Banner
মুসলিম অভিজাত ও মধ্যবিত্ত — অধ্যাপক নাজমুল করিম

লিখেছেনঃ অধ্যাপক নাজমুল করিম , আপডেটঃ April 23, 2009, 6:00 PM, Hits: 13954

 

 

ইংরাজ আমলে বাঙ্গালী মুসলিম সমাজের সামাজিক স্তর বিভাগে একটি মূলগত পরিবর্তন লক্ষ্য করতে পাই। বিদেশী শাসনের নিগ্রহ ও ইসলামের গণতান্ত্রিক প্রভাবই এর জন্য মূলত দায়ী। ইংরাজ আমল ও মুসলিম আমলের ভেতর পার্থক্য এই যে ইংরাজ আমলে দেশীয় সামন্ত সমাজ ব্যবস্থার উপর বণিক-রাজের প্রতিষ্ঠা হল। মুসলিম সামন্ত রাজাদের মত এ নয়া বণিক-রাজাদের দেশের মাটির সঙ্গে সংযোগ নাই; হিন্দু বেনিয়ান, মুন্সী, মুৎসুদ্দি, গোমস্তা এধরনের লোকেরাই বণিক-রাজের সবচেয়ে বেশী অনুগৃহীত; কারণ ব্যবসায়, শোষণ ও শাসন করতে গিয়ে এদেশে ইংরাজ এদের সাথেই সর্ব্ব-প্রথম খাতির করার সুযোগ পায়। রাষ্ট্রের অনুগ্রহে পুষ্ট হয়ে আমাদের সমাজে তারা ক্রমশ প্রতিপত্তিশালী হয়ে উঠল। তাদের পৃষ্ঠপোষকতা করতে গিয়ে এদেশের পুরনো জমিদার জায়গীরদারদের হাত থেকে ক্রমশ ক্ষমতা কেড়ে নেওয়া হল। তাদের প্রয়োজনে রাষ্ট্রের আইন তৈরী হল ও মুসলিম অভিজাত শ্রেণী আইনের কবলে পড়ে ক্রমশ তাদের জমিদারী জায়গীরদারী তালুকদারী সবই হারাল ও ইংরাজ অনুগ্রহপুষ্ট মুন্সী মুৎসুদ্দীরা এসে তাদের স্থান দখল করে নয়া অভিজাত শ্রেণীর প্রতিষ্ঠা করল।

বাঙ্গলা দেশে দু’শত বছর ইংরাজ রাজত্বের কাহিনী প্রধানত এসামন্ত শ্রেণীর ভাঙ্গা-গড়ার কাহিনী। ইংরাজ রাজত্বে আধুনিক শিক্ষার প্রবর্তন হ’ল, মধ্যবিত্ত শ্রেণীর প্রতিষ্ঠা হল, ব্যবসায়ী যুগ (Merchant capitalism) ও শিল্পযুগের (Industrialism) সূচনা হল, ব্যবসায়ী শ্রেণীর প্রতিষ্ঠা হল. এ সব অবশ্য হল; কিন্তু সাধারণ হিন্দু-মুসলিম বাঙ্গালী প্রধানত সামন্ত শ্রেণীকে আশ্রয় করেই ছিল। নয়া শ্রেণীসমূহ গড়ে উঠার ফলে ও শিল্প বিপ্লবের সূচন হওয়ার ফলে নূতন যুগের আরম্ভ হল; কিন্তু দেশের উপর সামন্ত সমাজ ব্যবস্থার যে বিপুল প্রভাব ছিল, তার প্রভাব থেকে নয়া সমাজ ব্যবস্থা সম্পূর্ণ মুক্ত হতে পারে নি। ধ্বংসপ্রাপ্ত সামন্ত শ্রেণীকে আশ্রয় করে মুসলিম সমাজ কি করে নয়া সমাজের প্রতিষ্ঠা করল ও তার স্বরূপ ও প্রকৃতি কি, তার আলোচনা আমাদের এ প্রবন্ধে করব। [প্রবন্ধ কেবল জমিদার, মধ্যবিত্ত ও ব্যবসায়ী শ্রেণীর উত্থান পতনের ভেতর সীমাবদ্ধ থাকবে, কারণ যুগ পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে এদের হাতেই সমাজের নেতৃত্ব বর্তাচ্ছে। কৃষক, মজুর, তাঁতি, জোলা এধরনের অসংখ্য শ্রমিক-মজুরই মুসলিম সমাজের বৃহত্তর অংশ; কিন্তু সমাজের নেতৃত্ব তাদের হাতে নয়। সমাজের স্বরূপ বুঝতে হলে নেতৃশ্রেণীর প্রকৃতি ও গঠন প্রথমে বোঝা প্রয়োজন, তাই এক্ষুদ্র প্রবন্ধে নেতৃশ্রেণীদেরকে নিয়েই আলোচনা করব।]

বাঙ্গালী মুসলিম সমাজের শ্রেণী বিন্যাসের দিকে তাকালে আমরা দেখতে পাব যে ইংরাজ রাজত্বে একে ক্রমশঃ গণতন্ত্রী’মুখীন করা হয়েছে, (অবশ্য তা ইংরাজরাজের অনিচ্ছা ও অগোচরে)। পৃথিবীর অন্য যে কোন দেশের মুসলিম সমাজের শ্রেণী বিন্যাসে অতটুকু গণতন্ত্রী প্রভাব দেখতে পাই না। এমন কি পশ্চিম পাকিস্তানে আজও ফিউডালতন্ত্র চালু ও কতক ফিউডালপ্রধান দেশ ও সমাজের মালিক। কিন্তু এদিক দিয়ে পূর্ববঙ্গ মুসলিম সমাজে বিপ্লব হয়ে গিয়েছে। এ বিষয়ে আমরা ইংল্যাণ্ডের মত প্রগতিশীল রাষ্ট্রের সাথেও পূর্ববঙ্গের তুলনা করতে পারি। ইংল্যাণ্ডে গণতন্ত্র চালু; কিন্তু ইংল্যাণ্ডের সামাজিক সংগঠন গণতান্ত্রিক নয়। লর্ড পরিবার, মধ্যবিত্ত ও সাধারণ শ্রমিকের ভেতর সামাজিক প্রভেদ আকাশ-পাতাল; তাদের ভেতর সামাজিক মেশামিশি বা বৈবাহিক সম্পর্ক চলতে পারে না। এ ধরণের সামাজিক অসাম্য দেখে বার্নাড শ’ একবার বলেছিলেন, “Equality of income will have the excellent result of making the whole community intermarriageable.”প.ূ কিন্তু বাঙ্গালী মুসলিম সমাজের দিকে তাকালে আমরা দেখতে পাব যে সে অন্তর্বিবাহ আমাদের সমাজে চালুই আছে। আমাদের প্রাদেশিক মন্ত্রি-সভা বা প্রাদেশিক পরিষদ বা রাষ্ট্রের বিভিন্ন দায়িত্বশীল পদের দিকে তাকালে দেখতে পাব যে উহাতে সামন্ত শ্রেণীর প্রভাব নেই বললেই চলে; কেবল তাই নয়, বরং উহা সামন্ত শ্রেণী বিরোধী। আজকে যদি আমাকে রাষ্ট্রীয় পরিষদের নির্বাচন প্রাথী হতে হয়; তবে আমাকে জমিদার-তালুকদার না হয়ে, আভিজাত্য বিহীন সাধারণ পরিবারে জন্মালে বিশেষ কোন ক্ষতি নাই, বরং নির্বাচন প্রতিযোগিতায় উহাই আমার একটি গুণ হয়ে দাঁড়াবে। দেশের শাসন পরিচালন আজ কতক মুষ্টিমেয় জমিদার পরিবারের হাতে নয়। কৃষিপ্রধান দেশে সাধারণত ফিউডালতন্ত্রেরই প্রভাব থাকার কথা, কিন্তু পূর্ববঙ্গ মুসলিম সমাজে উহার বিকল্প দেখে বিস্মিত হবারই কথা।

বাঙ্গালা দেশেই সকলের আগে ইংরাজ রাজত্বের সূচনা হয়। সে যুগের মুসলিম অভিজাত সমাজ এ রাষ্ট্রীয় পরিবর্তনকে কখনই সুনজরে দেখে নি; ইংরাজও মুসলিম অভিজাতকে সুনজরে দেখে নি। যে কোন সমাজের দিকে তাকালে আমরা বলতে পারি যে সামন্ত শ্রেণী রাষ্ট্রের অনুগ্রহ ছাড়া বাঁচতে পারে না; তাই বাঙ্গালী মুসলিম সামন্ত শ্রেণীও ক্রমে ক্রমে ধ্বংসের পথে চলল। ভারতের অন্যান্য প্রদেশে বাঙ্গলার অনুরূপ সামাজিক পরিবর্তন ঘটে না। যেমন ধরা যাক পাঞ্জাবের কথা। সেখানে অনেক পরে ইংরাজ রাজত্ব গিয়ে পৌঁছায় ও সেখানকার মুসলিম অভিজাত শ্রেণী বরং কিছুটা পৃষ্ঠপোষকতা ইংরাজ রাজ থেকে পেয়েছে; কিন্তু বাঙ্গলা দেশের বেনিয়ণ মুৎসুদ্দি শ্রেণী ইতিমধ্যে গড়ে উঠেছে ও তারা ইংরাজের এজেণ্ট হিসাবে দেশের শাসন ও শোষণ দুইই চালাচ্ছে। এভাবে বাঙ্গালী মুসলিম অভিজাত শ্রেণী ক্রমে ক্রমে জায়গা-সম্পত্তি হারিয়ে নামকাওয়াস্তে “অভিজাতে” পরিণত হল। যতদিন তাদের আর্থিক সচ্ছলতা ছিল, ততদিন তারা তাদের আভিজাত্য ও গৌরববোধ বজায় রাখতে সক্ষম ছিল। আর্থিক সচ্ছলতার দিনে বাঙ্গালী মুসলিম অভিজাত শ্রেণী শরাফতী ও খানদানীর দাবীতে কেবল মাত্র নিজেদের ভেতরই বিবাহ চালু রাখত, মুসলিম বাঙ্গালার অপরাপর শ্রেণীকে তারা “আতরাফ” ও নিজেদেরকে “আশরাফশ্রেণী” বলে প্রচার করত। কিন্তু এ “আশরাফ” শ্রেণী নূতন যুগের প্রভাবে তাদের পুরণো ঈথঢ়য়প হড়মনপ বজায় রাখতে পারল না। দেশ ও সমাজে নূতন যুগের প্রভাব এসে পড়ছিল, সে প্রভাবের সামনে দাঁড়াতে সক্ষম হল না। যারা নূতন পরিবর্তনের সাথে খাপ খাওয়াতে সক্ষম হল না তারা স্রোতের বিপাকে ধ্বংসের দিকে চলে গেল। ইংরাজ এদেশে কতক গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠার চালু করল - যেমন, নির্বাচন প্রার্থী, ধনী-দরিদ্র সকলের জন্য স্কুল-কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠা (ইংল্যাণ্ডে বড়লোকের ছেলেদের জন্য আলাদা পাবলিক স্কুল আছে) পাবলিক সার্ভিস কমিশন ইত্যাদি। এসবের ফলে মুসিলম সমাজের নানা স্তর থেকে নানা শ্রেণীর লোক রাষ্ট্রের চাকুরী ইত্যাদি নানা কিছুতে ঢুকে পড়ল। মুসলিম অভিজাত শ্রেণী প্রথম প্রথম অবশ্য এসবকে “গোলামী” বলেই উপেক্ষা করত কিন্তু এ নয়া আধুনিক শিক্ষিত মুসলিম মধ্যবিত্ত শ্রেণীর কাছে শেষ পর্যন্ত তাদেরকে পরাজয়ই স্বীকার করতে হল। আমরা শুনতে পেলুম অমুক গ্রামের সাধারণ গৃহস্থের ছেলে সরকারী বৃত্তি পেয়ে, পড়াশুনা করে, ডেপুটি হয়েছে ও অমুক “শরীফ” মুসলিম পরিবার তার সাথে তাদের মেয়ে বিয়ে দিয়েছে। “আশরাফ” পরিবার সমূহে এনিয়ে কানাঘুষা হল, তাদের কেউ কেউ নাক শিট্‌কাল। প্রথম প্রথম যারা নাক শিট্‌কাল শেষ পর্যন্ত তারাও “ডেপুটি” বরের মায়া ত্যাগ করতে পারল না।

বিংশ শতাব্দীর প্রথম ভাগে ইংরাজ নিজ প্রয়োজনে রাষ্ট্রের চাকুরী-বাকুরীতে কিছু কিছু মুসলমান ঢুকাবার পরিকল্পনা করল; তাই ধীরে ধীরে শিক্ষিত মুসলিম মধ্যবিত্ত শ্রেণী গড়ে উঠল। এ মুসলিম মধ্যবিত্ত শ্রেণীর রিক্রুট সমাজের সকল স্তর থেকে নেওয়া। কিন্তু “শরীফ” পরিবারের সাথে বিবাহাদি করে “জাতে” উঠার প্রবৃত্তি তারা তখনও ত্যাগ করতে পারে নি। আর্থিক বিপর্যয় ও নয়া যুগের সাথে তাল রাখতে না পেয়ে “শরীফ” পরিবার সমূহও তাদের শরাফতি বজায় রাখতে পারছিল না; তাই “জাতে” উঠা নামা দুইই বেশ চলল। আজিকার পূর্ববঙ্গ মুসলিম সমাজে যে “জাতি” বিচার নাই তা বলছি না, তবে তা পূর্বের ড়মবমনময়ী বহুল পরিমাণে হারিয়েছে। মধ্যবিত্ত শ্রেণীর সাথে “শরীফ” পরিবারের বিবাহাদি চালু হওয়ার ফলে এখন সব শ্রেণীর লোকেরাই নিজেদেরকে কোন না কোন সূত্রে “শরীফ” পরিবারের সঙ্গে সংযুক্ত বলে দাবী করতে পারে। “শরীফ” পরিবারের সঙ্গে সংযুক্ত থাকাটা এর আগের যুগে হয়তো বা কৃতিত্বের বিষয় ছিল। আজকাল তা কোন কৃতিত্বের বিষয়ও নয়। পূর্ববঙ্গে রাষ্ট্র পরিচালনায় আজকাল মধ্যবিত্ত শ্রেণী সবচেয়ে বেশী উল্লেখযোগ্য ভূমিকা গ্রহণ করছে, রাজনৈতিক আন্দোলনেও তার দান অপরিসীম; তাই মধ্যবিত্ত শ্রেণীতে আত্মবোধ জাগ্রত হয়েছে। নিজগুণে প্রতিষ্ঠিত মধ্যবিত্ত শ্রেণীর কাছে ধ্বংসপ্রাপ্ত নামকাওয়াস্তে “অভিজাত” শ্রেণীগুলি বেশী কিছু দাবীই করতে পারে না। তাই নয়া সমাজের পত্তন হতে চলেছে, এ সমাজ সম্পূর্ণ সামন্ত প্রভাব মুক্ত না হলেও, অনেকাংশে প্রভাব মুক্ত হয়েছে, একথা আমরা জোর দিয়ে বলতে পারি। পূর্ববঙ্গ কৃষি প্রধান দেশ, এদেশে এধরণের সামাজিক বিন্যাসের পত্তন বাস্তবিকই বিচিত্র। এর ফলে আমাদের দেশে শীঘ্রই নয়া যুগের সূচনা হবে একথা নিঃসন্দেহে বলা যায়।

কিন্তু মধ্যবিত্ত শিক্ষিত সমাজও বিগত মহাযুদ্ধে বিষম আঘাত পেয়েছে; তার জের আমরা এখনও কাটিয়ে উঠতে পারিনি। মুদ্রা-স্ফীতি, দুর্মূল্য, ধনাগম ও রিক্ততা আজ আমাদের সমাজকে নূতন পথের যাত্রী করেছে। মুদ্রা-স্ফীতি ও দুর্মূল্য আবার পূর্ববঙ্গেই সবচেয়ে বেশী হয়েছে, তাই সামাজিক পরিবর্তনও এখানে সবচেয়ে বেশী হবে। খোঁজ করলে দেখা যাবে যে মুদ্রা-স্ফীতির ফলে আমাদের সমাজে সামগ্রিকভাবে ভাঙ্গন আরম্ভ হয়েছে। গ্রাম্য সামাজিক সংগঠন, পারিবারিক মমত্ববোধ, যৌথকৃষি, গৃহ-শিল্প, ব্যবসায় ইত্যাদি সকল ক্ষেত্রেই ভাঙ্গন আরম্ভ হয়েছে। মুদ্রা-স্ফীতির ফলে সমাজের নানা স্তরে নানাভাবে অর্থের পরিব্যাপ্তি হয়েছে, তার ফলে সমাজ তার পূর্বের ভারসাম্য বজায় রাখতে পারছে না; তাই বিভিন্ন শ্রেণীতে বোঝাপড়ার মৃদু সংঘর্ষ চলছে। এদিকে এক নূতন শ্রেণী আমাদের সামাজিক গঠনে প্রভাব বিস্তার করতে চলেছে ু সে হল যুদ্ধের সুযোগে গড়া নয়া বাঙ্গালী মুসলিম ব্যবসায়ী শ্রেণী। এ ব্যবসায়ী শ্রেণী ঐতিহ্য বিহীন। ইংরাজ আমলের দেশীয় বেনিয়নের ঐতিহ্য ছিল - তারা মুসলিম আমল থেকেই পাকা ব্যবসায়ী, তারা ভূ’ইফোড় কিছু নয়, তাই তাদের ব্যবসায়ের কায়দা-কানুন বেশ জানা ছিল। কিন্তু বাঙ্গালী মুসলিম ব্যবসায়ী শ্রেণীর সে ঐতিহ্য নাই; যুদ্ধ ও দেশ বিভাগের ফলে তারা “হঠাৎ বড়লোক” হবার জোগাড় হয়েছে; তাই তাল সামলান দায় হয়েছে। এরা যে ব্যবসার ক্ষেত্রে দারুণ-ভুলভ্রান্তি করবে, তাতে সন্দেহের অবকাশ নেই; কিন্তু অল্পকাল মধ্যেই মুদ্রাস্ফীতি, যুদ্ধের কনট্রাক্টরী ইত্যাদির দৌলতে তারা সমাজের বিশিষ্ট স্থান দখল করেছে। বাঙ্গালী মুসলিম মধ্যবিত্ত শ্রেণীকে তারা “যুদ্ধং দেহি” ভাব দেখাচ্ছে। রাষ্ট্রপরিচালনায় আজও মধ্যবিত্ত শ্রেণীর প্রভাব অক্ষুণ্ন থাকলেও, নয়া ব্যবসায়ী শ্রেণী তাদের অর্থের প্রভাবে রাজনৈতিক জগৎ দখল করতে প্রয়াস পাচ্ছে। মুসলিম মধ্যবিত্ত ও নয়া ব্যবসায়ী সমাজের এখানেই বিরোধ উপস্থিত হয়েছে। এই দুই শ্রেণী আপোষ রফা করে চলতে পারবে কিনা সন্দেহ; তবে এ নিশ্চিত বলা যায় যে মধ্যবিত্তের এক অংশ নয়া ব্যবসায়ী সমাজের নিকট আত্মসমর্পণ করলেও অপর অংশ আত্মসমর্পণ করবে না। সভাসমিতি, খবরকাগজের পৃষ্ঠায় তা অনেকটা সপষ্ট হয়ে দেখা দিয়েছে। কিন্তু ব্যবসায়ী সমাজের অর্থের জোর আছে, মধ্যবিত্ত সমাজের তার জোর নাই; অতএব সমাজ যদি লাগামহীন ভাবে চলতে থাকে তবে মধ্যবিত্ত সমাজ ব্যবসায়ীদের কাছে আত্মসর্পন করতে বাধ্য। সত্যিকারের গণতন্ত্র আর্থিক বৈষম্যবাদের উপর গড়ে উঠতে পারে না; ব্যবসায়ী শ্রেণীর হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরের অর্থ আর্থিক বৈষম্যবাদের প্রশ্রয় দেওয়া। আর্থিক নেতৃত্বই সামাজিক স্তর বিভাগ ও শ্রেণী বিশেষের সামাজিক নেতৃত্বের মূলসূত্র। বুদ্ধিজীবী মধ্যবিত্তের নেতৃত্বকে আমরা এসন সফ গথশশসষ এর কাছে কোরবাণী দিতে পারি না; মুসলিম সমাজের আদর্শ কোন দিনই প্লুটোক্রেসীর আদর্শ হতে পারে না - বর্তমান মুসলিম রাষ্ট্রসমূহেও আমরা সে ধরনের প্লুটোক্রেসীর সন্ধানও পাই না, ভবিষ্যতেও ও ধরণের ধনতান্ত্রিক সমাজের প্রতিষ্ঠার সম্ভাবনা দেখি না। আমাদের সমাজের সংগঠন ও প্রকৃতির দিকে তাকিয়ে নিশ্চিত বলতে পারি যে আমাদের সামাজিক আদর্শ মোটামুটি গণতন্ত্র ও সমাজতন্ত্র মুখীন। ইসলামের সাম্য ও মৈত্রীর আদর্শ এ ধরণের গণতান্ত্রিক ও সমাজতান্ত্রিক সমাজ গঠনে সহায়তা করবে এ আমাদের পূর্ণ বিশ্বাস আছে। *

[চল্লিশের দশকের শেষের দিকে প্রকাশিত ঢাকা কলেজ বার্ষিকী থেকে পুনর্মুদ্রিত]

 

* সমাজতাত্ত্বিক হিসাবে প্রয়াত এ, কে, নাজমুল করিম এ দেশে বিশেষ মর্যাদার অধিকারী। বাঙ্গালী জাতির বিকাশ ও সমস্যা সংক্রান্ত আলোচনায় তার রচনাগুলি বিশেষ মূল্য বহন করে। তার কিছু ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ সম্পর্কে ভিন্ন মত পোষণ করলেও সামগ্রিক বিচারে গুরুত্ব ও তাৎপর্য বিবেচনা করে আমরা ইতিপূর্বে তার কয়েকটি প্রবন্ধ প্রকাশ করেছি। প্রবন্ধটি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সমাজ বিজ্ঞান বিভাগ কর্তৃক ১৯৮৪-তে প্রকাশিত ’এ,কে, নাজমুল করিম স্মারক গ্রন্থ’ হতে সংকলিত। - বঙ্গরাষ্ট্র

অনলাইন : ২৪ এপ্রিল, ২০০৯

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
Archive
 
সাম্প্রতিক পোষ্টসমূহ