জন্য আমরা অন্যান্য ধর্মের দিকে দৃষ্টি দিতে পারি। ইহুদী ধর্মের ঈশ্বর ইয়াহ্ওয়েহ্-এর (ইংরাজীতে জিহোবা) প্রত্যক্ষ সম্পর্ক শুধু মুসা বা মোশির সঙ্গে। ঈশ্বর তাঁর সঙ্গে সরাসরি কথা বলে তাঁর বিধান দিয়েছেন। সুতরাং ইয়াহ্ওয়েহর প্রতি আনুগত্যের অর্থ হল মোশির প্রতিও আনুগত্য।

খ্রীস্টধর্মে আমরা ঈশ্বর ও প্রফেটের সম্পর্ক আরও ঘনিষ্ঠ দেখতে পাই। বস্তুত ঈশ্বরের প্রতি আনুগত্যের মাধ্যম হলেন যীশু। বাইবেল১৯ থেকে কিছু উদ্ধৃতি দিলে ঈশ্বর ও যীশুর সম্পর্কের ঘনিষ্ঠতা এবং যীশুর গুরুত্ব স্পষ্ট হবে।

“খ্রীস্ট যীশুতে যে ভাব ছিল, তাহা তোমাদিগেতেও হউক। ঈশ্বরের স্বরূপবিশিষ্ট থাকিতে তিনি ঈশ্বরের সহিত সমান থাকা ধরিয়া লইবার বিষয় জ্ঞান করিলেন না, কিন্তু আপনাকে শূন্য করিলেন, দাসের রূপ ধারণ করিলেন, মনুষ্যদের সাদৃশ্যে জন্মিলেন; এবং আকার প্রকারে মনুষ্যবৎ প্রত্যক্ষ হইয়া আপনাকে অবনত করিলেন; মৃত্যু পর্যন্ত, এমন কি, ক্রুশীয় মৃত্যু পর্যন্ত আজ্ঞাবহ হইলেন। এই কারণ ঈশ্বর তাঁহাকে অতিশয় উচ্চপদান্বিত করিলেন, এবং তাঁহাকে সেই নাম দান করিলেন, যাহা সমুদয় নাম অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ; যেন যীশুর নামে স্বর্গ মর্ত্য পাতাল নিবাসীদের “সমুদয় জানু পাতিত হয় এবং সমুদয় জিহ্বা যেন স্বীকার করে” যে, যীশু খ্রীস্টই প্রভু, এইরূপে পিতা ঈশ্বর যেন মহিমান্বিত হন।”

(ফিলিপীয়াদের প্রতি প্রেরিত পৌলের পত্র। ২;৫-১১)।

“আর আমরা দেখিয়াছি ও সাক্ষ্য দিতেছি যে, পিতা পুত্রকে জগতের ত্রাণকর্তা করিয়া প্রেরণ করিয়াছেন। যে কেহ স্বীকার করিবে যে, যীশু ঈশ্বরের পুত্র, ঈশ্বর তাহাতে থাকেন, এবং সে ঈশ্বরে থাকে। আর ঈশ্বরের যে প্রেম আমাদিগেতে আছে, তাহা আমরা জানি ও বিশ্বাস করিয়াছি। ঈশ্বর প্রেম; আর প্রেমে যে থাকে, সে ঈশ্বরে থাকে, এবং ঈশ্বর তাহাতে থাকেন।”

(যোহনের প্রথম পত্র। ৪;১৪-১৬)।

“তখন যীশু নিকটে আসিয়া তাঁহাদের সহিত কথা কহিলেন, বলিলেন, স্বর্গে ও পৃথিবীতে সমস্ত কর্তৃত্ব আমাকে দত্ত হইয়াছে।”

(মথি। ২৮;১৮)

ইসলামে আল্লাহকে সমস্ত ক্ষমতার অধিকারী বলা হলেও শুধু বিমূর্ত আল্লাহর প্রতি আনুগত্য প্রদান করতে নির্দেশ দেওয়া হয় নি, একই সঙ্গে তাঁর রাসূল বা প্রতিনিধি স্বরূপ মোহাম্মদের প্রতিও আনুগত্য প্রদান করতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে:২০

“মুমিনদিগের (বিশ্বাসীদের) উক্তি তো এই যে – যখন তাহাদিগের মধ্যে ফয়সালা করিয়া দিবার জন্য আল্লাহ এবং তাঁহার রাসূলের দিকে আহ্বান করা হয় তখন তাহারা বলে, ‘আমরা শ্রবণ করিলাম ও মান্য করিলাম।’ আর উহারাই তো সফলকাম। যাহারা আল্লাহ ও তাঁহার রাসূলের আনুগত্য করে, আল্লাহকে ভয় করে ও তাঁহার অবাধ্যতা হইতে সাবধান থাকে তাহারাই সফলকাম।”

(২৪ সূরা নূর : ৫১,৫২ আয়াত)

“উহারা কি জানে না যে, যে ব্যক্তি আল্লাহ ও তাঁহার রাসূলের বিরোধিতা করে তাহার জন্য আছে জাহান্নামের (নরকের) অগ্নি, যেথায় সে স্থায়ী হইবে?”

(২৪ সূরা তাওবা : ৬৩ আয়াত)

বুদ্ধ ঈশ্বরবাদী ছিলেন না। তিনি মানুষকে দিয়েছেন জন্মান্তরের জীবন চক্র থেকে মুক্তির পথ – নির্বাণের পথ। কিন্তু এই নির্বাণ লাভের পথ হল তাঁর ধর্মমত গ্রহণ করা। এবং পরবর্তীতে তাঁর অনুসারীগণ মানুষ বুদ্ধকে ঈশ্বরের স্থানে আরোপ করেছেন।

বস্তুত সব ধর্মই কম বা বেশী দ্বৈত পূজারী হয়। দৈব এবং মানবিক, অমূর্ত এবং মূর্ত এই উভয় রূপ নিয়ে এক ঈশ্বর তাঁর ভক্তের কাছে ধরা দেন। এভাবেও বলা যায় যে, ভক্তের দুই ঈশ্বর – এক ঈশ্বর অজানা, অদেখা অমূর্ত কল্পনার ঈশ্বর, অপর এক ঈশ্বর জানা, দেখা মূর্ত প্রফেট। ভক্ত অনেক সময় এই দুইজনকে পৃথক করতে পারে না এবং পৃথক করলেও প্রফেটের মধ্যে ঈশ্বরকে মূর্ত দেখতে পায়। এই দিক থেকে প্রফেটের অবতার শব্দটি অধিকতর সঠিক অর্থ বহন করে। ঈশ্বর যে রূপ নিয়ে মানুষের নিকট অবতরণ করেন সেই রূপ হলেন অবতার। তাই সব প্রফেটই অবতার যাঁকে বাদ দিলে ঈশ্বরের কোন নির্দিষ্ট বা সামাজিক রূপ থাকে না।

বিশেষত গীতায় কৃষ্ণের অবতার রূপ খুব স্পষ্ট। তিনি নিজেই নিজেকে ঈশ্বর অর্থাৎ ঈশ্বরের মানবিক প্রকাশ বলছেন এবং তাঁর প্রতি মানুষের আনুগত্য দাবী করছেন। গীতার এই বক্তব্যগুলি থেকে কৃষ্ণের তত্ত্ব কিছুটা বোঝা যায় :

“কৃষ্ণ কহিলেন, “হে অর্জুন! আমি অনেকবার জন্মগ্রহণ করিয়াছি, তোমারও বহু জন্ম অতীত হইয়াছে; তুমি তাহার কিছুই জান না, কিন্তু আমি তৎসমুদায় অবগত আছি। আমি জন্মরহিত, অনশ্বর স্বভাব ও সকলের ঈশ্বর হইয়াও স্বীয় প্রকৃতিকে আশ্রয় করিয়া আত্মমায়ায় (আত্মশক্তিতে) জন্ম গ্রহণ করি। যে যে সময়ে ধর্মের বিপ্লব ও অধর্মের প্রাদুর্ভাব হয়, সেই সেই সময়ে আমি আত্মাকে সৃষ্টি করিয়া থাকি। সাধুগণের পরিত্রাণ, অসাধুগণের বিনাশ ও ধর্মের সংস্থাপনের নিমিত্ত যুগে যুগে জন্ম গ্রহণ করি।”

[মহাভারত। ভগবদ্গীতা পর্ব। (উপনিষৎ চতুর্থ অধ্যায়)]

“….. আমি কর্মফল, ভর্তা, প্রভু, সাক্ষী, নিবাস, কারণ, সুহৃদ, প্রলয়, আধার, লয়স্থান ও অব্যয় বীজ; আমি উত্তাপ প্রদান, বারিবর্ষণ ও বারি আকর্ষণ করিতেছি, আমিই অমৃত, মৃত্যু, সৎ ও অসৎ।”

(মহাভারত। ভগবদ্গীতা পর্ব। উপনিষৎ নবম অধ্যায়।)

“যে ব্যক্তি আমাকে অন্তঃকরণ সমর্পণ করিয়া শ্রদ্ধাপূর্বক আমাকে ভজনা করেন, তিনি আমার মতে সকল যোগী অপেক্ষা শ্রেষ্ঠতম।”

(মহাভারত। ভগবদ্গীতা পর্ব। উপনিষৎ ষষ্ঠ অধ্যায়।)

“হে অর্জুন! যে ব্যক্তি আমার কর্মানুষ্ঠান করে, যে আমার ভক্ত ও একান্ত অনুরক্ত, যে পুত্র কলত্র প্রভৃতি পরিবারের প্রতি আসক্তি রহিত, যাহার কাহার সহিত বিরোধ নাই এবং আমিই যাহার পরম পুরুষার্থ, সেই ব্যক্তিই আমাকে প্রাপ্ত হইয়া থাকে।”

(মহাভারত। ভগবদ্গীতা পর্ব। উপনিষৎ একাদশ অধ্যায়)।

এটা ঠিক যে, আমরা গীতার যে রূপ দেখছি সেটা অপরিবর্তিত আছে এমন মনে করার কারণ নেই। বৈদিক শক্তি তার বিজয়ের পর পুরাতন ধর্মের অবসান ঘটাবার জন্য যে সর্বাত্মক প্রয়াস নেয় তার ফলে গীতা এবং মহাভারতকে যে অনেক পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে আসতে হয়েছে তা আমরা মহাভারতে বরুণের পরিণতি থেকেও সহজেই অনুমান করতে পারি। যে দেবতাকে ঋগ্বেদেও বলা হয়েছে সমস্ত বিশ্বের অধিপতি (৪।৪২।১), সমস্ত ভুবনের সম্রাট (৮।৪২।১, সপ্তসিন্ধুর ঈশ্বর (৮।৪১।৯) তাকে কিভাবে নীচে নামানো হয়েছে তার এক প্রমাণ মহাভারত।

মহাভারতের অনুশাসন পর্বে বরুণ সম্পর্কে একটি কাহিনী বলা হয়েছে। এই কাহিনী অনুযায়ী জলাধিপতি (জলদেবতা) বরুণ অঙ্গিরার পুত্র মহর্ষি উতথ্যের ভার্যা (ভগবান চন্দ্রের কন্যা) কে হরণ করেন। দেবতা বরুণ উতথ্যের ভার্যাকে প্রদান করতে অস্বীকার করলে মহর্ষি উতথ্য বরুণের ছয় লক্ষ হৃদযুক্ত এবং বিবিধ প্রাসাদে সমাকীর্ণ পুরের সলিল সমুদয় স্তম্ভনপূর্বক পান করে তাকে জলশূন্য ঊষর ভূমিতে পরিণত করেন। ফলে বরুণ বাধ্য হয়ে ঋষিকে ভার্যা প্রত্যর্পণ করেন।

ছয় লক্ষ হ্রদ এবং বিবিধ প্রাসাদ সমাকীর্ণ পুর যে হরপ্পা সভ্যতার স্মৃতির প্রতিফলন মাত্র তা বুঝতে অসুবিধা হয় না।

কিন্তু বিস্ময়কর ব্যাপার হল মহাভারতে বরুণের উল্লেখ যেটুকু আছে মিত্রের উল্লেখ সেটুকুও নেই। কদাচিৎ মিত্রের নামোল্লেখ করা হলেও বরুণের মত তাঁকে নিয়ে কাহিনী তৈরী করা হয় নি। এর কারণ কি এই নয় যে, মিত্র যেহেতু মহাভারতের কেন্দ্রীয় চরিত্র সেহেতু তাঁকে ভিন্নভাবে উপস্থিত করার সুযোগ নেই? অর্থাৎ আমরা এই সিদ্ধান্তে পৌঁছতে পারি যে, ঋগ্বেদের মিত্র এবং মহাভারতের কৃষ্ণ একই চরিত্র।

আমরা অনুমান করতে পারি যে, মিত্র সিন্ধু হরপ্পা সভ্যতায় একেশ্বর বরুণের ধর্ম প্রবর্তন করেছিলেন। ঋগ্বেদে এই কারণে অনেক সময়ই তাঁকে বরুণ থেকে পৃথক করা যায় না এবং তাঁকে দেবতা হিসাবে স্তুতি করা হয়েছে।

তাছাড়া ঋগ্বেদ থেকে আমরা যেটুকু বুঝি তাহল অসুর বা দেবতা শব্দ দ্বারা সর্বদা অলৌকিক শক্তিও বোঝায় না। যে কোন শক্তিমান ব্যক্তি বোঝাতে এই শব্দের ব্যবহার লক্ষণীয়। আমরা দাস ও পণিদের সম্পর্কেও কয়েকবার অসুর শব্দ ব্যবহার করতে দেখেছি : “তাঁর (ইন্দ্রের) সহায়তায় আমাদের পূর্বপুরুষ অঙ্গিরাগণ, পদচিহ্ন দেখে পূজা করতঃ পণি অসুর দ্বারা অপহৃত গাভী উদ্ধার করেছিলেন” (১।৬২।২); “হে ইন্দ্র ও বিষ্ণু!.... তোমরা বর্চ্চি নামক অসুরের শত ও সহস্র সংখ্যক বীরকে যাতে তারা আর প্রতিদ্বন্দ্বী হতে না পারে, এরূপ করে নাশ করেছ” (৭।৯৯।৫); ইত্যাদি। তাছাড়া সাধারণ শত্রু সৈনিকদেরকেও অসুর বলা হয়েছে; “হে অধ্বর্যুগণ! শত্রু হননকারী যে ইন্দ্র ভূমির ক্রোড়ে শত সহস্র অসুরকে পাতিত করেছিলেন এবং যে ইন্দ্র কুৎস, আয়ু ও অতিথিগ্বের (দিবোদাসের) প্রতিদ্বন্দ্বিদের বধ করেছিলেন, সে ইন্দ্রের জন্য সোম আহরণ কর” (২।১৪।৭); ইত্যাদি।

সুতরাং অসুর অর্থ শক্তিমান। তাই ইন্দ্রকে বলা হচ্ছে, “হে অসুর! তুমি আমাদের রক্ষা কর” (১।১৭৪।১) আবার এই ইন্দ্রকেই বলা হচ্ছে, “তুমি অসুরনিহন্তা” (৬।২২।৪)।

এটা বোঝা যায় যে, দেব শব্দ পরবর্তীকালে ব্যবহৃত হলেও দেবতা বোঝাতে পূর্বকালে মূলত অসুর শব্দ ব্যবহার করা হত। অর্থাৎ মূল হরপ্পান ধর্মে সম্ভবত অসুর শব্দই সর্বাধিক ব্যবহৃত ও মর্যাদাজনক শব্দ ছিল। যে কারণে পুরাতন ধর্মের সম্মানিত বরুণ ও মিত্রের প্রতি অসুর শব্দের প্রয়োগ ঋগ্বেদে বেশী দেখা যায়। ঋগ্বেদে মিত্র ও বরুণ সম্পর্কে বলা হচ্ছে, “তারা দেবগণের মধ্যে অসুর” (৭।৫৬।২)।

কিন্তু পরবর্তী কালে বৈদিক শক্তি মূল হরপ্পান ধর্ম থেকে নিজেদের পৃথক করলে নিজেদের ধর্মের স্বাতন্ত্র্য প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যে অসুর শব্দের পরিবর্তে দেব শব্দ গ্রহণ করে। ক্রমে অসুর শব্দ পরিত্যক্ত হয় এবং ঋগ্বেদেও এটাকে পরবর্তী পর্যায়ে দেববিরোধী শক্তি হিসাবে ব্যবহার করা হতে থাকে। আরও পরবর্তী কালে পুরাণ কাহিনীগুলিতে অসুর অর্থ দানব বা অশুভ শক্তি করা হয়েছে।

যাইহোক বেদপূর্ব কিংবা বৈদিক ধর্মে দেবতা ও মানুষ উভয়কে শক্তির বিভিন্ন প্রকাশ হিসাবে চিন্তা করার প্রবণতা থেকে মিত্রকে দেবতায় রূপায়িত করা হতে পারে এবং বিশেষত বরুণের প্রতিনিধি বা অবতার হিসাবে ভক্তদের কাছে চিহ্নিত হওয়ায় তাঁর নাম বরুণের সঙ্গে দেবতা রূপে সংযুক্ত হয়েছে বলে আমরা ধারণা করতে পারি।

এখন আমরা এই প্রশ্ন করতে পারি মিত্র কিভাবে কৃষ্ণে রূপান্তরিত হতে পারে? কারণ যোগসূত্র ছাড়া কিংবা ভিত্তিহীনভাবে এত গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তির নাম পরিবর্তন হবার কথা নয়। এই পরিবর্তনের একটা সূত্র কোথায়ও থাকা উচিত। যেমন আমরা দেখেছি যে, বরুণের নাম ধর্ম করায় তাতে কৌশল থাকলেও সম্পূর্ণ মিথ্যা কিংবা ভিত্তিহীনতা নেই। যেহেতু বরুণের ধর্মই ধর্ম কিংবা বরুণ ধর্মের ঈশ্বর সেহেতু সেই অর্থের সঙ্গে সঙ্গতি দেখিয়ে বরুণের নাম ধর্ম করা সম্ভব।

হতে পারে যে, মিত্রের অপর নাম কৃষ্ণ ছিল। কিংবা তাঁর গাত্রবর্ণ ছিল কৃষ্ণ। মহাভারতের রচয়িতা বেদব্যাসের অপর নাম কৃষ্ণ দ্বৈপায়ন। মহাভারতে বলা হচ্ছে যে, বেদব্যাসের জন্ম যমুনা নদীর দ্বীপে হওয়ায় তার এক নাম হয়েছে দ্বৈপায়ন এবং তাঁর গাত্রবর্ণ অসিত হওয়ায় তাঁকে কৃষ্ণ দ্বৈপায়নও বলা হয়। অসিতবর্ণ অর্থ কৃষ্ণ, নীল, শ্যাম।

কৃষ্ণের বর্ণ যে কৃষ্ণ বা শ্যাম তা আমরা জানি। তবে কি মিত্র, কৃষ্ণ, বেদব্যাস এবং কৃষ্ণ দ্বৈপায়ন একজনেরই নাম?

এইবার আমরা মহাভারতে সত্যবতী বা মৎস্যগন্ধার গর্ভজাত বেদব্যাস সম্পর্কে যা বলা হচ্ছে তার দিকে দৃষ্টি দিব। তার আগে বলা দরকার যে, বেদব্যাসের মাতা সত্যবতী কুমারী অবস্থায় পরাশর ঋষির ঔরসে বেদব্যাসকে গর্ভে ধারণ করেন।

“সেই মহাযোগী পরাশরাত্মজ (বেদব্যাস) দ্বীপে অবর্তীর্ণ হইয়াছিলেন বলিয়া তাঁহার নাম দ্বৈপায়ন হইল; চতুর্বেদের বিভাগকর্তা বলিয়া তাঁহার নাম বেদব্যাস হইল এবং অসিতবর্ণ বলিয়া তাঁহার নাম কৃষ্ণদ্বৈপায়ন হইল।” (মহাভারত। আদিপর্ব। পৃষ্ঠা : ৭০)। অনুঃ কালীপ্রসন্ন সিংহ।)

কৃষ্ণ দ্বৈপায়নকে বেদপ্রণেতাও বলা হয়েছে। যেমন “বেদপ্রণেতা ভগবান ব্যাস, জননী স্মরণ করিয়াছেন জানিয়া তৎক্ষণাৎ অবিদিতরূপে আবির্ভূত হইলেন।” (মহাভারত। আদিপর্ব। পৃষ্ঠা : ৭১। অনুঃকালী প্রসন্ন সিংহ)।

মহাভারতে বেদব্যাসকে বেদপ্রণেতা, বেদের বিভাগকর্তা বলা হয়েছে। কিন্তু কেন? আমরা কি বেদের ইতিহাসে তেমন কোন বিবরণ পাই? চতুর্বেদের বিভাগকর্তারূপে বেদব্যাসের নাম মহাভারত ছাড়া আর কোথায়ও আছে কি? এবং মহাভারত প্রাক-বৈদিক যুগের রচনা হলে তখন তো চার বেদ দূরের কথা ঋগ্বেদও থাকবার কথা নয়। আমরা জানি দীর্ঘকাল পর্যন্ত ঋক, সাম ও যজুঃ বেদের এই তিনটি বিভাগ ছিল এবং অনেক পরে অথর্ববেদ রচিত হয়। সুতরাং নিঃসন্দেহে চতুর্বেদের বিভাগকর্তা রূপে বেদব্যাসের নামোল্লেখ মহাভারতের পরবর্তী সংশোধনকারীদের উদ্ভাবন মাত্র।
কিন্তু বেদব্যাসকে “বেদপ্রণেতা” বলবার কি অর্থ? তার অর্থ কি এই যে, হরপ্পা সভ্যতার মূল ধর্মগ্রন্থের নাম ছিল বেদ যার প্রণেতা হলেন মিত্র বা কৃষ্ণ বা কৃষ্ণ দ্বৈপায়ন কিংবা বেদব্যাস নামে একই ব্যক্তি?

এই রকম এক ঘটনা বহু পরবর্তীকালে ঘটেছিল বাইবেলের ক্ষেত্রে। যীশু খ্রীস্টের দ্বারা ধর্ম সংস্কারের ফলে বাইবেল দুইভাগে বিভক্ত হয় : পুরাতন নিয়ম ও নূতন নিয়ম। বাইবেলের পুরাতন নিয়ম (Old Testament) এর অনুসারী হল ইহুদীরা আর বাইবেলের নূতন নিয়ম (New Testament) এর অনুসারী হল খ্রীস্টানরা।

মহাভারতের সঙ্গে ধর্মগ্রন্থ বা ধর্মের সম্পর্কের সম্ভাবনা বোঝার জন্য আমরা কালী প্রসন্ন সিংহ অনূদিত মহাভারত থেকে আরও কিছু উদ্ধৃতি দিব :

“সত্যবতীপুত্র ভগবান ব্যাসদেব এই গ্রন্থে এক লক্ষ শ্লোক রচনা করিয়াছেন। যে সকল ব্যক্তি ইহা শ্রবণ করাইবেন এবং যাঁহারা শ্রদ্ধা ও ভক্তি সহকারে শ্রবণ করিবেন, তাঁহারা ব্রহ্মলোকে গমন করিয়া দেবতুল্য হইবেন। ...... মহর্ষি বেদব্যাস রচিত এই মহাভারতই পবিত্র ধর্মশাস্ত্র, অর্থশাস্ত্র ও মোক্ষশাস্ত্র। এক ব্যক্তি বক্তা ও অন্যে ইহার শ্রোতা হয়েন। ...... যে নর মহাভারত শ্রবণ করেন, তিনি কায়িক, বাচিক ও মানসিক ত্রিবিধ পাপরাশি হইতে বিমুক্ত হয়েন। যাঁহারা বিদ্বেষবুদ্ধিশূন্য হইয়া এই ভারতবংশীয় ইতিহাস শ্রবণ করেন, তাঁহাদিগের ব্যাধিভয় ও পরলোকভয় নিবারণ হয়। ...... যদি বেদপারগ ব্রাহ্মণ ব্রতানুষ্ঠানপরতন্ত্র হইয়া চারি বৎসর ও চারি মাস মহাভারত অধ্যয়ন করেন, তিনি সকল পাপ হইতে মুক্ত হইতে পারেন। ...... এই মহাভারত নিখিল বেদের সমষ্টিস্বরূপ। অতএব ধর্মবুদ্ধি লোকদিগের ইহা সর্বদা শ্রবণ করা কর্তব্য। ...... মন ও ইন্দ্রিয় দ্বারা অহোরাত্রে যে সকল পাপ সঞ্চিত হয় মহাভারত শ্রবণ করিলে তাহা তৎক্ষণাৎ নষ্ট হয়।” ইত্যাদি (আদিপর্ব। পৃষ্ঠা : ৩৯)।

মহাভারতের পবিত্রতা ও ধর্মীয় শক্তি সম্পর্কে এই ধরনের অনেক কথা আছে। সুতরাং আমরা এমন একটি সম্ভাবনাকে খাটো করে দেখতে পারি না যে, যেটিকে এখন আমরা মহাকাব্যরূপে দেখতে পাচ্ছি তার মূল উৎস হরপ্পান সভ্যতার ধর্মগ্রন্থ এবং ধর্মগ্রন্থের কাহিনী, এবং এই ধর্মগ্রন্থের নাম বেদ।

সেক্ষেত্রে বাইবেল (পুরাতন নিয়ম) এর আদি কাহিনী অর্থাৎ মোশীর কাহিনী অবলম্বন করে একটি মহাকাব্য রচনা করলে যে ব্যাপার হতে পারে মহাভারত হয়ত তেমন কিছু হয়েছে। হয়ত এই আদি বেদের মূল একটা পর্ব ছিল গীতা এবং তার সঙ্গে ছিল বিভিন্ন ঘটনার বর্ণনা ও বিধিবিধান। সেক্ষেত্রে মহাভারত হয়ত ছিল মূল ধর্মগ্রন্থের একটি পর্ব মাত্র।
একটি আশ্চর্য ব্যাপার হল যে, পৌরাণিক কাহিনীতে কৃষ্ণকে যেমন সুন্দর বলা হয় ঋগ্বেদে মিত্রকেও কিন্তু তাই বলা হয়েছে। বিশ্বামিত্র ঋষি বরুণের উপর কোন সূক্ত রচনা না করলেও মিত্রের স্তুতিতে একটি সম্পূর্ণ সূক্ত রচনা করেছেন। তাতে তিনি বলছেন, “এ মিত্র প্রাদুর্ভূত হয়েছেন, ইনি নমস্কারযোগ্য সুন্দর মুখবিশিষ্ট রাজা ও অত্যন্ত বলবিশিষ্ট এবং সকলের বিধাতা। ইনি যজ্ঞার্হ, আমরা যেন এঁর অনুগ্রহ ও কল্যাণকর বাৎসল্য লাভ করতে পারি” (৩।৫৯।৪)। মিত্র প্রাদুর্ভূত হয়েছেন বলবার অর্থ কি? এটা কি অবতারের আবির্ভাব অর্থে বলা হয়েছে যা কৃষ্ণ সম্পর্কে বলা হয়?

কৃষ্ণকে যেমন কর্ম, প্রেম, ক্ষমা, সত্য এবং কল্যাণের ধারণার সঙ্গে খুব বেশী যুক্ত করা হয় তেমন দেখা যায় মিত্রের ক্ষেত্রেও। গীতার কর্মবাদী কৃষ্ণের সঙ্গে এই মন্ত্রের মিত্রের মিল লক্ষণীয় : “মিত্র স্তুত হয়ে লোক সকলকে কার্যে প্রবর্তিত করছেন। মিত্র পৃথিবী এবং দ্যুলোক ধারণ করে আছেন, মিত্র অনিমেষ নেত্রে লোক সকলের দিকে চেয়ে আছেন” (৩।৫৯।১)।

বৈষ্ণব আন্দোলনের সত্যবান, প্রেমিক ও কল্যাণী কৃষ্ণের সঙ্গে এই মন্ত্রের মিত্রকে মেলাতে অসুবিধা হয় না : “যেন আমি সদগতি লাভ করি, যেন আমি মিত্র প্রদর্শিত পথে যাই। সে হিংসাবর্জিত প্রিয় দেবের কল্যাণ যেন আমরা প্রাপ্ত হই” (৫।৬৪।৩)।

কৃষ্ণ প্রসঙ্গে আর একটি কথা বলবার আছে। রাধাকৃষ্ণের উপাখ্যানের কৃষ্ণের সঙ্গে মথুরার নাম ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত। এই মথুরা মিত্র শব্দের রূপান্তর হওয়া সম্ভব।

সুতরাং মহাভারতের সূত্র ধরে আমরা ভারতবর্ষের এক অজ্ঞাত যুগের সন্ধান পেলাম। আসলে একটা এত বড় সভ্যতার সবকিছু ধ্বংস হয় না। অনেক কিছু লুকিয়ে থাকে মাত্র। আমাদের কাজ হল সেগুলিকে খুঁজে বের করা।

অবশ্য মহাভারত ইতিহাস গ্রন্থ নয়। কিন্তু এটা এমন এক বিশাল তাক যার অসংখ্য খোপে ভারতবর্ষের বহু হাজার বৎসরের অজস্র ঘটনার স্মৃতিকে উপকথার মোড়কে ঢেকে রাখা হয়েছে। তবে উপকথা থেকে সত্যকে বের করা দুঃসাধ্য। মহাভারতে উপকথা দ্বারা সত্যকে কিভাবে বিকৃত ও অচেনা করা হয়েছে তার একটি উদাহরণ হিসাবে আমরা অমৃত মন্থনের গল্প উল্লেখ করতে পারি।

অমৃত পান করলে অমর হওয়া যায়। সুতরাং অমৃত পাবার জন্য একবার দেবতা ও দানবগণ (অসুর) সম্মিলিত হয়ে সমুদ্র মন্থন শুরু করেন। মন্থন দণ্ড হিসাবে বিরাট মন্দর পর্বতকে তুলে আনা হয়। আর মন্থন দণ্ডের দড়ি হিসাবে ব্যবহারের জন্য মহানাগ বাসুকীকে আনা হয়।

অথচ আমরা বুঝি যে, এই অমৃত আর কিছু নয়, সোমরস বা ইক্ষুরস মাত্র। ঋগ্বেদেই বিশেষত শেষ দিকে সোমরসকে অমৃত বলা হয়েছে।। এইভাবে অমৃত উপকথা সৃষ্টির পরিস্থিতি তৈরী করা হয়েছে।

সুতরাং উপকথা দ্বারা সোমরস অমৃতে পরিণত হয়। এবং সোমরস প্রস্তুতের প্রস্তরখণ্ড পরিণত হয় মন্দর পর্বতে। অন্যদিকে মাখন প্রস্তুত প্রণালীর সঙ্গে সোমরস প্রস্তুত প্রণালীকে গুলিয়ে ফেলে দড়ির বদলে মহাসর্প বাসুকী, মথন দণ্ডের বদলে মন্দর পর্বত এবং উলুখলের বদলে সমুদ্রকে উপস্থিত করা হয়। এত ক্ষুদ্র উলুখলকে সমুদ্রের আকার ও আয়তনে নেওয়া কিভাবে সম্ভব?

অর্থাৎ পুরাণকথা আর ইতিহাস এক জিনিস নয়। তবু একজন নৃতাত্ত্বিক যদি এক খণ্ড অস্থি বা চোয়াল থেকে লক্ষ বা কোটি বৎসরের প্রাচীন প্রাণীর সম্পূর্ণ দেহাবয়ব ও খাদ্যাভ্যাস পর্যন্ত ধারণা করতে পারেন তবে কেন এইসব পুরাণকথার মধ্য থেকে ভারতবর্ষের ইতিহাসের অনেক বিস্মৃত অধ্যায়ের সূত্রগলি বের করা যাবে না? একজন প্রত্নতাত্ত্বিক প্রাগৈতিহাসিক মানুষের তৈরী প্রস্তর হাতিয়ারকে তারই মত দেখতে অসংখ্য প্রস্তরখণ্ড থেকে পৃথক করতে জানেন। তেমন মহাভারত, রামায়ণ ও অন্যান্য অসংখ্য পুরাণের মধ্যে ছড়ানো সত্যকে মিথ্যার স্তূপ থেকে পৃথক করতে পারতে হবে। তবে এর জন্য চাই তীক্ষ্ণ বিচার শক্তি, সমাজ, রাজনীতি, ইতিহাস এবং মানুষের চিন্তা প্রক্রিয়া সম্পর্কে স্বচ্ছ ধারণা এবং প্রত্নতাত্ত্বিক ও অন্যান্য তথ্যের সঙ্গে তুলনামূলক বিচার। অবশ্যই এতে কিছু ভুল হবে। তবু অনেক তথ্য ও সত্যকে পাবার জন্য এই কিছু ভ্রান্তির ধূলা-ময়লা আমাদের গায়ে-হাতে মাখতেই হবে।

মহাভারতের তাৎপর্য বুঝলে আমরা ভারতীয় সমাজ ও ইতিহাসের অনেক বৈশিষ্ট্য ও তাৎপর্য বুঝতে পারব। যেমন আমরা বুঝি এখানে ঐতিহ্যের শক্তি কতখানি এবং কেন? রামায়ণ, মহাভারতের অস্তিত্বই প্রমাণ করে যে, শত বিপর্যয় ও বিচ্ছেদ সত্ত্বেও ভারতীয় ইতিহাসে শেষ পর্যন্ত বিরাট কোন ছেদ ঘটে নি। ভারতীয় সভ্যতার ধারাবাহিকতা এবং সেই সঙ্গে তার ঐতিহ্যও শেষ পর্যন্ত রক্ষা পেয়েছে।

বস্তুত ভারতীয় আদি সভ্যতার ধারক ও বাহকরা সম্পূর্ণরূপে হারিয়ে যান নি বলেই তাঁদের সৃষ্টি রামায়ণ ও মহাভারত বেঁচে থাকে মহাকাব্য এবং অনেকাংশে ধর্মগ্রন্থও হিসাবে। মিসরের মতই সুমের বা মেসোপটেমিয়ার সভ্যতার জনকরা হারিয়ে গেছেন, তাই তাঁদের গিলগামেশ-এর মত মহাকাব্যসমূহের স্মৃতি পর্যন্ত নেই।

মহাভারতের অস্তিত্ব প্রমাণ করে ভারতীয় চেতনার উপর ঐতিহ্যের প্রচণ্ড প্রভাবের অস্তিত্বকে। এখানে হাজার হাজার বৎসর ধরে যত পরিবর্তন হয়েছে সেটা হয়েছে মূলত ঐতিহ্যের প্রতি নৈতিক আনুগত্য প্রদর্শন করেই। তাই বহু পুরুষের এক স্ত্রী হয়েও দ্রৌপদী যখন কৃষ্ণের স্ত্রী সত্যভামাকে স্ত্রীর সতিধর্ম সম্পর্কে উপদেশ দেন তখন সেটা ভারতীয় চেতনায় কোন সমস্যা সৃষ্টি করে না। অথবা সূর্য দেবতার ঔরসজাত অবৈধ সন্তান কর্ণের জননী এবং বিভিন্ন পুরুষ দেবতার ঔরসজাত সন্তানের জননী হয়েও কুন্তীর মহীয়সী নারী হতে কোন অসুবিধা হয় না।

এ ক্ষেত্রে বলতে হবে যে, ভারতীয় মন জটিল আবার সরল। জটিল এই কারণে যে, তা অতীত ও বর্তমান এই দুটিকেই একসঙ্গে রেখেছে। তার ঐতিহ্যকে ত্যাগ না করে তার নূতন জীবনাচরণ অনুসরণ করেছে। এতে অনেক সময় জটিলতাও সৃষ্টি হয়েছে, অনাবশ্যক আবর্জনার বোঝা বেড়েছে। আবার সরল এই কারণে যে, এই উভয়ের মধ্যে তা সর্বদা তালগোল পাকায় নি। একটিকে শুধু দূর থেকে শ্রদ্ধা জানাবার জন্য এবং অপরটিকে ব্যবহারের জন্য রেখেছে। অর্থাৎ একটি তাকে রেখেছে তার বিস্মৃত অতীত ঐতিহ্যের সঙ্গে সংযুক্ত, অপরটি তাকে রেখেছে জীবন প্রবাহের সঙ্গে সংযুক্ত।

বস্তুত এই ঐতিহ্যের শক্তির কাছে নত হয়েছিলেন বলে ঋগ্বেদের ঋষিরা বরুণকে প্রথমেই সম্পূর্ণ নাকচ না করে খর্ব এবং ধীর গতিতে বিলুপ্ত করার পদ্ধতি নিয়েছিলেন।

আমরা দেখেছি যে, সিন্ধু সভ্যতায় একেশ্বরবাদী ধর্ম প্রতিষ্ঠার সময়ও ঐতিহ্যকে ব্যবহার করা হয়েছে। এই জন্য আমরা পঞ্চপাণ্ডবের জনক রূপে বিভিন্ন ব্যক্তি বা উপজাতির উপাস্য দেবতাদের নাম পেয়েছি। যেমন বরুণ, ইন্দ্র, বায়ু, মরুৎ অশ্বিদ্বয়। পরাজিত কৌরব পক্ষে যোগদানকারী কর্ণের জনক হলেন সূর্য দেবতা। তাঁকে বলা হচ্ছে পঞ্চপাণ্ডবের মাতা কুন্তীর গর্ভজাত পুত্র। তবে কি কর্ণ মাতৃতন্ত্র বা বহুপতিত্বমূলক সমাজের সঙ্গে সম্পর্কিত কিংবা অতীতে পঞ্চপাণ্ডবদের সঙ্গে জোটবদ্ধ কোন উপজাতীয় নেতা ছিলেন? যাইহোক, এইসব দেবতাকে বরুণের অধীনস্থ করে নেওয়া হয়েছিল একেশ্বরবাদী ধর্মীয় কাঠামোতে। কাজেই সিন্ধুর হরপ্পান সংস্কৃতি একেশ্বরবাদ প্রতিষ্ঠা করলেও তার ঐতিহ্যকে সম্পূর্ণরূপে বর্জন করে নি।

অবশ্য ঐতিহ্যকে সম্পূর্ণরূপে বর্জন করলে দাঁড়াবার জন্য কোন জমিই পাওয়া যায় না। সেক্ষেত্রে পরের ঐতিহ্যকে নিজের ঐতিহ্য হিসাবে গ্রহণ করে নিতে হয়। তাই নিরঙ্কুশে একেশ্বরবাদী ধর্মের প্রফেট মোহাম্মদকেও বহু দেবতাবাদকে নাকচ করতে গিয়ে এক ঈশ্বর হিসাবে নিতে হয়েছে আল্লাহকে যে শব্দ ছিল আরবের প্রধান দেবতার নাম এবং কোরআন থেকেই আমরা জানতে পারি যে, পৌত্তলিক আরবদের বিশ্বাস অনুযায়ী এই দেবতার লাত, মানাত, উযযা নামে তিন কন্যা ছিল।

কিন্তু ইসলাম একমাত্র দেবতা বা ঈশ্বর হিসাবে আল্লাহকে রাখলেও আর কোন দেবতাকে রাখে নি। অর্থাৎ এখানে ঘটেছে এক ব্যক্তি ও গোষ্ঠী (কুরাইশ)-এর হাতে ক্ষমতার নিরঙ্কুশ বা চরম কেন্দ্রীভবন। আর সমস্ত ব্যক্তি ও গোত্রকে এখানে এই এক ব্যক্তি ও গোষ্ঠীর মধ্যে বিলীন হয়ে তার সবকিছু গ্রহণ করতে হয়েছে। যার ফলে ইসলামে সবকিছু নিরঙ্কুশ ও নিঃশর্তভাবে এককেন্দ্রিক।

কিন্তু সিন্ধু-হরপ্পান ধর্মের ক্ষেত্রে তা হয় নি। কারণ সেখানে একের অধীন করে একটি ঐক্য আনা হলেও স্বাতন্ত্র্যকে একেবারে অস্বীকার বা নাকচ করা হয় নি। হলে অবশ্য সিন্ধুর এই পরবর্তী বিস্ময়কর সভ্যতার চিত্রও আমাদের সামনে থাকত না।

হরপ্পান সভ্যতার সুদীর্ঘ কাল স্থায়ীত্বের ফলে নিরাকার একেশ্বরবাদের প্রভাব ভারতীয় সমাজ মানসে নিঃসন্দেহে গভীর হয়েছিল। কাজেই যুদ্ধ জয় দ্বারাই তাকে দ্রুত ধ্বংস করা গেছে মনে করলে ভুল হবে। এটা ততদিনে ভারতীয় সংস্কৃতির অত্যন্ত শক্তিশালী ঐতিহ্য হয়ে দেখা দিয়েছে।

তাছাড়া হরপ্পান সভ্যতা ও সংস্কৃতির বিশাল এলাকার সর্বত্র বৈদিক শক্তি সামরিকভাবে বিজয়ী হয়েছিল এমন মনে হয় না। হয়ত শত শত বৎসর লোথালের মত বিভিন্ন দূরবর্তী নগর ও অঞ্চল স্বাধীনতা ও স্বাতন্ত্র্য রক্ষাও করেছিল। তবে এ বিষয়ে সন্দেহ নেই যে, সভ্যতার মূল কেন্দ্র ধ্বংসের ফলে হরপ্পান ধর্ম ও সংস্কৃতির শক্তি সম্পূর্ণ ধ্বংস না হলেও ছত্রভঙ্গ হয়ে চতুর্দিকে ছড়িয়ে গেছে। খুব ধীর গতিতে এই শক্তিকে বিজয়ী বৈদিক শক্তির উত্তরাধিকারী ব্রাহ্মণরা যতটা সম্ভব অঙ্গীভূত করেছে।

অনুমান করা যায় যে, পরাজিত শক্তিকে সম্পূর্ণরূপে অধীনস্থ ও আত্তীকরণ করার জন্য ব্রাহ্মণরা অন্য অনেক গ্রন্থের মত মহাভারতকেও অধিকার ও ব্যবহার করেছে এবং তাতে ক্রমে বিরাট রকম পরিবর্তন এনেছে। কিন্তু নিশ্চয় তার মর্মবস্তু সম্পূর্ণ বদলানো সম্ভব ছিল না কারণ তাহলে মহাভারতের গ্রহণযোগ্যতাই নষ্ট হত।

তাই তারা মূল ঘটনাকে সম্পূর্ণ বদলাতে পারে নি। বরং তাকে যাতে চেনা না যায় এমনভাবে তাকে উল্টেপাল্টে সাজিয়েছে এবং তার উপরে নানান কল্পকথা বা উপকথা আর মিথ্যার আড়াল চাপিয়েছে। কিন্তু যে আড়ালের ভিতরে সত্য লুকানো আছে সেই আড়ালকে যতই দুর্ভেদ্য ও দুর্বোধ্য মনে হোক তাকে চূর্ণ-বিচূর্ণ করে মুক্ত সত্যকে নরায় সূর্য-এর আলোর নীচে দাঁড় করানো যায়।

এখন মহাভারতের রহস্যের দুয়ার খুলে গেছে। আমাদের সামনে উন্মোচিত হরপ্পান সভ্যতা প্রতিষ্ঠার ক্রান্তিলগ্ন। সুতরাং যে যুদ্ধ দ্বারা প্রাক-হরপ্পান সংস্কৃতি নামে কথিত পুরাতন সিন্ধু সভ্যতার নায়কেরা বিদায় নিয়েছে এবং হরপ্পান সংস্কৃতি নামে কথিত নূতন সিন্ধু সভ্যতার নায়কেরা ইতিহাসের মঞ্চে প্রবেশ করেছে এখন আমরা সেই যু্দ্ধের পটভূমি ও তাৎপর্য সম্পর্কে একটা সংক্ষিপ্ত আলোচনা করতে পারি।

 

৮। মহাভারত-যুদ্ধের পটভূমি ও তাৎপর্য

মহাভারতের যুদ্ধ হল সমাজের বিকাশমান শক্তিসমূহের অভিঘাতের একটি ফল। আমরা সাম্প্রতিক প্রত্নতাত্ত্বিক খননসমূহ দ্বারা জানতে পারছি যেটাকে প্রাক-হরপ্পান স্তর বলা হচ্ছে সিন্ধু সভ্যতার সেই কথিত অনুন্নত পর্যায়েও হরপ্পান সংস্কৃতির নগর পরিকল্পনার চিহ্ন ছিল। কোটদিজিতে খননকার্য চালিয়ে হরপ্পার পূর্ববর্তী স্তরে সুপরিকল্পিত এবং অত্যন্ত উন্নত নগরের সন্ধান পাওয়া গেছে। এই স্তরের মৃৎপাত্রগুলি পরবর্তী হরপ্পা স্তরের মৃৎপত্রের তুলনায় অধিকতর সুন্দর ও পাতলা। এমন অভিমতও এসেছে যে, হরপ্পা সভ্যতার নগর পরিকল্পনা কোটদিজির প্রাক-হরপ্পান সভ্যতা২১ থেকে এসেছে।

সুতরাং এটা স্পষ্ট যে, সিন্ধু উপত্যকায় সুদীর্ঘ কাল ধরেই নগর সভ্যতা গড়ে উঠছিল যার ভিতর থেকে পরবর্তী কেন্দ্রীভূত শক্তির অভ্যুদয় ঘটেছে। এই নূতন শক্তি পুরাতন মূল্যবোধ ও সমাজ সংগঠনের বিরোধী হওয়াই স্বাভাবিক। যেহেতু এটা চাইছে নগর কেন্দ্রিক ও কৃষি ভিত্তিক বৃহত্তর ও দৃঢ়ভাবে নিয়ন্ত্রিত সমাজ ও রাষ্ট্র গড়তে সেহেতু পুরাতন রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক কর্তৃত্বের সঙ্গে তার সংঘাত অনিবার্য হয়েছে। প্রতি পদে সংগ্রাম করেই তা এগিয়েছে এবং কর্মের অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে ক্রমেই তার কল্পনায় স্ফূট হয়ে উঠেছে বিস্ময়কর মহা সিন্ধু সভ্যতার নীলনকশা।

পুরাতন সমাজের ক্ষুদ্র নগর-রাষ্ট্রগুলির স্বাতন্ত্র্য, উপজাতীয় স্বাতন্ত্র্য, অভিজাততন্ত্র এবং যুদ্ধবাদের সঙ্গে নূতন সমাজ শক্তির স্বার্থের সংঘাত ঘটবার কথা। বিশেষত ভারতীয় প্রেক্ষিতে গ্রীস বা রোমের মত যুদ্ধবাদ দ্বারা গতিশীল সভ্যতা সংগঠন করা সম্ভব নয়। আমরা জানি এমন কি মোগল যুগেও কোন মোগল প্রদেশপাল বা শাসকের অত্যাচার খুব বেশী অসহনীয় হলে প্রজারা দল বেঁধে নিকটবর্তী কোন রাজার রাজ্যে পলায়ন করত।

যে যুগে উন্নত যান্ত্রিক পদ্ধতি মানুষের আয়ত্তে ছিল না এবং আধুনিক যুগের যন্ত্রশক্তির বদলে মানুষের দেহশক্তির উপর নির্ভর করে সভ্যতা নির্মাণ করতে হত সেই যুগে সিন্ধুর মত বিশাল ও উন্নত সভ্যতা নির্মাণের জন্য ধর্মকে পাশ কাটিয়ে প্রধানত ইহবাদ নির্ভর হলে মানুষদেরকে বাধ্য ও শৃঙ্খলাবদ্ধ করবার জন্য গ্রীসের মত বর্বরতার পথ অনুসরণ করতে হত। উপরন্তু এতে গ্রীসের মত ক্ষুদ্র নগর-রাষ্ট্রের কাঠামোর মধ্যে সভ্যতার শক্তি আবদ্ধ থাকত। বিশেষত ভারতীয় পরিস্থিতির জটিলতা মনে রাখতে হবে। বহু বিচিত্র বর্ণ, ভাষা ও সংস্কৃতির অধিকারী জনগোষ্ঠিগুলিকে সেই যুগে ধর্ম ছাড়া আর কোন শক্তির দ্বারা এভাবে এক অখণ্ড শৃঙ্খলায় আনা সম্ভব ছিল? অথচ এক অভিন্ন আদর্শ হিসাবে ধর্ম জাতীয় কিছু দিতে না পারলে ক্রমাগত আত্মক্ষয়ী যুদ্ধ দ্বারা সভ্যতার বিকাশ ক্ষতিগ্রস্ত হওয়া স্বাভাবিক ছিল।

খুব সম্ভব এক দীর্ঘ পর্যায়ের সামাজিক প্রয়োগ ও পরীক্ষার মধ্য দিয়ে ভারতীয় তথা সিন্ধুর পরিস্থিতিতে বলপ্রয়োগ ও যুদ্ধমূলক পদ্ধতির অকার্যকরতা স্পষ্ট হয়েছিল। সেহেতু, এটা অনুমেয় যে, সমাজে নূতন ধর্মের প্রয়োজন দেখা দিয়েছিল যে ধর্ম উপজাতীয় স্বাতন্ত্র্যকে যেমন কৌশলে দুর্বল করলে তেমন একটি কেন্দ্রীয় রাষ্ট্রীয়-সামাজিক কর্তৃত্বের প্রতি বৃহত্তর সমাজের জনগণকে অনুগত করবে। বিশেষত সিন্ধু উপত্যকায় বিরাট আয়তনে নগর সভ্যতা ও নদীনিয়ন্ত্রণব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার প্রথম পর্যায়ে যে কঠোর ও সুশঙ্খল কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রণের প্রয়োজন ছিল তার জন্য একেশ্বরবাদী ধর্মের উত্থান ঘটাই স্বাভাবিক।

সুতরাং এমন সম্ভাবনাও অস্বীকার করা যায় না যে, প্রাক-হরপ্পান তথা মহাভারত-যুদ্ধপূর্ব সমাজ ছিল উপজাতীয় ও জাতিগত স্বাতন্ত্র্যের প্রতি অনেক বেশী সহনশীল; অর্থাৎ অনেক বেশী গণতান্ত্রিক ও এবং সেই একই কারণে অনেক কম শৃঙ্খলাবদ্ধ। অবশ্য যে যুগের গণতন্ত্রকে আমরা যেন আজকের মত করে না দেখি। সমগ্র জনগণের জন্য গণতন্ত্র সে যুগে সম্ভব ছিল না। তাই গণতন্ত্রও তখন সীমিত থাকত উপর তলায়।

আর একটি সম্ভাবনাকে আমাদের বিবেচনায় নিতে হবে তা হল প্রাক-হরপ্পান সমাজে বস্তুবাদী দর্শন ও চিন্তার শক্তিশালী অবস্থান। আমরা প্রাচীন ভারতে বস্তুবাদী দার্শনিক ধারার শক্তিশালী অস্তিত্ব সম্পর্কে জানতে পারি। এই ধারার দার্শনিকদের মধ্যে লোকায়ত এবং চার্বাকদের বক্তব্য সম্পর্কে তাঁদের বিরোধী পক্ষের মাধ্যমে আমরা কিছু জানতে পারি।

সম্ভবত চার্বাক নামে একজন দার্শনিক ছিলেন যাঁর নাম অনুযায়ী বস্তুবাদী ধারার দার্শনিকদেরকে পরবর্তীকালে চার্বাক নামে অভিহিত করা হত। আমরা মহাভারতে চার্বাক নামে একজন দেববিরোধী ব্যক্তির উল্লেখ পাই। মহাভারতের শান্তি পর্বে চার্বাককে “ভিক্ষুকরূপ চার্বাক” এবং “দুরাত্মা চার্বাক রাক্ষস” হিসাবে অভিহিত করে তাঁর সম্পর্কে বলা হচ্ছে, “পূর্বে সত্যযুগে চার্বাক নামে এক রাক্ষস বদরী তপোবনে বহুকাল অতি কঠোর তপোনুষ্ঠান করিয়াছিল। প্রজাপতি ব্রহ্মণ তাহার তপঃপ্রভাবে অতিমাত্র সন্তুষ্ট হইয়া তাহাকে বর গ্রহণার্থ বারংবার অনুরোধ করিতে লাগিলেন। রাক্ষস কমলযোনিকে বরপ্রদানে সমুদ্যত দেখিয়া কহিল, ভগবন্! যদি প্রসন্ন হইয়া থাকেন, তবে আমাকে এই বর প্রদান করুন, যেন কোন প্রাণী হইতে আমার কিছুমাত্র ভয় না থাকে। তখন ব্রহ্মা কহিলেন, হে চার্বাক! আমি তোমাকে তোমার অভিলষিত বর প্রদান করিতেছি; কিন্তু তুমি কদাচ ব্রাহ্মণগণের অবমাননা করিও না। ব্রাহ্মণের অপমান করিলেই তোমাকে বিপদগ্রস্ত হইতে হইবে।

“চার্বাক রাক্ষস এইরূপে ব্রহ্মার প্রসাদে বর লাভ করিয়া স্বীয় বলবীর্য প্রভাবে দেবগণকে সন্তাপিত করিতে লাগিল।” (পৃষ্ঠা: ৯৬৮)।

অনুমান করা যায় যে, দার্শনিক চার্বাকই ব্রাহ্মণদের দ্বারা মহাভারতে চার্বাক রাক্ষসে পরিণত হয়েছেন। তাঁকে পাণ্ডবদের প্রতিপক্ষ প্রধান দুর্যোধনের সখা বলা হয়েছে। বলা হচ্ছে যে, মহাভারতের যুদ্ধের পর যুধিষ্ঠিদের অভিষেক অনুষ্ঠানের সময় জ্ঞাতি হত্যার জন্য চার্বাক যুধিষ্ঠিরকে ধিক্কার দিলে, সভাস্থ “ব্রাহ্মণগণ চার্বাকের প্রতি নিতান্ত ক্রুদ্ধ হইয়া ভর্ৎসনা করত হুঙ্কার শব্দ পরিত্যাগ করিতে লাগিলেন। তখন চার্বাক সেই মহাত্মাদিগের ক্রোধাগ্নিতে দগ্ধপ্রায় হইয়া আপনি দগ্ধ পাদপের ন্যায় অচিরাৎ ভূতলে নিপতিত হইল। মহারাজ যুধিষ্ঠির তদ্দর্শনে ব্রাহ্মণগণকে যথোচিত সম্মান করিতে লাগিলেন।” (পৃষ্ঠা : ৯৬৮)

মহাভারতের এই কাহিনীর পিছনে যদি কিছু সত্য থেকে থাকে তবে তা একটি সমাজ ও সভ্যতার বিকাশ ইতিহাস বুঝবার জন্য অসাধারণ গুরুত্বপূর্ণ তথ্য। কারণ আমরা সিন্ধু-হরপ্পার নগর পরিকল্পনা এবং বিশেষত তার জলনিয়ন্ত্রণব্যবস্থার উদ্ভবে ধর্মীয় শক্তির অন্তত মূল ভূমিকা থাকবার সম্ভাবনা দেখি না। পরবর্তীতে ধর্মের সহায়ক ভূমিকা গড়ে উঠলেও এটি মূলত এক সমাজের বিরাট বস্তুবাদী ও নিরীশ্বরবাদী চিন্তার শক্তির প্রেরণাতেই উদ্ভূত হয়েছে বলে মনে হয়।

চার্বাককে সত্য যুগের বলা হচ্ছে। সত্যের পর ত্রেতা, ত্রেতার পর দ্বাপর এবং দ্বাপরের পর কলি। ঐতিহ্য অনুসারে মহাভারতের যুদ্ধের পর দ্বাপর যুগ শেষ হয়ে কলি যুগের সূচনা ধরা হয়। তার অর্থ মহাভারতের কথা অনুযায়ী উন্নত সভ্যতারও অনেক পূর্বে চার্বাক ছিলেন। সত্যযুগ বলতে এ ক্ষেত্রে আমরা ধরতে পারি যখন থেকে মানুষ সভ্যতার পথে যাত্রা করেছে সেই সময়কে। হয়ত সভ্যতার প্রাথমিক পর্যায় থেকেই ভারতবর্ষে নিরীশ্বরবাদ ও বস্তুবাদ শক্তিশালী ছিল। তবে চার্বাক নামক কোন দার্শনিককে আমরা অনুমান করতে পারি প্রাক-মহাভারতীয় যুদ্ধ কালে।

চার্বাকের মত বিশাল ও প্রচণ্ড শক্তিমান মানুষের পাশাপাশিই কৃষ্ণকে মানায়। অর্থাৎ যুগটা ছিল মহাকায়দের, প্রকাণ্ড মানুষদের। হয়ত ভাববাদ ও অলৌকিকতা বিরোধী এই দার্শনিক দুর্যোধন বা কৌরবদের অধিকতর বিকেন্দ্রীকৃত শাসনব্যবস্থার সমর্থক ছিলেন যে কারণে তাঁকে মহাভারতে দুর্যোধনের সখা বলা হয়েছে।

হয়ত বিজয়ী একেশ্বরবাদী শক্তি চার্বাকের মত প্রচণ্ড ব্যক্তিত্বের বিরোধিতাকে ভয় পেয়ে তাঁকে হত্যা করেছিল। কারণ তখন ব্রাহ্মণও ছিল না, আর তা থাকলেও তার তেজ কোনও কালে এতটা হয় নি যে তার ক্রোধাগ্নিতে দগ্ধ হয়ে কারও মৃত্যু হয়।

হয়ত অগ্নিদগ্ধ করে কিংবা অন্যভাবে চার্বাককে হত্যা করা হয়েছিল। গ্রীসেও এক মনীষী সক্রেটিসকে তাঁর স্বাধীন মতামতের জন্য বিষপানে বাধ্য করে হত্যা করা হয়েছিল। এ বিষয়ে অবশ্য আমরা এখনই কোন সিদ্ধান্তে পৌঁছতে পারছি না। হয়ত অন্যান্য পুরাণের সাক্ষ্য কিংবা কোন বিবরণ থেকে আমরা এ ব্যাপারে সিদ্ধান্তে পৌঁছতে পারব। তবে একটি বিষয় স্পষ্ট যে, এত বড় দার্শনিক মানব ইতিহাসে দুর্লভ। শত্রুপক্ষ দ্বারা বিকৃত ও খণ্ডিতভাবে চার্বাকের মতবাদের যেটুকু আজকের যুগে আমাদের কাছে এসে পৌঁছয় তাতে এই দার্শনিকের মেধাশক্তি, যুক্তির তীক্ষ্ণতা এবং সাহসে আমরা বিস্ময়াভিভূত না হয়ে পারি না।

যদি প্রাক-হরপ্পান যুগে চার্বাক নামে কোন দার্শনিক থেকে থাকেন তবে মানব ইতিহাসের একজন শ্রেষ্ঠ দার্শনিকের উদ্ভবের সময়টির শক্তিকে আমাদের মানতে হবে। সম্ভবত একজন ব্যক্তিকে হত্যা করে এই যুগের শক্তিকে হত্যা করা যায় নি। আমরা অনুমান করতে পারি যে, মহাভারত-যুদ্ধ পরবর্তী কালে একেশ্বরবাদী রাজনৈতিক ও ধর্মীয় শক্তির আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হলেও ভারতীয় দর্শনের যুক্তিবাদী ও বস্তুবাদী ধারাটি হরপ্পান সভ্যতায় শক্তিশালী রূপ নিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল। কারণ এই দার্শনিক ধারাকে ধ্বংস করা সিন্ধু সভ্যতার নায়কদের পক্ষে সম্ভব এবং সঙ্গত কোনটাই ছিল না। এটা করা হলে সিন্ধু-হরপ্পান সভ্যতার এই বিরাট উত্থান সম্ভব হত না। সুতরাং আমরা অনুমান করতে পারি যে, শাসক গোষ্ঠী নিজ স্বার্থেই পৌত্তলিকতার প্রতি অসহিষ্ণুতা সত্ত্বেও বস্তুবাদের প্রতি তুলনামূলকভাবে সহিষ্ণু থেকেছে।

অবশ্য এই বিষয়ে খুব কম সন্দেহ আছে যে, প্রাক-হরপ্পান পর্যায়ের সহিষ্ণুতা এবং বিভিন্ন চিন্তার স্বাধীন বিকাশ এবং স্বাতন্ত্র্যের প্রবণতা হরপ্পান সভ্যতার পর্বে ক্রম সঙ্কুচিত হয়েছে। অর্থাৎ নূতন করে বেশী কিছু আর হয়েছে বলে মনে হয় না। বস্তুত সিন্ধু সভ্যতার হরপ্পান পর্যায় ছিল বিশাল আয়তনে পূর্ববর্তী সকল অভিজ্ঞতা ও পরিকল্পনার বাস্তবায়নের সময়। হরপ্পান স্তরে আমরা শত শত কিংবা সহস্র বৎসর প্রায় সবকিছুকে খূব উন্নত কিন্তু প্রায় এক পর্যায়ে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখি। অর্থাৎ আবিষ্কার ও উদ্ভাবনের প্রাণচঞ্চল যুগ সেই অর্থে আর আসে নি। সেটি ছিল প্রাক-হরপ্পান স্তরে। মহাভারত যুদ্ধের পূর্বে। শত শত কিংবা সহস্র বৎসর ব্যাপী ব্যাপক পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে যে ফলাফল পাওয়া গেছে তার ভিতর দিয়ে বৃহৎ আয়তনে স্থায়ী নির্মাণের এক মহাপরিকল্পনা বেরিয়ে এসেছে। কিন্তু সেই সঙ্গে এমন এক স্থিতাবস্থার শক্তিও বেরিয়ে এসেছে যা আর সমাজকে নূতন পরীক্ষা-নিরীক্ষা কিংবা নূতন প্রযুক্তিগত উদ্ভাবন ও আবিষ্কারের পিছনে বেশী সময় ব্যয় করতে দিতে পারবে না।

এই অবস্থায় পূর্বলব্ধ অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে তৈরী পরিকল্পনা অনুযায়ী সমগ্র সমাজকে এক নির্দিষ্ট ছাঁচে ফেলে বিরাট বিরাট নির্মাণ হয়েছে। এই দিক থেকে অনেক পরবর্তীকালের ইউরোপের রোমান সভ্যতার সঙ্গে হরপ্পান সভ্যতার একটি মিল আছে। অর্থাৎ বিরাট নির্মাণ হলেও নূতন উদ্ভাবন কম হয়েছে। সেগুলি হয়েছে প্রধানত প্রাক-হরপ্পান স্তরে। যেমন ইউরোপে তা হয়েছিল মূলত গ্রীসে।

যাইহোক এই বিষয়ে আমরা আরও কিছু পরে আলোচনা করব। বস্তুবাদের বিকাশ প্রক্রিয়া সম্পর্কে আমরা এটুকু বলতে পারি যে, সিন্ধু সভ্যতার উভয় স্তরেই এটি একটি প্রবল ও গুরুত্বপূর্ণ দার্শনিক ধারা ছিল। আমরা এই অনুমান করতে পারি যে, সিন্ধু সভ্যতার বস্তুবাদী দার্শনিক ঐতিহ্য ভারতীয় দার্শনিক ধারাকে সুদীর্ঘ কাল পর্যন্ত গভীরভাবে প্রভাবিত করে রেখেছিল। সাংখ্য দর্শনের মত এক কালের অত্যন্ত প্রভাবশালী দর্শনে নিরীশ্বরবাদী চেতনার গভীর উৎসটি এখন আমরা সিন্ধু সভ্যতায় খুঁজে পেতে পারি। এমন কি পরবর্তী ব্রাহ্মণ্য আধিপত্যের বিরুদ্ধে প্রতিক্রিয়া হিসাবে যখন ধর্মীয় আন্দোলন নূতন রূপ নিয়ে দানা বাঁধল তখনও তাকে এই বস্তুবাদী দর্শন ও নিরীশ্বরবাদকে কম বা বেশী অবলম্বন করতে হয়েছে। সংসারবিমুখ জৈন ও বৌদ্ধ ধর্মও নিরীশ্বরবাদের প্রভাব সম্পূর্ণরূপে কাটিয়ে উঠতে পারে নি।

মহাভারত আমাদের এই অনুমানকে অধিকতর দৃঢ়বদ্ধ করে, ভারতবর্ষে সুদূর অতীতে প্রজাতন্ত্র এবং গণতন্ত্র ছিল। আমরা কৌরব শাসনে এই রকম একটি সম্ভাবনার কথা বলেছি। আমাদের এই অনুমান দৃঢ় ভিত্তি পায় বিজয়ের পর পঞ্চপাণ্ডবের রাষ্ট্রক্ষমতা ত্যাগ করে মহাপ্রস্থানে গমনের বর্ণনায়। যে ক্ষমতার জন্য এত ঘটনা সেই ক্ষমতাকে হাতে পাবার পর রক্তপাত এবং  জ্ঞাতিহত্যার দুঃখে কিংবা কালের আহ্বানে তাকে এভাবে পরিত্যাগ কল্পলোকে ঘটলেও বাস্তব পৃথিবীতে ঘটে বলে মনে করবার কারণ নেই। এটা বিশ্বাস করলে আমাদের এও ধরে নিতে হয় যে, আওরঙ্গযেব সহোদর ভাইদের হত্যা করবার পূর্বে যে কথা মাঝে মাঝে বলতেন যে তিনি কাফের দারাকে সিংহাসনচ্যুত করার পর ফকির হয়ে মক্কায় চলে যাবেন সে কথা তিনি পালন করেছিলেন। বাস্তব হল যে, আপন ভাইদেরকে খুন করবার পর আওরঙ্গযেবের অন্তরে এমন কোন শোক না অনুতাপ উপস্থিত হয় নি যার তাড়নায় মহাপ্রস্থানের পথে হিমালয়ের বদলে মক্কার উদ্দেশ্যে যাত্রা করেছিলেন। তেমন কোন ঘটনা ঘটে নি। কারণ এটা ঘটে না। যে জিনিস বেশী রক্তের মূল্যে লাভ করা যায় তার মূল্যও বেশী হয়। তাও এক ভাই না হয় মহাপ্রস্থানে গেলেন কিন্তু বাকী চার ভাই-ই কেন যাবেন?

এর ব্যাখ্যা এই হতে পারে যে, ক্ষমতার মেয়াদ ছিল সীমিত। অর্থাৎ এটা রাজবংশ প্রতিষ্ঠার যুদ্ধ ছিল না। এটা ছিল ভিন্ন কিছু। এইবার আমরা যদি এর সঙ্গে প্রাচীন ভারতীয় চতুরাশ্রমের তত্ত্ব মেলাই তবে বিষয়টি আরও স্পষ্ট হয়। প্রাচীন ভারতীয় আদর্শ অনুযায়ী মানুষের জীবনের চারটি স্তর – ব্রহ্মচর্য, গার্হস্থ্য, বানপ্রস্থ ও সন্ন্যাস। বাল্য, কৈশোর ও তরুণ বয়সে বিদ্যার্জনের পর সংসার জীবন এবং অতঃপর সংসার জীবন ত্যাগের এই উৎকাল্পনিক বা কল্পস্বর্গীয় আদর্শ কি কোন কালে পালন করা হয়েছে? অন্তত সংসারী মানুষ এভাবে জীবনকে ভাগ করেছে এমন কয়টি বাস্তব দৃষ্টান্ত আমাদের সামনে আছে? অথচ এমন কোন আদর্শ হয়ত কখন ছিল যার অনুসরণে মানুষের জীবনকে এইভাবে ভাগ করে দেখবার কল্পনা এসেছে। এই সঙ্গে আমাদের এটা বুঝতে হবে যে, আদর্শ সম্পর্কে সকল ধারণার প্রধান উৎস হচ্ছে সমাজের নেতৃত্ব বা শাসক শ্রেণী। অর্থাৎ এমন একটা শাসক বা নেতৃত্বের সম্প্রদায় কখন ছিল যাদের শাসন বা ক্ষমতায় অধিষ্ঠানের মেয়াদ ছিল সামাজিকভাবে নির্দিষ্ট।

আমরা অনুমান করতে পারি যে, এমন এক সময় বা পরিস্থিতি ছিল যখন এক নির্দিষ্ট সময়ের পর রাষ্ট্রশাসক এবং কর্মকর্তারা ক্ষমতা এবং দায়িত্বে থাকতে পারত না। শাসকদের জন্য ছিল ক্ষমতায় অধিষ্ঠানের সময় সীমা এবং রাষ্ট্রীয় কর্মচারীদের জন্য অবসর নেবার নির্দিষ্ট সময় এমন এক বাস্তবতা সম্ভবত পরবর্তী যুগে চতুরাশ্রমের উৎকাল্পনিক ধারণার জন্ম দিয়েছে। পরবর্তী যুগে যখন রাজতন্ত্রের আদর্শ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে এবং সেই সঙ্গে গণতন্ত্রের দ্বারা প্রভাবিত উন্নত রাষ্ট্রব্যবস্থা লোপ পেয়েছে তখন হয়ত পুরাতন ব্যবস্থার স্মৃতি নূতন প্রেক্ষিতে ভিন্ন রূপ ধারণ করেছে। কিংবা ব্রাহ্মণ এবং রাজতন্ত্রীরা এই বিপদজনক দৃষ্টান্তের স্মৃতিকে হয়ত বিকৃত ও তাৎপর্যহীন করতে চতুরাশ্রমের তত্ত্ব হাজির করেছেন সামাজিকভাবে যার কোন প্রয়োগ দেখা যায় নি।

কিন্তু এই অনুমান দ্বারা আমরা একটি সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছি। যদি আমরা প্রাক-হরপ্পান পর্যায়ে তথা কৌরব শাসন কালে গণতান্ত্রিক কিংবা নমনীয় রাষ্ট্রশাসনের কোন কাঠামো থাকা সম্ভব বলে অনুমান করি তবে মহাভারতের যুদ্ধকে কিভাবে ব্যাখ্যা করব? আমরা ধৃতরাষ্ট্রের নিয়মতান্ত্রিক রাজা কিংবা প্রতীকী রাষ্ট্রপ্রধান হিসাবে থাকবার সম্ভাবনা উল্লেখ করেছি। এবং পরবর্তীতেও পঞ্চপাণ্ডবের ক্ষমতা ত্যাগ দেখা যাচ্ছে অর্থাৎ সম্ভবত রাষ্ট্রব্যবস্থা বা রাষ্ট্রশাসনপদ্ধতিতে বিশেষ কোন পরিবর্তন ঘটেনি। আর গণতান্ত্রিক কিংবা যে কোন নমনীয় রাজনৈতিক শাসনব্যবস্থা থাকলে সেখানে রাজনৈতিক ক্ষমতার প্রশ্নে এত প্রচণ্ড ও ব্যাপক গৃহযুদ্ধ ঘটা সম্ভব নয়।

সুতরাং আমরা এই সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া ছাড়া উপায় দেখি না যে, মহাভারত যুদ্ধের সর্বপ্রধান ইস্যু ছিল ধর্ম, অর্থাৎ মহাভারত-যুদ্ধ ছিল মূলত ধর্মীয় যুদ্ধ।

সেক্ষেত্রে এটা ছিল বহু ঈশ্বরবাদ ও পৌত্তলিকতার বিরুদ্ধে নিরাকারবাদ ও একেশ্বরবাদের যুদ্ধ। অবশ্যই এই যুদ্ধের বস্তুগত প্রেরণা এবং অন্যতম ইস্যুও ছিল বৃহত্তর ও দৃঢ়বদ্ধ সমাজ এবং মূলত এককেন্দ্রিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করা।

এই ধর্মযুদ্ধের মূল নায়ক এবং সংগঠক ছিলেন কৃষ্ণ বা মিত্র। পঞ্চপাণ্ডব ছিলেন এ ক্ষেত্রে কৃষ্ণের সমর্থক এবং শিষ্য। তাঁরা কৃষ্ণের বরুণকেন্দ্রিক একেশ্বরবাদী ধর্ম প্রতিষ্ঠার জন্য যুদ্ধ করেন। কিন্তু ধর্মনায়ক কৃষ্ণ রাষ্ট্রনায়ক হন নি। সম্ভবত বংশগত ও স্থায়ী রাষ্ট্রশাসক বা রাজতন্ত্র ছিল না। তাই কৃষ্ণের ক্ষমতায় যাবার প্রয়োজন ছিল না। তাছাড়া ধর্মটা নিরঙ্কুশভাবে এককেন্দ্রিক না হওয়ায় তাঁর পক্ষেও ধর্মীয় এবং রাষ্ট্রীয় উভয় ক্ষমতা নিজ হাতে কুক্ষিগত করা সম্ভব ছিল না। তাই ক্ষমতার বাইরে থেকে ধর্মীয় শক্তির সাহায্যে তিনি রাষ্ট্রকে প্রভাবিত এবং যতটা সম্ভব নিয়ন্ত্রণ করেছেন। অর্থাৎ ধর্মের বাইরে ভিন্ন সত্তা নিয়ে রাষ্ট্র দাঁড়িয়ে থাকলেও ধর্মের প্রভাবকে অস্বীকার করবার উপায়ও তার ছিল না। রাষ্ট্র ধর্মীয় শক্তি দ্বারা প্রত্যক্ষভাবে পরিচালিত ছিল না। কিন্তু রাষ্ট্র ছিল ধর্মের সঙ্গে গভীরভাবে সংযুক্ত। কাজেই কৃষ্ণ বা মিত্রের একেশ্বরবাদী ধর্ম ছিল রাষ্ট্রধর্ম। একইভাবে ধর্মও এমনভাবে রাষ্ট্রের সঙ্গে সংযুক্ত ছিল যে রাষ্ট্রের প্রভাব ও নিয়ন্ত্রণের বাইরে যাবার উপায়ও তার ছিল না।

একজন ধর্মনেতা ও একদল রাষ্ট্রনেতা পরস্পর সমন্বিতভাবে একটি ধর্ম এবং রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করায় এই বিশেষ পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়। এইভাবে রাষ্ট্র ও ধর্মের সমান্তরাল কিন্তু পরস্পর ঘনিষ্ঠ ও সংযুক্ত বিকাশ প্রক্রিয়ার সূচনা হিসাবে মহাভারতের যুদ্ধকে দেখলে আমাদের পক্ষে মহাভারতকে বোঝা যেমন সহজ হয় তেমন সিন্ধু সভ্যতার পরবর্তী স্তর যেটা হরপ্পান সংস্কৃতি বা সভ্যতা নামে পরিচিত তার বিকাশধারা ও সমস্যাগুলি বুঝতেও অনেক সুবিধা হয়।

এখন প্রশ্ন করা যাক, মহাভারতের ঘটনার সময় কোনটি? তাহলে আমরা হরপ্পান রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার সময়টিও নির্ধারণ করতে পারি।

অবশ্য আমরা ইতিপূর্বেই উল্লেখ করেছি যে, মহাভারতের যুদ্ধের পর দ্বাপর যুগ শেষ হয়ে কলিযুগের সূচনা হয়। তবে এটি ভারতীয় ঐতিহ্য অনুযায়ী একটি মত মাত্র। এ সম্পর্কে ভিন্ন একটি মতও আছে। আমরা এই উভয় মত সম্পর্কে আলোচনা করব।

কলিযুগের সূচনা ধরা হয় ৩১০২ খ্রীস্টপূর্বাব্দে। ভারতীয় পণ্ডিতগণের এক বৃহৎ অংশ মহাভারতের যুদ্ধের সময় হিসাবে নির্দিষ্ট করেছেন কলিযুগের এই সূচনাকাল ৩১০২ খ্রীস্টপূর্বাব্দকে। ২য় পুলকেশিন (খ্রীস্টীয় সপ্তম শতাব্দী)-এর এক উৎকীর্ণ লিপিতে আমরা মহাভারত যুদ্ধের এই সময় পাই। প্রাচীন ভারতীয় বিখ্যাত জ্যোতির্বিজ্ঞানী আর্যভট্ট এই মত পোষণ করতেন।

অপর একটি মত অনুযায়ী মহাভারত যুদ্ধ অনুষ্ঠিত হয় কলিযুগের ৬৫৩ বৎসর পর অর্থাৎ (খ্রীস্টপূর্বাব্দ ৩১০২-৬৫৩=)২৪৪৯ খ্রীস্টপূর্বাব্দে। বৃদ্ধ গর্গ, বরাহমিহির এবং কলহন এই মত পোষণ করতেন২২

আমাদের কাছে আর্যভট্ট কর্তৃক সমর্থিত মতটিই অধিকতর গ্রহণযোগ্য মনে হয়। কারণ কলিযুগের সূচনাকাল নির্ধারণের সঙ্গে অবশ্যই একটি বিশাল সামাজিক ওলটপালটের ঘটনা জড়িত আছে২৩

সুতরাং আমরা সিন্ধু সভ্যতার দ্বিতীয় পর্যায় তথা হরপ্পান সভ্যতা প্রতিষ্ঠার সময় পাচ্ছি ৩১০২ খ্রীস্টপূর্বাব্দ।

এখন আমাদেরকে ভারতীয় সভ্যতার জানা ইতিহাসকে অনেক পিছিয়ে দিতে হচ্ছে। আজ থেকে প্রায় ৫১০০ বৎসর পূর্বে এক মহাযুদ্ধে বিজয় দ্বারা সিন্ধু উপত্যকায় হরপ্পান রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হয় এবং এইভাবে সিন্ধু সভ্যতা নূতন পর্যায়ে প্রবেশ করে।

বস্তুত ঋগ্বেদের পর সব মহাকাব্য ও পুরাণ রচিত এমন এক ভ্রান্ত মত যদি আমরা আঁকড়ে না থাকি তবে ভারতীয় সভ্যতার ইতিহাসকে আমরা আরও বহুপূর্বে খুঁজে পাব। যেমন রামায়ণকে আমরা মহাভারতেরও পরে রচিত মনে করতে চাই। কিন্তু পুরাণিক ঐতিহ্যকে কিছু মূল্য দিলে ব্যাপারটা তা থাকে না। ভারতীয় ইতিহাস সম্পর্কে আধুনিককালে অর্জিত এক অত্যন্ত সীমাবদ্ধ ধারণার কাঠামো ভেঙ্গে যদি আমরা বের হতে পারি তবে দেখতে পাব বহু মানুষ, জনগোষ্ঠী, উপজাতি ও জাতি সমন্বয়ে বহু যুগ ধরে কি বিশাল ও বিস্ময়কর রূপ নিয়ে এক মহাসভ্যতার উত্তরাধিকার গড়ে উঠেছে!
ভারতীয় সভ্যতার এই যাত্রা কখন শুরু হয়েছিল? সভ্যতা তারিখ হিসাব করে শুরু হয় না। তবে পুরাণের মধ্য থেকে আমরা অন্তত ভারতীয় সমাজের প্রথম রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বের হিসাব ধরে এই সম্পর্কে একটা অনুমান দাঁড় করাতে চেষ্টা করতে পারি। পুরাণিক ঐতিহ্য অনুযায়ী মনু বৈবস্বত প্রথম রাজা। এবং তারও পূর্বে আছেন আদি মানব মনু স্বয়ম্ভুব। মনু স্বয়ম্ভুব থাক। আমরা মনু বৈবস্বতকেই ধরব। কারণ তাঁকে প্রথম রাজ্য প্রতিষ্ঠাতা বলা হয়েছে এবং তাঁর সঙ্গে জড়িত রয়েছে এক মহাপ্লাবনের কাহিনী। অনুমান করা যায় যে, এই কাহিনী থেকে বহু পরবর্তী কালে মধ্যপ্রাচ্যে নূহের প্লাবনের কাহিনী সৃষ্টি হয়েছে।
মনু বৈবস্বতের জন্ম মহাভারতের যুদ্ধের ৯৫ প্রজন্ম পূর্বে। সুতরাং আমরা যদি প্রতি প্রজন্মকে ১৮ বৎসর ধরে হিসাব করি তবে ৯৫×১৮=১৭১০ বৎসর পাচ্ছি। এর সঙ্গে খ্রীস্টপূর্ব ৩১০২ এবং খ্রীস্টীয় ১৯৯০ যোগ করলে আমরা পাই (১৭১০+৩১০২+১৯৯০=)৬৮০২ বৎসর। বস্তুত ভারতবর্ষে রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে বৈবস্বত মনু যদি প্রথম কিংবা সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ব্যক্তি হয়ে থাকেন তবে সভ্যতার পথে একটি উল্লেখ্য যাত্রাবিন্দু হিসাবে এই সময়কে ধরে নিয়ে ভারতীয় সভ্যতার পথে অগ্রগমনের ইতিহাসকে আজ থেকে প্রায় সাত হাজার বৎসর পিছিয়ে দিতে হয়।
অবশ্য এই হিসাব খুব বেশী অনুমান নির্ভর। তবে এটিকে স্বীকার বা অস্বীকার কোনটিই করবার উপায় নেই। এ সম্পর্কে নিশ্চিত হতে হলে প্রত্নতাত্ত্বিক সাক্ষ্য এবং অন্যান্য তথ্যের সমর্থন প্রয়োজন।
এখন আমরা এই প্রশ্নে আসি যে, মহাকাব্যের মত বিশাল আয়তন নিয়ে যে হরপ্পান সভ্যতা যাত্রা করেছিল তা কিভাবে এমন বিস্ময়কররূপে হারিয়ে যায়? কি সেই কারণ যার জন্য এমন একটি যুদ্ধ হল যে যুদ্ধ দ্বারা সমগ্র সভ্যতা জানা ইতিহাসের পৃষ্ঠা থেকে মুছে গেল? এই প্রশ্নগুলির উত্তর পাবার জন্য আমরা প্রত্যাবর্তন করি বৈদিক যুদ্ধের কালে।


৯। সিন্ধু সভ্যতার পতন ও বৈদিক ধর্মের উত্থান

সব মানুষের মত সব সভ্যতার দৈহিক মৃত্যু আছে। সুতরাং হরপ্পা তথা সিন্ধু সভ্যতার মৃত্যু বা ধ্বংস অস্বাভাবিক কোন ঘটনা নয়। তবে এক এক সভ্যতার পতন হয় এক এক ভাবে কিংবা এক এক প্রধান কারণে। সম্ভবত সিন্ধু-হরপ্পা সভ্যতার বিস্ফোরণের মত শক্তি দিয়ে উত্থান ও বিস্তার লাভের প্রধান কারণ ছিল যে জলনিয়ন্ত্রণব্যবস্থা তার মধ্যেই ছিল এই সভ্যতার ধ্বংসের মূল বীজও।

হরপ্পা সভ্যতার ধ্বংসের সঙ্গে বন্যা ও জলাবদ্ধতার যে একটি সম্পর্ক আছে সে কথা অনেকে বলছেন। আমরা একটু চিন্তা করলে নদীনিয়ন্ত্রণব্যবস্থার পরিণতি শেষ পর্যন্ত কি হতে পারে তা বুঝতে পারব। নদীখাত নিয়ন্ত্রণ কিংবা রুদ্ধ করায় সমুদ্রে যে পলি যেত সেটা জলপ্রবাহ যেখানে গেছে সেই উপত্যকা ভূমির উপর সঞ্চিত হয়েছে। নিয়মিত বন্যায় এর ফলে উপত্যকা ভূমি ক্রমেই উচ্চ হয়েছে। অন্যদিকে নদীখাত বা নদীমুখে বৃত্র দেওয়ায় নদী সম্পূর্ণ রুদ্ধ হবার কারণেই হোক অথবা নিয়ন্ত্রিত-স্রোত হবার কারণেই হোক নদীস্রোতের তীব্রতা কমেছে। এর ফলে নদীর জলরাশির সঙ্গে বাহিত পলি সহজেই নদীখাতে সঞ্চিত হয়ে নদীতলকেও উচ্চ করেছে।

এই অবস্থায় নদীখাতকে রক্ষা করতে গিয়ে মাঝে মাঝে নদীখাত খনন করতে কিংবা নদীতীরে বাঁধ দিতে কিংবা বাঁধ থাকলে তাকে উঁচু করতে হয়েছে। নদীখাত খনন করা সম্ভব নয়। সুতরাং যেটা সম্ভব সেটা ভাবতে হয়। শুধু নদীর দুই তীরের বাঁধ উঁচু করতে হয় নি। যে বিপুল জলরাশি হ্রদ বা জলাধারে সঞ্চিত হয়েছে সেগুলিও ভরাট হওয়ায় সেগুলির চারপাশের বাঁধও ক্রমাগতভাবে উঁচু করতে হয়েছে। অপর দিকে এই সামগ্রিক পরিস্থিতিতে নদীখাত ও সমভূমির ক্রমিক উচ্চতাবৃদ্ধির সঙ্গে তাল মিলিয়ে নগর, গ্রাম, রাস্তা ইত্যাদিকে বন্যা স্তরের উপরে নেবার জন্য উঁচু করতে হয়েছে।

বিষয়টিকে দুই বা চারশত বৎসরের প্রেক্ষিতে চিন্তা করলে চলবে না। এক কিংবা সোয়া এক হাজার বৎসর সময়ের প্রেক্ষিতে বিবেচনা করলে আমরা ঘটনাটির গুরুত্ব অনুধাবন করতে পারব। যত কার্যকরভাবে পরিচালনা করা যাক এক হাজার বৎসর পর আজকের ফারাক্কার মত নদীনিয়ন্ত্রণ বাঁধসমূহ বিভিন্ন নদী উপত্যকার জন্য কি পরিণতি বয়ে আনতে পারে? সিন্ধু উপত্যকায় ঘটনাটি তা-ই হয়েছে। নদীখাতে পলি সঞ্চয়, ভূমির উচ্চতা বৃদ্ধি, নদীর খাত পরিবর্তন, জলাবদ্ধতা, ক্রমবর্ধিত বন্যা এবং এই পরিস্থিতির সঙ্গে তাল মিলিয়ে নগর, গ্রাম, রাস্তা, বাঁধ ইত্যাদি সবকিছু ক্রমবর্ধমানভাবে উঁচু ও অবিরাম পুনর্নির্মাণ করতে গিয়ে বিপুল শ্রমশক্তি ব্যয় এই নদীনিয়ন্ত্রণব্যবস্থার অনুষঙ্গ হয়ে দেখা দিয়েছে। এর ফলে এক সময় যা ছিল সভ্যতা বিস্তারের একটি প্রধান উৎস তা দায়ে পরিণত হয়েছে এবং তা সভ্যতার শক্তি নিঙড়ে নিতে শুরু করেছে।

সিন্ধু উপত্যকায় খননকার্য চালিয়ে সর্বত্র উঁচু পলিমাটির যে স্তর দেখা যায় তা এই নদীনিয়ন্ত্রণব্যবস্থার পরিণতি। বিষয়টির গুরুত্ব উপলব্ধির জন্য উল্লেখ করা দরকার যে, বর্তমানে সিন্ধু নদীর তলদেশ উপরে থাকায় মহেঞ্জোদাড়ো নগরের ধ্বংষাবশেষের বেশী নীচে জলস্রোতের চাপে খনন করা যাচ্ছে না। ৩৯ ফুট পর্যন্ত নিম্নে খনন করে আর এগোনো যায় নি। এই স্তরেও নগরের চিহ্ন আছে২৪। অর্থাৎ ভূমির যে স্তরে এই নগরের নির্মাণ শুরু হয়েছিল বর্তমানে ভূ-পৃষ্ঠ তার উপরে এবং সেই সঙ্গে নদীতলদেশও।

আমরা ইতিপূর্বে হরপ্পান পর্যায়কে বলেছি পূর্ববর্তী সভ্যতার অভিজ্ঞতা ও পরীক্ষা-নিরীক্ষার ফলাফলের ভিত্তিতে তৈরী পরিকল্পনার ব্যাপক আয়তনে প্রয়োগের পর্যায়। বস্তুত হরপ্পান সভ্যতাকে প্রায় সর্বত্র এক পর্যায়ে দাঁড়িয়ে থাকা মনে হয়। নগর ও কৃষির বিস্তার হয়েছে। কিন্তু প্রযুক্তিবিদ্যার উল্লেখ্য উল্লম্ফন বেশী ঘটে নি। অর্থাৎ সমাজ ও সভ্যতার বিরাট বিস্তার ঘটলেও সেটা উচ্চতায় ততটা নয় যতটা পাশে।

হরপ্পান সভ্যতার রক্ষণশীল কিছু বৈশিষ্ট্য লক্ষণীয়। যেমন কুঠার বা কুড়ালে গর্ত থাকত না। কুঠার ফলাকে বাঁধা হত দণ্ডের সঙ্গে। অথচ সুমেরে কুঠার ফলার গোড়ায় আজকের মত ছিদ্র থাকত যার ভিতরে দণ্ড প্রবেশ করানো যেত। এই জাতীয় কুঠার হরপ্পান, সভ্যতায় খুব সামান্য পাওয়া গেছে। অর্থাৎ এটা স্পষ্ট যে, হরপ্পান সভ্যতা রক্ষণশীল হয়েছিল যে কারণে সুমেরের সঙ্গে বাণিজ্যিক সম্পর্ক এবং লেনদেন থাকলেও সেখান থেকে এই উন্নত প্রযুক্তিবিদ্যা নিতে চায় নি।

ধারণা হয় যে, ব্যাপক আবিষ্কার ও সৃষ্টির যুগ ছিল হরপ্পার বিরাট রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পূর্বকাল। এই পূর্বকালে বিভিন্ন অঞ্চল ও নগরের স্বাতন্ত্র্যের চিহ্ন মৃৎপাত্র, নগর বিন্যাস ইত্যাদিতে পরিস্ফুট যা হরপ্পান স্তরে বেশীরভাগ ক্ষেত্রে ক্রমে লোপ পেয়েছে। অনেক ক্ষেত্রে হরপ্পান স্তরেও মৃৎপাত্র, চিত্রাঙ্কুন ও প্রযুক্তিতে পূর্ববর্তী বিভিন্ন বৈশিষ্ট্যের ধারাবাহিকতা থাকলেও তখন সভ্যতার সর্বত্র সমধর্মীতা প্রবল হয়ে উঠছে। বোঝা যায় হরপ্পান রাষ্ট্র সম্প্রসারিত হচ্ছে এবং সেই সঙ্গে বিভিন্ন স্বাতন্ত্র্যও সঙ্কুচিত হচ্ছে।

এটা ঠিক যে, হরপ্পান সভ্যতার নগর পরিকল্পনার স্তরে পৌঁছবার জন্য অসাধারণ মেধাগত, সমাজসংগঠনগত এবং প্রযুক্তিগত উৎকর্ষতা অপরিহার্য ছিল। এই সভ্যতার সংগঠকরা তা অর্জন করেছিল। কিন্তু এই রকম একটি ধারণা করাও সম্ভবত ভুল হবে না যে, সিন্ধু উপত্যকার অকল্পনীয় সাহসী এবং জটিল জলনিয়ন্ত্রণব্যবস্থার মধ্যে জড়িয়ে গিয়ে এই উৎকর্ষতা আটকে গিয়েছিল। এটা স্পষ্ট যে, সিন্ধু সভ্যতার উত্থানের মূল উৎস কৃষির বদলে শিল্পে, প্রকৃতি নির্ভরতার বদলে প্রযুক্তিগত বিকাশ ও প্রয়োগে এবং গ্রাম্যতার বদলে নাগরিকতায়। বিশেষত শিল্প-বাণিজ্য নির্ভরতা যে, এই সভ্যতাকে হরপ্পান স্তরে নিতে পেরেছে তাতে সন্দেহ নেই।

বাণিজ্য কতখানি বিকাশ লাভ করেছিল তা আমরা বুঝি পায়ে হাঁটা সেই যুগে সিন্ধু-হরপ্পান সভ্যতার বাণিজ্যিক সংযোগ থেকে। উত্তর ভারত, বালুচিস্তান এবং আফগানিস্তানের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ বাণিজ্য সম্পর্ক ছিল। মধ্য এশিয়ার দক্ষিণ তুর্কমেনিয়ার সঙ্গে-ও হরপ্পান সভ্যতার বাণিজ্য সম্পর্কের প্রমাণ পাওয়া গেছে।

হরপ্পান সভ্যতার শেষ পর্যায়ের পূর্বে ঘোড়ার আবিষ্কার হয় নি। সুতরাং পায়ে হেঁটে এবং গরুর গাড়ীতে কিংবা গাধা বা উটের পিঠে মাল চাপিয়ে এত দূরবর্তী বিভিন্ন এলাকার সঙ্গে বাণিজ্য করা যে, সভ্যতার সেই ঊষাকালে কতখানি ব্যাপার ছিল অনুমেয়। উপরন্তু সমুদ্র বাণিজ্য ছিল সুমের-মেসোপটেমিয়া, বাহরাইন এবং দাক্ষিণাত্যের সঙ্গে।

একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল যে, ব্যবহার্য কোন ধাতুই সিন্ধু উপত্যকায় পাওয়া যেত না। তখনকার প্রধান ধাতু তামা কিছু পরিমাণে আমদানী করা হত বালুচিস্তান ও রাজস্থান থেকে। এবং সম্ভবত অধিকাংশ আমদানী করতে হত সমুদ্র পথে দাক্ষিণাত্য থেকে। ব্রঞ্জ নির্মাণের জন্য তামার সঙ্গে টিন মেশাতে হয়। টিন পাওয়া যেত বঙ্গের হাজারিবাগ এলাকায় এবং আফগানিস্তানে।

সমুদ্র যাত্রার উপযোগী জাহাজ নির্মাণ হত। সৌরাষ্ট্রের লোথালে পোড়া মাটির একটি গোটা জাহাজের মডেল পাওয়া গেছে। তাছাড়া ঋগ্বেদ থেকেও আমরা সমুদ্র বাণিজ্য এবং সমুদ্র যাত্রার উপযুক্ত নৌকা (জাহাজ)-এর কথা জানতে পারি। ঋগ্বেদে ১০০ দাঁড়বিশিষ্ট জাহাজের উল্লেখ আছে। তাতে বলা হচ্ছে, “হে অশ্বিদ্বয়! তোমরা অবলম্বনরহিত, ভূপ্রদেশরহিত, গ্রহণীয় বস্তুরহিত সমুদ্রে এ কাজ করেছিলে; শতদাঁড়যুক্ত নৌকায় ভুজ্যুকে রেখে তার গৃহে এনেছিলে” (১।১১৬।৫)।

এখানে উল্লেখ করবার মত যে দেবতাদের প্রিয় এই ভুজ্যুর পিতার নাম তুগ্র। অশ্বিদয় দেবতাদের উদ্দেশ্যে বলা হচ্ছে, “হে দুঃখহারিদ্বয়! তুগ্র তোমাদের পূর্বের স্তোত্র দ্বারা যেরূপ স্তুতি করত, পরে পুনরায় তোমাদের সেরূপ অর্চনা করত, কারণ তোমরা তার পুত্র ভুজ্যুকে বিক্ষিপ্ত সমুদ্র হতে গমনশীল নৌকা ও শীঘ্রগতি অশ্ব দ্বারা এনে দিয়েছিলে” (১।১১৭।১৪)।

অথচ মজার ব্যাপার হল আমরা এই আলোচনার গোড়ার দিকে ইন্দ্র কর্তৃক বিনাশ প্রাপ্ত দেবশত্রুদের যে নামের তালিকা দিয়েছি তাতে তুগ্র নাম আছে। এই তুগ্র সম্পর্কে ইন্দ্রের উদ্দেশ্যে বলা হয়েছে, “তুমি বেতসুর সাথে তুগ্রকে সংহার করেছ” (৬।২৬।৪)। অর্থাৎ তথাকথিত আর্য ও অনার্য-এর এক নাম। এই ধরনের দৃষ্টান্ত অবশ্য ঋগ্বেদে আরও আছে।

যাইহোক, আমরা যে বিষয়টি বুঝতে পারছি সেটি হল যে, প্রাক-হরপ্পান পর্যায়ে সিন্ধু সভ্যতার এই ব্যাপক বিস্তারের বুনিয়াদ নির্মিত হয়। আমরা অনুমান করি তখন জোর ছিল শিল্প ও বাণিজ্যের উপর। যার ফলে সমাজে প্রযুক্তিগত বিরাট উন্নয়ন সাধিত হয়। সম্ভবত এই পর্যায়েই জলসেচে বৃত্রব্যবস্থার কিছু প্রয়োগ হয় ছোটখাট খাল বা পাহাড়ী ক্ষুদ্র নদীতে। আমরা বালুচিস্তানে পাহাড়ী এলাকায় পাথর ও মাটি মেশানো প্রাচীন কালে নির্মিত নদীরোধকের সন্ধান পাই যেগুলি সেখানে গবরবন্দ্ নামে পরিচিত। এগুলি দ্বারা পাহাড়ী ক্ষুদ্র নদীর মুখ আটকে রেখে যৎসামান্য বৃষ্টি দ্বারা সঞ্চিত জলধারা সঞ্চয় করে কৃষিকাজে ব্যবহার করা হত। সুতরাং এটা অনুমানযোগ্য যে, সপ্তসিন্ধু আবদ্ধ করে বিশাল ভূভাগে জলসেচের পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে এই ধরনের সফল ক্ষুদ্র অভিজ্ঞতার মধ্য থেকে। তবে মূল সিন্ধু রুদ্ধ করার পরিকল্পনা নিয়েই যে হরপ্পা সভ্যতার সংগঠকরা যাত্রা করেছিলেন এমন কথা বলা যায় না। হয়ত প্রথমে উত্তরে সিন্ধুর কোন উপনদীকে তারা রুদ্ধ বা নিয়ন্ত্রণ করতে চেয়েছিলেন। আর এইভাবে ক্রমিক সাফল্যের অভিজ্ঞতার মাধ্যমে এই ধরনের নদীনিয়ন্ত্রণব্যবস্থার প্রসার ঘটেছে এটা মনে করাই যুক্তিযুক্ত হবে।

এই নদীনিয়ন্ত্রণ বা বৃত্রব্যবস্থার জন্য প্রয়োজনীয় ছিল সপ্তসিন্ধু উপত্যকাব্যাপী বৃহৎ ও দৃঢ়বদ্ধ রাষ্ট্র এবং কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রণ। কাজেই সমাজের যে শক্তি এই ধরনের কেন্দ্রীকরণের উপর জোর দিচ্ছিল তারা উপজাতি বা ক্ষুদ্র জাতি এবং নগরগুলির স্বাধীনতা কিংবা বিচ্ছিন্নতাকে ভাঙ্গতে চেয়ে একেশ্বরবাদী ধর্মের প্রয়োজন অনুভব করেছিল।

এই বৃত্রব্যবস্থা দ্বারা যে অসাধ্য সাধন হয়েছিল সেটা মেনে নিয়েও এখন আমরা তার ক্ষতির দিকগুলি বিচার করতে পারি। প্রথমত, তা সমাজের বিকাশমান মেধা ও পুঁজিকে শিল্প ও প্রযুক্তির উন্নয়ন অভিমুখী করার পরিবর্তে কৃষি অভিমুখী করেছে। দ্বিতীয়ত, তা সমাজের বিপুল শ্রমশক্তি ও মেধাকে জলনিয়ন্ত্রণের এক অকল্পনীয় জটিল, বিপদজনক ও বিশাল ব্যবস্থার মধ্যে আবদ্ধ করেছে। তৃতীয়ত, তা রাষ্ট্রের এবং ধর্মের কেন্দ্রিকতার ক্রমবর্ধমান শক্তিবৃদ্ধি দ্বারা সমাজে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির বিকাশ রোধ এবং ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য ও গণতন্ত্রের শক্তি হ্রাস করেছে।

আমরা এই বিষয়গুলি স্পষ্ট করার জন্য সংক্ষেপে কিছু আলোচনা করতে পারি। প্রথমত, আমরা দেখেছি যে, সিন্ধু সভ্যতার হরপ্পান স্তরে নগর পরিকল্পনা বা প্রযুক্তিতে তেমন কোন পরিবর্তন বা বিকাশ দেখা যায় না। পরিবর্তন ছাড়া উন্নয়ন বা বিকাশ সম্ভব নয়। অর্থাৎ পূর্ববর্তী স্তর পরিত্যাগ করে এগিয়ে এলে তাতে অবস্থার একটা সামগ্রিক পরিবর্তনও ঘটে। হরপ্পান স্তরে এই পরিবর্তন না ঘটবার অর্থ হল সত্যিকার বিকাশের দিকে অগ্রগমন না ঘটা। অর্থাৎ বুঝতে হবে যে, এই স্তরে সমাজ ও সভ্যতা শিল্প ও প্রযুক্তির পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও গতিশীলতার পরিবর্তে নিশ্চিত ও স্থিত কৃষি অভিমুখী হয়েছে এবং সেই সঙ্গে রক্ষণশীলও হয়েছে।

এটা ঠিক যে নাগরিক সম্প্রদায় মূলত সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করেছে। কিন্তু তখন তারা হয়েছে অনেকটা শহুরে জমিদারের মত। কৃষির উদ্বৃত্ত দ্বারা হরপ্পান সভ্যতার নাগরিক সম্প্রদায় নগর গড়েছে, উন্নত নাগরিক জীবনের সুযোগ-সুবিধা ভোগ করেছে এবং সর্বত্র তা বিস্তারও করেছে। কিন্তু সেটাও এক বিচারে এক ধরনের জমিদারী। আর জমির উপর নির্ভরতার অনিবার্য ফল হল রক্ষণশীলতা ও স্থিতাবস্থার শক্তিবৃদ্ধি পাওয়া। কারণ কৃষিতে গতি খুব কম। ফলে রক্ষণশীল ঐতিহ্যের শক্তি সমাজে প্রবল হয়ে উঠেছে। শেষ পর্যন্ত কৃষির বিস্তারের সঙ্গে কৃষক তার স্থবিরতা, ক্ষুদ্র গণ্ডীবদ্ধ জীবনের মন-মানসিকতা, রক্ষণশীলতা, স্থানীয় স্বাতন্ত্র্যবাদ এবং ধর্ম নির্ভরতা দ্বারা সমাজ ও সভ্যতাকে অধিকার করেছে।

দ্বিতীয়ত, আমরা দেখেছি যে, সিন্ধু-হরপ্পান জলনিয়ন্ত্রণব্যবস্থা ছিল অবিশ্বাস্য জটিল ব্যাপার। বর্তমান পাকিস্তান এবং ভারতরাষ্ট্রের পশ্চিমাংশের মানচিত্রের দিকে দৃষ্টি দিলে বিষয়টির বিশালতা ও জটিলতা অনুমান করা যায়। এবং সত্যি বলতে কি ঋগ্বেদের বর্ণনাও বিশ্বাস্য হত না যদি প্রত্নতাত্ত্বিক ও ভূতাত্ত্বিক গবেষণার ফলাফল দ্বারা আমরা ঋগ্বেদের বিবরণের সত্যতা বুঝতে না পারতাম।

এই জটিল ও কঠিন জলনিয়ন্ত্রণব্যবস্থা সমাজকে আর ভিন্ন কিছু ভাবতে বা করতে দেয় নি। বলা যায় এর সংগঠন, ব্যবস্থাপনা এবং রক্ষণাবেক্ষণের প্রক্রিয়া সমাজের উদ্বৃত্ত শ্রম ও মেধাকে আত্মসাৎ করে নিয়েছিল। ফলে সমাজ আর নূতন দিকে এগোতে পারে নি।

এবং তৃতীয়ত, কেন্দ্রীকরণ ও ধর্মের শক্তি বৃদ্ধি পাবার ব্যাপারটাও অনেকটা এই বৃত্রব্যবস্থার ফল বলা যায়। সেটা হয়েছে বিশেষত বৃত্রব্যবস্থা দ্বারা সমাজে যে রক্ষণশীলতা ও পরিবর্তনহীনতার শক্তি সৃষ্টি হয়েছিল তার কারণে। এক্ষেত্রে যে বলপ্রয়োগেরও খুব একটা ভূমিকা ছিল তা মনে হয় না। এই নূতন ব্যবস্থায় আবদ্ধ হয়ে সমাজ নিজেই ক্রমে রক্ষণশীলতার শিকার হয়েছে।

বস্তুত যে প্রযুক্তি ও প্রকৌশলগত জ্ঞান দ্বারা এই জলনিয়ন্ত্রণব্যবস্থা শুরু হয়েছিল তার অধিকতর উন্নয়নের বিশেষ সুযোগ থাকে নি এই ব্যবস্থা দ্বারা নূতন ও ভিন্ন ধর্মী সামাজিক শক্তিসমূহের বিকাশের পথ রুদ্ধ হওয়ায়।

এর একটি প্রধান কারণ হল এই জলনিয়ন্ত্রণব্যবস্থা লাভজনক হলেও সেই সময়ের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিগত মানের বিচারে অত্যন্ত স্পর্শকাতর ও ঝুঁকিপূর্ণ ছিল। এটি যে কোন বৃহৎ সামাজিক-রাষ্ট্রিক ভারসাম্যহীনতা বা বিশৃঙ্খলায় ভেঙ্গে পড়তে পারত। ফলে সামাজিক স্থিতিশীলতা রক্ষার উপর অতিরিক্ত গুরুত্ব দিতে গিয়ে সব রকম পরিবর্তনের শক্তিকে বিরোধিতা করতে হয়েছে।

অথচ নূতন ও ভিন্নধর্মী সামাজিক শক্তি ও প্রবণতার সংরক্ষণ ছাড়া সমাজে নূতন নূতন বৈজ্ঞানিক ও প্রযুক্তিগত উদ্ভাবন, আবিষ্কার ও প্রয়োগ হতে পারে না। অন্যদিকে, খুব গুরুত্বপূর্ণ নূতন বৈজ্ঞানিক বা প্রযুক্তিগত উদ্ভাবন বা আবিষ্কার সমাজের কারিগরি কাঠামোয় যে পরিবর্তন আনে তা আবার সমাজের সামগ্রিক বিন্যাসকে প্রভাবিত করে। এমন অবস্থায় সমাজ তার নিজের অস্তিত্বের প্রয়োজনেই একবার এই জলনিয়ন্ত্রণব্যবস্থার মধ্যে ধরা পড়বার পর নূতন করে খুব গুরুত্বপূর্ণ আর কোন সামাজিক বা প্রযুক্তিগত পরিবর্তন চায় নি।

সিন্ধু-হরপ্পান সভ্যতায় বলপ্রয়োগের শক্তির তেমন বিকাশ এবং প্রয়োজনও না হবার একটি প্রধান কারণ এই জলনিয়ন্ত্রণব্যবস্থা। এই ব্যবস্থার মধ্যে সমাজকে নেবার পর রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক কর্তৃত্বকে সমাজকে নিয়ন্ত্রণের জন্য বেশী কঠোর হতে হয় নি। অনুমেয় যে, এই অবস্থায় সমাজে রাষ্ট্রীয় ও ধর্মীয় শক্তির ক্ষমতা ক্রমে বৃদ্ধি পেয়েছে। পরবর্তী পর্যায়ে স্বৈরতন্ত্রের বিকাশ দ্বারা গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার অবসান ঘটাও অসম্ভব নয়।

বৃত্রব্যবস্থার আরও কতকগুলি ফল হয়েছিল যেগুলি সিন্ধু সভ্যতার পতনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। আমরা সেগুলি আলোচনা করতে পারি। হুইলার ভূতাত্ত্বিক পর্যবেক্ষণের ফল থেকে অনুমান করেন যে, সিন্ধু সভ্যতার সময় এবং হয়ত তারও পূর্ব থেকে মহেঞ্জোদাড়োর বেশ কিছু দক্ষিণে এবং আমরির কিছু উত্তরে কোথায়ও মাঝে মাঝে ভূপৃষ্ঠের উচ্চতাবৃদ্ধির কারণে ভূ-আক্ষেপ দেখা দিচ্ছিল। তিনি আরও অনুমান করেন যে, আমরি থেকে ২০ মাইল উত্তরে সেহ্ওয়ান-এর আশপাশে কোথায়ও এই ভূ-আক্ষেপ কেন্দ্র ছিল যার কারণে সিন্ধু নদীর প্রবাহ বাধাপ্রাপ্ত হয়ে সেখান থেকে উত্তর দিক অভিমুখে ১০০ মাইল পর্যন্ত দীর্ঘ একটি হ্রদ সৃষ্টি করে২৫

এখানে উল্লেখযোগ্য যে, আমরি মহেঞ্জোদাড়ো থেকে প্রায় ৮০ মাইল দক্ষিণে।  অর্থাৎ মহোঞ্জোদাড়ো থেকে কম বেশী ৬০ মাইল দক্ষিণে সিন্ধু নদী প্রবাহ রুদ্ধ হয়েছিল এবং এখান থেকে উত্তর অভিমুখী এক বিরাট হ্রদ সৃষ্টি হয়েছিল। বহুসংখ্যক ক্ষুদ্র হ্রদ ছাড়াও এই রকম বিশাল হ্রদ সমগ্র সিন্ধু উপত্যকায় সম্ভবত আরও ছিল। হুইলার ভূ-আক্ষেপের ফলে হ্রদ সৃষ্টির যে ধারণা করছেন ব্যাপারটি তেমন না হয়ে মানুষ দ্বারা নদীপ্রবাহ রুদ্ধ হওয়ায় হ্রদ সৃষ্টি হয়েছে মনে করাই অধিকতর যুক্তিযুক্ত। তা না হলে বৈদিক শক্তি কর্তৃক বৃত্র ধ্বংসের সঙ্গে নদীস্রোত সমুদ্রে গেল কিভাবে? বহুকাল অবরোধের পর যে, নদীগুলিকে মুক্ত করা হয় এই কথাটাও ঋগ্বেদ সুস্পষ্টভাবে জানায় :

“হে হরিবান ইন্দ্র! যখন তুমি বদ্ধ এ নদীগণকে বহুকাল অবরোধের পর প্রবাহিত হবার জন্য মোচন করেছিলে, সে সময়ে প্রসিদ্ধ দ্যুতিমতী ভগিনীগণ তোমার আশ্রয় লাভের জন্য তোমাকে স্তুতি করলেন” (৪।২২।৭)।

অর্থাৎ বাধাটা প্রাকৃতিক নয় মানবিক।

এই হ্রদ সৃষ্টির ফলে ভূকম্পন কিংবা ভূস্তরে আক্ষেপ দেখা দেওয়া অবশ্য খুব সম্ভব। কারণ সমগ্র সিন্ধু নদী দিয়ে সারা বৎসর যে জল সমুদ্রে যায় তা যদি ভূমিতে জমা করা হয় তবে ভূত্বকের উপর বিপুল পরিমাণ চাপ বা ওজন সৃষ্টি হতে পারে। জলপ্রবাহ বিশেষজ্ঞগণ বর্তমান সিন্ধু ও তার পাঁচ উপনদীর জলপ্রবাহ থেকে এই ওজন বের করতে পারেন।

এ ছাড়া বাৎসরিক যে পলি জলের সঙ্গে সমুদ্রে গিয়ে পড়ে তারও একটি হিসাব বের করা দরকার। বাৎসরিক এই পলি সঞ্চয় এক হাজার বৎসরে সিন্ধু–পাঞ্জাবের বিস্তীর্ণ ভূ-ত্বকের উপর নিশ্চয় নিদারুণ চাপ সৃষ্টি করেছিল। মনে হয় এই সমগ্র বিষয়টি সামনে রেখে পাঞ্জাব, সিন্ধু ও আশপাশের অঞ্চলে যদি ভূ-তাত্ত্বিক অনুসন্ধান চালানো যায় তবে হরপ্পান সভ্যতার সংগঠকরা কি পরিমাণ ভূভাগকে বৃত্রব্যবস্থার মাধ্যমে জলসেচের আওতায় নিয়েছিল সেটা এবং সেই সঙ্গে তার ভূপ্রাকৃতিক ফলাফলও বের করা সম্ভব হবে।

আমরা অনুমান করতে পারি যে, বৃত্রব্যবস্থার প্রসারের ফলে মহেঞ্জোদাড়োর নৌবাণিজ্য অসুবিধাজনক হয়ে উঠছিল। প্রথমে উপনদীগুলিতে এবং অবশেষে মূল সিন্ধু নদীতে বৃত্র দেবার ফলে গ্রীষ্ম ও বর্ষায় নদীতে কিছু নাব্যতা থাকলেও অন্যসময় সম্ভবত তা থাকত না।

ভাটি অঞ্চলে অবস্থিত মহেঞ্জোদাড়োর জন্য ছিল উভয় সঙ্কট। বন্যার সময় উত্তরের বাড়তি জল নেমে এসে চতুর্দিক প্লাবিত করত অথচ খরার সময় প্রয়োজনীয় জলও নদীতে থাকত না। অর্থাৎ বৃত্রব্যবস্থা ক্রমে দেশের সম্ভবত এক সময়কার প্রধান নগর ও রাজধানী মহেঞ্জোদাড়োকে শ্বাসরোধ করে হত্যা করেছে। বাণিজ্য কমেছে। ফলে শিল্পেরও ক্ষতি হয়েছে। এই সময় দ্বন্দ্বটা সম্ভবত ভূমিভিত্তিক শ্রেণীর সঙ্গে শিল্প ও বাণিজ্যভিত্তিক শ্রেণীর তীব্রতর হয়ে দেখা দেয়। এবং সেই সঙ্গে দ্বন্দ্বটা উত্তর ও দক্ষিণের মধ্যে আঞ্চলিক রূপও নেয়।

বাণিজ্য হ্রাস, বন্যার প্রকোপ ইত্যাদির ফলে মহেঞ্জোদাড়োর ভূমিকা ফুরিয়ে এসেছে। তখন বন্যার প্রকোপ থেকে অনেক বেশী মুক্ত উত্তরাঞ্চলে অবস্থিত হরপ্পা নগরের গুরুত্ব সামনে এসেছে। এক সময় মহেঞ্জোদাড়ো থেকে শাসনকেন্দ্র সরে গেছে হরপ্পায়। হয়ত নগরের অধিবাসীদের এক বৃহৎ অংশও সেখানে চলে গেছে। কিন্তু সবাই যেতে পারে নি। এবং সবাই গিয়ে পূর্বের মত স্থানও করে নিতে পারে নি। সভ্যতার কেন্দ্র পরিবর্তনে রাষ্ট্রের কাঠামোতেও অনেক গুরুত্বপূ্র্ণ পরিবর্তন ঘটা সম্ভব।

এইভাবে হয়ত শত শত বৎসর চলেছে। কিন্তু নদীর জল যদি শত শত কিংবা সহস্র বৎসর এক স্থানে সঞ্চিত হতে থাকে তবে সেখানে একটি ভয়ানক ক্ষতিকর ঘটনা ঘটতে পারে বলে আমরা অনুমান করতে পারি। সেটি হল লবণাক্ততা। সম্ভবত সমস্ত সিন্ধু উপত্যকা শেষাবধি এই লবণাক্ততার শিকার হয়েছিল এবং সবচেয়ে বেশী হয়েছিল সম্ভবত দক্ষিণ দিকের ভূভাগ কারণ জলপ্রবাহের সঙ্গে উত্তরের লবণও এ দিকেই বেশী আসবার কথা।

বাংলায় একটা প্রবাদ আছে পেটে খেলে পিঠে সয়। বৃত্রব্যবস্থা সিন্ধুর নগর সভ্যতা এবং জনগণের জন্য যত সমস্যা সৃষ্টি করুক সাধারণ মানুষ হয়ত দীর্ঘকাল সব মেনে নিচ্ছিল। কারণ খাদ্যের ঘাটতি হয় নি। কিন্তু যখন জমিতে লবণাক্ততার ক্রমবৃদ্ধির কারণে ফসল উৎপাদন কমে যেতে থাকে তখন সিন্ধু সভ্যতার জন্য গুরুতর সঙ্কট দেখা দিল। ব্যাপারটা এক সময়ে সর্বত্র হয়েছে তা নয়। ধীর গতিতে এবং বিভিন্ন স্থানে আগে পরে। কিন্তু এ ব্যাপারে সন্দেহ থাকা উচিত নয় যে, এই লবণাক্ততা আস্তে আস্তে সর্বত্র ছড়িয়েছে যার ক্ষতিকর প্রভাব পলির সঞ্চয় দ্বারাও দূর করা যায় নি। সম্ভবত ভূমির এই ক্রমবর্ধমান লবণাক্ততা সিন্ধু সভ্যতার অস্তিত্বকে ক্রমেই অসম্ভব করেছিল।

আমরা অনুমান করতে পারি এই অবস্থায় বৃত্রব্যবস্থার বিরুদ্ধে প্রথম ক্ষোভ দানা বাঁধে মহেঞ্জোদাড়োকে কেন্দ্র করে দক্ষিণ অঞ্চলে। এবং বৃত্রব্যবস্থার বিরুদ্ধে আন্দোলন বিকাশও লাভ করে সম্ভবত সেখান থেকে।

কিন্তু ঋগ্বেদ আমাদেরকে একটি জটিল প্রশ্নের সম্মুখীন করে। সেটি হল জলের প্রশ্ন। এ বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই যে, যুদ্ধটা মূলত নদীনিয়ন্ত্রণব্যবস্থা ভেঙ্গে ফেলার আশু উদ্দেশ্য নিয়ে পরিচালিত। কিন্তু সেই সঙ্গে যে গভীর বিষয়টি জড়িত সেটি হল জলাভাব। বৃত্রকে জলহীনতার জন্য দায়ী করা হচ্ছে। অর্থাৎ বন্যা বা জলাবদ্ধতার জন্য তাকে সেভাবে দায়ী করা হয় নি। তা যে জলরোধ করে রেখেছিল সে কথা বহুবার বলা হয়েছে। কিন্তু নদীনিয়ন্ত্রনব্যবস্থা জলসেচ বা জলসরবরাহের জন্য। তা হলে কেন জলবঞ্চিত হবার প্রশ্ন?

৪।১৯।৭ ঋকে বলা হচ্ছে : “ইন্দ্র শত্রুহিংসক সৈন্যের ন্যায় কূলসমূহের ধ্বংসকারিনী, যুবতী অন্নজনয়িত্রী নদীসকল পরিপূর্ণ করেছেন, তিনি নির্জল প্রদেশসমূহ পরিপূর্ণ করেছেন, পিপাসাতুর পথিকদের পরিপূর্ণ করেছেন। তিনি দস্যুদের অধিকৃতা প্রসবনিবৃত্তা গাভীসকলকে দোহন করেছেন।”

ঋকটি থেকে এটি স্পষ্ট যে, নির্জল প্রদেশসমূহ বলতে নদীর তীরবর্তী ভূমিকেই বোঝানো হয়েছে। কারণ নদীস্রোত না থাকলে দূরবর্তী অঞ্চলের যেমন ক্ষতি নেই তেমন তা থাকলেও তার লাভ নেই। কাজেই আমরা নিঃসন্দেহে ধরে নিতে পারি যে, উত্তরে জল আটকে দক্ষিণে জলসরবরাহ বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল। ফলে দক্ষিণের নদীতীরবর্তী অঞ্চল জলহীন হয়েছিল। প্রসবনিবৃত্তা গাভীসকলকে দোহন স্রোতহীন, মরা নদীর পুনরুজ্জীবনের রূপক বর্ণনা ছাড়া আর কি?
বিষয়টা স্পষ্ট। অর্থাৎ দ্বন্দ্বটা মূলত উত্তর ও দক্ষিণের মধ্যে রূপ নিয়েছিল। নিম্নের ঋকগুলিও এই বিষয়কে স্পষ্ট করে :

“হে ইন্দ্র! তুমি মহান। পৃথিবী মহত্বযুক্ত হয়ে তোমার বল অনুমোদন করেছেন, দ্যুলোকও তোমার বল অনুমোদন করেছেন। তুমি বল দ্বারা বৃত্রকে বধ করেছ। অহি যে সকল নদীকে গ্রাস করেছিল, তুমি তাদের মুক্ত করেছ (৪।১৭।১), তুমি দীপ্তিমান, তোমার জন্মের পর দ্যুলোক তোমার কোপভয়ে কম্পিত হয়েছিল, পৃথিবী কম্পিত হয়েছিল, ঐ বৃহৎ মেঘসমূহ আবদ্ধ হয়েছিল। ঐ মেঘসমূহ প্রাণিগণের পিপাসা বিনাশ করেছিল এবং মরুপ্রদেশে জল প্রেরণ করেছিল” (৪।১৭।২)।

“হে ইন্দ্র! তুমি বৃত্র কর্তৃক সমাচ্ছাদিত নদী সকলের প্রকাণ্ড বারিরাশি উন্মুক্ত করেছ; তুমি জলরাশি মুক্ত করেছ। তুমি সে সমস্ত নদীকে নিম্নপথে প্রবাহিত করেছ, তুমি বেগবান সলিলরাশিকে সমুদ্রে নিয়ে গিয়েছ” (৬।১৭।১২)।

তাহলে কি এই দাঁড়ায় না যে, নদীর নিম্নপথের লোকগণ বৃত্র দ্বারা জলবঞ্চিত হয়েছিল? কাজেই আমরা ঋগ্বেদে যুদ্ধের মূল ইস্যু হিসাবে জলের প্রশ্নকে দেখতে পাচ্ছি। কোসাম্বি “আর্যদেরকে” বহিরাগত আক্রমণকারী মনে করলেও এই বিষয়টি ধরতে ভুল করেন নি। তিনি মনে করেছেন যে, বহিরাগত বৈদিক আর্য এবং সিন্ধুর অধিবাসীদের মধ্যে যুদ্ধ হয়েছিল মূলত জলের উপর অধিকারের প্রশ্নকে কেন্দ্র করে২৬

কিন্তু আমরা পুনরায় যে প্রশ্নের সম্মুখীন হই তাহল হরপ্পা কেন একই রাষ্ট্র বা সভ্যতার অধীন দক্ষিণাঞ্চলে জলসরবরাহ বন্ধ করবে? আর এই সঙ্গে যে প্রশ্ন জাগে তা হল দক্ষিণে অর্থাৎ মহেঞ্জোদাড়োর দক্ষিণে কি বৃত্র ছিল না?

বৃত্র যে দক্ষিণে ছিল না তা আমরা বুঝি ঋগ্বেদের এই কথা থেকে, “রাজা ইন্দ্র বৃত্রকে পূর্ব পশ্চিম ও উত্তর দেশে বধ করেছেন “(৩।৫৩।১১)। পূর্ব, পশ্চিম ও উত্তর দেশে বৃত্র ধ্বংস করা হল কিন্তু দক্ষিণ দেশে নয় কেন? সুতরাং এটা স্পষ্ট যে, বৈদিক যুদ্ধের সময় দক্ষিণে বৃত্র ছিল না। তাহলে কি দক্ষিণে কখনই বৃত্র ছিল না?

কিন্তু প্রত্নতত্ত্বের সাক্ষ্য সে কথা বলে না। তাছাড়া একই রাষ্ট্র ও সভ্যতাভুক্ত মহেঞ্জোদাড়োকে জলসেচব্যবস্থার বাইরে রাখবার ও কারণ নেই। সুতরাং এই জায়গায় নিশ্চয় কোন গভীর রহস্য আছে যা ভেদ করতে পারলে ঋগ্বেদ থেকে আমরা ইতিহাসের আরও নূতন সূত্র খুঁজে পাব।

এই রহস্য ভেদ করতে হলে আমাদেরকে ঋগ্বেদের একটি বৈশিষ্ট্য বুঝতে হবে। সেটি হল দ্ব্যর্থক শব্দ বা রূপক ব্যবহারের প্রবণতা। একটি শব্দ বা বিষয়কে অনেক সময় এমনভাবে উপস্থিত করা হয় যাতে তার এক সঙ্গে দুই রকম অর্থ হয়।

আমরা দেখেছি নগর-দুর্গ কিংবা দুর্গ বোঝাতে পর্বত, গিরি, অদ্রি ইত্যাদি শব্দের ব্যবহার। অথচ পর্বত বা গিরির প্রকৃত অর্থ ভিন্ন। মেঘের বৈদিক প্রতিশব্দ দ্বারা আকাশের মেঘ এবং জলাধার উভয়ই বোঝানো হয়েছে। অহির প্রকৃত অর্থ সর্প কিন্তু তা দ্বারা নদী বা জলাধারের বাঁধকেও বোঝানো হয়েছে। কিছু ক্ষেত্রে গাভী দ্বারা নদীকেও বোঝানো হয়েছে মনে করার যুক্তিসঙ্গত কারণ আছে।

এমন মনে করা অনুচিত হবে যে, সিন্ধুর এত উন্নত সভ্যতার অধিকারীদের শব্দ ভাণ্ডার এত দরিদ্র ছিল যে, দুর্গ বা জলাধার কিংবা বাঁধ্যের জন্য তাদের নির্দিষ্ট শব্দ ছিল না। কারণ এত দরিদ্র শব্দ ভাণ্ডার নিয়ে তাদের পক্ষে উন্নত ও জটিল নাগরিক সভ্যতা গড়ে তোলা সম্ভব হত না। পর্বত বলতে বৃহৎ পাহাড় নাকি দুর্গ আর অহি বলতে সাপ নাকি বাঁধ এই বোঝাতে যদি ভাবভঙ্গিমায় সময় যায় তবে তারা সভ্যতাকে ভাষার আওতায় আনবার সময় ও শক্তি পাবে কিভাবে? সুতরাং আমাদের বিষয়টিকে একটু ভিন্নভাবে ভাবা দরকার।

ঋগ্বেদ ব্যাখ্যার সময় আমাদের এ কথা মুহূর্তের জন্য ভোলা উচিত হবে না যে, এটি একটি জনপ্রিয় গণ-আন্দোলনের মধ্য থেকে সৃষ্টি হয়েছে। অর্থাৎ এটি গণবিচ্ছিন্ন ও সমাজবিচ্ছিন্ন কিছু সংখ্যক ঋষির রচিত শব্দের মারপ্যাঁচের সমষ্টি মাত্র নয়। মন্ত্রগুলি এখন আমাদের কাছে যতই দুর্বোধ্য কিংবা অর্থহীন মনে হোক সৃষ্টির সময় সেগুলি ছিল সাধারণ মানুষের অন্ততপক্ষে এক বিরাট অংশের আশা-আকাঙ্ক্ষা ও দাবীর বোধগম্য প্রকাশ। যারা বৈদিক যুদ্ধে অংশ নিয়েছিল বা তাকে সমর্থন করেছিল তারা তা নিশ্চয় একদিনে করে নি। এর জন্য দীর্ঘকাল ধরে ঋষিগণ তাদেরকে বুঝিয়েছেন এবং বিভিন্ন মন্ত্র রচনা ও পাঠ এবং পূজা অনুষ্ঠান দ্বারা তাদের অন্তরে নূতন বিধানের পক্ষে আস্থা এবং পুরাতন বিধানের বিরুদ্ধে লড়বার ভরসা জাগিয়েছেন। কাজেই মন্ত্রের অর্থও বোঝাতে হয়েছে অন্তত যারা সমর্থক তাদেরকে।

আমরা অনুমান করতে পারি যে, বৈদিক আন্দোলন শুরু হয়েছিল এক শক্তিশালী রাষ্ট্র ও ধর্মের বিরুদ্ধে। সিন্ধু-হরপ্পান রাষ্ট্র ও ধর্মীয় যন্ত্রের নিয়ন্ত্রণক্ষমতা সহজেই অনুমেয়। সুতরাং আমরা অনুমান করতে পারি যে, বৈদিক আন্দোলনকে দীর্ঘদিন গোপন পদ্ধতিতে ও সুকৌশলে অগ্রসর হতে হয়েছে।

কিন্তু এই সঙ্গে আমরা এ কথাও বলতে পারি যে, এই আন্দোলন শুধু গোপন থাকলে এত বিরাট ব্যাপ্তি নিতে কিংবা গণ আন্দোলন ও গণ যুদ্ধে রূপ নিতে পারত না। সেক্ষেত্রে ব্যাপারটা হত ভিন্ন রকম। অর্থাৎ সিন্ধু সভ্যতার পতন ঘটাতে হত বহিঃশক্তির আক্রমণ দ্বারা। তার ফল আর যা-ই হোক আমরা ঋগ্বেদ পেতাম না। সুতরাং ঋগ্বেদ এমন এক গণ আন্দোলনের ফসল যা একই সঙ্গে গোপন এবং প্রকাশ্য ছিল।

কিন্তু সম্ভবত শুধু এইটুকু বললে রূপক ব্যবহারের তাৎপর্য স্পষ্ট হয় না। এর সঙ্গে সম্ভবত একই রকম কিংবা অধিকতর গুরুত্বপূর্ণ বিষয় যেটি ছিল সেটি হল জনগণ এবং সমাজের প্রচলিত মূল্যবোধ এবং ধর্মীয় বিশ্বাসে আঘাত না করে প্রচলিত ব্যবস্থার ভিত্তিকে আঘাত করবার উদ্দেশ্য।

বিষয়টিকে আর একটু ব্যাখ্যা করা যাক। আমরা ইতিপূর্বে বলেছি যে, বৃত্রের বিরুদ্ধে দীর্ঘকাল ধরে ক্ষোভ সৃষ্টি হয়েছিল। এখন ঋষিরা যদি নদীনিয়ন্ত্রণব্যবস্থার বিরুদ্ধে জনমত এবং গণ আন্দোলন সৃষ্টি করতে চান তবে তাঁদেরকে এটা ধ্বংসের জন্য মন্ত্র রচনা করে দেবতাদের কাছে প্রার্থনা জানাতে হবে। হয়ত প্রথম দিকে এটা প্রধানত বরুণের কাছেই জানানো হত।

কিন্তু নদীনিয়ন্ত্রণব্যবস্থা কিংবা বাঁধের প্রকৃত ও প্রচলিত নাম দিয়ে এটা করা যাবে না। কারণ প্রচলিত রাষ্ট্রীয় ও ধর্মীয় কর্তৃত্ব এটা করতে দিতে চাইবে না। দ্বিতীয়ত জনগণই এটা গ্রহণ করতে চাইবে না তাদের দীর্ঘকালের বিশ্বাস ও ঐতিহ্যে আঘাত পড়ায়। কারণ এ ব্যাপারে সন্দেহ করবার কারণ নেই যে, নদীনিয়ন্ত্রণব্যবস্থা ততদিনে তাদের ধর্ম ও সামাজিক ঐতিহ্যের অংশ হয়ে গিয়েছে। কাজেই যত কষ্টই হোক তাকে আঘাত না করে বরং তার কাছ থেকেই সমাধান চাইবে কিংবা তার দৈব রূপের নিকট করুণা প্রার্থনা করবে এমনটাই স্বাভাবিক।

সম্ভবত নদীরোধক কিংবা বাঁধকে বৃত্র বলা হত না। তার জন্য ভিন্ন শব্দ ছিল। অহিও সম্ভবত বাঁধের প্রতিশব্দ নয় যদিও বাঁধ বিশাল সাপের মত মাটিতে পড়ে থাকায় অহি দ্বারা তার অর্থ চমৎকার রূপে প্রকাশ করা যায়। একইভাবে দুর্গের প্রতিশব্দও পর্বত না হওয়াই সম্ভব।

এখন ধরা যাক বৃত্র বা অহির বিরুদ্ধে জনমত সৃষ্টির বিষয়। বৃত্র অর্থ প্রতিবন্ধক বা বাধাদানকারী। ঋগ্বেদেও তাকে বলা হয়েছে নদী “প্রতিরোধকারী” (১।৫২।২)। এখন যদি ঈশ্বর বা দেবতাদের কাছে প্রতিবন্ধক বা সর্প ধ্বংসের জন্য গণ প্রার্থনার আয়োজন করা যায় তবে কর্তৃপক্ষের কি করবার থাকবে? অন্যদিকে জনগণের প্রচলিত ধর্মীয় অনুভূতিতেও হঠাৎ করে আঘাত লাগবে না। অথচ ঋষিরা এবং জনগণ বুঝছেন যে, তারা দেবতার কাছে কি চাইছেন এবং তাঁরা এটাও ধরে নিয়েছেন যে, তাঁরা যে অর্থে ঈশ্বর বা দেবতার কাছে প্রার্থনা জানাচ্ছেন ঈশ্বর বা দেবতা সেই অর্থেই প্রার্থনাকে গ্রহণ করবেন। অর্থাৎ এটা জনমত সৃষ্টি ও গণসমাবেশের একটি পদ্ধতি।

সম্ভবত এইভাবে ধীরগতিতে আন্দোলন এগিয়েছে। এবং এক সময় শব্দগুলি তার নূতন অর্থ নিয়ে দৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। ক্রমে বরুণের পাশে নূতন দেবতা হিসাবে বরুণেরই অধীনস্থ ইন্দ্র এবং অন্যান্য দেবতা প্রবল রূপ নিয়ে উঠে এসেছে। অর্থাৎ ক্রমে পুরাতন ব্যবস্থার ভিতর থেকেই তার নিয়ন্ত্রণ ভেঙ্গে একটা নূতন শক্তি বা শক্তি জোট দাঁড়িয়েছে।

আমরা লক্ষ্য করেছি পুর শব্দের মধ্যে কোন দ্বৈততা নেই। এ ক্ষেত্রে রূপক ব্যবহার করা হয় নি। অথচ দুর্গের ক্ষেত্রে হয়েছে। কিন্তু কেন? আমরা জানি নগর-দুর্গগুলিই ছিল হরপ্পা সভ্যতার প্রশাসনিক-ধর্মীয়-সামরিক কেন্দ্র। আমরা অনুমান করতে পারি যে, পুর বা নগরের অধিবাসী ঋষিগণ দেবতাদের কাছে পুর ধ্বংসের জন্য প্রার্থনা না করে এইসব দুর্গ কিংবা সেগুলির অধিকারীদের ধ্বংসের জন্য প্রার্থনা করেছেন। এইভাবে বহু ব্যবহারে বিশেষত ধর্মীয় ব্যবহারে শব্দগুলি মন্ত্রযুক্ত হয়েছে।

আমরা রূপক ব্যবহারের এই সম্ভাব্য পটভূমি মনে রেখে অগ্রসর হলে সম্ভবত ঋগ্বেদের সব গুরুত্বপূর্ণ রহস্যই ভেদ করতে পারব।

ঋগ্বেদ এক দুর্ভেদ্য রহস্য বা ধাঁধা সৃষ্টি করেছে গাভী বা ধেনু শব্দ প্রয়োগ দ্বারা। এর প্রকৃত তাৎপর্য অনেক সময় না বোঝায় ঋগ্বেদের অনেক ভ্রান্ত ব্যাখ্যা হয়েছে। অথচ আমরা একটু মনোযোগ দিয়ে পাঠ করলে বুঝব যে, বিশেষ কতকগুলি ক্ষেত্রে ব্যবহৃত গাভী বা গরুর সঙ্গে আমাদের বহু পরিচিত শৃঙ্গযুক্ত চতুষ্পদ প্রাণীটির কোন সম্পর্ক নেই, এগুলি নদী বা নদীস্রোতের বর্ণনা মাত্র। আর এই বিষয়টি ধরতে পারলে বৈদিক আন্দোলনের এক অজ্ঞাত ও চমকপ্রদ অধ্যায় আমাদের সামনে উন্মোচিত হয়।

গাভীকে কিভাবে জলের রূপক হিসাবে ব্যবহার করা হয়েছে তা বোঝার জন্য আগে আমরা কয়টি উপমার প্রয়োগ দেখি:

“ইন্দ্র পর্বতাশ্রিত অহিকে হনন করেছিলেন; ত্বষ্টা ইন্দ্রের জন্য সুদূরপাতী বজ্র নির্মাণ করেছিলেন: তারপর যেরূপ গাভী সবেগে বৎসের দিকে যায়, ধারাবাহী জল সেরূপ সবেগে সমুদ্রাভিমুখে গমন করেছিলেন” (১।৩২।২)।

“ইন্দ্র স্বকীয় বল দ্বারা জলশোষক বৃত্রকে বজ্র দ্বারা ছেদন করেছিলেন; এবং গাভীসমূহের ন্যায় বৃত্র দ্বারা অবরুদ্ধ জগতের রক্ষণশীল জলসমুদয় ছেড়ে দিয়েছিলেন” (১।৬১।১০)।

উপরের মন্ত্র দুটিতে উপমার প্রয়োগ সহজবোধ্য। এখন আমরা একটু জটিল রূপকে প্রবেশ করতে পারি : “হে অঙ্গিরাবংশীয় বৃহস্পতি! পর্বত গোসমূহ আবরণ করেছিল। তোমার সম্পদের জন্য যখন তা উদ্ঘাটিত হল এবং তুমি গোসমূহকে বার করে দিলে, তখন ইন্দুকে সহায় পেয়ে তুমি বৃত্র কর্তৃক আক্রান্ত জলের আধারভূত জলরাশিকে অধোমুখ করেছিলে” (২।২৩।১৮)।

উপরোক্ত মন্ত্রের তাৎপর্য কি এই নয় যে, দুর্গ জলধারাকে রুদ্ধ করে রেখেছিল এবং যখন তার দরজা খোলা বা ভাঙ্গা হল তখন জলরাশি মুক্ত হয়ে প্রবাহিত হয়েছিল? অঙ্গিরা গোত্রের পূর্বকালের ঋষিদের দ্বারা সংঘটিত এই ঘটনার বর্ণনা ঋগ্বেদে বহুবার করা হয়েছে। এবং এটি ঋগ্বেদের এক বিরাট রহস্য উদ্ঘাটনের জন্য একটি অসাধারণ সূত্র। এই ধরনের আরও কয়েকটি মন্ত্র উল্লেখ করা যায় :

“দেবগণের মধ্যে সর্বোৎকৃষ্ট দেবতা সে ব্রহ্মণস্পতির কার্য দ্বারা দৃঢ় পর্বত শ্রথিত হয়েছিল ও সংস্তম্ভিত বৃক্ষাদি ভগ্ন হয়েছিল, তিনি গোসকলকে উদ্ধার করেছিলেন, মন্ত্রের দ্বারা বলকে ভেদ করেছিলেন (২।২৪।৩); যে প্রস্তরবৎ দৃঢ়মুখবিশিষ্ট, মধুর জলপূর্ণ, নিম্নবিলম্বিত মেঘকে ব্রহ্মণস্পতি বল দ্বারা বধ করেছিলেন, আদিত্যরশ্মি সকল তা পান করেছে এবং তারাই আবার জলধারাময় বৃষ্টি সেক করেছেন” (২।২৪।৪)।

“হে ইন্দ্র! বল নামক গোব্রজ বজ্র প্রহারের পূর্বেই ভীত হয়ে বিশ্লিষ্ট হয়েছিল। ইন্দ্র গাভীর নির্গমনের জন্য পথ সুগম করেছেন, রমনীয় শব্দায়মন জল সকল, বহুলোকের আহূত ইন্দ্রের অভিমুখে আগমন করেছিল” (৩।৩০।১০)।

“তিনি মেধাবী অঙ্গিরাগণের জন্য জননীস্বরূপ স্বর্গ ও পৃথিবীকে সূর্য দ্বারা প্রকাশিত করেছেন এবং তাঁদের দ্বারা স্তূয়মান হয়ে পর্বতকে চূর্ণ করেছেন এবং ধ্যানপরায়ণ স্তোতৃবর্গ অঙ্গিরাগণ কর্তৃক বার বার প্রার্থিত হয়ে ধেনুগণের বন্ধন মোচন করেছেন (৬।৩২।২), বহুকর্মের অনুষ্ঠানকারী ইন্দ্র ধেনুগণের উদ্ধারের জন্য জলপাতনপূর্বক নিরন্তর হব্যপ্রদানকারী স্তোতৃবর্গ অঙ্গিরাগণের সাথে মিলিত হয়ে শত্রুদের পরাজিত করেছেন। মিত্রভূত, মেধাবী অঙ্গিরাগণের সাথে মিত্রাভিলাষী ও দূরদর্শী হয়ে সে পুরন্দর দৃঢ় পুরীসকল ধ্বংস করেছেন” (৬।৩২।৩)।

সম্ভবত আর উদাহরণের দরকার হবে না। উপরের মন্ত্রগুলিতে এটা স্পষ্ট যে, এখানে গাভী নদী বা নদীস্রোতের রূপক। দুগ্ধবতী গাভীর দুগ্ধদানের সঙ্গে স্রোতবতী নদীর জলদানের তুলনা থেকে যে ঋষিগণ নদী বা নদীর স্রোতধারা বোঝাতে গাভীর রূপক ব্যবহার করেছেন সেটা স্পষ্ট। আমরা অল্পপূর্বে ৪।১৯।৭ ঋকে দেখেছি যেখানে ইন্দ্র সম্পর্কে বলা হয়েছে, “তিনি দস্যুদের অধিকৃতা প্রসবনিবৃত্তা গাভীসকলকে দোহন করেছেন।” অর্থাৎ যে নদীখাত জলহীন হবার কারণে প্রসবনিবৃত্তা গাভীর মত দুগ্ধহীনরূপ জলহীন হয়েছিল সেই নদীখাত পুনরায় দুগ্ধবতী গাভীর মত দুগ্ধ-রূপ জলপূর্ণ হয়েছে – এই হল এই কথার অর্থ।

ঋগ্বেদ আমাদের কাছে এই বিষয়টি স্পষ্ট করে যে, এই অঙ্গিরাগণই হলেন নদীনিয়ন্ত্রণব্যবস্থার বিরুদ্ধে এবং প্রচলিত ধর্মের বিরুদ্ধে বিদ্রোহের পতাকা প্রথম উত্তোলনকারী যাঁরা মহেঞ্জোদাড়োর দক্ষিণের বৃত্র বা ব্যারেজ যা-ই হোক ভেঙ্গেছিলেন। সম্ভবত নদীর দুই পাড়ে ছিল বৃত্রনিয়ন্ত্রণ ও রক্ষার জন্য দুর্ভেদ্য ও বিশাল দুর্গ এবং মাঝখানে ছিল সেতু ও জলকপাট। মাঝখানে পাথর বা ইটের কাঠামো ছিল কি না বলা যায় না তবে ঋগ্বেদের বর্ণনার ধরণ থেকে মনে হয় যে, মাঝখানে প্রস্তর বা ইট এবং সেই সঙ্গে কাঠের কাঠামো থাকা অসম্ভব নয়। একটু পূর্বে ২।২৪।৩ ঋকে আমরা দেখি যে বলা হচ্ছে, “দৃঢ় পর্বত শ্রথিত হয়েছিল ও সংস্তম্ভিত বৃক্ষাদি ভগ্ন হয়েছিল”। সম্ভবত সংস্তম্ভিত বৃক্ষাদি নদীখাতে কাষ্ঠস্তম্ভের বর্ণনা। অবশ্য ২।২৪।৪ ঋকে বলা হচ্ছে, “যে প্রস্তরবৎ দৃঢ়মুখবিশিষ্ট, মধুর জলপূর্ণ, নিম্নবিলম্বিত মেঘকে ব্রহ্মণস্পতি বল দ্বারা বধ করেছিলেন”। এতে ব্যারেজে ইট বা পাথর ব্যবহার করা হত এমন সন্দেহও জাগে।

এই কথাগুলিও তাৎপর্যপূর্ণ,

“তাঁরা (পিতৃপুরুষ অঙ্গিরাগণ) পর্বত বিদারণ সময়ে অগ্নির পরিচর্যা করেছিলেন (৪।১।১৪), তাঁরা কর্মনেতা এবং অগ্নিকাম। তাঁরা মনে মনে গো লাভ ইচ্ছা করে দ্বার নিরোধক, দৃঢ়বদ্ধ, গাভীগণের অবরোধক এবং সর্বতোব্যাপ্ত গোপূর্ণ গোষ্ঠরূপ পর্বতকে অগ্নিবিষয়ক স্তুতি দ্বারা উদ্ঘাটন করেছিলেন” (৪।১।১৫)।

উপরোক্ত মন্ত্রগুলির অর্থ তো এই যে, অগ্নি দগ্ধ করে জলের নির্গমন দ্বার মুক্ত করা হয়েছিল। নদীখাত মাটি দ্বারা সম্পূর্ণ রুদ্ধ করলে সেখানে নদীমুক্ত করবার জন্য অগ্নি প্রয়োগের প্রয়োজন হত না। ঋগ্বেদের বহু মন্ত্র দ্বারাই বোঝা যায় যে, এই পর্বত দ্বারা নদীস্রোত অবরুদ্ধ বা আবৃত করে রাখা হয়েছিল। বিশেষত বৃহস্পতি দেবতার স্তুতিতে অযাস্য ঋষি কর্তৃক রচিত ১০।৬৭ সূক্ত নদীনিয়ন্ত্রণব্যবস্থার রূপ উপলব্ধির জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হতে পারে। তার কিছু মন্ত্র বলের কিংবা বল নামক পর্বত বা দুর্গ দ্বারা রক্ষিত নদীনিয়ন্ত্রণব্যবস্থায় প্রস্তর কিংবা ইট এবং জলকপাট সংযুক্ত কাঠামোর ইঙ্গিত দেয় :

“২। অঙ্গিরার বংশধরেরা যজ্ঞের সুন্দর স্থানে যেতে মনস্থ করল। তারা সত্যবাদী, তাদের মনের ভাব সরল, তারা স্বর্গের পুত্র, মহাবলে বলী, তারা বুদ্ধিমান ব্যক্তির ন্যায় আচরণ করে থাকে। ৩। বৃহস্পতির সহায়গণ হংসের ন্যায় কোলাহল করতে লাগল, তাদের সাহায্যে তিনি প্রস্তরময় দ্বার খুলে দিলেন। অভ্যন্তরে রুদ্ধ গাভীগণ চীৎকার করে উঠল। তিনি উৎকৃষ্টরূপে স্তব ও উচ্চৈস্বরে গান করে উঠলেন। ৪। গাভীগণ নিম্নের একটি দ্বারের দ্বারা এবং উপরের দিকে দুটি দ্বারের দ্বারা অধর্মের আলয় স্বরূপ সে গুহার মধ্যে রুদ্ধ ছিল। বৃহস্পতি অন্ধকারের মধ্যে আলোক নিয়ে যেতে ইচ্ছা করে তিনটি দ্বার খুলে দিলেন এবং গাভীগণকে নিষ্কাশিত করলেন। ৫। তিনি রাত্রে নিভৃতভাবে শয়নপূর্বক পুরীর পশ্চাৎভাগ বিদীর্ণ করলেন এবং সমুদ্রতুল্য সে গুহার তিনটি দ্বারই খুলে দিলেন। প্রাতঃকালে তিনি পূজনীয় সূর্য আর গাভী এক সঙ্গে দর্শন পেলেন, তখন তিনি মেঘের ন্যায় বীরহুঙ্কার ছেড়েছিলেন।

৬। যে বল গাভী রুদ্ধ করেছিল, তাকে ইন্দ্র আপনার হুঙ্কাররবেই ছেদল করলেন। ….. তিনি পণিকে কাঁদালেন, তার গাভী কেড়ে নিলেন। ৭। তিনিই সত্যবাদী, দীপ্তিমান, ধনদানকারী সহায়দের সাথে গাভীরোধকারী বলকে বিদীর্ণ করলেন। আর ব্রহ্মণস্পতি বিপুলমূর্তি, বদান্য, ঘর্মাক্ত কলেবর দেবতাদের সাথে সে গোধন অধিকার করলেন।”

সুতরাং আমরা অনুমান করতে পারি, সর্বদক্ষিণে নদীখাতে যেখানটায় বৃত্র ছিল সেখানে ছিল জলনিয়ন্ত্রণব্যবস্থার এক উন্নত জটিল ও বৃহৎ আয়োজন এবং তার রক্ষণাবেক্ষণ ও নিরাপত্তার জন্য এক সুদৃঢ় ও বৃহৎ দুর্গ।

অঙ্গিরা বংশীয় পূর্বতন ঋষিগণ এই দুর্গ এবং জলনিয়ন্ত্রণব্যবস্থাকেই সফলভাবে ধ্বংস করেন। এই দুর্গের নাম হয়ত ছিল বল কিংবা তা হয়ত ছিল তার অধিপতির নাম। সুতরাং ঋগ্বেদে অনেকবার বলের বিদারণ বা বিনাশের প্রসঙ্গে এসেছে। আর এই ঘটনায় অঙ্গিরাগণ বৃত্রবিরোধী বৈদিক আন্দোলনে বীরে পরিণত হয়েছেন।

কিন্তু এটা স্পষ্ট যে, এই অঙ্গিরাগণ ছিলেন পরবর্তী সফল বৈদিক আন্দোলনের বহুকাল পূর্বের মানুষ। এই কারণে যুদ্ধ চলাকালীন ঋগ্বেদের ঋষিগণ তাঁদের সম্পর্কে এই ভাবে উল্লেখ করেছেন, “অঙ্গিরা নামক আমাদের পিতৃগণ” (১।৭১।২) কিংবা “আমাদের পূর্বপুরুষগণ” (৪।১।১৩)। ঋগ্বেদে তাঁদের প্রাচীন কীর্তির উল্লেখ বহুবার বহুভাবে হয়েছে। এর সঙ্গে আবার পণি এবং সরমার নামও অনেকবার যুক্ত হয়েছে।

এই অঙ্গিরাগণ-ই বৃত্রধ্বংসের উদ্দেশ্যে প্রথম ইন্দ্রের পূজা প্রবর্তন করেন বলে মনে হয়। কারণ গৃৎসমদ ঋষি বলছেন, “হে স্তোতাগণ! তোমরা অঙ্গিরাগণের ন্যায় নূতন স্তুতি দ্বারা ইন্দ্রকে উপাসনা কর। যেহেতু ইন্দ্রের শোষক তেজ: পূর্বকালের ন্যায় উদিত হচ্ছে। যেহেতু সোম জনিত হর্ষ উৎপন্ন হলে ইন্দ্র বৃত্র কর্তৃক আক্রান্ত সমস্ত মেঘরাশি উদ্ঘাটিত করেছিলেন।” (২।১৭।১)।

বিশ্বামিত্র ঋষিও বলছেন,

“হে ইন্দ্র! তুমি পুরাতন, অঙ্গিরাগণের ন্যায় আমি তোমাকে পূজা করছি, আমি তোমাকে ভজনা করবার জন্য নূতন করছি। তুমি দেবশূন্য বহুদ্রোহকারিদের মেরে ফেল” (৩।৩১।১৯)।

ঋগ্বেদের বর্ণনা থেকে আমরা সিদ্ধান্তে পৌঁছতে পারি যে, অঙ্গিরাগণ বৃত্র ধ্বংসের জন্য প্রথম ধর্ম সংস্কার করেন এবং বরুণের পরিবর্তে ইন্দ্র, অগ্নি প্রভৃতি দেবতাকে গুরুত্বপূর্ণ স্থান প্রদান করেন এবং সর্বোপরি প্রথম বৃত্র ধ্বংস করেন।

অর্থাৎ এটি ছিল সিন্ধু-হরপ্পান রাষ্ট্রীয় ও ধর্মীয় কর্তৃত্বের বিরুদ্ধে দক্ষিণাঞ্চলের প্রথম বিদ্রোহ। আমরা অনুমান করি যে, এই বিদ্রোহ দমনে ব্যর্থ হয়ে হরপ্পার সরকার বৃত্রব্যবস্থার জাল রুদ্ধ করে দক্ষিণে জলসরবরাহ সম্পূর্ণরূপে বন্ধ করে দেয় আর এইভাবে দক্ষিণাঞ্চল মরুভূমিতে পরিণত হয়।

ঋগ্বেদ কর্তৃক জলপ্রবাহ বন্ধের এই বিবরণের সত্যতা সম্পর্কে কোন সন্দেহ নেই। কিন্তু প্রশ্ন জাগে দক্ষিণাঞ্চলে যে বিপুল জলরাশি যেত সেটা বন্ধ করা হলে উত্তারঞ্চল কি জলমগ্ন হয় নি? এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়ে এই সন্দেহ জাগে যে, কাশ্মীর ও উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত কিংবা আফগানিস্তানে নদীগুলির উপত্যকায় বাড়তি জল সঞ্চয় করে রাখবার মত ব্যবস্থা ছিল। নতুবা হরপ্পা এমন ঝুঁকি কেন নিবে?

আমরা সহজেই অনুমান করতে পারি, বন্যা ও জলাবদ্ধতা যা পারে নি এই জলহীনতা তা পেরেছিল। মহেঞ্জোদাড়ো নগর পরিত্যক্ত হয়েছিল। সম্ভবত জলশূন্য দক্ষিণাঞ্চল থেকে ব্যাপক জনসংখ্যা উত্তর এবং অন্যত্র আশ্রয় নেয়। এই সময়ই বৈদিক আন্দোলনের ঋষি, তাদের অনুসারী বিদ্রোহী কর্মকর্তা, প্রশাসক, যোদ্ধা ইত্যাদি চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে বলে অনুমান করা যায়।

আপাত দৃষ্টিতে হরপ্পা সফল হয়েছিল। কারণ ঋগ্বেদ পড়লে বোঝা যায় এই ঘটনাটি অনেককাল পূর্বের। এই অঙ্গিরাগণের কোন মন্ত্র পর্যন্ত ঋগ্বেদে নেই। অর্থাৎ এটা প্রথম পর্যায়। একটা ধর্মীয় গণ-অভ্যুত্থানের পর্যায়। যা সফল হয়েও ব্যর্থ। কিন্তু এটাই পরবর্তী সাফল্যের ভিত্তি নির্মাণ করেছে এবং সমস্ত আন্দোলনের জন্য অগ্নি-মশাল হয়ে থেকে পথ দেখিয়েছে। এই ঘটনার ভাবপ্রেরণা কোনদিন ম্লান হয় নি।

এখন এটা আরও পরিস্কার হয় যে, অঙ্গিরাদের মত অনেক ঋষি ও রাজর্ষি বৈদিক আন্দোলন গড়ে তুললেও ঋগ্বেদ এই আন্দোলনের পরিণত ও চূড়ান্ত পর্যায়ের সৃষ্টি মাত্র। এই কারণে আমরা ঋগ্বেদে অনেক ঋষি ও রাজর্ষির নাম পেলেও ঋগ্বেদে তাঁদের কোন মন্ত্র পাই না। অর্থাৎ বৈদিক সমাজ শুধু তাঁদের মন্ত্রগুলিকে রক্ষা করেছে যাঁরা এই আন্দোলনকে পরিণত ও সফল রূপ দিতে পেরেছেন।

সুতরা আমরা ঋগ্বেদের জলের প্রশ্নের উত্তর পেলাম। সিন্ধু সভ্যতার ধ্বংসের কারণ হিসাবে প্রত্নতাত্ত্বিকদের জলাবদ্ধতা ও বন্যার সপক্ষে যেমন একটি মত আছে তেমন জলহীনতা বা খরার সপক্ষেও একটি মত আছে২৭। বস্তুত এই উভয়ের মধ্যেই সত্য আছে। প্রথম পর্যায়ে বন্যা ও জলাবদ্ধতা এবং দ্বিতীয় পর্যায়ে জলহীনতা এই সভ্যতার পতনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। দক্ষিণাঞ্চল জলহীন হয়েছিল বৃত্র ধ্বংসের প্রতিক্রিয়ায় উত্তর থেকে জলপ্রবাহ রুদ্ধ করায়। এবং উত্তরাঞ্চল জলহীন হয়েছিল বৃত্রব্যবস্থা ধ্বংস করায়।

বৈদিক আন্দোলন নগর-সভ্যতা ধ্বংসের সচেতন উদ্দেশ্য নিয়ে পরিচালনা করা হয়েছিল বলে মনে হয় না। এটা ঠিক যে, ইন্দ্রকে পুরন্দর বা পুর ভেদী বলা হয়েছে। কিন্তু তাকে সকল রকম পুরভেদী বলা হয় নি। শত্রুর পুর ভেদী রূপেই তাকে আমরা দেখি। ঋগ্বেদের ঋষি ইন্দ্রের উদ্দেশ্যে যখন বলেন “তুমি দেবরহিত বিপক্ষ নগর সকল ভেদ করেছ এবং দেবরহিত শত্রুর অস্ত্র নত করেছ” (১।১৭৪।৮) তখন এর অর্থ স্পষ্ট। আমরা পূর্বেই উল্লেখ করেছি যে, ঋগ্বেদের বর্ণনা অনুযায়ী বৈদিক পক্ষেরও পুর বা নগর ছিল। অর্থাৎ তারা অনেকেই নগরবাসী ছিল এবং নগরের মর্ম ভালই বুঝত। তা না হলে কেন ঋষি ইন্দ্রকে নগরের সঙ্গে তুলনা করে বলবেন, “হে ইন্দ্র! তুমি দৃঢ় হও, তুমি নগরের ন্যায় মঙ্গলময়ী” (৮।৮০।৭)। কিংবা বৈদিক শক্তি শুধু নগরধ্বংসী হলে এ কথা বলা হত না : “সমবৃত্তি, সহায়রহিত ইন্দ্র, পতি যেরূপ পত্নীকে শোধন করেন, সেরূপ সমস্ত শত্রুনগরী শোধন করেছিলেন” (৭।২৬।৩)। স্বামী কর্তৃক পত্নীকে শোধন করবার উপমা দেবার অর্থ শত্রুর নিকট থেকে নগরগুলিকে অধিকার করে সেখানে নিজেদের ধর্ম ও শাসন প্রতিষ্ঠা করা। নগর ধ্বংসের জন্য এমন উপমার ব্যবহার হতে পারে না।

এটা ঠিক যে, যখন যুদ্ধ শুরু হয় তখন পুরাতন অনেক বন্ধন ছিন্ন হয়, রক্তপাত জন্ম দেয় ঘৃণার। ফলে শত্রুপক্ষের নগর লুণ্ঠন ও ধ্বংসও অস্বাভাবিক নয়। বিশেষত যদি এই যুদ্ধ প্রধানত উত্তর ও দক্ষিণ কিংবা মধ্য ও প্রান্ত এই ধরনের বিবদমান অঞ্চলের মধ্যে সংঘাতে পরিণতি লাভ করে তবে সেটা অনেক ক্ষেত্রে স্বাভাবিক হবে। এই সঙ্গে আমরা ধরে নিতে পারি যে, এই যুদ্ধে বাহিরের বিভিন্ন শক্তি যোগ দিয়েছে।

যুদ্ধে দুইপক্ষই কম বেশী নিষ্ঠুরতা করেছে বলে মনে হয়। বিশেষত প্রতিষ্ঠিত সভ্যতা ও রাষ্ট্র বিরোধী এই যুদ্ধে মুক্ত হয়েছে সমাজের সব রকম লোভ, লুণ্ঠন, ধ্বংস এবং হিংসার শক্তি। কিন্তু তার জন্য যুদ্ধটাকে বহিরাগত শক্তির দ্বারা পরিচালিত নগরধ্বংসী মনে করবার কারণ নেই। সভ্যতা ধ্বংস নদীনিয়ন্ত্রণব্যবস্থা ধ্বংসের অনিবার্য পরিণতি মাত্র।

বৈদিক যুদ্ধ কতদিন চলেছিল আমরা জানি না। যত ক্ষয়িষ্ণুই হোক একটি সভ্যতার প্রতিরোধ শক্তি কম হতে পারে না। বিশেষত যে নদীনিয়ন্ত্রণব্যবস্থার বিরুদ্ধে বৈদিক শক্তির যুদ্ধ সেই ব্যবস্থা যত ক্ষতিকর কিংবা অকার্যকর হয়ে পড়ুক তার অস্তিত্বের সঙ্গে সমাজ ও রাষ্ট্রের এক বিরাট অংশের অস্তিত্ব জড়িত ছিল। তারা প্রাণপণ লড়েছে। সব সময় পিছু হটেছে তা মনে হয় না। ঋগ্বেদেও যুদ্ধ চলাকালে প্রতিপক্ষের আক্রমণাত্মক অবস্থান মাঝে মাঝে অনুভব করা যায়। অঙ্গিরার পুত্র (অঙ্গিরাবংশীয় একজন মাত্র) কুৎস ঋষি ১।১০২।৪ ঋকে শত্রুর অবরোধ থেকে মুক্তি চেয়ে ইন্দ্রের কাছে আবেদন করছেন, “তোমাকে সহায় পেয়ে আমরা অবরোধকারী শত্রুদের পরাস্ত করব, সংগ্রামে আমাদের অংশ রক্ষা কর, হে ইন্দ্র! সহজে ধন পাই এরূপ করে দাও; হে মঘবন! শত্রুদের বীর্য ভেঙে দাও।”

গৃৎসমদ ঋষি ২।১২।১১ ঋকে যা বলছেন তা তাৎপর্যপূর্ণ, “হে মনুষ্যগণ! যিনি পর্বতে লুক্কায়িত শম্বরকে চল্লিশ বৎসর অন্বেষণ করে প্রাপ্ত হয়েছিলেন, যিনি বল প্রকাশকারী অহি নামক শয়ান দানবকে বিনাশ করেছিলেন, তিনিই ইন্দ্র।”

তার মানে এই বিবরণকে মূল্য দিলে বলতে হয়, মূল সিন্ধু উপত্যকাভূমি এবং সংলগ্ন এলাকায় অন্ততপক্ষে চল্লিশ বৎসর যুদ্ধ চলেছিল। কারণ “কুলিতরের অপত্য দাস শম্বর” (৪।৩০।১৪) এক পরাক্রান্ত ব্যক্তি। “ইন্দ্র প্রস্তরের ন্যায় বজ্র দ্বারা শম্বরের অতি পুরাতন একশত পুরী ভেদ  করেছিলেন” (২।১৪।৬) কিংবা “ইন্দ্র হব্যদাতা দিবোদাসকে শম্বরের পাষাণ নির্মিত শত সংখ্যক পুরী প্রদান করেছিলেন” (৪।৩০।২০)। সম্ভবত হরপ্পান সভ্যতা বা রাষ্ট্রের প্রতিরোধ যুদ্ধের সর্বাপেক্ষা বড় নেতা ছিলেন শম্বর। বঙ্গৃদের শত শত নগর জয়ের কথা বলা হলেও তার সম্পর্কে ঋগ্বেদে সম্ভবত একবারের বেশী উল্লেখ করা হয় নি।

কিন্তু যুদ্ধ যতদিন চলুক নদীনিয়ন্ত্রণব্যবস্থা ধ্বংসের পর সভ্যতার অস্তিত্বের কোন ভিত্তিই আর থাকে নি। বৃত্রব্যবস্থার সঙ্গে গেছে জলসেচব্যবস্থা তথা খাদ্যোৎপাদন। বিশাল ভূভাগ পরিণত হয়েছে মরুভূমি এবং পশুচারণভূমিতে। কিন্তু পশুপালন দ্বারা যে পরিমাণ মানুষ বাঁচতে পারে কৃষি দ্বারা তার অন্তত দশগুণ মানুষ বাঁচতে পারে। এর সহজ অর্থ হল কমপক্ষে নয় গুণ মানুষকে কমে যেতে হয়েছে।

সুতরাং লোকসংখ্যা দ্রুত এক বা দেড় কোটি থেকে নেমে এসেছে দশ বা পনের লক্ষে। যেহেতু এটি মূলত গৃহযুদ্ধ সেহেতু বহিরাগত শত্রুর আক্রমণে যে ধ্বংস ও গণহত্যা হয় সেটিও ঘটে নি। তাছাড়া শুধু পরাজিতদের নয় বিজয়ীদেরও তো এক অবস্থা। সুতরাং সমগ্র সিন্ধু উপত্যকা ও সমাজের ব্যাপক মানুষ নূতন ভূমির উদ্দেশ্যে চতুর্দিকে যাত্রা করেছে। বহিরাগত হানাদারদের ভয়ে সন্ত্রস্ত্র মানুষের এলোমেলো পলায়নের পরিবর্তে এই যাত্রা হয়েছে তুলনায় অনেক সুস্থির ও সংগঠিত।

অবশ্য একদিনে এই যাত্রা হয় নি। সব সময়ই এটা কম বেশী চলে। বিশেষত অনুমেয় যে, সম্প্রসারণের যুগে সিন্ধুর অধিবাসীরা দেশ অধিকার করেছে, নগর গড়েছে, বসতি করেছে। যখন মূল  ভূখণ্ডে সঙ্কট দেখা দিয়েছে তখন অনেকে প্রান্তে চলে গেছে। সেখান হতে কেউ বা আরও দূরে। আর যখন নদীনিয়ন্ত্রণব্যবস্থা ধ্বংস হল তখন লক্ষ লক্ষ মানুষ পূর্ব পশ্চিমে যে যে দিকে পারল যাত্রা করল। এইভাবে নদীনিয়ন্ত্রণব্যবস্থা ধ্বংসের সঙ্গে মৃত্যু দশায় উপস্থিত একটি মহান সভ্যতা যেমন আপাত দৃষ্টিতে হঠাৎ করে এক বিস্ফোরণের মত ধ্বংস হল তেমন একই সঙ্গে ঘটল আর একটি বিস্ফোরণ। ইতিহাসের এক বিস্ময়কর ও রহস্যঘেরা এক ঘটনা – আর্য বিস্ফোরণ।

সুতরাং এখন আমরা যে প্রশ্নের সম্মুখীন হচ্ছি সেটি হল আর্য প্রশ্ন। কারা আর্য এই প্রশ্নের আরও নির্দিষ্ট উত্তর পাওয়া দরকার। তবে সেই প্রশ্নে যাবার পূর্বে আমাদেরকে সিন্ধু সভ্যতার অপর একটি রহস্য ভেদ করবার চেষ্টা করতে হবে। সেটি হল সিন্ধুর সিল রহস্য। এর সঙ্গে জড়িত চিত্র এবং লিপির প্রশ্ন।

 

১০।  সিল, চিত্র এবং লিপি প্রশ্ন

আমরা যখন সিন্ধু-হরপ্পান ধর্মকে একেশ্বরবাদী এবং অপৌত্তলিক হিসাবে চিহ্নিত করেছি তখন থেকে সিন্ধু উপত্যকায় প্রাপ্ত সিলগুলি আমাদের সামনে একটি বিব্রতকর প্রশ্ন হয়ে ঝুলে থেকেছে। সিন্ধুর সমাজ এবং রাষ্ট্র যদি পৌত্তলিকতাবিরোধী হয়ে থাকে তবে সিন্ধুর সিলের কি ব্যাখ্যা হতে পারে?

সিলগুলিতে আছে মানুষ ও পশুসহ বিভিন্ন ধরনের জীবের ক্ষোদিত চিত্র। এগুলির অনেকগুলির ধর্মীয় তাৎপর্য স্পষ্ট। সিলগুলি কি কাজে ব্যবহার হত বলা কঠিন। এটা মনে করার যুক্তি আছে যে, এইসব সিলের অনেকগুলিই ছিল ধর্মীয় বিশ্বাস ও আচারের সঙ্গে সম্পর্কিত। হয়ত এগুলি মন্ত্রপুত রক্ষাকবচ হিসাবে ব্যবহৃত হত। হয়ত দূরবর্তী বাণিজ্যের দ্রব্যাদিতে ছাপ দেবার কাজে কোন কোনটির ব্যবহার হত।

সিলের যে উদ্দেশ্যই থাক তার সঙ্গে পৌত্তলিকতার একটি সম্পর্ক অনুমেয়। এটাকে আমরা সিন্ধু-হরপ্পার অপৌত্তলিক সভ্যতার সঙ্গে কিভাবে মেলাতে পারি? এর উত্তর সম্ভবত এই যে, এটি ছিল হরপ্পান রাষ্ট্র বা ধর্মীয় নেতৃত্বের একটি আপোস। আমরা ইতিপূর্বে হরপ্পান সভ্যতার নমনীয় বৈশিষ্ট্যের সম্ভাবনার উল্লেখ করেছি। এটা ঠিক যে, দমন এবং নিয়ন্ত্রণ ছিল। তবে সেটা সবক্ষেত্রে নয়। কাজেই সমাজের বিভিন্ন প্রবণতাকে তা নিয়ন্ত্রিতভাবে খাতবাহিত করবার জন্য বিভিন্ন কৌশলপূর্ণ ব্যবস্থা নিয়েছে বলে মনে হয়।

আমাদের এটা বোঝা দরকার যে, এই সভ্যতা ও সংস্কৃতি সুদীর্ঘকাল অব্যাহতভাবে সম্প্রসারিত হয়েছে। ফলে যুদ্ধ দ্বারাই হোক আর উন্নত ও সভ্য জীবনের আকর্ষণ দ্বারাই হোক কিংবা যুদ্ধ বা চাপ এবং উন্নত জীবনের আকর্ষণ এই উভয়ের সমন্বয় দ্বারাই হোক এই সভ্যতা ও সংস্কৃতি বাহির থেকে অবিরামভাবে নূতন নূতন উপজাতি, গোত্র, জাতি ও জনগোষ্ঠীকে তার আওতায় নিয়েছে। তারা সহজেই তাদের পূজাপদ্ধতি বা ধর্মীয় বিশ্বাস বর্জন করেছে তা মনে করবার কারণ নেই। তাছাড়া যারা সভ্যতায় দীর্ঘকাল থেকেছে তাদেরও অনেকে নিজেদের কিছু গোত্রীয় স্বাতন্ত্র্য রক্ষার জন্য নিজস্ব দেবতা বিশ্বাসকে মূর্ত রূপ দিতে পারে। বিশেষ করে সমাজের যত নীচের দিকে যাওয়া যায় এই প্রবণতা তত প্রবল বা গভীর হবার সম্ভাবনা থাকে। কারণ প্রতীকহীন বা মূর্তিহীন ধর্ম ও তার মর্ম ধারণা করা পশ্চাদপদ মানুষের পক্ষে খুবই কঠিন। বিশেষত সভ্যতার সেই ঊষা কালের কথাটি যদি আমরা চিন্তা করি তবে বিষয়টির গুরুত্ব আরও স্পষ্ট হবে। এই অবস্থায় যদি সামাজিক নেতৃত্ব কঠোর একনায়কী না হতে চায় তবে এই সমস্যার কৌশলী মীমাংসা বের করবে।

হরপ্পা সভ্যতার নগর পরিকল্পনা থেকে আমরা এই সমাজের নেতৃত্বের কর্মকৌশল ও মেধা সম্পর্কে কিছু ধারণা করতে পারি। তাঁরা নগর পরিকল্পনায় কতটা খুঁতখুঁতে ছিলেন তাও বোঝা যায়। একটি নগরে সব সময় সব রাস্তা সোজা বা সরল করবার উপায় থাকে না। খাল, ডোবা, ঢিবি কত কিছু থাকে। কিন্তু সেসব কিছু না মেনে স্কেল দিয়ে সোজা রেখায় নকশা আঁকার মত প্রায় সোজাভাবে রাস্তাগুলি নির্মাণ করা হয়েছে। এটা তো শুধু সম্পদ এবং জনশক্তি থাকলেই হয় না। সেসব তো কত সভ্যতারই ছিল। কিন্তু এই চিন্তাই প্রাচীন কালে আর কারও মাথায় আসে নি।

কিংবা ধরা যাক মাটির নীচের ঢাকনা যুক্ত নালা বা আন্ডারগ্রাউন্ড ড্রেন তৈরীর চিন্তার কথা। নগর পরিকল্পক কিংবা পৌরকর্তারা জানতেন যে, মানুষ থাকলেই তার দ্বারা ময়লা সৃষ্টি হবে। এই বাস্তবতাকে মেনে নিয়ে তাঁরা মল সহ তরল ময়লা নিষ্কাশনের এমন ব্যবস্থা করেছেন যা প্রাচীন পৃথিবীতে আর কোথায়ও করা হয় নি। তরল ময়লা নগর থেকে বাইরে যাবে অথচ নাগরিক স্বাস্থ্য, মন এবং পরিবেশ দূষিত করবে না এমনভাবে প্রতিটি নগরে আন্ডারগ্রাউন্ড ড্রেন তথা মাটির তল দিয়ে ময়লা সঞ্চালন ব্যবস্থা গড়ে তোলা হয়েছে।

এই রকমভাবে সমাজের পশ্চাৎপদ বা অনাকাঙ্ক্ষিত বিশ্বাস ও প্রবণতার সঞ্চালনের একটি পথ করে দেবার জন্য সিল ব্যবহার করা হতে পারে কি না এই বিষয়টি আমরা ভাবতে পারি। সেক্ষেত্রে আমাদেরকে এমন একটি সিদ্ধান্তে পৌঁছতে হতে পারে যে, এইসব সিলে সমাজের সরকারী ধর্মের প্রতিফলন খুঁজে লাভ নেই।

হয়ত ক্ষুদ্র মাটির খেলনা জাতীয় মূর্তিগুলির অন্তত একাংশ এবং একইভাবে সিলগুলিরও অন্তত একাংশ অপেক্ষাকৃত পশ্চাৎপদ কিংবা পৌত্তলিক জনগোষ্ঠীসমূহের ধর্মীয় বিশ্বাস ও আবেগ প্রকাশের একটি মাধ্যমে ছিল।

সিলের প্রশ্ন বিচারে আর একটি তথ্য আমাদের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আমরা জানতে পারছি যে, বিভিন্ন সিলে যেগুলিকে লিপি বলা হচ্ছে সেগুলির কোন বিকাশ নেই। চিত্রলিপি, অক্ষর ইত্যাদি সব মিলিয়ে ৪০০-এর মত যে চিহ্ন দেখা যাচ্ছে সেগুলি সব প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত এক জায়গায় দাঁড়িয়ে আছে।

আমাদের মনে এ বিষয়ে সন্দেহ নেই যে, সিন্ধু সভ্যতার উন্নত ও জটিল যে স্তরটিকে হরপ্পান সংস্কৃতি হিসাবে চিহ্নিত করা হচ্ছে তার জন্য প্রয়োজন খুব উন্নত ভাষা এবং লিপির। বস্তুত ভাষার লিখিত রূপের সঙ্গে মানুষের চিন্তা এবং সভ্যতার বিকাশ ওতপ্রোতভাবে জড়িত। উন্নত লিপিমালা মানুষের ভাষা, সাহিত্য এবং চিন্তার বিকাশের অন্যতম মাধ্যম। বস্তুত হরপ্পান সভ্যতার নগর চিত্র, মৃৎপাত্রাদি দেখলে কল্পনায় আসে তেমনই একটি বাহুল্যবর্জিত, সোজা-সরল, বলিষ্ঠ, বেগবান এবং পরিচ্ছন্ন লিপিমালার চিত্র।

সেক্ষেত্রে প্রশ্ন আসে যে, একটি গোটা সভ্যতার লিপি তো এভাবে বিলুপ্ত হওয়া উচিত নয়। সেটা তা হলে কোথায় গেল? প্যাপিরাসে, প্রস্তর বা মাটির ফলকে মিসর, সুমের বা মেসোপটেমিয়ার প্রাচীন সভ্যতার যে লিপিমালা বা সাহিত্য লিখিত হয়েছে এখানে তেমন কিছু কি হয় নি?

এই প্রশ্নে মিসর-সুমেরের সঙ্গে সিন্ধুর পার্থক্যটা আমাদের চিন্তায় রাখতে হবে। মিসরের সভ্যতা মূলত উৎসর্গিত ছিল মিসর সম্রাট ফারাও এবং তার মৃতদেহ সংরক্ষণের উদ্দেশ্যে। সুতরাং সেখানে পিরামিড হয়েছে। ফারাও এর অনুসরণে যাদের সাধ্য হয়েছে তারাও বৃহৎ পিরামিড না হোক ক্ষুদ্র সমাধি সৌধ নির্মাণ করেছে। এইসব পিরামিড ও সমাধির গোপন গহ্বরে অনেক কিছু রাখা হয়েছে, সেই সঙ্গে অনেক লিপিও।

সুমেরেও দেবতার অছি পুরোহিত-রাজার হাতেই ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত। ফলে এখানেও বিরাট আয়তনে মন্দির হয়েছে এবং সেই সঙ্গে সংরক্ষণ করা হয়েছে বহু লিপি।

বস্তুত এই ধরনের সমাজে সবকিছুর অতিকেন্দ্রীভবনের ফলে শিক্ষার ক্ষেত্রেও তার প্রতিফলন ঘটে। যার ফলে খুব মুষ্টিমেয় লোক শিক্ষিত হয়। এই অবস্থায় জ্ঞানের হারিয়ে যাবার সম্ভাবনাও থাকে খুব বেশী। ফলে তাকে স্থায়ীত্ব দেবার সামাজিক তাগিদও বেশী থাকবার কথা। সুতরাং পাথরে বা পোড়া মাটির ফলকে বিভিন্ন অনুশাসন বা বিবরণ লিখে রাখবার প্রবণতাও বেশী থাকা উচিত।

কিন্তু সিন্ধুর অবস্থা ভিন্ন। এখানে দেবতা-রাজা বা পুরোহিত-রাজা নেই। শুধু তাই নয় এখানে দেবতারাও আশ্চর্য রকম মানবিক। মানুষেরই মত তাদের অনেক সীমাবদ্ধতা।

বস্তুত সিন্ধু ধর্মের একটি বিশ্বাস ছিল যে, মানুষের পূজা দ্বারা দেবতার শক্তি বৃদ্ধি হয় ফলে দেবতা তার পূজারীকে সাহায্য করে। অর্থাৎ আজকের মত দেবতা বা ঈশ্বর তখন মানুষের ইচ্ছানিরপেক্ষ শক্তি ছিল না। এই কারণে ঋগ্বেদে বলা হচ্ছে, “সে ইন্দ্র স্তবকারী ঋষিগণের প্রাচীন ও ইদানীন্তন স্তোত্র দ্বারা বর্ধিত হয়েছেন” (৬।৪৪।১৩)। কিংবা “মরুভূমিতে জল যেরূপ মনুষ্যকে পোষণ করে, সেরূপ স্তোত্র সকল হব্য সহকারে তাঁকে (ইন্দ্রকে) বর্ধিত করে” (৬।৩৪।৪)।

ঋগ্বেদে এই ধরনের কথা অনেকবার বলা হয়েছে। বরুণের উদ্দেশ্যে তো এক মন্ত্রে বলাই হয়েছে, “হে অসুর বরুণ! তুমি দেবতাই হও বা মানুষই হও, তুমি সকলের রাজা” (২।২৭।১০)।

অর্থাৎ সিন্ধু সভ্যতার ধর্মে দেবতা ও মানুষের মধ্যে অনেক সময় সীমারেখা টানা যেত না। দেবতারা স্বর্গের অধিবাসী, অদৃশ্য এবং মানুষের চেয়ে বেশী শক্তিমান; তাদের এইটুকুই যা শ্রেষ্ঠত্ব। আমরা বুঝতে পারি গ্রীকদের এই ধরনেরই দেবতা-চিন্তার উৎস কোথায়।

যাইহোক, একটা মোটামুটি ইহবাদী ও গণতান্ত্রিক পরিবেশের ফলে সিন্ধু সভ্যতায় অতিকেন্দ্রীভবনের অভাব ঘটায় আমরা ধারণা করতে পারি যে, সেখানে একটি ব্যাপক শিক্ষিত সম্প্রদায় ছিল। ফলে পাথর বা পোড়া মাটির ফলকে লিখবার প্রয়োজন কম অনুভূত হত বলে মনে হয়। সম্ভবত লিখা হত গাছের পাতায় যেমন তাল পাতায় কিংবা চামড়ায় বা কাপড়ে। সেসব বহুকাল পূর্বেই নষ্ট হয়েছে। হয়ত সিলের মত স্থায়ী কিছুতে লিপি উৎকীর্ণ করা হয়েছিল যা আমরা পাই নি। এবং এও সম্ভব যে, সিন্ধু ভাষার অন্তত কিছু লিপি কিছু সিলে রয়েছে।

তবে আমরা একটু তলিয়ে চিন্তা করলেই দেখতে পাব যে, মিসর বা সুমেরের তুলনায় সিন্ধুর ভাষা আজও অনেক বেশী জীবন্ত। মিসরের প্যাপিরাস বা প্রস্তর ফলক কিংবা সুমেরের মাটির ফলকের মত তার লিপিমালা পাওয়া না গেলেও বা ক্ষতি কি? মহাভারত এবং বিশেষত ঋগ্বেদ কি সিন্ধু সভ্যতার এক বিরাট দলিল হয়ে আজ পর্যন্ত আমাদের মধ্যে বেঁচে নেই?

এ বিষয়ে সন্দেহ নেই যে, ঋগ্বেদ প্রথম যে লিপিতে লিখা হয়েছিল তা আজ নেই। ঋগ্বেদের শব্দ বা ভাষার পরিবর্তন সম্ভব নয়। তাই সেটা হয় নি। কিন্তু লিপি বা অক্ষরের পরিবর্তন সম্ভব। ঋগ্বেদের বিশাল সাহিত্য যে অক্ষরে অক্ষরে কণ্ঠস্থ করে রাখা সম্ভব নয় এটা যে কেউ একটু চিন্তা করলেই বুঝতে পারবেন। মুখস্থ করা হলেও নির্ভুলভাবে সংরক্ষণের নিশ্চয়তার প্রয়োজনেই নিশ্চয় লিখে রাখা হত। মানুষের স্মৃতিশক্তির সীমাবদ্ধতা অনস্বীকার্য। এক্ষেত্রে শুধু মুখস্থ করা দ্বারা স্মৃতিতে রাখা হলে বিভিন্ন জনের ঋগ্বেদ পাঠে ভিন্নতা ঘটত ফলে তার অলঙ্ঘনীয়তা এবং কর্তৃত্ব বিনষ্ট হত। বিশেষত ব্যাপারটি যেখানে হাজার হাজার বৎসরের।

আমরা ঋগ্বেদেও মানুষের স্মৃতিশক্তির সীমাবদ্ধতার স্বীকৃতি পাই। ইন্দ্রের মুখ দিয়ে অগস্ত্য ঋষি বলছেন, “অদ্যতন বা কল্যতন বলে কিছুই নেই। অদ্ভূত কার্য-এর কথা কে বলতে পারে? অন্যলোকের মন অত্যন্ত চঞ্চল, যা উত্তম রূপে পাঠ করা যায় তাও ভুলে যাওয়া যায়” (১।১৭০।১)।

বস্তুত ঋগ্বেদকে ঘিরে সৃষ্ট অনেক মীথ বা উপকথার মতই এটি একটি উপকথা মাত্র যে, পূর্বকালে ঋষি বা ব্রাহ্মণরা ঋগ্বেদের মন্ত্রগুলি সব মুখস্থ করে রাখতেন এবং এগুলি লিপিবদ্ধ ছিল না। অবশ্য এমন একটি উপকথা সৃষ্টির কারণ সম্পর্কে এটুকু বলা যায় যে, সম্ভবত বহিরাগত আক্রমণকারী এবং বিশেষত মুসলমানদের শত শত বৎসর শাসনকালে তাদের হাত থেকে ঋগ্বেদ সহ সকল বেদকে রক্ষার জন্য এমন ধারণা সৃষ্টির প্রয়োজনে ব্রাহ্মণরা এটি প্রচার করেছিল। অর্থাৎ যাতে কোন উগ্র বেদ বিরোধী শক্তি বেদ ধ্বংস করতে চাইলে সমগ্র ভারতবর্ষের ব্রাহ্মণ হত্যা করা ছাড়া বেদ ধ্বংসের আর কোন পথ না দেখে। যেটা বাস্তবে অসম্ভব ছিল।

অবশ্য এই সঙ্গে অপর একটি কারণও যুক্ত থাকতে পারে তাহল কয়েক হাজার বৎসরে স্বাভাবিকভাবে লিপির পরিবর্তন হয়েছে। ফলে বেদের লিপিও বদলাতে হয়েছে। কিন্তু বেদ পবিত্র এবং চিরঞ্জীব শাস্ত্র। সুতরাং পরিবর্তনশীল লিপির সঙ্গে যুক্ত হয়ে বেদের অপরিবর্তনীয়তার ভাবমূর্তি যাতে ক্ষতিগ্রস্ত না হয় সেই জন্য বাইরে এমন একটা ধারণার ধূম্রজাল সৃষ্টির প্রয়োজন থেকেও এই ধারণা প্রচার করা হতে পারে যে, বেদের ভাষা লিপিনিরপেক্ষ, সুতরাং তা লিখিত নয় বরং স্মৃতি দ্বারা সংরক্ষিত। অবশ্য এই সঙ্গে প্রথমে উল্লেখিত কারণও যুক্ত থাকা উচিত।

যাইহোক, এবার আমরা সিন্ধুর সিলগুলির বিষয়ে আর একটু নূতন ভাবে চিন্তা করতে পারি। এমন একটি সম্ভাবনা যথেষ্ট যে, এই লিপির উদ্ভব ঘটেছিল হরপ্পা সভ্যতারও অনেক পূর্বে। হয়ত বিকাশের বিভিন্ন স্তরে অবস্থিত লিপিমালা ধর্মীয় আচার বা প্রতীকের সঙ্গে সংযুক্ত হয়ে সমাজের রক্ষণশীল শক্তিগুলি দ্বারা এক বা দেড় হাজার বৎসর মূলত অপরিবর্তিতভাবে সংরক্ষিত হয়েছিল।

বিভিন্ন গবেষক সিন্ধুসিলের লিপির সঙ্গে পৃথিবীর বিভিন্ন প্রাচীন লিপির মিল খুঁজে পেয়েছেন। প্রাচীন মিসর, সুমের, চীন ইত্যাদি বিভিন্ন দেশের বিভিন্ন ধরনের লিপির সঙ্গে সিন্ধু সিলের বিভিন্ন লিপির মিল রয়েছে বলে তাঁরা মনে করেন।

সিন্ধু সভ্যতায় যে সব নরকঙ্কাল পাওয়া গেছে তা থেকে বোঝা যায় যে, এই সভ্যতা বিশেষ কোন রেস কিংবা নৃতাত্ত্বিক গোষ্ঠী দ্বারা সংগঠিত হয় নি। ভারতবর্ষে আজ যেমন ধরনের মানুষ বাস করে মূলত সেই ধরনের মানুষ তখন সিন্ধু উপত্যকায় ছিল।

এমন হতে পারে যে, বিভিন্ন দেশ থেকে বিভিন্ন গোষ্ঠীর মানুষ প্রাক-হরপ্পান যুগে সিন্ধু উপত্যকায় এসেছিল। তারা নিয়ে এসেছিল বিভিন্ন স্তরের বা ধরনের লিপি যেগুলি তখন এখানে পাশাপাশি অবস্থান করছিল কিংবা সংমিশ্রিত হয়েছিল।

অবশ্য এর উল্টোটিও হতে পারে। সিন্ধু থেকেই দেশান্তরণের কারণে বিভিন্ন ভাষার লিপির সঙ্গে সিন্ধু লিপির মিল ঘটতে পারে। হতে পারে যে, মহাভারতের যুদ্ধের ফলে একটি ব্যাপক মাইগ্রেশন হয়েছিল। হয়ত পরাজিত শক্তি যারা নূতন ধর্ম এবং ব্যবস্থাকে মেনে নিতে চায় নি তারা দেশ ছেড়ে চতুর্দিকে চলে গিয়েছিল এবং যাবার সময় বিভিন্ন অঞ্চলের বিভিন্ন জাতি বা উপজাতি যার যার বিভিন্ন স্তরের লিপি সঙ্গে করে নিয়ে গিয়েছিল যা বিভিন্ন সভ্যতার লিপির উদ্ভবে কিংবা বিকাশে ভিত্তি কিংবা প্রেরণা যুগিয়েছিল।

অবশ্য দুটিই এমন সম্ভাবনা যে, কোনটির পক্ষেই মত দেওয়া কঠিন। তবে সিন্ধুর লিপির প্রশ্নে যে সম্ভাবনা আমাদের কাছে বেশী মনে হয় তা হল সিন্ধুর নগর পরিকল্পনার মতই একটি উন্নত, বলিষ্ঠ ও পূর্ণাঙ্গ লিপিমালা প্রাক-হরপ্পান পর্যায়ে সৃষ্টি হয়েছিল যেটিকে মহাভারতের যুদ্ধের পর নূতন রাষ্ট্র ও সমাজের নির্মাতারা গ্রহণ করে নিয়েছিলেন পরিবর্তন করে অথবা না করে। সিন্ধু লিপির প্রশ্ন বিচারের সময় আমাদেরকে বিকশিত সিন্ধু সভ্যতার সুশৃঙ্খল, গতিশীল এবং অত্যন্ত জটিল আয়োজনকে আশ্চার্য সহজ ও সরল বিন্যাসে রূপ দেবার দক্ষতার (যেমন পয়: প্রণালী ব্যবস্থার) কথা মনে রাখতে হবে।

তাছাড়া সিলের লিপি প্রসঙ্গে আমাদের মনে রাখতে হবে যে, সিলগুলিতে প্রাপ্ত লিপির পরিমাণও এমন বেশী নয় যে, এগুলির পাঠোদ্ধার হলে আমরা সিন্ধু সভ্যতা সম্পর্কে তেমন কিছু তথ্য পাব। তবে এটা ঠিক যে, তার ভাষা বুঝতে পারলে কিছু বিষয়ের মত বৈদিক ভাষার সঙ্গে তার সম্পর্ক বোঝা যেত। কিন্তু এক্ষেত্রে যে সমস্যা থাকতে পারে তা হল এই যে, যদি এটি পশ্চাৎপদ ধর্মীয় আচারের সঙ্গে সংযুক্ত এবং তার প্রতীকমূলক চিহ্ন হয় তবে এই লিপি তখনই মৃত লিপি হওয়া সম্ভব। অর্থাৎ অতীতের ছেড়ে আসা এবং ব্যবহারিক ক্ষেত্রে সাধারণভাবে অব্যবহৃত লিপি বা চিহ্নকে শুধু বিশেষ ধর্মীয় আচারের ক্ষেত্রে প্রয়োগ করা হতে পারে।

যদি তা হয় তবে সাধারণভাবে সিন্ধু সিলের লিপির পাঠোদ্ধারের আশা না করাই ভাল। কারণ সেক্ষেত্রে এটি তখনই একটি গুপ্ত ব্যাপারে পরিণত হবার কথা। অনেক পরবর্তী কালের তান্ত্রিক সঙ্কেত চিহ্নের সঙ্গে সিলের কিছু লিপির মিল২৮ সম্পর্কে যে তথ্য আমরা পাই সেই ব্যাপারটিও ভাবা দরকার।

সম্ভবত সিন্ধু সিলের চিত্র ও লিপি সম্পর্কে আলোচনায় আপাতত এর বেশী সময় দেবার প্রয়োজন নেই। সুতরাং এখন আমরা আর্য প্রশ্নে যেতে পারি।

 

১১। আর্য প্রশ্ন

ঋগ্বেদে ঋষিগণ আর্য বলতে কাদেরকে বোঝাচ্ছেন? শুধু বৈদিক পক্ষই কি আর্য? নাকি সিন্ধু সভ্যতার সমস্ত অধিবাসীই আর্য? নাকি আর্য সিন্ধু-সভ্যতার বিশেষ কোন শ্রেণীর পরিচয় সূচক শব্দ? অথবা তার সঙ্গে কোন ধর্মীয় পরিচয় জড়িত? বৈদিক ঋষিগণ তাঁদের শত্রুদের সম্পর্কে দাস ও দস্যু এই দুই শব্দ বেশী ব্যবহার করেছেন। এই দুটি শব্দের প্রকৃত অর্থ কি ছিল? এই প্রশ্নগুলির মোটামুটি সদুত্তর ছাড়া আর্য-অনার্য প্রশ্নের জট পুরোপুরি খোলা সম্ভব নয়।

আমাদের নিকট এখন অন্তত এই বিষয়টি সুস্পষ্ট যে, আর্যরা ভারতবর্ষে বহিরাগত পশুপালক এবং হানাদার জনগোষ্ঠী নয়। মধ্য এশিয়ার স্তেপভূমি কিংবা পূর্ব বা উত্তর ইউরোপের কোন প্রান্তর থেকে জনসংখ্যা বৃদ্ধি বা আর কোন কারণে তারা চারদিকে ছড়িয়ে গিয়েছিল বলে যে ধারণা করা হয় ব্যাপারটি তা নয়।

এটা ঠিক যে, আর্যদের ঘোড়া ছিল। তারা তাদের উন্নত সংগঠনশক্তি, দ্রুতগতি, যুদ্ধক্ষমতা ও মেধা দ্বারা বিশাল ভূভাগ অধিকার করে নিজেদের বাসভূমিতে পরিণত করে। তাদের ধর্মও ছিল উন্নত। তাদের ছিল সমাজ, সভ্যতা ও প্রকৃতির বিভিন্ন শক্তির বিমূর্ত প্রকাশ স্বরূপ বিমূর্ত দেবতার ধারণা এবং এইসব বিমূর্ত দেবতার পূজা।

কিন্তু এই সঙ্গে এই বিষয়ও এখন স্পষ্ট যে, আর্য বা ইন্দো-ইউরোপীয় যে নামেই অভিহিত করা হোক এই ধরনের উন্নত সংস্কৃতির জনগোষ্ঠী বিমূর্তভাবে তৃণপ্রান্তর বা অরণ্যের বর্বর কিংবা বন্য জীবন থেকে হঠাৎ করে উঠে আসতে পারে না। একটি সুউন্নত সভ্যতার মধ্য থেকে দীর্ঘকাল ধরে প্রক্রিয়াজাত হয়ে আসাতেই তারা এই রকম উন্নত হতে পেরেছে। এই আর্যদের পূর্বপুরুষরা যেখান থেকেই আসুক তারা আর্যে পরিণত হয়েছে সিন্ধু সভ্যতা দ্বারাই এবং সিন্ধুর জলনিয়ন্ত্রণব্যবস্থা ধ্বংসের ফলে একটি বিস্ফোরণের মত তারা পৃথিবীর চারপাশে ছড়িয়েছে।

তাদের ঘোড়া ছিল বলে তারা সিন্ধু-হরপ্পা সভ্যতার মানুষ নয় এমন মনে করবার কারণ নেই। সম্ভবত সিন্ধু-হরপ্পা সভ্যতা ধ্বংসের বেশ কিছু পূর্বেই সেখানে ঘোড়ার ব্যবহার প্রবর্তিত হয়। অর্থাৎ সিন্ধু সভ্যতাকে এতটা রক্ষণশীল ভাবার কারণ নেই।

পণ্ডিত মহলের একটি ধারণা যে, ২০০০ খ্রীস্টপূর্বাব্দের পূর্বে কোন সময়ে দক্ষিণ রুশ এবং ইউক্রেনীয় স্তেপভূমি, কাজাখস্তান কিংবা মধ্য এশিয়ার কোন এলাকায় ঘোড়াকে প্রথম পোষ মানানো এবং ব্যবহার করা হতে পারে২৯। কিন্তু এই ধারণা ভুলও হতে পারে। এটি প্রথম সিন্ধু-হরপ্পা সভ্যতার ভিতরে বা প্রান্তে হতে পারে। মহেঞ্জোদাড়োর শেষ দিকের স্তরে পোড়ামাটির ঘোড়ার মূর্তি পাওয়া গেছে। এখানে ঘোড়ার চোয়ালও পাওয়া গেছে। তাছাড়া রানা ঘুন্ডাই-এর সর্বনিম্ন যে স্তরে ঘোড়া এবং গাধা উভয়েরই অস্থি পাওয়া গেছে হুইলার সেই স্তরকে প্রাক-হরপ্পান হিসাবে সনাক্ত করছেন৩০। এই অঞ্চলে হরপ্পান রাষ্ট্র সম্প্রসারিত হতে বেশী হলে কয়েক শতাব্দী লাগতে পারে। কাজেই উত্তর বালুচিস্তানের প্রাক-হরপ্পান স্তরে ঘোড়ার ব্যবহার থাকলে সেটি হরপ্পান সভ্যতায় অন্তর্ভুক্ত হতে খুব বেশী সময় লাগবার কথা নয়। তাছাড়া এই অঞ্চল অধিকার করেই যে, ঘোড়ার ব্যবহার শিখতে হবে এমন নয়। যোগাযোগ থেকেও হরপ্পান সভ্যতায় ঘোড়ার ব্যবহার প্রবর্তিত হওয়া সম্ভব।

বিশেষত হরপ্পান রাষ্ট্রের বিশালত্বের কথা বিবেচনা করলে, আমরা অনুমান করতে পারি যে, বিভিন্ন দূরত্বে ব্যবহারের জন্য সেখানে অশ্ব এবং অশ্বরথের ব্যবহার খুব জনপ্রিয় ছিল। অন্তত শেষ দিকে তার ব্যাপক প্রচলনের অনুমান যুক্তিযুক্ত হবে। ঋগ্বেদ অশ্ব ও অশ্বরথের ব্যাপক ব্যবহারের সাক্ষ্য দেয়।

সিন্ধু সভ্যতার ব্রঞ্জ এবং পোড়া মাটির তৈরী যে সব গাড়ীর মডেল পাওয়া গেছে সেগুলির গঠন প্রণালী ঋগ্বেদের রথ বা গাড়ীর বর্ণনার সঙ্গে মিলে যায়। ঋগ্বেদে বলা হচ্ছে, “চক্রদ্বয় যেরূপ অক্ষকে ফিরিয়ে আনে” (১।৩০।১৪), কিংবা “শকটের গতি অক্ষকে ফেরায়” (১।৩০।১৫)।

সিন্ধু সভ্যতার গাড়ীর দুই চাকার সঙ্গে অক্ষদণ্ড এমনভাবে সংযুক্ত থাকত যে, চাকা ঘোরার সঙ্গে গাড়ীর অক্ষও ঘুরত। আমরা ঋগ্বেদের বিবরণ থেকে জানতে পারছি যে, বৈদিক আর্যরাও এমন ধরনের গরুর এবং ঘোড়ার গাড়ী ব্যবহার করত। সিন্ধুর গ্রামাঞ্চলে আধুনিক কাল পর্যন্ত এই ধরনের চাকাওয়ালা গাড়ী প্রচলিত।

সুতরাং আমরা এখন এই প্রশ্নে আসতে পারি যে, ঋগ্বেদের সেনাবাহিনী যাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছে তাদেরকে আর্য না বলে দাস এবং দস্যু বলা হয়েছে কেন? এবং আর্য শব্দের কি তাৎপর্য? তাছাড়া প্রতিপক্ষকে কিছু ক্ষেত্রে কৃষ্ণ বলবার কি অর্থ?

দাস ও দস্যু সম্পর্কে আমাদের আলোচনা সংক্ষিপ্ত করবার জন্য এইটুকু বলতে পারি যে, ঋগ্বেদের সূক্তগুলিকে যুদ্ধ পূর্ববর্তী, যুদ্ধের প্রথম পর্যায়ের এবং যুদ্ধের মধ্যে কিছু পরবর্তী পর্যায়ের এবং বিজয় অর্জনের পরবর্তী সময়ের এভাবে সাজালে আমরা দেখতে পাব যে, যুদ্ধ পূর্ববর্তী হিসাবে চিহ্নিত করা যায় এমন কোন সূক্তে বা মন্ত্রে শত্রুর উদ্দেশ্যে দাস বা দস্যু শব্দ ব্যবহার করা হয় নি। সেখানে তাকে শত্রু বলা হয়েছে, যজ্ঞহীন বলা হয়েছে। এটা লক্ষণীয় যে, বৃত্র ধ্বংস এবং যুদ্ধ জয়ের সঙ্গে দাস ও দস্যু শব্দের ব্যবহার বৃদ্ধি পেয়েছে।

এগুলি দ্বারা প্রথম দিকে কি বোঝানো হত বলা কঠিন হলেও পরবর্তীতে যে এগুলি ঘৃণা সূচক বা গালাগালির শব্দে পরিণত হয়েছিল তা স্পষ্ট।

আমরা কণ্বগোত্রের বৎস ঋষির ৮।৬ সূক্তের কয়েকটি মন্ত্র থেকে দাস শব্দের অর্থ সম্পর্কে একটা ধারণা পেতে পারি :

৪৬। যদুগণের মধ্যে পর্শুর পুত্র তিরিন্দিরের নিকট শত ও সহস্র ধন গ্রহণ করেছি। ৪৭। তারা পর্জ্জকে ও সামকে তিনশত অশ্ব ও দশশত গো প্রদান করেছিল। ৪৮। ইনি উন্নত হয়ে চার ধনভান্ডারযুক্ত উষ্ট্রসমূহ প্রদান করে এবং যদুগণকে দাসরূপে প্রদান করে কীর্তি দ্বারা স্বর্গ ব্যাপ্ত করেছিলেন।

এখন কণ্বগণ হলেন যদুগণের পুরোহিত। আর যদুগণ হল বৈদিক পক্ষের অত্যন্ত শক্তিশালী যোদ্ধা উপজাতি। কাজেই যদুগণকে দাসরূপে ঋষিকে দেবার অর্থ সেবক কিংবা অধীন বা ভক্ত রূপে দেবার অর্থ ছাড়া আর কি হতে পারে? সম্ভবত দাস বলতে প্রথমে অধীন বা অনুগত কিংবা সেবক বোঝাত। পরে শত্রুর বিরুদ্ধে এই শব্দকে ব্যবহার করায় এর অর্থ পরিবর্তন হয়েছে বলে মনে হয়। বিশেষত পরাজিত ও বন্দী শত্রুর প্রতি ব্যবহার দ্বারা এই শব্দের অর্থ পরবর্তীকালে হয়েছে ক্রীতবন্দী বা যুদ্ধবন্দী।

দস্যু শব্দের অর্থও পরিবর্তন হয়েছে মনে করাই সঙ্গত। এটা দাস থেকে আসাও অসম্ভব নয়। তবে মোট কথা এটা স্পষ্ট যে, দাস ও দস্যু শব্দ দুটি ঋষিদের শত্রু হরপ্পান সেনাবাহিনী নিজেদের পরিচয় হিসাবে ব্যবহার করত না। এই দুটি শব্দ ঋষিদের ব্যবহার।

কিছু ক্ষেত্রে শত্রুর প্রতি ঋষিগণ রাক্ষস শব্দ ব্যবহার করেছেন। কিন্তু স্পষ্টভাবে বোঝা যায় যে, শব্দটি দ্বারা শত্রুকে জঙ্গলী, অসভ্য ও নরমাংসখাদকের সঙ্গে তুলনীয় করে শত্রুর প্রতি ঘৃণা প্রকাশ করা হয়েছে।

আর কৃষ্ণত্বক বা কৃষ্ণবর্ণ সংক্রান্ত যে সামান্য কিছু উক্তি আমরা ঋগ্বেদে পাই তা দিয়ে শত্রুর বর্ণ সম্পর্কে সাধারণভাবে কোন ধারণা পাওয়া যায় না।

১।১৩০।৮ ঋকে বলা হচ্ছে যে, “ইন্দ্র মানুষের জন্য ব্রতরহিত ব্যক্তিদের শাসন করেন। তিনি কৃষ্ণের কৃষ্ণত্বক উন্মোচন করে তাকে বধ করেন, তিনি তাকে ভষ্মীভূত করেন।” ২।২০।৭ ঋকে বলা হচ্ছে, “বৃত্রহা, পুরনাশক ইন্দ্র কৃষ্ণযোনি দাস সেনাকে বিনাশ করেছেন, মনুর (মানুষের) জন্য পৃথিবী ও জল সৃষ্টি করেছেন।” ৩।৩১।২১ ঋকে বলা হচ্ছে, “বৃত্রহন্তা ও গাভীগণের স্বামী ইন্দ্র আমাদের গাভী দান করুন, কৃষ্ণদের দীপ্তিযুক্ত তেজ দ্বারা বিনাশ করুন।” কিংবা ৪।১৬।১৩ ঋকে ইন্দ্রকে বলা হচ্ছে, “তুমি পঞ্চাশৎ(পাঁচ) সহস্র কৃষ্ণবর্ণ শত্রুকে বিনাশ করেছিলে।” ৯।৪১।১ ঋকে বলা হচ্ছে, “যে সোম সকল জলের ন্যায় শীঘ্র দীপ্তিযুক্ত ও গমনশীল হয়ে কৃষ্ণত্বকদের হনন করে বিচরণ করেন তাদের স্তব কর।” ৯।৭৩।৫ ঋকে বলা হচ্ছে, “যে কৃষ্ণবর্ণ চর্মকে ইন্দ্র দেখতে পারেন না তার ক্ষমতাবলে সে কৃষ্ণবর্ণ চর্মকে ভূলোক ও দ্যুলোক হতে দূর করে দেয়।”

কিন্তু এই কয়টি ঋকের সঙ্গে বাকী সমস্ত ঋকের বর্ণনা পাশাপাশি রাখলে এটা সুস্পষ্ট হয় যে, দাস, দস্যু ইত্যাদির সঙ্গে কৃষ্ণবর্ণের কোন অঙ্গাঙ্গী সম্পর্কই নেই। প্রকৃতপক্ষে ঋগ্বেদে শত্রুর প্রতি কৃষ্ণ শব্দের ব্যবহার খুবই কম।

সর্বোপরি একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় আমাদের ভাবা দরকার। শত্রুসেনাকে কৃষ্ণযোনি বলবার অর্থ কি? এর অর্থ কৃষ্ণ গর্ভ বা উৎস থেকে আগত। এমন কি সম্ভব নয় যে, সিন্ধু-হরপ্পান দুর্গগুলিকে বিশেষত দুর্গ প্রাচীরকে কাল রঙ্ দ্বারা আবৃত করা হত? এতে দুর্গগুলি শত্রুর জন্য দেখতে ভয়প্রদ হবারও কথা। বিশেষত হরপ্পান শাসকরা যে মানুষের মনস্তত্ত্ব ব্যবহারে অসাধারণ দক্ষ এবং সচেনত ছিল এটা আমাদের চিন্তায় রাখা উচিত।

ঘটনাটা যদি তা-ই হয় তবে শত্রুর প্রতি কৃষ্ণবর্ণের ব্যবহার দ্বারা কৃষ্ণদুর্গ থেকে আগত বোঝানো হয়েছে।

অবশ্য এটা ঠিক যে, উপরে উদ্ধৃত ঋকগুলিতে কৃষ্ণবর্ণের প্রতি ঘৃণাও প্রকাশ পেতে পারে। কিন্তু এটা যুদ্ধের সেই তীব্রতার মধ্যে স্বাভাবিক যখন আজকের মতই বেশীর ভাগ ভারতবাসী কৃষ্ণবর্ণ থাকায় সৈনিকদেরও বেশীর ভাগ ছিল কৃষ্ণবর্ণ। রঙ্ বা বর্ণের মিশ্রণ দুই পক্ষেই ছিল। তবে যারা তুলনায় কম ময়লা বা কম কৃষ্ণ তারা সেদিনও আজকের অধিকাংশ ভারতবাসীর মতই বর্ণসচেতন বা গরবী ছিল বলে অনুমান করা চলে। তবে আমরা দেখেছি যে, ঋগ্বেদে তার প্রকাশও এত কম ক্ষেত্রে ঘটেছে যে, তা উল্লেখ করবার মত নয়।

এটা সুস্পষ্ট যে, ঋগ্বেদের যুদ্ধ জলনিয়ন্ত্রণধ্বংসী ধর্মীয় যুদ্ধ। কাজেই জলনিয়ন্ত্রণব্যবস্থা ধ্বংসের অগ্রগতির সঙ্গে যুদ্ধ ক্রমে ধর্মীয় উন্মাদনায় রূপ নিয়েছে। তখন শত্রুকে দেখা হচ্ছে মূলত দেবরহিত, যজ্ঞহীন ও সোমাভিষববিরোধী ইত্যাদি রূপে।

বৈদিক আর্যদেরকে বহিরাগত মনে করলেও পুসলকর বৈদিক যুদ্ধের ধর্মীয় বৈশিষ্ট্য বুঝতে ভুল করেন নি। তিনি বলছেন যে, দস্যু এবং বৈদিক আর্যদের মধ্যে পার্থক্য প্রধানত ধর্মীয় রূপ নিয়ে দেখা দিয়েছে৩১

এখন বৈদিক যুদ্ধ যদি কৃষ্ণবর্ণ জাতির বিরুদ্ধে শ্বেত জাতির যুদ্ধ হত তাহলে শত্রুকে ধর্মবিরোধী হিসাবে চিহ্নিত না করে কৃষ্ণ হিসাবে করা হত।

আর আর্য শব্দের তাৎপর্য সম্পর্কে বলতে গিয়ে প্রথমেই যেটা বলা দরকার সেটা হল যে, বৈদিক যুদ্ধ শুরুর প্রথম পর্যায় পর্যন্ত ঋষিগণ কদাচিৎ নিজেদেরকে আর্য বলেছেন। তবে দেবতাদের সম্পর্কে কয়েকবার আর্য শব্দ উল্লেখ করা হয়েছে। যেমন ৭।৪৮।৩ ঋকে বলা হচ্ছে। “বিভ্বা, ঋভুক্ষ, বাজ ও ইন্দ্র আর্য হয়ে মথন দ্বারা শত্রু বল বিকৃত করেন।”

এই আর্য হওয়া বলতে কি বোঝায়? দেবতারা আর্য হয়ে শত্রুদের বল বিকৃত বা নষ্ট করেন মানে কি? এটা কি দেবতাদের ক্ষমতাবান হয়ে বা শ্রেষ্ঠ হয়ে বোঝায় না? কিংবা ৮।১৯।৩৬ ঋকে কণ্বগোত্রীয় সোভরি ঋষি বলছেন, “পুরুকুৎসের পুত্র ত্রসদস্যু আমাকে পঞ্চাশজন বন্ধু প্রদান করেছেন; তিনি দাতাগণের মধ্যে শ্রেষ্ঠ, আর্য এবং সৎপতি।”

এখানে আর্য অর্থ সম্মানিত কিংবা মহৎ হওয়া উচিত। বাক্যের বিন্যাসই বলে দেয় যে, আর্য দ্বারা এখানে জাতিবাচক কিছু বোঝানো হয় নি। বরং আর্য শব্দ দেখা দিয়েছে গুণবাচক শব্দ হিসাবে।

৭।৬৫।২ ঋকে বলা হচ্ছে, “তাঁরা (মিত্র ও বরুণ) দেবগণের মধ্যে অসুর। তাঁরা আর্য, তাঁরা আমাদের প্রজা প্রবৃদ্ধ করেন।”

তাঁরা দেবগণের মধ্যে অসুর মানে বোধহয় ক্ষমতাবান কিংবা শ্রেষ্ঠ। আর্য মানেও কি তাই দাঁড়াচ্ছে না? হয়ত সম্মানিত কিংবা প্রভুও হতে পারে।

বিশেষত এই কথাটি তাৎপর্যপূর্ণ “আমি (ইন্দ্র) দস্যুজাতিকে “আর্য” এ নাম হতে বঞ্চিত রেখেছি” (১০।৪৯।৩)।

এর সহজ অর্থ কি এই দাঁড়ায় না যে, যদি ক্ষমতা থাকে তবে আর্য নাম যে কেউ নিতে বা ব্যবহার করতে পারে? ঋগ্বেদ থেকে আমরা একটি বিষয় সম্পর্কে নিশ্চিত হই যে, আর্য শব্দের সঙ্গে ক্ষমতা, শ্রেষ্ঠত্ব, মর্যাদা এবং প্রভুত্বের সম্পর্ক ছিল। হয়ত প্রভু বা শাসক কিংবা উপরস্থ যে কাউকে নিম্নস্থ ব্যক্তি আর্য বলে সম্বোধন করত।

বলা হয় আর্য শব্দ ঋ ধাতু থেকে উৎপন্ন৩২। ঋ অর্থ কৃষি। অর্থাৎ বর্বরতা ও বন্যতার সেই আদিযুগে কৃষি ছিল সভ্যতা আর তাই শ্রেষ্ঠত্বের প্রতীক। হতে পারে যে, আর্য অর্থ ছিল মূলত কৃষক আর তাই সভ্য৩৩, সংস্কৃত, সুতরাং শ্রেষ্ঠ।

আর একটি সম্ভাবনাকেও আমাদের মনে নেওয়া দরকার, তা হল আর্য শব্দটি হয়ত সিন্ধু-হরপ্পান ধর্ম ও সংস্কৃতির সঙ্গে সংযুক্ত হয়েছিল। হয়ত এই কারণে ঋগ্বেদের ঋষিগণ যুদ্ধের পূর্বে কিংবা খুব প্রাথমিক পর্যায়ে এই শব্দ নিজেদের প্রতি তেমন একটা প্রয়োগ করেন নি। হয়ত শত্রুর নিকট থেকে বহু কিছু অধিকারের মত এই গৌরবের শব্দটিও তাঁরা অধিকার করেছেন।

বরুণের উৎপত্তি বলা হয় বৃ ধাতু থেকে৩৪। বৃ অর্থ আবরক। কিন্তু এসব তো অনেক পরবর্তী পণ্ডিতদের ব্যাখ্যা। আর বস্তুত উচ্চারণগতভাবে আর্য (আর্য বা Arya)এবং বরুণ (অন্তস্থব-রুণ বা Varuna) এই উভয় শব্দের মধ্যে পার্থক্য কম। উভয়ের সংযোগ থাকা অসম্ভব নয়। এমন হওয়া যথেষ্ট সম্ভব যে, আর্য এবং বরুণ এই উভয় শব্দের উৎপত্তি এক ঋ ধাতু থেকেই।

যাইহোক, এখন আমাদের কাছে আর্য প্রশ্ন স্পষ্ট। এটি এখন দিবালোকের মত স্পষ্ট যে, যাদেরকে আর্য বলা হচ্ছে, তারা ছিল মূলত সিন্ধু উপত্যকার অধিবাসী এবং তারাই সিন্ধু সভ্যতার মূল সংগঠক। এই কারণে ঋগ্বেদের ঋষিগণ প্রতিপক্ষকে দাস, দস্যু, যজ্ঞহীন ইত্যাদি নামে কিংবা বিশেষণে ভূষিত করলেও প্রতিপক্ষকে অনার্য বলেন নি। কারণ যুদ্ধটা আর্য-অনার্য-এর মধ্যে ছিল না। বরং আর্যদের মধ্যকারই ছিল। অবশ্য আর্য শব্দের সঙ্গে বরুণের ধর্ম জড়িত থাকলে আমরা অনুমান করতে পারি যে, বরং প্রতিপক্ষই  ঋগ্বেদের ঋষিগণকে অনার্য এবং নিজেদেরকে আর্য বলেছে।

সম্ভবত সিন্ধু সভ্যতার সবাই নিজেদেরকে আর্য হিসাবে পরিচিত করতে চাইত। গৃহযুদ্ধের দ্বারা জলনিয়ন্ত্রণব্যবস্থা ধ্বংসের ফলে সভ্যতার যে সার্বিক ধ্বংস ঘটে তার ফলে আর্য নামে কথিত জনগণ পৃথিবীর বিভিন্ন স্থানে মাইগ্রেট করে। সুতরাং আমরা বিভিন্ন স্থানে আর্য যোগসূত্র দেখতে পাই। ভারতীয় উপমহাদেশের বাইরে এটা সবচেয়ে স্পষ্ট ইরানে। কারণ ইরান যেমন সিন্ধুর সন্নিকটে তেমন সেখানে সিন্ধুর সমতুল্য না হলেও পরবর্তীতে একটি উন্নত সভ্যতা গড়ে উঠেছিল এবং সেখানে এমন একটি ধর্মমত বহুকাল পর্যন্ত প্রচলিত ছিল যার সঙ্গে বৈদিক ভাষার বহু শব্দ এবং ঋগ্বেদের বহু বিষয়ের অনেক মিল দেখতে পাওয়া যায়।

সপ্তম শতাব্দী পর্যন্ত এই ধর্ম সেখানে প্রচলিত ছিল। এটা আমাদের নিকট পার্সী ধর্ম নামে পরিচিত। ৭ম শতাব্দীতে মুসলিম আরব অভিযানের পর সাসানীয় রাজবংশের পতনের সঙ্গে ইরানের স্বাধীনতা যেমন ধ্বংস হয় তেমন পার্সী ধর্মও সেখান থেকে উচ্ছেদ হয়। কিছু পারসী ভারতের পশ্চিম উপকূলে পালিয়ে আসে এবং তাদের ধর্ম রক্ষা করে। তাদের ধর্মগ্রন্থের নাম যেন্দ্-আবেস্তা (Zend-Avesta)।

যেন্দ্-আবেস্তার মূল গ্রন্থ বা ভাষা কিছু নেই। অনেক পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে তাকে আসতে হয়েছে যা নিয়ে এই গ্রন্থে আলোচনার অবকাশ নেই। আমরা এখানে এইটুকু বলতে পারি যে, যেন্দ্-আবেস্তার মূল রচয়িতা জরথুস্ত্র-এর সময়কার ভাষা যেমন বহু আগে অচল হয়েছে তেমন মূল আবেস্তা গ্রন্থও একাধিক বার রাজনৈতিক ওলটপালটে বিনষ্ট হয়েছে। বর্তমান গ্রন্থটি প্রাচীন ধর্মগ্রন্থের বিভিন্ন ছড়ানো অংশের পরবর্তী সঙ্কলন এবং এটা পরবর্তীকালের ভাষায় অনূদিত হয়ে বর্তমান রূপ নিয়েছে।

সুতরাং আমাদের কাছে জরথুস্ত্রের যে ধর্মগ্রন্থ এসে পৌঁছে তা দিয়ে তার মূল ভাষা, শব্দগত উচ্চারণ এবং বিষয়বস্তুকেও অনেক সময় ধারণা করা কঠিন হয়। তবু একটু মনোযোগ দিয়ে পাঠ করলেই যেন্দ্-আবেস্তাকে চেনা যায় সিন্ধু-হরপ্পান সংস্কৃতি ও ধর্মের উৎসজাত রূপে।

আবেস্তা পড়লে বোঝা যায় যে, সিন্ধু-হরপ্পান সভ্যতার যে একেশ্বরবাদী শক্তি পরাজিত হয়েছিল তারা শেষ পর্যন্ত ইরানে নূতন ও দৃঢ় অবস্থান নিয়ে দাঁড়াতে সক্ষম হয়েছিল। তবে সময়ের সঙ্গে, পরিবেশ ও পরিস্থিতির সঙ্গে তাল মিলিয়ে প্রাচীন ধর্মে বড় রকম সংস্কার ঘটানো হয়। জরথুস্ত্র হলেন এই সংস্কারক।

তা সত্ত্বেও এটা স্পষ্ট যে, জরথুস্ত্রের ধর্মই মূল সিন্ধু-হরপ্পান ধর্মের একেশ্বরবাদী ভাবপ্রেরণা রক্ষা করেছে।

আবেস্তা আমাদের জন্য সিন্ধু-হরপ্পান  ধর্ম ও সংস্কৃতির বিষয়সমূহ এবং ঋগ্বেদেরও অনেক বিষয় বোঝার জন্য অসাধারণ গুরুত্বপূর্ণ সূত্র হিসাবে কাজ করতে পারে। তবে এখানে আমরা খুব সংক্ষেপে কয়েকটি বিষয় সম্পর্কে মাত্র আলোচনা করব। বিশেষত ঋগ্বেদের কিছু বিষয় উপলব্ধি কিংবা যাচাই এর জন্য আমরা আবেস্তার৩৫ দিকে দৃষ্টি দিতে পারি।

 

১২। যেন্দ্-আবেস্তা ও ঋগ্বেদ

এটা স্পষ্ট যে যেন্দ্-আবেস্তা ও ঋগ্বেদ এই উভয়ের উৎস এক সিন্ধু-হরপ্পান ধর্ম। কিন্তু উভয়ের ধারা ভিন্ন খাতে প্রবাহিত। যেন্দ্-আবেস্তা নিয়েছে একেশ্বরবাদ এবং ঋগ্বেদ নিয়েছে মূলত বহু দেবত্ববাদ।

যেন্দ্-আবেস্তা পড়লেই বোঝা যায় বৈদিক আন্দোলনের প্রতি প্রচণ্ড ঘৃণা এবং আক্রোশ নিয়েই তার জন্ম। ঋগ্বেদের দেব শব্দ (যেন্দ্ উচ্চারণে দএব বা Daeva) এখানে অত্যন্ত ঘৃণ্য। দেব বা দএব অর্থ শয়তান বা দানব। শুভ শক্তি বা দেবতা হল অহুর। যেন্দ্ ভাষায় স-কে সাধারণত হ উচ্চারণ করায় অসুর অহুর হয়েছে।

আবেস্তার ঈশ্বর হলেন অহুর মযদা। বরুণ হলেন এই অহুর মযদা। ইন্দ্রের মত পুরাতন বৈদিক দেবতাদের সঙ্গে বরুণ নামের যে সংযুক্তি ছিল তা দূল করবার জন্য বরুণ নাম বাদ দিয়ে তাঁকে শুধু অহুর মযদা বলা হয়েছে। এর অর্থ সম্ভবত অসুর মস্তক বা শ্রেষ্ঠ অসুর।

ইন্দ্র এখানে ঘৃণিত শয়তান বা দানব মাত্র যার আবাস নরক। দএব ইন্দ্র অহুর মযদার অন্যান্য সৃষ্টির মত অশ বহিস্ট (Asha Vahista)-এর বিরোধিতা করে এবং মানুষকে দুষ্কর্মে লিপ্ত করে।

এই অশ বহিস্টকে অনুমান করা যায় অশ্ব বসিষ্ঠ রূপে। বিশেষত এই নাম যে বসিষ্ঠ গোত্রের কোন প্রধান পুরোহিত বা ব্যক্তির তাতে সন্দেহ থাকে না। এই সঙ্গে আমরা বুঝি কেন রাজা সুদাস ঋষি বিশ্বামিত্রকে বাদ দিয়ে বসিষ্ঠকে তাঁর পুরোহিত বা গুরু হিসাবে গ্রহণ করেছিলেন। এবং এই বসিষ্ঠ বরুণের উদ্দেশ্যে যেসব আর্ত মন্ত্র রচনা করেছিলেন সেগুলির তাৎপর্যও অধিকতর স্পষ্ট হয়। অর্থাৎ বসিষ্ঠ গোত্র বিভক্ত হয়েছিল। পুরাতন ধর্মে এই গোত্রের প্রতিষ্ঠা ছিল খুব উচ্চ। সম্ভবত রাজা সুদাস এই বংশ মর্যাদাকে ব্যবহারের উদ্দেশ্যে বিশ্বামিত্রের পরিবর্তে বসিষ্ঠকে তাঁর পুরোহিত রূপে গ্রহণ করেন।

তবে আমরা অনুমান করি যে, বসিষ্ঠ গোত্রের প্রধান অংশই ছিল ঋগ্বেদের আন্দোলনবিরোধী। আবেস্তায় সম্ভবত দলত্যাগী বসিষ্ঠকে বোঝাতে এক ঘৃণ্য শয়তান হিসাবে উল্লেখ করা হয়েছে হরিৎ বা পীত বাশিয়াস্ট (Yellow Bushiasta)এই নামে।

তবে যেন্দ্-আবেস্তায় সর্বপ্রধান দএব বা শয়তান হল অঙ্গর মইন্যু(Angra Mainyu)। অঙ্গর মইন্যু হল অহুর মযদার প্রধান প্রতিপক্ষ বা শত্রু।

বোঝা যায় বৈদিক আন্দোলনের উদ্গাতা অঙ্গিরা ঋষিদেরকে কিংবা তাঁদের প্রধান ব্যক্তিকে বোঝাতে এই শব্দের প্রয়োগ হয়েছে। অঙ্গর যে অঙ্গিরা থেকে এটা অনুমান করা যায়। কিন্তু মইনিউ বা মইন্যু কোথা থেকে? এটা মনু বা মানুষ থেকে হতে পারে, মান্য নাম থেকে হতে পারে, আবার ঋগ্বেদে মন্যু অর্থ দেবতা বা অপদেবতা হতে পারে বলে মনে হয়। আমরা ইতিপূর্বে বসিষ্ঠ ঋষিকে ৭।৮৬। ৬ ঋকে বলতে দেখেছি যে, মন্যুর কারণেও পাপ উৎপন্ন হয়। এদিকে ১০ম মণ্ডলে আমরা মন্যু দেবতার উদ্দেশ্যে রচিত ৮৩ ও ৮৪ এই দুইটি সূক্ত পাই। ১০।৮৩।১ ঋকে মন্যুর উদ্দেশ্যে বলা হচ্ছে, “হে মন্যু অর্থাৎ ক্রোধের অধিষ্ঠাত্রী দেবতা।” এবং তার সম্পর্কে এমনভাবে স্তুতি করা হয়েছে যে, তাকে ইন্দ্রের সমার্থক মনে হয়।

যাইহোক, জরথুস্ত্র ইরানে পুরাতন সিন্ধু-হরপ্পান ধর্মের সংস্কার দ্বারা যে নূতন ধর্ম প্রবর্তন করেন তাতে অহুর মযদার প্রধান বিরোধী শক্তি হিসাবে আমরা পাই অঙ্গর মইন্যুকে। এই উভয়ের মধ্যে দ্বন্দ্ব এবং তাতে শেষ পর্যন্ত অহুর মযদার বিজয়ের অনিবার্যতা হল জরথুস্ত্রের ধর্মের একটি মূল বার্তা।

আর আবেস্তা আমাদেরকে দেয় আর্য সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য। বস্তুত আবেস্তা শুরুই হয়েছে ঈশ্বর অহুর মযদা কর্তৃক সর্বশ্রেষ্ঠ মানবভূমি হিসাবে আর্যভূমি সৃষ্টির বর্ণনা দিয়ে। যেন্দ্-আবেস্তার প্রথম পর্ব ভেনদিদাদ-এ আমরা প্রথমে পাই অহুর মযদার সবচেয়ে প্রিয় জাতি আর্য জাতির জন্য আর্যভূমি সৃষ্টির বর্ণনা।

আবেস্তায় আর্যভূমির নাম বলা হয়েছে আইরিয়ান বএজ (Airyana Vaeja) কিংবা ইরান বেজ (Eran Vej)।

সম্ভবত এটাই ছিল সিন্ধু-হরপ্পান রাষ্ট্র বা দেশের নাম। কাজেই আমরা এই নামের প্রকৃত বা আদি উচ্চারণ বের করতে চেষ্টা করব। এতে কোন সন্দেহ নেই যে, ইরানে সুদীর্ঘ কাল অবস্থানে আর্যদের ভাষা ও উচ্চারণে অনেক পরিবর্তন হয়েছে যে কারণে আইরিয়ান বএজ বা ইরান বেজ মূল শব্দের কিছু রূপান্তর হওয়া সম্ভব।

ঋগ্বেদের ভাষার পরিবর্তন ঘটে নি। সুতরাং মূল সিন্ধু-হরপ্পান তথা আর্য ভাষা ঋগ্বেদে আছে। ঋগ্বেদের ভাষার বিচারে আমরা আইরিয়ান বএজ বা ইরান বেজ-এর সম্ভাব্য যে দুইটি মূল পাই তার একটি আর্য নিবাস এবং অপরটি আর্য ব্রজ।

অবশ্য ঋগ্বেদে আমরা এই ধরনের নামের উল্লেখ পাই না। তার কারণ হতে পারে যে, এটা ছিল রাষ্ট্রের নাম যার শাসকদের বিরুদ্ধে তখন যুদ্ধ চলছিল। তবে দেশ বোঝাতে যে ব্রজ শব্দ ব্যবহার হত সেটা আমরা বুঝি ঋগ্বেদের এই বর্ণনা থেকে : “বর্ষণকারী সে ইন্দ্র উদব্রজ নামক দেশে বর্চী ও শম্বর নামক দুই ধনার্থী দাসকে সংহার করেছেন” (৬।৪৭।২১)।

আমরা জানি কৃষ্ণকে ব্রজেশ্বরও বলা হয়। সুতরাং আমরা এই সিদ্ধান্তে পৌঁছতে পারি যে, সিন্ধু-হরপ্পান রাষ্ট্রের নাম ছিল আর্য ব্রজ।

এই সঙ্গে এই বিষয় আরও স্পষ্ট হয় যে, আর্য ব্রজ ছিল মূলত ধর্মীয় রাষ্ট্র। বরুণের ধর্ম ছিল আর্য ধর্ম এবং যারা এই ধর্মের অনুসারী তাদেরকে সম্ভবত বলা হত আর্য।

অবশ্য আর্য কথাটা শ্রেষ্ঠ এবং সুসভ্য অর্থেই প্রযোজ্য ছিল বলে বোধ হয়।  কাজেই শব্দটি একটি বিশেষ সংস্কৃতি ও জীবনাচারের দ্যোতক হয়েছিল এই রকম একটা অনুমান করা যায়। যা কিছু শ্রেষ্ঠ তা-ই আর্য এই রকম একটা বোধ এই শব্দের সঙ্গে জড়িয়ে গিয়েছিল বলে আর্য শব্দ নিয়ে এশিয়া ও ইউরোপ ব্যাপী এত হাজার বৎসরেও গৌরববোধ ফুরায় না।

আবেস্তা আর্য গৌরবে ঋগ্বেদের তুলনায় অনেক বেশী সোচ্চার। ঈশ্বরের মনোনীত জাতির এই স্বরের প্রতিধ্বনি আমরা শুনতে পাই বাইবেলের পুরাতন নিয়মে যেখানে ইহুদীদেরকে সদাপ্রভু ঈশ্বরের মনোনীত এবং প্রিয় জাতি বলা হয়েছে।
আবেস্তায় আমরা গীতার কর্মবাদের ছায়া দেখতে পাই। সেখানে কৃষি এবং পশুপালনকে সবচেয়ে মর্যাদাজনক কাজ বলা হয়েছে। আবেস্তার ধর্মতত্ত্বে উৎপাদন ও শ্রমের গুরুত্ব অসাধারণ।

আবেস্তায় আমরা ঈশ্বর অহুর মযদার অত্যন্ত প্রিয় সৃষ্টি এবং অত্যন্ত শক্তিশালী দেবতা হিসাবে মিথরকে পাচ্ছি। মিথর (মিথ্র বা Mithra) হলেন মিত্র-এরই সামান্য রূপান্তর মাত্র। কাজেই আরও সংশয় থাকে না যে, মথুরার উৎপত্তি এই ভাবে: মিত্র-মিথর-মথুরা।

ঋগ্বেদে মিত্রকে লোকপতি বলা হয়েছে। ৮।২৫ সূক্তে মিত্র সম্পর্কে যা বলা হয়েছে তার কিছুটা হলেও উল্লেখ করা যায়:

“২৬। লোকপতি মিত্র বহু সংখ্যক প্রধান হব্য এ প্রকারে দর্শন করেন। মিত্র ও বরুণের মধ্যে আমরা তোমাদের জন্য তাঁরই ব্রত পালন করব। ১৭। পরে সাম্রাজ্যবিশিষ্ট বরুণের পুরাতন গৃহ প্রাপ্ত হব, অতিশয় প্রসিদ্ধ মিত্রের ব্রতও লাভ করব।”

ঋগ্বেদের মিত্রের পাশে আবেস্তার মিথরকে মেলানো যাক :

৬। আমরা মিথরের উদ্দেশ্যে আহুতি দিই। তিনি বিস্তীর্ণ চারণভূমির অধিপতি, সত্যবাদী, সভাসমূহে প্রধান। সহস্র কর্ণ, সুন্দর আকৃতি, দশ সহস্র চক্ষু ও পূর্ণ জ্ঞান বিশিষ্ট এ মিথর বলবান, নিদ্রাহীন ও চিরজাগ্রত।

৭। সকল দেবতার (অহুরের) মধ্যে যাঁকে অহুর মযদা সবচেয়ে গৌরবান্বিত করে সৃষ্টি করেছেন সকল দেশের প্রভু সেই মিথরের উদ্দেশ্যে আমরা আহুতি দিই।

সুতরাং মিথর এবং অহুর এই দুই মহান দেবতা আমাদের সাহায্যার্থে আগমন করুন।” (নিয়াইস। ২: মিহির নিয়াইস)।

কাজেই ঋগ্বেদের লোকপতি মিত্র এবং আবেস্তার সভাসমূহের প্রধান এবং সকল দেশের প্রভু মিথর যে একই দেবতা তা সহজবোধ্য।

ঋগ্বেদের এক গুরুত্বপূর্ণ দেবতা বায়ুর অনেক বেশী গুরুত্ব দেখা যায় আবেস্তায়। বায়ু অহুর মযদার অধীন প্রধান, অসুর সেনাপতি বলে অনুভব করা যায়। অনুমান করা যায় বায়ুর গুরুত্ব পূর্বে ইন্দ্রের তুলনায়ও বেশী ছিল। সম্ভবত পঞ্চপাণ্ডবের মধ্যে সবচেয়ে বড় যোদ্ধা ভীমের উপাস্য দেবতা-বায়ু ছিলেন হরপ্পান ধর্মের প্রধান যুদ্ধু দেবতা। আবেস্তায় বায়ু ঘোষণা করছেন :

“আমার নাম সে যে ধ্বংস  করে    
আমার নাম সে যে কেড়ে নেয়
...... ...... ........ ...........
আমার নাম সাহসী; আমার নাম সবচেয়ে সাহসী
আমার নাম সে যে এক আঘাতে চূর্ণ করে
...... ....... ........ ........ .........
আমার নাম সে যে দএবদের বিরুদ্ধে কাজ করে।” ইত্যাদি।
(রাম ইয়াস্ত)

আমরা আবেস্তাতেও সোমলতার সন্ধান পাই। সোমকে আবেস্থায় বলা হচ্ছে হওম (Haoma)। হওমের রস পবিত্র। দেবতাদের উদ্দেশ্যে তা অগ্নিতে আহুতি দেওয়া হয়। আবেস্তা থেকে আমরা জানছি যে, সোমলতা সোনালী এবং দীঘল বা লম্বা। সিরোযাহ্-২, ৩০ অনেরান-এ বলা হচ্ছে: “আমরা সোনালী ও লম্বা হওমের উদ্দেশ্যে আহুতি দিই; আমরা সঞ্জীবনী হওমের উদ্দেশ্যে আহুতি দিই, তিনি জগতের বৃদ্ধি ঘটান; আমরা হওমের উদ্দেশ্যে আহুতি দিই, তিনি মৃত্যুকে দূর করেন।”

সুতরাং সোমলতা যে ইক্ষু বা আখ গাছ মাত্র আমাদের এই ধারণার সমর্থনে আরও সাক্ষ্য পাওয়া যাচ্ছে।

বস্তুত আবেস্তা আমাদের বহু প্রশ্নের উত্তর দেয় এবং ঋগ্বেদকে বুঝতেও বিরাটভাবে সাহায্য করে। সম্ভবত আবেস্তায় হরপ্পান সভ্যতার অনেক স্মৃতি রয়েছে। যেমন আবেস্তায় বর (Vara)-এর যে বর্ণনা পাওয়া যায় তা থেকে তাকে মহেঞ্জোদাড়ো কিংবা হরপ্পার নগর দুর্গের কিংবা আরও পূর্বের কোন নগরের স্মৃতি থেকে আগত বলে মনে হয়।

“বর” হল প্রচণ্ড শীতের আক্রমণ থেকে মানুষ, পশু ও উদ্ভিদের রক্ষার জন্য অহুর মযদার নির্দেশে তাঁর অনুগত য়িম (যম) কর্তৃক নির্মিত প্রথম বিশাল গৃহ (নগর?)। সেখানে ১৮টি রাস্তা, গ্যালারী এবং চত্বর বা আঙ্গিনা আছে। সূর্য বা চন্দ্রের আলো সেখানে প্রবেশ করে না। ছাদ থাকায় নক্ষত্রও দেখা যায় না। সেই জন্য সেখানে আছে কৃত্রিম আলোর ব্যবস্থা।

হতে পারে যে, “বর” পুর শব্দের পরিবর্তিত রূপ। এইভাবে আমরা যেন্দ্-আবেস্তা থেকে অনেক মূল্যবান তথ্য পেতে পারি। এবং এ ব্যাপারেও সন্দেহ নেই যে, যেন্দ্-আবেস্তা শব্দ দুইটিও প্রাচীন আর্য শব্দের রূপান্তর। অনুমান করা যায় যে ছন্দ শব্দটি যেন্দ্-এ রূপান্তরিত হয়েছে এবং বেদ-স্তোত্র কিংবা স্তোত্র পরিণত হয়েছে আবেস্তায়।

যাইহোক, যেন্দ-আবেস্তা আমাদেরকে কতকগুলি অভাবিতপূর্ব ধারণার দিকে নিয়ে যায়। আমরা বুঝি যে, ভারতীয় উপমহাদেশে একেশ্বরবাদী ধর্ম মূলত ধ্বংস হলেও বাইরে হয় নি। সুতরাং আরও পশ্চিমে যে হিব্রু ধর্মের উত্থান দেখা যায় সেটিও হরপ্পান ধর্মের শাখা কিংবা তার সঙ্গে সংযুক্ত হওয়া অসম্ভব নয়।

পারসিকদেরকে অনেক সময় অগ্নির উপাসক বলা হয়। এটা কিন্তু প্রকৃত অর্থে সঠিক ধারণা নয়। পার্সী ধর্মে অগ্নির গুরুত্ব ঈশ্বর হিসাবে নয়, বরং অহুর মযদার অধীনস্থ পবিত্র শক্তি হিসাবে। অগ্নির গুরুত্ব সিন্ধু ধর্মের একটি লক্ষণ। আমরা ঋগ্বেদে দেখি সব দেবতার উদ্দেশ্যে আহুতি দেওয়া হয় অগ্নিতে।

ঋগ্বেদে এই কারণে অগ্নিকে দেবতাদের জিহ্বা কিংবা দূত বলা হয়েছে। কারণ সব দেবতাই ভোগ গ্রহণ করেন অগ্নির মাধ্যমে। এর দ্বারা কিন্তু আগুন পূজা বোঝায় না। অবশ্য অগ্নিও একজন স্বতন্ত্র দেবতা।

ইহুদী বা হিব্রু ধর্মেও আমরা একই ব্যাপার দেখি। সেখানেও সদাপ্রভু ঈশ্বরের উদ্দেশ্যে সকল আহুতি দিতে হয় বেদীর অগ্নিতে। বাইবেল (পুরাতন নিয়ম)-এর “হোমবলির নিয়ম” থেকে কিছুটা উদ্ধৃতি দিলে বিষয়টি স্পষ্ট হবে :

“পরে সদাপ্রভু মোশিকে ডাকিয়া সমাগম-তাম্বু হইতে এই কথা কহিলেন, তুমি ইসরায়েল-সন্তানগণকে কহ, তাহাদিগকে বল, তোমাদের কেহ যদি সদাপ্রভুর উদ্দেশ্যে উপহার উৎসর্গ করে, তবে সে পশুপাল হইতে গরু কিংবা মেষপাল হইতে আপন উপহার লইয়া উৎসর্গ করুক।

সে যদি গোপাল হইতে হোমবলির উপহার দেয়, তবে নির্দোষ এক পুংপশু আনিবে; সদাপ্রভুর সম্মুখে গ্রাহ্য হইবার জন্য সমাগম-তাম্বুর দ্বীরসমীপে আনয়ন করিবে। পরে হোমবলির মস্তকে হস্তার্পণ করিবে; আর তাহা তাহার প্রায়শ্চিত্যরূপে তাহার পক্ষে গ্রাহ্য হইবে। পরে সে সদাপ্রভুর সম্মুখে সেই গোবৎস হনন করিবে, ও হারোণের পুত্র যাজকগণ তাহার রক্ত নিকটে আনিবে, এবং সমাগম তাম্বুর দ্বারসমীপে স্থিত বেদির উপরে সেই রক্ত চারিদিকে প্রক্ষেপ করিবে। আর সে ঐ হোমবলির চর্ম খুলিয়া তাহাকে খণ্ড খণ্ড করিবে। পরে হারোণ যাজকের পুত্রগণ বেদির উপরে অগ্নি রাখিবে, ও অগ্নির উপরে কাষ্ঠ সাজাইবে। আর হারোণের পুত্র যাজকেরা সেই বেদির উপরিস্থ অগ্নির ও কাষ্ঠের উপরে তাহার খণ্ড সকল এবং মস্তক ও মেদ রাখিবে। কিন্তু তাহার অন্ত্র ও পদ জলে ধৌত করিবে; পরে যাজক বেদির উপরে সে সমস্ত দগ্ধ করিবে; ইহা হোমবলি, সদাপ্রভুর উদ্দেশ্যে সৌরভার্থক অগ্নিকৃত উপহার।” (বাইবেল। পুরাতন নিয়ম। লেবীয় পুস্তক। হোমবলির নিয়ম। ১;১-৯)

আরও কিছু উদ্ধৃতি দেওয়া যায় :

“আর কেহ যখন সদাপ্রভুর উদ্দেশ্যে ভক্ষ্য-নৈবেদ্য উপহার দেয়, তখন সূক্ষ্ম সূজি তাহার উপহার হইবে, এবং সে তাহার উপরে তৈল ঢালিবে ও কুন্দুরু দিবে; আর হারোণের পুত্র যাজকদের নিকটে সে তাহা আনিবে, এবং সে তাহা হইতে এক মুষ্টি সূক্ষ্ম সূজি ও তৈল এবং সমস্ত কুন্দুরু লইবে; পরে যাজক সেই নৈবেদ্যের স্মরণার্থক অংশ বলিয়া তাহা বেদির উপরে দগ্ধ করিবে; তাহা সদাপ্রভুর উদ্দেশ্যে সৌরভার্থক অগ্নিকৃত উপহার। এই ভক্ষ্য-নৈবেদ্যের অবশিষ্ট অংশ হারোণেরও তাহার পুত্রগণের হইবে; সদাপ্রভুর অগ্নিকৃত উপহার বলিয়া ইহা অতি পবিত্র। (বাইবেল। পুরাতন নিয়ম। লেবীয় পুস্তক। হোমবলির নিয়ম। ভক্ষ্য-নৈবেদ্যের নিয়ম।২;১-৩)

সুতরাং পূজা পদ্ধতির ক্ষেত্রে সিন্ধু-ধর্মের সঙ্গে ইহুদী ধর্মের এই মিল তাৎপর্যপূর্ণ। অন্যদিকে ইহুদী ধর্মও একেশ্বরবাদী। তবে তার একেশ্বরবাদ নিরঙ্কুশ এবং অত্যন্ত অসহিষ্ণু।

ইহুদী বা হিব্রু ধর্মের সময়টা সিন্ধু সভ্যতা ধ্বংসের অনেক পর। মোশি আনুমানিক খ্রীস্টপূর্ব ১২ শতকের কোন সময়ের মানুষ।

যে বিশেষ সময়টিতে প্রাচীন পৃথিবীর বিস্তীর্ণ ভূভাগ জুড়ে জাতিগোষ্ঠিসমূহের অভূতপূর্ব সঞ্চালন চলছিল যদি আমরা সেই সময়টিকে চিহ্নিত করতে পারি তবে সিন্ধু সভ্যতা ধ্বংসের সম্ভাব্য সময়টির নির্ধারণ সহজতর হতে পারে। এখন এটা স্পষ্ট যে, সিন্ধু সভ্যতা ধ্বংসের ফলে আর্য বিস্ফোরণ এই সময় পৃথিবীর বিস্তীর্ণ ভূভাগে জাতিসমূহের স্থিতিশীলতা বিপর্যস্ত করেছিল।

আমরা দেখতে পাই হিকসস নামে এক যাযাবর জাতি আনুমানিক ১৬৭০ খ্রীস্টপূর্বাব্দে মিসর দেশ জয় করে এবং একশত বৎসরের কাছাকাছি সময় মিসর শাসন করে। মিসরে যাদেরকে হিকসস বলা হয়েছে তারা কারা এবং কোথা থেকে এসেছে এই সমস্ত বিষয়টি রহস্যাবৃত রয়েছে। তবে মিসরে তারাই প্রথম ঘোড়ার ব্যবহার প্রচলন করে। খ্রীস্টপূর্ব ষোড়শ শতাব্দীর সূচনায় ব্যাবিলনের ক্যাসাইট শাসকদের নামে আর্য শব্দ দেখা যায়।

১৩৮০ খ্রীস্টপূর্বাব্দে হিটাইট রাজা সুবিলিউলিউমা এবং মিটানিয়ান মত্তিওয়াযা-র মধ্যে সম্পাদিত চুক্তিপত্রে আমরা মিত্র, বরুণ, ইন্দ্র ইত্যাদি দেবতার নাম দেখতে পাই। গ্রীস-ইতালীতে আর্য মাইগ্রেশন হয়েছে আরও কিছু পরে।

অশ্বারোহী হিকসসদেরকে আর্য কিংবা আর্য অভিযাত্রীদের সঙ্গে সম্পর্কিত জনগোষ্ঠী ধারণা করবার কারণ আছে। হিকসসদের পর ২২ এবং ২৩তম রাজবংশের ফারাওদের মধ্যে (খ্রীস্টপূর্বাব্দ ৯৪৫-এর পর থেকে) শশঙ্ক নাম খুব বেশী দেখা যেত। শশঙ্ক স্পষ্টতই শশাঙ্ক শব্দের প্রকারভেদ।

সুতরাং আমরা হিকসসদেরকে কোন না কোনভাবে আর্য মাইগ্রেশনের সঙ্গে সম্পর্কিত ধরতে পারি। তাদের মিসর আক্রমণ ঘটে ১৬৭০ খ্রীস্টপূর্বাব্দের দিকে। ক্যাসাইটদের সময়টাও তাদের থেকে খুব বেশী পরে নয়। কাজেই আমরা অনুমান করতে পারি যে, ১৭০০ থেকে ১৮০০ খ্রীস্টপূর্বাব্দের মাঝে কোন সময়ে সিন্ধু সভ্যতা ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়।

অবশ্য প্রত্নতাত্ত্বিক গবেষণা দ্বারা কেউ কেউ অনুমান করেন যে, সিন্ধু সভ্যতার ভাঙ্গনের সময় হতে পারে ১৭৫০ খ্রীস্টপূর্বাব্দ৩৬। আমরা এভাবে না ধরে একটি মোটামুটি শতাব্দী কাল সময় ধরতে পারি যার এক দীর্ঘ সময় ধরে সভ্যতার ধ্বংস চলে। অর্থাৎ এটা সম্ভব যে, খ্রীস্টপূর্ব ১৮ শতাব্দী সিন্ধু সভ্যতার ধ্বংসের শতাব্দী। সেক্ষেত্রে ঋগ্বেদ রচনার সময়ও হয় মূলত সেইটিই।

যাইহোক, আমরা পুনরায় ইহুদী ধর্মের উদ্ভবের বিষয়টির দিকে মনোযোগ দিই। হিকসসদের শাসনের পর ইখনাটন নামে এক মিসরীয় ফারাও ১৩৮০ থেকে ১৩৬২ খ্রীস্টপূর্বাব্দ পর্যন্ত মিসর শাসন করেন। তিনি মিসরে প্রথম একেশ্বরবাদী ধর্ম প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করেন। তাঁর সময়ের প্রায় শতাব্দী কাল পর মোশির আবির্ভাব ঘটে। মোশির আনুমানিক সময় খ্রীস্টপূর্ব ১২ শতাব্দী।

মোশি মিসরে দাসত্বে আবদ্ধ হিব্রুদেরকে তাঁর নেতৃত্বে সংগঠিত করেন এবং তাদেরকে সেখান থেকে মুক্ত করে প্যালেস্টাইনে নিয়ে আসেন। এই হিব্রুরা আর্যদের একটা অংশ হওয়া অসম্ভব নয়। কারণ বাইবেলে বলা হয়েছে তারা মিসরে চারশত ত্রিশ বৎসর বাস করেছিল। আমরা অনুমান করতে পারি যে, এই সময়টা ৪০০ থেকে ৫০০ বৎসর হতে পারে। তার মানে তারা হিকসসদের সঙ্গে মিসরে প্রবেশ করেছিল কিংবা তারাই হিকসস বা হিকসসদের বংশধর। অবশ্য একইভাবে হিকসসদের অল্প পরে যাযাবরে পরিণত আর্যদের অপর একটি শাখা হিসাবে তাদের মিসর প্রবেশের সম্ভাবনাও অস্বীকার করা যায় না। হিকসস শাসন পতনের পর এইসব বহিরাগত উপজাতি দাসে পরিণত হয়।

হিব্রু একেশ্বরবাদ সম্পর্কে বলা যায় যে, মোশির পূর্ব থেকেই হিব্রুদের মধ্যে যে একেশ্বরবাদী চেতনা বা ঐতিহ্য ছিল তার সাক্ষ্য দেয় বাইবেল। এটাই যুক্তিসঙ্গত যে, পুরাতন নম্র একেশ্বরবাদী ধর্মবিশ্বাসকে সংস্কার করে মোশি উগ্র ও আক্রমণাত্মক রূপ দেন।

বাইবেলের অনেক শব্দে আর্য ভাষার ছায়া দেখতে পাওয়া যায়। বাইবেলে অব্রাহাম-এর পূর্ব নাম বলা হয়েছে অব্রাম। অবরাম অপরাম থেকে উদ্ভূত হতে পারে। অপ অর্থ জল। আদম সম্ভবত আদি মনু-র সংক্ষিপ্ত রূপ। স্বর্গ “এদন” উদ্যানের রূপান্তর হওয়া সম্ভব। দাউদকে মনে হয় দভীতির রূপান্তর। হারোণ সম্ভবত বরুণের রূপান্তর।

চমকপ্রদ ব্যাপার হল যে, ইহুদী ধর্মবিশ্বাস তথা বাইবেল অনুযায়ী মানুষকে স্বর্গচ্যুত করার জন্য দায়ী হল সর্প। এটা সম্ভব যে, আর্যদের যে অংশ মিসরে গিয়েছিল তারা অহি সম্পর্কে আর্য বা বৈদিক উপকথা নিয়ে গিয়েছিল।

হিব্রু ঈশ্বর ইয়াহ্ওয়েহ শব্দের উদ্ভব সম্ভবত আর্য ব্রজ থেকে। আর্য ব্রজের ঈশ্বর এই অর্থে ঈশ্বরকে ইয়াহ্ওয়েহ বলা হতে পারে।

তবে এটা ঠিক যে, এত দূরে এবং এত দীর্ঘ সময়ের ব্যবধানে আর্য ভাষা, সংস্কৃতি এবং ধর্মকে অপরিবর্তিত রূপে আশা করা ভুল হবে। শুধু যে দীর্ঘ যাত্রায় বহু স্মৃতি হারিয়ে গেছে তা নয়, রক্ত ও গোষ্ঠীতেও নিশ্চয় প্রচুর মিশ্রণ ঘটেছে। পরিবর্তন ঘটেছে ভাষায় ও উচ্চারণে। সময় ও পরিবেশ পরিস্থিতির পরিবর্তন দ্বারা অতীতের বহু কিছুই মূল্যহীন এবং বিস্মৃত হওয়াই স্বাভাবিক। সুতরাং যেটা থাকা সম্ভব সেটা হল উন্নত এক সভ্যতার কিছু অস্পষ্ট স্মৃতি এবং কিছু প্রভাব।

সম্ভবত এই সময়কার আর্য মাইগ্রেশনই সেমিটিক ভাষা গোষ্ঠীর উদ্ভব ঘটায় কিংবা তার উদ্ভবে একটি মৌলিক ভূমিকা পালন করে।

মোট কথা সিন্ধু সভ্যতার ধ্বংস এমন এক আর্য আন্দোলন সৃষ্টি করে যা পৃথিবীর বিভিন্ন স্থানে বহু নূতন উপকরণ ও উপাদান সঞ্চার করে এবং পরবর্তীতে অনেক নূতন সভ্যতার উদ্ভবের পরিস্থিতি সৃষ্টি করে। এই রকম এক সভ্যতা হল গ্রীক সভ্যতা।

সিন্ধু সভ্যতার ধ্বংস ভারতবর্ষের জন্যও এক নূতন পরিস্থিতি সৃষ্টি করে। যে ধরনের জলনিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থার উপর সিন্ধু-হরপ্পান সভ্যতা গড়ে উঠেছিল সে ধরনের কোন কিছু আধুনিক যুগের পূর্ব পর্যন্ত কখনই ভারতবর্ষ আর গড়ে তুলতে পারে নি। এটা ঠিক যে, পরবর্তীকালে আরও বৃহদায়তনে রাজপ্রাসাদ হয়েছে, মন্দির হয়েছে, সৌধ হয়েছে, নগরও হয়েছে; কিন্তু নাগরিক সভ্যতা বলতে যা বোঝায় সেটা একালের পূর্বে হরপ্পার পর আর সেভাবে গড়ে তোলা গেছে কি না সন্দেহ।

হরপ্পান যুগের অবসানের সঙ্গে সমাজে এক অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ উপাদান সংযুক্ত হয়েছে তা হল বৈদিক ধর্মকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা ব্রাহ্মণ শ্রেণী। ব্রাহ্মণের এই উত্থান ভারতবর্ষের পরবর্তী সুদীর্ঘ কালের ইতিহাসকে এমনইভাবে প্রভাবিত করেছে যে, ব্রাহ্মণের এই উত্থান ও ভূমিকার সঠিক মূল্যায়ন ছাড়া আমাদের পক্ষে ভারতীয় ইতিহাসের অনেক সমস্যা এবং সমাজ বিকাশের গতিপ্রকৃতি বোঝা সম্ভব নয়। সুতরাং এখন আমরা সেই দিকটাতে মনোযোগ দিব।

    
১৩। ব্রাহ্মণের উত্থান ও ভারতীয় সমাজ

এই বিষয়ে সন্দেহের কোন কারণ নেই যে, সিন্ধু সভ্যতার ধ্বংসের সময় এসে গিয়েছিল। একদিকে তার বন্ধ্যাত্ব, অভ্যন্তরীণ সঙ্কট এবং বিশেষত জলনিয়ন্ত্রণব্যবস্থা দ্বারা সৃষ্ট ভূ-প্রাকৃতিক বিপর্যয় সিন্ধু সভ্যতার পতন ঘটাবার সমস্ত শর্ত পূরণ করেছিল। তবে বৈদিক ঋষিগণ নিজেদের নেতৃত্বে এই পতনকে সম্পন্ন করেছেন।

সম্ভবত এই কারণে ভারতবর্ষ কোন দিন এই ঋষিদের প্রভাব ঝেড়ে ফেলে আর উঠে দাঁড়াতে পারে নি। পরবর্তী ব্রাহ্মণরা আর কিছু নয়, ঋষিগোষ্ঠীর নূতন নামকরণ। তবে পূর্বে ঋষিরা সবাই বংশানুক্রমিক ছিলেন না। যে কেউ ঋষি হতে পারতেন। সম্ভবত যাঁরা দেবতার উদ্দেশ্যে স্তোত্র রচনা করতেন তাঁরা ঋষি হিসাবে স্বীকৃতি পেতেন। অনেকটা কবির মত। এই কারণে আমরা অনেক রাজর্ষির উল্লেখ পাই যারা নিয়মিত পূজারী বা পুরোহিত না হয়েও ঋষি হয়েছেন। ঋগ্বেদের একজন ঋষি বলছেন, “দেখ আমি স্তোত্রকার, পুত্র চিকিৎসক ও কন্যা প্রস্তরের উপর যব-ভর্জন-কারিণী। আমরা সকলে ভিন্ন ভিন্ন কর্ম করছি”(৯।১১২)৩)।

এ থেকে বোঝা যায় পুরোহিতদের সম্মান থাকলেও এবং অনেক ক্ষেত্রে বংশগতভাবে ধর্মচর্চা করা হলেও হরপ্পান যুগে জাতিভেদ প্রথা এবং ব্রাহ্মণ্যবাদ ছিল না। কিন্তু বৈদিক আন্দোলন একটা নূতন পরিস্থিতি সৃষ্টি করল। আগে ঋষি কিংবা পুরোহিতরা বংশগত না হলেও ধর্মীয় শৃঙ্খলার জন্য নিশ্চয় একটা ধর্মীয় সংগঠন ছিল। কিন্তু বৈদিক আন্দোলন এক দেবতাকে ভেঙ্গে বহু দেবতায় পরিণত করতে গিয়ে এই কেন্দ্রীয় সংগঠনও ভেঙ্গে ফেলেছিল।

বস্তুত ঋষিদের মধ্যে বৃত্র ধ্বংস ও একেশ্বরবাদ বিরোধিতায় ঐক্য থাকলেও কোন কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব ছিল না। এইজন্য ঋগ্বেদের বিভিন্ন বক্তব্য ও বিষয়বস্তুতে অনেক স্ববিরোধ কিংবা বৈপরীত্য লক্ষ্য করা যায়। যখন যে দেবতার স্তুতি করা হয় অনেক সময় মনে হয় যে, সেই দেবতা ছাড়া আর কেউ নেই। অনেক ক্ষেত্রে এক দেবতাকে বড় করতে গিয়ে অপর দেবতাকে হেয় করা হয়। এ ছাড়া থেকে গেছে একেশ্বরবাদের গভীর প্রভাব। অনেক মন্ত্রে একেশ্বরবাদের প্রকাশ স্পষ্ট।

বাস্তব ক্ষেত্রে ঋষিদের মধ্যেও এই স্ববিরোধের প্রতিফলন ঘটেছিল। বসিষ্ঠ ও বিশ্বামিত্র ঋষিদ্বয়ের দ্বন্দ্ব বহু প্রচারিত। তাঁদের দ্বন্দ্বের ফলে দুই পক্ষে রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ অনুষ্ঠিত হয় এবং তাঁরা একে অপরকে গালাগালি করে ও অভিশাপ দিয়ে যেসব মন্ত্র রচনা করেন সেগুলির অন্তত কিছু সংখ্যক খোদ ঋগ্বেদেই স্থান পেয়েছে।

বস্তুত বৈদিক আন্দোলনের কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব ছিল না। এর কেন্দ্র ছিল একটি প্রেরণা যার লক্ষ্য ছিল জলনিয়ন্ত্রণব্যবস্থা এবং সেই সঙ্গে হরপ্পান ধর্মীয় ও রাষ্ট্রীয় কর্তৃত্বকে ধ্বংস করে ক্ষমতা ও সম্পদ লাভ করা। যে মুহূর্তে এই লক্ষ্য অর্জন হল সেই মুহূর্তে বৈদিক আন্দোলনের ঐক্য ও সংহতির ভিত্তি ধ্বংস হল।

এমন অবস্থায় সমগ্র বৈদিক আন্দোলন ও তার ধর্মীয় নেতৃত্ব ধ্বংস হতে পারত। এই ধ্বংস রোধ করার উপায় ছিল মন্ত্র রচনা এবং বেদ (ঋগ্বেদ) ভুক্ত করার অধিকার রুদ্ধ করা। অর্থাৎ আর কেউ যেমন নবী হতে পারবে না তেমন আর কেউ ঋষি হতে পারবে না ঘোষণা না দিয়েও এই ব্যবস্থা করা। বিশেষত সব বেদের মূল ঋগ্বেদের জন্য এই ব্যবস্থার গুরুত্ব ছিল সবচেয়ে বেশী। তবে ঋষিদের মধ্যে যেহেতু কেন্দ্রীয় সংগঠন ছিল না সেহেতু নিশ্চয় এই বিষয়টি নিশ্চিত করতে কিছু সময় লেগেছে। এই কারণে পরবর্তীকালে রচিত বেশ কিছু সূক্ত নবম ও দশম মণ্ডলে স্থান করে নিতে পেরেছে।

তবে ঋগ্বেদের পরেও অন্যান্য বেদ এবং বেদের শাখাসমূহ রচিত হয়েছে। কিন্তু ক্রমে ঋষিদের যুগ শেষ করতে হয়েছে। এবং বৈদিক আন্দোলনের নেতৃত্বের নিয়ন্ত্রণকে সুদৃঢ় করার প্রয়োজনে এরপর ধর্মচর্চা বা পুরোহিততন্ত্রকে বংশগত করতে হয়েছে। আর এইভাবে নূতন করে আর কারও ঋষি হবার উপায় রইল না। প্রাক্তন ঋষিদের বংশধররা আর ঋষি নামে পরিচিত নয়; তারা এখন ব্রাহ্মণ।

এই ব্রাহ্মণ শ্রেণী কুলভিত্তিক বা বংশানুক্রমিক। কিন্তু বিশাল ভারতবর্ষে বৈদিক ধর্ম (যা এখন ব্রাহ্মণ্য ধর্মে পরিণত) ছড়িয়ে দেবার এবং এই ধর্মের উপর নিয়ন্ত্রণ রক্ষার জন্য এই সীমিত সংখ্যক পরিবার বা গোত্র যথেষ্ট নয়। সুতরাং ভিন্ন সমাজ বা উপজাতি ও জাতির ধর্মীয় ব্যক্তিদেরকে নানানভাবে ধীর প্রক্রিয়ায় ব্রাহ্মণ শ্রেণীর অন্তর্ভুক্ত করে নিতে হয়েছে।

পূর্বে বিশ্বামিত্রের মত ঋষিগণ মন্ত্র রচনার পাশে রণক্ষেত্রে লড়াই করেছেন। কিন্তু বেদ ও ধর্মগ্রন্থের আয়তন বৃদ্ধি এবং সেই সঙ্গে ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠানের জটিলতা বৃদ্ধিরও সঙ্গে বিভিন্ন পেশার সাথে সংযুক্ত ঋষি ও রাজর্ষির যুগ শেষ হয়েছে। একদিকে ধর্মীয় নিয়ন্ত্রণকে কুলগত বা বংশগত নিয়ন্ত্রণের উপর প্রতিষ্ঠা করার প্রয়োজন, অপরদিকে ধর্মীয় জটিলতা বৃদ্ধি ব্রাহ্মণকে আর সকল পেশা থেকে বিচ্ছিন্ন করেছে।

এইভাবে যোদ্ধা কিংবা রাষ্ট্রশাসক শ্রেণী থেকে ব্রাহ্মণ স্বতন্ত্র হয়ে গেল। উভয়ের মধ্যে ঐক্য রইল। কিন্তু ক্ষমতা, সুযোগ-সুবিধা এবং সমাজ নিয়ন্ত্রণের প্রশ্নে যোদ্ধা ও শাসকের সঙ্গে ব্রাহ্মণের দ্বন্দ্বও দেখা দিল। বিশেষত যুদ্ধের প্রক্রিয়ায় যুদ্ধশক্তি প্রবল হয়ে উঠেছিল। সিন্ধুর কৃষিব্যবস্থা ধ্বংসের সঙ্গে পশুপালন ও যাযাবর শক্তির বিকাশ অনিবার্য ছিল। অনেক পরবর্তীকালে মধ্য এশিয়া থেকে যখন নূতন নূতন অভিযাত্রী দল অরক্ষিত উত্তর-পশ্চিম প্রান্ত দিয়ে উপমহাদেশে প্রবেশ করছিল তখন কৃষি সমাজ অধিকতর হুমকির সম্মুখীন হল এবং সেই সঙ্গে ব্রাহ্মণের নেতৃত্বও।

এই অবস্থায় ব্রাহ্মণকে কৃষি সমাজ সংগঠিত করার উপর সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিতে হল। বস্তুত পশুপালন মূলক যাযাবর জীবনে বেদ-উপনিষদ-পুরাণের কি মূল্য? সুতরাং মানুষ যাতে পশুপালন বৃত্তির উপর বেশী জোর না দেয় সম্ভবত সেই উদ্দেশ্যে গোমাংস ভক্ষণ নিষিদ্ধ করতে হল। অথচ ঋগ্বেদের ৬।১৬।৪৭; ১০।২৭।২; ১০।২৮।৩; ১০।৮৬।১৩-১৪ এবং ১০।৮৯।১৪ ইত্যাদি ঋকগুলি পাঠ করলে বোঝা যায় এই উষ্ণ জলবায়ুর দেশের আর্য এবং ঋষিগণ কি পরিমাণে গোমাংস ভক্ষণ করতেন। গোমাংসের প্রতি ইন্দ্রের লোলুপ দৃষ্টি পাঠকের চোখ এড়ায় না। ১০।৮৬।১৪ ঋক থেকে উদ্ধৃতি দেবার লোভ সংবরণ করতে পারছি না যেখানে ইন্দ্রের মুখ দিয়ে ঋষি বলছেন, “আমার জন্য পঞ্চদশ এমন কি বিংশ বৃষ পাক করে দাও। আমি খেয়ে শরীরের স্থূলতা সম্পাদন করি, আমার উদরের দু’পার্শ্ব পূর্ণ হয়। ইন্দ্র সকলের শ্রেষ্ঠ।”

বোধ করি পনের থেকে কুড়িটি বৃষমাংস ভক্ষণের সঙ্গে ইন্দ্রের শ্রেষ্ঠত্বের সম্পর্ক আছে!

আসলে গোবধ নিষেধের মধ্যে রয়েছে পশুপালন ও কৃষি এই উভয় সংস্কৃতি ও জীবন যাত্রার মধ্যকার দ্বন্দ্বের প্রতিফলন। শুধু পশুপালন ও যাযাবর বৃত্তিকে নয় যুদ্ধের শক্তি ক্ষত্রিয়কেও সংযত ও নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করতে হয়েছে। পশুপালন ও যাযাবর বৃত্তি রোধ হলে অবশ্য ক্ষাত্র শক্তি এমনিতেও অনেক দুর্বল হয়।

ব্রাহ্মণ সমগ্র সমাজকে এমনভাবে সংগঠিত করেছে যাতে ক্ষত্রিয় বা রাষ্ট্রশাসক কখনই খুব বেশী প্রবল হয়ে উঠতে না পারে। রাষ্ট্রকে দুর্বল রাখতে গিয়ে ব্রাহ্মণরা সামাজিক বিভক্তির শক্তিকে লালন করেছে। ব্রাহ্মণ সামাজিক ঐক্যের শক্তি নয়। বরং তার ভিত্তি রয়েছে সমাজের বিচ্ছিন্নতা, বিভক্তি, উপজাতীয় ও গোত্রীয় স্বাতন্ত্র্যের মধ্যে। ব্রাহ্মণের কোন বৃহৎ রাষ্ট্র বা সমাজ গড়বার আকাঙ্ক্ষা বা ক্ষমতা নেই। সে তার জাতিবর্ণভিত্তিক গোত্র বা কুলগত শ্রেষ্ঠত্ব রক্ষা করতে পারলেই সন্তুষ্ট। এর জন্য তার চারপাশে এমন একদল সমগোত্রীয় লোক অর্থাৎ ব্রাহ্মণ দরকার যাদের সঙ্গে এক অখণ্ড সংগঠন গঠন দ্বারা ঐক্যবদ্ধ না হলেও যাদের সঙ্গে ঐক্য ও দ্বন্দ্বের, নৈকট্য ও দূরত্বের এক আশ্চর্য জটিল সম্পর্ক রক্ষা করে চলবে।

ব্রাহ্মণ নিজে ঐক্যবদ্ধ নয়। ফলে বৃহৎ ও সংগঠিত সমাজ গঠনের শক্তি তা নয়। তা নিজ নিয়ন্ত্রণ ও নেতৃত্ব রক্ষার প্রয়োজনে সমাজকে বিভক্ত করে। ব্রাহ্মণ নগরের নেতা নয়, গ্রামের নেতা। ব্রাহ্মণ নগরের নেতা যেমন নয় তেমন মরুচারী বর্বরতা কিংবা অরণ্যের বন্যতারও নেতা নয়। দুইটির কোনটিতে তার লাভ বা অস্তিত্ব নেই। তাই ব্রাহ্মণ মূলত নিম্নমাত্রার কৃষি সমাজের নেতা। ব্রাহ্মণ্যবাদ এক ধরনের প্রতিক্রিয়া। এটা যেন হরপ্পার অনেক শত কিংবা সহস্র বৎসর পূর্বে আদিম মানুষ যখন অরণ্য ও শিকার জীবন ছেড়ে এসে স্থায়ী কৃষি জীবনে কিছুদূর প্রবেশ করেছে সেই পর্যায়ে ফেরা।

এ ক্ষেত্রে ব্রাহ্মণ যেমন ভারতবর্ষের আদিম সমাজকে ব্যবহার করেছে তেমন ভারতের ভূ-প্রাকৃতিক বিচ্ছিন্নতা ও বৈচিত্র্যকেও কাজে লাগাতে পেরেছে। পরবর্তীতে ব্রাহ্মণ বিমূর্ত বহু দেবতা পূজা থেকে পৌত্তলিকতায় নেমে গেছে। এইভাবে পশ্চাৎপদ ও আদিম সমাজের কাছাকাছি অবস্থান নেওয়ায় আদিম উপজাতিগুলি ব্রাহ্মণের ধর্ম ও সমাজের প্রতি আকর্ষণ বোধ করেছে এবং ব্রাহ্মণের কর্তৃত্ব মেনে নিয়ে নীচু মাত্রার সভ্য সমাজের অঙ্গীভূত হয়েছে। ব্রাহ্মণ তাদের উপজাতীয় বা গোত্রীয় স্বাতন্ত্র্যবোধকে ধর্মীয় তত্ত্ব দ্বারা জাতিবর্ণে রূপান্তরিত করায় এই বিচ্ছিন্নতার মধ্যে তারা স্বস্তিবোধ করেছে। এইভাবে জাতিবর্ণ কাঠামো দ্বারা আদিম উপজাতীয় পর্যায় থেকে আসা গোষ্ঠীগুলির স্বাতন্ত্র্য ও বিচ্ছিন্নতা রক্ষা করা হয়েছে।

অন্যদিকে, ভারতবর্ষের বর্ষা ও বিচিত্র ভূ-প্রকৃতি আধুনিক যন্ত্রযুগের পূর্ব পর্যন্ত এখানে বৃহত্তর ও ঐক্যবদ্ধ সমাজ গঠনের পথে সর্বদাই বিরাট বাধা হয়ে থেকেছে। ব্রাহ্মণ এই বাস্তবতাকে কাজে লাগিয়ে জাতিবর্ণ প্রথা দ্বারা একটি বহু বিচ্ছিন্ন দ্বীপের সমষ্টির মত একটি বহুবিচ্ছিন্ন সমাজ সমষ্টি গড়ে তুলেছে যার বিভক্তির মধ্যেও কিছু অভিন্ন আচার ও প্রথার মাধ্যমে একটি ঐক্যও রক্ষা পেয়েছে। বিভক্তির মধ্যেও ঐক্যের এই শক্তি হয়েছে ব্রাহ্মণ নিজেই।

যে যুদ্ধ দেবতা ইন্দ্রকে সামনে রেখে বৈদিক শক্তির উত্থান ব্রাহ্মণ তার নিজ প্রতিষ্ঠা এবং ক্ষত্রিয়কে সংযত করার প্রয়োজনে সেই ইন্দ্রকে পরবর্তীকালে এক তুচ্ছ দেবতায় পরিণত করেছে। তাকে পুরাণকাহিনীগুলিতে শুধু স্বর্গের রাজা হিসাবে রাখা হয়েছে।

অবশ্য এই পুরাণকাহিনীগুলি পরবর্তীকালের ধর্মীয় প্রয়োজনও পূরণ করেছে। বেদ আর লেখা যাবে না। কিন্তু সমাজ থেমে থাকে না। এই গতিশীল সমাজের সঙ্গে তাল মেলাতে ব্রাহ্মণ শ্রেণী পুরাণ রচনা করে সমাজ মানসকে তার নিয়ন্ত্রণে রেখেছে। যা বেদে পাল্টানো সম্ভব নয় তা পুরাণে করেছে।

সর্বত্র, সমস্ত ধর্মীয় সাহিত্যে ব্রাহ্মণের প্রাধান্য প্রতিষ্ঠার সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালানো হয়েছে। সর্বত্র ব্রাহ্মণের জয় জয়কার। ব্রাহ্মণকে দেবতার পর্যায়েই নেওয়া হয়েছে। মহাভারতে কৃষ্ণের মুখ দিয়ে বলানো হচ্ছে, “সত্য অপেক্ষা ধর্ম, মাতার তুল্য গুরু এবং ব্রাহ্মণের তুল্য উৎকৃষ্ট জীব আর কেহই নাই।........ ব্রাহ্মণ হইতে অন্যান্য বর্ণসমুদায় উৎপন্ন হইয়াছে। ব্রাহ্মণই দেবাসুরগণের সৃষ্টিকর্তা।......

“ব্রাহ্মণের প্রভাব অতি আশ্চর্য দেখ, দেবরাজ ইন্দ্র অহল্যার সতীত্ব ভ্রংস করিয়াছিলেন বলিয়া গৌতমের শাপে তাঁহার মূখমণ্ডল হরিদ্বর্ণ শ্মশ্রুজালে সমাকীর্ণ এবং মহর্ষি কৌণিকের অভিশাপে তাঁহার মুষ্ক নিপতিত ও পরিশেষে মেষবৃষণ দ্বারা তাঁহার বৃষণ নির্মিত হয়। সর্জ্জাতি রাজার যজ্ঞে মহর্ষি চ্যবন অশ্বিনীকুমারদ্বয়কে যজ্ঞভাগ প্রদানে কৃত সঙ্কল্প হইলে, ইন্দ্র তাঁহার প্রতি বজ্র নিক্ষেপে সমুদ্যত হইয়া তাঁহার শাপপ্রভাবে স্তম্ভিত হইয়াছিলেন। (শান্তিপর্ব। মোক্ষধর্ম পর্ব। পৃষ্ঠা: ১১৭০। মহাভারত, অনু: কালী প্রসন্ন সিংহ)

ব্রাহ্মণের হাতে ঋগ্বেদের ইন্দ্রের কী করুণ পরিণতি! ইন্দ্রের সঙ্গে যে যুদ্ধ শক্তির সম্পর্ক সেই যুদ্ধশক্তি তথা ক্ষত্রিয়ের শক্তি হরণের উদ্দেশ্যে ব্রাহ্মণ ইন্দ্রের এই পরিণতি ঘটিয়েছে।

জাতিবর্ণ ভিত্তিক সমাজের মূল সংগঠক ব্রাহ্মণ বিভক্ত ও নিরস্ত্র। তাই ব্রাহ্মণের প্রভাব যখন বেড়েছে ভারতীয় বিভিন্ন সমাজ ও জাতির ঐক্য ও সামরিক শক্তিও তখন হ্রাস পেয়েছে। এর ফল হয়েছে বৈদেশিক আগ্রাসন ও শাসন। ব্রাহ্মণ এবং সেই সঙ্গে সমগ্র গ্রাম-সমাজ এই সবকিছুর প্রতিই নির্লিপ্ত থেকে জীবন যাপন করেছে এবং উপরতলার বহিরাগত শাসকদেরকে ধীর প্রক্রিয়ায় আত্তীকরণ করে চলেছে। এই অবস্থায় ভারতবর্ষের কোন দেশে দীর্ঘ কাল রাষ্ট্রীয় স্বাধীনতা রক্ষা করা সম্ভব হয় নি।

ব্রাহ্মণ তার বিভেদের শক্তি নিয়ে অসাধারণ কৃতিত্বের সঙ্গে সমাজের এক শক্তিকে অপর শক্তির বিরুদ্ধে নিয়োগ করেছে। যাদের হাত থেকে তা ভারতবর্ষে সভ্যতার নেতৃত্ব কেড়ে নিয়েছিল সেই নাগরিক চেতনা সম্পন্ন কারিগর, কারখানা মালিক এবং বণিকদের আর কোন দিন উঠতে দেয় নি। সমাজের পশ্চাদপৎতার শক্তি, কৃষির শক্তিকে যেমন তাদের বিরুদ্ধে নিয়োগ করেছে তেমন নিয়োগ করেছে ক্ষাত্রশক্তিকেও। ফলে এই শক্তি আর কোন দিন মাথা সোজা করে দাঁড়াতে পারে নি। কেবল মাত্র আধুনিক কালে ইউরোপ থেকে আগত বণিক ও যন্ত্রের শক্তি ব্রাহ্মণ ও ক্ষাত্রশক্তির এই জোটকে কিছুটা হলেও ভাঙ্গতে পেরেছে।

হয়ত এই অবস্থায় বণিক ও কারিগরি শক্তি নিরুপায় হয়ে অহিংস উপায়ে দাঁড়াবার জন্য অবলম্বন করেছিল জৈন ও বৌদ্ধ আন্দোলনকে। ক্ষেত্র বিশেষে ক্ষাত্রশক্তিও এইসব আন্দোলনে সমর্থন যুগিয়েছে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত ব্রাহ্মণ দ্বারা রক্ষিত স্থিতাবস্থার বিরুদ্ধে কার্যকরভাবে ভূমিকা নেবার ক্ষমতা কারও হয় নি। কারণ সিন্ধু-হরপ্পা সভ্যতা ধ্বংসের পর গোটা দেশের মূল নিয়ন্ত্রণ যেখানে চলে গেছে সেটা হল পশ্চাৎপদ কৃষকের গ্রাম যার প্রকৃত প্রতিনিধি হয়ে ব্রাহ্মণ সমস্ত সমাজের নিয়ামক হয়ে থেকেছে।

বোঝা যায় কেন ব্রাহ্মণের নিরঙ্কুশ আধিপত্য প্রতিষ্ঠার পর মুসলিম আক্রমণ শুরু হলে কোথায়ও কোন প্রতিরোধ বেশী কাল দাঁড়িয়ে থাকতে পারে নি। আসলে ভারতীয় উপমহাদেশে ব্রাহ্মণ-চেতনা মানে কেন্দ্রীয় শক্তির দুর্বলতা, গ্রাম্যতা, সঙ্কীর্ণতা এবং বিভেদ হয়ে দেখা দিয়েছে। এমন অবস্থায় পরাক্রান্ত বহিরাগত মুসলিম শক্তির বিজয় ও আধিপত্য অনিবার্য ছিল। ব্রাহ্মণ তাকেও আত্মস্থ করার চেষ্টা করেছে। কিন্তু পারে নি। কারণ তার উৎস উপমহাদেশের ভিতরে নয়, বরং বাইরে ছিল। একদিকে তার ধর্মের কেন্দ্র বাহিরে, অপরদিকে শত শত বৎসর ধরে অব্যাহতভাবে বাহির থেকে ইসলামী ক্ষাত্রবাহিনী তলোয়ার হাতে এসে এখানে বহিরাগত শাসনকে স্থায়ী রেখেছে। দিল্লী ও উত্তর ভারতকে কেন্দ্র করে কমবেশী ভারতব্যাপী এক রাজনৈতিক ঐক্য গড়ে উঠেছে যা থেকেছে ভাসমান, জবরদস্তিমূলক এবং বৃহত্তর জনসমাজের সঙ্গে সম্পর্কহীন।

লক্ষণীয় যে এই বহিরাগত শাসনকালের একটা মোটামুটি লিখিত ইতিহাস আমাদের চোখের সামনে আছে। অর্থাৎ মুসলমানরা অন্তত কিছু পরিমাণে ইতিহাস চর্চা করত। বাবর, জাহাঙ্গীরের মত শাসকরা আত্মজীবনী পর্যন্ত লিখে রেখে গেছেন।

কিন্তু মুসলিম পূর্ব যুগে ইতিহাস চর্চা প্রায় হয় নি। এটাও ব্রাহ্মণ্য প্রভাবের এক ফল। এই প্রভাবে শিক্ষিত শ্রেণী রাজবংশের ইতিহাস বা ঘটনাবলির বর্ণনার নামে যেসব লিখেছেন সেগুলি অধিকাংশ ক্ষেত্রেই পুরাণ কাহিনী ছাড়া আর কিছু নয়।

ব্রাহ্মণ প্রভাবিত সমাজে ইতিহাস চর্চা হতে পারে না। কারণ ইতিহাস চর্চাও আর সবকিছুর মত মূলত সমাজের শাসক কিংবা নেতৃত্বের প্রয়োজনে গড়ে ওঠে। যেখানে সবকিছুকে জন্মগত বা কুলগত পবিত্রতা ও অপবিত্রতার সঙ্গে বাঁধা দেখাতে হয় ফলে যেখানে সমস্ত শ্রেষ্ঠ কিছুকে প্রাচীন শ্রেষ্ঠ ও পবিত্র ঐতিহ্যের সঙ্গে সংযুক্ত প্রমাণ করতে হয় সেখানে ইতিহাসের লিখিত দলিল শাসক বা নেতৃত্বের জন্য এক অতি বিপদজনক ব্যাপার নয় কি? ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়কে দেখাতে হবে তাদের রক্ত বা বংশ আদি কাল থেকে অমিশ্রিত বা শুদ্ধ আছে। সুতরাং ব্রাহ্মণরা তাদের নিজেদের বংশ বা কুলের ইতিহাসকে ঠেলে নিয়ে যাবে বিশ্বামিত্র, ভৃগু, ভরদ্বাজ, বসিষ্ঠ ইত্যাদি সব ঋষিদের উৎস পর্যন্ত। তা না হলে সমাজের স্বীকৃতি বা মর্যাদা পাওয়া যাবে না।

অন্যদিকে চণ্ডাল, শূদ্র, ম্লেচ্ছ, যবন ইত্যাদি নামে কথিত বিভিন্ন উপজাতির, নিম্নবর্ণের কিংবা বহিরাগত শক্তি বা ব্যক্তি যখন রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করেছে তখন তাদেরকে ক্ষত্রিয়ত্ব অর্জনের জন্য ব্রাহ্মণের দ্বারস্থ হতে হয়েছে। কারণ ক্ষমতা দখল করলেও সেটা টেকে না যদি তার সামাজিক ভিত্তি পাওয়া না যায়। সুতরাং ক্ষমতা দখলের পর রাজাদের সামাজিক মর্যাদা লাভের প্রয়োজনে ক্ষত্রিয় বর্ণের মর্যাদা লাভের প্রয়োজন দেখা দিত। এই মর্যাদা দান করার ক্ষমতা ব্রাহ্মণদেরই হাতে। কারণ তারা সমাজে ঐতিহ্যের ধারক-বাহক।

ব্রাহ্মণদেরও এইভাবে বিভিন্ন শক্তিকে ক্ষত্রিয় বর্ণে আরোহণ না করে উপায় ছিল না। কারণ তা না করলে বিজয়ী রাষ্ট্রশাসকরা ব্রাহ্মণদের সামাজিক কর্তৃত্বকে অস্বীকার করবে এবং শেষে জাতিবর্ণব্যবস্থাকেই আঘাত করবে। এইভাবে ব্রাহ্মণ ও ক্ষত্রিয় পরস্পরের সহযোগী হয়ে থেকেছে। আর ব্রাহ্মণরা সদ্য ক্ষমতারোহিদের বংশগত ক্ষত্রিয় ঐতিহ্য প্রমাণ করবার জন্য তাদের মনগড়া পূর্বপুরুষদের কাহিনী রচনা করে তাদের ক্ষত্রিয় ঐতিহ্যের অকাট্য প্রমাণ তৈরী করেছে!

সুতরাং এমন অবস্থায় ইতিহাস রচনা কিভাবে হবে! সত্য ও মিথ্যা, বাস্তব ও কল্পনার অদ্ভূত ও উদ্ভট মিশাল দিয়ে গাদা গাদা যেসব কাহিনী লেখা হয়েছে সেগুলিকে আর যা-ই বলা যাক ইতিহাস বলা যায় না।

অবশ্য ব্রাহ্মণের ভূমিকা বিচারের সময় আমাদের তার সামাজিক ও ঐতিহাসিক প্রেক্ষিত ভুললে চলবে না। ভারতবর্ষে সভ্যতার ঐতিহ্য অত্যন্ত প্রাচীন। সিন্ধু-হরপ্পার শুরু পাঁচ সহস্র বৎসরেরও পূর্বে। তারও পূর্বে নগর সভ্যতা গড়ে উঠেছিল। সম্ভবত হরপ্পান স্তরে পৌঁছতে এই সিন্ধু সভ্যতার আরও পাঁচশত থেকে এক সহস্র বৎসর লেগেছিল। সুতরাং আমরা অন্তত সাড়ে পাঁচ থেকে ছয় হাজার বৎসরের এক নগর সভ্যতার ইতিহাস পাই।

এটাই তো স্বাভাবিক যে, প্রাচীনত্বের একটা শক্তি আছে। বিশেষত যে প্রাচীন এত উন্নত। তাই যখন হরপ্পা সভ্যতা ভেঙ্গে পড়েছে তখন এই প্রাচীন সভ্যতার স্মৃতি নানানরূপে ভারতীয় চেতনা ও সংস্কৃতিকে অধিকার করে থেকেছে। হয়ত এই স্মৃতি ঐতিহ্যের রূপ ধরে ভারতীয় সভ্য সত্তাকে রক্ষাও করেছে। ভারত পরবর্তীকালেও উন্নত সভ্যতা নির্মাণ করেছে। কতোকগুলি বিচারে তা সিন্ধু-হরপ্পার সমপর্যায়ের না হলেও পরবর্তীতেও গৌরব করবার মত অনেক কিছুই হয়েছে। এবং এই সব কিছুতেই রক্ষা পেয়েছে প্রাচীন ঐতিহ্যের ধারা।

এই ঐতিহ্যকে অস্বীকার করে কেউ ভারতবর্ষে অন্তত ভিতর থেকে কিছু করতে পারে নি। তাই বাহির থেকে তলোয়ারের জোরে ভারতবর্ষ দখল করা যায়। কিন্তু ভারতীয় চেতনা ও ঐতিহ্যকে দখল করা যায় না। পাঁচশত বৎসর এক নাগাড়ে অধিকাংশ ভারত শাসন করেও ইসলাম ভারতের মূল ধারা হয়ে উঠতে পারে নি। ভারতের রাজনীতি, সংস্কৃতি ও চেতনায় ইসলামী ধারা একটি গৌণ ও পার্শ্বস্রোত মাত্র। আওরঙ্গযেবের মত গোঁড়া সম্রাট এবং অসংখ্য ধর্মোন্মাদ মুসলিম শাসকের সমস্ত প্রচেষ্টা ও জবরদস্তি ব্যর্থ করে দিয়ে অমুসলিম ভারতবর্ষ তার সুপ্রাচীন ঐতিহ্য ধরে থেকেছে। কালাপাহাড় দারুণ আক্রোশে মন্দির আর দেবতা-প্রতিমা ভেঙ্গে বেড়িয়েছে। কিন্তু ভারতবর্ষের অন্তরের মন্দির আর প্রতিমা ভাঙ্গবার সাধ্য তার হয় নি।

এই ঐতিহ্যকে সম্পূর্ণরূপে অস্বীকার করে এখানে যে কিছু সেভাবে দাঁড়াতে পারে না এ থেকেও আমাদের বহু কিছু বুঝবার ও লিখবার আছে। এটা আরও স্পষ্ট করে দেখিয়ে দেয় যে, বহিরাগত আর্য আক্রমণ একটা নিছক উপকথা বা মীথ ভিন্ন আর কিছু নয়। যদি এটা বহিরাক্রমণই হত তবে সেই “আর্যরা” যত লক্ষ সংখ্যায়ই আসুক তাদের অবস্থা খুব উন্নত হলে মুসলমানদের মতই হত। যেহেতু তারা ইসলামের মত বাহির থেকে কোন ধর্মীয় ও রাজনৈতিক কেন্দ্রের সম্প্রসারণ হয়ে আসে নি (আমরা যদি ধরেও নিই যে, “আর্যরা” বহিরাগত) সেহেতু তারা এদেশে যবন (আইওনিয়ান), শক, হুনদের মত বিলীন হয়ে যেত। এবং বহিরাক্রমণের স্মৃতিবাহী “আর্য” শব্দটা তাদেরও উত্তরপুরুষসহ সমগ্র ভারতবাসীর নিকট হয়ে থাকত যবন, ম্লেচ্ছের মত ঘৃণার শব্দ মাত্র।

আমরা এই কথাটি কখনই যেন ভুলে না যাই যে, শক্তির কারণে মুসলমানকে ভারতবর্ষের অমুসলিম জনগোষ্ঠী মেনে নিলেও অস্ত্রশক্তির জোরে এসেছে বলে ইসলাম ও মুসলমানকে সাধারণভাবে অমুসলিম কিংবা হিন্দু ভারতবর্ষ কোন দিন তার অন্তরের অন্তস্তলে স্থান দেয় নি। এই উপমহাদেশে ঐতিহ্যের ভিত্তি পায় নি বলে প্রকৃতপক্ষে মুসলমানরা সমগ্র উপমহাদেশে সংস্কৃতির বিচারে বহিরাগত ও ভাসমান হয়ে থেকেছে। এমনকি ইরানীয় ইসলামের সঙ্গে বাংলাদেশ ও পাকিস্তানসহ ভারতীয় উপমহাদেশের ইসলামের এই পার্থক্যটা যেন আমরা মনে রাখি।

বস্তুত ব্রাহ্মণের জন্যই শেষ পর্যন্ত ভারতীয় সভ্যতার ঐতিহ্য নিজেকে রক্ষা করতে পেরেছে। ভারতীয় সভ্যতার সঙ্কটের যুগের প্রেক্ষিতে উদ্ভূত হওয়ায় তা নূতন পরিস্থিতিতে নিম্ন মাত্রায় হলেও ভারতীয় সভ্যতার ধারাকে রক্ষা করবার উপযোগী ছিল। তার বিভক্তি, বিশৃঙ্খলা ও বিচ্ছিন্নতা যত দুঃখজনকই হোক সভ্যতার সঙ্কট ও বিপর্যয় কালে এইভাবে জ্ঞানচর্চাকে বংশধারায় প্রবাহিত করা গিয়েছিল বলেই সম্ভবত ভারতীয় সংস্কৃতি ও সভ্যতার ধারাবাহিকতা রক্ষা পেয়েছে।

ইরানে ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান তুলনায় অনেক বেশী কেন্দ্রীভূত ছিল। রাষ্ট্রের পাশে ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের সমান্তরাল ও কিছুটা কেন্দ্রীভূত প্রক্রিয়া থাকায় বহিরাক্রমণ দ্বারা রাষ্ট্রের পতন ঘটাবার পর ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানকেও ধ্বংস করা সম্ভব হয়েছে। এইভাবে ধর্মের সঙ্গে ইরানের সংস্কৃতির উত্তরাধিকারকে অনেকাংশে গুড়িয়ে দেওয়া গেছে। এমনকি ভারতেও আমরা দেখেছি যে, মুসলিম তুর্কী আক্রমণকারীরা কিভাবে নালান্দার মত জ্ঞান-সাধনার বৌদ্ধ কেন্দ্রগুলিকে আগুন ও তলোয়ারের মুখে নিক্ষেপ করেছিল। এইভাবে বহিরাগত মুসলিম আক্রমণ দ্বারা বৌদ্ধদের দ্বারা কেন্দ্রীভূতভাবে সংরক্ষিত ভারতে জ্ঞানচর্চা ও সংস্কৃতির ঐতিহ্যকে চূর্ণ-বিচূর্ণ করা হয়েছে। কিন্তু ব্রাহ্মণরা সারাদেশে ছড়িয়ে থেকে বংশগত ধারায় জ্ঞানচর্চাকে রক্ষা করতে পেরেছে। কারণ জ্ঞানচর্চার এই ধরনের অসংখ্য ক্ষুদ্র কেন্দ্রে পৌঁছবার ক্ষমতা কিংবা উৎসাহ বিদেশী ঘোড়সওয়ার বাহিনীর হয় নি।

সুতরাং  আমরা দেখতে পাচ্ছি, যার বর্তমান অনুজ্জ্বল, ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত, এমন এক সমাজের অতীত গৌরবের ঐতিহ্যকে সংরক্ষণের শক্তি হয়ে দেখা দিয়েছে ব্রাহ্মণ। ভবিষ্যৎ গড়ার ক্ষমতা নেই বলে তা অতীতকে আঁকড়ে থাকে। অতীতকেও পূর্বরূপে রক্ষার ক্ষমতা নেই বলে তা সমাজকে ধরে রাখে পশ্চাৎপদ অবস্থায় যার চারপাশে থাকে অতীত গৌরবময় ঐতিহ্য ও স্মৃতির বাতাবরণ।

ব্রাহ্মণ্য ধর্ম উপমহাদেশকে ভাল এবং মন্দ দুই-ই দান করেছে। এটা ভারতবর্ষকে জাতিভেদ প্রথার মত এক অত্যন্ত ক্ষতিকর ব্যবস্থা দান করেছে যার প্রভাব উপমহাদেশের হিন্দু সম্প্রদায় আজও কাটিয়ে উঠতে পারে নি। তবে আমরা যখন গ্রীস বা রোমের দাসব্যবস্থা কিংবা এশিয়ার অন্যান্য সমাজের ধর্মীয়-রাষ্ট্রীয়-সামাজিক স্বৈরতন্ত্রের সঙ্গে তুলনা করব তখন নিশ্চয় ক্ষোভের খুব বেশী কারণ থাকবে না। আধুনিক যন্ত্রের আবিষ্কারের পূর্ব পর্যন্ত সভ্যতা নির্মাণের জন্য মানুষ মানুষের প্রতি বিপুল পরিমাণে অমানুষতা করেছে, বর্বর হয়েছে। এখন পর্যন্ত আমরা বিভিন্নভাবে আমাদের জীবনে এই ঐতিহ্যকে বহন করছি। ব্রাহ্মণের ভূমিকা বিচারের সময় আমাদের এই কথাগুলি ভোলা উচিত হবে না।

সুতরাং আমরা ভারতবর্ষের ইতিহাসের সূত্র সন্ধান করতে গিয়ে ব্রাহ্মণের এমন এক ভূমিকা পেলাম যা হরপ্পা-উত্তর ভারতীয় সমাজ গঠনে প্রধান ভূমিকা পালন করেছে। আজও ভারতীয় হিন্দু সমাজ সংরক্ষণে ব্রাহ্মণের ভূমিকাই প্রধান। এই উপমহাদেশে ইসলামের ভূমিকাকে অনেক ক্ষেত্রে ব্রাহ্মণের এই ভূমিকার প্রতিক্রিয়া এবং তার সমান্তরাল হিসাবে দেখবার প্রয়োজন আছে। ভারতীয় সমাজ জীবনে ব্রাহ্মণ্য বা হিন্দু এবং ইসলাম এই উভয় ধর্ম, দৃষ্টিভঙ্গী ও ঐতিহ্যের টানাপোড়েনে আধুনিক ভারতীয় সমাজ ও রাষ্ট্রসমূহের বহু বৈশিষ্ট্য ও প্রবণতা গড়ে উঠেছে যা বুঝলে আমরা উপমহাদেশের সামাজিক বিকাশের বহু বৈশিষ্ট্য ও সমস্যাই বুঝব।

    
১৪। উপসংহার

সাড়ে পাঁচ বা ছয় হাজার বৎসরের প্রাচীন এক নগর সভ্যতার ইতিহাসের প্রবণতা ও সমস্যা বিচার এবং তার বিকাশের যোগসূত্র সম্পর্কে আলোচনা এত সংক্ষেপে সম্ভব নয়। সেহেতু আমরা এখানে খুব সংক্ষেপে মাত্র কয়েকটি বিষয়ে আলোচনা করলাম।

বিশেষত বৈদিক আর্য প্রশ্ন এবং সিন্ধু সভ্যতার রহস্য উদ্ঘাটনের উপরই এখানে আমরা সবচেয়ে বেশী জোর দিয়েছি। কারণ গোড়ার জট না খুলে সামনে এগোনো যায় না।

ভারতীয় ইতিহাসের বিচারের ক্ষেত্রে যে একরাশ বিভ্রান্তি জড়িয়ে আছে তার একটি বড় কারণ হল ভারতীয় সভ্যতার উৎস আবিষ্কারে ব্যর্থতা। সিন্ধুর ধ্বংসাবশেষ আবিষ্কৃত হলেও এই সভ্যতার যারা নির্মাতা তাদেরকে বোঝা যায় নি। অন্যদিকে ঋগ্বেদকে ভ্রান্তভাবে ধরে নেওয়া হয়েছে বৈদেশিক হানাদারদের সৃষ্টি হিসাবে। দীর্ঘ পরাধীনতায় আত্মবিস্মৃত মনের হীনমন্যতার কারণেও এই ধারণা সহজেই গৃহীত হয়েছে।

অথচ বর্তমানটাই একটা সমাজ কিংবা জাতি সমষ্টির জীবনে সব নয়। আজ মিসরে দাঁড়িয়ে কে ভাবতে পারবে যে, এই মিসর আর তিন হাজার বৎসর পূর্বের মিসর এক নয়? তবু সেখানে পিরামিড সব সময় মাটির উপর দম্ভভরে দাঁড়িয়ে থেকে অতীত গৌরবের স্মারক হয়ে থেকেছে। কিন্তু সিন্ধু তো সেদিনও মাটির নীচে ঘুমিয়ে ছিল। মিসরে লিপিমালার পাঠোদ্ধার হওয়ায় তার সভ্যতাকে ভিন্নভাবে ব্যাখ্যা করার উপায় নেই। কিন্তু সিন্ধুর লিপি আমরা আজও বুঝি নি।

মিসরের কথা থাক। এমনকি মধ্যযুগের ইউরোপে দাঁড়িয়েও কি কেউ কল্পনা করতে পারত যে, একদা গ্রীসে কী দ্যুতিময় চক্ষু এবং তীক্ষ্ণ চিন্তার অধিকারী মানুষেরা চলমান ছিলেন?

কাজেই আত্মবিস্মৃত আমরাও নিজেদের ইতিহাসকে চিনতে পারি না। বহু যুগ ধরে ভারতের বুকে বার বার যেভাবে বৈদেশিক আধিপত্য নেমে এসেছে তাতে করে খুব সহজে আর্য সংস্কৃতি ও সভ্যতাকে বৈদেশিক অভিযান দ্বারা সৃষ্ট মনে হয়েছে। আমরা এই ধারণা থেকেই শুরু করি এবং শেষও করি। কারণ মানুষ অনেক সময়েই তার ধারণার কাঠামোতে বন্দী থাকে। তাই আমরা সাহস করে নূতন দৃষ্টির আলো নিয়ে ঋগ্বেদের ভিতরে প্রবেশ কিংবা বিচরণ করি না। তা করলে কিন্তু আমাদের জানা ইতিহাস বদলে যায়।

বস্তুত যে কোন ধর্মীয় আন্দোলনের পটভূমি বিচার করলেই বৈদিক ধর্মের উত্থান বিচারে আমাদের ভুল হওয়া উচিত নয়। কারণ আক্রমণ অভিযানে ব্যস্ত থাকবার সময় কোন ধর্মেরই উত্থান সম্ভব নয়। তখন সামরিক ফরমান জারী হতে পারে, কিন্তু ধর্মীয় আবেগ-অনুভূতি ও জীবন-জিজ্ঞাসা সঞ্জাত মন্ত্র রচনা সম্ভব নয়। এমন কি ইসলামের মত সামরিক বৈশিষ্ট্যপূর্ণ ধর্মের দিকেও যদি আমরা দৃষ্টি দিই তাহলে দেখতে পাব তা প্রথমে মক্কায় উদ্ভূত হয়েছে শান্তিপূর্ণ পরিস্থিতিতে একটা ধর্মীয়-সামাজিক আন্দোলন হিসাবে। মদীনায় গিয়ে তা সামরিক ভিত্তি ও শক্তি লাভ করলেও এটা একটা ধর্মের সম্প্রসারণের হাতিয়ার হয়ে দেখা দিয়েছে। ধর্ম প্রচারে এই পর্যায়ে যুদ্ধ প্রবণতা বৃদ্ধি পেলেও যে সামাজিক উদ্দেশ্যে সাধ্যনের জন্য ইসলামের আবির্ভাব ও বিকাশ হয়েছে তার পরিপূর্ণ ছাপ রয়েছে তার সমস্ত শরীরে। এটা যে আরব সমাজজীবনের ধর্ম তা বুঝবার জন্য বেশী মেধার প্রয়োজন হয় না। অর্থাৎ যতই সামরিক রূপ গ্রহণ করুক ইসলাম আরব সমাজের জন্য ছিল মূলত একটি ধর্মকেন্দ্রিক সামাজিক-রাজনৈতিক আন্দোলন।

কিন্তু ইসলাম যখন আরবের বাইরে সামরিক অভিযান শুরু করেছে তখন তার আর সামাজিক আন্দোলন হিসাবে নূতন করে বিকাশ হয় নি। তখন এসেছে সামরিক ফরমান এবং ভিন্ন সমাজ ও পরিস্থিতিকে কোরআন-হাদীসের উপযোগী করবার প্রয়াস।

ঋগ্বেদ পড়লে বোঝা যায় আর দশটি ধর্মীয়-সামাজিক আন্দোলনের মত এটিও একটি আন্দোলনের ফল। এর সঙ্গে বৈদেশিক আক্রমণের সম্পর্ক নেই। ঋগ্বেদের ঋষিগণ সপ্তসিন্ধুর অধিবাসী।

যাইহোক এই আলোচনা আমরা করেছি। কিন্তু এই সঙ্গে এইটুকুও বলা দরকার যে, ঐতিহ্য সন্ধান করার উদ্দেশ্য ঐতিহ্য নিয়ে মৃত অতীতে পড়ে থাকা নয়। সুতরাং সপ্তসিন্ধুর মহান সভ্যতার ঐতিহ্য নিয়ে উপমহাদেশবাসী হিসাবে গৌরব করলেও আমরা সেখানে আর ফিরতে পারব না। কারণ চাইলেও অতীতে ফেরা যায় না, বরং চেষ্টাটা ক্ষতিকর হয়ে দেখা দেয়।

আর শুধু সপ্তসিন্ধুর ঐতিহ্যই আমাদের ঐতিহ্য নয়। সমগ্র মানব জাতির সমস্ত গৌরবময় কর্ম এবং সৃষ্টিই আমাদের ঐতিহ্যের অন্তর্ভুক্ত। কারণ কোন মানুষ যেমন একা কিছু করতে পারে না তেমন কোন জাতিও নয়। শুধু কয়েক হাজার বৎসর নয়, লক্ষ লক্ষ বৎসর ধরে মানুষের মানুষ হয়ে ওঠার অক্লান্ত প্রয়াসের পটভূমিকে আমাদের চোখের সামনে রাখলে সঙ্কীর্ণ অহমিকা জাগবার কারণ থাকে না।

অপর দিকে সপ্ত সিন্ধুর গৌরব শুধু সিন্ধু-পাঞ্জাবের কিংবা ভারতীয় উপমহাদেশের একার নয়, এটাও সমগ্র পৃথিবীর হয়ে গেছে। এখান থেকে আর্যরা বহু দেশের মত ইউরোপেও গেছে এবং সেখানে তাদের উত্তরপুরুষরা গ্রীস ও রোমে নূতন করে সভ্যতার আলো জ্বালিয়েছে। সেই সভ্যতার আলো নিভে গেলেও তার ঐতিহ্য অনুসরণে ইউরোপের মানুষ নূতন করে আরও উন্নত রূপে আধুনিক যন্ত্র সভ্যতার যে আলো জ্বালিয়েছে সেই আলোয় আজ সমগ্র গ্রহ এবং মানব জাতি আলোকিত।

এই গ্রন্থ শেষ করবার পূর্বে লেখক হিসাবে আমার বলা দরকার যে, ভারত-ইতিহাসের সূত্র অনুসন্ধানে অনেক প্রয়োজনীয় বিষয় আমি আলোচনায় আনতে পারি নি। ফলে অনেক কিছু অস্পষ্ট থেকে যাবার সম্ভাবনা রয়েছে। কিন্তু ভারতবর্ষ একটি মাত্র ভাষা বা দেশ নয়, একটি মাত্র জাতি বা রাষ্ট্রও নয়। সুতরাং এত বিরাট পটভূমিতে এই ক্ষুদ্র আলোচনাকে নেওয়া সম্ভব নয়। আমি এখানে ভারতীয় উপমহাদেশের ইতিহাস ও সমাজ-বিকাশের মূল সূত্রটিকে ধরতে চেয়েছি মাত্র। এমনকি এখানে ঋগ্বেদের বাইরে যেমন অন্যান্য বেদের ক্ষেত্রে যাই নি তেমন এখানে রামায়ণ প্রসঙ্গেও আলোচনা করি নি যদিও সেটিও আলোচনার জন্য এক চমকপ্রদ বিষয় হতে পারে। বস্তুত গোটা আলোচনা প্রধানত কেন্দ্রীভূত থেকেছে ঋগ্বেদ, সিন্ধু সভ্যতা ও মহাভারতের মধ্যে যোগসূত্র সন্ধানে। কারণ এই জায়গাতেই ভারতীয় ইতিহাস সবচেয়ে বেশী রহস্যাবৃত।

রচনাকাল : ১২ অক্টোবর-২৯ নভেম্বর, ১৯৯০ খ্রীস্টাব্দ।

 

সূত্র, উদ্ধৃতি ও মন্তব্য

১। Ram Shankar Tripathi বৈদিক সাহিত্য ও সভ্যতার সূচনাকালকে খ্রীস্টপূর্ব ষোড়শ শতাব্দীর দিকে নিতে চান। Ram Shankar Tripathi, History of Ancient India, Motilal Banarsidass Delhi : Varanasi : Patna Third : 1467, Page :39

২। রোমিলা থাপার, ভারতবর্ষের ইতিহাস (১০০০ খ্রীস্টপূর্বাব্দ - ১৫২৬ খ্রীস্টাব্দ), ওরিয়েন্ট লংম্যান লিমিটেড, তৃতীয় সংস্করণ : ১৯৮৮। পৃষ্ঠা : ১

৩। এই গ্রন্থে ঋগ্বেদের সমস্ত উদ্ধৃতির উৎস : ঋগ্বেদ-সংহিতা, (রমেশচন্দ্র দত্তের অনুবাদ অবলম্বনে), হরফ প্রকাশনী, এ-১২৬ কলেজ স্ট্রীট মার্কেট, কলকাতা-৭ প্রথম খণ্ড, দ্বিতীয় প্রকাশ : সেপ্টেম্বর, ১৯৮৭। দ্বিতীয় খণ্ড, ১৩ সেপ্টেম্বর, ১৯৭৬

৪। Sir Mortimer wheeler, The Indus civilization, Supplementary Volume To the Cambridge History of India, Cambridge, At The University Press, 1968, Page : 55.

৫। "About thirty miles west of Kot Diji on the right bank of the Indus lies Mohenjo-daro, now some three miles from the river, but squarely on the flood-plain, The continuing deposition of alluvial silt with each year's floods has raised the whole land surface in this area more than 30 feet since Harappan times, and as the water table has risen correspondingly archaeologists have so for been unable to plumb the lower levels of this vast site." Page : 119

By Bridget And Raymond Allchin, The Birth of Indian Civilization, Penguin Books Ltd., Harmondsworth, Middlesex, England, First Published 1968.

৬। Sir Mortimer Wheeler, The Indus Civilization. Page : 88

৭। " Page : 5 & 129

৮। " Page : 5

৯। " Page : 126-129

১০। Damodar Dharmanand Kosambi, An Introduction To The  Study of Indian History, Popular Prakashan, Bombay, Revised Second Edition 1975. Reprinted 1985. Page : 74-75

১১। " Page : 69

১২। Sir Mortimer Wheeler, The Indus Civilization. Page : 7

১৩। Damodar Dharmanand Kosambi, An Introduction To The Study of Indian History. Page : 67-68

১৪। " Page : 68

১৫। সাপ্তাহিক খবরের কাগজ, ১ বর্ষ ১৭-১৮ সংখ্যা, ২৬ এপ্রিল ১৯৯০, ঢাকা, পৃষ্ঠা : ৩২

১৬। "There is some evidence both at Mohenjo-daro and Harappa of a general cultural evolution, but the earlier excavations of Marshall and Vats are not helpful on this point. We feel that the expansion was something of an explosion and that it reflected among other things an outcome of the successful control of the tremendous agriculturally productive potentialities of the Indus plains." Page : 126

Bridget And Raymond Allchin, The Birth of Indian Civilization.

১৭। "At Amri and Kot Diji there is important evidence of a general destruction by fire coinciding with the emergence of the new Harappan culture. What is Particularly exciting in these recent excavations is the repeated evidence of continuity from pre-Harappan to Harappan times, suggesting that a large if not a major element in the Harappan civilization must derive from the pre-Harappan culture of the Indus Valley itself. Another interesting evidence of massive fortification walls in the pre-Harappan period." Page : 123

Bridget And Raymond Allchin, The Birth of Indian Civilization.

১৮। এই গ্রন্থে মহাভারতের সকল উদ্ধৃতির উৎস কালীপ্রসন্ন সিংহ কর্তৃক মহাভারতের বঙ্গানুবাদ গ্রন্থ। অনুবাদকের ভূমিকার সময় ১৭৮৮ শকাব্দ। পুরাতন গ্রন্থটির প্রথম দিকে কয়েকটি পৃষ্ঠা না থাকায় প্রকাশকের বিবরণ দেওয়া গেল না।

১৯। এই গ্রন্থে বাইবেলের উদ্ধৃতিসমূহের উৎস : পবিত্র বাইবেল, পুরাতন ও নূতন নিয়ম, বাংলাদেশ বাইবেল সোসাইটি, ঢাকা,

২০। কোরআনের উদ্ধৃতির উৎস : আল-কুরআনুল করীম, ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ, মূদ্রণ ডিসেম্বর, ১৯৮৭

২১। "Recently however short excavations at Kot Diji in Khairpur division of west Pakistan, which were conducted with a view to investigating the nature and approach of small settlement of Harappa period in an outlying agricultural district, accidentally revealed early stages of Harappa culture levels superimposed upon thick deposits of a hitherto unknown culture of still earlier date.

"The pre-Harappan settlers, whom we shall henceforth call  the Kot Dijiaus, possessed a highly developed culture of their own, from which the Harappans appear to have borrowed certain ideas including systems of town-planning and fortification." Page : 13

Dr. F.A. Khan Excavations at Kot Diji, Pakistan Archaeology, Number 2 -1965, Published by the Department of Archaeology in Pakistan, Karachi.

২২। "According to the Aihole inscription of Pulkesin" (seventh century A.D.) the Bharata war took place in 3102 B.C., which is the starting point of the Kaliyuga are according to the astronomical tradition represented by Aryabhata.

"Another school of Hindu astronomers and historians, represented by Vridha-Garga, Varahemihira and kalhana, places the Bharata war 653 years after the Kaliyuga era, i.e in 2449 B.C." Page : 272

A.D. Pusalker, M.A. LL.B., PH.D., chapter XIV, Traditional History From The Earliest Time To The Accession of Pariksit, Book IV. Historical Traditions. The History And Culture of The Indian People, The Vedic Age general Editor. R.C. Majumdar, 1971. Bombay Vidya Bhavan.

২৩। "There is no doubt that the date 3102 B.C. signifies some important and epoch making event in the traditional history of India." Page : 273

A.D. Pusalker, Traditional History From The Earliest Time To The Accession of Pariksit.

২৪। Bridget And Raymond Allchin, The Birth of Indian Civilization. Page : 119

২৫। Sir Mortimer Wheeler, The Indus Civilization. Page : 128

২৬। "Indra is called apsu-jit, the 'water-conqueror (RV. 8.13.2, 1.100.11, 6.44.18, & c). It was for the sake of water that he overthrew the brazen cities of the Dasyus in RV. 2.20.8. and elsewhere." Page : 88

Damodar Dharmanand Kosambi, An Introduction To The Study Of Indian History.

২৭। কোকা আন্তোনভা, গ্রিগোরি বোনগার্দ-লেভিন, গ্রিগোরি কতোভস্কি, ভারতবর্ষের ইতিহাস, প্রগতি প্রকাশন, মস্কো।

২৮। Damodar Dharmanand Kosambi, An Introduction To The Study Of Indian History Page : 58

২৯। Bridget And Raymond Allchin, The Birth Of Indian Civilization. Page : 144

৩০। Sir Mortimer Wheeler, The Indus Civilization. Page : 82

৩১। "The main difference between the Dasyu and the Vedic Aryen appears to be religious."

A.D. Pusalker, chapter VIII. Aryan settlements in India. The History And Culture Of The Indian People. The Vedic Age.

৩২। ঋগ্বেদ-সংহিতার টীকায় বলা হচ্ছে, “ঋ” অর্থ চাষ করা অতএব ‘অর্য বা আর্য’ শব্দের মূল অর্থ কৃষি ব্যবসায়ী।” পৃষ্ঠা: ১২২

৩৩। "The very name Arya, by which the Aryan conquerors of India have distinguished themselves from the aborigines on Dāsas, is said to come from a root which means to cultivate......

"There are two other words in the Rig Veda which are synonymous, not with the Aryan tribe, but rather man generally; and both of them come from roots which indicate cultivation. The words are Charshana (1,3,7, & c.) and Krishti (1,4,6, & c.), and both these words come from modification of the same root krish on Chrish to cultivate.

"Thus the very names which the Aryan conquerors of India gave themselves are names which are believed to indicate that useful occupation which distinguishes the civilized man from the barbarian, viz., cultivation of the soil." Page : 34-35

Ramesh Chandra Dutt, A History of civilization In Ancient India, Based On Sanskrit Literatre. Vol.1. B.C.2000 to 320. Vishal Publishers, 2/53/2, Fountain, Delhi-6. First Indian Reprint 1972

৩৪। বরুণ শব্দের উৎপত্তি সম্পর্কে ঋগ্বেদ-সংহিতা-র টীকায় বলা হচ্ছে, “বরুণ আর্যদের আরও পুরাণ দেবতা। আবরণকারী (বৃ ধাতু হতে) নৈশ আকাশকেই আর্যগণ বরুণ বলে পূজা করতেন এবং সে দেবকে গ্রীকগণ Uranos, ইরানীয়গণ ‘বরণ’ ও হিন্দুগণ ‘বরুণ’ নামে জানেন। ‘মৈত্রং বৈ অহরিতি শ্রুতে: শ্রুযতে চ বারুণী রাত্রী।’ সায়ণ। আকাশ জলীয়, এ বিশ্বাস হতে অবশেষে বরুণ জলের দেব বলে পরিগণিত হলেন।” পৃষ্ঠা :৮৩

৩৫। এই গ্রন্থে যেন্দ-আবেস্তার বঙ্গানুবাদগুলি James Darmesteter কৃত এবং F. Max Muller সম্পাদিত ইংরাজী অনুবাদ গ্রন্থের সাহায্যে করা হয়েছে।

The Sacred Books Of The East, VoI. IV, The Zend-Avesta, Edited by F. Max Muller. second Edition, Oxford. At The Cleardon Press. 1895

৩৬। Bridget And Raymond Allchin, The Birth Of Indian Civilization. Page : 143

 

---------------------    সমাপ্ত    ---------------------

 

 

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
Archive
 
সাম্প্রতিক পোষ্টসমূহ