লিখেছেনঃ শামসুজ্জোহা মানিক, আপডেটঃ December 11, 2019, 12:00 AM, Hits: 2517
বিষয় সুচী :
প্রথম পর্ব : ইতিহাসের উপনিবেশিক পাঠ
(ক) ঋগ্বেদ পাঠ : আমার অভিজ্ঞতা
(খ) জ্ঞানতত্ত্ব ও রাজনীতি
দ্বিতীয় পর্ব : ইতিহাসের হিন্দুত্ববাদী পাঠ
তৃতীয় পর্ব : ইতিহাসের বস্তু-নির্ভর পাঠ
(ক) পুনরায় ঋগ্বেদ
(খ) সিন্ধু সভ্যতায় ধর্মের স্থান
(গ) প্রাচীন ইতিহাসের দিকে একটু দৃষ্টি দেওয়া যাক
(ঘ) সিন্ধু সভ্যতায় অভিন্নতা এবং কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রণের রূপ
(ঙ) সভ্যতার অনুরূপতা এবং ঐক্যের মূল শক্তি
(চ) বস্তু-নির্ভর ইতিহাস পাঠের সমস্যা
প্রথম পর্ব : ইতিহাসের উপনিবেশিক পাঠ
(ক) ঋগ্বেদ পাঠ : আমার অভিজ্ঞতা
ভারতবর্ষের ইতিহাস পাঠের সমস্যা বলতে গিয়ে আমার নিজ অভিজ্ঞতা দিয়েই শুরু করি। ভারতবর্ষের সমাজ ও ইতিহাসের আদিপর্বকে বুঝতে চেয়ে আমি আজ থেকে ঊনত্রিশ-ত্রিশ বৎসর পূর্বে প্রণালীবদ্ধভাবে ঋগ্বেদ পড়তে শুরু করি। কারণ সাধারণভাবে এটাই সর্বজনগ্রাহ্য যে, এটি উপমহাদেশের প্রাচীনতম গ্রন্থ, যা ধর্মীয় গ্রন্থ হবার কারণে লিপিবদ্ধ হবার পর থেকে আজ অবধি বোধগম্য এবং অবিকৃত ও অপরিবর্তিত রূপে বিদ্যমান রয়েছে। তারও পূর্বেকার সিন্ধু সভ্যতার লিপির পাঠোদ্ধার না হওয়ায় আমাদের নিকট ঋগ্বেদই ভারতবর্ষের প্রাচীনতম একমাত্র লিখিত দলিল হিসাবে বিবেচিত হতে পারে।
সম্পূর্ণ গ্রন্থটি প্রণালীবদ্ধভাবে পড়বার পূর্বে আমার জানা ছিল যে, উত্তর-পশ্চিমাঞ্চল থেকে বহিরাগত হানাদার, যাযাবর, পশুপালক ও বর্বর বা অসভ্য ‘আর্য’ (সংস্কৃত উচ্চারণ আরিয়) নামে কথিত জনগোষ্ঠী ভারতবর্ষে প্রবেশের পর এখানকার স্থানীয় ‘অনার্য’ অধিবাসীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধের সময় জয়লাভের জন্য দেবতাদের নিকট প্রার্থনা হিসাবে যে সকল মন্ত্র রচনা করে মূলত সেগুলির সংকলিত রূপ হচ্ছে ঋগ্বেদ। আমি আরও জানতাম যে, এই বহিরাগত আর্যরা ছিল দীর্ঘদেহী এবং শ্বেতকায় কিংবা ফর্সা রঙের। আমার এটাও জানা ছিল যে, এই বহিরাগত যুদ্ধজয়ী আর্যরা এই উপমহাদেশে তাদের যে বৈদিক ভাষা, সংস্কৃতি ও ধর্ম নিয়ে আসে তারই ধারাবাহিকতা বা উত্তরাধিকার হচ্ছে উপমহাদেশের বিদ্যমান অধিকাংশ প্রধান ভাষা, সংস্কৃতি এবং বিশেষত হিন্দু ধর্ম। বস্তুত আর্যরা যে বহিরাগত ও বহিরাক্রমণকারী এবং ঋগ্বেদ যে এই বহিরাগত ও বহিরাক্রমণকারীদের দ্বারা রচিত ধর্মগ্রন্থ এটা আমার নিকট ছিল একটি স্বতঃসিদ্ধ সত্য। এর বাইরে আর কোনও ব্যাখ্যা বা বক্তব্য সম্পর্কে আমার কোনও ধারণাই ছিল না। কারণ পণ্ডিতদের দ্বারা প্রচারিত এই একটি মতই আমি এতকাল পড়ে এবং শুনে এসেছিলাম। স্বাভাবিকভাবে সূর্য যেমন পূর্ব দিকে উদিত হয় এবং পশ্চিম দিকে অস্ত যায় তেমনইভাবে ভারতবর্ষে বহিরাগত আর্য আক্রমণ তত্ত্বকে স্বতঃসিদ্ধ সত্য বা অভ্রান্ত জেনে আমি ঋগ্বেদ পড়তে শুরু করি। এবং পড়তে গিয়ে আমি স্তম্ভিত হই। সত্যি কথা বলতে কি আমি পণ্ডিতদের ভ্রান্তি অনুভব করে হতভম্ব হই। গ্রন্থের শুরু থেকেই মন্ত্র রচয়িতাদের আমার সিন্ধু সভ্যতার অধিবাসী ছাড়া আর কিছুই মনে হল না। ক্রমে আমার কাছে এটা স্পষ্ট হল যে, এটা আর দশটা ধর্মসংস্কার আন্দোলনের প্রয়োজনে লিখিত একটা ধর্মগ্রন্থ মাত্র, যার সঙ্গে বৈদেশিক পশুচারী এবং যাযাবর আক্রমণকারীদের কোনও সম্পর্কই নাই। তখন আমার মনে প্রশ্ন এল, এতকাল ধরে এত পণ্ডিত যারা ঋগ্বেদ পড়ে এর অর্থ এবং ব্যাখ্যা করেছেন তারা সবাই ভুল, আর আমি একা সঠিক, এটা কী করে সম্ভব হতে পারে?
ঋগ্বেদ দশ মণ্ডলে বিভক্ত। কিন্তু প্রথম মণ্ডল পড়বার পর আমি এই সিদ্ধান্তে পৌঁছালাম যে, সবাই ভুল আর আমি একাই ঠিক। এরপর সিন্ধু সভ্যতার প্রত্নতত্ত্ব, পারসী ধর্মাবলম্বীদের ধর্মগ্রন্থ আবেস্তাসহ আরও কিছু গ্রন্থ অধ্যয়নের পর ১৯৯০ সালে লিখি ‘ভারত-ইতিহাসের সূত্র সন্ধান’ নামে একটি গ্রন্থ। এরপর গ্রন্থটি নিয়ে দুই বঙ্গেই কিছু ঘোরাঘুরি করে বুঝলাম যে, আমার কাছে যেটা নেহায়েৎ কাণ্ডজ্ঞানের ব্যাপার মনে হচ্ছে ব্যাপারটা আসলে তত সহজ নয়।
এরপর শামসুল আলম চঞ্চল আমার সঙ্গে যুক্ত হন। তার ছিল সিন্ধু সভ্যতার প্রত্নতাত্ত্বিক আবিষ্কারসমূহের উপর প্রচুর অধ্যয়ন। আমার সঙ্গে আলোচনা এবং ঋগ্বেদ পাঠের পর তিনিও আমার সঙ্গে একমত হন। এরপর আমরা দুইজনে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের পণ্ডিতদের সঙ্গে যোগাযোগসহ বেশ কিছু কাজ করি। শামসুল আলম চঞ্চল আমাদের উভয়ের ধারণা The Indus Civilization and the Aryans নামে একটি ইংরাজী প্রবন্ধে লিখে ১৯৯৩ সালে পৃথিবীর কয়েকজন পণ্ডিতের নিকট পাঠান। প্রবন্ধের একটা কপি পাঠের পর সিন্ধু সভ্যতার উপর বর্তমান পৃথিবীর একজন শ্রেষ্ঠ প্রত্নতত্ত্ববিদ এবং পাকিস্তান প্রত্নতত্ত্ব ও যাদুঘর বিভাগের তৎকালীন মহাপরিচালক ডঃ মোহাম্মদ রফিক মোগল ১৯৯৪ সালে তার এক সংক্ষিপ্ত চিঠিতে আমাদের ধারণার প্রতি তার জোরালো সমর্থন জ্ঞাপন করে সেটা যত দ্রুত সম্ভব প্রকাশের তাগিদ দেন।*
---------------------------------------------------------------
* চিঠিটির অনুলিপি লেখার শেষে সংযুক্ত করা হয়েছে।
----------------------------------------------------------------
এটা ছিল আমাদের জন্য বিপুল অনুপ্রেরণা সঞ্চারী ঘটনা। সত্যি কথা বলতে কি এ ধরনের সমর্থন এবং প্রেরণা আমরা আর কোনও পণ্ডিতের নিকট থেকেই পাই নাই। যাইহোক, মোগলের সমর্থন এবং প্রবন্ধটি প্রকাশের তাগিদের পর প্রবন্ধটিকে আরও কিছু সমৃদ্ধ করে আমরা উভয়ে ১৯৯৫ সালে ইংরাজীতে The Aryans and the Indus Civilization (Link : http://www.bangarashtra.net/article/848.html) নামে একটি গ্রন্থ প্রকাশ করি। এছাড়া ২০০৩ সালে বাংলায় ‘আর্যজন ও সিন্ধু সভ্যতা’ (Link : http://www.bangarashtra.net/article/853.html) নামে একটি গ্রন্থ প্রকাশ করি। আমার ১৯৯০ সালে লিখা কিন্তু অপ্রকাশিত রয়ে যাওয়া ‘ভারত-ইতিহাসের সূত্র সন্ধান’-এর বেশ কিছু অংশ আমি এই প্রকাশিত গ্রন্থের অন্তর্ভুক্ত করি।
আজ এ কথা বলতে দ্বিধা নাই যে, মোগলের সমর্থন এবং প্রেরণা না পেলে আমরা আমাদের উদ্যমকে কতটা রক্ষা করতে পারতাম সে ব্যাপারে আমার সন্দেহ আছে। এই চিঠির প্রেরণা আমাদেরকে দুইটি গ্রন্থ লিখায় বিপুল উৎসাহ যুগিয়েছে। মোগলের এই সমর্থন লাভের পর ১৯৯৫ সালে প্রকাশিত The Aryans and the Indus Civilization ভারতসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের বহু সংখ্যক পণ্ডিতের নিকট পাঠাই এবং এর ভিত্তিতে মত বিনিময়ের চেষ্টা করি।
যত সহজে এবং যত সংক্ষেপে আমি এখানে আমাদের এই কর্মপ্রয়াসের বয়ান দিলাম ব্যপারটা মোটেই তত সহজ এবং সংক্ষিপ্ত কোনটাই নয়। চঞ্চল এবং আমার এক দীর্ঘ পথ পরিক্রমার মধ্য দিয়ে ইতিহাসের উপনিবেশিক পাঠ সম্পর্কে সিদ্ধান্ত টানতে হয়েছে। বিশেষ করে আমার নিজের কথা বলতে পারি। ঋগ্বেদ পাঠের পর আমার শুধু বারবার একটা কথা মনে হত যারা ঋগ্বেদ পাঠ করে এর ব্যাখ্যা করেছেন তারা কী করে এত বড় ভুল করতে পারেন? সবাইকে সবকিছু পড়তে হবে তার কোনও মানে নাই। সেটা সম্ভবও নয়। সুতরাং ঋগ্বেদ না পড়ে বেদ-পণ্ডিতদের লেখা পড়ে যেমন এক সময় আমি মনে করতাম ঋগ্বেদ বহিরাগত পশুচারী ও বর্বর মানুষদের রচনা তেমন অন্য যারা নিজেরা ঋগ্বেদ না পড়ে বেদ-পণ্ডিতদের ব্যাখ্যা অনুযায়ী আর্যদের বহিরাগত আক্রমণকারী মনে করেছেন তাদেরকে আমি দায়ী করব না। কিন্তু যে বেদ-পণ্ডিতরা ঋগ্বেদ পড়ে তার এমন অর্থ করেছেন তাদের বুদ্ধিমত্তা বা প্রজ্ঞার প্রতি আর যা-ই হোক শ্রদ্ধা থাকবার কারণ নাই।
যারা ঋগ্বেদ পড়েছেন তারা জানবেন ঋগ্বেদ কীভাবে একটা সভ্য সমাজের চিত্র অঙ্কন করে। যেহেতু বিভিন্ন লেখায় শামসুল আলম চঞ্চলের সঙ্গে যৌথভাবে এবং এককভাবেও এ বিষয়ে অনেক আলোচনা করেছি সেহেতু এখানে আর এ বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা করব না। তবু এটুকু বলি যে, ঋগ্বেদের ঋষিদের বর্ণিত তাদের নিজেদের প্রাচীর ঘেরা নগর বা পুর, জলসেচ-নির্ভর ও লাঙ্গল দ্বারা কৃষি, বিশাল বিশাল ভবন, পাকা বাসগৃহ, বস্ত্রবয়ন, সমুদ্র-বাণিজ্য ও সামুদ্রিক জাহাজ, উন্নত চিকিৎসা ব্যবস্থা, জ্যোতির্বিজ্ঞান সংক্রান্ত ধারণা ইত্যাদির বিবরণ মোটেই পশুপালন নির্ভর যাযাবর সমাজের চিত্র দেয় না। বহিরাক্রমণকারীদের চিত্র দেওয়া তো দূরের কথা। কিছু গরু বা গবাদি পশুর বিবরণ মানে কি কৃষি ছিল না? যেন পশু কিংবা গরুর কথা থাকলেই ধরে নিতে হবে সেখানে কৃষি ছিল না! কৃষিজীবীরা যেন গবাদি পশু পালন করে না! গরুর আর সব ব্যবহার যেমন গাড়ী টানা ইত্যাদির কথা বাদ দেওয়া যাক, লাঙ্গল দিয়ে জমি চাষের জন্যও তো সে যুগে গরুর ব্যবহার হতে পারত। যেহেতু ঋগ্বেদে প্রচুর গরুর উল্লেখ আছে সেহেতু ঋগ্বেদ রচয়িতারা পশুচারী যাযাবর ছিল এমন সিদ্ধান্ত টানাটা হাস্যকর হয় নাকি? অথচ সভ্য এবং স্থিতিশীল নাগরিক ও কৃষি জীবনের যে সব বিবরণ সমগ্র ঋগ্বেদ জুড়ে ছড়িয়ে আছে সেগুলি এই সব পণ্ডিতের চোখ এড়িয়ে গেল! যেমন এড়িয়ে গেল ঋষিদের বহুবার সপ্তসিন্ধু অঞ্চলকে নিজেদের বাসভূমি হিসাবে উল্লেখের বিষয়টি।
যাইহোক, আমার হতভম্ব হবার আরও বাকী ছিল। সেটুকু পূর্ণ হল উপমহাদেশীয় এবং বিশেষত ইউরোপীয় পণ্ডিতদেরকে ঋগ্বেদ সম্পর্কে আমাদের ধারণা জানাতে গিয়ে। আমার একটা ধারণা ছিল যে, পণ্ডিতরা সাধারণত জ্ঞানের সন্ধানী হওয়ায় সত্যান্বেষী হন। সুতরাং তাদেরকে যদি ঋগ্বেদের সহজ সত্যটা ধরিয়ে দিই তবে তারা সেটাকে অন্তত গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করবেন।
ইউরোপ থেকে সাধারণভাবে কোন উত্তর পাই নাই। ২/৪ জন আমাদের ইংরাজী গ্রন্থ পাবার পর প্রাপ্তি স্বীকার পর্যন্ত গেলেও বাকীরা কোনও উত্তর দিবারও প্রয়োজন মনে করেন নাই। একজন খুব নামী আমেরিকান প্রত্নতত্ত্ববিদ আমাদের গ্রন্থ থেকে যে অনেক কিছু জানতে পেরেছেন এ কথা জানিয়ে তার সৌজন্যমূলক উত্তরটি দেওয়ার কষ্টটুকু করেন। তবে আমরা দেশ-বিদেশের পণ্ডিতদের নিকট বক্তব্য প্রদানে লেগে থেকেছি। এ ক্ষেত্রে বিশেষভাবে উদ্যোগী ভূমিকা পালন করেছেন চঞ্চল। গত বছর অর্থাৎ ২০১৮ সালে আমরা দুইজন যৌথভাবে Decline of Indus Civilization and Vedic Upheaval (Link : http://www.bangarashtra.net/article/1385.html) নামে একটা লেখা লিখি। এর ভিত্তিতে আমরা পুনরায় নূতন করে ভারতীয় এবং পাশ্চাত্যের কিছু সংখ্যক পণ্ডিতের সঙ্গে মত বিনিময়ের চেষ্টা করি। তারও আগে ২০১২ সালে চঞ্চল এবং আমি যৌথভাবে Rediscovering Indus Civilization and Aryans: Journey to Our Renaissance (Link : http://www.bangarashtra.net/article/1202.html) নামে ইংরাজীতে একটি প্রবন্ধ লিখে ভারতসহ কয়েকটি দেশের পণ্ডিতদের নিকট প্রেরণ করি। এটির বাংলা ‘নূতন দৃষ্টিতে সিন্ধু সভ্যতা ও আর্যজন : আমাদের নবজাগৃতির উদ্বোধন’ (Link : http://www.bangarashtra.net/article/1231.html) ওয়েবসাইট বঙ্গরাষ্ট্রে ২০১৫ সালের ১৯ জুলাইতে প্রকাশিত হয়। এ সকল চেষ্টা থেকে নূতন করে আরও কিছু অভিজ্ঞতা আমাদের হয়েছে।
এখন সিন্ধু সভ্যতার অনেক আবিষ্কার হয়েছে। ইতিমধ্যে এই সব আবিষ্কারের ফলে বহিরাগত আর্য আক্রমণ তত্ত্ব প্রত্নতাত্ত্বিক বিচারে নাকচও হয়ে গেছে। কিন্তু এতদিনে বিশেষ করে ইউরোপ ও আমেরিকান পণ্ডিতদের মনে হল শুধু সাহিত্যের বিচারে ঋগ্বেদের ব্যাখ্যা চলে না। অর্থাৎ ঋগ্বেদ যে সিন্ধু সভ্যতার অধিবাসীদের সৃষ্টি সে কথা মানতে এখনও তাদের আপত্তি। এখন তাদের কেউ কেউ বিশেষত প্রত্নতাত্ত্বিকরা ঋগ্বেদকে গুরুত্ব দিতে প্রস্তুত নন। তাদের মতে এটা একটা ধর্মীয় সাহিত্য যার ঐতিহাসিক মূল্য প্রশ্ন সাপেক্ষ। অর্থাৎ তাদের মতে সিন্ধু সভ্যতার লিপির পাঠোদ্ধার হবার পূর্ব পর্যন্ত আমরা সিন্ধু সভ্যতার সঙ্গে তার সম্পর্ক সম্পর্কে কোনও সিদ্ধান্ত নিতে পারি না।
এই পণ্ডিতরা কিন্তু এই বিষয়টিকে আদৌ গুরুত্ব দিতে চান না যে, সিন্ধু সভ্যতা আবিষ্কারেরও অনেক কাল পূর্বে ঊনবিংশ শতাব্দীর ইউরোপীয় এবং বিশেষত ব্রিটিশ পণ্ডিতরা ঋগ্বেদ যে ভারতবর্ষে বহিরাগত যাযাবর আর্যদের দ্বারা লিখিত ধর্মগ্রন্থ সেই মর্মে স্থির সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছিলেন। তখন কিন্তু কোনও প্রত্নতাত্ত্বিক সাক্ষ্য-প্রমাণেরই প্রয়োজন হয় নাই। আমি আমার ইতিপূর্বেকার বিভিন্ন লেখায় এর পিছনে ক্রিয়াশীল সাম্রা্জ্যবাদী-উপনিবেশবাদী দৃষ্টিভঙ্গী এবং উদ্দেশ্য সম্পর্কে ব্যাখ্যা করেছি। সুতরাং এ বিষয়ে নূতন করে আলোচনা করে এখানে আমি অযথা সময় নষ্ট করতে চাই না। এ বিষয়ে আমার কিছু বিস্তারিত আলোচনার জন্য আগ্রহী পাঠক ‘কেস-স্টাডি ঋগ্বেদ এবং পাশ্চাত্য ও ভারতবর্ষের মূলধারার বুদ্ধিবৃত্তির স্বরূপ দর্শন’ (Link : http://www.bangarashtra.net/article/1387.html) পাঠ করতে পারেন। অল্প কিছুদিন আগে আমার লিখা ‘সিন্ধু সভ্যতা ও আর্য সম্পর্কে পুনর্মূল্যায়ন : সঠিক ইতিহাসের প্রয়োজন কেন?’ (Link : http://www.bangarashtra.net/article/1413.html) নামক একটি ছোট প্রবন্ধেও আমি সাম্রাজ্যবাদী-উপনিবেশবাদী দৃষ্টিভঙ্গী এবং উদ্দেশ্যের বিষয় উল্লেখ করেছি।
(খ) জ্ঞানতত্ত্ব ও রাজনীতি
অভিজ্ঞতা থেকে আমাদেরকে এই নির্দয় সত্যের সম্মুখীন হতে হচ্ছে যে, সাধারণ নিয়ম অনুযায়ী জ্ঞান, বিশেষত যে জ্ঞান মানুষের সমাজ, ইতিহাস ও রাজনীতির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট থাকে, তা রাজনীতির বাইরে যেতে পারে না। বিশেষত প্রাতিষ্ঠানিক জ্ঞানের ক্ষেত্রে এ কথা খুব খাটে। মনে রাখতে হবে যত বড় বড় পণ্ডিত অথবা জ্ঞানী হোক তারাও আর দশটা মানুষের মতো রক্তমাংসের শরীর বিশিষ্ট মানুষ। প্রতিষ্ঠানের চাকুরীতে থেকে যারা জ্ঞান চর্চা করে তাদের তো খেয়েপরে বেঁচে থাকতে হয়, চাকুরীতে পদোন্নতি, খ্যাতি এবং নানান ধরনের পুরস্কারের লোভ তো তাদেরও থাকতে পারে। এসব ক্ষেত্রে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে রাষ্ট্রের অথবা রাষ্ট্রকে যারা প্রভাবিত বা নিয়ন্ত্রণ করে তাদের সমর্থন অথবা পৃষ্ঠপোষকতা অপরিহার্য। সুতরাং জ্ঞানী বা বুদ্ধিচর্চা যারা করেন তাদের জ্ঞান বা বুদ্ধিচর্চাও সাধারণভাবে রাজনীতির অধীনস্থ। ব্রিটিশরা দুইশত বৎসর ভারতীয় উপমহাদেশ শাসন করেছিল। এই শাসনকে রক্ষা এবং দীর্ঘস্থায়ী করার জন্য যা যা করা দরকার তারা মনে করেছিল তা তা-ই তারা যে করার চেষ্টা করেছিল সেটাই কি একান্ত স্বাভাবিক নয়? সুতরাং ভারতবর্ষের ইতিহাসের একটা মিথ্যা বয়ান তাদের জন্য খুব প্রয়োজনীয় ছিল। যাদেরকে আমরা সত্যান্বেষী জ্ঞানসাধক মনে করি সেইসব জ্ঞানী পণ্ডিত হয়েছিল তাদের এই মিথ্যা বয়ান তৈরীর জন্য সবচেয়ে বড় সহায়ক। আর সুপ্রতিষ্ঠিতদের দ্বারা একবার বয়ান তৈরী হলে সেটার বিরুদ্ধে দাঁড়াবে কে? ইউরোপীয়রা? তাদের কী ঠ্যাকা পড়েছে? বরং তারাই তো এই বয়ান তৈরী করেছে। যাদের দাঁড়াবার কথা ইংরাজী শিক্ষায় শিক্ষিত সেই ভারতীয় পণ্ডিতরা তাদের ব্রিটিশ প্রভু-পণ্ডিতদের দ্বারা প্রবর্তিত ঋগ্বেদ ব্যাখ্যা এবং ইতিহাস পাঠের বিরুদ্ধে দাঁড়াবে? আর একবার একটা বিষয় বা ধারণাকে উপর থেকে চাপিয়ে দিতে পারলে তার বিরুদ্ধে দাঁড়ানো দুঃসাধ্য হয়। আরও বিশেষত যদি ধারণাটা উপনিবেশিক কালে উপনিবেশিক প্রভুদের দ্বারা প্রতিষ্ঠিত হয়।
এরপরেও স্বামী বিবেকানন্দের মতো খুবই মুষ্টিমেয় ২/৪ জন পণ্ডিত ব্যক্তি ভারতবর্ষে বহিরাগত আর্য আক্রমণ তত্ত্বের বিরুদ্ধে কথা বলবার চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু তাদের কথা কে শুনবে, কে লিখবে? ফলে জানবেই বা কে? এমনকি ১৯৯০ সালের আগে আমি নিজেও জানতাম না যে, এই তত্ত্বের বিরুদ্ধে আর কোনও মত আছে। এটা জেনেছিলাম ঋগ্বেদ পাঠের পর আমার নূতন জিজ্ঞাসা নিয়ে বিভিন্ন গ্রন্থ পাঠ করতে গিয়ে। তখন কে, এম, মুন্সী নামে একজন পণ্ডিতের কথাও জানতে পারি যিনি আর্য আক্রমণ তত্ত্বের বিরুদ্ধে বক্তব্য দেওয়ার কারণে তীব্রভাবে সমালোচিত হন। আমি যতদূর মনে করতে পারি পরবর্তী কালে তিনি তার মত প্রত্যাহার করে উপনিবেশিক ইতিহাস পাঠকে গ্রহণ করে নেন।
যাইহোক, আমার মতো সাধারণ ইতিহাস পাঠকদের এই সব পণ্ডিতের ভিন্ন মত জানবার কোনও কারণ ছিল না। কারণ এসব কথা ইতিহাস গ্রন্থে আলোচিত হত না। প্রকৃতপক্ষে সামান্য কিছু সংখ্যক হিন্দু ধর্মীয় পণ্ডিত আর্যদেরকে উপমহাদেশের স্থানীয় অধিবাসী মনে করতেন। তাদের যুক্তির উৎস ছিল ঋগ্বেদসহ বিভিন্ন বেদ এবং প্রাচীন ভারতীয় অন্যান্য হিন্দু ধর্মীয় গ্রন্থ। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে ইউরোপীয় পণ্ডিতরা যেমন তাদের উপনিবেশবাদী দৃষ্টি থেকে ঋগ্বেদকে ব্যাখ্যা কিংবা প্রাচীন ভারতবর্ষের ইতিহাসের বয়ান নির্মাণ করেছিলেন তেমন এরা তাদের হিন্দুত্ববাদী দৃষ্টি থেকে আর্য প্রশ্ন এবং ঋগ্বেদের ব্যাখ্যা দেওয়ার চেষ্টা করেছিলেন। ধর্মবিশ্বাস দিয়ে তো কোনও কিছুর বিজ্ঞানসম্মত ব্যাখ্যা চলে না। ফলে তারা ব্রিটিশ এবং ইউরোপীয় পণ্ডিতদের ইতিহাস পাঠকে নাকচ করে ইতিহাসের পাল্টা পাঠ দানে অক্ষম ছিলেন।
অনেক কাল ধরে সিন্ধু সভ্যতার পুরাতাত্ত্বিক আবিষ্কারসমূহ ঋগ্বেদের ব্যাখ্যাসহ প্রাচীন ভারতীয় ইতিহাসের ইউরোপীয় তথা উপনিবেশিক বয়ানকে হতভম্বকর অবস্থায় নিক্ষেপ করার পর সম্প্রতি বেশ কিছুদিন থেকে ভারতের হিন্দুত্ববাদী পণ্ডিতরা নূতনভাবে প্রাচীন ভারতবর্ষের হিন্দুত্ববাদী বয়ান দিতে শুরু করেছেন। এখন তারা জোরালো ভাষায় ঋগ্বেদ যে সিন্ধু সভ্যতার অধিবাসীদের সৃষ্টি এবং আর্যরা যে সিন্ধু সভ্যতারই অধিবাসী সে কথা বলছেন। কিন্তু ঋগ্বেদের একটা বস্তুনিষ্ঠ এবং বিজ্ঞানসম্মত ব্যাখ্যা তারা দিতে পারছেন না বলে তাদের ব্যাখ্যায় প্রভূত গোঁজামিল বা ফাঁক রয়ে যাচ্ছে। ফলে তাদের বয়ান উপনিবেশিক বয়ানকে যথাযথভাবে খণ্ডন করতে পারছে না। এটা ঠিক যে প্রত্নতাত্ত্বিক আবিষ্কারসমূহ ভারতবর্ষে বহিরাগত আর্য আক্রমণতত্ত্বের দাঁড়াবার কোনও জায়গাই আর রাখে নাই। কিন্তু সেটুকুই তো সুদীর্ঘ কাল ধরে বিশ্বব্যাপী প্রতিষ্ঠিত এই তত্ত্বকে খণ্ডন করার জন্য যথেষ্ট নয় যদি সেই সঙ্গে সিন্ধু সভ্যতার সঙ্গে ঋগ্বেদের সম্পর্ককে সঠিকভাবে চিহ্নিত করা না যায়। যে কোনও পূর্বনির্ধারিত ধারণা যদি দৃষ্টি এবং বিচার-বুদ্ধিকে আচ্ছন্ন করে থাকে তাহলে কোনও কিছুরই বাস্তবসম্মত কিংবা বিজ্ঞানস্মত ব্যাখ্যা কীভাবে সম্ভব? ইতিহাসের উপনিবেশিক পাঠের মতো হিন্দুত্ববাদী পাঠের সমস্যাটাও এই জায়গায়। এখন আমি হিন্দুত্ববাদী ইতিহাস পাঠের সমস্যাটা ঠিক কোথায় সেটাকে খুব সংক্ষেপে চিহ্নিত করতে চেষ্টা করব।
তবে এই পর্বের আলোচনা শেষ করার পূর্বে আমি এ কথা বলতে চাই যে, ঋগ্বেদের প্রসঙ্গ দিয়ে এই আলোচনা শুরু করলেও আমাদের মনে রাখতে হবে, উপনিবেশিক বয়ান শুধু ঋগ্বেদ কিংবা প্রাচীন ভারতবর্ষের ইতিহাস ও সমাজের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। স্বাভাবিকভাবে উপনিবেশিক আধিপত্যের কালে পাশ্চাত্য বিশেষত ব্রিটিশ প্রাতিষ্ঠানিক পণ্ডিতরা যখন ভারতবর্ষের ইতিহাস ও সমাজের বিভিন্ন বয়ান নির্মাণ করেছে তখন তাদের চেতনায় কম আর বেশী ক্রিয়াশীল থেকেছে উপনিবেশিক স্বার্থ রক্ষার প্রেরণা অথবা উপনিবেশিক দৃষ্টিভঙ্গী। অনেক সময় ভলোভাবে খোঁজখবর না নিয়েই কোনও বিষয় নিয়ে ঢালাও মন্তব্যের ব্যাপার তো আছেই। যেহেতু তারা তখন প্রভু সেহেতু তারা যেটা বলে বা লিখে সেটাই তৎক্ষণাৎ ভারতীয় প্রজাদের নিকট মহামূল্যবান বয়ানে পরিণত হয়। তখন সেই বয়ানের বিরুদ্ধে প্রশ্ন তোলে কিংবা পাল্টা বয়ান দেয় এমন সাধ্য কার? ব্রিটিশ রাজনৈতিক আধিপত্য শেষ হয়েছে তো কী হয়েছে? দাসত্বের ধারাবাহিকতা অব্যাহত রয়েছে। সুতরাং বিশেষত ব্রিটিশ ঐতিহাসিক বা গবেষকদের ভারতবর্ষের ইতিহাস ও সমাজ বিষয়ক যে কোনও বয়ানকে খুবই সতর্কতার সাথে এবং সন্দেহযুক্ত মন নিয়ে পাঠ করা উচিত। এ সম্পর্কে আমি নির্দিষ্টভাবে আরও বিভিন্ন বিষয়ের উল্লেখ পূর্বক আলোচনা করতে পারতাম। যেমন বাংলার ইতিহাসের অন্তর্ভুক্ত কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে ব্রিটিশ লেখকদের ঢালাও মন্তব্য কীভাবে আমাদের ইতিহাসের ভ্রান্ত পাঠ নির্মাণ করেছে সে বিষয়ে আলোচনা করা যায়। তবে আলোচনাকে যতটা সম্ভব সংক্ষিপ্ত করতে চেয়ে সেসব প্রসঙ্গে এখানে যাব না। সম্ভব হলে বারান্তরে এসব বিষয়ে আলোচনা করা যাবে।
দ্বিতীয় পর্ব : ইতিহাসের হিন্দুত্ববাদী পাঠ
ভারতবর্ষের ইতিহাসের উপনিবেশিক পাঠের মতো হিন্দুত্ববাদী পাঠেরও মূল ভিত্তি হচ্ছে ঋগ্বেদ। সিন্ধু সভ্যতার উপর ব্যাপক খননকাজের পর এখন প্রত্নতাত্ত্বিক বিচারে বহিরাগত আর্য আক্রমণতত্ত্ব নাকচ হয়ে যাবার পর আর্য বা যে নাম দেওয়া যাক ঋগ্বেদ রচয়িতাদের মূলভূমি বা আবাসভূমি হিসাবে যুক্তিসঙ্গতভাবে সিন্ধু সভ্যতা উপস্থিত হয়। এখন প্রশ্ন যে, সিন্ধু সভ্যতার অধিবাসীদের সৃষ্টি যদি ঋগ্বেদ হয়ে থাকে তাহলে সিন্ধু সভ্যতার সঙ্গে তার মিল কতটুকু বা সম্পর্ক কী ধরনের?
হিন্দুত্ববাদীরা এই প্রশ্নের উত্তরে যে কথা বলতে চান সেটা হচ্ছে উন্নত নগর সভ্যতা হিসাবে সিন্ধু সভ্যতার শুরুর সময় কিংবা পূর্ব থেকেই বৈদিক ঋষিরা যে সকল মন্ত্র রচনা করেন সেগুলির সমাহারে যেমন ঋগ্বেদ ধর্মগ্রন্থ হিসাবে প্রবর্তিত হয় তেমন এই সকল মন্ত্রের প্রেরণায় সিন্ধু সভ্যতা নির্মিত হয় কিংবা ঋষিরা সিন্ধু সভ্যতা নির্মাণের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। এই ধরনের ব্যাখ্যার অর্থ এই দাঁড়ায় যে, পুরোহিত শ্রেণী হিসাবে বৈদিক ঋষিরা ছিলেন সিন্ধু সভ্যতা নির্মাণের মূল নায়ক কিংবা এই সভ্যতার প্রতিষ্ঠায় অগ্রণী ভূমিকা পালনকারী।
আলোচনা সহজ ও সংক্ষিপ্ত করার জন্য এখন আমি ভারতের বিখ্যাত বৈদিক পণ্ডিত ভগবান সিংয়ের লিখা The Vedic Harappans-এর প্রসঙ্গে কিছু আলোচনা করতে পারি (Bhagwan Singh, The Vedic Harappans, Aditya Prakashan, New Delhi, First Published: 1995)। স্বাভাবিক গ্রন্থের দ্বিগুণ আয়তনবিশিষ্ট ৪৯৩ পৃষ্ঠার এই বিরাট গ্রন্থটি ভাষাতাত্ত্বিক বিচারে একটি অসাধারণ গ্রন্থ। লেখক ভাষাতাত্ত্বিক এবং অন্যান্য বিষয়ের বিচার-বিশ্লেষণের সাহায্যে ঋগ্বেদ যে সিন্ধু সভ্যতার সঙ্গে সংযুক্ত সেটা অকাট্যভাবে প্রমাণ করেছেন।
এ পর্যন্ত ঠিক আছে। কিন্তু লেখক যখন সিন্ধু সভ্যতার নির্দিষ্ট কালপর্বের সঙ্গে ঋগ্বেদের সংশ্লিষ্টতার বিষয়টিকে উপেক্ষা করে তাকে ঢালাওভাবে সিন্ধু সভ্যতার সঙ্গে সংযুক্ত করেন তখন কতকগুলি বিষয়ের ব্যাখ্যা করা সম্ভব হয় না। যেমন ঋগ্বেদের যুদ্ধগুলির বর্ণনাকে কীভাবে ব্যাখ্যা করা যাবে? কিংবা ঋগ্বেদের কেন্দ্রীয় বিষয় যেখানে যুদ্ধ সেখানে সিন্ধু সভ্যতার শান্তিপূর্ণ বিকাশ ও বিস্তার প্রক্রিয়াকে কীভাবে ব্যাখ্যা করা যাবে ঋগ্বেদের এই ব্যাখ্যা দিয়ে? এমন আরও বেশ কিছু সমস্যা দেখা দেয় ঋগ্বেদের এ ধরনের ব্যাখ্যা থেকে।
আসলে হিন্দুত্ববাদী পাঠ দিয়ে ঋগ্বেদ এবং সিন্ধু সভ্যতার মধ্যকার সম্পর্কের সঠিক রূপ অনুসন্ধানের পরিবর্তে ঋগ্বেদকে ঢালাও বা অনির্দিষ্টভাবে সিন্ধু সভ্যতার উপর আরোপ করে বৈদিক ধর্মের শ্রেষ্ঠত্ব বা মহত্ত্ব প্রতিষ্ঠা করতে চাওয়া হয়। অন্তরালে থাকে বৈদিক ধর্মের ধারাবাহিকতা হিসাবে বর্তমান হিন্দু ধর্মের শ্রেষ্ঠত্ব প্রতিষ্ঠার আকাঙ্ক্ষা। এই কারণে যখন সিন্ধু সভ্যতার পতনকালে সভ্যতার বিরুদ্ধে একটা প্রতিক্রিয়া হিসাবে বৈদিক ধর্মীয় আন্দোলনকে ব্যাখ্যা করা হয় তখন হিন্দুত্ববাদীরা আর সেটাকে গ্রহণ করতে পারেন না।
ভগবান সিং-এর সঙ্গেও আমাদের মতপার্থক্য ঘটে এই জায়গায়। তার The Vedic Harappans প্রকাশিত হয় ১৯৯৫ সালে। আমাদের ইংরাজী গ্রন্থ The Aryans and the Indus Civilization-ও প্রকাশিত হয় একই বৎসর অর্থাৎ ১৯৯৫ সালে। উভয় গ্রন্থে আর্যরা যে সিন্ধু সভ্যতার অধিবাসী এ কথা বলা হলেও ঋগ্বেদ সংক্রান্ত ব্যাখ্যায় আমাদের মতপার্থক্য খুব বড় হয়ে দেখা দেয়। আমরা অর্থাৎ চঞ্চল এবং আমি সিন্ধু সভ্যতার পতনের সময়ে সিন্ধু সভ্যতায় প্রচলিত নদীনিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থার বিরুদ্ধে একটা বিদ্রোহ হিসাবে বৈদিক আন্দোলনকে বিচার করেছি। যেহেতু এ বিষয়ে আমার একক বা আমাদের উভয়ের অন্যান্য লেখায় আলোচনা করেছি সুতরাং আলোচনা সংক্ষিপ্ত করার প্রয়োজনে এখানে এটুকু বলি যে, সিন্ধু সভ্যতা প্রতিষ্ঠিত ছিল আধুনিক কালের মতো জলকপাট ও বাঁধযুক্ত নদীনিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থার উপর। ঋগ্বেদের বিবরণ এবং সিন্ধু সভ্যতার বিশাল অঞ্চলব্যাপী সমৃদ্ধি, জনকল্যাণমূলক আয়োজন এবং শান্তিনির্ভরতার প্রত্নতাত্ত্বিক প্রমাণ এবং সেই সঙ্গে কিছু প্রত্নতাত্ত্বিক সাক্ষ্য থেকে আমরা খাদ্যোৎপাদনের প্রয়োজনে সেখানে সকল নদীর উপর এমন ধরনের নিয়ন্ত্রণ আরোপকে দেখতে পেয়েছি। তবে সিন্ধু সভ্যতার শেষ পর্যায়ে মানুষ কর্তৃক প্রকৃতির উপর এ ধরনের হস্তক্ষেপের পরিণতিতে নদীখাতে পলি সঞ্চয়, নদীর গতিপথ পরিবর্তন ইত্যাদির ফলে নদী নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা ভেঙ্গে পড়তে থাকে। সরস্বতী ছিল সিন্ধু সভ্যতার বৃহত্তম নদী। নদীর জলধারা জলকপাটযুক্ত বাঁধ দ্বারা রুদ্ধ হবার পর এক সময় তার গতিপথ পরিবর্তিত হয় এবং পরিণতিতে মূল নদীর মৃত্যু ঘটে। বিরাট অঞ্চলব্যাপী বহুসংখ্যক নদীর গতিধারায় আপতিত এ ধরনের বিশৃঙ্খলা ও বিপর্যয়ের ফলে ব্যাপক অঞ্চলব্যাপী জনজীবনে যে বিপর্যয় ঘটে তাতে করে জনগণের একাংশ নদীনিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থার অবসান দাবী করে। কিন্তু ইতিমধ্যে নদীনিয়ন্ত্রণব্যবস্থা সিন্ধু সভ্যতার ধর্মের অন্তর্ভুক্ত হয়েছিল।
অন্যদিকে, পুরাতন ধর্ম ছিল সিন্ধু সভ্যতার শান্তিপূর্ণ বৈশিষ্ট্যের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ। সিন্ধু সভ্যতা যে মূলত অহিংসা-নির্ভর তথা যুদ্ধ বিমুখ একটা সভ্যতা ছিল সকল প্রত্নতাত্ত্বিক আবিষ্কার সে বিষয়টিকে নিশ্চিত করেছে। সুতরাং এমন একটা সভ্যতার ধর্ম যে অহিংসার সহায়ক বা সমর্থক হবে সেটাই স্বাভাবিক। কিন্তু নদীনিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থার অবসান ঘটাতে গেলে যারা তখনও এই ব্যবস্থার পক্ষে ছিল তাদের সঙ্গে সহিংস সংঘাত ঘটাতে হয়। ঋগ্বেদ পাঠ থেকে আমরা অনুমান করি, রাষ্ট্র তথা শাসক শ্রেণীর মধ্যেও নদীনিয়ন্ত্রণের প্রশ্নে বিরোধ ঘটে। তবে আমাদের অনুমান যে, সিন্ধু সভ্যতার শাসক শ্রেণীর প্রধান অংশ ছিল নদীনিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা সংরক্ষণের পক্ষপাতী। যাইহোক, একটা পর্যায়ে বিরোধ সশস্ত্র বা সহিংস সংঘাতে রূপ নেওয়ার দিকে গেল। কিন্তু বিদ্যমান ধর্ম থাকলে যুদ্ধ কিংবা নদীনিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা ধ্বংসের সপক্ষে ধর্মীয় অনুমোদন লাভ সম্ভব না।
সুতরাং জনসখ্যার যে অংশ এই ব্যবস্থার অবসান চাচ্ছিল তাদের জন্য বিদ্যমান ধর্মের সংস্কারের প্রয়োজন হয়েছিল। সিন্ধু সভ্যতার পুরোহিত শ্রেণীর একাংশ এই সংস্কারের কাজ করে। এভাবে বৈদিক ধর্মের উত্থান ঘটে। এই ধর্মসংস্কারের প্রক্রিয়ায় যে সকল মন্ত্র রচিত হয় সেগুলির সমষ্টি হচ্ছে ঋগ্বেদ। এই ধর্মসংস্কার একটি গৃহযু্দ্ধের দিকে সমাজ এবং সভ্যতাকে নিয়ে যায়। বৈদিক বিদ্রোহ ও যুদ্ধের পরিণতিতে পতনোন্মুখ নদীনিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়, যা পতনোন্মুখ এই সভ্যতার পতনকেও ত্বরান্বিত করে। এই হচ্ছে আমাদের ব্যাখ্যা।
আর এই জায়গায় ভগবান সিংয়ের আপত্তি। কারণ আমাদের ব্যাখ্যা অনুযায়ী সিন্ধু সভ্যতার নির্মাণের কৃতিত্ব বৈদিক ঋষিদের উপর অর্পিত না হয়ে তার ধ্বংস ত্বরান্বিত করার দায় তাদের উপর অর্পিত হয়। তবে ভগবান সিং আমাদের ব্যাখ্যাকে এভাবে দেখেন যে, আমরা সিন্ধু সভ্যতার ধ্বংসের জন্যও বৈদিক আন্দোলন বা ঋষিদেরকে দায়ী করেছি। আমাদের গ্রন্থের প্রেক্ষিতে তিনি তার এই আপত্তির কথা জানালে আমরা তাকে এ কথা বলি যে, আমরা সিন্ধু সভ্যতার ধ্বংসের জন্য বৈদিক আন্দোলনকে দায়ী করি নাই। তবে সভ্যতার পতনোন্মুখ অবস্থায় তার নদীনিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থার ধ্বংসসাধন করে বৈদিক ঋষিরা সভ্যতার পতনকে ত্বরান্বিত করেছে।*
--------------------------------------------------------------------------------------------------------------
* ভগবান সিং এবং আমাদের মধ্যে কয়েকটি পত্রবিনিময় হয়। এগুলির মধ্যে তার এবং আমার দুইটি পত্রবিনিময়ের অনুলিপির জন্য লিংক : http://www.bangarashtra.net/article/4.html
--------------------------------------------------------------------------------------------------------------
যাইহোক, সিংয়ের সিদ্ধান্তের সঙ্গে আমাদের সিদ্ধান্ত বিরোধাত্মক। তার ব্যাখ্যা থেকে এই দাঁড়ায় যে, বৈদিক ঋষিরা সিন্ধু সভ্যতা নির্মাণের সঙ্গে আদি থেকে সমাপ্তির পর্যায় পর্যন্ত সংশ্লিষ্ট। তিনি প্রকৃতপক্ষে সিন্ধু সভ্যতা নির্মাণের জন্যও বৈদিক ঋষিদের ভূমিকা দেখতে পান। আর আমরা বলছি বৈদিক শক্তি এবং ঋষিরা তার ধ্বংস বা পতন ত্বরান্বিতকারী। তিনি সিন্ধু সভ্যতার পতনের জন্য জলবায়ু পরিবর্তনকে দায়ী করছেন। আর আমরা বলছি মানুষ নির্মিত নদীনিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থার সঙ্কট ও ব্যর্থতার কারণে সিন্ধু সভ্যতার পতন ঘটে, যাকে ত্বরান্বিত এবং চূড়ান্ত রূপ দান করে বৈদিক আন্দোলন এবং যুদ্ধ। প্রকৃতপক্ষে ভগবান সিংয়ের লিখা গ্রন্থের The Vedic Harappans অর্থাৎ ‘বৈদিক হরপ্পানগণ’ নামকরণের মধ্যেই নিহিত রয়েছে দৃষ্টিভঙ্গীর সঙ্কট। তিনি হরপ্পান তথা সিন্ধু সভ্যতার অধিবাসীদেরকে বৈদিক ধর্মাবলম্বী হিসাব দেখতে চাচ্ছেন। তাতে এই দাঁড়ায় যে, বৈদিকরাই সিন্ধু সভ্যতার নির্মাতা। বস্তুত এখানেই হচ্ছে হিন্দুত্ববাদীদের দৃষ্টিভঙ্গীগত সমস্যা এবং সীমাবদ্ধতা। অন্য সব দিক বাদ দিলেও সিন্ধু সভ্যতার যুদ্ধ-বিমুখ প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনাদির সঙ্গে ঋগ্বেদের যুদ্ধ নির্ভরতাকে মিলানো যাবে কী করে? ঋগ্বেদকে সিন্ধু সভ্যতার একটা নির্দিষ্ট কালপ্রেক্ষিতে স্থাপন করতে না পারলে কীভাবে সিন্ধু সভ্যতার সঙ্গে ঋগ্বেদের যৌক্তিক সম্পর্ক স্থাপন করা সম্ভব?
বিশাল পাণ্ডিত্যের জন্য আমি প্রয়াত ভগবান সিংকে খুবই শ্রদ্ধা করি। ২০০০ সালে দিল্লীতে তার বাসগৃহে তার সঙ্গে চঞ্চলের দীর্ঘ আলোচনাও হয়েছিল। তার সঙ্গে আমাদের উভয়ের পত্র বিনিময় এবং চঞ্চলের কাছ থেকে শুনে তাকে আমার অত্যন্ত সজ্জন ব্যক্তি মনে হয়েছিল। সুতরাং তার সঙ্গে বিরোধের জায়গাটাকে এখানে আনতে চাচ্ছিলাম না। তা সত্ত্বেও এখানে ভগবান সিং-এর দৃষ্টান্ত দিলাম হিন্দুত্ববাদী দৃষ্টিভঙ্গীর সমস্যাটা সুনির্দিষ্টভাবে তুলে ধরবার জন্য। ব্যক্তিগত বিশ্বাসে তিনি যেমনই হোন তার এই দৃষ্টিভঙ্গীকে হিন্দুত্ববাদী বলা ছাড়া আর কিছু বলার উপায় নাই। হিন্দুত্ববাদীরা সাধারণত এ ধরনের বক্তব্য দেন। তারা সাধারণত এটা বলতে পছন্দ করেন যে, সিন্ধু সভ্যতার জন্ম থেকেই বৈদিক ঋষিদের কম-বেশী নায়কোচিত ভূমিকা রয়েছে এই সভ্যতার নির্মাণ ও বিকাশে। বস্তুত এই দৃষ্টিভঙ্গীর পিছনে যেটা কাজ করে সেটা হচ্ছে ধর্মগ্রন্থ হোক আর প্রত্নতাত্ত্বিক আবিষ্কার হোক সবকিছুর মধ্য থেকে ছাড়া ছাড়াভাবে উপকরণ সংগ্রহ করে হিন্দুত্বের শ্রেষ্ঠত্বের বয়ান তৈরীর আকাঙ্ক্ষা। ইতিহাসের উপনিবেশিক পাঠের মতো এটাও আমাদেরকে আর এক ভ্রান্তির মধ্যে নেয়।
তৃতীয় পর্ব : ইতিহাসের বস্তু-নির্ভর পাঠ
(ক) পুনরায় ঋগ্বেদ
এই পর্বের আলোচনাও ঋগ্বেদ দিয়েই শুরু করি। আমাদের হিসাব অনুযায়ী এটা সিন্ধু সভ্যতার সূচনার সময় থেকে রচিত নয়, বরং তার সমাপ্তির সময়কার সৃষ্টি। সিন্ধু সভ্যতার সীমিত সংখ্যক লিপি যেটুকু পাওয়া গেছে তার পাঠোদ্ধার হয় নাই। ফলে সিন্ধু সভ্যতার সময় নির্ধারণের জন্য এখন আমাদেরকে কার্বন ডেটিং এবং অধুনা প্রবর্তিত কয়েকটি পদ্ধতির উপর নির্ভর করতে হচ্ছে। তা দিয়ে সিন্ধু সভ্যতার পরিণত বা নগর পর্যায় হিসাবে যেটাকে ধরা হয় সেটার সূচনার সময় নির্ধারিত হয়েছে মোটামুটি খ্রীষ্টপূর্বাব্দ ২,৬০০ কাল থেকে। প্রত্নতত্ত্বের ভাষায় এটাকে পরিণত হরপ্পান বা হরপ্পান সভ্যতা হিসাবেও বলা হয়। আর এই নগর সভ্যতার অবসান হয় মোটামুটি ১,৯০০ খ্রীষ্টপূর্বাব্দে। তবে নগর সভ্যতা যেমন হঠাৎ করে শুরু হয় নাই, বরং তার একটা দীর্ঘকাল স্থায়ী পূর্বপ্রস্তুতির পর্যায় চলছিল তেমন নগর সভ্যতার ধ্বংস বা অবসানও হঠাৎ করে ঘটে নাই। বরং একটা দীর্ঘ সময় ধরে ক্রমশ নগরগুলি পরিত্যক্ত হতে থাকে, জনবসতি এলোমেলো বা বিশৃঙ্খল হতে থাকে, নদীগুলির গতিপথও এলোমেলো হতে থাকে এবং এ ক্ষেত্রে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হল সিন্ধু সভ্যতার বৃহত্তম নদী সরস্বতী নদীর ক্রমশ মৃত্যুবরণ। এভাবে সিন্ধু সভ্যতার প্রাথমিক পর্যায়ের সূচনা কাল যদি এখন থেকে সাড়ে পাঁচ বা ছয় হাজার বছর সময়ের আগে ধরা যায় তবে তার পরিসমাপ্তি ঘটতেও একটা দীর্ঘ সময় লাগে। সেটার সময় মূলত ১৯০০ খ্রীষ্টপূর্বাব্দ হলেও চূড়ান্তভাবে সিন্ধু সভ্যতার অবসান হয় খ্রীষ্টপূর্বাব্দ ১,৫০০ থেকে কোন কোন ক্ষেত্রে খ্রীষ্টপূর্বাব্দ ১,০০০ পর্যন্ত। প্রত্নতাত্ত্বিকরা সিন্ধু সভ্যতার এই তিন পর্যায়কে আদি হরপ্পান (Early Harappan), পরিণত হরপ্পান (Mature Harappan) এবং বিদায়ী হরপ্পান (Late Harappan) এভাবে ভাগ করেন। কার্বন ডেটিংসহ বিভিন্ন হিসাব অনুযায়ী খ্রীষ্টপূর্বাব্দ ২,৬০০ থেকে শুরু হয়ে খ্রীষ্টপূর্বাব্দ ১,৯০০ পর্যন্ত স্থায়ী কালপর্বই হচ্ছে পরিণত হরপ্পান বা সিন্ধুর নগর সভ্যতার প্রকৃত কালপর্ব।
সুতরাং ঋগ্বেদকে যদি সভ্যতার সঙ্কটের সময়ে রচিত ধরা যায় তবে আমরা অনুমান করতে পারি যে, ১,৯০০ খ্রীষ্টপূর্বাব্দের আরও কিছু আগে পুরাতন ধর্ম সংস্কারের লক্ষ্য নিয়ে ঋগ্বেদের মন্ত্র রচনা শুরু হয়েছিল। ঋগ্বেদের আরও প্রাচীনত্বের প্রমাণ স্বরূপ অনেক হিন্দুত্ববাদী পণ্ডিত সরস্বতী নদীর স্তুতিতে রচিত মন্ত্রের উল্লেখ করেন। বস্তুত সরস্বতী নদীকে যে মহিমা ঋগ্বেদকে দেওয়া হয়েছে সিন্ধু বা আর কোনও নদীকে সেই মহিমা দেওয়া হয় নাই। ঋগ্বেদে সরস্বতীকে বলা হয়েছে ‘পবিত্রা, অন্নযুক্তযজ্ঞবিশিষ্টা ও যজ্ঞফলরূপধনদাত্রী সরস্বতী’ (১/৩/১০), ‘শুচি’ (১/১৪২/৯), ‘নদীগণের মধ্যে শুদ্ধা’ (৭/৯৫/২)। অথচ সরস্বতী ১,৯০০ খ্রীষ্টপূর্বাব্দের অনেক আগে থেকেই স্রোত হারিয়ে মরে যেতে শুরু করে। তার একটা ধারা পশ্চিমে সিন্ধু নদীতে অপর একটি ধারা পূর্বে যমুনা নদীতে মিলিত হয়। এর ফলে তার মৃত্যু নিশ্চিত হয়।
সুতরাং প্রশ্ন আসে যে, ঋগ্বেদ যদি সভ্যতার ক্ষয়ের সময় একটা ধর্মীয় সংস্কার আন্দোলনের মধ্য দিয়ে রচিত হয় তবে সেখানে স্রোতস্বিনী সরস্বতী নদীর স্তুতিতে মন্ত্র পাই কীভাবে? এর সহজ উত্তর হচ্ছে যেহেতু ঋগ্বেদ ধর্মসংস্কারের ফসল সুতরাং বৈদিক সংস্কারকরা তাদের নিজেদের সংস্কারকে বৈধতা দেওয়ার প্রয়োজনে পুরাতন অনেক মন্ত্রকে গ্রহণ বা রক্ষা করেছে। এ বিষয়ে আমাদের গ্রন্থ ‘আর্যজন ও সিন্ধু সভ্যতা’য় আলোচনা করেছি। পৃথিবীর সকল ধর্মীয় আন্দোলনে নানান রূপে পূর্বতন বা আদি ধর্মের বহু উপাদানকে গ্রহণ বা রক্ষা করতে দেখা যায়। সুতরাং ঋগ্বেদকেও দেখতে হবে সেভাবে। তা না হলে ঋগ্বেদের সঠিক ব্যাখ্যা অসম্ভব হয়ে পড়ে। ফলে নানান গোঁজামিল দিতে হয়।
এর আগে আমি বলেছি যে ঋগ্বেদের যুদ্ধ-নির্ভরতাকে সিন্ধু সভ্যতার শান্তিপূর্ণ রূপের সঙ্গে মিলানো যায় না। এই রকম যুদ্ধংদেহী ঋষিদের বা বৈদিক শক্তির পক্ষে বিশাল অঞ্চলব্যাপী বিস্তৃত সিন্ধু সভ্যতার মতো মূলত অহিংস একটা সভ্যতাকে কীভাবে নির্মাণ করা সম্ভব? কাণ্ডজ্ঞান কী বলে? তাহলে ঋগ্বেদে যু্দ্ধের এত বিবরণ, যুদ্ধজয়ের জন্য দেবতাদের নিকট এত আকুতি — এগুলি কেন? এই প্রশ্নের উত্তরও ঋগ্বেদেই আছে।
বৃত্র-বিরোধী বৈদিক আন্দোলনের উদ্ভব ও ইন্দ্রের উথান সম্পর্কে কিছু ধারণা পাবার জন্য ঋগ্বেদের একজন প্রসিদ্ধ ঋষি বিশ্বামিত্রের রচিত পুরো সূক্তটি উদ্ধৃত করা যাক :
‘১। হে ইন্দ্র! বৃত্র বিনাশকর বললাভের জন্য ও শত্রু সেনার অভিভবের জন্য তোমাকে প্রবর্তিত করছি। ২। হে শতক্রতু! স্তোতাগণ তোমার মন চক্ষু প্রীত করে আমাদের অভিমুখে প্রেরণ করুক। ৩। হে শতক্রতু! আমরা গর্বিত শত্রুদের অভিভবকর যুদ্ধে সমস্ত স্তুতি দ্বারা তোমার নাম কীর্তন করব। ৪। ইন্দ্র সকলের স্তুতিযোগ্য, অপরিমিত তেজবিশিষ্ট এবং মনুষ্যদের স্বামী, আমরা তার স্তুতি করছি। ৫। হে ইন্দ্র! বৃত্রকে বিনাশ করবার জন্য এবং যুদ্ধে ধন লাভের জন্য বহু লোকের আহূত ইন্দ্রকে আহ্বান করছি। ৬। হে শতক্রতু! তুমি যুদ্ধে শত্রুদের অভিভবকারী হও, বৃত্রকে বিনাশ করবার জন্য আমরা তোমাকে প্রার্থনা করছি। ৭। হে ইন্দ্র! যারা ধনে, যুদ্ধে, বীরসমূহে ও বলে আমাদের অভিমানী শত্রু তাদের পরাজিত কর। ৮। হে শতক্রতু! আমাদের আশ্রয় দানের জন্য অতিশয় বলবান, দীপ্তিযুক্ত, স্বপ্ন নিবারক সোম পান কর। ৯। হে শতক্রতু! পঞ্চজনে যে সকল ইন্দ্রিয় আছে, আমি সেগুলি তোমারই বলে জানি। ১০। হে ইন্দ্র! প্রভূত অন্ন তোমার নিকট গমন করুক, শত্রুদের দুর্ধর্ষ ধন আমাদের প্রদান কর। আমরা তোমার উৎকৃষ্ট বল বর্ধিত করব। ১১। হে শক্র! নিকট অথবা দূর দেশ হতে আমাদের অভিমুখে এস। হে বজ্রবান ইন্দ্র! তোমার যে উৎকৃষ্ট স্থান আছে সেখান হতে এ যজ্ঞে এস।’ (৩ মণ্ডল, ৩৭ সূক্ত)*
-------------------------------------------------------------------------------------------------------
* ঋগ্বেদ সংহিতা (প্রথম খণ্ড), রমেশচন্দ্র দত্তের অনুবাদ অবলম্বনে, হরফ প্রকাশনী, কলকাতা, ১৯৮৭
-------------------------------------------------------------------------------------------------------
যারা ঋগ্বেদ পাঠ করেছেন তারা সবাই জানেন যে, যুদ্ধ দেবতা ইন্দ্র হচ্ছে প্রধান বৈদিক দেবতা। সুতরাং ঋগ্বেদে তার মর্যাদা সর্বোচ্চ। হিন্দু শাস্ত্র সম্পর্কে মোটামুটি ধারণা রাখেন এমন সবাই ঋষিদের মধ্যে বিশ্বামিত্রের মর্যাদা সম্পর্কেও জ্ঞাত। এখন সেই ঋষি স্পষ্টভাবে বলছেন কেন দেবতা ইন্দ্রের পূজা প্রবর্তন করা হয়েছে। সেই কারণ হচ্ছে বৃত্র বধ করা। সুতরাং সমগ্র বৈদিক আন্দোলনের কেন্দ্রীয় প্রণোদনা আমাদের নিকট ঋষি স্পষ্ট করে ব্যক্ত করলেন। অর্থাৎ বৃত্র বধের উদ্দেশ্যেই মূলত যুদ্ধ দেবতা ইন্দ্রের পূজা প্রবর্তন। এক অর্থে ঋগ্বেদ যেন ইন্দ্র আর বৃত্রের মধ্যকার সংঘাত এবং অবশেষে পরাক্রান্ত বৃত্র সংহারের মধ্য দিয়ে ইন্দ্রের গৌরব কীর্তনে রচিত এক মহাকাব্য। মহাকাব্যে যেমন মূল নায়ক এবং খল নায়কের বাইরেও আরও অনেক চরিত্র থাকে, থাকে আরও অনেক কাহিনীর বর্ণনা তেমন ঋগ্বেদেও আছে আরও অনেক দেবতা ও দানবের আখ্যান, দেবতাদেরও কারও উন্নয়ন এবং কারও অবনমন এবং ইন্দ্র ও বৃত্র কিংবা দেবতাদের বিষয় ছাড়াও আরও বহু বিষয় নিয়ে রচিত মন্ত্র। তবে মনে রাখতে হবে দেবতা ইন্দ্র এবং তার শত্রু বৃত্র বধই হচ্ছে ঋগ্বেদের মূল ভরকেন্দ্র যাকে কেন্দ্র করে বৈদিক বিশ্ব আবর্তিত।
সুতরাং বৃত্রের স্বরূপ উদ্ঘাটন করতে পারলেই ঋগ্বেদের রহস্যের দরজা খুলে যায়। এ বিষয়ে ‘আর্যজন ও সিন্ধু সভ্যতা’সহ আমাদের বিভিন্ন লেখায় বিস্তারিত আলোচনা করায় এখানে এ বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনার প্রয়োজন দেখি না। এখানে সংক্ষেপে শুধু এটুকু বলি যে, বৃত্র হচ্ছে নদীতে দেওয়া জলকপাট বা sluice-gate যুক্ত বাঁধ। সিন্ধু সভ্যতায় নদীনিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থার অস্তিত্বের কথা ইতিপূর্বে উল্লেখ করেছি। জনসমর্থন লাভের প্রয়োজনে একটা পর্যায়ে জলকপাট ও নদী রোধক বাঁধকে সিন্ধু সভ্যতার ধর্মীয় বিশ্বাসের অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছিল বলে আজ আমরা ধারণা করি। ফলে বাঁধ বা জলকপাটকে দৈব রূপ দেওয়া হয়েছিল অর্থাৎ বাঁধের দেবতাও ছিল।
একটা সময়ে যখন নদীনিয়ন্ত্রণের এই কৃত্রিম ব্যবস্থা ভেঙ্গে পড়তে থাকে তখন এক বিরাট জনগোষ্ঠী যে এই ব্যবস্থার চূড়ান্ত অবসান চেয়েছিল সেটাকেই স্বাভাবিক মনে হয়। কিন্তু ধর্মের অংশ নদীনিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থাকে ধ্বংস করতে হলে তাদের জন্য একটা পাল্টা ধর্ম প্রবর্তনের জন্য পুরাতন ধর্মের সংস্কার ছিল অপরিহার্য। এভাবে নদীনিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থার সঙ্গে সংযুক্ত পুরাতন দেবতাদের কাউকে অবনমিত এবং কাউকে দানবে পরিণত করে পুরাতন ধর্মের সংস্কারের মাধ্যমে তার বদলে একটা নূতন ধর্ম প্রবর্তন করা হল। এভাবে বাঁধের দেবতাকে বৃত্র হিসাবে উল্লেখ করে তাকে সংহার তথা ধ্বংসের লক্ষ্যে একটা নূতন আন্দোলন গড়ে তোলা হল। সুতরাং বৈদিক পক্ষের প্রধান দেবতা যেমন যুদ্ধ দেবতা ইন্দ্র তেমন বৈদিক পক্ষের প্রধান শত্রু হচ্ছে বৃত্র, যাকে ঋগ্বেদে কখনও ‘দেব’ (হে ইন্দ্র! যখন সেই এক দেব বৃত্র তোমার বজ্রের প্রতি আঘাত করেছিল : ১/৩২/১২) বলা হলেও তাকে দানবের জায়গায় অবনমিত করা হয়েছে।
ঋগ্বেদের সঙ্গে সিন্ধু সভ্যতার সম্পর্কের প্রশ্নে অনেকের একটা আপত্তি হল এই যে ঋগ্বেদে যেভাবে যুদ্ধ এবং ‘পুর’ বা নগর ধ্বংসের চিত্র তুলে ধরা হয় প্রত্নতত্ত্ব তার সপক্ষে কোনও প্রমাণ উপস্থিত করে না। এ প্রসঙ্গে আমাদের বক্তব্য হল বৈদিক আন্দোলনের প্রধান লক্ষ্য মানুষ হত্যা বা নগর ধ্বংস নয়, বরং বৃত্র হত্যা তথা বাঁধ ধ্বংস বা নদীনিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা ধ্বংস। মনে রাখতে হবে একই সমাজের একটি জনগোষ্ঠীর মধ্যকার একটা গৃহযুদ্ধের চিত্র আমরা ঋগ্বেদ থেকে পাই যেখানে প্রধান লক্ষ্য মোটেই প্রতিপক্ষের নগর ধ্বংস বা লোকহত্যা নয়, বরং জলকপাট সংযুক্ত বাঁধ ধ্বংসের মাধ্যমে নদীনিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থাকে ধ্বংস করা। সুতরাং শত্রু সৈন্য হত্যা বা নগর ধ্বংসের যে চিত্র আমরা পাই সেগুলি অধিকাংশ ক্ষেত্রে প্রতীকী মাত্র। আর মনে রাখতে হবে সিন্ধু সভ্যতার সুদীর্ঘ কালব্যাপী মূলত অহিংস সংস্কৃতিতে অভ্যস্ত জনগণের নিকট একটা ছোট যুদ্ধ, রক্তপাত এবং ধ্বংসও বিরাট রূপ নিয়ে দেখা দিতে পারে। এর প্রকাশ যে আমরা ঋগ্বেদে পাই সেটা মনে করার কারণ আছে।
সবচেয়ে বড় কথা ঋগ্বেদের বিভিন্ন শব্দের এখন যে অর্থ করা হয় সেগুলি যে সম্পূর্ণ সঠিক তার কী মানে আছে? ‘আর্যজন ও সিন্ধু সভ্যতা’য় এ সম্পর্কে আলোচনা করেছি। যেমন ‘অয়স’ শব্দের অর্থ এখন লৌহ করা হলেও ঋগ্বেদের কালে অগ্নিদগ্ধ করে যে কোনও কঠিন বস্তুকে বুঝাতে অয়স শব্দের ব্যবহার হত। এই কারণে অয়স নির্মিত নগর (ঋগ্বেদ : ৭/৩/৭) বলতে লৌহ দ্বারা নির্মিত নগর নয়, বরং পাকা ইটে তৈরী নগরকে বুঝতে হবে। একই ভাবে অয়স নির্মিত ‘উজ্জ্বল কলস’ (ঋগ্বেদ : ৫/৩০/১৫) বলতে তামা বা ব্রোঞ্জ নির্মিত কলস বুঝতে হবে। সুতরাং ‘পুর’ বললেই আমরা সর্বদা নগর বুঝব কেন? প্রত্নতত্ত্ববিদ অধ্যাপক মিশেল ড্যানিনো তার এক বক্তৃতায় ‘পুর’কে যে কোনও ধরনের বসতিও বলতে চেয়েছেন (Michel Danino Part 6 of 27 : https://www.youtube.com/watch?v=QBCmXr8_V28)। সুতরাং ঋগ্বেদে যখন ইন্দ্রকে পুরন্দর বলা হয় তখন সেটার অর্থ বসতি বিনাশকারীও হতে পারে।
যাইহোক, নদীনিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা যা ইতিমধ্যে ভেঙ্গে পড়তে থাকলেও কিছু ক্ষেত্রে টিকেছিল তার ধ্বংস সাধনের পর ক্ষয়িষ্ণু সভ্যতার অবশিষ্টটুকুরও ধ্বংস হতে খুব বেশী সময় লাগে নাই। মনে রাখতে হবে বিশেষ করে জলকপাট রক্ষায় নিয়োজিত প্রতিপক্ষের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাকে ধ্বংস করতে পারলে জলকপাট ধ্বংস করা খুব সহজ কাজ হয়ে পড়ে। আর জলকপাট ধ্বংস হলে নদীনিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত কৃত্রিম জলসেচ ব্যবস্থা এমনিতেই ভেঙ্গে পড়ে। বিস্তীর্ণ অঞ্চলে জলসেচ না থাকায় যখন গ্রাম, নগর বা বসতিসমূহ ক্রমান্বয়ে পরিত্যক্ত হয়েছে তখন সভ্যতা এমনিতেই ক্রমশ পরিত্যক্ত এবং ধ্বংস হয়েছে। এর জন্য আলাদাভাবে ধ্বংসকার্য চালাবার প্রয়োজন হয় নাই। আমাদের নিকট এটাই হচ্ছে প্রত্নতত্ত্বের বিচারে সিন্ধু সভ্যতার ধ্বংসে যুদ্ধের ভূমিকা সেভাবে না থাকবার মূল কারণ।
সুতরাং প্রকৃত অর্থে যুদ্ধও নয়, প্রাকৃতিক বা জলবায়ুগত পরিবর্তনও নয়, বরং নদীনিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থার ক্রমবর্ধমান সঙ্কটের প্রতিক্রিয়া হিসাবে তার বিরুদ্ধে মানুষের বিদ্রোহ ও তার ধ্বংসসাধন সিন্ধু সভ্যতার চূড়ান্ত ধ্বংসের মূল কারণ। এটা আমাদের কাছে স্পষ্ট যে, যদি পৃথিবীর জলবায়ু পরিবর্তন সিন্ধু সভ্যতার কৃষির বিপর্যয় তথা খাদ্যোৎপাদন ব্যবস্থা ধ্বংসের কারণ হত তবে ধর্মসংস্কারের মাধ্যমে বৈদিক আন্দোলন সংগঠন ও যুদ্ধের কোনও প্রয়োজনই হত না। ফলে ঋগ্বেদ রচনাও হত না। কারণ মানুষ রচিত কোনও কৃত্রিম ব্যবস্থা না থাকায় তার বিরুদ্ধে ক্ষোভের প্রকাশ থেকে একটা ধর্মসংস্কারেরও প্রয়োজন বোধ জন্মাতে পারত না। মানুষের হস্তক্ষেপে একটা ব্যবস্থা প্রবর্তিত হবার পর যখন তার ইতিবাচক ভূমিকা হারিয়ে সেটা মানুষের জন্য সঙ্কট সৃষ্টি করেছিল তখন যারা পাল্টা হস্তক্ষেপ দ্বারা এই ব্যবস্থাকে ধ্বংস করে অতীতের বন্ধনমুক্ত জলপ্রবাহের স্বর্ণযুগে ফিরে যেতে চেয়েছিল ঋগ্বেদ হল তাদের স্বপ্নগাথা।
সুতরাং সভ্যতার মানদণ্ডে ঋগ্বেদ হচ্ছে পশ্চাদমুখী যাত্রা; এটা সভ্যতার ক্রিয়া নয়, বরং প্রতিক্রিয়া। এই প্রতিক্রিয়ার ফলশ্রুতি হল বৈদিক বিজয় পরবর্তী কালে ভারতবর্ষে ধর্মের ক্রমিক শক্তিবৃদ্ধি। অথচ সিন্ধু সভ্যতার প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনাদি আমাদের সামনে একটা সম্পূর্ণ ভিন্ন চিত্র উপস্থিত করে।
সিন্ধু সভ্যতায় ধর্ম কিংবা পুরোহিত শ্রেণীর গৌণ দশার জন্য ঋগ্বেদের সাক্ষ্যই যথেষ্ট। সমগ্র ঋগ্বেদ বহু বিষয়েই একটা সভ্য সমাজের বিশদ চিত্র উপস্থিত করে। অথচ সেখানে রাজনৈতিক বিষয়াদি কিংবা রাষ্ট্রশাসন সংক্রান্ত বিষয়াদির উল্লেখ প্রায় নাই বললেই চলে। এটা আমাদেরকে এই সিদ্ধান্তে নিয়ে যায় যে, যে ঐতিহ্যিক পুরোহিত শ্রেণী থেকে বৈদিক পুরোহিত বা ঋষিদের আগমন সেই পুরাতন পুরোহিত শ্রেণীরও রাষ্ট্রশাসনে কোনও ভূমিকা ছিল না। বৈদিক ঋষিরা সনাতন পুরোহিত শ্রেণী থেকে আসায় তাদের রাজনীতি বা রাষ্ট্রশাসনের বিষয়াদি নিয়ে এই ধরনের নীরবতা। অথচ তারা একটা যুদ্ধকে বৈধতা দানের জন্য ধর্মসংস্কার করছেন, যুদ্ধের মতো ঘোরতর রাজনীতি নিয়ে মাতামাতি করছেন। যুদ্ধকে সমর বিজ্ঞানে অনেকেই রাজনীতির সম্প্রসারণ বা সশস্ত্র রাজনীতিও বলেন। সেই যুদ্ধের সপক্ষে যারা মন্ত্র রচনা করে যু্দ্ধের জন্য সামাজিক মনস্তত্ত্ব তৈরী করছেন তারা রাষ্ট্রশাসন সম্পর্কে যখন কোনও কিছু বলেন না তখন ধরে নিতে হবে ঐতিহ্যিকভাবে এটা তাদের অধিকার বহির্ভূত বিষয়। অর্থাৎ সিন্ধু সভ্যতার রাষ্ট্রশাসনের সঙ্গে সেখানকার পুরোহিত শ্রেণীর কোনও সম্পর্কই ছিল না। এটা তাদের অভিজ্ঞতা এবং এখতিয়ার বহির্ভূত বিষয় বলে তাদের থেকে আসা বৈদিক ঋষিরা সিন্ধু সভ্যতার রাষ্ট্র সম্পর্কে কথা প্রায় বলেনই নাই। ঋগ্বেদে সমিতি, সভা, পঞ্চজন ইত্যাদির উল্লেখ আমাদেরকে রাষ্ট্রব্যবস্থা সম্পর্কে তেমন কোনও স্পষ্ট চিত্র দেয় না।
সুতরাং আমরা সিন্ধু সভ্যতার রাষ্ট্রশাসনের ধর্মমুক্ত রূপ সম্পর্কে একটা চিত্র কল্পনা করতে পারি। ‘আর্যজন ও সিন্ধু সভ্যতা’য় আমরা সেক্যুলার শ্রেণীর হাতে রাষ্ট্রক্ষমতা থাকার সপক্ষে আমাদের অনুমানের কথা বলেছি। সেখানে একটা গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থার অস্তিত্বও দেখতে পেয়েছি। চঞ্চল এবং আমার যৌথভাবে লিখা গ্রন্থ বা রচনাগুলিতে এ বিষয়ে অনেক কথা বলেছি। বিশেষত আমার লিখা ‘সিন্ধু সভ্যতার রাষ্ট্র-দর্শন’ (Link : http://www.bangarashtra.net/article/1333.html)-এ গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা এবং অলোকবাদী ধর্মবিশ্বাসমুক্ত একটা সভ্যতার চিত্র অধিকতর স্পষ্ট করে আঁকতে চেয়েছি। চঞ্চল এবং আমার যৌথভাবে সাম্প্রতিক লিখা Decline of Indus Civilization and Vedic Upheaval-এও বিষয়গুলিকে আলোচনায় এনেছি। তবে সিন্ধু সভ্যতার ক্রমবর্ধমান প্রত্নতাত্ত্বিক আবিষ্কারসমূহ পর্যবেক্ষণ এবং প্রাচীন ভারতবর্ষের ইতিহাসের অনুধ্যান আমাকে এ সিদ্ধান্তে নিয়েছে যে, সিন্ধু সভ্যতার গৌরবদীপ্ত কালে রাজতন্ত্রের যেমন কোনও জায়গা ছিল না তেমন সভ্যতার মূলধারায় অলোকবাদী ধর্মেরও জায়গা ছিল না।
বস্তুত প্রত্নতত্ত্ব থেকে এটা স্পষ্ট যে, সিন্ধু সভ্যতার কোনও পর্যায়েই রাজতন্ত্রের অস্তিত্ব ছিল না। বহসংখ্যক প্রত্নতত্ত্ববিদ সিন্ধু সভ্যতার নিদর্শনাদি থেকে এ বিষয়ে মোটামুটি একমত। অনুমান করি ভারতবর্ষে পরবর্তী ঐতিহাসিক কালে বিশেষত বৌদ্ধ ধর্ম প্রবর্তক গৌতম বুদ্ধের সময়ে শাক্য, বিদেহ, ভাগ্য, মল্ল (রাজধানী পব), মল্ল (রাজধানী কুশিনারা), লিচ্ছবি (রাজধানী বৈশালী) ইত্যাদি যে সকল প্রজাতন্ত্রের অস্তিত্ব সম্পর্কে আমরা জানতে পারি সেগুলি সবই সিন্ধু সভ্যতার রাষ্ট্রশাসন ব্যবস্থার একটা ধারাবাহিক রূপ। আর্যরা যেমন বহিরাগত নয় তেমন এই সকল প্রজাতন্ত্রও বহিরাগতদের দ্বারা প্রতিষ্ঠিত নয়। অর্থাৎ ঐতিহাসিক কালের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা এবং প্রজাতন্ত্রসমূহ সিন্ধু সভ্যতার উত্তরাধিকার।
সিন্ধু সভ্যতায় গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার অস্তিত্বের সম্ভাবনা বা বাস্তবতা নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা এখানে করব না। এটার খুব একটা প্রয়োজনও নাই। যারা সিন্ধু সভ্যতার বিষয়ে খোঁজখবর রাখেন, আশা করি তারা এ বিষয়ে প্রত্নতাত্ত্বিক বা পণ্ডিতদের অভিমত জানেন। সমগ্র সিন্ধু সভ্যতায় ক্ষমতা কিংবা সম্পদের অতিকেন্দ্রীভবনের কোনও লক্ষণ দেখা যায় না। নগরগুলিতে বাসগৃহের সুষম বিন্যাস একটি লক্ষণীয় দিক। রাজপ্রাসাদ হিসাবে চিহ্নিত করা যায় এমন কোনও ভবনও সমগ্র সিন্ধু সভ্যতা জুড়ে কোথায়ও পাওয়া যায় না। এই বাস্তবতা স্পষ্টতই যে ধরনেরই হোক একটা গণতান্ত্রিক এবং প্রজাতান্ত্রিক রাষ্ট্রের চিত্র উপস্থিত করে। সুতরাং আমাদের সামনে সিন্ধু সভ্যতা এমন এক প্রাচীন সভ্যতার চিত্র আঁকে যেখানে সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী বংশানুক্রমিক রাজা বা সম্রাট ছিল না। পরবর্তী ঐতিহাসিক ভারতবর্ষে রাজতন্ত্রের যে বিকাশ এবং বিস্তারই ঘটুক এটা স্পষ্ট যে সিন্ধু সভ্যতায় রাষ্ট্র ছিল রাজ-শাসনহীন। অর্থাৎ অন্যান্য সভ্যতায় যা-ই থাকুক ভারতবর্ষের সবচেয়ে গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাসের পর্যায়ে রাষ্ট্রশাসনে স্বৈরতন্ত্র এবং রাজতন্ত্রের কোনও স্থান ছিল না। অন্তত প্রত্নতত্ত্বের সাক্ষ্যপ্রমাণকে মানতে হলে আমাদেরকে এই সিদ্ধান্তই টানতে হবে।
(খ) সিন্ধু সভ্যতায় ধর্মের স্থান
এখন সিন্ধু সভ্যতায় ধর্মের অবস্থান সম্পর্কে কিছু কথা বলা যাক। ঋগ্বেদ এবং সিন্ধু সভ্যতার প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনাদি থেকে আমি কয়েকটি সিদ্ধান্তকে যৌক্তিক মনে করি।
প্রথমত, সিন্ধু সভ্যতায় পুরোহিত শ্রেণীর অবস্থান ছিল গৌণ। বিশেষত রাষ্ট্রশাসনে তাদের খুব বেশী হলে অধীনস্থ এবং সহায়কের বেশী কোনও ভূমিকা ছিল না। ধর্ম এবং পুরেহিত শ্রেণীর ভূমিকা বৃদ্ধি সভ্যতার বস্তুগত সঙ্কটের সঙ্গে জড়িত। অর্থাৎ নদী নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থার ক্ষয় বা বিপর্যয়ের ফলে সভ্যতায় যে সঙ্কট বা বিপর্যয় ঘটে তার ফলে ধর্ম ও পুরোহিত শ্রেণীর গুরুত্ব বৃদ্ধি পায়। আমার লেখা ‘সিন্ধু সভ্যতার রাষ্ট্র-দর্শন’-এ সভ্যতা নির্মাণে বলপ্রয়োগের সঙ্গে ধর্মের উত্থান বা বিকাশের সম্পর্কের উপর আলোচনা করেছি। সেটারই জের টেনে এখানে বলতে চাই যে, সঙ্কটের সময়ে সমাজকে নিয়ন্ত্রণের জন্য শাসকদের নিকট ধর্মের গুরুত্ব ক্রমশ বৃদ্ধি পায়। ফলে ধর্মের পাশাপাশি পুরোহিত শ্রেণীরও শক্তি ও মর্যাদা বৃদ্ধি পায়।
দ্বিতীয়ত, সিন্ধু সভ্যতার যে ধর্ম থেকে বৈদিক ধর্মের উত্থান সেটা যে ছিল নিরাকারবাদী এবং মূলত একেশ্বরবাদী তেমন একটা সিদ্ধান্ত ঋগ্বেদের পাঠ থেকে অনায়াসে নেওয়া চলে। এ সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা ‘আর্যজন ও সিন্ধু সভ্যতা’য় কিংবা অন্যান্য রচনায় করায় এখানে এ বিষয়ে বিশদ আলোচনা করা নিষ্প্রয়োজন। তবু এখানে এ প্রসঙ্গে এটুকু বলি যে, সিন্ধু সভ্যতায় বৃহৎ মূর্তির অনুপস্থিতি এবং ঋগ্বেদে তথা বৈদিক ধর্মে মূর্তিপূজার অনুপস্থিতির গুরুত্ব বিশেষভাবে প্রণিধানযোগ্য।
এটা নিশ্চয় তাৎপর্যপূর্ণ যে, আর সব প্রাচীন সভ্যতায় যেখানে রাজা ও দেবতাদের বৃহৎ কিংবা অতিকায় মূর্তির ছড়াছড়ি সেখানে সিন্ধু সভ্যতায় একটিও বৃহৎ মূর্তি বা প্রতিমা নাই। সেটা না রাজা বা সম্রাটের না দেবতার। যেসব ক্ষুদ্র বা ছোট মূর্তি পাওয়া গেছে সেগুলি নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা না করে এক কথায় বলা যায় যে, অত বৃহৎ সভ্যতার রাজকীয় বা দেব-দেবীর মূর্তি কখনই অত ছোট অথবা অযত্নে নির্মিত হতে পারে না। কারণ সভ্যতার নায়করা তথা শাসক শ্রেণী তাদের শক্তি ও সম্পদের বহিঃপ্রকাশ অবশ্যই ঘটাতে চাইবে তাদের যে কোনও বস্তুগত নির্মাণের মধ্য দিয়ে। সুতরাং যেটাকে কেউ কেউ পুরোহিত-রাজা বলতে চান সেটা যে কোনও রাজার মূর্তি যেমন নয় তেমন নৃত্যরত নারীর ব্রো্ঞ্জ মূর্তি কিংবা অযত্নে নির্মিত পোড়া মাটির ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র মাতৃমূর্তি যেগুলিকে বলা হয় সেগুলি যে সিন্ধু সভ্যতার রাষ্ট্র কিংবা যদি রাষ্ট্র কর্তৃক পৃষ্ঠপোষকতাপ্রাপ্ত বা সরকারী কোনও ধর্ম থেকে থাকে তবে তার সঙ্গে যে সম্পর্কিত নয় সে কথা নির্দ্বিধায় বলা যায়।
এমতাবস্থায় সিন্ধু সভ্যতার রাষ্ট্রশাসন এবং সরকারী ধর্ম থেকে দূরবর্তী স্থানে রেখেই এসব মূর্তির সঠিক অবস্থান নির্ণয়ের চেষ্টা করাটা যুক্তিসঙ্গত হবে। ক্ষুদ্র এবং অযত্নে নির্মিত পোড়া মাটির নারী মূর্তিগুলি হয়ত খেলনা অথবা সমাজের পশ্চাৎপদ জনগোষ্ঠীর ধর্মবিশ্বাসের স্মারক। এর বাইরে এগুলির আর কোনও গুরুত্বই থাকবার কারণ নাই।
এখন আমরা যে প্রশ্নের সম্মুখীন হই সেটা হচ্ছে সিন্ধু সভ্যতায় আদৌ কি অলোকবাদে তথা অলৌকিকতায় বিশ্বাসী ধর্মের স্থান ছিল? সত্যি বলতে কী যদি ঋগ্বেদ না থাকত তা হলে হয়ত সহজেই আমরা ঈশ্বর কিংবা দেবতায় বিশ্বাসহীন, অলৌকিক সত্তায় বিশ্বাসহীন এবং লোকবাদ বা বস্তুবাদী দর্শনে বিশ্বাসী একটা সভ্যতার অস্তিত্ব সম্পর্কে সিদ্ধান্ত নিতাম। যে সভ্যতার প্রবল শক্তি, বিপুল সম্পদ ও বিশাল আয়তনের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ রূপ এবং আয়তনের দেব-দেবীর প্রতিমা নাই, মন্দির হিসাবে চিহ্নিত করা যায় এমন কোনও গৃহ নাই সেই সভ্যতায় ধর্মবিশ্বাসের অস্তিত্ব ছিল এমন সিদ্ধান্ত টানাটা কি খুব কঠিন হয়ে পড়ে না? হ্যাঁ, বলা হবে বহু সংখ্যক ক্ষুদ্র সিলের কথা যেগুলিতে বিভিন্ন প্রাণী কিংবা অনুমেয় দেবতার চিত্র আছে। বলা হয় এগুলির অন্তত কিছু সংখ্যক ধর্মবিশ্বাসের স্মারক।
সিন্ধু সভ্যতার লিপির পাঠোদ্ধার না হওয়ায় স্বাভাবিকভাবে সিল নিয়ে অনেক রহস্য রয়েছে। সিলগুলিতে লিপির খোদাই ছাড়াও বিভিন্ন প্রাণীর চিত্রও রয়েছে। শিংবিশিষ্ট মানুষের এমন চিত্র আছে যেটাকে অনেক পণ্ডিত পশুপতি কিংবা শিবের সম্ভাব্য আদিরূপ হিসাবে ব্যাখ্যা করেন। যাইহোক, সিলের ব্যবহার এবং তাৎপর্য নিয়ে যথেষ্ট প্রশ্ন আছে এবং যতদিন সিন্ধু লিপির পাঠোদ্ধার না হবে ততদিন হয়ত এ সকল প্রশ্ন রইবে। তবে একটা বিষয় অনুমান করা চলে যে, বিভিন্ন বাণিজ্যিক কাজে এগুলির ব্যবহার ছিল। হতে পারে রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ দালিলিক স্বাক্ষরের কাজেও সিলের ব্যবহার ছিল। এমনকি কিছু ক্ষেত্রে ধর্মীয় বিষয়বস্তুর প্রকাশও কিছু সংখ্যক সিলে থাকতে পারে।
হয়ত সেটা ছিল খুব ক্ষুদ্র পরিসরে দেবতার প্রতীক নির্মাণের প্রতি অনুমোদনের প্রকাশ। অর্থাৎ এভাবে খুবই সীমাবদ্ধ এবং ক্ষুদ্র আয়তনে দেবতার প্রতীককে স্থান দান। যদি এখানে ধর্মের কোনও সম্পর্ক থাকে তবে সেটাকে কঠোরভাবে রাষ্ট্র নিয়ন্ত্রিত একটি বিষয় হিসাবে বিবেচনা করতে হবে। এটা খুবই স্বাভাবিক যে, বিভিন্ন উপজাতির ভিতরে দেবতার ধারণা বিকাশ লাভ করলে উপজাতীয় স্বাতন্ত্র্যের প্রতীক হিসাবে উপজাতিসমূহের স্বতন্ত্র দেবতার মূর্তি দেখা দিবে। এটা বৃহত্তর সামাজিক ঐক্য প্রতিষ্ঠার পথে দুর্লঙ্ঘ বাধা সৃষ্টি করে। অন্যান্য সমাজে এই সমস্যার সমাধান করা হয় যুদ্ধের মধ্য দিয়ে অন্যান্য উপজাতিকে পরাস্ত করে জয়ী উপজাতির দেবতাকে প্রধান দেবতা হিসাবে সবার উপর চাপিয়ে দিয়ে এবং পরাজিত উপজাতিদের দেবতাসমূহকে ক্ষেত্রবিশেষে বৃহত্তর ধর্মের কাঠামোর ভিতরে অধঃস্তন দেবতা হিসাবে গ্রহণ করে। সিন্ধু সভ্যতায় যুদ্ধের ভূমিকা একেবারে ছিল না এটা ভাবাটা অযৌক্তিক হবে বলেই মনে হয়। তবে সেটা থাকলেও তা যে খুবই গৌণ ছিল সেটা প্রত্নতাত্ত্বিকভাবে প্রমাণিত। সুতরাং এখানে সামাজিক ঐক্য প্রতিষ্ঠার জন্য দেবতাদের মূর্তি-বিহীন পূজা-নির্ভর ধর্ম গড়ে তোলা হয়েছিল। বরুণকে কেন্দ্র করে গড়ে তোলা এই নিরাকার দেবতাদের উপাসনার মধ্য দিয়ে ক্রমে একেশ্বরবাদী ধারণা প্রতিষ্ঠা লাভ করেছিল। এটা ছিল শান্তিপূর্ণভাবে সামাজিক ঐক্য গড়ে তোলায় সহায়ক। রাষ্ট্রশাসকরা এই কারণে এই ধরনের একটি ধর্মকে হয়তবা অনুমোদন কিংবা পৃষ্ঠপোষকতা দিয়েছিল।
মূলত এই ধরনের বক্তব্য চঞ্চল এবং আমি The Aryans and the Indus Civiliztion এবং ‘আর্যজন ও সিন্ধু সভ্যতা’য় দিয়েছি। কিন্তু সাম্প্রতিক কালে আমাদের মনে হচ্ছে এই পৃষ্ঠপোষকতা সেভাবে যদি এসে থাকে তবে সেটা এসেছে অনেক পরবর্তী কালে। যখন নদীনিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থার সঙ্কটজনিত কারণে সভ্যতার শক্তি ক্ষয় হয়েছে তখন শাসক শ্রেণী সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় ঐক্য ও সংহতি রক্ষার জন্য ক্রমে ধর্মের প্রয়োজন অনুভব করেছে। ফলে এ্ই ধরনের বরুণ কেন্দ্রিক নিরাকারবাদী কোনও ধর্ম গড়ে তোলায় পুরোহিত শ্রেণীকে উৎসাহ দিয়েছে অথবা যদি সমাজের প্রান্তে তেমন ধরনের কোনও ধর্ম ভ্রূণ আকারে কিংবা দুর্বল বা ক্ষীণ ভাবে থেকে থাকে তবে তাকে পৃষ্ঠপোষকতা দিয়েছে।
এ প্রসঙ্গে প্রত্নতত্ত্ববিদ মাইকেল জ্যানসেনের মন্তব্যটি খুবই তাৎপর্যপূর্ণ হতে পারে। মহেঞ্জোদাড়োর নগর-দুর্গের ‘গ্রেট বাথ’ যেটাকে বলা হয় সেটা যে মূল কাঠামোগত পরিকল্পনার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ নয় সে কথা তিনি বলছেন। তিনি বলছেন যে, এটা ২৩০০ খ্রীষ্টপূর্বাব্দের আশপাশে নির্মিত হয়েছিল (Michael Jansen, "Mohenjo-Daro, Indus Valley Civilization: Water Supply and Water Use in One of the Largest Bronze Age Cities of the Third Millennium BC," in, eds, Terje Tvedt and Terje Oestigaard, A History of Water, A, Series III, Vol. 1: Water and Urbanism, I.B. Tauris, 2014, pp. 60-63.{Available from internet})।
‘গ্রেট বাথকে’ প্রত্নতাত্ত্বিকরা সাধারণত বিদ্যমান ধর্মের অংশ হিসাবে অনুমান করেন। হতে পারে যে, কৃত্রিম উপায়ে জলকপাট, বাঁধ ও বিরাট বিরাট জলাধারযু্ক্ত নদীনিয়ন্ত্রণ-ভিত্তিক সভ্যতা নির্মাণের কয়েক শত বৎসর পরই তাতে সঙ্কট দেখা দিচ্ছিল; ফলে জনমানস নিয়ন্ত্রণের সহজ হাতিয়ার হিসাবে ধর্মের গুরুত্ব দেখা দেয়। সুতরাং মহেঞ্জোদাড়োর জলাধারটি ধর্মীয় অনুষ্ঠানের প্রয়োজনে পরবর্তী সময়ে নির্মিত হয়ে থাকতে পারে।
(গ) প্রাচীন ইতিহাসের দিকে একটু দৃষ্টি দেওয়া যাক
প্রাচীন এমন একটি সভ্যতার দৃষ্টান্ত কি দেওয়া যাবে যেখানে ধর্ম কিংবা ধর্মের অংশ হিসাবে দেব-দেবীর মূর্তি পূজার আয়োজন ছিল না? সুতরাং ছিল না দেব-দেবীর প্রতীক স্বরূপ তাদের প্রতিমা এবং তাদের প্রতিমা রাখবার জন্য মন্দির? না, এমন একটি সভ্যতার চিহ্নও আমরা আজ অবধি পাই নাই একমাত্র সিন্ধু সভ্যতা ব্যতিরেকে। তবে কি বলব যে সিন্ধু সভ্যতায় অলৌকিক শক্তি নির্ভর কোনও ধর্মই ছিল না?
তবে সে প্রশ্নের উত্তরে যাবার আগে এ প্রশ্ন করা যাক, প্রাচীন পৃথিবীতে সিন্ধু সভ্যতা ব্যতিরেকে আমরা এমন আর কি কোনও সভ্যতার চিহ্ন খুঁজে পেয়েছি যেখানে একটা রাষ্ট্রের উপযোগী সেনাবাহিনী কিংবা যুদ্ধ নির্ভরতার প্রত্নতাত্ত্বিক প্রমাণ পাওয়া যায় না? কিংবা আসা যাক শাসনব্যবস্থার প্রশ্নে। দশ থেকে বারো কিংবা সাড়ে বারো লক্ষ বর্গকিলোমিটার বিস্তৃত একটা রাষ্ট্র একজন রাজা বা সম্রাট ছাড়া কীভাবে শাসিত হত, কীভাবে তার রাষ্ট্রীয় ঐক্য বা অখণ্ডতা রক্ষা করত? সমকালীন মিসর কিংবা মেসোপটেমিয়া এমনকি কিছু পরবর্তী কালের প্রাচীন চীনের সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী রাজতন্ত্রের সঙ্গে কি সিন্ধু সভ্যতাকে মিলানো যায়?
যুদ্ধ নির্ভর রাজতন্ত্র নয়, ধর্মীয় শক্তি তথা পুরোহিত শ্রেণীও নয়। তা হলে সিন্ধু সভ্যতার মতো এক মহাকায় সভ্যতার নির্মাতা বা নায়ক কারা? তারা যারাই হোক তারা যে এক অতুলনীয় সভ্যতা নির্মাণের কৃতিত্বের দাবীদার তাতে কোনই সন্দেহ নাই। সমগ্র সভ্যতার প্রাপ্ত বসতি ও নগরগুলির উপর যেটুকু খননকাজ হয়েছে তা থেকে যে বিষয়টি সবচাইতে বেশী চোখে পড়ে সেটি হচ্ছে বিশাল সভ্যতার সর্বত্র একটি প্রচণ্ড শক্তিশালী কেন্দ্রীয় কর্তৃত্বের উপস্থিতি। অথচ নির্দিষ্ট কোনও নগর, বাসগৃহ বা ভবনে তার অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যায় না। কিন্তু তার পরিকল্পনা এবং পরিচালনার প্রায় অভিন্ন রূপের মাধ্যমে সর্বত্র তা যেন এক অদৃশ্য শক্তিরূপে অস্তিত্বমান ছিল।
বিশাল অঞ্চলব্যাপী বিস্তৃত সভ্যতার সকল নগর বা বসতিগুলিকে চেনা যায় তাদের পরিকল্পনা এবং কিছু বৈশিষ্ট্যের অভিন্নতা দিয়ে। নগর পরিকল্পনা নিয়ে অনেক কথা বলা যায়। কিন্তু এ প্রসঙ্গে আলোচনা করতে গেলে অনেকটা সময় লাগবে। আজকের এই আলোচনার জন্য আমি সেটাকে খুব দরকারীও মনে করছি না। এ নিয়ে অনেক পণ্ডিত অনেক আলোচনা করেছেন। এখানে এ প্রসঙ্গে এটুকু বলি যে, প্রায় অভিন্ন পরিকল্পনা অনুযায়ী নগরগুলি নির্মিত। প্রায় সোজা রাস্তার দু’পাশ দিয়ে পাকা বাসগৃহ তৈরী। সকল নাগরিকের জন্য পর্যাপ্ত ব্যবহার্য জল সরবরাহের ব্যবস্থা, নগরের সকল বাসগৃহ থেকে আন্ডারগ্রাউন্ড ড্রেনের সাহায্যে পয়োনিষ্কাশনের নিখুঁত ব্যবস্থা, নগরগুলির পরিচ্ছন্নতা রক্ষার নিয়মিত বন্দোবস্ত ইত্যাদি প্রমাণ করে অন্তত অধিকাংশ নাগরিকের সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যের প্রতি রাষ্ট্র কতখানি মনোযোগী ছিল সেটা। কোনও নগরে বস্তির চিহ্ন পাওয়া যায় না। প্রাম ও নগরে বৈষম্য নিশ্চয় ছিল। মানুষের পুষ্টিমানের বিচারে সেটা যে আকাশ-পাতাল ছিল না সেটা অনুমান করা যায় সিন্ধু সভ্যতা থেকে প্রাপ্ত বেশ কিছুসংখ্যক নরকঙ্কালের উপর বিজ্ঞানীদের পরীক্ষা থেকে। অন্যান্য সভ্যতার ধনী-দরিদ্রদের কঙ্কালের পরীক্ষা থেকে পুষ্টিমানে যে ধরনের পার্থক্যের চিহ্ন পাওয়া যায় সে ধরনের পার্থক্য সিন্ধু সভ্যতার নরকঙ্কাল থেকে পাওয়া যায় না।
সকল নগরে নগর-দুর্গ বলা হয় এমন একটি আলাদা প্রাচীর ঘেরা স্থান আছে। অনুমান করা যায় এখানে নগর বা রাষ্ট্রের প্রশাকদের বাসস্থান এবং কার্যালয় ছিল। কিন্তু সেটা সাধারণ নাগরিকদের সঙ্গে নগর-কর্তৃত্বের বিরাট ব্যবধানের চিহ্ন বহন করে না।
যাইহোক, নগর পরিকল্পনার অভিন্ন রূপ একটি কেন্দ্রীয় কর্তৃত্বের অস্তিত্বকে প্রমাণ করে। এই অভিন্নতা শুধু নগর বা বসতির পরিকল্পনায় সীমাবদ্ধ নয়। সমস্ত সভ্যতার বিশাল অঞ্চল জুড়ে সর্বত্র একই বাটখারা বা ওজন, একই মাপ এবং এমনকি একই মাপের ইটের ব্যবহার, একই ধরনের সিল এবং একই ধরনের লিপির ব্যবহার এবং একই ধরনের বিভিন্ন দ্রব্যের ব্যবহার খুবই লক্ষণীয়। এগুলি দ্বারা বিশাল অঞ্চলব্যাপী বিস্তৃত একটি সভ্যতাকে সহজেই চিহ্নিত করা যায়। অর্থাৎ অসাধারণভাবে ক্ষমতাসম্পন্ন একটা সুসংহত এবং এককেন্দ্রিক শাসক বা কর্তৃত্বকারী শ্রেণী সিন্ধু সভ্যতাকে নিয়ন্ত্রণ করত, যার ছাপ পড়েছে সুবিশাল সভ্যতার সর্বত্র অভিন্ন বিভিন্ন বৈশিষ্ট্যের মাধ্যমে। অবশ্য এর মানে এ কথা আমি বলছি না যে, সভ্যতায় বৈচিত্র্য বা ভিন্নতা ছিল না। অঞ্চল ভেদে বহু ধরনের ভিন্নতার ছাপই সেখানে পাওয়া গেছে। তাছাড়া সব নগরের মাপ যেমন এক নয় তেমন পরিকল্পনায় অনেক অভিন্নতা থাকলেও সবকিছুই হুবহু এক রকম বা অভিন্ন নয়। তবে সিন্ধু সভ্যতার সব বৈশিষ্ট্যকে ছাপিয়ে যে তার অভিন্নতার দিকটি সামনে উঠে আসে এই বাস্তবতাকে অস্বীকার করা যায় না। এ থেকে আমরা একটি কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রণের অসাধারণ দৃঢ়তার অস্তিত্ব সম্পর্কে সিদ্ধান্ত নিতে পারি।
মনে রাখতে হবে যুগটা ঘোড়ার যুগ নয়, বরং পায়ে হেঁটে যাতায়াত এবং গরু-মহিষ-গাধা দিয়ে টানা গাড়ী আর নদী থাকলে নৌকায় যাতায়াতের যুগ। অর্থাৎ খুবই ধীরগতির যোগাযোগের কাল সেটা। সেই রকম এক কালে আফগানিস্তানের দক্ষিণ-পূর্বাংশ থেকে বর্তমানের সমগ্র পাকিস্তান এবং ভারতের পাঞ্জাব, হরিয়ানা, দিল্লীর নিকটবর্তী অঞ্চল, রাজস্থান এবং গুজরাটসহ এক বিশাল অঞ্চলব্যাপী বিস্তৃত এক রাষ্ট্রে এমন অভিন্নতা অর্জন এবং রক্ষা করা কীভাবে সম্ভব? আজকের এত দ্রুতগতির যান্ত্রিক যুগে উপমহাদেশের দিকে দৃষ্টি দিলে কী মনে হবে?
পুনরায় প্রশ্ন আসবে কী ছিল সেই শক্তির উৎস যা সমগ্র সভ্যতায় এভাবে ঐক্য বা অভিন্নতা এনেছিল এবং সেই সঙ্গে সভ্যতাকে শান্তিপূর্ণ উপায়ে দীর্ঘস্থায়ী হবার শক্তি যুগিয়েছিল। ধর্ম যে সেই শক্তি নয় সেটা বুঝা যায় সিন্ধু সভ্যতার দিকে দৃষ্টি দিলেও। এ সম্পর্কে কিছু আগে বলেছি। তবু বলি শুধু যে মূর্তি বা প্রতিমার অভাব আমাদেরকে এই সিদ্ধান্তে নেয় তা-ই নয়, অধিকন্তু মন্দির বা পূজাগৃহ হিসাবে চিহ্নিত করা যায় এমন কিছুরও অভাব আমাদেরকে এই সিদ্ধান্তে নেয়। শুধু এইটুকু নয়। এবার আমরা সিন্ধু সভ্যতা ধ্বংসের অনেক পরবর্তী ঐতিহাসিক কালের দিকে একটু দৃষ্টি দিই আমাদের প্রশ্নের উত্তর পাবার জন্য। সেই উত্তর খুঁজতে গিয়ে পুনরায় প্রশ্ন করি সিন্ধু সভ্যতার অন্তত সমাজ ও রাষ্ট্রের মূলধারায় কি অলৌকিক সত্তার অস্তিত্বে বিশ্বাসী ধর্মের অস্তিত্ব ছিল? ঐতিহাসিক কালের সাক্ষ্য আমাদের কী বলে?
আমরা বৌদ্ধধর্মের প্রতিষ্ঠাতা গৌতম বুদ্ধের কালে যাই। যদি খ্রীষ্টপূর্ব ১৯০০ অব্দকে পরিণত হরপ্পান সভ্যতা তথা সিন্ধুর নগর সভ্যতার অবসানের সময় ধরা হয় তবে বুদ্ধের সময়টা তার প্রায় সোয়া এক হাজার বছর পর। অর্থাৎ সিন্ধু সভ্যতার ধ্বংসকাল সূচনার প্রায় সোয়া এক হাজার বছর কাল পর খ্রীষ্টপূর্ব ৪০০ থেকে ৬০০ সালের মধ্যে কোনও এক সময় বুদ্ধ জীবিত ছিলেন এবং তার ধর্মমত প্রচার করেন। বুদ্ধের ধর্মমতের একটি প্রধান বৈশিষ্ট্য অহিংসা, ইংরাজীতে যেটাকে nonviolence বলা হয়। অপর একটি প্রধান বৈশিষ্ট্য নিরীশ্বরবাদ অর্থাৎ সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী এবং জগৎস্রষ্টা হিসাবে কোনও অলৌকিক ক্ষমতাসম্পন্ন সত্তার অস্তিত্বে অবিশ্বাস। এখানে অলৌকিক সত্তা হিসাবে আত্মার যে ধারণা আছে সেটাকে খ্রীষ্টান কিংবা ইসলাম ধর্মের আত্মার সঙ্গেও মিলানো যায় না। এখানে আত্মা জীবের বাসনার সঙ্গে সম্পর্কিত। এই কারণে পুণ্যকর্মের মাধ্যমে এবং বাসনা থেকে মুক্তিলাভ করতে পারলে মানুষ জন্মান্তরের চক্র থেকে এবং ফলত জীবনের দুঃখ থেকেও মুক্তি লাভ করতে পারে। এটাই হল নির্বাণ। বুদ্ধের চেতনায় দুঃখ একটা বড় জায়গা অধিকার করে আছে। তিনি বলছেন, সব্বং দুক্খং। অর্থাৎ সবকিছু দুঃখময়। এই দুঃখময় জীবনচক্র থেকে মুক্তির উপায় হল নির্বাণ লাভ, যা সম্ভব পুণ্যকর্ম এবং বাসনা থেকে মুক্তিলাভের মাধ্যমে। বুদ্ধের ধর্মমতে প্রচলিত অন্যান্য প্রধান ধর্মগুলির মতো ঈশ্বর ধারণা পাই না। একইভাবে পাই না বিশেষত খ্রীষ্টান এবং ইসলাম ধর্মের মতো স্বর্গ-নরক সম্পর্কে ধারণাও।
ভারতবর্ষে এক সময় বৌদ্ধধর্মের ব্যাপক বিস্তার সম্পর্কে আমরা জানি। পরাক্রান্ত মৌর্য সম্রাট অশোক (শাসনকাল : খ্রীষ্টপূর্ব ২৬৮ – ২৩২) এক সময় বৌদ্ধধর্ম গ্রহণ করেন। তার সময়ে ভারতের বাইরেও বিভিন্ন অঞ্চলে বৌদ্ধ ধর্মের বিস্তার ঘটে। তার রাজকীয় পৃষ্ঠপোষকতার একটা খুব গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল উপমহাদেশের বাইরে বিভিন্ন দেশে বৌদ্ধধর্মের এই বিস্তারে। সিংহলে তার পুত্র মহিন্দা (মহেন্দ্র) এবং কন্যা সংঘমিত্রার নেতৃত্বে মিশনারী দল যায় সেখানে বৌদ্ধধর্ম প্রচারের জন্য। পরবর্তী কিছু কালের মধ্যে এই ধর্ম মধ্য এশিয়া, আফগানিস্তান, সমগ্র ভারতীয় উপমহাদেশ, সিংহল, মিয়ানমার, থাইল্যান্ড, ইন্দোচীন এবং চীন, জাপান পর্যন্ত এক বিশাল ভূভাগে বিস্তৃত হয়। তবে এই প্রচার ও প্রসারের শক্তির মূল উৎস ছিল ভারতবর্ষে বৌদ্ধধর্মের ব্যাপক জনভিত্তি তথা জনপ্রিয়তা। অর্থাৎ স্বভূমির শক্তি তাকে এভাবে বিস্তারের শক্তি যুগিয়েছিল।
বহুদিন পর্যন্ত যে বৌদ্ধধর্ম ভারতবর্ষে প্রবল প্রতাপে টিকেছিল তার প্রমাণ হচ্ছে উত্তর ভারতের শক্তিশালী সম্রাট হর্ষবর্ধন (শাসনকাল : ৬০৭ খ্রীষ্টাব্দ – ৬৪৭ খ্রীষ্টাব্দ) কর্তৃক এই ধর্মকে পৃষ্ঠপোষকতা দান। বাংলার পরাক্রমশালী পাল রাজবংশ যে বৌদ্ধ ছিল সে কথা সবার জানা। ৭৫০ খ্রীঃ থেকে ১১৭৪ খ্রীঃ পর্যন্ত মোটামুটি ৪২৪ বৎসর স্থায়ী তাদের সাম্রাজ্য একটা পর্যায়ে প্রায় সমগ্র উত্তর ভারতব্যাপী বিস্তৃত ছিল। রাজাদের বৌদ্ধ ধর্মের প্রতি অনুরাগ বা সমর্থন যে প্রজাসাধারণের একটি খুব বড় এমনকি গরিষ্ঠ অংশের বৌদ্ধ ধর্মবিশ্বাসের প্রতি সমর্থনের প্রতিফলন এমন সিদ্ধান্ত নেওয়াই কি যৌক্তিক নয়?
এখন যে প্রশ্ন আসবে সেটা হচ্ছে সিন্ধু সভ্যতা ধ্বংসের পর সমাজের যে পশ্চাৎপদ যা্ত্রা শুরু হয় তাতে কী করে সেই পশ্চাৎপদ অবস্থায় বৌদ্ধধর্মের মতো একটা নিরীশ্বরবাদী ধর্মমতের এত বিপুল জনসমর্থন লাভ সম্ভব, যদি না পূর্ব থেকেই তার জন্য একটি খুবই শক্তিশালী জনভিত্তি না থাকে? একইভাবে বুদ্ধের অল্প কিছু পূর্বে খ্রীষ্টপূর্ব ৬ শতকে আবির্ভূত জৈন ধর্মও আমাদের্ নিকট তাৎপর্যপূর্ণ বার্তা দেয়। এটিও বৌদ্ধধর্মের মতো সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী বিশ্বস্রষ্টা হিসাবে ঈশ্বর ধারণায় অবিশ্বাসী। সুতরাং জৈনধর্মও নিরীশ্বরবাদী। এবং এটিও পুণ্যকর্মের মাধ্যমে জন্মান্তরের চক্র থেকে মানুষের মুক্তিতে বিশ্বাসী। অন্যদিকে এটিও অহিংসাবাদী। তবে বৌদ্ধধর্মের চেয়েও এটি আরও অনেক বেশী অহিংসার উপর গুরুত্ব দেয়। এ ব্যাপারে জৈন ধর্মকে চরমপন্থী বলতে হবে। এক সময় বৌদ্ধ ধর্মের পাশাপাশি জৈন ধর্মও ভারতবর্ষে জনপ্রিয় ছিল। এমনকি কোন কোন রাজা বা সম্রাটও জৈন ধর্মের অনুসারী ছিল। এখনও ভারতে এক কোটির বেশী মানুষ জৈন ধর্মাবলম্বী। যাইহোক, জৈন এবং বৌদ্ধ এক সময়ের এই দুই জনপ্রিয় ধর্ম কর্তৃক অহিংসা এবং নিরীশ্বরবাদ এই দুই বিষয়কে গুরুত্বদানের কারণ নিশ্চয় সমকালীন জনসমাজের ভিতরই নিহিত রয়েছে। এখানে আর একটা বিষয় উল্লেখ করা উচিত হবে যে, জৈন ধর্মের প্রবর্তক মহাবীরকে এই ধর্মের ২৪তম ও শেষ তীর্থঙ্কর বলা হয়। অর্থাৎ জৈন মতে তিনি এই ধর্মের ঠিক প্রবর্তকও নন, বরং তিনি হলেন এই ধর্মের সর্বশেষ সংস্কারক। জৈনধর্ম মতে ঋষভ হলেন এই ধর্মের প্রথম তীর্থঙ্কর। তবে কি এই ধর্মবিশ্বাসের উৎসে পৌঁছাতে হলে আমাদেরকে সিন্ধু সভ্যতাতে পৌঁছাতে হবে?
বুদ্ধের সমসাময়িক আরও যেসব দার্শনিক মতবাদের কথা আমরা জানতে পারি সেগুলিও কি একই দিকে ইঙ্গিত দেয় না? এই সময়কার বিভিন্ন নিরীশ্বরবাদী দার্শনিকের মধ্যে অজিত কেশকম্বলীর কথা উল্লেখ করা যায়। সাংখ্যবাদী দার্শনিকরাও যথেষ্ট প্রভাবশালী ছিলেন, যারা ভাববাদী হলেও নিরীশ্বরবাদী। তাদের দর্শনের মূল বিষয় পুরুষ ও প্রকৃতি এই দুই সত্তায় জগতের বিভাজন। পুরুষ প্রকৃতপক্ষে এমন চেতনা যা প্রকৃতির সহায়তা ছাড়া কিছুই করতে পারে না। আর প্রকৃতিও পুরুষ ছাড়া অচল। এমনভাবে চেতনা ও বস্তু এই দ্বৈতসত্তার মিলনে জগৎসংসার চলমান। চেতনাকে স্বতন্ত্র সত্তা হিসাবে ধারণা করায় ভাববাদী হলেও সাংখ্যদর্শনকে সর্বশক্তিমান সত্তা হিসাবে ইশ্বর ধারণায় বিশ্বাসী বলবার কারণ নাই।
তবে সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ হল চার্বাক কিংবা লোকায়ত দর্শনের অস্তিত্ব। প্রাচীন ব্রাহ্মণ পণ্ডিতরা সঙ্গত কারণে এই দর্শনের বিরুদ্ধে সর্বাত্মক ‘জিহাদ’ পরিচালনা করেছেন। বস্তুজগতের বাইরে আর কোনও চেতন সত্তায় সম্পূর্ণরূপে অবিশ্বাসী চার্বাক বা লোকায়ত দর্শনের অনুসারীরা। সুতরাং তারা দেবতা কিংবা ঈশ্বর, দেহাতীত আত্মা, পরকাল কিংবা পরজন্ম, স্বর্গ এবং নরকের ধারণার সম্পূর্ণ বিরোধী। তাদের মতে অলোকবাদে তথা অলৌকিক সত্তা ও অলৌকিকতায় বিশ্বাসী সকল চিন্তা কিংবা মত বা ধর্মই ভুল।
এখন আমার মনে যে প্রশ্ন খুব বেশী করে আসে সেটা হচ্ছে এমন একটি সুউন্নত বস্তুবাদী কিংবা লোকবাদী দর্শন চিন্তার নাম কী করে লোকায়ত দেওয়া হয়েছিল? লোকায়ত শব্দ দেওয়া হয়েছে এই অর্থে যে এটি লোক সমাজে প্রচলিত বা জনপ্রিয়। সংস্কৃত লোকেষু আয়ত থেকে লোকায়ত। তাহলে কি এই দাঁড়ায় না যে এক সময় জনসমাজে বহুল প্রচলিত দর্শন হিসাবে লোকায়ত দর্শন নামটা দেওয়া হয়েছে?
সিন্ধু সভ্যতার প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনাদি এবং পরবর্তী কালে নিরীশ্বরবাদী বৌদ্ধ ও জৈন ধর্মের বিস্তার এবং সেই সঙ্গে এক কালে প্রচলিত বস্তুবাদী এবং লোকবাদী দর্শনকে লোকায়ত নামে উল্লেখকে এখন আমাদের নূতনভাবে বিচার করতে হবে।
এ বিষয়ে কোনও সন্দেহ নাই যে, সভ্যতার পশ্চাদগতির অবস্থায় যখন প্রতিক্রিয়া ও প্রতিক্রিয়াশীলতার কাল চলছে তখন নূতন করে নিরীশ্বরবাদ কিংবা উন্নত লোকবাদী বা বস্তুবাদী দর্শনের বিকাশ সম্ভব নয়। অর্থাৎ এ সকল দার্শনিক ধারণা যে পূর্ববর্তী সিন্ধু সভ্যতার গৌরবময় কালের জ্ঞানচর্চার ধারাবাহিকতা বা অবশেষ মাত্র তাতে কোনও সন্দেহ নাই।
সিন্ধু সভ্যতার বস্তুগত মৃত্যু ঘটলেও তার ভাবগত মৃত্যু যে ঘটে নাই তারই প্রমাণ হচ্ছে এ সকল ধর্মীয় এবং দার্শনিক মতবাদ। ভাবগত মৃত্যু ঘটতে খ্রীষ্টপূ্র্ব ৬ শত কিংবা ৫ শত বৎসর কালপর্বের পরেও আরও বহু শতাব্দী কিংবা সহস্রাধিক বৎসর লেগেছে। অবশ্য সিন্ধু সভ্যতার মতো মহাসভ্যতার পরিপূর্ণ মৃত্যু কখনই ঘটে না। তার সাক্ষ্য দেয় আজকের ভারতবর্ষ তার ভাষা এবং সংস্কৃতির বহু উপাদানের মধ্য দিয়ে। প্রায় পাঁচ হাজার বছর আগেকার স্বস্তিকা চিহ্ন আজও কল্যাণ বা মঙ্গলের প্রতীক হিসাবে ভারতের সর্বত্র ব্যবহৃত। আরও বহু কিছুর উল্লেখ করা যায় যেগুলি সম্পর্কে প্রত্নতাত্ত্বিকদের অনেক আলোচনা আছে।
এমনকি সিন্ধু সভ্যতার ভাষা তো আজও তার উত্তরাধিকারের মধ্য দিয়ে জীবিত। যেগুলিকে আমরা ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষা পরিবারভুক্ত বলি সেগুলি যে সবই সিন্ধু সভ্যতার রাষ্ট্রভাষা বৈদিক ভাষার উত্তাধিকারী এ বিষয়ে আমার সামান্য সন্দেহও নাই। চঞ্চল ও আমার যৌথভাবে ইংরাজীতে লিখা Decline of Indus Civilization and Vedic Upheaval-এ সিন্ধু সভ্যতার ভাষার প্রশ্নে আলোচনা করেছি। কিছু পরে বিষয়টা নিয়ে পুনরায় কিছু আলোচনা করব। কারণ ভাষার প্রশ্ন সিন্ধু সভ্যতাকে বুঝবার ক্ষেত্রে প্রভূত পরিমাণে সহায়ক হতে পারে। এর জন্য সিন্ধু সভ্যতার লিপির পাঠোদ্ধারের প্রয়োজন নাই। বৈদিক এবং তার পরবর্তী রূপ সংস্কৃত ভাষা সম্পর্কে কিছু প্রাথমিক ধারণা থাকলে সিন্ধু সভ্যতার ভাষাগত বৈশিষ্ট্যকে বুঝা সম্ভব হতে পারে।
আমরা যে আলোচনায় ছিলাম সেখানে ফিরে প্রশ্ন করা যাক আসলে কি সিন্ধু সভ্যতায় অলোকবাদী ধর্মে বিশ্বাস ছিল? যদি চার্বাকপন্থী কিংবা লোকায়তের মতো বিভিন্ন নিরীশ্বরবাদী এবং বস্তুবাদী দর্শনের অনুসারী জনগোষ্ঠী সিন্ধু সভ্যতার অঞ্চল থেকে সভ্যতা ধ্বংসকালে পূর্ব দিকে গাঙ্গেয় অববাহিকা অঞ্চলে এসে থাকে তবে আমাদেরকে এই সিদ্ধান্ত টানতে হবে যে, সিন্ধু সভ্যতার অন্তত মূলধারায় অলোকবাদী ধর্মের স্থান ছিল না। অর্থাৎ প্রকৃতপক্ষে সিন্ধু সভ্যতা এমন সভ্যতা যা ছিল আজকের অর্থে ধর্মমুক্ত। সভ্যতা ধ্বংসের পরবর্তী সময়ে সমাজের পশ্চাদগতি তথা প্রতিক্রিয়ার অবস্থায় আত্মা, জন্মান্তর ইত্যাদি ধারণা উত্তর ভারতের গঙ্গা অববাহিকায় স্থানান্তরিত তথা অভিবাসী জনসমাজে বিস্তার লাভ করতে থাকে। আরও অনেক পরবর্তীকালে জৈন কিংবা বৌদ্ধ মতবাদ সিন্ধু সভ্যতার উত্তরাধিকার হিসাবে তখনও গভীর প্রভাব নিয়ে টিকে থাকা অহিংসা ও নিরীশ্বরবাদের ধারণার সঙ্গে জনসমাজে ক্রমে গড়ে উঠা আত্মা, জন্মান্তর ইত্যাদি ধারণাকে সংমিশ্রিত করে ধর্ম হিসাবে গড়ে উঠে।
এখন আমরা বৈদিক তথা ব্রাহ্মণ্যবাদী ধর্মের উত্থান ও বিকাশ প্রক্রিয়াকে একটু বিচার করি। নদীনিয়ন্ত্রণ ধ্বংসে বৈদিক শক্তির সাফল্য তার দুর্বলতারও কারণ হয়েছিল বলে ধারণা করি। সিন্ধু সভ্যতায় যে বিপুল জনসংখ্যা ছিল সে ব্যাপারে সন্দেহের কোনও কারণ নাই। সভ্যতার আয়তনের দিকে তাকালে মনে হয় দুই থেকে তিন কোটি কিংবা আরও বেশী সংখ্যক মানুষ এই সভ্যতায় বাস করত। নদীনিয়ন্ত্রণের ফলে সভ্যতার বিশাল অঞ্চলে জলসেচের সাহায্যে বিপুল খাদ্যোৎপাদন করতে পারায় বিশাল জনসংখ্যাকে ধারণ করা এই সভ্যতার পক্ষে সহজ ছিল। নূতন নূতন এলাকার নদীসমূহে জলকপাটযুক্ত বাঁধ দেওয়ার ফলে নূতন নূতন এলাকা কৃত্রিম উপায়ে জলসেচের অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। সভ্যতার কেন্দ্রীয় অঞ্চলে জনসংখ্যা বৃদ্ধি ঘটলে এইসব প্রান্তস্থ অঞ্চলে তাদের পুনর্বাসন করা হত বলে ধারণা করা চলে। যুদ্ধের ভূমিকা গৌণ থাকায় সামাজিক ও রাজনৈতিক অস্থিরতায় মৃত্যু কম হত বলে ধারণা করার কারণ আছে। অন্যদিকে নগর পরিকল্পনা থেকে যেভাবে সাধারণ মানুষের জন্য স্বাস্থ্য সচেতনতার সাক্ষ্য পাওয়া যায় তাতে এটা সহজবোধ্য যে, ব্যাধিতে এ সভ্যতায় মৃত্যু তুলনায় কম ছিল। সে কালে জন্মনিয়ন্ত্রণের আধুনিক পদ্ধতি ছিল না। সুতরাং কৌমার্যব্রত কিংবা সন্ন্যাস ব্যতীত জনসংখ্যা রোধের আর কোনও সহজ পন্থা ছিল না। অন্যদিকে, নগর পরিকল্পনা এবং নর-কঙ্কালে ধনী-দরিদ্রে পুষ্টিমানের প্রায় সমতার উপস্থিতি ইত্যাদি থেকে অন্যান্য সভ্যতার তুলনায় সম্পদের সুষম বণ্টনের চিত্র ফুটে উঠে। ফলে শান্তিপূর্ণ জীবনযাপনকারী, মোটামুটি প্রয়োজনীয় খাদ্যপুষ্টি লাভের সুবিধাভোগী এবং স্বাস্থ্য সচেতন জনগোষ্ঠীর জনসংখ্যার তুলনামূলক বৃদ্ধি ছিল স্বাভাবিক। এই অবস্থায় রাষ্ট্রীয় পরিকল্পনায় যে নির্দিষ্ট এলাকা বা অঞ্চলের উদ্বৃত্ত জনসংখ্যাকে রাষ্ট্রের প্রান্তে নূতন নূতন এলাকা বা অঞ্চলে স্থানান্তরিত করা হত সেটাই স্বাভাবিক মনে হয়।
তবে নদীনিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থায় সঙ্কট দেখা দিলে কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রণ ভেঙ্গে পড়তে থাকে। সম্ভবত এই সঙ্কটের প্রাথমিক পর্যায়েই সিন্ধু সভ্যতার নদীনিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থাকে ধর্মের অন্তর্ভুক্ত করা হয়। আমার অনুমান সভ্যতার সূচনা থেকেই লোকবাদ এবং বস্তুবাদী জীবন দর্শনের পাশাপাশি ভাববাদী দর্শন এবং অলোকবাদী ধর্মের উদ্ভব ঘটেছিল। তবে বহুদিন পর্যন্ত ধর্ম যে খুবই প্রান্তস্থ এবং গৌণ অবস্থানে ছিল সেই অনুমানটাই এখন আমার নিকট যৌক্তিক মনে হয়। ব্যাপক জনগণ ছিল লোকবাদী তথা বস্তুবাদী জীবন দর্শনে বিশ্বাসী। রাষ্ট্র সেভাবেই তাদেরকে গড়ে তুলেছিল। অর্থাৎ অলোকবাদী ধর্মবিরোধী প্রচারে সুদীর্ঘ কাল রাষ্ট্রের উদ্যোগী এবং নেতৃত্বকারী ভূমিকা ছিল এমনটা অনুমান করা চলে।
তবে সভ্যতার সঙ্কট শুরু হলে এই অবস্থার পরিবর্তন ঘটতে শুরু করে বলে অনুমান করি। তখন স্বাভাবিক নিয়মে জনগণকে নিয়ন্ত্রণের সহজ হাতিয়ার হিসাবে ধর্ম গুরুত্ব অর্জন করতে থাকে। হয়ত এই সঙ্গে কিছু করে সশস্ত্র বাহিনী তথা যুদ্ধও গুরুত্ব অর্জন করতে থাকে। কারণ শুধু ধর্মবিশ্বাস দিয়ে মানুষকে নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন হয়ে পড়ে যদি সমান্তরালে বলপ্রয়োগের যন্ত্র তথা কোনও না কোনও রূপে সশস্ত্র বাহিনী না থাকে। অনুমান করা চলে সিন্ধু সভ্যতার এমন এক সঙ্কটের কালে জনগণের একাংশের মনে বিশেষত যারা বেশী ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল তাদের মনে নদীনিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থাকে ধ্বংস করে নদীগুলিকে মুক্ত করার প্রয়োজন অনুভূত হয়েছিল। সুতরাং বিদ্যমান ধর্মের সংস্কারের মাধ্যমে যুদ্ধকে প্রাধান্য দান এবং নদীনিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থাকে ধ্বংস করা হল।
আমরা অনুমান করি সভ্যতার পতনের পর্যায়ে যখন ধর্ম গুরুত্ব অর্জন করতে শুরু করেছে এবং বৈদিক সংস্কারের মাধ্যমে নদীনিয়ন্ত্রণকে ধ্বংসের লক্ষ্যে যুদ্ধ শুরু হয়েছে তখন রাষ্ট্রের মূল শাসক শ্রেণী সমাজে বিদ্যমান অহিংসার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ বরুণকেন্দ্রিক ধর্মে অপর একটি সংস্কারকে উৎসাহ বা পৃষ্ঠপোষকতা দিয়েছে। এভাবে হিংসা বা যুদ্ধকে শাসক শ্রেণীর দিক থেকেও ধর্মীয় বৈধতা দেওয়া হল। আবেস্তা হল এই ধর্মের গ্রন্থ। ‘আর্যজন ও সিন্ধু সভ্যতা’য় এ সম্পর্কে আমাদের আলোচনা আছে। যাইহোক, একটা দীর্ঘকাল স্থায়ী যুদ্ধে সভ্যতার শাসক শ্রেণীর যে অংশ তখনও পর্যন্ত নদীনিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থার পক্ষে ছিল তাদের পরাজয় হল এই অর্থে যে, তারা নদীনিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা রক্ষায় ব্যর্থ হল। আমাদের অনুমান মূলত শাসক শ্রেণী নদীনিয়ন্ত্রণের প্রশ্নে দ্বিধাবিভক্ত হয়েছিল। তবে শাসক শ্রেণীর মূল বা প্রধান অংশই যে নদীনিয়ন্ত্রণের পক্ষে ছিল তেমনটাই অনুমান করি।
আজ থেকে প্রায় চার বা পৌনে চার হাজার বৎসর পূর্বে সিন্ধু-সরস্বতী অবাহিকার বিশাল অঞ্চলে নদীনিয়ন্ত্রণের সমগ্র কৃত্রিম ব্যবস্থাকে ধ্বংস করে নদীগুলিকে মুক্ত করা গেল বৈকি, কিন্তু তার আগেই যেমন নদীর খাত পরিবর্তনের ফলে সরস্বতী মৃত্যু বরণ করেছিল তেমন কৃত্রিম জলনিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থার অবসানের ফলে প্রচুর খাদ্যোৎপাদনের সহজ ব্যবস্থারও অবসান হল। এর পরিণতি হল খাদ্যোৎপাদনের মূল ভিত্তি ধ্বংসের সঙ্গে জনসংখ্যার বিরাট অংশের ধ্বংস বা মৃত্যু এবং বাকী বিরাট অংশের স্থানান্তরগমন। সিন্ধু সভ্যতার অঞ্চল থেকে চতুর্দিকে প্রাচীন পৃথিবীর বৃহত্তম অভিগমন বা অভিবাসন ঘটল। এটা এক মহাযাত্রা। পশ্চিম ও উত্তরে ইরান, আফগানিস্তান, মধ্য-এশিয়া থেকে শুরু করে সুদূর ইউরোপ এবং এদিকে নিকটবর্তী পূর্ব ও দক্ষিণ ভারত পর্যন্ত বিশাল ভূভাগে চলল এই গণ-অভিবাসন। যে অঞ্চলগুলিতে এই অভিবাসন প্রবল ছাপ রাখতে সক্ষম হয়েছে সেগুলিকে আজ আমরা খুব সহজে ভাষাতত্ত্ব দিয়ে বুঝতে পারি। ইন্দে-ইউরোপীয় পরিবারভুক্ত ভাষাগুলি যেখানেই আছে বুঝতে হবে সেখানেই সিন্ধু সভ্যতার অধিবাসীদের এই অভিগমন বা মহাযাত্রা তার পদচিহ্ন রেখেছে।
যাইহোক, সিন্ধু সভ্যতার ধ্বংসের পিছনে নদীনিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থার ব্যর্থতা ভূমিকা রাখলেও এই ধ্বংসকে ত্বরান্বিত ও চূড়ান্ত করায় বৈদিক আন্দোলনের ভূমিকাই সর্বাধিক। আর সব সভ্যতার মতো সিন্ধু সভ্যতাও স্বাভাবিক নিয়মে এক সময় মৃত্যু বরণ করত। কারণ নদীনিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা এমনিতেই অকার্যকর হয়ে পড়ছিল। ফলে সভ্যতার ধ্বংস সময়ের ব্যাপার মাত্র ছিল। কিন্তু নদীনিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা ধ্বংস না করলে সিন্ধু সভ্যতা হয়ত আরও কিছুকাল টিকে থাকত, ফলে তা তার প্রভাব ও উত্তরাধিকারকে হয়ত আরও সময় নিয়ে চতুর্দিকে স্থানান্তরিত করে যেতে পারত। কিন্তু বৈদিক আন্দোলন সেই সুযোগ দেয় নাই।
নদীনিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা ধ্বংসের মাধ্যমে সভ্যতা ধ্বংসে বৈদিক আন্দোলন তথা বৈদিক ধর্ম সফল। কিন্তু এর মাধ্যমে বৈদিক ধর্ম তার মর্যাদাও নিদারুণভাবে হারিয়েছিল। কারণ সভ্যতা ধ্বংসের দায়ও তার উপরই বর্তেছিল। সম্ভবত এর ফলে উপমহাদেশে জনসংখ্যার বিরাট অংশের ভিতরে বৈদিক ধর্ম তেমন একটা জনপ্রিয় ছিল না। একদিকে সভ্যতা ধ্বংসের দায়, অন্যদিকে ব্যাপক জনসংখ্যার স্থানচ্যুতি ও স্থানান্তরিত হওয়ার কারণে বৈদিক পুরোহিত শ্রেণীর যে মর্যাদাহানি ঘটে সেটা তাদেরকে গাঙ্গেয় উপত্যকায় বসতি স্থাপনের পর অনেক বেশী আপোসমুখী হতে বাধ্য করে বলে অনুমান করা চলে। ঋগ্বেদ থাকল। এর ধারাবাহিকতায় অন্যান্য বেদ ও ধর্মগ্রন্থসমূহ রচিত হল। কিন্তু বৈদিক ধর্মের শুদ্ধতা রইল না। যে বৈদিক ধর্মে প্রতিমার স্থান ছিল না সেখানে প্রতিমা পূজা প্রবর্তিত হল। বেদের মন্ত্র পাঠ করেই পূজার কাজ সম্পন্ন হতে থাকল। কিন্তু ক্রমে বৈদিক দেবতাদের পরিবর্তে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই অবৈদিক দেব-দেবী প্রধান উপাস্য রূপে দেখা দিল। সবচেয়ে বড় কথা বৈদিক সমাজে বর্ণজাতিভেদের জায়গা না থাকলেও সমাজকে তাত্ত্বিকভাবে চতুর্বর্ণ বা চার বর্ণজাতিতে ভাগের নামে শত-সহস্র বা অগণিত ভাগে ভাগ করা হল। এভাবে বৈদিক উত্তরাধিকারের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করে একটি নূতন ধর্মের বিকাশ ঘটানো হল। বৈদিক ঋষিদের তথা পুরোহিত শ্রেণীর উত্তরাধিকারী হিসাবে ব্রাহ্মণদের নেতৃত্বেই বেদের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করে নূতন ধর্ম গঠনের এই সমগ্র কর্মকাণ্ড পরিচালনা করা হল। এটাই এখন আমাদের নিকট হিন্দু ধর্ম হিসাবে পরিচিত।
হিন্দু ধর্ম গঠনের এই জটিল গতিধারা বিশেষ আলোচনা দাবী করে যেটার সুযোগ এখানে নাই। তবে এখানে আমি এ সম্পর্কে যেটুকু বুঝেছি তার সামান্য কিছু ইঙ্গিত দিতে চাই। আমার ধারণা সিন্ধু সভ্যতা ধ্বংসের পর বৈদিক পক্ষ প্রধানত অপেক্ষাকৃত উর্বর ও নিকটবর্তী গাঙ্গেয় অববাহিকা অঞ্চলে অভিবাসন করে। এ কথা আমরা ‘আর্যজন ও সিন্ধু সভ্যতা’-তেও বলেছি। এ কথাও বলেছি যে ব্রাহ্মণরা এই অঞ্চলের আদিম ও পশ্চাৎপদ উপজাতিসমূহের সাথে মিথষ্ক্রিয়া এবং আপোসের মাধ্যমে ক্রমশ প্রতিমা পূজা এবং বর্ণজাতি প্রথা ভিত্তিক হিন্দু ধর্ম গড়ে তোলে।
কিন্তু সাম্প্রতিক কালে আমার ধারণা হয়েছে যে, সিন্ধু সভ্যতার মূল অধিবাসীবৃন্দ যারা বৈদিক পক্ষের মতো পূর্ব-উত্তর ভারতের দিকে বিশেষত গাঙ্গেয় উপত্যকায় বসতি স্থাপন করে তাদের বেশীর ভাগই বৈদিক ধর্ম বিরোধী ছিল এবং এরা ছিল সিন্ধু সভ্যতার ধর্মমুক্ত রীতি-নীতি-বিশ্বাসের অনুসারী। সুতরাং এরা ছিল মূলত লোকায়ত দর্শনের অনুসারী। একদিকে দেবতা তথা ধর্মে অবিশ্বাস, অন্যদিকে সিন্ধু সভ্যতা ধ্বংসের কারণে বৈদিক পক্ষের নৈতিকতা ও মর্যাদার হানি এই বিরাট জনগোষ্ঠীর নিকট বৈদিক ধর্মের কোনও ধরনের গ্রহণযোগ্যতা রাখে নাই। ফলে বৈদিক পক্ষ বা ব্রাহ্মণরা নিজেদের শক্তিভিত্তি খুঁজে পেতে বিন্ধ্য ও গঙ্গার পাহাড়-পর্বত ও অরণ্যসঙ্কুল অঞ্চলের আদিম অধিবাসীদের দিকে হাত বাড়ায়। কৃষিভিত্তিক সমাজের তুলনামূলকভাবে নিশ্চিত জীবনের আশায় আদিম অধিবাসীরা যখন কৃষিসমাজের অন্তর্ভুক্ত হতে রাজী হয়েছে তখন ব্রাহ্মণরা তাদের অনেক রীতি-নীতি ও সামাজিক প্রথাকে গ্রহণ করে তাদেরকে নিম্নতর বর্ণজাতির অন্তর্ভুক্ত করে বৃহত্তর বৈদিক সমাজের অন্তর্ভুক্ত করেছে এভাবে ব্যাখ্যা করলে হিন্দু সমাজের বিকাশকে বুঝতে সুবিধা হয়। এভাবে বর্ণজাতির কাঠামোতে স্থান পাওয়ায় আদিম সমাজের স্বাতন্ত্র্যবোধ যেমন রক্ষিত হয়েছে তেমন তারা ধীরগতিতে কৃষিসমাজে বিলীন হয়ে সভ্য সমাজের অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। কিন্তু এর ফলে হিন্দু সমাজ ও ধর্মে স্থান পেয়েছে অবিশ্বাস্য গোঁজামিল, স্ববিরোধ, বিস্ময়কর অনেক আদিমতা। যেমন সতীদাহ এবং রাম কর্তৃক সীতার সতীত্বের প্রমাণ লাভের জন্য অগ্নিপরীক্ষার ব্যবস্থার মাধ্যমে একটা অমানবিক প্রথাকে ধর্মীয় অনুমোদন দান। এ ছাড়া আছে জাতপাতের ভয়ঙ্কর ও কদর্য সব প্রকাশ। এখানে এর একটাই দৃষ্টান্ত দিই — নিম্নবর্ণের শূদ্র শম্বুক স্বর্গলাভের জন্য ধ্যান করায় রাম কর্তৃক তার শিরচ্ছেদ। এছাড়া মনুসংহিতা ইত্যাদি ধর্মীয় গ্রন্থের অনুশাসনাদি থেকে ধর্মের যে চিত্র বেরিয়ে আসে এবং বিশেষত ব্রহ্মবৈবর্তপুরাণ, কল্কিপুরাণ ইত্যাদি বহুসংখ্যক পুরাণগুলি থেকে যেসব হাস্যকর এবং নিকৃষ্ট কাহিনীর বিবরণ পাওয়া যায় তা থেকে হিন্দু ধর্মের ভিতরকার আদিমতা ও অমানবিকতার অনেক বৈশিষ্ট্যই পরিস্ফুট হয়।
এটা ঠিক যে, হিন্দু ধর্ম আপাতদৃষ্টিতে নির্বিরোধ এবং সহিষ্ণু। বহু মত ও পথের প্রতি তার অনুমোদনের কথাও বারংবার বলা হয়। কিন্তু এ সবই প্রযোজ্য শক্তিমানের সঙ্গে সম্পর্কের ক্ষেত্রে। দুর্বলের প্রতি তার দৃষ্টিভঙ্গী কিন্তু ভয়ঙ্কর হিংস্র ও অসহিষ্ণু হতে পারে। সুতরাং নারীর প্রতি অতীব নির্দয় এই ধর্মের বিধিবিধান। বিধবা নারীদের অগ্নিচিতায় জীবন্ত দগ্ধ হবার হাত থেকে রক্ষার জন্য এই সেদিন বিদেশী, বিজাতীয় এবং বিধর্মীদের হস্তক্ষেপের প্রয়োজন হয়েছিল। আর শূদ্র এবং বিশেষত হিন্দু সমাজ বহির্ভূত হিসাবে বিবেচিত অস্পৃশ্য বা বর্তমানে কথিত দলিতদের প্রতি এই ধর্মের দৃষ্টিভঙ্গী কতটা সঙ্কীর্ণ এবং ক্ষেত্র বিশেষে কতটা হিংস্র হতে পারে হিন্দু সমাজ সম্পর্কে যাদের কিছু ধারণা আছে তারা জানেন। এখনও ভারতে ঘোড়ায় চড়ার অপরাধে দলিতকে উচ্চবর্ণের হিন্দুরা পিটিয়ে হত্যা করে। কিংবা মোচ রাখার অপরাধে হামলার শিকার করে।
হিন্দু ধর্ম মানুষকে এক ধরনের নৃশংস মানসিকতার অধিকারী করে। এটা নিদারুণ আত্মপীড়নেরও রূপ নিতে পারে। অনেকে জানেন ব্রিটিশ শাসন কালেও চড়কপূজার সময় পুণ্য অর্জনের আশায় অনেকে শরীরে বড়শী ঢুকিয়ে ঝুলত এবং এই বড়শী গাঁথা অবস্থায় তাদেরকে শূন্যে ঘুরানো হত। পুনরায় এ ধরনের অমানবিক ধর্মীয় প্রথা বন্ধের জন্য ব্রিটিশ শাসকদের হস্তক্ষেপের প্রয়োজন হয়েছিল।
অনেকে জানেন হিন্দু ধর্মের অনুশাসনে অনুমোদন দেওয়া না হলেও এক সময় ধর্মীয় বিশ্বাসের অংশ হিসাবে কীভাবে নরবলি বিশেষত শিশুবলি কতটা প্রচলিত ছিল। হিন্দু দেবতাদেরকে বিশেষত কালীকে তুষ্ট করার জন্য এটা একটা অলিখিত হলেও যথেষ্ট প্রচলিত ধর্মীয় প্রথা ছিল। নিঃসন্দেহে এ ধরনের নৃশংস রীতিগুলির উৎস আদিম উপজাতীয় মানুষদের পশ্চাৎপদ মানসের মধ্যে ছিল। এভাবে ব্রাহ্মণরা আদিম উপজাতিসমূহকে শান্তিপূর্ণভাবে সভ্য সমাজে আত্মস্থ করতে গিয়ে নিজেরাও নানান ধরনের আদিমতায় অধঃপতিত হয়েছে।
আসলে বোকাদের নেতা হয় চালাক বা ধূর্তরা। বিশেষত যারা বোকা মানুষদেরকে ব্যবহার করে নিজেদের স্বার্থসিদ্ধি করতে চায় তারা হয় নিদারুণভাবে অনৈতিক এবং ধূর্ত। সিন্ধু সভ্যতার উন্নত চেতনার মানুষরা ব্রাহ্মণদেরকে মানবে কেন? সুতরাং পশ্চাৎপদ আদিম মানুষরা তাদের মূর্খতা ও অজ্ঞতা দিয়ে ব্রাহ্মণের ধূর্ততার সহজ শিকার হল। আমি সব ব্রাহ্মণকে দায়ী করছি না। কিন্তু তারা এই রকম পরিস্থিতিতে টিকবে কেন? মূর্খ, মূঢ় এবং অজ্ঞ আদিম মানুষদেরকে যারা সবচেয়ে সহজে প্রতারিত করতে পারবে তারাই নূতন কালের পরিস্থিতিতে নূতন পদ্ধতিতে নূতন সমাজ গঠনের নায়ক হবে।
যুদ্ধের মধ্য দিয়ে উত্থান হলেও ব্রাহ্মণরা শান্তিপূর্ণভাবে সমাজ গঠনের কলাকৌশল শিখে এসেছিল সিন্ধু সভ্যতা থেকে। কিন্তু সিন্ধু সভ্যতার বস্তুগত ভিত্তি ছিল এমন এক নদীনিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা যা সভ্যতার প্রায় সবাইকে মূলত একই ছাঁচে ঢেলে সাজাতে সাহায্য করেছিল। কিন্তু সিন্ধু সভ্যতা ধ্বংসের পর নদীনিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থার পুনর্বহাল আর সম্ভব ছিল না। তার ব্যর্থতা মানুষের দেখা হয়েছে। আর বৈদিক পক্ষের উত্তরাধিকারী ব্রাহ্মণদের পক্ষে তো এমন আর একটা ব্যবস্থা প্রবর্তনের কল্পনাও করা সম্ভব ছিল না। কারণ এর ধ্বংসের মধ্য দিয়ে তাদের উত্থান।
এটা ঠিক যে, সিন্ধু সভ্যতায় যুদ্ধের যে শক্তি অনেকাংশে অবদমিত ছিল বৈদিক শক্তি তাকে মুক্ত করেছিল। পরবর্তী ঐতিহাসিক কালের ইতিহাস থেকে আমরা তার সাক্ষ্য পাই। কিন্তু পূর্ব ও উত্তর ভারতের আদিম উপজাতীয় সমাজগুলিকে জবরদস্তিপূর্বক সভ্য সমাজের অন্তর্ভুক্ত করে তাদের শ্রমশক্তির ব্যবহার যথেষ্ট কঠিন ছিল। কারণ এই অঞ্চলে গভীর অরণ্য এবং পাহাড়-পর্বত ইত্যাদি যে কোনও জনগোষ্ঠীর পালানোর পথ খোলা রেখেছিল। ফলে ব্রাহ্মণরা আদিম মানুষকে এখানে কৌশলে সভ্য সমাজের অন্তর্ভুক্ত করার পদ্ধতি হিসাবে হিন্দু ধর্মের বিকাশ ঘটিয়েছে এভাবে ব্যাখ্যা করলে আমাদের পক্ষে হিন্দু ধর্মকে বুঝা অনেকটা সহজ হয়। অনুমান করি এ ক্ষেত্রে তাদের জন্য কিছুটা হলেও সহায়ক হয়েছিল সিন্ধু সভ্যতার শান্তিপূর্ণ আত্মীকরণ পদ্ধতি। তবে সিন্ধু সভ্যতা যেখানে জোর দিত বৃহত্তর সমাজের সর্বোচ্চ পরিমাণ ঐক্য, সমতা ও অভিন্নতা অর্জনের উপর সেখানে ব্রাহ্মণরা জোর দিয়েছে অসমতা, অনৈক্য ও বিভিন্নতার ভিত্তিকে রক্ষা করেই নিজেদের নেতৃত্বে এক ধরনের সামাজিক ঐক্য প্রতিষ্ঠার উপর, যার মূলে রইল ধর্মীয় কিছু প্রথা ও বিশ্বাসের অভিন্নতা।
আমার এখন অনুমান ব্রাহ্মণরা সিন্ধু সভ্যতার গরিষ্ঠ অভিবাসীদের নিকট জনপ্রিয় হতে যেমন পারে নাই তেমন সিন্ধু সভ্যতার লোকায়ত দর্শনসহ বেশ কিছু ধারণা, প্রথা ও রীতিনীতি বহুকাল পর্যন্ত গরিষ্ঠ অভিবাসীদের মধ্যে দৃঢ়মূল ছিল। একটা দীর্ঘ কাল তারা তাদের নিজস্ব ধ্যান-ধারণা ও বিশ্বাস নিয়ে গাঙ্গেয় অববাহিকা অঞ্চলকে কেন্দ্র করে উত্তর ভারতব্যাপী বিস্তীর্ণ অঞ্চলে নিজেদের জীবন যাপন করেছিল। মহাবীর ও বুদ্ধের সমকালীন বিভিন্ন প্রজাতন্ত্র তারই স্মারক। বলা হয় এরা ছিল ক্ষত্রিয় অর্থাৎ যোদ্ধা। যুদ্ধ করেই এসব প্রজাতন্ত্রকে টিকে থাকতে হলেও অহিংসার আবেদন যে তখনও তাদের মনের গভীরে ছিল তার প্রমাণ দুইটি প্রজাতন্ত্র যথাক্রমে জ্ঞাত্রিক ও শাক্য থেকে মহাবীর এবং বুদ্ধের উত্থান।
তারা উভয়ে নিরীশ্বরবাদী। মহাবীর চরম অহিংসাবাদী। মহাবীরের মতো চরমপন্থী না হলেও বুদ্ধও অহিংসাবাদী। অনেক বেশী প্রভাব বিস্তারকারী বুদ্ধ দুঃখবোধে ভারাক্রান্ত একজন সমাজ-সংসার ত্যাগী সাধক। এক দুঃখময় জীবন চক্র থেকে মানুষকে মুক্তির পথ দেখাতে চেয়ে তার ধর্মবাণী। তিনি দেখতে পাচ্ছেন, সব্বং দুক্খং — সবই দুঃখময়। একটা অতীব গৌরবময় ও তুলনাবিহীন মহাসভ্যতার ধ্বংস ও মৃত্যুর বেদনা বহন করে যে জনগোষ্ঠী গাঙ্গেয় অববাহিকায় অভিবাসন করেছিল তাদের বেদনা ও হতাশা যেন বুদ্ধের মধ্য দিয়ে বাঙ্ময় হয়েছে। সেই সঙ্গে সেই সভ্যতার কিছু স্মৃতিকে ধারণ করে বেঁচে থাকার প্রেরণা, যেমন অহিংসা এবং নিরীশ্বরবাদের ধারণা। এই জায়গায় অবশ্য বুদ্ধের সঙ্গে মহাবীরেরও মিল।
এটা অনুমেয় যে, একটা সুদীর্ঘ কাল লোকায়তসহ সিন্ধু সভ্যতার বস্তুবাদী বা নিরীশ্বরবাদী চিন্তাধারা এবং বৈদিক ধর্মীয় চিন্তাধারা নানান পরিবর্তন ও মোড়পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে পরস্পরের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বী হিসাবে ক্রিয়াশীল ছিল। যার কিছু ছাপ আমরা ব্রাহ্মণদের সাহিত্যে পাই। তবে সিন্ধু সভ্যতার মতো এক মহাসভ্যতার পতনের পর সেটা ছিল প্রকৃতপক্ষে সভ্যতার বিচারে প্রতিক্রিয়ার যুগ, পশ্চাদগতির যুগ। ফলে ধর্মেরও বিকাশ ও প্রাধান্যের যুগ। বস্তুগতভাবে সভ্যতার মৃত্যু হয়েছে। গাঙ্গেয় উপত্যকায় আর একটি সভ্যতার জন্ম বা উত্থান ঘটতে আরও দেরী। তবে গণতান্ত্রিকতা, জনকল্যাণ, শান্তিনির্ভরতা, সামাজিক ঐক্য ও সমতার বিচারে সেটা আর কখনও সিন্ধু সভ্যতার সমতুল্য হবে না। তবু সিন্ধু সভ্যতার ভাবপ্রেরণা পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে ধর্মের আবরণ নিয়ে নিজেকে মূর্ত করে তুলল। সুতরাং এল বৌদ্ধ ধর্ম, যা বুদ্ধের মৃত্যুর প্রায় আড়াইশ’ বছর পরই ভারতবর্ষের সীমানা পার হয়ে পরিণত হল একটি বৈশ্বিক ধর্মে।
এভাবে বৈদিক ধর্মের পরিবর্তিত রূপ হিন্দু বা ব্রাহ্মণ্য ধর্মের বিপরীতে বৌদ্ধধর্ম দেখা দিল ভারতবর্ষের এক প্রধান ধর্ম রূপে। এই উভয় ধর্মের প্রবল প্রতিযোগিতা চলল কম-বেশী প্রায় দেড় হাজার বছর জুড়ে। অষ্টম শতাব্দীতে আরব মুসলিম হানাদার কাসিমের সিন্ধু জয়ের পর মুসলিম অগ্রগমন অনেকটা সময়ের জন্য থেমেছিল। তখনও উত্তর ভারতে বৌদ্ধধর্ম যথেষ্ট প্রভাবশালী। দ্বাদশ শতাব্দীর একেবারে শেষ এবং ত্রয়োদশ শতাব্দীর শুরুর দিকে নূতন উদ্যমে শুরু হওয়া মুসলিম আগ্রাসন ও বিজয়ের কিছু পূর্বে বৌদ্ধ রাষ্ট্রগুলির, যেমন বাংলায় পাল রাষ্ট্রের, পতনের সঙ্গে হিন্দু ধর্মের বিজয় যেমন নিরঙ্কুশ হল তেমন মুসলিম বিজয়ও অনিবার্য হল।
বৌদ্ধ ধর্মের অবসান ছিল প্রকৃতপক্ষে সিন্ধু সভ্যতার ভাবপ্রেরণার অবশেষটুকুরও অবসান। এইবার নাগরিক চেতনার প্রতিনিধিদের শেষ অবশেষটুকুর জায়গা নিল বুদ্ধিমান কিন্তু ধূর্ত ব্রাহ্মণ শ্রেণীর নেতৃত্বে সংগঠিত আদিম, পশ্চাৎপদ, কুসংস্কারাচ্ছন্ন ও কূপমণ্ডুক গ্রাম্য সমাজ। যে বৈদিক পুরোহিত শ্রেণী থেকে ব্রাহ্মণরা এসেছিল সেই শ্রেণীরও ছিল সিন্ধু সভ্যতার মতো একটা উন্নত নাগরিক সভ্যতার পটভূমি। সেটা তাদের বৈদিক ও পরবর্তী কালের ভাষা ও সাহিত্য চর্চার মান দিয়ে সহজেই বুঝা যায়। কিন্তু গাঙ্গেয় উপত্যকায় এসে যে আদিম মানুষদেরকে সংগঠিত করে তারা তাদের ধর্ম পুনর্গঠিত করল তাদের আদিমতা, মূঢ়তা ও নিকৃষ্টতার অধীনস্থ অনেকাংশে তারা নিজেরা যেমন হল তেমন বৈদিক ধর্মের প্রতি মৌখিক আনুগত্য প্রদর্শন করে তারা যে নূতন ধর্ম গড়ল সেটিও বহু ক্ষেত্রেই হল আদিমতা, মূঢ়তা ও নিকৃষ্টতার মূর্ত প্রতীক। ব্রাহ্মণের বুদ্ধি, জ্ঞান ও অনেক উচ্চমার্গের চিন্তাশীলতা যেমন এখানে প্রতিফলিত হয়েছে তেমন অবর্ণনীয় পরিমাণে আদিমতা, মূঢ়তা, কুসংস্কার, নিকৃষ্টতা এবং অমানবিকতার সমাহার ঘটেছে এই ধর্মে। আমার এই মূল্যায়ন অনেকের নিকট রূঢ় ঠেকতে পারে। কিন্তু এর সত্যতা বুঝবার জন্য হিন্দু ধর্মের দিকে একটু মনোযোগী দৃষ্টিপাতই যথেষ্ট।
তবে এই হিন্দু ধর্ম যে সিন্ধু সভ্যতার কিছু কিছু বৈশিষ্ট্যকে গভীরভাবে ধারণ করে সেই বিষয়ে কোনও সন্দেহ নাই। এ ব্যাপারে শবদেহ সৎকারে দাহের আশ্রয় নেওয়া আমার নিকট খুবই তাৎপর্যপূর্ণ মনে হয়। ভারতের বাইরে প্রায় সকল অঞ্চলের মানুষরা সাধারণত শবদেহ সমাধিস্থ করে বা মাটিতে কবর দেয়। এর সঙ্গে মৃত্যু পরবর্তী জীবন তথা আত্মার ধারণা থাকে। ধরে নেওয়া হয় যে মৃত্যুর পর দেহান্তরিত আত্মা তার দেহে ফিরে আসে। অথবা মৃত্যুর পর আত্মা তার দেহকে মর্যাদাপূর্ণ অবস্থায় সমাহিত দেখতে চায়। যখন ধর্মের বিকাশ হয় নাই তখনও মানুষের মধ্যে এ ধরনের একটা চেতনা দেখতে পাওয়া যায়। এমনকি আজ থেকে প্রায় ৩০/৩৫ হাজার বছর আগে বিলুপ্ত হওয়া মানুষের কাছাকাছি প্রজাতি নিয়ান্ডারথলরা নির্দিষ্ট সমাধি স্থানে যত্নসহকারে তাদের মৃত সদস্যদের দেহ সংরক্ষণ করত। অথচ ভারতবর্ষে হিন্দু, বৌদ্ধ, জৈন, শিখ ইত্যাদি সকল ধর্মাবলম্বী তাদের মৃতদেহ চিতার আগুনে পুড়ায়। আমি অনুমান করি এই প্রথা সিন্ধু সভ্যতা থেকে আগত। মানুষের আত্মায় বিশ্বাস না থাকায় মৃত্যুর পর শবকে আবর্জনা ছাড়া আর কিছু মনে করা হত না বলে এই প্রথার প্রবর্তন ও প্রচলন হয়েছিল এমন অনুমান করাটা কি অযৌক্তিক হবে?
এটা ঠিক যে, সিন্ধু সভ্যতায় শব সমাধিস্থও করা হত। আবার কিছু ক্ষেত্রে শব দাহ করে তার ভস্ম পোড়ামাটির পাত্রে সংরক্ষণও করা হত। প্রত্নতত্ত্ব থেকে এই দুই ধরনের মৃতদেহ সৎকারের প্রমাণ পাওয়া গেছে। যেহেতু শব দাহ করলে সচরাচর তার কোনও প্রত্নতাত্ত্বিক সাক্ষ্য পাওয়া সম্ভব নয় সেহেতু আমরা তার প্রচলনের সপক্ষে কোনও প্রমাণ পাচ্ছি না। মাটির জালায় সংরক্ষিত মৃতদেহের ভস্ম সংরক্ষণ ছিল সম্ভবত ব্যতিক্রমী ঘটনা। অবশ্য এটাও মৃতদেহে আত্মার প্রত্যাবর্তনের ধারণার ইঙ্গিত বহন করে না। ভারতবর্ষে ঐতিহাসিক কাল ধরে শবদাহের প্রচলন থেকে আমার এটাই অনুমান যে, এই প্রথার উত্তরাধিকার মৃত্যু পরবর্তী জীবনে অবিশ্বাসী সিন্ধু সভ্যতা থেকেই এসেছে।
সিন্ধু সভ্যতা প্রকৃতপক্ষে বলপ্রয়োগ-নির্ভর ছিল না। সুতরাং বিভিন্ন বিশ্বাস এবং প্রথাও সেখানে সহাবস্থান করত। তার ফলে মৃতদেহ সৎকারের বিভিন্ন পদ্ধতি পাশাপাশি ছিল। তবে একটি পদ্ধতি যে সেখানে বহুল প্রচলিত ছিল তেমনটাই মনে হয়। সিন্ধু সভ্যতায় অভিন্নতার উপর যেভাবে গুরুত্ব দেওয়া হত তা থেকে আমরা এই সিদ্ধান্তই নিতে পারি। আমরা বার বার সিন্ধু সভ্যতায় অভিন্নতা অর্জনের সর্বাত্মক চেষ্টার উপর বিশেষ গুরুত্ব দিয়েছি। আমার মনে হয় কিছু পুনরুক্তি হলেও বিষয়টাকে স্পষ্টতর করার জন্য এখন এ বিষয়ের উপর সংক্ষেপে হলেও কিছু কথা বলা দরকার। যেহেতু অভিন্নতা বা ঐক্য অর্জনের জন্য একটি কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব বা নিয়ন্ত্রণ অপরিহার্য সেহেতু এই কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব বা নিয়ন্ত্রণের স্বরূপ বুঝবার জন্য এখন সংক্ষিপ্ত আলোচনায় যাব।
(ঘ) সিন্ধু সভ্যতায় অভিন্নতা এবং কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রণের রূপ
সিন্ধু সভ্যতার অভিন্ন বৈশিষ্ট্যসমূহ সম্পর্কে ইতিপূর্বে কিছু আলোচনা করেছি। সেখানে যে কথা উল্লেখ করেছি তার কিছুটা পুনরুক্তি করে বলি যে, বিশাল অঞ্চলব্যাপী বিস্তৃত সভ্যতার সর্বত্র একই ধরনের নগর পরিকল্পনা, একই ধরনের ওজন, মাপ, ইটের ব্যবহার, একই সিল এবং একই লিপির ব্যবহার এবং বেশ কিছু উপকরণের অভিন্ন বৈশিষ্ট্য সমগ্র সভ্যতায় বিস্ময়কর সমরূপতা বা ঐক্যের বিষয়টিকে সবার সামনে নিয়ে আসে। এ কথা ঠিক, এত বিশাল ভূভাগ জুড়ে সবকিছু এক রকম হতে পারে না। ফলে অঞ্চল ভেদে ধর্মীয় অনুষ্ঠান পদ্ধতি এবং তৈজসপত্র ইত্যাদির ভিন্নতা লক্ষণীয়। কিন্তু তা সত্ত্বেও সভ্যতার অভিন্ন বহু বৈশিষ্ট্যই সিন্ধু সভ্যতার অভিন্নতার দিকটিকে সামনে তুলে ধরে। অভিন্নতা যে সভ্যতার প্রধান বৈশিষ্ট্য সে ব্যাপারে কোনও সন্দেহ নাই।
এখন প্রশ্ন যে, একটি কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের সুদৃঢ় নিয়ন্ত্রণ ছাড়া কীভাবে সেই যুগে এত দূরবিস্তারী সভ্যতায় এভাবে সমরূপতা অর্জন করা সম্ভব হয়েছিল? কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের নিয়ন্ত্রণ ছাড়া এটা তো কোনও কালেই সম্ভব নয়। সুতরাং এটা বোধগম্য যে, একটা খুবই শক্তিশালী কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব সভ্যতা বা রাষ্ট্রকে পরিচালনা করত। প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনাদি থেকে এটা স্পষ্ট যে, যুদ্ধ নির্ভর না হওয়ায় কোনও সামরিক শক্তি বা গোষ্ঠীর হাতে সিন্ধু সভ্যতার নেতৃত্ব বা পরিচালনা ভার ছিল না। প্রত্নতাত্ত্বিক সাক্ষ্য এবং ঋগ্বেদ থেকে এটা স্পষ্ট যে, কোনও ধর্মীয় তথা পুরোহিত শ্রেণীর হাতেও সিন্ধু সভ্যতার নেতৃত্ব বা নিয়ন্ত্রণ ছিল না।
এটা স্পষ্ট যে, প্রাচীন আর সব সভ্যতা থেকে এ ক্ষেত্রে সিন্ধু সভ্যতা সম্পূর্ণ ভিন্ন। এটা এমন এক সভ্যতা যেখানে যুদ্ধ এবং ধর্ম অন্তত প্রাধান্যে ছিল না। বরং এই দুইয়েরই অবস্থান যে সভ্যতার প্রান্তে ছিল তেমন সিদ্ধান্তেই এখন আমরা পৌঁছাতে পারি। অর্থাৎ সভ্যতা মূলত অহিংসা বা শান্তি এবং লোকায়ত চেতনার উপর প্রতিষ্ঠিত ছিল।
এই সিদ্ধান্ত থেকে আমরা এখন অনায়াসে এমন একটি সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে পারি যে, প্রচলিত অর্থে ধর্মবিশ্বাসমুক্ত তথা লোকায়তপন্থী একটি অসামরিক নেতৃত্বকারী শ্রেণী সিন্ধু সভ্যতাকে নিয়ন্ত্রণ করত। এই শ্রেণীর রূপ বুঝবার জন্য চঞ্চল এবং আমি আমাদের পূর্বেকার বিভিন্ন লেখায় আলোচনা করেছি। বিশেষত আমার লিখা ‘সিন্ধু সভ্যতার রাষ্ট্র-দর্শন’-এ এ সম্পর্কে কিছু বিশদ আলোচনা করেছি। সুতরাং এখানে এ বিষয়ে নূতন করে আলোচনা করব না। তবে খুব সংক্ষেপে এটুকু বলি যে, বুদ্ধিজীবী, প্রকৌশলী, ব্যবসায়ী, কারখানা মালিক, ভূস্বামী এবং বিভিন্ন ধরনের পেশাজীবীরা যে সিন্ধু সভ্যতার রাষ্ট্র ও সমাজের মূল নিয়ন্তা ছিল আমরা এমনটা অনুমান করতে পারি। জটিল নদীনিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থার উপর নির্ভরতার কারণে কারিগরি বা প্রকৌশল বিদ্যায় দক্ষ লোকজনের প্রভাব ও গুরুত্ব যে এই সভ্যতায় খুব বেশী ছিল সেটা মনে করার সঙ্গত কারণ আছে। একইভাবে নদীনিয়ন্ত্রণের মতো অত্যন্ত জটিল এবং সুউন্নত প্রযুক্তি-নির্ভর সভ্যতায় উচ্চশিক্ষিত ও পণ্ডিত শ্রেণীর যে বিশেষ মর্যাদা ছিল সে কথাও মনে করার কারণ আছে।
সভ্যতা যে গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে পরিচালিত সে ব্যাপারে সন্দেহ করার কারণ নাই। কারণ গোটা সভ্যতায় ক্ষমতা এবং সম্পদের অতিকেন্দ্রীভবনের চিহ্ন নাই। বরং নগর পরিকল্পনা এবং বসতিগুলি সম্পদ ও ক্ষমতার মোটামুটি ভারসাম্যপূর্ণ বণ্টন-নির্ভর একটা সমাজের চিত্র উপস্থিত করে। ফলে মিসরের পিরামিড, মেসোপটেমিয়ার জিগ্গুরাট ও প্রাসাদ এবং চীনের রাজপ্রাসাদ বা রাজার সমাধিগৃহের সমতুল্য বিরাট আয়োজন এখানে নাই। বুঝা যায় অন্যসব সভ্যতা থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন ধরনের একটি শ্রেণীর হাতে এই সভ্যতার নিয়ন্ত্রণ ছিল। এই শ্রেণী যে ধরনের হোক জনপ্রতিনিধিত্বমূলক নির্বাচনের মধ্য দিয়ে নির্বাচিত হত। হয়ত তারই জের বা ধারাবাহিকতা হিসাবে আমরা প্রাক-ব্রিটিশ কাল পর্যন্ত ভারতবর্ষে বিদ্যমান গ্রাম পঞ্চায়েতের অস্তিত্ব দেখতে পাই। প্রকৃতপক্ষে ব্রিটিশ শাসনের পূর্বকাল পর্যন্ত রাষ্ট্রের বাইরে ভারতীয় সমাজের স্বশাসনের ব্যবস্থা ছিল পঞ্চায়েত।
সিন্ধু সভ্যতায় কেন্দ্রীভূত নিয়ন্ত্রণের উপস্থিতি স্পষ্ট। অর্থাৎ পঞ্চায়েত জাতীয় কোনও প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে সম্ভবত সভ্যতার প্রতিনিধিত্বিকারী ব্যক্তিদের যৌথ সিদ্ধান্তে রাষ্ট্র পরিচালিত হত। রাষ্ট্র যে সহিংস ছিল না সে প্রশ্নে নূতন করে বলবার প্রয়োজন নাই। অর্থাৎ জনমত নিয়ন্ত্রণের জন্য প্রধান পদ্ধতি বলপ্রয়োগ ছিল না। ফলে বলপ্রয়োগের ব্যবস্থার অনুষঙ্গ হিসাবে ধর্মও ছিল না। সেক্ষেত্রে এটা সহজেই বোধগম্য যে, রাষ্ট্রকে তথা শাসক শ্রেণীকে রাষ্ট্রে ঐক্য ও সংহতি রক্ষার জন্য ভাষা ও সংস্কৃতির অভিন্নতা অর্জনের উপর সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিতে হয়েছিল। সুতরাং সভ্যতার সর্বত্র বিভিন্ন ক্ষেত্রে এমন অনুরূপতা।
সম্ভবত সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেওয়া হয়েছিল অভিন্ন ভাষা প্রতিষ্ঠার উপর। অর্থাৎ রাষ্ট্র সর্বোচ্চ জোর দিয়েছিল তার অধিকারভুক্ত বিশাল ভূভাগের সর্বত্র একটি মাত্র ভাষার প্রচার ও প্রসার ঘটাবার উপর। কারণ ভাষার অভিন্নতা যে কোনও জাতি ও সমাজের অভিন্নতা রক্ষার জন্য সবচেয়ে সহজ এবং টিকসই হাতিয়ার। আজ আমরা অনুমান করতে পারি ঋগ্বেদ যে ভাষায় রচিত হযেছে আজকের বৈদিক হিসাবে কথিত সেই ভাষা ছিল সিন্ধু সভ্যতার রাষ্ট্রভাষা। শত শত কিংবা হয়ত প্রায় সহস্র বৎসর ধরে শাসক শ্রেণী সভ্যতার বিপুল সম্পদ ও শ্রম ব্যয় করেছিল রাষ্ট্র যেখানেই প্রসারিত হয়েছিল সেখানেই এই ভাষার প্রসার ঘটাবার উপর। ফলে বিপুল সংখ্যক মানুষ এই ভাষায় লিখতে এবং পড়তে শিখেছিল। বৈদিক বিশেষত পরবর্তী কালে তার কিছু পরিবর্তিত রূপ সংস্কৃত ভাষা সম্পর্কে যারা কিছু ধারণা রাখেন তারা জানেন এই ভাষায় নিখুঁত উচ্চারণের উপর কতটা জোর দেওয়া হয়। সামান্য অকার আকার উচ্চারণেও অর্থ পরিবর্তন ঘটতে পারে। একই মন্ত্রের সামান্য ভুল উচ্চারণেও উল্টা অর্থ হতে পারে; যে ব্যক্তি ভুল উচ্চারণে মন্ত্র পাঠ করবে তার জন্য ভয়ঙ্কর বা মারাত্মক ফল হতে পারে। পৌরাণিক কাহিনী অনুযায়ী দেবতা ত্বষ্টার পুত্র বৃত্রের শত্রু দেবতা ইন্দ্রকে বধের উদ্দেশ্যে রচিত ত্বষ্টার মন্ত্রের একটা শব্দের ভুল উচ্চারণের ফলে ইন্দ্রের পরিবর্তে ইন্দ্রের হাতে বৃত্র নিহত হয়।
বৈদিক ভাষা যে সিন্ধু সভ্যতার প্রচলিত ভাষা এ সম্পর্কে ভাষাতাত্ত্বিক বিচারে অত্যন্ত সমৃদ্ধ আলোচনা ভগবান সিং তার The Vedic Harappans-এ করেছেন। বস্তুত একপাশে বৈদিক ভাষার বিপুল সমৃদ্ধি এবং সুউন্নত নগর সভ্যতার স্মারক বিশাল শব্দ ভাণ্ডার এবং অপর পাশে বিশালায়তন ব্যাপী বিস্তৃত সুউন্নত সভ্যতার অধিকারী সিন্ধু সভ্যতাকে পাশাপাশি রাখলে যে চমৎকারভাবে উভয়ের মধ্যে মিল খুঁজে পাওয়া যায় ভগবান সিং সেটা এই গ্রন্থে বিশদ আলোচনার মাধ্যমে স্পষ্ট করেছেন। ঋগ্বেদের অসংখ্য শব্দ বিচার করে তিনি দেখিয়েছেন কীভাবে সেগুলি সিন্ধু সভ্যতার মতো একটা অত্যন্ত উন্নত নগর সভ্যতার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ। প্রকৃতপক্ষে সিন্ধু সভ্যতার কাঠামোর মধ্যে ঋগ্বেদকে স্থাপন করা ছাড়া গত্যন্তর নাই। সিন্ধু সভ্যতার আবিষ্কারের পর ঋগ্বেদের পটভূমি অন্যত্র খোঁজার চেয়ে হাস্যকর ব্যাপার আর কিছুই হতে পারে না। এরপরেও যদি কেউ প্রশ্ন তুলে বলেন যে, ঋগ্বেদে বর্ণিত গ্রাম, কৃষি ইত্যাদির ব্যাখ্যা কী হবে তবে তার সহজ উত্তর হবে সভ্যতা শুধু নগর নিয়ে নয়। সেখানে গ্রামও থাকে, থাকে কৃষি, থাকে পশুপালনও। আর সবচেয়ে বড় কথা নগর সভ্যতার ক্ষয় এবং গৃহযুদ্ধের পর্যায়ে ঋগ্বেদ মূলত রচিত হয়েছিল। সুতরাং সিন্ধু সভ্যতার সেই ক্ষয় এবং অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বের পটভূমিতে ফেলেই তাকে বিচার করতে হবে।
যাইহোক, আমাদের ধারণা বৈদিক ভাষা সিন্ধু সভ্যতার রাষ্ট্রভাষা ছিল। সেই ভাষার প্রকৃত নাম কী ছিল তা অন্তত এখন পর্যন্ত আমাদের জানা নাই। সুতরাং ঋগ্বেদের ভাষার নাম বৈদিক দেওয়ায় এটাকে বৈদিক হিসাবেই আমরা অভিহিত করতে পারি। এটা এখন বোধগম্য যে, রাষ্ট্রের ঐক্য ও অখণ্ডতা রক্ষার প্রয়োজনে শাসক শ্রেণী ভাষাগত নিয়ন্ত্রণের উপর সর্বাধিক গুরুত্ব দিতে গিয়ে এই ভাষা চর্চার উপর সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়েছিল। অনুমান করি সভ্যতা যেখানেই বিস্তার লাভ করেছিল সেখানেই এই ভাষা শিক্ষাদানের জন্য শিক্ষিত লোকদেরকে পাঠানো হত। ফলে বিশাল অঞ্চলব্যাপী সভ্যতার সর্বত্র ভাষা শিক্ষাদানের জন্য এক বিশাল শিক্ষক শ্রেণী গড়ে উঠেছিল। যে ভাষার চর্চাকে রাষ্ট্র পৃষ্ঠপোষকতা দিত বিশাল সভ্যতার সর্বত্র যাতে তার পঠন, পাঠন, লিখন ও উচ্চারণে এতটুকু বিচ্যুতি বা হেরফের না ঘটে রাষ্ট্র নিশ্চয় সেদিকেও কঠোর দৃষ্টি রাখত।
এ বিষয়ে সন্দেহের কারণ না্ই যে, সিন্ধু সভ্যতার বিশাল ভূভাগে যেমন ছিল বিপুল সংখ্যক উপজাতির বাস তেমন ছিল বহুসংখ্যক ভাষারও অস্তিত্ব। একটি ভাষা বাদ দিয়ে কি আর সব ভাষা অস্তিত্ব হারিয়ে ফেলেছিল? সেটা সম্ভব না হলেও তাদের প্রান্তিক দশা আজ অনুমান করা চলে। যতদূর মনে হয় শেষ পর্যন্ত বৈদিক ভাষার মধ্যে অধিকাংশ ভাষাই বিলীন হয়ে তার আরও সমৃদ্ধি ঘটিয়েছে। হয়ত এর পরেও টিকে থাকা ছোট ছোট ভাষাগুলিও রাষ্ট্রের ভাষা দ্বারা গভীরভাবে প্রভাবিত হয়েছিল।
আজ যখন সমগ্র পৃথিবীর বিস্তীর্ণ ভূভাগে ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষা পরিবারের অন্তর্ভুক্ত ভাষাগুলির দিকে দৃষ্টি দেওয়া যায় তখন সিন্ধু সভ্যতার ভাষার শক্তির প্রচণ্ডতাকে সহজেই অনুভব করা যায়। অর্থাৎ সিন্ধু সভ্যতার অঞ্চল থেকে উত্তর-পূর্ব ভারত, ইরান, মধ্য এশিয়া এবং সুদূর ইউরোপ পর্যন্ত ভূভাগে যে যেখানে গেছে তারা প্রায় সবাই সাথে করে নিয়ে গেছে একটি অভিন্ন ভাষা হিসাবে ঋগ্বেদ যে ভাষায় লিখা হয়েছিল সেই ভাষাকে। নিশ্চয় অধিকাংশ অঞ্চলে সিন্ধু সভ্যতার অভিবাসীরা ছিল স্থানীয় জনসংখ্যার তুলনায় অত্যন্ত সংখ্যালঘু। এই সংখ্যালঘুরা সভ্যতার ভিত্তিভূমি হারালেও সংস্কৃতি ও ভাষায় ছিল তুলনায় অনেক উন্নত। সুতরাং তারা স্থানীয়দের জীবনকেও প্রভাবিত করেছে নিজেদের উন্নততর সংস্কৃতি ও ভাষা দিয়ে। স্থানীয়দের সঙ্গে কালক্রমে তাদের অনেক সংমিশ্রণ হলেও তারা যে একেবারে বিলীন হয় নাই বরং স্থানীয় সমাজ-জীবনকে প্রবলভাবে প্রভাবিত করেছিল তার প্রমাণ হচ্ছে পৃথিবীর বিস্তীর্ণ অঞ্চল ব্যাপী ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষাসমূহের আবির্ভাব। বাংলা ও হিন্দীসহ সমগ্র উত্তর ভারতবর্ষের সকল প্রধান ভাষা যেমন বৈদিক ভাষার উত্তরসূরি হিসাবে বিকশিত হয়ে ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষা পরিবারভুক্ত হয়েছে তেমন ইরান, আফগানিস্তান এবং মধ্য এশিয়ারও এক বিরাট অঞ্চলের ভাষাগুলি এবং ইংরাজী, ফরাসী, জার্মান, রুশ ও লিথুয়ানীয়সহ সমগ্র ইউরোপের সকল প্রধান ভাষাই ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষা পরিবারভুক্ত ভাষা হিসাবে বিকাশ লাভ করেছে। পৃথিবীর এক বিশাল ভূভাগকে আজ থেকে প্রায় চার হাজার বছর আগে ধ্বংস হবার পরেও সিন্ধু সভ্যতা কীভাবে তার সংস্কৃতি বিশেষত ভাষা দিয়ে প্রভাবিত করেছে এটা তার প্রমাণ। এ থেকে ধারণা করা যায় একটি ভাষার প্রতি রাষ্ট্রের কী পরিমাণ মনোযোগ এবং পরিপোষণ ছিল। এ থেকে রাষ্ট্রের সমৃদ্ধির পরিমাণ সম্পর্কেও সহজেই কল্পনা করা যায়। সবচেয়ে বিস্ময়কর ব্যাপার হচ্ছে সিন্ধু সভ্যতার অধিবাসীরা একটি রাষ্ট্রের অবলম্বন হারিয়ে নূতন আবাসের সন্ধানে যখন দেশে দেশে ভ্রাম্যমাণ যাযাবরের মতো অনিশ্চিত জীবন যাপন করছিল তখনও তারা তাদের ভাষার উত্তরাধিকারকে হারিয়ে ফেলে নাই। এ ক্ষেত্রে সভ্যতার শক্তি তো বটেই বরং তার চেয়েও বেশী করে দেখা দেয় ভাষার শক্তি, যার পিছনে ঐ রকম এক দুর্গত অবস্থায় রাষ্ট্রের সামরিক শক্তি কিংবা বস্তুগত শক্তি কোনটাই ছিল না।
অনুমান করা চলে ভাষা শিক্ষা এবং জ্ঞানচর্চার জন্য বিদ্যালয়, মহাবিদ্যালয় এবং বিশ্ববিদ্যালয় জাতীয় প্রতিষ্ঠানগুলি সাম্রাজ্যের সর্বত্র প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। এটা নিশ্চয় অনুমান করা ভুল হবে না যে ধর্মীয় আবরণে সিন্ধু সভ্যতার ভাবপ্রেরণা ধারণকারী জৈনধর্মের মতো বৌদ্ধধর্মও জ্ঞানচর্চার এই ঐতিহ্যকে ধারণ করেছে। সুতরাং আমরা ঐতিহাসিক কালের বৌদ্ধ মঠগুলিতে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ব্যাপক বিস্তার দেখতে পাই। বখতিয়ার খলজীর নেতৃত্বে বহিরাগত মুসলমান আক্রমণকারীদের হাতে ধ্বংসের পূর্বমুহূর্ত পর্যন্ত নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয় ছিল এমনই এক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয় ছিল এমনই এক আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন বিশ্ববিদ্যালয় যেখানে দেশ-বিদেশ থেকে প্রতিবছর আগত হাজার হাজার শিক্ষার্থী ভাষা, ইতিহাস, গণিত, ধর্ম, দর্শন ইত্যাদি বিভিন্ন বিষয়ে শিক্ষা গ্রহণ করত। এখানে যে ধ্বংসযজ্ঞ চালানো হয় সে সম্পর্কে সঠিক চিত্র পাওয়া খুব কঠিন, যেমন তার সঠিক সময় নিয়েও বিভিন্ন মত আছে। বিভিন্ন বিবরণ থেকে অনুমান করা চলে ধ্বংসের সময় ১১৯৩ থেকে ১২০৬-এর মধ্যে যে কোনও একটা সময় হবে। বিভিন্ন বিবরণ থেকে এটাও অনুমান করা চলে হানাদার মুসলমানদের হাতে শুধু মঠের নিরস্ত্র বৌদ্ধ শ্রমণরা নয়, উপরন্তু প্রায় দশ হাজার শিক্ষার্থী এবং আনুমানিক দেড় থেকে দুই হাজার শিক্ষক নিহত হন। এরা সকলেই ছিলেন নিরস্ত্র। বখতিয়ার খলজীর নেতৃত্বে নৃশংস ও কাপুরুষোচিত গণহত্যার পর নালন্দার বিশাল গ্রন্থাগারটিতে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়। কথিত আছে গ্রন্থাগারটির প্রায় নব্বই লক্ষ পাণ্ডুলিপি ভস্মীভূত হতে তিনমাস সময় নেয়। হয়ত এই সময়টা আরও বেশী ছিল। সেই হত্যা ও ধ্বংসের সঠিক ও বিস্তারিত বিবরণ না পাওয়ায় এখন এগুলির অনেক কিছুকেই অনুমানের উপর ছেড়ে দেওয়া ছাড়া আমাদের উপায় নাই। তবু বিভিন্ন সময়ের ছাড়া ছাড়া বিভিন্ন বিবরণ এবং ধ্বংসস্তূপের প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনাদি থেকে আমাদের সামনে পরিস্ফুট হয় এক অতুলনীয় জ্ঞানতীর্থের অত্যন্ত বেদনাদায়ক ও মর্মন্তুদ ধ্বংসের চিত্র্র। এ ছিল ইতিহাসের এক অতীব ঘৃণ্য হত্যা ও ধ্বংস যজ্ঞ। এভাবে ভারতবর্ষে সিন্ধু সভ্যতার প্রাতিষ্ঠানিক জ্ঞান সাধনার ধারাবাহিকতায় যে অবশিষ্ট আলোকবর্তিকাটুকু কোনও ক্রমে জ্বালিয়ে রাখা হয়েছিল মুসলিম হানাদাররা সেসবই নিভিয়ে দিয়ে ভারতবর্ষকে সুদীর্ঘ কালের জন্য অন্ধকারের অতল গহ্বরে নিক্ষেপ করল।
এরপর একপাশে থাকল খাইবার গিরিপথ দিয়ে অব্যাহত ধারায় আসা মুসলিম হানাদারদের স্রোত যারা ভারতবর্ষে অবিরাম ধারায় তাদের ধর্মের সঙ্গে বহন করে নিয়ে এল অবর্ণনীয় বর্বরতার অব্যাহত চর্চা, অপর পাশে থাকল ভারতবর্ষের দিগন্ত বিস্তারী অরণ্য এবং দুর্গম পাহাড়-পর্বত থেকে অব্যাহত ধারায় সভ্য সমাজে আগত পশ্চাৎপদ ও আদিম উপজাতিসমূহকে ব্রাহ্মণদের নেতৃত্বে সংগঠিত ক’রে অব্যাহতভাবে হিন্দু ধর্ম ও সমাজের নির্মাণ এবং পুনর্নির্মাণ। এ এক আশ্চর্য ঘটনা। মুসলিম আগ্রাসনে ভারতবর্ষ ভেঙ্গে পড়ল এক দীর্ঘ কালের জন্য। কিন্তু সেটা অনেকটা রাজনৈতিক ও সামরিক প্রেক্ষিতের বিচারে। কিন্তু ভারতবর্ষের জনসমাজের বিশাল অংশ হিন্দু ধর্মকে আঁকড়ে ধরে তাদের সংস্কৃতির অনেক বৈশিষ্ট্যকেই রক্ষা করল। প্রায় সর্বত্র মুসলমান আগ্রাসীরা সফল হলেও ভারতবর্ষে তাদের সাফল্য হল খুবই খণ্ডিত। এটা হিন্দু ধর্মের অবদান। আমার ধারণা এই সাফল্যের খুব বড় উৎস ভারতবর্ষের অরণ্যচারী আদিম সমাজের মানুষরা, যারা অব্যাহত ধারায় সভ্য সমাজে এসে এবং হিন্দু সমাজের অন্তর্ভুক্ত হয়ে ভারতবর্ষকে সভ্যতার বিচারে মধ্য ও পশ্চিম এশিয়া কিংবা উত্তর আফ্রিকার মতো একেবারে দেউলিয়া বা নিঃস্ব হবার হাত থেকে রক্ষা করেছে। সুতরাং এ কথা বলতে হবে যে, বহু ধরনের আদিমতা ও পশ্চাৎপদতায় নিক্ষেপ করলেও হিন্দু ধর্ম সভ্যতা ও চেতনার বিচারে ভারতবর্ষকে ঊষর মরুতে পরিণত হবার হাত থেকে রক্ষা করেছে। আর এভাবে ঠিক বৌদ্ধদের মতো করে না হলেও আর একভাবে হিন্দু ধর্ম সিন্ধু সভ্যতার উত্তরাধিকারের অনেক কিছুকে রক্ষা করেছে।
হিন্দু এবং ইসলাম এই উভয় ধর্মকে আমি মাঝে মাঝে একটা উপমা দিয়ে বুঝতে চাই। হিন্দুধর্ম যদি আরণ্যক বা বন্য জীবনের আবেষ্টন হয় তবে ইসলাম যেন ঊষর মরুজীবনের আবেষ্টন। প্রথমটা হয়ত মানুষের চেতনাকে অনেকাংশে অরণ্যের আদিমতায় নিতে চায়, কিন্তু দ্বিতীয়টা নিতে চায় মরুর শুষ্কতা ও রুক্ষতায়। কষ্টসাধ্য হলেও অরণ্য পরিষ্কার করে কৃষি কাজ করা বা সভ্যতা নির্মাণ সম্ভব। কিন্তু মরুতে চাষ করা অসম্ভব না হলেও অতীব কষ্টসাধ্য।
যাইহোক, ভাষার প্রশ্নে ফিরে বলি যে, সিন্ধু সভ্যতায় আমরা যে সমরূপতা দেখি তার পিছনে শাসক শ্রেণীর যেসব আয়োজন ছিল সেগুলির মধ্যে ভাষা একটি। সমস্ত সভ্যতায় একটি অভিন্ন ভাষার প্রবর্তন ছিল সভ্যতার জন্য অপরিহার্য। আমাদের বুঝতে হবে যে বিশাল অঞ্চলব্যাপী বিস্তৃত সভ্যতা নিশ্চয় একদিনে প্রতিষ্ঠিত হয় নাই। একটি কেন্দ্রীয় এলাকা থেকে সভ্যতার সম্প্রসারণ হয়েছে। এটা হয়ত এক বা একাধিক উপজাতির কনফেডারেসির নেতৃত্বে সংগঠিত হয়েছিল। সভ্যতার বিস্তারে যুদ্ধ যদি থেকেও থাকে তবে তার ভূমিকা যে খুব গৌণ ছিল অন্তত প্রত্নতত্ত্ব সেই সাক্ষ্য দেয়। এটা বুঝা যায় যে, সভ্যতার শান্তিপূর্ণ বিস্তারের মূল হাতিয়ার ছিল নদীনিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা। সহজে খাদ্য লাভের প্রেরণা বিশাল অঞ্চলব্যাপী বসবাসরত উপজাতিসমূহকে সহজে একটা কেন্দ্রীয় শাসনব্যবস্থায় নিয়েছে। যেহেতু বলপ্রয়োগ সভ্যতা প্রসারের প্রধান হাতিয়ার ছিল না সেহেতু উপজাতিসমূহের স্বেচ্ছাসম্মতির অতীব গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল। যারা সভ্যতার অন্তর্ভুক্ত হত তাদেরকে অর্থাৎ তাদের প্রতিনিধিদেরকে কেন্দ্রীয় নেতৃত্বে তথা রাষ্ট্রের নীতিনির্ধারণের জায়গায় নিতে হত। অন্যদিকে, নদীনিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা রক্ষা ও পরিচালনার জন্য যেমন কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রণ ছিল অতীব গুরুত্বপূর্ণ তেমন বিভক্তির শক্তি যাতে মাথা চাড়া দিতে না পারে সেদিকে সভ্যতার নেতাদেরকে সদাসতর্ক দৃষ্টি রাখতে হত। কারণ সভ্যতায় সামরিক শক্তি বা বলপ্রয়োগের ভূমিকা গৌণ থাকায় সহজেই সমাজে বিভক্তির শক্তি প্রবল হতে পারত। আর সে রকমটা ঘটলে নদীনিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থাও ভেঙ্গে পড়তে পারত। অবশ্য একবার নদীনিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থার অন্তর্ভুক্ত হলে সেখান থেকে বেরিয়ে যাওয়াও কঠিন ছিল। কারণ সামগ্রিক কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রণ ও ব্যবস্থাপনা ছাড়া নদীনিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থাকে রক্ষা করাই সম্ভব ছিল না।
সুতরাং একদিকে নদীনিয়ন্ত্রণের অন্তর্ভুক্ত হবার পর বিভিন্ন জনগোষ্ঠী যেমন তাকে রক্ষার প্রয়োজনে কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রণ রক্ষা করতে চেয়েছে তেমন সভ্যতার সর্বত্র ঐক্য ও অভিন্নতা প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে এই কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রণকে অধিকতর নিরাপদ ও নিশ্চিত করতে চেয়েছে। সুতরাং আমরা এ ব্যাপারে অনুমান করতে পারি কেন সিন্ধু সভ্যতায় অভিন্নতার এত প্রভাব। আসলে এইভাবে সভ্যতা নিজেকে রক্ষা করতে চেয়েছে।
আমার মনে হয় এ প্রসঙ্গে আমরা সিন্ধু সভ্যতার নগরগুলির প্রাচীর নিয়ে একটু কথা বলতে পারি। নগর প্রাচীর একটা রহস্য হয়ে আছে। নগর-প্রাচীরের গঠন প্রণালী থেকে এগুলি যুদ্ধে আত্মরক্ষার প্রয়োজনে নির্মিত বলে মনে হয় না।
এই কারণে অনেক প্রত্নতাত্ত্বিক অনুমান করেন যে, বন্যার হাত থেকে রক্ষার জন্য নগরপ্রাচীর নির্মাণ করা হয়েছিল। কিন্তু আরও অনেক প্রত্নতাত্ত্বিকের সঙ্গে সহমত পোষণ করে সম্প্রতি একটি বক্তৃতায় মিশেল ড্যানিনো একটা ভিন্ন সম্ভাবনার কথা বলেছেন। তিনি বলছেন যে, বাণিজ্যকে নিয়ন্ত্রণ করার উদ্দেশ্যে নগর-প্রাচীর নির্মাণ করা হতে পারে (Harappan Civilization | Michel Danino | India ki Khoj | 2019 : https://www.youtube.com/watch?v=_s5EDxuL0Vs)। তার অনুমান অনুযায়ী নগরের ভিতরে এবং বাইরে পণ্য গমনাগমনকে নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে রাষ্ট্রের আয় নিশ্চিত করার উদ্দেশ্যে নগর-প্রাচীর নির্মাণ করা হয়ে থাকতে পারে। এ কথা সবার জানা যে বাণিজ্য সিন্ধু সভ্যতায় খুবই গুরুত্বপূর্ণ স্থান অধিকার করেছিল। সুতরাং ড্যানিনোর অনুমানে যুক্তি আছে। এছাড়া কোনও কোনও পণ্ডিতের একটি মতের কথাও তিনি বলছেন যাদের মতে নগর-প্রাচীর রাষ্ট্রীয় কর্তৃত্বের প্রতীক হতে পারে।
কিন্তু আমি আর একটা সম্ভাবনার দিকেও দৃষ্টিকে নিতে চাই। সেটা হচ্ছে সিন্ধু সভ্যতায় মানুষের জীবন ও চেতনা নিয়ন্ত্রণের সর্বাত্মক একটা সাংস্কৃতিক ব্যবস্থার অংশ হিসাবে এইসব প্রাচীর নির্মাণ কিনা। প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনাদি অনুযায়ী এই সভ্যতায় মানুষের চেতনা ও জীবন নিয়ন্ত্রণের উপর যেভাবে গুরুত্ব দেওয়ার কথা অনুমান করা যায় তা থেকে এটা অনুমান করা অযৌক্তিক হবে না যে, নগরের মানুষের জীবন-যাপনের উপর নিয়ন্ত্রণ রক্ষার প্রয়োজন থেকে এই প্রাচীর দেওয়া হত। এর ফলে শাসকদের পক্ষে নাগরিকদের জীবনকে সুনিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হত। উপরন্তু এটা একটা নির্দিষ্ট সীমার বাইরে নগরের প্রসারকেও অসম্ভব করত। অর্থাৎ নগর সর্বদা থাকত নির্দিষ্ট সীমায় আবদ্ধ। এটার শুধু বস্তুগত দিক যে থাকা সম্ভব তা নয়, সেই সঙ্গে এটার মনস্তাত্ত্বিক দিকও থাকা সম্ভব। অর্থাৎ একটা নির্দিষ্ট ছকে মানুষকে আবদ্ধ রাখা — বস্তুগতভাবে এবং মনস্তাত্ত্বিকভাবেও। হয়ত শুধু নগর নয়, সমগ্র সভ্যতার সকল বসতি এবং গৃহ নির্মাণেও ছিল সুপরিকল্পিত নিয়ন্ত্রণমূলক ব্যবস্থা। অর্থাৎ এমন একটা সভ্যতা আমরা পাচ্ছি যেখানে প্রায় সমস্ত কিছু পূর্বপরিকল্পিত, সুনিয়ন্ত্রিত এবং অপরিবর্তিত। সভ্যতায় যে সব বড় ধরনের পরিবর্তন লক্ষণীয় সেগুলি প্রায় সবই সিন্ধুর নগর সভ্যতা নির্মাণ পূর্ববর্তী তথা আদি হরপ্পান কালে এবং সিন্ধুর নগর সভ্যতার ধ্বংস বা বিদায়ী হরপ্পান কালে। পরিণত হরপ্পান তথা সিন্ধুর পূর্ণাঙ্গ নগর সভ্যতা বা পরিণত হরপ্পান সভ্যতার কাল হচ্ছে সভ্যতার একটা মোটামুটি অপরিবর্তনশীলতার কাল। সভ্যতা একই রকমভাবে প্রসার লাভ করেছে। কিন্তু নূতন উদ্ভাবন ও সৃষ্টির কাল এটা নয়। সভ্যতার বিরাট বিস্তার ঘটলেও এটা তার রক্ষণশীলতারও কাল। এতে সন্দেহ নাই যে, এই রক্ষণশীলতার মূল কারণ ছিল অতীব স্পর্শকাতর নদীনিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা। সভ্যতার শক্তির যেটা অফুরন্ত উৎস ছিল সেটাই এক সময় তার রক্ষণশীলতা, অনড়তা এবং দুর্বলতার উৎসে পরিণত হয়েছিল।
(ঙ) সভ্যতার অনুরূপতা তথা ঐক্যের মূল শক্তি
এখন আমরা এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজি কোন্ শক্তি সভ্যতাকে ঐক্যবন্ধনে এত দীর্ঘ সময় বেঁধে রেখেছিল? যদি ধর্ম না হয় এবং সামরিক শক্তিও না হয় তবে কী সেই শক্তি যা একটা নেতৃত্বকে এতটা সক্ষমতা দিয়েছিল? অন্যান্য সভ্যতায় ব্যাপক জনগণকে বহুবিধ মানবিক অধিকার থেকে, খাদ্য থেকে বঞ্চিত রেখে একটা সংখ্যালঘু শাসক শ্রেণী রাষ্ট্র এবং সভ্যতা গঠন করেছিল। রাষ্ট্র প্রয়োজনীয় ছিল মূলত শাসক শ্রেণী বা উচ্চবর্গের নিরাপত্তার জন্য এবং সভ্যতা প্রয়োজনীয় ছিল এই উচ্চবর্গের স্বাচ্ছন্দ্য ও সুখভোগের জন্য। ফলে এই সকল সভ্যতায় ব্যাপক সংখ্যক জনগণকে নিয়ন্ত্রণের জন্য সামরিক শক্তি বা সেনাবাহিনীর গুরুত্ব ছিল অপরিমেয়। শুধু বহিরাক্রমণ থেকে আত্মরক্ষার প্রয়োজনে নয়, অধিকন্তু অভ্যন্তরীণ বিদ্রোহ দমন এবং অধীনস্থ জনগণকে ভয়প্রদর্শন পূর্বক শান্ত রাখার জন্যও সামরিক শক্তি ছিল অপরিহার্য। কিন্তু শুধু সামরিক শক্তিতে কুলাত না। সুতরাং জনমত তথা জনগণকে নিয়ন্ত্রণের জন্য আর সব সভ্যতায় অলোকবাদী ধর্মের ছিল অপরিমেয় গুরুত্ব। সেনাবাহিনী এবং ধর্ম এই দুইটি হাত ধরাধরি করে আর সব সভ্যতায় থেকেছে। এর কোনও ব্যতিক্রম নাই। সেটা মিসর, মেসোপটেমিয়া, চীন অথবা আমেরিকার আজটেক, মায়া এবং ইনকা সভ্যতা ইত্যাদি যেটাই হোক। সিন্ধু সভ্যতায় যে সেটা হয় নাই সেটা প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনাদির দিকে দৃষ্টি দিলে বুঝা যায়।
এ সম্পর্কে ইতিপূর্বে কিছু কথা বলেছি। তবু বলি, শুরু থেকে স্বেচ্ছাসম্মতির ভিত্তিতে ব্যাপক সংখ্যক মানুষের সাহায্য নিয়ে বাঁধ ও জলকপাট যুক্ত নদীনিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা নির্মাণ এবং সর্বাধিক সংখ্যক মানুষের ব্যবহারিক বা বৈষয়িক চাহিদার দিকে দৃষ্টি রেখে সভ্যতার নির্মাণ শুরু থেকেই জবরদস্তির প্রয়োজনকে গৌণ করেছিল। কিছু বলপ্রয়োগ না থাকবার কারণ নাই। তবে সেটার তেমন একটা প্রয়োজন না হবার একটা বড় কারণ হয়ত ছিল জলনিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থার শক্তির ব্যবহার। পরবর্তী ভারতবর্ষে অবাধ্য বা সামাজিক প্রথার বিরুদ্ধে যাওয়া ব্যক্তি বা গোষ্ঠীকে দমন করার জন্য যেমন সমাজচ্যুত করা হত এবং সেই সঙ্গে সাধারণের জন্য নির্দিষ্ট সর্বজনীন কূপ বা পুকুরের জল ব্যবহারের অধিকার থেকে বঞ্চিত করা হত হয়ত তেমনভাবে সমাজচ্যুত এবং জলবঞ্চিত করা হত। সে যুগে সমাজচ্যুত কিংবা জল ব্যবহারের সুযোগ থেকে বঞ্চিত করা অনেক সময় মৃত্যুদণ্ড দেওয়ার সমতুল্য হত। কিন্তু এ ধরনের শাস্তি তো ব্যাপক সংখ্যক মানুষকে দেওয়া সম্ভব নয়। কারণ তাতে বঞ্চিতরা নিজেরা বৃহৎ সমাজ বা গোষ্ঠী গঠন করে এ ধরনের শাস্তির উদ্দেশ্যকেই ব্যর্থ করে ফেলবে। সমাজচ্যুত কিংবা জলবঞ্চিত করে বিচ্ছিন্ন কিছু ব্যক্তিকে কিংবা খুব ক্ষুদ্র গোষ্ঠীকে শায়েস্তা করা সম্ভব, তার বেশী না।
এটা স্পষ্ট যে, সিন্ধু সভ্যতায় শক্তিশালী সেনাবাহিনী এবং অলোকবাদী ধর্মের প্রয়োজন হয় নাই সম্পদের মোটামুটি সুষম বণ্টন এবং সামাজিক ন্যায়বিচারের উপর গুরুত্ব দেওয়ায়। সমাজে ধনবৈষম্য প্রকট ছিল না। সকলের প্রয়োজন যতটা সম্ভব পূরণের প্রতি রাষ্ট্র যে মনোযোগী এই বোধও রাষ্ট্র নিশ্চয় তার নাগরিকদের মধ্যে রক্ষা করতে পেরেছিল। সুতরাং নদীনিয়ন্ত্রণ যতদিন কার্যকর ছিল ততদিন নাগরিকদের দিক থেকে রাষ্ট্র মূলত নিরাপদ ছিল। রাষ্ট্র নানানভাবে যে জনগণকে নিয়ন্ত্রণের প্রয়োজনেই অব্যাহত জনসংযোগের উপর অসাধারণ গুরুত্ব দিত সেটাও মনে হয়। আজকের যুগের মতো করে না হলেও সে যুগের মতো করে জনসংযোগের একটা রাজনৈতিক ব্যবস্থা যে রাষ্ট্র গড়ে তুলেছিল সেটা অনুমান করা চলে। হয়ত শিক্ষার অব্যাহত চর্চা ও বিস্তারের পাশে জনমতকে নিয়ন্ত্রণ বা প্রভাবিত করার জন্য অব্যাহতভাবে জনসংযোগ করা হত। এর ফলে রাষ্ট্রও জনগণের চাহিদা এবং জনমতের গতিধারাকে বুঝতে সক্ষম হত। সম্ভবত এমন একটা শাসন ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল যাতে করে অব্যাহতভাবে বিশাল রাষ্ট্রের কেন্দ্র থেকে প্রান্তে এবং প্রান্ত থেকে কেন্দ্রে চক্রাকারে মতামত সঞ্চালিত হত। হৃদযন্ত্র যেমন রক্ত সঞ্চালনের চক্রকে অব্যাহত রেখে দেহকে সজীব রাখে এটাও হয়ত তেমনভাবে সমাজ ও রাষ্ট্রকে সজীব এবং গতিশীল রাখত। হয়ত সমাজ ও রাষ্ট্রের সর্বস্তরে পঞ্চায়েতের মতো জনপ্রতিনিধিত্বমূলক কোনও ব্যবস্থা গড়ে তোলা হয়েছিল। আমার ধারণা বহু প্রাচীন কাল থেকে চলে আসা পঞ্চায়েত ব্যবস্থার শিকড় সিন্ধু সভ্যতাতেই প্রোথিত ছিল।
রাষ্ট্র সহিংসতার সংস্কৃতির বিরুদ্ধে ব্যাপক জনমত গড়ে তুলবার উপর গুরুত্ব দিত বলে আমরা ধারণা করতে পারি। ধর্মের অন্ধ বিশ্বাসের বিরুদ্ধে প্রচারের উপরও রাষ্ট্র জোর দিত বলে ধারণা করি। তবে রাষ্ট্র জবরদস্তি এড়াতে পছন্দ করত বলে সম্ভবত ধর্মের বিরুদ্ধে তার সংগ্রাম ছিল বুদ্ধিবৃত্তিক এবং প্রচারমূলক। যতদিন সভ্যতায় সঙ্কট দেখা দেয় নাই ততদিন ধর্ম সমাজ ও রাষ্ট্রের প্রান্তিক বা একেবারে গৌণ অবস্থানে ছিল বলে ধারণা করি। যেমনটা অনুমান করা চলে রাষ্ট্রের অস্তিত্বের প্রয়োজনে যুদ্ধ ও সেনাবাহিনী থাকলেও তা ছিল সভ্যতার প্রান্তবর্তী। বিশেষত সভ্যতার বিপুল সম্পদ পার্শ্ববর্তী কিংবা কিছু দূরবর্তী অঞ্চলের বিভিন্ন উপজাতি কিংবা জনগোষ্ঠীর মানুষদেরকে প্রলুব্ধ করতে পারত। প্রতিরক্ষার ব্যবস্থা একেবারে না রাখা মানে তাদেরকে সভ্যতার উপর আক্রমণে প্ররোচিত বা উৎসাহিত করা। সুতরাং অন্ততপক্ষে বহিরাক্রমণ থেকে আত্মরক্ষার জন্য পর্যাপ্ত সামরিক ব্যবস্থা সভ্যতা নিশ্চয় রেখেছিল। হয়ত সভ্যতার প্রান্তবর্তী এলাকাসমূহে প্রতিরক্ষার এমন ব্যবস্থা ছিল যেটা এখনও আমাদের অজানা।
যাইহোক, ঋগ্বেদের নির্মোহ এবং সাহসী পাঠ এবং সিন্ধু সভ্যতার এ পর্যন্ত প্রাপ্ত নিদর্শনাদির উপর মনোযোগী দৃষ্টিপাত দ্বারা আমরা সহজেই সিন্ধু সভ্যতার অনন্যতা ও মহিমার মূল উৎস হিসাবে নদীনিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থাকে চিহ্নিত করতে পারি। এ বিষয়ে সন্দেহের কারণ নাই যে, যে মানুষগুলি এমন একটা কালব্যতিক্রমী ব্যবস্থার উদ্ভাবন এবং প্রয়োগ ঘটিয়েছিল তারা এক অর্থে নিজেরাই ছিল কালব্যতিক্রমী মানুষ। নদীর দুই তীরে বাঁধ নির্মাণ দ্বারা নদীর গতিধারাকে অনেকাংশে নিয়ন্ত্রণ করা অন্যান্য সভ্যতায়ও অপ্রচলিত বা অভাবিত ছিল না। কিন্তু নদীর দুই পাশে বাঁধই শুধু নয়, অধিকন্তু নদীর মাঝখানে আড়াআড়িভাবে জলকপাটযুক্ত বাঁধ নির্মাণ দ্বারা সমগ্র নদীর জলপ্রবাহকে নিয়ন্ত্রণ বা শাসন করা আধুনিক যুগের পূর্ব পর্যন্ত অন্য সকল সভ্যতাতেই অকল্পনীয় ছিল। এমনকি সিন্ধু সভ্যতা ধ্বংসের পর আধুনিক কালের পূর্ব পর্যন্ত ভারতবর্ষেও আর কখনও এমন একটা নদীনিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা প্রবর্তনের কল্পনা কেউ করে নাই।
যাইহোক, নদীনিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা একদিনে গড়ে উঠে নাই। ‘আর্যজন ও সিন্ধু সভ্যতা’য় আমরা এ বিষযে আলোচনা করেছি। সুতরাং এ সম্পর্কে আলোচনা করব না। তবে এটুকু বলা যেতে পারে এই রকম ব্যবস্থা গড়ার উপযোগী হিসাবে দীর্ঘকাল ধরে লোকবাদী তথা অন্ধবিশ্বাসমুক্ত এবং গণতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গীসম্পন্ন একদল অনন্যসাধারণ মানুষকে গড়ে উঠতে হয়েছে। প্রকৃতির উপর হস্তক্ষেপ করতে গিয়ে ক্রমে একদল দুঃসাহসী এবং কালব্যতিক্রমী মানুষের উদ্ভব ঘটেছিল। যেহেতু মানুষের স্বেচ্ছাসম্মতির উপর তাদেরকে নির্ভর করতে হয়েছিল সেহেতু সমাজ ও রাষ্ট্র গঠনের প্রক্রিয়ায় তারা ক্রমশ প্রথার গুরুত্ব অনুধাবন করেছিল। এ সম্পর্কে আমি আমার লেখা ‘সিন্ধু সভ্যতার রাষ্ট্র-দর্শন’-এ আলোচনা করেছি। ধর্ম এবং বলপ্রয়োগ-নির্ভর আইনের পরিবর্তে ক্রমে প্রথা বা সামাজিক নিয়ম হয়ে উঠেছিল সমাজ ও রাষ্ট্র নিয়ন্ত্রণ তথা জনগণকে নিয়ন্ত্রণেরও প্রধান পদ্ধতি। অর্থাৎ সহজ করে বললে নদীনিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থার পাশাপাশি গড়ে উঠা প্রথা ছিল সিন্ধু সভ্যতার শান্তিপূর্ণ বিকাশ, বিস্তার ও স্থিতির অন্যতম মূল ভিত্তি।
সবশেষে বলতে চাই এমন একটা জনকল্যাণবাদী সভ্যতায় কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রণ এবং পরিকল্পনার যে ছাপ আমরা দেখতে পাই তা থেকে সেখানে এক ধরনের সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থার অস্তিত্ব সম্পর্কে অনুমান করাটা মোটেই অযৌক্তিক হবে না। হয়ত গণতান্ত্রিক বৈশিষ্ট্যপূর্ণ সমাজতন্ত্র কিংবা সামাজিক গণতন্ত্রের একটা আদিরূপ সেটা ছিল। ব্যক্তিমালিকানা ছিল বৈকি। তা না হলে বাণিজ্যের এমন বিকাশ সম্ভব হত না। কিন্তু সেসবই যে কঠোর সামাজিক এবং রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণের অধীনে ক্রিয়াশীল ছিল তেমনটা আমরা ধারণা করতে পারি। এর ফলে কোনও ব্যক্তির পক্ষেই অপরিমিত অর্থ-বিত্তের অধিকারী হওয়া সম্ভব ছিল না। ফলে তার প্রকাশও ঘটে নাই বাসগৃহ নির্মাণে কিংবা অন্য কোনও বস্তুগত নির্মাণে। শত শত কিংবা সহস্র বৎসর কিংবা ততোধিক কাল সমাজ ও রাষ্ট্রের সামগ্রিক পরিকল্পনা ও নিয়ন্ত্রণের ভিতরে থেকে ব্যক্তির উদ্যোগ ভূমিকা রেখেছিল বলে মনে হয়। মধ্যযুগ পর্যন্ত ভারতবর্ষের জনসমাজে বিদ্যমান পঞ্চায়েতমূলক শাসনব্যবস্থার মধ্য থেকে আমরা হয়ত সিন্ধু সভ্যতায় বিদ্যমান ব্যক্তি ও সমাজের মধ্যকার সম্পর্কের একটা আদিরূপ খুঁজে পেতে পারি।
(চ) বস্তু-নির্ভর ইতিহাস পাঠের সমস্যা
ভারতবর্ষের তথা দক্ষিণ এশিয়ার ইতিহাস পাঠ প্রসঙ্গে আলোচনায় ইতিপূর্বের দুই পর্বে উপনিবেশিক এবং হিন্দুত্ববাদী পাঠের সমস্যা নিয়ে আলোচনা করেছি। তবে বর্তমানে বিশেষত হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠ ভারত-রাষ্ট্রে ভারতবর্ষের ইতিহাস পাঠে হিন্দুত্ববাদী পাঠ জায়গা করে নিতে থাকলেও এখন পর্যন্ত সামগ্রিকভাবে ভারতবর্ষে উপনিবেশিক পাঠই আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করে আছে। বিশেষত ঋগ্বেদের হাস্যকর ও বিকৃত পাঠ পরবর্তী কালের ইতিহাস পাঠকে যেমন বিভ্রান্ত ও বিপথগামী করে তেমন আরও দূরবর্তী অতীতের সিন্ধু সভ্যতার পাঠেও অনেক সমস্যা তৈরী করে। বস্তুত ভারতবর্ষের ইতিহাস অনুসন্ধানে ঋগ্বেদ এমনই এক গুরুত্বপূর্ণ সোপান যে তাকে এড়িয়ে গিয়ে ভারতবর্ষের ইতিহাস ও সমাজের কোনও পর্যায়েরই সঠিক কিংবা বস্তুনিষ্ঠ অনুসন্ধান বা পাঠ অসম্ভব।
ঊনবিংশ শতাব্দী থেকে বহিরাগত আর্য আক্রমণ তত্ত্ব প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার অন্তর্ভুক্ত হয়ে একটি প্রায় স্বতঃসিদ্ধ সত্যে পরিণত হয়েছিল এতকাল। এর বিরুদ্ধে একমাত্র যে তত্ত্ব ছিল সেটাকে আমরা হিন্দুত্ববাদী বলতে পারি যেটা সম্পর্কেও শিক্ষিত সমাজ প্রায় সম্পূর্ণ অজ্ঞ ছিল বলা চলে। ইদানীং কালে সিন্ধু সভ্যতার প্রত্নতাত্ত্বিক আবিষ্কারগুলির ফলে বহিরাগত আর্য আক্রমণতত্ত্ব তার পায়ের নীচে মাটি হারিয়েছে। স্বাভাবিকভাবে এই অবস্থার সুযোগ নিচ্ছে হিন্দুত্ববাদী ইতিহাস পাঠ। এই পাঠের দুর্বলতা নিয়ে আমি কিছু পূর্বে আলোচনা করেছি।
তবে যত দুর্বলতা থাক ইতিহাসের উপনিবেশিক পাঠ এখন পর্যন্ত সমগ্র উপমহাদেশের ইতিহাসের প্রায় সর্বজনীন পাঠ হয়ে আছে। এর সবচেয়ে বড় উৎস হল যেটাকে ব্রিটিশ প্রবির্তিত আধুনিক শিক্ষা ব্যবস্থা বলা হয় সেটার মর্মে অবস্থিত উপনিবেশিক স্বার্থসংশ্লিষ্ট দৃষ্টিভঙ্গী। এই দৃষ্টিভঙ্গী বিশেষত উপমহাদেশের প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষায় শিক্ষিতদেরকে ইউরোপীয়দের সঙ্গে সম্পর্কের ক্ষেত্রে দাসত্বের অবস্থানে নিয়ে যায়। ফলে ইউরোপীয় জ্ঞানতত্ত্বের কোনও কিছুকেই চ্যালেঞ্জ করার সাহস এদের সাধারণত থাকে না। সুতরাং দাসত্বের এই দৃষ্টিভঙ্গীর সবচেয়ে বড় প্রচারক হয় প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার অধ্যাপক, পণ্ডিত ইত্যাদি। এরই এক মূর্ত দৃষ্টান্ত হচ্ছে মার্কসবাদী অধ্যাপক, পণ্ডিতরা। ইউরোপের প্রাধান্যকারী জ্ঞানতত্ত্ব বা ধারণাকে প্রত্যাখ্যানের জন্য এদের লাগে ইউরোপ থেকেই আগত আর একটি তত্ত্বের অন্ধ অনুসরণ। ভারতে হিন্দুত্ববাদী ইতিহাসের বয়ানকে খণ্ডন বা বিরোধিতা করতে গিয়ে এরা যেভাবে উপনিবেশিক বয়ানকে আঁকড়ে ধরে থাকেন তাতে এদের বুদ্ধিবৃত্তিক দাসত্ব এবং দারিদ্র্য দেখে এদের প্রতি করুণা ছাড়া আর কিছুই জাগে না। সত্যকে গ্রহণ করবার মতো সাহস এদেরও নাই। সত্য যত নিষ্ঠুর হোক তাকে গ্রহণ করতে না পারলে যে মানুষের নূতন ইতিহাস নির্মাণ করা যায় না সেই সত্যই এরা বুঝেন না।
যাইহোক, দীর্ঘ লড়াইয়ের অভিজ্ঞতা থেকে আমি যেটা বুঝেছি সেটা হচ্ছে এই যে, উপনিবেশিক কাঠামোবদ্ধ উপমহাদেশের বিদ্যমান প্রতিষ্ঠানসমূহের ভিতর থেকে উপমহাদেশের ইতিহাসের সঠিক পাঠ আসবে না। বিচ্ছিন্ন দুই চারজন প্রাতিষ্ঠানিক পণ্ডিত ইতিহাসের নূতন ও স্বাধীন পাঠ নির্মাণের কাজে হাত দিতে পারেন। কিন্তু আমাদেরকে অপেক্ষা করতে হবে মূলত আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত হলেও বিদ্যমান উপনিবেশিক কাঠামোবদ্ধ প্রতিষ্ঠানসমূহের বাহির থেকে আসা এক দল নূতন ইতিহাস পাঠক ও লেখকের জন্য। ভারতবর্ষের বস্তু-নির্ভর ইতিহাস পাঠ তখনই পূর্ণাঙ্গ রূপ নিবে। শুধু তাই নয়, তাদের মতো মানুষদের হাত দিয়েই নির্মিত হবে আগামী দিনের উপমহাদেশের স্বাধীন ও উন্নত চিন্তা-চেতনার উৎকর্ষ সাধনে নিবেদিত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসমূহ।
------------
উপরের আলোচনায় শামসুল আলম চঞ্চল এবং আমার উল্লেখিত কয়েকটি গ্রন্থ অথবা রচনার নাম এবং অনলাইন লিংক :
১। The Aryans and the Indus Civilization — Shamsuzzoha Manik and Shamsul Alam Chanchal (Link : http://www.bangarashtra.net/article/848.html)
২। আর্যজন ও সিন্ধু সভ্যতা — শামসুজ্জোহা মানিক ও শামসুল আলম চঞ্চল (Link : http://www.bangarashtra.net/article/853.html)
৩। Rediscovering Indus Civilization and Aryans: Journey to Our Renaissance — Shamsuzzoha Manik and Shamsul Alam Chanchal (Link : http://www.bangarashtra.net/article/1202.html)
৪। নূতন দৃষ্টিতে সিন্ধু সভ্যতা ও আর্যজন : আমাদের নবজাগৃতির উদ্বোধন — শামসুজ্জোহা মানিক ও শামসুল আলম চঞ্চল (Link : http://www.bangarashtra.net/article/1231.html)
৫। সিন্ধু সভ্যতার রাষ্ট্র-দর্শন — শামসুজ্জোহা মানিক (Link : http://www.bangarashtra.net/article/1333.html)
৬। Decline of Indus Civilization and Vedic Upheaval — Shamsuzzoha Manik and Shamsul Alam Chanchal (Link : http://www.bangarashtra.net/article/1385.html)
৭। কেস-স্টাডি ঋগ্বেদ এবং পাশ্চাত্য ও ভারতবর্ষের মূলধারার বুদ্ধিবৃত্তির স্বরূপ দর্শন — শামসুজ্জোহা মানিক (Link : http://www.bangarashtra.net/article/1387.html)
৮। সিন্ধু সভ্যতা ও আর্য সম্পর্কে পুনর্মূল্যায়ন : সঠিক ইতিহাসের প্রয়োজন কেন?’ — শামসুজ্জোহা মানিক (Link : http://www.bangarashtra.net/article/1413.html)
৯। ভগবান সিং এবং শামসুজ্জোহা মানিকের মধ্যে দুইটি পত্রবিনিময়ের অনুলিপির জন্য (Link : http://www.bangarashtra.net/article/4.html)
* ডঃ মোহাম্মদ রফিক মোগলের চিঠির অনুলিপি স্ক্যান করে নিম্নে দেওয়া হল :
রচনা : ১৩ জুন ২০১৯ – ২৩ জুন ২০১৯