লিখেছেনঃ শামসুজ্জোহা মানিক, আপডেটঃ October 15, 2010, 6:00 PM, Hits: 23667
(নিবন্ধটি লেখকের ইংরাজী নিবন্ধ The Crisis of Bangladesh-এর বঙ্গানুবাদ। ইংরাজী নিবন্ধটি বঙ্গরাষ্ট্রে ৫ জুন ২০০৭ তারিখে প্রকাশিত হয়। লেখাটির গুরুত্ব বিবেচনা করে এটির বাংলা অনুবাদ প্রকাশ করা হল। -বঙ্গরাষ্ট্র)
বাংলাদেশের সঙ্কট নিয়ে অনেক কথা বলা হয়। তবে এখানে বিস্তারিত আলোচনা না করে এমন একটি বিষয়কে এই আলোচনার কেন্দ্রে আনতে চাই যে বিষয়টি এ দেশের মূল ধারার বুদ্ধিজীবীদের আলোচনায় প্রায় সম্পূর্ণরূপে উপেক্ষিত অথবা অস্বীকৃত হয়ে আছে।
সুনির্দিষ্টভাবে বিষয়টিকে উপস্থিত করার জন্য আমি এই বলে আলোচনাটি শুরু করতে চাই যে, বাংলাদেশের সঙ্কটের মূল নিহিত রয়েছে তার জন্ম প্রক্রিয়ার ভিতর। সুতরাং আজকের দিনের সঙ্কটের উৎসমূলে পৌঁছাবার জন্য আমাদেরকে ১৯৭১ সালে ফিরে যেতে হবে, এবং সেখানে ফিরে আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধের সমস্যা ও প্রকৃতিকে বুঝতে হবে।
সমর বিজ্ঞানের একটি কথা, যুদ্ধ হচ্ছে রাজনীতির সম্প্রসারণ। কিন্তু এই বিষয়ে চিন্তা করলে সত্যি বিস্ময়ে হতবাক হতে হয় যে, আমাদের এই বাংলাদেশে এই বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিকোণ থেকে স্বাধীনতা যুদ্ধের পটভূমি ও সমস্যাকে বুঝবার চেষ্টা আদৌ করা হয় নাই অথবা কদাচিৎ হলেও খুব সামান্যই সে চেষ্টা করা হয়েছে। বরং সাধারণভাবে মূলধারার ঐতিহাসিকগণ এমনভাবে ইতিহাসকে উপস্থিত করেন যেন ১৯৭১ সালের আগে স্বাধীনতা এবং সশস্ত্র সংগ্রামের রাজনীতি ছিল না। যেন ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ তারিখ রাতে পাকিস্তানী সেনাবাহিনী আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন স্থায়ত্তশাসন আন্দোলন দমন করার জন্য অথবা ১৯৭০ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের যে বিশাল বিজয় অর্জন হয়েছিল সেই বিজয়ের ফলকে নস্যাৎ করার জন্য আক্রমণ অভিযান শুরু করলে তার প্রতিক্রিয়ায় হঠাৎ করে স্বাধীনতা যুদ্ধ শুরু হয়। যেন স্বাধীনতা যুদ্ধের আগে এ দেশে স্বাধীনতা আন্দোলনের কোন ইতিহাস ছিল না, যেন পূর্ব থেকেই এ দেশে বাঙ্গালী জাতির একটি লোকবাদী বা সেকিউলার রাষ্ট্র গঠনের রাজনীতি ছিল না এবং সেই কারণে সমগ্র জনগণ ছিল কেবলমাত্র স্থায়ত্তশাসন ও নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলনের পক্ষে। এই ধরনের ইতিহাস চর্চার ভিতর রয়েছে সত্য এবং কল্পগল্পের মধ্যকার বিরাট ব্যবধান। এই ব্যধানকে ঢাকবার জন্য স্বাধীনতার ঘোষণার নানান ভাষ্য উদ্ভাবন করা হয়েছে।
সুতরাং ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ তারিখে প্রদত্ত শেখ মুজিবুর রহমানের ভাষণকে স্বাধীনতার ঘোষণা হিসাবে চালানোর জন্য অনেক চেষ্টা হয়েছে। এ ধরনের চেষ্টা যখন হালে পানি পায় নাই তখন তার স্বাধীনতা ঘোষণা নিয়ে আরেক গল্প ফাঁদা হয়েছে। সুতরাং গল্প বানানো হল কীভাবে মুজিব তার ঢাকার বাসভবনে বসে থেকে পাকিস্তান বাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করার বা ধরা দিবার পূর্বে প্রতিরোধ যুদ্ধ শুরু করার গোপন নির্দেশ দিয়েছিলেন, যে যুদ্ধের নির্দেশ সম্পর্কে জাতি কিছুই জানতে পারে নাই। এই ধরনের ধাপ্পাবাজিকে মোকাবিলা করার জন্য আরেক দল ঐতিহাসিকের আবির্ভাব হল। ক্যান্টনমেন্ট থেকে আসা প্রভুদের পৃষ্ঠাপোষকতা প্রাপ্ত এই ঐতিহাসিকগণ তখন পর্যন্ত অচেনা এক মেজরের স্বাধীনতার ঘোষণাকে এমন ভাবে উপস্থিত করলেন যেন ঐ ঘোষণা দ্বারাই স্বাধীনতা যুদ্ধ শুরু হয়েছিল। এই ঐতিহাসিকের দল এই গল্প ফাঁদার সময় এই সহজ সত্যটা ভুলে যান যে, ঐ অখ্যাত মেজর যার নামে ঘোষণাটি দিয়েছিলেন তিনি হলেন শেখ মুজিব যিনি আবার কিনা তার আগেই পাকিস্তানী সেনার কাছে আত্মসমপর্ণ করেছিলেন। এই সমুদয় ঐতিহাসিকগণ যে সত্যটিকে অস্বীকার করেন তা হচ্ছে এই যে ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চের কয়েকদিন পূর্বেই জয়দেবপুরে বাঙ্গালী সৈনিকরা অস্ত্র হাতে তুলে নিয়েছিল। আর সত্য যদি বলতে হয় তা হলে এ কথা বলতে হয় যে ১৯৭১-এর মার্চ মাসের পূর্বেই সিরাজ শিকদারের গোপন সংগঠন কর্তৃক জাতীয় স্বাধীনতার জন্য সশস্ত্র সংগ্রাম শুরু হয়ে গিয়েছিল। যাইহোক, এইক্ষেত্রে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল ১৯৭১-এর ২৫ মার্চের দিন অথবা তার পূর্বে স্বাধীনতা যুদ্ধ শুরু হয়েছিল কোন কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব ছাড়া। এই প্রসঙ্গে এ কথা বলা উচিত হবে যে আওয়ামী লীগের দিক থেকে ১৯৭১-এর ১৭ এপ্রিলের পূর্ব পর্যন্ত স্বাধীনতা যুদ্ধের কোন ঘোষণা বা কর্মসূচী ছিল না। তারা ভারতে প্রবাসী সরকার গঠন করার পর স্বাধীনতা যুদ্ধের এই ঘোষণা দেয়।
এ কথা আমাদের বুঝা দরকার যে, ছয় দফা কর্মসূচীর মত পাকিস্তানের ধারণাগত কাঠামোর মধ্যে আবদ্ধ একটি নিয়মতান্ত্রিক ও নির্বাচনমুখী আন্দোলন কোন ক্রমেই হঠাৎ করে এবং নিজে থেকে বাঙ্গালী জনগণের স্বাধীন ও লোকবাদী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জন্য সশস্ত্র সংগ্রামে পরিণত হতে পারে না। অথচ এ দেশের মূলধারার ঐতিহাসিকরা সাধারণভাবে সর্বদা এই সত্যটিকেই অস্বীকার করে থাকেন। প্রকৃতপক্ষে পূর্ব পাকিস্তানের স্বায়ত্তশাসনের জন্য ছয় দফা কর্মসূচীর ধারণা এবং তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান বা পূর্ব বাংলার বুকে বাঙ্গালী জাতির জন্য একটি স্বাধীন ও লোকবাদী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার ধারণা একই সমাজের অবতলে ক্রিয়াশীল দুইটি স্বতন্ত্র গতিধারাকে প্রতিনিধিত্ব করে।
কখনও কখনও তারা একে অপরের পরিপূরক হতে পারে, কখনও কখনও তাদের মধ্যে পরসপর বিজড়ন ঘটতে পারে আবার কখনও কখনও তারা এমনকি পরসপর বিরুদ্ধও হতে পারে।
যাইহোক, স্বায়ত্তশাসনের নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলন ব্যর্থ হলে জাতীয় স্বাধীনতার জন্য সশস্ত্র সংগ্রামের প্রস্তুতির সপক্ষে আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে যদি কোন রকম গোপন অথবা অপ্রকাশ্য কর্মনীতি থাকত তবে বিষয়টা ভিন্ন হতে পারত। কিন্তু এ কথা সবার ভালভাবে জানা যে সশস্ত্র সংগ্রাম দূরে থাক এমনকি স্বাধীনতার জন্য কোন ধরনের প্রকাশ্য বা অপ্রকাশ্য রাজনীতিও আওয়ামী লীগের ছিল না।
সুতরাং জাতীয় সংগ্রামের প্রকৃতিতে পরিবর্তন আনার জন্য এবং পাকিস্তানী সামরিক জান্তার দমন অভিযানের মোকাবিলায় পূর্ণাঙ্গ সশস্ত্র সংগ্রাম শুরু এবং জাতীয় স্বাধীনতার লক্ষ্যে জনগণকে সংগঠিত করার জন্য একটি রাজনীতির হস্তক্ষেপ প্রয়োজনীয় হয়ে পড়েছিল। আর এই রাজনীতি ইতিমধ্যেই আওয়ামী লীগ বহির্ভূত রাজনৈতিক শিবিরে জন্ম ও বিকাশ লাভ করেছিল। আর এইভাবে আমরা সেই শক্তিটিকে খুঁজে পাচ্ছি যে শক্তিটি স্বায়ত্তশাসনের আন্দোলন এবং স্বাধীনতার যুদ্ধ - এই উভয়ের মধ্যকার ফাঁকটিকে পূরণ করেছিল, এবং এইভাবে এক পর্যায় থেকে আরেক পর্যায়ে আন্দোলনের উত্তরণকে সম্ভব করেছিল। এই শক্তিটি প্রধানত গঠিত হয়েছিল ষাটের দশকের তরুণ প্রজন্ম দ্বারা। তবে প্রজন্মটি ছিল মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর সামগ্রিক নেতৃত্বাধীন বিস্তৃত পরিসরের সমাজতান্ত্রিক শিবিরে অবস্থিত বিভিন্ন পরসপর বিরোধী ধারার অন্তর্ভুক্ত।
১৯৭০-এর ২২ ফেব্রুয়ারী তারিখে পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়নের পক্ষ থেকে বিশোর্ধ্ব বয়সের কয়েকজন তরুণ নেতা ঢাকার এক জনসভায় স্বাধীন জন-গণতান্ত্রিক পূর্ব বাংলা প্রতিষ্ঠার জন্য ১১ দফা কর্মসূচী ঘোষণা করে। কাজেই এতে অবাক হবার কিছু থাকে কি যে স্বাধীনতার যুদ্ধ শুরু হল তার এক বৎসর পর? তবে বিভিন্ন কারণে তাদের জন্য পরিণতি হল ভিন্ন। অনেক কারণের মধ্যে যেটা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হিসাবে প্রমাণিত হল সেটা হচ্ছে ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ পরবর্তী ঘটনা প্রবাহে ভারতের হস্তক্ষেপ।
এভাবে আমরা আমাদের ইতিহাসের একটা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনার মুখোমুখি হচ্ছি। এবং এটা বিস্ময়কর হলেও সত্য যে এটা আমাদের ইতিহাসের সবচেয়ে কম আলোচিত একটা ঘটনাও বটে।
সুতরাং এখন আমি গত শতাব্দীর ষাটের দশকে সংঘটিত এই বিস্ময়কর ঘটনার বিকাশের উপর কিছু আলোকপাত করব। ঘটনাটি ঘটেছিল তৎকালীন বাম আন্দোলনে। প্রকৃতপক্ষে এই ঘটনা বুঝতে না পারলে বাংলাদেশের অভ্যুদয় এবং পরবর্তী সমস্যাবলীর কিছুই আমরা বুঝতে পারব না।
সে কালের বামপন্থী ছাত্র সংগঠন পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়নের অগ্রণী ছাত্ররা মার্কসবাদ দ্বারা প্রভাবিত ছিল। মার্কসবাদী দর্শনের প্রভাবে তাদের বিশ্বদৃষ্টি হয়ে উঠেছিল লোকবাদী ও যুক্তিবাদী। সুতরাং তাদের দর্শনগত অবস্থানের কারণে পাকিস্তান তাদের নিকট হয়ে পড়েছিল একটি অযৌক্তিক ও অপ্রাসঙ্গিক সত্তা। ফলশ্রুতিতে তারা পাকিস্তানের বিপরীতে একটা বিকল্প জাতীয় পরিচয় সন্ধান করছিল। স্বাভাবিকভাবে বাঙ্গালী জাতি হিসাবে সচেতনতা তাদেরকে সেই পরিচয়বোধ দিল। অধিকন্তু তৎকালে বাঙ্গালীদের বিরুদ্ধে পশ্চিম পাকিস্তানী শাসক শ্রেণী কর্তৃক অনুসৃত বৈষম্যমূলক কর্মনীতির প্রশ্ন ছিল। সুতরাং দার্শনিক অনুসন্ধিৎসার ফলে যে সচেতনতার জন্ম হয়েছিল সেটি দাঁড়াবার মত একটা শক্ত বাস্তব ভিত্তি পেল।
এ দেশের মুসলিম জনগণের ভিতর বাঙ্গালী জাতি হিসাবে চেতনার জাগরণের প্রথম সূচনা হয় ১৯৪৮-’৫২-এর ভাষা আন্দোলন কালে। কিন্তু তখন পর্যন্ত এই বোধের সঙ্গে ধর্মীয় অর্থাৎ ইসলামের পরিচয় বিজড়িত ছিল। ঐ রকম বাস্তবতায় স্বায়ত্তশাসনের দাবীই ছিল দার্শনিক এবং রাজনৈতিক উভয় দিক থেকেই পাকিস্তানের কাঠামোর সঙ্গে সর্বোচ্চ পরিমাণে সঙ্গতিপূর্ণ।
কিন্তু ষাটের দশকের প্রথম দিকে এক নূতন প্রজন্মের ছাত্রদের উত্থান ঘটল যারা ছিল লোকবাদী দর্শন ও বিপ্লবী রাজনীতি দ্বারা উদ্বুদ্ধ। যে কথা আমি ইতিপূর্বেই বলেছি তদের দর্শনের কারণে তারা পাকিস্তানের বিরুদ্ধে চলে গিয়েছিল। সুতরাং তারা বাঙ্গালী জাতির জন্য একটি লোকবাদী এবং সমাজতান্ত্রিক স্বাধীন রাষ্ট্রের স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছিল। পাকিস্তানী শাসক শ্রেণী কর্তৃক বাঙ্গালী জাতির প্রতি বঞ্চনা তাদের স্বপ্নকে নূতন শক্তি ও বস্তুগত ভিত্তি যুগিয়েছিল।
কিন্তু তৎকালীন সামাজিক চেতনার প্রেক্ষিতে জাতি-রাষ্ট্র গঠনের এই স্বপ্ন ছিল অনেক বেশী অগ্রগামী। এই ধরনের কোন চিন্তাকে গ্রহণ করবার জন্য তখন পর্যন্ত জনগণ প্রস্তুত হয় নাই। সুতরাং তখন বামপন্থী ছাত্রদের জন্য দরকার ছিল স্বায়ত্তশাসনের এমন একটা কর্মসূচী যেখানে স্বায়ত্তশাসনের দাবীকে কেন্দ্র করে বৃহত্তর জনগণের অন্যান্য অত্যাবশ্যকীয় দাবীসমূহ জায়গা পাবে। এই ধরনের কর্মসূচী স্বাধীনতার গোপন আন্দোলন গড়ে তুলবার ক্ষেত্রে তাদেরকে একটা প্রয়োজনীয় আড়াল দিতে পারত।
সুতরাং তারা তাদের প্রকাশ্য ও গোপন বামপন্থী নেতাদের উপর তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান বা পূর্ব বাংলা প্রদেশের জন্য একটি কর্মসূচী দেওয়ার জন্য চাপ দিয়ে যাচ্ছিল। কিন্তু তাদের নেতারা কর্ণপাত করছিল না। তবে যখন আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে ১৯৬৬ সালের ফেব্রুয়ারী মাসে শেখ মুজিবুর রহমান ৬ দফা কর্মসূচী ঘোষণা করলেন তখন আর বামপন্থী নেতাদের পক্ষে একটি কর্মসূচী না দিয়ে উপায় থাকল না। দলের ভিতর এবং বাইরের চাপে ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (ন্যাপ)-এর পক্ষ থেকে ১৯৬৬ সালের জুন মাসে শেষ পর্যন্ত তারা ১৪ দফা কর্মসূচী ঘোষণা করলেন।
কিন্তু তারা যে এই কর্মসূচীকে এগিয়ে নিতে ইচ্ছুক ছিলেন না সেটা পরবর্তী ঘটনাপ্রবাহ দ্বারা প্রমাণিত হয়েছিল। প্রকৃতপক্ষে তারা সরকার বিরোধী কোন আন্দোলন গড়ে তোলায় আগ্রহী ছিলেন না। তারা ছিলেন গোঁড়া মার্কসবাদী। সুতরাং প্রধানত অর্থনৈতিক শ্রেণী সংগ্রাম এবং স্থানীয় ইস্যুভিত্তিক গণ-আন্দোলনের মধ্যে তাদের কর্মকাণ্ড সীমাবদ্ধ থাকত। অধিকন্তু সেই সময়ে আইয়ূব সরকার চীনের সঙ্গে সুসম্পর্ক রাখার কারণে আইয়ূব সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলনের প্রশ্নে তারা ছিলেন দ্বিধান্বিত; কারণ তাদের রাজনৈতিক অবস্থান ছিল চীনপন্থী। সেই সময় তাদের কর্মনীতি ছিল আইয়ূবের হাতকে দুর্বল না করা। সুতরাং তারা ১৪ দফা কর্মসূচীর ভিত্তিতেও কোন আন্দোলন গড়ে তোলার ব্যাপারে আগ্রহী ছিলেন না।
অন্যদিকে, সাধারণভাবে কয়েকটি কারণে বামপন্থী ছাত্ররা এই কর্মসূচীকে প্রত্যাখ্যান করেছিল। প্রথমত, স্বায়ত্তশাসনের দাবীর সন্নিবেশ সত্ত্বেও এটি ছিল ৬ দফা কর্মসূচীর মত সারা পাকিস্তান ভিত্তিক কর্মসূচী। অথচ ৬ দফায় পূর্ব পাকিস্তানের স্বায়ত্তশাসনের প্রশ্নে যে বিশেষ জোর দেওয়া হয়েছিল ১৪ দফায় সেই জোর দেওয়া হয় নাই। দ্বিতীয়ত, ৬ দফার তুলনায় ১৪ দফা ছিল অধিকতর শক্তিশালী কেন্দ্রের পক্ষে। ৬ দফায় কেন্দ্রের হাতে শুধুমাত্র প্রতিরক্ষা ও পররাষ্ট্র নীতি রাখা হয়েছিল। কিন্তু ১৪ দফায় প্রতিরক্ষা, পররাষ্ট্র নীতি এবং অর্থ কেন্দ্রের হাতে রাখা হয়েছিল। তৃতীয়ত, ৬ দফার মতো ১৪ দফা ছোট অথচ সুবিন্যস্ত এবং সুসংহত কর্মসূচী ছিল না। সুতরাং কিছু খুবই গণমুখী ও প্রগতিশীল দাবীর সন্নিবেশ সত্ত্বেও ১৪ দফা কর্মসূচী আমূল পবিরর্তনবাদী তরুণদের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে ব্যর্থ হল।
পাকিস্তান আমলে ছাত্ররাই ছিল যে কোন কার্যকর রাজনৈতিক আন্দোলনের অগ্রবাহিনী। এবং তারাই এই কর্মসূচী গ্রহণ করতে ও জনগণের মধ্যে নিয়ে যেতে অস্বীকার করল, অন্যদিকে মওলানা ভাসানী বাদে অন্য নেতারা আইয়ূব সরকারের বিরুদ্ধে কোন অর্থবহ আন্দোলন গড়ে তুলতে রাজি ছিল না। সুতরাং ১৪ দফার পরিণতি যা হবার তাই হল। এবং শীঘ্রই কর্মসূচীটি বিস্মৃতির অতলে হারিয়ে গেল। কিন্তু ৬ দফা কর্মসূচীর পরিণতি হল ভিন্ন। আওয়ামী লীগ শিবিরের সাথে সম্পৃক্ত ছাত্ররা সর্বান্তঃকরণে ৬ দফা কর্মসূচীকে গ্রহণ করে জনগণের মধ্যে নিয়ে গেল। অন্যদিকে এই কর্মসূচীর পক্ষে আন্দোলন গড়ে তোলার প্রশ্নে আওয়ামী লীগের বেশীর ভাগ নেতাই মুজিবকে সমর্থন করেছিলেন।
যাইহোক, এ কথা বলা যায় যে ভাসানী অথবা ন্যাপ স্বায়ত্তশাসনের একটি যথাযথ কর্মসূচী দিতে পারলেও ঘটনা ধারার অগ্রগতি শেষপর্যন্ত যা হয়েছে তা থেকে যে বেশী ভিন্ন হত না সে কথা বলা যায়। আমি কেন এ কথা বলছি তা কিছুক্ষণের মধ্যে পরিষকার করব।
বামপন্থী নেতৃত্ব স্বায়ত্তশাসনের কর্মসূচী যথাযথভাবে দিতে ব্যর্থ হলেও বামপন্থী তরুণ এবং ছাত্রদের ব্যাপকভাবে গরিষ্ঠ অংশ ১৯৬৮ সাল থেকেই প্রকাশ্যভাবে স্বাধীনতার ধ্বনি তুলতে শুরু করেছিল। অধিকন্তু, যে কথা ইতিপূর্বে বলা হয়েছিল তরুণরা তাদের ছাত্র সংগঠনের পক্ষ থেকে পূর্ব বাংলার স্বাধীনতার কর্মসূচী ঘোষণা করেছিল। বাস্তবে পূর্ব বাংলা কিংবা বর্তমান বাংলাদেশ ভূ-খণ্ডে বাঙ্গালী জাতির স্বাধীন ও লোকবাদী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার চিন্তা ষাটের দশকের তরুণ প্রজন্মের মধ্যে উদ্ভূত হয়েছিল, এবং সেখান থেকে উদ্ভূত হয়ে এটা বামপন্থী আন্দোলনের প্রধান অংশকেই দখল করে নেয়; এবং এভাবে শেষ পর্যন্ত সমগ্র বাঙ্গালী জাতিকে ১৯৭১ সালে স্বাধীনতার যুদ্ধে নিয়ে যায়।
অবশ্য ১৯৭১-এর ২৫ মার্চে পাক-বাহিনীর আক্রমণ অভিযান শুরুর পূর্ব পর্যন্ত বেশীর ভাগ জনগণ পাকিস্তান বিরোধী ছিল না, বরং তাদের দাবী পাকিস্তান কাঠামোবদ্ধ স্বায়ত্তশাসনের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল। সুতরাং আম-জনতার জন্য স্বাধীনতা ও সশস্ত্র সংগ্রামের ধ্বনি ও কর্মসূচী ছিল খুব বেশী অগ্রগামী। কাজেই জনমনের উপর এইসব ধ্বনির প্রভাব পড়লেও সেগুলি তখন পর্যন্ত সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের কার্যকর সমর্থন আদায় করতে সক্ষম হয় নাই।
কিন্তু পাকিস্তানী সশস্ত্র বাহিনীর ভিতর অবস্থিত যেসব বাঙ্গালী অফিসার এবং সৈনিক পশ্চিম পাকিস্তানীদের দ্বারা নিগৃহীত, লাঞ্ছিত ও অধিকার বঞ্চিত ছিল তাদের মনে এইসব ধ্বনির প্রভাব হয়েছিল ইতিবাচক। সুতরাং নির্বাচনে আওয়ামী লীগের বিপুল বিজয় সত্ত্বেও পাকিস্তানের সামরিক শাসক গোষ্ঠী আওয়ামী লীগের নিকট ক্ষমতা হস্তান্তরে কালক্ষেপণ করতে থাকলে বাঙ্গালী সৈনিকরা অস্থির হয়ে পড়ল এবং বিদ্রোহের কথা চিন্তা করতে শুরু করল। এখানে এ প্রসঙ্গে উল্লেখ করা যায় যে, পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের বাঙ্গালী সৈনিকরা ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চের কয়েক দিন পূর্বে জয়দেবপুরে বিদ্রোহ করেছিল। এবং এ ঘটনার সাথে দলীয়ভাবে আওয়ামী লীগের কোন সম্পর্ক ছিল না।
যাইহোক, ১৯৭১-এর ২৫ মার্চ মধ্যরাত্রিতে পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর দমন অভিযান ঘটলে এই অবস্থার আমূল পরিবর্তন হয়। এই অবস্থা স্বাধীনতাকামী বামপন্থী শক্তিদের জন্য নূতন সুযোগ এনে দিতে পারত; কারণ দমন অভিযানের সঙ্গে সঙ্গেই আওয়ামী লীগের ৬ দফা ভিত্তিক নির্বাচনী বিজয় অপ্রাসঙ্গিক হয়ে পড়ে। শুধু তাই নয় যুদ্ধ শুরু দ্বারা নির্বাচনী বিজয়ের বৈধতারও সমাপ্তি ঘটল । কারণ নির্বাচনের রায় স্বাধীনতা অথবা যুদ্ধ কোনটার জন্যই ছিল না। দমন অভিযান এবং ফলশ্রুতিতে বাঙ্গালী জনগণ বিশেষত বিদ্রোহী সৈনিক এবং পুলিশ ইত্যাদি দ্বারা ব্যাপক বিদ্রোহের ফলে স্বায়ত্তশাসনের শান্তিপূর্ণ আন্দোলনের পর্যায় শেষ হয়ে গেল। স্বাভাবিকভাবে পরবর্তী পর্যায় যেটা সশস্ত্র সংগ্রাম দ্বারা শুরু হল সেই পর্যায় সূচিত হওয়া উচিত ছিল সেইসব শক্তিকে সামনে রেখে যারা দীর্ঘদিন ধরে স্বাধীনতার জন্য সশস্ত্র সংগ্রামের রাজনীতি গড়ে তুলছিল। পরিস্থিতিটাকে আরও সপষ্ট করার জন্য এ কথা বলা জরুরী যে স্বাধীনতাপন্থী এইসব শক্তি নির্বাচনী রাজনীতির বিরুদ্ধে ছিল। ফলে তারা ১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে নাই, বরং তার বিরোধিতা করেছে।
কিন্তু যখন পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর অভিযান ও গণহত্যা শুরু হল এবং তার ফলে আওয়ামী লীগ এবং কিছু সংখ্যক স্বাধীনতাকামী বাম নেতা ও কর্মী, বিদ্রোহী বাঙ্গালী সৈনিক এবং অন্যান্য স্বাধীনতাকামী শক্তিসহ লক্ষ লক্ষ বাঙ্গালী জনতা ভারতে আশ্রয় নিল তখন আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধে ভারত পরিণত হল সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ এবং নির্ধারক শক্তিতে। দেশের ভিতর থেকে সংঘটিত স্বল্পকাল স্থায়ী স্বতঃস্ফূর্ত এবং অসংগঠিত প্রতিরোধ যুদ্ধ ভেঙ্গে পড়লে এবং নেতা ও যোদ্ধারা ভারতে পালিয়ে গেলে স্বাধীনতা যুদ্ধের ভরকেন্দ্র দেশের ভিতর থেকে ভারতে সরে গেল। আর এইভাবে তা স্বাধীনতা যুদ্ধের মূলধারার উপর ভারত সরকারের নিরঙ্কুশ নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করল।
এখন যে প্রশ্নের সমমুখীন আমরা হই তা হচ্ছে এই যে, ভারত সরকার কি ন্যাপের মত কোনও বামপন্থী শক্তির নেতৃত্বে স্বাধীনতা যুদ্ধ গড়ে উঠতে দিতে পারত? বামপন্থীরা ছিল দেশ প্রেমী, সৎ এবং তাদের আদর্শের প্রতি নিবেদিত। আমাদের সমাজে তারাই লোকবাদী ও অসাম্প্রদায়িক রাজনীতির মশালধারী এবং সবচেয়ে বলিষ্ঠ সমর্থক। কিন্তু ভারত তার আবেষ্টনের ভিতর একটি বিপ্লবী অথবা সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় সাহায্য করতে পারত না। এ ধরনের রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হলে ব্রিটিশ উপনিবেশিক শাসন থেকে উত্তরাধিকার সূত্র থেকে পাওয়া তার ব্যবস্থা শেষ পর্যন্ত ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারত। অধিকন্তু, এটা পশ্চিম বাংলা এবং ত্রিপুরায় যেমন তেমন আসামের মত অঞ্চলগুলি যেখানে বৃহৎ সংখ্যক বাঙ্গালী জনগোষ্ঠী বাস করে সেসব অঞ্চলে বাঙ্গালী জাতীয়তাবাদের জোয়ার জেগে উঠতে পারত। সুতরাং ভারত সরকার সব রকম উপায়ে জাতীয় মুক্তিযুদ্ধে বাম শক্তিগুলোর অংশগ্রহণকে বাধা দিয়েছিল এবং এই কর্মনীতি অনুসারে বামপন্থী নেতা মওলানা ভাসানীকে অন্তরীণ করে রেখেছিল।
ভারত সরকার আওয়ামী লীগ নেতৃত্বের চরিত্র ও পটভূমি জানত। তারা জানত কীভাবে আওয়ামী লীগ নেতৃত্ব ১৯৫৬-’৫৭ সালে পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় ক্ষমতায় গিয়ে পূর্ব বাংলার স্বায়ত্তশাসনের দাবীর প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা করেছিল, কীভাবে আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি ভাসানীকে তার দল ত্যাগ করে ন্যাপ গঠন করতে বাধ্য করেছিল। এইভাবে বস্তুত আওয়ামী লীগ পরিণত হল আমাদের সমাজের মধ্যবিত্ত শ্রেণীর সবচাইতে সুবিধাবাদী, লোভী, অসৎ এবং ঠগ গোষ্ঠীগুলোর প্রতিনিধিতে।
পঞ্চাশের দশকে ক্ষমতা এবং অর্থের জন্য যে খেলা আওয়ামী লীগ খেলতে পেরেছিল ’৭০-এর নির্বাচনে বিজয়ের পর তার পক্ষে সেই ধরনের খেলা সম্ভব হয় নাই। কারণ এবার ছিল দেশে বিশেষত বামপন্থী জাতীয়তাবাদী তরুণদের দ্বারা গড়ে তোলা এক অত্যন্ত শক্তিশালী অনিয়মতান্ত্রিক আন্দোলন। সমাজে এই নূতন উপাদানের উপস্থিতি ’৭০-এর নির্বাচনের পর জেনারেল ইয়াহিয়া এবং মুজিবের মধ্যে ক্ষমতা ভাগাভাগির লক্ষ্যে গোপন কোন বন্দোবস্তকে অসম্ভব করেছিল। অধিকন্তু দ্রুত বিকাশমান বিপ্লবী স্বাধীনতা আন্দোলনের প্রচণ্ড চাপের ফলে পাকিস্তান সরকার ও আওয়ামী লীগ উভয়ের হাত থেকেই পরিস্থিতির নিয়ন্ত্রণ চলে যাচ্ছিল। সুতরাং আক্রমণ অভিযান অনিবার্য হয়ে পড়েছিল। এইরকম পরিস্থিতিতে আওয়ামী লীগ নেতারা নিজেদেরকে ভারত ও পাকিস্তান এই দুই রেখায় বিভক্ত করার সিদ্ধান্ত নিল। সুতরাং মুজিব পাকিস্তান সেনাবাহিনীর নিকট আত্মসমর্পণ করলেন, তাকে অনুসরণ করলেন ডঃ কামাল হোসেন এবং বাকীরা পালালেন ভারতে। এই রকম নেতৃত্ব-ই ছিল ভারতের নিকট সবচেয়ে বেশী প্রয়োজনীয় ও কাম্য।
আওয়ামী লীগের জন্য এটা ছিল এক চমৎকার কৌশল। ভারত এবং পাকিস্তান যে পক্ষই জিতুক আওয়ামী লীগের লাভ ছাড়া ক্ষতি নাই।
কাজেই বামপন্থী জাতীয়তাবাদীদের অবদানকে স্বীকৃতি দেবার প্রয়োজন কোথায়? সুতরাং যখন অস্থায়ী সরকার গঠিত হল তখন সেখানে তাদের কোন জায়গা হল না। না, তাদের জায়গা কোথাও হবে না! সম্পূর্ণরূপে অস্বীকার করা হবে তাদেরকে এবং সেই সঙ্গে স্বাধীনতার জন্য তাদের সকল ইতিবাচক ভূমিকাকে! আর ইতিপূর্বেকার তাদের ঐতিহাসিক ভূমিকা? কোন চিন্তা নাই! ইতিহাস(!) বানানো হবে এবং ঘটনার জায়গা নিবে বানানো গল্প।
এইভাবে অনাগত এক দীর্ঘ কালের জন্য জাতির ভাগ্য নির্ধারিত হয়ে গেল। বেশী বিস্তারিত না করে সংক্ষেপে এই কথা বললে চলে যে উপরে বর্ণিত বাস্তবতা এ দেশে এমন এক শাসক শ্রেণীর উত্থান ঘটিয়েছিল যা মর্মমূলে ছিল নষ্ট-ভ্রষ্ট, আপাদমস্তক দুর্নীতিগ্রস্ত। সুতরাং বেশীর ভাগ ক্ষেত্রে শ্রেণীটি নৈতিকতা, আত্মমর্যাদা, স্বাধীন মন-মানসিকতা ও দেশ প্রেম বিবর্জিত। এটা শুধু কোন সরকারের সমস্যা নয়। সমস্যাটা নিহিত রয়েছে আমাদের সমাজের এই ধরনের উচ্চতর সামাজিক শ্রেণীগুলির কিংবা শাসক শ্রেণীর জন্ম ও বিকাশ প্রক্রিয়ার ভিতর। একটি দুর্নীতিগ্রস্ত রাজনৈতিক নেতৃত্বের অধীনে এই শ্রেণীটি যুদ্ধের মাধ্যমে একটি রাষ্ট্র পেয়েছিল, যে যুদ্ধ পরিচালিত হয়েছিল ভারত সরকারের নিয়ন্ত্রণ ও দিক নির্দেশনা দ্বারা। জাতি-রাষ্ট্রের কোন স্বপ্ন তাদের ছিল না এবং এ ধরনের একটি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জন্য সশস্ত্র সংগ্রাম গড়ে তোলার কল্পনাও তাদের ছিল না। সুতরাং রাষ্ট্র অথবা যুদ্ধের জন্য কোন প্রস্তুতি তাদের ছিল না। এরা শুধুমাত্র অপরের শ্রমের ফসল আত্মসাৎকারী, যে আত্মসাৎ তারা করেছে বহিঃশক্তির সাহায্যে। এরা হচ্ছে প্রতারক এবং অসৎ। সুতরাং এরা অন্যদের সকল অবদানকে নিজেদের বলে চালায়। জন্ম থেকেই এরা চরম দুর্নীতিগ্রস্ততা এবং বহিঃশক্তির উপর নির্ভরতা দ্বারা বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত। এইরকম পরিস্থিতিতে আমাদের স্বাধীনতা এবং উন্নয়ন চরম সীমাবদ্ধতা ও বিকৃতি দ্বারা অধিকৃত হতে বাধ্য।
যাইহোক, এই শ্রেণীর উত্থানের জন্য শুধুমাত্র বাইরের উপাদানকে (যেমন ধরা যাক ভারত অথবা অন্য কোন দেশকে) দায়ী করা ভুল হবে। প্রকৃতপক্ষে এই শ্রেণীর মূলকে খুঁজতে হবে আমাদের নিজ সমাজেরই কতকগুলি দুর্বলতার ভিতর, যে দুর্বলতাগুলি বিভিন্ন সামাজিক, ঐতিহাসিক, প্রাকৃতিক, ভূ-তাত্ত্বিক এবং অন্যান্য কারণ দ্বারা সৃষ্ট। এই দুর্বলতাগুলি সবচেয়ে বেশী মূর্ত রূপ নিয়েছে আমাদের সমাজের নেতৃত্বকারী শ্রেণীগুলির মধ্যে। এমনকি ষাটের দশকের বামপন্থীরা যখন তাদের উত্থান এবং প্রভাবের সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছেছিল তখন সমাজের সর্বশ্রেষ্ঠ এবং সবচেয়ে অগ্রণী অংশ হওয়া সত্ত্বেও যে সামাজিক ভিত্তির উপর তারা দাঁড়িয়েছিল তার কতকগুলি দুর্বলতা তারাও কাটিয়ে উঠতে পারে নাই।
সুতরাং এ রকম পরিস্থিতিতে এটাই স্বাভাবিক যে, সামাজিক অগ্রগতি অর্জন হবে এমন এক প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যেখানে বাইরের প্রভাবকসমূহ অধিকাংশ ক্ষেত্রেই নিয়ামক উপাদান হিসাবে ভূমিকা পালন করবে এবং বাইরের শক্তির সমর্থনের উপর নির্ভরশীল একটি দুর্নীতিগ্রস্ত শাসক শ্রেণীর বিকাশের পাশাপাশি জন্ম এবং বিকাশ লাভ করবে পরনির্ভর অথবা অধীনস্থ রাষ্ট্র। সুতরাং এটা অস্বাভাবিক নয় যে এইরকম এক সমাজে যাদের আত্মমর্যাদা, স্বাধীন মন-মানসিকতা এবং সততা কম অথবা সবচেয়ে কম অধিকাংশ ক্ষেত্রে তারাই ক্ষমতা এবং সম্পদের সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠার সুযোগ পাবে।
যাইহোক সবকিছুর একটা সীমা থাকে। উপরে আমি যে শ্রেণী সম্পর্কে আলোচনা করলাম তা তার বিকাশের সর্বোচ্চ সীমায় পৌঁছেছে বলে মনে হয়। কোন সমাজই দীর্ঘকাল এ ধরনের একটা দুর্নীতিবাজ, পরগাছা, ভোগসর্বস্ব এবং দায়িত্বহীন শাসক শ্রেণীকে ধারণ করতে পারে না। ক্রমবর্ধমান সামাজিক উত্তেজনা, আইন প্রয়োগকারী সংস্থা দ্বারা বিচার বর্হিভূত হত্যাসহ অন্যান্য হত্যাকাণ্ড, ইসলামী জঙ্গিবাদের উত্থান এবং বিশেষত আওয়ামী লীগ ও বিএনপি-এর মধ্যকার সংঘাতের রাজনীতি এসবই হচ্ছে এই শ্রেণীর সঙ্কটের বহিঃপ্রকাশ। এই সঙ্কট বর্তমানে শুধু যে শাসক শ্রেণীর অস্তিত্বকেই বিপন্ন করছে তাই নয়, উপরন্তু রাষ্ট্র ও সমাজের ভিত্তিমূলকেও ধ্বংসের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। এই রকম পরিস্থিতিতে ২০০৭-এর ১১ জানুয়ারী তারিখে রাষ্টপতি কর্তৃক জরুরি অবস্থা ঘোষণা দ্বারা দেশে একটি বড় ধরনের পরিবর্তন এসেছে। ২০০৭-এর ১২ জানুয়ারীতে সশস্ত্র বাহিনীর সমর্থনে প্রধান উপদেষ্টা ডঃ ফখরুদ্দীন আহমদের নেতৃত্বে একটি নূতন তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রতিষ্ঠিত হয়। এই পরিবর্তন দেশের জন্য দিক পরিবর্তনের ঘটনা হিসাবে দেখা দিয়েছে। এ কথা নিঃসন্দেহে বলা যায় যে অবশেষে পরিবর্তন শুরু হয়েছে। অবশ্য এই সরকার কতদূর পর্যন্ত যেতে পারবে সেটা এখনও দেখবার বিষয়। সরকার দুর্নীতির বিরুদ্ধে তার অভিযান শুরু করেছে। কিন্তু এটা কেবলমাত্র একটা সূচনা, এর বেশী কিছু না। তাদেরকে আরও অনেক দূর পথ সামনে যেত হবে। কাজটা বিরাট। এর জন্য প্রয়োজন রাষ্ট্র এবং সমাজসহ শাসক শ্রেণীর সর্বাত্মক পুনর্গঠন।
বর্তমান পরিস্থিতির জটিলতা সম্পর্কে আর বেশী কথা না বলে আমি কেবলমাত্র এই কথাটি বলব যে, যদি আমরা আমাদের দেশকে ধ্বংস অথবা বিলুপ্তির আসন্ন বিপদ থেকে রক্ষা করতে চাই তবে অবশ্যই আমাদেরকে এতকাল দেশকে যে পথে পরিচালনা করা হয়েছে সে পথ থেকে ভিন্ন পথে নিতে হবে। অর্থাৎ এখন আমাদের চাই পথ পরিবর্তন। এ কথা আমাদের অবশ্যই বুঝতে হবে যে আমাদের জাতীয় সঙ্কটের এক প্রধান কারণ নিহিত রয়েছে বিদেশী শক্তিসমূহের উপর আমাদের নির্ভরতার ভিতর। অথবা ভিন্নভাবে বললে এ কথা বলা যায় যে, এই কারণটি হল আমাদের দেশের উপর বহিঃশক্তিসমূহের নিয়ন্ত্রণ, আধিপত্য এবং প্রভাব। এসব নিয়ন্ত্রণ ও যোগসূত্রকে ব্যবহার ক’রে কিছু সংখ্যক বহিঃশক্তি বাংলাদেশকে এমন এক পরিস্থিতির দিকে ঠেলে দিতে চেষ্টা করছে যা হবে দেশের অস্তিত্বের জন্য চরমভাবে ক্ষতিকর। সুতরাং এখন আমাদের প্রধান কাজ হচ্ছে দেশকে বহিঃশক্তির নিয়ন্ত্রণ, আধিপত্য এবং প্রভাব থেকে মুক্ত করা। বহিঃশক্তির উপর নির্ভর না করে আমাদেরকে নিজস্ব উন্নয়নের পথ নির্ধারণ করতে হবে। অন্যথায় এবার এ দেশ চিরকালের মত হারিয়ে যাবে।
এটা এমন এক করণীয় যা বাহির থেকে কেউই আমাদের উপর চাপিয়ে দিতে অথবা আমাদের পক্ষ হয়ে সম্পাদন করতে পারে না। সুতরাং আমাদের ইতিহাসে এই প্রথম আমরা এমন এক পরিস্থিতির সমমুখীন হয়েছি যখন আমরা বহিঃশক্তির হস্তক্ষেপ অথবা ভূমিকার উপর আশা না রেখে নিজেরাই নিজেদের করণীয় নির্ধারণ ও সম্পাদন করতে বাধ্য হচ্ছি। এইবার আমাদের রাষ্ট্রীয় সীমানার বাইরে আর কোথায়ও যাবার জায়গা নাই।