Banner
আসাঞ্জকে নিয়ে মাতামাতি ও এক সাম্রাজ্যবাদী দালালের ভাবনা -- আলমগীর হুসেন

লিখেছেনঃ আলমগীর হুসেন, আপডেটঃ August 31, 2012, 3:19 PM, Hits: 1409

 

(ওয়েবসাইট উইকিলিক্স্-এর প্রতিষ্ঠাতা জুলিয়ান অ্যাসাঞ্জকে নিয়ে এখন পৃথিবীতে তোলপাড় চলছে। বলতে গেলে তাকে কেন্দ্র করে পৃথিবীর জনমত এখন দুই শিবিরে বিভক্ত। একদিকে আছে বর্তমান পৃথিবীর একমাত্র পরাশক্তি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন প্রধানত পশ্চিমা শক্তিবর্গ, অপর দিকে আছে লাতিন আমেরিকাসহ সারা পৃথিবীর ব্যাপক জনমত। বিশেষত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ক্রোধকে উপেক্ষা করে লাতিন আমেরিকার একটি ক্ষুদ্র রাষ্ট্র ইকুয়েডর কর্তৃক ব্রিটেনস্থ তার দূতাবাসে আশ্রয় গ্রহণকারী অ্যাসাঞ্জকে রাজনৈতিক আশ্রয় দেওয়ার সিদ্ধান- ঘোষণার পর এবং তাতে লাতিন আমেরিকার রাষ্ট্রগুলির ব্যাপক সমর্থন এবং সবশেষে ইকুয়েডরের দূতাবাসে হামলা চালিয়ে অ্যাসাঞ্জকে ধরার জন্য ব্রিটেনের হুমকির বিরুদ্ধে Organization of American States বা সংক্ষেপে O.A.S. কর্তৃক ইকুয়েডরের দূতাবাসের কূটনৈতিক মর্যাদার প্রতি সমর্থন জানানোর পর অ্যাসাঞ্জ বিতর্ক নবতর মাত্রা পেয়েছে। এই বিতর্কের অংশ হিসাবে অ্যাসাঞ্জের বিরোধিতা করে বাংলা ওয়েবসাইট “নবযুগ”(www.nabojug.com)-এ আলমগীর হুসেনের লিখা “আসাঞ্জকে নিয়ে মাতামাতি ও এক সাম্রাজ্যবাদী দালালের ভাবনা” শিরোনামে ২৮ আগস্ট ২০১২ তারিখে একটি নিবন্ধ প্রকাশিত হয়। আমরা এটির গুরুত্ব বিবেচনা করে লেখকের অনুমতিক্রমে “বঙ্গরাষ্ট্র”-এ প্রকাশ করলাম। আমরা চাই আমাদের পাঠকদের মধ্যেও বিষয়টা নিয়ে একটা আলোচনা তথা বিতর্ক হোক। আমরা এ বিষয়ে পাঠক/লেখকদের অভিমত প্রকাশ করতে আগ্রহী। -- বঙ্গরাষ্ট্র)

 

ব্যক্তিগতভাবে আমি উদার-গণতন্ত্রপন্থী, যা পাশ্চাত্যে ও এশিয়ার জাপান, দঃক্ষিণ কোরিয়া, তাইওয়ান ইত্যাদি দেশগুলোতে চর্চা হচ্ছে। সে কারণে আমাকে সাম্রাজ্যবাদের দালাল লেবেল দিয়েছে অনেকেই, কেননা এসব দেশগুলো পৈচাশিক পূজিবাদ চর্চা করে, যার অন্তরালে রয়েছে জঘন্য সাম্রাজ্যবাদ তৎপরতা। এ নিয়ে আমি কখনো প্রতিবাদ করি না। মত প্রকাশের অধিকার সবারই থাকা উচিত। সাম্রাজ্যবাদী-পূজিবাদী উদার-গণতান্ত্রিক পাশ্চাত্য সে মন্ত্রেই বিশ্বাসী। আমি তার বাইরে যেতে পারি না।

 

রাজনৈতিক বিষয়ে আমি সাধারণত লিখি না, কেননা ইন্টারনেট জগতের অনেক বন্ধুই পাশ্চাত্যে উদার-গণতান্ত্রিক সাম্রাজ্যবাদী পূজিবাদের চরম বিদ্বেষী। তারা সবসময়ই নানান রাজনৈতিক বিষয় নিয়ে হৈ-হুল্লোরে ব্যস্ত। অনেক ক্ষেত্রেই দ্বিমত থাকে, তবে অগ্রাহ্য করি। কেননা আমি মত দিলে অনেকের সাথেই উষ্ণ বন্ধুত্বের সমাপ্তি বা তাতে ভাটা পড়বে। এটা অনুমান নয়, পরীক্ষা-লব্ধ অভিজ্ঞতা।

 

আসাঞ্জ কে নিয়ে বুদ্ধিবৃত্তি চর্চাকারী অনেক বন্ধু সেই শুরু থেকে মাতামাতিতে সরগরম। বিশেষ মতানৈক্য থাকা সত্ত্বেও দীর্ঘদিন ধরে চলা এ ঘটনায় কোন মন্তব্য করি নি। রাজনৈতিক বিষয় পরিহার করে চলার চেষ্টার কারণে বিষয়টি যতটা-সম্ভব অগ্রাহ্য করেছি। আসাঞ্জকে ঘিরে নিম্নোক্ত প্রসংগগুলোর উপর দু’কথা বলার জন্য মনস্থির করলাম আজ।

 

•    আসাঞ্জের বাক-স্বাধীনতার লড়াই। আসাঞ্জকে সমর্থকগণ নিয়ে এতটা মাতামাতি করছে মূলত তাকে বাক-স্বাধীনতার মহানায়ক হিসেবে জ্ঞান করে। আসাঞ্জেও তার তৎপরতাকে সেভাবেই প্রতিফলিত করছে। আসলে কি তাই?

•    আসাঞ্জের উপর অবিচার। আইন-কানুনের ধার না ধরে আসাঞ্জের উপর চরম অবিচার-অত্যাচার করছে বা করতে যাচ্ছে সাম্রাজ্যবাদী পাশ্চাত্য। এ দাবী কতটা সত্য?

•    আসাঞ্জ হচ্ছে বিশ্ব-মানবতার এক নম্বর বন্ধু, নতুন যুগ সৃষ্টিকারী মহানায়ক, অথচ পূঁজিবাদী-সাম্রাজ্যবাদী চক্র তার উপর অমানবিক নির্যাতনে তৎপর। ঘটনা কি তাই?

 

বাক-স্বাধীনতা ও আসাঞ্জের কর্মকাণ্ড

বাক-স্বাধীনতা তথাকথিত সাম্রাজ্যবাদী পশ্চিমা বিশ্বের সংবিধানেই সর্বাধিক গুরুত্ব পেয়েছে, যা সেখানে মানুষের মৌলিক অধিকার হিসেবে স্বীকৃত। মানবাধিকার হিসেবে বাক-স্বাধীনতার উৎপত্তি সেখানেই। অথচ তারাই সে বাক-স্বাধীনতার চরম লংঘনকারী মনে করছে আসাঞ্জ ও ভক্তগণ। উদার-গণতন্ত্রী জীবনদর্শনের অনুসারী হওয়ার সুবাধে বাক-স্বাধীনতা আমার কাছে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কাজেই বিশ্বের কোথাও যদি তার লংঘন হয়, তা আমাকে পীড়িত করে – হোক সে আসাঞ্জের বিরুদ্ধে পাশ্চাত্যে কিংবা পুতিনের রাজ্যে অথবা একুইডরে। কাজেই পাশ্চাত্য যখন বাক-স্বাধীনতাকে এভাবে ধর্ষণ করছে, তখন বাক-স্বাধীনতার একাগ্র সমর্থক হিসেবে দু’কথা বলার অধিকার আমার আছে।

 

আসাঞ্জের কর্মকাণ্ড কি বাক-স্বাধীনতার লড়াই? আসাঞ্জ ও তার সমর্থকদের কাছে আসাঞ্জের কর্মকাণ্ড পুরোটাই বাক-স্বাধীনতা প্রতিষ্ঠা বা রক্ষার লড়াই বা এমন কিছু। যেমন ১৯ তারিখে লন্ডনস্থ একুইডর দূতাবাসের বারান্দায় দাঁড়িয়ে নিচে জড়ো হওয়া সমর্থকগণকে দেওয়া ভাষণে আসাঞ্জ মানবাধিকার ও বাক-স্বাধীনতার নিবেদিত-প্রাণ ধারক ও বাহক আর্জেন্টিনা, বলিভিয়া, ব্রাজিল, চিলি, কলম্বিয়া, এল সালভাদর, হন্ডুরাস, মেক্সিকো, নিকারাগুয়া, পেরু এবং ভেনেজুয়েলার সরকার ও জনগণকে কৃতজ্ঞতা ও বাহবা জানান এবং বিপরীতপক্ষে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, সুইডেন ও অস্ট্রেলিয়ার সরকারকে ভড়ৎসনা করে। আমেরিকাকে উদ্দেশ্য করে আসাঞ্জ বলেঃ

 

এই মুহূর্তটিকে আমরা যুক্তরাষ্ট্র সরকারের বোধোদয়ের জন্য কাজে লাগাতে চাই। তারা কি তাদের রাষ্ট্রের ভিত্তিমূলে প্রোথিত বিপ্লবী মূল্যবোধে ফিরতে পারবে? আরও বিপজ্জনক ও নিপীড়নকারী এক দুনিয়ার দিকে আমাদের সবাইকে টেনে নিয়ে যাওয়া থেকে বিরত হবে কি দেশটি? সেই দুনিয়ায় সাংবাদিকেরা প্রতিহিংসার ভয়ে ভীত এবং নাগরিকেরা কথা বলে অন্ধকারে, ফিসফিস করে।

 

আসাঞ্জের বক্তব্য স্বচ্ছ নয় এখানে। সে হয়ত বলতে চাচ্ছেঃ (১) আমেরিকা এমন এক দেশ যেখানে সাংবাদিক, সাধারণ নাগরিক মত প্রকাশের ভয়ে ভীত সন্ত্রস্ত, অথবা (২) আমেরিকা বিশ্বকে উন্মুক্ত বাক-স্বাধীনতার যুগ থেকে বাক-স্বাধীনতাহীন ত্রাস-পূর্ণ দুনিয়ার দিকে নিয়ে যাচ্ছে।

 

ওদিকে ভক্তরা আসাঞ্জের কর্মকাণ্ডকে দেখছেন ভিন্ন চোখে। বাংলাদেশের যুক্তি পত্রিকাটি (যার আগামী সংখ্যার জন্য আমি একটা লেখা দিয়েছি) এক প্রতিবেদনে বলছেঃ

 

কথা হচ্ছে আমাদের এই সময়ের সবচেয়ে আলোচিত, ইতিহাস-সৃষ্টিকারী ব্যক্তিকে নিয়ে। "বাকস্বাধীনতা", "গণমাধ্যমের স্বাধীনতা", "রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা" আর "গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে তথ্য জানার অধিকার" ইত্যাদি শব্দগুচ্ছের সনাতনী অর্থ ভেঙেচুড়ে দিয়েছেন এই ব্যক্তি।

 

জনগণ বনাম রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা'র যে আধোকাল্পনিক "লক্ষণরেখা" তৈরি করা হয়েছিল ধীরলয়ে, গতশতকের প্রথম দিক থেকে, আমাদের মস্তিষ্কের নিউরনে জায়গা করিয়ে দেবার জন্য যত ধরনের কুশলী বিদ্যা প্রয়োগ করা হয়েছিল, তার সবই আজ ভেস্তে যাবার উপক্রম!

 

মাত্র একজন ব্যক্তি, মাত্র একটা প্রতিষ্ঠান এমন লৌহকঠিন শব্দবন্ধন, একেবারে তাসের ঘরের মতো সব উড়িয়ে দিচ্ছে, ভাবাই যায় না! যা হয়তো এক দশক আগেও কল্পনা করা যায় নি!

 

আসাঞ্জ ও তার ভক্তরা যেন সবকিছু গুলিয়ে ফেলছে। আসাঞ্জ বলছে তার লড়াই বাক-স্বাধীনতা নিশ্চিত বা মান্য করার লড়াই, অথবা আমেরিকা-কর্তৃক তার অধঃগতি রোধ করার লড়াই। ওদিকে অনেক ভক্তরা বলছে, তার লড়াই বাক-স্বাধীনতার সনাতনী প্রাচীর ভেঙ্গে ফেলার লড়াই।

 

আমার মনে হয়, আসাঞ্জ বেঠিক; যুক্তি পত্রিকার আসাঞ্জে-ভক্ত লেখক সঠিক। আসাঞ্জ যদি ভাবে যে, সে সাম্রাজ্যবাদী আমেরিকা ও সহোদর পাশ্চাত্য কর্তৃক বাক-স্বাধীনতার অবক্ষয় ও অধঃগতির বিরুদ্ধে লড়াই করছে, তাহলে আমাদেরকে মানতে হবে যে তার কর্মকাণ্ড হচ্ছে এমন কিছু, যা এ-যাবৎ মানুষ চিরাচরিতভাবে বাক-স্বাধীনিতার অংশ হিসেবে চর্চা করে এসেছে।

 

ঘটনা কি তাই? আসাঞ্জ যা করছে, তা মানব সমাজ এতদিন ন্যায্য বাক-স্বাধীনতার অধিকার হিসেবে অহরহ চর্চা করেছে কি? অহরহ কেন, এমন একটা ঘটনার কথাও আমার জানা নেই। তবে হ্যা, রাষ্ট্রীয় গুপ্ততথ্য প্রতিপক্ষের কাছে ফাস করেছে অনেকেই, বিশেষত বিগত কমিউনিস্ট আমলে, এবং তাদের মধ্যে যারা ধরা পড়েছে – তাদের ভাগ্যে রুশ, চীন, উত্তর কোরিয়া, চেকোশ্লোভাকিয়া, রোমানিয়ার কমিউনিস্ট সরকারগুলো কি বরাদ্দ করেছিল – সেটা আসাঞ্জ ও তার ভক্তগণ আমাদেরকে জানাবে কি?

 

নিঃসন্দেহে আসাঞ্জের লড়াই বাক-স্বাধীনতা অবক্ষয় রোধের লড়াই নয়, কেননা সে যা করছে – আমেরিকার রাষ্ট্রীয় গুপ্ত-তথ্য চুরি ও ফাস – তা বাক-স্বাধীনতা হিসেবে চর্চা হয়নি কোন দেশেই – আসাঞ্জ যদিও উলটা দাবী করছে।

 

কাজেই যুক্তি পত্রিকা আসাঞ্জের লড়াইকে যেভাবে দেখছে – যে তার লড়াই বাক-স্বাধীনতার সনাতনী প্রাচীর ভাঙ্গার লড়াই – সেটাই অধিক সঠিক। লড়াকুর চেয়ে ভক্তরাই বেশী সমজদার নিঃসন্দেহে।

 

আসাঞ্জের কর্মকাণ্ড কি বাক-স্বাধীনতা? প্রশ্ন থেকে যায়, আসাঞ্জের কর্মকাণ্ড আদৌ বাক-স্বাধীনতার মধ্যে গণ্য হতে পারে কি না। আসাঞ্জ ও ভক্তগণ তাই ভাবছে। কিন্তু এ প্রশ্নের সঠিক জবাব আমার জানা নেই।

 

বর্তমান মানব-সমাজে দু’টি প্রধান কর্মকারক বা এ্যাক্টর বিদ্যমানঃ (ক) ব্যক্তি; (খ) রাষ্ট্র। এ দু’টো সত্তাই স্বাধীন ও স্বার্বভৌম গণ্য, তবে ভিন্ন পরিসরে – ব্যক্তির রাষ্ট্রের ভিতর, আর রাষ্ট্র বিশ্ব সমাজে।

 

রাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ কর্মকারক ব্যক্তির জীবনে দু’টো বলয় রয়েছেঃ একটা ব্যক্তিগত বা গুপ্ত বা নিভৃত (প্রাইভেট), আরেকটি প্রকাশ্য। নিভৃত বলয়টি অন্যের দৃষ্টি-সীমার বাইরে থাকবে – একান্তই নিজের। কারও ব্যক্তিগত বলয়ে দৃষ্টি দেওয়া, হস্তক্ষেপ করা, বা তা প্রকাশ করা বাক-স্বাধীনতার পরিপন্থী – যা দণ্ডনীয় অপরাধও নির্ধারিত হতে পারে।

 

তেমনিভাবে অন্তররাষ্ট্রীয় ও বিশ্ব পর্যায়ে রাষ্ট্র যেহেতু ব্যক্তির মত সার্বভৌম কর্মকারক বা এ্যাক্টর, তারও একটা গোপনীয় বলয় আছে বা থেকেছে, প্রকাশ্য জনসমক্ষে যার উন্মোচন দণ্ডনীয় অপরাধ বিবেচিত হয়ে এসেছে এ পর্যন্ত। সম্প্রতি অতিতের কমিউনিস্ট রাষ্ট্রগুলো সে গোপনীয়তা ভঙ্গের দায়ে দোষীদেরকে কোন গ্রহণযোগ্য বিচার-আচার ছাড়াই যেভাবে নিষ্ঠুর, বর্বর শাস্তি দিয়েছে, তার তুলনা মেলা ভার। তাদের কপালে কি ঘটেছে তা জানারও সুযোগ হয় নি অন্যদের, আপনজনদের। এ প্রসংগে স্মরণ করা যেতে পারে যে, রাশিয়ান গোয়েন্দা সংস্থা কেজিবি’র কর্মী আলেক্সান্ডার লিটভিনেঙ্কো লন্ডনে পালিয়ে গিয়ে পুতিন সরকার-কর্তৃক সংঘটিত অপকর্মের কথা “Blowing up Russia: Terror from within” ও “Lubyanka Criminal Group” ইত্যাদি পুস্তকে প্রকাশ করে দিলে নভেম্বর ২০০৬ তাকে তেজষ্ক্রিয় বিষ (radioactive poison) খাইয়ে হত্যা করা হয়।

 

কাজেই আসাঞ্জের কর্মকাণ্ড বাক-স্বাধীনতা কিনা সে ব্যাপারে আমি নিশ্চিত নই। তবে এটা নিশ্চিত যে, আজ পর্যন্ত বিশ্বের কোন দেশই এমন কাজকে বাক-স্বাধীনতা হিসেবে স্বীকৃতি দেয় নি। রাষ্ট্রীয় গুপ্ত-তথ্য চুরি করে প্রকাশ করা বাক-স্বাধীনতা হিসেবে গ্রহণযোগ্য হয় নি আমেরিকা-ব্রিটেনের কাছে; রাশিয়া-একুইডরের কাছে এরূপ কর্মকাণ্ডের বাক-স্বাধীনতা হিসেবে গ্রহণযোগ্যতা আরও কম।

 

এক কথায়, আসাঞ্জের কর্মকাণ্ড চিরাচরিত বাক-স্বাধীনতার অংশ ছিল না কখনোই। এমন দাবী আহাম্মুকী মাত্র।

 

রাশিয়া, একুইডর – আসাঞ্জের বাক-স্বাধীনতার পূণ্যভূমি! আসাঞ্জের কাছে বাক-স্বাধীনতার পূণ্যভূমিগুলোর মধ্যে রাশিয়া ও একুইডর সর্বশ্রেষ্ঠ; আমেরিকা ও অন্যান্য পশ্চিমা দেশগুলো বাক-স্বাধীনতার বদ্ধভূমি। গুরু যখন এমত বলেন, শিষ্যরাও অনুরূপই ভাববেন। কথায় বলেঃ হুজুরের মতে অমত কার? অবস্থা দৃষ্টে তাই ঘটেছে।

 

রাশিয়াঃ রাশিয়া কেন বাক-স্বাধীনতার পূণ্যভূমি? কেননা রাশিয়াই একমাত্র দেশ যাকে আসাঞ্জ সাংবাদিকতা চর্চার উদার ক্ষেত্র মনে করে এবং পুতিন সরকারের নিয়ন্ত্রণাধীন “রাশিয়া টুডে” টেলিভিশনে উপস্থাপকের চাকরী নিয়েছে। একুইডর দূতাবাসে লুকানোর আগে ১২টি অনুষ্ঠান উপস্থাপন করেছে সে। সেসব অনুষ্ঠানে আসাঞ্জ কোরেয়া ও ইরানের মদদ-পুষ্ট হেজবুল্লাহ সন্ত্রাসী সংগঠনের নেতা হাসান নাসরাল্লাহর মত ব্যক্তিদের মতামতের মাধ্যমে পাশ্চাত্যে বাক-স্বাধীনতার লংঘনের নিন্দার করেছে। তার বর্তমান পরিস্থিতির একটা সুরাহা হলে আসাঞ্জ “রাশিয়া টুডে” টেলিভিশনের কাজে পুনরায় যোগ দিবে বলে আশা ব্যক্ত করেছে। সে যে হতেই হবে! বিশ্বে বাক-স্বাধীনতার একমাত্র পূণ্যভূমিতে না ফিরে কি পারে বাক-স্বাধীনতা আন্দোলনের যুগান্তরকারী গুরু?

 

সম্প্রতি লন্ডনে আসাঞ্জকে ঘিরে উন্মত্ততার অন্তরালে রাশিয়ায় ঘটে গেল বাক-স্বাধীনতা বিষয়ক এক ঘটনার বিচার, তার সদিস আসাঞ্জ ও ভক্তকূল রাখে নি নিঃসন্দেহে। ‘পাসি রায়ট’ নামক এক নারীবাদী পাঙ্ক ব্যান্ড এক চার্চে পুতিন-বিরোধী একটা গান গায়, যাতে মা মেরীকে আহবান করা হয় পুতিনের পতন ঘটানোর জন্য। “আমেরিকা নিপাত যাক”, “বুশ নিপাত যাক” বা অনুরূপ শ্লোগান যেখানে আমেরিকা ও অন্যান্য পশ্চিমা দেশগুলোতে নানান দল-কর্তৃক আয়োজিত বিক্ষোভে সচরাচর শ্লোগান, সেখানে ‘পাসি রায়ট’ ব্যান্ডের এ গানকে কেন্দ্র করে ব্যান্ডটির সদস্যদেরকে মাসের পর মাস রিমান্ডে রেখে শেষ পর্যন্ত দু’বছরের কারাদণ্ড দিয়েছে পুতিন সরকারের বিচার বিভাগ। অবশ্য বিশ্বব্যাপী এ বিচারকে কেন্দ্র করে বেশ বিক্ষোভও হয়েছে। তা না হলে তাদের সাজা আরও ভয়ঙ্কর হত নিঃসন্দেহে। এই হলো আসাঞ্জের জগতে বাক-স্বাধীনতার পূণ্যভূমি। মনে রাখতে হবে, সৃষ্টিশীল কলায় – যেমন সাহিত্য ও গানে – সবচেয়ে বেশী ছাড় দেওয়া হয় পাশ্চাত্যের বাক-স্বাধীনতা আইনে, এবং তার লক্ষ্য যদি কোন রাজনৈতিক ব্যক্তি হন, তাহলে ছাড়ের পরিমাণ সর্বোচ্চ।

 

আসাঞ্জের বাক-স্বাধীনতা মায়াকান্নার সবচেয়ে ঘৃণ্য ও ন্যাক্কারজনক দিক হচ্ছে, সে ১৯ আগষ্ট তারিখে লন্ডনের একুইডর দূতাবাসের বারান্দা থেকে দেওয়া ভাষণে আমেরিকাকে বাক-স্বাধীনতা ধ্বংস করা থেকে বিরত থাকার আহবান জানিয়ে বিশ্বব্যাপী ভক্তদের উন্মত্ত বাহবা কুড়াল। অথচ তার দু’দিন আগে রাশিয়ায় ‘পাসি রায়ট’ ব্যান্ডের সদস্যেরকে পুতিন সরকারের এমন ন্যাক্কারজনকভাবে শাস্তি দেওয়ার ব্যাপারে একটা কথাও বলল না সে। না আমার চোখে পড়েছে বাক-স্বাধীনতার লড়াইয়ে উন্মত্ত আসাঞ্জ ভক্তদের কাছ থেকে জঘন্য ‘পাসি রায়ট’ শাস্তিদানকে নিন্দা করে একটিমাত্র মন্তব্য। আজ আমেরিকাতে “মা মেরী, অবামাকে আমাদের দৃশ্যপট থেকে সরিয়ে নাও” এমন গানের জন্য গায়ককে একইরূপে শায়েস্তা করা হলে জানিনা সে শাস্তিকে নিন্দা করে আসাঞ্জ ও তার ভক্তরা কিরূপ উন্মত্ত নর্তন-কুর্দনে মত্ত হত।

 

আসাঞ্জ ‘পাসি রায়ট’ ব্যান্ডের শাস্তিদানকে নিন্দা করবেন কেন? সেটা যে তার আপন জগতে বাক-স্বাধীনতার পূণ্যভূমি। পূণ্যভূমিতে কখনো অপূণ্য, নিন্দাযোগ্য ঘটনা ঘটতে পারে কি? তদুপরি সে একমাত্র ঐ দেশেরই নুন খায়। লন্ডন থেকে সহি-সালামতে বেরিয়ে যেতে পারলে আরও খাবে – এমন সুদৃঢ় সংকল্প সে লালন করছে মনে। যার নুন খেয়েছে তার অ-গুণ গাইতে পারে মূল্যবোধ-সম্পন্ন মানুষ? আর রাশিয়ায় যে হবে তার চলমান বাক-স্বাধীনতা ক্রুসেডের লীলাক্ষেত্র। বাক-স্বাধীনতার ভবিষ্যতকে তো বাক-স্বাধীনতা আন্দোলনের কিংবদন্তীয় নায়ক জলাঞ্জলি দিতে পারে না।

 

একুইডরঃ আসাঞ্জের মতে রাশিয়ার পর পরবর্তি শ্রেষ্ঠ বাক-স্বাধীনতা চর্চার পূণ্যভূমি প্রেসিডেন্ট রাফায়েল কোরেয়ার অধীন একুইডর, যে দেশটির সরকার আসাঞ্জের বাক-স্বাধীনতার অধিকার রক্ষার্থে বলিষ্ঠ সাহসী অবস্থান নিয়ে বাহবা কুড়িয়েছে আসাঞ্জ ও ভক্তদের। অথচ রিপোর্টার্স ইউদাউট বর্ডারস-এর ২০১১ সালে সমীক্ষা অনুসারে পৃথিবীর ১৭৯টি দেশের মধ্যে বাক-স্বাধীনতায় একুইডরের অবস্থান ‘১০৪’ (স্কোর ৩৮) এবং রাশিয়ার ১৪২ (স্কোর ৬৬) – যেখানে সুইডেনের ‘১২’ (স্কোর -৫.৫), ব্রিটেনের ‘২৮’ (স্কোর ২), এবং আমেরিকার ‘৪৭’ (স্কোর ১৪)। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি হলোঃ প্রেসিডেন্ট কোরেয়ার বিগত ৭ বছরের শাসনামলে সেখানে বাক-স্বাধীনতার ব্যাপক অবক্ষয় ঘটেছে – যেমন ২০০৬ সালে বাক-স্বাধীনতায় একুইডরের অবস্থান ছিল ৬৬। ২০১১ জুলাই মাসে El Universo পত্রিকাটি এক সম্পাদকীয়তে প্রেসিডেন্ট কোরেয়াকে ‘একনায়ক’ বলায় পত্রিকাটির তিন কর্মীকে তিন বছরের কারাদন্ড দেওয়া হয়। প্রেসিডেন্ট কোরেয়া বিরোধী Vanguardia নামক এক ম্যাগাজিনের অফিসে বার বার হানা দিয়েছে পুলিশ।

 

অবাক না হয়ে পারা যায় না যে – যে প্রেসিডেন্ট একুইডরের বাক-স্বাধীনতার চরম অবক্ষয় ঘটাচ্ছেন, তিনিই হচ্ছেন আসাঞ্জ ও ভক্তদের নজরে বাক-স্বাধীনতার শীর্ষ-স্থানীয় ত্রাণকর্তা। এটা সুস্পষ্ট যে, বাক-স্বাধীনতা উন্নয়নে প্রেসিডেন্ট কোরেয়ার কোনই আগ্রহ নেই। এবং আসাঞ্জের ব্যাপারেও তিনি মাথায় ঘামাতেন না, যদি-না আসাঞ্জের উইকিলিক্স-এর মাধ্যোমে একুইডরস্থ আমেরিকান এ্যাম্বাসেডর হীথার হজেসের পাঠানো এক কূটনৈতিক বার্তা ফাস হয়ে যেত। বার্তাটিতে হীথার হজেস প্রেসিডেন্ট কোরেয়া কর্তৃক জেইমি হুরতাদোকে পুলিশ কমিশনার নিয়োগের নিন্দা করেন, কেননা ২০০৬-০৭ সালের এক তদন্ত হুরতাদোকে দুর্নীতির দায়ে অভিযুক্ত করে। হজেসের মতেঃ প্রেসিডেন্ট কোরেয়া এসব জেনে-শুনেই হুরতাদোকে পুলিশের সর্বোচ্চ পদে নিয়োগ দেন, কেননা কালিমাযুক্ত অবস্থানের কারণে তাকে নিজের ইচ্ছে মত ব্যবহার করতে পারবেন প্রেসিডেন্ট কোরেয়া। স্পেনের El País পত্রিকায় বার্তাটি প্রকাশের পর প্রেসিডেন্ট কোরেয়া এ্যাম্বাসেডর হজেসকে অনাকাংখিত (persona non grata) ঘোষণা করেন, যা আমেরিকার সাথে একুইডরের কূটনৈতিক সম্পর্কে বিপর্যয় ঘটায়।

 

উল্লেখ্য, কোরেয়া যদিও ল্যাটিন আমেরিকায় চলমান বাম-সোশ্যালিস্ট জোয়ার ও  আমেরিকা-বিরোধী গণ-উচ্ছ্বাসকে পূঁজি করে রাজনৈতিক সফলতা পেয়েছেন, তথাপি আমেরিকার ইউনিভার্সিটি অব ইলিনয়া (আরবানা-চ্যাম্পেইন) থেকে পি,এইচ,ডি, ডিগ্রীধারী কোরেয়া-ই ছিলেন সে অঞ্চলে আমেরিকার সর্বাধিক কাছের বন্ধু। হিলারি ক্লিনটন জুন ২০১০-এ একুইডর সফরে গিয়ে একুইডরকে ল্যাটিন আমেরিকাতে যুক্তরাষ্ট্রের সর্বাধিক প্রিয় বন্ধু বলে দাবী করেন। জবাবে প্রেসিডেন্ট কোরেয়া বলেন, “আমরা আমেরিকাকে খুব ভালবাসি” এবং  “আমেরিকায় কাটানো চারটি বছর ছিল আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ সময়।”

 

আমরা জানি বাংলাদেশের মত উন্নয়নশীল দেশগুলোতে রাজনীতি কিভাবে চলে। একুইডরের রাজনৈতিক খেলা তার চেয়ে খুব পৃথক হওয়ার কথা নয়। কাজেই এ্যাম্বাসেডর হজেসের সে কূটনৈতিক বার্তা অমূলক ছিল, এমন ভাবার কোনই অবকাশ নেই। এবং এমন খবর দূতাবাসগুলো অহরহই প্রেরণ করে থাকবে। অথচ আসাঞ্জের কৃপায় সে গোপন বার্তাটি প্রেসিডেন্ট কোরেয়ার কানে আসায়, তা নিয়ে তিনি আমেরিকার সাথে কূটনৈতিক দ্বন্দ্ব শুরু করে দেন। তার জের হিসেবেই আসাঞ্জকে নিয়ে প্রেসিডেন্ট কোরেয়ার এত টানাটানি, যা মায়াকান্না ছাড়া আর কিছুই নয় – কেননা কোরেয়ার কাছে এটা আমেরিকা-কর্তৃক অপদস্থ হওয়ার পালটা জবাব ছাড়া আর কিছুই নয়। অন্ততঃ সেটা বাক-স্বাধীনতা রক্ষার কোনই প্রচেষ্টা নয়, কেননা তিনিই একুইডরের সাম্প্রতিক ইতিহাসে বাক-স্বাধীনতার চরম অবনতি ঘটিয়েছেন।


আসাঞ্জের উপর চরম অবিচার

 

আসাঞ্জ ও ভক্তদের আরেক জোর প্রচারণা হচ্ছে – আইন-কানুনের ধার না ধরে আসাঞ্জের উপর চরম অবিচার-অত্যাচার করতে যাচ্ছে সাম্রাজ্যবাদী পাশ্চাত্য, যার দোসর হয়েছে আরেক পৈচাশিক বিশ্ব-মানবতার শত্রু ও বিচার-আচারহীন দেশ সুইডেন। আসাঞ্জ-বিরোধী সাম্রাজ্যবাদী চক্রে সুইডেন নিজেকে জড়ায় বা সুইডেনকে জড়ানো হয়েছে আসাঞ্জ-ভক্ত দুই সুইডিশ মহিলা কর্তৃক আসাঞ্জের বিরুদ্ধে ধর্ষণ বা যৌন-অনাচারের (sexual molestation) দায়ে অভিযুক্ত করার ঘটনাকে কেন্দ্র করে। আসাঞ্জ যেভাবে মহানায়ক হয়ে উঠে আমেরিকার গোপন তথ্য প্রকাশ করে দিয়ে, তাতে অনেক ভক্ত ললনাই তার প্রেমে পড়বে নিঃসন্দেহে। আর মহানায়ক কি তার সুযোগ না নিয়ে পারে? মুস্কিল হয় তখন, যখন ললনা-দ্বয় জানতে পারে মহানায়ক অন্য মেয়েটির সাথেও যৌন-খেলা খেলছে।

 

যাহোক, শুরুতে আসাঞ্জ ভক্তকূল সে অভিযোগকে আমেরিকা ও তার দোসর কর্তৃক ফাঁদ পাতার ষঢ়যন্ত্র হিসেবে প্রচারণা চালাতে থাকে, যার মাধ্যমে আসাঞ্জকে আজীবন কারারুদ্ধ করে শায়েস্তা করা হবে। তবে সে প্রচারণার ভাটা পড়ে শীঘ্রই। ২০১০ আগষ্টে সুইডিশ পুলিশও আসাঞ্জকে জিজ্ঞাসাবাদ করে ছেড়ে দেয় এ মর্মে যে, আসাঞ্জ ধর্ষণের মত গুরুতর অপরাধ করে নি। অভিযোগটিকে যৌন-সংশ্রবে ছোট-মোট ভুল বা দোষ হিসেবে শ্রেণীকরণ করা হয়।

 

যাহোক, আসাঞ্জের বিরুদ্ধে যৌন-অনাচারের অভীযোগকারী মহিলাদ্বয় তাদের কেইস নিয়ে তৎপরতা চালাতে তাকে। এর ফলে, সুইডেন সরকার আসাঞ্জকে পুনরায় জিজ্ঞাসাবাদের জন্য ইউরোপব্যাপী পুলিপ ওয়ারেন্ট জারি করে ডিসেম্বর ২০১০। ব্রিটেনে বসবাসকারী আসাঞ্জ ৭ ডিসেম্বর লন্ডনে পুলিশের কাছে হাজিরা দিলে তাকে গ্রেফতার করে জিজ্ঞাসাবাদ হয়, এবং তার বিরুদ্ধে সুইডেন সরকারের অভিযোগগুলো অবহিত করা হয়। অভিযোগগুলো হচ্ছেঃ ১) ১৪ আগষ্ট ২০১০ তারিখে সে প্রথম অভিযোগকারীর উপর যৌন-কর্মমূলকভাবে নিজের শরীর চাপিয়ে দিয়ে “অপরাধমূলক জোর-জবরদস্তি” করেছে (সে তার বাসায় মেয়েটিকে বিছানার উপর দু’হাত চেপে ধরে দুই পা ফাক করে, যাকে আসাঞ্জ উভয়ের মাঝে ইচ্ছাকৃত যৌনকর্ম বলে দাবী করেছে); ২) প্রথম অভিযোগকারী তাকে কন্ডম ব্যবহার করার অনুরোধ সত্ত্বেও সে কন্ডম ছাড়াই তার সাথে যৌনকর্ম করে; ৩) ১৭ই আগষ্ট তারিখ সকালে সে ঘুমন্ত দ্বিতীয় অভিযোগকারীর সাথে কন্ডম-বিহীনভাবে যৌন-কর্মে লিপ্ত হয়; ৪) তার পরের দিন (১৮ আগষ্ট) সে প্রথম অভিযোগকারীর শরীরের উপর তার দণ্ডায়মান লিংগ দিয়ে ঘষাঘষি করে।

 

এরপর লন্ডন পুলিশ তার শরীরে ইলেক্ট্রনিক ট্যাগ লাগিয়ে নিয়মিত পুলিশে হাজিরা দেওয়ার নির্দেশ দিয়ে জামিনে ছেড়ে দেয়। আদালতে বিবেচনা শুরু হয় তাকে সুইডেনে হস্তান্তর করা হবে কিনা সে ব্যাপারে।

 

ওয়েস্টমিনিস্টার শহর ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে ৭-৮ ও ২৫ ফেরুয়ারী ২০১১ তারিখে শুনানীতে আসাঞ্জের উকিল জোর তর্ক ও প্রতিবাদ তোলে আসাঞ্জকে সুইডেনে হস্তান্তরের বিরুদ্ধে। কিন্তু আদালত সুইডেন সরকারের ওয়ারেন্টের পক্ষে রায় দেয় ২৫ ফেব্রুয়ারী তারিখে। এ রায়ের বিরুদ্ধে হাইকোর্টে আসাঞ্জের আবেদন (আপীল) প্রত্যাখ্যাত হয় ২ নভেম্বর ২০১১ তারিখে এবং সুপ্রিম কোর্ট আসাঞ্জের আবেদন ৫-২ ভোটের ভিত্তিতে প্রত্যাখ্যান করে ৩০ মে ২০১২ তারিখে। এরপর আসাঞ্জের সামনে রয়েছে ইউরোপীয় মানবাধিকার আদালতে আপীলের সুযোগ। ইতিমধ্যে আসাঞ্জ জামিনের শর্ত ভেঙ্গে একুইডর দূতাবাসে আশ্রয় নেয়।

 

এদিকে ব্রিটেন সুপ্রীমকোর্টে আপীল অগ্রাহ্য হওয়ার পর ৯ মাস আগে (ডিসেম্বর ২০১১) আসাঞ্জের উকিল দাবী করে যে, আমেরিকা আসাঞ্জকে আদালতে নেওয়ার জন্য মামলা খাড়া করছে এবং তাকে সুইডেন থেকে আমেরিকা পাঠানো হবে, যেখানে সে গুপ্তচরবৃত্তির দায়ে মৃত্যুদণ্ডের শিকার হবে। অতি-সাম্প্রতিক খবরে দেখা যায়, ওবামা সরকার সম্ভব তার বিচার বিভাগকে তদন্ত করতে বলেছে আমেরিকার রাষ্ট্রীয় গুপ্ততথ্য চুরির দায়ে আসাঞ্জকে বিচারের আওতায় আনা যায় কি না। সে ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্র সরকার কোন সিদ্ধান্তে পৌঁছেছে কিনা, তা জানা যায় না। অনেকেই প্রচার করছে যে, আমেরিকা আসাঞ্জকে হস্তান্তরের জন্য ব্রিটেন ও সুইডেনের সাথে গোপনে কাজ করছে। অবামা সরকার সে অভিযোগ অস্বীকার করেছে। তবে আসাঞ্জ ও তার উকিলের দাবী যে, তাকে আমেরিকাতে হস্তান্তরের ষঢ়যন্ত্রে লিপ্ত হয়েছে আমেরিকা-ইংল্যান্ড-সুইডেন চক্র – সে ষঢ়যন্ত্রমূলক দাবী গোগ্রাসে গিলেছে আসাঞ্জের ১০০% ভক্তকূল।

 

সুইডেনে আসাঞ্জের বিচারে গরমিলঃ আসাঞ্জ ও তার ভক্তকূল সুনিশ্চিতভাবে দাবী করছে যে, তার বিরুদ্ধে যৌন-অপরাধের অভিযোগ ধুয়া মাত্র, যার মাধ্যমে তাকে সুইডেনে এনে আমেরিকাতে প্রেরণ করে দেবে সুইডেন সরকার। আমার ব্যক্তিগত ধারনায়, যুক্তরাষ্ট্র সরকারের আসাঞ্জকে বিচারের আওতায় আনার সম্ভাবনা রয়েছে যথেষ্ট। কিন্তু আসাঞ্জের সুইডেনে হস্তান্তর বা আপন ইচ্ছায় সুইডেনে গিয়ে তার বিরুদ্ধে যৌন-অপরাধের অভিযোগের জবাবদিহি কিভাবে তার আমেরিকায় হস্তান্তরের পথ সুগম করবে সেটা আমার মগজে ঢুকছে না কিছুতেই।

 

আসাঞ্জের বিরুদ্ধে আনীত যৌন-হয়রানীর অভিযোগের ভিত্তি খুব শক্ত না। ধর্ষণের দায় থেকে সে নিঃসন্দেহে মুক্তি পাবে (সুইডেনে যার সর্বোচ্চ শাস্তি ৪ বছর জেল)। তবে ক্ষুদ্র যৌন-অপরাধের দায়ে সে দোষী সাব্যস্ত হতে পারে। বিশেষত গণপ্রতিনিধি বা কীর্তিমান (celebrity) ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে এমন কারণে যৌন-অপরাধের অভিযোগ পাশ্চাত্যে ঘটে যথেষ্ট। আসাঞ্জের মত বিশ্ব-পর্যায়ে আলোড়ণ-সৃষ্টিকারী সেলিব্রিটি, যার ইউকিলিক্স প্রকল্প এক পর্যায়ে দৈনিক ৮৫,০০০ ডলার উপার্জন করছিল, তার বিরুদ্ধে এমন অভিযোগ থাকলে তা আদালতে উঠাই স্বাভাবিক পাশ্চাত্যের দেশগুলোতে। এবং কেউ যদি আদালতে কোন অভিযোগ আনে, সুইডেনের মত দেশ তাতে আমল না দিয়ে পারে না।

 

আসাঞ্জ যদি দোষী সাব্যস্তও হয়, তার সাজা কোন ক্রমেই সাংঘাতিক হবে না, সেটা নিশ্চিত। কারণ সুইডেন বিশ্বের মধ্যে সবচেয়ে সুষ্ঠভাবে পরিচালিত দেশগুলোর মধ্যে অন্যতম এবং তার বিচার-ব্যবস্থার মান বিশ্বের এক নম্বর [ওয়ার্ল্ড জাস্টিস প্রজেক্ট-এর ২০১১ সালের আইনের শাসন (রুল অব ল) মানদন্ডে সুইডেন প্রথম স্থান অধিকার করে] এবং শাস্তিদানে সবচেয়ে নমনীয় পাঁচটি দেশের মধ্যেও পড়বে সুইডেন। নরডিক দেশগুলো – যেমন সুইডেন, নরওয়ে, ফিনল্যান্ড ইত্যাদি – বিশ্বের সেরা শাসন ও বিচারব্যবস্থা হিসেবে প্রশংসিত। কাজেই সুইডেনে আসাঞ্জ কিংবা অন্য যে কোন ব্যক্তি কোন অপরাধের জন্য সবচেয়ে প্রকাশ্য, স্বচ্ছ ও সুষ্ঠ বিচার পাবে সেটা নিশ্চিত। বাংলাদেশ, রাশিয়া বা একুইডরের মতো দেশের বিচারবিভাগকে যেভাবে ইচ্ছামত নাকে ধরে ঘুরাতে পারবে শাসক-গোষ্ঠি, তেমনভাবে সুইডেনের বিচারবিভাগকে চালিত করা সম্ভব নয়। এমনকি আমেরিকাও ৯/১১ সন্ত্রাসী আক্রমণের প্রধান পরিকল্পনাকারী খালিদ শেখ মুহাম্মদ –- যে কিনা ১৯৯৩ অয়ার্ল্ড ট্রেইড সেন্টার বম্বিং, বজিংকা আক্রমণ প্রকল্প, বিফলকৃত লসএঞ্জেলেস ইউএস ব্যাংক টাউয়ার আক্রমণ প্রকল্প (২০০২), ২০০২ বালী বম্বিং (ইন্দোনেশিয়া), বিফলকৃত আমেরিকান এয়ারলাইন্স ফ্লাইট ৬৩ বম্বিং, মিলেনিয়াম বম্বিং প্রকল্প (২০০০) এবং পাকিস্তানে আমেরিকান সাংবাদিক ড্যানিয়েল পার্ল হত্যার ইত্যাদি সন্ত্রাসী প্রকল্প ও কর্মকাণ্ডে নেতৃত্ব দানের কথা স্বীকার করেছে – তাকেও ফাসিতে ঝোলাতে পারছে না ৯ বছর আগে গ্রেফতার করা সত্ত্বেও। প্রকৃতপক্ষে ৯/১১ আক্রমণ প্রায় ১১ বছর পার হতে চলল, কিন্তু একজন আটককৃত আল-কায়েদা কর্মীকে ফাসিতে ঝোলাতে পারে নি আমেরিকা আজ পর্যন্ত।

 

যাহোক, বাংলাদেশের আসাঞ্জ ভক্তদের কাছে চ্যালেঞ্জ রাখতে পারি যে, আপনি যদি একজন সাধারণ ব্যক্তি হন এবং কোন গুরুতর অপরাধ করে বসেন, এবং আপনাকে সুযোগ দেওয়া হয় বিচারের জন্য বাংলাদেশ, রাশিয়া, একুইডর ও সুইডেন থেকে একটি দেশ চয়ন করার – আপনি নিঃসন্দেহে সুইডেনকে চয়ন করবেন। কারণ, আপনি জানেন যে, ঐ দেশটিতে সবচেয়ে ভাল বিচার পাবেন। আসাঞ্জ প্রসংগে বলতে হয় – তার বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগের জন্য সে অত্যন্ত ভাল বিচার পাবে সুইডেনে এবং অপরাধী সাব্যস্ত হলেও পরিমিত শাস্তি পাবে অন্যান্য দোষীদের মত। তার অন্যথা হলে সরকার ও বিচারবিভাগ জনগণকে তা খাওয়াতে পারবে না, বিশেষত দেশটিতে যখন আসাঞ্জ ও উইকিলিক্সের সমর্থন খুবই জোরালো। আর আসাঞ্জের ঘটনা বিশ্বব্যাপী যে আলোড়ণ সৃষ্টি করেছে, সুইডেনের বিচার-বিভাগকে তার মালমাটি চালনা করতে হবে সর্বোচ্চ সতর্কতা ও স্বচ্ছতার সাথে।

 

সুইডেনে হস্তান্তর আসাঞ্জের আমেরিকাকে হস্তান্তর সুগম করবে কি? মাথা ঝালাপালা-করা চিন্তা ও জল্পনা-কল্পনা করেও আমি একটি যুক্তিও দাড় করাতে পারলাম না যে, যৌন-অপরাধের অভিযোগের জবাবদিহি করার জন্য আসাঞ্জ সুইডেনে গেলে তার আমেরিকায় হস্তান্তরের পথ সুগম হবে। বরং একাধিক কারণে তা আসাঞ্জের আমেরিকায় হস্তান্তরের পথকে আরও দুর্গম করবে। কারণগুলো নিম্নে দেওয়া হলোঃ

 

(ক) ইংল্যান্ড থেকে আসাঞ্জের আমেরিকায় হস্তান্তর সহজতরঃ  সুইডেন আমেরিকার কথিত আগ্রাসী নীতির বড় সমর্থক নয় কখনোই, বিশেষত দেশটি ইউরোপের মধ্যে সবচেয়ে বেশী সমাজবাদী বা কমিউনিস্ট-ঘেষা বলে। বরং ব্রিটেন হচ্ছে আমেরিকার পররাষ্ট্রনীতিতে সবচেয়ে বড় ও অনড় সমর্থক। আমেরিকা ও ব্রিটেন যদি আসাঞ্জকে আমেরিকাতে হস্তান্তরের ষঢ়যন্ত্রে লিপ্ত হত, তাহলে তাকে সুইডেনে পাঠানোর কোনই মানে হয় না। আসাঞ্জতো ব্রিটেনেই ছিল। একদিন লন্ডনের রাস্তা বা আসাঞ্জের বাসা থেকে তাকে উঠিয়ে নিয়ে চুপে চুপে আটলান্টিকের অপারে পাঠিয়ে দিত ব্রিটেন।

 

(খ) সুইডেন মৃত্যুদণ্ড আইন-সম্পন্ন দেশে বিচারের জন্য কাউকে পাঠাবে নাঃ ইউরোপের দেশগুলো মৃত্যুদণ্ড উঠিয়ে দিয়েছে, এবং সুইডিশ জনগণ, সরকার ও বিচার-বিভাগের মৃত্যুদণ্ড-বিরোধী অবস্থান ইংল্যান্ডের তুলনায় অধিক জোরদার। কাজেই সুইডেন কোন ক্রমেই কোন অপরাধীকে অন্য দেশে পাঠাবে না, যেখানে মৃত্যুদণ্ড বহাল রয়েছে এবং সে ব্যক্তির মৃত্যুদণ্ডের সম্ভাবনা রয়েছে। ইংল্যান্ড যদিও মৃত্যুদণ্ড চর্চা করে না, কিন্তু অন্য দেশে পাঠানো কোন অপরাধী সেখানে মৃত্যুদণ্ড পেতে পারে কিনা, সে ব্যাপারে কম কঠোর। এ প্রসঙ্গে আমেরিকার কাছে আসামী হস্তান্তর প্রসংগে ব্রিটিশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডেভিন লিমিব্যান্ড ২০০৮ ফেব্রুয়ারীতে এক উক্তিতে বলেনঃ

 

যুক্তরাষ্ট্রের সাথে আমাদের সন্ত্রাস-প্রতিরোধ সম্পর্ক ব্রিটেনের প্রতিরক্ষার চাবিকাঠি। আমি নিশ্চিত যে, যুক্তরাষ্ট্রের সাথে আমাদের যথা-সম্ভব জোরদার গোয়েন্দা ও সন্ত্রাস-প্রতিরোধ সম্পর্ক চালাতে হবে ও চলবে, তবে তা হবে ব্রিটিশ আইন ও আমাদের আন্তর্জাতিক দায়-দায়িত্বের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ। আমাদের ঘনিষ্ট সহযোগিতার অংশ হিসেবে যুক্তরাষ্ট্র কর্তৃপক্ষের সাথে আমাদের নিয়মিত আদান-প্রদান হয়েছে, যাতে আমরা তাদেরকে শুরুতেই বলেছি যে, আমরা ব্রিটিশ ভূখণ্ড ও আকাশ-পথ এবং বহির্দেশীয় ভূখণ্ডের মাঝ দিয়ে আটককৃতদেরকে পার হওয়ার অনুমতি দেব তখনই, যখন আমরা নিশ্চিত হব যে, তা ব্রিটিশ আইন ও আমাদের আন্তর্জাতিক দায়িত্বের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ হবে; এবং যেভাবে আমরা জাতিসংঘের নির্যাতন-বিরোধী বিধানকে জ্ঞান করি।

 

ওদিকে, যেসব দেশে কয়েদীদের নির্যাতন ও মৃত্যুদণ্ড ভোগের সম্ভাবনা রয়েছে, সেসব দেশে সন্দেহভাজন আসামী প্রেরণ সম্প্রতি নিষিদ্ধ করেছে সুইডেন। এবং সুইডিশ বার এ্যাসোসিয়েশনের মহাসচিব এ্যান রামরার্গ বলেছেন, সুইডেন কাউকে যুক্তরাষ্ট্রে পাঠাতে পারবে না যদি সে ব্যক্তির সেখানে মৃত্যুদণ্ড হওয়ার সম্ভাবনা থাকে কিংবা তার অপরাধ রাজনৈতিক প্রকৃতির হয়। (উল্লেখ্য আসাঞ্জের অপরাধ রাজনৈতিক প্রকৃতির এবং মৃত্যুদণ্ড হওয়ার আশঙ্কাই করছে আসাঞ্জ ভক্তগণ)

 

“সে যে সুইডেন থেকে আমেরিকাতে হস্তান্তরিত হবে এমন সম্ভাবনা, আমার মতে, খুবই, খুবই, খুবই কম। কোন ক্রমেই সে ঝুকি তার ইংল্যান্ডে থাকার চেয়ে বেশি নয়,” বলেছেন রামবার্গ।

 

রামবার্গের এ উক্তি দ্রুব সত্য, কেননা সুইডেনের বিচারব্যবস্থা বিশ্বে এক নম্বর; ইংল্যান্ডের তুলনায় উচ্চমানের। অথচ ইংল্যান্ডে থাকার জন্য প্রায় দেড় বছরব্যাপী আসাঞ্জ লড়াই করে গেল ম্যাজিস্ট্রেট কোর্ট থেকে সুপ্রিম কোর্ট পর্যন্ত। সেটা নির্বোধের মত কাজ নয় কি আসাঞ্জের জন্য? যেখানে তার উচিত ছিল ইংল্যান্ড থেকে সুইডেনে ভাগার চেষ্টা করা, সেখানে সে সুইডেনকে ছেড়ে ইংল্যান্ডে থাকার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করেছে।


 

আসাঞ্জ কি নতুন যুগ সৃষ্টিকারী বিশ্ব-মানবতার বন্ধু?

 

আলোচনার সুবিধার্থে আসাঞ্জের কথিত মহত্তোম কর্মকাণ্ড সম্পর্কে উপরে উদ্ধৃত যুক্তি পত্রিকার মন্তব্য আংশিক পুনরাবৃত্ত করছিঃ

 

কথা হচ্ছে আমাদের এই সময়ের সবচেয়ে আলোচিত, ইতিহাস-সৃষ্টিকারী ব্যক্তিকে নিয়ে। "বাকস্বাধীনতা", "গণমাধ্যমের স্বাধীনতা", "রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা" আর "গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে তথ্য জানার অধিকার" ইত্যাদি শব্দগুচ্ছের সনাতনী অর্থ ভেঙেচুড়ে দিয়েছেন এই ব্যক্তি।

 

বাংগালী সামাজিক ও গণ-মাধ্যম আসাঞ্জের লড়াই সম্পর্কে এরূপ মন্তব্যে ভরপুর। বাংগালী যে কতটা ভাবালু ও বাস্তবতা-বিচ্ছিন্ন, তার পরিচয় মেলে এমন সব মন্তব্যের প্রতিটি শব্দে।

 

যুক্তি পত্রিকা বলছেঃ আসাঞ্জ নতুন ইতিহাস সৃষ্টি করেছে। কোথায় সে নতুন ইতিহাস, নতুন বিশ্ব। দু’বছর আগের তুলনায় আজকের পৃথিবী কোথায় ও কিভাবে ভিন্ন? কিভাবে কালকের দুনিয়া ভেঙ্গেচুরে আজকের যুগান্তরকারী নতুন পৃথিবী সৃষ্টি হয়েছে আসাঞ্জের লড়াইয়ের মাধ্যমে? কেউ কি দেবেন প্রশ্নগুলোর সুনিশ্চিত ও গ্রহণযোগ্য উত্তর।

 

যুক্তি পত্রিকা আরও বলছে বাক-স্বাধীনতা সনাতনী – যেন মানবজাতি শত বছর ধরে নির্বিঘ্ন বাক-স্বাধীনতার চর্চা করে এসেছে এবং তাতে অবসাদগ্রস্থ হয়ে পড়েছে। তাই এখন বাক-স্বাধীনতা সনাতনী প্রাচীর ভেঙ্গে তাতে নতুন মাত্রার যোগ করা দরকার পড়েছে।

 

আমি ঘুরেছি বাংলায়, ভিয়েতনামে, চীনে, থাইল্যান্ডে, মালয়েশিয়ায় – কই দেখা মেলে নি বাক-স্বাধীনতার। আমি পর্যবেক্ষণ করেছি সাম্প্রতিক রাশিয়ায়, কিউবায়, একুইডরের ঘটনাবলী? কই বাক-স্বাধীনতার কোন নমুনা যে আমার নজরে পড়ে নি। কোথায় বাক-স্বাধীনতা সেখানে? আর যেখানে বাক-স্বাধীনতার অস্তিত্বই নেই, তার কি প্রাচীর থাকে? যুক্তি আমাদেরকে বুঝিয়ে বলবে কি – কোথায়, কবে, কিভাবে বাংলায়, ভিয়েতনামে, চীনে, থাইল্যান্ডে, মালয়েশিয়ায়, রাশিয়ায়, কিউবায়, একুইডরে বাক-স্বাধীনতা সনাতনী প্রাচীর ভাংগল?

 

যুক্তি পত্রিকার সুবোধ লেখকের মনে রাখা উচিত যে, বিশ্বমানবতার বিরাট অংশের জন্য বাক-স্বাধীনতা এখনো অলীক স্বপ্ন মাত্র এবং সে অবস্থা বহাল থাকবে আজ থেকে দশক বা শত বর্ষ পর্যন্ত। কাজেই সেখানে বাক-স্বাধীনতার দেয়াল থাকার প্রশ্নই উঠে না। আর যার অস্তিত্বই নেই, তাকে কিভাবে ভেঙ্গে চুরমান করল আসাঞ্জের এ নবযুগ-সৃষ্টিকারী লড়াই। রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, সত্যেন বোস, আরজ আলীর মত প্রতিভাবানদের পূণ্যভূমিতে যুক্তিবাদের এমন দশা দেখে অবাক না হয়ে পারা যায় না।

 

প্রকৃতপক্ষে, উইকিলিক্স প্রকাশিত আমেরিকান কূটনৈতিক বার্তা যতটা পর্যবেক্ষণ করেছি, নতুন তেমন কোনই তথ্যই আমার নজরে পড়ে নি, যুগান্তরকারী কোন অবদান তো হাজার মেইল দূরে থাক। যা কিছু তথ্য বেরিয়েছে, বিশ্বের কোথাও-না-কোথাও বার্তা-মাধ্যম সেগুলো দাবী করে এসেছে আগেই। আমার মতে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশটুকু ছিল আমেরিকার সাথে সহায়তাকারী বেশ কয়েকজন আফগান গোয়েন্দার নাম প্রকাশ, যা তাদেরকে আল-কায়েদা ও তালেবানের আক্রমণের শিকার করতে পারত, এবং তাদের নিরাপত্তার জন্য হয়ত আমেরিকা ব্যবস্থা গ্রহণে বাধ্য হয়েছে।

 

আসাঞ্জ ভক্তকূল যাই ভাবুক না কেন, উইকিলিক্স প্রকাশিত গোপন তথ্য বিশ্বের পরিচালনাকে সামান্যও পরিবর্তিত করেছে কিনা সন্দেহ। তার কর্মকাণ্ডের একমাত্র ফল হচ্ছেঃ আমেরিকা-সহ বিশ্বের অন্যান্য দেশগুলোকে তাদের গোপন কূটনৈতিক আলোচনা ও তথ্য সংরক্ষণ আরও সতর্কতার সাথে পরিচালনা করা। অন্যকথায়, উইকিলিক্সের সূচণার আগে পারষ্পারিক সম্পর্ক ও বিশ্ব-পরিস্থিতি পরিচালনায় আমেরিকা-সহ অন্যান্য দেশ ও আন্তর্জাতিক সংগঠনগুলোকে যেসব নানান বিষয় পরিচালনা ও সামাল দিতে হতো গোপনে-গোপনে, আজও সেসব একইভাবে চলছে, তবে একটু বেশি সতর্কতার সহিত তথা আরও গোপনীয়তার সহিত – যাতে গুপ্ত বার্তাগুলো উইকিলিক্সের মতো সংগঠনের হাতে না পড়ে। এর মাধ্যমে উইকিলিক্স বিশ্ব-পরিচালনার গতি-পদ্ধতিতে যে সামান্য চাপ ফেলেছে, তা বিশ্বে নতুন যুগের সূচণা করবে বা বিশ্ব-মানবতার ভাগ্যে স্বর্ণ-যুগের আনয়ণ  করবে – এমন কোন আলামত বা ভিত্তি নেই। আসাঞ্জ নভেম্বর ২০১০-এ আমেরিকান দূতবার্তা প্রকাশ করা শুরু করে ইরাক ও আফগানিস্তান যুদ্ধ বন্ধের লক্ষ্যে তার ক্রুসেড হিসেবে। তার আগেই প্রেসিডেন্ট ওবামা যেভাবে ঘোষণা দিয়েছিলেন, ইরাক ও আফগানিস্তানে আমেরিকা ও ন্যাটোর কর্মতৎপরতা ঠিক সেভাবেই চলছে। একবিন্দুও বদলেছে – এমন আলামত নেই।

 

এ প্রসঙ্গে আলোচনায় সমাপ্তি টানার আগে এটুকু বলতে চাই যে, আমি আজ ১১ বছর ধরে ইন্টারনেট জগতের বাংগালীদের মাঝে বুদ্ধি-বৃত্তিক প্রচারণার সাথে পরিচিত এবং কিছুটা সম্পৃক্তও বটে। এবং সে অভিজ্ঞতায়, বিশেষত দু’বছর আগে ফেইসবুকে সক্রিয় হওয়ার পর, বিশ্বের নানান কোণে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা তথা-কথিত মুক্তমনা বাংলাদেশীদের মাঝেও যে ব্যাপক হানাহানি, খেচাখেচি, দোষাদোষী, ভাঙ্গন-খণ্ডন দেখেছি – সেখানে সমগ্র বিশ্ব-পর্যায়ের চরম আগোছালো ও অসম বাস্তব পরিস্থিতিকে পরিচালনা করা বা সামাল দেওয়া যে কতটা কষ্টকর হবে – তা আমার কল্পনারও বাইরে। সে পরিস্থিতির পরিচালনায় রাষ্ট্র ও আন্তর্জাতিক সংগঠনগুলোকে যে কিছু-কিছু গোপনীয়তা অবলম্বন করতে হবে, তা অবধারিত – যে গোপনীয়তার বিরুদ্ধে জিহাদ ঘোষণা করেছে আসাঞ্জ ও তার ভক্তকূল। সবচেয়ে বড় পরিহাসের বিষয় যে, যে বাংগালী ভক্তকূল বিশ্ব থেকে সকল গোপনীয়তার দেয়াল উড়িয়ে দেওয়ার উন্মত্তায় আসাঞ্জের লড়াইয়ে একাত্মতা ঘোষণা করেছে, তারাই যে সামান্য অন্তর্জালীয় বুদ্ধি-বৃত্তিক কর্মকাণ্ডে কত্ত ধরনের গোপনীয় কূটচাল খেলে, তার ইয়ত্তা নেই। তাদের এমন গোপনীয় কূটচাল খেলা আমাকে বারবার ভাবতে বাধ্য করিয়েছে যে, গোপনীয় কূটচাল খেলায় বাংলাদেশীদের মত দ্বিতীয় কোন মানুষ পৃথিবীতে আছে কিনা সন্দেহ। গোপনীয় কূটচাল চালানোতে যারা এতটাই অভ্যস্ত ও পটু, তারাই নেমেছে বিশ্ব থেকে সকল গোপনীয়তার পর্দা জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে ছারখার করতে।

 

ব্যক্তিগতভাবে আমি গোপনীয়তা অপসারণের বিপক্ষে নই। গোপনীয়তা বিহীন স্বচ্ছ পৃথিবীতে বাস করার সৌভাগ্য হলে নিজেকে ভাগ্যবাণই মনে করতাম। সে হিসেবে আমি নগ্নতাকেও কিছুটা সমর্থন করি। কিন্তু বাস্তব জগত গোপনীয়তার উর্ধ্বে উঠার সন্ধিক্ষণ থেকে অনেক অনেক দূরে। আসাঞ্জের বেশীরভাগ বাংলাদেশী ভক্তগণ ইন্টারনেটে বুদ্ধি-বৃত্তিক কর্মকাণ্ডের মত সামান্য ব্যাপারে যে ধরনের অহেতুক গোপনীয় কূটচাল খেলে, তাই-ই তাদের জন্য এ বাস্তবতা অনুধাবন করার জন্য যথেষ্ট হবে।

 

শেষ কথায় বলতে হয়ঃ আজকের বাস্তব জগত সকল গোপনীয়তার উর্ধ্বে উঠার স্বপ্নজগত থেকে বহু দূরে। এবং আসাঞ্জের কর্মকাণ্ড সত্ত্বেও রাষ্ট্রগুলোর পারষ্পারিক সম্পর্ক পরিচালনায় গোপনীয়তা চর্চা আগের মতই চলছে এবং চলবে। পৃথিবীর সব দেশই নিজ-নিজ প্রয়োজনমত গোপনীয়তা চর্চা করে যাচ্ছে – হোক সে আমেরিকা, ব্রিটেন, রাশিয়া, একুইডর কিংবা চীন। আসাঞ্জ পাশ্চাত্যের বিশেষত আমেরিকার বিরুদ্ধে একাগ্রভাবে তার রাষ্ট্রীয় গোপনীয়তা-বিরোধী জিহাদ চালিয়ে গেলেও চীন বা রাশিয়ার রাষ্ট্রীয় গুপ্ততথ্য চুরি ও প্রকাশের ব্যাপারে সে একেবারেই উদাসীন। কেন উদাসীন সেটা বুঝার জন্য কাউকে লেকচার দেওয়ার প্রয়োজন নেই। কথায় বলে ঠেলার নাম বাবাজী। যেখানকার ঠেলা সামাল দেওয়া যাবে আসাঞ্জ খুচা কেবল সেখানেই দিবে। রাশিয়ায় ‘পাসি রায়ট’ ব্যান্ডের বিরুদ্ধে জঘন্য বাক-স্বাধীনতা হনণকারী মামলার ব্যাপারে তার লজ্জাজনক নিরবতা এবং রাশিয়া বা চীনের রাষ্ট্রীয় গুপ্ত তথ্য উন্মোচন করার ব্যাপারে তার তৎপরতাহীনতাই তা প্রমাণ করে।

 

আসাঞ্জের লড়াই – মানবতার জয় না ভরাডুবির লক্ষ্যেঃ আসাঞ্জ তার ভক্তকূলের কাছে বিশ্ব-মানবতার একান্ত বন্ধু, যে তার লড়াইয়ের মাধ্যমে নতুন যুগের সূচনা করেছে – অন্ততঃ বাক-স্বাধীনতার চর্চায় যুগান্তর ঘটিয়েছে। কিন্তু উপরের আলোচনা সুস্পষ্ট করে তোলে যে, আসেঞ্জের কর্মকাণ্ড বিশ্ব-মানবতার ভাগ্যে কোনই পরিবর্তন আনে নি, না সূচিত করেছে কোন নতুন যুগের। আসাঞ্জের কর্মকাণ্ড যদি বিশ্বব্যাপী বাক-স্বাধীনতার সার্বিক উন্নতির লক্ষ্যেও পরিচালিত হত, তা কিছু অর্জনে সক্ষম না হলেও তার প্রচেষ্টাকে অন্তত বাহবা দেওয়া যেত। কিন্তু যেভাবে সে তার কর্মকাণ্ড পরিচালিত করছে, তা সার্বিকভাবে বাক-স্বাধীনতার ভরাডুবির পক্ষেই কাজ করবে। আমরা দেখেছি সে কিভাবে রাশিয়ার মত একটা চরম বাক-স্বাধীনতা হনণকারী দেশকে তার বাক-স্বাধীনতা ক্রুসেডের পূণ্যভূমি হিসেবে ব্যবহার করছে, কিভাবে তার নাকে ডগায় রাশিয়াতে ঘটা বাক-স্বাধীনতা-বিরোধী জঘন্য “পাসি রায়ট” মামলায় সে ও তার ভক্তকূল একদম চুপ থেকেছে। এবং “রাশিয়া টুডে” টেলিভিশনে তার বাক-স্বাধীনতা উন্নয়নমূলক অনুষ্ঠানগুলো লেকচার-দাতা অতিথী হয়েছেন প্রেসিডেন্ট কোরেয়া, ইরানী সাহায্যপুষ্ট হেজবুল্লাহ ইসলামি সন্ত্রাসী দলের নেতা হাসান নাসরুল্লাহ। উল্লেখ্য হাসান নাসরুল্লাহ মধ্যপ্রাচ্যে রাশিয়ার সবচেয়ে প্রিয় বন্ধু সিরিয়ার বাসার আল-আসাদের একনিষ্ঠ সমর্থক। এসব অতিথীদেরকে তার অনুষ্ঠানে এনে আসাঞ্জ পাশ্চাত্যের পূঁজিবাদী উদার-গণতান্ত্রিক বিশ্বে বাক-স্বাধীনতার মিথ্যে মুখোশের নিচে যে শঠতা চলে, তার উন্মোচনে লিপ্ত হয়েছে আসাঞ্জে।

 

তার এ কর্ম-প্রণালী থেকে আমরা অন্তত একটা বিষয় নিশ্চিত হতে পারি যে, আসাঞ্জের দৃষ্টিতে পাশ্চাত্যের উদার-গণতান্ত্রিক বিশ্ব হচ্ছে বাক-স্বাধীনতার বদ্ধভূমি। আর রাশিয়া, একুইডর ও সম্ভবত আসাদ-শাসিত সিরিয়া বাক-স্বাধীনতার পূণ্যভূমি বা শ্রেয়তর দেশ। অন্যকথায়, পাশ্চাত্যের রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা নিপাত যাক; সেখানে রাশিয়া, একুইডর, বা আসাদ-অধীন সিরিয়া, হেজবুল্লাহ-শাসিত দেশের উদ্ভব হোক। এমন বিশ্বই আসাঞ্জের মানসে আদর্শ কিংবা শ্রেয়তর। বাংলাদেশ-সহ বিশ্বের সর্বত্র আসাঞ্জ ভক্তকূল যখন তার লড়াইয়ে অন্ধ সমর্থন দান করেছে, তারাও অন্তত অনুসিদ্ধান্তগতভাবে (theoretically) সে রকম মনে করবে। হয়ত তাদের সে ধারণাই সঠিক।

 

তবে আমি বাংলাদেশী আসাঞ্জ ভক্তকূলের কাছে একটি প্রশ্ন রাখতে চাইঃ

 

আপনারা অনেকেই ইন্টারনেট জগতে নাস্তিক্য চর্চা করে যাচ্ছেন। ধরুন আগামী নির্বাচনের পর জামাতে ইসলামী-নেতৃত্বাধীন এক ইসলামপন্থী সরকার এলো। ইসলাম-বিরোধী প্রচারণার জন্য আপনাদেরকে নিধনের জিহাদ ঘোষিত হল। আপনাদেরকে সু্যোগ দেওয়া হলো নিম্নোক্ত দেশগুলোতে পালানোরঃ রাশিয়া, একুইডর, সুইডেন, ব্রিটেন ও আমেরিকা। আপনারা কোন দেশটি চয়ণ করবেন? বাক-স্বাধীনতা চর্চার জন্য বাংলাদেশের ইসলামপন্থী সরকার আপনাকে কোতল করতে চাচ্ছে। আপনি নিশ্চয়ই গুরু আসাঞ্জের বাক-স্বাধীনতার পূণ্যভূমি রাশিয়া বা একুইডর যেতে চাইবেন, নয় কি?

 

যে দেশটিই চয়ন করুন-না কেন, তবে একটি হুশিয়ারী উচ্চারণ করে সাবধান করে দিই আপনাদেরকে। যদি আসাঞ্জের বাক-স্বাধীনতার পূণ্যভূমি রাশিয়া বা একুইডরকে আশ্রয়-প্রার্থী দেশ হিসেবে চয়ন করতেই চান, তাহলে সাবধান। কোরেয়া বা পুতিন সরকারের বিরোধী কোন কথা বলবেন না যেন। আপনাদের গুরু আসাঞ্জ ব্যাপারটা ভাল করেই জানে এবং সেভাবে চালাচ্ছে নিজেকে। সময় থাকতে তার সাথে আলাপ করে নিশ্চিত হয়ে নিন।

 

আর যদি সুইডেন, ব্রিটেন ও আমেরিকাকে আপনার আশ্রয়-প্রার্থী দেশ হিসেবে চয়ন করতে চান, তাহলে আপনার মনে সেসব দেশের বিরুদ্ধে বা রাজনীতিকদের বিরুদ্ধে যা মন চাই বলে যান – কেবলমাত্র সন্ত্রাসী হামলার হুমকি দিবেন বা সহিংসতা উদ্রেককারী কিছু বলবেন কারও বিরুদ্ধে। অবশ্য এ ব্যাপারে আপনাদেরকে জ্ঞান দেওয়ারও প্রয়োজন নেই। আপনারাও জানেন আয়াতুল্লাহ খোমেনি আমেরিকাকে বড় শয়তান এবং ইউরোপকে ছোট হিসেবে দেখা সত্ত্বেও সে ফ্রান্সে জায়গা পায় এবং আমেরিকা বা অন্য কোন পাশ্চাত্য দেশ তাকে ধরে ফাসিতে ঝোলানোর চেষ্টা করে নি। ইরানের নোবেল বিজয়ী শিরিন ইবাদির কাছে ইরানের মুল্লারা যত বড় সমস্যা, তার চেয়ে বড় সমস্যা এ্যাংলো-মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ। অথচ ইরান ছেড়ে যখন তাকে পালাতে হলো, সে আশ্রয় পেল ব্রিটেনে। ইরানের মরিয়ম নামাজী -- এজকন জাঁত কমিউনিস্ট -- সারা জীবন পুজিবাদী সাম্রাজ্যবাদের গোষ্ঠি উদ্ধার করে গেল লণ্ডনে বসেই। আমাদেরই মাক্সিস্ট মনের তসলিমা নাসরিন, যার লেখায় পশ্চিমা পূঁজিবাদ, সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে নিন্দার খই ফুটে, সে আশ্রয় পেয়েছে সুইডেনে। ইমরান খান -- যার আমেরিকা-ব্রিটেন বিদ্বেষী বক্তব্য তালেবানদেরকেও মার মানাবে -- সে কেবল ব্রিটেন ও আমেরিকায় গিয়েও এ্যাংলো-আমেরিকার তীব্র সমালোচনাকারী বক্তব্যই দেয় না, পাকিস্তানে তার রাজনীতি পরিচালনার জন্য চাদাও তোলে প্রবাসী পাকিস্তানীদের কাছ থেকে।

 

মার্ক্সবাদী কি মুল্লাপন্থী আসাঞ্জ ভক্তদের জন্য আরেকটা খারাপ খবর – আপনি যদি কখনো রাজনৈতিক নির্যাতন বা মানবাধিকার হরণের শিকার হন, রাশিয়া বা একুইডরে আপনাদের রাজনৈতিক আশ্রয় পাওয়ার সম্ভাবনা প্রায় শূণ্য। তবে সুখবরও আছে - আপনাদের লাগামহীন সুইডেন বিদ্বেষ সত্ত্বেও সে দেশটিতেই আপনাদের রাজনৈতিক আশ্রয় পাওয়ার সম্ভাবনা সর্বাধিক। দঃ আমেরিকার একনায়ক স্বৈরাচারীদের হাতে নির্যাতিত হাজার হাজার মার্ক্সিস্ট কর্মিকে সুইডেন রাজনৈতিক আশ্রয় দিয়েছে, আফগানিস্তানের তালেবান-বিরোধী বহু মার্ক্সিস্ট ও গণতন্ত্রপন্থী রাজনৈতিক কর্মি, সোশ্যালিস্ট সাদ্দাম ও গাদ্দাফীর হাতে নির্যাতিত বহু রাজনৈতিক কর্মি সুইডেনে আশ্রয় পেয়েছে। সুইডেন যেন বিশ্বের সকল রাজনৈতিক আশ্রয়-প্রার্থীদের পূণ্যভূমি হয়ে উঠেছে – হোক সে কমিউনিস্ট, ইসলামপন্থী কিংবা উদারবাদী।

 

কাজেই আসাঞ্জ যখন সুইডেন-সহ পাশ্চাত্যের উদার-গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রগুলোকে হৃদয়-মন দিয়ে ঘৃণা করে এবং সেগুলোর পরিবর্তে রাশিয়া ও একুইডরের মতো দেশ দেখতে চায়, তার আকাঙ্ক্ষা সফল হলে তা মানবতার জয় নাকি ভরাডুবি হবে, তার বিচারের ভার আপনাদের বিবেকের কাছেই ছেড়ে দিলাম।

 

শেষকথা

 

আপনার যদি সামান্যও বিবেক-বিবেচনা থেকে থাকে এবং বাস্তবতার সাথে সংযোগ থাকে, তাহলে কোন ক্রমেই স্বীকার না করে পারবেন না যে, সুইডেনের মত পাশ্চাত্যের উদার-গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রগুলো মানবজাতির জন্য শ্রেষ্ঠ অর্জন – যে রাষ্ট্রগুলো অতি উচ্চমানের জীবনযাত্রা, সুবিচার ও মানবাধিকার নিশ্চিত করতে পেয়েছে সে দেশগুলোর নাগরিকদের জন্য; এবং বিশ্বের বিভিন্ন কোণের মানবাধিকার বঞ্চিত ও নিপীড়নের শিকার বহু লোকের আশ্রয়স্থলও হয়েছে সে দেশগুলো। বাক-স্বাধীনতার প্রশ্নে – যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন বা সুইডেন যে সব কারণে বাক-স্বাধীনতা ভঙ্গের অজুহাতে আপনাকে শাস্তি দেবে, তার প্রত্যেকটা কারণে রাশিয়া বা একুইডরও আপনাকে শাস্তি দেবে, তবে অধিক নিষ্ঠুরতা সহকারে। এবং রাশিয়া বা একুইডর আপনাকে এমন অনেক কারণে বাক-স্বাধীনতা ভঙ্গের দোষে শাস্তি দেবে, যা আমেরিকা, ব্রিটেন ও সুইডেনে শাস্তিযোগ্য অপরাধ বিবেচিত হবে না। যারা বাস্তব পৃথিবীতে বাস করেন, তাদেরকে এ ব্যাপারটা উপলব্ধি করতে একটুও কাঠ-খড় পোড়াতে হবে না। বিশ্বের চারিদিকে একটু নজরপাত করলেই তা স্ফটিক-স্বচ্ছ হয়ে দেখা দিবে আপনার চোখে।

 

তবে আসাঞ্জ ও ভক্তকূলের নজরে সবকিছুই তার উলটো মনে হয়। সুইডেন, ব্রিটেন, আমেরিকা-সহ পাশ্চাত্যের উদার-গণতান্ত্রিক পূজিবাদী রাষ্ট্রগুলো তাদের দৃষ্টিতে মানবতার সবচেয়ে বড় কলংক; মানবতার গর্বিত মুকুট হচ্ছে রাশিয়া, একুইডর, সিরিয়া...। আসাঞ্জ ও তার ভক্তকূলের আজব মনোবৃত্তি বোঝা বড়ই দায়। ১৯ আগষ্ট তারিখে লন্ডনের একুইডর দূতাবাসের বারান্দা থেকে আসাঞ্জের বক্তৃতার পর সুইডেনের Svenska Dagbladet পত্রিকা মনে হয় ঠিকই বলেছেঃ “আসাঞ্জ এক  আত্মম্ভরী উন্মাদ (megalomanic)-এ পরিণত হয়েছে, যার বাস্তবতার সাথে কোন সংযোগ আছে বলে মনে হয় না।”

 

যে নিজেকে বিচার-আচারের উর্ধ্বে মনে করে এবং যার মানসে আজকের বিশ্ব বাস্তবতার ঠিক বিপরীত, তাকে "আত্মম্ভরী উন্মাদ" বলা অযৌক্তিক নয়। মানবতার জন্য বাক-স্বাধীনতার উৎকর্ষ সাধনই যদি হতো আসাঞ্জের আন্দোলনের সত্যিকার উদ্দেশ্য, রাশিয়া, একুইডর, চীন বা বাংলাদেশের মত রাষ্ট্রগুলো হতো তার ক্রুসেডের প্রাথমিক লক্ষ্য, পাশ্চাত্য হতে পারত শেষ লক্ষ্য। কিন্তু আফসোচঃ আসাঞ্জের জগতে রাশিয়া, একুইডরের মত দেশগুলো হচ্ছে বাক-স্বাধীনতার পুণ্যভূমি, আর বদ্ধভূমি হচ্ছে পশ্চিম ইউরোপ, আমেরিকা, ক্যানাডা ও অস্ট্রেলিয়ার মত দেশগুলো!

 

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
Archive
 
সাম্প্রতিক পোষ্টসমূহ