লিখেছেনঃ শামসুজ্জোহা মানিক এবং শামসুল আলম চঞ্চল, আপডেটঃ September 28, 2012, 10:00 AM, Hits: 2738
ঋগ্বেদে ইন্দ্রকে বহুগুণে ভূষিত করা হয়েছে। তবে ঋগ্বেদের ঋষিরা অগ্নি, বরুণ প্রভৃতি দেবতা সম্পর্কেও স্তুতিতে অনেক সময় এমনভাবে গুণ আরোপ করেন যে, তখন মনে হয় যেন সেই দেবতাই সর্বশ্রেষ্ঠ কিংবা তিনি একেশ্বর এবং বিভিন্ন দেবতা তাঁরই বিভিন্ন নামকরণ মাত্র। ঋগ্বেদে শক্তির যে কোনও প্রকাশের উপর সাধারণত দেবত্ব আরোপ করা হয়েছে। ফলে সব শক্তির মধ্যে একটা ঐক্য বা ছন্দ দেখতে পেয়ে ঋষিগণ অনেক সময় কম বা বেশী একেশ্বরবাদী প্রবণতা দ্বারা প্রভাবিত হয়েছেন। তবে এই একেশ্বরবাদী প্রবণতাও অধিকাংশ সময় ইন্দ্রকে অবলম্বন করে মূর্ত হয়েছে।
ঋষিদের কাছে ইন্দ্র শক্তি এবং বিজয়ের প্রতীক। ঋগ্বেদের ঋষি বলছেন, ‘হে ইন্দ্র! তুমি শক্তিমান, বীর ও শত্রু নিহন্তা বলে আমরা তোমার স্তব করি’ (৬/৩৫/৫)। ‘হে পূজনীয় উগ্র ইন্দ্র! ....... তুমি সমস্ত ভুবনের একমাত্র রাজা, তুমি শত্রুদের প্রহার কর ও সাধু ব্যক্তিদের স্বস্থানে স্থাপিত কর’ (৩/৪৬/২)। ‘ইন্দ্রের বজ্র অয়োনির্মিত এবং তাঁর হস্তে সম্বন্ধ, তাঁর হস্তে বহুতর বল আছে। যুদ্ধগমনকালে ইন্দ্রের মস্তকে শিরস্ত্রাণ থাকে, তাঁর আজ্ঞা শ্রবণার্থে সকলে তাঁর সমীপে আগমন করে’ (৮/৯৬/৩)।
অর্থাৎ ইন্দ্রকে কল্পনা করা হয়েছে সর্বদা বিজয়ী ও অপরাজেয় এক সেনাপতি রূপে। হয়ত বহু প্রাচীন কালের কোন বিজয়ী উপজাতিনেতা বা সেনাপতির নামে এই দেবতার নামকরণ হয়েছে। কারণ ঋগ্বেদে তাঁর প্রাচীন ঐতিহ্যের কথা অনেকবার বলা হয়েছে। ৩/৫২/৪ ঋকে বলা হচ্ছে, ‘হে প্রাচীন কাল হতে প্রসিদ্ধ ইন্দ্র!’ ৬/৩৮/৩ ঋকে ইন্দ্রকে বলা হচ্ছে, ‘তুমি প্রাচীন ও ক্ষয়রহিত, আমি উৎকৃষ্টতম স্তুতি ও হব্য দ্বারা তোমার স্তব করছি।’
সুতরাং প্রাচীন এক যুদ্ধ দেবতা ঋগ্বেদের গৃহযুদ্ধের কালে এসে নূতন গুরুত্ব ও তাৎপর্য নিয়ে দেখা দিয়েছে বলে মনে হয়। তবে ঋগ্বেদ থেকে এটা অনুমান করা চলে যে, পুরাতন ধর্মে ইন্দ্রের গুরুত্ব থাকলেও তা ছিল তুলনায় অনেক কম। সম্ভবত তার অধিকতর গুরুত্ব ছিল কোন অঞ্চলের আঞ্চলিক দেবতা হিসাবে। অর্থাৎ গৃহযুদ্ধের প্রয়োজনে ইন্দ্রের উত্তরণ ঘটানো হয়েছে। ঋগ্বেদে ইন্দ্র অনেক নগর বিদারণকারী কিংবা ধ্বংসকারী এবং শত্রুহন্তা। কিন্তু তার সর্বশ্রেষ্ঠ কীর্তি হল বৃত্রবধ। আমরা ঋগ্বেদে বৃত্রহা বা বৃত্রহন্তা কিংবা বৃত্রবিনাশী হিসাবে ইন্দ্রের বহু বহুবার উল্লেখ পাই এবং দেখতে পাই যে, এই কীর্তির জন্য ঋগ্বেদের ঋষিরা ইন্দ্রের প্রশংসায় ও স্তুতিতে উচ্ছ্বসিত। এবং একটু লক্ষ্য করলেই আমরা দেখতে পাব যে, বৃত্রবধের সঙ্গে নদীর জলরাশি বা জলস্রোত মুক্তির গভীর সম্পর্ক আছে। যেহেতু বৃত্রবধ ইন্দ্রের সর্বশ্রেষ্ঠ কীর্তি হিসাবে আমাদের কাছে ধরা পড়েছে সেহেতু আমরা প্রধানত এই বিষয়টিকে অবলম্বন করে ঋগ্বেদের রহস্য উন্মোচনের চেষ্টা করব।
পাতা: ১০৭
তবে এই আলোচনায় যাবার পূর্বে ঋগ্বেদের বিভিন্ন শব্দের অর্থ ও ব্যবহার সম্পর্কে কিছু আলোচনা করে নিলে ভাল হয়। এটা মনে রাখা দরকার যে, কয়েক সহস্র বৎসরে ঋগ্বেদের ভাষার সামগ্রিক অর্থ ঠিক থাকলেও তার অনেক শব্দের অর্থ পরিবর্তিত হতে পারে এমন কি কিছু শব্দের প্রকৃত বা আদি অর্থ হারিয়েও যেতে পারে। এই ধারণা নিয়ে পাঠ করলে অনর্থক গোলকধাঁধায় ঘুরতে হয় না। যেমন অনেক সময় অয়স নির্মিত বা আয়স পুর বা নগর (৭/৩/৭), কলস (৫/৩০/১৫) এবং বজ্রের (৮/৯৬/৩) উল্লেখ করা হয়েছে। এখন অয়সের অর্থ লৌহ ধরা হয়। সেক্ষেত্রে নগর, কলস, বজ্র ইত্যাদি সবগুলিকেই লৌহ নির্মিত বলতে হয়। অর্থাৎ অয়স অর্থ লৌহ করলে গোটা ব্যাপারটা অর্থহীন হয়ে দেখা দেয়। কারণ বজ্র বা বিশেষ ধরনের যুদ্ধাস্ত্র লৌহ নির্মিত হলেও নগর লৌহ নির্মিত হতে পারে না এবং উজ্জ্বল কলসও (৫/৩০/১৫) লৌহ নির্মিত হবার কারণ
নেই।
ঋগ্বেদে ইষ্টক বা ইট শব্দের ব্যবহার না থাকায় অনেক পণ্ডিত ধারণা করেছেন বৈদিক আর্যরা পাকা বাড়ী বা গৃহ তৈরী করতে যেমন জানত না তেমন নগরবাসীও ছিল না। কিন্তু অয়স শব্দ দ্বারা যে ইটকেও বোঝানো হতে পারে এমন সম্ভাবনা মাথায় নিলে অনেক বিভ্রান্তিই দূর হয়। এটা বিস্ময়কর যে, ইন্দ্রের বজ্রকে অয়োময় বা অয়সনির্মিত বলা হয়েছে। কিন্তু কখনও তাম্র বা ব্রোঞ্জ নির্মিত বলা হয় নি। এমনকি দধীচি বা দধীচের অস্থি দ্বারা অস্ত্র (১/৮৪/১৩) নির্মাণের উল্লেখও আছে। কিন্তু তাম্র অস্ত্র বা বজ্রের উল্লেখ নেই। এটা স্বাভাবিক যে, নূতন উপাদান আবিষ্কার বা ব্যবহার হলেও পুরাতন উপাদানও পাশাপাশি দীর্ঘকাল টিকে থাকে। কাজেই তাম্র যুগে যেমন প্রস্তরের হাতিয়ার ছিল তেমন লৌহ যুগে তাম্র ও ব্রোঞ্জের হাতিয়ারও নিশ্চয় দীর্ঘকাল পাশাপাশি ছিল। সুতরাং অয়স শব্দের অর্থ অগ্নি দ্বারা রূপান্তরিত যে কোন কঠিন পদার্থ এবং ধাতু হতে পারে এমনটা ধরে নিয়ে অগ্রসর হলে অনেক কিছুর সহজ ব্যাখ্যা পাওয়া যেতে পারে। সুতরাং এটা বোধগম্য যে, পাষাণ নির্মিত নগরের কথা (৪/৩০/২০) যখন ঋষিরা বলেছেন তখন সেটা যেমন প্রস্তর নির্মিত বুঝিয়েছেন যা স্বাভাবিক এবং বাস্তব সম্মত তেমন যখন অয়স নির্মিত নগরের কথা বলেছেন তখন তাঁরা পোড়া ইট নির্মিত নগরের কথা বুঝিয়েছেন। একইভাবে যখন অয়স নির্মিত উজ্জ্বল কলসের কথা বলা হয়েছে তখন তার অর্থ লৌহ নির্মিত না করে তাম্র বা ব্রোঞ্জ নির্মিত করাই যুক্তিযুক্ত।
এই প্রসঙ্গে আর একটি বিষয় আমাদের বিবেচনা করা দরকার। সিন্ধু সভ্যতার কালে এমন কি খ্রীষ্টপূর্ব পনেরো বা ষোল শতাব্দীতেও ভারতবর্ষে লোহার ব্যবহার প্রচলিত হয় নি। সুতরাং ঋগ্বেদ রচনা কালে অয়স অর্থ যে লৌহ ছিল না এটা স্পষ্ট। পরবর্তীকালে এই শব্দের অর্থ পরিবর্তন হয়েছে এবং তার অর্থ লৌহ করা হয়েছে।
এখন ধরা যাক পর্বত বা গিরি শব্দটিকে। ঋগ্বেদে আমরা বহুবার এই শব্দের উল্লেখ পাই।১ যেমন ৪/১৭/৩ ঋকে পাচ্ছি: ‘শত্রুদের অভিভবকর ইন্দ্র তেজ ও বজ্র২ প্রেরণ করে পর্বতসমূহকে বিদীর্ণ করেছিলেন।’ ২/১৫/৮ ঋকে বলা হচ্ছে: ‘অঙ্গিরাগণ স্তব করলে ইন্দ্র বলকে বিদীর্ণ করেছিলেন। পর্বতের দৃঢ়ীকৃত দ্বার উদ্ঘাটিত করেছিলেন। এদের কৃত্রিম রোধ সকলও উদ্ঘাটিত করেছিলেন।’
_________________________________________________________________________________
১ ঋগ্বেদের যে বাংলা অনুবাদ গ্রন্থের উদ্ধৃতিগুলি আমরা দিয়েছি সেখানে পর্বত শব্দই সাধারণত ব্যবহার করা হয়েছে। পর্বত এবং গিরি উভয়ের অর্থ এক। আবার বাংলা মেঘ শব্দ অর্থেও ঋগ্বেদের এই দুই শব্দের অনুবাদ হয়েছে।
২ সঙ্গতরূপে বোঝা যায় যে, তেজ বলতে আগুন এবং বজ্র বলতে সশস্ত্র বাহিনীর ব্যবহার বোঝানো হচ্ছে।
_________________________________________________________________________________
পাতা: ১০৮
এখন আমরা যদি পর্বত বলতে শুধু বর্তমান অর্থে পর্বত মনে করি তবে এইসব ঋকের কোন অর্থ খুঁজে না পেয়ে গোলকধাঁধায় ঘুরব। রূপকার্থেও অনেক শব্দের ব্যবহার হয়েছে এটা ধরে নিলে অনেক শব্দের তাৎপর্য বোঝা সম্ভব হবে এবং তখন এটাও স্পষ্ট হবে কেন এইসব রূপকের ব্যবহার।
যাইহোক, এখন পর্বত বলতে উঁচু প্রাচীর বা বাঁধ জাতীয় কিছু বোঝানো হয়েছে এটা ধরলে অনেক বাক্যের অর্থ স্পষ্ট হবে। তাহলে পর্বতের ‘দৃঢ়ীকৃত দ্বার’ এবং ‘কৃত্রিম রোধসকল’-এর অর্থও স্পষ্ট হয়।
এইভাবে আমরা দেখতে পাব মেঘ শব্দের ব্যবহার : ‘হে ইন্দ্র! তুমি মেঘকে বিদীর্ণ করে জলনির্গম মার্গ উন্মুক্ত করেছ’ (৫/৩২/১)। ইন্দ্রের বজ্র আর আকাশের বজ্র যেমন সর্বদা এক বস্তু নয় তেমন এই মেঘ আর আকাশের মেঘও সর্বদা এক বস্তু নয়। বস্তুত এখানে মেঘকে নদী বা জলাধারের বাঁধ অথবা জলাধার হিসাবে বিবেচনা করলে এইসব ঋকের ভিতর থেকে এক বিশাল ঐতিহাসিক ঘটনার প্রেক্ষিত উঁকি দেয়।
অর্থাৎ বেদ পাঠের সময় আমাদের মনকে রাখতে হবে সদাসতর্ক, সমালোচনামূলক এবং সংস্কারমুক্ত। প্রচলিত অর্থ বা ধারণার কাঠামোয় আবদ্ধ না থেকে দুর্বোধ্য বিষয় বা শব্দগুলির বিভিন্ন বাস্তবভিত্তিক অর্থ করার চেষ্টা করতে হবে। তাহলে দেখা যাবে আমরা বহু রহস্য ভেদ করতে পারছি। যেমন ধরা যাক সোমলতা ও সোমরসের কথা।
সোম ঋগ্বেদে এক অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ স্থান অধিকার করে আছে। সোমলতা থেকে সোমরস হয়। দেবতাদের পূজায় সোমরস তাদের উদ্দেশ্যে অগ্নিতে আহুতি দেওয়া হত। বিশেষত ইন্দ্রের জন্য সোমাভিষব বৈদিক ধর্মানুষ্ঠানের একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ। এটিকে ইন্দ্রের খুবই প্রিয় পানীয় বলা হয়েছে। অর্থাৎ বোঝাই যায় যে এটি ঋষিদের এবং বৈদিক জনের অত্যন্ত প্রিয় ছিল। সোমলতার সুমিষ্ট রস যেমন পানীয় হিসাবে ব্যবহৃত হত তেমন তা দুধ, দধি ও ক্ষীরে দেওয়া হত মিষ্টতার জন্য। সোমরস মদ হিসাবেও ব্যবহার করা হত। সোম কতখানি জনপ্রিয় ছিল তা বোঝা যায় যখন দেখা যায় যে, বিভিন্ন্ মণ্ডলে সোমের উপর সূক্ত থাকলেও এবং বিভিন্ন দেবতা বিশেষত ইন্দ্রের স্তুতির সময় বারংবার সোমের উল্লেখ থাকলেও ঋগ্বেদের নবম মণ্ডল গঠিত হয়েছে পবমান সোম দেবতা নামে সোমের স্তুতিতে রচিত সূক্তসমূহ দ্বারা। অর্থাৎ এই প্রিয় আহার্য-উদ্ভিদের উপর দেবত্ব আরোপ করা হয়েছিল।
স্বাভাবিকভাবে যে কোন ঋগ্বেদ পাঠকের মনে সোমলতা সম্পর্কে কৌতূহল জাগবে। অথচ বলা হয় যে, বহুকাল আগেই সোমলতা বিলুপ্ত হয়েছে। সোমলতা কি ছিল তা নিয়ে পণ্ডিতদের মধ্যে বহুকাল ধরে বহু বিতর্ক এবং জল্পনাকল্পনা চলে আসছে।
সোম যে বহুদূর দেশে বা এক বিস্তীর্ণ অঞ্চলে বিদ্যমান এবং ব্যাপক জনপ্রিয় ছিল
পাতা: ১০৯
ঋগ্বেদ সে কথা জানায় : ‘যে সকল সোমরস অতি দূর দেশে, কিংবা অতি সন্নিহিত দেশে প্রস্তুত হয়েছে কিংবা যে সকল সোম শর্ষণাবৎ নামক সরোবরে প্রস্তুত হয়েছে (৯/৬৫/২২)। কিংবা যে সকল সোম আর্জীকদেশে কিংবা কৃত্বদেশে কিংবা সরস্বতী প্রভৃতি নদীর মধ্যে কিংবা পঞ্চজনের মধ্যে প্রস্তুত হয়েছে’ (৯/৬৫/২৩)।
এখন প্রশ্ন জাগা উচিত যে, এত জনপ্রিয় বস্তু যা সপ্তসিন্ধুর বিশাল অঞ্চলে পূজায় ও আহারে ব্যবহার হত তা কিভাবে বিলুপ্ত হতে পারে? এটা অসম্ভব নয় কি? বরং এমন চিন্তাই আমাদের মনে আসা উচিত যে, নিশ্চয় এই অতি উপাদেয় ও সুমিষ্ট (এবং মাদক রসের উৎসও) লতাটি মানুষের দ্বারা ব্যবহৃত ও রক্ষিত হয়ে আজ পর্যন্ত আছে আমাদের অতি পরিচিত ও প্রিয় এক খাদ্যের উৎস হয়ে, কিন্তু যার অতীত নামটি হারিয়ে গেছে।
সুতরাং লতা অর্থে গাছে পেঁচিয়ে ওঠে এমন উদ্ভিদের ধারণা না করে এটি দুর্বল বা শীর্ণ কাণ্ডবিশিষ্ট কোন উদ্ভিদ হতে পারে এমনভাবে চিন্তা করলে ক্ষতি কি? আর তৎক্ষণাৎ যে চিন্তা মনে উঁকি দেয় তা হল সোমলতা এবং ইক্ষু বা আখ গাছ এক উদ্ভিদ হওয়া সম্ভব।
এই সম্ভাবনার চিন্তা মাথায় নিয়ে ঋগ্বেদের যত ভিতরে যাওয়া যায় তত এই ধারণা দৃঢ় হতে থাকে। ‘অত্যন্ত মধুর রস বিশিষ্ট সোম’ (৩/৫৮/৯), ‘এর তুল্য সুস্বাদু বস্তু আর কিছুই নেই, এর রস অতি চমৎকার’ (৯/৭৮/৪), ‘হে সোম! তোমার তুল্য মধুর বস্তু কিছুই নেই’ (৯/৬৭/১৬), কিংবা ‘হে অমৃততুল্য সোম!’ (৯/১১০/৪) এই কথাগুলি ইক্ষু বা ইক্ষুরস সম্পর্কেও প্রযোজ্য। প্রস্তর দ্বারা নিষ্পেষণ করে সোমলতা থেকে রস সংগ্রহ করা হত। এ সম্পর্কে ১ মণ্ডলের ২৮ সূক্ত বা ৯ মণ্ডলের ৬৬ সূক্ত ইত্যাদি সূক্তে বর্ণনা আছে। বিশেষত ৯ মণ্ডলের ৬৬ সূক্তে সোমলতা নিষ্পেষণ থেকে সোমরস সংগ্রহ ও শোধন পর্যন্ত সমগ্র প্রক্রিয়ার বর্ণনা আছে।
সোমরসের রঙ সম্পর্কে বলা হচ্ছে, ‘এর ধারা হরিৎবর্ণ’ (৯/৬৬/২৬), আবার কখনও বলা হচ্ছে , ‘শুভ্রবর্ণ সোমরসগুলি ক্ষরিত হতে হতে এবং নানাবিধ স্তুতিবাক্য গ্রহণ করতে করতে উৎপাদিত হলেন’ (৯/৬৩/২৫), কিংবা ‘লোহিতবর্ণ সোমরসকে নিষ্পীড়নের দ্বারা প্রস্তুত করা হল’ (৯/৮২/১), ইত্যাদি। এটা ঠিক যে, ইক্ষুরস হরিৎ বা পিঙ্গল কিংবা ঈষৎ লোহিতবর্ণের হয়। তবে রস ক্ষরণের সময় সাদা বা শুভ্র দেখায়। ঋগ্বেদে অধিকাংশ সময় সোমরসের বর্ণকে হরিৎ বলা হয়েছে।
সোমরসকে মাদকও বলা হচ্ছে। যেমন ‘তোমরা ইন্দ্রের উদ্দেশ্যে মদকর সোম প্রদান কর’ (২/১৪/৯), ‘হে ইন্দ্র! মদকর সোম সকল তোমায় মত্ত করুক’ (৭/২৩/৫), কিংবা ‘এ আসব মদকর ও চারু, এ মত্ততার জন্য সম্পন্ন হয়’ (৮/১/২৬); ইত্যাদি।
ইক্ষুরস থেকে প্রস্তুত গুড় দ্বারা সুরা বা মদ তৈরী হয়। কিন্তু ঋগ্বেদে মদ প্রস্তুত প্রণালী বলা না হলেও সোমরসকে যে মাদক বা মদকর করা হত তা বলা হয়েছে। হয়ত কাঁচা রস তাল বা খেজুর রসের মত কিছু সময় রেখে মাদক করে পান করা হত।
সোমলতার পত্রের বর্ণনাও ইক্ষুপত্রের সঙ্গে মিলে। ‘বিচিত্র কুশযুক্ত’ (১/২৩/১৩,১৪) সোমলতার মত ইক্ষুও বিচিত্র কুশসংযুক্ত। কুশ মানে তৃণ বা ঘাস। আসলে বাঁশের মতই
পাতা: ১১০
ইক্ষু বা আখ এক জাতীয় তৃণ। তাই এগুলির কুশ বা তৃণের মত পত্র। পত্রের বর্ণনা আরও আছে, ‘হে সোম! তোমার যে দুটি পত্র বক্রভাবে অবস্থিত ছিল তদ্বারা তোমার সর্বাপেক্ষা চমৎকার শোভা হয়েছিল’ (৯/৬৬/২) এবং ‘হে সোম! তোমার চতুর্দিকে লতা অবস্থায় যে সকল পত্র বিদ্যমান ছিল তদ্বারা তুমি সকল ঋতুতে সুশোভিত ছিলে’ (৯/৬৬/৩)। আখ গাছেরও দুই পাশে দুইটি করে লতার মত পাতা বক্রভাবে শোভিত হয় এবং আখ বর্ষজীবী।
ঋষি আরও বর্ণনা দিচ্ছেন, ‘এ সোম শৃঙ্গ কম্পিত করেন। এর শৃঙ্গ যূথপতি বৃষভের ন্যায় তীক্ষ্ম’ (৯/১৫/৪)। বৃষভ বা ষাঁড়ের তীক্ষ্ণাগ্র শৃঙ্গের সঙ্গে কেউ যদি দীর্ঘ, বক্র ও তীক্ষ্ণাগ্র ইক্ষুপত্রের মিল খুঁজে পান তবে তাঁকে বোধ হয় মাত্রা অতিক্রমের দোষ দেওয়া যাবে না। বিশেষত যখন বাতাসের দোলায় ইক্ষুপত্র দোলায়িত হয় তখন বৃষভের শৃঙ্গের আন্দোলনের সঙ্গে তার মিল খুঁজে পাওয়া যেতে পারে।
৯/১৫/৫ ঋকের ‘এ বেগবান শুভ্র লতাবিশিষ্ট সোম’ বর্ণনা দ্বারা ইক্ষুকাণ্ডকে চেনা যায়। মসৃণ এবং সরলের উপমা হিসাবে বেগবান ব্যবহার করা হয়েছে। ‘হরিদ্বর্ণ ও লতাতন্তুর আকারধারী সোম’কে (৯/৯২/১) সহজে চেনা যায়। ‘সুবর্ণময় পিঙ্গলবর্ণ’ এবং ‘সুন্দর অঙ্গুলিধারী সোম’ (৯/১০৭/২১) এই বর্ণনা দ্বারা সোনালী হরিৎ বর্ণের নিটোল, গোলাকার, লম্বা ও সরল যে উদ্ভিদকাণ্ডের চিত্র আমাদের চোখের সামনে ভেসে আসে তাকে ইক্ষুকাণ্ডরূপে চিনতে আর কষ্ট হবার কথা নয়।
কিন্তু এখানেই শেষ নয়। ইক্ষুকাণ্ড থেকে যেমন ইক্ষু বা আখ গাছ জন্মায় তেমন অবয়ব বা দেহকাণ্ড থেকে যে সোমলতা জন্মায় সে কথাও ঋগ্বেদে বলা হয়েছে, ‘হে সোম! তোমার প্রধান উৎপত্তিস্থান স্বর্গের মধ্যে বিদ্যমান আছে। সেখান থেকে গ্রহণপূর্বক পৃথিবীর উন্নত প্রদেশে তোমার অবয়বগুলি নিক্ষিপ্ত হয়েছিল, সে স্থানে তারা বৃক্ষরূপে জন্মিল।’ (৯/৭৯/৪)
সুতরাং আর উদাহরণের প্রয়োজন নেই। অর্থাৎ সোমলতা ইক্ষু বা আখ নামে আমাদের নিত্য দিনের অসংখ্য খাদ্যের মিষ্টতার সাধারণভাবে একমাত্র উৎস হয়ে বিদ্যমান আছে।১ কিন্তু তার সোম নামটির অর্থ বহুকাল পূর্বে হারিয়ে গিয়েছিল। এই অর্থ বিস্মৃতির কারণও নিশ্চয় আছে। সেটাও বোঝার চেষ্টা করা দরকার।
আমরা জানি যে, সোম শুধু সুমিষ্ট রস নয়, তা থেকে মদও হয়। বৈদিক আন্দোলনের পরবর্তীকালে যখন সমাজে মদ্যপান নিন্দনীয় কিংবা অবাঞ্ছিত হল তখন সোমরসের প্রচলিত
_________________________________________________________________________________
১ Bhagwan Singh-ও তাঁর ১৯৯৫-তে প্রকাশিত The Vedic Harappans-এ সোমকে ইক্ষু বলেছেন। আমরাও ১৯৯৫-তে প্রকাশিত আমাদের গ্রন্থ The Aryans and the Indus Civilization -এ সোম সম্পর্কে আমাদের এই সিদ্ধান্ত সংক্ষেপে তুলে ধরি। ভগবান সিংহের বক্তব্যের জন্য দেখুন : Bhagwan Singh, The Vedic Harapppans, (Aditya Parkashan, New Delhi, 1995), pp. 434-439. আমাদের বক্তব্যের জন্য দেখুন: Shamsuzzoha Manik and Shamsul Alam Chanchal, The Aryans and the Indus Civilization, (Dinratri Prakashani, 38/2 ka Banglabazar (2nd floor) Dhaka-1100, September 1995), pp. 160-161.
_________________________________________________________________________________
পাতা: ১১১
অর্থ রক্ষা করা বৈদিক ধর্মের জন্য ক্ষতিকর হয়ে দেখা দিল। হয় বহু প্রশংসিত মদকর সোম বা সুরা পানকে সমাজে অবাধ রাখতে হবে নয় এটাকে শুধু দেবতাদের অতীতের ব্যবহৃত পানীয় হিসাবে দেখাতে গিয়ে এর অর্থ বিলুপ্ত করতে হবে। এটা স্পষ্ট যে, সচেতন ও সংগঠিত প্রয়াস দ্বারা বৈদিক ঐতিহ্য ধারণকারী ব্রাহ্মণ শ্রেণী পরবর্তীকালে এই কাজ করেছিল এবং ক্রমে সোমরসের সঙ্গে অমৃত সম্পর্কিত পুরাণ কাহিনী বা মিথ জড়িত করে গোটা জিনিসটাকেই রহস্যের ভিতরে ঠেলে দিয়েছিল। বিশেষত বৈদিক অপৌত্তলিক বা নিরাকার দেবতাদের পূজা পদ্ধতির অবসানের সঙ্গে যখন তাদের জন্য অগ্নিতে সোমাভিষবের প্রয়োজন ফুরালো তখন সোমের অর্থ বিস্মৃত করা আরও সহজ হল।
আমাদের এ কথা বোঝা দরকার যে, ঋগ্বেদ অর্থহীন কাব্যচর্চা বা বিমূর্ত ও উদ্দেশ্যহীন এবং দুর্বোধ্য মন্ত্র রচনা ছিল না। এর সৃষ্টির পিছনে ছিল একটা বিশেষ সামাজিক শক্তির নেতৃত্ব ও নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার তাড়না বা তাগিদ যে তাড়না বা তাগিদ সমাজের মূর্ত পরিস্থিতির সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ ছিল। অপরদিকে পরবর্তীকালে এই গ্রন্থ হয়ে দাঁড়িয়েছিল ব্রাহ্মণ ও উচ্চবর্ণের শ্রেণীসমূহের সামাজিক নিয়ন্ত্রণ রক্ষার হাতিয়ার। সুতরাং শুধু কালের প্রভাবে যে অর্থ পরিবর্তন বা বিস্মরণ সম্ভব তাই নয় উপরন্তু ধর্মীয় শক্তির প্রয়োজনেও অনেক শব্দের অর্থ পরিবর্তন বা বিস্মরণ ঘটানো হতে পারে। উদ্দেশ্য, ঋগ্বেদের ঘটনার বৈষয়িক ও লৌকিক রূপকে অস্পষ্ট ও অদৃশ্য করে অতিকথা ও রহস্যের ধূম্রজালে জনমানসকে আবদ্ধ করা।
এখন আমরা ইন্দ্র ও বৃত্রকে ঘিরে ঋগ্বেদের যে রহস্যময়তা ও দুর্বোধ্যতা সেটিকে ভেদ করার চেষ্টা করব। বস্তুত ঋগ্বেদে বৃত্রকে ঘিরে অনেক রহস্যময়তা রয়েছে। আমরা পূর্বেই বলেছি যে, ইন্দ্রের সর্বশ্রেষ্ঠ কীর্তি হল বৃত্রসংহার। কয়েকটি ঋক থেকে আমরা এই বিষয়ে ধারণা পেতে চেষ্টা করব। প্রথমে ১ মণ্ডলের ৩৩ সূক্ত থেকে কয়েকটি ঋক উদ্ধৃত করা যাক : ‘৫। হে ইন্দ্র! সে যজ্ঞরহিত ও যজ্ঞানুষ্ঠাতাদের বিরোধীগণ মস্তক ফিরিয়ে পালিয়েছে। হে হর্ষশ্বসম্পন্ন, পলায়নরহিত উগ্র ইন্দ্র! তুমি দিব্যলোক হতে এবং আকাশ ও পৃথিবী হতে ব্রতরহিতদের উঠিয়ে দিয়েছ। ৬। তারা দোষরহিত (ইন্দ্রের) সেনার সাথে যুদ্ধ ইচ্ছা করেছিল; সচ্চরিত্র মনুষ্যেরা (ইন্দ্রকে) প্রোৎসাহিত করেছিল। পুরুষের সাথে যুদ্ধে লিপ্ত নপুংসকেরা যেরূপ পলায়ন করে, সেরূপ তারা নিরাকৃত হয়ে আপনাদের শক্তিহীনতা জেনে ইন্দ্রের নিকট হতে সহজ পথ দিয়ে দূরে পলায়ন করল। ৭। হে ইন্দ্র! তুমি সেই রোদনকারী বা হাস্যপরায়ণদের অন্তরীক্ষের প্রান্তে যুদ্ধ দান করেছ; দস্যুকে দিব্যলোক হতে এনে সম্পূর্ণরূপে দগ্ধ করেছ এবং সোমাভিষবকারী ও স্তুতিকারীর স্তুতি রক্ষা করেছ। ৮। সেই বৃত্রের অনুচরেরা পৃথিবী আচ্ছাদন করেছিল এবং হিরণ্য ও মণি দ্বারা শোভমান হয়েছিল। কিন্তু সেই শত্রুগণ ইন্দ্রকে জয় করতে পারল না, ইন্দ্র সে বাধকদের সূর্য দ্বারা তিরোহিত করলেন। ৯। হে ইন্দ্র! যেহেতু তুমি মহিমা দ্বারা দ্যুলোক ও ভূলোক সর্বতোভাবে বেষ্টন করে সমস্ত ভোগ করেছ, অতএব তুমি মন্ত্র দ্বারা দস্যুকে নি:সারিত করেছ; সে মন্ত্র-অর্থ গ্রহণে অক্ষম যজমানদেরও রক্ষা করবার মানস কর। ১০। যখন জল দিব্যলোক হতে পৃথিবীর অন্ত প্রাপ্ত হল না এবং ধনপ্রদ ভূমিকে উপকারী দ্রব্য দ্বারা পূর্ণ
পাতা: ১১২
করল না, তখন বর্ষণকারী ইন্দ্র হস্তে বজ্র ধারণ করলেন এবং দ্যুতিমান বজ্র দ্বারা অন্ধকার রূপ মেঘ হতে পতনশীল জল নি:শেষিতরূপে দোহন করলেন। ১১। প্রকৃতি অনুসারে জল প্রবাহিত হল; কিন্তু বৃত্র নৌকাগম্য নদীসমূহের মধ্যে বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হল; তখন ইন্দ্র স্থিরসংকল্প বৃত্রকে অতিবলযুক্ত প্রাণসংহারক আয়ুধ দ্বারা কয়েক দিনে হনন করলেন।’
উপরের ঋকগুলো মনোযোগ দিয়ে পড়লেই বোঝা যায় এটা প্রাকৃতিক কিংবা অলৌকিক কোন ঘটনার বর্ণনা নয়। ইন্দ্রের নামে এবং বিশেষ ধর্মীয় বিশ্বাস নিয়ে বৈদিক যোদ্ধারা এমন একদল শত্রুর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করছিল যাদেরকে ঋষি বলছেন বৃত্রের অনুচর, দস্যু এবং যজ্ঞরহিত বা ব্রতরহিত অর্থাৎ বৈদিক ধর্মকর্মহীন। এরা সমৃদ্ধ ও নগরের অধিকারী। কিন্তু বৃত্র কোন মানুষ নয়, তা জলরোধক। তা ছিল বাঁধ যা নদীর জলপ্রবাহকে আটকে রেখেছিল।১ অর্থাৎ নদীর জল উজানে আটকে থাকায় ভাটিতে জল যায় নি। ফলে জলাভাবে ক্ষতিগ্রস্ত যারা তারা এই বাধা অপসারণের জন্য যুদ্ধ করেছে, যার সঙ্গে জড়িয়ে গেছে ধর্মবিশ্বাস। এটা সুস্পষ্ট যে, বৈদিক শক্তি বৃত্রের উপর দেবত্ব আরোপ করেছিল। ফলে বৃত্রকে শত্রুর দেবতা হিসাবে কল্পনা করে তাকে ধ্বংসের প্রয়োজনে দানব হিসাবে চিহ্নিত করেছে এবং তার রক্ষাকারী শত্রু-সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে লড়াই করতে গিয়ে বৈদিক শক্তি নিজেদের সপক্ষের দেবতা হিসাবে ইন্দ্রের কল্পনা করেছে। ফলে এটা ঋগ্বেদে উপস্থিত হয়েছে দুই দেবতা বা দেবতা ও অপদেবতার মধ্যে যুদ্ধ হিসাবে।
কিন্তু যতই ধর্মকে জড়ানো হোক মূল বিষয় জল নিয়ন্ত্রণ বা নদী নিয়ন্ত্রণ। সুতরাং বৈদিক যুদ্ধের কেন্দ্রীয় বিষয় হল প্রতিপক্ষের বাঁধ তথা নদীনিয়ন্ত্রণব্যবস্থা ভেঙ্গে ফেলা। এই বিষয়টিই সমগ্র ঋগ্বেদ জুড়ে অজস্র উপমা, রূপক এবং বর্ণনা দ্বারা অজস্রভাবে বলা হয়েছে। তবে তাতে অনেক সময় এমন সব রূপক বা উপমা ব্যবহার করা হয়েছে যে, তার ভিতর থেকে বাস্তবকে বের করা কঠিন হয়।
বৈদিক যুদ্ধ যে দীর্ঘস্থায়ী হয়েছিল সেটা ঋগ্বেদ থেকেই স্পষ্ট হয়। এমনকি আমরা যে সূক্ত থেকে উপরে উদ্ধৃতি দিয়েছি সেই সূক্তে বৃত্রধ্বংস এবং শত্রুর পরাজয়ের বর্ণনা দিয়েও শেষ ঋকে বলা হচ্ছে, ‘যারা আমাদের সাথে বহুকাল যুদ্ধ করছে, সেই শত্রুকাঙ্ক্ষীদেরও তুমি বেদনা ও দু:খ প্রদান কর’ (১/৩৩/১৫)। অন্য একটি সূক্তের ঋকে
_________________________________________________________________________________
১ সি, বেনভেনিস্টে এবং এল, রেনো ভাষাতাত্ত্বিক বিচারে বৃত্রের অর্থ ‘বাঁধ’ অথবা ‘ব্যারেজ’ করেছিলেন। দামোদর ধর্মানন্দ কোসাম্বিও তাঁদের সাথে একমত পোষণ করেন এবং তিনি সঠিকভাবেই বৃত্রকে বাঁধ হিসাবে চিহ্নিত করেন। কিন্তু তিনি সিন্ধু সভ্যতায় বাঁধের গুরুত্ব যেমন বোঝেন নি তেমনি যে অভ্যন্তরীণ সংকটের কারণে বাঁধগুলি ধ্বংস হয় সেটিও তিনি ধরতে ব্যর্থ হয়েছেন। এই ব্যর্থতার কারণ তিনি আর্যদের এই অঞ্চলে বহিরাগত হানাদার হিসাবে দেখেছেন। তিনি বলেছেন যে সিন্ধু উপত্যকার ছোট নদীগুলিতে বাঁধ দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু ঋগ্বেদ বলছে যে সিন্ধু নদী সহ সপ্তসিন্ধুতে বাঁধ দেওয়া হয়েছিল। তবু, ঋগ্বেদে বৃত্র ধ্বংসের ব্যাপারে কোসাম্বির ব্যাখ্যাটি গুরুত্বপূর্ণ। দেখুন : Damodar Dharmanand Kosambi, An Introduction to the Study of Indian History. (Popular Prakashan, Bombay, Revised Second Edition 1975, reprinted 1985), pp 74-75.
_________________________________________________________________________________
পাতা: ১১৩
বলা হচ্ছে, ‘হে মনুষ্যগণ! যিনি পর্বতে লুক্কায়িত শম্বরকে চল্লিশ বৎসর অন্বেষণ করে প্রাপ্ত হয়েছিলেন, যিনি বল প্রকাশকারী অহি নামক শয়ান দানবকে বিনাশ করেছিলেন, তিনিই ইন্দ্র’ (২/১২/১১)। সম্ভবত এটি একটি অঞ্চলে চল্লিশ বৎসর ব্যাপী যুদ্ধের বিবরণ। কাজেই ঋগ্বেদ বিচারের সময় একটি সমাজের দীর্ঘস্খায়ী যুদ্ধ, ধ্বংস ও তজ্জনিত তীব্র পারস্পরিক ঘৃণা ও তিক্ততার বিষয়টিকে আমাদের বিবেচনায় নেওয়া প্রয়োজন।
বৃত্র এবং জলরোধ বা নদীনিয়ন্ত্রণের বিষয়টিকে আরও স্পষ্ট করার জন্য আমরা আরও কিছু মন্ত্রের সাহায্য নিতে পারি :
‘৭। হস্তপদ-শূন্য বৃত্র ইন্দ্রকে যুদ্ধে আহ্বান করল, ইন্দ্র তার সানু তুল্য প্রৌঢ় স্কন্ধে বজ্র আঘাত করলেন; যেরূপ পুরুষত্বহীন ব্যক্তি পুরুষত্ব সম্পন্ন ব্যক্তির সাদৃশ্য লাভ করতে বৃথা যত্ন করে, বৃত্রও সেরূপ বৃথা যত্ন করল; বহুস্থানে ক্ষত হয়ে বৃত্র ভূমিতে পড়ল। ৮। ভগ্নকূলকে অতিক্রম করে নদ যেরূপ বয়ে যায়, মনোহর জল সেরূপ পতিত বৃত্রদেহকে অতিক্রম করে যাচ্ছে; বৃত্র জীবদ্দশায় নিজ মহিমা দ্বারা যে জলকে বদ্ধ করে রেখেছিল, অহি এখন সে জলের পদের নীচে শয়ন করল। ৯। বৃত্রের মাতা তীর্যকভাবে রইল, তখন ইন্দ্র তার অধোভাগে অস্ত্রাঘাত করলেন, তখন মাতা উপরে ও পুত্র নীচে রইল, তারপর বৎসের সাথে ধেনুর ন্যায় বৃত্রের মাতা দনু শুয়ে পড়ল। ১০। স্থিতি রহিত বিশ্রাম রহিত জলের মধ্যে নিহিত, নাম-শূন্য শরীরের উপর দিয়ে জল বয়ে যাচ্ছে; ইন্দ্রশত্রু দীর্ঘ নিদ্রায় পতিত রয়েছে। ১১। .... জলের বহন দ্বার রুদ্ধ ছিল, বৃত্রকে হনন করে ইন্দ্র সে দ্বার খুলে দিয়েছেন। ১২। হে ইন্দ্র! যখন সেই দেব১ বৃত্র তোমার বজ্রের প্রতি আঘাত করেছিল, তখন তুমি অশ্বপুচ্ছের ন্যায় হয়ে আঘাত নিবারণ করেছিলে; তুমি গাভী জয় করেছ, সোমরস জয় করেছ এবং সপ্তসিন্ধু প্রবাহ ছেড়ে দিয়েছ।’ (১ মণ্ডল, ৩২ সূক্ত)
‘হে মনুষ্যগণ! যিনি অহিকে বিনাশ করে সপ্তসংখ্যক নদী প্রবাহিত করেছিলেন.... তিনিই ইন্দ্র (২/১২/৩)। হে মনুষ্যগণ! .... যিনি সাতটি নদীকে প্রবাহিত করে দিয়েছিলেন .... তিনিই ইন্দ্র।’ (২/১২/১২)
‘হে ইন্দ্র! তুমি মেঘকে বিদীর্ণ করে জলনির্গম মার্গ উন্মুক্ত করেছ, তুমি রুদ্ধ জলসকলকে মুক্ত করেছ।’ (৫/৩২/১)
‘হে ইন্দ্র! তুমি বৃত্র কর্তৃক সমাচ্ছাদিত নদীসকলের প্রকাণ্ড বারিরাশি উন্মুক্ত করেছ; তুমি জলরাশি মুক্ত করেছ; তুমি সে সমস্ত নদীকে নিম্নপথে প্রবাহিত করেছ; তুমি বেগবান সলিলরাশিকে সমুদ্রে নিয়ে গিয়েছ।’ (৬/১৭/১২)
‘যে কালে মরুৎগণ সোম পান করে উল্লসিত ইন্দ্রের স্তব করেছিলেন তখন তিনি বজ্র গ্রহণপূর্বক বৃত্রকে সংহার করলেন এবং প্রকাণ্ড জলরাশিকে স্বেচ্ছানুসারে প্রবাহিত করলেন।’ (৫/২৯/২)
_________________________________________________________________________________
১ এটা খুব তাৎপর্যপূর্ণ যে বৃত্রকে এখানে দেব বলা হয়েছে।
_________________________________________________________________________________
পাতা: ১১৪
পাতা: ১১৫
পাতা: ১১৬
পাতা: ১১৭
পাতা: ১১৮
পাতা: ১১৯
পাতা: ১২০
পাতা: ১২১
পাতা: ১২২
হে ইন্দ্র! বৃত্র যখন জলদের গ্রাস করছিল, তুমি তাদের মোচন করে দিলে। তখনই জলগুলি সর্বত্র বেগে ধাবিত হল। ইন্দ্র ইচ্ছাপূর্বক যখন জল মোচন করে দিলেন, তখন সে পরিশুদ্ধ জল সকল আর স্থির থাকতে পারল না।’ (১০/১১১/৯)
‘তিনি (ইন্দ্র) বৃত্রকে ছেদন করলেন, জলসমূহ মোচন করে দিলেন।’ (১০/১১৩/৪)
এ ধরনের আরও বহু সংখ্যক উদাহরণ দেওয়া যায় যা থেকে বৃত্র সম্পর্কে আমাদের ধারণা অধিকতর দৃঢ়বদ্ধ হয় মাত্র। বস্তুত বৃত্র যেমন ঋগ্বেদের সবচেয়ে বড় রহস্য তেমন তাই আবার ঋগ্বেদের রহস্য উন্মোচনের সর্বশ্রেষ্ঠ চাবিকাঠি।
এখন আমরা একটি মন্ত্রের উদ্ধৃতি দিব বৃত্র-বিরোধী বৈদিক আন্দোলনের উদ্ভব ও ইন্দ্রের উথান সম্পর্কে আরও কিছু ধারণা পাবার জন্য। ঋগ্বেদের একজন প্রসিদ্ধ ঋষি বিশ্বামিত্রের রচিত পুরো সূক্তটি আমরা উদ্ধৃত করছি :
‘১। হে ইন্দ্র! বৃত্র বিনাশকর বললাভের জন্য ও শত্রু সেনার অভিভবের জন্য তোমাকে প্রবর্তিত করছি। ২। হে শতক্রতু! স্তোতাগণ তোমার মন চক্ষু প্রীত করে আমাদের অভিমুখে প্রেরণ করুক। ৩। হে শতক্রতু! আমরা গর্বিত শত্রুদের অভিভবকর যুদ্ধে সমস্ত স্তুতি দ্বারা তোমার নাম কীর্তন করব। ৪। ইন্দ্র সকলের স্তুতিযোগ্য, অপরিমিত তেজবিশিষ্ট এবং মনুষ্যদের স্বামী, আমরা তার স্তুতি করছি। ৫। হে ইন্দ্র! বৃত্রকে বিনাশ করবার জন্য এবং যুদ্ধে ধন লাভের জন্য বহু লোকের আহূত ইন্দ্রকে আহ্বান করছি। ৬। হে শতক্রতু! তুমি যুদ্ধে শত্রুদের অভিভবকারী হও, বৃত্রকে বিনাশ করবার জন্য আমরা তোমাকে প্রার্থনা করছি। ৭। হে ইন্দ্র! যারা ধনে, যুদ্ধে, বীরসমূহে ও বলে আমাদের অভিমানী শত্রু তাদের পরাজিত কর। ৮। হে শতক্রতু! আমাদের আশ্রয় দানের জন্য অতিশয় বলবান, দীপ্তিযুক্ত, স্বপ্ন নিবারক সোম পান কর। ৯। হে শতক্রতু! পঞ্চজনে যে সকল ইন্দ্রিয় আছে, আমি সেগুলি তোমারই বলে জানি। ১০। হে ইন্দ্র! প্রভূত অন্ন তোমার নিকট গমন করুক, শত্রুদের দুর্ধর্ষ ধন আমাদের প্রদান কর। আমরা তোমার উৎকৃষ্ট বল বর্ধিত করব। ১১। হে শক্র! নিকট অথবা দূর দেশ হতে আমাদের অভিমুখে এস। হে বজ্রবান ইন্দ্র! তোমার যে উৎকৃষ্ট স্থান আছে সেখান হতে এ যজ্ঞে এস।’ (৩ মণ্ডল, ৩৭ সূক্ত)
উপরের সূক্ত থেকে এটা স্পষ্টভাবে বোঝা যাচ্ছে যে, ইন্দ্র পূজা প্রবর্তন করা হচ্ছে মূলত বৃত্র বধের উদ্দেশ্যে। এবং এটাও অনায়াসে অনুমান করা চলে যে, ঋষি বিশ্বামিত্র এই মন্ত্র রচনা করেছেন বৃত্র এবং শত্রুপক্ষের বিরুদ্ধে যুদ্ধ শুরুর উদ্দেশ্যে ধর্ম সংস্কারের অংশ হিসাবে। এটাকে আমরা একটা যুদ্ধ ঘোষণার মন্ত্রও বলতে পারি। ঋগ্বেদে আরও বিভিন্ন ঋষির মন্ত্র পাওয়া যায় যেগুলিতে বৃত্রবধে সাহায্যের জন্য বা বৃত্র বধ করার জন্য ইন্দ্রের কাছে প্রার্থনা করা হয়েছে। এগুলির মধ্যে কিছু উল্লেখ করা যায় : ‘যজমান বিশিষ্টরূপে এ ইন্দ্রের বলের পূজা করেন ও বীরত্বের নিমিত্ত তাঁরই উপর নির্ভর করেন এবং অবিচ্ছিন্ন শত্রুশ্রেণীর নিরোধকারী, হিংসাকারী ও আক্রমণকারী ইন্দ্র বৃত্র সংহার করবেন বলে তাঁর পরিচর্যা করেন।’ (৬/৩৬/২, নর ঋষি)
‘শত্রু নিহন্তা ইন্দ্র বিশিষ্টরূপে বৃত্র সংহার করুন।’ (৬/৩৭/৫, ভরদ্বাজ ঋষি)
পাতা: ১২৩
‘জ্ঞানসম্পন্ন ও অপ্রতিহত প্রভাব ইন্দ্র এ সোম পান করে উল্লসিত হয়ে অসংখ্য প্রতিকূলাচারী শত্রু বিনাশ করেছেন। .... (৬/৪৪/১৪)। ইন্দ্র যেন এ অভিষুত সোম পান করেন এবং এ দ্বারা উল্লসিত হয়ে বজ্র দ্বারা বৃত্র সংহার করেন।’(৬/৪৪/১৫, বৃহস্পতির অপত্য শংযু ঋষি)।
‘হে ঋভুগণ! আমরা তোমাদের দ্বারা প্রথিত। তোমরা সমর্থ; তোমাদের সাহায্যে সমর্থ হয়ে তোমাদের বলে শত্রুবল অভিভব করব। বাজ আমাদের যুদ্ধে রক্ষা করুন। ইন্দ্রকে সহায় পেয়ে আমরা বৃত্রের হস্ত হতে উত্তীর্ণ হব।’ (৭/৪৮/২, বসিষ্ঠ ঋষি)
‘হে পুরুহূত ইন্দ্র! আমাদের হিংসাকারীগণকে যুদ্ধে জয় করব। পাপবুদ্ধি লোককে পরাভূত করব। মরুৎগণের সাহায্যে বৃত্রকে বধ করব।’ (৮/২১/১২, কণেñর পুত্র সোভরি ঋষি)
স্পষ্টই বোঝা যায় যে, এই মন্ত্রগুলি বৃত্রবধ কামনায় রচিত। এমন কিছু মন্ত্র পড়লে বোঝা যায় যে, যুদ্ধ তখনও শুরু হয় নি, তবে তার সূচনার জন্য প্রস্তুতি চলছে। এ ছাড়া যুদ্ধের মধ্যবর্তী কালে রচিত বহু সংখ্যক মন্ত্র পাওয়া যায়। যুদ্ধ শেষ হবার পরের মন্ত্রও বহু সংখ্যায় আছে। তবে একটা বিষয় স্পষ্ট যে, সপ্তসিন্ধুর বিশাল এলাকায় সর্বত্র যুদ্ধ যেমন একসাথে শুরু হয় নি তেমন তা এককালে বিস্তার লাভও করে নি। সুতরাং বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন অঞ্চলের ঋষিরা যে পৃথকভাবে একই উদ্দেশ্যে মন্ত্র রচনা করছেন তা বোঝা যায়।
এইসব সূক্তের কোন কোনটিতে যুদ্ধ শুরুর পূর্বেকার দ্বিধা, ভয়, সংশয় প্রতিফলিত। যেমন কণেñর পুত্র ঋষি সোভরি ৮/২১/৬ ঋকে বলছেন, ‘হে ইন্দ্র! এ স্তোত্রের সাথে তোমার অভিমুখে তোমারই স্তব করব। তুমি কেন বার বার চিন্তা করছ?’ অর্থাৎ ঋষি নিজেদের ভয়, সংশয়, দ্বিধা ও চিন্তাকে দেবতার উপর আরোপ করছেন। ঋষি পরের ঋকে যেটা বলছেন সেটা ইন্দ্রের উথান প্রক্রিয়া বোঝার জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ : ‘হে ইন্দ্র! তোমার রক্ষা লাভ করে আমরা নূতন হব। হে বজ্রধারী ইন্দ্র! পূর্বে জানতাম না যে তুমি মহান। সম্প্রতি জেনেছি।’ (৮/২১/৭)
এ ধরনের বক্তব্য সম্বলিত মন্ত্র আরও পাওয়া যায়, যেমন ব্যশ্বপুত্র বৈয়শ্ব ঋষি বলছেন :
‘১১। হে বজ্রবান মঘবা ইন্দ্র! আমরা পূর্বে তোমা ভিন্ন অন্য দেবগণের নিকট আশা করেছিলাম। তোমার ধন ও রক্ষা আমাদের প্রদান কর। ১২। হে নর্তয়িতা, স্তুতিভাক্ ইন্দ্র ! অন্ন, দ্যুতিমান যশ ও বল লাভার্থে তোমা ভিন্ন আর কারও কাছে যাব না।’ (৮ মণ্ডল, ২৪ সূক্ত)
অর্থাৎ অনেক দ্বিধা-দ্বন্দ্বের ভিতর দিয়ে ইন্দ্রকে প্রধান এক দেবতা হিসাবে গ্রহণ বা প্রবর্তন করা হয়েছে। স্বাভাবিকভাবে এর পিছনে আছে দীর্ঘদিনের সামাজিক ক্ষোভ, আন্দোলন এবং বহু কিছুর ওলটপালট ও বিপর্যয়।
ঋগ্বেদ থেকে এটা যেমন স্পষ্ট হয় যে, বৈদিক আন্দোলন গড়ে উঠতে দীর্ঘ সময় লেগেছিল তেমন এটাও অনুমান করা চলে যে, এই আন্দোলন সংগঠিত করতে গিয়ে অনেক ঋষি এবং কিছু রাজর্ষি বা রাজা নিগ্রহ ভোগ করেছেন। যেমন :
পাতা: ১২৪
‘শুন:শেপ ধৃত হয়ে ও তিন পদ কাষ্ঠে বদ্ধ হয়ে অদিতির পুত্র বরুণকে আহ্বান করেছিল; অতএব বিদ্বান ও অহিংসিত বরুণ তাকে মুক্তি দিন, তার বন্ধন মোচন করে দিন।’ (১/২৪/১৩)
‘তোমরা (অশ্বিদ্বয়) হিম দ্বারা অত্রির চতুর্দিকস্থ দীপ্যমান অগ্নি নিবারণ করেছিলে এবং তাকে অন্নযুক্ত বলপ্রদ খাদ্য দিয়েছিলে ; হে অশ্বিদ্বয়! অত্রি অবনতমুখে যে আলোকশূন্য পীড়াযন্ত্র গৃহে প্রক্ষিপ্ত হয়েছিল, তোমরা তাকে তার সমভিব্যাহারীগণের সাথে সুখে তথা হতে উঠিয়েছিলে।’ (১/১১৬/৮)
‘হে দস্র অশ্বিদ্বয়! পাপে পতিত মানুষের ন্যায় অন্ধকারে ক্ষয়প্রাপ্ত, সূর্যের ন্যায় শোভনীয়, দীপ্তিমান আভরণের ন্যায় দর্শনীয়, সে কূপে প্রক্ষিপ্ত, বন্দন ঋষিকে তোমরা উঠিয়েছিলে।’ (১/১১৭/৫)
‘হে নাসত্যদ্বয়১ ! তোমার হর্ম্যতলে বদ্ধ কণ্ব মুনিকে নানাপ্রকার রক্ষা প্রদান করেছিলে।’ (৮/৫/২৩)
এ ধরনের আরও অনেক উল্লেখ আমরা ঋগ্বেদে পাই।
এই যুদ্ধ কিভাবে একটু একটু করে সংগঠিত হয়ে এক বিশাল যুদ্ধে পরিণত হয়েছে তারও সাক্ষ্য আছে ঋগ্বেদে। এ প্রসঙ্গে ১ মণ্ডলের ১৩৩ সূক্ত উল্লেখ করা যায় যার রচয়িতা দিবোদাসের অপত্য পরুচ্ছেপ ঋষি শত্রু নিধনে বিরাট উল্লাস প্রকাশ করে বলছেন, ‘শত্রুরা যেখানেই একত্রিত হয়েছিল সেখানেই হত হয়েছে। সম্পূর্ণরূপে বিনষ্ট হয়ে তারা শ্মশানের চারদিকে পড়ে আছে’ (১/১৩৩/১), ‘হে শত্রুভক্ষক ইন্দ্র! তুমি হিংসাবতী সেনার মস্তক একত্র করে তোমার বিস্তৃত পদদ্বারা ছেদন কর।’ (১/১৩৩/২)
এই সূক্তে ঋষি যেভাবে শত্রু সংহারে উল্লাস প্রকাশ করেছেন তাতে সঙ্গত কারণে পাঠক এটাকে একটা বিরাট জয়ের ঘটনা মনে করতে পারেন। কিন্তু ১/১৩৩/৪ ঋকে যখন ঋষি বলছেন, ‘হে ইন্দ্র! তুমি এরূপ ত্রিগুণিত পঞ্চাশৎ সংখ্যক সেনা নাশ করেছ’ তখন হতাশই হতে হয়। কারণ সংখ্যাটা হচ্ছে মাত্র ৫০x৩=১৫০ (দেড়শত)। ঋগ্বেদের কিছু সূক্তে যেখানে ১০ হাজার (৮/৯৬/১৩), ৫০ হাজার (৪/১৬/১৩) এবং ৬০ হাজার(৬/২৬/৬) শত্রুসৈন্য ধ্বংসেরও বর্ণনা পাই সেখানে মাত্র দেড়শত শত্রুসৈন্য নিধনের পর তা নিয়ে উল্লাসের কারণ বোঝা কঠিন হতে পারে। কিন্তু একটু চিন্তা করলে বোঝা যাবে যে, এটি শত্রুসেনার বিরুদ্ধে কোন অঞ্চলে প্রথম পর্যায়ের একটি সফল যুদ্ধের বিবরণ যে কারণে এই যুদ্ধ জয়ের মূল্য ঋষির কাছে এত বড় হয়ে দেখা দিয়েছে। এই একই সূক্তের পরবর্তী ঋকগুলিতে ঋষি চারদিকের প্রবল শত্রুদের সম্পর্কে যেভাবে আতঙ্ক প্রকাশ করে দেবতা ইন্দ্রের আশ্রয় ও সাহায্যের জন্য মিনতি করেছেন তাতে বোঝাই যায় যে, বৈদিক যুদ্ধ কত ধীরে ও অনিশ্চয়তার মধ্যে একটু একটু করে সংহত হয়ে পরে বৃহৎ আকার ধারণ করেছে : ৫। ‘হে ইন্দ্র! তুমি ঈষৎ রক্তবর্ণ অতি ভয়ঙ্কর শব্দকারী পিশাচকে বিনাশ কর এবং সমস্ত রাক্ষসগণকে নি:শেষ কর। ৬। হে ইন্দ্র! তুমি প্রকাণ্ড মেঘকে নিম্নমুখ করে বিদীর্ণ কর। আমাদের কথা শোন।’ (১ মণ্ডল, ১৩৩ সূক্ত)
_________________________________________________________________________________
১ অশ্বিদ্বয়।
_________________________________________________________________________________
পাতা: ১২৫
এই আন্দোলন ও যুদ্ধ প্রধানত ধর্মীয় রূপ বা আবরণ নিলেও তার অন্তরালবর্তী প্রেরণা ছিল অবশ্যই বৈষয়িক যার কেন্দ্রবিন্দু ছিল বৃত্রবধের নামে প্রচলিত নদীনিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থার ধ্বংসসাধন।
কিন্তু প্রশ্ন হল যে, এই নদীনিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থাকে কেন ধ্বংস করতে চাওয়া? অর্থাৎ সপ্তসিন্ধু অঞ্চল তথা সিন্ধু সভ্যতায় তাহলে এমন একটা নদীনিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা গড়ে উঠেছিল বৈদিক শক্তি যাকে ধ্বংস করতে চেয়েছিল। কিন্তু সেই প্রশ্নে যাবার আগে আমরা সপ্তসিন্ধু তথা সিন্ধু সভ্যতার ধর্মের রূপ বোঝার চেষ্টা করব যে ধর্মের সংস্কারের মাধ্যমে বৈদিক শক্তি একটি ধর্মীয় গৃহযুদ্ধ গড়ে তুলেছিল যার প্রধান লক্ষ্য ছিল নদীনিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থাকে ধ্বংস করা।
আমরা প্রথমে সিন্ধু সভ্যতার দিকে দৃষ্টি দিই। আমরা মহেঞ্জোদাড়োর নগর-দুর্গে একটি চৌবাচ্চা দেখেছি যা গ্রেট বাথ নামে পরিচিত। অনেক লেখক অনুমান করেন যে, এটা নিছক স্নানের জন্য তৈরী না করে ধর্মীয় উদ্দেশ্যে তৈরী করা হয়েছিল। তাঁদের যুক্তি আছে। কারণ আশ্চর্য নিপুণ হাতে তৈরী এই চৌবাচ্চার নিকটবর্তী প্রাচীরের পরই ছিল নদীখাত যেখানে প্রাচীরের বহির্গাত্রের সিঁড়ি বেয়ে অনায়াসে নামা যেত। তাছাড়া ভিতরেও আছে কূপ। সুতরাং নিছক স্নানের প্রয়োজনে এটা তৈরী করবার কথা নয়। বিশেষ করে সিন্ধু সভ্যতার সর্বত্র এত কূপ, স্নানাগার ও জল ব্যবহারের আয়োজন দেখে জল ব্যবহার এবং বিশেষ করে চৌবাচ্চাটির সঙ্গে ধর্মের সম্পর্ক আছে মনে করাই যুক্তিযুক্ত।
যেহেতু আমাদের কাছে স্পষ্ট যে, ঋগ্বেদ সিন্ধু সভ্যতার সঙ্গে কোন না কোনভাবে সম্পর্কিত ধর্মীয় সামাজিক-রাজনৈতিক আন্দোলনের প্রকাশ সেহেতু আমরা এখন সিন্ধু সভ্যতার প্রতিষ্ঠিত ধর্মের সূত্র খোঁজার জন্য ঋগ্বেদের দিকে দৃষ্টি দিব। আর তখন আমাদের সামনে আলী বাবার রত্নগুহার দরজা খুলে যায়।
আমরা দেখতে পাই যে, সিন্ধু সভ্যতার ঈশ্বর হলেন ঋগ্বেদের দেবতা বরুণ।
পাতা: ১২৬