Banner
জ্যোৎস্নার মৃত্যু — তামান্না ঝুমু

লিখেছেনঃ তামান্না ঝুমু, আপডেটঃ November 22, 2022, 12:00 AM, Hits: 290

জ্যোৎস্না আমাদের গ্রামের মেয়ে। খুব ছোট বয়সে জ্যোৎস্না ওর বাবাকে হারায়। ওরা দুই বোন, ভানু আর জ্যোৎস্না। দুইবোনের মধ্যে জ্যোৎস্না ছোট। নবযৌবনে জ্যোৎস্নার মা তার স্বামীকে হারান। হতদরিদ্র বিধবা অসহায় মহিলা দুটি শিশুকন্যাকে পক্ষীমাতার মতো বুকে আগলে স্বামীর স্মৃতি ও ভিটে আঁকড়ে থেকে যান, পুনর্বিবাহ না ক’রে। ভিটেবাড়ি বলতে ছোট্ট একটি পাখির বাসার মতো কুটীর; খড়ের ছাউনি, বাঁশের বেড়া, মাটির মেঝে। কিন্তু খুব পরিচ্ছন্ন ঝকঝকে। ঘরের মেঝে ও ঘরের সামনের একচিলতে উঠোনটি সর্বদা নিকোনো। 

দরিদ্র হলেও স্বামীর জীবদ্দশায় জ্যোৎস্নার  মাকে কোনোদিন অন্ন-বস্ত্রের চিন্তা করতে হয় নি। পরিবারের মোটা ভাত ও মোটা কাপড়ের ব্যবস্থা কোনোরকমে জ্যোৎস্নার বাবাই করতেন। কিন্তু বিধবা হবার পর জ্যোৎস্নার মাকে তার নিজের ও দুটি শিশুকন্যার অন্নের যোগানে নামতে হয়। জ্যোৎস্নার  মা মানুষের বাড়ি-বাড়ি ঝিয়ের কাজ করতে শুরু করেন। কিন্তু তাতেও তিনজনের ভাতের ব্যবস্থা ক’রে উঠতে পারেন না তিনি। তখনকার সময়ে গ্রামে মানুষের বাড়িতে ঝিয়ের কাজ করলে মানুষ সাধারণত বেতন দিতো না। শুধু ভাতের বিনিময়ে সারাদিন খাটাতো। কোনো কোনোদিন একটুখানি ভাত বাড়িতে নিতে দিতো, বাচ্চাদের জন্য। আর কালেভদ্রে শতচ্ছিন্ন পুরানো কাপড় দিতো, যা একদিক দিয়ে টান দিলে অন্যদিকে ছিঁড়ে যেতো।

জ্যোৎস্নার মা বাধ্য হয়ে ভানু ও জোৎস্নার বয়েস ছয়-সাত বছরের মতো হলে ওদেরকেও মানুষের বাড়িতে কাজ করতে দিয়ে দেন। ওদের মা-মেয়ে তিনজনের এভাবে মানুষের বাড়ি-বাড়ি ঝিয়ের কাজ ক’রে কাটতে কাটতে একদিন ভানুর বিয়ে হয়ে যায়। বিয়ের কয়েকবছর পার হয়ে যাবার পরেও ভাবুর কোনো সন্তান হয় নি। তবে ভানুর বরটি ভালো মানুষ। দরিদ্র হলেও ওরা সুখেই দিন কাটাচ্ছিল। বেলাল নামে এক প্রতিবেশী ছেলের সঙ্গে জ্যোৎস্নার ভাব হয়। বেলালের সঙ্গেই জ্যোৎস্নার মা তার ছোটকন্যার বিয়ে দেন। জ্যোৎস্নাদের কোনো ভাই ছিল না। বড়বোন ভানু বিয়ের পরে শ্বশুরবাড়ি চলে যায়। ঘরে শুধু জ্যোৎস্নারা মা-মেয়ে দু’জন। জ্যোৎস্নার মা তাই তার এই ছোটমেয়ের জামাইটিকে ঘরজামাই নিয়ে আসেন। বেলাল রোজগার করে আর জ্যোৎস্না সংসার গুছিয়ে রাখে। শিশুবয়সে পিতৃহীন দুটি কন্যাকে সীমাহীন কষ্টে পালন ক’রে বিয়ে দিতে পেরে অনেকদিন পর জ্যোৎস্নার মা এবার একটু স্বস্তির নিশ্বাস ফেলেন, একটু নির্ভার বোধ করেন।

জ্যোৎস্নার একটি কন্যা হয়। পরিবারে খুশির জোয়ার বইতে থাকে। ভানুর কোনো সন্তান হয় নি। বহুদিন পরে এটিই ওদের পরিবারের প্রথম শিশু।  মায়ের প্রথম নাতনি। কয়েকবছর পর জ্যোৎস্নার আরেকটি বাচ্চা হয়। এবারের বাচ্চাটি পুত্র। এবার ওদের পরিবারে খুশির বন্যা বইতে শুরু করে। জ্যোৎস্নারা দুই বোন। ওদের কোনো ভাই নেই। ভানুর কোনো সন্তান হয় নি। জ্যোৎস্নার একটি কন্যা হবার পর এই পুত্রের জন্ম। জ্যোৎস্নার কোলে তাই যেন পুত্র নয়, চাঁদ এসেছে। এই চাঁদের আগমন শুধু একটি সাদামাটা ঘটনা হয়ে তো থাকতে পারে না। একে স্মরণীয় ক’রে রাখা প্রয়োজন, এর উদযাপন প্রয়োজন। এই শিশুটির জন্মের আনন্দে ওরা সবাই উৎসব পালনের সিদ্ধান্ত নেয়। উৎসবের ব্যাপক প্রস্তুতি চলতে থাকে। সকল আত্মীয়-স্বজনকে নিমন্ত্রণ করা হবে, অতিথিদের উৎকৃষ্ট আহার করাতে হবে। শুধু আহার করালেই চলবে না, বিনোদনেরও ব্যবস্থা রাখতে হবে। তাই রাতব্যাপী উঠোনে চলবে নৃত্যগীত। উৎসবের দিন চলে আসে। আত্মীয়-স্বজন, পাড়া-প্রতিবেশী সবাই এসেছে নিমন্ত্রিত হয়ে। খাওয়াদাওয়ার বিপুল আয়োজন। ওরা  ধনী নয়, কিন্তু একমাত্র পুত্রের জন্মোৎসবে তো কার্পণ্য করা যাবে না। মন খুলে অতিথিদের খাওয়াতে হবে। আহারাদি শেষে উঠোনে বসেছে নৃত্যগীতের জলসা। আত্মীয়া ও প্রতিবেশীনীদের যারা গীত জানে, তারা একে-একে ও গলা মিলিয়ে গীত গাইছে। কেউ কেউ সেই গানের তালে নাচছে। দর্শক-শ্রোতাও কম নয়। শিল্পীদেরকে গোল হয়ে ঘিরে দাঁড়িয়ে নাচ ও গীত উপভোগ করছে ওরা। আকাশে জ্যোৎস্না ছিল সেদিনের সেই শরতের রাতে। আকাশ হ’তে ঝরছিল দুধের মতো জ্যোৎস্না। অন্তরীক্ষে শরতের মিষ্টি বাতাস। আর মাটিতে, জ্যোৎস্নাদের উঠোনে গানের সুর, অতিথিদের হাসি-আনন্দের ফোয়ারা, সবার মনে  আনন্দ। একটি নবজাত শিশুকে পৃথিবীতে স্বাগতম জানানোর এর চেয়ে চমৎকার উপায় কি আর হ’তে পারে?

জ্যোৎস্না ওর শিশুপুত্রকে স্তন্যপান করাতে ঘরে ঢোকে। হঠাৎ একটি বিকট চিৎকার আসে ওর ঘর থেকে। সবাই ছুটে যায় ওর ঘরে। জ্যোৎস্না বলে, সাপে কেটেছে আমাকে। সবাই দেখতে পায়, একটি সাপ জ্যোৎস্নার গায়ের কাছ থেকে সরসর করে বেরিয়ে যাচ্ছে। কেউ একজন লাঠির বাড়ি দিয়ে সাপটিকে মেরে ফেলে। জ্যোৎস্নার মাথা ঝিমঝিম করতে শুরু করে। ওর বমি হয়। একটু আগে যেখানে আনন্দধারা বইছিল মুহূর্তেই সেখানে কষ্টের ছায়া নেমে আসে। জ্যোৎস্নার হাত-পায়ে কাপড় ও সুতলি দিয়ে শক্ত করে বেঁধে দেয় কেউ, যাতে বিষ সারাশরীরে ছড়িয়ে পড়তে না পারে। কেউ কেউ ঝাড়ফুক করতে শুরু করে, কেউকেউ তন্ত্রমন্ত্র ও দোয়াদরুদ পড়তে শুরু করে। আর সবাই শুধু একটি কথাই জপতে থাকে, হে আল্লাহ্‌, হে দয়াময়, তুমি জ্যোৎস্নাকে ওর দুটি অবুঝ শিশুর কাছ থেকে কেড়ে নিয়ো না। ওকে দয়া করে সুস্থ করে দাও। ওর প্রাণ ভিক্ষা দাও। জ্যোৎস্নার নবজাত শিশুটি তখন চিৎকার করে কাঁদছে। হয়ত দুধের জন্য। দয়াময়  ওর কান্না শুনতে পেয়েছিলেন কিনা, জানি না।

দশদিকে লোক ছুটে গেল ঊর্ধ্বশ্বাসে। কেউ ডাক্তার আনতে গেল, কেউ ওঝা আনতে গেল, কেউ তন্ত্রকার আনতে গেল। আমাদের গ্রামের একজনের কাছে মোটর সাইকেল ছিল। কয়েকজনে মিলে তার কাছে গিয়ে বললো, কাকা, আপনার  মোটর সাইকেলটা যদি দিতেন, আমরা ওই যে দূরের গ্রামে একজন ভালো ওঝা আছে, তাকে আনতে পারতাম। জ্যোৎস্না তাহলে হয়ত বেঁচে যাবে। মোটর সাইকেলের মালিক একবাক্যে বললেন, না বাপু, আমার মোটর সাইকেলখানা দেওয়া যাবে না। রাত ভোর হয়ে এলো। কবিরাজ ওঝা তন্ত্রকার একাকার হয়ে গেল। কিন্তু কারো কোনো কার্যকলাপে জ্যোৎস্না আর কোনো প্রকারের সাড়া দিচ্ছে না। আমার ছোটফুপা, ডাক্তার গোলাম মোস্তফা এলেন। তিনি পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে বললেন, জ্যোৎস্নার শরীরে আর প্রাণ নেই। সন্দ্বীপে তখন বিদ্যুৎ ছিল না। তাই বিষনাশক ইনজেকশনও ছিল না। বিষনাশক ইনজেকশন ফ্রিজে বিশেষ তাপমাত্রায় রাখতে হয়।  প্রার্থনা, তন্ত্রমন্ত্র, আত্মীয়স্বজনের আহাজারি, দুটি অবুঝ শিশুর কান্না সবকিছুকে পরাস্ত করে দিয়ে জ্যোৎস্নার শরীরটি কখন নিথর হয়ে গেল, কেউ টের পেলো না। 

জ্যোৎস্নার শরীরটি তখন উঠোনে শায়িত। ওর মায়ের শরীরে তখন আর আর্তনাদ করার শক্তি নেই। তবুও ধুলোয় গড়াগড়ি খেয়ে বুক চাপড়ে-চাপড়ে বলছেন, আমার মানিক! আল্লাহ্‌, আমার মানিককে কেড়ে নিয়ো না। কিন্তু আল্লাহ্‌ তার অনুরোধ রাখলেন না। এই দরিদ্র দুখিনী নারী খুব অল্প বয়েসে বিধবা হয়েছিলেন। তারপর ভীষণ কষ্টে দুটি শিশুকন্যাকে পালন করেছিলেন। সুদীর্ঘদিনের অনাহার-অর্ধাহার, দুঃখ আর সংগ্রামের পর একটি অপার আনন্দের জ্যোৎস্নারাতে তিনি তাঁর নিজের জ্যোৎস্নাটিকে হারান। জ্যোৎস্নার নবজাত শিশুটি তখন দুধের জন্য কাঁদছে।

সাম্প্রতিক পোষ্টসমূহ