Banner
ইসরায়েল-ইরান-হামাসের সংঘাত : প্রয়োজন শান্তির অন্বেষা — মো. শহীদুল্লাহ

লিখেছেনঃ মো. শহীদুল্লাহ, আপডেটঃ August 1, 2024, 12:00 AM, Hits: 419

এই লেখা যখন লিখছি, তখন মধ্যপ্রাচ্যে ইহুদিদের জাতিরাষ্ট্র ইসরায়েল এবং ইসলামি সাংগঠনিক সশস্ত্র শক্তি হামাস ও ফিলিস্তিন ইসলামি জিহাদের মধ্যে যুদ্ধ চলছে। লেবাননের হিজবুল্লাহ ও শিয়া ধর্মগুরুদের পরিচালিত ফ্যাসিবাদী রাষ্ট্র ইরান হামাসের পক্ষ নিয়ে মাঝে-মধ্যেই প্রক্সিযুদ্ধে লিপ্ত হচ্ছে। এই যুদ্ধের সন্ধিভিত্তিক অবসান কিংবা চূড়ান্ত সামরিক জয়-পরাজয় এখনও পরিষ্কার নয়। তবে এই যুদ্ধ নিয়ে বৈশ্বিক উদ্বেগ বাড়ছে। আশঙ্কা করা হচ্ছে, এই যুদ্ধ আরো ডালপালা ছড়াবে। হবে আরো ভয়ানক ধ্বংসাত্মক। হবে দীর্ঘস্থায়ী। বাংলাদেশসহ বিশ্বের দেশে-দেশে এই যুদ্ধের পক্ষে-বিপক্ষে রাজনৈতিক মেরুকরণ আরো ঘণীভূত হচ্ছে। এতে দিনের আলোর মতো খোলাসা হবে প্রগতি-পরাগতির চেহারা। এই পটভূমিকে সামনে রেখে এ নিবন্ধ রচিত। যুদ্ধ আমাদের কাছে কাম্য নয়, তবু ইতিহাসের বাঁকে বাঁকে যুদ্ধ-মহাযুদ্ধ হয়। যুদ্ধ এড়ানো যায় না। ইসরায়েল-হামাস-হিজবুল্লাহর যুদ্ধও এমনই এক সামাজিক বাস্তবতা। অন্যদিকে শান্তি, সমৃদ্ধি, উন্নয়ন, মানবিক সম্প্রীতি ও সামাজিক অন্তর্ভুক্তি মানবজাতির শ্বাসত আকাঙ্ক্ষা। সেই শান্তি অন্বেষণের তাগিদ প্রতিফলিত হয়েছে এই  লেখায়। তাই এখানে মধ্যপ্রাচের সামাজিক ইতিহাস, ভূরাজনৈতিক গুরুত্ব, ইসরায়েল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা, হামাসের ইহুদিবিরোধী জিহাদি যুদ্ধ এবং এতে ফ্যাসিবাদী ইরানের ভূমিকা- এসব বিষয় গুরুত্ব সহকারে আলোচনা করার চেষ্টা করা হয়েছে।

মধ্যপ্রাচ্যে রয়েছে ভৌগোলিক ও ইতিহাস-ঐতিহ্যগত দুটি এলাকা। একটি আরব উপদ্বীপ, অন্যটি ইরান বা প্রাচীন পারস্য। এই দুই অঞ্চলের ইতিহাস-নৃতত্ত্ব ও ধর্মীয় ঐতিহ্য নিয়ে রয়েছে বিপুল-বিস্তর ব্যবধান এবং মৌলিক  প্রার্থক্য। ইরানে চলে ফারসি ভাষা। আরব বিশ্বে চলে আরবি ভাষা। এই দুই রাষ্ট্রিক এলাকার শিল্প-সংস্কৃতি এবং জাতি-গরিমা আলাদা। সমাজের বিকাশধারা ও বর্তমান শ্রেণি কাঠামো পাশ্চাত্য সমাজ, ভারতীয় সমাজ, চীন ও দূর প্রতীচ্যের সমাজগুলো থেকে একেবারেই অন্য রকম। আরব ও পারস্য- এই দুই ভৌগোলিক এলাকার মানুষের সমাজস্বপ্ন পৃথক, ইসলামের সুন্নি ও শিয়া আকিদার দ্বন্দ্ব-সংঘাত রয়েছে। এখনো আরব সমাজে বুদ্ধিবৃত্তিক আলোকায়ন হয়নি। আরবের সমাজ ও রাষ্ট্র, এই আধুনিক যুগেও পড়ে আছে কোনো এক পর্বতের গুহা, জেবাল আল তুর-এ অলীক নূরের তাজ্জাল্বি এবং আস্তাবলের বরপুত্রের (!) লোককথা ও লোকশ্রুতির কিচ্ছা-কাহীনিতে। বর্তমান আরব এবং এখনকার ইরানি সমাজে শিক্ষা-দীক্ষা ও সামাজিক রীতি-রেওয়াজে রয়েছে আসমান-জমিন ব্যবধান। এ বিষয়গুলো বিবেচনায় নিয়েই বুঝতে হবে আরব-ইরান সমস্যা। বন্ধুত্ব। হামাস-ইসরায়েল যুদ্ধ এবং এ অঞ্চলে শতাব্দীপ্রাচীন নানা সংঘাতের মর্ম-শাঁস। এসব বিষয়ে জানা-বোঝার ওপরই নির্ভর করবে হামাসের প্রতি কারো সমর্থন-অসমর্থনের প্রশ্ন। 

১. আরব-ভূখণ্ড আয়তনিক দিক থেকে অনেকটা বাঁকা চাঁদের মতো। এই ভূখণ্ডের উত্তরে কৃষ্ণসাগর, দক্ষিণে আরবের মরুভূমি, পূর্বে পারস্য (ইরান) এবং পশ্চিমে ভূমধ্যসাগর। ইরান বাদে মধ্যপ্রাচ্যে রয়েছে সৌদি আরব, ইয়ামেন, ইসরায়েল, কুয়েত, ইরাক, সিরিয়া, সংযুক্ত আরব আমিরাত, কাতার, বাহরাইন, লেবানন, ওমান ও জর্ডান নামের দেশ। উত্তর আফ্রিকায় আরব সংস্কৃতি এবং ঐতিহ্যের দেশ মিসর ফিলিস্তিনের রাফা সীমান্ত দিয়ে আরবভূমির সঙ্গে যুক্ত।

২. ইরান একটি ইসলামি প্রজাতন্ত্র, প্রতিষ্ঠা ১৯৭৯ খ্রিস্টাব্দে। শিয়া ধর্মের ইমাম বা আয়াতুল্লাহরা এই দেশটির শাসক। ইরানে রয়েছে ইসলামি-সমাজকল্যাণমূলক সমাজ। কিন্তু মোল্লাশাসিত এই দেশটি একটি ফ্যাসিবাদী রাষ্ট্র। নিজেদের গণবিরোধী ও নারী-নিপীড়নকারী সমাজ ও রাষ্ট্রব্যবস্থা টিকিয়ে রাখার স্বার্থে ইরানের স্বৈরতান্ত্রিক শাসকরা আন্তর্জাতিক পরাশক্তি রাশিয়া ও চীনের সঙ্গে জোটবদ্ধ। কৌশলগত অংশীদার। রাজনীতি বিশ্লেষকরা রাশিয়া-ইরান-চীনের এই কৌশলগত অবস্থানের নাম দিয়েছেন- গণতন্ত্রবিরোধী কর্তৃত্ববাদী রাষ্ট্রশক্তির অক্ষ। অন্যদিকে এখনকার ইরান প্রাশ্চাত্য গণতন্ত্র, নারীমুক্তি ও মানবাধিকার এবং মুক্ত-স্বাধীন জীবনবোধের মারাত্মক বিরোধী। ইরান জ্বালানি তেল, যুদ্ধাস্ত্র এবং খনিজসম্পদ বিক্রির অর্থের একটা সামান্য অংশ গরিব পরিবারগুলোকে সরকারি খয়রাত হিসেবে দিয়ে থাকে। এতে সমাজে ধনী-গরিবের মধ্যে একধরনের আপাত ভারসাম্য বজায় রয়েছে। কিন্তু ইরানের বাম, বুর্জোয়া গণতন্ত্রী, নারী অধিকারকর্মী এবং নিপীড়িত ধর্ম ও জাতিসত্তাগুলোর মানুষ দেশটির এই দমবন্ধ শিয়া-দোজখ থেকে মুক্তি চাইছে। সেই মুক্তির লড়াই শত সীমাবদ্ধতার মধ্যেও চলমান রেখেছে তারা। ইরানের নিষ্ঠুর কাঠমোল্লাদের ক্ষমতাচ্যুত করার জন্য পরাশক্তি যুক্তরাষ্ট্র এবং পাশ্চাত্য দুনিয়া ইরানের এই পরিবর্তনকারী সংগ্রামীদের নৈতিক সমর্থন করে থাকে। যা যৌক্তিক। সমর্থনযোগ্য। অন্যদিকে গোটা আরব দুনিয়ার ওপর ঐতিহাসিক ও ধর্ম-সাংস্কৃতিক দিক থেকে দৃঢ় সম্পর্ক রয়েছে তুরস্কের। পাশ্চাত্যের মিত্র এবং সামরিক জোট ন্যাটোর সদস্য এই প্রভাবশালী দেশটিও চায় না ইরাক ও সিরিয়ায় ঘাঁটি ঘেড়ে আরববিশ্বে আরো বেশি প্রভাব বিস্তার করুক ইরান। ২০১৯ সালে ইরাকে সরকারবিরোধী বিক্ষোভের পর দেশটিতে শিয়া ইসলামের ফেরিওয়ালা ইরানের প্রতি ইরাকের জনসাধারণের বিতৃষ্ণা বাড়ছে। ইরাকের সুন্নি জনগোষ্ঠী ও প্রগতিশীল গণতন্ত্রীদের মাঝে ইরানের প্রতি এই রাজনৈতিক উষ্মা কাজে লাগিয়ে আঙ্কারা এখন বাগদাদের সঙ্গে নতুন করে সুস্পর্ক গড়ার কূটনৈতিক নীতি গ্রহণ করেছে এবং সে লক্ষ্যে এগুচ্ছে। এটা নিশ্চিতবাবেই বলা যায় তুরস্কের এই আরবমুখী নয়া কূটনীতি মধ্যপ্রচ্যের আরব অংশে ইরানের প্রভাব আরো খর্ব করবে। তাছাড়া, ২০২০ সালের ৩ জানুযারি, ইরাকে বাগদাদ আন্তর্জাতিক বিমান বন্দরের অদূরে মার্কিন ড্রোন হামলায় নিহত হন ইরানের ইসলামি গার্ড বাহিনীর অন্যতম শীর্ষ কমান্ডার কাশেম সোলাইমানি। তিনি হামাস, হিজবুল্লাহ, ফিলিস্তিনি ইসলামি জিহাদ,  হুতি এবং ইরাকে ক্রিয়াশীল শিয়া মতাদর্শের সন্ত্রাসবাদী সামরিক সংগঠন পপুলার মোবিলাইজেশন ফোর্সের (পি এম এফ) যোদ্ধাদের প্রশিক্ষণ ও আক্রমণের বুদ্ধি-পরামর্শ-সামরিক সহায়তা এবং যুদ্ধনকশা প্রস্তুতের দিকনিদের্শনা দিতেন। গেরিলা যুদ্ধ পরিচালনায় তাঁর ছিল ইর্ষণীয় দক্ষতা। ইরানি এই সেনা কর্মকর্তা নিহত হওয়ার পর ইরাকে তেহরানের প্রভাব অনেক কমে গেছে। এ ছাড়া সম্প্রতি হেলিকপ্টার দুর্ঘটনায় ইরানি প্রেসিডেন্ট ইব্রাহিম রাইসির মৃত্যু দেশটিকে সমস্যায় ফেলেছে। রাইসি সৌদি আরবসহ আরব দেশগুলোর সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নে উদ্যোগী ছিলেন। এই উদ্যোগ এখন হিমাগারে।

৩. আরবের দেশগুলো রাজা, বাদশাহ, আমির ও সামন্ততান্ত্রিক গোত্রপতিদের দ্বারা শাসিত। এসব দেশের অর্থনীতি পশু পালন, খনিজ তেল-গ্যাস, দামী আকরিক এবং কৃষির ওপর নির্ভরশীল। ইসরায়েল উঁচুমানের প্রযুক্তি পণ্য, কৃষি, ওষুধশিল্প-নির্ভর দেশ। ইসরায়েলের যুদ্ধাস্ত্র অতি উন্নত মানের, যা কি না যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র, ফ্রন্স ও জার্মানির সমক্ষ। তাছাড়া ইসরায়েলের রয়েছে অতি আধুনিক মানব সম্পদ ও প্রকৌশল জ্ঞান। যুদ্ধের সময় এবং রাষ্ট্রীয় কাজে আঁড়িপাতার যন্ত্র উৎপাদনে ইসরায়েল বিশ্বসেরা। আরব দেশগুলো বুঝতে পেরেছে, অচিরেই বিশ্ববাজারে বিকল্প জ্বালানি আসতে যাচ্ছে। পরিবেশধ্বংসী জীবাশ্ম জ্বালানির দিন দ্রুত ফুরিয়ে আসছে। তাই তাদের রাষ্ট্রীয় অর্থনীতি ও সমাজের অনেক কিছু আমূল বদলে ফেলতে হবে। রাষ্ট্রের ক্ষমতাকাঠামো ও সমাজে নানাপ্রকার শ্রেণি ও লিঙ্গের মানুষকে নতুনভাবে গড়ে তুলতে হবে। তাদের সঙ্গে প্রশাসনিক ও সামাজিক ক্ষমতা ও কর্তৃত্ব ভাগ-বাঁটোয়ারা করতে হবে। আরব নেতারা উপলদ্ধি করতে পারছেন নিজেদের  আরবি সংস্কৃতি ও জাতি-বোধের মধ্যপ্রাচ্য এবং উত্তর আফ্রিকার দেশ মিসরের মধ্যে এখন নতুন রাষ্ট্রিক বন্দোবস্ত প্রতিষ্ঠার সামাজিক উপযোজ্যতা সৃস্টি হয়েছে। এটি একটি রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জ। এ চ্যালেঞ্জ বাস্তবায়ন করতে নতুন সামাজিক চুক্তি দরকার। প্রয়োজন রাজনৈতিক বোঝাপড়া। এই সামাজিক চুক্তি ও বন্দোবস্ত হতে হবে গণতন্ত্র, নারীমুক্তি, সমাজের যুক্তিনির্ভর মানবিক বিকাশ, উদার আন্তঃরাষ্ট্রীয় বিনিয়োগ ও বাণিজ্য, নমনীয় অভিবাসননীতি, সামাজিক ন্যায় বিচার, আইনের শাসন, ধনী-গরিবের মধ্যে আয়-বৈষম্য  হ্রাস এবং পরিবেশবান্ধব সবুজ-উন্নয়ন নীতির আলোকে। নতুন প্রজন্মের আবর নেতা ও বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে এই যে নতুন রাষ্ট্রদর্শন ও সমাজ পুনর্গঠনের আকাঙ্ক্ষা, এর দিকদর্শন কিন্তু কোনো সেমিটিক প্রাচীন পুঁথি বা কিতাব থেকে পাওয়া যাবে না। আরববিশ্বে কাম্য এই  সমাজসংস্কারের জন্য দরকার হবে যুক্তিবাদী শিক্ষা, বৈজ্ঞানিক সমাজ দর্শন, সমাজিক গণতন্ত্রায়ন ও নারীর ক্ষমতায়ন। এ ক্ষেত্রে বোঝার বাকি থাকে না যে, ইসলাম ধর্মের শরিয়া-দৃস্টিভঙ্গির হামাস, হেজবুল্লাহ এবং ইরানের শিয়া ধর্মগুরু মাথামোটা আয়াতুল্লাহরা সময়োপযোগী এই সমাজ সংস্কারের পথে পাহাড় সমান বাঁধা। রাজনৈতিক ইসলামের এই সমাজ-ক্যান্সারের পচা ঘুঁটিগুলোকে সমূলে উৎপাটন ছাড়া সামনের দিকে এগিয়ে যাওয়া মুশকিল। মধ্যপ্রাচ্যের প্রগতিশীল সমাজসংস্কার ও উন্নয়নের চলমান ধারাকে রাজনৈতিক ইসলামের বিষাক্ত আগাছামুক্ত করতে হলে আরবের পুরোনো সমাজকাঠামো, প্রাচীনপন্থি একগুঁয়েপনা, ধর্ম-জেদ, জাতি ও ধর্মঘৃণা, নারীর প্রতি মধ্যযুগীয় জীবনদৃষ্টিতে ইতিবাচক পরিবর্তন আনতে হবে। এ জন্য ধর্মীয় ফেকরা ও ইসলামি সমাজে আলেমকেন্দ্রিক পুরোনো সামাজিক জ্ঞানকাঠামোর শরীরে বেলচা-শাবল চালিয়ে এর ক্ষতিকর খাদগুলো ঝরিয়ে ফেলতে হবে। বুর্জোয়া অর্থে প্রগতিশীল এই সমাজ সংস্কারে নেতৃত্ব দিচ্ছেন সৌদি আরবের প্রধানমন্ত্রী মুহম্মদ বিন সালমান। নতুন সমাজবিনির্মাণের এই লড়াইয়ে কাতারের আমির শেখ তামিম বিন হামাদ আল থানি শরিক রয়েছেন। নীল নদের দেশ মিসর জড়িত রয়েছে এই উন্নয়ন যাত্রায়। মধ্যপ্রাচ্যের আরব দেশগুলোয় এই পুনর্গঠনের কাজ হচ্ছে আরব সংহতি এবং আরব জাতীয়তাবাদের চেতনায়। যুগের চাহিদার সঙ্গে তাল মিলিয়ে গড়ে ওঠছে সমাজিক যোগাযোগ ও বিশাল বিশাল অবকাঠামো। এক্ষেত্রে উল্ল্যেখযোগ্য যে, গালফ কো-অপারেশন কাউন্সিলভুক্ত ৬ টি আরব দেশ হচ্ছে বাহরাইন, কুয়েত, ওমান, সৌদি আরব ও সংযুক্ত আরব আমিরাত। এই দেশগুলোর মধ্যে রাজনৈতিক বোঝাপড়া বৃদ্ধি, নিজেদের মধ্যে অভিন্ন বাজার ও বাণিজ্য ব্যবস্থা, বাণিজ্য উদারীকরণ এবং জাতিগত ও সাংস্কৃতিক একীকরণের লক্ষ্যে ২০০৮ সাল থেকে কাজ হচ্ছে। ইরানের কূপমণ্ডুক  শাসকরা বাড়ির পাশে আরব দেশগুলোতে এই পরিবর্তনের গতিধারা এবং ঐক্যসংহতি দেখে ভীত ও সন্ত্রস্ত হয়ে পড়েছেন। ইরানের শাসকরা আরবের এই নবজাগরণ ঠেকানোর জন্য ইসলাম ধর্মের শিয়া মাজহাবের আলখেল্লা ব্যবহার করে সিরিয়ায়, ইরাকে, লেবাননে ও ফিলিস্তিনে ভাড়াটে বাহিনী গড়ে তুলেছে। ‘শত্রুর শত্রু আমার মিত্র’ এই সামাজিক সমীকরণের ওপর ভিত্তি করে ইরান প্রক্সি যুদ্ধ চলমান রাখার জন্য কৌশলগত সাহায্য করছে শিরিয়ার স্বৈরশাসক আলাউয়ি শিয়া গোত্রের নেতা বাশার আল আসাদের সমর্থক শিয়া মিলিশিয়া বাহিনীকে, ফিলিস্তিনে হামাসকে, ফিলিস্তিনি ইসলামি জিহাদকে, লেবাননে হিজবুল্লাহকে এবং ইয়ামেনে শিয়া-হুতি বিদ্রোহীদের (প্রসঙ্গত, ইয়ামেনের শিয়া নেতৃত্বের সঙ্গে ইরানি আয়াতুল্লাহদের ধর্ম-দৃষ্টি এবং মাসআলা-মাসআয়েলে ব্যাপক প্রার্থক্য রয়েছে, (দেখুন বই : ‘ওয়াহাবিজম থেকে আইসিস’)। এসব কাজ করে ইরানের শাসকরা গোঁফে তাঁ দিয়ে আত্মতৃপ্তির ঢেঁকুড় তুলছেন- মধ্যপ্রাচ্যে তারা ইসরায়েল ও মার্কিন স্বার্থকে সামরিকভাবে ঘিরে ফেলেছেন, আরব ভূমিতেও দেশটির শক্তি সুসংহত হয়ে গেছে। জানি না, আহম্মকের এই আত্মসুখ কয়দিন টিকে!

৪. বলছিলাম- মধ্যপ্রাচ্যের আরব দেশগুলোতে সময়োপযোগী সামাজিক-আঞ্চলিক-রাষ্ট্রীয় পুনর্গঠনের কথা। এই স্বল্প-আলোকায়ন ও পুনর্গঠনের পথে কালাপাহাড়ী বাধা হচ্ছে ইরানের মোল্লাতন্ত্র, ফিলিস্তিনের হামাস জঙ্গিগোষ্ঠী,  ফিলিস্তিনি ইসলামি জিহাদ ও লেবাননের হিজবুল্লাহ। এই তিন অপশক্তির নাফরমানি বাধা এবং কূটকৌশল অতিক্রম করেই এগোতে হবে আরববিশ্ব ও ইসরায়েলকে। গড়ে তুলতে হবে সহিষ্ণু ও সমাজের সর্বস্তরের মানুষকে উন্নয়ন যাত্রায় সামিল করে নতুন ঝলমলে এক আরব। এই প্রশ্নে অনিবার্যভাবেই নিতে হবে গণতান্ত্রিক পশ্চিমা দুনিয়ার সহায়তা, জ্ঞান-বিজ্ঞান এবং প্রয়োজন মাফিক কৌশলগত অংশীদারত্ব। এই আরব ঐক্য, বৌদ্ধিক আলোকায়ন এবং মুক্তসংস্কৃতির নতুন সমাজ গঠনের প্রক্রিয়াকেই যত ভয় বর্তমান ইরানের। এ দেশের মোল্লা শাসকরা নিজ দেশের মানুষকে বন্দি করেছে ধর্মীয় ফ্যাসিবাদ ও সামরিক আমলাতন্ত্রে। পাশাপাশি আরববিশ্বে একাধিক দেশে প্রক্সিযুদ্ধের সন্ত্রাসী সংগঠন গড়ে তুলে নিজেদের এই সামন্তসাম্রাজিক তৎপরতা জারি রেখেছে। ইরানের এই আচরণ আরববিশ্ব ও তুরস্ক সহ্য করছে না। করার কথা নয় মোটেই।

৫. হামাস নিয়ে কথা : ফিলিস্তিনের এক মসজিদের ইমাম ছিলেন আহমেদ ইয়াসিন। তিনি এবং তার সহযোদ্ধা আবদেল আজিজ আল রনতিস ১৯৮৭ খিস্ট্রাব্দে ইসলামি প্রতিরোধ আন্দোলন বা হামাস নামের সংগঠনটি গড়ে তুলেন। এটি ফিলিস্তিনি প্রতিরোধ ও স্বাধীনতা আন্দোলন ফাতাহর ভেতরের নেতাকর্মীদের মধ্য থেকে উগ্রধর্মপন্থিদের সমন্বয়ে কাজ শুরু করেছিল। এই হামাস গঠনের প্রক্রিয়া শুরু হয় ১৯৭৩ সাল থেকে। প্রথমে এটি এনজিও আকারে কাজ শুরু করে। আদি নাম মুজামা আল ইসলামিয়া, অনেকটা আমাদের দেশের ইসলামি ব্যাংক, রাবেতা আল ইসলাম, হেফাজতে ইসলাম এবং জামায়াত-শিবির পরিচালিত বিভিন্ন এনজিওর মত। আসলে মুজামা আল ইসলামিয়া ছিল ইসলামি সেবামূলক এনজিও। এটি কাজ শুরু করেছিল ইখওয়ানুল মুসলিমিন নামের প্যান-ইসলামিক উগ্রবাদী সংগঠনের আদলে। এ ধরনের অসামরিক রাজনৈতিক দল এখন মিসরে বেশ (প্রয়াত নেতা মুরসির দল) শক্তিশালী এবং তুরস্কে (এরদোয়ানের দল) ক্ষমতাসীন। হামাস পাশ্চাত্যের জ্ঞান-বিজ্ঞান-দর্শন এবং হস্তক্ষেপ বিরোধী প্যান-ইসলামিক দৃষ্টিভঙ্গির মৌলবাদী জঙ্গি ধারার সংগঠন হিসেবে বিশ্বে সমধিক পরিচিত। এটি এখন মিসরের সালাফি ঘরানার ইসলামি বুদ্ধিজীবী সৈয়দ ইবরাহিম কুতুব, বিচারপতি সৈয়দ খলিল মুহম্মদ কুতুব, এই দুই ইসলামি পণ্ডিতের বোন আমিনা কুতুব এবং স্কুল শিক্ষক হাসান আল বান্নার মৌলবাদী এবং নারী স্বাধীনতাবিরোধী ইসলামি চিন্তা দ্বারা পরিচালিত। ইখওয়ানুল মুসলিমিনের এই রাষ্ট্রচিন্তা পাশ্চাত্যের যুক্তিবাদী দর্শন, বিজ্ঞানচিন্তা, বস্তুবাদী সেক্যুলার জীবনবোধ এবং সমাজে নারীর সার্বিক ক্ষমতায়নের বিরোধী। 

হরকাত আল মুকাওয়ামা আল ইসলাম বা হামাস একটি সুন্নি ইসলামিক পার্টি। এটি পাশ্চাত্য সাংস্কৃতিক জীবনধারা বিরোধী এবং মধ্যপ্রাচ্যে ইউরো-মার্কিন হস্তক্ষেপ বরদাস্ত না করার পক্ষে। এ পার্টির নেতারা ইসলামি রাষ্ট্র ও সমাজচিন্তার সালাফি এবং ওয়াহাবি মৌলবাদী ইসলামের অনুসারী। তবে হামাস ২০১৭ সালে এক ঘোষণায় বলেছিল “আমারা সাধারণ ইহুদী জনতার বিরুদ্ধে নই। আমাদের সংগ্রাম জায়নবাদী ইহুদী দখলদারিত্ব এবং তাদের পৃষ্ঠপোষক সকল প্রকার বিদেশি পরাশক্তির বিরুদ্ধে। কিন্তু সংগঠনটি বাস্তবে আগের ওই ঘোষণায় নেই। কালক্রমে মতাদর্শিকভাবে বিবর্তিত হয়ে এটি এখন সন্ত্রাসী ও মৌলবাদী সংগঠনে পরিণত হয়েছে। সাধারণ অরাজনৈতিক ইহুদী জনতা তো দূরের কথা এই সংগঠনের নেতারা ফিলিস্তিনি জাতিসত্তার মানুষের সঙ্গে ঐক্য-সংগতি গড়ে তুলতে ব্যর্থ হয়েছে। ২০০৬ সালের নির্বাচনে গাজা উপত্যকার নিয়ন্ত্রণ মাহমুদ আব্বাসের ফাতাহ দলের কাছ থেকে হামাসের কাছে যায়। তখন ভোটে বিজয়ী হয়ে গাজা অঞ্চলের নিমন্ত্রণ হাতে পাওয়ার পর হামাসের অস্ত্রধারীরা ফাতাহ দলের নেতাকর্মীদের ওপর হত্যা ও নির্যাতন চালায়। ফাতাহ দলের অফিসে অগ্নিসংযোগ করে। এভাবে ফিলিস্তিনি শান্তিকারী গণতান্ত্রিক সেক্যুলার জনতার সঙ্গে সশস্ত্র সংগঠন হামাসের দূরত্ব সৃস্টি হয়েছে। এ দূরত্ব দিন দিন বাড়ছে। এবার গাজায় ইসরায়েলি সামরিক অভিযানের সময় ফাতাহ-নিয়ন্ত্রিত পশ্চিমতীর শান্ত ও প্রতিবাদ-বিক্ষোভহীন রয়েছে। একটা বিষয় খুব পরিষ্কার যে, হামাস ফিলিস্তিনি জনতার সামান্য অংশকে এখন প্রতিনিধিত্ব করে। ইসরায়েলের কোনো গণতান্ত্রিক ও প্রগতিশীল সরকার যদি ফিলিস্তিনিদেরকে জমি-বাড়ি-ঘর এবং সহায়-সম্পদ থেকে উচ্ছেদ বন্ধ এবং তাদের কর্মসংস্থান ও অন্তর্ভূক্তিমূলক সর্বজনীন সামাজিক বিকাশ নিশ্চিত করে তাহলে  হামাসের কোনো সামাজিক ও রাজনৈতিক উপযোজ্যতা আর থাকবে না। ফিলিস্তিনি মানুষ জীবন, বিশ্বাস এবং তাদের সম্পদের নিরাপত্তা চায়। শান্তি চায়। ইসরায়েলি রাষ্ট্রকাঠামোর মধ্যেই ফিলিস্তিনিদের জন্য যুক্তরাষ্ট্রীয় মডেলে সাংবিধানিক স্বায়ত্তশাসন ইসরায়েলি এবং ফিলিস্তিনি নেতারা যদি মেনে নেন তাহলে ইসরায়েল-ফিলিস্তিন ভূখণ্ডে শান্তি ও সামাজিক অগ্রগতি অতি শিগগিরই সম্ভব। এই উন্নয়ন হবে আরবভূখণ্ডের অভিন্ন বাজার, বিনিয়োগ ও উদারপন্থি নতুনসংস্কৃতির চেতনায়। তবে সমাজে  এই পুনর্গঠন কাজের প্রক্রিয়া শুরু করার আগে হামাসকে জাতিসংঘ ও আরব লীগের মধ্যস্থতায় ও তত্ত্বাবধানে নিরস্ত্র করার দরকার হবে। আরব দেশগুলোর নেতারা এবং বিশ্বের পরাশক্তিগুলো এ লক্ষ্যে আন্তরিক পদক্ষেপ নিলে তা মোটেই অসাধ্য কোনো বিষয় নয়। তবে এই মহতী কাজে ইরান ও এর কালা-মুরুব্বি বর্তমান চীন ও রাশিয়া যে ইতিবাচক ভূমিকায় থাকবে না তা আগে-ভাগেই বলা যায়।

৬. সুন্নি সংগঠন হামাস এখন শিয়া ফ্যাসিবাদী রাষ্ট্র ইরানের পাইক-পেয়াদায় পরিণত হয়েছে। হামাস এখন একটি সহিংস যোদ্ধা সংগঠন ছাড়া অন্য কিছু নয়। এর সিভিল নেতৃত্বের কাঠামো এরমধ্যেই ঠুঁঠু জগন্নাথে পরিণত হয়েছে। হামাস এখন চলে একান্তই এর সামরিক শাখার কথায়। গঠনমূলক রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি হামাসের আর নেই, যা আছে তা গণবিচ্ছিন্ন সহিংসা ও রোমানটিক শমরবাদ। আমার দৃষ্টিতে হামাস হচ্ছে ফিলিস্তিনের নকশাল। এটি ইরানের মদদে এখন হামাসের সখ্য গড়ে ওঠেছে এশিয়ার পরাশক্তি বাণিজ্যিক সমরবাদী চীনের সঙ্গে। রাশিয়া বরাবরই ইসরায়েল সমর্থক দেশ। এটি মধ্যপ্রাচ্যের বর্তমান প্রেক্ষাপটে ইসরায়েলকে ছেড়ে সরাসরি হামাসকে সমর্থন দিবে কিনা তা এখনো পরিষ্কার নয়। তাছাড়া ইউক্রেনে সামরিক আগ্রাসন চালাতে গিয়ে পুতিনের ফ্যাসিবাদী শাসন-কর্তৃত্ব এখন বিরাট চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে। 

হামাসের সামরিক শক্তি : হামাস ফিলিস্তিনি ভুখণ্ডে একটি অঞ্চলভিত্তিক সামরিক শক্তি। এটি ইসলামি শরীয়ার আদর্শে অনুপ্রাণিত একটি গেরিলা যোদ্ধা দল। চোরাগুপ্তা হামলায় এরা দুর্ধর্ষ এবং পারঙ্গম। ইসরায়েলের সঙ্গে এবারের যুদ্ধে হামাসের ২৪ ব্যাটালিয়ন সেনা কাঠামোর ২০টি ধ্বংস এবং ছাত্রভঙ্গ হয়ে গেছে। মনোবলহীন বাদবাকি হামাস-সৈনিকরা এখন দক্ষিণ গাজার রাফায় স্বণিয়ন্ত্রিত এলাকায় লুকিয়ে আছে। এক কথায় এই যুদ্ধে হামাস মারাত্মকভাবে পর্যদুস্ত হয়ে গেছে। ইসরায়েলের প্রতি বড় ধরণের জবাবি আক্রমণের শক্তি আর হামাসের নেই। হামাস এখন আত্মরক্ষার অবস্থানে আছে। এরইমধ্যে ৪০ দিনের যুদ্ধ বিরতির লক্ষ্যে কাজ করেছে যুক্তরাষ্ট্র, সৌদি আরব ও কাতার। এই আলোচনার শর্ত ছিল  ইসরায়েলের কারাগারে যেসব হামাস নেতাকর্মী বন্দি আছে তাদের মুক্তি দিতে হবে। বিনিময়ে ৭ অক্টোবরের হামলায় হামাসের হাতে জিম্মি থাকা ইসরাইলি নাগরিকরাও মুক্তি পাবেন। এ যুদ্ধ বিরতির আলোচনা ফলপ্রসূ হয়নি। ইসরায়েলের সেনারা এখন দক্ষিণ রাফার দখল নিয়েছে। মিসর সীমান্তের এই শহরে এখন ইসরায়েলি সেনা ও হামাসের যোদ্ধাদের মাঝে আক্রমণ-প্রতিআক্রমণ চলছে। রাফা শহর আন্তর্জাতিক সীমান্ত দ্বারা মিসরের সঙ্গে বিভক্ত। এই শহরের অর্ধেক ফিলিস্তিনের বাকিটুকু মিসরের, নাম একই-রাফা। ১৯৮২ সালে ইসরায়েল সিনাই উপত্যকা থেকে সেনা প্রত্যাহার এবং মিসরের সঙ্গে সীমানা নির্ধারণের পর রাফা শহর দুইভাবে ভাগ হয়ে যায়। ফিলিস্তিনের রাফা এবং মিসরের রাফায় ফিলিস্তিনিদের বসবাস রয়েছে। ১৯৭৯ খ্রিস্টাব্দে মিসরের সঙ্গে ইসরায়েলের ক্যাম্প ডেভিড শান্তিচুক্তি হয়। এই চুক্তির শর্ত অনুসারে ফিলিস্তিনের গাজার দক্ষিণে দৈর্ঘ্যে ১৪ কিলোমিটার এবং প্রস্থে ১০০ মিটার একটি অসামরিক করিডোর প্রতিষ্ঠা করা হয়। এটির নাম ফিলাডেলফিয়া করিডোর। এই করিডোরকে ইসরায়েল ও মিসরের মধ্যে ব্যবসা-বাণিজ্যের লাইফ-লাইন হিসেবে গণ্য করা হয়। চুক্তির শর্ত মোতাবেক এই করিডোরে ইসরায়েলকে বিশেষ পরিস্থিতিতে সীমিত সংখ্যায় সেনা মোতায়েনের সুযোগ দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু এবারের গাজা অভিযানে ইসরায়েল এই ছোট্ট করিডোরটির সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নিয়েছে। এর ফলে ফিলিস্তিনি ভূখণ্ড এখন ইসরায়েরের সৈন্য বেষ্টিত একটি অঞ্চলে পরিণত হয়েছে।

ঊনবিংশ শতাব্দীর গোড়ার দিকে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে, বিশেষ করে ইউরোপের অনেক দেশ, আমেরিকা ও রাশিয়ায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা ইহুদীদের মাঝে স্বজাত্যবোধ প্রবল হয়। এই স্বজাত্যবোধের ভিত্তিতে রয়েছে তাদের প্রতি প্রাচীন যুগে খ্রিস্টান ও মুসলিম সমাজে এবং ফের আধুনিক যুগে এই দুই সিমেটিক ধর্মীয় সমাজে তাদের প্রতি অকথ্য নির্যাতন ও সমাজিকভাবে হেয় করার ঘৃণা-আচরণ। জাজিরাতুল আরবে ইসলাম বিস্তারের যুগে উৎখাত ও গণহত্যার শিকার হওয়া, তারও আগে খ্রিস্টীয় সামন্ত সাম্র্রাজ্য রোমান যুগে, আধুনিক ইউরোপে, রাশিয়ার সম্রাট জার আলেকজান্ডার নিকোলাইয়ের শাসনে সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় নিমূর্লীকরণের শিকার হওয়া (সামাজিক ঘৃণা এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় অ্যাডলফ হিটলারের হলোকাস্ট) ইহুদী ব্যবসায়ী শ্রেণি এবং তাদের বুদ্ধিজীবীরা বুঝতে পারেন তাদের ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। এ ছাড়া তাদের উপায় নেই। তাই তাদের আদি আবাসভূমি (ওল্ড টেস্টামেন্টের প্রমিজল্যান্ড) জেরুজালেমের আশপাশ তথা ফিলিস্তিনে তাদের জাতি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করতে হবে। এরপর থেকে তারা উসমানীয় খেলাফতের ফিলিস্তিনি অঞ্চলের স্থানীয় সামন্ত শাসকদের কাছ থেকে জমি ক্রয় করে, দীর্ঘ মেয়াদী লিজ নিয়ে এবং পতিত জমি বাসযোগ্য করে ফিলিস্তিন এবং এর সংলগ্ন এলাকায় ইহুদী বসতি গড়ে তুলতে থাকেন। ইহুদী জনগোষ্ঠীর পিতৃ-মাতৃভূমি বলে খ্যাত সেই সবুজ প্রকৃতির মরোদ্যানের দেশ-কেনান। এখন যা ফিলিস্তিন ও ইসরায়েল। এখানে ইহুদীদের বসতি গড়ার ব্যাপারে স্থানীয় মুসলিম কাঠ-মোল্লারা গোড়া থেকেই তীব্র বিরোধিতা করে আসছিল। গড়ে তুলেছিল ইহুদী বিরোধী সশস্ত্র জিহাদ। তখন ইহুদীদের সঙ্গে দাঙ্গা, সামাজিক ফ্যাসাদ এবং তাদের ব্যবসা ও কৃষির ক্ষতি করাই ছিল এই মুসলিম মৌলবাদী সন্ত্রাসীদের প্রধান কাজ। ফিলিস্তিনে ইহুদের সঙ্গে মুসলিমদের দাঙ্গা সংঘাত ও ঘৃণাবাণি প্রচার চালাচ্ছিল ফিলিস্তিান আরব মুসলিম জঙ্গি মোল্লারা, তারা সুযোগ পেলেই তাদের এলাকার বাইরে থেকে আসা ইহুদিদের সঙ্গে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষে জাড়িয়ে পড়ত। এর বিপরীতে ইহুদীরাও গড়ে তুলে তাদের আত্মরক্ষামূলক আধা-সামরিক মিলিশিয়া বাহিনী। জায়নবাদী এই ঘাতক, মৌলবাদী, জঙ্গি ও অত্যাচারী বাহিনীগুলোর মধ্যে অন্যতম ছিল হাগানাহ, ইরগুন ও স্ট্যার্ন গ্যাং। 

৭. জায়নবাদে ধর্মীয়, ধর্মনিরপেক্ষ,বামপন্থি এবং ডানপন্থি উপাদান রয়েছে। এ মতাদর্শিক উপাদানগুলো প্রথম থেকেই ছিল, এখনো আছে। অনেকের অভিমত- জায়নবাদ এখন বর্ণবাদ, নয়া-বাণিজ্যিক যুদ্ধে আগ্রাসী পরাশক্তি যুক্তরাষ্ট্রের এবং নতুন আধিপত্যবাদী রাষ্ট্রশক্তির সমর্থক হয়ে ওঠেছে। অনেকে এখনও বিশ্বাস লালন করেন যে- মানবিক, ভালো এবং সামাজিক ন্যায়ের পক্ষে একজন খাঁটি গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের মানুষ হতে হলে তাকে অতি অবশ্যই জায়নবাদবিরোধী হতেই হবে। কথা বলতে হবে জায়নবাদের সমর্থক পাশ্চাত্যের পরাশক্তিগলোর বিরুদ্ধে। এই ক্ষতিকর ভাবনার ভ্রান্তিবিলাস ও গোলক ধাঁধা বামপন্থিদের মধ্যেই বেশি। এই ভাবনার কানাগলিতে পথ হারিয়েছে বাংলাদেশসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশের মৌলবাদী ইসলামী রাজনৈতিক শক্তিগুলো এবং কমিউনিস্টরা। মুসলিম মৌলবাদীদের এই চিন্তাভ্রান্তির ভিত্তি হচ্ছে কোরআন এবং হাদিসে বয়ানকৃত অতিপুরনো ইহুদি-বিদ্বেষ। মুসলিম জনসংখ্যা অধ্যুষিত দেশ-সমাজ-পরিবারে জন্ম নেওয়া নতুন প্রজন্মের যুক্তিবাদী ও বিজ্ঞানমনস্ক জীবনবোধের মানুষ আজকাল আর এই ভ্রান্তি বিলাসে বিশ্বাস করেন না কিংবা আস্থা রাখেন খুব কম। একারণেরই আরবদেশগুলোতে আর আগের মত ইসরায়েল বিরোধিতা নেই। ইসলাম ও খ্রিস্টান ধর্মের আলখেল্লা গায়ে জড়িয়ে বাছ-বিচারহীন ইহুদী বিদ্বেষ আরব সমাজেও আর রাজনীতির মরুঝড় তুলছে না। আরব ও ইরানে ইসলামের ভুল বয়ানে বিভ্রান্তরা ছাড়া নতুন প্রজন্মের মানুষ-জনরা এখন আগের মত ইহুদী বিদ্বেষী নয়। এ কারণেই আরববিশ্বে জন সমর্থনের দিক থেকে হামাস ও ফিলিস্তিনের ইসলামি জিহাদ এখন ক্রমশ প্রান্তিক হয়ে পড়ছে।

৮. আরেকটা কথা মনে রাখতে হবে যে হামাস মানেই গোটা ফিলিস্তিÍনের জনগোষ্ঠীর প্রতিনিধি নয়। হামাসের সঙ্গে আছে আরেকটি ইসরায়েলবিরোধী কড়া মৌলবাদী দল, সেটি ফিলিস্তিন ইসলামি জিহাদ। বাস্তবতা হলো ফিলিস্তিনিরা নানা ধারায় বিভক্ত। এই বিভক্তিগুলো হচ্ছে। ভূখণ্ডগত ও মতাদর্শিক। ফিলিস্তিনি জনগোষ্ঠী এখন ছড়িয়ে-ছিটিয়ে একাদিক দেশ ও ভূখণ্ডে বসতি গড়েছে। তারা ফিলিস্তিনের গাজা, পশ্চিম তীর, ইসরায়েল অধিকৃত পূর্ব জেরুজালেম, লেবানন, জর্ডন, তুরস্ক, মিসর, সিরিয়া এবং পাশ্চত্যবিশে^র বিভিন্ন দেশে বসবাস করছেন। এক হিসাব থেকে জানা গেছে-গাজায় ২৩ লাখ, পশ্চিমতীরে ২৭ লাখ এবং ইসরায়েলের ভেতরে ১০ লাখ ফিলিস্তিনি বাসবাস করেন। এই ফিলিস্তিনিরা ধর্ম-ভাবনা, জীবনসংস্কৃতি ও ভবিষ্যৎ রাষ্ট্রস্বপ্নের দিক থেকে এক না। তাদের বসবাসের স্থান যেমন পৃথক, তেমনি পৃথক তাদের জীবনবোধ, রাষ্ট্রদর্শন। সন্ত্রাসী হামাস ও জঙ্গি দল ‘ফিলিস্তিন ইসলামি জিহাদ’কে ফিলিস্তিনিরা তাদের রাজনৈতিক দল মনে করে না। এবার ইসরায়েলের হামাসবিরোধী অভিযানে তার প্রমাণিত। 

৯. আমাদের দেশের বাম, কমিউনিস্ট, প্যান-ইসলামিক ও মৌলবাদী সামাজিক শক্তি বুঝে হোক, না-বুঝে হোক, মধ্যপ্রাচ্য ইস্যুতে ইরান ও হামাসের পক্ষে গলা ফাটায়, মিছিল-সামাবেশ করে। যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েলের বিরোধিতা করা তাদের বহু বছরের মজ্জাগত স্বভাব। মুসলিম মৌলবাদীরা মনে করেন এটা তাদের জিহাদি ও ইমানি দায়িত্ব। আর জনসর্মথন-শূন্য কমিউনিস্টারা ভাবেন ইসরায়েলের বিরোধিতা করলে ইসলামপন্থি ধর্মভীরু মানুষ তাদের সমর্থন করবে। তাদের কাস্তে-হাতুড়ি মার্কা পতাকা তলে সমবেত হবে। বাংলাদেশে এই ইসরায়েল বিরোধিতার দুইটি উৎসমুখ রয়েছে। একটি কুরআন ও সুন্নাকেন্দ্রিক মৌলবাদী মন ও ইসলামি রাষ্ট্রদর্শনের অলীক ভাবনা, অন্যটি হলো বামপন্থি ও কমিউনিস্ট চেতনা। মুসলিমরা যুক্তরাষ্ট্র ও পাশ্চাত্য বিরোধিতার এই ছবক পেয়েছে কুরআন, হাদিস ও মক্তব-মাদরাসার আধা-মূর্খ বক্তাদের নানা প্রকার গল্প-গুজব থেকে। প্রশ্ন হচ্ছে-বাম ও কমিউনিস্টরা কোনো প্রকার ধর্মগ্রন্থ এবং হাদিসের বয়ান বিশ্বাস করেন না। তারা হরহামেশাই বলেন, এগুলো আধুনিক যুগে অচল, প্রাচীন ও মধ্যযুগের আষাঢ়ে গল্প। তাদের এই বিশ্বাস সঠিক। এরপরও তারা কোন যুক্তিতে ইসরায়েল রাষ্ট্রের বিরোধিতা করেন? এই যে আত্মপ্রপঞ্চক কমিউনিস্ট কিংবা বামপন্থার অনুসারীরা-রাশিয়ার ক্রিমিয়া দখল, চেচনিয়ায় পুতিনের মুসলিম নিধন, ইউক্রেন আক্রমণ, সোভিয়েত রাশিয়ার আফগানিস্তানে সামরিক আগ্রাসন, চীনের উইঘুরে মুসলিমদের ওপর অকথ্য নির্যাতন, মিয়ানমারে চীন ও রাশিয়ার মদদপুষ্ট ফ্যাসিবাদী সেনাশাসকদের রোহিঙ্গা-গণ্যহত্যা, মধ্যপ্রাচ্যে প্রবাসী নারী শ্রমিকদের ওপর মধ্যযুগীয় নিপীড়ন, পাকিস্তানের বেলুচিস্থানে ও অধিকৃত কাশ্মীরে (তথাকথিত আজাদ কাশ্মির) পাকিস্তানি সেনাদের হত্যা-নির্যাতনের ব্যাপারে এই বাম-কমিউনিস্টদের তেমন সোচ্চার হতে দেখা যায় না। এখানেই ধরা পড়ে তাদের রাজনৈতিক ভণ্ডামি! চিন্তার অন্তঃসারশূন্যতা।

১০. স্মরণযোগ্য যে, ব্রিটিশ শাসিত ভারতে কমিউনিস্টরা ছিল সমাজতান্ত্রিক বলে পরিচিত সোভিয়েত রাশিয়ার মাউথ-পিচ বা ডেড়া-পিটানো পাঁইক- পেয়াদা।  যুক্তরাষ্ট্র যেহেতু স্বৈরতান্ত্রিক ও গণতন্ত্রবিরোধী নেতা ভ্লাদিমির লেনিন ও জোসেফ স্টালিনের রাশিয়ার বিরোধী, সুতরাং ভারতবর্ষের কমিউস্টি এবং বামরাও তীব্রভাবে যুক্তরাষ্ট্র, গ্রেড ব্রিটেন এবং গোটা প্রশ্চাত্যের গণতান্ত্রিক পুঁজিবাদ ও সমাজকল্যাণমূলক রাষ্ট্রগুলোর বিরুদ্ধে রাজনৈতিক অবস্থান গ্রহণ করেছিল। সেই পরনির্ভর ও শিকড়ছিন্ন চিন্তার রেশ এখনো চলছে বাংলাদেশের নতুন প্রজন্মের কমিউনিস্টদের মাঝে। এই গণ্ডিবদ্ধ ও কূপমণ্ডূক চিন্তাজগত থেকে নিষ্কৃতি পাওয়া তাদের জন্য বাস্তবেই কঠিন। অন্যদিকে শিল্পবিপ্লব-উত্তর যুগে ইউরোপের আধুনিক জ্ঞান, প্রযুক্তি, পেশাদার সামরিকবাহিনী এবং উন্নত শমরাস্ত্রের কাছে পরাজিত হয়ে ইউরোপের দখলকৃত ভূখণ্ড ছাড়তে হয়েছে মুসলিম আরব ও তুর্কি শাসকদের। তিনটি ক্রুসেডের রক্তস্মৃতি এবং প্রথম বিশ্বযুদ্ধে উসমানীয় খেলাফতের পতন-রাজতন্ত্র সমর্থক মুসলিম বুদ্ধিজীবী এবং লুটেরা চরিত্রের সামন্ত স্বভাবের নতুন প্রজন্মের মুসলিম নেতারা আজও ভুলতে পারেননি। এই ভুলতে না-পারার মনোজাগতিক যন্ত্রণার নর্দন-কুর্তন আজো আমরা দেখি ও শুনি সালাফি-ওয়াহাবি ধারার নারীবিদ্বেষী মৌলবাদী আলেম এবং ভণ্ড ওয়াজিয়ানদের ধর্মব্যবসার আসরে। তাদের লোক ঠকানোর ভেলকিবাজিতে।

১১. ইতিহাসের কী নির্মম পরিহাস! আমাদের দেশে কমিউনিস্ট কিংবা বাম বলে যারা পরিচিত, তারা এখন নিজদেশে এবং বিশ্বের দেশে দেশে জনসমর্থন হারিয়ে প্রকৃতার্থেই রাজনৈতিক সর্বহারায় পরিণত হয়েছেন। ভুলেভরা ও হীনতার অতিতস্মৃতি তড়পানো ছাড়া তাদের আর গর্ব বা গৌরব করার মত বিন্দুমাত্র কিছু নেই। রাজনীতিতে ও সমাজে জনসমর্থন বলতে তাদের কেন কিছু নেই? এর আর্থ-সামাজিক ও জাতীয়-আন্তর্জাতিক কারণ কি? এ সববিষয়ে কোনো প্রশ্নও জাগে না তাদের মোটা মাথায়! কী আর করা, তারা এখন জনতুষ্টিবাদী অবাস্তব রাজনৈতিক বিশ্বাস, আচার এবং যুক্তরাষ্ট্র, ইসরায়েল ও পাশ্চাত্যবিরোধী বেহুদা রাগী বক্তৃতা দিয়ে পরাজিত মনের জেদ এবং হীনমন্যতা প্রসমিত করার চেষ্টা করে থাকেন। সতেজ রাখতে চান তাদের কমিউনিস্ট-বিপ্লবীর শৌর্য-বীর্জ। আর এসব ছাই-ভষ্ম হাতড়ানো ছাড়া তাদের আর উপায়ই বা কী অবশিষ্ট আছে? এ এক অদ্ভূত আত্মরতির কানাগলি!

১২. প্রসঙ্গত, ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর হামাস যোদ্ধারা ইসরায়েলে দক্ষিণ এলাকায় এক পর্যটন কেন্দ্রে হামলা চালায়। এতে নারী, শিশু, বিদেশি পর্যটকসহ ১২০০ জন নিহত হয়। ২৫৩ জনকে জিম্মি হিসেবে আটক করে হামাসের হানাদাররা। এরপর ইসরায়েলের সেনাবাহিনী ফিলিস্তিনের গাজা এলাকায় সর্বাত্মক সামরিক আক্রমণ চালায়। এতে গাজায় নারী, শিশু, বৃদ্ধ, হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে আসা রোগী এবং হামাসের যোদ্ধাসহ নিহতের সংখ্যা এখন ৪০ হাজার ছুঁই ছুঁই। আহত মানুষের সংখ্যা ৮০ হাজার ছাড়িয়েছে। হামাসের এই সামরিক পাগলামি ফিলিস্তিনের গাজায় সাধারণ মানুষের জীবনে দুবির্ষহ দুঃখ-কষ্ট নামিয়ে এনেছে। গোটা ফিলিস্তিনে জায়নবাদী উগ্র ইহুদীদের সমরতান্ত্রিক ফ্যাসিবাদী কর্তৃত্ব বহাল রাখার সুযোগ করে দিয়েছে। ফিলিস্তিনের একটি ছোট অংশে মানুষের এই প্রাণ ও সম্পদহানীর জন্য হামাসের দায় কম নয়। দায় রয়েছে হামাসকে ইন্ধন জোগানো ইরান এবং ইরান-সমর্থক নতুন পরাশক্তি চীন ও রাশিয়ার।

১৩.  রাষ্ট্রের জন্ম : ইহুদী রাষ্ট্রের স্বপ্ন দ্রষ্টা হলেন সাংবাদিক ও বুদ্ধিজীবী  থিওডর হার্জেল (১৮৬০-১৯০৪ খ্রি.)। ইসরায়েল রাষ্ট্রের জন্ম ১৯৪৮ সালের ১৪ মে, ১৯১৭ সালে গৃহিত ব্যালফোর ঘোষণা অনুসারে। এই ঘোষণার নামকরণ করা হয়েছিল তৎকালীন ব্রিটিশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী লর্ড আর্থার জেমস ব্যালফোরের নামানুসারে। এই ঘোষণার নথি প্রস্তুত করা হয়েছিল সে সময়ের বিরাট পরাশক্তি ব্রিটেন ও যুক্তরাষ্ট্রের কূটনৈতিক অনুমোদন সাপেক্ষে। মনে রাখা ভালো যে ইসরায়েল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার প্রথম কারিগর ও পৃষ্ঠপোষক ছিল ব্রিটেন। এরপর দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ অবসানের পরপরই ইসরায়েলকে টিকিয়ে রাখার এবং শক্তি জোগানোর দায়িত্ব নিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র, বলতে গেলে গোটা পাশ্চাত্য বিশ্ব। ইসরায়েল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে তৎকালীন সোভিয়েত রাশিয়ার জোরালো সমর্থন ছিল। নবগঠিত ইসরায়েল রাষ্ট্রকে অ-পাশ্চাত্য দেশগুলোর মধ্যে প্রথম স্বীকৃতি দেয় কামাল আতাতুর্কের ধর্মনিপেক্ষ তুরস্ক। দ্বিতীয় ধাপে স্বীকৃতি দেয় রেজা শাহ পেহলভীর রাজতান্ত্রিক ইরান। ইরানে ১৯৭৯ সালে শিয়া ধর্মগুরুরা ক্ষমতা দখল করার পর পরিস্থিতি উল্টে যায়। ইরানি শিয়া আয়তুল্লারা ইসরায়েলের অস্তিত্ব অস্বীকার করেন। শুরু হয় ইরান-ইসরায়েল সামরিক দ্বৈরথ। যা আজো চলমান। ফিলিস্তিনি ভূখণ্ড ছিল তুরস্ককেন্দ্রিক ওসমানীয় সাম্রাজ্যভূক্ত। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ওনমানীয় খেলাফতের পতন হয়। তখন বিজয়ী পক্ষের অন্যতম প্রধান শক্তি  ব্রিটেনের ম্যানডেট বা শাসনাধীনে থাকে ফিলিস্তিন। এ সময় ১৯২২ সাল থেকে স্পেন ও ইউরোপের ভিন্ন দেশ, আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়া, রাশিয়া থেকে ইহুদী জনগোষ্ঠীর মানুষ ফিলিস্তিনে বসতিগড়ার জন্য আসতে থাকে। তবে ভুললে চলবে না, উসমানীয়  খেলাফতের অধীন এই ফিলিস্তিন অঞ্চলে আগে থেকেই ইহুদী বসতি ছিল। তবে এখানে আরবরা ছিল বিশাল আকারে সংখ্যাগরিষ্ঠ এবং ইহুদীরা ছিল সংখ্যায় খুব কম, ১০ শতাংশ। ইহুদীরা ভূমিকেন্দ্রিক জীবিকার মানুষ নন। তারা বণিকচরিত্রের। তাই ফিলিস্তিনে তাদের জমি-সম্পদ ছিল মাত্র ২ শতাংশ।

১৪. ইসরায়েল রাষ্ট্রের বয়স এখন ৭৬ বছর। আরবভূখণ্ডে অনারব এবং ইউরোপীয় শ্রেষ্ঠত্ববাদী এই দেশটি আরব দেশগুলোর শত্রুতা ও আক্রমণ মোকাবিলায় যুদ্ধ, অসাধারণ সামরিক শক্তি অর্জন, আরবে এবং বাকি বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সঙ্গে প্রকাশ্য এবং গোপন অর্থনৈতিক কূটনীতির মাধ্যমে এর সার্বভৌমত্ব পাকাপোক্ত করেছে। বিশেষ করে গত দশ বছরে ইসরায়েল অভাবনীয় অর্থনৈতিক উন্নতি করেছে। যুক্তরাষ্ট্রের ওপর এর অস্ত্র ও অর্থনৈতিক নির্ভরতা বহুলাংশে কমে গেছে। ১৯৮১ সাল পর্যন্ত ইসরায়েলের ব্যষ্টিক অর্থনীতিতে নির্ভরতা ছিল মোট জাতীয় বাজেটের ১০ শতাংশ। ২০২০ সালে তা দাঁড়ায় মাত্র এক শতাংশে। এ ছাড়া  আরবে ও এর বাইরের দুনিয়ায় ইসরায়েলের মিত্র বৃদ্ধি পেয়েছে। ইসরায়েলের সঙ্গে শান্তিচুক্তি রয়েছে মিসর ও জর্ডানের। ২০২০ সালে সংযুক্ত আরব আমিরাত, বাহরাইন, মরক্কো ও সুদান ইসরায়েলের সঙ্গে স্বাভাবিক বাণিজ্য সম্পর্ক স্থাপন করেছে। রাষ্ট্রসংঘের সদস্য রাষ্ট্রের সংখ্যা ১৯৩। এরমধ্যে ১৬৩টি দেশ ইসরায়েলকে স্বাকৃতি দিয়েছে। ইসলামি দুনিয়ায় প্রভাবশালী দেশ সৌদি আরবের সঙ্গে ইসরায়েলের রয়েছে অবৈরি সম্পর্ক। এসব বাস্তবতা বিবেচনায় না নিয়ে যারা ইসরায়েলের অস্তিত্ব অস্বীকার করেন, তাদের উট-বুদ্ধিতে পরিহাস করা ছাড়া উপায় থাকে না।

১৫. ইসরায়েলের চরম ডানপন্থি জায়নবাদীরা ফিলিস্তিনি জনতাকে আপন ভাবতে পারে না। তাদের ধর্মবোধ ও সাংস্কৃতিক ভিন্নতাকে সম্মান করতে জানে না। গায়ের জোরে ফিলিস্তিনিদের আরব-সংস্কৃতি এবং পুরনো জীবনবোধ সামরিক ট্যাংকের চাকায় গুঁড়িয়ে দিতে তারা সদা উদ্ব্যত। ডানপন্থি ইহুদীদের এই আচরণ আমানবিক ও রাষ্ট্রিক ন্যায়বিচার পরিপন্থি। ইসরায়েল রাষ্ট্রের স্বপ্নদ্রষ্টা থিওডর হার্জেলের রাষ্ট্রচিন্তা কিন্তু এমন ছিল না। উসমানীয় সাম্র্রাজ্যভূক্ত ফিলিস্তিন-ভূখণ্ডে ইহুদী রাষ্ট্রের নৈতিক নীতিমালা সম্পর্কে তিনি বলেছিলেন ওই নতুন রাষ্ট্র হবে ইহুদীদের আবাসভূমি, কিন্তু সেখানে অন্যধর্ম ও জাতিগোষ্ঠীর মানুষের নাগরিকত্ব থাকবে। ইহুদি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার তাত্তি¡ক আলোচনায় তিনি ধর্মনিপেক্ষতাকেও স্থান দিয়েছিলেন। কিন্তু তার এই বহুত্ববাদী গণসংস্কৃতির চিন্তা ইসরায়েলে এখন অনেক দুর্বল, কোণঠাশা। ইসরায়েল রাষ্ট্রটি এখন কড়া ডানপন্থি নেতানিয়াহুদের হাতে। ইসরায়েলে এই যে চরম ডানপন্থার উত্থান, এটা কি ইহুদীদের প্রতি শত শত বছরের বা সহস্র্রাব্দব্যাপী খ্রিস্টান ও মুসলিম সমাজের উগ্রপন্থিদের দ্বারা হত্যা-নিপীড়ন এবং সামাজিক-ধর্মীয় ঘৃণার ভীবৎস ও সর্বনাশা প্রতিবিম্ব? আমার মতে নিশ্চিতভাবেই তা। এই একই তাত্ত্বিক বিশ্লেষণ খাপে-খাপ মিলে যাবে হামাসের বিদ্রোহীদের বেলায়ও; কেননা, ফিলিস্তিনের অ-ইহুদী মানুষের প্রতি ইসরায়েলের সীমাহীন নিষ্ঠুর আচরণ, অবন্ধুসুলভ মনোভঙ্গি, দলব্ধ-সামাজিক ঘৃণা এবং সশস্ত্র আঘাত-বঞ্চিত-নিপীড়িত ফিলিস্তিনিদের একটি ছোট অংশকে হামাস-সমর্থক বানিয়েছে। তারা হাতে তুলে নিচ্ছে যুদ্ধের অস্ত্র। চলছে যুগযুগ ধরে ফিলিস্তিন-ইসরায়েল সংঘাত। তাই নয় কী? তা হলে সমাধান কী? দুই-রাষ্ট্র সমাধান কি সম্ভব? ফিলিস্তিন নতুন রাষ্ট্র হবে। ফিলিস্তিন ও ইরায়েল একে অপরকে স্বীকৃতি দেবে। একজন ফিলিস্তিনি আরব স্বাধীনভাবে সিদ্ধান্ত নেবেন তিনি ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের নাকি ইসরায়েলের নাগরিক হবেন। এরপর জাতিসংঘের সদস্য হয়ে এই দুই রাষ্ট্র সুপ্রতিবেশী দেশ হিসেবে সহাবস্থান করবে, এই হলো দুই-রাষ্ট্র সমাধানের নীতিসূত্র বা মডালিটি। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে,  ফিলিস্তিনের মুসলিম ও ইসরায়েলের ইহুদীদের মধ্যে প্রাচীন পুঁথি-কিতাবকেন্দ্রিক অধ্যাত্মবাদ মুক্ত সেকুলার (ধর্মনিরপেক্ষ) এবং অন্তর্ভ‚ক্তিমূলক সমসমাজের ভাবনা এবং শাসনতন্ত্রিক নীতিমালা ছাড়া দুই-রাষ্ট্র সমাধানে কি ইতিহাসখ্যাত এই আরব-ভূমিতে শান্তির পায়রা উড়বে? হামাসের শাসনাধীন ইসলামি শরিয়ার ভুজঙ্গ-রাষ্ট্র এবং নেতানিয়াহুদের জায়নবাদী নেউল-রাষ্ট্র কী শান্তি বজায় রেখে চলবে? সাপ ও বেজি কি এক খাঁচায় সহাবস্থান করে? মিলেমিশে থাকে?  তাছাড়া দুই রাষ্ট্র সামাধানের পক্ষে উভয় জনগোষ্ঠীর মধ্যে জন সমর্থন এখন ক্রমহ্রাসমান। ২০০৬ সালে এই দুই-রাষ্ট্র সমাধানের পক্ষে ছিল ফিলিস্তিনিদের ৭১ শতাংশ এবং ইসরায়েলিদের ৬৮ শতাংশ মানুষ। ২০১৮ সালে এ সমর্থন কমে যথাক্রমে ৪৪ এবং ৫৫ শতাংশ দাঁড়িয়েছে। অন্যদিকে ফিলিস্তিনি ও ইসরায়েলিদের এক রাষ্ট্রের নাগরিক হিসেবে অন্তর্ভূক্তিকরণের পক্ষে রয়েছে ৩৬ শতাংশ ফিলিন্তিনি, ১৯ ভাগ ইসরায়েলি ইহুদি এবং ৫৬ শতাংশ ইসরায়েলি আরব। একটি সামাজিক সমীক্ষার তথ্য মতে ‘দুই-রাষ্ট্র’ সমাধানের সমর্থক তরুণ ফিলিস্তিনি ও ইহুদিতের মধ্যেই কমছে বেশি। (তথ্য: ইসরায়েলি সেন্টার ব্যুরো অফ স্ট্যাটিসটিকস ও জেরুজালেম  ইন্সটিটিউট ফর ইসরায়েল স্টাডিস। ফিলিস্তিন সেন্টার ফর পলিসি অ্যান্ড সার্ভে রিসার্চ অ্যান্ড দ্য ইসরায়েল ডেমোক্রেসি ইন্সটিটিউট এবং তেল আবিব বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালিত এক সামাজিক জনমত সমীক্ষায়ও অনুরূপ তথ্য পাওয়া গেছে। তবে এই জনমত সমীক্ষাগুলো চালোনো হয়েছিল ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর হামাস কর্তৃক ইসরায়েলে সামরিক হামলা চালানোর আগে।)

ইসরায়েল ১৯৬৭ সালের যুদ্ধে মিসর, জর্ডান ও লেবানন এবং ফিলিস্তিনের ভূমি দখল করে নিয়েছে। এরপর থেকে ইসরায়েল ভূমি-সম্প্রসারণবাদী রাষ্ট্রিক নীতি গ্রহণ করে এবং সামরিক শক্তির বদৌলতে ফিলিস্তিনি ভূমিতে আরো নতুন ইহুদি-বসতি স্থাপন করেছে। ইসরায়েলে থাবামুক্ত ফিলিস্তিনি জমি-খণ্ড বলতে এখন আর কিছু অবশিষ্ট্য নেই। ভাববার বিষয়- একটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র গঠনের যে প্রাথমিক উপাদান, তা হচ্ছে, জনগণের কমন উইল (ঐক্যবদ্ধ ও সমন্বিত ইচ্ছা), শত্রুমুক্ত ও বিতর্কহীন ভূখণ্ড, সরকার ও শাসনতন্ত্রের নীতিশোষণার উপস্থিতি। তাছাড়া, ১৯৩৩ সালের মন্টেভিডিও কনভেনশন অনুযায়ী রাষ্ট্রের যে সংজ্ঞা-ফিলিস্তিন কি এখন সে শর্তগুলো পূরণ করে? যেমন-স্থায়ী জনগোষ্ঠী, একটি নির্দিষ্ট ভূসীমানা, সরকার ও অন্য দেশের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্কে যাওয়ার নৈতিক ও সাংবিধানিক নীতির উপস্থিতি। আমার প্রশ্ন-হামাস ও ফিলিস্তিন কর্তৃপক্ষ এক হয়ে বিশ্বের সামনে কি সেই সমাজিক-রাজনৈতিক-শাসনতান্ত্রিক-ভূখণ্ডগত নীতিঘোষণা তুলে ধরতে পেরেছে? আমার বিবেচনায় পারেনি। তাই আমার অভিমত মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার আমলে সূত্রায়িত করা দুই-রাষ্ট্র সমাধান এখন বাস্তবত মৃত।

১৬. ভূরাজনৈতিক গুরুত্ব : ফিলিস্তিন ও ইসরায়েল আরব ভূখণ্ডের দক্ষিণাংশে অবস্থিত। এই ভৌগলিক অঞ্চল ভূমধ্যসাগরের বেলাভূমি ও জর্ডান নদীর তীরবর্তী। এশিয়া, ইউরোপ ও আফ্রিকার রাষ্ট্র ও বাণিজ্যিক শক্তিগুলোর জন্য এই এলাকার সামরিক ও ব্যবসায়িক গুরুত্ব অপরিসীম। তাছাড়া এই ভূঅঞ্চল ইহুদী, খ্রিস্টান ও ইসলাম ধর্মের পীঠস্থান। এ অঞ্চলের রয়েছে ধর্মযুদ্ধ, রাজ্যবিস্তারের যুদ্ধ, উপনিবেশ স্থাপনের যুদ্ধ এবং জাতিরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার বহুবিদ রক্তক্ষয়ী লড়াই-সংগ্রামের ইতিহাস। আছে প্রাগৈতিহাসিক স্মৃতিকথা, শ্রত্রুতি, অন্ধবিশ্বাস ও লোককাব্যের বীরগাঁথা। বিশ্ব ইতিহাসের জন্য অতীব গুরুত্বপুর্ণ এমন একটি নৃ-তত্ত্ব সমৃদ্ধ ভূখণ্ডে হামাস এবং এর ক্ষুদ্র শরিক ফিলিস্তিন জিহাদের নেতৃত্বাধীন একটি ইসলামি শরীয়া-ভিত্তিক মধ্যযুগীয় রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা আধুনিক বিশ্বের পাশ্চাত্য পরাশক্তিগুলো কস্মিন কালেও চাইবে না, এমন কি রাশিয়াও না। অন্যদিকে হামাস নিয়ন্ত্রিত ফিলিস্তিন নিয়ে নতুন রাষ্ট্র হলে তা হবে ইরানের মোয়াক্কেল রাষ্ট্র (ক্লায়েন্ট স্ট্যাট বা বাফার স্ট্যাট)। আরবের জাতিরাষ্ট্রগুলো এবং এ অঞ্চলের বড় শক্তি তুরস্ক মোটেই চাইবে না ফিলিস্তিনে ইরানের লেজ-রাষ্ট্র সৃষ্টি হোক। যা কিনা হতে পারে ওয়াহাবি-সালাফিদের সামরিক ও সন্ত্রাসী আকড়া। তা হলে উপায়?

রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস, ধর্ম ও সামাজিক ঘৃণা-বিদ্বেষ, পাল্টা-পাল্টি রক্তপাত, ফিলিস্তিনি-ইসরায়েলি-দুই দিক থেকেই আছে। এই ঘৃণা-বিদ্বেষের বীজ-উৎস হচ্ছে জাবুর, ইনজিন, কোরআন এবং হাদিসে বর্ণিত প্রাচীন ও মধ্যযুগীয় গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব,  দেব-দেবীতে বিশ্বাস-অবিশ্বাসের দ্বন্দ্ব, সম্পদ-পশুর পাল, ফলের বাগান দখলের হানাহানি ও রাজতান্ত্রিক যুদ্ধ-বিদ্রহ। কিন্তু যে যুগ আর নেই। এখন অতি-আধুনিক যুগ। পাশাপাশি যুক্তি, প্রযুক্তিগত বিকাশ, কারিগরি বিদ্যা, নারীর ক্ষমতায়ন, মানবাধিকার, অন্তভর্‚ক্তিমূলক সামাজিক আত্তীকরণ এবং পরস্পরিক অংশীদারত্বের আলোকে বৈশ্বিক উন্নয়ন-অগ্রগতির যুগ। এই যুগে জঙ্গি জায়নবাদ ও জঙ্গিবাদী শরীয়াবাদের অনুসারীরা ফিলিস্তিন-ইসরায়েলে রাজত্ব করতে পারে না, সেই সুযোগ তাদের দেওয়া উচিত নয়।। যুগযুগ ধরে তারা এ ভূ-খণ্ডে অস্ত্রবাজি করে রক্ত ছিটিয়ে হোলি খেলবে তা কাম্য হতে পারে না। এই অমানবিক হানাহানি আরব অঞ্চলে চলমান অর্থনৈতিক উদারীকরণ, শান্তি, সমাজের প্রগতিশীল বিকাশ ও সমৃদ্ধির পথে বিরাট অন্তরায় হবে সন্দেহ নেই। ইসরায়েল ও ফিলিস্তিনিদের মধ্যে এখন দরকার সম্প্রীতি, সৌহার্দ্য, উন্নয়ন এবং অন্তর্ভ‚ক্তিমূলক ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রীয় নীতি। এই নীতি কিভাবে কার্যকর হতে পারে? সেই লক্ষ্যে নিচে উল্লিখিত শান্তি প্রস্তাব বা রূপকল্প নিয়ে ভাবনা-চিন্তা করা যেতে পারে।

এক.  ফিলিস্তিনে সক্রিয় হামাস, ফিলিস্তিনি ইসলামি জিহাদ এবং এ ধরণের ইরান সমর্থিত সকল ধর্মবাদী উগ্র সংগঠনকে নিরস্ত্র করতে হবে। নিষিদ্ধ করতে হবে। এ কাজের সূচনা পর্বে হামাস ও অন্য ফিলিস্তিনিদের অস্ত্র সমর্পণের সময়সীমা বেধে দিতে হবে। অস্ত্র ছেড়ে শান্তির জীবনে ফিরতে ইচ্ছুকদের পুনর্বাসনের দায়িত্ব ইসরায়েলকে নিতে হবে। পাশাপশি সামরিক আক্রমণ ও পাল্টা আক্রমণের শিকার হয়ে যে ফিলিস্তিনিরা বাস্তুচ্যুত হয়ে মাতৃভূমি ছাড়া হয়েছে, তারা নিজদেশে ফিরতে চাইলে সেই সুযোগ অবারিত রাখতে হবে। অন্তত ২৫ বছর। উদ্বাস্তু শিবির থেকে ফিলিস্তিনে ফিরে আসাদের পেশাভিত্তিক প্রশিক্ষণ ও পুর্নবাসনের জন্য ফিলিস্তিন কর্তৃপক্ষ এবং ইসরায়েলকে অর্থ বরাদ্দ রাখতে হবে। এ কাজ শুরু করবে আরব লীগ, অরগানাইজেশন অব ইসলামিক কোপারেশন (ওইসি), যুক্তরাষ্ট্র ও পাশ্চাত্য রাষ্ট্রশক্তির সমর্থন নিয়ে জাতিসংঘের মধ্যস্থতায়। এ শান্তি প্রক্রিয়ার সূচনাপর্বে ইসরায়েল রাষ্ট্রকে রাজগুণের উদারতা ও বদান্যতা দেখাতে হবে। ইসরায়েলের কারাগারে বন্দি থাকা সকল রাজবন্দির নিঃশর্ত মুক্তি দিতে হবে। তাদের সামাজিক ও রাজনৈতিক পুনর্বাসনের দয়িত্ব ইসরায়েলকে নিতে হবে।

দুই. এ ক্ষেত্রে ইসরায়েস রাষ্ট্রকে ফিলিস্তিনিদের ওপর সামরিক নির্যাতন বন্ধ করতে হবে। প্রভাবশালী আন্তর্জাতিক মধ্যস্থতাকারীর উপস্থিতিতে উভয় পক্ষের মধ্যে যৌক্তিক আলোচনার মাধ্যমে ফিলিস্তিনিদের ভূমি, বাড়ি ও ফসলের খেত জবরদখল করা বন্ধ রাখতে হবে। ইসরায়েলের সামরিক আক্রমণে নিহত, নিখোঁজ ও আহতদের পরিবারকে অর্থ সহযোহিতা ও বাসস্থান নির্মাণ করে দিতে হবে। এ কাজের অর্থ সরবরাহ করতে হবে ইসরায়েল, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, জার্মানি, ফ্রান্স এবং এ কাজে স্বেচ্ছায় অংশ নিতে আগ্রহী কোনো রাষ্ট্র ও আন্তর্জাতিক সংস্থাকে। 

তিন. ফিলিস্তিনের রাফা, গাজা ও পশ্চিম তীর শাসনের জন্য অবাধ নির্বাচনের মাধ্যমে স্বায়ত্ত-শাসন কর্তৃপক্ষ গঠন করতে হবে। এ কর্তৃপক্ষের কোনো সামরিক বাহিনী থাকবে না। তবে পুলিশবাহিনী থাকবে। এই কর্তৃপক্ষই ইসরায়েলের সঙ্গে আগামী দিনে অন্তর্ভূক্তিমূলক সামাজিক উন্নয়ন-অগ্রগতির নীতিকৌশল ঠিক করবে। সামাজিক ও ধর্মকেন্দ্রিক বিরোধগুলো নিরসন করবে, নিরপেক্ষভাবে।

চার. রাষ্ট্রিক ভূখণ্ডগতভাবে ফিলিস্তিন হবে ইসরায়েলি রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্বের অধীন, এই সার্বভৌমত্ব একক কারো নয়, ইসরায়েল ও ফিসিস্তিনের জনগণের সম্মিলিত স্বইচ্ছার ফল। আগামী ২০ বছর ফিলিস্তিন থাকবে পূর্ণাঙ্গ স্বায়ত্ত শাসিত এলাকা। তবে, ফিলিস্তিনিদের থাকবে ইসরায়েলি নাগরিকত্ব ও পাসপোর্ট। এরপর যুক্তরাষ্ট্রীয় কিংবা কনফেডারেটিভ শাসনতন্ত্র প্রণয়ণের জন্য গোটা ফিলিস্তিন ও ইসরায়েলে অবাধ ও নিরপেক্ষভাবে সংবিধান সভার নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। ওই সংবিধান সভা ‘প্রজাতান্ত্রিক ইসরায়েল-ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের’ সেক্যুলার সংবিধান প্রণয়ন করবে। সেই সংবিধান প্রণয়নে বুদ্ধিবৃত্তিক পরামর্শ দেবেন জাতিসংঘ এবং ফিলিস্তিনি শাসন-কর্তৃপক্ষ ও ইসরায়েল মনোনীত আন্তর্জাতিক মানের মানবাদিকার নেতা ও সংবিধান বিশেষজ্ঞরা।

পাঁচ. ফিলিস্তিনের গাজায় সন্ত্রসবাদী সংগঠন হামাস ও ফিলিস্তিন ইসলামি জিহাদিদের শায়েস্তা করার সামরিক অভিযানের বিরুদ্ধে বিশ্বের দেশে দেশে বিক্ষোভ হয়েছে। এই বিক্ষোভের তীব্রতা যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপেই ছিল বেশি। বাংলাদেশসহ পাকিস্তানেও ফিলিস্তিনের স্বাধীনতা এবং গাজায় ইরায়েলি হামলা বন্ধের দাবিতে মিছিল ও বিক্ষোভ হয়েছে। এ সময় কলেজ-বিশ্ববিদ্যায় মিলিয়ে ১৩০টিরও বেশি উচ্চবিদ্যাপীঠে বিক্ষোভ হয়। তখন কমবেশি দুই হাজার শিক্ষার্থীকে গ্রেফতার করে পুলিশ। অনেক ছাত্র-ছাত্রীর বিরুদ্ধে কড়া একাডেমিক ব্যবস্থা নিয়েছে তাদের স্ব স্ব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। এই বিক্ষোভকারী শিক্ষার্থীদের দাবি ছিল তাদের রাষ্ট্রকে ইসরায়েলে সঙ্গে ক‚টনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন করতে হবে। পাশাপাশি তাদের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে ইহুদিদের পরিচালিত বহুজাতিক কোম্পানির সঙ্গে অনুধান, গবেষণা-তহবিল ও অ্যাকাডেমিক চুক্তি বালিত করতে হবে। তরুণ মনের হালকা উদ্দীপনায় এসব দাবি স্লোগান হিসেবে মন্দ না। কিন্তু বৈশ্বিক উদারবাদী অর্থনীতি ও প্রযুক্তি-বিজ্ঞানের দুনিয়া বড় কঠিন। যার সিংহভাগই রয়েছে ইহুদি ব্যবসায়ীদের হাতে। চাইলেই কেউ বা কোনো রাষ্ট্র বৈশ্বিক অর্থনীতিতে ইহুদিদের বিশাল আকার বহুজাতিক কোম্পানি এবং ডিজিটাল প্রযুক্তিকে এড়িয়ে চলতে পারে না। ছাত্র-ছাত্রীদের মন নবীন, নিষ্পাপ। তারা দুর্বল ও নিষ্পেষিতের পক্ষে দাঁড়াবে এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু তারা কি জানে হামাস ও ফিলিস্তিনি ইসলামিক জিহাদের গুহাবাদী মতাদর্শ কত ভয়ংকর! যারা কিনা তাবৎ পৃথিবীর ইহুদি, নাসারা ও অন্য সব ধর্ম ও সংস্কৃতি ও জীবনবোধের মানুষকে ফ্যাসীবাদী ইসলামের গোলামির শৃঙ্খলে চিরতরে আবদ্ধ করতে চায়। আমার প্রশ্ন, আধুনিক পৃথিবীর নারী-পুরুষরা কি ইসলামী সন্ত্রাসীদের গাদা-দুম্বার পুঁতিগন্ধময় গোয়ালে বন্দি হতে রাজি হবেন?

প্রিয় পাঠক, বর্তমান যুগ হচ্ছে গণতন্ত্র, মানবাধিকার, নারীমুক্তি, সমন্বিত বৈশ্বিক উন্নয়ন, সমাজকল্যাণমূলক রাষ্ট্র বিনির্মাণ ও বিজ্ঞানের যুগ। এই আধুনিক প্রযুক্তির যুগে প্রাচীন ও মধ্যযুগের মতো ধর্মের ভিত্তিতে মারামারি ও হানিহানি কাম্য নয়।  কোনো ধরনের কিতাববাজি, শাস্ত্রবাজি, সাম্প্রদায়িক হানাহানি এবং জাতিগত বা ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর মানুষকে নির্মূলীকরণ পৃথিবীর যেখানেই হোক, এর সঙ্গে যারাই জড়িত, আমরা তাদের নিন্দা করি। নিপীড়নকারী এসব অপশক্তির বিনাশ চাই। হামাস, হিজবুল্লাহ, ফিলিস্তিনি ইসলামি জিহাদ এবং রাষ্ট্র হিসাবে ইরান- এমনই সব হানাহানি ও রক্তপাতের অপশক্তি। যারা কি না গোটা বিশে^ ইসলামি সাম্রারাজ্য কায়েমের চিন্তা করে। নারী ও মুক্তিকামী জনতার বিকাশ রুদ্ধ করে দিতে আশ্রয় নেয় শ্বেতসন্ত্রাসের। এই অপশক্তিগুলোর ধ্বংস হওয়া এখন সময়ের ব্যাপার মাত্র। মধ্যপ্রাচ্যের আধুনিক ও নতুন প্রজন্মের বিজ্ঞানমনস্ক নেতৃত্ব ক্রমেই জেগে ওঠছে। সমাজ ও রাষ্ট্রব্যবস্থা সংস্কারের সময়োপযোগী পদক্ষেপ নিচ্ছেন তারা। এর সামাজিক মিথষ্ক্রিয়ার ধাক্কায় হামাস, হিজবুল্লাহ ও ইরানের শিয়া মোল্লাদের মরণবিণ বেজে ওঠছে। সম্প্রতি ইরানের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে সংস্কারপন্থি ও শান্তিপ্রয়াসী নেতা মাসুদ পেজেশকিয়ানের বিজয় সে ইঙ্গিত-ই দেয়। বাংলাদেশে হোক, যুক্তরাষ্ট্রে হোক, এমন কি ইউরোপে হোক, মধ্যপ্রাচ্যের এই প্রগতিশীল সমাজ বিকাশের সম্মুখগতি যারা ধরতে পারেন না, তারা কোন ধরনের কমিউনিস্ট, বাম, গণতন্ত্রী কিংবা মানবতাবাদী, তা আমার বোঝে আসে না।                                                              

সহায়ক গ্রন্থ :-

১. সিক্রেটস অব জায়োনিজম, লেখক: হেনরি ফোর্ড, অনুবাদ: ফুয়াদ আল আজাদ, গার্ডিয়ান পাবলিকেশনস, বাংলাবাজার,  ঢাকা

২. ইহুদি রাষ্ট্র : থিওডর হার্ৎজেল 

৪. ISRAEL: and the Clash of Civilisation, By Jonathan Cook

৫. মধ্যপ্রাচ্য অতীত ও বর্তমান, মূল লেখক: ইয়াহ্ইয়া আরমাজানী, অনুবাদ : ড. মো. ইনামুল হক 

৬. এ ছাড়া- ইসরায়েল, ফিলিস্তিনি ও আরবের ইতিহাসের ওপর আমার দীর্ঘদিনের অধ্যয়নজাত উপলব্ধি

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
Archive
 
সাম্প্রতিক পোষ্টসমূহ