লিখেছেনঃ এম এ খান, আপডেটঃ July 20, 2012, 4:16 PM, Hits: 2782
সম্প্রতি মুসলিম বণিকদের দ্বারা বিধর্মীদেরকে ইসলামে ধর্মান্তর, বিশেষ করে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় যেটা ঘটেছিল, তা ইসলামে ধর্মান্তরের একটা নতুন দৃষ্টান্তরূপে প্রচারণা পাচ্ছে। দ্য টাইমস অব ইন্ডিয়া-র এক নিবন্ধে অতুল শেঠী দাবী করেন: ‘ভারতে মুসলিম হানাদারদের দ্বারা ইসলাম আনীত হয়েছিল - এটা একটা ভুল ধারণা। এ ভুল ধারণা সংশোধন করতে তিনি লিখেছেন:169
অধিকাংশ ইতিহাসবিদ এখন একমত যে, ভারতে ইসলামের প্রবর্তন আরব বণিকদের মাধ্যমে হয়েছে, মুসলিম হানাদারদের দ্বারা নয় - যা সাধারণত বিশ্বাস করা হয়। আরবরা বাণিজ্যের উদ্দেশ্যে দীর্ঘদিন থেকে দক্ষিণ ভারতের মালাবার উপকূলে আসা-যাওয়া করে আসছিল, আরবে ইসলাম প্রচারেরও অনেক আগে থেকে। এইচ. জি. রাউলিনসন তার এইনসান্ট অ্যান্ড মেডিয়েভল হিস্ট্রি অব ইন্ডিয়া গ্রন্থে লিখেছেন: ‘সপ্তম শতকের শেষাংশে ভারতের উপকূলীয় শহরগুলোতে প্রথম আরব মুসলিমরা বসতি স্থাপন করতে শুরু করে। তারা ভারতীয় নারীদের বিয়ে করে ও সম্মানসূচক আচরণ পায়। তারা তাদের ধর্মবিশ্বাস প্রচারেরও অনুমতি পায়। দিল্লী বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের প্রধান বি. পি. শাহুর মতে, অষ্টম ও নবম শতকের মধ্যে যেখানে যেখানে আরব মুসলিমরা বসতি স্থাপন করেছিল, সেখানেই তারা বিশিষ্ট অবস্থান দখল করতে শুরু করে। বস্তুতঃ এদেশে প্রথম মসজিদটি প্রতিষ্ঠিত হয় এক আরব বণিকের দ্বারা ৬২৯ সালে কোদুনগালুরে, যা এখন কেরালা নামে পরিচিত। কৌতূহলের বিষয় হলো, সেসময় নবী মুহাম্মদ জীবিত ছিলেন ও ভারতের এ মসজিদটি সম্ভবত বিশ্বের প্রথম গুটিকয় মসজিদের একটি। এটা প্রমাণ করে যে, ভারতে ইসলামের উপস্থিতি শুরু হয় মুসলিম হানাদারদের আগমনের অনেক আগেই।
প্রখ্যাত মুসলিম বণিক ও ইতিহাসপঞ্জিকার আল-মাসুদী ৯১৬-১৭ সালে আধুনিক বোম্বাই থেকে পঁচিশ মাইল দক্ষিণে অবস্থিত ‘চউল-এ হাজার হাজার মুসলিমের এক আবাসের বর্ণনা দিয়েছেন, যাদের পূর্বপুরুষরা আরব ও ইরাক থেকে লঙ্কা ও মশলার ব্যবসার জন্য এসেছিলেন। স্থনীয় রাজা এ বসতির লোকদেরকে কিছুটা রাজনৈতিক স্বায়ত্তশাসন প্রদান করেছিলেন। এর সদস্যরা ছিল প্রধানত আরব, যারা চউলে জন্মগ্রহণ করেছে ও স্থানীয় লোকদের সাথে যথেষ্ট পরিমাণে বৈবাহিক সম্পর্ক গড়ে তুলেছিল।’ 170
স্পষ্টতঃই মুসলিম আক্রমণকারীরা ৭১২ সালে সিন্ধুতে বিজয়ের খুঁটি গাড়ার অনেক আগেই মুসলিম বণিকরা ভারতে আগমন করে বসতি স্থাপন করে। এসব উদাহরণের ভিত্তিতে দাবী করা হয় যে, আক্রমণকারী মুসলিম হানাদার ও বীর যোদ্ধারা নয়, বরং বণিকরা ভারতে ও অন্যান্য অনেক স্থানে ইসলামের বিস্তার ঘটিয়েছিল। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া, দক্ষিণ ফিলিপিন ও দক্ষিণ থাইল্যান্ড বণিকদের মাধ্যমে এরূপে ইসলাম বিস্তারের এক অনন্য দৃষ্টান্ত হয়ে দাঁড়িয়েছে। অমুসলিমদের ইসলামে ধর্মান্তরে শক্তি প্রয়োগের অভিযোগ অস্বীকার করতে জাকির নায়েক প্রশ্ন রাখেন:
ইন্দোনেশিয়া একটা দেশ যেখানে বিশ্বের সবচেয়ে বেশী সংখ্যক মুসলিম বাস করে। মালয়েশিয়ার অধিকাংশ মানুষ মুসলিম। প্রশ্ন হলো: ‘কোন্মুসলিম বাহিনী অস্ত্রহাতে ইন্দোনেশিয়া ও মালয়েশিয়ায় গিয়েছিল?’
মুসলিমদের কাছ থেকেই এ প্রশ্নের উত্তর আসে: ‘সে কালের শাসকরা স্বেচ্ছায় আজকের ধর্মের (অর্থাৎ ইসলামের) কাছে সমর্পণ করেছিল সিল্ক রুট ও সমুদ্র পথ দিয়ে আগত আরব মুসলিম বণিকদের মাধ্যমে’ (ব্যক্তিগত যোগাযোগ)। অপরদিকে ড্যানিয়েল পাইপস নায়েকের সাথে সহমত প্রকাশে তার প্রশ্নের জবাব দেন এভাবে: ‘দ্বারুল ইসলাম শান্তিপূর্ণভাবেও বিস্তৃতি লাভ করে রাজাদের স্বেচ্ছায় ধর্মান্তরের মাধ্যমে, যেমন ১৪১০ সালে মালাক্কার শাসনকর্তা পরমেশ্বরের ধর্মান্তর; পরবর্তীতে তার নগরী দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় ইসলামের প্রধান কেন্দ্রে পরিণত হয়।’171 একইভাবে আরব লীগের সেক্রেটারি জেনারেল আব্দুল খালেক হাসৌনা দাবী করেন (১৯৩৮): ‘কোনো যুদ্ধ-বিগ্রহ ছাড়াই ইসলাম চীন, মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া ও ফিলিপিনে বিস্তার লাভ করে।’172
ইন্দোনেশিয়ার ইতিহাসবিদ রাদেন আব্দুলকাদির উইদিয়োতমোদিয়ো ইন্দোনেশিয়ার অমুসলিমদেরকে ইসলামে ধর্মান্তর সম্পর্কে লিখেন:
ইন্দোনেশিয়ায় ধর্মান্তরের গোটা ইতিহাসে কোথাও কোনো বহিরাগত শক্তির অস্তিত্ব নেই। সত্যিকারের ধর্ম বিস্তারে জিহাদ বা পবিত্র ধর্মযুদ্ধই একমাত্র পথ নয়। নিয়ম অনুযায়ী, কেবলমাত্র উপদেশ ও প্রচারণা ব্যর্থ হলে শক্তি প্রয়োগ অনুমোদিত।173
উইদিয়োতমোদিয়ো অন্তত ইসলামে ধর্মান্তরের ক্ষেত্রে ‘ধর্মযুদ্ধের’ মাধ্যমে শক্তি-প্রয়োগ ধর্মীয়ভাবে অনুমোদিত বলে একমত হয়ে সততার পরিচয় দিয়েছেন, কিন্তু তিনি ইন্দোনেশিয়ায় তার প্রয়োগের কোনো আলামত খুঁজে পান নি। এবং তিনি সোজাসুজি স্বীকার করেন যে, বুঝিয়ে-সুঝিয়ে ইন্দোনেশীয় দ্বীপপুঞ্জের বিধর্মীদেরকে ধর্মান্তরের প্রচেষ্টায় বাধা এলে বা তা ব্যর্থ হলে, বল প্রয়োগ হতো বা হতে পারতো।
দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় ইসলাম প্রসারের পূর্বে ত্রয়োদশ থেকে পঞ্চদশ শতাব্দী পর্যন্ত এ অঞ্চলে তিনটি শক্তিশালী রাজ্য ছিল, যেগুলো হলো শ্রীবিজয়া (মালয়েশিয়া), মাজপাহিত (ইন্দোনেশীয় দ্বীপপুঞ্জ) ও সিয়াম বা শ্যাম (থাইল্যান্ড)। জনগণ তখন হিন্দু, বৌদ্ধ ও সর্বপ্রাণবাদের সংমিশ্রণে সৃষ্ট একটি মিশ্র ধর্ম অনুসরণ করতো। ইসলামের তৃতীয় খলীফা ওসমানের (মৃত্যু ৬৫৬) রাজত্বের প্রথম দিকে আরব মুসলিম বণিকরা সমুদ্রপথে চীনের উদ্দেশ্যে যাত্রাকালে ইন্দোনেশিয়ার উপকূলীয় বন্দরে যাত্রাবিরতির মাধ্যমে সর্বপ্রথম এ অঞ্চলের সাথে ইসলামের যোগসূত্র স্থাপন করে।
পরে ৯০৪ সাল থেকে দ্বাদশ শতাব্দীর মধ্যবর্তী সময় পর্যন্ত মুসলিম বণিকরা শ্রীবিজয়ার সুমাত্রা বন্দরের বাণিজ্যকর্মে ক্রমে অধিকতর জড়িত হয়। ভারতে ইসলাম প্রতিষ্ঠিত হবার পর মুসলিম বণিকরা ভারতের গুজরাট, বাংলা ও দক্ষিণ ভারতের উপকূলীয় বন্দর এবং চীন থেকেও অধিক সংখ্যায় আসতে থাকে। এসব মুসলিম বণিক, যারা সর্বদাই ধর্মপ্রচার মিশন সঙ্গে আনত, তারা উপকূলীয় বন্দর-শহরগুলোতে স্থায়ীভাবে বসতিস্থাপন করে, যেমন মালাক্কা ও উত্তর সুমাত্রার (আচেহ, জাভা) সামুদ্রা বা পাসাই। তারা স্থানীয় বিধর্মী নারীদের সাথে বিবাহ বন্ধনের মাধ্যমে মুসলিম সমপ্রদায় গড়ে তুলে। সম্ভবত দশম শতাব্দীর গোড়ার দিকে এ অঞ্চলে মুসলিম বণিক কর্তৃক স্থাপিত মুসলিম বসতি ত্রয়োদশ শতাব্দীর শেষ দিকে উত্তর সুমাত্রায় উল্লেখযোগ্য উপস্থিতি গড়ে তুলে। এ সময়ের মধ্যে তারা দু’টো মুসলিম নগর-রাজ্য প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়: একটা সামুদ্রা বা পাসাই-এ, অপরটি ইন্দোনেশীয় দ্বীপপুঞ্জের পার্লাক-এ। ১৩৪৫-৪৬ সালে ইবনে বতুতা সামুদ্রা মুসলিম নগর-রাজ্যটি সফর করেন।
তখন পর্যন্ত এ অঞ্চলের অবিশ্বাসীরা উল্লেখযোগ্য সংখ্যায় ইসলামে ধর্মান্তরিত হয়নি বলে মনে হয়। মুসলিমরা স্থানীয় সহনশীল ও উদার সংস্কৃতির সুযোগ নিয়ে স্থানীয় নারীদেরকে বিবাহের মাধ্যমে তাদের সন্তান্তসন্ততিদের দ্বারা ধীরে ধীরে মুসলিম সমপ্রদায় গড়ে তুলে। তারা তিন থেকে চার শতাব্দীর মধ্যে সামুদ্রা ও পার্লাকে দু’টো নগর-রাজ্য গড়ে তোলার মতো মুসলিম জনসংখ্যা অর্জনে সক্ষম হয়। এবং শীঘ্রই তারা আশপাশের বিধর্মীদের বিরুদ্ধে নিষ্ঠুর জিহাদে ঝাঁপিয়ে পড়ে। সামুদ্রা সুলতানাত সফরের পর ইবনে বতুতা উল্লেখ করেন: ‘শাসক সুলতান আল-মালিক আজ-জাহির ছিলেন সুখ্যাত ও মুক্তহস্ত শাসক।’ তার কারণ:
তিনি অবিরাম ধর্মের জন্য যুদ্ধে (অবিশ্বাসীদের বিরুদ্ধে জিহাদে) ও যুদ্ধাভিযানে লিপ্ত ছিলেন। তার প্রজারাও নিজেদের ধর্ম বিশ্বাসের জন্য যুদ্ধ করতে আনন্দ পেত ও স্বেচ্ছায় যুদ্ধাভিযানে তার সঙ্গী হতো। মুসলিমরা সে অঞ্চলের সমস্ত অবিশ্বাসীদের উপর কর্তৃত্বকারী অবস্থানে ছিল, যাদেরকে (মুসলিমদেরকে) ভূমিকর দিয়ে শান্তির নিশ্চয়তা কিনতে হতো।174
রাজা পরমেশ্বরের ধর্মান্তর: তথাপি চতুর্দশ শতাব্দীর শেষ পর্যন্ত এ অঞ্চলের অবিশ্বাসীদেরকে ধর্মান্তরিত করতে ইসলাম খুব সামান্যই সফলকাম ছিল এবং তাদের উপস্থিতি মাত্র কয়েকটি বিচ্ছিন্ন ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র কোণে সীমাবদ্ধ ছিল। কিন্তু এর নাটকীয় পরিবর্তন ঘটে প্রতারণার মাধ্যমে শ্রীবিজয়ার রাজা পরমেশ্বরের ধর্মান্তরিত হওয়ার সাথে সাথে। পরমেশ্বর পালেমবাং থেকে শাসনকার্য পরিচালনা করতেন। এ সময় শ্রীবিজয়া রাজ্যের পতন ঘটছিল এবং মাজ্পাহিত শাসকরা তাদের প্রভু হয়ে উঠছিল। মাজ্পাহিত শাসকের সাথে এক কলহের কারণে তিনি তাঁর রাজধানী পালেমবাং থেকে কিছুটা নিরাপদ তেমাসেক দ্বীপে (সিঙ্গাপুর) স্থানান্তর করতে বাধ্য হন। মাজ্পাহিত বাহিনীর সাথে এক হাতাহাতি যুদ্ধে তিনি মাজ্পাহিতের মিত্র শ্যামের যুবরাজ তেমাগিকে হত্যা করেন। এতে শ্যামের ক্রুদ্ধ রাজা মিত্র মাজ্পাহিতের সঙ্গে যৌথশক্তিতে পরমেশ্বরকে বন্দী ও হত্যার উদ্দেশ্যে একের পর এক শ্রীবিজয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে। পরমেশ্বর পিছুপদ হয়ে তেমাসেক দ্বীপ থেকে পালিয়ে যান - প্রথমে মুয়ারে, পরে মালাক্কায়, এবং ১৪০২ সালে মালাক্কাকে রাজধানী করেন তিনি।
এ সময় বন্দর-নগরী মালাক্কায় দীর্ঘদিন আগে বসতি স্থাপনকারী মুসলিমরা উল্লেখযোগ্য উপস্থিতি গড়ে তুলেছিল। প্রধানত ব্যবসায়ী পেশায় নিয়োজিত হওয়ায় তারা ভারতের সাথে মালাক্কার প্রসারিত বাণিজ্যে ছিল গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকায়। সুতরাং পরমেশ্বরের রাজদরবারে তারা স্বাগত পেত এবং সেখানে তাদের উপস্থিতি ক্রমশঃ বর্ধিত করে তারা পরমেশ্বরের রাজনৈতিক ভাগ্য নির্ধারণে প্রভাব বাড়িয়ে তুলে। মুসলিমরা তার সেনাবাহিনীতে ঢুকে পড়তে থাকে এবং তিনি শ্যাম ও মাজ্পাহিত শাসকদের আক্রমণ প্রতিহত করতে ক্রমশ তাদের উপর অধিকতর নির্ভরশীল হয়ে পড়েন। ঠিক এ সময়ে পরমেশ্বরের মুসলিম উপদেষ্টারা তাকে প্রস্তাব দেয় যে, তিনি ইসলাম গ্রহণ করলে তার পক্ষে যুদ্ধ করার জন্য আরো আরব মুসলিম যোদ্ধা পাঠানো হবে। পরমেশ্বর এ প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেন। এরপর কয়েক বছর ধরে তার প্রতিজ্ঞাবদ্ধ শত্রুর বিরুদ্ধে চলমান যুদ্ধে অবস্থান ক্রমশ দুর্বল ও বিপজ্জনক হতে থাকে।
ঠিক এ সন্ধিক্ষণে আরব বণিকরা তাকে পাসাই থেকে মিশ্ররক্তের এক সুন্দরী তন্বীকে উপহার দেয়, যার পিতা ছিল আরব ও মাতা ইন্দোনেশীয় বংশোদ্ভূত। পরমেশ্বর এ অনন্য সুন্দরী দাস-কন্যার প্রেমে পড়ে যান ও তার হারেমে সে গর্ভবতী হয়। নিঃসন্তান পরমেশ্বর দীর্ঘদিন থেকেই তার রাজ্যের জন্য এক উত্তরসূরীর আকাঙ্ক্ষা করছিলেন। তিনি গর্ভবতী দাস-বালিকাকে তার সন্তানের বৈধতা প্রদানের উদ্দেশ্যে বিয়ের প্রস্তাব দিলে, বিয়ের আগে সে পরমেশ্বরকে অবশ্যই ইসলাম গ্রহণের দাবী করে বসে। উত্তরোত্তর দুর্বল ও বিপজ্জনক অবস্থার মধ্যে মুসলিম সেনাদের থেকে অধিক সাহায্যের জরুরী প্রয়োজন ও এর সাথে উত্তরসূরীর আকাঙ্ক্ষা - এ দু’টো কারণে পরমেশ্বর শেষ পর্যন্ত ধর্মান্তরে সম্মত হন। তিনি ইসলামে ধর্মান্তরিত হয়ে গর্ভবতী দাস-বালিকাটিকে বৈধ রাণী করে প্রাসাদে নিয়ে আসেন।
মালাক্কা সুলতানাত ও জিহাদের তীব্রতা বৃদ্ধি: ১৪১০ সালে ইসলাম ধর্ম গ্রহণের পর পরমেশ্বর হিন্দু রাজ্য শ্রীবিজয়াকে একটি মুসলিম সুলতানাত অর্থাৎ মালাক্কা সুলতানাতে পরিণত করেন এবং নিজে সুলতান ইস্কান্দার শাহ নাম ধারণ করেন। ধর্মান্তরের পর তার অর্ধ-মুসলিম রাণী এবং মুসলিম যোদ্ধা ও উপদেষ্টারা তাকে এক কট্টর মুসলিম শাসক বানিয়ে তুলে। চীন সম্রাট ইউং লো’র এক কূটনীতিকের সেক্রেটারী ড্রাগোম্যান হিসেবে আগত মা হুয়ান নামক এক চীনা মুসলিম ১৪১৪ সালে সুলতান ইস্কান্দার শাহের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। তিনি সুলতানকে ইতিমধ্যেই এক ‘কঠোর ধর্মবিশ্বাসীরূপে’ দেখতে পান।175
ইবনে বতুতার তথ্য অনুযায়ী, চতুর্দশ শতকের গোড়ার দিকে মুসলিমরা সামুদ্রায় কিছুটা শক্তিশালী হয়ে উঠার সাথে সাথে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় বিধর্মীদের বিরুদ্ধে ছোট ছোট সহিংস জিহাদ শুরু করে দিয়েছিল। মালাক্কা সুলতানাত প্রতিষ্ঠার পর জিহাদ তীব্রতর হয় বৃহত্তর গৌরব অর্জনের লক্ষ্যে। মালাক্কা সুলতানাত ইসলামের পরিধি সম্প্রসারণের জন্য প্রতিবেশী রাজ্যগুলোর বিরুদ্ধে বড় আকারের জিহাদ অভিযানের কেন্দ্র হয়ে উঠে। গাজী কিংবা শহীদ হওয়ার জন্য আল্লাহর পথে জিহাদের ইসলামী জোশে অনুপ্রাণিত এখনকার মুসলিম বাহিনী নাটকীয়ভাবে তার ভাগ্যে পরিবর্তন আনে বিপজ্জনকভাবে দুর্বল অবস্থান থেকে। প্রায় ধ্বংসের দ্বার প্রান্তে চলে আসা ইস্কান্দার শাহ (তথা পরমেশ্বর) ও তার বংশধররা দ্রুত প্রতিবেশী রাজ্যগুলোর উপর রাজনৈতিক কর্তৃত্বের শক্তি অর্জন করে। সুলতানাতটি বিস্তৃত হতে থাকে: সর্বোচ্চ সম্প্রসারণকালে তা পরিবেষ্টিত ছিলো আজকের মালয়েশিয়া উপদ্বীপ, সিঙ্গাপুর এবং পূর্ব সুমাত্রা ও বোর্ণিওর বৃহত্তর অঞ্চল পর্যন্ত। পরে বোর্ণিও আরেকটি স্বাধীন সুলতানাত হিসেবে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। দীর্ঘ দিন ধরে মালাক্কা দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ায় ইসলামের প্রাণকেন্দ্ররূপে গণ্য ছিল, যার সঙ্গে যুক্ত ছিল মালয়েশিয়া, আচেহ্, রিয়াউ, পালেমবাং ও সুলাওয়েসি।
পঞ্চদশ শতাব্দীর মধ্যে মালাক্কা সুলতানাত প্রতিবেশী রাজ্যগুলোর বিরুদ্ধে জিহাদে লিপ্ত হয়ে শক্তিশালী মাজ্পাহিত রাজ্যকে ধ্বংসের মুখে পতিত করে ও শ্যাম রাজ্যকে দুর্বল করে তুলে। ১৫২৬ সালে মুসলিম যোদ্ধারা যখন জাভা অধিকার করে, তখন মাজ্পাহিত সাম্রাজ্যের অস্তিত্ব বিলুপ্ত হয়। মালাক্কা সুলতানাত তখনো পর্যন্ত টিকে থাকা থাই রাজ্যের সাথে প্রতিদ্বন্দ্বিতা অব্যাহত রেখে তার দক্ষিণাংশ থেকে কিছু ভূখণ্ড দখল করে নেয়। পঞ্চদশ শতাব্দীর শেষ ও ষোড়শ শতাব্দীর শুরুর দিকে মুসলিম আক্রমণকারীরা ঝড়ের বেগে থাই রাজধানী আয়ূথায়া আক্রমণ করে। কিছু সময়ের জন্য পরিস্থিতি এমন হয়ে উঠে যে, মুসলিম ধর্মযোদ্ধারা যেন সিয়াম অধিকার করে নিবে।
ঠিক এ বিপজ্জনক সন্ধিক্ষণে মালাক্কা প্রণালীর নৌপথ বরাবর কাকতালীয়ভাবে এক পর্তুগীজ বাণিজ্যবহর এসে নোঙ্গর করলে পর্তুগীজ ও মালাক্কা সুলতানের মধ্যে মারাত্মক দ্বন্দ্ব শুরু হয়, যা বিপন্ন ও অবরুদ্ধ সিয়ামের জন্য এক আশীর্বাদ হয়ে উঠে। ১৫০৯ সালে লোপেজ ডা সেকুরার নেতৃত্বে পর্তুগীজ নৌবহর মালাক্কা প্রণালীতে পৌঁছে। তৎকালীন মালাক্কার শাসক সুলতান মাহমুদ শাহ সম্প্রতি ভারতে ঘটিত মুসলিম-পর্তুগীজ দ্বন্দ্বের সূত্রে পর্তুগীজ বহরটিকে আক্রমণ করে তাড়িয়ে দেয়। ১৫১১ সালে ভাইসরয় আলফোন্সো ডা’আলবুকার্ক-এর নেতৃত্বে ভারতের কোচিন থেকে আরেকটি পর্তুগীজ বহর মালাক্কায় এলে পুনরায় দ্বন্দ্ব শুরু হয়। চল্লিশ দিন যুদ্ধের পর ২৪ আগস্ট পর্তুগীজ বাহিনীর হাতে মালাক্কার পতন ঘটে এবং সুলতান মাহমুদ শাহ মালাক্কা থেকে পালিয়ে যান। পরবর্তী বছর ও দশকগুলোতে পর্তুগীজ ও মুসলিম বাহিনীর মধ্যে রক্তক্ষয়ী লড়াই চলতে থাকে। পর্তুগীজদের দ্বারা মালাক্কা সুলতানাতের এ বিহ্বলতা ও পরিণামে অবলুপ্তি সিয়াম রাজ্যকে মুসলিম শাসকদের হাতে ধ্বংস হওয়া থেকে রক্ষা করে। সপ্তদশ শতকে শ্যামের শাসকরা সমুদ্র ভ্রমণকারী পর্তুগীজ ও ডাচ (হল্যান্ড) শক্তির সাথে মিত্রতা স্থাপন করলে তারা মুসলিম আক্রমণের হুমকী প্রতিরোধে সফলকাম হয়। অষ্টাদশ শতাব্দীতে সিয়াম তার হারানো ভূখণ্ড ফিরে পেতে প্রতিআক্রমণ চালায়। তারা পতনোন্মুখ মুসলিম সুলতানাত পাট্টানি অধিকার করে শ্যাম রাজ্যের সঙ্গে যুক্ত করে।
ফিলিপিনে ইসলামের বিস্তার: ফিলিপিনের মুসলিম অধ্যুষিত অঞ্চল মিন্দানাও ও সুলু হলো আরেকটি দৃষ্টান্ত যেখানে বণিকদের দ্বারা শান্তিপূর্ণ উপায়ে ইসলামের প্রসার ঘটেছিল বলে মুসলিম ও অনেক পণ্ডিতরা দাবী করেন। মুসলিমরা প্রশ্ন তোলেন: কোন্মুসলিম বাহিনী তলোয়ার দ্বারা ইসলাম বিস্তারের জন্য ফিলিপিনে গিয়েছিল? তারা দাবী করেন: ভারত ও মালয় উপদ্বীপ থেকে আগত সূফী ও মুসলিম বণিকরাই শান্তিপূর্ণ মিশনারী কার্যক্রমের মাধ্যমে সেখানে ইসলামের বিস্তার ঘটায়।
জানা যায়, ১৩৮০ খ্রীষ্টাব্দে ভারত থেকে আগত আরব বণিক মাখদুম করিমের মাধ্যমে দক্ষিণ ফিলিপিনের সুলু দ্বীপপুঞ্জে প্রথম ইসলাম আনীত হয়। তিনি সেখানে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করে একটি মসজিদ প্রতিষ্ঠা করেন, যা ঐ অঞ্চলের সবচেয়ে প্রাচীন মসজিদ। কিন্তু মালয় উপদ্বীপ ও ইন্দোনেশীয় দ্বীপপুঞ্জে মালাক্কা সুলতানাতের রাজনৈতিক উত্থান না হওয়া পর্যন্ত ফিলিপিনের সর্বপ্রাণবাদী বিধর্মীরা ব্যাপকহারে ইসলামে দীক্ষিত হয়নি। মালয়েশিয়ার জোহর’এ জন্মগ্রহণকারী এক আরব যোদ্ধা শরীফুল হাশেম সৈয়দ আবু বকর এক বাহিনী নিয়ে ১৪৫০ সালে বোর্ণিও থেকে পাল তুলে সুলু দ্বীপে আসেন ও সুলু সুলতানাত প্রতিষ্ঠা করেন। এরপর ইসলামী রাজনৈতিক শক্তিবলে সেখানকার সর্বপ্রাণবাদীদেরকে ইসলামে ধর্মান্তর অতিশয় সাগ্রহে শুরু হয়ে যায়। পঞ্চদশ শতাব্দীর শেষ দিকে বোর্ণিও সুলতানাতের পৃষ্ঠপোষকতায় সুলু থেকে অগ্রসরমান জিহাদ ভিসিয়াস (মধ্য ফিলিপিন)-এর প্রায় সবটুকু, লুজন (উত্তর ফিলিপিন)-এর অর্ধাংশ ও দক্ষিণের মিন্দানাও দ্বীপসমূহ মুসলিম নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসে। অবিরাম বিধর্মী ভূখণ্ডে প্রবেশ করে মুসলিম জিহাদীরা আতঙ্কিত সর্বপ্রাণবাদী জনগণের মধ্যে ইসলামের বিস্তার তীব্রতর করে। মুসলিম ধর্মযোদ্ধাদের পথ ধরে ১৫৬৫ সালের মধ্যে ইসলাম সুলু থেকে মিন্দানাও পর্যন্ত বিস্তৃত হয়ে ম্যানিলা পৌঁছে যায়।
স্থানীয় ফিলিপিনোরা ছোট ছোট বারাঙ্গীতে (গ্রাম বা উপজাতীয় সম্প্রদায় ভিত্তিক দল) সংগঠিত হয়ে সুসংগঠিত মুসলিম হানাদারদের বিরুদ্ধে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র দুর্বল প্রতিরোধ গড়ে তোলার চেষ্টা করে। ১৫২১ খ্রীষ্টাব্দে স্পেনীয় উপনিবেশীরা ফিলিপিনের সেবু দ্বীপে এসে পৌঁছে। সেখান থেকে তারা ধীরে ধীরে ফিলিপিনের উপর তাদের নিয়ন্ত্রণ সম্প্রসারণ করলে অবশেষে ইসলামের বিস্তার থেমে যায়। স্পেনীয়রা যখন মুসলিম-নিয়ন্ত্রিত দক্ষিণ ফিলিপিনো দ্বীপগুলোর উপর তাদের রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণ সম্প্রসারণে ব্রতী হয়, তখন মুসলিম যোদ্ধাদের হুমকি ও নিষ্ঠুরতার শিকার সর্বপ্রাণবাদী জনগণ এ নতুন সাম্রাজ্যবাদীদের বিরুদ্ধে তেমন কোনো প্রতিরোধ গড়ে তুলে নি। কিন্তু মুসলিম-অধ্যুষিত দ্বীপগুলোতে স্পেনীয়রা প্রচণ্ড ও সুদীর্ঘ প্রতিরোধের মুখে পড়ে।176 স্থানীয় শক্তিগুলো স্পেনীয়দের সাথে মিত্রতা করে মুসলিম অধ্যুষিত দ্বীপগুলো কব্জা করার চেষ্টা করে, কিন্তু ব্যর্থ হয়।
যাহোক, স্পেনীয় দখলদাররা কিছু কিছু এলাকা থেকে প্রতিদ্বন্দ্বী মুসলিম দখলকারীদেরকে পিছনে হটে যেতে বাধ্য করে এবং ইসলামের আরো ভূখণ্ড দখল ও বিস্তার রুদ্ধ করে দেয়। পুরোপুরি ইসলামী করণকৃত মিন্দানাও ও সুলু দ্বীপপুঞ্জ মুসলিম নিয়ন্ত্রণে থেকে যায় এবং আজও তা ইসলামী রয়ে গেছে।
দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় ধর্মান্তর পদ্ধতি
এটা বিতর্কাতীত যে, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় মুসলিমরা প্রথমে বণিকরূপে এসে বন্দর নগরীগুলোতে স্থানীয় জনগণের পাশে বসতি গড়ে তোলে। স্থানীয় সহনশীল ও উদার সংস্কৃতির সুযোগ নিয়ে তারা বাধাহীনভাবে সেখানকার অবিশ্বাসী নারীদেরকে বিয়ে করে। তাদের এ মিশ্র-বিয়ের জাতকরা হয় মুসলিম। এরূপ মিশ্র-বিয়েতে এমনকি ক্ষমতাধর রাজা পরমেশ্বরও তার নিজের ধর্ম ধরে রাখতে পারেন নি, যদিও তার তন্বী উপপত্নী ছিল অর্ধ-মুসলিম, অর্ধ-ইন্দোনেশীয়। দশম শতাব্দীর গোড়ার দিকে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় প্রধানত পুরুষ মুসলিম বণিকরা এসে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করার পর মূলত মিশ্র-বিয়ের মাধ্যমে সন্তানের জন্মই মুসলিম জনসংখ্যা বৃদ্ধির প্রধান উৎস ছিল বলে মনে হয়। সে সময় কিছু চাকর-বাকর বা কর্মচারী, যাদেরকে মুসলিম বণিকরা নিজস্ব ব্যবসার কাজে নিয়োজিত করত, তাদের কেউ কেউ ইসলামে ধর্মান্তরিত হয়ে থাকতে পারে, কেননা বিধর্মীদের প্রতি মুসলিমদের তীব্র ঘৃণা বা বিরূপ মনোভাবের প্রেক্ষিতে এ ধর্মান্তর দু’পক্ষের মধ্যে সুসম্পর্ক গড়ে তুলতে সহায়ক ছিল। অধিকন্তু ইসলামে এক পুরুষের চার-চারটি স্ত্রী, তাদের সাময়িক বিবাহবন্ধনে (মুতা বিবাহ)177 আবদ্ধ হওয়া ও অসংখ্য উপপত্নী (যৌনদাসী) রাখার ধর্মীয় অনুমোদনও মুসলিম জনসংখ্যার দ্রুত বৃদ্ধিতে অবশ্যই সহায়ক হয়েছিল।
দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় মুসলিম বসতির প্রাথমিক পর্যায়ে ইসলামের তথাকথিত উচ্চমানের বার্তার কারণে খুব বেশী মানুষ ধর্মান্তরিত হয়নি। মুসলিমদের স্থায়ী বসবাস শুরুর প্রায় চারশ বছর পর ১২৯০-র দশকে উত্তর সুমাত্রায় মাত্র দু’টো ছোট মুসলিম নগর-রাজ্য প্রতিষ্ঠা লাভ করেছিল। রাজা পরমেশ্বর ধর্মান্তরিত হয়ে মালাক্কায় একটি ইসলামীক সুলতানাত প্রতিষ্ঠার পর ইসলাম ক্ষিপ্রগতিতে বিস্তার লাভ করে মালয় উপদ্বীপ, ইন্দোনেশীয় দ্বীপপুঞ্জ, ফিলিপিন ও দক্ষিণ থাইল্যান্ড বিজয়ের মাধ্যমে। মালাক্কা সুলতানাত পর্তুগীজদের আগমনের পূর্বে মাত্র এক শতাব্দীর কিছুটা বেশী সময় মুসলিমদের নিয়ন্ত্রণে ছিল। আর এ স্বল্প সময়ের মধ্যেই বিজিত জনগণের বিপুল অংশ মুসলিম হয়ে গিয়েছিল।
দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার অন্যথায় প্রতিরোধী বিধর্মীরা মুসলিম রাজনৈতিক শক্তি প্রতিষ্ঠার পর দ্রুত ধর্মান্তরিত হয় কী কারণে?
রিচার্ড ইটন ও অ্যন্টনি জন্সসহ অনেক ইতিহাসবিদের মতে, এবার আসে প্রধানত ভারত থেকে আগত সূফীদের শান্তিপূর্ণভাবে বুঝিয়ে-সুঝিয়ে তখন্ত পর্যন্ত-প্রতিরোধী অবিশ্বাসীদের মাঝে দ্রুত ইসলাম প্রচারের পালা। কিন্তু ইটনের বিবৃতিতেও কোনো সুস্পষ্ট সাক্ষ্য-প্রমাণ নেই যাতে বলা যেতে পারে যে, সূফীরাই অবিশ্বাসীদেরকে ইসলামে ধর্মান্তর করে। কিংবা ধর্মান্তরে তারা কী পন্থা ব্যবহার করেছিল তারও কোন ইঙ্গিত নেই। ইটনের মতে, সেখানে কেবলমাত্র ‘অতি প্রভাবশালী জাভানি সূফী (কিয়ায়ি)’-দের সম্পর্কে ‘কাল্পনিক রূপকথার’ মত কিছু বিচ্ছিন্ন লেখার খোঁজ পাওয়া যায়।178 এরূপ বাস্তবতা-বিবর্জিত ও প্রমাণহীন কাহিনীর ভিত্তিতে এসব বিজ্ঞ পণ্ডিতরা তরিৎ দাবী করে বসেন যে, সেথায় ধর্মান্তর ছিল শান্তিপূর্ণ প্রকৃতির, যার কৃতিত্ব সূফীদের প্রাপ্য। এক অতিশয় আগ্রহপূর্ণ দাবীতে সৈয়দ নাগুইব আল-আত্তাস লিখেন: ‘আমি বিশ্বাস করতে চাই যে, প্রকৃতপক্ষে সূফীরাই ইসলামের বিস্তার ঘটান ও জনগণের মাঝে ইসলামকে সুপ্রতিষ্ঠিত করতে সক্ষম হন। মালয়ের ক্ষেত্রে আমি প্রায় নিশ্চিত যে, ইসলাম সূফীদের দ্বারাই বিস্তৃত হয়।’ তার এ দাবী আদৌ কোন প্রমাণের উপর ভিত্তিশীল নয়, যা স্বীকার করে তিনি দ্রুত যোগ করেন: ‘এই মতবাদের সমর্থনে যদিও কোনো প্রত্যক্ষ প্রমাণ নেই।’179
ভারতে এ ধরণের সূফী রূপকথা বা কাল্পনিক গল্প যত্রতত্র ছড়িয়ে রয়েছে, যার প্রায় সবই সম্ভবত বানানো গল্প। আগেই বর্ণিত হয়েছে যে, ভারতের বিধর্মীদেরকে শান্তিপূর্ণ উপায়ে ধর্মান্তরে সূফীরা কতটা অসফল ছিল; এবং কাশ্মীরে যখন তারা সফল হয়, তা কতটা ভয়ঙ্কর ছিল। উইদিয়োতমোদিয়োর মতে, ইবনে বতুতা সামুদ্রা সুলতানাতের মুসলিম শাসককে তার ঐকান্তিক আগ্রহ নিয়ে ধর্ম পালন করতে দেখতে পান। সেই শাসক ছিলেন ইমাম শাফীর ‘মাযহাব’ বা তরিকার ভক্ত।180
দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার মুসলিমরা শা’ফী আইন গ্রহণ করেছিল। এ আইন শাস্ত্রে ধর্মান্তর বা মৃত্যুর যে কোন একটি বেছে নেওয়ার রায় পৌত্তলিকদের জন্য, যে শ্রেণীর অন্তর্ভুক্ত ছিল ইসলাম-পূর্ব দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় বসবাসকারী হিন্দু, বৌদ্ধ ও সর্বপ্রাণবাদীরা। ইবনে বতুতার বর্ণনায় দেখা যায়, সামুদ্রার মত ক্ষুদ্র নগর-রাজ্যে মুসলিমরা রাজনৈতিক ক্ষমতা অর্জনের সাথে সাথে আশপাশের বিধর্মীদের বিরুদ্ধে নিষ্ঠুর ও নির্মম জিহাদ শুরু করে দেয়।
পরমেশ্বরের ইসলামে ধর্মান্তরিত হওয়ার ঠিক চার বছর পর চীনা মুসলিম মা হুয়ান তাকে ‘একজন অত্যন্ত কট্টর ধর্মবিশ্বাসী’ রূপে দেখতে পান। তার অর্থ: ইতিমধ্যে তিনি তার সুলতানাতে শাফি আইন কঠোরতার সাথে প্রয়োগ করছিলেন। এ থেকে ধারণা পাওয়া যেতে পারে যে, সুলতান ইস্কান্দার ও তার পরবর্তী বংশধর শাসকরা অমুসলিম প্রজাদের উপর কিরূপ নীতি প্রয়োগ করেছিল। অনেক বেশী শক্তিশালী মালাক্কা সুলতানাত বিধর্মীদের উপর অধিকতর ভয়ঙ্কর ও মারাত্মক শক্তি ও নিষ্ঠুরতা প্রয়োগ না করলেও সামুদ্রার মতো ক্ষুদ্র সুলতানাতের পার্শ্ববর্তী বিধর্মীদের উপর নিষ্ঠুরতার দৃষ্টান্ত মালাক্কা সুলতানাতের জন্য অনুকরণীয় মডেল বা আদর্শ হিসেবে কাজ করে থাকতে পারে।
পঞ্চদশ শতাব্দীর গোড়ার দিকে কীভাবে মুসলিম শাসিত মালয় উপদ্বীপ ও ইন্দোনেশীয় দ্বীপপুঞ্জে ইসলাম বিস্তার লাভ করে তার কিছুটা ধারণা পাওয়া যেতে পারে তৎকালে গুজরাটে ঘটিত পাশাপাশি ধর্মান্তর থেকে, যার সঙ্গে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার মুসলিম সুলতানাতের ছিল ঘনিষ্ঠ বাণিজ্যিক যোগাযোগ। গুজরাট ছিল সে সময়ে মালয় ও ইন্দোনেশীয় দ্বীপপুঞ্জে আগত মুসলিম বণিক ও সূফীদের এক উল্লেখযোগ্য উৎসস্থল। তখন ভারতের, বিশেষ করে গুজরাটের, সূফীরা ধর্মান্তরে যে ভূমিকা পালন করছিলেন, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় সুলতানাতের সূফীদের অনুসরণের জন্য সম্ভবত তা মডেল হিসেবে কাজ করেছে। বাণিজ্যের মাধ্যমে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বন্দর-নগরীগুলোর সাথে তখন দক্ষিণ ভারতের উপকূলীর অঞ্চলের সূফীদেরও একই ধরনের কিংবা অধিককতর ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ ছিল। বাস্তবতঃ দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া যেহেতু দক্ষিণ-ভারতের মতো একই শাফী আইন অনুসরণ করে, সুতরাং সেকালের দক্ষিণ ভারতের সূফী কর্তৃক বিধর্মীদেরকে ধর্মান্তরের পদ্ধতি খুব সম্ভব মালয় ও ইন্দোনেশীয় সূফীদের ধর্মান্তরে মডেল হিসেবে কাজ করেছে। ইতিপূর্বে উল্লিখিত হয়েছে, কীভাবে হিন্দুদের বিরুদ্ধে জিহাদ করার জন্য ভারতের উপকূলীয় শহর মা’বার থেকে পীর মা’বারি বিজাপুরে এসেছিলেন এবং কীভাবে তিনি এ অঞ্চলকে ইসলামীকরণে বিধর্মীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ও ব্রাহ্মণদেরকে পৈতৃক ভিটামাটি বা মাতৃভূমি থেকে নির্বাসিত করেছিলেন।
ভারতের তুলনায় দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় মুসলিম শাসক, সূফী ও উলেমাদের বিধর্মীদের প্রতি অসহিষ্ণুতা সম্ভবত সর্বক্ষেত্রে অধিক মাত্রার ছিল (সম্ভবত দক্ষিণ ভারত বাদে)। কারণ এ অঞ্চলে প্রচলিত শা’ফী আইন বহুঈশ্বরবাদীদের জন্য মৃত্যু কিংবা ধর্মান্তরের রায় দেয়; অপরদিকে ভারতে অধিকতর সহনশীল হানাফী আইনের চর্চা তাদেরকে অধিক সুবিধাপ্রাপ্ত ‘জিম্মি’ প্রজার মর্যাদা দেয়। প্রকৃতপক্ষে মুসলিম বিজিত ভূখণ্ডে বিধর্মীদের প্রতি আচরণে শা’ফী আইন অত্যন্ত কঠোর ও নির্মম। কুরআনের ৯:২ নং আয়াত - ‘সমগ্র দেশে তোমরা চার মাস খুশীমতো সামনে বা পিছনে যেতে পার, কিন্তু জেনে রেখো, (মিথ্যাচার দিয়ে) তোমরা আল্লাহকে প্রতারিত করতে পারবে না। যারা তাঁকে প্রত্যাখ্যান করে আল্লাহ তাদেরকে লজ্জায় ঢেকে দেবে’ - এর ভিত্তিতে শা’ফী (হাম্বালিও) আইন অবিশ্বাসীদেরকে ধর্মান্তরের জন্য ঠিক চার মাস সময় দেয়; অন্যান্য মাযহাব সময় দেয় এক বছর পর্যন্ত।181 আর হানাফী মাযহাম পৌত্তলিকদেরকে সে বাধ্যকতা থেকে পুরোপুরি রেহাই দিয়েছে। রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় আসার পর মুসলিমরা দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় অন্যথায় ইসলাম বিমুখী বা প্রতিরোধী বিধর্মীদের ইসলামে ধর্মান্তর ভারতের তুলনায় অনেক কম সময়ে অথচ অনেক বেশী সম্পূর্ণরূপে সাধিত করেছিল। ১৫১১ সালে পর্তুগীজরা এসে মালাক্কা সুলতানাত বিলুপ্ত করার আগে তা টিকে ছিল মাত্র এক শতাব্দী কাল। এসব দৃষ্টান্ত ঈঙ্গিত করে যে, এ অঞ্চলের হিন্দু-বৌদ্ধ-সর্বপ্রাণবাদী বিধর্মীদেরকে ইসলামে ধর্মান্তর করতে অধিকতর জোরজবরদস্তি প্রয়োগ করা হয়েছিল।
ইটন লিখেছেন, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার ‘অত্যন্ত প্রভাবশালী সূফীরা কোনো কোনো ক্ষেত্রে সুলতানকে ক্ষমতায় বসতে সহযোগিতা করতে, আবার কখনো গ্রাম্য জনগণের সঙ্গে যুক্ত হয়ে তাদের প্রভাব খাটিয়ে সুলতানের ক্ষমতা ক্ষুণ্ন করতে দেখা যায়।’182 এসব দৃষ্টান্তই ড. ইটনের এ সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়ার জন্য যথেষ্ট যে, ঐসব জনপ্রিয় বিপ্লবী বীর সূফীরা একটা অলৌকিক, আধ্যাত্মিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক আন্দোলনে উদ্যোগী হয়ে ‘হিন্দু-বৌদ্ধ ও স্থানীয় জাভানীজ ধারণার’ সমন্বয়ে একটা মিশ্র ইসলাম সৃষ্টি করে, যা ‘হিন্দু জাভা’কে ‘মুসলিম জাভা’য় রূপান্তরিত করে - এবং অবশ্যই তা ঘটে এক মানবিক ও শাক্তিপূর্ণ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে।
ইটন উপেক্ষা করেছেন বা লক্ষ্য করেন নি যে, শুধুমাত্র জাভা নয়, সূফীরা একই রকম রাজনৈতিক আন্দোলনে লিপ্ত হয়েছেন সর্বত্রই। কখনো তারা অবিশ্বাসীদেরকে নির্যাতন্তনিপীড়ন করতে শাসকদের সাথে হাত মিলিয়েছেন; আবার কখনো তারা মুসলিম জনতার সাথে যুক্ত হয়ে মুসলিম শাসকদের বিরুদ্ধে উঠে পড়ে লেগেছেন, বিশেষত যেসব মুসলিম শাসক অমুসলিমদের প্রতি সহনশীল ছিল, তাদের বিরুদ্ধে। বার্নার্ড লুইস লিখেছেন: মুসলিম শাসকরা ‘সূফী দরবেশদের ভয়ঙ্কর রুদ্ধ শক্তিকে ভয় পেত, যা তারা খেয়াল-খুশী মত নিয়ন্ত্রণ বা ছেড়ে দিতে পারত। সেল্জুক ও অটোমান সুলতানদের আমলে দরবেশ বিদ্রোহ হয়েছিল, যা তখনকার প্রতিষ্ঠিত রাষ্ট্রযন্ত্র বা কাঠামোর প্রতি প্রচণ্ড হুমকী হয়ে দাঁড়িয়েছিল।’183
আগেই উল্লেখ করা হয়েছে যে, সূফীবাদের বিকাশ ঘটেছিল আব্বাসীয় শাসকদের পথবিচ্যুতির বিরুদ্ধে একটা প্রতিক্রিয়ারূপে। কারণ তারা অনৈসলামিক পারস্য সংস্কৃতির পৃষ্ঠপোষকতা ও ইসলামের লঙ্ঘনে নৈতিক শিথিলতা প্রদর্শন করছিলেন। কাশ্মীর ও গুজরাটে সূফীরা হিন্দুদের উপর নির্যাতন চালানোর জন্য শাসকদের সাথে যোগ দেন। সূফী সাধক সাইয়িদ আলী হামদানী ইসলামের নীতি অনুযায়ী হিন্দুদের উপর নির্যাতনে কাশ্মীরের সুলতানকে প্ররোচিত করতে ব্যর্থ হলে প্রতিবাদে কাশ্মীর ত্যাগ করেন। অমুসলিমদের প্রতি সম্রাট আকবরের সহনশীল নীতির বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করতে তৎকালীন শ্রেষ্ঠ সূফী সাধক শেখ আহমদ সিরহিন্দি সাধারণ মুসলিম জনগণ ও উলেমাদের সাথে হাত মেলান।
ধার্মিক মুসলিম শাসকদের বিরুদ্ধে সূফীদের যোগ দেওয়ার ঘটনা খুবই অপ্রতুল। এরকম একটা ঘটনা হলো, সম্রাট আওরঙ্গজেবের স্বেচ্ছাচারী শাসনের বিরুদ্ধে বুদ্দু শাহ নামক এক ক্ষুদে সূফী সাধক তার ৭০০ ভক্ত নিয়ে গুরু গোবিন্দ সিং-এর সাথে বিদ্রোহে যোগ দিয়েছিলেন। কিন্তু তার এ মিত্রতায় গোবিন্দ সিং-এর বাহিনীর হিন্দু ও শিখ সেনাদের মনে ইসলামে দীক্ষিত হওয়ার কোনো ছাপ ফেলতে পারেনি। মোটকথা, সূফীরা সাধারণত শাসকদের সাথে আঁতাত গড়ে তোলেন বিশেষ করে অমুসলিম প্রজাদের উপর ইসলামের নিষ্ঠুর ও নিষ্পেষণমূলক আইন কার্যকর করার জন্য; তারা মুসলিম শাসকদের বিরুদ্ধে জনগণের সাথে হাত মিলিয়েছেন, যখন শাসকরা ইসলামের আইন প্রয়োগে শিথিলতা, বিশেষত বিধর্মীদের উপর নির্যাতন্তনিপীড়ন চালাতে ব্যর্থ হন বা অস্বীকৃতি জানান। শাসকদের বিরুদ্ধে কিংবা পক্ষে জাভার সূফীদের রাজনৈতিক আন্দোলনে জড়িত হওয়ার কারণ অন্যান্য অঞ্চলে ঘটিত কারণ থেকে ভিন্ন হওয়ার কথা নয়। আর তারা কখনো নির্যাতিত অবিশ্বাসীদের পক্ষে যোগ দিয়ে থাকলেও, এটা বিশ্বাস করার কোনোই কারণ নেই যে, সে মিত্রতা বিধর্মীদেরকে ব্যাপক হারে ইসলামে আকৃষ্ট করে।
ইসলামের ধর্মযোদ্ধারা বিধর্মীদেরকে ইসলামে অনুগত বা আনয়নের জন্য পরিচালিত যুদ্ধাভিযানে যে নির্মমতা প্রদর্শন করেছে, তা ইতিপূর্বেই আলোচিত হয়েছে। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার মুসলিম শাসকদের দ্বারা সংঘটিত জিহাদ অভিযান বা জিহাদী আক্রমণেও আতঙ্ক ও নিষ্ঠুরতা কোনো অংশে কম ছিল না। প্রফেসর অ্যান'নি রীড দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় ‘ইসলামকে অনেক বেশী রাজনৈতিক ও সামাজিক সমতাবাদী’ রূপে দেখেন। অথচ তিনিই উল্লেখ করেন: ‘১৬১৮-২৪ সালের মধ্যে মুসলিম শাসকদের দ্বারা আচেহ অভিযানের ফলে মালয় তার অনেক জনসংখ্যা হারায়।’184 একইভাবে মাতারাম-এর সুলতান অগুঙ, যিনি দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার এক মহান মুসলিম শাসক হিসেবে খ্যাত, তার ৮০,০০০ সেনা সুরাবায়া ও তার নিকটবর্তী শহরসমূহ পাঁচ বছর ধরে (১৬২০-২৫) অবরোধ করে রাখে। সে অবরোধে তার বাহিনী সমস্ত শস্যক্ষেত্র ধ্বংস করে দেয়, এমনকি পানিতে বিষ প্রয়োগ ও নদীতে বাঁধ দিয়ে শহরমুখী পানি প্রবাহ বন্ধ করে দেয়। এ অভিযানের ফলশ্রুতিতে সেখানকার ৫০,০০০ থেকে ৬০,০০০ বাসিন্দার মাত্র ৫০০ জনের মত অবশিষ্ট থাকে। বাকী সবাই হয় মারা যায় অথবা চরম কষ্ট ও দুর্ভিক্ষ থেকে রেহাই পেতে সেখান থেকে পালিয়ে যায়।185
তদুপরি দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার মুসলিম শাসকদের যুদ্ধে অবতীর্ণ হওয়ার মূল উদ্দেশ্য ছিল জনগণকে জোরপূর্বক গণহারে ধর্মান্তরিত করা। ষোড়শ শতাব্দীতে সুলাওয়েসির মাকাসারবাসীরা ইসলাম প্রতিরোধীদের মধ্যে বিশিষ্ট ছিল। বুলো-বুলো (সিন্দজাই অঞ্চল)-র স্থানীয় উপাখ্যানে বলা হয়েছে, মাকাসার-এর মুসলিম শাসক ইসলাম গ্রহণের জন্য অবাধ্য মাকাসারবাসীদেরকে আমন্ত্রণ জানান ও তা অস্বীকার করলে যুদ্ধের হুমকী দেন। এক বিশিষ্ট মাকাসার নেতা ‘অবজ্ঞা বা ঔদ্ধত্যের সাথে ঘোষণা করেন যে, বুলো-বুলোর জঙ্গলে খাবার জন্য যতদিন শুকর পাওয়া যাবে, ততদিন নদীতে যদি রক্তের বন্যাও বয়ে যায়, তবুও তিনি ইসলামের কাছে নতি স্বীকার করবেন না।’ উপাখ্যানে আরো বলা হয়েছে, ‘অলৌকিকভাবে সে রাতেই সমস্ত শুকর অদৃশ্য হয়ে যায়; সুতরাং সে নেতা ও তার সমস্ত লোকজন ইসলামে ধর্মান্তরিত হতে বাধ্য হয়।’186 এ ঘটনা একদিকে এ অঞ্চলের লোকদের মাঝে তথাকথিত ইসলামের উৎকৃষ্ট বার্তার প্রতি চরম বিদ্বেষ ও প্রতিরোধ প্রতীয়মান করে; অন্যদিকে অলৌকিকভাবে সত্যি সত্যি শুকরগুলো গায়েব হয়ে গেল, এটা কেউ বিশ্বাস করলে, সে হবে চরম ও হাস্যকরভাবে বিশ্বাসপ্রবণ। কিন্তু বাস্তবে কী মাকাসারবাসীকে গণহারে ইসলাম গ্রহণে প্রবৃত্ত করেছিল: নির্মম সহিংসতার হুমকী না সত্যি সত্যি যুদ্ধ?
সপ্তদশ শতাব্দীর মধ্যভাগের বানজারমাসিন (ইন্দোনেশিয়া)-এর উপাখ্যান ‘হিকায়াত বানজার’ মোতাবেক ‘বানজারমাসিনের ইসলামীকরণ কার্যকরভাবে নির্দিষ্ট হয়ে যায় যখন সিংহাসনের দুই দাবীদার গৃহযুদ্ধ পরিহারের জন্য দু’জনের মাঝে একক লড়াইয়ের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে।’187 এটা পুনরায় প্রমাণ করে যে, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার মুসলিম শাসকরা বিজিত জনগণকে গণহারে ধর্মান্তরিত করার সুস্পষ্ট লক্ষ্যেই যুদ্ধে লিপ্ত হতেন। যখন তারা জয়লাভ করতেন, সমস্ত জনগণকে বাধ্যগতভাবে ধর্মান্তরিত হতে হত, স্বেচ্ছায় নয়। এসব উদাহরণের ভিত্তিতে এম. সি. রিকলেফ্স বলেন: ‘জাভায় অস্ত্রের মুখে ধর্মান্তরকরণ ঘটতে পারে যখন এক মুসলিম শাসক অমুসলিম শাসককে পরাজিত করে। যার ফলশ্রুতিতে পরাজিত বীর ও তার জনগণকে সম্ভবত ইসলাম গ্রহণ করতে হয়।’188
দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় মালাক্কা ও অন্যান্য সুলতানাত তাদের ভূখণ্ড বিস্তৃতির জন্য বহু জিহাদী অভিযানে অবতীর্ণ হয়। নিঃসন্দেহে এসব যুদ্ধে তারা অগণিত বন্দীকে ক্রীতদাস হিসেবে কব্জা করে, যারা বরাবরই ইসলাম গ্রহণে বাধ্য হয়েছে। মুসলিমরা ক্ষমতা লাভের পর এ অঞ্চলে ক্রীতদাসকরণ ব্যাপকভাবে বেড়ে যায়। পর্তুগীজরা যখন ইসলাম-শাসিত দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় আগমন করে, তখন মজুরীর ভিত্তিতে কাজের লোক পাওয়া তাদের পক্ষে কঠিন হয়ে পড়ে, কারণ সে সময় সমস্ত লোক ছিল কোন না কোন প্রভুর ক্রীতদাস। পারস্যের ইতিহাসবিদ মোহাম্মদ ইবনে ইব্রাহীম ১৬৮৮ সালে লিখেন: ‘ক্রীতদাস ভাড়া নেয়া তাদের প্রথা। ক্রীতদাসকে তারা কিছু টাকা দেয়, যা সে তার মালিকের হাতে তুলে দেয়। তারপর তারা সে ক্রীতদাসকে ঐ দিনের জন্য তাদের ইচ্ছামত কাজে লাগায়।’ একইভাবে পর্তুগীজ লেখক ইয়োয়াও দা বারোস ১৫৬৩ সালে লিখেন: ‘যত গরীবই হোক না কেন, তুমি এমন কোনো স্থানীয় মালয়ীকে পাবে না, যে তার নিজের কিংবা অপর কারো জিনিস পিঠে তুলে নিবে, তার জন্য তাকে যত মজুরীই দেওয়া হোক না কেন। তাদের সমস্ত কাজ করে ক্রীতদাসরা।’189 চীনা পরিব্রাজক হুয়াং চুং ১৫৩৭ সালে ভ্রমণকালে লিখেন: ‘(মালাক্কার জনগণ) বলে যে জমি থাকার চেয়ে ক্রীতদাস থাকা ভাল, কারণ প্রধানত ক্রীতদাসরাই মালিকের রক্ষক।’ 190 রীড-এর মতে: ‘(দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার) দাস-মালিক শ্রেণীর বণিকদের অনেক সদস্যেরই শক্ত শেকড় ছিল ইসলামী বিশ্বে, যেসব দেশে সম্পদরূপে দাসদের ব্যাপারে পরিষ্কার কতকগুলো আইন ছিল।’191 এতে বুঝা যায় যে, মুসলিম বা আরব দেশ থেকে আগত মুসলিম বণিক ও তাদের বংশধররা দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় ক্রীতদাস ব্যবসায় ব্যাপকভাবে লিপ্ত হয় ও দাসপ্রথার বিস্তার ঘটায়।
ইব্নে বতুতার সামুদ্রা সুলতানাত সফরকালে সুলতান তাকে দুই দাস-বালিকা ও দু’জন পুরুষ চাকর উপহার দেন।192 বতুতা মুল্জাওয়ার বিধর্মী শাসক, যিনি বতুতাকে তিন দিন আপ্যায়ন করেছিলেন, তার মালিকানাধীন ক্রীতদাসের কথাও উল্লেখ করেন। বতুতা বলেন, ওই শাসকের প্রতি ভালবাসার প্রতীক হিসেবে তার এক ক্রীতদাস নিজ হাতে আত্মাহুতি দেয়।193 তার মানে, ইসলাম-পূর্ব আমলেও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় দাসপ্রথার প্রচলন ছিল। রীড উল্লেখ করেছেন, থাই রাজ্যের নাগরিকদেরকে বছরের অর্ধেক সময় রাজার জন্য কাজ করতে হতো।194 এটাও এক ধরনের দাস প্রথা বা অর্ধ-দাসপ্রথা। ইসলাম-পূর্ব দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় সম্ভবত শাসক ও উচ্চ কর্মচারীরাই কেবল দাস-মালিক হতে পারত, সাধারণ বণিকরা নয়। সাধারণ বণিকরা ব্যাপক হারে দাস-মালিক হতে পেরেছে মুসলিম শাসনের অধীনে। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, মুসলিমদের মালিকানাধীন ক্রীতদাসদেরকে সাধারণত ইসলামে ধর্মান্তরিত হতে হতো, যে বাধ্যবাধকতা পূর্বে ছিল না।
দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় মুসলিম শক্তি প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর অমুসলিম ভূখণ্ডে হানা বা আক্রমণ একটা বিরামহীন দৃশ্য হয়ে দাঁড়ায়। রিকলেফ্স বলেন: ‘এটা ছিল প্রায় অবিরাম যুদ্ধ-বিগ্রহে ভরপুর জাভার ইতিহাসের একটা সময়।’ 195 জনসংখ্যার একটা বড় অংশ যাদেরকে আদিম বা বর্বর বলা হয়ে থাকে, তারা পাহাড়ে বাস করতো। পঞ্চদশ শতকের গোড়ার দিকে মুসলিমরা ক্ষমতায় আসার পর পাঁচ শতাব্দীরও বেশী সময় ধরে ঐসব সর্বেশ্বরবাদী পাহাড়ী মানুষকে ক্রীতদাস বানিয়ে মালয়, সুমাত্রা ও বোর্ণিওর মুসলিম জনগণের সাথে একীভূত করার ফলে তারা প্রায় সম্পূর্ণ নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়; এবং তাদেরকে ক্রীতদাস করা হয়েছিল আক্রমণ, বশ্যতাকর পরিশোধ ও বিশেষত শিশুদেরকে ক্রয়ের মাধ্যমে।196 রীড আরো উল্লেখ করেন, ‘কিছু কিছু ক্ষুদ্র সুলতানাত, যেমন সুলু, বুটোন ও টিডোর প্রভৃতি এক লাভজনক ব্যবসা শুরু করে পূর্ব-ইন্দোনেশিয়া ও ফিলিপিনে ক্রীতদাসের জন্য হানাকারী আক্রমণ ও তাতে ধৃত মনুষ্য শিকারকে ধনী শহরগুলোতে অথবা সপ্তদশ শতকের দক্ষিণ বোর্ণিওর বর্ধমান মরিচের জমিদারীগুলোতে বিক্রির মাধ্যমে।’ 197
দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার মুসলিমদের যুদ্ধগুলোতে কখনো কখনো ক্রীতদাসকরণ প্রক্রিয়া ছিল সম্পূর্ণ: গোটা জনগোষ্ঠীকেই দাস বানিয়ে অন্যত্র নিয়ে যাওয়া হতো। উদাহরণস্বরূপ, টমাস আইভি ১৬৩৪ সালে জানান: এক ইংরেজ ব্যবসায়ী দল মরিচ ক্রয়ের জন্য একদা সমৃদ্ধশীল সুমাত্রা দ্বীপের শহর ইন্দেরাগিরির খুঁজে দুই দিন ধরে ঘোরাঘুরি করে ব্যর্থ হয়। শহরটির কোনো অস্তিত্ব বা চিহ্নই পাওয়া যায় না। পরে তারা জানতে পায় যে, ছয় বছর আগে আচেহ্র মুসলিমদের এক আক্রমণে পরাজিত হওয়ার ফলে শহরের সমস্ত বাসিন্দাকে তিন দিনের উজান পথের একটা স্থানে নিয়ে যাওয়া হয়।198 পৌত্তলিক শ্রেণীর হিন্দু, বৌদ্ধ ও সর্বপ্রাণবাদী ধর্মের এসব দাসকৃত জনগণকে তাদের শাফী তরীকার মুসলিম কব্জাকারীরা স্বাভাবিকভাবেই নিজস্ব ধর্ম ধরে রাখতে দেয় নি।
যদিও স্পেনীয়রা ফিলিপিন দখল করে ও দক্ষিণের মুসলিম নিয়ন্ত্রিত অঞ্চলের উপর চাপ অব্যাহত রাখে, তথাপি মোরো মুসলিমরা দাস ধরার জন্য স্পেন্তঅধিকৃত ভূখণ্ডগুলোতে লাগাতার হানাকারী আক্রমণের মাধ্যমে জিহাদ চাঙ্গা রাখে। ১৬৩৭ সালে ম্যানিলার আর্চবিশপ লিখেন: তারা গত ৩০ বছর ধরে প্রতিবছর গড়ে ১০ হাজার ক্যাথলিক ফিলিপিনোকে দাস বানিয়েছে। হিসাব করে দেখা গেছে যে, ১৬৬৫ সাল থেকে শুরু করে ফিলিপিনে স্পেনীয়দের শাসনের প্রথম দুই শতাব্দীতে মোরো জিহাদীরা প্রায় দুই মিলিয়ন (কুড়ি লক্ষ) অমুসলিমকে দাসত্বের শৃঙ্খল পরায়।199 অতঃপর স্পেনীয় ও পর্তুগীজ নৌ-পাহারা উত্তরোত্তর কার্যকর হয়ে উঠে মোরো জিহাদী আক্রমণ রুখতে। তথাপি এক রক্ষণশীল হিসাব মতে, ১৭৭০ থেকে ১৮৭০ সালের মধ্যে দক্ষিণ ফিলিপিনো মুসলিমরা দাসকরণের মাধ্যমে ২০০,০০০ থেকে ৩০০,০০০ বিধর্মীকে সুলু সুলতানাতে আনে।200 ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষ দিকেও মালয় উপদ্বীপ ও ইন্দোনেশীয় দ্বীপপুঞ্জে দাসকরণ বিদ্যমান ছিল ব্যাপকহারে: ১৮৭৯ সালে পেরাক সুলতানাতে মোট জনসংখ্যার ছয় শতাংশ ছিল দাস; ১৮৬০-এর দশকে পশ্চিম সুমাত্রার পূর্বাঞ্চলসমূহে জনসংখ্যার এক-তৃতীয়াংশ দাস ছিল; ১৮৮০-র দশকে উত্তর সুলাওয়েশীর মুসলিম শাসিত অঞ্চলে ৩০ শতাংশ ও উত্তর বোর্ণিওতে দুই-তৃতীয়াংশ কিংবা তারও বেশী লোক ছিল দাস।201 এখানে এটা বিবেচ্য যে, ১৮১৫ সালে ইউরোপ দাসপ্রথা নিষিদ্ধ করে ও মুসলিম বিশ্বকে সেপথ অনুসরণের জন্য চাপ দিতে থাকে এবং যখন সম্ভব বাহুবলের মাধ্যমে দাস-বাণিজ্য রুখতে হস্তক্ষেপ করে।
এরূপ ব্যাপকহারে দাসকরণের দৃষ্টান্ত পাঠককে ধারণা দিবে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় কীভাবে ধর্মান্তর ঘটেছিল সে সম্পর্কে। জোরপূর্বক পরাজিত জনগণকে ধর্মান্তরিত করার সুস্পষ্ট লক্ষ্যে মুসলিম শাসকগণ যুদ্ধে লিপ্ত হতেন। অধিকন্তু মুসলিমদের বিরামহীন হানাকারী আক্রমণ, ইসলামী শাসনাধীনে বিধর্মী প্রজাদের প্রতি ভয়াবহ সামাজিক অমর্যাদা ও ভোগানি-, এবং খারাজ, জিজিয়া ও অন্যান্য দুর্বহ করের বোঝা নিঃসন্দেহে তাদের উপর ইসলাম গ্রহণের বাধ্যবাধকতা চাপিয়ে দেয়। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার মুসলিম শাসকরা বিধর্মী জনগণের মাঝে কতটা সন্ত্রাস বা আতঙ্ক সৃষ্টি করেছিল তা অনুমান করা যায় ডাচ জেনারেল কোহেনের সাক্ষ্য থেকে (১৬১৫)। লোকেরা তাকে জানায়: ‘বান্তেনের পান্জোরানরা কোনো স্পেনীয়, হল্যাণ্ডার বা ইংরেজকে ভয় পায় না, কিন্তু ভয় পায় কেবলমাত্র মাতারামকে (এর মুসলিম শাসককে)।’ তারা বলে: ‘মাতারামের কাছ থেকে কেউ পালাতে পারে না। কিন্তু অন্যদের হাত থেকে বাঁচতে গোটা পাহাড়টাই আমাদের জন্য যথেষ্ট, কেননা তারা তাদের জাহাজ নিয়ে আমাদেরকে পিছু ধাওয়া করতে পারে না।’ 202 এরূপ বেপরোয়া বিপর্যস্ত অবস্থার মধ্যে মুসলিম ধর্মপ্রচারক সূফী ও উলেমারা সেসব নির্যাতিত, নিগৃহীত, অসম্মানিত, নিঃস্ব ও আতঙ্কিত বিধর্মীদেরকে ধর্মান্তরে কিছুটা অবদান রেখে থাকতে পারেন। কিন্তু সেসব ধর্মান্তরের প্রভাব ছিল সম্ভবত খুবই গৌণ, কেননা ‘চতুর্দশ শতাব্দী থেকে ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষ পর্যন্ত ইন্দোনেশীয় দ্বীপপুঞ্জে প্রায় কোন রকম মুসলিম মিশনারী কর্মকাণ্ড দেখা যায় নি।’203 ইটনের মত ইতিহাসবিদদের উচিত অস্পষ্ট ও অবাস্তব ঐতিহাসিক কল্পকাহিনীর ভিত্তিতে ইসলামে ধর্মান্তরের বিষয়ে কোনো সিদ্ধান্তে পৌঁছানোর আগে এ সত্যটি অনুধাবন করা। তার অর্থ দাঁড়ায়: সেখানে সুসংগঠিত কোনো মিশনারী কার্যক্রম ছিল প্রায় অনুপস্থিত (ভারতের ক্ষেত্রেও একই ঘটনা), হোক তা সূফীদের দ্বারা কিংবা উলেমাদের। সুতরাং উদ্বুদ্ধকরণের মাধ্যমে ধর্মান্তরের ওসব ঘটনা ছিল নেহাৎই নগণ্য। অবশ্যই ধর্মান্তর সাধিত হয়েছিল প্রধানত রাষ্টযন্ত্রের প্রচেষ্টায়: তলোয়ারের ডগা, ব্যাপকহারে ক্রীতদাসকরণ ও অন্যান্য জবরদস্তিমূলক বাধ্যকতার মাধ্যমে, যেমনটা ঘটেছিল ভারতে।
মুসলিমরা যখন দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় এসে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করে, তখন স্পষ্টতই তারা মিশ্র বিয়ে বা ব্যবসায়িক সম্পর্কের মাধ্যমে স্থানীয় জনগণকে স্বাধীনভাবে ইসলামে ধর্মান্তরিত করতে পারত। মুসলিমরা কখনো তাদের সহধর্মীদেরকে ইসলাম ত্যাগের অনুমতি দেয় না, অথচ এখানে ইসলাম গ্রহণকারী অবিশ্বাসী কিংবা তাদের ইসলামে প্ররোচনাকারী মুসলিমরা স্বভাবত সহনশীল স্থানীয় লোকদের হাতে কোনো রকম নির্যাতনের মুখোমুখি হয় নি। ইসলামের বার্তায় বড় কোন আবেদন থাকলে এরূপ একটি সহায়ক পরিবেশে মুসলিম বিজয়ের পূর্বের সূফী বা বণিকদের উদ্বুদ্ধকরণমূলক ইসলাম প্রচার অন্তত সেরূপ সফলতা পেত, যেমনটি পায় শক্তিবলে অঞ্চলটির মুসলিম কর্তৃক বিজয়ের পর। প্রকৃতপক্ষে মুসলিমদের যুদ্ধ মারফত অঞ্চলটি বিজয়ের পূর্বে প্রচারের মাধ্যমে ধর্মান্তর যেহেতু খুবই সামান্য বা তুচ্ছ ছিল, সুতরাং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় বিধর্মীদেরকে ইসলামে ধর্মান্তরিতকরণে মূলত তরবারীর মহোল্লাসই ছিল প্রাথমিক অস্ত্র।
ভারতের ক্ষেত্রেও একই দৃষ্টান্ত খাটে। আল-মাসুদীর লেখায় সুস্পষ্ট ধারণা পাওয়া যায় যে, মুসলিম হানাদার বাহিনী পৌঁছানোর পূর্বে মুসলিম জনসংখ্যার বিস্তৃতি ঘটেছিল প্রধানত ভারতের সহনশীল সংস্কৃতির মাঝে মিশ্র বিবাহের দ্বারা সন্তান জন্মদানের মাধ্যমে। উপরোল্লিখিত আল-মাসুদীর উদ্ধৃতি থেকে বুঝা যায় যে, মিশ্র বিবাহ ব্যতীত ধর্মান্তর খুবই অপ্রত্যুল ঘটনা ছিল। কিন্তু মুসলিম হানাদার বাহিনী তিনটি ধাপে ভারতে ইসলামের তরবারী আনয়নের পর - প্রথমত অষ্টম শতাব্দীর গোড়ায় মোহাম্মদ বিন কাসিম কর্তৃক, দ্বিতীয়ত একাদশ শতাব্দীর শুরুর দিকে সুলতান মাহমুদ দ্বারা ও পরিশেষে দ্বাদশ শতাব্দীর শেষদিকে সুলতান মোহাম্মদ ঘোরীর দ্বারা - ভারতে মুসলিম জনসংখ্যা দ্রুত বৃদ্ধি পায়। এবং তা ঘটে মূলত নিষ্ঠুর মুসলিম আক্রমণের মুখে ভারতের স্থানীয় জনগণকে ব্যাপকহারে দাসকরণ ও অন্যান্য নানা জবরদস্তিমূলক বাধ্যকতায় ধর্মান্তরিত করার মাধ্যমে।
169. Sethi A, Islam was brought to India by Muslim invaders, The Time of India, 24 June 2007; also see Qasmi MB, Origin of Muslims in India, Asian Tribune, 22 April 2008
173. Widjojoatmodjo RA (1942) Islam in the Netherlands East Indies, in the Far Eastern Quarterly, 2 (1), p. 51
179. Al-Attas SN (1963) Some Aspects of Sufism as Understood and Practice Among the Malays, S Gordon ed., Malaysian Sociological Research Institute Ltd., Singapore, p. 21
181. Peters R (1979) Islam and Colonialism: The Doctrine of Jihad in Modern History, Mouton Publishers, The Hague, p. 31
184. Reid A (1988) Southeast Asia in the Age of Commerce 1450-1680, Yale University Press, New Haven, Vol. I, p. 35,18
199. Reid A (1983) Introduction: Slavery and Bondage in Southeast Asian History, in Slavery Bondage and Dependency in Southeast Asia, Anthony Reid ed., University of Queensland Press, St. Lucia, p. 32
200. Warren JF (1981) The Sulu Jone, 1968-1898: The Dynamics of the External Slave Trade, Slavery and Ethnicity in the Transformation of a Southeast Asian Maritime State, Singapore University Press, Singapore, p. 208.