লিখেছেনঃ শামসুজ্জোহা মানিক, আপডেটঃ January 13, 2015, 12:00 AM, Hits: 4678
বিষয়সূচী :
প্রথম অধ্যায় : পশ্চিম ইউরোপের অভিজ্ঞতা
দ্বিতীয় অধ্যায় : রাশিয়ার অভিজ্ঞতা
তৃতীয় অধ্যায় : ইসলামের সমস্যা
চতুর্থ অধ্যায় : আধুনিক সভ্যতায় ইসলামের ভূমিকা
পঞ্চম অধ্যায় : নূতন বিশ্ববিপ্লবের প্রয়োজন
প্রথম অধ্যায়
পশ্চিম ইউরোপের অভিজ্ঞতা
আধুনিক সভ্যতার যুগে বাস করেও উন্নত ও সভ্য সমাজ নির্মাণে আমাদের ব্যর্থতা কতখানি তা বাংলাদেশের আজকের বাস্তবতার দিকে দৃষ্টি দিলে সহজেই বুঝা যায়। অথচ আধুনিক সভ্যতা সম্পর্কে আমাদের অভিজ্ঞতা কম দিনের নয়। ১৭৫৭-তে ব্রিটিশ শাসন প্রতিষ্ঠিত হবার পর আমরা আধুনিক সভ্যতার অন্তর্ভুক্ত হই। তবে সেটা ছিল জাতি হিসাবে আমাদের পরাধীনতার কাল। সে কালের অবসান হয়েছে অনেক আগে। ১৯৪৭ সালে। তারপর ১৯৪৭ থেকে ১৯৭১ পর্যন্তও ছিল আমাদের আরেক পরাধীনতার কাল। কিন্তু ১৯৭১ থেকে আজ অবধি আমরা কোন্ বিজাতির শাসনাধীনে আছি যে তাকে দোষারোপ করে আমাদের দারিদ্র্য, দুর্নীতি, পশ্চাৎপদতা, অব্যবস্থা, সন্ত্রাস এবং অনুন্নয়নের জন্য সান্ত্বনা খুঁজে পাব? অথচ পৃথিবীর অনেক জাতিই পরাধীনতার অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে এসে আমাদের থেকে ভিন্ন ইতিহাস গড়েছে। তারা পরাধীনতার অবসান ঘটিয়ে উন্নত সভ্যতার অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে উন্নতির পথে এগিয়ে যেতে পেরেছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র একটা রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মধ্য দিয়ে স্বাধীনতা অর্জন করে উন্নত ও পরাক্রান্ত রাষ্ট্র গড়েছে। চীন, ভিয়েৎনাম ইত্যাদি রাষ্ট্রও বিদেশী রাষ্ট্রের আধিপত্যকে উৎখাত করে উন্নত রাষ্ট্র ও সমাজ গঠনের পথে দৃপ্তপায়ে এগিয়ে চলেছে ।
যুদ্ধ না করে কানাডা, অস্ট্রেলিয়া ও নিউজিল্যান্ড ব্রিটেনের কাছ থেকে স্বাধীনতা অর্জন করে উন্নত রাষ্ট্র গঠন করেছে। হয়ত বলা হবে এই তিনটি দেশের বর্তমান অধিবাসীবৃন্দ সাধারণভাবে ইউরোপ থেকে আগত। সুতরাং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মত উপনিবেশিক কালেও তারা যে আধুনিক ও উন্নত সমাজ গঠন করেছিল আজকের রাষ্ট্রগুলি তারই ধারাবাহিক, স্বাধীন ও রাজনৈতিক রূপ মাত্র। আর এখানেই আমরা আমাদের অনুসন্ধানের মূল জায়গাটা খুঁজে পাই। সেটা হচ্ছে ইউরোপ। অর্থাৎ আজকের আধুনিক সভ্যতার উৎস ইউরোপের সমাজে এমন কিছু বৈশিষ্ট্য ছিল যা সেখানে আধুনিক ও উন্নত সভ্যতার উপযোগী সমাজ ও রাষ্ট্রের উদ্ভবকে সম্ভব করেছিল। সুতরাং এখন আমরা সেই দিকটাতে দৃষ্টি দিই। তাহলেই আমরা আমাদের প্রশ্নের উত্তর খুঁজে পাব।
আমরা যেটাকে আধুনিক ইউরোপ বলি তার যাত্রা রেনেসাঁ বা নবজাগরণ দিয়ে। ইউরোপে নবজাগরণের কাল হিসাবে সাধারণভাবে ধরা হয় খ্রীষ্টীয় চতুর্দশ-সপ্তদশ শতাব্দীকে, যে সময়টাতে প্রাচীন বিস্মৃত গ্রীক ও ল্যাটিন সাহিত্য, শিল্পকলা ও জ্ঞানের চর্চা শুরু হয়। রোমান সভ্যতার পতনের পর খ্রীষ্ট ধর্মের প্রভাবে এই সব বিষয়ের চর্চা নিষিদ্ধ অথবা পৃষ্ঠপোষকতার অভাবে বন্ধ হয়ে যায়। বর্বরদের হাতে রোমান সভ্যতার চূড়ান্ত পতন হয় ৪৭৬ খ্রীষ্টাব্দে। এরপর থেকে একেবারে প্রায় চতুর্দশ শতাব্দী পর্যন্ত যে কাল চলে সেটাকে বলা হয় অন্ধকার যুগ, যখন ধর্মের বিধিনিষেধের কারাগারে মানুষের যুক্তি-বুদ্ধি-বিবেচনা বন্দী হয়ে পড়ে। মানুষের চিন্তার নিয়ামক হিসাবে দেখা দেয় অন্ধ বিশ্বাস নির্ভর ধর্ম। ফলে জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চার পথও অবরুদ্ধ হয়ে পড়ে।
সমগ্র ইউরোপ জুড়ে অভিন্ন খ্রীষ্টধর্মের প্রসার ঘটলেও বিভিন্ন ধর্মীয় প্রশ্নে মতভেদকে কেন্দ্র করে ইউরোপ রোমান ক্যাথলিক ও অর্থডক্স্ এই দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়ে। পশ্চিম ইউরোপে খ্রীষ্টীয় ধর্মের যে মতবাদ প্রাধান্য অর্জন করে সেটাকে আমরা জানি রোমান ক্যাথলিক হিসাবে আর পূর্ব ইউরোপে যে মতবাদ প্রাধান্য অর্জন করে সেটা পরিচিত অর্থডক্স্ হিসাবে। খ্রীষ্টীয় গীর্জা বা চার্চ এই দুই প্রধান ধারায় বিভক্ত হয়। ক্যাথলিক চার্চ রোমান সাম্রাজ্যের রাজধানী রোমকে কেন্দ্র ক’রে এবং অর্থডক্স্ চার্চ বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্যের রাজধানী কন্স্ট্যান্টিনোপলকে কেন্দ্র করে বিকশিত হয়। প্রধানত এই দুই শাখায় খ্রীষ্ট ধর্মের বিকাশে যেটা সবচেয়ে লক্ষ্যণীয় সেটা হচ্ছে ধর্মগুরু হিসাবে পোপকে কেন্দ্র করে ক্যাথলিক চার্চের কেন্দ্রীভূত প্রতিষ্ঠান রূপে বিকাশ লাভ যেটা অর্থডক্স্ চার্চের ক্ষেত্রে ঘটে নাই। এই প্রভেদ ইউরোপের রাষ্ট্র ব্যবস্থাতেও গুরুতর প্রভেদ বা পার্থক্য ঘটায়। পশ্চিম ইউরোপে খ্রীষ্টধর্মের কেন্দ্রীয় প্রতিষ্ঠান হিসাবে পোপের উদ্ভব রাষ্ট্রের উপর পোপ তথা চার্চের যে প্রাধান্য প্রতিষ্ঠা করে সেটা পূর্ব ইউরোপের ক্ষেত্রে ঘটে নাই।
আমাদের আলোচনায় এই বিষয় মনে রাখতে হবে যে, খ্রীষ্ট ধর্মের বিশেষ দর্শন ও বিকাশ পদ্ধতি চার্চ ও রাষ্ট্রকে কখনই পুরাপুরি একীভূত করে নাই। অর্থাৎ যারা ধর্ম চর্চা ও প্রচারের নির্দিষ্ট দায়িত্ব পালন করে তারা প্রত্যক্ষভাবে রাষ্ট্র পরিচালনা করে না, যদিও তারা রাষ্ট্রকে প্রভাবিত এমনকি অনেকাংশে নিয়ন্ত্রণও করতে পারে। তবে সেটা তারা করলেও করে নিজেদের স্বতন্ত্র সত্তা বজায় রেখে। অর্থাৎ ধর্ম নেতা বা পুরোহিত এবং রাষ্ট্র নেতা বা রাষ্ট্রের শাসক একজন নয়।
তবে ক্যাথলিক চার্চ ব্যবস্থায় সকল চার্চ বা গীর্জার কেন্দ্রীভূত কর্তৃত্ব হিসাবে পোপের পদ সৃষ্টি ক্যাথলিক মতাবলম্বী পশ্চিম ইউরোপে চার্চ রাষ্ট্র থেকে পৃথক হলেও রাষ্ট্রের উপর পোপের প্রাধান্য সৃষ্টি করে। পোপ যেহেতু সর্বোচ্চ ধর্মগুরু বা ধর্মনেতা এবং পশ্চিম ইউরোপের জনগণ ক্যাথলিক খ্রীষ্টীয় মতাবলম্বী হিসাবে পোপকে তাদের সর্বোচ্চ আধাত্মিক ও নৈতিক কর্তৃত্ব হিসাবে মেনে নেয় সেহেতু পশ্চিম ইউরোপের রাজা বা সম্রাটরাও পোপের ধর্মীয় কর্তৃত্বের প্রতি আনুগত্য প্রদান করতে বাধ্য হয়। আর এইভাবে পশ্চিম ইউরোপে সুদীর্ঘ কাল রাষ্ট্রের উপর পরোক্ষভাবে হলেও পোপ তথা চার্চের আধিপত্য বজায় থাকে। রাজা বা সম্রাটরা যা-ই করুক পোপ বা গীর্জার নৈতিক কর্তৃত্বকে মেনে চলতে হত। এটা একটা বড় কারণ যার ফলে পশ্চিম ইউরোপে রাজা বা রাষ্ট্রের নিরঙ্কুশ স্বেচ্ছাচার বা স্বৈরতন্ত্র গড়ে উঠার সুযোগ পায় নাই। অন্যদিকে, চার্চের হাতে সরাসরি রাষ্ট্র ক্ষমতা না থাকায় তাকেও নির্ভর করতে হত রাষ্ট্রের উপর। এর ফলে পশ্চিম ইউরোপে ধর্ম ও রাষ্ট্রের ক্ষমতার মধ্যে এক ধরনের ভারসাম্য সৃষ্টি হয়েছিল।
কিন্তু পূর্ব ইউরোপের অর্থডক্স্ প্রভাবিত দেশগুলির পরিস্থিতি ভিন্ন হল। অর্থডক্স্ চার্চগুলির কেন্দ্রীভূত রূপ হিসাবে পোপ জাতীয় কোন প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠল না। অর্থডক্স্ মতবাদকে কেন্দ্র করে নিজেদের মধ্যে ঐক্য ও সমন্বয় থাকলেও চার্চগুলি কেন্দ্রীভুত ধর্মীয় কর্তৃত্বের অধীনে সংগঠিত না হওয়ায় এগুলির রাষ্ট্রের উপর প্রাধান্য প্রতিষ্ঠার উপায় থাকে নাই, বরং রাষ্ট্রই চার্চকে নিজের অধীনে নিয়েছে। প্রতিষ্ঠান হিসাবে চার্চ ও রাষ্ট্র স্বতন্ত্র থেকেছে। কিন্তু চার্চের উপর রাষ্ট্র প্রধান হিসাবে রাজা বা সম্রাটের প্রাধান্য থেকে গেছে। ফলে ধর্মীয় বিষয়ে রাষ্ট্রের হস্তক্ষেপ ঘটতে পেরেছে। এরই প্রকাশ হিসাবে আমরা বাইজেন্টাইন রোমান সাম্রাজ্যের রাজধানী কন্স্ট্যান্টিনোপলকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠা অর্থডক্স্ চার্চের উপর বাইজেন্টাইন সম্রাটের আধিপত্যমূলক ভূমিকা দেখতে পাই; অর্থাৎ এ ক্ষেত্রে অর্থডক্স্ চার্চের পোপ হিসাবে অনেকাংশে ভূমিকা পালন করতেন সম্রাট নিজে। এর ফলে রাষ্ট্র ও ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের মধ্যে ক্ষমতার ভারসাম্যের যে অভাব ঘটে তার প্রকাশ আমরা দেখতে পাই অর্থডক্স্ চার্চ নিয়ন্ত্রিত খ্রীষ্টান সমাজগুলিতে। অর্থডক্স্ খ্রীষ্টান অধ্যুষিত রাশিয়ায়ও আমরা স্পষ্টরূপে এই বাস্তবতার প্রকাশ দেখতে পাই যেখানে রাষ্ট্র অনেকাংশে এশীয় স্বৈরতন্ত্রের অনুরূপ হয়ে গড়ে উঠেছে। এর ফলে যে সামন্ত শ্রেণী পশ্চিম ইউরোপে গড়ে উঠেছিল তার অনুরূপ কোন শ্রেণী আমরা এখানে দেখতে পাই না।
পশ্চিম ইউরোপে সামন্ত প্রভুরা রাজার অধীনস্থ হলেও তারা নিজ নিজ জমিদারী বা ভূখণ্ডে প্রায় স্বাধীন ছিল। কিন্তু পূর্ব ইউরোপ বিশেষত রাশিয়ায় ভূ-স্বামী বা সামন্তদের তেমন কোন অবস্থা ছিল না। রাশিয়ায় জার বা সম্রাটদের মর্জির উপর নির্ভর করত সামন্ত প্রভু বা ভূ-স্বামীদের অস্তিত্ব। এটা ঠিক যে জারের শাসন ব্যবস্থা ভূ-স্বামীদের উপর নির্ভর করত। কিন্তু তার মানে এই নয় যে বিশেষ কোন ভূ-স্বামীর অধিকারে হস্তক্ষেপ করার ক্ষমতা তার ছিল না।
কিন্তু পশ্চিম ইউরোপে ব্যাপারটা এত সহজ ছিল না। রোমান সাম্রাজ্যের পতনের সময় থেকে এখানে দীর্ঘ প্রক্রিয়ায় অঞ্চলগত বিভিন্নতা, জটিলতা ও পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে সামন্ত ব্যবস্থার একটি জটিল রূপ গড়ে উঠে। এখানে সামন্ত প্রভু ভিন্ন সত্তা। তার জমিদারী বা ভূ-স্বত্বে রাজা ইচ্ছা করলেই হস্তক্ষেপ করতে পারত না। তাদের অধিকারভুক্ত ভূমি তাদের ব্যক্তিগত অধিকারে থাকত যা তারা বংশপরম্পরায় ভোগদখল করত। তবে এটা ঠিক যে, এই সামন্ত প্রভুরা রাজাকে নিয়মিত কর এবং যুদ্ধের প্রয়োজনে রাজাকে সেনাবাহিনী দিয়ে সাহায্য করতে বাধ্য ছিল। তা সত্ত্বেও পশ্চিম ইউরোপে শত শত বৎসর ধরে সামন্ত শ্রেণীর এই আপেক্ষিক স্বাধীনতা বজায় ছিল। সামন্ত শ্রেণীর এই তুলনামূলক বা আপেক্ষিক স্বাধীনতা এবং রাজা বা রাষ্ট্রের ক্ষমতার সীমাবদ্ধতা সৃষ্টির ক্ষেত্রে ক্যাথলিক চার্চের ভূমিকাকে যদি আমরা বুঝতে বা চিনতে না পারি তবে পশ্চিম ইউরোপের সামন্তবাদ সম্পর্কে আমরা কিছুই বুঝব না। বস্তুত চার্চের এই ভূমিকার কারণে পশ্চিম ইউরোপে এমন এক সামন্ত ব্যবস্থা গড়ে উঠেছিল যার তুলনা আমরা পৃথিবীর কোথায়ও সেভাবে পাই না। এটা ঠিক যে জাপানে পশ্চিম ইউরোপের প্রায় অনুরূপ একটি সামন্ত শ্রেণী ও সামন্ত ব্যবস্থা গড়ে উঠেছিল। কিন্তু তা সত্ত্বেও জাপানের সামন্তবাদী সমাজ ব্যবস্থাকে পশ্চিম ইউরোপের সামন্তবাদী ব্যবস্থার সঙ্গে হুবহু এক করে দেখা ঠিক হবে না। যে কারণে জাপানের সামন্তবাদী সমাজের ভিতর থেকে পশ্চিম ইউরোপের মত করে পুঁজি বা পুঁজিবাদী সমাজের উদ্ভব ও বিকাশ ঘটানো যায় নাই। তবে জাপান যেটা করতে পেরেছিল সেটা হচ্ছে পশ্চিম ইউরোপ তথা পাশ্চাত্যকে অনুকরণ করে দ্রুত শিল্প সভ্যতা নির্মাণের পথ গ্রহণ করা।
যাইহোক, প্রায় স্বাধীন সামন্ত শ্রেণীর অস্তিত্ব রাজা বা রাষ্ট্রের ক্ষমতাকে সীমাবদ্ধ করায় পশ্চিম ইউরোপে রাষ্ট্র তুলনামূলকভাবে দুর্বল ছিল। এই অবস্থায় সামাজিক বিশৃঙ্খলা এবং পরিণতিতে বৈদেশিক আগ্রাসনে সমাজ ও রাষ্ট্রের ধ্বংস হওয়া স্বাভাবিক হতে পারত। বিশেষত খ্রীষ্টীয় ৮ম শতাব্দী থেকে ইসলামের যে অভিযান ইউরোপের উপর আছড়ে পড়ছিল (৭১১ খ্রীষ্টাব্দে তারিকের নেতৃত্বে ইসলামী আরব বাহিনী স্পেনে প্রবেশ করার পর সেখানে ইসলামের বিজয় অভিযান শুরু হয়) তার আঘাতে ইউরোপের প্রতিরোধের শক্তি চূর্ণ হতে পারত। মুসলিম আরবরা স্পেন জয় করল। পরবর্তীকালে তুর্কী মুসলিমরা বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্যের রাজধানী কন্স্ট্যান্টিনোপলও জয় করল (১৪৫৩ খ্রীষ্টাব্দ), যা ইস্তানবুল নাম নিয়ে আজ অবধি তুরস্কের অধিকারে আছে।
কিন্তু এর পরেও ইসলামী বাহিনী ইউরোপের অভ্যন্তরে খুব বেশী যে অগ্রসর হতে পারে নাই তার পিছনে ক্যাথলিক চার্চের ভূমিকা ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
ইসলামী আগ্রাসনে বাইজেন্টাইন রোমান সাম্রাজ্যের পতন-পরবর্তী কালে ইসলামী আগ্রাসনের বিরুদ্ধে পূর্ব ইউরোপে প্রতিরোধের শক্তি হিসাবে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করেছিল বৃহৎ ও শক্তিশালী রাষ্ট্র রাশিয়া। কিন্তু পশ্চিম ইউরোপ ছিল রাজনৈতিকভাবে তুলনায় অনেক বেশী বিভাজিত। বেশী রকম রাষ্ট্রীয় বিভাজন থাকলেও পশ্চিম ইউরোপের সমাজ বা রাষ্ট্রগুলিতে খ্রীষ্টধর্ম এবং পোপ কেন্দ্রিক চার্চ যে ঐক্য প্রতিষ্ঠা করে তা ইসলামী আক্রমণ অভিযান প্রতিহত করতে বিরাট ভূমিকা রাখে।
ক্যাথলিক চার্চের এই ঐক্য রক্ষাকারী ভূমিকা বলার সময় আমরা যেন এমন মনে না করি যে চার্চের আধিপত্যের ফলে পশ্চিম ইউরোপ অভ্যন্তরীণ যুদ্ধ ও বিদ্রোহ থেকে মুক্ত ছিল। রাজাদের তথা রাষ্ট্রগুলির মধ্যে পারস্পরিক যুদ্ধ যেমন লেগে থাকত তেমন রাজাদের বিরুদ্ধে সামন্তদের বিদ্রোহও অনুপস্থিত ছিল না। এ ছাড়া ছিল সামন্ত প্রভুদের নিজেদের মধ্যে যুদ্ধ। অর্থাৎ চার্চের নিয়ন্ত্রণ বা পোপের আধিপত্যের ফলে পশ্চিম ইউরোপে অভ্যন্তরীণভাবে শত শত বৎসর ব্যাপী শান্তিপূর্ণ অবস্থা বিরাজ করছিল এ কথা মনে করা ভুল হবে। কিন্তু তা সত্ত্বেও সবার উপরে পোপের নৈতিক অবস্থান পশ্চিম ইউরোপকে অনেকখানি সামাজিক সংহতি এবং তুলনামূলক শান্তি ও স্থিতিশীলতা দিয়েছিল। এর জন্য প্রাচ্য সমাজের মত প্রধানত বৃহদায়তন রাষ্ট্র অথবা নিরঙ্কুশ স্বৈরতন্ত্র নির্ভর এককেন্দ্রিক শাসনের প্রয়োজন হয় নাই।
পশ্চিম ইউরোপে চার্চের এই ভূমিকাকে বুঝলে আমরা সেখানে ভিতর থেকে বুর্জোয়া সমাজের উত্থানের প্রক্রিয়াকেও অনেকাংশে বুঝতে পারব। বুর্জোয়া শ্রেণীকে কেন্দ্র করে আধুনিক এবং শিল্প সভ্যতার যে উদ্ভব পশ্চিম ইউরোপে হয়েছে তার মর্মে যে ব্যক্তিসত্তা আছে তাকে বুঝতে না পারলে আমরা আধুনিক ইউরোপের উদ্ভবের বিষয়টাও বুঝব না। বস্তুত রাষ্ট্র থেকে চার্চের স্বতন্ত্র এবং প্রাধান্যকারী অবস্থান পশ্চিম ইউরোপে রাজা বা রাষ্ট্রকে নিরকুশ হতে দেয় নাই। এর ফলে সেখানে সামন্ত শ্রেণীর তুলনামূলকভাবে স্বাধীন অস্তিত্ব সম্ভব হয়। এই সামন্ত শ্রেণীর শক্তিশালী অবস্থান রাজার বা রাষ্ট্রের শক্তিকে খর্ব করত যা আবার চার্চকে সুবিধাজনক অবস্থায় রাখত। এভাবে পশ্চিম ইউরোপে চার্চ, রাষ্ট্র এবং সামন্ত শ্রেণীর মধ্যে দ্বন্দ্বের পাশাপাশি ঐক্য ও সমন্বয়ের মাধ্যমে এমন এক ভারসাম্য প্রতিষ্ঠিত ছিল যার ফলে সেখানে ব্যক্তি ও গণতন্ত্রের বীজ রক্ষা পেয়েছিল।
চার্চের প্রধান বা পোপ বংশগত হতে পারত না। কারণ পাদ্রী বা পুরোহিতরা বিবাহ করতে পারত না। সুতরাং এখানে যে ধরনের হোক নির্বাচন বা মনোনয়নের ভূমিকা থেকে গিয়েছিল। অন্য দিকে, সামন্ত ভূস্বামীর ব্যক্তি মালিকানার মধ্যে রক্ষা পেয়েছিল ব্যক্তির মালিকানা এবং অধিকার। সর্বোপরি, রাজাকে পরামর্শ দান এবং রাজকার্যে সহায়তার জন্য যে রাজসভা বা পার্লামেন্ট থাকত সেখানে সামন্ত্র প্রভু এবং পুরোহিত বা পাদ্রীরা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করত। এই রকম এক সামাজিক বাস্তবতায় ব্যবসায়ী এবং কারখানা মালিকদের অস্তিত্ব পরবর্তীকালে পুঁজিবাদের দিকে অর্থনীতির ক্রমবিকাশে ধীরগতিতে হলেও ভূমিকা রেখেছিল।
তবে নবজাগরণের পূর্ব পর্যন্ত গোটা মধ্য যুগ ছিল অন্ধকারের যুগ যখন যুক্তি ও জ্ঞান-বিজ্ঞানের পরিবর্তে প্রধানত ধর্ম বিশ্বাস দ্বারা মানুষের সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় জীবন নিয়ন্ত্রিত হত। ধর্ম ছিল মধ্য যুগের ভাবাদর্শ। যে কথা ইতিপূর্বে বলেছি চতুর্দশ-সপ্তদশ শতাব্দীতে প্রাচীন গ্রীক ও রোমান বা লাতিন শিল্পকলা ও জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চার পুনরুজ্জীবনের ফলে নবজাগরণ শুরু হলে অন্ধকার যুগের অবসান ঘটে এবং ধর্মের যে আধিপত্য ইউরোপে এতকাল ছিল তা ভেঙ্গে পড়তে থাকে। তবে রেনেসাঁর পূর্বে ছিল প্রায় দুই শতাব্দীব্যাপী ক্রুসেড বা ধর্মযুদ্ধের কাল।
ক্রুসেড ছিল খ্রীষ্টানদের তীর্থভূমি জেরুসালেম এবং প্যালেস্টাইনকে মুসলমানদের আধিপত্য থেকে মুক্ত করার জন্য ইউরোপের খ্রীষ্টানদের যুদ্ধ, যা ১০৯৬ সালে শুরু হয়ে ১২৯১ সাল পর্যন্ত চলে। খ্রীষ্টীয় শক্তি প্যালেস্টাইন মুক্ত করার জন্য অনেক কয়টি অভিযান পরিচালনা করে এবং জেরুসালেম ও প্যালেস্টাইনের অনেক এলাকা মুক্ত করতে সক্ষমও হয়। কিন্তু শেষ পর্যন্ত ক্রুসেড ব্যর্থ হয়। মুসলমানদের হাতে ১২৯১-তে খ্রীষ্টানদের শেষ দুর্গের পতন হলে খ্রীষ্টানদের জেরুসালেমকে মুক্ত করার চেষ্টা শেষ পর্যন্ত পরিত্যক্ত হয়। এভাবে ক্রুসেডের অবসান হয়। দুইশত বৎসর ব্যাপী ক্রুসেডে ইউরোপের বিপুল জীবন ও সম্পদ ক্ষয় হয়। ক্রুসেডের ব্যর্থতা ছিল পোপ এবং ধর্মের মর্যাদার উপর বিরাট আঘাত। এর ফলে নূতন উদ্যমে জেগে উঠতে থাকা ইউরোপের শক্তি জ্ঞান-বিজ্ঞান ও জাগতিক উন্নয়নের পথে এগিয়ে যাবার সুযোগ পায়। এর ফলে ঘটে নবজাগরণ। এটা লক্ষ্যণীয় যে, ক্রুসেডের সমাপ্তি এবং নবজাগরণের সূচনা প্রায় একই সময়ে ঘটে। প্যালেস্টাইনের শেষ খ্রীষ্টান দুর্গের পতন ঘটে ১২৯১-তে। এটাও লক্ষ্যণীয় যে নবজাগরণ চর্তুদশ শতাব্দীতে প্রবল রূপ নিলেও তার সূচনা প্রকৃতপক্ষে ক্রয়োদশ শতাব্দীর শেষ দিক থেকে হয়। অর্থাৎ ব্যাপারটা এমন যে, ব্যর্থ ধর্মযুদ্ধের কাল শেষ হবার পাশাপাশি শুরু হয়েছে সফল নবজাগরণের কাল। এভাবে ইউরোপের উত্থান শুরু হয়।
তবে এই উত্থান বাধামুক্ত ছিল না। অনেক সংগ্রাম করেই নবজাগরণের পথে ইউরোপকে অগ্রসর হতে হয়েছে। এই সংগ্রাম ছিল প্রধানত বিদ্যমান ধর্মের আধিপত্যের বিরুদ্ধে। একদিকে, ধর্মযুদ্ধের ব্যর্থতা, অপরদিকে সাহিত্য, শিল্পকলা ও জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চার ফলে নবজাগরণ ক্যাথলিক চার্চের প্রবল প্রভাবের উপর আঘাত হানে। তার ফলে জ্ঞান জগতে লোকবাদী বা জাগতিক চেতনার উন্মেষ ঘটাটা যে সম্ভব হয় শুধু তা-ই নয়, অধিকন্তু এর একটা ফল হয় বিদ্যমান খ্রীষ্টান ধর্মের সংস্কার। ক্যাথলিক চার্চের আধিপত্যের বিরুদ্ধে লুথার (১৪৮৩-১৫৪৬), ক্যালভিন (১৫০৯-১৫৬৪), জুইংলি (১৪৮৪-১৫৩১) ইত্যাদি বিভিন্ন ধর্ম সংস্কারক তাদের মতবাদ প্রচার করতে থাকেন, যার মূল কথা ছিল যীশু খ্রীষ্টের মূল আদর্শে ফিরে যাওয়া তথা মূল বাইবেলের শিক্ষায় খ্রীষ্টান সমাজের পুনর্গঠন।
প্রোটেস্ট্যান্ট আন্দোলন (ষোড়শ শতাব্দীতে সূচিত) পশ্চিম ইউরোপের উত্তরাংশে ক্রমে ব্যাপকভাবে জনপ্রিয় হয়ে উঠে। ক্যাথলিক চার্চ তাকে দমনের জন্য অনেক চেষ্টা চালায়। বিভিন্ন দেশে বহু সংখ্যক প্রোটেস্ট্যান্টকে হত্যা করা হয়। ইংল্যান্ড, ফ্রান্স, জার্মানিসহ ইউরোপের বিভিন্ন দেশে প্রোটেস্ট্যান্ট ও ক্যাথলিকদের মধ্যে যুদ্ধও সংঘটিত হয়, যার ফলে লক্ষ লক্ষ মানুষের প্রাণহানি ঘটে। কিন্তু প্রোটেস্ট্যান্ট তথা ধর্ম সংস্কার আন্দোলনের প্রভাবকে ঠেকানো গেল না। ক্রমে সমাজ ও রাষ্ট্রের উপর থেকে চার্চের নিয়ন্ত্রণ শিথিল হল।
প্রোটেস্ট্যান্ট আন্দোলনের প্রভাব পশ্চিম ইউরোপের দেশগুলিতে পোপ তথা কেন্দ্রীভূত চার্চের মর্যাদায় বিরাট আঘাত করে। এর ফলে রাষ্ট্রের উপর এতকাল ধর্ম ও ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান হিসাবে চার্চের যে আধিপত্য ছিল তা দুর্বল হতে বা ভেঙ্গে পড়তে থাকে। এই ভাঙ্গন সবচেয়ে প্রবল রূপ নেয় ইংল্যান্ডসহ উত্তরের কয়েকটি দেশে। একদিকে, ষোড়শ শতাব্দীতে শুরু হয়ে ইউরোপব্যাপী সাধারণ মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ছিল ধর্মসংস্কার আন্দোলন। অপর দিকে, সপ্তদশ শতাব্দী থেকে শুরু হল যুক্তি ও জ্ঞান চর্চা নির্ভর আলোকায়নের যুগ (Age of Enlightenment বা Age of Reason), যা চলল অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষ ভাগ পর্যন্ত। চার্চের আধিপত্যের যুগ শেষ হয়েছে। ফলে দর্শন ও যুক্তির বিচারে জীবন ও জগতের সবকিছুকে দেখার একটা জোয়ার শুরু হয় বুদ্ধিবৃত্তির জগতে। ধর্মসংস্কার এবং আলোকায়নের যুগের আর একটা ফল ইউরোপে জাতি-রাষ্ট্রের উদ্ভব ও বিকাশ। মানুষের চিন্তার জগতে যে বিপ্লব ঘটতে থাকে তার ফল হল যুগান্তকারী। চিন্তার বিপ্লবের হাত ধরাধরি করে ঘটতে শুরু করে রাজনৈতিক তথা রাষ্ট্র বিপ্লব। ইংল্যান্ডে সপ্তদশ শতাব্দীতে পার্লামেন্টের সঙ্গে রাজার বিবাদ ঘটে, যা ক্রমে গৃহযুদ্ধ ও বিপ্লবে রূপ নেয়। এই বিপ্লবে একটা পর্যায়ে ক্রমওয়েলের (জন্ম ২৫ এপ্রিল ১৫৯৯ - মৃত্যু ৩ সেপ্টেম্বর ১৬৫৮) নেতৃত্বমূলক ভূমিকা প্রতিষ্ঠিত হয়। রাজা ১ম চার্লস পরাজিত ও বন্দী হন। বিচারে রাজাকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়। ৩০ জানুয়ারী ১৬৪৯-এ রাজার শিরোশ্ছেদ করা হয়। ১৬৫৩ থেকে ১৬৫৮ পর্যন্ত ক্রমওয়েল শাসন করেন। ক্রমওয়েলের মৃত্যুর পর রাজতন্ত্র ফিরে এলেও ইতিহাসের গতি ছিল নিরঙ্কুশ রাজতন্ত্রের বিরুদ্ধে। ১৬৮৮-তে আর একটি বিপ্লবের মধ্য দিয়ে রাষ্ট্র শাসনের মূল ক্ষমতা পার্লামেন্টের হাতে চলে যায়। ফ্রান্সে ১৭৮৯-তে ঘটে আরও প্রচণ্ড এবং যুগান্তকারী একটি ঘটনা - ফরাসী বিপ্লব। এইভাবে পশ্চিম ইউরোপে আধুনিক শিল্প সভ্যতার নায়ক হিসাবে যে ব্যক্তিসত্তা অপরিহার্য ছিল তার উদ্ভব ঘটে। ফলে ইউরোপে ঘটল আধুনিক সভ্যতার সূচনা। ঘটল শিল্প বিপ্লব। প্রতিষ্ঠিত হল শিল্প নির্ভর এবং গণতান্ত্রিক সমাজ ও রাষ্ট্র। এই সব ঘটনার পাশাপাশি পৃথিবী ব্যাপী চলল ইউরোপের জয়যাত্রা।
এটা স্পষ্ট যে ধর্মের তথা চাচের্র আধিপত্য খর্ব না হলে আধুনিক ইউরোপের জন্ম সম্ভব হত না। কিন্তু বিস্ময়কর মনে হলেও এটাই আবার সত্য যে, আধুনিক ইউরোপের জন্মই সম্ভব হত না যদি সেখানে খ্রীষ্টধর্ম না থাকত এবং কয়েক শতাব্দী ব্যাপী ক্যথলিক চার্চের আধিপত্য না থাকত।
কেন এ কথা বলছি তা বুঝার জন্য খ্রীষ্টধর্মের কিছু বৈশিষ্ট্যের দিকে দৃষ্টি দেওয়া দরকার। এটা ঠিক যে আর সব আলোকবাদী ধর্মের মত খ্রীষ্টধর্মও অন্ধ ও যুক্তি-প্রমাণহীন বিশ্বাসের উপর প্রতিষ্ঠিত। যেমন ঈশ্বর, আত্মা, স্বর্গ-নরক ইত্যাদি সংক্রান্ত ধারণা। কিন্তু এ ধরনের বিশ্বাস নির্ভর ধারণাগুলি সে কালে সাধারণ মানুষের জন্য স্বাভাবিক ছিল এবং দেবতা বা ইশ্বর কিংবা অলৌকিক শক্তি এবং আত্মা ইত্যাদি ধারণাকে কেন্দ্র করে মানুষ তার ধারণা বা বিশ্বাসের যে কাঠামো গড়ে তুলত তা দিয়ে তার বাস্তব জীবনকেও কম বা বেশী নিয়ন্ত্রণ ও পরিচালনা করতে চাইত। কিন্তু এই বিশ্বাসের কাঠামো নির্মাণের ক্ষেত্রে খ্রীষ্টধর্ম এমন কিছু মূল্যবোধ এবং নীতি বা ধারণাকে গুরুত্ব দিয়েছিল যা মানুষের মানবিক গুণাবলীর বিকাশের ক্ষেত্রে বিরাট ভূমিকা রেখেছিল। যীশুখ্রীষ্টের বাণীতে ধর্ম-বর্ণ-জাতি নির্বিশেষে মানুষের জন্য প্রেম, সহমর্মিতা এবং সেবা ধর্মকে যে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে এ ক্ষেত্রে তার উল্লেখ করতে হয়। খ্রীষ্টধর্মে শুধু যে যীশু ইশ্বর পুত্র তা-ই নয়, এমন কি মানুষও তা-ই, যে কারণে বাইবেলে যীশু ঈশ্বরকে নিজের সঙ্গে অন্য সব মানুষের পিতা বলছেন, ‘কেননা তোমরা সকলে, খ্রীষ্ট যীশুতে বিশ্বাস দ্বারা, ঈশ্বরের পুত্র হইয়াছ।’(বাইবেল, নূতন নিয়ম, গ্যালাতীয়, ৩:২৬)।* কিংবা ‘তখন যীশু লোকসমূহকে ও নিজ শিষ্যদিগকে কহিলেন, ..... তোমরা সকলে ভ্রাতা। আর পৃথিবীতে কাহাকেও “পিতা” বলিয়া সম্বোধন করিও না, কারণ তোমাদের পিতা এক জন, তিনি সেই স্বর্গীয়।’(বাইবেল, নূতন নিয়ম, মথি লিখিত সুসমাচার, ২৩:১,৮-৯)। অথবা ‘যীশু তাঁহাকে (মগ্দলীনী মরিয়মকে) কহিলেন, আমাকে স্পর্শ করিও না, কেননা এখনও আমি ঊর্ধ্বে পিতার নিকটে যাই নাই; কিন্তু তুমি আমার ভ্রাতৃগণের কাছে গিয়া তাহাদিগকে বল, যিনি আমার পিতা ও তোমাদের পিতা, এবং আমার ঈশ্বর ও তোমাদের ঈশ্বর, তাঁহার নিকটে আমি ঊর্ধ্বে যাইতেছি।’ (যোহন- ২০:১৭)।
অর্থাৎ মানুষের সঙ্গে ঈশ্বরের সম্পর্ক মূলত দাস ও প্রভুর না হয়ে সন্তান ও প্রেমময় পিতার সম্পর্ক হয়ে দেখা দেয়। বাইবেলে মানুষের প্রতি যে বিরাট মর্যাদা যীশু দিয়েছেন তার প্রভাবে মানুষকে অধিকারহীন ও অসহায় দাস বা ইসলামের মত ‘বান্দা’ হিসাবে না দেখে মানুষ হিসাবে দেখা হয়েছে। খ্রীষ্টীয় এই দৃষ্টিভঙ্গীর গভীরে ধর্মীয় আবরণে সংগুপ্ত ছিল ব্যক্তি মানুষের মুক্তি এবং স্বাধীনতার চেতনা।
অপর একটি বৈশিষ্ট্য খ্রীষ্টধর্মকে অনন্যতা দান করেছে, তা হল এক স্বামী-এক স্ত্রী ভিত্তিক বিবাহ ব্যবস্থার প্রতি গুরুত্ব প্রদান, ‘সুতরাং তাহারা আর দুই নয়, কিন্তু একাঙ্গ।‘ (মথি- ১৯:৬)
----------------------------
* পবিত্র বাইবেল : নূতন ও পুরাতন নিয়ম, বাংলা অনুবাদ, বাংলাদেশ বাইবেল সোসাইটি, ঢাকা।
----------------------------
বস্তুত এর ফলে প্রাচ্য সমাজে অখ্রীষ্টীয় সমাজগুলিতে এক স্বামীর বহু নারী বিবাহের যে অবাধ সুযোগ ছিল ইউরোপে সেই সুযোগ থাকে নাই। খ্রীষ্টধর্ম পুরুষতান্ত্রিক হলেও এবং নারী-পুরুষের সমাধিকার না দিলেও এক স্বামী এক স্ত্রী ব্যবস্থার উপর গুরুত্ব দিবার ফল হয়েছে যুগান্তকারী। এটি ভবিষ্যতে নারীর জন্য অধিকতর অধিকার বা সমাধিকার লাভের পথ খুলে দেয়।
অতীতে বিভিন্ন সময়ে আমরা ইউরোপে নারীর যে মর্যাদা ও ভূমিকা দেখতে পাই তা সমকালীন অনেক সমাজের তুলনায় বিস্ময়কর। শুধু ডাইনি পুড়ানো দেখলে হবে না। সামাজিক ও রাজনৈতিক জীবনে নারীদের অংশগ্রহণকেও দেখতে পারতে হবে। এখানে স্পেনের রাণী ইসাবেলার (জন্ম ১৪৫১ খ্রীঃ - মৃত্যু ১৫০৪ খ্রীঃ। শাসনকাল ১৪৭৪-১৫০৪।) দৃষ্টান্ত উল্লেখ করা যায়। তিনি তার বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকার জন্য স্মরণীয় হয়ে আছেন। তিনি ছিলেন স্পেনের উত্তরাঞ্চলের একটি শক্তিশালী রাজ্য ক্যাস্তিলের রাণী। স্পেনের উত্তরাঞ্চলের অপর একটি শক্তিশালী রাজ্য আরাগনের রাজসিংহাসনের উত্তরাধিকারী ফার্দিনান্দকে তিনি ১৪৬৯-এ বিবাহ করেন এবং স্বামীর সঙ্গে সম্মিলিতভাবে তার সেনাবাহিনী নিয়ে যুদ্ধ করে ১৪৯২ খ্রীষ্টাব্দে মুসলিমদের শেষ রাজ্য গ্রানাডা জয়ের মাধ্যমে সমগ্র স্পেন থেকে মুসলিম শাসন উচ্ছেদ করেন। এই জয়ের মাধ্যমে স্পেন থেকে আটশত বৎসর স্থায়ী মুসলিম শাসন উচ্ছেদ হয়। স্পেনে ইসলামী শাসন ছিল ৭১১ খ্রীষ্টাব্দ থেকে ১৪৯২ খ্রীষ্টাব্দ পর্যন্ত স্থায়ী। স্বামীর সঙ্গে রাণী ইসাবেলা যৌথভাবে স্পেন শাসন করেন। আমেরিকা আবিষ্কারের (১৪৯২ খ্রীঃ) জন্য অর্থ, জাহাজ ও জনবল দিয়ে তিনি ক্রিস্টোফার কলম্বাসকে সাহায্য করেন। এভাবে আমেরিকা আবিষ্কারের কৃতিত্বের সঙ্গে তার নামও জড়িয়ে গেছে।
মধ্যযুগে খ্রীষ্টান ইউরোপের বিভিন্ন রাজ্যে রাষ্ট্র পরিচালনায় নারীদের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা সম্পর্কে জানা যায়, যা প্রাচ্য সমাজে সাধারণভাবে অভাবিত ছিল। মুসলমানদের অধিকার থেকে জেরুসালেম ও প্যালেস্টাইনকে মুক্ত করার জন্য দুই শত বৎসর ব্যাপী পরিচালিত ক্রুসেডে ইউরোপের খ্রীষ্টান নারীদের বিপুল ভূমিকা ছিল। পুরুষদের পাশাপাশি তারা যুদ্ধে অংশ নিয়েছিল এবং প্রাণ বিসর্জন দিয়েছিল।
মধ্যযুগীয় ইউরোপের নাইট বা যোদ্ধা শ্রেণীর কথা হয়ত অনেকের জানা আছে। তাদেরকে আমরা প্রাচীন ভারতের ক্ষত্রিয় কিংবা আরও সঠিকভাবে জাপানের সামুরাই যোদ্ধা শ্রেণীর সঙ্গে তুলনা করতে পারি। তাদের ‘শিভালরি’ বা বীরধর্মের একটি গুরুত্বপূর্ণ নীতি ছিল নারীর প্রতি সম্মান এবং নারী ও দুর্বলের বিপদ দেখলে তাকে উদ্ধারের জন্য ঝাঁপিয়ে পড়া। ইউরোপ এমনই ইউরোপ হয় নাই। নারীর প্রতি এই যে গুরুত্ব ও মর্যাদা দান তার ভাবাদর্শিক প্রেরণার উৎস যদি খ্রীষ্টধর্মে না থাকত তাহলে আমরা মধ্যযুগের ইউরোপে নারীর এমন গুরুত্বপূর্ণ ও মর্যাদাপূর্ণ অবস্থান দেখতে পেতাম না। কারণ মধ্যযুগের ভাবাদর্শ ছিল ধর্ম।
এমনিতে খ্রীষ্টধর্ম ছিল শান্তিবাদী। শান্তিপূর্ণভাবে জন্ম নেওয়া এই ধর্ম সুদীর্ঘকাল ছিল নির্যাতনের শিকার। প্রথমে ইহুদীদের চাপে এই ধর্মের প্রতিষ্ঠাতা যীশুখ্রীষ্টকে প্যালেস্টাইনের রোমান শাসক ক্রুশবিদ্ধ করেন। এরপরও যখন রোমান সাম্রাজ্যে খ্রীষ্টধর্ম ছড়িয়ে পড়তে থাকে তখন বহুসংখ্যক খ্রীষ্টানকে হত্যা ও অবর্ণনীয় নির্যাতন করা হয়। কিন্তু তা সত্ত্বেও খ্রীষ্টধর্মের প্রসারকে রোধ করা যায় নাই। এটি ছিল প্রথমে দাস, দরিদ্র এবং নিম্নবর্গের জনসাধারণের ধর্ম। কিন্তু ক্রমে রোমের স্বাধীন মানুষ, দাস মালিক, রোমের সেনাবাহিনীর সদস্য এবং উচ্চ শ্রেণীর নাগরিকদের মধ্যেও তা বিস্তৃত হয়। প্রায় তিনশত বৎসর পর রোমের সম্রাট কন্সট্যান্টাইন (শাসনকাল ৩০৬ খ্রীঃ - ৩৩৭ খ্রীঃ) ৩১৩ খ্রীষ্টাব্দে ‘মিলান অনুশাসন’ দ্বারা খ্রীষ্টধর্মসহ সকল ধর্মের প্রতি সহনশীলতার নীতি ঘোষণা করলে খ্রীষ্টধর্মের সঙ্গে রোমান রাষ্ট্রের দ্বন্দ্বমূলক সম্পর্কের অবসান হয়। তার মা হেলেনা ছিলেন খ্রীষ্টান। তিনিও তার মায়ের ধর্ম গ্রহণ করেন। সম্রাট কন্সট্যান্টাইনের উপর খ্রীষ্টধর্মের প্রভাব সম্পর্কে বলতে গিয়ে এটুকু বলাই মনে হয় এখানে যথেষ্ট হবে যে, মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত ব্যক্তিদেরকে ক্রুশবিদ্ধ করে ভয়ানক যন্ত্রণা দিয়ে রোমান সাম্রাজ্যে হত্যার যে জনপ্রিয় বিধান ছিল তা রদ করে তিনি মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত ব্যক্তিদের ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করার বিধান চালু করেন। এবং ৩২৫ খ্রীষ্টাব্দে তিনি গ্ল্যাডিয়েটদের দিয়ে দর্শকদের মনোরঞ্জনের জন্য অনুষ্ঠিত নৃশংস মরণ খেলা নিষিদ্ধ করেন। তাছাড়া রোমান সাম্রাজ্যের বন্দীদেরকে কারাগারের অন্ধকারে সারাক্ষণ রাখা নিষিদ্ধ করে তিনি তাদেরকে কারাকক্ষের বাইরে যাবার এবং দিনের আলো পাবার অধিকার দেন।
ভয়ানক সহিংসতা, নির্দয়তা, অসাম্য, যুদ্ধ এবং দাসত্বের উপর প্রতিষ্ঠিত রোমান সভ্যতার বিরুদ্ধে খ্রীষ্টধর্ম ছিল একটা প্রতিক্রিয়া বা বিদ্রোহ। তবে এই বিদ্রোহ ছিল শান্তিপূর্ণ। কিন্তু দাস, দরিদ্র এবং পরাধীন জাতিসমূহের মানুষদের মনে মানুষের মুক্তির জন্য ক্রুশে আত্মদানকারী যীশুর প্রভাব হল দূর প্রসারী ও প্রচণ্ড। প্রেমময় ও দয়ার্দ্র যে সত্তার আশ্রয় সাধারণ মানুষ খুঁজে ফিরছিল তা তারা পেল ক্রুশবিদ্ধ যীশু এবং তার প্রেমময় ও পরম পিতা ঈশ্বরের কল্পনার মধ্যে।
পোপকে কেন্দ্র করে রোমান ক্যাথলিক চার্চের বিকাশ আদি খ্রীষ্টান ধর্মের সহজ, সরল ও বিকেন্দ্রীভূত রূপের অবসান ঘটায় এবং মূল খ্রীষ্টান ধর্মে ছিল না এমন কিছু প্রথা বা নিয়মের বিকাশ ঘটায়। এর মধ্যে একটা ছিল অর্থের বিনিময়ে চার্চ বা পোপের নিকট থেকে পাপমোচন এবং স্বর্গে যাবার ব্যবস্থা। রাষ্ট্র থেকে পার্থক্য থাকলেও রাষ্ট্রের উপরেও চার্চের নিয়ন্ত্রণ বা আধিপত্য চার্চকে ক্রমে একটি বিশেষ সুবিধাভোগী এবং নিপীড়ক প্রতিষ্ঠানে পরিণত করেছিল। ক্রুসেডের ব্যর্থতা এবং রেনেসাঁ বা নবজাগরণ চার্চের নিয়ন্ত্রণকে দুর্বল করে ফেলে। এই অবস্থায় সাধারণ মানুষের ধর্মীয় চেতনার সঙ্গে সঙ্গতি রেখে একটি ধর্ম সংস্কার আন্দোলনের উত্থান স্বাভাবিক ছিল। এটা কেন্দ্রীভূত চার্চের ক্ষমতার অবসান ঘটায়। এর ফলে ধর্ম যেমন আদি খ্রীষ্টধর্মের ব্যক্তির বিশ্বাস পালনের স্বেচ্ছামূলক জায়গায় ফিরল তেমন রাষ্ট্র হয়ে উঠল অনেকাংশে ধর্মের খবরদারি মুক্ত। এই অবস্থায় বুদ্ধিবৃত্তির উন্নততর চাহিদা পূরণে দেখা দিল 'এনলাইটেনমেন্ট' বা আলোকায়নের যুগ; গুরুত্ব পেল যুক্তি এবং ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য।
এভাবে ব্যক্তি ও তার চেতনার মুক্তির ফলে পুঁজির বিকাশের যে পরিবেশ সৃষ্টি হল তা সম্ভব করল উন্নততর যন্ত্র-কৌশল প্রবর্তনের মাধ্যমে শিল্প বিপ্লব। এ ক্ষেত্রে অষ্টাদশ শতাব্দীতে ইংল্যান্ডে স্টীম ইঞ্জিন উদ্ভাবন ছিল বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। এভাবে শুধু ইউরোপ নয়, পৃথিবীও প্রবেশ করল মানুষের ইতিহাসের নবতর অধ্যায়ে, যে অধ্যায়ে আজ আমরা বাস করছি। ব্যক্তির মুক্তি না ঘটলে আধুনিক পুঁজির এবং সভ্যতার এই জয়যাত্রা সম্ভব হত না।
ক্যাথলিক চার্চের নিয়ন্ত্রণ মুক্ত হয়ে বিভিন্ন প্রোটেস্ট্যান্ট মতবাদ ও চার্চের বিকাশ এবং পাশাপাশি যুক্তিবাদের ক্রমপ্রসার একদিকে উদার ধর্মমতের দিকে যেমন সমাজের বৃহত্তর অংশকে নেয় অপর দিকে তেমন একটি সংখ্যালঘু কিন্তু উন্নততর বুদ্ধিবৃত্তি ও জ্ঞানতত্ত্বের অধিকারী গোষ্ঠীকে ক্রমবর্ধমানভাবে নিরীশ্বরবাদ বা ধর্ম সম্পর্কে অবিশ্বাসের দিকে নেয়। কিন্তু ধর্ম বিশ্বাসের ব্যাপারে যেমনটাই ঘটুক চার্চের জবরদস্তি বা বলপ্রয়োগের কাল শেষ হয়।
ধর্ম বিশ্বাসের ক্ষেত্রে এইসব আন্দোলন ও পরিবর্তনের পাশাপাশি ঘটতে থাকে সামন্তবাদ ও স্বৈরতন্ত্র বিরোধী গণতান্ত্রিক চেতনা ও আন্দোলনের ক্রমবিকাশ। সপ্তদশ-অষ্টাদশ শতাব্দীতে ইংল্যান্ড-ফ্রান্সসহ বিভিন্ন দেশ প্রত্যক্ষ করে জাতীয় ও গণতান্ত্রিক বিপ্লব। সপ্তদশ শতাব্দীর মধ্যবর্তী সময়ে ইংল্যান্ডে রাজা ও পার্লামেন্টের মধ্যে যুদ্ধে রাজা পরাজিত এবং রাজতন্ত্র সাময়িকভাবে উচ্ছেদ হলেও ১৬৬০ সালে রাজতন্ত্র ফিরে আসে। ফ্রান্সেও ১৭৮৯-এর প্রচণ্ড রক্তক্ষয়ী বিপ্লবের মাধ্যমে রাজতন্ত্র উচ্ছেদ হলেও পরবর্তী সময়ে নেপোলিয়নের নেতৃত্বে পুনরায় রাজতন্ত্র ফিরে আসে। কিন্তু এগুলি ছিল পূর্বতন রাজতন্ত্রের অক্ষম অনুকরণ। ইংল্যান্ডে ১৬৮৮-এর বিপ্লবের মাধ্যমে রাজতন্ত্র নিয়মতান্ত্রিক এবং নিয়ন্ত্রিত রাজতন্ত্রে পর্যবসিত হয় যেখানে রাজার নামে প্রকৃতপক্ষে জন-প্রতিনিধিরা দেশ শাসন করে। ফ্রান্স বিভিন্ন পটপরিবর্তনের মধ্য দিয়ে প্রজাতন্ত্রে পরিণত হয়।
এভাবে পশ্চিম ইউরোপ পুঁজিবাদের বিকাশ ও শিল্প বিপ্লবের পাশাপাশি গণতান্ত্রিক বিপ্লব এবং রাষ্ট্র গঠনের দিকে এগিয়ে যায়। কিন্তু আধুনিক গণতন্ত্র এবং গণতান্ত্রিক ও মানবিক মূল্যবোধের অনেক কিছুরই বীজ আমরা খুঁজে পাব খ্রীষ্টধর্মের ভিতর। ধর্ম বিশ্বাসের অন্ধত্ব এবং বিশেষত ধর্মের কেন্দ্রীয় প্রতিষ্ঠান হিসাবে চার্চের জবরদস্তির চাপে যে ব্যক্তিসত্তার বীজ ছিল এতকাল সঙ্কুচিত ও অবদমিত হয়ে কেন্দ্রীভূত চার্চের অবসান পশ্চিম ইউরোপের সামন্তবাদী সমাজ জমিতে সেই বীজের অঙ্কুরোদ্গমের মাধ্যমে পুঁজিবাদ ও গণতন্ত্রের উত্থানের পথ করে দেয়।*
----------------------------
* সমাজতত্ত্ববিদ ম্যাক্স ওয়েবার প্রোটেস্ট্যান্ট নীতিবোধের মধ্যে পুঁজিবাদের বিকাশের শর্ত দেখতে পেয়েছেন। Max Weber, The Protestant Ethic and the Spirit of Capitalism.
----------------------------
দ্বিতীয় অধ্যায়
রাশিয়ার অভিজ্ঞতা
রোমকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠা রোমান সাম্রাজ্য প্রায় সমগ্র উত্তর ও পশ্চিম ইউরোপ এবং ভূমধ্যসাগর তীরবর্তী এশিয়া-আফ্রিকার বিশাল অঞ্চল ব্যাপী বিস্তৃত ছিল। বহুকাল পর্যন্ত তার রাজধানী রোম থেকে সমগ্র সাম্রাজ্য শাসিত হত। কিন্তু পরবর্তী সময়ে শাসনের সুবিধার জন্য সম্রাট কনস্ট্যান্টাইনের শাসনকালে ৩৩০ খ্রীষ্টাব্দে রাজধানী পূর্ব দিকের গ্রীক উপনিবেশে অবস্থিত বাইজেনটিয়ামে নেওয়া হয়। এ ছাড়া শেষ দিকে সাম্রাজ্যে যখন দুর্বলতা দেখা দেয় তখন শাসনের সুবিধার জন্য সাম্রাজ্যকে কয়েক বার ভাগ করা হয়। কিন্তু চূড়ান্ত ভাগ হয় ৩৯৫ খ্রীষ্টাব্দে যখন সম্রাট ১ম থিওডসিয়াস রোমান সাম্রাজ্যকে তার দুই পুত্র আরকাডিয়াস এবং অনরিয়াসের মধ্যে ভাগ করে দিয়ে যান। পশ্চিম রোমান সাম্রাজ্য রোমকে কেন্দ্র করে এবং পূর্ব রোমান সাম্রাজ্য বাইজেনটিয়ামকে কেন্দ্র করে পরিচালিত হয়। বাইজেনটিয়ামের নাম পরবর্তী কালে কন্সট্যান্টিনোপল করা হয়।
এই বিভাজন চার্চের বিভাজনকে ত্বরান্বিত করে। সাম্রাজ্যের দুই অংশে পূর্ব থেকেই খ্রীষ্টধর্মের গ্রন্থ বাইবেলের ভাষাকে কেন্দ্র করে এমনিতে বিভাজন ছিল। রোম কেন্দ্রিক পশ্চিম অঞ্চলে বাইবেল লেখা হত লাতিন ভাষায়, অন্যদিকে পূর্ব দিকের ভাষা ছিল গ্রীক। পরবর্তী কালে এর সঙ্গে আরও বিভিন্ন পার্থক্য যুক্ত হতে থাকে এবং সবশেষে বিবাদের মধ্য দিয়ে ১০৫৪-তে রোমের চার্চ এবং কনস্ট্যান্টিনোপল কেন্দ্রিক বাইজেনটাইন চার্চ পৃথক হয়ে যায়। এই কন্সট্যাটিনোপল কেন্দ্রিক চার্চ সাধারণভাবে পরিচিত অর্থডক্স চার্চ হিসাবে।
রোমান ক্যাথলিক চার্চের সঙ্গে অর্থডক্স্ চার্চের যে পার্থক্যটি আমাদের বিবেচনায় সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ এবং যুগান্তকারী সেটা হচ্ছে ক্যাথলিক চার্চে কেন্দ্রীভূত প্রতিষ্ঠান হিসাবে পোপের যে পদ ছিল অর্থডক্স্ চার্চে তেমন কোন প্রতিষ্ঠান ছিল না। এটা ঠিক যে ক্যাথলিক চার্চের মত অর্থডক্স্ চার্চও রাষ্ট্র থেকে পৃথক প্রতিষ্ঠান ছিল। কিন্তু ক্যাথলিক চার্চের মত কেন্দ্রীভূত প্রতিষ্ঠান না থাকায় সম্রাট বা রাষ্ট্রের উপর চার্চের প্রাধান্য বজায় রাখার উপায় ছিল না। বরং সম্রাট বা রাষ্ট্র চার্চকে নিয়ন্ত্রণ করত।
তুর্কী মুসলমানদের হাতে ১৪৫৩ খ্রীষ্টাব্দে কন্সট্যান্টিনোপলের পতন হলে বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্যের অবসান হয়। এরপর একটা পর্যায়ে খ্রীষ্টীয় শক্তি হিসাবে পূর্ব ইউরোপে রাশিয়া আবির্ভূত হয়। রাশিয়ায় আমরা চার্চকে রাষ্ট্রের তুলনায় খর্ব দশায় দেখতে পাই যেখানে তা ছিল শাসকদের সহযোগী ও অধীনস্থ। ধর্মের নীতি-নিয়ম সম্রাটকে মেনে চলতে হত। কিন্তু চার্চ সম্রাটের রাষ্ট্রপরিচালনা বা নীতি-নির্ধারণে হস্তক্ষেপ করতে পারত না যেটা আমরা পশ্চিম ইউরোপের ক্ষেত্রে ঘটতে দেখি। অর্থডক্স্ চার্চের এই অবস্থার ফলে পূর্ব ইউরোপ বিশেষত রাশিয়ায় আমরা রাষ্ট্রের যে রূপ দেখতে পাই তা অনেকটা প্রাচ্যের স্বৈরতন্ত্রের অনুরূপ। অর্থাৎ এখানে রাষ্ট্রের স্বৈরতা বা স্বেচ্ছাচারের ক্ষমতাকে সংযত বা প্রতিহত করার মত কোন কার্যকর সামাজিক প্রতিষ্ঠান ছিল না।
এই অবস্থায় আমরা পশ্চিম ইউরোপের সামন্ত শ্রেণীর অনুরূপ কোন শ্রেণীকে অর্থডক্স খ্রীষ্টান রাশিয়ায় পাই না। এখানে ভূ-স্বামী শ্রেণী হিসাবে আমরা যাদেরকে দেখতে পাই তারা ছিল সম্রাটের মর্জির উপর নির্ভরশীল।
রাষ্ট্রীয় স্বৈরতন্ত্রের এই বিকাশের ফলে রাশিয়ায় পরিবর্তনের জন্য রাষ্ট্রের হস্তক্ষেপের প্রয়োজন হয়েছে। অর্থাৎ পরিবর্তন যখন এসেছে তখন তা এসেছে উপর থেকে। ব্যক্তির ভূমিকা রাখবার সুযোগের কারণে পশ্চিম ইউরোপে যেভাবে সমাজের ভিতর বা তুলনায় নীচ থেকে পরিবর্তনের শক্তি ও প্রেরণা জন্ম নিতে ও বিকাশ লাভ করতে পেরেছে পূর্ব ইউরোপে, বিশেষত রাশিয়ায় তেমনটা ঘটে নাই।
পশ্চিম ইউরোপের রাষ্ট্রগুলির মত এগিয়ে যেতে চেয়ে রাশিয়ায় আধুনিকায়নের সূত্রপাত ঘটান রাশিয়ার জার বা সম্রাট পিটার দি গ্রেট (জন্ম ১৬৭২ খ্রীঃ - মৃত্যু ১৭২৫ খ্রীঃ, রাজত্ব করেন ১৬৮২ খ্রীঃ থেকে ১৭২৫ খ্রীঃ পর্যন্ত)। আধুনিক শিক্ষা প্রবর্তন, নৌবাহিনী ও আধুনিক সেনাবাহিনী গঠন, শিল্প ও বাণিজ্যের বিকাশ সাধন, রাষ্ট্র পরিচালনায় ভূমিকা রাখার জন্য সিনেট প্রতিষ্ঠা ইত্যাদি দ্বারা তিনি পশ্চাৎপদ রাশিয়ার আধুনিকায়নের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। আধুনিকায়নের প্রয়োজনে তিনি পশ্চিম ইউরোপ থেকে শিক্ষক-প্রশিক্ষকদেরকে আনয়ন করেন। মোট কথা আধুনিক রাশিয়ার প্রথম স্থপতি যদি কাউকে বলতে হয় তবে সেটা বলতে হবে পিটার দি গ্রেটকে।
এই ধারাতেই রাশিয়ার পরবর্তী বিরাট পরিবর্তন ঘটে ১৯১৭ সালে লেনিনের নেতৃত্বে কমিউনিস্ট বিপ্লবের মাধ্যমে। অর্থাৎ পশ্চিম ইউরোপের তুলনায় পশ্চাৎপদ রাশিয়ার দ্রুত আধুনিকায়ন এবং উন্নয়নের জন্য ব্যক্তির দুর্বলতা বা অনুপস্থিতির জন্য রাষ্ট্রকেই হস্তক্ষেপ করতে হয়েছে। তবে কমিউনিস্ট বিপ্লবের ক্ষেত্রে আমরা রাষ্ট্রযন্ত্র বহির্ভূত একটি রাজনৈতিক দলকে রাষ্ট্রের উপর একক নিয়ন্ত্রণ নিয়ে আধুনিকায়ন ও উন্নয়ন ঘটাতে দেখি। এ যেন আধুনিকায়নের জন্য ধর্মবিশ্বাস-মুক্ত এবং লোকবাদী ক্যাথলিক চার্চ কর্তৃক রাষ্ট্রের উপর কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা। প্রকৃতপক্ষে পশ্চিম ইউরোপে সমাজ ও রাষ্ট্র ব্যবস্থা পরিবর্তনে ব্যক্তি যে ভূমিকা নিতে পেরেছিল রাশিয়ার ক্ষেত্রে ব্যক্তির অক্ষমতায় রাজনৈতিক দলকে সেই ভূমিকা নিতে হয়। এ ক্ষেত্রে মার্কসবাদ এবং কমিউনিজমের মতাদর্শের সর্বাত্মক রাষ্টীয়করণ বা জাতীয়করণ সমাজের দ্রুত শিল্পায়নের কাজে লাগে। রাশিয়ার নেতৃত্বে পূর্ব ইউরোপ তার শিল্পায়নের জন্য এই পথ গ্রহণ করে।
তবে ব্যক্তিকে সম্পূর্ণ অস্বীকার করে সর্বাত্মক জাতীয়করণের মাধ্যমে শিল্পায়নে যে সমস্যা একটা পর্যায়ে দেখা দেয় সেটা পূর্ব ইউরোপসহ রাশিয়ায় দেখা দেয়। নূতন উদ্ভাবন ও আবিষ্কারের মূলে থাকে ব্যক্তি। ব্যক্তির ভূমিকা না থাকলে সমাজ এক সময় বন্ধ্যা এবং স্থবির হয়ে যায়। ফলে অর্থনৈতিক ও সামাজিক সঙ্কট নেমে আসে। এই সঙ্কটকে মোকাবিলা করতে গিয়ে এক পর্যায়ে মার্কসীয় সমাজতন্ত্র পরিত্যাগ ক’রে রাশিয়া ও পূর্ব ইউরোপ পুঁজিবাদের পথ গ্রহণ করে। ১৯৯১ সালে সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙ্গে যায়। সেই সঙ্গে রাশিয়ায় কমিউনিস্ট পার্টির শাসনেরও অবসান হয়। এভাবে প্রতিষ্ঠিত হয় বহুদলীয় গণতান্ত্রিক শাসন পদ্ধতি।
চীনে কমিউনিস্ট পার্টির শাসন অব্যাহত থাকলেও তা পার্টি এবং রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণেই ব্যক্তিপুঁজির বিকাশের পথ গ্রহণ করে। অর্থনীতির এই ব্যবস্থাকে চীনের পার্টি নাম দিয়েছে সমাজতান্ত্রিক বাজার অর্থনীতি। ভিয়েৎনামও এই ধরনের অর্থনীতির পথ অনুসরণ করছে। এই দুই দেশেরই উন্নয়ন প্রবল গতিসম্পন্ন। চীন ইতিমধ্যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে ছাড়িয়ে পৃথিবীর এক নম্বর অর্থনৈতিক শক্তিতে পরিণত হয়েছে।
যাইহোক, আমরা পশ্চিম ও পূর্বসহ সমগ্র ইউরোপে আধুনিক সভ্যতার উদ্ভব ও বিকাশের শর্ত পূরণের ক্ষেত্রে খ্রীষ্ট ধর্মের একটি প্রধান ভূমিকা দেখতে পেলাম। আধুনিক সভ্যতা এবং গণতান্ত্রিক সমাজ ও রাষ্ট্র গঠনের জন্য যে ধরনের ব্যক্তির উদ্ভবের প্রয়োজন ছিল খ্রীষ্টান ধর্ম এবং বিশেষত ক্যাথলিক চার্চের প্রভাব তার পরিপোষণে প্রাথমিক ভূমিকা পালন করেছিল। একটা পর্যায়ের পর ক্যাথলিক চার্চের ভূমিকা এই ধরনের ব্যক্তির বিকাশ ও প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছিল। ফলে তার উৎখাত সাধনের জন্য নবজাগরণ, ধর্ম সংস্কার এবং যুক্তিবাদী বুদ্ধিবৃত্তিক আন্দোলনের প্রয়োজন হয়েছিল। এসবের ফল ইউরোপে জাতি-রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা, গণতান্ত্রিক বিপ্লব এবং শিল্প বিপ্লব।
এটা লক্ষ্যণীয় যে প্রোটেস্ট্যান্ট আন্দোলন পশ্চিম ইউরোপের যে সব দেশে শক্তিশালী হয়েছিল এবং ক্যাথলিক চার্চের প্রতাপকে দুর্বল করেছিল উত্তরের ইংল্যান্ডসহ সেই দেশগুলিতে গণতান্ত্রিক ও শিল্প বিপ্লব সবার আগে সফল হয় এবং এইসব দেশ ক্যাথলিক চার্চ দ্বারা তুলনায় অনেক বেশী প্রভাবিত দক্ষিণের স্পেন, পর্তুগাল, ইতালির চেয়ে অনেক বেশী এগিয়ে যায়।
সমাজ ও রাষ্ট্র গঠনে ধর্মের ভূমিকা কতটা গুরুত্বপূর্ণ হতে পারে সেটা প্রাচ্যের বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী দেশগুলির দিকে দৃষ্টি দিলেও বুঝা যায়। এ ক্ষেত্রে বিশেষ করে চীন এবং ভিয়েৎনাম, লাওস, কম্বোডিয়া, থাইল্যান্ড ইত্যাদি দেশের দৃষ্টান্ত উল্লেখ করা যায়। বৌদ্ধ ধর্মে কতকগুলি সুনীতি পালন এবং পুণ্যকর্মের মাধ্যমে জন্মান্তরের চক্র থেকে মানুষের আত্মার মুক্তি বা নির্বাণের ধারণার উপর গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। শুধু মানুষের প্রতি নয় অধিকন্তু সব জীবের প্রতি দয়া ও প্রেমের উপর এই ধর্মে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। তার মানে এই নয় যে বৌদ্ধ ধর্ম গ্রহণের ফলে মানুষ হিংসা, যুদ্ধ, নিপীড়ন বাদ দিয়েছে। কিন্তু এও ঠিক যে, ধর্মে এগুলির প্রতি বিরোধিতা থাকায় শান্তি, সহাবস্থান এবং ভ্রাতৃত্ব বোধ সমাজে একটা গুরুত্বপূর্ণ স্থান করে নেয়। বিশেষত সংযম, অহিংসা, শান্তি ও নম্রতার মূর্ত প্রতীক হিসাবে সর্বস্ব ত্যাগী ভিক্ষুদের দ্বারা গঠিত বৌদ্ধ সংঘের অবস্থান বৃহত্তর সমাজে শান্তি, স্থিতি ও সৌভ্রাতৃত্ব রক্ষায় বিরাট ভূমিকা পালন করে। বৌদ্ধ সংঘের সদস্যরা বিবাহ করতে পারে না যেমন তারা যুদ্ধ করতে পারে না। সেখানে নারীরাও প্রবেশ করতে এবং সংসার বহির্ভূত সন্ন্যাস জীবন যাপন করতে পারে। সংঘের সদস্যদের যৌন সম্পর্ক স্থাপন নিষিদ্ধ এবং ধর্মীয় বিধান অনুযায়ী শুদ্ধ জীবন যাপন বাধ্যতামূলক। আসলে বৌদ্ধ সংঘের প্রায় অনুরূপ খ্রীষ্টীয় চার্চ। তবে ক্যাথলিক চার্চের মত কোন কেন্দ্রীয় প্রতিষ্ঠানের অনুপস্থিতির ফলে প্রাচ্যে বৌদ্ধ ধর্ম প্রভাবিত সমাজগুলিতে স্বৈরতান্ত্রিক রাষ্ট্র বা রাজার উত্থান সহজতর হয়েছে। সংঘ রাষ্ট্র থেকে পৃথক। জনগণের ধর্ম বিশ্বাসের মাধ্যমে সংঘ বা ধর্ম রাষ্ট্রশাসনের উপরেও প্রভাব ফেলেছে। কিন্তু তা সত্ত্বেও কেন্দ্রীয় প্রতিষ্ঠানের অভাবে তা রাষ্ট্রকে নিয়ন্ত্রণের পর্যায়ে যেতে পারে নাই, বরং রাষ্ট্রের অধীনস্থ হয়েছে।
সুতরাং পশ্চিম ইউরোপে যেভাবে ব্যক্তির নিজস্ব শক্তির একটা জায়গা ধর্মের আবরণে এবং সামন্ত কৃষি ব্যবস্থার মাধ্যমে হলেও রক্ষা পেয়েছে প্রাচ্যের বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী দেশগুলিতে তেমনটা সাধারণভাবে হতে পারে নাই। এই বাস্তবতায় আধুনিক সভ্যতা নির্মাণের প্রয়োজনে চীন, উত্তর কোরিয়া এবং ইন্দোচীনের দেশগুলিতে রাজনৈতিক দল একক কর্তৃত্বকারী ভূমিকা গ্রহণ করেছে।* আধুনিক সভ্যতা নির্মাণে এইসব দেশ বিশেষত চীন এবং ভিয়েৎনামের সাফল্য লক্ষ্যণীয়। এইসব দেশ এক দল কর্তৃক শাসিত হলেও সাধারণভাবে দলের ভিতর গণতন্ত্রের বিকাশ যেমন লক্ষ্যণীয় তেমন একক দলের অধীনস্থ রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণ ও উদ্যোগে ব্যক্তি পুঁজির বিকাশও লক্ষ্যণীয়।
----------------------------
* ইন্দোচীনের কম্বোডিয়া আনুষ্ঠানিকভাবে বহুদলীয় হলেও কার্যত একদল শাসিত রাষ্ট্র। শাসক দলের নাম কম্বোডীয় জনগণের দল বা কম্বোডিয়ান পিপল্স্ পার্টি। ভিয়েৎনাম এবং লাওস সাংবিধানিকভাবে একদলীয় রাষ্ট্র।
----------------------------
জাপানের অভিজ্ঞতা অবশ্য ভিন্ন। জাপানে আদি শিন্টোধর্ম এবং বৌদ্ধ ধর্ম উভয়ই প্রচলিত ছিল। তবে ধর্মীয় উগ্রতা বা গোঁড়ামি জাপানে ছিল না। সেখানে পশ্চিম ইউরোপের কাছাকাছি ধরনের একটা সামন্ত শ্রেণী গড়ে উঠেছিল। পশ্চিম ইউরোপের যোদ্ধা শ্রেণী হিসাবে নাইটদের অনুরূপ সামুরাই নামে খ্যাত একটি যোদ্ধা শ্রেণীও সেখানে গড়ে উঠেছিল। সবার উপরে ছিলেন সম্রাট। তাকে দেবতা হিসাবে বিবেচনা করা হত। কিন্তু রাষ্ট্র শাসনে তার প্রত্যক্ষ ভূমিকা দুর্বল ছিল। তিনি থেকেছেন জাপানের ঐক্যের প্রতীক হিসাবে। এই অবস্থায় ইউরোপের আধুনিক সভ্যতার সংস্পর্শে আসবার পর তা থেকে শিক্ষা নিয়ে জাপানের শাসকরা দ্রুত শিল্প পুঁজি গড়ার উদ্যেগ নেয় এবং জাপানকে আধুনিক যুগে নেয়। তবে পূর্ব থেকেই ব্যক্তির ভূমিকা নিবার সুযোগ না থাকলে ব্যক্তির মালিকানায় এই শিল্পায়নের উদ্যোগ সম্ভব হত না।
আধুনিক সভ্যতা নির্মাণের ক্ষেত্রে একটা বিষয় পরিষ্কার যে ধর্মের সঙ্গে আধুনিক সভ্যতার সম্পর্ক মোটেই সঙ্গতির নয়, বরং সাংঘর্ষিক। কারণ আধুনিক সভ্যতা অন্ধ বিশ্বাস নির্ভর ধর্ম চর্চার পরিবর্তে সম্পূর্ণ রূপে জ্ঞান-বিজ্ঞান এবং যুক্তি-প্রমাণ নির্ভর। এই অবস্থায় পশ্চিম ইউরোপে রাষ্ট্রের উপর চার্চের আধিপত্যের অবসান ঘটাতে হয়েছে। প্রোটেস্ট্যান্ট সংস্কারের ফলে নমনীয় এবং বিকেন্দ্রীভূত চার্চ প্রতিষ্ঠা রাষ্ট্রকে লোকবাদী তথা সেকিউলার পথে চলার সুযোগ করে দেয়। যেখানে প্রোটেস্ট্যান্ট মতবাদ প্রাধান্য অর্জন করতে পারে নাই, ফলে ক্যাথলিক মতবাদ ও চার্চ প্রাধান্য বজায় রাখতে পেরেছে, সেখানেও রাষ্ট্রের উপর চার্চের আধিপত্যের অবসান ঘটে। ইউরোপে চার্চ প্রধান হিসাবে পোপের ভূমিকা ধর্মের নিজস্ব গণ্ডীর মধ্যে সীমাবদ্ধ হয়ে পড়ে। ফলে ধর্ম হয়ে পড়ে যার যার ব্যক্তিগত বিশ্বাস-অবিশ্বাসের বিষয়।
এ প্রসঙ্গে আমরা যীশুর সেই বাণী উল্লেখ করতে পারি যেখানে তিনি বলছেন, ‘সিজারের প্রাপ্য সিজারকে দাও এবং ঈশ্বরের প্রাপ্য ঈশ্বরকে দাও’(মার্ক- ১২꞉১৭)। এর অর্থ তিনি রাষ্ট্রের প্রাপ্য রাষ্ট্রকে এবং ঈশ্বরের প্রাপ্য ঈশ্বরকে দিতে বলছেন। এর তাৎপর্য অপরিসীম। প্রোটেস্ট্যান্ট সংস্কারের প্রভাবে আদি খ্রীষ্টান ধর্মে প্রত্যাবর্তনের ফলে রাষ্ট্র এবং জাগতিক কর্মকাণ্ডের উপর ধর্মের হস্তক্ষেপের সুযোগ রইল না। একবার ধর্ম রাষ্ট্র থেকে নিজেকে গুটিয়ে নিবার পর রাষ্ট্রও আর তাকে নিয়ে মাথা ঘামাবার প্রয়োজন তেমন একটা বোধ করে নাই। ফলে ব্যক্তিগত বিশ্বাস-অবিশ্বাসে সীমাবদ্ধ ধর্মের প্রতি রাষ্ট্র নমনীয়ও হয়েছে ক্ষেত্র বিশেষে।
কিন্তু অর্থডক্স চার্চ শাসিত রাশিয়ার ক্ষেত্রে ধর্মের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে রাষ্ট্রকে তুলনায় অনেক বেশী সক্রিয় হতে হয়। পশ্চিম ইউরোপের সমকক্ষতা অর্জনের জন্য রাশিয়ার নেতৃত্বে পূর্ব ইউরোপের যে দ্রুততা অর্জনের প্রয়োজন ছিল তা সেখানে রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণে ও কর্তৃত্বে শিল্পায়নের পাশাপাশি ধর্মের বিরুদ্ধে আদর্শিক সংগ্রামেও কমিউনিস্ট পার্টিকে ভূমিকা নিতে বাধ্য করে। ফলে সব কমিউনিস্ট শাসিত রাষ্ট্রই পুরাপুরি সেকিউলার বা লোকবাদী হয়। অবশ্য কমিউনিস্ট মতাদর্শের উৎস মার্ক্সবাদ দর্শনগতভাবেই বস্তুবাদী ও ধর্মবিশ্বাস মুক্ত। এই রকম অবস্থায় কমিউনিস্ট পার্টির শাসনে মতাদর্শিক ক্ষেত্রে কমিউনিস্ট পার্টি ধর্মের বিরুদ্ধে কম-বেশী ভূমিকা রাখতে বাধ্য হয়। একই ঘটনা আমরা বৃহৎ ধর্মগুলির মধ্যে সবচেয়ে উদার বৌদ্ধধর্ম প্রভাবিত চীন-ভিয়েৎনামের ক্ষেত্রেও দেখি। এই যেখানে অবস্থা সেখানে ইসলাম শাসিত সমাজে আধুনিকায়ন তথা সমাজের উন্নয়ন ও গণতন্ত্রায়ন অবিশ্বাস্য রকম জটিল ও কঠিন।
সবচেয়ে বড় কথা খ্রীষ্টান বা বৌদ্ধ ধর্মের উদ্ভব ও বিকাশ হয়েছে সম্পূর্ণরূপে সামাজিক তথা অরাজনৈতিক আন্দোলন রূপে। ফলে বিকাশের একটা পর্যায়ে তা রাষ্ট্র বা রাজনীতিতে যে ভূমিকাই পালন করুক তার বিরুদ্ধে সংগ্রামের মূল রূপ সামাজিক ও সাংস্কৃতিক হতে বাধ্য হয়। বিদ্যমান ধর্মের বিরুদ্ধে সামাজিক আন্দোলন কখনও রাজনৈতিক ও সামরিক রূপ নিলেও সেটা মূলত সামাজিক ও সাংস্কৃতিক আন্দোলনের অধীনস্থ হয়ে থাকে। যে কারণে ধর্মীয় আন্দোলনের পরিণতিতে যে পরিবর্তনই ঘটুক ধর্মীয় শক্তি রাষ্ট্র ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয় না। পশ্চিম ইউরোপে এই কারণে প্রোটেস্ট্যান্ট আন্দোলনের সাফল্য নূতন কোনও ধরনের চার্চকে রাষ্ট্র ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত করে নাই। কিন্তু ইসলাম একই সঙ্গে সামাজিক, রাজনৈতিক ও সামরিক ধর্ম হিসাবে বিকাশ ও বিস্তার লাভ করায় এক সম্পূর্ণ ভিন্ন ধরনের সমস্যা হাজির করে।
তৃতীয় অধ্যায়
ইসলামের সমস্যা
মুসলিম বা ইসলামী সমাজের সমস্যা প্রকৃতপক্ষে ইসলামের সমস্যা। কারণ মুসলিম সমাজ গঠনের মূল ভিত্তি ইসলাম ধর্ম তথা ইসলামী প্রথা, বিশ্বাস এবং মূল্যবোধ। এগুলির প্রধান উৎস কুরআন ও হাদীস। কুরআন হচ্ছে ইসলামের প্রতিষ্ঠাতা মুহাম্মদের বলা সেই সকল বাণীর সংকলন যেগুলিকে সরাসরি আল্লাহ্র প্রত্যাদেশ বলা হয়, আর হাদীস হচ্ছে মুহাম্মদের কথা, কাজ এবং কাজের অনুমোদন সংক্রান্ত সংকলনগুলি।
এটা ঠিক যে, আধুনিক যুগে ইসলামের বহু নিয়ম ও রীতিনীতি মেনে চলা সম্ভব হয় না বা মানাও হয় না। যেমন ধরা যাক চিত্র নির্মাণের কথা। ইসলামে প্রাণীর মূর্তি বা চিত্র নির্মাণ কঠোরভাবে নিষিদ্ধ হলেও এটা এখন খোদ সৌদী আরবও সব ক্ষেত্রে মানে না। ফলে হজের জন্য পাসপোর্ট করতে হলেও ছবি লাগে। এখন ছবি নিষিদ্ধ করলে পাসপোর্ট এবং সেই সঙ্গে সৌদী নাগরিক নয় এমন সবার হজ নিষিদ্ধ করতে হয়। ইসলামে নিষিদ্ধ বা অনাকাঙ্ক্ষিত এমন বহু কিছু আছে যেগুলিকে নিষিদ্ধ বা বন্ধ করা সম্ভব নয়। ফলে সিনেমা, অভিনয়, পর নারী-পুরুষের মেলামেশা, নারীদের শিক্ষা ও পুরুষ নিকটাত্মীয় সঙ্গে না নিয়ে এবং মুখ-মাথা-শরীর না ঢেকে বাহিরে যাওয়া ইত্যাদি অনেক কিছুকে ইসলামী সমাজ মেনে নিতে বাধ্য হচ্ছে। কিন্তু মনে রাখতে হবে এসবই সাধারণভাবে পাশ্চাত্য সভ্যতার আধিপত্য, নিয়ন্ত্রণ এবং প্রভাবের ফল। ফলে এসবই বহিরারোপিত, যার প্রতি থাকে অক্ষম ইসলামের অন্তর্গত ঘৃণা ও প্রতিরোধের আকাঙ্ক্ষা, যা যে কোনও সুযোগে বিস্ফোরিত হতে ও আত্মপ্রকাশ করতে পারে।
ইসলামে সমস্ত ক্ষমতা এককেন্দ্রীভূত। খ্রীষ্টধর্মে একেশ্বরবাদ থাকলেও ঈশ্বরপুত্র যীশু খ্রীষ্টের হাতে এ পৃথিবীর যাবতীয় ক্ষমতা অর্পিত। বাইবেলে বলা হচ্ছে বিচার দিবস পর্যন্ত স্বর্গ ও মর্ত্যের যাবতীয় ক্ষমতা ঈশ্বর যীশুর হাতে অর্পণ করেছেন। শুধু তাই নয় বিচার দিবসে ঈশ্বরের পাশে বসে যীশু মানুষের পাপ-পুণ্যের বিচার করবেন। এভাবে খ্রীষ্টধর্ম তত্ত্বগতভাবে দ্বৈততার এমন এক অবস্থান দিয়েছে যা সমস্ত ক্ষমতা এক হাতে কেন্দ্রীভূত করার পথে বিরাট বাধা অর্পণ করে। খ্রীষ্টধর্ম একেশ্বরবাদী হলেও এটা দ্বৈততার এমন এক জায়গা তৈরী করেছে যা চিন্তা প্রক্রিয়ার মাধ্যমে সমাজের ভিতর ব্যক্তি এবং ফলত গণতন্ত্রের অস্তিত্বের একটা সুযোগ করে রাখে ইসলামে যেটার কল্পনাও করা চলে না। অন্যদিকে, খ্রীষ্টধর্ম মানুষকে ঈশ্বরের দাস মাত্র করে নাই যে তার কোনও অধিকার থাকবে না। সে দয়াময় বা প্রেমময় ঈশ্বরের সন্তানও বটে। ফলে এই সন্তান তার পিতার কাছে অনেক কিছুই দাবী করতে পারে। কিন্তু ইসলামে স্বাধীন মানুষের অস্তিত্ব নাই। সকলেই আল্লাহর বান্দা বা দাস। কুরআনে বলা হচ্ছে, ‘আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবীতে এমন কেহ নাই, যে দয়াময়ের নিকট বান্দারূপে উপস্থিত হইবে না’(১৯ নং সূরা মার্য়াম ꞉ ৯৩ নং আয়াত)।* অথবা বলা হচ্ছে, ‘আমার দাসত্বের জন্যই মানুষ ও জিনকে সৃষ্টি করেছি’(৫১꞉৫৬)।** হাদীসে মুহাম্মদ নিজেও বলছেন, ‘আমি আল্লাহর বান্দা ও রসূল।’***
----------------------------
* আল-কুরআনুল করীম, প্রকাশক- ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ, ঢাকা, ছত্রিশতম মুদ্রণ, ডিসেম্বর ২০০৭।
** কোরান সূত্র, অনুঃ মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান, প্রকাশক, বাংলা একাডেমী, ঢাকা, প্রকাশ- ১৯৮৪।
*** বোখারী শরীফ (বাংলা তরজমা ও বিস্তারিত ব্যাখ্যা), তৃতীয় খণ্ড, অনু- মাওলানা শামছুল হক ফরিদপুরী (রঃ) ও মাওলানা আজিজুল হক সাহেব; হামিদিয়া লাইব্রেরী, ঢাকা, একাদশ সংস্করণ, জুন ২০০৭, পৃষ্ঠা- ৯২।
----------------------------
অর্থাৎ এই ধর্মে মুহাম্মদসহ সবাই আল্লাহ্র দাস। এই রকম সর্বাত্মক দাসত্বের ধর্মে স্বাভাবিকভাবেই ইসলামের বান্দা তার মালিক বা প্রভু আল্লাহর কাছে তেমন কোন দাবীই করতে পারে না যা খ্রীষ্টধর্মের মানুষ তার পিতা ঈশ্বরের কাছে করতে পারে। সুতরাং মানুষের স্বাধীনতার চেতনা ইসলামের চেতনা বিরোধী। বান্দাত্ব বা দাসত্বের সর্বাত্মক চেতনার উপরই ইসলাম প্রতিষ্ঠিত।
এই রকম এক বান্দা সমাজ তথা দাস সমাজ ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠায় মুহাম্মদ (জন্ম আনুমানিক ৫৭০ খ্রীঃ - মৃত্যু ৬৩২ খ্রীঃ) যে পথ বেছে নিয়েছিলেন তা হল যুদ্ধ। যতদিন তিনি মক্কায় শান্তিপূর্ণভাবে ধর্ম প্রচার করেছিলেন ততদিন তার অনুসারীদের সংখ্যা ও শক্তি খুব সামান্য ছিল। মক্কায় তেরো বৎসরে তার অনুসারী একশত থেকে দেড়শত জনের মত ছিল। কিন্তু মদীনায় রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পর এই অবস্থা বদলে যায়। মদীনায় গিয়ে তিনি যে পথ গ্রহণ করেন তা হল যুদ্ধ। কুরআনে বলা হল, ‘তোমাদের জন্য যুদ্ধের বিধান দেওয়া হইল যদিও তোমাদের নিকট ইহা অপ্রিয়। কিন্তু তোমরা যাহা অপসন্দ কর সম্ভবত তাহা তোমাদের জন্য কল্যাণকর এবং যাহা ভালবাস সম্ভবত তাহা তোমাদের জন্য অকল্যাণকর। আল্লাহ্ জানেন আর তোমরা জান না’ (২꞉২১৬)।* অথবা ‘হে মুমিনগণ! তোমাদের হইল কী যে, যখন তোমাদিগকে আল্লাহর পথে অভিযানে বাহির হইতে বলা হয় তখন তোমরা ভারাক্রান্ত হইয়া ভূতলে ঝুঁকিয়া পড়? ..... যদি তোমরা অভিযানে বাহির না হও, তবে তিনি তোমাদিগকে মর্মন্তুদ শাস্তি দিবেন .....’ (৯꞉৩৮-৩৯)। বুঝাই যায় যে মুসলমানরা প্রথম দিকে যুদ্ধের পথে যেতে অনিচ্ছুক ছিল, যে কারণে আল্লাহর পক্ষ থেকে যুদ্ধের সপক্ষে এভাবে আরও অনেক ওহী বা আয়াত নাজিল করতে হয়েছে। এই বাস্তবতায় একদিকে নিরঙ্কুশ একেশ্বরবাদ এবং অপর দিকে যুদ্ধ ইসলামকে যে বিশিষ্টতা দিয়েছে তা দিয়ে তাকে বুঝতে হবে।** বুদ্ধ বা যীশুর মতাদর্শ বা ধর্ম ছিল অহিংসা ও শান্তিতে বিশ্বাসী। বুদ্ধ বা যীশু সংসারীও ছিলেন না। মানুষের মুক্তির পথের সন্ধানে রাজার পুত্র গৌতম বুদ্ধ সংসার ও স্ত্রী-পুত্র ত্যাগ করেন এবং শান্তিপূর্ণভাবে তার শান্তি ও অহিংসার ধর্ম প্রচার করেন। একইভাবে যীশুও তার ধর্ম প্রচারে মানুষের প্রতি শান্তি ও অহিংসাকে গুরুত্ব দেন। যীশু বলছেন, ‘যে কেহ তোমার দক্ষিণ গালে চড় মারে, অন্য গাল তাহার দিকে ফিরাইয়া দেও’(বাইবেল꞉নূতন নিয়ম, মথি - ৫꞉৩৯)। যীশুর অনেক পরবর্তী কালে খ্রীষ্টধর্মে জবরদস্তি ও যুদ্ধ প্রবেশ করলেও সেটা ছিল খ্রীষ্টানদের প্রতি দীর্ঘ নির্যাতন ও সহিংসতার প্রতিক্রিয়া। বিশেষ করে দীর্ঘ ইসলামী আগ্রাসনে পশ্চিম এশিয়া ও উত্তর আফ্রিকা থেকে খ্রীষ্টধর্ম উচ্ছেদ হয়ে যায়। ইউরোপ ছিল দীর্ঘকাল ধরে অব্যাহত ইসলামী আরব ও তুর্কী আক্রমণের শিকার। এছাড়া ছিল প্যালেস্টাইনে যাওয়া ইউরোপের খ্রীষ্টান তীর্থযাত্রীদের প্রতি দুর্ব্যবহার। এইসব ঘটনার প্রতিক্রিয়ায় ঘটে ক্রুসেড বা ধর্মযুদ্ধ। তবে মনে রাখতে হবে পোপ তথা চার্চের আহ্বানে ক্রুসেড সংগঠিত হলেও যুদ্ধ করেছিল যোদ্ধা ও রাজারা।
----------------------------
* আল-কুরআনুল করীম, প্রকাশক- ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ, ঢাকা, ছত্রিশতম মুদ্রণ, ডিসেম্বর ২০০৭। পরবর্তী সকল আয়াতের অনুবাদ নেওয়া হয়েছে এই অনুবাদ গ্রন্থ থেকে।
** ইসলামে যুদ্ধের বিস্তারিত ভূমিকা জানার জন্য দেখুন꞉ এম এ খান, জিহাদ ꞉ জবরদস্তিমূলক ধর্মান্তরকরণ, সাম্রাজ্যবাদ ও দাসত্বের উত্তরাধিকার, ব-দ্বীপ প্রকাশন, কাঁটাবন, শাহবাগ, ঢাকা।
----------------------------
বস্তুত ধর্মের প্রভাবে যেসব সমাজ প্রতিষ্ঠিত হয় সেইসব সমাজের মূল বৈশিষ্ট্য, প্রবণতা এবং চরিত্র বুঝবার সর্বশ্রেষ্ঠ উপায় হচ্ছে সেই সব ধর্মের প্রতিষ্ঠাতাদেরকে বুঝা। এটা বুঝতে হবে যে, একটা সমাজ যত শান্তিবাদী হোক বাইরের শক্তির আগ্রাসন ও অধীনতা বা ধ্বংস থেকে তা বাঁচতে পারে না যদি তার সামরিক বা যুদ্ধের শক্তি না থাকে। এভাবে আমরা দেখি খ্রীষ্টান বা বৌদ্ধ সমাজেও যুদ্ধ ও সহিংসতার উপস্থিতি। এটা হচ্ছে বাস্তবতা বা ব্যবহারিক জীবনের চাহিদা বা দাবীর পূরণ। কিন্তু তার মানে এই নয় যে যুদ্ধকে সমাজ বিশেষত ধর্মীয় দৃষ্টি থেকে তার নৈতিক আদর্শ হিসাবে গ্রহণ করে। এই অবস্থায় আত্মরক্ষার প্রয়োজনে ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান বা ধর্মের দিক থেকে কখনও যুদ্ধকে গ্রহণ করা বা বৈধতা দেওয়া হলেও যুদ্ধকে নৈতিক শ্রেষ্ঠত্ব প্রদান করা হয় না। যে কারণে খ্রীষ্টান পাদ্রী বা বৌদ্ধ শ্রমণ তলোয়ার হাতে যুদ্ধ করে বেড়ায় না। কিন্তু ইসলামের ক্ষেত্রে আমরা বিপরীতটা ঘটতে দেখি। এখানে ধর্ম প্রচারক ও যোদ্ধা একই ব্যক্তি।
বুদ্ধ বা যীশুর পাশে মুহাম্মদকে দাঁড় করালে ইসলামকে আমরা অনেক সহজে বুঝতে পারব। ইসলামকে শান্তির ধর্ম বলা হলেও তা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে যুদ্ধের মাধ্যমে। ইসলামী ইতিহাসবিদদের দ্বারা লিখিত মুহাম্মদের জীবনীতে মদীনায় তার বসবাসকালীন শেষ দশ বৎসরে মুহাম্মদ কর্তৃক পরিচালিত বা নির্দেশিত ৭০ থেকে ১০০টি ব্যর্থ বা সফল আক্রমণ, লুণ্ঠন অভিযান এবং যুদ্ধের উল্লেখ পাওয়া যায়। এর মধ্যে ১৭ থেকে ২৯টিতে মুহাম্মদ নিজে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন।* মজার ব্যাপার হচ্ছে বদর, ওহোদ ও খন্দক বাদে এই যুদ্ধগুলির সবই পরিচালিত হয়েছে অন্যান্য ধর্মাবলম্বী জনগোষ্ঠী বা উপজাতিদের উপর বাধ্যতামূলকভাবে তার ধর্ম চাপিয়ে দিবার জন্য। বদর, ওহোদ ও খন্দকের যুদ্ধ ছিল মুহাম্মদের নিজ গোত্র কুরাইশদের দিক থেকে মদীনার উপর আক্রমণ। কিন্তু কুরাইশদের দ্বারা পরিচালিত প্রথম যুদ্ধ বদরের যুদ্ধ ছিল কুরাইশদের বাণিজ্য বহরসমূহের উপর মদীনার ইসলামী বাহিনীর আক্রমণ, লুণ্ঠন ও হত্যা বন্ধ করার উদ্দেশ্যে পরিচালিত। এই যুদ্ধে মক্কার কুরাইশ বাহিনী পরাজিত হয়ে ফিরে যায়। এরপর কুরাইশ সেনাবাহিনী পুনরায় মদীনা আক্রমণ করলে ওহোদের প্রান্তরে যে যুদ্ধ হয় তাতে ইসলামী বাহিনী পরাজিত ও ছত্রভঙ্গ হয়ে যায়। মুহাম্মদ নিজে গুরুতর আহত ও অজ্ঞান হয়ে যান। কুরাইশরা ইচ্ছা করলে তাকে হত্যা করতে পারত। কিন্তু তারা তা না করে চলে যায়। যাবার পূর্বে তারা বলে যে, তারা মুহাম্মদকে হত্যা করতে আসে নাই, বরং বদরের যুদ্ধে পরাজয়ের প্রতিশোধ নিতে এসেছিল। সেই প্রতিশোধ নেওয়া হয়েছে। সুতরাং তারা ফিরে যাচ্ছে।
এটা বুঝা যায় যে, যে কারণে কুরাইশরা মক্কায় মুহাম্মদকে তার ধর্ম প্রচারের তেরো বৎসর সহ্য করেছিল একই কারণে তারা মুহাম্মদকে হত্যা না করে ফিরে গিয়েছিল। তারা চেয়েছিল তিনি যাতে শান্তিপূর্ণভাবে তার ধর্ম প্রচার করেন। সুতরাং ওহোদের যুদ্ধের পর তারা সন্তুষ্ট চিত্তে ফিরে গিয়েছিল। কিন্তু তারা মুহাম্মদকে চিনতে ভুল করেছিল। এরপর মুহাম্মদ পুনরায় ধর্ম প্রচারে তার যুদ্ধ তৎপরতায় ফিরে যান। কুরাইশদের তৃতীয় এবং শেষ আক্রমণ ছিল খন্দকের যুদ্ধ। মুহাম্মদ কুরাইশদের বিশাল বাহিনীর মোকাবিলায় সম্মুখ যুদ্ধে অবতীর্ণ না হয়ে পরিখা খনন করে আত্মরক্ষার ব্যবস্থা করেন। আরবরা এমন কোন যুদ্ধ কৌশলের কথা ইতিপূর্বে জানত না এবং এ ধরনের যুদ্ধের জন্য তাদের কোন প্রস্তুতি ছিল না। সুতরাং কয়েক দিন (প্রায় কুড়ি দিন, কারও মতে প্রায় এক মাস)** অবরোধ করার পর কুরাইশরা হতোদ্যম হয়ে মক্কায় ফিরে যায়। এটাই ছিল কুরাইশদের দিক থেকে প্রত্যাঘাতের শেষ প্রয়াস।
----------------------------
* দেখুন ꞉ এমএ খান, জিহাদ ꞉ জবরদস্তিমূলক ধর্মান্তরকরণ, সাম্রাজ্যবাদ ও দাসত্বের উত্তরাধিকার, ব-দ্বীপ প্রকাশন, ঢাকা, প্রকাশ- ২০১০, পৃষ্ঠা- ৮৯-৯০।
** বোখারী শরীফে বলা হচেছ, ‘প্রায় দীর্ঘ এক মাসকাল এই অবস্থা চলিল।’ বোখারী শরীফ, তৃতীয় খণ্ড, অনুবাদ- মাওলানা শামছুল হক ও মাওলানা আজিজুল হক, হামিদিয়া লাইব্রেরী, জুন ২০০৭, পৃষ্ঠা- ১৯২।
------------------------------
যাইহোক, যুদ্ধ ইসলামকে যে বিশিষ্টতা দিয়েছে তা না বুঝলে আমরা ইসলামের কিছুই বুঝব না। পৃথিবীর কোন ধর্মই যুক্তি-প্রমাণ নির্ভর নয়। সবই বিশ্বাস বা আরও সঠিকভাবে বললে অন্ধ বিশ্বাস নির্ভর। আরবে তখন বিভিন্ন উপজাতির নিজস্ব যেসব ধর্ম ও দেবতা ছিল সেগুলি যেমন অন্ধ বিশ্বাস নির্ভর ছিল তেমন খ্রীষ্টান ও ইহুদীদের ধর্মও ছিল অন্ধ বিশ্বাস নির্ভর। কিন্তু মুহাম্মদ বললেন একমাত্র তার ধর্মই সত্য এবং অন্য সকল ধর্ম মিথ্যা। সুতরাং যারা তার ধর্মমত তথা তার আনুগত্য গ্রহণ করবে না তাদেরকে তিনি কাফের অর্থাৎ সত্য প্রত্যাখ্যানকারী বললেন। স্বাভাবিকভাবে সবাই যার যার নিজ বিশ্বাসকে সত্য মনে করে নিজ নিজ ধর্মকে ধরে রাখতে চাইবে। এ ক্ষেত্রে মুহাম্মদ অন্যদের উপর নিজ ধর্মকে চাপিয়ে দিবার জন্য তলোয়ার তথা যুদ্ধের আশ্রয় নিলেন। যুদ্ধের অনুষঙ্গ হিসাবে যা যা আনা দরকার মনে করলেন সবই তিনি তার ধর্মে আনলেন। তার পক্ষে যুদ্ধ করে যারা মৃত্যু বরণ করবে তাদেরকে তিনি মৃত্যুর পর স্বর্গ বা বেহেশতের প্রতিশ্রুতি দিলেন। তিনি ঘোষণা করলেন, ‘তোমরা জানিয়া রাখ, নিশ্চয় বেহেশ্ত তরবারির ছায়াতলে।’* তিনি প্রতিপক্ষের সম্পদ লুণ্ঠনকে ধর্ম সম্মত করলেন। পরাজিতদের তিনি বন্দী এবং দাস করলেন। তাদেরকে এবং তাদের সকল সম্পদ ও সম্পত্তি তিনি গনীমতের মাল হিসাবে ভাগবাটোয়ারা করলেন। এই গনীমতের মাল হল নারী ও শিশুরাও। কুরআনের নির্দেশ (কুরআন- ৮꞉৪১) হাজির করে গনীমতের মালের এক পঞ্চমাংশ বা ২০% নিজের ভাগে রেখে বাকী চার পঞ্চমাংশ বা ৮০% যুদ্ধে অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে বণ্টনের ব্যবস্থা করলেন।
এভাবে অপরের সম্পদ ও সম্পত্তি লুণ্ঠন এবং অপরকে দাস-দাসী করার এক ধর্ম প্রতিষ্ঠা করা হল। এর ফলে ধর্মের মাধ্যমে ইসলামী সমাজে দাস ব্যবস্থা ব্যাপকায়তনে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ লাভ করে। শুধু তা-ই নয় যুদ্ধে বন্দিনী বা দাসী ধর্ষণকেও ধর্মীয় বিধানে বৈধতা দেওয়া হল। কুরআনে বলা হল, ‘যাহারা নিজেদের যৌন অঙ্গকে সংযত রাখে, নিজেদের পত্নী অথবা অধিকারভুক্ত দাসীগণ ব্যতীত, ইহাতে তাহারা নিন্দনীয় হইবে না’ (২৩꞉৫-৬), ‘এবং যাহারা নিজেদের যৌন অঙ্গকে সংযত রাখে, তাহাদের পত্নী অথবা অধিকারভুক্ত দাসী ব্যতীত, ইহাতে তাহারা নিন্দনীয় হইবে না’ (৭০꞉২৯-৩০), ইত্যাদি। এ ছাড়া বিভিন্ন হাদীস থেকে আমরা ‘অধিকারভুক্ত দাসীদের’ প্রতি ইসলামের যোদ্ধাদের এই ধরনের অধিকারের প্রয়োগ সম্পর্কে জানতে পারি। একটি হাদীসের কিছুটা উদ্ধৃত করা যাক, ‘আবু সায়ীদ খুদরী (রাঃ) বর্ণনা করিয়াছেন, “কোন এক জেহাদে শত্রু পক্ষের লোক আমাদের হাতে বন্দী হইল। (নারী বন্দিনীদের সুব্যবস্থাপনাকল্পে শরীয়ত সম্মত বৈধ সম্পর্ক সূত্রে) তাহারা আমাদের করায়ত্তে আসিলে পর আমরা নিজ নিজ প্রাপ্ত রমণীকে ব্যবহার করিলাম।”**
এই ধর্ষণের চর্চা অন্যান্য সাহাবার মত ইসলামের নবী মুহাম্মদও যে করতেন কুরআন-হাদীসের যে কোন মনোযোগী পাঠক তা বুঝবেন। এ প্রসঙ্গে এখানে বেশী আলোচনা না করে একটা উদাহরণ উল্লেখ করব। মদীনার বানু কুরাইযা গোত্র ছিল ইহুদী। মুহাম্মদ ও ইসলামের বিরুদ্ধে তারা চক্রান্ত করছে এই অভিযোগ তুলে মুহাম্মদ শান্তিপূর্ণ এবং যুদ্ধের জন্য অপ্রস্তুত বানু কুরাইযা গোত্রকে আক্রমণ করলেন। সবাইকে বন্দী করা হল। অতঃপর মুহাম্মদ যৌনাঙ্গে কেশ গজিয়েছে এমন সকল পুরুষ বন্দীকে প্রাপ্তবয়স্ক বিবেচনা করে হত্যার নির্দেশ দেন। নিজ হাতে বানু কুরাইযা গোত্র প্রধান কাব বিন আসাদের শিরোশ্ছেদ করে তিনি এই হত্যাযজ্ঞের সূচনা করেন। একটি গর্ত খুঁড়ে তার পাশে এভাবে গলা কেটে হত্যা করে লাশ সেই গর্তে ফেলা হচ্ছিল। এভাবে সকাল থেকে সন্ধ্যার অন্ধকার হলে মশাল জ্বালিয়ে ৮০০ থেকে ৯০০ ইহুদীকে হত্যা করা হয়।***
----------------------------
* বোখারী শরীফ (বাংলা তরজমা ও বিস্তারিত ব্যাখ্যা), তৃতীয় খণ্ড, অনুবাদ- মাওলানা শামছুল হক ফরিদপুরী (রঃ) ও মাওলানা আজিজুল হক সাহেব, হামিদিয়া লাইব্রেরী লিঃ, ঢাকা, একাদশ সংস্করণ. জুন ২০০৭, পৃ- ৬৩।
** ঐ, ষষ্ঠ খণ্ড, সপ্তম সংস্করণ ২০০৬, পৃ-১৪৯।
*** বানু কুরাইযা হত্যাকাণ্ড সম্পর্কে বিস্তারিত জানার জন্য দেখুন ꞉ ‘ইসলাম বিতর্ক’ গ্রন্থে সংকলিত আয়েশা আহমেদ-এর বনি ক্বারাইযার হত্যাযজ্ঞ ꞉ মুসলিম উম্মার সবচেয়ে খুশীর দিন, ব-দ্বীপ প্রকাশন, ঢাকা, ২০১০, পৃ ꞉ ৬৮-৭১।
----------------------------
ইতিমধ্যে বন্দী নারী ও শিশুদের গনীমতের মাল হিসাবে ভাগবাটোয়ারা করা হয়। এরা হল দাস-দাসী। সেই সঙ্গে ভাগ করা হল ইহুদীদের সহায়-সম্পদ যা ছিল সবকিছু। এই ভাগ বাটোয়ারায় মুহাম্মদ নিজ ভাগে নেন এক সুন্দরী তরুণী রায়হানাকে। অন্যান্য বন্দীর মত রায়হানা প্রত্যক্ষ করে তার স্বামী, পিতা এবং ভাইদেরকে গলা কেটে হত্যা করার দৃশ্য। ঐ নারীর ‘ট্রমা’ আমরা সহজেই অনুভব করতে পারি।
কিন্তু এখানেই শেষ নয়। ঐ নারীর অমন ভয়ঙ্কর অভিজ্ঞতার পরেও ঐ রাতেই নবী রায়হানাকে সম্ভোগ করার জন্য নিজ শয্যায় টেনে নিয়ে যান। ঐ একই রাতে মুহাম্মদের অন্য সাহাবীরাও নিজদের ভাগের নারীদেরকে ধর্ষণ করে, যারা একইভাবে এক ভয়ংকর ‘ট্রমা’র শিকার হয়েছিল সারাদিন ধরে আপনজনদের হত্যাযজ্ঞ দেখে। ইসলামের এই এক পদ্ধতিই যথেষ্ট মানুষের অনুভূতিকে ধ্বংস করে দিবার জন্য। এটা অস্বাভাবিক নয় যে ইসলামের এই ধরনের ভয়ংকরতার শিকার যারা হয় তারা তাদের শিকারীদের মতই একটা পর্যায়ে মানবিকতার সব কিছু হারিয়ে ফেলে।
বন্দী নারী এবং দাসী সম্ভোগে ইসলামের নবীর রুচির কথা আমাদের অজানা নয়। উপহার হিসাবে পাঠানো মিসরের সুন্দরী দাসী মারিয়ার গর্ভে মুহাম্মদের এক স্পল্পায়ু পুত্রের কথাও আমরা হাদীস থেকে জানতে পারি, যার নাম ছিল ইবরাহীম।
বস্তুত ইসলামের নবী মুহাম্মদ হলেন ইসলামের প্রথম হেরেম প্রতিষ্ঠাতা, যেখানে ছিল তার বহু সংখ্যক স্ত্রী এবং যুদ্ধবন্দী দাসী। তার স্ত্রীর সংখ্যা নিয়ে মতৈক্য নাই। সেটা নিম্নে নয় বা এগারো এবং ঊর্ধ্বে কুড়ি বা একুশ হতে পারে। নারীর প্রতি অসংযত লালসা যে নবীর জীবনের এক গুরুত্বপূর্ণ প্রবণতা ছিল তা তার ব্যক্তি জীবন সম্পর্কে কিছু জানলেই বুঝা যায়।
মুহাম্মদের পালক পুত্র যায়িদের স্ত্রী ছিলেন যয়নব। এক সময় তার প্রতি মুহাম্মদের আসক্তি জন্মালে আরবের সর্বজন পালিত রীতিকে লঙ্ঘন করে যায়িদ থেকে ছাড়িয়ে নিয়ে যয়নবকে তিনি বিবাহ করেন। অথচ তৎকালীন আরবে পালক-পুত্রকে আপন পুত্রসম জ্ঞান করা হত। এই রীতি লঙ্ঘনের সমর্থনে তিনি আল্লাহর তরফ থেকে ওহী উপস্থিত করেন, ‘তোমার পোষ্য পুত্রদিগকে তিনি তোমাদের পুত্র করেন নাই’ (কুরআন- ৩৩꞉৪)। তাছাড়া দ্রষ্টব্য কুরআনের ৩৩꞉৩৭ আয়াত যেখানে যয়নবকে বিবাহের সপক্ষে আল্লাহর বক্তব্য দেওয়া হয়েছে।* যয়নব ছিলেন নবী থেকে তেইশ বৎসরের ছোট।
----------------------------
* যয়নবকে বিবাহ সংক্রান্ত বিশদ আলোচনার জন্য দেখুন ꞉ মুমিন সালিহ্, যয়নব ও জানোয়ার ꞉ মুহাম্মদের সঙ্গে যয়নবের স্বর্গীয় বিবাহ এবং যায়িদের জীবন ধ্বংস, ইসলাম বিতর্ক, প্রকাশক- ব-দ্বীপ প্রকাশন, ঢাকা, ২০১০, পৃষ্ঠা-৩৯-৪৭)।
----------------------------
কিন্তু আবু বকরের ছয় বৎসরের শিশু কন্যা আয়েশাকে পঞ্চাশ বৎসর বয়সী নবীর বিবাহকে কী দৃষ্টিতে দেখা যাবে? জীবনের ভাল-মন্দ কিছুই বুঝবার বয়স যার হয় নাই এবং পুতুল নিয়ে যার খেলবার কথা তাকে পঞ্চাশ বৎসরের বৃদ্ধ নবী বিয়ে করেন। আয়েশার বয়স নয় হলে মুহাম্মদ তাকে স্বগৃহে নিয়ে যান।
একটা ধর্মের প্রতিষ্ঠাতা যদি তার ধর্মমত প্রতিষ্ঠার জন্য আক্রমণ, যুদ্ধ, লুণ্ঠন, ধর্ষণ এবং দাসকরণের পথ বেছে নেয় তবে তার ফল কত ভয়ানক হতে পারে তা সহজে অনুমেয়। এই সবকিছুকেই অনুমোদন দেওয়া হয়েছে আল্লাহ্র নামে। অর্থাৎ আল্লাহর ধারণা এবং বিশ্বাস ছিল মুহাম্মদের হাতিয়ার।
মরুময় আরবের যাযাবর ও পশুপালক বেদুইন উপজাতিরা ছিল যুদ্ধপ্রবণ। তৎকালীন আরবের ধর্মীয়, সামাজিক ও অর্থনৈতিক কেন্দ্র মক্কার সবচেয়ে প্রভাবশালী গোত্র বা উপজাতি কুরাইশরা তাদের ঐক্যবদ্ধ ও সংযত করার জন্য বিভিন্ন পদক্ষেপ দিয়েছিল। যেমন বিভিন্ন উপজাতির নিজ নিজ দেবতার প্রতীক হিসাবে তাদের মূর্তিকে মক্কায় অবস্থিত কাবাগৃহে স্থান দান এবং ধর্মমন্দির হিসাবে কাবাকে কেন্দ্র করে নিয়মিত বাৎসরিক পূজা ও মিলন মেলার আয়োজন করা। এভাবে কাবা হয়ে উঠে বৃহত্তর আরবের ঐক্যের প্রতীক। বলা হয় কাবা গৃহে ছিল ৩৬০টি প্রতিমা। এছাড়া আরবের উপজাতিগুলির মধ্যে শান্তি স্থাপনের লক্ষ্যে চার মাস যুদ্ধ নিষিদ্ধ করা হয়েছিল, যা আরবরা কঠোরভাবে মেনে চলত। এভাবে কুরাইশরা পেগান বা পৌত্তলিক আরবদের মধ্যে প্রচলিত বিভিন্ন দেবতা-বিশ্বাস বা উপজাতীয় ধর্ম-বিশ্বাসকে কেন্দ্র করে আরবে এমন একটা ঐক্য গড়ে তুলছিল যার পরিণতি ছিল একটা রাষ্ট্র গঠন, যা তখন পর্যন্ত মূল আরব ভূখণ্ডে ছিল না। অর্থাৎ কুরাইশরা বিভিন্ন গোত্র-উপজাতি ও ধর্ম বিশ্বাসের সমন্বয়ে আরবে শান্তিপূর্ণভাবে একটি বৃহত্তর ঐক্যবদ্ধ সমাজ এবং রাষ্ট্র গঠনের প্রক্রিয়া চালু করেছিল।
মুহাম্মদ এই রাষ্ট্র গঠনের প্রক্রিয়াকে ভিন্ন রূপ ও পদ্ধতি দান করেন যুদ্ধ এবং বলপ্রয়োগের মাধ্যমে নিজের নিরঙ্কুশ একনায়কত্ব প্রতিষ্ঠা দ্বারা। এ কাজে ধর্ম এবং ধর্মযুদ্ধ বা জিহাদ হল তার হাতিয়ার। মুহাম্মদের ধর্ম প্রচারে যুদ্ধ এমনই গুরুত্বপূর্ণ হাতিয়ার হল যে আরবের সুদীর্ঘ ঐতিহ্য ও রীতিকে উড়িয়ে দিয়ে যে চার মাস ছিল যুদ্ধের জন্য নিষিদ্ধ এবং শান্তির সময় সেই সময়েও তিনি আক্রমণ ও যুদ্ধ শুরু করলেন। এই সবই করলেন তিনি আল্লাহর নামে। কুরাইশ এবং মক্কার আশপাশের আরবদের প্রধান দেবতা আল্লাহকে তিনি একমাত্র দেবতা বা উপাস্য হিসাবে ঘোষণা করলেন এবং অন্য সকল দেবতাকে নাকচ করলেন। যুদ্ধের মাধ্যমে আল্লাহর নিরঙ্কুশ একত্ব (লা শরীক আল্লাহ) ও শ্রেষ্ঠত্বের (আল্লাহু আকবর) ধারণা প্রতিষ্ঠা দ্বারা আরবের বিদ্যমান উপজাতীয় স্বাতন্ত্র্যের ভিত্তিকে চূর্ণ করে একটি যুদ্ধ ভিত্তিক নিরঙ্কুশ একনায়কী ধর্মীয় সমাজ ও রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করলেন। ধর্মকে ব্যবহার করে তিনি হলেন এই রাষ্ট্রের নিরঙ্কুশ একনায়ক।
এই একনায়কী সামরিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জন্য মুহাম্মদ আরব মরুচারী বেদুইনদের সহিংসতা, লুণ্ঠনপরায়ণতা এবং ধর্ষণপরায়ণতাকে অর্গলমুক্ত করে ব্যবহার করলেন। এক উপজাতিকে ইসলামে দীক্ষিত করে তাকে তিনি আর এক অমুসলিম উপজাতিকে আক্রমণের বাহিনী হিসাবে ব্যবহার করলেন। আক্রান্ত ও পরাজিত উপজাতি লুণ্ঠিত ও ধর্ষিত হবার যে অভিজ্ঞতা লাভ করল বাধ্যতামূলকভাবে ইসলাম গ্রহণ করার পর একই অভিজ্ঞতার শিক্ষা তারা অন্যদের উপরেও প্রয়োগ করল। এটা একটা চেইন রিঅ্যাক্শন। যুদ্ধ, হত্যা, লুণ্ঠন এবং ধর্ষণের মধ্য দিয়ে গোটা আরবের ইসলামীকরণ সম্পন্ন হলে একই প্রক্রিয়ায় চলল আরবের বাইরেও ইসলামের সম্প্রসারণ । ১৯৭১ সালে তৎকালীন পূর্ব বাংলায় পাকিস্তানী সেনাবাহিনী ইসলামের নামে যে হত্যা, লুণ্ঠন ও ধর্ষণ যজ্ঞ পরিচালনা করেছিল তা মুহাম্মদের দ্বারা প্রবর্তিত এই ঐতিহ্যেরই ধারাবাহিকতা মাত্র।
জিহাদ বা ধর্মযুদ্ধ হচ্ছে ইসলামের প্রাণশক্তির মূল উৎস। অর্থাৎ মুহাম্মদ তার নিরঙ্কুশভাবে একনায়কী আধিপত্য এবং ধর্ম প্রতিষ্ঠা করেছেন মূলত যুদ্ধের মাধ্যমে। এ ক্ষেত্রে অপর দুই প্রধান ধর্ম প্রতিষ্ঠাতা যীশু এবং বুদ্ধের সঙ্গে তার একটি মৌল পার্থক্যকে অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনায় নিতে হবে। মুহাম্মদ যীশু এবং বুদ্ধের মত শান্তিপূর্ণভাবে মানুষের হৃদয়ের কাছে আবেদন রেখে তার ধর্ম প্রতিষ্ঠা করেন নাই। তাই মক্কা থেকে মদীনায় যাবার পর থেকেই একজন আধিপত্যবাদী ও আগ্রাসী সেনাপতি বা যোদ্ধা হিসাবে তার আবির্ভাব। যোদ্ধা হিসাবে আবির্ভাবের পর থেকে বলপ্রয়োগের মাধ্যমে তিনি তার ধর্মের প্রসার ও প্রতিষ্ঠায় সফল হন। অর্থাৎ তিনি সাফল্যের সাথে তার কর্তৃত্ব, ক্ষমতা, সম্পদ এবং অনুসারীদের সংখ্যা বৃদ্ধি করতে সমর্থ হন। সুতরাং মুহাম্মদের ধর্ম তথা ইসলামকে বুঝতে হবে মূলত যুদ্ধের ধর্ম হিসাবে। অপর পার্থক্যটিও কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। সেটা হচ্ছে মুহাম্মদ যীশু বা বুদ্ধের মত কোন অরাজনৈতিক সামাজিক আন্দোলনের মধ্যে নিজেকে সীমাবদ্ধ রাখেন নাই, বরং ধর্মের মাধ্যমে এমন একটি রাজনৈতিক আন্দোলন সংগঠিত করেছিলেন যা রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে তাকে রাষ্ট্র নেতা বা শাসকে পরিণত করেছিল। অর্থাৎ মুহাম্মদকে চিনতে পারতে হবে একজন সশস্ত্র ও সহিংস ধর্ম প্রচারক, রাজনৈতিক নেতা এবং রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠাতা হিসাবে। সুতরাং মুহাম্মদের ধর্ম ও রাষ্ট্রের ভিত্তি হচ্ছে যুদ্ধ। এখানে যুদ্ধ, রাষ্ট্র এবং ধর্ম একীভূত অথবা এমনইভাবে পরস্পরের সঙ্গে জড়িয়ে আছে যে একটাকে অপরটা থেকে বিচ্ছিন্ন করা সম্ভব নয়। সুতরাং যুদ্ধ কী জিনিস তা বুঝলে ইসলামের মর্ম উদ্ঘাটন করা আরও সহজ হবে।
প্রথমে বুঝতে হবে যুদ্ধ কেন? অন্ধ বিশ্বাস বাদ দিলে উত্তর সহজ। ধর্ম বিশ্বাসকে ব্যবহার করে মুহাম্মদের নিজের একক শ্রেষ্ঠত্ব এবং আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করা। যারা তার কথায় বিশ্বাস ক’রে তার নিরঙ্কুশ শ্রেষ্টত্ব ও কর্তৃত্ব মেনে নিবে তথা তার কাছে আত্মসমর্পণ করবে তারা তার শত্রু হবে না। যারা তা করবে না তারা হবে শত্রু। তার ভাষায় এরা সবাই সত্য প্রত্যাখ্যানকারী অর্থাৎ কাফের। এই সত্য প্রত্যাখ্যানকারীদের বিরুদ্ধে তিনি করবেন জিহাদ বা যুদ্ধ।
তাহলে কী দাঁড়াচ্ছে? মুহাম্মদের মতানুযায়ী বিশ্ব-স্রষ্টা ও বিশ্ব-শাসক হিসাবে আল্লাহ যেমন একমাত্র সত্য তেমন পৃথিবীতে তার প্রতিনিধি হিসাবে মুহাম্মদও একমাত্র সত্য। আল্লাহর অস্তিত্বের একমাত্র সাক্ষী ও প্রমাণ মুহাম্মদ নিজে। সুতরাং যারা তাকে বা তার কথা অস্বীকার করে তারা সবাই মিথ্যা। এই মিথ্যার উপর জয়যুক্ত হওয়া তথা তার স্বমতে এবং নিজ আধিপত্যাধীনে সবাইকে আনার জন্য যুদ্ধবিদ্যার নিয়ম অনুযায়ী তিনি সবই করেছেন বা করাকে যুক্তিসঙ্গত মনে করেছেন, যেটা পৃথিবীর সকল দক্ষ ও সফল সেনাপতি বা জেনারেলই করে। সুতরাং মুহাম্মদকে চিনতে হবে বুদ্ধ বা যীশুর বিপরীতে এমন একজন দক্ষ ও সফল জেনারেল রূপে যিনি তার ধর্মমত ও আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করেছেন যুদ্ধের মাধ্যমে।
একজন আধিপত্যবাদী রাজা বা সেনানীর মত তিনি তার প্রতি আনুগত্য প্রদান কিংবা আরও সঠিকভাবে বললে আত্মসমর্পণের জন্য প্রথমে অন্যদেরকে আহ্বান জানাচ্ছেন। যারা সেই আহ্বানে সাড়া দিচ্ছে না তাদের বিরুদ্ধে তিনি যুদ্ধ করছেন। এ ক্ষেত্রে তিনি সকল দক্ষ সেনাপতি বা সমর নেতার মতই কৌশলকে অগ্রাধিকার দিচ্ছেন এবং সেই সঙ্গে ছল-চাতুরী, গোপনতা, মিথ্যা এবং প্রতারণাকে। মুহাম্মদ নিজেই বলছেন, ‘কৌশলই যুদ্ধের প্রাণ বস্তু।’* কিংবা বলছেন, ‘কূটকৌশলের নামই যুদ্ধ।’** অথবা ‘কৌশলই হল যুদ্ধ।’*** শুধু এইটুকুই নয়, মুহাম্মদ আরও বলছেন, ‘যুদ্ধ একটি প্রতারণা বিশেষ।’†
----------------------------
* বোখারী শরীফ, [বাংলা তরজমা ও বিস্তারিত ব্যাখ্যা], ৩য় খণ্ড, অনুবাদঃ মাওলানা শামসুল হক ফরিদপুরী [রঃ] ও মাওলানা আজিজুল হক সাহেব, প্রকাশকঃ হামিদিয়া লাইব্রেরী লিঃ, ঢাকা, একাদশ সংস্করণ, জুন ২০০৭, পৃষ্ঠা-৮৯।
** হাদীস নং ৪৩৮৯- মুসলিম শরীফ, চতুর্থ খণ্ড, সম্পাদনা পরিষদের তত্ত্বাবধানে অনূদিত এবং সম্পাদিত, ইসলামিক ফাউন্ডেশন, তৃতীয় সংস্করণ জুন ২০১০, পৃষ্ঠা- ২৬৬।
*** হাদীস নং ৪৩৯০, ঐ, পৃষ্ঠা- ২৬৭।
† সুনানু ইবনে মাজাহ্, দ্বিতীয় খণ্ড, প্রকাশক- ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ, ঢাকা, মে ২০০৮, পৃষ্ঠা-৫৬৯।
----------------------------
এ যেন মুহাম্মদেরও প্রায় এক হাজার বৎসর পূর্বে জন্ম নেওয়া চীনের বিশ্ববিখ্যাত সমর বিজ্ঞানী সান জু-এর কথার প্রতিধ্বনি। আজকের যুগে যুদ্ধ বিদ্যা বা সমর বিজ্ঞানের চর্চা যারা করেন তাদের নিকট সান জু খুব পরিচিত একটা নাম। খ্রীষ্টপূর্ব ৫০০ বৎসর পূর্বে চীনের উ রাজ্যের অজেয় সেনাপতি সান জু তার লেখা গ্রন্থ ‘যুদ্ধবিদ্যা’ (The Art of War)-এর জন্য অমর হয়ে আছেন।
সান জু-এর মতে সামরিক শক্তি বা গায়ের জোরের চেয়ে কৌশল, গোপনতা এবং প্রতারণা যুদ্ধে অনেক বেশী গুরুত্বপূর্ণ। সান জু বলছেন, ‘সব যুদ্ধেরই ভিত্তি হচ্ছে প্রতারণা।’ (All warfare is based on deception.)
যুদ্ধে গোপনতা রক্ষার উদ্দেশ্যে মুহাম্মদ যে তার অনুসারী বা সাহাবীদের নিকটও সত্যের পরিবর্তে মিথ্য বলতেন সে সম্পর্কেও আমরা হাদীস থেকে জানতে পারি। বোখারী শরীফের একটি হাদীস থেকে কিছুটা উদ্ধৃত করা যাক, ‘রসুলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু অসাল্লাম কোন অভিযানের ইচ্ছা করিলে পূর্বাহ্নে উহার স্থান নির্দিষ্টরূপে উল্লেখ করিতেন না; বরং গোপনীয়তা রক্ষার্থ অন্য কোন স্থানের (এলাকা বা দিক রূপে) নাম উল্লেখ করিতেন।’* শত্রুদের বিশ্বাসঘাতকতা বা ষড়যন্ত্র সম্পর্কে আল্লাহ যে পূর্বেই নবীকে জানিয়ে দিতেন সে কথা আমরা হাদীস থেকে জানতে পারি। এ প্রসঙ্গে বোখারী শরীফের একটি হাদীসের কথা আমরা উল্লেখ পারি যেখানে বলা হয়েছে যে, ইহুদী বনু নযীর গোত্রের সঙ্গে মুহাম্মদের আলোচনা সভায় তাকে হত্যার জন্য বনু নযীররা হত্যার ষড়যন্ত্র করলে আল্লাহ ওহী মারফৎ তাকে তা জানালে তিনি আলোচনা না করে সভাস্থল থেকে উঠে চলে আসেন। ‘ইহুদীগণ প্রকাশ্যে তাঁহাদিগকে সাদর আহ্বান জানাইল এবং খাতির-তাওয়াজু ও বন্ধুত্বের পরিচয় দিল; কিন্তু ভিতরে ভিতরে অন্যরূপ দুরভিসন্ধি করিল যে ..... একটি বড় পাথর রাসুলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহে অসাল্লামের উপর ফেলিয়া দিয়া তাঁহাকে প্রাণে বধ করিয়া ফেলিবে। ..... সঙ্গে সঙ্গে আল্লাহ তাআলা ওহী মারফত রসুলুল্লা (সঃ)-কে সমস্ত ষড়যন্ত্র জ্ঞাত করাইয়া দিলেন। তৎক্ষণাৎ তিনি তথা হইতে উঠিয়া আসিলেন, তাঁহার সঙ্গী ছাহাবীগণও চলিয়া আসিলেন।’** অর্থাৎ বুঝাই যায় যে, যে কোন কাজের অজুহাত দিবার জন্য সর্বদাই নবীর নিকট আল্লাহর নাম মজুত থাকত।
----------------------------
* বোখারী শরীফ, তৃতীয় খণ্ড, অনু- মাওলানা শামছুল হক ও মাওলানা আজিজুল হক, হামিদিয়া লাইব্রেরী লিঃ, একাদশ সংস্করণ- জুন ২০০৭, পৃষ্ঠা- ২৬১।
** বোখারী শরীফ, তৃতীয় খণ্ড, অনু- মাওলানা শামছুল হক ও মাওলানা আজিজুল হক, হামিদিয়া লাইব্রেরী লিঃ, একাদশ সংস্করণ- জুন ২০০৭, পৃষ্ঠা- ১৪৮-১৪৯।
----------------------------
যুদ্ধজয়ী হতে হলে নিজের দুর্বলতা, শক্তি, অবস্থান ইত্যাদি শত্রুর নিকট গোপন রাখতে হয়, শত্রুকে ভালভাবে জানতে হয়, সুতরাং তার সম্পর্কে বিশদ সংবাদ সংগ্রহ করতে হয় এবং শত্রুকে মিথ্যা দ্বারা প্রতারিত করে তার দুর্বল জায়গায় ও দুর্বল মুহূর্তে আক্রমণ করতে হয়। আধুনিক কালে যারা সমর বিজ্ঞান চর্চা করেন তারা জানেন যে, এগুলি সকল যুদ্ধের মূলনীতির মধ্যে পড়ে। তাহলে হয়ত প্রশ্ন করা হবে, তাহলে কি মিথ্যা ও প্রতারণার কারণে সকল যুদ্ধই অন্যায়? কিন্তু আমরা জানি যুদ্ধ মাত্রই অন্যায় নয়। তাহলে ’৭১-এ পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে বাঙ্গালী জাতির যুদ্ধও অন্যায় যুদ্ধ হত। সাধারণ বিচারে আত্মরক্ষা, মানবিক অধিকার অর্জন ও নারীর মর্যাদা রক্ষার জন্য যে কোন শান্তিপূর্ণ মানুষ, জাতি বা জনগোষ্ঠীর যুদ্ধই ন্যায় যুদ্ধ। কিন্তু ইসলামের যুদ্ধকে কি সেই ভাবে বিচার করা যাবে? সুতরাং যুদ্ধের প্রয়োজনে তার মিথ্যা ও প্রতারণার পক্ষে কোন যুক্তিই টিকে না। সবচেয়ে বড় কথা ধর্ম প্রতিষ্ঠার জন্য কাউকে যুদ্ধ করতে হবে কেন? তাহলে কি এই দাঁড়ায় না যে আসল উদ্দেশ্য মোটেই পরলৌকিক বা অলৌকিক নয় বরং সম্পূর্ণরূপে ইহলৌকিক বা লৌকিক? ধর্মটা হচ্ছে স্রেফ ধাপ্পা। আত্মপ্রতিষ্ঠার হাতিয়ার। বস্তুত, কুরআন-হাদীসের মনোযোগী পাঠ আমাদেরকে এই সিদ্ধান্তে নিয়ে যায় যে, এই ধর্ম পুরাটাই দাঁড়িয়ে আছে মিথ্যা, ভণ্ডামি ও প্রতারণার উপর। যুদ্ধে তিনি যেমন মিথ্যাচার, প্রতারণা ও ভণ্ডামি করেছেন ধর্ম প্রতিষ্ঠা করতে গিয়েও তিনি তেমন সেই একই কাজ করেছেন।
জিহাদের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত ধর্ম ইসলাম প্রতিষ্ঠায় কৌশল, গোপনতা এবং প্রতারণা তথা ছল-চাতুরী ও মিথ্যা কতখানি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে তা সহজেই অনুমেয়। ইতিহাস লেখে বিজয়ীরা। সুতরাং ইসলাম প্রসার ও প্রতিষ্ঠার অপ্রিয় সত্যকে প্রথম থেকেই ইসলামের ইতিহাস লেখকরা যে, যতটা সম্ভব গোপন করেছে তাতে কোনও সন্দেহ নাই। তা সত্ত্বেও ইসলামের মূল ধর্মগ্রন্থ কুরআন এবং হাদীসসহ আদি ইসলামী পর্বের বিভিন্ন দলিল থেকে ইসলাম প্রতিষ্ঠার যেটুকু অন্ধকার দিক বেরিয়ে আসে সেটুকুই এই ধর্মের তাৎপর্য বুঝার জন্য যথেষ্ট হতে পারে। বিভিন্ন হাদীস থেকে আমরা জানতে পারি কোনও উপজাতি বা গোত্র কিংবা জনগোষ্ঠীকে আক্রমণের পূর্বে মুহাম্মদ কীভাবে গোপনতা অবলম্বন করতেন, কীভাবে তাদের সম্পর্কে গোপনে খোঁজ-খবর নিয়ে অসতর্ক অবস্থায় থাকা তাদের বসতিতে আক্রমণ করতেন। মদীনায় প্রথম দিকে নিজের দুর্বল অবস্থায় তিনি আশপাশের যেসব অমুসলিম উপজাতির সাথে শান্তি চুক্তি সম্পাদন করেছিলেন উপযুক্ত সময়ে তাদেরকে আক্রমণ করতেও তার দ্বিধা হত না। তার জন্য তার ছলের অভাব হত না। তার সমালোচনা বা নিন্দা করাও ছিল অত্যন্ত বিপজ্জনক। হাদীস থেকে জানা যায় যখন তিনি মক্কা জয় করেন নাই তখনও এ ধরনের ব্যক্তিদেরকে তিনি গুপ্তঘাতক পাঠিয়ে হত্যা করতেন। যখন তিনি জয়ী তখন আর কে তার বিরোধিতা করে বেঁচে থাকবে? মোট কথা আল্লাহর নবীর কোনও ধরনের বিরোধিতার জায়গাই তিনি রাখেন নাই। কিন্তু সকল কাজই মুহাম্মদ আল্লাহর নামে করতেন; সেটা আক্রমণ হোক, যুদ্ধ হোক, লুণ্ঠন হোক, হত্যা হোক, ধর্ষণ হোক, দাসকরণ হোক এবং গনীমতের মালের বণ্টন হোক।
এখানে দীর্ঘ আলোচনার সুযোগ নাই। তবু আশা করি এই সংক্ষিপ্ত আলোচনা মুহাম্মদ ও ইসলামের স্বরূপ বুঝতে অনেকখানি সাহায্য করবে। বস্তুত ধর্ম প্রবক্তা হিসাবে বুদ্ধ ও যীশুর সঙ্গে মুহাম্মদকে যেমন এক কাতারে ফেলাটা ভ্রান্ত তেমন ধর্ম হিসাবে বৌদ্ধ ও খ্রীষ্ট ধর্মের সঙ্গে ইসলামকে গুলিয়ে ফেলাটাও ভ্রান্ত। একই যুক্তি অনুযায়ী ইসলামের ভূমিকার সঙ্গে বৌদ্ধ এবং খ্রীষ্টান ধর্মের ভূমিকাকে গুলিয়ে ফেলাটাও ভ্রান্ত। যারা নিজেদেরকে বস্তুবাদী বা লোকবাদী কিংবা যুক্তিবাদী মনে করেন তাদের অনেকে সব অলোকবাদী ধর্মকে ভ্রান্ত বলে উড়িয়ে দিয়ে ধর্মগুলির ভূমিকার পার্থক্য এবং সমস্যার ভিন্নতাকে যেমন অস্বীকার করেন তেমন মনে করেন জ্ঞান-বিজ্ঞান এবং যুক্তি চর্চার একই প্রক্রিয়ায় অলোকবাদী সকল ধর্মের সমস্যার সমাধান হবে। তাদের মত মানলে আমাদের প্রাণী হিসাবে যেমন বাঘ, নেকড়ে, হায়েনা এবং গরু, ঘোড়া, ছাগলকে এক দৃষ্টিতে দেখতে এবং সেগুলির প্রতি একই রকমভাবে আচরণ করতে হবে তেমন মানুষের পৃথক পৃথক সমাজ ও সংস্কৃতি নির্মাণে ধর্মগুলির ভূমিকার ভিন্নতাকে অস্বীকার করে সেগুলিকেও একই দৃষ্টিতে দেখতে এবং সেগুলির প্রতিও একই রকমভাবে আচরণ করতে হবে।
অথচ যে কোন অলোকবাদী ও অন্ধ বিশ্বাস নির্ভর ধর্মের বিরুদ্ধে সংগ্রাম না করে আধুনিক সভ্যতা এবং তার উপযোগী সমাজ নির্মাণ করা অসম্ভব। পশ্চিম ইউরোপ এবং পূর্ব ইউরোপ এই কাজ করেছে তাদের মত করে। আজ চীন ও ভিয়েৎনামের মত দেশগুলি যে অবিশ্বাস্য গতিতে এগিয়ে যাচ্ছে সেটাও সম্ভব হত না এই সংগ্রাম ছাড়া। এই সংগ্রাম হয়েছে যার যার ধর্মের ও সমাজের বাস্তবতা অনুযায়ী। যেহেতু খ্রীষ্ট বা বৌদ্ধ ধর্মের উদ্ভব যুদ্ধ, বলপ্রয়োগ, সহিংসতা ও নারী ধর্ষণের মধ্য দিয়ে হয় নাই সেহেতু এইসব ধর্মের বিরুদ্ধে সংগ্রামের ধরনও তুলনায় অনেক শান্তিপূর্ণ হতে পারে। এর পরেও ইউরোপে খ্রীষ্টধর্ম এবং তার প্রতিষ্ঠান হিসাবে চার্চের আধিপত্যের বিরুদ্ধে দীর্ঘ ও প্রবল সংগ্রাম করতে হয়েছে। রোমান ক্যাথলিক চার্চের বিরুদ্ধে ধর্ম সংস্কার আন্দোলনের প্রক্রিয়ায়ও বিপুল রক্তপাত হয়েছে। প্রথম পর্যায়ে প্রোটেস্ট্যান্টদের অনেক মূল্য দিতে হয়েছিল। ইংল্যান্ড, ফ্রান্স, জার্মানী ইত্যাদি দেশে প্রধানত ধর্ম সংস্কারকে সামনে রেখে, মোটা দাগে একটা সময়কে ধরলে, ১৫২৪ খ্রীঃ থেকে ১৬৪৮ খ্রীঃ পর্যন্ত যে সকল যুদ্ধ অনুষ্ঠিত হয় তার ফলে লক্ষ লক্ষ মানুষকে প্রাণ দিতে হয়।
খ্রীষ্ট ধর্মের ভিতর অনেক মানবিকতা, সহিষ্ণুতা, প্রেম, সমতা ও ব্যক্তির মর্যাদা থাকার পরেও এই যেখানে অবস্থা সেখানে চরম সহিংসতা, সন্ত্রাস, মিথ্যাচার ও যুদ্ধের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত ইসলামের অধীন সমাজে যুক্তি ও লোকবাদ, সহিষ্ণুতা, ব্যক্তির স্বাধীনতা, নারীর মানবিক অধিকার ও গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা কতখানি কঠিন তা সহজেই অনুমেয়।
এ কথা আমাদেরকে বুঝতে হবে যে, মানুষের ভিতর বিবেক, বিবেচনা, দয়া এবং মানবিকতা যেমন থাকে তেমন তার বিপরীত গুণাবলীও থাকে। ফলে মানুষ সহিংস এবং নৃশংস বা নিষ্ঠুরও হতে পারে। মানুষ যেমন ত্যাগ করতে পারে তেমন স্বার্থান্ধ ভোগবাদীও হতে পারে। বরং মানুষের ভিতর পশু প্রবৃত্তির প্রভাবই বেশী থাকে। কিন্তু প্রকৃতির জগতে মানুষ একা বাঁচতে পারে না। ফলে সমাজবদ্ধ হয়েই তাকে বাঁচতে হয়। আর সমাজবদ্ধ হতে গিয়ে তাকে সমাজ গঠন করতে হয়। কিন্তু কিছু সামাজিক নিয়ম এবং নীতি-নৈতিকতার প্রতিষ্ঠা ছাড়া সমাজ গঠন করা যায় না। এগুলির চর্চা দ্বারা মানুষ এবং তার সমাজ মানুষের পশু প্রবৃত্তিকে যতটা সম্ভব সংযত করতে চেষ্টা করে। আদিম মানুষ যখন আত্মা ও অলৌকিক বা অতিপ্রাকৃতিক শক্তির কল্পনা করতে শিখেছে তখন তারা তাদের গোত্র এবং উপজাতি গঠন ও রক্ষার জন্য যে সকল নিয়ম ও নীতি-নৈতিকতা প্রবর্তন ও অনুশীলন করত সেগুলির সঙ্গে আত্মা ও অতিপ্রাকৃতিক শক্তির কল্পনা স্বাভাবিক নিয়মে জড়িয়ে যেত। এভাবে ধর্মের উদ্ভব ও বিকাশ ঘটতে থাকে। এক একটি উপজাতি নিজেদের উপজাতীয় সংহতি ও অন্যান্য উপজাতির সঙ্গে নিজেদের পার্থক্য রক্ষার প্রয়োজনে ধর্মকে ব্যবহার করতে শুরু করে। সভ্যতার দিকে মানুষ যত এগিয়ে যেতে থাকে তত ধর্ম বোধেরও বিকাশ হতে থাকে। মানুষ প্রকৃতির বিভিন্ন শক্তির অতিপ্রাকৃতিক রূপ কল্পনার পাশাপাশি তাদের উপজাতির নিজস্ব অতিপ্রাকৃতিক শক্তির রূপ তথা দেবতার কল্পনা করতেও শিখে। দেবতাদের তুষ্ট করার জন্য তাদের প্রতীক নির্মাণ ও পূজা দিতে শুরু করে। প্রাকৃতিক শক্তি এবং মূর্তি বা প্রতীক পূজা মূলক এই ধর্মগুলিকে আমরা পেগান (Pagan) ধর্ম বলতে পারি। এই শব্দ দিয়ে এক সময় খ্রীষ্টানরা খ্রীষ্টান ধর্মের আবির্ভাবের পূর্ব কালীন এবং সমকালীন সকল পৌত্তলিক ধর্মকে বুঝাত।
গ্রীক এবং রোমান সভ্যতা যারা নির্মাণ করেছিল তারা ছিল পেগান। পেগান ধর্মের একটা সমস্যা হল উপজাতির বাইরের মানুষদের প্রতি ভ্রাতৃত্ব বোধ বা সহমর্মিতার অভাব, যে কারণে বৃহত্তর সমাজ বা রাষ্ট্র গঠনে উদ্যোগী ভূমিকা গ্রহণকারী উপজাতি অন্যান্য উপজাতির প্রতি নিষ্ঠুর ও নির্বিবেক হয়ে উঠতে পারে। সিন্ধু সভ্যতা ছাড়া মিসর, মেসোপটেমিয়া ও চীনের প্রাচীন সভ্যতায় রাষ্ট্র ও সভ্যতা গঠনে পেগান মানুষদের সীমাহীন নিষ্ঠুরতার কথা জানা যায়। সমকালীন মিসর ও মেসোপটেমিয়ার তুলনায় অনেক বেশী এলাকায় বিস্তৃত সিন্ধু সভ্যতা (পাঁচ হাজার বৎসর পূর্বে প্রতিষ্ঠিত) প্রাচীন পৃথিবীর এক বিস্ময়, যা প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল প্রধানত শান্তিপূর্ণ ও অহিংস উপায়ে। তবে সেখানে যে ধর্ম ছিল তাকে প্রত্নতাত্ত্বিক সাক্ষ্য থেকে এবং হিন্দুদের আদি ধর্মগ্রন্থ ঋগ্বেদের সূত্র ধরে মূলত শান্তিপূর্ণ, নিরাকারবাদী এবং একেশ্বরবাদী বলে অনুমান করা চলে। এটা উপজাতীয় চেতনার গণ্ডী ভেঙ্গে মানুষকে বিশ্বজনীনতার বোধ দিয়েছিল। আমার অনুমান এই ধর্ম সেখানে বিভিন্ন উপজাতি ও জনগোষ্ঠীর মধ্যে শান্তিপূর্ণভাবে বৃহত্তর সমাজ ও রাষ্ট্র গঠনে সহায়ক ভূমিকা পালন করেছিল। যাইহোক, এটা ভিন্ন ও বিস্তারিত আলোচনার বিষয়।* আমরা এখানে শুধু এইটুকু বলতে পারি যে, পেগান সমাজগুলি রাষ্ট্র ও সভ্যতা গঠনে যে সহিংসতা ও বর্বরতার আশ্রয় নিয়েছিল খ্রীষ্ট এবং বৌদ্ধ ধর্ম ছিল তার বিরুদ্ধে একটা প্রতিক্রিয়া। এটা খুব লক্ষ্যণীয় যে পেগান গ্রীক ও রোমান সভ্যতা প্রতিষ্ঠিত ছিল যুদ্ধ, জবরদস্তি এবং ব্যাপক দাস প্রথার উপর।
----------------------------
* সিন্ধু সভ্যতায় ধর্ম ও রাষ্ট্রের বৈশিষ্ট্য ও বিকাশ সম্পর্কে আলোচনার জন্য দেখুন ꞉ শামসুজ্জোহা মানিক ও শামসুল আলম চঞ্চল, আর্যজন ও সিন্ধু সভ্যতা, ব-দ্বীপ প্রকাশন, ঢাকা, ২০০৩।
----------------------------
গ্রীক ও পরবর্তী কালে গড়ে উঠা রোমান সভ্যতা বিরাট উন্নতি সাধন করলেও দাস শ্রমের উপর নির্ভরতার কারণে একটা পর্যায়ে গিয়ে আটকে গিয়েছিল। অন্যান্য সমাজ থেকে মানুষ ধরে এনে দাস করে তাদের শ্রমের উপর গোটা সভ্যতার নির্ভরতা সভ্যতার প্রযুক্তিগত অগ্রগতির পথ রুদ্ধ করে দিল। একদিকে, যুদ্ধ ও নির্দয়তা, অপর দিকে, সহজলভ্য দাস শ্রম দিয়ে সব কাজ করাবার প্রবণতা সভ্যতার প্রাণশক্তি নিংড়ে নিচ্ছিল। ভূমধ্যসাগরের চারপাশ ঘিরে ইউরোপ, এশিয়া ও আফ্রিকার বিশাল অঞ্চল ব্যাপী বিস্তৃত রোমান সাম্রাজ্যের মানুষকে এমন একটা সময়ে খ্রীষ্টের প্রেম ও সৌভ্রাতৃত্বের বাণী নূতন আশায় উজ্জীবিত করল। সভ্যতার ক্ষয়ের সঙ্গে, হুন-গথ-ভ্যান্ডাল ইত্যাদি পেগান বর্বরদের ক্রমাগত আক্রমণের মুখে পেগান রোমান সভ্যতার বিপর্যয়ের সঙ্গে সাম্রাজ্যের বিস্তীর্ণ অঞ্চলে বিস্তৃত হল খ্রীষ্টের ধর্ম। ক্রমে সর্বজনীন প্রেমের ধর্মের শক্তির কাছে পরাভূত হল আক্রমণকারী ও আক্রান্ত সব পেগানরাই। এক সময় রোমের বিশাল বস্তুগত সাম্রাজ্য থাকল না, কিন্তু খ্রীষ্টধর্মকে অবলম্বন করে প্রতিষ্ঠিত হল ভাবগত সাম্রাজ্য। উন্নত নগর সভ্যতা হারিয়ে গেল, সেই সঙ্গে হারিয়ে গেল দাস ব্যবস্থার উপর প্রতিষ্ঠিত নির্দয় সভ্যতা। রোমান সাম্রাজ্যের তুলনায়ও বিশালায়তনে প্রতিষ্ঠিত হল ধর্ম সাম্রাজ্য যে সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠার জন্য যুদ্ধ এবং সন্ত্রাসের পরিবর্তে হাতিয়ার হল অহিংসা ও প্রেম বা ভালবাসার আবেদন।
ধর্মগ্রন্থের চুলচেরা বিশ্লেষণ দিয়ে যীশুর শক্তির কিছুই বুঝা যাবে না যদি না মানুষের জন্য ব্যথিত ক্রুশবিদ্ধ যীশুর আত্মদানের মহিমাকে বুঝা না যায়। দয়াহীন পৃথিবীতে যীশু মানুষকে শুনালেন তার দয়াময় পরমপিতা ঈশ্বরের স্বর্গরাজ্যে যাবার বার্তা। এই ঈশ্বর সব মানুষের জন্য দয়াময়। সেখানে জাতি, উপজাতি, গোত্র, বর্ণ ও শ্রেণীর কোন ভেদ নাই। শুধু বাণী নয়, বরং নিজের জীবনাচরণ ও শেষাবধি ক্রুশে আত্মদান করে নিজের বিশ্বাসকে মহিমান্বিত করলেন। হয়ত ক্রুশে বিদ্ধ হয়ে মৃত্যু বরণ করলে সব হারিয়ে যেত। কিন্তু কবরস্থ করার পরেও তৃতীয় দিনে ফিরে এসে শিষ্যদের নিকট তার দর্শন দান ঈশ্বর-পুত্র হিসাবে তার প্রতি শিষ্যদের বিশ্বাসকে নূতন শক্তি দান করল। এরপর চল্লিশ দিন তিনি তার শিষ্যদের নিকট তার বাণী প্রচার করেন এবং অবশেষে অদৃশ্য হন। দয়াহীন পৃথিবীতে দয়াপূর্ণ স্বর্গরাজ্যের সন্ধান দিতে চেয়ে যীশুর তিরোধানের পর তার শিষ্যরা যীশুর প্রেম ও ক্ষমার বাণী প্রচারে নেমে পড়ল। নির্দয় সভ্যতার পেষণে পিষ্ট মানুষের কাছে তাদের প্রতি দয়ামায়াহীন যুক্তি ও বিচার-বুদ্ধির কী মূল্য?
রোমান সভ্যতার পতনের পর উন্নত নগর সভ্যতা থেকে মানুষ পিছিয়ে গেল। অন্ধ বিশ্বাস নির্ভর ধর্মে মানুষ আশ্রয় নিল। কিন্তু, এও ঠিক যে ধর্মের আবরণে ইউরোপে গ্রীক ও রোমান সভ্যতার এমন কিছু উপাদান রক্ষা পেল যা ভবিষ্যতে ইউরোপের পুনর্জাগরণে সহায়ক হবে। দাস ব্যবস্থা নির্ভর সভ্যতার সঙ্গে একটা ছেদ দরকার ছিল। প্রেম ও ভ্রাতৃত্বের ধারণার উপর প্রতিষ্ঠিত খ্রীষ্ট ধর্ম এই ছেদ ঘটাবার ক্ষেত্রে ভাবাদর্শিক প্রয়োজন পূরণ করেছিল। এটা স্পষ্ট যে খ্রীষ্ট ধর্মের কারণে ইউরোপে আর কখনই দাস ব্যবস্থা ফিরে আসে নাই।
এর মধ্যে অর্থনীতি খুঁজে লাভ নাই। অর্থাৎ অর্থনীতির পশ্চাৎপদতার কারণে ইউরোপে দাস ব্যবস্থা আর প্রবর্তিত হয় নাই বা টিকে নাই এটা ভাবা ভুল হবে। তা হলে প্রশ্ন আসবে অনেক পশ্চাৎপদ অর্থনীতি নিয়ে ইসলাম যেখানে গেছে সেখানেই দাসত্বের ভয়াবহ বিস্তার কীভাবে ঘটেছে। ইসলাম উন্নত সভ্যতা দিতে না পারলেও দাস ব্যবস্থার বিস্তার দিতে পেরেছে। ইসলামের প্রভাবে সর্বত্র উৎপাদন ব্যবস্থার যে অধঃপতন ঘটে তার ফলে গ্রীস বা রোমের মত দাস ব্যবস্থা ভিত্তিক উন্নত সভ্যতাও আর নির্মাণ করা সম্ভব হয় নাই। যে কারণে ইসলামে দাসত্বের ভয়াবহ প্রসার ঘটলেও উৎপাদন তথা অর্থনীতির মূল ভিত্তি হিসাবে সেটা আর দাঁড়াতে পারে নাই। কিন্তু এ থেকে এ কথা মনে করা ভুল হবে যে ইসলাম চেতনাগত বা আদর্শিকভাবে দাসত্ব বিরোধী ছিল। বরং মানুষের বান্দাত্ব বা দাসত্বের ধারণার উপর প্রতিষ্ঠিত ইসলাম ধর্মীয় বিধান অনুযায়ীই দাসত্ব চর্চা করেছে, যার সূত্রপাত করেন মুহাম্মদ নিজেই। ইসলামের এই বাস্তবতার সঙ্গে খ্রীষ্টীয় মূল্যবোধ ও আদর্শ সাংঘর্ষিক। প্রকৃতপক্ষে খ্রীষ্টীয় চেতনা ও মূল্যবোধ দাস ব্যবস্থার বিরোধী ছিল।
এটা স্পষ্ট যে বৌদ্ধ ও খ্রীষ্ট ধর্ম বৃহত্তর ও শান্তিপূর্ণ সমাজ গঠন করতে চেয়ে মানুষের মানবীয় গুণাবলীকে ধারণ ও রক্ষা করতে এবং সহিংসতা, লোভ, নির্দয়তা ইত্যাদি প্রবৃত্তিকে সংযত বা দমন করতে চেয়েছে। তা সত্ত্বেও বৌদ্ধ ও খ্রীষ্ট ধর্মাবলম্বীদের সহিংসতা ও নিষ্ঠুরতার ইতিহাস কম দীর্ঘ নয়। এই যেখানে অবস্থা সেখানে যদি কোন ধর্ম মানুষের ভিতরকার সহিংসতা ও পশু প্রবৃত্তিগুলিকে অর্গল মুক্ত এবং লালন করে তবে কী ভয়ানক অবস্থা হতে পারে তা সহজেই অনুমান করা যায়।
মিথ্যাচার, প্রতারণা, ভণ্ডামি, সহিংসতা ও হিংস্র আক্রমণাত্মকতা, অসহিষ্ণুতা, লোভ, হত্যা, নারী ধর্ষণ এবং চক্রান্ত জন্মলগ্ন থেকে ইসলামকে যেভাবে অধিকার করে আছে তার ফল ইসলামের জন্যও মুহাম্মদের মৃত্যুর সাথে সাথে ফলতে শুরু করে। মুহাম্মদের মৃত্যুর পর ক্ষমতার উত্তরাধিকার নিয়ে মদীনায় তার অনুসারী বা সাহাবীদের মধ্যে দ্বন্দ্ব এবং চক্রান্ত শুরু হয়। দুইদিনের উপর তার লাশ দাফনের অভাবে বিছানায় পড়ে থাকে। অবশেষে ষড়যন্ত্রের প্রক্রিয়ায় ওমরের উদ্যোগে আবু বকরকে খলীফা মনোনীত করা হয়। উদ্দেশ্য মুহাম্মদের চাচাতো ভাই এবং জামাতা আলীকে বঞ্চিত করা। মিথ্যা, চক্রান্ত, হত্যা, সন্ত্রাস এবং যুদ্ধ দ্বারা ইসলামের যে যাত্রা শুরু হয়েছিল তার শিকার হয়েছিলেন প্রথম চার খলীফার মধ্যে প্রথম খলীফা আবু বকর বাদে বাকী তিন খলীফাই। আবু বকর মাত্র ২৭ মাস খলীফা হিসাবে বেঁচে ছিলেন। ৬৩২ খ্রীঃ-এ খলীফা পদ লাভ ক’রে ৬৩৪ খ্রীঃ-এ মারা যান। বাঁচলে হয়ত তাকেও মরতে হত বাকী তিন খলীফা যথাক্রমে ওমর, ওসমান এবং আলীর মত শত্রুর ছুরিকাঘাতে।
ইসলামে যুদ্ধ লাগবেই, আর যুদ্ধ করার জন্য স্বাভাবিক নিয়মে শত্রুও লাগবে। অসুমলমান বা কাফের পাওয়া না গেলে মুসলমানকেই কাফের বা শত্রু ঘোষণা করে তার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে হবে। আলীর বিরুদ্ধে গৃহযুদ্ধ শুরু হল ব্যাপকায়তনে। এমন কি আলীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করলেন মুহাম্মদের বিধবা স্ত্রী আয়েশা, যিনি কিনা আবার আলীর সৎ শাশুড়িও বটে। এই যুদ্ধ উষ্ট্রের যুদ্ধ হিসাবে পরিচিত। যুদ্ধে আয়েশা পরাজিত ও বন্দী হন। তবে আলী তাকে মুক্তি দেন।
আসলে শান্তির মত গণতন্ত্রের একটা পদ্ধতি নির্বাচনের সঙ্গেও ইসলামের কোন সম্পর্ক নাই। প্রাক-ইসলামী যুগের আরবদের মধ্যে উপজাতীয় গণতন্ত্রের যে প্রভাব ছিল তার ধারাবাহিকতায় প্রথমেই রাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হতে পারে নাই। ফলে আমরা প্রথম চার খলীফার ক্ষমতা গ্রহণে চক্রান্ত, সংঘাত ও রক্তপাত সত্ত্বেও পারিবারিক রাজতন্ত্রের বদলে এক ধরনের নির্বাচন দেখতে পাই। তবে এই প্রক্রিয়ায় যেটা উল্লেখ করার মত তা হল একদিকে আলীকে বাদ দেওয়া, অপরদিকে মদীনাবাসী এবং অকুরাশইদেরকে ক্ষমতার কেন্দ্র থেকে দূরে সরিয়ে রাখা। অর্থাৎ মুহাম্মদের ধর্ম প্রকৃতপক্ষে কুরাইশদের বংশগত একনায়কতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করে। একনায়ক-শাসক নির্বাচনে অনিশ্চয়তা, রক্তপাত ও বিশৃঙ্খলা দূর করার জন্য আলীর মৃত্যুর পর খলীফা মুয়াবিয়ার নেতৃত্বে রাজবংশ প্রতিষ্ঠা করা হয়।
ইসলামের সহিংসতার থাবা থেকে মুহাম্মদের বৎসধররাও রক্ষা পেলেন না। তার কোন পুত্র ছিল না। তার কন্যা ফাতেমার গর্ভে হাসান ও হুসেন নামে তার দুই দৌহিত্র ছিলেন। খলীফা মুয়াবিয়ার শাসনকালে হাসানকে বিষ প্রয়োগ ক’রে এবং মুয়াবিয়ার পুত্র খলীফা এজিদের শাসনকালে তার নির্দেশে হাসানের ছোট ভাই হুসেনকে কারবালার মরু প্রান্তরে আরও অনেকের সঙ্গে হত্যা করা হয়। হুসেনকে হত্যা ক’রে তার মাথা কেটে নিয়ে খলীফা এজিদের কাছে উপস্থিত করা হয়। এই হচ্ছে ইসলামের শান্তির ঐতিহ্য প্রতিষ্ঠার নমুনা!
বস্তুত ইসলামের মূল সামাজিক ভিত্তির দিকে দৃষ্টি দিলে যুদ্ধ ও সহিংসতার ধর্ম হিসাবে তার বিকাশকে যৌক্তিক মনে হবে। মুহাম্মদের যোদ্ধা বাহিনীর প্রধান অংশ এসেছিল অপেক্ষাকৃত দরিদ্র, অর্ধযাযাবর এবং বিশেষত যাযাবর বেদুইন উপজাতিগুলি থেকে। বেদুইনরা কৃষক বা উৎপাদক জনগোষ্ঠী নয়। তারা ছিল যুদ্ধ প্রবণ, লুণ্ঠনপরায়ণ ও বিচরণশীল। ফলে তারা সভ্যতা নির্মাণের নয়, বরং লুণ্ঠন ও ধ্বংসের শক্তি।
এই জায়গায় পৃথিবীর বর্তমান আর সকল বৃহৎ ধর্মের সঙ্গে ইসলামের পার্থক্য। যেমন, মোশি বা মুসা মিসরে দাসে পরিণত ইসরাইলীয় কৃষক ও শ্রমজীবী মানুষদেরকে মুক্ত করে প্যালেস্টাইনে আনেন এবং তাদেরকে নিজ ধর্মমতে দীক্ষিত করেন, যা আমাদের নিকট ইহুদী ধর্ম হিসাবে পরিচিত। অর্থাৎ মোশির ধর্মের মূল ভিত্তি উৎপাদক ও শ্রমজীবী জনগোষ্ঠী। রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠাতা মোশির ধর্মে সামরিকতা, উগ্র রক্ষণশীলতা ও অসহিষ্ণুতা প্রকট হলেও তা অন্য জাতি বা সমাজের প্রতি সেভাবে আগ্রাসী নয়। কারণ মোশির ধর্মের মূল লক্ষ্য ছিল দাসত্বে আবদ্ধ ইসরাইলীয়দেরকে ঈশ্বরের মনোনীত জাতি হিসাবে মুক্ত করা এবং তাদেরকে ঈশ্বরের প্রতিশ্রুত ভূমি হিসাবে প্যালেস্টাইনে নেওয়া। এভাবে মোশির ধর্মমতের মাধ্যমে একটি মুক্ত জাতিই শুধু সৃষ্টি হল না, অধিকন্তু একটি রাষ্ট্রও প্রতিষ্ঠিত হল। এই রাষ্ট্রটিও হল মূলত একটি নির্দিষ্ট ভূখণ্ডে সীমাবদ্ধ।
ইহুদী বংশোদ্ভূত যীশু কঠোর ও অসহিষ্ণু ইহুদী ধর্মকে নমনীয় রূপ দিতে গিয়ে এমন একটি সংস্কার ঘটালেন যা একটি নূতন ধর্ম জন্ম দিল। তার ধর্মে যোগ দিল সমাজের দরিদ্র শ্রমজীবী, কৃষক, কারিগর, ক্ষুদে ব্যবসায়ী, দাস ইত্যাদি নিম্নবর্গের শ্রমজীবী ও উৎপাদনশীল মানুষ। পরবর্তী সময়ে বিভিন্ন জাতি ও শ্রেণীর মানুষ এতে যোগ দিলেও নম্রধারায় উদ্ভূত এই ধর্মের মূল ভিত্তি ছিল শাসিত, শোষিত, শ্রমজীবী ও উৎপাদনশীল জনগোষ্ঠী।
অহিংস ও শান্তিবাদী বৌদ্ধ ধর্মও উদ্ভূত ও প্রসার লাভ করে সমাজের কারিগর, বণিক, কৃষক এবং বিভিন্ন বৃত্তিজীবীর সমর্থন নিয়ে। পরবর্তী সময়ে সমাজের উপর তলার সমর্থন লাভ করলেও নিম্নবর্গ এবং বর্ণজাতিভেদ বিরোধী জনগোষ্ঠীর আন্দোলন রূপে তা বিকাশ লাভ করে। এভাবে বৌদ্ধধর্মের ভিত্তিমূলে আমরা পাই উৎপাদনশীল জনগোষ্ঠীকে।
বর্ণজাতিভেদ ভিত্তিক হিন্দু ধর্ম কোন একজন ধর্মনেতার দ্বারা প্রতিষ্ঠিত হয় নাই। এক কথায় হিন্দু ধর্মকে ব্যাখ্যা করাও সম্ভব নয়। আত্মা, জন্মান্তরবাদ, দেবতা ইত্যাদি কতকগুলি বিশ্বাসকে ভিত্তি করে এমন একটি ধর্ম গড়ে উঠেছে যেটাকে প্রচলিত অন্যান্য ধর্মের মত ধর্ম না বলে সামাজিক প্রথা ও বিশ্বাসের একটি সমষ্টি বলাই ভাল যেখানে সঙ্গতি বা ঐক্যের পাশে প্রভৃত পরিমাণে অসঙ্গতি, অনৈক্য এমনকি পরস্পর বিরুদ্ধতাও রয়েছে। এটি অবিশ্বাস্য রকম জটিলতায় আবদ্ধ একটি সমাজ। তত্ত্বগতভাবে হিন্দু সমাজ চার বর্ণে বিভক্ত, যথা ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য এবং শূদ্র। কিন্তু এটা তত্ত্বগত ভাগ মাত্র। বাস্তবে সমাজ অজস্র ভাগে বিভক্ত, অর্থাৎ অসংখ্য বর্ণজাতিতে বিভক্ত। এই বর্ণজাতিগুলি শ্রমকর্ম বিভাজন এবং পবিত্রতা-অপবিত্রতার নির্দিষ্ট স্তরবিন্যাস দ্বারা আবদ্ধ হয়ে থাকে। সবার উপরে সবচেয়ে পবিত্র বর্ণজাতি হিসাবে ব্রাহ্মণ এবং সবার নীচে শূদ্র ও অস্পৃশ্যদের স্থান।
বর্ণজাতিভেদ মূলক ব্যবস্থায় আবদ্ধ হবার ফলে হিন্দু সমাজ যেমন গ্রীস, রোম বা সমকালীন চীনের সমপর্যায়ের উন্নত নগর সভ্যতা গড়তে অক্ষম হয় তেমন অসংখ্য বিভাজনের কারণে দীর্ঘ সময়ের জন্য কোন বৃহৎ রাষ্ট্র গড়তে ও কোন প্রবল বহিরাক্রমণকে মোকাবিলা করতে পারে নাই। একটা দীর্ঘ সময় ভারতীয় উপমহাদেশে বৌদ্ধ ধর্ম এবং হিন্দু ধর্মের মধ্যে প্রতিযোগিতা চলেছিল। এই প্রতিযোগিতায় শেষাবধি হিন্দু সমাজ ব্যবস্থার বিকাশ ও প্রসারের সঙ্গে হিন্দু ধর্ম জিতে যায়। কিন্তু সেই সঙ্গে বৈদেশিক আক্রমণকারীদের মোকাবিলায় দাঁড়াতেও ভারতীয় রাষ্ট্রগুলির অক্ষমতা লক্ষ্যণীয়। শক ও হুন আক্রমণকারীরা উপমহাদেশের উত্তর-পশ্চিম অংশ দখল করে। অষ্টম শতাব্দীতে (৭১২ খ্রীষ্টাব্দ) আরব আক্রমণকারীরা সিন্ধুর রাজা দাহিরকে আক্রমণ ও পরাজিত ক’রে সিন্ধু দখল করে। একাদশ শতাব্দীতে সুলতান মাহমুদ সতেরো বার (১০০০-১০২৭ খ্রীষ্টাব্দ) উত্তর ও পশ্চিম ভারতে লুণ্ঠন অভিযান পরিচালনা করেন। আর ত্রয়োদশ শতাব্দী থেকে অষ্টাদশ শতাব্দী পর্যন্ত চলে বহিরাক্রমণকারী তথা বহিরাগত মুসলিমদের লাগাতার শাসন। এর অবসান হয় আর একদল বহিরাগত আক্রমণকারী ব্রিটিশদের হাতে। ব্রিটিশ শাসন চলে প্রায় দুইশত বৎসর।
যাইহোক, হিন্দু ধর্ম সমাজ ও সভ্যতার বিকাশে বাধাদানকারী হলেও এটা ভারতবর্ষে নিম্ন মাত্রায় কৃষি ভিত্তিক সভ্যতাকে ধরে রাখায় সহায়ক হয়েছিল। অনুমান করি সিন্ধু সভ্যতার পতনের পর সভ্যতার পশ্চাৎগতির অবস্থায় গাঙ্গেয় উপত্যকায় সিন্ধু সভ্যতার ধর্ম ও সংস্কৃতির ঐতিহ্যের সঙ্গে অসংখ্য পেগান উপজাতির ধর্ম ও সংস্কৃতির সম্মিলনে বিভিন্ন রূপান্তরের মধ্য দিয়ে যে নূতন ধর্ম ও সংষ্কৃতি গড়ে উঠে তা-ই হিন্দু ধর্ম হিসাবে বিকশিত হয়। সভ্যতার বিকাশের ধর্ম এটি নয়। বরং সভ্যতার সংকট কালে সভ্যতাকে নিম্ন মাত্রায় ধরে রাখার ধর্ম, যা ভারতবর্ষের বিশেষ ভূ-প্রাকৃতিক ও জনগোষ্ঠীগত বাস্তবতায় উদ্ভূত ও বিকশিত হয়েছিল।*
----------------------------
* হিন্দু ধর্ম এবং বর্ণজাতি প্রথার উদ্ভব ও বিকাশ সংক্রান্ত আলোচনার জন্য দেখুন ꞉ শামসুজ্জোহা মানিক ও শামসুল আলম চঞ্চল, আর্যজন ও সিন্ধু সভ্যতা, ব-দ্বীপ প্রকাশন, ঢাকা। এছাড়া এ বিষয়ে লেখকের সংক্ষিপ্ত আকারে আরও কিছু আলোচনার জন্য দেখুন ꞉ শামসুজ্জোহা মানিক, বাঙ্গালী জাতির সঙ্কটের উৎস ও তার প্রতিকার সন্ধান-এর পাদটীকা, ব-দ্বীপ প্রকাশন, ঢাকা, ২০১০, পৃষ্ঠা-৬৭-৬৮।
----------------------------
সিন্ধুর উন্নত নগর সভ্যতার পতন কালে এর উদ্ভবের বীজ রচিত হয়েছিল বলে সভ্যতার বিরুদ্ধে হিন্দু ধর্মে প্রতিক্রিয়ার প্রভাব এত গভীর বলে অনুমান করি। অবিশ্বাস্য রকম পশ্চাৎপদতা, ধর্মীয় গোঁড়ামি এবং কুসংস্কার এই ধর্মে রয়েছে যেগুলির বিরুদ্ধে লড়াই করা ছাড়া হিন্দু সমাজকেও আধুনিক সভ্যতার উপযোগী করে গড়ে তোলা সম্ভব নয়। তবে হিন্দু ধর্ম বা সমাজ আক্রমণাত্মক এবং হিংস্র না হওয়ায় কাজটা প্রধানত শান্তিপূর্ণভাবে করা সম্ভব। অনেক কাল ধরে বহুমুখী আন্দোলনের মধ্য দিয়ে ভারতে সেই চেষ্টা চলছেও।
যাইহোক, সবচেয়ে বড় কথা ইসলাম বাদে আর সকল প্রধান ধর্ম এক অর্থে কৃষক সমাজের ধর্ম তথা কৃষি নির্ভর সভ্যতার ধর্ম। প্রতীকীভাবে এগুলিকে কৃষকের ধর্মও বলা যায়। ফলে এইসব ধর্মে কমবেশী উৎপাদনশীলতা আছে। কিন্তু ইসলাম হচ্ছে এমন যাযাবর সমাজের ধর্ম যা আক্রমণ, যুদ্ধ, লুণ্ঠন ও ধর্ষণকে বেছে নিয়েছে তার জীবন-জীবিকার ভিত্তি এবং প্রেরণার উৎস হিসাবে। অন্যান্য কৃষি নির্ভর সমাজের উৎপাদনশীল জনগণের উপর ধর্মের অজুহাতে আক্রমণ ক’রে তাদেরকে পদানত এবং তাদের সম্পদ লুণ্ঠন করা হবে, তাদের কাছ থেকে নিয়মিত কর আদায় ক’রে এবং তাদেরকে নানানভাবে শ্রমদানে বাধ্য ক’রে আরাম-আয়েশ করা হবে এবং তাদের নারীদের বন্দী ও দাসী করে ধর্ষণ ও সম্ভোগ করা হবে।
সুতরাং ভূমিকার বিচারে পরবর্তী কালের সভ্যতা ধ্বংসী ও গণহত্যাকারী বিশ্বত্রাস মোঙ্গল নেতা চেঙ্গিস খানের (জন্ম আনুমানিক ১১৬২ খ্রীঃ-মৃত্যু ১২২৭ খ্রীঃ) সঙ্গে মুহাম্মদকে মিলানো যায়। মোঙ্গলরা সভ্যতাগুলিকে আক্রমণ ক’রে কোটি কোটি মানুষকে হত্যা করে (এক হিসাবে চেঙ্গিস খান তৎকালীন চীনের আনুমানিক দশ কোটি মানুষের মধ্যে দুই কোটি মানুষকে হত্যা করেছিলেন), তাদের সম্পদ লুণ্ঠন করে, তাদের নারীদেরকে ধর্ষণ করে এবং বিশাল অঞ্চল ব্যাপী সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করে। তবে চেঙ্গিস নূতন ধর্ম প্রবর্তন করেন নাই। শুধুমাত্র সামরিক শক্তি এবং যুদ্ধকৌশলের সাহায্যে চেঙ্গিসের নেতৃত্বে মোঙ্গলরা বিজয় অভিযান পরিচালনা করে। মুহাম্মদ তার জিহাদী ধর্মের মাধ্যমে আরবদেরকে একটি একনায়কী ধর্মীয় সামরিক রাষ্ট্র দান করেন যার বলে বলীয়ান হয়ে মূলত মরুচারী ও যাযাবর আরবরা তৎকালীন সভ্য পৃথিবী লুণ্ঠন ও ধ্বংসের অভিযানে বের হয়ে পড়ে।
হাদীসসমূহ মনোযোগ দিয়ে পড়লে বুঝা যায় যে, বিশ্বজয়ের একটি পরিকল্পনা বহুকাল ধরেই মুহাম্মদ তার অন্তরে লালন করতেন। যার জন্য তার প্রয়োজন হয়েছিল নিজ একনায়কী নেতৃত্বে আরবদের সংগঠিত করা। এ কাজে ধর্ম হয়েছিল তার হাতিয়ার। এ প্রসঙ্গে একটি হাদীস উল্লেখ করা যায় যেখানে মুহাম্মদ বলছেন, ‘(পারস্য সম্রাট) কিস্রা ধ্বংস হবে, তারপর আর কিস্রা হবে না। আর (রোমক সম্রাট) কায়সার অবশ্যই ধ্বংস হবে, তারপর আর কায়সার হবে না। এবং এটা নিশ্চিত যে, তাদের ধনভাণ্ডার আল্লাহর রাহে ব্যয় হবে।’* আসলে সমস্ত পৃথিবীর মালিকানা তিনি নিজের মনে করতেন, যে কারণে একদিন তিনি ইহুদীদের নিকট গিয়ে তাদেরকে বললেন, ‘হে ইহুদী সম্প্রদায়! তোমরা মুসলমান হয়ে যাও, নিরাপদ থাকবে।..... তোমরা জেনে রেখো যে, যমীন কেবল আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের।’একই কথার পুনরুক্তি করে তিনি বললেন, ‘তোমরা জেনে রেখো যে, যমীন কেবল আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের। আমি তোমাদেরকে দেশান্তর করতে মনস্থ করেছি। তাই তোমাদের যার অস্থাবর সম্পত্তি রয়েছে, তা যেন সে বিক্রি করে দেয়। অন্যথায় জেনে রেখো, যমীন কেবল আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের।’** মুসলিম শরীফে এই কথাটি আর একভাবে বলা হচ্ছে, ‘নতুবা জেনে রেখো যে, সমগ্র ভূ-মণ্ডল আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের।’***
অপর একটি হাদীসে মুহাম্মদকে বলতে দেখা যাচ্ছে, ‘একদা আমি নিদ্রিত ছিলাম, স্বপ্নে বিশ্বের ধনভাণ্ডারের চাবিগুচ্ছ আমার হস্তে দেওয়া হইল।’†
----------------------------
* বুখারী শরীফ, পঞ্চম খণ্ড, ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ, জুন ১৯৯৯, পৃষ্ঠা-২৪৩।
** বুখারী শরীফ, দশম খণ্ড, ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ, মে ১৯৯৪, পৃষ্ঠা- ৩০৪।
*** হাদীস নং ৪৪৩৯, মুসলিম শরীফ, চতুর্থ খণ্ড, সম্পাদনা পরিষদের তত্ত্বাবধানে অনূদিত এবং সম্পাদিত, ইসলামিক ফাউন্ডেশন, তৃতীয় সংস্করণ, জুন ২০১০, পৃষ্ঠা-২৯৪।
† বোখারী শরীফ (বাংলা তরজমা ও বিস্তারিত ব্যাখ্যা), তৃতীয় খণ্ড, অনুবাদক ꞉ মাওলানা শামছুল হক ফরিদপুরী (রঃ) ও মাওলানা আজিজুল হক সাহেব, প্রকাশক- হামিদিয়া লাইব্রেরী লিঃ, জুন ২০০৭, পৃষ্ঠা- ৮৫।
----------------------------
মুহাম্মদ আরবের বাইরে তার বিজয় অভিযান দেখে যেতে পারেন নাই। কিন্তু তার আরব্ধ কাজ সমাপ্ত করার জন্য ধর্মের মাধ্যমে একদল অনুসারী এবং একটি দুর্ধর্ষ সেনাবাহিনী ও আগ্রাসী রাষ্ট্র রেখে গেলেন।
পেগান মোঙ্গল ও ইসলামী আরব উভয় অভিযানই ছিল কৃষি নির্ভর সভ্যতাগুলির জন্য ধ্বংসাত্মক। তবে মোঙ্গল দখলীকৃত অধিকাংশ অঞ্চলে পরবর্তীকালে নূতন করে সভ্যতা প্রতিষ্ঠিত হয়। সভ্যতার শক্তির কাছে বর্বরতা শেষ পর্যন্ত হার মানে। মোঙ্গলরা মরুময় মোঙ্গলিয়াতেও নগর-শহর গড়ে তুলে। এ ক্ষেত্রে সারা পৃথিবীর লুণ্ঠিত সম্পদ, বন্দী শ্রমশক্তি ও মেধা তাদের কাজে লাগে। কিন্তু শুধু বর্বরতা ও হিংস্রতা নির্ভর মোঙ্গল সভ্যতা ও রাষ্ট্র বেশী দীর্ঘস্থায়ী হয় নাই। চীনে একশত বৎসরও তাদের শাসন স্থায়ী হয় নাই। মধ্য এশিয়া, রাশিয়া ইত্যাদি অঞ্চলে মোঙ্গল শাসন আরও বেশী কাল স্থায়ী হলেও সুদীর্ঘ কাল ধরেই মোঙ্গল অভিযান, বিজয়, হত্যা ও ধ্বংস স্মৃতি মাত্র।
কিন্তু একটি ধর্ম বা মতাদর্শের কারণে আরবের ইসলাম পৃথিবীর বিশাল অঞ্চলব্যাপী চৌদ্দশত বৎসর ধরে জীবন্ত হয়ে আছে। এটা ঠিক যে আরবের মরুময় বুকে আরবরা উন্নত সভ্যতা গড়তে না পারলেও সিরিয়া, ইরাক, ইরান ইত্যাদি সভ্য দেশগুলি দখলের পর সেখানে পরবর্তী কালে আরবরাও একটি উন্নত সভ্যতা গড়ে তুলে। বিশেষত আব্বাসীয় যুগে জ্ঞান-বিজ্ঞানও যথেষ্ট উন্নতি সাধন করে। কিন্তু এটাও বিজয় অভিযানের ফলে উন্নত সভ্যতাগুলির কেন্দ্রীভবনের ফল। চারপাশের সম্পদ, জ্ঞান, মেধা ও শ্রমশক্তি কেন্দ্রীভূত হওয়ায় ইসলামের অনেক রীতিনীতি ও বিশ্বাস লঙ্ঘন করে জ্ঞান-বিজ্ঞানের এই বিকাশ ঘটে। কিন্তু এ সবই ছিল সাময়িক এবং অতিকেন্দ্রীভূত স্ফুরণ মাত্র। ইসলাম নিজে জ্ঞান-বিজ্ঞান বিমুখ এবং সভ্যতা বিরোধী। ফলে ইসলামীকরণ সম্পূর্ণ হলে জ্ঞান-বিজ্ঞানের সাময়িক বিকাশ রুদ্ধ হয়ে গেল। সমাজতলের ইসলামী চেতনা জ্ঞানের সীমিত কেন্দ্রকে আক্রমণ ও ধ্বংস করল। সুতরাং নবম শতাব্দীতেই শুরু হল ইসলামের উদারপন্থী মুতাজিলা এবং অন্যান্য যুক্তিবাদীদের বিরুদ্ধে হত্যা অভিযান। হাজার হাজার পণ্ডিত ও জ্ঞানীকে তাদের উন্নত অথবা উদার এবং যুক্তিবাদী চিন্তার জন্য হত্যা করা হল। এভাবে ইসলামের প্রাথমিক বিজয় অভিযানের পর ইসলামপূর্ব জ্ঞান-বিজ্ঞানের কেন্দ্রীভবনের ফলে জ্ঞান-বিজ্ঞানের যেটুকু বিকাশ ঘটেছিল তাকে শেষ করা হল। যুদ্ধ, ধ্বংস, হিংস্রতা ও অন্ধত্ব সমাজকে গ্রাস করল। এটাই স্বাভাবিক ছিল। কিন্তু সমাজ ও সভ্যতা পিছিয়ে গেলেও খুবই মুষ্টিমেয় শাসকের নির্বিবেক ভোগের আয়োজনের জন্য অধীনস্থ সমাজ ও অবশিষ্ট সভ্যতার সকল শক্তি নিয়োজিত হল। ইসলাম যেখানে গেল সেখানেই স্থানীয় সকল সভ্যতা, সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যকে ধ্বংস ক’রে তার মরু প্রকৃতির স্থূল ভোগবাদ ও নৃশংস সংস্কৃতি চাপিয়ে দিল, যার সবচেয়ে বড় শিকার হল নারী।
ইসলামী আগ্রাসন ও যুদ্ধের সবচেয়ে বড় লক্ষ্যবস্তু প্রতিপক্ষের নারী। শুধু লুণ্ঠনে তার তৃপ্তি নাই। পরাজিত ও দাস করে সবাইকে হত্যাও তা করতে চায় না। কারণ তা করলে অন্যদের শ্রমের বিনিময়ে ভোগ করবে কী করে? সুতরাং অপরের শ্রমোৎপন্ন ভোগের প্রয়োজনে সব সময় যে বাধ্যতামূলকভাবে ইসলামে দীক্ষিত করেছে তাও নয়। আরব ভূখণ্ডে ইসলাম গ্রহণ সবার জন্য বাধ্যতামূলক করলেও বাহিরে অনেক সময় অত্যন্ত অসম্মানজনক জিজিয়া করের দুর্বিষহ বোঝার বিনিময়ে অমুসলমানদেরকে নিজেদের ধর্ম পালন করতে দিত। তবে ইসলামের অধীনে অমুসলমানদের জীবন থাকত অত্যন্ত অনিশ্চিত, অপমানিত ও অধিকাংশ ক্ষেত্রে সব দিক থেকে দুর্গত।
তবে যে কথা একটু আগেই বলেছি, আর সব আগ্রাসী বর্বরতার মত ইসলামী আক্রমণের সবচেয়ে বড় লক্ষ্যবস্তু হচ্ছে নারী। নারীদের বন্দী ক’রে দাসকরণ এবং ধর্ষণে যে শুধু পুরুষ যোদ্ধারা ধর্ষণের আনন্দ পেত তাই নয়, এ দ্বারা বন্দী নারীদের গর্ভে সন্তান জন্মদানের মাধ্যমে তারা ইসলামের সংখ্যা বৃদ্ধিরও সহজ উপায় খুঁজে পেত। অধিকন্তু এটা ছিল বিরুদ্ধ বা অমুসলিম জাতি বা জনগোষ্ঠীর মর্যাদা বোধ ভেঙ্গে দিবার সহজ পদ্ধতি। নারী মানুষের জননী। সুতরাং নারী মানুষের মর্যাদা বোধ এবং আবেগ-অনুভূতিরও সবচেয়ে স্পর্শকাতর জায়গা। তাই যারা মুহাম্মদের অনুসারী, অনুগত এবং অধীনস্থ নয় তাদের সবচেয়ে দুর্বল বা স্পর্শকাতর জায়গাতে আঘাত করেও ইসলাম তাদের প্রতিরোধের শক্তিকে ভাঙ্গতে চেয়েছে। এর পাশাপাশি ছিল ইসলামের বর্বর ও হানাদার পুরুষ শক্তিকে তৃপ্তি দানের উদ্দেশ্য। সুতরাং ইসলামে বন্দী নারী এবং ক্রীতদাসী ধর্ষণ অনুমোদন লাভ করেছে। আমরা এই প্রসঙ্গে ১৯৭১-এ বাংলাদেশে পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর লক্ষ লক্ষ নারী ধর্ষণের কথা স্মরণ করতে পারি, যার আদর্শিক উৎস ছিল কুরআনের অনুমোদন এবং মুহাম্মদের দৃষ্টান্ত।
বস্তুত ইসলামকে শুধু আগ্রাসী যুদ্ধের ধর্ম বললে খুব সামান্যই বলা হয়; তাকে একই সঙ্গে বলতে হবে লুণ্ঠন, ধর্ষণ ও সন্ত্রাসের ধর্ম। তবে সবটাই তা ঢেকে রাখে অবিশ্বাস্য রকম ভণ্ডামি, মিথ্যাচার ও প্রতারণা দিয়ে। সুতরাং ন্যায়-নীতি বোধহীন দুর্নীতির ধর্মও এটা। ইসলামী পৃথিবীর দেশে দেশে শাসক বা সমাজ নেতাদের দুর্নীতির ব্যাপ্তি এই জন্য বিস্ময়কর নয়। পাশ্চাত্যের যে সমালোচনাই আমরা করি তার রাষ্ট্রনেতাদের কাছ থেকে যে নৈতিক সততা এবং সংযম সমাজ দাবী করে তার কোন প্রতিফলন ইসলামী পৃথিবীতে খুঁজে লাভ নাই।
নির্বিবেক নারী সম্ভোগী ও ধর্ষবাদী পুরুষ এবং স্বেচ্ছাচারী একনায়ক সৃষ্টি ও লালনের জন্য এমন অনুকূল সামাজিক পরিবেশ আর কোনও ধর্ম দেয় নাই যা ইসলাম দিয়েছে। ইসলাম যেখানে গেছে সেখানে মানুষের রক্ত, অশ্রু ও ঘামের উপর দিয়ে গড়ে তুলা হয়েছে নিরঙ্কুশভাবে একনায়কী শাসকের ভোগ-সম্ভোগের জন্য জমকালো সব আয়োজন, বিরাট বিরাট প্রাসাদ, অগণিত বন্দী ও অবরুদ্ধ নারীর হেরেম, এইসব হেরেম পাহারার জন্য নৃশংস খোজা ব্যবস্থা এবং ঘটানো হয়েছে দাস ব্যবস্থার অপ্রতিরোধ্য বিস্তার।
শুধু আরবের মরুচারী যাযাবরদের জন্য নয়, উপরন্তু পৃথিবীর বিস্তীর্ণ অঞ্চলের কৃষি নির্ভর সভ্যতাগুলির প্রান্তে অবস্থিত যাযাবর ও অর্ধ যাযাবর বর্বর জনগোষ্ঠীসমূহের নিকট যুদ্ধ, লুণ্ঠন ও ধর্ষণের উপযোগী ধর্ম হিসাবে ইসলামের আবেদন হল অপ্রতিরোধ্য। এদের রাষ্ট্র ছিল না, সভ্যতা ছিল না, প্রকৃতপক্ষে পশু পালন ব্যতিরকে উৎপাদনও ছিল না, নির্দিষ্ট ভূমির সাথে এরা আবদ্ধও ছিল না। আরব ছাড়াও উত্তর আফ্রিকা, মধ্য এশিয়া, আফগানিস্তান ও ভারতের উত্তর-পশ্চিম প্রান্তের যাযাবর, অর্ধ যাযাবররা ইসলামী বাহিনীর দ্বারা আক্রান্ত হয়ে হোক আর স্বেচ্ছায় হোক ইসলাম গ্রহণ ক’রে দলে দলে কৃষি সমাজগুলির উপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। মিসর, সিরিয়া, ইরাক, ইরান, ভারত, স্পেন, গ্রীস ও বলকানের কৃষক সমাজগুলি তছনছ হয়ে গেল। সব জায়গায় ইসলামী বাহিনীর হাত ধরে গেল অর্ধসভ্য আরবের ভাষা ও সংস্কৃতি। সুপ্রাচীন সভ্যতার লীলাভূমি মিসর, সিরিয়া, ইরাক তাদের ধর্ম ও সংস্কৃতির সঙ্গে তাদের ভাষাও হারালো। গর্বিত ও সুপ্রাচীন সভ্যতার অধিকারী ইরান আরবী লিপিমালা গ্রহণ করে তাদের ভাষাকে কোনক্রমে রক্ষায় সমর্থ হলেও তার প্রাচীন ধর্ম, সংস্কৃতি ও সভ্যতার গৌরবময় উত্তরাধিকারকে হারাতে বাধ্য হল। ভারতবর্ষ ইসলামের তরবারিকে মোকাবিলায় ব্যর্থ হলেও তার কৃষি সমাজ ও সভ্যতার শক্তির গুণে শেষ পর্যন্ত তার নিজ ধর্ম ও সংস্কৃতিকে অনেকাংশে রক্ষা করতে সমর্থ হল। অবশ্য ইসলামের ধ্বংসযজ্ঞের বিরাট আঘাত তাকে তছনছ করেছে সহস্রাধিক বৎসর ধরে। অধ্যাপক লালের হিসাব অনুযায়ী ১,০০০ থেকে ১৫২৫ খ্রীষ্টাব্দের মধ্যে ভারতবর্ষে ইসলামের আগ্রাসনে ছয় থেকে আট কোটি মানুষ নিহত হয়েছিল। অর্থাৎ ৮ম শতাব্দীতে মুহাম্মদ বিন কাসিমের নেতৃত্বে আরব মুসলিম বাহিনী বৃহত্তর সিন্ধু অঞ্চলে যে ধ্বংস ও হত্যা যজ্ঞ পরিচালনা করে এবং ১৫২৫ খ্রীষ্টাব্দের পরেও মুসলিম হানাদাররা যে সকল হত্যাযজ্ঞ পরিচালনা করে এই হিসাবের ভিতরে সেগুলিকে ধরা হয় নাই। এ থেকেই বুঝা যায় ইসলামের আগ্রাসনের সমগ্র কাল জুড়ে ভারতবর্ষে ইসলামের তরবারিতে কী বিপুল সংখ্যক মানুষ প্রাণ দিয়েছিল।* ধর্ষিত হয়েছে হয়ত আরও বহু বেশী সংখ্যক নারী যাদের হিসাব করার চেষ্টা আজ অবধি হয়েছে বলে আমার জানা নাই। হয়ত সেটা সম্ভবও নয়। তবে নারীর প্রতি ভয়ঙ্কর ঘৃণা ও বিদ্বেষ পোষণকারী এবং নারীকে পুরুষের মত মানুষ হিসাবে বিবেচনা না ক’রে শুধুমাত্র পুরুষের ভোগের সামগ্রী বিবেচনাকারী ইসলামের আক্রমণ ও আধিপত্য নারীর জন্য কী পরিণতি বয়ে আনতে পারে তা সহজেই অনুমান করা চলে।
যাইহোক, ইসলামের আঘাতে প্রাচীন সভ্যতাগুলি গুড়িয়ে গেলেও খ্রীষ্টধর্মের মাধ্যমে ঐক্যের শক্তিতে বলীয়ান কৃষক ইউরোপ শেষ পর্যন্ত ইসলামকে প্রতিহত করে এবং একটা পর্যায়ে প্রত্যাঘাতেও সক্ষম হয়। স্পেন থেকে ইসলাম উৎখাত হয় এবং শেষ পর্যন্ত অতি সামান্য ভূখণ্ড বাদে বলকান এবং গ্রীসও মুক্ত হয়। তবে অনেক দূরবর্তী চীনের সভ্যতার শক্তিকে আঘাত করার ক্ষমতা ইসলামের ছিল না। তা সত্ত্বেও এশিয়া ও আফ্রিকার বিশাল অঞ্চলে ইসলামের প্রসার হল।
----------------------------
* এমএ খান, জিহাদ ꞉ জবরদস্তিমূলক ধর্মান্তরকরণ, সাম্রাজ্যবাদ ও দাসত্বের উত্তরাধিকার, পৃষ্ঠা- ২৭০।
----------------------------
প্রত্যেক মানুষ তার চেতনা বা চরিত্র ও প্রবণতা অনুযায়ী পরিপার্শ্বকে নির্মাণ করে। এই অর্থে বলা যায় মানুষ নিজেকেই পুনরুৎপাদন বা সম্প্রসারণ করে, অন্যকে নয়। সুতরাং মুহাম্মদ এমন সমাজ নির্মাণ করেছেন যার নেতা বা শাসক হবে তার নিজের পুনরুৎপাদন বা সম্প্রসারণ। সাধারণ নিয়ম অনুযায়ী তার চরিত্র ও মনস্তত্ত্বের প্রতিফলন ঘটবে শাসকের মধ্যে, এই সমাজের নেতার মধ্যে। একই সঙ্গে এই সমাজের শাসিতরা হবে স্বেচ্ছাচারী একনায়কী শাসকের স্বেচ্ছাচারী শাসনের উপযোগী। সাধারণ মানুষ বা জনগণ যে ভয়ঙ্কর দাস ব্যবস্থার সবচেয়ে বড় শিকার হয় তারা সেই ব্যবস্থার সবচেয়ে দৃঢ় সমর্থক ও রক্ষকে পরিণত হয়। উপরের তলার শাসকদের মধ্যে তবু শিক্ষা, প্রাচুর্য এবং তুলনামূলক নিরাপদ জীবনের প্রভাবে কিছু উদারতা ও সহিষ্ণুতা আসতে পারে। তাছাড়া শুধু নামাজ-রোজা দিয়ে রাষ্ট্র চলে না। অন্যান্য সমাজের বিরুদ্ধে যুদ্ধের প্রয়োজনেও ধর্ম বহির্ভূত কিছু জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চার প্রয়োজন হয়। সমাজ-তল জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চার প্রতি বিমুখ বা বিরোধী হওয়ায় সমাজের ভিতর থেকে এ সবের বিকাশ ঘটে না। ফলে অন-ইসলামী সমাজ থেকে এগুলিকে যত সীমাবদ্ধ আকারেই হোক দখল বা গ্রহণ করতে হয়। এভাবে দেখা যায় উপর তলার শাসকরা ধর্মের বিধিনিষেধের গণ্ডী অনেক সময় ভঙ্গও করে রাষ্ট্র বা শাসন রক্ষার প্রয়োজনে, নিজেদের ভোগেরও প্রয়োজনে। কিন্তু সমাজের নীচ তলা ধর্মের প্রশ্নে হয়ে থাকে ভয়ঙ্কর রকম উগ্র, অন্ধ ও গোঁড়া। এভাবে এই ভয়ঙ্কর ব্যবস্থার যে সবচেয়ে বড় শিকার সে নিজেই হয়ে পড়ে ভয়ঙ্কর শিকারী।
ইসলামী পৃথিবীর এই কালো অধ্যায়ের অবসান সূচিত হয়েছে আধুনিক ইউরোপের আঘাতের ফলে। ইউরোপ যখন আধুনিক ও উন্নততর সমাজ সংগঠন, প্রযুক্তি এবং অস্ত্রের বলে বলীয়ান হয়ে ইসলামী সমাজকে আঘাত করেছে তখন ইসলামী সমাজের আক্রমণ ও আত্মরক্ষার শক্তি ভেঙ্গে পড়েছে। আধুনিক ইউরোপ পৃথিবীকে অনেক কিছুই দিয়েছে। দাস ব্যবস্থার অবসান, নারীর অধিকার ও স্বাধীনতা সম্পর্কে চেতনা, আধুনিক গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা, শিল্প সভ্যতা - এ সবই ইউরোপের অবদান। কিন্তু একই সঙ্গে ইউরোপ দিয়েছে উপনিবেশবাদ ও সাম্রাজ্যবাদ।
ইউরোপের অধীনে প্রায় সমগ্র পৃথিবী চলে যায়। উত্তর ও দক্ষিণ আমেরিকা এবং অস্ট্রেলিয়া - এই তিন মহাদেশকে আবিষ্কার এবং অধিকার করে ইউরোপীয়রা নিজেদের আবাস ভূমিতে পরিণত করে। দক্ষিণ আমেরিকার আদিবাসী রেড ইন্ডিয়ানরা কিছু পরিমাণে টিকে থাকলেও উত্তর আমেরিকা মহাদেশের মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং কানাডায় তারা প্রায় নির্মূল হয়ে যায়। আফ্রিকার সমগ্র এবং এশিয়ার বিশাল ভূ-ভাগ ইউরোপীয় বিভিন্ন রাষ্ট্রের অধিকারে চলে যায়। সেই সঙ্গে ইসলামী পৃথিবীর অধিকাংশ অঞ্চলও ইউরোপীয়দের অধিকারভুক্ত হয়।
ইউরোপের আধিপত্য সর্বত্র পরিবর্তন সূচিত করে। তার পুঁজি এবং প্রযুক্তি সর্বত্র কম-বেশী বিস্তৃত হয় সেই সঙ্গে বিস্তৃত হয় তার বাজার ব্যবস্থা। তবে সাম্রাজ্যবাদী রূপে আবির্ভূত পাশ্চাত্যের ইতিবাচক ভূমিকার তুলনায় নেতিবাচক ভূমিকাই প্রকট হয়ে দেখা দিয়েছে। ইউরোপীয় রাষ্ট্রসমূহের আধিপত্যের বিরুদ্ধে সংগ্রামও ছিল সর্বত্র কম আর বেশী। বিশেযত বিংশ শতাব্দীর মধ্যভাগে এশিয়া-আফ্রিকার বহু সংখ্যক দেশ স্বাধীন হয়। এভাবে প্রত্যক্ষ সাম্রাজ্যবাদ বা উপনিবেশবাদের যুগের অবসান ঘটে।
ইউরোপ থেকে উদ্ভূত আধুনিক সভ্যতা সর্বত্র যে পরিবর্তন সূচিত করে সেই পরিবর্তনের ঢেউ মুসলিম পৃথিবীতেও আছড়ে পড়ে। প্রথম পর্যায়ে পরিবর্তন সূচিত হয় সেইসব দেশে যেসব দেশ প্রত্যক্ষ ইউরোপীয় শাসনাধীনে যায়। পরবর্তী সময়ে তুরস্ক, সৌদী আরব বা ইরানের মত যে দেশগুলি ইউরোপের অধিকারে যায় নাই সেই দেশগুলিতেও ধীর গতিতে আধুনিক সভ্যতার স্পর্শ লাগতে শুরু করে। বিশেষ করে অবকাঠামো এবং প্রযুক্তির ক্ষেত্রে পরিবর্তন প্রায় সব ইসলামী দেশে লক্ষ্যণীয় মাত্রায় ঘটেছে।
অর্থাৎ বস্তুগত উন্নয়ন ও প্রযুক্তির ক্ষেত্রে ইসলামী পৃথিবীও সামনের নিকে যাত্রা করেছে। কিন্তু এটা লক্ষ্যণীয় যে এই যাত্রায় অমুসলিম চীন, ইন্দোচীন কিংবা লাতিন আমেরিকার দেশগুলির সাফল্যের তুলনায় ইসলামী দেশগুলির সাফল্য নগণ্য। বিশেষত মধ্যপ্রাচ্যের তেল ও গ্যাস সম্পদে সমৃদ্ধ দেশগুলির ব্যর্থতা থেকে আমাদের অনেক কিছু শিক্ষণীয় আছে। এবং ইসলামী পৃথিবীর প্রায় সব দেশ হয়ে আছে লাগামহীন দুর্নীতি, সন্ত্রাস, আত্মঘাতী সহিংসতা ও খুনাখুনি, ধর্মীয় সংখ্যালঘু, দরিদ্র ও দুর্বলদের উপর অবর্ণনীয় নির্যাতন এবং নারী নিগ্রহের লালন-ভূমি। পরমাণু শক্তিধর ইসলামী রাষ্ট্র পাকিস্তান ইসলামের কোন চিত্র তুলে ধরে? ইসলামী পৃথিবীর এই সামগ্রিক দুর্দশার বাইরে বাংলাদেশও নাই।
এই অবস্থার জন্য কাকে দায়ী করব? অনেকে এর জন্য ‘যত দোষ নন্দঘোষ’ পাশ্চাত্য সাম্রাজ্যবাদের ঘাড়ে সব দোষ চাপিয়ে শান্তি পান। তাতে অবশ্য নিজেদের ত্রুটি ও ব্যর্থতার মূল কারণ অনুসন্ধানের কঠিন কাজটা এড়ানো যায়। কিন্তু সমাধানের পথ পাওয়া যায় না। এ কথা বুঝতে হবে যে, পাশ্চাত্যের আধিপত্যবাদ ও সাম্রাজ্যবাদ ইসলামী পৃথিবীর উপর চেপে আছে ইসলামী সমাজের নিজস্ব দুর্বলতার কারণে, যার উৎস ইসলাম নিজেই।
আধুনিক সভ্যতার সঙ্গে অলোকবাদী ধর্মগুলির সম্পর্ক মূলত সাংঘর্ষিক। কারণ আধুনিক সভ্যতা অন্ধবিশ্বাস নির্ভর ধর্ম চর্চার পরিবর্তে যুক্তি ও প্রমাণ নির্ভর জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চার উপর নির্ভরশীল। এই অবস্থায় বিদ্যমান ধর্মের বিরুদ্ধে লড়াই না করে আধুনিক সভ্যতা কোথায়ও অগ্রসর হতে পারে নাই। এই কাজ পশ্চিম ইউরোপ একভাবে, পূর্ব ইউরোপ আর একভাবে, আবার চীন, ভিয়েৎনাম, উত্তর কোরিয়া, লাওস, কম্বোডিয়ার মত দেশগুলি যার যার মত করে করেছে। খ্রীষ্টধর্ম এবং বৌদ্ধধর্ম মূলত শান্তিপূর্ণ সামাজিক ধর্ম হওয়ায় এই ধর্মগুলির বিরুদ্ধে লড়াইয়ের রূপ সাধারণভাবে থেকেছে শান্তিপূর্ণ। তবে পশ্চিম ইউরোপে বিদ্যমান ধর্মের বিরুদ্ধে লড়াই যে এক সময় শান্তিপূর্ণ এবং সহজ ছিল না সে বিষয়ে ইতিপূর্বে বলেছি। ক্যাথলিক ধর্মমতের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করতে গিয়ে এক সময় সেখানে প্রোটেস্ট্যান্টদেরকে অনেক নিপীড়ন সহ্য করতে হয়েছে যেমন হয়েছে রেনেসাঁর নায়কদের অনেককে। ইংল্যান্ড, ফ্রান্স ও জার্মানীর মত দেশগুলিতে ক্যাথলিক ও প্রোটেস্ট্যান্টদের মধ্যে যুদ্ধে লক্ষ লক্ষ মানুষ নিহত হয়। ধর্মীয় আন্দোলনের পাশাপাশি ছিল বুদ্ধির মুক্তি তথা যুক্তিবাদী আন্দোলন। সব মিলিয়ে রাষ্ট্রের উপর ধর্মের আধিপত্য শেষ হয়েছে, ব্যক্তির ধর্ম বিশ্বাস ও পালন না করার স্বাধীনতা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে এবং জাগ্রত ইউরোপ পৃথিবীতে তার আধিপত্য প্রতিষ্ঠার পাশাপাশি তার ধর্মমুক্ত সেকিউলার বা লোকবাদী চেতনাও ছড়িয়ে দিয়েছে।
বস্তুত মানবিক উন্নয়নের প্রধান শর্ত তার চেতনার উন্নয়ন। এই চেতনাকে অন্ধ বিশ্বাস ও কুসংস্কার থেকে মুক্ত না করে মানুষের প্রকৃত মুক্তির পথে যাত্রা করা সম্ভব নয়। সুতরাং ব্যক্তি ও রাষ্ট্রের উন্নয়নকে নিশ্চিত করতে আজকের যুগে সব আধুনিক ও উন্নত রাষ্ট্রকেই অলোকবাদী ধর্মের শাসন ও খবরদারী থেকে মানুষকে মুক্ত করার জন্য কম অথবা বেশী পদক্ষেপ দিতে হয়েছে। এটা ঠিক যে ইউরোপ বা আমেরিকায় ধর্ম বিশ্বাস ও পালনের স্বাধীনতা আছে। কিন্তু সেটা শর্ত সাপেক্ষে। অন্যের ব্যক্তিগত অধিকারে হস্তক্ষেপ করে নয়। রাষ্ট্র চলে জাগতিক তথা লোকবাদী আইনে। সেখানে আল্লাহর আইনের মত ঈশ্বর বা ধর্মের আইন প্রয়োগের উপায় নাই। রাষ্ট্র সেটাকে মানবে না। খ্রীষ্টধর্ম রাজনৈতিক ও সামরিক ধর্ম না হওয়ায় ব্যক্তিগত বিশ্বাসের জায়গায় তা ফিরে যেতে ও থাকতে পারে। ব্যক্তির জীবনাচরণে সীমাবদ্ধ থাকলে তা সমাজ বা রাষ্ট্রের জন্য বড় ধরনের কোন সমস্যা সৃষ্টি করে না। তখন তার বিরুদ্ধে লড়াইটাও শান্তিপূর্ণ হতে পারে। তখন সকলে যে যার যুক্তি অথবা বিশ্বাস নিয়ে পরস্পরকে সমর্থন অথবা খণ্ডনের চেষ্টা করতে পারে।
এই প্রসঙ্গে এই কথাও এখানে বলা প্রাসঙ্গিক হবে যে, অতীতে অনেক নেতিবাচক ভূমিকা রাখলেও খ্রীষ্টীয় নীতি-নৈতিকতা ও মূল্যবোধের এমন কিছু ইতিবাচক দিক আছে যেগুলি সমাজের জন্য বিপুলভাবে কল্যাণকর ভূমিকা পালন করেছে। খ্রীষ্টধর্ম বর্তমানে ইউরোপ-আমেরিকায় ক্রমবর্ধমানভাবে প্রভাব হারাতে থাকলেও তার উত্তরাধিকার বৌদ্ধ ধর্মের মতই মানুষের জন্য এমন এক মহৎ উত্তরাধিকার রেখে যাচ্ছে যার মূল্যায়নে আমরা যেন অনুদার না হই। এই আলোচনায় ইতিপূর্বে আমি যে কথা বলেছি সেই কথার জের টেনে বলতে হয় যে, খ্রীষ্টধর্মের উত্তরাধিকার ছাড়া আধুনিক ইউরোপের জন্ম হত না। আবার এক সময় এই উত্তরাধিকারের সঙ্গে একটা ছেদেরও প্রয়োজন হয়েছিল। এই ছেদ কোথায়ও কম, কোথায়ও বেশী এবং নানান রূপে ঘটেছিল। না ঘটলে আধুনিক সভ্যতার উদ্ভব এবং সমাজ ও রাষ্ট্র বিপ্লব কিংবা শিল্প বিপ্লব কোনটাই সম্ভব হত না।
কিন্তু যে কথা খ্রীষ্ট বা বৌদ্ধ ধর্ম সম্পর্কে বলা যায় ইসলাম সম্পর্কে যে সে কথা বলা যায় না তা আশা করি আমার এই আলোচনায় ইতিমধ্যেই কিছুটা হলেও স্পষ্ট করতে পেরেছি। এই তিন ধর্মের ভূমিকাকে আরও স্পষ্ট করার জন্য তিন ধর্ম প্রতিষ্ঠাতার দিকে আর একবার দৃষ্টি দেওয়া যাক। ধর্মের আবরণ সরালে আমরা কী দেখতে পাই? মানুষের জন্য শুধু নয়, বরং সব প্রাণীর জন্যও করুণাঘন বুদ্ধ যেন প্রেম ও দয়ার মূর্ত প্রতীক। মানুষের মুক্তির পথ সন্ধানে সমাজ, সংসার, স্ত্রী-পুত্র সবই ত্যাগ করে রাজপুত্র বুদ্ধ তার বিশ্বাস অনুযায়ী আমৃত্যু মানুষের কাছে বাণী প্রচার করে গেছেন। বুদ্ধ চলে গেছেন। কিন্তু তার শিক্ষা ও দৃষ্টান্তে অগণিত মানুষ অনুপ্রাণিত হয়েছে। সবাই বুদ্ধের পথ অনুসরণ করে সংসার ত্যাগী বা ব্রহ্মচারী-ব্রহ্মচারিণী হয়ে শুদ্ধ জীবন যাপন করে না, করতে পারেও না। কিন্তু সঙ্ঘে বাস ক’রে যে সব নারী ও পুরুষ সেই ধরনের জীবন যাপন ও ধর্ম চর্চা করে বুদ্ধ তাদের মধ্য দিয়েই সমাজে বেঁচে থাকেন। সংসারী ও সাধারণ মানুষ তাদের মধ্য দিয়েই বুদ্ধের সামনে প্রণত হয়ে সমাজ, মানুষ ও জীবন সম্পর্কে একটা বোধের সামনে প্রণত হয়। আসলে একেবারে শুদ্ধতার ধারণা দিয়ে সমাজ-রাষ্ট্র চলতে পারে না। কিন্তু মহত্তর একটা বোধ যদি মানুষের মধ্যে না থাকে তবে পৃথিবী ও সমাজ বাসযোগ্য থাকে না। সে কালে সে কালের মত করে বুদ্ধ সেই বোধ মানুষের মধ্যে জাগাতে পেরেছিলেন। এটা হয়ত এমন একটা আদর্শ যাকে ধ্রুবতারার মত দেখা যায় কিন্তু ধরা যায় না। তবু এটা পথ দেখাতে তো পারে। যে কালে কম্পাসের সন্ধান মানুষের জানা ছিল না সে কালে অকূল সাগরে রাতের আঁধারে জাহাজের পথের দিশা ধ্রুবতারাই তো দিবে।
মানুষের দুঃখে ব্যথিত যীশুও যেন মানুষের জন্য প্রেম ও দয়ার মূর্ত প্রতীক। শান্তির পথচারী, অকৃতদার যীশু তার প্রেম, করুণা ও সেবার ধর্ম প্রচার করতে গিয়ে ক্রুশবিদ্ধ হয়ে আত্মদান করে গেছেন। এ যেন ক্রুশবিদ্ধ বুদ্ধ। তবে প্যালেস্টাইনে জন্ম লাভকারী এ বুদ্ধের বিস্তার মূলত রোমান সাম্রাজ্যভুক্ত তিন মহাদেশের বিশাল অঞ্চলে। পরবর্তী কালে সারা পৃথিবীর আরও বিস্তীর্ণ অঞ্চলে তার বিস্তার। তিনিও পেয়েছেন বুদ্ধের মত অনুসারী ও সঙ্ঘ বা চার্চ। প্রেম ও করুণার প্রতীক যীশুর ভূমিকাও অনেকাংশে বুদ্ধের অনুরূপ।
প্রেম ও করুণার প্রতীক বুদ্ধ ও যীশুর পাশে এবার দাঁড় করানো যাক মুহাম্মদকে। মুহাম্মদ যেন মানুষের প্রতি এবং আরও বিশেষ করে নারীর প্রতি ঘৃণার মূর্ত প্রতীক। এ ঘৃণা যেন জীবনের প্রতি, জীবের প্রতি। এই জীবনকে যে তার গর্ভে ধারণ করে সেই নারীর প্রতি তাই বুঝি তার সবচেয়ে বেশী ঘৃণা। মুহাম্মদ বলছেন, ‘দোযখ পরিদর্শন কালে আমি দোযখের দ্বারে দাঁড়াইলাম এবং জানিতে পারিলাম যে, দোযখীদের মধ্যে নারীদের সংখ্যাগরিষ্ঠতা হইবে’(হাদীস নং- ২০৫১, বোখারী শরীফ),* ‘দোযখও দেখিয়াছি (জ্ঞাত হইয়াছি) যে, তথায় প্রবেশকারীদের মধ্যে সংখ্যাগরিষ্ঠতা হইবে নারীদের (হাদীস নং- ২০৫২, বোখারী শরীফ)।’** এক হাদীসে মুহাম্মদ নারীকে গাধা এবং কাল কুকুরের সঙ্গে তুলনা করে বলছেন, ‘যখন তোমাদের কেহ নামাযের জন্য দাঁড়াইবে, সে তাহার সম্মুখে হাওদার পিছনের কাঠটির পরিমাণ একটি কাঠ রাখিয়া দিবে। যদি ঐ রূপ কোন কাঠ বা অন্য কিছু রাখা না হয় এমতাবস্থায় তাহার সম্মুখ দিয়া গাধা, স্ত্রীলোক অথবা কাল কুকুর গমন করিলে তাহার নামায ভঙ্গ হইয়া যাইবে।’ লাল বা হলুদ রঙের কুকুর থেকে কাল কুকুরকে পৃথক করার কারণ সম্পর্কে মুহাম্মদকে জিজ্ঞাসা করা হলে তিনি উত্তর দেন, ‘কাল কুকুর একটি শয়তান।’*** অন্যত্রও তিনি নারীকে শয়তানের সঙ্গে তুলনা করে বলছেন, ‘নারী শয়তানের আকৃতিতে সম্মুখে আসে এবং শয়তানের আকৃতিতে চলিয়া যায়’ (বোখারী শরীফ)।†
----------------------------
* বোখারী শরীফ, ষষ্ঠ খণ্ড, অনুঃ মাওলানা শামছুল হক ও মাওলানা আজিজুল হক, সপ্তম সংস্করণ, জুলাই ২০০৬, পৃষ্ঠা- ১৪৬।
** ঐ, পৃষ্ঠা- ১৪৭।
*** মুসলিম শরীফ, বঙ্গানুবাদ, ২য় খণ্ড, অনুঃ আল্লামা মৌলানা নেছারুল হক, ইসলামিয়া লাইব্রেরী, চট্টগ্রাম, ১৯৭৫, পৃষ্ঠা- ৩১৭।
† বোখারী শরীফ, ষষ্ঠ খণ্ড, অনুঃ মাওলানা শামছুল হক ও মাওলানা আজিজুল হক, সপ্তম সংস্করণ, জুলাই ২০০৬, পৃষ্ঠা- ২৯১।
----------------------------
ত্যাগের মহিমা নয় বরং ভোগের লোভ এবং শাস্তির ভয় দেখিয়ে মুহাম্মদ তার ধর্মরাজ্যের যাত্রাপথ নির্মাণ করেছেন। যারা তাকে অনুসরণ করবে তাদের জন্য ভোগের আয়োজন শুধু পরলোকে নয় ইহলোকেও করেছেন। আর যারা তাকে প্রত্যাখ্যান করবে তাদের শাস্তির আয়োজনও শুধু পরলোকে নয় ইহলোকেও করেছেন। সুতরাং মানুষের মনে লোভের পাশে ভয় বা ত্রাস সৃষ্টির জন্য যা যা করা সম্ভব সবই মুহাম্মদ করেছেন। এক হাদীসে মুহাম্মদ গর্বের সঙ্গে বলছেন, ‘এক মাসের পথের সুদূর প্রান্তে আমার প্রভাবে ভীতির সঞ্চার দ্বারা আল্লাহ তাআলা আমায় সাহায্য করিয়াছেন।’*
শান্তি ও সহিষ্ণুতার কথা বলা আর যা-ই হোক ইসলামের জন্য সাজে না। অথচ এগুলির কথা হরহামেশাই ইসলাম আর তার অনুসারীরা শুনায়। এটা তার ভণ্ডামি ও প্রতারণা মাত্র। মুহাম্মদ বা তার ইসলাম ভিন্নতার সামান্যতম চিহ্নকে পর্যন্ত সহ্য করে না। সুতরাং মুহাম্মদ তার ধর্মমতের অনুসারী যারা নয় তাদের সবাইকে সমগ্র আরব ভূমি থেকে বিতাড়নের সিদ্ধান্ত ঘোষণা করেন, ‘আমি ইয়াহুদী ও নাসারাদের অবশ্যই আরবভূমি হতে বের করে দেব এবং এখানে মুসলমান ছাড়া আর কেউ থাকবে না।’** তার জীবদ্দশায় সে কাজ শুরু করলেও সমাপ্ত করতে পারেন নাই। তার মৃত্যুর পর খলীফা ওমর এই সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করেন। ইসলাম গ্রহণ যারা করল না তাদেরকে বিতাড়ন অথবা হত্যা ক’রে আরব উপদ্বীপকে সম্পূর্ণরূপে মুসলিম আবাস ভূমিতে পরিণত করা হল। তবে মুহাম্মদের মৃত্যুর পর প্রথম খলীফা আবু বকরের শাসনকালে আরবের নিরঙ্কুশ ইসলামীকরণ সম্পূর্ণ হবার আগেই ইসলামের বাহিনী ঝাঁপিয়ে পড়ল সভ্য পৃথিবীর উপর।
আসলে এই রকম বর্বরতাপূর্ণ ধর্মের উত্থান তখনই সম্ভব হয়েছিল যখন বিশাল অঞ্চল ব্যাপী সভ্যতায় ব্যাপক ধ্বংস এবং ক্ষয় নেমে এসেছিল। প্রাচীন মিসর, মেসোপটেমিয়া, সিন্ধুর সভ্যতার আলো বহু কাল আগে নিভে গেছে। গ্রীসের আলোও নিভে গেছে। রোমের সভ্যতাও তখন ধ্বংস প্রায় । ভিসিগথ বর্বরদের হাতে ৪১০ খ্রীষ্টাব্দে রোম নগর লুণ্ঠিত হয়। রোমকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠা পশ্চিমের রোমান সাম্রাজ্যের পতন হয়েছে ৪৭৬ খ্রীষ্টাব্দে। এরপর কন্সট্যান্টিনোপলকে কেন্দ্র করে টিকে থাকা পূর্ব দিকের বিরাটায়তন বাইজেন্টাইন রোমান সাম্রাজ্যও তখন পতনের দিকে এগিয়ে চলেছে। কিন্তু রোমান সভ্যতার সেই গৌরব তখন অনেকটাই স্মৃতি মাত্র। তার সাম্রাজ্যের পূর্ব দিকে অবস্থিত বৃহৎ ও শক্তিশালী পারস্য সাম্রাজ্যও তখন ক্ষয়িষ্ণু। তৎকালীন পৃথিবীর এই দুই পরাশক্তি পরস্পরের সঙ্গে অমীমাংসিত যুদ্ধে অবসন্ন। এক বিশাল ভূভাগের মানুষ সভ্যতার উপর আস্থা রাখার কারণ দেখছিল না। যে কোন বর্বরতার উত্থানের জন্য এটা ছিল একটা উপযুক্ত সময়। এই রকম সময়েই সভ্যতার প্রান্তে থাকা আরবের এক মরূদ্যান শহর মক্কায় আনুমানিক ৫৭০ খ্রীষ্টাব্দে মুহাম্মদের জন্ম।***
----------------------------
* বোখারী শরীফ, তৃতীয় খণ্ড, অনুঃ মাওলানা শামছুল হক ও মাওলানা আজিজুল হক, একাদশ সংস্করণ, জুন ২০০৭, পৃষ্ঠা-৮৫।
** আবু দাউদ শরীফ, চতুর্থ খণ্ড, ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ, ২০০৬, পৃষ্ঠা- ২১৭।
*** সভ্যতার এই সঙ্কট বিষয়ে লেখকের কিছু বিস্তারিত আলোচনার জন্য দেখুন ꞉ শামসুজ্জোহা মানিক, ইসলামের ভূমিকা ও সমাজ উন্নয়নের সমস্যা, ব-দ্বীপ প্রকাশন, ঢাকা, ২০১০, পৃঃ ৭৫-৮০)
----------------------------
আরবের নিকটবর্তী বিভিন্ন দেশে বাণিজ্যের প্রয়োজনে সেই সময় আরব বণিক বিশেষত কুরাইশদের যেতে হত। বাণিজ্যোপলক্ষ্যে তার গোত্রের অন্যান্য কুরাইশের মত মুহাম্মদও একাধিক বার সিরিয়ায় গিয়েছিলেন। অন্যান্য কুরাইশের মত সভ্যতার এই সঙ্কট দশা তারও নিশ্চয় চোখে পড়েছিল। এটাই যুক্তিসঙ্গত মনে হয় যে, সভ্যতার সঙ্কট ও দুর্বলতাকে কাজে লাগিয়ে বিশ্বজয়ের উচ্চাকাঙক্ষা তার মাথায় কাজ করছিল। এর জন্য প্রয়োজন ছিল একটি সেনাবাহিনীর, যা হবে প্রথমে আরব জয়, সেখানে একটি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা এবং অতঃপর বিশ্বজয়ের হাতিয়ার। এই সেনাবাহিনী এবং রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জন্য তার প্রয়োজন ছিল বিভিন্ন উপজাতিতে বিভক্ত আরব উপদ্বীপে ঐক্যবদ্ধ সমাজ প্রতিষ্ঠার। এই ঐক্যবদ্ধ সমাজ প্রতিষ্ঠার জন্য তিনি ধর্মকে দেখতে পান সবচেয়ে কার্যকর হাতিয়ার হিসাবে।
কিন্তু আরবের বিদ্যমান ধর্মগুলিকে অথবা এগুলির কোন একটিকে তিনি তার উদ্দেশ্য সাধনের উপযোগী দেখতে পান নাই। এ ক্ষেত্রে তার প্রয়োজন হয়েছিল আরবে প্রচলিত ধর্মগুলিকে ব্যবহার করে একটি নূতন ধর্ম প্রতিষ্ঠা করা। তার জন্য তিনি তার মত করে আরবে বিদ্যমান পৌত্তলিক তথা পেগান, ইহুদী ও খ্রীষ্টানসহ সকল ধর্ম থেকে তার উপকরণ সংগ্রহ করলেন এবং আরবে কুরাইশদের প্রভাব ও ঐতিহ্যকে ব্যবহার করলেন। আরবের নেতৃস্থানীয় কুরাইশ গোত্রের প্রভাবশালী পরিবারের একজন হওয়ায় কাজটা তার জন্য সহজতর হল। তার এই প্রয়োজনে তিনি তৎকালীন মক্কা এবং কুরাইশদের প্রধান দেবতা আল্লাহকে সর্বশক্তিমান ও একমাত্র উপাস্য দেবতা হিসাবে ঘোষণা করলেন।
কিন্তু এটা তাৎপর্যপূর্ণ যে তৎকালীন আরব সমাজের মানদণ্ড বিচারে মক্কার সভ্য কুরাইশদের মধ্যে মুষ্টিমেয় কয়েক জন বাদে মুহাম্মদ আর কাউকে তার ধর্মে স্বেচ্ছায় নিতে পারেন নাই। তাদেরকে যুদ্ধে পরাজিত ক’রে হত্যার ভয় দেখিয়ে নিতে হয়েছে। এর জন্য তিনি সাহায্য নিয়েছেন প্রধানত মরুচারী, বর্বর ও সভ্যতাবিরোধী বেদুইনদের। সুতরাং এই বেদুইনদের জীবন বোধ, বিশ্বদৃষ্টি, আচার-আচরণ ও চরিত্র ইসলামের গভীরে ছায়া ফেলে আছে। বেদুইনদের উপর নির্ভর করে তিনি যে ধর্ম গড়লেন তা যে শুধু অমানবিক হল তাই নয় সেই সঙ্গে হল সভ্যতা বিরোধী।
ইসলাম ধর্মের মাধ্যমে তিনি কী ধরনের মানুষ তার চারপাশে জড়ো করেছিলেন এবং কী ধরনের মন-মানসিকতা তার অনুসারীদের মধ্যে সঞ্চারিত করেছিলেন সে সম্পর্কে একটা ধারণা পাবার জন্য বুখারী শরীফের একটি হাদীস থেকে কিছুটা উদ্ধৃতি দেওয়া যাক, ‘তিনি পানি ভরে একটি পাত্র আনতে বললেন। (পানি আনা হল) তিনি এর মধ্যে নিজের উভয় হাত ও মুখমণ্ডল ধুয়ে কুল্লি করলেন। তারপর (আবূ মূসা ও বিলাল [রা]-কে) বললেন, তোমরা উভয়ে এ থেকে পান করো এবং নিজেদের মুখমণ্ডল ও বুকে ছিটিয়ে দাও। আর সুসংবাদ গ্রহণ করো। তাঁরা উভয়ে পাত্র তুলে নিয়ে যথা নির্দেশ কাজ করলেন। এমন সময় উম্মে সালামা (রা) পর্দার আড়াল থেকে ডেকে বললেন, তোমাদের মায়ের জন্যও অবশিষ্ট কিছু রেখে দিও। অতএব তাঁরা এ থেকে অবশিষ্ট কিছু উম্মে সালামা (রা)-এর জন্য রেখে দিলেন।’* আর একটা হাদীস থেকে কিছুটা উদ্ধৃতি দেওয়া যাক যেটা হুদায়বিয়ার সন্ধির অল্প সময় পূর্ববর্তী একটি দৃশ্যের বিবরণ ꞉ ‘এতদ্ভিন্ন ওরওয়া এই বিষয়ের প্রতি বিশেষরূপে লক্ষ্য করিয়াছিল যে, রসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহে অসাল্লামের থুথু বা শ্লেষ্মা মাটিতে পতিত হইতে পারিত না, বরং উহা ছাহাবীগণ নিজ হস্তে লইয়া লইতেন এবং তৎক্ষণাৎ স্বীয় চেহারা ও শরীরে মাখিয়া ফেলিতেন।’** এই ধরনের মনন ও রুচি সভ্যতার কোন মানদণ্ডে পড়ে সঙ্গত কারণেই সে সম্পর্কে প্রশ্ন করা যায়। কিন্তু এই ধরনের মনন ও রুচির অনুসারীরাই হল এই ধর্মের মূল সামাজিক ভিত্তি, যারা আবার ছিল প্রধানতই অসভ্য বা অর্ধসভ্য যাযাবর বেদুইন।
----------------------------
* বুখারী শরীফ (সপ্তম খণ্ড), ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ, দ্বিতীয় সংস্করণ, মে ২০০১, পৃষ্ঠা- ১৬৮।
** বোখারী শরীফ (বাংলা তরজমা ও বিস্তারিত ব্যাখ্যা), তৃতীয় খণ্ড, অনুবাদ ꞉ মাওলানা শামছুল হক ফরিদপুরী (রঃ) ও মাওলানা আজিজুল হক সাহেব, হামিদিয়া লাইব্রেরী লিঃ, একাদশ সংস্করণ, জুন ২০০৭, পৃষ্ঠা- ২১০
----------------------------
সুতরাং যা কিছু মানুষের মনকে চিন্তাশীল করে, নম্র করে, সুকুমার বৃত্তির অধিকারী করে, সৃজনশীল করে তার প্রতিই তার ঘৃণা এবং বিদ্বেষ। প্রকৃতপক্ষে মানুষকে যা কিছু সভ্যতামুখী করে তার প্রতিই ইসলামের ঘৃণা এবং বিদ্বেষ। যে সভ্যতা তা নির্মাণ করতে পারে না তার প্রতি তার ঘৃণা। অথচ ঘৃণিত এই সভ্যতার প্রতি তার লোভ। লোভ সভ্যতার দ্বারা সৃষ্টি ভোগের সামগ্রীর জন্য। কাজেই ঘৃণার সঙ্গে ভোগ ইসলামের মর্মমূলে গাঁথা। যেমন তা ঘৃণার সঙ্গে নারীকে সম্ভোগ করে তেমন তা ঘৃণার সঙ্গে সভ্যতাকেও ভোগ করে। এই রকম ধর্ম নিয়ে যে মানবিক মূল্যবোধসম্পন্ন কোনও সমাজ এবং উন্নত সভ্যতা নির্মাণ করা সম্ভব নয় সেটা বহু অভিজ্ঞতা থেকে প্রমাণিত।
চতুর্থ অধ্যায়
আধুনিক সভ্যতায় ইসলামের ভূমিকা
বস্তুত এটি বুঝা খুবই গুরুত্বপূর্ণ যে, ইসলামী সমাজ মাত্রই রাজনৈতিক সমাজ। ইংরাজী পরিভাষা ব্যবহার করলে একে পলিটি (polity) বলা যায়। কারণ ধর্মটিই রাজনৈতিক। ফলে ইসলামী সমাজে রাষ্ট্রকে ধর্ম থেকে পৃথক ঘোষণা করে কোন লাভ হয় না। যদি করা যায় তবে সেটা যে কাগুজে ঘোষণা মাত্র হয় তার সবচেয়ে বড় উদাহরণ বাংলাদেশ, যেখানে ১৯৭২-এর সংবিধানে রাষ্ট্রকে লোকবাদী বা ধর্মনিরপেক্ষ ঘোষণা করা হয়েছিল। ধর্মনিরপেক্ষতার ঘোষণা সত্ত্বেও বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার পর মুজিব সরকার বিভিন্ন কৌশলে ইসলামকে পৃষ্ঠপোষকতা দানের যে কর্মনীতি অনুসরণ করে তা ১৯৭৫-এর পটপরিবর্তনের পর ধর্মনিরপেক্ষতাকে প্রত্যাখ্যানের রাষ্ট্রীয় নীতিতে পরিণত হয়। আনুষ্ঠানিকভাবেই বাংলাদেশকে পুনরায় একটি ইসলামী রাষ্ট্রে পরিণত করা হয়। এভাবে ’৭২ থেকে ’৭৫ পর্যন্ত রাষ্ট্র পরিচালনায় যে কপটতা চলছিল তার অবসান ঘটানো হয়। এটা বিস্ময়কর নয় যে কামাল পাশার দেশ তুরস্কেও আজ ইসলামবাদীরা ক্ষমতায় আছে। এবং তারা ক্ষমতায় এসেছে নির্বাচন প্রক্রিয়ায় শান্তিপূর্ণভাবে। আসলে শেষ বিচারে রাষ্ট্র সমাজের অভিব্যক্তি। সুতরাং কিছু সময়ের জন্য সমাজের সঙ্গে রাষ্ট্রের দূরত্ব সৃষ্টি করা গেলেও একটা সময় সমাজ রাষ্ট্রকে অধিকার করে।
বস্তুত, কখনও পাশ্চাত্য আধিপত্যের প্রভাবে উপর তলায় একটা উদার বা অর্ধ ইসলামের আবরণ কিছু কাল রক্ষা করতে পারলেও সমাজতলে অবস্থানকারী এবং প্রাধান্য বিস্তারকারী ইসলামী চেতনা শেষ পর্যন্ত উপরতলা এবং রাষ্ট্রকে যে প্রভাবিত করে শুধু তা-ই নয়, উপরন্তু অধিকারও করে। আধুনিক সভ্যতার সঙ্গে অসঙ্গতিপূর্ণ ও সাংঘর্ষিক ইসলামী সমাজে অভ্যন্তরীণ সংকট ও বিরোধ যে ক্রমবর্ধমান হবে সেটাই স্বাভাবিক। নূতন চিন্তায় অক্ষম সমাজ সঙ্কট দেখা দিলে সর্বদা সমাধান হিসাবে ইসলামকেই দেখতে পায়। যেটুকু তা এগিয়েছে সেখান থেকেও তা পিছন ফিরে ইসলামের যাত্রা শুরুর সেই আদি অধ্যায়ের সময়টাতে ফিরতে চায় যখন মুহাম্মদ ও তার পরবর্তী খোলাফায়ে রাশেদীনের খলীফারা যুদ্ধ ও লুণ্ঠনের পথে নিয়ে দরিদ্র ও বর্বর বেদুইনদেরকে ভোগের জন্য এনে দিয়েছিলেন বিপুল সম্পদ, শ্রমদাস এবং যৌনদাসী হিসাবে অগণিত লুণ্ঠিত নারী। ইসলামের আদি যাত্রা প্রায় অপ্রতিহত বিজয়ের পথ ধরে। ওহোদের যুদ্ধের কথা বাদ দিলে তার আদি যাত্রায় কোনও পরাজয় নাই। সুতরাং ইসলাম মানে বিজয়। আর বিজয় মানেই লুঠ। আর লুঠ মানে দরিদ্র ও বর্বর আরবদের জন্য সব সমস্যার সমাধান। এভাবে ইসলামের বিজয় মুসলমানদের চেতনায় এমন এক স্বর্ণযুগের চিত্র এঁকে দিয়েছে যা হয়ে থাকে বিশ্বাসী মুসলমানের বিপুল প্রেরণার উৎস। যে কোন সমাজ সঙ্কটে তাই সে ইসলামের সেই আদি অধ্যায়ে প্রত্যাবর্তন করতে চায়। অন্যদের কাছে এটা মানবতার অন্ধকার অধ্যায় মনে হতে পারে। কিন্তু এটাই বিশ্বাসী মুসলমানের কাছে সবচেয়ে আলোকিত অধ্যায়। ফলে উগ্র ও মৌলবাদী ইসলামের প্রত্যাবর্তন বা পুনঃপ্রতিষ্ঠা সময়ের ব্যাপার মাত্র হয়ে দাঁড়ায়। বহুদলীয় নির্বাচনমূলক ব্যবস্থা থাকলে ঘটনাটা তুলনায় শান্তিপূর্ণভাবে এবং নির্বাচনের মাধ্যমে ঘটতে পারে।
এই বাস্তবতায় ইসলামী সমাজের ভিতর থেকে স্বাধীনভাবে আধুনিক সভ্যতার বিকাশ অসম্ভব ব্যাপার হয়ে থেকেছে। যেটুকু হয়েছে তা পাশ্চাত্য আধিপত্যের চাপে এবং প্রয়োজনে। ইসলামী পৃথিবীর দেশে দেশে বিরাজমান দুর্নীতি, পশ্চাৎপদতা, দারিদ্র্য, সন্ত্রাস, সহিংসতা, স্বৈরতন্ত্র বা ফ্যাসিবাদী একনায়কতন্ত্র এবং অবণর্নীয় নারী নিগ্রহের মূল উৎস বাহিরে না খুঁজে ইসলামের ভিতরেই খুঁজতে হবে। পাশ্চাত্য আধিপত্যকে কেন্দ্র করে যে সাম্রাজ্যবাদী বিশ্ব ব্যবস্থা গড়ে উঠেছে তার সবচেয়ে বড় শিকার আজ ইসলামী পৃথিবী। কিন্তু সেটাও সম্ভব হয়েছে ইসলামের কারণে। চীন-ইন্দোচীন অনেক পূর্বেই সাম্রাজ্যবাদী আধিপত্যকে পিছনে ফেলে স্বাধীনভাবে উন্নত সভ্যতা নির্মাণের পথে এগিয়ে চলেছে। কিউবার পথ অনুসরণ করে জাগ্রত লাতিন আমেরিকার দেশগুলিও একে একে মার্কিন নিয়ন্ত্রণ ও আধিপত্যের শৃঙ্খল ভেঙ্গে বেরিয়ে আসছে। কিন্তু ইসলামী বিশ্ব সামান্য ব্যতিক্রম বাদে পুরাপুরি মার্কিন নেতৃত্বাধীন পাশ্চাত্যের অধীনস্থ ব্যবস্থাধীনে আবদ্ধ। সিরিয়া, ইরান যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তথা পাশ্চাত্যকে অগ্রাহ্য করে দাঁড়িয়ে আছে সেটা সম্ভব হয়েছে অমুসলিম রাশিয়ার কারণে।
ইসলাম যে পৃথিবীতে আধিপত্য প্রতিষ্ঠাকারী বা সাম্রাজ্যবাদী পাশ্চাত্যের আধিপত্য রক্ষার এক মহামূল্যবান হাতিয়ার তা বহুকাল যাবৎ পাশ্চাত্য বুঝেছে। যতদিন দেহশক্তি ও ঢাল-তলোয়ারের যুগ ছিল ততদিন ইসলাম তার অগ্রাভিযান অপ্রতিহত রাখতে পেরেছিল। তা সত্ত্বেও ইউরোপ শেষ পর্যন্ত ইসলামকে প্রতিহত করতে পেরেছিল; এবং একটা পর্যায়ে যখন উন্নততর চেতনা, সমাজ সংগঠন এবং প্রযুক্তির বলে বলীয়ান হয়ে ইউরোপ পাল্টা আঘাত হেনেছে তখন ইসলাম পরাভূত হয়েছে। এরপর ইসলামী পৃথিবীর প্রায় সবটা ইউরোপীয় বিভিন্ন রাষ্ট্রের পদানত হয়। একটা পর্যায়ে ইউরোপের প্রত্যক্ষ শাসন থেকে মুক্ত হয়ে ইসলামী দেশগুলি স্বাধীন রাষ্ট্র হিসাবে দেখা দেয়। কিন্তু ইউরোপের আধিপত্যমূলক যে ব্যবস্থার জালে ইসলামী পৃথিবী বাঁধা পড়েছে তা থেকে তার মুক্তিলাভ আর সম্ভব হয় নাই।
এক অর্থে এই জাল আধুনিক সভ্যতার জাল, যাতে বাঁধা পড়েছে শুধু ইসলামী পৃথিবী নয়, উপরন্তু সমগ্র পৃথিবী এবং মানব জাতিও। তবে এটা মানব জাতির জন্য জাল বা বন্ধন কোনটাই নয়, বরং মুক্তি। কারণ আধুনিক সভ্যতা মানুষকে বিরাট মুক্তি দিয়েছে, তার আরও সামনে যাবার পথকে উন্মোচিত করেছে। অন্যান্য সমাজ ক্রমবর্ধমান সংখ্যায় পাশ্চাত্য আধিপত্যের জালকে ছিন্ন করে যার যার মত করে আধুনিকায়ন, উন্নয়ন ও গণতন্ত্রায়নের পথ ধরে এগিয়ে চলেছে। কিন্তু ইসলামের জন্য এ কথা আদৌ প্রযোজ্য নয়। কারণ ইসলাম সভ্যতার বিপরীতে বর্বরতা ও বন্যতার ধর্ম, মানবতার পরিবর্তে নৃশংস পশুত্বের ধর্ম। মুহাম্মদের নেতৃত্বে একদল হিংস্র, বর্বর, লুঠেরা ও ধর্ষক বেদুইনের হাত দিয়ে যে ধর্ম প্রতিষ্ঠা ও প্রসার লাভ করেছিল তার মর্মমূলে মানুষের যে চেতনা কাজ করে তাকে ধূর্ত, প্রতারক, হিংস্র, বর্বর ও নারীধর্ষক গুহা-মানব চেতনা বলাই সঙ্গত হবে। এদের আধুনিক সভ্যতা নির্মাণের ক্ষমতা যেমন নাই তেমন নাই তাকে প্রতিরোধ করার ক্ষমতাও।
ইসলামের প্রভাবে কোন মুসলিম সমাজের পক্ষে যে সভ্যতার উৎকর্ষ সাধন করা এবং পাশ্চাত্যের সমকক্ষ হওয়া সম্ভব নয় সেটা না বুঝবার মত বোকা পাশ্চাত্য নয়। সুতরাং তা ইসলামকে নিজ আধিপত্যাধীনে নিবার পর বহুকাল ধরে তাকে ব্যবহার, রক্ষা ও লালনের কৌশল নিয়েছে। এ ক্ষেত্রে ইসলামের চরম অমানবিকতা, স্বেচ্ছাচার, নারী অধিকারের প্রতি নির্লজ্জ অবমাননা ও মানুষের ব্যক্তি স্বাধীনতা হরণকারী দাসত্ব বা বান্দাগিরির ধারণা এগুলি কোনই সমস্যা সৃষ্টি করে না। সুতরাং প্রতিক্রিয়ার ইসলামী দুর্গ সৌদী রাজতন্ত্র আজ সাম্রাজ্যবাদী বিশ্ব ব্যবস্থার নেতা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এত প্রিয় এবং নির্ভরযোগ্য পোষ্য। সর্বত্র গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের জন্য গলাবাজী করে বেড়ানো মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং পশ্চিম ইউরোপ সর্ব প্রযত্নে সৌদী আরবকে রক্ষা করে চলেছে যেখানে গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের চিহ্নমাত্র নাই।
ইসলামের লুণ্ঠনজীবী চরিত্রের কারণে পাশ্চাত্যের হাতে পরাজয়ের পর বিশেষ করে ইসলামের পরবর্তী বা নূতন নেতৃত্বের পক্ষে পাশ্চাত্যের পরাক্রান্ত কাফেরদের দাসত্ব করতে বা অধীনতামূলক অবস্থান গ্রহণ করতে সমস্যা হয় না। নিজেদের আধিপত্য ও শোষণের স্বার্থে পাশ্চাত্যও ইসলামী কর্তৃত্বের সাথে একটা আপোস বা সমঝোতা ক’রে চলতে পারে। পাশ্চাত্য তার পুঁজিবাদী বাজার ব্যবস্থা রক্ষার স্বার্থে যেটুকু পরিবর্তন ঘটাবার প্রয়োজন মনে করে সেটুকু ঘটায়। তবে এই পরিবর্তন ঘটে ইসলামের সামাজিক ভিত্তিভূমির উপর দাঁড়িয়ে বা মূল ভিত্তিকে অক্ষত রেখে। ফলে আধুনিক বিশ্ব ব্যবস্থায় প্রবেশের পর ইসলামী সমাজ সম্মুখীন হয় এক অস্বাভাবিক দ্বন্দ্বের। তার মাথা বা নেতৃত্ব প্রভাবিত হয় আধুনিক সভ্যতার নানান উপকরণ দ্বারা, শিক্ষা ও চেতনা দ্বারা, অথচ তার শরীর তথা নীচ তলার আমজনতা রয়ে যায় ধর্মাচ্ছন্ন তথা ইসলামের পশ্চাৎপদতা, ভাগ্যবাদ, হিংস্রতা, নারী বিদ্বেষ এবং নিরঙ্কুশ একত্ববাদী বা একনায়কী আধিপত্যবাদী চেতনার অধীন। ইসলাম না পারে আধুনিক সভ্যতাকে আত্মস্থ করতে, না পারে তাকে প্রত্যাখ্যান করতে। ইসলাম পাশ্চাত্যের আঘাতকে প্রতিহত করতে অক্ষম। কিন্তু ভিতর থেকে স্বাধীন, উন্নত ও মানবিক সভ্যতার উত্থানকে আঘাত এবং নস্যাৎ করতে তা সক্ষম। এমন অবস্থায় পাশ্চাত্যের উপনিবেশবাদী, নয়া উপনিবেশবাদী এবং সাম্রাজ্যবাদী বিশ্ব ব্যবস্থা রক্ষায় ইসলাম হয়ে দেখা দিয়েছে এক প্রচণ্ড শক্তিশালী হাতিয়ার।
আমরা বঙ্গ এবং ভারতবর্ষে ইসলামকে পাশ্চাত্য সাম্রাজ্যবাদের অনুচর ও সহযোগী রূপে ভূমিকা পালন করতে দেখেছি। অষ্টাদশ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ে (১৭৫৭ খ্রীঃ) বাংলার নবাব সিরাজ উদ্দৌলার প্রধান সেনাপতি মীর জাফর কর্তৃক ইংরেজ সেনাপতি ক্লাইভের নিকট নবাবী রাষ্ট্র ক্ষমতা হস্তান্তর ছিল লুণ্ঠনজীবী ইসলামের এই নবরূপে আত্মপ্রকাশ। সেই সময় চলছিল পাঞ্জাবে শিখ এবং মহারাষ্ট্রে মারাঠা উত্থান। এছাড়া বিভিন্ন গণ-বিদ্রোহে মোগল সাম্রাজ্য ভেঙ্গে পড়ছিল। উপমহাদেশের বিভিন্ন জাতির জনগণের জাগরণের কালে যখন বহিরাগত মুসলিম শাসক শ্রেণী বুঝেছে যে বাংলার এবং ভারতবর্ষের হিন্দু ও অন্যান্য অমুসলিম জনগণের উত্থানকে ঠেকানো যাবে না তখন তাদের প্রধান অংশ মীর জাফরের নেতৃত্বে ইংরেজদের সঙ্গে হাত মিলিয়ে বাংলা এবং ভারতবর্ষকে নূতন পর্যায়ের পরাধীনতায় নিক্ষেপ করেছে। ১৭৫৭ সালে পলাশীর প্রান্তরে যে যুদ্ধ হয় তাতে নবাব সিরাজউদ্দৌলার সৈন্য সংখ্যা ছিল প্রায় ৬৭ হাজার। এর মধ্যে আনুমানিক মাত্র ১৭ হাজার সৈন্য নবাবের পক্ষে যুদ্ধ করেছিল। বাকী ৫০ হাজার সৈন্য প্রধান সেনাপতি মীর জাফরের অধীনে দাঁড়িয়ে থাকল। এটা ছিল কৌশলে ইংরেজদের প্রতি সমর্থন। অর্থাৎ বাংলা-বিহার-উড়িষ্যায় ইসলামী যে রাষ্ট্র ছিল তার চার ভাগের তিন ভাগ ছিল ব্রিটিশদের নিকট রাষ্ট্রের প্রকৃত ক্ষমতা হস্তান্তরের পক্ষপাতী। এই কারণে মীর জাফর নিজে নবাব সিরাজউদ্দৌলাকে উৎখাত করে ক্ষমতা দখল করলেন না। সেনাবাহিনীর সংখ্যাগরিষ্ঠ সৈন্য তার পক্ষে থাকায় সেটা তিনি চাইলে করতে পারতেন। কিন্তু তার উদ্দেশ্য ক্ষমতা দখল ছিল না, বরং মূল রাষ্ট্র ক্ষমতা ইংরেজদের হাতে হস্তান্তর করে ক্ষমতার গৌণ অংশীদার হিসাবে টিকে থাকা। সুতরাং পলাশীর রণক্ষেত্রে যুদ্ধের নাটক করা হল। এভাবে ইসলামী সাম্রাজ্যবাদ যার মর্মমূলে আছে আরব সাম্রাজ্যবাদ তার জায়গা নিল ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ।
মীর জাফর পরবর্তী মুসলিম নেতৃত্বের ভূমিকাকে তার ভূমিকা থেকে ভিন্নভাবে দেখার উপায় নাই। যদিও ১৮৫৭-তে মুসলিম নেতৃত্বের একাংশ হিন্দুদের সঙ্গে হাত মিলিয়ে একটা বিদ্রোহ করেছিল তা ছিল পুরাতন নেতৃত্বের শেষ প্রয়াস। বস্তুত ভারতবর্ষে ইসলামের ভূমিকা প্রধানত বিদেশী ব্রিটিশ শাসনের সঙ্গে সহযোগিতামূলক। হিন্দু-মুসলিম দ্বন্দ্ব, বর্ণজাতিভেদের কারণে হিন্দু সমাজের শতধা বিভক্তি ও কাপুরুষতা, হিন্দু সমাজের নেতৃত্বেরও অযোগ্যতা ইত্যাদি কারণ ভারতবর্ষে ব্রিটিশ শাসনকে প্রায় দুইশত বৎসর স্থায়ী রাখায় সাহায্য করে। ওয়াহাবী আন্দোলনের মত কিছু ধর্মান্ধ ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলন হলেও এসব কাফের বিরোধী আন্দোলনের শেষ পরিণতি হল হিন্দু বিরোধী পাকিস্তান আন্দোলন, যা বাংলা এবং ভারতবর্ষকে বিভক্ত করে। আর বঙ্গের বিভক্তির মধ্য দিয়ে এই উপমহাদেশে ইসলামের প্রকৃত ভূমিকা আর একবার প্রকাশ পেল।
ভারতবর্ষে মুসলমান সংখ্যালঘু হওয়ায় সেখানে তার স্বতন্ত্র ইসলামী রাষ্ট্র চাওয়ার ব্যাপারটা বোধগম্য হতে পারে। কিন্তু বঙ্গে সংখ্যাগুরু হওয়া সত্ত্বেও কেন ইসলামী নেতৃত্ব মুসলমানের আলাদা রাষ্ট্র হিসাবে পাকিস্তান চাইবে? অর্থাৎ মুসলমান নেতৃত্ব বাঙ্গালী হিসাবে তার রাষ্ট্র পেতে চায় নাই, বরং মুসলমান হিসাবে তার রাষ্ট্র পেতে চেয়েছিল, যে রাষ্ট্র হাতে পেয়ে তার লুণ্ঠনজীবিতার ঐতিহ্যকে রক্ষা করবে। সেটা তারা ’৪৭ থেকে আজ অবধি রক্ষা করেছে। ’৪৭ থেকে আজ পর্যন্ত বাংলাদেশে হিন্দু জনসংখ্যার হ্রাস-চিত্র দেখলেও এটা বুঝতে কষ্ট হয় না। এই লুণ্ঠনজীবীরা লুণ্ঠনের জন্য যে কোন কৌশল নিতে অভ্যস্থ। সুতরাং সেকিউলারিজম, জাতীয়তাবাদ ইত্যাদির বুলি আওড়াতেও তাদের অসুবিধা হয় না। ’৭১-এ পাকিস্তানের কাঠামো ভেঙ্গে বাংলাদেশের অভ্যুদয়ও ইসলামের এই লুণ্ঠনবৃত্তি ও হিংস্র গুহামানব সুলভ কর্মধারার অবসান ঘটাতে পারে নাই। কারণ বাংলাদেশ ইসলামী রাষ্ট্র পাকিস্তানের বিরুদ্ধে আন্দোলনের মধ্য দিয়ে জন্ম নিলেও ইসলামের অধীনতা থেকে মুক্তির বিপ্লবে রূপ নিতে পারে নাই।
আর পাকিস্তান? পাকিস্তান রাষ্ট্রটির দিকে তাকালে বুঝা যায় এটা সেখানকার এবং উপমহাদেশের জনগণকে কী দিয়েছে। ব্রিটিশ চলে যাবার পর এটা হয়েছে সাম্রাজ্যবাদী বিশ্ব ব্যবস্থা রক্ষার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ দুর্গ। এটা হয়েছে একদিকে পাকিস্তানের জনগণের উপর দাসত্বের ব্যবস্থা রক্ষার এক পাহারাদার রাষ্ট্র, অপরদিকে উপমহাদেশের অন-ইসলামী জনগণের উত্থানের বিরুদ্ধে সাম্রাজ্যবাদের এক দুর্গ। গণতন্ত্রের বুলি আওড়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তাদেরই ভাষায় পৃথিবীর ‘বৃহত্তম গণতন্ত্র’ ভারতের বিরুদ্ধে পাকিস্তানকে যত রকমভাবে সম্ভব ব্যবহার করেছে।
আফগানিস্তানের বাদশাহ্ আমানুল্লাহ তার দেশের আধুনিকায়নের যে উদ্যোগ গ্রহণ করেন ইসলামবাদী শক্তিগুলিকে ব্যবহার ক’রে তাকে কীভাবে তৎকালীন ভারতের ব্রিটিশ সরকার নস্যাৎ করেছিল তা আমরা জানি। একইভাবে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদীদের উত্তরাধিকারী মার্কিন সাম্রাজ্যবাদীরাও কমিউনিস্টদের নেতৃত্বে আফগানিস্তানের আধুনিকায়নের উদ্যোগকে পাকিস্তানের সাহায্যে এবং আফগানিস্তানে জঙ্গী জিহাদীদের উত্থান ঘটিয়ে নস্যাৎ করে। এই হচ্ছে ইসলামী পৃথিবীতে বর্বর ও ধর্ষক গুহামানবদের রক্ষায় পাশ্চাত্যের উদার গণতন্ত্রীদের কিছু কর্মকাণ্ডের নমুনা।
কিন্তু ইসলামের বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী তার লাগবে শত্রু, যার বিরুদ্ধে তা জিহাদ বা ইসলামী যুদ্ধ করবে। এই জিহাদে জয়ী হলে তার লাভ হবে শত্রুর সম্পদ, ভূমি, সম্পত্তি এবং নারী। যুদ্ধে মৃত্যু হলে তার হবে অনন্ত বেহেশ্ত্, যেখানে তা পাবে অনন্ত জীবন, অফুরন্ত মদের নদী, ফল-মূল, সুস্বাদু খাদ্য, বহু সংখ্যক অনন্ত যৌবনা নারী এবং অগণন বালক। ইসলামের আদর্শের প্রকৃত ও সাহসী অনুসারীরা সেই যুদ্ধ বা জিহাদ এখন নূতন উদ্যমে পরিচালনা করতে শুরু করেছে মধ্যপ্রাচ্য এবং অন্যান্য ইসলামী দেশ থেকে ইউরোপ এমনকি খোদ আমেরিকা পর্যন্ত পৃথিবীর বিস্তীর্ণ অঞ্চল জুড়ে। তারা বিশ্বাস করে মুহাম্মদ যেমন বিজয়ী হয়েছিলেন তেমন মুহাম্মদের পথ অনুসরণ করে তারাও বিজয়ী হবে ।
কিন্তু এই যুদ্ধে ইসলামের শক্তি যে বিজয়ী হতে পারবে না সেটা পাশ্চাত্য খুব ভালভাবে জানে। তবে এটা পরমাণু প্রযুক্তির যুগ। সব প্রযুক্তি উদ্ভাবন করতে হয় না। কোন প্রযুক্তিই মানুষ চিরকাল নিজের একচেটিয়া বা গোপন করে রাখতে পারে না। সেটা ক্রয় করে হোক, চুরি করে হোক কিংবা অন্যভাবে হোক আগে বা পরে সংগ্রহ করা যেতে পারে। ইতিমধ্যে পাকিস্তান পরমাণু বোমার অধিকারী হয়েছে। পরমাণু প্রযুক্তি যে পাকিস্তান রাষ্ট্রের হাত থেকে প্রকৃত জিহাদী শক্তির হাতে যাবে না এমন নিশ্চয়তা কোথায়?
তবে এখন পর্যন্ত ইসলামের লালন ও পৃষ্ঠপোষকতাতেই পাশ্চাত্যের লাভ। জিহাদী না হলে আমাদের মত দেশগুলির জন্য ইসলাম তার খুব পছন্দের। কারণ ইসলাম ইসলামী পৃথিবীকে পাশ্চাত্যের অধীনস্থ ও দয়ার ভিখারী করে রাখছে। প্রকৃতপক্ষে আধুনিক যুগে বিশ্ব বাজার ব্যবস্থার বাইরে যাবার উপায় কোন দেশ বা সমাজেরই নাই। এমন কি সেই ক্ষমতা জিহাদী মুসলামানদেরও নাই। সভ্যতার প্রতি বৈরী আফগান তালেবানরাও আধুনিক অস্ত্র ও প্রযুক্তি নিয়েই সভ্যতাকে আঘাত করতে বাধ্য হয়েছে এবং হচ্ছে। এটা হচ্ছে ইসলামের এক ট্র্যাজিডি। সভ্যতা নির্মাণে অক্ষম এবং সভ্যতার প্রতি বৈরী ইসলাম আধুনিক ও উন্নত পৃথিবীর দয়ার উপর নির্ভর করেই এবং এখন পর্যন্ত বিশেষত পাশ্চাত্যের প্রয়োজনেই বেঁচে আছে এবং যতদিন তাকে পাশ্চাত্যের প্রয়োজন হবে ততদিন পাশ্চাত্য তাকে বাঁচিয়ে রাখার চেষ্টা করবে। তবে বেশী বাড়াবাড়ি ক’রে পাশ্চাত্যের জন্য সমস্যা সৃষ্টি করলে তাকে শায়েস্তা করবে। এ ক্ষেত্রে লাদেনের দৃষ্টান্ত দেওয়া যায়। আমেরিকার সৃষ্টি লাদেন বধ আমেরিকাই করেছে। এখন ইসলামিক স্টেট (আইএস) নিয়ে ইরাক-সিরিয়ায়ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের একই নাটক মঞ্চস্থ হচ্ছে। আমেরিকার নীতি পরিষ্কার - ‘সর্প হইয়া দংশন করো, ওঝা হইয়া ঝাড়ো।’ আমাদের মত দেশগুলোয় ইসলাম ও ইসলামী চেতনা লালন ও রক্ষার জন্য সম্ভাব্য সবই তা করবে। আবার ইসলাম যদি তার চরিত্র অনুযায়ী ভিতর বাদ দিয়ে বাহিরেও গিয়ে তাকে আঘাত করার দুঃসাহস করে তবে তাকে শাস্তি দিয়ে বুঝাবে যে বেশী বাড়াবাড়ি করা ঠিক নয়। উদ্দেশ্য একটাই, ইসলামী পৃথিবীকে নিজেদের নিয়ন্ত্রণাধীনে রেখে দেওয়া।
ফলে শেষ বিচারে আধুনিক সভ্যতায় ইসলাম মুসলমানদেরকে দিয়েছে এমন এক কারাগার যেখানে তারা পাশ্চাত্যের দাস হয়ে থাকতে বাধ্য হবে। প্রকৃতপক্ষে আধুনিক বিশ্ব ব্যবস্থায় পুঁজিবাদ, গণতন্ত্র ইত্যাদি যা-ই করা যাক সভ্যতা ইসলামের জন্য এমন এক বন্দীশালা তৈরী করেছে যেখানে মুসলমানরা বন্দী হয়ে থেকে পাশ্চাত্যের বিভিন্ন প্রয়োজন পূরণে বাধ্য হবে। সভ্যতা নির্মাণে পাশ্চাত্যের সেই আদি উদ্যম ও প্রেরণার যুগ শেষ হয়েছে। এখন পাশ্চাত্যের অধিবাসীরা তাদের পূর্বপুরুষদের মত আবিষ্কার, উদ্ভাবন ও নির্মাণের জন্য জীবনপাতের পরিবর্তে ভোগ ও আনন্দ-ফূর্তিতে গা ভাসাতেই অনেক বেশী আগ্রহী। সুতরাং কষ্টসাধ্য শ্রম করার জন্য তাদের দরকার প্রাচ্যের সস্তা শ্রমশক্তি। এ ছাড়া আরও অনেক বেশী প্রয়োজন মেধার, যা আজকের মেধাভিত্তিক সভ্যতার মূল বুনিয়াদ। সস্তা দেহশ্রমের পাশাপাশি এই মেধার অফুরন্ত সরবরাহ ভাণ্ডার হয়ে আছে ইসলামী পৃথিবী। এখান থেকে মেধাবীরা গিয়ে পাশ্চাত্য সভ্যতার চাকা সচল রাখার কাজে নিজেদের নিয়োজিত রাখছে। মেধাশক্তিই পৃথিবীকে বদলায়। সুতরাং ইসলামী পৃথিবীতে তাদের অভাবে অন্ধকার দীর্ঘতর হচ্ছে মাত্র।
মেধাবী ও উন্নত চিন্তার মানুষদের জন্য এই সমাজে দমবন্ধকর পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়ে থাকে। আধুনিক শিক্ষা ও প্রযুক্তির প্রভাবে যে উন্নত মেধা তৈরী হচ্ছে তার বিরাট অংশ হিংস্র ও বর্বর বান্দাদের আধিপত্য, দুর্নীতি, সন্ত্রাস, সহিংসতা, সামাজিক ও রাজনৈতিক স্বৈরাচার, ইত্যাদির চাপে এখানে টিকতে না পেরে পাশ্চাত্যে চলে যেতে চায়। এখানে তার পরেও মেধার বিকাশ সম্ভাবনা নিয়ে যারা থাকে ইট চাপা ঘাসের মত তারাও এক সময় লালনের অভাবে এবং বান্দা সমাজের চাপে শুকিয়ে মরে যায়। এভাবে ইসলামী সমাজগুলি যেটা হারায় সেটা হচ্ছে মেধাশক্তির বিকাশ সম্ভাবনা, যা আজকের সভ্য সমাজ ও রাষ্ট্র নির্মাণ ও রক্ষার জন্য সবচেয়ে বেশী প্রয়োজনীয়। এভাবে ইসলামী পৃথিবী হয়েছে পাশ্চাত্যের জন্য শ্রমশক্তি এবং ততোধিক গুরুত্বপূর্ণ মেধাশক্তি সরবরাহের জন্য এক অফুরন্ত সরবরাহ ভাণ্ডার। এই ভাণ্ডার রক্ষার জন্যও আজ পাশ্চাত্যের আধিপত্যবাদী শক্তিগুলি প্রাচ্যে ইসলাম রক্ষায় এত তৎপর।
এভাবে ইসলাম এবং পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদ একসূত্রে গাঁথা। সুতরাং আজ আমাদের মত দেশে সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী লড়াই এবং ইসলাম বিরোধী লড়াই এক এবং অভিন্ন এক লড়াই।
পঞ্চম অধ্যায়
নূতন বিশ্ববিপ্লবের প্রয়োজন
এক সময় ভিতর থেকে ইসলামের বিরুদ্ধে কার্যকরভাবে লড়াই করা সম্ভব ছিল না। কারণ শান্তির ধর্ম ইসলাম ও তার নবীর যে কোন ধরনের সমালোচনা হিংস্র গুহামানবদের হাতে মৃত্যু ঘটাতে পারত। ইসলাম সম্পর্কে যাদের জ্ঞান আছে তারা হয়ত জানেন যে, সমালোচক কিংবা নিন্দাকারীরা ইসলাম পরিত্যাগকারী তথা মুরতাদ হিসাবে বিবেচিত হবে এবং নবীর নির্দেশ অনুযায়ী তাদের জন্য একমাত্র শাস্তি মৃত্যু। ইসলাম ও তার নবীর সামান্য সমালোচনা যেখানে মৃত্যুর কারণ হতে পারে সেখানে ইসলাম ধর্মের সত্য নির্ভর ও নিরপেক্ষ আলোচনা-সমালোচনা হবে কী করে? বস্তুত গোটা ধর্মটাই সন্ত্রাসের ধর্ম।
কিন্তু বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির সাম্প্রতিক বিকাশ ইসলামকে অসহায় করে ফেলছে। বিশেষত ইন্টারনেট প্রযুক্তির উদ্ভাবন ও ব্যবহার এখন বিশ্বব্যাপী ইসলাম ও তার নবীর চুলচেরা বিশ্লেষণ ও সমালোচনার পথ খুলে দিয়েছে। ইন্টারনেটকে গুহামানবরা আক্রমণ কিংবা হত্যা করবে কীভাবে? বরং ইসলামবাদীরা নিজেদের গুহামানবীয় ধর্মকে বাঁচাবার চেষ্টায় মরীয়া হয়ে এখন ইন্টারনেটেরও আশ্রয় নিয়েছে। কিন্তু এতকালের অবরুদ্ধ সত্যের বাঁধভাঙ্গা বন্যার আঘাতে ইসলামের ব্যূহ তছনছ হয়ে যেতে আর বেশী দেরী নাই। ইন্টারনেটের বাইরেও মুদ্রণ ও প্রকাশ্য আলোচনা ইত্যাদি বিভিন্ন পদ্ধতিতে ইসলাম ও তার নবীর স্বরূপ প্রকাশ শুরু হয়েছে। এ মহাপ্লাবনকে রোধ করবে এমন সাধ্য কার?
বস্তুত প্রশ্নটা শুধু মানবিকতার নয়, প্রতিযোগিতার পৃথিবীতে আমরা মর্যাদার সঙ্গে টিকে থাকতে পারব কিনা তারও। আজকের যুগে দেহশক্তি, পাশবিক আদর্শ এবং ধূর্ত ও হিংস্র গুহামানবীয় বুদ্ধিবৃত্তি নিয়ে টিকে থাকা সম্ভব নয়, মর্যাদার সঙ্গে টিকে থাকার তো প্রশ্নই উঠে না। ইসলামের কারণে পাশ্চাত্যের যে দাসত্ব আমরা করে চলেছি সেটা মেনে নিয়ে মানবেতর জীবন যাপন করব নাকি সভ্যতা ও উন্নয়নে তাদের সমকক্ষ হয়ে বিশ্বসভায় মাথা উঁচু করে দাঁড়াব সেই সিদ্ধান্ত আজ আমাদেরকে নিতে হবে।
মানুষ আজ পৃথিবীর সীমানা ছাড়িয়ে নাক্ষত্রিক সভ্যতার যুগে প্রবেশ করছে। পৃথিবীর উন্নত দেশগুলি আজ আকাশ জয়ের প্রতিযোগিতায় নেমেছে। আর কিছুকালের মধ্যে মানুষ গ্রহ-গ্রহান্তরে বাস করবে। আর আমরা কি সেসব শুধু চেয়েই দেখব? নাকি আমরাও সেই আকাশ জয়ের প্রতিযোগিতায় নামব? যদি সেই প্রতিযোগিতায় আমরা নামতে চাই তবে আমাদের সে ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় বাধা হিসাবে ইসলামকে চিনতে হবে। অর্থাৎ ইসলাম শুধু মানবতার শত্রু নয়, উপরন্তু ইসলামী পৃথিবীর উন্নয়নেরও সবচেয়ে বড় শত্রু। শুধু বাংলাদেশের নয়, বিশাল ইসলামী পৃথিবীরও যে অপার সম্ভাবনা চাপা পড়ে আছে তাকে মুক্ত করা ইসলামী পৃথিবীর মানুষ হিসাবে আমাদের করণীয়। এটি দাবী করে এক বিরাট আদর্শিক এবং সেই সঙ্গে সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক বিপ্লব। শুধু বাংলাদেশ নয়, উপরন্তু সমগ্র ইসলাম অধিকৃত পৃথিবী তার মুক্তির প্রয়োজনে এই বিপ্লবের জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে। অর্থাৎ আজ আমরা বিশ্ববিপ্লবের এক নবতর অধ্যায়ে প্রবেশ করতে যাচ্ছি।
রচনা ꞉ ৯ অক্টোবর - ৮ নভেম্বর, ২০১৪