Banner
ইসলামের বলি ইরান – আমিল ঈমানী

লিখেছেনঃ আমিল ঈমানী, আপডেটঃ August 21, 2009, 12:00 AM, Hits: 802


 প্রায় ১৪০০ বছর পূর্বে রুক্ষ আরব উপদ্বীপ অঞ্চল অদম্য, অসভ্য, হিংস্র উপজাতীয়দের পরস্পরের বিরুদ্ধে যুদ্ধ-বিগ্রহ করার দেশ হিসাবে পরিচিত ছিল। নৃশংসতা, লুণ্ঠন এবং দাস ব্যবসা ছিল তাদের দৈনন্দিন কাজ। নিজ সুবিধার্থে এবং প্রয়োজন ছাড়া, বছরে একটি মাস তারা যুদ্ধ বা হানাহানি করত না – সেই মাসটি হলো মহরম মাস (নিষিদ্ধ মাস)। তথাপি এই যুদ্ধ বিরতির সময় কোন কোন উপজাতি অস্ত্র সংগ্রহ করত এবং পরবর্তী এগারো মাসের রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের জন্য প্রস্তুতি সম্পন্ন করত। সহিংসতা ছিল তাদের জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ।

 যদিও প্রতিনিয়ত হানাহানি ও যুদ্ধ অবর্ণনীয় কষ্ট ও মৃত্যু বয়ে আনত, যারা বেঁচে যেত তাদের জন্য রুক্ষ মরুভূমিতে জীবন যাপনে অত্যাবশ্যকীয় প্রাণী দুম্বা, উট এবং যুদ্ধের জন্য একান্ত প্রয়োজনীয় ঘোড়া অবশিষ্ট থাকত। নৃশংস মৃত্যুই ছিল শাসক। যে বিজয়ী হত সে কিছু দিনের জন্য নিস্তার পেত নিজে শিকারে পরিণত হবার আগ পর্যন্ত।

 ঐ সময়ে নূতন আহ্বান এলো। কুরাইশ উপজাতির এক এতিম যার নাম মুহাম্মদ, মৃত আব্দুল্লাহর সন্তান, আরবের অসভ্য উপজাতীয় দলগুলিকে সমঝোতা চুক্তি করতে বললেন – যা প্রত্যাখ্যান করা সহজ ছিল না। তিনি মূর্তি-পূজা বন্ধ করতে বললেন, মক্কার বেদী হতে সকল দেব-দেবীর মূর্তি অপসারণ করতে বললেন এবং বহু সংখ্যক দেব-দেবীর মধ্যে আল্লাহকে একমাত্র সৃষ্টিকর্তা হিসাবে মেনে নিতে বললেন। তিনি বললেন আল্লাহ এই মহাবিশ্বের সৃষ্টিকর্তা এবং পরকালের জন্য সৃষ্টি করে রেখেছেন অপরিমেয় পুরস্কার ও অসীম আনন্দে পূর্ণ আরেক জগৎ।
 
তিনি কথা দিলেন, যদি বর্বর উপজাতিগুলি আল্লাহ্কে বিশ্বাস করে এবং তার নেতৃত্বে একত্রিত হয়ে আল্লাহর আদেশ পালনে ব্রতী হয় তবে  তারা যেমন লুণ্ঠনলব্ধ বিপুল জাগতিক সম্পদ লাভ করবে তেমন মৃত্যুর পর পুরস্কার স্বরূপ লাভ করবে গৌরবান্বিত বেহেস্ত বা স্বর্গে প্রবেশের অনুমতি, এবং পরকালের স্বর্গীয় জীবন কখনও শেষ হবে না।

 মুহাম্মদ আরো আশ্বাস দিলেন হাজার হাজার বৎসর ধরে আরবরা যেভাবে সামান্য প্রাপ্তির জন্য পরস্পরের বিরুদ্ধে হানাহানি করেছে যদি তারা সেটা পরিহার করে তবে তারা দারিদ্র্য পীড়িত মরুভূমির সীমানার বাইরে অঢেল সম্পদ ও পুরস্কারের পৃথিবীতে অভিযান চালাবার ঝুঁকি নিতে পারবে। মুহাম্মদ তার ক্রমবর্ধমান অনুসারীদের তার চারপাশে সমবেত হতে অনুপ্রাণিত করার জন্য ঘোষণা করলেন – (১) যদি তারা বিজয়ী হয় তা হলে বিজিত অবিশ্বাসীদের সমুদয় সম্পদের মালিকানা যেমন তারা পাবে তেমন তারা বিজিতদের স্ত্রী ও সন্তানদের দাস হিসাবে রাখবার অথবা বিক্রি করবার অধিকার পাবে; (২) আল্লাহর কাজে যদি কোন বিশ্বাসী অবিশ্বাসীদেরকে খুন করে তবে মৃত্যুর পর সে পুরস্কার স্বরূপ স্বর্গ বা বেহেস্তে প্রবেশের সুযোগ লাভ করবে; (৩) অনাকাঙ্ক্ষিত হলেও যদি তার কোন বিশ্বাসী অনুসারী লড়াইয়ে শত্রুর হাতে নিহত হয় তবে মৃত্যুর পর আল্লাহ্ তাদেরকে বেহেস্ত্ প্রদান করবেন যেখানে তারা অপার আনন্দ-উল্লাসে অনন্ত কাল কাটাবে।
 
অল্প কিছু সংখ্যক মানুষ যাদের কিছুটা বুঝার ক্ষমতা ছিল তারা মুহাম্মদের অদ্ভূত, বারংবার বিভ্রান্তিকর এবং প্রায়শ পরস্পর বিরোধী ও অসংলগ্ন বাগাড়াম্বরের কারণে তার মানসিক সুস্খতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিলেন। তারা তাকে “উম্মাদ কবি” হিসাবে প্রত্যাখ্যান করেছিলেন। তবু বর্বরদের অধিকাংশই তাকে “ত্রাণকর্তা” হিসাবে মেনে নেয় – যিনি তাদেরকে এই পৃথিবীতে এবং মৃত্যুর পরবর্তী জীবনে সকল ভালো কাজে পথ দেখাবেন। এটা তাদের জন্য এক সম্ভাবনার দুয়ার খুলে দেয়। বিজয়ী হলে মোটা দাগের পুরস্কার লাভ আর মৃত্যু ঘটলে সরাসরি বেহেস্তে গমন। তারা কী করে এই সুযোগ প্রত্যাখান করে?

 মুহাম্মদ তাদেরকে বোঝান জাগতিক জীবন ক্ষণস্থায়ী, যাকে পরকালের অনন্ত জীবনের জন্য কাজে লাগানো উচিত। সকল বিশ্বাসীকে পরকালে কল্যাণ অর্জনের জন্য সচেষ্ট হতে হবে। এ কারণে বলা যায় ইসলাম একটি মৃত্যু কেন্দ্রিক ধর্ম, জীবিতের বা জীবনের ধর্ম নয়। ইসলামে কখনই আত্মোৎসর্গকারী স্বেচ্ছাসেবীর অভাব হবে না যতদিন না ইসলাম পরিত্যাক্ত হয়।
 
লোভের তাড়নায় তরবারি হাতে আরবের খুনীরা ইসলামের পতাকা হাতে বহির্বিশ্বে পা বাড়ায়। কয়েক শতাব্দীর মধ্যে সভ্য পৃথিবীর বিস্তীর্ণ অঞ্চল জুড়ে তারা প্রমত্ত অভিযান চালিয়ে সবকিছু তছনছ করে দেয়। তাদের যাত্রা পথের দু’পাশ জুড়ে তারা ছড়িয়ে দেয় মৃত্যু আর ধ্বংস।
 
লুটপাট ও ধ্বংসের উদ্দেশ্যে তাদের প্রথম দিককার শিকার ছিল পারস্য বা ইরান, যে দেশ ছিল যুক্তিসঙ্গতভাবে পৃথিবীর অন্যতম শ্র্রেষ্ঠ সভ্য জাতির দেশ। প্রাচীন ইরানীয়রাই মানব জাতিকে প্রথম “মানবাধিকার সনদ” দান করেছিল, বিশাল পারস্য সাম্রাজ্যের সর্বত্র বিভিন্ন ভাষা ও সংস্কৃতির অধিকারী সকল জনগোষ্ঠীর জন্য স্বায়ত্তশাসন, সহনশীলতা এবং ন্যায়পরায়ণতা রক্ষা করেছিল। ইসলাম সুপরিকল্পিতভাবে সেই সভ্যতাকে ধ্বংস করেছে এবং কালক্রমে তার জায়গায় অতীত উপজাতীয় সমাজের পশ্চাৎপদ ধ্যান-ধারণা ও আচার-আচরণকে পুন:প্রতিষ্ঠার জন্য সর্বাত্মক চেষ্টা চালিয়েছে। লক্ষ লক্ষ ইরানী এর বিরোধিতা ও প্রতিরোধ সংগ্রামে জীবন বিসর্জন দেন। অনেক অ-মুসলিম জোরপূর্বক চাপানো “জিজিয়া কর” প্রদান করে জীবন রক্ষা করেন।
 
অন্যরা তাদের পরিচিতি এবং ঐতিহ্য বিলিয়ে দিয়ে নূতন শাসকদের পথ গ্রহণ করে নিল। এটা সেই নির্দয় সংখ্যালঘু গোষ্ঠী যারা স্বৈরাচারের মাধ্যমে ইরানকে শাসন করছে। এখনও ফ্যাসিবাদী ইসলামী শাসনের যাঁতাকলে বিভিন্ন জাতি, বর্ণ ও ধর্মীয় সত্তার ইরানীগণ নিষ্পেষিত হলেও তারা তাদের প্রাচীন বিশ্বাসকে লালন করছেন – যে বিশ্বাসকে তাদের জন্য জরথুস্ত্র রেখে গেছেন। জরথুস্ত্রের মতবাদ তিনটি ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত – ভালো চিন্তা, ভালো কথা এবং ভালো কর্ম, যা ছিল পারস্যবাসীদের জীবনযাত্রার অবিচ্ছেদ্য অংশ। জরথুস্ত্রের ধর্ম ছিল যুক্তিসঙ্গতভাবে সবচেয়ে প্রাচীন পবিত্র ধর্ম। এই ধর্মের শিক্ষাসমূহ বিভিন্ন ধর্মের শিক্ষাসমূহকে অনুপ্রাণিত করেছিল।
 
জরথুস্ত্রবাদের প্রভাব ইহুদীবাদের মধ্যে বিদ্যমান, যে কারণে অনেক প্রভাবশালী ধর্মীয় পণ্ডিত স্বীকার করতে বাধ্য হয়েছেন যে, ইহুদীবাদ হল “জরথুস্ত্রবাদের দৃষ্টিতে মোজেজ বা মুসা”। অধিকন্তু, পারস্যের বিভিন্ন জরথুস্ত্রবাদী রাজাদের শাসন কালে ইহুদীদের ধর্মগ্রন্থ ওল্ড টেস্টামেন্টকে প্রথম লিখিত রূপ দান করা হয়। ভালো-মন্দ, স্বর্গ-নরক, পুনরুজ্জীবন এবং বেহেস্ত সংক্রান্ত ধারণাগুলি জরথুস্ত্রবাদ হতে এসেছে। বাস্তবে ইহুদী ও খৃষ্টান এই উভয় ধর্মের শিকড় রয়েছে জরথুস্ত্রবাদের ভিতর। ডব্লিও, ওয়াই, ইভান্স্-ওয়েন্ৎস্ নামের অক্স্ফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষক যিনি প্রাচ্যের আধ্যাত্মিকতা ও ধর্ম বিষয়ে অন্যতম বিশেষজ্ঞ তিনি বলেছেন, “জরথুস্ত্র না থাকলে কোন যীশু থাকত না।” জরথুস্ত্রের ধর্ম ও খ্রীষ্টধর্মের মধ্যে আত্মিক বন্ধনের আরও প্রমাণ পাওয়া যায় এই বিবরণের মধ্য দিয়ে যে যীশুর জন্মের সময় পূর্ব হতে অনুমান করে তিন জন জরথুস্ত্রবাদী পুরোহিত পারস্য হতে জেরুজালেম গমন করেন শিশু যীশুর জন্ম উৎসব উদ্যাপনের জন্য।

 এটা সত্যি যে ইসলাম জয়ী হয়েছে এবং পারস্য সভ্যতার শ্বাসরোধ করতে সক্ষম হয়েছে। আবারো নূতন করে প্রবল শক্তি নিয়ে জঙ্গী ইসলাম ধ্বংস করতে চাইছে অন্য আরেক সভ্যতাকে – ইহুদী-খৃষ্টান সভ্যতাকে, যে সভ্যতা কিনা ইসলামের আদিম ও পশ্চাৎপদ ধর্মবিশ্বাস যে ভুল সে কথা সতত প্রমাণ করে চলেছে। ইসলামী ফ্যাসিবাদ শুধু যে পশ্চিমা বিশ্বের জন্য নয় বরং সমগ্র সভ্য বিশ্বের জন্য হুমকি স্বরূপ তার প্রমাণ বর্তমান ইরানের ক্ষমতাসীন ইসলামবাদীরা।
 
বর্তমানে ইরানের দ্রুত এমন এক পারমাণবিক শক্তিধর রাষ্ট্র হিসাবে দাঁড়াবার এবং সেই সঙ্গে  এমন এক ভয়ানক শত্রু হিসাবে দাঁড়াবার সম্ভাবনা তৈরী হয়েছে যা সমগ্র মুক্ত বিশ্বকে পদানত না করে থামতে চাইবে না। অন্যদিকে, ইরানের জনগণ ও সংস্কৃতির মধ্যে এমন এক সম্ভাবনা আছে যার কারণে ইরানের পক্ষে সম্ভব রোজ-কেয়ামত অভিমুখী মোল্লাতন্ত্রকে হটিয়ে দিয়ে মুক্ত বিশ্বের সাথে ইসলামী বিশ্বের ঐক্যের ক্ষেত্রে সবচেয়ে শক্তিশালী অংশীদার হিসাবে ভূমিকা পালন করা।
 
ইরানের বিপুলভাবে সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণ আজ পৃথিবীর সভ্য মুক্ত জনগণের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে ইসলামী ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করছেন। ইরানী জনগণ তাদের ঐতিহ্য ভুলে যান নাই। তারা গর্ব বোধ করেন তাদের আলোকিত প্রাচীন ধর্মবিশ্বাসের জন্য – সেটি হলো জরথুস্ত্রবাদ। তারা নিজেদেরকে এক মহান ইতিহাস-ঐতিহ্যের উত্তরাধিকারী, দৃষ্টান্তস্থানীয় ন্যায়বান রাজা মহান সাইরাসের উত্তরাধিকারী হিসাবে গণ্য করেন, এবং  তারা ইসলামী ফ্যাসিবাদের মারাত্মক ব্যাধি থেকে ইরানকে মুক্ত করতে যে কোন মূল্য দিতে প্রস্তুত।

 
(নিবন্ধটি Amil Imani-এর Islam’s Victimization of Iran-এর ভাষান্তর। এটি  Faith Freedom International (www.faithfreedom.org)-এ ৩ জুলাই, ২০০৯ তারিখে প্রকশিত হয়। – বঙ্গরাষ্ট্র)
 
অনলাইন : ২১ আগস্ট, ২০০৯

 

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
Archive
 
সাম্প্রতিক পোষ্টসমূহ