Banner
নূতন দৃষ্টিতে সিন্ধু সভ্যতা ও আর্যজন : আমাদের নবজাগৃতির উদ্বোধন -- শামসুজ্জোহা মানিক এবং শামসুল আলম চঞ্চল

লিখেছেনঃ শামসুজ্জোহা মানিক এবং শামসুল আলম চঞ্চল, আপডেটঃ July 19, 2015, 12:00 AM, Hits: 2976

 

প্রাচীন পৃথিবীর উল্লেখযোগ্য চারটি নগর সভ্যতা হল মিসরের নীল নদের তীরে মিসরীয় সভ্যতা, বর্তমান ইরাকের ইউফ্রেটিস ও টাইগ্রিস নদী উপত্যকায় মেসোপটেমীয় সভ্যতা, চীনের পীত ও ইয়াংজি নদী উপত্যকায় প্রাচীন চীন সভ্যতা এবং বর্তমান পাকিস্তান ও ভারতের উত্তর-পশ্চিম অংশে সিন্ধু নদীর উপত্যকায় সিন্ধু সভ্যতা। এগুলোর বিস্তৃত এলাকা জুড়ে অবস্থান, হাজার হাজার বছর ব্যাপী স্থিতিকাল, বড় বড় নগর ও স্থাপত্য নির্মাণ, কারিগরী মানের জন্য এই সভ্যতাগুলো বিখ্যাত। সমসাময়িক সভ্যতাগুলোর মধ্যে সিন্ধু সভ্যতা অসাধারণ হিসাবে বিবেচিত হয় তার বিশাল অঞ্চলব্যাপী চমৎকারভাবে অলংকৃত জিনিসপত্র, স্থাপত্য ও নগর পরিকল্পনার উচ্চ মান, পয়:নিষ্কাশনের জন্য নর্দমা ব্যবস্থা এবং সংস্কৃতি ও ধর্মে সাধারণ মিলের জন্য। এই সভ্যতার বিস্তারও অন্যান্য সমসাময়িক সভ্যতার চেয়ে অনেক বেশী, দক্ষিণ এশিয়ার উত্তর-পশ্চিম অংশে ৬৬০,০০০ বর্গ কিলোমিটারের চেয়েও বেশী (প্রাচীন মিসর বা মেসোপটেমিয়ার চেয়ে কমপক্ষে দ্বিগুণ এলাকা জুড়ে বিস্তৃত)। এই সংস্কৃতি আট হাজার খ্রীষ্ট পূর্বাব্দে শুরু হওয়া  কৃষি ও সংগ্রহ ভিত্তিক স্থিতিশীল সমাজ থেকে যাত্রা শুরু করে দ্বিতীয় সহস্রাব্দের দ্বিতীয়ার্ধে শেষ হয়ে যাওয়া নগর বসতিগুলোর পতন পর্যন্ত ধারাবাহিকতা রক্ষা করেছিল।

      

স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন আসে যে এই অসাধারণ সভ্যতার নির্মাতা কারা, আর যে আর্যরা প্রাচীন পৃথিবীর বিরাট অঞ্চলকে সভ্য করেছিল তাদের সাথে এই সভ্যতার নির্মাতাদের কোন সম্পর্ক আছে কিনা। এই প্রশ্নটি আরও প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠে এই জন্য যে, আর্যদের সবচেয়ে প্রাচীন সাহিত্য ও ধর্মগ্রন্থ ঋগ্বেদ সিন্ধু সভ্যতা যে অঞ্চলে অবস্থিত সেই একই অঞ্চলে রচিত হয়েছিল। কিছু স্থানের নাম ছাড়াও ঐ অঞ্চলের সিন্ধু ও সরস্বতী (দীর্ঘকাল ধরে মৃত নদী) সহ সব প্রধান নদীর নামই ঋগ্বেদে বর্ণিত আছে। ঋগ্বেদের রচয়িতারা তাদের নিজেদের দেশকে অসংখ্য বার  সপ্তসিন্ধু বা সাতটি নদীর  অঞ্চল বলে উল্লেখ করেছেন, যে নদীগুলো এক সময় ভারতীয় উপমহাদেশের উত্তর-পশ্চিম অংশের বিশাল এলাকা জুড়ে প্রবাহিত হত।  তাদের দেবতারাও সপ্তসিন্ধু অঞ্চলের অর্থাৎ তাদের ভূমির সাথে ঘনিষ্ঠভাবে সংশ্লিষ্ট দেবতা হিসাবেই উল্লেখিত হয়েছে। অধিকন্তু ঋগ্বেদের কোথায়ও বলা হয় নাই যে ঋগ্বেদের রচয়িতারা অর্থাৎ আর্যরা এই সপ্তসিন্ধু অঞ্চলে বহিরাক্রমণকারী বা বাইরে থেকে আসা জনগোষ্ঠী।

  

ভারতীয় উপমহাদেশ যা দক্ষিণ এশিয়া নামে পরিচিত, বর্তমানে বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তান, নেপাল, ভুটান, ইত্যাদি দেশ নিয়ে গঠিত, তা প্রাচীনকালে ভারত নামে পরিচিত ছিল। প্রাচীন ভারত তার সাহিত্যের জন্য সমৃদ্ধ ছিল, যা প্রাচীন পৃথিবীতে অতুলনীয় । এগুলোর মধ্যে বৈদিক সংহিতা সমূহ (ঋগ্বেদ, যজুর্বেদ, অথর্ববেদ ও সামবেদ), ব্রাহ্মণ সমূহ (যেমন শতপথ বাহ্মণ, তৈত্তিরীয় ব্রাহ্মণ, ইত্যাদি) এবং আরণ্যক ও উপনিষদ সমূহ (উভয়ই সৃষ্টিরহস্য-সংক্রান্ত ও দার্শনিক গ্রন্থ, যেমন ছান্দ্যোগ্য উপনিষদ, কৌশিতকী উপনিষদ, কঠোপনিষদ, মুণ্ডক উপনিষদ, ইত্যাদি)। এছাড়াও সূত্র সমূহ (যেমন শুল্বসূত্র, শ্রৌতসূত্র, ইত্যাদি), মহাকাব্য যেমন রামায়ণ ও মহাভারত, উপকথা  যেমন পুরাণ সমূহ (বায়ু পুরাণ, বিষ্ণুপুরাণ, কুর্ম পুরাণ, ইত্যাদি)। হিন্দু, বৌদ্ধ ও জৈনদের  সাহিত্যসমূহ যেগুলোর অনেকগুলোই দুই হাজার বৎসর বা তারও বেশী প্রাচীন (কিছু অনেক আগের এবং কিছু পরবর্তীকালের)। ঋগ্বেদকে সবচেয়ে প্রাচীন বলে মনে করা হয়, যা প্রচলিত তত্ত্ব মতে ১৫০০ থেকে ১২০০ খ্রীষ্ট পূর্বাব্দের মধ্যে রচনা করা হয়েছিল বলে ধারণা করা হয় (ভারতবর্ষে তথাকথিত আর্য আক্রমণের সময়ের সাথে মিল রেখে)। দেখা গেছে যে, হিন্দু, বৌদ্ধ ও জৈনদের প্রাচীন ধর্মগ্রন্থসমূহ এবং প্রাচীন ইরানীয় জরথুস্ত্র-ধর্মের অনুসারীদের গ্রন্থ আবেস্তায় “আর্য” নামের সাথে গৌরববোধ জড়িয়ে আছে। এই প্রাচীন সাহিত্যসমূহে সম্মানিত ও সভ্য বুঝাতে আর্য শব্দ ব্যবহার করা হত। সম্মানিত ব্যক্তির প্রতি সম্মান প্রকাশ করার জন্যও এটি ব্যবহার করা হত। এভাবে আর্য নামটি প্রাচীন ভারতে সভ্যতা ও শ্রেষ্ঠত্বের দ্যোতক বা পরিচায়ক ছিল।

 

অষ্টাদশ শতকে যখন উপনিবেশিক ইংরেজরা ভারতের বিভিন্ন ভাষার সংস্পর্শে আসে, তারা দেখতে পায় যে হিন্দুদের পবিত্র ও মৃত ভাষা সংস্কৃতের সাথে প্রাচীন ইরানীয় এবং গ্রীক, ল্যাটিন, জার্মান, স্লাভিক, বাল্টিক ও ইংরাজী ভাষার আশ্চর্য রকম নৈকট্য আছে। তারা পরবর্তীকালে এই সিদ্ধান্তে পৌঁছায় যে,  এই ভাষা সমূহ পরস্পর  জ্ঞাতিসূত্রে আবদ্ধ এবং এগুলোর নাম দেয় ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষা পরিবার। পরবর্তীকালে হিন্দুদের সবচেয়ে প্রাচীন গ্রন্থ ঋগ্বেদ ও অন্য বেদ সমূহ এবং প্রাচীন ভারতীয় সাহিত্য সমূহ অধ্যয়ন করে ইউরোপীয় পণ্ডিতরা  এই সিদ্ধান্তে উপনীত হলেন যে, আরিয়  নাম থেকে উদ্ভূত আর্য নামে এক জনগোষ্ঠী চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ে ভারত, ইরান, মধ্য ও পশ্চিম এশিয়ার বিরাট অঞ্চল এবং প্রায় সম্পূর্ণ ইউরোপকে সভ্য করেছিল। পণ্ডিতরা ভ্রান্তভাবে বলেছিলেন যে, এই আর্য জনগোষ্ঠী তাদের মূল ভূমিতে যাযাবর ও পশুচারী ছিল। এভাবে আর্যদের  ভুল পরিচিতি গড়ে তোলা হল। তারা ভুলভাবে আরও বললেন যে, এই যাযাবর ও পশুচারী জনগোষ্ঠী মধ্য এশিয়ার কোন অজানা স্থান, উত্তর ইউরোপ অথবা ইউরোপের কোন অজানা অংশ থেকে উদ্ভূত হয়ে ভারতের উত্তর-পশ্চিম অঞ্চলে আক্রমণ চালায় এবং সেখানে এক সভ্যতা গড়ে তোলে। তারা আরও বললেন যে, আর্যরা ছিল উন্নততর জাতিগোষ্ঠী এবং তারা উজ্জ্বল দেহবর্ণ, উন্নত নাক এবং নীল চোখের অধিকারী।

 

জার্মান পণ্ডিতরা এই দাবী করতে লাগলেন যে, জার্মানরাই আদি আর্য অথবা আর্য জাতির নিকটতম। অ্যাডলফ্ হিটলার পৃথিবীর অন্যান্য জাতির উপর জার্মান জাতির শ্রেষ্ঠত্ব প্রতিষ্ঠা করতে চেয়ে এই তত্ত্ব গ্রহণ করলেন এবং দ্বিতীয় বিশ্ব যুদ্ধ শুরুর জন্য এই তত্ত্বের প্রেরণাকে কাজে লাগালেন। যুদ্ধে জার্মানদের পরাজয়ের পর ইউরোপীয় পণ্ডিতরা আর্যদের জাতিতাত্ত্বিক মতবাদ প্রচার প্রায় বন্ধ করে দেন। এরপর তারা বলতে লাগলেন যে আর্যরা ভাষাতাত্ত্বিক গোষ্ঠী। কিন্তু আমাদের জন্য তারা আর্য আক্রমণ তত্ত্ব বজায় রাখলেন।

 

সম্প্রতি কিছু সংখ্যক পণ্ডিত কুরগান নামে তুরস্কের আনাতোলিয়ার এক ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠীর সাথে আদি আর্যদের সম্পর্ক দেখাবার চেষ্টা করছেন। তারা মনে করছেন যে, এই জনগোষ্ঠী ঐ অঞ্চল থেকে ছড়িয়ে পড়ে এবং ইউরোপ ও এশিয়ার বিরাট অঞ্চল জুড়ে ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষা ও সংস্কৃতি গড়ে তুলে। আর্য ভাষা ও সংস্কৃতি বিষয়ে অনেক প্রশ্নের উত্তর এই তত্ত্ব দিয়ে দেওয়া সম্ভব নয় বলে এটি ধোপে টিকছে না।

 

ঋগ্বেদের কোথায়ও বলা হয় নাই যে আর্যরা বাইরে থেকে ভারতে অভিগমন করেছে অথবা আক্রমণ করেছে, অথবা আর্যরা দেশজ জনগোষ্ঠী নয়, যা আমরা আগেই উল্লেখ করেছি। এছাড়া সেখানে আর্যদের নৃতাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্যর কথাও উল্লেখ নাই। শুধু তাই নয়, ঋগ্বেদের কোথায়ও বলা হয় নাই যে আর্যরা যাযাবর বা পশুচারী জনগোষ্ঠী ছিল। বরং আর্যদেরকে বা আরিয়দেরকে ঋগ্বেদ উল্লেখ করেছে সভ্য ও স্থিতিশীল জনগোষ্ঠী হিসাবে যারা ইষ্টক নির্মিত বাড়ী ও নগরের  অধিকারী (ঋগ্বেদে সহস্র স্তম্ভ বিশিষ্ট ও সহস্র দ্বার বিশিষ্ট ভবনের কথা উল্লেখ আছে), ও যারা সমুদ্র বাণিজ্য, কৃষি ও শিল্পে নিয়োজিত ছিল। ঋগ্বেদের রচয়িতারা অসংখ্য মন্ত্রে যে উন্নত মানের সাহিত্য ও দার্শনিক চিন্তার পরিচয় দিয়েছেন তা কোনভাবেই যাযাবর দলের মস্তিষ্ক থেকে উদ্ভূত হতে পারে না।

 

মুক্ত মন ও সতর্কতার সাথে পড়লে বুঝা যায় যে ঋগ্বেদের অনেক মন্ত্রে যে যুদ্ধের কথা উল্লেখ আছে তা একই জনগোষ্ঠীর মধ্যকার যুদ্ধ। যুদ্ধরত গোষ্ঠীগুলোর যে নাম সমূহ পাওয়া যায় সেগুলোর মধ্যে বেশীর ভাগেরই আশ্চর্য রকম মিল  থেকে তা ধারণা করা যায়। বৈদিক পক্ষ তাদের শত্রুদের সম্পর্কে প্রায়ই যে দাস (ভৃত্য, সেবক বা  বর্বর, অবিশ্বাসী, অসৎ, ইত্যাদি) বা দস্যু (বর্বর, পরস্বাপহারক, অধার্মিক ব্যক্তি, যে ব্যক্তি প্রচলিত ধর্মীয় আচার বা অনুষ্ঠান না করায় গোত্র বা সমাজ থেকে বহিষ্কৃত হয়েছে, ইত্যাদি) শব্দ ব্যবহার করেছে তা শত্রুদের সম্পর্কে অমর্যাদা ও ঘৃণা প্রকাশ করার জন্য, এবং এগুলোর সাথে  কোন বিজাতীয় শত্রু জনগোষ্ঠী বা বিদেশীদের কোন সম্পর্ক নাই। সেখানে আর্য নামের সাথে উজ্জ্বল গাত্রবর্ণ, উন্নত নাসিকা অথবা নীল চোখের অধিকারী কোন বৈশিষ্ট্যের কথা উল্লেখ নাই যা ঊনবিংশ শতক ও বিংশ শতকের প্রথম দিককার পণ্ডিতরা উল্লেখ করেছিলেন। ঋগ্বেদের রচয়িতারা ভারতের উত্তর-পশ্চিমাংশের নদী ও ভূমির কথা উল্লেখ করেছেন যেখানে তারা বসবাস করতেন। কীভাবে এই প্রাচীন সাহিত্য যা সাহিত্য মূল্যে সমৃদ্ধ এবং যেখানে নগর জীবনের কথা বলা আছে, তা যাযাবর বা পশুচারী অথবা পশ্চাৎপদ কৃষিভিত্তিক জনগোষ্ঠীর দলিল হতে পারে?

 

সাম্প্রতিক নৃতাত্ত্বিক গবেষণায় জানা যাচ্ছে যে, এই অঞ্চলে খ্রীষ্ট পূর্বাব্দ পঞ্চম সহস্রাব্দ থেকে ৮০০ খ্রীষ্ট পূর্বাব্দ পর্যন্ত সময় কালে বড় ধরণের বাইরের জনগোষ্ঠীর অভিগমন হয় নাই। এভাবে সব দিক থেকে বিচার করলে খ্রীষ্ট পূর্ব দ্বিতীয় সহস্রাব্দে ভারতকে সভ্য করার জন্য পশ্চিম থেকে আক্রমণকরী আর্যদের আসার তত্ত্ব সম্পূর্ণভাবে মিথ্যা প্রমাণিত হয়।

 

১৯২০-এর দশক থেকে শুরু করে এখন পর্যন্ত ভারতীয় উপমহাদেশের উত্তর-পশ্চিম অঞ্চলে (সমগ্র পাকিস্তান,  এবং ভারতের হরিয়ানা, উত্তর প্রদেশ, ভারতীয় পাঞ্জাব, রাজস্থান ও গুজরাট জুড়ে) সিন্ধু সভ্যতার আধুনিক প্রত্নতাত্ত্বিক খননের ফলে জানা যাচ্ছে যে, সেখানে আগে থেকে বিরাজমান সমাজ ও সংস্কৃতি থেকেই পরবর্তী নগর সভ্যতা গড়ে উঠেছিল। ১৯৭০-এর দশক থেকে শুরু হওয়া প্রত্নতাত্ত্বিক অনুসন্ধান থেকে দেখা গেছে যে, ঘাগর-হাকরা নদী উপত্যকায় প্রচুর ঘন সন্নিবিষ্ট প্রাচীন বসতি ছিল। এই নদীকে তখন সরস্বতী নদী বলা হত। সরস্বতী এক সময় বিশাল নদী ছিল এবং আদি হরপ্পান ও হরপ্পান যুগে হিমালয় থেকে প্রবাহিত হয়ে ক্যাম্বে উপসাগরে পড়ত। এটি সিন্ধু সভ্যতার হরপ্পান যুগের শেষে সম্পূর্ণভাবে শুকিয়ে যায়। সরস্বতী নদীর তীরে  বিপুল সংখ্যক বসতির ঘনত্ব থাকার কারণে সম্প্রতি কিছু সংখ্যক পণ্ডিত সিন্ধু সভ্যতাকে সিন্ধু-সরস্বতী   সভ্যতা এবং ঐ অঞ্চলকে বৃহত্তর সিন্ধু উপত্যকা অথবা সিন্ধু-সরস্বতী উপত্যকা বলে অভিহিত করছেন। পাকিস্তানের পাঞ্জাব প্রদেশে অবস্থিত হরপ্পার নাম অনুসারে সিন্ধু সভ্যতার নগর পর্যায়কে কখনো কখনো হরপ্পান সভ্যতা বলা হয়। ইতিহাসের বিভিন্ন যুগে সভ্যতার বিভিন্ন পর্যায় হিসাবে সিন্ধু সভ্যতাকে নব প্রস্তর (প্রায় ৭৫০০ খ্রীঃপূঃ থেকে ৫০০০ খ্রীঃপূঃ), তাম্রযুগ (প্রায় ৫০০০ খ্রীঃপূঃ থেকে ৩৪০০ খ্রীঃপূঃ), আদি হরপ্পান (প্রায় ৩৪০০ খ্রীঃপূঃ থেকে ২৬০০ খ্রীঃপূঃ), পরিণত হরপ্পান বা হরপ্পান (প্রায় ২৬০০ খ্রীঃপূঃ থেকে ১৯০০ খ্রীঃপূঃ) এবং বিদায়ী হরপ্পান (প্রায় ১৯০০ খ্রীঃপূঃ থেকে ১০০০ খ্রীঃপূঃ) পর্যায়ে ভাগ করা হয়। পরিণত হরপ্পান বা হরপ্পান হল সিন্ধু সভ্যতার নগর পর্যায় যাকে মাঝে মাঝে হরপ্পান সভ্যতা বলা হয়, যা আমাদের আলোচনার মূল বিষয়।

 

রাজা বা শাসকদের জমকালো রাজপ্রাসাদ আর মন্দিরের বিবেচনায় সিন্ধু সভ্যতা প্রাচীন মিসর বা মেসোপটেমিয়ার মত চোখ ধাঁধানো নয়, কিন্তু সেখানে সামাজিক স্তরবিভাজন আশ্চর্যজনকভাবে কম দৃশ্যমান  এবং তা সম্পদ ও ক্ষমতায় কম বৈষম্যপূর্ণ।১০ সিন্ধু সভ্যতার উদ্ভব ও বিকাশ যে শান্তিপূর্ণ পদ্ধতিতে হয়েছিল তা বুঝা যায় ধাতুর ও অন্য পদার্থের তৈরী  নীচু মানের ও  কম সংখ্যায় অস্ত্রের নমুনা থেকে, পাথরের, পোড়া মাটির বা ধাতুর জিনিসের উপর যুদ্ধের দৃশ্যের অনুপস্থিতি থেকে এবং এ বিষয়ে অন্যান্য প্রত্নতাত্ত্বিক সাক্ষ্য থেকে। সিন্ধু-সরস্বতী উপত্যকার বসতিগুলো থেকে প্রাপ্ত সাক্ষ্য থেকে এ বিষযটি বলা যায় যে, সভ্যতার নির্মাতারা শান্তিপূর্ণ উপায়ে বিশাল এলাকা জুড়ে বিভিন্ন গোত্র-উপজাতি অথবা সামাজিক গোষ্ঠী বা সম্প্রদায়কে একক নেতৃত্বের অধীনে একটি সাম্রাজ্যে একীভূত করেছিল প্রধানত শান্তিপূর্ণ পদ্ধতিতে। শান্তিপূর্ণ পদ্ধতির কারণেই বিশাল অঞ্চল জুড়ে এই সভ্যতায় সমরূপতার পাশাপাশি বিভিন্ন স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য এবং বৈচিত্র্য রক্ষা পেয়েছিল।

 

প্রাচীন পৃথিবীর সভ্যতাগুলোতে নিষ্ঠুরতা ছিল এক সাধারণ বিষয় । প্রাচীন চীন ও মেসোপটেমিয়ায় এই বিষয়টি সাধারণ ছিল যে, যখন রাজারা মারা যেত তখন তাদের সেবক ও দাসদেরও হত্যা করা হত এবং মৃত্যু পরবর্তী জীবনে সেবা করবার জন্য রাজার সাথে তাদেরকে সমাধিস্থ করা হত । সিন্ধু সভ্যতায় তার সমস্ত সময়ব্যাপী কখনই এই ধরণের প্রথার প্রচলন দেখা যায় না। সমগ্র সভ্যতায় এমন কোন ভবন বা কাঠামো পাওয়া যায় নাই যাকে রাজার সমাধি, মন্দির বা রাজকীয় সমাধি হিসাবে চিহ্নিত করা যায়। রাজ প্রাসাদের অনুপস্থিতি থেকে এ বিষয়টি বুঝা যায় যে সেখানে ক্ষমতা বা সম্পদের অতি-কেন্দ্রীভবন ছিল না। এ থেকে আরও বুঝা যায় যে সমগ্র সাম্রাজ্য শাসন করার জন্য সেখানে স্থায়ী বা বংশানুক্রমিক রাজা ছিল না। এই কারণে কেউই অত্যধিক সম্পদ এবং ক্ষমতার সমাবেশ ঘটাতে পারত না এবং ফলশ্রুতিতে কেউই নিজের ক্ষমতা ও সম্পদ প্রদর্শন করার জন্য প্রকাণ্ড ও দীর্ঘস্থায়ী কাঠামো নির্মাণ করতে পারত না।

 

মিসর, মেসোপটেমিয়া আর চীনে আমরা দেখেছি কীভাবে নির্মমতার রাজত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। বিভিন্ন জিনিসের উপর আঁকা ছবি, সমাধি থেকে পাওয়া নিদর্শন থেকে এবং রাজপ্রাসাদ ও মন্দিরের বিশাল স্থাপত্য থেকে এ বিষয়টি প্রমাণিত হয়। মিসরের বিশাল সব পিরামিড তৈরীতে হাজার হাজার বা লক্ষ লক্ষ  দাসের শ্রমকে শতাব্দীর পর শতাব্দী ব্যবহার করা হয়েছিল। এ বিষয়ে সন্দেহ নাই যে, শাসকরা অবশ্যই বল প্রয়োগের মাধ্যমে তাদেরকে শ্রমে নিয়োজিত করেছিল।

 

সিন্ধু সভ্যতায় ধাতুর জিনিসের উপস্থিতি বসবাসের এলাকা জুড়ে তুলনামূলকভাবে সমভাবে ছড়ানো ছিল। হরপ্পান বসতিতে কোন নির্দিষ্ট এলাকায় বা কোন নির্দিষ্ট বসতির কোন ধরণের স্থাপত্য কাঠামোর মধ্যে ধাতুর জিনিসপত্র কেন্দ্রীভূতভাবে পাওয়া যায় নাই।১১ এ থেকে বোঝা যায় যে, জনসাধারণের মধ্যে সম্পদ তুলনামূলক সমভাবে বণ্টিত ছিল এবং রাষ্ট্র ও সমাজে ক্ষমতার অতিকেন্দ্রীভবনের অভাব ছিল।

 

অন্যান্য নগর সভ্যতায় এটা স্বাভাবিক ছিল যে শাসকদের বাসস্থান বা প্রাসাদের আশেপাশে ধনী লোকদের বাড়ীঘর কেন্দ্রীভূত থাকত এবং কম ধনী লোকজন নগরের প্রান্তের দিকে বসবাস করত। মেসোপটেমিয়ার নগর রাষ্ট্র সমূহের রাজারা তাদের ক্ষমতা প্রদর্শন করার জন্য বিশদভাবে বিন্যস্ত প্রাসাদ ও বিশাল মন্দির তৈরী করত। মেসোপটেমিয়ার নগরগুলোতে দরিদ্ররা প্রাচীর ঘেরা নগরের বাইরে বসবাস করত।১২

 

মিসরে বড় কোন নগর পাওয়া যায় নাই, কিন্তু ফারাও বা রাজাদের হাতে ক্ষমতা কেন্দ্রীভবনের প্রকাশ হিসাবে রাজারা সমাধি সৌধ স্বরূপ বৃহদাকার পিরামিড, বিশাল মন্দির এবং মূর্তি নির্মাণ করেছিল।

 

সিন্ধু সভ্যতায় ধনী ও অন্যান্য শ্রেণীর লোকদের বাড়ীঘর সমস্ত নগর জুড়ে ছড়ানো ছিল এবং কোন কুটির ও খড় বা পাতার ছাউনি দেওয়া ঘর সিন্ধুর নগর বা শহরগুলোতে পাওয়া যায় নাই। সেখানকার নগর বা শহরগুলো বিশদভাবে বিন্যস্ত ছিল এবং সেখানে প্রায় সকল শ্রেণীর লোকের বসতি থাকত,  সোজা রাস্তা ও গলি ছিল, যা প্রাচীন সভ্যতাগুলোর মধ্যে অতুলনীয় ছিল। নগর বা শহরগুলি ব্যাপক ও বিশেষীকৃত গোষ্ঠীসমূহের মানুষদের উপস্থিতিকে প্রকাশ করে, যার মধ্যে আছে কুমোর, প্রস্তর খোদাইকারী, তামা, ব্রোঞ্জ, রূপা ও সোনার উপর কাজ করার জন্য ধাতু শিল্পী, অলংকার নির্মাণকারী, সীল খোদাইকারী, চূড়ি নির্মাণকারী, পুতি শিল্পী, ভাস্কর এবং আরও অনেকে। নগর, শহর ও গ্রামের অন্য বিশেষীকৃত শিল্প ছিল পশুবাহিত গাড়ী ও চাকা নির্মাণ। সেখানে অবশ্যই নৌকা নির্মাতা ও নাবিকদের উপস্থিতি ছিল যারা দীর্ঘ দূরত্বের বাণিজ্য করত। নগরগুলোতে আরও কিছু পেশার লোকজন ছিল যারা লিপিকার, পরিমাপকারী, জরিপকারী, নগর পরিকল্পনাকারী এবং ধর্ম ও আচার-অনুষ্ঠান সংক্রান্ত কাজে জড়িত ছিল। সামাজিক জটিলতার সমস্ত নিদর্শনই সিন্ধু সভ্যতার নগর ও শহরগুলিতে পরিস্ফুট ছিল, এর ভবনগুলিতে, বিন্যাসে এবং ধাতুর, পোড়ামাটির এবং অন্যান্য জিনিসে। সিন্ধু-সরস্বতী উপত্যকার নগর ও শহরগুলোতে ঢাকনা বিশিষ্ট নর্দমা সাধারণভাবে পাওয়া গেছে, যা থেকে বুঝা যায় যে শাসকরা নগর ও শহরে বসবাসকারী সর্বাধিক সংখ্যক মানুষের নাগরিক সুযোগ-সুবিধার প্রতি মনোযোগী ছিল।

 

হরপ্পান সভ্যতার বিভিন্ন প্রধান বসতির নরকংকালের উপর পরীক্ষা করে দেখা গেছে যে, সমাজের উঁচু ও নীচু স্তরের লোকদের মধ্যে পুষ্টি ও খাদ্য জনিত বৃদ্ধি ও বিকাশের পার্থক্য তুলনামূলকভাবে কম ছিল।১৩ অন্যান্য সভ্যতায় এটি সাধারণ ব্যাপার ছিল যে, নীচু স্তরের জনসাধারণের মধ্যে খাদ্যাভাব জনিত প্রভাব স্পষ্টভাবে প্রতীয়মান হত। এটা সিন্ধু-সরস্বতী উপত্যকায় সম্পদ ও ক্ষমতার কম বৈষম্যসহ এক সমৃদ্ধ সমাজ থাকার ইঙ্গিত দেয়। সিন্ধু সভ্যতার প্রধান নগর কেন্দ্রগুলো হল হরপ্পা (৭৬ হেক্টর), মহেঞ্জোদাড়ো (৮৩ হেক্টর), গানেরিওয়ালা (৮১.৫ হেক্টর) এবং রাখিগাড়ি (৮০ হেক্টর)।১৪  এই নগরগুলির কোনটিতেই সম্পদ ও ক্ষমতার   কেন্দ্রীভবন এবং নগরগুলির মধ্যে আয়তনের বড় পার্থক্য না থাকায় কোন বিশেষ নগরকেই রাজধানী হিসাবে চিহ্নিত করা যায় না। এইসব বৈশিষ্ট্য এই সমাজে গণতন্ত্র থাকার সম্ভাবনাকে প্রকাশ করে।

 

হরপ্পান সমাজ যে ব্যবহারোপযোগবাদী ছিল তা জানা যায় ধাতুর তৈরী জিনিসের ব্যবহার থেকে। এখানে মানুষেরা জীবনের ব্যবহারিক প্রয়োজনে লাগে এমন কাজেই এগুলো ব্যবহার করত, অন্যান্য প্রাচীন সভ্যতার মত প্রদর্শন কিংবা সমাজে নিজের মর্যাদার অবস্থান প্রকাশ করার জন্য সেটা ছিল না।১৫

 

এখানে অন্যান্য সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্যের সাথে এমন কি ছোট বসতিগুলোতেও হরপ্পান লিপি ছিল। প্রত্নতাত্ত্বিকরা উল্লেখ করেছেন যে, নগর কেন্দ্রগুলোতে শিক্ষার মত অপরিহার্য বৈশিষ্ট্যসমূহ তুলনামূলক ছোট বসতিগুলোতেও প্রতিফলিত হয়েছিল, যা সীল ও অন্যান্য বস্তুর মধ্যে লেখার উপস্থিতি থেকে বুঝা যায়। ধোলাভিরা নগরের প্রবেশদ্বারে একটি সাইনবোর্ড পাওয়া গিয়েছিল যেখানে সিন্ধুলিপি খোদিত ছিল (লিপিগুলো প্রায় ৩৭ সেন্টিমিটার উচ্চতা ও ২৫-২৭ সেন্টিমিটার প্রস্থ বিশিষ্ট ছিল)১৬। এ থেকে বুঝা যায় যে সিন্ধু সভ্যতার একটি বৃহৎ জনগোষ্ঠী শিক্ষিত ছিল; সম্ভবত সাইনবোর্ডটিতে বণিক বা নগরে আগমনকারী লোকজনের জন্য কোন তথ্য উল্লেখিত ছিল। এটি মানব সভ্যতার ইতিহাসে এখন পর্যন্ত জানা সর্বপ্রাচীন সাইনবোর্ডের নিদর্শন। সিন্ধু লিপির পাঠোদ্ধার ছাড়া এটি বলা খুব কঠিন যে হরপ্পান নগর এবং শহরগুলো কীভাবে ক্রিয়াশীল ছিল এবং কীভাবে এত বড় একটি সাম্রাজ্যে শাসন কার্য পরিচালিত হত। অগ্নিবেদী, যাকে আর্যদের সাথে সম্পর্কিত করা হয়, বনওয়ালী, কালিবংগান ও লোথালের মত হরপ্পান বসতিগুলোতে পাওয়া গেছে। আর্যদের সাথে সম্পর্কিত অন্য একটি প্রতীক স্বস্তিকা চিহ্ন সম্বলিত সীলও সিন্ধু সভ্যতায় পাওয়া গেছে।

 

আমাদের উভয়ের (শামসুজ্জোহা মানিক ও শামসুল আলম চঞ্চল) লিখিত ১৯৯৫ সালে প্রকাশিত বই The Aryans and the Indus Civilization- এ১৭  ঋগ্বেদ, সিন্ধু সভ্যতার প্রত্নতত্ত্ব ও নৃতত্ত্ব থেকে আমরা এই সিদ্ধান্তে উপনীত হই যে আর্যরা দক্ষিণ এশিয়ার উত্তর-পশ্চিম অঞ্চলের স্থানীয় অধিবাসী এবং তারা সিন্ধু সভ্যতা গড়ে তুলেছিল। ২০০০ খ্রীষ্টপূর্বাব্দ থেকে ১৭০০ খ্রীঃপূঃ-এর১৮ মধ্যে সভ্যতার ক্ষয় শুরু হলে  তারা দলে দলে পশ্চিম দিকে ইরান, মধ্য প্রাচ্য, মধ্য এশিয়া এবং সমগ্র ইউরোপে, অন্যদিকে পূর্ব দিকে গাঙ্গেয় উপত্যকা এবং দক্ষিণ ভারতে ছড়িয়ে পড়ে।

 

বইটিতে দেখানো হয়েছে যে ঋগ্বেদ হল এমন এক গৃহযুদ্ধের দলিল যা সিন্ধু সভ্যতার হরপ্পান পর্যায়ের শেষের দিকে সিন্ধু সভ্যতার ক্ষয় শুরু হলে সংঘটিত হয়েছিল এবং সভ্যতার পতনকে ত্বরান্বিত করেছিল। সভ্যতার শেষ পর্যায়ে সামাজিক ও অর্থনৈতিক সংকটের প্রেক্ষিতে সমাজের ক্ষুব্ধ ও বঞ্চিত অংশ সপ্তসিন্ধুর রাষ্ট্রের ধর্মকে সংস্কার করতে শুরু করে এবং গৃহযুদ্ধের সূচনা ঘটায়। যেহেতু ঋগ্বেদ ঋষিদের দ্বারা রচিত সপ্তসিন্ধু জনগোষ্ঠীর একাংশের ধর্মীয় সংস্কার আন্দোলনের ফসল, স্বাভাবিকভাবেই ঋগ্বেদে সিন্ধুর সমাজ ও সংস্কৃতির তুলনামূলকভাবে সামান্য প্রতিচ্ছবিই দেখতে পাওয়া যায়। প্রচলিত তত্ত্বের বিপরীতে আমরা দেখিয়েছি যে, সিন্ধু-সরস্বতী উপত্যকার আর্যরা ইরান, পশ্চিম এশিয়া ও ইউরোপের কিছু অংশকে সভ্য করেছিল এবং দক্ষিণ এশিয়ার সমাজে সভ্যতাকে নীচু পর্যায়ে টিকিয়ে রেখেছিল। বইটি বর্তমানে বাজারে পাওয়া যাচ্ছে না, কিন্তু ওয়েবসাইট বঙ্গরাষ্ট্র-এ  বিনা মূল্যে পাওয়া যাচ্ছে (www.bangarashtra.org অথবা  www.bangarashtra.net   Library বিভাগে)।

 

সিন্ধু সভ্যতার নির্মাতা আর্যরা যে প্রাচীন পৃথিবীর সবচেয়ে সভ্য জনগোষ্ঠী ছিল তা খুবই ভালভাবে বুঝা যায় যখন আমরা ঋগ্বেদ ও অন্যান্য প্রাচীন ভারতীয় সাহিত্য এবং সিন্ধু ও অন্যান্য সভ্যতার প্রত্নতাত্ত্বিক প্রমাণ সমূহের সমাবেশ ঘটাই এবং তুলনামূলক পর্যালোচনা করি। আমরা দৃঢ়ভাবে বলছি যে, তারা দেশজ জনগোষ্ঠী ছিল যারা ২৬০০ খ্রীঃপূঃ-এ পরিণত হরপ্পান সভ্যতার সূচনার আগে দীর্ঘ ও ধারাবাহিকভাবে অন্তত পাঁচ হাজার বছরের সামাজিক ও সাংস্কৃতিক প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে এসেছিল এবং এভাবে উন্নত নগর সভ্যতা গড়ে তুলেছিল। এতে কোন সন্দেহ নাই যে, ঋগ্বেদের ভ্রান্ত ও অস্পষ্ট ব্যাখ্যা দিয়ে ইংরেজ শাসনামলে উপনিবেশিক যুগের পাশ্চাত্য পণ্ডিতরা ইচ্ছাকৃতভাবে আর্য বিষয়ে মিথ্যা তত্ত্ব দাঁড় করান ভারতীয় জনগণকে এই গৌরব থেকে বঞ্চিত করার জন্য যে, তারা প্রাচীন পৃথিবীতে এক অত্যুৎকৃষ্ট সভ্যতার অধিকারী ছিল। এভাবে প্রাচীন পৃথিবীর সবচেয়ে সভ্য মানুষদের গ্রন্থ পরিণত হল পশুচারী, যাযাবর আর বর্বর মানুষদের গ্রন্থে! যে মানুষেরা দক্ষিণ এশিয়ার দেশজ জনগোষ্ঠী ছিল, তারা পরিণত হল বহিরাক্রমণকারী অথবা বহিরাগত অভিবাসীতে!

 

সিন্ধু সভ্যতা বুঝতে আমাদের ঋগ্বেদকে ব্যবহার করা প্রয়োজন এ কথা মনে রেখে যে এটি ধর্মীয় সংস্কার আন্দোলন থেকে উদ্ভূত এবং সিন্ধু সভ্যতার পুরোহিত বা ঋষিদের একটি বিরোধী বা বিবদমান গোষ্ঠী দ্বারা রচিত। সুতরাং ঋগ্বেদের সকল বিষয়কে সিন্ধু সভ্যতার সাথে মেলাতে চাওয়া একটি ভুল পদ্ধতি। ঋগ্বেদের রচনার সময়ে সভ্যতা ইতিমধ্যেই ক্ষয়ের পর্যায়ে ছিল। এবং ঋগ্বেদের ঋষিদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ ছিল নূতন বৈদিক ধর্ম প্রতিষ্ঠিত করতে গিয়ে ধর্মের নূতন উপাদান ও আচার-অনুষ্ঠান এবং নূতন দেবতা সমূহ চালু করা। তাই, ঋগ্বেদের  অন্তত গুরুত্বপূর্ণ কিছু  দেবতার পক্ষে সিন্ধু-সরস্বতী সমাজ ও রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ দেবতা হওয়া সম্ভব নয়।

 

প্রত্যেক সফল ধর্ম পুরাতন প্রচলিত ধর্মের সংস্কার প্রচেষ্টার ফলেই উদ্ভূত হয়। অন্যথায় সেই সমাজের মানুষ তাকে গ্রহণ করে না। এ বিষয়ে বৈদিক ধর্মেরও কোন ব্যতিক্রম নাই। সিন্ধু সভ্যতার প্রচলিত ধর্মকে সংস্কার করতে চেয়ে বৈদিক সংস্কারকরা পুরাতন অনেক উপাদানই গ্রহণ করেছিল এবং একই সময়ে অনেক নূতন এবং এমন কি বাইরের উপাদানও গ্রহণ করেছিল। এভাবে বাস্তবে বৈদিক সংস্কারকরা পুরাতন ধর্মের জায়গায় নূতন ধর্ম প্রতিষ্ঠা করল।

 

বৈদিক সংস্কারকরা যে নূতন ধর্মের উদ্ভব ঘটায় তাতে তাদের প্রয়োজন পূরণ করার জন্য যুদ্ধ একটি প্রধান ভূমিকা নিয়েছিল। কিন্তু আমরা সিন্ধু সভ্যতার প্রত্নতাত্ত্বিক প্রমাণ থেকে জানি যে পৃথিবীর অন্যান্য সভ্যতার বিপরীতে সিন্ধু সভ্যতা বিশাল অঞ্চল জুড়ে প্রধানত অহিংস পদ্ধতিতে উদ্ভূত ও বিস্তৃত হয়েছিল। এটি মনে হয় যে, এই বিশাল সভ্যতায় অন্তত বড় সময় ধরে বলপ্রয়োগ বা সহিংসতা এবং যুদ্ধ গৌণ বা তাৎপর্যহীন ভূমিকা পালন করেছিল। কিন্তু এমন এক সময় এল যখন এই সভ্যতার অহিংস বিকাশ ও সম্প্রসারণের ভিত্তি ভেঙ্গে পড়তে থাকে, সভ্যতার ভিতর থেকে সংকট শুরু হয়১৯ এবং ফলশ্রুতিতে সমাজ সহিংস পদ্ধতি গ্রহণের প্রয়োজন উপলব্ধি করে। এটি সহজবোধ্য যে, সিন্ধু সভ্যতার প্রতিষ্ঠাতারা সভ্যতাকে শান্তিপূর্ণ অথবা অহিংস পদ্ধতিতে নির্মাণ ও রক্ষা করার জন্য অহিংসার আদর্শ গড়ে তুলেছিল। এটা স্বাভাবিক যে ধর্ম সাধারণ মানুষের জন্য আদর্শিক কাঠামোয় সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করত। এই অবস্থায় বৈদিক সংস্কারকদের প্রচলিত ধর্মকে সংস্কার করার প্রয়োজন দেখা দেয় যুদ্ধ বা সহিংস পদ্ধতির পক্ষে জনগণকে প্রস্তুত করার জন্য। এভাবে অনেক ক্ষেত্রেই বৈদিক ধর্ম-সংস্কার অতীত ঐতিহ্য থেকে নিজেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলল।

 

ঋগ্বেদ সম্পর্কে পরিষ্কার ধারণা পাবার জন্য আমরা ইসলামের সাথে বৈদিক ধর্মকে তুলনা করতে পারি। মুহাম্মদ আরবে নূতন ধর্মের সূচনা করেন সেখানে প্রচলিত বহুদেবতাবাদী ধর্মকে সংস্কার করে। তিনি বহুদেবতাবাদী কুরাইশদের এবং মক্কা ও তার আশেপাশে বসবাসকারী বহুদেবতাবাদী লোকজনের প্রধান দেবতা আল্লাহ্‌কে একমাত্র দেবতা হিসাবে ঘোষণা করেন এবং অন্য সকল দেব ও দেবীকে প্রত্যাখান এবং প্রচলিত মূর্তি পূজাকে নিষিদ্ধ করেন। এই প্রক্রিয়ায় তিনি স্থানীয় বহুদেবতাবাদীদের অনেক প্রাচীন বিশ্বাস ও প্রথা এবং বহিরাগত খ্রীষ্টান ও ইহুদীদের অনেক বিশ্বাস ও রীতি তাঁর নূতন ধর্মে অন্তর্ভুক্ত করেন। যেহেতু ইসলাম আরব ভূমি থেকে উৎপন্ন তাই এর মধ্যে তার অনেক  সামাজিক বাস্তবতার ছাপ পাওয়া যায়। কিন্তু ইসলাম বা তার গ্রন্থ কুরআন কি তার জন্মের সময়ের সামগ্রিক সমাজকে প্রতিফলিত করে? ইসলাম পূর্ব আরব আর ইসলাম পরবর্তী আরবের মধ্যে অনেক মিল সত্ত্বেও এই দুই আরবের মধ্যে দুস্তর ব্যবধান রয়েছে। ভাষা এবং কিছু বৈশিষ্ট্যের মিল থাকার পরও এই দুই আরবের সমাজ দুইটি ভিন্ন ও পরস্পর বিরোধী পৃথিবীকে প্রকাশ করে। তা সত্ত্বেও ইসলামের ধর্মগ্রন্থ কুরআন সমসাময়িক আরব সমাজ সম্পর্কে একটা ধারণা পেতে আমাদেরকে সাহায্য করে।

 

বৈদিক ধর্ম বা ঋগ্বেদের ক্ষেত্রেও একই ঘটনা প্রযোজ্য। ঋগ্বেদের মধ্য দিয়ে আমরা সিন্ধু সভ্যতার কেবল একটি আংশিক চিত্র দেখতে পাই। কিন্তু অবশ্যই, পক্ষপাতহীনতা ও মনোযোগ দিয়ে ঋগ্বেদ পড়লে সিন্ধু সভ্যতার স্থানীয় মানুষদের একটি গোষ্ঠীর রচনা বলে সহজেই তাকে চিনতে পারা যায়।

 

ঋগ্বেদের ঋষিদের দ্বারা পরিচালিত ধর্ম সংস্কার আন্দোলনের সময়, আমরা সহজেই জরথুস্ত্র দ্বারা সূচিত অপর একটি ধর্ম সংস্কার আন্দোলন দেখতে পাই, যার ধর্মগ্রন্থ হল আবেস্তা২০। ইতিহাসে অনেক বিপর্যয়ের মধ্য দিয়ে যাওয়ার ফলে আবেস্তায় অনেক পরিবর্তন ঘটেছে। কিন্তু এতসব পরিবর্তনের পরেও সিন্ধু-সরস্বতী অঞ্চলে আবেস্তার উৎপত্তি হবার বিষয়টিকে চিহ্নিত করা যায়। আবেস্তা সিন্ধু-সরস্বতী অঞ্চলে একটি সমান্তরাল ধর্মীয় সংস্কার আন্দোলনের চিত্র তুলে ধরে, যা বৈদিক সংস্কার আন্দোলনের বিপরীতে দাঁড়াবার লক্ষ্য নিয়ে গড়ে উঠেছিল২১। এটি চমকপ্রদ যে বৈদিক ও আবেস্তান দুই প্রতিদ্বন্দ্বী পক্ষই  গর্বের সাথে নিজেদেরকে আর্য বলে দাবী করছে ও বিরোধী পক্ষকে হীনতা সূচক নাম বা পরিচয় দিয়ে গালাগালি করছে। ঋগ্বেদের মত আবেস্তায়ও সিন্ধু সভ্যতার পূর্ণাঙ্গ চিত্র পাবার চেষ্টা করা বাস্তব সম্মত নয়। কিন্তু এটা স্পষ্ট যে উভয় দলিলই সিন্ধু-সরস্বতী উপত্যকায় দুটি বিপরীত পক্ষের ধর্ম সংস্কার আন্দোলন থেকে উদ্ভূত, যা এই বিশাল রাষ্ট্রে এক ব্যাপক গৃহযুদ্ধের সূচনা করেছিল।

 

এখন এটি বোধগম্য যে, সিন্ধু সভ্যতার পতনের পর আবেস্তান আর্যরা ইরানে বৃহৎ সাম্রাজ্য গঠনের ঐতিহ্য নিয়ে যায়। তবে পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে সিন্ধু সভ্যতার তুলনামূলক শান্তিপূর্ণ উপায়ে বৃহৎ সাম্রাজ্য গড়ার পদ্ধতি ইরানে আর ধারাবাহিকতা রক্ষা করে নাই। এরপরও আবেস্তানরা সিন্ধু সভ্যতার মধ্যকার বিভিন্ন সামাজিক গোষ্ঠী, ধর্মীয় ধারণা এবং সাংস্কৃতিক প্রথা সমূহকে একত্র করার ভাবপ্রেরণাকে ইরানে বহন করে নিয়ে যায়। পরবর্তী ইতিহাসে এমনকি এর সর্বাধিক সম্প্রসারণের সময়ও আবেস্তান ইরানীয় সাম্রাজ্য সমন্বয়ের মাধ্যমে ধারণ এবং সহনশীলতার এই নীতি তার বিশাল সাম্রাজ্যে প্রয়োগ করেছিল। প্রাচীন ইরানীয়রা আর্য হিসাবে গৌরব বোধের একই ধারাবাহিকতা রক্ষা করেছিল এবং তাদের দেশের নাম আর্য পরিচিতি থেকে উদ্ভূত ইরান রেখেছিল।

 

সাম্প্রতিক প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন এবং নৃতত্ত্ব, বাস্ত্তসংস্থানবিদ্যা এবং আধুনিক পদ্ধতিতে জরিপের ফলে জানা যাচ্ছে যে, দূর অতীতে সিন্ধু সভ্যতা একটি গৌরবময় সভ্যতা ছিল যা ঐ অঞ্চলে পূর্বের সংস্কৃতি ও সমাজ থেকে শান্তিপূর্ণ উপায়ে উদ্ভূত হয়েছিল, সম্পদের তুলনামূলক সমান বণ্টনসহ সমাজে সমৃদ্ধি ছিল, বিপুল সংখ্যক শিক্ষিত জনগোষ্ঠীর উপস্থিতি এবং সমাজে ও রাষ্ট্র শাসনে এক ধরণের গণতন্ত্রের উপস্থিতি ছিল। এই বিষয়গুলো এই সভ্যতাকে প্রাচীন পৃথিবীতে অতুলনীয় সভ্যতা হিসাবে প্রতিষ্ঠিত করেছিল। পরবর্তী কালের ভারতীয় সমাজে মধ্য যুগে ইসলামী আগ্রাসনের পূর্ব পর্যন্ত ভারতীয় শাসকদের রাষ্ট্র শাসনের ক্ষেত্রে তুলনামূলক শান্তিপূর্ণ ও নম্র পদ্ধতি অনুসরণ এবং বল প্রয়োগের উপর তুলনামূলক কম প্রাধান্য প্রদান এবং জনসাধারণের কল্যাণের উপর বেশী গুরুত্ব আরোপ নিশ্চিতভাবে সিন্ধু সভ্যতার ঐতিহ্য থেকে উদ্ভূত হয়েছিল।

 

এখন আমরা সহজেই বৌদ্ধ ও জৈন মতবাদকে পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে পরিবর্তিত রূপে হয়ত একই ঐতিহ্যের ধারাবাহিকতা হিসাবে চিহ্নিত করতে পারব। বাস্তবিকপক্ষে কোন মহাসভ্যতাই তার উত্তরাধিকারকে পরের প্রজন্মের সভ্যতার কাছে হস্তান্তর না করে মৃত্যু বরণ করে না। সিন্ধুর মত একটি মহাসভ্যতা, যা অন্য সকল সভ্যতা থেকে বিশাল, যার দীর্ঘ পটভূমি ও আয়ুষ্কাল আছে এমন একটি সভ্যতা অভিবাসনের মাধ্যমে অথবা বিভিন্ন ধরণের সংযোগের মাধ্যমে অবশ্যই তার উত্তরাধিকারকে হস্তান্তর করেছিল এবং তার প্রভাবকে বিশাল অঞ্চলব্যপী ছড়িয়ে দিয়েছিল। এটা আরও বেশী করে এই উপমহাদেশ ও ইরানের জন্য প্রযোজ্য যেখানে আমরা দেখতে পাই যে অনেক ভাঙ্গন, অবক্ষয় আর পরিবর্তন সত্বেও সিন্ধু সভ্যতার সাংস্কৃতিক ধারাবাহিকতা পৃথিবীর যে কোন অঞ্চলের চেয়েও অধিকতর কাল অবিচ্ছিন্নভাবে রক্ষা পেয়েছিল।

 

এই উপমহাদেশে বৈদিক বা সংস্কৃত ভাষার সমৃদ্ধি, দীর্ঘস্থায়িত্ব আর প্রভাব সিন্ধু সভ্যতার শক্তির ফলেই ঘটেছিল এবং উপমহাদেশ ও তার বাইরে বিরাট অঞ্চলব্যাপী এত বিপুল সংখ্যক সমগোত্রীয় ভাষার বিকাশ ও সম্প্রসারণও একই কারণে ঘটেছিল। প্রকৃতপক্ষে ভাষা সমাজের সৃষ্টি। সুতরাং একটি বিকশিত ভাষা একটি বিকশিত সমাজকেই প্রতিফলিত করে। যদি আমাদের বিশ্বাস করতে হয় যে প্রচণ্ড শক্তিশালী সভ্যতার পটভূমি ছাড়া কিছু বর্বর, যাযাবর অথবা পশ্চাৎপদ কৃষি থেকে আসা লোকজন ঋগ্বেদের মত সমৃদ্ধ ও শক্তিশালী ভাষা সৃষ্টি করেছে, যা বিশাল অঞ্চলব্যাপী প্রসারিত এত বিপুল সংখ্যক ভাষার পূর্বসূরি বা পূর্বপুরুষ, তাহলে আমাদেরকে ঐশ্বরিক পরিকল্পনায় বিশ্বাস করতে হবে এবং সব কিছুকেই ঈশ্বরের ইচ্ছা হিসাবে ব্যাখ্যা করতে হবে।

 

ভারতে আর্য আক্রমণ তত্ত্ব ইতিহাসের সত্যকে অস্বীকার করার জন্য প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে, যা এখনও চালু আছে সিন্ধু-সরস্বতী উপত্যকায় এত আবিষ্কার হবার পরও এবং ঋগ্বেদসহ অন্যান্য প্রাচীন গ্রন্থ অধ্যয়নের পরও। এক সময় এটি ছিল উপনিবেশের মানুষদের অধীনস্থ রাখার জন্য পাশ্চাত্যের শাসকদের পরিকল্পনার অংশ। পাশ্চাত্যের পণ্ডিতরা তাদের উদ্দেশ্য পূরণের স্বার্থে  জ্ঞানের তত্ত্বায়ন করে এই কর্ম পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করেছিল। উপনিবেশের মানুষদেরকে তাদের মহিমান্বিত অতীতের গৌরববোধ থেকে বঞ্চিত করার প্রয়োজনে এটি তাদের জন্য প্রয়োজন ছিল। সুতরাং, ভারতবর্ষে আর্য আক্রমণ তত্ত্ব উদ্ভাবন করা হয়েছিল।

 

ভারতীয় উপমহাদেশ বা দক্ষিণ এশিয়া এখন আর উপনিবেশ নয়। কিন্তু সাম্রাজ্যবাদী রাজনীতির পাণ্ডিত্য আজও জ্ঞানতত্ত্বের উপর প্রভাব বিস্তার করে আছে। তাই বুদ্ধিবৃত্তিক বা মানসিক এবং বস্তুগত উভয় ক্ষেত্রে উপনিবেশিক উত্তরাধিকারের ধারাবাহিকতা রক্ষা করার জন্য একই উপনিবেশিক ধারায় এখনও ইতিহাস লেখা হচ্ছে।

 

আজকের পৃথিবীতে যে উন্নত ও শিল্পায়িত দেশগুলো গৌরবের সাথে দাঁড়িয়ে আছে, তারা তাদের উন্নয়ন অর্জন করেছিল তাদের উচ্চাকাঙ্ক্ষা ও অতীতের গৌরবময় ঐতিহ্যের জন্য তাদের গৌরববোধ ছিল বলেই। এমন এক সময় ছিল যখন ইউরোপ হাজার বছরের জন্য অজ্ঞানতার অন্ধকার যুগে হারিয়ে গিয়েছিল। ত্রয়োদশ শতাব্দীর শেষ ও চতুর্দশ শতাব্দীর শুরু থেকে ইউরোপীয়রা গ্রীসের প্রাচীন জ্ঞান ভাণ্ডার আবিষ্কার করতে শুরু করে এবং গ্রীক ও রোমান ঐতিহ্যের ভাণ্ডার থেকে তাদের গৌরবের সামগ্রী সংগ্রহ করতে থাকে। এভাবে তারা মধ্যযুগের অন্ধকারের বেড়ী চূর্ণ করে এবং তাদের নবজাগৃতি বা রেনেসাঁর সূচনা ঘটায়। একইভাবে, আমরা যদি সিন্ধু সভ্যতা ও আর্যদের উত্তরাধিকারী হিসাবে দক্ষিণ এশিয়া এবং ইরানসহ আশেপাশের অঞ্চলের জাতিগুলির মর্যাদা আর স্বাধীনতার সাথে উন্নয়ন চাই, তাহলে আমাদেরকেও আমাদের ইতিহাস থেকে গৌরবের উৎস খুঁজে বের করতে হবে। আর তখন আমরা সিন্ধু সভ্যতার অত্যুৎকৃষ্ট ও মহান উত্তরাধিকার দেখতে পাই, যা এই উপমহাদেশের ভূমি-সন্তান আর্যদের দ্বারা নির্মিত ছিল।

 

ভারতবর্ষে আর্য আক্রমণের প্রতারণাপূর্ণ তত্ত্বকে এখন আমাদের ছুঁড়ে ফেলে দিতে হবে এবং আমাদের স্বাধীন জ্ঞানতত্ত্ব প্রতিষ্ঠা করে আমাদের ইতিহাসের সত্যকে প্রতিষ্ঠা করতে হবে। আমাদের ভবিষ্যৎ সভ্যতার নূতন দিগন্তের পথ রচনায় আমাদের উত্তরাধিকার হিসাবে সিন্ধু সভ্যতা এবং এই অত্যুৎকৃষ্ট মহাসভ্যতার নির্মাতা আর্যরা আমাদের প্রেরণা ও গৌরবের এক বিশাল উৎস হতে পারে। নূতন প্রেক্ষিতে সিন্ধু সভ্যতা ও তার সংস্কৃতি ও মানুষদের সম্পর্কে উপলব্ধি হতে পারে আমাদের নবজাগৃতির যাত্রাবিন্দু ।   

 

টীকা :

১।     Jonathan Mark Kenoyer, Ancient Cities of the Indus Valley Civilization, Oxford University Press and American Institute of Pakistan Studies, Karachi, 1998, p. 17.


২।     M. Rafique Mughal, “Further Evidence of the Early Harappan Culture in the Greater Indus valley: 1970-90”, in, South Asian Studies 6, 1990, pp. 177-197.


৩।    ঋগ্বেদ অনেক লেখক ইংরাজীতে অনুবাদ করেছেন। এগুলোর মধ্যে একটি হল Ralph T.H. Griffith –এর The Hymns of the Ṛgveda, Motilal Banarsidass Publishers Pvt. Ltd, Delhi, 1973.


৪।    আর্যদের ভারতে তথাকথিত আগমণের উপর পণ্ডিতরা যে সমস্ত আলোচনা করেছেন তাতে ১৫০০ খ্রীঃপূ থেকে ১২০০ খ্রীঃপূঃ ধরেছেন।


৫।    Kenneth A.R. Kennedy, “Have Aryans been identified in the prehistoric skeletal record from South Asia? Biological anthropology and concepts of ancient races”, in, George Erdosy, ed., The Indo-Aryans of Ancient South Asia: Language, Material Culture and Ethnicity, Munshiram Manoharlal Publishers Pvt. Ltd., New Delhi, First Published 1995, pp. 46-61.


৬।    D.P. Agrawal and R.K. Sood, “Ecological Factors and the Harappan Civilization”, in, Harappan Civilization: A Contemporary Perspective”, ed. Gregory L. Posssehl, Oxford & IBH Publishing Co. in Collaboration with American Institute of Indian Studies, New Delhi, 1982, pp. 223-226.


৭।    S.P. Gupta, “The Indus-Sarasvatī Civilization: Beginnings and Developments, in, The Aryan Debate, ed., Thomas R. Trautmann, Oxford University Press, New Delhi, 2005, pp. 157-165.


৮।    M. Rafique Mughal, “Further Evidence of the Early Harappan Culture in the Greater Indus Valley: 1971-1990,” in, South Asian Studies 6 (1990), p.176.


৯।    Jean-Francois Jarrige, “Chronology of the Early Periods of the Greater Indus as seen from Mehrgarh, Pakistan,” in, South Asian Archaeology 1981, ed., Bridget Allchin, Cambridge University Press, Cambridge, 1984, pp. 22-23.
M. Rafique Mughal, Further Evidence of the Early Harappan Culture in the Greater Indus Valley: 1971-1990, in, South Asian Studies 6 (1990), p. 177-197.
Jim G. Shaffer & Diane Lichtenstein, 1999: “Migration, philology and South Asian archaeology”, in, Aryan and Non-Aryan in South Asia: Evidence, Interpretation and Ideology: Proceedings of the International Seminar on Aryan and Non-Aryan in South Asia, ed. by Johannes Bronkhorst and Madhav M. Deshpande, University of Michigan, Ann Arbor, pp. 244-256.


১০।    Jim G. Shaffer, 1993: “Harappan Culture: A Reconsideration”, in, Harappan Civilization: A Recent Perspective, ed. by Gregory L. Possehl, IBH Publishing Co. Pvt. Ltd., New Delhi, Second Revised Edition, p. 48.


১১।    প্রাগুক্ত, পৃঃ ৪৭।


১২।    Susan Pollock, Ancient Mesopotamia, Cambridge University Press, Cambridge, 1999, pp. 46-52.


১৩।    M. Rafique Mughal, “The Harappan “Twin Capitals” And Reality”, Journal of Central Asia, Vol. XIII, No. 1 (Juluy, 1990), pp. 158-159
J.M. Kenoyer, Ancient Cities of the Indus Valley Civilization (1998), pp. 50-53.

 

 ১৪।    Gregory L. Possehl, ed., Harappan Civilization: A Contemporary Perspective, Oxford & IBH Publishing Co., New Delhi, 1982.

 

২০০০ ও ২০০১ সালে জলের নীচে শব্দ তরঙ্গ পরীক্ষার (Sonar underwater landscape testing)  সাহায্যে গুজরাটের কাছে ক্যাম্বে উপসাগরে সাগরের ২০ থেকে ৪০ মিটার গভীরতায় একটি নিমজ্জিত নগর পাওয়া গিয়েছিল, যেখানে সিন্ধু সভ্যতার প্রাচীন নগরগুলোর মত বৃহদাকার জ্যামিতিক আকৃতির কাঠামো ছিল। শব্দ তরঙ্গের ধারাবাহিক পরীক্ষায় মাইলের পর মাইল এই ধরণের নগরের মত উপস্থিতি দেখা গেছে। শব্দ তরঙ্গের পরীক্ষার ফলে গভীর খাল পাওয়া গেছে যা থেকে বুঝা যায় যে, ক্যাম্বে উপসাগর বা খম্বট এক সময় সাগর তলের উপরে ছিল এবং সেখানে ভূমির উপর দিয়ে প্রবাহিত নদী অথবা নদীর মোহনা ছিল।

 

সাগর জলের তলে খননের ফলে অনেক জিনিসপত্রের সাথে এক টুকরো কাঠ পাওয়া গিয়েছিল যা বেলনাকার এবং কেন্দ্রে ছিদ্র থাকার জন্য মানুষের তৈরী বলে মনে করা হয়। এটি প্রথম পরীক্ষা করে যে বয়স পাওয়া যায় তা ৯,৫০০ বছর পুরোন বা ৭,৫০০ খ্রীঃপূঃ-এর। ঐ কাঠের নমুনাটি অন্য একটি পরীক্ষাগারে পরীক্ষা করা হয়, এবং তাতে মাত্র ৫,০০০ খ্রীঃপূঃ-এর তারিখ দেখায়। পরবর্তীকালে ২০০২ ও ২০০৪ সালে জলের নীচে আরও খনন পরিচালনা করা হয় এবং ঐ বসতি থেকে মৃৎপাত্র, পুতি, আরও কাঠ এবং প্রায়-মূল্যবান পাথর (semi-precious stone) পাওয়া যায়।

 

অসংখ্য ভূ-দৃশ্যচিত্র জরিপের ফলে সেখানে বৃহৎ মন্দিরের মত কাঠামো, হরপ্পান রীতির বৃহৎ ভিত্তির উপর স্থাপিত ভবন সমূহ, স্তম্ভ, গম্বুজ এবং এমন কী সিঁড়ির মত দেখতে কাঠামোর প্রমাণ পাওয়া যায়।

 

সমুদ্র জল ঘোলা ও উচ্চ গতিবেগের জন্য জলের তলে যে কোন বিশদ জরিপ পরিচালনা করা এবং সে কারণে কোন গবেষণা পরিচালনা করাও কঠিন। কোন সিদ্ধান্তে পৌঁছানোর পূর্বে আমাদের আরও মাঠ পর্যায়ের গবেষণা এবং প্রকাশিত দলিলের জন্য অপেক্ষা করতে হবে।

 

১৫।    Jim G. Shaffer, 1993: “Harappan Culture: A Reconsideration”, in, Harappan Civilization: A Recent Perspective, ed. by Gregory L. Possehl, IBH Publishing Co. Pvt. Ltd., New Delhi, Second Revised Edition, p. 48.


১৬।    Jonathan Mark Kenoyer, Ancient Cities of the Indus Valley Civilization, Oxford University Press and American Institute of Pakistan Studies, Karachi, 1998, p. 53.

 

১৭।    Shamsuzzoha Manik and Shamsul Alam Chanchal, The Aryans and the Indus Civilization, Dinratri Prakashani, Dhaka, 1995.

 

১৮।    Bridget and Raymond Allchin, in, Origins of a Civilization: The Prehistory and Early Archaeology of South Asia, Published by Viking in Penguin Books India (P), Ltd., 1997, pp.208-213.

 

১৯।    আমরা এই সংকটের কারণ সম্পর্কে আমাদের গ্রন্থ The Aryans and the Indus Civilization- এ আলোচনা করেছি।

 

২০।    জরথুস্ত্র ধর্মের গ্রন্থ আবেস্তার ইংরাজী অনুবাদ করেছেন James Darmesteter, The Zend Avesta, Second Edition, Oxford 1895, Sacred Books of the East series, vol. IV & XIII –এ।

 

২১। ঋগ্বেদ ও আবেস্তার তুলনামূলক অধ্যয়ন ও বিচার আমাদের একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তে নিয়ে যায়, তা হল সিন্ধু সভ্যতার ক্ষয়ের পর্যায়ে দুটি ধর্মগ্রন্থই একই সময়ে দুইটি বিবদমান ধর্মীয় সংস্কার আন্দোলনের ফসল। প্রথমে বৈদিক ধর্মান্দোলন শুরু হয় সিন্ধুর প্রচলিত ধর্মকে প্রতিস্থাপিত করতে চেয়ে। বৈদিক সংস্কার প্রচলিত অহিংস পদ্ধতিকে প্রত্যাখ্যান করেছিল এবং তার বিবেচনানুযায়ী সামাজিক অবস্থার প্রয়োজনীয় পরিবর্তন আনতে চেয়ে সহিংস পদ্ধতি গ্রহণ করে। বাস্তবিকপক্ষে, ক্ষয়ের পর্যায়ে ঐ সভ্যতার শাসক শ্রেণীসহ জনসাধারণ দ্বিধাবিভক্ত হয়ে পড়েছিল। এটা মনে হয় যে, শাসক শ্রেণীর একটি সংখ্যালঘু অংশ পরিবর্তন ও সহিংসতাকে গ্রহণ করেছিল। সুতরাং তারা জনসাধারণকে সংগঠিত করতে চেয়ে পুরাতন ধর্মের বৈদিক সংস্কারকে পৃষ্টপোষকতা বা অনুপ্রাণিত করেছিল। একই অধ্যয়ন থেকে আমরা এই সিদ্ধান্তে পৌঁছাই যে বৈদিক সংস্কারের উদ্যোগ শাসক শ্রেণীর সংখ্যাগুরু অংশকে পুরাতন ধর্মের অপর একটি  সংস্কারকে পৃষ্টপোষকতা করতে বাধ্য করেছিল। এভাবে একটি পাল্টা সংস্কার হয়েছিল, যা জরথুস্ত্রের দ্বারা আবেস্তান ধর্ম গঠনের দিকে নিয়ে যায়। বৈদিক যুদ্ধকে মোকাবিলা করতে গিয়ে আবেস্তান ধর্মকেও সিন্ধুর ধর্ম ও সমাজের সাধারণ নীতি অহিংসাকে বর্জন করতে হয়। এভাবে এক দীর্ঘ গৃহযুদ্ধ শুরু হয়েছিল যা ইতিমধ্যেই মরনোন্মুখ সভ্যতার মৃত্যুর সাথে শেষ হয়ে যায়।

 

প্রকৃতপক্ষে, যে শর্তসমূহ সিন্ধু সভ্যতার নির্মাতা এবং নেতৃত্বকে  সমাজ ও রাষ্ট্রের অহিংস বা শান্তিপূর্ণ উপায়ে গঠন ও বিকাশের পথ অনুসরণে সহায়তা দিয়েছিল অথবা এমন কি বাধ্য করেছিল, সেসব শর্ত তার পতনের পর্যায়ে আর বিদ্যমান ছিল না। তাই পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে অহিংসা আর টিকতে পারল না। এই পরিস্থিতিতে সমাজের ভিতর থেকে যুদ্ধ ও ধ্বংসের শক্তিকে মুক্ত করতে একটি সংস্কার প্রয়োজনীয় ছিল অথবা অবশ্যম্ভাবী হয়েছিল । এটি দুই প্রান্ত থেকে বৈদিক ও আবেস্তান সংস্কারের মাধ্যমে করা হয়েছিল। এভাবে বেশীরভাগ ক্ষেত্রেই পরবর্তী ইতিহাসে আর্যরা যেখানে গেছে সেখানে যুদ্ধ প্রধান বা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে শুরু করে।

 

পরবর্তী ভারতীয় সাহিত্যে বৈদিক ও আবেস্তানদের সংঘাত এক সুগভীর প্রভাব রেখেছিল। ভারতীয় পুরাণগুলো এই সংঘাতের স্মৃতিতে পরিপূর্ণ। পুরাণ বা উপকথার অসংখ্য কাহিনীতে সুর (দেবতা) ও অসুরের (দানব অথবা দেবতার শত্রুপক্ষ) সংঘাতের কথা বলা আছে, যা আমাদেরকে বৈদিক ও আবেস্তান গোষ্ঠীর সংঘাতের কথা মনে করিয়ে দেয়।

 

যখন আমরা ১৯৯৫ সালে  আমাদের ইংরাজী গ্রন্থ The Aryans and the Indus Civilization প্রকাশ করি আমরা তখনও উপরের সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে পারি নাই যে আবেস্তান সংস্কারও সিন্ধু-সরস্বতী নদী উপত্যকায় ঘটেছিল। সুতরাং, আমরা সেখানে বলেছিলাম যে আর্যরা বৃহত্তর সিন্ধু উপত্যকা থেকে  ইরানে অভিগমন করার পর সেখানে অপর একটি সংস্কার করে, যা থেকে আবেস্তা  রচিত হয়। আরও অধ্যয়ন আমাদেরকে এই সিদ্ধান্তে নিয়ে যায় যে বৈদিক ও আবেস্তান দুই বিরুদ্ধ ধর্মীয় সংস্কার আন্দোলন একই সাথে পরস্পর বিরোধী আন্দোলন হিসাবে সিন্ধু-সরস্বতী উপত্যকায় সভ্যতার ক্ষয়ের পর্যায়ে ঘটেছিল। আমাদের এই নূতন উপলব্ধিকে আমরা ২০০৩ সালে প্রকাশিত আমাদের বাংলা বই আর্যজন ও সিন্ধু সভ্যতা-য় আলোচনা করেছি, যা ইংরাজি বইটির তুলনায় সমৃদ্ধ ও অনেক বিশদ। বাংলা বইটি বিনামূল্যে পড়া এবং ডাউনলোড করার জন্য অন্তর্জাল www.bangarashtra.org (বৈশাখী বাংলা ফন্টে) এর গ্রন্থাগার বিভাগে পাওয়া যাচ্ছে। আমরা বইটির ইংরাজী অনুবাদ প্রকাশ করার ইচ্ছা রাখি।

 
(প্রবন্ধটি ওয়েবসাইট বঙ্গরাষ্ট্র-এ ৯ সেপ্টেম্বর ২০১২ তারিখে প্রকাশিত একই লেখকদের লিখা ইংরাজী প্রবন্ধ Rediscovering Indus Civilization and Aryans: Journey to Our Renaissance-এর বাংলায় ভাষান্তর।)

 

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
Archive
 
সাম্প্রতিক পোষ্টসমূহ