Banner
ইডেন গার্লস কলেজে অনুষ্ঠিত ডিগ্রী পরীক্ষা নিয়ে কিছু কথা — শামসুজ্জোহা মানিক

লিখেছেনঃ শামসুজ্জোহা মানিক, আপডেটঃ November 1, 2019, 12:00 AM, Hits: 1143

 

আমি যখন প্রথম একজন ডিগ্রী পরীক্ষার্থীর কাছ থেকে ঘটনাটা শুনি তখন হতভম্ব হয়েছিলাম। যদিও বাংলাদেশে এখন আর কোনও অস্বাভাবিক ঘটনাকেই অস্বাভাবিক মনে করা উচিত নয় তবু কথাটা শুনে আমি শুধু বিস্মিত নই, উপরন্তু হতভম্ব হয়েছিলাম। আমার মনে প্রশ্ন জেগেছিল তাহলে কোমলমতি শিক্ষার্থীদের প্রতি সারাদেশের প্রসারমান অসভ্যতা এবং অসদাচরণ এখন ইডেন মহিলা মহাবিদ্যালয় বা ইডেন গার্লস কলেজ পর্যন্ত পৌঁছেছে?

ঘটনাটা প্রথমে একজন বিএ পরীক্ষার্থীর মুখ থেকে শুনলাম যিনি বর্তমানে চলমান ডিগ্রী ফাইনাল পরীক্ষার একজন পরীক্ষার্থী। ভিন্ন কলেজের শিক্ষার্থী হলেও তাদের পরীক্ষা দিতে এবার ইডেন মহিলা কলেজে যেতে হচ্ছে। পরে আরও পরীক্ষার্থীর কাছ থেকে একই অভিজ্ঞতার কথা শুনলাম। ঘটনাটা এ রকম। কলেজ বাউন্ডারিতে প্রবেশের মুখে প্রধান ফটকে সবার শরীর পরীক্ষা করা হয়। ছেলেদের একটা লাইন তার সমান্তরালে মেয়েদের আর একটা লাইন। এই দুই লাইনের মাঝখানে চার-পাঁচ হাত ব্যবধান। মাঝখানে কোনও আড়াল বা পার্টিশনও নাই। সদর দরজায় এ ধরনের চেকিং হয় বলে বড় রাস্তা বা ফুটপথ দিয়েও এ দৃশ্য দেখা যায়।

এখানে প্রবেশ পথে মেয়েদের সমস্ত শরীর চেক করা হয়। বিশেষত নারী পরীক্ষার্থীদের বুক থেকে শুরু করে তাদের দুই উরুর মাঝখানে যৌনাঙ্গের জায়গা পর্যন্ত ভালোভাবে চেক করা হয়। মেয়েদের শরীর এভাবে হাতানোর কাজটা অবশ্য ইডেনের মহিলা অথবা পুরুষ অধ্যাপকদের তত্ত্বাবধানে সেখানকার নারী কর্মচারীদের দিয়ে করানো হয়। উদ্দেশ্য শরীরের কোথায়ও নকল করার জন্য কাগজ বা মোবাইল সেট লুকিয়ে রাখা আছে কিনা সেটা দেখা। সুতরাং যারা এ কাজে নিয়োজিত হয় তারা ভালোভাবে নারীদেহের বিশেষ জায়গাগুলিকে ডলে এবং পরীক্ষা করে দেখে। ছেলেদের সামনে মেয়েদের লাইনে তাদের শরীরে যখন এই ধরনের ঘর্ষণ এবং ডলন কর্ম চলে তখন পাশে ছেলেদের লাইনে পুরুষ পরীক্ষার্থীদের শরীরেও একই রকম পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালানো হয়। জামা-প্যান্টের পকেট থেকে দুই উরুর মাঝখানের জায়গা পর্যন্ত। তবে ছেলেদের শরীর হাতানোর জন্য ইডেনের নারী কর্মচারীর পরিবর্তে পুরুষ কর্মচারীদেরকে নিয়োজিত করা হয়। অবশ্য এটাও শুনেছি যে, পাশের লাইনে দাঁড়ানো মেয়েদের শরীরে এভাবে ডলাইমলাইয়ের দৃশ্য কিছুসংখ্যক ছেলে বেশ উৎসাহের সঙ্গে উপভোগ করে।

মেয়েদের জন্য তো বটেই এমনকি ছেলেদের জন্যও এটা কতটা অসম্মানের হতে পারে সেটা আমি পরীক্ষার্থীদের মুখ থেকে শুনে বুঝেছি। অবশ্য এ ধরনের ঘটনা কতখানি অসম্মানের এবং মানসিক পীড়নের কারণ হতে পারে সেটা তাদের প্রতিক্রিয়া না শুনেও বুঝতে কষ্ট হবার কথা নয়। সবচেয়ে বড় কথা এভাবে মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হবার পর পরীক্ষা দিতে বসার ফল পরীক্ষার্থীদের জন্য কতটা ক্ষতিকর হতে পারে সেটা বুঝতে হবে।

শুধু এইটুকু নয় সেখানে ব্যাগ পর্যন্ত নিতে নিষেধ করা হয়। ফলে পানির বোতল পর্যন্ত নিবার সুযোগ থাকে না। অর্থাৎ পিপাসার্ত হলে পানিও খাওয়া চলবে না।

এই ঘটনা শুনে আমার নিজের অতীত জীবনের কথা মনে হল। এক সময় আমরা কলেজ এবং বিশ্ববিদ্যালয়ে পরীক্ষা দিয়েছি। কিন্তু এ ধরনের কোনও অভিজ্ঞতা আমরা কখনই কোথায়ও কারও কাছ থেকে শুনি নাই। জানি না এখন এটা দেশের চলতি রেওয়াজ হয়েছে কিনা। কিন্তু না, গতবছর তিতুমীর কলেজের পরীক্ষা দিতে যাওয়া পরীক্ষার্থীদের অভিজ্ঞতা শুনেছিলাম। কিন্তু তারা এমন অভিজ্ঞতার কথা আমাকে জানায় নাই।

বুঝা গেল দেশ এখন দারোগাগিরির দিকে ক্রমেই বেশী বেশী করে এগিয়ে চলেছে। সবচেয়ে বড় কথা যাদের মানুষ গড়ার কারিগর হবার কথা তারা ব্রিটিশ আমলের কায়দায় পুলিশের দারোগা হবার উপরই সবচেয়ে বেশী গুরুত্ব দিচ্ছে। এমন এক দারোগার নিষ্ঠুর আচরণের শিকার হয়ে অল্প কিছুদিন ঘটা আগে ভিকারুন্নিসা ‍নূন স্কুল এন্ড কলেজের কিশোরী শিক্ষার্থী অর্ত্রীর আত্মহত্যার স্মৃতি এখনও আমাদের মন থেকে মুছে যাবার কথা নয়। অবশ্য সারাদেশকে দারোগার কায়দায় গড়ার এটাই হচ্ছে প্রকৃষ্ট পদ্ধতি। না হলে মন ও মননে শিক্ষার্থীরা ভবিষ্যতের দারোগা হবে কী করে?

আসলে সমাজে করুণা, মানবিক বিবেচনা এবং ন্যায়-বোধের চর্চার পরিবর্তে জোর দেওয়া হচ্ছে নিষ্ঠুর, নির্বিবেক, স্বার্থান্ধ এবং অমানবিক ও দানবিক মানুষ তৈরী যাতে হয় সেই চর্চার উপর। সুতরাং ভিকারুন্নিসার মত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের একজন অধ্যক্ষের পক্ষে ব্রিটিশ আমলের দারোগা বা থানাদারের মত হয়ে উঠা সম্ভব হয়। নিজেদের নির্দয় আচরণ দিয়েই তো কোমলমতি শিক্ষার্থীদেরকেও ভবিষ্যতের নির্দয় নাগরিকে পরিণত করার কাজটা সুচারুভাবে সম্পন্ন করা সম্ভব!

ইডেন কলেজ কর্তৃপক্ষ নিশ্চয় তাদের কাজের সপক্ষে একরাশ শক্তিশালী যুক্তি হাজির করবেন। তারা হয়ত বলবেন নকল ঠেকাবার জন্য এছাড়া আর কোনও উপায় নাই। আমাদের সময় আমরা যখন পরীক্ষা দিতাম তখন নকলের প্রভাব তুলনায় অনেক কম ছিল মানছি। কিন্তু তখনও তো নকল ছিল। অল্প কিছু সংখ্যক পরীক্ষার্থী তখনও নকলের সুযোগ পেলে নকল করত। কিন্তু তখন কোনও প্রতিষ্ঠানের দায়িত্বপ্রাপ্ত শিক্ষকরা এ ধরনের পুলিশের দারোগার ভূমিকায় অবতীর্ণ হতেন বলে আমার জানা নাই। নকল রোধ করার চেষ্টা থাকত। কেউ নকল করার সময় ধরা পড়লে সতর্ক করা হত, হয়ত একটা পর্যায়ে খাতাও কেড়ে নেওয়া হত। কিন্তু পরীক্ষার্থী মানেই নকলবাজ, নকল করার জন্য তারা সবাই পরীক্ষা দিতে আসে এমন একটা মন নিয়ে পরীক্ষার্থীদের বিচার করার কথা অন্তত আমার জানা নাই। অথচ দেশ নাকি তখন পরাধীন ছিল, আর এখন নাকি স্বাধীন! আর সে স্বাধীনতারও প্রায় অর্ধশতাব্দী পূর্ণ হতে চলেছে!

হ্যাঁ, এখন স্বাধীন বাংলাদেশে তো ডিজিটাল যুগ চলছে। সুতরাং পরীক্ষার জায়গায়ও এখন ডিজিটাল আইন শুরু হয়েছে। আর কেউ কোথাও এই আইন চালু করেছে কিনা তা আমি জানি না তবে ইডেন গার্লস কলেজ যে এই আইন চালু করেছে সে কথা আমি বলতে পারি।

তবে এ প্রসঙ্গে আমার কয়েকটা কথা বলবার আছে। আজকের যুগে মোবাইল ফোন-সেট বহন না করে চলাফরার উপায় কতটা আছে? অন্যান্য সভ্য দেশের কথা বলতে পারব না। কিন্তু বাংলাদেশের মত দেশে মানুষের বিশেষত মোবাইল ফোন বহন করা মেয়েদের জন্য অত্যাবশ্যক। অনেক মেয়ে অনেক দূর থেকে পরীক্ষা দিতে যায়। আর পরীক্ষা শেষই তো হয় বিকাল সাড়ে পাঁচটায় অথবা ছয়টায়। অর্থাৎ এখনকার দিনে তখন সন্ধ্যা হয়ে যায়। মোবাইল সেট ছাড়া বাসায় পরীক্ষার্থী খবর দিবে কীভাবে? অর্থাৎ খবর না দেওয়া মানে বাসা বা বাড়ীর সবাইকে টেনশনে রাখা। আর বাংলাদেশ এবং ঢাকারও নিরাপত্তাজনিত পরিস্থিতি কেমন সেটা সবার জানা আছে। যাদের জন্য প্রাইভেট কারের ব্যবস্থা আছে তাদের কথা আলাদা। কিন্তু বাকীরা? তাদের কী হবে? তাদের আপনজনদের মনের অবস্থা কী হয়? ছেলেদেরই নিরাপত্তা নাই। সেক্ষেত্রে মেয়েদের অবস্থাটা এ দেশে কতটা নাজুক তা কী বলে দিতে হবে? তাছাড়া যে কোনও সময় কোনও সাধারণ দুর্ঘটনার শিকার হলে একটা ছেলে বা বিশেষ করে মেয়ে ফোন করে তার আপনজনদের কাছে সাহায্য চাইতে পারে। ফোন নিতে না দেওয়া বা ফোন কেড়ে নেওয়া মানে এদেরকে এই সুযোগ থেকে বঞ্চিত করা।

আমার প্রশ্ন, পরীক্ষার হলে ব্যাগ কেন নিতে দেওয়া হবে না? হলের এক জায়গায় ব্যাগ জমা রাখলেই তো হয়! অন্যদিকে মোবাইল ফোন সেট সম্পূর্ণ বন্ধ করে সাথে রাখলে ক্ষতি কী? এটা কি অপবিত্র কিছু যে সাথে রাখলে পরীক্ষা হলের বা পরীক্ষকদের ‘জাত’ যাবে? পরীক্ষার হলে শিক্ষকরা থাকেন কীসের জন্য? তাদের কাজ পরীক্ষার হলে শৃঙ্খলা রক্ষার পাশাপাশি নকল রোধ করাও।

আমি গত বছর রাজধানী ঢাকার কোনও একটা নামী সরকারী কলেজে ডিগ্রী পরীক্ষার্থীদের এক জায়গায় জমা রাখা টাচ ফোনসহ ১২/১৪টা মোবাইল ফোন চুরির কথা শুনেছিলাম। অনুমান করি এগুলি কলেজেরই লোকদের কাজ। শিক্ষকরা না করলেও এমন কাজ করার মত লোকের অভাব কলেজে হবার কথা নয়। একটা বড় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মচারী রাখতে হয়। তাদের একজন বা দুইজন এমন চুরি করতে পারে। যাইহোক, এ ধরনের সমস্যা আমাদের দেশে নূতন নয়। সে ক্ষেত্রে আমি মোবাইল ফোন-সেট সঙ্গে রাখতে দেওয়ার পক্ষপাতী। তবে সেটা বন্ধ করে রেখে, যেটা অনায়াসে করা যায়।

আজকের যুগে আমাদের চিন্তাপদ্ধতি এবং আচরণে অনেক পরিবর্তন আনা দরকার। ইডেন কলেজের ঘটনাটা আমার কাছে মনে হয়েছে আধুনিক সভ্যতার সঙ্গে অসঙ্গতিপূর্ণ মধ্যযুগীয় ও স্বৈরতান্ত্রিক যে দৃষ্টিভঙ্গী আমাদের সমাজে প্রভাব বিস্তার করে আছে তারই একটা বহিঃপ্রকাশ। অধিকন্তু সারাদেশে যে সার্বিক অধঃপাত ঘটছে এটা তারও একটা অংশ। আজকের শিক্ষাব্রতী যে তরুণ-তরুণীরা আগামী দিনে এ সমাজের গঠন ও পুনর্গঠনে ভূমিকা রাখবে তাদেরকে এভাবে অপমানিত করা, তাদের আবেগ-অনুভূতিকে আহত করা হল একই প্রক্রিয়ার মাধ্যমে আত্মমর্যাবোধহীন এবং আবেগ-অনুভূতিহীন নূতন আর এক প্রজন্ম তৈরী করা। এটা হল যে দুষ্টচক্রে বাংলাদেশকে আবদ্ধ করা হয়েছে সেই চক্রকে অপ্রতিহত হতে সাহায্য করা।

আমাদের নিজেদের অতীতের কথা মনে হলে এখন বুঝি পাকিস্তান কালে আমাদের মধ্যে যে নীতি-নৈতিকতা বোধ এবং স্বাধীনতার চেতনা জন্ম নিতে পেরেছিল তার মূলে ছিল সে কালের শিক্ষা ব্যবস্থাও যা সকল ত্রুটি সত্ত্বেও এমন অধঃপতিত ছিল না। আমি নিজে কলেজ হোস্টেল এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হলে থেকে লেখাপড়া করা মানুষ। সত্যি কথা বলতে কি এ ধরনের র‌্যাগিংয়ের কথা আমরা কল্পনাও করতে পারতাম না। এমনকি বলা উচিত যে, ভালো বা মন্দ যেমন হোক কোনও ধরনের র‌্যাগিংয়ের স্মৃতিও আমার নাই। আসলে পাকিস্তানের শাসক শ্রেণী তখনও আজকের শাসকদের মত পরিপক্ব ও ধূরন্ধর ছিল না। সুতরাং ছাত্র সমাজকে নিজেদের শাসনের উপযোগী করার জন্য তথা একটা দানবিক শাসনের উপযোগী প্রজন্ম হিসাবে গড়ে তুলবার জন্য উপযুক্ত পদক্ষেপ দিতে পারে নাই। আইয়ুবের শাসনের শেষ পর্যায়ে মোনায়েম খানের সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সরকারী ছাত্র দল এনএসএফ-এর দুর্বৃত্ত বাহিনী গড়ার কাজে হাত দেওয়া হলেও তখন অনেক দেরী হয়ে গিয়েছিল। ১৯৬৯-এ মূলত ছাত্র অভ্যুত্থানে আইয়ুব সরকারের পতনের সঙ্গে এনএসএফ-ও ছিন্নভিন্ন হয়ে গিয়েছিল।

যাইহোক, আামার নিজের অভিজ্ঞতা থেকেই বলতে পারি, পাকিস্তান কালে একটা স্বাধীনচেতা ও আত্মমর্যাবোধসম্পন্ন ছাত্র ও তরূণ প্রজন্মের উত্থান ঘটেছিল। তারাই সারাদেশে সমাজতন্ত্র এবং পূর্ব বাংলার স্বাধীনতার চেতনা বিস্তৃত করেছিল। এদেরই সংগ্রামের ফল হচ্ছে তৎকালীন পূর্ব বাংলার বুকে ১৯৭১-এ সংঘটিত স্বাধীনতা যুদ্ধ। বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার পরবর্তী ইতিহাস হচ্ছে শাসকদের আশ্রয়, প্রশ্রয় ও পরিচালনায় আত্মস্বার্থ সর্বস্ব, আত্মমর্যাদাবোধহীন এবং মেরুদণ্ডহীন প্রজন্ম নির্মাণের পথে জয়যাত্রার ইতিহাস।

এখন এটা স্পষ্ট যে, ১৯৭১-এর ১৬ ডিসেম্বর থেকে বাংলাদেশে যে দুর্বৃত্ত ও দানবিক শাসক শ্রেণীর উত্থান ঘটেছে তার অনিবার্য পরিণতি হচ্ছে কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে র‌্যাগিং, গণরুম, সরকার দলীয় ক্যাডার বাহিনীর সন্ত্রাস ইত্যাদির মাধ্যমে দানবিক সংস্কৃতির সর্বব্যাপী চর্চার বিস্তার। বুয়েটের আবরার ফাহাদ নির্যাতন ও হত্যা সবাইকে আজ নাড়া দিলেও এমন অসংখ্য ঘটনা ঘটেছে এবং ঘটে এ দেশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলিতে। কিছু সংখ্যক দৈহিক মৃত্যুতে হয়ত কিছু চাঞ্চল্য হয়। কিন্তু সারাদেশে যে অসংখ্য এবং অপরিমেয় মানবিক ‍নিগ্রহ এবং মৃত্যু ঘটে চলেছে তা নিয়ে কে কতটা সোচ্চার? হ্যাঁ, আমি এ ধরনের মানসিক নিগ্রহ ও অসম্মানকে মানবিক হত্যাই বলতে চাই। কারণ এভাবে মানুষের আত্মমর্যাদাবোধের মৃত্যু ঘটানো হয়। ফলে ‍মৃত্যু ঘটে স্বাধীন ও মর্যাদা বোধসম্পন্ন মানুষেরও।

চরমে পৌঁছালে সাধারণত সব অন্যায়েরই বিরুদ্ধে একটা প্রতিক্রিয়া ঘটে। সেটা কিছুটা হলেও আমরা আবরারের ক্ষেত্রে ঘটতে দেখেছি। অবশ্য যারা দীর্ঘ প্রক্রিয়ায় নিজেদের হাতিয়ার হিসাবে আবরার হত্যাকারীদের সৃষ্টি এবং লালন করেছে বুয়েট প্রশাসনসহ সেইসব খলনায়করা এখনও এ দেশে বহাল তবিয়তে রয়েছে; কতদিন থাকবে তা বলতে পারি না। এরা তো একটা জায়গায় নাই, সারা দেশের সর্বত্র এদের বিস্তার ও প্রতিষ্ঠা ঘটেছে। এদের কল্যাণে এখন এমন একটা সংস্কৃতি প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, যার ফলে ক্ষমতার যে কোনও মানবিক রূপ এবং উদ্দেশ্য থাকতে পারে সেটাকে সম্পূর্ণরূপে ভুলিয়ে দেওয়া হচ্ছে।

অনেকে হয়ত অল্প কিছুদিন আগে ঘটা এক মহিলা সরকারী কর্মকর্তার আচরণ স্মরণ করতে পারবেন যে, এক মাছ বিক্রেতা তাকে দিদি সম্বোধন করায় তিনি ক্রোধে ক্ষিপ্ত হয়ে সেই মাছ বিক্রেতার মাছের ঝুড়ি লাথি মেরে রাস্তা সংলগ্ন ড্রেনে ফেলে দিয়ে নিজের ক্ষমতা দেখিয়েছিলেন। সংশ্লিষ্ট উপজিলায় অনেকের নিকট পরিচিত সেই মহিলা কর্মকর্তা ছিলেন হিন্দু। সুতরাং তাকে দিদি সম্বোধন করা। আসলে মাছ বিক্রেতার অপরাধ ছিল তাকে ম্যাডাম না বলে দিদি বা আপা সম্বোধন করা। হ্যাঁ, এটাই এ দেশের নিয়ম। ক্ষমতার বাইরে যে থাকে তাকে ক্ষমতাসীনের সামনে প্রায় নতজানু হয়ে মুখ কাচুমাচু করে এবং হাত কচলাতে কচলাতে ‘স্যার’ ‘স্যার’, ‘ম্যাডাম’ ‘ম্যাডাম’ করতে হবে। তা না হলে ক্ষমতার কীসের ক্ষমতা, পাবলিককে কীসের ‘ডিসিপ্লিন’, কীসের ‘ল এন্ড অর্ডার’ শিখানো!  

যাইহোক, মূল প্রসঙ্গে ফিরে আমি বলতে চাই এ কথা আমি বুঝি না ইডেন কলেজ কর্তৃপক্ষ মানুষ গড়ার কারিগরের ভূমিকা পালন করতে চান, নাকি ব্রিটিশ আমলের পুলিশের দারোগাগিরি করতে বেশী পছন্দ করেন। ইডেন গার্লস কলেজের মত দেশের একটা বহু পুরাতন এবং খ্যাতিমান ঐতিহ্যের অধিকারী শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের কর্ণধার হয়ে পরীক্ষার কক্ষে প্রবেশের ঠিক পূর্বমুহূর্তে কোমলমতি ছেলেমেয়েদেরকে এভাবে মানসিক নির্যাতন করে তারা দেশের সামনে কোন দৃষ্টান্ত স্থাপন করছেন তা কি তারা বুঝেন বা জানেন?    

 

রচনা : ৩১ অক্টোবর, ২০১৯

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
Archive
 
সাম্প্রতিক পোষ্টসমূহ