Banner
সিন্ধু সভ্যতা থেকে হিন্দু সমাজ ─ শামসুজ্জোহা মানিক

লিখেছেনঃ শামসুজ্জোহা মানিক, আপডেটঃ March 4, 2020, 12:00 AM, Hits: 1898


সাধারণভাবে সিন্ধু সভ্যতা নামে পরিচিত প্রায় দশ লক্ষ বর্গকিলোমিটার (কোনও কোনও হিসাব অনুযায়ী সোয়া বারো লক্ষ বর্গকিলোমিটারের অধিক) এলাকা ব্যাপী বিস্তৃত এক বিশাল সভ্যতার কীভাবে উত্থান সম্ভব হয়েছিল, কীভাবে বা কোন কারণে এই সভ্যতার পতন হল সেসব বিষয় নিয়ে এখানে আলোচনা করব না। কারণ সেটা আরেক এবং অনেক বিস্তৃত আলোচনার বিষয়। এ বিষয়ে শামসুল আলম চঞ্চল এবং আমার যৌথভাবে লিখা বই ‘আর্যজন ও সিন্ধু সভ্যতা’য় বিস্তারিত আলোচনা আছে। এখানে এ প্রসঙ্গে শুধু একটা কথা বলি তা হচ্ছে আমাদের অনুমান এই যে প্রধানত শান্তিপূর্ণ ধারায় এমন এক বিশাল সভ্যতার উত্থান হয়েছিল জলকপাট বা স্লুইসগেট সংযুক্ত ব্যারেজ এবং বাঁধ দ্বারা গড়ে তুলা নদী নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থার মাধ্যমে। এক সময় এই ধরনের দুঃসাহসী এবং অত্যন্ত জটিল নদী নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা ভেঙ্গে পড়লে সভ্যতার বিপর্যয় ও পতন ঘটে।

যাইহোক, সিন্ধু সভ্যতার কথা যখন চিন্তা করি তখন মনে প্রশ্ন জাগে, যেমন এক নির্দিষ্ট ছকে সিন্ধু সভ্যতা তার মৃত্যুর সময় পর্যন্ত নির্মিত ও বাঁধা ছিল তেমন ভিন্ন হলেও আর এক ধরনের ছকে কি তা ভারতবর্ষকে আবদ্ধ করে রাখার ব্যবস্থা করে গিয়েছিল। এত বড় এক সভ্যতা উপমহাদেশের সমাজ কাঠামোতেও কি কোনও উত্তরাধিকার রেখে যাবে না, যার অনেক ইতিবাচক দিক থাকলেও নেতিবাচক অনেক দিকও থাকতে পারে? সুতরাং সেই দিকটা বুঝার জন্য সিন্ধু সভ্যতার দিকে একটু দৃষ্টি দেওয়া যাক।

সিন্ধু সভ্যতার নগর বিন্যাসের দিকে দৃষ্টি দিলে মনে হয় প্রায় হাজার বৎসর ব্যাপী যেন তার সবকিছু ছকে বাঁধা, প্রায় অপরিবর্তিত। নগরের রাস্তাগুলি সবগুলিই প্রায় সরল রেখায় পরস্পরকে ৯০ ডিগ্রী কোণে ছেদ করেছে। যেন কাগজে স্কেল টেনে নগরের নকশা আঁকবার পর এবং আন্ডারগ্রাউন্ড ড্রেন, পয়োনিষ্কাশন, সরল রেখায় যাওয়া রাস্তাগুলির দুই পাশে বাড়ীঘরের সারিবদ্ধ বিন্যাস এবং সব মিলিয়ে নগর ব্যবস্থাপনার খুঁটিনাটি বিষয়গুলি পুঙ্খানুপুঙ্খ রূপে নিরূপণের পর নগরগুলি নির্মাণ করা হয়েছে। মাটি ফেলে চারপাশ থেকে উঁচু এবং সমতল করে নগরের জায়গা ঠিক করা হয়েছে। এ ছাড়া রয়েছে প্রায় সমআয়তন বিশিষ্ট সর্ববৃহৎ চারটি নগরের সমদূরত্বের অবস্থান, যার দিকে প্রথম দৃষ্টি আকর্ষণ করেন বিখ্যাত প্রত্নতাত্ত্বিক রফিক মোগল। অর্থাৎ নগর চারটির প্রতিটি অপরটি থেকে প্রায় সমপরিমাণ দূরত্বে অবস্থিত। এই চারটি নগর হচ্ছে মহেঞ্জোদাড়ো, হরপ্পা, রাখিগাড়ি ও গানেরিওয়ালা। পরবর্তী দুই নগর অনেক পরবর্তী কালে আবিষ্কৃত বলে এগুলির কথা বেশী উচ্চারিত হয় না। তাছাড়া আমাদের জানা মতে এগুলির খনন কার্যও এখনও ভালভাবে হয় নাই। দেড় হাজারের কিছু বেশী নগর ও বসতির সন্ধান দশ বা সোয়া বারো লক্ষ  বর্গকিলোমিটারের অধিক অঞ্চল ব্যাপী ভূভাগে পাওয়া গেলেও এখনও প্রত্নতাত্ত্বিক খনন হয় নাই বিপুল সংখ্যারই।

 

তবে যতগুলি বসতিরই উৎখনন হোক সিন্ধু সভ্যতার সকল নগর, শহর বা বসতি একটি দিককে স্পষ্ট করে দেখায় তা হল তার সুপরিকল্পিত ব্যবস্থা। সব কিছু যেন ছকে বাঁধা। এবং এ ক্ষেত্রে যে বিষয়টিকে সবচেয়ে গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনায় নেওয়া দরকার সেটি হচ্ছে প্রায় সমগ্র নগর সভ্যতার বিন্যাস যেন পূর্ব নির্ধারিত পরিকল্পনা অনুযায়ী করা হয়েছে। উন্নত নগর সভ্যতার পর্যায়কে প্রত্নতাত্ত্বিকরা সাধারণত পরিণত হরপ্পান সভ্যতা বলেন। এর আগে যে পর্যায় ছিল সেটা ছিল হরপ্পার আদি পর্যায়। এই আদি হরপ্পান পর্যায়ের সূচনা প্রায় সাড়ে পাঁচ হাজার বৎসর পূর্বে। সেটা কিছু বেশীও হতে পারে। কোন কোন প্রত্নতাত্ত্বিক ছয় হাজার বছরের দিকেও ইঙ্গিত করেন। তখন পরিণত হরপ্পান সভ্যতা তথা নগর সভ্যতার প্রস্তুতি চলছিল। বলা যায় নগরের কিছু লক্ষণ দেখা গেলেও এটা তখনও গ্রাম গঠনের পর্যায়। গ্রাম থেকে নগর গঠনের পর্যায়ে পরিবর্তন লক্ষ্যণীয়। কিন্তু একবার নগর সভ্যতা নির্মাণের পর আর তেমন কোনও পরিবর্তন লক্ষ্য করা যায় না। খুব কম করে খ্রীষ্টপূর্ব ২৬০০ সাল থেকে খ্রীষ্টপূর্ব ১৯০০ সাল পর্যন্ত উন্নত নগর সভ্যতার সময়সীমা ধরলেও আট শত বৎসর প্রায় সবকিছু একটা ছকে আবদ্ধ হয়ে থেকেছে।

এটা ঠিক যে সেখানে বৈচিত্র্য ও বিভিন্নতা ছিল। এত বড় সভ্যতার সর্বত্র সবকিছু এক রকম হবে সেটা সম্ভব নয়। কিন্তু তার অনেক বৈচিত্র্য সত্ত্বেও যেটা প্রত্নতাত্ত্বিকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে সেটা হচ্ছে উন্নত নগর সভ্যতার শুরু থেকে সমাপ্তি পর্যন্ত সর্বত্র বেশ কিছু অভিন্নতা ও অপরিবর্তনীয়তা। যেন একটা সাধারণ ছকে সভ্যতাকে গড়ে তুলা হয়েছে।

সভ্যতা যখন প্রসারিত হয়েছে তখন যেন সেই ছক অনুযায়ী প্রসারিত হয়েছে। যখন সভ্যতা প্রাচীন হয়েছে তখনও তার ছক তেমন একটা বদলায় নাই। কারণ সবই পূর্ব নির্ধারিত। বাড়ীঘর অনেকবার নূতন করে নির্মাণ করতে হয়েছে। বন্যাপ্লাবিত হয়ে পলি পড়ার দরুন হরপ্পা-মহেঞ্জোদাড়োর মত নগরগুলির রাস্তা ও বাড়ীঘর অনেক বার উঁচু করতে এবং নূতন করে নির্মাণ করতে হয়েছে। কিন্তু ছক বদলায় নাই। একইভাবে এক স্তরের উপর আর এক স্তর পুনর্নির্মিত হয়েছে। তার সাক্ষ্য দেয় রাস্তা, বাড়ী এবং এমনকি কূপ পর্যন্ত, যা শত শত বৎসর যাবৎ পুনর্নির্মাণের ফলে সুউচ্চ চিমনির মত আকার ধারণ করেছে।

এছাড়া সভ্যতার বিশাল অঞ্চলের সর্বত্র রয়েছে একই রকম ওজন, মাপ, সিল, মাটির পাত্র ও দব্য সামগ্রী এবং একই মাপের ইটের ব্যবহার। মনে রাখতে হবে সিন্ধু সভ্যতা নির্মাণের সময় ঘোড়ার ব্যবহার প্রচলিত হয় নাই। তখনও ছিল পায়ে হাঁটা  এবং গাধা ও গরুর গাড়ীতে যাতায়াত বা পরিবহনের যুগ। অবশ্য সিন্ধু সভ্যতা ছিল মূলত নদী কেন্দ্রিক। ফলে নৌপরিবহনের সুযোগ ছিল। কিন্তু সেটা সভ্যতার বিশাল অঞ্চল ব্যপী সর্বত্র যোগাযোগে যে ভূমিকা রাখত না সেটা সহজবোধ্য। অর্থাৎ মূলত পায়ে হাঁটা, গরুর গাড়ীতে এবং নৌযানে চলা সেই যুগের পটভূমিতে ফেলে এই সুবিশাল সভ্যতার বৈশিষ্ট্যগুলিকে বিচার করতে হবে। সেখানে আমরা দেখতে পাই তার আশ্চর্য রকম রক্ষণশীলতা, সমরূপতা ও অপরিবর্তনীয়তা। যেন এক ছকে প্রায় সবকিছু বাঁধা শতাব্দীর পর শতাব্দী জুড়ে, সহস্র বৎসর ধরে।   

কিন্তু সিন্ধু সভ্যতায় কেন এত রক্ষণশীলতা? কেন এত দীর্ঘস্থায়ী অপরিবর্তনীয়তা এবং এত সমরূপতা? এর উত্তর কিছুটা খুঁজেছি শামসুল আলম চঞ্চল ও আমার যৌথভাবে লিখা গ্রন্থ ‘আর্যজন ও সিন্ধু সভ্যতা’য়। সেখানে আমরা জলকপাট, বাঁধ ও ব্যারেজ সংযুক্ত নদী নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থার স্পর্শকাতর জটিলতার মধ্যে এই সভ্যতার এমন রক্ষণশীলতার কারণ বা উৎস খুঁজেছি।

সিন্ধু সভ্যতার অনেক রহস্যের মত এই রক্ষণশীলতা বা অপরিবর্তনীয়তাও একটা রহস্য হয়ে আছে। তবে নদী নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা যদি সভ্যতার রক্ষণশীলতার প্রধান বস্তুগত ভিত্তি হয়েও থাকে তবে তার ভাবগত ভিত্তি কী ছিল? শুধুমাত্র বস্তুগত ভিত্তির উপর নির্ভর করে কোনও ব্যবস্থাই দীর্ঘস্থায়ী হতে পারে না। তবে কি এটা এখানে এমন কোনও ধর্ম বা এমন কোনও ধরনের আদর্শ ছিল, যার রূপ এখনও আমাদের সঠিকভাবে জানা নাই? কিন্তু, এটা এখানে আমার আলোচনার মূল বিষয় নয়। সুতরাং সিন্ধু সভ্যতার নগর বিন্যাসের অপরিবর্তনীয়তাকে মাথায় রেখেই এখানে আলোচনা করব।

যাইহোক, সিন্ধু সভ্যতা ধ্বংসের পরে স্বাভাবিক নিয়মে সেই ছক বা শৃঙ্খলা থাকে নাই। সবচেয়ে বড় কথা সিন্ধু সভ্যতার ধ্বংসাবশেষ থেকে যে উন্নত ও গণতান্ত্রিক নাগরিকতা সেখানে ছিল বলে আমরা অনুমান করি সেই নাগরিকতারও অবসান হয়েছিল এবং এটাও অনুমেয় যে, সমগ্র উপমহাদেশ বহুকালের জন্য চলে গিয়েছিল পশ্চাৎপদ, কূপমণ্ডূক এবং প্রতিক্রিয়াশীল গ্রাম্যতায়।

তবে এই আলোচনায় সিন্ধু সভ্যতার রক্ষণশীলতার দিকটিকে গভীর বিবেচনায় রাখতে হবে। যতই জনকল্যাণমুখী এবং উন্নত নাগরিক হোক এক বিস্ময়কর রক্ষণশীলতায় সমগ্র সভ্যতা বাঁধা পড়ে ছিল প্রায় হাজার বছর। বুঝা যায় ব্যাপক সংখ্যক মানুষের জন্য যতই উপযোগবাদী হোক, কল্যাণমুখী হোক সভ্যতা একটা নির্দিষ্ট পর্যায়ে আটকা পড়ে থাকায় প্রায় হাজার বছর তার আর অগ্রগতি ঘটে নাই। তবে সব সভ্যতার নিয়মে তারও একটা সময় এমন সঙ্কট এসেছিল যা থেকে তার আর পরিত্রাণ ঘটে নাই। তখন রক্ষণশীল কিন্তু উন্নত নাগরিকতার অবসান ঘ’টে তার ভিতরকার রক্ষণশীল গ্রাম্যতার উত্থান ঘটেছে বলে অনুমান করা যায়।

ভারতবর্ষের ক্ষেত্রে এই গ্রাম্যতার বিশেষ ধরনের প্রকাশ হল তার বর্ণজাতিভেদ ভিত্তিক হিন্দু সমাজ ও ধর্ম। এ যেন নাগরিকতা, উন্নত সমাজ চিন্তা ও উন্নত সভ্যতা থেকে বিদায় নিয়ে সিন্ধু সভ্যতার হাজার বছরের দৃঢ়বদ্ধ ছক বা শৃঙ্খলা এবার কয়েক হাজার বছরের পশ্চাৎপদ গ্রাম্যতায় উপমহাদেশকে আবদ্ধ করে রাখার দায়িত্ব নিল। উন্নত ও সুপরিকল্পিত নগর নাই, নাই তার উন্নত জীবন, নাই বৃহৎ ও ক্ষুদ্রের প্রধানত স্বেচ্ছামূলক সমন্বয়ের মাধ্যমে মহাকায় সমাজ ও সভ্যতা নির্মাণের পথে অভিযাত্রা। তার পরিবর্তে থাকল কোনও রকমে খেয়েপরে কিছুটা নির্ভাবনায় বেঁচে থাকার জন্য বজ্রকঠিন নিয়মে বাঁধা জীবন ব্যবস্থা। এই ব্যবস্থায় ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র কুঠরিতে সমাজ স্থায়ীভাবে বিভক্ত হয়ে থাকবে। সমাজের ক্ষুদ্র ভাগগুলি পাশাপাশি অবস্থান করলেও কারও সঙ্গে কারও সহজ ও স্বচ্ছন্দ যোগাযোগ থাকবে না।

তত্ত্বগতভাবে বর্ণাশ্রমের কাঠামোতে ফেলে সমাজকে বিভক্ত করা হল সুনির্দিষ্ট মর্যাদা ও অপরিবর্তনীয় পেশার ভিত্তিতে ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য ও শূদ্র এই চার বর্ণে। কিন্তু এটা কাগুজে ভাগ মাত্র। বাস্তবে এক একটা বৃহত্তর বর্ণের ভিতরেও সৃষ্টি হল নির্দিষ্ট পেশা বা কর্মের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট হয়ে ‘জাত’ বা ‘জাতি’নামে অসংখ্য গোষ্ঠী। চলতি ভাষায় ‘জাত’আর সাধু ভাষায় ‘জাতি’। এখানে জাতের বাইরে ব্যক্তি মানুষের কোনও পরিচয় রইল না। জাতের নামে মানুষকে করা হল ক্ষুদ্র গোষ্ঠীবদ্ধ। উচ্চবর্ণের এক জাতের মানুষের সঙ্গে নিম্নবর্ণের আর এক জাতের মানুষের মিলনের সব পথ বন্ধ করা হল। অসম মর্যাদাভিত্তিক জাতের মানুষদের একত্র আহার এবং বিবাহ নিষিদ্ধ হল। উচ্চবর্ণের মানুষকে শিখানো হল তুলনায় কম পবিত্র অথবা অপবিত্র হিসাবে নিম্নবর্ণের মানুষকে ঘৃণা করতে। নিম্ন বর্ণের মানুষকে শিখানো হল জন্মগত কারণে সৃষ্ট নিজের নীচ অথবা অপবিত্র ও ঘৃণিত অবস্থানকে নির্দ্বিধায় মেনে নিতে। এক অর্থে গোটা ব্যবস্থাটাই ঘৃণার উপর প্রতিষ্ঠিত। এই ঘৃণা ধাবিত উচ্চ থেকে নিম্নের দিকে। সবার উপরে ব্রাহ্মণ। তার নীচে ক্ষত্রিয়। তার নীচে বৈশ্য। আর সবার নীচে শূদ্র। ধর্মের দায়িত্ব ব্রাহ্মণের হাতে। সে সবচেয়ে পবিত্র। কিন্তু রাষ্ট্রপরিচালনার ভার ক্ষত্রিয়ের হাতে থাকায় তার ক্ষমতা এবং ফলত মর্যাদা কম নয়। যুদ্ধ করাটাও একমাত্র তার কাজ। বৈশ্য ও বিশেষত সবার নীচে থাকা শূদ্রের কাজ হল এই দুই বর্ণের নীচে অমর্যাদাজনক অবস্থানে থেকে তাদেরকে সেবা করা এবং বাঁচিয়ে রাখা।

একই গ্রামে বা নগরে বাস করলেও বর্ণব্যবস্থায় বিভক্ত জাত বা গোষ্ঠীগুলির পাড়া বা মহল্লা যেমন ভিন্ন তেমন পাশাপাশি শত শত বছর বাস করেও তারা একে অন্যের সঙ্গে একীভূত হবে না। কিন্তু এখানেই শেষ নয়। আরও কিছু মানুষ রয়ে গেল যারা সমাজের আবর্জনা পরিষ্কার করবে, কিন্তু সমাজ থেকে দূরে থাকবে। যেমন চণ্ডাল, মেথর, চর্মকার ইত্যাদি। এদের বাদ দিয়েও তো সমাজ বিশেষত নগর সমাজ অচল। এদের কেউ মানুষের মৃতদেহ সৎকারের সময় কিংবা জীবের মৃতদেহ দূরে ফেলার জন্য প্রয়োজনীয় হবে, কারও প্রয়োজন মানুষের মল এবং বর্জ্য নগর থেকে দূরে নিয়ে ফেলার জন্য, কারও প্রয়োজন মৃত গবাদিপশুর চামড়া ছাড়িয়ে তা দিয়ে জুতা বানানোর জন্য। কিন্তু এরা সমাজের হয়েও সমাজের কেউ না। এরা হল অস্পৃশ্য বা অচ্ছুৎ। চতুর্বর্ণেরও বাইরের এরা। এদের বাস হল নগর বা গ্রামের সীমার বাইরে। শুধু তারা নয়, তাদের শরীরের ছায়া পর্যন্ত অপবিত্র ছিল। চতুর্বর্ণের কাঠামোর বাইরে এদেরকে রাখা হলেও এরাও বর্ণজাতিভেদ ভিত্তিক হিন্দু সমাজের অন্তর্ভুক্ত হল। তত্ত্বগতভাবে স্বীকৃত না হলেও এরা হল সমাজের পঞ্চম ‘বর্ণ‘। এই সব বর্ণের এক একটার ভিতর আবার থাকল অসংখ্য ‘জাত’ বা ‘জাতি’। এই সবগুলিকে বর্ণজাতি বলা চলে। তত্ত্বের বর্ণ আর বাস্তবের ‘জাতিকে’একত্রে মিলালে যেটা দাঁড়ায় সেটাকে বর্ণজাতি বললে চিনতে ও বুঝতে সুবিধা হয়।  

সমাজের এই ধরনের পবিত্রতা-অপবিত্রতা ভিত্তিক স্তরবিন্যাসের মূল দার্শনিক ভিত্তি হল এই বিশ্বাস যে মানুষের জীবনের সবকিছুই তার পূর্বজন্মের কর্মফল  অনুযায়ী নির্ধারিত। সুতরাং পূর্বজন্মের কর্ম অনুযায়ী এই জীবনে যে ‘জাত’-এ সে জন্ম নিয়েছে সেই ‘জাতের’যে ধরনের মর্যাদা ও কর্ম নির্ধারিত রয়েছে সেটাকে যথাযথভাবে রক্ষা করে কর্ম করে যাওয়াই তার ‘ধর্ম’। যদি এই ‘ধর্ম’সে সঠিকভাবে পালন করে তবে পরের জন্মে সে উন্নততর জীবন ও ‘জাত’বা ‘বর্ণজাতি’ লাভ করবে কিংবা এ জীবনের কর্মফল অনুযায়ী সে স্বর্গলাভও করতে পারে।

এই রকম এক কর্মফলবাদ ভিত্তিক বর্ণজাতির ব্যবস্থায় সমাজ আবদ্ধ হয়ে এক ধরনের বিস্তৃতি, স্থিতি, সহাবস্থান রক্ষা করল। কিন্তু বাস্তবে এতে বৃহত্তর সমাজ হারালো গতিশীলতা, সৃষ্টিশীলতা, শৌর্য-বীর্য-সাহস এবং বৃহৎ নির্মাণের ক্ষমতা। অজস্র  বিভক্তির কারণে সমাজ অশক্ত ও দুর্বল হয়ে থাকায় বাহির থেকে যখন প্রবল কোনও শক্তি আক্রমণ করেছে তখন অধীনস্থ হয়েছে। এই বিভক্তি শুধু যে তাকে সামাজিকভাবে দুর্বল করেছে তাই নয়, উপরন্তু তাকে চেতনাগতভাবে বা বুদ্ধিবৃত্তিকভাবেও দুর্বল করেছে। কারণ মানুষের চেতনা বা বুদ্ধিবৃত্তি সমাজকে অবলম্বন করেই ক্রিয়াশীল ও বিকশিত হয়।

সিন্ধু সভ্যতার নায়ক যে ধর্মীয় শক্তি তথা পুরোহিত শ্রেণী ছিল না তেমনটাই মনে হয়। ধারণা করা যায় লোকবাদী শ্রেণী বা শ্রেণীসমূহ ছিল এই সভ্যতার নায়ক। এ বিষয়ে ‘আর্যজন ও সিন্ধু সভ্যতা’য় আলোচনা আছে। এটা নিয়ে এখানে আলোচনা করব না। সিন্ধু সভ্যতা ছিল এমন এক প্রবল সভ্যতা যেখানে ধর্মের ভূমিকা থাকলেও রাষ্ট্র ও সভ্যতা নির্মাণ ও পরিচালনায় তার ভূমিকা সহায়কের ছিল বলে মনে হয়। সিন্ধু সভ্যতার পতনের পর বৃহত্তর সমাজ নির্মাণ ও রক্ষার জন্য সভ্যতার বস্তুগত শক্তি যখন দুর্বল হয়েছিল তখন পশ্চাৎপদ সাধারণ মানুষকে নিয়ন্ত্রণের জন্য ধর্মের ভাবগত শক্তির প্রাধান্যে আসাটা ছিল স্বাভাবিক। সুতরাং বৈদিক ধর্ম সংস্কারের মধ্য দিয়ে সিন্ধু ও সিন্ধু পরবর্তী ভারতীয় সমাজে পুরোহিত শ্রেণী হিসাবে ব্রাহ্মণ বর্ণজাতি তার আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করেছে। রাষ্ট্র পরিচালনা ও যুদ্ধের দায়িত্ব ক্ষত্রিয় বর্ণজাতির হাতে দেওয়া হলেও ধর্মের মাধ্যমে সামাজিক নিয়ন্ত্রণ নিজের হাতে নিয়ে ব্রাহ্মণ প্রকৃতপক্ষে ক্ষত্রিয়কেও নিজের নিয়ন্ত্রণে নিল। ফলে রাষ্ট্রশাসনেও তার ভূমিকা নানানভাবে রাখল। শেষ পর্যন্ত অন্ধ বিশ্বাস নির্ভর ধর্মই সমাজকে টিকিয়ে রাখার এবং নিয়ন্ত্রণ ও পরিচালনা করার প্রধান শক্তি হল।

অনুমান করা যায় এভাবে সভ্যতার বস্তুগত শক্তির জায়গা নিল অন্ধবিশ্বাস নির্ভর ধর্মের ভাবগত শক্তি। এই শক্তি বস্তুগত সভ্যতা থেকে উঠে এলেও নিয়ে এল প্রধানত তার অন্ধবিশ্বাস নির্ভর ভাবগত দিককে, যা তার অন্ধকার দিক। এভাবে অনুমান করা যুক্তিসঙ্গত মনে হয় যে, সর্বোচ্চ সংখ্যক মানুষের ব্যবহারিক জীবনের কল্যাণকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে যারা সুদূরপ্রসারী দূরদৃষ্টি ও পরিকল্পনা নিয়ে সভ্যতা নির্মাণ করেছিল তাদের পতন পরবর্তী উন্নত সভ্যতা নির্মাণে অক্ষম উত্তরসূরীরা নগর ও সভ্যতা নির্মাণের পরিকল্পনাকে কাজে লাগালো সমাজের এমন এক ছক নির্মাণে যা বস্তুগত উন্নয়নের শক্তি দিতে না পারুক সমাজকে অচলায়তনে ধরে রাখায় অতুলনীয় এক হাতিয়ার হবে। এভাবে সিন্ধু সভ্যতার নগর বিন্যাসের অপরিবর্তনীয় ছক যেন সমাজ বিন্যাসের অপরিবর্তনীয় ছকে পরিবর্তিত হল। এল বর্ণজাতিভেদ ভিত্তিক সমাজ বিন্যাস। নগরের রাস্তা পারাপার করা যায়। কিন্তু এখানে সেটা নিষিদ্ধ। বর্ণজাতির এক কুঠরি থেকে আরেক কুঠরিতে প্রবেশ নিষেধ। যেন একটা ছকে ফেলা নগর, অসংখ্য তার মহল্লা, যেখানে আছে রাস্তাগুলির দুই পাশ দিয়ে গড়ে উঠা পাকা বাড়ীর সারি। কিন্তু এক মহল্লা থেকে আরেক মহল্লায় যাওয়ায় সেখানে বারণ।

সিন্ধু সভ্যতা পতন পরবর্তী কালে সেখানকার অভিগামীদের যে অংশ পূর্ব দিকে উত্তর ও পূর্ব ভারতের গাঙ্গেয় উপত্যকায় বসতি করল তারা সেখানকার আদিম ও পশুশিকারী উপজাতিসমূহের বিভিন্ন সামাজিক প্রথা ও বিশ্বাসের সঙ্গে সমন্বয় সাধন করে ক্রমে বর্ণজাতিভেদের সমাজ কাঠামো গড়ে তুলেছিল এভাবে চিন্তা করলে বর্ণজাতিভেদের উদ্ভব রহস্যকে বুঝতে সুবিধা হয়। অর্থাৎ তার মাথাটা উন্নত বা সভ্য সমাজ থেকে এলেও শরীরটা এল আদিম ও বন্য সমাজ থেকে। এভাবে উন্নত বুদ্ধির কৌশল ও ধূর্ততার সঙ্গে যেন যুক্ত হল অনুন্নত বুদ্ধির মূঢ়তা ও পশ্চাৎপদতা।

কিছু আগে যে কথা বলেছি, হিন্দু ধর্ম ও সমাজের বর্ণজাতিভেদ প্রথার মূল দার্শনিক ভিত্তি হল জন্মান্তরবাদের কর্মফল তত্ত্ব। বলা হল মানুষ তার পূর্বজন্মের কর্মফল অনুযায়ী নির্দিষ্ট মর্যাদা ও বৃত্তি বা কর্ম ভিত্তিক বর্ণজাতি বা জাতে জন্ম নেয়। এই জন্মে এই বর্ণজাতির মর্যাদা পরিবর্তন সম্ভব নয়। বাস্তবে অবশ্য ক্ষমতা ও সামর্থ্যের সঙ্গে কদাচিৎ পরিবর্তন ঘটত। তবে সেটা ছিল নিয়মের ব্যতিক্রম। এভাবে বংশগত ও গোষ্ঠীগত ভাবে মানুষের পরিচয়, সামাজিক মর্যাদা বা অবস্থান, পেশা বা বৃত্তি পূর্বনির্ধারিত হয়ে থাকল। সেটা ব্যক্তি-মানুষ এবং বর্ণজাতি উভয়ের জন্যই প্রযোজ্য। এগুলির উপর মানুষের কোনও হাত রইল না। সবচেয়ে বড় কথা নির্দিষ্ট বর্ণজাতি বা ‘জাতের’বাইরে ব্যক্তির কোনও সামাজিক পরিচয় বা অস্তিত্ব রইল না এবং এভাবে ব্যক্তির অস্তিত্ব বর্ণজাতি নামে একটি গোষ্ঠীর ভিতর বিলীন হল।

পূর্বজন্মের কর্মফলের নামে এখানেও কাজ করল পূর্বনির্ধারণবাদ। এভাবে মৃত সিন্ধু সভ্যতার প্রেতাত্মা যেন সওয়ার হল জীবিত সমাজের উপর, হিন্দু সমাজের উপর। ধরে নেওয়া হল পূর্ব জন্মের কর্মফল মানুষ পায় এ জীবনে। সুতরাং তার এ জীবনের সবকিছু ছকে বাঁধা ─ পূর্বনির্ধারিত ও অপরিবর্তনীয় ছকে বাঁধা। মানুষের জীবনের সবকিছুকে এমন এক রক্ষণশীলতার বেড়ীতে আবদ্ধ করা হল যা থেকে তার পরিত্রাণ হল অতীব দুরূহ কিংবা অসম্ভব। মানুষ আসে, মানুষ যায়। সমাজ আসে, সমাজ যায়। রাষ্ট্র আসে, রাষ্ট্র যায়। পরিবর্তনের পর পরিবর্তনের ঝড় ব্যক্তি, সমাজ ও রাষ্ট্রের উপর দিয়ে বয়ে যায়, মানুষের জীবনকে তছনছ করে দিয়ে যায়। কিন্তু কয়েক হাজার বছরেও সে ছক বদলানো গেল না।

প্রথম প্রকাশ : ২৯ জুলাই, ২০১৫

 

সাম্প্রতিক পোষ্টসমূহ