Banner
পশ্চিম বঙ্গে বাঙ্গালী জাতীয়তাবাদের উত্থান এবং ভোলায় ‘তৌহিদী জনতা’র তাণ্ডব — শামসুজ্জোহা মানিক

লিখেছেনঃ শামসুজ্জোহা মানিক, আপডেটঃ November 5, 2019, 12:00 AM, Hits: 1125


 
পশ্চিম বঙ্গে বাঙ্গালী জাতীয়তাবাদের যে নবজাগরণ ঘটছে তার প্রেক্ষাপটে যখন সম্প্রতি ভোলায় সংগঠিত ‘তৌহিদী জনতা’র তাণ্ডবকে বিচার করি তখন আমার কাছে এই তাণ্ডব ভিন্ন তাৎপর্য নিয়ে দেখা দেয়। গত ২০ অক্টোবর তারিখ বুধবারে ভোলায় ‘তৌহিদী জনতা’র ব্যানারে জিহাদের জোশে উন্মত্ত কয়েক হাজার মানুষের তাণ্ডব আমরা দেখলাম। একজন হিন্দু যুবকের ফেসবুক আইডি হ্যাক করে একটা মিথ্যা গুজব ছড়িয়ে নিরীহ ও নির্দোষ হিন্দু সম্প্রদায়ের উপর হামলার অজুহাত খোঁজার এ ধরনের চেষ্টা এ দেশে নূতন নয়। এই ঘটনা আমাদের পুনরায় রামু কিংবা নাসিরনগরসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে সংগঠিত তাণ্ডবের কথা মনে করিয়ে দেয়।

তবে ভোলার তাণ্ডবের মত ঘটনা এ দেশে নূতন না হলেও যে সময়ে এবং যেভাবে এই তাণ্ডব সংগঠিত হয়েছে তাতে এর পিছনে খুব বড় ধরনের ষড়যন্ত্র যে ক্রিয়াশীল রয়েছে সেটা অনুমান করতে কষ্ট হয় না। দেশের প্রধান মন্ত্রী স্বয়ং ঐদিন সন্ধ্যায় গণভবনে তার সঙ্গে বৈঠকে বসা যুবলীগ নেতাদেরকে ভোলার বোরহানউদ্দীনের তাণ্ডব ও হত্যাকাণ্ডকে চক্রান্ত বলেন। পরের দিন অর্থাৎ ২১ অক্টোবর তারিখে হাইকোর্টের একটি বেঞ্চ থেকে বলা হয় যে, ভোলার বোরহানউদ্দীনে জনতার বিক্ষোভ সমাবেশকে কেন্দ্র করে পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে চারজন নিহত, পুলিশ ও অসংখ্য জনতা আহত হওয়ার ঘটনা রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে গভীর ষড়যন্ত্র।

অর্থাৎ ভোলার সহিংসতা যে, রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে একটি ষড়যন্ত্র সে বিষয়ে রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ মহলও নিশ্চিত। যদি তাই হয় তবে প্রশ্ন আসে যে, কারা এই ষড়যন্ত্রে জড়িত, তারা কীভাবে জড়িত এবং রাষ্ট্র-বিরোধী ষড়যন্ত্র করার জন্য তাদের বিরুদ্ধে কী ধরনের ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। ঘটনার পর দুই সপ্তাহ পার হলেও এসব প্রশ্নের উত্তর কি আমাদেরকে দেওয়া হয়েছে?

আসলে ভোলার ঘটনা এমনিতে কিছু প্রশ্ন মাথায় জাগায়। এ ধরনের একটা ঘটনা রাষ্ট্র এবং বিশেষত স্থানীয় প্রশাসনের অজ্ঞাতে হঠাৎ করে সংগঠিত হতে পারে না। অন্যদিকে যখন যার ফেসবুক একাউন্ট হ্যাক হয়েছে সেই হিন্দু যুবক সেই হ্যাকের ঘটনা সেই দিনই থানায় জানানো সত্ত্বেও অপরাধীদের সাথে সাথে না ধরে তাকে গ্রেফতার করা হল কেন? এটা পুলিশের কী ধরনের আচরণ? এভাবে আসলে এ দেশে দুর্বৃত্তদেরকে আস্কারা দেওয়া হয়। শুনছি হ্যাকার সংশ্লিষ্ট দুই দুর্বৃত্তকে ধরা হয়েছে। কিন্তু এটাও ন্যায়ের স্বার্থে দেশবাসীকে জানানো উচিত যে, নির্দোষ হিন্দু যুবককেও ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। সে যদি নির্দোষ হয় তবে কেন তাকে আটকে রাখা হবে? এ কথাও দেশবাসীর জানা উচিত যে, দুর্বৃত্তদের বিরুদ্ধে কী ধরনের ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।

যাইহোক, যে কথা কিছু আগে বলেছিলাম, এ ধরনের একটা ঘটনা হুট করে ঘটানো যায় না। তার আগে একটা প্রস্তুতির পর্যায় থাকে। সেটা স্থানীয় পুলিশ ও প্রশাসনের না জানবার কথা নয়। কেউ না কেউ ষড়যন্ত্রের কিছু না কিছুর আঁচ যে পেয়েছিল সেটা মোটামুটি নিশ্চিতভাবে বলা যায়। সংবাদপত্রে জেনেছিলাম যে, এই সমগ্র সময়ে সংশ্লিষ্ট এলাকার আওয়ামী লীগ সাংসদ এলাকায় যাবার কোনও প্রয়োজনই বোধ করেন নাই। সুতরাং ডাল মে যে কুছ কালা হ্যায় সে কথাটা আরও জোরের সঙ্গে বলা যায়।

পুলিশের ভূমিকা নিয়েও প্রশ্ন আছে। তারা আত্মরক্ষার জন্য গুলি করেছেন। কাগজে পড়েছি উচ্ছৃঙ্খল জনতার দুইজনের গুলিবিদ্ধ হবার ফলে মৃত্যু হয়েছে, বাকী দুইজনের মৃত্যু গুলিতে নয়। তাদের মাথা ভারী বস্তুর আঘাতে থ্যাঁৎলানো ছিল। অর্থাৎ এটা সহজে অনুমান করা যায় যে, লাশ তৈরীর জন্য ‘মব’ বা উচ্ছৃঙ্খল জনতার ভিতর থেকেই কেউ তাদের মৃত্যু ঘটিয়েছে। এ ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা হল, যে ‘তৌহিদী জনতা’র ব্যানারে এই হত্যা সংগঠনের আয়োজন চলছিল তাদের দাবী মেনে নিয়ে পোস্টমর্টেম না করেই লাশগুলি তাদের হাতে তুলে দেওয়া। পোষ্টমর্টেম করলেই কিন্তু ষড়যন্ত্রের বিষয়টা হাতেনাতে ধরা পড়ত। অর্থাৎ একটা ষড়যন্ত্র বা চক্রান্তকেও কবরস্থ করার একটা আয়োজন করা হল।

এরপরেও প্রশাসনের প্রশ্নবিদ্ধ ভূমিকা থেমে থাকল না। ‘তৌহিদী জনতা’র সামনে নতজানু হয়ে তাদের সকল অন্যায় দাবীর নিকট প্রশাসন আত্মসমর্পণ করল। এসব বিষয়ে আমি আর বিস্তারিত লিখতে চাই না। কারণ ভোলার ঘটনার প্রতিবেদন লিখা এখানে আমার উদ্দেশ্য নয়। বিগত কয়েক দিন যারা ভোলার ঘটনা সংবাদপত্রের মাধ্যমে পর্যবেক্ষণ করেছেন তারা সবাই বিস্তারিত জানেন। এখানে আমি বরং কিছু প্রশ্ন তুলতে চাচ্ছি।

রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকেই একটা চক্রান্ত বা ষড়যন্ত্রের কথা বলা হচ্ছে। কিন্তু সেই চক্রান্ত উদ্ঘাটনের চেষ্টা কি আমরা দেখতে পাচ্ছি? বরং ক্রমে এটা স্পষ্ট হয়েছে যে, রাষ্ট্র নিজেই সমস্যার গভীরে যেতে প্রস্তুত নয়। অন্তত আমার কাছে ভোলার ঘটনার তাৎপর্য বিরাট। আমার অভিজ্ঞতা এবং কাণ্ডজ্ঞান থেকেই বলতে পারি যে, রাষ্ট্রের অন্তত একটা গুরুত্বপূর্ণ অংশ এ ধরনের ঘটনার পিছনে না থাকলে ভোলার মত ঘটনা যেমন ঘটানো যায় না তেমন সেটা ঘটলেও তার মূল রহস্য উন্মোচনে এত সময়ও লাগবার কথা নয়।

স্বাভাবিকভাবে, ভোলার ঘটনাকে যখন রাষ্ট্র এবং বিচার বিভাগের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকেই ষড়যন্ত্র মনে করা এবং বলা হচ্ছে তখন বাংলাদেশের নাগরিক হিসাবে আমাদর জন্য এ ষড়যন্ত্রের সম্ভাব্য কারণ সম্পর্কে অনুমান করতে চাওয়াটা অনুচিত হবে না। সবচেয়ে বড় কথা এ ধরনের ঘটনা মোল্লাদের দ্বারা এককভাবে সংগঠিত কোনও ঘটনাই হতে পারে না। উপরন্তু দেশের ভিতরের কোনও গোষ্ঠী এর সঙ্গে জড়িত থাকলেও বর্তমান প্রেক্ষিতে ঘটনার পিছনে বাইরের শক্তির সংশ্লিষ্টতা থাকবার সম্ভাবনাকে খাটো করে দেখা যায় না। এ ক্ষেত্রে পাকিস্তান নয়, বরং ভারতের দিকেই সন্দেহের তীর যায়।

কারণ এ মুহূর্তে এ ধরনের ঘটনায় ভারতের হিন্দুত্ববাদী শক্তিই লাভবান হবে। বিশেষত পশ্চিম বঙ্গে বাঙ্গালী জাতীয়তাবাদ এখন দ্রুত বিকাশমান। যারা পশ্চিম বঙ্গ সম্পর্কে কিছু ধারণা রাখেন তারা জানেন যে, খুব দেরীতে হলেও এখন পশ্চিম বঙ্গের বাঙ্গালীদের মধ্যে বাঙ্গালী জাতীয়তাবাদী চেতনা দ্রুত প্রসারলাভ করছে। বলা যায় পাকিস্তান কালে ষাটের দশকে তৎকালীন পূর্ব বঙ্গে বাঙ্গালী জাতীয়তাবাদ যেভাবে দ্রুত বিস্তারলাভ করেছিল পশ্চিম বঙ্গেও এখন অনেকটা সেই অবস্থা দেথা দিয়েছে। বাঙ্গালীদের প্রতি কেন্দ্রীয় শাসক শ্রেণীর দীর্ঘদিনের তুলনামূলক বঞ্চনা, বিশেষত হিন্দীভাষীদের তুলনায় বাঙ্গালীদের পিছিয়ে পড়া অবস্থা ইত্যাদি বহুবিধ কারণ এর পিছনে আছে। তবে সম্প্রতি আসামে বাঙ্গালী-বিরোধী এনআরসি-এর বাস্তবায়ন ও তার ফলাফল এবং পশ্চিম বঙ্গেও এনআরসি করার জন্য দিল্লীর বিজেপি সরকার এবং বিজেপি-নেতৃত্বের বারংবার সংকল্প ঘোষণা পশ্চিম বঙ্গের বাঙ্গালী জাতির মনে তীব্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেছে। যাইহোক, সব মিলিয়ে পশ্চিম বঙ্গে বাঙ্গালী জাতীয়তাবাদ প্রবল শক্তি নিয়ে জেগে উঠছে। গর্গ চট্টোপাধ্যায় নেতৃত্বাধীন ‘বাংলা পক্ষ’ নামে সামাজিক সংগঠন এ ক্ষেত্রে বিশেষভাবে উদ্যোগী ভূমিকা নিলেও আরও বিভিন্ন সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠন বাঙ্গালী জাতির অধিকার নিয়ে সোচ্চার হয়ে উঠছে। পশ্চিম বঙ্গের পথে-মাঠে এখন উচ্চারিত হচ্ছে ‘জয় বাংলা’ ধ্বনি। এর প্রতিফলন রাজনীতিতেও ঘটছে। সস্তা জনপ্রিয়তার জন্য হলেও মমতা বন্দোপাধ্যায়ও সময়ের স্রোতকে ব্যবহার করতে চেয়ে ‘জয় বাংলা’ স্লোগান দিচ্ছেন। অর্থাৎ পশ্চিম বঙ্গে বাঙ্গালী জাতীয়তাবাদের নবজাগরণ এখন একটা বাস্তবতা।

আমার মনে হয এমন একটা বাস্তবতার প্রেক্ষিতে বাংলাদেশে হিন্দু বা ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের বিরুদ্ধে যে কোনও মুসলিম সাম্প্রদায়িক হামলা বা উন্মত্ততাকে দেখতে হবে। পশ্চিম বঙ্গে হিন্দু বাঙ্গালীদের মধ্যে ধর্মীয় সম্প্রদায়গত পরিচয়ের ঊর্ধ্বে উঠে বাঙ্গালী জাতীয়তাবাদী চেতনার জাগরণকে অঙ্কুরেই বিনষ্ট করার সবচেয়ে সহজ পন্থা হচ্ছে বাংলাদেশে বিশেষত সংখ্যালঘু হিন্দুদের উপর মুসলিম সাম্প্রদায়িক হামলা পরিচালনা করা। কারণ এর প্রভাব খুব স্বাভাবিকভাবেই পশ্চিম বঙ্গে পড়বে। অর্থা্ৎ বাংলাদেশে যে কোনও মুসলিম সাম্প্রদায়িক কর্মকাণ্ডকে ভারতের হিন্দুত্ববাদের সহাযোগী এবং সহায়ক হিসাবে বিবেচনা করতে হবে। আরও রূঢ়ভাবে বললে বলতে হবে, বাংলাদেশের প্রতিটি উগ্র মুসলিম সাম্প্রদায়িকতাবাদী জ্ঞানে অথবা অজ্ঞানে ভারতের হিন্দুত্ববাদীদের সপক্ষে কাজ করছে।

এ কথা বুঝতে হবে যে, বাংলাদেশ এখন ভারতের দ্বারা গভীর এবং প্রবল ভাবে প্রভাবান্বিত এবং নিয়ন্ত্রিত। বাংলাদেশের উপর ভারতের প্রভাব এবং নিয়ন্ত্রণ কতটা গভীর এবং প্রবল হয়েছে তার সর্বশেষ দৃষ্টান্ত ভারতের সঙ্গে করা শেখ হাসিনার সর্বশেষ চারটি চুক্তি।

এই রকম এক সময়ে যখন পশ্চিম বঙ্গে বাঙ্গালী জাতির নবজাগরণের ফলে সেখানে ভারতের কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রণ শিথিল হবার সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে তখন সেই নবজাগ্রত পশ্চিম বঙ্গের পশ্চাদভূমি হিসাবে যাতে বাংলাদেশ না দাঁড়ায় সেদিকটা নিশ্চিত করা কি ভারতে বাঙ্গালী জাতীয়তাবাদ-বিরোধী শক্তির সামনে করণীয় হযে দেখা দেয় না? এ ক্ষেত্রে সবচেয়ে সহজ করণীয় হল বাংলাদেশে ইসলামী সাম্প্রদায়িক উন্মত্ততা সৃষ্টি ক’রে পশ্চিম বঙ্গের বাঙ্গালীর মনেও একদিকে ভীতি অপর দিকে পাল্টা ধর্মীয় প্রেরণা সৃষ্টি ক’রে সেখানে উদীয়মান বাঙ্গালী জাতীয়তাবাদী চেতনার অঙ্কুরেই বিনাশ সাধন।

যেহেতু পশ্চিম বঙ্গে বাঙ্গালী জাতীয়তাবাদী আকাঙ্ক্ষা ও চেতনার জাগরণ এখন একটি ক্রমবর্ধমান বাস্তবতায় পরিণত হয়েছে সেহেতু বাঙ্গালী জাতীয়তাবাদী চেতনার বিনাশ সাধনের কর্মকাণ্ড বাংলাদেশে ভোলার একটি মাত্র সাম্প্রদায়িক উন্মত্ততার মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকবে এটা মনে করা ভুল হতে পারে। আমার ধারণা ভোলার ‘তৌহিদী জনতা’র তাণ্ডব বাঙ্গালী জাতীয়তাবাদের জাগরণের বিরুদ্ধে এমন এক বৃহৎ চক্রান্তের অংশ হতে পারে যার জাল বাংলাদেশের সীমানা পার হয়ে ভারত পর্যন্ত বিস্তৃত। সুতরাং সামনে ভোলার মত কিংবা তার চেয়েও ধ্বংসাত্মক আরও ঘটনা ঘটাবার চেষ্টা হতে পারে। তবে পূর্ব থেকে সচেতন থাকলে সব চক্রান্তকেই নস্যাৎ করা সম্ভব।

রচনা : ৪ অক্টোবর, ২০১৯      

 

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
Archive
 
সাম্প্রতিক পোষ্টসমূহ