Banner
পথের গল্প : ২ — তামান্না ঝুমু

লিখেছেনঃ তামান্না ঝুমু, আপডেটঃ October 31, 2022, 12:00 AM, Hits: 393

 

কিছু প্রয়োজনীয় কেনাকাটা ছিল। তাই একটি সওদা কেন্দ্রে যাবার জন্য একদিন পাতাল ট্রেনে চেপে রওনা হলাম। আমার স্টেশনটিতে ট্রেন থামলে আমি নামলাম। স্টেশনটি বিশাল ও বেশ ব্যস্ত। তখন অনেক যাত্রীর ভীড়। গায়ে-গায়ে ধাক্কা লেগে যাবে, এমন অবস্থা। আমি নেমে, ভীড়ের ফাঁকে-ফাঁকে সিঁড়ির দিকে এগুতে যাচ্ছিলাম, পাতাল স্টেশন থেকে বের হয়ে যাবার জন্য। হঠাৎ আমার চোখ আটকে গেল একজন যুবা-পুরুষের আপাদমস্তকে গিয়ে। বয়েস তিরিশের কিছু বেশি হবে। চোখে ভারি কাঁচের চশমা, এক হাতে সাদা ছড়ি। অন্য হাতটি দিয়ে সাধ্যমতো এদিক-ওদিক হাতড়ে, রাস্তা পরিষ্কার আছে কিনা নিশ্চিত হয়ে, এক-একটি কদম খুব সাবধানে সামনের দিকে ফেলে-ফেলে সিঁড়ির দিকে এগিয়ে যাবার চেষ্টা করছে। খুব সম্ভব, আমার পাশের বগি থেকেই বের হয়েছে সে। আমি ওর দিকে এগিয়ে গেলাম। জিজ্ঞেস করলাম, আমি কি তোমাকে একটু সহায়তা করতে পারি অনুগ্রহপূর্বক? ও খুব বিনয়ের সঙ্গে বললো, তোমাকে ধন্যবাদ, বন্ধু! সহায়তা লাগবে না। আমি পেরে যাবো।

আমি বললাম, কোনো সমস্যা নেই, তুমি কি স্টেশন থেকে বের হবে, নাকি অন্য কোনো ট্রেন ধরবে, আমাকে বলতে পারো। আমি তোমাকে কিছুদূর এগিয়ে দিতে পারবো। ও বললো, ওকে আরেকটি ট্রেন ধরতে হবে। সে-ট্রেনটি আমাদের ট্রেন থেকে কিছুটা দূরে। কয়েকটি সিঁড়ি ওঠা-নামা ক’রে তবে সেই ট্রেনটির প্লাটফর্মে যেতে হয়। লিফট্‌ও আছে। তবে তা আরো ঝামেলার, এবং এখানকার পাতাল ট্রেন স্টেশনগুলির লিফট্‌গুলি খুব পরিচ্ছন্ন মনে হয় না আমার। তাই আমরা সিঁড়ির পথই ধরলাম। আমি ওর একটি হাত ধ’রে পরবর্তী ট্রেনটির দিকে নিয়ে গেলাম। ট্রেনের জন্য আমাদেরকে কিছুক্ষণ অপেক্ষা করতে হয়েছিল। ততক্ষণে আমাদের কিছু কথোপকথন হয়।

- তোমার নাম কী?

আমি আমার নাম বললাম। তোমার নাম কী? জিজ্ঞেস করলাম।

    নয়েল (ছদ্মনাম), বললো ও।
    এই শহরে কতদিন ধরে আছ?
    বছর পাঁচেক।
    এর আগে কোথায় ছিলে?
    এর আগে বোস্টনে ছিলাম। সেখানে সঙ্গীত নিয়ে পড়ালেখা করেছি। একজন যন্ত্রশিল্পী আমি। গীটার ও মাউথ অর্গান বাজাই। পড়ালেখার পাট চুকিয়ে এই শহরে বাস করতে এসেছি। বোস্টনের আগে ইতালির একটি ছোট্ট শহরে ছিলাম। সেখানেই আমার জন্ম ও বেড়ে ওঠা।
    বাঃ! দারুণ তো! ইতালি তো খুব সুন্দর দেশ।  আর ফিরে যাবে না?
    না। ইতালির যে-শহরটিতে আমি থাকতাম, তাতে গণপরিবহনের তেমন সুবিধা নেই। আমি তো গাড়ি চালাতে পারি না। তাই সবখানে ট্যাক্সিতে যেতে হতো। যা আমার সাধ্যের বাইরে। তারচেয়ে এই শহরই আমার চলাফেরার জন্য সুবিধাজনক। এখানে শহরের ভেতরে যেকোথাও আমি গণপরিবহনে চেপে বা পায়ে হেঁটে চলে যেতে পারি। তাছাড়া আমি সঙ্গীতের মানুষ, আমার কাজের সুবিধাও এখানে ইতালির চেয়ে বেশি। গীটার ও মাউথ অর্গান বাজাতে আমাকে একেকদিন একেক জায়গায় যেতে হয়। এটাই আমার কাজ, আমার জীবিকা, আমার ভালোবাসা। গণপরিবহন নিয়ে বা হেঁটে আমি সব জায়গায় নিজেই চলে যাই।

ও জিজ্ঞেস করলো, আমি কোথায় থাকি। আমি আমার রাস্তার নাম্বার বলতে ও বললো, আরে, তোমার ঠিক দুই রাস্তা পরেই আমি থাকি। আমরা তো দেখছি, নিকট-প্রতিবেশী! বললো, ও একাই থাকে বাসায়। ওকে দেখাশোনা করার কেউ আছে কিনা জিজ্ঞেস করলে বললো, না। বললো, ছোটবেলায় ওর মা মারা গেলে বাবা আবার বিয়ে করে। বাবা সৎ-মাকে নিয়ে বোস্টনে থাকে। কিন্তু ওর সঙ্গে তেমন যোগাযোগ নেই। ততক্ষণে ওর ট্রেন চলে এসেছে। আমি ওকে ট্রেন তুলে দিলাম।

নয়েল বললো, চলতে পথে হয়ত আবারো আমাদের দেখা হয়ে যাবে কোনোদিন। আমরা পরস্পর বিদায় নিলাম। ওর ট্রেন ছেড়ে দিল। মুহূর্তেই ঝিকঝিক শব্দে ওর ট্রেনটি পাতালের অন্ধকারে অদৃশ্য হয়ে গেলো। আমি পাতাল থেকে ওপরে উঠে এলাম, আমার কেনাকাটা সারতে।

সেদিন সারাটি ক্ষণ এবং তার পরের কয়েক দিন আমার কেবল মনে হলো নয়েলের কথা। ও চোখে দেখতে পায় না। মা মারা গেছে ছোটবেলায়। বাবা তার মাতৃহীন ও দৃষ্টিহীন ছেলেটির তেমন খোঁজখবর নেয় না। নয়েল একা থাকে। কীভাবে ও রান্না করে? কীভাবে ও পাতাল ট্রেনের স্টেশন চেনে? ঠিক কোন ট্রেনটি সে ধরবে এবং তা কোনদিকে, কোনটি ইত্যাদি ও কীভাবে বোঝে? এরকম অজস্র প্রশ্ন আমার মনে এলো। এবং আমি নিজের মনে তাদের কোনোই সমাধান পেলাম না। ও চাইলেই নানান রকমের সরকারি সুযোগ-সুবিধা পেতে পারে, যা ও দরকার, এবং যাতে ওর ন্যায্য অধিকারও আছে। যেমন, বাসা ভাড়াসহ কিছুটা মাসিক খরচের টাকা, ওকে দেখাশোনা করার জন্য লোক। কিন্তু নয়েল এসবের কিছুই নেয় না। ও নিজের জীবিকা নিজেই পরিশ্রম করে উপার্জন করে। নিজের যত্ন নিজেই নেয়, রাস্তাঘাটেও একাই চলাফেরা করে। এতসব  কীভাবে করে?

তারপর কয়েকমাস কেটে গেল। একদিন আমি ফুটপাত দিয়ে হাঁটছি। দেখি, আমার বিপরীত দিক থেকে একজন যুবা এদিকে হেঁটে আসছে। তার হাতে সাদা ছড়ি। কাছাকাছি হতেই আমি তাকে চিনতে পারি। এ তো নয়েল! আমি ওর কাছে গেলাম। জিজ্ঞেস করলাম, কেমন আছ, নয়েল? ও আমাকে চোখে না দেখলেও শুধু গলা শুনেই চিনে ফেললো। আরে, তামান্না! কেমন আছ তুমি? কিছুক্ষণ কথা হলো আমাদের। বললো, আসছে শনিবারে এক জায়গায় ওর অনুষ্ঠান আছে। আমি গেলে খুব খুশি হবে। আমি উদ্দীপিত হয়ে বললাম, তোমার অনুষ্ঠানে আমি অতি অবশ্যই যাবো। আমরা আমাদের ফোন নাম্বার বদলা-বদলি করলাম। অনুষ্ঠানের দিন এলো। নয়েল আমাকে টেক্সট মেসেজ দিয়ে মনে করিয়ে দিল। আমি সময়মত যথা-স্থানে উপস্থিত হলাম। নয়েল ইতোমধ্যে সেখানে উপস্থিত ছিল। ও আমাকে স্বাগত জানালো। এক জায়গায় বসালো। অনুষ্ঠান শুরু হতে তখনো কিছুটা দেরি আছে। আমরা কিছুক্ষণ টুকটাক কথাবার্তা বললাম। ওকে জিজ্ঞেস করলাম, আচ্ছা, নয়েল, তুমি টাইপ করো কীভাবে? ও আমাকে ওর ফোন বের করে দেখালো। ওর ফোনটি আইফোন। ফোনের  এপ্লিকেশনগুলোতে এলোমেলো হাত বোলালে যেখানেই আঙুলের ছোঁয়া লাগে, তার নাম সঙ্গে সঙ্গে বলে ওঠে ফোন। যেমন : ক্লক, ক্যালেন্ডার, ফটোস, ক্যামেরা, মেইল ইত্যাদি। ওর যেখানে যাওয়া দরকার  সেখানে চাপ দিলে সেই এপ্লিকেশনটি খুলে যায়।। টাইপ করার জন্য আঙুল বোলাতে থাকলে আঙুলের ছোঁয়া যেখানে  লাগে সেই অক্ষরটি উচ্চারণ ক’রে ফোন বলে দেয়। ওর যেখানে দরকার সেখানে চাপ দিলে সেই অক্ষরটি লেখা হয়ে যায় এবং সম্ভাব্য পরবর্তী কিছু অক্ষর এবং  কিছু শব্দ ওকে স্মরণ করিয়ে দেয়। ও ওর দরকারি অক্ষর এবং শব্দে চাপ দেয়। এভাবে একেকটি অক্ষর শব্দ বাক্য লিখে নয়েল। নয়েল চোখে দেখতে পায় না। তবুও ওর লেখা এবং তাতে বিরামচিহ্নের ব্যবহার একদম নির্ভুল। আমি মুগ্ধ হয়ে গেলাম! কী দারুণ ওর মেধা! আর কী সুন্দর প্রযুক্তি! প্রযুক্তি কিছুটা সহজ করে দিয়েছে ওর জীবন।

নয়েল আমাকে জিজ্ঞেস করলো, তোমার জন্মদিন কখন? সেদিন থেকে সপ্তা-দুয়েক পরেই আমার জন্মদিন ছিল। আমি বললাম আমার জন্মদিনের তারিখ। ও বললো, তোমার জন্মদিনের দিন আমি তোমাকে জন্মদিনের শুভেচ্ছা জানাবো।

    আশ্চর্য! তোমার কি মনে থাকবে আমার জন্মের তারিখ?
    আমি মনে রাখার চেষ্টা করবো।
    এতো কষ্ট করে মনে রাখার দরকার কী? তুমি আমাকে এখনই অগ্রীম শুভেচ্ছা জানিয়ে দিতে পারো। কোনো সমস্যা নেই।
    না, আমি যেদিনের শুভেচ্ছা সেদিনই জানাবো।
    আচ্ছা! তবে তা-ই সই!

ওর অনুষ্ঠান শুরু হল। ও বাজাতে চলে গেলো। ওর মুখে মাউথ অর্গান আর হাতে গীটার। একই সঙ্গে দুটি বাদ্যযন্ত্র চোখে না দেখেই কী চমৎকার বাজায় নয়েল! খুবই আশ্চর্যের ব্যাপার।

সেদিনের অনুষ্ঠান শেষ হলো। তার সপ্তা-দুয়েক পরে পঁচিশে জুন রাত দুটোয়, মানে অফিসিয়ালি ছাব্বিশে জুনে, যেদিন আমার জন্মদিন, আমার ফোনে মেসেজ আসে–শুভ জন্মদিন! তোমার জন্মদিন অনেক আনন্দের হোক! একজন দৃষ্টিহীন মানুষ, যে আমার নিতান্তই স্বল্পপরিচিত, রাত দুটোয় আমাকে জন্মদিনের শুভেচ্ছা লিখে পাঠিয়েছে! এমন অমূল্য, এমন বিশেষ আর কোনো শুভেচ্ছাবার্তা হতে পারে কি? আমি আনন্দে বিস্ময়ে অভিভূত হয়ে যাই।

সাম্প্রতিক পোষ্টসমূহ