Banner
নারীর শত্রুর অনুসন্ধান — ইমাম গাজ্জালী

লিখেছেনঃ ইমাম গাজ্জালী, আপডেটঃ March 8, 2020, 12:00 AM, Hits: 1284

 

মিত্র না হয় পরে খুঁজব, আগে অনুসন্ধান করি নারীর শত্রু কে। নারীর শত্রু কি পুরুষ? নারীর পক্ষের মানুষ হিসেবে কাজ করে যারা জীবিকা নির্বাহ করেন, অন্যান্য দরকারি প্রশ্নকে বাদছাদ দিয়ে যারা কেবল নারীর অধিকারটাই প্রতিষ্ঠা করতে চান, এই বেকারির দেশে তারা বেঁচে-বর্তে থাকার একটা উপায় খুঁজে পান বটে। তাদের উপস্থাপনায় ঘোরপ্যাঁচের কথা বাদ দিয়ে সোজাসুজি বললে এটাই দাঁড়ায় যে, নারীর শত্রু যেন পুরুষ, কেবলি পুরুষ। বিষয়টা সে রকম হলে সেটা খুবই বাজে ব্যাপার যে, শত্রুর সঙ্গেই ভরজীবন বসবাস করতে হয় নারীকে। এ ছাড়া নারী প্রেমও করে শত্রু সঙ্গে, সঙ্গতির চেয়ে বেশি খরচাপাতি করে ঢাক-ঢোল পিটিয়ে সমাজ-স্বজনদের সম্পৃক্ত করে ধর্মকে সাক্ষী রেখে নারী বিয়েও করে ‘শত্রু পুরুষকে’। শুধু তাই নয়, শত্রুর সঙ্গেই নারীকে উপভোগ করতে হয় জীবনের চরমতম সুখ, সবচেয়ে আনন্দঘন ক্রীড়া। সে কাজে ‘পুরুষ শত্রু’ ছাড়া তার দ্বিতীয় কোনো অপশন নাই। বংশ বিস্তারের মত মহৎ ও গুরু দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে নারীকে শরণ নিতে হয় পুরুষের।

এ কথা ঠিক যে, আমাদের মত পশ্চাৎপদ সমাজে নারীর ওপর যে হামলা-নিপীড়ন ও আধিপত্য জারি থাকছে প্রতিদিন-প্রতিক্ষণ, দৃশ্যত সেটা বহাল থাকছে প্রধানত পুরুষের মাধ্যমে। হয়ত সেই খেদেই আমাদের নারীবাদী বন্ধুরদের উপস্থাপনায় পুরুষ শত্রু হিসেবে দৃশ্যমান হয়। এ কথাও সমান সত্য যে, নারীর ওপর নিপীড়ন, হামলা ও আধিপত্য শুধু পুরুষের মাধ্যমে জারি থাকার কথা শতভাগ সত্য নয়, খোদ নারীদের মাধ্যমেও নারীর ওপর ওই সব খড়্গ নেমে আসে। পশ্চাৎপদ সমাজে যৌতুকের জন্য স্বামীর পক্ষ নিয়ে শাশুড়ি-ননদের নির্যাতন ও নিপীড়ন, পুরুষের পক্ষ নিয়ে নারীর বিরুদ্ধে নারীরই নিপীড়ন। সেটা সমাজ, পরিবার ও ব্যক্তির ব্যাপার, কিন্তু রাষ্ট্র ও রাজনীতির ক্ষেত্রে?

ধরা যাক একজন নারী শাসক হলেন, তখন কি নারীর রাজত্ব তৈরি হয়? নারীর ওপর নিপীড়ন-নির্যাতন দূর হয়ে যায়? না হয় না। বরং আগের মতই নারীর ওপর নিগ্রহের মাত্রা জারি থাকে, ঘটনা পরম্পরায় সেটা কখনো বাড়ে, কখনো কমে, কখনো দূর হয় না কিংবা দূর হওয়ার আয়োজনও শুরু হয় না।

বাংলাদেশের ক্ষেত্রে শেখ হাসিনা, রওশন এরশাদ, শিরীন শারমীন চৌধুরী প্রমুখ রাষ্ট্রের শাসনকাঠামোর শীর্ষ অবস্থান করছেন। খালেদা জিয়াও এই তো কিছু দিন আগেও সেই অবস্থানে ছিলেন। ভারতের ক্ষেত্রে ইন্দিরা গান্ধী, সোনিয়া গান্ধী, ব্রিটেনের মার্গারেট থ্যাচার প্রমুখ ক্ষমতার কেন্দ্রে ছিলেন। নারী রাষ্ট্রের রাজনীতির শীর্ষ দায়িত্বে থাকার পরেও নারীর ওপর নিগ্রহের যে খড়্গ সহস্র সহস্র বছরব্যাপী চলে আসছে, সেটা দূর হওয়ার কোনো আয়োজন আলাদাভাবে শুরু হয়নি।

রাষ্ট্র, রাজনীতির শীর্ষ দায়িত্বে নারীর অধিষ্ঠান হলেই, প্রধানমন্ত্রী বিরোধী দলীয় নেত্রী ও স্পিকার হলেই, নারী জজ-ব্যারিস্টার-বিসিএস ক্যাডার হলেই নারীর ওপর নিগ্রহ-নিপীড়ন দূর হওয়ার আয়োজন বোঝায় না। নারীকে এসব দায়িত্বে আনার সঙ্গে নারীর ওপর নিগ্রহ ও নিপীড়ন দূর করার দূরতম সম্পর্কও নাই। বরং তারা নারী হয়ে নারী নিগ্রহমূলক রাষ্ট্র ও সমাজের প্রতিনিধিত্ব করেন। নারী নিগ্রহের রাজনীতি, সংস্কৃতি ও অর্থনীতির নিরাপদ প্রতিনিধি হন এসব নারীরা। এতে ধোঁকা পায় বোকা নারীরা। সনাতন ধর্মে অনেক ক্ষমতাধর নারী দেবী রয়েছেন, কালী-দুর্গা-লক্ষ্মী-স্বরস্বতী। তারা মা’য়ের আসনে বসে পুরুষ ভক্তের পুজো পায়। কিন্তু নারীর ওপর যে নিগ্রহ রয়েছে, তার পুরুষ ভক্তেরাই সেটা জারি রাখে। এসব দেবী কখনো নারী নিগ্রহকারী ভক্তের বিরাগভাজন হন না।

তা হলে নারীর শত্রু কে? আসলে শুধু লৈঙ্গিক সমস্যার মধ্যে নারী নিগ্রহের সমাধান নেই। এই সমস্যার সমাধানের আলোচনার বিস্তৃতি দরকার। এই সমস্যার জন্য সমাজ, রাজনীতি, সংস্কৃতি ও অর্থনীতিকে আলাদা করা যায় না, বরং অনিবার্যভাবে যুক্ত করতে হয়। নারীর জন্য মুক্ত সমাজ নির্মাণ করতে হলে সকল শ্রেণির জন্যই মুক্ত সমাজ সৃষ্টির দায় চলে আসে।

চীনের একটি প্রাচীন প্রবাদ ছিল, ‘খুদগুলো যেমন চাল নয়, নারীরাও তেমনি মানুষ নয়।’ আধুনিক সমাজ গড়ার আগে কমবেশি সব সমাজেই নারীদের সম্পর্কে মনোভাব এই প্রবাদটির মত খুব পোক্তভাবেই প্রতিষ্ঠিত ছিল। কমবেশি সকল ধর্মগ্রন্থে নারীদেরকে পুরুষের অধস্তন অর্ধাঙ্গিনী, অনেকটা দাসী, হিসেবে দেখানো হয়েছে। এই দাসত্বের সংস্কৃতি এত গভীরে পৌঁছে গেছে যে, এত আন্দোলন-সংগ্রাম, এত যুদ্ধ, এত রেনেসাঁ, এত আয়োজনেও সেই নারী সম্পর্কে পশ্চাৎপদ ধারণা দূর হয়নি। উন্নত দেশের কিংবা সমাজের অগ্রসর অংশে সেই পশ্চাৎপদতা দূরীভূত হলেও, নীচেকার বিশাল জনগোষ্ঠী এখনো সেই সাবেকি জায়গাতেই রয়ে গেছে।

নারীদের মানুষের কাতারে নিয়ে আসার কার্যকর আয়োজন শুরু হয় অষ্টাদশ শতকে। তাদের ওপর থেকে নিগ্রহের সকল নিগড় ভেঙ্গে ফেলা হয় আধুনিক সমাজ নির্মাণের ধারায়। অর্থাৎ আধুনিকতার অন্যতম প্রতিশ্রুতি ছিল নারীমুক্তি। আধুনিকতা নারীর ওপর কোনো ধরণের নিপীড়ন অনুমোদন করে না। পুঁজিবাদ ও সমাজতন্ত্র — দু’টোই আধুনিক সমাজ। আজকের যুগে আধুনিক পুঁজিবাদী সমাজ তার যৌবনদীপ্ত স্বরূপ হারিয়ে ফেলেছে, আপোষকামী হয়ে উঠেছে। তার দেহে দেখা যাচ্ছে বার্ধক্য ও জরা। তাই যৌবনকালের প্রতিশ্রুতি থেকে সরে এসেছে আধুনিক পুঁজিবাদ। নারী মুক্তির প্রশ্নে আপোষকামী। জরাগ্রস্ত পুঁজিবাদী-সাম্রাজ্যবাদী বিশ্ব ব্যবস্থা নারীর ওপর সকল নিগড় ভাংতে সে অনেক হিসাব-নিকাশ করে, পাছে পায়ের নীচ থেকে মাটি সরে না যায়। যার কারণে সমাজের নারী সম্পর্কে পশ্চাৎপদতা দূর করার ঝুঁকি নেয় না। নারী সম্পর্কে কতটা পশ্চাৎপদতা এখনো বহাল আছে, তা এক প্রতিবেদন থেকেই কিছুটা বোঝা যায়।

এক প্রতিবেদনে দেখা গেছে, নারীর প্রতি বিশ্বের ৯০ শতাংশ নারী-পুরুষই নেতিবাচক মনোভাব পোষণ করেন। অর্থাৎ ১০০ জনের মধ্যে ৯০ জনেরই রয়েছে নারীর প্রতি নেতিবাচক মনোভাব। গত ৫ মার্চ ২০২০ ‘জেন্ডার সোশ্যাল নর্ম’ সূচক প্রকাশ করে জাতিসংঘ। আর সেখানেই এ তথ্য উঠে আসে। বিবিসির এক প্রতিবেদনে এ তথ্য জানানো হয়।

ওই প্রতিবেদনে দেখা যায়, বিশ্বব্যাপী ৫০ শতাংশ পুরুষ মনে করেন চাকরির ক্ষেত্রে নারীর চেয়ে তাদের অধিকার বেশি। জরিপে অংশ নেওয়া এক-তৃতীয়াংশ মানুষ মনে করেন, পুরুষ যদি তাদের নারী সঙ্গীকে আঘাত করেন, তা গ্রহণযোগ্য। গবেষণায় দেখা গেছে, বিশ্বের কোনো দেশেই লিঙ্গ সমতা নেই।

জিম্বাবুয়ের ৯৬ শতাংশ মানুষ মনে করেন, নারীর প্রতি সহিংসতা গ্রহণযোগ্য। ফিলিপাইনের ৯১ শতাংশ মানুষের এই মতামত। চীনে ৫৫ শতাংশ মানুষ মনে করেন পুরুষরা রাজনৈতিক নেতা হওয়ার জন্য সবচেয়ে উপযুক্ত। যুক্তরাষ্ট্রের ৩৯ শতাংশ মানুষ মনে করেন, পুরুষরাই যোগ্য নেতৃত্ব দেন। নিউজিল্যান্ডের ২৭ শতাংশ মানুষ এমন মনোভাব পোষণ করেন। যুক্তরাষ্ট্রে ২৫ শতাংশ মানুষ মনে করেন, নারীর চেয়ে পুরুষের চাকরি করার অধিকার বেশি এবং পুরুষরা নারীর চেয়ে ভালো কর্মী হন। ভারতে এই হার ৬৯ শতাংশ। অর্থাৎ বোঝা যাচ্ছে, কথিত অগ্রসর দেশেও সাধারণের মধ্যে নারীকে নিয়ে কত পশ্চাৎপদ ধারণা রয়েছে। আমাদের মত ধর্মীয় প্রভাবাধীন দেশের তো কথাই নেই। বাংলাদেশের গ্রাম, শহরের মুসলিমদের ধর্মীয় আলোচনায় নারীকে কুৎসিত ও রগরগে ভাবে উপস্থাপন চলে। উত্তরাধিকার আইনে বাবার সম্পত্তিতে নারীর অংশে রয়েছে বড় ধরণের বৈষম্য।

এছাড়া এসিড নিক্ষেপ, নারীশ্রমিকদের হত্যা-ধর্ষণের ঘটনার বিবরণ এতটাই দীর্ঘ হবে যে, সেটা দিলে মূল কথাটাই আড়াল হয়ে যাবে। অর্থাৎ বোঝা যাচ্ছে যে, নারীকে মুক্ত করার বেশির ভাগ কাজ এখনো বকেয়া পড়ে আছে। নারীর নিরাপদ রাষ্ট্র নেই।

বর্তমান যুগে বুড়ো হয়ে যাওয়া পুঁজিবাদের ঘাড়ে চাপা আধুনিকতা নারীকে সকল নিগ্রহ থেকে মুক্তি দিতে অক্ষম। ইউরোপ নারীকে মুক্তি দিয়েছে, তবে পুরোপুরি মুক্তি দিতে পেরেছে কি? আমাদের মত পশ্চাৎপদ সমাজে নারী মুক্তির ছিটেফোটা কাজ শুরু হয়েছে আধুনিক সমাজ বিনির্মাণের ধারায়। আধুনিকতা যতটুকু এসেছিল, তার আলো ফিকে হওয়ার পর উপর তলায় কিছুটা পড়েলেও নীচের তলা অন্ধকারই থেকেছে। কারণ আমাদের সমাজে আধুনিকতা এসেছে উপনিবেশের হাত ধরে। উপনিবেশিক দস্যুরা তাদের লুটপাটের বৈধতা, ন্যয্যতা ও যৌক্তিকতা প্রমাণ করতে আধুনিকতার ঝান্ডা নিয়ে এসেছিল। তাদের আধুনিকতা হলো, উপনিবেশের লুটপাটের উপযোগী। তারা এমন আধুনিকতাকেই অনুমোদন করতেন, যা তাদের অন্যায় লুটপাটকে প্রশ্ন করে না, ছুঁড়ে দেয় না চ্যালেঞ্জ। আমাদের মতে, পররাজ্য গ্রাসকারী উপনিবেশিক শাসকদের শোষণ-লুঠতরাজকে নিরাপদ ও ঝুঁকিমুক্ত রাখতে, তাদের যাবতীয় অপকর্মকে সমর্থন করে, তাকে বৈধতা দিয়ে, আধুনিকতার মূল্যবোধ যতটুকু টেকে ততটুকুই উপনিবেশিক আধুনিকতা।

তবুও সেই সময় উপনিবেশিকতার হাত ধরে আসা আধুনিকতার ছোঁয়ায়, ভারতীয় নারীকে প্রাচীন প্রথার নিগড় থেকে মুক্ত করার আয়োজন শুরু হয়। তারই প্রভাবে রাজা রাম মোহন রায় সতীদাহ বন্ধের জন্য লড়েছিলেন। ভারতে হিন্দু নারীকে মুক্ত করতে এগিয়ে এসেছিলেন তিনি। রামায়নের গ্রন্থ মতে, নারীকে (সীতা) আগুনে নিক্ষেপ করেছিল ত্রেতা যুগের হিন্দুর অবতার রামচন্দ্র। আর ভারতবর্ষে শুরু হওয়া প্রাক আধুনিক যুগে নারীকে আগুন থেকে রক্ষা করেছিলেন রাজা রাম মোহন রায়। তাই হিন্দু নারীর কাছে নি:সন্দেহে রাম চন্দ্রের চেয়ে শতগুন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্ব রাম মোহন। রাজা রাম মোহন রায় হিন্দু নারীর ত্রাতা ও তার দ্বিতীয় জন্মদাতা।

আজকের যুগে উপনিবেশিক আধুনিকতার মধ্যে সীমাবদ্ধ আধুনিকতাও আর নারীকে মুক্তি দিতে পারে না। ঊনিশ শতকে কলকাতাকেন্দ্রিক কথিত রেনেসাঁর ভেতর দিয়ে যেসব ভাবাদর্শ বেরিয়ে এসেছে, সেটা হল উপনিবেশিক আধুনিকতার উদাহরণ, যেখানে নারীর মুক্তির দিশা নাই। এমনকি ষাটের দশকে পূর্ববাঙলায় যে উত্থানপর্ব সূচিত হয়েছিল, সেখানে জাতীয় মুক্তি ও ধর্মনিরপেক্ষতার প্রশ্নটি আলোচনায় আসলেও, নারী মুক্তির প্রশ্নটি আড়ালেই থেকেছে। তাই এখন আমাদের ঘাড়ে চেপেছে এদেশের উপযোগী একটি আধুনিকতার জমিন নির্মাণের কাজ, যেখানে অন্যান্য গুরুত্বপুর্ণ প্রশ্নের সঙ্গে নারী মুক্তির যাত্রা শুরু হতে পারে; যা আমরা এখনো নির্মাণ করিনি, যেকাজে এখনো হাত লাগানো হয়নি। তবে সে কাজে হাত লাগানোর এখনি শ্রেষ্ঠ সময়।

আমাদের উপযোগী একটি আধুনিক সমাজ নির্মাণের স্বরূপ কেমন হবে? নারী প্রশ্নে আমাদের জবাব হলো, সেখানে নারীর ওপর সবধরণের নিপীড়নের বিলোপ। তার ওপর যৌন নিপীড়ন বন্ধ হবে, শারীরিক নির্যাতন বন্ধ হবে অথচ রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক নিপীড়ন আগের মতই বহাল থাকবে — সেরকম চিন্তা করাটাও স্বাভাবিক নয়। আবার সমাজে সাধারণভাবে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক শোষণ থাকলেই নারীরা মুক্ত থাকবে, সে রকম চিন্তাও স্বাভাবিক নয়। অর্থাৎ নারীকে মুক্তি দিতে গিয়ে দরকার পড়ে পুরো সমাজের ওপর থেকেই যাবতীয় শোষণের বিলোপ সাধন। এর অর্থ এই নয় যে, সমাজে শ্রেণি শোষণ দূর হলেই নারী মুক্তি পাবে। না, শ্রেণি শোষণ দূর হলেই নারী মুক্তি পাবে না। নারীর ওপর দুই ধরণের শোষণ বহাল আছে, এক. শ্রেণি শোষণ, যা সকল মজুর শ্রেণির ওপরই কার্যকর, দুই. পুরুষতান্ত্রিক শোষণ, যা ধর্ম ও পুরানা ধ্যান-ধারণা থেকে উৎসারিত, সেই ধারণা দ্বারা প্রভাবিত নারী ও পুরুষ উভয়ই নারীর ওপর নিপীড়ন চালায়।

তাই শোষণহীন একটি সমাজ গড়ার জন্য শ্রেণি মুক্তির লড়াইয়ের পাশাপাশি নারী মুক্তির লড়াইও আলাদাভাবে জোরালোভাবে বহাল রাখতে হয়। সেই লড়াইয়ের প্রতিপক্ষ সব ধরণের শোষণ (শ্রেণি শোষণ, জাতিগত শোষণ ও পুরুষতান্ত্রিক শোষণ), সেই শোষণের প্রতিনিধি, সে নারীই হোক আর পুরুষই হোক, তাকেই শত্রু জ্ঞান করতে হবে। ভাবাদর্শিক শত্রু হিসেবে যে সব ধারণা নারীকে দমিয়ে রাখে, বঞ্চিত রাখে, নিগৃহীত করে, নিপীড়িত রাখে, সেটা ধর্মই হোক বা সমাজের পশ্চাৎপদ চিন্তাভাবনাই হোক কিংবা মিথই হোক, তাকে মোকাবিলা করতে হবে সাহসের সঙ্গে, পরাস্ত করতে হবে দৃঢ়তার সঙ্গে। সেই লড়াইয়ের সহযোদ্ধা, সে নারীই হোক বা পুরুষই হোক, তাকেই মিত্র হিসেবে গ্রহণ করতে হবে।

নারীর ওপর সব ধরণের শোষণ দূর না করে,  নারী যে সমাজে বসবাস করে সেই সমাজের সব ধরণের শোষণ, বিশেষত রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক শোষণ দূর না করে, যারা নারীকে মুক্তি দিতে চায়, তারা আসলে নারীকে মুক্ত করতে চায় না। বরং তারা নারী মুক্তির লড়াইয়ের নামে দু’টো আয়-রোজগার করে খেতে চায়।

নারীকে মুক্তি দিতে পুরো সমাজকেই মুক্ত করে দিতে হবে। নারীর ওপর সব ধরণের শোষণের বিলোপ চাইলে পুরো সমাজ থেকেই শোষণের বিলোপ ঘটাতে হবে। সন্তানের ওপর পিতামাতার শোষণ, পরিবারের ‘পবিত্র সম্পর্কের’ আড়ালে বিয়ের নামে নারীর ওপর বেশ্যাবৃত্তির বিলোপ সাধন এবং সর্বোপরি নারীকে পণ্য করার দশা থেকে মুক্তি দিলেই নারীর মানুষের কাতারে আসার শর্ত তৈরি হবে।

 

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
Archive
 
সাম্প্রতিক পোষ্টসমূহ