Banner
নারীর ক্ষমতায়ন নাকি নারীর ক্ষমতা প্রতিষ্ঠা? : গারো সমাজের অভিজ্ঞতা কী বলে? — শামসুজ্জোহা মানিক

লিখেছেনঃ শামসুজ্জোহা মানিক, আপডেটঃ December 2, 2021, 12:00 AM, Hits: 820

 

ধারণাগত সমস্যা : নারীর ক্ষমতায়ন নাকি ক্ষমতা প্রতিষ্ঠা?

যখন থেকে আমি নারীর ক্ষমতায়ন শব্দটির সঙ্গে পরিচিত হয়েছি তখন থেকে আমি এর প্রতি বিরোধিতা অনুভব করেছি। আমার মনে হয়েছে এই শব্দে নারীকে ক্ষমতাহীন বিবেচনা করা হয়েছে। সুতরাং তাকে ক্ষমতা দিতে চাওয়া হয়েছে। ক্ষমতাটা দিবে কে? পুরুষ। পুরুষ কীভাবে নারীর ক্ষমতা নারীকে দিতে পারে? তার মানে পুরুষ নারীকে পুরুষের ক্ষমতা দিবে। আর এভাবে তাকে পুরুষের সমান করবে!

নারী সম্পর্কে এই ধারণাকেই আমার ভ্রান্ত মনে হয়েছে। আমার মনে হয়েছে এই ধারণার মর্মে আছে নারীকে পুরুষের ক্ষমতার অধিকারী করে তাকে পুরুষের সমান করা। বস্তুত এই ধারণায় নারীর স্বতন্ত্র সত্তাকে অস্বীকার করা হয়। সে যে পুরুষ না হয়েও নারীত্বের গুণাবলী সম্পন্ন মানুষ হিসাবে সকল ক্ষমতার অধিকারী এই বাস্তবতাকে এই ধারণা অস্বীকার করে। যেন নারীকে মানুষ হতে হলে পুরুষ হতে হবে। নারীর পক্ষে পুরুষ তো হওয়া সম্ভব না। তাহলে সে নারীর পরিবর্তে পুরুষে পরিণত হবে। সুতরাং নারীর নারীসুলভ গুণাবলী ধ্বংস করে নারীকে নারীদেহী পুরুষে পরিণত করাই হয়ে উঠে এই ধরনের ধারণার লক্ষ্য।

অথচ নারীর নিজস্ব যে ক্ষমতা আছে সেটা কিন্তু অতুলনীয়। পুরুষের পক্ষে সর্বাত্মকভাবে এই ক্ষমতার অধিকারী হওয়া সম্ভব নয়। তাহলে তার দেহের পরিবর্তন ঘটিয়ে তাকে নারী হতে হবে।

আসলে শব্দের মধ্য দিয়েও সমাজের প্রাধান্যকারী স্বার্থ এবং দৃষ্টিভঙ্গী কথা বলতে পারে। সুতরাং প্রভুত্বকারী পুরুষবাদ বা পুরুষতন্ত্র নিজেকে অভিব্যক্ত করে নারীর ক্ষমতায়ন শব্দ বা পরিভাষা দ্বারা। এই পরিভাষার মর্মে আছে নারীকে পুরুষের মতো ঢাল-তলোয়ার বা কামান-বন্দুক নিয়ে লড়াইয়ের ময়দানে পুরুষের মতো যুদ্ধের সক্ষমতা প্রদর্শনের দাবী। ধরে নেওয়া হয় পুরুষ যা পারে তার সবই নারীকে পারতে হবে। এ কথা ভাবার সময় ভুলে যাওয়া হয় যে, নারী এমন কিছু কাজ করতে পারে যা পুরুষ কখনই পারে না, কখনই পারবেও না। যেমন গর্ভে সন্তান ধারণ। জীব কিংবা মানব জাতির সংরক্ষণে যার গুরুত্ব সর্বাধিক।

এ কথা আমি বলি না যে, নারী যুদ্ধ করতে পারে না। ক্ষেত্র বিশেষে কোনও নারী পারতে পারে। কিন্তু আমার কাছে যুদ্ধে পুরুষকে হারিয়ে ক্ষমতার পরীক্ষায় নারীকে উত্তীর্ণ হতে হবে এমন দাবী একটা হাস্যকর চিন্তার ফসল। বস্তুত পুরুষের জায়গায় যেমন পুরুষ শ্রেষ্ঠ তেমন নারীর জায়গায় নারী শ্রেষ্ঠ। সুতরাং ক্ষমতার ক্ষেত্রেও উভয়ের শ্রেষ্ঠত্বের নিজস্ব এলাকা আছে। প্রয়োজন সেটার স্বীকৃতি। ফলে নারীকে বন্দুক তুলে পুরুষকে মেরে তার ক্ষমতার প্রমাণ দিতে হবে না। নারী হিসাবে তার যে ক্ষমতা আছে সেটার স্বীকৃতি স্বরূপ সমাজ ও রাষ্ট্রের ক্ষমতা নিয়ন্ত্রণে পুরুষের পাশাপাশি নারী হিসাবে তার অংশগ্রহণের নিশ্চয়তা বিধান করাই হচ্ছে মূল কাজ। অর্থাৎ ইসলাম ধর্মের মতো নারীর শ্রেষ্ঠত্বের জায়গা সন্তান ধারণ ও পালন এবং স্বামীর সেবা বলে নারীকে ঘরে ঢুকিয়ে সেখানে বন্দী করে রাখা নয়। বরং সমাজ ও রাষ্ট্রের নীতিনির্ধারণের জায়গাগুলিতে তার অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা হচ্ছে মূল কাজ।

এ কথা সর্বজন বিদিত যে, ঐতিহ্যিকভাবে গারো সমাজ মাতৃশাসিত বা নারী শাসিত। সুতরাং নারীর ক্ষমতা সংক্রান্ত সমস্যাগুলিকে ভালোভাবে বুঝবার জন্য আমি গারো সমাজের উপর অনুসন্ধানমূলক কাজ করার সিদ্ধান্ত নিই। ১৯৯৮ – ১৯৯৯ সালে বৎসরাধিক কাল আমি বাংলাদেশের নেত্রকোনা, শেরপুরসহ বৃহত্তর ময়মনসিংহ অঞ্চলে গারো জাতিসত্তার উপর অনুসন্ধান বা গবেষণা পরিচালনা করি। এটা বলে রাখা উচিত হবে যে, এটা ছিল আমার একক উদ্যোগ। মাঠ পর্যায়ের অনুসন্ধানের পাশে ছিল গারো সমাজের উপর বইপত্র পাঠ। মাঠ পর্যায়ের অনুসন্ধানের জন্য প্রথমে আমি যার সাহায্য পাই আমার মনে হয় তার নাম বলাটা অপ্রাসঙ্গিক হবে না। বিশিষ্ট গারো লেখক এবং বুদ্ধিজীবী সঞ্জীব দ্রংয়ের সাহায্যে আমি গারো সমাজের ভিতর সহজ প্রবেশাধিকার পাই। এছাড়া সেই সময় নেত্রকোনা জিলায় অবস্থিত বিরিশিরি ট্রাইবাল কালচারাল একাডেমীর পরিচালক ছিলেন আমার বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের বন্ধুস্থানীয় প্রয়াত কবি রফিক আজাদ। তার সহযোগিতাও আমার জন্য খুব মূল্যবান ছিল।

এক-সোয়া এক বৎসরে একটা স্বতন্ত্র জনগোষ্ঠীকে খুব ভালোভাবে বুঝা যায় সেই দাবী আমি করি না। কিন্তু আন্তরিকতার সাথে চোখ-কান খোলা রেখে তার মৌল বৈশিষ্ট্য এবং সমস্যাগুলিকে বুঝতে চাইলে অনেকখানি বুঝা যেতে পারে। আমি গারো সমাজের উপর আমার অনুসন্ধান থেকে অর্জিত উপলব্ধি দুইটি প্রবন্ধে লিপিবদ্ধ করি। এই দুইটি প্রবন্ধ যথাক্রমে ‘একজন অ-গারোর দৃষ্টিতে গারো জাতিসত্তা’ এবং ‘ঘুমন্ত এক জাতির জাগরণের অপেক্ষায়’। লিখবার পর এ দুইটি সম্ভবত ২০০০ সালের প্রথম দিকে দুইটি পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। প্রবন্ধ দুইটি ‘বঙ্গরাষ্ট্র’-এর গ্রন্থাগার বিভগের ‘রাজনীতি বিষয়ক গ্রন্থ’-এর ‘ধর্ম ও শ্রেণীতত্ত্বের যাঁতাকলে বাঙ্গালী জাতি’ (http://www.bangarashtra.net/article/398.html) নামক সংকলন গ্রন্থে দেওয়া আছে।

 

গারো সমাজের অভিজ্ঞতার আলোয় নারীর ক্ষমতার প্রশ্ন

কেউ যদি মনে করেন যে, বর্তমানে গারো সমাজ তার মাতৃতন্ত্রের আদি বা সনাতন রূপে আছে তাহলে ভুল করবেন। বাংলাদেশে বাঙ্গালী বিশেষত বাঙ্গালী মুসলিমদের বিভিন্ন ধরনের আগ্রাসন এবং হস্তক্ষেপে এবং সেই সঙ্গে কালের প্রভাবে বিশেষত চারপাশের আধিপত্যকারী পুরুষতান্ত্রিক সমাজ ও সভ্যতার প্রভাবে গারোদের বিভিন্ন সামাজিক প্রথা ও নিয়মে ব্যাপক পরিবর্তন ঘটেছে। প্রকৃতপক্ষে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর থেকে মুসলিমদের নানান ধরনের অত্যাচার ও হামলায় গারো গ্রামগুলি ছত্রখান হয়ে গেছে। বিশেষত গারো সমাজের নারীর প্রাধান্য এবং স্বাধীনতাকে মর্মগতভাবে নারী-বিদ্বেষী এবং আক্রমণাত্মক মুসলিম সমাজ সহজভাবে নিতে পারে না। ফলে ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর থেকে বাঙ্গালী মুসলিমদের আক্রমণাত্মক আচরণের মুখে গারোদের বৃহত্তর অংশই ক্রমাগতভাবে দেশ ত্যাগ করে ভারতের মেঘালয় প্রদেশে আশ্রয় নেয়। এখনকার কথা বলতে পারব না। তবে আমি যখন গারোদের উপর কাজ করি তখনই গারোদের বসতি বা পল্লীসমূহের দুর্দশাপূর্ণ এবং ভগ্ন দশা আমার চোখে পড়েছিল। প্রায় সব গ্রাম বা পল্লীর ভিতরে বা পাশেই মুসলিমদের বাড়ীঘর এবং বসতির বিস্তার বলে দিচ্ছিল কীভাবে গারো সমাজ ছিন্নভিন্ন হয়ে যাচ্ছে। অথচ ব্রিটিশ শাসনকালেও বৃহত্তর ময়মনসিংহের সম্ভবত সাত অথবা আটটা থানা ছিল ব্যাপকভাবে গারো অধ্যুষিত। সুতরাং আমি যখন গারোদের উপর আমার গবেষণা পরিচালনা করি তখন সেটা ছিল এ দেশের ছন্নছাড়া এবং বিলুপ্তির মুখে থাকা এক জনজাতির উপর আমার কাজ।

তবু গারো সমাজের উপর বিভিন্ন গবেষক এবং পণ্ডিতের লেখা পাঠ, গ্রাম ও শহরের বিভিন্ন পর্যায় কিংবা পেশা ও শ্রেণীর গারোদের সঙ্গে আলোচনা এবং পর্যবেক্ষণ থেকে একটা জনজাতি সম্পর্কে অনেক কিছু জানা যায় বৈকি। যেহেতু আমি সমাজ ও রাষ্ট্রে নারীর ক্ষমতা প্রতিষ্ঠার সমস্যাগুলিকে বুঝতে চেয়েছিলাম সেহেতু আমার অনুসন্ধান ও পর্যবেক্ষণে নারীদের স্থান ছিল বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ। ফলে বিভিন্ন পর্যায়ের কিছু সংখ্যক গারো নারীর সাক্ষাৎকার নিই এবং বিভিন্ন বিষয়ে তাদের মতামত জানতে চাই।

যাইহোক, আমার এই অনুসন্ধানে পুরুষতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গী থেকে গড়ে তোলা নারীবাদ এবং নারীর ক্ষমতায়নের অন্তঃসারশূন্যতা আরও স্পষ্ট হয়ে ধরা পড়ে। এ প্রসঙ্গে প্রথমেই বলি যে, এখন যে অবস্থাই হোক গারো সমাজ ঐতিহ্যিকভাবে নারীর প্রাধান্যবিশিষ্ট। শুধু যে সন্তানরা মায়ের সূত্রে পরিচিত হয় তাই নয়, সম্পত্তিতেও পুরুষের অধিকার নাই। পুরুষ যে সম্পত্তিই অর্জন করুক অবিবাহিত অবস্থায় সেটা তার মায়ের হবে আর বিবাহিত হলে সেটা তার স্ত্রীর অধিকারভুক্ত হবে। এখন হয়ত ঐতিহ্যিক এই নিয়ম আর সর্বক্ষেত্রে প্রয়োগ হচ্ছে না, কিন্তু এটাই গারো সমাজের চিরাচরিত নিয়ম ছিল এই সেদিনও। অতীতে বিয়ের পর গারো পুরুষদেরকে যেতে হত তার স্ত্রীদের গৃহে, সেখানেই তাদের আশ্রয় হত। এখন অবশ্য এই প্রথা ভেঙ্গে পড়ছে। তবে সেটা সব ক্ষেত্রে নয়। বর্তমান নেত্রকোনা জিলার গ্রামাঞ্চলে আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মাস্টার্স পাস করা যুবককেও তাদের সামাজিক প্রথা মেনে স্ত্রীর বাসগৃহে বাস করতে দেখেছি।

গারো সমাজের আর একটা প্রথা হয়ত অনেককে বিস্মিত করবে। সেটা হচ্ছে ‍বিয়ের প্রস্তাব কোনও ছেলের পক্ষ থেকে কোনও মেয়েকে দিতে না পারা। পরস্পরকে ভালো লাগলেও প্রস্তাবটা দিতে হবে মেয়েকে। ছেলের কাজ হল সেই প্রস্তাব গ্রহণ অথবা প্রত্যাখ্যান করা। এমনকি সামাজিক প্রথা অনুযায়ী সেদিনও কোনও ছেলের পক্ষে মেয়েকে প্রেম নিবেদন করাটাও ছিল লজ্জাজনক। কারণ এই অধিকার ছিল মেয়েদের জন্য সংরক্ষিত। মেয়ে আগে ছেলেকে প্রেম নিবেদন করবে, তারপর ছেলের তাতে সাড়া দিবার কিংবা না দিবার প্রশ্ন আসবে। গারো সমাজের মাতৃতন্ত্র কিংবা নারীতন্ত্রের আরও কিছু প্রথা কিংবা নিয়ম আমাদের নিকট বিস্ময়কর কিংবা অগ্রহণীয় মনে হতে পারে। কিন্তু নারীর প্রায় নিরঙ্কুশ আধিপত্যকে রক্ষার স্বার্থে সমাজ সেই সব প্রথা বা নিয়মকে হাজার হাজার বৎসর ধরে রক্ষা করেছে। এবং তার জন্য যুদ্ধও করেছে।

যুদ্ধটা নারী করত? না, পুরুষই করত। কারণ কাজটা মূলত পুরুষের। গারো মাতৃতন্ত্রকে বুঝার জন্য আরও দৃষ্টান্ত দিই। যেমন, গারো সমাজের নারীরা খুবই পরিশ্রমী। কিন্তু খুব বেশী ভারী কাজের দায়িত্ব ছিল পুরুষের। সুতরাং আগের কালে যখন জঙ্গল পরিষ্কার করে চাষাবাদ করা হত তখন বড় বড় গাছ কাটার দায়িত্ব ছিল পুরুষদের। সাধারণ নিয়মে মেয়েদের যেহেতু পুরুষের মতো দেহশক্তি থাকে না সেহেতু সেই ধরনের সকল কাজের দায়িত্ব নিতে হত পুরুষদেরকে। অথচ সমাজ ছিল নারী শাসিত। আজ যখন অতীতের মতো জঙ্গল পরিষ্কার করে এবং মাটি খুঁড়ে বীজ বুনবার পরিবর্তে গরুর কাঁধে লাঙ্গল জুড়ে দিয়ে জমি চাষ করতে হয় তখন লাঙ্গল দিয়ে জমি চাষের দায়িত্বও পুরুষকে নিতে হচ্ছে। কারণ সেটা নারীর পক্ষে দুঃসাধ্য কিংবা অসম্ভব।

নারীর আধিপত্যাধীন কিংবা নারীতান্ত্রিক গারো সমাজ স্মরণাতীত কাল থেকে হাজার হাজার বছর ধরে সম্পূর্ণ স্বাধীন সত্তা নিয়ে টিকে ছিল ব্রিটিশদের আধুনিক অস্ত্রশক্তির নিকট পরাজয়ের পূর্ব পর্যন্ত। এরপর থেকে নারীতান্ত্রিক গারো সমাজের পরিবর্তন ও ভাঙ্গন শুরু হয়। অর্থাৎ গারো সমাজের পতনের কারণ অভ্যন্তরীণ ভাঙ্গন নয়, বরং প্রবলতর বহিঃশক্তির হস্তক্ষেপ। অর্থাৎ ভিতর থেকে নারীতন্ত্র বা মাতৃতন্ত্রের পতন হয় নাই। মাতৃতন্ত্রের পরিবর্তে পুরুষতান্ত্রিক এই শক্তির উৎস কী বা কীভাবে তার উত্থান ঘটেছে সেটা্ও নিশ্চয় আলোচনার বিষয় হতে পারে। তবে এ ক্ষেত্রে সেটা আমাদের বিবেচ্য বিষয় নয়। আমরা যেটা বুঝতে চাচ্ছি সেটা হচ্ছে একটা সমাজে পুরুষের মতো যোদ্ধা এবং দেহবলে পুরুষের সমকক্ষ না হয়েও কীভাবে নারীরা হাজার হাজার বছর ধরে সমাজে প্রাধান্য প্রতিষ্ঠা করে রেখেছে। শুধু তাই নয়, সেই নারীতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে রক্ষার জন্য যুদ্ধের প্রয়োজন হলে সেটা পুরুষই করেছে হাজার হাজার বছর ধরে। এর মধ্যে সমাজের বস্তুগত প্রয়োজন নিশ্চয় কাজ করেছে। কিন্তু সেটা দিয়েই হাজার হাজার বছর কাল ধরে চারপাশের যুদ্ধনির্ভর এবং আগ্রাসী পুরুষতান্ত্রিক সমাজ ও রাষ্ট্রগুলির আগ্রাসনকে মোকাবিলা করে টিকে থাকা যায় না। এর মধ্যে চেতনাগত বিষয়ের গুরুত্বকেও বুঝতে পারতে হবে। গারো নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সবার নিকট মাতৃ বা নারী শাসিত এই সমাজই নিশ্চয় গৌরব, অহঙ্কার এবং শান্তির জায়গা ছিল। সুতরাং চারপাশের আপাতদৃষ্টিতে পরাক্রমশালী পুরুষ প্রাধান্যবিশিষ্ট সমাজ এবং রাষ্ট্রগুলিকে মোকাবিলা করে টিকেছিল, শুধু অহিংসভাবে নয়, যুদ্ধ করেও। তেমনভাবে যুদ্ধপ্রবণ এবং আগ্রাসী না হলেও এক সময় গারো যোদ্ধাদেরকে প্রতিবেশী সমাজ এবং রাষ্ট্রগুলি ভয় করত। নৃমুণ্ড শিকারী হিসাবেও গারো পুরুষ যোদ্ধাদেরকে ভয় করা হত। মেঘালয় এবং সংলগ্ন অঞ্চলের ভূ-প্রকৃতি এবং জলবায়ুও অবশ্য গারোদের জন্য রক্ষাব্যূহ হিসাবে কাজ করেছিল। তবে গারো যোদ্ধাদের শৌর্যবীর্য না থাকলে শুধু ভূ-প্রকৃতির আনুকূল্য কয়দিন কাজ করত? এভাবে নারীরা নিজেদের প্রাধান্যযুক্ত যে সামাজিক ব্যবস্থা গড়ে তুলেছিল বাহিরের আক্রমণ ও আগ্রাসনকে প্রবল বিক্রমে প্রতিহত করে পুরুষরাই সেই ব্যবস্থাকে রক্ষা করেছিল।   

এ থেকে এটাই প্রমাণিত হয় যে, বাহুবল বা অস্ত্রবলই একটা ব্যবস্থা রক্ষার একমাত্র, এমনকি সর্বক্ষেত্রে প্রধান নিয়ামক নয়। এ থেকে এটাও বুঝা যায় যে, নারীর যে নিজস্ব শক্তি রয়েছে সমাজ ও রাষ্ট্রের নীতিনির্ধারক জায়গাগুলিতে তার স্বীকৃতি এবং প্রতিষ্ঠাই সমাজ ও রাষ্ট্রের সর্বক্ষেত্রে তার অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য যথেষ্ট। এর জন্য তাকে সেনাবাহিনীতে যোগ দিতে এবং রণক্ষেত্রে অস্ত্র হাতে যুদ্ধ করতে হবে এমন ধারণাকেই আমি ভুল মনে করি। এটা নারীর যে নিজস্ব শ্রেষ্ঠত্ব এবং শক্তি তথা ক্ষমতার জায়গা আছে সেটাকে উপেক্ষা করতে শিখায় এবং নারীদেরকেও পথভ্রষ্ট করে। আগ্রহী নারীরা সেনা কিংবা যুদ্ধেও যেতে পারে। কিন্তু সেটা প্রধানত তাদের জায়গা নয়। সেটা প্রধানত পুরুষদের জায়গা। তবে নারীরা সেখানে থাকবে বৈকি। থাকবে তার নীতিনির্ধারণের জায়গায়। অর্থাৎ রাষ্ট্রের নীতিনির্ধারণের প্রতিটি জায়গায় স্বতন্ত্রভাবে নারী হিসাবে নারী পুরুষের পাশাপাশি সমান ক্ষমতা নিয়ে অবস্থান করবে। তাহলে রাষ্ট্র বাধ্য হবে নারীর স্বার্থের প্রতিনিধিত্ব করতে, যা দিবে নারী এবং পুরুষ উভয়কেই সমাধিকার। সুতরাং আমি নারীর ক্ষমতায়ন ধারণার বিরোধী, বরং নারীর নিজস্ব ক্ষমতা যেটা তার আছে আমি তার স্বীকৃতির মাধ্যমে রাষ্ট্র ও সমাজের সকল ক্ষমতাযন্ত্রের নীতিনির্ধাণের জায়গাগুলিতে নারীর স্বতন্ত্র এবং নিজস্ব প্রতিনিধিত্বের ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার পক্ষপাতী।

এই বিষয়ের উপর এখন আর আলোচনা না করে একটা সমাজের বাস্তবতা কীভাবে তার সদস্যদের মনস্তত্ত্ব এবং আচরণের ‍উপর প্রভাব ফেলে তার উপর সামান্য কিছু আলোকপাত করে আমি এই আলোচনা শেষ করব।

গারো সমাজের কর্তৃত্বশীল নারীদের সম্পর্কে কথা উঠলে হয়ত রূঢ়, উদ্ধত এবং আক্রমণাত্মক নারীর ভাবমূর্তি কল্পনায় ভেসে উঠবে। অথচ গারো সমাজের বাস্তবতা ঠিক এর বিপরীতটা। সাধারণ বাঙ্গালী নারীদের চেয়ে আমার কাছে গারো নারীদের বেশী আত্মপ্রত্যয়ী এবং ব্যক্তিত্বশালী মনে হয়েছে। অথচ তারা আচরণে সাধারণত বিস্ময়করভাবে নম্র বা কমনীয়। অনুমান করি গারো সমাজে নারীর যে মর্যাদা ও নিরাপত্তা বিদ্যমান সেটা নারীদের জীবনে এবং মনে যে প্রভাব ফেলে সেটা প্রতিফলিত হয় তাদের চোখে-মুখে, আচরণে এবং চলাফেরায়। আগেই বলেছি গারো নারীরা খুব পরিশ্রমী। আমার মনে হয়েছে পুরুষদের চেয়েও তারা অনেক বেশী পরিশ্রমী। সংসার এবং স্বামী-সন্তানদের জন্যও তারা সাধারণভাবে খুব মনোযোগী।

সবার কথা বলতে পারব না। তবে আমি যে কয়টি গারো দম্পতি দেখেছি তাদেরকে সুখী মনে হয়েছে। আর একটা বিষয় মনে হয়েছে, তাহল গারো স্বামীরা সাধারণত স্ত্রীর প্রতি অনুগত থাকে। সম্ভবত এটা নারীকে একটা নিরাপত্তা বোধ দেয়।

আর একটা কথা বলে এই আলোচনা শেষ করি। সেটা হল বাংলা ধর্ষণ কিংবা ইংরাজী Rape-এর কোনও গারো প্রতিশব্দ নাই। নারী ধর্ষণ গারো সমাজে হাজার হাজার বছর ধরে প্রায় অজানা একটা বিষয়। আসলে নারীনিগ্রহের এই প্রকাশ গারোদের নিকট অচিন্ত্যনীয়। সুতরাং এর প্রতিশব্দ তাদের ভাষায় না থাকাই স্বাভাবিক। তবে এ ধরনের কাজ কেউ কখনও করলে তার শাস্তি ছিল মৃত্যুদণ্ড। অতীতে গারোদের মধ্যে রাষ্ট্র না থাকায় সামাজিকভাবে তা কার্যকর করা হত।

হ্যাঁ, বিস্ময়কর মনে হলেও এটা ঘটনা যে, বৃহৎ অঞ্চলব্যাপী গারো সমাজ থাকলেও তাদের কোনও রাষ্ট্র ছিল না। ফলে বিভিন্ন গারো গ্রাম কিংবা গোত্র বা গোষ্ঠীর মধ্যে সামাজিক ঐক্যের অনুভূতি এবং সাংস্কৃতিক ঐক্য থাকলেও কোনও কেন্দ্রীভূত নেতৃত্ব বা দৃঢ়বদ্ধ কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রণ যেমন ছিল না, তেমন ছিল না নিয়মিতভাবে যুদ্ধ করার জন্য কোনও স্থায়ী সেনাবাহিনীও। যখন প্রয়োজন হত তখন গ্রাম বা গ্রামসমষ্টির অধিবাসীদের যৌথ সিদ্ধান্তের ভিত্তিতে সকল সক্ষম গারো পুরুষ অস্ত্র হাতে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ত। এই ধরনের যে কোনও আলোচনা সভায় পুরুষদের মতো নারীরাও উপস্থিত থেকে মতামত দিত। সিদ্ধান্ত হত সাধারণত মতৈক্যের ভিত্তিতে। যুদ্ধ শেষে যারা বেঁচে ফিরত তারা নারীদের সহযোগী হিসাবে গৃহকর্মে কিংবা সামাজিক কর্মে মন দিত। অবশ্য যুদ্ধজয়ী হয়ে ফিরলে সঙ্গে থাকত শত্রুর কাটা মুণ্ডু, সেগুলিকে তারা ঝুলিয়ে দিত গৃহের সামনে উঁচু কোনও কিছুতে তাদের শত্রুনিধনের এবং বীরত্বের চিহ্ন বা স্মারক হিসাবে।

২ ডিসেম্বর, ২০২১

 

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
Archive
 
সাম্প্রতিক পোষ্টসমূহ