Banner
সিন্ধু সভ্যতাঃ প্রাচীন পৃথিবীর এক অতুলনীয় সভ্যতা ─ শামসুল আলম চঞ্চল

লিখেছেনঃ শামসুল আলম চঞ্চল, আপডেটঃ February 3, 2019, 12:00 AM, Hits: 1378

 

সমসাময়িক মিসর ও মেসোপটেমিয়ার সভ্যতার তুলনায় সিন্ধু সভ্যতার প্রতি সাধারণভাবে মানুষের আগ্রহ কম। এর প্রধান কারণ এই দুই সভ্যতার তুলনায় সিন্ধু সভ্যতায় বিশালাকায় নির্মাণ না থাকা। এছাড়াও অপর একটি কারণ হল, সিন্ধু সভ্যতার লিপি পাঠোদ্ধার না হওয়ায়, এই সভ্যতা সম্পর্কে অনেক কিছুই অজানা রয়ে যাওয়া। কিন্তু সিন্ধু সভ্যতায় মিসর বা মেসোপটেমিয়ার মত মহা নির্মাণের সাক্ষ্য পাওয়া না গেলেও সিন্ধু সভ্যতা যে সে যুগের মত করে অনন্য এক মানবিক ও গণতান্ত্রিক বৈশিষ্ট্য সম্পন্ন সভ্যতা ছিল তা সেখানকার প্রত্নতাত্ত্বিক ও অন্যান্য ক্ষেত্রে গবেষণার ফলাফল দ্বারা অনুমান করা যায়। সকল নাগরিকের জন্য সে যুগের মত করে সুযোগ-সুবিধার ব্যবস্থা, ধন ও সম্পদের তুলনামূলক কম বৈষম্য, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় ক্ষেত্রে দাস প্রথার অনুপস্থিতি, এককেন্দ্রিক ও বংশানুক্রমিক শাসকের অনুপস্থিতি, যুদ্ধ ও সামরিক শক্তির অপ্রাধান্য, রাষ্ট্র শাসনে ধর্মের তুলনামূলক অনুপস্থিতি, ইত্যাদি দ্বারা সিন্ধু সভ্যতা এক অনন্য বৈশিষ্ট্যের অধিকারী হয়ে আছে।

মিসর বা মেসোপটেমিয়া সহ অন্যান্য সমসাময়িক সভ্যতার ক্ষেত্রে দেখা গেছে, নগরে রাজ প্রাসাদ বা ধনীদের বাড়ীর চারপাশে অন্যান্য ধনী বা সম্পদশালী লোকজনের বসবাস ছিল। সাধারণ লোকজনের বাড়ীঘর দূরে থাকত। অন্যদিকে সিন্ধু সভ্যতার নগরগুলোর একটিতেও রাজপ্রাসাদ খুঁজে পাওয়া যায় নাই। সেখানে ধনীদের বাড়ীগুলো কোথায়ও কেন্দ্রীভূত না থেকে নগরের বিভিন্ন অংশে ছড়ানো ও সাধারণ মানুষের বাড়ীঘরের আশেপাশেই থাকত। এ পর্যন্ত খনন করা হয়েছে সিন্ধু সভ্যতার এমন প্রধান নগরগুলোর যেমন, মহেঞ্জোদাড়ো (পাকিস্তানের সিন্ধু প্রদেশে), হরপ্পা (পাকিস্তানের পাঞ্জাব প্রদেশে), রাখিগাড়ি (ভারতের হরিয়ানা প্রদেশে), ধোলাভিরা (ভারতের গুজরাট প্রদেশে), বা লাখানঞ্জো-দাড়ো (পাকিস্তানের সিন্ধু প্রদেশে; এটি সম্প্রতি খনন করা হয়েছে), কোনওটাকেই সিন্ধু সভ্যতার রাষ্ট্রের রাজধানী হিসাবে চিহ্ণিত করা যায় না। এই সমস্ত বৈশিষ্ট্য থেকে সেখানে অন্যান্য সভ্যতার মত কেন্দ্রীভূত রাজা বা বংশানুক্রমিক রাজতন্ত্র থাকার সম্ভাবনাকে বাতিল করে দেওয়া যায়। অন্যান্য সভ্যতায় কেন্দ্রীভূত ক্ষমতার অধিকারী হিসাবে যে রাজা এবং রাজতন্ত্রের উদ্ভব ঘটে সেটাই সেখানে সম্পদেরও কেন্দ্রীভবন ঘটায়। এর সাক্ষ্য হিসাবে আমরা মিসরে বিশালাকৃতির পিরামিড ও রাজপ্রাসাদ এবং মেসোপটেমিয়ায় রাজপ্রাসাদ ও ধর্ম মন্দির হিসাবে পরিচিত জিগ্গুরাটের মত মহা নির্মাণ দেখতে পাই। সিন্ধু সভ্যতার বিভিন্ন বৈশিষ্ট্য থেকে এটাই মনে হয় যে, সিন্ধু সভ্যতার শাসন কাজ যৌথ সম্মতির ভিত্তিতে পরিচালনা করা হত। ভারতবর্ষে গৌতম বুদ্ধের সময় থেকে বেশ কিছু শতাব্দী কাল টিকে থাকা ’রিপাবলিক’ বা গণরাজ্যগুলো সিন্ধু সভ্যতার রাষ্ট্র শাসন পদ্ধতির ধারাবাহিকতা বলে অনুমান করা যেতে পারে।

সিন্ধু সভ্যতার নগরগুলোয় পাওয়া নরকংকালের উপর গবেষণা করে দেখা গেছে যে, সমাজের ধনী ও দরিদ্র বিভিন্ন স্তরে পুষ্টিমানে পার্থক্য সমসাময়িক অন্যান্য সভ্যতার তুলনায় আশ্চর্যজনকভাবে কম। এই বৈশিষ্ট্য সাধারণভাবে সেখানে মানুষের তুলনামূলক কম ধনবৈষম্য ও ব্যপক সমৃদ্ধি প্রকাশ করে।

সেখানকার শাসকশ্রেণী যে সাধারণ মানুষের নাগরিক সুযোগ সুবিধার প্রতি যত্নবান ছিল তার প্রমাণ পাওয়া যায় নগরগুলোতে জল সরবরাহের জন্য প্রচুর কুয়োর উপস্থিতি এবং বেশীরভাগ নগরের ক্ষেত্রে স্নানাগার ও শৌচাগারের বর্জ নগরের বাইরে নিষ্কাশনের জন্য ঢাকনাযুক্ত নর্দমা ব্যবস্থা গড়ে তোলা। প্রত্নতাত্ত্বিকরা মহেঞ্জোদাড়ো নগরে ৭০০টি কুয়ো পাওয়ার কথা উল্লেখ করেছেন। অথচ সাধারণ মানুষের জন্য এই ধরণের কোনও নর্দমা ব্যবস্থা বা এত বেশী সংখ্যক জল সরবরাহের ব্যবস্থা সমসাময়িক অন্য কোনও সভ্যতায় দেখতে পাওয়া যায় না।

সিন্ধু সভ্যতায় সমরাস্ত্র যা পাওয়া গেছে সেগুলোর সংখ্যা যেমন কম তেমনি সেগুলোর মান যথেষ্ট দুর্বল। এটি তাম্রযুগের সভ্যতা বলে সব অস্ত্রই তামা, ব্রোঞ্জ, পাথর, হাড়, ইত্যাদির তৈরী হত। এছাড়া অন্যান্য সভ্যতায় যেমন যুদ্ধের বা যুদ্ধের সাথে সম্পর্কিত প্রচুর ছবি ও ভাস্কর্য পাওয়া গেছে, সিন্ধু সভ্যতায় আশ্চর্যজনকভাবে তা পাওয়া যায় না। সিন্ধু সভ্যতার নগরগুলোকে বেষ্টন করে যে প্রাচীর দেখতে পাওয়া যায়, প্রত্নতাত্ত্বিকরা একমত হয়েছেন যে সেগুলো শত্রুর হাত থেকে রক্ষার জন্য নয়। অন্যান্য সভ্যতাকে যেখানে বল প্রয়োগের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত করতে হয়েছিল ও তাকে বল প্রয়োগের মাধ্যমে রক্ষা করতে হয়েছিল, সিন্ধু সভ্যতায় এর কোনও প্রমাণ পাওয়া যায় না। তুলনায় শান্তিপূর্ণভাবে সেখানে সভ্যতা বিকাশ লাভ করেছিল ও টিকেছিল বলে মনে করা হয়। রাষ্ট্র থাকলে বল প্রয়োগের প্রতিষ্ঠান হিসাবে নিশ্চয়ই সেখানে সেনাবাহিনী ছিল। কিন্তু এটুকু বুঝতে পারা যায় যে, সেনাবাহিনী সেখানে রাষ্ট্র দ্বারা নিয়ন্ত্রিত ও অপ্রাধান্যে ছিল। সেনাবাহিনী বা রাষ্ট্রের বল প্রয়োগের মাধ্যম দুর্বল হওয়ায় সেখানে দাস প্রথাও অনুপস্থিত ছিল বা একেবারে সীমিত ছিল। প্রত্নতাত্ত্বিকরাও সেখানে দাস প্রথার সপক্ষে কোনও সাক্ষ্য পান নাই বলে জানাচ্ছেন।

সমসাময়িক মিসর বা মেসোপটেমিয়ায় দেখা যায় রাজাদের যেমন বিশালাকৃতি মূর্তি তেমনি তাদের দেব-দেবীদেরও বড় বড় মূর্তি। কিন্তু মিসর বা মেসোপটেমিয়ার সভ্যতাগুলোর চেয়ে অনেক বড় এলাকা জুড়ে বিস্তৃত সিন্ধু সভ্যতার শাসকদের মূর্তিও বিশাল হবার কথা। কিন্তু আশ্চর্য হবার মত বিষয় হল যে, প্রথমত সেখানে বড় কোনও মূর্তিই পাওয়া যায় নাই। দ্বিতীয়ত, সেখানে এমন কোনও ভবন পাওয়া যায় নাই যাকে মন্দির হিসাবে চিহ্ণিত করা যায়। যে সমস্ত ছোট মূর্তি পাওয়া গেছে সেগুলোকে দেব-দেবীর মূর্তি হিসাবে প্রত্নতাত্ত্বিকরা মনে করেন না। আগে যে সব ছোট মূর্তিগুলোকে মাতৃদেবীর মূর্তি মনে করা হত, সেগুলো নিয়ে এখনকার পণ্ডিতরা ভিন্নমত পোষণ করেন এবং সেগুলোকে তারা খেলনা হিসাবে চিহ্ণিত করেছেন। উপরের আলোচনা থেকে এটাই যুক্তিযুক্ত মনে হয় যে, সিন্ধু সভ্যতার শাসকরা রাষ্ট্র শাসনে ধর্মের ব্যবহারকে নিয়ণ্ত্রিত রেখেছিল। নিরাকার একেশ্বরবাদী ধারণা থাকলে সেটা এক কেন্দ্রিক শাসন ব্যবস্থা ও স্বৈরাচারের দিকে নিয়ে যেতে পারা স্বাভাবিক ছিল। এমন হতে পারে  শাসকরা এবং জনগণের অগ্রগামী অংশ হয়ত নিরীশ্বরবাদী ছিল। সে যুগে নীচ তলায় সাধারণ মানুষ ধর্মাচ্ছন্ন থাকার কথা। সেটা নিশ্চয়ই ছিল। এটি ভেবে আশ্চর্য লাগে যে, সিন্ধু সভ্যতার পতনের প্রায় দেড় হাজার বছর পরে ভারতবর্ষের সমাজে বৌদ্ধ ধর্মের মত একটি নিরীশ্বরবাদী ধর্ম কীভাবে এত জন সমর্থন নিয়ে প্রতিষ্ঠা পেয়েছিল। অনুমান করা যায়, গৌতম বুদ্ধের সময়েও জন সমাজের একটি বড় অংশ নিরীশ্বরবাদী ভাবধারা দ্বারা প্রভাবিত ছিল, যা সিন্ধু সভ্যতার মত একটি সভ্যতার প্রভাব ছাড়া বিকাশলাভ করা সম্ভব নয়। এই জনগোষ্ঠীই বৌদ্ধ ধর্মের অনুসারী হয়েছিল বলে মনে হয়। এছাড়াও চার্বাক ও সাংখ্য দর্শনের মত নিরীশ্বরবাদী মতবাদ এবং জৈন ধর্মের মত একটি নিরীশ্বরবাদী ধর্মও পরবর্তী ভারতবর্ষে প্রভাব বিস্তার করেছিল।

 

গ্রন্থপঞ্জি :

১। Jonathan Mark Kenoyer, “The Archaeological heritage of Pakistan: From the Palaeolithic to the Indus Civilization,” in ed, Roger D. Long, A History of Pakistan, Oxford University press, 2015.

২। R.S. Bisht, "Harappan Civilization (1921-2013): An Overview,” in, Puratattva, No. 43, 2013.

৩। Jonathan Mark Kenoyer, Ancient Cities of the Indus Valley Civilization, Oxford University Press, Karachi, 1998.

৪। Vasant Shinde, Shweta Sinha Deshpande, Toshiki Osada and Takao Uno, "Basic Issues in Harappan Archaeology: Some Thoughts," in, Ancient Asia, Vol. I, 2006.

৫। Kenneth A.R. Kennedy, "Skulls, Aryans and Flowing Drains: The Interface of Archaeology and Skeletal Biology in the Study of the Harappan Civilization," in, ed, Gregory L. Possehl, Harappan Civilization: A Contemporary Perspective, Oxford & IBH Publishing Co, New Delhi, 1982.

৬। Jonathan Mark Kenoyer and Richard H. Meadow, "Harappa: New Discoveries on its Origins and Growth," in, Lahore Museum Bulletin, Vol. XII, No. 1, 1999.

৭। Michael Jansen, "Mohenjo-Daro, Indus Valley Civilization: Water Supply and Water Use in One of the Largest Bronze Age Cities of the Third Millennium BC," in, eds, Terje Tvedt and Terje Oestigaard, A History of Water, A, Series III, Vol. 1: Water and Urbanism, I.B. Tauris, 2014.

৮। Jim G. Shaffer, "Harappan Culture: A Reconsideration," in, ed, Gregory L. Possehl, Harappan Civilization: A Recent Perspective, American Institute of Indian Studies and Oxford & IBH Publishing Co. Pvt. Ltd., New Delhi, 1993.

৯। G.P. Singh, Republics, Kingdoms, Towns and Cities in Ancient India, D.K. Printworld (P) Ltd., New Delhi, 2003.

 

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
Archive
 
সাম্প্রতিক পোষ্টসমূহ