লিখেছেনঃ নূহ আইনুল ইসলাম, আপডেটঃ May 28, 2009, 12:00 AM, Hits: 2942
পৃথিবীর ইতিহাস যখন দর্শন আর তত্ত্বে সয়লাব হয়ে গেছে এবং একের পর এক দর্শন এবং তত্ত্ব মার খেয়ে খেয়ে সমকাল মাড়িয়ে মহাকালের অতলে বেমালুম হাওয়া হয়ে যাচ্ছে, তখন আমাদের বাঙালীদের মধ্যেই নতুন একটি সামাজিক-অর্থনৈতিক দর্শন বা তত্ত্ব নিয়ে কাজ করতে শুরু করেছেন পশ্চিমবাঙলার কিছু সক্রিয় মানুষেরা। শোষণ ও বঞ্চনা থেকে মুক্তির চিরায়ত পথ ‘সমাজতন্ত্র’ প্রতিষ্ঠার একটি কার্যকর উপায় খুঁজে বের করতে গিয়েই এ দর্শন বা তত্ত্বের আবির্ভাব। নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসুর গুণমুগ্ধ এ সক্রিয় মানুষগুলোর অনুসৃত দর্শনটির নাম– প্রাউট।
‘প্রাউট’কে বলা হচ্ছে মার্ক্সবাদ ও পুঁজিবাদের একমাত্র বিকল্প। বাঙালী তাত্ত্বিক শ্রীযুক্ত প্রভাতরঞ্জন সরকার এর প্রতিষ্ঠাতা। এ দর্শনটি পশ্চিমবাঙলার রাজনৈতিক দল ‘আমরা বাঙালী’র অর্থনৈতিক আন্দোলনের অস্ত্রস্বরূপ। প্রাউট মুখ্যত ইংরেজি শব্দসংক্ষেপ, যাকে প্রসারিত করলে পাওয়া যাবে – প্রোগ্রেসিভ ইউটিলাইজেশন থিওরি। এ তত্ত্বকে দাবী করা হচ্ছে সমাজতন্ত্র-প্রতিষ্ঠা ও শোষণমুক্তির পথ হিশেবে। প্রাউট ঘোষণা করে যে, পুঁজিবাদী রাষ্ট্রের মতো মুষ্টিমেয় কিছু পুঁজিপতির হাতে কিংবা মার্ক্সবাদী বা কম্যুনিস্ট রাষ্ট্রের মতো মুষ্টিমেয় কিছু কম্যুনিস্ট নেতার হাতে অর্থনৈতিক ক্ষমতা থাকতে পারবে না। ’পরন্তু, সমাজ বা রাষ্ট্রের অর্থনৈতিক ক্ষমতা থাকতে হবে জনসাধারণের হাতে। এ অর্থব্যবস্খাকে তাই বিকেন্দ্রিত অর্থনীতির ব্যবস্থা বলা হচ্ছে। সমষ্টির স্বার্থেই ব্লক-স্তর থেকে অর্থনৈতিক পরিকল্পনা গড়ে উঠবার কথা এতে বলা হয়ে থাকে। এ অর্থনৈতিক ও সামাজিক দর্শনের লক্ষ্য হচ্ছে – সম্পদের পরিপূর্ণ উপযোগিতা গ্রহণ ও সুষ্ঠু বন্টনের দ্বারা সকলের চাহিদা পূরণ ও সমৃদ্ধ জীবন দান করা। বেকার সমস্যার কার্যকর সমাধানের জন্যে প্রাউট পথনির্দেশ করে কুটির শিল্পের প্রসার এবং কৃষিভিত্তিক ও কৃষিসহায়ক শিল্প স্থাপনের।
প্রাউট যদিও পুঁজিবাদ বা ধনতন্ত্র এবং মার্ক্সবাদ বা কম্যুনিজমের বিকল্প দর্শন হিশেবে প্রকাশিত হয়েছে, এটিকে কোনোক্রমেই সমাজতন্ত্রের বিকল্প হিশেবে দাবী করা হচ্ছে না। অধিকন্তু, প্রাউট হলো সমাজতান্ত্রিক অর্থব্যবস্থা য় পৌঁছনোর অধুনা-আবিস্কৃত ও কার্যকর পথ। প্রাউটের অপরিহার্য দু’টি নীতি– ১) সম্পদের সার্বিক উপযোগিতা গ্রহণ ও ২) সম্পদের সুষ্ঠু বন্টন। এ দু’টি নীতির ভিত্তিতেই ব্লক-স্তর থেকে অর্থনৈতিক পরিকল্পনা গড়ে উঠবে। উৎপাদন হবে চাহিদা অনুযায়ী, অতিরিক্ত মুনাফার আশায় নয়। অর্থনৈতিক পরিকল্পনার লক্ষ্য হবে – অন্ন, বস্ত্র, বাসস্খান, শিক্ষা ও চিকিৎসা-সংক্রান্ত যাবতীয় সমস্যা থেকে মানুষকে মুক্তি দ্যাওয়া। উৎপাদন হবে উৎপাদিকা সমবায়ের মাধ্যম এবং কেবলমাত্র চাহিদা পূরণের জন্যে; তার বন্টন হবে উপভোক্তা সমবায়ের মাধ্যমে। এতে সংশ্লিষ্ট প্রদেশ বা রাষ্ট্রের অর্থনৈতিক ক্রিয়াকলাপের প্রতিটি খুঁটিনাটিকে পরিচালনা ও নিয়ন্ত্রণ করবার জন্য সেখানে ‘জাতীয় ব্যাংক’ এর প্রতিষ্ঠা করার কথা বলা হয়ে থাকে।
সামাজিক নেতৃত্বের ব্যাপারে প্রাউট ‘সদ্বিপ্র’ অভিধায় অভিহিত প্রাউটিস্ট নেতাদের হাতে রাখবার প্রস্তাব করে থাকে। ‘সদ্বিপ্র’ বলতে এ দর্শনে আধ্যাত্মিক অনুশীলনের মাধ্যমে নীতিবাদী ও নব্যমানবতাবাদী হিশেবে জীবনকে ব্রতী করা ব্যক্তিবর্গকেই বোঝানো হয়।
১৯৫৯ খ্রীষ্টাব্দে দার্শনিক ও আধ্যাত্মিক নেতা প্রভাতরঞ্জন সরকার এই সামাজিক-অর্থনৈতিক দর্শনটি প্রকাশ করেন। এ দর্শনের মৌলিক নীতি মোট পাঁচটি।
এক) নিয়ন্ত্রকসমষ্টির সুস্পষ্ট অনুমোদন ছাড়া কোনো ব্যক্তি কোনোরকম বাহ্যত-সম্পদ সঞ্চয় করতে পারবে না।
দুই) সকল ইহজাগতিক ও অধিজাগতিক বিষয়াদি ও দক্ষতার সর্বোচ্চ উপযোগিতা গ্রহণ এবং সুষম বন্টন নিশ্চিত হতে হবে।
তিন) মানবসমাজের বাহ্যত, অধিজাগতিক এবং আধ্যাত্মিক কর্মদক্ষতার উপযোগিতার সর্বোচ্চ ও পূর্ণ সদ্ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে।
চার) এসকল বাহ্যত, অধিজাগতিক, ইহজাগতিক, এবং আধ্যাত্মিক উপযোগিতার পূর্ণসদ্ব্যবহার এগুলোর পারস্পরিক সঠিক ও কার্যকর সমন্বয় সাধন করতে হবে।
পাঁচ) উপযোগিতাগ্রহণ বা নিশ্চিতকরণের পদ্ধতি সময়, স্খান, বা ব্যক্তি-ভেদে আলাদা আলাদা হতে পারবে এবং উপযোগিতার পূর্ণ সদ্ব্যবহার নিশ্চিতকরণ প্রক্রিয়া প্রগতিশীল প্রকৃতির হতে হবে।
অনলাইন : ২৮ মে, ২০০৯