Banner
জ্ঞানকাণ্ডে কাণ্ডজ্ঞানহীনতা : পুনরায় ঋগ্বেদ — শামসুজ্জোহা মানিক

লিখেছেনঃ শামসুজ্জোহা মানিক, আপডেটঃ March 22, 2018, 12:00 AM, Hits: 1658


 
বিষয়সূচী :

প্রথম পর্ব : প্রাককথন

দ্বিতীয় পর্ব : ঋগ্বেদ এবং জ্ঞানতাত্ত্বিক বিভ্রাট

তৃতীয় পর্ব :  সঠিক জ্ঞানের উৎস

 

প্রথম পর্ব : প্রাককথন

ইচ্ছা আছে জ্ঞানকাণ্ডে যে সকল কাণ্ডজ্ঞানহীনতার চর্চা চলে সেগুলিকে কয়েকটি লেখায় সংক্ষেপে তুলে ধরব। তারই অংশ হিসাবে আজকের লেখা।

জ্ঞানকাণ্ড বলতে আভিধানিক অর্থ বেদের দার্শনিক অংশ উপনিষদ কিংবা দর্শন বা philosophy বুঝাতে এখানে আমি আলোচনার অবতারণা করতে যাচ্ছি না। বরং যেটাকে সহজ বাংলায় বুদ্ধি-বিবেচনা কিংবা বিচার-বুদ্ধি বলে সেটাকেই এখানে বুঝাতে চাচ্ছি। আর সেই বুদ্ধি-বিবেচনায় অনেক ক্ষেত্রে যে মতিভ্রম হয় সেটাকে তুলে ধরতে আমার এই আলাচনার অবতারণা। আমাদের বুদ্ধি-বিবেচনা কিংবা বিচার-বুদ্ধি যে কত সময়ে কত সহজেই লোপ পায় কিংবা চিরকালই ভুলটাকে সত্য জেনে স্থির সিদ্ধান্তে অটল থাকতে চাই তার অনেক দৃষ্টান্ত দেওয়া যায়। একটা তো সহজ দৃষ্টান্ত সব সময়ই হাতের কাছে মওজুদ থাকে। ধর্ম। তবে ধর্ম হচ্ছে যুক্তির পরিবর্তে অন্ধ বিশ্বাসের জায়গা। সুতরাং ওটা অন্ধ বিশ্বাসীদের জায়গা। কখনও যুক্তি-প্রমাণ কিংবা বিজ্ঞান মনস্কতার ভান করলেও ধর্মবিশ্বাসীরা আর যা-ই হোক জ্ঞানতত্ত্বের জায়গায় খবরদারির স্পর্ধা করে না বা সাহস করে না। যদি কেউ করে তবে সেটা করে মূর্খদের সভায়। কিন্তু জ্ঞানতত্ত্বের জায়গাতেও যে বিজ্ঞান কিংবা বৈজ্ঞানিক দৃষ্টি থেকে বিচার-বিশ্লেষণের নামে অনেক হাস্যকর অন্ধত্ব শুধু নয় এমনকি মূর্খামিরও চর্চা করা হয় জ্ঞানের বিভিন্ন শাখায় বিচরণের সময় হঠাৎ করে হলেও কখনও সেটারও দেখা মিলে।

আসলে জ্ঞানের পথ দুর্গম। বহু প্রাচীন কালে সে কথাটা উপনিষদের ঋষি বলে গিয়েছেন। কথাটা এমন — উঠো, জাগো, হে জীব, উৎকৃষ্ট আচার্যের নিকট জ্ঞাত হও। ক্ষুরের তীক্ষ্ণ ধার যেমন অতিক্রম করা যায় না, কবিরা বলেছেন জ্ঞানের পথও তেমনই দুর্গম।

সংস্কৃতে শ্লোকটা এমন —

উত্তিষ্ঠত জাগ্রত প্রাপ্য বরাণ্নি বোধত।

ক্ষুরস্য ধারা নিশিতা দুরত্যয়া

দুর্গম পথস্তৎ কবয়ো বদন্তি।

(কঠোপনিষদ তৃতীয়া বল্লী ১৪ শ্রুতি)

আমি যখন যশোর শহরে দশম শ্রেণীতে পড়তাম তখন মনোরঞ্জন রায়ের লেখা ‘দর্শনের ইতিবৃত্ত’ পড়েছিলাম। প্রাচীন ভারত ও গ্রীসের দর্শন এবং আধুনিক ইউরোপীয় দর্শন সম্পর্কে সেই বই পড়েই আমি প্রথম একটা ধারণা অর্জন করি। সেখানে ‘উপনিষদের চিন্তাধারা’ অধ্যায়ে লেখক প্রাচীন ঋষির এই উক্তি বাংলা মানেসহ উদ্ধৃত করেছিলেন। আমাকে খুব নাড়া দিয়েছিল। বহুকাল আগের পড়া বইটার এই শ্লোকটা আমার মুখস্থ হয়ে গিয়েছিল, যা মাঝে মাঝে আমি আপন মনে আবৃত্তি করতাম। তবে এখানে পাঠকদের সঙ্গে এই উদাত্ত মন্ত্রটা শেয়ার করার আগে আর একবার দেখে নিতে চেয়ে ভেবেছিলাম বইটা হয়ত নাই। কারণ বইটা পাচ্ছিলাম না। আমার ছেলেবেলা থেকে তিল তিল করে সঞ্চিত বহু বই-ই নাই। আমার অনিশ্চিত, ঝঞ্ঝাক্ষুব্ধ জীবনের ধাক্কায় সেসব বিদায় নিয়েছে। কিছু গেছে বন্যার জলে, কিছু গেছে উই পোকার পেটে। কিছু নানানভাবে। এরপরও কীভাবে যেন আমার অনেক স্মৃতি বিজড়িত ‘দর্শনের ইতিবৃত্ত’ যা পড়ে আমার কিশোর বয়সে উদ্বেলিত হয়েছিলাম তা রয়ে গিয়েছিল।

কিন্তু কিছু খুঁজে বইটা না পেয়ে প্রথমে ভেবেছিলাম বন্যা এবং উই পোকার বদলে এবার ওটা পুলিশে নিয়েছে। ‘ব-দ্বীপ প্রকাশন’ থেকে ‘ইসলাম বিতর্ক’ নামে একটা অনুবাদ সংকলন প্রকাশের অভিযোগে ২০১৬ সালের ফেব্রুয়ারী মাসে বাংলা একাডেমীর একুশে বই মেলার সময় অনেক কাণ্ড এদেশে ঘটেছিল, যার কথা এখনও অনেকে হয়ত স্মরণ করতে পারবেন। সেই সময়ে ইসলামী ছাত্র শিবিরসহ ইসলামী শক্তিগুলির দাবীতে সাড়া দিয়ে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ সরকারের নির্দেশে ধর্মানুভূতিতে আঘাতের অভিযোগে ২০১৬-এর ১৬ ফেব্রুয়ারী তারিখে পুলিশ The Aryans and the Indus Civilization এবং ‘আর্যজন ও সিন্ধু সভ্যতা’র অন্যতম লেখক শামসুল আলম চঞ্চল, যে ছাপাখানায় ‘ইসলাম বিতর্ক’ ছাপা হয়েছিল তার মালিক তসলিম উদ্দীন ফকির কাজল এবং ‘ইসলাম বিতর্ক’-এর প্রকাশক ও ব-দ্বীপ প্রকাশনের স্বত্বাধিকারী হিসাবে আমাকে শুধু যে গ্রেফতার এবং আমার প্রকাশনের বিক্রয় কেন্দ্র থেকে বিপুল পরিমাণ বইপত্র জব্দ করেছিল তাই নয়, উপরন্তু আমাকে আমার বাসগৃহ থেকে গ্রেফতারের সময় সেখান থেকেও কম্পিউটার-মোবাইল ইত্যাদি বিভিন্ন জিনিসপত্রসহ বাসগৃহ প্রায় খালি করে বহু পরিমাণ বই জব্দ করে নিয়ে যায়। যেগুলির মধ্যে বেদ এবং উপনিষদও আছে। বইপত্র সরকারের কী কাজে লাগে তা জানি না। হয়ত এগুলিকে আওয়ামী লীগ সরকার বিস্ফোরকের মত বিপজ্জনক জ্ঞান করে। যাইহোক, আমার অনেক ভাগ্য যে বেদ-উপনিষদসহ অন্য আরও বহু বইপত্রের মত দুর্ভাগ্য হয় নাই বহু ব্যবহার এবং সময়ের আঘাতে জীর্ণ ‘দর্শনের ইতিবৃত্ত’ গ্রন্থটির। অনেক খোঁজাখুঁজির পর জানলাম যে জরাজীর্ণ বইটাকে নিজের কাছে না রেখে পড়তে দিয়েছিলাম আর একজনকে। সুতরাং পুলিশের চোখ এড়িয়ে গ্রন্থটি রয়ে যাওয়ায় এটিকে পেলাম। কাজেই শুধু স্মৃতির উপর নির্ভর করে যা লিখেছিলাম তাকে সামান্য কিছু সংশোধন করে মূল গ্রন্থের সঙ্গে মিলিয়ে সংস্কৃত মন্ত্রটিকে অর্থসহ তুলে দিলাম। আর তা করতে গিয়ে লেখাটা শেষ করতে কিছু দেরী করলাম।

জ্ঞানের সাধনার হবার কথা সত্যের সাধনা। তবে সত্য তথা সঠিক জ্ঞানের পথ সত্যিই দুর্গম। সুতরাং জ্ঞানের সাধনায় প্রচুর ভুল ঘটে এবং ঘটাটাই স্বাভাবিক। অনেক অভিজ্ঞতা এবং পর্যালোচনার পরিণতিতে মানুষ সঠিক-বেঠিক সম্পর্কে ধারণা করতে পারে। তবে সমস্যা বাধে তখন যখন শক্তিমানের স্বার্থপরতা জ্ঞানের চর্চাকে মিথ্যার অধীনস্থ করে এবং অসংখ্য মানুষের ভ্রান্তির কারণ হয়। এর ভুরি ভুরি দৃষ্টান্ত দেওয়া যায়। তেমনই একটা দৃষ্টান্তকে নিয়ে আমার আজকের এই আলোচনা। সেটা হচ্ছে ঋগ্বেদ এবং তাকে কেন্দ্র করে ইতিহাস পাঠ কিংবা নির্মাণ। কয়েক দিন আগেই ‘কেস-স্টাডি ঋগ্বেদ এবং পাশ্চাত্য ও ভারতবর্ষের মূলধারার বুদ্ধিবৃত্তির স্বরূপ দর্শন’ নামে একটা দীর্ঘ প্রবন্ধে ঋগ্বেদ এবং ভারতবর্ষে আর্য আক্রমণ প্রসঙ্গে অনেক কথা বলেছি। তবে এখনকার প্রসঙ্গটা একটু ভিন্ন। জ্ঞানকাণ্ডে যেসব কাণ্ডজ্ঞানহীনতা অনেক সময় ঘটে কিংবা ঘটানো হয় সেই বিষয়ে ভিন্নভাবে কিছু বলতে চেয়েই আজকের প্রসঙ্গের অবতারণা। এখন মূল প্রসঙ্গে যাওয়া যাক।

 

দ্বিতীয় পর্ব : ঋগ্বেদ এবং জ্ঞানতাত্ত্বিক বিভ্রাট

ঋগ্বেদ প্রণালীবদ্ধ বা সুশৃঙ্খল ভাবে পড়ি ১৯৯০ সালে। তার আগে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন বই বা লেখায় ছাড়া ছাড়া ভাবে ঋগ্বেদের কিছু মন্ত্রের কিছু বাক্য বা লাইন পড়লেও তা থেকে আমি তেমন কিছু ভাববার সুযোগ পাই নাই। সম্পূর্ণ গ্রন্থ পড়বার পূর্ব পর্যন্ত ঋগ্বেদ সম্পর্কে আমার ধারণা ছিল যে এটা ভারতবর্ষ আক্রমণকারী বহিরাগত যাযাবরদের রচনা, যারা ভারতবর্ষের উত্তর-পশ্চিম অঞ্চলে তথা পাঞ্জাব-সিন্ধু অঞ্চলে প্রবেশের পর সেখানকার স্থানীয় অধিবাসীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধের সময় ঋগ্বেদের মন্ত্রগুলি রচনা করে। এরা গরু, ভেড়া, ঘোড়া ইত্যাদি পশু পালন করত এবং সেগুলি নিয়ে এক অঞ্চল থেকে আর এক অঞ্চলে ঘুরে বেড়াত। এরা ছিল অশ্বারোহী এবং লৌহাস্ত্র ব্যবহারকারী। এরা ছিল আর্য নামে পরিচিত। আর্যদের নিয়ে আরও যেসব ধারণা বা প্রচার ছিল সেগুলি নিয়ে তেমন মাথা ঘামাবার প্রয়োজন এখন নাই। তাদের গাত্রবর্ণ কিংবা উচ্চতা, চক্ষুর রঙ্, ইত্যাদি। এগুলি নিয়ে এক কালে মাতামাতি এবং সেই সঙ্গে বিতর্ক থাকলেও বিশেষত দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ পরবর্তী কালে সেসব অনেকটা স্তিমিত হয়। তবে আর্যদের সম্পর্কে যত আলোচনা কিংবা বিতর্ক থাক একটা ব্যাপারে মূলধারার সব পণ্ডিতই একমত ছিলেন তা হল এই যে, আর্যরা ছিল ভারতবর্ষে বহিরাগত আক্রমণকারী এবং যাযাবর জনগোষ্ঠী। তাদের ভাষা ছিল বৈদিক ভাষা যে ভাষায় ঋগ্বেদ লিখা হয়েছিল। এবং তাদের এই ভাষাই সংস্কৃত, বাংলা, হিন্দী, উর্দূ, পাঞ্জাবী, গুজরাতী, মারাঠী, অসমীয়া, উড়িয়া ইত্যাদি অধিকাংশ ভারতীয় ভাষার উৎস। যাইহোক, এটা আমার মত সাধারণ ইতিহাস পাঠকের কাছে স্বতঃসিদ্ধ সত্য ছিল যে আর্যরা ছিল ভারতীয় উপমহাদেশে বহিরাগত যাযাবর আক্রমণকারী।

আর কোনও মতের কথা আমার জানা ছিল না। আমি জানতাম ভাষাতাত্ত্বিক এবং ঐতিহাসিকসহ সকল পণ্ডিত এবং সকল শিক্ষিত মানুষেরই এটাই মত। সুতরাং সূর্য যেমন পূর্ব দিকে উদিত হয় এবং পশ্চিম দিকে অস্ত যায় তেমন স্থির সত্য জেনে আমি ঋগ্বেদের আর্যদেরকেও যাযাবর, পশুপালক বা পশুচারী বহিরাগত আক্রমণকারী হিসাবে ধরে নিয়ে তাদের রচিত গ্রন্থ হিসাবে ঋগ্বেদ পাঠ করতে শুরু করি।

সম্প্রতি লিখা ‘কেস-স্টাডি ঋগ্বেদ এবং পাশ্চাত্য ও ভারতবর্ষের মূলধারার বুদ্ধিবৃত্তির স্বরূপ দর্শন’-এ আমার ঋগ্বেদ পাঠের উদ্দেশ্য সম্পর্কে বলেছি। হ্যাঁ, আমি ঋগ্বেদ পাঠের সাহায্যে ভারতবর্ষের সমাজ বিকাশের শুরুর জায়গাটাতে পৌঁছাতে চেয়েছিলাম। আমার ধারণা ছিল তাহলে তার বিকাশের গতিধারাকে বুঝা অনেক সহজ হবে। কারণ পরবর্তী কালের সামগ্রিক বিকাশের অনেক কিছুরই বীজ সুপ্ত আকারে হলেও রয়ে যায় বিকাশধারার সূচনা পর্বে।

ঋগ্বেদ দশ মণ্ডলে বিভক্ত। অনেক কয়টি সূক্ত নিয়ে একটি করে মণ্ডল গঠিত। আবার অনেক কয়টি বা কয়েকটি করে ঋক নিয়ে গঠিত একটি করে সূক্ত। সাধারণত একটি সূক্ত একটি বিশেষ দেবতা বা বিষয় কেন্দ্রিক কয়েকটি ঋক নিয়ে গঠিত হয়। সুতরাং সূক্তকে পূর্ণাঙ্গ মন্ত্র বলা যায়, যাতে থাকে অনেক কয়টি ঋক।

ঋগ্বেদ পাঠ করতে গিয়ে প্রথম মণ্ডলের প্রথম সূক্ততেই আমি হোঁচট খেলাম। কারণ ঋগ্বেদের ভাষা যাযাবর পশুপালকদের পক্ষে কীভাবে রপ্ত করা সম্ভব সেই প্রশ্ন আমার মনে দেখা দিল। আমি অনুবাদ পড়েছিলাম। কিন্তু তার মধ্য দিয়েও ঋগ্বেদের ভাব ও ভাষার শক্তিকে অনুভব করা যায়। আমার মনে সন্দেহ দেখা দিল। আমাকে এই সন্দেহ থেকে কিছু সময়ের জন্য উদ্ধার করেন দামোদর ধর্মানন্দ কোসাম্বি। যতদূর মনে হয় তার গ্রন্থ An Introduction to the Study of Indian History আমি ১৯৭৬-৭৭-এর কোনও এক সময়ে পড়েছিলাম। সেখানে তিনি বলেছেন যে, বহিরাগত যাযাবর আর্যরা সিন্ধু সভ্যতায় আক্রমণ করার পর্যায়ে সেখানকার অনেক শিক্ষিত পণ্ডিতকে বন্দী করে এবং এই বন্দী পণ্ডিতদের দিয়ে নিজেদের ভাষায় মন্ত্র রচনা করায়। এই কারণে ঋগ্বেদের এমন সাহিত্য মূল্য! অবশ্য বন্দী হলেই কি একটা বিদেশী ভাষায় এত দ্রুত ব্যুৎপত্তি অর্জন করা সম্ভব কিংবা যাযাবর জনগোষ্ঠীর ভাষাকে কি এত দ্রুত এত সমৃদ্ধ ও উন্নত করা সম্ভব? প্রশ্নগুলি আমাকে অস্থির করল।

আমি সংস্কৃতের পূর্বসূরি বৈদিক ভাষা দূরের কথা সংস্কৃত ভাষারও পণ্ডিত নই। সংস্কৃতে আমার প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাও নাই। তবে কৌতূহলের কারণে ছাত্র জীবন থেকেই সংস্কৃত ভাষা শিখবার চেষ্টা কিছু করে করতাম। অবশ্য ধারাবাহিকতা বজায় রাখতে পারতাম না। বিশেষত কৃষক আন্দোলন করতে ১৯৬৬-তে গ্রামে চলে গিয়েছিলাম বেশ কয়েক বৎসরের জন্য। তারপর ১৯৭২-এ নাগরিক জীবনে ফিরলেও জীবন-জীবিকার সংগ্রামের ঝড়ঝঞ্ঝা আমার এমন অনেক আকাঙ্ক্ষা বা ইচ্ছার বাস্তবায়নের পক্ষে ছিল না। ফলে সংস্কৃতও আর শিখা হয় নাই। তবে কিছু করে চর্চা রেখেছিলাম যাকে ঋগ্বেদ পাঠের সময় আমি আমার কাজে লাগিয়েছিলাম।

ভাষাতত্ত্বের যারা ছাত্র তারা জানেন যে, বৈদিক এবং বাংলা একই ভাষাগোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত। অবশ্য বৈদিক ভাষার অনেক পরবর্তী প্রজন্মের একটি ভাষা এটি যার উৎস ভাষা হচ্ছে বৈদিক এবং তারও পরবর্তী রূপ সংস্কৃত। ভাষাতত্ত্বের বিচারে বাংলা ভাষা আর দশটি ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষার মত ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষা পরিবারভুক্ত। বিশেষত বৈদিক এবং বাংলা উভয়ই ভারতীয় উপমহাদেশের ভাষা হওয়ায় এবং শব্দসম্ভারসহ অন্যান্য কিছু বিচারে বৈদিক ভাষার প্রভাব বাংলা ভাষায় গভীর হওয়ার কারণে বাংলা ভাষার মানুষ হিসাবে আমাদের এই ভাষার মর্ম অনুভব করা কিছুটা সহজতর বলেও আমার মনে হয়েছে। আমার বিবেচনায় বৈদিক ভাষা থেকে আগত অথবা বৈদিক ভাষার প্রভাবে গঠিত অন্যান্য ইউরোপীয় ভাষা যেমন ইংরাজী, ফরাসী, জার্মান, রুশ ইত্যাদি ভাষার তুলনায় এ দিক থেকে আমরা অনেক বেশী সুবিধা ভোগ করি।

এখানে বলে রাখা উচিত হবে যে, আমি পরবর্তী সময়ে ইংরাজীতে কাজের প্রয়োজনে ইংরাজীতে ঋগ্বেদের মন্ত্রসমূহ পড়লেও প্রথমে বাংলাতেই পড়েছিলাম। বাংলায় ঋগ্বেদ পাঠের সময় আমি অনেক সময় বৈদিক ভাষায় রচিত মন্ত্র বা সূক্তগুলি পড়বার চেষ্টা করতাম স্পষ্ট উচ্চারণে। মূল বৈদিক ভাষায় পাঠের সময় ভাষার ধ্বনি গাম্ভীর্য, ঝঙ্কার, ভাব, ব্যঞ্জনা এবং শক্তিমত্তাকে অনুভব করে আমি রোমাঞ্চিত হতাম। বাংলা অর্থের সঙ্গে বৈদিক মূল মন্ত্র পাঠের আনন্দময়তায় আমি অভিভূত হতাম। প্রশ্ন জাগল, এমন সুউন্নত সাহিত্য মূল্য বিশিষ্ট ঋগ্বেদ কী করে যাযাবর কিংবা পশুপালকদের রচনা হয় কিংবা কোসাম্বির দুর্বল যুক্তি ধরলেও বন্দী মানুষদের রচনা হয়? শুধু তা-ই নয়, ঋগ্বেদ থেকে আমার সামনে চিত্রিত হচ্ছিল একটা সুউন্নত সভ্য সমাজ। কী নাই সেখানে? বিরাট ভবন বুঝাতে সহস্র স্তম্ভবিশিষ্ট কিংবা সহস্র দ্বারবিশিষ্ট ভবন (ঋগ্বেদ- ২/৪১/৫, ৫/৬২/৬, ৭/৮৮/৫) বণিক ও বাণিজ্য (১/১১২/১১, ৫/৪৫/৬, ১০/১৫৬/৩ ইত্যাদি), সমুদ্র বাণিজ্য এবং সাগরগামী জাহাজ (১/৪৮/৩, ১/৫৬/২, ১/১১৬/৫, ৪/৫৬/৬ ইত্যাদি), নগর (১/১৮৯/২, ৭/৩/৭, ৭/১৫/১৪ ইত্যাদি), চাষী (৪/৫৭/৮), কৃষি (১/১১৭/২১, ৪/৫৭ সূক্ত, ১০/১০১/৩ ইত্যাদি), জলসেচ (১০/৯৩/১৩ ইত্যাদি), বস্ত্রবয়ন (২/৩/৬, ১০/১০৬/১ ইত্যাদি), চিকিৎসা (১/১১৬/১৫, ১/১১৭/৪ ইত্যাদি), জ্যোতির্বিজ্ঞান (১/২৫/৮, ১/১৬৪/১২, ১/৮৪/১৫ ইত্যাদি), ধাতুশিল্পী (৫/৯/৫, ৬/৩/৪, ৯/১১২/২ ইত্যাদি), ভিস্তি বা বৈদিক সেক্তা (৩/৩২/১৫), রথ নির্মাণ (৪/২/১৪ ইত্যাদি), স্তোত্রকার (৯/১১২/৩), নগরপিতা বা মেয়র (১/১৭৩/১০) — মোটকথা একটা সুউন্নত এবং সুসভ্য সমাজের বিস্তারিত চিত্র উঠে এল ঋগ্বেদের মধ্য থেকে। এবং সত্য বলতে কি আমি হতভম্ব হলাম। এত বড় ভুল সারা পৃথিবী জুড়ে সবাই, প্রত্যেকেই, সমস্ত পণ্ডিতই কীভাবে করেছে সে কথা ভেবেই হতভম্ব হলাম। প্রশ্ন এল, আমি একা সঠিক আর উপমহাদেশ এবং সমগ্র পৃথিবীর সকল পণ্ডিত যারা ঋগ্বেদের ব্যাখ্যা দিয়েছেন এবং ঋগ্বেদ ও আর্য প্রশ্নকে কেন্দ্র করে ইতিহাস লিখেছেন তারা সবাই ভুল, এটা কী করে হতে পারে!

আমার তখনও আর্য তত্ত্ব নিয়ে ব্যাপক পড়াশুনা ছিল না। সাধারণভাবে যা সবাই তখন জানত আমিও সেটুকু জানতাম। জানতাম যে কোথা থেকে আর্যদের উদ্ভব তা নিয়ে পণ্ডিতদের মধ্যে মতপার্থক্য আছে। যেমন কারও মতে ইউরোপ আবার কারও মতে মধ্য এশিয়ার কোনও অনির্দিষ্ট এলাকা আর্যদের আদি বাসভূমি। এক সময় অনেক ইউরোপীয় পণ্ডিতের মধ্যে ইউরোপের উপর জোর বেশী দেওয়া হত এবং সেই সঙ্গে শ্বেত বর্ণ, উন্নত নাক বা নীল চোখ ইত্যাদির সপক্ষে জাতিবাদী বক্তব্য ছিল। তবে দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের অভিজ্ঞতার পর ইউরোপীয়দের মধ্যে আর্যদের জাতিতত্ত্ব নিয়ে মাতামাতি বন্ধ হয়েছে। কিন্তু উপমহাদেশে সেটার প্রভাব কম-বেশী আরও অনেক কাল রয়ে যায়। তবে ইউরোপে এবং আন্তর্জাতিক পরিসরেও অনেক দিন ধরে প্রাধান্যে আছে ভাষাতত্ত্ব সংক্রান্ত বক্তব্য। সেটা হল ঋগ্বেদে আর্য নামে কথিত একটা যাযাবর জনগোষ্ঠী একটা মূল ভূমিতে একত্রে ছিল যাদের ভাষা হচ্ছে বৈদিক বা বৈদিক ভাষার সমগোত্রীয়। এই জনগোষ্ঠীর ভাষাতাত্ত্বিক নাম হচ্ছে ইন্দো-ইউরোপীয়। এখন এই ইন্দো-ইউরোপীয় তথা আর্য বা বৈদিক ভাষাভাষী জনগোষ্ঠী ইউরোপ অথবা মধ্য-এশিয়ার তাদের কথিত অজ্ঞাত বাসভূমি বা মূলভূমি থেকে ভারতবর্ষ এবং ইরান থেকে ইউরোপ পর্যন্ত বিস্তৃত হয়। এখন আর্য জনগোষ্ঠী সংক্রান্ত যে ধরনের ব্যাখ্যাই থাক কিংবা এ প্রশ্নে যত মতপার্থক্য থাক সকল বক্তব্যের মূল সুর কিন্তু একটাই তা হচ্ছে আর্যরা ভারতীয় উপমহাদেশে বহিরাগত, সুতরাং ঋগ্বেদ তাদের ভারতবর্ষ জয়ের গাথা। আমিও এতকাল সেটাই জানতাম এবং মানতাম। সুতরাং সেটা মেনে নিয়ে পড়লে আমার সমস্যা থাকবার কারণ ছিল না।

কিন্তু সমস্যা বাধাল আমার কাণ্ডজ্ঞান। ঋগ্বেদের মন্ত্র আমার কাছে শুধু প্রাণহীন শব্দ সমষ্টি ছিল না। এটা ছিল জীবন্ত মানুষের ভাষা। আমি মন্ত্রের পিছনে মানুষ দেখতে পাচ্ছিলাম। সেই মানুষগুলি কোসাম্বির বন্দী মানুষ যেমন ছিল না তেমন যাযাবর, পশুপালক এমনকি বহিরাগত মানুষও ছিল না। আমি তো কিছু হলেও মানুষকে বুঝতাম। কৃষক এমনকি গ্রামীণ জীবনে বাসকারী একজন মানুষের কল্পনা, আকাঙ্ক্ষা, অভিজ্ঞতা, অনুভূতি ইত্যাদি কীভাবে তার ভাষার মাধ্যমে প্রকাশ পায় সেটা আমার বেশ ভাল মতই জানা ছিল। ঋগ্বেদের মন্ত্রের সমপর্যায়ের মন্ত্র রচনা কোনও কৃষক কিংবা গ্রামীণ মানুষের পক্ষেও যে করা সম্ভব নয় সেটা আমার বুঝতে না পারার কারণ ছিল না। নিছক কৃষক বা পল্লীবাসীর পক্ষে যখন এমন সব মন্ত্র রচনা করা অসম্ভব তখন ভ্রাম্যমান বা যাযাবর জীবন যাপনকারী পশুচারী মানুষদের পক্ষে তাদের শিক্ষা এবং অভিজ্ঞতার বাইরে গিয়ে ঋগ্বেদের মন্ত্রগুলির মত মন্ত্র কীভাবে রচনা করা সম্ভব?

আমি মন্ত্রগুলির পিছনে সাধারণ কোনও সভ্যতা নয়, বরং সুউন্নত সভ্যতার অধিকারী মানুষদেরকে দেখতে পাচ্ছিলাম। ভাষা তো শূন্য থেকে উড়ে আসে না। ভাষা সমাজের সৃষ্টি। মানুষ ভাব বিনিময়ের প্রয়োজনে ভাষা সৃষ্টি করেছে। তার সঙ্গে জড়িত তার সভ্যতার মান, তার সংস্কৃতি, তার জীবন যাপনের বাস্তবতা। প্রকৃতপক্ষে ভাষা থেকে অবশ্যই কম অথবা বেশী অনুভব করা যাবে তার সামাজিক বাস্তবতা। যে কথা একটু আগেই বলেছি আমি ঋগ্বেদের মন্ত্র থেকে দেখতে পাচ্ছিলাম মানুষকে — একটা সুউন্নত সভ্যতার স্বাধীন ও কাল প্রেক্ষিতে সুশিক্ষিত মানুষদেরকে। ঋগ্বেদের ঋষিরা যাকে সপ্তসিন্ধু (১/৭১/৭, ৬/৭/৬, ৬/৬১/১০, ৭/৩৬/৬ ইত্যাদি) বলেছেন আমি সেটাকে স্পষ্ট রূপে চিনলাম আমাদের নিকট সাধারণভাবে সিন্ধু সভ্যতা নামে পরিচিত সভ্যতার অধিষ্ঠান-ভূমি হিসাবে।

ঋগ্বেদ পড়তে পড়তে আমার মনে প্রশ্ন এল এত মানুষ, এত  বড় বড় পণ্ডিত কেউ বুঝল না এতকাল, আর আমি একা বুঝলাম? এটা কি সম্ভব? এই প্রশ্ন আমাকে কুরে কুরে খাচ্ছিল। কিন্তু আমার নিজের বুঝবার ক্ষমতার উপর আস্থা ছিল। আমার বিচার-বুদ্ধি দিয়েই আমি বুঝছিলাম ঋগ্বেদ বুঝায় আমি এতকাল যাদের উপর নির্ভর করেছিলাম তারা সবাই ভুল। এবং আমার বুঝটাই সঠিক। আমি ঋগ্বেদের দশ মণ্ডলের প্রথম মণ্ডল শেষ করলাম এই সিদ্ধান্ত নিয়ে যে আমাকেই ঋগ্বেদের সঠিক অর্থ বের করতে হবে। এরপর আমি সমস্ত দ্বিধা, সংশয় বাদ দিয়ে নিজের উপর পূর্ণ আস্থা রেখে ঋগ্বেদের মর্মোদ্ধারে সর্বশক্তি নিয়োগ করলাম। ঋগ্বেদের প্রথম মণ্ডলের প্রথম মন্ত্র থেকেই প্রায় পৌনে চার হাজার বছর পূর্বে হারিয়ে যাওয়া সিন্ধু সভ্যতা উঠে আসতে শুরু করল আমার চোখের সামনে। ঋগ্বেদ পাঠের মধ্য দিয়ে ক্রমশ সিন্ধু সভ্যতা এবং ঋগ্বেদের মধ্যে সম্পর্কের অনেক রহস্যও উন্মোচিত হল। পরবর্তী কালে সিন্ধু সভ্যতার প্রত্নতাত্ত্বিক আবিষ্কারগুলি সম্পর্কে অধিকতর অধ্যয়ন আমার চিন্তা বা ধারণাকে আরও সমৃদ্ধ করল। সেই আলোচনার জায়গা এটা নয়। যাদের আগ্রহ বা কৌতূহল থাকবে তারা শামসুল আলম চঞ্চল এবং আমার যৌথভাবে লিখা গ্রন্থ ‘আর্যজন ও সিন্ধু সভ্যতা’ পাঠ করতে পারেন। যারা পড়েছেন তাদেরকে এ প্রসঙ্গে আর কিছু বলার দরকার পড়ে না। তবে এই প্রবন্ধের আগে লিখা প্রবন্ধ ‘কেস-স্টাডি ঋগ্বেদ এবং পাশ্চাত্য ও ভারতবর্ষের মূলধারার বুদ্ধিবৃত্তির স্বরূপ দর্শন’-এ এ প্রসঙ্গে কিছু আলোচনা করেছি।

এখানে প্রসঙ্গক্রমে বলা উচিত হবে যে, ১৯৯০-এ প্রথম ঋগ্বেদ পাঠের সময় পর্যন্ত আমার জানা ছিল না যে পৃথিবীতে আমি একা নই, আরও পণ্ডিত বা লেখক আছেন যারা আর্যরা যাযাবর এবং ভারতবর্ষে বহিরাগত আক্রমণকারী এই তত্ত্বের সঙ্গে একমত নন। ঋগ্বেদ পাঠের পরবর্তী সময়ে আর্য তত্ত্ব নিয়ে কাজ করতে গিয়ে আমি প্রথম জানতে পারি যে, কোনও কোনও পণ্ডিত এ বিষয়ে দ্বিমত প্রকাশ করেছিলেন। তবে তাদের মতামতকে গুরুত্ব যেমন দেওয়া হত না তেমন এক কথায় তাদের বক্তব্যকে ভ্রান্ত বক্তব্য হিসাবে উড়িয়ে দেওয়ায় সেগুলি নিয়ে তেমন কোনও আলোচনাও হত না। ফলে আমার মত সাধারণ পাঠকরা এ সম্পর্কে বিশেষ কিছুই জানতে পারত না।

এখানে আর একটু বলে রাখা ভাল হবে যে, আসলে ভারতবর্ষে বহিরাগত আর্য আক্রমণ তত্ত্ব সম্পূর্ণরূপে ঊনিশ শতকের ইউরোপীয় পণ্ডিতদের উদ্ভাবন। ভারতবর্ষের ব্রাহ্মণ পণ্ডিতরা এমন কোনও উদ্ভট তত্ত্ব ইংরেজদের আধিপত্য প্রতিষ্ঠার পূর্বে কল্পনাও করতে পারেন নাই। তাদের কাছে ভারতবর্ষই ছিল বেদ রচয়িতা আর্য কিংবা ঋষিদের আদি এবং অকৃত্রিম বাসভূমি। ব্রিটিশদের ভারতবর্ষে শাসন প্রতিষ্ঠার পর ক্রমে এটি এই উপমহাদেশের ইতিহাস রচনার মূল ভিত্তি হয়ে গেল। এ বিষয়ে আমরা ‘আর্যজন ও সিন্ধু সভ্যতা’য় আলোচনা করেছি। কেন ইউরোপীয় বিশেষত ব্রিটিশ পণ্ডিতরা এমন উদ্ভট তত্ত্ব প্রতিষ্ঠায় এমন আদাজল খেয়ে নেমেছিল উপমহাদেশের মানুষ হিসাবে সেটা বুঝাটা আমাদের জন্য অত্যাবশ্যক বলে আমি মনে করি। এ সম্পর্কে ‘কেস-স্টাডি ঋগ্বেদ এবং পাশ্চাত্য ও ভারতবর্ষের মূলধারার বুদ্ধিবৃত্তির স্বরূপ দর্শন’-এ আলোচনা করেছি। সুতরাং এখানে আর সে প্রসঙ্গে যেতে চাই না।

যাইহোক, পরবর্তী কালে আমি দেখতে পেয়েছি যে, আর্যরা যে ভারতবর্ষে বহিরাগত নয় অন্তত এই বক্তব্য আরও কিছু সংখ্যক পণ্ডিত দিয়েছেন বা দিচ্ছেন। বস্তুত ভারতবর্ষে যে সব প্রত্নতাত্ত্বিক সাম্প্রতিক কালে কিংবা ইদানীং সিন্ধু সভ্যতায় উৎখনন কার্য করেছেন কিংবা করছেন তারা কেউই এখন আর বহিরাগত আর্য আক্রমণ কিংবা অভিগমন তত্ত্বকে সমর্থন করছেন না। যারা এই তত্ত্বের বিরোধিতায় সোচ্চার নন তারাও এ তত্ত্বের সমর্থনে কথা বলছেন না। কিংবা তারা এ নিয়ে মাথা ঘামাচ্ছেন না। তারা বিষয়টাকে ভাষাতাত্ত্বিক এবং ঐতিহাসিকদের উপর ছেড়ে দিচ্ছেন।

যাইহোক, এটা এখনকার অবস্থা। কিন্তু আজ থেকে আটাশ বছর আগে আমি যখন প্রথম ঋগ্বেদ পড়ি এবং তার ভিত্তিতে ‘ভারত-ইতিহাসের সূত্র সন্ধান’ লিখি তখন কিন্তু আমার চিন্তার সমর্থনে একজনকেই পেয়েছিলাম। তিনি হলেন শামসুল আলম চঞ্চল। পরে আমরা দুইজনে যৌথভাবে অনেক কাজ করি। এ সম্পর্কে ‘কেস-স্টাডি ঋগ্বেদ এবং পাশ্চাত্য ও ভারতবর্ষের মূলধারার বুদ্ধিবৃত্তির স্বরূপ দর্শন’-এ লিখেছি। এ প্রসঙ্গে আর একটু বলে নেওয়া উচিত হবে যে, আর্যরা বহিরাগত নয় এ ব্যাপারে পৃথিবীর কিছু সংখ্যক পণ্ডিত বিশেষত প্রত্নতাত্ত্বিকরা আমাদের মত চিন্তা করলেও ঋগ্বেদ যে বৈদিক ধর্মসংস্কার আন্দোলনের ফসল আমাদের এই তত্ত্বকে ১৯৯৪ সালে পাকিস্তান প্রত্নতত্ত্ব ও যাদুঘর বিভাগের সাবেক মহাপরিচালক (ডিজি) ডঃ মোহাম্মদ রফিক মোগল সফল প্রয়াস হিসাবে উল্লেখ করলেও এটা এখন পর্যন্ত আমাদের দুইজনের চিন্তায় বা তত্ত্বে সীমাবদ্ধ হয়ে আছে। অবশ্য তার মানে এই নয় যে, আমাদের এই তত্ত্ব নিয়ে আমাদের মনে কোনও প্রকার সংশয় আছে। আমি যখন প্রথম ঋগ্বেদের প্রচলিত ব্যাখ্যা বা ধারণাকে প্রত্যাখ্যান করি তখন যেমন এর বিরুদ্ধ কোনও মত সম্পর্কে আমার কোনও ধারণাই ছিল না তেমন যখন সিন্ধু সভ্যতার ধর্মসংস্কার আন্দোলন তথা সিন্ধু সভ্যতার ফসল হিসাবে ঋগ্বেদকে চিহ্নিত করি তখন এর প্রত্নতাত্ত্বিক সাক্ষ্য-প্রমাণও প্রায় কিছু আমার জ্ঞানে ছিল না। অর্থাৎ প্রায় শুধু ঋগ্বেদকে অবলম্বন করেই আমি তার ভিত্তিভূমি হিসাবে সিন্ধু সভ্যতার্ বাস্তবানুগ একটা চিত্র যেমন মির্মাণ করেছিলাম তেমন বৈদিক আন্দোলনের গতিধারা সম্পর্কেও একটা মোটামুটি স্পষ্ট চিত্র নির্মাণে সমর্থ হয়েছিলাম।

 

তৃতীয় পর্ব : সঠিক জ্ঞানের উৎস কী?

এখন আমি এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজি, আমার যেটুকু হোক সেইটুকু সঠিক জ্ঞান বা সঠিক উপলব্ধির উৎস কী। নিশ্চয় আমার ভিতরে এমন কোনও শক্তি আছে যা আমার বিবেচনায় আমাকে দিয়ে কিছু হলেও অসাধ্য সাধন করিয়েছে। এটা ঠিক যে জীবনে অনেক ভুল আমি করেছি। রাজনৈতিক জীবনে এবং তার বাইরের জীবনেও। বিশেষত আমার রাজনৈতিক জীবনে কৃত এমন কিছু বড় ধরনের ভুলের উদাহরণ দেওয়া যাবে। অনেক কিছু বুঝলেও অনেক সময় বুঝেছি দেরীতে। কিংবা কখনও দ্রুত বুঝলেও একা হবার ভয়ে ভুলের সঙ্গে থেকেছি দীর্ঘতর সময়। তবে আমি মনে করি, যে কাজ করে সে ভুল করে। ভুল তার একেবারে হয় না যে কিছু করে না। সুতরাং ভুল করাটা দোষের তা আমি মনে করি না। তবে ভুল থেকে শিক্ষা না নেওয়াটাকে আমি দোষণীয় মনে করি। যাইহোক, আমি যে বিষয়গুলি সম্পর্কে খুব সিরিয়াস হই এবং যেগুলির মর্মোদ্ধারে নেমে পড়ি আমি সাধারণত সেগুলির মর্মোদ্ধারে সফল হই। তবে আমরা কখনই পূর্ণ সত্যে পৌঁছাতে পারি না। বড়জোর তার কাছাকাছি যেতে পারি। কথাটা লেনিনের। আমি নিজেও এ কথা বিশ্বাস করি।

কিছু নির্দিষ্ট ক্ষেত্রে সত্যের কাছাকাছি যাবার আমার এই ক্ষমতা কি অলৌকিক কিছু? অর্থাৎ আমি কি কোনও অতিমানবীয় সত্তা? যদি সেটা না হই, যেটা আমি নইও, তবে অবশ্যই আমার এই সঠিক জ্ঞান বা ধারণার উৎসকে বুঝতে হবে। আমার বক্তব্য স্পষ্ট, আমার জীবন ধারার মধ্যেই আমার প্রচলিত ভ্রান্ত তত্ত্ব বা ধারণার বৃত্ত ভাঙ্গবার শক্তি নিহিত রয়েছে। এটা ঠিক যে, আমি আমার ছেলেবেলা থেকেই প্রাতিষ্ঠানিক পড়ার বাইরেও পড়ার প্রতি মনোযোগী ছিলাম। কিন্তু আমি যদি মানুষ সম্পর্কে এবং সমাজ সম্পর্কে, বিশেষত সামাজিক-রাজনৈতিক আন্দোলন সম্পর্কে বাস্তব অভিজ্ঞতা না রাখতাম তাহলে পণ্ডিতদের আজগুবি কথাতেও সম্ভবত বিশ্বাস অর্পণ করতাম। আর সংশয় কিছু দেখা দিলেও দৃঢ় প্রত্যয়ের সাথে সেটাকে নিয়ে অগ্রসর হবার সাহস অর্জন করতাম না। কারণ বাস্তব অভিজ্ঞতার অভাবে নিজের উপর ততখানি অবিচল আস্থা রাখতে পারতাম না।

প্রসঙ্গক্রমে এ কথা এখানে বলা উচিত হবে যে, আমি প্রথম ঋগ্বেদ গ্রন্থাকারে পড়ার সুযোগ পাই তখন যখন আমি বিশ্ববিদ্যালয়ে অনার্স-এ পড়ি। হয়ত তখন আমি অনার্স প্রথম অথবা দ্বিতীয় বর্ষে পড়ছিলাম। কিন্তু সত্যি কথা বলতে কি ৩/৪টা সূক্ত বা মন্ত্র পড়বার পর আমি পড়বার আগ্রহ হারাই। প্রথম কথা ঋগ্বেদ পাঠের গুরুত্ব বুঝবার উপযুক্ত মন তখনও আমার হয় নাই। উপমহাদেশীয় সমাজে ধর্মের ভূমিকা মোটামুটি বুঝলেও তার গুরুত্ব তখনও সঠিকভাবে উপলব্ধি করি নাই। দ্বিতীয়ত, মন্ত্রগুলির অন্তর্নিহিত অর্থ বুঝবার সক্ষমতাও তখন আমার হয় নাই। ফলে প্রচলিত ধারণা নিয়ে ঋগ্বেদ পড়তে গিয়ে তার প্রতি আ্গ্রহ হারাই। যদি সেটা ১৯৬২ বা ১৯৬৩ সাল হয় তবে তারপর আগ্রহ নিয়ে ঋগ্বেদ পাঠের জন্য আমাকে অপেক্ষা করতে হয়েছে আরও ২৭ বা ২৮ বছর।

১৯৯০-তে আমি যখন ঋগ্বেদ পড়তে শুরু করি তখন তার অল্প কিছু আগে ১৯৮৯-তে আমি ঢাকায় ফিরেছি। প্রায় তিন বৎসর গ্রামে থেকে আর একবার গ্রামের এবং কৃষকদের মধ্যে কাজের অভিজ্ঞতা নিয়ে আমি ঢাকায় ফিরেছি। কিছু আগে বলেছি যে, তারও পূর্বে ১৯৬৬ থেকে ১৯৭২ পর্যন্ত কালপর্বে আমি গ্রামে থেকে কৃষক আন্দোলন ও সংগঠনে নিয়োজিত ছিলাম। তবে যুদ্ধের সময়টা বাদ দিয়ে। কারণ তখন স্বাধীনতা যুদ্ধ সংগঠনের জন্য আমাকে দুই বঙ্গের বিস্তীর্ণ অঞ্চল পরিভ্রমণ করতে হয়। তবে সেটা আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে ছিল না। অবশ্য এখানে সেই আলোচনা অপ্রাসঙ্গিক।

যাইহোক, আমার বিবেচনায় ১৯৮৯ সাল থেকে ১৯৯০ সাল পর্যন্ত কালপর্বে বিভিন্ন বিষয়ের উপর কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ রচনা সম্পূর্ণ করি। যেমন ঢাকায় ফিরবার অল্প পর ১৯৮৯-এর নভেম্বরের ৯ থেকে ২০ তারিখের মধ্যে লিখি ‘মার্কসবাদের সঙ্কট ও বিপ্লবের ভবিষ্যৎ’। এটার মূল বা খসড়া কাঠামো ১৯৮৭ অথবা ১৯৮৮ সালে গ্রামে থাকা অবস্থায় তৈরী করি। ঢাকায় ফিরে এটাকে চূড়ান্ত রূপ দিয়ে আহমদ ছফা সম্পাদিত ‘উত্তরণ’ পত্রিকায় প্রকাশের জন্য দিলে সেখানে এটি ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হয়। তারপর লিখি ‘ইসলামের ভূমিকা ও সমাজ উন্নয়নের সমস্যা’। সেটা লিখবার সময় ছিল ১৯৯০-এর ১৮ মে থেকে ১৩ জুন। এটা প্রকাশিত হয় অবশ্য অনেক পরে। এরপর প্রণালীবদ্ধভাবে ঋগ্বেদ পাঠ করি এবং তার ভিত্তিতে ১৯৯০-এর ১২ অক্টোবর থেকে ২৯ নভেম্বর পর্যন্ত সময়ে লিখি ‘ভারত-ইতিহাসের সূত্র সন্ধান’। বইটা প্রকাশিত না হলেও এটা পরবর্তী সময়ে লিখা ইংরাজী The Aryans and the Indus Civilization এবং বিশেষ করে বাংলা বই ‘আর্যজন ও সিন্ধু সভ্যতা’র ভিত্তি হিসাবে কাজ করে। এটা লক্ষ্যণীয় যে আমার বিবেচনায় তিনটি বিষয়ের উপর আমার জীবনের তিনটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ সম্পন্ন হয় ১৯৮৯ থেকে ১৯৯০-এর মধ্যে। এই তিনটি বিষয়ের মধ্যে একটি মার্কসবাদ, অপরটি ইসলাম এবং তৃতীয়টি হিন্দুদের আদি ধর্মগ্রন্থ হিসাবে পরিচিত ঋগ্বেদ এবং তার সঙ্গে সম্পর্কিত সিন্ধু সভ্যতা।

আমি যেটা বুঝেছি সেটা হচ্ছে একদিকে অধ্যয়ন এবং অপরদিকে মাঠ পর্যায়ে কাজ এই উভয়ের সম্মিলন আমার শক্তির প্রকৃত উৎস। সাধারণত যারা মাঠ পর্যায়ে আন্দোলন এবং সংগঠন নিয়ে ব্যস্ত থাকে আমি দেখেছি তারা সাধারণত লেখাপড়া করে না। আর যারা বেশী লেখাপড়া করে তারা সাধারণত মাঠ পর্যায়ের কাজে যায় না। কিছু ব্যতিক্রম পাকিস্তানের সেই কালটাতে বিশেষত ষাটের দশকে থাকলেও এই উভয়ের সম্মিলন সেই কালেও খুব একটা চোখে পড়ত না। আসলে বেশী লেখাপড়া যারা করে কিংবা যারা ভাল ছাত্র হিসাবে সুনাম অর্জন করে তারা সেকালে অনেকে বিপ্লবী রাজনীতিকে পছন্দ করলেও বা মুখে সমর্থন করলেও তারা সে কালেও ২/৪ জন ব্যতিক্রম ছাড়া ঝুঁকি বা কষ্টের জীবনকে এড়াতে চাইত। এ কথাই বলা সঙ্গত যে, তারা সাধারণত কেরিয়ারিস্ট বা আত্মোন্নতিবাদী হত। আর সাধারণ নিয়মে এরা সহজ পথের যাত্রী হয়।

অন্যদিকে, যারা অধ্যয়নশীলতা সত্ত্বেও শ্রমিক ও কৃষকসহ শ্রমজীবী জনগণ বিশেষত গ্রামীণ জনগণের মাঝে দীর্ঘ কাল অবস্থান করত তারা সমাজের পশ্চাৎপদতা দ্বারা নিজেরাও প্রভাবিত হত। আর সর্বদা আন্দোলন নিয়ে ব্যস্ত থাকায় লেখাপড়ার সুযোগও তেমন একটা থাকত না। শেষ পর্যন্ত তাদেরও অবনতি হত। পার্টির শৃঙ্খলাও একটা খুব বড় বাধা হয়ে দাঁড়াত। যাইহোক, এটা আর একটা আলোচনার বিষয় যা আমি বারান্তরে করবার ইচ্ছা রাখি। তবে আমার জীবনের শিক্ষা হচ্ছে মহৎ কিছু বা বড় কিছু করতে চাইলে আমাদের মত পশ্চাৎপদ, ধর্মশাসিত, দরিদ্র এবং দৃঢ়বদ্ধ উপনিবেশিক উত্তরাধিকারের সমাজে শুধু যে অধ্যয়ন কিংবা জ্ঞান এবং অনুশীলন বা মাঠ পর্যায়ের কাজের মধ্যে সমন্বয় সাধন করতে জানতে হয় তা-ই নয়, অধিকন্তু বুদ্ধিবৃত্তির জায়গাগুলিতে যে সকল প্রতিষ্ঠান এবং শ্রেণী জাঁকিয়ে বসে থাকে তাদের বিরুদ্ধেও প্রায়শ প্রচণ্ড এবং সাহসী সংগ্রাম পরিচালনা করতে হয়। এ বিষয় নিয়েও বারান্তরে কিছু বলবার ইচ্ছা রইল।

 

রচনা : ১১ - ২২ মার্চ, ২০১৮
    

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
Archive
 
সাম্প্রতিক পোষ্টসমূহ