Banner
ধুলায় আমাদের খেলাধুলা — তামান্না ঝুমু

লিখেছেনঃ তামান্না ঝুমু, আপডেটঃ June 8, 2022, 12:00 AM, Hits: 536



এইখানে একটা বটগাছ ছিল; আমাদের প্রাইমারি স্কুলের পুকুরের উত্তর-পশ্চিম কোণায়। গ্রীষ্মের খাঁ-খাঁ রোদে আমরা সেই গাছের ছায়ার নিচে ব'সে খেলা করতাম। গাছ থেকে ঝ'রে-ঝ'রে পড়ত লাল-লাল পাকা বটফল, ঝ'রে পড়ত গাছের বৃদ্ধ হলুদ পাতারা। আমরা সেসব বটপাতা আর ফল দিয়ে রান্নাবাড়ি খেলতাম। গাছের ডালে-ডালে পাখিদের বাসা ছিল। সে-গাছের বাসিন্দা পাখিরা মনের সুখে বটফল খেতো আর গান গাইতো মিষ্টি সুরে। পাখিদের গান শুনতে-শুনতে আমরা কৃত্রিম রান্না করা বটফলভোজনে মেতে উঠতাম। আর বটপাতাদের মৃদু বাতাস গায়ে মাখতে-মাখতে নেমে পড়তাম পুকুরের হাঁটুজলে, মাছেদের সঙ্গে খুনসুটিতে। সেই বটগাছটি এখনো আছে কি? আছে কি সেই পুকুরটি? সেখানে আজকের শিশুকিশোরেরা আমাদের মতো খেলা করে কি?

এইখানে একটা তালগাছ ছিল; আমাদের প্রাইমারি স্কুলের মাঠের দক্ষিণ-পূর্ব কোণায়, কারো ক্ষেতের পাড়ে। দুপুরে টিফিন বিরতিতে আমরা বাড়িতে ভাত খেতে না গিয়ে এখানে বৌচি, গোল্লাছুট, লুকোচুরি ইত্যাদি খেলায় মত্ত হয়ে পড়তাম। বৌচি খেলাটাই বেশি খেলা হতো। নিরপেক্ষভাবে দল ভাগ করার জন্য আমরা নাম বাটতাম। দুইজন দলপ্রধান নির্বাচন করা হতো। আর বাকিরা সবাই দুইজন দুইজন ক'রে নিজেদের মধ্যে গোপনে দুইজনের দুটি নাম ঠিক করতো; যেমন: একজনের নাম গোলাপফুল, আরেকজনের নাম বেলিফুল। তারপর দলপ্রধানদের কাছে এসে নিজেদের নামের প্রস্তাব করতে হতো এভাবে:

ডাক ডাক ডাক বেলি কিংবা ডাক ডাক ডাক কুসচু ডাক। দলপ্রধানদ্বয় সে-প্রস্তাব শুনে একসঙ্গে সুর মিলিয়ে বলতো-- আসো, আমরা খেলি কিংবা আংকু মারি তুংকু ডাক। তারপর  তাদের জিজ্ঞেস করা হতো, গোলাপফুল নেবে, নাকি বেলিফুল নেবে? কেউ নিতো গোলাপফুল আর কেউ- বা বেলিফুল। এভাবে নাম-বাটা শেষে খেলা শুরু হতো

তালগাছের গোড়াকেই আমরা বৌয়ের বাড়ি বানাতাম। তার থেকে একটু দূরে বৌকে দাঁড় করানো হতো। বৌয়ের পক্ষের খেলোয়াড়দেরকে দম আটকিয়ে বোল দিতে-দিতে প্রতিপক্ষের খেলোয়াড়দের দৌড়িয়ে ছুঁয়ে দেবার আপ্রাণ চেষ্টা করতে হয়। আর এ-সময় বৌয়ের চেষ্টা থাকে, প্রতিপক্ষকে ফাঁকি দিয়ে এক দৌড়ে বাড়িতে পৌঁছে যাবার। যাবার সময় প্রতিপক্ষের কেউ এসে বৌকে ছুঁয়ে দিতে পারলে বৌপক্ষের পুরো দলকে প্রতিপক্ষের ভূমিকায় গিয়ে খেলতে হয়। বোল দেবার কালে দম ফুরিয়ে যাবার সময় হয়ে এলে দৌড়ে এসে বৌ কিংবা বৌয়ের বাড়িতে এসে আশ্রয় নিয়ে হয় বোলদাতাকে। নতুবা প্রতিপক্ষের কেউ এসে দম ফুরিয়ে যাওয়া বৌ-পক্ষের বোলদাতাকে ছুঁয়ে দিতে পারলে বৌপক্ষরা তাদের খেলার দান হারায়। তখন ওদেরকে হতে হয় প্রতিপক্ষ। দম আটকিয়ে প্রতিপক্ষকে ধাওয়া করার অনেকগুলি সুন্দর সুন্দর বোল ছিল। তার অনেকগুলিই ভুলে গেছি। দু-একটা আবছা আবছা মনে আছে এখনো:

- চি কুত কুত আলমারি, রাস্তা বান্ধি সরকারি।
সরকারি সরকারি সরকারি...

- চিয়ার ভাই চিচি খেলা খাই
চিয়ার গরমে ঘাম দিয়া যাই।
ঘাম দিয়া যাই, ঘাম দিয়া যাই, ঘাম দিয়া যাই...

- এদেনা কুকুর বেদেনা-দারি
চলছে কুকুর মহিলা-দারি মহিলা-দারি মহিলা-দারি...

বোল শুরু করার আগমুহূর্তে বলতে হতো, বিরিশ। আর খেলার মাঝখানে কোনো অনিচ্ছাকৃত ত্রুটি হয়ে গেলে বলতে হতো, ত্থুক্ক।

ধান তোলার মৌসুমে আমাদের লুকোচুরি খেলার হিড়িক প'ড়ে যেতো। উঠোনে স্তূপিকৃত ধান ও খড়ের ঢিবির পেছনেই আমরা সাধারণত লুকোতাম। লুকোতাম খড়ের স্তূপের ভেতরেও।

কাঠবিড়ালির মতো গাছের ডালে-ডালে চ'ড়ে আমরা খেলতাম ফুলচিউডি। একজন পুলিশ হতো। সে থাকতো গাছের নিচে। আর বাকিরা থাকতো গাছের ডালে। পুলিশ গাছের নিচে দাঁড়িয়ে বাকিদের উদ্দেশ্যে বলতো:

ফুলচিউডি ভাইরে, গাছে উঠেছিস কিয়েল্লাই (কেন)?
বাকিরা গাছের উপর থেক জবাব দিত:
- বাঘের ডরে।
- বাঘে কী করে?
- মাকে ধরে।
মায়ের নাম কী নাম?
- ফুলচিউডি।
- একলাফে তোরে ধরি।

এ-ব'লেই একলাফে পুলিশ গাছে উঠে সর্বপ্রথম যাকে ছুঁয়ে দিতে পারতো, সে-ই হয়ে যেতো পুলিশ। তাকে গাছ থেকে মাটিতে নেমে এসে পুলিশের ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে হতো।

আম আর তেঁতুলের দিনে, চড়তে সহজ এমন আম আর তেঁতুলগাছে আমরা খেলতাম ফুলচিউডি খেলা। খেলতে-খেলতে গাছের সমস্ত কাঁচাআম ও কাঁচাতেঁতুল আমরা লবণ ছাড়াই চিবায়ে খেয়ে সাবাড় ক'রে দিতাম। এমন মর্মান্তিক টক খাওয়াতে আমি খুবই অদক্ষ ছিলাম। কিন্তু নিজের অদক্ষতা সঙ্গীদের কাছে প্রকাশ হয়ে পড়লে মান-সম্মান থাকবে না, তাই আমিও আমার সুদক্ষ টকখেকো সঙ্গীদের সামনে টক খেতে পারাব ভান করতাম।

খেজুরের দিনে পাকাখেজুরের বীজ সংগ্রহ ক'রে শুকিয়ে রাখতো বাড়ি বৌ-ঝিয়েরা। খেজুরের শুকনো বীজ দিয়ে গুটি বানিয়ে ওরা খেলতো তীত। বিকেল বেলায় উঠোনে অজস্র খেজুরের বীজ মেলে দিয়ে শুরু হতো তীত খেলা। মেয়েদের সঙ্গে কখনো-কখনো ছেলেরাও অংশ নিতো এই খেলায়।

কাঁচভাঙা বা মাটির পাত্রভাঙাকে সন্দ্বীপে বলা হয় স্যাঁড়া। এই স্যাঁড়াও ছিল না ফেলনা। বরং ছিল তা বিশেষ খেলনা। এই স্যাঁড়া দিয়ে খেলা হতো স্যাঁড়া খেলা। ছেলেরাই সাধারণত খেলতো এ-খেলা। ছেঁড়া কাপড় দিয়ে আমরা বানাতাম কাপড়ের পুতুল আর পুতুলদের জামা। আমরা পুতুলের বিয়ে দিতাম। সে-বিয়েতে থাকতো কৃত্রিম ভোজোৎসব।

উঠোনে ছক কেটে আমরা খেলতাম কুতকুত খেলা। কুতকুত খেলতে ব্যবহার করতাম মাটির পাত্র ভাঙা স্যাঁড়া। জীবনের ধন কিছুই আমরা ফেলি নি।

ফসল উঠে যাবার পরে খালি জমিতে ছেলেরা খেলতো ডাং-গুলি। ওরা আকাশে ওড়াতো ঘুড়ি। আমরা মেয়েরা সাধারণত ঘুড়ি ওড়াতাম না। আমরা দেখতাম, আকাশে পাখির মতন উড়ছে রঙ-বেরঙের কাগজের ঘুড়ি।

ইট কিংবা পাথরের ছোট-ছোট টুকরো খুঁজে নিয়ে আমরা এক বিশেষ ধরনের গুটি বানিয়ে খেলতাম-- ফুলফুল। এই খেলারও খুব সুন্দর বোল ছিল:

- ফুল ফুল ফুলটি। এক-এ দৌলটি, তেউলটি। জামোনা জামোনা জামোনাটি, এক-এ জোড় জামোনাটি...

এই খেলায় একেকটা গুটি শূন্যে ছুঁড়ে দিয়ে মাটি থেকে বাকি গুটিগুলি তুলে তুলে নিতে হয়, শূন্যের গুটিটি মাটিতে প'ড়ে যাবার আগে আগে।

প্রতিদিন পুকুরে গোসলের সময়েও ছিল নানারকম জলখেলা। পুকুরের পাড় হ'তে জলে লাফায়ে পড়ার খেলা। সাঁতরায়ে এপার-ওপার করার খেলা। সাঁতরে একে অপরকে ছুঁয়ে দেবার খেলা। ডুব দিয়ে জলের নিচে দম বন্ধ ক'রে কে কত বেশিক্ষণ থাকতে পারে, তার খেলা। পুকুরের পাড় হ'তে জলে স্লাইড বানায়ে হড়কায়ে পড়ার খেলা।

সকালে ঘুম থেকে জেগে আমরা নগ্নপায়ে মাটির মেঝেতে পা দিতাম। সারাদিন আমরা নগ্নপায়েই থাকতাম। এমন কি, স্কুলেও যেতাম নগ্নপায়েই। কালেভদ্রে স্কুলের কোনো অনুষ্ঠান উপলক্ষ্যে আমরা স্কুলে জুতা প'রে যেতাম। আমাদের জুতাগুলি ছিল অতি আদিকালের, ছেঁড়া, পায়ের মাপের চেয়ে বড় কিংবা ছোট; কখনো-বা দুই-পাটি ভিন্ন দুই জোড়ার। তাই স্কুলের অনুষ্ঠানে জুতা প'রে যাওয়া আমরা প্রায় প্রত্যেকেই আমাদের বিচিত্র ধরনের জুতা-পরা পা-দুটি পৃথিবীর কাছ থেকে লুকোতে ব্যস্ত থাকতাম। জনচক্ষু হ'তে জুতা লুকোনোর সবচেয়ে জনপ্রিয় ও ফলপ্রসূ পন্থা ছিল, টুলে বসা অবস্থায় নিজের পা-দুটি সামনের দিকে বের ক'রে না রেখে পেছনের দিকে লুকিয়ে রাখা।

সন্ধ্যায় আমরা পুকুর হ'তে পা ধুয়ে চপ্পল প'রে আসতাম। পা ধুতে যাওয়াটাও ছিল একটা ছোটখাটো উৎসবের মতো। একজন হাতে চপ্পল নিয়ে উঠোনে বের হয়ে সবার উদ্দেশ্যে হাঁক দিতাম, ভোইর ধুইতি যাইবি কে কে? মানে, পা ধুতে যাবি কে কে? আমরা অনেকসময় কাঠবাদাম-পাতা দিয়ে চপ্পল বানাতাম নারিকেলপাতা দিয়ে বেঁধে।

আমাদের সময়ে এ্যামিউজমেন্ট পার্ক ছিল না, ছিল না এমন চটকদার সব রাইড। আমরা গাছের ডালে দড়ি বেঁধে তার মধ্যে নারিকেল বা তালের গোদা আসন হিসেবে দিয়ে বানাতাম দোলনা। কখনো সুপারিপাতার খোলে একজন বসতাম, আরেকজন পাতার অগ্রভাগ ধ'রে টানতাম। এভাবে পালাক্রমে আমরা হতাম সুপারিখোল বাহনের যাত্রী ও চালক। ধানের দিনের বাড়িতে ধান আনা হতো গরুর গাড়িতে বোঝাই ক'রে। ধান নামিয়ে দিয়ে গরুর গাড়ি শূন্য ফিরে যাবার সময় আমরা দল বেঁধে একলাফে সেই গাড়িতে উঠে যেতাম। চ'লে যেতাম অনেক দূর। আমাদের গ্রামের কোনো রিক্সাচালক আমাদের বাড়িতে যাত্রী নামিয়ে দিয়ে ফিরে যাবার সময় আমরা অনেকজন রিক্সার চতুর্দিকে উঠে পড়তাম। বায়না ধরতাম, কাকু, আমাদেরকে গ্রাম ঘুরায়ে আনো। কাকুরা আমাদের নিরাশ করতো না কখনো।

হাডুডু ও ব্যাডমিন্টন সাধারণত ছেলেদের খেলা। কিন্তু আমার কাকিরা শহর থেকে বেড়াতে এলে প্রতিবেশীনীদের সঙ্গে এসব খেলা খেলতো আমাদের উঠোনে। আমার দাদু তার পুত্রবধূদের খেলা দেখতে-দেখতে মুখে মিষ্টি হাসি নিয়ে একপাশ দিয়ে হেঁটে পার হয়ে যেতো।

আজকের শিশু-কিশোরেরা আইপ্যাড, স্মার্ট ফোন ইত্যাকার জিনিসে খেলে দিনমান। আমাদের সময়ে এসব ছিল না। এমন কি, আমাদের ছিল না কোনো বাজার থেকে কেনা খেলনাও। আমরা আমাদের চারিপাশের ধুলামাটি, ছেঁড়া কাপড়, ফলের বীজ, লতাপাতা ইত্যাদি দিয়ে নিজেদের খেলনা বানিয়ে নিয়ে খেলেছি। জানি না, আজকের গ্রামের শিশু-কিশোরদেরও আর মাটি-ধুলা, ফসলের মাঠ, গাছের ডাল ইত্যাদির সঙ্গে সম্পর্ক আছে কি না।

 

সাম্প্রতিক পোষ্টসমূহ