Banner
পথের গল্প : ৪ — তামান্না ঝুমু

লিখেছেনঃ তামান্না ঝুমু, আপডেটঃ January 13, 2023, 12:00 AM, Hits: 475

 

কয়েকবছর আগে একবার ফ্রান্সে গিয়েছিলাম বেড়াতে। প্যারিস শহরে ছোট্ট একটা বাসা ভাড়া নিয়ে আমরা ছিলাম। বাসার অদূরেই ছিল ট্রেন স্টেশন। একদিন বেড়াতে বের হয়ে ট্রেন স্টেশনে নামতে গিয়ে দেখি, পাশেই ছোট্ট একটি ভ্যান গাড়িতে সুন্দর সুন্দর তাজা ফল বিক্রি করছে খুব অল্প বয়সী দু’টি ছেলে। ওদের মুখশ্রী আমারই মতো শ্যামল। দেহের গড়নও আমাদের বাঙালি ছেলেদের মতো। প্যারিস শহরে পৃথিবীর নানা দেশের লোকের বাস। তাই ওই ছেলে দু’টি দেখতে আমাদের মতো হলেও, বাঙালি কিনা, সে-ব্যাপারে মনে কোনো সিদ্ধান্তে উপনীত হ’তে পারলাম না। আমার মেয়েদেরকে জিজ্ঞেস করলাম, ফল খাবে কিনা। ওরা হ্যাঁ-বাচক উত্তর দিলো। আমরা ফল কিনতে ভ্যানের দিকে এগিয়ে গেলাম। মেয়েদেরকে জিজ্ঞেস করলাম, এখান থেকে কোন কোন ফল তোমরা খেতে চাও? ওরা কয়েকটি ফলের নাম বললো। বাংলায় আমাদের কথোপকথন শুনে বিক্রেতা ছেলে দু’টি আমার মুখের পানে গভীর আনন্দ ও বিস্ময়ে তাকিয়ে বললো, আপু, আপনারা কি বাঙালি? আমি বললাম, হ্যাঁ। এবার ওদের আনন্দ আর যেনো চোখে-মুখে ধরে না। নানা প্রশ্ন আর উচ্ছ্বাস খলবল ছলছল ক’রে ঝ’রে পড়তে শুরু করলো ওদের মুখ হ’তে।

- আপু, আপনারা কি প্যারিসেই থাকেন? নাকি বেড়াতে এসেছেন?

না, আমরা ইউএসএ-তে থাকি। এখানে কয়েকদিনের জন্য বেড়াতে এসেছি। 

- এখানে কোথায় উঠেছেন?

এইতো, এখান থেকে মাত্র দুই মিনিটের হাঁটা দূরত্বে একটা বাসা ভাড়া নিয়েছি। ওখানেই থাকছি।

- আমাদের বাসাও তো এই এলাকাতেই। ছোট্ট একটা বাসায় আমরা দশ-বারোজন গাদাগাদি ক’রে থাকি। নইলে বলতাম, আপু, ভাড়া বাসা ছেড়ে দিয়ে আমাদের বাসায় চ’লে আসুন। আপনাদেরকে আমাদের বাসায় কয়েকটা দিন রাখতে পারলে কী যে আনন্দ হতো! 

আরো কয়েকজনা ক্রেতা এসেছে ততক্ষণে। কোনো কোনো ফলের দাম জিজ্ঞাসা করছে। কিন্তু বিক্রেতাদ্বয় তাদের দিকে মনোযোগ না দিয়ে একনিষ্ঠ মনে আমাদের সঙ্গেই কথা বলে চলেছে। আমি বললাম, আপনাদের ব্যবসায়ের ক্ষতি হয়ে যাচ্ছে। আমরা তাড়াতাড়ি বিদায় হই। ওরা দু’জনেই হাহাকারের সুরে একই সঙ্গে ব’লে উঠলো, না না, আপু, একদিন ব্যবসা একটু কম হ’লে কোনো ক্ষতি নেই। আজ আপনাদেরকে পেয়েছি আমরা। এটা আমাদের বিরাট আনন্দ ও ভাগ্যের ব্যাপার। কী যে খুশি লাগছে আপনাদেরকে পেয়ে, ব’লে বোঝাতে পারবো না। এখানে বাঙালি খুব একটা দেখি না। কারো সঙ্গে নিজের মাতৃভাষায়  কথা বলতে পারি না। এখানকার ভাষাটা এখনো তেমন শিখতে পারি নি তো, তাই এদের সঙ্গে তেমন ভাব-বিনিময় করতে পারি না। কারো সঙ্গে কথা বলবার সময়ও অবশ্য পাই না। ভোরবেলায় ফল বিক্রি করতে বের হয়ে যাই। বাসায় ফিরি মধ্যরাতে। বাসায় ফিরে রান্না খাওয়া গোসল। এরপরে শরীর এতোটা ক্লান্ত থাকে যে বাড়িতে কল করার শক্তিও অনেক সময় থাকে না। তারপরে একজনের ওপরে আরেকজের খড়ের গাদার মতো প’ড়ে ঘুম। ঘুম না পুরতেই ভোরে উঠে ফল নিয়ে দৌড়। এখানে, এই প্যারিস-প্রবাসে, এ-রকমই আমাদের নিত্যদিন নিত্যরাত্রি; একদিনও এর ব্যতিক্রম নেই। সপ্তাহে একদিনও ছুটি করি না। এখানে নিজেদের সব খরচ, তারপর বাড়িতে টাকা পাঠানো। একমাস টাকা পাঠাতে না পারলে বাড়িতে বাবা-মা, ভাই-বোন না খেয়ে থাকবে। ফল বেচতে একেকদিন একেক এলাকায় যাই। আজ বড় সৌভাগ্যক্রমে এখানে এসেছিলাম, তাই তো আপনাদেরকে পেয়ে গেলাম! জিজ্ঞেস করলাম, কতদিন ধ’রে ফরাসি দেশে আছেন? বললো, তা বছর দুয়েক হবে। বাংলাদেশ ছেড়েছি চার বছর আগে। জমি-জিরেত, হালের গরু, লাঙ্গল সব বিক্রি করে দালালের হাতে টাকা দিয়ে অনেক স্বপ্ন আর আশা নিয়ে পাড়ি দিয়েছিলাম বিদেশ। দেশ থেকে সোজা কিন্তু আমরা  ফরাসি দেশে আসি নি। আরো কয়েকটি দেশ পার হয়ে, অবশেষে এসে ভিড়েছি এখানে। কখনো বরফ-শীতল নদী সাঁতরে ওপারের তীরে উঠেছি, ভীষণ ঠাণ্ডায় ঠকঠক ক’রে কাঁপতে কাঁপতে। কখনো দিনের পর দিন দুর্গম পাহাড় জঙ্গল নগ্নপায়ে ডিঙিয়েছি। পা ফেটে রক্ত পড়েছে পথে পথে। পথিমধ্যে আমাদের রসদ ফুরিয়ে গিয়েছিল। বন্য লতাপাতা কাঁচা কচকচিয়ে চিবিয়ে খেয়ে আমরা প্রাণে বেঁচেছি কখনো। আবার কখনো দিনের পর দিন খাদ্যের অভাবে ছিলাম অভুক্ত। লতাপাতাও মেলে নি ক্ষুন্নিবৃত্তির জন্য। আমাদের কয়েকজন সহযাত্রী কষ্ট ও খিদা সহ্য করতে না পেরে মারাও গেছে। এখানে এখনো আমাদের বৈধ কাগজপত্র হয় নি। এখানকার পুলিশ জানে আমাদের কাগজ নেই। কিন্তু কিছু বলে না। আমাদের কাছ থেকে মাঝেমাঝে ফল কিনে খায় ওরা। আমাদের মতো অবৈধ মানুষ এখানে আরো অনেক আছে। পুলিশ তেমন ঝামেলা করে না কারো সঙ্গে। 

আমি স্তব্ধ হয়ে শুনছিলাম ওদের জীবনের সংগ্রামগাথা। কিছু বলবার ভাষা খুঁজে পাচ্ছিলাম না। বাইশ-তেইশ বছর বয়স ওদের। আমাদের দেশে অবস্থাপন্ন পরিবারে এই বয়সের ছেলেমেয়েদের গায়ে সাধারণত ফুলের আঘাতও লাগে না। আর এই দু’টি ছেলে জমিজমা বিক্রি করে বিদেশে পাড়ি জমিয়েছিল নিজেদের ও পরিবারের অন্ন ও সুখের অন্বেষণে, উন্নত সচ্ছল আর নিরাপদ জীবনের আশায়। জীবন আর মৃত্যুর সঙ্গে প্রতি মুহূর্তে যুদ্ধ ক’রে ক’রে ওরা এসে পৌঁছেছে স্বপ্নের প্যারিস শহরে। কিন্তু জীবন-মৃত্যুর যুদ্ধ এখানেও, এখনও হয়নি শেষ। দৈনিক প্রায় আঠারো ঘণ্টা কাজ করে ওরা। সপ্তাহে ওদের কোনো ছুটি নেই। কোনো বিনোদন নেই ওদের জীবনে, নেই কোনো অবসর। জীবনের বড় ভারী বোঝা ওদের ওপর। অনেকের জন্যই এই পৃথিবী বড় নিষ্ঠুর, বড় অন্যায্য জায়গা। কিন্তু এতো পরিশ্রম ও কষ্টের পরেও কী ভীষণ অতিথিপরায়ণ ওরা! আমি শুধু বাংলাভাষী ব’লেই হৃদয় উজার ক’রে বলছে আমাকে ওদের মনের সঞ্চিত যতো জীবনেতিহাস, যতো কথা! একজন বাংলাভাষী পেয়েই ওদের প্রাণের সকল কথা ঝর্ণাধারার মতো মুখরিত হয়ে বইতে শুরু করেছে। শুধু বাংলাভাষী ব’লেই ওরা অপরিচিত আমাকে, আমার কন্যাদেরকে আপ্যায়নের চূড়ান্ত করতে চাইছে। ওরা ওদের ফোন নাম্বার দিয়েছিল আমাকে, আমার নাম্বারও নিয়েছিলো। আমরা ফ্রান্সে থাকাকালীন কয়েকবার ফোনে কথা হয়েছিলো ওদের সঙ্গে। ইউএসএ-তে ফিরে আসবার পরেও কিছুদিন যোগাযোগ ছিল।

ওরা বললো, আপু, আমাদের বাসায় একবেলা আহার করবেন অনুগ্রহ ক’রে। বললাম, ভাই, আপনারা যে এমন আন্তরিকতায় এই বিদেশ বিভূঁইয়ে আমাদেরকে আপনাদের বাসায় থাকার কথা বলেছেন, এতক্ষণ  সম্পূর্ণ অপরিচিত আমাদের সঙ্গে জন্ম-জন্মান্তরের আত্মীয়ের মতো কথা বলেছেন, আপনাদের জীবনের অনেক একান্ত গল্প বলেছেন, এটাই তো অনেক কিছু। কিন্তু ওরা বাংলাদেশের বাঙালি; নাছোড় বান্দা। এবার জোরাজুরি করতে শুরু করলো, তাহলে চলুন দোকানে, আপনাদেরকে একটু খাবার কিনে দিই। আমার কন্যাদের দিকে তাকিয়ে বললো, এইযে, আমাদের ভাগনিদের জন্য একটু খাবার কিনে দিই, আপু। ওদের অনুরোধ আমি রাখতাম, খাবারটা আমি নিতাম। কিন্তু যেখানে এত কষ্টের উপার্জনে ওদেরই চলতে খুব কষ্ট হয়, সেখানে আমাদের জন্য একটা বাড়তি খরচ করতে ওদের কীভাবে দিই? বললাম, ভাই, আপনাদের আন্তরিকতায়, ধ’রে নিন, আমাদের খাওয়া হয়ে গেছে। আমরা কিছু ফল নিলাম। মূল্য দিতে গেলাম। কিন্তু ওরা কিছুতেই মূল্য নেবে না। বলে, আপনাদেরকে তো কিছু খাওয়াতে পারলাম না, আমাদের বাসায়ও নিয়ে রাখতে পারলাম না। এই ফলটুকু অন্তত গ্রহণ করুন, আপু। এটা আমরা আমাদের ভাগনিদের জন্য দিলাম। কিন্তু এমন দরিদ্র দু’টি ছেলের কাছ থেকে আমি বিনামূল্যে কীভাবে ফল নেবো? ওদের প্রাণঢালা ভালোবাসার উপহার আমি গ্রহণ করলাম আমার মনের গভীরে। ফলের মূল্যটা ভ্যানের উপর রেখেই দুই কন্যাকে দুই হাতে নিয়ে দৌড় লাগালাম পাতাল ট্রেনের স্টেশনের দিকে। পেছন থেকে ডাক শুনতে পেলাম, আপু, দাঁড়ান দাঁড়ান! বাবুরা, দাঁড়াও দাঁড়াও! আমরা পেছনে ফিরে তাকালাম না। স্টেশনে ট্রেন তৈরিই ছিল। আমরা উঠতেই ছেড়ে দিলো। ট্রেনের ঝিকঝিক ঝিকঝিক শব্দের সঙ্গে তাল ও ছন্দ মিলিয়ে মনে বাজতে থাকলো ডাকটি, আপু, দাঁড়ান দাঁড়ান! বাবুরা, দাঁড়াও দাঁড়াও!

সাম্প্রতিক পোষ্টসমূহ