লিখেছেনঃ সোহাগ কুমার বিশ্বাস, আপডেটঃ April 18, 2011, 6:26 AM, Hits: 23791
পৃথিবীর প্রাচীনতম যানবাহন নৌকা। সভ্যতার ঊষালগ্নে আমদের পূর্ব পুরুষেরা যখন সভ্য হয়েও ওঠেনি, তখন হয়তো তাদেরই কেউ গাছের গুঁড়ি খুঁড়ে খোল বানিয়ে পানিতে ভাসিয়ে তার উপর চেপে বসে। সেই থেকে মনের খেয়ালে নিজের অজানে-ই পৃথিবীর শ্রেষ্ট যানবাহন নির্মানের সূচনা করেছিল আদিম মানুষেরা। কালের বিবর্তনে গাছের গুঁড়ির সেই খোলকে অধুনিকায়ন করে আমরা নৌকায় রূপ দিয়েছি। তিন ভাগ জল আর এক ভাগ স'লের এই পৃথিবীতে নৌকার উপর ভর করেই গড়ে উঠেছে আজকের সভ্যতা।
নদীমাতৃক বাংলাদেশের প্রায় প্রতিটি শহর ও শিল্পাঞ্চল গড়ে উঠেছে নৌপথ ও নৌকাকে কেন্দ্র করে। প্রাচীন কাল থেকেই দেশের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে যাতায়াত, ভ্রমণ-বিলাস. ব্যবসা-বাণিজ্য, পণ্য আনয়ন সব কিছুই ছিল নদী ও নৌকা কেন্দ্রিক। যুগে যুগে নৌকা বাঙ্গালীর সংস্কৃতিরই একটি অংশে পরিণত হয়েছে। কিন্তু উজানে পার্শ্ববর্তী দেশের নির্বিচার বাঁধ নির্মাণ, সরকারের তৎপরতা ও সংস্কারের অভাবে নদীগুলো আপন রূপ হারিয়েছে অনেক আগেই। সেই সঙ্গে হারিয়ে যেতে বসেছে প্রাচীন এই ঐতিহ্যবাহী যানবাহনটিও।
পৃথিবীতে ৮০ প্রকারের নৌকার মধ্যে বাংলাদেশে ১৫ প্রকারের নৌকার প্রচলনের কথা জানা যায়। সাধারণত কাঠ দিয়ে নির্মিত নৌকার মধ্যে ছই বা ছাউনী, হাল, দাঁড়, পাল, পালের দড়ি, মাস'ল, নোঙর, খুঁটি, দড়ি, গলুই, বৈঠা, লগি, গুণ ইত্যাদি উপকরণ রয়েছে। একেক এলাকায় একেক ধরনের নৌকার প্রচলন লক্ষ্য করা যায়। তবে এসব নৌকার মধ্যে বেশীরভাগই আজ বিলুপ্তির পথে। জ্যোৎস্না রাতে পাল ছেড়ে দিয়ে মাঝির কন্ঠে ভাটিয়ালী, ভাওয়াইয়ার সুমধুর সুর এখন শোনা যায় না। নৌকায় চেপে নদীতে ভাসতে ভাসতে কুল কুল রবে বয়ে যাওয়া পানির শব্দ সাধনা করেও মেলে না।
বাংলাদেশে প্রচলিত নানা ধরণের নৌকাগুলোর মধ্যে-।বাইচ : মুসলিম শাসনামলে প্রতিযোগিতার জন্য বাংলায় বাইচ নৌকার প্রচলন শুরু হয়। এখনো কিছু কিছু এলাকায় বাইচ নৌকা টিকে আছে। এগুলো সাধারণত সরু ও লম্বায় ১০০ থেকে ৩০০ ফুট পর্যন্ত হয়ে থাকে। প্রতিযোগিতার সময় ১০ থেকে ১০০ জন মাঝি নৌকাটি পরিচালনা করে।
ডিঙি : দেশের সব থেকে প্রচলিত নৌকাটি হচ্ছে ডিঙি। নদীর পাড়ে কিংবা জলাশয়ের খুব কাছাকাছি থাকা মানুষেরা প্রত্যহিক কর্মকাণ্ডের জন্য এটি ব্যবহার করে। এগুলো সাধারণত ৫ থেকে ৭ মিটার পর্যন্ত লম্বা। একজন লোকই বৈঠার সাহায্যে ডিঙি চালাতে পারে। অনেক সময় পালও ব্যবহার করা হয়।
পাতাম : পাতাম নামের এক ধরনের লোহার কাটা দিয়ে কয়েকটি কাঠকে জোড়া লাগিয়ে এই নৌকা তৈরী করা হয়। মালবাহী এই নৌকাগুলো ১২ থেকে ২০ মিটার লম্বা হয়ে থাকে। ২ থেকে ৫ জন মাঝি এগুলো পরিচালনা করে। নৌকা চালাতে দুইটি বৈঠার সঙ্গে একটি পালও ব্যবহৃত হয়। সাধারণত সিলেট ও কিশোরগঞ্জ এলাকায় এই নৌকার প্রচলন ছিল। তবে নৌকাটি এখন বিলুপ্ত প্রায়।
কোষা : ৬ থেকে ১০ মিটার লম্বা কোষা নৌকাটি দেশের প্রায় সব অঞ্চলেই দেখা যায়। বর্ষাকালে চরাঞ্চলের মানুষের নিত্য সঙ্গী কোষা। ৪ থেকে ৮ জন চড়তে পারে এই নৌকাতে। বৈঠা ও লগির সাহায্যে একজন মাঝিই নৌকাটি চালাতে পারে।
বিক : ১২ থেকে ১৭ মিটার লম্বার বিক নামের এই নৌকাটি ২৫ থেকে ৩২ টন পর্যন্ত পণ্য বহন করতে পারে। মালবাহী এই নৌকাটি সাধারণত ফরিদপুর অঞ্চলেই দেখা যেত। তবে ২৫/৩০ বছর আগেই নৌকাটি বিলুপ্তির খাতায় নাম লেখায়। এটি পরিচালনায় ৬ জন মাঝির প্রয়োজন হত। এছাড়া দুইটি পাল ছিল এর বিশেষ বৈশিষ্ট্য। দুই পালের মাঝখানটা একটি বাঁশের সঙ্গে লাগোয়া। নৌকার ছইটি থাকে পিছনের দিকে এবং আকারে অনেক ছোট।
সামপান : সমুদ্র এলাকার নৌকা সাম্পান। এই সম্পান নিয়ে কত জনপ্রিয় গান রচিত হয়েছে তার ইয়ত্তা নেই। সাম্পানের সামনের দিকটা বাঁকানো চাঁদের মতো যাতে সমুদ্রের ঢেউ কেটে সামনের দিকে যেতে পারে। আর পেছনের দিকটা একরকম সোজা বলা যায়। দেখতে অনেকটা হাঁসের মতো। বাংলাদেশে দুই ধরনের সামপান আছে। সমুদ্র উপকূলের আশপাশে চলার জন্য ছোট সামপান আর সমুদ্রে চলাচলের জন্য বড় সামপান। এসব সামপান দৈর্ঘ্যে ৬ থেকে ১৫ মিটার পর্যন্ত হয়।
গয়না : চমকপ্রদ এই নামের অধিকারী গয়না নামের এই যাত্রিবাহী নৌকাটি অনেক আগেই বিলুপ্ত হয়েছে। ৮ থেকে ১৪ মিটার দৈর্ঘ্য ও ২ থেকে সাড়ে ৩ মিটার প্রস' নৌকাটি রাজশাহী ও কিশোরগঞ্জ এলাকায় প্রচলিত ছিল। ৩০ থেকে ৫০ জন যাত্রী এই নৌকাটিতে বহন করা হত।
ময়ূরপঙ্ক্ষী : রূপকথার গল্পের রাজ্যের এক অন্যতম উপাদান ময়ূরপঙ্ক্ষী নাও। প্রাচীনকালে রাজা-বাদশাহরা এই নৌকায় চড়ে ভ্রমণ করতো। ১১ থেকে ১৩ মিটার লম্বা এই নৌকাগুলো তুলনামূলকভাবে একটু বেশী চওড়া ছিল। এর সামনের দিকটার ছিল ময়ূরের অবয়ব। বাস্তবে না থাকলে কিছু কিছু পার্কে ময়ূরপঙ্খীর আদলে নির্মিত নৌকা দেখতে পাওয়া যায়।
বালার : কুষ্টিয়া অঞ্চলে প্রচলিত মালবাহী নৌকা বালার। ১৫ থেকে ১৮ মিটার দৈর্ঘ্যের এই নৌকা চালাতে ১০/১২ জন মাঝির প্রয়োজন হয়। এই নৌকা আকার অনুযায়ী ১৫ থেকে ৫৫ টন পর্যন্ত মালামাল বহনে সক্ষম। বৈঠা, লগির সঙ্গে জোড়া পাল টানিয়ে কখনো গুণ টেনে এগুলো চালানো হয়। নৌকাটির প্রচলন কমে গেলেও এখনো বিলুপ্ত হয় নি।
বাতনাই বা পদি : ব্যাবসা-বাণিজ্যের জন্য খুলনা অঞ্চলে যে মালবাহী নৌকাটির প্রচলন ছিল তার নাম বাতনাই বা পদি। ১৪০ থেকে ১৫০ টন পর্যন্ত মালামাল বহন করা হত দৈত্যাকার এই নৌকাটিতে। ১৬/১৭ জন মাঝি লাগতো নৌকাটি চালানোর জন্য। অনেক আগেই বাংলার ঐতিহ্য থেকে বিদায় নিয়েছে এই নৌকাটি।
মাছ ধরার নৌকা : মাছে ভাতে বাঙালীর প্রিয় খাদ্য মাছ ধরতে নৌকার বিকল্প নেই। খাল, বিল, পুকুর, জলাশয় থেকে শুরু করে সমুদ্রের অথৈই জলে নৌকায় ভেসে ভেসে জেলেরা মাছ ধরে। একেক এলাকায় একের ধরনের নৌকায় মাছ ধরা হয়। ৭ থেকে ৯ মিটার দৈর্ঘ্যের নৌকায় চেপে নদীতে মাছ ধরে জেলেরা। আবার চট্টগ্রাম এলাকায় এলে দেখা যাবে ১৮ থেকে ২০ মিটার দৈর্ঘ্যের সাম্পান আকৃতির বিশাল নৌকায় উত্তাল সাগর থেকে মাছ শিকার করছে জেলেরা।
বজরা : ১৩/১৪ মিটার লম্বা বজরা ছিল সৌখিন মানুষের ভ্রমণ বিলাস। পরিবার-পরিজন নিয়ে দীর্ঘ নৌ-ভ্রমনের জন্য বজরার তুলনা নেই। নৌকার বডির উপর বাঁশ দিয়ে তৈরী করা হত বিশেষ ধরনের ঘর। রান্নাবান্না করার ব্যবস্থাও থাকতো। ঠিক যেন ভাসমান বাড়ি। ১৫/২০ বছর আগেও পাবনা ও সিরাজগঞ্জ এলাকায় এই নৌকাগুলোর ব্যাপক প্রচলন ছিল। তবে এখন প্রায় বিলুপ্তির পথে।
জোড়া নৌকা : দুইটি নৌকা পাশাপাশি রেখে বাঁশ দিয়ে জোড়া লাগিয়ে তৈরী করা হয় জোড়া নৌকা। সাধারণত রাজশাহী অঞ্চলে পণ্য বহনে জোড়া নৌকা ব্যবহৃত হয়। এই নৌকাগুলো চালাতে ৪/৬ জন মাঝির প্রয়োজন হয়।
তালো ডোঙা : আস- তাল গাছের গুড়ি খুঁড়ে খোল বানিয়ে বিশেষ ভাবে তৈরী নৌকার নাম তালো ডোঙা। চরাঞ্চলের দরিদ্র জেলেরা এখনো মাছ ধরার কাজে এই বিশেষ ডোঙ্গাটি ব্যবহার করে। মাঝি ও যাত্রী যা-ই হোক না কেন একজনই চড়তে পারে এই ডোঙায়।
ভেলা : গ্রাম বাংলার চিরচেনা একটি জলযানের নাম ভেলা। ভাসমান যে কোন গাছের কয়েকটি অংশ একত্র করে এই ভেলা বানানো হয়। বর্ষাকালে খালে-বিলে গ্রামের দুরন্ত বলকদের কলার ভেলায় চড়ে উল্লাস বাংলার চিরচেনা রূপের একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ। ভেলার বিশেষ বৈশিষ্ট হল ডুবে যাওয়ার কোন ভয় থাকে না।