Banner
নতুন একটি গল্পের অপেক্ষা – সৈয়দ ওমর হাসান (ছোট গল্প)

লিখেছেনঃ সৈয়দ ওমর হাসান, আপডেটঃ October 22, 2008, 7:53 AM, Hits: 1097

একদিন আপনার সঙ্গে অফিস পিকনিকে কুয়াকাটা যাই। অফিস স্টাফ আমরা কুড়িজনের মত। বাড়তির মধ্যে রীনাদির বৃদ্ধ মা আর আপনার মেয়ে যূথী। আপনি, যূথী, রীনাদি, রীনাদি’র মা একই রুমে দুই বিছানায়। আমরা চারজন পাশের রুমে সন্ধ্যার পর থেকে তাস পেটাচ্ছি। আর কোকের বোতলে রাখা চোলাইয়ে মাঝে মাঝে চুমুক দিচ্ছি।
 
আমরা কুয়াকাটা যখন পৌছি তখন সন্ধ্যা উতরে গেছে। সমুদ্রের পাড়ে, খোলা হাওয়ায় কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে, হেটে, ভাসমান দোকানগুলো থেকে এটা সেটা কিনে, বিকেলের নাস্তা সেরে, ফাঁকে দুবোতল চোলাই সংগ্রহ করে ঢুকে পড়ি কটেজে। কটেজটি একটি স্কুলঘরের মত। এল প্যাটার্ন। প্রতিটা রুম এটাচবাথ, একটি কমনকিচেন। আমরা কিচেন দেখেই কটেজটি বুক করেছি। আমাদের সঙ্গে বাবুর্চি আছে সে-ই তিনবেলা রান্নাবান্না করে খাওয়ায়। বাবুর্চি এসেই রান্না চড়িয়ে দËিয়ছে। রান্না হতে হতে রাত দশটা। সারাদিনের যাত্রার ক্লান্তি, কটেজে ঢুকে ফ্রেস হয়ে ক্যাজুয়াল ড্রেস পরার পর একদম হাওয়া। তারপর আমরা বসে গেছি কেউ আড্ডায়, কেউ দাবা নিয়ে, কেউ গিটারে, কেউ খোলা গলায় গানে। আমরা যেন হঠাৎ করে এসে একটা মেলা বসিয়ে দিয়েছি। রাতে খাবার পরও আমাদের কোন ক্লান্তি আসেনি। আমরা প্রায় সবাই অনেক রাত পর্যন্ত জেগে ছিলাম। আমরা চারজন ১০ নম্বর কক্ষে রাত দুটো পর্যন্ত তাস পিটিয়ে, কেউ লাভ করে কেউ ফতুর হয়ে, কোকের বোতলের পর্যাপ্ত চোলাই টেনে ছত্রাখান হয়ে ঘুমিয়ে পড়েছি।
 
কিন্তু খুব সকালে, প্যাসেজে হাটাহাটির শব্দ, কথাবার্তা, ডাকাডাকিতে আমার ঘুম ভেঙ্গে যায়। বুঝতে পারি, সবাই সূর্য দেখতে যাচ্ছে। বন্ধুদের ঘুম তখনও ভাঙ্গেনি। আমি আবার ঘুমানোর চেষ্টা করি। কিন্তু ঘুম আর আসেনা। শরীরটা টায়ার্ড লাগে। মনে হয়, ভারি কোন কাজ করেছি। এখন কি করব? সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগি। আমার একবার ঘুম ভেঙ্গে গেলে আর ঘুম আসেনা। কাটা মুরগির মত বিছানায় ছটফট করতে থাকি। এরকম আমার বহুদিন হয়েছে। শরীর টায়ার্ড সত্ত্বেও আজ আমি উঠে দাঁড়াই, দরজা খুলে বাইরে উঁকি দেই, দেখি প্যাসেজে আলো জ্বলছে। প্যাসেজ খাঁ খাঁ শূন্য। একটু খারাপ লাগল, শরীরটা টায়ার্ড না থাকলে আমিও সবার সঙ্গে সূর্য দেখতে যেতে পারতাম। কটেজের বাইরে ঘন কুয়াশা, অন্ধকার খানিকটা ফিঁকে হয়ে এসেছে। দূরে কোন কটেজের অস্পষ্ট আলো চোখে লাগে। হঠাৎ খেয়াল হল, আমার পাশের রুমের দরজাটা ভেজানো, ভিতরে আলো জ্বলছে। হয়ত ফ্যানও, কারণ দরজার ভারি পর্দাটা মৃদু দুলছে। তাহলে কি রীনাদি, তার মা, আপনি কেউ সূর্য দেখতে যাননি! আমি যেন নিঃসঙ্গ সকালে হঠাৎ একটি কাজ পেয়ে যাই। ভেজানো দরজা ঠেলে ভেতরে উঁকি দিয়ে দেখি, আপনি বিছানায় আধশোয়া হয়ে যুঁথির পিঠে চাপড় দিচ্ছেন। অন্য খাটে রীনাদির মা ঘুমিয়ে। আপনি আমাকে দেখতে পেয়ে জেগে ওঠেন, আপনার তন্দ্রা ভাব ছুটে যায়। আপনি আধশোয়া অবস্থা থেকে বসে পড়েন। নিজেকে সামলে নেন। আমি হঠাৎ করে রুমে ঢুকেপড়ার জন্য দুঃখ প্রকাশ করে রীনাদির কথা জানতে চাই। বলেন, উনি সূর্য দেখতে গেছে। আমার অবাক ভঙ্গি, মাকে ফেলে? আপনি বলেন, উনি ঘুমাচ্ছিলেন দেখে রীনাদি একাই চলে গেছে। আমি হালকা সুরে বলি, রীনাদি পারেনও, ব্যাচেলর মানুষ, ঝাড়া হাত পা; যখন যেখানে খুশি ছুট দিতে পারেন। আপনি চোখে তীর্যক ভাব ফুটিয়ে বলেন, আপনি পারেন না? আমি আপনার উত্তর সহজ ভাবে দেইনা। একটু পেচিয়ে ফেলি, আমরা দুজনেই পারি কিন্তু আপনি যে পারেন না। আমি একটু হাসি, হেসে নাটকীয়ভাবে বলি, আপনি হন বন্দী সংসার নামক এক দুর্ভেদ্য কারাগারে। আমি আবার দুঃখ প্রকাশ করে চলে যেতে উদ্যত হতেই আপনি পিছন ডাকলেন, শুনুন। আমি থমকালাম, দাঁড়ালাম, ইতস্তত করলাম। আপনি খাটের পাশে রাখা চেয়ারটা টেনে দিয়ে বললেন, বসুন এখানে। আমি বসতে না চাইলেও বসে পড়লাম। আপনি বললেন, সত্যি ভাই আপনি ঠিকই বলেছেন, সংসার এক দুর্ভেদ্য কারাগার। সূর্য দেখতে এসেছি, সবার সঙ্গে আমারও যেতে ইচ্ছে করছিল কিন্তু কি করব বলুন, যুঁথিকে কার কাছে রেখে যাব। সঙ্গে নিয়ে গেলে সমস্যা, ঠান্ডা লাগতে পারে। আমি আপনাকে সান্ত্বনা দেই, আরে তাতে কি হয়েছে? আমিও তো যাইনি, আমার কি সংসার আছে নাকি? কাল আমরা একসাথে যাব, যুঁথিকে ভাল করে গরম কাপড় চোপর পরিয়ে নিয়ে তারপর যাব।
 
আপনি, তানভীর, রীনাদি সবার সঙ্গেই আমার আড্ডার সম্পর্ক, বন্ধুর সম্পর্ক এমন কি আপনার হাজবেন্ড সোলায়মান সাহেবের সঙ্গেও আমার সম্পর্ক বন্ধুর মত। কিন্তু আজ, এই নিভৃত সকালে, সেই বন্ধুত্বের ভিতর ঢুকতে পারছিনা। কোথায় যেন একটি কাঁটা বিঁধে আছে। ভেতরে জড়তা কাজ করছে। মনে হল, হঠাৎ যদি কেউ আমাকে এখানে দেখে ফেলে, কি ভাববে? অথচ আমরা সারাক্ষণ হৈ হুল্লোড় করি, ওঠাবসা করি, টুøর করি, হোটেলে ভাত খাই, বেড়াই। তখন তো এরকম মনে হয় না।
 
আমি একটা পাতলা টিশার্ট পরে আছি। নীচে লুঙ্গি। একটু একটু শীত করছে। আমি দুই হাত বুকে চেপে আপনার সঙ্গে কথা বলছি। আপনি চোখ নাচিয়ে হঠাৎ বললেন, আপনাকে লুঙ্গিতে প্রথম দেখলাম, লুঙ্গিতে আপনাকে বেশ সুপুরুষ লাগে তো। তারপর কন্ঠে যথেষ্ট আন্তরিকতা ঢেলে বলেন, আপনার বোধহয় শীত করছে। লেপের নীচে চলে আসেন না। আমি কথাটা শুনে আঁৎকে উঠি, অবিশ্বাস করি, শরীরের কোথায় যেন বিদুøৎ তৈরি হয়। এরকম একটি কথা কি আপনার পক্ষে বলা সম্ভব! বন্ধু সম্পর্কের ভেতর দিয়েও কি সম্ভব! আন্তরিকতার ভেতর দিয়ে! আমি বুঝে উঠতে পারিনা। আমি আপনার আন্তরিকতার সঙ্গে সঙ্গে রেসপঞ্জ না করায় আপনি কথাটিকে ভারসাম্য দিয়ে বললেন, আমার মাথার দিকে আপনি পা দেন, তাহলে মুখোমুখি বসে কথা বলা যাবে। আমি ইতস্ততঃ করি, মুখে না পর্যন্ত বলি। বললেন, আসুনতো এভাবে শীতে কষ্ট করার কোন মানে হয় না। আপনি যেন হ্যাঁচকা এক টানে আমাকে পাশে বসিয়ে দিলেন। আমি আপনার পাশেই বসি। অফিসে আমাদের পাশাপাশি টেবিল। কিন্তু মনে হল, সেই পাশ এই পাশ এক নয়। এই পাশের ভিতর নিভৃত বড় বেশী।
 
আমার মুখোমুখি নব্বই ডিগ্রী কোনে বসি। আমার পা আপনার কোমর পর্যন্ত, আপনার পা আমার কোমর পর্যন্ত। দু’জনের পায়ের উপর একটাই লেপ। যুঁথি আপনার ডানপাশে ঘুমানো। সেও লেপের খানিকটা পেয়েছে। এভাবে বসে আমার মনে হল, এই মহিলার সঙ্গে মুখোমুখি বসে আমার কি বলার আছে! আমাদের দীর্ঘ চাকরি জীবনে নতুন আর কি গল্প আছে? আমি আমার হারানো প্রেমের গল্প বহুবার বহু কর্ণার থেকে বলেছি। বলেছি, আমি সেই হারিয়ে ফেলা মেয়েটিকে চাইনা। আমি চাই ভালবাসার পুনর্জন্ম। তা না হলে আমি কখনোই বিয়ে করব না। আপনি বলেছেন, সোলায়মান সাহেব আর আপনার ভালবাসার কথা; বহুবার বলেছেন। আপনারা পালিয়ে বিয়ে করেছেন। এক বস্ত্রে ঘর ছেড়েছেন। সেকথাও অনেকবার হয়েছে। আপনি আমাকে হেসে হেসে একটা প্রতিশ্রুতিও দিয়েছিলেন, আমার হারানো ভালবাসা ফিরিয়ে দেবেন। আমার প্রেমিকা আমার সাথে যা করত আপনিও তাই তাই করবেন। আর আমি আপনার সংসার জীবনের এক ঘেয়েমি কাটাবো, সঙ্গ দেব। আমি অবশ্য একথা কখনোই প্রকাশ করিনি, আপনিও বলেলনি, সংসার জীবনে আপনি একঘেয়েমি আক্রান্ত। আপনি আমার ভালবাসা ফিরিয়ে দেবার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন, হতে পারে এটা তারই গোপন প্রতিদানের সংকল্প।
 
আমার সমস্যা ভালবাসার অনুপস্থিতি আর আপনার নিসঙ্গতা। আমরা পরস্পরের সমস্যা সমাধানের জন্য খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে বিচিত্র সব প্রশ্ন করেছি। মনে হয়েছে আমরা কোন ব্যক্তি সাবজেক্ট নই। আমরা যেন বিরাট বহমান জীবনেরই সাবজেক্ট। কিন্তু আজ খাটে মুখোমুখি বসে একটি প্রশ্নও নেই। আমরা স্তম্ভিত, আমরা মুক, কিছু একটা ঘটার অপেক্ষায় অনঢ়। হঠাৎ আমার শরীরে লেপের ভিতরে আপনার পা লাগে। আমি শরীর সরাই, মনে হয়, এ হঠাৎ লাগা। এরকম তো লাগতেই পারে। কিন্তু কিছুক্ষণ পর আমার পা লাগে আপনার শরীরে। আপনিও শরীর খানিকটা সরিয়ে নেন। আমি ধন্ধে পড়ে যাই, আমার পা লাগাটি কি ইচ্ছকৃত ছিল? নাকি অবচেতনে? মস্তিস্কের নির্দেশের বাইরে কি শরীর চলে? আমার মনে হল আমার পা লাগাটা ছিল সম্পূর্ণ অনিচ্ছাকৃত। কিন্তু একটু সময় নিয়ে আবার আমার শরীরে আপনার পা লাগে। এবং তক্ষণি একটি বিদুøৎ শক ছড়িয়ে পড়ে আমার শরীরের প্রতিটি বিন্দুতে। প্রতিটি বিন্দু সচকিত হয়ে ওঠে। তারপরও আমি সচেতন হই; কোন ক্রমেই আমার পা যেন আপনার শরীরে আর না লাগে। কিন্তু শরীরের বিদুøৎ আরো তীব্রতা পেয়ে আমার সবকিছু ওলট পালট করে দেয়। আমার প্রবল ইচ্ছা জাগে, আপনার শরীরে ফের পা লাগিয়ে নিশ্চিত প্রতিক্রিয়া জানতে। কিন্তু বিশ্বাস করুন আমার সাহস হয়নি। আমি অবিশ্বাসের ভয়াবহতায় রীতিমত কাঁপতে থাকি। এই কি সেই ভাললাগা! ভালবাসার পুণর্জন্মকে আকন্ঠ পান না করে আমি রীতিমত ভয় পেয়ে যাই। এবং সেকারণেই আমি আপনার শরীরে সচেতন ভাবে স্পর্শ করিনি।
 
আমি লেপের তলা থেকে নেমে এসে বাথরুমে ঢুকে পড়ি। অসহায়ের মত আয়নার সামনে দাঁড়াই। নিজের মুখ দেখি, অভিব্যক্তি দেখি। আমি একদা যে মেয়েটিকে ভালবাসতাম, যে ভালবাসা ছিল পাগলের মত। আমি সে সময় এভাবে বাথরুমের আয়নার সামনে দাঁড়াতাম, দাঁড়িয়ে দেখতাম আমি এমন কি সুন্দর যে ঐ মেয়েটি আমার প্রেমে পড়ল। আমার এমন কি আছে যে, ঐ মেয়েটি নিজেকে সমর্পন করল। আজ কি আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে আমার সেরকম মনে হয়? হ্যাঁ মনে হয়! এ ভালবাসা তো অসম্ভব।
 
আমি দশ বছর আগে যে মেয়েটিকে ভালবাসতাম তার প্রায়ই বিয়ের প্রস্তাব আসত। তখন কি ভীষণ কষ্টে এমনি ভাবে বাথরুমের আয়নার সামনে দাঁড়াতাম। আমার চোখ বেয়ে অঝোর ধারায় কান্না নেমে আসত। অবাকও হতাম; আমি এতবড় একটা ছেলে ভালবাসার কষ্টে কিরকমভাবে কাঁদছি। আমি কি এ সময় আপনার জন্যও এরকমভাবে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে কাঁদব?
 
বাথরুম থেকে বেরিয়ে আমি আর লেপের মধ্যে গেলাম না। আপনি তখন নব্বই ডিগ্রী কোনে বসে নেই। হেলান দিয়েছেন দেয়ালের সঙ্গে। বাথরুমের দিকে মুখ করে। আপনার চোখে খানিকটা বিস্ময়, খানিকটা সন্দেহ। ‘চলুন সমুদ্রের পাড় থেকে ঘুরে আসি।’ আমি বিছানার উপর বসে প্রস্তাব দেই। আপনি নীরবে উঠে বাথরুমে যান। আপনিও কি আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে তখন? নিজের চেহারা দেখছেন? অভিব্যক্তি? বাথরুম থেকে বেরিয়ে বললেন, বীচে এখন যাবনা। যুঁথি ঘুমাচ্ছে। চলুন কাছাকাছি কোথাও ঘুরে আসি। ও উঠে আমাকে না দেখলে কান্না-কাটি শুরু করে দেবে।
 
আমরা কটেজের সামনের রাস্তায় কুয়াশাচ্ছন্ন সকালে পায়চারি করতে করতে একটা ঝুপড়ি মত চায়ের দোকান পেয়ে যাই। দোকানটির পেতে রাখা টুলে বসে লিকার চা খাই। স্থানীয় একজনের সঙ্গে আলাপ করে জানি, মিস্রিপাড়ায় একটি বড় বৌদ্ধমন্দির আছে। বেলা উঠলে আমরা সেখানে যাব ঠিক করি।
 
কুয়াশা কেটে যাবার পর সহকর্মীরা সবাই সূর্যদয় দেখে ফিরে আসে। তানভীর আর রীনাদিকে মিস্রিপাড়ার কথা বলতেই ওরা যাবার জন্য লাফিয়ে উঠে। সকালের নাস্তা সেরে আমি আপনি, রীনাদি আর তানভীর দুটো রিক্সা ভ্যানে হুঁ হুঁ করা উত্তরা বাতাস ঠেলে রওনা দিই মিস্রিপাড়া। যুঁথি রীনাদির মা’র কাছে। আপনি পুরোপুরি নিশ্চিন্ত। মিস্রিপাড়া কুয়াকাটা থেকে বহু দূর। রাস্তা বলতে তেমন কিছু নেই। মাটির এবড়ো থেবড়ো রাস্তা, খানাখন্দ। প্রায় জায়গায়ই আমাদের ভ্যান থেকে নামতে হয়। কখনো ভ্যানটি টেনে নামাবার জন্য। কখনো ঠেলে তুলবার জন্য। নামা ওঠার সময় আপনি আমার হাত ধরেন, কাধে ভর দেন তখন আমি এক অপূর্ব শিহরণে প্লাবিত। তানভীরদের ভ্যানের খবর নেই। ওদের ভ্যান চালকটা তাগড়াই গোছের। আমাদের অনেক পেছনে ফেলে দিয়েছে। মিস্রিপাড়ায় পৌঁছে তানভীর আর রীনাদি আমাদের জন্য অপেক্ষা করছে। একটু হাঁটতেই মন্দির। জুতা স্যান্ডেল খুলে মন্দির চত্ত্বরে প্রবেশ করবার সময় তানভীর আমার কানে কানে বলে, বস এখানের চোলাই কিন্তু বিখ্যাত। যাবার সময়-
 
মন্দির গৃহে ঢুকে বৌদ্ধমূর্তিটি দেখে আমরা বিস্ময়ে স্তম্ভিত হয়ে যাই। স্তম্ভিত অবস্থাটা কাটানোর জন্যই হয়ত মূর্তিটি ঘুরে ঘুরে দেখি। ছুঁয়ে দেখি, তারপর ওর বিশালত্ব আর ধ্যানমগ্ন আসনের সামনে আমরা যেন বিবশ হয়ে পড়ি। একসময় নড়াচড়া বন্ধ হয়ে যায়। ওর মুখের দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকি। আমরা কি অজান্তেই মূর্তিটিকে শ্রদ্ধা করতে শুরু করি! ভয় করতে শুরু করি! বলতে পারব না। ঠিক তখন তানভীর আমার পিঠে হাত রাখে। আমি তানভীরের দিকে তাকাই। তানভীরের চোখে চোলাইয়ের ইঙ্গিত। আমরা আপনাদের মন্দির চত্ত্বরটা ভাল করে ঘুরে দেখতে বলে এক রাখাইন পল্লীতে ঢুকে পড়ি। চোলাইয়ের কথা জিজ্ঞেস করতে এক যুবক আমাদের একটা বাড়ি দেখিয়ে দেয়। বাড়িটি বাঁশ আর শনের তৈরি। পুরো খাটাল জুড়ে নীচু তক্তপোশ তার উপর হোগলা বিছানো। আমরা ঘরে ঢুকতেই মলিন ঘাগড়া ব্লাউজ পরা এক বৃদ্ধা আমাদের অভর্থøনা জানায়। আমরা তক্তপোশে আসন গেড়ে বসি। বয়স্কা মিনারেল ওয়াটারের বোতলে চোলাই আর পানি নিয়ে আসে। আমরা বাহ্‌ বাহ্‌ করতে করতে আধা লিটার শেষ করে ফেলি। আমাদের তখন পা টলছে, কথায় জড়তা, মুখে দুর্গন্ধ কিন্তু চেতনা একেবারে লোপ পায়নি। বন্ধুদের জন্য এক লিটারের একটা বোতল নিয়ে পল্লী থেকে বেরিয়ে পড়ি।
 
চেতনার মধ্যে আমরা প্রস্তুত হই রীনাদি আর আপনার সামনে স্বাভাবিক আচরণ করার। কিন্তু বুঝতে পারি চেতনার উপরও ধীরে ধীরে পা রাখছে রাখাইন চোলাই। আমরা আপনাদের খুঁজে পাই একই সঙ্গে একটি ভ্যানের উপর। আপনাদের মুখ অন্ধকার। আপনারা যেতে উদ্যত। এই দৃশ্য দেখে আমরা হতাশ হয়ে পড়ি। নির্জন রাস্তায় আপনাদের সঙ্গহীনতা কেমন লাগবে ভেবে পাইনা, আমরা দুজনেই আপনাদের পায়ের কাছে কুকড়ে মুকড়ে বসে অসহায়ের মত বার বার অনুনয় করি, প্লিজ আমাদের ফেলে যাবেনা, প্লিজ........চোলাই খেয়ে ফেরার সময় এক বাড়ি থেকে একটা রক্তজবা ছিড়ে ছিলাম। হঠাৎ রক্তজবাটি আপনার হাতে তুলে দেই। জড়িত কন্ঠে বলি, ‘ভালবাসি।’ অমনি রীনাদির মুখ থেকে সমস্ত ক্রোধ অভিমান নিমেষে উধাও হয়ে যায়। সেখানে ফুটে ওঠে এক চিতলে হাসি। আর আপনি অপার বিস্ময়ে একবার তাকান আমার দিকে একবার ফুলটির দিকে। এই একটি ফুল, একটি শব্দ ভোজবাজির মত আপনাদের শক্ত জোট ভেঙ্গে ফেলে। রীনাদি ভ্যান থেকে নেমে যায়। আমি বসি আপনার পাশে। আপনি আমার দিকে বাঁকা চোখে তাকান। আপনার চোখের তলে বিদুøৎ। বিদুøৎ আমাকে প্রবল বেগে আকর্ষণ করে। আমি আচমকা আপনার হাতের উপর হাত রাখি। আপনি হাতটি সরাতে গিয়েও থেমে যান। ঠোঁটের কোনে ফুটে ওঠে লাজাভাস। তারপর আপনিও আমার হাতের উপর কম্পমান হাত রাখেন। প্রথম আপনার হাত তারপর আমার, ফের আপনার। আমরা হাত দিয়ে অসম্ভব এক ভিত্তিপ্রস্তর গড়ি। আমাদের চোখ সমান্তরালে চলে আসে, চোখে উদাসীনতা, প্রশ্বাস ঘন হয় এবং আমাদের ঠোঁট কাঁপতে থাকে। ঠিক তখনই ক্ষিপ্রগতিতে রীনাদিদের ভ্যানটি আমাদের পাশ কাটিয়ে চলে যায়। যাবার সময় তানভীর হৈ হৈ করে ওঠে। রীনাতি হাত নাড়ে। আমরা আবার নিবিষ্ট হই। আমি আপনার পিঠে হাত রেখে আপনাকে দেখি। আমি আপনার চিবুক ছুঁয়ে আপনাকে দেখি। আপনার উরুতে মৃদু স্পর্শ রেখে নিজেকে অনুভব করি। আপনি অন্যদিকে তাকিয়ে থাকেন। আপনার চোখ কান্না।
 
আপনাকে প্রশ্ন করি, সোলায়মান সাহেবের সঙ্গে পালানোর অনুভূতি কি এরকম ছিল? আপনি ঝাপসা কন্ঠে বলেন, মনে নেই। তাকে কি আপনি  এখনও আগের মত ভালবাসেন? আপনার কন্ঠ স্পষ্ট হয়, আপনি বলেন, না। কেন? আমি কৌতুহল নিয়ে জানতে চাই। আপনি ধরা গলায় বলেন, সবকিছুর মতই হয়ত ভালবাসা ক্ষয়ে যায়। ভালবাসা কি নিঃশেষ হয়? আমি যেন নিজেকেই প্রশ্ন করি। আপনি বলেন, হয়ত তাও হয়। তাহলে কি, সোলায়মান সাহেবের প্রতি আপনার ভালবাসা মৃত? আপনি বলেন, জানিনা। আমার কথা জানার জন্য অথবা আমার প্রশ্নবান এড়ানোর জন্য আপনি জিজ্ঞেস করেন, আপনি কি ভালবাসা খুঁজে পেয়েছেন? আমি আপনার এই প্রশ্নে দ্বিধায় পড়ে যাই। আমি কি এতদিন আমার হারিয়ে যাওয়া ভালবাসা খুঁজেছি? নাকি অন্য একটি ভালবাসা? না ভালবাসার পুনর্জন্ম। আমি দ্বিধায় থেকে যাই, দ্বিধা কিছুতেই কাটেনা। আপনি হয়ত আমার সমস্যাটি ধরে ফেলেন, জিজ্ঞেস করেন, এখন কি আপনার প্রথম ভালবাসার কথা মনে পড়ছে? আমি ঘাড় নাড়ি। তাহলে কি এটাই আপনার প্রথম ভালবাসা? আপনি বিস্ময় নিয়ে জানতে চান। আমি কোন উত্তর দিতে পারিনা। এক অসম্ভব ঘোরের মধ্যে আপনার বাহুতে মুখ ঘষতে থাকি।
 
রাতে দিগন্তভেদী সমুদ্রের পাড়ে দাঁড়িয়ে আমি আপনাকে বিয়ের প্রস্তাব দেই। আপনি প্রস্তাব শুনে প্রথমে হো হো করে হেসে ওঠেন। আমি তাতে বিব্রত বোধ করি। মনে হয় আমি আপনার সঙ্গে কোন শিশু সুলভ আচরণ করেছি। আমি আপনার হাত চেপে ধরে হাসতে নিষেধ করি। এবং বোঝাই, ব্যাপারটি মোটেও হাসির নয়। আমি আপনাকে সত্যি সত্যি চাই।
 
আপনি হাসির গমক থামিয়ে জানতে চান আপনার স্বামীর কি হবে? আমি অবলিলায় তাকে ডিভোর্স দিতে বলি। একথা বলার সময় আমার কোন অপরাধ বোধ কাজ করেনি। আমি যেন তাকে খুন করতেও বলতে পারতাম। আমার স্মৃতির ভালবাসা তখন হাওয়ায় মিলিয়ে গেছে। আপনি যেন আমার প্রথম ভালবাসা। আপনাকে ছাড়া যেন আমার কিছুতেই চলবেনা। আমি রাজ্য চাইনা, রাজকন্যা চাইনা, শুধু আপনাকে চাই। সেখানে তৃতীয় কাউকে সহ্য করাতো আমার পক্ষে অসম্ভব।
 
তারপর আপনি যেন একটু বিভ্রান্ত একটু সিরিয়াস। আমাকে বলেন, তাকে আমি কি বলে ডিভোর্স দেব। আমি বলি শারীরিক অক্ষমতা-টক্ষমতা কিছু একটা দেখিয়ে। সেটা কোন ব্যাপার নয়, ভাল কোন লইয়ারের পরামর্শ নিলেই চলবে। আপনি অসহায়ের মত আপনার মেয়ের কথা জানতে চান। ওর কি হবে? আমি আপনার পিঠে হাত রেখে আশ্বস্ত করি। ও আমারই মেয়ে হবে। ন্ধধরুন আমি যদি আর কোন ইসুø না চাই? আমি আপনার কন্ঠ জড়িয়ে ধরে ভরসা দেই, আমার আর কিছু চাইনা।
 
আপনি কিছুক্ষণ থমকে থাকেন। দ্বিধায় থাকেন। তারপর বলেন, আসলে আমি যুঁথির বাবার মুখোমুখি দাঁড়াতে পারবনা। উনি বড্ড ভাল। তার চে বরং আমরা পালাই। আমি তাকে বোঝাই, পালানো কাপুরুষতা। তাছাড়া ঝামেলাও অনেক, চাকরী, সমাজ সবকিছু ওলটপালট হয়ে যাবে না? কিন্তু আপনি আমাকে বোঝান, সোলায়মান সাহেব এত ভাল যে, আপনি পালিয়ে গেলেও আপনাকে খুঁজে সে বিব্রত করবে না। আমি তখন রাতের অন্ধকারে নয় একদিন ভোরের সূর্য দেখে পালানোর এক পরিকল্পনা করে ফেলি। যদিও পালানোর জন্য সামান্য গ্লানি থাকবে, কিন্তু ......।
 
কুয়াকাটার সিভিউ নামে একটি কটেজের ১০ নম্বর কক্ষে আমি কিছুদিন থাকি। সে কক্ষের ড্রেসিং টেবিলের দেরাজে পাওয়া ডায়রির কয়েকটি ছেঁড়া পাতা থেকে এই লেখাটি উদ্ধার করি। এবং ক্রিয়ার কালরূপের সামান্য পরিবর্তন করে আপনাদের (পাঠক) সামনে গল্পাকারে উপস্থাপন করি। ডায়রিতে মানুষ ছদ্দবেশ ধারণ করে। এই ডায়রির লেখকও তার ব্যতিক্রম নয়। ফলে লেখাটির মূল চরিত্র দুটির কোন সূত্র খুঁজে পাওয়া যায়নি। পুরো লেখাটিতে মাত্র চারটি চরিত্রের নাম খুঁজে পাওয়া যায়; রীনাদি, তানভীর, সোলায়মান সাহেব এবং যুঁথি। এদেরকেও আমি চিনি না। হয়ত এই নামগুলোও ছদ্দনাম। লেখাটি গল্পের মত করে উপস্থাপন করা হলেও এটা আসলে কোন গল্প নয়। আমার ধারণা সমুদ্রের পাড়ে সূর্যের আলোছায়ায় বিচিত্র বর্ণিল সব সম্ভাবনার জন্ম হয়, এটি তারই একটি উদাহরণ মাত্র।
 
অনেক কিছুর মত আমার একথা জানাও সম্ভব হয়নি যে, ডায়রির লেখক তার প্রিয় সহকর্মীকে নিয়ে পালাতে সক্ষম হয়েছিল কিনা অথবা তাদের শেষ পর্যন্ত কি হয়েছিল। আমার ধারণা তারা পালাতে সক্ষম হয়নি। কারণ অত দ্রুত ঘটে যাওয়া ভালবাসার পরিণাম ফল সাধারণত শরীরের দিকে গড়ায়। তাছাড়া একটা ব্যাপার আমার খটকা লাগে, লোকটি ডায়রি থেকে পাতাগুলো ছিঁড়ে রেখে গেল কেন? সেকি ১০ নং কক্ষের পরবর্তী অচেনা কোন বোর্ডারের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চেয়েছিল? নাকি অন্য কিছু? আমার মনে হয়, সে চলে যাবার সময় তর সঙ্গে কোন প্রমান রাখতে চায়নি। ডায়রির কয়েকটি পাতার সামান্য ভার যে বহন করতে পারেনি তারপক্ষে সহকর্মীকে নিয়ে পালানো সম্ভব নয়। এ কাহিনীটি যে তার নিজের এবং সত্য এব্যাপারে আমি পুরোপুরি সন্দেহ মুক্ত। কারণ সহকর্মী দুজন রাতের অন্ধকারে সমুদ্রের পাড়ে বসে একটি পরিকল্পনা করেছিল-তারা একদিন ভোরের সূর্য দেখে পালাবে। লেখক তার পরিকল্পনার কথা ডায়রিতে লিখে রেখেছিল। আমার ধারণা মানুষ ডায়রিতে কখনো মিথ্যে পরিকল্পনা লেখে না।
 
তারা শেষ পর্যন্ত পালাতে পারুক বা না পারুক সেটা কোন কথা নয়। কথা, তারা অতীতের দুটি ভয়াবহ চক্র থেকে বেরিয়ে আসতে পেরেছে; একজন বেরিয়ে এসেছে তার হারানো প্রেমের গল্প থেকে, আরেকজন তার স্বামীর গল্প থেকে। তাদের জীবনে নতুন একটি গল্প শুরু হল। আমরা ভবিষ্যতের কোন একদিন হয়তো সে গল্পটিও শুনতে পাব।
 
[ গল্পটি লেখকের ‘স্বপ্ন ভালোবাসা ও অন্যান্য পরমানু’ নামক গ্রন্থে প্রকাশিত হয়েছে। প্রকাশকঃ মোহাম্মদ জসিম উদ্দিন, কথাপ্রকাশ, ১ আজিজ সুপার মার্কেট (তৃতীয় তলা), শাহবাগ, ঢাকা-১০০০। – বঙ্গরাষ্ট্র ]
 
অনলাইনঃ ২২ অক্টোবর, ২০০৮

সাম্প্রতিক পোষ্টসমূহ