Banner
সী প্রেয়ার — খালেদ হোসেইনি : ভাষান্তর — তামান্না ঝুমু (কবিতা)

লিখেছেনঃ তামান্না ঝুমু, আপডেটঃ May 20, 2022, 12:00 AM, Hits: 566

 

প্রিয় মারওয়ান,
শৈশবের দীর্ঘ গ্রীষ্মগুলিতে,
যখন আমি তোমার বয়েসী বালক ছিলাম,
তোমার কাকারা আর আমি
তোমার দাদাভাইয়ের হোমসের বাইরের খামারবাড়ির ছাতে
মাদুর বিছিয়ে ঘুমোতাম।

সকালে আমরা জেগে উঠতাম,
বাতাসে জলপাই গাছের দোলনে,
তোমার দিদিমার ছাগলের ডাকে,
ওঁর হাঁড়িপাতিলের টুনটুন শব্দে,
শীতল বাতাস আর পুবাকাশে পার্সিমন ফলের মতো প্রভাতরবির বেড়-এ।

তোমার পিচ্চিকালে আমরা তোমায় সেখানে নিয়ে গিয়েছিলাম।
সেবার ভ্রমণকালীন তোমার মায়ের স্মৃতি আমার স্পষ্ট  মনে আছে।
ও তোমায় দেখাচ্ছিল, মাঠে বুনোফুলের মাঝে চ’ড়ে বেড়ানো গরুর পাল।

ইস! তুমি যদি তখন অতোটা ছোট না হতে তাহলে ভুলতে না সে-খামারবাড়ির কথা,
তার পাথরের দেওয়ালের ঝুলের কথা,
সেই খাতের কথা যেখানে তোমার কাকারা আর আমি
হাজারো বাঁধ তৈরি করেছিলাম আমাদের শৈশবে।
ইস! তোমারও যদি হোমসের কথা মনে থাকতো আমার মতো, মারওয়ান!

এই কোলাহলমুখর প্রাচীন নগরীতে,
আমাদের মুসলিমদের জন্য একটি মসজিদ ছিল,
একটি গীর্জা ছিল আমাদের খ্রিস্টান প্রতিবেশীদের জন্য,
আর একটি বড় বাজার ছিল আমাদের সবার জন্য,
যেখানে সবাই আড্ডায় লিপ্ত হতো, সোনার হার, টাটকা সামগ্রী ও কনের পোশাক নিয়ে দর কষাকষি করতো।

ইস! তোমার যদি মনে থাকতো সেইসব জনাকীর্ণ গলির কাবাব ভাজার গন্ধ
আর ঘড়ির টাউয়ারের চত্তরে তোমার মায়ের সাথে সান্ধ্য-ভ্রমণের কথা!

কিন্ত সেই জীবন, সেই সময় এখন এমনকী আমার কাছেও স্বপ্ন মনে হয়। মনে হয়, দীর্ঘ-দ্রবিভূত গুজব।

প্রথমে শুরু হয় প্রতিবাদ।
তারপর অবরোধ।
আকাশ হতে বোমাবর্ষণ।
অনাহার।
মৃত্যু।

এই সবই তুমি জানো।

তুমি জানো, নদীতেও বোমা পোঁতা হতে পারে।
তুমি জেনেছ, কালো রক্তের খবর উজ্জ্বল রক্তের চেয়ে উত্তম।

তুমি জেনেছ, মা-বোন ও সহপাঠীদের লাশ পাওয়া যেতে পারে কংক্রিট ইট ও কড়িকাঠের ফাঁকে,
আলোর ক্ষুদ্র বিন্দুও আঁধারের মাঝে জ্বলে।

আজ রাতে তোমার মা আছে এখানে, মারওয়ান,
আমাদের সাথে, এই চাঁদনীভরা সাগর সৈকতে,
ক্রন্দনরত শিশুদের সাথে আর আমাদের অজানা ভাষায় উৎকণ্ঠিত মহিলাদের সাথে।
আফগানি, সোমালি, ইরাকি, ইরিট্রেন আর সিরিয়ান।
এখানে আমরা সবাই সর্যোদয়ের ভয়ে শঙ্কিত,
আমরা সবাই আবাসের খোঁজে।

বলা হচ্ছে, আমরা নাকি অনাহূত, অবাঞ্ছিত, আমরা যেন আমাদের দুর্ভাগ্য নিয়ে অন্য কোথাও চলে যাই।
কিন্তু আমি স্রোতের গর্জনের মাঝে তোমার মায়ের কণ্ঠ শুনতে পাই।
ও আমার কানেকানে বলছে,
“ওরা আমার বাছাকে যে দেখেনি! যদি দেখতো তাহলে আমি নিশ্চিত ওরা আরো মানবিক হতো।”

আমি তোমার মুখপানে তাকাই, এই
তিন-চতুর্থাংশ চাঁদনীতে,
আমার বাছা, তোমার চোখের পাপড়িরা যেন অনির্বচনীয় শিল্প রচনা করে ঘুমোচ্ছে।

আমি তোমায় বললাম,
“আমার হাত ধরো।
খারাপ কিছুই ঘটবে না।”

শুধু এই ক’টা শব্দই।
এক পিতার চালাকি।
যা খুন করে তোমার পিতাকে, খুন করে তার প্রতি তোমার বিশ্বাস।
কারণ আজ রাতে আমি কেবলই ভাবতে পারছি,
এই সাগর কতোটা গভীর,
কতোটা বিস্তীর্ণ, কতোটা নির্বিকার।
এর কাছ থেকে তোমায় রক্ষা করতে আমি কতোটা অসহায়।

আমি কেবল পারি প্রার্থনা করতে।

বিধাতার কাছে প্রার্থনা করি,
সত্যের হাল ধরো,
আমরা ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র,
উত্তাল জলধি আমাদের জলে ফেলছে, তুলছে আবার গিলে ফেলছে অনায়াসে।

তুমি অমূল্য, মারওয়ান।
সবকিছুর চেয়ে অমূল্য।

আমার প্রার্থনা, সাগর তা জানে।
সাগর জানে, আমার প্রার্থনা।

 

সাম্প্রতিক পোষ্টসমূহ