Banner
খ্রিস্ট ধর্মের স্বরূপ সন্ধান — আলমগীর হুসেন

লিখেছেনঃ আলমগীর হুসেন, আপডেটঃ December 24, 2020, 12:00 AM, Hits: 1965

 

 

 

যিশু কে ছিলেন, যিশুর অস্তিত্ব নিয়ে বিতর্ক

[লক্ষ্যনীয় : রচনাটি ইব্রাহিমী একত্ববাদী ধর্মের আবির্ভাবের রহস্য উদ্ঘাটনের লক্ষ্যে খ্রিস্টপূর্ব ইহুদি জনগোষ্ঠীর প্রায় ২০০০ বছরের সামাজিক, রাজনৈতিক ও ধর্মীয় ইতিহাস অনুসন্ধানের অংশ হিসেবে লিখিতে হয়েছিল, এবং সে কারণে পাঠকের কাছে কিছুটা খাপছাড়া লাগতে পারে।

* রচনাটি ২০১৭ ডিসেম্বরে প্রথম প্রকাশিত হয়েছিল]

 

যিশু কে ছিলেন? আদৌ যিশুর অস্তিত্ব ছিল কী?

ইহুদি ধর্ম হচ্ছে খ্রিস্টধর্মের অগ্রদূত। খ্রিস্টধর্ম ইব্রাহিমী একত্ববাদী ধর্মের একটা প্রশাখাই নয়, এর সূচনাও হয়েছিল ইহুদিধর্মের কেন্দ্রস্থল ফিলিস্তিনে। খ্রিস্টধর্মের জন্মকালে (১ম শতাব্দী) ফিলিস্তিন ছিল পৃথিবীর সর্বোচ্চ সংখ্যক ইহুদির বাসভূমি এবং ধর্মীয় ও রাজনৈতিকভাবে ইহুদিবাদের সর্বোচ্চ গুরুত্বপূর্ণ পূণ্যভূমি।

ইসলাম ধর্মীয় উপাখ্যানে যিশুর জন্ম সংক্রান্ত নানান কেচ্ছা-কাহিনী প্রচলিত আছে। তবে খ্রিস্টধর্মীয় উপাখ্যান অনুসারে যিশু জন্মেছিলেন ফিলিস্তিনে কুমারী মাতা মেরির (মরিয়ম) গর্ভে, যিনি তখন যোসেফের (ইউসুফ) বাগদত্তা ছিলেন। যিশুর জন্মের পর ফিলিস্তিনের রোমান শাসক হেরোড নাকি ইহুদিদের নবজাতক শিশুদের হত্যা করার সিদ্ধান্ত নেন, যদিও এর কোন ঐতিহাসিক প্রমাণ নেই। সে কারণে মেরী ও যোসেফ বাচ্চা যিশুকে নিয়ে পার্শ্ববর্তী দেশ মিশরে পালিয়ে যান এবং সেখানেই যীশু বেড়ে উঠে। হ্যারোডের মৃত্যুর পর যিশু বাবা-মার সাথে ফিলিস্তিনে ফিরে এসে হ্যারোড অ্যান্টিপাস শাসিত গ্যালিলির নাজারেথ শহরে আবাস গড়েন। মোটামুটি ৩০ বছর বয়সে তিনি ধর্ম প্রচারণা শুরু করেন এবং বছর তিন পর তাকে ক্রুশবিদ্ধ করে হত্যা করা হয়।

যিশু প্রকৃতপক্ষে কে ছিলেন কিংবা এমন কেউ আদৌ ছিলেন কীনা, সে সম্পর্কে অনেক বাক-বিতণ্ডা রয়েছে। খ্রিস্টধর্মের উৎপত্তি হৃদয়ঙ্গম করতে হলে এর সূচনাকালে ফিলিস্তিনের আর্থ-সামাজিক অবস্থা অনুধাবন করা অপরিহার্য। এ বিষয়গুলো এখানে সংক্ষেপে আলোচিত হবে।

 

যিশু কে ছিলেন?

যিশুর ঐতিহাসিকতা বিষয়ক সংশয়ঃ

যুগযুগ ধরে অনেক বিখ্যাত গবেষক ও পণ্ডিত যিশুর ঐতিহাসিক অস্ত্বিত্ব সম্পর্কে প্রশ্ন তুলে এসেছেন। ব্যক্তি যিশুর ঐতিহাসিক অস্তিত্ব তথা রক্তমাংসের মানবদেহে পৃথিবীতে ঈশ্বরের আবির্ভাব সম্পর্কে বিতর্ক শুরু হয় খ্রিস্টধর্ম প্রতিষ্ঠার সূচনাযুগেই, যখন ‘ডকিটিক নস্টিক’ নামের এক খ্রিস্টান সম্প্রদায় বিশ্বাস করতো যে, বস্তু হচ্ছে মন্দের প্রতীক যা ঈশ্বরের প্রকৃতি-বিরুদ্ধ; ফলে রক্তমাংসের শরীর-রূপী যিশু তথা বস্তুরূপে ঈশ্বরের ধরাতলে আগমন অসম্ভব ছিল। নস্টিকদের এই দাবীর জবাব দিতে বাধ্য হন প্রাথমিক যুগের খ্রিস্টান পণ্ডিতগণ, যাদের মধ্যে রয়েছেন ‘গস্পেল’ (যিশুর বাণী) লেখক ও প্রচারক অ্যাপোসল জন। রক্তমাংসের শরীরে যিশুর আবির্ভাবতত্ত্বের বিরোধীদেরকে নিন্দা করতঃ খ্রিস্ট-বিরোধী (অ্যান্টি-ক্রায়েস্ট) শয়তানের প্রেতাত্মা আখ্যা দিয়ে তিনি লিখেনঃ

(১) “যীশু রক্তমাংস রূপে এসেছেন – এ তত্ত্বটি গ্রহণকারী প্রতিটি আত্মার উৎপত্তি স্বয়ং ঈশ্বর থেকে এবং তা প্রত্যাখ্যানকারী আত্মার উৎপত্তি ঈশ্বর থেকে নয়, তারা এ্যান্টি-ক্রায়েস্ট তথা শয়তানের প্রেতাত্মা মাত্র” (১ জন ৪:২-৩)।

(২) “অনেক প্রতারক, যারা রক্তমাংস রূপে যীশুর আগমণকে অস্বীকার করে, তারা বিপথগামী। এরূপ মানুষ প্রতারক ও এ্যান্টি-ক্রায়েস্ট ছাড়া কিছুই নয়।” (২ জন ৭)

খ্রিস্টধর্মের জন্মের সূচনাযুগেই যিশুর ঐতিহাসিক অস্তিত্ব সম্পর্কে উদ্ভূত এ সন্দেহ সচল থেকেছে আধুনিককাল পর্যন্ত। আমেরিকার প্রতিষ্ঠা পিতা ও তৃতীয় প্রেসিডেন্ট টমাস জেফারসন ও দার্শনিক বার্ট্রান্ড রাসেলের মত বিদ্যান ব্যক্তিও যিশুর ঐতিহাসিক অস্তিত্ব সম্পর্কে সন্দেহ প্রকাশ করে গেছেন। অন্যদিকে গোড়া খ্রিস্টানরা এরূপ সন্দেহকারীদেরকে ‘শয়তানের প্রেতাত্মা’ আখ্যা দিয়ে গেছেন। যিশুর অস্তিত্ব সম্পর্কে যাবতীয় তথ্য ও বিতর্ক এখানে সংক্ষিপ্তাকারে উপস্থাপন করা হবে।

খ্রিস্টধর্মের বয়স দুই হাজার বছর। অথচ আজও ‘যিশু কে ছিলেন’ প্রশ্নটি অনিশ্চয়তায় পূর্ণ। খ্রিস্ট বাইবেল তথা নিউ টেস্টামেন্টে যিশুর নানান অলৌকিক কর্মকাণ্ড বর্ণিত হয়েছে – যেমন নানান দুরূহ রোগে আক্রান্তদের অলৌকিকভাবে নিরাময়করণ, বারবার এক টুকরো রুটি দিয়ে হাজার হাজার মানুষকে পেটভরে খাওয়ানো, এবং তার জন্মকে ঘিরে অবিশ্বাস্য ও কিংবদন্তীরূপ ম্যাজাই কাহিনী ও অন্যান্য। যৌক্তিক ও বাস্তববাদী মনে এসব উদ্ভট কেচ্ছা-কাহিনী সহজেই যিশুর ঐতিহাসিকতার বিষয়ে সন্দেহের সৃষ্টি করে। বলা আবশ্যক যে, গস্পেল অনুসারে যিশুর দুনিয়াতে আগমন ছিল শুধুই ইজরাইলবাসী বা ইহুদিদের ‘মেসিয়া’ বা ‘পরিত্রাণকারী’ হিসেবে, কিন্তু ইহুদিদেরকে তার ধর্ম সংস্কারের মিশনে আকৃষ্ট করতে চরমভাবে ব্যর্থ হন এবং শেষশেষ ইহুদিদের অভিযোগের ফলশ্রুতিতে তৎকালীন রোমান শাসক তাকে শুলে চড়িয়ে হত্যা করে। কবর থেকে কথিত পুনরুত্থানের পর যিশু নাকি তার ১২জন নিবেদিতপ্রাণ অনুসারীর সাথে গোপনে বৈঠক করেন এবং তাদেরকে ইহুদিদেরকে বাদ দিয়ে পৌত্তলিকদের (জেন্টাইল) মাঝে তার ধর্ম প্রচারের নির্দেশ দিয়ে চিরতরে উধাও হয়ে যান। স্বভাবতই প্রশ্ন উঠে, সমগ্র মহাবিশ্বের স্রষ্টার জন্য কেবল মানব প্রজাতির ছোট্ট একটা গোষ্ঠীর জন্য এতোটা দরদ দেখানো বা তাদেরকে রক্ষার জন্য ভুড়িভুড়ি অলৌকিক অনুদান-আশীর্বাদসহ যিশুকে পাঠানো কতোটা যৌক্তিক? একজন ন্যায়পরায়ণ ও সমতাবাদী ঈশ্বরের দরদ, করুণা ও আশীর্বাদ অবশ্যই সমগ্র প্রাণীজগতের প্রতি না হলেও অন্তত সমগ্র মানবজাতির জন্য সমানভাবে বরাদ্দ থাকবে। আরও গুরুত্বপূর্ণ – যে ইহুদিদের জন্য এতোটা দরদ দেখাতে, তাদেরকে রক্ষা করতে, ঈশ্বর স্বয়ং যিশুরূপে ধরনীতে এলেন, তখন পর্যন্ত পৃথিবীতে সে জাতিটির তেমন কোন অবদান ও অর্জন ছিল না। মিশরীয়, ভারতীয়, গ্রিক এবং পারস্য জাতিগুলো পৃথিবীতে অনেক বেশী অবদান রেখেছিল এবং তারা ইহুদিদের তুলনায় ঈশ্বরের দরদ ও আশীর্বাদের অনেক বড় দাবিদার ছিল।

যিশু কে ছিলেন, সে বিষয়ে বাইবেলেও অনেক অস্পষ্ট, গোলমেলে, পরস্পরবিরোধী ধারনা বিদ্যমান। নিউ টেস্টামেন্ট দাবী করে যে, মা মেরীর গর্ভে যিশুর ভ্রুণায়ন হয়েছিল তথাকথিত ‘পবিত্র আত্মা’ (হোলি স্প্রিট) দ্বারা (ম্যাথিও ২:২০): “…তার (মেরীর) গর্ভে যা ধারিত, তা এসেছে হোলি স্প্রিট থেকে।” অথচ যিশুর পরিচয় সম্পর্কে বাইবেল ৩টি গোলমেলে দাবী উপস্থাপন করেছেঃ

() যিশু মানব পুত্রঃ  নিউ টেস্টামেন্টে যিশুকে ৮বার ‘মানব পুত্র’ বা ‘পুরুষ মানুষের পুত্র’ (Son of Man) আখ্যা দেওয়া হয়েছে। দেখুন ম্যাথিউ ১৬:২৭-২৮, ২৬:৬৪; মার্ক ২:১০,২৮, ৮:৩১, ৯:৯,৩১; লুক ৬:৫,২২; জন ১:৫১, ৩:১৩-১৪ ইত্যাদি বাণীগুলো।

() যিশু ঈশ্বর পুত্রঃ  বাইবেলে যিশুকে ঈশ্বরপুত্র (Son of God) বলা হয়েছে অনেকবার। দেখুন ম্যাথিউ ৪:৩, ২৬:৬৩ ও ২৭:৪০,৪৩,৫৪; মার্ক ১:১ ও ৩:১১; লুক ১:৩৫ ও ৪:৩,৯; জন ১:৩৪,৪৯ এবং গ্যাল ২:২০ ইত্যাদি।

() যিশু স্বয়ং ঈশ্বরঃ  গসপেলে যিশুকে স্বয়ং ঈশ্বর হিসেবেও দাবী করা হয়েছে। যেমন জন ১:১ বলছেঃ “শুরুতে ছিল শব্দ এবং শব্দ ছিল ঈশ্বরের সাথে এবং শব্দই ছিল ঈশ্বর। শুরুতে তিনি (যিশু) ছিলেন ঈশ্বরের সাথে।” অর্থাৎ শুরুতে শব্দ ছিল ঈশ্বরের সাথে এবং শব্দই ঈশ্বর, এবং যিশু ছিলেন ঈশ্বরের সাথে। কাজেই যিশু-ই শব্দ এবং স্বয়ং ঈশ্বর।

যিশুর ঈশ্বর স্বরূপ ধ্বণিত হয়েছে জন ১:১৪ আয়াতেওঃ “আমরা দেখেছি মাহাত্ম সেই জনের, শুধুই সেই জনের (the One and Only), যিনি (যিশু) পিতার কাছ থেকে সম্পূর্ণ মহিমা ও সত্যসহ এসেছেন।”

‘সেই জনের, শুধুই সেই জনের’ (the One and Only) বলতে সর্বশক্তিমান ঈশ্বরকে বোঝানো হয়েছে এবং যিশু এসেছিলেন সর্বশক্তিমানের সকল মহিমা ও সত্য নিয়ে। কাজেই যিশু এবং ঈশ্বর এক ও অভিন্ন। আরেক ঘটনায় (জন ১৪:১০) ইহুদিদের সাথে তর্কাতর্কির মাঝে যিশু দাবী করেন তিনি ইহুদিদের পিতৃপুরুষ ইব্রাহিমকে দেখেছেন। এতে ইহুদিরা অবজ্ঞার সুরে বলেঃ “তোমার বয়স এখনও পঞ্চাশই হয় নি অথচ তুমি ইব্রাহিমকে দেখেছো?” প্রতিউত্তরে যিশুর দাবী: “ইব্রাহিমের জন্মের আগেই জন্মেছিলাম আমি”।

যা আবারও যিশুর ঈশ্বরীয় প্রকৃতির দাবী প্রতিপন্ন করে। তবে যিশু যে স্বয়ং বিশ্বপিতা বা ঈশ্বর ছিলেন, তার সবচেয়ে জোরদার দাবী উত্থিত হয়েছে তার এ উক্তিতেঃ “তোমরা কী বিশ্বাস করো না যে আমিই পিতার মাঝে এবং আমার মাঝেই পিতা?” (জন ১৪:১০)

অর্থাৎ যিশু ও বিশ্বপিতা একই সত্ত্বা। আরেক জায়গায় যিশু বলেনঃ “হে পবিত্র পিতা, তাদেরকে তোমার নামে রক্ষা করো, যে নাম তুমি আমাকে দিয়েছো, যাতে তারা এক হয়ে যায় যেভাবে আমি ও তুমি একই (জন ১৭:১১)

এখানে আবারও দাবী করা হচ্ছে যে, ঈশ্বর ও যিশু একই সত্তা।

খ্রিস্টানরা সার্বিকভাবে যিশুকে স্বয়ং ঈশ্বর হিসেবে গ্রহণ করেছে কিংবা ঈশ্বরের পুত্র হিসেবে – যা বাইবেলের বক্তব্যের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ। অথচ এক জায়গায় যিশু নিজেই তার পূনঃপূন ঈশ্বরত্বের দাবীকে অস্বীকার করেছেন (মার্ক ১০:৭-১৮):

যিশু পথে বের হলে এক লোক দৌঁড়ে গিয়ে তার চরণতলে পড়ে গিয়ে বললঃ “হে মহান গুরু, চিরন্তন জীবন লাভের জন্য আমি কী করতে পারি?” জবাবে যিশু বলেন, “আমাকে কেন মহান বলছো? কেউই মহান নয়, শুধুই ঈশ্বর ছাড়া।”

যিশু এখানে সুস্পষ্ট বলছেন যে, তিনি ঈশ্বরের সমতুল্য নন।

খ্রিস্টানরা যেহেতু যিশুকে ঈশ্বরপুত্র বা স্বয়ং ঈশ্বর বলে গ্রহণ করেছে, বাইবেলে ‘মানবপুত্র’ হিসেবে যিশুর পরিচয়টি তাদের জন্য এক মাথাব্যাথার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। তারা নানান গোলমেলে ব্যাখ্যা দিয়েছে এ অসঙ্গতি সম্পর্কে। কেউ কেউ বলেছেন, ‘মানবপুত্র’ হিসেবে যিশুর পরিচয় শুধুই একটা ‘ত্রাণকর্তামূলক শিরোনাম’ মাত্র। অন্যদের মতে, মানব পুত্র ‘বিস্তৃত তাৎপর্য’ বহন করে। প্রখ্যাত লেখক ও ধর্মতত্ত্ব যাজক সংঘের প্রেসিডেন্ট ডঃ রন রোডস-এর মতে, মানব পুত্র শব্দদ্বয় যিশুর মানবত্বকে প্রতিপন্ন করে ‘তার ঈশ্বরত্ব’কে অস্বীকার না করেই। তিনি বলেন, ‘মানুষ হয়েও যিশু ঈশ্বর হওয়া থেকে সরে যান নি। যিশুর (মানব) দেহধারন তার ঈশ্বরত্বকে অপসারণ করে নি, ঈশ্বরত্বে মানবীয়তা যোগ করেছে মাত্র।’[1]

বলা আবশ্যক, বাইবেলে ইহুদি নবী এজিকিয়েল'কেও মানবপুত্র আখ্যা দেওয়া হয়েছে ৯৩ বার। এজিকিয়েল যেহেতু শুধুই মানুষ ছিলেন, কাজেই মানবপুত্র শব্দদ্বয় সম্ভবত আসলেই যিশুর মানবীয়তার পরিচয় বহন করে। এটা লক্ষণীয় যে, এজিকিয়েল ও যিশু উভয়কে ‘মানব পুত্র’ পরিচয়ে ভূষিত করে বাইবেল এর মাধ্যমে দু’টি খুবই ভিন্ন প্রকৃতির সত্তাকে তুলে ধরেছে।

বাইবেলিয় ঈশ্বর সম্পর্কে আরেক গোলমেলে ব্যাপার হচ্ছে, যিশুকে মানবীয় ও ঐশ্বরিক সত্তার এক শংকর (হাইব্রিড) মনে হয়, কেননা ঐশ্বরিক আত্মার (হোলি স্প্রিট) দ্বারা মানবীয় মেরীর ভ্রুণায়নের মাধ্যমে যিশুর জন্ম হয়েছিল। সে ভিত্তিতে যিশুকে ‘ঈশ্বরের পুত্র’, অথবা ‘মেরীর পুত্র’ কিংবা ‘নারীর পুত্র’ বলা যায়, কিন্তু কোন যুক্তিতেই ‘Son of Man’ বা ‘পুরুষ মানুষের পুত্র’ বলা যায় না। বাইবেলের বর্ণনায় কোন পুরুষই যিশু জন্মদানে ও তার দৈহিক সংগঠনে আদৌও কোন অবদান রাখে নি।

সার্বিক বিচারে, যিশু এক অত্যন্ত গোলমেলে সত্তা। তিনি কে বা কী ছিলেন সে বিষয়ে নিজেই বিভ্রান্ত। একবার তিনি নিজেকে ‘মানবপুত্র’ বলে দাবী করেছেন, আরেকবার ‘ঈশ্বরপুত্র’ হিসেবে, আরেক জায়গায় ‘স্বয়ং ঈশ্বর’ হিসেবে। চারিত্রিক গুণাবলীতেও তার মাঝে দু’টো চরম বিপরীতধর্মী প্রকৃতি ফুটে উঠে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে তিনি ধৈর্যশীলতা, ভব্যতা ও ক্ষমাশীলতার সর্বোচ্চ প্রতীক হয়ে উঠেছেন, অন্যত্র দেখিয়েছেন ধৈর্যহীন অশিষ্টতা (যেমন তার ক্ষুধার সময় ঝাউ গাছে ফল না থাকায় গাছটিকে অভিশাপ দান, ম্যাথিউ ২১:১৮-১৯), আক্রমণ প্রবণতা (যেমন মন্দির প্রাঙ্গনে ব্যবসায়ীদের মালামাল বেচাকেনার টেবিল-বেঞ্চ উপরে ফেলা এবং ব্যবসায়ীদেরকে তাড়িয়ে দেওয়া, ম্যাথিউ ২১:১২-১৩), এবং গালাগাল প্রিয়তা (‘তোমরা সাপ! তোমরা বিষধর সর্পছানা’ (ম্যাথিউ ২৩:৩৩, ১২:৩৪)। আজকের যুগে যে কোনো মানুষের জন্যই এমন আচরণ অশিষ্টাচারী, অশোভনীয় বিবেচিত।

যিশুর ব্যক্তিত্ব ও সত্তাকে ঘিরে এসব বিষয়গুলো সুস্পষ্টভাবে তাকে ‘অবাস্তব’ সত্তা হিসেবে প্রতিপন্ন করে।[2] আমরা আরও তথ্যসাক্ষ্য দেখতে পাবো, যা প্রমাণ করবে যে যিশুর ঐতিহাসিক অস্তিত্ব সম্পর্কে সংশয়বাদীদের সন্দিহান অবস্থান আদৌ ভিত্তিহীন নয়, বরং শক্ত ভিত্তির উপর দাঁড়িয়ে।

টীকা:

[1]Ron Rhodes, If Jesus was the Son of God, why did He call Himself the Son of Man?: http://www.christiananswers.net/q-eden/son-of-man.html

[2]For more information on this issue, readers may look at Jim Walker, Did a historical Jesus exist?: http://www.nobeliefs.com/exist.htm

===========================

যিশুর নৈতিক শিক্ষার পুরোধা – স্বয়ং যিশু না সক্রেটিস?

যিশুর মিশন ও প্রকৃত ইহুদি মেসিয়া মিশনের মাঝে বৈপরীত্য:

নিউ টেস্টামেন্টে যিশুর প্রাথমিক বাণীগুলো স্পষ্ট করে তোলে যে, খ্রিস্টধর্ম ছিল মূলত মুসার আইনসমূহ তথা ইহুদি ধর্মের সংস্কারের প্রচেষ্টা। যেমন যেমন ম্যাথিউ ৫:১৭: “ভেবো না যে আমি ধর্মীয় বিধান বা নবীদেরকে ধ্বংস করতে এসেছি; ধ্বংস করতে নয়, আমি এসেছি পরিপূর্ণতা দিতে।“

অথচ যিশু প্রচারিত কিছুকিছু আইন বা নৈতিক ভাবনা তৌরাত-এর বিরোধী, যেমন ব্যভিচারের ক্ষেত্রে। তৌরাতে ব্যভিচারের শাস্তি পাথর-ছুড়ে হত্যা (লেভিটিকাস ২০:১০), অথচ যিশুর সামনে এক ব্যভিচারী মহিলাকে হাজির করলে যিশু তাকে অনুতপ্ত হওয়ার উপদেশ দিয়ে বেকসুর মুক্ত করে দেন (জন ৮:৩-১১)। মুসা নবী ইহুদিদের জন্য একটা ধর্মীয়-রাজনৈতিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করেছিলেন, যা মুসার তথা ইহুদিদের ধর্মীয় আইনের ভিত্তিতে পরিচালিত হবে, অথচ গস্পেলে যিশু ইহুদিদের প্রতি পৌত্তলিক গ্রিকো-রোমান সাম্রাজ্যবাদী শাসনের আনুগত্য প্রচার করেছেন [ম্যাথিউ ২২:২১]। ইতিহাস থেকে আমরা জানি যে, যে কোনো বিশেষ সামাজিক, রাজনৈতিক ও ধর্মীয় আন্দোলনের পেছনে সে স্থানের সমকালীন আর্থ-সামাজিক বা রাজনৈতিক পরিস্থিতি উদ্দীপক অনুঘটক হিসেবে কাজ করে। কাজেই যিশুর ধর্মীয় ও সামাজিক সংস্কার আন্দোলন প্রসঙ্গেও এ প্রশ্নটির যথাযথ বিবেচনা অপরিহার্য যে,  কেনো ঠিক ওই সময়ে হঠাৎ মেসিয়া দাবিকারী যিশু এভাবে ইহুদি আইন সংস্কারের চেষ্টায় ব্রতী হবেন?

প্রশ্নটির সহজ জবাব হচ্ছে – ইহুদিরা বরাবরই বিশ্বাস করতো যে, তাদের সঙ্কটের সময়ে ঈশ্বর তাদের জন্য একজন নবী (মেসিয়া?) প্রেরণ করবেন তাদেরকে সঙ্কটমুক্ত করতে। মুসা নবী ইহুদি জাতির জন্য নবীর আগমনের ভবিষ্যদ্বাণী করতঃ বলেছেন,

“ঈশ্বর তোমাদের জন্য তোমাদের ভ্রাতৃকূলের মধ্য থেকেই আমার মত একজন করে নবী খাড়া করবেন” (ডিঃ ১৮:১৫)। যীশুর শিষ্য এ্যাপোসল পিটার নিউ টেস্টামেন্টে সেই আয়াতটি উদ্ধৃত করেন যীশুর মেসিয়া হওয়ার দাবীকে বৈধতা দিতে “ (অ্যাক্ট ৩:২২)

কিন্তু ইহুদিদের জন্য যুগে যুগে নবী এসেছে। তবে ব্যবিলোনিয় রাজা নেবুকাদনেযার কর্তৃক তাদের ‘প্রতিশ্রুত বাসভূমি’ ফিলিস্তিন থেকে বিতাড়িত হওয়ার পর থেকে ইহুদিদের ভাবনায় মেসিয়ার বৈশিষ্ট্যে ও মিশনে বেশ কিছুটা ভিন্নতা যোগ হয়। এসময় থেকে এক ‘পরিত্রাণদাতা’ মেসিয়ার আগমনের ভাবনাটি ঘনীভূত হতে থাকে প্রধানত বিদেশ-বিভূঁইয়ে নির্বাসিত ইহুদিদের মাঝে। পবিত্র পিতৃভূমিতে ফেরার প্রত্যাশায় মশগুল নির্বাসিত ইহুদিরা স্বপ্ন দেখতে থাকে যে, এক পরিত্রাণদাতা মেসিয়া এসে তাদেরকে পবিত্র বাসভূমি ফিলিস্তিনে ফিরিয়ে নিয়ে যাবে, যেখানে তারা নিজ ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক পরিবেশে বসবাস করতে পারবে। পরবর্তীতে ব্যবিলোনিয়দেরকে হটিয়ে পারস্য শাসক সিরাস দ্যা গ্রে’ট ফিলিস্তিন দখলের পর নির্বাসিত ইহুদিদেরকে পিতৃভূমিতে ফেরার অনুমতি দিলে তারা এতোটাই ধন্যবোধ করে যে, সম্রাট সিরাসকে তৌরাতে ‘ঈশ্বরের anointed one’ তথা ‘মেসিয়া’ হিসেবে অভিষিক্ত করা হয় (ইসাঃ ৪৫:১)। কিন্তু নানান দুর্ভাগ্যজনক কারণে পরবর্তী গ্রিক ও রোমান দখলদারদের হাতে ইহুদিরা নির্যাতিত হতেই থাকে। সেই সাথে ইহুদি মানসে ঘনায়িত হতে থাকে মেসিয়ার আগমণের স্বপ্নও। স্পেনের মুসলিম শাসকের অমানুষিক অত্যাচারে বিমর্ষ দ্বাদশ শতকের সুখ্যাত ইহুদি দার্শনিক ও শাস্ত্রবিদ মাইমোনিদিস ইহুদিদের প্রত্যাশিত মেসিয়ার ব্যাপারে লিখেছেনঃ “আমি পূর্ণ আস্থাসহ মেসিয়ার আগমণে বিশ্বাসী। যদিও তিনি বিলম্ব করে চলছেন, তথাপি আমি প্রতিনিয়ত তার আগমনের প্রত্যাশায় থাকি।

ইহুদি ধর্মগ্রন্থে মেসিয়ার আগমণের কথা বলা থাকলেও এবং ইহুদি জনগোষ্ঠীর মাঝে মেসিয়ার আগমণের প্রত্যাশা জোরদার থাকলেও, ঠিক এই সময়ে তাদের জন্য যিশুর মতো একজন মেসিয়া কেনো আসবে, তার কিছুটা সঙ্গত কারণ থাকা আবশ্যক। মেসিয়ার আগমনের মূল উদ্দেশ্য হবে ঈশ্বরের চয়নকৃত ইহুদি জাতিকে সঠিকপথে চালিতকরণ, যখন তারা ঐশ্বরিক আইন থেকে বিচ্যুত হবে। তৌরাত মতে, ঐশ্বরিক আইন, যা ইহুদিরা মুসার মাধ্যমে পেয়েছিল, তা শ্বাশ্বত, চিরন্তন। তৌরাত কোনোই ইঙ্গিত দেয় না যে, সে আইন কখনো পরিবর্তিত বা বাতিল হতে পারে। অথচ যিশু তা পরিবর্তিত, এমনকি বাতিল করার চেষ্টা করেছেন। তবে যিশুর প্রথম দিকের বক্তব্যগুলো ইহুদি ধর্মগ্রন্থে উল্লেখিত মেসিয়ার মিশনের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ। ইহুদিরা বিপথে গিয়েছে তথা ইহুদি আইন থেকে বিচ্যুত হয়েছে, তাই তাদেরকে রক্ষা করতে হবে, অর্থাৎ সঠিক পথে আনতে হবে। একবার তার ১২জন শিষ্যকে ধর্ম প্রচারের কর্তৃত্বদানকালে যিশু বলেন,

“পৌত্তলিকদের মাঝে যাবে না, না ঢুকবে সামারিতানদের শহরে। বরং যাবে হারিয়ে যাওয়া ইহুদি ভেড়ার পালের মাঝে” (ম্যাথিউ ১০:৫-৬)

অর্থাৎ ইহুদি জনগোষ্ঠী হারিয়ে গেছে, মানে ঈশ্বরের আইন থেকে দূরে সরে গেছে। এবং তার মিশনের উদ্দেশ্য শুধুই পথভ্রষ্ট ইহুদিদেরকে রক্ষা করা, পৌত্তলিকদেরকে নয়।

অথচ যিশু বেশকিছু বিধান প্রণয়নের চেষ্টা করেন, যা তৌরাত বিরোধী। ইহুদি মেসিয়ার অন্যান্য প্রধান কর্মপ্রচেষ্টা হবে, নির্বাসিত ইহুদিদেরকে তাদের পবিত্রভূমি ফিলিস্তিনে ফিরিয়ে আনা (ইসাঃ ১১:১২) এবং ফিলিস্তিনের ধ্বংসকৃত শহরগুলোর পুনঃনির্মাণ (এজিঃ ১৬:৫৫), ইত্যাদি। অথচ যিশু এ কর্মগুলো সাধনের প্রতি কোনো আগ্রহই দেখান নি।

মোট কথায়, যিশুর কর্মকাণ্ডকে ইহুদি ধর্মশাস্ত্রে উল্লেখিত মেসিয়া মিশন বলা যেতো, যদি তা কেবল বিপথগামী ইহুদিদেরকে মুসা নবী প্রণীত তৌরাতের মূল হুকুম প্রতিষ্ঠার জন্যে চালিতো হতো। এ বিচারে মার্টিন লুথারের কর্মকাণ্ডকে খ্রিস্ট্রিয় মেসিয়া মিশন বিবেচিত হয়, কেননা খ্রিস্ট বাইবেলে নির্দেশিত পথ থেকে বিচ্যুত রোমান ক্যাথলিকদেরকে বাইবেলিয় হুকুমের পথে ফিরিয়ে আনাই ছিল লুথারের সংস্কারকর্মের মূল উদ্দেশ্য। কাজেই যৌক্তিক বিচারে যিশুর কর্মকাণ্ডকে ইহুদি মেসিয়া মিশন হিসেবে গণ্য করা কঠিন। এ প্রেক্ষাপটে যিশুর সমসাময়িককালে ফিলিস্তিনে ইহুদিদের আর্থ-সামাজিক পরিস্থিতি বা সঙ্কট আমাদেরকে ধারণা দিতে পারে যে, কেনো যিশু এই সময়ে ‘মেসিয়া’ দাবী তোলে ইহুদিবাদের এমন অপ্রত্যাশিত একটা সংস্কার প্রচেষ্টা হাতে নিয়েছিলেন।

গোড়া ও হেলিনিস্ট ইহুদিদের মাঝে দ্বন্দ্ব

যুগযুগ ধরে ইহুদিদের ধর্মীয় ও সামাজিক বিধান ছিল খুবই অনমনীয়, বিচ্যুতির প্রতি খুবই অসহনশীল, এবং তাদের প্রতিশ্রুত বাসভূম ফিলিস্তিনে অন্য ধর্মের চর্চার প্রতি অত্যন্ত ঘৃণাত্মক ও সহিংস। তৌরাতের বেশকিছু বিধানও অত্যন্ত সহিংস, নির্মম ও বর্বরতামূলক। ফিলিস্তিন ভূখণ্ডে তৎকালীন জগতের প্রধান ধর্ম পৌত্তলিকতা চর্চার প্রতি ইহুদিরা ছিল রক্তক্ষয়ীভাবে সহিংস। তা সত্ত্বেও ইহুদি সমাজ ও জনগোষ্ঠী কখনোই পুরোপুরি একরোখা ও গোড়া ছিল না। রাজনৈতিক বাঞ্ছনীয়তা কিংবা শুধুই সহনশীলতা ও প্রগতিশীলতার খাতিরে সমাজের উচ্চতর অংশ, বিশেষত রাজকীয় কর্তৃপক্ষ, বরাবরই সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় ছাড় দিতে প্রস্তুত থেকেছে। জুদিয়ার ইহুদি রাজা মানাসেহ (খ্রি:পূ: ৭০৯-৬৪২) পিতার অসহনশীল ধর্মীয় শুদ্ধি প্রক্রিয়া ছুড়ে ফেলে জেরুজালেম গীর্জায় মূর্তি স্থাপন করেছিলেন, যা কীনা ইহুদি জাতির কাছে সর্বোচ্চ ঘৃণাত্মক ও অসহনীয়, এবং তিনি সেটা করেছিলেন দৃশ্যতঃ কোনো রকম রাজনৈতিক বা অন্য কোনো সুবিধা হাসিলের উদ্দেশ্য ছাড়াই। অন্যদিকে এমন ধর্মীয় বিচ্যুতি বা অবমাননাকে বারবার ভীষণ নির্মমতার সাথে দমন করা হয়েছে – প্রত্যেকবারই একজন অত্যুৎসাহী গোড়া বিদ্রোহী জেগে উঠেছে, এবং সহিংস অভ্যুত্থানের মাধ্যমে বিচ্যুত ব্যক্তিবর্গকে সমূলে উৎখাত করেছে, অনেকক্ষেত্রে তাদের পরিবার ও সমর্থকগণকেও ছাড় দেওয়া হয় নি।

আগ্রাসী নেবুকাদনেযার (খ্রি:পূ: ৬০৫-৫৬২) কর্তৃক ফিলিস্তিন থেকে ব্যাবিলনে নির্বাসিত হওয়ার পর ইহুদিরা পরবর্তী পারস্য ও গ্রিক শাসনকালে সেখান থেকে ধীরে ধীরে পুরো সাম্রাজ্যে ছড়িয়ে পড়ে। এর ফলে তারা বিচিত্র ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক বাস্তবতার সম্মুখীন হয়। প্রতিশ্রুত বাসভূমি ফিলিস্তিনে তারা ভিন্ন ধর্মাচারের প্রতি সর্বদাই অসহনশীলতা দেখিয়েছে, অথচ নির্বাসনে তারা ধর্মীয় বৈচিত্র এবং নানান ধর্মের একে অন্যের প্রতি সহনশীলতা দেখতে থাকে; এমনকি সাম্রাজ্যবাদী ব্যবিলনিয় প্রভূরা নির্বাসিত ইহুদিদের নিজস্ব ধর্ম চর্চার প্রতিও সহনশীল ছিল। পরবর্তীতে ব্যবিলন পারস্য সাম্রাজ্যের অধীনস্ত হওয়ার পর নির্বাসিত ইহুদিদের ধর্ম-সংস্কৃতির প্রতি নতুন শাসকদের সহনশীলতা আরও বেড়ে যায় – এতোটাই বেড়ে যায় যে, সম্রাট সিরাস দ্যা গ্রেইট তাদেরকে ফিলিস্তিনে ফেরার অনুমতি দিলেও অনেকেই ফিরে না গিয়ে নির্বাসনের আবাসেই থেকে যায়। এরপর আলেকজান্ডার দ্য গ্রেইট-এর বিজয়ের মাধ্যমে তারা গ্রিক সাম্রাজ্যের অধীনে এলে তাদের প্রতি সহনশীলতা না বাড়লেও কমে নি পারস্য শাসনামলের তুলনায়।

ইহুদি সমাজে বরাবরই একটা সামাজিক বিভাজন বর্তমান থেকেছে – যার এক অংশে থেকেছে নমনীয়, সহনশীল, উদার ও সমন্বয়মুখী উচ্চস্তর ও রাজপরিবার; অন্যদিকে থেকেছে গোড়া ধার্মিক ও অসহনশীল শ্রেণী। ফিলিস্তিন সাম্রাজ্যবাদী পারস্য ও গ্রিক শাসনে আসার পর শাসকগোষ্ঠীর বিভিন্ন ধর্মের প্রতি সার্বজনীন সহনশীলতার অভিজ্ঞতা ইহুদি সমাজের এ বিভাজনকে আরও প্রসারিত ও প্রকট করেছিল। ফলে আমরা দেখি যে, সিলিউসিদ (গ্রিক, খ্রি:পূ: ৩১২-৬৩) দখলে আসার পর ফিলিস্তিনের ইহুদি জনগোষ্ঠী দু’টি সুস্পষ্ট ভিন্ন শিবিরে বিভাজিত হয়ে পড়েঃ (১) সাজুসী শ্রেণী, যারা ছিল নমনীয়, সহনশীল ও হেলিনিস্ট; (২) ফারিসী শ্রেণী, যারা ছিল গোড়া ও অসহনশীল এবং সাধারণ জনতার মাঝে অধিক সমর্থনপুষ্ট।

অনুমান করা যায় যে, ফিলিস্তিনি ইহুদি সমাজে নমনীয়তা ও সহনশীলতা তখন চাঙ্গা হয়ে উঠছিল, যার ফলে আমরা দেখি যে জেরুজালেম গীর্জার প্রধান পুরোহিত জেইসন (১৭৫-১৭২ BC) ও মেনিলাউস (১৭১-১৬১ BC) সেলিউসিদ সম্রাট এ্যান্টিওকাস এপিফেনিস-এর জবরদস্তিমূলক হেলিনাইজেশন-এর প্রতি অবারিত সমর্থন, বলা যেতে উৎসাহ, প্রদান করেন। হেলিনাইজেশন-এর বিরুদ্ধে গোড়া ইহুদিবাদী হাসমোনিয়ান বিদ্রোহ শুরু হলে মেনিলাউস ইহুদিবাদের অবলুপ্তি ঘোষণা করতেও দ্বিধা করেন নি।

সম্রাট এ্যান্টিওকাস ফিলিস্তিনে আগ্রাসী প্রক্রিয়ায় হেলিনাইজেশন শুরু করলে আমরা সেখানকার ইহুদি সমাজের বিভাজিত রূপ বেরিয়ে আসতে দেখি – সাজুসীরা হেলিনাইজেশকে সমর্থন করে, ফারিসীরা করে বিরোধীতা। আরও লক্ষ্যণীয় যে, যে হাসমোনিয়ান সম্প্রদায় সম্রাট এ্যান্টিওকাস-এর হেলিনাইজের বিরুদ্ধে সহিংস বিদ্রোহ শুরু করে ক্ষমতায় আসে, তারাই পরবর্তীতে নিজ রাজত্বকালে (~১৪০-১১৬ BC) ক্রমান্বয়ে হেলিনিজমের প্রতি ঝুকে পড়ে, যে হেলিনিজমকে সমূলে উৎপাটন করতেই ছিল তাদের ক্ষমতা দখল।

বোঝা যায় যে হেলিনিজম – যা ছিল প্রধানত গ্রিক সংস্কৃতি ও সভ্যতা – তার প্রতি ফিলিস্তিনের জনগণের মাঝে বিশেষ আকর্ষণ ছিল। এমনকি ভিন্ন আচার-সংস্কৃতির প্রতি অত্যন্ত অসহনশীল ও বিরুদ্ধাচারী ইহুদিরাও ক্রমান্বয়ে হেলিনিক ভাবধারায় আচ্ছন্ন হয়ে পড়ে। আলেকজান্ডার কর্তৃক এশিয়ায় বিশাল সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠার পর হেলিনিক ভাবধারা যেভাবে সারা সাম্রাজ্যে দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে, এমনকি মিশরীয় ও পারস্যীয়দের মতো উন্নত জাতির মাঝেও – তা থেকে সহজেই হেলিনিজমের আকর্ষণীয়তা অনুমান করা যায়। এমনকি প্রাচীন মানব সভ্যতার প্রাণকেন্দ্র মিশরের আলেকজান্দ্রিয়া শীঘ্রই হয়ে উঠে হেলিনিক সভ্যতার প্রাণকেন্দ্র। প্রাচ্যে আলেকজান্ডারের সাম্রাজ্যবাদী বিজয়াভিযানের পূর্বে গ্রিক সভ্যতার আবির্ভাব ও বিবর্তন সম্পর্কে সংক্ষিপ্ত আলোচনা হেলিনিজমের প্রতি বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর এরূপ আকর্ষণের কারণ অনুধাবনে সহায়ক হবে। গ্রিক সভ্যতার ভাবধারা ও চিন্তাচেতনা ফিলিস্তিনি ইহুদি সমাজে কেবল এক অমোচনীয় প্রভাবই ফেলে নি, সম্ভবত ইহুদিবাদের প্রথম শতাব্দের প্রশাখা খ্রিস্টবাদের সূচনাকেও অনুপ্রাণিত করেছিলো, যা শুধু ইহুদিবাদেরই নয়, পুরো মানবসভ্যতারই গতিধারাকে চিরতরে ঘুরিয়ে দিয়েছে।

 

গ্রিক সভ্যতা ও সাংস্কৃতিক ভাবধারা ও তাতে সক্রেটিসের ব্যাপক প্রভাব:

প্রাচ্যে আলেকজান্ডারের বিশাল বিজয়াভিযানের ফলে গ্রিক সংস্কৃতি ও সভ্যতা বিশ্বকে বিশেষভাবে বদলে দেয়। এতে করে গ্রিক সংস্কৃতি, জ্ঞান ও ভাবধারা শুধু বিজিত অঞ্চলেই বিস্তৃত হয় নি, প্রাচ্যীয় (আরব, ভারতীয়, মিশরীয় এবং পারস্যীয় ইত্যাদি) সাংস্কৃতিক, নৈতিক ও ধর্মীয় ভাবনাও পুরো সাম্রাজ্যে বিস্তৃত হওয়ার পথ সুগম করে, যার ফলে একটি শংকর ভাবধারার উদ্ভব ঘটে, যাকে বলা হয় হেলিনিজম। এটা সর্বজনবিদিত যে, খ্রিস্টপূর্ব প্রথম শহস্রাব্দে গ্রিক সমাজে নৈতিক, দার্শনিক, সাহিত্যিক ও বৈজ্ঞানিক চিন্তাচেতনায় এক অভাবনীয় বিপ্লব ঘটে। বিশেষত সক্রেটিসের (মৃত্যু ৩৯৯ BC) দার্শনিক ও নৈতিক ভাবনা গ্রিক সমাজে এক বলিষ্ঠ প্রভাব ফেলে। সক্রেটিসের চিন্তাচেতনা ও শিক্ষা পরবর্তীতে প্লেটো, অ্যারিস্টটল ও ইউক্লিদের মত মহান দার্শনিক ও চিন্তাবিদের আবির্ভাব-ই ঘটায় নি, তাঁর বেশকিছু সহচর সক্রেটিসের শিক্ষার অনুকরণ করতঃ বেশ কয়েকটি অনেকাংশে বিরুদ্ধাচারী, এমনকি উদ্ভট দার্শনিক ভাবধারা ও সামাজিক আন্দোলনের উদ্ভব ঘটায়।[1]

 

() প্লেটোর ‘রিপাবলিক’ – সক্রেটিসের না স্বয়ং প্লেটোর?

সক্রেটিস নিজে কোনো লেখা রেখে যান নি। ফলে তাঁর সবচেয়ে স্বনামধন্য শিষ্য প্লেটোর লেখা থেকেই শুধু আমরা সক্রেটিসের চিন্তাচেতনা ও ভাবধারা সম্পর্কে ধারনা পাই। সক্রেটিস অনেকাংশে অরাজনৈতিক ছিলেন। তবে প্লেটো আমাদেরকে জানান যে, গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ব্যবস্থা সক্রেটিসের অপছন্দ ছিল, সক্রেটিসের সে অপছন্দের ভিত্তিতেই প্লেটা তার ‘রিপাবলিক’ গ্রন্থে এক অসম ও স্বৈরাচারী রাজনৈতিক ভাবনার রূপরেখা চিত্রিত করেন। তবে সার্বিক বিবেচনায় মৃত্যু পর্যন্ত গণতন্ত্রের প্রতি সক্রেটিসের ছিল সুদৃঢ় সমর্থনই পরিলক্ষিত হয়, এবং প্লেটোর ‘রিপাবলিক’ সম্ভবত ছিলো গণতন্ত্রের প্রতি প্লেটোর নিজস্ব অনাস্থার ফসল মাত্র কিংবা গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার অধীনে গুরু সক্রেটিসের করুণ মৃত্যুতে তার আক্রোশের ফসল মাত্র।

 

() অ্যারিস্টিপাস – সুখের খোঁজে আত্মনিয়ন্ত্রণ না আত্মনিবেদন?

বর্তমান লিবিয়ার সাইরীনি শহরের অ্যারিস্টিপাস ছিলেন সক্রেটিসের আরেক নামকরা শিষ্য। সক্রেটিসের মৃত্যুর পর অ্যারিস্টিপাস সাইরীনিতে কথিত সক্রেটিসের শিক্ষার ভিত্তিতে এক জীবনাচরণ মূলক দার্শনিক ভাবধারা প্রতিষ্ঠিত করেন, যাকে বলা হয় সাইরীনিয়াক। সক্রেটিস মনে করতেন যে সুখের খোঁজে মানুষের যৌক্তিক আত্মনিয়ন্ত্রণ এবং সদাচার ও ন্যায়পরায়ণতা চর্চা প্রয়োজন। এ্যারিস্টিপাস সক্রেটিসের আত্মনিয়মানুবর্তিতাকে শুধুই সুখের তরে উৎসর্গ করেন। সক্রেটিস মনে করতেন, সুখী হওয়ার জন্য সততা ও সৎপন্থা চর্চা আবশ্যক। এ্যারিস্টিপাস এর ব্যাখ্যায় ভাবতেন, যতক্ষণ সে সুখী ততক্ষণ সে সৎপন্থা চর্চা করছে। এভাবে অ্যারিস্টিপাস সক্রেটিসের ভাবনাকে এক অবারিত ও বিশ্রী উপভোগ-ভিত্তিক আনন্দবাদী আন্দোলনে রূপান্তরিত করে। সক্রেটিসের প্রত্যাশিত সৎপন্থা ও ন্যায়পরায়নতা চর্চার তাতে কোনো গুরুত্ব ছিল না। তারা বিশ্বাস করতো – জীবনে আনন্দ-ফূর্তি হচ্ছে একমাত্র ভালো জিনিস, এবং ব্যাথা-বেদনা শুধুই মন্দের প্রতীক। সাইরীনিয়াক ভাবধারা এক শতাব্দের মধ্যেই উঠে গেলেও পরবর্তীতে তা এপিকিউরিয়ান নামক আরেকটি অধিক নান্দনিক ভাবধারা ও সামাজিক আন্দোলনের মাঝে পুনর্জীবন লাভ করে।

 

() অ্যান্টিসথিনেস – সুখের তরে সন্যাস চর্চা:

আরেক শিষ্য অ্যান্টিস্থিনেস সক্রেটিসের সুখের খোঁজে আত্মনিয়ন্ত্রণ চর্চার উপদেশের ভিত্তিতে আরেক সামাজিক আন্দোলন প্রতিষ্ঠা করেন, যাদেরকে বলা হত ‘সিনিক্স’ এবং তাদের মূলকথা ছিল সাইরিনিয়াক তত্ত্বের ঠিক বিপরীত। সুখ অর্জনে মনের দৃঢ়তা চর্চা ও সহজ-সরল জীবন চলার উপদেশ দিতেন সক্রেটিস। এ দু’টো উপদেশের উপর জোর দেন অ্যান্টিসথিনেস। সক্রেটিস আকাঙ্ক্ষা পূর্তি চেয়ে আকাঙ্ক্ষা বর্জনের উপর জোর দিতেন, এবং ব্যক্তি জীবনে তিনি অর্থ-সম্পদ ও আরাম-বিলাসিতা বর্জন করে চলতেন। সে ভিত্তিতে অ্যান্টিসথিনেস একটা দারিদ্র্য আলিঙ্গনকারী সন্ন্যাসী আন্দোলন প্রতিষ্ঠা করেন। ভাল মানুষ হওয়া ও ভাল কাজ করার ওপর জোর দিতেন সক্রেটিস, এবং বলতেনঃ যে ভাল কাজ করে কেউ তার ক্ষতি করতে পারে না। সে ভিত্তিতে সিনিকরা অপকার ও ক্ষতি থেকে নিজেদেরকে আড়াল করার জন্য শুধুই ভাল হওয়া, ভালোত্ব অর্জন করার উপর জোর দিতেন। এর বাইরে তাদের আর কিছুরই প্রয়োজন ছিল না। এভাবে সক্রেটিসের সৎ ও পূণ্যবান জীবনলাভ বিষয়ক শিক্ষাকে সিনিকরা এক চরম অস্বাভাবিক পর্যায়ে নিয়ে যায়, যেখানে স্বাভাবিক জীবনের যাবতীয় পার্থিব বিষয় ও কর্মকাণ্ড একেবারেই বিবর্জিত। ভাল হোক কিংবা মন্দ – তারা এসবকে বোকামি, অপ্রয়োজনীয় ও অপ্রাকৃতিক মনে করতো। প্রাকৃতিক ও সহজ-সরল জীবন চলাই ছিল তাদের জাগতিক দর্শনের মূল মন্ত্র।

সিনিক আন্দোলনের এক অনুসারী ছিল কৃষ্ণসাগর অঞ্চলের সিনোপির অধিবাসী ডিওজিনিস (~৪০০-৩২৫ খ্রি:পূ:)। ডিওজিনিস ছিলেন এক চরমপন্থী প্রকৃতিবাদী, যিনি সিনিক আন্দোলনকে আরও চরম সন্ন্যাসী ও প্রাকৃতিক প্রক্রিয়ায় উন্নীত করেন। তিনি মনে করতেন যে অ্যান্টিসথিনেস নিজেই তার শিক্ষা অনুসরণ করতে ব্যর্থ ছিলেন। সে ভাবনা থেকে তিনি সিনিক সন্যাসবাদকে এক চরম ‘পাগলামী ও অস্বাভাবিক জীবনাচার’ প্রক্রিয়ায় উন্নীত করেন। কিংবদন্তি আছে যে, ডিওজিনিস এক মাটির ভাড়ে বাস করতেন এবং সিনিকদের মাঝে প্রকাশ্যে হস্তমৈথুন চর্চা চালু করেন। সত্যি কী মিথ্যা, লোকে তাকে ‘কিয়ন’ (কুকুর) বলে ডাকতো, কেননা তিনি ‘জটিলতাহীন, প্রবৃত্তি-ভিত্তিক ও লজ্জাহীন প্রাণীর মতো জীবনচলায় নিজেকে নিবেদিত করেছিলেন, কেননা প্রাণীকূলকে তিনি প্রাকৃতিক গুণাবলীর সত্যিকার প্রতিনিধি বা উপস্থাপক বিবেচনা করতেন।[2]

সত্যিকার প্রাকৃতিক জীবন চলতে গিয়ে তিনি সব রকম ধন-সম্পদ, আরাম-আয়েস ও আনুষ্ঠানিক পারিবারিক জীবন বর্জন করেন, এমনকি নাগরিক জীবনের সকল বাধা-নিষেধ – যেমন অজাচার কিংবা মানব মাংস খাওয়ার নিষিদ্ধতা, বিবাহ প্রথা, সামাজিক শ্রেণী বিভাজন এবং গতানুগতিক ধর্ম। আদর্শ সমাজ হবে স্বয়ংসম্পূর্ণ ও বিচার-বিবেচনা সম্পন্ন এক ঢিলেঢালা ত্যাগী সম্প্রদায় – যারা যে কোনো সামাজিক সম্পর্কেই যুক্ত হতে পারবে সম্পৃক্ত পক্ষগুলোর অনুমোদনের ভিত্তিতে, এবং সেখানে থাকবে না কোনো গতানুগতিক বাধা-নিষেধ।[3]

প্লেটো ডিওজিনিসকে ‘এক পাগল বনে যাওয়া সক্রেটিস’ বলেছিলেন সঙ্গত কারণেই। তথাপি মনে হচ্ছে, তার অস্বাভাবিক কার্যকলাপ তাকে যথেষ্ট জনপ্রিয় করে তুলেছিলো – কেননা তার মাটির ভাড়টি ভেঙ্গে গেলে এ্যাথেন্সবাসী একসাথে হয়ে তাকে আরেকটা কিনে দিয়েছিল। ডিওজিনিসের আন্দোলনটি অনেক শতাব্দী টিকে ছিল। প্রথম ও দ্বিতীয় খৃষ্টীয় শতাব্দে সমাজের যাবতীয় ভবঘুরে হিপ্পি, উন্মুক্ত ভালবাসা পন্থী ও তল্পিতল্পা সহ ঘুর্ণমান ভিখারীরা আন্দোলনটিতে আকর্ষিত হয়। ডিওজিনিসের খ্যাতনামা ছাত্র ও দার্শনিক থিবসের ক্রেইটস (~৩৬৫-২৮৫ BC) নিজের সব ধনসম্পত্তি বিলিয়ে দিয়ে সিনিক সম্প্রদায়ে যোগদান করেন। হিপার্কিয়া নামের ধনী পরিবারের এক মেয়ে ক্রেইটসের সাথে পরিচয়ের পর তার প্রেমে পড়ে যায় এবং তার সাথে যোগ দেওয়ার জন্য আত্মহত্যার ভয় দেখিয়ে বাবা-মার অনুমতি আদায় করে। দম্পত্তিটি এখানে-সেখানে ঘুরে বেড়াতো, এ্যাথেন্সের রাস্তায় দারিদ্রের জীবন যাপন করতো এবং ‘প্রকাশ্যে যৌনকর্মের পর নৈশভোজে যেতো’।

 

() ইউক্লিদের যুক্তির কারখানা :

সক্রেটিসের আরেক নিবেদিতপ্রাণ শিষ্য মেগারার ইউক্লিদ (~৪৩৫-৩৬৫ BC) সক্রেটিসের শিক্ষায় নৈতিক শুদ্ধি ও যুক্তিবাদের প্রতি অনুরক্ত হন। তিনি যৌক্তিক তর্কাতর্কিতে, বিশেষত আপাতঃবিরোধী যুক্তিতর্কে, আসক্ত হয়ে পড়েন, এবং তার নিজ বাসভূম মেগারাতে এক পাঠচক্র প্রতিষ্ঠা করেন, যার সম্পর্কে তার এক প্রতিদ্বন্দ্বী বলেছিলেনঃ “ঝগড়াটে ইউক্লিদ মেগারাবাসীকে বাদানুবাদের প্রতি উন্মত্ত ভালবাসায় উদ্বুদ্ধ করতেন“।

ইউক্লিদের পাঠশালা ‘যুক্তি ও ভাষা বিষয়ক অনেকগুলো সর্বোচ্চ দীর্ঘস্থায়ী দ্বাঁদ্বার জন্ম দেয়’ এবং মেগারাকে এক হাস্যকরভাবে অতিরঞ্জিত ‘যুক্তিতর্কের কারখানায়’ রূপান্তরিত করে।

 

যিশুর শিক্ষায় হেলিনিয় প্রভাব:

সক্রেটিসের ধ্যানধারনা, চিন্তাচেতনা, যার কিছু কিছু কিছুটা পাগলাটে হলেও নিঃসন্দেহে এক বৈপ্লবিক বুদ্ধিবৃত্তিক ও দার্শনিক স্বর্ণখনি রেখে যায়, যা অনুসরণ করতে গিয়ে তার শিষ্যরা এতটা হাস্যকর রকম চরমে নিয়ে যেতে সমর্থ হয়। এ প্রেক্ষাপটে যে বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ রূপে প্রস্ফুটিত হয়ে উঠে, তা হচ্ছেঃ গতানুগতিক চালচলন, প্রজ্ঞা ও ঐতিহাসিক অর্জন বিরোধী যাবতীয় সব উদ্ভট সামাজিক আন্দোলনের প্রতিও পৌত্তলিক গ্রিক সমাজের অবিশ্বাস্য রকমের সহনশীলতা ছিল। প্রাচ্যে হেলিনিক সভ্যতা ও সংস্কৃতির বিস্তার ইহুদিদেরকে সে সহনশীলতার মুখোমুখী করে। সক্রেটিসের কিছু কিছু উর্বর ভাবনা ফিলিস্তিনের ইহুদি সমাজের অংশবিশেষকে এতোটাই প্রভাবিত করে যে, তাদের কেউ কেউ – যেমন প্রধান পুরোহিত জেইসন ও মেনিলাউস এবং তাদের সমর্থকরা হেলিনিজমের সংস্পর্শে তাদের সমাজ থেকে কট্টর ও অসহনশীল ইহুদি ভাবধারা সমূলে উঠিয়ে দিতেও প্রস্তুত ছিল। অন্য দিকে যিশু সংস্কারের নামে ইহুদি ধর্মের অনেক মৌলিক শিক্ষা উঠিয়ে দিয়ে সক্রেটিস উদ্ভূত নৈতিক ভাবনা প্রচলনের জন্য এক নৈতিক ও সামাজিক আন্দোলন শুরু করেন, যা এখন আলোচনা করা হবে।

 

যিশুর সুবর্ণ নীতি না সক্রেটিসের?

জীবন চলা সম্পর্কে সক্রেটিসের মূল সুর ছিল ভালো ও পূণ্যবান জীবন-যাপন করা। যে ভালো কেউ তার ক্ষতি করতে পারে না। ভালো হওয়ার জন্য, অন্যের দ্বারা ক্ষতিগ্রস্ত না হওয়ার জন্য, তোমাকেও অন্যের ক্ষতি বা অপকার করা থেকে বিরত থাকতে হবে – যা কিনা সুখ্যাত ‘সুবর্ণ নীতি’র (গোল্ডেন রুল) মূল ভিত্তি।

৩৯৯ খ্রিস্টপূর্বাব্দে আলাদতে বিচারে অ্যাথেন্সের নবীনদেরকে কলুষিত করার দায়ে সক্রেটিসকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়। অভিযোগটির বিষয়ে প্রতিক্রিয়ায় সক্রেটিস বলেছিলেনঃ “কাউকে কলুষিত করা মানে তার ক্ষতি করা… এবং কারও ক্ষতি করলে সে তোমার পাল্টা ক্ষতি করবে।”

অর্থাৎ সক্রেটিস কখনোই অন্যের ক্ষতি করে নিজের ক্ষতি ডেকে আনবে না।[4] সক্রেটিসের এই নীতিই ৪ শতাধিক বছর পর যিশু প্রচারিত ‘সুবর্ণ নীতি’তে রূপ নিয়েছেঃ “সুতরাং সবকিছুতেই অন্যের প্রতি তুমি শুধু এমন কাজই করবে, যা তুমি চাও অন্যেরাও তোমার প্রতি করুক…।”  (ম্যাথিউ ৭:১২)

ডান গালে চড় মারলে বাম গালও এগিয়ে দাওঃ সক্রেটিস শুধু অন্যের ক্ষতি বা অপকার করা থেকেই বিরত থাকাতেই নিজেকে সীমাবদ্ধ রাখেন নি, বরং আরও একধাপ এগিয়ে গেছেন। সক্রেটিসের ক্ষতি যে করবে, তার ক্ষতি করার বিরোধীও ছিলেন তিনি, ছিলেন অপকর্মের জবাবে অপকর্মের বিরুদ্ধে। অনেকটা সক্রেটিসের এই নৈতিক অবস্থানই ধ্বণিত হয়েছে যিশুর আরেক প্রসিদ্ধ বাণীতে: “কেউ তোমাকে ডান গালে আঘাত করলে, বাম গালটিকেও তার প্রতি এগিয়ে দাও।” (ম্যাথিউ ৫:৩৯)

আঘাতের বিপরীতে পাল্টা আঘাত থেকে বিরত থাকাই যিশুর এই বাণীটির মূল বক্তব্য। এবং যদিও খুব কম খ্রিস্টানই আজ এ উপদেশ অনুসরণ করবে, ব্যক্তিগতভাবে সক্রেটিস এর প্রয়োগের পক্ষে দৃঢ় ছিলেন। কেননা এর মাঝে নিহিত ছিল সক্রেটিসের আধ্যাত্মিক ভাবনার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় – আত্মার কল্যাণ।

শত্রুকেও ভালবাসোঃ  সক্রেটিস বলতেনঃ “সব ধরনের অপকর্ম থেকে বিরত থাকো, কেননা আত্মা ‘খারাপ কর্ম দ্বারা আহত হয়, আর ভালো কর্ম দ্বারা লাভবান হয়।”

তাঁর মতে, সবাইকে ভালো কাজ করতে হবে, তা যে পরিস্থিতিতেই হোক না কেন, কেননা সেটাই সঠিক পন্থা। অপকর্মে নিযুক্ত হওয়া, কিংবা অন্য কেউ খারাপ কাজ করে বলে নিজেও খারাপ কাজ করা, ইত্যাদির মাধ্যমে কেউ শুধু নিজেরই ক্ষতি করে, নিজ আত্মাকে আহত করে। সক্রেটিস মনে করতেন [5]: “ভালো মানুষকে কোনো কিছুই ক্ষতি করতে পারে না – না এ জীবনে, না পরকালে“।

শত্রুর ক্ষতি করা গ্রিক সমাজে গ্রহণযোগ্য ছিল। সক্রেটিসের এ কঠোর নৈতিক অবস্থান গ্রিক সমাজের সে গতানুগতিক নৈতিক ভাবনাকে চ্যালেঞ্জ করে। সক্রেটিসের মতে, শত্রুর ক্ষতি করাও উচিত নয়; যদি কিছু করতেই চাও উপকার করো – যা কিনা যিশুর সুপ্রসিদ্ধ ‘শত্রুকেও ভালবাস’ (ম্যাথিউ ৫:৪৪) শিক্ষাটির মূল কথা।

সক্রেটিসের শিক্ষায় এসব নৈতিক ভাবনার অবতারণা এবং ৪ শতাধিক বছর পর কথিত যিশু কর্তৃক খ্রিস্ট বাইবেলে সেগুলোর চমৎকার ভাষায় উপস্থাপন – এ দু’য়ের মাঝে একটা মৌলিক ব্যবধান রয়েছে। যিশুর ক্ষেত্রে এগুলোর একটা স্বর্গীয় উদ্দেশ্য ও অনুপ্রেরণা রয়েছে, যে ভক্তরা সেগুলো অনুসরণের মাধ্যমে বহুল লাভবান হবে, পরজীবনে ঈশ্বরের অশেষ কৃপা ও প্রতিদান উপভোগ করবে। কিন্তু এসব চর্চার মাধ্যমে সক্রেটিসের প্রাচুর্যপূর্ণ দৈবধনের কোনো প্রত্যাশা ছিলো না, না ছিলো কোনো স্বর্গীয় শক্তির ইচ্ছে বা ইঙ্গিত। তার মতে, কেউ এসব নৈতিক গুণাবলী চর্চা করবে শুধু পার্থিব ও মানবীয় কারণে – শুধুই একটা ভালো, নৈতিক ও ন্যায়পরায়ন জীবন যাপনের উদ্দেশ্যে, পৃথিবীতে শুধুই একটা আদর্শ, সম্মানজন ও সুখী জীবন অতিবাহিত করার লক্ষ্যে, এবং তা কারও নিজেরই স্বার্থে, মানবিক ও নৈতিক হওয়ার উদ্দেশ্যে। তিনি মনে করতেনঃ 'সৎ জীবনযাপন মানেই সম্মানজনক জীবনযাপন’ এবং ন্যায়পরায়ন ব্যক্তি সুখী, অন্যায়কারীর জীবন শোচনীয়। [৬]

সিজারকে তার প্রাপ্য দাও, ঈশ্বরকে তার প্রাপ্যঃ  যিশুর আরেকটি সুপ্রসিদ্ধ বাণী হচ্ছেঃ “সিজারকে দাও যা তার প্রাপ্য এবং ঈশ্বরকে দাও যা ঈশ্বরের প্রাপ্য” (ম্যাথিউ ২২:২১), যা পাশ্চাত্যের দেশগুলোতে রাষ্ট্রকে উপাসনালয় থেকে পৃথক করতে সাহায্য করেছে বলে দাবি করা হয়। এ বাণীর মূলমন্ত্রটিও সক্রেটিসের শিক্ষার মাঝে অন্তর্নিহিত। একদিকে সক্রেটিস সরকারের অন্যায় নীতির বিরুদ্ধে প্রতিবাদের পক্ষে ছিলেন, যা রাষ্ট্রকে তা সংশোধন করে উন্নততর সমাজব্যবস্থা অর্জনের পথ দেখাবে; অন্যদিকে তিনি ভাবতেন নাগরিকদের উচিত রাষ্ট্রীয় কর্তৃপক্ষের অনুগত হওয়া, রাষ্ট্র-বিবেচিত আইন, শাস্তি ইত্যাদি মেনে নেওয়া। কাজেই মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত সক্রেটিসকে এক বন্ধু জেল থেকে পালানো ও অ্যাথেন্স ছেড়ে অন্যত্র চলে যাওয়ার পথ সুগম করার প্রস্তাব দিলেও তিনি তা প্রত্যাখ্যান করেন। সক্রেটিস মনে করতেনঃ “বৈধ সরকারের ও সঠিক আইনী প্রক্রিয়ার অনুগত হওয়া ছিল তাঁর নৈতিক দায়বদ্ধতা, এবং সক্রেটিস অ্যাথেন্সকে ভালোবাসতেন এবং অন্যত্র জীবনকে উপভোগ করবেন না মনে করতেন।” [7]

যিশুকে পাকড়াও করার পরও আমরা তার মাঝে অনুরূপ দৃষ্টিভঙ্গির চিহ্ন দেখি। তার গ্রেফতারকে কেন্দ্র করে যিশু অনুসারীদেরকে সহিংসতা থেকে নিরুৎসাহিত করেন, এবং অনেকটা ইচ্ছাকৃতভাবেই রোমান কর্তৃপক্ষের মৃত্যুদণ্ডের শাস্তি মেনে নিয়ে এটাকে ‘স্বর্গীয় অভিপ্রায়’ হিসেবে উপস্থাপন করে বলেনঃ “শাস্ত্রীয় বিধান অবশ্যই পূর্ণতা পাবে” (মার্ক ১৪:৫১, ম্যাথিউ ২৬:৫৪)

গস্পেলে যিশুর এসব বিশেষ শিক্ষাগুলো ছাড়াও তার আরেক প্রসিদ্ধ শিক্ষা, ব্যাভিচারীকে শাস্তি না দেওয়া, মুসার আইনে যার শাস্তি পাথর-ছুড়েঁ হত্যা, সেটাও তার ভাবনায় সেকালে ফিলিস্তিনে বিরাজমান সহনশীল হেলিনিয় সংস্কৃতির প্রভাবেরই ফসলমাত্র। যিশু গসপেলে ‘অমর আত্মার’ ধারনা উপস্থাপন করতঃ বলেন, “যারা দেহকে হত্যা করতে চায় তাদেরকে ভয় করো না, কেননা তারা আত্মাকে হত্যা করতে পারবে না।” (ম্যাথিউ ১০:২৮)

ইহুদি ধর্মশাস্ত্র তৌরাত বা ওল্ড টেস্টামেন্টে আত্মার ধারনা অনুপস্থিত। অথচ গ্রিক দার্শনিক ও আধ্যাত্বিক ভাবনায় আত্মার ধারনাটি যিশুর জন্মের বেশ কয়েক শতাব্দী আগেই সুপ্রতিষ্ঠিত ছিল। উল্লেখ্য সক্রেটিসের নৈতিক ও আধ্যাত্মিক ভাবনার মূলে ছিল ‘আত্মার কল্যাণ’ সাধন – যা ইতোমধ্যে আলোচনা করা হয়েছে।

 

টীকা:

[1]Gottlieb, Anthony (2001), in R. Monk and F. Raphael ed., The Great Philosophers: From Socrates to Turning, Phoenix, London, p. 37–44

[2]Gottlieb, p. 41

[3]Gottlieb, p. 41

[4]Gottlieb, p. 14

[5]Gottlieb, p. 33

[6]Gottlieb, p. 34

[7]Gottlieb, p. 45

=============================

 

খ্রিস্টধর্মের স্বরূপসন্ধান ৩য় পর্ব

খ্রিস্টধর্মের ভিত্তিপ্রস্তরে প্রাচীন মিশরীয় ও গ্রিক ধর্ম ও কল্পকাহিনীর প্রভাব

মিশরে যিশুর শৈশবঃ  আমরা দেখি যে, খ্রিস্ট বাইবেলের প্রসিদ্ধ নৈতিক শিক্ষা ও আধ্যাত্বিক ভাবনাগুলো প্রাচীন গ্রিসে যিশুর জন্মের শতশত বছর আগেই উদ্ভূত হয়েছিল। ফিলিস্তিনিরা আলেকজান্ডারের সময় হেলিনিয় ও পরবর্তীতে গ্রিকো-রোমান সভ্যতার অংশ হয়ে পড়ে, এবং সে পরিবেশেই যিশুর জন্ম ও বড় হওয়া। এবং  যিশুর ধর্ম প্রচারের মিশনে এসব নৈতিক ও আধ্যাত্বিক ভাবনাগুলোকে পুঁজি করা থেকে বোঝা যায় হেলিনিয় সভ্যতার অন্তর্ভূক্ত গ্রিক ও অন্যান্য এশীয় ভাবধারা ফিলিস্তিনের ইহুদি সমাজকে, অন্তত এর অংশ-বিশেষকে, কতটা প্রভাবিত করেছিলো! যিশুর মিশরে বড় হওয়া আরেকটি উল্লেখযোগ্য বিষয়। বিভিন্ন তথ্যমতে যিশু ৬ থেকে ১০ বছর পর্যন্ত মিশরে বাস করেন। আলেকজান্ডারের নির্দেশানুসারে নির্মিত মিশরের আলেকজান্দ্রিয়া শহরটি পরবর্তীতে হেলিনীয় সভ্যতার প্রাণকেন্দ্র, ইহার বুদ্ধিবৃত্তিক কারখানা, হিসেবে রূপ লাভ করেছিলো। সে-যুগের সেরা গ্রিক দার্শনিকগণ বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চার জন্য আলেকজান্দ্রিয়ার সুবিখ্যাত পাঠাগারে জড়ো হতেন। ঐতিহাসিকভাবে এর আগে ইহুদীরা সাধারণত কখনও ধর্ম-বহির্ভূত বিষয়ে বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চায় আগ্রহ দেখায় নি। অথচ আলেকজান্দ্রিয়ার বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চার উর্বরতা এতটাই প্রেরণাদায়ক ছিল যে, আমরা দেখি কিছু ইহুদি সেখানেই প্রথম বৈশ্বিক বিষয়ে বুদ্ধিবৃত্তিক ও দার্শনিক চর্চায় অংশ নিতে শুরু করে। তাদের মধ্যে ছিল যিশুর সমসাময়িক হেলিনিয় ইহুদি দার্শনিক ফিলো জুদিয়াস (20 BC–50 AD), যিনি প্রাচীন গ্রিক প্রজ্ঞাশীলতা, বিশেষত বৈরাগ্যবাদকে (Stoicism) তার দার্শনিক কর্মে অন্তর্ভূক্ত করেন।

সেকালে মিশরে ইহুদিদেরকে ঘিরে বিদ্যমান আরেকটি বিষয় বিবেচ্য, তা হচ্ছে জোর মিশরীয়দের মাঝে ইহুদি-বিরোধী প্রচারণা ও উত্তেজনা। গ্রিক শাসনাধীনে আসার পর বিজিত মিশরিয়দেরকে সুযোগ-সুবিধার জন্য ইহুদিদের সাথে একই শর্তে প্রতিযোগিতা করতে হতো, কেননা উভয়ই নাগরিকত্ব বহির্ভূত বিবেচিত ছিল। কাজেই ইহুদীরা স্থানীয় মিশরিয়দের সাথে অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক সুযোগে সমানে সমান প্রতিযোগিতায় অবতীর্ণ হতে বাধ্য হলে মিশরিয়দের মাঝে ক্রমেই ইহুদি-বিরোধী অসন্তোষ দানা বাধতে থাকে এবং মিশরিয় সাহিত্য ও বক্তৃতায় ইহুদি-বিদ্বেষ ধ্বনিত হতে থাকে। যিশুর সমকালীন মিশরিয় বক্তা অ্যাপিওন (মৃঃ খ্রি: ৪৫) ছিলেন এক খ্যাতনামা ইহুদি-বিদ্বেষ প্রচারক। ইহুদি-বিরোধী প্রচারণা সেখানে তখন এতটাই জোরদার ছিল যে, ইহুদি বুদ্ধিজীবি জোসেফাস নিজ ধর্মীয় গোষ্ঠীর সমর্থনে অ্যাপিওনের সবচেয়ে বিষাক্ত ইহুদি-বিরোধী বক্তব্যগুলো খণ্ডন করে ‘এগেইন্সট অ্যাপিওন’ শীর্ষক এক নিবন্ধ রচনা করেন। এসব বিদ্বেষমূলক প্রচারণাগুলো – হোক সে মিশরিয় কিংবা রোমান লেখক, দার্শনিক বা রাষ্ট্রীয় ব্যক্তিত্ব লিখিত – তার মূলে ছিল ইহুদি ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক শিক্ষা ও ভাবধারাকে সমালোচনা বা আঘাত করা – বিশেষত ইহুদিদের অসামাজিক ও বিচ্ছিন্নতামুখী মনোভাব, এবং ইহুদি ধর্মের নির্মম ও অসহনশীল বিধানগুলো। যিশুর সময়ে অ্যাপিওন ও সহযোগীদের ইহুদি-বিদ্বেষী প্রচারণা মিশরে তুঙ্গে উঠেছিলো, যা শীঘ্রই সহিংসতা ও দাঙ্গায় রূপ নিতে শুরু করে যিশুর মৃত্যুর (৩৩ সাল) মাত্র কয়েক বছর পরে (৩৮-৪১ সাল)। ঘরের পাশে মিশরে ইহুদি-বিরোধী এসব প্রচারণা ও অসন্তোষ অবশ্যই যিশুর মনে প্রভাব ফেলার কথা।

পরবাসে ভিন্ন বাস্তবতার সম্মুখীন ইহুদি জাতিঃ ফিলিস্তিন থেকে বিতাড়িত ইহুদিরা প্রথমত গ্রিকো-হেলিনিস্ট ও অতঃপর গ্রিকো-রোমান সাম্রাজ্যের পরবাসী জীবনে ২টি অপরিচিত বাস্তবতার মুখোমুখি হয়। (১) তারা নির্বাসনে ব্যাপক সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক স্বাধীনতা ও সার্বজনীন সহনশীলতা দেখতে পায়, যা ছিল তাদের ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক ভাবধারা ও অভিজ্ঞতা থেকে খুবই ভিন্ন। (২) অন্যদিকে নিজেদের অসামাজিক ও অসহনশীল সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় ভাবধারার কারণে তারা বিদ্বেষী প্রচারণার সম্মুখীন হয়, যার বিরুদ্ধে তাদের হাতে জবাব ছিলো সীমিত। এ পরিস্থিতিতে ফিলিস্তিনের কিংবা নির্বাসনের ইহুদি সমাজের অপেক্ষাকৃত উদার অংশ হেলিনিয় সংস্কৃতির সার্বজনীন সহনশীলতা ও মানবিকতার ভাবধারায় বিশেষভাবে প্রভাবিত হয়ে পড়ে। সেই সাথে পরবর্তীতে সমালোচকদের ইহুদি-বিদ্বেষী প্রচারণা তাদেরকে নিঃসন্দেহে বিচলিত করে। ফলে আমরা দেখি ফিলিস্তিনে ও নির্বাসনে উভয় জায়গাতেই সমাজের সম্ভ্রান্ত অংশ হেলিনিয় সংস্কৃতিতে আবিষ্ট হয়ে পড়ে। হেলিনিয় সহনশীলতা ও উদারতার প্রভাবে তাদের মধ্যে কেউ কেউ নিজস্ব কট্টর ও অসহনশীল ধর্মীয় সংস্কৃতির প্রতি এতটাই বিরূপ মনোভাবাপন্ন হয়ে উঠে যে, জেরুজালেম গির্জার পুরোহিত জেইসন ও মেনিলাউস ও তাদের হেলিনিজম-মুখী সমর্থকরা সম্রাট এপিফেনিস-এর ফিলিস্তিনি ইহুদি সমাজকে জোরপূর্বক হেলিনিয়করণ প্রক্রিয়াকে সক্রিয় সমর্থন দেয় (খ্রি:পূ: ১৭০-১৬০-এর দশক)। এমনকি তারা সম্রাট এপিফেনিসের ইহুদি ধর্ম বিলুপ্তকরণমূলক রাজকীয় ঘোষণাপত্রকেও সমর্থন দেয়। এর প্রায় ২ শতাব্দী পর মিশরে বসবাসকারী যিশু নিঃসন্দেহে বিদ্যমান গ্রিকো-হেলিনিস্ট সভ্যতা ও সংস্কৃতির উদারতা, সহনশীলতা ও অন্তর্নিহিত সার্বজনীন সুর দ্বারা বিশেষভাবে প্রভাবিত হয়েছিলেন। অন্যদিকে তার সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে চলমান বিদ্বেষী প্রচারণাও তাকে নিঃসন্দেহে বিচলিত করতো। হতে পারে এ অভিজ্ঞতাই যিশুকে ইহুদিবাদের সংস্কারে উদ্দীপিত করেছিলো, কিংবা ব্যক্তিগত অনুপ্রেরণা বা ঐশ্বরিক নির্দেশে তিনি ধর্মীয় প্রচারণার মিশন হাতে নেন। তবে সমালোচকগণ ইহুদি ধর্মের যেসব বিষয়কে কেন্দ্র করে ইহুদি-বিদ্বেষী প্রচারণা চালাতেন, যিশুর ধর্মীয় সংস্কার প্রচেষ্টায় সে বিষয়গুলোর উপর জোর দিতে দেখা যায় এবং তার ধর্মীয় সংস্কার প্রক্রিয়ার সার্বিক উদ্দেশ্য কট্টর ও অসহনশীল ইহুদি ধর্ম ও সংস্কৃতিকে হেলিনিয় সহনশীলতা, প্রজ্ঞা ও সার্বজনীনতার সাথে একাত্মকরণমূলক মনে হয়। এবং তা করতে গিয়ে যিশুকে সক্রেটিসের বেশকিছু গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা ও ভাবনাকে তার গসপেলে সংযুক্ত করতে দেখা যায়, যা মুসার আইনের পুরোপুরি বিপরীতধর্মী।

 

খ্রিস্টধর্মীয় তত্ত্বে প্রাচীন মিশরিয় ধর্মের প্রভাবঃ

যিশুর ধর্মীয় তত্ত্বে সক্রেটিসের শিক্ষা ও ভাবনা তথা গ্রিক বা হেলিনিয় প্রভাব ছাড়াও অন্যান্য, বিশেষত পৌত্তলিক মিশরিয় ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক ভাবনার, যথেষ্ট প্রভাব পরিলক্ষিত হয়। শৈশবে যিশুর বাসভূমি মিশর, যা ছিল পৃথিবীর প্রসিদ্ধ ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যবাহী এক প্রাচীনতম অগ্রগামী সভ্যতা। এবং খ্রিস্টধর্মের বেশকিছু মৌলিক তত্ত্ব ও বৈশিষ্ট মিশরিয় ধর্ম ও সংস্কৃতিতে বিদ্যমান ছিল বলে খোঁজ পাওয়া যায় – যেমন (১) যিশুই ঈশ্বর কিংবা এক কুমারী সতী নারীর গর্ভে জাত ঈশ্বরের পুত্র, (২) তার ১২জন শিষ্য, (৩) তাকে শুলে চড়িয়ে হত্যা, (৪) কবর থেকে মৃত যিশুর পুনরুত্থান, (৫) ধর্মীয় প্রতীক ক্রুশ ইত্যাদি। মিশরিয় ঈশ্বর ওসিরিস ও পুত্র হোরাস সম্পর্কিত আখ্যান ও খ্রিস্টধর্মীয় ঈশ্বর ও ঈশ্বর পুত্র সম্পর্কিত আখ্যানের মাঝে বিশেষ মিল রয়েছে। অসিরিস মানব ইতিহাসের সবচেয়ে পুরাতন ঈশ্বরদের মাঝে অন্যতম, যার নাম পালেরমো প্রস্তরে খ্রি:পূ: ২৫০০ সালে খোদিত দেখা যায় এবং তিনি খ্রিস্ট ধর্মের উত্থানের পূর্ব পর্যন্ত মিশরে পূজিত ছিলেন।  ওসিরিস ছিলেন পরকালে মৃতদের জন্য করুণাশীল বিচারক, জীবনদাতা, ও ‘ভালবাসার গুরু’। করুণা, ভালবাসা ও জীবনদান – এই তিনটি খ্রিস্ট ইশ্বরেরও মৌলিক বৈশিষ্ট্য।

ওসিরিস-এর উপাখ্যানে ক্রুশবিদ্ধ হয়ে মৃত্যু এবং পুনরুত্থানের কাহিনীও বর্তমান। ওসিরিসের ভাই সেট, যে ছিল মন্দের প্রতীক এবং মরুভূমি, ঝড়-তুফান ও বিশৃংখলার দেবতা, সে ওসিরিসকে হত্যা করে। ওসিরিসের স্ত্রী আইসিস তার ক্ষতবিক্ষত মৃতদেহ খুঁজে পায় এবং মন্ত্র পড়ে তাকে পুনরুজ্জীবিত করে তোলে। এই ঘটনার স্মৃতিচারণে মিশরীয়রা ১৩ই নভেম্বরে এক উৎসব পালন করতো। উৎসবটির প্রথম পর্বে একটি প্রকাশ্য নাটকে ওসিরিসকে নির্মমভাবে হত্যা ও ক্ষতবিক্ষত করা দেখানো হতো; দ্বিতীয় পর্বে স্ত্রী আইসিস কর্তৃক তার মৃতদেহ খোঁজাখুঁজি ও উদ্ধার এবং পুনরুত্থিত ওসিরিসের বিজয়ীর বেশে প্রত্যাবর্তন, এবং সবশেষে ওসিরিসের পুত্র হোরাসের হাতে শয়তান সেট-এর পরাজয় প্রদর্শিত হতো।

 

(ছবিঃ মা আইসিস ও শিশু হোরাস বণাম মা মেরী ও শিশু যীশু)

ত্রাণকর্তা যীশুর মিল রয়েছে প্রাচীন মিশরিয় আরেক দেবতা ‘শেদ’-এর সাথে, যার নামের অর্থ ত্রাণকর্তা। শেদ পরিত্রাণের প্রতীক এবং তাকে হোরাস, বিশেষত ‘শিশু হোরাস’-এর প্রতিরূপ গণ্য করা হয়।  হোরাস ও খ্রিস্টধর্মের মাঝে এক শক্ত সংযোগ পাওয়া যায় প্রাথমিক যুগের খ্রিস্টানদের কবরে স্থাপিত প্রতিকৃতিতে। কবর থেকে উদ্ধারকৃত এক তাবিজে একপাশে যিশু ও অন্যপাশে হোরাসরূপী শেদ-এর ছবি দেখতে পাওয়া যায়। ওসিরিস সম্পর্কে মিশরিয়দের ধারনা ব্যাখ্যা করতঃ স্যার ই, এ, উয়ালিস বাজ লিখেছেনঃ

‘সকল যুগের মিশরিয়রাই বিশ্বাস করতেন যে, ওসিরিস ছিল স্বর্গ উদ্ভূত; তিনি শয়তানী শক্তির হাতে মৃত্যুবরণ ও ক্ষতবিক্ষত হয়েছিলেন; এক বিরাট লড়াইয়ের পর তিনি পুনরুত্থিত হন এবং অতঃপর যমরাজ্যের অধিশ্বর ও মৃতদের বিচারক হন; এবং তিনি যেহেতু মৃত্যুকে জয় করেছিলেন, পুণ্যবানরাও অনুরূপে মৃত্যুকে জয় করতে পারবে।

ওসিরিসের উপাখ্যানের সাথে যিশুর কাহিনীর সংযোগ ব্যাখ্যা করতে স্যার বাজ লিখেন, “খ্রিস্টান মিশরিয়রা ওসিরিসের মাঝে যিশুর নমুনা খুঁজে পায়, এবং পুত্র হোরাসকে দুগ্ধপানকারী আইসিসের ছবি ও ভাস্কর মূর্তি থেকে তারা কুমারী মেরি ও শিশু যিশুর প্রতিকৃতির ধারনা পায়।”

খ্রিস্টান-পূর্ব যুগে ব্যবহৃত ‘ক্রুশ’ প্রতীকঃ  খ্রিস্টধর্মের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ প্রতীকি পরিচিতি হচ্ছে ‘ক্রুশ’। খ্রিস্টপূর্ব মিশরীয়, এমনকি গ্রিক, উপাখ্যানে পরিত্রাণের উপায়রূপী ঈশ্বর বা প্রতীক ছিল ‘ক্রুশ’ আকৃতির। প্রাচীন মিশরিয় জেদ স্তম্ভ, যা কিনা দুই বোন কর্তৃক ঘেরা ওসিরিসের মেরুদণ্ড ও স্থিতিশীলতার প্রতীক – সেটা দেখতে অনেকটা ক্রুশে চড়ানো যিশুর মত। মিশরীয় প্রতিকৃতিতে ওসিরিসের স্ত্রী আইসিসকে ক্রুশ আকৃতিতে উপস্থাপন করা হয়েছে, যা দেখতে ঠিক ক্রুশে চড়ানে যিশুর মত। এমনকি নানান মিশরিয় বন্দনাগীতি ও কফিন লিপিতে সূর্যদেবতা হোরাসকে আকাশে উড়ন্ত পাখাধারী বাজপাখী রূপে প্রদর্শন করা হয়েছে, যা দেখতে অনেকটা ক্রুশ আকৃতির। আবার মৃত ওসিরিসকে জীবিত করতে হোরাস জীবন দানের প্রতীক হিসেবে ‘ক্রুশ আকৃতির হুক (আঙটা)’ ব্যবহার করেন, যা খ্রিস্টধর্মে যিশুর ক্রুশবিদ্ধ হয়ে মৃত্যুবরণকে মানবজাতির পরিত্রাণের উদ্দেশ্যে উপস্থাপন বা বিবেচনার অনুরূপ।

মিশরের বাইরে গ্রিক ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক কল্পকাহিনীতেও ‘ক্রুশ’ প্রতিকৃতি বিদ্যমান ছিল। গ্রিক পুরানের অ্যান্দ্রোমেদা নামক কথিত ইথিউপীয় রাজকন্যা, ইংরেজীতে যে ‘চেইন্ড লেডি’ নামে পরিচিত, তাকে দেখানো হয় প্রস্তরখণ্ডে শৃংখলায়ীত যেখান থেকে স্বামী পার্সিউস তাকে উদ্ধার করে।  গ্রিক কল্পকাহিনীতে জ্ঞানের দেবতা প্রমিথিউস, মানবজাতিকে জ্ঞানের প্রদীপ দানের কারণে ঈশ্বর জিউস যাকে শাস্তি দিয়েছিল, তাকেও অনেকক্ষেত্রে পাহাড়-চূড়ায় প্রস্তরখণ্ডে শৃংখলায়িত দেখা যায়। প্রস্তরখণ্ডে শৃংখলায়িত অ্যান্দ্রোমেদা ও প্রমিথিউস দেখতে প্রায় ক্রুশে চড়ানো যিশুর মতো। অন্যদিকে খ্রিস্টপূর্ব ৩৫০ সালের দিকের এক ফুলদানীতে প্রমিথিউসকে এক খাম্বায় শৃংখলায়ীত দেখা যায়, যা দেখতে ঠিক ক্রুশে চড়ানো যিশুর প্রতিকৃতির মতো।

 

(ছবিঃ  ক্রুশবিদ্ধ প্রমিথিউস [যীশু নন])

অন্যদিকে প্লেটো তার Timaeus গ্রন্থে (~৩৬০ খ্রি:পূঃ) বিশ্ব-আত্মাকে আকাশে ভাসমান এক ‘স্বর্গীয় ক্রুশ’রূপে উপস্থাপন করেছেন। প্লেটোর ‘স্বর্গীয় ক্রুশ’ সম্পর্কে প্রাথমিক যুগের চার্চ-ফাদার জাস্টিন মার্টার (মৃঃ 165 AD) তার ‘ফার্স্ট অ্যাপোলোজি’ গ্রন্থের ‘প্লেটোস ডক্ট্রিন অব দ্যা ক্রস’ শীর্ষক অনুচ্ছেদে (৬০/১) লিখেছেনঃ

এবং Timaeus গ্রন্থে ঈশ্বরের পুত্রের শারীরিক বর্ণনায় প্লেটো লিখেছেন, ‘তিনি তাকে ক্রুশ আকারে আসমানে স্থাপন করলেন।’ খ্রিস্টান ধর্মতাত্ত্বিক রেভঃ হিউগো রাহনার-এর মত প্রাথমিক যুগের খ্রিস্টানদের মতে এটা ছিল, ‘ক্রুশবিদ্ধ স্বর্গীয় বিশ্ব-নির্মাতার একটা পৌত্তলিক অনুকৃতি, যিনি বিশ্বব্রহ্মাণ্ড ব্যপ্ত এবং ইহাকে ক্রুশের রহস্যের চারিদিকে ঘূর্ণমান রাখে।’

রচনাটিকে ছোটো রাখতে আলোচনা আর না বাড়িয়ে মোটামুটি নিশ্চয়তার সাথেই বলা যায় যে, খ্রিস্টধর্মের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রতিকৃতি যে ‘ক্রুশ’, তা যিশুর সময়ে মিশরিয় ও গ্রিক ধর্মীয় গাথায় প্রায় একই অর্থে ব্যবহৃত হতো। খ্রিস্টধর্ম সম্ভবত সেখান থেকে প্রতীকটিকে আত্মস্থ করেছে।

ফরাসি ইতিহাসবিদ চার্লস দুপিউস (মৃঃ ১৮০৯) জানান, রোমান সূর্যদেবতা জেনাস-এর ঠিক যিশুর মত বৈশিষ্ট্য ছিল – যেমন কুমারীর গর্ভে জন্মলাভ, পুনরুত্থান ও ১২জন শিষ্য ইত্যাদি। তিনি লিখেছেন,

কবে আমরা দুনিয়ার সামনে তুলে ধরব এক ঈশ্বরের ভাণধরা ইতিহাস, যিনি কুমারী মাতার গর্ভে দক্ষিণায়নের দিন (উইন্টার সলস্টিস, ~২২ ডিসেম্বর) জন্মগ্রহণ করেন, যিনি নরকে ডুবার পর ঈস্টারে (বসন্তে দিবারাত্রি সমান দৈর্ঘ্যের দিন) পুনরুত্থিত হন, যার পেছনে থাকে ১২জন ধর্ম-প্রচারক শিষ্য, যাদের গুরুর (অর্থাৎ যিশু) রয়েছে জেনাসের সকল বৈশিষ্ট্য। তিনি অন্ধকার জগতের রাজপুত্রকে জয়কারী এক ঈশ্বর, যিনি মানবজাতিকে আলোর রাজ্যে পুনর্স্থাপিত করেন, এবং যিনি প্রকৃতির মন্দ দিক জয় করেন – যা কিনা শুধুই এক সৌর কল্পকাহিনী…

অনুরূপভাবে হার্ব কাটনার লিখেছেন,

প্রায় সবগুলো সূর্য-দেবতারই মা হিসেবে রয়েছে এক অক্ষত কুমারী… যিশুর মতই মিথ্রা ও অন্যান্য সূর্য-দেবতার জন্মদিন ছিল ২৫ ডিসেম্বরের আশেপাশে এবং তার ১২জন অ্যাপোসল অবশ্যই রাশিচক্রের ১২টি প্রতীকের অনুরূপ। যখন যিশু (যে ছিল ন্যায়পরায়নতার সূর্য) ক্রুশবিদ্ধ হয়, তার সাথে স্বভাবতই সূর্যও মারা যায়, অর্থাৎ অস্তমিত হয়। এবং পরদিন, অর্থাৎ ইস্টারের দিন, সূর্যের সাথে সে আবার পুনরুত্থিত হয়।’

কাজেই এটা সুস্পষ্ট হয়ে উঠে যে, খ্রিস্টটধর্মের সবগুলো ভিত্তিমূলক বৈশিষ্ট্য ও প্রতিকৃতিই – যেমন যিশুর কুমারী মাথার গর্ভে জন্ম, ১২জন অপেসলপোসল, ক্রুশবিদ্ধকরণ, পূনরুত্থান ও খৃষ্টধর্মীয় প্রতীক ‘ক্রুশ’, এগুলোর সবই যীশুর জন্ম-পূর্ব মিশরীয় ও গ্রিক পৌত্তলিক ধর্মে ও পৌরানিক আখ্যানে প্রচলিত ছিল। প্রাথমিক খ্রিস্টান পণ্ডিতদের লেখায়ও সেটা প্রমাণিত হয়। যেমন খ্যাতনামা খিস্টোনদের লেখক টার্টুলিয়ান (মৃঃ ২২০ সাল) সমকালীন পৌত্তলিকদেরকে উদ্দেশ্য করে লিখেছেন,

আমরা আগেই দেখিয়েছি যে, তোমাদের দেবতারা এসেছে ‘ক্রুশ’ আকৃতির প্রতিকৃতি থেকে। কিন্তু তোমরা বিজয়কেও পূজা করো, কেননা তোমাদের বিজয়স্মারকগুলোর কেন্দ্রস্থলে থাকে ‘ক্রুশ’। রোমান শিবিরে ধর্মচর্চা যুদ্ধ পতাকার পূজা মাত্র, যেখানে পতাকাকে সকল দেবতাদের উপর স্থাপন করা হয়। আন, পতাকা থেকে গড়িয়ে পড়া প্রতিকৃতিগুলো ‘ক্রুশ’ আকৃতির অলঙ্কার ছাড়া আর কিছুই না। তোমাদের পতাকা ও ব্যানারগুলো থেকে ঝুলন্ত অলঙ্কারগুলো ‘ক্রুশ’ আকৃতির জামা মাত্র। (Apology 16)

এখানে টার্টুলিয়ান সুস্পষ্ট করে বলছেন যে, খৃষ্টপূর্ব পৌত্তলিক ধর্মগুলোতে ঈশ্বরকে ‘ক্রুশ’ আকৃতির প্রতীকরূপে ব্যবহার করা হতো। আরেক রচনায় [Ad Nationes (12)] তিনি এটাকে আরও সুস্পষ্ট করে তোলেনঃ

…পৌত্তলিকরা নিজেরাই ‘ক্রুশ’কে পবিত্রতার প্রতীক হিসেবে ব্যাপক ব্যবহার করেছে, তাদের নিজেদের দেবমূর্তিকে ‘ক্রুশ’ আকৃতির একটা কাঠামোর উপর বানানো হতো।

প্রাথমিক যুগের আরেক খৃষ্টান লেখক ফেলিক্স মিনিকিউস (লেখার কাল ১৫০-২৭০ সাল) তার Octavius (29)-এ বলেন যে, খৃষ্টপূর্ব পৌত্তলিক সমাজে ক্রুশের ব্যবহার সুবিস্তৃত ছিলঃ

বরং তোমরাই কাঠের ঈশ্বরকে পূজার জন্য পবিত্রায়িত করো, কাঠের ক্রুশকে ভালবাস – সম্ভবত তোমাদের ঈশ্বরের অংশ হিসেবে। তোমাদের প্রত্যেকটি পতাকা এবং ব্যানার – সেগুলো সোনায় মোড়া ও অলঙ্কারিত ক্রুশ ছাড়া আর কি? তোমাদের বিজয়স্মারকগুলো শুধু একটা ক্রুশের অনুকৃতিই নয়, তাতে একজন মানুষও জোড়া লাগানো থাকে।

অন্যত্র ফাদার জাস্টিন মার্টার সুস্পষ্ট করে বলেন যে, খৃষ্টানরা কেবল ক্রুশ প্রতীকটির ধারনাই পৌত্তলিকদের থেকে গ্রহণ করে নি, কুমারী মায়ের গর্ভে মানুষ-রূপে ঈশ্বরের জন্ম, তাকে ক্রুশবিদ্ধ করণ, তার পুনরুত্থান ও স্বর্গে উড্ডয়নের ধারনাওঃ

যখন আমরা এটাও বলি যে, ঈশ্বরের প্রথম সন্তান ‘শব্দ’ কোন যৌনমিলন ছাড়াই জন্মেছিল, যে আমাদের শিক্ষক যীশু খৃষ্টকে ক্রুশবিদ্ধ করে মারা হয়েছিল, এবং তিনি জেগে উঠেন ও স্বর্গে উত্থিত হন, তখন আমরা এমন কিছু বলি না, যা তোমরা জুপিটারের সম্মানিত পুত্রদের ব্যাপারে বিশ্বাস করো না…

=======================

খ্রিস্টধর্মের স্বরূপসন্ধান (৪র্থ পর্ব)

যিশু কর্তৃক ইহুদিবাদের সংস্কার প্রচেষ্টার কার্যকারণ ও খ্রিস্টধর্মের জন্ম

যীশুর জন্ম ও জীবনকালে ফিলিস্তিন ও পরদেশে ইহুদী সমাজ কি পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে যাচ্ছিলো, এতক্ষণে পাঠকবৃন্দ তা কিছুটা উপলব্ধি করতে পারবেন। এবং সে পরিস্থিতিই সম্ভবত যীশুকে উদ্বুদ্ধ করেছিল ইহুদী ধর্মের সংস্কারের মিশনে, এবং অপ্রত্যাশিতভাবে তার চূড়ান্ত ফলাফল হয় একটা নতুন ধর্মের উৎপত্তি।

রোমান শাসকদের সাথে যীশুর সম্ভাব্য বোঝাপড়া?

আমরা দেখি যীশু সাম্রাজ্যবাদী রোমানদের প্রতি আনুগত্য দেখাতে তার ইহুদী ধর্ম ভাইদেরকে উপদেশ দেন। তাহলে ফিলিস্তিনের রোমান শাসকদের সাথে যীশুর কোনোরূপ বোঝাপড়া ছিল কি? অসম্বভব নয়। কারণ ইহুদী ধর্মীয় তত্ত্ব বা মুসার বিধান অনুসারে ইহুদীরা হচ্ছে ঈশ্বরের চয়নকৃত জনগোষ্ঠী, খোদ ঈশ্বরের সম্পত্তি (ডিউঃ ৭:৬)। ইহুদীরা দাসত্ব করবে, সেবা করবে, শুধুই সর্বশক্তিমান ঈশ্বরের (জেহভার) – ঈশ্বরের আইন ও বিধান প্রতিপালনের মাধ্যমে। তারা ইহুদী–বহির্ভূত কর্তৃপক্ষের দাসত্ব ও বশ্যতা মেনে নেবে না। বরং তৌরাতের বিধান অনুযায়ী ঈশ্বরের চয়নকৃত জনগোষ্ঠী হিসেবে ইহুদীরা অন্য জনগোষ্ঠীর উপর রাজত্ব করবে, অন্যরা ইহুদীদের জন্য দাসত্ব খাটবে, ইহুদীদের সেবা করবে। যেমনঃ

(১) ‘তোমরা যুদ্ধের জন্য ভিন্ন জনগোষ্ঠীর জনপদের দ্বারে পৌঁছে প্রথমে তাদেরকে শান্তিচুক্তির প্রস্তাব দাও।তারা শান্তি প্রস্তাবে রাজী হয়ে তোমাদের জন্য জনপদের দরজা উন্মুক্ত করলে সেখানকার সব মানুষকে তোমরা জোরপূর্বক তোমাদের জন্য বেগার খাটতে বাধ্য করবে। (ডিউঃ ২০:১০–১৬)

(২) ‘বিদেশীরা তোমাদের শহরের দেয়াল নির্মাণ করবে এবং তাদের রাজাগণ তোমাদের সেবা করবে… তোমাদের শহরের দরজা সর্বদা, দিন–রাত, খোলা থাকবে যাতে বিদেশীরা তাদের ধনসম্পদ তাদের রাজাদের তত্ত্বাবধানে যখন–তখন আনতে পারে।যেসব জাতি বা রাজ্য তোমাদের সেবা করবে না, তারা ধ্বংস হবে; তাদেরকে নির্মমভাবে গুড়িয়ে দেওয়া হবে… (ইসাঃ ৬০:১০–১২)

(৩) অপরিচিতরা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে তোমাদের গরু–ছাগলকে ঘাস খাওয়াবে; তোমাদের জমি চাষ করবে এবং আঙুরবাগান পরিচর্চা করবে।তোমাদেরকে বলা হবে ঈশ্বরের প্রতিনিধি; জনগণ তোমাদেরকে ঈশ্বরের যাজক হিসেবে সম্মান করবে; তোমরা অন্যান্য জাতির সম্পদ উপভোগ করবে, এবং অন্যের ধনসম্পদে তোমরা গৌরবান্বিত হবে। (ইসাঃ ৬১:৫–৬)

অথচ যীশুর গস্পেলে (ম্যাথিউ ২২:২১) আমরা যীশুকে বলতে দেখি – সীজারকে (রোমান শাসককে) দাও যা তার প্রাপ্য, যা নিঃসন্দেহে পৌত্তলিক রোমান রাজশক্তির সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসনের প্রতি আনুগত্য প্রদর্শনের উপদেশ মাত্র, এবং ইহুদী ঈশ্বরীয় বিধানের বিরুদ্ধাচরণ।

যীশুর রাজনৈতিক আকাঙ্ক্ষা?  খৃষ্টানরা দাবী করে যে, যীশুর ধর্ম-প্রচার মিশনের উদ্দেশ্য ছিল শুধুই আধ্যাত্বিক, রাজনৈতিক নয়; তাই তিনি রোমান শাসকদের সাথে টেক্কা দেওয়া থেকে দূরে থাকতে চেষ্টা করেন। যীশুর মিশন শুধুই আধ্যাত্বিক ছিল – এ দাবীটির যথার্থতা যাচাই করা প্রয়োজন। ফিলিস্তিনে রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার ২টি স্তর বিদ্যমান ছিল। রোমানরা ছিল সর্বেসর্বা সাম্রাজ্যবাদী রাজশক্তি। দ্বিতীয় স্তরে ইহুদীদের প্রত্যেকটি শহরে থাকতো স্যানহেদ্রিন নামক ইহুদী সামাজিক–রাজনৈতিক পরিষদ। পরিষদগুলোর প্রতিনিধিত্ব করতো ২৩ থেকে ৭১ গণ্যমান্য ইহুদী ব্যক্তির এক কমিটি, এবং তারা ইহুদী সমাজের সামাজিক ও রাজনৈতিক বিষয়াদি পরিচালনা করতো। ফিলিস্তিনে রোমান শাসকরা স্যানহেদ্রিনের সাথে বোঝাপড়ার ভিত্তিতে তাদের শাসনকার্য চালাতো।

কথা হচ্ছে, যীশু যদিও শোষণকারী ও প্রায়শঃ নির্মম সাম্রাজ্যবাদী রোমানদের প্রতি আনুগত্য দেখানোর নির্দেশ দিয়েছেন, কিন্তু স্যানহেদ্রিন–এর ব্যাপারে মনোভাব ছিল একেবারেই ভিন্ন। তিনি স্যানহেদ্রিন প্রতিনিধিদেরকে কড়া ও প্রায়শঃ আক্রমণাত্মক ও অশালীন ভাষায় গালাগালি করেন, তাদেরকে শিক্ষাগুরু ডাকার বিরোধীতা করেন, এবং দাবী করেন, কেবল যীশু নিজে শিক্ষাগুরু হওয়ার যোগ্য (ম্যাথিউ ২৩)। অন্য কথায়, যীশু নিজেকে স্যানহেদ্রিন পরিষদের নেতৃত্বের ঘোষণা করেছিলেন।

ফলে এটা অনুমান করা অযৌক্তিক নয় যে, যীশুর রোমান শাসকদের সাথে এমন একটা বোঝাপড়া ছিলো যে, ঘনঘন ইহুদী বিদ্রোহ ও রক্তপাতে সিক্ত ফিলিস্তিনে তিনি ইহুদীদেরকে রোমান রাজশক্তির অনুগত করার চেষ্টা চালাবেন, স্বভাবত কট্টর ও অসহনশীল ইহুদীদেরকে সহনশীল ও গ্রিকো–রোমান সংস্কৃতি ও ভাবধারার সাথে সম্পৃক্ত করার চেষ্টা করবেন ইত্যাদি। এরূপ অনুমানের সপক্ষে গস্পেলে ইঙ্গিতও পাওয়া যায়। যেমন গস্পেলে উল্লেখ আছে যে, ফিলিস্তিনের রোমান শাসকরা যীশুর কর্মকাণ্ডের উদ্দেশ্য সম্পর্কে উয়াকিবহাল ছিল, এমনকি সম্ভবত তার মিশনের পক্ষপাতি ছিল।

ফিলিস্তিনে প্রথমত সিলিউসিদ ও পরে রোমান শাসকরা রক্তক্ষয়ী ইহুদী বিদ্রোহের সম্মুখীন হয়েছে বার বার।প্রকৃতপক্ষে ফিলিস্তিনে ইহুদী বিদ্রোহ উভয় সাম্রাজ্যবাদী শক্তির মেরুদণ্ডই নড়বড়ে করে ফেলার জন্য দায়ী ছিল। ক্ষুদ্র ভূখণ্ড ফিলিস্তিনের ছোট্ট ইহুদী জনগোষ্ঠীর পক্ষ থেকে তারা যেরূপ ভয়ঙ্কর ও দৃঢ় প্রতিরোধের সম্মুখীন হয়, তা আর কোথাও হয় নি।

যীশুর সমসাময়িক কালে ফিলিস্তিনে রোমান শাসন – খৃঃপূঃ ৬৩ অব্দে রোমান সাম্রাজ্যের প্রতিদ্বন্দ্বী পম্পি দ্যা গ্রেইট ফিলিস্তিনকে রোমান সাম্রাজ্যের সাথে সংযুক্ত করলে ইহুদীরা প্রবল বিরোধীতা করে এবং তাদের সে অসন্তোষ আর কখনোই স্তিমিত হয় নি। এরপর খৃষ্টীয় ৬ সালে জুদিয়া অঞ্চলকে সরাসরি রোমান শাসনের অধীনে আনলে ইহুদীরা প্রথম সঙ্ঘবদ্ধ বিদ্রোহ শুরু করে, যার উদ্যোক্তা ছিল জিলোট নামের গোড়া ইহুদী সম্প্রদায়। রোমান শাসকরা তা নির্মমতার সাথে দমন করে। কিন্তু ইহুদী সম্প্রদায়ের মাঝে অসন্তোষ নিরবে জমা বাধতে থাকে, যা ১৬–১৭ খৃষ্টাব্দে আবার অস্থিরতায় রূপ নেয় এবং রোমান প্রতিনিধি পিলেটের শাসনকালে (২৬–৩৬ সাল) তা বিকট বিদ্রোহ রূপে জ্বলে উঠে। এরূপ অস্থিরতার সময়ে অত্যুৎসাহী ত্রাণকারী ধর্মগুরুরা পরবাস থেকে ফিলিস্তিনে এসে বিদ্রোহে যোগ দিতো। ঐতিহাসিক সেসিল রথ–এর মতে যীশু ছিলেন এমন এক বিপ্লবী ধর্মগুরু, যাকে পিলেট ক্রুশবিদ্ধ করে হত্যা করে।

পিতৃভূমি ফিলিস্তিনে ইহুদীদের এ অদম্য চেতনার খোজ পাওয়ায় যায় সেখানে প্রথম বহির্দেশীয় দখলদার এ্যাসিরীয়দের সময় থেকেই। পারস্য সম্রাট সিরাস দ্যা গ্রেট (মৃঃ খৃঃপূঃ ৫২৩) এ্যাসিরীয়দের দ্বারা ধ্বংসকৃত ফেরুজালেম গীর্জা পুনর্নিমাণের অনুমতি দিলেও সম্রাটের ফিলিস্তিনস্থিত প্রতিনিধিরা গীর্জাটি মেরামতের বিরোধীতা করেছিল ধর্মীয় কারণে ইহুদীদের চিরাচরিত বিদ্রোহী চরিত্রের কারণে। এবং সেলিউসিদ সম্রাট এ্যাপিফেনিসের হেলিনাইজেশনের বিরুদ্ধে খৃঃপূঃ ১৬০–এর দশকে যে ধ্বংসাত্মক হাসমোনিয়ান বিদ্রোহ ছড়িয়ে পড়ে, তার আগুন পরবর্তী রোমান শাসনামলে যীশুর সময় (১–৩৩ সাল) পর্যন্ত কদাচিত স্তিমিত হয়েছিল। ফলে রোমান শাসকরা যীশুর মত একজন হেলিনীয় ভাবধারার ব্যক্তিকে ইহুদীবাদের সংস্কারের পথ সুগম করবে, যাতে ইহুদী সমাজ রোমান শাসনের প্রতি অপ্রতিবাদী হয় – সেটা একেবারেই অসম্ভব নয়। এ প্রসঙ্গে যীশুর গস্পেলে কিছু কিছু বাণী পাওয়া যায়, যা ইঙ্গিত করে যে যীশুর মিশনের প্রকৃত উদ্দেশ্য সম্পর্কে রোমান প্রতিনিধি পিলেট–এর একটা বোঝাপড়া ছিল।যেমন আমরা দেখি, গস্পেলে পিলেটকে একজন অত্যন্ত মানবিক, বলা যায় সাধুসন্ত রূপ, ব্যক্তি হিসেবে দেখানো হয়েছে এবং যীশুর প্রতি অবিচারের সকল দোষ ইহুদীদের উপর চাপানো হয়েছেঃ ‘‘আমি এ ব্যক্তির রক্তের দায়বদ্ধতা থেকে মুক্ত’, বলল সে (পিলেট)। ‘এর দায়দায়িত্ব তোমাদের ঘাড়ে (ইহুদীদের)।’’ অথচ সমকালীন ঐতিহাসিক তথ্যে পিলেট ছিল অত্যন্ত নির্মম প্রকৃতির।সে এতটাই নির্মম ছিল যে, রোম সম্রাট হাদ্রিয়ান তাকে ডেকে পাঠিয়ে হত্যা করে। গস্পেলে আরও বলা হয়েছে যে, পিলেট যীশুর বিচারের আসনে বসাকালীন তার স্ত্রীর যীশুর ক্ষতি না করার জন্য বার্তা পাঠান যে: “ঐ নিষ্পাপ মানুষটির কোনই ক্ষতি করবে না যেন…” (ম্যাথিউ ২৭:২০)। গসপেল গুলোতে পিলেট ও তার স্ত্রী সম্পর্কে এমন অনুরাগী মনোভাব ইঙ্গিত দেয় যে, যীশু ও পিলেট তথা ফিলিস্তিনের রোমান কর্তৃপক্ষের মাঝে সহানুভূতিশীল বা সহযোগীতামূলক বোঝাপড়া ছিল।

যীশুর পুনরুত্থানের কাহিনীর সম্ভাব্য ব্যাখ্যাঃ  যীশু ও পিলেটের মাঝে বিদ্যমান এ সম্ভাব্য বোঝাপড়া যীশুর কথিত পুনরুত্থানের কাহিনী ব্যাখ্যা করতে সহায়ক হতে পারে অলৌককত্বে বিশ্বাস না করেও। যীশুর কবর থেকে মৃত যীশুর পুনরুত্থানের কাহিনী গস্পেল গুলোর একটা প্রধান সুর।যদিও বৈজ্ঞানিক ও যৌক্তিক বিবেচনায় কাহিনীটি গ্রাহ্যশীল নয়, তবুও যীশু সরাসরি শিষ্যদের সাক্ষ্যকে একেবারেই অগ্রাহ্য করা সহজ নয়। কাজেই পিলেট ও যীশুর মাঝে যেহেতু একটা সম্ভাব্য সহানুভূতিশীল বোঝাপড়া ছিল, এমনকি পিলেটের স্ত্রীও যীশুর কোনরূপ ক্ষতি করার বিরুদ্ধে ছিল, কাজেই পিলেট সম্ভবত যীশুর প্রাণ বাঁচানোর জন্য আন্তরিক চেষ্টাই করেছিল।ফলে যীশুকে ক্রুশে ছড়িয়ে হত্যা ও সমাধিতকরণ ছিল সম্ভবত লোক–দেখানো মাত্র।ফলে তাকে মৃত্যু থেকে বাঁচানো হয়েছিলো, কিন্তু তার মিশন যেহেতু ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়ে পড়েছিলো এবং ফিলিস্তিনি ইহুদি জনতা তার তৌরাত–বিরোধী প্রচারণার কারণে ক্ষুব্ধ হয়ে উঠেছিলো, কাজেই যীশুকে নীরবে অন্যত্র পাঠিয়ে দেওয়াই রোমান কর্তৃপক্ষের জন্য সহায়ক ছিলো, বিশেষত যখন চিরাচরিত বিদ্রোহী মনোভাবাপন্ন ফিলিস্তিনি ইহুদীদের মাঝে অসন্তোষ আবারও চাঙ্গা হয়ে উঠছিলো ঠিক ঐ সময়ে। এবং চুপেচাপে পরবাসে পাঠানোর আগে যীশুর সাথে তার নিবেদিতপ্রাণ শিষ্যদের (১২জন এ্যাপোসল) শেষ সাক্ষাতের ব্যবস্থা করা হয়েছিলো, যে ভিত্তিতে তারা প্রচারণা চালায় যে, যীশু মরে নি, পুনরুত্থিত হয়েছে ইত্যাদি।

জোর দেওয়া প্রয়োজন যে, যীশু মূল লক্ষ্য ছিল শুধুই ইহুদীবাদের সংস্কার। প্রথম দিকে তিনি এ্যাপোসলদেরকে পৌত্তলিক ও সামারিতানদের কাছে না গিয়ে শুধু বিপথে চলে যাওয়া ইহুদীদের কাছে যেতে নির্দেশ দিয়েছিলেন (ম্যাথিউ ১০:৫–৬)... বলেছিলেন, “আমি প্রেরিত হয়েছি শুধু বিপথগামী ইহুদীদের জন্য” (ম্যাথিউ ১৫:২৪)। কিন্তু এখন যেহেতু ইহুদীদেরকে পথে আনার আর আশা নেই, তার মূল মিশন ব্যর্থ হয়েছে, কাজেই শেষ সাক্ষাতে যীশু শিষ্যদেরকে শুধুই ইহুদীদের পেছনে সময় ও প্রয়াস ব্যয় না করে সব জাতির প্রতি তার ধর্মকে উন্মুক্ত করার নির্দেশ দিয়ে যানঃ “সুতরাং যাও, সব জাতিকে আমার অনুসারী বানাও…” (ম্যাথিউ ২৮:১৯)।

যীশুর উধাও হয়ে যাওয়ার পর ভেঙ্গে পড়া শিষ্যরা ইহুদীদেরকে উত্তপ্ত করে না তুলতে কিছুকাল ধর্ম প্রচারকার্য শুধুই পৌত্তলিকদের মাঝে সীমাবদ্ধ রাখে। ইহুদীদের পাশে শতশত বছর ধরে বসবাসের সুবাদে ইতিমধ্যেই একত্ববাদী ইহুদী ধর্মের প্রতি পৌত্তলিকদের আগ্রহ ক্রমান্বয়ে বাড়ছিল। এবং খৃষ্টধর্ম যেহেতু ছিল ইহুদীবাদেরই একটা সংস্কারকৃত অধিক মানবিক ও সহনশীল একত্ববাদী পন্থা এবং শুরুতে খৃষ্টের অনুসারীরা ইহুদী ধর্মের প্রায় সব আচার–রীতিই পালন করতো, পেছনে রেখে যাওয়া যীশুর শিষ্যদের জন্য পৌত্তলিকদেরকে যীশুর ধর্মে আকৃষ্ট করা সম্ভবত ইহুদীদের তুলনায় সহজতর ছিল। এরপর শুরু হয় ফিলিস্তিনে ইহুদীদের রোমান শাসন বিরোধী ‘বিশাল বিদ্রোহ’ (গ্রেইট রিভোল্ট, ৬৬–৭০ সাল), যখন যীশুর শিষ্যরাও প্রচারকার্য্যে ব্যাপক তৎপর ছিল, এবং প্রথম গস্পেলটি (যীশুর বাণী) লিপিবদ্ধ হয় সে সময়েই।

সংক্ষেপে বলতে গেলে, যীশু ধর্ম প্রচার মিশন মূলত ইহুদী সমাজ ও ধর্মের অসহনশীল ও নির্মম এবং বিদ্রোহসূচক, অসামাজিক ও সাম্প্রদায়িক বিধান ও বৈশিষ্টগুলোর সংস্কারের লক্ষ্যে পরিচালিত হয়েছিল বলে মনে হয়, যা ফিলিস্তিনের ইহুদী জনগোষ্ঠী ও সমাজকে কর্তৃত্বকারী গ্রিকো–রোমান সভ্যতা ও শাসনের প্রতি বৈরিতাহীন করে তুলতে পারতো।গস্পেলে যীশুর সাজুদীদেরকে বাদ দিয়ে গোড়াপন্থী ফারিসী ইহুদিদের বারবার আক্রমণও এমন অনুসিদ্ধান্তকে সমর্থন করে।যেমন ম্যাথিউ ১৬:১১: “তোমরা কেন বুঝতে পার না যে আমি রুটির কথা বলি নি, ফারিসী ও সাজুসীদের কুমন্ত্রণার ব্যাপারে সতর্ক থাকতে বলেছি।” এখানে যীশু ফারিসী ও সাজুসী উভয়ের প্রতিই সতর্কতা আহবান করলেও আমরা তার বাণীতে বিশেষত ফারিসী সম্প্রদায়ের প্রতি কড়া আক্রমণ লক্ষ্য করি।যেমন ম্যাথিউ’র গসপেলের অধ্যায় ২৩–এর ফারিসীদের আক্রমণ করে যীশু বলেন, “ধিক্কার তোমাদের প্রতি, ধর্মশাস্ত্রবিধ ও ফারিসীগণ, তোমরা ভণ্ড প্রতারক”; এবং এক নয়, দুই নয়, ৭বার যীশু ফারিসীদেরকে “তোমরা সর্প, তোমরা সর্পছানা” বলে গালি দিয়েছে (যেমন ম্যাথিউ ২৩:৩৩)।  অন্যত্র যীশু ফিলিস্তিনিদেরকে ফারিসীদের ব্যাপারে সতর্ক করতঃ বলেন, “তোমরা সাবধান থেকো ফারিসীদের কুমন্ত্রণার ব্যাপারে, যা ভণ্ডামি মাত্র”। (লুক ১২:১)

যীশু ইহুদী ধর্মের যে ধরনের সংস্কার সাধনে ব্রতী হয়েছিলেন, সে প্রেক্ষাপটে সাজুসী সম্প্রদায়কে ছাড় দিয়ে ফারিসীদেরকে লক্ষ্য করে বারবার তার এসব শত্রু–ভাবাপন্ন ক্ষোভ প্রকাশ ও কুৎসিত গালিগালাজ বিশেষ গুরুত্ব বহন করে এ কারণে যে, ফারিসী সম্প্রদায় ছিল গোড়া এবং ইহুদীবাদের কোন রকম সংস্কার বা শুদ্ধতা নষ্ট করার বিরোধী।অন্যদিকে হেলিনীয়মুখী সাজুসীরা ছিল এমন প্রচেষ্টার সমর্থক, যা আমরা দেখেছি সম্রাট এপিফেনিসের জোরপূর্বক ফিলিস্তিনি সমাজকে হেলিনীয়করণের প্রচেষ্টাকে সাজুসীদের সমর্থনের মধ্যে। এবং ফিলিস্তিনে পুনঃপুন গোড়াপন্থী দাঙ্গা–হাঙ্গামার সময়ে আমরা সাজুসীদেরকে উগ্র মৌলবাদীদের আক্রমণ ও হত্যার লক্ষ্য হতে দেখা দেখি।সঙ্গত কারণেই সাজুসীরা সম্ভবত যীশুর সংস্কার প্রচেষ্টার সমর্থকই ছিল, অন্তত বিরোধী ছিল না।আমরা এটাও দেখি যে, যীশুর ১২জন এ্যাপোসল–এর বেশিরভাগ ছিল সাজুসী সম্প্রদায়ভুক্ত হেলিনিস্ট। নিঃসন্দেহে এসব কারণেই যীশু সাজুসীদের প্রতি প্রধানত নিরব, কিন্তু ফারিসীদের প্রতি আক্রমণাত্মক ও কটুভাষী।

উল্লেখ করা হয়েছে যে, বিশেষত ফিলিস্তিনের বাইরে পরবাসী ইহুদী সম্প্রদায়ের মাঝে যুগে যুগে, যীশুর আগে এবং পরেও, ইহুদী জাতির জন্য ‘মেসিয়া’ বা ‘পরিত্রাণকর্তা’ দাবীকারী অত্যুৎসাহী ধর্মগুরুর আবির্ভাব হত। মিশরবাসী যীশু সম্ভবত ছিলেন তাদের মতই একজন, তবে তার মিশনের উদ্দেশ্য বাকীদের থেকে কিছুটা ভিন্ন ছিল। বাকীরা চাইতেন ইহুদীবাদের বিশুদ্ধতা সাধন ও মৌলিকরূপ পুনঃপ্রতিষ্ঠা করা এবং পবিত্র পিতৃভূমি ফিলিস্তিনে ইহুদীদের জাতীয় স্বাধীনতা ও গৌরব ফিরিয়ে আনা; সেখানে যীশুর মিশরের উদ্দেশ্য ছিল ইহুদীবাদের কিছু অসহনশীল, নির্মম ও বিচ্ছিন্নতাবাদী বিধানের সংস্কার সাধন করে ইহুদী জাতীয় সংস্কৃতি ও ভাবধারাকে যুগ ও পরিস্থিতি উপযোগী করে তোলা। সত্যিকার ব্যক্তি যীশু ও তার ব্যক্তিত্ব পরবর্তীতে, সম্ভবত বেশ কয়েক শত বছর ধরে, ব্যাপক রূপান্তরিত হয় – একে একে অনেক পৌরানিক ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক কল্পকাহিনী ও বৈশিষ্ট যুক্ত করা হয়, বিশেষত পার্শ্ববর্তী প্রভাবশালী মিশরীয় সভ্যতার ধর্মীয় কিংবদন্তি ও দেবতা–ঈশ্বরদের বৈশিষ্টগুলো। ফলাফল? যীশুর মিশনের সফলতা, যদিও ইহুদীবাদের সংস্কার হিসেবে নয়, একটা ভিন্ন ও নতুন ধর্ম হিসেবে প্রতিষ্ঠা লাভের মাধ্যমে।

 

যীশুর ঐতিহাসিক অস্তিত্ব বিনা খৃষ্টধর্মের উৎপত্তি সম্ভব ছিল কি?

খৃষ্ট ধর্মের উৎপত্তি সম্পর্কিত এ পর্যালোচনার শেষ পর্বে যীশুর ঐতিহাসিকতা বিষয়ক বিতর্ক সম্পর্কে দু'কথা বলা আবশ্যক। খৃষ্টপূর্ব মিশরীয় ও গ্রিক ধর্ম ও সংস্কৃতিতে খৃষ্টীয় যীশুর বিশেষ বৈশিষ্টগুলোর পুরো ছকের উপস্থিতি ব্যক্তি যীশুর ঐতিহাসিকতা সম্পর্কে উত্থিত সন্দেহ ও প্রশ্নগুলোকে আরও জড়ালো করে তোলে। অধিকন্তু যৌক্তিক ও বৈজ্ঞানিক বিচারে যীশুকে ঘিরে অতিপ্রাকৃতিক বিষয়গুলো – যেমন অক্ষত কুমারীর গর্ভে জন্ম, পুনরুত্থান, মৃত ব্যক্তিকে জীবিতকরণ ইত্যাদি – গ্রহণযোগ্য নয়।তথাপি সমকালীন ইহুদী সমাজের সমস্যা ও টানাপোড়েনের প্রেক্ষাপটে এটা বিশ্বাস করা যায় যে, স্বাভাবিক প্রজনন প্রক্রিয়ায় জন্মগ্রহণকৃত এক ইহুদী ব্যক্তি সম্ভবত তখনকার দিনে ইহুদী ধর্মের সংস্কারের কাজে হাত দিয়েছিলেন, যিনি যীশু রূপে আমাদের কাছে পরিচিত।ইহুদী ধর্মকে মৌলিক রূপে পুনঃপ্রতিষ্ঠার কথা মৌখিক বা লোক–দেখানো ভাবে বলা হলেও যীশুর মিশনের মূল বা বাস্তব লক্ষ্য ছিল সেকালীন সমাজ ও যুগ অনুপযোগী ইহুদী ধর্মীয় বিধানগুলোর সংশোধন বা বিলুপ্তকরণ। যদিও ধারকৃত তথাপি তার প্রধান শিক্ষাগুলোর অত্যন্ত মানবিক প্রকৃতি প্রমাণ করে যে, যীশু হেলিনীয় সংস্কৃতির সহনশীলতা ও মানবিকতা দ্বারা বিশেষ প্রভাবিত হয়েছিলেন। যীশুর নিবেদিতপ্রাণ শিষ্যরাও ছিল প্রধানত হেলিনীয় ইহুদী, যা এমন ধারনাকে সমর্থন দেয়। তার ইচ্ছে ছিল মানবিকতা–বিরোধী ধর্মীয় ভাবনা ও বিধানগুলো – যেমন ব্যভিচারের শাস্তি, শত্রুর প্রতি নির্মমতা, ভিন্ন ধর্মের প্রতি অসহনশীলতা ইত্যাদি – ইহুদীবাদের অবয়ব থেকে অপসারিত করা।

তবে ব্যক্তি যীশুর অস্তিত্ব বিনা খৃষ্টান ধর্মের জন্মই হতে পারতো না – তাও একেবারেই যুক্তিযুক্ত নয়।আমরা দেখেছি, ইসলামের প্রতিষ্ঠাকালে নবী মুহাম্মদ যখন যে পরিস্থিতির সম্মুখীন হতেন, ঠিক সে অনুসারে কবিতার পংতি উপস্থাপন করতেন পরিস্থিতির সমাধানে। এবং সে কবিতার পংতিগুলোকে তিনি স্বয়ং আল্লাহর কাছে নেমে আসা বলে দাবী করতেন। পংতিগুলো ঠিকই আল্লাহর কাছ এসেছে কিনা তা নিশ্চিত হওয়ারও কোন উপায় নেই বা ছিল না কারও জন্য – না আমাদের, না মুহাম্মদের শিষ্যদের। আসল কথা হচ্ছে, মুহাম্মদ সেগুলোকে আল্লাহর মুখ থেকে রচিত বলে তার অনুসারীদেরকে বিশ্বাস করাতে পেরেছিলেন। অনুরূপভাবে ধর্মীয় অসহিষ্ণুতার কারণে ইহুদী সমাজ যুগে যুগে সাম্রাজ্যবাদী শাসকদের হাতে প্রচণ্ড মার খেয়েছে। এবং কথিত যীশুর জীবনকালে ফিলিস্তিনের ইহুদী সমাজ আবারও একে একে বিদ্রোহে ফুসে উঠছিল (খৃষ্টীয় ৬ সাল, ১৬–১৭ সাল, ও ২৬–৩৬ সাল), যা ৬০'এর দশকে তা ক্রমেই ঘনীভূত হয়ে ৭০ সালে ‘দ্যা গ্রেইট রিভোল্ট’ বা ‘মহা বিদ্রোহ’-এ রূপ নেয় এবং তার ফলে রোমান শাসকদের হাতে ফিলিস্তিনি ইহুদী সমাজ একেবারেই লণ্ডভণ্ড হয়ে যায়। এবং এ মহা বিদ্রোহের গোলযোগের মাঝেই খৃষ্টধর্মের জোর প্রচারণা ও প্রথম ‘গস্পেল’টির সংকলন। এ প্রেক্ষাপটে ফিলিস্তিনের ইহুদী সমাজ যখন তাদের ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক অসহিষ্ণুতার কারণে শক্তিশালী রোমান শাসকদের সাথে ক্রমেই বিদ্রোহে লিপ্ত হয়ে ধ্বংসের দিকে ধাবিত হচ্ছিল, তখন সে সঙ্কট রোধ করণের উদ্দেশ্যে কিছু শান্তিমুখী উদার-মনা ইহুদী এক সাথে হয়ে ইহুদী জনগণকে ধর্মীয় উগ্রতা থেকে নমনীয়তার পথে আনয়নের জন্য আন্দোলন শুরু করতে পারেন। এবং সে উদ্দেশ্যে যেসব ভাবনাগুলো ইহুদী ধর্মীয় ও সংস্কৃতিতে অনুপ্রবেশ জরুরী ছিল, সেগুলোকে যীশুর মুখে চাপিয়ে দিয়ে তারা প্রচারণা চালিয়ে থাকতে পারে, ঠিক মুহাম্মদ যেমন প্রয়োজনীয় ভাবনাগুলো আল্লাহর নামে চালিয়ে দিয়েছে। মুহাম্মদের আল্লাহ বা আরব ঈশ্বরের মতই গস্পেল প্রচারকগণ যীশুকেও ঐ-সময়ে সে অঞ্চলে প্রচলিত ঈশ্বরের গুণাবলীতে ভূষিত করেছেন। ফলে বাস্তব যীশুর অস্তিত্ব বিনাও খৃষ্টধর্মের উৎপত্তি অসম্ভব ছিল না।

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
Archive
 
সাম্প্রতিক পোষ্টসমূহ