Banner
ধরম বেটি -- শামসুন নাহার

লিখেছেনঃ শামসুন নাহার, আপডেটঃ October 5, 2007, 12:00 AM, Hits: 13382

গ্রামের বাড়ী এসেছি। সব কিছু নতুন, অপরিচিত। আত্মীয়তা অথবা  পরিচয়ের সূত্র ধরে অনেকে এসে সম্পর্কটা  ঝালিয়ে নেয়।

একদিন রান্নঘরে কি কাজে যেন ব্যস্ত ছিলাম। একটি বয়স্ক মহিলা দরজায় দাঁড়িয়ে। দু’দিকের চৌকাঠ দু’হাত দিয়ে ধরা।

ওকে কোন দিন দেখি নাই, তাই অবাক হয়ে বললাম, ‘তুমি কে?’

সে একটু গর্বিত ভঙ্গিতে বলল, ‘মুই অবিনাশ কবিরাজের বেটি।’ এ্যাঠেকার নাম করা কবিরাজ। এ্যলা মাইনষের বাড়ীত চায়া খাঁও।’

মনে হোল এটা ছিল তার দুঃখ বা কষ্টের প্রকাশ। হয়ত কিছু দুঃখ  আর হতাশাও  হতে পারে।

এর আগে ওকে কিছু চাইতে বা ভিক্ষা করতে দেখি নাই।

গৌর বর্ণ। যৌবনে সুন্দরীও ছিল বলে মনে হোল।

বাড়ীতে কেউ নাই। তাই তার সম্পর্কে কিছু জানতে ইচ্ছা হোল।

‘কোথায় বাড়ী?’ জিজ্ঞেস করলাম। ও ওদের পাড়ার দিকে আঙ্গুল দেখিয়ে বলল, ‘উত্তি।’    

মোটামুটি পরিচয় জানলাম। একটি ছেলে আর বৌ নিয়ে থাকে। বিধবা। সব চেয়ে ছোট ছেলেকে নিয়ে এখানে থাকে।

অন্য ছেলেগুলি ভারতে চলে গেছে। ছোট ছেলে দেশ ছাড়তে রাজী নয়।

তাই বিধবা ছোটটিকে নিয়ে এ দেশে রয়ে গেছে।

আবার আসতে বলে সেদিন তাকে বিদায় করে দিলাম।

তারপর কিছু দিন তার আর দেখা নাই।

শুনলাম মহিলার পিতা একজন নাম করা কবিরাজ ছিলেন।

এই মেয়েটিই ছিল তাঁর একমাত্র সন্তান। ফর্শা আর সুশ্রী।

অল্প বয়সে যখন গা ভরা গয়না পরে ঘুরে বেড়াত, পিতা ভাবতেন কার হাতে তিনি তাঁর এই কন্যাটিকে সঁপে দিবেন? কে তাঁর কন্যাটিকে মর্যাদায় রাখতে পারবে?

তখন লেখা-পড়ার তত প্রচলন ছিল না। মেয়েদের জন্য তখন সেটা অসম্ভব ব্যাপার ছিল। তায় আবার অজ পাড়া-গ্রাম।

কবিরাজ মশাই চিন্তা করলেন স্বজাতির কোন দরিদ্র ছেলের সঙ্গে মেয়ে বিয়ে দিয়ে তাকে নিজের বিদ্যা দান করবেন।

এতে করে তার বিদ্যাও লোপ পাবে না। সেই ছেলেই পেশাটা বাঁচিয়ে রাখবে। মেয়েও সুখে থাকবে।

খোঁজা-খুঁজি চলতে লাগল। বেশী বয়সে মেয়েটি জন্মেছিল। তার বিয়ের বয়স হয়ে যাচ্ছে। আর কত দিনই বা রাখা যায়?

অনেক খোঁজা-খুঁজির পর একটি ছেলের সন্ধান পাওয়া গেল। স্বজাতির ছেলে। বাবা নাই। কবিরাজ মশাই ছেলেটিকে লেখাপড়া শিখিয়ে মেয়েটিকে পাত্রস্থ করার কথা চিন্তা করতে লাগলেন। ছেলের মা এ প্রস্তাবে রাজী।

অতএব, একদিন শুভড়্গণে বিবাহ হয়ে গেল। কবিরাজ মশাই জামাই পেলেন। ভাবলেন ছেলেটিকে কাছে রেখে তাঁর পেশা সম্পর্কে তালিম দিবেন।

জামাই কিন্তু শ্বশুরের পেশার ধার দিয়েও গেল না। শ্বশুরের যা সম্পত্তি আছে তাই দিয়ে সে সুখে কাল কাটাতে পারবে বলে হয়ত তার মনে হয়েছিল।

কবিরাজ মশায়ের স্বচ্ছল জীবনের জন্য যথেষ্ঠ সম্পদ বা সম্পত্তি ছিল।

সম্পত্তি থাকলেও ঠিকমত ব্যবহার না করলে সে সম্পদ যে কাজে লাগে না এ বোধ হয়ত জামাইয়ের ছিল না। পেশার দিকে জামাইয়ের অনীহা ত আছেই।

কবিরাজ মশায় শেষ পর্যন্ত হতাশা নিয়েই পৃথিবী ত্যাগ করলেন।

সংসারের দায়িত্ব পড়ল জামাইয়ের উপর। অল্প বয়স না হলেও গায়ে হাওয়া লাগিয়ে বেড়ান অভ্যাস।  সংসারে অনভিজ্ঞ।

শ্বশুরের রেখে যাওয়া সম্পত্তি ঠিক মত চালালে অভাব হোত না হয়ত।  সময় বসে থাকে না। সংসার বসে থাকে না। জীবনের টানা পোড়েনে চলতে চলতে একদিন জামাই বাবাজীও গত হলেন। এতদিনে বেশ কয়েক সন্তানের জন্ম হয়েছে। জামাই দূরদৃষ্টিহীন। ছেলেদের জন্য সে আর কি রেখে যেতে পারবে?

এই বিপর্যয়ের মুখে দেশ ভাগ হয়ে গেল। উদভ্রান্ত ছেলেরা দেশ ত্যাগ করে চলে গেল ভারতে।

শুধু ছোট ছেলেটি বলল,“মা, হামরা বিদেশত  না যাইম’। (মা আমরা বিদেশ যাব না) মা-আর ছেলের কষ্টকর জীবন যাত্রা চলল।

তাদের জীবনের ঘটনাগুলি শুনলাম। সে কি আমার কাছে কোন প্রত্যাশা নিয়ে আসে? কে জানে।

আর একদিন যখন ঐ মহিলা আমার সঙ্গে দেখা করতে এল, তখন মনে হোল তার কিছু প্রয়োজন আছে। হয়ত কিছু প্রত্যাশা।

একে একটু আড়ালে ডেকে নেয়ে ওর হাতে কিছু টাকা গুঁজে দিলাম। দুই শত।

সে তখন এমন অভিভূত হোল যে আমাকে প্রণাম করার জন্য মাথা নিচু করতে গেল। আমি সরে এলাম। বাধা দিলাম।

সেদিন তার হয়ত খুব প্রয়োজন ছিল কিছু টাকার, যা সে লজ্জা বশত চাইতে পারে নাই।

সে আবেগ  আপস্নুত গলায় বলল, ‘তোমরা (তুমি) মোর মাও (মা)। মোর ধরম মাও।’

সেদিন থেকে সে আমার ‘ধরম বেটি।’

সেই অভাবগ্রস্ত ভিন্নধর্মীই আমার ধরম বেটি। তাকে নিয়েই আমার গল্প লেখা।

বছরে তাকে আমি দু’খানা ‘ফোতা’ (লুঙ্গি) দিয়ে আমার ধর্মের দায় সারি।

এই দু’খানা ফোতা বা লুঙ্গি দিয়েই তার বছর চলে যায়।

কিন্তু, যা তার দরকার সব সময় তা হোল তার প্রতি একটু মনোযোগ। কোন সেবা নয়, শুশ্রষা নয়, শুধু দুবেলা দু’মুঠো ভাত।

ছেলে দিন মজুর। যা আনে তা দিয়ে কোন মত বাঁচা চলে। সেই বাঁচারই বা উপায় কি?

বৌ সাত কথা বলে যা ছেলে বা আর কাউকে বলা চলে না।

আমি মাঝে মাঝে গ্রামের বাড়ী যাই। সংবাদ পেলেই সে আসে।

জিজ্ঞেস করি, ‘কেমন আছ বেটি?’

সে মাথা নাড়ে। ‘কেমুন আর থাকিম মা? মরণও হয় না! মরণ চাঁও (চাই)। মরো (মরি) কই?’

এক কথায় তার সব কথা হয়ে যায়।

শুনলাম বৌ তাকে খেতে দিতে চায় না। বলে, ‘তোর কি আছে? কয় বিঘা জমি তোর?’ কথা শেষ।

ছেলে বাড়ী এলে খোঁজ নেয়, ‘মা খাইছে?’ বৌ উত্তর দেয়, ‘তোমার সাতে খাইবে এ্যালা (এখন)।’

এভাবে তার জীবন চলছে, চলবে। জীবনের কয়টা দিন আর?

অনেক শক্ত সমর্থ মহিলা বয়স্ক ভাতা পায়। আমার ধরম বেটি পায় না কেন?      

হয়ত ঘুষ দিতে হয়। হয়ত অন্য কারণ থাকতে পারে। কে জানে!



 

অনলাইন প্রকাশ : ৫ অক্টোবর, ২০০৭

সাম্প্রতিক পোষ্টসমূহ