Banner
ঘুমন্ত এক জাতির জাগরণের অপেক্ষায় ─ শামসুজ্জোহা মানিক (পুনঃপ্রকাশিত)

লিখেছেনঃ শামসুজ্জোহা মানিক, আপডেটঃ April 12, 2022, 12:00 AM, Hits: 676

 

এক

যে জাতির নারীরা ছিল স্বাধীন, কর্তৃত্বকারী এবং ক্ষমতা ও অপরিমেয় মর্যাদার অধিকারী এবং যে জাতির নারীরা এবং সেই সঙ্গে নারী অনুগত এবং নারীর প্রতি শ্রদ্ধাশীল বলদৃপ্ত পুরুষ যোদ্ধারা ছিল প্রতিবেশী পিতৃতান্ত্রিক বা পুরুষতান্ত্রিক সমাজগুলোর জন্য ত্রাস স্বরূপ সেই এক কালের প্রবল গারো জাতি কি হারিয়ে যাচ্ছে? ব্রিটিশ শাসন কালের পূর্বে সপ্তদশ-অষ্টাদশ শতাব্দীতেও বর্তমান ভারতের মেঘালয় রাজ্যের গারো পাহাড় ছাড়াও বর্তমান বাংলাদেশের বৃহত্তর ময়মনসিংহ জেলা এবং ভারতের অন্তর্ভুক্ত আসাম রাজ্যের গোয়ালপাড়া, কামরূপ জেলাসহ এক বৃহৎ অঞ্চলে ছিল মাতৃতান্ত্রিক গারো জাতির বসবাস। এই অঞ্চলের মধ্যমণি স্বরূপ ছিল অজেয় গারো বাসভূমি গারো পাহাড়। দীর্ঘ দিন ধরে গারো জনগোষ্ঠী চতুর্দিকের পিতৃতান্ত্রিক সমাজগুলোর চাপে মেঘালয় রাজ্যের গারো পাহাড়কে কেন্দ্র করে একটি অঞ্চলে কেন্দ্রীভূত হয়েছে। এখন ভারতের মেঘালয় রাজ্যে তারা সংখ্যাগুরু জাতিসত্তা হিসাবে নিজেদের অস্তিত্ব কিছুটা নিরাপদে বজায় রাখতে পারলেও বাংলাদেশে তাদের অস্তিত্ব নিদারুণভাবে সঙ্কটাপন্ন। বিশেষত বর্তমান টাঙ্গাইল জেলার মধুপুর এলাকাসহ বৃহত্তর ময়মনসিংহের উত্তরের অনেক এলাকায় এক সময় গারোরা সংখ্যাগুরু হলেও বর্তমানে তারা নিদারুণভাবে সংখ্যালঘুতে পরিণত হয়েছে।

ব্রিটিশ শাসন পূর্বকালে পিতৃতান্ত্রিক হিন্দু এবং মুসলমান জমিদার এবং রাজশক্তির আক্রমণ ও আগ্রাসন যেমন মাতৃতান্ত্রিক গারো সমাজের শক্তি হ্রাস করেছিল তেমন পিতৃতান্ত্রিক ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ গারো সমাজের শক্তি হ্রাসে নানানভাবে ভূমিকা রেখেছিল। কিন্তু গারোদের উপর ভয়ঙ্করভাবে দুযোর্গ নেমে আসে ১৯৪৭ সালে উগ্র নারী-বিদ্বেষী এবং পিতৃতান্ত্রিক তথা পুরুষবাদী ইসলাম ধর্ম ভিত্তিক পাকিস্তান রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পর। বিদেশী সাম্রাজ্যবাদী এবং পিতৃতান্ত্রিক ব্রিটিশ সরকার মাতৃতন্ত্রী গারো ঐতিহ্য ও স্বার্থ রক্ষার ব্যবস্থা না করে বৃহত্তর ময়মনসিংহ জেলার বিস্তীর্ণ এলাকার গারো জনগণকে ধর্ম-সাম্প্রদায়িক এবং উগ্র পুরুষতন্ত্রী পাকিস্তান রাষ্ট্রের নিকট জিম্মি করে দিয়ে গেল। এরপর আসামসহ বিভিন্ন অঞ্চলের মুসলমান বাঙ্গালীরা লাখে লাখে স্রোতের মত ঢুকেছে গারো জনগোষ্ঠী অধ্যুষিত এলাকাগুলোতে। তারা গারোদের জমি দখল করেছে, পতিত ভূমিতে বিনা বাধায় আবাস ও আবাদ করেছে এবং ব্যাপক নির্যাতন ও জবরদস্তির মাধ্যমে হিন্দু বাঙ্গালী এবং হাজং জাতিসত্তার মত গারোদেরকেও বিতাড়িত করেছে স্বভূমি থেকে। এইভাবে এ দেশের গারোদেরকে স্বদেশে পরবাসী করা হয়েছে।

 

দুই

বর্তমান বাংলাদেশ রাষ্ট্রের দক্ষিণ-পূর্ব কোণে পার্বত্য চট্টগ্রামের কয়েকটি ক্ষুদ্র জাতিসত্তার অস্তিত্বও পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর থেকে হুমকির সম্মুখীন হয়ে পড়ে। এই জাতিসত্তাগুলি মাতৃতন্ত্রী না হলেও উগ্র পিতৃতন্ত্রী এবং নারী নিগ্রহী নয়। চাক্‌মা, মারমা, ত্রিপুরা ইত্যাদি এগারো ক্ষুদ্র জাতিসত্তা অধ্যুষিত পার্বত্য চট্টগ্রামে পাকিস্তান সরকার এইসব জাতিসত্তার উৎসাদনের জন্য বিভিন্ন ধরনের কার্যক্রম শুরু করে। ’৫০-’৬০-এর দশকে কাপ্তাই হ্রদ নির্মাণ এমন একটি বৃহৎ কার্যক্রম। এর পাশাপাশি চলে মুসলমান বাঙ্গালী অভিবাসনের ধীর এবং সতর্ক প্রক্রিয়া। ১৯৭১-এ বাংলাদেশ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পর এই অঞ্চলের বাঙ্গালী এবং ইসলামীকরণের উদ্দেশ্যে দাঙ্গা-হাঙ্গামা, লুণ্ঠন ও ধর্ষণের কার্যক্রম জোরালোভাবে শুরু করা হয়।

অবশেষে পার্বত্য চট্টগ্রাম জন-সংহতি সমিতির নেতৃত্বে পার্বত্য চট্টগ্রামের এগারো জাতিসত্তা সমন্বিত জুম্ম জনগণ আত্মরক্ষার্থে সশস্ত্র প্রতিরোধ সংগ্রাম শুরু করে। জুম্ম জনগণ যারা সমগ্র বাংলাদেশের জনসংখ্যার এক শতাংশও নয় তাদের বিরুদ্ধে বাংলাদেশের বিভিন্ন সরকার কর্তৃক চালানো হয় সামরিক অভিযানের পাশাপাশি লক্ষ লক্ষ মুসলমান বাঙ্গালী অভিবাসনের মাধ্যমে আদিবাসীদেরকে উৎসাদনের অভিযান। একুশ-বাইশ বছর সুদীর্ঘ প্রতিরোধ যুদ্ধের পর অবশেষে ’৯৭-এর ২ ডিসেম্বর জুম্ম জনগণ প্রথম বিরাট বিজয় অর্জন করে শান্তি চুক্তিতে বাংলাদেশ সরকারকে স্বাক্ষর দানে বাধ্য করতে পারার ফলে।

শান্তি চুক্তির মাধ্যমে বাংলাদেশের জনসংখ্যার .৫০%-এর কিছু বেশী জনসংখ্যা হলেও জুম্ম জনগোষ্ঠী নিজেদের স্বতন্ত্র জাতিগত স্বীকৃতি আদায় করে। এ চুক্তিতে জুম্ম জনগণ এবং পার্বত্য চট্টগ্রামের জন্য পূর্ণ স্বায়ত্তশাসন অর্জন না হলেও এমন কিছু অধিকার অর্জিত হয়েছে যা জুম্ম জনগণ এবং পার্বত্য চট্টগ্রামকে বাংলাদেশের রাষ্ট্র ও সমাজ কাঠামোতে স্বাতন্ত্র্য, বিশেষ মর্যাদা এবং আংশিক স্বায়ত্তশাসন প্রদান করেছে। একদা যে দলের নেতা জুম্মদের স্বতন্ত্র জাতি পরিচয় মুছে ফেলে দম্ভ এবং ঔদ্ধত্য ভরে তাদেরকে বাঙ্গালী হবার হুকুম দিয়েছিলেন সেই দলের সেই নেতারই কন্যার সরকার অবশেষে জুম্ম জনগণের স্বতন্ত্র জাতিসত্তাগত পরিচয়কে মেনে নিতে এবং আইনগত স্বীকৃতি দিতে বাধ্য হয়েছে। এর তাৎপর্য যুগান্তকারী। এক ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠী চূড়ান্ত বিপর্যয় এবং বিলুপ্তির মুখে রুখে দাঁড়িয়ে শুধু নিজেদের জন্য বিজয় অর্জন করে নি উপরন্তু একই রকম ভাবে বিপন্ন সকল দুর্বল অথবা ক্ষুদ্র, নিগৃহীত এবং ন্যায়বান জাতিসত্তা কিংবা জনগোষ্ঠীর অধিকার আদায়ের সংগ্রামের জন্য এক বিরাট প্রেরণার উৎসে পরিণত হয়েছে।

 

তিন

সামাজিক ব্যবস্থায় গারো সমাজ এখন কতটা মাতৃতান্ত্রিক বা নারীতান্ত্রিক সন্দেহ। কারণ পারিবারিক কিছু রীতি-নীতি এবং সম্পত্তির উত্তরাধিকার প্রথায় গারোদের মধ্যে এখন পর্যন্ত মাতৃতন্ত্র কিছু পরিমাণে টিকে থাকলেও ধর্মীয় এবং সামাজিক ব্যবস্থায় গারোরা এখন সাধারণভাবে পিতৃতান্ত্রিক তথা পুরুষতান্ত্রিক ব্যবস্থার অন্তর্ভুক্ত হয়েছে বললে ভুল হবে না। বাংলাদেশে গারোরা এখন প্রায় সকলে খ্রীষ্ট ধর্মাবলম্বী। খ্রীষ্টধর্ম একটি সেমিটিক পুরুষতান্ত্রিক ধর্ম। এটা ইহুদী ধর্ম এবং বিশেষ করে ইসলাম ধর্মের মত অতটা উগ্র এবং আক্রমণাত্মক না হলেও এটা একটা পুরুষতান্ত্রিক ধর্ম। অন্যদিকে গারো সমাজের পরিবারে মেয়েদের স্বাধীনতা এবং মর্যাদা এখন পর্যন্ত অনেকাংশে থাকলেও সমাজ জীবনে তা কতটা আছে সন্দেহ। কারণ সামাজিক ক্ষেত্রে মেয়েদের নেতৃত্বমূলক ভূমিকা দেখা যায় না। বস্তুত সামাজিক ভূমিকা কিংবা নেতৃত্বের বিচারে অন্যান্য পিতৃতান্ত্রিক সমাজের সঙ্গে মাতৃতান্ত্রিক গারো সমাজের পার্থক্য নির্ণয় করাটা কঠিন। পরিবারে এবং ক্ষুদ্র পরিসরে যে মেয়েদেরকে স্বচ্ছন্দ, সাবলীল ও সতেজ দেখা যায় তাদেরকেই সমাজে এবং বৃহৎ পরিসরে যথেষ্ট রকম কুণ্ঠিত, দ্বিধান্বিত ও নিস্তেজ দেখা যায়। মাতৃতন্ত্রের তথা নারীর বিশ্ব পরিসরে যে পরাজয় ঘটে চলেছে তা থেকে যে গারো সমাজও দূরে নেই এই অবস্থা তার প্রমাণ।

অবশ্য গারো সমাজ মাতৃতন্ত্রকে এখনো পুরোপুরি পরিত্যাগ করে নি। কিন্তু সুদীর্ঘকাল ধরে চারদিকের পিতৃতন্ত্র বা পুরুষতন্ত্রের প্রবল আক্রমণ ও আগ্রাসনের ফলে এত কাল মাতৃতন্ত্র বা নারীতন্ত্রের যে সঙ্কোচন, পশ্চাদপসরণ ও ক্ষয় ঘটে চলেছিল তা এখন প্রায় চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছেছে। হয়তবা মাতৃতন্ত্রের শেষ চিহ্নটুকু মুছে যাওয়াই এখন বাকী আছে এবং সেই সঙ্গে গারো সত্তারও।

গারো সমাজের অবক্ষয়ের দিকে তাকিয়ে আমার মনে প্রশ্ন জাগে তার অস্তিত্ব রক্ষার উপায় কী? সেটা কি মাতৃতন্ত্রের চূড়ান্ত অবসান এবং পিতৃতন্ত্রের চূড়ান্ত প্রতিষ্ঠা? কিন্তু আমার মনে পুনরায় প্রশ্ন জাগে মাতৃতন্ত্রের সম্পূর্ণ অবসান ঘটলে কি গারো জাতিসত্তার অস্তিত্ব থাকবে? তাছাড়া নারীর ভিতর মনুষ্যত্বের যে মহিমা আমি দেখতে পাই তার কারণে আমি গারো জাতিসত্তার মাতৃতন্ত্রের ভিতরেও মনুষ্যত্বের এক মহিমা দেখতে পাই। সুতরাং আমার নিকট গারো জাতিসত্তার অস্তিত্ব ও মর্যাদার প্রশ্ন শুধু একটি জাতিসত্তার অস্তিত্ব ও মর্যাদা রক্ষা এবং প্রতিষ্ঠার প্রশ্ন হয়ে দেখা দেয় না, উপরন্তু এটা মাতৃতন্ত্র তথা নারীতন্ত্রকে কোন না কোন রূপে রক্ষা এবং প্রতিষ্ঠা করার প্রশ্ন হয়েও দেখা দেয়।

অবশ্য আমি এ কথা বলি না যে, আদিম স্তরে পড়ে থেকে গারো জাতির আপন মহিমা এবং শ্রেষ্ঠত্ব রক্ষা করা সম্ভব। এমনকি এভাবে তার অস্তিত্বই রক্ষা করা সম্ভব নয়। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে গারো সমাজ তার আদিম মাতৃতন্ত্রের স্তরেও পড়ে নেই। গারো মাতৃতন্ত্র অনেকাংশে ভেঙ্গে পড়েছে। অথচ তা পুরোপুরি ধ্বংসও হয় নি। এমন অবস্থাই কিন্তু মাতৃতন্ত্র বা নারীতন্ত্রের পুনর্সংগঠনের উপযুক্ত অবস্থা। প্রথাগত মাতৃতন্ত্র একটি পশ্চাৎপদ এবং এ কালের জন্য অনুপযোগী ব্যবস্থা। সুতরাং তাকে ফিরিয়ে আনার চেষ্টাটা অর্থহীন এবং ক্ষতিকরও। কিন্তু মাতৃতন্ত্রের একটা পুনর্সংগঠনের প্রয়োজন আছে বলে আমি মনে করি। কারণ আমি মনে করি আধুনিক নারীবাদ বা নারীতন্ত্র অপরিহার্য।

আমার এ সংক্রান্ত ধারণা আমি বিভিন্ন জায়গায় ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করেছি বিভিন্ন সময়ে। সুতরাং কিছু পুনরুক্তি হবে। তবু পাঠকের প্রয়োজনে আমার ধারণাটা খুব সংক্ষেপে বলার চেষ্টা করছি।

আমার ধারণা পুরুষ মূলত ধ্বংস, গতি এবং বর্বরতার শক্তি, আর নারী মূলত সৃষ্টি, স্থিতি, লালন এবং করুণার শক্তি। মানুষের উৎস যে মূলত নারী শুধু তাই নয়, উপরন্তু মানুষের মানবিকতারও উৎস মূলত নারী। মূলত নারীর প্রয়োজনে মানবিকতার উদ্ভব ও বিকাশ। বলবান পুরুষ শক্তির নিকট প্রেম, করুণা, বিবেচনা এসবের প্রয়োজন কতটুকু? যে নারী মানব শিশুকে আপন গর্ভে শুধু ধারণ করেন না, তাকে জন্মের পর থেকে লালন করেন, তার জন্য তিনি যে এক নিরাপদ, নিশ্চিত ও মানবিক পৃথিবীর সন্ধান করবেন তা-ই তো একান্ত স্বাভাবিক।

নারী এবং পুরুষ কে শ্রেষ্ট এ বিতর্কে না গিয়ে বলা যায় উভয়ের প্রয়োজন এবং অপরিহার্যতা আছে। সমস্যাটা দেখা দেয় তখন যখন একের মূল্য ও ভূমিকাকে তুচ্ছ করে অপরকে নিরংকুশ করা হয়। তাই উভয়ের সম্পর্ক এবং ক্ষমতার মধ্যে ভারসাম্য বা সুষমতার প্রয়োজন আছে। পিতৃতান্ত্রিক বা পুরুষতান্ত্রিক সভ্যতার সংকটটা এই জায়গায় যে, তা নারীর কিছু দৈহিক সীমাবদ্ধতার সুযোগ নিয়ে তাকে পুরুষের বর্বরতা, ভোগ, সম্ভোগ ও শোষণের শিকার করেছে। বিশেষত পুরুষের বীরত্ব ও ক্ষমতা যখন নিরংকুশভাবে নারীর নিয়ন্ত্রণমুক্ত হয় তখন তা বর্বর হয়ে দেখা দেয়। নারীকে অস্বীকার ক’রে, লাঞ্ছিত ক’রে পুরুষের যে পৌরুষ তা পৈশাচিক পাশবিকতা মাত্র। এই বর্বরতা ও পৈশাচিকতা থেকে মুক্তি মনুষ্যত্বের দাবী।

মাতৃতান্ত্রিক গারো সমাজের আদিমতায় ফেরা আর সম্ভব নয়। কিন্তু গারো সমাজের মাতৃতন্ত্রের যে মহত্ত্ব, যে মানবিকতা ছিল এবং আজও আছে সেখানে ফেরা ছাড়া নূতন ও উন্নততর মানবিকতা প্রতিষ্ঠার আর কোন পথ আমাদের সামনে আছে বলে আমি মনে করি না। এ যেন পুরুষের সমস্ত শৌর্য-বীর্য, জ্ঞান-গরিমা এবং শক্তি নিয়ে বিনয়ের সঙ্গে, নম্রতার সঙ্গে নারীর কাছে ফেরা। কত হাজার বৎসর পূর্বে একদা নারী কৃষি আবিষ্কারের মাধ্যমে সভ্যতার পথে মানব সমাজকে চলতে শিখিয়েছিল। তারপর এক সময় লাঙ্গল আবিষ্কারের পর সভ্যতার ক্রমবর্ধমান শক্তির বলে বলীয়ান হয়ে পুরুষ নারীকে অস্বীকার ক’রে, দলন ক’রে চলেছে। অন্য মানুষকে দলন ক’রে, প্রতরণা ক’রে, বন্দী ক’রে উদ্ধত, ধূর্ত এবং হৃদয়হীন পুরুষ যে নির্বিবেক সভ্যতা নির্মাণ করেছে সেই নির্বিবেক সভ্যতার শিক্ষাটা সে সর্বাগ্রে এবং সর্বাপেক্ষা বেশী প্রয়োগ করেছে নারীকে দলিত, দমিত ও বঞ্চিত করে।

অনেক হয়েছে! এ থেকে পুরুষকে, মানুষের সমাজ ও সভ্যতাকে ফিরতে হবে। পুরুষের আর উপায়ও নেই এছাড়া। কারণ পরমাণু এবং উন্নত প্রযুক্তির এ সভ্যতার স্তরে ধ্বংসপ্রবণ পুরুষের কর্তৃত্ব আত্মধ্বংসের নামান্তর হয়ে দাঁড়াচ্ছে। ক্লান্তæ, বিপর্যস্তপুরুষ শক্তি আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য মানবিক এক ব্যবস্থার কাছে যে ব্যবস্থায় পুরুষের পাশে নারী এসে ক্ষমতা, মর্যাদা এবং গুরুত্ব নিয়ে সমাজ ও সভ্যতার হাল ধরবে। ধ্বংসের শক্তিকে সৃষ্টির শক্তির নিয়ন্ত্রণাধীন করতে গিয়ে পুরুষকে নারীর নিয়ন্ত্রণ যথেষ্ট পরিমাণে মেনে নিতে হবে। সমাজ ও সভ্যতার নেতৃত্ব ও কৃর্তত্বে নারীর অংশগ্রহণ এক নূতন বাস্তবতা হয়ে দেখা দিবে। যেমনটাই হোক সমাজ ও সভ্যতার উপর থেকে পুরুষের স্বেচ্ছাচারী, একচ্ছত্র এবং নিরংকুশ আধিপত্য ও ক্ষমতার অবসান হচ্ছে নূতন কালের আসন্ন অনিবার্যতা। নারীবাদ হচ্ছে আগামী সভ্যতার এক মৌল এবং অনিবার্য বৈশিষ্ট্য যেখানে নারী তার স্বমহিমায় পুরুষের পাশাপাশি সমাজ ও সভ্যতার অন্যতম নিয়ামক হয়ে দেখা দিবে।

 

চার

গারো জাতির যে সার্বিক বিপর্যয় বাংলাদেশে ঘটে চলেছে তা থেকে মুক্তির পথ কোনটা সে সম্পর্কে গারোদেরকে ভাবতে হবে। তাদের অনেকে সেটা ভাবছেন। অনেক অধিকার সচেতন গারো নারী এবং পুরুষ প্রশ্ন তুলছেন, আলোচনা করছেন, সোচ্চার এবং সংগঠিত হচ্ছেন, সভা-মিছিল করছেন, প্রতিবাদ করছেন, আন্দোলন করছেন। নির্বিবেক এক পুরুষতান্ত্রিক সমাজ ও সভ্যতার আক্রমণ, নির্যাতন, আগ্রাসন ও আধিপত্য বিস্তার যখন গারো সমাজের অস্তিত্ব বিলুপ্ত করতে চলেছে তখন তা ফিরে এবং রুখে দাঁড়াতে চাইছে বলে মনে হচ্ছে। পুরুষতান্ত্রিক ধর্ম, সভ্যতা ও সংস্কৃতির যা কিছু এত কাল নির্বিচারে গ্রহণ করা হয়েছিল সেগুলি সবই এখন বিচারের কাঠগড়ায় জেরার সম্মুখীন হচ্ছে একে একে। আমি মনে করি অন্যায়, অবিচার এবং বঞ্চনার বিরুদ্ধে দীর্ঘ কাল নিপীড়িত, বিলীয়মান এবং ঘুমন্ত এক জাতিসত্তার জাগরণের এ সবই লক্ষণ। ঘুমন্ত এক বল-বীর্যবান জাতি, কৃষি আবিষ্কারের মাধ্যমে মানুষকে সভ্যতার পথে চলতে শেখানো আদি নারীদের, মাতাদের কালজয়ী ঐতিহ্যের প্রতি অনুগত ও অনুরক্ত এক পরাক্রান্ত অথচ ঘুমন্ত জাতি কি সত্যি জাগছে? যদি জাগে তবে তা কোন পথে যাবে? তার জাগরণ এই দেশ এবং পৃথিবীর চেহারায় বা সভ্যতার চরিত্রে কি সত্যি কোনও পরিবর্তন এনে দিবে? এনে দিলে তার রূপ কি হবে? আর এই পরিবর্তন আনতে গিয়ে গারো জাতিসত্তা কি নৃতাত্ত্বিক ‘জাতি’ থেকে রাজনৈতিক ‘জাতিতে’ পরিবর্তিত হবে? সময় এসব প্রশ্নের উত্তর দিবে।

রচনাঃ ২৮ নভেম্বর ১৯৯৯

 

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
Archive
 
সাম্প্রতিক পোষ্টসমূহ