Banner
বাংলাদেশ ও ভারতের সমাজ, রাষ্ট্র ও সভ্যতা বিষয়ে আরও একগুচ্ছ পত্র বিনিময় : অভিরূপ মুখোপাধ্যায় ও শামসুজ্জোহা মানিক

লিখেছেনঃ অভিরূপ মুখোপাধ্যায় ও শামসুজ্জোহা মানিক, আপডেটঃ July 26, 2024, 12:00 AM, Hits: 287

 

(পত্র প্রকাশ উপলক্ষ্যে কিছু কথা : অভিরূপ মুখোপাধ্যায়ের সাথে আমার ও শামসুল আলম চঞ্চলের যে সকল পত্র বিনিময় হয় সেগুলির মধ্যে কিছু সংখ্যক ইতিপূর্বে ওয়েবসাইট ‘বঙ্গরাষ্ট্র’-এ প্রকাশিত হলেও পরবর্তী সময়ের কিছু সংখ্যক পত্র বিশেষ করে যে পত্রগুলি পরবর্তী সময়ে অভিরূপ মুখোপাধ্যায় ও আমার মধ্যে বিনিময় হয়েছিল সেগুলির বেশ কিছু সংখ্যক অপ্রকাশিত রয়ে গেছে। গুরুত্ব বিবেচনা করে সেগুলির মধ্য থেকে আমাদের উভয়ের বাছাইকৃত কিছু সংখ্যক পত্র প্রকাশ করা হল। কিছু ক্ষেত্রে পত্রের অপ্রয়োজনীয় অংশ বাদ দেওয়া হয়েছে। যেখানে বাদ দেওয়া হয়েছে সেখানে …………………………. এই চিহ্ন ব্যবহার করা হয়েছে। — শামসুজ্জোহা মানিক, ২৬ জুলাই ২০২৪)

 

১৫ অক্টোবর, ২০২৩ তারিখের পত্রের উত্তর  

প্রিয় মানিকবাবু,

পূর্ববর্তী পত্রে আপনি ঠিকই বলেছেন, 'যদি উন্নত ও ন্যায়সঙ্গত পৃথিবীর জন্য কেউ অস্ত্রের মোকাবিলায় পাল্টা অস্ত্রের সাধনা করে তবে সেটা অন্যায় বা অকাম্য হবে কেন?' এ ব্যাপারে আমি পুরোপুরি একমত আপনার সাথে।

অস্ত্রের 'নৃশংস ব্যবহার'-এর কথা আমি বলেছি গত পত্রে। আপনি নিজের বক্তব্য সেই প্রসঙ্গে জানিয়েছেন। সেই সাথে আমারও নিজস্ব মত আছে। ব্যক্তি গান্ধীর কার্যকলাপ অবশ্যই অস্ত্রের বিরুদ্ধে ছিল; তবে সেই নিরস্ত্রীকরণটা কেবল ভারতীয় জনতার ক্ষেত্রেই সীমাবদ্ধ ছিল। অর্থাৎ ব্রিটিশ সরকার হত্যালীলা চালালে সেটাকে 'মহাত্মা' খুব একটা সহিংস মনে করবেন না, কিন্তু আমরা পাল্টা মারতে গেলে সেটা নাকি হিংসার পথে যাওয়া হয়ে গেল! হতে পারি আমরা সাধারণ ভারতবাসীরা নির্ঝঞ্ঝাট, স্বায়ত্তশাসিত এক জাতি, যারা বড়োসড়ো বিরোধের পথ এড়িয়ে চলেছি এতকাল; তাই বলে গান্ধীর একপেশে অহিংসপন্থা কি আদৌ সৎ মানুষ হবার লক্ষণ, না ব্রিটিশের ভারতীয় কেরানি হবার পরিণতি?

না, ব্যক্তিগত মতের দিক থেকে আমি গান্ধীপন্থার মতো ভণ্ড অহিংস নই। শাসককে সশস্ত্র রেখে জনতাকে নিরস্ত্র করে রাখার স্বৈরতান্ত্রিক রুচি আমার নেই। রাষ্ট্র যদি সামরিক শক্তিকে জননিপীড়নের কাজে লাগায়, তাহলে শাসিত হিসেবে আমরাও পাল্টা সশস্ত্র অভ্যুত্থানে যাব না কেন? এই ব্যাপারে বরং আপনার সাথে আমি একমত।

পাশাপাশি রাষ্ট্র যদি জনতার প্রকৃত প্রতিনিধির করায়ত্ত হয়ে যায়, তখন প্রশাসনের চরিত্রই বদলে যাবে; রাষ্ট্রকে অধীনস্থ করার মধ্য দিয়ে গণ প্রতিরোধ সম্পূর্ণতা পাবে। খারাপ জিনিস হচ্ছে যে, আমাদের উভয় বাংলার প্রশাসনিক কর্তারা নিপীড়নমূলক ভূমিকা নিচ্ছে। আশা করি, এর একটা ইতিবাচক প্রতিক্রিয়া শীঘ্রই দেখতে পাব।

সেই সময়টা আসলে সচেতন ব্যক্তি হিসেবে আমাদের সামাজিক ভূমিকাও অনিবার্য হয়ে পড়বে। সন্ন্যাস হল স্বার্থপরতার পথ, শুধু নিজেরই ভালোমন্দটুকু বোঝার আত্মকেন্দ্রিক নীচতা। তুলনায় সমাজ ও সংসারের জীবনধারা নিজেকে ত্যাগের বিনিময়ে অন্যকে রক্ষা করার শিক্ষা দেয়। এখন এর মধ্যে কোনটা উঁচু মানের সামাজিক মূল্যবোধ, আপনিই বলুন।

আপনি সুস্থ থাকবেন। আজকের মতো এইটুকুই।

ইতি,

অভিরূপ মুখোপাধ্যায়

17 Oct 2023

========================

Sent On, Thu, 19 Oct 2023

প্রিয় অভিরূপ বাবু,

আমরা কত রকম স্ববিরোধই না আমাদের চেতনা বা জীবনে ধারণ করি, তাই না? এই যেমন আমার সবচেয়ে প্রিয় কবি জীবনানন্দ দাশ হলেও তার কাব্যিক চেতনার কিছু মৌল দিকের সমালোচনা করে গত পত্রে লিখেছিলাম। অথচ আমার জীবনের নিঃসঙ্গ ও বিপর্যস্ত সমযগুলির এক উল্লেখযোগ্য অংশকে আমি সুখময় করতে চেয়েছি জীবনানন্দের দুঃখময় কবিতার চরণগুলি পাঠ ক’রে। জীবনানন্দের অনেক সমালোচনা শুনেছি। আমি তাদের সঙ্গে বিতর্কে যাই নাই। কারণ এটাকে আমার একান্ত ব্যক্তিগত অনুভবের জায়গা মনে হয়েছে। জীবনের অনেক সত্যকে কবি জীবনানন্দ তার মতো করে বলেছেন। সেটাকে সেভাবে নেওয়াই ভালো বলে মনে হয়। আসলে জীবনের সব সত্যকে সর্বদা নিক্তিতে মেপে নিখুঁতভাবে ওজন করা যায় না।

হয়ত দুঃখবোধ থেকে আমার জীবনের যাত্রাপথ নির্মিত হওয়ায় কবি জীবনানন্দ আমার এত প্রিয় কবি। আপনি জানেন, অষ্টম শ্রেণী থেকে আমি ধর্মবিরোধী। ধর্মবিরোধী থেকে আমি যেটা হয়ে উঠি সেটা হচ্ছে প্রবলভাবে ইসলাম-বিরোধী। এর প্রথম ও প্রধান কারণ নারীর প্রতি আমার অপরিমেয় শ্রদ্ধাবোধ ও ভালবাসা। ধর্মবিশ্বাস হারাবার পর মুসলিম সমাজের মানুষ হিসাবে এই ধর্মে নারীর ভয়ানক নিগৃহীত অবস্থানকে বুঝতে আমার আর সময় লাগে নাই। সুতরাং ধর্মবিশ্বাস ত্যাগের পর ইসলাম-দ্রোহী হিসাবে বেড়ে উঠি।

ধর্মবিশ্বাস থেকে মুক্তি আমার ভিতর যে মানবিকতার উন্মেষ ঘটায় সেটা আমার মনোজগতে আর একটা বিরাট ঘটনা ঘটায়। সেটা হচ্ছে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর থেকে হিন্দু নির্যাতন ও বিতাড়নের বিরুদ্ধে প্রতিক্রিয়া। আমি যখন বালক তখন পূর্ব বঙ্গে জনসংখ্যা ছিল সোয়া চার কোটি। ১৯৪৭ সালে বঙ্গভঙ্গের সময় যদি এই সংখ্যার মধ্যে ২৮ শতাংশ হিন্দু হয়ে থাকে তবে তাদের সংখ্যা যে, সোয়া কোটি থেকে দেড় কোটি ছিল তা বলা যায়। এখন এই বিপুল জনগোষ্ঠীর সংখ্যা প্রজন্ম পরম্পরায় আরও অনেক বৃদ্ধি পেয়েছে। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর থেকে আজ অবধি এই জনসংখ্যার বিরাট অংশের ক্রমাগত দেশত্যাগকে কল্পনায় নিন।

এদের অনেকে ছিল আমার পরিচিত জন, কেউ কেউ নানান সূত্রে বন্ধু কিংবা ঘনিষ্ঠ। চোখের সামনে বছরের পর বছর ধরে তাদের স্বভূমিচ্যুতি আমাকে ভয়ানকভাবে ব্যথিত করেছে। আমার মা ও নানীকে দিয়ে আমি বুঝেছি জন্মভূমির স্মৃতি মানুষকে কতটা ব্যাকুল করতে পারে। সর্বোপরি হিন্দুরা এ দেশে খুব নিরীহ, এবং এক সময় তাদের ভিতর মুসলিমদের তুলনায় অনেক বেশী গুণাবলী ছিল। দেশভাগের পরিণতিতে হিন্দুদের দুর্দশাও আমার রাজনৈতিক যাত্রাপথ নির্মাণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে।

যে কথা বলতে গিয়ে এত কথা বলা সেটা হল দুঃখবোধ। মানুষের জন্য, জীবনের জন্য আমার এই দুঃখবোধকে না বুঝলে আমাকে বুঝা যাবে না। জীবনের জন্য আমার এই অনন্ত বেদনাবোধকে কাব্যিক ভাষায় রূপ দেওয়ায় কবি জীবনানন্দের প্রতি আমার গভীর অনুরাগ।

তবে মাঝে মাঝে কবিতা লিখলেও আমি কবি নই। এবং আমার মধ্যে দুঃখবোধ যেমনই থাকুক আমি সর্বদা হয়ে থেকেছি বৃহত্তর মানুষের জন্য সুখসন্ধানী এক পথযাত্রী। এটা এমন এক পথযাত্রা যা আমাকে নিয়েছে বিপ্লবের পথে, প্রয়োজনে সেটা রক্তাক্ত বিপ্লবেরও পথে। এবং কোনও রকম ভণ্ডামি না করেই বলি, ভয়ঙ্কর বর্বরতা ও রক্তপাতের মধ্য দিয়ে প্রতিষ্ঠিত যে সমাজের ভিতর আমার জন্ম ও বিকাশ তাকে উৎখাতে পাল্টা বর্বরতা ও রক্তপাতের পথ পাড়ি দিতে হলে কেন সেটা আমি দিব না?

সামাজিক ক্ষেত্রে অবশ্য হিন্দু সমাজে বাস করে আপনার আমার মতো করে মানসিক গঠন হবার কথা নয়। হিন্দু ধর্মের অনেক সমস্যা আছে। তবে সেটা এই মুহূর্তে আমার জন্য প্রধান সমস্যা বা আলোচ্য বিষয় কোনাটাই নয়। আমার কাছে ইসলামের সমস্যাটাই সবচেয়ে বড় সমস্যা। বাংলাদেশে বাস করে আমাকে প্রতিমুহূর্তে এটাকেই মোকাবিলা করতে হয়। আমি ইসলামকে চিনেছি যুদ্ধাপরাধের ধর্ম হিসাবে। কুরআন-হাদীস পাঠ করলেই যুদ্ধাপরাধের ধর্ম হিসাবে ইসলামকে চিনতে এতটুকু কষ্ট হয় না। এর সঙ্গে যদি ইসলামের জন্ম থেকে তার বিস্তারের ইতিহাস পাঠ করা যায় তবে অন্তত তত্ত্বগতভাবে বুঝা যাবে কত ভয়ানক যুদ্ধাপরাধের ধর্ম এটা। এই যুদ্ধাপরাধী এক সমাজের ভিতরে থেকে এবং অব্যাহতভাবে তার বিরুদ্ধে লড়াই করে এখানে বেঁচে থাকা যে কী নিদারুণ এক অসাধ্য সাধন সেটা আমি প্রতিটি মুহূর্তে অনুভব করি। এতে অগ্রগমন আছে, পশ্চাদগমন আছে, সাহস আছে, কৌশল আছে। কিন্তু স্বাভাবিকভাবে আপনাদের দৃষ্টিতে কিছু অস্বাভাবিক আচরণ বা পদক্ষেপেরও আশ্রয় আমাকে নিতে হয়েছে। আসলে আমার জীবনটাই হয়ে গেছে অনেকখানি অস্বাভাবিক। আমি যদি পাশ্চাত্যের নিরুপদ্রব, ভদ্র ও সভ্য সমাজে অনেক আগে চলে যেতাম (যে সুযোগ আমি বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার অল্পসময় পরই পেয়েছিলাম এবং তার পরবর্তী কালেও একাধিকবার পেয়েছিলাম) তবে আমি কী হতাম তা জানি না; তবে এটুকু বলতে পারি যে, আমি আজকের এই আমি হতাম না। হয়ত বিমূর্ত এক শত্রুর বিরুদ্ধে কিছুকাল বিশুদ্ধ বুদ্ধিবৃত্তির লড়াই চালিয়ে এক সময় ভিন্ন সমাজের স্রোতে গা ভাসিয়ে পথ ও লক্ষ্য সবই হারাতাম। বরং তার পরিবর্তে এখানে লড়াইয়ের মধ্যে থেকে প্রতিমুহূর্তে লড়াইয়ের সংকল্প ও তেজকে শানিত করে চলেছি।

গান্ধী সম্পর্কে আপনার মূল্যায়ন চমৎকার। আসলে, লোকটাকে আমি মনের ভিতর থেকে ঘৃণা করি। তবে হিন্দু সমাজের পক্ষেই সম্ভব এমন এক নিকৃষ্ট চেতনার মানুষকে নেতৃত্বের এমন উচ্চতায় তুলে দেওয়া। ঠিকই আছে, যেমন জাতি তেমন তার নেতা হবে! ঠিক যেমন বাংলাদেশে স্বাধীনতা এবং স্বাধীনতা যুদ্ধের দায়-দায়িত্ব কিছুই না নিয়ে স্বাধীনতা যুদ্ধের নেতা, রাষ্ট্রের জন্মদাতা পিতা, ইত্যাদি আরও বহুকিছু হওয়া যায়! পৃথিবীর যাবতীয় নিকৃষ্টতার লালনভূমি যে আজ অবধি এই উপমহাদেশ হয়ে আছে তাতে সন্দেহ কী?

এমন জনগণ দিয়ে কী করবেন? সমাজতন্ত্র? গণতন্ত্র? এদের হাতে ক্ষমতা? এদের হাত দিয়ে কী পয়দা হতে পারে? এদের কাছ থেকে কোন্ উন্নত ব্যবস্থা বা কাঠামো আশা করতে পারেন?

আগে উপযুক্ত মানুষ তৈরী করতে হয়। মানুষ তৈরীর কাজ বাদ দিয়ে কাঠামোর সন্ধান করে লাভ নাই। যত উন্নত হোক সে কাঠামো কীভাবে তৈরী হবে কিংবা বাইরে থেকে চাপিয়ে দিলেও কীভাবে টিকসই হবে যদি তার উপযুক্ত মানুষ না থাকে? এই মানুষ গড়ার কাজটাই সবচেয়ে বড় কাজ। এটা শুধু বই পড়ে আর নিঃসঙ্গ কল্পচারিতায় হয় না।

আপনার শুভার্থী,

শামসুজ্জোহা মানিক

19 Oct 2023

========================

Sent On Oct 20, 2023, 12:10 PM

প্রিয় মানিকবাবু,

জীবনানন্দ দাশ আমারও প্রিয় কবি। তাঁর কবিতাকে আমি নিজের ক্ষেত্রেও ব্যক্তিগত অনুভবের জায়গাতেই আটকে রেখেছি মূলত। এই তো, সত্তর বছর আগেও এই সময়টায় জীবনানন্দ মৃত্যুশয্যায় ছটফট করছিলেন। পরশু তাঁর প্রয়াণদিবস।

এটা ঠিক যে, হিন্দু সমাজের শিথিল কাঠামোয় বেড়ে উঠেছি আমি। তাই ঐতিহ্যগতভাবে ব্যক্তিগত উদারতা কিছু পরিমাণে আছে বৈকি। চরিত্রের দিক থেকে এদেশি হিন্দু সমাজ ও তার শাস্ত্র অনেকটাই গ্রাম্য বুদ্ধিজীবীদের দর্শন দ্বারা পরিচালিত হয়েছে। ফলে এই সমাজের শেকড় যত না রাষ্ট্রের মধ্যে, তার চেয়েও বেশি সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে ছড়িয়ে আছে।

এবার তুলনা করুন ইসলামের অনুসারী মুসলমানদের সাথে এই হিন্দুদের সমাজ, চিন্তাধারাকে। প্রথমত, মুসলমানরা একটি রাষ্ট্রনির্ভর জাতি। মুসলমানদের আমি স্রেফ ধর্মীয় সম্প্রদায় হিসেবে বিচার করি না। একেশ্বর আল্লাহ্‌র বিধান বড়োজোর কোরানের দ্বীন ইত্যাদি হতে পারে। কিন্তু মুসলমানরা যেমন বলে, ইসলাম একটি পূর্ণাঙ্গ জীবনব্যবস্থা-- বস্তুত ইসলাম একটা আর্থসামাজিক মতবাদ বললে ভুল বলা হবে না। হিন্দু বা পৃথিবীর অন্য যে-কোনো ধর্মসম্প্রদায়ের সাথে ইসলামের এখানেই মূল তফাত যে, ইসলাম একটা আস্ত জাতির জন্ম দিয়েছে, যে জাতি বিশ্বজয়ের মধ্য দিয়ে জনভুক্তি ঘটিয়েছে। আর একটা জাতিকে রক্ষা করবে তার নিজস্ব রাষ্ট্রব্যবস্থা। ফলে ইসলামী সরকারগুলি ইসলামী জাতীয়তার প্রশাসনিক বহিঃপ্রকাশ বলে মনে হয়। ইসলামকে একটি আন্তর্জাতিক জাতীয়তাবাদ বললেও ভুল হবে না, যার নির্দিষ্ট জীবনপ্রণালী-প্রশাসন ইত্যাদি বর্তমান। এমন কোনো ধর্মসম্প্রদায় আছে কি, যারা একটা সামরিক রাষ্ট্রব্যবস্থাকে জন্ম দিয়েছে? ইসলাম সেখানে একটা ব্যতিক্রম। ফলে অধ্যাত্মের জগতে ইসলাম ততটাও বিস্তারলাভ করেনি, যতটা মর্ত্যলোকে সাম্রাজ্যবাদের মধ্য দিয়ে ইসলামের অনুসারীরা ছড়িয়েছে।

এরকম পাক্-ইসলামী রাষ্ট্রের উত্তরাধিকার আজকের বাংলাদেশ।  সেখানে এরকম একটা রাষ্ট্র-পরিপোষিত জাতির মুখোমুখি লড়াই করে গোটা জীবনটা কাটিয়ে দেওয়া আর সশরীরে বেঁচে থাকাটা সহজ কথা নয়। অন্তত আমি এপারের তুলনামূলক সুস্থির হিন্দু সমাজে থেকে সেটা বুঝতে পারব না। আর আপনি ঠিকই বলেছেন, মুসলমানদের সমাজে থেকে তাদের সাথে সংঘর্ষে জড়ানো আর পশ্চিমের নিরাপদ সমাজে বসে দূর থেকে পাটকেল ছোঁড়ার মধ্যে আকাশ-পাতাল তফাত রয়েছে।

তাই আপনি সাবধানে, সুস্থ থাকবেন। শুভেচ্ছা রইল।

আপনার শুভার্থী,

অভিরূপ মুখোপাধ্যায়

Oct 20, 2023

========================

Sent On 10 November, 2023

প্রিয় মানিকবাবু,

………………………………………………………………………………….……………………………… .………………………………………………………………………………….………………………………।

ইসলামের অনুরাগী এই মুসলমান সমাজের মধ্যে তার ভেতর থেকে নবজাগরণ গড়ে ওঠার খুব বেশি সম্ভাবনা দেখতে পাই না আমি। এমনকি যাঁরা মুক্ত চিন্তাবুদ্ধির মানুষ, যাঁরা ইসলামের প্রতিক্রিয়া থেকে নিজেদেরকে ছাড়িয়ে আনতে পেরেছেন, মোল্লাসমাজ তাদেরকে প্রায়ই নাস্তিক-শয়তানের চর-ইলুমিনাতির দালাল ইত্যাদি উপাধি দিয়ে একঘরে করে রাখে। সবচেয়ে বড়ো সমস্যা খোদ মুসলমান সমাজ তো বটেই। পাশাপাশি মুসলিম জনতার ওপর মোল্লাদের প্রভাব আর মোল্লাদের ওপর তাদের আস্থা হয়ে দাঁড়িয়েছে দু-মুখো তলোয়ারের মতো। বিশেষ করে মাদ্রাসায় এখনকার তরুণ মুসলিম প্রজন্ম একেকটা কট্টরপন্থী হিসেবে গড়ে উঠছে বলে দেখতে পাই। আর তারাই কদিন পর ইসলামিক স্কলার আর আলেমের বেশ ধরে প্রচারে নামবে। এ ক্ষেত্রে এই ইসলামিক ইন্টেলেকচুয়াল আর মুসলমান সমাজের মধ্যকার সম্পর্কের সুতোকে কোনোভাবে ছিঁড়ে ফেলা সম্ভব কি?

এর জন্যে হয়তো বা ইসলামিক স্কলার আর এই স্কলার তৈরির কারখানা মাদ্রাসাগুলির বিরুদ্ধে ধারাবাহিকভাবে লড়াই করতে হতে পারে। এবং সেই শক্তি খুব বেশি পরিমাণে মুসলমানদের ভেতর থেকে আসতে পারবে না, কারণ হল শরীয়ার কঠোর নিয়ন্ত্রণ। ফলে কোনো বহিঃসমাজ থেকে প্রত্যাঘাতের আশা করাটা অস্বাভাবিক নয়। হতে পারে ভারতের তরফ থেকে একটা সুশৃঙ্খল আঘাত নামবে ইসলামী সৌধের ওপর। কিন্তু রাজনৈতিক বাস্তবতা এমন, যেখানে সুন্নী কাঠমোল্লাদের এড়িয়ে গিয়ে (সংঘর্ষে গিয়ে নয়) একটু উদার বা শিয়াপন্থী দেশগুলোর সাথে বর্তমান কেন্দ্রীয় সরকার পররাষ্ট্রীয় সম্পর্কে আবদ্ধ হচ্ছে। ফলে যেটা ঘটছে, সেটা হল ইসলামের সাথে সংঘাতের জায়গায় পশ্চিম-ঘেঁষা মুসলিম দেশগুলির আনুকূল্যে বিশ্বমঞ্চে ইসলামের সংজ্ঞাই পাল্টে ফেলার চেষ্টা চলছে। এতে করে কট্টরপন্থার নখদাঁত আন্তর্জাতিকভাবে কিছুটা ভাঙবে বলে আশা করি আর বাংলাদেশেও পশ্চিম বা মধ্যপ্রাচ্য থেকে সমর্থনের ছুতোয় যে দাদাগিরি দেখায় আলেমরা, সেটাও কমে আসতে পারে, অর্থাৎ তারা কিছুটা সমঝে চলার নীতি নিতে পারে পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে।

এটা গেল সরকারি উদ্যোগ থেকে রাষ্ট্রীয় বিষয়টাকে বোঝা। কিন্তু ভারতীয় সমাজের মধ্য থেকে যদি দেখা যায়, তবে এত বছরকার ইসলামের তোষণকারী কেন্দ্রীয় স্তরের কংগ্রেস আর রাজ্যস্তরে সিপিআই(এম) এখন বিশেষ সরকারে নেই বটে, কিন্তু সমাজের কাছে তাদের গ্রহণযোগ্যতা অনেক ক্ষেত্রেই রয়ে গেছে। পুরোনো ভিত উপড়ে ফেলা দীর্ঘমেয়াদী কাজ। ফলে বাম-কংগ্রেসী জমানায় পরিপুষ্ট বুদ্ধিজীবীরা আজও ফিলিস্তিনের মুসলিম নিয়ে হাহাকার করছে এবং এটাই ওদের বৈষয়িক চরিত্র। কারণ টাকার যোগান তো আসে বাইরে থেকে। আর বিরুদ্ধ গোষ্ঠী বলতে সংকীর্ণ হিন্দু লবি, যারা ভারতীয়ত্বের নাম করে ধর্মীয় মাহাত্ম্য নিয়েই বেশি প্রচার করে বা ইসলামের নামে ওদের এজেন্ডা মতো সমালোচনা করে। ফলে ভারত, বিশেষ করে পশ্চিমবাংলার সমাজে মুসলমানদের বিরুদ্ধে বিশেষ হেলদোল নেই বললেই চলে। সরকারি বয়ানের বাইরে বেরিয়ে যে বিপ্লবী শক্তি বেড়ে উঠতে দেখেছি ইতিহাসে আমরা বারবার, সেই শক্তির প্রকাশ এখনো অবধি খুব বেশি পরিমাণে নেই। তবে ইদানীং পুরোনো কিছু বামপন্থী মানুষ বাংলায় তৃণমূলের মাফিয়ারাজের বিরোধিতা করতে গিয়ে মুসলমানদের আগ্রাসী চরিত্রকে সমালোচনা করছে বলে দেখতে পাই। এরা পুরোপুরি আরএসএস-এর আদর্শে বিশ্বাসী না-হলেও বাংলাভাগ বা এই ধরনের জিনিসকেও মেনে নিতে পারে না। এরকম বিদ্বজ্জন সংগঠিত আকার নিতে পারে সেটা একটা সূত্রপাত হতে পারে। কিন্তু প্রায়শই ইসলামের সমালোচনাকে দেখানো হয় যেন 'অসহায়, গরিব' মুসলমানদের ওপর বিজাতীয় আক্রমকরা আগ্রাসন চালাচ্ছে। ফলে বুঝতেই পারছেন এতদিনকার বিপুল ইসলাম-চাটা এলিট সম্প্রদায়কে ধ্বংস করে ইসলামের সমস্যাকে নজরের সামনে আনাটা বেশ দুরূহ ব্যাপার, অন্তত পশ্চিমবাংলায়। কিন্তু বাংলাদেশে পৃথক অবস্থা। সেখানে মুসলমানরা এতই সংখ্যাগরিষ্ঠ যে, অন্য সম্প্রদায়গুলির মুক্তিসংগ্রামই ইসলামের বিরুদ্ধে অশনি-সংকেত হয়ে দাঁড়াতে পারে। অন্তত পার্বত্য বাংলাদেশকে যেভাবে নোংরামোর মধ্য দিয়ে দখলে রাখা হয়েছে, সেটা আওয়ামীর বজ্জাতি ছাড়া আর কিছুই নয়।

আজকের মতো এটুকুই। ভালো থাকবেন।

আপনার হিতাকাঙ্ক্ষী,

অভিরূপ মুখোপাধ্যায়

10 November, 2023

========================

Sent On 5 Nov, 2023

প্রিয় অভিরূপ বাবু,

গতকাল ‘বঙ্গরাষ্ট্র’-এ আলাপচারিতা – (১) প্রকাশের পর তার লিংক এবং একটা সংশ্লিষ্ট কপি আপনাকে পাঠিয়েছিলাম। …………………………………………………………………………।

অল্পস্বল্প কিছু কাজ করলেও আলাপচারিতা – ১ নিয়ে আমি যে খুব সন্তুষ্ট তা নয়। আমার মনে হয়েছে অনেক বিষয়কেই আমি স্পষ্ট করতে পারি নাই, যার ফলে অনেক পাঠকের মনে অনেক জিজ্ঞাসা ও অতৃপ্তি রয়ে যাবে। তবু একটু ভিন্নভাবে হলেও নিজের একান্ত অভিজ্ঞতালব্ধ উপলব্ধির কথা বলতে শুরু করলাম। আসলে এটা একটা বক্তব্যের সমাপ্তি নয়, বরং শুরু। আলাপচারিতার আরও পর্ব লিখতে পারলে হয়ত আরও কিছু বিষয়কে ক্রমশ পাঠকের নিকট পরিস্ফুট করতে পারব।

আপনি আপনার ২০ অক্টোবর, ২০২৩ তারিখের পত্রে হিন্দু ও মুসলিম সমাজ ও মানস সম্পর্কে যে মন্তব্য করেছেন তার সাথে আমি একমত। তবে প্রশ্ন, এই বর্বর অবস্থা থেকে মুসলিম সমাজকে মুক্ত করায় ভূমিকা রাখবে কারা? একটা পর্যায় পর্যন্ত ইউরোপ এ ক্ষেত্রে ইতিবাচক ভূমিকা রাখলেও সাম্রাজ্যবাদী ও উপনিবেশবাদী শক্তি হিসাবে তার উত্থান তার সেই ভূমিকাকে আর এগিয়ে নিতে দেয় নাই।

৭১১ খ্রীষ্টাব্দে মুহাম্মদ বিন কাসিমের সিন্ধু বিজয়ের সময় থেকে ধরলে ভারতবর্ষে মুসলিম আগ্রাসন ও শাসন প্রায় ১,৩১২ বৎসরেরও কিছু বেশী সময় পার করেছে। এর মধ্যে ১৭৫৭ খ্রীষ্টাব্দে পলাশীর যুদ্ধে বাংলায় ইংরেজ বিজয়কে ধরলে ভারতবর্ষে মুসলিম শাসন কিংবা তার ঐতিহ্য টিকে ছিল ১০৪৭ বৎসর সময়। এই এক হাজার এবং ব্রিটিশ উপনিবেশিক শাসনের দুইশ’ বছর এই দুই কালপর্ব হচ্ছে সাম্রাজ্যবাদী ও উপনিবেশবাদী শাসনের যাঁতাকলে ভারতবর্ষের পিষ্ট হবার অভিজ্ঞতার কাল। আরও পূর্ববর্তী কালে শক-হুনদের আক্রমণ ও আগ্রাসনের অভিজ্ঞতা ভারতবর্ষের থাকলেও তার মধ্যে কিছু ভিন্নতা আছে। ভালো বা মন্দ যেমন ফলই ফলুক বিশেষ করে হিন্দু ধর্মের সাহায্যে ভারতবর্ষ সেগুলিকে আত্মস্থ করেছে। ফলে এইসব আগ্রাসনকে ভারতবর্ষের নিজস্ব ইতিহাস-ঐতিহ্য থেকে পৃথক করা অতীব কঠিন।

ভারতের সবচেয়ে বড় ব্যর্থতা ইসলামী ও ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ ও উপনিবেশবাদের ছায়া থেকে বেরিয়ে আসতে না পারা। ইউরোপ কিন্তু ইসলামী আগ্রাসন ও শাসনের সকল প্রভাব অনেক আগেই ঝেড়ে ফেলেছিল। এই ঝাড়ার প্রক্রিয়ায় তার শুধু ক্রুসেড নয়, বরং সবচেয়ে বড় কথা তার নবজাগরণ বা রেনেসাঁর পথ ধরে ধর্ম থেকে মুক্ত পৃথিবীর পথে জয়যাত্রা। ক্রুসেড দিয়ে তা ইসলামকে সবলে প্রতিহত করেছে আর রেনেসাঁ দিয়ে তা খ্রীষ্টধর্মের আধিপত্য থেকে মুক্ত হয়ে পৃথিবী জয়ের পথে যাত্রা করেছে।

অর্থাৎ ক্রুসেড তথা খ্রীষ্টধর্ম দ্বারা ইসলামী আগ্রাসনকে প্রতিহত করলেও পৃথিবী জয় করতে গিয়ে ইউরোপ খ্রীষ্টধর্ম তথা ধর্মের শাসন থেকেও নিজেকে মুক্ত করেছে। ভারতবর্ষও ইসলামী শাসনকে প্রতিহত করতে না পারলেও ইসলাম ধর্মকে তার সমাজ জীবনে অনেকটাই প্রতিহত করেছে হিন্দু ধর্মের সাহায্যে। ইসলামের ভয়ঙ্কর প্রতিক্রিয়ার তুলনায় হিন্দু ধর্মের এইটুকু ইতিবাচক অবদানকে আমাদের স্বীকার করে নিতে হবে। কিন্তু ইউরোপ যা খ্রীষ্টধর্মের সাহায্যে পেরেছে ভারত তা হিন্দু ধর্মের সাহায্যে পারে নাই। ইসলামকে অনেকটা প্রতিহত করতে পারলেও তার এলাকা থেকে উচ্ছেদ করতে পারে নাই। আর ইউরোপের মতো আগ্রাসনকারীর ভূমিকায় অবতীর্ণ হওয়া তো দূরের কথা।

নারীত্ব ও মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ এবং যুদ্ধাপরাধের ধর্ম ইসলাম থেকে মানুষের মুক্তির জন্য যে কোনও বহিঃশক্তির হস্তক্ষেপ অপরিহার্য বলে আমি মনে করি। ইসলাম থেকে মুক্তির শক্তির নেতৃত্ব তার ভিতর থেকে জন্ম নিলেও তার বিকাশ ও পূর্ণাঙ্গতা ভিতর থেকে হবে বলে আমি মনে করি না। ইসলামের আক্রমণ ও আগ্রাসনের শক্তিকে ইউরোপ পরাভূত করলেও তাকে উৎখাতের শক্তি তা হারিয়েছে। সব কায়েমী শক্তির মতো তা এখন রক্ষণশীল, ফলে স্থিতাবস্থা রক্ষাকামী। মধ্যপ্রাচ্যে মুসলিম শক্তির সঙ্গে মাঝে মাঝে পাশ্চাত্যের দ্বন্দ্ব হলেও তা নিয়ে বেশী আশাবাদী হবার কারণ নাই।

আমার ধারণা ইসলাম থেকে মানব জাতিকে মুক্তিদানের জন্য এক মহাকায় শক্তির উত্থান ঘটতে পারে ভারত থেকে, যা ইসলামী সমাজ থেকে উত্থিত শক্তির সঙ্গে সমন্বিত হয়ে ইসলাম থেকে মুক্তির লড়াইকে নূতন ও চূড়ান্ত রূপ দিবে। কিন্তু হিন্দু ধর্মের কাঠামোবদ্ধ ভারতের পক্ষে এই ভূমিকা পালন সম্ভব নয়। ইউরোপ যেমন নবজাগরণ  ও আলোকায়নের মাধ্যমে ধর্মের গণ্ডী ভেঙ্গে বের হয়েছিল তেমন ভারতকেও সেটা পারতে হবে। আর তাহলে ভারত ইসলাম অধিকৃত সমগ্র মুসলিম পৃথিবীর সামনে মুক্তির দিশারী হয়ে দেখা দিবে।

সবশেষে বলি, মার্কসবাদ এবং ইউরোপীয় অর্থনীতিবাদী জ্ঞানতত্ত্বের প্রভাবে আচ্ছন্ন না থেকে আমাদেরকে সমাজ ও রাষ্ট্র গঠনে ধর্ম ও সংস্কৃতির যে অপরিমেয় ভূমিকা থাকে সেটাকে বুঝার চেষ্টা করতে হবে। অর্থনীতির ভূমিকা থাকে। কিন্তু সর্বদা সেটা প্রধান কিংবা নির্ধারক নয়। এমনকি অনেক ক্ষেত্রে অনেক বেশী গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দেখা দেয় ধর্মীয় কিংবা সাংস্কৃতিক অথবা উত্তরাধিকারসূত্রে প্রাপ্ত ঐতিহ্যিক বিষয়গুলি।

ভালো থাকবেন। আজ এখানেই বিদায় নিই।

আপনার শুভার্থী,

শামসুজ্জোহা মানিক  

5 Nov 2023

========================

Re: ১০ নভেম্বর, ২০২৩ তারিখের পত্রের উত্তর

Sent On Dec 5, 2023

প্রিয় মানিকবাবু,

২২ নভেম্বরে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি পত্র, বলা ভালো নিবন্ধ লিখে পাঠিয়েছেন আমাকে। সাধারণত অভিজ্ঞতার অভাব আর একপেশে ধারণার জন্য আমরা যারা মুসলিম সমাজের বাইরে বসবাস করি, তারা ভাবি মুসলমানদের এই আগ্রাসী প্রবণতার জন্য হয়তো বা একতরফা মোল্লাতন্ত্রই দায়ী। মোল্লাদের ভূমিকাটা এত বড়ো করে দেখানো হয় যে, মুসলিম শাসক শ্রেণি, যারা ক্রমাগত নিজেদের বাহ্যিক চরিত্র পাল্টে ফেলছে আর পশ্চিমের স্মার্ট-চতুর জীবনযাত্রার ভান করছে, তাদেরকে সেকুলার ভেবে আমরা ভুল করি। নীচের তলার একটা বিপুল নিম্নশ্রেণির মুসলিম লুম্পেন জনতা, তাদেরকে দেখেই আমরা ভাবি ইসলামের উত্তরাধিকার যেন এই দেড় হাজার বছরের পুরোনো আদবকায়দার রক্ষণশীল জনতা! ইসলামের রক্ষণশীলতাকে এভাবে প্রচারে রাখার ফলে আধুনিক পশ্চিমীকৃত মুসলিম অভিজাত, উচ্চবিত্তদের ঘাড় থেকে দোষটা নামিয়ে দিই সমাজের এই নিম্নশ্রেণির ঘাড়ে। অথচ ইসলামী সরকারের এই সেনাপ্রধান, আমলা, ব্যবসায়ীরাই যে আধুনিকতার ছদ্মবেশে প্রাচীন লুম্পেন লুটেরার বংশধর, সেটা বেমালুম চোখের বাইরে চলে যায়। ফলে ইসলামী প্রতিক্রিয়াশীলতার প্রাণশক্তির উৎস অজানাই থেকে যাচ্ছে অমুসলিম সমাজের কাছে।

ফলে পত্রের আকারে লিখিত এই নিবন্ধটির বিশেষ গুরুত্ব রয়েছে। আমরা যারা সব দোষ প্রায় অশিক্ষিত মুসলিম সমাজ আর মোল্লা-ইসলামিক স্কলারদের দিকেই ঠেলে দিই আর প্রকৃত চালিকাশক্তি 'আধুনিক' মুসলিম শাসকদের গুরুত্বহীন মনে করি, তাদের ভ্রান্তি দূর করার ক্ষেত্রে আপনার এই রচনাটির ভূমিকা অপরিসীম।

তার সাথে এই রচনায় বাংলাদেশে ইসলামের উৎখাতকারী বিপ্লবের চরিত্র এবং বহিঃরাষ্ট্রের সমর্থন বিষয়ে স্পর্শকাতর মন্তব্য রয়েছে। বাংলাদেশের আসন্ন নির্বাচনের সময় এই ধরনের লেখা প্রকাশ করলে সমস্যাই হতে পারে বরং।

                 ☆       ☆       ☆       ☆       ☆

বহিঃরাষ্ট্রের সমর্থন বিষয়ে ভাবতে গিয়ে উল্টো একটা সম্ভাবনার কথা মাথায় এল। এখানে কিছু একপেশে মন্তব্যও আমি সচেতনভাবে করব, যেটা আসলেই পশ্চিমবাংলার বেশ কিছু চিন্তাশীল মানুষের মত বলে ধরে নেবেন। আমি শুধু সেই মতামতটাকে প্রশ্নের রূপ দিচ্ছি।

ইন্দিরা গান্ধী আর কংগ্রেসী রাজনীতির বিরোধী বেশ কিছু মানুষকে আমি বলতে শুনেছি যে, ভারত বাংলাদেশের স্বাধীনতার যুদ্ধে অংশ নিয়ে ভুল কিছু করেনি। তবে ভারতের নাকি আওয়ামীর সরকারকে ওভাবে বাংলাদেশে রাজত্ব চালাতে দেওয়াটা উচিত হয়নি; ʼ৭১-এর যুদ্ধে পাকিস্তানের পরাজয়ের পর গোটা বাংলাদেশকে নাকি ভারতের সাথে যুক্ত করে নেওয়া সবচেয়ে সঠিক কাজ হত! এতে করে অন্তত এত হিন্দু মানুষের নিধন আর শরণার্থীর অবস্থা হত না বলে সেরকম মানুষরা মত দেন। এঁরা অনেকেই এককালে বামপন্থী রাজনীতির সাথে যুক্ত থেকেছেন। ইদানীং বিজেপির রাজনীতির সাথে যুক্ত ব্যক্তিরাও অখণ্ড ভারত আর সেখানে পাকিস্তান আর বাংলাদেশকে অন্তর্ভুক্ত করে নেবার কথা বলে থাকে। ধর্মের ভিত্তিতে ভাগ হওয়া ভারতভূমিকে নাকি অখণ্ড রূপে ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়াটা দেশপ্রেমিকের কর্তব্য!

এরকম উদ্ভট দাবি ভারতীয় সাম্রাজ্যবাদ কিনা, সেটা অন্য প্রশ্ন। তবে পরিস্থিতির জটিলতা দেখে আমি একটা সহজ প্রশ্ন করব।

এমন যদি হয়, বাংলাদেশের নির্বাচন-পরবর্তী অবস্থায় আওয়ামীর একচেটিয়া প্রভাব ক্ষুণ্ণ হল এবং ভারত বাংলাদেশের বিনিয়োগের বাজারে নাক গলানো শুরু করল, তাহলে ভারতের ভূমিকাকে আপনি কী চোখে দেখবেন?

লোকায়ত বিপ্লবের দৃষ্টিকোণ থেকে প্রশ্নটা হবে এরকম: বাংলাদেশের লোকায়ত বিপ্লব ভারতীয় উপমহাদেশে লোকায়ত স্বায়ত্তশাসন প্রতিষ্ঠার সূত্রপাত হতে পারে। কিন্তু বাংলাদেশ তথা ভারতে লোকায়ত জনশাসন প্রতিষ্ঠার আগেই ভারত সরকার যদি বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে প্রভাব খাটাতে চেয়ে থাকে, তাহলে লোকায়ত বিপ্লবের সম্ভাবনা কি সময়ের দিক থেকে আরও কয়েক ধাপ প্রতিক্রিয়াশীলতায় পিছিয়ে যাবে? উত্তরের অপেক্ষায় রইলাম।

আজকের মতো এটুকুই। আপনি সুস্থ থাকার চেষ্টা করবেন এই শীতের মরসুমে। বিদায়।

আপনার কল্যাণকামী,

অভিরূপ মুখোপাধ্যায়

5 December, 2023

========================

৫ ডিসেম্বর, ২০২৩ তারিখে পাঠানো পত্রের উত্তর

প্রিয় অভিরূপ বাবু,

মুসলিম সমাজের শাসক বা নেতৃত্বকারী শ্রেণীর স্বরূপ ও ভূমিকা সম্পর্কে আমরা যেহেতু অভিন্ন মত পোষণ করি সেহেতু এ নিয়ে আর আলোচনার প্রয়োজন নাই। তবে আমাকে এ কথা মানতে হবে যে, খুব সংক্ষিপ্ত হলেও মুসলিম শাসক শ্রেণী সম্পর্কে আপনার ব্যাখ্যার ধার ও ভার আমাকে মুগ্ধ করেছে।

এখন আপনার পত্রের অন্যান্য বিষয় প্রসঙ্গে আসি। আপনার পত্র খুব সংক্ষিপ্ত হলেও সেখানে আপনি কিছু গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন উত্থাপন করেছেন। তবে এই সকল প্রশ্নের উত্তর আমার দিক থেকে কী হতে পারে সেটা বুঝা আপনার নিকট কঠিন হবে না যদি বর্তমান ভারতীয় রাষ্ট্রের অন্তর্ভুক্ত সমাজ ও রাষ্ট্র সম্পর্কে আমার মূল্যায়ন আপনার জানা থাকে। আপনি জানেন যে, এই সমাজ ও রাষ্ট্র ব্যবস্থা সম্পর্কে আমি উঁচু ধারণা পোষণ করি না। এই সমাজ যেমন মূলত ধর্ম বিশেষত সংখ্যাগুরু জনসংখ্যার ধর্ম হিন্দু ধর্মের কাঠামোবদ্ধ তেমন রাষ্ট্রটা উপনিবেশিক কাঠামোবদ্ধ বলে আমি মনে করি। স্বাভাবিকভাবে ভারতের অর্থনীতিতেও ধর্ম ও রাষ্ট্রের বৈশিষ্ট্যের প্রভাব পড়েছে। এই বাস্তবতা ভারতের প্রগতি বা অগ্রযাত্রাকে অব্যাহতভাবে বাধা দান করে চলেছে। এটা সমাজ ও রাষ্ট্রের নাগরিকদের প্রকৃত গণতন্ত্রের পথে অগ্রযাত্রাকেও বাধাগ্রস্ত করে রেখেছে। সুতরাং ভারত ও তার নাগরিকদের উন্নয়ন ও গণতন্ত্রের পথে অগ্রযাত্রাকে বাধামুক্ত করার জন্য অলোকবাদী ধর্ম বিশেষত হিন্দুধর্ম এবং উপনিবেশিক রাষ্ট্র কাঠামোর উচ্ছেদ সাধন অপরিহার্য। এটা সম্ভব কেবলমাত্র একটি সামাজিক, রাষ্ট্রিক ও অর্থনৈতিক বিপ্লবের মাধ্যমে। একদিকে, ভূ-রাজনৈতিক বাস্তবতা, অপর দিকে, ঐতিহাসিক উত্তরাধিকারের অভিন্নতার কারণে ভারতীয় বিপ্লব আমার নিকট অপরিমেয় গুরুত্ব বহন করে। কিন্তু আমি যে সামাজিক ও রাজনৈতিক বাস্তবতায় বাস করি সেটা হচ্ছে পূর্ব বাংলা বা আজকের গণ-প্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্র। ভারতীয় বিপ্লবে যদি আমরা কোনও প্রকার ভূমিকা রাখতে চাইও তবে সেটাও সম্ভব কেবলমাত্র বাংলাদেশে যে বিপ্লব ১৯৭১ সালে প্রতিবিপ্লবী আওয়ামী লীগের নেতৃত্ব এবং কংগ্রেস নেতৃত্বাধীন ভারত-রাষ্ট্রের হস্তক্ষেপের কারণে অসমাপ্ত হয়ে রয়েছে সেটাকে সম্পূর্ণ করেই। 

আমার মনে হয় বিশেষত ভারত-রাষ্ট্রের প্রকৃত রূপ সম্পর্কে ধারণা থাকলে বাংলাদেশে তার ভূমিকা সম্পর্কে মোহ বা বিভ্রান্তি থাকবার কোনও কারণ থাকে না। ১৯৪৬ সালের ‘গ্রেট ক্যালকাটা কিলিংযের’ নায়ক তৎকালীন অবিভক্ত বাংলার প্রধান মন্ত্রী হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী ও তার শিষ্য শেখ মুজিবের নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগের ঘৃণ্য রূপকে ব্যাখ্যা করতে গিয়ে এই মুহূর্তে আমার একটা উপমা দিতে ই্চ্ছা করছে, সেটা হল আপাদমস্তক মানুষের মল-মূত্র মাখা একটা মানুষ। হ্যাঁ, এই গু-মুতমাখা মানুষকে ’৭১-এ পরম যত্নে ভারত তার কোলে তুলে নিয়ে রেখে গু-মুত মাখবার ট্রেনিংটা আরও ভালোভাবে দিয়েছিল। বিজেপি সরকারও তার পূর্ববর্তী কংগ্রেস সরকারের ভূমিকাই অব্যাহত রেখেছে। আজ যখন শেখ হাসিনা সরকারকে বিশেষ করে ভারতের মোদী সরকারের সমর্থনপুষ্ট দেখতে পা্ই তখন কল্পনায় আসে মোদী কর্তেৃক আলিঙ্গনাবদ্ধ সর্বাঙ্গে গু-মুত মাখা শেখ হাসিনার ছবি। এভাবে হাসিনার মললিপ্ত শরীরের ক্লেদ মোদীর শরীরেও মাখামাখি হয়েছে। বাংলাদেশের জায়গায় দাঁড়িয়ে বাংলাদেশ ও ভারতের বর্তমান সম্পর্ককে যদি এভাবে বর্ণনা করা যায় তবে সেটা বোধ হয় অত্যুক্তি হবে না।

বাংলাদেশে হাসিনার ভূমিকার তুলনা কী দিয়ে আপনাকে বুঝাব? পশ্চিম বঙ্গের ইতর ও লুম্পেন শ্রেণীর বর্তমান নেতা মমতা বন্দোপাধ্যায় কিছুটা তুলনীয় হতে পারেন। কিন্তু পশ্চিম বঙ্গ এক বৃহৎ রাষ্ট্রের একটা ক্ষুদ্র প্রদেশ মাত্র। সেই সঙ্গে প্রধানত হিন্দু অধ্যুষিত, যাদের এক বৃহৎ অংশ এখন যতই লুম্পেন ও ‍নিকৃষ্ট হোক আর যা-ই হোক, নিকৃষ্টতায় আমাদের এ বাংলার সংখ্যাগুরু ‘চইরা’ বাঙ্গালী মুসলমানদের ধারেকাছেও যাবার ক্ষমতা রাখে না। এবং কেন্দ্রে যিনি প্রধান মন্ত্রী হিসাবে এই বৃহৎ রাষ্ট্রের হাল ধরে আছেন তিনি সকল সমালোচনা সত্ত্বেও ব্যক্তিগত জীবনে অনেক গুণের অধিকারী মানুষ। ফলে মমতার সামনে এমন অনেক বাধা আছে যা হাসিনার সামনে নাই; কারণ হাসিনা একটা রাষ্ট্রের সর্বময় তথা একনায়কী ক্ষমতার অধিকারী প্রধান মন্ত্রী। তিনি বাংলাদেশের সর্বনিকৃষ্ট ইতর, নৃশংস ও দুর্বৃত্তদের নিয়ে গঠিত শাসক শ্রেণীর প্রকৃত প্রতিনিধিত্বকারী রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগের মাথায় বসে আছেন। এই দল কত নিকৃষ্ট ও ভয়ঙ্কর হতে পারে সেটা আমরা ১৯৭২ থেকে ১৯৭৫ পর্যন্ত দেখেছি। সবশেষে ২০০৯ থেকে ২০২৩ পর্যন্ত পনেরো বৎসর ধরে দেখছি। ক্ষমতা হাতে নিয়ে ও পেয়ে এরা দেশটাকে নরক বানিয়ে ফেলেছে। এরা এখন ব্যাপক জনসমাজে কতটা ঘৃণিত সেটা আপনারা বাহির থেকে বিশেষত ভারতে থেকে হয়ত কল্পনাও করতে পারেন না।

আওয়ামী লীগ সরকারের পৃষ্ঠপোষক হয়ে গত শতাব্দীর ’৭০-এর দশকে ভারত যেমন এ দেশের ব্যাপক জনমনে ঘৃণার পাত্র হয়েছিল এখনও তেমন বা তার চেয়েও বেশী হচ্ছে। এই ভারত-বিদ্বেষ আবার হিন্দু বিরোধিতাকে বৃদ্ধি করে। কারণ বাংলাদেশের উত্তরাধিকারে রয়েছে ধর্মের ভিত্তিতে ভারত ভাগ ও পাকিস্তান প্রতিষ্ঠায় উদ্যোগী ভূমিকা। ফলে ভারত-বিদ্বেষ সাধারণ মুসলিমদেরকে ইসলামের দিকে বেশী করে ঝুঁকতে অনুপ্রাণিত করতে পারে। ১৯৭১-এর ১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার পর আওয়ামী লীগের লুণ্ঠন, দুর্নীতি, সন্ত্রাস জনমানসে যে প্রতিক্রিয়া ঘটায় সেটা মুসলিম জনসাধারণকে শুধু যে লীগ-বিদ্বেষী করে তুলে তা-ই নয়, অধিকন্তু লীগের পৃষ্ঠপোষক ও ঘনিষ্ঠতম মিত্র ভারত হওয়ায় তাদেরকে ভারত-বিদ্বেষীও করে তুলে, যেটা আবার হিন্দু বিরোধী সাম্প্রদায়িকতাকে নবতর শক্তি যোগাতে থাকে।

এভাবে পাকিস্তান কালে বাঙ্গালীর জাতি চেতনার জাগরণ ও পশ্চিম পাকিস্তানের সঙ্গে দ্বন্দ্বের ফলে যে ধর্মীয় সাম্প্রদায়িক চেতনা ক্রমক্ষয়িষ্ণু হচ্ছিল সেটা বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার পর লীগ সরকারের কর্মকাণ্ডের কারণে নবতর শক্তি নিয়ে জেগে উঠতে শুরু করল। লীগ সরকার গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা ও জাতীয়তাবাদের নামে সকল দুষ্কৃতি করায় সাধারণ মানুষ এই শব্দগুলির প্রতিও আস্থা হারাতে থাকে। বৈরী পরিস্থিতির চাপে ও নিজেদের ভুলেও আওয়ামী লীগ সরকারের বিরুদ্ধে সশস্ত্র সংগ্রামে নিয়োজিত কমিউনিস্ট বিপ্লবীরা তখন মূলত ধ্বংসপ্রাপ্ত। এটা ছিল ইসলামী সাম্প্রদায়িক চেতনার পুনরুত্থানের জন্য এক উপযুক্ত সময়। এই পরিস্থিতির সুযোগ নিতে সেনাবাহিনী থেকে এগিয়ে এলেন প্রথমে জিয়াউর রহমান এবং তার পরবর্তী সময়ে এরশাদ।

যুক্তবাংলা বা বঙ্গরাষ্ট্রের রাজনীতি দিয়ে আমি এ দেশে এই প্রবণতাকে যতটা সম্ভব রুখতে চেষ্টা করছি ১৯৭২ থেকেই। বাঙ্গালী জাতির বৃহত্তর ঐক্যের প্রেরণা যে এ ক্ষেত্রে কার্যকর শক্তি হতে পারে তার প্রমাণ হচ্ছে বিশেষ করে ধর্মের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে প্রায় নিঃসঙ্গ সৈনিক হলেও এই লড়াইকে আমার এভাবে এতকাল টিকিয়ে রাখতে পারা।

আপনার পত্রের শেষে আপনি যে প্রশ্ন করেছেন সেটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আপনি বলেছেন, ‘এমন যদি হয়, বাংলাদেশের নির্বাচন-পরবর্তী অবস্থায় আওয়ামীর একচেটিয়া প্রভাব ক্ষুণ্ণ হল এবং ভারত বাংলাদেশের বিনিয়োগের বাজারে নাক গলানো শুরু করল, তাহলে ভারতের ভূমিকাকে আপনি কী চোখে দেখবেন?

‘লোকায়ত বিপ্লবের দৃষ্টিকোণ থেকে প্রশ্নটা হবে এরকম: বাংলাদেশের লোকায়ত বিপ্লব ভারতীয় উপমহাদেশে লোকায়ত স্বায়ত্তশাসন প্রতিষ্ঠার সূত্রপাত হতে পারে। কিন্তু বাংলাদেশ তথা ভারতে লোকায়ত জনশাসন প্রতিষ্ঠার আগেই ভারত সরকার যদি বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে প্রভাব খাটাতে চেয়ে থাকে, তাহলে লোকায়ত বিপ্লবের সম্ভাবনা কি সময়ের দিক থেকে আরও কয়েক ধাপ প্রতিক্রিয়াশীলতায় পিছিয়ে যাবে?’

আপনার প্রশ্ন অত্যন্ত সারবত্তাপূর্ণ। এমন একটা ঘটনার অভিজ্ঞতা তো আমাদের আগেও হয়েছে। আমাদের বামপন্থী নেতৃত্বের ভুলে ও আমাদের সামগ্রিক অনভিজ্ঞতার কারণেও ভারতের হস্তক্ষেপে একাত্তর সালে পূর্ব বঙ্গের স্বাধীনতা যুদ্ধের নেতৃত্ব আওয়ামী লীগের হাতে চলে গিয়েছিল। তার কুফল বায়ান্ন বৎসর ধরে আমাদেরকে ভোগ করতে হচ্ছে।

তবে এখন সময়টা ’৭১ নয়। এটা ভালো হয়েছে যে, নির্ভেজাল দুর্বৃত্তের দল আওয়ামী লীগ দীর্ঘ পনেরো বৎসর একটানা ক্ষমতায়। বিশেষত বিগত পনেরো বছর ধরে তার ভয়ঙ্কর ও উন্মত্ত লুঠ, বিদেশে বেপরোয়াভাবে অর্থ ও সম্পদ পাচার, দেশের স্বার্থবিরোধী বিভিন্ন কর্মকাণ্ড এবং জনগণের উপর লাগামহীন অত্যাচার তাকে ভয়ানকভাবে জনবিচ্ছিন্ন ও জনগণের ঘৃণার পাত্রে পরিণত করেছে। হয়ত আওয়ামী লীগ সরকার আগামী ৭ জানুয়ারীতে ‘ডামি নির্বাচন’ অনুষ্ঠান করে তার দখলদারিকে আরও কিছু কাল চালিয়ে নিবে। কিন্তু তাতে কি্ ইতিহাসের গতিমুখ আওয়ামী লীগের পক্ষে যাবে? আমি সেটা মনে করি না। তার পতন এখন দূরবর্তী সময়ের ব্যাপার বলে আমি মনে করি না। হ্যাঁ, আওয়ামী লীগের পতন পরবর্তী সরকারের সময়ে ভারত সরকার এখানে নূতন করে প্রবেশ করতে পারে। তবে তখনকার আমাদের করণীয়কে এখনও পরবর্তী সময়ের হাতে ছেড়ে দেওয়াই সঙ্গত হবে। আগে বাংলাদেশে একটা বড় ধরনের পরিবর্তন ঘটুক।

আমার কাছে প্রধান সমস্যা এখন আওয়ামী লীগকেই মনে হয়। এমনকি আমাদের দেশের জন্য ভারত আমাদের জন্য প্রধান সমস্যা কখনই নয়। কারণ তা এখানে সরাসরি ক্ষমতায় নাই। লড়াইটা রাষ্ট্র ক্ষমতায় যারা আছে মুখ্যত ও প্রত্যক্ষভাবে তাদের সঙ্গেই হয়। ভারত যদি কিছু করে থাকে তবে সেটা ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের মাধ্যমেই করছে। একই কথা প্রযোজ্য চীন, রাশিয়া সম্পর্কেও। এখন এ দেশে তাদের ভূমিকাও লীগ সরকারের মাধ্যমেই ক্রিয়াশীল হচ্ছে।

এটা বিস্ময়কর যে, যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র পনেরো বছর আগে ভারতের সঙ্গে হাত মিলিয়ে আওয়ামী লীগকে ক্ষমতায় বসাতে ভূমিকা রেখেছিল আজ সেই ‍যুক্তরাষ্ট্রই আওয়ামী লীগের অধীনে এক তরফা নির্বাচনের বিরোধিতা করছে, আর এভাবে প্রকারন্তরে তার পতন চাইছে। আসলে পৃথিবীর রাজনীতির অনেক কিছু বদলে যাচ্ছে। আমরা যদি কোনও বিশেষ মতের প্রতি ও কোনও বৈদেশিক শক্তির প্রতি অন্ধ অনুগত না হই এবং চোখ-কান খোলা রেখে বিচারশীল হই তবে আন্তর্জাতিক শক্তি বিন্যাসের জাটলতাকে কাজে লাগিয়ে বাংলাদেশের বুকে আমাদের জাতীয় বিপ্লবকে সফল করায় আমরা সক্ষম হতে পারি।

আমার নিকট যে এই জাতীয় বিপ্লব একটা বৃহত্তর বিপ্লবের প্রথম ধাপ মাত্র সে কথা, আশা করি, আর নূতন করে ব্যাখ্যা করতে হবে না। এই সঙ্গে এটাও পুনরায় বলা দরকার যে, প্রথম ধাপ বাংলাদেশ কেন্দ্রিক হলেও এই বিপ্লব শুধু বাংলাদেশের মানুষ নিয়ে সংগঠিত হবে না। প্রথমে এটা ১৯৪৭-এ বাঙ্গালী জাতির ধর্মভিত্তিক বিভাজনকে অস্বীকার করে দাঁড়াতে চেয়ে পশ্চিম বঙ্গসহ ভারতে অবস্থিত সকল বাঙ্গালী জনগণকে এই বিপ্লবে সম্পৃক্ত করবে। এভাবে এই বিপ্লব ক্রমশ বৃহত্তর ভারতীয় জনগণকেও এই বিপ্লবের সঙ্গে সম্পৃক্ত করবে। সুতরাং বাংলাদেশের বিপ্লব হবে আফগানিস্তানসহ সমগ্র উপমহাদেশে লোকায়ত বিপ্লবের প্রথম ধাপ মাত্র। এই সঙ্গে এটাও স্পষ্ট করা দরকার যে, বাংলাদেশ থেকে সূচিত হওয়ায় এই বিপ্লবের একটা প্রধান অঙ্গীকার হবে ইসলাম থেকে মানব জাতির মুক্তি অর্জনে ভূমিকা রাখা। আমার লিখা ‘ইসলাম থেকে মুক্তির বিপ্লব’সহ (http://bangarashtra.net/article/1542.html ) আমার কিছু সংখ্যক রচনায় আমাদের বিপ্লবের এই আন্তর্জাতিক দিকটাকে তুলে ধরতে চেষ্টা করেছি। সুতরাং ইসলাম থেকে মানবতার বিশ্বব্যাপী মুক্তির বিপ্লবে বাংলাদেশের লোকায়ত বিপ্লব হতে পারে সূচনাবিন্দু। তেমনটা ঘটলে এই লোকায়ত বিপ্লবে অংশগ্রহণের মাধ্যমে ভারতবর্ষ তথা দক্ষিণ এশিয়া বিশ্বব্যাপী ইসলাম থেকে মুক্তির বিপ্লবেরও ঘাঁটিতে পরিণত হবে।

আশা করি, আমি আপনার কাছে আমার কিছু ভাবনা স্পষ্ট করতে পেরেছি। অবশ্য এখন পর্যন্ত এটা আমার ভাবনা মাত্র। বাস্তবে কী হবে সেটা সময় বলবে।

পত্র শেষ করার আগে যারা ’৭১-এ যুদ্ধে পাকিস্তানের পরাজয়ের পর ভারত কর্তৃক বাংলাদেশ দখল করার পক্ষে বলেন তাদের চিন্তার অসারতা সম্পর্কে আমি সামান্য কিছু কথা বলব। তারা মনে করেন এতে বাংলাদেশে হিন্দু নিধন ও অন্যান্য সাম্প্রদায়িক সমস্যার মীমাংসা হত। আসলে সমাজ, রাষ্ট্র কিংবা রাজনীতি এত সরল অঙ্কের সমীকরণে আগায় না।

তখন পূর্ব বাংলা বা আজকের বাংলাদেশের জনসংখ্যা ছিল প্রায় ৭ কোটি। ভারতেরও জনসংখ্যা এখনকার তুলনায় অনেক কম ছিল। এখন বাংলাদেশের জনসংখ্যা প্রায় ২০ কোটি। ভারতের জনসংখ্যা এখন ১৪০ কোটির কিছু বেশী। যেমনই হোক সমর শক্তির জোরে বাংলাদেশকে সেদিন যেমন আজও তেমন ভারতের পক্ষে পদানত করে রাখা সম্ভব নয়। হ্যাঁ, এক সময় খুব ক্ষুদ্র বহিরাগত হানাদার মুসলিম শক্তির পক্ষে ভারতবর্ষ জয় এবং দীর্ঘকাল পদানত করে রাখা সম্ভব হয়েছিল। সেটা কোন পরিস্থিতিতে ও কোন প্রেক্ষিতে সেটা নিয়ে আলোচনা করা যায়। তবে সেই পরিস্থিতি ও প্রেক্ষাপট কিছুই আর নাই। সুতরাং ব্রিটিশ উপনিবেশিকদের ভারতবর্ষ ত্যাগ করে যাবার সময় মুসলিমদের ভারতের ক্ষুদ্র একটা অংশের শাসন ক্ষমতা হাতে নিয়েই সন্তুষ্ট হতে হয়েছিল। এরপরের হিন্দু বা অমুসলিম ভারতের হাতে মুসলিম রাষ্ট্র পাকিস্তানের একাধিক পরাজয়ের অভিজ্ঞতা হয়েছে। অর্থাৎ পরিস্থিতি বদলেছে। সেটা কিন্তু সবার জন্যই প্রযোজ্য।

এই ধরনের মন্তব্য বা চিন্তা যারা করেন তাদের বর্তমান পৃথিবীর বাস্তবতাকেও হিসাবে নিতে হবে। বাংলাদেশে হস্তক্ষেপ করার ক্ষমতা ভারতের একচেটিয়াও নাই। চীন, যুক্তরাষ্ট্রসহ বিভিন্ন বিশ্বশক্তিও এখানে হস্তক্ষেপের ক্ষমতা রাখে। বাংলাদেশের ব্যাপক জনতা যদি এই বাস্তবতাকে কাজে লাগিয়ে এখানে একটা যুদ্ধ গড়ে তুলে তবে সেটাকে ভারতীয় আধিপত্যবাদী শক্তি কয়দিন দাবিয়ে রাখবে? আগেকার বিশ্বপরিস্থিতিতে যা-ই করা সম্ভব হোক আজকের পরিস্থিতিতে সেসব অনেক কিছুই আর সম্ভব নয়। অবশ্য আজকের পরিস্থিতিতেও সমাজ, রাষ্ট্র ইত্যাদি অপরবর্তনীয় নয়। কিন্তু সেই পরিবর্তনের জন্য জনমতের গুরুত্ব এখন এক অর্থে অনেক বেশী। যে কোনও পরিবর্তনের জন্য এখন নেতৃত্বের অনেক বেশী জ্ঞান, ধৈর্য ও কৌশলের অধিকারী হতে হয়। বিশেষত সংশ্লিষ্ট সমাজের ইতিহাস ও ঐতিহ্যের ভিতর থেকে ইতিবাচক ও কাঙ্ক্ষিত উপাদানসমূহকে চিহ্নিত করে পদক্ষেপ করতে হয়।

আমি এ বিষয়ের গুরুত্ব বিশেষভাবে অনুধাবন করেছি ইতিহাসের উপর কাজ করতে গিয়ে। বিশেষ করে আর্যতত্বের উপর কাজ করতে গিয়ে ইতিহাসের সত্য উদ্ঘাটন মানুষের চেতনায় কীভাবে কাজ করে সেটা ভালোভাবে দেখেছি ও বুঝেছি। শামসুল আলম চঞ্চলের সঙ্গে যৌথভাবে লিখা ও ২০০৩ সালে ঢাকা থেকে প্রকাশিত ‘আর্যজন ও সিন্ধু সভ্যতা’ প্রকাশের পর বাংলাদেশে যেভাবে সাড়া পাই তাতে আমি বিস্ময়াভিভূত হই। অবশ্য এই উচ্ছ্বাসের শুরু আরও আগে ১৯৯০ থেকে যখন আমি ‘ভারত-ইতিহাসের সূত্র সন্ধান’ লিখে তার হাতে লিখা পাণ্ডুলিপির ফটোকপি পাঠকদেরকে পড়তে দিতে শুরু করি। এটাই নূতন মাত্রা পায় ১৯৯৪ সালে পাকিস্তান প্রত্নতত্ত্ব ও যাদুঘর বিভাগের তৎকালীন মহাপরিচালক ডঃ মোহাম্মদ রফিক মোগলের নিকট থেকে আমাদের আর্যতত্ত্বের প্রতি সমর্থন লাভের পর।

এই সমগ্র ঘটনা আমাকে অনেক কিছু নূতন করে ভাবতে বাধ্য করে। আমাদের আর্যতত্ত্বের প্রতি পাকিস্তান ও বাংলাদেশের মুসলিম সমাজ থেকে এমন উচ্ছ্বাসপূর্ণ সমর্থন ও আগ্রহের কারণ বুঝবার জন্য আমাকে অনেকটা সময় দিতে হয়েছে। বিশেষ করে সেটা যখন পশ্চিম বঙ্গ ও ভারতের পণ্ডিত অথবা পাঠক মহলের নির্লিপ্ত এবং কখনও বা বিরূপ মনোভাবের বিপরীতে ঘটে। বাংলাদেশে ‘আর্যজন ও সিন্ধু সভ্যতা’ প্রকাশের পর এখানে পাঠক মহলে তার উচ্ছ্বাসপূর্ণ সাড়া যে আমাকে অভিভূত করেছিল সে কথা একটু আগেই বলেছি। এবং আমি বুঝতে চেয়েছি যেখানে আমার প্রত্যাশা খুবই কম ছিল সেখানে কেন এমন বিপুল প্রাপ্তি আর যেখান থেকে আমার প্রত্যাশা বিপুল ছিল সেখান থেকে আমাদের প্রাপ্তি এত সামান্য কেন। বিশেষ করে পশ্চিম বঙ্গে তো সেটা ছিল শূন্যের কোঠায়।

আমার এই জিজ্ঞাসার উত্তর পেতে মুসলিম ও হিন্দু সমাজের বৈশিষ্ট্য ও মনস্তত্ত্ব সম্পর্কে আমাকে অনেক কিছু নূতন করে বুঝতে হয়েছে। এ সম্পর্কে বিশদ আলোচনা এখন করব না। সেটা এখানে অনেকটা অপ্রাসঙ্গিকও হবে। তবে এখানে খুব সংক্ষেপে বিশেষত মুসলিম মানসের একটা বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে কিছু কথা বলব।

মুসলিম মানস সম্পর্কে এটা বুঝা অত্যাবশ্যক যে, সুদীর্ঘ কালব্যাপী দিগ্বিজয়ী যোদ্ধা ও শাসকের ভূমিকা রাখায় সাধারণ মুসলিমের মনে প্রকাশ্যে অথবা গোপনে মুসলিম হিসাবে তীব্র গৌরব ও শ্রেষ্ঠত্বের বোধ কাজ করে। কিন্তু বিগত কয়েক শত বৎসর যাবত বিশেষ করে পাশ্চাত্যের হাতে পরাজয় ও লাঞ্ছনা সেটাকে নিদারুণ রূপে আহত করেছে। কিন্তু বাস্তব জগতে মুসলিম শ্রেষ্ঠত্ব মার খেলেও মুসলিম চেতনার মর্মে তার জন্য ক্ষুধা থেকেই যায়। আর্যরা যে সিন্ধু সভ্যতার মানুষ ইতিহাসের এই সত্যের আবিষ্কার কিংবা ঘোষণা মুসলিম মনকে নূতন চেতনায় জাগিয়ে তুলে। তখন দক্ষিণ এশিয়ার মানুষ হিসাবে সিন্ধু সভ্যতার উত্তরাধিকারী তথা আর্য গৌরবেরও অধিকারী হিসাবে নিজেদেরকে দেখতে পায়।

এখন তো মুসলিমদের বীরগাথার যুগ শেষ হয়ে গেছে। বিশেষত উচ্চবর্গের মুসলিমরা সেটা খুব ভালো বুঝে। এখন তারা যদি বুঝে যে, আজকের বিশ্বশাসক ইউরোপীয়রাও ভারত থেকে যাওয়া আর্য বা সিন্ধু সভ্যতার অধিবাসীদের উত্তরাধিকারী কিংবা তাদের বংশধর তখন মূল আর্যভূমির উত্তরাধিকারী হিসাবে দক্ষিণ এশিয়ার মুসলিমরা নবগৌরব বোধে বলীয়ান হয়। দক্ষিণ এশিয়া কিংবা ভারতবর্ষের মানুষ হিসাবে সিন্ধু সভ্যতার মধ্যে নিজেদের শিকড় দেখতে পেয়ে উজ্জীবিত হয়। সিন্ধু সভ্যতার লোকায়ত তথা ধর্মমু্ক্ত রূপ তাদেরকে বরং অধিকতর আকৃষ্ট করে। কারণ শত শত বৎসর হিন্দু সমাজের সঙ্গে এক ধরনের সংঘাতমূলক সম্পর্কে থাকবার দরুণ তাদের মনে হিন্দু ধর্মের প্রতি যে ঘৃণা বা বিদ্বেষ সঞ্চিত থাকে সেটাও এ ক্ষেত্রে বাধা হিসাবে থাকে না। ইতিমধ্যে সিন্ধু সভ্যতার অতুলনীয়তা সম্পর্কে মুসলিম পণ্ডিত বা শিক্ষিত মহলও মোটামুটি জ্ঞাত। সুতরাং আমরা যখন আর্যতত্ত্ব ও সিন্ধু সভ্যতার উপর নূতন দিক থেকে আলোকপাত করেছি তখন সেটা বাংলাদেশের শিক্ষিত সমাজকে এভাবে নাড়া দিয়েছে। বলা যায় অনেক ক্ষেত্রে অনেকে আবেগাপ্লুত হয়েছেন। এভাবেও বিশেষ করে বাংলাদেশে আমার একটা বিশেষ অবস্থান তৈরী হয়েছে বলে আমি ধারণা করি। অর্থাৎ শুধু আমার দীর্ঘ রাজনৈতিক পটভূমি ও ভূমিকা নয়, উপরন্তু আমার ইতিহাস তত্ত্বও বাংলাদেশে ধর্মের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে আমার রক্ষাব্যূহ হিসাবে কাজ করেছে বলে মনে হয়।

অর্থাৎ একটা মনস্তাত্ত্বিক লড়াইয়ে আমি মুসলিমদের মুসলিম হিসাবে গৌরববোধের জায়গাকে ধ্বংস করলেও তাদেরকে লোকায়ত সিন্ধু সভ্যতার উত্তরাধিকার দিয়ে বিকল্প গৌরববোধের জায়গা দিয়েছি। মানুষের আইডেনটিটি কিংবা আত্মপরিচয় নিয়ে বাঁচতে চাওয়ার গুরুত্বকে বুঝতে হয়। মানুষ একা বাঁচতে পারে না। তাকে সমাজবদ্ধ হয়ে বাঁচতে হয়। আর সমাজবদ্ধ হতে গিয়ে তাকে সমাজ গড়তে হয়। এভাবে পরিবার, গোত্র, উপজাতি এবং বৃহত্তর জাতি গঠনের মধ্য দিয়ে মানুষের আত্মপরিচয়ের ক্রমবিকাশ ঘটতে থাকে। সমাজ গঠনের গতিধারায় এই আত্মপরিচয় এমনই শক্তি নিয়ে গড়ে উঠে যে, অনেক সময় মানুষ সেই পরিচয় রক্ষার জন্য যে কোনও ত্যাগ স্বীকার করতে কিংবা আত্মবিসর্জন দিতেও দ্বিধা করে না। এর পরেও মানুষ কতকগুলি পরিস্থিতিতে তার ধারণা বা বিশ্বাসের ভিত্তিতে আত্মপরিচয় বদলাতেও পারে। কিন্তু তারও একটা নিজস্ব নিয়ম এবং শর্ত থাকে। যাইহোক, বিষয়টা সহজভাবে ব্যাখ্যাযোগ্য নয়। তবু এই বিষয় বুঝবার উপর আমাদের বিশেষ মনোযোগী হওয়া উচিত। আজকের মতো মনে হয় এখানেই আমার বক্তব্য শেষ করা যায়। 

আপনার সুস্বাস্থ্য ও কল্যাণ কামনা করে এখনকার মতো এখানেই বিদায় নিই।

আপনার শুভার্থী,

শামসুজ্জোহা মানিক

Dec 10, 2023

========================

Sent On Jan 1, 2024

প্রিয় মানিকবাবু,

ভারত যে স্বাধীনতা লাভ করেছে, সেটা আমার মতে ঔপনিবেশিক স্বাধীনতা এবং বর্তমান বিজেপির জোটের এই সরকার আগেকার সেই কংগ্রেসী মডেলকেই পরিপুষ্ট করে চলছে, অর্থাৎ সদ্যনির্মিত সংসদভবন সেই ব্রিটিশ পার্লামেন্টীপ্রথাকেই দৃঢ় করে চলেছে। ফলে ভারতীয় রাজনীতি লোকায়ত স্বায়ত্তশাসনভিত্তিক গণতন্ত্রের দিকে যাচ্ছে না, আন্দাজ সেটা আরো বেশি করে আধিপত্যমূলক কেন্দ্রিভবনের দিকে ঝুঁকে পড়ছে।

এহেন মোদী সাহেব মমতার সামনে নিশ্চিতরূপে বাধা সৃষ্টি করেছে। তবে মমতা ব্যানার্জীর সাথে আরএসএসের অন্য ব্যক্তিদের সুসম্পর্ক ২০০০ সালের আগে থেকেই। ফলে বলতে চাইছি, আপাতভাবে রাজনীতির মঞ্চে বিরোধিতা থাকলেও কংগ্রেস-বিজেপি বা বিজেপি-তৃণমূলের সম্পর্ক গভীরতর স্বার্থের দিক থেকে একই সূত্রে গাঁথা। হাসিনা সে-ক্ষেত্রে বরং তুলনামূলক সুবিধাজনক অবস্থানে রয়েছে। হাসিনা স্বয়ং বাংলাদেশের সরকারপ্রধান। ফলে দেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতি, বিরোধীদের প্রতি দমননীতি-- সব ক্ষেত্রেই কঠোর অবস্থান নিতে ওনার হাত কাঁপবে না। ফলে আপনারা যাঁরা আওয়ামীর শাসনের উচ্ছেদ চান, তাঁরা আসলেই এক স্বৈরাচারী পরিবার আর তার জঙ্গি ক্যাডারবাহিনীর বিরুদ্ধে লড়াই করছেন রাষ্ট্রক্ষমতা দখল ও সামাজিক পরিবর্তনের লক্ষ্য নিয়ে। বাংলাদেশ থেকে আওয়ামীর সর্বাত্মক বিরোধিতা হলে যদি নতুন সরকার গঠিত হয়, তবে সেখানে প্রগতিশীল আর প্রতিক্রিয়াশীল-- সব ধরনের বেনোজলই ঢুকবে। তেমনটা হলে একটা নতুন সূত্রপাত হবে আর আজকের রণকৌশলের নবীকরণও ঘটবে।

আপনার গত পত্রের একটা অনুচ্ছেদ আমার খুবই ভালো লেগেছে:

'আওয়ামী লীগ সরকারের পৃষ্ঠপোষক হয়ে গত শতাব্দীর ’৭০-এর দশকে ভারত যেমন এ দেশের ব্যাপক জনমনে ঘৃণার পাত্র হয়েছিল এখনও তেমন বা তার চেয়েও বেশী হচ্ছে। এই ভারত-বিদ্বেষ আবার হিন্দু বিরোধিতাকে বৃদ্ধি করে। কারণ বাংলাদেশের উত্তরাধিকারে রয়েছে ধর্মের ভিত্তিতে ভারত ভাগ ও পাকিস্তান প্রতিষ্ঠায় উদ্যোগী ভূমিকা। ফলে ভারত-বিদ্বেষ সাধারণ মুসলিমদেরকে ইসলামের দিকে বেশী করে ঝুঁকতে অনুপ্রাণিত করতে পারে। ১৯৭১-এর ১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার পর আওয়ামী লীগের লুণ্ঠন, দুর্নীতি, সন্ত্রাস জনমানসে যে প্রতিক্রিয়া ঘটায় সেটা মুসলিম জনসাধারণকে শুধু যে লীগ-বিদ্বেষী করে তুলে তা-ই নয়, অধিকন্তু লীগের পৃষ্ঠপোষক ও ঘনিষ্ঠতম মিত্র ভারত হওয়ায় তাদেরকে ভারত-বিদ্বেষীও করে তুলে, যেটা আবার হিন্দু বিরোধী সাম্প্রদায়িকতাকে নবতর শক্তি যোগাতে থাকে।'

এই নতুন সাম্প্রদায়িক উত্থান শুধু এরশাদের সময় অবধিই নয়, আজকের সময়েও এর অব্যাহত বিস্তার। একটিমাত্র অনুচ্ছেদের মধ্যে লীগ আর হিন্দুবিরোধী ইসলামী সাম্প্রদায়িকতার মধ্যে যোগসাজশ বুঝতে হলে আওয়ামীর ডাকাতি স্বভাবকে জানতে হবে; 'আধুনিক' ইসলামী শাসকের প্রকৃত স্বরূপ বোঝাটা অমুসলিমদের কাছে সমস্যাজনক।

☆       ☆       ☆       ☆       ☆

বাংলাদেশকে ঘিরে পশ্চিমবঙ্গ, ভারত ও পাকিস্তান-আফগানিস্তান জুড়ে স্বায়ত্তশাসনভিত্তিক বিপ্লব ধাপে ধাপে ঘটার স্বপ্ন দেখেছেন আপনি। সারাটা জীবন আপনি এই আদর্শের জন্য ত্যাগ করে গিয়েছেন। আমি একটা অন্য দিক থেকে বলব মুসলমানদের ব্যাপারে।

আলোচনাটা শুরু হয়েছিল মুসলিম শাসকশ্রেণির তথাকথিত 'আধুনিক' হয়ে ওঠা নিয়ে। কিন্তু এর আগেও একটা বিষয় নিয়ে আমি ভেবেছি এবং গত এক পত্রে আপনার নিবন্ধটি থেকে পশ্চিমীকৃত মুসলমানদের নিয়ে সচেতন হবার পর থেকে আরও জোরালো হয়ে উঠেছে সেই ধারণা।

মধ্যপ্রাচ্য ইসলামের জন্মস্থল। সেই হিসেবে আরবভূমি ও তার পাশ্ববর্তী এলাকাকে বিশ্ব-ইসলামের কেন্দ্র বলা যেতে পারে। এভাবে ভেবে নিলে বাংলাদেশ বা অনারব জাতিগুলির দেশকে বিশ্ব-ইসলামের প্রান্ত বলা যেতে পারে।

আপনি বাংলাদেশের মাটিতে ইসলামী প্রতিক্রিয়া আর আগ্রাসী মনোভাবের মাঝে দাঁড়িয়ে ভেবেছেন ইসলাম এবং এর পরিপোষক মুসলমানদের পতনের কথা। এটাই মাটির বাস্তবতার দিক থেকে স্বাভাবিক। কোনো-না-কোনো সংঘাতের মধ্য দিয়ে এই একবগ্গা মুসলিম সমাজটাকে যেতেই হবে। এর কারণ এরা স্বয়ং নিজেরাই।

কিন্তু ওপরতলার পলিটিশিয়ানরা কি আমাদের মতো লড়াইয়ের মাটিতে দাঁড়িয়ে ইসলামের বিরোধিতা করে? একেবারেই এটা হবার কথা নয়। ফলে আপনি আর মুক্ত চিন্তাবুদ্ধির মানুষ যাঁরা মনুষ্যত্ব আর গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের পক্ষ থেকে ইসলামের বিরুদ্ধে লড়াই করছেন, ইসলামবিরোধী সরকারের লোকেরা কিন্তু ততটাও খাঁটি বা সৎ হবে না। সেই হিসেবে তারা যদি দেখে একটা সমাজের শিরায় শিরায় ইসলামের গুরুতর প্রভাব রয়েছে, তখন তারা জনমানস থেকে ইসলামকে দূর করতে তো চাইবেই না, বরং ইসলামী প্রশাসনটার সাথে একটা রফায় আসতে চাইবে। হতে পারে সেটা আর্থিক বোঝাপড়া, যেমনটা আপনি বলেন যে, হাসিনা তাঁর পরিবারের জন্য বিদেশে সম্পত্তি বানিয়ে রেখেছে, অথবা সাংস্কৃতিক বোঝাপড়া, যেখানে সমাজটাকে ধীর গতিতে পশ্চিমি অভ্যাসে অভ্যস্ত করে তোলা হবে।

বিশ্ব-ইসলামের কেন্দ্র হিসেবে মধ্যপ্রাচ্যে আরব জাতিগুলির সাথে আমেরিকা আর ইউরোপের তৈল-কূটনীতির সম্পর্ক অত্যন্ত ভালো। ইদানীং ওই দেশগুলো চিনের বিনিয়োগও টানছে, এমনকি ভারতেও বিনিয়োগ করছে দুবাইওয়ালারা। আর দেখুন নিজের দেশ, প্রান্তীয় ইসলামের এক দেশ বাংলাদেশকে-- সেখানেও নগদ টাকার লোভ, বিকৃত লালসা, মুখে চরম সাত্ত্বিক আর কাজে চরম তামসিক ভণ্ডামোর মুসলমান পুরুষ চারিদিকে হরদম খুঁজে পাবেন। এরপরেও কি ভাবা অন্যায় হবে যে, বাংলাদেশি মুসলমানরা কোরানের কাঠখোট্টা নিয়মবাজির মোড়কে ধীরে ধীরে পশ্চিমি আচরণে অভ্যস্ত হয়ে উঠছে? প্রাথমিকভাবে সেটা অবশ্য ইসলামের দোহাই দিয়েই হবে! দেখুন না, কোরানে সুদ কী কঠোরভাবেই না হারাম। আর ইউনুসকে পশ্চিমিরা কোলে করে কতই না দোল খাওয়াল, কেন-না তিনি ধ্রুপদী গ্রাম-সমাজের মধ্যে ব্যাঙ্কিং ব্যবস্থার তীব্র অনুপ্রবেশকে সহজতর করে দিয়েছেন। এ ছাড়াও সরাসরি ইসলামী ব্যাঙ্কের নামেই প্রতিষ্ঠান পাবেন বাংলাদেশে। এগুলো কী! সনাতন সংকীর্ণ ইসলাম তো নয়ই, বরং কোরানের চোগাচাপকান চড়িয়ে 'ধনতান্ত্রিক মুসলমান' পয়দা হচ্ছে জঘন্য পাষণ্ডপনার মধ্য দিয়ে।

এই সমাজটা নিজেই উসমানীয় ইসলামের মধ্যে পুরোপুরি আর নেই। ফলে বহিরঙ্গে ইসলামী ধাঁচার বিরোধিতা করলেও এই সমাজটার অন্তরঙ্গ শক্তির বিনাশ সম্ভব নয়। বরং মধ্যপ্রাচ্যের কর্পোরেট শেখদের বাদ দিলেও দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে একমাত্র বাংলাদেশই মুসলিমপ্রধান দেশ হিসেবে হয়তো এমন এক পর্যায়ে গিয়ে পৌঁছাচ্ছে, যেখানে ইসলামী আর পুঁজিবাদী চরিত্র একই অঙ্গে পুঞ্জীভূত হচ্ছে বাঙালি মুসলমানের মধ্যে। ফলে আপাতত বাংলাদেশে ক্ষমতাহীন হয়ে-পড়া কমিউনিস্টরা তাদের দুই শত্রু ইসলাম আর পুঁজিতন্ত্রকে এক দেহের মধ্যে এক তিরেই বধ করার সুযোগ পেতে পারে। তেমনটা হলে বিশ্ব-ইতিহাসে সেটা এক নতুন দৃষ্টান্ত আর আগামীর পথপ্রদর্শক হয়ে উঠতে পারে আমাদের কাছে। সেই সুযোগ কি আসতে পারে নিকট ভবিষ্যতে? আপনি কী মনে করেন?

একই বৃন্তে দুটি কুসুম-- পুঁজি-মুসলমান,

ব্যাঙ্কিং তাহার নয়নমণি, সন্ত্রাস তাহার প্রাণ।

নতুন ইংরেজি বছরে সমস্ত কিছু ভালো হোক। আপনিও শারীরিকভাবে সুস্থ থাকুন। আজকের মতো এখানেই বিদায় নিই।

আপনার শুভাকাঙ্ক্ষী,

অভিরূপ মুখোপাধ্যায়

01 January, 2024

========================

১ জানুয়ারী, ২০২8 তারিখে পাঠানো পত্রের উত্তর

Sent On Thu, Jan 18, 2024

প্রিয় অভিরূপ বাবু,

বাংলা এবং ভারতীয় উপমহাদেশের ভবিষ্যৎ পুনর্গঠনের কথা যখন আমি ভাবি তখন আমি শুধু স্বায়ত্তশাসনের কথা ভাবি না, অধিকন্তু ব্যাপক কেন্দ্রীকরণের কথাও ভাবি। বরং আমার ধারণা বিপ্লব যতই বিকেন্দ্রীকরণের তথা সর্বস্তরে জনগণের স্বশাসনের প্রতিশ্রুতি দান করুক সমাজের পুনর্গঠন ঘটাতে গিয়ে শুরু করতে হয় প্রচণ্ড রকম কেন্দ্রীভবন ঘটিয়ে। মধ্যযুগের সঙ্গে ছেদ ঘটিয়ে আধুনিক যুগের চেতনা ও মূল্যবোধের উপর সমাজকে প্রতিষ্ঠিত করতে গিয়ে সব সমাজকে কোনও না কোনও ধরনের কেন্দ্রীকরণ বা একনায়কতন্ত্রের পর্যায় পার হয়ে আসতে হয়েছে। আধুনিক সাম্রাজ্যবাদের যুগে এই ধরনের যুগান্তকারী সমাজ-বিপ্লবগুলি সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়েছে। রাশিয়া, চীন, ভিয়েৎনাম, কোরিয়া, কিউবার অভিজ্ঞতার দিকে তাকিয়ে দেখুন। কিউবার ক্যাস্ট্রো বিপ্লব ও ক্ষমতা দখলের আগে মোটেই কমিউনিস্ট কিংবা সমাজতন্ত্রী ছিলেন না। কিন্তু বিপ্লবকে রক্ষা করতে ও সফল পরিণতি দিতে গিয়ে তাকে তা হতে হয়।

আমার মনে হয় বিপ্লব করতে চাইলে আমাদেরকে ব্যবহারিক বুদ্ধিসম্পন্ন হতে হবে। ভারত বা পাকিস্তানের কথা বাদ দেওয়া যাক। বাংলাদেশে বিপ্লব করতে চাইলে আমরা ধর্মকে বিশেষত ইসলামকে কোনও ধরনের ছাড় দিতে পারব না। অন্যদিকে, লুঠতরাজ ও দুর্নীতির মাধ্যমে যে পুঁজিবাদী আর্থ-সামাজিক ব্যবস্থা গড়ে উঠেছে তাকে সমূলে উৎপাটন করতে চাইলে ব্যাপক জাতীয়করণ করা ছাড়া আর কোন উপায় থাকবে?

এই প্রথম পর্যায়টা কি সর্বজনীন ভোটাধিকার আর স্বায়ত্তশাসনের নিকট সমর্পিত হবে? পুরাতন চেতনা আর ব্যবস্থায় অভ্যস্ত সংখ্যাগুরুদের হাতে পড়লে সংখ্যালঘু নূতন চেতনার শক্তির কী পরিণতি ঘটবে? কাণ্ডজ্ঞান সম্পন্ন ক্যাস্ট্রোকে বাতিস্তার দেশবৈরী একনায়কতন্ত্রকে উৎখাত করে দেশ হিতৈষী সমাজতান্ত্রিক একনায়কতন্ত্রকে প্রতিষ্ঠা করতে হয়েছিল। এটাই ছিল সময় ও বিপ্লবের দাবী।

গণতন্ত্রের প্রশ্নে আমার নিকট অতীব গুরুত্বপূর্ণ দৃষ্টান্ত হিসাবে কাজ করে সিন্ধু সভ্যতা। এখন আর এ সুপ্রাচীন সভ্যতার গণতান্ত্রিকতা নিয়ে প্রশ্ন নাই। সমগ্র সভ্যতায় সমতা ও শান্তিপূর্ণতার প্রাধান্য নিয়েও প্রশ্ন নাই। একইভাবে সমগ্র সভ্যতার ভিত্তিমূলে যে স্বায়ত্তশাসনমূলক ব্যবস্থা ক্রিয়াশীল ছিল তেমনটা ধারণা করা হয়। এই স্বায়ত্তশাসনমূলক ব্যবস্থার ফলেই যে সভ্যতায় ক্ষমতার অতিকেন্দ্রীভবন ঘটে নাই সেটা স্পষ্ট। অর্থাৎ যে নামেই হোক পঞ্চায়েতমূলক ব্যবস্থার উপর সমাজ ও রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত ছিল।

কিন্তু প্রশ্ন থেকে যায়, স্বায়ত্তশাসন বা স্বাতন্ত্র্যের উপর যদি এতই জোর দেওয়া হয় তবে দশ থেকে বারো লক্ষ বর্গকিলোমিটারের বিশাল অঞ্চল ব্যাপী বিস্তৃত সভ্যতায় সেই পায়ে হাঁটা আর গরুর গাড়ীর ধীর গতির যুগে কীভাবে সর্বত্র নগর পরিকল্পনায়, লিপিতে (ভাষাতেও কি?) এবং আরও বিভিন্ন বিষয়ে এমনই অভিন্নতা? অর্থাৎ এটা যেন এমন যে, প্রথমে একটা কেন্দ্রীয় ছাঁচে ফেলে সমগ্র জনগোষ্ঠীকে একটা অভিন্ন রূপ দেওয়া হয়েছে, অতঃপর ছাঁচ থেকে সবাইকে মুক্ত করে যার যার মতো করে চলবার স্বাধীনতা দেওয়া হয়েছে। সবাই চলেছে যার যার মতো করে, আপাত দৃষ্টিতে স্বাধীন ও স্বতন্ত্রভাবে, কিন্তু অভিন্ন ছন্দে অভিন্ন বৈশিষ্ট্য নিয়ে।

আমার বিবেচনায়, প্রথম পর্যায়টা হল বিপ্লবের। এই পর্যায কেন্দ্রীভবনের। এরপরের পর্যায়টা বিকেন্দ্রীভবন বা স্বায়ত্তশাসনের। বিশেষ করে সিন্ধু সভ্যতার গঠন ও বিকাশ প্রক্রিয়ার মধ্যে আমি হৃৎপিণ্ডের সঙ্কোচন ও প্রসারণের ছন্দ দেখতে পাই। হয়ত সেই সঙ্কোচন ও প্রসারণ অনেক শতাব্দী কাল জুড়ে। যাইহোক, সিন্ধু সভ্যতার অনেক কিছুই এখনও অনাবিষ্কৃত। সুতরাং খুব বেশী কল্পনা না করাই উচিত হবে। তবে যেটুকু আবিষ্কার হয়েছে তার ভিত্তিতেই অনেক কিছু এখন ধারণা করা যায় বৈকি!

*********************************

যাইহোক, আমাকে ভাবতে হয় প্রধানত বাংলাদেশের প্রেক্ষিতে। আর সে প্রসঙ্গে প্রাধান্যে আসে ইসলাম ও মুসলিমের প্রসঙ্গ। ইসলামকে বুঝার ‍উপর যেমন দৃষ্টি নিবদ্ধ করতে হয় তেমন তা থেকে মুক্তির পথ সন্ধানও আমার চিন্তাকে অধিকার করে থাকে।

ইসলাম প্রসঙ্গে কাব্য করে বলেছেন,

একই বৃন্তে দুটি কুসুম-- পুঁজি-মুসলমান,

ব্যাঙ্কিং তাহার নয়নমণি, সন্ত্রাস তাহার প্রাণ।

পাশ্চাত্য অধীনতায় পুঁজির সঙ্গে ইসলাম বা মুসলিমের সম্মিলন হতে পারে। কিন্তু আধুনিক পুঁজি শুধু মুনাফাবৃত্তি নয়, তার আর একটা দিক হচ্ছে উৎপাদনশীলতা। শ্রমশীলতা ছাড়া উৎপাদনশীলতা সম্ভব নয়। পুঁজির মালিক বিকাশের পরবর্তী স্তরে যা-ই হোক, তার যাত্রা সূচিত হয় শ্রমশীলতা ও নূতন নূতন উদ্ভাবন কিংবা আবিষ্কার দিয়ে। বিশেষত শ্রমশীলতা ছাড়া উদ্বৃত্ত মূল্য (Surplus Value) সৃষ্টি সম্ভব নয়। এটা তার মৌল দিকও বটে। এর সঙ্গে জড়িত থাকে পুঁজির মালিকের দায় কিংবা দায়িত্বশীলতাও। হ্যাঁ, মুনাফাবৃত্তি থেকে পুঁজি লুণ্ঠনবৃত্তিতে যেতে পারে; কিন্তু সেটা তার পরবর্তী রূপ। যখন তা আত্মপ্রতিষ্ঠা থেকে আত্মবিস্তারের উন্মুক্ত ও অসহায় জগৎকে পদানত করেছে। পুঁজি তো বিমূর্ত কোনও সত্তা নয়; তার পিছনের শক্তি হল মানুষ। সেই মানুষ যখন দায়-দায়িত্বহীন ও সম্পূর্ণ বাধামুক্ত হয় তখন তা অমানুষ হতে পারে বৈকি! তবু আধুনিক শিল্প-সভ্যতার পুঁজি তার অস্তিত্বের জন্য কম আর বেশী নির্ভর করে উৎপাদনশীলতা তথা শ্রমশীলতার উপর। এছাড়া তার উদ্বৃত্ত মূল্য কিংবা মুনাফা সৃষ্টি সম্ভব নয়।

ইসলামের মুনাফাবৃত্তির সঙ্গে উৎপাদনের কোনও সম্পর্ক নাই। কারণ পুঁজি বা উৎপাদনের দায়িত্ব না নিয়ে তা অন্যের উৎপাদন আত্মসাৎ করে লাভবান হয়। এই আত্মসাতের পদ্ধতি উৎপাদনের মধ্য দিয়ে উদ্বৃত্ত মূল্য সৃষ্টি নয়, বরং যুদ্ধ বা জিহাদের মধ্য দিয়ে পরভূমি ও পরশ্রম গ্রাস। ইসলাম মানেই যুদ্ধ কিংবা বলপ্রয়োগের মধ্য দিয়ে পরশ্রম ভোগ এবং অবশ্যই অগণিত নারী সম্ভোগ। ভয়ঙ্কর এক ভোগবাদী ধর্ম এটা, যেখানে দুর্বল ও নারীর কোনও মূল্যই নাই একমাত্র ভোগ ও সম্ভোগের বস্তু হওয়া ছাড়া। সুতরাং দুর্বল ও নারীর জন্য এটা ভয়ঙ্কর নির্দয় এক ধর্ম। এই ধর্ম শেষ পর্যন্ত কাউকেই আর মানুষ রাখে না। শুধু যে সবল ও শাসকরা অমানুষ হয় তাই নয়, উপরন্তু এই ধর্ম বা জীবন ব্যবস্থার চাপে দুর্বল, শাসিত ও নারীরাও আর মানুষ থাকে না।

পাশ্চাত্যের পুঁজি যখন ইসলামের সঙ্গে সম্মিলিত হয়েছে তখন ইসলামের দায়-দায়িত্বহীন ও লুণ্ঠন নির্ভর ভোগবাদ পুঁজির মুনাফাবৃত্তিকে নৃশংস রূপ দান করে। সুতরাং পুঁজি কখনও কখনও ইসলামের সঙ্গে সংঘাতে জড়িয়ে পড়লেও তার সর্বদা একটা চেষ্টা থাকে তার জন্য সহনীয় (অধীনস্থ) রূপে ইসলামের সংরক্ষণ। ঐ ‘বাবু রাম সাপুড়ে’র সাপের মতো। তবে পাশ্চাত্যের জন্য তা যতই নিরীহ সাপ হোক, ইসলাম অধিকৃত সমাজের জন্য ইসলাম সর্বদাই এক অতীব বিষধর সাপ, যার অবিরাম ছোবলে মানবদেহ বিষাক্ত হয়ে থাকে। বিশেষত অমুসলিম, নারী ও দুর্বল মানুষরা বিষজর্জর জীবন যাপন করে। সুতরাং পুঁজির বিকৃত ও লুণ্ঠন-নির্ভর রূপের প্রতি ইসলাম কিংবা মুসলিম শাসক শ্রেণীর এমন আকর্ষণ। বাংলাদেশের জন্য আপনার এ কথা খুব প্রযোজ্য যে, ‘একই বৃন্তে দুটি কুসুম-- পুঁজি-মুসলমান।’

আপনি আপনার পত্রের শেষে লিখেছেন,

‘এই সমাজটা নিজেই উসমানীয় ইসলামের মধ্যে পুরোপুরি আর নেই। ফলে বহিরঙ্গে ইসলামী ধাঁচার বিরোধিতা করলেও এই সমাজটার অন্তরঙ্গ শক্তির বিনাশ সম্ভব নয়। বরং মধ্যপ্রাচ্যের কর্পোরেট শেখদের বাদ দিলেও দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে একমাত্র বাংলাদেশই মুসলিমপ্রধান দেশ হিসেবে হয়তো এমন এক পর্যায়ে গিয়ে পৌঁছাচ্ছে, যেখানে ইসলামী আর পুঁজিবাদী চরিত্র একই অঙ্গে পুঞ্জীভূত হচ্ছে বাঙালি মুসলমানের মধ্যে। ফলে আপাতত বাংলাদেশে ক্ষমতাহীন হয়ে-পড়া কমিউনিস্টরা তাদের দুই শত্রু ইসলাম আর পুঁজিতন্ত্রকে এক দেহের মধ্যে এক তিরেই বধ করার সুযোগ পেতে পারে। তেমনটা হলে বিশ্ব-ইতিহাসে সেটা এক নতুন দৃষ্টান্ত আর আগামীর পথপ্রদর্শক হয়ে উঠতে পারে আমাদের কাছে। সেই সুযোগ কি আসতে পারে নিকট ভবিষ্যতে? আপনি কী মনে করেন?’

আপনি খেয়াল করলে দেখবেন, আমি সব সময় বাংলাদেশে বিপ্লবী পরিবর্তন সম্পর্কে আশাবাদ ব্যক্ত করি। আসলে ১৯৫৭ সালে অষ্টম শ্রেণীর ছাত্র থাকা অবস্থায় বুদ্ধিচর্চার প্রভাবে ধর্মবিশ্বাস ত্যাগ করার পর থেকেই ধর্মবিরোধী বিপ্লবী রাজনীতির পথে আমার যে যাত্রা শুরু, বহু চড়াই উৎরাই পার হয়ে আমার সেই যাত্রা আজও থেমে নাই। বরং ধর্ম বিশেষত ইসলাম ধর্মের বিরুদ্ধে আমার লড়াই এখন অনেক বেশী পরিপূর্ণতা বা পরিপক্বতা ও শক্তি লাভ করেছে। অর্ধশতাব্দীর অধিক কাল কোনও রাজনৈতিক সংগঠন না করা আমার জন্য বরং অনেক ভালো হয়েছে। এর ফলে গণ-সংগঠন ও গণ-রাজনীতি করতে গিয়ে আমি আপোসের চোরাবালিতে পথ হারাই নাই। কারণ আমাকে জনতোষণ করতে হয় নাই। দল থেকে, ক্ষমতা থেকে, জন-মণ্ডলী থেকে দূরে অনেকটা নিভৃতচারী জীবন কাটানো যত কষ্টদায়ক হোক না কেন আমার জন্য আশীর্বাদ স্বরূপ হয়েছে। এমন না যে আমি আজন্ম সমাজ বিচ্ছিন্ন। বরং ১৯৭২ পর্যন্ত আমার জীবন ছিল বহু মানুষের ভীড়ে আবিষ্ট। ততদিনে জাতীয় ও এলাকাভিত্তিক রাজনীতির বিপুল অভিজ্ঞতায় আমি সমৃদ্ধ।

অবশ্য বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার পরবর্তী সময়ে আমি কয়েক বছর কাল জাতীয় পর্যায়ে বিদেশী সাহায্য-নির্ভর একটা এনজিও গড়েছিলাম। এক সময় সেটা পরিত্যাগ করি। এটা একটা অভিজ্ঞতা বৈকি! এ ছাড়া নব্বইয়ের দশকে দুই দফায় চার বছর কাল গ্রামে থেকে ব্যক্তি পর্যায়ে নূতনভাবে ও স্থানীয়ভাবে সংগঠন ও আন্দোলন করি। এটা ছিল আমার জন্য আর এক অমূল্য অভিজ্ঞতার কাল। এরপর ২০০২ থেকে ২০১৬ পর্যন্ত সময়টাতে ব্যস্ত ছিলাম ‘ব-দ্বীপ প্রকাশন’ নামে আমার প্রকাশনী সংস্থা নিয়ে। তারপর সরকারী আক্রোশে সাড়ে আট মাস কারাবাস এবং অতঃপর মামলার আসামী হিসাবে ২০২০-এর ২৩ জানুয়ারী পর্যন্ত আদালত চত্বরে নিয়মিত হাজিরা দেওয়া। যাইহোক, ২০০৬ থেকে আছি ওয়েবসাইট ‘বঙ্গরাষ্ট্র’ নিয়ে। কারাবাসের কারণে এতে কিছুকাল (প্রায় সোয়া এক বছর) ছেদ ঘটলেও এটাকে পুনরায় চালু করেছি।

বলা যায়, ২০১৬ সালে আওয়ামী লীগ সরকার চঞ্চলসহ আমাকে কারারুদ্ধ করার পর থেকে আমি সমাজ থেকে অনেক দূরবর্তী জীবন যাপন করছি।

এই সবটা মিলে আমার যে জীবন তা থেকে আমি বাংলাদেশের ব্যাপারে আশাবাদী। লোকায়ত বিপ্লবের অগ্রযাত্রার পথে এখানে এমন কিছু অনুকূল উপাদান সঞ্চিত হয়ে আছে যা সমগ্র উপমহাদেশের আর কোথায়ও আমি দেখি না। এটা ঠিক যে, এই বাংলার বাঙ্গালী ভারত ভেঙ্গে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার প্রধান হোতা। কিন্তু সেই তাদের সাধের পাকিস্তান ভাঙ্গার পথে তাদের যাত্রা শুরু হয় পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার প্রায় পর পরই। এটা ঠিক যে, এটা পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার প্রজন্ম ছিল না। বরং এটা ছিল তার ঠিক পরবর্তী প্রজন্ম। কিন্তু এটা এসেছিল অভিন্ন বাঙ্গালী মুসলিম সমাজ থেকে।

কিন্তু কী বিস্ময়করভাবে তাদের পিতা ও পিতামহদের থেকে ভিন্ন স্বপ্ন, আকাঙ্ক্ষা ও চরিত্র নিয়ে বেড়ে উঠা এক প্রজন্ম এটা! এটা প্রায় সবদিক থেকে তাদের পিতা-পিতামহদের থেকে ভিন্ন এক প্রজন্ম। কীভাবে একটা উগ্র, অস্থির ও নীতিনৈতিকতাহীন জনগোষ্ঠীর ভিতর থেকে এমন পরাক্রান্ত রূপ ও চরিত্র নিয়ে এমন এক প্রজন্ম উঠে এসেছিল এ কথা ভাবলে আমি আজও বিস্ময়াভিভূত হই। হিন্দু সমাজের জ্ঞানচর্চার প্রতি অনুরাগ, সত্য ও ন্যায়-নীতি নিষ্ঠা আর মুসলিম সমাজের সাহস, উচ্চাকাঙ্ক্ষা আর আবেগ-উচ্ছ্বাসের এক বিস্ময়কর সম্মিলন ঘটেছিল আমাদের ঐ প্রজন্মের ভিতর। অন্তত আমার কথা বলতে পারি। জ্ঞান পিপাসার কারণে শৈশব থেকে আমি ছিলাম বিস্ময়কর রকম অধ্যয়নশীল। কিন্তু সেটা আমি একা ছিলাম না। যেমন সত্যনিষ্ঠও আমি একা ছিলাম না। তবে চিন্তাশীলতা ও জিজ্ঞাসার বিচারে আমি সে কালেও অনেকটা ব্যতিক্রম ছিলাম। যেমন নেতৃত্ব, পদ বা ক্ষমতা কিংবা অর্থের লোভ আমাকে কখনও আমার লক্ষ্যচ্যুত বা পথবিচ্যুত করতে পারে নাই কোনও দিনই।

এটা ঠিক যে, আমি লোকায়ত এবং আমাদের সমাজের প্রেক্ষিতে সমাজতান্ত্রিক বা জন-গণতান্ত্রিক বিপ্লবে বিশ্বাস করতাম। কিন্তু আমি যখন বিএ (অনার্স)-এর ছাত্র তখনই কমিউনিজমের লক্ষ্যকে ভ্রান্ত মনে করতাম। মনে হত মানুষের সমাজ কখনই দ্বন্দ্বমুক্ত হবে না। অর্থাৎ কমিউনিজমকে কল্পস্বর্গ বা ইউটোপিয়া মনে হত। তবে মনে হত আজকের অমানবিক দ্বন্দ্বগুলি থেকে মুক্তি সম্ভব এবং তার জন্য বিপ্লবের প্রয়োজন। এসব নিয়ে সে কালে কথা বলতাম না তা নয়। তবে এ ধরনের ভাবনার জগতে যে আমি একা ছিলাম সে কথাই বলা উচিত হবে।

অপর দিকে, এসব আলোচনা অন্যদের হতাশ কিংবা বিপ্লবের পথ বিচ্যুত করতে পারে সে ভয়ও করতাম। নিজেরও তো বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবার ভয় ছিল। সর্বোপরি আমি ছিলাম আমার উন্মুক্ত চিন্তা ও বিভিন্ন রাজনৈতিক বক্তব্যের কারণে বিশেষ করে কমিউনিস্ট নেতৃত্বের সন্দেহ ও আক্রমণের লক্ষ্যবস্তু। বিপ্লবের পথচারী হিসাবে যে চীনপন্থী নেতৃত্বের সঙ্গে আমি ছিলাম তারা তাদের অন্ধ চীনপন্থার কারণে আমার প্রতি সর্বদাই বৈরী ভাবাপন্ন ছিলেন। পদ কিংবা নেতৃত্বের প্রতি আমার কোনও দৃষ্টি ছিল না বলে একজন বেগারখাটা কর্মী হিসাবে তারা আমাকে সহ্য করতেন। কিন্তু আমি যাতে কোনও কেন্দ্রীয় পদে যেতে না পারি সে দিকে সতর্ক দৃষ্টি রাখতেন। তবে এটা ঠিক যে, রাজনীতি ও সংগঠনের জন্য অক্লান্ত শ্রম এবং ব্যাপক অধ্যয়নশীলতার ফলে বিভিন্ন বিষয়ের উপর জ্ঞান বা ধারণার কারণে আমার একটা ভিন্ন মর্যাদা সেকালে ছিল। নেতারা আমাকে যতই অপছন্দ করুন আমাকে সর্বদা ‍উপেক্ষাও করতে পারতেন না। ফলে কেন্দ্রীয় কমিটিতে দীর্ঘদিন আমাকে ঢুকতে না দিলেও যখন খুব গুরুত্বপূর্ণ কোনও বিষয়ে পার্টিতে বিতর্ক বা সিদ্ধান্ত হত তখন কেন্দ্রীয় সদস্য না হলেও আমার মতামত জানবার জন্য তারা সেসব সভায় আমাকে ডাকতেন। এখানে এ প্রসঙ্গে বলি যে, দেবেন শিদার ও আলাউদ্দীন-মতিন নেতৃত্বাধীন ‘পূর্ব বাংলার কমিউনিস্ট পার্টি’তে ষাটের দশকের তরুণ প্রজন্মের বৃহত্তর অংশকে নিয়ে যাবার মূল কারিগর ছিলাম আমি। কারণ আমার উদ্যোগেই তরুণ প্রজন্মের এই যোগদান ঘটে। এবং যোগদানের প্রথম সভাতেই তারা আমার সহকর্মীদের মধ্য খেকে দুইজনকে কেন্দ্রীয় কমিটিতে গ্রহণ করলেন, কিন্তু আমাকে বাদ দিলেন। এর মধ্যে একজন আমার সহপাঠী হলেও অপর জন ছিল আমার জুনিয়র বা কনিষ্ঠ।

যাইহোক, এসব ক্ষোভের কথা থাক। এখন এ কথা বলে এ প্রসঙ্গ শেষ করি যে, অনেক গুণের অধিকারী হলেও নীতি বা আদর্শের বিচারে শেষ পর্যন্ত আমার প্রজন্মের অনেকে হেরে গেছে। সময়ের বৈরী স্রোতের আঘাতে অনেকে পথবিচ্যুত হয়েছে। অবশ্য সবাই তা হয় নাই। তারা হয়ত আমার মতো নূতন চিন্তার পতাকা তুলে ধরতে পারে নাই, তবু তাদের জীবনাচরণ এবং চিন্তাশীলতার দিকে যখন আমি দৃষ্টি দিই তখন কিন্তু অনুপ্রাণিত হই।

এটা আমি বুঝি যে, আমাদের প্রজন্মের ভিত্তিটা তৈরী করে দিয়েছিয়েছিলেন হিন্দু সমাজ থেকে আসা কমিউনিস্টরা, এমনকি সামগ্রিকভাবে এ দেশের হিন্দুরা। হিন্দুদের বিরাটতর অংশ এ দেশ থেকে চলে গেছে; আসলে চলে যেতে বাধ্য হয়েছে। সেই সঙ্গে ক্রমে চলে গেছে কমিউনিস্ট আন্দোলনের বিরাটতর অংশও। কিন্তু যারা গেছেন তারা যাবার আগে তাদের চেতনার দীপশিখা থেকে আমাদের মনে আলো জ্বালিয়ে দিয়েছিলেন। অবশ্য কমিউনিস্টদের সবাই চলে যান নাই। তারা অনেকে পাকিস্তান কালে কারাবন্দী ছিলেন, অনেকে ছিলেন বা থাকতেন আত্মগোপনে। মূল নেতারা আত্মগোপনে থেকে তখন কাজ করতেন।

যদিও জ্ঞানতৃষ্ণা, সত্য ও ন্যায় নিষ্ঠা আমি পেয়েছি মূলত আমার মাতৃসূত্রে অর্থাৎ পরিবার সূত্রে তবু সেটার যে সামাজিক ভিত্তি আমি পেয়েছিলাম সেটার কৃতিত্ব দিতে হবে এ দেশের হিন্দু সমাজ ও বিশেষত হিন্দু সমাজ থেকে আসা কমিউনিস্টদেরকে। এভাবে কবির এ কথা সত্য হয়েছে, ‘যে নদী মরুপথে হারালো ধারা/ জানি হে জানি তাও হয়নি হারা।’

আসলে আমরা কেউই স্বয়ম্ভু নই। আমাদের সবার উত্থান ও বিকাশের পিছনে থাকে মানুষের দীর্ঘ ইতিহাস। নূতন ও মহত্ত্বের পথে এগিয়ে যাবার প্রয়োজনে অনেক সময় ইতিহাসের অনেক পর্বের সঙ্গে আমাদের বিচ্ছেদ ঘটাতে হয়। এভাবে ইতিহাসের বাঁক পরিবর্তনে ভূমিকা রাখায় আমরা সক্ষমও হতে পারি। কিন্তু আমাদের মহত্তর জীবন সৃষ্টিতে যারা ইতিবাচক ভূমিকা রেখে গেছেন তাদের সেই ভূমিকাকে সশ্রদ্ধ চিত্তে স্মরণে রাখতে হয়। অগ্রজ কিংবা অতীত প্রজন্মের মহৎ ভূমিকার ঋণ শোধ কখনই সম্ভব নয়। তবু অন্তত ঋণ স্বীকার করতে হয়।

*********************************

বাংলাদেশ এখন বিরাট পরিবর্তনের দ্বারপ্রান্তে। গত ৭ জানুয়ারীর ডামি নির্বাচনের মধ্য দিয়ে শেখ হাসিনা আওয়ামী লীগের রাজনীতির পর্যায়কে মূলত শেষ করে দিয়েছেন। এখন তার পতন ও ধ্বংস দেখার জন্য আমাদেরকে অপেক্ষা করতে হবে। 

তবে যে আশা আপনি কমিউনিস্টদের নিয়ে করেন সেটা পূরণ হবার নয়। এ দেশে কমিউনিস্টদের ইতিবাচক ভূমিকা যেটুকু ছিল সেটা পাকিস্তান পর্বের সমাপ্তির সঙ্গেই শেষ হয়েছে। কমিউনিজম কিংবা মার্কসবাদ থেকে অনেক উপকরণ নিলেও তত্ত্ব হিসাবে ওটাকে পরিত্যাগ করা ছাড়া আমাদের উপায় নাই। কমিউনিস্ট বা মার্কসবাদী বিশ্বাস কিংবা পরিচয় নিয়ে সে কাজ করা সম্ভব নয়। সুতরাং আগামী লোকায়ত বিপ্লবে বাংলাদেশে যারা ভূমিকা রাখবে তারা কমিউনিস্ট আন্দোলনের উত্তরাধিকার থেকে যা-ই গ্রহণ করুক তাদের গড়ে তুলতে হবে নূতন তত্ত্ব বা মতাদর্শ। একটা দীর্ঘ সময় আমি কমিউনিস্টদের মতাদর্শিক রূপান্তর বা ট্রান্সফর্মেশনের আশা করতাম। এখন বুঝি দীর্ঘদিন দৃঢ়বদ্ধ দল বা সংগঠন করলে মানুষ বন্ধ্যা হয়ে যায়। বিশেষত একা হবার ভয়ে সেখান থেকে মুক্ত হয়ে আসতে পারে না। আর অর্ধশতাব্দী কালের ক্রমবর্ধমান অবক্ষয় আর ব্যর্থতার পর এ দেশে কমিউনিস্ট আন্দোলন থেকে কতটুকুই বা আর পাবার আছে? এক দীর্ঘ সময় সেখানে সততা ও ন্যায়-নীতি চর্চার যে ঐতিহ্য ছিল সেটাতেও ক্ষয় ধরেছে। বিশেষ করে বহুধা বিভক্ত কমিউনিস্ট নেতৃত্বের একটা বড় অংশই এখন ন্যায়-নীতির বিচারে অধঃপতিত। রাশেদ খান মেননের মতো কমিউনিস্ট নেতারা নিজেদের অধঃপতিত ও অসৎ চরিত্রকে যেন আরও প্রকটতর করেছে ইসলামের রীতি মেনে হজ্ সম্পন্ন ক’রে। তিনি অবশ্য অনেক দিন ধরেই রাজনীতিতে তার দল ওয়ার্কার্স পার্টিকে নিয়ে আওয়ামী লীগের সহযাত্রী। উদ্দেশ্য তো একটাই — ক্ষমতার সঙ্গে থেকে দুর্নীতির মাধ্যমে অর্থ-বিত্ত সংগ্রহ করা। তার মতো আরও কিছু সংখ্যক নেতার এই কলঙ্কিত রূপ এখন বহুজনের নিকট প্রকাশ্য। এদিক থেকে বরং হিন্দু সমাজ থেকে আসা কমিউনিস্ট নেতারা আমাদের সামনে মহৎ জীবনের দৃষ্টান্ত স্থাপন করে গেছেন। মুসলিম বাঙ্গালীর একটা অংশ যে বহিরাগত হানাদার ও লুঠেরাদের বংশধর আর বাকী প্রায় সবটা যে অস্থিতিশীল ও অনিশ্চিত নদীভাঙ্গা চর থেকে উঠে আসা অস্থিরচিত্ত মানুষ তাতে সন্দেহ কী? তা না হলে কী করে মুসলিম কমিউনিস্টদের, বিশেষত তাদের নেতৃত্বের এক বৃহদাংশের এমন ঘৃণ্য পরিণতি হয়? এই অধঃপতিত লোকদের আজকের রূপ দেখলে সত্যি খুব দুঃখ ও ঘৃণা দুই-ই হয়। ষাটের দশকে এদের অনেকের কী উজ্জ্বল বা দ্যুতিময় জীবন ছিল! বাঙ্গালী মুসলমানের বেশীর ভাগই সত্যি খুব দুর্বল চরিত্রের!

যাইহোক, কমিউনিস্ট আন্দোলনের সবাই মেননের মতো অধঃপতিত ও পথবিচ্যুত না হলেও তাদের বন্ধ্যা মস্তিষ্ক থেকে বেশী প্রত্যাশা না করাই উচিত হবে। বিশেষত মুসলিম সমাজের বিপ্লব যেখানে প্রধানতই লোকায়ত রূপবিশিষ্ট সেখানে এইসব পরাজিত, ব্যর্থ ও অনেকটাই কোণঠাসা মানুষদের কাছে ধর্মের বিরুদ্ধে দাঁড়াবার সাহস কোথা থেকে আসবে? আসলে লোকায়ত বিপ্লবের জন্য আমাদের সমাজে প্রবল সাহসেরও দরকার। শুধু বুদ্ধিবৃত্তির ধার ও উজ্জ্বলতা দিয়ে মুসলিম সমাজে লোকায়ত বিপ্লবের পথ রচনা সম্ভব নয়। নূতন বিপ্লবের পথ রচনা করবার জন্য আজ নূতনদেরকে এগিয়ে আসতে হবে। সেটা যতদিন না হবে ততদিন এ দেশে কিছু হবে না। তবে আমি আশাবাদী। কারণ নূতন শক্তির উত্থানের ভিত্তিটা এ দেশে তৈরী হয়ে আছে।

গত ৭ জানুয়ারীর আওয়ামী লীগের ডামি নির্বাচনের মাধ্যমে শুধু যে আওয়ামী লীগের পথযাত্রার অবসান সূচিত হয়েছে তা-ই নয়, অধিকন্তু প্রচলিত ধারার রাজনীতিরও অবসান সূচিত হয়েছে। শূন্যতা তো বেশী কাল থাকে না। এখন নূতন পথযাত্রার সূচনা ঘটাতে নূতন শক্তি কখন কোথা দিয়ে আসবে সেটা দেখবার অপেক্ষায় থাকা ছাড়া উপায় কী?

ঢাকায় খুব শীত। আপনাদের ওখানেও হয়ত তা-ই। এর মধ্যেই কাজ করতে হয়। আপনার পত্রের উত্তরও লিখলাম কিছু করে। মনে হয় এখন বিদায় নিতে পারি। আপনার উত্তরের অপেক্ষায় থাকব। আপনার সুস্বাস্থ্য ও কল্যাণ কামনা করে এখনকার মতো বিদায় নিই।

ইতি – শুভার্থী

শামসুজ্জোহা মানিক

Jan 18, 2024

========================

Sent On Feb 20, 2024

প্রিয় মানিকবাবু,

পত্রের উত্তর দিতে বিলম্ব হওয়ায় আমি দুঃখিত। গত পত্রের প্রথমাংশে ও শেষ অংশ জুড়ে আপনি বাংলাদেশে ছকে বাঁধা কমিউনিস্ট বিপ্লবের ধরন এবং পরিস্থিতি অনুসারে তার অচল হয়ে যাবার যথেষ্ট কারণও দেখিয়েছেন। আমার মতামতও আপনারই মতো। পাশাপাশি এটাও বুঝলাম যে, বাংলাদেশের মুসলিম মানস যে একাই 'ইসলামী বন্ধ্যাত্ব'-এ ভোগে, তাই না, বরং মুসলমান কমিউনিস্টরাও একটা সময় পর গিয়ে তত্ত্বের যান্ত্রিকতা থেকে বেরোতে অক্ষম হয়ে যান। এটাকে কী বলব, 'কম্যুনিস্টি বন্ধ্যাত্ব'?

আবার আমাদের অবস্থাও ভিন্ন কিছু নয়। যে সময়টা ছিল লড়াইয়ের যুগ, নিজের জীবনের বিনিময়েও আদর্শকে রক্ষা করার কালপর্ব, দেখুন, সেই পর্বে বিশেষত হিন্দু সমাজে কত সোজা শিরদাঁড়ার বামপন্থী এসেছিলেন। আমি তাদের অবশ্যই স্বচক্ষে দেখিনি, কিন্তু তাদের চিন্তাভাবনার অতি উচ্চমান দেখে সম্ভ্রম আসে। আপনি ষাটের দশকের পূর্ববঙ্গে এমন কিছু মানুষ নিশ্চয়ই দেখেছিলেন। ভাসানীর মতন বিচক্ষণ জননেতাকেও দেখেছেন। অথচ তাঁর কথা, তাঁর সাংগঠনিক প্রতিভার মূল্যায়ন কি মুজিবের 'জনগণতান্ত্রিক' বাংলাদেশের পাঠ্যপুস্তকে পড়ানো হয়?

আমাদের এদিকে সিপিআই(এম) মূলত গণসংগঠন করা বামপন্থী দল; বাদ বাকিরা সকলেই অল্পবিস্তর সংখ্যালঘু বাম বলা চলে। এদের মধ্যে কী বিপুল পরিমাণের 'মানসিক বন্ধ্যাত্ব'! সিপিআই(এম)-কে কিছু বলতে যান, ফ্যাসিস্ট-ফ্যাসিস্ট করে 'বিজেপি হঠাও' কান্নাকাটি জুড়ে দেবে। প্রাতিষ্ঠানিক নকশালরা [সিপিআই(এম) লিবারেশন] আরেকটু পণ্ডিতি ফলিয়ে ওই একই কাঁদুনি গাইবে। অন্যসব সংসদীয় বামদলের কথা বাদই দিলাম নয়। মধ্যভারতের জঙ্গলমহলে নিষিদ্ধ সিপিআই(মাওবাদী) কী অ্যাকশন করছে, একমাত্র এই একটা বিষয়েই আগ্রহ বোধ করেছি আমি। নইলে গতানুগতিক ধারার বামরাজনীতির সেরকম কোনো প্রভাব জনমানসে নেইই আর তারাও নিজেদের অহং থেকে একচুল সরে আসতে রাজি নয়। ইসরাইল মানবাধিকার লঙ্ঘন করছে বলেই আমাদের বামপন্থীরা শুধু প্যালেস্টাইনের সমর্থক, এমনটা নয়; যুদ্ধবিহীন অবস্থাতেও এরা সর্বদা মুসলিম-মুসলিম করে মরে গেল! বিজেপির হিন্দু সাম্প্রদায়িকতার রাজনীতি কেন মাথা তুলে দাঁড়াতে পারছে, তার একটা বড়ো কারণ হল বাম-কংগ্রেসীদের নির্লজ্জ আরবপ্রেম! এরাও কি মেননের মতোই নয়, যেমনটা আপনি গত পত্রে বলেছেন?

ফলে প্রথাগত যে কমিউনিস্টিপনা রয়েছে টেক্সটবুকে বেবিফুড হিসেবে, এই জোড়াতালি তত্ত্ব আজকের পৃথিবীর জন্যে তো বটেই, বিশেষ করে দক্ষিণ এশিয়ার স্বতশ্চল সমাজের ক্ষেত্রে খাটানো খুবই মুশকিল বলে মনে হয়। খোদ মার্কস যদি জার্মান দর্শন, ফরাসী সমাজবাদ আর ইংলন্ডীয় অর্থনীতি জেনেশুনে ইউরোপের শিল্পায়নভিত্তিক সমাজে বিপ্লবের তত্ত্বনির্মাণ করতে পারেন, আমাদের দেশের বিপ্লবী চেতনার ব্যক্তিরা তবে কেনই বা ভারতীয় দর্শন (অধ্যাত্মিক আর লোকায়ত উভয়ই), পঞ্চায়েতভিত্তিক স্বায়ত্তশাসন তথা এশীয় সমাজবাদ আর স্বশাসিত অর্থনীতির শিক্ষা থেকে দক্ষিণ এশিয়ার জন্য উপযোগী বিপ্লবী তত্ত্বনির্মাণ করতে পারবেন না? কে জানে কেন, হয়তো নিজেদের বিপ্লবী বলে ঢ্যাঁড়া পেটানো লোকেরাও সুন্নিদের কাছে মাথা বেচে বসে আছে!

                 ☆       ☆       ☆       ☆       ☆

অন্য প্রসঙ্গে আসি। লগ্নি আর লুঠের পুঁজির প্রতিই যে অনুৎপাদক ইসলামীদের নেকনজর থাকবে, সেটা স্বাভাবিক। ফলে আমার মনে হয় উৎপাদনমূলক পুঁজির মালিকরাই যুদ্ধবাদী ইসলামকে রুখতে চেয়েছে বরাবর। হয়তো এই জায়গা থেকে নবজাগরণের সময়কার ইসলামবিরোধী ক্রুসেডারদের পেছনে সদ্যোত্থিত বণিকপুঁজির প্রেরণা কাজ করেছে। ফলে আধুনিক বিশ্বে হয় ইসলামকেই উদ্বৃত্ত মূল্য/ পুঁজির উপযোগী করে তোলা হবে, নয় লুঠেরা লগ্নিপুঁজির বাহক হিসেবে 'ইসলামী বিপ্লব' পয়দা করা হবে। দেশের ভেতরের কথা বাদ দিলেও বাইরের বিশ্বরাজনীতির অবস্থা অতীব জটিল রূপ নিচ্ছে। যেন আরেকটা 'গ্রেট ডিপ্রেশন' আসছে এই তিরিশের দশকে!

                  ☆       ☆       ☆       ☆       ☆

আপনার সাথে পত্র আদানপ্রদানের এক বছর হয়ে গেছে। আপনাদের মতো সিরিয়াস ও অন্বেষক মানুষের সান্নিধ্য পাওয়ার সৌভাগ্য আমার কিছু ক্ষেত্রে হয়েছে।

লেখালিখি ও অন্যান্য কাজ করার মতো সুস্থ ও কর্মক্ষম থাকুন-- এই প্রার্থনা করি। আপনাদের 'সিন্ধু থেকে গঙ্গা'র তৃতীয় খণ্ড লেখার কাজ শেষ? আর চঞ্চলবাবু সুস্থ আছেন তো?

এই নতুন বছরে সমস্ত কিছুই ভালো হোক। আপনার সাথে পত্রালাপের স্মৃতি থাকবে আজীবন। সুস্থ থাকবেন। আবার ফিরব আগামী পত্রে।

আপনার সাফল্যকামী,

অভিরূপ মুখোপাধ্যায়

Feb 20, 2024

========================

Sent On March 3, 2024

প্রিয় অভিরূপ বাবু,

বেশ কয়েক দিন পর আপনার পত্র পেলাম। স্বাভাবিকভাবে প্রতিটি পত্রের মতো এবারকার আপনার পত্র থেকেও চিন্তার নূতন কিছু খোরাক পেলাম। ইসলাম বা মুসলমানের কাছ থেকে আপনি উৎপাদনশীল পুঁজির সহযোগী শক্তির আশা রেখেছেন। এটা ঠিক যে, খুব মন্দ জিনিসেরও কিছু ভালো দিক থাকতে পারে বা থাকেও। যেমন মুসলমানের ভিতরে সাধারণত থাকে সাহসিকতা, দলগত ঐক্যবদ্ধতার প্রবণতা কিংবা  তীব্র গতিশীলতা। সেগুলি ভালো। কিন্তু এই গুণগুলি তখনই মানুষের জন্য কল্যাণকর হয়ে দেখা দিতে পারে যখন তা ইসলামের কাঠামো থেকে বেরিয়ে মানবতার বৃহত্তর ও মহত্তর চেতনার ভূমিতে দাঁড়াতে পারে। কিন্তু ইসলামের কাঠামোবদ্ধ থাকা অবস্থায় এই সবকয়টি গুণই মানবতার প্রতি অভিশাপ হতে পারে। ইসলাম কোনও মুক্ত মানুষের ধর্ম হতে পারে না। এটা দাসদের জন্য দাসত্বের ধর্ম। এখানে সবাই দাস। প্রভুরাও বড় দাস মাত্র, দাসত্বের বিধিবিধানকে অস্বীকার করার ক্ষমতা যাদেরও থাকে না। অর্থাৎ মুসলিমের সাহসিকতা, ঐক্যবদ্ধতা কিংবা গতিশীলতা সবই ইসলামী দাসত্বের কাঠামোবদ্ধ।

আমার মনে হয় না ইসলামকে কখনও ‘উদ্বৃত্ত মূল্য/পুঁজির উপযোগী’ করা যাবে। খ্রীষ্টান বা বৌদ্ধ, এমনকি হিন্দু ধর্মেও গোঁজামিল দিয়ে কিছু দূর পর্যন্ত চালিয়ে নেওয়া সম্ভব হলে হতেও পারে, কিন্তু ইসলামে সেটা যে একেবারে সম্ভব নয় তার প্রমাণ সমস্ত মুসলিম পৃথিবী। মুসলিম দেশগুলিতে আধুনিক শিল্প-সভ্যতা নির্মাণের যে সামান্য অগ্রযাত্রা হচ্ছে তার প্রায় সবটাই বাইরে থেকে জোর করে চাপানো বা বাধ্যবাধকতামূলক। এর ভিত্তি অব্যাহত বিদেশ নির্ভরতা কিংবা আরও নির্দিষ্ট করে বললে বৈদেশিক নিয়ন্ত্রণ ও আধিপত্য। এভাবে কি পুঁজির শক্তি সুস্থ ও সবল ভাবে বিকাশ লাভ করতে পারে?

হ্যাঁ, বৈদেশিক লুঠেরা লগ্নি পুঁজির তল্পিবাহক হিসাবে ইসলাম কিংবা ইসলামী ‘বিপ্লব’ ঘটতে পারে। কিন্তু সেই বিপ্লবের সঙ্গে প্রকৃত বিপ্লবের কী বা কতটুকু সম্পর্ক? ওটাকে বিপ্লব না বলে প্রতিবিপ্লব বলাই সমীচীন হবে। ইসলামের সঙ্গে মানুষের পশ্চাদযাত্রা বা প্রতিক্রিয়াশীলতার গভীর সম্পর্ক আছে। তাই তা সর্বদা প্রগতিমুখী আবিষ্কার ও উদ্ভাবন বিরোধী। কিন্তু পুঁজি কিন্তু কোনও না কোনও ভাবে উৎসাহ দেয় এই সবগুলিকেই।

ইসলামের ভূমিকার দৃষ্টান্ত দিতে গিয়ে তুরস্কের সুলতান বা খলীফার একটা ঘটনার কথা বলতে ইচ্ছা করছে। তবে এটা আমার অনেক কাল আগে পড়া। এখন আমি খলীফার সময় এবং নাম যেমন বলতে পারব না তেমন যে ইতিহাস বইতে আমি ঘটনাটার কথা পড়েছিলাম সেটার নামও বলতে পারব না। তবে আমার ধারণা, সন্ধান করলে এর সত্যতা নির্ধারণ করা যাবে। যাইহোক, ঘটনাটা উল্লেখ করি।

একজন কারিগর, হয়ত তাকে বিজ্ঞানীও বলা যায়, তিনি একটা অপূর্ব সুন্দর কাঁচের পাত্র তৈরী করে সেটা তুরস্কের রাজদরবারে নিয়ে যান। তার সৌন্দর্য ও আলোকছটা রাজসভায় উপস্থিত সবাইকে অভিভূত করে। খলীফা নিজেও এর রূপ দেখে স্তম্ভিত হন। কিন্তু ঐ নির্মাতার ভাগ্যে কী জুটেছিল জানেন? তাৎক্ষণিক মৃত্যুদণ্ড। খলীফার বক্তব্য ছিল এই কারিগরকে বাঁচিয়ে রাখলে সোনার মূল্য আর কাঁচের মূল্য এক রকম হবে। ফলে সোনার মূল্য বা আকর্ষণ থাকবে না। সুতরাং তার নির্দেশে এই বিপজ্জনক উদ্ভাবককে তৎক্ষণাৎ হত্যা করা হল।

আমার মুসলিম সমাজের অভিজ্ঞতার সঙ্গে আমি এই ঘটনার তাৎপর্যকে মিলিয়ে বহুকাল ধরে যেটা বুঝেছি সেটা হচ্ছে খুব বেশী সহিংস কোনও সমাজের ভিতর থেকে নূতন নূতন আবিষ্কার বা উদ্ভাবন সম্ভব না। কারণ এটা সমাজের স্থিতাবস্থাকে হুমকির সম্মুখীন করে। তার মানে এই নয় যে, সহিংসতা নির্ভর সমাজ বাহির থেকে নূতন উপকরণ গ্রহণ করে না। তবে সেটা করে বাধ্য হয়ে কিংবা খুব লাভজনক হয়ে দেখা দিলে। অর্থাৎ বিষয়টা ভিতর থেকে উদ্ভূত নয়, বরং বহিরাগত বা বহিরারোপিত। যখন থেকে আমার মনে এই বোধ গভীর হয়েছে তখন থেকে মানব সভ্যতার অগ্রগতিতে ভূমিকা রাখবার ক্ষেত্রে ভারতবর্ষ এবং আরও বিশেষ করে সিন্ধু সভ্যতা আমার কাছে নূতন তাৎপর্য নিয়ে ধরা দিয়েছে। মিসর বলুন, মেসোপটেমিয়া বলুন, চীন বলুন সকল সভ্যতা প্রভূত পরিমাণে সহিংসতা নির্ভর। নূতন নূতন উদ্ভাবন এসব সমাজের ভিতর থেকে কতটা সম্ভব? বরং এটা সম্ভব যে, কোথায়ও থেকে তৈরী বা প্রাপ্ত বিদ্যা নিয়ে গিয়ে কেউ নূতন ভূমিতে অবস্থিত সহিংস সমাজগুলিকে পরাস্ত করে এই সব সভ্যতার ভিত্তি নির্মাণ করেছে।

অবশ্য আমার বক্তব্যের মানে এই নয় যে, সহিংস সমাজগুলিতেও নূতন নূতন উদ্ভাবন হতে পারে না। তাহলে চীনে বারুদ কিংবা কাগজ উদ্ভাবনের ব্যাখ্যা করা যাবে না। কিন্তু এগুলির সঙ্গে একদিকে সামাজিক বাধ্যতা বা চাহিদার এমন সম্পর্ক ছিল যার ফলে এ ধরনের কিছু উদ্ভাবনের প্রসারকে প্রতিহত করা যায় না। বরং রাষ্ট্রের কোনও না কোনও শক্তি এ ধরনের বস্তুগুলির ব্যবহারকে সমর্থন বা পৃষ্ঠপোষকতা দিয়েছে। কিন্তু এও ঠিক যে, চীন বা ইউরোপের সমাজের মতো সমাজগুলির পটভূমি বিচারের সময় আমরা যেন মূলত শান্তিবাদী বৌদ্ধ ও খ্রীষ্টান ধর্মের ভূমিকাকে ভুলে না যাই। যুদ্ধ, হিংসা যেমন এই সমাজগুলি নির্মাণে প্রভূত ভূমিকা রেখেছে তেমন বৌদ্ধ ও খ্রীষ্টান ধর্মের ত্যাগ, শান্তি ও অহিংসারও বিরাট ভূমিকা এই সমাজগুলিতে রয়ে গেছে। বিশেষত সমাজের ভিতরে ত্যাগ, শান্তি, সেবা ও অহিংসার চেতনাকে সতত জাগিয়ে রাখবার প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থা হিসাবে সংঘ বা চার্চের ভূমিকাকে যেন একেবারে তুচ্ছ করে না দেখি। এ ধরনের অহিংসা নির্ভর কোনও প্রতিষ্ঠানের অস্তিত্ব কি কোনও মুসলিম সমাজে সম্ভব? কাঁঠালের আমসত্ত্ব কীভাবে হতে পারে?

প্রতিকূল পরিস্থিতিতে শাসক শ্রেণী কিংবা উচ্চবর্গ বা ‘এলিট’ শ্রেণী থেকে একটা ধূর্ত গোষ্ঠী এসে একটা ভদ্র ও আধুনিক পোশাক ও মুখোস পরিয়ে ইসলামের কুৎসিত ও হিংস্র রূপকে ঢাকবার প্রয়াস করতে পারে। কিন্তু ইসলামী কবি ইকবালের ভাষায় বলতে হয়, ‘ইসলাম জিন্দা হোতা হ্যায়, হর কারবালা কে বাদ।’ এ কথার মূল বার্তা হল প্রত্যেক বিপর্যয়ের পর ইসলাম পুনরুজ্জীবিত হয়। ইসলাম সর্বদা তার আদি রূপে ফিরতে চায়। এখানে ভিন্ন ধরনের সংস্কারের কোনও জায়গা নাই। ফলে কখনও আপোসমুখিতা হিসাবে এক ধরনের নম্রতা বা নমনীয়তার কাল এলেও তার পরেই আসবে ভয়াবহ হিংস্রতার মাধ্যমে তার আদিপর্ব বা মূল রূপে ফিরবার পথযাত্রা।

আসলে ইসলামের ধর্মীয় বিধান অনুযায়ীও প্রতিকূল পরিস্থিতিতে ইসলামী পরিভাষা অনুযায়ী যেটাকে ‘তাকিয়া’ বলা হয় সেই তাকিয়া অর্থাৎ প্রতারণার ব্যবহার বৈধ। ইসলাম ভয়ঙ্কর মিথ্যা ও প্রতারণার ধর্ম। আল্লাহর নামে যে কোনও অপকর্ম করা যায়। ধর্মের অজুহাতে বিনা উস্কানিতে আক্রমণ, হত্যা, লুণ্ঠন, দাসকরণ, নারী অপহরণ ও ধর্ষণ সবই এই ধর্মে ন্যায়সঙ্গত। সুতরাং বুঝতেই পারছেন দরিদ্র, অশিক্ষিত ও মূর্খ, অমার্জিত, লুঠেরা, ইতর, নারী-বিদ্বেষী ও ধর্ষকদের নিকট এই ধর্মের আকর্ষণ কতটা প্রবল হতে পারে! ইসলামের ছায়ার নীচে বিদেশানুগত পুঁজির যে রূপের স্বচ্ছন্দ বিকাশ ঘটতে পারে সেটা হচ্ছে লুঠেরা, লুম্পেন ও হিংস্র একনায়কী পুঁজি। কিন্তু অভ্যন্তরীণ সমাজের ক্ষেত্রে এর রূপ যতই হিংস্র ও নৃশংস হোক বাইরের পুঁজির শক্তিমত্তার সম্মুখে এটা সর্বদা মাথা নত ক’রে ও হাঁটু গেড়ে থাকে। পাশ্চাত্য কিংবা রাশিয়া অথবা চীনের বিপরীতে পাকিস্তানের ভূমিকার দিকে তাকিয়ে দেখুন! একইভাবে দেখুন ভারত, পাশ্চাত্য কিংবা চীন-রাশিয়ার বিপরীতে বাংলাদেশের ভূমিকা।

আসলে পুঁজিও বিমূর্ত সত্তা নয়। তার পিছনের শক্তি হল মানুষ এবং আরও সঠিকভাবে বললে মানুষের সমাজ। সুতরাং পুঁজি সমাজের সৃষ্টি। যে সমাজের আশ্রয়ে পুঁজি জন্ম ও বিকাশ লাভ করে তার বৈশিষ্ট্য যে তা সর্বাঙ্গীনভাবে গ্রহণ করবে সেটাই তো স্বাভাবিক।

☆       ☆       ☆       ☆       ☆

পশ্চিম বঙ্গের বাম ধারার বুদ্ধিবৃত্তির সমস্যা সম্পর্কে বলতে গিয়ে একটা ঘটনার কথা বলতে ইচ্ছা করছে। সময়টা ১৯৯১ সাল। আমি তখন বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান বা Bangladesh Institute of Development Studies (BIDS) নামে বাংলাদেশ সরকারের গবেষণা প্রতিষ্ঠানের একটা প্রকল্পে গবেষক হিসাবে কর্মরত ছিলাম। সেই সময় উক্ত সংস্থা থেকে পশ্চিম বঙ্গের ভূমি প্রশাসন ও ভূমি সংস্কারের উপর মাঠ পর্যায়ে অনুসন্ধানের জন্য আমাদের দুইজন গবেষককে পশ্চিম বঙ্গ ভ্রমণের জন্য পাঠানো হয়। এটা ছিল প্রায় এক মাসের একটা সফর।

সেই সময় কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন খ্যাতনামা অধ্যাপক আমাদের দুইজনের সম্মানে একটা পরিচিতি ও মতবিনিময় সভার আয়োজন করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আমার ঘনিষ্ঠ এক অধ্যাপকের যোগসূত্র ধরে তার সঙ্গে আমি দেখা করি। তিনি কোনও দল না করলেও ছিলেন কট্টর বামপন্থী। যতদূর মনে পড়ছে তিনি এক সময় নকশালপন্থার সমর্থক ছিলেন। যাইহোক, সভার শুরুতে তিনি তার ভাষণে ভারতের রাজনীতির উপর বক্তব্য দিলেন। বক্তব্য দিতে গিয়ে তিনি হিন্দুত্ববাদ ও বিজেপি রাজনীতির সমালোচনায় বক্তব্য দিলেন। তখনও বিজেপির এভাবে উত্থান ঘটে নাই। যাইহোক, তিনি তার ভাষণে হিন্দু ধর্মের বিরুদ্ধে বলতে গিয়ে এতটাই আবেগাপ্লুত হলেন যে, আমাকে হতভম্ব করে দিয়ে এক পর্যায়ে তিনি বললেন, ‘পারলে আমি নিজেই মুসলমান হয়ে যাই।’

আমি তার সঙ্গে বিতর্কে যেতে চাই নাই। আমি শুধু তাকে জিজ্ঞাসা করলাম তিনি কুরআন পড়েছেন কি না। তিনি হাঁ সুচক উত্তর দিলেন। এবং জানালেন যে, তিনি গিরীশ সেনের বাংলা অনুবাদ পড়েছেন। এরপর আমি জিজ্ঞাসা করলাম, ‘আপনি কি হাদীস পড়েছেন?’ তিনি জানালেন যে, তিনি হাদীস পড়েন নাই। ব্যাস, এ প্রসঙ্গে আমি তার সঙ্গে আর কোনও কথা বলি নাই। আসলে ইসলাম নিয়ে তার সঙ্গে বিতর্কে গিয়ে তিক্ততা সৃষ্টি করতে চাই নাই। কিন্তু ‘পারলে আমি নিজেই মুসলমান হয়ে যাই’ এই কথা আজও যখন আমার মনে হয় তখন পশ্চিম বঙ্গের প্রগতিশীল বা বামপন্থী চেতনার দুর্গতি সম্পর্কে আমার এতটুকু সংশয় থাকে না। ভদ্রলোকের নামটা বললাম না। জানি না তিনি বেঁচে আছেন কিনা। তবে তিনি সেই সময় নাম করা একজন পণ্ডিত ছিলেন।

আরও কিছু পরবর্তী কালে যখন আমি ‘ইসলামের ভূমিকা ও সমাজ উন্নয়নের সমস্যা’র হাতে লিখা পাণ্ডুলিপির ফটোকপি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক অধ্যাপককে পড়তে দিই তখন বইটি পড়ে তিনি এতই ক্ষুব্ধ হয়েছিলেন যে, আমাকে তিনি হুমকি পর্যন্ত দিয়েছিলেন। এ ধরনের লেখা নিয়ে আমি পশ্চিম বঙ্গে গেলে তারা যে আমাকে ছাড়বেন না সেটাও বললেন। আমি যাদের কথা বললাম তারা কিন্তু সকলেই হিন্দু সমাজভুক্ত মানুষ এবং কমিউনিস্ট বা মার্কসবাদী ছিলেন। এবার ‍বুঝুন কমিউনিস্ট চেতনার দশা!

যেহেতু প্রধানত ইসলামের বিরুদ্ধে সমালোচনা ও লড়াই থেকে কৈশোরে আমার রাজনৈতিক যাত্রাপথের শুরু সেহেতু উগ্র ইসলামবাদীদের মতো পশ্চিম বঙ্গের এসব হিন্দু কমিউনিস্টের বক্তব্য আমাকে কী পরিমাণে ক্ষুব্ধ, আশাহত ও বিস্মিত করেছিল সেটা বুঝতেই পারেন। বাংলাদেশের মতো উগ্র মুসলিম সমাজেও আমাকে এতটা তিক্ত অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হতে হয় নাই। অবশ্য বাংলাদেশ-রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পর থেকে পরিস্থিতির ক্রমবর্ধমানভাবে অবনতি হয়েছে। এক সময় আমি যেটা প্রায় সর্বত্র বলতে পারতাম এখন আর সেটা সম্ভব নয়। কেন এমন হয়েছে এবং বিশেষত কাদের কারণে হয়েছে সেটা নিয়ে কথা বলে আর কাল ক্ষেপণ করতে চাই না। সে প্রসঙ্গে গেলে আসবে ভারতের ভূমিকার কথা, আসবে বিশেষ করে আওয়ামী লীগ ও তার পরবর্তী কালে বিএনপি-র ভূমিকার কথা, আসবে কমিউনিস্টদেরও ভূমিকার কথা। অন্য প্রসঙ্গগুলি আপাতত থাক। বরং এই আলোচনার জন্য খুব প্রাসঙ্গিক ভেবে কমিউনিস্টদের ভূমিকা সম্পর্কে কিছু বলি।

আপনি জানেন কমিউনিস্ট বা মার্কসবাদী রাজনীতির সঙ্গে আমার সম্পৃক্ততা অল্প সময়ের নয়। বস্তুবাদী বা নিরীশ্বরবাদী চিন্তার প্রতি আস্থা অর্পণের মধ্য দিয়ে মার্কসবাদী আদর্শের পথে আমার যাত্রা শুরু হয় যখন আমি ১৯৫৭ সালে উচ্চবিদ্যালয়ের অষ্টম শ্রেণীর ছাত্র সেই তখন থেকে। সেই সময় থেকে একজন ব্রতচারী বা মিশনারীর উদ্যম ও প্রাবল্য নিয়ে নিরীশ্বরবাদ প্রচার করতে শুরু করি। কম্যুনিজম সম্পর্কে দশম শ্রেণী থেকেই কিছু সংশয় ও সমালোচনা থাকলেও মূলত সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের লক্ষ্যকে সামনে রেখেই আমার কর্মতৎপরতা অব্যাহত ছিল ১৯৭১ সাল পর্যন্ত। ষাটের দশকের শেষার্ধ এবং বিশেষত একাত্তরের যুদ্ধের সময়কার আমার অভিজ্ঞতা আমার জন্য যথেষ্ট ছিল এ দেশের কমিউনিস্ট রাজনীতি সম্পর্কে মোহমুক্তি ঘটবার জন্য।

বহুকাল আমি চিন্তা করতাম মার্কসবাদী হলে মানুষ এমন যুক্তিবুদ্ধিহীন এবং যান্ত্রিক হয় কী করে? রাশিয়া, চীনের মতো বিভিন্ন দেশে তো মার্কসবাদ নিয়েই মানুষ বিপ্লব করেছে। তারা তো আমাদের দেশের মার্কসবাদীদের মতো মতান্ধ হয়ে পড়ে থাকে নাই। যার যার দেশের বাস্তবতা অনুযায়ী তারা তত্ত্বকে পরিবর্তিত বা পরিমার্জিতও করে নিয়েছে। পরবর্তী সময়ে বুঝেছি এটা সমাজেরও সমস্যা বটে। মুসলিম বা হিন্দু সমাজের ধর্মাচ্ছন্নতার প্রভাব থেকে মানুষ সহজে বের হয়ে আসতে পারে না। তাই মার্কসবাদও তাদের নিকট দেখা দেয় আর এক ধরনের ধর্ম হিসাবে। পশ্চিম ইউরোপ, রাশিয়া এবং চীনের যে অভিজ্ঞতার পটভূমিতে মার্কসবাদী রাজনীতি বা তত্ত্বের যে ক্রমবিকাশ ঘটেছে তারা নিজেদেরকে সেই ধারার মধ্যে আবদ্ধ করে রাখতে চায়।

আমার মনে আছে, ১৯৭২ সালের মাঝামাঝি সময়ে আমি যখন বাংলাদেশের এক প্রখ্যাত কমিউনিস্ট নেতা অমল সেনকে মার্কসবাদী রাজনীতি ও তার নেতাদের সম্পর্কে আমার তিক্ত অভিজ্ঞতা ও মূল্যায়নের কথা বলছিলাম তখন তিনি আমার কথার উত্তরে বললেন, ‘কমরেড, আমি কমিউনিস্ট হিসাবে মরতে চাই।’ বুঝতেই পারছেন, তার এ কথার পর তার সাথে আমার আর কথা বাড়াবার আগ্রহ থাকে নাই। ব্যক্তিগত জীবন ও গুণাবলীর জন্য আমি আজ অবধি এই প্রয়াত নেতাকে খুব শ্রদ্ধা করি। কিন্তু বলুন এই সব এক ধরনের ধর্মান্ধ ব্যক্তি বিপ্লব করবেন কী করে? পাওয়া তত্ত্বের শুদ্ধতা রক্ষাতেই তাদের জীবনপাত হবে!

আমি বহুকাল ধরে বুঝতে চেষ্টা করেছি, যে সব দেশে মার্কসবাদীরা বিপ্লব সম্পন্ন করেছে তারা পেরেছে অথচ আমরা পারি নাই কেন? তাদের জন্য শ্রেণীতত্ত্ব বাধা হয় নাই, অথচ আমাদের জন্য বাধা হয়েছে কেন? ক্রমে আমি বুঝেছি যে, যেসব দেশে জাতি গঠন আগেই মূলত সম্পন্ন হয়েছে সেসব দেশে সামাজিক বিপ্লব সম্পন্ন করাও সহজতর হয়েছে। এমনকি পশ্চিম ইউরোপের বুর্জোয়া বিপ্লবের ক্ষেত্রেও এ কথা প্রযোজ্য। এক সময় সেখানে ক্যাথলিক চার্চ ছিল রাষ্ট্রেরও উপর কর্তৃত্বশীল। কিন্তু রেনেসাঁ পরববর্তী কালে যখন চার্চের কর্তৃত্ব ভেঙ্গে পড়ে তখন আসে জাতি ভিত্তিক রাষ্ট্র গঠনের কাল। এই জাতি-রাষ্ট্র গঠনের সমান্তরালে সামন্ততন্ত্রের উচ্ছেদ সাধন ও গণতান্ত্রিক বিপ্লব ঘটতে থাকে। এভাবে ক্রমে আজকের পশ্চিম ইউরোপের জাতি-রাষ্ট্রগুলির উত্থান ঘটে। এই জাতিগুলি আবার অধিকাংশ ক্ষেত্রে অভিন্ন ভাষাকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে। সুইজারল্যান্ডের মতো কতিপয় রাষ্ট্র একাধিক ভাষাভিত্তিক জাতি বা জাতিসমষ্টি নিয়ে গঠিত হলেও ফ্রান্স, ইংল্যান্ড, জার্মানীর মতো রাষ্ট্রগুলি মূলত এক ভাষাভিত্তিক জাতিকে কেন্দ্র করে গঠিত। 

পরবর্তী কালে যখন পাশ্চাত্য পুঁজিবাদের মোকাবিলায় রাশিয়া, চীন, ভিয়েৎনাম, কিউবার মতো দেশগুলির আধুনিকায়নের প্রয়োজনে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব করতে হয়েছে তখন সেটা সম্পন্ন করা গেছে জাতি গঠন ও তার ভিত্তিতে রাষ্ট্র গঠনের মৌল ভিত্তি আগেই নির্মিত হয়ে থাকায়। কিন্তু উপমহাদেশে জাতি গঠনের করণীয় আজও অসম্পূর্ণ হয়ে রয়েছে মূলত ধর্মের কারণে। প্রথমত হিন্দু ধর্ম ও দ্বিতীয়ত ইসলাম ধর্ম এ ক্ষেত্রে বাধা হয়ে থেকেছে। এছাড়া বাধা হয়ে আছে ব্রিটিশ উপনিবেশবাদের আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক ব্যবস্থার ধারাবাহিকতা।

তবে হিন্দু ধর্মই বৃহৎ ভারতের ঐক্যের মূল শক্তি হয়ে আছে আজ অবধি। কিন্তু হিন্দু ধর্ম যে সমাজকে শুধু পশ্চাৎপদতায় আবদ্ধ করে রাখার শক্তি হিসাবে কাজ করে তা-ই নয়, অধিকন্তু বিভাজনবাদী চেতনার সূতিকাগার হিসাবে কাজ ক’রে ভারতের রাষ্ট্রীয় ঐক্যের শক্তিকে অবিরাম অন্তর্ঘাত করে চলে। এভাবে এই ধর্ম ভারতের জন্য এক অদ্ভূত স্ববিরোধের ফাঁদ তৈরী করে রাখে।

বাংলাদেশের জন্য ইসলাম ধর্ম আর একভাবে সঙ্কট সৃষ্টি করে রাখে। এ সম্পর্কে এখন আর নূতন করে বলব না। এর আগে বিভিন্ন পত্রে আমি ইসলাম সৃষ্ট সমস্যা সম্পর্কে বেশ কিছু আলোচনা করেছি।

যাইহোক, আমি পাকিস্তান কাল থেকে কমিউনিস্টদের মধ্যে যে সমস্যা দেখে আসছি তা হল তারা মতাদর্শিকভাবে ধর্ম বিশ্বাসী না হলেও তারা ধর্মকে অনেকটা পাশ কাটিয়ে চলতে চায় সমাজের বিরুদ্ধতাকে এড়াতে চেয়ে। তাদের ধারণা শ্রেণী চেতনার জাগরণ ঘটিয়ে তারা ধর্মীয় চেতনাকে দুর্বল বা খর্ব করতে পারবে। আসলে ধর্মের প্রশ্ন এলে এরা ভীত হয়ে পড়ে। শ্রেণীতত্ত্বের তুলনায় ধর্মের বিরুদ্ধ শক্তি হিসাবে যে জাতীয়তাবাদ কিংবা জাতি চেতনা অনেক বেশী কার্যকর এই সহজ সত্য কমিউনিস্টরা বুঝে না। আসলে জাতি চেতনা তাদের সর্বহারা শ্রেণী ভিত্তিক আন্তর্জাতিকতার চেতনাকে খর্ব করতে পারে এই ভয় তাদেরকে সন্ত্রস্ত করে রাখে। যদি ধর্মের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের গুরুত্ব তারা বুঝত তাহলে এই অবস্থা হত না। তখন তারা আরব জাতীয়তাবাদ তথা আরব সাম্রাজ্যবাদের ধর্ম হিসাবে ইসলামকে চিনে তার বিপরীতে নিজ জাতি গঠন ও সেই জাতি ভিত্তিক রাষ্ট্র গঠনের গুরুত্ব বুঝত। বিশেষত পাকিস্তান আমল থেকে পূর্ব বাংলায় যে বাঙ্গালী জাতীয়তাবাদ ইসলামের বিরুদ্ধ শক্তি হিসাবে বিরাট ভূমিকা রাখায় সক্ষম সেটা তো প্রমাণিত ঘটনা। কিন্তু এ দেশে কমিউনিস্টদের সমস্যা যে তারা জাতি কিংবা জাতি ভিত্তিক রাষ্ট্র গঠনের সাধনা করতে রাজী নয়। পাকিস্তান কালে আমরা যারা সে কাজ করতে চেয়েছিলাম তারা ছিলাম সম্পূর্ণরূপে অনভিজ্ঞ ও নেতৃত্বহীন। ব্যর্থতাই ছিল আমাদের ভাগ্যলিপি।

আমাদের মতো পাশ্চাত্যের উপনিবেশিক উত্তরাধিকার বহনকারী দেশগুলির ক্ষেত্রে পাশ্চাত্য কিংবা আধিপত্যকারী বহিঃশক্তিসমূহকে মোকাবিলা করে দাঁড়াবার ক্ষেত্রে জাতীয়তাবাদের গুরুত্ব অপরিমেয়। মনে রাখতে হবে এইসব আধিপত্যকারী শক্তির মর্মে যেমন আছে তাদের নিজস্ব জাতি ও জাতীয়তাবাদের বাস্তবতা তেমন তাদের বিপরীতে আছে আমাদের নিজ জাতিগত স্বাতন্ত্র্যেরও বাস্তবতা। এই বাস্তবতাকে অস্বীকার করে বিশেষ করে আজকের বৈশ্বিক বাস্তবতায় স্বাধীনভাবে দাঁড়াবার প্রশ্নই উঠে না। ইসলামী সাম্রাজ্যবাদের প্রশ্ন দূরে থাক, আধুনিক সাম্রাজ্যবাদকে মোকাবিলা করে দাঁড়াতে হলেও কোনও না কোনও ধরনের জাতিগত চেতনা তথা জাতীয়তাবাদের আশ্রয় লাগবে। আমাদের মতো দেশে নির্বিচারে জাতীয়তাবাদকে বিরোধিতা করার অর্থ হল সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে লড়াই পরিত্যাগ করে ভুল জায়গায় লড়াইয়ের শক্তি সমাবেশ করা। এ দেশে কমিউনিস্টরা চিরকাল এই কাজ খুব ভালোভাবে করেছে। শ্রেণী সংগ্রামকে আমি ভুল মনে করি না। কিন্তু সেটা হওয়া উচিত ছিল জাতি ও জাতি-রাষ্ট্র গঠনের সংগ্রামের অধীনস্থ অথবা সহযোগী। 

পশ্চিম বঙ্গ ভ্রমণকালে ২০০১ সালের মার্চ মাসে ‘ধর্ম ও শ্রেণীতত্ত্বের যাঁতাকলে বাঙ্গালী জাতি’ নামে একটা প্রবন্ধ লিখেছিলাম যেটা ঐ সময় কলকাতা থেকে প্রকাশিত ‘স্বাধীন বাংলা’ নামে একটা পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। আপনাকে প্রবন্ধটার লিংক দিচ্ছি। কেশব মুখোপাধ্যায় ছিলেন পত্রিকাটার সম্পাদক। যাইহোক, প্রবন্ধটা ঐ নামে একটি প্রবন্ধ সংকলনে পরবর্তী কালে ‘ব-দ্বীপ প্রকাশন’ কর্তৃক প্রকাশিত হয়। বঙ্গরাষ্ট্রেও লেখাটা দেওয়া আছে। প্রবন্ধের লিংক : (http://bangarashtra.net/article/398.html)। অন্যান্য প্র্রবন্ধ না পড়লেও এটা পড়তে পারেন।

☆       ☆       ☆       ☆       ☆

জাতি গঠন কিংবা জাতীয়তাবাদের পথে আমার যাত্রা বাংলা ও বাঙ্গালী জাতিকে নিয়েই শুরু হয়েছিল। কিন্তু সেটা শেষ পর্যন্ত সেখানে যে সীমাবদ্ধ থাকে নাই, সেটা আমার মনে হয়, আমি স্পষ্ট করতে পেরেছি আমার বিভিন্ন পত্র ও রচনার মাধ্যমে। বিশেষ করে ‘আলাপচারিতা’র প্রথম রচনায় আমি সেটা স্পষ্ট করতে চেয়েছি। আসলে বঙ্গ বা বাংলা থেকে শুরু হলেও এটা পূর্ণতা নিতে চেয়েছে ভারতবর্ষ পর্যন্ত বিস্তৃত হয়ে।

ভারত পর্যন্ত আমার চিন্তার বিস্তারের প্রধান কারণ সম্ভবত খুব ছেলেবেলা থেকে আমার অধ্যয়নশীলতা। বিশেষত দেড়-দুই হাজার বছরের ভারতবর্ষের বেদনার ইতিহাস আমাকে অভিভূত করে রাখত আমার কিশোর বয়স থেকেই। বিভিন্ন বৈদেশিক হানাদার বিশেষ করে মুসলিম হানাদারদের আক্রমণ, হত্যা ও ধ্বংসের বিবরণসমূহ পাঠ করে নবন-দশম শ্রেণী থেকেই ব্যথিত ও ক্ষুব্ধ হতাম। ভারতীয়রা সচরাচর বাইরে আক্রমণ ও লুণ্ঠন করত না। অথচ তারা এগুলির শিকার হত বারবার। স্বাভাবিকভাবে ভারত আমার কাছে অতীব ভালোবাসা ও সহানুভূতির একটা ধারণা হিসাবে গড়ে উঠেছিল। ভারত ছিল আমার কাছে এক গভীর মমতার ভাব বা Idea। কিন্তু বাস্তবে সেটাকে ধারণ করবার উপায় ছিল না। সেটা ছিল পাকিস্তান কালে পূর্ব বাংলা। পূর্ব বাংলাকে কেন্দ্র করে আমি বাস্তব পৃথিবীতে পা ফেলতে চেয়েছিলাম। এখান থেকে যুক্তবাংলা এবং পরবর্তী ধাপে সমাজতান্ত্রিক বা জন-গণতান্ত্রিক ভারতীয় যুক্তরাষ্ট্র।

তবে সুদীর্ঘ কাল ভারতীয় যুক্তরাষ্ট্র গঠনের ক্ষেত্রে ভাষা ও জাতির বিভাজনগত সমস্যার যৌক্তিক কোনও সমাধান আমি পাই নাই। বিদ্যমান ভারতীয় ঐক্যের ক্ষেত্রে হিন্দু ধর্মকে দেখতাম। অথচ আমি ধর্ম বিরোধী। বর্ণজাতিভেদ ভিত্তিক হওয়ায় আমার মনে হিন্দু ধর্মের প্রতি বিরোধিতা ছিল আরও অনেক বেশী।

হিন্দু ধর্মের প্রতি আমার অনীহার আর এক কারণ ছিল আর্য আক্রমণ সংক্রান্ত ধারণায় বিশ্বাস। এর ফলে ‘বহিরাক্রমণকারী’(!) আর্যদের উত্তরসূরী হিসাবে হিন্দুদের দেখতাম। এটা আর যা—ই হোক হিন্দুদের কিংবা তাদের ধর্মের প্রতি তেমন একটা সহানুভূতি ও মর্যাদা বোধ জাগাত না, যদিও বহুকাল ধরে বৈদেশিক হানাদারদের হাতে নির্যাতিত হিসাবে হিন্দুদের জন্য দুঃখবোধও ছিল। তবে ছেলেবেলা থেকে ভারতীয় সাহিত্য, ইতিহাস ও দর্শন পাঠ থেকে ভারতীয় জনসমাজ সম্পর্কে একটা মমত্ব বা একাত্মতাবোধ আমার মনে জন্মেছিল।

এখন এটুকু বলি যে, আমি যখন বিদ্যালয়ে দশম শ্রেণীর ছাত্র তখনই মহাকবি কালীদাসের ‘মেঘদূত’ কাব্যের বঙ্গানুবাদ পাঠ করি। পাশে ছিল সংস্কৃত। তার প্রথম লাইনের কয়েকটি শব্দ আজও আমি মনে করতে পারি, ‘আষাঢ়স্য প্রথম দিবসে’। কী উদাত্ত ছিল তার ধ্বনি, ছন্দ! বাংলার পাশে সেটাও পড়তাম। অবশ্য ঐ কালে আমি একা এমন পাঠক ছিলাম না। যাইহোক, আজ চিন্তা করুন খুব ছেলেবেলা থেকে কী ধরনের মনন নিয়ে আমি বেড়ে উঠেছিলাম। এবং সেই সঙ্গে আমার প্রজন্মও। তবু বাঙ্গালীত্ব ও ভারতীয়ত্বের মধ্যে সমন্বয়ের সমস্যাটা আমার মনে রয়ে গিয়েছিল। 

বস্তুত এই অবস্থার পরিবর্তন সূচিত হয় ১৯৮৯-’৯০ সালে প্রণালীবদ্ধভাবে ঋগ্বেদ পড়তে গিয়ে। ঋগ্বেদ পাঠে আমি শুধু ঋগ্বেদ রচয়িতা আর্যদের উৎসভূমি হিসাবে সিন্ধু সভ্যতাকে চিনলাম না, সিন্ধু সভ্যতার বহু রহস্যের দরজাও আমার সামনে খুলে গেল। ঋগ্বেদ পাঠ প্রসঙ্গ যখন এল তখন বলি বঙ্গানুবাদের পাশে যখন মূল বৈদিক ভাষায় ঋগ্বেদের মন্ত্র উচ্চারণ করে পাঠ করতাম তখন আমি শিহরিত হতাম। যতই ধর্মভাব নিয়ে লিখা হোক আমি তার ধ্বনি মাধুর্য ও ভাব গভীরতা অনুভব করে রোমাঞ্চিত হতাম। আমি তার আগে বাইবেল (নূতন বিধান) ও কুরআন পড়েছিলাম। কিন্তু ভাব-সৌন্দর্য কিংবা আর কিছু দিয়েই ঋগ্বেদের সঙ্গে কারোর তুলনা হয় না। পশুপালক হওয়া তো দূরের কথা, এমনকি কৃষিজীবীদের মস্তিষ্ক থেকেও যে এমন মন্ত্র আসতে পারে না এটা বুঝতে আমার সময় লাগে নাই। তার ভাষা, ভাব সবই ছিল এতই উন্নত।

ঋগ্বেদ পাঠের পর সিন্ধু সভ্যতাকে অবলম্বন ক’রে আমার চেতনায় ক্রমে নবভারত উদ্ভাসিত হতে থাকে। সিন্ধু সভ্যতা কেন্দ্রিক যে ভাবনা আমার মনে এতকাল ভ্রূণাকারে ছিল তা এখন দ্রুত বিকশিত হল। এতকাল আমার মনে বাংলা ও ভারতের মধ্যে সম্পর্ক বিন্যাসের ক্ষেত্রে যে অন্তর্দ্বন্দ্ব কাজ করত তা থেকে ‍মুক্তির পথে আমার যাত্রা শুরু হল। এরই পরিণতি হল এক ভাষা হিসাবে বৈদিক ভাষার বন্ধনে আবদ্ধ এক মহাজাতি রূপে ভারতের পুনর্গঠনের স্বপ্ন। এই স্বপ্ন এখন আমি দেখি। ‘সিন্ধু সভ্যতার লোকায়ত চেতনায় জেগে উঠুক উপমহাদেশ’-এ (http://bangarashtra.net/article/1504.html) এই স্বপ্নযাত্রার কথাই উচ্চারণ করেছি। এখন আমি বৈদিক ভাষার পুনরুজ্জীবনের মাধ্যমে আসমুদ্রহিমাচল অখণ্ড ভারত-ভূমির এক অভিন্ন ভারতীয় লোকায়ত মহাজাতির উত্থানের স্বপ্ন দেখি। তবে আমাকে তো আমার বাস্তব অবস্থাকে মাথায় রেখে পদক্ষেপ করতে হবে। সুতরাং লোকায়ত জন-গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে আমার যাত্রা শুরু করতে চাই। সামনে শুধু বাঙ্গালী জাতির পুনরেকত্রীকরণ এবং লোকায়ত ও জন-গণতান্ত্রিক ভারত নির্মাণ নাই, অধিকন্তু সমস্ত মুসলিম পৃথিবীর অগণিত মানুষের ইসলাম থেকে মুক্তির লড়াইয়ে ভূমিকা রাখবার করণীয়ও আছে। এভাবে জাতি গঠনের সংগ্রামের মাধ্যমে আমি আন্তর্জাতিকতাবাদের প্রতি দায়বদ্ধ থাকতে চাই। সবার আগে আমাদেরকে তো আগে নিজ ভিত্তিভূমির উপর শক্ত পায়ে দাঁড়াতে হবে। তবে না আমরা অন্যদেরকেও উঠে দাঁড়াতে সাহায্য করতে পারব।

এই লড়াই করতে গিয়ে আমি মার্কসবাদ থেকে আংশিকভাবে হলেও শ্রেণী সংগ্রামের ধারণা নিব, যেমন নিব প্রয়োজনীয় ক্ষেত্রে জাতীয়করণের ধারণা। কিন্তু সেটা হবে আমার জাতি গঠনের সংগ্রামের সহযোগী বা অংশ। এতকালের কমিউনিস্টদের দ্বারা অনুসৃত কর্মনীতির মতো সেটা জাতি খণ্ডনকারী হবে না। এ দেশে কমিউনিস্টদের মধ্যে যারা কখনও জাতি বা জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের গুরুত্ব স্বীকার করেছেন তখন তারা সেটাকে শ্রেণী সংগ্রামের অধীনস্থ করতে গিয়ে ভ্রান্তির চোরাবালিতে তলিয়ে গেছেন। পুরাতন নেতৃত্বের কারণে আমরা তরুণ প্রজন্মও এই ভুল রাজনীতির শিকার হয়েছিলাম।

এসবই তো আমার নিজ অভিজ্ঞতার কথা। ফলে এত জোরের সঙ্গে বলতে পারি। আমি দেখতাম নেতৃত্ব কীভাবে উগ্র বাঙ্গালী জাতীয়তাবাদের ধুয়া তুলে বাঙ্গালী জাতির মুক্তির মূল কর্তব্যকে অবহেলা, এমনকি অন্তর্ঘাত করত। এতে তাদের শ্রেণী সংগ্রাম হয়ত কিছু হত, কিন্তু ইসলাম ধর্মের শক্তি কতটা ক্ষুণ্ন হত সে প্রশ্ন করা চলে। আর ইসলামের শক্তি মানে প্রতিক্রিয়ারও শক্তি। অথচ বাস্তব ঘটনা হচ্ছে, যে ইসলাম ধর্ম বাঙ্গালী জাতি ও তার রাষ্ট্র গঠনের পথে বাধা হয়েছে সেই ধর্মকে মোকাবিলার মূল রাজনৈতিক শক্তি হতে পারত জাতিগত চেতনার বিকাশ। পাকিস্তান কালে যেটুকু লোকবাদী বা ধর্মমুক্ত চিন্তা-চেতনার বিকাশ বা প্রসার হয়েছিল সেটুকু তো প্রধানত জাতীয়তাবাদী চেতনার উন্মেষ ও বিকাশের ফল, যার উৎস ছিল ’৫২-এর ভাষা আন্দোলন। 

আমার মনে হয়, এই পত্রে আমার শ্রেণী সংগ্রাম, সমাজতন্ত্র বা জন-গণতন্ত্র এবং জাতি ও জাতীয়তাবাদ সংক্রান্ত ধারণাকে আপনার নিকট আরও বেশী স্পষ্ট করতে পেরেছি।

☆       ☆       ☆       ☆       ☆

পত্রটা শেষ করার আগে মনে হল পশ্চিম বঙ্গের কমিউনিস্ট বা সেকিউলারদের হিন্দুত্ব বিদ্বেষ থেকে ইসলাম প্রীতিতে উত্তরণ সম্পর্কে কিছু কথা বলা উচিত। এটাকে আরব প্রেম বলা যাবে, নাকি ইসলাম প্রেম বলা যাবে, নাকি একই সাথে উভয়ই, সেটা ভাবা যায়। আমার ধারণা এক দিকে হিন্দু ধর্ম সম্পর্কে ভ্রান্ত ধারণা, অপর দিকে, ইসলাম ধর্ম সম্পর্কেও ভ্রান্ত ধারণা তাদেরকে এই জায়গায় নেয়। সমস্যা হচ্ছে যে, হিন্দু ধর্মকে খারাপ মনে করলে তারা সাধারণত বিকল্প হিসাবে ইসলামের শ্রেষ্ঠত্ব দেখতে পান এবং সেটা প্রকৃত কোনও জ্ঞান ছাড়াই। বেশীর ভাগ ক্ষেত্রেই তারা ইসলামবাদীদের তাকিয়াবাজী দ্বারা প্রভাবিত হন। মুসলিমরা ধর্মের প্রশ্নে অত্যন্ত মিথ্যাচারী হয়। নিজেদের লেজ তো কাটা গেছে, এরপর লেজকাটা শিয়ালের মতো বাকী সবারই লেজ কাটায় তারা ব্যস্ত থাকে। আসলে মিথ্যা প্রচারে গোয়েবলসও তাদের কাছে দুগ্ধপোষ্য শিশু।

যাইহোক, সেকিউলার হিন্দুদের মধ্যে হিন্দু ধর্ম বিরোধিতা থেকে ইসলাম প্রীতি আমি আমাদের এ বঙ্গেও দেখেছি। কোনও কিছুর গভীরে না গিয়ে ভাসাভাসাভাবে বুঝতে চাওয়া থেকে তাদের এই ভুল। এদের অনেকে আবার মুসলিমদের আচরণে আঘাত পেলেও মনে করেন ধর্ম ঠিক আছে, সমস্যা মানুষদের। অবশ্য অনেক হিন্দুকে আমি সব ধর্ম ভালো বা ধর্মে দোষ নাই, দোষ মানুষের — এ ধরনের কথা বলতে শুনেছি। এটা হল এ ধরনের কথার উল্টা পিঠ যে, ধর্ম মাত্র ভুল, সুতরাং আলাদাভাবে নির্দিষ্ট ধর্মের ভূমিকা বা সমস্যা বুঝতে হবে কেন? এ বঙ্গের কমিউনিস্টরা সাধারণত এমন একটা ধারণা করতে পছন্দ করত বা করে।

যাইহোক, আজকের বাংলাদেশে হিন্দু সমাজ এমনই সংখ্যালঘু এবং আরও বিশেষ করে এমনই হীনবল যে, এখানে তাদের সামাজিক ও রাজনৈতিক চিন্তার গুরুত্ব তেমন একটা নাই। কিন্তু পশ্চিম বঙ্গের ক্ষেত্রে হিন্দু চেতনার গুরুত্ব অনেক অনেক বেশী। সেখানকার সেকিউলারদের কথা মনে এলে ১৯৯১ সালে শুনা আমার ঐ কথা খুব মনে আসে, ‘পারলে আমি নিজেই মুসলমান হয়ে যাই।’ অথবা আমাকে হুমকিদাতা মার্কসবাদী আরেক অধ্যাপকের কথা মনে হয়। পাশ্চাত্য এবং আরও বিশেষ করে মার্কসবাদী জ্ঞানতত্ত্বের এ কী গর্ভস্রাব ঘটেছে এ উপমহাদেশে এবং বঙ্গে!

ভারতে যে বিজেপির উত্থান ঘটতে চলেছে সে ব্যাপারে আমি প্রথম ধারণা করি ১৯৯১ সালের সেই সভায় যেখানে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রখ্যাত অধ্যাপক বলেছিলেন, ‘পারলে আমি নিজেই মুসলমান হয়ে যাই।’ বিজেপি-র রাজনীতি সম্পর্কে ধারণা দেওয়ার জন্য সেই ভদ্রলোক উমা ভারতীর একটা বক্তৃতার অডিও পুরাটা আমাদেরকে শুনান। মহিলার নাম জানেন কিনা জানি না। এক সময় বিজেপির আদর্শিক প্রবক্তা হিসাবে তার খুব নাম ছিল। এখন তার নাম শুনি না। জানি না তিনি বেঁচে আছেন কিনা। যাইহোক, তার বক্তব্যের সারবস্তু ছিল ধর্মমত নির্বিশেষে সকল ভারতীয়ের প্রতি ভারতীয় হবার আহ্বান। কথার মর্ম ছিল এমন যে, হিন্দু তুমি হিন্দু থাকো, মুসলিম তুমি মুসলিম থাকো। তারপরেও ভারতীয় হও, ভারতীয় হিসাবে গর্বিত হও। তার বক্তব্যের মধ্য দিয়ে একদিকে যেমন ভারতীয় হওয়ার জন্য গর্বিত হওয়ার আহ্বান ছিল তেমন অপর দিকে যুগ যুগান্তের পরশাসন কিংবা পরনিপীড়নের জন্য বেদনার সুরও ছিল।

ঐ বক্তৃতা শুনে আমি বিজেপির শক্তির মূল জায়গাটা প্রথম অনুধাবন করি এবং ঐ সভায় আমি সেটা তুলে ধরি। হাজার হাজার বছরের বহিরাক্রমণ, লুণ্ঠন ও ধ্বংসের মধ্য দিয়ে উঠে আসা একটা জনগোষ্ঠীর বেদনা ও অহঙ্কারের ফসল হচ্ছে বিজেপি। তখনই মনে হয়েছিল হিন্দুধর্ম বিজেপির জাতি গঠনের হাতিয়ার মাত্র। ভারত দুঃসময়ের স্মৃতি ঝেড়ে গর্বিত জাতি হয়ে উঠতে চাইছে। এই আকাঙ্ক্ষার প্রতিনিধি হয়ে বিজেপি উপস্থিত হতে চাইছে। হয়ত চাওয়ার প্রক্রিয়ায় অনেক ভুল আছে, ত্রুটি আছে। কিন্তু এই অন্তর্গত আকাঙ্ক্ষার জায়গাটাকে সহানুভূতির সাথে বুঝতে চাইতে হবে।

যুগ যুগান্তের বহিরাক্রমণকারী, পরশাসকদের অধস্তন নাগরিক উচ্চবর্গের প্রতিনিধিত্বকারী কংগ্রেসের পরিবর্তে মূলত গ্রাম-ভারতের কণ্ঠস্বর আমরা শুনতে পাই বিজেপির মাধ্যমে। হোক তা কিছুটা স্থূল, কিছুটা পশ্চাৎপদ এবং হোক ধর্মঘেঁষা। তবুও তার কাছে আছে ভারতের গ্রাম ও মাটির গন্ধ, কৃষক ও কারিগরদের গায়ের গন্ধ। হয়ত বলা হবে বিজেপি গ্রামীণ উচ্চবর্গ বা এলিটদের প্রতিনিধি। তা হোক, তবু এরা শত শত বৎসর ধরে বৈদেশিক হানাদার, ধর্ষক, লুঠেরা ও শাসকদের উত্তরাধিকার বহনের তুলনায় হাজার হাজার বছর ধরে টিকে থাকা স্বশাসিত গ্রামীণ ভারতের উত্তরাধিকার অধিকতর পরিমাণে ধারণকারী। হয়ত বলা হবে এ গ্রামীণ ভারত এখনও ঘুমন্ত বা অর্ধঘুমন্ত। তা হোক, তবু এই গ্রামের জাগরণের মধ্য দিয়েই প্রকৃত স্বাধীন ও মুক্ত আগামী ভারত জাগবে। নাগরিক সমাজ বড় বেশী ইসলামী এবং ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদী-উপনিবেশবাদী প্রভাবে আচ্ছন্ন হয়ে আছে। নূতন ও স্বাধীন ভাবে যাত্রা শুরুর জন্য এখন আমাদের অপেক্ষাকৃত পশ্চাৎপদ ভূমি হিসাবে গ্রাম সমাজের আশ্রয় নেওয়া ছাড়া উপায় কী? মাও সে-তুং যেমন চিংকাং পাহাড়ে আশ্রয় নিয়েছিলেন, তারপর সেখান থেকে লং মার্চ করে সুদূর ইয়েনানে ঘাঁটি গেড়েছিলেন, হো চি মিন যেমন দুর্গম গ্রাম আর পাহাড় ঘেরা বনাঞ্চলে সমর সজ্জা করেছিলেন, ক্যাস্ট্রো যেমন সিয়েরা মায়েস্ত্রা পাহাড়ে আশ্রয় নিযে সেখান থেকে বিপ্লবী যুদ্ধ গড়ে তুলেছিলেন ব্যাপারটা যেন তেমন। অনেক সময় সামনে যাবার জন্য পিছু হটতে হয়।

যেভাবেই দেখা যাক, ভারতের অপরিমেয় ও স্বাধীন প্রাণশক্তি লুকিয়ে আছে তার গ্রামে। এই গ্রামের মানুষরা বেশী ধর্মভীরু হয়। ধর্ম ছাড়া আর কারও আশ্রয় তারা সেভাবে পায় না বলে তারা ধর্মকে আশ্রয় করে তাদের জীবনধারাকে রক্ষা করতে চায়। স্বাধীন, বিপ্লবী ও অগ্রগামী নাগরিক শক্তির কর্তব্য ধর্মের বিকল্প শক্তি ও আশ্রয় রূপে গ্রামীণ ভারতের কাছে উপস্থিত হওয়া। মনে রাখতে হবে ভারত চিরকাল ধর্মাচ্ছন্ন ছিল না। সিন্ধু সভ্যতা সেই সাক্ষ্য দেয়। সভ্যতার সঙ্কটের কালে ধর্ম এসেছে। তাতে ভালো, মন্দ দুই দিকই আছে। যত কাল পরে হোক আধুনিক কালে ধর্মকে বিদায় নিতে হবে। বিদায় তো এমনই হয় না, মানুষই বিদায় দেয়। যাইহোক, আমি মনে করি বিপ্লবী নাগরিক শক্তিকে গ্রামীণ ভারতকে জাগাবার জন্য গ্রামে যেতে হবে।

কাজটা বিজেপিকে দিয়ে কতটা হবে তা এখানে থেকে বলা অন্তত আমার পক্ষে সম্ভব নয়। তবে সর্বভারতীয় পরিসরের কথা বিবেচনা করলে এখন পর্যন্ত বিজেপির বিকল্প আমি দেখি না।

বিজেপির প্রসঙ্গ এলে হিন্দু ধর্ম বা হিন্দুত্বের প্রসঙ্গ আসবে। কিন্তু ধর্ম ভুল ও প্রতিক্রিয়াশীল বলে তাকে বুঝতে ভুল করলে চলবে না। সব ধর্মকে এক পাল্লায় মাপতে গিয়ে এই ভুল অনেকে করেন। এটা বুঝতে হবে যে, ইসলামের মতো হিংস্র, নৃশংস, আক্রমণাত্মক ও নারী-ধর্ষক হিন্দু ধর্ম নয়। হিন্দু ধর্মেও নারী বিদ্বেষ আছে, কিন্তু সেটা ইসলামের তুলনায় অত্যন্ত নগণ্য। আসলে এটা বুঝলে বহু কিছু বুঝা সহজ হয় যে, হিন্দু ধর্ম গড়ে উঠেছে একটা কৃষিজীবী জনগোষ্ঠীকে কেন্দ্র করে, যার পিছনে আবার রয়েছে সিন্ধু সভ্যতার উত্তরাধিকার। ভারতের বহু অঞ্চলের বহু উপজাতি বা জনগোষ্ঠীর স্বাতন্ত্র্যকে ধারণ ও রক্ষা ক’রে এবং মূলত শান্তিপূর্ণভাবে একটা ঐক্যবদ্ধ সমাজ গড়তে গিয়ে তা নির্দিষ্ট ধর্মের রূপ গ্রহণ করেছে। এখানে শক-হুনদের মতো আক্রমণকারীদের আত্মীকরণ যেমন আছে তেমন অভ্যন্তরীণ অগণিত জনগোষ্ঠীর মধ্যে সমন্বয়সাধনও আছে। বর্ণজাতিভেদের কলঙ্ক দিয়েই যেন আমরা সবটা বিচার না করি। ঠিক আছে, ভারতকে বহুধা বিভক্ত ক’রে শক্তিহীন ক’রে রাখায় তার সমালোচনা, নিন্দা সবই চলবে। কিন্তু এর নিন্দা করার সময় আমরা যেন পাশাপাশি তার ইতিবাচক ভূমিকাও ভুলে না যাই। বিশেষত ইসলামের মতো এক ভয়ঙ্কর ও বীভৎস ধর্মের হাত থেকে ভারতকে রক্ষা করার ক্ষেত্রে তার বিরাট ভূমিকাকে আমরা যেন সর্বদা সশ্রদ্ধচিত্তে স্মরণ করি। সবচেযে বড় কথা আমরা যেন হানাদার, নারী অপহরণকারী ও ধর্ষক এবং লুঠেরা পশুচারী আরব বেদুইনদের ধর্ম ইসলামের সঙ্গে হিন্দু ধর্মকে গুলিয়ে না ফেলি। এটা বুঝতে হবে যে, ইসলাম যেখানে মূলত পশুচারী ও যাযাবরদের ধর্ম, হিন্দু ধর্ম সেখানে মূলত স্থিতিশীল কৃষকদের ধর্ম। এই দুইটা দুই বিপরীতধর্মী মানুষদের ধর্ম।

এটা ঠিক যে, আজ আমাদেরকে ধর্ম থেকে মুক্তি পেতে হবে। কিন্তু হিন্দু ধর্মের ক্ষেত্রে সতর্ক বিবেচনার গুরুত্ব খুব বেশী। এ কথা আমরা যেন ভুলে না যাই যে, অনেক সহস্র বৎসর ধরে যারা পিতা-মাতা কিংবা পূর্বপুরুষদের উত্তরাধিকারকে প্রাণপণে রক্ষা করে বাঁচতে চেয়েছে তাদের সংস্কৃতি বা জীবন ব্যবস্থার একটা বিশেষ রূপ হয়ে দেখা দিয়েছে হিন্দু ধর্ম। এই জীবন ব্যবস্থার বিরুদ্ধে আপনি কোথায় কীভাবে লড়াই করবেন, কোথায় তাকে বরণ করে নিবেন সেটা বুঝা অত সহজ নয়। এর জন্য চাই অনেক বিচার-বিবেচনা ও সহানুভূতিশীল মন। এটা ইসলাম ধর্ম নয় যে, শক্তি ও সামর্থ্য থাকলে আপনি খাপ খোলা তলোয়ার হাতে ঝাঁপিয়ে পড়ে ফয়সালা করবেন। অবশ্য আধুনিক যুগে এসে ইন্টারনেটের কল্যাণে ইসলাম বিরোধী প্রচার নূতন শক্তি লাভ করছে। ইন্টারনেট এখন বিশ্বব্যাপী ইসলামের বিরুদ্ধে নবজাগরণকে অপ্রতিরোধ্য করছে। ফলে ব্যাপকায়তনে খাপখোলা তলোয়ার হাতে ঝাঁপিয়ে পড়ার কাল এখন সন্নিকটবর্তী। হিন্দু ধর্ম সম্পর্কে  সবশেষে বলি ইউরোপের মন দিয়ে হিন্দু ধর্মকে বিচার না করাই উচিত হবে।

-----------------------------------------

ইসলামের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের সমস্যা ও সম্ভাবনা সম্পর্কে আমার সংক্ষিপ্ত আলোচনার জন্য দেখতে পারেন : ইন্টারনেট এবং আসন্ন বিশ্ববিপ্লব : http://bangarashtra.net/article/1433.html

-----------------------------------------

‘সিন্ধু থেকে গঙ্গা’র ৩য় খণ্ড লিখবার কাজ চলছে। চঞ্চল তার পেশাগত কাজ নিয়ে খুব ব্যস্ত থাকে। তার পেশাগত কাজের ফাঁকে তাকে কাজ করতে হয়। আমার চোখ ও শরীরের সমস্যার কারণে ইদানীং আমি তেমন একটা কাজ করতে পারি না। ফলে আমাকে নির্ভর করতে হয় চঞ্চলের উপর। এই অবস্থায় আামাদের কাজের গতি যথেষ্ট ধীর হয়েছে। আমার চোখের ছানি অপারেশন করতে আরও মাস দেড়েক লাগতে পারে। এই সময়ে কাজ কতটা করতে পারব তা বলা কঠিন। তবু কিছু করে করছি। এর মধ্যে শরীরটা একটু ভালো থাকায় আপনাকে একটু করে পত্রটাও লিখলাম।

পশ্চিম বঙ্গে বড় ধরনের পরিবর্তনের হাওয়া বইতে শুরু করেছে। দু’টি ঘটনা আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। একটা, সন্দেশখালীর নারী বিদ্রোহ। অপরটা, বিচারপতি অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়ের পদত্যাগ ও রাজনীতিতে প্রবেশের সিদ্ধান্ত। ভারতের রাজনীতিতেও এই দুই ঘটনা বড় ধরনের প্রভাব ফেলবে বলে অনুমান করি।

আমাদের প্রতি শুভকামনার জন্য আপনাকে অনেক ধন্যবাদ।

শুভেচ্ছান্তে,

শামসুজ্জোহা মানিক

3 March, 2024

========================

প্রেরণ ১৭ মার্চ, ২০২৪

শ্রদ্ধেয় মানিকবাবু,

আপনার গত পত্র চারটি অংশে বিভক্ত। চতুর্থ তথা শেষ অংশটি থেকে আমি আমার প্রত্যুত্তর শুরু করব।

প্রায় একবছর আগে যখন কথা শুরু হয়েছিল আমাদের মধ্যে, কিছুটা স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে আমিই ভারতের স্বশাসিত গ্রামব্যবস্থার কথা টেনে এনেছিলাম। সে নিয়ে বিস্তর আলোচনাও হয়েছিল। অন্যান্য পত্রের সাথেই গত পত্রের শেষাংশেও আপনি ঐতিহ্যের ধারাবাহিকতায় যে গ্রাম্য স্বশাসন চলে এসেছে আজ অবধি, রাষ্ট্রের নিপীড়নের বিরুদ্ধে তার প্রতিরোধকে স্বীকৃতি দিয়েছেন। এতদূর আমিও জানতাম আপনার মতামত। তারপর আপনি বিজেপির রাজনীতির উত্থানের প্রাসঙ্গিকতা সম্পর্কে যা যা বললেন, অর্থাৎ আমাদের শহরাঞ্চলের এলিট শ্রেণি ঔপনিবেশিক উত্তরাধিকারে আচ্ছন্ন ইত্যাদি এবং গ্রামের সমাজ তাদের প্রতারণার শিকার... বিজেপির রাজনীতি যদি দাঁড়াতে পারে, তবে তাকে গ্রামের চাষি-কারিগর মেহনতিদের সাথে জোট করতে হবে-- এই কথাগুলো একেবারে আমার মনের কথা। বিশেষ করে 'যুগ যুগান্তের বহিরাক্রমণকারী, পরশাসকদের অধস্তন নাগরিক উচ্চবর্গের প্রতিনিধিত্বকারী কংগ্রেসের পরিবর্তে মূলত গ্রাম-ভারতের কণ্ঠস্বর আমরা শুনতে পাই বিজেপির মাধ্যমে। হোক তা কিছুটা স্থূল, কিছুটা পশ্চাৎপদ এবং হোক ধর্মঘেঁষা। তবুও তার কাছে আছে ভারতের গ্রাম ও মাটির গন্ধ, কৃষক ও কারিগরদের গায়ের গন্ধ। হয়ত বলা হবে বিজেপি গ্রামীণ উচ্চবর্গ বা এলিটদের প্রতিনিধি। তা হোক, তবু এরা শত শত বৎসর ধরে বৈদেশিক হানাদার, ধর্ষক, লুঠেরা ও শাসকদের উত্তরাধিকার বহনের তুলনায় হাজার হাজার বছর ধরে টিকে থাকা স্বশাসিত গ্রামীণ ভারতের উত্তরাধিকার অধিকতর পরিমাণে ধারণকারী। হয়ত বলা হবে এ গ্রামীণ ভারত এখনও ঘুমন্ত বা অর্ধঘুমন্ত। তা হোক, তবু এই গ্রামের জাগরণের মধ্য দিয়েই প্রকৃত স্বাধীন ও মুক্ত আগামী ভারত জাগবে। নাগরিক সমাজ বড় বেশী ইসলামী এবং ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদী-উপনিবেশবাদী প্রভাবে আচ্ছন্ন হয়ে আছে। নূতন ও স্বাধীন ভাবে যাত্রা শুরুর জন্য এখন আমাদের অপেক্ষাকৃত পশ্চাৎপদ ভূমি হিসাবে গ্রাম সমাজের আশ্রয় নেওয়া ছাড়া উপায় কী? মাও সে-তুং যেমন চিংকাং পাহাড়ে আশ্রয় নিয়েছিলেন, তারপর সেখান থেকে লং মার্চ করে সুদূর ইয়েনানে ঘাঁটি গেড়েছিলেন, হো চি মিন যেমন দুর্গম গ্রাম আর পাহাড় ঘেরা বনাঞ্চলে সমর সজ্জা করেছিলেন, ক্যাস্ট্রো যেমন সিয়েরা মায়েস্ত্রা পাহাড়ে আশ্রয় নিযে সেখান থেকে বিপ্লবী যুদ্ধ গড়ে তুলেছিলেন ব্যাপারটা যেন তেমন। অনেক সময় সামনে যাবার জন্য পিছু হটতে হয়।

যেভাবেই দেখা যাক, ভারতের অপরিমেয় ও স্বাধীন প্রাণশক্তি লুকিয়ে আছে তার গ্রামে। এই গ্রামের মানুষরা বেশী ধর্মভীরু হয়। ধর্ম ছাড়া আর কারও আশ্রয় তারা সেভাবে পায় না বলে তারা ধর্মকে আশ্রয় করে তাদের জীবনধারাকে রক্ষা করতে চায়। স্বাধীন, বিপ্লবী ও অগ্রগামী নাগরিক শক্তির কর্তব্য ধর্মের বিকল্প শক্তি ও আশ্রয় রূপে গ্রামীণ ভারতের কাছে উপস্থিত হওয়া। মনে রাখতে হবে ভারত চিরকাল ধর্মাচ্ছন্ন ছিল না। সিন্ধু সভ্যতা সেই সাক্ষ্য দেয়। সভ্যতার সঙ্কটের কালে ধর্ম এসেছে। তাতে ভালো, মন্দ দুই দিকই আছে। যত কাল পরে হোক আধুনিক কালে ধর্মকে বিদায় নিতে হবে। বিদায় তো এমনই হয় না, মানুষই বিদায় দেয়। যাইহোক, আমি মনে করি বিপ্লবী নাগরিক শক্তিকে গ্রামীণ ভারতকে জাগাবার জন্য গ্রামে যেতে হবে।'-- এই অংশটি পড়ে আমি অভিভূত। বিশেষ করে শেষ বাক্যটি খেয়াল করুন: '... বিপ্লবী নাগরিক শক্তিকে গ্রামীণ ভারতকে জাগাবার জন্য গ্রামে যেতে হবে।'-- এই কথাটির মধ্যেই রয়েছে প্রান্ত দ্বারা কেন্দ্রকে ঘিরে ধরা, শাসিতের দ্বারা শাসককে ঘিরে ধরার মাও-ৎসে-তুঙ চিন্তাধারার রাজনীতির মূলমন্ত্র। এক ঝলকে আমার সত্তরের দামাল ছেলেদের কথা মনে পড়ে গেল; যারা কমিউনিস্ট নেতৃত্বের হঠকারিতা, রাষ্ট্রনৈতিক সন্ত্রাস, ব্যাপক অন্তর্ঘাতে নিকেশ হয়ে গেল, অথচ চারু মজুমদার ভারতীয় কমিউনিস্ট রাজনীতিতে ওই গোড়ার জায়গাটা ধরে ঝাঁকুনি দিতে পেরেছিলেন-- স্বশাসিত গ্রাম থেকেই জনযুদ্ধ পরিচালিত হবে শহরের অভিমুখে এবং শহরাঞ্চলের ম্রিয়মাণ বিপ্লবী শক্তিকে তা জাগিয়ে তুলবে। এতে সবচেয়ে বেশি আতঙ্কিত হয়েছিল শহরাঞ্চলের রক্তচোষা শিল্পমালিক-ব্যাঙ্কার-বাবুসমাজ, যারা নিঃসন্দেহে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিকতার জারজ সন্তান। ফলাফল তো দেখেইছি আমরা: সংগঠিত আক্রমণ-নৃশংসতা কাকে বলে! মুক্তিযুদ্ধের আগে পাক-বাহিনী যে নৃশংসতা চালিয়েছে, তা কি 'মার্জিত' মাদ্রাসাবাবুরা ভুলে যান, না চেপে যেতে চান?

সব মিলিয়ে, 'গ্রাম দিয়ে শহর ঘেরা'র রণকৌশল বস্তুত হয়ে উঠতে পারত 'গ্রাম দিয়ে শহরকে পরিবর্তিত করা'র প্রক্রিয়া, যার পরিণতিতে ঔপনিবেশিক জোঁকদের 'খতম' করে ফেলা সম্ভব হত। ফলে রাজনৈতিকভাবে ব্যর্থ হলেও নকশাল আন্দোলন (শহরাঞ্চলের অন্তর্ঘাতী নগরবিরোধী যুবকদের গ্রামমুখী যাত্রা) বিলাতি দৃষ্টিভঙ্গির বিকল্প বিশ্ববোধ হাজির করতে পেরেছিল। অথচ আজ পঞ্চাশ বছর পর ঠিক সেই দিনের বক্তব্যকে বিকৃত করা হয়েছে হাজারটা উপায়ে। নকশাল বিদ্রোহ যা ছিল, আজকের উপস্থাপন তার থেকে অনেক ভিন্ন। একেই বলে একটা জাতির ইতিহাসের দিক্‌নির্দেশকে ভুলিয়ে দেওয়া, যেভাবে পশ্চিমি ও এ দেশের পদলেহী ঐতিহাসিকরা আরো বৃহৎ পরিসরে সিন্ধু সভ্যতার অতীত বা তৎপ্রসূত ঋগ্বৈদিক ধারাকে বহিরাগত দেখাতে চাইছে ক্রমাগত। এখন তো আবার জিনেটিক 'প্রমাণ' দিয়ে 'আর্য আক্রমণ তত্ত্ব'কে জাগানোর চেষ্টা চলছে দেখতে পাচ্ছি। সুবিধামত 'আর্য পরিযান তত্ত্ব'ও বানানো হয়েছে।

ফলে বিজেপির অভিমুখ যদি গ্রাম হয়, বাস্তবেও নরেন্দ্র মোদী গ্রামভিত্তিক ক্লাস্টার ও আঞ্চলিক উৎপাদনের ওপর গ্রামীণ উৎপাদনকে আধারিত করতে চান বারবার, পরিণতিতে শহরাঞ্চলগুলো মোটের ওপর গবেষণাকেন্দ্র বা প্রশাসনিক কেন্দ্র হিসেবেই বিরাজ করবে মূলত। এত নিঃসন্দেহে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক তথা সত্তরের গর্ভস্রাবেরা আতঙ্কিত হয়ে পড়েছে আর মুহুর্মুহু মূর্ছা যাচ্ছে 'ফ্যাসিস্ট' বিজেপির ভয়ে। ইহুদিদের শুভাকাঙ্ক্ষী মোদী নাকি হিটলারের সাথে তুলনীয় ফ্যাসিস্ট! হাস্যকর।

 

卐         卐         卐          卐          卐

পত্রের অন্য অংশে আলোচনা প্রসঙ্গে আপনি একটা অতি সঠিক কথাই বলেছেন যে, কোনো জাতির রাষ্ট্রগঠন আগে থেকে না-হলে সেখানে সমাজবিপ্লব পরিপূর্ণতা পায় না। বিপ্লবী সরকার প্রতিষ্ঠিত হলেও সেই জাতিকে আবার জাতিরাষ্ট্রের পর্যায় পেরোতেই হয়। উদাহরণ হিসেবে দেখুন সোভিয়েত ইউনিয়নকে। একাধিক জাতির সাথে মূল রুশিদের (বড়ো রুশি) বিরোধ একটা সময়ে এমন জায়গায় পৌঁছল যে, একাধিক জাতিরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে সোভিয়েত যুক্তরাষ্ট্র ভেঙে পড়তে বাধ্য হল। তার মানে নিশ্চয়ই যান্ত্রিক উপায়ে নিছক আন্তর্জাতিকতার প্রচারটুকুই হয়েছিল; আপনি ভারতের ক্ষেত্রে ইসলাম প্রসারের বিরুদ্ধে হিন্দুসমাজের যে ভূমিকার কথাকে সহানুভূতির সাথে দেখতে বলেছেন, রুশ রাষ্ট্রপ্রধানদের হয়তো অ-রুশ (ছোটো রুশি) জাতিগুলির প্রতি সেই সহানুভূতির অভাব ছিল। মাঝখান থেকে মধ্য এশিয়ায় একগাদা মুসলিম রাষ্ট্র তৈরি হল, যার প্রায় কোনোটাই রাজনৈতিকভাবে স্থিতিশীল অবস্থায় নেই। মধ্যপ্রাচ্যকেও স্থিতিশীল জাতিরাষ্ট্রের পর্যায়ের ভেতর দিয়ে যেতে হলে বহিঃরাষ্ট্রীয় হস্তক্ষেপ থেকে তাকে মুক্ত হতে হবে। সেটা হবে হয় UNO-র দয়ায়, নয় মধ্যপ্রাচ্যের প্রতিরোধের মাধ্যমে।

বাকি রইল এশিয়ায় মুসলমানদের কথা। বিশেষ করে বলব ভারতীয় মুসলমানদের কথা এবং যে মুসলমানরা উঃপূঃ ভারতের গাঙ্গেয় কৃষি এলাকায় বসবাস করে, তাদের কথা। আপনি গত একটি পত্রে সঠিকভাবেই বিষয়টি ধরেছিলেন বলে আমার মনে হয়েছে যে, বাংলাদেশি মুসলমানরা একপ্রকার হীনমন্যতায় ভোগে। এবার সেটা হতে পারে, লুঠেরা প্রবৃত্তির ইসলামীরা যদি উৎপাদক কৃষি অঞ্চলে থাকে, তাদের হতাশা আসতে পারে নিজেদের পেশা সম্পর্কে; আবার সরাসরি আরবীয় উৎস থেকে তারা আসেনি বলেও হীনমন্যতা আসতে পারে। উভয়ক্ষেত্রেই তাদের হীনমন্যতা কাটতে পারে, যদি আপনার উপদেশ মতো তাদেরকে সিন্ধু সভ্যতার একাধারে উৎপাদক কৃষিজীবী-কারিগরী চরিত্র আর অন্যদিকে সিন্ধুজাতির বাঙালি উত্তরাধিকারের ধারণার আওতায় আনা সম্ভব হয়। এই হিসেবে বাঙালি জাতিসত্তার অখণ্ডতার বোধ যত তীব্র হবে, ততই ১৯৪৬-এর সাম্প্রদায়িক বোধ ফিকে হতে শুরু করবে এবং কাঁটাতারের বিভাজন আর তার সাথে দেশভাগের নেপথ্যের ব্রিটিশ-কংগ্রেসী রাজনীতির বিনাশ ঘটবে-- 'বিনাশায় চ দুষ্কৃতাম্'। এ ক্ষেত্রে যদি ভারতবর্ষীয় ঘরানায় সমাজবিপ্লবের মতধারা নির্মাণ করতে হয়, তাহলে আজকের ভারতীয় উপমহাদেশ যে সিন্ধু সভ্যতার ধারাবাহিক উত্তরসূরি, সেটাকে প্রতিষ্ঠা দিতে হবে। তবে না আমরা অতীতের সাথে নাড়ির যোগ খুঁজে পাব আর অহেতুক 'দিশি মুরগির বিলিতি চাল' মারা বন্ধ হবে। প্রথাগত বিজেপির রাজনীতি এতখানি সামাজিক পরিবর্তনের সূচনা করতে পারবে বলে মনে হয় না কখনোই। তবে ইসলামপ্রেমী সোহরাওয়ার্দী মার্কা রাজনীতির ধারাকে যদি বিজেপি শেষ করে দিতে পারে, রাজনৈতিক দর্শনের জায়গায় একটা শূন্যতা আসতে বাধ্য। সেই ভরাটটা সিন্ধু সভ্যতার সাম্যতন্ত্রী অতীত গৌরব মারফৎ পূরণ করার একটা বড়ো সুযোগ ইতিহাস আমাদেরকে দিতে পারে। প্রথাগত বামপন্থী মহল নিজেদের সেই ক্ষয়িষ্ণু ভবিষ্যৎটা বুঝতে পেরে তাই এখন থেকেই ভারতে জন্মানো মার্কসবাদী ও দার্শনিকদের নিয়ে চচ্চড়ি পরিবেশন শুরু করেছে। আগে সিপিআই(এম) যে রাহুল সাংকৃত্যায়নকে পুঁছেও দেখত না, আর তারাই রাহুলজী-কোশাম্বির রচনাবলী নিয়ে ব্যস্ত; ভাবখানা এমন, যেন গত একশো বছরের রাজনৈতিক ইতিহাসে কমিউনিস্টরা এই প্রথম ভারতকে তার শেকড় থেকে বুঝতে চাইছে!

কাজেই বুঝতে পারছেন, 'আর্যজন ও সিন্ধু সভ্যতা'র থেকেও কেন আমি 'সিন্ধু থেকে গঙ্গা' তৃতীয় খণ্ডে এতটা আগ্রহ দেখাচ্ছি। প্রত্নতত্ত্ব একদিন ঠিকই আরো পোক্ত প্রমাণসমেত বাঙালি জাতিসত্তাকে সিন্ধু সভ্যতার উত্তরসূরি হিসেবে দেখাতে সক্ষম হবে (বৈদিক ও সংস্কৃত শাস্ত্রে এর কিছু প্রমাণ আছে), যদি না মাঝে কোনোরকম শয়তানি হয় (আমাদের ASI, Archaeological Survey of India খুব একটা সুবিধার প্রতিষ্ঠান নয়। বিশেষ করে সেটা আবার বাংলাভাগের নায়ক কার্জনেরই তৈরি করা প্রতিষ্ঠান)। সেই অপেক্ষায় না-থেকে মতবাদ হিসেবে 'সিন্ধু থেকে গঙ্গা'র তৃতীয় খণ্ড যদি গাঙ্গেয় বাঙালীত্বকে সিন্ধুত্বের উত্তরসূরির ধারায় ফেলতে সক্ষম হয়, সেটা একটা সূচনা হতে পারে ভারতীয় উপমহাদেশের ইতিহাসকে নবরূপে বিচার করার পদ্ধতি হিসেবে। ফলে আপনাদের লেখালেখির কাজ সফলতার সাথে সমাপ্ত হোক-- এইই আমার প্রার্থনা।

আপনি সুস্থ থাকার চেষ্টা করবেন। চোখের অপারেশনের পর আমাকে একটানা এতটা টাইপ করে লিখে না-পাঠানোই চোখের পক্ষে মঙ্গল হবে। আমার লেখাও অল্প করে পড়লেই ভালো। মাঝে বিরতি থাকলেও শেষ অবধি নিয়মিতই থাকব আপনার মতো মানুষের সাথে পত্রবিনিময়ের মধ্য দিয়ে।

নিরন্তর মঙ্গলকামনায়,

অভিরূপ মুখোপাধ্যায়

Mar 17, 2024

========================

Sent On 24 March, 2024

প্রিয় অভিরূপ বাবু,

আপনার গত ১৭ মার্চ তারিখে পাঠানো পত্রের উত্তর দিতে বেশী দেরী করতে ইচ্ছা করল না। তাই কিছু করে হলেও উত্তর লিখতে শুরু করলাম। অবশ্য ‘সিন্ধু থেকে গঙ্গা’র প্রথম অধ্যায়টা প্রায় সম্পূর্ণ হওয়ায় অনেকটা ভারমুক্ত বোধ করছি। এটা ভারতে মুসলিম আগ্রাসন ও শাসনের উপর লিখা। এটা ভারতবর্ষের মানুষের উপর সুদীর্ঘ কালব্যাপী পরিচালিত আক্রমণ, হত্যা, নির্যাতন, লুণ্ঠন, ধর্ষণ ও ধ্বংসের বিবরণ সম্বলিত এক ভয়াবহ অধ্যায়। অন্তত এটার উপর কাজ করতে গিয়ে মনের উপর এতটা চাপ নেওয়া আমার জন্য সত্যি খুব কঠিন হয়েছে। শতাধিক পাতার পুরা অধ্যায় বহু ঐতিহাসিক দলিলাদির বিবরণ সংক্রান্ত। এবং প্রায় সবটাই তৎকালীন বা সমকালীন মুসলিম লেখক, ঐতিহাসিকদের বিবরণ থেকে নেওয়া। পড়লে বুঝবেন মুসলমানরা ভারতীয় উপমহাদেশে কী করেছে, তাদের ভূমিকা কী! এর পরের অধ্যায়ে আসবে ব্রিটিশ উপনিবেশিক পর্ব থেকে শুরু করে আধুনিক কাল পর্যন্ত ভারতীয় সমাজের ক্রমবিকাশ সংক্রান্ত আলোচনা।

তবে আমাদের আলোচনা কিছু বেশী সময় নিচ্ছে। সেই জন্য আর বেশী সময় না নিয়ে তৃতীয় খণ্ডের মুসলিম আগ্রাসন ও শাসনের অধ্যায়টাই যত দ্রুত সম্ভব প্রকাশের সিদ্ধান্ত নিয়েছি। এখন এটা সম্পূর্ণ করার কাজ চঞ্চল করছে। সে আমাকে সবটা পাঠালে আমি আবার যাচাই করে শেষবার দেখার জন্য তার কাছে পাঠাব। তারপর পুনরায় সবটা দেখে প্রকাশ করব। সব মিলিয়ে হয়ত ১৫-২০ দিন লাগবে। অবশ্য শরীরের অবস্থার উপরও অনেকটা নির্ভর করে। তবে এখন আমি অনেকটা ভালো বোধ করছি। যাইহোক, ৩য় খণ্ডের ১ম অধ্যায়টা প্রকাশের তাড়না খুব বোধ করছি। এতসব প্রায় কেউ জানে না। যে সামান্য কিছু সংখ্যক মানুষ জানে তারা প্রায় সবাই রাজনৈতিক ও অন্যান্য বিবেচনা থেকে চেপে দেওয়ার চেষ্টা করে। এ কথা উপমহাদেশের হিন্দু-মুসলিম নির্বিশেষে প্রায় সকল লেখক ও ঐতিহাসিক সম্পর্কে প্রযোজ্য। আমরা তাদের দলে নই; সুতরাং অতীতের মাটি খুঁড়ে ইতিহাসের সত্য তুলে আনবার কাজ করছি। এই অধ্যায় প্রকাশ করবার পরই আপনাকে জানাব।

এবার আপনার পত্রের বিষয়বস্তুতে আসা যাক। গ্রাম ভারত সংক্রান্ত বক্তব্য আপনি আপনার পত্রে প্রথম পর্যায় থেকে দিয়ে আসছেন। ফলে আমার বক্তব্যে নূতনত্ব নাই। গ্রামীণ ভারতবর্ষ থেকে আগামী ভারতবর্ষ উঠে আসবে। সেটা ঠিক আছে। এর জন্য আগামী ভারতবর্ষের শক্তিকে গ্রাম ভারতে যেতে যে হবে সেটাও ঠিক আছে। কিন্তু তারা যে যাবে, কোন বার্তা নিয়ে যাবে? শ্রেণী সংগ্রামের বার্তা নিয়ে যাবে? যা গ্রাম ভারতকে বিভক্ত ও আত্মদ্বন্দ্বে পর্যুদস্ত করবে।

শ্রেণীতত্ত্বটা আমি ভালোই বুঝি। কারণ ওটা চর্চা করেছিলাম। ভারতে চারু মজুমদারের আবির্ভাবের অনেক আগে থেকেই আমাদের এ বাংলায় শ্রেণীসংগ্রামের তত্ত্ব নিয়ে বিশেষ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে কৃষক আন্দোলন গড়তে গ্রামে যাওয়া শুরু হয়েছিল। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পঞ্চাশের দশকে প্রথম যান ভাষা আন্দোলনের নেতা হিসাবে সমধিক পরিচিত আ্দুল মতিন, ষাটের দশকে গ্রামে প্রথম যাই আমি। সেটা ১৯৬৬ সালে, যখন আমি এম, এ, ফাইনাল ইয়ারের ছাত্র। এছাড়া সারা দেশের বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে ছাত্ররা শহরের শ্রমিকদের পাশাপাশি গ্রামে যেতে শুরু করে। পঞ্চাশের দশকে এই যাওয়াটা তুলনায় অনেক কম ছিল। সেটা ছিল বাংলা ভাষাকে কেন্দ্র করে বাঙ্গালী চেতনার জাগরণের দশক। কিন্তু ষাটের দশকে শ্রমিক ও কৃষকদের মধ্যে কাজ করতে যাওয়াটা প্রায় একটা জোয়ারের রূপ নেয়। বিশেষ করে কৃষক আন্দোলন গড়তে গ্রামে যাওয়া। অবশ্য গ্রামে যাওয়া ছেলেদের অধিকাংশ ছিল গ্রামের ছেলে যারা লেখাপড়া করতে শহরে এসেছিল বা গ্রাম থেকে কাছাকাছি শহরের কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়মিত যাতায়াতের মাধ্যমে পড়তে আসত। সেদিক থেকে আমি ছিলাম ব্যতিক্রম। আমি গ্রামে গিয়েছিলাম একটা দীর্ঘ নাগরিক পটভূমি নিয়ে। ১৯৬৬ থেকে ১৯৭১-এর যুদ্ধের প্রায় পুরা সময় পর্যন্ত আমি ছিলাম মূলত গ্রামীণ জীবনের সঙ্গে সংযুক্ত। যুদ্ধের সময়টা বাদ দিলে আমি ছিলাম কৃষক সংগঠন ও আন্দোলনে নিয়োজিত একজন কর্মী। কৃষক আন্দোলন করার সময়েও আমি পূর্ব বাংলার স্বাধীনতার প্রশ্নকে গুরুত্ব দিয়ে চিন্তা করতাম এবং বলতাম। বিশেষ করে সেই লক্ষ্যে পাকিস্তান কালীন পূর্ব বাংলার স্বায়ত্তশাসনের দাবীর ভিত্তিতে জাতীয় কর্মসূচী দাবী করতাম। এ প্রশ্নে কমিউনিস্ট পার্টির দেউলিয়া ভূমিকা সম্পর্কে আমি বিশেষ করে ‘রাজনীতির পুনর্বিন্যাস’ গ্রন্থে আলোচনা করেছি। কমিউনিস্ট নেতৃত্ব জাতীয় আন্দোলনকে অগ্রাধিকার কেন দিবে? তাদের কাজ হল শ্রেণী রাজনীতি গড়ে তুলা। সুতরাং সব বাদ দিয়ে সে কাজটাই তারা করতে বলত। আগে শ্রেণী সংগ্রাম। শ্রেণী সংগ্রামের ভিত্তিতে হবে জাতীয় সংগ্রাম। এটা ছিল কমিউনিস্ট নেতৃত্বের তত্ত্ব, যার খেসারত দিতে হয়েছে এ দেশের বামপন্থী আন্দোলনকে। স্বাধীনতার জন্য সারা দেশে যুদ্ধ শুরু হলে এই নেতৃত্বের অনুসারীরা রাষ্ট্রযন্ত্রের বিকলতার কারণে যে শূন্যতা শুরু হয়েছিল তার সুযোগ নিয়ে সারা দেশের ব্যাপক গ্রামাঞ্চলে শ্রেণী সংগ্রামকে সশস্ত্র রূপ দিতে চেয়ে স্বাধীনতার যুদ্ধকে গৌণ করে বা বাদ দিয়ে গ্রামীণ শ্রেণী শত্রু নিধনের কাজ শুরু করল। এভাবে তারা স্বাধীনতার যুদ্ধকে বিভক্ত ও ক্ষতিগ্রস্ত করার কাজ করল। আওয়ামী লীগ একই কাজ করল বামপন্থীদের বিরুদ্ধে হত্যাভিযান চালিয়ে। এসব তো আমার নিজ চোখে দেখা।

আমি ছিলাম তখন আমাদের পার্টি নেতৃত্বের এ ধরনের কর্মনীতির বিরুদ্ধে। স্বাধীনতা যুদ্ধ শুরু হলে আমি সারা দেশে স্বাধীনতার যুদ্ধ সংগঠিত করার কাজে আত্মনিয়োগ করেছিলাম। আপনি জানেন এ প্রশ্নে পার্টি নেতৃত্বের সঙ্গে আমার মতভেদের কথা, যার কিছু হলেও আমি বিভিন্ন সময়ে ‘রাজনীতির পুনর্বিন্যাস’সহ আমার বিভিন্ন রচনায় বলতে চেষ্টা করেছি।

এটা ঠিক যে, আমি আজও গ্রামের প্রশ্নকে গুরুত্ব দিই। আমার গত পত্রে এ কথাই বলেছি। এ প্রশ্নে আপনার সঙ্গে আমার কোনও মতভেদ নাই। তবে আমি শ্রেণী সংগ্রামের তত্ত্ব নিয়ে গ্রামে যাবার ঘোর বিরোধী। যারা এ কাজ করে তারা কীভাবে বিশ্বসাম্রাজ্যবাদের অধস্তন রাষ্ট্র ও সাম্রাজ্যবাদের সাথে সংশ্লিষ্ট রাজধানী ও নগর কেন্দ্রিক লুম্পেন ধনিক শ্রেণীর স্বার্থ রক্ষা করে সেটা আমি দেখেছি এবং ভালোভাবে বুঝেছি। অন্তত বাংলাদেশের অভিজ্ঞতা থেকে আমি সহজেই এই সত্য উপলব্ধি করেছি।

বিশ্বসাম্রাজ্যবাদ ও তার অধস্তন শ্রেণীসমূহ ও রাষ্ট্রের মোকাবিলায় যে গ্রাম দাঁড়ায় তার নেতৃত্বকারী শক্তি কে বা কারা? তারা কি দরিদ্র ও ভূমিহীন কৃষক, নাকি, গ্রামীণ সম্পত্তিবান শ্রেণী তথা ধনী কৃষক, জোতদার ও স্থানীয় সাধারণ ব্যবসায়ী, যারা সাধারণভাবে গঠন করে গ্রামীণ নেতৃত্ব? নগরের আর্থ-সামাজিক বিন্যাসকে অক্ষত রেখে গ্রামীণ এই নেতৃত্বকে ধ্বংস করা মানে সমগ্র গ্রাম সমাজকে বিশ্বসাম্রাজ্যবাদ কিংবা তার অধীনস্থ এ দেশীয় নগরকেন্দ্রিক শ্রেণীসমূহের অসহায় শিকারে পরিণত করা। গ্রামীণ দুর্বৃত্ত (চোর, বিশেষত গরুচোর-ডাকাত ইত্যাদি) ও জনগণের উপর নির্যাতনকারী যারা তাদের সঙ্গে উৎপাদন-ঘনিষ্ঠ গ্রামীণ ধনিকদেরকে এক করে দেখাটা এক ভয়ানক ভুল।

এই ভুল আমাদের দেশের কমিউনিস্টরা করেছে। ভারতের কমিউনিস্টরাও করেছে। বিশেষ করে পশ্চিম বাংলার আজকের দুর্গত অবস্থার জন্য আমি সবচেয়ে বেশী দায়ী করি সেখানকার কমিউনিস্টদেরকে। গ্রামীণ উৎপাদনশীল সমাজ-শক্তিকে তারা প্রকৃতপক্ষে ধ্বংস করেছে। এই সমাজ-শক্তিকে তারা দুই দিক থেকে মেরেছে। এক দিকে ছিল ক্ষমতাসীন বামফ্রন্ট সরকার যারা ভূমি সংস্কার করতে গিয়ে গ্রামীণ উৎপাদক শক্তির মেরুদণ্ডটাকে প্রায় ধ্বংস করেছে। অপর দিকে, থেকেছে চারু মজুমদারের শ্রেণী শত্রু খতমের রাজনীতির ধারকরা।

গ্রামে যাওয়ার ক্ষেত্রে চারু মজুমদারের ডাক দেওয়ার কোনও কৃতিত্ব আছে বলে আমি মনে করি না। ওটা ষাটের দশকের দ্বিতীয়ার্ধে চীনপন্থী রাজনীতির জোয়ার উঠার সঙ্গে সম্পর্কিত। আমি নিজেও তার সাক্ষী। চারু মজুমদারের নাম শুনবারও বেশ আগে আরও অনেকের মত আমি গ্রামে গিয়েছিলাম। চারু মজুমদারের রাজনীতির বিশেষত্ব গ্রামে যাবার ডাক দেওয়ার সঙ্গে সম্পর্কিত নয়। বরং সেটা শ্রেণী শত্রু খতমের নামে নির্বিচারে গ্রামীণ সমৃদ্ধ ও নেতৃত্বকারী ব্যক্তিদেরকে হত্যার ডাক দেওয়ার সঙ্গে সম্পর্কিত। এভাবে অনেক গভীর গ্রামাঞ্চলে নেতৃত্ব শূন্যতা সৃষ্টি করা হয়। মার্কসবাদের শ্রেণী সংগ্রাম তত্ত্বের কী ভয়ঙ্কর গর্ভপাত!

আমি যখন আজকের পশ্চিম বঙ্গের দিকে দৃষ্টি দিই তখন বাম রাজনীতির যান্ত্রিক প্রয়োগ কী বিষময় ফল দিতে পারে সেটা আরও ভালোভাবে অনুভব করি। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এবং তার দলের বিভিন্ন নেতার বক্তৃতা এবং তাদের বিভিন্ন কীর্তির কথা যখন শুনি তখন আমার মনে মাঝে মাঝে যে প্রতিক্রিয়া ঘটে সেটাকে বিবমিষা বলা চলে। বিশেষ করে মমতাসহ তৃণমূল নেতাদের কথাবার্তা অনেক সময় এত কুৎসিত ও অরুচিকর হয় কী করে সে কথা ভেবে অবাক হই। পশ্চিম বঙ্গের জনতার রুচির কতটা অধঃপতন ঘটলে তৃণমূলের মতো একটা দলের উত্থান ও এতকাল ক্ষমতায় অধিষ্ঠান সম্ভব সেটাই তখন ভাবি। শক্ত মেরুদণ্ডের যতই অভাব থাকুক এক কালে পশ্চিম বঙ্গের মানুষ সভ্য, ভদ্র ও নম্র ছিল। আমার মনে হয় সেখানে সৎ মানুষের সংখ্যাও একেবারে কম ছিল না। সেই পশ্চিম বঙ্গ এবং বিশেষ করে তার রাজধানী কলকাতা আজ কোন পর্যায়ে নেমেছে যে সেখানে তৃণমূলের দুর্বৃত্ত, ইতর ও দুর্নীতিবাজরা এতকাল ধরে এভাবে দাপিয়ে বেড়াতে পারছে! 

অনেক কাল ধরে কলকাতার প্রতি আমার শ্রদ্ধা নাই। ওখানকার মেরুদণ্ডহীন মধ্যবিত্তের জন্মপ্রক্রিয়াই এর জন্য যে দায়ী সেটা বুঝি। উপনিবেশিক শাসন কেন্দ্র হিসাবে যে নগরের জন্ম তার গর্ভে কতটা মেরুদণ্ডসম্পন্ন মানুষ জন্ম নিতে পারে বলুন? সুতরাং এই নগর ও তাকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠা সমাজ সুভাষ চন্দ্র বসুকে ধারণ করতে পারে নাই। কলকাতার বিকল্প আর কোনও নগর-কেন্দ্র ছিল না যাকে আশ্রয় করে বাংলায় নবতর জাগরণ ঘটতে পারত। জানি না সমাজের অন্তর্গত অথচ অব্যক্ত আকাঙ্ক্ষাকে ব্যক্ত করার জন্য ঢাকার উত্থান কিনা। তবে এটা তো ঠিক যে, যত অল্প সময়ের জন্য হোক আমরা এক বিরাট যুদ্ধ ঘটিয়েছি, যেটা জাতীয় মুক্তি যুদ্ধ এবং আমরা এসেছি সেই জাতীয় মুক্তি যুদ্ধের মধ্য দিয়ে। এই ধরনের যুদ্ধের অভিজ্ঞতা আপনাদের নাই। ১৯৭১-এ সেই সুযোগও এসেছিল পশ্চিম বঙ্গের নিকট। কিন্তু সেই দৃষ্টি বা চিন্তা দুই বঙ্গে সেভাবে ছিল না। কিন্তু আমি পূর্ব বঙ্গের স্বাধীনতা যুদ্ধের সঙ্গে পশ্চিম বঙ্গের বিপ্লবী শক্তির সমন্বয় ও সম্মিলনের প্রয়োজন খুব অনুভব করতাম, বলতামও। কিন্তু আমার একার ভাবনার মূল্য কী? আর এমনিতেই তো পার্টিতে আমাকে কোণঠাসা করে রাখা হত। আর নয় মাস সময়টাও খুব অল্প এই চিন্তা করলেও তাকে বাস্তবায়নের জন্য। তবে আমি নিজে পশ্চিম বঙ্গে ছুটে গেছি সেখানকার কমিউনিস্ট আন্দোলনকে আমাদের যুদ্ধের সঙ্গে সংযুক্ত করার উদ্দেশ্যে। যাইহোক, সে প্রসঙ্গ এখন তুলে লাভ নাই। আমি আমার ঘরে, অর্থাৎ আমার পার্টিকে, বুঝাত পারি নাই, বাইরে বুঝাব কী করে? আর যে কথা বললাম সময়টা ছিল খুব সংক্ষিপ্ত। এসব চিন্তা অনেক আগে থেকে করতে হয়। আর দৃষ্টিটাও হতে হয় স্বচ্ছ।

একাত্তরের স্বাধীনতা যুদ্ধ বহু বিষয়েই আমার দৃষ্টিকে খুলে দিয়েছে। চিন্তায় যেমন পরিবর্তন এনেছে তেমন আমার পূর্ব থেকে থাকা বহু ধারণা অনেক বেশী দৃঢ় হয়েছে। বিশেষত এ দেশের পরিপ্রেক্ষিতে কমিউনিস্ট রাজনীতির যে আর কোনও ইতিবাচক ভূমিকা নাই সেই বিষয়ে স্থির সিদ্ধান্তে উপনীত হই।

মাও সে-তুং গ্রাম দিয়ে শহর ঘেরাওয়ের কথা বলেছিলেন। কিন্তু এটা একটা কৌশলগত ধারণা মাত্র। আমরা যেন এ কথা মনে না করি যে, এর মানে এই যে, গ্রাম থেকে উঠে আসা নেতৃত্ব শহর দখল করে জাতীয় নেতৃত্ব গঠন করতে পারে। সেটা সম্ভব নয়। এ কথা মুহূর্তের জন্যও আমরা যেন ভুলে না যাই যে, গ্রামের মোড়ল হওয়া আর জাতির নেতা বা জাতীয় নেতা হওয়া এক জিনিস নয়। এই দুইয়ের উত্থান বা বিকাশ প্রক্রিয়াই ভিন্ন। গ্রামের মোড়লের পক্ষে যেমন কখনই জাতীয় নেতা হওয়া সম্ভব নয় তেমন গ্রামের নেতৃত্ব যারা গঠন করে তাদেরকে দিয়ে যদি জাতীয় নেতৃত্ব গঠন করতে চাওযা হয় তাহলেও ভুল করা হবে। গ্রামীণ বা স্থানীয় নেতৃত্বের পক্ষে জাতীয় নেতৃত্বে অংশগ্রহণ সম্ভব হতে পারে; এবং সেই ধরনের ব্যবস্থা রাখা গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার জন্য অপরিহার্যও বটে। তবে সে ক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় নেতৃত্বে তাদের ভূমিকা মূলত পরামর্শকের হয়ে দেখা দেয়। হয়ত এই প্রক্রিয়ায় তাদের মধ্য থেকে একটা অংশ জাতীয় পর্যায়ের নেতা হিসাবে নিজেদের উত্তরণ ঘটাতে পারে।

আমাদের দেশে মার্কসীয় শ্রেণীতত্ত্বের অনুশীলন বহু সমস্যা ঘটিয়েছে। ‘মার্কসবাদের সঙ্কট ও বিপ্লবের ভবিষ্যৎ’-এ আমি এই তত্ত্বের সমালোচনা করেছি। আপনি রচনাটা পড়েছেন কিনা জানি না। পড়লে আমার এ সংক্রান্ত দৃষ্টিভঙ্গী জেনেছেন।

যাইহোক, গ্রাম দিয়ে শহর ঘেরাও করার তত্ত্বের প্রয়োগ ঘটাতে গিয়ে আমরা যেন গ্রামের নেতৃত্বকারী শ্রেণীগুলিকে ধ্বংস করে গ্রামগুলিকে লুঠেরা ও লুম্পেন নাগরিক শক্তির উন্মুক্ত চারণ ভূমিতে পরিণত না করি আর এভাবে দেশটাকে সাম্রাজ্যবাদী বিশ্বব্যবস্থার জন্য অধিকতর উন্মুক্ত না করি।

জাতীয় নেতার ভূমিকার গুরুত্ব ও তাৎপর্য সংক্রান্ত আমার ধারণা বা উপলব্ধির প্রধান উৎস মওলানা ভাসানী সম্পর্কে আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা। যদিও পাকিস্তান কালে আমি ছিলাম খুব কনিষ্ঠ একজন কর্মী তা সত্ত্বেও কিছু সময়ের জন্য ভাসানীকে বিভিন্নভাবে কাছে থেকে দেখার ও তার কিছু সাহচর্য লাভের সুযোগ আমার হয়েছিল। এটা বুঝতে হবে যে, পাকিস্তান কালে প্রথম পর্যায়ে সোহরাওয়ার্দী ও সোহরাওয়ার্দীর মৃত্যুর পরবর্তী পর্যায়ে মুজিবের সমান্তরালে তিনি ছিলেন তৎকালীন পূর্ব বঙ্গের অন্যতম প্রধান নেতা। আর এভাবে তিনি হয়ে উঠেছিলেন পাকিস্তানেরও অন্যতম নেতা। কিন্তু এই নেতা অন্যদের মত ক্ষমতালোভী ছিলেন না, যেমন ছিল না তার মধ্যে অর্থের প্রতি আর এভাবে প্রতিপত্তিশালী জীবনের প্রতি লোভ। আর এই এক গুণের কারণে তিনি হয়ে উঠেছিলেন সে কালের এক বিস্ময়কর নায়ক। সময়ের সাথে সঙ্গতি রেখে তার মধ্যে কীভাবে রূপান্তর বা transformation ঘটেছিল সেটাও আমি দেখার ও বুঝার সুযোগ পেয়েছিলাম।

তিনি ছিলেন একজন পীর বা মুসলিম ধর্মীয় নেতা, যার ছিল বিপুল সংখ্যক মুরীদ বা ধর্মীয় শিষ্য। এটা ছিল তার এক দিক। আসলে এই জায়গা থেকে তিনি উঠে এসেছিলেন আসামে কৃষকদের (বাঙ্গালী মুসলিম অভিবাসী) বিভিন্ন দাবী আদায়ের আন্দোলন করতে গিয়ে। মুসলিম লীগের জোয়ারের সময় তিনি আসামে মুসলিম লীগের রাজনীতির সাথে যুক্ত হন এবং ক্রমে আসাম মুসলিম লীগের নেতা হন (আসাম প্রাদেশিক মুসলিম লীগের সভাপতি)। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার সময় তিনি পূর্ব বঙ্গে ফিরে আসেন। এরপর এখানকার মুসলিম লীগ নেতা হিসাবে যাত্রা শুরু করলেও অতি দ্রুত তিনি মুসলিম লীগের বিরুদ্ধে অবস্থান নেন এবং ১৯৪৯ সালে মুসলিম লীগ পরিত্যাগ করে গঠন করলেন আওয়ামী মুসলিম লীগ। ১৯৫৫ সালে তার উদ্যোগে মুসলিম শব্দ বাদ দিয়ে তার দলের নাম শুধু আওয়ামী লীগ রাখা হল। এভাবে তার উদ্যোগে পূর্ব বঙ্গে মুসলিম বাঙ্গালীর লোকবাদী রাজনীতির দিকে নবযাত্রা শুরু হল। অবশ্য তার ভিত্তিমূলে ছিল ছাত্রদের দ্বারা সূচিত ভাষা আন্দোলনের অভিঘাত। কিন্তু তিনি সেই অভিঘাতকে গ্রহণ করতে পেরেছিলেন। অনেকে হয়ত জানেন না প্রথম দিকে সোহরাওয়ার্দীও আওয়ামী লীগ থেকে মুসলিম শব্দ বর্জনের বিরোধী ছিলেন। কিন্তু তিনি শেষ পর্যন্ত ভাসানীর দৃঢ়তার কাছে নতি স্বীকার করেন। ফলে সর্বসম্মতিক্রমে মুসলিম শব্দ বর্জন করে দলের নাম শুধু আওয়ামী লীগ করা হল।

ভাসানীর পরবর্তী বিরাট রূপান্তর ঘটে ১৯৫৭ সালে সোহরাওয়ার্দীর কব্জায় চলে যাওয়া আওয়ামী লীগ পরিত্যাগ করে নীতিনিষ্ঠ কর্মীদের নিয়ে ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি বা ন্যাপ গঠনের মাধ্যমে। ন্যাপ গঠনে তিনি তার সঙ্গে পেলেন প্রধানত গোপনে থাকা কমিউনিস্ট পার্টির প্রকাশ্যে থাকা নেতা-কর্মীদের। অর্থাৎ ন্যাপ হল মূলত গোপন কমিউনিস্ট পার্টির সঙ্গে তার সমঝোতার ফসল।

এবার এ দেশে ঘটল এক বিস্ময়কর ঘটনা। মূলত ধর্মবিশ্বাসহীন কমিউনিস্টদের লোকবাদী রাজনীতির অভিভাবক হিসাবে আবির্ভূত হলেন একজন ধর্মীয় নেতা, যিনি এ দেশে সমাজতন্ত্রেরও প্রধান প্রবক্তা হয়ে উঠলেন। আমার মনে আছে একদিন ভাসানী যখন কিছু সংখ্যক নেতা-কর্মীর সাথে কথা বলছিলেন তখন আমি সেখানে উপস্থিত হয়ে শুনতে পেলাম, ‘আপনাদের কারা নাস্তিক বলে না কী বলে তা নিয়ে আপনারা চিন্তা করেন কেন? সেটা সামলাবার জন্য তো আমি আছি! আপনারা নিশ্চিন্ত মনে আপনাদের কাজ করে যান!’

কত কথা বলব তার সম্পর্কে? এ কথা ভাবতে মজা লাগে যে, তিনি নামাজের সময় এলে অনেক সময় একা নামাজ পড়তেন আর তার দলের নেতা-কর্মীদের প্রায় সবাই কাছে বসে বা হেঁটে বেড়িয়ে সময় পার করত। আমি কোন দিনই তাকে কাউকে নামাজ পড়তে বলতে শুনি নাই। আসলে তার ধর্মবিশ্বাস ছিল কিনা সে বিষয়েও আমি খুব একটা নিঃশংসয় হতে পারি নাই। তবে তিনি রাজনীতির জন্য যে ধর্মকে ব্যবহার করতেন সেটা আমি বুঝি। এ ব্যাপারে তিনি অকপটও ছিলেন। কিন্তু সেটা মোটেই অসৎ উদ্দেশ্য প্রণোদিত নয়। তিনি ছিলেন নির্লোভ ও ন্যায়-নীতিনিষ্ঠ। তার রাজনীতিতে ভুল থাকতে পারে, কিন্তু ব্যক্তিগত স্বার্থে কোনও ধরনের বদমায়েশী ও ধূর্ততা ছিল না। তার কষ্টটাও অন্তত কিছু পরে হলেও বুঝেছি। তার সঙ্গে প্রথম পর্যায়ে জুটেছিল সোহরাওয়ার্দী-মুজিবের মতো ধুরন্ধর স্বার্থান্ধরা। আর পরবর্তী পর্যায়ে যারা জুটেছিল তারা বেশীর ভাগ সৎ ও নীতিনিষ্ঠ হলেও বিশেষ মতবাদের প্রতি অন্ধত্বের কারণে ছিল মানসিক প্রতিবন্ধী। আমি কমিউনিস্টদেরকে মানসিক প্রতিবন্ধী বলছি। ভাসানী সততা ও আদর্শনিষ্ঠার কারণে কমিউনিস্টদের শ্রদ্ধা করতেন। কিন্তু তাদের উদ্ভট সব কর্মকাণ্ড ও মতিচ্ছন্নতার দরুণ তাদের প্রতি বিমুখও হতেন। অথচ এরাই ছিল সঙ্গী। তিনি বুঝতেন এরা তাদের মতিচ্ছন্নতার দরুণ বেশী দূর যেতে পারবে না, অথচ এদের বিকল্পও এ দেশে নাই। বুঝা যায় এর ফলে তিনি নিজেও খুব স্ববিরোধে ভুগতেন।

সমাজতন্ত্রে তার আস্থা জন্মেছিল। এবং তিনি স্বপ্ন দেখতেন এ দেশে একটা সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব হবে, যে বিপ্লবে তিনি সহযোগী শক্তি হবেন। প্রায়শ সে কথা বলতেন। এই বিপ্লবে তিনি যে নেতৃত্ব দিতে পারবেন না সেটা বলতেন। তবে তিনি বিপ্লবীদের পৃষ্ঠপোষক, অভিভাবক হতে চাইতেন। আসলে চীনের সান ইয়াৎসেনের মত ভূমিকা পালন করতে চাইতেন। আমি দেখেছি কেউ যখন তার ভূমিকাকে সান ইয়াৎসেনের ভূমিকার সাথে তুলনা করত তখন তিনি কীভাবে আবেগ আপ্লুত হয়ে পড়তেন। সেসব মনে হলে এখনও আমার চোখে জল চলে আসতে চায়।

এমন লোককে কমিউনিস্ট নেতারা কীভাবে অবজ্ঞা করেছে, অবমূল্যায়ন করেছে সেসবও আমার দেখা। পূর্ব বাংলার কমিউনিস্ট পার্টি তার সম্পর্কে একটা লিখিত মূল্যায়ন করেছিল এই বলে যে, ভাসানী একজন পেটি বুর্জোয়া নেতা। এই মূল্যায়ন আবার তাকে পড়তে দিয়েছিলেন পার্টির এক প্রধান নেতা আলাউদ্দীন আহমদ। সেই নেতার মুখ থেকে আমি শুনেছিলাম যে, ভাসানী সম্পর্কে পার্টির এই লিখিত মূল্যায়ন তাকে পড়তে দেওয়ার সময় মুখে বলা হলে ভাসানী উত্তরে গর্ব ভরে বলেন, ‘কে বলেছে আমি পেটি বুর্জোয়া? আমি পেটি বুর্জোয়া নই, আমি জাতীয় বুর্জোয়া।’

এদের আচরণ ও মূল্যায়ন আমার কাছে এত অরুচিকর মনে হয়েছিল যে, ঐ মূল্যায়ন আমাকে দেওয়া হলেও আমি ওটা পড়ি নাই কখনও। তবে মানতে হবে এই মানসিক প্রতিবন্ধীরা সৎ ছিল, শঠ ছিল না।

কমিউনিস্ট পার্টি ও রাজনীতি সম্পর্কে আমার মোহমুক্তির পিছনে অনেক ঘটনা ক্রিয়াশীল হলেও এখানে দুইটি ঘটনার কথা উল্লেখ করব। একটা একাত্তরের যুদ্ধের পরপর সময়ের ঘটনা। মাসটা একাত্তরের ডিসেম্বর। যুদ্ধ তখন কেবল শেষ হয়ে রাষ্ট্র হিসাবে বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। আওয়ামী লীগ বাহিনীর হাতে পাবনার কমিউনিস্ট ঘাঁটির পতনের পর একটু আগে যে নেতার উল্লেখ করেছিলাম সেই আলাউদ্দীন আহমদ তখন সাময়িক আশ্রয়ের জন্য ঢাকায় আসেন। এটা ডিসেম্বর মাসের দ্বিতীয়ার্ধের কথা। আমিও তখন ঢাকায় এসেছিলাম। তার সাথে দেখা হলে আমি স্বাভাবিকভাবে পার্টির ভ্রান্ত লাইন এবং পাক বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধকে প্রধান করণীয় না করার সমালোচনা করে অনেক বক্তব্য দিই। স্বাভাবিকভাবে পাক-সেনাবাহিনীর নৃশংসতার বিরুদ্ধে আমার ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশও ঘটেছিল। আলাউদ্দীন ভাই শান্তভাবে ও ধৈর্য ধরে আমার কথা শুনে উত্তরে যে কথা বললেন তার প্রায় সবটা আমার কানে আজও বাজে, ‘কমরেড! পাক বাহিনী তো আমারও বাড়ী পুড়িয়েছে, আমাদের অনেক কমরেডের বাড়ীঘরও পুড়িয়েছে, তাদের অনেক মা-বোনকে ‘‘রেপ’’ও করেছে, কিন্তু কৈ, আমি তো “ইমোশনাল” হই না!’

পার্টির প্রধান হিসাবে দায়িত্ব না নিলেও ‘পূর্ব বাংলার কমিউনিস্ট পার্টি’র মূল নীতিনির্ধারক ছিলেন তিনি। বুঝুন, মতবাদ মানুষকে কী পরিমাণে হৃদয়হীন যন্ত্রে পরিণত করতে পারে!

দ্বিতীয় ঘটনাটাও যুদ্ধের সময়কার। আমি আমাদের পার্টির নেতৃত্বে সারাদেশে যুদ্ধ সংগঠিত করার কাজে তখন ছুটাছুটি করছিলাম। যুদ্ধের প্রথম দিকের কথা এটা। আমি কয়েক দিনের জন্য ঢাকায় এলে আমাদের পার্টির এক কমরেডের সাথে দেখা হল। তিনি চীন সম্পর্কে যে ক্ষোভ প্রকাশ করেন এটা তার সঙ্গে সম্পৃক্ত। পাক সেনা ২৫ মার্চ ‘ক্র্যাক ডাউন’ করার ৩/৪ দিন পর যখন ঢাকায় কার্ফিউ একটু শিথিল হয় সেই সময়কার ঘটনা। ঢাকায় চীনের কনস্যুলেট ছিল। তখন তারা কনস্যুলেটে গিয়ে সেখানে যে প্রধান দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তি ছিলেন তার সঙ্গে দেখা করেন। রাজনৈতিক কারণে আগে থেকে যোগাযোগ থাকায় পূর্ব পরিচিতি ছিল। যাইহোক, আমার কমরেডরা কনস্যুলেটের ফার্স্ট সেক্রেটারী অথবা সেকেন্ড সেক্রেটারী যিনি তখন ঢাকায় ছিলেন তার সঙ্গে কথা বলেন। তবে আমার এটুকু মনে আছে যে, সেই চীনা ভদ্রলোক ঢাকার চীনা কনস্যুলেট বা দূতাবাসে সেই সময় চীনা কমিউনিস্ট পার্টির যে শাখা বা কমিটি ছিল তার প্রধান ছিলেন। অর্থাৎ তিনি ছিলেন তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান বা পূর্ব বাংলায় চীনা কমিউনিস্ট পার্টির প্রতিনিধিত্বকারী প্রধান ব্যক্তি। পাকিস্তান কর্তৃক পরিচালিত গণহত্যার প্রতি চীনের সমর্থনকে যৌক্তিতা দিতে গিয়ে তিনি আমাদের কমরেডদেরকে ইংরাজীতে যে কথা বললেন সেটা এই রকম, ‘You see the Pakistani soldiers are kiling the Hindus only. And you know all Hindus are Indian agents.’

এমনিতেই পূর্ব বাংলার প্রেক্ষিতে পাকিস্তান প্রশ্নে আমি চীনের ভূমিকাকে সমর্থন করতাম না। অবশ্য ভাবতাম এটা চীনের জাতীয় প্রশ্ন যাকে আমাদের সমর্থনের কোনও প্রয়োজন নাই। কিন্তু যুদ্ধের সময়কার এমন বীভৎস গণহত্যা, গণ-নির্যাতন, নারী ধর্ষণের প্রতি এমন নির্বিকার সমর্থন আমার ভিতর ভয়ঙ্কর প্রতিক্রিয়া ঘটিয়েছিল। বস্তুত ঘৃণার আগুনে আমার মনে চীনের প্রতি দুর্বলতা ও সমর্থন যেটুকু অবশিষ্ট ছিল, পুড়ে ছা্ই হয়ে গেল।

আজ বুঝি চীন তার জায়গায় ঠিক ছিল। কিন্তু একই সাথে আমরা চীনের মিত্র পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধেও ঠিক। এমনকি আত্মরক্ষার প্রয়োজনে চীনের বিরুদ্ধে যুদ্ধও ন্যায়সঙ্গত। কেন, ১৯৭৯ সালে কমিউনিস্ট চীন যখন কমিউনিস্ট ভিয়েৎনামের উপর হামলা করেছিল তখন ভিয়েৎনাম কি চীনকে পাল্টা মার দিয়ে শিক্ষা দেয় নাই?

যাইহোক, ভাসানীর সূত্র ধরে আমি জাতীয় নেতৃত্ব গঠনের বিষয় নিয়ে বলতে গিয়ে প্রসঙ্গান্তরে চলে গেছি। এই বাস্তবতাকে বুঝতে হবে যে, আমাদের দেশে জাতীয় নেতা হবার জন্য কোনও শুদ্ধ ‘তরিকা’ নাই। যিনি জাতীয় নেতা হবেন তাকে জনগণের ভিতর থেকে উঠতে গিয়ে জনগণের এমন অনেক আবেগকে ধারণ করতে হয় যেগুলি অনেক সময় প্রতিক্রিয়াশীল এবং এমনকি অরুচিকর মনে হতে পারে। যেমন ধর্মীয় আবেগের প্রকাশ। কিন্তু জাতীয় নেতা তার মূল জায়গা বা উৎসে পড়ে থাকে না। শুরুতে যেগুলি তার দেহে লেপ্টে থাকে সেগুলির অনেক কিছুই তার উত্থান ও বিকাশের সঙ্গে আলগা হয়ে ঝরে পড়তে থাকে। অন্তত বাইরে যা-ই হোক মনের ভিতরে তার নবজন্ম ঘটতে থাকে। আসলে খুব জনপ্রিয় হলে তার ভিতরে আকাশ ছোঁয়া উচ্চাকাঙ্ক্ষা জাগতে থাকে। বিশেষ করে যারা অর্থ-বিত্তের মোহ পরিত্যাগ করতে পারে তারা সাম্রাজ্যবাদী-উপনিবেশবাদী পুঁজিবাদী বিশ্বব্যবস্থার জন্য হুমকি হয়ে উঠতে পারে। এরা তখন তাদের দেশকেও নিতে চায় উন্নয়নের শিখরে এবং সমগ্র জনগণকে করতে চায় তার অংশীদার। স্বাভাবিকভাবে এরা সাম্রাজ্যবাদ-বিরোধী হয়ে উঠে।

আপনি পাকিস্তানের ইমরান খানের দিকে তাকিয়ে দেখুন্। তার রূপান্তর বুঝতে চেষ্টা করুন। তিনি ধর্মের কথা বলছেন। কিন্তু সেটা তার অনেকটা মুখোশ হয়ে উঠছে। পাকিস্তানের জনমন নন্দিত হতে তাকে ইসলামের বুলি আওড়াতে হতে পারে অন্তত একটা পর্যায় পর্যন্ত। তবে আরও অগ্রগমনের জন্য তাকে পেতে হবে একটা ধর্মমুক্ত ও অগ্রসর গোষ্ঠী। ভাসানী কিন্তু ততদিন ইতিবাচক ভূমিকা রাখতে পেরেছিলেন যতদিন কমিউনিস্টরা তার সঙ্গে ছিল। কমিউনিস্টদের সকল সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও এই বাস্তবতাকে আমাদের মেনে নিতে হবে। এবং এ থেকে শিক্ষাও নিতে হবে। আসলে তখন পর্যন্ত এ দেশে কমিউনিস্টদের চেয়ে আর কোনও অগ্রসর শক্তি ছিল না।

উপমা দিয়ে বললে বলতে হয় এ যেন মৌর্য রাষ্ট্র গঠনে চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য ও চাণক্যের সম্মিলন। এই দুই ব্যক্তি তো দুই সামাজিক শক্তির প্রতিনিধি। এক মহানির্মাণের জন্য এমন দুই মহাশক্তির সম্মিলন ঘটতে হয়। আমাদের সবটা হয় নাই, তবে কিছুটা হয়েছিল, যার ফলে সম্ভব হয়েছিল আমাদের নিজ উদ্যোগে বাঙ্গালীর জাতীয় স্বাধীনতা যুদ্ধের সূচনা।

আমি বাংলাদেশে বিপ্লবের সূচনার ব্যাপারে আশাবাদী হলেও এটা এখানে বিচ্ছিন্নভাবে সফল হবে বলে মনে করি না। এ ক্ষেত্রে ভারতের ভূমিকাকে খুবই গুরুত্বপূর্ণ মনে করি। তবে সেই ভারতকে এখনও না দেখলেও এবং নরেন্দ্র মোদীর ব্যাপারে আমি খুব আশাবাদী না হলেও তার বিকাশ সম্ভাবনাকে আমি উড়িয়েও দিই না। মোদীর উত্থান প্রক্রিয়ার মধ্যে আমি একটা সম্ভাবনা দেখি। ভারতীয় সমাজ সত্তার জন্য তার যে আবেগ, ভালবাসা এবং ভারতকে নিয়ে তার যে স্বপ্ন সেটার মধ্যে আমি একটা সম্ভাবনা দেখি। অন্যদিকে, তিনি পশ্চিম বঙ্গের মমতা কিংবা ভারতের আরও অনেক নেতার মতো চোর বা দুর্নীতিগ্রস্ত নন। এটা কিন্তু একটা প্রচণ্ড গুণ আমাদের মতো সমাজগুলাতে। তবে এটা একটা দিক মাত্র। তিনি না হয় চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য হলেন, কিন্তু চাণক্য কোথায়? ভারতীয় জনতা পার্টিতে কিংবা তার বাইরে আর কোথায়ও কি সেই প্রজ্ঞাপূর্ণ ভূমিকা পালন করার মত কেউ আছে? জানি না। না থাকলে বিশেষ কিছু হবে না মোদীকে দিয়ে। সে ক্ষেত্রে অপেক্ষা করতে হবে অনির্দিষ্ট কাল।

আসলে আমার বিবেচনায় আজকের বৈশ্বিক বাস্তবতায় বাংলাদেশে আমাদের মূল করণীয় ইসলামী সাম্রাজ্যবাদ ও আধুনিক সাম্রাজ্যবাদ-উপনিবেশবাদের প্রভাব ও ধারাবাহিকতা থেকে মুক্ত একটা লোকায়ত ও গণতান্ত্রিক সমাজ ও রাষ্ট্র গঠন করা। সে ক্ষেত্রে আসে সিন্ধু সভ্যতার লোকায়ত আদর্শের পুনরুজ্জীবন ও আজকের প্রেক্ষিতে তার বাস্তবায়নের প্রশ্ন।

ভারত প্রসঙ্গে বলতে গিয়ে বলতে হয়, আমাদের এমন অভিজ্ঞতাও আছে যেগুলা নিয়ে বলতে সঙ্কোচ বোধ করি। অনেক ক্ষেত্রে এ ভয় করি যে, আমাদের অভিজ্ঞতা হিন্দু বিদ্বেষী মনোভাবকে আমাদের এ বঙ্গে আরও বৃদ্ধি করবে। সুতরাং ভারতীয় পাণ্ডিত্য সম্পর্কে গুরুতর অভিযোগ নিয়েও আমরা আজ অবধি মুখ খুলতে চাই না। বরং, আমার প্রত্যাশা বাংলাদেশ থেকেই এক অর্থে বেশী। আমাদের আর্যতত্ত্ব ও সিন্ধু সভ্যতা সম্পর্কে যে উচ্ছ্বাসপূর্ণ সমর্থন আমরা বাংলাদেশের পণ্ডিত মহলে পেয়েছিলাম তার কোনও তুলনা ভারতে নাই। এমনকি পাকিস্তান প্রত্নতত্ত্বের তৎকালীন সর্বোচ্চ ব্যক্তি ডঃ রফিক মুঘল যেভাবে উচ্ছ্বাসপূর্ণ ভাষায় আমাদের থিসিসকে সমর্থন জানিয়েছিলেন তার কি তুলনা আছে ভারতে?

আমি জানি মুসলিম চেতনায় অনেক সমস্যা আছে। কিন্তু এখানেই আছে বৃত্ত ভাঙ্গার অদম্য শক্তি। বাংলাদেশে আওয়ামী লীগের উত্থানের পিছনে ভারতের ভূমিকাকেও গৌণ করে দেখা ঠিক হবে না। এটা ঠিক যে, ভারতের জায়গায় ভারত ঠিক আছে। কিন্তু এই ভারত মূলত হিন্দু চেতনা ভিত্তিক। এই চেতনার আত্মবদ্ধতার সমস্যাকে আমাদের চিনতে হবে। এ ছাড়া এখান থেকে বের হওয়া যাবে না। ফলে বৈশ্বিক পটভূমিতে গিয়ে মার খেতে হবে।

তবে এখন বাংলাদেশে যে কোনও শুভ শক্তির উত্থানের পথে সবচেয়ে বড় বাধা আওয়ামী লীগ। তার ক্ষমতাচ্যুতি ছাড়া আমাদের পক্ষে অগ্রগতি ঘটানো সম্ভব নয়। জানি না লীগ যাবে কীভাবে। আপাতত অপেক্ষা করে দেখা ছাড়া উপায কী?

সিন্ধু সভ্যতার প্রশ্ন যখন এল তখন বলি ভারত, বিশেষত পশ্চিম বঙ্গের তুলনায় বাংলাদেশ থেকে আমার প্রত্যাশা এখন অনেক বেশী, অন্তত সূচনার পর্যায়ে। পশ্চিম বঙ্গ কিংবা ভারত থেকে আমরা এ প্রশ্নে যা পেয়েছি সেটার বেশীর ভাগকেই এক কথায় অবজ্ঞা এমনকি বিরোধিতাও বলতে পারি। তবে বাংলাদেশে আমাদের জন্য অনুকূল শুভ শক্তির জাগরণের পথে সবচেয়ে বড় বাধা হয়ে আছে ভারত সমর্থিত আওয়ামী লীগ সরকার, যার পিছনে আবার আছে চীনেরও দৃঢ় সমর্থন।

………………………………………………………………………………………………………………………………… ……………………………………………………………………………………………………………………………………।

আপনার শুভ কামনায়,

শামসুজ্জোহা মানিক

24 March, 2024

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
Archive
 
সাম্প্রতিক পোষ্টসমূহ