Banner
যে কথাটি না বুঝলে মানুষ ধ্বংস হবে — মনস্বিতা বুলবুলি

লিখেছেনঃ মনস্বিতা বুলবুলি, আপডেটঃ May 4, 2020, 12:00 AM, Hits: 1094

 

এটা জ্ঞান ও বিজ্ঞানের অগ্রগতির যুগ, সবাই বলে। লক্ষণীয় হল জ্ঞান, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির এত শীর্ষে উঠার সাথে সাথে পৃথিবীর প্রাণ-প্রকৃতি যেন পাল্লা দিয়ে বিনাশের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। এমনটা কি হওয়ার কথা? যুক্তি, বুদ্ধি ও কাণ্ডজ্ঞান কি বলে? মানুষ জ্ঞান-বিজ্ঞানের চর্চা করে যাতে সে আরও সভ্য হয়, সমাজ আরও উন্নত হয় এবং জীবন যাপন আরও সুন্দর হয়। কিন্তু বাস্তবতা কি? আমরা দেখছি পৃথিবীজুড়ে হানাহানি, অর্থনৈতিক মন্দা, মানুষের হাহাকার, কান্না আর সেই সঙ্গে প্রকৃতির রুদ্ররূপ। অসংখ্য প্রাণী বিলুপ্ত হয়ে গেছে বা বিলুপ্তির পথে। এমন কিছু প্রাণী বিলুপ্তির পথে যার পরিণাম ভয়াবহ, যেমন মৌমাছি। বলা হচ্ছে মোবাইল টাওয়ারের রেডিয়েশানের ফলে এরা বিলুপ্ত হচ্ছে। মৌমাছি না থাকলে পরাগায়ন হবে না, আর তাহলে প্রকৃতির বনায়ন কেমন করে হবে? শুধু তাই নয়, কাণ্ডজ্ঞানহীন লোভী মানুষের টাকা বানানোর খপ্পরে পড়ে বন-জঙ্গল, নদীনালা, সাগর পর্যন্ত আজ উজাড় ও দূষিত। ফলে প্রকৃতির অন্যান্য প্রাণীদের আবাসস্থল ও খাদ্যের যোগান আজ ভয়াবহ সঙ্কটের মুখে। এখন কথা হল মানুষের এই যে এত বিদ্যা, জ্ঞান, আবিষ্কার, প্রযুক্তিগত উৎকর্ষ এগুলো কোন কাজে আসলো মানব সমাজের এবং এই পৃথিবীর? এগুলো কল্যাণকর না হয়ে বিধ্বংসী কেন হল? কোথাও শান্তি নেই, প্রকৃতি রোষে ফুঁসছে। এর কারণটা মানুষকে বুঝতেই হবে যদি সে বাঁচতে চায় ও এই পৃথিবীকে বাঁচাতে চায়।

মানুষ প্রথমেই যে ভুল দৃষ্টিভঙ্গীর উপর দাঁড়িয়ে জ্ঞান ও বিজ্ঞানের চর্চা ও বিভিন্ন আবিষ্কার শুরু করেছিল এবং এখনো করে যাচ্ছে তা হল নিজেকে প্রকৃতির একটি অংশ না ভেবে প্রকৃতির নিয়ন্ত্রক ভাবা। নিজেকে প্রকৃতির প্রাণীচক্র থেকে বা প্রকৃতি থেকে বিচ্ছিন্ন করে ভাবা। অথচ বাস্তবতা হল আমরা এই পৃথিবীর প্রাকৃতিক চক্রের একটি অংশ মাত্র। তাই এর অন্যান্য অংশীদারদের সাথে প্রাকৃতিক নিয়মে সহাবস্থান না করে তাকে কেবল বস্তু বা পণ্যের মত ব্যবহার করাতো আসলে কাণ্ডজ্ঞানহীন অবাস্তব একটি ব্যাপার। তাই যা ঘটার প্রকৃতি জগতে আজ তাই ঘটছে। বন, নদী বেদখল, সাগর দূষিত, প্রাণীকুল বিলুপ্তির পথে, ঘন ঘন প্রাকৃতিক দুর্যোগ।

এখন দৃষ্টিপাত করা যাক আমাদের সমাজের দিকে। কী ঘটছে সেখানে? জ্ঞান,বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির জগতে অভূতপূর্ব অগ্রগতি ঘটেছে। শিক্ষার হারও অতীতের চেয়ে অনেক বেড়েছে। অথচ সমাজে এর কোন সুফল কী দেখতে পাচ্ছেন? বিশ্বের দেশে দেশে হানাহানি, রক্তারক্তি, অর্থনৈতিক মন্দা, মানুষের নৈতিক স্খলন। কিন্তু কেন? নিশ্চয়ই কোথাও গুরুতর সমস্যা আছে। সেটা কী?

মানুষের সমাজের মূল চালিকাশক্তি হল তার রুটি-রুজি যোগানের ব্যবস্থা বা অর্থনৈতিক ব্যবস্থা। বর্তমানে যে অর্থনৈতিক ব্যবস্থা চলছে তার মূল লক্ষ্য বা চালিকা শক্তি হল মুনাফা বা লাভ বাড়ানো। এই মুনাফা বাড়ানো হয় বেশীরভাগ মানুষকে পণ্যের মত ব্যবহার করে, অর্থাৎ, এখানে মানুষের শ্রম পণ্যের মত কিনে নেয়া হয়।  এই শ্রম যত কম মূল্যে কেনা যায়, মুনাফা তত বেশী হয়। এই মুনাফা দ্বারা গুটিকয়েক ব্যক্তি বা মালিকের কব্জায় চলে যায় বেশীরভাগ সম্পদ। তখন এমন এক অবস্থার সৃষ্টি হয় যে বেশীরভাগ মানুষ স্বল্প মূল্যে তাদের শ্রমের দীর্ঘ ঘণ্টা বিক্রি করতে বাধ্য হয়। এই অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় সবকিছুই পণ্য বা বেচাকেনার বস্তু, মানুষ সহ। মানুষ যখন আর চিন্তাশীল, আবেগ ও মানবিকবোধ সম্পন্ন প্রাণী হিসেবে গণ্য না হয়ে পণ্যের মত বিবেচিত হয় তখন সেই সমাজে কী আশা করা যায়? বাজারে পণ্যের বেচাকেনার একটি প্রতিযোগিতা থাকে। মানুষ পণ্যও তখন সেই প্রতিযোগিতার বাজারে শামিল হয়। একে অপরের সাথে প্রতিযোগিতায় লিপ্ত থাকে বেঁচে থাকার উপায়ের খোঁজে। আর যেহেতু এই ধরণের সমাজে মুনাফা, অর্থ-সম্পদই সকল ক্ষমতা, মানসম্মান, নিরাপত্তার উৎস তাই সকলেই এর পিছনে ছুটে। মানবিকতা, নৈতিকতা, প্রাণ ও প্রকৃতির প্রতি দায়িত্বশীলতার অভাব প্রকট হয়। কেননা মানুষ তো আর এখানে মানুষ নয়, কেবল পণ্য; জীবন হল কেবল আত্বস্বার্থের, ভোগের। কিন্তু এই পুরো প্রক্রিয়াটাই প্রকৃতি বিরুদ্ধ। প্রকৃতিতে কোন প্রাণ একা বাঁচা অসম্ভব। প্রতিটি প্রাণ একে অপরের উপর নির্ভরশীল। কেবল আমি বাঁচবো, আমি সুখে থাকব, আমি পৃথিবীটাকে ভোগ করব, এটা  প্রকৃতির নিয়মই নয়। তাই এই নিয়মে চললে মনুষ্য সমাজ আর টেকে না। তাই প্রকৃতি বিচ্ছিন্ন হয়ে, প্রকৃতির বিরুদ্ধাচার করে মানুষ উন্নতির ও অগ্রগতির যে স্বপ্ন দেখছে তা যে কতোটা অবাস্তব তা বর্তমানের আবহাওয়া পরিবর্তন ও দেশে দেশে মানুষের হাহাকার দেখে বুঝে নিন। বাঁচতে হলে সত্যটা অনুধাবন করতে হবে।

 

লেখক পরিচিতি : মনস্বিতা বুলবুলি

সাংবাদিক (প্রাক্তন যুগ্ম বার্তা সম্পাদক, TBN24; প্রাক্তন সহকারী সম্পাদক, ঢাকা ট্রিবিউন, ডেইলি অবজারভার, ডেইলি স্টার, ডেইলি সান)

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
Archive
 
সাম্প্রতিক পোষ্টসমূহ