Banner
পাশ্চাত্যে থেকে যারা বাংলাদেশের রাজনীতির বিকল্প নেতৃত্ব গঠন করছেন — শামসুজ্জোহা মানিক

লিখেছেনঃ শামসুজ্জোহা মানিক, আপডেটঃ February 6, 2022, 12:00 AM, Hits: 750

 

দেশের ভিতর থেকে বিরোধী রাজনৈতিক শক্তির উত্থানের পথ বন্ধ করা হয়েছে। কিন্তু তার মানে এই নয় যে, বিদেশ থেকে বিশেষত পাশ্চাত্য থেকে সরকার বিরোধী প্রচার বন্ধ হয়েছে। বরং দেশের ভিতর থেকে বলার সুযোগ বন্ধ করার পরিণতি হচ্ছে পাশ্চাত্য থেকে বিরোধী মত বা বক্তব্য প্রচারের গতি ও শক্তি বৃদ্ধি। আজকের ইন্টারনেট বা ডিজিটাল প্রযু্ক্তির যুগে সেই প্রচার মুহূর্তের মধ্যে বাংলাদেশের আনাচে-কানাচে থাকা অগণিত আগ্রহী শ্রোতা-দর্শকের কাছে পৌছাচ্ছে। যারা ইদানীং ইউটিউব এবং ফেসবুকের মাধ্যমে বক্তব্য দিয়ে বিদেশ থেকে বাংলাদেশের জনমতে প্রভাব রাখায় বিশেষভাবে সমর্থ হচ্ছেন তাদের সংখ্যা যে বেশী তা নয়। লেখক, গবেষক, শিক্ষাবিদ, সাংবাদিক এবং সাবেক সামরিক কর্মকর্তাসহ যে কয়জন বিশেষ করে ফেসবুক এবং বিভিন্ন ইউটিউব চ্যানেলের মাধ্যমে শ্রোতাদের সামনে কম-বেশী উপস্থিত হচ্ছেন আমার ধারণা তাদের মধ্যে ইতিমধ্যে ৫/৭ জন বিশেষ গুরুত্ব অর্জন করেছেন। তাদের বক্তব্য শুনে এবং তাদের দর্শক-শ্রোতার সংখ্যা তথা ভিউয়ারের সংখ্যা থেকে আমি তাদের জনপ্রিয়তার ধরন বুঝার চেষ্টা করি।

এটা আমার কাছে স্পষ্ট যে, আওয়ামী লীগ সরকার ২০০৯ সালের ৬ জানুয়ারীতে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হবার পর থেকে বিগত ১৩ বৎসরের শাসনে দেশের ভিতরে সকল বিরোধী রাজনৈতিক শক্তি এবং মতকে দমন করায় সক্ষম হলেও এ ক্ষেত্রে সরকার সঙ্গত কারণেই ব্যর্থ। কারণ ইউরোপ-আমেরিকায় প্রচারের স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করার ক্ষমতা বাংলাদেশ সরকারের নাই।

সরকার সম্ভবত এই দিককে এতদিন হিসাবে নেয় নাই। দেশের ভিতরে বিকল্প রাজনীতি এবং আন্দোলনের পথকে বন্ধ করে রাখবার বিপদ এখন তার উপর ঝাঁপিয়ে পড়তে যাচ্ছে। বেশী কথা না বলে বলি, মার্কিন নিষেধাজ্ঞা সরকারের সামনে এমন বিপদ উপস্থিত করেছে যা থেকে তার পরিত্রাণের কোনও পথ খোলা নাই। এটা ঠিক যে, আপাত দৃষ্টিতে দেশে আন্দোলনের জন্য কার্যকর নেতৃত্ব এবং রাজনীতি নাই মনে হতে পারে। দেশের ভিতরে যখন বিকল্প নেতৃত্ব এবং রাজনীতির বিকাশ বা উত্থানের পথ বন্ধ করা হয় তখন কিন্তু বিদেশ থেকেও সেটা ঘটতে পারে। পৃথিবীর দেশে দেশে তার দৃষ্টান্ত আছে।

রুশ বিপ্লবের নেতৃত্ব কিন্তু বিদেশ তথা পশ্চিম ইউরোপেই পুষ্টি বা পরিণতি লাভ করেছিল। জারতন্ত্রের নিষ্পেষণ থেকে মুক্তির জন্য রাশিয়ার বিভিন্ন বিপ্লবাকাঙ্ক্ষী শক্তি যেমন পশ্চিম ইউরোপ থেকে উদ্ভূত বিভিন্ন ধারার সমাজতন্ত্রী এবং মার্কসবাদী রাজনীতিকে গ্রহণ করেছিল তেমন এই বিপ্লবীদের অনেকেরই আশ্রয় হয়েছিল পশ্চিম ইউরোপের বিভিন্ন দেশে। প্রথম মহাযুদ্ধে রাশিয়ার বিদ্যমান ব্যবস্থা ভেঙ্গে পড়লে তার সুযোগ নেন মার্কসবাদী এবং সমাজতন্ত্রীদের একটি ধারা বলশেভিক পার্টির নেতা লেনিন।

একটা ধ্রুপদী দৃষ্টান্ত হিসাবে আমি রুশ বিপ্লবের কথা উল্লেখ করলাম। কম্যুনিস্ট বিপ্লব ছাড়াও ভিন্ন রূপের হলেও বড় ধরনের পরিবর্তনের একটা দৃষ্টান্ত হিসাবে ইরানের কথা বলা যায়। কোনও দেশের পরিবর্তন হুবহু আর একটা দেশের মতো করে সাধারণত হয় না। তবে পরিবর্তনের শক্তি সমাজের ভিতরে জন্ম নিলে তা কোনও না কোনও ভাবে পথ করে নিতে চায়।

আমাদের মতো সমাজে পরিবর্তন রাশিয়া, চীন কিংবা ইরান ইত্যাদি দেশের মতো করে হবে সে কথা আমি বলি না। তবে সমাজে পরিবর্তনের বাস্তব পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে বলে আমি মনে করি। স্বাভাবিকভাবে ভিতর থেকে যদি তার নেতৃত্ব গঠনের পথ বন্ধ করে রাখা হয় তবে সে কাজটা বাহির থেকে হবে। এখন তো একশ’ বা পঞ্চাশ বছর আগের চেয়েও কাজটা অনেক সহজ হয়েছে। কারণ এটা ডিজিটাল প্রযুক্তির যুগ। যার হাতে স্মার্টফোন কিংবা কম্পিউটার আছে এবং সেই সঙ্গে আছে ইন্টারনেট সংযোগ সে সমস্ত পৃথিবীর সঙ্গে সংযুক্ত। ফলে আজকের যুগে কারও পক্ষে আগের কালের মতো বলপ্রয়োগ এবং ত্রাস সৃষ্টি করে মানুষের চেতনাকে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব নয়। আগের কালেও যখন সর্বত্র ও সর্বদা কাজটা করা সম্ভব হয় নাই তখন এ কালে কাজটা আরও দুরূহ হয়ে পড়েছে। তবু এ কাজ করতে গিয়ে অনেক দেশের রাষ্ট্রশাসকরা বিপদে পড়ে।

বাংলাদেশের শাসকরা এই নিদারুণ ভুলটা করে বিপদে পড়তে যাচ্ছে। আমার ধারণা কয়েক বৎসর ধরে বিশেষ করে কয়েকজন ব্যক্তি পাশ্চাত্য সমাজের স্বাধীনতার সুযোগ নিয়ে নিয়মিত প্রচারের মাধ্যমে একটা পর্যায়ের জন্য হলেও বিকল্প নেতৃত্ব গড়ে তুলছেন।  সরকার দেশের অভ্যন্তরে বিরুদ্ধ নেতৃত্বকে না হয় নিয়ন্ত্রণ করবে, কিন্তু বিদেশের মাটি থেকে বাধাহীনভাবে যে নেতৃত্ব দাঁড়াচ্ছে তাকে কিংবা তার গতিধারাকে নিয়ন্ত্রণ করবে কী করে?

এদের অনেক চিন্তা বা ধারণার সঙ্গে আমার গুরুতর পার্থক্য আছে। কিন্তু আমি এমন একটা জীবন্ত ধারাকে উপেক্ষা করতে পারি না। সুতরাং অনেক দিন ধরেই তাদের বক্তব্য তথা চিন্তার গতিধারাকে বুঝতে চেষ্টা করছি। তাতে এটাও বুঝছি যে, তাদের চিন্তার মধ্যেও কম অথবা বেশী পরিবর্তন ঘটছে। বাস্তব অভিজ্ঞতাই তাদেরকে এক জায়গায় দাঁড়িয়ে থাকতে দিচ্ছে না। কারও পরিবর্তন বেশী লক্ষ্যণীয়, কারওটা কম। তা হোক, তারা বিদেশে থেকে তাদের মতো করে বাংলাদেশ সরকার-বিরোধী রাজনীতি গড়ে তুলছেন। ক্রমে তারা সরকারের সমস্যা থেকে রাষ্ট্র ব্যবস্থার সমস্যাগুলির দিকেও দৃষ্টি দিচ্ছেন। ধর্ম সংক্রান্ত প্রশ্নে তাদের অবস্থান কিছু করে নমনীয় হচ্ছে, যদিও এ প্রশ্নে তাদের বিভ্রান্তি অন্তত আমার কাছে স্পষ্ট। বিশেষত এদের মধ্যে ইসলাম-পছন্দ চিন্তা অনেক ক্ষেত্রেই বেশ জোরালোভাবে আত্মপ্রকাশ করে।

বাংলাদেশের বাস্তবতায় ১৯৪৭ সালে বাংলা ও বাঙ্গালী জাতির ধর্মভিত্তিক বিভাজনকে অস্বীকার করা ছাড়া যে কোনও রাজনীতি ধর্মীয় সাম্প্রদায়িক রাজনীতিতে মোড় নিতে পারে। এটা একটা দর্শনগত সমস্যা। এই সমস্যার সমাধান তাদের কাছে নাই বলে জেনারেল জিয়া এবং তার বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদী রাজনীতির প্রতি তাদের এত দুর্বলতা। যাইহোক, কোনও ধরনের ইসলামী বা ধর্মীয় রাজনীতি নিয়ে তারা আজকের যুগের চ্যালেঞ্জকে মোকাবিলা করতে যে পারবে না সেটা সময়ের সঙ্গে স্পষ্ট হবে। তবে সেসব তো ভবিষ্যতের কথা। তার আগে তাদের এই ভ্রান্তির মূল্য এ দেশকে দিতে হতে পারে। মূল্যটা খুব বেশীও হতে পারে।

অবশ্য এর দায়ও সরকারকে নিতে হবে। দীর্ঘকাল ধরে দমন-পীড়ন দ্বারা ধর্মমুক্ত বা লোকবাদী বিভিন্ন ব্যক্তি ও লেখকের কণ্ঠরোধ করে সরকার বাংলাদেশকে প্রকারান্তরে ইসলামী শক্তির জন্য অনুকূল ভূমিতে পরিণত করেছে। কাজেই যুক্তি ও মুক্তচিন্তা বা লোকবাদী চেতনার বিস্তারের পরিবর্তে ইসলামী চিন্তার প্রসার ঘটানোটাই সহজতর হয়েছে। ব্রিটিশ কালে পাকিস্তান আন্দোলন, তার পরিণতিতে ১৯৪৭ সালে বাংলা ও বাঙ্গালী জাতির বিভাজনের মধ্য দিয়ে মুসলিম সংখ্যাগুরু পূর্ববঙ্গের পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্তি এবং ১৯৭১-এ পূর্ব পাকিস্তানে গণ-প্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে যে ইসলামী রাজনীতির ধারাবাহিকতা অব্যাহত আছে তাকে চিনতে কি কষ্ট হয়? সুতরাং এ দেশে বাঙ্গালী পরিচয়ের তুলনায় ইসলামী তথা ধর্মীয় পরিচয় বড় হয়ে দেখা দেয়। মুখে বাঙ্গালী পরিচয় দিলেও মনের ভিতরে প্রবল হয়ে থাকে মুসলিম পরিচয়, যেটা যে কোনও ছুতায় সবকিছু ছাপিয়ে সামনে চলে আসতে পারে।

এই বাস্তবতায় যে কোনও ভারত-বিরোধিতা মুসলিমের হিন্দু-বিরোধিতায় পরিণত হতে পারে। বিশেষত সাধারণ মুসলিমদের জন্য সেটাই স্বাভাবিক। মুসলিম পণ্ডিতরাও অধিকাংশ সময়ই এর বাইরে থাকে না। এরই বহিঃপ্রকাশ ঘটতে দেখছি বিদেশ থেকে যারা দেশের রাজনীতি এবং চেতনায় প্রভাব ফেলে চলেছেন তাদের অনেকের বক্তব্যে।

অবশ্য দর্শনগত বিচারে এদের বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদের সঙ্গে আওয়ামী লীগের বাঙ্গালী জাতীয়তাবাদের কোনও পার্থক্য নাই। কারণ উভয় পক্ষের জাতীয়তাবাদী আদর্শই ১৯৪৭-এর ধর্মভিত্তিক বিভাজনের উপর প্রতিষ্ঠিত। বরং আওয়ামী লীগের জাতীয়তাবাদের প্রতারণা ও দ্বিচারিতা তাদের মধ্যে নাই। এরা স্পষ্টভাবে পাকিস্তান আন্দোলনের উত্তরাধিকারী হিসাবে নিজেদেরকে চিহ্নিত করেন। আর এখানেই এদের আদর্শিক সঙ্কট। পাকিস্তান আন্দোলনের উত্তরাধিকার নিয়ে দাঁড়াতে গিয়ে এরা ইসলামী রাজনীতির ভিত্তির উপর দাঁড়াতে বাধ্য হন এবং এভাবে অধঃপতিত হন আদর্শিক ও চেতনাগত পশ্চাৎপদতা ও প্রতিক্রিয়ায়। যাইহোক, এটা ভিন্ন প্রসঙ্গ।

এদেরকে এ দেশের আগামী রাজনীতিতে ফ্যাক্টর মনে না করলে আমি এই আলোচনায় যেতাম না। এরা কতটা ফ্যাক্টর হবেন এবং কীভাবে হবেন সেটা বলতে পারব না। তবে বাংলাদেশের বিদ্যমান পরিস্থিতিতে এরা যে বাংলাদেশের আগামী রাজনীতি এবং আন্দোলনের গতিধারায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে চলেছেন আমার সে রকমটাই মনে হয়। বাংলাদেশের রাজনীতিতে এখন যে শূন্যতা চলছে তার প্রেক্ষিতে তাদের ভূমিকাকে দেখতে হবে। চেতনার জায়গাটা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। সামাজিক আন্দোলনের গতিধারা তো তার পরেকার কথা। বলা যায় সেটা চেতনার ফলশ্রুতি। বাংলাদেশ তার জন্মের পর থেকে তার পঞ্চাশ বছরের ইতিহাসের সবচেয়ে জটিল এবং কঠিন একটি সময়ে প্রবেশ করেছে। এক বিরাট পরিবর্তন এখন আমাদের সামনে অপেক্ষা করছে। সুতরাং পরিবর্তনের গতিধারা নির্মাণে চেতনার ভূমিকা সম্পর্কে কিছু ধারণা থাকলেই এই সকল ব্যক্তির বর্তমান ভূমিকার সঙ্কট ও সীমাবদ্ধতা এবং একই সঙ্গে তার গুরুত্ব ও তাৎপর্য স্পষ্ট হবে।

৬ ফেব্রুয়ারী, ২০২২

 

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
Archive
 
সাম্প্রতিক পোষ্টসমূহ