লিখেছেনঃ শামসুজ্জোহা মানিক, আপডেটঃ May 6, 2018, 12:00 AM, Hits: 2825
আমাদের সমাজে বিপ্লবী বা অবিপ্লবী যে কোনও রাজনীতি করতে গেলে আগে এ দেশের মুসলিম জন-মানসকে বুঝতে হবে : শামসুজ্জোহা মানিক
(সাংবাদিক ও রাজনৈতিক সংস্কৃতি কর্মী মাসুদ রানা শামসুজ্জোহা মানিককে সাক্ষাৎকারের উদ্দেশ্যে প্রথম দফায় ১৫ টি লিখিত প্রশ্ন পাঠান। তিনি সেগুলির লিখিত উত্তর দিলে তার প্রেক্ষিতে মাসুদ রানা আরও ৬ টি প্রশ্ন পাঠান। শামসুজ্জোহা মানিক দ্বিতীয় দফায় সেগুলির উত্তর পাঠান। এই দুই দফার প্রশ্নোত্তর নিম্নে প্রকাশ করা হল। -- বঙ্গরাষ্ট্র)
সাক্ষাৎকার প্রসঙ্গে মাসুদ রানার কিছু কথা :
আমি সাক্ষাৎকারের উদ্দেশ্যে শামসুজ্জোহা মানিককে প্রথম দফায় কিছু লিখিত প্রশ্ন পাঠাই। তিনি সেগুলির লিখিত উত্তর দিলে আমি তার প্রেক্ষিতে আরও কয়েকটি প্রশ্ন পাঠাই। তিনি দ্বিতীয় দফায় সেগুলির উত্তর পাঠান। এই দুই দফার প্রশ্নোত্তর এখানে প্রকাশ করা হল।
শামসুজ্জোহা মানিক সম্পর্কে বলতে গিয়ে বলতে হয় যে তিনি একজন নিভৃতচারী মানুষ। ষাটের দশকের একজন তুখোড় বাম ছাত্র নেতা। পরবর্তী কালে কৃষকদের মাঝে কাজ করেছেন। পাকিস্তান আমলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের মেধাবী ছাত্র ছিলেন। অবিভক্ত কমিউনিস্ট পার্টির সাথে যুক্ত ছিলেন। ’৭১ সালে পাক হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে মুক্তিযুদ্ধ সংগঠিত করেন। কমিউনিস্ট পার্টি নেতৃত্বের সঙ্গে বিভিন্ন মৌলিক প্রশ্নে মতপার্থক্যের কারণে তিনি বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার পর ’৭২ সালে কমিউনিস্ট রাজনীতি পরিত্যাগ করেন এবং এ দেশের উপযোগী সঠিক, নতুন বিপ্লবী তত্ত্ব ও রাজনীতি গড়ার কাজে আত্ননিয়োগ করেন।
গবেষক হিসেবে তিনি বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান (BIDS), মাল্টিডিসিপ্লিনারী একশন রিসার্চ সেন্টার এবং আদিবাসী উন্নয়ন কেন্দ্র এবং ব্যক্তিগতভাবে বৃহত্তর ময়মনসিংহ অঞ্চলে গারোদের উপর কাজ করেন।
তিনি অনেকগুলো নতুন ভাবনা উদ্রেককারী গ্রন্থ রচনা করেছেন। তাঁর উল্লেখযোগ্য বইসমূহ হলো : রাজনীতির পুনর্বিন্যাস, আর্যজন ও সিন্ধু সভ্যতা (সহ লেখক), The Aryans and the Indus Civiliztion (Co-author), জাতির মুক্তি কোন পথে, বাংলাদেশের উন্নয়ন সমস্যা, ধর্ম ও শ্রেণীতত্ত্বের যাঁতাকলে বাঙ্গালী জাতি, বাঙ্গালী মধ্যবিত্তের উত্থান, আওয়ামী লীগ-বিএনপি বিরোধের সমাজতত্ত্ব, ইসলামের ভূমিকা ও সমাজ উন্নয়নের সমস্যা এবং ইসলাম ও আধুনিক সভ্যতা প্রভৃতি।
তিনি “বঙ্গরাষ্ট্র” ওয়েব-সাইটের সম্পাদক।
- মাসুদ রানা,
সাংবাদিক ও রাজনৈতিক সংস্কৃতি কর্মী
প্রথম দফায় মাসুদ রানার ১৫ টি প্রশ্ন :
প্রশ্ন : ১। প্রথমে আপনার ছেলেবেলার কথা বলুন। মা-বাবা, পরিবার সম্বন্ধেও বলবেন।
প্রশ্ন : ২। আপনি কিভাবে রাজনীতির সাথে যুক্ত হলেন?
প্রশ্ন : ৩। আপনার বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের কথা, শিক্ষকদের কথা এবং রাজনীতির কথা বলুন।
প্রশ্ন : ৪। শুনেছি আপনি ছাত্রাবস্থায় বাম রাজনীতির সাথে যুক্ত ছিলেন। পরবর্তীতে কমিউনিস্ট পার্টির সাথে যুক্ত হন। সম্ভবত মতিন-আলাউদ্দিন গ্রুপের সাথে যুক্ত ছিলেন। আবার এক সময় পার্টি ছেড়ে দিলেন। কেন সক্রিয় রাজনীতি মানে পার্টি ছেড়ে দিলেন, বিস্তারিত বলবেন।
প্রশ্ন : ৫। সক্রিয় রাজনীতি ছেড়ে দিয়ে পরবর্তীতে লেখালেখিতে সক্রিয় হয়ে উঠলেন কেন? আপনার মেধাকে দেশের রাজনৈতিক পরিবর্তন ত্বরান্বিত করার কাজে নিয়োগ না করে, ব্যক্তিগত সৃজনশীলতায় ব্যবহার করাকেই জরুরি মনে করেছিলেন তখন?
প্রশ্ন : ৬। আমার কাছে মনে হয়েছে, আপনাদের লেখা ‘আর্যজন ও সিন্ধুসভ্যতা’ বইটি দিয়ে আপনারা ভারতীয় উপমহাদেশের ইতিহাসের একটি দিককে কাউন্টার হিসেবে উপস্থাপন করেছেন। কাজটা আমার কাছে অসাধারণ মনে হয়েছে। আমার প্রশ্ন হলো, কোন ধরনের প্রণোদনা আপনাদেরকে এ বই লিখতে উদ্বুদ্ধ করেছে।
প্রশ্ন : ৭। বাংলাদেশে মনে হয় প্রথম আপনিই ‘অখণ্ড বঙ্গ রাষ্ট্রের’ধারণার উদ্ভাবক। আপনি কোন প্রেক্ষিতে এ ধরনের রাজনীতির প্রয়োজন উপলব্ধি করলেন? আর মার্কসবাদী রাজনীতি ছেড়ে কেনইবা এ ধারণায় কাজ করার প্রণোদনা পেলেন?
প্রশ্ন : ৮। এবার বলুন আপনার লেখার বিষয়টি শুরু হলো কখন থেকে এবং কেন।
প্রশ্ন : ৯। আপনি যখন রাজনীতিতে সক্রিয় ছিলেন তখনকার পার্টি ও কমরেডদের সম্পর্কে বলুন।
প্রশ্ন : ১০। স্বাধীনতার পর বাংলাদেশের রজনীতি আওয়ামী লীগ-বিএনপি এ দুটি বুর্জোয়া ধারা দ্বারা নিয়ন্ত্রিত ও পরিচালিত হচ্ছে। এ দুই ধারার মধ্যে ন্যূনতম গণতন্ত্রের লেশমাত্র নেই। তাদের এতো ব্যর্থতার পরেও জনগণ তাদেরকেই গ্রহণ করছে। এই যে জনগণের মনস্তত্ত্ব - এ নিয়ে কিছু বলুন।
প্রশ্ন : ১১। সারা বিশ্বেই তো বাম রাজনীতির নাজুক অবস্থা। অপরদিকে পুঁজিবাদী-সাম্রাজ্যবাদী ব্যবস্থাও জোর জবরদস্তির মধ্যে টিকে আছে। এক্ষেত্রে কোন দার্শনিক দৃষ্টিভঙ্গি আছে, যা পুঁজিবাদী ব্যবস্থার বিকল্প হতে পারে?
প্রশ্ন : ১২। বাংলাদেশের রাজনীতিতে সাম্রাজ্যবাদী এবং ভারতীয় আধিপত্যের প্রভাব কি আপনি স্বীকার করেন? একটি স্বাধীন রাষ্ট্রের অস্তিত্বের হুমকি কি উপরোক্ত সমস্যাদ্বয় নয়? এ থেকে মুক্তির উপায় আপনার মতে কী হতে পারে?
প্রশ্ন : ১৩। বাংলাদেশের বাম রাজনীতিতে অসংখ্য নেতা-কর্মীর আত্নত্যাগের পরও এ দেশে এ রাজনৈতিক ধারা দাঁড়াতে পারছে না কেন? আপনার কাছে কী মনে হয়?
প্রশ্ন : ১৪। আপনি আপনার ‘রাজনীতির পুনর্বিন্যাস’ বইয়ে ‘কমিউনিজম কোন দিন এ দেশে আসবে না’- এভাবে বলেছেন। আপনি ‘কেন’ এবং কী কী কারণে- এভাবে কথাটি বলতে পারলেন?
প্রশ্ন : ১৫। আপনি আপনার ‘রাজনীতির পুনর্বিন্যাস’বইয়ে মস্কোপন্থীদের ‘নিবীর্য শূদ্র-ব্রাহ্মণ সংস্কৃতির এক আধুনিক সংস্করণ’বলেছেন আর পিকিংপন্থীদের এর উল্টোটা বলেছেন। কিন্তু সিপিবি তো আজ পর্যন্ত বামপন্থীদের মধ্যে বড় রাজনৈতিক দল আর পিকিংপন্থীরা ভেঙ্গে ভেঙ্গে প্রায় কাঁচের টুকরা হয়ে গেছেন। তাহলে শেষ পর্যন্ত কারা টিকে থাকবেন?
দ্বিতীয় দফায় মাসুদ রানার আরও ৬ টি প্রশ্ন :
১। একাত্তর সালে আপনি কি যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলেন? যদি করে থাকেন তাহলে যুদ্ধের স্মৃতিচারণ একটু করবেন কি?
২। আপনি শুধু ইসলামকে সব কিছুর প্রতিবন্ধক হিসেবে দেখছেন, তাহলে অন্য ধর্ম কি প্রগতিশীল? দেশের সব জনগণকে ইসলাম মুক্ত করলেই কি সমাধান হয়ে যাবে? আর সব মানুষকে কি ইসলাম মুক্ত করা সম্ভব?
৩। আপনি আপনার পূর্ববর্তী বক্তব্যে “বিকল্প তত্ত্ব নির্মাণ”এর কথা বলেছেন। বিকল্প তত্ত্ব নির্মাণ কীভাবে সম্ভব?
৪। অখণ্ড বঙ্গ রাষ্ট্রের যে ধারণা, সেটি বাস্তবায়ন করতে গেলে তো ভারতকে আগে ভাঙ্গতে হবে। শুধু জাতিরাষ্ট্র হিসেবে একটা রাষ্ট্র গঠন হলেই কি মানুষের মুক্তি আসবে? এটার রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক কাঠামো কেমন হবে?
৫। “মার্কসবাদ মানুষের বুদ্ধিবৃত্তি ও চেতনাকে একটা পর্যায়ে নিবার পর তাকে আটকে দেয়, তার অধিকতর অগ্রসর হবার পথে বাধা সৃষ্টি করে।”- পুঁজিবাদ কি এর চেয়ে ভাল কিছু দিতে পেরেছে?
৬। আপনি আপনার সাক্ষাৎকারের অনেক জায়গায় বিপ্লবী রূপান্তরের কথা বলেছেন। আসলে আপনি বিপ্লব বোঝাতে কী বলতে চেয়েছেন?
অনেক সময় দেয়ার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।
প্রথম দফায় শামসুজ্জোহা মানিক-এর উদ্দেশ্যে মাসুদ রানার প্রশ্ন এবং শামসুজ্জোহা মানিকের উত্তর:
প্রশ্ন : ১। প্রথমে আপনার ছেলেবেলার কথা বলুন। মা-বাবা, পরিবার সম্বন্ধেও বলবেন।
উত্তর : ১। আমার জন্ম ১৯৪২ সালের ২১ সেপ্টেম্বর। আমরা ছিলাম পাঁচ ভাই তিন বোন। আমি ছিলাম সবার বড়। আমার বাবার নাম মোহাম্মদ আবদুল্লাহ্, মায়ের নাম মোসাম্মৎ শামসুন্নাহার। আমার বাবা ছিলেন একজন মাঝারী পর্যায়ের পুলিশ কর্মকর্তা। ডিএসপি হিসাবে কর্মরত অবস্থায় তিনি ১৯৭০ সালে চাকুরী থেকে অবসর গ্রহণ করেন। আমার মা ঢাকার একটি বেসরকারী উচ্চবিদ্যালয়ে ১৯৭২ থেকে ১৯৯৩ পর্যন্ত একটানা ২১ বৎসর সহকারী প্রধান শিক্ষিকার পদে কর্মরত ছিলেন। আমার বাবা মৃত, মা এখনও জীবিত।
সরকারী চাকুরীতে কর্মরত থাকার কারণে আমার বাবাকে বিভিন্ন জায়গায় বদলী হতে হত। সুতরাং পরিবারের সঙ্গে আমাকেও বিভিন্ন জায়গায় যেতে হত। এর ফলে আমাকে বিভিন্ন জিলা এবং এলাকার বিভিন্ন স্কুলে পড়তে হয়েছিল। আমি যশোর জিলা স্কুল থেকে ১৯৬০ সালে ম্যাট্রিক পরীক্ষা পাশ করে ঢাকা কলেজে আইএ-তে (ইন্টারমিডিয়েট অব আর্টস) ভর্তি হই। এর পর ১৯৬২-তে আইএ পাস করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বিএ (অনার্স)-এ ভর্তি হই।
এই হচ্ছে আমার ছেলেবেলার জীবন সম্পর্কে খুব সংক্ষিপ্ত একটা বিবরণ। আমার নিজের ছেলেবেলার বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে আমি নিজেও সহজে বা এক কথায় ব্যাখ্যা করতে পারি না। যেমন ক্লাস ওয়ান থেকে ক্লাস ফাইভ বা পঞ্চম শ্রেণী পর্যন্ত আমি তিনটা জায়গায় ছিলাম। তখন আমি সিরাজগঞ্জ, শাহ্জাদপুর এবং বগুড়া শহর এই তিন জায়গায় ছিলাম। এই সময় আমি ঘুরে বেড়াতে খুব পছন্দ করতাম। সিরাজগঞ্জে আমি খুব ছোট। একটু বড় হয়ে সেখানে ক্লাস ওয়ানে ভর্তি হই। শাহজাদপুরে থাকা অবস্থায় আমি ক্লাস টুতে পড়ি। বগুড়ায় ক্লাস থ্রি, ফোর এবং ফাইভে পড়ি। শাহজাদপুর এবং বগুড়ায় থাকা অবস্থায় আমি পথে পথে ঘুরে বেড়াতে খুব পছন্দ করতাম। এই সময়ে ছেলেদের সঙ্গে কিছু মেলামেশা করলেও সেটা বেশী না। বেশীর ভাগ সময় আমি একা ঘুরে বেড়াতে পছন্দ করতাম। এইসব জায়গায় তখন প্রচুর খোলা মাঠ, বন, গাছপালা ছিল। সেসব জায়গায় একা একা ঘুরতাম। আর ভাল লাগত নদীর পাড়ে ঘুরে বেড়াতে। ছিপ দিয়ে কখনও মাছ ধরার চেষ্টা করতাম। তবে সফল কমই হতাম। আর অপরিমেয় আনন্দ পেতাম পাখী দেখে। এই সময়ের সেইসব মাঠ, বন, গাছগাছালি, পাখী, নদী আর খাল-বিলের স্মৃতি আমাকে আজও আলোড়িত করে।
রাজশাহীতে গিয়ে ক্লাস সিক্সে ভর্তি হলাম। সেখানে গিয়ে আমি বাইরে খেলা এবং ঘুরে বেড়ানো বন্ধ করলাম। সেখানকার পরিবেশ ভাল ছিল না বা আমার কাছে ভাল লাগত না। বাইরের ছেলেদের সঙ্গে মিলামিশা বন্ধ করে দিই। ফলে স্কুলে যাওয়া ছাড়া বাইরে কম যেতাম। তবে বাজার করতে যেতে হত। এছাড়া ঘরে বসে সময় কাটাতাম। আমি ছেলেবেলা থেকে পড়তে খুব পছন্দ করতাম। হাতের কাছে বাংলায় লেখা যে বই পেতাম বুঝি না বুঝি তা পড়তাম। দেশ বা পৃথিবীর খবরাখবর জানবার আগ্রহও ছিল। যে কারণে ক্লাস থ্রিতে যখন পড়তাম তখন থেকেই সংবাদপত্র পড়তে শুরু করি। বাসায় দৈনিক সংবাদপত্র রাখা হত। মনে আছে তখন বাংলা দৈনিক আজাদ ছিল জনপ্রিয়। আমাদের বাসায়ও এটা রাখা হত। আমি সেটা পড়তাম।
রাজশাহী শহরে যাবার পর ক্লাস সিক্সে ভর্তি হবার পর স্কুল ছাড়া বাইরে যাওয়া খুব কমিয়ে দেওয়া এবং সমবয়সীদের সঙ্গে মিলামিশা বন্ধ করার ফলে আমি লেখাপড়ার দিকে আরও ঝুঁকে পড়ি। গল্প-উপন্যাস যা পড়তাম সেগুলি নিয়ে আমার মায়ের সাথে মতবিনিময় করতাম। কারণ তিনিও প্রচুর পড়তেন। এবং তিনি ছিলেন ভাবুক। সংসার জীবনে প্রচণ্ড পরিশ্রমী ও উদ্যমী হলেও তার ছিল বিস্ময়কর কল্পনাশক্তি, চিন্তাশীলতা এবং আদর্শবোধ।
পড়ার টানে সেভেন, এইটে পড়ার সময় আমি রাজশাহী পাবলিক লাইব্রেরীতে যাওয়া শুরু করি। বলা যায় ক্লাস সিক্স-সেভেনের ছাত্র জীবন থেকেই আমার মধ্যে বিরাট পরিবর্তন ঘটতে শুরু করে। আমি জীবন, পৃথিবী, প্রকৃতি এসব নিয়ে গভীরভাবে ভাবতে শুরু করি। ফলে আমার সহপাঠী এবং সমবয়সীদের থেকে আমার অনেক দূরত্ব তৈরী হয়। আমি আগে যেটুকু বহির্মুখী ছিলাম সেটুকুরও অবসান হয় এবং অনেক বেশী অন্তর্মুখী হয়ে পড়ি। বিশেষ করে আমার চিন্তা, চেতনা এবং চরিত্রে আমার মায়ের প্রভাব এই সময় থেকে অনেক বেশী গভীর হয়ে পড়ে।
প্রশ্ন : ২। আপনি কিভাবে রাজনীতির সাথে যুক্ত হলেন?
উত্তর : ২। আমি যখন রাজশাহী কলেজিয়েট স্কুলে অষ্টম শ্রেণীতে পড়ি তখন আমি কমিউনিজম ও সমাজতন্ত্র দ্বারা প্রভাবিত হই। ছেলেবেলা থেকে আমি যুক্তিবাদী ছিলাম। যুক্তিবাদ আমাকে প্রথমে লোকবাদী এবং নিরীশ্বরবাদী বিশ্বদৃষ্টির অধিকারী করে। ক্লাস এইটে পড়ার সময়ে তর্ক-বিতর্ক এবং আলোচনার মাধ্যমে প্রথমে অলৌকিকতা ও ঈশ্বর বা আল্লাহর অস্তিত্বহীনতা সম্পর্কে নিঃসংশয় হই। এর আগে সাম্যের দর্শন হিসাবে কমিউনিজমকে পছন্দ করলেও তার নিরীশ্বরবাদ বা লোকবাদী দর্শনের কারণে তাকে আমি গ্রহণ করতাম না। কিন্তু দার্শনিকভাবে নিরীশ্বরবাদকে গ্রহণ করার পর আমি নিরীশ্বরবাদী দর্শন হিসাবে কমিউনিজমকে আমার আদর্শ হিসাবে গ্রহণ করে নিই। বিদ্যমান সমাজের অন্যায়, অবিচার, বৈষম্য ও অনৈতিকতা ইত্যাদির বিরুদ্ধে আমার ভিতরে ক্রমবর্ধমান অসন্তোষ ও ঘৃণা এর ফলে গতিশীলতার বা আত্মপ্রকাশের একটা পথ পেল।
এই সময় আমি তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়নের সঙ্গে যুক্ত হই। প্রথমে তার স্থানীয় নেতাদের সঙ্গে আমার মতবিনিময় হত। আমি তাদের খুব স্নেহ ও মনোযোগের পাত্র হয়েছিলাম। তাদের কারও কারও সঙ্গে আমার এক ধরনের ঘনিষ্ঠতাও জন্মে। এই সময় একই সঙ্গে আমার চেতনায় যে বিরাট বিপ্লব ঘটে সেটা হচ্ছে ইসলামী পরিচয়ের ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত রাষ্ট্র পাকিস্তানের পরিবর্তে ধর্মপরিচয় মুক্ত এবং বাঙ্গালী জাতি পরিচয় ভিত্তিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার যৌক্তিকতা উপলব্ধি। যে মুহূর্তে আমি অলোকবাদী ধর্মবিশ্বাস থেকে মুক্ত হই সেই মুহূর্ত থেকে আমার মধ্যে এই ধারণা প্রবল হয় যে, ১৯৪৭-এ অলোকবাদী ধর্মীয় পরিচয়ের ভিত্তিতে বাঙ্গালী জাতির বিভক্তি বাঙ্গালীর জন্য ভয়ানক ক্ষতির কারণ হয়েছে। এর পর থেকে আমি একটি স্বাধীন রাষ্ট্রে বাঙ্গালী জাতির পুনরেকত্রীকরণকে যৌক্তিক করণীয় হিসাবে দেখতে পাই। এর জন্য প্রথম পর্যায়ে তৎকালীন পূর্ব বঙ্গ বা পূর্ব পাকিস্তানের স্বাধীনতা ও পরবর্তী পর্যায়ে পশ্চিম বঙ্গেরও স্বাধীনতা এবং অতঃপর স্বেচ্ছাসম্মতির ভিত্তিতে উভয় বঙ্গের পুনরেকত্রীকরণকে আমি আমাদের করণীয় হিসাবে দেখতে পাই।
তবে আমার চেতনায় স্বাধীন পূর্ব বঙ্গ এবং স্বাধীন যুক্তবঙ্গ উভয়ই ছিল সমাজতান্ত্রিক। অষ্টম শ্রেণীতে অধ্যয়নরত অবস্থায় আমি প্রবল উদ্যমে আমার এইসব চিন্তা নিয়ে আলোচনা এবং বিতর্ক শুরু করি। এটা উল্লেখ করা চিত্তাকর্ষক হবে যে, আমার এইসব আলোচনা এবং বিতর্কে যাদের সঙ্গে আমি জড়াতাম তারা ছিলেন প্রধানত তৎকালীন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজের ছাত্র ইউনিয়নের নেতা এবং কর্মীরা, যারা সকলে ছিলেন আমার অনেক জ্যেষ্ঠ বা সিনিয়র।
এরপর আমি ১৯৫৮ সালে রাজশাহী কলেজিয়েট স্কুলে নবম শ্রেণীতে উঠি। সেই বৎসর পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়নের জিলা সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। সেখানে আমাকে ছাত্র ইউনিয়নের রাজশাহী জিলা কমিটির সদস্য নির্বাচিত করা হয়। যতদূর মনে আছে আমি ছিলাম জিলা কমিটির সর্বকনিষ্ঠ সদস্য। স্কুলে যাওয়া এবং ক্লাসের পড়ার বাইরে আমার কাজ ছিল প্রধানত লাইব্রেরীতে পড়া আর সিনিয়র নেতা-বন্ধুদের সঙ্গে আলোচনা-তর্ক করা আর কখনও রাস্তায় ঘুরা বা হাঁটাহাঁটি করা। নিজের সহপাঠীদের সঙ্গে খুব কমই সিরিয়াস বিষয়গুলি নিয়ে কথা হত। তারা উৎসাহ পেত না বলে আমিও উৎসাহ পেতাম না। ১৯৫৮-এর অক্টোবরে আইয়ুবের সামরিক আইন জারীর পর সর্বত্র ত্রাস চলছিল। ফলে আমার ঘুরাফিরা করা এবং আড্ডা দিবার সুযোগও কমে যায়। তবু নির্দিষ্ট অল্প কয়েক জনের সঙ্গে যোগাযোগ থাকে।
এই অবস্থার পরিবর্তন হয় আমার বাবা যশোর শহরে বদলী হয়ে যাবার পর। সেখানে আমি ১৯৫৯ সালে যশোর জিলা স্কুলে দশম শ্রেণীতে ভর্তি হই। সেখানে সিনিয়র বা জ্যেষ্ঠ লোকজন প্রায় কাউকে পাই নাই যার বা যাদের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রাখতে পারি। রাজশাহী থেকে যশোরে আসবার আগে একজনের যোগসূত্র নিয়ে এলেও তিনি অল্পদিন পরে যশোর থেকে খুলনায় চলে যান। যোগাযোগ করার মত আর কেউ ছিল না। ফলে আমি এখানে এসে সম্পূর্ণ মনোযোগ দিলাম আমার সহপাঠীদের দিকে। তাদের মধ্যে আমার লোকবাদী, জাতীয়তাবাদী এবং সমাজতান্ত্রিক ও কমিউনিস্ট রাজনীতি প্রচার করতে শুরু করি। এখানে আমি অভূতপূর্ব সাড়া পাই। তবে প্রথমেই যে সমর্থন পেতাম তা নয়। তবে তর্ক-বিতর্কের একটা পর্যায়ে আমি সমর্থন পেতে শুরু করি। এখানে আমি আমজাদ হোসেন ও খালেদুর রহমান টিটোর সঙ্গে আরও কিছুসংখ্যক কিশোরকে আমার চিন্তার সমর্থক হিসাবে পাই। এরা আমার সহপাঠী ছিল। এর বাইরেও আমি আমার চিন্তার সমর্থক অথবা সহযাত্রী হিসাবে অনেককে পাই।
যশোরের অন্তত একটা বৎসর ছিল আমার জীবনের এক শ্রেষ্ঠ সময়। সেখানে আগে থেকে সমাজতান্ত্রিক ও কমিউনিস্ট রাজনীতির একটা প্রভাব থাকায় আমি একটা অনুকূল পরিবেশ পেয়েছিলাম। কিন্তু সামরিক আইনের দরুন রাজনীতি নিষিদ্ধ থাকায় ঐ সময় আমার সকল রাজনৈতিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক কর্মকাণ্ড ছিল মূলত স্বাধীন। আমাদের প্রজন্মের মধ্যে তখন সেখানে আমি নেতা ও উদ্যোক্তা। এবং সেই সঙ্গে আমি প্রচণ্ড রকম পড়ুয়া। বই কেনার অভ্যাস অনেক অল্প বয়স থেকেই ছিল। টিফিন বা হাত খরচের জন্য যে সামান্য কিছু টাকা পেতাম (আমার বাবা ঘুষখোর অফিসার না হওয়ায় ছেলেবেলা থেকে আমরা টানাটানির মধ্য দিয়ে বড় হই) তা দিয়ে সাধারণত প্রতি মাসেই কিছু না কিছু বই কিনতাম।
যশোরের পাবলিক লাইব্রেরী ছিল সমৃদ্ধ। সেখানে তো নিয়মিতভাবে যেতামই এছাড়া বইয়ের সন্ধানে ঘুরে বেড়াতাম বিভিন্ন জায়গায়। পড়ার জন্য একটা বই পাওয়া ছিল গুপ্তধনের সন্ধান পাবার মত আনন্দের ও রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতার বিষয়। সামরিক শাসনের কারণে রাজনীতি বিশেষ করে কমিউনিস্ট রাজনীতির উপর বই পাওয়া তখন খুবই কঠিন ছিল। ইতিহাস, দর্শন, রাজনীতি, গল্প-উপন্যাস-কবিতা, ভ্রমণকাহিনী যা পেতাম গোগ্রাসে গিলতাম এবং সেগুলা নিয়ে আমার বন্ধুদের সঙ্গে আলোচনা করার চেষ্টা করতাম। এ ক্ষেত্রে আমি আমার বিশেষ বন্ধু হিসাবে পাই আমজাদ হোসেনকে। তবে বলতে দ্বিধা নাই যে, প্রায় সর্বত্র আমি হতাম বক্তা এবং অন্যরা সাধারণত শ্রোতা, কিছু ক্ষেত্রে মন্তব্যকারী মাত্র। আজ এ কথা বলা যায় যে, আমার চিন্তা বা পাঠের বিষয়গুলিকে সেভাবে ভাগাভাগি করে নিতে পারার মত মানুষের অভাব আমাকে পীড়া দিত, যা পরবর্তী কালে আমাকে মনের ভিতরে খুব একাকী মানুষে পরিণত করেছিল। এর ফলে রাজনীতির প্রয়োজনে বহু মানুষের সঙ্গে চলাফিরা করলেও বহু মানুষের ভীড়ে আমি ছিলাম একা।
যশোর জিলা স্কুল থেকে ম্যাট্রিক পাস করি ১৯৬০ সালে এবং সেই বৎসর আমি ঢাকা কলেজে আইএ-তে ভর্তি হই। এখানে এসে হোস্টেলে সিট নিই। এভাবে আমি পরিবারের বাইরে চলে আসি। ঢাকা কলেজ থেকে আমার জীবনের আরেক অধ্যায় শুরু হয়। সারা দেশ থেকে তখন সেরা ছাত্ররা ঢাকা কলেজে আসত। স্বাভাবিকভাবে সেখানে প্রায় সবাই আত্মোন্নতি করার বা কেরিয়ার গড়ার কথাই ভাবত। ততদিনে সমাজ পরিবর্তন বা বিপ্লবের সংকল্প আমার মধ্যে দৃঢ়বদ্ধ হয়েছিল। সেই লক্ষ্যে বিশেষ করে কলেজ হোস্টেলে আমার বন্ধুদের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা শুরু করি। ঢাকা কলেজের জীবন আমার জন্য ভয়ানক নিঃসঙ্গতার। তবু ২/৪ জনকে সমর্থক হিসাবে পাই। এদেরকে নিয়ে আমি যে হোস্টেলে ছিলাম সেই উত্তর হোস্টেলে হাতে লিখা একটা পাক্ষিক দেওয়াল পত্রিকা প্রকাশের উদ্যোগ নিই। এটি মোটামুটি নিয়মিতভাবে বের হত। এর সুফল ১৯৬২ সালে আইয়ুব-বিরোধী ছাত্র আন্দোলনে পাই। ঢাকা কলেজ থেকে একটা গোষ্ঠী বের হয়ে আসে, যারা ১৯৬২ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়ে ছাত্র ইউনিয়নের রাজনীতির বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।
তবে একটু আগেই যে কথা বলেছি ঢাকা কলেজের জীবন আমার জন্য ছিল ভয়ঙ্কর একাকীত্বের। যশোরে ক্লাস টেনে পড়ার সময় যেমন আমার চিন্তাগুলা নিয়ে বলার বা আলোচনা করার জন্য কিছু সংখ্যক সমবয়সী কিশোরকে পেয়েছিলাম এখানে সেই পর্যায়ের ঠিক কাউকে পাই নাই। এই একাকীত্বের হাত থেকে বাঁচবার জন্য আমার সাধারণত দুইটা অবলম্বন ছিল। এক, কলেজের ক্লাসের পর পাবলিক লাইব্রেরীতে যাওয়া, দুই, রাস্তায় রাস্তায় ঘণ্টার পর ঘণ্টা ঘুরে বেড়ানো। বিভিন্ন চিন্তায় মগ্ন থেকে আমি পথ হাঁটতাম। আমার এই হাঁটা বা ঘুরে বেড়ানোর মত উদ্ভট খেয়ালের সাথী খুব কমই পেতাম। পুরাতন ঢাকার সরু পথ ও গলিপথগুলিতে হাঁটবার সময় আমি কল্পনার পৃথিবীতে বিচরণ করতাম। কখনও মনে হত আমি যেন প্রাচীন কোনও নগরের পথে দূর দেশীর মত ঘুরে বেড়াচ্ছি। সেটা কখনও মধ্যযুগের দিল্লী, কখনও আরও প্রাচীন উজ্জয়িনী বা পাটলীপুত্র হয়ে উঠত আমার কল্পনায়। অনেক সময়ই একটা ঘোরের মধ্যে যেন ঘণ্টার পর ঘণ্টা পুরাতন ঢাকার পথে পথে ঘুরে বেড়াতাম। আবার কখনও সেই সময়কার শহরের পথ ছাড়িয়ে আরও অনেক দূরে গ্রামের পথে চলে যেতাম। ঢাকা ছিল তখন ছোট একটা নগর। প্রায় চারপাশে খুব কাছেই ছিল গ্রাম।
এভাবে প্রায় ক্ষেত্রেই একা একা ঘুরে বেড়ানো ছিল আমার কলেজ জীবনে এক অপরিমেয় আনন্দের উৎস। আর যে কথা বলেছি আমার অন্যতম গন্তব্য ছিল পাবলিক লাইব্রেরী। অনেক সময়ই লাইব্রেরী থেকে বেরিয়ে একা ঘুরে বেড়াতাম। আমার এভাবে ভবঘুরের মত ঘুরে বেড়ানো কিছুটা কমে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হবার পর। কারণ সেখানে আমার একাকীত্ব কমে রাজনীতি নিয়ে ব্যস্ততার ফলে। লাইব্রেরীতে পড়তে যেতাম তবে সেটাও কমে ব্যস্ততার ফলে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আমাকে যেমন বৃহত্তর পরিসরের সন্ধান দেয় তেমন আমার জীবনকে দেয় নূতন ও প্রবল গতিশীলতা। আমি যেন একটা ছোট ডোবা থেকে প্রমত্ত ও বিশাল নদীতে এসে পড়লাম।
প্রশ্ন : ৩। আপনার বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের কথা, শিক্ষকদের কথা এবং রাজনীতির কথা বলুন।
উত্তর : ৩। ১৯৬২-তে আমি ঢাকা কলেজ থেকে আইএ-তে উত্তীর্ণ হয়ে এসএম হলের আবাসিক ছাত্র হিসাবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হই। বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের সঙ্গে আমার রাজনীতির যে আলাদাভাবে কোন সম্পর্ক নাই সেটা আশা করি আমার পূর্বেকার কথাতেই স্পষ্ট হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির অনেক পূর্ব থেকেই আমি রাজনীতি করি। ১৯৫৭ সালে সেই অষ্টম শ্রেণীতে অধ্যয়নরত অবস্থা থেকেই। বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির পর আমার রাজনৈতিক জীবন নূতন পর্যায় ও গতি পায় মাত্র। এই সময়ে আমার চিন্তাতেও বড় ধরনের পরিবর্তন ঘটে, যা সেকালে অপ্রকাশ্য ছিল। কারণ সেসব নিয়ে সে কালে আলোচনার অবকাশ ছিল না। আমি মার্কসবাদ ও কমিউনিজমে বিশ্বাস করলেও সেটা অন্ধ তো ছিলই না, বরং সেটা ছিল শর্ত সাপেক্ষ। এবং কিছু বিষয়ে আমার সন্দেহ ও দ্বিমত ছিল। যেমন ক্লাস টেনে যখন পড়তাম তখন এঙ্গেলসের ‘পরিবার, ব্যক্তিগত সম্পত্তি ও রাষ্ট্রের উৎপত্তি’ পড়ে আমার মনে হয়েছিল তিনি ইতিহাসের স্তরবিন্যাস যেভাবে করেছেন সেটা ইউরোপ সম্পর্কে প্রযোজ্য হলেও ভারতবর্ষ সম্পর্কে প্রযোজ্য নয়। অর্থাৎ এটা সর্বজনীন নয়। ম্যাট্রিক পরীক্ষা দিবার পর বইটা পড়ে শেষ করি। এরপর এ সম্পর্কে আমি আমার তৎকালীন সহপাঠী-বন্ধু আমজাদকে আমার মন্তব্য জানাই। আমার বক্তব্য ছিল ভারতবর্ষে ইরোপের মত দাস প্রথার উদ্ভব হয় নাই। এখানে একটা ভিন্ন ধরনের শ্রম-কর্ম ভিত্তিক শ্রেণী বিভাজনের ব্যবস্থা গড়ে উঠেছিল যেটা জাতিভেদ হিসাবে পরিচিত। এটা আবার পৃথিবীর অন্য কোথায়ও ছিল না। এ ছাড়া আমি স্ট্যালিনকে ক্রমে অপছন্দ করতে শুরু করি। বিশেষত বিপ্লবের নেতা ও সহকর্মীদেরকে তিনি যেভাবে হত্যা করেন সেটার জন্য আমার মনে তার জন্য গ্রহণযোগ্যতা ছিল না। বিশ্ববিদ্যালয়ে যখন পড়তাম তখন আমি সোভিয়েত ইউনিয়নের রাষ্ট্রকে আমলাতান্ত্রিক মনে করতাম।
বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হবার পর আমার লেখাপড়া ও আলাপ-আলোচনার বর্ধিত পরিবেশ আমার চিন্তায় বিরাট উত্তরণ ঘটায়। এই সময় কমিউনিজম বা সাম্যবাদকে অবাস্তব কল্পনা বা ইউটোপিয়া মনে হয়। দ্বন্দ্বহীন বা শ্রেণী দ্বন্দ্বহীন সমাজের যে চিত্র কমিউনিজম এঁকেছে সেটাকে বাস্তবতা বর্জিত মনে হল। মার্কসীয় দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদের সূত্র অনুযায়ীও এটাকে ভ্রান্ত মনে হল। অর্থাৎ এখানে মার্কসবাদকে স্ববিরোধী মনে হল। আমার মনে হল সমাজে দ্বন্দ্বের রূপ পরিবর্তন হবে, কিন্তু তার নিরসন কোনদিন হবে না। সুতরাং লক্ষ্য নির্ধারণে মার্কস-এঙ্গেল্স ভ্রান্ত বলে আমার মনে হল। তা সত্ত্বেও আমি মার্কসবাদকে পরিত্যাগ করি নাই। বরং এটাকে তখনও আমি সমাজ বিপ্লবের বিজ্ঞান মনে করতাম। যেহেতু বিজ্ঞান সেহেতু মনে করতাম যে এর বহু কিছু বর্জন বা পরিবর্তন করা যেতে পারে। সবচেয়ে বড় কথা মার্কসবাদকে আমাদের সমাজের বিপ্লবের জন্য হাতিয়ার হিসাবে নিয়েছিলাম। আমার মনে হয়েছিল এর চেয়ে ভাল কোন হাতিয়ার আমাদের সামনে নাই। বিশেষত সাম্রাজ্যবাদ, সাম্রাজ্যবাদের অধীনস্থ তথা মুৎসুদ্দি পুঁজিবাদ এবং অলোকবাদী ধর্মের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের জন্য আমি মার্কসবাদ ও কমিউনিজমের গুরুত্ব অনুভব করতাম এবং সেই সঙ্গে বিপ্লবের পর্যায় হিসাবে আমি সমাজতন্ত্রের অপরিহার্যতা দেখতে পেতাম।
তবে সেকালে আমার এইসব সংশয় এবং জিজ্ঞাসা আমি খুব কমই আলোচনা করতাম। আমার তৎকালীন ঘনিষ্ঠ রাজনৈতিক বন্ধু আমজাদের সঙ্গেও এসব নিয়ে সাধারণত কোনও আলোচনা করতাম না। আমজাদ এসব আলোচনায় উৎসাহী যেমন ছিল না তেমন কোনও মন্তব্যও করত না বা মতামত দিত না। যাইহোক, এসব আলোচনা যে শুধু অর্থহীন তা-ই নয়, অধিকন্তু যে ক্ষতিকরও সেটা মনে করতাম। কারণ এসব প্রশ্ন তুলবার অর্থ হচ্ছে নিজেকে বিচ্ছিন্ন করা অথবা কর্মীদেরকে হতাশ করা এবং বিপ্লবী রাজনীতি বিমুখ করা। মনে করতাম বিপ্লবী আন্দোলন গড়ে তুলতে পারলে তার অভিজ্ঞতা থেকে আমাদের দেশের বিপ্লবের সঠিক তত্ত্ব ও পথ বেরিয়ে আসবে। তার পূর্বে আমার কাজ হচ্ছে কাজ করে যাওয়া। সুতরাং কাজ করতাম। কী পরিমাণে কাজ করতাম সেটা সে কালে আমাকে যারা জানতেন তারা জানেন।
মনের ভিতরে অনেক সংশয় এবং ভিন্নমত বা সমালোচনা থাকলেও সেকালে আমাদের দেশের বাস্তবতায় সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের জন্য মার্কসবাদের গুরুত্ব আছে বলে আমার কাছে মনে হত। অন্তত আমাদের সমাজের বাস্তবতায় মার্কসবাদকে সৃজনশীলভাবে প্রয়োগের চেষ্টা করতাম। আমাদের দেশ ও সমাজের বাস্তবতায় যে মার্কসবাদের সৃজনশীল প্রয়োগ সম্ভব নয় সেটা অনেক অভিজ্ঞতায় বুঝেছিলাম, যে কারণে ১৯৭২ সালের শুরুর দিকেই কমিউনিস্ট রাজনীতি পরিত্যাগ করি। তবে আমাদের সমাজে মার্কসবাদের সমস্যা কোথায় এবং মার্কসবাদের ভ্রান্তিগুলি ঠিক কোথায় এবং কীভাবে এবং আমাদের দেশ ও সমাজে বিপ্লবের সমস্যাগুলি কী এবং বিপ্লবের বিকল্প পথ কী হতে পারে সেসব বুঝতে আমার অনেক সময় লেগেছে। শুধু অধ্যয়ন দিয়ে আমি সেসব বুঝি নাই, এর জন্য আমাকে অনেক সংগ্রাম ও পরীক্ষা-নিরীক্ষার অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে আসতে হয়েছে।
বিশ্ববিদ্যালয়ে বিএ (অনার্স) প্রথম বর্ষ কি দ্বিতীয় বর্ষে পড়ার সময় একদিন বিকালে তৎকালীন রেসকোর্সের (এখনকার সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) উত্তর পাশের রাস্তা দিয়ে হাঁটবার সময় কমিউনিজম প্রসঙ্গে আমজাদকে বলেছিলাম যে কমিউনিজম কোনদিন হবে না। এ প্রসঙ্গে আমার লিখা গ্রন্থ ‘রাজনীতির পুনর্বিন্যাস'-এ (অষ্টম অধ্যায়, পৃঃ ১৩৬, ব-দ্বীপ প্রকাশন, প্রকাশ- এপ্রিল ২০০২) স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে যে কথা লিখেছি সেটা এখানে উদ্ধৃত করি : ‘আমার সে কালের ঘনিষ্ঠ রাজনৈতিক বন্ধু আমজাদ হোসেনকে বিশ্ববিদ্যালয়ে অনার্সের প্রথম কি দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র থাকাকালীন অবস্থায় একদিন বলেছিলাম যে, কমিউনিজম আমাদের আজকের দ্বন্দ্ব, সঙ্কট ও দুঃখ থেকে মুক্তির পথে এগিয়ে যাবার জন্য একটা দিক চিহ্ন মাত্র, তার বেশী কিছু নয় এবং কমিউনিজম কোন দিন আসবে না। কারণ সমাজে দ্বন্দ্বের রূপ বদলাবে, কিন্তু মানুষের সঙ্গে মানুষের দ্বন্দ্ব চিরকাল থাকবে। ফলে দ্বন্দ্বমুক্ত কমিউনিস্ট সমাজ একটা কল্পনা মাত্র। তবু এর প্রয়োজন আছে আজকের দ্বন্দ্ব থেকে মুক্তির জন্য। আমার কথাটা ছিল প্রাচীন কালের জাহাজের নাবিক যেমন অকূল সাগরে রাতের আঁধারে দিক ঠিক করার জন্য ধ্রুব তারার সাহায্য নিত, কমিউনিজমও ঠিক তেমন ধ্রুব তারার মত যা আমাদের নিজেদের পথটা চিনতে সাহায্য করে মাত্র। আমজাদকে কবিতার মত করে বলা আমার সেদিনের শেষ কথাটা চিরকাল আমার মনের গভীরে গানের সুরের মত বেজেছে, হয়তো বা সেটা বিষাদের সুর, ''ধ্রুবকে যেমন পাওয়া যায় না, কমিউনিজমকেও তেমন পাওয়া যাবে না।
যে তত্ত্ব বা মতবাদ নিয়ে সে কালে আমি বিপ্লবের রাজনীতি করেছিলাম তা নিয়েই যে শুধু আমার ভিতর জিজ্ঞাসা এবং সন্দেহ ছিল তা-ই নয়, উপরন্তু যারা আমাদের নেতা ছিল আমাদের সমাজ, জাতি ও দেশের জন্য অনুপযোগী তত্ত্বের কারণে তাদের বিভ্রান্ত কর্মনীতি ও কর্মকাণ্ডও এই মতবাদের প্রতি আমার অনাস্থাকে আরও বৃদ্ধি করেছিল। তা সত্ত্বেও বিপ্লবের প্রবল আর্তি আমার ভিতর ছিল। যে কারণে এত দ্বিধা, ভিন্নমত ও সংশয় নিয়েও ’৭২-এর প্রথম দিক পর্যন্ত আমি কমিউনিস্ট রাজনীতি করি এবং ১৯৬৬-তে গ্রামে কৃষক আন্দোলন করতে যাওয়ার পর থেকে ১৯৭২-এর প্রথম দিক পর্যন্ত প্রায় ছয় বৎসর সময় সার্বক্ষণিক কর্মী হিসাবে কাজ করি।
বিশ্ববিদ্যালয় বলে কথা নয়, বরং সমস্ত ছাত্র জীবনে আমি এমন কোনও শিক্ষকের সংস্পর্শে আসি নাই যার উল্লেখ করার মত প্রভাব আমার উপর পড়েছিল। স্কুল জীবনে বাবার কর্মস্থলের বদলীর ফলে ঘন ঘন স্কুল বদলানোর কারণে হয়ত কোনও শিক্ষকের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে উঠে নাই। কোন কোন শিক্ষককে বেশী পছন্দ বা শ্রদ্ধা করতাম তাদের আচরণ এবং পড়াবার গুণের কারণে। এই পর্যন্ত। কলেজের শিক্ষদের সঙ্গে দূরত্ব আরও অনেক বেশী ছিল। তাদেরকে অনেক দূরের এবং অপরিচিত মানুষ মনে হত। একমাত্র আমাদের বাংলার শিক্ষক প্রখ্যাত কথাসাহিত্যিক শওকত ওসমানের ক্লাস করতে আমি খুব আনন্দ পেতাম। তিনি গতানুগতিক পাঠের মধ্যে সীমিত না থেকে ক্লাসে ইতিহাস, সমাজ ইত্যাদি ব্যাপ্ত পরিসরে এমন সব বিষয় ব্যাখ্যা বা আলোচনা করতেন যার সঙ্গে পাঠ্যপুস্তকের আপাতদৃষ্টিতে কোন সম্পর্ক থাকত না। আর এই কারণে তিনি ছিলেন আমার খুব প্রিয় একজন শিক্ষক, যার ক্লাস করার জন্য আমি উদগ্রীব হয়ে থাকতাম। অথচ সাধারণ ছাত্ররা এই একই কারণে তাকে পছন্দ করত না। মনে করত তিনি না পড়িয়ে ক্লাসে এসে শুধু গল্প করেন, যার অনেক কিছুই আবার তাদের কাছে ছিল দুর্বোধ্য। যাইহোক, শওকত ওসমান স্যারকে শিক্ষক হিসাবে আমি পছন্দ করলেও তার কাছে কোনদিন যাই নাই বা ব্যক্তিগত সম্পর্ক গড়ার চেষ্টা করি নাই।
বিশ্ববিদ্যালয়ে কোন কোন শিক্ষককে শিক্ষকতার ক্ষমতার কারণে শ্রদ্ধা বা পছন্দ করলেও কোনও শিক্ষকের সঙ্গে নৈকট্য গড়ে উঠে নাই। আমার কাজ ছিল ক্লাস করা, লাইব্রেরীতে গিয়ে পড়া, ছাত্র রাজনীতি করা আর মাঝে মাঝে রাস্তায় রাস্তায় একা ঘুরে বেড়ানো। রাজনীতি নিয়ে ব্যস্ততা এতই ছিল যে, ক্লাসেও নিয়মিত উপস্থিত হতাম না। আসলে বিদ্যমান সমাজে আমি আমার জায়গা গড়তে চাই নাই বলে প্রচুর পড়াশুনা করলেও একাডেমিক পড়ার প্রতি মনোযোগী ছিলাম না। মনে করতাম বিপ্লবের জন্য আমার একটা সামাজিক স্বীকৃতি বা প্রতিষ্ঠা লাগবে। আর তার জন্য আমার লাগবে একটা মোটামুটি ভাল ডিগ্রী। আমার বিবেচনায় তখনও সেটা ছিল অনার্স গ্র্যাজুয়েশন। যাইহোক, মনস্তাত্ত্বিক ও ব্যবহারিক ভাবে আমি এই সমাজ থেকে অনেক দূরবর্তী মানুষ হিসাবে বেড়ে উঠেছিলাম। ফলে রাজনীতির বাইরে সেকালে আমার ব্যক্তিগত কোনও বন্ধু ছিল না বলাই সঙ্গত। রাজনীতিতেও চিন্তা ও অনুভবের জায়গায় আমি যে খুব একা মানুষ ছিলাম সে কথা বোধ হয় আমার কথা থেকে স্পষ্ট হয়েছে। অনেকের কাছে রাজনীতি, বিপ্লব, মানুষ, জীবন ইত্যাদি বিষয়ক প্রশ্নের উত্তর যেমন সহজ দেখতাম আমার কাছে তেমনটা ছিল না।
আমার কাছে এ দেশে বিপ্লবের প্রশ্ন এত গুরুত্বপূর্ণ ছিল যে নিজের ব্যক্তিগত নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠার গুরুত্ব বা তাড়না কিছুই অনুভব করতাম না। এই কারণে ১৯৬৪ সালের শেষ দিকে অবিভক্ত পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদকের পদ নিতে আমাকে প্রস্তাব দেওয়া হলেও আমি সেটা গ্রহণ করি নাই। প্রস্তাবটা এসেছিল কাজী জাফর আহমদের কাছ থেকে। তবে এটা ছিল মোহাম্মদ ফরহাদ ও তার যৌথ প্রস্তাব। এ বিষয়ে ‘রাজনীতির পুনর্বিন্যাসꞌ-এর পঞ্চম অধ্যায়ে আমি বলেছি।
আসলে আমি বুঝতাম যে, বিপ্লবের অনেক প্রশ্নের উত্তর আমার জানা নাই। অন্যদের যে সেটা জানা আছে সেটাও মনে করতাম না। তৎকালে এ দেশের নেতৃত্ব যে কর্মনীতি অনুসরণ করত তার প্রতি আমার আস্থা ছিল না। আমি সশস্ত্র বিপ্লবের রাজনীতিতে বিশ্বাস করতাম। সুতরাং ১৯৬২-’৬৩ থেকে বিপ্লবের প্রশ্নে চীন-সোভিয়েত দ্বন্দ্ব আমাদের কাছে প্রকাশিত হতে থাকলে আমি চীনকে সঠিক মনে করি। আমাদের দেশে কমিউনিস্ট রাজনীতির উপর এই দ্বন্দ্বের প্রবল প্রভাব পড়ে। যারা শান্তিপূর্ণ উপায়ে সমাজতন্ত্রে উত্তরণের রাজনীতিকে সঠিক মনে করল তারা মস্কোপন্থী হিসাবে পরিচিত হল। আর সশস্ত্র পথে যারা সমাজতন্ত্রে উত্তরণের পথকে গ্রহণ করল তারা পিকিংপন্থী বা চীনপন্থী হিসাবে পরিচিত হল। এ দেশে বিশেষ করে বামপন্থী ছাত্র ও গণ-রাজনীতিতে পিকিংপন্থীরা অনেক বেশী শক্তিশালী হল। সে কালে এ দেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় বামপন্থী জননেতা মওলানা ভাসানী নিজেও এদের সঙ্গে ঐক্য করলেন বা এদের প্রতি তার সমর্থন দিলেন।
১৯৬৫-’৬৬ থেকে এই বিভাজন আমাদের দেশে জোরদার হতে থাকে। সশস্ত্র বিপ্লবের প্রতি সমর্থনের কারণে আমি ছিলাম সাধারণভাবে চীনপন্থী ধারার সঙ্গে। কিন্তু এই ধারার নেতৃত্ব আইয়ুব সরকার এবং পূর্ব বাংলার স্বায়ত্তশাসন প্রশ্নে যে কর্মনীতি অনুসরণ করছিল আমি ছিলাম তার তীব্র বিরোধী। মতবাদ বা মতাদর্শের অন্ধত্ব যে মানুষকে কীভাবে কাণ্ডজ্ঞানহীন করে সেটা তখন দেখলাম।
আমি ছিলাম আইয়ুব সরকার বিরোধী এবং স্বায়ত্তশাসন আন্দোলনের দৃঢ় সমর্থক। আগেই বলেছি যে খুব অল্পবয়স থেকে আমি পূর্ব বাংলার স্বাধীনতার লক্ষ্য নিয়ে অগ্রসর হচ্ছিলাম। এ প্রশ্নে আমার মধ্যে কোনও ধরনের দ্বিধা বা সংশয় ছিল না। তবে আমি মনে করতাম যে, প্রথমে আমাদের দরকার পূর্ব বাংলার স্বায়ত্তশাসনের একটা পূর্ণাঙ্গ কর্মসূচী, যাকে সামনে রেখে আমরা গোপনে স্বাধীনতা আন্দোলন এবং অতঃপর স্বাধীনতা যুদ্ধ গড়ে তুলব। আমার ধারণা ছিল স্বায়ত্তশাসন আন্দোলন একটা পর্যায়ে স্বাধীনতা যুদ্ধে পরিণত হবে। ইতিহাস প্রমাণ করেছে যে আমার ধারণা সঠিক ছিল। কারণ ১৯৬৬ সালে শেখ মুজিব ৬ দফা কর্মসূচী দিবার পর ঘটনা শেষ পর্যন্ত সেভাবেই ঘটেছে।
মোহাম্মদ ফরহাদের মাধ্যমে গোপন ও অবিভক্ত কমিউনিস্ট পার্টির সঙ্গে ১৯৬৪ থেকে একটা সম্পর্ক থাকলেও ১৯৬৫-এর এপ্রিল মাসে ছাত্র ইউনিয়ন দ্বিধাবিভক্ত হবার পর ফরহাদ ভাইয়ের সঙ্গে একটা রাজনৈতিক বিতর্কের মাধ্যমে আমি পার্টির সঙ্গে সকল সম্পর্ক ছেদ করি। এ সম্পর্কে আমি ‘রাজনীতির পুনর্বিন্যাসꞌ-এর পঞ্চম অধ্যায়ে আলোচনা করেছি। তবে এখানে এটুকু বলি যে ফরহাদ ভাইয়ের সঙ্গে দীর্ঘ বিতর্কে বাঙ্গালী জাতীয়তাবাদ ভিত্তিক রাজনীতি, পূর্ব বাংলার স্বাধীনতা এবং আমাদের দেশের বাস্তবতায় সশস্ত্র বিপ্লবের মাধ্যমে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় আমার বিশ্বাসকে তার কাছে স্পষ্টভাবে জানাই। তৎকালীন কমিউনিস্ট পার্টির মস্কোপন্থী লাইন অনুযায়ী এসব প্রশ্নে তার বিরোধিতাও তিনি আমাকে জানান। যেমন তারা অর্থাৎ পার্টি জাতীয়তাবাদে বিশ্বাস করে না, তারা আন্তর্জাতিকতাবাদে বিশ্বাস করে। তারা পূর্ব বাংলা ভিত্তিক রাজনীতি করে না, সুতরাং পূর্ব বাংলার স্বাধীনতার রাজনীতির প্রতি তাদের কোনও প্রকার সমর্থন নাই। বরং তারা সারা পাকিস্তান ভিত্তিক রাজনীতি করে। এবং তারা সশস্ত্র সংগ্রাম নয়, বরং শান্তিপূর্ণ উপায়ে সমাজতন্ত্রে উত্তরণের রাজনীতিতে বিশ্বাস করে।
এসএম হলে কমিউনিস্ট পার্টির গোপন যে সেল বা গ্রুপ ছিল আমি ছিলাম তার সম্পাদক। এই বিতর্কের পরিণতিতে সেটার অস্তিত্বও বিলুপ্ত হল। গোপন কমিউনিস্ট পার্টির সঙ্গে আমার যেটুকু সম্পর্ক ছিল সেটুকু ছিন্ন হল। এর পর আমি মেনন নেতৃত্বাধীন ছাত্র ইউনিয়নকে গড়ে তুলবার কাজে আমার সর্বশক্তি নিয়োগ করি।
তবে সেখানেও আমার অভিজ্ঞতা তিক্ত। পিকিংপন্থী কমিউনিস্ট নেতাদের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে মেনন এবং তার সঙ্গেকার নেতারা সাধারণভাবে আইয়ুব-বিরোধী আন্দোলন থেকে সরে দাঁড়ান। তারা যে পন্থা সে কালে অনুসরণ করতেন সেটা পরিচিত ছিল ‘ডোন্ট ডিস্টার্ব আইয়ুব’লাইন হিসাবে। ১৯৬৫ সাল থেকে চীনের সঙ্গে পাকিস্তানের সুসম্পর্ক গড়ে উঠলে চীন যে শুধু আইয়ুবকে সমর্থন করা শুরু করে তাই নয়, অধিকন্তু পাকিস্তানের ঐক্য ও সংহতির দৃঢ় সমর্থকে পরিণত হয়। এই অবস্থায় এ দেশের পিকিংপন্থী কমিউনিস্ট নেতাদের কাজ হয়ে দাঁড়ায় আইয়ুব বিরোধী আন্দোলনকে বিভিন্ন কৌশলে থামিয়ে দেওয়া এবং সেই সঙ্গে পূর্ব বাংলার স্বায়ত্তশাসনের আন্দোলনকেও বিভিন্ন কৌশলে বিরোধিতা করা। এভাবে স্বায়ত্তশাসন আন্দোলনের যারা ছিল এক সময় অগ্রদূত তারা পরিণত হল তার বিরোধী শক্তিতে। অবশ্য এসব কাজে তাদের হাতিয়ার হল শ্রেণী সংগ্রামের তত্ত্ব এবং আন্তর্জাতিক বিপ্লবের কেন্দ্র হিসাবে চীনকে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের আগ্রাসী চক্রান্ত থেকে রক্ষার তত্ত্ব। ১৯৬৫-’৬৬ থেকে এই তত্ত্বের অনুসারী হিসাবে ভূমিকা পালন করেন তৎকালীন সাবেক ছাত্র নেতা এবং শ্রমিক নেতা কাজী জাফর আহমদ এবং হায়দার আকবর খান রনো। তবে ছাত্রদের মধ্যে ছাত্র ইউনিয়নের সভাপতি এবং নেতা হিসাবে রাশেদ খান মেননের ভূমিকাই ছিল সবচেয়ে প্রত্যক্ষ ও গুরুত্বপূর্ণ। এদের সহযোগী হিসাবে তখন ছিলেন আব্দুল মান্নান ভূঁইয়া। মোট কথা মেনন নেতৃত্বাধীন ছাত্র ইউনিয়নের নেতৃত্বের প্রধান অংশই তখন চীনপন্থী কমিউনিস্ট নেতৃত্বের অনুসারী হিসাবে ‘ডোন্ট ডিস্টার্ব আইয়ুব’লাইনের অনুসারী হয়। সুতরাং স্বায়ত্তশাসন আন্দোলনেরও কোনও গুরুত্ব আর তাদের কাছে থাকল না।
কিন্তু ছাত্র ইউনিয়নের উত্থান হয়েছিল আইয়ুব বিরোধী আন্দোলনের মধ্য দিয়ে, যার সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত ছিল স্বায়ত্তশাসনের দাবী। ১৯৬২ থেকেই আমাদের সভা-মিছিলে আইয়ুব-বিরোধী স্লোগানের সঙ্গে উচ্চারিত হত স্বায়ত্তশাসনের দাবী। ছাত্রদের যে বিরাট অংশ মেনন নেতৃত্বাধীন ছাত্র ইউনিয়নে সমবেত হয়েছিল তাদের প্রাণের দাবী ছিল পূর্ব বাংলার স্বায়ত্তশাসন, যা তখন ছিল নিদারুণ আঞ্চলিক বঞ্চনা ও জাতিগত বৈষম্যের শিকার। ফলে নেতৃত্বের এই ধরনের বিভ্রান্তিমূলক ও প্রতারণামূলক কর্মকাণ্ড ছাত্র-তরুণ প্রজন্মের ব্যাপকতর অংশকে ক্ষুব্ধ করে তুলে।
শুধু যে মেননপন্থী ছাত্র ইউনিয়নের নেতৃত্ব আইয়ুব বিরোধী আন্দোলন পরিহার করেছিল তা-ই নয়, অধিকন্তু ভাসানী নেতৃত্বাধীন ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি বা ন্যাপও আইয়ুব বিরোধী আন্দোলন পরিহার করেছিল। পিকিংপন্থী কমিউনিস্টরা তখন ন্যাপকে নিয়ন্ত্রণ করত। ভাসানীর পক্ষেও দীর্ঘদিন তাদেরকে অস্বীকার করে কিছু করা সম্ভব হয় নাই। ১৯৬৮-এর ডিসেম্বরে তিনি যখন কমিউনিস্টদেরকে অস্বীকার করে আইয়ুব বিরোধী আন্দোলন শুরু করলেন তখন যে শুধু অনেক দেরী হয়ে গিয়েছিল তা-ই নয়, উপরন্তু স্বায়ত্তশাসনকে কেন্দ্র করে কোনও জাতীয় কর্মসূচী না থাকায় তার আন্দোলন ৬ দফার সহায়ক আন্দোলনে পরিণত হল। ততদিনে জনমত তলে তলে শেখ মুজিবের ৬ দফার পক্ষে চলে গিয়েছিল। ফলে ভাসানীর শুরু করা আন্দোলন যখন গণ-অভ্যুত্থানে পরিণত হল তখন কারাবন্দী শেখ মুজিব তার নেতায় পরিণত হলেন এবং বীর হিসাবে মুক্ত হলেন।
আসলে মওলানা ভাসানী ভুল করেছিলেন আরও আগে। ১৯৬৬ সালের ফেব্রুয়ারীতে শেখ মুজিব ৬ দফা দিবার পর জনমত ও কর্মীদের বিশেষ করে ছাত্রদের প্রচণ্ড চাপের মুখে ন্যাপ নেতৃত্ব ঐ একই সালের জুন মাসে যখন ১৪ দফা কর্মসূচী ঘোষণা করল, আজ বুঝি যে, তখনই তারা তৎকালীন পূর্ব বাংলার জাতীয় রাজনীতিতে নিজেদের তথা এ দেশের বামপন্থী ও বিপ্লবী রাজনীতির মৃত্যু পরোয়ানায় স্বাক্ষর দিয়েছিল। হাত থেকে তীর একবার ছুটে গেলে সেটাকে যেমন আর ফিরানো সম্ভব হয় না তেমন ঐ রকম এক ঐতিহাসিক মুহূর্তে সময়ের প্রয়োজন পূরণে অক্ষম কর্মসূচী দিবার ফলে তারা জাতীয় রাজনীতির নিয়ন্ত্রণ লাভের শেষ সুযোগটা হারিয়েছিল। এটাকে রূপকার্থে লগ্ন হারানো বলা যায়। ৬ দফার পাশে যে কেউ ১৪ দফাকে রেখে দেখলেই বুঝবেন আমার কথার যৌক্তিকতা। ব-দ্বীপ প্রকাশন কর্তৃক প্রকাশিত ‘রাজনীতির পুনর্বিন্যাসꞌ-এর পরিশিষ্টে এই কর্মসূচী দুইটি দেওয়া আছে। আগ্রহী পাঠক পড়তে পারেন।
এটা ঠিক যে ১৪ দফায়ও স্বায়ত্তশাসনের কর্মসূচী ছিল, কিন্তু সেটা ছিল ৬ দফার তুলনায় শুধু যে দুর্বল তা-ই নয়, উপরন্তু কর্মসূচীটা এমনভাবে রচনা করা হয়েছিল যে এটার প্রতি কোনও আকর্ষণই আমরা যারা ছাত্র কর্মী ছিলাম তারা অনুভব করতাম না। আমরা ৬ দফার সমান্তরালে পূর্ব বাংলার স্বায়ত্তশাসনের এমন একটি কর্মসূচী চেয়েছিলাম যা হবে সুসম্বদ্ধ, অধিকতর সমৃদ্ধ ও আকর্ষণীয় এবং যাকে প্রকাশ্যে সামনে রেখে আমরা গোপনে স্বাধীনতার রাজনীতিকে এগিয়ে নিতে পারব। এ প্রসঙ্গে বলে রাখা ভাল যে কিছুটা নীচের দিকে মেনন নেতৃত্বাধীন ছাত্র ইউনিয়নের ব্যাপক সংখ্যক কর্মী এবং নির্ধারক অংশের মধ্যে তখন পূর্ব বাংলার স্বাধীনতার চিন্তা ছড়িয়ে পড়ছিল। যাইহোক, ব্যাপক ছাত্র ইউনিয়ন কর্মীরা ১৪ দফাকে প্রত্যাখ্যান করল। বস্তুত ১৪ দফাকে কোনও প্রকার কর্মসূচী হিসাবে আলোচনার যোগ্যও আমরা মনে করতাম না। নেতাদের জন্য এটা ছিল প্রকৃতপক্ষে জনমতকে প্রতারিত ও বিভ্রান্ত করার হাতিয়ার। সুতরাং তারাও এই কর্মসূচী নিয়ে মাঠে যেতে প্রস্তুত ছিল না। তবে তারা চাইলেও বিশেষ কিছু করতে পারত না। প্রথম কারণ কর্মসূচীর দুর্বলতা এবং দ্বিতীয় কারণ ছাত্রদের প্রত্যাখ্যান। সে যুগে যে কোনও রাজনৈতিক আন্দোলনে নির্ধারক শক্তি ছিল ছাত্ররা। সুতরাং ছাত্ররা ১৪ দফাকে প্রত্যাখ্যান করায় এটা প্রকৃতপক্ষে মৃত কর্মসূচীতে পরিণত হয়।
আমি ১৯৬৫-তে দ্বিতীয় শ্রেণী পেয়ে বিএ (অনার্স) পাস করি। ১৯৬৫-এর মাঝামাঝি সময়ে এমএ-তে ভর্তি হই। এমএ পরীক্ষা দিবার কথা ছিল ১৯৬৬ সালে। কিন্তু পরীক্ষা দিবার অল্প কয়েক মাস আগে আমি কৃষক আন্দোলন করতে গ্রামে চলে যাই।
নেতৃত্বের প্রতি তীব্র অনাস্থা, জাতীয় রাজনীতিতে আমাদের নেতৃত্বের কাণ্ডজ্ঞানহীন আচরণ ও বালখিল্যতা, সমবয়সী বা ছাত্র-তরুণদের মধ্যেও আমার চিন্তাগত নিঃসঙ্গতা ইত্যাদি থেকে শেষ পর্যন্ত আমি গ্রামে কৃষক আন্দোলন করতে চলে যাবার সিদ্ধান্ত নিই। জাতীয় রাজনীতিতে আমাদের তথা বিপ্লবের নিকটবর্তী বা আশু সাফল্যের তেমন কোনও সম্ভাবনা তখন আর আমি দেখছিলাম না। সামনে একটা বিপ্লবী অভ্যুত্থান বা যুদ্ধ দেখতে পাচ্ছিলাম। তবে সেখানে আমাদের বা আমাদের নেতৃত্বের কী ভূমিকা হবে সেটা বুঝতে পারতাম না। তখন মনে হল ঢাকায় থেকে আমার কোনও লাভ নাই। বরং গ্রামে গিয়ে কৃষক আন্দোলনের মধ্য দিয়ে বিপ্লবী রাজনীতি করা এবং তার অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা নেওয়া হবে আমার কাজ। এমএ ফাইনাল পরীক্ষা দিবার ৩/৪ মাস আগে গ্রামে চলে যাই। ফলে সেই সময় আর এমএ পরীক্ষা দেওয়া হয় নাই। এই পরীক্ষা দিয়ে পাস করি অনেক পরবর্তী কালে। অনেক পরে চাকুরী করতে গিয়ে যখন মাস্টার্স সার্টিফিকেটের অত্যাবশ্যকতা দেখতে পাই তখন পরীক্ষা দিই।
মনে হয় এই প্রশ্নে আমার বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের রাজনীতি সম্পর্কে যে কথা জানতে চাওয়া হয়েছে আমার উত্তরে তা অনেকটা উঠে এসেছে।
প্রশ্ন : ৪। শুনেছি আপনি ছাত্রাবস্থায় বাম রাজনীতির সাথে যুক্ত ছিলেন। পরবর্তীতে কমিউনিস্ট পার্টির সাথে যুক্ত হন। সম্ভবত মতিন-আলাউদ্দিন গ্রুপের সাথে যুক্ত ছিলেন। আবার এক সময় পার্টি ছেড়ে দিলেন। কেন সক্রিয় রাজনীতি মানে পার্টি ছেড়ে দিলেন, বিস্তারিত বলবেন।
উত্তর : ৪। আশা করি আমার পূর্ববর্তী উত্তরগুলি থেকেই ছাত্রাবস্থায় বাম রাজনীতির সঙ্গে আমার যুক্ত থাকার বিষয় স্পষ্ট হয়েছে। কমিউনিস্ট পার্টির সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে কী ধরনের সম্পর্ক হয়েছিল সেটাও হয়ত কিছুটা স্পষ্ট হয়েছে। আমি পার্টির সদস্য ছিলাম না। পার্টির সঙ্গে যুক্ত ছিলাম এসএম হলের পার্টি গ্রুপের সদস্য এবং সম্পাদক হিসাবে। সেটাও বেশী দীর্ঘ সময়ের জন্য নয়।
পূর্ব বাংলার স্বাধীনতার লক্ষ্যকে সামনে রেখে আমার উদ্যোগে ১৯৬৮ সালে ‘পূর্ব বাংলার বিপ্লবী কমিউনিস্ট আন্দোলনꞌ গঠিত হয়। ঐ একই বৎসরের শেষ দিকে দেবেন শিকদার-আবদুল মতিনের নেতৃত্বে পূর্ব বাংলার কমিউনিস্ট পার্টি গঠিত হলে ঐক্য প্রক্রিয়ার মাধ্যমে আমরা তাতে যোগ দিই। যোগদান পর্ব সম্পন্ন হয় ১৯৬৯ সালে। এভাবে এই প্রথম আমি প্রথম সনাতন কমিউনিস্ট পার্টির সদস্যপদ লাভ করি। এ সম্পর্কে আমার বিভিন্ন লেখায় বিশেষত ‘রাজনীতির পুনর্বিন্যাসꞌ-এ কিছু বিস্তারিত আলোচনা করেছি। এ ছাড়া লেনিন আজাদের সঙ্গে আমার পত্রালাপেও বলেছি। এটা ব-দ্বীপ প্রকাশন থেকে প্রকাশিত ‘মার্কসবাদ ও বিপ্লব বিতর্ক’গ্রন্থে আছে। এই উভয় গ্রন্থে নেতাদের সঙ্গে আমার বিতর্কগুলি নিয়ে কিছু আলোচনা আছে। পূর্ব বাংলার কমিউনিস্ট পার্টির সম্পাদক ছিলেন আত্মগোপনকারী নেতা দেবেন শিকদার। ১৯৬৯-এ তিনি গ্রেপ্তার হন। এর পর সম্পাদক নির্বাচিত হন আবদুল মতিন। ভাষা নেতা আবদুল মতিন সম্পাদক হলেও পার্টির কর্মনীতি ঠিক করতেন এবং পার্টি পরিচালনা করতেন মূলত আলাউদ্দীন আহমদ। এই কারণে এই পার্টি মতিন-আলাউদ্দীন গ্রুপ নামে সমধিক পরিচিত ছিল।
পার্টির সঙ্গে আমার সম্পর্কচ্ছেদ হয় ১৯৭২ সালের মার্চ-এপ্রিলের দিকে। যুদ্ধের মধ্যে কেন্দ্রীয় কমিটির সামান্য কয়েকজনের সভা ডেকে ‘পূর্ব বাংলার কমিউনিস্ট পার্টি’র নাম বদল করে পূর্ব বাংলার কমিউনিস্ট পার্টি (মার্কসবাদী-লেনিনবাদী) করা হয় এবং আবদুল মতিনের পরিবর্তে যশোরের আমজাদ হোসেনকে পার্টির সম্পাদক করা হয়। ১৯৭১-এ যুদ্ধের মধ্যে যশোরে গেলে পার্টির নাম পরিবর্তন সম্পর্কে আমাকে জানানো হলে আমি ক্ষোভ প্রকাশ করি। আমার বক্তব্য ছিল এই পদ্ধতি স্বেচ্ছাচারিতামূলক, অগঠনতান্ত্রিক ও অগ্রহণযোগ্য। অবশ্য যুদ্ধের প্রশ্নে পার্টির পাকিস্তান ও আওয়ামী লীগ এই দুই ফ্রন্টে লড়াইয়ের তত্ত্বের বিরুদ্ধেও আমি পার্টির তখনকার নেতা আমজাদকে আমার বক্তব্য জানাই।
আমার কমিউনিস্ট রাজনীতি করার ইতিহাস যেমন দীর্ঘ তেমন কমিউনিস্ট নেতৃত্বের সঙ্গে মতাদর্শিক ও রাজনৈতিক বিভিন্ন প্রশ্নে আমার দ্বন্দ্ব ও বিরোধের ইতিহাসও যে দীর্ঘ সেটা আশা করি এই আলোচনায় কিছুটা হলেও বেরিয়ে এসেছে। জাতীয় আন্দোলনে ভূমিকা রাখার প্রশ্নে, স্বায়ত্তশাসনের কর্মসূচীর প্রশ্নে, ছাত্র, শ্রমিক ও কৃষকদের ভূমিকা ইত্যাদি বহু প্রশ্নে তৎকালীন কমিউনিস্ট নেতাদের সঙ্গে আমার অব্যাহত বিরোধ বা ভিন্নতা থেকে গিয়েছিল। অধিকাংশ নেতা-কর্মীকে আমার সৎ ও নিবেদিত মনে হত। কিন্তু তাদেরকে বাস্তব সম্পর্কে কিছু বুঝানো যেত না। বিশেষত নেতাদেরকে এ দেশে আন্দোলনের পদ্ধতিগত বিষয় বা বাস্তব সমস্যাগুলি সমাধানের উপায় নিয়ে আমার মত জানাতাম। যেমন স্বায়ত্তশাসন কর্মসূচীর গুরুত্ব। কিংবা আমাদের দেশের বিপ্লবে ছাত্রদের ভূমিকার গুরুত্ব। কিন্তু কোনও ফল হত না। স্বায়ত্তশাসন আন্দোলনের কী দশা তারা করেছিল তা ইতিপূর্বে বলেছি। আর ছাত্রদেরকে তারা পেটি বুর্জোয়া বলে উড়িয়ে দিত। এসব বিষয়ে আমার মতামত ব্যক্ত করার পরিণতি হয়েছিল নেতাদের দিক থেকে আমার প্রতি সন্দেহ, বিরুদ্ধতা এবং আমার বিরুদ্ধে চক্রান্ত।
আজ এ দেশে কমিউনিস্ট পার্টির নেতৃত্ব শুধু নয় উপরন্তু কমিউনিস্ট রাজনীতিও আর জাতীয় রাজনীতিতে ফ্যাক্টর নয় বলে আমি মনে করি। সুতরাং সেকালে কমিউনিস্টদের ভূমিকা এবং কর্মকাণ্ড নিয়ে তেমন একটা আলোচনার উৎসাহই আমি আর পাই না। আবদুল হকের মত নেতার যে সব মিথ্যাচার এবং প্রতারণা আমি দেখেছি কিংবা আবদুল মতিনের মত নেতার যে সব কাণ্ডজ্ঞানহীন ও উগ্র আচরণ আমি দেখেছি এবং কথা আমি শুনেছি কিংবা যাদের নানান ধরনের বিভ্রান্ত কর্মনীতি ও কর্মকাণ্ড আমি দেখেছি সেসব উল্লেখ করে আজ কী লাভ?
যে বিষয়গুলাকে আমি সহজভাবে বুঝতাম যারা মার্কসবাদ ও কমিউনিজম একটু ভালভাবে রপ্ত করত তাদের সবারই দেখতাম আমার থেকে উল্টা দশা হত। শুধু তাই নয়, এদের সঙ্গে রাজনীতি করতে গিয়ে আমার জ্ঞান-বুদ্ধিকেও অনেক সময় নীচে নামিয়ে আনতে বাধ্য হয়েছিলাম।
আমি মার্কসবাদকে যেটুকু বুঝেছিলাম তাতে মার্কসবাদকে আদর্শের হাতিয়ার করে অন্যান্য দেশে যারা সফল বিপ্লব করেছিলেন তাদের কাউকে অন্ধ মার্কসবাদী মনে হত না। বরং মনে হত যে কিছু ক্ষেত্রে তারা মার্কসবাদের মূল জায়গা থেকে সরেছেন। সেটাকেই আমি তাদের সৃজনশীলতা মনে করতাম। যেমন লেনিন একদেশে সমাজতন্ত্র নির্মাণ করতে গিয়ে মার্কসবাদের মূল একটা সিদ্ধান্ত থেকে সরেন। তার এবং অন্যদের সম্পর্কে এমন আরও দৃষ্টান্ত উল্লেখ করা যায়। আমার বিচারে লেনিন, মাও, হো এরা কেউ মার্কসবাদের অন্ধ পূজারী ছিলেন না। ক্যাস্ট্রো তো যুদ্ধের মধ্য দিয়ে কিউবার রাষ্ট্র ক্ষমতা দখলের পূর্ব পর্যন্ত মার্কসবাদীও ছিলেন না। পরে বিপ্লবকে রক্ষা করতে গিয়ে মার্কবাদকে গ্রহণ করলেন এবং কমিউনিস্ট পার্টি গঠন করলেন।
যাইহোক, কমিউনিস্ট রাজনীতির সঙ্গে আমার দীর্ঘ সংশ্লিষ্টতা ও অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে মার্কসবাদ এবং কমিউনিজম বা কমিউনিস্ট রাজনীতি সম্পর্কে আমার যে মোহমুক্তি ঘটতে থাকে তা একটা চূড়ান্ত রূপ নেয় ১৯৭১-এর জাতীয় মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে। মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে ইসলামী রাষ্ট্র পাকিস্তান ধ্বংস ও বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার ফলে আমি মনে করলাম আমার জীবনের একটা লক্ষ্য কিছুটা হলেও অর্জিত হয়েছে। কারণ কৈশোর জীবন থেকে আমার একটা লক্ষ্য ছিল বাঙ্গালীর একটা জাতীয় মুক্তি যুদ্ধের মধ্য দিয়ে পাকিস্তানকে ধ্বংস করে পূর্ব বাংলার বুকে বাঙ্গালীর একটা স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করা। সেই লক্ষ্য যার নেতৃত্বে হোক এবং যেভাবে হোক যখন অর্জিত হল তখন আমি একটা ঐতিহাসিক দায়বোধ থেকে নিজেকে অনেকটা মুক্ত বোধ করলাম। এটা ঠিক যে, যে রাষ্ট্র আমি চেয়েছিলাম সেটা যে হয় নাই সেটা আমি বুঝেছিলাম। কিন্তু সেটা যে কমিউনিস্ট রাজনীতি দিয়ে কোনও কালে সম্ভব হবে না সে ব্যাপারেও আমি নিশ্চিত হয়েছিলাম।
সুতরাং যুদ্ধের পর কমিউনিস্ট পার্টি ও কমিউনিস্ট রাজনীতি পরিত্যাগ করা আমার জন্য সময়ের ব্যাপার মাত্র ছিল। ঐ রাজনীতি করা আমার পক্ষে আর সম্ভব ছিল না। তবে এটা পরিত্যাগের দায়িত্ব আমি নিই নাই। ১৯৭১-এর মার্চ-এপ্রিলের দিকে বাংলাদেশকে আমাদের রাজনীতির জন্য একধাপ অগ্রগতি হিসাবে বিবেচনা করে এবং পার্টির তৎকালীন লাইন পরিবর্তনের দাবী জানিয়ে পার্টিতে রংপুর জিলা কমিটির পক্ষ থেকে আমরা লিখিত বক্তব্য উপস্থিত করি। আমি তখন পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য না হলেও রংপুর জিলা কমিটির সম্পাদক ছিলাম। আমার উত্থাপিত লিখিত বক্তব্য জিলা কমিটি কর্তৃক সর্বসম্মতিক্রমে গৃহীত হয়। আমি দাবী করি মতামত যাচাইয়ের জন্য আমাদের বক্তব্য পার্টিতে প্রচার করা হোক। জবাবে পার্টি আমাকে পূর্ব বাংলার কমিউনিস্ট পার্টি (মার্কসবাদী-লেনিনবাদী) থেকে বহিষ্কার করে এবং রংপুর জিলা কমিটিকে বাতিল ঘোষণা করে।
আসলে স্বাধীনতা যুদ্ধের পর আমার মনে হল এ দেশে কমিউনিস্ট রাজনীতির যেটুকু দেওয়ার ছিল তা দেওয়া হয়েছে। এর পক্ষে আর বেশী কিছু করা সম্ভব নয়। শুধু তা-ই নয় এই রাজনীতিকে আমাদের অসমাপ্ত বিপ্লবের জন্য ক্ষতিকরও মনে হল। অসমাপ্ত বিপ্লব বলছি এই কারণে যে আমি ’৭১-এর স্বাধীনতা যুদ্ধকে বিপ্লব হিসাবে বিবেচনা করতাম, যা নেতৃত্বের সঙ্কটের কারণে অসম্পূর্ণ রয়ে গেছে।
কমিউনিস্ট রাজনীতিতে আমার অভিজ্ঞতা কম দিনের নয়। তা থেকে আমার মনে হয়েছিল মার্কসবাদ মানুষের বুদ্ধিবৃত্তি ও চেতনাকে একটা পর্যায়ে নিবার পর তাকে আটকে দেয়, তার অধিকতর অগ্রসর হবার পথে বাধা সৃষ্টি করে। আমাদের দেশের প্রেক্ষিতে তার সবচেয়ে প্রগতিশীল এবং বিপ্লবাত্মক যে দিকটাকে আমি বিবেচনা করতাম তা হচ্ছে তার লোকবাদী বা নিরীশ্বরবাদী বিশ্বদৃষ্টি। আসলে আমি আমার সমাজে অলোকবাদী ধর্ম তথা আমার সমাজের প্রেক্ষিতে ইসলাম ধর্মকে সমাজের অগ্রগতি ও মানবতা প্রতিষ্ঠার পথে সবচেয়ে বড় বাধা হিসাবে বিবেচনা করতাম। ইতিপূর্বে আমি বলেছি যে, ১৯৫৭ সালে অষ্টম শ্রেণীতে পড়ার সময় আমি অলোকবাদী ধর্মে বিশ্বাস হারাবার পরই মাত্র কমিউনিস্ট রাজনীতিকে গ্রহণ করি। তারপর আমি যৌক্তিক কারণে ধর্মভিত্তিক রাষ্ট্র পাকিস্তান বিরোধী হয়ে পড়ি। অর্থাৎ মার্কসবাদের পথে আমার যাত্রা দর্শনগত উপলব্ধি থেকে। এই উপলব্ধি অর্থাৎ প্রচলিত ধর্মে বিশ্বাস হারাবার পর আমার মধ্যে জাতিগত পরিচয়ের ক্ষেত্রে যে সঙ্কট দেখা দেয় তা থেকে থেকে মুক্তির পথ হিসাবে আমি দেখতে পাই বাঙ্গালী হিসাবে আমার পরিচয়কে। সেই সঙ্গে এটা মনে রাখতে হবে যে ১৯৫২-এর ভাষা আন্দোলনের পর থেকে এমনিতেই তখন বাঙ্গালীর মধ্যে বাঙ্গালী জাতি চেতনার জাগরণ ঘটছিল। নিরীশ্বরবাদী ও লোকবাদী হবার পর আমার ভিতর এই জাগরণ একটা নূতন মাত্রা এবং গতি নেয় যা আমাকে প্রথমে পূর্ব বঙ্গে বাঙ্গালীর রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা এবং অতঃপর উভয় বঙ্গের পুনরেকত্রীকরণের মাধ্যমে বাঙ্গালী জাতির অখণ্ড রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার ভাবনায় নিয়ে যায়। সেকালে বাঙ্গালী ও পূর্ব বঙ্গের প্রতি পাকিস্তানের পশ্চিমা শাসক শ্রেণীর জাতিগত ও আঞ্চলিক বৈষম্য ও উপেক্ষা আমার দার্শনিক চিন্তাকে সহজ বস্তুগত ভিত্তি দান করে। অর্থাৎ জাতীয়তাবাদ আমার কাছে ছিল একদিকে প্রচলিত ধর্মের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের হাতিয়ার, অপর দিকে পাকিস্তানের পশ্চিমা শাসক শ্রেণীর বিরুদ্ধে লড়াইয়ের হাতিয়ার। এই লড়াইয়ের সঙ্গে আমি সংযুক্ত দেখতে পেতাম সাম্রাজ্যবাদ-বিরোধী ও সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার লড়াইকে।
আমার এই ধরনের চিন্তার সঙ্গে যারা কমিউনিস্ট হত তাদের প্রায় কারোরই মিল দেখতে পেতাম না। যারা কমিউনিস্ট রাজনীতির প্রতি আস্থাশীল হত তারা ধর্ম বিশ্বাস হারাবার পর প্রথম পর্যায়ে জাতিগত প্রশ্ন বা জাতীয়তাবাদের প্রতি দুর্বল হয়ে পড়লেও দেখতাম যে কমিউনিস্ট রাজনীতি ভালভাবে রপ্ত করার পর অথবা কমিউনিস্ট নেতৃত্ব দ্বারা প্রভাবিত হবার পর শ্রেণী সংগ্রামকে অগ্রাধিকার দিতে গিয়ে তারা প্রকৃতপক্ষে জাতীয়তাবাদ থেকে সরে যেত অথবা তার প্রতি বিরোধীও হয়ে পড়ত।
সবচেয়ে বড় কথা পরলোকবাদী ধর্মের যে ভয়ানক ক্ষতিকর দিকটা আমি দেখতে পেতাম সেটা কমিউনিস্টরা দেখতে পেত না। ফলে এর বিরদ্ধে লড়াইয়ের পদ্ধতি ও তত্ত্ব নির্মাণের সমস্যা নিয়ে তাদের মাথা ঘামাবার কারণও ছিল না। তারা মাকর্সীয় বিপ্লবের সহজ সূত্রে ফেলে অর্থনৈতিক পরিবর্তনের মধ্যে সব সমস্যার সমাধান দেখতে পেত। কাজেই ধর্মের বিষয়টা তাদের কাছে অপ্রাসঙ্গিক মনে হত। মনে করত অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় পরিবর্তন ঘটিয়ে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করলেই ধর্মের সমস্যার সমাধান হবে।
আমি পাকিস্তান আমলে নেতাদেরকে বিভিন্ন বিষয়ে বুঝাবার চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়েছিলাম। বরং এর ফলে আমি তাদের সন্দেহ, ঘৃণা এবং চক্রান্তের শিকার হয়েছিলাম যে সম্পর্কে ইতিপূর্বে বলেছি। তার পরেও মার্কসবাদকে আমাদের দেশের উপযোগী করে প্রয়োগের চেষ্টা আমি করতাম। স্বাভাবিকভাবে আন্তর্জাতিক কমিউনিস্ট বা মার্কসবাদী বিপ্লবের কর্তৃত্ব যারা তাদের বক্তব্যের সূত্র ধরে বা তাদের কথার উদ্ধৃতি দিয়ে নেতারা যখন আমাকে খণ্ডন করতেন তখন আমার কাছে নিজ দেশের বাস্তবতার কথা বলে তাদের জবাব দিবার চেষ্টা করা ছাড়া উপায় থাকত না। কিন্তু এ কথা তো সত্য যে মার্কস-এঙ্গেল্স কিংবা বিদেশের সফল কমিউনিস্ট নেতারা পূর্ব বঙ্গে বিপ্লবের জন্য তাদের তত্ত্ব নির্মাণ করেন নাই। সুতরাং সূত্র বা উদ্ধৃতির প্রতিযোগিতায় আমি এ দেশের নেতাদের সঙ্গে পারব কেন? বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার পর আমি নিঃসংশয় হয়েছিলাম যে এ দেশের বাস্তবতায় বিপ্লবী তত্ত্ব হিসাবে মাকর্সবাদ যে শুধু অকার্যকর তা-ই নয়, অধিকন্তু এটা এখন ক্ষতিকরও। এক কালে এর কিছু উপযোগ থাকলেও এখন এটা সম্পূর্ণরূপে অনুপযোগী। একটা বিপ্লবী আন্দোলন গড়ে তুলবার জন্য এক কালে এটার যে প্রয়োজন ছিল সেটা ’৭১ ঘটে যাবার পর ফুরিয়েছে এবং এটাকে এখন বর্জন করতে হবে। কিন্তু সেটা বললেই তো হল না, তার জন্য আমাদের দেশের জন্য বিপ্লবের বিকল্প তত্ত্বও তো নির্মাণ করতে হবে। সেই কাজে হাত দিবার সিদ্ধান্ত নিয়ে আমি ১৯৭২ সালে কমিউনিস্ট রাজনীতি পরিত্যাগ করি। কারণ সেখানে থাকলে যে সে কাজ করা সম্ভব নয় সে ব্যাপারে আমি নিঃসংশয় হয়েছিলাম।
আর এ বিষয় আশা করি আমি স্পষ্ট করেছি যে নেতা হবার লক্ষ্য নিয়ে আমি রাজনীতি করি নাই। আমার লক্ষ্য ছিল বিপ্লব করা। আমার নেতৃত্বের প্রশ্ন ছিল তার সঙ্গে সম্পর্কিত। এমন কি যে পার্টি আমাকে বহিষ্কার করেছিল সেই পূর্ব বাংলার কমিউনিস্ট পার্টি (মার্কসবাদী-লেনিনবাদী)ও এক সময় আমাকে তার নেতৃত্ব গ্রহণ করার জন্য আহ্বান জানিয়েছিল। সময়টা সম্ভবত ১৯৭৬ সাল। আমজাদ তার অনেক আগে পার্টি ছেড়ে দিয়ে আবদুল হক নেতৃত্বাধীন পূর্ব পাকিস্তানের কমিউনিস্ট পার্টি (মার্কসবাদী-লেনিনবাদী)-তে যোগ দেয়। এরপর পার্টির নেতা আলাউদ্দীন-মতিন ভাইরা তখন জেলখানায়। সেই সময় পার্টির দায়িত্বে যিনি ছিলেন তিনি আমার প্রতি পার্টির বহিষ্কারাদেশের জন্য দুঃখ প্রকাশ করেন এবং এটা যে ভুল সিদ্ধান্ত সে কথাও জানান এবং আমাকে তাদের পার্টির নেতৃত্ব গ্রহণের জন্য আবেদন করেন। সম্ভবত তার ছদ্মনাম সেই সময় ছিল বাবু।
এখানে এ কথা বলা ভাল যে অতীতে কমিউনিস্ট নেতারা আমার প্রতি যেমন আচরণ করুক এবং তাদের সঙ্গে আমার রাজনৈতিক যত মতপার্থক্য থাকুক নির্যাতিত ও বঞ্চিত মানুষের মুক্তির জন্য তাদের ত্যাগ ও আদর্শ নিষ্ঠাকে আমি শ্রদ্ধা করতাম। আমি তাদের বুদ্ধিবৃত্তিক সীমাবদ্ধতা ও রাজনৈতিক ভ্রান্তিকে তাদের মতাদর্শ তথা মার্কসবাদের সীমাবদ্ধতা ও ভ্রান্তির ফল বলে মনে করতাম। ফলে ব্যক্তিগতভাবে আমি তাদেরকে যেমন শ্রদ্ধা করতাম তেমন তাদের অনেকের সঙ্গে সুসম্পর্ক রাখতাম এবং একই ভাবে তারাও অনেকে আমার সঙ্গে সম্পর্ক রাখতেন। এই সম্পর্কের সূত্র ধরে আমি যেটা চেষ্টা করতাম সেটা হচ্ছে তাদেরকে ভিন্নভাবে চিন্তা করতে অনুপ্রাণিত করা। গ্রেফতারী পরোয়ানা থাকার ফলে মুজিবের শাসন কালের পুরা সময়টা এবং জিয়া ক্ষমতাসীন হবারও কিছুকাল পর্যন্ত নেতারা আত্মগোপন অবস্থায় থাকতেন। এই গোপনতার মধ্যেও আমার সঙ্গে তাদের যোগাযোগ হত। আমি যেখানে থাকতাম সেই এলাকায় আমার বাসগৃহের নিকটে তাদের গোপন আশ্রয় থাকায় ’৭৩-’৭৪ থেকে ’৭৬-’৭৭ সময় পর্যন্ত আমাদের মধ্যে মাঝে মাঝে এবং কখনও ঘন ঘন সাক্ষাৎ এবং আলোচনা হত।
যাইহোক, যে কথা বলেছি নেতাদের বিভ্রান্তির উৎস মার্কসবাদকে মনে করায় আমার প্রতি অতীতে যেমন আচরণই করা হোক তার জন্য আমার মনে যেমন তেমন কোন ক্ষোভ ছিল না তেমন কমিউনিস্ট পার্টির নেতৃত্ব গ্রহণের কোনও ইচ্ছাও আমার ছিল না। কমিউনিস্ট রাজনীতি যে আমি আর করব না সে কথা প্রস্তাবের উত্তরে আমি স্পষ্টভাবে এবং বিনয়ের সঙ্গে জানিয়ে দিই। আমি জানতাম যে কমিউনিস্ট পার্টিকে যেমন আমার চিন্তার কাছে নিতে পারব না তেমন তার চেয়েও বড় কথা আমার নিজেরও বহু কিছু বুঝবার বাকী আছে, এ দেশের বিপ্লবের সমস্যাগুলির স্বরূপ এবং সমাধানের স্পষ্ট ধারণাও আমাকে পেতে হবে। এগুলা ছাড়া আমি যদি পার্টির নেতৃত্ব দিতে যাই তবে পার্টির যেমন ক্ষতি হবে তেমন আমারও ক্ষতি হবে। সুতরাং একবার কমিউনিস্ট রাজনীতি পরিত্যাগের পর সেখানে আর ফিরতে চাই নাই।
তবে গণ-রাজনীতি ছাড়তে চাই নাই। যে কারণে ভাসানী নেতৃত্বাধীন ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি বা ন্যাপ করার চেষ্টা করি। কিন্তু কমিউনিস্টরা ভাসানীকে পরিত্যাগ করার পর তিনি ১৯৭২ থেকে ইসলামী সাম্প্রদায়িক রাজনীতির দিকে ঝুঁকে পড়েন। ফলে আমার ন্যাপ করার আগ্রহও ফুরায়। ভাসানীর মৃত্যুর পর যাদু মিয়ার নেতৃত্বাধীন ন্যাপ সামরিক শাসক জিয়াকে নিঃশর্ত সমর্থন দিবার পর ন্যাপের সঙ্গে আমার যেটুকু সম্পর্ক পুনঃপ্রতিষ্ঠা করেছিলাম সেটুকুও ছেদ করি। এরপর রাজনীতি করি নাই এ কথা বলা ভুল হবে। কারণ পার্টি না করলেও রাজনীতি গড়ার চেষ্টা বিভিন্ন সময়ে বিভিন্নভাবে করেছি। এবং সেটা বিপ্লবের লক্ষ্যাভিমুখী রাজনীতি। সুতরাং এ কথা বলাই যথাযথ হবে যে, পার্টি বা দল না করলেও আমি আমার মত করে রাজনীতি করেছি।
প্রশ্ন : ৫। সক্রিয় রাজনীতি ছেড়ে দিয়ে পরবর্তীতে লেখালেখিতে সক্রিয় হয়ে উঠলেন কেন? আপনার মেধাকে দেশের রাজনৈতিক পরিবর্তন ত্বরান্বিত করার কাজে নিয়োগ না করে, ব্যক্তিগত সৃজনশীলতায় ব্যবহার করাকেই জরুরি মনে করেছিলেন তখন?
উত্তর : ৫। সক্রিয় রাজনীতি বলতে যদি পার্টি রাজনীতিকে বুঝানো হয় তবে সেটা মূলত ’৭২-এ ছেড়েছি। পার্টি ছাড়লেও কি সক্রিয় রাজনীতি ছেড়েছি? মনে হয় না যে আমার ক্ষেত্রে বিষয়টাকে এত সহজে ব্যখ্যা করা যাবে। যেমন আমি যখন ১৯৫৭ সালে অষ্টম শ্রেণীর ছাত্র তখন থেকে ১৯৫৮-তে নবম শ্রেণীতে যখন পড়ি তখন পর্যন্ত আমি ছাত্র ইউনিয়নের কর্মী হিসাবে সক্রিয় থাকলেও ১৯৫৮ সালের অক্টোবর মাসের ৭ তারিখে সামরিক শাসন জারী হলে সংগঠন নিষিদ্ধ হল। ফলে আপাত দৃষ্টিতে আমি সংগঠনের সক্রিয় কর্মী থাকলাম না। সংগঠনই যখন নাই তখন আমি সংগঠনের কর্মী থাকব কী করে? কিন্তু এর পরেও কি আমি নিষ্ক্রিয় ছিলাম? রাজনৈতিকভাবে আমি প্রতি মুহূর্তেই ছিলাম একজন সক্রিয় কর্মী। ১৯৫৮-এর অক্টোবর থেকে ১৯৬২-এর মধ্যবর্তী সময়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রবেশের পূর্ব পর্যন্ত ছাত্র ইউনিয়ন করার সুযোগ পাই নাই। সামরিক শাসন প্রত্যাহার হলে ১৯৬২-তে কনভেনশনের মাধ্যমে ছাত্র ইউনিয়ন পুনরুজ্জীবিত ও পুনর্গঠিত হয়। এখন ১৯৫৮-এর অক্টোবর থেকে ১৯৬২ পর্যন্ত আমার রাজনৈতিক ও মতাদর্শিক কর্মকাণ্ডকে কীভাবে ব্যাখ্যা করা যাবে?
সুতরাং পার্টি বা সংগঠন ছাড়লেও আমি কখন কতটা রাজনীতি ছেড়েছি তা বলা খুব কঠিন। আর লেখালেখির কথা যদি বলা যায় তবে বলতে হয় যে আমি বিশ্ববিদ্যালয় জীবন থেকে পত্র-পত্রিকায় কম-বেশী লেখালেখি করেছি। তৎকালীন দৈনিক সংবাদ এবং সাপ্তাহিক জনতায় আমার কয়েকটা লেখা প্রকাশিত হয়েছিল। এছাড়া আমি চে গুয়েভারার লেখা গ্রন্থ ‘গেরিলা যুদ্ধ’বাংলায় অনুবাদ করলে সেটার পুরাটা ধারাবাহিকভাবে সাপ্তাহিক জনতায় প্রকাশিত হয়। তবে সেটার অনুবাদক হিসাবে আমার নাম না দিয়ে ছদ্মনাম হিসাবে কল্যাণ ব্যবহার করেছিলাম। এ ছাড়া আমি যখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র তখন মাও সে-তুং-এর ‘জাপ বিরোধী গেরিলা যুদ্ধে রণনীতির সমস্যাবলী’ইংরাজী থেকে বাংলায় অনুবাদ করি, যা সেই সময় গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয়। এটার অনুবাদক হিসাবে আমার নামই দেওয়া ছিল।
তবে এটা ঠিক যে পাকিস্তান আমলে আমার লেখালেখি কম ছিল। কারণ যতই কাজ করি তখন আমি একজন অনুসন্ধিৎসু মাত্র, যে এ দেশের বিপ্লবের সঠিক পথ অনুসন্ধান করছে। আমি যেখানে নিজেই পথের সন্ধান করছি সেখানে আমি কীভাবে আমার লেখার মাধ্যমে দিক নির্দেশ করব? বাস্তব জ্ঞান ও কর্মের অভিজ্ঞতা বর্জিত যে সব বুদ্ধিজীবী বিপ্লব অথবা রাজনীতির দিশা দেখাতে চায় আমি তাদের মত ছিলাম না। আমি সেভাবে লেখায় হাত দিই আরও অনেক পরবর্তী কালে। বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার পরেও এই কারণে তুলনায় অনেক কম লিখতাম। জাতীয় পর্যায়ে এবং মাঠ পর্যায়ে আরও অনেক অভিজ্ঞতা সংগ্রহের মাধ্যমে আমার ধারণাগত একটি মোটামুটি পূর্ণতা আসবার পর ১৯৮৯ সাল থেকে আমি জীবন-জীবিকার সংগ্রামের পাশে লেখায় হাত দিই। সে সময়ে সেগুলির খুব সামান্যই প্রকাশিত হয়। তবে সে সময়ে কথাসাহিত্যিক আহমদ ছফার সম্পাদনায় প্রকাশিত সাপ্তাহিক ‘উত্তরণ’-এ আমার যে কয়েকটি লেখা প্রকাশিত হয় তার মধ্যে ‘মার্কসবাদের সঙ্কট ও বিপ্লবের ভবিষ্যৎ’-এর নাম এখানে উল্লেখ করা যায়। এটি একটি গ্রন্থ, যা পত্রিকাটিতে ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হয়।
আমি জানি না আমি প্রশ্নের উত্তর ঠিকভাবে দিতে পেরেছি কিনা। আমার মেধাকে লেখা তথা তত্ত্ব নির্মাণ বাদ দিয়ে আর কীভাবে দেশের রাজনৈতিক পরিবর্তন ত্বরান্বিত করার কাজে নিয়োগ করতাম? যারা রাজনীতি করছে তারা কি এই পরিবর্তন ত্বরান্বিত করতে পারছে? অবশ্য তাদের পক্ষে যা সম্ভব বা যৌক্তিক মনে হচ্ছে তা তারা করছে। আওয়ামী লীগ, বিএনপি যারা করছে তাদেরও যুক্তি আছে। অসংখ্য দল-উপদলে বিভক্ত কমিউনিস্টরাও পরিবর্তন ত্বরান্বিত করার কাজ করছে বলে দাবী করে থাকে। কিন্তু আমি তাদের প্রতি আস্থাশীল নই। অন্তত বিপ্লবী পরিবর্তনের কাজ যে কমিউনিস্টদের দিয়ে হবে না সেটা বুঝি। কলুর বলদের মত ঘানি ঠেলে যদি কেউ চলতে চায় তবে চলুক। আমি বাধা দিবই বা কেন আর বাধা দিলেই বা তারা শুনবে কেন?
কিন্তু মাঠের অভিজ্ঞতা থেকে আমি বুঝি যে কলুর বলদের মত ঘানি ঠেললেই বিপ্লব করা যায় না। এর জন্য চাই সঠিক ধারণা। আবার শুধু সঠিক ধারণা থাকলেই হয় না। এটা ব্যক্তির ইচ্ছাধীন ব্যাপার নয়। পরিস্থিতিকে তৈরীর কাজ যেমন করতে হয় তেমন এবং তার চেয়েও বেশী পরিস্থিতিকে বিভিন্ন ঘটনাধারার মধ্য দিয়ে বিপ্লবের জন্য অনিবার্যও হতে হয়। এই কারণে লেনিন বিপ্লবী পার্টিকে বিপ্লবের ধাত্রী বলেছেন। তার বক্তব্য হচ্ছে সমাজ তার নিজস্ব প্রয়োজনে বিপ্লব ঘটায়। তখন পুরাতন সমাজের গর্ভ থেকে নূতন সমাজ জন্ম নেয়। বিপ্লব হচ্ছে এই জন্মদান প্রক্রিয়া। এখানে বিপ্লবী নেতা বা পার্টির ভূমিকাকে সন্তান জন্মদানে একজন ধাত্রীর ভূমিকার চেয়ে বেশী গুরুত্ব লেনিন দেন নাই। লেনিন কথাটা অনেকাংশে রূপকার্থে বলেছিলেন। কিন্তু এ কথার ভিতরে গভীর তাৎপর্য নিহিত রয়েছে। একজন ধাত্রীকে যেমন সন্তান প্রসবের প্রক্রিয়া সম্পর্কে ধারণা অর্জন করতে হয় তেমন বিপ্লবের নেতাকে বিপ্লবের প্রক্রিয়া সম্পর্কেও ধারণা অর্জন করতে হয়।
এখন এক একটা সমাজের সমস্যা যেমন এক এক রকম হতে পারে তেমন এক এক সমাজের বিপ্লবের প্রকার বা বৈশিষ্ট্য এবং প্রক্রিয়াও এক এক রকম হতে পারে। বিপ্লবের সমস্যা, বৈশিষ্ট্য ও প্রয়োজন যেমন দেশ ও সমাজ ভেদে ভিন্ন রকম হয় তেমন এ সংক্রান্ত কোন ধারণা বা তত্ত্বও বিশ্বজনীন সত্যের আধার বা নিরঙ্কুশ সত্যের দাবীদার হতে পারে না। আমার কথা হল আমাদের সমাজের বিপ্লবের পথ ও প্রক্রিয়া সম্পর্কে ধারণা আমাদেরকেই নির্মাণ করতে হবে। এটা করার উপরই নির্ভর করছে এ সমাজে বিপ্লব যখন আসন্ন ও অনিবার্য হবে তখন তার যোগ্য ধাত্রীর ভূমিকায় আমরা অবতীর্ণ হতে পারব কিনা সেটা। সেই কাজটাই এখন আমি করার চেষ্টা করছি।
কাউকে কাউকে দেখেছি আমি মাঠের রাজনীতি সরগরম করি না বলে আমাকে তুচ্ছ করার চেষ্টা করে। কেউ কেউ এমনভাবেও মন্তব্য করেছে যে তাতে মনে হয়েছে বন্দুক কাঁধে নিয়ে দৌড়াদৌড়ি করে না বেড়ালে বিপ্লবী হওয়া যায় না। এ কথা তারা যখন বলে তখন কিন্তু তারা তাদের গুরু মার্কস-এঙ্গেল্সকেও নাকচ করে, যাদের অনুসারী হিসাবে তারা নিজেদেরকে জাহির করে। মার্কস কোনদিন বন্দুক হাতে নিয়েও দেখেছিলেন কিনা আমার জানা নাই। শ্রমিক আন্দোলনেও মার্কসের প্রত্যক্ষ ভূমিকা কতটুকু? তিনি তো মূলত একজন বুদ্ধিজীবী। শ্রমিক আন্দোলনে এঙ্গেলস সেই তুলনায় বেশী ভূমিকা রাখলেও সেটা শ্রমিক নেতা হিসাবে নিশ্চয় আহামরি কোন প্রতিষ্ঠা তাকে দেয় নাই। প্রকৃতপক্ষে তাদের ভূমিকা অনেক বেশী উজ্জ্বল তাদের তৎকালীন শ্রমিক আন্দোলনে তত্ত্বগত ও রাজনৈতিক ভূমিকার কারণে। এমন কি মাও সে-তুংও কি গ্রামে গিয়ে নির্দিষ্ট এলাকায় পড়ে থেকে এলাকা ভিত্তিক কৃষক আন্দোলন করে কমিউনিস্টদের ভাষা অনুযায়ী ‘শ্রেণীচ্যুত’ হয়েছিলেন?
যাইহোক, এ প্রসঙ্গে আমি আর আলোচনার প্রয়োজন দেখি না। আর আমার তত্ত্বগত বিষয়গুলি নিয়েও এখানে বিস্তারিত আলোচনা করতে চাই না। কারণ সেটার জায়গা এটা নয়। এতে আমার উত্তরও অনাবশ্যকভাবে দীর্ঘ হবে, যা ধৈর্যচ্যুতির কারণ হবে। আমার বহুসংখ্যক বই এবং প্রবন্ধে আমি এসব নিয়ে আলোচনা করেছি। এগুলির অধিকাংশ ব-দ্বীপ প্রকাশন কর্তৃক প্রকাশিত হয়েছে। এছাড়া ওয়েবসাইট ‘বঙ্গরাষ্ট্র’ (www.bangarashtra.net)-এ আমার লেখাগুলির প্রায় সব প্রকাশিত হয়েছে।
প্রশ্ন : ৬। আমার কাছে মনে হয়েছে, আপনাদের লেখা ‘আর্যজন ও সিন্ধুসভ্যতা’ বইটি দিয়ে আপনারা ভারতীয় উপমহাদেশের ইতিহাসের একটি দিককে কাউন্টার হিসেবে উপস্থাপন করেছেন। কাজটা আমার কাছে অসাধারণ মনে হয়েছে। আমার প্রশ্ন হলো, কোন ধরনের প্রণোদনা আপনাদেরকে এ বই লিখতে উদ্বুদ্ধ করেছে।
উত্তর : ৬। প্রসংশাসূচক মন্তব্যের জন্য ধন্যবাদ। আসলে ভারতবর্ষের ইতিহাসের সূত্র সন্ধানের চিন্তাটা আমার মাথায় বহুদিন ধরে কাজ করছিল। স্কুল জীবন থেকেই সমাজ ও ইতিহাসের অনেক প্রশ্নের উত্তর পাবার জন্য আমার ভিতর তীব্র তাড়না কাজ করত। আমার মনে হয়েছিল আমাদের সমাজকে গভীরভাবে বুঝতে গেলে আমাদেরকে অতীতে যেতে হবে। এ ছাড়া এ সমাজের বিপ্লবের সমস্যাও বুঝা যাবে না বলে আমার মনে হয়েছিল। সমস্যা না বুঝলে সমাধান পাব কী করে? যেহেতু আমরা ভারতবর্ষের সমাজ ও সভ্যতার উত্তরাধিকারকে বিভিন্নভাবে ধারণ করি সেহেতু ভারতবর্ষের সমাজ ও সভ্যতাকে এবং তার সমস্যাকে বুঝতে চেয়ে তার ইতিহাসের যাত্রাবিন্দুতে পৌঁছাতে চাইলাম।
ভারতবর্ষের সমাজের সেই আদি যাত্রাবিন্দুতে পৌঁছাতে চেয়ে ১৯৯০ সালে ঋগ্বেদ সংগ্রহ করে তা পাঠের সিদ্ধান্ত নিই। কারণ এটাই হচ্ছে ভারতবর্ষের সবচেয়ে প্রাচীন গ্রন্থ যা বোধগম্য রূপে আজ অবধি বিদ্যমান। এর আগে বিচ্ছিন্নভাবে ঋগ্বেদের কিছু সংখ্যক মন্ত্র পড়লেও তার তাৎপর্য বুঝি নাই। সুতরাং ১৯৯০ সালে যখন সম্পূর্ণ ঋগ্বেদের অনুবাদ প্রণালীবদ্ধভাবে পড়তে শুরু করি তখন আমি প্রচণ্ড ধাক্কা খাই। এতকাল ধরে অন্য সবার মত আমিও মনে করতাম ঋগ্বেদের রচয়িতা আর্যরা ভারতবর্ষে বহিরাগত, পশুপালক এবং বর্বর বা অসভ্য। কিন্তু ঋগ্বেদ পাঠ আমার এতকালের সমস্ত ধারণা এবং বিশ্বাসকে তছনছ করে দিল। আমি নিশ্চিত হলাম যে ঋগ্বেদের রচয়িতা ঋষিরা সিন্ধু সভ্যতার অধিবাসী এবং একটা সামাজিক দ্বন্দ্ব, সংঘাত ও গৃহযুদ্ধের প্রক্রিয়ায় ঋগ্বেদ রচিত হয়। অবশ্যই আমার বাস্তব জীবন এবং আন্দোলনের অভিজ্ঞতা এবং মাঠ ও মাটির সঙ্গে ঘনিষ্ঠ মানুষ সম্পর্কে আমার ব্যবহারিক ধারণা আমাকে ঋগ্বেদকে বুঝতে বিপুলভাবে সাহায্য করে।
এরপর সিন্ধু সভ্যতার উপর নূতন করে কিছু বই পড়ার পর ১৯৯০ সালেই আমার নবলব্ধ ধারণার ভিত্তিতে ‘ভারত-ইতিহাসের সূত্র সন্ধান’ নামে একটা বই লিখি। এটা প্রকাশের জন্য দুই বাংলায়ই পণ্ডিত মহলে ঘুরাফিরার পর হতাশ হয়ে সে চেষ্টা বাদ দিয়ে সিদ্ধান্ত নিই যে বাংলা ভাষা দিয়ে কাজ হবে না। ইংরাজীতে লিখে বিদেশী পণ্ডিতদের কাছে পাঠাতে হবে। আমার ঋগ্বেদ ও আর্য সংক্রান্ত এই চিন্তার সঙ্গে প্রথম থেকেই একমত হয় আমার ছোটভাই শামসুল আলম চঞ্চল। আমার ভাই-বোনদের মধ্যে সে সবার ছোট। সে আমার উদ্যোগে যোগ দেয়। এরপরের কাজের কৃতিত্ব মূলত তার। এমনিতে তার ছিল সিন্ধু সভ্যতার প্রত্নতত্ত্বের উপর প্রচুর পড়া। তারপর আমার সঙ্গে আলোচনার ভিত্তিতে আরও অনেক বই-পত্র যোগাড় করে ইংরাজীতে The Indus Civilization and the Aryans নামে একটা বৃহৎ প্রবন্ধ লিখে পাকিস্তানের প্রত্নতত্ত্ব ও যাদুঘর বিভাগের বর্তমানে সাবেক মহাপরিচালক এবং সিন্ধু সভ্যতার একজন শ্রেষ্ঠ প্রত্নতত্ত্ববিদ ডঃ রফিক মোগলসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের পণ্ডিতদের নিকট পাঠায়।
ডঃ মোগলের উত্তর ছিল আমাদের জন্য বিরাট প্রেরণাদায়ী। তিনি প্রবন্ধটির উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করে অনতিবিলম্বে সেটি প্রকাশের তাগিদ দিয়ে চঞ্চলকে তার অফিসিয়াল প্যাডে চিঠি পাঠন। এটি ছিল আমাদের জন্য একটি বিরাট ঘটনা। কারণ সিন্ধু সভ্যতার উপর পৃথিবীর একজন প্রতিষ্ঠিত এবং অন্যতম শ্রেষ্ঠ প্রত্নতাত্ত্বিকের সমর্থন বা মতামতকে পণ্ডিতদের পক্ষে তাচ্ছিল্যের সাথে উড়িয়ে দেওয়া আর সম্ভব ছিল না। এরপর চঞ্চলের পূর্ববর্তী প্রবন্ধকে ভিত্তি করে তার সঙ্গে যৌথভাবে ইংরাজীতে The Aryans and the Indus Civilization নামে বই লিখি। এটা পৃথিবীর আরও অনেক পণ্ডিত ও লেখক-গবেষকদের নিকট পাঠাই। বাংলাদেশেও কিছু সংখ্যক পণ্ডিতকে আমরা বইটা পড়তে দিই। এরপর চঞ্চলের সঙ্গে বাংলায় নূতন করে লিখার সিদ্ধান্ত নিই। ‘আর্যজন ও সিন্ধু সভ্যতা’হচ্ছে আমাদের যৌথ শ্রমের সেই ফসল, যা প্রকাশ করতে করতে ২০০৩ সালের জানুয়ারী হয়ে যায়।
এখানে যত সহজে ও সংক্ষেপে ‘আর্যজন ও সিন্ধু সভ্যতা’র পটভূমি ও লিখবার প্রক্রিয়া বর্ণনা করলাম কাজটা যে তত সহজ ও সংক্ষিপ্ত ছিল না তা আশা করি বুঝা খুব কঠিন হবে না। কারণ আমাদের কাজ শুধু ইতিহাস ও সমাজের নূতন পাঠ দিচ্ছে না, সেই সঙ্গে এটা এতকাল ধরে চলে আসা ইতিহাস ও সমাজের বহু পাঠকে নস্যাৎ করে দিচ্ছে। এটা ভাবজগতে একটা বিপ্লবের সূচনা ঘটিয়েছে। কারণ আমরা ভারতীয় উপমহাদেশকে ঘিরে পাশ্চাত্যের উপনিবেশবাদী ও সাম্রাজ্যবাদী ইতিহাস পাঠকে বাতিল করেছি। ফলে পদে পদে বিভিন্ন ধরনের অজস্র বাধাকে পার হয়ে আমাদেরকে এ পর্যন্ত আসতে হয়েছে। এ প্রসঙ্গে এখানেই আমার উত্তর শেষ করি। তবে প্রশ্নের শেষ কথার উত্তর দিতে গিয়ে বলি ইতিহাসের সত্য আবিষ্কার এবং সমাজ ও রাষ্ট্র বিপ্লবের প্রণোদনা এ বই লিখতে আমাদেরকে উদ্বুদ্ধ করেছে। বিশেষত আমার কাছে এটা ছিল আমার জীবনব্যাপী বিপ্লবী লড়াইয়ের অংশ।
প্রশ্ন : ৭। বাংলাদেশে মনে হয় প্রথম আপনিই ‘অখণ্ড বঙ্গ রাষ্ট্রের’ধারণার উদ্ভাবক। আপনি কোন প্রেক্ষিতে এ ধরনের রাজনীতির প্রয়োজন উপলব্ধি করলেন? আর মার্কসবাদী রাজনীতি ছেড়ে কেনইবা এ ধারণায় কাজ করার প্রণোদনা পেলেন?
উত্তর : ৭। বাংলাদেশে আমিই প্রথম ‘অখণ্ড বঙ্গ রাষ্ট্র’-এর ধারণার উদ্ভাবক কিনা জানি না। কারণ এ ধরনের চিন্তার সামাজিক ভিত্তি যেহেতু এ দেশে আছে সেহেতু আরও মানুষের মধ্যে এই চিন্তা থাকাটা স্বাভাবিক। তবে এ কথা বলা যায় যে, চিন্তাটাকে আমি সুদীর্ঘ কাল ধরে যেভাবে ধরে রেখেছি এবং এটার জন্য একাগ্রভাবে যেভাবে কাজ করছি সেটা আর কেউ করে নাই।
আসলে এ চিন্তা যে ১৯৫৭ সালে অষ্টম শ্রেণীর ছাত্র থাকা অবস্থা থেকেই আমার ভিতরে এসেছিল সে কথা আমি ইতিপূর্বে বলেছি। তবে তখন যুক্তবঙ্গ বা বঙ্গ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যকে সামনে আনার সময় হয় নাই। সেই সময় পাকিস্তানের কবল থেকে পূর্ব বঙ্গকে স্বাধীন করার প্রশ্নটাই ছিল অনেক বেশী গুরুত্বপূর্ণ। আমার চিন্তাটা আমি এর আগে বলেছি। আগে পূর্ব বঙ্গকে স্বাধীন করে এখানে একটা সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করা হবে, তারপর পশ্চিম বঙ্গের কাছে পুনরেকত্রীকরণের আহ্বান রাখা হবে। আসলে পশ্চিম বঙ্গের সঙ্গে পূর্ব বঙ্গের পুনরেকত্রীকরণ ঠিক কোন প্রক্রিয়ায় সম্পন্ন হবে সেটা আমার কাছে যে স্পষ্ট ছিল তা নয়। এটা নিয়ে যে খুব একটা ভাবতাম তাও নয়। শুধু আমাদের প্রধান করণীয় হিসাবে পূর্ব বঙ্গের স্বাধীনতার প্রশ্নকে অগ্রাধিকার দিয়ে চিন্তা করতাম। আমার ধারণা সেই সময় সেই চিন্তাই সঠিক ছিল। আর তাছাড়া ঐ অত অল্প বয়সে এইটুকু যে চিন্তা করতাম সেটাই কি বিস্ময়কর নয়? তাও অনেক দিন পর্যন্ত আমি এই চিন্তা একা করতাম এবং এ নিয়ে একাই আলোচনা করতাম। দশম শ্রেণীতে আমার কিছু সহপাঠী, বন্ধু আমার এই চিন্তাকে সমর্থন করলেও তারাও যে এ নিয়ে তেমন ভাবত বা আলোচনা করত তা নয়। এটা আরও অনেক দিন পর্যন্ত আমার একার ভাবনা ছিল। আমার এই ভাবনার কম-বেশী উৎসাহী অংশীদার পাই কেবলমাত্র ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হবার পর।
তবে আমার ছোট মামা ছিলেন আমার এই ভাবনার উৎসাহী সমর্থক। আমি যখন ম্যাট্রিক পরীক্ষা দিয়ে তৎকালীন বৃহত্তর রংপুর জিলার অন্তর্গত কালীগঞ্জ থানার আদিতমারীর এক গ্রামে আমার নানার বাড়ীতে যাই তখন বিভিন্ন আলোচনা এবং তর্ক-বিতর্কের মধ্য দিয়ে ছোটমামা আমার চিন্তার সমর্থকে পরিণত হন। তিনি আমার ২/৩ বৎসরের বড় ছিলেন এবং আমার বন্ধুর মত ছিলেন। তখন তিনি রংপুর কারমাইকেল কলেজে পড়তেন। তাদের গ্রামের বাড়ীর কাছের রেলওয়ে স্টেশন আদিতমারী থেকে ট্রেনে করে তিনি নিয়মিত রংপুর পর্যন্ত যাতায়াত করতেন। বর্তমানের লালমণিরহাট জিলা আদালতে দেওয়ানী উকিল হিসাবে কর্মরত থেকে ৪/৫ বৎসর পূর্বে তিনি ব্রেন ক্যানসারে মারা যান। তিনি আমার বহু চিন্তাকে গ্রহণ করলেও কমিউনিস্ট পার্টি কখনও করেন নাই। সুখেন্দু দস্তিদার, আবদুল মতিনের মত এ দেশের সেই সময়ের কমিউনিস্ট আন্দোলনের কয়েকজন দিকপালের সঙ্গে কথা বলে এবং তাদের বুদ্ধিবৃত্তি ও চিন্তা-চেতনার মান দেখে তিনি খুবই হতাশ হয়েছিলেন। তাদের নেতৃত্বে যে এ দেশে বিপ্লব হবে না সে বিষয়ে তিনি নিঃসংশয় ছিলেন। কমিউনিস্ট পার্টি না করায় তিনি অনেক বদ্ধতা থেকে মুক্ত ছিলেন। অথচ তার পড়া-শুনা এবং গভীর চিন্তাশীলতা ছিল। কমিউনিস্ট পার্টি না করলেও সামাজিক-সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক আন্দোলন ও কর্মকাণ্ডে নিজ এলাকায় তার সক্রিয় ভূমিকা আমাদের আন্দোলনের জন্য খুব সহায়ক হয়েছিল।
তিনি ছিলেন ইসলামের ক্ষতিকর ভূমিকা সম্পর্কে সচেতন। ইসলাম বিরোধী হিসাবে তিনি যতটা না মার্কসবাদের সমর্থক ছিলেন তার চেয়ে অনেক বেশী ছিলেন বাঙ্গালী জাতীয়তাবাদের সমর্থক। তিনি ইসলাম এবং পাকিস্তানকে প্রচণ্ড ঘৃণা করতেন। তিনি মনে করতেন ধর্মরাষ্ট্র পাকিস্তানকে ধ্বংস করার জন্য জাতীয়তাবাদের প্রয়োজন সর্বাধিক। সুতরাং তিনি পূর্ব বঙ্গের স্বাধীনতার প্রশ্নে ছিলেন আমার উৎসাহী সমর্থক। কমিউনিস্ট পার্টি করার ফলে সাংগঠনিক পরিস্থিতির চাপে আমার ভিতর জাতীয়তাবাদের প্রশ্নে কখনও কোনও রকম শৈথিল্য বা বিচ্যুতি দেখলে তিনি সাথে সাথে আমাকে সতর্ক করতেন। এটা আমাকে খুব সাহায্য করত। মার্কসবাদে বিশ্বাস করলেও নিজ সমাজের বাস্তবতাকে বুঝবার সক্ষমতা তার ছিল এবং কমিউনিস্ট পার্টি না করায় তার মধ্যে মতবদ্ধতা ছিল না। আমার চিন্তার একাকীত্ব আমি অনেক দিন পর্যন্ত তার সঙ্গে আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে কমাতাম বা যতটা সম্ভব দূর করতাম। আমার মত লড়াকু তিনি ছিলেন না। যে স্বপ্ন তিনি এক কালে লালন করতেন কমিউনিস্টদের মতিচ্ছন্নতা এবং ব্যর্থতার ফলে বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার পর সেই স্বপ্ন তিনি হারিয়ে ফেলেন। ফলে স্বাভাবিকভাবে পরবর্তী কালে তিনি যেমন বৈষয়িক এবং সাংসারিক জীবনে হারিয়ে গিয়েছিলেন তেমন আমার সঙ্গে তার দূরত্বও তৈরী হয়েছিল।
আমার মনে হয় এ বিষয়টা আমি কিছুটা হলেও স্পষ্ট করতে পেরেছি যে বঙ্গ রাষ্ট্র ভাবনা বা যুক্তবাংলার ভাবনা আমার বাঙ্গালীর জাতি-রাষ্ট্র ভাবনা থেকে এসেছে, যার প্রথম পর্যায় ছিল পূর্ব বঙ্গের স্বাধীনতা। প্রথম পর্যায়টা আপাত দৃষ্টিতে সম্পন্ন হলেও প্রকৃত অর্থে সম্পন্ন হয় নাই। কারণ ইসলামী সাম্প্রদায়িকতার ঊর্ধ্বে উঠে স্বাধীন পূর্ব বঙ্গ তথা আজকের বাংলাদেশ রাষ্ট্র তার জাতীয়তাবাদের পূর্ণতার প্রয়োজনে বঙ্গরাষ্ট্র গঠনকে তার লক্ষ্য হিসাবে তুলে ধরতে পারে নাই।
ইতিপূর্বে সম্ভবত এ কথাটাও কিছুটা হলেও স্পষ্ট করতে পেরেছি যে, দার্শনিক জিজ্ঞাসা থেকে ধর্ম সম্পর্কে আমার মনে যে অবিশ্বাস ও অনাস্থা জন্মে তা থেকে ধর্মের ভিত্তিতে বাঙ্গালী জাতির বিভক্তিকে আমি কোন ক্রমেই মেনে নিতে পারি নাই। এবং আমি ধর্মের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের হাতিয়ার হিসাবে কমিউনিজমকে যেমন দেখতে পাই তেমন বাঙ্গালী জাতীয়তাবাদকেও দেখতে পাই। জাতীয়তাবাদের প্রকাশ্য রূপ ছিল আমার কাছে পূর্ব বঙ্গের স্বায়ত্তশাসন এবং গোপন ও চূড়ান্ত রূপ ছিল বঙ্গরাষ্ট্রের লক্ষ্যাভিমুখী স্বাধীন পূর্ব বঙ্গ।
এতে কোন সন্দেহ নাই যে, দর্শনগত চেতনা থেকে আমার মধ্যে জাতীয়তাবাদের জন্ম ও বিকাশ ঘটে। কিন্তু সে কালে বাঙ্গালী ও পূর্ব বঙ্গের প্রতি পশ্চিম পাকিস্তানীদের উপেক্ষা ও বঞ্চনা আমার এই বোধকে প্রেরণা ও শক্তি যুগিয়েছিল। বিশেষত এর ফলে তৎকালে সাধারণ বাঙ্গালীর ভিতরে বাঙ্গালী হিসাবে পশ্চিমা বিরোধী যে চেতনার প্রসার ঘটছিল সেটাকে ব্যবহার করে স্বায়ত্তশাসন ভিত্তিক দাবীকে পাকিস্তান-বিরোধী স্বাধীনতার দাবীতে পরিণত করার কাজ করা আমার জন্য সহজতর হয়েছিল।
বাঙ্গালী জাতীয়তাবাদকে আমি কেন এভাবে বা এত গুরুত্ব দিয়ে নিয়েছিলাম সেটা আরও স্পষ্ট করার জন্য আরও কিছু কথা এভাবে বলা বোধ হয় যুক্তিসঙ্গত হবে যে, যে মুহূর্তে আমি লোকবাদী বা নিরীশ্বরবাদী হই সেই মুহূর্ত থেকে একদিকে যেমন আমার অলোকবাদী ধর্মবিশ্বাস নষ্ট হয়, অপর দিকে তেমন আমাদের সমাজে ইসলাম ধর্মের ভয়ঙ্কর ক্ষতির দিক দেখতে পাই। ধর্মবিশ্বাস হারাবার ফলে বাঙ্গালী হিসাবে আমার চেতনা তো প্রবল হয়েছিলই কিন্তু তার চেয়েও বেশী যে ঘটনাটা গুরুত্বপূর্ণ ছিল সেটা হচ্ছে অনেক আগে থেকে আমার ভিতরে মানবিক বোধের যে বিকাশ ঘটছিল সেটার হঠাৎ বিস্ময়কর বিচ্ছুরণ। ক্লাস এইট থেকে আমি মানবতার শত্রু হিসাবে ইসলামকে দেখতে পাই।
হিন্দুদের উপর মুসলমানদের ধারাবাহিক নির্যাতন ও তার ফলে হিন্দুদের দেশত্যাগ আমাকে ভয়ানক কষ্ট দিত। যতদিন আমার ইসলাম বা ধর্মে বিশ্বাস ছিল ততদিন এটা তেমনভাবে আমাকে আলোড়িত করত না। কিন্তু আমার চৈতন্যের জাগরণ ঘটবার পর আমার কাছে তখন ছিল এটা একটা অসহনীয় যন্ত্রণাদায়ক অভিজ্ঞতা, যা আমাকে আজ অবধি ভোগ করতে হচ্ছে।
আর একটা কারণ আমাকে তীব্রভাবে ইসলাম-বিরোধী করে। সেটা হচ্ছে ইসলামের ভয়ঙ্কর নারী বিদ্বেষী ও নারী নিগ্রহী চরিত্র। এছাড়া ইসলামী সমাজের সহিংস, অসহিষ্ণু ও নিপীড়ক রূপ এবং স্থূল ভোগবাদী মানসিকতা আমার ভিতর ইসলাম-বিরুদ্ধতাকে তীব্রতর করে। ক্রমে ইসলামকে আমি সমাজ ও সভ্যতার ভয়ঙ্কর শত্রু হিসাবে চিনতে শিখি। শুধু আমাদের দেশ বা সমাজের জন্য নয়, সারা পৃথিবীর মানুষ এবং মানবতার শত্রু হিসাবে আমি ইসলামকে চিনতে শিখি। আমি শুধু সাম্রাজ্যবাদ-বিরোধী নয়, ইসলাম-বিরোধীও হয়ে উঠি। যত অভিজ্ঞতা হয়, যত পড়াশুনা করি তত আমার ভিতরে এই বোধ তীব্রতর হয়ে উঠে। কোনও ধর্মের প্রতি আমার যে পক্ষপাতিত্ব ছিল তা নয়, কিন্তু ইসলামের সঙ্গে অন্যান্য ধর্মকে মিলিয়ে এক করে দেখতাম না।
বিশেষ করে আমার ভিতরে নারীর প্রতি ছিল তীব্র মমত্ব ও শ্রদ্ধা বোধ। মুসলমান সমাজের নারী নিগ্রহী রূপ আমাকে ভয়ানক পীড়া দিত। নারীর প্রতি মমত্ববোধ থেকে স্কুল জীবন থেকেই আমি বিপ্লবী জীবন বেছে নিবার প্রেরণা পাই। সেই বিচারে বলা যায় আমার জীবনের মূল চালিকা শক্তি বা প্রেরণা নারীর মুক্তি। এটা শুধু ইসলামী সমাজের জন্য নয়, বরং সমগ্র পৃথিবীর নারীর মুক্তির জন্য। আমি নারীর মুক্তি ও অধিকারের যে রূপ কল্পনা করতাম সেটা মার্কসবাদ বা কমিউনিজমেও দেখতে পেতাম না। তত্ত্বে বা কথায় যা-ই বলা হত বাস্তবে সোভিয়েত ইউনিয়ন বা চীনকে আমার মনে হত পুরুষ শাসিত রাষ্ট্র ও সমাজ। শ্রমিক শ্রেণীকে আমি মূলত পুরুষের শ্রেণী মনে করতাম। সুতরাং মার্কসবাদকে আমি পুরুষের প্রতিনিধিত্বকারী দর্শন মনে করতাম, নারীর প্রতি সহানুভূতি রাখলেও তা প্রধানত নির্যাতিত শ্রমজীবী পুরুষ এবং তার মুক্তির বিষয় নিয়ে ভেবেছে মনে হত। এটাকে নারীর প্রতি একটা সহানুভূতিশীল দর্শন হিসাবে দেখতাম। কিন্তু এটাকে নারীর মুক্তির দর্শন হিসাবে বিবেচনা করতাম না। অর্থাৎ সমাজতন্ত্র হলেই নারীর প্রকৃত মুক্তি হয় এটা আমি বিশ্বাস করতাম না। দশম শ্রেণীতে যখন আমি পড়তাম তখনই আমার ভিতরে এই চিন্তা স্পষ্ট রূপ নিয়েছিল। আমি বিষয়গুলি নিয়ে ভাবতাম। কিন্তু এসব নিয়ে কারও সঙ্গেই তেমন একটা আলোচনা করতাম বলে মনে হয় না। আসলে এর আগে যে কথা বলেছি আমার চিন্তা এবং অনুভবের জগতে আমি খুব একা মানুষ ছিলাম।
যাইহোক, আমাদের সমাজের বাস্তবতায় আমি ধর্ম বিশেষত ইসলামের বিরুদ্ধে জাতীয়তাবাদকে অতীব শক্তিশালী হাতিয়ার হিসাবে দেখেছিলাম। কমিউনিজম এবং মার্কসবাদকেও আমি ধর্মের বিরুদ্ধে হাতিয়ার হিসাবে দেখেছিলাম। কিন্তু মার্কসবাদের ক্ষেত্রে আমার পরবর্তী কালের অভিজ্ঞতা আমাকে ভয়ানক হতাশ করে। মার্কসবাদ কীভাবে মানুষকে মতান্ধ ও মানসিক প্রতিবন্ধী করে তা আমি দেখতে পাই। এটা জাতির বিরুদ্ধে শ্রেণীকে দাঁড় করিয়ে কীভাবে এ দেশের বিপ্লবী সম্ভাবনাকে ধ্বংস করে সেটা আমি দেখেছি। ফলে এটাকে পরিত্যাগ করি। কিন্তু জাতীয়তাবাদ সম্পর্কে আমার ধারণা তা নয়। আমি মনে করি আমাদের সমাজে নারীর মুক্তি, মানবিকতা এবং ভারসাম্যপূর্ণ ও সুপরিকল্পিত উন্নয়নের পথে সবচেয়ে বড় দুই বাধার একটা হচ্ছে অলোকবাদী ধর্ম এবং অপরটা হচ্ছে সাম্রাজ্যবাদ। এই দুই বাধার বিরুদ্ধে লড়াইয়ের প্রধান হাতিয়ার হিসাবে আমি আজও জাতীয়তাবাদকে দেখতে পাই। অর্থাৎ এ দেশে জাতীয়তাবাদ আমার কাছে একটা রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক বিপ্লবের হাতিয়ার। পূর্ব বঙ্গের বুকে স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার পর এই জাতীয়তাবাদেরই পরিণত রূপ হচ্ছে বঙ্গরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যকে গ্রহণ করা। বঙ্গরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হলে জাতীয়তাবাদের এই ভূমিকা ফুরাবে। তখনকার আদর্শ বা রাজনীতির রূপ কী হবে সেটা পরবর্তী কালের প্রজন্ম ঠিক করবে।
তবে এখানে এ প্রসঙ্গে কথা শেষ করার পূর্বে এ কথা বলে নিই যে, আমি উগ্র জাতীয়তাবাদ বিরোধী। সুতরাং এ দেশে সকল সংখ্যালঘু জাতিসত্তার আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকারে আমি বিশ্বাস করি। অর্থাৎ আমার জাতীয়তাবাদ হচ্ছে আপাদমস্তক গণতান্ত্রিক এবং আমি যে ধরনের সামাজিক বিপ্লবে বিশ্বাস করি এই জাতীয়তাবাদ হবে তার হাতিয়ার।
আমার কথা হল সমাজ বিপ্লব করতে গেলে তো আগে হাতে একটা রাষ্ট্র লাগবে। সেই রাষ্ট্রের ভিত্তি এই মুহূর্তে বর্তমান বাংলাদেশ-রাষ্ট্র হলেও একটা রাজনৈতিক বিপ্লবের মাধ্যমে রাষ্ট্রটার পুনর্গঠন লাগবে। কারণ ’৭১-এর জাতীয় বিপ্লব অসমাপ্ত রয়েছে। এই বিপ্লবকে সমাপ্ত করার প্রয়োজনে তথা রাষ্ট্রের পুনর্গঠনের প্রয়োজনে বঙ্গরাষ্ট্রের লক্ষ্যকে সামনে রাখতে হবে। এর ফলে জনচেতনায় যে উল্লম্ফন বা উত্তরণ ঘটবে তা সম্ভব করবে এখানে একটা সফল রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক বিপ্লব সংঘটন। পুনরায় বলি বঙ্গরাষ্ট্র এবং বাঙ্গালী জাতীয়তাবাদ আমার কাছে বিপ্লবের হাতিয়ার। সেই বিপ্লব সম্পর্কে আমার ধারণার সঙ্গে কমিউনিস্টদের কল্পস্বর্গীয় ধারণা না মিলতে পারে। কিন্তু আমি মনে করি আমার ধারণা বাস্তবসম্মত। আমি কমিউনিস্টদের মত পৃথিবী ও মানুষের সব সমস্যার চিরন্তন বা শেষ সমাধানে বিশ্বাস করি না। আমার কাছে মানুষের শেষ বিপ্লব বলে কিছু নাই। সুতরাং সাম্যবাদ বা কমিউনিজমের মত শেষ সমাধান আমার কাছে নাই।
আমার মনে হয় আমি মার্কসবাদী রাজনীতি ছেড়ে কেনই বা এ ধারণায় অর্থাৎ বঙ্গরাষ্ট্রের ধারণায় কাজ করার প্রণোদনা পেয়েছি তা কিছুটা হলেও এই আলোচনায় স্পষ্ট করতে পেরেছি।
প্রশ্ন : ৮। এবার বলুন আপনার লেখার বিষয়টি শুরু হলো কখন থেকে এবং কেন।
উত্তর : ৮। আমার মনে হয় এ প্রশ্নের উত্তর ইতিমধ্যে মূলত দেওয়া হয়েছে। আমি লিখেছি প্রধানত আমার রাজনৈতিক তাড়না থেকে। এছাড়া পত্র-পত্রিকায় লিখি নাই তা নয়, তবে সেগুলির সংখ্যা কম।
আমার অবশ্য আর একটা দিক ছিল যা প্রায় কেউ বহুকাল পর্যন্ত জানত না। সেটা হচ্ছে কবিতা লিখা। কবিতা আমি ভাল লিখতাম তা নয়, কিন্তু নিঃসঙ্গ অনেক সময়কে আমি ভরিয়ে রাখতাম কবিতা লিখে, যেগুলির পাঠক ছিলাম সাধারণত আমি নিজে। ১৯৭২ পরবর্তী কালে আমার খুব সামান্য কিছু সংখ্যক কবিতা পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত হলেও এই দিকটাতে আমি তেমন একটা মন দিই নাই। তবে সম্প্রতি আমার কিছু সংখ্যক কবিতা ওয়েবসাইট বঙ্গরাষ্ট্র-এ প্রকাশ করেছি। এ ছাড়া ‘স্বপ্নের কাল মিছিলের কাল’ নামে একটা কাব্যগ্রন্থ ব-দ্বীপ প্রকাশন কর্তৃক প্রকাশিত হয়েছে।
প্রশ্ন : ৯। আপনি যখন রাজনীতিতে সক্রিয় ছিলেন তখনকার পার্টি ও কমরেডদের সম্পর্কে বলুন।
উত্তর : ৯। অর্থাৎ পাকিস্তান কালে আমি যখন কমিউনিস্ট পার্টি করতাম কিংবা কমিউনিস্ট নেতাদের সঙ্গে সম্পর্ক থাকত বা হত তাদের সম্পর্কে বলব, এই তো? আমার মনে হয় এর মধ্যে কিছু বলা হয়েছে। তবে বললে আরও বহু কিছু বলা যায়। কারণ আমি পার্টি অল্প দিন করলেও পার্টির সঙ্গে বা তার নেতাদের সঙ্গে আমার নানানভাবে যোগাযোগ হত। আমি পরিশ্রমী কর্মী ছিলাম। ফলে আমার গুরুত্ব তৈরী হয়েছিল। মজার ব্যাপার হল আমি যাদের রাজনৈতিক লাইন সমর্থন করতাম না সেই মস্কোপন্থী নেতা-কর্মীরা আমাকে সবচেয়ে বেশী পছন্দ করত। আমিও মানুষ হিসাবে এদেরকে পরবর্তী কালে যারা পিকিংপন্থী হয়েছিল তাদের থেকে সব দিক থেকে উন্নত বিবেচনা করতাম। অথচ আমি যাদেরকে গুণাবলীর বিচারে নিকৃষ্টতর মনে করতাম তাদের সঙ্গে রাজনীতি করার পথ বেছে নিয়েছিলাম বিপ্লব করতে চেয়ে।
এখানে আর একটা কথা বলা বোধ হয় উচিত হবে সেটা হচ্ছে হিন্দু সমাজ থেকে আসা কমিউনিস্ট নেতাদেরকে আমার মুসলিম সমাজ থেকে আসা নেতাদের চেয়ে অনেক উন্নততর মানুষ মনে হত। এমন কি পিকিংপন্থী রাজনীতি করতে আসা হিন্দু পটভূমির নেতাদেরও অধিকাংশকে আমি মানুষ হিসাবে মুসলিম পটভূমির নেতাদের চেয়ে অনেক উন্নত বিবেচনা করতাম। যেমন অনেক সীমাবদ্ধতা থাকলেও আজও যখন সুখেন্দু দস্তিদারের কথা স্মরণ করি তখন তার জীবনাচরণের কথা স্মরণ করলে শ্রদ্ধায় মাথা নত হয়। তার রাজনীতি এ দেশের আর সব কমিউনিস্টের মত ভুল ছিল, কিন্তু তার বিনয় নম্র আচরণ, তার জীবনব্যাপী ত্যাগ, তার আদর্শনিষ্ঠা - এসবের মহিমাকে আমি কী করে খাটো করে দেখব? এ কথা বলতে আমার দ্বিধা নাই প্রধানত হিন্দু সমাজ-উদ্ভূত কমিউনিস্টরাই আমার সামনে চিরকাল মহত্তর আদর্শের জন্য লড়াইয়ের দৃষ্টান্ত হয়ে থেকেছেন। তাদের পথ ও পদ্ধতি সম্পর্কে আমার যে সমালোচনাই থাক এক অর্থে তাদের উত্তরাধিকারকে আমি আমার চেতনায় ধারণ করি।
আমার বিবেচনায় তাদের একটা অন্যতম প্রধান সমস্যা ছিল রাষ্ট্র ক্ষমতা দখলের চিন্তাকে বাদ দিয়ে কমিউনিস্ট মতাদর্শ বা রাজনীতিকে জনপ্রিয় করার জন্য বিভিন্ন ধরনের সামাজিক-সাংস্কৃতিক আন্দোলন ও কর্মকাণ্ডকে অগ্রাধিকার দান করা। রাজনৈতিক আন্দোলন তাদের ছিল; কিন্তু এ দেশীয় বুর্জোয়া রাজনীতিকদের সহযোগী শক্তি হিসাবে যতটা সম্ভব ততটাই ছিল। ক্ষমতা দখলের বা রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার ভাবনা তাদের ছিল না। তাদেরকে সমাজ সংস্কারবাদী বলা উচিত। প্রকৃত অর্থে তারা রাজনৈতিক শক্তি নয়। কারণ রাজনীতির সঙ্গে রাষ্ট্র ক্ষমতার সম্পর্ক ওতপ্রোতভাবে জড়িত। ক্ষমতার পরিবর্তে কমিউনিস্ট মতাদর্শ ও সর্বহারা শ্রেণী চরিত্র অর্জনের নামে নীতি-নৈতিকতার চর্চা ও ত্যাগের সাধনায় তারা নিজেদের এবং কর্মীদের সকল শক্তি নিঃশেষ করতেন।
ক্ষমতা বিমুখ এই কমিউনিস্টদেরকে অনেকটা খ্রীষ্টান পাদ্রী বা বৌদ্ধ সন্ন্যাসীদের সঙ্গে মিলানো যায়। তাদের এই ক্ষমতা বিমুখতার অবশ্য একটা বাস্তব সামাজিক ভিত্তি ছিল। প্রধানত হিন্দু সমাজ থেকে আসায় পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর তাদের পক্ষে এ দেশের রাজনীতিতে নেতৃত্বমূলক ভূমিকা পালন করা আর সম্ভব ছিল না। এই অবস্থায় তারা রাষ্ট্র ক্ষমতা দখলের স্বপ্ন কীভাবে দেখবেন? ক্ষমতা দখলের রাজনীতি বাদ দিয়ে সমাজকে দীর্ঘ প্রক্রিয়ায় সংস্কার ও পরিবর্তনের দিকে নেওয়াই তাদের রাজনীতি হয়ে দাঁড়াল। এটাকে যদি রাজনীতি বলা যায় তবে এটা রাজনীতি। কিন্তু এর সঙ্গে বিপ্লব ও ক্ষমতা দখলের কোনও প্রকার সম্পর্কই ছিল না। ক্ষমতা দখল করতে চাইলে আগে পাল্টা নিজস্ব ক্ষমতা গঠন করতে হয়। ক্ষমতা দখলের স্বপ্ন যার নাই সে কেন এবং কীভাবে নিজস্ব ক্ষমতা গঠন করবে?
এদের তুলনায় পিকিংপন্থী কমিউনিস্ট যারা হয়েছিল তাদের মধ্যে ক্ষমতার চিন্তাটা কিছু বেশী ছিল। কিন্তু সেখানেও ছিল মতাদর্শিক অন্ধতা। ফলে মার্কসবাদ এবং আন্তর্জাতিক কমিউনিস্ট আন্দোলনের অভিজ্ঞতার বাইরে গিয়ে এ দেশ ও সমাজের বাস্তবতায় দাঁড়িয়ে বিপ্লবের সমস্যা ও রূপ বুঝবার চেষ্টা করা এবং পাল্টা ক্ষমতা গঠন ও রাষ্ট্র ক্ষমতা দখলের চিন্তা তারা করে নাই। শেষ পর্যন্ত মস্কো-পিকিং উভয় পন্থীরই সমস্যা হচ্ছে এ দেশের বাস্তবতার প্রেক্ষিতে স্বাধীনভাবে চিন্তার অক্ষমতা।
এখানে এ কথা বলে রাখা উচিত হবে যে, ১৯৬২-’৬৩ থেকে বিভিন্ন সময়ে আমি কমিউনিস্ট নেতাদের সঙ্গে কথা বললেও পার্টির সদস্য হই অনেক পরে; ১৯৬৯-এ। সুখেন্দু দস্তিদার ছিলেন আত্মগোপনে থাকা নেতা। এ ছাড়া আত্মগোপন অবস্থায় থাকা নেতা আব্দুল হকও আমার সঙ্গে মাঝে মাঝে কথা বলতেন। তিনি হুলিয়া প্রত্যাহার হলে ১৯৬৬ সালে প্রকাশ্যে আসেন। তখন তার সঙ্গে আরও বেশী কথা বলার সুযোগ হত। এ ছাড়া প্রায়শ কথা হত ভাষা আন্দোলনের সাবেক নেতা এবং তৎকালীন কমিউনিস্ট নেতা আব্দুল মতিনের সঙ্গে। প্রথমে যখন তাকে জেল থেকে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হয় সেই সময় আমাকে তিনি লোক মারফত দেখা করার জন্য খবর দিলে আমি তার সঙ্গে দেখা করি। সেটা সম্ভবত ১৯৬৫ সাল। এরপর ১৯৬৬-তে তাকে জেল থেকে মুক্তি দিলে তার সঙ্গে আমার মাঝে মাঝে দেখা ও কথা হত। কমিউনিস্ট নেতা আলাউদ্দীন আহমদ পাবনার ঈশ্বরদীতে থাকতেন। সেখানে তার বাড়ী। তিনি মাঝে মাঝে ঢাকায় এলে তার সঙ্গে কখনও দেখা ও কথা হত।
যাইহোক, তৎকালীন কমিউনিস্ট পার্টি এবং কমরেডদের সম্পর্কে এ ছাড়া বেশী কিছু বলার আগ্রহ অন্তত এখন পাচ্ছি না। এদের সম্পর্কে বলতে গেলে অনেক পীড়াদায়ক ও তিক্ত স্মৃতি চলে আসে। কী দরকার আজ সে সব কথা তুলবার! তারা অনেক আগেই এ দেশের রাজনীতিতে অপ্রাসঙ্গিক হয়ে গেছেন। আজ থেকে ২০-২৫ বৎসর আগে যখন তারা কিছু প্রাসঙ্গিক ছিলেন তখনও রাজনৈতিক প্রশ্ন বাদে তাদের সম্পর্কে বিশেষ কিছু বলি নাই। যতদূর মনে হয় রাজনৈতিক বিরোধের প্রশ্নে লিখিতভাবে প্রথম কিছু কথা বলেছি ১৯৯৬ সালে লিখা এবং ২০০২ সালে ব-দ্বীপ প্রকাশন কর্তৃক প্রকাশিত গ্রন্থ ‘রাজনীতির পুনর্বিন্যাসꞌ-এ। তাও যতটা সম্ভব ব্যক্তিগত বিষয়গুলাকে এড়িয়েছি।
এখন শুধু একটা কথা বলে এ প্রসঙ্গে বলা শেষ করি সেটা হচ্ছে পিকিংপন্থায় যারা গিয়েছিল তাদের চিন্তা ও আচরণের স্থূলতা ও আক্রমণাত্মকতা আমার জন্য ছিল পীড়াদায়ক। তারা বোধ হয় মনে করত যে বিপ্লবী হতে হলে অনাবশ্যক হলেও অভদ্র, আক্রমণাত্মক ও অসহিষ্ণু হতে হবে। মতপার্থক্য দেখলেই অনেক ক্ষেত্রে এরা হিংস্রভাবে প্রতিপক্ষকে আক্রমণ করে যেন আক্রোশ মিটাত। প্রধানত মুসলিম সমাজ থেকে উদ্ভূত এই কমিউনিস্টরা মুসলিম সমাজের মূল প্রবণতা ও বৈশিষ্ট্যগুলিকে যে সাধারণভাবে ধারণ ও প্রতিফলিত করবে সেটা অবশ্য স্বাভাবিক। বিশেষত যারা দীর্ঘকাল শ্রমিক ও কৃষক আন্দোলনের মধ্য দিয়ে এসেছিল তাদের অনেকের স্থূলতা ও নিকৃষ্টতা ছিল চোখের পড়ার মত। তারা নেতা হবার কারণে তাদের আচরণ ও প্রবণতা দ্বারা কর্মীরা সহজে প্রভাবিত হত। আমার সৌভাগ্য যে শ্রেণীচ্যুত হয়ে সর্বহারার শ্রেণী চরিত্র অর্জনের তাড়নায় তাদের নিকৃষ্টতাকে আমি আত্মস্থ করতে পারি নাই। ’৭১-এ আমি যখন বুঝেছি যে এ দেশে কমিউনিস্ট রাজনীতি বিপ্লবে চূড়ান্তভাবে ব্যর্থ প্রমাণিত হয়েছে এবং বিপ্লবের প্রশ্নে এর আর কোনও প্রকার ভবিষ্যৎ নাই তখন এর পিছনে পণ্ডশ্রম না করে ‘৭২ থেকেই বিপ্লবের বিকল্প পথ সন্ধানে আমি নূতন করে যাত্রা শুরু করি।
প্রশ্ন : ১০। স্বাধীনতার পর বাংলাদেশের রজনীতি আওয়ামী লীগ-বিএনপি এ দুটি বুর্জোয়া ধারা দ্বারা নিয়ন্ত্রিত ও পরিচালিত হচ্ছে। এ দুই ধারার মধ্যে ন্যূনতম গণতন্ত্রের লেশমাত্র নেই। তাদের এতো ব্যর্থতার পরেও জনগণ তাদেরকেই গ্রহণ করছে। এই যে জনগণের মনস্তত্ত্ব - এ নিয়ে কিছু বলুন।
উত্তর : ১০। আওয়ামী লীগ-বিএনপি বলে কথা নয়, এ দেশে যে কোনও জনপ্রিয় ও জননির্ভর পার্টি অন্তর্বস্তুতে বা ভিতরে গণতান্ত্রিক যদি হয়ও তবু প্রকাশ রূপের দিক থেকে বা বহিরাঙ্গনে তাকে একনায়কী হতে হবে। এটা ইসলামের একটা সমস্যা। ইসলাম হচ্ছে লা শরীক আল্লাহ্র ধর্ম। আল্লাহ তো ক্ষমতা সম্পর্কে মানুষের ধারণা। অর্থাৎ ইসলামী বা মুসলিম চেতনায় ক্ষমতার কোনও ধরনের বিভাজন নাই। ক্ষমতার বিভাজন বাদ দিয়ে গণতন্ত্র হতে পারে না। যেটা হতে পারে সেটা হচ্ছে একনায়কতন্ত্র। অথচ মুসলিম মানস একনায়ক খুঁজে বেড়ায়। যদি কোনও দল এক ব্যক্তিকে সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী হিসাবে দেখাতে ব্যর্থ হয় তাহলে তারা স্বাভাবিকভাবে ভোটের রাজনীতিতে দাঁড়াতে পারবে না। এমনকি ব্যাপক জনপ্রিয় দল হিসাবেও গড়ে উঠতে পারবে না।
এ প্রসঙ্গে হয়ত পাকিস্তান আমলে ন্যাপের দৃষ্টান্ত দিয়ে আমার এই সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করা হবে। হ্যাঁ, ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (ন্যাপ) ছিল গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে পরিচালিত দল। কিন্তু সেটা ছিল তার ভিতরের রূপ। কারণ মওলানা ভাসানী কোনও সিদ্ধান্ত চাপাতেন না বা এককভাবে নিতেন না। দলের কেন্দ্রীয় কমিটির সংখ্যাগুরু সদস্যদের দ্বারা গৃহীত সিদ্ধান্তকেই তিনি বাইরে এগিয়ে নিতেন। কিন্তু সেটা ভিতরের বিষয়। বাইরের মানুষের কাছে ন্যাপ মানেই ছিল ভাসানী। গোটা পার্টি যে তার নামে পরিচিত ছিল শুধু তা-ই নয়, উপরন্তু জনগণ সাড়া দিত তার ডাকেই। অর্থাৎ অন্তরঙ্গে গণতান্ত্রিক কিন্তু বহিরঙ্গে একনায়কী ছিল বলে ন্যাপ সে কালে গণ-মানুষের দল হয়ে উঠতে পেরেছিল। এখানে অন্তত জনসমক্ষে বা জনচেতনায় একজনকে কেন্দ্র করেই দল পরিচিত হবে এবং দাঁড়াবে। এর অন্যথা করতে গেলে সে দল ব্যাপক জনসমর্থন নিয়ে দাঁড়াবে না। এটা বিপ্লবী, অবিপ্লবী, বুর্জোয়া, সমাজতন্ত্রী, ইসলামী, লোকবাদী বা নিরীশ্বরবাদী যে কোনও রাজনৈতিক দলের জন্য প্রযোজ্য। যতদিন পর্যন্ত ইসলামী সংস্কৃতি বা চেতনা সমাজে আধিপত্য বজায় রাখবে ততদিন পর্যন্ত এই অবস্থাকে বদলানো যাবে না।
অবশ্য রাজনীতিতে এই ধরনের একনায়কতন্ত্রের প্রভাব শুধু যে ইসলামের একচেটিয়া বিষয় তা নয়। আধুনিক যুগে এটা অনেকটা রাজতন্ত্রের জের। এটা প্রকৃতপক্ষে সমাজের পশ্চাৎপদতার ফল, যা পশ্চাৎপদ সমাজগুলির রাজনীতিতে প্রতিফলিত হয়। আধুনিক সভ্যতা ও গণতান্ত্রিক চেতনার বিকাশের ফলে ইউরোপে একনায়কের আবেদন আর নাই। কিন্তু মধ্যযুগ হতে আধুনিক যুগে উত্তরণের কালপর্বে সেখানেও আমরা একনায়কদের ভূমিকা দেখতে পাই। ইংল্যান্ডে বুর্জোয়া বিপ্লবের ঊষালগ্নে ক্রমওয়েল এবং ফরাসী বুর্জোয়া বিপ্লবের সময় রোবেসপিয়ের আর তার কিছুপরেই নেপোলিয়ন, আবার সমাজতান্ত্রিক রুশ বিপ্লবে লেনিন এবং সমাজতান্ত্রিক চীন বিপ্লবে মাও সে-তুং - এদের দিকে দৃষ্টি দিলেই আমরা সমাজে বুর্জোয়া বিপ্লব কিংবা সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের ক্ষেত্রেও একনায়কী নেতৃত্বের ভূমিকা ও তাৎপর্য বুঝব। লেনিন বা মাওয়ের ক্ষেত্রে হয়ত বলা হবে যে, তাদের একনায়কতন্ত্র ছিল গণতান্ত্রিক কেন্দ্রীকতার ভিত্তিতে। কিন্তু সেটা তো ভিতরের ব্যাপার। আসলে এক অর্থে সব ধরনের নেতৃত্বই যৌথ। কারণ একা কেউ নেতা হয় না। একদল লোক তাকে নেতা বানায়। এখন কোন পদ্ধতিতে নেতা বানায় এবং কীভাবে নেতৃত্ব পরিচালিত হয় তার উপর নির্ভর করে নেতৃত্ব গণতান্ত্রিক নাকি একনায়কী।
পশ্চাৎপদ সমাজগুলির জন-মানস এমন একজন মাত্র নেতা বা নায়ককে দেখতে চায়, যার আড়ালে থাকবে বাকী সবাই। সুতরাং এই রকম সমাজে বিপ্লব তথা সমাজের পশ্চাৎপদতা ও স্বৈরতা থেকে উত্তরণের প্রয়োজনেও একটা পযার্য়ের জন্য হলেও গণতান্ত্রিকতাকে আড়ালে রেখে পাল্টা বা বিপ্লবী স্বৈরতা বা একনায়কতন্ত্রকে সামনে রাখতে হয়। আজকের চীনের কমিউনিস্ট পার্টির দিকে দৃষ্টি দিলে বুঝা যায় তার ভিতর গণতন্ত্র কত বেশী দৃশ্যমান। কিন্তু এটা বিপ্লব পরবর্তী বিকাশ। পরিবর্তন ও উন্নয়নের একটা পর্যায়ে এসে চীনের পার্টি তার ভিতরের গণতান্ত্রিকতাকে ক্রমেই বেশী করে সামনে আনছে। একটা পর্যায়ে সেটার সঙ্গে হয়ত পাশ্চাত্যের বহুদলীয় গণতন্ত্রের তেমন কোনও দৃশ্যমান পার্থক্য থাকবে না। যাইহোক, আমার বক্তব্য হল যেহেতু ইসলাম ভয়ঙ্কর পশ্চাৎপদতায় ও এক ধরনের সহিংস আদিমতায় সমাজ-মানসকে ধরে রাখে সেহেতু সেখানকার পশ্চাৎপদ ও সহিংস আদিম সমাজ-মানসকে হিসাবে না নিয়ে কিছু করা যাবে না।
এ প্রসঙ্গে আমার বক্তব্য শেষ করার পূর্বে বলি ন্যাপের কেন্দ্রীয় কমিটির সিদ্ধান্তের তোয়াক্কা না করে ১৯৬৮ সালের ডিসেম্বরে ভাসানী যখন একক সিদ্ধান্ত বলে গণ-আন্দোলন শুরু করেন তখন বুঝা গেল ব্যক্তি-নেতা এ দেশে কত গুরুত্বপূর্ণ। এই আন্দোলন অচিরেই ১৯৬৯-এ গণ-অভ্যুত্থানে পরিণত হয়। এভাবে তিনি চীনপন্থী কমিউনিস্টদের দ্বারা অনুসৃত ‘ডোন্ট ডিস্টার্ব আইয়ুব লাইনꞌকে একক সিদ্ধান্ত বলে উৎখাত করলেন। যেহেতু এতদিন যারা তাকে ঘিরে রেখেছিল সেই কমিউনিস্ট নেতৃত্বও আর তার সঙ্গে ছিল না এবং ছয় দফার সমান্তরালে তার কোনও জাতীয় কর্মসূচীও ছিল না সেহেতু এরপর জাতীয় আন্দোলনের নিয়ন্ত্রণ মুজিব ও আওয়ামী লীগের হাতে চলে যায় এবং কমিউনিস্টরাও কিছুদিনের মধ্যে যার যার মত তাকে তথা ন্যাপ ছেড়ে চলে যায়। তাতে একা হবার দরুন ভাসানীর ক্ষতি হল ঠিক, কিন্তু কমিউনিস্টদের লাভ কতটা হয়েছে তার সাক্ষী তো এ দেশের ইতিহাস।
তবে আমি মনে করি ভাসানীর এই একক সিদ্ধান্ত ছিল ঐতিহাসিক গুরুত্বসম্পন্ন। কারণ তার সিদ্ধান্তের ও ভূমিকার পরিণতিতে ঘটেছিল ’৬৯-এর গণ-অভ্যুত্থান। আমার বিবেচনায় ’৬৯-এর গণ-অভ্যুত্থান না হলে ’৭১-এর জাতীয় মুক্তি যুদ্ধ হত না। ’৬৯ ছিল ’৭১-এর মহড়া। পুনরায় এভাবে চলে আসে এ দেশের জন-মানসে ব্যক্তির ভূমিকার গুরুত্ব। তবে এ প্রসঙ্গে বলা দরকার যে, চাইলেই কেউ ভাসানী বা সমপর্যায়ের নেতা হয়ে উঠতে পারে না। নেতাকে সৃষ্টি করে সমাজ ও জনতা। আবার বিপ্লবী নেতা বিভিন্ন সংগ্রামের মধ্য দিয়ে সেই সমাজ ও জনতাকে নিজ নেতৃত্বের উপযোগীও করে নেয়। অর্থাৎ বিপ্লবী নেতৃত্ব দ্বিপাক্ষিক প্রক্রিয়ার ফল।
যাইহোক, আমার বক্তব্যটা স্পষ্ট - আমাদের সমাজে বিপ্লবী বা অবিপ্লবী যে কোনও রাজনীতি করতে গেলে আগে এ দেশের মুসলিম জন-মানসকে বুঝতে হবে। তার চেতনার মূল বৈশিষ্ট্য এবং প্রবণতা বুঝে কর্মপন্থা নির্ধরণ করতে হবে। এর জন্য ইসলাম এবং এ দেশের ইতিহাস-ঐতিহ্য ও সামাজিক বৈশিষ্ট্যকে বুঝতে হবে। আমি আমার বিভিন্ন লেখায় ইসলাম, মুসলিম এবং সেই সঙ্গে বাঙ্গালী জন-মানসের সমস্যা ও বৈশিষ্ট্যগুলি আলোচনা করার চেষ্টা করেছি। এগুলি না বুঝে এখানে বিপ্লব করা যাবে কী করে? এমনকি এখানকার বিপ্লবের বৈশিষ্ট্য এবং সমস্যাও তো ইউরোপ-রাশিয়া এবং চীনের মত খ্রীষ্টান ও বৌদ্ধ সমাজগুলির সমস্যা ও বৈশিষ্ট্য থেকে ভিন্ন হবার কথা। সেটাই হয়েছে। আর তাই ইউরোপ-রাশিয়া-চীনের তত্ত্ব ও অভিজ্ঞতা আমাদের তেমন কোনও কাজে লাগে নাই। বরং যখন সেগুলিকে অনুসরণ করে এখানে বুর্জোয়া সমাজ নির্মাণের চেষ্টা হয়েছে তখন যেমন ব্যর্থতা এসেছে, যেমন এ চেষ্টা আজ অবধি এখানে ব্যর্থ, তেমন যখন সেগুলিকে অনুসরণ করে এ দেশে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের চেষ্টা হয়েছে তখন সেগুলিও ব্যর্থ বা বিপর্যস্ত হয়েছে। বিভিন্ন সফল বিপ্লবের অভিজ্ঞতার মূল্য অনেক। কিন্তু নিজ সমাজ ও দেশের বাস্তবতাকে মাথায় রেখে সেগুলি থেকে খুব সতর্কভাবে শিক্ষা নিতে হয়।
যাইহোক, এ প্রসঙ্গে কথা শেষ করার আগে বলতে হয় যে আওয়ামী লীগ-বিএনপি-এর মত বিদ্যমান সমাজ ও রাষ্ট্র ব্যবস্থার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ দলগুলি শুধু যে বাইরের রূপ তথা বহিরঙ্গে একনায়কী এবং গণতন্ত্র বিরোধী হবে তা-ই নয়, উপরন্তু ভিতরে বা অন্তরঙ্গেও একনায়কী এবং গণতন্ত্র বিরোধী হবে। কারণ সমাজের বিদ্যমান স্বৈরতান্ত্রিক ব্যবস্থা ও জনগণেরও স্বৈরতন্ত্রের উপযোগী চেতনার পরিবর্তন নয়, বরং বিদ্যমান ব্যবস্থা ও চেতনাকে ব্যবহার করে জনপ্রিয় হওয়া এবং রাষ্ট্রক্ষমতায় যাওয়াটাই তাদের রাজনীতির মূল বিবেচ্য। সুতরাং তাদের রাজনীতি ও দল পরিচালনা পদ্ধতি হয় আপাদমস্তক একনায়কী। ফলে দলের চরিত্র হয় সম্পূর্ণ রূপে একনায়কী ও অগণতান্ত্রিক। গণতন্ত্র যেটা থাকে সেটা থাকে মুখের কথায়, যার সাথে কাজ বা চর্চার কোনও সম্পর্ক থাকে না।
এই রকম সামাজিক বাস্তবতায় আমাদের দেশে বিদ্যমান বহুদলীয় ব্যবস্থাধীনে গণতন্ত্র হলে সেটা হতে পারে বড় জোর এমন একটা ব্যবস্থা যেখানে জনগণ নির্বাচনের মাধ্যমে পাঁচ বৎসর পর পর একনায়ক পরিবর্তনের একটা সুযোগ পেতে পারে। এই একনায়করা দল পরিচালনা করবে চরম স্বৈরাচারীর মত, আবার ক্ষমতায় গেলে রাষ্ট্রও পরিচালনা করবে একই রকম স্বৈরাচারীর মত। দলের ভিতরে তারা যেমন নিরঙ্কুশ রাজা বা রাণী, রাষ্ট্র ক্ষমতা হাতে পেলে সেখানেও তারা তেমন নিরঙ্কুশ রাজা বা রাণী। এই ব্যবস্থা প্রকৃতপক্ষে গণতন্ত্রের আবরণে এমন স্বৈরতন্ত্র, যা সমাজের পশ্চাৎপদতা এবং এ দেশে সাম্রাজ্যবাদী আধিপত্যকে রক্ষা করে। কাজেই সাম্রাজ্যবাদী বিশ্বব্যবস্থার রক্ষকরাও এতে তুষ্ট থাকে। আমাদের দেশের বিদ্যমান বুর্জোয়া ধারার রাজনৈতিক দল ও নেতারা পুতুল-নাচের পুতুলের মত যে খেলা খেলে সেই খেলার সূতা ধরা থাকে মূলত সাম্রাজ্যবাদী বিশ্বব্যবস্থার পরিচালক পাশ্চাত্যের বৃহৎ রাষ্ট্রগুলার হাতে, দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পর থেকে যাদের নেতৃত্ব ধরা আছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের হাতে।
প্রশ্ন : ১১। সারা বিশ্বেই তো বাম রাজনীতির নাজুক অবস্থা। অপরদিকে পুঁজিবাদী-সাম্রাজ্যবাদী ব্যবস্থাও জোর-জবরদস্তির মধ্যে টিকে আছে। এক্ষেত্রে কোন দার্শনিক দৃষ্টিভঙ্গি আছে, যা পুঁজিবাদী ব্যবস্থার বিকল্প হতে পারে?
উত্তর : ১১। বাম রাজনীতি বলতে যদি কমিউনিস্ট রাজনীতিকে বুঝানো হয় তবে এ কথা সঠিক। কিন্তু বাম রাজনীতি বলতে যদি বিদ্যমান সাম্রাজ্যবাদী বিশ্ব ব্যবস্থার অধীনস্থ নিজ পশ্চাৎপদ সমাজ ব্যবস্থাকে ভেঙ্গে স্বাধীন, উন্নত ও মানব কল্যাণমুখী ব্যবস্থা নির্মাণের সংগ্রামের অগ্রযাত্রাকে বুঝানো হয় তাহলে বোধ হয় এ কথা বলা পুরাপুরি ঠিক হবে না। সাম্রাজ্যবাদ-বিরোধী সংগ্রামে আজ লাতিন আমেরিকার দেশে দেশে যে সাফল্য আসছে সেটাকে বাম রাজনীতির জয়যাত্রা ছাড়া আর কীভাবে ব্যাখ্যা করা যাবে? এটা সনাতন কমিউনিস্ট বা কমিউনিজমের লক্ষ্যাভিমুখী সমাজতান্ত্রিক ধারার রাজনীতি না হতে পারে কিন্তু এটা সমাজতন্ত্র ও গণতন্ত্রের এক নূতন ধারার বিকাশ ঘটাচ্ছে। তবে এশিয়ার অবস্থাটা এই মুহূর্তে অনেকটা ভিন্ন। আবার এশিয়ার চীনের উন্নয়নকে যদি হিসাবে নেওয়া যায় তবে আশাবাদী হবার কারণ আছে। চীন পাশ্চাত্যের পুঁজিবাদী-সাম্রাজ্যবাদী উন্নয়নের ধারণার বিকল্প বা পাল্টা ধারণা উপস্থিত করেছে। আইএমএফ-এর হিসাবেই চীনের অর্থনীতি এখন মার্কিন অর্থনীতিকে ছাড়িয়ে এক নম্বরে অবস্থান করছে। সুতরাং অর্থনীতির বিচারে চীন এখন পৃথিবীর এক নম্বর পরাশক্তি। সাম্রাজ্যবাদ আধিপত্যাধীন পৃথিবীর দেশ ও জাতিগুলির জন্য এটা ভাল ঘটনা নয় কি?
আমার মনে হয় পুঁজিবাদ ও সমাজতন্ত্র সম্পর্কে আমাদের মধ্যে যে ধারণাগত কাঠামো আছে সেটাকে বদলাতে হবে। এই দুই ধারণাই প্রকৃতপক্ষে শিল্প নির্ভর সমাজ ও সভ্যতা নির্মাণের দুইটি পদ্ধতি বা ব্যবস্থাকে প্রতিনিধিত্ব করে। আধুনিকায়ন ও শিল্পায়নের পথ সম্পর্কে এই দুই ধারণাই পশ্চিম ইউরোপ থেকে উদ্ভূত। আকাঙ্ক্ষায় যার যা খুশী তা-ই থাক সমাজতন্ত্রও প্রকৃতপক্ষে পুঁজিবাদ, তবে এটা ব্যক্তিমালিকানাধীন পুঁজিবাদ না হয়ে রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন পুঁজিবাদ। কারণ তত্ত্বে যা-ই বলা বা লিখা হোক এই ব্যবস্থায় সমাজের প্রতিনিধি হিসাবে পুঁজির উপর মালিকানা ও নিয়ন্ত্রণ রাখে রাষ্ট্র। সোভিয়েত ইউনিয়ন এবং চীন থেকে শুরু করে কিউবা পর্যন্ত সব সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রেরই অভিজ্ঞতা আমাদেরকে এই ঘটনাকে চিনতে শিখিয়েছে।
এটা শুধু যে আমি বলছি তা নয়, উপরন্তু অনেক পরিচ্ছন্ন দৃষ্টির বিপ্লবী নেতা লেনিনও রুশ বিপ্লব পরবর্তী সময়ে এটা বুঝতে পেরেছিলেন। এই কারণে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের পর সোভিয়েতে যে ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল সেটাকে তিনি ‘রাষ্ট্রীয় পুঁজিবাদ’ বা State Capitalism বলেছিলেন। তবে তার আশা ছিল রাষ্ট্রে এবং উৎপাদনের ব্যবস্থাপনায় শ্রমিকসহ সমগ্র শ্রমজীবী জনগণের ব্যাপক ও প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণ ও নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে এক সময় সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা হবে। সেটা কোনও দিন কি হয়েছে? হয় নাই। কারণ কমিউনিজম বা সাম্যবাদের মত এই ধরনের সমাজতন্ত্রও কল্পস্বর্গ বা ‘ইউটোপিয়া’। সুতরাং একটা আমলাতান্ত্রিক রাষ্ট্র হিসাবে ৭৪ বৎসর টিকে থাকার পর সোভিয়েত ইউনিয়ন বিদায় নিয়েছে।
সমাজতান্ত্রিক বা কমিউনিস্ট রাষ্ট্রে বিপ্লব পরবর্তী কালে কামউনিস্ট পার্টির নেতৃত্বে কীভাবে জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন নূতন শাসক শ্রেণী হিসাবে আমলা শ্রেণী গড়ে উঠে তার জীবন্ত বিবরণ আমরা পাই বিখ্যাত যুগোস্লাভ কমিউনিস্ট নেতা মিলোভান জিলাসের লিখা ‘নূতন শ্রেণী’ বা The New Class নামে বই থেকে। যুগোস্লাভিয়ার কমিউনিস্ট পার্টির তিনি ছিলেন অন্যতম প্রধান নেতা। তাছাড়া তিনি ছিলেন যুগোস্লাভিয়ার ভাইস প্রেসিডেন্ট। আমি পড়েছিলাম যে যুগোস্লাভ প্রেসিডেন্ট ও কমিউনিস্ট নেতা মার্শাল টিটোর বন্ধু ছিলেন তিনি। । কিন্তু বিপ্লব পরবর্তী কালে তার ভিন্নমতের কারণে টিটো তাকে জেলে পাঠান। যতদূর মনে পড়ছে জেলে বসে তিনি পঞ্চাশের দশকে এই অসাধারণ গ্রন্থটি লিখেন এবং সেখান থেকে এটিকে পশ্চিম ইউরোপে পাঠাতে সক্ষম হলে সেখানে এটি প্রকাশিত হয়।
যাইহোক, পুঁজিবাদ ও সমাজতন্ত্র সম্পর্কে কথা উঠালে এবং এগুলির গভীরে যেতে চাইলে অনেক কথা চলে আসে। যেমন পুঁজিবাদ বলতে আমরা ব্যক্তি মালিকানাধীন শিল্পপুঁজির ব্যবস্থাকে বুঝি। আর সমাজতন্ত্র বলতে সাধারণভাবে রাষ্ট্রের মালিকানাধীন শিল্পপুঁজির ব্যবস্থাকে বুঝি। এখন শিল্প পুঁজি আধুনিক কালের ব্যবস্থা হলেও পুঁজি যেমন শুধু আধুনিক কালের ব্যবস্থা নয় তেমন ব্যক্তি মালিকানাও নূতন কোনও ব্যবস্থা নয়। প্রাচীন যুগেও ব্যক্তি মালিকানা ছিল। কখনও সেটা জমির উপর, কখনও হস্তচালিত কারখানার উপর, কখনও খনির উপর এবং কখনও ব্যবসা বা বাণিজ্যের উপর। সভ্যতার সূচনা থেকেই আমরা ব্যক্তিমালিকানার বিভিন্ন রূপের সন্ধান পাই। একইভাবে রষ্ট্র বা সমাজের মালিকানাও ইতিহাসে নূতন কোনও ঘটনা নয়।
মধ্যযুগ বা প্রাচীন যুগের ভারতবর্ষ বা চীনের ইতিহাসের দিকে যদি দৃষ্টি দিই তা হলে রাষ্ট্র বা সমাজের মালিকানাকে আমরা বিভিন্নভাবে কার্যকর থাকতে দেখব। প্রাচীন বা মধ্য যুগের চীনের ইতিহাসে দেখা গেছে রাষ্ট্র কখনও উৎপাদন ও বাণিজ্যের বিভিন্ন জায়গায় ব্যাপকভাবে নিজ মালিকানা ও নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করেছে। আবার কখনও বিরাষ্ট্রীয়করণ করে সেগুলিকে ব্যাপকভাবে ব্যক্তির হাতে ছেড়ে দিয়েছে। এটা বেশ কিছুকাল পর পর পর্যায়ক্রমে চলত। এটাকে কীভাবে ব্যাখ্যা করা যাবে? অথচ আধুনিক যুগের ব্যক্তিপুঁজিবাদ, গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র ইত্যাদি সংক্রান্ত কোনও ধারণাই তখন সেখানে থাকবার কথা নয়। রাজা বা সম্রাটের শাসনাধীনেই এসব ঘটনা ঘটত। অর্থাৎ রাষ্ট্রের প্রয়োজনে এভাবে অর্থনীতির পরিচালনা ব্যবস্থায় পরিবর্তন ঘটত।
একইভাবে আমরা যদি ভারতবর্ষের অতীত ইতিহাসের দিকে দৃষ্টি দিই তবে ব্যক্তিমালিকানার পাশে রাষ্ট্রীয় মালিকানার রূপ দেখতে পাব। শুধু ভারতবর্ষ বলে কথা নয় সাধারণভাবে প্রাচ্যের সমাজগুলিতে বিশেষত জমিতে রাষ্ট্রের মালিকানা বা নিয়ন্ত্রক ভূমিকা মার্কসেরও চোখে পড়েছিল। তিনি রাষ্ট্রের এই প্রাধান্যকারী ভূমিকাকে উৎপাদনের এশীয় ধরন বা Asiatic Mode of Production বলে উল্লেখ করেছেন।
এই ব্যবস্থায় ব্যক্তির মালিকানা থাকে রাষ্ট্র বা সমাজের অধীনস্থ হয়ে। যেমন ভারতের কথা ধরা যাক। এখানে জমি যে চাষ করত তার উপর কৃষকের মালিকানা ছিল শর্ত সাপেক্ষ। সে চাষ না করলে জমির উপর তার মালিকানা থাকত না। জমি ক্রয়-বিক্রয়ও ছিল। তবে সেসবও শর্তসাপেক্ষ। কৃষকদের উপর ছিল জমিদার। জমিদাররাও ইউরোপীয় সামন্তের মত জমির মালিক নয়। তারা নির্দিষ্ট ভূখণ্ড বা এলাকার খাজনা আদায়কারী মাত্র। সবার উপরে ছিল রাজা বা সম্রাট। এক অর্থে তারা ছিল সমস্ত জমির মালিক। তবে তাদের মালিকানাও প্রকৃতপক্ষে সমাজের মালিকানার একটা রূপ। মোগল শাসনামলে ফরাসী চিকিৎসক ও পর্যটক বার্নিয়েরের ভ্রমণ বৃত্তান্তে আমরা ভারতীয় মালিকানা রূপের জীবন্ত বিবরণ পাই।
এ প্রসঙ্গে আলোচনা শেষ করার পূর্বে বলি গ্রাম সমাজ বা ‘ভিলেজ কমিউনিটি’কে না বুঝলে প্রাক-ব্রিটিশ ভারতীয় সমাজকে বুঝা যাবে না। ভারতীয় সমাজ এবং বিশেষত তার কৃষি ব্যবস্থা দাঁড়িয়েছিল মূলত তার গ্রাম সমাজ কাঠামোর উপর, যার পরিচালনা বা নিয়ন্ত্রণ ভার ছিল মূলত পঞ্চায়েতের হাতে। গ্রাম সমাজের নিজস্ব পরিচালনা ব্যবস্থা ছিল পঞ্চায়েত। পঞ্চায়েতগুলি গ্রামের কৃষক ও অন্যান্য পেশার জনগণের স্বশাসনের এক ধরনের ব্যবস্থা। এ ক্ষেত্রে হিন্দু ধর্মের শ্রম-কর্ম বিভাজনমূলক বর্ণজাতিভেদ প্রথার বিশেষ গুরুত্ব ও ভূমিকা ছিল। রাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্ক দেখাশুনা করা, গ্রামের অভ্যন্তরে শ্রম-কর্ম বিভাজনের সামাজিক প্রথার ভিত্তিতে উৎপাদন, সেবা ও শ্রমের দায়িত্ব বণ্টন, গ্রামের শান্তি-শৃঙ্খলা রক্ষা, গ্রামের বাইরের অন্যান্য গ্রাম ও শহরের সঙ্গে উৎপন্ন লেনদেন বা বাণিজ্য - এই সব কিছুর ব্যবস্থাপনায় পঞ্চায়েতের ভূমিকা থাকত।
আমি বিষয়গুলি নিয়ে এত দীর্ঘ আলোচনা করলাম এইজন্য যে মার্কস-এঙ্গেলস অর্থনৈতিক ব্যবস্থা হিসাবে সমাজতন্ত্র বা রাষ্ট্রীয় মালিকানার যে রূপ উপস্থিত করেছেন সেটা পৃথিবীতে নূতন তো নয়ই বরং বহু দেশ বা সমাজেই বহু পরীক্ষিত বা প্রচলিত একটা ব্যবস্থা। তবে এই ব্যবস্থা ছিল প্রাক-শিল্প যুগের সমাজ ও রাষ্ট্র ব্যবস্থার সঙ্গে সংযুক্ত। এর সঙ্গে আধুনিক কালের মার্কসীয় সমাজতন্ত্রের মর্মে অবস্থিত সাম্য, মৈত্রী, স্বাধীনতার মত ধারণা ও আকাঙ্ক্ষাগুলিকে মিলাতে চাওয়া ভুল হবে।
মার্কসবাদ ইউরোপের বুর্জোয়া বিপ্লবের সৃষ্টি। বুর্জোয়া বিপ্লব ইউরোপে মানুষের সাম্য, স্বাধীনতা, মুক্তি ইত্যাদি সম্পর্কে যে আকাঙ্ক্ষা জন্ম দিয়েছিল ব্যক্তিপুঁজির উন্মত্ত রথচক্রে যখন সেই আকাঙ্ক্ষা পিষ্ট হচ্ছিল তখন শিল্প সমাজ ও সভ্যতা নির্মাণের বিকল্প পথের সন্ধান দিয়েছিলেন মার্ক্স এবং এঙ্গেল্স। তারাও ফরাসী বিপ্লবের সাম্য, মৈত্রী, স্বাধীনতার মত এমন কিছু ধ্বনি এবং লক্ষ্য নিয়ে এসেছিলেন যা একটা ঐতিহাসিক কালপর্বে পৃথিবীর এক বিশাল অঞ্চলের পশ্চাৎপদ কৃষি নির্ভর সমাজ থেকে উত্তরণ ঘটিয়ে অত্যন্ত দ্রুত শিল্প নির্ভর সমাজ ও সভ্যতা নির্মাণে মানুষের জন্য বিপুল প্রেরণার কারণ হয়েছিল। পশ্চিম ইউরোপের তুলনায় পিছিয়ে থাকা রাশিয়া, চীনের মত দেশগুলি এই প্রেরণায় অত্যন্ত দ্রুত এবং অবিশ্বাস্য গতিতে পশ্চিম ইউরোপের সমকক্ষতা অর্জন করেছে।
একটা পর্যায়ে এসে মার্কসীয় সমাজতন্ত্র আটকে গেছে। তবে তার পূর্বে শিল্পায়নে তার যে ভূমিকা ছিল সেটা সম্পূর্ণ করেছে। ফলে আরও অগ্রগতির জন্য এখন তার নূতন দর্শন লাগবে। সেটার সন্ধান তাকে করতে হবে।
পশ্চিম ইউরোপও কিন্তু ধ্রুপদী পুঁজিবাদের পথ বহু আগেই ত্যাগ করেছে। সমাজতন্ত্র এবং ব্যক্তিপুঁজিবাদ এই উভয়ের সংযোগ ঘটিয়ে তা অর্থনীতির যে রূপ গড়ে তুলেছে তা জনকল্যাণবাদী অর্থনীতি হিসাবে এখন পরিচিত। এই অর্থনীতির ভিত্তিতে সেখানে জনকল্যাণবাদী রাষ্ট্র গড়ে উঠেছে। সেখানে রাষ্ট্র মানুষের অনেক দায়িত্বই পালন করে, যা আমাদের সমাজে এখনও অকল্পনীয়। ফলে সেখানে বিশুদ্ধ সমাজতন্ত্রের প্রয়োজনও মানুষ অনুভব করে না।
বিশুদ্ধ কিংবা মার্কসীয় সমাজতন্ত্রের প্রয়োজন আমাদেরও নাই। তবে একধরনের সমাজতন্ত্রের প্রয়োজন আমাদেরও আছে। কারণ যে পুঁজিবাদী এবং সাম্রাজ্যবাদী বিশ্ব ব্যবস্থার মধ্যে আমরা আছি তার সঙ্গে ছেদ ঘটাতে না পারলে আমরা স্বাধীনভাবে আমাদের উন্নয়নের নিজস্ব পথ নির্মাণ করতে পারব না। এ দেশে সাম্রাজ্যবাদের নিয়ন্ত্রণমুক্ত ও স্বাধীন জাতীয় পুঁজির বিকাশ ঘটাবার জন্য সমাজতন্ত্রের এই প্রয়োজন রয়েছে। তা না হলে আমরা পাশ্চাত্যের দাসত্ব করে চলব এবং সেই সঙ্গে আমাদের মেধা ও শ্রম নিয়োজিত হবে প্রধানত তাদের সেবায়।
সুতরাং এই ছেদের প্রয়োজনে প্রয়োজন হবে জাতীয়করণের বা রাষ্ট্রীয়করণের। রাষ্ট্রকে বহু কিছুকে নিয়ন্ত্রণে নিতে হবে। কিন্তু এই রাষ্ট্রীয়করণ নিরঙ্কুশ হবে না। ব্যক্তিগত সম্পত্তিও থাকবে। তবে সেটা হবে নিয়ন্ত্রিত। আসলে অনিয়ন্ত্রিত কিছুই হবে না। না রাষ্ট্র, না ব্যক্তি। আমি আমার বিভিন্ন লেখায় এ বিষয়ে আলোচনা করেছি। এখানে এ প্রসঙ্গে বিশেষভাবে ‘মার্কসবাদের সঙ্কট ও বিপ্লবের ভবিষ্যৎ’-এর নাম উল্লেখ করতে চাই। সেখানে ব্যক্তি ও সমাজ বা রাষ্ট্রের মধ্যে ভারসাম্যপূর্ণ সম্পর্কের প্রয়োজনের কথা বলেছি। আমি এও বলেছি প্রগতির প্রয়োজনে কখনও ব্যক্তির অধিকারের উপর বেশী জোর দিতে হয়, কখনও সেই জোর দিতে হয় সমাজ বা রাষ্ট্রের অধিকারের উপর। পরিস্থিতি বলবে কখন কোনটার উপর বেশী জোর দিতে হবে।
যাইহোক, আমি বিদ্যমান দুর্নীতি নির্ভর ও দুর্বৃত্তায়িত সমাজ ও রাষ্ট্র ব্যবস্থা এবং সাম্রাজ্যবাদী বিশ্বব্যবস্থা থেকে মুক্তির প্রয়োজনে সমাজতন্ত্রের প্রয়োজন দেখি। তবে সেটা মার্কসবাদী তত্ত্বের সূত্রে আবদ্ধ সমাজতন্ত্র নয়, যার লক্ষ্য কমিউনিজম। বরং আমার লক্ষ্য এমন সমাজতন্ত্র যেখানে ব্যক্তি মালিকানাও থাকবে সমাজের অব্যাহত সৃষ্টিশীলতা ও গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা রক্ষার স্বার্থে। অর্থনীতির এ ধরনের রূপকে চীন সমাজতান্ত্রিক বাজার অর্থনীতি হিসাবে যে নাম দিয়েছে সেই নামে এটাকে অভিহিত করতে আমার আপত্তি নাই। যাইহোক, আমার ধারণা সাম্রাজ্যবাদেরও পতনের সময় ঘনিয়ে আসছে। তবে পুঁজিবাদ থাকবে না আমি এটা মনে করি না। কারণ কোনও না কোনও রূপে ব্যক্তি মালিকানা থাকবে। কিন্তু পাশ্চাত্যের অধীস্থ ব্যবস্থাধীনে পৃথিবীর যে বিশাল অঞ্চল আজও পড়ে আছে সেগুলা এভাবে আর বেশীকাল থাকবে না। আমাদের মত দেশগুলা পাশ্চাত্যের নিয়ন্ত্রণ ভেঙ্গে ঘুরে দাঁড়াবে।
তবে এতক্ষণ আমি সমাজ পরিবর্তন বা বিপ্লবের বিষয়ে যে সব আলোচনা করলাম তাতে আমাদের মত দেশের বিপ্লবের একটা মৌল বিষয়কে আনি নাই। সেটা হচ্ছে নারীর নিজস্ব ক্ষমতা কাঠামো প্রতিষ্ঠার বিষয়। এটা প্রকৃতপক্ষে রাষ্ট্রের প্রতিটি পর্যায়ে নারীর নিজস্ব প্রতিনিধিত্ব প্রতিষ্ঠার বিষয়। অর্থাৎ নারী-পুরষের সমন্বিত প্রতিনিধিত্বের পাশাপাশি শুধু নারীদের ভোটে নির্বাচিত হয়ে নারীদের প্রতিনিধি হিসাবে নারী প্রতিনিধিরা রাষ্ট্র শাসনের সকল স্তরে অংশ নিবে। তাদের অংশগ্রহণ থাকবে সেনাবাহিনী, পুলিশ, প্রশাসন ও বিচার বিভাগসহ রাষ্ট্রের প্রতিটি অঙ্গ বা সংস্থার নীতি নির্ধারণী পর্যায়ে । এই বিষয়ে আমি আমার বিভিন্ন লেখায় আলোচনা করেছি। যেমন ‘রাজনীতির পুনর্বিন্যাসꞌ। সেখানে দ্বাদশ অধ্যায়ে সম্পূর্ণ রূপে নারীর উপর আলোচনা করা হয়েছে। এর পরেও নারীর উপর আলোচনা করা হয়েছে। আমার ‘নারী ও ধর্মꞌও এখানে উল্লেখ করতে হয়। এছাড়া আরও অনেক লেখায় আমি নারীর নিজস্ব প্রতিনিধিত্ব বা নিজস্ব ক্ষমতা কাঠামো প্রতিষ্ঠার বিষয়টা আলোচনা করেছি। বলা যায় আমার বিপ্লব ভাবনার একটি কেন্দ্রীয় বা অন্যতম প্রধান বিষয় হয়ে আছে নারীর ক্ষমতা কাঠামো প্রতিষ্ঠার বিষয়টি।
আমি মনে করি সমাজ ও সভ্যতায় নারী ও পুরুষ উভয়েরই ভূমিকা সব দিক বিচার করলে সমান। কিন্তু উভয়ে সব বিষয়ে সমান ক্ষমতার অধিকারী নয়। একজনের যে বিষয়ে যোগ্যতা বা সক্ষমতা বেশী অথবা আছে অপরজনের সেটা কম অথবা নাও থাকতে পারে। যেমন পুরুষ গর্ভ ধারণ করতে পারে না। কিন্তু দৈহিক কিছু সুবিধা পুরুষকে এমন কিছু সুবিধা এনে দিয়েছে যার সুযোগ নিয়ে পুরুষ সভ্যতা নির্মাণে ও পরিচালনায় নারীকে চরম বৈষম্য, বঞ্চনা, নিগ্রহ ও অসম্মানের শিকার করেছে। আধুনিক গণতন্ত্রেও পুরুষ-নারীর সমাধিকারের ধারণা রক্ষা করে নারীর প্রতি এই বৈষম্য বজায় রাখা হয়েছে। এটা একটা কৌশল, যে কৌশল দিয়ে সমতার নামে এমন এক অসম প্রতিযোগিতায় নারীকে ঠেলে দেওয়া হয় যে প্রতিযোগিতায় সামষ্টিকভাবে নারীর পরাজয় অবধারিত হয়ে থাকে। এখানে পুরুষের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় ২/১ জন ব্যক্তি-নারীর জয় হতে পারে, ২/১ জন নারী প্রধান মন্ত্রী, রাষ্ট্রপতির মত গুরুত্বপূর্ণ পদও দখল করতে পারে। কিন্ত্র সে ক্ষেত্রে তারা উপস্থিত হয় পুরুষের তথা পুরুষতান্ত্রিক ব্যবস্থার প্রতিনিধি হিসাবে, যেখানে নারীর অবস্থান গৌণ।
আমার বক্তব্য হচ্ছে নারীর সমস্যাটা প্রধানত নারীর। সেটা তাকে বুঝতে এবং সেটার সমাধানও তাকে করতে দিতে হবে। এটা পুরুষের উপর তার আধিপত্য দিবে না। কিন্তু সমাজ ও সভ্যতায় তার জায়গাটা তাকে ছেড়ে দিবে। আমার এই ধারণা এমনই নূতন যে এত সহজে হয়ত আমি এটাকে এখানে ব্যাখ্যা করতে পারছি না। এ ক্ষেত্রে আমার বিভিন্ন লেখা পড়া ছাড়া উপায় দেখি না। আমি ধারণা করি নারীর নিজস্ব প্রতিনিধিত্বের ধারণা আগামী বিপ্লবে একটা নূতন সংযোজন হিসাবে দেখা দিবে। বিশেষত ইসলামী সমাজের জন্য এই ধারণার মূল্য অপরিমেয়। কারণ ইসলামে জনগোষ্ঠীর যে অংশ সবচেয়ে নিগৃহীত এবং অমানবিকতার শিকার সেই অংশ হচ্ছে নারী। ইসলামে প্রলেতারিয়েত বা সর্বহারা শ্রেণী যদি কাউকে বলতে হয় তবে সেটা নারীকে বলতে হবে। অর্থাৎ ইসলামের প্রলেতারিয়েত হচ্ছে নারী।
এখানে এ বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনার সুযোগ নাই। তবে আমার ধারণা আমাদের সমাজের বিপ্লবের রূপ হবে অনেকাংশে নারীবাদী। প্রচলিত ইউরোপীয় অর্থে নারীবাদী বলছি না। আমাদের বিপ্লবের একটা নিজস্ব রূপকে তুলে ধরতে গিয়ে আমি তাকে নারীবাদী বলছি। আমার ধারণা বিপ্লবের নারী কেন্দ্রিক রূপ আমাদের বিপ্লবকে শেষাবধি শুধু ইসলামী পৃথিবীর জন্য নয়, অধিকন্তু সমগ্র পৃথিবীর জন্যও একটা বিশ্বজনীনতা দিবে। আমি অনুমান করি আগামী পৃথিবীর মানুষের মুক্তি ও অগ্রযাত্রায় নারীর ভূমিকা হবে অতীব গুরুত্বপূর্ণ। আগামী পৃথিবীর দর্শন অনেকখানি নির্মিত হবে নারীকে কেন্দ্রে রেখে। অবাধ পুঁজিবাদ ও সাম্রাজ্যবাদের যে উন্মত্ত ভোগবাদ ও ধ্বংসাত্মকতা তা কিন্তু প্রধানত পুরুষ প্রকৃতিকে প্রতিনিধিত্ব করে। সুতরাং শুধু আমাদের দেশে নয়, বরং সমগ্র পৃথিবীতেও ক্ষমতার সকল ক্ষেত্রে নারীর নিজস্ব নিয়ন্ত্রণ ও প্রতিনিধিত্ব প্রতিষ্ঠা করতে হবে। এই জন্য আমি কয়েক বৎসর আগে আমার একটা ইংরাজী ছোট লেখায় আমাদের দেশসহ সকল রাষ্ট্রে এবং সকল রাষ্ট্রের প্রতিনিধিত্ব নিয়ে গঠিত জাতিসংঘেও নারীর নিজস্ব প্রতিনিধিত্ব প্রতিষ্ঠার দাবী তুলেছিলাম। I am for Women’s Political Power নামে লেখাটা ওয়েবসাইট ‘বঙ্গরাষ্ট্র’-এ আছে। এটার প্রকাশ তারিখ মে ৭, ২০০৭।
আমি রাষ্ট্রে বা যে কোনও ক্ষমতা যন্ত্রে নারীর নিজস্ব প্রতিনিধিত্ব বা ক্ষমতা কাঠামোকে পুঁজিবাদেরও বিকল্প দার্শনিক ব্যবস্থা গড়ার অন্যতম উৎস হিসাবে বিবেচনা করি। এই নারী পুরুষতন্ত্রের প্রতিনিধি হবে না, বাংলাদেশে যার কুৎসিত ও কদর্য রূপ আমরা দেখি। এই নারী হবে পুরুষের পাশাপাশি আগামী পৃথিবীর স্বাধীন নির্মাতা। স্বাভাবিকভাবে এই পৃথিবী নির্মাণের জন্য একটা আদর্শ বা দর্শনের প্রয়োজন হবে। সময়ের দাবীতে সেটা আসবেও।
প্রশ্ন : ১২। বাংলাদেশের রাজনীতিতে সাম্রাজ্যবাদী এবং ভারতীয় আধিপত্যের প্রভাব কি আপনি স্বীকার করেন? একটি স্বাধীন রাষ্ট্রের অস্তিত্বের হুমকি কি উপরোক্ত সমস্যাদ্বয় নয়? এ থেকে মুক্তির উপায় আপনার মতে কী হতে পারে?
উত্তর : ১২। বাংলাদেশ যে সাম্রাজ্যবাদের অধীনস্থ একটা দেশ সে কথা ইতিপূর্বে প্রশ্নোত্তরে আমি বলেছি। এটা পূর্ব কালের মত প্রত্যক্ষ উপনিবেশবাদের যুগ নয়। সুতরাং সাম্রাজ্যবাদের আধিপত্য এখন পরোক্ষ রূপে বিদ্যমান। ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদী শাসকরা এখানে তাদের উপনিবেশিক শাসনকালে যে অর্থনৈতিক ও রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা গড়ে তুলেছিল সেই ব্যবস্থাটা আজও সুরক্ষিত রয়েছে। কারণ এই ব্যবস্থার সঙ্গে সংযুক্ত এবং এই ব্যবস্থার সুফলভোগী যে শ্রেণীগুলির হাতে তারা উপমহাদেশের রাষ্ট্র ক্ষমতা হস্তান্তর করে গিয়েছিল তারা আজও রাষ্ট্র ক্ষমতা দখল করে আছে। এ দেশে যাদেরকে বুর্জোয়া বলা হয় তারা প্রকৃতপক্ষে ইউরোপের বুর্জোয়ার মত স্বাধীন নয়, এরা সাম্রাজ্যবাদের অধীনস্থ, অতীতেও ছিল, এখনও আছে। এই অধীনস্থ বুর্জোয়াদেরকে বলা হয় মুৎসুদ্দি বুর্জোয়া। আমাদের বিপ্লবের একটা দায়িত্ব হচ্ছে এই মুৎসুদ্দি বুর্জোয়াদেরকে উচ্ছেদ করা। এরা আমাদের স্বাধীন জাতীয় অর্থনীতি এবং স্বাধীন রাষ্ট্র ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার পথে বাধা, সুতরাং হুমকি তো বটেই।
আমাদের প্রায় তিন দিক পরিবেষ্টনকারী ভারত সম্পর্কে আমার বক্তব্য হচ্ছে ভারতকে আপাত দৃষ্টিতে যতই স্বাধীন মনে হোক তা বিদ্যমান মার্কিন কেন্দ্রিক সাম্রাজ্যবাদী অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক বিশ্ব ব্যবস্থার একটি প্রধান দুর্গ হিসাবে কাজ করছে। সাম্রাজ্যবাদী বিশ্বব্যবস্থার অধীনস্থ এই ভারতকে অধিকার করে রয়েছে ভয়ানক দুর্নীতি, নারীর ভয়াবহ অসম্মান, নিরাপত্তাহীনতা ও নিগ্রহ, পশ্চাৎপদ ও দুর্বল জনগোষ্ঠীসমূহের নিদারুণ বঞ্চিত অবস্থা এবং কয়েক হাজার বছরের প্রাচীন বর্ণজাতিভেদের দৌরাত্ম্য। এই ভারতকে নিয়ে গৌরব করার কিছুই নাই। আর আমাদের জন্য ভারতের গণতন্ত্র যে তামাশামূলক দৃষ্টান্ত শুধু তা-ই নয়, উপরন্তু ভারত-রাষ্ট্রের আগ্রাসী ভূমিকাও আমাদের জন্য বহুবিধ সমস্যা সৃষ্টি করেছে। তার মধ্যে বিভিন্ন নদীর উজানে বাঁধ নির্মাণ ক’রে নদী নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে আমাদের জন্য অসম জল-বণ্টন একটি। এছাড়া আমাদের অর্থনীতির উপরও ভারতের আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। বর্তমান সরকারসহ বিভিন্ন সরকারের ভারত তোষণ নীতি যেমন এর জন্য দায়ী তেমন আমাদের অর্থনৈতিক ও সামাজিক পশ্চাৎপদতাও এর জন্য দায়ী। এটা স্বাভাবিক যে আমাদের অর্থনীতি যদি পিছিয়ে থাকে এবং আমরা যদি দুর্বল থাকি তবে যে শূন্যতা তৈরী হয় তা পূরণ করবে তুলনায় শক্তিশালী প্রতিবেশী রাষ্ট্র হিসাবে ভারত।
মার্কিন নেতৃত্বাধীন সাম্রাজ্যবাদী বিশ্ব ব্যবস্থা এবং ভারতের যে নিয়ন্ত্রণ ও আধিপত্যের অধীনে আমরা আছি তা থেকে মুক্তি পেতে হলে আমাদের দেশে একটি সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক বা রাষ্ট্রিক বিপ্লব প্রয়োজনীয়। আর এই বিপ্লবের সামগ্রিক বিষয়টা আমি আমার উত্তরে ইতিমধ্যে কিছুটা হলেও বলতে পেরেছি বলে আশা করি।
প্রশ্ন : ১৩। বাংলাদেশের বাম রাজনীতিতে অসংখ্য নেতা-কর্মীর আত্মত্যাগের পরও এ দেশে এ রাজনৈতিক ধারা দাঁড়াতে পারছে না কেন? আপনার কাছে কী মনে হয়?
উত্তর : ১৩। এই প্রশ্নের কিছুটা উত্তর বোধ হয় আগের উত্তরগুলিতে এসেছে। তবু আর একটু বলি। মানুষের শ্রেষ্ঠত্ব তার উন্নত বুদ্ধিবৃত্তিতে। যদি সেই বুদ্ধিবৃত্তির ক্ষেত্রে কোন ব্যক্তি বা গোষ্ঠী দেউলিয়া হয় তবে কোনও কাজে সফল হবে কী করে? শুধু ত্যাগ দিয়ে কী হবে যদি সেই ত্যাগের কোনও সঠিক লক্ষ্য ও পন্থা না থাকে? আমাদের দেশে যারা বামপন্থী রাজনীতি করেছেন তারা সাধারণভাবে মতান্ধ হয়ে থেকেছেন। বাস্তব অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা নিয়ে তারা মানুষ এবং এ দেশের সমাজ, রাষ্ট্র এবং বিপ্লবের সমস্যা বুঝবার চেষ্টা যেমন করেন নাই তেমন বাস্তবতা বুঝে করণীয় নির্ধারণ করার চেষ্টাও করেন নাই। যারা এ দেশে বুর্জোয়া রাজনীতি করে তারা যেমন বাস্তব ও চেতনাগতভাবে ব্রিটেন ও মার্কিন তথা পাশ্চাত্যের দাসত্ব করে চলেছে তেমন এ দেশে যারা মার্কসবাদী রাজনীতি ও আদর্শের চর্চা করে তারাও একইভাবে পাশ্চাত্য বা বাহির থেকে আসা রাজনীতি ও আদর্শের দাসত্ব করে চলেছে। চেতনাগতভাবে বামপন্থীরাও এ দেশে স্বাধীন মানুষ নয়। বিপ্লব তো প্রকৃতপক্ষে সমাজের ভিতর থেকে স্বাধীনভাবে সমাজ ব্যবস্থা পরিবর্তনের ঘটনা। চেতনাগতভাবে পরাধীন বা দাস মানুষদেরকে দিয়ে এ কাজ হবে কীভাবে? সুতরাং এ দেশে আজ অবধি বিপ্লবের কোনও চেষ্টাই সফল হয় নাই।
তবু এটা ঠিক যে তাদের সংগ্রামের মধ্য দিয়ে এ দেশের বিপ্লবী আন্দোলনের এমন এক অভিজ্ঞতা ভাণ্ডার সৃষ্টি হয়েছে যার মূল্য অপরিমেয়। যেটার প্রয়োজন সেটা হচ্ছে চেতনাকে অন্ধ বিশ্বাস থেকে মুক্ত করা। এ প্রসঙ্গে এ কথা বলা উচিত হবে যে, প্রধানত ষাটের দশকের বিপ্লবী কমিউনিস্টদের ভূমিকার ফলে ’৭১-এ পূর্ব বাংলার জাতীয় মুক্তি যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছে। বামপন্থীদের অনভিজ্ঞতা, মতাদর্শিক গোঁড়ামি ও অন্ধত্ব এবং আরও বহুবিধ কারণে সেটা অনেকাংশে ব্যর্থ হলেও এর মধ্য দিয়েই রচিত হয়েছে আগামী সফল বিপ্লবের রূপরেখা।
মানুষকে কোনও কাজ করতে গেলে একটা পূর্ব নির্ধারিত বা পূর্ব থেকে পাওয়া ধারণা নিয়ে অগ্রসর হতে হয়। কিন্তু কাজ শুরু করার পর যে অভিজ্ঞতা হয় তার ভিত্তিতে সেই ধারণায় প্রয়োজনে পরিবর্তনও আনতে হয়। অর্থাৎ অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে ধারণাকে পুনর্গঠন করতে হয়। ধারণা বলতে এখানে আমি তত্ত্বকে বুঝাচ্ছি। কারণ তত্ত্বও ধারণা। কিন্তু আমাদের দেশের বামপন্থীরা যুগের পর যুগ একটা ধারণা বা তত্ত্বকে ধর্মান্ধদের মত আঁকড়ে ধরে পড়ে আছে। আসলে এটা সমাজেরও পশ্চাৎপদতার একটা প্রকাশ। ধর্ম এবং সংস্কৃতির কারণে আমাদের সমাজের নিদারুণ চেতনাগত বা বুদ্ধিবৃত্তিক পশ্চাৎপদতার ফলে এই মতবদ্ধতা বা মতান্ধতা সম্ভব হয়েছে। এ দেশে কমিউনিস্ট আন্দোলনের প্রায় শতাব্দী কাল যাবত চলে আসা এত চেষ্টা, এত পরীক্ষা-নিরীক্ষার পরও তারা নিজ দেশ ও পৃথিবীরও অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা নিয়ে এ দেশের বিপ্লবের বিকল্প পথ অন্বেষণ করে না কেন? কারণ সমাজ বা সমাজের অগ্রগামী বা নির্ধারক শক্তিসমূহও এ ধরণের কোনও স্বাধীন চিন্তা বা ধারণাকে ধারণ বা লালন করতে পারে না।
তবে এতে হতাশ হবারও কারণ নাই। কারণ একদিনে বড় কিছুই অর্জন করা যায় না। কোনও সমাজই দীর্ঘ সংগ্রাম ও চেষ্টা ছাড়া স্বাধীনভাবে চিন্তা বা ধারণা করার সামর্থ্য অর্জন করে না। বিশেষ করে ইসলাম মানুষের চিন্তা করার ক্ষমতাকে নিদারুণভাবে রুদ্ধ করে রাখায় সমাজ বা মানুষের গড় চেতনার মান হয় অবিশ্বাস্য রকম নীচু। স্বাভাবিকভাবে এই সমাজে চেতনার জগতে যেটুকু পরিবর্তন ঘটে সেটুকু ঘটে বাহিরের প্রবলতর শক্তির আঘাতে বা তার আধিপত্যের ফলে। এই অবস্থায় এখানে চিন্তার দাসত্ব স্বাভাবিক বাস্তবতা হয়ে আছে। তবে এই অবস্থাও তো চিরন্তন নয়। একটা পর্যায়ে বামপন্থীরা একটা প্রগতিশীল ভূমিকা পালন করেছিল এই রকম এক নিদারুণ পশ্চাৎপদ সমাজকে এগিয়ে নিবার ক্ষেত্রে। স্বাভাবিক নিয়মে সে কাজটা তারা শুরু করেছিল উন্নততর ভিন্ন সমাজ বা বাইরের ধারণা নিয়ে। একটা পর্যায় পর্যন্ত তারা সমাজকে এগিয়েও নিয়েছে। এখন সমাজকে আরও এগিয়ে নিবার জন্য তাদের অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা নিয়ে নূতন চেতনার শক্তি এগিয়ে আসবে, যাদের চেতনা হবে পরনির্ভরতা ও বিদেশনির্ভরতার পরিবর্তে স্বাধীন। মার্কসবাদ বা পুরাতন গৎবাঁধা বামপন্থার অনুসারী না হলেও এরাও হবে বামপন্থী। কারণ এরা হবে বিপ্লবী। এরা চাইবে সমাজ ও রাষ্ট্রের বিপ্লবী রূপান্তর। তবে এরা যেহেতু কমিউনিস্ট হবে না সেহেতু চাইলে এদের বামপন্থার আগে ‘নয়া’শব্দ যোগ করে পরিচয় হিসাবে এদেরকে বলা যেতে পারে নয়া বামপন্থী।
প্রশ্ন : ১৪। আপনি আপনার ‘রাজনীতির পুনর্বিন্যাসꞌ বইয়ে ‘কমিউনিজম কোন দিন এ দেশে আসবে না’- এভাবে বলেছেন। আপনি ‘কেনꞌ এবং কী কী কারণে- এভাবে কথাটি বলতে পারলেন?
উত্তর : ১৪। কথাটা আমি এভাবে বলেছি, ‘কমিউনিজম কোন দিন আসবে না।’ ‘রাজনীতির পুনর্বিন্যাসꞌ গ্রন্থে যে কথাটা বলেছি এবং এর আগে ৩ নম্বর প্রশ্নের উত্তরে যে কথাটা উদ্ধৃত করেছি সেখান থেকে আমি পুনরায় কিছুটা উদ্ধৃত করছি, ‘আমার সে কালের ঘনিষ্ঠ রাজনৈতিক বন্ধু আমজাদ হোসেনকে বিশ্ববিদ্যালয়ে অনার্সের প্রথম কি দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র থাকাকালীন অবস্থায় একদিন বলেছিলাম যে, কমিউনিজম আমাদের আজকের দ্বন্দ্ব, সঙ্কট ও দুঃখ থেকে মুক্তির পথে এগিয়ে যাবার জন্য একটা দিক চিহ্ন মাত্র, তার বেশী কিছু নয় এবং কমিউনিজম কোন দিন আসবে না। কারণ সমাজে দ্বন্দ্বের রূপ বদলাবে, কিন্তু মানুষের সঙ্গে মানুষের দ্বন্দ্ব চিরকাল থাকবে। ফলে দ্বন্দ্বমুক্ত কমিউনিস্ট সমাজ একটা কল্পনা মাত্র। তবু এর প্রয়োজন আছে আজকের দ্বন্দ্ব থেকে মুক্তির জন্য।’
অর্থাৎ আমার বক্তব্যের মর্ম ছিল এই যে শুধু আমাদের দেশ বলে কথা নয়, বরং কোথায়ও কমিউনিজম আসবে না। আমি যখন এ কথা বলেছিলাম তখন এ বিষয়টা আমার কাছে স্পষ্ট ছিল যে, যে দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদের দর্শনের উপর নির্ভর করে কমিউনিজমের রাজনৈতিক তত্ত্ব গড়ে তুলা হয়েছে কমিউনিজমের তত্ত্ব সেই দর্শনেরই বিরোধী। অর্থাৎ কমিউনিজম একটা স্ববিরোধী তত্ত্ব। কমিউনিস্ট সমাজের কল্পনাটা এসেছে অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব বা বিরোধ মুক্ত সমাজ প্রতিষ্ঠার কল্পনা থেকে। এঙ্গেল্স কল্পনা করেছিলেন যে, এই সমাজে মানুষের সঙ্গে মানুষের দ্বন্দ্বের অবসান হবে। কিন্তু মার্কসীয় সূত্র অনুযায়ীই তো দ্বন্দ্ব ছাড়া বস্তু অচল। তাহলে সমাজ চলবে কী করে? এই প্রশ্নের উত্তর এঙ্গেলস দিয়েছেন এভাবে যে, মানুষের সঙ্গে মানুষের দ্বন্দ্ব পরিণত হবে প্রকৃতির সঙ্গে মানুষের দ্বন্দ্বে। তাহলে মানুষ কি বস্তুর নিয়মের বাইরে চলে যাবে কমিউনিস্ট সমাজে? শুধু প্রকৃতির সঙ্গে দ্বন্দ্ব দিয়ে সমাজ অগ্রসর হতে পারবে? এটা দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদ-বিরোধী সিদ্ধান্ত নয় কি?
আমার বক্তব্য হচ্ছে মানুষের সঙ্গে মানুষের দ্বন্দ্ব চিরকাল থাকবে। অর্থাৎ সমাজের ভিতরেও দ্বন্দ্ব থাকবে। এই দ্বন্দ্বের অনেক রূপের মধ্যে শ্রেণীদ্বন্দ্ব একটি। তবে তার রূপ বদল হয় এবং হবেও। আমার বক্তব্য হল আজকের যে দ্বন্দ্ব আমাদের জন্য দুঃখজনক হয়েছে সেগুলির অবসান ঘটাতে হবে। তাতে করে চিরকালের জন্য শ্রেণীদ্বন্দ্বসহ সব দ্বন্দ্বের অবসান ঘটবে এমন নয়। আগামীতে নূতন দ্বন্দ্ব নূতন রূপে আবির্ভূত হবে। অর্থাৎ শ্রেণীদ্বন্দ্বও নূতন রূপে আবির্ভূত হবে। সেটা যখন মানুষের জন্য দুঃখজনক হবে তখন মানুষ তার অবসানের জন্য নূতন করে সংগ্রাম করবে। আমি মনে করি এই দ্বন্দ্ব এবং তার নিরসনের অব্যাহত সংগ্রামের মধ্য দিয়ে মানুষ ও তার সভ্যতা এগিয়ে যাবে। আমার এই বোধ সেই ছাত্র বয়সে আজকের মত করে না হলেও অনেকটাই স্পষ্ট ছিল। যে কারণে আমি মানুষের সব সমস্যার চিরন্তন সমাধান খুঁজতাম না এবং কমিউনিজমের লক্ষ্যকে ভ্রান্ত মনে করতাম। তবে কিছু শর্ত সাপেক্ষে সমাজতন্ত্রের প্রতি আমার সমর্থন ছিল। যাইহোক, কমিউনিজম সংক্রান্ত আমার ধারণা বিস্তারিতভাবে আলোচনা করেছি ‘মার্কসবাদের সঙ্কট ও বিপ্লবের ভবিষ্যৎ’গ্রন্থে।
প্রশ্ন : ১৫। আপনি আপনার ‘রাজনীতির পুনর্বিন্যাসꞌ বইয়ে মস্কোপন্থীদের ‘নির্বীর্য শূদ্র-ব্রাহ্মণ সংস্কৃতির এক আধুনিক সংস্করণ’বলেছেন আর পিকিংপন্থীদের এর উল্টোটা বলেছেন। কিন্তু সিপিবি তো আজ পর্যন্ত বামপন্থীদের মধ্যে বড় রাজনৈতিক দল আর পিকিংপন্থীরা ভেঙ্গে ভেঙ্গে প্রায় কাঁচের টুকরা হয়ে গেছেন। তাহলে শেষ পর্যন্ত কারা টিকে থাকবেন?
উত্তর : ১৫। মস্কোপন্থীদেরকে আমি কখনই বিপ্লবী মনে করি না। এমনকি রাজনৈতিক চিন্তা বা আদর্শ থাকলেও তারা কতটা রাজনৈতিক শক্তি আর কতটা সামাজিক-সাংস্কৃতিক শক্তি সেটা নিয়েই বরং আলোচনা হওয়া উচিত বলে মনে করি। রাষ্ট্র ক্ষমতা দখলের চিন্তা যাদের মাথায় নাই তারা আবার রাজনৈতিক শক্তি হয় কী করে? বিপ্লবী রাজনৈতিক শক্তি হবার তো প্রশ্নই উঠে না। যাইহোক, তবু তাদের যেহেতু রাজনৈতিক কিছু কর্মসূচী আছে এবং জিতুক না জিতুক নির্বাচনে অংশ নেয় সেহেতু তাদেরকে রাজনৈতিক শক্তি বা দল হিসাবে স্বীকৃতি দেওয়া যায়। তবু মনে রাখতে হবে যে, সব দিক বিচার করলে রাজনৈতিক দিকের তুলনায় তাদের সামাজিক-সাংস্কৃতিক দিকটাই প্রধান দিক হিসাবে বেরিয়ে আসে। নারীর প্রতি মর্যাদা, শ্রমজীবীদের অধিকার, সততা, নিয়মানুবর্তীতাসহ কতগুলি নিয়ম-নীতি-মূল্যবোধ ও ধারণা সমাজে প্রচার ও অনুশীলন দ্বারা তারা সমাজে যে ভূমিকা পালন করে সেটারও একটা প্রগতিশীল ভূমিকা আছে। এগুলিকে খাটো করে দেখব কী করে? তবে বিপ্লবটা আলাদা বিষয়। আমার আপত্তিটা তখন যখন তারা বিপ্লবী বা বিপ্লবে নেতৃত্বকারী শক্তি হিসাবে নিজেদেরকে দাবী করে। সেটা তারা কোনও কালেই হতে পারবে না। আশা করি আমি তাদের সম্পর্কে যা বলেছি তা থেকে তারা কেন টিকে আছে তা কিছুটা হলেও বুঝা গেছে।
যারা বিদ্যমান ব্যবস্থাকে ভাঙ্গতে চায় তাদেরকে ঝুঁকি নিতে হয়। যারা ঠিক করেছে তারা কোনও ঝুঁকিই নিবে না টিকে থাকবার ক্ষেত্রে তাদের সমস্যাটা কোথায়? একটা দীর্ঘ ঐতিহ্যের উপর প্রতিষ্ঠিত কোনও ধর্মীয় সংগঠনেরও টিকে থাকাটা সমস্যা নাও হতে পারে। বিশেষ ধরনের সামাজিক সংগঠন হিসাবে কতকগুলি বিশ্বাস, মূল্যবোধ ও আচার-অনুষ্ঠানকে অবলম্বন করে তা যেমন টিকে থাকে, রাজনৈতিক কিছু বিশ্বাস ও আচরণ নিয়ে বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি বা সিপিবিও তেমন টিকে আছে, হয়ত আরও অনেক কাল টিকে থাকবে। কিন্তু তাতে বিপ্লবের কী? রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ভাষায় বলতে হয়, ‘অতিকায় হস্তী লোপ পাইয়াছে, কিন্তু তেলাপোকা সগর্বে টিকিয়া আছে।’ তা তেলাপোকার মত যে কোনও ভাবে টিকে থাকাটাই যদি মানুষের একমাত্র লক্ষ্য হওয়া উচিত হয় তবে সিপিবি অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত হতে পারে। কিন্তু তেলাপোকার মত এভাবে ‘সগর্বে’টিকে থাকা আমার কাছে কোনও অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত নয়।
যত ভুল-ত্রুটি থাক সাবেক চীনপন্থীরা বিপ্লব করতে চেয়েছিল। আর বিপ্লবে ঝুঁকি থাকেই, কম অথবা বেশী। সবচেয়ে বড় কথা পূর্ব অভিজ্ঞতা বা দৃষ্টান্ত থাকে না বলে সব প্রথম বিপ্লব ব্যর্থ হয়। আগেকার বুর্জোয়া বিপ্লবগুলির কথা বাদ দিই। আধুনিক কালের কয়েকটি সফল সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের দিকে দৃষ্টি দিই। রাশিয়ার প্রথম বিপ্লব যেটা ১৯০৫ সালে ঘটেছিল সেটা ব্যর্থ হয়েছিল। এরপর ১৯১৭ সালে দ্বিতীয় বিপ্লব হয় রাশিয়ার পুরাতন ক্যালেন্ডার অনুযায়ী ফেব্রুয়ারী মাসে, কিন্তু রাশিয়ার নূতন ক্যালেন্ডার অনুযায়ী মার্চ মাসে। তখনও লেনিন বা তার বলশেভিক পার্টি ক্ষমতা দখল করে নাই। এই বিপ্লবের মাধ্যমে জারের রাজতন্ত্র উচ্ছেদ হয় এবং অস্থায়ী সরকার ক্ষমতায় আসে। কেরেন্স্কি নেতৃত্বাধীন অস্থায়ী সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করে লেনিন যে বিপ্লবের মাধ্যমে ১৯১৭ সালের ৭ নভেম্বর (পুরাতন ক্যালেন্ডার অনুযায়ী ২৫ অক্টোবর) ক্ষমতা দখল করেন সেটা প্রকৃতপক্ষে তৃতীয় বিপ্লব, যেটা রাশিয়ার পুরাতন ক্যালেন্ডার অনুযায়ী অক্টোবর বিপ্লব হিসাবে সমধিক পরিচিত।
চীনের বিপ্লব তো দীর্ঘস্থায়ী গৃহযুদ্ধ এবং জাতীয় স্বাধীনতা যুদ্ধের ফসল। ব্যাপক ধ্বংস, বিপর্যয় ও মৃত্যুর পথ পার হয়ে আসতে হয়েছে চীন বিপ্লবকে। ১৯১১-১২ সালে সান ইয়াৎসেনের নেতৃত্বে সূচিত গণতান্ত্রিক বিপ্লবের ইতিহাসের কথা না হয় বাদ দেওয়া গেল। ১৯২১ সালে চীনের কমিউনিস্ট পার্টি গঠনের পর থেকে বিপ্লবী আন্দোলনের যে নবতর যাত্রা শুরু হয় তাও কি কম দীর্ঘ এবং কম জটিল? বিশেষ করে ১৯২৭ থেকে ১৯৪৯ পর্যন্ত কমিউনিস্ট পার্টির উত্থান-পতন সমাকীর্ণ যে দীর্ঘস্থায়ী বিপ্লবী যুদ্ধের ইতিহাস রচিত হয়েছে তাকে বাদ দিয়ে কি চীনের বিপ্লবকে বুঝা যাবে?
ভিয়েৎনামের দীর্ঘস্থায়ী গেরিলা যুদ্ধের ইতিহাস আশা করি নূতন করে মনে করিয়ে দিতে হবে না। ১৯৪৫ সালে হো চি মিন ভিয়েৎনামের স্বাধীন গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠার ঘোষণা দেন। এর পরিণতিতে ফ্রান্সের বিরুদ্ধে যে জাতীয় মুক্তি যুদ্ধ শুরু হয় তার চূড়ান্ত পরিণতি ঘটে ১৯৭৫ সালে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদী হানাদারদের দক্ষিণ ভিয়েৎনাম থেকে বিতাড়ন করে ভিয়েৎনামের পুনরেকত্রীকরণ ও পূর্ণ স্বাধীনতা অর্জনের মধ্য দিয়ে। সুদীর্ঘ কালের এই যুদ্ধে ভিয়েৎনামের জনগণকে যে দুঃখ-কষ্ট সহ্য করতে হয়েছে তাকে কোনও ভাষা দিয়ে বুঝানো খুবই কঠিন। এখানে লোকক্ষয় যেমন আছে তেমন আছে বিভিন্ন পর্যায়ের ব্যর্থতা। সুদীর্ঘ কালব্যাপী অনেক চড়াই-উৎরাই পার হয়ে ভিয়েৎনামের জনগণকে বিজয় পেতে হয়েছে।
ক্যাস্ট্রোর নেতৃত্বে কিউবার বিপ্লবের ইতিহাসের দিকে দৃষ্টি দিলেও আমরা দেখতে পাই প্রথম বিপ্লব প্রয়াসের ব্যর্থতা। ১৯৫৩ সালে ক্যাস্ট্রো ১২৩ জনের ছোট বাহিনী নিয়ে সান্টিয়াগোর মনকাদা এবং বাইয়ামোর সামরিক ব্যারাকসমূহ আক্রমণ করলে তিনি পরাজিত এবং বন্দী হন। ক্যাস্ট্রোর বক্তব্য অনুযায়ী সংঘর্ষে ৯ জন নিহত হয় এবং বন্দী করার পর ৫৬ জনকে হত্যা করা হয়। এরপর প্রবল জনমতের চাপে কিউবার একনায়ক বাতিস্তা তাকে মুক্তি দিলে তিনি কিউবা থেকে পালিয়ে বিদেশে যান। সেখানে গিয়ে শক্তি সংগ্রহ করে ১৯৫৬ সালে গ্রান্মা নামে একটা ছোট স্টীমারে করে ক্যাস্ট্রোসহ ৮২ জনের একটি সশস্ত্র বাহিনী কিউবায় অবতরণ করে। অবতরণের পর সরকারী বাহিনীর আক্রমণে ক্যাস্ট্রোর বাহিনীর ব্যাপক ক্ষয়-ক্ষতি হয়। যতদূর জানা যায় ফিদেল ক্যাস্ট্রো, তার ছোটভাই রাউল ক্যাস্ট্রো এবং চে গুয়েভারাসহ সর্বোচ্চ ২০ জন মৃত্যু অথবা বন্দীদশা এড়াতে সক্ষম হন। বাকীরা নিহত অথবা বন্দী হন। এরপর ক্যাস্ট্রো সঙ্গীদেরকে নিয়ে সিয়েরা মায়েস্ত্রা পর্বতে আশ্রয় নেন এবং গেরিলা যুদ্ধ শুরু করেন। ব্যাপক জনসমর্থন নিয়ে তিনি ১৯৫৯ সালে বিজয় অর্জন করেন।
সুতরাং এক বিপ্লব প্রয়াসের ব্যর্থতাকে দৃষ্টান্ত করে সব বিপ্লবকে নাকচ করার চিন্তাকে আমি ভুল মনে করি। আমার বক্তব্য হচ্ছে প্রথম বিপ্লব বা যে কোনও প্রথম বিপ্লব প্রয়াস যে অভিজ্ঞতা দেয় তার মূল্য পরবর্তী বিপ্লবের জন্য অপরিমেয়। পরবর্তী বিপ্লব সফল হতে পারে এই অভিজ্ঞতার যথাযথ সারসংকলন ও তার পরিপ্রেক্ষিতে সঠিক কর্মপন্থা নির্ধারণ করে। সাবেক যে চীনপন্থীরা সে কাজ করতে ব্যর্থ হয়েছে বা হচ্ছে তাদের ব্যর্থতার দায়ভার বিপ্লব কেন নিবে? সেটা তাদেরই।
আমাদের জাতীয় জীবনে এক বিশাল বিপ্লব ঘটেছিল। সেটা ১৯৭১-এর জাতীয় মুক্তি যুদ্ধ। সেটা তো প্রধানত আমাদেরই শ্রম ও চেষ্টার ফসল। প্রথম বিপ্লবের মত এটা এক অর্থে ব্যর্থ হয়েছে বলে কি আমরা বিপ্লবের সব স্বপ্ন বিসর্জন দিব? সাবেক চীনপন্থীদের বিপর্যয়, কাঁচের মত ভেঙ্গে ভেঙ্গে টুকরা টুকরা হওয়া এবং প্রায় বিলুপ্তির অনেক কারণের মধ্যে একটা বড় কারণ হচ্ছে ’৭১-এর তাৎপর্য ও গুরুত্বকে না বুঝা।
কারণ শ্রেণীর বাইরে তাদের মাথা যেতে চায় না। মার্কসবাদের প্রভাবে অনেক সময়েই তারা জাতির বিরুদ্ধে শ্রেণীকে স্থাপন করে। অথচ এখানে উচিত ছিল শ্রেণীকে তথা শ্রেণী সংগ্রামকে জাতির তথা জাতি গঠনের সংগ্রামের অধীনস্থ বা অংশ করা। এখানে বাঙ্গালী জাতি গঠনের কাজটাই অসমাপ্ত হয়ে আছে প্রধানত অলোকবাদী ধর্মের কারণে। আবার জাতি গঠন হয় নাই বলে অলোকবাদী ধর্মের এত প্রতাপ। অথচ এই ধর্মের বিরুদ্ধে না লড়ে এ দেশে প্রগতির পথে এক পাও অগ্রসর হওয়া যাবে না। অন্যদিকে, জাতি গঠনের কাজটা এ দেশে সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী লড়াইয়ের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত। এখানে একটা প্রকৃত স্বাধীন ও শক্তিশালী জাতি এবং তার রাষ্ট্র গঠন সাম্রাজ্যবাদের নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থাকে ভেঙ্গে ফেলবে। সুতরাং অলোকবাদী ধর্মের বিরুদ্ধে লড়াই সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী লড়াইয়েরও অবিচ্ছেদ্য অংশ। বিশেষ করে ইসলাম ধর্মের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের সঙ্গে সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী লড়াইয়ের সম্পর্কের গুরুত্ব ও তাৎপর্য নিয়ে আমি আমার সাম্প্রতিক গ্রন্থ ‘ইসলাম ও আধুনিক সভ্যতা’য় আলোচনা করেছি। যাইহোক, আমার বিবেচনায় এ দেশে বাঙ্গালীর জাতি গঠন এবং জাতি-রাষ্ট্র গঠনের রাজনীতি তথা বঙ্গরাষ্ট্রের রাজনীতি অলোকবাদ এবং সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী সংগ্রামের এক অমিত শক্তিশালী হাতিয়ার।
কমিউনিস্টদের সমস্যা হচ্ছে বিপ্লবের এ দেশীয় সমস্যা ও বৈশিষ্ট্যকে বুঝতে না চাওয়া, যে কথা ইতিপূর্বে আমি বলেছি। এটা শুধু চীনপন্থী নয়, উপরন্তু সব পন্থী কমিউনিস্টেরই সমস্যা।
ধন্যবাদ।
দ্বিতীয় দফায় মাসুদ রানার আরও ৬ টি প্রশ্ন :
১। একাত্তর সালে আপনি কি যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলেন? যদি করে থাকেন তাহলে যুদ্ধের স্মৃতিচারণ একটু করবেন কি?
২। আপনি শুধু ইসলামকে সব কিছুর প্রতিবন্ধক হিসেবে দেখছেন, তাহলে অন্য ধর্ম কি প্রগতিশীল? দেশের সব জনগণকে ইসলাম মুক্ত করলেই কি সমাধান হয়ে যাবে? আর সব মানুষকে কি ইসলাম মুক্ত করা সম্ভব?
৩। আপনি আপনার পূর্ববর্তী বক্তব্যে “বিকল্প তত্ত্ব নির্মাণ”এর কথা বলেছেন। বিকল্প তত্ত্ব নির্মাণ কীভাবে সম্ভব?
৪। অখণ্ড বঙ্গ রাষ্ট্রের যে ধারণা, সেটি বাস্তবায়ন করতে গেলে তো ভারতকে আগে ভাঙ্গতে হবে। শুধু জাতিরাষ্ট্র হিসেবে একটা রাষ্ট্র গঠন হলেই কি মানুষের মুক্তি আসবে? এটার রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক কাঠামো কেমন হবে?
৫। “মার্কসবাদ মানুষের বুদ্ধিবৃত্তি ও চেতনাকে একটা পর্যায়ে নিবার পর তাকে আটকে দেয়, তার অধিকতর অগ্রসর হবার পথে বাধা সৃষ্টি করে।”- পুঁজিবাদ কি এর চেয়ে ভাল কিছু দিতে পেরেছে?
৬। আপনি আপনার সাক্ষাৎকারের অনেক জায়গায় বিপ্লবী রূপান্তরের কথা বলেছেন। আসলে আপনি বিপ্লব বোঝাতে কী বলতে চেয়েছেন?
অনেক সময় দেয়ার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।
দ্বিতীয় দফায় মাসুদ রানার প্রশ্ন এবং শামসুজ্জোহা মানিকের উত্তর :
প্রশ্ন : ১। একাত্তর সালে আপনি কি যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলেন? যদি করে থাকেন তাহলে যুদ্ধের স্মৃতিচারণ একটু করবেন কি?
উত্তর : ১। যদি প্রশ্ন করা যায় যে আমি পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে সম্মুখ যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলাম কিনা তাহলে এক কথায় উত্তর হবে, না। যদি প্রশ্নটা এমন হয় যে আমি পাকিস্তান ও তার সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ সংগঠিত করার জন্য কাজ করেছিলাম কিনা তবে এক কথায় তার উত্তর হবে, হাঁ।
যুদ্ধের স্মৃতিচারণ আমার জন্য খুব কষ্টের। আমি জাতীয় মুক্তি যুদ্ধ সংগঠিত করার জন্য শুধু এ বঙ্গ নয়, পশ্চিম বঙ্গেও ভ্রমণ করেছিলাম। সেসব প্রচুর ঝুঁকি নিয়ে। এ পাশে পাকিস্তানের সেনাবাহিনী আমাকে খুঁজছিল, ও পাশে আমাকে খুঁজছিল আওয়ামী লীগের প্রবাসী সরকার এবং ভারত সরকার বা তার পুলিশ ও গোয়েন্দা বাহিনী। এ সম্পর্কে সামান্য কিছু বিবরণ আমি ‘রাজনীতির পুনর্বিন্যাসꞌ-এ দিয়েছি। এখানে আর সে প্রসঙ্গে বলতে চাই না। শুধু এইটুকু বলি যে, পূর্ব বাংলা ছাত্র ইউনিয়নের তৎকালীন বৃহত্তর রংপুর জিলা ছাত্র ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক শফিক যুদ্ধ শুরু হলে তাতে যোগ দিয়ে পাটগ্রাম সেক্টরে যখন পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করছিল তখন তার সঙ্গে থাকা আওয়ামী লীগের লোকরা তাকে পিছন থেকে গুলি করে হত্যা করে। তৎকালীন বৃহত্তর রংপুর জিলার রউমারীর ছাত্র ও তরুণ কৃষক নেতা আব্দুল মজিদ মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিতে ভারতে অবস্থিত মুক্তিবাহিনীতে যোগ দেয়। যুদ্ধের মধ্যে ভারতীয় সেনা তাকে ধরে নিয়ে যায়। সে ফিরে আসতে পেরেছিল। তবে চিরজীবনের জন্য অসুস্থ হয়ে।
আমি তখন পূর্ব বাংলার কমিউনিস্ট পার্টির তৎকালীন বৃহত্তর রংপুর জিলার সম্পাদক। তারা যে আমার পরামর্শে বা নির্দেশে এভাবে ভারতে গিয়ে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মুক্তিবাহিনীতে যোগ দিয়েছিল তা নয়। ’৭১-এর মার্চে পাক বাহিনীর আক্রমণ অভিযান শুরু হলে তার মোকাবিলায় যে পাল্টা প্রতিরোধ যুদ্ধ শুরু হয় তার টানে তারা ভেসে গিয়েছিল এমন এক স্থানে যেখানে তাদেরকে আঘাত অথবা নিশ্চিহ্ন করার জন্য যে আর একদল শত্রু তৈরী হয়ে আছে সেটাকে তারা হিসাবে নেয় নাই। অবশ্য তৎকালীন রংপুরের এক বৃহৎ অঞ্চল ভারত সীমান্ত সংলগ্ন হওয়ায় ভারত বা লীগ নিয়ন্ত্রিত মুক্তিবাহিনীকে বাদ দিয়ে বা এড়িয়ে যুদ্ধ করা সম্ভব ছিল না। বিশেষত আমাদের পার্টির নিয়ন্ত্রণে গড়ে তুলা কৃষক আন্দোলনের এলাকাগুলি সবই ছিল ভারতের সীমান্ত লাগোয়া।
অবশ্য এই সঙ্গে এ কথাও বলতে হবে যে তারা একটা পার্টির ভুল রাজনীতিরও বলি। যদি আমাদের পার্টির পথ পূর্ব থেকে সঠিক হত তবে তাদেরকে হয়ত এভাবে মূল্য দিতে হত না। অবশ্য তার মানে এই নয় যে আমি এ কথা বলতে চাইছি যে পার্টির পথ সঠিক হলেই মৃত্যু এবং ক্ষয়-ক্ষতি হত না। কোন্ যুদ্ধ মৃত্যু এবং রক্তপাত হীন? তবে অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা লাভের গুরুত্ব সব সময়ই থাকে। পার্টির ভুল রাজনীতির কারণে মৃত্যুর জন্য যে শোক বহন করতে হয় তার ভার অনেক বেশী।
’৭১-এর যুদ্ধে আমার জন্য এটা ভয়ঙ্কর কষ্ট বা মর্মপীড়ার কারণ হয়েছিল যে, স্বাধীনতা যুদ্ধ সংগঠনের প্রতিশ্রুতি দেওয়ায় যে পূর্ব বাংলার কমিউনিস্ট পার্টিতে আমি যোগ দিয়েছিলাম এবং আমার প্রভাব খাটিয়ে তৎকালীন বিপ্লবী ছাত্র ও তরুণ প্রজন্মের বৃহত্তর অংশকে নিয়ে গিয়েছিলাম এবং যে পার্টির শক্তিকে ব্যবহার করে স্বাধীনতার রাজনীতিকে সারা দেশে বিস্তৃত করার লক্ষ্যে কাজ করেছিলাম স্বাধীনতা যুদ্ধ শুরু হলে সেই পার্টির কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব প্রকৃতপক্ষে স্বাধীনতা যুদ্ধ বিরোধী ভূমিকা নিল। সেই সময় আমার ভূমিকাকে এক অর্থে পার্টির লাইন বিরোধী বলা যায়। কারণ আমি শ্রেণী সংগ্রাম ও শ্রেণী শত্রু খতমের নামে জাতীয় যুদ্ধকে বিভক্ত ও ক্ষতিগ্রস্ত করার কাজের বিরোধী ছিলাম। ফলে সারা দেশে যেখানে যেখানে সম্ভব সেখানে সেখানে গিয়ে স্থানীয় নেতা বা পার্টির কর্মীদেরকে স্বাধীনতা যুদ্ধের জন্য সংগঠিত করার কাজ করেছিলাম। সেটা দিনাজপুর-রংপুর থেকে যশোর এবং চট্টগ্রাম পর্যন্ত। তবে পার্টির কেন্দ্রীয় নেতৃত্বকে সঙ্গে নিয়ে কাজটা করার উপর জোর দেওয়ায় আমি পার্টি ভাঙ্গার চিন্তা করি নাই।
এখন তখনকার যুদ্ধের পরিস্থিতিতে আমার কাজের ঝুঁকি এবং সমস্যাকে বুঝানো খুব কঠিন। এই রকম যুদ্ধের পরিস্থিতিতে যখন পাকিস্তান, ভারত, আওয়ামী লীগ সবাই আমার শত্রু বা আমাকে শত্রু মনে করছে এবং অপর দিকে পার্টির নেতৃত্ব আমার বিরুদ্ধ তখন আমি একা পার্টির সঙ্গে থেকে কতটুকু কী করতে পারি? যুদ্ধ দীর্ঘস্থায়ী হবার বাস্তবতা এ দেশে ছিল না। হলে হয়ত আমি পার্টিকে স্বাধীনতা যুদ্ধের পথে পুনর্গঠন করতে পারতাম। যে চেষ্টাটা আমি করছিলাম হয়ত সেটা সফল হত। অবশ্য সেসব আজ অনেক হয়ত এবং যদির শর্তাবদ্ধ। যা হয় নাই তা নিয়ে বাগাড়ম্বর করে কী লাভ? যা হয়েছে সেটাই তো ইতিহাসের বাস্তবতা। এবং যুদ্ধের ভিতর দিয়ে আমি চূড়ান্তভাবে উপলব্ধি করলাম রাশিয়া, চীন, ভিয়েৎনামে যা-ই হোক, আমাদের দেশে যে যত বেশী খাঁটি মার্কসবাদী বা কমিউনিস্ট হবে সে তত বেশী মতিচ্ছন্ন এবং মানসিক প্রতিবন্ধীতে পরিণত হবে।
যুদ্ধের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে আমার কিছু ক্ষোভের কথাও এসে পড়ল। আসলে মার্কসবাদের প্রতি আমার যেটুকু মোহ বা আকর্ষণ ছিল সেটুকু থেকে আমাকে মুক্ত করার জন্য ’৭১-এর যুদ্ধই যথেষ্ট ছিল। তবে কি আমি এ কথা বলব যে, কমিউনিস্ট রাজনীতি করে আমি ভুল করেছিলাম? সেটা আমি কখনই কোথায়ও বলি নাই। কারণ সেটা আমি মনে করি না। এর আগেও প্রশ্নোত্তরে বলেছি যে একটা ধারণা নিয়ে যাত্রা শুরু করতে হয়। মার্কসবাদ ছিল সে কালে আমাদের যাত্রা শুরুর জন্য সেই ধারণা। এটা শুধু কাগজে লেখা ধারণা ছিল না। এই ধারণার পিছনে বাস্তব শক্তি হিসাবে ছিল পরাক্রমশালী সোভিয়েত ইউনিয়ন ও চীন। তাদের অগ্রগতি ও সাফল্য মার্কসবাদী তত্ত্বকে যে মর্যাদা ও শক্তি দিয়েছিল সেটা দিয়েও এই তত্ত্ব বা ধারণার গুরুত্বকে বুঝতে পারতে হবে। সুতরাং আমাদের সমাজে পরিবর্তনের আকাঙ্ক্ষার বিস্তারের সঙ্গে পরিবর্তনের উপায় হিসাবে যে ধারণা নিয়ে আমরা যাত্রা শুরু করেছিলাম সেটা হচ্ছে মার্কসবাদ। প্রকৃতপক্ষে, ষাটের দশকে ঊনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থান ও একাত্তরের স্বাধীনতা যুদ্ধের পূর্বে আধুনিক কালে বড় ধরনের কোনও বিপ্লবী আন্দোলন ও যুদ্ধের অভিজ্ঞতা আমাদের সমাজের ছিল না। সুতরাং আধুনিক পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে অনুশীলিত ও পরীক্ষিত একটা বিপ্লবী তত্ত্ব নিয়ে ইতিপূর্বে আমাদেরকে যাত্রা শুরু করতে হয়েছিল। তত্ত্ব তো আর আকাশ থেকে এসে পড়ে না। এটা অভিজ্ঞতা থেকে উঠে আসে। ১৯৭১ পর্যন্ত ধরলেও একটা দীর্ঘ বিপ্লবী আন্দোলন এবং অবশেষে একটা জাতীয় মুক্তি যুদ্ধ আমাদেরকে যে বিপুল অভিজ্ঞতা দিয়েছে বিকল্প তত্ত্ব নির্মিত হতে পারে তার যথাযথ সারসংকলন এবং মূল্যায়নের মাধ্যমে। সেই কাজ করার চেষ্টা আমি করছি। কতটা পারছি সেটা ভবিষ্যৎ বলবে।
প্রশ্ন : ২। আপনি শুধু ইসলামকে সব কিছুর প্রতিবন্ধক হিসেবে দেখছেন, তাহলে অন্য ধর্ম কি প্রগতিশীল? দেশের সব জনগণকে ইসলাম মুক্ত করলেই কি সমাধান হয়ে যাবে? আর সব মানুষকে কি ইসলাম মুক্ত করা সম্ভব?
উত্তর : ২। আমি শুধু ইসলামকেই সব কিছুর প্রতিবন্ধক হিসাবে দেখছি এ তথ্য তুমি কোথায় পেলে? আমি কি কোথায়ও সে কথা বলেছি? আরও প্রতিবন্ধক আছে। সেগুলি নিয়ে আমার বিভিন্ন লেখায় অনেক আলোচনা আছে। তবে আমার মতে ইসলাম ইসলামী সমাজে এমন প্রধান একটি সমস্যা হয়ে রয়েছে যাকে এড়িয়ে এ সমাজের অগ্রগতি সম্ভব নয়।
ইসলামের সমস্যাকে আমি যথাযথভাবে চিহ্নিত করতে চেয়েছি বলে কি আমি অন্যান্য ধর্মকে প্রগতিশীল বলেছি? আমি কিন্তু অন্যান্য ধর্মকে প্রগতিশীল বলি নাই। আমি আধুনিক সভ্যতার সঙ্গে সকল অলোকবাদী ধর্মের সম্পর্ককে সাংঘর্ষিক মনে করি। আমার সর্বশেষ গ্রন্থ ’ইসলাম ও আধুনিক সভ্যতাꞌয়ও আমি বিষয়টাকে স্পষ্ট করেছি। তবে ইসলামকে আমাদের সমাজের প্রেক্ষিতে সবচেয়ে প্রতিক্রিয়াশীল বলেছি এবং বলি। আমার কথা হল আমাদের সমাজের সমস্যাটা বুঝার উপর যদি আমরা জোর না দিই তবে তার সমাধানের পথ বের করব কীভাবে?
তবে এখানে দুই বিষয়কে বিবেচনায় নিতে হবে। এক, পৃথিবীর ব্যাপকতর জনগোষ্ঠী ইসলাম বাদে আর যে তিন ধর্মসম্প্রদায়ভুক্ত সেই তিন ধর্ম খ্রীষ্টান, বৌদ্ধ এবং হিন্দু ধর্ম ইসলামের মত রাজনৈতিক নয়, বরং অরাজনৈতিক। দুই, ইসলামের উদ্ভব, প্রসার ও প্রতিষ্ঠা হয়েছে যুদ্ধ ও জবরদস্তি তথা বলপ্রয়োগের মাধ্যমে। ফলে এটা মূলত যুদ্ধ, সহিংসতা ও বলপ্রয়োগ নির্ভর একটা রাজনৈতিক ধর্ম।
বাকী তিন ধর্মের প্রসারে সহিংসতা ও যুদ্ধের ভূমিকা কখনও থাকলেও সেটা ইসলামের সঙ্গে তুলনীয় নয়। অবশ্য খ্রীষ্টধর্মে এক সময় যুদ্ধ এবং বলপ্রয়োগ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। তবে সেটা ছিল অনেকাংশে দীর্ঘ আক্রমণ ও নির্যাতনের প্রতিক্রিয়া এবং আত্মরক্ষার তাড়না সম্ভূত। যেমন প্রায় তিনশত বৎসর অহিংস খ্রীষ্টান সম্প্রদায় রোমান শাসকদের হাতে তাদের ধর্মমতের কারণে ভয়ানক নির্যাতনের শিকার হয়েছিল। আর মধ্যযুগের শেষ পর্বে ক্রুসেড ছিল মুসলমানদের হাত থেকে খ্রীষ্টানদের পবিত্র ভূমি জেরুজালেম মুক্ত করার জন্য যুদ্ধ। তার আগে কয়েক শত বৎসর ব্যাপী খ্রীষ্টান অধ্যুষিত পশ্চিম এশিয়া ও উত্তর আফ্রিকায় আরব মুসলিমদের আক্রমণ, দখল, জবরদস্তিমূলক ধর্মান্তরকরণ ও নির্যাতনকে হিসাবে নিতে হবে। মুসলমানরা খ্রীষ্টধর্মকে এই সব অঞ্চল থেকে উখাত করে। তবে খ্রীষ্টধর্মে যুদ্ধ বা বলপ্রয়োগ পরবর্তী কালের আরোপ অথবা তার অবস্থান এমনই গৌণ যা যীশুর শিক্ষা বা মূল ধর্মের ভাবপ্রেরণার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ নয়। যেমন যীশু বলছেন, ‘যে কেহ তোমার দক্ষিণ গালে চড় মারে, অন্য গাল তাহার দিকে ফিরাইয়া দেও।’ (বাইবেল: নূতন নিয়ম, মথি- ৫:৩৯)
বৌদ্ধ ধর্মে বলপ্রয়োগের তেমন কোনও ইতিহাস জানা যায় না। হিন্দু ধর্ম ভারতীয় উপমহাদেশের প্রাচীন সামাজিক প্রথা, বিশ্বাস, ঐতিহ্যকে ধারণ করে বর্ণজাতির কাঠামোতে প্রধানত শান্তিপূর্ণ উপায়ে বৃহত্তর সমাজ নির্মাণের এমন এক জটিল পদ্ধতি উপমহাদেশকে দিয়েছে যার কোনও তুলনা পৃথিবীর আর কোথায়ও মিলে না। হিন্দু ধর্ম বিশ্বজনীনতার কোনও দাবীই করে না। তা উপমহাদেশের গণ্ডীতে আবদ্ধ হয়ে থেকেই তুষ্ট। তা উপমহাদেশে কৃষি নির্ভর সমাজ ও সভ্যতার একটা রূপ হিসাবে টিকে থেকেছে। অলোকবাদী এবং বিশেষ করে বর্ণজাতিবাদের ধর্ম হওয়ায় তার গুরুতর সমস্যা আছে এবং সেটা আমার বিবেচনায় বিপ্লবেরও সমস্যা। এই সমস্যা না বুঝলে হিন্দু সমাজে বিপ্লবের সমস্যার সমাধান করা যাবে না।
কিন্তু যদি কোনও ধর্ম প্রত্যক্ষত এবং প্রধানত রাজনৈতিক না হয়ে সামাজিক হয় তাহলে বিপ্লবের সমস্যাটাও কি সেক্ষেত্রে প্রধানত সামাজিক ও সাংস্কৃতিক হয় না? কিন্তু ইসলামের সমস্যা অনেক ভিন্ন। ইসলাম একই সঙ্গে সামাজিক, রাজনৈতিক ও সামরিক ধর্ম হওয়ায় এখানে বিপ্লবের সমস্যা ইসলামের বিরুদ্ধে সমাজ ও রাষ্ট্র ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার সংগ্রামের সঙ্গে সম্পর্কিত হয়ে দেখা দেয়। অর্থাৎ এখানে বিপ্লবের লক্ষ্যে রাষ্ট্র ক্ষমতা দখলের রাজনীতির সঙ্গে ইসলাম থেকে মুক্তির লড়াই অবিচ্ছেদ্যভাবে জড়িত। সুতরাং ইসলামের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের প্রশ্নটা বিপ্লবের একটা মৌল নীতিগত প্রশ্ন। তবে কখন, কোথায় বা কোন পরিস্থিতিতে লড়াইটা কীভাবে করা হবে সেটা কৌশলগত প্রশ্ন। আগে নীতিগত বিষয়টা আমরা নিষ্পত্তি করি তার পরে কৌশলগত বিষয়টা ঠিক করা যাবে। বিপ্লবের কর্মনীতি নির্ধারণের প্রশ্নটা আগে। তারপর ঠিক করতে হবে সেটা নিয়ে জনগণের কাছে কীভাবে যাওয়া হবে, কীভাবে জনগণকে স্বমতে দীক্ষিত করতে হবে সেই বিষয়।
এখন ইসলাম থেকে সব মানুষের মুক্তি সম্ভব কিনা আর সম্ভব হলেও সেটা কীভাবে সেসব প্রশ্নের উত্তর খুঁজা তো পরের ব্যাপার। আগে তো সমস্যাটাকে বুঝতে পারতে হবে। সমস্যাকে সমস্যা মনে না করলে তার সমাধান পাওয়া যাবে কী করে? সমস্যা হচ্ছে যে কমিউনিস্টরা প্রায় সর্বত্র ইসলামের সমস্যাকে না বুঝে বিপ্লব করতে বা রাষ্ট্র ক্ষমতা দখল করতে গিয়েছিল। তারা পশ্চিম ইউরোপের খ্রীষ্টান সমাজ থেকে উদ্ভূত এবং খ্রীষ্টান ও বৌদ্ধ সমাজ বা রাষ্ট্রগুলিতে অনুশীলিত তত্ত্ব ইসলামী সমাজগুলিতে প্রয়োগ করতে গিয়ে প্রায় সর্বত্র ব্যর্থ হয়েছে। বিশেষত ইন্দোনেশিয়া, ইরান ও আফগানিস্তানে কয়েক মিলিয়ন মানুষকে প্রাণ দিয়ে ব্যর্থতার মাশুল দিতে হয়েছে। এ থেকেও কি আমাদের কিছুই শিক্ষা নিবার নাই? নাকি এ দেশের ‘অভ্রান্ত’এবং ‘কাকাতুয়া’কমিউনিস্টদের মত ঐসব দেশের কমিউনিস্টদের মার্কসবাদ বুঝায় অক্ষমতা অথবা সুবিধাবাদের উপর সব দায়ভার চাপিয়ে দিয়ে বিপ্লবের বাস্তব সমস্যা বুঝবার কঠিন কাজটাকে এড়িয়ে চলব?
এটা আমাদেরকে বুঝতে হবে কেন ইসলামী সমাজগুলি কয়েক শত বৎসর ধরে পাশ্চাত্য সাম্রাজ্যবাদের চারণভূমি হয়ে আছে; কেন এই সমাজগুলি পাশ্চাত্য আধিপত্য, নেতৃত্ব ও নিয়ন্ত্রণ ছাড়া ভিতর থেকে স্বাধীনভাবে উন্নয়ন ঘটাতে সক্ষম হচ্ছে না; কেন এই সমাজগুলি পাশ্চাত্যের প্রভাব বা নিয়ন্ত্রণে থেকেও একটা পর্যায়ের পর উন্নয়নের পথে আর অগ্রসর হতে পারছে না। আমি আমার বিভিন্ন লেখায় সমাজ উন্নয়নের ক্ষেত্রে ইসলামের সমস্যা নিয়ে আলোচনা করেছি। এ প্রসঙ্গে ‘ইসলামের ভূমিকা ও সমাজ উন্নয়নের সমস্যা’র নাম উল্লেখ করা যায়। তাছাড়া আমার সর্বশেষ প্রকাশিত বই ‘ইসলাম ও আধুনিক সভ্যতা’য় অন্যান্য ধর্মের পাশাপাশি ইসলামের সমস্যা নিয়ে কিছু বিস্তারিত আলোচনা করেছি। সেখানে আমি বলতে চেয়েছি যে ইসলামের বিরুদ্ধে বিপ্লবের যুগ এসেছে।
ইসলাম প্রসঙ্গে যে কথাটা এখানে বলার প্রয়োজন বোধ করছি সেটা হচ্ছে বিপ্লব মানে শুধু আইন জারী বা ঘোষণা নয়। বরং এমন মানুষ সৃষ্টি করা যে মানুষরা বিপ্লবী আইন বা ব্যবস্থাকে শুধু প্রতিষ্ঠা নয়, উপরন্তু রক্ষাও করবে। এই মানুষ কি শুধু দুই হাত-দুই পা ওয়ালা প্রাণী হলেই হবে, নাকি তাকে বিপ্লবী চেতনা সম্পন্ন হতে হবে? বিপ্লবের জন্য উপযুক্ত চেতনা সম্পন্ন মানুষ সৃষ্টিটাই যে কোনও সমাজ ও রাষ্ট্র বিপ্লবের প্রধান পূর্বশর্ত। প্রাচীন ধর্ম দ্বারা নিয়ন্ত্রিত সমাজগুলির কোনওটিতেই কি ধর্মের বিরুদ্ধে লড়াই না করে মানুষকে প্রতিক্রিয়াশীল কিংবা প্রতিবিপ্লবী ও পশ্চাৎপদ চেতনা থেকে মুক্ত করে প্রগতিশীল, আধুনিক ও বিপ্লবী চেতনার অধিকারী করা সম্ভব হয়েছে? হয় নাই।
আমি ‘ইসলাম ও আধুনিক সভ্যতা’য় দেখাবার চেষ্টা করেছি কীভাবে ইউরোপে আধুনিক সভ্যতার উদ্ভব ও প্রতিষ্ঠার সঙ্গে বিদ্যমান ধর্ম ও ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান এবং সেই সঙ্গে অনেক ক্ষেত্রে সকল ধরনের ধর্মবিশ্বাসেরও বিরুদ্ধে লড়াই ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে। সেখানে রোমান ক্যাথলিক চার্চের বিরুদ্ধে খ্রীষ্টীয় ধর্মসংস্কার আন্দোলন যেমন হয়েছে তেমন বুদ্ধির মুক্তি বা যুক্তিবাদী আন্দোলনও হয়েছে যা মূলত নিরীশ্বরবাদী। এই সব আন্দোলনের অন্যতম প্রেরণা ছিল ধর্মের আধিপত্য থেকে রাষ্ট্রের মুক্তি এবং ধর্মীয় বিশ্বাস-অবিশ্বাসের প্রশ্নে ব্যক্তির স্বাধীনতা। সেখানে চেতনার জগতে বিপ্লবের পরিণতি হচ্ছে জাতি-রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা, গণতান্ত্রিক বিপ্লব এবং শিল্প বিপ্লব। সেখানে রাষ্ট্রের উপর থেকে ধর্মের যে আধিপত্য ছিল সেটা উৎখাত হয়েছে এবং রাষ্ট্র হয়েছে লোকবাদী। তবে ইসলামের সমাজে কাজটা আজ অবধি খুবই কঠিন হয়ে আছে তার অবিশ্বাস্য রকম পশ্চাৎপদ, বর্বর ও হিংস্র গুহামানবীয় চেতনার জন্য।
পুনরায় বলি, আমি কোথায়ও এ কথা বলি নাই যে ইসলামই একমাত্র সমস্যা যে তা থেকে মুক্ত করলেই সব সমস্যার সমাধান হবে। তা হলে যেখানে ইসলাম নাই সেখানে বুর্জোয়া বিপ্লব কিংবা সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব করতে হয়েছে কেন? আমার কথা, ইসলাম আমাদের সমাজে বিপ্লবের প্রধান সমস্যা। আরও অনেক সমস্যা আছে। কিন্তু ইসলামী সমাজে সব সমস্যার মূলে আছে এই সমস্যা। এই সমস্যার সমাধান বের করতে না পারলে অন্যান্য সমস্যার সমাধান করা যাবে না। বিশেষ করে যে সাম্রাজ্যবাদী বিশ্ব ব্যবস্থায় আমরা বন্দী হয়ে আছি সেখান থেকে আমরা মুক্তি পাব না। এই বিষয়ে আমি ‘ইসলাম ও আধুনিক সভ্যতা’য় আলোচনা করেছি।
আমি ইসলামের সমস্যাটাকে সবাইকে ভাবতে বলছি। সব সমস্যার সমাধান আমার কাছে আছে এমন ভাবাটা কি ভুল হবে না? সেই রকম ভুল দাবী আমিও করি না। ইসলামের ব্যাপারেও সব প্রশ্নের উত্তর আমার কাছে নাই। আমার কথা হচ্ছে সবাই মিলে সমস্যাটাকে আগে বুঝবার চেষ্টা করি। তা হলে ইসলাম থেকে মুক্তি আদৌ পাওয়া যাবে কিনা আর পাওয়া গেলেও কীভাবে পাওয়া যাবে সেসব প্রশ্নের উত্তরও নিশ্চয় পাওয়া যাবে। ইসলামের জগতে এতকাল কাজটা করা যায় নাই ইসলামের প্রাণঘাতী ভয়ঙ্কর হিংস্রতার জন্য। কিন্তু ইন্টারনেট প্রযুক্তির আবিষ্কার ও প্রসার ইসলামকে অসহায় করে ফেলেছে। বেঁচে থাকার জন্য তার চৌদ্দশ’বছরের সবচেয়ে কার্যকর জিহাদী বুদ্ধি তথা হত্যার মাধ্যমে প্রতিবাদী এবং জিজ্ঞাসু কণ্ঠকে স্তব্ধ করার সন্ত্রাসী পদ্ধতি এখন ক্রমবর্ধিতভাবে অকার্যকর এবং হাস্যকর হচ্ছে। সুতরাং একশত ষাট কোটি মানুষ অধ্যুষিত ইসলামী পৃথিবীতে আধুনিক কালের উপযোগী নূতন এক সমাজ ও রাষ্ট্র বিপ্লব আসন্ন হয়েছে। এ বার্তাই আমি ‘ইসলাম ও আধুনিক সভ্যতা’য় দিয়েছি।
প্রশ্ন : ৩। আপনি আপনার পূর্ববর্তী বক্তব্যে “বিকল্প তত্ত্ব নির্মাণ”এর কথা বলেছেন। বিকল্প তত্ত্ব নির্মাণ কীভাবে সম্ভব?
উত্তর : ৩ । আমি যখন ‘বিকল্প তত্ত্ব’-এর কথা বলি তখন সেটা ‘বিপ্লবের বিকল্প তত্ত্ব’বুঝাতে বলি। আমাদের সমাজ ও দেশে সামগ্রিকভাবে বিপ্লবী রূপান্তরের প্রয়োজন আছে। এর জন্য আবার প্রয়োজন রাষ্ট্রিক ও সামাজিক বিপ্লব, যে বিপ্লবের জন্য আবার প্রয়োজন বিপ্লবী তত্ত্ব। আমার বক্তব্য হল সেই তত্ত্ব নির্মাণ হবে আমাদের নিজ সমাজের বাস্তবতা ও তার অভিজ্ঞতার নিরিখে। আমাদের নিজ সমাজের সুদীর্ঘ কালের সাম্রাজ্যবাদ ও পাকিস্তানী আধিপত্য বিরোধী এবং ধর্মীয়সহ বিভিন্ন ধরনের শোষণ ও নির্যাতন বিরোধী নিরস্ত্র ও সশস্ত্র সংগ্রামের অভিজ্ঞতা আমাদের নিজস্ব বিপ্লবের তত্ত্ব নির্মাণের মাল-মশলা যোগাবে বলে আমি মনে করি। পৃথিবীর অন্যান্য দেশ বা সমাজের তত্ত্ব ও বিপ্লবের অভিজ্ঞতা নিশ্চয় আমাদের কাজে লাগবে। কিন্তু এই তত্ত্ব নির্মাণে মূল ভিত্তি হবে আমাদের নিজ অভিজ্ঞতা।
ইউরোপ কিন্তু তত্ত্ব নির্মাণের কাজ বাদ দিয়ে বুর্জোয়া বা সমাজতান্ত্রিক কোনও ধরনের বিপ্লবই করতে পারে নাই। কিন্তু সেই তত্ত্বও বিভিন্ন জন বিভিন্নভাবে নির্মাণ করেছে সেখানকার বিভিন্ন দেশের শত শত বৎসর ব্যাপী সংগ্রামের অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে। এর সবকিছুর সূচনায় আছে মূলত রেনেসাঁ বা নবজাগরণ, যা ত্রয়োদশ শতাব্দীর শেষ দিক থেকেই শুরু হয়ে চতুর্দশ শতাব্দীতে প্রবল রূপ নেয়। এটা কিন্তু মূলত বুদ্ধিবৃত্তিক বিপ্লব, যা বিদ্যমান ক্যাথলিক চার্চ কেন্দ্রিক ধর্মের আধিপত্যের বিরুদ্ধে ইউরোপে জাগরণ ঘটায়।
মার্কসবাদ বা কমিউনিজমের মার্কসীয় ব্যাখ্যা ইউরোপের দীর্ঘ সমাজতান্ত্রিক ও কমিউনিস্ট আন্দোলনের একটা পর্যায়ে একটা ধারা হিসাবে আবির্ভূত হয়। সমাজতন্ত্র বা কমিউনিজম মার্কস এবং এঙ্গেলসের উদ্ভাবন বা আবিষ্কার কোনটাই নয়। তবে এটার যে ব্যাখ্যা তারা দাঁড় করান বিপ্লবের তত্ত্ব হিসাবে সেটা ইউরোপে সর্বাধিক জনপ্রিয় হয়। বিশেষ করে মার্কসীয় তত্ত্বকে ব্যবহার করে রাশিয়ায় বিপ্লব হলে এটা একটা শক্তিশালী রাষ্ট্রের পৃষ্ঠপোষকতা পাবার কারণে সারা পৃথিবীতে ক্রমবর্ধমানভাবে জনপ্রিয় হয়। সাম্রাজ্যবাদ দ্বারা আক্রান্ত অথবা অধিকৃত দেশসমূহের মানুষের নিকটে তা ব্যাপকভাবে সমাদৃত একটা আদর্শ হিসাবে দেখা দেয়। পাশ্চাত্যের তুলনায় পিছিয়ে থাকা শুধু রাশিয়ার নিকট নয়, উপরন্তু চীন-ভিয়েৎনামের মত আরও অনেক বেশী পিছিয়ে থাকা দেশগুলির নিকটও মার্কসীয় সমাজতন্ত্র আধুনিকায়ন তথা উন্নয়নের বিকল্প পথ উপস্থিত করে।
এখন ‘বিকল্প তত্ত্ব নির্মাণ’কীভাবে হবে এই প্রশ্নের উত্তর আমার ইতিপূর্বেকার উত্তরগুলিতে কি আসে নাই? তবে এই প্রশ্নের উত্তর শেষ করার পূর্বে বলি তত্ত্ব কোনও বিশুদ্ধ বন্তু নয়। সমাজ পরিবর্তনের সংগ্রামের মধ্য দিয়ে তা উঠে আসে এবং একটা নির্দিষ্ট সময় ও স্থান বা সমাজের প্রয়োজন পূরণের পর তা বিদায়ও নেয়। সুতরাং তত্ত্বের কোনও শাশ্বত এবং স্থান ও কাল নিরপেক্ষ রূপ সন্ধান করে লাভ নাই।
প্রশ্ন : ৪। অখণ্ড বঙ্গ রাষ্ট্রের যে ধারণা, সেটি বাস্তবায়ন করতে গেলে তো ভারতকে আগে ভাঙ্গতে হবে। শুধু জাতিরাষ্ট্র হিসেবে একটা রাষ্ট্র গঠন হলেই কি মানুষের মুক্তি আসবে? এটার রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক কাঠামো কেমন হবে?
উত্তর : ৪। অখণ্ড বঙ্গ রাষ্ট্রের ধারণার বাস্তবায়নের প্রয়োজনে আগে ভারতকে নয় বরং বর্তমান বাংলাদেশ-রাষ্ট্রের বিদ্যমান আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক ব্যবস্থাকে ভাঙ্গতে হবে। এর জন্য এখানকার সমাজ, সংস্কৃতি ও রাজনীতি বা রাষ্ট্র ব্যবস্থায় এক বিরাট বিপ্লব প্রয়োজন হবে। এই বিপ্লব সম্পন্ন করার পর আমরা পশ্চিম বঙ্গ ও ত্রিপুরার কাছে বঙ্গ ও বাঙ্গালীর ঐক্যের বাস্তবতা উপস্থিত করতে পারব, যে বাস্তবতার প্রেক্ষিতে তারা কী ভূমিকা নিবে সেটা তারা ঠিক করবে। সুতরাং আমাদের এখানকার বিপ্লবের কাজ সেই বাস্তবতাটা তৈরী করা।
কোন্ মানুষের মুক্তি অর্থে তুমি প্রশ্নটা করেছ সেটা তেমন স্পষ্ট না হলেও অনুমান করছি যে বাংলাদেশে বা সর্ববঙ্গে জাতিরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা হলে এখানকার সাধারণ মানুষের মুক্তি হবে কিনা সেই প্রশ্ন তুমি করতে চেয়েছ। অবশ্য মুক্তি কথাটার অর্থ আপেক্ষিক। তবে আমি জটিল তর্ক না করে সহজভাবে আমার কথাটা এখানে বলি।
প্রথমেই আমি বলি যে, মানুষের সব সমস্যার চিরন্তন সমাধান আমার কাছে নাই। তবে দেশে এখন যে সমস্যাগুলি মানুষের জন্য অপরিমেয় দুঃখের কারণ হয়ে আছে সেগুলি যদি মোটামুটি দূর করা যায় তবে আমি বলব যে সেটা আমাদের দেশের মানুষের জন্য আপেক্ষিক অর্থে মুক্তি হবে।
আমি এই মুহূর্তে এখানে এমন এক সমাজ ও দেশ কল্পনা করি যেখানে প্রতিটি নারী হবে পুরুষের সব ধরনের যৌন আগ্রাসন থেকে মুক্ত। যারা নারীর উপর আগ্রাসন করবে তাদের জন্য কঠোর থেকে কঠোরতম শাস্তির ব্যবস্থা থাকবে। এই সমাজে প্রতিটি নারী একাকী নির্জন রাত্রিতেও নির্ভয়ে পথ চলবে। নারীর শরীরের মালিক হবে নারী নিজে। শুধু তা-ই নয়, নারীর নিজস্ব প্রতিনিধিরা জাতীয় সংসদসহ রাষ্ট্রের নীতি নির্ধারণের প্রতিটি ক্ষেত্রে অবস্থান করে নারীর স্বার্থ সংরক্ষণ করবে। এটা যদি মানুষের মুক্তি না হয় তবে মানুষের মুক্তি কিসে?
আমি যে সমাজের কল্পনা করি সেখানে শ্রমজীবীরা তাদের শ্রমের ন্যায্য মজুরী বা মূল্য পাবে। ঘুষ, দুর্নীতির পথ বন্ধ করা হবে। ঘুষ, দুর্নীতির মধ্য দিয়ে অর্জিত সম্পদ ও সম্পত্তি রাষ্ট্র বাজেয়াপ্ত করবে। মানুষ সম্পদ ও সম্পত্তি অর্জন করতে পারবে, তবে তা হবে সৎ উপায়ে ও পরিশ্রমের মাধ্যমে। সুতরাং ব্যক্তিপুঁজি থাকবে। তবে তা হবে নিয়ন্ত্রিত; সমাজ ও রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণের মধ্যে থেকে তা ভূমিকা রাখবে। এই নিয়ন্ত্রণের একটি লক্ষ্য হবে উন্মত্ত ভোগবাদ ও একচেটিয়া পুঁজির বিকাশ রোধ করা। ব্যক্তির স্বাধীনতা থাকবে। তবে ব্যক্তি হবে সমাজের প্রতি দায়বদ্ধ। আমার এই কল্পিত সমাজে পঙ্গু, অক্ষম মানুষদের দায়িত্ব রাষ্ট্র নিবে। সুতরাং বৃদ্ধদের দায়িত্বও রাষ্ট্র নিবে। শিক্ষার অধিকার হবে প্রতিটি মানুষের জন্য নিশ্চিত।
আমি যে বঙ্গরাষ্ট্রের কল্পনা করি উন্নয়নের মাপকাঠির বিচারে তা হবে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ রাষ্ট্রগুলির সমপর্যায়ের। এবং তা যোগ দিবে মহাশূন্য অভিযানে। মধ্যপ্রাচ্য বা অন্যান্য দেশে শ্রমিক হিসাবে যাবার গ্লানিময় স্মৃতি অতীতের বিষয় হবে। বঙ্গরাষ্ট্রের বাঙ্গালীর যাত্রা হবে মহাশূন্যের পথ ধরে গ্রহ থেকে গ্রহান্তরে।
একই সঙ্গে বাঙ্গালী তার দেশের অন্যান্য জাতির মানুষদেরকেও তার সকল কর্মের সমান অংশীদার করে নিবে। আমার কথা, যে দিন বাঙ্গালীর জাতি-রাষ্ট্র হিসাবে বঙ্গরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হবে সে দিন থেকে বাঙ্গালী জাতি হিসাবে তার ভাবনায় অধিকতর গুরুত্ব পাবে বৃহত্তর জাতিবোধ, এ দেশে বসবাসকারী সকল জাতির গণতান্ত্রিক অধিকারের ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত জাতিসমষ্টির রাষ্ট্র চিন্তা। বঙ্গরাষ্ট্র তখন তার কাছে দেখা দিবে বহুজাতির সমন্বিত এক রাষ্ট্র তথা জাতিসংঘের আর এক রূপ হিসাবে। অর্থাৎ বাঙ্গালী জাতীয়তাবাদকে অবলম্বন করে বঙ্গরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হলেও যে মুহূর্তে তা প্রতিষ্ঠিত হবে সেই মুহূর্তে তা আবির্ভূত হবে একটি বহুজাতিক রাষ্ট্র রূপে। এই কারণে পূর্ব থেকেই বঙ্গরাষ্ট্রের রাষ্ট্রচিন্তায় বাংলাদেশের অন্যান্য জাতি বা জাতিসত্তার জাতিগত অধিকারসমূহকে যথাযোগ্য মর্যাদা ও স্বীকৃতি দেওয়া হবে।
মোট কথা আমার কল্পিত সমাজ ও রাষ্ট্র একটি মডেল সমাজ ও রাষ্ট্র হিসাবে পৃথিবীতে উঠে দাঁড়াবে। এর পরেও বহু সমস্যা সেখানে থাকবে। সেগুলি মীমাংসার সংগ্রামও সেখানে চলবে সময় ও পরিস্থিতির দাবী অনুযায়ী। আর একটা কথা, যে সমাজ ও রাষ্ট্রের একটা খুব সংক্ষিপ্ত রূপকল্প এখানে আমি দিলাম সেটা বাস্তবায়ন করতে গেলে যাদের স্বার্থের ক্ষতি হবে তারা কি সেটাকে মানুষের মুক্তি হিসাবে মেনে নিবে? এছাড়া এতে যে স্বর্গরাজ্য প্রতিষ্ঠিত হবে তা মনে করার কারণ নাই। কারণ মানুষই তো সবকিছু করবে। সুতরাং সর্বদাই কম-বেশী সমস্যা এবং ত্রুটি থাকবে। তবু আজকের তুলনায় সেটা হবে মানুষের মুক্তি।
কিন্তু প্রতিটি মুক্তি এক সময় বন্ধন হয়ে দেখা দেয়। ১৯৯১-তে সোভিয়েত সমাজতন্ত্রের পতন হয়েছে এবং সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙ্গে গিয়েছে। যে মানুষদের কাছে এটা এক সময় মুক্তি হয়ে দেখা দিয়েছিল তাদের বংশধরদের নিকটই তো এটা আর এক সময় বন্ধন হয়ে দেখা দিয়েছিল। আর বন্ধন হয়ে দেখা দিয়েছিল বলেই তো তা থেকে তারা মুক্তি চেয়ে তাকে ছিন্ন করেছিল। এখন হয়ত বলা হবে যেহেতু এটা টিকে নাই সেহেতু প্রমাণিত হয়েছে যে সোভিয়েত বিপ্লব ভুল ছিল। হাঁ, সাম্রাজ্যবাদীদের জন্য এটা ভুল বিপ্লব ছিল। কিন্তু আমাদের মত পশ্চাৎপদ, অধীনস্থ বা পরাধীন ও দরিদ্র দেশগুলির মানুষদের জন্য কি তা ঠিক বিপ্লব ছিল না? ইতিহাসে যে ভূমিকা তা রেখেছে তাকে বিবেচনায় নিলে তাকে যুগান্তকারী এবং আমাদের জন্য কল্যাণকর বলা ছাড়া উপায় নাই। সুতরাং ১৯১৭-এর সোভিয়েত বিপ্লব এক সময় মানুষের মুক্তি হয়ে দেখা দিয়েছিল। প্রকৃতপক্ষে এটা ছিল পৃথিবীর বিরাট সংখ্যক মানুষের জন্য মুক্তি। কিন্তু সব মুক্তির মত তার ভূমিকা শেষ করে এক সময় সেটাও মানুষের জন্য বন্ধন হয়ে দেখা দিয়েছিল। সুতরাং সেটা গেছে। এবং সেটা বাইরের শক্তির আক্রমণে যায় নাই। গেছে ভিতর থেকেই এবং ভিতরের চাপেই। আর তা থেকে নিশ্চয় শিক্ষা লাভেরও অনেক কিছু আছে।
মনে রাখতে হবে পশ্চিম ইউরোপে যে বুর্জোয়া বিপ্লবগুলি হয়েছিল সেগুলিরও এক অর্থে পতন ঘটেছিল। ইংল্যান্ডে রাজতন্ত্র উচ্ছেদের পর পুনরায় রাজতন্ত্র ফিরে এসেছিল। এবং নিয়ন্ত্রিত রূপে হলেও আজও তা আছে। ফ্রান্সেও রাজতন্ত্র উচ্ছেদের পর ফিরে এসেছিল। অবশ্য পরবর্তী কালে পুনরায় প্রজাতন্ত্র ফিরে আসে। এবং এই সঙ্গে এটাও মনে রাখতে হবে বুর্জোয়া বিপ্লব-পরবর্তী কালে যে পুঁজিবাদ প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল তার সেই আদিরূপও সেখানে আর নাই। এই সঙ্গে আমাদেরকে মানতে হবে যে এখন পর্যন্ত পশ্চিম ইউরোপের সমাজ ও রাষ্ট্রগুলি সাধারণভাবে অন্য সমাজগুলির তুলনায় অনেক এগিয়ে আছে। সেইসব দেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি, জীবনের মান কি অতীতের সোভিয়েত সমাজ এবং বর্তমান রাশিয়া-চীনের চেয়েও উন্নত নয়? তা যদি না হবে তবে এশিয়া-আফ্রিকার দেশগুলি থেকে মানুষ এভাবে পঙ্গপালের মত সেখানে ছুটছে কেন? তার মানে আমি এ কথা বলি না যে তারা যেভাবে উন্নয়ন ঘটিয়েছে ঠিক একইভাবে আমাদেরও তা ঘটাতে হবে। সেটা হবার নয় বলে এ ধরনের নকলনবিশী দিয়ে আমাদের মত দেশগুলিতে তেমন কোনও ফল হয় না, হয় নাইও। এটা বরং তাদের নিয়ন্ত্রণাধীনে আমাদের মত দেশগুলিকে রেখে দেয়, যা থেকে আমাদের মুক্তি দরকার।
যাইহোক, এ প্রসঙ্গে আর একটা কথা বলা দরকার মনে করি যে, পশ্চিম ইউরোপ বা আমেরিকার সমাজ তার উন্নতির এমন এক পর্যায়ে পৌঁছেছে যেখানে তার আরও অগ্রগতির প্রেরণা ক্রমেই ফুরিয়ে যাচ্ছে। ফলে এখানে পশ্চাদগতি দেখা দিয়েছে। এটাকে রোধ করার জন্য এখন তার পশ্চাৎপদ সমাজ থেকে শ্রমশক্তি ও মেধাশক্তি সংগ্রহের উপর জোর দিতে হচ্ছে। এর ফলে সেখানে বাহির থেকে ব্যাপক হারে অভিবাসন ঘটছে। এটাকে নয়া উপনিবেশবাদ বা সাম্রাজ্যবাদের নবতর রূপ বলা যায়। যেটাই হোক পাশ্চাত্যের সঙ্কট দেখা দিয়েছে। এটা শুধু আজকের পাশ্চাত্যের সমস্যা নয়। এটা সব সমাজ বা সভ্যতার সমস্যা। এটা জীবনেরই একটা অন্তর্গত সমস্যা। এক সময় একটা নির্দিষ্ট সমাজ বা সভ্যতা তার কর্মোদ্যোগ ও প্রেরণা হারিয়ে ফেলে এবং অলস ও ভোগসর্বস্ববাদী হয়ে পড়ে। ফলে তার ক্ষয় কিংবা পতন ঘটে। আর এভাবেই সভ্যতার নূতন নূতন কেন্দ্র সৃষ্টি হয় এবং নূতন নূতন কেন্দ্রকে অবলম্বন করে মানুষের সভ্যতা এগিয়ে যায়।
তার মানে কি এই যে যেহেতু চিরস্থায়ী রাষ্ট্র, সমাজ ও সভ্যতা বলে কিছু নাই সেহেতু আমরা নূতন রাষ্ট্র, সমাজ ও সভ্যতা নির্মাণ করব না? এ কথা বলার মানে কি এই হবে যে যেহেতু জীবন চিরস্থায়ী নয় সেহেতু বাঁচাটা অপ্রয়োজনীয়? যেহেতু মৃত্যু একদিন হবেই সেহেতু এখনই কবরে গিয়ে শুয়ে পড়তে হবে? না, এমন কোন তত্ত্বে আমি বিশ্বাস করি না যে, যা প্রতিষ্ঠার জন্য সংগ্রাম করব বা যাকে জন্ম দিব তাকে চিরস্থায়ী হতে হবে। কোনও কিছুই চিরস্থায়ী হবে না। তবে লক্ষ্যটা অবশ্যই হওয়া উচিত নিজ সৃষ্টিকে যতটা সম্ভব সুন্দর, বলিষ্ঠ ও দীর্ঘস্থায়ী করা, যেমন চেষ্টা হওয়া উচিত যত বেশী দিন পারা যায় সুস্থ, সুন্দর ও প্রবল ভাবে বেঁচে থাকা, জীবনকে অর্থপূর্ণ করে বেঁচে থাকা।
মানুষের মুক্তি বলতে আমি কী বুঝাতে চেয়েছি আশা করি তা আমি এতক্ষণে কিছুটা হলেও বুঝাতে পেরেছি। কমিউনিজমের কল্পস্বর্গ আমার কাছে নাই, যে কথাটা আগেও বলেছি। কাজেই সেই ধরনের কোনও চিরস্থায়ী সমাধান আমার কাছে নাই। যে বঙ্গরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হবে সেটার রূপ যেমন চিরকাল এক রকম থাকবে না তেমন সেই রাষ্ট্রও চিরস্থায়ী হবে না বলে আমি মনে করি। তাই বলে কি এই রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার লড়াই বাদ দিব? সেই প্রশ্নই উঠে না। অপর দিকে, এই রাষ্ট্র কোনও অপরিবর্তনীয় রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক কাঠামো নিয়ে প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত যাত্রা করবে আমি তাও মনে করি না। বিপ্লবের নিয়মে প্রথম পর্যায়ে যে কঠোরতার প্রয়োজন হবে সেই প্রয়োজনকে চিরন্তন মনে করলে ভুল করা হবে। আমি ইতিপূর্বেকার উত্তরে বলেছি যে, এখানে সমাজতন্ত্র ও ব্যক্তিপুঁজিবাদ উভয় ব্যবস্থারই নিয়ন্ত্রিত অনুশীলন হবে। এটাকে ভারসাম্যপূর্ণ অনুশীলন বলা উচিত। প্রথম পর্যায়ে রাষ্ট্র ব্যবস্থায় আমাদের দেশের বাস্তবতায় চীন-ভিয়েৎনামের মত একদলীয় গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থার প্রয়োজন দেখি। তবে পরবর্তী পর্যায়ে ক্রমে শাসন ব্যবস্থার উদারীকরণ ঘটাটা স্বাভাবিক মনে করি। হয়ত একটা পর্যায়ে বহুদলীয় গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হবে। অবশ্য ভবিষ্যতের বিষয়টা ভবিষ্যৎ প্রজন্ম ঠিক করবে। আমরা এখনই সব নির্দিষ্ট করে বলব কী করে?
প্রশ্ন : ৫। “মার্কসবাদ মানুষের বুদ্ধিবৃত্তি ও চেতনাকে একটা পর্যায়ে নিবার পর তাকে আটকে দেয়, তার অধিকতর অগ্রসর হবার পথে বাধা সৃষ্টি করে।”- পুঁজিবাদ কি এর চেয়ে ভাল কিছু দিতে পেরেছে?
উত্তর : ৫। আমার কথাটার অর্থ কিন্তু ভিন্ন। আমি পুঁজিবাদ মার্কসবাদের তুলনায় শ্রেষ্ঠ সে কথা বুঝাতে কিন্তু বলি নাই যে, ‘মার্কসবাদ মানুষের বুদ্ধিবৃত্তি ও চেতনাকে একটা পর্যায়ে নিবার পর তাকে আটকে দেয়, তার অধিকতর অগ্রসর হবার পথে বাধা সৃষ্টি করে।’আমি মার্কসবাদের সমস্যাটা বুঝাতে গিয়ে এ কথা বলেছি। সেটা কেউ না মানতে পারে। সেটা তার মনে করার কিংবা বুঝার বা বিশ্বাসের ব্যাপার। আমি আমার নিজ অধ্যয়ন ও অনুশীলনগত অভিজ্ঞতা থেকে আসা উপলব্ধির কথাটা বলেছি মাত্র। আমি পশ্চিম ইউরোপের বুর্জোয়া এবং রাশিয়া-চীনের সমাজতন্ত্র কোনও বিপ্লবের তত্ত্বগুলির অনুসারী নই। আমি সবারই অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা নিবার প্রয়োজন দেখি। কিন্তু তত্ত্ব তথা পথটা আমাদেরই। কেউ যদি বাইরের কারও তত্ত্ব বা মতবাদ অনুশীলন করতে চায় তবে করুক না! যাইহোক, মার্কসবাদের তত্ত্বগত সমস্যা নিয়ে আমি ‘মার্কসবাদের সঙ্কট ও বিপ্লবের ভবিষ্যৎ’এবং আমাদের সমাজে মার্কসবাদ অনুশীলনের ব্যবহারিক সমস্যাগুলি নিয়ে ‘রাজনীতির পুনর্বিন্যাসꞌ এবং ‘মার্কসবাদ ও বিপ্লব বিতর্কꞌ-এ কিছু বিস্তারিত আলোচনা করেছি।
প্রশ্ন : ৬। আপনি আপনার সাক্ষাৎকারের অনেক জায়গায় বিপ্লবী রূপান্তরের কথা বলেছেন। আসলে আপনি বিপ্লব বোঝাতে কী বলতে চেয়েছেন?
উত্তর : ৬। আমার মনে হয় আমি ইতিপূর্বে যে উত্তরগুলি দিয়েছি সেগুলি থেকে আমার বিপ্লব সংক্রান্ত ধারণা কিছুটা হলেও বেরিয়ে এসেছে। এর বেশী স্পষ্ট করব কী করে? বিপ্লবই সেটাকে স্পষ্ট করবে।
মাসুদ রানা : অনেক সময় দেয়ার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।
শামসুজ্জোহা মানিক : তুমি যে অনেক সময় নিয়ে এবং চিন্তা করে প্রশ্নগুলো করেছ, এই প্রশ্নগুলোর মাধ্যমে বহু বিষয়ে আমার চিন্তার প্রকাশের সুযোগ করে দিয়েছ এবং সর্বোপরি অনেক সময় ও ধৈর্য নিয়ে পূর্ববর্তী দফায় পাঠানো উত্তরগুলো পড়েছ সেই জন্য তোমাকেও অনেক ধন্যবাদ।