Banner
দ্বিতীয় - অধ্যায় ঋগ্বেদ পুনর্বিচার

লিখেছেনঃ শামসুজ্জোহা মানিক এবং শামসুল আলম চঞ্চল, আপডেটঃ September 28, 2012, 1:00 PM, Hits: 2874

 

ঋগ্বেদের ১০টি মণ্ডলে ১০,৫৫২টি ঋক নিয়ে ১,০২৮টি সূক্ত আছে। এই বিরাট গ্রন্থটি যখন আমরা মনোযোগ দিয়ে পড়তে শুরু করি তখন কিন্তু যাযাবর, পশুপালক এবং ভারতবর্ষে বহিরাগত আক্রমণকারী আর্যদের দ্বারা ঋগ্বেদ রচিত এ যাবৎ কালের বহু প্রচারিত এবং পৃথিবীব্যাপী জ্ঞানজগতে প্রতিষ্ঠিত এই ধারণাকে টিকিয়ে রাখা যায় না। কারণ এই ধারণার সঙ্গে ঋগ্বেদের সাহিত্যশক্তি ও মর্মবস্তুকে একেবারেই মেলানো যায় না। ঋগ্বেদ দর্শন বা বিজ্ঞান গ্রন্থ না হয়ে একটি ধর্মগ্রন্থ হলেও তার প্রতিটি মন্ত্রে যে মন নিহিত আছে তা বর্বর কিংবা যাযাবর, অশিক্ষিত এমন কি অর্ধশিক্ষিতেরও হতে পারে মনোযোগ দিয়ে পড়লে সেটা বিশ্বাস করার কোনও যুক্তিসঙ্গত কারণ থাকে না।
বস্তুত শিক্ষা ও সংস্কৃতির সুদীর্ঘ ও অত্যন্ত শক্তিশালী পটভূমি ছাড়া যে ঋগ্বেদের মত গ্রন্থ রচনা করা অসম্ভব এই সিদ্ধান্তে পৌঁছবার জন্য বৈদিক ভাষা কিংবা ভাষাতত্ত্বে পণ্ডিত হবার প্রয়োজন হয় না। এইটুকু বোঝাই যথেষ্ট যে, যুদ্ধরত যাযাবর কিংবা অর্ধ-যাযাবর জীবনে মানসিক বৃত্তির স্ফুরণের বাস্তব ভিত্তিই থাকে না। সেই সময় যুদ্ধের শক্তি অর্থাৎ যোদ্ধারা হয় সমাজের মূল নায়ক আর পুরোহিত বা যাদুকরদের কাজ হয় যোদ্ধা নেতৃত্বের অধীনস্থ হয়ে যাযাবর ও বর্বর সমাজের প্রচলিত নিয়মে ধর্মীয় অনুষ্ঠান পালন করা। তার জন্য এত উপমা, সূক্ষ্মতা এবং চিন্তার প্রয়োজন ও অবকাশ কোনটাই থাকে না। তাছাড়া সভ্যতা ও সভ্য জীবনের যেসব বর্ণনা এবং উপমা ঋগ্বেদের মন্ত্রসমূহে রয়েছে সেগুলোও কোনও অসভ্য, অসংস্কৃত এবং যাযাবর আক্রমণকারীদের মস্তিষ্ক থেকে উদ্ভূত হতে পারে না।
এটা ঠিক যে, ঋগ্বেদের মূল পটভূমি হচ্ছে যুদ্ধ। সুতরাং শত্রুর বিরুদ্ধে যুদ্ধে বিজয় এবং নিরাপত্তা ও সম্পদ কামনা ঋগ্বেদের অধিকাংশ মন্ত্র রচনার প্রেরণা যুগিয়েছে। কিন্তু প্রশ্ন, যুদ্ধের প্রেরণা থাকলেই কি কোন যাযাবর পশুপালক কিংবা অসভ্য হানাদারদের পক্ষে ঋগ্বেদের মত ধর্মগ্রন্থ রচনা করা সম্ভব ? তাহলে তো শক, হুন, মোঙ্গলরাও ভিন্ন দেশ আক্রমণ ও জয়ের সময় একটা করে ধর্মগ্রন্থ রচনা করতে পারত। বস্তুত এমন ধরনের যাযাবর বা আক্রমণকারীদের আক্রমণ অভিযানের সময় ঋগ্বেদের মত সাহিত্য মূল্য বিশিষ্ট হওয়া তো দূরের কথা, এমন কি আদৌ কোন ধর্মগ্রন্থই রচিত হয় নি।
যাইহোক, আমাদের নিকট এটি সুস্পষ্ট যে, যাযাবর ও যুদ্ধ-নির্ভর মানুষদের পক্ষে ঋগ্বেদ রচনার মত বুদ্ধিবৃত্তির মান অর্জন করা সম্ভব নয়। এর জন্য প্রয়োজন দীর্ঘ স্থিতিশীল, সচ্ছল ও উন্নত সভ্য জীবনযাপনের অভিজ্ঞতা।


পাতা: ১৫



একটা বর্বর জনগোষ্ঠী একটা সভ্য সমাজকে আক্রমণ করে ধ্বংস করতে পারলেও তার পক্ষে মেধার বিকাশ ঘটানো সম্ভব নাও হতে পারে। আর যদি সেটা সম্ভব হয়ও তবে তা দীর্ঘ সময় সাপেক্ষ ব্যাপার। ইউরোপে বর্বররা রোমান সভ্যতা ধ্বংস করার পর ইউরোপ নগর সভ্যতা থেকে পশ্চাৎপদ কৃষি সমাজে ফিরে যায়। গ্রীক ও রোমান সভ্যতার ছড়ানো-ছিটানো কিছু অবশেষ থাকার পরেও সেখানে উন্নত নগর সভ্যতা গড়তে ইউরোপকে হাজার বৎসরেরও বেশী সময় অপেক্ষা করতে হয়েছে। চতুর্দশ এবং পঞ্চদশ শতাব্দীতে এসে ইউরোপ পুনরায় জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চা করতে শুরু করে। এজন্য তাকে পেতে হয়েছে অন্যান্য সভ্যতা থেকে উপকরণ এবং তাকে ঘটাতে হয়েছে বিস্মৃত গ্রীক ও রোমান জ্ঞানচর্চার পুনরুজ্জীবন।
ঋগ্বেদ পড়লে এটা স্পষ্ট হয় যে, বৈদিক যুদ্ধের মূল নিয়ন্ত্রণ ছিল ঋষিদের হাতে। ঋষিরা তাঁদের যুদ্ধের সপক্ষে দেবতাদের নিকট সমর্থন ও সাহায্য চেয়ে মন্ত্র রচনা করেছেন। এই পদ্ধতিতে ঋষিরা প্রকৃতপক্ষে তাঁদের যুদ্ধের সপক্ষে জনমত গড়ে তুলেছেন। এর ফলে সেনাপতি বা যোদ্ধারা যুদ্ধ করলেও এবং সব ঋষি যুদ্ধে প্রত্যক্ষ অংশ না নিলেও যুদ্ধের মূল নিয়ন্ত্রণ থেকেছে ঋষিদের হাতে। এটা স্পষ্ট যে, সমাজে যুদ্ধের মনস্তত্ত্ব গড়ে তোলায় এবং যুদ্ধ সংগঠনে ঋষিদের গুরুত্ব বা ভূমিকা সর্বাধিক না হলে তাদের দ্বারা মন্ত্র রচনার সামাজিক প্রেরণা বা তাগিদ সৃষ্টি হত না।
ঋগ্বেদ পাঠে আমাদের এই দৃঢ় ধারণা জন্মেছে যে, বৈদিক ঋষিরা একটি উন্নত ও সভ্য নগর সমাজের পটভূমিতে দাঁড়িয়ে একটি ধর্মীয় যুদ্ধ সংগঠিত করেছিলেন। সেটা কিভাবে, সেই আলোচনায় আমরা এখন যাব। তবে আমাদের আলোচনাকে যতটা সম্ভব সহজ ও স্বচ্ছন্দ করার প্রয়োজনে আমাদের যুক্তির সমর্থনে ঋগ্বেদ থেকে বহু সংখ্যক উদ্ধৃতি দিতে পারলেও তা না করে আমরা দৃষ্টান্তমূলক অল্প কিছু মন্ত্র উদ্ধৃত করব ঋগ্বেদের সমাজ সম্পর্কে একটা প্রাথমিক ধারণা সৃষ্টির জন্য। তাহলে পাঠক সহজেই বুঝবেন যে, ঋগ্বেদ বর্বর, যাযাবর এবং বহিরাগত আক্রমণকারী পশুপালক সমাজের সৃষ্টি, নাকি একটি স্থিতিশীল এবং উন্নত নগর সভ্যতা ভিত্তিক সমাজের সৃষ্টি।
সভ্যতা নির্মাণের একটা প্রধান শর্ত খাদ্য উৎপাদনের প্রধান ব্যবস্থা হিসাবে কৃষির প্রবর্তন। এখন দেখা যাক এ বিষয়ে ঋগ্বেদ কি সাক্ষ্য দেয়। ঋগ্বেদের ১ম মণ্ডলের অন্তর্ভুক্ত ১১৭শ সূক্তের ২১শ ঋকে দেবতার উদ্দেশ্যে বলা হচ্ছে : ‘হে অশ্বিদ্বয় ! তোমরা আর্যদের জন্য লাঙ্গল দ্বারা চাষ ও যব বপন করিয়ে অন্নের জন্য বৃষ্টি বর্ষণ করে এবং বজ্র দ্বারা দস্যুকে বধ করে, তার প্রতি বিস্তীর্ণ জ্যোতি প্রকাশ করেছ।’ (১/১১৭/২১)
এখানে অনুন্নত কোন কৃষিপদ্ধতির পরিবর্তে লাঙ্গল দ্বারা চাষের কথা বলা হচ্ছে। অর্থাৎ আর্যদের কৃষি পদ্ধতি ছিল সেকালের পরিপ্রেক্ষিতে সর্বোন্নত।
_________________________________________________________________________________
এই গ্রন্থে উদ্ধৃত ঋগ্বেদের সকল মন্ত্র নেওয়া হয়েছে রমেশচন্দ্র দত্তের বঙ্গানুবাদ অবলম্বনে দুই খণ্ডে প্রকাশিত ঋগ্বেদ-সংহিতা থেকে। ঋগ্বেদ-সংহিতা, প্রকাশক : হরফ প্রকাশনী, এ-১২৬ কলেজ স্ট্রীট মার্কেট, কলকাতা-৭, ১৯৮৭
_________________________________________________________________________________


পাতা: ১৬


৪ মণ্ডলের ৫৭ সূক্তের ৪ ঋকে বলা হচ্ছে : ‘বলীবর্দসমূহ সুখে বহন করুক, মনুষ্যগণ সুখে কার্য করুক, লাঙ্গল সুখে কর্ষণ করুক।’

উপরোক্ত ৪ মণ্ডলের ৫৭ সূক্তের ৮ ঋকে বলা হচ্ছে : ‘ফাল সকল সুখে ভূমি কর্ষণ করুক, রক্ষকগণ বলীবর্দের সাথে সুখে গমন করুক, পর্জন্য মধুর জল দ্বারা পৃথিবী সিক্ত করুন।’
প্রকৃতপক্ষে ৪ মণ্ডলের ৫৭তম সূক্তটি সম্পূর্ণরূপে কৃষিকার্য সম্বন্ধীয়। আরও উদাহরণ দেওয়া যায় : ‘লাঙ্গলগুলি যোজনা কর, যুগগুলি বিস্তারিত কর, এ স্থানে যে ক্ষেত্র প্রস্তুত করা হয়েছে, তাতে বীজ বপন কর, আমাদের স্তবের সাথে আমাদের অন্ন পরিপূর্ণ হোক। সৃণিগুলি (কাস্তে) নিকটবর্তী পক্বশস্যে পতিত হোক।’ (১০/১০১/৩)
একটি ঋকে পাশা খেলার তুলনায় কৃষিকে উৎকৃষ্ট বলা হচ্ছে :
‘হে দ্যূতকার ! পাশা কখন খেল না, বরং কৃষিকার্য কর। তাতে যা লাভ হয় সে লাভে সন্তুষ্ট হও ও আপনাকে কৃতার্থ বোধ কর।’(১০/৩৪/১৩)
দেবতা ইন্দ্রের উদ্দেশ্যে অন্য এক জায়গায় বলা হচ্ছে : ‘হে ইন্দ্র ! আমি তোমার আশাতেই হস্তে দাত্র (কাস্তে) ধারণ করছি, হে মঘবন ! পূর্বছিন্ন অথবা পূর্ব সংগৃহীত যবের মুষ্টি পূর্ণ কর।’ (৮/৭৮/১০)
কৃষিতে জলসেচের জন্য ঘটিচক্রের ব্যবহার সম্পর্কে জানতে পারি : ‘যেরূপ যুদ্ধের সৈন্যগণ বার বার অগ্রসর হয় অথবা ঘটিচক্র শ্রেণীবদ্ধ হয়ে অগ্রপশ্চাৎভাবে উঠতে থাকে, আমার স্তবগুলিও সেরূপ।’ (১০/৯৩/১৩)
ঘটিচক্রের পরিধিতে অনেকগুলি ঘটি সংযুক্ত থাকে। চক্রের ঘূর্ণনের সাথে ঘটিগুলি ক্রমান্বয়ে জলের মধ্যে নিমজ্জিত হয়ে জলপূর্ণ হয়ে উপরে উঠে জল ঢেলে দেয়। পাওয়ার পাম্পের ব্যবহারের পূর্ব পর্যন্ত উপমহাদেশের উত্তর এবং পশ্চিম অংশে জমিতে জলসেচ করার জন্য ঘটিচক্রের ব্যবহার ছিল।
দ্রোণি বা সেচনী দ্বারা জল নিয়ে যে ক্ষেত্রে সেচন করা হত তাও বলা হচ্ছে : ‘সে সকল ক্ষেত্রে অনেক ক্ষুদ্র নদী একত্র হয়ে ঘৃততুল্য জল বইয়ে দেয়, তাদের চরণ নেই, রথ নেই, দ্রোণিই তাদের অশ্ব।’ (১০/৯৯/৪)
শস্য, চাষ, সেচ, খাল, নালি, কূপ, জলাধার ইত্যাদি কৃষি সংশ্লিষ্ট আরও বহু দৃষ্টান্ত বা উল্লেখ ঋগ্বেদে পাওয়া যায়। যাইহোক, যে উদ্ধৃতি কয়টি আমরা দিয়েছি সেগুলি উন্নত কৃষি সমাজের অস্তিত্বের প্রমাণ দেয়। বিশেষত লাঙ্গল এবং জলসেচ এই দুইয়ের কোনটিই যাযাবর পশুপালক এমন কি অস্খায়ী জুম চাষমূলক পশ্চাৎপদ কৃষি সমাজেও কল্পনা করা যায় না। ।
বৈদিক সমাজে উদ্বৃত্ত খাদ্যশস্য জমা রাখবার জন্য শস্যগোলা যে ছিল সে কথাও আমরা জানতে পারি : ‘হে অধ্বর্যুগণ ! ইন্দ্র স্বর্গীয় ও অন্তরীক্ষস্খ, এবং পৃথিবীস্খ ধনের রাজা যবদ্বারা যেরূপ শস্য রাখবার স্থান পূর্ণ করে, ইন্দ্রকে সোম দ্বারা সেরূপ পূর্ণ কর।’ (২/১৪/১১)


পাতা: ১৭


এখন হস্তশিল্প এবং কারিগরী বিদ্যার অবস্থাটা দেখা যাক। বস্ত্র বয়ন সম্পর্কে ঋগ্বেদে বলা হচ্ছে : ‘আমাদের সাধু কর্মফলের চিরপ্রদায়ী ঊষা ও নক্ত রূপ অগ্নি, বয়নকুশল রমণীদ্বয়ের ন্যায় পরস্পর সাহায্যার্থে গমনাগমন করে যজ্ঞের রূপ নির্মাণার্থে পরস্পরকে আনুকূল্য করে বিস্তৃত তন্তুবয়ন করছেন।’ (২/৩/৬)
এ ঋক থেকে অনুমান করা যায় যে, সেকালে দুইজন নারী ‘টানা ও পোড়েন’ সঞ্চালন করে বস্ত্র বয়ন করত। অপর এক মন্ত্রে বলা হচ্ছে :
আমি তন্তু (টানা সূত্র) অথবা ওতু (পড়্যান সূত্র) জানি না, কিংবা সতত চেষ্টা দ্বারা যে বস্ত্র বয়ন করে তার কিছুই অবগত নই। (৬/৯/২)
রূপকার্থে ঋষি যা-ই বলতে চান উপরের কথাগুলি থেকে সমাজে বস্ত্র বয়নের অস্তিত্বের কথা জানা যায়। তন্তুবায় সম্পর্কে জানছি অশ্বিদ্বয় নামক যুগ্ম দেবতার উদ্দেশ্যে রচিত মন্ত্র থেকে :
‘হে অশ্বিদ্বয় ! তোমরা দুজনে আমাদের আহুতি অভিলাষ করছ, যেরূপ তন্তুবায় বস্ত্র বয়ন করে, সেরূপ আমাদের স্তব বিস্তার করে দিচ্ছি। (১০/১০৬/১)
রথ ও রথ নির্মাণ সম্পর্কে জানা যায় :
‘হে অগ্নি ! যেহেতু আমরাও তোমার কামনায় হস্ত পদ ও শরীর দ্বারা কার্য করি, অতএব শিল্পীগণ যেরূপ রথ নির্মাণ করে সেরূপ যজ্ঞরত শোভনকর্মা লোকে বাহু দ্বারা কাষ্ঠ মন্থন করে তোমাকে উৎপন্ন করলেন।’ (৪/২/১৪)
‘হে বহুভাব প্রাপ্ত অগ্নি ! আমি তোমার স্তোতা। ধীর কর্মকুশল ব্যক্তি যেরূপ রথ নির্মাণ করে, সেরূপ আমি তোমার জন্য এ স্তোত্র নির্মাণ করেছি। (৫/২/১১)
১০/৬৮/৮ ঋক থেকে জানা যায় ‘কাষ্ঠ হতে চমস নামক পানপাত্র কুঁদে বার’ করার কথা।
কর্মকারের অস্তিত্ব সম্পর্কে জানা যায় :
‘কর্মকার অস্ত্রাদি দ্বারা অগ্নিকে যেরূপ সম্বর্ধিত করে সেরূপ ত্রিত যখন অন্তরীক্ষে অগ্নিকে বর্ধিত করে তখন অগ্নি কর্মকার দ্বারা সন্ধুক্ষিত অগ্নির ন্যায় তীক্ষ্ণতা প্রাপ্ত হয়।’ (৫/৯/৫)
‘দেখ, শুষ্ক বৃক্ষশাখা পক্ষীর পক্ষ ও শান দেবার নিমিত্ত উজ্জ্বল প্রস্তর এ কয় প্রকার বস্তুর সহযোগে কর্মকার বাণ প্রস্তুত করে, সে বাণ ক্রয় করবার উপযুক্ত কোন ধনাঢ্য ব্যক্তিকে অন্বেষণ করে।’ (৯/১১২/২)
সমাজে স্বর্ণকারও অপরিচিত ছিল না :
‘স্বর্ণকার যেরূপ ধাতুসকল দ্রবীভূত করে সেরূপ অগ্নি কাষ্ঠসকল ভস্মসাৎ করে কুঠারবৎ নিজ জিহ্বা নি:সৃত করছে।’ (৬/৩/৪)
বাণিজ্যের সঙ্গে আর্যদের সম্পৃক্ততার সাক্ষ্য ঋগ্বেদ থেকে পাওয়া যায়। ঋষি বাণিজ্য প্রবর্তনের জন্য দেবতার নিকট প্রার্থনা করছেন :


পাতা: ১৮


‘হে অগ্নি ! প্রচুর ধন দাও, তার সঙ্গে যেন বহুসংখ্যক গাভী ও অশ্ব থাকে। আকাশকে বৃষ্টি জলে অভিষিক্ত কর, বাণিজ্যকারীর বাণিজ্যকার্য প্রবর্তিত কর।’ (১০/১৫৬/৩)
বণিকদের উল্লেখ পাই :
‘হে দানশীল অশ্বিদ্বয় ! যে সকল উপায় দ্বারা উশিজের পুত্র বণিক দীর্ঘশ্রবাকে মেঘ হতে মধুর জল দিয়েছিলে এবং যে সকল উপায় দ্বারা উশিজের পুত্র স্তোতা কক্ষীবানকে রক্ষা করেছিলে, হে অশ্বিদ্বয় ! সে সকল উপায়ের সাথে এস।’ (১/১১২/১১)
সামুদ্রিক বাণিজ্যে আর্যদের ভূমিকা সম্পর্কে ঋগ্বেদের সাক্ষ্য সুস্পষ্ট :
‘যিনি অন্তরীক্ষগামী পক্ষীদের পথ জানেন, যিনি সমুদ্রে নৌকাসমূহের পথ জানেন।’ (১/২৫/৭)
‘....... ধনলুব্ধ লোক যেরূপ সমুদ্রে নৌকা প্রেরণ করে.......’ (১/৪৮/৩)
‘ধনার্থী বণিকেরা যেরূপ সকল দিকে সঞ্চরণ করে সমুদ্র রূপে থাকে, হব্যবাহী স্তোতাগণ সেরূপ সে ইন্দ্রকে সকল দিকে ব্যেপে রয়েছে।’ (১/৫৬/২)
‘হে অশ্বিদ্বয় ! তোমরা অবলম্বন রহিত, ভূপ্রদেশ রহিত, গ্রহণীয় বস্তু রহিত সমুদ্রে এ কাজ করেছিলে ; শতদাঁড় যুক্ত নৌকায় ভুজ্যুকে রেখে তার গৃহে এনেছিলে।’ (১/১১৬/৫)
‘হে দ্যাবাপৃথিবী দেবীদ্বয় ! যেমন ধনলাভেচ্ছু ব্যক্তিরা সমুদ্র মধ্যে গমনের জন্য সমুদ্রকে স্তুতি করে সেরূপ অভিলষিত কার্য লাভের জন্য অহির্বুধ্ন্য নামক দেবতার সাথে তোমাদের স্তুতি করি।’ (৪/৫৫/৬)
প্রশ্ন জাগাই স্বাভাবিক বহিরাগত পশুপালক যাযাবর যারা তখনও ভিন্ন ও নূতন একটি ভূমি দখলের জন্য যুদ্ধরত রয়েছে তারা কি করে এই অবস্থায় সমুদ্র বাণিজ্য গড়ে তুলেছে যার চিত্র উপরোক্ত মন্ত্রগুলি সহ অন্য আরও অনেক মন্ত্রে ফুটে ওঠে ? শুধু তাই নয় নৌকা যে নদীর মতই বৈদিক আর্যদের কাছে খুব গুরুত্বপূর্ণ একটি বস্তু ছিল তার প্রমাণ পাই ঋগ্বেদে বহুবার নৌকার উপমা ব্যবহার থেকে। যেমন :
‘হে অশ্বিদ্বয় ! স্তুতিসমূহের পারে গমনার্থে নৌকারূপে এস, আমাদের অভিমুখে তোমাদের রথ সংযোজিত কর।’ (১/৪৬/৭)
অবশ্য উপরোক্ত ঋকের পরবর্তী ঋকে বন্দরে ভিড়ানো সমুদ্রগামী জাহাজের উপমা দেওয়া হয়েছে : ‘তোমাদের আকাশ অপেক্ষাও বিস্তীর্ণ যান সমুদ্রের ঘাটে রয়েছে, ভূমিতে রথ রয়েছে; সোমরস তোমাদের যজ্ঞ কর্মে মিশ্রিত হয়েছে।’ (১/৪৬/৮)
নৌকার আরও উল্লেখ আছে :
‘৭। হে সর্বতোমুখ অগ্নি ! নৌকায় যেরূপ নদী পার হওয়া যায়, সেরূপ আমাদের শত্রুসমূহ হতে পার করে দাও, আমাদের পাপ বিনষ্ট হোক। ৮। নৌকার দ্বারা যেরূপ নদী পার হওয়া যায়, আমাদের কল্যাণের জন্য তুমি সেরূপ আমাদের শত্রু হতে পার করিয়ে পালন কর ; আমাদের পাপ বিনষ্ট হোক।’ (১ মণ্ডল, ৯৭ সূক্ত)

পাতা: ১৯


‘তুমি (ইন্দ্র) শত্রু বিনাশক, তুমি সংগ্রামে স্তোত্রাভিলাষী ও নৌকার ন্যায় বিপদ উদ্ধারক, আমি যজ্ঞকালে স্তোত্র করতে করতে তোমার নিকট যাচ্ছি।’ (২/১৬/৭)
‘হে মিত্র ও বরুণ ! নৌকা দ্বারা যেমন জল পার হয়, তোমাদের যজ্ঞের পথে সেরূপ দুরিত হতে পার হব।’ (৭/৬৫/৩)
অর্থাৎ আমরা দেখছি বৈদিক আর্যরা নদী ও সমুদ্রের সঙ্গে যেমন সম্পর্কিত তেমন নদী ও সমুদ্রে বিচরণের জন্য জলযানের সঙ্গেও সম্পর্কিত। বিশেষ করে বাণিজ্যের প্রয়োজনে বৈদিক আর্যদের দূর সমুদ্র যাত্রার সাক্ষ্য পাওয়া যায় ঋগ্বেদ থেকে।
বৈদিক আর্যদের সম্পর্কে বলা হয় যে, তারা নগর নির্মাণ জানত না। বরং ভারতবর্ষে প্রবেশের পর তারা সপ্তসিন্ধু এলাকায় যে সব নগর ধ্বংস করে তার বিবরণ ঋগ্বেদে পাওয়া যায়। কিন্তু বৈদিক আর্যরা যেসব নগর ধ্বংস করেছিল সেগুলো তো শত্রুদের নগর। শত্রু নগর ধ্বংস করা মানে কি নিজেদের নগর না থাকা ? কয়েকটি উদাহরণ দিলে স্পষ্ট হবে বৈদিক আর্যদের নগর সংক্রান্ত অভিজ্ঞতা এবং ধারণা কেমন ছিল সেটা:
‘হে অগ্নি ! তুমি নূতন ; তুমি আমাদের স্তুতি দ্বারা সমস্ত দুর্গম পাপ হতে উদ্ধার কর। আমাদের নগরী অত্যন্ত প্রশস্ত হোক ; আমাদের ভূমিও প্রশস্ত হোক ; তুমি আমাদের পুত্র ও অপত্য সকলকে সুখ প্রদান কর।’ (১/১৮৯/২)
 ‘হে অগ্নি ! আমরা যেরূপ গব্য ও ঘৃত যুক্ত হব্যের দ্বারা তোমাদের স্বাহা দান করব, হে অগ্নি ! তুমিও সেরূপ সে অমিত তেজবলে অপরিমিত অয়োনির্মিত নগরী দ্বারা আমাদের রক্ষা কর।’ (৭/৩/৭)
‘তুমি (অগ্নি) অপ্রতিধর্ষণীয়, এক্ষণে তুমি আমাদের নরগণের রক্ষার্থে মহতী অয়োনির্মিতা শতগুণা পুরী হও।’ (৭/১৫/১৪)
‘হে ইন্দ্র ! দৃঢ় হও, তুমি নগরের ন্যায় মঙ্গলময়, স্তুতিক্রিয়া যথাকালে তোমার নিকট গমন করে, তুমি যজ্ঞনিষ্পাদক।’ (৮/৮০/৭)
একদল যাযাবর পশুপালকের সমাজজীবনচিত্র কি উপরের মন্ত্রগুলি থেকে ফুটে ওঠে? বিশেষ করে এটা খুব তাৎপর্যপূর্ণ যে নগর বিদারক, নগরধ্বংসী হিসাবে বহু কথিত দেবতা ইন্দ্রকে ৮/৮০/৭ ঋকে বলা হচ্ছে নগরের ন্যায় মঙ্গলময়। শুধু তাই নয় উপরন্তু একটি মন্ত্র থেকে আমরা বৈদিক আর্য সমাজে নগরপতি বা নগরের মেয়রের অস্তিত্বের প্রমাণ পাচ্ছি :
‘হিতৈষিগণ যেমন সুশাসক নগরপতির পূজা করে, সেরূপ আমাদের মধ্যে অবস্থানাভিলাষী অধ্বর্যুগণ হব্য প্রভৃতি দ্বারা ইন্দ্রের পূজা করছেন।’ (১/১৭৩/১০)
এবার দেখা যাক বাসগৃহ বা গৃহ সম্পর্কে কি বলা হচ্ছে :
‘সমবল সম্পন্ন ঋভু আমাদের রক্ষক অন্ন ও বাসগৃহ দাতা, ঋভু আমাদের নিবাস হেতু, অতএব তিনি আমাদের তা দান করুন।’ (১/১১০/৭)
‘হে অপ্রতিহত প্রভাব অগ্নি ! ........ তুমি বীতহব্য ভরদ্বাজকে (এই মন্ত্রের ঋষি) ধন ও গৃহ প্রদান কর।’ (৬/১৫/৩)
‘হে ইন্দ্র ! হব্যরূপ ধনসম্পন্ন ব্যক্তিগণকে ও আমাকে এরূপ একটি গৃহ প্রদান কর, যা ত্রিধাতু ও ত্রিবরুথ ও সমৃদ্ধ ও আচ্ছাদক এবং তাদের নিকট হতে দীপ্তিসম্পন্ন আয়ুধ সকল দূরীকৃত কর।’ (৬/৪৬/৯)

পাতা: ২০


‘হে সবিতা ! ....... এ সকল যজমানগণকে গৃহবিশিষ্ট নিবাস প্রদান কর।’ (৪/৫৪/৫)
নিম্নোক্ত উপমাটি কি তাৎপর্যপূর্ণ নয় ?
‘স্তম্ভ যেরূপ ছাদকে ধারণ করে, সেরূপ তিনি সম্পূর্ণ এবং বৃহৎ শরীর দ্বারা দ্যুলোক ধারণ করেন।’ (৪/৫/১)
যাযাবরদের নিকট থেকে স্থায়ী ও সুন্দর বাসগৃহের জন্য এমন আকুতি কি কল্পনা করা যায় ? তাও আবার যারা কি না বাহির থেকে এসে আক্রমণ চালাচ্ছে বা কেবল দেশ দখল করেছে তাদের কাছ থেকে ! সোভিয়েত বিপ্লবের পর মধ্য এশিয়ায় যাযাবরদের গৃহবাসে অভ্যস্ত করার জন্য কতটা বেগ পেতে হয়েছিল সে সম্পর্কে আমরা কিছু হলেও জানি। সৌদি আরব কিংবা লিবিয়ার মত দেশগুলির যাযাবরদের অনেককে অনেক সুযোগ-সুবিধা দেবার পরও এখন পর্যন্ত স্থায়ী গৃহবাসে অভ্যস্ত করানো যায় নি বলে জানা যায়। অনেক স্থানে এখনও যাযাবররা সরকার কর্তৃক প্রদত্ত বিনামূল্যের আরামদায়ক পাকা বাড়ী ফেলে দিয়ে তাঁবু নিয়ে মরুভূমিতে বসবাসের জন্য ফিরে যায় বলে আমরা জানতে পারি। তবে কি মানতে হবে যে, বৈদিক যাযাবররা ব্যতিক্রম এবং তারা ভারতবর্ষে প্রবেশের পর অনার্যদের স্থায়ী বাসগৃহ দেখা মাত্র যাযাবর জীবন ত্যাগ করে স্থায়ী গৃহবাসের জন্য ব্যাকুল হয়ে পড়েছিল?
এ ছাড়া দেবতা বরুণ ও মিত্রের উদ্দেশ্যে রচিত মন্ত্রে আমরা সহস্র স্তম্ভ কিংবা সহস্র দ্বার বিশিষ্ট ভবনের বর্ণনা পাচ্ছি :
‘হে মিত্র ও বরুণ ! তোমরা যজ্ঞভূমিতে যে যজমানকে রক্ষা কর, শোভন স্তুতিকারী সে যজমানের প্রতি দানশীল হও ও তাকে রক্ষা কর। কারণ তোমরা উভয়ে রাজা ও ক্রোধবিহীন হয়ে ধন ও সহস্র স্তম্ভ সমন্বিত সৌধ ধারণ কর।’ (৫/৬২/৬)
‘হে অন্নবান বরুণ ! তোমার মহান ভূতগণের বিচ্ছেদকারী সহস্র দ্বারবিশিষ্ট গৃহে যাব।’ (৭/৮৮/৫)
অর্থাৎ এটা স্পষ্ট যে, বৈদিক দেবতা বরুণ এবং মিত্রের পূজা বা উপাসনার জন্য বিশাল অট্টালিকা বা ভবন নির্মিত ছিল। একটি মন্ত্রে ঋষি উভয় দেবতাকে একত্রে সম্বোধন করে বলছেন :
‘শত্রুতাশূন্য রাজা মিত্রাবরুণ স্থির, উৎকৃষ্ট, সহস্র স্তম্ভবিশিষ্ট এ স্থানে উপবেশন করুন।’ (২/৪১/৫)
২/৪১/৫ ঋক থেকে এটা স্পষ্টভাবে বোঝা যাচ্ছে যে, বৃহৎ কোন পাকা মন্দির ভবনে বা উপাসনা গৃহে দেবতাদ্বয়ের উপাসনার সময় তাদের প্রতি প্রার্থনা জানিয়ে এ মন্ত্র রচনা বা পাঠ করা হচ্ছে।
বৈদিক সমাজে যে উন্নত চিকিৎসা এবং শল্য বিদ্যার চর্চা ছিল ঋগ্বেদ থেকে সে সম্পর্কেও ধারণা পাওয়া যায়

পাতা: ২১


‘খেলের স্ত্রী বিশ্পলার একটি পা, পক্ষীর একটি পাখার ন্যায় যুদ্ধে ছিন্ন হয়েছিল, হে অশ্বিদ্বয় ! তোমরা রাত্রি যোগে সদ্যই বিশ্পলাকে গমনের জন্য এবং শত্রু ন্যস্ত ধন লাভার্থে লৌহময় জঙ্ঘা পরিয়ে দিয়েছিলে।’ (১/১১৬/১৫)
উপরোক্ত ঋকে কৃতিত্ব দেবতার উপর অর্পণ করা হলেও কাজটা যে শল্যচিকিৎসকের তা বুঝতে না পারার কোন কারণ নেই। অশ্বিদ্বয়ের উদ্দেশ্যে ভিন্ন একটি মন্ত্রে যা বলা হচ্ছে তা উন্নত চিকিৎসা বিজ্ঞানের অস্তিত্বের সাক্ষ্য দেয় :
‘হে নেতৃদ্বয় ! হে অভীষ্টবর্ষী অশ্বিদ্বয় ! দুর্দমনীয় শত্রুদের দ্বারা জলে নিগূঢ় রেভ ঋষিকে তোমরা উঠিয়ে পীড়িত অশ্বের ন্যায় তার বিনষ্ট অবয়ব তোমাদের ভৈষজ কর্ম দ্বারা শোধন করেছিলে ; তোমাদের পূর্বের কর্মসমূহ জীর্ণ হয় নি।’ (১/১১৭/৪)
চিকিৎসক সম্পর্কে বলা হচ্ছে :
‘যেমন রাজাগণ যুদ্ধে একত্র হন সেরূপ যে ব্যক্তির নিকট ওষধিগণ মিলিত হয় অর্থাৎ যে ওষধি জানে সে বুদ্ধিমান ভিষক ব্যক্তিকে চিকিৎসক বলে, সে রোগদের ধ্বংস করে।’ (১০/৯৭/৬)
ঋগ্বেদ থেকে আর্যদের জ্যোতির্বিজ্ঞান সংক্রান্ত জ্ঞান সম্পর্কে কিছু ধারণা করা যায় :
‘যিনি (বরুণ) ধৃতব্রত হয়ে স্ব-স্ব ফলোৎপাদী দ্বাদশ মাস জানেন এবং যে ত্রয়োদশ মাস উৎপন্ন হয় তাও জানেন।’ (১/২৫/৮)
সৌর বৎসর অপেক্ষা চান্দ্র বৎসরে কয়েকটা দিন কম হয়। এ জন্য সৌর বৎসর ও চান্দ্র বৎসরের ঐক্য বিধানার্থে চান্দ্র বৎসর গণনায় প্রতি তিন বৎসরে একটি অধিক মাস (মলমাস) যোগ করতে হয়। উপরোক্ত ১/২৫/৮ ঋক থেকে এটা বোঝা যায় যে, বৈদিক আর্যগণ উভয় বৎসরের গণনা যেমন জানতেন তেমন উভয় বৎসরের মধ্যে ঐক্য বিধান করতেও জানতেন।
নীচের ঋকে উত্তরায়ণ ও দক্ষিণায়ন সম্পর্কে জ্ঞান প্রকাশ পাচ্ছে :
‘পঞ্চপাদ ও দ্বাদশ আকৃতি বিশিষ্ট আদিত্য যখন দ্যুলোকের উৎকৃষ্ট অর্ধে থাকেন, কেউ কেউ তাঁকে পূরীষী বলে অপর কেউ কেউ ছয় অরবিশিষ্ট সপ্ত চক্রবিশিষ্ট রথে দ্যোতমান আদিত্যকে অর্পিত বলে, যখন তিনি দ্যুলোকের অপর অর্ধে অবস্থিত
(১/১৬৪/১২)
২ মণ্ডলের ৩২ নং সূক্তে রাকা ও সিনীবালীর স্তুতি করা হয়েছে। রাকা হচ্ছে পূর্ণিমার রাত, সিনীবালী হচ্ছে অমাবস্যা।

_________________________________________________________________________________
পঞ্চপাদ ও দ্বাদশ আকৃতি বিশিষ্ট আদিত্য প্রসঙ্গে খ্রীষ্টীয় চতুর্দশ শতাব্দীর প্রসিদ্ধ বেদ ভাষ্যকার সায়ণ বলছেন : ‘যদিও ঋতু ছয়, তথাপি হেমন্ত ও শিশির এক বলে পঞ্চঋতু বলা হয়েছে এবং দ্বাদশ মাস দ্বাদশ রূপ।’
পূরীষ অর্থ জল, পূরীষী অর্থ বৃষ্টিকর্তা সূর্য :  সায়ণ।
ঋকের শেষাংশের অর্থ প্রসঙ্গে ঋগ্বেদ-সংহিতার টীকাকার বলছেন : ‘সপ্তরশ্মিই সপ্তচক্র ; ছয় ঋতুই ছয় অর। এ ঋকের শেষাংশে সূর্যের উত্তরায়ণ ও দক্ষিণায়ন গমন উল্লিখিত হয়েছে।’
_________________________________________________________________________________

পাতা: ২২


সূর্যগ্রহণের উল্লেখ পাওয়া যায় : ‘হে সূর্য ! যখন আসুর স্বর্ভানু তোমাকে অন্ধকারাচ্ছন্ন করেছিল, নিজস্থান নিরূপণে অসমর্থ হতবুদ্ধি ব্যক্তি যেরূপ দৃষ্ট হয়, তৎকালে ত্রিভুবনও সেরূপ লক্ষিত হয়েছিল।’ (৫/৪০/৫)
ধর্মীয় আবরণে পৃথিবীর কক্ষ পথে আবর্তন সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায় :
‘যেমন অক্ষ দ্বারা চক্র ধারিত হয়, সেরূপ সে ইন্দ্র নিজ কাষ্ঠের দ্বারা দ্যুলোক ও ভূলোককে স্তম্ভিত করে রাখেন ।’ (১০/৮৯/৪)
জ্যোতির্বিজ্ঞান সম্পর্কে বিস্ময়কর জ্ঞানের পরিচায়ক নীচের ঋকটি :
‘এরূপ আদিত্যরশ্মি এ গমনশীল চন্দ্রমণ্ডলের অন্তর্হিত সূর্য তেজ পেয়েছিল ।’ (১/৮৪/১৫)
এ পর্যন্ত আলোচনায় আমরা ঋগ্বেদ থেকে যেসব মন্ত্র বা মন্ত্রাংশ উদ্ধৃত করেছি সেগুলো কি বহিরাগত এক দঙ্গল যাযাবর, বর্বর, পশুপালক আক্রমণকারীর সমাজচিত্রকে তুলে ধরে? উদ্ধৃতিগুলি যে সমাজের ছবি আমাদের কল্পনায় আঁকে তা কেবলমাত্র একটি স্থিতিশীল নগরকেন্দ্রিক উন্নত সভ্যতাতেই সম্ভব। সভ্য সমাজ, প্রযুক্তি ও অর্থনীতির অসংখ্য বস্তুগত উদাহরণ ঋগ্বেদে ছড়িয়ে আছে যা যে কোনও আগ্রহী পাঠক সংস্কারমুক্ত মন নিয়ে এবং মনোযোগ দিয়ে পড়লেই বুঝতে পারবেন বলে আমরা মনে করি।
এখন আমাদের আলোচনাকে সংক্ষিপ্ত করার স্বার্থে সভ্য সমাজের বস্তুগত নমুনা বিশ্লেষণ আর না করে ঋগ্বেদের ভাবগত কিছু বিষয় বিশ্লেষণ করব। সুতরাং এখন আমরা বৈদিক ঋষিদের চিন্তা, অনুভব এবং কল্পনা শক্তি বিচার করব। আমরা ইতিমধ্যে যদিও কিছু সংখ্যক ঋকে ঋষিদের রূপকল্প এবং উপমা থেকে তাদের সভ্য ও উন্নত মনের কিছু পরিচয় পেয়েছি তবু এ বিষয়ের উপর আরও কিছু আলোচনা করলে ঋগ্বেদ সম্পর্কে আমাদের সিদ্ধান্তের যৌক্তিকতা অধিকতর স্পষ্ট হবে। নিম্নে কিছু উদ্ধৃতি দেওয়া যাচ্ছে :
‘ঐ যে সপ্তর্ষি নক্ষত্র যা উচ্চে স্থাপিত আছে এবং রাতে দৃষ্ট হয়, দিনে কোথায় চলে যায়?’ (১/২৪/১০)
‘হে ইন্দ্র ! ...... নদীসমূহ যেরূপ সবদিকে বয়ে স্বভাবতই সমুদ্রকে পরিপূরিত করে, তুমিও সেরূপ তোমার রক্ষিত মানুষকে প্রভূত ধনে পূর্ণ কর।’ (১/৮৩/১)
‘হে সোম ! গাভী যেরূপ সুন্দর তৃণে তৃপ্ত হয়, মনুষ্য যেরূপ স্বীয় গৃহে তৃপ্ত হয়, সেরূপ তুমি আমাদের হৃদয়ে তৃপ্ত হয়ে অবস্থান কর।’ (১/৯১/১৩)
‘দেবগণের প্রথম অশ্বিদ্বয় ! ........ চক্রবাকদ্বয় যেরূপ দিবসে আসে অথবা রথিদ্বয় যেরূপ আসে, সেরূপ তোমরা আমাদের অভিমুখে এস।’ (২/৩৯/৩)

_________________________________________________________________________________
এ ঋক প্রসঙ্গে ঋগ্বেদ-সংহিতার টীকায় বলা হয়েছে : ‘আচার্য লুডউইগ বিবেচনা করেন, ইন্দ্রের নিজ কাষ্ঠ অর্থে Axis of the Earth’’
ঋগ্বেদ-সংহিতার টীকায় এ ঋক সম্পর্কে বলা হচ্ছে : ‘ত্বষ্টৃতেজ অর্থাৎ সূর্যতেজ। “তদেতেন উপেক্ষিতব্য আদিত্যত: অস্য দীপ্তির্ভবতি।” নিরুক্ত ২/৬। অতএব সূর্য কিরণ চন্দ্রে প্রতিফলিত হয়ে চন্দ্রের আলোক হয় এ কথা ঋগ্বেদের সময় অথবা যাস্কের সময় জানা ছিল।’
_________________________________________________________________________________


পাতা: ২৩


‘হে অশ্বিদ্বয় ! নৌকার ন্যায়, রথচক্রের নাভিফলকের ন্যায়, তৎপার্শ্বস্থ ফলকের ন্যায়, চক্রের বাহ্য দেশের বলয়ের ন্যায় আমাদের পার কর।’ (২/৩৯/৪)
‘হে আদিত্যগণ ! তোমরা কি প্রকারে দু:খ নিবারণ করতে হয় তা জান। পক্ষিগণ যেমন আপনাদের শিশুদের উপরে পক্ষ বিস্তার করে সেরূপ আমাদের সুখ প্রদান কর।’ (৮/৪৭/২)
‘১০। কত কাল হতে ঊষা উৎপন্ন হচ্ছেন, কত কাল পর্যন্ত উৎপন্ন হবেন। বর্তমান ঊষা পূর্ব ঊষাকে সাগ্রহে অনুকরণ করেছেন, আবার আগামী ঊষাসমূহ এ দীপ্তিমান ঊষাকে অনুকরণ করবেন। ১১। যে মানুষেরা অতি পূর্ব কালের ঊষাকে আলোক প্রকাশ করতে দেখেছিলেন তাঁরা এক্ষণে গত হয়েছেন; আমরা এক্ষণে ঊষাকে দর্শন করছি, ভবিষ্যতে যাঁরা ঊষাকে দর্শন করবেন তাঁরা আসছেন।’ (১ মণ্ডল, ১১৩ সূক্ত)
উপরের সূক্ষ্ম অনুভূতি সম্পন্ন এবং উচ্চ সাহিত্য মূল্য বিশিষ্ট মন্ত্রগুলি কি কোনও যাযাবর পশুপালকের মাথায় জন্ম নিতে পারে ? আরও দেখা যাক। নিম্ন লিখিত ঋকটি গভীর চিন্তা জাগায় :
‘দুটি পক্ষী বন্ধুভাবে এক বৃক্ষে বাস করে। তাদের মধ্যে একটি স্বাদু পিপ্পল ভক্ষণ করে, অন্যটি ভক্ষণ করে না ­ কেবলমাত্র অবলোকন করে।’ (১/১৬৪/২০)
১০ মণ্ডল, ৮২ সূক্ত থেকে দু’টি ঋক উদ্ধৃত করা যাক :
‘৩। যিনি আমাদের জন্মদাতা পিতা, যিনি বিধাতা, যিনি বিশ্বভুবনের সকল ধাম অবগত আছেন, যিনি একমাত্র, অথচ সকল দেবের নাম ধারণ করেন, অন্য সকল ভুবনের লোকে তার বিষয়ে জিজ্ঞাসাযুক্ত হয়। ৭। যিনি এ সৃষ্টি করেছেন, তাঁকে তোমরা বুঝতে পার না, তোমাদের অন্ত:করণ তা বুঝবার ক্ষমতা প্রাপ্ত হয় নি। কুজ্ঝটিকাতে আচ্ছন্ন হয়ে লোকে নানা প্রকার জল্পনা করে, তারা আপন প্রাণের তৃপ্তির জন্য আহারাদি করে এবং স্তব স্তুতি উচ্চারণ করে বিচরণ করে।’
ঋষির মনের এমন চিন্তাকে খাটো করে দেখার উপায় আছে কি? ঋষিদের ধর্মচিন্তার মধ্যে উন্নত দর্শনচিন্তার সন্ধান পাওয়া যায়, পাওয়া যায় সংশয় ও জিজ্ঞাসা :
‘প্রথম জাতকে কে দেখেছিল যখন অস্থিরহিতা অস্থিযুক্তকে ধারণ করল? ভূমি হতে প্রাণ ও শোণিত, কিন্তু আত্মা কোথা হতে? কে বিদ্বানের নিকট এ বিষয় জিজ্ঞাসা করতে যায় ? ’ (১/১৬৪/৪)
‘আমি অজ্ঞান কিছু না জেনেই জ্ঞানী মেধাবীগণের নিকট জানবার জন্য জিজ্ঞাসা করছি, যিনি এ ছয় লোক স্তম্ভণ করেছেন, যিনি জন্মরহিতরূপে নিবাস করেন তিনি কি সেই এক ? ’ (১/১৬৪/৬)
কিংবা ধরা যাক ১০ মণ্ডলের ১২৯ সূক্তের দুইটি ঋকের কথা :
‘১। সেকালে যা নেই তাও ছিল না, যা আছে তাও ছিল না। পৃথিবীও ছিল না, অতি দূরবিস্তার আকাশও ছিল না। আবরণ করে এমন কি ছিল ? কোথায় কার স্থান ছিল ? দুর্গম ও গভীর জল কি তখন ছিল ? ২। তখন মৃত্যুও ছিল না, অমরত্বও ছিল না, রাত্রি ও দিনের প্রভেদ ছিল না। কেবল সে একমাত্র বস্তু বায়ুর সহকারিতা ব্যতিরেকে আত্মা মাত্র অবলম্বনে নি:শ্বাস-প্রশ্বাসযুক্ত হয়ে জীবিত ছিলেন। তিনি ব্যতীত আর কিছুই ছিল না।’

পাতা: ২৪


উপরের সূক্তের ঋক দু’টির বক্তব্য মনকে নাড়া দেবার মত। কিন্তু এখানেই শেষ নয়। একই সূক্তের ঋষি ঐ সূক্তের শেষ দুইটি ঋকে যে প্রশ্ন তুলেছেন তা হচ্ছে বিস্ময়কর :
‘৬। কেই বা প্রকৃত জানে ? কেই বা বর্ণনা করবে ? কোথা হতে জন্মিল? কোথা হতে এ সকল নানা সৃষ্টি হল? দেবতারা এ সমস্ত নানা সৃষ্টির পর হয়েছেন। কোথা হতে যে হল, তা কেই বা জানে? ৭। এ নানা সৃষ্টি যে কোথা হতে হল, কার থেকে হল, কেউ সৃষ্টি করেছেন, কি করেন নি, তা তিনিই জানেন, যিনি এর প্রভুস্বরূপ পরমধামে আছেন। অথবা তিনিও না জানতে পারেন।’
সৃষ্টির আদি কারণ জিজ্ঞাসা থেকে ঋষি যে স্থানে পৌঁছেছেন কত উন্নত চিন্তাশক্তি থাকলেই যে সেটা সম্ভব তা সহজেই অনুমেয়। এ শুধু উন্নত দর্শন-চিন্তা নয় তার চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হল একটি ধর্মগ্রন্থে এই ধরনের সন্দেহবাদী দর্শনচিন্তামূলক মন্ত্রকে স্থান দেওয়া।
এই ধরনের সন্দেহবাদী দর্শন-জিজ্ঞাসা কি খুব পশ্চাৎপদ কিংবা যাযাবর, পশুপালক যোদ্ধা সমাজের মানুষের মাথায় জাগা সম্ভব? অনেক সভ্য সমাজেও তো এমন চিন্তার প্রকাশকেই সহ্য করা হয় না।
ঋগ্বেদের সব মন্ত্রে যে এমন উন্নত দর্শনচিন্তার প্রকাশ ঘটেছে তা নয়। ঋগ্বেদ ধর্মগ্রন্থ। সুতরাং সেখানে উন্নত দর্শন এবং যুক্তিবিদ্যা আশা করা ভুল হবে। কিন্তু তা সত্ত্বেও ঋগ্বেদের বিভিন্ন মন্ত্রে গভীর চিন্তার যেটুকু প্রকাশ ঘটেছে পাঠকমনকে অভিভূত করার জন্য সেটুকু যথেষ্ট হবে। বৈদিক ভাষা না জেনেও শুধু অনুবাদের মাধ্যমেও যে কোন মনোযোগী পাঠক ঋগ্বেদের শক্তিকে অনুভব করতে পারেন। তার ভাষার বিন্যাস বা গাঁথুনি, রূপকল্প বা উপমা এবং উপস্থাপনা ইত্যাদি প্রমাণ করে যে, ঋগ্বেদের ভিত্তিমূলে আছে একটি সুউন্নত সভ্যতা।
ঋগ্বেদ পাঠ দ্বারা আমরা একটি দৃঢ় সিদ্ধান্তে পৌঁছতে বাধ্য হই যে, তা পরাধীন বা অধীনস্থ ঋষিদের সৃষ্টি যেমন নয় তেমন বহিরাগত আক্রমণকারী যাযাবর সমাজ থেকে আগত ঋষিদেরও সৃষ্টি নয়। একটি স্বাধীন ও সুউন্নত সমাজের ভিতর থেকে এবং স্বাধীন কণ্ঠ থেকে ঋগ্বেদের মন্ত্রগুলি স্বত:স্ফূর্তভাবে উচ্চারিত হয়েছে।
আমাদের আলোচনায় আমরা এ পর্যন্ত যে সামান্য কয়টি উদ্ধৃতি দিয়েছি তা থেকেই কি বিষয়টি স্পষ্ট হয় না? বস্তুত এই রকম সাহিত্যমূল্য বিশিষ্ট এক বিশাল গ্রন্থ রচনার ভার যাযাবরদের ঘাড়ের উপর চাপাতে হলে কি অতি দুর্দান্ত ও মাত্রাজ্ঞানহীন কল্পনাশক্তির আশ্রয় নিতে হয় না ? অথবা উল্টোটাও হতে পারে যেখানে বাস্তব জ্ঞান এবং কল্পনাশক্তির নিদারুণ অভাবে সহজ সত্যকে বোঝার ক্ষমতাও থাকে না।

পাতা: ২৫

 


ঋগ্বেদ যে বহিরাগতদের সৃষ্টি নয় এর সপক্ষে আরও একটি জোরালো যুক্তি দেওয়া যায় এই বিষয় উল্লেখ করে যে, ঋষিরা বিভিন্ন মন্ত্রে শত্রু হিসাবে যে সব নাম উল্লেখ করছেন তাদের বিপুল সংখ্যাগুরু অংশকেই বৈদিক বা আর্য নাম থেকে পৃথক করা যায় না। এখানে একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় বলে রাখা দরকার যে, ঋষিরা নিজেদের আর্য বললেও শত্রুদেরকে কখনই অনার্য বলেন নি। অধিকাংশ ক্ষেত্রে শত্রুদেরকে রাক্ষস, দাস, দস্যু ইত্যাদি বলেছেন। বোঝাই যায় এসব প্রতিপক্ষের প্রতি গালাগালি এবং ঘৃণা প্রকাশের শব্দ। এ ছাড়া তাদের সম্পর্কে বলা হয়েছে যে, তারা যজ্ঞবিরোধী, দেবরহিত ইত্যাদি। এ থেকে বোঝা যায় যে, বৈদিক ঋষিরা যাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ সংগঠিত করছেন তাদের সঙ্গে বৈদিক পক্ষের ধর্মীয় পার্থক্য এবং বিবাদ আছে।
ঋগ্বেদ থেকে আমরা দাস, দস্যু, যজ্ঞবিরোধী, দেবরহিত ইত্যাদি হিসাবে কথিত প্রায় ৭০টি নাম পাচ্ছি, যাদের প্রায় সকলে বৈদিক দেবতাদের হাতে বিশেষ করে ইন্দ্রের হাতে হত বা বিনাশপ্রাপ্ত বলা হয়েছে। এখন আমরা স্বাভাবিকভাবে এই ভেবে অবাক হব যে, যাদের বিরুদ্ধে ঋষিদের যুদ্ধ জয়ের জন্য ইন্দ্র ও অন্যান্য দেবতার সাহায্য ভিক্ষা করে কিংবা যুদ্ধ জয়ের পর আনন্দ ও কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে দেবতাদের উদ্দেশ্যে মন্ত্রোচ্চারণ সেই আর্যশত্রুরা ভিন্ন সমাজ বা জাতির হলে তাদের নামের সঙ্গে বৈদিক ঋষি এমন কি দেবতাদেরও নামের এত মিল হয় কি করে! এ ছাড়াও আছে উভয় পক্ষের আরও অনেকের এক নাম।
আমরা খুব সংক্ষেপে এই বিষয়ে আলোচনা করতে পারি। ১/১৩০/৮, ৮/৯৬/১৩,১৪,১৫ ইত্যাদি ঋকে বৈদিক শত্রু কৃষ্ণের উল্লেখ পাওয়া যায় যাকে দেবতা ইন্দ্র বধ করেন। অথচ ৮ম মণ্ডলের ৮৫ সূক্তের রচয়িতা হলেন আঙ্গিরস কৃষ্ণ। একই মণ্ডলে ৮৬ সূক্তের রচয়িতা হলেন কৃষ্ণের পুত্র বিশ্বকায় ঋষি। ১০ম মণ্ডলে ৪৪ নম্বর সূক্তের রচয়িতা হলেন কৃষ্ণ ঋষি। ইন্দ্র ‘অর্বুদকে আধোমুখ করে বিনাশ করেছিলেন’ (২/১৪/৪ ইত্যাদি)। এদিকে ঋগ্বেদের রচয়িতা ঋষিদের মধ্যে ১০ম মণ্ডলে আমরা অর্বুদ (৯৪ সূক্তের রচয়িতা) নামে একজন ঋষিকে পাচ্ছি। ইন্দ্র কবষকে ‘আনুপূর্বরূপে জলে নিমগ্ন করেছিলেন’(৭/১৮/১২)। অথচ কবষ নামে একজন ঋষি ঋগ্বেদের ১০ম মণ্ডলে ৩০ থেকে ৩৪ সূক্ত পর্যন্ত সকল সূক্তের রচয়িতা। ‘যে ইন্দ্র সুখে অশ্বকে বিনাশ করেছিলেন’ (২/১৪/৫), সেই ইন্দ্রের স্তুতিতে ৮ম মণ্ডলে অশ্বসূক্তি ঋষি এবং অশ্বপুত্র বশ ঋষি মন্ত্র রচনা করেছেন। উপরন্তু অশ্ব দেবতার স্তুতিতেও সূক্ত রচিত হয়েছে ; যেমন ১ মণ্ডলের ১৬২ ও ১৬৩ সূক্ত। শ্রুতকেও ইন্দ্র ‘আনুপূর্বরূপে জলে নিমগ্ন করেছিলেন’ (৭/১৮/১২)। ঋগ্বেদের ৫ম মণ্ডলে অত্রিবংশীয় ঋষি বসুশ্রুত এবং অত্রির অপত্য ঋষি শ্রুতবিদ এবং ৮ম মণ্ডলে ঋষি শ্রুতবন্ধু ও শ্রুতকক্ষ ইত্যাদি নাম পাচ্ছি। অর্থাৎ শ্রুত নামটি বৈদিক। ৭/১৮/২০ ঋকে ইন্দ্রকে উদ্দেশ্য করে বলা হচ্ছে, ‘তুমি মান্যমানের পুত্র দেবককে বধ করেছ।’ দেবক শব্দটা বৈদিক। অন্যদিকে ৮ম মণ্ডলের একজন ঋষি হলেন মান্য। মান্যমানের সঙ্গে তফাৎটা সামান্য। ২/১৩/৮ ঋকে ঋষি বলছেন, ‘হে বহুকর্মকর্তা ইন্দ্র! তুমি হব্যলাভ ও দাসদের নাশের উদ্দেশ্যে নৃমরের পুত্র সহবসুকে বিনাশ করার জন্য বলবতী বজ্রধারার নির্মল মুখ প্রদেশে ওকে প্রদান করেছ, তুমি স্তুতি যোগ্য।’ এদিকে ঋগ্বেদের বিভিন্ন মণ্ডলে সূক্ত রচয়িতা ঋষি হিসাবে বসুশ্রুত, প্রভুবসু, বসুমনা, বসুকর্ণ, বসুকৃৎ ইত্যাদি নাম যেমন পাওয়া যাচ্ছে তেমন ৮ম মণ্ডলে দুইজন ঋষির নাম সহ পাওয়া যাচ্ছে। তাছাড়া ১ম মণ্ডলের ১০০ তম সূক্তের রচয়িতা বৃষাগিরের পুত্রগণ ঋষিগণের মধ্যে একজনের নাম সহদেব।

পাতা: ২৬


এগুলি ছাড়া আরও কয়টি শত্রু নামের সঙ্গে বৈদিক দেবতার নামের মিল দেখা যায়। ইন্দ্র ‘গাভী হরণকারী বল নামক শত্রুর গহ্বর উদ্ঘাটিত’ করেছিলেন (১/১১/৫)। অথচ বহু সংখ্যক ঋকে ইন্দ্র, অগ্নি ইত্যাদি দেবতাকে বলের পুত্র বলা হচ্ছে। বল অর্থ শক্তি। অর্থাৎ শব্দটা বৈদিক বা আর্য। ঋগ্বেদের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ তথা প্রধান দেবতা ইন্দ্রের সবচেয়ে বড় কীর্তি হিসাবে যে বৃত্রবধের কথা ঋগ্বেদের ঋষিরা বারবার উচ্ছ্বসিত কণ্ঠে উচ্চারণ করেছেন সেই বৃত্রের এক নাম বলা হচ্ছে অহি। ‘ইন্দ্র .......অহি অর্থাৎ বৃত্রকে বধ করলেন’ (১০/৬৭/১২) বহুবার অহি বধের বর্ণনা দেওয়া হয়েছে। ঋগ্বেদে অহি এক অত্যন্ত ঘৃণিত দানবের নাম। অথচ এই একই গ্রন্থে বহু সংখ্যক মন্ত্রে ঋষিরা অহির্বুধ্ন্য বা অহির্বুধ্ন্যা নামে এক দেবতার কাছে প্রার্থনা করছেন। যেমন ৫/৪১/১৬ ঋকে বলা হচ্ছে, ‘দেবঅহির্বুধ্ন্য যেন আমাদের অনিষ্ট না করে শত্রুদের সংহার করেন।’    
এখন প্রশ্ন অহির্বুধ্ন্য কে ? ‘সায়ণাচার্যের মতে “বুধ্ন্য” শব্দের অর্থ অন্তরীক্ষে জাত, “অহির্বুধ্ন্যা” শব্দের অর্থ অন্তরীক্ষে জাত অহি নামক দেবতা।’ (ঋগ্বেদ-সংহিতা, প্রথম খণ্ড, টীকা, পৃষ্ঠা : ৩৭৫)। অর্থাৎ পৃথিবীর অহি ঘৃণিত ও দেবশত্রু দানব হলেও অন্তরীক্ষের অহি পূজনীয় দেব। এটা কিভাবে সম্ভব যে, ‘অনার্য’ দেবতা বা শত্রুর নাম অহি আর এই অহি বা বৃত্রের অনুচরদের বিরুদ্ধে যে ‘আর্যরা’ যুদ্ধ করছে তাদের দেবতার নাম অহির্বুধ্ন্য বা অন্তরীক্ষের অহি ? ইন্দ্র কর্তৃক বিনাশকৃত আর এক শত্রুর নাম রুধিক্রা (২/১৪/৫)। অশ্বরূপ অগ্নি বা সূর্যের নাম হল দধিক্রা। শব্দ দুইটির নৈকট্য লক্ষণীয়।
আমরা বিষয়টিকে আরও জীবন্তভাবে তুলে ধরার জন্য নিম্নে বৈদিক ঋষিদের শত্রুপক্ষ এবং বৈদিক পক্ষের অভিন্ন বা প্রায় সমরূপ নামগুলিকে পাশাপাশি সাজিয়ে একটা তুলনামূলক তালিকা দিচ্ছি। অবশ্য এগুলির সব নাম উপরে আলোচনা করা হয় নি। ফলে সবগুলি পুনরুক্তি মনে হবে না। আগ্রহী পাঠক যাতে মূল গ্রন্থের সঙ্গে সহজে মেলাতে পারেন সেই জন্য নামগুলির পাশে সূত্র হিসাবে পরিচয়ের সঙ্গে এক দু’টি ঋক সংখ্যা বন্ধনীর মধ্যে দেওয়া হয়েছে।

                                                       
                           
           

শত্রু পক্ষের নাম

বৈদিক পক্ষের নাম

অহি - প্রধান বৈদিক দেবতা ইন্দ্রের প্রধান শত্রু বৃত্রের অপর নাম; শয়ান দানব অহি  জল রোধ করে রেখেছিল এবং ইন্দ্র কর্তৃক নিহত হয় (/১০৩/, /১২/১১, /১৭/)

অহির্বুধ্ন্যা বৈদিক দেবতা (/১৮৬/, /৩১/)

 

পাতা: ২৭

 

 

 

অহীশুব - ইন্দ্র কর্তৃক হত (/৩২/)

অহির্বুধ্ন্যা   

অশ্ব - ইন্দ্র কর্তৃক হত (/১৪/) এবং ইন্দ্র কর্তৃক তার পুরাতন নগরসমূহ বিনষ্ট (/২০/)

অশ্ব - মণ্ডলের ১৬২ এবং ১৬৩ নম্বর সূক্তের দেবতা ৮ম মণ্ডলের ৪৬ নম্বর সূক্তের ঋষির নাম অশ্বপুত্র বশ

অর্বুদ - ইন্দ্র কর্তৃক বিনাশ প্রাপ্ত (/১১/২০,/১৪/)

অর্বুদ - ১০ মণ্ডল ৯৪ সূক্তের ঋষি 

কবষ - ইন্দ্র কর্তৃক আনুপূর্বরূপে জলে নিমজ্জিত (/১৮/১২)

কবষ - ঋগ্বেদের ১০ মণ্ডলের ৩০ হতে ৩৪ মণ্ডলের ৩০ হতে ৩৪ সূক্তের ঋষি

কৃষ্ণ - ইন্দ্র কর্তৃক হত (/১৩০/) এবং ইন্দ্র কর্তৃক তার স্ত্রীরা হত (/১০১/)

কৃষ্ণ- ১০ মণ্ডলের ৪৪ নম্বর সূক্তের রচয়িতা ঋষি

চিত্ররথ - ইন্দ্র কর্তৃক হত (/৩০/১৮)

চিত্র - বৈদিক রাজা (/২১/১৭-১৮)

জরুথ - অগ্নি কর্তৃক দগ্ধ (১০/৮০/)

জরৎকর্ণ - অগ্নি কর্তৃক রক্ষাপ্রাপ্ত  (১০/৮০/)

তুগ্র - ইন্দ্র কর্তৃক হত (/২৬/)

তুগ্র - বৈদিক যুগ্ম দেবতা অশ্বিদ্বয়ের প্রিয়পাত্রতার পুত্র ভুজ্যু অশ্বিদ্বয় কর্তৃক রক্ষাপ্রাপ্ত (/১১৬/-)

ত্রিশিরা - ইন্দ্র প্রেরিত ত্রিত কর্তৃক হত (১০//)

ত্রিশিরা- ১০ মণ্ডল, সূক্তের রচয়িতা ঋষি

পূরু - অগ্নি দেবতা কর্তৃক পরাজিত (//)

পুরু - বৈদিক রাজা; তার পুত্র ইন্দ্র কর্তৃক রক্ষাপ্রাপ্ত (//১২)

বল - গো হরণকারী এবং ইন্দ্র কর্তৃক পরাজিত বিনাশপ্রাপ্ত (/১১/,/১১/২০, /১৪/)

বল - ইন্দ্রের পিতা (/৬২/, /২৪/), অগ্নির পিতা (১০/১১/)

 

 পাতা: ২৮

 

 

বিশ্বরূপ - বৈদিক দেবতা ত্বষ্টার পুত্র; ইন্দ্র কর্তৃক হত (/১১/১৯, ১০//)

বিশ্বকর্মা - বৈদিক দেবতা এবং একই নামের একজন বৈদিক ঋষি (১০/৮১ এবং ১০/৮২ সূক্ত)

বৃহদ্রথ - ইন্দ্র কর্তৃক ভগ্ন (১০/৪৯/)

বৃহদুক্থ - ১০ মণ্ডলের ৫৪-৫৬ সূক্তের ঋষি

বৃষশিপ্র - ‘হে ইন্দ্র বিষ্ণু ! ..... সংগ্রামে বৃষশিপ্র নামক দাসের মায়াকে বিনষ্ট করেছ’ (/৯৯/)

বৃষভ - যুদ্ধে ইন্দ্র কর্তৃক সাহায্যপ্রাপ্ত একজন রাজা (/২৬/)

বৃষয় -অগ্নি সোম কর্তৃক বৃষয়ের পুত্র হত (/৯৩/)

বৃষণশ্চ - বৈদিক রাজা (/৫১/১৩)বৃষাগির-বৃষাগিরের পুত্রগণ মণ্ডলের ১০০ নং সূক্তের ঋষি

মান্যমান - ইন্দ্র কর্তৃক মান্যমানের পুত্র দেবক হত (/১৮/২০)

মান্য - মণ্ডল, ৬৭ সূক্তের ঋষি

মৃগয় - ইন্দ্র কর্তৃক বিনাশ প্রাপ্ত (//১৯)

গয় - ১০ মণ্ডলের ৬৩ ৬৪ সূক্তের ঋষি

রুধিক্রা - ইন্দ্র কর্তৃক হত (/১৪/)

দধিক্রা - বৈদিক দেবতা; ৪র্থ মণ্ডলের ৩৯ ৪০ সূক্তের এবং ৭ম মণ্ডলের ৪৪ সূক্তের দেবতা

শম্বর - ইন্দ্র কর্তৃক হত পরাক্রান্ত শত্রু; তার ৯৯ নগর ইন্দ্র কর্তৃক ধ্বংস সাধন (/৫১/,/৫৪/,/১২/১১)

সম্বরণ - প্রজাপতির অপত্য সম্বরণ ৫ মণ্ডলের ৩৩ নং সূক্তের ঋষি

শ্রুত - ইন্দ্র কর্তৃক জলে আনুপূর্বরূপে নিমজ্জিত (/১৮/১২)

শ্রুতর্ষ - দেবতা অশ্বিদ্বয় কর্তৃক রক্ষাপ্রাপ্ত (/১১২/)

সহবসু - ইন্দ্র কর্তৃক হত (/১৩/)

সহদেব - বৃষাগিরের পুত্র, ঋষি (১মণ্ডল ১০০ সূক্ত) প্রভুবসু - ৫ম মণ্ডলের ৩৬ নং সূক্তের ঋষি

 

 পাতা: ২৯


উপরে প্রদত্ত তালিকা থেকে আমরা বৈদিক ও অবৈদিক উভয় পক্ষে এক অথবা প্রায় এক নাম পেয়েছি। এ ছাড়া অবৈদিক শত্রুপক্ষের আরও অনেক নাম উল্লেখ করা যায় যাদের প্রায় সবগুলোকে বৈদিক ভাষার শব্দ হিসাবে চেনা যায়। যেমন, আর্য অর্ণ (৪/৩০/১৮), অংহা (১/৬৩/৭), অনর্শনি (৮/৩২/২), উরণ (২/১৪/৪), অযু (১/১০৪/৪), অনু (৭/১৮/১৩,১৪), অৎক (১০/৪৯/৩), ঔর্ণবাভ (৮/৩২/২৬), কুথর (১/১০৩/৮), কুযব (১/১০৪/৩), কুযবাচ (১/১৭৪/৭), করঞ্জ (১/৫৩/৮), ইলীবিশ (১/৩৩/১২), চুমুরি (৭/১৯/৪), দৃভীক (২/১৪/৩), ধুনি (৭/১৯/৪), পর্ণয় (১/৫৩/৮), পণি (১/৩২/১১), পীয়ু (২/১৯/৭), পিপ্রু (৪/১৬/১৩), বৃত্র (১/৪/৮), বৃদ্ধ (৭/১৮/১২), বর্চি (৪/৩০/১৫), ব্যংস (৪/১৮/৯), বরশিখের পুত্র বৃচীবানের বংশধরগণ (৬/২৭/৫), বঙ্গৃদ (১/৫৩/৮), দেবক (৭/১৮/২০), নমুচি (২/১৪/৫), নববাস্তব (৬/২০/১১),দ্রুহ্যু (৭/১৮/১২), যুধ্যামধি(৭/১৮/২৪), রৌহিণ (২/১২/১২), শুষ্ণ (১/১১/৭), শরত (৬/২০/১০), সৃবিন্দ (৮/৩২/২), নৃষদের পুত্র (১০/৬১/১৩), ইত্যাদি।
এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে যে, বর্ণিত নামগুলির প্রায় সকলে হত কিংবা বিনাশপ্রাপ্ত শত্রুর নাম হিসাবে উল্লেখ করা হয়েছে। কিছু ক্ষেত্রে পরাজিত বলা হয়েছে। সামান্য কিছু ক্ষেত্রে কারও পরাজয় বা বিনাশ প্রার্থনা করা হয়েছে। যাইহোক, আমাদের তালিকায় ঋগ্বেদে উল্লিখিত শত্রুনাম থেকে সামান্য সংখ্যক নাম বাদ পড়েছে। এ নামগুলির পরিচয় যা-ই হোক এগুলিকে কি আর্য সমাজের নাম মনে হয় না ?
অবশ্য একটা যুক্তি দেওয়া হতে পারে যে, ‘অনার্য’ শত্রুদের নাম সঠিকভাবে উচ্চারণ করতে না পারায় ‘অনার্য’ নামগুলি ‘বহিরাগত আর্যদের’ বৈদিক ভাষায় উচ্চারিত ও লিখিত হওয়ায় এমন অবস্থা হয়েছে। কিন্তু তা হলে বৈদিক আর্যদের নামের ক্ষেত্রেও দাস এবং দস্যু শব্দের যে ব্যবহার দেখা যায় তার কি ব্যাখ্যা দেওয়া যাবে ? দাস ও দস্যুদের বিরুদ্ধে ইন্দ্র কর্তৃক সাহায্যপ্রাপ্ত এবং যুদ্ধজয়ী যে কয়জন রাজার নাম ঋগ্বেদে বহুবার উল্লিখিত হয়েছে তাদের মধ্যে তিনজনের নাম হল দিবোদাস, সুদাস এবং ত্রসদস্যু। দাস এবং দস্যু শব্দ যদি অনার্য জাতির হয় তবে আর্যরা কেন এই নাম নিবে ? যুদ্ধরত এবং বহিরাগত হানাদার আর্যদের পক্ষে বিদেশী এবং বিজাতীয় ঘৃণ্য শত্রুদের পরিচয়সূচক নাম গ্রহণ করার কোন কারণ নেই। এটা সম্ভব দীর্ঘকাল শান্তিপূর্ণ বসবাস ও মিশ্রণের পর। অথচ যখন দাস ও দস্যুদের বিরুদ্ধে দেবতাদের বিশেষত ইন্দ্রের সাহায্য চাওয়া হচ্ছে কিংবা যখন দাস ও দস্যুদের পরাজয় বর্ণনা করা হচ্ছে তখন ঋষিরা দিবোদাস, ত্রসদস্যু, সুদাস ইত্যাদি রাজার জন্য কখনও কখনও সাহায্য চাচ্ছেন কিংবা তাদেরকে ইন্দ্র কিভাবে সাহায্য করেছেন তা বলছেন। ৭/১৯/৩ ঋকে ইন্দ্রের উদ্দেশ্যে বলা হচ্ছে, ‘হে ধর্ষক ! হব্যদাতা সুদাসকে ধর্ষক বজ্রের দ্বারা সমস্ত রক্ষার সাথে রক্ষা কর, যুদ্ধে ভূমি লাভের জন্য পুরুকুৎসের পুত্র ত্রসদস্যু ও পুরুকে রক্ষা কর।’ এর পরের ঋক অর্থাৎ ৭/১৯/৪ ঋকে বলা হচ্ছে, ‘তুমি দভীতির জন্য দস্যু, চুমুরি ও ধুনিকে বজ্রের দ্বারা বধ করেছ।’


পাতা: ৩০


দিবোদাস ঋগ্বেদের এক বিখ্যাত যোদ্ধা রাজা। ইন্দ্র ‘দিবোদাসের জন্য শম্বরের নবনবতি পুরী বিদারণ করেছিলেন’ (২/১৯/৬), এবং ‘ইন্দ্র হব্যদাতা দিবোদাসকে শম্বরের পাষাণ নির্মিত শত সংখ্যক পুরী প্রদান করেছিলেন’ (৪/৩০/২০), ইত্যাদি। ৪/৩০/১৪ ঋকে শম্বরকে বলা হচ্ছে ‘কুলিতরের অপত্য দাস শম্বর’।
এখন পরাজিত শম্বর হচ্ছে দাস ‘জাতীয়’ আর বিজয়ী বৈদিক রাজার নাম দিবোদাস। শব্দের অর্থ যা-ই হোক নাম এবং শব্দের এই মিল কিন্তু আকস্মিক হবার কথা নয়। তাই আরেক বিখ্যাত বৈদিক রাজা এবং ঋষির নাম সুদাস হওয়া সম্ভব। অর্থাৎ দাস ও দস্যু ইত্যাদি শব্দ এক সময় সমাজে বহু প্রচলিত ছিল যে কারণে বৈদিক পক্ষে আমরা দাস ও দস্যু সংযুক্ত নাম দেখতে পাই।
এটা সহজবোধ্য যে, যুদ্ধ শুরুর পূর্বে শব্দগুলির তুচ্ছার্থে ব্যবহার ছিল। অনুমান করা চলে যে, দস্যু বলতে ডাকাত এবং পরস্বাপহারককে বোঝানো হত; আর দাস বলতে ভৃত্য, সেবক বা অধীনস্থ, কিংবা বন্দী বোঝানো হত। পরবর্তী সময়ে যুদ্ধ শুরুর কালে শত্রুর প্রতি ঘৃণা এবং তাচ্ছিল্য প্রকাশের জন্য এই দুই শব্দ বেছে নেওয়া হয়েছে বলে অনুমান করা যায়। শত্রুর প্রতি রাক্ষস শব্দের ব্যবহারও এই একই কারণে। অনুমান করা চলে যে, সে কালে নরমাংসভোজী আদিম মানুষদের বোঝানো হত এই শব্দ দ্বারা।
এই দাস, দস্যু ও রাক্ষসদের যজ্ঞবিরোধী, দেবরহিত ইত্যাদি বলা হচ্ছে। অর্থাৎ বৈদিক ধর্ম বিরোধী অর্থে শত্রু হল যজ্ঞবিরোধী বা দেবরহিত। বৈদিক শক্তির মধ্যে সংঘাত দেখা দিলেও এক পক্ষ অপর পক্ষকে ধর্মহীন অর্থে যজ্ঞরহিত বলে গালি দিয়েছে। এমন কি যখন বসিষ্ঠ ঋষির অনুসারী সুদাস রাজার সঙ্গে বিশ্বামিত্র ঋষি কর্তৃক সংগঠিত পুরু, যদু, অনু, দ্রুহ্যু প্রভৃতি দশ উপজাতির জোটের যুদ্ধ হয় এবং সেই যুদ্ধে দশ উপজাতির জোট পরাজিত হয় তখন বসিষ্ঠ ঋষি আনন্দ প্রকাশ করে মন্ত্র রচনা করছেন, ‘হে ইন্দ্র ও বরুণ ! দশজন যজ্ঞরহিত রাজা মিলিত হয়েও সুদাস রাজাকে প্রহার করতে সমর্থ হল না।’ (৭/৮৩/৭)
এই যেখানে অবস্থা সেখানে দাস, দস্যু, রাক্ষস শব্দ দ্বারা সম্পূর্ণ ভিন্ন জাতির মানুষ বোঝানো হচ্ছে এটা মনে করার যুক্তি নেই। বরং একই জাতি বা জনগোষ্ঠীর মধ্যে সংঘাতের সম্ভাবনাকেই অধিকতর গুরুত্বের সঙ্গে বিচার করতে হয়।
এখন আমরা বৈদিক দেবতাদের মধ্যকার সংঘাতের দিকে দৃষ্টি দিতে পারি। ৪ মণ্ডলের ৩০ সূক্তে কয়েকটি ঋকে দেবতা ঊষার সঙ্গে দেবতা ইন্দ্রের সংঘাত বর্ণনা করা হয়েছে :
‘৯। হে মহান ইন্দ্র ! তুমি দ্যুলোকের দুহিতা পূজনীয়া ঊষাকে সংপিষ্ট করেছিলে। ১০। অভীষ্টবর্ষী ইন্দ্র যখন ঊষার শকট ভগ্ন করেছিলেন তখন ঊষা ভীত হয়ে ভগ্ন শকট হতে অবতরণ করেছিলেন। ১১। ঊষাদেবীর চূর্ণীকৃত শকট বিপাশা নদীর তীরে পড়ে থাকল, তিনি দূর দেশে অপসৃত হলেন।’
ঊষা ঋগ্বেদের এক গুরুত্বপূর্ণ দেবতা। সুতরাং ঊষার সঙ্গে ইন্দ্রের সংঘাতের মধ্যে দুই শক্তিশালী সামাজিক প্রথা এবং গোষ্ঠীর দ্বন্দ্ব প্রতিফলিত হয়েছে। এতে ইন্দ্রের পক্ষশক্তির জয় হলেও ঊষা এবং তার সঙ্গে সম্পর্কিত সামাজিক প্রথা ও গোষ্ঠীকে যে বিনষ্ট করা যায় নি তার প্রমাণ হল ঋগ্বেদ যেখানে বহু মন্ত্রে ঊষা দেবীর স্তুতি করা হয়েছে এবং তাঁর উদ্দেশ্যে কিছু সংখ্যক সম্পূর্ণ সূক্ত রচনা করা হয়েছে।


পাতা: ৩১


দেবতা ত্বষ্টার সঙ্গেও ইন্দ্রের বিরূপ সম্পর্ক। ‘ইন্দ্র ত্বষ্টাকে সামর্থ্য দ্বারা পরাভূত করে তাঁর চমসস্থিত সোম পান করেছিলেন’ (৩/৪৮/৪) ; এবং ‘শিষ্ট পালনকর্তা ইন্দ্র, অভিমানী ও সর্বব্যাপীতেজোবিশিষ্ট ত্বষ্টার পুত্রকে বিদীর্ণ করলেন। তিনি গাভীদের আহ্বান করতে করতে ত্বষ্টার পুত্র বিশ্বরূপের তিন মস্তক ছেদন করলেন’ (১০/৮/৯)। অথচ ঋগ্বেদেই বলা হচ্ছে, ‘হে ইন্দ্র ! ......... ত্বষ্টা তোমার দীপ্তিমান বজ্র নির্মাণ করেছেন’ (৫/৩১/৪)। কিংবা ‘শোভনকর্মা ত্বষ্টা যে সুনির্মিত, হিরণ্ময় ও অনেক ধারাযুক্ত বজ্র ইন্দ্রকে দিয়েছিলেন, ইন্দ্র সে বজ্র সংগ্রামে কার্যসাধন করবার জন্য ধারণ করে বৃত্রবধ করেছিলেন এবং বারিরাশি বর্ষিত করেছিলেন’ (১/৮৫/৯)। ঋগ্বেদে বহু মন্ত্রে আমরা ত্বষ্টার স্তুতি পাই। ত্বষ্টা বৈদিক যুদ্ধের পূর্বে সমাজে অত্যন্ত শক্তিশালী দেবতা না হলে ঋষি ঋকে এ কথা বলতেন না, ‘হে স্তোতা ! ত্বষ্টার ন্যায় ইন্দ্রের স্তুতি প্রদীপ্ত কর’ (৩/৩৮/১)। কিংবা ১/১৩/১০ ঋকে বলা হচ্ছে, ‘শ্রেষ্ঠ ও বহুবিধ রূপসম্পন্ন ত্বষ্টাকে এ যজ্ঞে আহ্বান করছি; তিনি কেবল আমাদের পক্ষেই থাকুন।’
অর্থাৎ এই সব ঋক দ্বারা আমরা আর্য সমাজের অভ্যন্তরীণ ধর্মীয় ভাঙ্গন ও পরিবর্তনের চিত্র পাচ্ছি। আর এই ধর্মীয় ভাঙ্গন ও পরিবর্তন হল সমাজের ভাঙ্গন ও পরিবর্তনেরই প্রতিফলন মাত্র যে কারণে এক কালের ক্ষমতাবান দেবতা ত্বষ্টাকে ঋষি স্বপক্ষে থাকবার জন্য আবেদন জানাচ্ছেন।
বৈদিক আর্যরা যদি বহিরাগত হত তবে বিদেশের মাটিতে যুদ্ধরত অবস্থায় এই ধরনের সামাজিক ভাঙ্গন ও পরিবর্তন ঘটা অসম্ভব হত। বৈদিক ঋষিরা যখন ঋগ্বেদের মন্ত্রসমূহ রচনা করছেন তখন তাদের প্রতিপক্ষ এমন এক প্রবল শক্তি ঋগ্বেদের বর্ণনা অনুযায়ীই যাদের আছে বহু সংখ্যক দুর্ভেদ্য নগর এবং বিশাল সেনাবাহিনী। কাজেই এই অবস্থায় বৈদিক আর্যদের মধ্যে সামাজিক আন্দোলন ও বিক্ষোভ ঘটা মানে বৈদিক শক্তির সম্পূর্ণ ধ্বংস হয়ে যাওয়া। অন্যদিকে এই যুদ্ধের অবস্থায় বিদেশী এবং বিজাতীয় শত্রুর ধর্মের সঙ্গে লেনদেন কিংবা সমন্বয়ের প্রশ্নও ওঠে না। এই মন্ত্রগুলি যাঁরা রচনা করছেন তাঁদের অনেকের নাম এবং তাঁদের রচিত মন্ত্রগুলি বলে দেয় যে, তাঁরা যুদ্ধকালীন সময়ের ঋষি। যেমন ৪/৩০/৯,১০,১১ ঋকগুলিতে ইন্দ্র-ঊষার সংঘাতের বর্ণনা দিয়েছেন যে ঋষি তিনি হলেন বামদেব এবং ৩/৪৮/৪ ঋকে ইন্দ্র-ত্বষ্টার দ্বন্দ্বের বিবরণ দিয়েছেন যে ঋষি তিনি হলেন বৈদিক যুদ্ধের এক বিখ্যাত ঋষি বিশ্বামিত্র। এঁরা উভয়েই বৈদিক যুদ্ধকালীন বহু সূক্তের রচয়িতা।
সুতরাং বৈদিক আর্যদের বহিরাগত বলতে হলে দেবতাদের মধ্যকার এইসব সংঘাতকে সপ্তসিন্ধু এলাকায় প্রবেশের অনেক পূর্বে দূর অতীতে তারা যখন মধ্য এশিয়া বা ইউরোপে তাদের তথাকথিত আদি বাসস্থানে ছিল সেই সময়কার সমাজজীবনের স্মৃতি হিসাবে ব্যাখ্যা দেবার চেষ্টা করতে হয়। কিন্তু সেখানে প্রশ্ন আসবে বিপাশা নদীর তীরে ঊষার বিরুদ্ধে ইন্দ্রের যুদ্ধের (৪/৩০/১১) কি ব্যাখ্যা তবে হবে ? কিংবা এই প্রশ্ন দেখা দিবে আর্যরা যদি তাদের ‘আদি বাসভূমির’ ধর্মীয় জীবনের স্মৃতিই মনে রাখবে তবে সমগ্র ঋগ্বেদ জুড়ে সপ্তসিন্ধু এবং তার পার্শ্ববর্তী স্থানসমূহ ছাড়া ঋগ্বেদের কোথায়ও সেই ‘আদি বাসভূমির’ উল্লেখ বা চিহ্ন মাত্র কেন নেই ?


পাতা: ৩২


এর সহজ উত্তর হল আর্য বা যে নামই দেওয়া যাক বৈদিক শক্তির আদি বাসভূমি হল সপ্তসিন্ধু এবং তার সংলগ্ন অঞ্চলসমূহ। এই কারণে সপ্তসিন্ধু বৈদিক ঋষিদের স্মৃতিকে এভাবে অধিকার করে থেকেছে এবং বহু পণ্ডিত কল্পিত তাদের ভিন্ন আদি বাসভূমির চিহ্নমাত্র ঋগ্বেদে খুঁজে পাওয়া যায় না। অবশ্য কাবুল নদী বা গঙ্গা ইত্যাদি নদীর নামোল্লেখ দ্বারা বহু বিস্তৃত এলাকায় একটি সমাজের অবস্থান বা বসবাস কিংবা যোগাযোগের ধারণা পেতে পারি। কিন্তু সপ্তসিন্ধু তথা মূলত আজকের পাকিস্তান ও ভারতের পাঞ্জাব, সিন্ধু, রাজস্থানের পশ্চিমাংশ, হরিয়ানা, উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ ইত্যাদি নিয়ে গঠিত উপ-মহাদেশের এক বিশাল বিস্তৃত ভূভাগ যে ঋগ্বেদের মূল ভিত্তিভূমি এটা বুঝতে অসুবিধা হয় না।
ঋগ্বেদে বর্ণিত যুদ্ধ যে গৃহযুদ্ধ মাত্র তা স্পষ্টতর করার জন্য আমরা পণিদের প্রসঙ্গে খুব সংক্ষেপে আলোচনা করতে পারি। পণিদেরকে ইন্দ্র বা দেবতাদের শত্রু বলা হয়েছে। ১/১৮২/৩ ঋকে অশ্বিদ্বয় দেবতাদের উদ্দেশ্যে অগস্ত্য ঋষি বলছেন, ‘হে অশ্বিদ্বয় ! এখানে কি করছ ? এখানে কেন আছ ? হব্যশূন্য যে কোন ব্যক্তি পূজনীয় হয়েছে তাকে পরাভব কর। পণির প্রাণ বিনাশ কর। আমি মেধাবী ও তোমার স্তুতি অভিলাষী, আমাকে জ্যোতি প্রদান কর ।’ এর পরের ঋক পড়লে এই আকুল ও ব্যগ্র আবেদনের কারণ বোঝা যায়। ১/১৮২/৪ ঋকে ঋষি বলছেন, ‘হে অশ্বিদ্বয় ! জঘন্য শব্দ করে কুকুরের ন্যায় যারা আমাদের বিনাশ করতে আসছে, তাদের বিনাশ কর। তারা সংগ্রাম করতে চায়, তাদের মেরে ফেল। তাদের মারবার উপায় তোমরা জান। তোমাদের যারা স্তুতি করে তাদের প্রত্যেক কথা রত্নবতী কর। হে নাসত্যদ্বয় ! তোমরা উভয়ে আমার স্তুতি রক্ষা কর।’
কিংবা ৭/৬/৩ ঋক উল্লেখ করা যায় যেখানে বৈশ্বানর অগ্নি দেবতার উদ্দেশ্যে ঋষি প্রার্থনা জানাচ্ছেন, ‘অগ্নি যজ্ঞরহিত, জল্পক, হিংসিতবাক, শ্রদ্ধারহিত, বৃদ্ধিশূন্য পণি নামক যজ্ঞহীন সে দস্যুদের বিদূরিত করুন, তিনি প্রধান হয়ে অপর যজ্ঞরহিতগণকে হেয় করুন।’ অর্থাৎ বোঝা যায় যে, পণিরা ঋষিদের নিকট ঘৃণিত ও শক্তিশালী শত্রু। ১/১৫১/৯, ৩/৫৮/২, ৪/২৫/৭, ৪/৫১/৩, ৬/১৭/৩, ৬/৫১/১৪, ৮/২৬/১০, ৮/৭৫/৭ ইত্যাদি বহু সংখ্যক ঋকে আমরা পণিদের বিরুদ্ধে ঘৃণা ও আক্রোশ কিংবা দেবতাদের নিকট সাহায্যের আবেদন দেখতে পাই ।
এ ছাড়া বহু সংখ্যক ঋক আছে যেগুলিতে পণিদের পরাজয় ও লাঞ্ছনার বর্ণনা আছে। যেমন, ‘অঙ্গিরা নামক আমাদের পিতৃগণ মন্ত্র দ্বারা অগ্নির স্তুতি করে বলবান ও দৃঢ়াঙ্গ পণি (নামক অসুরকে) স্তুতি শব্দ দ্বারাই বিনাশ করেছিলেন এবং আমাদের নিমিত্ত মহৎ দ্যুলোকের পথ করেছিলেন’ (১/৭১/২)। ‘তিনি (সরস্বতী দেবী) নিয়ত কেবল আত্মচিন্তনকারী দানবিমুখ পণি সংহার করেছেন’ (৬/৬১/১); ইত্যাদি।


পাতা: ৩৩


অথচ এই পণি সম্পর্কেই ৭/১৯/৯ ঋকে ঋষি বসিষ্ঠ ইন্দ্রের উদ্দেশ্যে বলছেন, ‘হে ধনবান ! তোমার যজ্ঞে আমরাই নেতা ও উকথোচ্চারণকারী, অদ্য উকথ উচ্চারণ করছি ও তোমার হব্য দ্বারা পণিগণকেও ধন দান করছি। আমাদের সখারূপে গ্রহণ কর।’
এ কথা যিনি বলছেন তিনি সাধারণ কোন ঋষি নন, ঋগ্বেদের একজন সুবিখ্যাত ও বিশিষ্ট ঋষি। এবং এই মন্ত্র যখন তিনি রচনা করছেন তার পূর্বে যে অনেক শত্রুর পরাজয় বা ধ্বংস হয়েছে তা বোঝা যায় সূক্তটি পড়লে। কারণ একই সূক্তের কয়েক ঋক পূর্বে ৭/১৯/৪ ঋকে ঋষি বলছেন, ‘হে নেতৃদের স্তুতিযোগ্য ইন্দ্র ! তুমি সংগ্রামে মরুৎগণের সঙ্গে বহুবৃত্রগণকে বধ করেছ। হে হরিৎযুক্ত ! তুমি দভীতির জন্য দস্যু, চুমুরি ও ধুনিকে বজ্রের দ্বারা বধ করেছ।’

কিংবা ধরা যাক পণিদের নেতৃস্থানীয় এক ব্যক্তি বৃবু সম্পর্কে ৬ মণ্ডল, ৪৫ সূক্তের ৩১, ৩২ ও ৩৩ ঋকে যা বলা হয়েছে তার কথা। বৃহস্পতির অপত্য শংযু ঋষি বলছেন, ‘৩১। গঙ্গার উন্নত কূলের ন্যায় পণিগণের মধ্যে উচ্চস্থানে বৃবু অধিষ্ঠান করেছিলেন। ৩২। আমি ধনার্থী; যিনি আমাকে বায়ুবেগে বদান্যতাপূর্বক সহস্র সংখ্যক ধেনু সত্বর প্রদান করেছেন। ৩৩। আমরা সকলে স্তব করে সহস্র ধেনু প্রদানকারী প্রাজ্ঞ ও সহস্র স্তোত্রভাজন সে বৃবুর নিরন্তর প্রশংসা করছি।’
এখানে আমরা গঙ্গা নদীর নাম পাচ্ছি ঋষি যার উন্নত কূলের সঙ্গে পণি বৃবুর সামাজিক মর্যাদার তুলনা দিচ্ছেন। অর্থাৎ সপ্তসিন্ধু অঞ্চলের ঋষিরা গঙ্গা সম্পর্কে ভালভাবেই জ্ঞাত ছিলেন। আমরা ঋষির উচ্ছ্বাসের কারণও বুঝতে পারছি। কারণ এক হাজার গরু দান স্বরূপ পাওয়া কম কথা নয় !
কিন্তু এখানে আমরা এই প্রশ্নের সম্মুখীন হই যে, সব পণি যদি শত্রু হবে তবে পণিগণের মধ্যে উচ্চস্থানে অধিষ্ঠিত বৃবুর কাছ থেকে দান নিতে হবে কেন? শত্রুর ধন-সম্পদ লাভ বা লুণ্ঠনের বহু বর্ণনা এবং প্রার্থনাই তো আমরা ঋগ্বেদে পাই। এই একই ঋষি অর্থাৎ বৃহস্পতির অপত্য শংযু ঋষি ঐ একই সূক্তে অর্থাৎ ৬ মণ্ডলের ৪৫ সূক্তে শত্রুর বিরুদ্ধে জয় ও শত্রু-সম্পদ লাভের উদ্দেশ্যে ইন্দ্রের নিকট প্রার্থনা করে ১২ ঋকে বলছেন, ‘হে ইন্দ্র ! তুমি আমাদের স্তোত্র শ্রবণে প্রসন্ন হলে তোমার অনুগ্রহে যেন আমরা অশ্বগণদ্বারা শত্রুগণের অশ্বসমূহ, উৎকৃষ্ট অন্ন ও গূঢ়ধন জয় করতে সমর্থ হই।’

_________________________________________________________________________________
দভীতি একজন বৈদিক রাজা।
গুপ্তধন।
_________________________________________________________________________________

পাতা: ৩৪


কাজেই এই ধরনের ঘটনার ব্যাখ্যা এটাই হতে পারে যে , পণিগণের বৃহৎ অংশ শত্রু হলেও তাদের একটা অংশ প্রথম থেকে বৈদিক শক্তির পক্ষে ছিল কিংবা তা না থাকলেও যুদ্ধের একটা পর্যায়ে পণিগণের একাংশ বৈদিক শক্তিকে সমর্থন দিয়েছিল।
পণিদের উপর আলোচনা প্রসঙ্গে তাদের পরিচয় সম্পর্কে প্রশ্ন আসাটা স্বাভাবিক। অনেক পণ্ডিত মনে করেন যে, বণিকদেরকে পণি বলা হয়েছে। অর্থাৎ তাঁদের মতে পণিরা ছিল ব্যবসায়ী । তবে তারা যে সপ্তসিন্ধু অঞ্চলে একটি প্রভাবশালী, ধনাঢ্য এবং শক্তিশালী সামাজিক শ্রেণী বা গোষ্ঠী ছিল তা অনুমান করা চলে।
বস্তুত ঋগ্বেদ আমাদের সামনে এক প্রাচীন সভ্য সমাজের অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বের চিত্র পরিস্ফুট করে। সমাজের দ্বন্দ্ব ও সংকট নিরসনের জন্য সমাজের এক বৃহৎ অংশ দ্বারা যে সামাজিক আন্দোলন গড়ে উঠেছে তার মধ্য দিয়ে ঋগ্বেদ রচিত হয়েছে আর সব ধর্মগ্রন্থের মত। আমরা যদি অন্যান্য ধর্মের উদ্ভব প্রক্রিয়ার দিকে দৃষ্টি দিই তবে আমরা সহজেই ঋগ্বেদকে চিনতে পারব একটি ধর্মীয় আন্দোলনের দলিল হিসাবে যার লক্ষ্য অন্য সকল ধর্মের মত পুরাতন সমাজের সংস্কার বা পরিবর্তন সাধন করা। সুতরাং আমরা এখন সেই বিষয়টি আলোচনা করব।

_________________________________________________________________________________
ঋগ্বেদ সংহিতার (প্রথম খণ্ড) টীকায় বলা হচ্ছে : সায়ণ এখানে পণি শব্দের অর্থ বণিক, লুব্ধক, অঘষ্টা করেছেন। পৃ: ৩২৪
_________________________________________________________________________________

পাতা: ৩৫


সাম্প্রতিক পোষ্টসমূহ