Banner
গো-পূজারী থেকে গো-খাদকঃ ভারতবর্ষীয় মুসলমানদের মাঝে গোমাংস ও গো-কোরবানী প্রিয় হয়ে উঠার রহস্য — আলমগীর হুসেন

লিখেছেনঃ আলমগীর হুসেন, আপডেটঃ August 3, 2019, 12:00 AM, Hits: 2550

 

ভারতবর্ষীয় মুসলমানদের গোমাংস প্রীতিঃ

গ্রাম্য পরিবেশে পরিবেশে বড় হয়েছি। আমাদের পরিবারে আমিষ জাতীয় খাদ্যের মধ্যে সবচেয়ে প্রিয় মাছ, তারপর মুরগী ও খাসীর মাংস এবং সবচেয়ে কম পছন্দের হচ্ছে গোমাংস। ভাবতাম বাংলাদেশের সবার পছন্দ সম্ভবত একই। কিন্তু অবাক হই ১৯ বছর বয়সে পড়াশুনার জন্য বিদেশ গমনের পর। বাংলাদেশের বাইরে একাদিক দেশে পড়াশুনার সময় দেশ থেকে আগত ছাত্রছাত্রীদের সাথে থাকা ও উঠা-বসা। ওদের প্রায় সকলেই উচ্চশিক্ষিত কিংবা সম্ভ্রান্ত শহুরে পরিবার থেকে আসা।

মাছ-মাংসের মধ্যে ওদের প্রায় সবার সবচেয়ে প্রিয় হচ্ছে গোমাংস। আবার গোমাংসের মাঝেও কোরবানীর গোমাংস নাকী সবচেয়ে সুস্বাদু। তাইতো দেখেছি ৩মাস, ৪মাস কিংবা ৬ মাস সংরক্ষণ করে রাখা কোরবানীর গোমাংস ওরা দেশ থেকে আনিয়ে খেত। কোরবানীর গোমাংস আসলে ওদের চোখে-মুখে আনন্দ জ্বলে উঠত, জানাশুনা সবাইকে দাওয়াত দেওয়া হতো। আর কোন হিন্দুকে দাওয়াত দিয়ে কোরবানীর গোমাংস খাওয়াতে পারলে তো আনন্দের আরও পোয়াবারো। একবার অত্যন্ত উদার মনের এক বড় ভাই, রেজা, দেশ থেকে কোরবানীর মাংস আনিয়ে উনার এক শিখ বন্ধুকে দাওয়াত দিয়েছে। শিখরা সাধারণত শাকাহারী এবং হিন্দুদের মতই গরুকে সম্মানের চোখে দেখে। উদার মনের শিখ বন্ধুটি আমাদের সামনে গোমাংস খেতে-খেতে বলল, রেজার কুমন্ত্রণায় পড়ে আমি আমার ধর্ম বিসর্জন দিলাম আজ। ওদিকে রেজা ভাই আত্মতৃপ্তির ঢেকুর তুলে শিখ বন্ধুটিকে বলল, গরুর মাংসের মত সুস্বাদু কোন মাংস হয় না; কোরবানীর গোমাংস আরও মজা।

গো-কোরবানী বনাম ছাগল/ভেড়া কোরবানীঃ

ছোটকালে দেখতাম আমাদের আশে-পাশে গরু, ছাগল ও ভেড়া কোরবানী হতো। কিন্তু সবার খায়েশ থাকতো গরু কোরবানী দেওয়ার। অনেকে আর্থিক কারণে ছাগল বা ভেড়া কোরবানী দিতে বাধ্য হতো, কিন্তু গরু কোরাবানী দিতে না পারলে যেন কোরাবানীর উদ্দেশ্য হাসিলে কিছুটা অপূর্ণতা থেকে যেতো। আমাদের বাড়িতে ছাগল বা ভেড়া কোরবানী হতো এবং আমাদের পরিবারে গোমাংসের চেয়ে খাসির মাংস প্রিয় হওয়া সত্ত্বেও গরু কোরবানী দিতে না পারায় একটা অপূর্ণতা প্রতিবারই অনুভব করতাম।

[বাংলাদেশঃ  হিন্দু মন্দিরের সামনে মুসলমানরা গরু কোরবানী দিচ্ছে, ২০১৫]

 

মুসলমানদের গোমাংস প্রিয়তা ও কিছু প্রশ্নঃ

উপরোক্ত ঘটনাগুলো ১৯৯০-এর দশকে বা তার আগে অবলোকন করা। তখন এগুলো মনে কোন প্রশ্ন তোলে নি। হিন্দুধর্মে গরু পূজনীয়, তাই ওরা গোমাংস খায় না। মুসলমানরা চিরাচরিতভাবে গোমাংস খায়, ফলে গোমাংস তাদের সবচেয়ে প্রিয় হতেই পারে। অনুরূপভাবে, মুসলমানদের মাঝে ছাগল-ভেড়া ছেড়ে গরু কোরাবানী দেওয়ার খায়েশের ব্যাপারটিও তখন মনে কোন প্রশ্ন তোলে নি। কিন্তু পরবর্তীতে যখন উপলব্ধি করতে পারলাম যে, আমাদের হিন্দু-বৌদ্ধ পূর্বপুরুষেরা ইসলাম গ্রহণের আগে গরুকে হিন্দু সম্মান করতো, তখন মনে প্রশ্ন জাগতে থাকে সেই গরু-পূজারীদের উত্তরসূরীরা আজ গোমাংস খাওয়ার প্রতি এতটা খায়েসী কেন? গোমাংস বাংলা ও ভারতবর্ষের মুসলিমদের কাছে এতটা প্রিয় কেন? উল্লেখ্য, মুসলমানেরা সুন্নত পালনে অত্যন্ত আগ্রহী। নবী (সঃ) জমজমের পানি, আরব দেশের খোর্মা-খেজুর খেতেন। তাই এগুলো ভারতবর্ষের মুসলিমদের কাছে অত্যন্ত প্রিয়। একইভাবে নবী খেতেন উট ও দুম্মার মাংস, ফলে উট ও দুম্মার মাংস হওয়া উচিত এ অঞ্চলের মুসলমানদের সবচেয়ে প্রিয়। অথচ উটের মাংস দেখলে বাংলার মুসলমানদের বমি-বমি ভাব হয়। ওদিকে দুম্মার মাংসের অনুরূপ হচ্ছে ভেড়ার মাংস, যা এ অঞ্চলের মুসলমানদের কাছে সবচেয়ে কম প্রিয় মাংস।

ভারতে ইসলামী যুগের কিছু ঐতিহাসিক গ্রন্থ পাঠ করতে গিয়ে এ অঞ্চলের মুসলমানদের মাঝে গোমাংস সবচেয়ে প্রিয় হয়ে উঠার রহস্য সম্পর্কে কিছুটা ধারনা পাই। কয়েক বছর আগে ভারতে গোমাংস ভক্ষণ নিষিদ্ধকরণ সত্ত্বেও জিদ করে গোমাংস খাওয়ার চেষ্টার কারণে বেশকিছু মুসলমানকে হত্যা করা হয়েছে। এতে প্রায় সকলেই হিন্দুদের নিন্দা করেছে এবং সঙ্গত কারণেই। আবার অল্পকিছু মানুষকে প্রশ্ন করতে দেখেছি যে, মুসলমানদেরকে গোমাংস খেতেই হবে – এমন বাধ্যবাধকতা কেন? বাংলাদেশে উদার মনের এক বন্ধু ভারতের গো-হত্যা নিষেধাজ্ঞা বিষয়ে তর্ক করতে গিয়ে স্থানীয় মুসলমানদের রোষানলে পড়েছে। এ প্রেক্ষাপটে ভারতবর্ষীয় মুসলমানদের মাঝে গোমাংস এতটা প্রিয় হয়ে উঠার উপর কিছুটা আলোকপাত করতে আগ্রহী হলাম।

ভারত, মিশর ও অন্যান্য সভ্যতায় গরু পূজাঃ

মানবপ্রজাতি আফ্রিকা থেকে ৫০ থেকে ১০০ হাজার বছর আগে বিশ্বের অন্যত্র ছড়িয়ে বহু জনপদ গড়ে তোলে। এসব জনপদগুলো ভিন্ন ভিন্ন অভিজ্ঞতা, পরিবেশ-প্রকৃতি, কাল্পনিক গাল-গল্প ও ঐতিহাসিক গাথা ইত্যাদির ভিত্তিতে নিজ-নিজ আচার ও কৃষ্টি গড়ে তোলে। এসব আচার ও কৃষ্টির যেগুলো জনতার মাঝে অত্যন্ত জনপ্রিয় হয়ে উঠে, সেগুলোর সমষ্টিতে গড়ে উঠে ধর্ম। যেমন কৃষিজীবী প্রাচীন মিশর ও ভারতীয় সভ্যতায় সূর্য-পূজা প্রাধান্য পেয়েছিল (আদিত্য বা সূর্য প্রাচীন ভারতে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ দেবতা ছিল), কেননা নিরাপত্তা ও নিশ্চয়তার পাশাপাশি কৃষিকাজের জন্য সূর্যের আলো ও তাপ অপরিহার্য। কাজেই জীবিকা, নিরাপত্তা ও নিশ্চয়তা দানকারী সূর্যকে পূজা করে মানুষ কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেছে; স্তুতি-আরাধনার মাধ্যমে সূর্য-দেবতার অনুগ্রহ ও কৃপা অর্জনের প্রত্যাশাও পোষণ করেছে (সম্ভবত বিশ্বের প্রত্যেকটি জনপদই একদিন সূর্যের পূজা করতো)। অন্যদিকে উত্তপ্ত মরুভূমি আরবে পশুচারণ ছিল জীবিকা নির্বাহের প্রধান উপায়। অতিরিক্ত উত্তাপের কারণে আরবের বেদুইনরা রাত্রিবেলা পশুচারণ করতো, ঘাসের খোঁজে এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় স্থানান্তরিত হতো (এমন কি নবী  মুহাম্মদ ও তাঁর সাহাবাগণ যখন দূর-দূরান্তের জনগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে জিহাদ অভিযানে বের হতেন, উনারা সাধারণত  রাত্রিবেলা পথ পাড়ি দিতেন, দিনের বেলায় পথের বিভিন্ন স্থানে লুকিয়ে থেকে অবসর নিতেন)। ফলে চন্দ্রের আলো তাদের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ ছিল এবং আরবভূমির মানুষ চাঁদকে ঈশ্বরজ্ঞান করতো। ইসলামের আগমন-পূর্বে আল্লাহ ছিল আরবদের কাছে চন্দ্রদেবতা (Moon-god)। অপরদিকে ইহুদি ধর্মগ্রন্থ তৌরিত মূলত হিব্রু জনগোষ্ঠীর এক ঐতিহাসিক গাথা মাত্র, যার মাঝে গোষ্ঠীটির জীবনের রাজনৈতিক কাহিনী, বিশিষ্ট ঘটনা, কাল্পনিক গাল-গল্প, নৈতিক ভাবনা, ধর্মীয় নেতা ও গুণীজনের কথা ও উপদেশ ইত্যাদি স্থান পেয়েছে। এসব দৃষ্টান্ত বিচিত্রউপায়ে মানবসমাজে ধর্মীয় সংস্কৃতি গড়ে উঠার ইঙ্গিত দেয়।

[বাংলাদেশঃ  হিন্দু মন্দিরের সামনে ফেলে রাখা কোরবানীর গরু নাড়িভুড়ি, ২০১৫]

 

এভাবে প্রাচীনকালে পৃথিবীপৃষ্ঠের প্রত্যেকটি জনগোষ্ঠীরই নিজস্ব ধর্ম গড়ে উঠে। পরবর্তীকালে খ্রিস্টান ও ইসলাম অত্যন্ত ভিন্ন ধাঁচের ও বৈশ্বিক সাম্রাজ্যবাদী উদ্দেশ্য নিয়ে হাজির হওয়ার পর পৃথিবীর বহু জনগোষ্ঠীর সে প্রাচীন ধর্মীয় আচার ও কৃষ্টি ধ্বংস করে ফেলা হয়েছে।

অনেক মুসলিমকে দাবী করতে দেখেছি যে, হিন্দুরা গরুকে পূজা করে। দাবীটি পুরোপুরি সঠিক নয়। হিন্দুরা গরুকে সম্মান করে, গরু তাদের কাছে পবিত্রতার প্রতীক, এমনকী দেবী কামধেনু (সুরভী) কে হিন্দুরা গরুর মাতা মনে করে, কিন্তু গরুর জন্য বিশেষ কোন পূজার প্রচলন নেই হিন্দুসমাজে। গরুকে পবিত্রতার প্রতীক মনে করার, এমনকী দেবতা হিসেবে পূজা করার, রীতিও পৃথিবীর অন্যান্য সভ্যতায়ও প্রচলিত ছিল। যেমন, প্রাচীন মিশরে আজ থেকে ৫ শহস্রাধিক বছর আগে কৃষিকাজজনিত উৎপাদিকা শক্তির প্রতীক হিসেবে Apis নামের গো-দেবতার পূজার সূচনা হয়। প্রাচীন হিব্রু (ইহুদি) জনগোষ্ঠীর মাঝেও গো-পূজার প্রচলন ছিল। মিশর থেকে পলায়নকালে (খ্রি:পূ: ৩২০০ সাল) হিব্রু গোষ্ঠীকে আমরা গো-শাবকের পূজা করতে দেখি। সম্ভবত মিশরে সুদীর্ঘকাল (~খ্রি:পূ: ৩৮০০–৩২০০ সাল) বসবাসকালে তারা মিশরিয়দের দেখাদেখি গো-পূজার রীতি গ্রহণ করেছিল। হিব্রুরা মিশর থেকে পলায়নের পর সিনাই উপত্যকায় ঘুরে বেড়ানোর সময় মুসা একবার তাদেরকে মূর্তি-পূজা নিষেধ করে ঈশ্বরের সাথে সাক্ষাৎ করতে উধাও হয়ে যান। বহুদিন পার হয়ে যায়, কিন্তু মুসা ফিরে আসে না। মুসার ভাগ্যে কী ঘটল বা না ঘটল এ নিয়ে জনতার মাঝে সন্দেহ জাগে। এ দ্বন্দ্বের মাঝে জনতা চিরাচরিত রীতি অনুযায়ী একটি সুবর্ণ গো-শাবক মূর্তি বানিয়ে পূজা করে। ফিরে এসে মুসা তার জনগণের গো-মূর্তির পূজাকে মহাপাপ ঘোষণা করে (দেখুন, এক্সোডাস ৩২/১-৩৫)। এবং সম্ভবত সেই থেকে হিব্রু জনগোষ্ঠীর মাঝে ও আব্রাহামীয় ধর্মে (ইহুদি, খ্রিস্টান, ইসলাম) মূর্তি-পূজার প্রতি ঘৃণার সূচনা।

পারস্যের জরাথ্রুষ্টবাদ ধর্মেও গরু পবিত্রতার প্রতীক। প্রাচীন গ্রিস, রোম ও জার্মান ধর্মীয় সংস্কৃতিতেও গরুকে পবিত্র মনে করা হতো। জীবিকার মূল ভিত্তি কৃষিকাজে গরুর অপরিহার্য ভূমিকার কারণেই বহু প্রাচীন জনগোষ্ঠি গরুকে পবিত্রতার প্রতীক বিবেচনা করেছে, দেবতা হিসেবে পূজাও করেছে কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপনের উদ্দেশ্যে। ভারতবর্ষে গরুর সম্মানিত ও পবিত্রতার প্রতীক হয়ে উঠার কারণও একই।

গোমাংস  নিষিদ্ধ  কেন?

ভারতবর্ষে উদ্ভূত হিন্দু, জৈন, বৌদ্ধ ও শিখ ধর্মগুলোতে গরু শুধু পবিত্রতার প্রতীক-ই নয়, গরু হত্যা এবং গোমাংস ভক্ষণও নিষিদ্ধ। তবে গরুকে পবিত্রতার প্রতীক মনে করা কিংবা অবতার বা দেবতা হিসেবে পূজা করা মানে গো-হত্যা বা গোমাংস ভক্ষণ নিষিদ্ধ হওয়া নয়। বিশ্বের অন্যত্র একসময় গরু পূজিত বা পবিত্রতার প্রতীক বিবেচিত হওয়া সত্ত্বেও গো-হত্যা বা গোমাংস ভক্ষণ নিষিদ্ধ ছিল না।

প্রাচীন ভারতবর্ষেও গোমাংস ভক্ষণ নিষিদ্ধ ছিল না। বেদিক যুগীয় (খ্রি:পূ: ১৫০০-৫০০ সাল) শাস্ত্র ‘গ্রহ সূত্র’-এ বিশেষ ধর্মীয় অনুষ্ঠানের পর গোমাংস ভক্ষণ সুপারিশ করা হয়েছে, যদিও অন্যত্র বেদিক শাস্ত্রে গোমাংস নিষিদ্ধ করা হয়েছে বলে দাবী করা হয় (যেমন রিগ্বেদ ১০/৮৭/১৬)। ঠিক কখন ও কী কারণে ভারতবর্ষে গো-হত্যা ও গোমাংস ভক্ষণ নিষিদ্ধ হলো, সে বিষয়ে সঠিক তথ্য পাওয়া কঠিন। বেশীরভাগ গবেষক ও পণ্ডিতের মতে ভারতীয় ধর্মগুলোর মূলমন্ত্র ‘সকল প্রাণীর প্রতি অহিংসা’ চর্চা থেকে গো-হত্যা ও গোমাংস ভক্ষণ নিষিদ্ধ হয়ে উঠেছে। বিষয়টি গোলমেলে। তাহলে কালি দেবীর উদ্দেশ্যে পাঠা বলি কেন?

তবে খুব সম্ভবত খ্রি:পূ: ৬ষ্ঠ শতকে উলঙ্গ নবী মহাবীর কর্তৃক জৈন ধর্ম প্রতিষ্ঠার পর ভারতবর্ষে প্রাণী হত্যার মাঝে নিহিত নিষ্ঠুরতার ব্যাপারে বোধোদয় হতে থাকে। জৈনধর্ম কঠোরভাবে শাকাহারী। ডিম নতুন জীবনের উৎস বিধায় ডিম খাওয়াও নিষিদ্ধ। এমনকি মাটি থেকে তোলার সময় পেঁয়াজ, রসুন, আলু ইত্যাদির সাথে জড়িত ক্ষুদ্র কিড়া, পোকা ইত্যাদি ব্যথা পায় বিধায় মাটির নীচে জন্মানো ফলমূল খাওয়াও নিষিদ্ধ জৈন ধর্মে। এর কিছুকাল পরে (খ্রি:পূ: পঞ্চম শতক) গৌতম বুদ্ধ লিখেছেন, ভারতের ব্রাহ্মণ সম্প্রদায় পূর্বে গো-হত্যা বর্জন করতো (ব্রাহ্মণধামিকা সুত্তা ১৪) এবং ব্রাহ্মণদের সে প্রথাকে প্রশংসা করতঃ গরুকে সর্বোত্তম আপনজন ঘোষণা দিয়ে বুদ্ধ লিখেন (ব্রাহ্মণধামিকা সুত্তা ১৩):

“মা, বাবা, ভাই বা অন্যান্য আত্মীয়জনের মত, গরুও আমাদের সর্বোত্তম আপনজন, যাদের থেকে আসে বহু প্রতিষেধক উপকরণ।”

বুদ্ধ আরও লিখেছেন, ব্রাহ্মণরা পরবর্তীতে লোভের বশে ও রাজাদের কুমন্ত্রনায় গো-হত্যা শুরু করলে ঈশ্বরগণ স্বর্গ থেকে চেচিয়ে বলল, ‘এটা অন্যায়’ এবং নিষ্পাপ গরুকে হত্যার কারণে পুরোহিতেরা ধর্ম থেকে বিচ্যুত হয়েছে। (ব্রাহ্মণধামিকা সুত্তা ২৭-২৯)

এটা মোটামুটি নিশ্চিত যে, জৈন ধর্মের মাধ্যমে ভারতবর্ষে, প্রকৃতপক্ষে সারা বিশ্বে, নিরামিষ ভোজের সূচনা হয়। পরবর্তীতে মৌর্য্য রাজবংশের প্রতিষ্ঠাতা চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য্যের (রাঃ খ্রি:পূ: ৩২১-২৯৮) জৈন ধর্ম গ্রহণের ফলে নিরামিষ ভোজ ভারতীয় জনগণের মাঝে ব্যপ্তি লাভ করে। এরপর বিশাল মৌর্য্য সাম্রাজ্যের অধিকারী চন্দ্রগুপ্তের নাতি সম্রাট অশোক (রাঃ খ্রি:পূ: ২৬৮-২৩২) কলিঙ্গা যুদ্ধের পর বৌদ্ধধর্ম গ্রহণ ও প্রচারে বিশেষ সচেষ্ট হওয়ার ফলে ভারতবর্ষে নিরামিষ ভোজ ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভ করে (উল্লেখ্য, পরবর্তীতে মুসলিম দখলে আসার পর ভারতে মাংস ভোজন উৎসাহিত হয়, ধর্মান্তরিত মুসলমানরা ১০০% নিরামিষভোজী হয়ে উঠে)।

প্রশ্ন হচ্ছে, মাংসভোজী হিন্দু ও বৌদ্ধরা শুধু গোমাংস বর্জন করে কেন? ভারতীয় ধর্মশাস্ত্রগুলোতে গরুকে সম্মানের আসনে অভিষিক্তকরণ অবশ্যই এর প্রধান কারণ। যেমন, বৌদ্ধ ধর্মশাস্ত্র যখন গরুকে মা-বাবা সমতুল্য ঘোষণা দিয়েছে, গরু হত্যায় ব্যথিত ঈশ্বরেরা ‘এটা অন্যায়’ বলে চেচিয়ে উঠেছে, তখন বৌদ্ধরা গরুকে হত্যা করে কীভাবে, গোমাংস খায় কীভাবে? উল্লেখ্য, একসময় বৌদ্ধধর্ম ভারতের সর্বত্র সবচেয়ে জনপ্রিয়তা অর্জন করেছিল এবং বৌদ্ধশাস্ত্রে গরুকে মা-বাবা সম আপন আখ্যায়িত হওয়ায় সম্ভবত বৌদ্ধ ধর্মের কারণেই ভারতবর্ষে গো-হত্যা ও গোমাংস ভক্ষণ নিষিদ্ধ বা বর্জিত হয়ে উঠে। সম্ভবত বৌদ্ধদের দেখাদেখি হিন্দুরাও গো-হত্যা ও গোমাংস ভক্ষণ বর্জন করে, যার ফলে গোমাংস বর্জন ভারতবর্ষে সার্বজনীনতা লাভ করে। আবার এটাও সত্য যে, ভারতের বাইরে বহু জাতি, যেমন শ্রীলঙ্কা, থাইল্যান্ড, জাপান, কোরিয়া ইত্যাদি বৌদ্ধ ধর্ম গ্রহণ করলেও গোমাংস ভক্ষণ পরিত্যাগ করে নি।

তবে সব প্রাণীর মধ্য থেকে শুধু গরু কেন সম্মানের পাত্র হয়ে উঠবে? এ প্রসঙ্গে বলা হয়েছে, কৃষিজীবি প্রাচীনসমাজে হাল-চাষের জন্য গরুর অপরিহার্য ভূমিকা একটা বিশেষ কারণ হতে পারে। আবার জৈন ও বৌদ্ধ ধর্মের প্রসারের কারণে ভারতবর্ষে জনগণ নিরামিষ ভোজের দিকে ঝুকে পড়লে গো-দুগ্ধ আমিষের বড় উৎস হিসেবে স্থান পায়। হিন্দুশাস্ত্রে গো-দুগ্ধকে জীবন দান ও নির্বাহকারী ঘোষণা করা হয়েছে। হালচাষে অপরিহার্যতার পাশাপাশি নিরামিষ-ভোজী ভারতে গো-দুগ্ধ আমিষের প্রধান উৎস হয়ে উঠায় গরুর গুরুত্ব আরও বেড়ে যায়। মায়ের মত গরু জীবনের জন্য অপরিহার্য দুধের একমাত্র উৎস। গরু ভারতীয়দের কাছে মা সমান হয়ে উঠে।

ভারতীয় মুসলমানদের মাঝে গোমাংস প্রিয়তার কারণঃ

ভিন্ন ধর্মীয়দের কাছে যা কিছু পবিত্রতার প্রতীক, সম্মানের প্রতীক ও পূজনীয় – সেগুলোকে আঘাত করা ইসলামে এক বিশিষ্ট ঐতিহ্য হয়ে উঠে নবী মুহাম্মদের আমলেই। শুধু কাবায় স্থাপিত ৩৬০টি পূজিত মূর্তিই নয়, মক্কা বিজয়ের দিন নবীর নির্দেশে ধ্বংস করা হয় মক্কায় পাদদেশের বনী জাজিমার (Banu Jadhima) আল-উজ্জা দেবীর মন্দির, মদীনায় পূজিত আল-মানাত দেবীর মন্দির। এরপর নবীর কাছে তায়েফবাসীর আত্ম-সমপর্নের পর তাদের বহু মিনতি সত্ত্বেও নবী তাদের আল-লাত দেবীর মন্দিরটি ধ্বংস করেন। মদীনার ইহুদি সম্প্রদায়গুলোকে একে একে নির্বাসন বা গণহত্যার মাধ্যমে নির্মূল করার সাথে তাদের সিনাগগগুলোও ধ্বংস হয়ে যায়। ৬৩০ খ্রিস্টাব্দে মক্কা বিজয়ের পর আরবের দূর্বল জনগোষ্ঠীগুলো ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে পড়ে। এসময় ইয়ামামা থেকে বনী হানিফার এক প্রতিনিধি দল আসে নবীর কাছে নিরাপত্তা চাইতে। বেশ কয়েকদিন তারা নবীর সাথে ধর্মীয় বিষয়ে আলোচনা করে এবং তাদের ফেরার সময় নবী ওজুর অবশিষ্ট পানিসহ ভাণ্ডটি তাদের হাতে ধরিয়ে দিয়ে আদেশ দেন (ইবনে সা’দ, আল-তাবাকত আল-কবীর, ২/২৯৮-২৯৯):

“তোমরা দেশে পৌঁছে তোমাদের গির্জাটি ধ্বংস করে ফেলবে এবং এই পানি ছিটিয়ে দিয়ে সে স্থানটি পবিত্র করে তদস্থলে একটি মসজিদ নির্মাণ করবে।”

এসব দৃষ্টান্ত থেকে স্পষ্ট হয়ে উঠে যে, ধর্মীয় বিদ্বেষের কারণে বিধর্মীদের মন্দির, চার্চ, সিনাগগ ইত্যাদি ধ্বংস করা ইসলামে একটি অত্যন্ত মৌলিক সুন্নতি ঐতিহ্য। ফলে পরবর্তীতে মুসলিমরা তলোয়ার হাতে যেখানেই গিয়েছে, সেখানেই স্থানীয় জনগোষ্ঠীর ধর্মীয় প্রতীকগুলোর ওপর প্রথম আঘাত হেনেছে। ফিলিস্তিন দখলের পর খলিফা হযরত উমর ইহুদিদের প্রাণপ্রিয় জেরুজালেম মন্দিরটির জায়গায় আল-আকসা মসজিদ নির্মাণ করেন; সেকালীন খ্রিস্ট্রিয়শক্তির প্রধান কেন্দ্র ইস্তাম্বুল (কনস্ট্যান্টিনোপোল) দখলের পর সুবিখ্যাত হাইয়া সোফিয়া (Hagia Sophia) গির্জাটি দখল করে মসজিদ বানানো হয়। অনুরূপভাবে আলি ইবনে হামিদ আল-কুফি রচিত ‘চাচনামা’ নামক প্রাচীন সিন্ধুর ইতিহাস গ্রন্থে লিখিত হয়েছে যে, মুহাম্মদ বিন কাসিম (৭১২ খ্রিস্টাব্দ) উত্তর-পশ্চিম ভারতের সিন্ধ দখল অভিযানে দেবাল-এ পৌঁছে সর্বপ্রথমে মন্দির আক্রমণ করে; এরপর সিজিস্তানে পৌছে সেখানকার বুধ মন্দিরটি ধ্বংস করে এবং তদস্থলে মসজিদ নির্মাণ করে।[1] একইভাবে সম্রাট বাবর হিন্দুদের পূণ্যভূমি অযোধ্যা দখলের পর তাদের সর্বোচ্চ গুরুত্বপূর্ণ রামমন্দিরটি ধ্বংস করে তদস্থলে মসজিদ (বাবরী মসজিদ) নির্মাণ করেন।

ঐতিহাসিক গ্রন্থগুলোতে উল্লেখিত তথ্যাদি প্রমাণ দেয় যে, গো-পূজারী হিন্দুদের ইসলাম গ্রহণের পর গো-খাদক হয়ে উঠার পেছনেও রয়েছে ধর্মীয় উদ্দেশ্য বা অনুপ্রেরণা তথা অমুসলিমদের ধর্মীয় প্রতীকে আঘাত হানার সুন্নতি প্রচেষ্টা। এ প্রসঙ্গে নিম্নোক্ত ঐতিহাসিক তথ্যগুলো বিবেচ্যঃ

(১) সম্ভবত ভারতের শ্রেষ্ঠ দু’জন সুফি সাধকের একজন মইনুদ্দিন চিশতি (মৃঃ ১২৩০ খ্রি:), যার সমাধির ওপর প্রতিষ্ঠিত হয়েছে ভারতবর্ষের মুসলিমদের প্রিয় আজমির শরীফ। ভারতীয় কাফেরদের বিরুদ্ধে জিহাদ করার উদ্দেশ্যে মইনুদ্দিন চিশতি শিষ্যদেরকে নিয়ে মুহাম্মদ গোরীর বাহিনীতে যোগ দেন। ১১৯২ খ্রিস্টাব্দে গোরীর বাহিনীর কাছে আজমির অধিপতি পৃথ্বীরাজ চৌহানের পরাজয়ের পুরো কৃতিত্ব দাবী করেছেন মইনুদ্দিন চিশতি ও তার শিষ্যরা। এরপর আজমিরে পৌঁছে তিনি এক বিশাল মন্দির দেখতে পান, যেখানে সেখানকার রাজা পূজো করতো। আল্লাহ ও নবীর সহায়তায় তিনি মন্দিরটি ধ্বংস করার সংকল্প করে মন্দিরটির পাশেই তার খানকা (আস্তানা) স্থাপন করেন। এরপর তিনি শিষ্যদের নিয়ে প্রতিদিন মন্দিরটির সামনে গরু জবাই করে কাবাব বানিয়ে খেতেন।[2]

(২) ওদিকে কাশ্মীরের শ্রেষ্ঠ সুফি সাধকদের একজন শেখ সামসুদ্দিন ইরাকী (মৃঃ ১৫২৬ খ্রি:)। মালিক মুসা রায়নার কর্তৃত্বকালে ১৫০১ খ্রিস্টাব্দে তিনি কাশ্মীরে আসেন (দ্বিতীয়বার) এবং কাশ্মীর থেকে হিন্দুদের উৎখাতে মুসা রায়নাকে অনুপ্রাণিত করেন। সমকালীন কাশ্মীরী ঐতিহাসিক দলিল তোহফাত-উল-আহবাব থেকে জানা যায় যে, মুসা রায়নার সহযোগিতায় পীর ইরাকীর শিষ্যরা প্রতিদিন দেড় থেকে দুই হাজার হিন্দুকে ধরে আনতো। তাদের পৈতা কেটে ফেলে পীর ইরাকী কলেমা পড়িয়ে, খতনা করিয়ে এবং গোমাংস খাইয়ে ছেড়ে দিতেন। এভাবে তারা চিরতরে মুসলমান হয়ে যেতো, কেননা একবার গোমাংস খেলে তাদের আর হিন্দুসমাজে ফিরে যাওয়া সম্ভব ছিল না।[3]

(৩) এগিয়ে যাওয়া যাক বিংশ শতাব্দে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে ব্রিটিশ মিত্রপক্ষের হাতে জার্মানি-তুর্কি জোটের পরাজয় ঘটলে তুর্কি খিলাফতের অস্তিত্ব হুমকির মুখে পড়ে। এতে ভারতবর্ষের মুসলমানরা ১৯১৯ খ্রিস্টাব্দে খিলাফত আন্দোলন শুরু করে, যার চূড়ান্ত উদ্দেশ্য ছিল ব্রিটিশদেরকে বিতাড়িত করে ভারতবর্ষকে তুর্কি খিলাফতের অংশ বানানো। ভারতবর্ষের প্রায় সব মুসলিম নেতা খিলাফত আন্দোলনে যোগ দেয়। দক্ষিণ ভারতের কেরালায় (মালাবর) কাদেরিয়া ঘরানার বিশিষ্ট সুফি সাধক পীর আলী মুসলিয়ারের নেতৃত্বে খিলাফত আন্দোলন সে অঞ্চলে সহিংস হয়ে উঠে। কেরালার খিলাফতপন্থীরা ইরানাদ ও ভাল্লুভানাদ অঞ্চলে খিলাফত প্রতিষ্ঠার ঘোষণা দেয় এবং ব্রিটিশ শাসন বিলুপ্ত ঘোষণা করে। মপলা নামে অভিহিত কেরালার মুসলিমরা ক্রমান্বয়ে ১৫,০০০ থেকে ৩৮,০০০ সৈন্যের সশস্ত্র বাহিনী গঠন করে। ১৯২১ খ্রিস্টাব্দের আগস্টে ব্রিটিশ সরকার খিলাফতপন্থীদের সহিংস কর্মকাণ্ডে বাধা দেওয়ার চেষ্টা করলে সহিংস সংঘর্ষ বাধে এবং আগস্টের শেষ অবধি ব্রিটিশ সরকার ইরানাদ ও ভাল্লুভানাদ তালুকে পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলে। দাঙ্গাকারী মলপারা পুলিশ ফাঁড়ি দখল করে, সরকারি অফিস-আদালত আক্রমণ ও ভাংচুর করে, রেল ও টেলিযোগাযোগ ব্যবস্থা বানচাল করে। ওদিকে হিন্দুরা সার্বিকভাবে খিলাফত আন্দোলন অপছন্দ করতো। ফলে তাদের কেউ কেউ মপলাদের খিলাফত আন্দোলন দমনে পুলিশের সাথে সহযোগিতা করে। এতে খিলাফতপন্থী মপলা বিদ্রোহীদের ক্রোধ স্থানীয় হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপর নিক্ষিপ্ত হয় এবং নির্মম সহিংসতায় রূপ নেয়, যা ছিল নিম্নরূপঃ

হিন্দু নারীদেরকে ধর্ষণ করা হয়; গণহারে হিন্দু নারী-পুরুষ-শিশুকে হত্যা করা হয়; জ্যান্ত অবস্থায় হিন্দুদের শরীরের চামড়া তুলে নেওয়া হয়; হাজার-হাজার হিন্দুকে মৃত্যুর মুখে ইসলামে গ্রহণে বাধ্য করা হয়; অর্ধমৃত হিন্দুদেরকে কুপে ছুড়ে ফেলে কুপ ভর্তি করা হয়; বহু হিন্দুকে জ্যান্ত পুড়িয়ে মারা হয়; হিন্দু ও খ্রিস্টানদের সব বাড়িঘর জ্বালিয়ে দেওয়া হয়; হিন্দু ধর্ম-মন্দির ধ্বংস ও অবমাননা করা হয়, বিশেষত মন্দিরের ভিতর গরু জবাই করে গরুর নাড়ি-ভূড়ি দেবদেবীর মূর্তির গলায় গড়িয়ে দিয়ে এবং গরুর মাথা মন্দিরের দেয়াল ও ছাদে ঝুলিয়ে দিয়ে; হিন্দু সন্যাসীদেরকে গরুর কাঁচা চামড়া পরিধান করতে বাধ্য করা হয়।[4]

হিন্দুদেরকে জোরপূর্বক মুসলিম বানানোর প্রক্রিয়া সম্পর্কে জানা যায় যে, মপলা বিদ্রোহীরা হিন্দুদের ওপর চড়াও হয়ে তাদেরকে মুসলমান হতে ও খেলাফত আন্দোলনে যোগ দিতে বাধ্য করার চেষ্টা করে। সম্মত না হলে তাদের মুখে গোমাংস ভরে দেয়, এবং আপনজন ও আত্মীয় স্বজনকে তাদের চোখের সামনে মারধর করে। এতেও মুসলমান হতে রাজী না হলে তাদেরকে হত্যা করে খণ্ড-বিখণ্ড করে কুপের মধ্যে নিক্ষেপ করে।[5]

(৪) এগিয়ে যাওয়া যাক ভারত-বিভাগ আন্দোলনে উত্তপ্ত ১৯৪৬ খ্রিস্টাব্দের বাংলায়। মুসলিমদের জন্য আলাদা রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে বাংলার মুসলমানেরা ১৯৪৬ খ্রিস্টাব্দের ১৬ আগস্ট সহিংস ‘ডাইরেক্ট অ্যাকশন’ সূচনা করে, যার ফলে কোলকাতা দাঙ্গায় মুসলমান ও অমুসলমানরা (হিন্দু ও শিখ) প্রায় অনুরূপ সংখ্যায় হতাহত হয়। এরপর নোয়াখালীর খ্যাতনামা পীর ও রাজনৈতিক নেতা গোমাল সারোয়ার কোলকাতা দাঙ্গার সকল দোষ হিন্দুদের ওপর চাপিয়ে দিয়ে স্থানীয় মুসলিমদেরকে হিন্দুদের বিরুদ্ধে সহিংসতায় অনুপ্রাণিত করে, যা বিখ্যাত নোয়াখালী দাঙ্গায় রূপ নেয়। একতরফা এ দাঙ্গায় মুসলিমরা হিন্দুদের বাড়িঘর জ্বালিয়ে দেয়, তাদের মন্দির ভেঙ্গে ফেলে, মূর্তি গুড়িয়ে দেয়, নারীদের ইজ্জ্বত লুট করে এবং সর্বোপরী নোয়াখালীর ৪ লাখ হিন্দুর কমপক্ষে ৯৫ শতাংশকে মৃত্যুর হুমকির মুখে ইসলাম গ্রহণে বাধ্য করে। মুসলমান বানানোর প্রক্রিয়া সম্পর্কে লাহোড় হাইকোর্টের জজ গি,এস, খোসলা লিখেছেন,

ধমান্তরিত হিন্দুদেরকে কলেমা পড়ানো হয়, তাদেরকে দিয়ে গরু জবাই করানো হয় এবং সে গরুর মাংস খাওয়ানো হয়।’[6]

বাংলায় হিন্দুদের ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাতের অস্ত্র হিসেবে গো-হত্যার ঐতিহ্যঃ নবী মুহাম্মদ (সঃ)-র অনুকরণে বাংলায় পা ফেলেই বখতিয়ার খিলজি বহু মন্দির ধ্বংস করেন বলে উল্লেখ করা হয়েছে মিনহাজ সিরাজের ‘তাবাকৎ-ই-নাসিরী’ গ্রন্থে।[7] বাংলার সুলতানদের মাঝে মন্দির ধ্বংস করার এ ঐতিহ্য বহাল থাকে মুর্শিদ কুলী খানের শাসনকাল (১৭১৭-১৭২৭ খ্রিস্টাব্দ) পর্যন্ত, কেবল ইসলামত্যাগী উদারনৈতিক আকবরের আমল (১৫৫৬-১৬০৫ খ্রিস্টাব্দ) বাদ দিয়ে। মন্দির ও মূর্তি ছাড়া গরু ছিল হিন্দুদের কাছে আরেক পবিত্রতার প্রতীক। হিন্দুদের ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাতের উদ্দেশ্যে গো-হত্যা ও হিন্দুদেরকে জোর করে কিংবা ছলে-বলে গোমাংস খাওয়ানোর এ প্রবণতা বাংলায় মুসলিমদের মাঝে তাদের আগমনের সূচনা থেকেই বিদ্যমান ছিল বলে মনে হয়, নোয়াখালী দাঙ্গাতেই তা প্রথম ঘটেনি। প্রচলিত কাহিনী থেকে জানা যায় যে, সিলেটের সর্বশেষ হিন্দু রাজা গৌড়গোবিন্দের সাথে মুসলমানদের সঙ্ঘাত বেধেছিল গো-হত্যাকে কেন্দ্র করে (১৩০৩ খ্রিস্টাব্দে)।

সুলতান গিয়াসুদ্দিন আজম শাহ (রাঃ ১৩৯২-১৪১১ খ্রিস্টাব্দে) বাংলার সুফি সম্প্রদায়ের প্রতিবাদের মুখে সরকারি চাকুরি থেকে হিন্দুদেরকে বরখাস্ত করেন (এসময়ে বাংলায় আগত চীন সরকারের দূতেরা সুলতানের দরবারে একজন অমুসলিম কর্মচারীও দেখতে পান নি)। সম্ভবত এর ফলে হিন্দুদের মাঝে সৃষ্ট অসন্তোষের সুযোগ নিয়ে হিন্দু জমিদার গণেশ বিদ্রোহ করে ১৪১৪ খ্রিস্টাব্দে বা ১৪১৫ খ্রিস্টাব্দে বাংলার ক্ষমতা দখল করেন। হিন্দু গণেশের ক্ষমতায় আরোহণে ক্রুদ্ধ হয়ে বাংলার ধার্মিক মুসলিম সম্প্রদায়গুলো, বিশেষত সুফি সম্প্রদায়, ক্রুদ্ধ হয়ে উঠে। তাদের অনুরোধে অল্পদিনের মধ্যেই বর্তমান উত্তর প্রদেশের জৌনপুরের সুলতান ইব্রাহিম শর্কী বাংলা আক্রমণ করে গণেশকে পরাজিত করেন। এমতাবস্থায় তৎকালীন বাংলার শ্রেষ্ঠ সুফি সাধক নূর কুতবে আলমের মধ্যস্থতায় গণেশের ১৪-বছর-বয়সী নাবালকপুত্র যদু ক্ষমতার লোভে হিন্দুধর্ম ত্যাগ করে ইব্রাহিম শর্কীর পক্ষ নেয় এবং জালালুদ্দিন মুহাম্মদ নাম ধারণ করে বাংলার সুলতান হন। সুলতান জালালুদ্দিন বাংলার হিন্দুদের ওপর চরম অত্যাচার চালান – হিন্দুদেরকে শুধু ইসলাম গ্রহণ, নইলে মৃত্যু‘র শর্ত দেন, যার ফলে ব্যাপক সংখ্যক হিন্দু তার আমলে (১৪১৬-১৪৩৩ খ্রিস্টাব্দে) ইসলাম গ্রহণ করে এবং বাকীরা আসামের জঙ্গলে আশ্রয় নিয়ে তাদের ধর্ম ও জীবন রক্ষা করে। ক্ষমতার লোভে যদু হিন্দুধর্ম ত্যাগের সিদ্ধান্ত নিলে কিছু ব্রাহ্মণ তাকে হিন্দু ধর্মে ফিরিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করেছিল। সুলতান হওয়ার পর তিনি সেসব ব্রাহ্মণদেরকে যন্ত্রণামূলক শাস্তি দেন এবং গোমাংস খাইয়ে তাদেরকে ধর্মচ্যুত করেন।[8]

বাংলায় হাবশী রাজত্বের প্রতিষ্ঠাতা নাসিরুদ্দিন মাহমুদ শাহের রাজত্বকালে (~১৪৩৫-১৪৫৯ খ্রিস্টাব্দে) যশোর-খুলনা অঞ্চলে সুলতানের প্রতিনিধি হন সুবিখ্যাত যোদ্ধা ও সুফি সাধক পীর খান জাহান আলী। খান জাহান আলীর অধীনে হিন্দুদের নানান কৌশলে গোমাংসের কবলে ফেলে মুসলমান বানানোর প্রমাণ পাওয়া যায়। খান জাহান আলীর সভায় নিযুক্ত হন এক কুলীন ব্রাহ্মণ গোবিন্দলাল রায় বা গোবিন্দ ঠাকুর। সমকালে জনৈক নীলকান্ত রচিত ‘ঘটকদিগের পুঁথি’ থেকে জানা যায়, গোবিন্দলাল এক রূপবতী মুসলিম নারীর রূপে মুগ্ধ হয়ে ও উজির হওয়ার লোভে ইসলাম গ্রহণ করে –

পূর্বেতে আছিল সেও কুলীনের নাতি।

মুসলমানী রূপে মজে হারাইল জাতি।।

পীর আলী নাম ধরে পীরাল্যা গ্রামে বাস।

যে গাঁয়েতে নবদ্বীপের হইল সর্বনাশ।।

সুবিধা পাইয়া তাহির হইল উজীর।

মুসলিম হয়ে গোবিন্দলাল তাহের পীরালী (পীর আলী মুহাম্মদ তাহের) নামগ্রহণ করেন এবং খান জাহান আলী তাকে উজির পদে উন্নীত করেন। এরপর তাহের পীরালী নানান ছলে ও কৌশলে বহু হিন্দুকে মুসলমান বানান, যারা পীরালী সম্প্রদায়ের অংশ হয়। ‘ঘটকদিগের পুঁথি’তে তাহের পীরালীর হিন্দুদেরকে মুসলমান বানানোর এক ঘটনা বর্ণিত হয়েছে এভাবে –

আঙ্গিনায় বসে আছে উজির তাহির।

কত প্রজা লয়ে ভেট করিছে হাজির।।

রোজার সে দিন পীর উপবাস ছিল।

হেনকালে একজন নেবু এনে দিল।।

গন্ধামোদে চারিদিক ভরপুর হইল।

বাহবা বাহবা বলে নাকেতে ধরিল।।

কামদেব জয়দেব পাত্র দুইজন।

বসে ছিল সেইখানে বুদ্ধি বিচক্ষণ।।

কি করেন কি করেন বলিলা তাহিরে।

ঘ্রাণেতে অর্ধেক ভোজন শাস্ত্রের বিচারে।।

অর্থাৎ এক রোজার দিনে উজির পীরালী প্রজাদের কাছে থেকে খাজনা গ্রহণ করছিলেন। এসময় একজন লেবু এনে উজিরকে দেয়। সে লেবুর সুগন্ধে চারিদিক ভরপুর হয়ে উঠায় রোজাদার উজির পীরালী নাক চেপে ধরে। এতে সভায় উপস্থিত দুই ব্রাহ্মণ ভাই, কামদেব ও জয়দেব, উজিরকে বলেন – নাক ধরে কী লাভ? শাস্ত্রের বিচারে ঘ্রাণেই অর্ধভোজন। অর্থাৎ উজিরের রোজা ভঙ্গ হয়ে গেছে। ব্রাহ্মণ ভ্রাতৃদ্বয়ের কথায় উপহাসের সুর অনুভব করে উজির তাহের পীরালী রাগে অস্থির হয়ে উঠেন এবং তাদেরকে উচিত শিক্ষা দেওয়ার জন্য নিম্নোক্ত ব্যবস্থা করেন –

কথায় বিদ্রূপ ভাবি তাহির অস্থির।

গোঁড়ামি ভাঙ্গিতে দোহের মনে কৈলা স্থির।।

দিন পরে মজলিস করিল তাহির।

জয়দেব কামদেব হইল হাজির।।

দরবারের চারিদিকে ভোজের আয়োজন।

শত শত বকরী আর গো-মাংস রন্ধন।।

পলান্ডু রশুন গন্ধে সভা ভরপুর।

সেই সভায় ছিল আরও ব্রাহ্মণ প্রচুর।।

নাকে বস্ত্র দিয়া সবে প্রমাদ গণিল।

ফাঁকি দিয়া ছলে বলে কত পালাইল।।

কামদেব জয়দেব করি সম্বোধন।

হাসিয়া কহিল ধূর্ত তাহির তখন।।

জারি জুরি চৌধুরী আর নাহি খাটে।

ঘ্রাণে অর্ধেক ভোজন শাস্ত্রে আছে বটে।।

নাকে হাত দিলে আর ফাঁকি তো চলে না।

এখন ছেড়ে ঢং আমার সাথে কর খানাপিনা।।

উপায় না ভাবিয়া দোহে প্রমাদ গণিল।

হিতে বিপরীত দেখি শরমে মরিল।।

পাকড়াও পাকড়াও হাঁক দিল পীর।

থতমত খেয়ে দোহ হইল অস্থির।।

দুইজনে ধরি পীর খাওয়াইল গোস্ত।

পীরালি হইল তাঁরা হইল জাতি ভ্রষ্ট।।

কামাল জামাল নাম হইল দোহার।

ব্রাহ্মণ সমাজে পড়ে গেল হাহাকার।।

তখন ডাকিয়া দোহে আলী খানজাহান।

সিঙ্গির জায়গীর দিল করিতে বাখান।।

অর্থাৎ কামদেব ও জয়দেবকে উচিত শিক্ষা দিতে উজির তাহির পীরালী এক মজলিশের আয়োজন করে হিন্দুদের দাওয়াত দিলেন। সেখানে কামদেব, জয়দেব ও অন্যান্য বহু ব্রাহ্মণ হাজির হলো। এরপর পাশের রান্নাঘরে গোমাংস রান্না চাপিয়ে দেওয়া হলো এবং মাংসের গন্ধে সভা ভরপুর হয়ে গেলে উপস্থিত ব্রাহ্মণেরা নাক চেপে ধরে পালিয়ে গেল। সভায় রয়ে গেল নাক-চেপে ধরা উজীরের কর্মচারী কামদেব ও জয়দেব। তাদেরকে তাহির পীরালী বললেন, শাস্ত্রমতে ঘ্রাণেই যেহেতু অর্ধভোজন, নাক চেপে ধরে ফাঁকি দেওয়ার চেষ্টা বৃথা; বরং আমাদের সাথে যোগ দিয়ে গোমাংস খেয়েই ফেল। এই বলে তাহির পীরালী ‘পাকড়াও পাকড়াও’ (ওদেরকে ধর) হাক তুললেন এবং ব্রাহ্মণ ভাতৃদ্বয়কে পাকড়াও করে পীর তাহের জোরপূর্বক গোমাংস খাইয়ে দিলেন। ওদের জাতি নষ্ট হয়ে গেলো, ওরা হিন্দু সমাজ থেকে বিচ্যুত হলো, এবং কামাল ও জামাল নামধারণ করে পীরালী মুসলিম সম্প্রদায়ের অংশ হয়ে গেল। মুসলমান হওয়ার কারণে খান জাহান আলী তাদেরকে সিঙ্গির অঞ্চলের জায়গীর দান করে পুরস্কৃত করলেন।[9]

উল্লেখ্য, অনুরূপ প্রক্রিয়ায় গোমাংস খাইয়ে দিয়ে খান জাহান আলী গোবিন্দলাল রায়কে মুসলমান বানিয়েছিলেন বলে তথ্য পাওয়া যায়। একদিন রোজাদার খান জাহানকে ফুলের ঘ্রাণ নিতে দেখে ঠাট্টার ছলে গোবিন্দলাল বলেন, ‘ঘ্রাণেই অর্ধভোজন’। এতে খান জাহান আলী অসন্তুষ্ট হন এবং গোবিন্দলালকে উচিত শিক্ষা দিতে একদিন গোমাংস রান্নার আয়োজন করে তাকে ডেকে পাঠান। এসে উপস্থিত হতেই গোবিন্দলালের নাকে গোমাংসের গন্ধ ঢুকে যায়। এতে তিনি নাক চেপে ধরলে খান জাহান আলী বলেন, ঘ্রাণেই যেহেতু অর্ধভোজন সেহেতু তোমার জাত নষ্ট হয়ে গেছে। কাজেই বরং এই খানা খেয়ে মুসলমান হয়ে যাও। এভাবে গোমাংস খেয়ে ব্রাহ্মণ গোবিন্দলাল মুসলমান হয়ে যায়।[10]

বাংলায় মুসলিম শাসনের প্রথম ৩’শ বছরের বিস্তারিত ঐতিহাসিক তথ্য পাওয়া মুশকিল। এসময়ে বাংলা তথা ভারতবর্ষের হিন্দুদের মাঝে ঐতিহাসিক তথ্যাদি লিপিবদ্ধকরণের প্রবণতা ছিল না। স্থানীয় মুসলিমরাও সমকালীন ঐতিহাসিক কাহিনী লিপিবদ্ধ করে নি। এসময়ের বাংলার কিছু ঐতিহাসিক তথ্য পাওয়া যায় মূলত দিল্লী সুলতানের প্রাসাদে অবস্থানকারী ঐতিহাসিকদের লিখিত গ্রন্থ থেকে। তারা লিখে গেছে প্রধানত বাংলার সুলতানের যুদ্ধ-বিগ্রহের কাহিনী। হিন্দু সমাজ ও সংস্কৃতির ওপর মুসলিম শাসনের প্রভাব তাদের লেখায় স্থান পায় নি। তবে এর কিছুটা নমুনা পাওয়া যায় পঞ্চদশ শতাব্দীর শেষ দশকে হোসেন শাহী রাজবংশের প্রতিষ্ঠালগ্নে, যখন বাংলায় শ্রীচৈতন্য দেবের উদয় ঘটে এবং পর্তুগিজরাও বাংলায় পদার্পণ করে। সময়সাময়িককালে লিখিত শ্রীচৈতন্য’র বেশ কয়েকটি জীবনী ও পর্তুগিজদের লেখা থেকে সেকালীন বাংলার রাজনীতি ও সমাজ-সংস্কৃতির কিছুটা বিস্তারিত তথ্য পাওয়া যায়।

হোসেন শাহী বংশের প্রতিষ্ঠাতা আলাউদ্দিন হোসেন শাহ (রাঃ ১৪৯৩-১৫১৯ খ্রিস্টাব্দে) তুর্কিস্তান কিংবা আরব দেশ থেকে পিতার সাথে বাংলায় এসেছিলেন। ছোটকালে তিনি এক হিন্দু ব্রাহ্মণের বাড়িতে কাজ করতেন। এরপর ক্ষমতা দখল করে সুলতান হওয়ার পর কৃতজ্ঞতাস্বরূপ তিনি চাঁদপাড়া গ্রামটিকে ওই ব্রাহ্মণের কাছে মাত্র এক আনা খাজনায় জায়গীর দেন। বোঝা যায় ব্রাহ্মণ ভদ্রলোকটি সুলতানের বাড়িতে আসা-যাওয়া ও খাওয়া-দাওয়া করতেন। এবং সুযোগ বুঝে সুলতান স্ত্রীর সাথে যোগসাজশে একদিন গোমাংস খাইয়ে তার জাত নষ্ট করেন।

এ সময়ে চৈতন্যের অনুকরণে হিন্দু সমাজে কীর্তন জনপ্রিয়তা পেতে শুরু করে। নবদ্বীপে কীর্তন চর্চার খবর পেলে কাজী এতে ক্রুদ্ধ হন এবং কীর্তনের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা জারী করেন। নিষেধাজ্ঞা ভঙ্গকারীদেরকে তিনি জাত নষ্ট করার হুমকি দেন। অবশ্য জাত নষ্ট করা হতো গোমাংস খাইয়ে দিয়ে। চৈতন্যচরিতামৃত থেকে জানা যায় যে, হোসেন শাহ’র আমলে বেনাপোলের জমিদার রামচন্দ্রের খাজনা বাকী পড়লে সুলতানের উজীর রামচন্দ্রের বাড়ি দখল করে তার দুর্গামন্দিরে গরু জবাই করে তিন ধরে রান্না করান।[11]

গোমাংস খাইয়ে হিন্দুদের জাত নষ্ট করার চলমান প্রবণতাঃ

বিদেশে পড়াশুনাকালীন এক বড় ভাইয়ের দেশ থেকে কোরবানীর গোমাংস আনিয়ে এক শিখ বন্ধুকে খাওয়ানোর কাহিনী আগেই উল্লেখ করেছি (১৯৯২ খ্রিস্টাব্দের ঘটনা)। এজাতীয় আরও কিছু কাহিনীর অভিজ্ঞতা আছে। তার আগে ১৯৯০ খ্রিস্টাব্দ থেকে ৪টি অমুসলিম দেশে বসবাসকালে আমার কিছু অভিজ্ঞতা উল্লেখ করছি। এ ২৭ বছরে প্রধানত অমুসলিম বন্ধু, সহপাঠী ও সহকর্মীদের সাথে উঠাবসা। অথচ আজ পর্যন্ত তাদের কেউ-ই কোনদিন আমাকে শুকরের মাংস খাওয়ার দাওয়াত দেয় নি। বরং কোন খাবারে শুকরের মাংস থাকতে পারে, সে ব্যাপারে তারা আমাকে বার বার সতর্ক করেছে। যেমন একদিন ক্যান্টিনে বসে একটা কারি-পাফের (সিঙ্গারা) সাথে চা খাচ্ছি। এসময় এক সহপাঠী এসে যোগ দিল। আমার হাতে লাঞ্চিয়ন মিটের কারি-পাফ দেখে বলে উঠল, “এটা কী খাচ্ছ? লাঞ্চিয়ন মিটে শুকরের মাংস থাকে।” আমার জানা ছিল না। ওই কারি-পাফ আগে অনেকবার খেয়েছি এবং সেই থেকে বন্ধ করে দিলাম। ১৯৯৭ খ্রিস্টাব্দে জার্মানি যাই মাস দুই-এর জন্য ট্রেনিং-এ। কার্লশ্রুয়া গবেষণা সেন্টারে এক ল্যাবে কাজ করি। ল্যাবের সাথীরা প্রথমদিন ক্যান্টিনে নিয়ে গিয়ে কোন কোন খাবারে শুকরের মাংস থাকে সেটা আমাকে জানিয়ে দিল। সিংগাপুরে পড়াশুনা ও চাকুরি কালে দুপুরে লাঞ্চের জন্য ল্যাবের সহপাঠী-সহকর্মীদের সাথে ক্যান্টিনে যাওয়া হতো। তাদের কেউ শুকরের মাংসসহ খাবার কিনলে অন্তত প্রথমবার অনেকটা অপরাধীর সুরে বলবে যে, তার খাবারে শুকরের মাংস আছে, কাজেই একসাথে বসতে আমার আপত্তি আছে কিনা।

এ ঘটনাগুলো বলার উদ্দেশ্য হলো, মুসলমানেরা সব মাংস খায় কিন্তু শুকরের মাংস খায় না, যা ভিন্ন ধর্মীয়দের কাছে খুবই ফালতু মনে হবে। কিন্তু এটা যেহেতু মুসলমানদের ধর্মীয় প্রথা, কাজেই সে প্রথার প্রতি সম্মান দেখাতে তারা কোন মুসলমানকে শুকরের মাংস খাওয়ার প্রস্তাব-তো দেবেই না, বরং শুকরের মাংসজনিত খাবার সম্পর্কে তাদেরকে পূর্বেই সতর্ক করে দেবে। এর ব্যতিক্রম অবশ্যই আছে, তবে তা খুবই বিরল। ফেসবুকে উদার মনের এক বাঙালি মুসলমানকে তার ইউরোপিয় বন্ধু কর্তৃক অজান্তে শুকরের মাংস খাইয়ে দেওয়ার ঘটনা আমার নজরে পড়েছে। কিন্তু এমন কাজ সে মুসলমানদেরকে কতটা মানসিক কষ্ট দেবে, তা জানা থাকলে ইউরোপিয় বন্ধুটি সম্ভবত কাজটি করতো না। অন্যথায়, ওই লোক এক চরম বদমাস।

অথচ মুসলিমদের মাঝে এর পুরো বিপরীত প্রবণতা বিদ্যমান। ছোটকালে ছলে-বলে-কৌশলে হিন্দুদেরকে গোমাংস খাওয়ানোর নানান কাহিনী শুনেছি। হিন্দু পাড়ার পাশে বড় হয়েছি। সমবয়সী হিন্দু ও মুসলিম ছেলে-মেয়েদের মাঝে বন্ধুত্ব দেখেছি। সে বন্ধুত্বের ছলে সুযোগ পেলেই হিন্দু বন্ধুদেরকে কলে-কৌশলে গোমাংস খাইয়ে দিয়ে মুসলমান বানিয়ে ফেলার নানান কাহিনী কানে এসেছে। যদিও ব্যক্তিগতভাবে এমন কপট চিন্তা আমার মাথায় কোনদিন আসে নি, কিন্তু এসব কাহিনী তখন আমাকে অবাক করেনি, বরং শুনে কিছুটা মজা পেতাম। এমন কি বিদেশে গিয়েও মুসলমান বন্দুদের এ জঘন্য কর্ম থেকে রেহাই পায় না কিছু হিন্দু। ১৯৯৬ খ্রিস্টাব্দের কথা। সিংগাপুরে গিয়েছি পড়াশুনা করতে। সিংগাপুরে কর্মরত এলাকার ৬-৭ জন ছেলে একসাথে থাকতো। ওদের ওখানে যেতাম মাঝে মাঝে খোজ-খবর নিতে। ওদের এক হিন্দু বন্ধু, নাম ‘বিদ্যুৎ’, মাঝে মাঝে ছুটির দিনে আড্ডা মারতে আসতো। বিদ্যুতের সাথে আমারও কিছুটা বন্ধুত্ব হয়। একবার লম্বা বিরতির পর এক ছুটির দিনে ওদের সাথে দেখা করতে গেছি। জিজ্ঞেস করলাম, বিদ্যুৎ আসবে কিনা। খুব উল্লসিত মনে ওরা জানালো – গত সপ্তাহে এসেছিল, রাতে ওরা কৌশলে ওকে গোমাংস খাইয়ে দিয়েছে; তারপর পাকড়াও করে ‘কলেমা’ পড়িয়ে মুসলমান বানিয়ে ছেড়ে দিয়েছে। এরপর বিদ্যুৎ আর কোনদিন ওদের সাথে দেখা করতে আসে নি।
 
মোটকথা

ভারতবর্ষে পা ফেলেই মুসলমানরা দেখতে পায় যে, মন্দির, মূর্তি ও গরু স্থানীয় জনগোষ্ঠীর প্রধান ধর্মীয় প্রতীক। বিধর্মীদের ধর্মীয় প্রতীকে আঘাত হানার সুন্নতি ঐতিহ্য চর্চার লক্ষে শুরুথেকেই মুসলিমরা হিন্দুদের মন্দির ধ্বংস করেছে, মূর্তি গুড়িয়ে দিয়েছে এবং গরু হত্যা করেছে। উল্লেখ্য, মধ্যযুগে বাংলার যেসব অঞ্চলে মুসলিম শাসন সুপ্রতিষ্ঠিত হয়েছিল, সেসব অঞ্চলে ব্রিটিশ-পূর্ব আমলের কোন মন্দির খুঁজে পাওয়া কঠিন। এগুলোর বেশিরভাগ গুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে, এবং অনেকক্ষেত্রে মন্দিরের মাল-মসলা দিয়ে মসজিদ নির্মাণ করা হয়েছে। অল্প কিছু মন্দিরের ক্ষত-বিক্ষত ধ্বংসাবশেষ দেখতে পাওয়া যায়। অথচ পশ্চিমবঙ্গের মল্লভূমে, বিশেষত এর রাজধানী বিষ্ণুপুরে, অনেকগুলো সুদৃশ্য ব্রিটিশ-পূর্ব মন্দির আজও দাঁড়িয়ে আছে মধ্যযুগীয় হিন্দুধর্মীয় স্থাপত্যের নিদর্শন হিসেবে। এ ভিন্নতার কারণ, মল্লভূমে মুসলিম শাসন প্রতিষ্ঠিত হতে পারে নি, বরাবরই হিন্দু রাজাগণ প্রায় স্বাধীনভাবে রাজত্ব করেছেন। যদিও বলা হয় মুসলমানদের হিন্দু মন্দির ধ্বংসকরণ ব্রিটিশ-পূর্ব আমল পর্যন্ত বিদ্যমান ছিল, তা আসলে সঠিক নয়। আজও বাংলাদেশে সামান্য অজুহাতেই হিন্দু মন্দির আক্রমণ, মূর্তি চুরমার করা হয়। এগুলো বাংলায় মুসলিম আমলের শুরু থেকে হিন্দু ধর্মের ওপর আঘাত হানার চিরাচরিত ঐতিহ্যেরই বহমানতা মাত্র।

গোমাংস  প্রিয়তাঃ  একইভাবে, মুসলমানদের মাঝে আজ যে গোমাংস সবচেয়ে প্রিয়, কিংবা ছাগল, ভেড়া, উটের চেয়েও গরু কোরবানী দেওয়ার খায়েস ইত্যাদিও ভারতবর্ষে মুসলমানদের আগমণের সূচনা থেকেই হিন্দুদের ধর্মীয় প্রতীকে আঘাত করার ঐতিহ্যের বহমানতামাত্র। হিন্দুদের ধর্মীয় অনুভূতিকে আঘাতের লক্ষ্যে গো-হত্যার পাশাপাশি মুসলমানরা গোমাংসকে হিন্দুদেরকে মুসলমান বানানোর জন্য মোক্ষম হাতিয়ার হিসেবেও ব্যবহার করেছে। মুসলমানরা দেখতে পায় যে, দেবী মাতা তুল্য গরুর মাংস একবার খেলে হিন্দুরা হিন্দুধর্ম ও সমাজ থেকে বিচ্যুত হয়েছে এবং চিরতরে মুসলমান হয়েছে। ফলে হিন্দুদেরকে মুসলমান বানানোর জন্য গোমাংস খাইয়ে দেওয়ার মতো মোক্ষম হাতিয়ার আর ছিল না। ফলে, হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গায় যখনই সম্ভব হয়েছে তখনই হিন্দুদেরকে ধরে গণহারে গোমাংস খাইয়ে দেওয়া হয়েছে। হিন্দুরা মুসলমানদের সাহচর্যে এলেই নানা ছলে-ছুতোয়, কলা-কৌশলে তাদেরকে গোমাংস খাইয়ে দেওয়া হয়েছে, আজও হচ্ছে। মুসলিম শাসনামলে কোন হিন্দু কোন মুসলমানকে সামান্য অসন্তুষ্ট করলেই সে হিন্দুকে গোমাংস খাইয়ে জাতি নষ্ট করার চেষ্টা চালানো হয়েছে, যার ফলে স্ত্রী সন্তান-সহ সে হিন্দু মুসলমান হয়ে গেছে। হিন্দুরা খাজনা দিতে ব্যর্থ হলে তাদের ওপর চড়াও হয়ে নির্যাতন করা হয়েছে এবং সাধারণত গোমাংস খাইয়ে জাত নষ্ট করা হয়েছে। হিন্দুদেরকে এভাবে গরুর মাংস খাইয়ে দেওয়া মুসলিমদের সংখ্যা বৃদ্ধিতে সহায়ক হয়েছে। মুসলমানদের সংস্পর্শে এলেই গোমাংস খাইয়ে দেওয়ার ভয়ে একসময়ে হিন্দুরা মুসলমানদের থেকে সর্বোচ্চ দূরত্ব বজায় রাখার চেষ্টা করেছে, মুসলমানদের ছোয়া কোন কিছুই খায় নি। এতে হিন্দু সমাজে একদিকে গোঁড়ামি বেড়েছে, অন্যদিকে এরূপ কড়াকড়ির কারণে হিন্দু সমাজের বড় অংশ ইসলামে ধর্মান্তর থেকে বেঁচে গেছে, যা মুসলমানদের দখলকৃত অন্য অঞ্চলে প্রায় বিরল।

গো-কোরবানীর   খায়েসঃ   গরু কোরবানীর প্রতি খায়েশের ব্যাপারে বলা আবশ্যক যে, আল্লাহর উদ্দেশে কোন প্রাণীকে যদি বলি (কোরবানী) দিতেই হয়, তাহলে হিন্দুদের দেবী মাতা গরুকে কোরবানী দেওয়ার চেয়ে শ্রেয় আর কী হতে পারে! কাজেই ইসলামের নবী ভেড়া বা উট কোরবানী দিলেও বাংলার তথা ভারতবর্ষের মুসলমানদের কাছে গরু কোরবানী সবচেয়ে প্রিয় হয়ে উঠেছে। ইসলামের জন্ম হয়েছে অন্য সব ধর্মকে আঘাত করার, পৃথিবী থেকে অন্য সব ধর্ম নির্মূল করার, উদ্দেশ্যে (কোরান ৮:৩৯, ২:১৯৩)। কাজেই বিধর্মীদের ধর্মে আঘাত (গরু কোরবানী) নবীর সুন্নত (ভেড়া বা উট কোরবানী) পালনের চেয়েও শ্রেয়। গরু বধ যেহেতু হিন্দুদের অনুভূতিতে আঘাত হানার উদ্দেশ্যে, কাজেই জবাই প্রক্রিয়া এমন হতে হবে, যাতে হিন্দুদের অনুভূতিতে আঘাতের তীব্রতা হয় সর্বোচ্চ। তাই তো খাজা মইনুদ্দিন চিশতি আজমীরের সবচেয়ে বড় মন্দিরটির সামনে গোবধ করে কাবাব বানিয়ে খেতেন, সুলতান হোসেন শাহের আমলে বেনাপলের জমিদার রামচন্দ্রের খাজনা বাকী পড়লে শাস্তি স্বরূপ তার দুর্গামন্দিরে গরু জবাই করে তিন ধরে রান্না করা হয়, কিংবা কেরালায় খিলাফতপন্থীদের দাঙ্গার সময় মন্দিরে গরু জবাই করে গরুর নাড়িভুঁড়ি মূর্তির গলায় জড়িয়ে দেওয়া হয়, গরুর মাথা মন্দিরের দেয়াল ও ছাদে ঝুলিয়ে দেওয়া হয়। অনুরূপভাবে, ২০১৫ সালে বাংলাদেশে জিহাদের জোয়ার যখন তুঙ্গে, তখন আমরা দেখি কোরবানী ঈদের সময় মুসলমানরা এক হিন্দু মন্দিরের সামনে গরু কোরবানী দিচ্ছে; আরেক ঘটনায় কোরবানীকৃত গরুর নাড়িভুড়ি এক মন্দিরের সামনে ছুড়ে ফেলেছে।

সবশেষে, ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা ও ভাবনা থেকে দু’টো অপ্রাসঙ্গিক কথা যোগ করতে চাই। মানুষে মানুষে শান্তিপূর্ণ সহবাস খুবই কঠিন বিষয়। অনেক ছাড় দিতে হয়। স্নাতকোত্তর পড়াশুনাকালীন দুই হিন্দু সহপাঠীর সাথে থাকতাম প্রায় ২ বছর। তাদের একজন অন্ধ্র প্রদেশের শাকাহারী হিন্দু। ওই ২ বছর বাসায় গরুর মাংস আনা তো দূরের কথা, কোন মাছ-মাংসও আনি নি। ভার্সিটির ক্যান্টিনে দুপুরের খাবার খাওয়ার সময় মাছ, মাংস যা ইচ্ছে খেয়ে নিতাম। শাকাহারী সহপাঠী খুবই আফসোস করতো যে, তার কারণে আমাকে এতটা ছাড় দিতে হচ্ছে। ছাড় যে দিতে হচ্ছে এমন প্রশ্ন আমার মাথায় চাড়া দেয় নি। ছাড় দিয়ে থাকলেও বিনিময়ে সারা জীবনের জন্য দু’জনে চমৎকার বন্ধু হয়ে গেছি, যার মূল্য অনেক বেশি। বিগত ১১ বছর বাড়িতে ৩-৪ ভাবধারার লোকের সাথে উঠা-বসা – কেউ খ্রিস্টান, কেউ পৌত্তলিক, কেউ কট্টর শাকাহারী, কেউ মডারেট শাকাহারী নাস্তিক। বাসার খ্রিস্টান সদস্যরা পৌত্তলিক ধর্মের উদ্দেশ্যে উৎসর্গকৃত খাবারও খাবে না; আবার কট্টর শাকাহারী সদস্যরা মাছ-মাংস রান্না করা পাতিলের রান্নাও খাবে না। এতকিছু বাছ-বিচারের ঝালেমা মাথায় নিয়েও এতগুলো বছর এক বাড়িতে থেকে, একই রান্নাঘরের খাবার খেয়ে, কাটিয়ে দিয়েছি এবং আরও কাটবে। ছাড় দিয়েছি কি না দিয়েছি, সে প্রশ্ন কখনো মাথায় ঢুকে নি। ঢুকলেও এত বিচিত্র পছন্দ-অপছন্দের মানুষগুলো যে এতটা আপন হয়ে উঠেছে, যেটা খাবার-দাবারে যে কোন ছাড়ের চেয়ে অনেক বড় অর্জন।

ধর্মীয়, সাংস্কৃতিক, নৈতিক ও অভ্যাসগত আচার-রীতি ও পছন্দ-অপছন্দ মানুষের কাছে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। সেগুলোর প্রতি শ্রদ্ধা দেখানোর চেষ্টা শান্তি ও সন্তুষ্টি পূর্ণ সহবাসের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ, বিশেষত আজকের এ বিশ্বায়নের যুগে, যখন অনেক সমাজই বহুসাংস্কৃতিক, বহুধার্মিক ও বহুজাতিক। এসব আচার-রীতি ও পছন্দ-অপছন্দের অনেক কিছুই অযৌক্তিক হতে পারে। সে ব্যাপারে পারস্পরিক শ্রদ্ধাপূর্ণ যৌক্তিক আলোচনা-সমালোচনা হতে পারে, কিন্তু কারও আচার-রীতি ও পছন্দ-অপছন্দকে পদদলিতকরণ অশান্তি, অসন্তুষ্টি, সঙ্ঘাত, এমনকী রক্তপাতের পথ সুগম করে। ভারতবর্ষীয় অঞ্চলে গো-হত্যা বিষয়ে বলা আবশ্যক যে, কোন মসজিদের সামনে শুকর জবাই করা মুসলমানদের কাছে যতোটা ব্যথাদায়ক ও উস্কানিমূলক, মন্দিরের সামনে গরু জবাই হিন্দুদের কাছে তার চেয়ে অনেকগুণ বেশী ব্যথাদায়ক ও উস্কানিমূলক। কেননা শুকর মুসলমানদের কাছে এক ঘৃণ্য প্রাণীমাত্র, যার প্রাণহরণ কোন ব্যথার কারণ নয়। কিন্তু হিন্দুদের কাছে গরু মা বা দেবী মাতা বিবেচিত, এবং তাদের কাছে গরুর মর্যাদা মুসলমানদের কাছে তাদের কোন নবী বা মইনুদ্দিন চিশতির মতো কোন পূজনীয় পীরের মর্যাদার সমতুল্য।

---

[লেখাটি ১৬ সেপ্টেবার ২০১৭ তে প্রথম প্রকাশিত হয়েছিল]

সূত্র সমূহঃ

[1] Chachnamah – An Ancient History of Sindh – https://www.scribd.com/document/23239620/Chachnamah-An-Ancient-History-of-Sindh, আরও দেখুন Elliot and Dowson, The History of India as Told by Its Historians (Mohammedan Period), I:158

[2] Sharma SS, Caliphs and Sultan, Rupa, New Delhi, p. 200

[3] KN Pundit (translator), Baharistani Shahi, p. 105–106; Also see, Kashmiri Society and Shamsuddin Iraqi’s program of Islamization, Dr. Ejaz Husain Malek, https://www.imamreza.net/eng/imamreza.php?id=13104

[4] Banninga JJ (1923) The Moplah Rebellion of 1921, in Moslem World 13, p. 379–87; Nair G & Bahadur D (1922), Moplah

Rebellion 1921,  p. 8; Hamid A (1967)  Muslim Separation in India – A brief survey, 1858-1947, p. 159

[5] Hamid, p. 158-159

[6] G.S. Khosla, Stern Reckoning : A Survey of the Events leading up to and following the Partition of India,  p. 72

[7] মজুমদার, আর, সি, বাংলা দেশের ইতিহাস – মধ্যযুগ, জেনারেল প্রিন্টার্স, কলিকাতা (২০০৩ প্রিন্ট), পৃঃ ৩

[8] মজুমদার, বাংলা দেশের ইতিহাস – মধ্যযুগ, পৃঃ ৫২

[9] তাহির পীরালী সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে দেখুন, নাসির হেলাল, সেরা মুসলিম মনীষীদের জীবনকথা , ১ম খণ্ড, অধ্যায় হযরত পীর আলী মুহাম্মদ তাহির (র.)।

[10] আবদুল জলীল এ.এফ.এম. সুন্দরবনের ইতিহাস, ২য় খণ্ড, পৃঃ ৩৩৩-৩৩৪।

[11] মজুমদার, বাংলা দেশের ইতিহাস – মধ্যযুগ, পৃঃ ৮৯

 

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
Archive
 
সাম্প্রতিক পোষ্টসমূহ