Banner
হিন্দু সমাজ এবং একটি কেস-স্টাডি ─ শামসুজ্জোহা মানিক

লিখেছেনঃ শামসুজ্জোহা মানিক, আপডেটঃ February 2, 2019, 12:00 AM, Hits: 1631

 

বিষয় সূচী ꞉
কেস-স্টাডি ꞉ খেনপাড়া
কিছু মন্তব্য ও কিছু প্রশ্ন
খেনপাড়ার অগ্রগতির একটা খতিয়ান
শেষ কথা

 

 


কেস-স্টাডি ꞉ খেনপাড়া

 

আজ আমি এমন একটা ঘটনার বিবরণ দিব যা হিন্দু ধর্ম ও সমাজের একটি মৌল সমস্যাকে তুলে ধরবে। এটাকে একটা ‘কেস-স্টাডি’ বলা যেতে পারে, যা আমার নিজ অভিজ্ঞতা ভিত্তিক। এ থেকে অবশ্য আমার জীবনের ও কর্মকাণ্ডের কিছুটা চিত্রও বেরিয়ে আসবে। তবে নিজের কথা যতটা সম্ভব কম বলে মূল বিষয়টাকে তুলে ধরতে চেষ্টা করব।
 
১৯৬৬ সাল থেকে ১৯৭২ সালের প্রায় প্রথমার্ধ পর্যন্ত আমি গ্রামে কৃষক সংগঠন ও আন্দোলনে নিয়োজিত ছিলাম। ১৯৭২ থেকে ১৯৮৬ পর্যন্ত ঢাকায় থাকবার পর পুনরায় গ্রামে কৃষকদের মধ্যে থেকে কাজ এবং আন্দোলনের মাধ্যমে সমাজ পরিবর্তনের সমস্যাগুলিকে আরও ভালভাবে এবং নূতন করে বুঝতে চাওয়ার উদ্দেশ্যে আমি গ্রামে যাবার সিদ্ধান্ত নিই। পাকিস্তান আমলে আমি যখন কৃষক আন্দোলন করতে গ্রামে গিয়েছিলাম তখন আমি ছিলাম ভাসানী নেতৃত্বাধীন কৃষক সমিতির একজন কর্মী। তখন আমার পিছনে ছিল বামপন্থী আন্দোলনের বিরাট শক্তি। কিন্তু এবার আমি একা।
 
যাইহোক, ১৯৮৬ সালে আমি গ্রামে যাই এবং আমার কাজের এলাকা হিসাবে আমার পৈত্রিক নিবাস দিনাজপুর জিলাধীন খানসামা থানার হোসেনপুর গ্রামকে বেছে নিই। সরকারী চাকুরী থেকে ১৯৭০ সালে অবসর নিবার পর আমার পিতা হোসেনপুরে নিজ পৈত্রিক বাড়ীতে ফিরে গিয়েছিলেন। তিনি তখন জীবিত ছিলেন। সুতরাং গ্রামের বাড়ীতে আমার থাকার সমস্যা ছিল না। গ্রামের বাড়ীতে থেকে আমি কৃষকদের সঙ্গে যোগাযোগ গড়ে তুলবার জন্য বিভিন্ন সামাজিক ও অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড সংগঠিত করার কাজ শুরু করি। যেমন সঞ্চয় সমিতি গঠন। তবে আমি বেশী জোর দিই গণ-শিক্ষার উপর।
 
বিভিন্ন পল্লী বা পাড়ায় কাজ করার চেষ্টা করলেও শেষ পর্যন্ত আমার কাজ সবচেয়ে বেশী কেন্দ্রীভূত হয় আমাদের বাড়ী এবং পাড়া থেকে কিছু দূরে অবস্থিত খেনপাড়া (স্থানীয় উচ্চারণে খ্যান পাড়া) নামে একটা হিন্দু পাড়া বা পল্লীতে। কারণ সেখানে আমি সবচেয়ে বেশী সাড়া পাই। এখানে এ প্রসঙ্গে বলে রাখা ভাল যে এখন এই পল্লীকে আর খেনপাড়া না বলে সেনপাড়া বলা হয়। কিন্তু আমি সেই সময়কার নামটাই তখনকার চিত্র তুলে ধরতে চেয়ে ব্যবহার করছি। এখন মূল প্রসঙ্গে আসি।
 
আমার সম্পর্কে চাচাতো ভাই-বোনদের মধ্যে যে ৩/৪ জনকে সঙ্গে পাই তাদের নিয়ে কাজ শুরু করি। বিশেষ করে বোনদের মধ্যে নিঃস্বার্থ কাজের জন্য উৎসাহ ও অঙ্গীকার দেখতে পাই। তাদেরকে দিয়ে মূলত মেয়েদের মধ্যে গণ-শিক্ষা কার্যক্রম শুরু করি। আমার চাচাতো বোনরা খেন পাড়ায় প্রথমে কিছুটা বয়স্ক নারীদের মধ্যে গণশিক্ষা শুরু করে। এরপর গোটা পল্লীর যত শিশু ছিল সবাই তাদের মা বা কাকী বা বড় বোনদের সঙ্গে পড়তে আসায় গণশিক্ষায় প্রচুর ছাত্র-ছাত্রীর অংশগ্রহণ ঘটে। আমার বোনরা সামাল দিতে না পারায় বাচ্চা বা শিশুদের পড়াবার দায়িত্ব আমাকেও নিতে হয়।
 
এখন খেনপাড়া সম্পর্কে কিছু বিবরণ দিতে হয়। ১৯৮৬-এর দিকে এর খানা বা পরিবার সংখ্যা ছিল আনুমানিক ৭০/৭২টা। এগুলির মধ্যে মাত্র ৩টি খানা ছিল মুসলমান। তবে তারা পাকিস্তান হবার পর এই পল্লীর তিনটি হিন্দু পরিবারের সঙ্গে জমি বদল করে ভারতের পশ্চিম বঙ্গ থেকে এখানে এসেছিল। ফলে এরা ছিল এখানে অনেকটাই বিচ্ছিন্ন। পল্লীর জনসংখ্যা ছিল প্রায় সাড়ে তিনশত। কাজ শুরুর পর আমি অবশ্য একটা জরিপ করেছিলাম। এতদিন পর তার হিসাব যেমন নাই তেমন সবকিছু মনেও নাই। তবু সামান্য কিছু মনে আছে। তাছাড়া  সর্বশেষ ২০১৫ সাল পর্যন্ত খেনপাড়ার বাসিন্দাদের কাছ থেকে যাচাই করে নিয়েছি। বর্তমান সময়ের পরিসংখ্যনও (২০১৫ সাল পর্যন্ত) তাদের কাছ থেকে জেনে নেওয়া।
 
সেই সময় পল্লীটা সবদিক থেকে খুব পিছিয়ে ছিল। শিক্ষা প্রায় ছিল না। গোটা পল্লীতে গ্র্যাজুয়েট দূরের কথা একজন এইচএসসি বা ইন্টারমিডিয়েট পর্যায়েরও কেউ ছিল না। মাত্র একজন ছিল যে এসএসসি পাস বা ম্যাট্রিক্যুলেট। এ ছাড়া পল্লীর অধিকাংশ মানুষ ছিল অত্যন্ত দরিদ্র। বড় একটা অংশ ছিল দিনমজুর শ্রেণীর। সামান্য কয়েকটা পরিবার ছিল কিছুটা সচ্ছল। শিক্ষার প্রতি আগ্রহ তাদের মধ্যেও তেমন একটা ছিল না। যাইহোক, সামগ্রিকভাবে পল্লীটা ছিল অত্যন্ত দরিদ্র, পিছিয়ে থাকা, অবহেলিত এবং নিগৃহীতও। একটা প্রায় মরা ছোট নদীর দুইপাশ ঘিরে গড়ে উঠা পল্লীটা চারপাশের বসতি বা পল্লী থেকে কিছুটা দূরে এবং বিচ্ছিন্ন ছিল। নদীটাতে স্রোত থাকে শুধু বর্ষার সময়।
 
আমি যখন ঐ পল্লীর দিকে মনোযোগ দিই তখন আর একটি ঘটনা দেখি। সেটা হচ্ছে মুসলমানদের প্রতি তাদের অবিশ্বাস ও ভীতি। একটা ঘটনা বললে তাদের অবস্থাটা বুঝা যাবে। হিন্দুরা এমনিতে আনন্দ-উৎসব প্রিয়। পাকিস্তান আমলেও তারা সন্ধ্যার পর রাত্রে কীর্তন গানের আসর বসাত। গান-বাজনা করার পর তারা ঘুমাত। তাদের পল্লী মুসলমানদের বাসস্থান বা পল্লী থেকে যে দূরত্বে অবস্থিত তাতে তাদের গান-বাজনায় মুসলমানদের অসুবিধা হবার কোনই কারণ ছিল না। এমন নয় যে মাইক দিয়ে বা ঢাক-ঢোল বাজিয়ে তারা দূরের মানুষের জন্য কোনও ধরনের সমস্যা তৈরী করত। কিন্তু হিন্দুদের এই আনন্দটুকুও মুসলমানদের সহ্য হল না। কোনও এক রাতে যখন তারা কীর্তন গানের আসর বসিয়েছিল তখন আমাদের পল্লী থেকে বিশেষত এখানে বসবাসকারী মৌলবীর পরিবার ও বংশের নেতৃত্বে মুসলমানরা দলবেঁধে কুড়াল-দা হাতে নিয়ে তাদের উপর হামলা করে তাদের হারমোনিয়াম, ডুগি, তবলা কুপিয়ে টুকরা টুকরা করে দেয়। এবং বলে তারা যদি এর পরেও গান-বাজনা করে তবে তাদেরকে দেশছাড়া করবে।
 
দিনাজপুর জিলার মুসলমানরা ধর্মীয় প্রশ্নে অন্যান্য অনেক এলাকার তুলনায় অনেক বেশী সহনশীল ও উদার হলেও বিশেষ করে আমাদের গ্রামটা ভিন্ন ধরনের ছিল। এখানকার মুসলমানরা বেশীর ভাগ ছিল উগ্র এবং হিন্দু বিদ্বেষী। এ ক্ষেত্রে এলাকায় মৌলবী হিসাবে পরিচিত মৃত মওলানা মোহাম্মদ হাবীবুর রহমান এবং তার পরিবারের ভূমিকা ছিল নেতৃত্বমূলক। এদের সম্পর্কে এটুকু বলাই এখানে বোধ হয় যথেষ্ট হবে যে ১৯৭১-এর স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় এই পুরা পরিবারই ছিল প্রকাশ্যে পাকিস্তানপন্থী এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ বিরোধী।
 
হিন্দুদের পল্লী তাদের বাসস্থানের কিছুটা নিকটবর্তী হওয়ায় হিন্দুদের উপর তাদের চাপ ছিল প্রবল। তবে আমার পিতার কারণে তাদের উপর খুব বেশী অত্যাচার তিনি গ্রামে যাবার পর হত না। তিনি অবশ্য সামাজিক কোনও কাজে নিজেকে জড়াতেন না। নিজের জমিজমা দেখাশুনা নিয়েই ব্যস্ত থাকতেন। আর বাড়ীতে বসে থেকে সময় কাটাতেন। সাবেক পুলিশ অফিসার হিসাবে তিনি গ্রামকে ভালভাবে বুঝতেন। তিনি ধার্মিক মুসলমান হলেও অন্যায়-অত্যাচার পছন্দ করতেন না এবং আচরণগতভাবে অসাম্প্রদায়িক ছিলেন। ফলে হিন্দু বা মুসলমান যে কেউ বড় ধরনের কোনও বিপদে পড়লে তিনি কখনও পরামর্শ দিতেন কিংবা খুব বেশী হলে তাকে থানায় পাঠিয়ে দিতেন। এইটুকুই হিন্দুদের জন্য কিছুটা সুরক্ষার কারণ হয়েছিল। কারণ সুনামের সঙ্গে চাকুরী করা একজন অবসরপ্রাপ্ত ডিএসপি হিসাবে গ্রামে বাস করায় থানা-পুলিশ তাকে সম্মান করত বা গুরুত্ব দিত। তিনি যে হিন্দুদের রক্ষার জন্য খুব বেশী করতে পারতেন তা নয়। তবে তিনি না থাকলে হয়ত খেনপাড়ার হিন্দুদের সকলে না হলেও অনেকে ভারতে পালাতে বাধ্য হত।
 
তবে আমি ঐ পাড়ার অবস্থা যে বিশেষ সুবিধার দেখেছিলাম তা নয়। আমাকে ওটাকে একটা প্রায় মরা পল্লী মনে হত। পল্লীবাসীর নিজেদের মধ্যে পর্যন্ত সহজ যোগাযোগ ছিল না। অর্থাৎ তাদের কোনও সামাজিক জীবনও প্রায় ছিল না। সবাই ব্যস্ত থাকত নিজের পরিবার এবং নিজেকে নিয়ে। এমনকি পূজাও ছিল না। সন্ধ্যার পর প্রায় সবাই যে যার ঘরে ঢুকে যেত। তখন সেখানে বিদ্যুৎ ছিল না। একটু রাত হলে মনে হত যেন প্রাণহীন, জনহীন এক গ্রাম বা পল্লী। একদিকে দারিদ্র্য, অপরদিকে নিরাপত্তা বোধের অভাব এবং হীনমন্যতা পল্লীবাসীদের জীবনীশক্তিকে নিঙড়ে নিত। মুসলমানদের ছোটখাটো উপদ্রব লেগেই ছিল। এ ক্ষেত্রে অগ্রণী ভূমিকা রাখত আমাদের পল্লীর মৌলবীর জ্ঞাতিগুষ্টি। কথায় কথায় মারধর করা, গালাগালি করা তাদের সহজাত চরিত্র ছিল। হিন্দু পাড়ার বাঁশ পছন্দ হলে বলত কেটে দিতে কিংবা কেটে নিয়ে যেত। কিন্তু মূল্য দিত না। অনেক সময় গাছে উঠে তাদের পছন্দের পাকা কাঁঠাল পেড়ে দিতে হত। এভাবে বিনামূল্যে অনেক কিছু এ পল্লী থেকে পাওয়া যেত। বিশেষ করে মৌলবী বংশ এবং তাদের জ্ঞাতিগুষ্টির দাপট ছিল কখনও কখনও অসহনীয়। যেমন ডাকার পরেও মজুর হিসাবে কাজ করতে না আসায় বাড়ীতে ধরে নিয়ে এসে গাছে ঝুলিয়ে মারার ঘটনাও আমি শুনেছি। অথচ কাজ করিয়ে অনেক সময় মজুরীর টাকাও তারা দিত না। খেনপাড়ার দরিদ্রদের উপর তাদের অত্যাচার ছিল আরও বেশী। কারণ তারা শুধু হিন্দু হবার কারণে দুর্বল ছিল না, দরিদ্র হবার কারণে তারা আরও বেশী দুর্বল ছিল।
 
যাইহোক, খেনপাড়া একটা জীবন্মৃত পল্লীর বেশী আর কিছু ছিল না। সেই অবস্থায় আমি সেখানে কাজ শুরু করি। আমার বোনরা ব্যস্ত থাকত সেখানকার বয়স্ক মেয়েদেরকে শিক্ষাদানে আর আমি ব্যস্ত থাকতাম শিশুদেরকে শিক্ষাদানে। এভাবে প্রায় ছয়-সাত মাস সময় অতিবাহিত হবার পর সেখানে একটি ধর্ষণের ঘটনা ঘটে। পল্লীর এক হিন্দু ভূমিহীন দিনমজুরের স্ত্রীকে পার্শ্ববর্তী কিন্তু কিছু দূরবর্তী এক পল্লীর মুসলমান যুবক ধর্ষণ করে। ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানের কাছে অভিযোগ গেলে চেয়ারম্যান স্বামী-স্ত্রী দুইজনকে ইউনিয়ন পরিষদ অফিসে নিয়ে আটকে রাখেন। অনুমান করি চেয়ারম্যান টাকা খেয়ে এ কাজ করেছিলেন অপরাধীকে বাঁচাবার জন্য।
 
মজার ব্যাপার ইতিমধ্যে ঐ পল্লীর অনেকের সঙ্গে আমার সুসম্পর্ক গড়ে উঠলেও তারা কেউ আমাকে কিছু জানায় নাই। তারা হয়ত মুসলমান হিসাবে আমাকেও আস্থার যোগ্য মনে করে নাই। অথবা তারা হয়ত এমন ঘটনাকে তাদের জন্য নিয়তির স্বাভাবিক বিধান হিসাবে মেনে নিয়েছিল। তাই আমি যখন ছেলেমেয়েদেরকে বিকালে পড়াচ্ছিলাম তখন আমার পাশ দিয়ে ইউনিয়ন পরিষদের চৌকিদার স্বামী-স্ত্রীকে নিয়ে গেলেও কেউ আমাকে কিছুই জানায় নাই। যাইহোক, সন্ধ্যায় বাড়ীতে ফিরবার পরে জানতে পেরে আমি আমার চাচাত ভাইদের কয়েকজনকে নিয়ে ইউনিয়ন পরিষদ অফিসে গিয়ে বিষয়টার গুরুত্ব বুঝতে পারি এবং চেয়ারম্যানের উদ্দেশ্য সম্পর্কে সন্দিহান হই। স্বাভাবিকভাবে চেয়ারম্যান তাদেরকে ইউনিয়ন পরিষদ অফিসে সারা রাত আটকে রেখে যে সময়টা পেতে চেয়েছিলেন তা পেলেও আমি এটা নিয়ে এমন এক আন্দোলন গড়ে তুলি যা এলাকায় পরবর্তী কালে অনেক পরিবর্তনের সূচনা ঘটায়। আমি এলাকার হিন্দু-মুসলমান নির্বিশেষে প্রায় সবাইকে এই আন্দোলনে শরীক করি। পাশাপাশি মামলাও করা হয়। সেই মামলায় অবশ্য আইনগত ফল না হলেও আমাদের আন্দোলনের পক্ষে এলাকায় বাপক জনমত গড়ে উঠে। এই ঘটনা এলাকায় হিন্দুদের জন্য মুসলমানদের মনে সহানুভূতি ও সহমর্মিতার একটা শক্তিশালী জায়গা তৈরী করে। সুতরাং আন্দোলনের বিচারে আমরা ছিলাম সফল। বস্তুত এই একটি ঘটনা এবং তার পরিণতিতে আন্দোলন গোটা খেনপাড়ার চিত্রকে বদলে দেয়।

এই ঘটনার পর আমি খেনপাড়ার মানুষদের ঐক্যবদ্ধ এবং সাহসী করার জন্য নিয়মিত প্যারেড অনুষ্ঠানের সিদ্ধান্ত নিই। এতে খেনপাড়ার মানুষ ছাড়াও পার্শ্ববর্তী বিশেষত আমাদের পল্লীর কিছু সংখ্যক মুসলমান যুবকও কিছুদিন অংশ নিলেও তাদের ঐ উৎসাহ বেশী দিন থাকে নাই। তবে খেনপাড়ার মানুষদের উৎসাহের ঘাটতি কখনই ঘটে নাই। আমার বাড়ী থেকে কিছুটা দূরে হওয়ায় আমাকে অবশ্য একটু কষ্ট করে প্রতি ভোর রাতে উঠতে হত। আমি আমার বাড়ী থেকে সাইকেলে ভোর রাতে খেনপাড়ার মধ্যবর্তী একটা রাস্তায় গিয়ে হুইসেল বাজাবার সাথে সাথে বিবাহিত এবং বয়স্ক নারী বাদে ছেলে-বুড়ো নির্বিশেষে প্রায় সব বয়সের নারী-পুরুষ প্যারেডের জন্য সারিবদ্ধভাবে দাঁড়া্ত। এরপর আমি নিয়মিতভাবে দুইটি ধ্বনি বা স্লোগান দিতাম। এ্কটা হচ্ছে ‘জয় বাঙ্গালী’, অপরটা হচ্ছে ‘সবার উপর মানুষ সত্য’। এই দুই স্লোগান অন্যরাও দিত। জয় বাংলার প্রতি আমার কোনও অনীহা বা বিদ্বেষ না থাকলেও এই স্লোগানের সঙ্গে আওয়ামী লীগের নাম এমনভাবে জড়িয়ে আছে যে আমি ঐ ছাপ নিজের গায়ে লাগানো ঐ সময় সমীচীন মনে করি নাই। দ্বিতীয়ত বাংলার তুলনায়ও বাঙ্গালীত্বের চেতনার গুরুত্ব আমার কাছে অনেক বেশী। আমি জাতি চেতনার জাগরণের উপর সর্বাধিক গুরুত্ব দিতে চেয়েছি। এবং আজও তা দিই। জাতিকে বাদ দিয়ে কিংবা জাতির গুরুত্ব না বুঝে জায়গার কী নাম দেওয়া হল না হল তাতে কী যায় আসে? যে দেশের মর্মে জাতি নাই সেই দেশের নামের কোনও মূল্য আমার কাছে সে দিনও ছিল না, আজও নাই। মানুষ বিহীন মাটির আবার কীসের মূল্য?

কিন্তু আমি অন্ধ পরজাতিবিদ্বেষ এবং পরজাতি পীড়নকে ঘৃণা করি। জাতীয়তাবাদ আমার কাছে বৃহত্তর মানবতাবাদ কিংবা আন্তর্জাতিকতাবাদের পরিপূরক একটি চেতনা মাত্র।কিংবা এটা আন্তর্জাতিকতাবাদ কিংবা বৃহত্তর মানব ঐক্যে পৌঁছাবার সিঁড়ি মাত্র। কেউ যদি সিঁড়ির অপব্যবহার করে তবে সেটা সিঁড়ির দোষ হবে কেন, সেটা হবে অপব্যবহারকারীর দোষ। তবে হ্যাঁ, সতর্কতার প্রয়োজন সবকিছু সম্পর্কেই আছে এবং থাকতে হয়। সুতরাং বঙ্গালী জাতীয়তাবাদ যাতে মানবতারও ঊর্ধ্বে উঠে মানবিক চেতনাকে বিনষ্ট করার জায়গায় যাবার সুযোগ না পায় সেই জন্য ‘জয় বাঙ্গালী’ স্লোগানের সঙ্গেই থাকত ‘সবার উপর মানুষ সত্য’। আমি বা যে কেউ একজন ‘জয়’ ধ্বনি তুললে সবাই সমস্বরে বলত ‘বাঙ্গালী’। কখনও বা সেটা হয়ে উঠত ‘বাঙ্গালী’, ‘বাঙ্গালী’। এবং এর সঙ্গেই অনিবার্যভাবে যখন ধ্বনি উঠত ‘সবার উপর’ তখন সমস্বরে ধ্বনি উঠত ‘মানুষ সত্য’। ভোর বা ভোর রাতে বহুকণ্ঠের এই উচ্চধ্বনি দূরদিগন্তে ছড়িয়ে যেত। জানি কবি বলেছেন, ‘শুনহ মানুষ ভাই, সবার উপরে মানুষ সত্য তাহার উপরে নাই।’ ‘সবার উপরে’ বললে স্লোগানে ঠিক জোর পাওয়া যায় না বলে আমি এটুকু পরিবর্তন করে ‘সবার উপর’ করে নিয়েছিলাম।
এখানে প্রসঙ্গক্রমে বলে রাখা উচিত হবে যে, এতকাল হিন্দুরা আমাকে সেভাবে গ্রহণ না করলেও এই আন্দোলনের পর খেনপাড়ার হিন্দুরা আমাকে তাদের আপনজন হিসাবে গ্রহণ করে। এর কিছু দিন পর তাদের সাহায্য নিয়ে আমি এলাকায় তাদের পল্লীর পাশের জমিতে একটি জুনিয়র স্কুল প্রতিষ্ঠা করি। এই স্কুল করতে গিয়েও আমি দেখেছি সামাজিক সেবামূলক কাজে মুসলমানদের তুলনায় হিন্দুদের ভূমিকা কত বেশী উদ্যমী এবং নিষ্ঠাবান হয়। যাইহোক, কিছু ক্ষেত্রে তুলনামূলকভাবে হিন্দু জনসমাজের চরিত্রগত শ্রেষ্ঠত্বের বিষয়টি ভিন্ন আলোচনার বিষয়। এখানে বিদ্যালয় প্রসঙ্গে শুধু এইটুকু উল্লেখ করতে চাই যে এই বিদ্যালয়টি পরে উচ্চবিদ্যালয়ে পরিণত হয়। সেখানে কলেজও হয়েছে।
 
সবচেয়ে বড় কথা এই আন্দোলনের মধ্য দিয়ে খেনপাড়ার এমন এক জাগরণ ঘটে যার ফলে সেখানে যে সব মুসলমান অত্যাচার করত তাদের অনেকে তাদেরকে ভয় পেতে ও শ্রদ্ধা করতে শুরু করে। গণ-শিক্ষা আমি আগে থেকে চালাচ্ছিলাম। এখন এই আন্দোলনের সময় থেকে গণ-শিক্ষার পাশাপাশি আমি পল্লীতে প্রতিভোরে নিয়মিত প্যারেড করাতাম। এবং সঙ্গে থাকত দুইটি ধ্বনি, ‘জয় বাঙ্গালী’ এবং ‘সবার উপর মানুষ সত্য’। একটু আগেই যে কথা বলেছি, উদ্দেশ্য ছিল পল্লীবাসীদের মধ্যে সাহস, শৃঙ্খলা এবং ঐক্য গড়ে তুলা এবং সেই সঙ্গে মানবিক বাঙ্গালীত্বের চেতনা জাগিয়ে তুলা। এতে ছেলেমেয়ে এবং পল্লীর ৬০-৬২ বৎসর বয়সের বৃদ্ধরাও নিয়মিত অংশ নিত। ৬২ বছর বয়সের এক বৃদ্ধ ৪০/৫০ বছর বয়সী কিংবা আরও কম বয়সীদের সঙ্গে প্রতিভোরে প্যারেড করছে এই দৃশ্য হয়ত অনেকের নিকট হাস্যকর মনে হবে। কিন্তু এটাই ছিল ঘটনা। কীভাবে আন্দোলন সমাজ বাস্তবতাকে বদলে দেয় এই ঘটনা তার প্রমাণ। বয়স অনুযায়ী এবং ছেলেমেয়ে অনুযায়ী বিভিন্ন ছোটদল বা স্কোয়াড গঠনের মাধ্যমে পল্লীতে একটা কেন্দ্রীয় পরিচালনা কাঠামোও (Central Command Structure) গড়ে তুলি। ছেলে এবং মেয়েদেরকে বয়স ও উচ্চতা অনুযায়ী আলাদা আলাদা স্কোয়াড বা উপদলে ভাগ করা হলেও সবাই থাকত একই পরিচালনা কাঠামোর অধীনে। গণ-শিক্ষাসহ এই সমগ্র প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে পল্লীর একটা নূতন সামাজিক নেতৃত্ব কাঠামোও গড়ে উঠে।

স্বাভাবিকভাবে প্যারেডের ঘটনা শুধু এক থানায় নয়, উপরন্তু কয়েক থানাব্যাপী জানাজানি হয়। কারণ সাধারণত খুব ভোর এবং এমনকি কখনও ভোর রাত থেকে সূর্য উঠার আগ পর্যন্ত তারা প্রতিদিন পল্লীর সন্নিকটস্থ নির্মীয়মান অথবা নবনির্মিত স্কুলের মাঠ এবং তৎসংলগ্ন মাটির বড় রাস্তায় প্যারেড করত (এখন সেই রাস্তা পাকা হয়েছে এবং সেটা উপজেলার প্রধান রাস্তা হয়েছে)। সেই দৃশ্য ভোরে যাতায়াতকারী নিকট-দূরের পথিক অথবা সাইকেল-ভ্যানের যাত্রীরা দেখত। এটা কয়েক বৎসর চলেছিল। এমনকি আমি চলে আসার পরেও অনেক দিন চলেছিল। এভাবে খেনপাড়ার মানুষদেরকে অঞ্চলের মানুষজন বিস্ময় ও শ্রদ্ধার চোখে দেখতে শুরু করে। এটা যেন ছিল মরাগাঙে বান ডাকা।
 
ঐ পল্লীর অধিকাংশ ক্ষেত্রে দরিদ্র পরিবারসমূহের রোগা বা অপুষ্ট ছেলেমেয়েদের শৃঙ্খলা এবং প্যারেডের নৈপুণ্য সম্পর্কে গল্পের মত যেসব কথা লোকমুখে ছড়িয়ে গিয়েছিল তার কিছু আমি শুনতাম। আর আমি নিজেও তাদের প্যারেড দেখে বিস্মিত হয়ে ভাবতাম এই দারিদ্র্যক্লিষ্ট এবং অপুষ্ট ছেলেমেয়েদের পক্ষে এতটা শৃঙ্খলা এবং নৈপুণ্য এত অল্প সময়ে এবং এত অল্প বয়সে কীভাবে অর্জন করা সম্ভব! পেশাদার সেনাবাহিনীর কুচকাওয়াজের সঙ্গে আমি তাদের নৈপুণ্য এবং শৃঙ্খলার পার্থক্য দেখতে পেতাম না। একটা পর্যায়ে তাদের প্যারেড দেখে আমার কাছে মনে হত কয়েকটি ছোট দলে বিভক্ত একটা বৃহত্তর যন্ত্র একই ছন্দে ও তালে চলছে, ফিরছে, দাঁড়াচ্ছে। একটা ঘটনা উল্লেখ করে আমি এ প্রসঙ্গ শেষ করব।
 
এটা প্রত্যক্ষদর্শী অনেকের কাছ থেকে শুনা। কিছু দূরের এক স্কুলের মাঠে একটা খেলাধূলার অনুষ্ঠানের উদ্যোক্তারা এই পল্লীর ছেলেমেয়েদেরকে সেখানে প্যারেড করার জন্য আহ্বান করলে আমিসহ পল্লীর সবার সম্মতিক্রমে তারা সেখানে যায়। কয়েক গ্রুপের যে প্রধান কম্যান্ডার ছিল তরুণ বয়সী সেই ছেলেটি প্যারেড পরিচালনার সময়ে এমন একটা জায়গায় সবাইকে থামতে বলে বা হল্ট করায় যেখানে একটা জায়গায় ছিল লাল বিষ পিঁপড়ার বাসা। সেখানে ১৪/১৫ বৎসর বয়সের এক ছেলেকে দাঁড়াতে হয়েছিল। তার পরণে ছিল হাফপ্যান্ট। লোকজনের ভাষ্যমতে পিঁপড়ার সারি তার পা বেয়ে এমনভাবে উপরে উঠছিল যে তার দুই পা লাল পিঁপড়া দিয়ে ঢাকা পড়ে গিয়েছিল। অথচ সে নড়া দূরের কথা আহাউহু শব্দ পর্যন্ত উচ্চারণ করে নাই। অসংখ্য বিষপিঁপড়ার কামড় খেয়েও সে অচঞ্চল ছিল। এই ঘটনা দর্শকদের নজরে পড়লে তারা চীৎকার করে কম্যান্ডারকে জানালে সে তখন দেরী না করে প্যারেডে কিছু সময়ের জন্য বিরতি দেয়। আমি শুনেছি এর পরই মাত্র সেই ছেলে পিঁপড়া ঝেড়ে ফেলা শুরু করে। এই ঘটনা অনেক দিন পর্যন্ত মানুষের গল্পের বিষয় হয়ে ছিল। মানুষের জীবনে প্রণোদনা কী জিনিস এই একটা ঘটনা থেকেই তা বুঝা যায়।
 
এই বিবরণ যাতে দীর্ঘ না হয় সেই জন্য এইটুকু বলি যে একটা সময়ে আমি ঢাকায় আসবার প্রয়োজন অনুভব করছিলাম। কারণ আমার চিন্তাগুলিকে তখন যতটুকু গুছিয়েছিলাম তার ভিত্তিতে অবসর সময়ে কিছু করে লিখতে শুরু করেছিলাম। কিন্তু সেখানে সেসব নিয়ে আলোচনা করার মত মানুষ যেমন ছিল না তেমন প্রকাশের সুযোগও ছিল না। ফলে আমি ১৯৮৯ সালে ঢাকায় আসি। তার আগে অবশ্য আমি বিদ্যালয়ের দায়িত্ব অন্যদের হাতে দিয়ে আসি। এবং ১৯৮৯ সাল থেকে আমি নূতন উদ্যমে লিখতে শুরু করি। ১৯৯৩-’৯৪-তে আমি বৎসরখানেক পুনরায় গ্রামে থাকি। সেই সময়টা ছিল বিএনপি-এর শাসনামলের কাল। সেই সময় স্কুলকে কেন্দ্র করে বিএনপি-এর ছত্রছায়ায় অনুষ্ঠিত দুর্নীতির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ ও আন্দোলন শুরু হলে আমি তাতে জড়িয়ে পড়ি। দুর্নীতির প্রতিবাদ করায় শাসক দল বিএনপি খেনপাড়া এবং আমাকে নানানভাবে হেনস্থা করার চেষ্টা করে। আসলে প্রথম থেকেই এলাকার কিছু সংখ্যক প্রভাব ও প্রতাপশালী লোক আমার ভূমিকাকে ভাল চোখে দেখছিল না। থানা সদরে আওয়ামী লীগের অবস্থান থাকলেও এলাকায় তাদের তেমন কোনও অবস্থান ছিল না। আমাদের এলাকার প্রতিপত্তিশালীরা ছিল মূলত বিএনপি-জামাতপন্থী। ফলে এরা ছিল এলাকায় বিএনপি-জামাতের মূল ভিত্তি। তাদের স্বার্থে এবং দৃষ্টিভঙ্গীতে তারা আমার উপর ক্ষুব্ধ হচ্ছিল। কিন্তু জনমত আমার পক্ষে ছিল। আমার আচরণেও যথেষ্ট নমনীয়তা ও কৌশল ছিল। ফলে তারা সুবিধা করতে পারছিল না। এলাকায় আমাদের পারিবারিক প্রভাবও একটা বড় কারণ ছিল প্রতিপক্ষের অক্ষমতার।

সবচেয়ে বড় কথা ১৯৮৬ থেকে ১৯৮৯ পর্যন্ত আমি যতদিন গ্রামে ছিলাম ততদিন ছিল জেনারেল এরশাদের শাসনামল। গ্রামে তার দলের সাংগঠনিক ভিত্তি ছিল তুলনায় খুব দুর্বল। কিন্তু এরশাদের পতনের পর পরিস্থিতি বদলে যায়। ১৯৯৩ সালে যখন আমি গ্রামে যাই সেই সময় বিএনপি রাষ্ট্র ক্ষমতায়। এর আগে তারা আমাকে দমাতে না পারলেও তখন রাষ্ট্র ক্ষমতায় থাকার সুযোগ তারা নিল। খেনপাড়ার উপর হামলাও হয়। তবে তারা প্রতিরোধ করে। খেনপাড়ার হিন্দুরা এই সময় অবিশ্বাস্য সাহসের পরিচয় দিয়েছিল। এই সংঘাতে দিনাজপুর জিলার ওয়ার্কার্স পার্টি আমাদের পাশে দাঁড়ায়। এটা আমাদের জন্য খুব সহায়ক হয়। যাইহোক, এটা ভিন্ন আলোচনার বিষয়।
 
এখানে এইটুকু বলি এই আক্রমণের পিছনে ছিল বিএনপি-এর জিলা পর্যায়ের আশরাফুল আলম নামে এক নেতার পৃষ্ঠপোষকতা, যে ছিল মৌলবী বংশের একজন। তার বাড়ী খানসামা থানার হোসেনপুরে হলেও সে থাকত দিনাজপুরে। তখন ক্ষমতাসীন প্রধান মন্ত্রী খালেদা জিয়ার বড় বোন খুরশিদ জাহান হক চকোলেটের সে ছিল ঘনিষ্ঠ অনুচর। এক সময় সে দিনাজপুর জিলা বিএনপি-এর সাধারণ সম্পাদকও ছিল। এখন তার পদ সম্পর্কে আমার জানা নাই। চকোলেট বা আশরাফুলের দুর্নীতি ও দুর্বৃত্তপনা কিংবা তাদের দুর্বৃত্তপনার প্রতি প্রধান মন্ত্রীর অফিসের (কিংবা প্রধান মন্ত্রীর নিজেরই?) পৃষ্ঠপোষকতার বিবরণ এখানে দিতে চাই না কেস-স্টাডি বা আলোচনাটাকে যতটা সম্ভব সংক্ষিপ্ত রাখতে চেয়ে। আর এটা এই আলোচনার জন্য অপ্রাসঙ্গিক। এখানে এ সম্পর্কে এইটুকু বললাম মৌলবী বংশের এবং এলাকার অন্য দুর্বৃত্তদের দুর্বৃত্তপনার শক্তির উৎস সম্পর্কে একটা ধারণা দিবার জন্য।
 
এখানে এইটুকু বলি যে এই সংঘাতের পর আমার নিজের এবং খেনপাড়ার নিরাপত্তার দিক বিবেচনা করে আমি ঢাকায় চলে আসার সিদ্ধান্ত নিই। কারণ এখন আমি তাদের মূল টার্গেট এবং আমি সেখানে থাকলে খেনপাড়াও আমার কারণে আরও বেশী করে তাদের টার্গেট হবে। এই আন্দোলনের মধ্য দিয়ে আমি প্রত্যক্ষ করলাম কীভাবে রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ পর্যায় তথা প্রধান মন্ত্রী এবং তার অফিস থেকে গ্রাম পর্যায় পর্যন্ত দুর্নীতি ও দুঃশাসন স্তরবিন্যস্ত হয়। তবে এই অভিজ্ঞতাও একটা চমকপ্রদ ও গুরুত্বপূর্ণ আলোচনার বিষয় হতে পারে। তবে একটু আগেই যে কথা বলেছি যে, এই আলোচনার জন্য সেটা প্রাসঙ্গিক নয়।

যাইহোক, অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে আমি বুঝলাম যে, আমি যতই ন্যায়ের পক্ষে থাকি দুর্বৃত্তায়ন ও লুণ্ঠনের পক্ষে দাঁড়ানো একটা সরকার এবং তার পরিচালনাধীন পুরা রাষ্ট্রের শক্তিকে আমার পক্ষে একা মোকাবিলা করা সম্ভব নয়। তবে আসবার পূর্বে আমি খেনপাড়ার হিন্দুদেরকে বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টির সঙ্গে যুক্ত করে দিই। এটা তাদেরকে মোটামুটি শক্তিশালী একটা জাতীয় রাজনীতির রক্ষাব্যূহ দিল। আর সে সময়ে দিনাজপুর জিলায় এবং বিশেষ করে‍ দিনাজপুর শহরে ওয়ার্কার্স পার্টির ভাল শক্তি ছিল। সেই সময় দিনাজপুর পৌরসভার চেয়ারম্যান ছিল ওয়ার্কার্স পার্টির একজন নেতা। ফলে খেনপাড়ার হিন্দুরা এখন আর বিএনপি-এর মত প্রবল জাতীয় রাজনৈতিক শক্তির মোকাবিলায় একা নয়। বস্তুত, এছাড়া তৎকালে ক্ষমতাসীন বিএনপি-এর ছত্রছায়ায় তাদের উপর যেভাবে আক্রমণ আসা শুরু হয়েছিল সেটাকে মোকাবিলা করা সম্ভব হত না। এখানে এইটুকু বলা বোধ হয় অপ্রাসঙ্গিক হবে না যে খানসামার আওয়ামী লীগ নেতৃত্বের ভূমিকাও খেনপাড়া বা আমাদের পক্ষে ছিল না। নির্মোহ বিচারে বলতে হবে খেনপাড়াকে প্রায় অনিবার্য বিপর্যয় থেকে রক্ষার জন্য সেই সময় দিনাজপুর জিলা ওয়ার্কার্স পার্টি নেতৃত্ব যে ভূমিকা পালন করেছিল তা অত্যন্ত প্রশংসনীয়। আমি এখনও কৃতজ্ঞতার সঙ্গে তাদের সেই সময়কার ভূমিকাকে স্মরণ করি।
 
যাইহোক, ১৯৮৯ থেকেই খেনপাড়া আর আগের জায়গায় থাকে নাই। তার অনেক রূপান্তর ঘটেছে। এই রূপান্তর সম্পর্কে একটা ধারণা দিবার জন্য এখানে আমি এইটুকু বলি ১৯৯৪ পরবর্তী কালে আমার অনুপস্থিতেও ঐ পল্লীতে মৌলবী বংশের লোকরা যারা বিভিন্ন সময়ে মারধর করতে গেছে তারা নিজেরাই মার খেয়ে ফিরে এসেছে। এভাবে তারা লোকজনের হাসি এবং তামাশার পাত্রও হয়েছে। আশা করি এ থেকে ঐ হিন্দু পল্লীবাসীদের নূতন সামাজিক শক্তি হিসাবে রূপান্তরের বিষয়টি স্পষ্ট হবে।
 
এটা বলা অপ্রাসঙ্গিক হবে না যে, ১৯৮৬ থেকে ১৯৮৯ পর্যন্ত আমি সেখানে যতদিন ছিলাম ততদিন খেনপাড়ার হিন্দুরা ধর্ম নিয়ে তেমন একটা মাথা ঘামাত না। যদিও হিন্দু হিসাবে বোধ তাদের মধ্যে ছিল। এখানে বলে রাখা ভাল যে, খেনপাড়ায় হিন্দুদের দুইটা বর্ণজাতি বাস করে। একটা হচ্ছে খেন, অপরটা হচ্ছে ক্ষত্রি বা ছত্রি। বুঝা যায় যে ক্ষত্রিয় শব্দটা তাদের মুখের ভাষায় ছত্রি হয়েছে। আজকাল খেনপাড়ার খেনরা সাধারণত নিজেদেরকে সেন বলে। একই নিয়মে খেনপাড়াও সেনপাড়া হয়েছে। এক সময় নেপাল বা তরাইয়ের দিকে খ্যান নামে উপজাতির বসবাসের কথা পড়েছিলাম। এটা পরবর্তী কালে খ্যান বা খেন বর্ণজাতিতে পরিণত হয়েছে বলে মনে হয়। ছত্রি বা ক্ষত্রিরা আগে বর্মণ পদবী ব্যবহার করলেও ইদানীং রায় পদবী ব্যবহার করে।
 
এই পল্লীর নাম খেন থেকে হলেও এখানে সংখ্যাগুরু হচ্ছে ছত্রিরা। যখন তাদের মধ্যে জাগরণ এল তখন ছত্রি-খেনসহ গোটা পল্লী একজোট হল। তাদের পল্লীর মুসলমানরা এবং আশেপাশের কিছু সংখ্যক মুসলমানরাও তাদের সহযোগী হতে শুরু করল। বিশেষত হিন্দুদের ঐক্য ছিল দর্শনীয়। ১৯৮৯ সালে আমি চলে আসবার পর তারা নিজেদের মধ্যে ঐক্য এবং সংহতি রক্ষার জন্য এবার ধর্ম চর্চার সিদ্ধান্ত নিল।
 
তারা প্রতিদিন সন্ধ্যার পর মহাভারত এবং গীতা পাঠ শুরু করল। কিছু দিন পর তারা গ্রামে সর্বজনীন মন্দিরও প্রতিষ্ঠা করল। এখানে এখন হরিবাসর এবং দুর্গামণ্ডপ আছে। অতীতে আমি মাঝে মাঝে সেখানে গেলে স্বাভাবিকভাবে তারা আমাকে তাদের চিন্তা এবং সিদ্ধান্ত জানাত। আমি বিরোধিতা না করলেও এর ফল যে তাদের জন্যও ভাল হবে না তা মনে হত। কিন্তু তাদের তো একটা অবলম্বন দরকার এ কথা মনে করে আমি মেনে নিতাম। তবে পরবর্তী সময়ে আমার শঙ্কা ঠিকই ফলল।
 
১৯৯৯ সালের ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে সাধারণ সদস্য পদে খেনপাড়ার ওয়ার্ড থেকে একজন দাঁড়ালেন। তার বর্ণজাতি বা ‘জাত’ হল ছত্রি। গ্রামের হিন্দুরা সবাই একজোট হয়ে তাকে ভোট দিলে তিনিই নির্বাচনে জয়ী হতেন। কিন্তু এ ক্ষেত্রে সমস্যা হল তার বর্ণজাতিগত পরিচয়। পরবর্তী সময়ে আমি জেনেছিলাম যে, পল্লীর খেনরা আলাদাভাবে সভা করে সিদ্ধান্ত নিল তাকে ভোট না দিতে। তাদের যে কথা আমাকে বলা হয়েছিল তা হল এই রকম, ‘খেন আর ছত্রি কখনও এক হতে পারে না। আমরা একজন মুসলমানকে ভোট দিব তাও ছত্রিকে ভোট দিব না।’ ঐ নির্বাচনে খেনপাড়ার প্রার্থী হেরে যায় এবং কিছু দূরবর্তী পল্লীর মুসলমান প্রার্থী জয়ী হয়। এবং এভাবে এ পল্লীতে হিন্দুদের মধ্যে যে ঐক্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল সেটা কিছু সময়ের জন্য হলেও ভেঙ্গে গেল। অর্থাৎ এটা বুঝা গেল বৃহত্তর হিন্দু সমাজের ঐক্য বা সংহতি বড় ভঙ্গুর। এই কেস-স্টাডিকে আমি আলোচনায় আনলাম এই ঘটনার তাৎপর্য বুঝার জন্যই।

আমার নিকট এই ঘটনার তাৎপর্য অপরিমেয়। বিশেষত হিন্দু ধর্ম ও সমাজকে নূতন করে এবং নিজ অভিজ্ঞতা দিয়ে বুঝতে এটা আমাকে বিরাটভাবে সাহায্য করেছে। এক সময় ঐ গ্রাম প্রায় মরে গিয়েছিল। সকল জাতের হিন্দুর হিন্দু হিসাবে এক অবস্থা। মুসলমানরা তো অন্যায়-অত্যাচার করার সময় জাতের বিচার করত না। আর হিন্দুরাও ধর্ম পালনের তেমন একটা সুযোগ না পাওয়ায় এ নিয়ে ভাববারও সুযোগ তেমন একটা পেত না। সামাজিক জীবনও তেমন একটা ছিল না। বলা যায় সবাই ব্যস্ত থাকত যার যার জীবন নিয়ে। ফলে হিন্দু হিসাবে এবং জাত নিয়ে চেতনা থাকলেও তারা কোনক্রমে ভেসে চলেছিল তাদের প্রথাগত জীবনের স্রোতে। এতদিন এক জাতের সঙ্গে আর এক জাতের ঐক্য দূরে থাক এক জাতের মানুষদের নিজেদের মধ্যেই জীবন্ত সামাজিক সম্পর্ক ছিল দুর্বল। তবে এক গ্রামে বা পল্লীতে বাস করলে সব সময় দেখা-সাক্ষাৎ হবে। ফলে একটা সম্পর্ক তো থাকে। কিন্তু সেটাকে জীবন্ত বলা যায় না।
 
কিন্তু আন্দোলনের ধারায় তাদের মধ্যে দৃঢ় ঐক্য এবং সংহতির সম্পর্ক গড়ে উঠল। একই জাতের মানুষদের মধ্যে এবং এক জাতের মানুষদের সঙ্গে আর এক জাতের মানুষদেরও। এ ক্ষেত্রে গ্রামকে কেন্দ্র করে তাদের মধ্যে বৃহত্তর সামাজিক বা গোষ্ঠী চেতনা গড়ে উঠতে থাকে। বাঙ্গালীত্বের চেতনা্ও এ ক্ষেত্রে সহায়ক ভূমিকা নিতে শুরু করেছিল। বিশষত মুসলমানদের সঙ্গে ঐক্যের ক্ষেত্রে এটার একটা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা গড়ে উঠছিল। হিন্দু হিসাবে আত্মরক্ষার প্রেরণা থাকলেও সেটা ততটা ধর্ম চেতনা নির্ভর ছিল না যতটা ছিল আগ্রাসী মুসলমানদের অত্যাচার-পীড়নকে মোকাবিলা করে একটা নূতন সমাজ-শক্তি হিসাবে দাঁড়াবার আকাঙ্ক্ষা নির্ভর, যার ভিতর ছিল বাঙ্গালীত্বেরও বোধ এবং সেই সঙ্গে অবশ্যই মানুষ হিসাবে মর্যাদা নিয়ে দাঁড়াবারও আকাঙ্ক্ষা। বিষয়টা স্পষ্টতর করার জন্য এ কথা বলা উচিত হবে যে, এ ক্ষেত্রে আশপাশের কিছু সংখ্যক মুসলমানও তাদের সহযোগী হিসাবে ভূমিকা নিয়েছিল। বিশেষত আমাদের পল্লীর কিছ্র সংখ্যক মুসলমান যুবক-যুবতী নানানভাবে তাদের পাশে দাঁড়িয়েছিল।
 
কিন্তু তারা যখন দেব-দেবীর পূজা-অর্চনাসহ নিয়মিত ধর্মচর্চা শুরু করে এবং মুসলমানদের দিক থেকে তাদের উপর থেকে চাপ কমে যেতে থাকে তখন তাদের মধ্যে হিন্দুধর্ম চেতনার অনুষঙ্গ হিসাবে বর্ণজাতি চেতনাও স্পষ্ট ও তীব্র হতে শুরু করে। এ কথা বুঝতে হবে যে সাধারণ হিন্দুর জন্য বেদের চেয়ে অনেক বেশী গুরুত্বপূর্ণ হল রামায়ণ, মহাভারত ও গীতার মত গ্রন্থ কিংবা বিভিন্ন পৌরাণিক কাহিনী। বিশেষত রামায়ণ-মহাভারতের মত পৌরাণিক গ্রন্থগুলি হিন্দুদেরকে তাদের হাজার হাজার বৎসরের ধর্মীয় ঐতিহ্য সম্পর্কে সচেতন করতে গিয়ে তাদেরকে বর্ণজাতি সচেতন তথা ‘জাত’ সচেতন বা Caste Conscious করে। কারণ হিন্দু ধর্ম এবং ঐতিহ্যের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িয়ে আছে বর্ণজাতিভেদ ভিত্তিক সমাজ-বিন্যাসের চেতনা ও ঐতিহ্য। ফলে হিন্দু চেতনার জাগরণ তার বর্ণজাতি বা ‘জাত’ চেতনাকে নানানভাবে উস্কে দেয়। আর জাত সচেতন বা caste conscious হবার এক অনিবার্য পরিণতি হল হিন্দু সমাজের আত্মবিভাজন ও আত্মবিচ্ছেদ। যে কোনও সামাজিক বা ব্যক্তিগত কিংবা গোষ্ঠীগত দ্বন্দ্ব বর্ণজাতিগুলিকে পরস্পর থেকে বিচ্ছিন্ন, এমনকি পরস্পরের বিরুদ্ধেও নিতে পারে। সবচেয়ে বড় কথা রক্তের যে বন্ধন কিংবা বৈবাহিক সম্পর্ক মানুষের সঙ্গে মানুষের সহজ মিলন ঘটায় বর্ণজাতিভেদ প্রথা তার পথে এক দুর্লঙ্ঘ্য বাধা হয়ে থেকে সমাজকে যেমন বিভক্ত করে রাখে তেমন দুর্বলও করে রাখে। এরই সুযোগ নিতে পারে যে কোনও প্রবলতর শক্তি। আমি দেখেছি মুসলমান যেমন মুসলমানের জন্য অনুভব করে হিন্দুর মধ্যে সেই ধরনের অনুভব কমই কাজ করে। আমার সুদীর্ঘ কালের ব্যক্তিগত বিপুল অভিজ্ঞতা থেকেই আমি কথাটা বেদনা এবং ক্ষোভের সঙ্গে বলছি। এই ধরনের মানসিকতার উৎস হিসাবে আমি মূলত বর্ণজাতিপ্রথাকেই দেখতে পাই।
 

 

কিছু মন্তব্য ও কিছু প্রশ্ন

 

ইতিহাস ও ঐতিহ্যের গুরুত্ব অপরিমেয়। কিন্তু ইতিহাস-ঐতিহ্যের সবকিছু গ্রহণযোগ্য নয়। অনেক কিছু পরিত্যাজ্য বা বর্জনীয়। ধর্মের অলৌকিকতা, দেবতা-ঈশ্বর-আত্মা কিংবা জন্মান্তরবাদ ইত্যাদিতে বিশ্বাসের যৌক্তিকতা বা অযৌক্তিকতা নিয়ে আলোচনা না করেও বর্ণজাতিভেদের ক্ষতিকর দিক সম্পর্কে আমরা নিঃসংশয়ে বলতে পারি যে এটার এক কালে যতটুকুই সামাজিক উপযোগ থাকুক বহুকাল ধরে এটা হিন্দু সমাজের জন্য অভিশাপ। এ থেকে বের হতে না পারলে হিন্দু সমাজ প্রকৃতপক্ষে উন্নতি ও মানবিকতার পথ ধরে এগিয়ে যেতে পারবে না। এটা তাকে প্রাচীন যুগের কারাগারে আবদ্ধ করে রাখবে এবং প্রতিযোগিতার পৃথিবীতে তাকে অসহায় করে রাখবে। এখন আমার প্রশ্ন বর্ণজাতিভেদ থেকে হিন্দু সমাজের মুক্তি কীভাবে সম্ভব? হিন্দুত্ব বজায় রেখে সেটা কি সম্ভব? হিন্দুত্ব থেকে মুক্তি সেটাই বা কী জিনিস? ধর্ম ও ঐতিহ্যের অনেক কিছুর সঙ্গে ছেদ না ঘটিয়ে কি সেটা সম্ভব? সেটারই বা রূপ এবং পদ্ধতি কী হবে? আপাতত প্রশ্নগুলি তুললাম।


 
খেনপাড়ার অগ্রগতির একটা খতিয়ান

 

এই কেস-স্টাডিতে একই সঙ্গে খেনপাড়ার উত্তরণ বা অগ্রগতি কতখানি হয়েছে সেটুকু সম্পর্কে একটা সাধারণ ধারণা দিতে গিয়ে এইটুকু বলি যে, আমি যখন ১৯৮৬-তে যাই তখন যেই পাড়ায় একজন গ্র্যাজুয়েট দূরের কথা একজন ইন্টারমিডিয়েট পাসও ছিল না সেই পাড়ায় সর্বশেষ প্রাপ্ত হিসাব অনুযায়ী ২০১৫-তে মাস্টার্স ৩ জন (২ জন এমএ এবং ১ জন এমএসসি পাস, যে নারী), গ্র্যাজুয়েট ১২ জন এবং এইচএসসি বা ইন্টারমিডিয়েট পাস ২৩ জন এবং এসএসসি বা মাধ্যমিক পাস ১৩ জন আছে। অবশ্য এই হিসাবে এই গ্রামে অন্য গ্রাম থেকে যেসব মেয়ে বৌ হয়ে এসেছে তাদেরকে ধরা হয় নাই। যেমন এখানে অন্য গ্রাম থেকে একজন মাস্টার্স পাস মেয়ে বৌ হয়ে এলেও তাকে এই হিসাবে ধরা হয় নাই। তাকে হিসাবে নিলে পল্লীর মাস্টার্স করা মানুষের সংখ্যা ২০১৫-তে ৪ জন হবে। একইভাবে যেসব গ্র্যাজুয়েট বা অন্যান্য সার্টিফিকেটধারী মেয়ে এই পল্লীর বৌ হয়ে এখানে এসেছে তাদেরকেও এই হিসাবে ধরা হয় নাই। এই হিসাবে যারা এখন ছাত্র-ছাত্রী বা লেখাপড়া করছে তাদের সংখ্যাও ধরা হয় নাই। তবে এখন গ্রামের প্রায় সবাই কম-বেশী লেখাপড়া জানা। নিরক্ষরতার হার প্রায় শূন্যের কোঠায়। খুব বেশী বয়সী ২/১ জনকে পাওয়া যেতে পারে যার অক্ষরজ্ঞান নাই। অথচ ১৯৮৬ অথবা ১৯৮৭-এর প্রথম দিকে আমি যে জরিপ করেছিলাম তাতে কোনও রকমে নাম সই করতে পারে এমন ব্যক্তিকে সাক্ষর ধরে সম্ভবত ১২ বা ১৩ শতাংশ সাক্ষরতার হার পেয়েছিলাম।
 
ইতিমধ্যে খানাসংখ্যা এবং জন সংখ্যাও এই পল্লীতে অনেক বেড়েছে। যেমন ১৯৮৬-তে খানা বা পরিবার সংখ্যা ৭০/৭২ হলেও ২০১৫-তে তা বেড়ে হয়েছে ১৫৮টা। ১৯৮৬-তে হিন্দু পরিবার ছিল ৬৭/৬৯টা আর মুসলিম পরিবার ৩টা।  আর এখন ২০১৫-তে ১৫৮টা পরিবারের মধ্যে হিন্দু পরিবার ১৪৬টা আর মুসলিম পরিবারের সংখ্যা ১২টা। ১৯৮৬-তে গোটা পল্লীর জনসংখ্যা প্রায় ৩৫০ হলেও এখন সেই সংখ্যা ৭০০-এর উপরে। আমার মনে হয় জনসংখ্যা বৃদ্ধির তুলনায় প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার এই বৃদ্ধি যথেষ্ট তাৎপর্যপূর্ণ। এটা পল্লীর সামগ্রিক উন্নয়নের দিকেও ইঙ্গিত দেয়। অর্থনৈতিক অবস্থাও এখন পূর্বের তুলনায় অনেক ভাল।    
 
আগে কৃষির বাইরে পল্লীর মানুষদের কাউকে দেখা যেত না বলা যায়। সেখানে এখন পুলিশ, বিজিবি, ব্যাংক, স্কুল, কলেজসহ বিভিন্ন সরকারী ও বেসরকারী প্রতিষ্ঠানের বিভিন্ন পর্যায়ের পদে এই পল্লীর অনেক কয়জন কর্মরত আছে। তারা এখন ব্যবসার দিকেও কিছু করে ঝুঁকছে। মোট কথা ১৯৮৬ থেকে ২০১৫ পর্যন্ত এই প্রায় ৩০ বৎসরে বহু বাধাবিপত্তির মধ্য দিয়েও খেনপাড়ার অগ্রগতি কম নয়।
 
একটা অন্ধকার গ্রাম থেকে তাদের এভাবে জেগে উঠবার শক্তির সবচেয়ে বড় উৎস ছিল অন্যায়-অবিচারের বিরুদ্ধে তাদের লড়াই। সেই লড়াই তাদেরকে আজ এখানে নিয়ে এসেছে। আমি তাদেরকে পথ দেখিয়েছিলাম মাত্র। কিন্তু কাজটা প্রধানত তারাই করেছিল। এবং আমি চলে আসবার পর ওয়ার্কার্স পার্টির সাহায্য নিয়ে হলেও তারা নিজেরাই করেছিল। কিন্তু আরও বৃহত্তর যে শক্তি ও সম্ভাবনা নিয়ে তারা দাঁড়াতে পারত সেটা সম্ভবত তারা খানিকটা হলেও খর্ব করেছে তাদের বর্ণজাতি চেতনা দ্বারা। অর্থাৎ হিন্দু হিসাবে তাদের যে চেতনা তাদের মধ্যে উদ্যম, প্রেরণা ও সাহস এনে দিয়েছিল সেইটাই এক পর্যায়ে তাদের জন্য ক্ষতিকর হয়ে দেখা দিয়েছে কিনা সেই বিষয়টাই আমি পুনরায় ভাবতে বলি।


 
শেষ কথা

 

তবে এই সঙ্গে আমি এ কথাও বলব কারও বাস্তবতা না বুঝে তার কাছ থেকে খুব বেশী আশা করতে নাই। খেনপাড়া সারা দেশ থেকে বিচ্ছিন্ন কোনও দ্বীপ নয় যে সেখানে তারা একটা বিপ্লব ঘটিয়ে সবকিছুর আমূল পরিবর্তন ঘটিয়ে দিবে। সেটা সম্ভব ছিল না। একটা ক্ষুদ্র পর্যায়ে এবং সামগ্রিকভাবে এ দেশের বাস্তবতার মধ্যে থেকে তারা যেটুকু করেছিল বা করেছে সেটুকুই তাদের প্রেক্ষিতে বিপ্লবাত্মক।
 
তবে আমার জন্য গ্রামের কয়েক বৎসরের অভিজ্ঞতা এবং বিশেষ করে খেনপাড়ার অভিজ্ঞতার মূল্য অপরিমেয়। পাকিস্তান কালে ৫/৬ বৎসর গ্রামে থেকে কৃষক সংগঠন ও আন্দোলনের মধ্য দিয়ে আমি যে সব অভিজ্ঞতা সংগ্রহ করেছিলাম সেগুলি ছিল এক ধরনের অভিজ্ঞতা। তখন আমি দেশব্যাপী বিন্তৃত একটি বৃহৎ কৃষক সংগঠনের কর্মী। সুতরাং আমার পিছনে ছিল বৃহৎ বামপন্থী রাজনৈতিক শক্তি। কিন্তু বাংলাদশে পরবর্তী কালে আমি যখন গ্রাম এলাকায় কাজ করতে যাই তখন আমি একা। আমার পিছনে কোনও সংগঠন বা শক্তির আশ্রয় বা পৃষ্ঠপোষকতা কিছুই ছিল না। যাইহোক, খেনপাড়া আমার জন্য ব্যষ্টিক বা ক্ষুদ্র পর্যায়ে সামাজিক অনুসন্ধান তথা পরীক্ষা-নিরীক্ষার এমন এক সুযোগ করে দিয়েছিল যেখানে আমি আমার অনেক চিন্তা বা ধারণাকে যাচাই করেছি এবং যেখান থেকে আমি বহু অমূল্য শিক্ষা এবং প্রেরণা সংগ্রহ করেছি। এটাকে আমার জন্য ‘মাইক্রো লেভেল স্টাডি’ হিসাবে উল্লেখ করতে পারি। সমাজ বিপ্লব সম্পর্কে আমার নিজস্ব যে ধারণা গড়ে উঠেছে তার বিকাশ বা পুষ্টিসাধনে আমার পূর্ববর্তী অভিজ্ঞতার সঙ্গে যুক্ত হয়ে খেনপাড়া এবং এই সময়কার গ্রামের কয়েক বৎসরের অভিজ্ঞতা বিরাটভাবে ভূমিকা রেখেছে।

 

 

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
Archive
 
সাম্প্রতিক পোষ্টসমূহ