Banner
আমি কোন ধর্মটি চয়ন করব? — আলমগীর হুসেন

লিখেছেনঃ আলমগীর হুসেন, আপডেটঃ July 13, 2019, 12:00 AM, Hits: 984

 

আমি বয়সে তিরিশের মাঝামাঝি এবং একজন জীবন সাথীর খোঁজে প্রাণান্ত। এমতাবস্থায় ২০০৩ সালের মার্চ মাসে এক বন্ধু আমারই সমবয়সী এক মুসলিম মেয়ের সাথে পরিচয় করিয়ে দেয়। মেয়েটির পাকিস্তানী-ভারতীয় মুসলিম পিতামাতার ঘরে জন্ম এবং সে পশ্চিমা উদার পরিবেশে লালিত। সে ক্যানাডার ব্রাঞ্জুউইক বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক (B.Sc.) ও ইংল্যান্ডের কেম্ব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর (M.Sc.) ডিগ্রীধারী। এরপর সে একটা বিশ্ববিদ্যালয়ে ৭ বছর ধরে শিক্ষকতা ও পাশাপাশি পিএইচডি (Ph.D.) ডিগ্রীর উপর কাজ করছিল।

আমি বাংলাদেশের এক গ্রামে জন্মেছি ও রক্ষণশীল মুসলিম পরিবেশে বড় হয়েছি। কিন্তু ২০০১ সালের ১১ই সেপ্টেম্বরে আমেরিকার ওয়ার্ল্ড ট্রেইড সেন্টার-এর উপর ইসলামী জিহাদের নামে মুসলিম সন্ত্রাসীদের নির্মম আক্রমণের পর বিশ্বব্যাপী ইসলামের নামে আতংকের যে জোয়ার বইতে থাকে, তাতে ইসলামে আমার বিশ্বাস নড়বড়ে হয়ে উঠছিল। মেয়েটির সাথে পরিচয় হওয়ার সময় ইসলামের বিশ্বাসযোগ্যতা কিংবা ইসলাম ধর্ম হিসাবে গ্রহণযোগ্য কিনা সে বিষয়ে আমি কিছুটা সন্দিহান হয়ে উঠছিলাম। আমার বন্ধু ও তার নব্য ইসলাম-গ্রহণকারী জাপানী স্ত্রীর উপস্থিতিতে আমি যখন দ্বিতীয়বার মেয়েটির সাথে দেখা করি, তখন সে ইসলামে আমার বিশ্বাস সম্পর্কে জিজ্ঞেস করে বসে; কেননা ধর্ম তার জীবনে খুবই গুরুত্বপূর্ণ ছিল।

ঐ মুহূর্তে ইসলামে আমার বিশ্বাস যেহেতু গোলমেলে বা দুর্বল হয়ে পড়ছিল, আমি তাকে তার মনঃপুত জবাব দিতে পারলাম না, কেননা আমি তার সাথে সততা দেখাতে চেয়েছিলাম – বিশেষত আমি যখন আমার বাকী জীবনটা তার সাথেই কাটানোর কথা ভাবছিলাম। আমি বললামঃ মুসলিম, হিন্দু বা খৃষ্টান হওয়া আমার জন্য গুরুত্বপূর্ণ নয়, গুরুত্বপূর্ণ হলো একজন ভাল মানুষ হওয়া, মানবতাবাদী হওয়া। এ জবাব তার মনঃপুত হবার ধারে-কাছেও ছিল না। শেষ পর্যন্ত আমার বন্ধু ও মেয়েটি আমাকে যে প্রশ্নটি করল, তা হলোঃ আমাকে যদি একটা ধর্ম পছন্দ করতেই হয়, তাহলে কোন ধর্মটি চয়ন করব?

কিন্তু ইসলামসহ অন্যান্য ধর্মগ্রন্থ সম্পর্কে আমার যথেষ্ট পড়াশুনা না থাকায় আমি এবারও মেয়েটির মনঃপুত কোন সুস্পষ্ট জবাব দিতে পারলাম না।

এরপর আমি ইন্টারনেটের কয়েকটি আলোচনা মঞ্চে “আমি কোন ধর্মটি চয়ন করব?” প্রশ্নটি উপস্থাপন করি নানান ধর্মের বিশ্বাসীদের কাছ থেকে মতামত ও কারণ জানার জন্য, যাতে করে আমি আমার সম্ভাব্য জীবন-সাথীকে প্রশ্নটার একটা সুস্পষ্ট জবাব দিতে পারি। সহমর্মী কয়েকজন ইন্টারনেট বন্ধুর (মুসলিম, হিন্দু, খৃষ্টান) কাছ থেকে কিছু ভাবালু ধরনের জবাব পাই মাত্র। তারা আমাকে সুস্পষ্টভাবে যুক্তি দিতে পারে নিঃ কেন আমি ইসলাম, হিন্দু বা খৃষ্টান ধর্ম গ্রহণ করব?

আমি মেয়েটির সাথে আরেকবার দেখা করেছি এবং এক-দু’বার ফোনে কথা বলেছি। শেষ পর্যন্ত সে আমাদের যোগাযোগের সমাপ্তি টানল এই বলেঃ “ধর্ম (ইসলাম) আমার জীবনে সবচেয়ে বড় জিনিস এবং আমি অনুরূপ জীবনদর্শনের একজন জীবনসাথী খুঁজছি।”

যাহোক, “আমি কোন ধর্মটি চয়ন করব?” প্রশ্নটির জবাব আমি খুঁজতে থাকি। এরপর বেশ সময় পার হয়ে গেছে এবং ইতিমধ্যে আমি আব্রাহামীয় (ইসলাম, খৃষ্টান, ইহুদী) ও হিন্দু ধর্ম সম্পর্কে কিছুটা পড়াশুনা করেছি। সেই সাথে আমার জীবনে ও আশেপাশে ঘটা কিছু ঘটনার ভিত্তিতে আমি এখন মোটামুটি একটা স্পষ্ট সিদ্ধান্তে আসতে পেরেছি যে, আমাকে যদি একটা ধর্ম চয়ন করতেই হয়, সে ধর্মটি কী হবে!

 

কেন ধর্ম ও কোন ধর্ম?

কেন আমাদের একটা ধর্মের প্রয়োজন? এটা ব্যাখ্যা করার দরকার পড়ে না যে, কেউ একটা ধর্মকে আলিঙ্গন করে যাতে সেটা পালনের মাধ্যমে মৃত্যুপর অনন্ত জীবনে সুখ-শান্তি নিশ্চিত হয় – যেমন ইসলামের ক্ষেত্রে তার জন্য বেহেস্তের দ্বার খুলে যায়। একজন ধার্মিক মানুষের জন্য পার্থিব জীবন হলো এক স্বল্পস্থায়ী বিরতিমাত্র, যার গুরুত্ব খুবই নগণ্য। তার কাছে অসীম গুরুত্বপূর্ণ হলো মৃত্যু-পরবর্তী আগামী জীবন, যা অন্তহীন। কাজেই কোন ধর্মটি আমরা বেছে নিব তার জন্য এটা উপলব্ধি করা প্রয়োজন যে, সৃষ্টিকর্তা মাত্র একজন এবং তাঁর প্রদত্ত সত্যধর্ম মাত্র একটি বা কয়েকটি – যদিও মানবজাতির ইতিহাসে হাজার হাজার ধর্ম এসেছে এবং সেগুলোর বহু বিলীন হয়ে গিয়েছে। কাজেই আমাদেরকে যথার্থ চৌকস হতে হবে সত্যিকার ধর্মটি নির্ণয় করতে এবং সেটিই গ্রহণ করতে হবে। কেউ যদি এখানে ভুল করে বসে এবং ভ্রান্ত একটি ধর্ম চয়ন করে ফেলে, তাহলে তার সর্বনাশ। মৃত্যুপর অনন্তকাল ধরে প্রচণ্ড অগ্নিদাহনে জ্বলেপুড়ে মরা হবে তার নিয়তি।

কাজেই আমি ব্যক্তিগতভাবে কোন ধর্মটি পছন্দ করব সে বিষয়ে গভীর ও সূক্ষ্মভাবে চিন্তা করেছি এবং আমার মনে হয় আমি নির্ণয় করতে পেরেছি কোন ধর্মটি সত্য বা সর্বাধিক সত্য ও খাঁটি, যা আমি নীচে আলোচনা করব।

এ আলোচনায় আমি চারটি প্রধান ধর্মকে গুরুত্ব দিয়েছিঃ ইসলাম, ইহুদী, খৃষ্টান ও হিন্দু ধর্ম। মানব সভ্যতার ইতিহাসে হারিয়ে যাওয়া হাজার হাজার ধর্ম – যেমন হেলিনিক যুগের (Hellenic Age) জিউস, এ্যাপোলো প্রমুখ ইশ্বরের ধর্মগুলো, যা মৃত্যুর নির্মম শিকারে পরিণত হয়েছে, সেগুলোও এ আলোচনায় আসে নি। কেননা আমি মনে করি সর্বশক্তিমান ও মহাবিশ্বের সবকিছুর নিয়ন্তা প্রকৃত স্রষ্টার সত্যধর্ম এমন শোচনীয় মৃত্যুবরণ করতে পারে না। আমি আজকের যুগে বিদ্যমান অনেক ছোট ছোট ধর্মগুলোকেও আলোচনায় আনি নি; কেননা সর্বশক্তিমান ঈশ্বর যখন ধর্মের মাধ্যমে মানবজাতির কাছে নিজেকে প্রকাশ করতে এতটাই আগ্রহী এবং যার জন্য তিনি হাজার হাজার বছর চেষ্টা চালিয়েছেন ইতিমধ্যে, তাহলে আল্লাহর প্রকৃত ধর্ম পৃথিবীতে বিদ্যমান ছোট ছোট ধর্মগুলোর মধ্যে থাকার কথা নয়। এটা বিশেষত যুক্তিযুক্ত এ কারণে যে, মরণশীল মানুষ তার প্রচেষ্টা ও বুদ্ধি-বিবেচনা খাটিয়ে আজ জ্ঞান-বিজ্ঞান, উন্নতি ও সভ্যতার অত্যন্ত উচ্চ পর্যায়ে পৌঁছে গেছে, যেখানে আল্লাহর ধর্মীয় প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়ে ক্ষুদে ধর্মগুলোর মধ্যে ঘুরে মরতে পারে না। আর এটাও হতে পারে না যে, মানুষ আজ জ্ঞানগরিমার চরম শীর্ষে পৌঁছে গেছে, অথচ স্রষ্টার আসল ধর্মটি নির্ণয় করতে ব্যর্থ হয়েছে। কাজেই ঈশ্বরের প্রকৃত ধর্মটি বা ধর্মগুলো অবশ্যই আজকের পৃথিবীতে বিদ্যমান বড় বড় ধর্মগুলোর মধ্যে থাকবে।

বৌদ্ধ ধর্ম আজ একটি প্রভাবশালী ধর্ম হলেও সেটা এ আলোচনায় আসে নি, কেননা তাতে কোন সৃষ্টিকর্তা বা পরকালে বেহেস্ত-দোজখের ধারণা নেই। প্রকৃতপক্ষে গৌতম বুদ্ধ কখনোই কোন ধর্ম প্রচার করেন নি। তিনি ছিলেন সমকালীন একজন ভাবুক চিন্তাবিদ, যিনি তার শিষ্যদের মাঝে আদর্শ জীবনযাপনের উপায় বা পথ কি হবে সেটা প্রচার করতেন। প্রায় সমকালীন প্রাচীন গ্রীসে সক্রেটিস, এ্যারিস্টোটল, লুক্রিটিয়াস, এপিকিউরাস প্রমুখ বড় বড় চিন্তাবিদও তাদের শিষ্যদের মাঝে অনুরূপভাবে জীবনদর্শন প্রচার করতেন। বুদ্ধবাদকে ধর্ম হিসাবে স্বীকৃতি দিলে সক্রেটিস, এ্যারিস্টোটল, লুক্রিটিয়াস, এপিকিউরাস প্রচারিত শিক্ষা এবং জীবনদর্শনও ধর্ম হিসাবে গণ্য হবে।

 

ইসলাম, খৃষ্টান ও ইহুদী ধর্ম একই প্রকৃতির?

মুসলিমরা দাবী করে যে, আল্লাহ নামক একই ঈশ্বর নূহ, মূসা, যীশু এবং সর্বশেষ ও সর্বশ্রেষ্ঠ মুহাম্মদকে নবী হিসাবে পৃথিবীতে প্রেরণ করেছিলেন তার ধর্মকে মানবজাতির কাছে প্রচার করতে। তবে ইহুদী ও খৃষ্টানরা বিশ্বাস করে না যে, তাদের ঈশ্বরই মুহাম্মদকে নবী হিসাবে পাঠিয়েছিলেন। মুসলিমদের মত খৃষ্টানরা বিশ্বাস করে মুসা ও যীশুকে পাঠিয়েছিলেন একই স্রষ্টা, কিন্তু ইহুদীরা সেটা বিশ্বাস করে না। এরূপ বিশ্বাস করা না-করার মাঝে আমি ঘুরে ফিরেছি বহুদিন এবং ভেবেছিঃ একই ঈশ্বর যদি এসব নবীকে পাঠিয়ে থাকেন তাঁর নীতি ও শিক্ষা প্রচার করতে, তাহলে এ ধর্মগুলোর আচার-প্রকৃতি এতটা ভিন্ন কেন, যেমনটি আমরা দেখি এসব ধর্মের অনুসারীদের ভিন্ন ভিন্ন ধর্মীয় আচার-প্রথা পালনের মাঝে। বিগত দু’বছর ধরে আমি ধর্মগুলো সম্পর্কে বেশকিছু জ্ঞান অর্জন করেছি এবং আমি ব্যক্তিগত জীবনে এমন কিছু ঘটনার মুখামুখি হয়েছে – যার ভিত্তিতে আমি অনুধাবন করতে পারি যে, এসব ধর্মকে বাহ্যিকভাবে ভিন্ন মনে হলেও মূল শিক্ষায় সেগুলোর মাঝে একত্ব বা সমরূপতা আছে। বাহ্যিক আচারের ভিন্নতাগুলো সম্ভবত শত শত বছর ধরে পরিবর্তন বা পথ-ভ্রষ্টতার কারণে সৃষ্টি হয়েছে। আমি এখানে কিছু দৃষ্টান্ত উপস্থাপন করব যা সূত্রহীন হতে পারে, কেননা আমি সেগুলো পারস্পারিক আলোচনার ভিত্তিতে জেনেছি; তবে আমার বিশ্বাস সেগুলো সত্যকে প্রতিফলিত করবে।

 

ব্যভিচারের জন্য পাথর ছুঁড়ে জ্যান্ত হত্যাঃ ইসলাম, খৃষ্টান ও ইহুদী ধর্মে একই প্রথা!

আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত বেশীরভাগ মুসলিমরা তর্ক করে যে, ব্যভিচারের জন্য পাথর ছুঁড়ে জ্যান্ত হত্যার প্রথা ইসলামে নেই। তারা দাবী করেঃ “ব্যভিচারের জন্য পাথর ছুঁড়ে হত্যার বিষয়ে কিছুই বলা হয় নি কোরানে।” এটা সত্য যে ব্যভিচারের জন্য পাথর ছুঁড়ে হত্যার বিষয়ে কোরান কিছুই বলে নি, তবে জ্যান্ত ক্রুশবিদ্ধ করে হত্যা, হাত-পা বিপরীত দিক থেকে কেটে ফেলা ইত্যাদিকে স্বর্গীয়ভাবে অনুমোদিত শাস্তি হিসাবে উল্লেখ করেছে (কোরান ৫:৩৩)। অবৈধ যৌনকর্মের জন্য শাস্তির ব্যাপারে কোরান ২৪:২-৩ আয়াতে বলেঃ

“ব্যভিচার ও বিয়ে-পূর্ব যৌনকর্মে দোষী নারী ও পুরুষকে ১০০টি দোররা মেরে শাস্তি দাও… ব্যভিচার ও বিয়ে-পূর্ব যৌনকর্মে দোষী পুরুষ কেবল একই চরিত্রের বা একজন কাফের নারীকে বিয়ে করতে পারবে…”

এ আয়াতটির ভিত্তিতে শিক্ষিত মুসলিমরা দাবী করে যে, কোরানে ব্যভিচারের (বিয়ে-পূর্ব অবৈধ যৌনকর্মের) শাস্তি ১০০টি দোররা মারা, পাথর ছুঁড়ে হত্যা নয়। এখানে কয়েকটি বিষয় বিবেচ্যঃ

ক) সেসব শিক্ষিত মুসলিমদেরকে যদি জিজ্ঞেস করা হয়ঃ বিয়ে-পূর্ব যৌনকর্মের জন্য অবিবাহিত ছেলেমেয়েদেরকে ১০০টি দোররা মারা ঠিক কিনা, তারা তাতে না’সূচক উত্তর দিবে। তারাই দাবী করছে এটা আল্লাহর স্বর্গীয়ভাবে অনুমোদিত শাস্তি – অথচ সেটা কার্যকর করা যাবে না।

খ) আয়াতটিতে আপাতঃদৃষ্টিতে অবিবাহিত ছেলেমেয়েদের মাঝে এবং বিবাহিত নারী-পুরুষের মাঝে অবৈধ যৌনকর্মের জন্য একই শাস্তির রায় দিয়েছে আল্লাহ। কিন্তু সেসব শিক্ষিত মুসলিমদেরকে যদি জিজ্ঞেস করা হয়ঃ অবৈধ যৌনকর্মে দোষী অবিবাহিত ছেলেমেয়ে ও বিবাহিত নারী-পুরুষকে একই শাস্তি দেওয়া ন্যায় বা যুক্তিযুক্ত কিনা – তারা না’সূচক উত্তর দিবে। এখানেও সেই একই সমস্যাঃ তারা স্বীকার এবং দাবী করছে এটা আল্লাহ-অনুমোদিত শাস্তি, কিন্তু সঠিক না।

হারিয়ে যাওয়া ব্যভিচারের আয়াতঃ পৃথিবীর কোন জনগোষ্ঠীই ব্যভিচার ও অবিবাহিত ছেলেমেয়েদের মাঝে যৌনকর্মকে একই দৃষ্টিতে দেখে না, এবং উভয়কে একই শাস্তি দেওয়া অন্যায় মনে করবে। তার মানে দাঁড়ায় আল্লাহর চিন্তাধারা ভুল; স্বয়ং শিক্ষিত মুসলিমরাও সেটাই বলছে। তবে আল্লাহ কিভাবে ভুল করতে পারেন? ভুল করতে পারে কেবল মানুষ। ইসলামের ক্ষেত্রেও ঠিক তাই হয়েছে। উপরে উল্লেখিত ২৪:২-৩ আয়াতে আল্লাহ সম্ভবত কেবল অবিবাহিতদের মাঝে যৌনকর্মের কথা বলেছেন। বিবাহিতদের মাঝে ব্যভিচারের কথা বললে তাদের বিয়ের কথা আসবে কেন! ইসলামী সূত্র থেকে আমরা জানতে পাই, আল্লাহ আসলে ব্যভিচারের বিষয়ে আলাদা একটা আয়াত (আর-রাজম) নাজিল করেছিলেন, কিন্তু সেটা হারিয়ে যায়। সহি হাদীস সংগ্রহকারী ইসলামী পণ্ডিত ইবনে মাযা জানানঃ আল-আহযাব সুরাটি (সুরা ৩৩) চামড়ার পাতায় লিখে মহানবী তা প্রিয়তম স্ত্রী আয়শার কাছে রেখেছিলেন। মহানবীর মৃত্যুর পর আয়শা তার মৃতদেহের সাথে কবরস্থানে যান, এবং ফিরে এসে দেখেন চামড়া পাতাগুলোর একটি ছাগলে খেয়ে ফেলেছে, যার অন্তর্ভুক্ত ছিল আর-রজমের (পাথর ছুঁড়ে হত্যার) আয়াতটি। এ সম্পর্কে মহানবীর প্রথম জীবনীতে ইবনে ইসহাক লিখেছেনঃ

“আল্লাহ মুহাম্মদকে প্রেরণ করেন এবং তার মাধ্যমে ধর্মীয় বাণী পাঠান, যার মাঝে ছিল আর-রজমের বা পাথর ছুঁড়ে হত্যার আয়াত। উমর বলেনঃ “আমরা সেটা পড়েছি, আমাদেরকে সেটা শিখানো হয়েছিল এবং আমরা সে নির্দেশ মেনে চলেছি। মহানবী পাথর ছুঁড়ে মেরেছেন; তার (মৃত্যুর) পরে আমরা পাথর ছুঁড়ে মেরেছি।”i

সহি হাদীস সংগ্রহকারক আবু মুসলিমও পাথর-ছুঁড়ে হত্যার আয়াতের কথা বলেছেনঃ

উমর জানানঃ “আল্লাহ মহানবীর কাছে আসমানী কিতাব (কোরান) প্রেরণ করেন এবং সে কিতাবে পাথর ছুঁড়ে হত্যার আয়াত ছিল।” উমর আরও জানানঃ “বিবাহিত নারী-পুরুষরা ব্যভিচারে লিপ্ত হলে এবং তা সাক্ষ্য-প্রমাণে কিংবা গর্ভধারণ বা স্বীকারোক্তি দ্বারা সঠিক প্রতিপন্ন হলে, তাদেরকে পাথর ছুঁড়ে হত্যা আল্লাহর কিতাবে নির্ধারিত দায়িত্ব।”

(সহি মুসলিম ১৭:৪১৯৪)

তাহলে আমরা দেখছি, বিবাহিত ও অবিবাহিতদের মাঝে অবৈধ যৌনকর্মের শাস্তি যেহেতু এক হতে পারে না – যা মুসলিমরাও স্বীকার করবে – সে বিবেচনা বা যুক্তির সাথে সঙ্গতি রেখে আল্লাহ ব্যভিচারের ক্ষেত্রে আলাদা আয়াত নাজিল করেছিলেন, যার প্রমাণ আসছে ইসলামের বিভিন্ন সূত্র থেকে। এবং নবী মুহাম্মদের সময় থেকে ইসলামী সমাজে তা প্রয়োগ হয়ে এসেছে। এ সম্পর্কে আমরা আরো প্রমাণ পাই মহানবী কিভাবে ব্যভিচারীদেরকে শাস্তি দিতেন সেসব দৃষ্টান্ত থেকে। আসুন নজর দিই নিম্নোক্ত সহি হাদীসগুলোর দিকেঃ

সহি বুখারী ৪:৫৬:৮২৯:

আব্দুল্লাহ ইবনে উমর জানানঃ “ইহুদীরা মহানবীর কাছে এসে বলে তাদের গোত্রের এক মহিলা ও পুরুষ অবৈধ যৌনকর্মে লিপ্ত হয়েছে। আল্লাহর নবী তাদেরকে বললেনঃ ‘তোমরা তাউরাতে পাথর ছুঁড়ে হত্যার আয়াত পাওনি?’ তারা উত্তর দেয়ঃ ‘আমরা তাদের অপকর্ম প্রচার করি এবং দোররা মারি।’ আব্দুল্লাহ বিন সালাম জানানঃ ‘(নবী বললেন) তোমরা মিথ্যা বলছ; তাউরাতে পাথর ছুঁড়ে হত্যার আয়াত আছে।’ তারা তাউরাত আনল এবং তাদের একজন পাথর ছুঁড়ে হত্যার আয়াতটি হাত দিয়ে আড়াল করে আগের ও পরের আয়াতগুলো পড়তে লাগল। আব্দুল্লাহ বিন সালাম জানানঃ ‘(নবী বললেন) তোমার হাত সরাও।’ যখন সে হাত সরালো পাথর ছুঁড়ে হত্যার আয়াতটি বেরিয়ে এল। তখন তারা বললঃ ‘মুহাম্মদ সত্য কথা বলেছেন; তাউরাতে পাথর ছুঁড়ে হত্যার আয়াত আছে।’ নবী তখন দোষী দু’জনকে পাথর ছুঁড়ে হত্যার নির্দেশ দিলেন। (আব্দুল্লাহ ইবনে উমর জানানঃ ‘আমি দেখলাম পুরুষটি মহিলাটিকে নিজের শরীর দিয়ে আড়াল করছে নিক্ষিপ্ত পাথর থেকে রক্ষা করতে।’)

সহি মুসলিম ১৭:৪২০৭:

ইমরান বিন হুসেন জানান যে, জুহাইনা গোত্রের এক মহিলা নবীর কাছে আসে এবং সে অন্তঃসত্ত্বা হয়ে পড়েছিল। সে বললঃ আল্লাহর রসুল, আমি অপকর্ম করেছি যার জন্য আমার শাস্তি হওয়া দরকার এবং আমাকে শাস্তি দিন। আল্লাহর নবী মহিলার মালিককে ডেকে বললেনঃ তাকে ভালমত দেখাশুনা কর এবং বাচ্চা জন্ম দেওয়ার পর তাকে আমার কাছে নিয়ে এসো। সে কথা মত কাজ করল। তারপর আল্লাহর নবী মহিলার জন্য প্রাপ্য শাস্তি ঘোষণা করলেন। এবং কাপড় দিয়ে তাকে বেঁধে নবী নির্দেশ দিলেন ও তাকে পাথর ছুঁড়ে মেরে ফেলা হল।

সহি বুখারী ৪:৫৬:৮২৯:

আবু হুরাইরা জানানঃ বনি আসলামের এক ব্যক্তি নবীর মসজিদে এসে নবীকে বললেনঃ ‘হে আল্লাহর রসুল! আমি অবৈধ যৌনকর্মে লিপ্ত হয়েছি।’ এ কথা শুনে নবী অন্য দিকে মুখ ফিরালেন। এরপর লোকটি নবীর দিকে ফিরে আবারও একই কথার পুনরাবৃত্তি করল। নবী আবারও অন্য দিকে মুখ ফিরালেন। লোকটি নবীর দিকে আবারও মুখ ফিরিয়ে এভাবে চতুর্থবারের মত একই কথার পুনরাবৃত্তি করল। চতুর্থবারের পর নবী তাকে বললঃ ‘তুমি কি পাগল হয়ে গেছ?’ সে জবাব দিলঃ ‘না’। নবী তখন তার সাহাবীদেরকে নির্দেশ দিলেনঃ ‘যাও, ওকে পাথর ছুঁড়ে মেরে ফেল।’ লোকটি বিবাহিত ছিল। জাবির বিন আব্দুল্লাহ আল-আনসারী জানানঃ ‘আমি পাথর নিক্ষেপকারীদের একজন ছিলাম। আমরা তাকে মদীনার মুসাল্লাতে (ঈদের নামাজের জায়গা) পাথর ছুঁড়ে হত্যা করি। আমরা তার উপর ধারালো কোণাওয়ালা পাথর ছুঁড়তে থাকলে সে পালাতে চেষ্টা করে, কিন্তু আমরা তাকে আল’হাররাতে ধরে ফেলি এবং পাথর ছুঁড়তে থাকি সে মরে যাওয়া পর্যন্ত।’

সহি মুসলিম ১৭:৪২০৯:

আবু হুরাইরা ও জায়েদ বিন খালিদ আল-জুহানি জানানঃ তারপর আল্লাহর রসুল বললেনঃ ‘বল।’ সে বললঃ ‘আমার ছেলে ঐ ব্যক্তির বাড়িতে চাকর ছিল এবং তার স্ত্রীর সাথে ব্যভিচারে লিপ্ত হয়েছে। আমাকে জানানো হয়েছে যে, (ইসলাম মতে) পাথর ছুঁড়ে হত্যা তার প্রাপ্য শাস্তি। এ অপরাধের বিনিময় হিসাবে আমি ১০০টি ছাগল ও একজন দাসী দিয়েছি। তা এ অপরাধের জন্য যথেষ্ট কিনা জানতে চাইলে ধর্মপণ্ডিতরা আমাকে বলেন যে, আমার ছেলেকে ১০০ দোররা মারতে হবে এবং এক বছরের জন্য নির্বাসনে যেতে হবে। এবং ঐ মহিলাকে পাথর ছুঁড়ে মেরে ফেলতে হবে (যেহেতু সে বিবাহিতা)।’ এরপর আল্লাহর নবী বললেনঃ ‘যাঁর হাতে আমার জীবন তাঁর নামে শপথ করে বলছি, আমি এ ব্যাপারে আল্লাহর কিতাবের ভিত্তিতে রায় দিব। ঐ দাসী ও ছাগলগুলো ফেরত নিতে হবে, এবং তোমার ছেলেকে ১০০ দোররা মেরে ও এক বছরের জন্য নির্বাসনে পাঠিয়ে শাস্তি দিতে হবে। এবং ও অনাইস! সকালে ঐ মহিলার কাছে যাবে এবং সে স্বীকারোক্তি করলে তাকে পাথর ছুঁড়ে মেরে ফেলবে।’ সে সকালে মহিলার কাছে গেল এবং সে স্বীকারোক্তি দিল। এরপর আল্লাহর নবী শাস্তি ঘোষণা করলেন এবং তাকে পাথর ছুঁড়ে মেরে ফেলা হল।

সহি বুখারী ৪:৫৬:৮২৯:

ইবনে আব্বাস জানান যে, আল্লাহর নবী মাই’জ বিন মালিককে বললেনঃ ‘তোমার সম্পর্কে যা আমার কানে এসেছে তা কি সত্য?’ সে বললঃ ‘আমার সম্পর্কে আপনি কি শুনেছেন?’ নবী বললেনঃ ‘আমি শুনলাম তুমি ওমুকের ক্রীতদাসীর সাথে ব্যভিচারে লিপ্ত হয়েছো।’ সে বললঃ ‘হ্যাঁ’। সে চারবার সেটা স্বীকার করল। নবী তখন তার জন্য শাস্তি ঘোষণা করলেন এবং তাকে পাথর ছুঁড়ে মেরে ফেলা হল।

সুতরাং আমরা দেখছি কম করে হলেও চার-চারটি ভিন্ন ঘটনায় নবী মুহাম্মদ ব্যভিচারের অপরাধে পাথর ছুঁড়ে হত্যার নির্দেশ দিয়েছিলেন এবং নবীর সময় থেকে বর্তমানকাল পর্যন্ত মুসলিম বিশ্বের কোন-না-কোন দেশে তা বহাল থেকেছে। অবৈধ যৌনকর্মের জন্য পাথর ছুঁড়ে হত্যার সুস্পষ্ট বিধান আমরা দেখি ইহুদী ধর্মীয় অনুশাসনে। তাউরাতের নিম্নোক্ত বাণীগুলোতে পাথর ছুঁড়ে হত্যা শাস্তি হিসাবে নির্ধারিত হয়েছেঃ

“যদি কোন পুরুষকে এক মহিলার সাথে শুতে দেখা যায়, যে অন্য স্বামীর সাথে বিবাহ–বন্ধনে আবদ্ধ…, তাহলে তোমরা তাদের দু’জনকে শহরের মুক্তাঙ্গনে আনবে এবং তাদেরকে পাথর ছুঁড়ে মেরে ফেলবে…” (ডিউটেরোনোমি ২২:২২-২৪)

তাউরাতের লেবিটিকাস ২০:১০ আয়াতেও ব্যভিচারের জন্য একই শাস্তির বিধান পুনরাবৃত্ত হয়েছে। যদিও ইহুদী সমাজে এ বর্বর শাস্তির সূচনা হয়েছিল বা কার্যকর হয়ে আসছিল, নবী মুহাম্মদের সময়ে (এমনকি যীশু খৃষ্টের সময়েই) ইহুদীরাও এমন বর্বরতা বর্জন করছিল, যার প্রমাণ আমরা দেখি উপরোক্ত এক হাদীসে (সহি বুখারী ৪:৫৬:৮২৯)। অবৈধ যৌনকর্মের জন্য পাথর ছুঁড়ে হত্যার দৃষ্টান্ত সাধারণত পৌত্তলিক সমাজে দেখা যায় নি। বিশেষত মুহাম্মদের সময়কালীন আরব পৌত্তলিক সমাজ অত্যন্ত উদার ছিল যৌন আচরণের বিষয়ে। ইসলাম-পূর্ব আরব সমাজে যৌনকর্মের জন্য পাথর ছুঁড়ে হত্যার ইতিহাস নেই।

কাজেই ইসলামের আগমনের পর যৌন-অপকর্মের জন্য পাথর ছুঁড়ে হত্যা কিভাবে মুসলিম সমাজে ঢুকে পড়তে পারে এবং আজ পর্যন্ত বলবৎ থাকে?

নবী মুহাম্মদ কর্তৃক পাথর ছুঁড়ে হত্যার যেসব দৃষ্টান্ত আমরা দেখেছি, সেখান থেকেই যে ইসলামী সমাজে এ বর্বর শাস্তির সূচনা, সে ব্যাপারে সন্দেহ প্রকাশের কোন অবকাশ থাকে না। আর এটাও অসম্ভব যে, আল্লাহর নির্দেশ ছাড়া মহানবী এমন একটা শাস্তি কার্যকর করবেন – বিশেষত তিনি যখন অবিবাহিত ছেলেমেয়েদের মাঝে যৌনকর্মের জন্য শাস্তি ১০০ দোররা মারা কার্যকর করেছিলেন আল্লাহর অনুমোদন অনুসারে (সুরা ২৪:২-৩)। কাজেই এ ব্যাপারে সন্দেহের কোন অবকাশ থাকে না যে, আল্লাহ আসলেই ব্যভিচারের জন্য আর-রজম বা পাথর ছুঁড়ে হত্যার আয়াত নাজিল করেছিলেন, যার দলিল ঘটনাক্রমে হারিয়ে যায় সম্ভবত ছাগলে খেয়ে ফেলার কারণে। খলীফা উসমানের আমলে যেহেতু কোরান সংকলিত করা হয়েছিল আল্লাহর আয়াতের বিদ্যমান দলিলের ভিত্তিতে, কাজেই আর-রজমের আয়াতটির দলিল ছাগলে খেয়ে ফেলার কারণে কোরানে সংকলিত হতে পারে নি। কিন্তু কোরানই যেহেতু বহু আয়াতে মুসলিমদেরকে বলেছে, “আমাকে ও আমার রসুলকে অনুসরণ কর” (কোরান ৩:৩২; ৪:১৩,৫৯,৬৯; ৫:৯২; ৮:১,২০,৪৬…) – সে সূত্রে নবীর দৃষ্টান্তের অনুকরণে ব্যভিচারের শাস্তি পাথর ছুঁড়ে হত্যা ইসলামী সমাজে বলবৎ রয়ে গেছে। অন্য কথায়ঃ ইসলামে ব্যভিচারের শাস্তি পাথর ছুঁড়ে হত্যা নিঃসন্দেহে স্বর্গীয়ভাবে নির্ধারিত।

আজও সৌদি আরব, ইরান, সুদান ও তালেবানাধীন আফগানিস্তানে ইসলামবাদী ব্যভিচারের শাস্তি পাথর ছুঁড়ে হত্যা। পশ্চিমা উপনিবেশিক শাসন মুসলিম বিশ্বে এলে পাথর ছুঁড়ে হত্যার মত বর্বর শাস্তি দমন করা হয়। পশ্চিমা উপনিবেশিক শাসন পরবর্তী অনেক মুসলিম রাষ্ট্র ধর্মনিরপেক্ষ আইন গ্রহণ করে এবং পাথর ছুঁড়ে হত্যার মত বর্বর শাস্তি বর্জিত হয়। তথাপি এরূপ কোন কোন রাষ্ট্রে ইসলামী পণ্ডিত ও মোল্লা-মাওলানারা অনেক ক্ষেত্রে ব্যভিচারে দোষীদেরকে পাথর ছুঁড়ে হত্যা স্থানীয়ভাবে কার্যকর করে। তুর্কি, নাইজেরিয়া ও পাকিস্তান থেকে পাথর ছুঁড়ে হত্যার খবর এসেছে সম্প্রতিকালে।

২০০৪ সালে ঝিলা ইযাদি নামের ১৩ বছরের এক ইরানি মেয়ে তার ১৫ বছর বয়স্ক ভাইয়ের দ্বারা অন্তঃসত্ত্বা হয়ে পড়লে তাকে পাথর ছুঁড়ে হত্যার রায় দেওয়া হয়। আরেক ঘটনায় ফাতিমা নামের ৩৩ বছরের এক মহিলা তার মেয়েকে স্বামী-কর্তৃক (অর্থাৎ বাপ-কর্তৃক) ধর্ষণ থেকে রক্ষা করতে গিয়ে স্বামীকে মেরে ফেলে এবং সে দায়ে ফাতিমাকে পাথর ছুঁড়ে হত্যার রায় দেওয়া হয়। আন্তর্জাতিকভাবে প্রচারকৃত আরেক ঘটনায় নাইজেরিয়ায় আমিনা লাওয়াল নামের ৩৫ বছরের এক মহিলাকে ২০০২ সালের মার্চ মাসে পাথর ছুঁড়ে হত্যার শাস্তি ঘোষণা করা হয়। তার দোষঃ ইয়াহিয়া মুহাম্মদ নামক এক প্রতিবেশী বিয়ের প্রতিশ্রুতিতে আমিনার সাথে যৌন-সম্পর্ক গড়ে তুলে, যার ফলে সে অন্তঃসত্ত্বা হয়ে পড়েছিল। এ ঘটনায় মানবাধিকার সংগঠনগুলো আন্তর্জাতিকভাবে ব্যাপক প্রচারণা চালায়; ৩০ মিলিয়ন লোক তার জীবন রক্ষার জন্য নাইজেরিয়ার সরকারের উদ্দেশ্যে আবেদনপত্রে স্বাক্ষর করে। এ আন্তর্জাতিক চাপের মুখে নাইজেরিয়ার সরকার আমিনা লাওয়ালের জীবন বাঁচাতে বাধ্য হয়।

২০০২ সালে পাকিস্তানে জাফরান বিবি নামের এক মহিলা তার স্বামীর ভাই কর্তৃক ধর্ষিত হওয়ার অভিযোগ করতে পুলিশ কার্যালয়ে গেলে তাকে গ্রেফতার করা হয় এবং তার জন্য পাথর ছুঁড়ে হত্যার শাস্তি ঘোষণা করা হয়। এ ব্যাপারে আন্তর্জাতিকভাবে ব্যাপক প্রচারণা চালানো হলে চাপের মুখে প্রেসিডেন্ট পারভেজ মুশাররফ তার জীবন বাঁচাতে হস্তক্ষেপে বাধ্য হয়। ইসলামের পুণ্যভূমি সৌদি আরবে ব্যভিচার ও অবৈধ যৌনকর্মের জন্য পাথর ছুঁড়ে হত্যা নিত্যকার ঘটনা, কিন্তু গণমাধ্যমের কঠোর নিয়ন্ত্রণের কারণে সে সব ঘটনা প্রচার পায় না।

ব্যভিচারের দোষে পাথর-ছুঁড়ে হত্যা ইহুদী ধর্মের পাশাপাশি ইসলাম ধর্মেও যে বৈধ সে ব্যাপারে এখন আর কারো সন্দেহ থাকার কথা নয়। এবার দেখা যাক খৃষ্টান ধর্ম কি বলে ব্যভিচারের শাস্তির বিষয়ে। এটা মনে রাখতে হবে যে, খৃষ্টানরা বিশ্বাস করেঃ ইহুদী ধর্ম তাদেরই ঈশ্বর দ্বারা প্রেরিত হয়েছিল। তার মানে দাঁড়ায়ঃ ব্যভিচারের জন্য পাথর ছুঁড়ে হত্যার শাস্তি, যা ইহুদী ধর্মীয় বাণীতে নির্ধারিত হয়েছে, তা আপনাআপনিই খৃষ্টান ধর্মে বৈধ হয়ে যায়। তদুপরি যীশু নিজে বলেছেনঃ “মনে কোরো না যে, আমি তাউরাতের আইন নির্মূল করতে এসেছি; আমি সেগুলো নির্মূল করতে আসি নি, এসেছি সেগুলো কার্যকর করতে…” (ম্যাথিউ ৫:১৭)।

কিন্তু অস্ট্রেলীয় এক ক্যাথলিক খৃষ্টান বান্ধবী ও সহকর্মীর সাথে আলাপে সে আমাকে খৃষ্টীয় ধর্মগ্রন্থে (New Testament) বর্ণিত এক অনুরূপ কাহিনীর কথা জানায়ঃ ইহুদীরা ব্যভিচারে লিপ্ত হওয়াকালে এক মহিলাকে ধরে যীশুর কাছে আনে তার জন্য শাস্তির রায় ঘোষণা করতে (মজার ব্যাপার হল পুরুষটিকে আনা হয় নি শাস্তি দেওয়ার জন্য)। তারা যীশুকে বলেঃ মুসা নবী তাদেরকে বলেছেন ব্যভিচারে অভিযুক্তদেরকে পাথর ছুঁড়ে হত্যা করতে; তোমার কি বিধান এ মহিলার জন্য। যীশু কিছুক্ষণ চুপ থাকার পর বললেনঃ “তোমাদের মধ্যে যারা নিষ্পাপ তারা প্রথম পাথর ছুঁড়বে।” সমেবেতদের মাঝে কেউ নিষ্পাপ ছিল না বলে সবাই একে একে কেটে পড়ল। মহিলাটি বেঁচে গেল। (দেখুন জন ৮:৩–১১)

এ ঘটনাকে আজকের খৃষ্টানরা দু’মুখোভাবে ব্যবহার করছে। একদিকে তারা কৃতিত্ব নেয় যে, এ চাতুরতার মাধ্যমে যীশু ব্যভিচারে অভিযুক্ত মহিলাটির জীবন রক্ষা করলেন। অন্য কথায়ঃ খৃষ্টধর্ম ব্যভিচারের জন্য পাথর-ছুঁড়ে হত্যার বিধান দেয় না। তাদের এরূপ দাবী বা ব্যাখ্যা যীশুর নিজেরই দাবীর বিরুদ্ধে চলে যায়, যে তিনি তাউরাতের কোন আইনই বিলুপ্ত করতে আসেন নি। অন্যদিকে যীশু, যাঁকে খৃষ্টানরা স্বয়ং ঈশ্বর বা ঈশ্বরের পুত্র মনে করে, তিনি স্পষ্টতই এ ঘটনায় ব্যভিচারের জন্য পাথর-ছুঁড়ে হত্যাকে ন্যায্য শাস্তি হিসাবে রায় দিয়েছেন। কিন্তু দুর্ভাগ্য যে সমেবেতদের মাঝে নিষ্পাপ কেউ ছিল না; যার ফলে মহিলাটির উপর ন্যায্য শাস্তি কার্যকর করা সম্ভব হল না এবং বর্বর পন্থায় হত্যা থেকে রেহাই পেয়ে গেল মহিলাটি। তার মানে এটা নয় যে, অনুরূপ অন্য ঘটনায় উপস্থিতদের মাঝে নিষ্পাপ লোক থাকবে না এবং একই দোষে দোষী ব্যক্তি পাথর ছুঁড়ে হত্যার মত বর্বর পন্থায় হত্যার শিকার হবে। সুতরাং যীশুর এরূপ বিধানে কোন ন্যায়-পরায়ণতা নেই। কেননা একই শাস্তির জন্য কেউ বেকসুর খালাস পেয়ে যাচ্ছে, আবার কেউ নির্মমভাবে মৃত্যুবরণ করছে। এটাও বিবেচনা করতে হবে যে, যীশু কেবল নিষ্পাপ ব্যক্তিদেরকে পাথর ছুঁড়ে মারার রায় দিচ্ছেন। সেকি পুণ্যবান ধর্ম, যা নিষ্পাপদেরকে রায় দেয় এমন বর্বরভাবে কোন দোষীকে হত্যা করতে! সে কি পুণ্যবান কর্ম।

সেখানেই এ আলোচনার সমাপ্তি নয়। যীশু উক্ত মহিলাকে নিষ্পাপ ঘোষণা করে ছেড়ে দিলেনঃ “এবং যীশু তাকে বললেনঃ আমিও তোমাকে দোষী সাব্যস্ত করি না; চলে যাও এবং আর পাপ কোরো না” (জন ৮:১১)। অথচ অন্যত্র খৃষ্টীয় ধর্মীয় বাণী বলছে যে, তাদের ঈশ্বর ব্যভিচারকারী, বিবাহপূর্ব যৌনকর্মকারী, আমোদ-প্রমোদকারী, ধর্মত্যাগী ও পৌত্তলিকদেরকে দোজখের আগুনে ছুঁড়ে ফেলবেন (গ্যালাশিয়ানস ৫:১৯-২১)। খৃষ্ট ধর্মবাণী অন্যত্র আবারো বলেছে যে, ব্যভিচারী ও অবিবাহিত যৌনকর্মকারীদেরকে কঠোর যন্ত্রণাময় শাস্তি দেওয়া হবে, যদি না তারা অনুশোচনা প্রকাশ করে (রেভেলেশন ২:২০-২২) এবং এরূপ যৌনকর্মে জন্ম-নেওয়া সন্তানকে হত্যা করা হবে (রেভেলেশন ২:২৩)। সে কি আত্মবিতর্ক! একদিকে যীশু ব্যাভচারীকে নিষ্পাপ ঘোষণা দিয়ে ছেড়ে দিচ্ছেন, অন্যদিকে বলছেন তাদেরকে বর্বরোচিত শাস্তি দেওয়া হবে। শুধু তাই নয়। প্রকৃত দোষীরা একটু অনুশোচনা প্রকাশ করলেই ঈশ্বর তাদেরকে সব শাস্তি থেকে মুক্তি দেবে, অথচ তাদের অপকর্মে জাত সন্তানকে – যার কোনই দোষ নেই – তাকে তিনি হত্যা করবেন। সে কি ঈশ্বরীয় বর্বরতা; ঈশ্বরের অসুস্থ মানসিকতা! এ আলোচনার ভিত্তিতে আমরা এ সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে পারি যে, আজ বিশ্বে, প্রধানত পাশ্চাত্যে যে হাজার হাজার শিশু বিয়ে-বহির্ভুত যৌনসম্পর্কের ফসলরূপে জন্ম নিচ্ছে, তাদের সবাইকে খৃষ্টধর্ম নিঃশর্ত হত্যার রায় দিয়েছে।

এ পর্যালোচনা এটা সুস্পষ্ট করে তোলে যে, ব্যভিচারের জন্য ইহুদী, খৃষ্ট ও ইসলাম ধর্ম একই শাস্তির, অর্থাৎ পাথর ছুঁড়ে হত্যার রায় দিয়েছে। অর্থাৎ মৌলিক অর্থে ব্যভিচারের শাস্তির বিষয়ে তিনটি ধর্মই একই কাতারে সামিল হয়।

 

ধর্মঃ হত্যা ও ধ্বংসের প্রতিষ্ঠান

আমি সম্প্রতি “ডিস্কভারি ট্রাভেল এ্যাডভেঞ্চার” টেলিভিশন চ্যালেনে একটা অনুষ্ঠান দেখছিলাম, যাতে প্রাথমিক পর্যায়ে খৃষ্টান ধর্মের প্রসারের কাহিনী দেখানো হচ্ছিল। এটা সর্বজনবীদিত যে, যীশু তার ধর্মপ্রচার অভিযানে কোন সহিংতার আশ্রয় নেন নি। কিন্তু তাঁর পরবর্তী অনুসারীরা খৃষ্টধর্মের প্রসারে সহিংসতা থেকে বিরত থাকে নি; ইহুদী ও পৌত্তলিকরা খৃষ্টানদের হাতে নির্মম বর্বরতার শিকার হয়েছিল। প্রোগ্রামটি মুতাবেক, চতুর্থ শতাব্দীর শুরুতে রোম সম্রাট কন্সট্যান্টিন দ্যা গ্রেট খৃষ্টধর্ম গ্রহণের পরপরই খৃষ্টানরা ইহুদীদের উপর নির্যাতন, তাদেরকে হত্যা ও তাদের ধর্মপ্রতিষ্ঠান ধ্বংস করা শুরু করে দেয় (উল্লেখ্য পৌত্তলিকদের উপর অত্যাচার আরও নিষ্ঠুর ছিল)। এ প্রসংগে মাইকল হার্ট তার “The 100” গ্রন্থে লিখেছেনঃ “…সম্রাট কন্সট্যান্টিনের রাজত্ব ইউরোপে রাষ্ট্রীয়ভাবে ইহুদীদের উপর নির্যাতন–নিপীড়নের সূচনা করে, যা বহু শতাব্দী ধরে চলতে থাকে।” এমনকি সেইন্ট পল, যিনি যীশুর পর খৃষ্টধর্মের অগ্রপুরুষ এবং খৃষ্টধর্মকে শক্ত পায়ের উপর দাঁড় করাতে যার ছিল অসামান্য ভূমিকা, তিনি নিজেই একজন সহিংস লোক ছিলেন খৃষ্টধর্ম গ্রহণের পূর্বে, এবং তার সহিংসতার শিকার হয়েছিল খৃষ্টানরাও। শক্ত পায়ে দাঁড়াতে না দাঁড়াতেই খৃষ্টানরা ইহুদী-পৌত্তলিকদের উপর অত্যাচার-নির্যাতনের যে সূচনা করেছিল তা চলে যায় উত্তর ও দক্ষিণ আমেরিকা থেকে ভারতের গোয়া পর্যন্ত। বিশেষত ইউরোপের ইহুদীদের উপর সে অত্যাচারের পরিণাম আমরা দেখি বিংশ শতাব্দীতে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ‘হলোকস্ট’-এ, যার ফলশ্রুতিতে হিটলারের নাৎসী বাহিনীর হাতে ইউরোপে বসবাসকারী ১২ মিলিয়ন ইহুদীদের প্রায় ৬ মিলিয়ন মৃত্যুর শিকার হয়। ইউরোপ থেকে ইহুদী নির্মূলকরণের এ অভিযান উদ্দীপিত হয়েছিল খৃষ্টীয় প্রটেস্টান্ট রিফর্মেশনের অগ্রপুরুষ মার্টিন লুথারের শিক্ষা ও প্রচারণা দ্বারা, যা ছিল অত্যন্ত ইহুদী বিদ্বেষী।

হিটলার জার্মানদেরকে তার ইহুদী নিধন অভিযানে উদ্দীপিত করতে খৃষ্টধর্মকে প্রধান হাতিয়ার হিসাবে ব্যবহার করেছিলো। হিটলারের সেনারা তাদের দখলদার যুদ্ধে যেতো “ঈশ্বর আমাদের পাশে আছেন” এমন গান গাইতে গাইতে। হিটলার ও তার উচ্চপদস্থ নাৎসী সহকর্মীরা খৃষ্টধর্মকে সরাসরি ব্যবহার করেছিল তাদের দখলদার ও ইহুদী নিধন অভিযানে জনমত গড়ে তুলতে। যেমন ইহুদীদের বিরুদ্ধে জনমত গড়ে তুলতে ১২ই এপ্রিল ১৯২২ সালে হিটলার মিউনিকে এক বক্তব্যে বলেঃ

“একজন খৃষ্টান হিসাবে আমার মন বলে আমি আমার ঈশ্বর ও রক্ষাকারীর একজন যোদ্ধা। এটা আমাকে ইঙ্গিত দেয় সামান্য কয়েকজন শিষ্যসহ এমন এক অসহায় ব্যক্তির প্রতি (অর্থাৎ যীশুর প্রতি), যিনি সনাক্ত করতে পেরেছিলেন প্রকৃতপক্ষে ইহুদীরা কী ছিল? এবং জনগণকে আহবান করেছিলেন তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে এবং তিনি (ঈশ্বরের সত্যতা) সর্বাধিক উৎকর্ষতা দেখিয়েছিলেন নির্যাতিত হিসাবে নয়, বরং যোদ্ধা হিসাবে। একজন মানুষ ও খৃষ্টান হিসাবে অশেষ ভক্তিভরে আমি যখন সে কথাগুলো পড়ি, আমি অনুধাবন করি কিভাবে ঈশ্বর শেষ পর্যন্ত তার শক্তিতে মেতে উঠলেন ও চাবুক হাতে পিটিয়ে বিষাক্ত সাপের পালকে (অর্থাৎ ইহুদীদেরকে) তাড়িয়ে দিলেন। কী চমৎকার বা সাংঘাতিক ছিল “ইহুদী বিষ”-এর বিরুদ্ধে তাঁর সে যুদ্ধ! দুই হাজার বছর পর আজ গভীর অনুরাগের সাথে আমি সনাক্ত করি যে, কেবলমাত্র এ কারণেই তাঁকে ক্রুশে জীবন বলি দিতে হয়েছিল। একজন খৃষ্টান হিসাবে আমি নিজেকে প্রতারিত করতে পারি না; রবং আমার দায়িত্ব হলো সত্য ও ন্যায়ের জন্য যোদ্ধা হওয়া… একজন খৃষ্টান হিসাবে জনগণের প্রতি আমার সহানুভূতি রয়েছে… আমি যখন সকালে বের হই এবং দেখি শুষ্ক-মুখ এ মানুষগুলো সারিতে দাঁড়িয়ে আছে, তখন আমি মনে করি আমি এদের প্রতি করুণাশীল না হলে, যারা (অর্থাৎ ইহুদীরা) আজ এ অসহায় মানুষগুলোকে লুটপাট ও শোষণ করছে, তাদের বিরুদ্ধে আমাদের ঈশ্বর যেভাবে ২,০০০ বছর আগে দাঁড়িয়েছিলেন, সেরূপ না করলে আমি একজন খৃষ্টান না হয়ে একটা দানব হব।”ii

হিটলার তার ইহুদী-বিরোধী অভিযানকে খৃষ্টীয় বৈধতা দিয়ে লিখেঃ

সুতরাং আজ আমি বিশ্বাস করি আমি ঈশ্বরের ইচ্ছা অনুসারে কাজ করছিঃ ‘ইহুদীদের বিরুদ্ধে আমাদেরকে রক্ষা করতে; আমি ঈশ্বরের কাজে লড়াই করে যাচ্ছি।’iii
২৬ এপ্রিল ১৯৩৩ তারিখে এক বক্তব্যে হিটলার তার ইহুদী-বিরোধী আন্দোলন সম্পর্কে ক্যাথলিক চার্চের বরাত দিয়ে বলেঃ

“ক্যাথলিক চার্চ ১,৫০০ বছর ধরে ইহুদীদেরকে মহামারি বা প্লেইগ হিসাবে দেখেছে ও তাদেরকে একঘরে করে রেখেছিল, কেননা ইহুদীরা যে কী তা চার্চ সত্যকার অর্থে সনাক্ত করতে পেরেছিল… আমিও এই গোষ্ঠীকে রাষ্ট্র ও চার্চের জন্য মহামারি হিসাবে দেখি এবং স্কুল ও সরকারী পদ থেকে তাদেরকে বহিষ্কার করে আমি সম্ভবত খৃষ্টধর্মের জন্য বড় ধরনের সেবা করছি।”iv

জার্মানীকে ইহুদীদের হাত থেকে রক্ষা করতে খৃষ্ট ধর্মের দোহাই দিয়ে হিটলারের উচ্চ-পদস্থ কর্মকর্তা হারমান গোরিং বলেছিলঃ

ঈশ্বর জার্মানীর জন্য রক্ষাকারী পাঠিয়েছেন। আমাদের গভীর ও দৃঢ় বিশ্বাস যে, তিনি (হিটলার) ঈশ্বর-কর্তৃক প্রেরিত হয়েছেন জার্মানীকে রক্ষা করতে।v

উপরে উদ্ধৃত ও আরও বহু উক্তিতে আমরা দেখি হিটলারের মাঝে খৃষ্টধর্ম প্রীতির ছড়াছড়ি এবং সে ধর্মের দোহাই দিয়ে সে ও তার কর্মকর্তারা তার বর্বর অভিযানকে বৈধতা দান করেছিল। অথচ খৃষ্টানরা আজকাল হিটলারকে নাস্তিক্যবাদী সোশ্যালিস্ট-কমিউনিস্ট আখ্যা দিয়ে খৃষ্টান হিসাবে স্বীকৃতি দিতে চায় না। মজার ব্যাপার হল, নাস্তিক ও সোশ্যালিস্ট-কমিউনিস্টরা ইহুদীদের মতই হিটলারের নিধন অভিযানের শিকার হয়েছিল। এমনকি হিটলার নিজেই বলেছিল যে, খৃষ্টধর্মকে রক্ষা করতে নাস্তিক্য নির্মূলে সে বদ্ধপরিকর ছিল। যেমন ১৯৩৩ সালের ২৪শে অক্টোবর বার্লিন-এ এক বক্তব্যে হিটলার বলেছিলঃ

আমরা জানি জনগণের জন্য ধর্মের প্রয়োজন এবং এই ধর্মের (অর্থাৎ খৃষ্টধর্মের) প্রয়োজন। কাজেই আমরা নাস্তিক্যবাদী আন্দোলনের (অর্থাৎ সোশ্যালিজম-কমিউনিজমের) বিরুদ্ধে যুদ্ধ শুরু করেছি – কেবলমাত্র কয়েকটি তত্ত্বীয় ফাঁকাবুলির মাধ্যমে নয়; আমরা তা নির্মূল করে ফেলেছি।vi

এমনকি ভ্যাটিকান (পোপ) ১৯৩৩ সালের ২০শে জুলাইতে এক চুক্তি স্বাক্ষরের মাধ্যমে হিটলারের একনায়কতান্ত্রিক সরকারকে স্বীকৃতি দিয়েছিল এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পুরো সময় ধরে মৌনতা বজায় রেখে হিটলারের অভিযানে সহমত দিয়েছিল।

ইউরোপে ইহুদী নিধনমূলক হলোকস্ট ছাড়াও বিগত সহস্রাব্দের শেষ দিকে উত্তর ও দক্ষিণ আমেরিকায় খৃষ্টধর্মের প্রসারে মিলিয়ন মিলিয়ন আদিবাসীকে হত্যা খৃষ্টধর্মের বর্বরতার আরেক নির্মম দৃষ্টান্ত। সম্প্রতি সেইন্ট জন পল-২ তার বিশ্বের বিভিন্ন দেশ ভ্রমণে অতীত খৃষ্টীয় বর্বরতার জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করতে ব্যস্ত থেকেছেন। এটা মানবতার জন্য খুবই লজ্জাজনক ও মর্মাহত হওয়ার বিষয় যে, সেইন্ট জন পল-২ এমন জঘন্য, অমানবীক ও গণহত্যাকারী আন্দোলনের ঐতিহ্যের শিরোমণি হয়েও আজকের একুশ শতাব্দীর এ ন্যায় ও মানবাধিকারের যুগেও এতটা সম্মান ও ভক্তি পাচ্ছেন বিশ্বের সর্বত্র।

ইসলামের বর্বরতার কথা আজকাল অনেকেরই মুখে মুখে, যার সূচনা হয়েছিল নবী মুহাম্মদ কর্তৃক মদীনা ও আরবের অন্যান্য পৌত্তলিক-ইহুদী-খৃষ্ট গোষ্ঠীর উপর অত্যাচার ও গণহত্যার মাধ্যমে, যা যুগ যুগ ধরে বজায় থাকে ও প্রসারিত হয়। উপরোক্ত আলোচনা প্রতিপন্ন করে যে, খৃষ্টধর্মও অমানবীক ও বর্বর প্রকৃতির ও এরূপ অপকর্ম চালানোতে ইসলামের তুলনায় খুব একটা পিছিয়ে থাকে নি। তাউরাত (Old Testament) – যাকে যীশু তার মৌলিক ধর্মীয় বাণী হিসাবে গ্রহণ করেছিলেন এবং তিনি কেবল সে বাণী প্রচার করার জন্যই এসেছিলেন বলে দাবী করেছিলেন (নিউ টেস্টামেন্ট-এর বেশিরভাগ অংশ সেইন্ট পলের লেখা)vii – তাতেও প্রচুর আয়াত রয়েছে, যা সর্বাধিক জঘন্য ও অমানবীক নির্মমতাকে বৈধতাদান ও মহিমান্বিত করেছে। কাজেই খৃষ্টানদের দ্বারা সংঘটিত ওসব নির্মম ও ধ্বংসমূলক কর্মকাণ্ড খৃষ্টধর্মের ঈশ্বর-কর্তৃক বৈধতা পায়। আজ খৃষ্টান বিশ্ব অনেকটা শান্ত ও মানবীক এবং তার কারণ হলোঃ খৃষ্টধর্ম ধর্মনিরপেক্ষ, মানবীক ও উদারনীতিক রাষ্ট্রীয় নীতির কাছে পরাজিত হয়েছে এবং এ প্রক্রিয়ায় প্রধানত খৃষ্টীয় পশ্চিমা বিশ্ব মানবাধিকারের দিকে অগ্রসর হয়েছে – যদিও তা এসেছে মুক্তচিন্তক, ধর্মীয় সংস্কারক ও সমালোচকদের ব্যাপক প্রয়াস ও ত্যাগের ফসল হিসাবে।

যীশুর বিপরীতে নবী মুহাম্মদ নিজেই ইসলামকে প্রতিষ্ঠা করতে আল্লাহর বাণী ও নির্দেশের দোহাই দিয়ে সহিংসতার প্রয়োগ করে গেছেন। মুহাম্মদ “জিহাদ” বা ইসলামী ধর্মযুদ্ধের নামে তার জীবনে প্রায় ৭৮-১০০টি হানা ও যুদ্ধের পৃষ্ঠপোষকতা করেছিলেন এবং কম করে হলেও তার ২৭টিতে নিজে অংশগ্রহণ করেছিলেন ও নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। ওসব আক্রমণ ও যুদ্ধের শিকার হয়েছিল আরবাঞ্চলের পৌত্তলিক, ইহুদী ও খৃষ্টানরা। নবীর নির্মম সহিংসতার দৃষ্টান্ত হিসাবে আসুন আমরা নজর দিই মদীনার বনি কুরাইজা ইহুদী গোত্রের উপর তার আক্রমণের দিকে। আক্রমণটির কারণ উদ্ধৃত হয়েছে নিম্নোক্ত সহি হাদীসেঃ

আয়শা জানানঃ নবী যখন “খন্দক”-এর যুদ্ধ থেকে ফিরলেন এবং তার অস্ত্র রেখে গোসলে গেলেন, তখন জিব্রাইল ফেরেস্তা এসে নবীকে বললেন, “তুমি দেখছি অস্ত্র নামিয়ে ফেলেছো? আল্লাহর দোহাই, আমরা ফেরেস্তারা এখনো অস্ত্র ছাড়িনি। সুতরাং অস্ত্র তুলে চল যাই।” নবী জিজ্ঞেস করলেন, “কোথায় যাব?” বানু কুরাইজা গোত্রের দিকে ইঙ্গিত করে জিব্রাইল বললেন, “ঐ দিকে”। সুতরাং নবী সেদিকে ছুটে গেলেন। (সহি বুখারী ৫:৫৯:৪৪৩)

হাদীসটি বনি কুরাইজার কোন দোষ-ত্রুটি উল্লেখ না করেই তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করছে। কোরানে আল্লাহ কুরাইজার দোষ ও আক্রমণটি সম্পর্কে বলেনঃviii

এবং তিনি (আল্লাহ) ধর্মগ্রন্থের সেসব লোকদেরকে (বানু কোরাইজা ইহুদী) বের করে এনেছেন, যারা তাদের ঘাঁটিতে বসে থেকে তাদেরকে (কোরাইশ) সহায়তা করেছিল, এবং আল্লাহ আতঙ্ক ঢুকিয়ে দিয়েছেন তাদের প্রাণে। (তাদের) কিছু সংখ্যককে (বয়স্ক পুরুষ) তোমরা বধ করেছো, কিছু সংখ্যককে (নারী ও শিশু) করেছ বন্দী… (কোরান ৩৩:২৬-২৭)

এ আয়াতটিতে আল্লাহ বনি কোরাইজা ইহুদীদেরকে নিজস্ব বস্তির মধ্যে বসে থেকেই মক্কার কোরাইশদেরকে মুসলিম-বিরোধী “খন্দকের যুদ্ধে” সমর্থন করার অভিযোগে অভিযুক্ত করেছেন। তা কীভাবে সম্ভব সেটা বুঝা মুস্কিল হলেও সে অবান্তর অভিযোগের ভিত্তিতে আল্লাহ অনুমোদন দেন যে, ইহুদী গোত্রটির বয়স্ক পুরুষদেরকে হত্যা করতে হবে এবং অবশিষ্ট নারী ও শিশুদেরকে ক্রীতদাস বানাতে হবে। নবী যথাযথরূপে সে আদেশ পালন করেন এবং আত্মসমর্পণকৃত কুরাইজা গোত্রের ৬০০ থেকে ৯০০ পুরুষকে হত্যা করে বর্বরতার এক চরম দৃষ্টান্ত স্থাপন করেন। বন্দীকৃত নারী ও শিশুদেরকে তিনি তাঁর অনুসারীদের মাঝে ক্রীতদাস হিসাবে বিতরণ করে দেন ও এক-পঞ্চমাংশ নিজের ভাগ হিসাবে রাখেন। কুরাইজা গোত্রের সব ধনসম্পদ ও ভিটেমাটি হস্তগত করে নিজে এক-পঞ্চমাংশ রেখে বাকি সব তাঁর শিষ্যদের মাঝে বিলিয়ে দেন।ix

নবী একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটান মদীনার বাইরের বনি মুস্তালিক ও খাইবারের বনি নাদির ইহুদীদের উপর। এভাবে সহিংস আগ্রাসী যুদ্ধ ও বর্বরতার যে ঐতিহ্য নবী মুহাম্মদ স্বয়ং স্থাপন করে যান, তা পরবর্তী মুসলিমরা উদ্দীপনার সাথে অব্যাহত ও প্রসারিত করতে থাকে, যার ফলে মুসলিমরা বিশ্বের বুকে সর্বকালের সবচেয়ে বড় ইসলামী সাম্রাজ্য স্থাপনে সমর্থ হয়। ইসলামী বিজয়াভিযানে কোটি কোটি মানুষ জীবন হারায়ঃ ভারতেই প্রায় ৬ থেকে ৮ কোটি। তদুপরি ভারতে হাজার হাজার মন্দির ধ্বংস করে মুসলিম আগ্রাসক ও শাসকরা। সম্রাট আওরঙ্গজেবের রাখা রাজকীয় তথ্য জানায় ১৬৭৯ সালেই তিনি ২০০-র বেশী মন্দির ধ্বংস করেছিলেন।

নবী মুহাম্মদের পাশাপাশি যিশু খৃষ্টের সহিংসতা তুলনা করতে গেলে এটা মনে রাখতে হবে যে, যীশু শক্তিবলে ছিলেন খুবই দুর্বল। তার মাত্র ১১ নিবেদিতপ্রাণ শিষ্য ছিল। এরূপ অবস্থায় আমরা দেখিঃ যীশু ইহুদী ব্যবসায়ীদেরকে আক্রমণ করে জেরুজালেম মন্দির থেকে বের করে দেন, সেখানে ভাংচুর করেন ও তাদের ব্যবসাকর্ম ভঙ্গ করেন। তদুপরি যীশু জেরুজালেমের ইহুদী রাজনৈতিক ক্ষমতা দখলের চেষ্টায় ছিলেন এবং ইহুদী সেনহাড্রিন বা ক্ষমতাশীল রাজনীতিকদেরকে অকথ্য ভাষায় গালাগাল করেছিলেন (দেখুন ম্যাথিউ ২৩, লুক ১২:৩৯-৫২)। এসব ঘটনা বিবেচনা করলে আমরা দেখি যে বাহুবলে এতটা দুর্বল হওয়া সত্ত্বেও যীশু সহিংসতার যথেষ্ট ইঙ্গিত দিয়েছিলেন। যীশু নিজেই বেশকিছু সহিংসতা উদ্দীপক উক্তি করে গেছেন। যেমনঃ

“ভেব না যে আমি দুনিয়াতে শান্তি আনয়নের জন্য এসেছি; আমি শান্তি আনয়নের জন্য আসি নি, এসেছি তলোয়ার দিতে।” (ম্যাথিউ ১০:৩৪)

“…যার কাছে কোন তলোয়ার নেই, সে তার জামাকাপড় বিক্রি করে একটা কিনে নিক।” (ম্যাথিউ ২৪:৩৬)

“এবং তোমরা কি যুদ্ধে ও যুদ্ধের গুজবে ভীত, যাতে তোমরা সেগুলোর আপদে না পড়? এগুলোর সবই আসবে; এখনো তা শেষ হয়নি। কেননা দেশ দেশের বিরুদ্ধে, রাজ্য রাজ্যের বিরুদ্ধে যুদ্ধে অবতীর্ণ হবে।” (ম্যাথিউ ২৪:৬-৭)

“যে পবিত্র দেবতার (Holy Ghost) বিরুদ্ধে কথা বলবে, তাকে এ জীবনে ও পরজীবনে রেহাই দেওয়া হবে না।” (ম্যাথিউ ১২:৩২)

স্বয়ং যীশুর এসব সহিংসতা উদ্দীপক উক্তি মানবজাতির উপর অকথ্য খৃষ্টীয় নির্মমতার পিছনে অবশ্যই ইন্ধন যুগিয়েছিল। বিবেচনা করতে হবে যে, উপরোক্ত আলোচনায় যীশু ও তার সাথীরা প্যালেস্টাইনের ইহুদীদের জীবনে যথেষ্ট ঝামেলার সৃষ্টি করেছিল, যাতে অতিষ্ঠ হয়ে ইহুদীরা তাকে ধরে রাজত্বকারী রোমানদের হাতে তুলে দেয় এবং রোমানরা তাকে ক্রুশ বিদ্ধ করে হত্যা করে। কাজেই যীশু যদি নবী মুহাম্মদ ও মূসার মত শক্তিশালী হতেন, তাহলে তিনিও যে তাদের মতই সহিংসতায় অবতীর্ণ হতেন সে ব্যাপারে যথেষ্ট সম্ভাবনা থেকে যায়। এটাও বিবেচনা করতে হবে যে, নবী মুহাম্মদ তাঁর ইসলাম প্রচারের প্রাথমিক পর্বে – যখন তাঁর বাহুবল শক্ত ছিল না – তখন তাঁর প্রচারণা ও কর্মকাণ্ড যথেষ্ট অহিংস ছিল। মক্কা থেকে মদীনায় অভিবাসনের পর যখন মুহাম্মদের বাহুবল শক্ত ও তাঁর সম্প্রদায়ের নিরাপত্তা অনেকটা নিশ্চিত হয়ে উঠে, তারপরই তিনি আগ্রাসী সহিংসতায় তৎপর হয়ে উঠেন।

ইহুদী ধর্মে সহিংসতাঃ ধর্মের কারণে সহিংসতার বিষয়ে বার্ট্রান্ড রাসেল লিখেছেনঃ “কন্সট্যান্টিনের যুগ থেকে সপ্তদশ শতাব্দী পর্যন্ত খৃষ্টানরা অন্য খৃষ্টান দ্বারা রোমান সম্রাটদের তুলনায় অনেক বেশী নির্যাতিত হয়েছিল। খৃষ্টধর্মের আগে এরূপ নির্যাতনমূলক মনোবৃত্তি ইহুদীদের বাইরে অন্য কোন জনগোষ্ঠীর মাঝে ছিল না।”x ইহুদী ধর্মীয় গ্রন্থে অনেক অত্যাচার-নির্যাতন উদ্দীপক আয়াত রয়েছে; অনেক নৃশংস হত্যাকাণ্ডের কাহিনীও বর্ণিত হয়েছে, কিন্তু সে সব সহিংস ঘটনার উপর কোন নির্ভরযোগ্য ঐতিহাসিক তথ্য বা দলিল নেই। বরং আধুনিক গবেষণা তাউরাতে বর্ণিত সেসব হত্যাকাণ্ডের কাহিনীকে মিথ্যা প্রতিপন্ন করেছে। তাউরাতে উদ্ধৃত সহিংস নির্মমতামূলক কিছু আয়াত নীচে উল্লেখ করা হলঃ

“এবং সে (ডেভিড) ভিতরের লোকদেরকে বের করে আনল এবং তাদেরকে করাত, লোহার মগুর ও কুরাল দিয়ে কেটে মারল” (১ ক্রোনিকলজ ২০:৩) [মন্তব্যঃ তাউরাতের এ কাহিনী অনুসারে (অধ্যায় ১৭-১৯) রাজা ডেভিড তথা ইসলামের নবী দাউদ ২২,০০০ সিরীয়কে এবং আবিসাই ১৮,০০০ হাজার এডোমাইট’কে হত্যা করে, যা তাউরাতে মহিমান্বিত হয়েছে।]

“এবং ইসরাইলীরা বালপিওরের সাথে যোগ দিল এবং ঈশ্বরের ক্রোধ ইসরাইলীদের বিরুদ্ধে জ্বলে উঠল। এবং ঈশ্বর মূসাকে বললেনঃ ‘সেসব লোকদের মাথা কেটে এনে ঈশ্বরের সামনে ঝুলিয়ে দাও সূর্যের তাপের মুখে যাতে ঈশ্বরের ক্রোধ–উন্মত্ততা ইসরাইলরীদের উপর থেকে সরে যায়” (নাম্বারস ২৫:৩-৪)। (মন্তব্যঃ অন্য ঈশ্বরকে উপাসনা করার জন্য ইহুদী ঈশ্বর নবী মূসাকে নির্দেশ দিচ্ছেন তাদের মাথা কেটে রোদে ঝুলিয়ে দিতে।)

“দেখ! এটা ইসরাইলীদেরকে বালামের পরামর্শে ঈশ্বরের বিরুদ্ধে পিওরের ব্যাপারে প্ররোচিত করল এবং ঈশ্বরের সেবকদের মাঝে মহামারি নেমে এল। কাজেই এখন মেরে ফেল প্রত্যেক বাচ্চা শিশুদেরকে এবং সব মহিলাকে যারা তার সাথে শুয়েছিল। কিন্তু যেসব অল্প-বয়সী মহিলারা তার সাথে শোয়নি, তাদেরকে তোমাদের জন্য রেখে দাও” (নাম্বারস ৩১:১৬-১৮)। [মন্তব্যঃ এ আয়াতে ইহুদী ঈশ্বর প্রায় ১০০,০০০ অল্প-বয়স্ক ছেলে-শিশুকে ও প্রায় ৬৮,০০০ মহিলাকে মেরে ফেলার নির্দেশ দিচ্ছে।

“এবং আমরা সবগুলো শহর জয় করলাম এবং শহরগুলোর পুরুষ, নারী ও শিশুদেরকে ব্যাপকভাবে ধ্বংস করলাম; আমরা কাউকে বাঁচিয়ে রাখলাম না” (ডিউটেরোনোমি ২:৩৪)

“এবং আমরা তাদের উপর ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ সাধন করলাম, যেমনটি করেছিলাম হেসবোনের রাজা সিহোনের উপর; আমরা শহরের পুরুষ, নারী ও শিশুদেরকে চরমভাবে ধংস করলাম। কিন্তু সব গবাদি পশু ও লুটের মাল আমাদের শিকার হিসাবে রাখলাম” (ডিউটেরোনোমি ৩:৬-৭)। [মন্তব্যঃ এ আয়াতটিতে ইহুদী ঈশ্বর বিজিত শহরের সব নারী-পুরুষ ও শিশুদের হত্যাকে মহিমান্বিত করেছেন।

“এবং তোমরা কোন ডাইনিকে বাঁচিয়ে রাখবে না। যে কোন পশুর সাথে সহবাস করবে তাকে অবশ্যই মেরে ফেলবে। যে কেবলমাত্র ঈশ্বরকে বিনা অন্য দেবদেবীর উপাসনা করবে, তাকে অবশ্যই ধ্বংস করবে” (এক্সোডাস ২২:১৮-২০)। [মন্তব্যঃ এ আয়াতের ভিত্তিতে খৃষ্টানরা ১৪-১৫তম শতাব্দীতে ৯০ লাখ নারীকে ডাইনি আখ্যা দিয়ে হত্যা করেছে বলে উল্লেখ হয়েছে সমকালীন ডঃ স্প্রেংগারের “ডাইনির হাতুড়ি” গ্রন্থে; ডঃ স্প্রেংগার নিজেই এক বছরে প্রায় ৫০০ ডাইনিকে হত্যা করেছিলেন বলে জানান।]

তাউরাতে আরো অনেক এমন অকথ্য বর্বরতা মহিমান্বিতকারী আয়াত রয়েছে। নবী মূসা নিজেই অনেক নির্মম হত্যাকাণ্ডমূলক দখলদারী যুদ্ধে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন, যদিও আধুনিক গবেষণা সেসব কাহিনী ভিত্তিহীন বা অতিরঞ্জিত বলে প্রতিষ্ঠিত করেছে। তবু এটা নিঃসন্দেহে বলা যায় যে, আব্রাহামীয় একত্ববাদী যে ধর্মগুলো আজ বিদ্যমান – ইসলাম, খৃষ্টধর্ম ও ইহুদী ধর্ম – সেগুলোর তাত্ত্বিক ভিত্তিপ্রস্তর নির্মমতা-সহিংসতার উপর প্রতিষ্ঠিত। সহিংসতার ক্ষেত্রে ধর্মগুলোর এ একাত্মতা তাদেরকে একই কাতারে দাঁড় করায়।

 

ধর্ম ও বোরখা প্রথা

সম্প্রতি বিশেষত পাশ্চাত্যে মুসলিমরা ব্যাপক সমালোচনার সম্মুখীন হয়েছে মুসলিম মহিলাদের বোরখা পরানোর বিষয়ে। মানবতাবাদী-উদারবাদীরা মহিলাদেরকে বোরখা পরানোকে দেখছেন নারী নির্যাতনের সংস্কার হিসাবে। মুসলিমরা ধর্মীয় প্রথার দোহাই কিংবা শালীনতার দোহাই দিয়ে মহিলাদের বোরখা পরানোকে বৈধতা দিতে চাচ্ছে। কোরান ৩৩:৫৯ মহিলাদেরকে বোরখা পরানোর বিষয়ে বলেছেঃ “ও নবী! তোমার স্ত্রী ও কন্যাদেরকে এবং মোমিন নারীদেরকে বল তারা যেন কাপড় দিয়ে তাদেরকে ঢাকে (যখন তারা বাইরে যায়), যাতে তাদেরকে সনাক্ত করা যায় এবং উত্ত্যক্ত করা থেকে রেহাই পায়…”

যাহোক, সমালোচকরা বলছেঃ ছেলে ও মেয়ে শিশু উভয়েরই জন্ম হয় পৃথিবীতে একইভাবে (ন্যাংটা অবস্থায়); কাজেই পুরুষ ও মহিলার পোশাকে এ ব্যাপক ব্যবধান কেন? যে কারণে নারীদেরকে বোরখা পরানোর প্রয়োজনীয়তা দাবী করছে মুসলিমরা একই কারণে পুরুষদেরকেও বোরখা পরানো উচিত দাবী করা যেতে পারে বলছেন সমালোচকরা। সম্প্রতি বেশ কয়েকটি ইউরোপীয় দেশে – যেমন ফ্রান্স, বেলজিয়াম, নেদারল্যান্ডস ইত্যাদিতে – জনসমক্ষে বা রাষ্ট্রীয় কার্যালয়ে বোরখা পরা নিষিদ্ধ করা হয়েছে। উল্লেখ্য একই যুক্তিতে – অর্থাৎ নারীর সম-অধিকার ও নারীমুক্তির প্রশ্নে – ইরান ও তুর্কির ধর্ম-নিরপেক্ষ শাসকরা ১৯৩০-এর দশকে বোরখা পরা নিষিদ্ধ করেছিল এবং ইসলামপন্থী সরকার আসার পর সে আইন উভয় দেশেই অবলুপ্ত হয়েছে।

যাহোক, বোরখার বিষয়ে মুসলিমরা যখন সমালোচিত হচ্ছেন তখন খৃষ্ট ও অন্যান্য ধর্মের অনুসারীরা তাদের ধর্মে এরূপ প্রথা নেই বলে তৃপ্তি পাচ্ছে। কিন্তু ঘটনা কি আসলেই তাই? ইহুদী-খৃষ্ট ধর্মে ধর্মীয়ভাবে নির্ধারিত পোশাক কি ধরনের সেটা আলোচনা করা হবে এখানে। আমি বহুদিন ভেবেছিঃ মুসলমানরা যেহেতু দাবী করে নবী মূসা, ঈসা (যীশু) ও মুহাম্মদ একই ঈশ্বরের প্রেরিত, তাহলে ধর্মগুলোতে চর্চাকৃত পোশাক-প্রথায় এমন ব্যবধান কেন? আজ একজন সুন্দরী তন্বী তরুণী যৌন-আবেদন উদ্রেককারী উন্মুক্ত নাভী সহ গীর্জায় যাচ্ছে, কিন্তু হতভাগী মুসলিম মহিলারা উত্তপ্ত আরব মরুভূমিতে কালো-কাপড়ে ঢাকা বোরখা নামক চলন্ত জেলখানার মধ্যে দগ্ধ হয়ে মরছে।

কিন্তু আমার সাম্প্রতিক গবেষণায় এটা প্রতীয়মান হয় যে, এসব ধর্মগুলোতে মৌলিকভাবে প্রস্তাবিত পোশাকে তেমন কোন ব্যবধান নেই। প্রথমত নজর দিই খৃষ্টান ধর্মযাজক ও গীর্জার দেয়াসিনি বা নানদের দিকে। তাদের পোশাক মুসলিম নারীদের মত কেন? আমার বিশ্বাস ঐ ধরনের পোশাকই খৃষ্টধর্মে মৌলিকভাবে অনুমোদিত। উপরোল্লেখিত টেলিভিশন অনুষ্ঠানে দেখানো হচ্ছিল গ্রিসের এক দ্বীপে এক খৃষ্টান মঠ (monastery), যেখানে সেইন্ট জনের কাছে খৃষ্ট বাইবেল বা নিউ টেস্টামেন্টের সর্বশেষ “রেভেলেশন” (Revelation) অধ্যায়টি উন্মোচিত হয়েছিল। আমি লক্ষ্য করলাম যে, মঠটির যাজকরা (সত্যিকার বিশ্বাসী) ইসলামী মুল্লাদের চেয়েও বেশী কঠোর পোশাক পরত। মুল্লারা গোঁফ কাটে (কামায়), সেসব যাজকরা গোঁফও কাটত না। ইহুদী রাব্বি বা যাজকরাও মুল্লাদের মত কঠোর পোশাক প্রথার চর্চা করে – এবং দাড়ি-গোঁফ রাখে। ভ্যাটিকানের পোপ-কার্ডিনাল এবং ইহুদী রাব্বিরা ও গোঁড়া ধার্মিক ইহুদীরাও মুল্লাদের মত টুপি পরে। কোরানের মত খৃষ্ট বাইবেলও পুরুষদেরকে বাদ রেখে কেবল মহিলাদেরকে ঘোমটা বা বোরখা পরার নির্দেশ দিয়েছেঃ

পুরুষ প্রার্থনা বা ধর্মীয় বাণী পাঠের সময় তার মাথা “ঢাকলে” সে তার মাথাকে অসম্মান করবে। আর কোন নারী প্রার্থনা বা ধর্মীয় বাণী পাঠের সময় তার মাথা “না ঢাকলে” সে তার মাথাকে অসম্মান করবে, যেন তার মাথা ন্যাড়া করে দেওয়ার মত। কেননা মহিলা মাথা না ঢাকলে তার মাথা ন্যাড়া করে দেওয়া হোক; কিন্তু ন্যাড়া করা মাথা যদি লজ্জাজনক হয় তাহলে তাদেরকে মাথা ঢাকতে হবে। একজন পুরুষ মাথা ঢাকবে না, কেননা সে ঈশ্বরের প্রতিচ্ছবি; এবং নারী হলো পুরুষের মহিমা মাত্র। (১ করিন্থিয়ান ১১:৪-৭)।

ইসলামে মাদকদ্রব্য নিষিদ্ধ হওয়ায় অন্য ধর্মের লোকেরা সেটাকে নিয়ে কটাক্ষ করে। তবে আমি জানি না খৃষ্টান যাজক ও নানদেরকে মাদকদ্রব্য সেবন করতে দেওয়া হয় কি না? তবে খৃষ্ট বাইবেলে মাদকদ্রব্য সেবনে লিপ্তকারীদেরকে দোজখের আগুনের ছুঁড়ে ফেলার কথা বলা হয়েছেঃ “ঈর্ষা, হত্যা, মাদকে উন্মত্ততা, আমোদ–প্রমোদ ইত্যাদিতে যারা যোগ দিবে – যেরূপ আমি পূর্বে তোমাদেরকে বলেছি – তারা ঈশ্বরের স্বর্গালোক থেকে বহিষ্কৃত হবে।” (গ্যালাসিয়ান ৫:২১)

সুতরাং দেখা যাচ্ছে যে, প্রকৃত ধর্মীয় বিবেচনায় এসব ধর্মগুলো পোশাক প্রথা, আমোদ-প্রমোদ, মাদকদ্রব্য সেবন ইত্যাদিতে একই রায় দিয়েছে। ভিন্নতা কেবলমাত্র – অন্তত আজকের যুগে – এখানে যে, ইসলামে সেগুলো প্রত্যেক ব্যক্তির জন্য প্রযোজ্য, কিন্তু ইহুদী-খৃষ্ট ধর্মে তা কেবল তাদের যাজক ও ধর্মে আত্মনিবেদনকারীদের জন্য প্রযোজ্য। কাজেই বলা যায়, ইসলাম অন্যান্য ধর্মগুলোর তুলনায় অধিক ন্যায়শীল, কেননা হোক সে মুল্লাহ-মাওলানা কিংবা সাধারণ মানুষ – সবাইকে ইসলাম একই মাপকাঠিতে মেপেছে, সবাইকে কেবলই মানুষের কাতারে দাঁড় করিয়েছে।

হিন্দু ধর্মঃ  উপরের আলোচনা এটা ইঙ্গিত করে যে, ইসলাম, খৃষ্ট ও ইহুদী ধর্ম মৌলিক অর্থে একই শ্রেণীর এবং সম্ভবত একই ঈশ্বর থেকে এসেছে, যেমনটি মুসলিমরা দাবী করে। এগুলোর বাইরে আরেকটি বড় ধর্ম হলো হিন্দু ধর্ম। ধর্মের নামে সহিংসতা, বিদ্বেষ, নারী-নির্যাতন ও ধ্বংসকাণ্ডের ক্ষেত্রে হিন্দু ধর্মও উপরে আলোচিত একত্ববাদী ধর্মগুলোর কাতারেই পড়ে। নজর দিন সম্প্রতি অতীতে ধর্মের জন্য হিন্দুদের মুসলিম-বিরোধী উস্কানি ও হত্যাকাণ্ড (১৯৯২ সালে বাবরী মসজিদ দাংগা; ২০০২ সালে গুজরাট দাংগা ইত্যাদি), মানবজীবন নাশ করে ঈশ্বরকে সন্তুষ্ট করার জন্য “সতীদাহ” প্রথা, এবং মানুষের মাঝে বিভেদ ও বৈষম্য-সৃষ্টিকারী জঘন্য বর্ণপ্রথা (Caste System)। প্রকৃত অর্থে হিন্দু ধর্মও ব্যভিচারের জন্য মৃত্যুদণ্ড অনুমোদন করে, কেননা হিন্দু দেব রাম তার স্ত্রী সীতাকে আগুনে ঝাঁপ দিয়ে প্রমাণ করতে বাধ্য করেছিল রাবণের হাতে বন্দী থাকাকালীন সে ধর্ষিত বা যৌনকর্মে লিপ্ত হয়েছিল কিনা। রাবণ সীতার প্রতি অত্যন্ত সম্মানসূচক ব্যবহার করেছিল বলে সীতা আগুনে ঝাঁপ দিয়েও বেঁচে যায়। কোন দুষ্ট লোকের হাতে পড়লে এবং সীতা ধর্ষিত হয়ে থাকলে তাকে নির্ঘাত আগুনে পুড়ে মরতে হত। তবে পোশাকের ক্ষেত্রে হিন্দু ধর্মে কঠোরতা কম মনে হয়, যদিও হিন্দু নারীদের পোশাক যথেষ্ট রক্ষণশীল। আমার জানামতে, হিন্দু পুরোহিতদের জন্যও মাদকদ্রব্য সেবন নিষিদ্ধ। সুতরাং হোক একেশ্বরবাদী ইসলাম-খৃষ্ট-ইহুদী ধর্ম কিংবা বহু-ঈশ্বরবাদী হিন্দু ধর্ম – তাদের ঈশ্বরের প্রকৃত শিক্ষা প্রায় একই।

 

কোন ধর্মটি চয়ন করব?

আমরা এখন অনেকটা একমত হতে পারি যে, আজকের চারটি প্রধান ধর্মই – ইহুদী, খৃষ্ট, ইসলাম ও হিন্দু ধর্ম – খুব সম্ভবত একই ঈশ্বর থেকে এসেছে। এবার সময় এসেছে কোন ধর্মটি চয়ন করব, তা বিবেচনা করার পালা। আমি সে ধর্মটি চয়ন করব, যা আমার পরকালে সুখ-শান্তি নিশ্চিত করবে। স্বভাবতই আমাকে মহাবিশ্বের সৃষ্টিকর্তার সত্য বা সর্বাধিক খাঁটি ধর্মটি চয়ন করতে হবে। যেহেতু বিবেচ্য চারটি ধর্মই সত্য হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে, এখন আমাকে যাচাই-বিচার করে দেখতে হবে কোনটি সর্বাধিক খাঁটি। যাচাই করে দেখা যাক সে ধর্মটি হবে কোনটি?

সত্যিকার ও সর্বাধিক খাঁটি ধর্মঃ যখন বিবেচ্য চারটি ধর্মই সম্ভবত একই ঈশ্বর থেকে এসেছে এবং মৌলিকভাবে তাদের মাঝে এতটা মিল, তাহলে বাহ্যিক চর্চায় সেগুলো এতটা ভিন্ন কেন? এক হিন্দু বন্ধুর মন্তব্য আমাকে সম্ভবত এ প্রশ্নের উত্তর দিয়েছে। এ বন্ধুটি ইসলামের সমালোচনা করতে গিয়ে অহংকার করছিলঃ কীভাবে হিন্দু ও খৃষ্ট ধর্ম ইত্যাদি সংশোধিত হয়েছে, কিন্তু ইসলামে সেটা ঘটেনি বলে সে ইসলামকে ধিক্কার দিচ্ছিল। আমার বোঝাপড়ায়ঃ কেবলই নির্বোধ অর্ধ-ধার্মিকেরা তাদের ধর্ম মানুষের হাতে সংশোধিত হওয়ায় গর্ব করতে পারে, প্রকৃত ধার্মিক সেটা পারে না। এ বিষয়ে নিম্নোক্ত প্রশ্নগুলো বিবেচনা করা প্রয়োজনঃ

কারা সে সব লোক, যারা ধর্মগুলোকে সংশোধিত করেছে?

তারা কি ঈশ্বরের অনুমোদন পেয়েছিল ধর্মগুলোকে সংশোধিত করতে?

তারা কি কেবলই নশ্বর পার্থিব মানুষ ছিল না? তারা কিভাবে বিশ্বস্রষ্টার শিক্ষা ও নীতি সংশোধন করার যোগ্যতা পায়?

হিন্দু ধর্মের বিষয়ে আসুন আমরা নজর দেই সতীদাহ প্রথার সংশোধনের দিকে। সতীদাহ প্রথায় মৃত স্বামীর জীবন্ত স্ত্রীকে স্বামীর সাথে একই চিতায় পুড়িয়ে মারা হত। হিন্দু ধর্মশাস্ত্রের বেশ কয়েকটি শ্লোকে সে অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। যেমন,

তাদের স্বামীরা যোগ্য হয়ে থাকলে এসব জীবন্ত নারীদেরকে (চোখে) গোলাপজলের মত ঘি মাখিয়ে ঘরে ঢুকতে দাও। এসব স্ত্রীদেরকে অশ্রু ও বেদনাহীনভাবে এবং সুসজ্জিত অবস্থায় প্রথমে চিতায় উঠতে দাও। (ঋগ্বেদ ১০:১৮:৭)

একজন সতী, যে স্বামীর জ্বলন্ত চিতায় মারা যাবে, সে স্বর্গে অন্তহীন অনুগ্রহ ভোগ করবে। (দক্ষ স্মৃতি ৪:১৮-১৯)

স্বামীর মৃত্যুতে একজন নারীকে অবশ্যই তার স্বামীর চিতায় জীবন্ত জ্বালিয়ে মারতে দিতে হবে। (বসিষ্ঠ পদ্ম পুরাণ Du.B345)

কোন মহিলার স্বামী মারা গেলে তাকে সতীত্বের জীবন বরণ করতে দাও, নইলে তাকে চিতায় তুলে দাও। (বিষ্ণু স্মৃতি ২৫:১৪)

স্বামীর মৃত্যুর পর আগুনে পুড়ে মরা স্ত্রীর সর্বশ্রেষ্ঠ দায়িত্ব। (ব্রাহ্ম পুরাণ ৮০:৭৫)

এবং কে সংশোধন করেছিল এ নির্মম সতীদাহ প্রথা, যা লাখ লাখ নারীকে জীবন্ত পুড়িয়ে মেরেছিল যুগ যুগ ধরে। কোন হিন্দু এ নির্মম প্রথার সংশোধন করে নি, বরং লর্ড বেন্টিংক, যিনি ছিলেন একজন অহিন্দু বিট্রিশ উপনিবেশিক শাসক, রাষ্ট্রীয় আইনের মাধ্যমে এর বিলুপ্তি হিন্দু সমাজের চাপিয়ে দিয়েছিলেন ১৮২৯ সালে। ইউরোপীয় উদারবাদের হাওয়ায় সতীদাহের নির্মমতার বিরুদ্ধে আওয়াজ তুলা শুরু করেন রাজা রামমোহন রায় (১৭৭২-১৮৩৩), যিনি ছিলেন হিন্দুধর্ম ত্যাগী এবং একেশ্বরবাদী ব্রাহ্ম ধর্মের প্রতিষ্ঠাতা। সতীদাহ প্রথা নিষিদ্ধ করার পর হিন্দু ধর্মের পরবর্তী সংশোধনী হল বিধবা নারীদেরকে পুনরায় বিয়ের অধিকার দেওয়া এবং সে আন্দোলনের সূচনা করেছিলেন ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর (১৮২০-১৮৯১) – যিনিও ছিলেন হিন্দুধর্ম ত্যাগকারী এবং মনপ্রাণে নাস্তিক। কাজেই যারা হিন্দু ধর্মের সংশোধনে নেতৃত্ব দিয়েছিল, তারা কোন হিন্দু ঈশ্বর, এমন কি হিন্দু পুরোহিত সম্প্রদায় দ্বারাও নির্দেশিত ছিলেন না; এমনকি তারা বিশ্বাসী হিন্দুও ছিলেন না, বরং হিন্দু ধর্মের বাইরের মানুষ।

খৃষ্টধর্মের সংশোধনীতে প্রটেস্টান্ট সংশোধনীর পিতৃপুরুষ ছিলেন মার্টিন লুথার (১৪৮৩-১৫৪৬)। প্রথম কথা হলঃ কোনই প্রমাণ নেই যে খৃষ্ট ঈশ্বর লুথারকে ধর্মটি সংশোধনের নির্দেশ দিয়েছিলেন; দ্বিতীয়ত, লুথারের সংশোধনী মূলত খৃষ্টধর্মকে চলমান ক্যাথলিক খৃষ্টবাদের তুলনায় অধিক সহিংসতার দিকে নিয়ে যাচ্ছিল। উপরে বলা হয়েছে যে, হিটলারের ইহুদী নিধন অভিযানের মননশীল বা তাত্ত্বিক উদ্দীপনা দান করেছিল মার্টিন লুথারের বক্তব্য ও লেখা। উল্লেখ্য লুথার শুরুতে ইহুদীদের বিষয়ে ভাল ভাল কথা বলেছিলেন – এ প্রত্যাশায় যে, তাদেরকে প্রশংসা করলে তারা লুথারের প্রটেস্টান্ট খৃষ্টবাদ গ্রহণ করবে। কিন্তু ইহুদীরা যখন তার ধর্মের ছায়াতলে এলো না, তখন তিনি তাদের বিরুদ্ধে অকথ্য বিদ্বেষ প্রচার শুরু করে দেন। যেমন, তার “Concerning the Jews and Their Lies” গ্রন্থে লুথার লিখেনঃ

জেনে রাখ ও আদরের খৃষ্ট (যীশু)! এবং কখনোই ভুলে যেয়ো না যে, একমাত্র দানবের (devil) বাইরে তোমার আর অধিক বিষধর, অধিক বেপরোয়া, অধিক তিক্ত কোন শত্রু নাই কেবলমাত্র মনেপ্রাণে ইহুদীদের ছাড়া। [উল্লেখ্য, স্বয়ং যীশু “গসপেল”–এ ইহুদীদেরকে “দানব” আখ্যা দিয়েছেন (জন ৮:৪৪–৪৫)]

সত্যিকার বিষয়টি হলঃ ঈশ্বর কখনোই ভ্রান্ত হতে পারেন না; তার বিচার ও অনুশাসন চিরন্তন এবং তিনি মূল ধর্মগ্রন্থে যা দীক্ষা দিয়েছেন, সেগুলো তার সর্বাধিক সত্য ও শ্রেষ্ঠতম শিক্ষা। ঈশ্বরের নিজের শিক্ষাকে তাঁরই সৃষ্ট মরণশীল ও ভুলপ্রবণ মানুষের দ্বারা সংশোধনের চেষ্টা ঈশ্বরকে বিরোধিতার শামিল, ঈশ্বরের মুখে থাপ্পড় মারার শামিল। যে ঈশ্বরের মৌলিক শিক্ষাকে সংশোধন বা পরিবর্তন করতে চায় – তাউরাত, খৃষ্ট বাইবেল ও কোরানের নির্দেশানুসারে তাদেরকে হত্যা করা উচিত। অথচ আজকের আধুনিক ও বৈষয়িক শিক্ষায় শিক্ষিত তথাকথিত হিন্দু ও খৃষ্টানরা এরূপ ধর্ম-বিরোধী কর্মপ্রয়াসে অহংকার বোধ করে, এবং তাদের খাদমিশ্রিত ধর্ম নিয়ে আত্মতৃপ্তি পায়। মোদ্দাকথা হলঃ আমরা যখন ঈশ্বরের নির্দেশ ব্যতীত মরণশীল মানুষের দ্বারা স্রষ্টার মূল শিক্ষাকে পরিবর্তন-সংশোধন করে তৃপ্তি পায়, তখন আমরা ঈশ্বরকে স্পষ্ট ভাষায় বলছিঃ

“ঈশ্বর, তুমি ফালতু কথা বলেছো এবং আমরা যা ভাবি তা অধিক ভাল – তুমি দোজখে চলে যাও। অন্য কথায়, যখন কোন হিন্দু স্বামীর মৃত্যুর পর তার বিধবা স্ত্রীকে স্বামীর চিতায় একসাথে পুড়ানোর বিরোধিতা করছে, সে হিন্দু ঈশ্বরকে বলছেঃ ‘তুমি এক নির্মম–নির্দয় অসুর, তুমি চলে যাও নরকে, আমি তোমার তোয়াক্কা করি না। আমি এ অসহায়, দুঃখপীড়িত মহিলাটির উপর এমন বর্বর ও অমানবিক শাস্তি প্রয়োগ করাকে মেনে নিতে পারি না, যার জন্য সে নিজে কোনই ভুল করে নি।।’”

কাজেই এ আলোচনার আলোকে আমরা দেখিঃ ইসলাম একমাত্র ধর্ম, যা সংশোধিত হয় নি এবং তা ঈশ্বরের মৌলিক শিক্ষা হিসাবে টিকে আছে। আমরা উপরে দেখেছি যে, ইহুদীরা আল্লাহর মৌলিক শিক্ষা ব্যভিচারের জন্য পাথর ছুঁড়ে হত্যার বিধান পরিত্যাগ ও অবহেলা করছিল; অথচ ইসলামের নবী মুহাম্মদ এসে আল্লাহর সে মূল শিক্ষাকে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করলেন। তথাপি দুঃখের বিষয় যে, ইসলামও বিশ্বের বিভিন্ন অংশে আল্লাহর মূল শিক্ষা থেকে সরে গেছে ও যাচ্ছে এবং নানা ভ্রষ্ট ধরনের ইসলাম – যেমন সুফি ইসলাম, মুতাজিলা ইসলাম এবং আধুনিক বা নমনীয় (moderate) ইসলাম – ইত্যাদির জন্ম দিয়েছে। মুসলিম দেশগুলোতে পশ্চিমা উপনিবেশিক শাসনও সেসব মুসলিম সমাজকে বিভিন্ন মাত্রায় প্রকৃত ইসলামের চর্চা থেকে বিচ্যুত করেছিল।

যাহোক, আজকের চলমান ইসলামী পুনর্জাগরণ – যা নবীর চর্চাকৃত ৭ম শতাব্দীর উজ্জ্বল ইসলামের ঝলক দেখাচ্ছে – সেটা আল্লাহর প্রকৃত বান্দাদের জন্য একটা সুখবর। ইসলাম তার সত্যিকার ও মৌলিক শিক্ষা পুনঃপ্রতিষ্ঠার মাধ্যমে আবারও ঝলসে উঠতে যাচ্ছে। ভাগ্যক্রমে সৌদি আরব অনেক কষ্টত্যাগ ও দৃঢ়তার সাথে ইসলামের প্রায় বিশুদ্ধ রূপকে বাঁচিয়ে রেখেছে এবং আল্লাহর মহিমায়, প্রকৃত ইসলাম তার পুণ্যভূমি থেকে পৃথিবীর কোণে কোণে বিস্তৃত হচ্ছে ও হতে থাকবে। সত্যিকার ইসলাম ইতিমধ্যে পুনঃপ্রতিষ্ঠা করা হয়েছে ইরানে, যে দেশটির রয়েছে উজ্জ্বল ইসলামী ঐতিহ্য, এবং যেখানে গাদ্দার শাসকদের কারণে পাশ্চাত্যের অশুভ ও অনৈসলামিক সংস্কৃতি ও জীবনাচরণ এসে ইসলামকে প্রায় মৃত্যুমুখে পতিত করেছিল। আফগানিস্তানেও ইসলাম মরণমুখী হয়ে পড়েছিল নাস্তিক্যবাদী সমাজতান্ত্রিক ও পশ্চিমা সংস্কৃতির প্রভাবে এবং তালেবানরা সেখানে সগৌরবে প্রকৃত ইসলাম পুনঃপ্রতিষ্ঠা করে। তবে দুঃখের বিষয় যে, ওসামা বিন নাদেনের আল-কায়েদা সন্ত্রাসী দল কর্তৃক ২০০১ সালে আমেরিকায় সন্ত্রাসী আক্রমণের পর কাফের-বিধর্মী আমেরিকানরা তালেবানদের সে গৌরবোজ্জ্বল সফলতা নস্যাৎ করে ফেলে আফগানিস্তানে আক্রমণ করে। যাহোক, এটা একটা সাময়িক বিপর্যয় মাত্র। পশ্চিমা শক্তি ইতিমধ্যে সেখান থেকে চলে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে এবং তারা চলে যেতেই প্রকৃত ইসলাম সেখানে চলে আসবে।

প্রকৃত ইসলাম প্রায় নিখুঁতরূপে পাকিস্তান, সুদান ও নাইজেরিয়ার মুসলিম-অধ্যুষিত উত্তর অংশে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হয়েছে। প্রকৃত ইসলাম প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে মালয়েশিয়ার কেলান্তান ও টেরাংগানু প্রদেশে এবং ইন্দোনেশিয়ার জাভা ও আচেহ-তে। আমেরিকা ও মিত্র শক্তি ইরাকের তথাকথিত ধর্ম-নিরপেক্ষ সাদ্দাম হুসেনকে সরানোর পর আমরা দেখছি ইরাক আবার প্রকৃত ইসলামের মুখ দেখতে যাচ্ছে, যেখানে মুক্তাদা আল-সাদর ও মহান আয়াতুল্লাহ আল-সিস্তানির মত মুল্লারা রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে শক্তিশালী অবস্থানে চলে আসছে। প্রকৃত ইসলাম বাংলাদেশকে ধীরে ধীরে ইসলামীভাবে বিশুদ্ধ করে তুলছে এবং শীঘ্রই তা কর্তৃত্ব সহকারে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পথে। আমরা দেখছি স্বর্ণোজ্জ্বল ইসলাম পশ্চিমা বিধর্মী দেশগুলোতেও শিকড় গাড়তে শুরু করেছেঃ যেমন ক্যানাডার অন্টারিও প্রদেশে মুসলিমদের জন্য “শরিয়া আদালত” আংশিকভাবে কার্যকর ছিল দীর্ঘদিন (১৯৯১-২০০৫ সাল) এবং সম্প্রতি ব্রিটেনে ইসলামী শরিয়া আদালত মুসলিম নাগরিকদের জন্য বৈধ করেছে সরকার। অন্যান্য পশ্চিমা দেশে মুসলিমরা শরিয়া আইন প্রতিষ্ঠার দাবী করে যাচ্ছে।

 

স্বর্গের পাসপোর্ট

যারা সত্যি সত্যি মৃত্যু-পরবর্তী জগতে তাদের সৌভাগ্য ও শান্তি নিশ্চিত করতে চায়, তাদের সবার কাছে সঠিক পথটি এখন খোলাসা হয়ে যাওয়ার কথা। আমার কাছে অন্তত সে পথটি স্বচ্ছ হয়ে উঠেছে; আমি আলোকের পথ দেখছি। আমি বলিঃ “আসুন সত্যিকার ও নিখুঁততম কভি-না-সংশোধিত ইসলাম ধর্মে এবং আপনারা নিশ্চিত স্বর্গের পথে পা রাখবেন। এবং আল্লাহ যে তোড়জোরের সাথে বিশ্বের প্রান্তে প্রান্তে তার স্বর্ণোজ্জ্বল কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করে যাচ্ছে – তাতে ইসলাম কেবল স্বর্গের দুয়ারই উন্মোচন করছে না, সেটা পার্থিব জগতেও একমাত্র জীবন-আদর্শ হিসাবে প্রতিষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। ইহজগতে ইসলামের এ একচ্ছত্র প্রাধান্য প্রতিষ্ঠার প্রতিজ্ঞা আল্লাহ নিজেই করেছেনঃ

“লড়াই করে যাও তাদের সাথে যতদিন না গণ্ডগোল ও নির্যাতন শেষ হয় এবং ন্যায়বিচার ও একমাত্র আল্লাহতে বিশ্বাস পরিপূর্ণভাবে ও সর্বত্র প্রাধান্য পায়।” (কোরান ৮:৩৯)”
আল্লাহর এ নির্দেশ যে বৃথা যেতে পারে না বা যাবে না, সেটা আমাদের কাছে স্পষ্ট হয়ে উঠছে। কাজেই ইহজগত ও পরজগত – উভয় জগতেরই ভাল চাইলে আমাদের কি করা উচিত সেটা সুস্পষ্ট, বলার অপেক্ষা রাখে না।

(দ্রঃ লেখাটি প্রথমত ২০০৩ সালে ইংরেজীতে ‘Which Religion Should Choose?‘ শিরোনামে mukto-mona.com-এ প্রকাশিত হয়েছিল। বঙ্গানূদিত এ রচনাটি মূল রচনা থেকে সামান্য পরিবর্ধিত ও সংশোধিত।)

সূত্রঃ

i Ibn Ishaq, The Life of Muhammad, Oxford University Press, Karachi, p. 684

ii http://www.nobeliefs.com./speeches.htm

iii Hitler, Adolf, Mein Kampf, Vol. 2, Chapter 1

iv উদ্ধৃতি The Holy Reich, by Richard Steigmann-Gall

v উদ্ধৃতি Hitler’s Elite, Shocking Profiles of the Reich’s Most Notorious Henchmen গ্রন্থে, Berkley Books, 1990; দেখুন http://www.nobeliefs.com/henchmen.htm

vi Adolf Hitler, in a speech in Berlin on 24 Oct. 1933

vii খৃষ্ট বাইবেল, ম্যাথিউ ১০:৫-৬; ১৫:২৪

viii এম, এ, খান (২০১০) জিহাদঃ জবরদস্তিমূলক ধর্মান্তরকরণ, সাম্রাজ্যবাদ ও দাসত্বের উত্তরাধিকার, ব-দ্বীপ প্রকাশন, ঢাকা

ix Ibn Ishaq, The Life of Muhammad, Oxford University Press, Karachi, p. 461-70

x Russell B (1956) Why I am not a Christian, Simon& Schuster, New York, p36

৬ ফেঃ ২০১৩
 

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
Archive
 
সাম্প্রতিক পোষ্টসমূহ