Banner
চতুর্থ অধ্যায় - সিন্ধু সভ্যতার প্রত্নতাত্ত্বিক পর্যালোচনা

লিখেছেনঃ শামসুজ্জোহা মানিক এবং শামসুল আলম চঞ্চল, আপডেটঃ September 28, 2012, 11:00 AM, Hits: 6238

 

১৮২৬ সালে এই উপমহাদেশে প্রাচীন শহরের ধ্বংসাবশেষ হিসাবে হরপ্পাকে প্রথম চিহ্নিত করা হয়। কিছু পরে ঊনবিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি পাঞ্জাব ইংরেজ শাসনের অধীনে আসার পর সে সময়ে প্রতিষ্ঠিত আর্কিওলজিক্যাল সার্ভে অফ ইন্ডিয়ার পরিচালক আলেকজান্ডার কানিংহাম হরপ্পার ঢিবিটিকে পরিদর্শন করেন ও বেশ কিছু খনন কাজ চালান। কিন্তু তিনি প্রত্নতাত্ত্বিক স্থান হিসাবে হরপ্পার প্রাচীনত্ব বা গুরুত্ব কোনটিই বোঝেন নি। পরে ১৯২১ সালে প্রত্নতাত্ত্বিক খননে হরপ্পাকে তাম্র যুগের সভ্যতা হিসাবে চিহ্নিত করা হয়। ১৯২২ সালে রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায় সিন্ধু প্রদেশে বৌদ্ধ স্তূপের নীচে একই যুগের মহেঞ্জোদাড়ো নামে আরেকটি নগরী আবিষ্কার করেন। এরপর চল্লিশের দশকে ভারত পাকিস্তান ভাগ হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত এই উপমহাদেশের উত্তর-পশ্চিম অংশে হরপ্পা ও মহেঞ্জোদাড়ো যুগের সভ্যতার আরও বসতি পাওয়া গেল। সে সময়ে যাঁরা এই সব খনন কাজে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিলেন তাঁদের মধ্যে জন মার্শাল, আর্নেস্ট ম্যাকে, মর্টিমার হুইলার, এম,এস, ভাট্স্ অন্যতম।
আগে মনে করা হত মৌর্য যুগের আগে এই উপমহাদেশে কোন সভ্যতা ছিল না। হরপ্পা-মহেঞ্জোদাড়ো আবিষ্কার হবার পর আগের ধারণা বদলে গেল এবং এই বিষয়টি প্রতিষ্ঠিত হল যে প্রাচীন মিসর ও মেসোপটেমিয়ার সভ্যতার মত ভারতবর্ষেও একটি সুউন্নত নগর সভ্যতা গড়ে উঠেছিল। ভারত ও পাকিস্তানের স্বাধীনতার পর আরো প্রত্নতাত্ত্বিক খননে সমস্ত পাকিস্তান জুড়ে এবং ভারতের উত্তর-পশ্চিম অংশে সিন্ধু সভ্যতার বিপুল সংখ্যক বসতি পাওয়া যেতে লাগল। যতই দিন গেল ততই নূতন নূতন বসতি আবিষ্কৃত হল এবং এই আবিষ্কারগুলি সভ্যতা সম্পর্কে সমস্ত পুরনো ধারণা ভেঙ্গে দিয়ে নূতন নূতন দিক উন্মোচিত করল।
এখন পর্যন্ত সিন্ধু সভ্যতার ১৫০০-এরও বেশী বসতি আবিষ্কৃত হয়েছে এবং এগুলো দক্ষিণ এশিয়ার উত্তর-পশ্চিম অঞ্চলে কমপক্ষে ১০,০০,০০০ বর্গ কিলোমিটার এলাকা জুড়ে ছড়িয়ে রয়েছে। প্রাচীন মিসর বা মেসোপটেমিয়ার তুলনায় এই আয়তন প্রায় তিনগুণ

_________________________________________________________________________________
মেসোপটেমিয়া অর্থ হল দুই নদী ঘেরা ভূমি। প্রধানত আজকের ইরাকের ইউফ্রেটিস ও টাইগ্রীস নদী দু’টির মধ্যবর্তী অঞ্চলে প্রাচীনকালে সুমেরীয়, আক্কাদীয়, ব্যাবিলনীয়, ক্যালদীয় ও অ্যাসিরীয় সভ্যতা গড়ে উঠেছিল। এই সবগুলোই মেসোপটেমীয় সভ্যতার অন্তর্ভুক্ত।
দেখুন : B.K. Thapar and M. Rafique Mughal, The Indus Valley (3000-1500 BC), in, History of Humanity : Scientfic and Cultural Development, ed. A.H. Dani and J.-P. Mohen, (Routledge, UNESCO, London, 1996), vol, II, p. 262.
কেনোয়ার এই অঞ্চলকে ৬,৮০,০০০ বর্গ কিলোমিটার বলেছেন। দেখুন : Jonathan Mark Kenoyer, Ancient Cities of the Indus Valley Civilization (Oxford University Press and American Institute of Pakistan Studies, Karachi, 1998), p. 17.

_________________________________________________________________________________

পাতা: ৫০

 

এবং এটি প্রাচীন পৃথিবীর সবচেয়ে বড় সভ্যতা (চিত্র-২ দেখুন)। প্রত্নতাত্ত্বিকভাবে এই বিষয়টি এখন জানা যাচ্ছে যে, খ্রীষ্টপূর্ব অষ্টম সহস্রাব্দে নিকট প্রাচ্যের জাগরোস অঞ্চলে যখন নবপ্রস্তর যুগের মানুষ শিকার জীবন থেকে পশু-পালন ও কৃষির উদ্ভব ঘটায় তখন প্রায় একই সময়ে বৃহত্তর সিন্ধু উপত্যকার মেহরগড়ে মৃৎশিল্প-পূর্ব যুগে মানুষ স্থিতিশীল বসতিতে পশু পালন ও কৃষিকাজ শুরু করে। এর পরে যুগ পরিক্রমায় দেখতে পাওয়া যায় যে, মেহরগড় ও একই সংস্কৃতির উত্তরপুরুষরা ক্রমশ তাদের বসতি ও এলাকার সম্প্রসারণ ঘটাতে থাকে এবং বৃহত্তর সিন্ধু-সরস্বতী উপত্যকায়১ ছড়িয়ে পড়ে। তারা তাম্র-যুগ ও আদি হরপ্পান (Early Harappan) পর্যায় পেরিয়ে প্রায় ২৬০০ খ্রীষ্টপূর্বাব্দ থেকে শুরু করে ১৯০০ খ্রীষ্টপূর্বাব্দ পর্যন্ত২ মোটামুটি ৭০০ বৎসর স্খায়ী এক অত্যুন্নত নগর সভ্যতা গড়ে
_______________
১ হরপ্পা, মহেঞ্জোদাড়ো প্রভৃতি প্রাচীন নগরী আবিষ্কৃত হবার পর এই সভ্যতার নামকরণ করা হয় সিন্ধু সভ্যতা। প্রধানত সিন্ধু ও তার উপনদীসমূহের উপত্যকা জুড়ে এর বসতিগুলোর অবস্থান বলে এই নামকরণ করা হয়। কিন্তু পরে আরো অনেক প্রত্নতাত্ত্বিক খনন হবার পর মূল সিন্ধু উপত্যকা ও তার উপনদীগুলোর বাইরেও প্রচুর বসতি পাওয়া গেল। বিশেষভাবে অবিভক্ত পাঞ্জাবের মধ্যবর্তী অঞ্চলে ঘাগর-হাকরা (বর্তমানে মৃত) নদীর উপত্যকা জুড়ে প্রচুর বসতি আবিষ্কার হবার পর এই বৃহত্তর অঞ্চলকে বোঝাবার জন্য নূতনভাবে নামকরণ করার প্রয়োজন হয়ে পড়ে। ১৯৭০ সালে পাকিস্তানের বিখ্যাত প্রত্নতাত্ত্বিক এম, রফিক মুঘল এই অঞ্চলের নাম রাখেন ‘বৃহত্তর সিন্ধু উপত্যকা’।
দেখুন : M. Rafique Mughal, ‘Further Evidence of the Early Harappan Culture in the Greater Indus Valley : 1971-90,’ in, South Asian Studies 6, (1990), p 176.
ঘাগর-হাকরা-নারা নদী আজকে মৃত হলেও প্রাচীনকালে বড় নদী ছিল ও সরাসরি সমুদ্রে গিয়ে পড়ত। তাকে সে সময় সরস্বতী নদী বলা হত। সিন্ধু সভ্যতার বসতিগুলোর ঘনত্ব এই প্রাচীন সরস্বতী নদীর তীরে সবচেয়ে বেশী ছিল। তাতে সভ্যতায় সরস্বতী নদীর গুরুত্ব বিবেচনা করে এবং সমগ্র সভ্যতার বিস্তার বোঝাবার জন্য আলাদাভাবে সরস্বতী নদীর নাম উল্লেখ করার প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়। তাই আমরা আমাদের আলোচনায় এই অঞ্চলকে বোঝাবার জন্য অনেক সময় ‘বৃহত্তর সিন্ধু-সরস্বতী’ উপত্যকা বলে উল্লেখ করেছি।
২ সিন্ধু সভ্যতার নগর পর্যায় অর্থাৎ পরিণত হরপ্পান পর্যায়ের শুরু ও শেষ নিয়ে কিছু ভিন্ন মত আছে। রফিক মুঘল এর শুরু ২৫০০ খ্রী:পূ: ধরলেও ২৫৫০ এমনকি ২৬০০ খ্রী:পূ:-এর দিকে হবার সম্ভাবনার কথা উল্লেখ করেছেন। দেখুন : প্রাগুক্ত গ্রন্থ, পৃ:- ১৯৬
অপর একটি লেখায় বি, কে, থাপার ও রফিক মুঘল উল্লেখ করেছেন যে, প্রচলিত তেজস্ক্রিয় কার্বন (কার্বন-১৪) পরীক্ষায় যে সময় পাওয়া যায় তার সাথে ক্রমাংক দিয়ে গণনা করলে হরপ্পান সভ্যতার সময়কাল ২৭০০-১৯০০ খ্রী:পূ: হয়।
দেখুন : B.K. Thapar and M. Rafique Mughal, ‘The Indus Valley (3000-1500 BC),’ in, History of Humanity : Scientific and Cultural Development (1996), pp. 262-263.
গ্রেগরি পোসেল হরপ্পান সভ্যতার সময়কাল সংশোধিত কার্বন-১৪-এর উপর ভিত্তি করে ২৬০০-১৮০০ খ্রী:পূ: ধরেছেন। দেখুন : Gregory L. Possehl, Indus Civilization in Saurashtra, (B.R. Publishing Corporation, Delhi, 1980), p. 18.
কেনোয়ার এই সময়কাল ২৬০০ থেকে ১৯০০ খ্রী:পূ: পর্যন্ত বলে মনে করেন। দেখুন : J.M. Kenoyer, Ancient Cities of the Indus Valley Civilization (1998), p 17.
জিম শেফার ও ডায়ান লিখটেনস্টেইনও পরিণত হরপ্পান সভ্যতার সময়কাল ২৬০০ থেকে ১৯০০ খ্রী:পূ: ধরেছেন। দেখুন : Jim G. Shaffer & Diane A. Lichtenstein, ‘Migration, Philology and South Asian Archaeology,’ in, Aryan and Non-Aryan in South Asia, ed. Johannes Bronkhorst and Madhav M. Deshpande (Department of Sanskrit and Indian Studies, Harvard University, 1999) p. 247.
আরো বিভিন্ন লেখকের বিভিন্ন মত আছে। আমরা আলোচনায় সাধারণভাবে হরপ্পান সভ্যতার সময়কাল ২৬০০ থেকে ১৯০০ খ্রী:পূ: ধরেছি। তবে সমগ্র গ্রন্থের বিভিন্ন স্থানে প্রাসঙ্গিক কারণে কখনো কখনো এর শুরুকে ২৫০০ খ্রী:পূ: বলা হয়েছে।

 

পাতা: ৫১

 


তোলে যাকে হরপ্পান সভ্যতাও বলা হয়। হরপ্পান সভ্যতার ক্ষয়ের শুরু খ্রীষ্টপূর্ব দ্বিতীয় সহস্রাব্দের প্রথম দিকে ধরা হলেও খ্রীষ্টপূর্ব প্রথম সহস্রাব্দ পর্যন্ত এই অঞ্চলে সিন্ধু সভ্যতা বা হরপ্পান সভ্যতার উত্তরাধিকার নিয়ে বিভিন্ন বসতিতে মানুষদের বাস করতে দেখা যায়। প্রত্নতাত্ত্বিকভাবে এত দীর্ঘ সময় ধরে মানব সভ্যতার ধারাবাহিকতা বহন করতে অন্য কোথাও দেখা যায় না (চিত্র-৩ দেখুন)। এখন সিন্ধু সভ্যতার নানা বিচিত্র বৈশিষ্ট্যের উপর আমরা সংক্ষিপ্ত আলোচনা করব এবং প্রাচীন পৃথিবীর সমসাময়িক অন্যান্য সভ্যতা যেমন, মেসোপটেমিয়া, মিসর ও চীনের সভ্যতার সাথে তুলনামূলক চিত্র দেখাব।
আমরা বালুচিস্তানের কাচি এলাকায় বোলান নদীর ধারে অবস্থিত মেহরগড়ের কথা কিছু আগে উল্লেখ করেছি। মেহরগড় হল এখন পর্যন্ত পাওয়া প্রথম স্থিতিশীল মানব বসতি, যারা শিকারের পাশাপাশি কৃষির ব্যবহার শুরু করেছিল আজ থেকে প্রায় নয় বা সাড়ে নয় হাজার বছর আগে। সে সময়ে তারা কাঁচা ইটের ঘরবাড়ী তৈরী করত। তবে মৃৎপাত্রের ব্যবহার তখনও শুরু হয় নি। নব প্রস্তর যুগের এই বসতিতে এর উপরের স্তরে কাস্তের অংশ এবং পাথরের যাঁতাকল পাওয়া গেছে। দুই সারি বিশিষ্ট ও ছয় সারি বিশিষ্ট যব, আইনকর্ন গম (eincorn wheat), এমার গম (emmer wheat), এবং রুটির গম (bread wheat) পাওয়াতে অনুমান করা যায় কৃষি যথেষ্ট বিস্তৃত ও বিকশিত হয়েছিল। এই সময়টি হল খ্রীষ্টপূর্ব ষষ্ঠ সহস্রাব্দের শেষ পর্যায়।
এই বসতিতে আরও বিকশিত পর্যায় দেখা যায় কিছু পরে। শিকার করা গজলা হরিণ, বুনো ভেড়া, সোয়াম্প হরিণ (Swamp deer) ও গরুর হাড়, এবং গৃহপালিত ভেড়া, ছাগল এবং গরুর হাড় পাওয়াতে এই জনগোষ্ঠীর পরিবর্তনের ধারাটি বোঝা যায়। একই স্তর থেকে পাওয়া মোষের (water buffalo) দু’টি হাড় প্রমাণ করে যে, এটি দক্ষিণ এশিয়ায় প্রথম। এই স্তরে পাথরের তৈরী জিনিস সবচেয়ে বেশী সংখ্যক পাওয়া গেছে।
উপরে বর্ণিত মৃৎশিল্প-পূর্ব (aceramic) যুগের পরে অর্থাৎ এর উপরের স্তরে বড় আয়তাকার ঘর-বাড়ী পাওয়া গেছে যেগুলো সমানভাবে বিভিন্ন কক্ষে বিভক্ত ছিল। কিছু ছিল বর্গাকার ছোট দরজাবিহীন ঘর যেগুলোকে গুদাম ঘর বলে মনে করা হয়। এই ভবনগুলোর মাঝখানে বড় কবরস্থান আছে।

পাতা: ৫২

 

 

 

নব প্রস্তর যুগে দক্ষিণ দিকে খ্রীষ্টপূর্ব পঞ্চম সহস্রাব্দের আরেকটি বসতি আছে। এখানে একই ধরনের ইটের তৈরী একটি বড় আয়তাকার ভবন পাওয়া গেছে। এটি নব প্রস্তর যুগের প্রথম পর্যায়ের। ১০টি সংকীর্ণ কুঠরিতে এটি ভাগ করা। এটিকে এই যুগের শস্যাগার বলে মনে করা হয়, কারণ এখানে প্রচুর পরিমাণ যব ও গমের চিহ্ন পাওয়া গেছে। এখানে তুলোর বীজের চিহ্ন পাওয়াতে অনুমান করা হয় যে, এই সময়ে তুলোর চাষ করা হত। এর উদ্দেশ্য তুলো বীজ থেকে তেল নেবার জন্য অথবা তুলো থেকে আঁশ নিয়ে সুতো বানাবার জন্য হতে পারে। শস্যাগারের দক্ষিণে স্টীয়েটাইট পাথর কাটার কারখানা ছিল। এখানে ছিদ্র করার যন্ত্রসহ বিভিন্ন ধরনের পাথরের যন্ত্রপাতি পাওয়া গেছে। এই ভবনের পূর্ব পাশে ছাইয়ের সাথে মিশ্রিত বিভিন্ন পশুর হাড়ের স্তূপ পাওয়া গেছে। কিছু সংখ্যক খোলামকুচিও এই দালানের ভিতরে ও বাইরে ছিল। এই মৃৎপাত্রগুলোর বেশীর ভাগ ছিল নাশপাতি আকৃতির। এটি খুবই কৌতূহলোদ্দীপক যে, এই মৃৎপাত্রগুলো কুমোরের চাকে তৈরী করা এবং হাতে থাবড়ান। এখানে দু’টি মানুষের মূর্তিও পাওয়া গেছে। এর মধ্যে একটি বসা অবস্থায়। আরেকটি চার পা-ওয়ালা জন্তুর মূর্তি পাওয়া গেছে। এই সময়ের শেষে মেহরগড়ে রঙিন মৃৎপাত্র পাওয়া যায় (মেহরগড় স্তর ৩) । কিলি গুল মোহাম্মদ স্তর ২-এ পাওয়া সহজ জ্যামিতিক নকশার সাথে এগুলোর মিল পাওয়া যায়। মেহরগড়ে পঞ্চম ও ষষ্ঠ সহস্রাব্দে পাওয়া বিভিন্ন নমুনা থেকে কৃষিভিত্তিক অর্থনীতির খুবই প্রাচীন প্রমাণ মিলে। এছাড়া বিশেষীকৃত হস্তশিল্প এবং নীলকান্তমণি (turquoise), লাপিস লাজুলি (এক ধরনের মূল্যবান পাথর) এবং সামুদ্রিক খোলার যেসব নিদর্শন পাওয়া গেছে সেগুলির উপর ভিত্তি করে দীর্ঘ দূরত্বের বাণিজ্যের অস্তিত্ব সম্পর্কে অনুমান করা যায়। পরবর্তী কালে খ্রীষ্টপূর্ব তৃতীয় ও চতুর্থ সহস্রাব্দের বালুচিস্তান ও সিন্ধু উপত্যকায় স্থানীয় ঐতিহ্যের সাংস্কৃতিক ধারাবাহিকতাকে রক্ষা পেতে দেখা যায় বিভিন্ন বসতিতে, যেমন কিলি গুল মোহাম্মদ স্তর-৩, টোগাউ, চানহুদাড়ো এবং ইরানের শাহর-ই সোখ্তা ও শাহ্দাদে। এই যুগকে একই সাথে প্রযুক্তির আবিষ্কার এবং নানামুখী কৃষি উৎপাদনের যুগ হিসাবে চিহ্নিত করা যায়।
প্রায় ৩৫০০ খ্রীষ্টপূর্বাব্দে মেহরগড়ে যে ধরনের বসতি শুরু হয় তা তাৎপর্যপূর্ণ। এই সময়ে ছোট ও নীচু দরজাবিশিষ্ট বসবাসের উপযোগী বাড়ী তৈরী হতে থাকে। এই স্তরে

_________________________________________________________________________________
স্টীয়েটাইট এক ধরনের নরম পাথর। এগুলোর উপর খোদাই করা তুলনামূলকভাবে সহজ।
প্রত্নতাত্ত্বিকরা কোন প্রত্নস্থল খননের সময় মাটির সর্বোচ্চ স্থান থেকে সর্বনিম্ন পর্যন্ত বিভিন্ন স্তরের অস্তিত্ব নির্ধারণ করেন প্রতিটি স্তরের বিশেষ গভীরতা, রঙ, বয়ন ও সাংস্কৃতিক সঞ্চয় থেকে। বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী প্রতিটি স্তরকে যথাক্রমে স্তর ১, স্তর ২, স্তর ৩, ইত্যাদি হিসাবে গণনা করা হয়। কখনো উপস্তর পাওয়া গেলে এভাবে লেখা হয়, যেমন- স্তর ১ক, স্তর ১খ ও স্তর ১গ (Phase IA, IB and IC) ইত্যাদি।
চিত্র নং ৬- এ বিষয়টি দেখানো হয়েছে।
_________________________________________________________________________________

পাতা: ৫৩


pic-2

চিত্র ২ : প্রাচীন পৃথিবীর প্রধান চারটি নগর সভ্যতার তুলনামূলক বিস্তার। 

পাতা: ৫৪


pic-3
পাতা: ৫৫

pic-4

পাতা: ৫৬

 

 

pic-5
পাতা: ৫৭

pic-6
পাতা: ৫৮



লাল, সাদা, ও কাল রঙের সাহায্যে চিত্রিত বহু রঙা মৃৎপাত্র ব্যবহার হতে দেখা যায়। এখানে স্তর ৪-এ পোড়ামাটি ও হাড়ে প্রথম খোদাই করা সিল দেখতে পাওয়া গেছে। মেহ্রগড়ে ৩২০০ খ্রীষ্টপূর্বাব্দে যে সংস্কৃতি দেখতে পাওয়া যায় তার সাথে পূর্ব ইরানের শাহর-ই-সোখতায় বসতির শুরু কোয়েটা উপত্যকায় মুণ্ডিগক স্তর ৩ ও ডাম্ব সাদাত স্তর ২-এর বসতিগুলি একই পর্যায়ভুক্ত। আরো পরে ৩২০০ থেকে ২৫০০ খ্রীষ্টপূর্বাব্দ পর্যন্ত মেহরগড়ের শিল্পে যে অগ্রগতি দেখতে পাওয়া যায় তার সাথে সংস্কৃতিগত মিল পাওয়া যায় সিন্ধু উপত্যকায় ফয়েজ মোহাম্মদ, রহমান ধেরী ও কোট দিজির বসতিগুলির। এই পর্যায়ে পরিণত হরপ্পান পর্যায়ের অনেক উপাদানের সূচনা দেখতে পাওয়া যায়। পরিণত হরপ্পান পর্যায় বা পূর্ণ নগর সভ্যতা শুরুর ঠিক পূর্বে মেহরগড়ের বসতি পরিত্যক্ত হয়।
আমরা সিন্ধু সভ্যতার সাংস্কৃতিক ধারাবাহিকতার গুরুত্ব বোঝার জন্য মেহরগড়ের উপর আলাদাভাবে আলোচনা করলাম। কারণ এখন পর্যন্ত সিন্ধু সভ্যতার ইতিহাসে মেহরগড় একটি মাইলফলক হয়ে আছে। সিন্ধু সভ্যতাকে সামগ্রিকভাবে বোঝার জন্য এখন আমরা দক্ষিণ এশিয়ার এই দীর্ঘ সভ্যতা সম্পর্কে আলোচনা করব আলাদাভাবে প্রতিটি যুগ ও পর্যায়ের উপর।


নবপ্রস্তর যুগ (প্রায় ৭৫০০-৫০০০ খ্রী:পূ:)

নবপ্রস্তর যুগে পৃথিবীর বিভিন্ন স্থানে জীবন-যাপন প্রণালীতে বৈপ্লবিক পরিবর্তন সূচিত হয়েছিল। এ যুগে মানুষ খাদ্য সংগ্রহের জীবন ছেড়ে খাদ্য উৎপাদনের জীবনে প্রবেশ করে ও স্থিতিশীল সমাজ গড়ে তোলে। এই সময়ে মানুষ কৃষির প্রচলন ঘটায়। তখন হাতিয়ারের মানে চমকপ্রদ পরিবর্তন সূচিত হয়েছিল। মেহরগড় সহ উপমহাদেশের পশ্চিমাংশের নবপ্রস্তর যুগ সম্পর্কে আমরা আলোচনা করেছি। এছাড়াও যেসব স্থানে নবপ্রস্তর যুগের বসতি পাওয়া গেছে সেগুলো হল কোয়েটা উপত্যকায় কিলি গুল মোহাম্মদ এবং বান্নু অববাহিকায় শেরিখান তারাকাই। পাকিস্তানের উত্তরাংশে ভিন্ন ধরনের নবপ্রস্তর যুগের সংস্কৃতি আবিষ্কৃত হয়েছে, সেগুলি হল : লোয়েবনর, ঘালিগাই, আলিগ্রাম এবং তক্ষশীলা উপত্যকায় সরাই খোলা। বৃহত্তর সিন্ধু উপত্যকায় পরবর্তী তাম্র ও ব্রোঞ্জ যুগের সংস্কৃতিকে পাকিস্তানের পশ্চিমাংশের এই সংস্কৃতি প্রভাবিত করেছিল।
_________________________________________________________________________________
মেহরগড়ে নবপ্রস্তর যুগের শুরু আনুমানিক ৬৫০০ খ্রী:পূ: ধরে এভাবে যুগ বিভাজন করেন রফিক মুঘল। কিন্তু রিচার্ড মিডো মেহরগড়ের উপর তাঁর লেখায় এখানে মানুষের বসবাসের শুরু খ্রীষ্টপূর্ব অষ্টম সহস্রাব্দ বলে উল্লেখ করেছেন। জঁ ফ্রানসোয়া জারিজ -এর মত অনুযায়ী এখানে আরো কিছু আগে থেকে স্থিতিশীল জীবনের প্রক্রিয়া চলতে পারে। তাই আমরা রফিক মুঘলের নবপ্রস্তর যুগের সময়কালের (প্রায় ৬৫০০ থেকে ৫০০০ খ্রী:পূ:) পরিবর্তে প্রায় ৭৫০০ থেকে ৫০০০ খ্রী:পূ: ধরেছি। বিস্তারিত জানার জন্য দেখুন :
Jean - FranÇois Jarrige, ‘Chronology of the Earlier Periods of the Greater Indus as seen from Mehrgarh, Pakistan,’ in, South Asian Archaeology 1981, ed., Bridget Allchin (Cambridge University Press, Cambridge, 1984), pp. 22-23.
Richard H. Meadow, ‘A Note on the Distribution of Faunal Remains During the Later Periods of Mehrgarh (Baluchistan, Pakistan),’ in, South Asian Archaeology 1985, eds., Karen Frifelt and Per Sfrensen (Curzon Press, The Riverdale Company, Copenhagen, 1989), p. 167. M. Rafique Mughal, ‘Further Evidence of the Early Harappan Culture in the Greater Indus Valley: 1971-90,’ in, South Asian Studies 6, (1990), p. 177.
_________________________________________________________________________________

পাতা: ৫৯


তাম্রযুগ (প্রায় ৫০০০-৩৪০০ খ্রী:পূ:)

এই যুগে পাথরের ব্যবহারের সাথে মানুষ তামার ব্যবহার শুরু করে। এই যুগে মেহরগড়ের বিবরণ আমরা আগে দিয়েছি (মেহরগড় স্তর ৩)। এর সমসাময়িক কালের নিদর্শন পাওয়া গেছে কোয়েটা উপত্যকায় কিলি গুল মোহাম্মদ স্তর ২ ও ৩, কালাত অঞ্চলে টোগাও ক, মুণ্ডিগক স্তর ১, নামাযগা স্তর ২ বা হিসার যুগ ও আদি হিসার স্তর২-এর মধ্যবর্তী সময়ে। এই সময়ে মৃতের সৎকারের বৈশিষ্ট্যে ব্যাপক পরিবর্তন হয়েছিল। তখন মৃতের কবরখানায় কোন সমাধি কাঠামো ছিল না এবং লাল গিরিমাটির (red ochre) ব্যবহারও ছিল না। পূর্ব-পশ্চিম বরাবর মৃতের কবর দেবার রীতি আগের ঐতিহ্য থেকে এসেছিল। যে সমস্ত স্থানের নাম উল্লেখ করা হয়েছে সেগুলির মধ্যে যোগাযোগের প্রমাণ মেলে একই ধরনের মৃৎপাত্র ও নকশা থেকে। পাথরের ক্ষুদ্র ড্রিল এবং খোলায় (Shell) উৎকীর্ণ করার যন্ত্রপাতি থেকে বোঝা যায় যে তাম্রযুগে স্থানীয়ভাবে প্রচুর জিনিসপত্র তৈরী করা হত। এগুলো চতুর্থ সহস্রাব্দের শুরুতে পেশাগত বা শ্রেণীগত স্তরবিন্যাসের উদ্ভব প্রমাণ করে। সামাজিক-সাংস্কৃতিক স্তরে গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তনসমূহ এই অঞ্চলে নগরায়ন প্রক্রিয়ার সূচনাকে ইঙ্গিত করে। সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে তাম্রযুগের বিভিন্ন বৈশিষ্ট্য পরবর্তী আদি হরপ্পান পর্যায়ের সাথে সম্পর্কিত ছিল

আদি হরপ্পান পর্যায় (প্রায় ৩৪০০-২৬০০ খ্রী:পূ:)

এই পর্যায়ের সূচনা থেকেই কৃষি, শিল্প ও বাণিজ্যের দ্রুত বিকাশ হতে থাকে আরো বিস্তৃত এলাকা জুড়ে। প্রায় ৮০০ বৎসর ব্যাপী বিকাশমান এই পর্যায়কে তাই হরপ্পান সভ্যতার নির্মাণের কাল বলা হয়। এই পর্যায়ের সূচনা পর্বে মেহরগড় ছাড়াও বান্নু অববাহিকায় শেরিখান তারাকাই, লোয়েব্নর স্তর ৩, ঘালিগাই, আলিগ্রাম এবং তক্ষশীলা উপত্যকায় সরাই খোলায় বসতি গড়ে উঠতে দেখা যায়।

_________________________________________________________________________________
দেখুন : M. Rafique Mughal, ‘Further Evidence of the Early Harappan Culture in the Greater Indus Valley: 1971-90,’ in, South Asian Studies 6, (1990), p. 179.
দেখুন : M. Rafique Mughal, ‘The Cultural Pattern of Ancient Pakistan and Neighbouring Regions circa 7000-1500 B.C.,’ in, Pakistan Archaeology, No. 26, (1991), pp. 222-223.
রফিক মুঘল আদি হরপ্পান পর্যায়কে প্রায় ৩৪০০ খ্রী:পূ: থেকে ২৫০০ খ্রী:পূ: ধরেছেন। আমরা আদি হরপ্পানের শুরু ৩৪০০ খ্রী:পূ: রাখলেও এর সমাপ্তিকে ২৬০০ খ্রী:পূ: ধরেছি। উল্লেখ্য যে, আদি হরপ্পানের সমাপ্তি ও পরিণত হরপ্পানের শুরু একই।
_________________________________________________________________________________

পাতা: ৬০


প্রায় ৩৪০০ খ্রী:পূ: থেকে নগর সভ্যতার প্রাথমিক পর্যায় শুরু হয়। এ সময় আমরি, কোট দিজি, কালিবঙ্গান ও হরপ্পায় এর সাক্ষ্য দেখতে পাওয়া যায়। এছাড়াও এ ধরনের আরও বসতি দেখা যায় সরাই খোলা, গুমলা, জলিলপুর ও ভুট বা কালেপারে। আদি হরপ্পান (কোট দিজি সংস্কৃতির) বসতি পাওয়া গেছে ৯৫টি ; ৪০টি লাহোরের কাছে চোলিস্তানে, তক্ষশীলা উপত্যকায় ৩টি, গোমাল উপত্যকায় ২টি, বান্নু অববাহিকায় ৮টি, দক্ষিণ-পশ্চিম সিন্ধুতে ৩১টি (২৮টি আমরি সংস্কৃতির বসতি সহ)। ভারতীয় অঞ্চলে কোট দিজি - কালিবঙ্গান স্তর ১ সম্পর্কিত সংস্কৃতির চিহ্ন পাওয়া গেছে সোথি, বিঞ্জোর, মান্ডা, বনওয়ালী ও সিসওয়াল-এ। পূর্বোল্লিখিত বসতি ছাড়াও আরও ১৩১টি আদি হরপ্পান বসতি চিহ্নিত হয়েছে।
আদি হরপ্পান পর্যায়ে (Early Harappan Pase) বসতিগুলোর আয়তনও বড় হতে থাকে। যেমন, গমনওয়ালা ছিল এখন পর্যন্ত পাওয়া সবচেয়ে বড় আদি হরপ্পান বসতি, যার আয়তন ২৭.৩ হেক্টর। এছাড়াও সমসাময়িক অন্য বসতিগুলো হল জলিলপুর (১৫.৬ হে:), সরাই খোলা (১৮.৫ হে:), রহমান ধেরি (২১.৭ হে:), তারাকাই কিলা (১৬ হে:) এবং কালিবঙ্গান স্তর-১ (৪.৫ হে:)। প্রত্নতাত্ত্বিকভাবে এখন এই বিষয়টি জানা যাচ্ছে যে, ভবনসমূহের বিন্যাসে সাধারণ সমরূপতা ও ক্রমবর্ধমান জটিলতা ছিল আদি হরপ্পান পর্যায়ের বৈশিষ্ট্য। এসব বৈশিষ্ট্য বিশাল সিন্ধু-সরস্বতী উপত্যকায় সুসংগঠিত ও স্থিতিশীল মানব সমাজের বসবাসের সম্ভাবনার প্রতি ইঙ্গিত করে। কোট দিজিতে কাঁচা ইটের তৈরী বিশাল আয়তনের দুর্গ প্রাচীর এবং হরপ্পায়ও সমসাময়িক কালে একই বৈশিষ্ট্য দেখতে পাওয়াতে অনুমান করা যায় যে, বড় বড় দালান-কোঠা ও দুর্গ প্রাচীর নির্মাণে সে সময়ের অধিবাসীরা শ্রম ও অর্থনৈতিক শক্তিকে সংগঠিত করার মত সমাজ সংগঠন গড়ে তুলেছিল। এই সমস্ত কর্মতৎপরতা স্তরবিন্যস্ত সমাজ ও প্রযুক্তির সামর্থ্যের কারণেই সম্ভব হয়েছিল, যা আবার সম্ভব হয় নদীর জলকে কৃষিকাজে ব্যবহার করে বিপুল উদ্বৃত্ত উৎপাদনের ফলে। সমগ্র অঞ্চলে সাংস্কৃতিক বিকাশ একটি সমরূপ বৈশিষ্ট্য নিয়ে অগ্রসর হচ্ছিল খ্রীষ্টপূর্ব চতুর্থ সহস্রাব্দের মাঝামাঝি থেকেই।
নগরায়নের আরেকটি বৈশিষ্ট্য ছিল বাইরের অঞ্চলের সাথে দীর্ঘ দূরত্বের বাণিজ্য বা বিনিময়। আদি হরপ্পান পর্যায়ে উত্তর আফগানিস্তান থেকে লাপিস লাজুলি যেত সিন্ধু-সরস্বতী উপত্যকার বসতিগুলিতে এবং বালুচিস্তান ও রাজস্থান থেকে তামা যেত এখানকার অন্যান্য অঞ্চলে। দক্ষিণ ইরান, পূর্ব আরব সহ উপসাগরীয় অঞ্চল ও দক্ষিণ মেসোপটেমিয়ার সাথে তৃতীয় সহস্রাব্দের শুরুর দিকে মহেঞ্জোদাড়োর যোগাযোগের প্রমাণ মিলে।

_________________________________________________________________________________
দেখুন : M. Rafique Mughal, ‘Further Evidence of the Early Harappan Culture in the Greater Indus Valley: 1971-90,’ in, South Asian Studies 6, (1990), p. 181.
দেখুন : M. Rafique Mughal, ‘The Protohistoric Settlement Patterns in the Cholistan Desert,’ in, South Asian Archaeology 1987, ed., Maurizio Taddei (Istituo Italiano per il Medio ed Estremo Oriente, Rome, 1990), Part 1, pp. 146-149.
দেখুন : M. Rafique Mughal, ‘Genesis of the Indus Valley Civilization,’ in, Off-print from: Lahore Museum Bulletin, (1988), vol. 1(1), pp. 49-50.
_________________________________________________________________________________

পাতা: ৬১


আদি হরপ্পান পর্যায়ের বিভিন্ন জিনিসপত্রে শিল্পের বিশেষীকরণ দেখা গিয়েছিল। যেমন চার্ট পাথরের যন্ত্রপাতি ও অন্যান্য হাতিয়ার তৈরীর শিল্প। ছোট বস্তু পোড়ানোর চুল্লীও দেখা গিয়েছিল বিভিন্ন জায়গায়। পোড়ামাটির একই ধরনের নারী মূর্তি ও শিংওয়ালা দেবতার রঙিন চিত্র অনেক বসতিতে দেখা গেছে, যেমন, সরাই খোলা, রহমান ধেরি, বান্নু অববাহিকার বসতিগুলোতে, কালিবঙ্গান ও মান্ডাতে। অপর্যাপ্ততার কারণে সিন্ধু সভ্যতার লিপির আদি পর্যায়গুলো এখনও সেভাবে জানা যায় নি। তবে আদি হরপ্পান স্তরে মৃৎপাত্রের উপর খোদিত বা উৎকীর্ণ সাধারণ দাগ বা চিহ্নকে লিপির শুরু বলে মনে করা হয়। রহমান ধেরিতে প্রাপ্ত সিন্ধু লিপির কাছাকাছি চিহ্নযুক্ত কিছু ছোট সিলের সাথে হরপ্পার ঢিবি এফ-এ প্রাপ্ত সিল শৈলীগতভাবে মিলে। ছোট সিলে আঁকা বিভিন্ন চিহ্ন ও আঁচড় কাটা দাগ (graffiti marks) পরবর্তী পরিণত হরপ্পান পর্যায়ের সিন্ধু লিপির পথে অগ্রগমনের প্রচেষ্টা বলে মনে হয়।
সংক্ষেপে, প্রায় ৮০০ বৎসর ধরে আদি হরপ্পান পর্যায়ব্যাপী সামাজিক-অর্থনৈতিক, ধর্মীয় ও রাজনৈতিক ক্ষেত্রে যে জটিল ও পরস্পর সম্পর্কযুক্ত প্রক্রিয়া চলছিল তারই চূড়ান্ত পরিণতি ঘটে মোটামুটি ২৬০০ খ্রীষ্টপূর্বাব্দে আদি হরপ্পান পর্যায়ের সমাপ্তি এবং হরপ্পান পর্যায়ের তুলনামূলক কেন্দ্রীভবন ও জটিল নগর-ব্যবস্থাযুক্ত সভ্যতা প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে।

হরপ্পান বা পরিণত হরপ্পান পর্যায় (প্রায় ২৬০০-১৯০০ খ্রী:পূ:)
আজ থেকে প্রায় নয় বা সাড়ে নয় হাজার বছর আগে বালুচিস্তানের মেহ্রগড়ে যে জনগোষ্ঠী পশুচারী-শিকারী ও যাযাবর জীবন ছেড়ে কৃষির সূচনা ঘটিয়ে স্থিতিশীল গ্রাম গড়ে তুলেছিল তাদের উত্তরসূরিরা প্রায় পাঁচ হাজার বছরের যাত্রায় ২৬০০ খ্রী:পূ:-এর দিকে এক অতুলনীয় সভ্যতা গড়ে তোলে। এটাই হরপ্পান বা পরিণত হরপ্পান পর্যায় (Mature Harappan Phase)„ পরিণত হরপ্পান পর্যায়ের প্রধান দিকগুলো হল, অসাধারণ নগর/শহর পরিকল্পনা, বাসগৃহের জটিল স্থাপত্য, জনসাধারণের কাজে ব্যবহৃত বিশাল আকৃতির ভবন (public building),বিভিন্ন ভাস্কর্য, সিল, ধাতুশিল্প ও মৃৎশিল্পের বিপুল উৎপাদন ও প্রমিতকরণ, দীর্ঘ দূরত্বের বাণিজ্য ও বিনিময়, সামাজিক স্তরবিন্যাস ও লিপির অস্তিত্ব। এই পর্যায়ে বিশাল আয়তনের যে পাঁচটি নগর পাওয়া গেছে সেগুলো হল :

_________________________________________________________________________________
দেখুন : M. Rafique Mughal, ‘Archaeological Field Research in Pakistan Since Independence : An Overview,’ in, Bulletin of the Deccan College Post-Graduate & Research Institute, (Pune, 1990) Volume 49, p. 266.
_________________________________________________________________________________

 

পাতা: ৬২


মহেঞ্জোদাড়ো (৮৩ হেক্টর), গানেরিওয়ালা (৮১.৫ হে:), রাখিগাড়ি (৮০ হে:), হরপ্পা (৭৬ হে:) ও ধোলাভিরা বা কোটাডা (৪৭ হে:)। যতদূর এই সভ্যতা বিস্তৃত হয়েছিল ততদূর নগর পরিকল্পনার ক্ষেত্রে লক্ষণীয় সমরূপতা বা মিল দেখা যায়। একই ধরনের মিল দেখা যায় বিভিন্ন ধরনের ও মানের জিনিসপত্রে ও চিত্রশিল্পে। এখন পর্যন্ত কোন নগরেই মিসর বা মেসোপটেমিয়ার মত মন্দির বা এ জাতীয় উপাসনালয় পাওয়া যায় নি। এছাড়া ধনী বা সমাজের উঁচু শ্রেণীর কোন সমাধিও পাওয়া যায় নি, যা অন্যান্য সমাজে উচ্চ শ্রেণীর মানুষদের কবর দেবার প্রতিষ্ঠিত রীতি ছিল। নগরদুর্গ কৃত্রিমভাবে কাঁচা ইটের ও মাটির তৈরী উঁচু স্থানে হত এবং প্রাচীর ঘেরা থাকত আর নীচু নগর এর গা ঘেঁষে গড়ে উঠত। এই বিন্যাসই প্রধান নগর ও শহরগুলো কঠোরভাবে অনুসরণ করত। হরপ্পা, মহেঞ্জোদাড়ো ও কালিবঙ্গানে নগরদুর্গের অবস্থান ছিল নীচু শহরের পশ্চিমে। আর লোথাল, বনওয়ালী ও সুরকোটডায় একই প্রাচীরের মাঝখানে এর অবস্থান ছিল, যদিও নগর বা নগরদুর্গ আলাদাভাবে সীমানা প্রাচীর ঘেরা থাকত। উঁচু নগর বা নগরদুর্গ ছিল নগরের প্রশাসনিক কেন্দ্র।
নগর পরিকল্পনায় সিন্ধু সভ্যতা প্রাচীন পৃথিবীর অন্যান্য সভ্যতা থেকে অনেক উন্নত ছিল। উত্তর-দক্ষিণ ও পূর্ব-পশ্চিমগামী রাস্তাগুলো সমগ্র নগরকে আয়তাকার অনেক ব্লকে ভাগ করেছে। নগরগুলোতে নানা আকারের ঘরবাড়ী ছিল। সবচেয়ে বড়গুলো পুরু দেয়ালের তৈরী, সেগুলোতে বিরাট উঠান ও স্নানাগার, কুয়ো এবং দোতলায় ওঠার সিঁড়ি সহ অনেক কক্ষ ছিল। ছোট বাড়ীগুলোতে দু’টি থেকে চারটি কামরা ও উঠান থাকত। নগরের মধ্যে বিভিন্ন এলাকা ছিল যেখানে নানা ধরনের বিশেষীকৃত শিল্প-কারখানা গড়ে উঠেছিল ; যেমন, কুমোরের কাজের, খোলা ও পাথর খোদাই করার এবং শস্য ভাঙ্গানোর শিল্প ছিল। এখানে ইটের তৈরী যে পয়:নিষ্কাশন ব্যবস্থা গড়ে তোলা হয়েছিল তা কারিগরী দক্ষতা ও রুচিবোধের এক অতুলনীয় নিদর্শন।
হরপ্পান পর্যায়ে মৃতের সৎকারে সাধারণভাবে তিনটি পদ্ধতি প্রচলিত থাকতে দেখা যায় : (১) মৃতদেহকে কবর দেওয়া (২) বৃত্তাকার পাত্রে মৃতদেহকে রেখে মাটির নীচে পুঁতে ফেলা এবং (৩) দাহ করা। সমাধিস্থ প্রায় প্রতিটি মৃতের সাথে তার ব্যবহৃত জিনিসপত্র রাখা হত, যেমন মৃৎপাত্র, অলংকার ইত্যাদি।

_________________________________________________________________________________
কেনোয়ার এই নগরগুলোর আয়তন ধরেছেন যথাক্রমে মহেঞ্জোদাড়ো ২৫০ হে, গানেরিওয়ালা ৮০ হে:, রাখিগাড়ি ৮০ হে:, হরপ্পা ১৫০ হে:, এবং ধোলাভিরা ১০০ হে:। প্রকৃতপক্ষে এই সব মাপ বেশী হবার কারণ নগরের বাইরের কবরখানা (Cemetery)- কে প্রাচীর ঘেরা নগরের সাথে অন্তর্ভুক্ত করা। হরপ্পা ও মহেঞ্জোদাড়োর মাপে ফেনট্রেসের (১৯৭৬) পুনর্গণনাকে রফিক মুঘল সঠিক বলে উল্লেখ করেছেন (অর্থাৎ যথাক্রমে ৭৬ ও ৮৩ হে:)। ধোলাভিরার মাপ মুঘল ৪০ হে: করেছিলেন (১৯৯০)। ধোলাভিরার প্রাচীর ঘেরা স্থানের মাপ ৪৭ হে: ধরেছেন আর, এস, বিশ্ট্ (১৯৯৪), যা কেনোয়ার উল্লেখ করেছেন। গানেরিওয়ালার ক্ষেত্রে আমরা মুঘলের উল্লিখিত মাপ গ্রহণ করেছি।
দেখুন : M. Rafique Mughal ‘The Harappan “Twin Capitals” And Reality,’ in, Jounral of Central Asia, Vol. XIII, No. 1, (July, 1990), pp. 158-159. J.M. Kenoyer, Ancient Cities of the Indus Valley Civilization, (1998), pp 50-53.
_________________________________________________________________________________

 

পাতা: ৬৩


ইটের মাপে, ওজন এবং দৈর্ঘ্যরে পরিমাপে, মৃৎপাত্রের গঠন ও চিত্রিত নকশায়, চার্ট পাথরের তৈরী ফলকে, ধাতুর বিভিন্ন জিনিসপত্রে এবং সিলে সিন্ধু সভ্যতা এক উন্নত মান গড়ে তুলেছিল। এইসব সাক্ষ্য থেকে এটাই মনে করা যায় যে, হরপ্পান পর্যায়ের প্রশাসন ব্যবস্থা সব জায়গায় একই মান গ্রহণ করাবার ক্ষেত্রে খুবই দক্ষতার পরিচয় দিয়েছিল। যদিও প্রত্নতাত্ত্বিকভাবে সরকার বা প্রশাসনের বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে জানা যায় না, তবু তারা প্রাদেশিক বা আঞ্চলিকভাবে শাসন করার জন্য শ্রেণী বিভাগ গড়ে তুলতে পেরেছিল বলে মনে হয়। এর প্রমাণ মেলে সমগ্র এলাকা জুড়ে দক্ষ যোগাযোগ ব্যবস্থা রক্ষা এবং সাংস্কৃতিক একত্রীকরণের মাধ্যমে বিভিন্ন বস্তুগত সামগ্রীর প্রমিতকরণ বা স্ট্যান্ডার্ডাইজেশন থেকে। প্রাচ্য সভ্যতায় এটি নজিরবিহীন ঘটনা।
রফিক মুঘল সিন্ধু সভ্যতার একটি বৈশিষ্ট্যপূর্ণ দিক উল্লেখ করেছেন। তা হল এর বড় নগরগুলো সমদূরবর্তী। হরপ্পা থেকে পূর্বদিকে রাখিগাড়ির দূরত্ব ৩৫০ কি: মি: এবং দক্ষিণ-পশ্চিম দিকে গানেরিওয়ালার দূরত্ব ২৮০ কি: মি:। গানেরিওয়ালা থেকে ধোলাভিরার দূরত্ব ৫২২ কি: মি: এবং এর মাঝখানে অন্য কোন বড় নগর এখন পর্যন্ত আবিষ্কৃত হয় নি। সমদূরবর্তী হবার বৈশিষ্ট্য থেকে এর মাঝখানে অন্য কোন বড় নগর সিন্ধু প্রদেশের পূর্বাংশে পাওয়া যেতে পারে বলে মুঘল মনে করেন। এ থেকে সিন্ধু সভ্যতার বসতিসমূহের মধ্যে সম-দূরত্বের বিন্যাস রক্ষা করা হয়েছিল বলে বোঝা যায়।
হরপ্পান সভ্যতায় বৃহত্তর সিন্ধু-সরস্বতী উপত্যকাব্যাপী সাধারণভাবে মিল পাওয়া গেলেও বিভিন্ন স্থানে প্রত্নতাত্ত্বিকভাবে সংস্কৃতি ও ধর্মীয় ক্ষেত্রে পার্থক্যও দেখা গেছে। যেমন কালিবঙ্গান, লোথাল ও বনওয়ালী ছাড়া হরপ্পা, মহেঞ্জোদাড়ো সহ অন্যান্য স্থানে অগ্নি উপাসনার বেদি চিহ্নিত করা যায় নি। আবার হরপ্পা, মহেঞ্জোদাড়ো সহ অন্যান্য বসতিতে পোড়ামাটির নারী-মূর্তি (মাতৃ-দেবী) ও আরো অন্যান্য মানুষের মূর্তি পাওয়া গেলেও কালিবঙ্গানে একটিও পাওয়া যায় নি। এমন কি সিলেও এমন কোন মানুষের ছবি পাওয়া যায় নি যাকে দেবতা হিসাবে চিহ্নিত করা যায়। সিলে আঁকা ছবি এবং কিছু গর্তে পাওয়া পশুর হাড় থেকে কালিবঙ্গান, মহেঞ্জোদাড়ো ও লোথালে পশুবলির প্রমাণ পাওয়া গেলেও হরপ্পা সহ অন্যান্য বসতিতে এর প্রমাণ পাওয়া যায় না। সব নগর/শহরে রাস্তার পাশে ঢাকনা দেওয়া নর্দমা পাওয়া যায় না। যেমন বনওয়ালী ও ধোলাভিরায় পয়:নিষ্কাশনের জন্য নর্দমা ছিল না। তবে এখানে রাস্তার ধারে চাড়ি জাতীয় পাত্র বা শুষে নেবার গর্ত (jar or soakage pit) ছিল। ধর্মীয় স্নানের নিদর্শন মহেঞ্জোদাড়ো ও স্বল্প পরিসরে লোথালে পাওয়া গেলেও হরপ্পা, কালিবঙ্গান সহ অন্যান্য স্থানে পাওয়া যায় নি।

_________________________________________________________________________________
দেখুন : B.K. Thapar and M. Rafique Mughal, ‘The Indus Valley (3000-1500 BC),’ in, History of Humanity : Scientific and Cultural Development, (1996), vol. II, p. 254.
দেখুন : প্রাগুক্ত গ্রন্থ, ঢ়. ২৫৪.
দেখুন : M.R. Mughal, ‘The Harappan “Twin Capitals” And Reality,’ in, Journal of Central Asia, Vol. XIII, No. 1, (July, 1990), pp.155-159.
_________________________________________________________________________________

পাতা: ৬৪


সিন্ধু সভ্যতার প্রচুর সংখ্যক নগর খনন করা হলেও ব্যাপক খনন করা হয়েছে খুব কম সংখ্যক নগরীতেই। আলোচনা সংক্ষিপ্ত করার প্রয়োজনে হরপ্পা, মহেঞ্জোদাড়ো, কালিবঙ্গান, লোথাল, ধোলাভিরা (কোটাডা) এবং রাখিগাড়ি সম্পর্কে আমরা শুধুমাত্র প্রধান দিকগুলো তুলে ধরব। এই সঙ্গে সদ্য আবিষ্কৃত (২০০১) ক্যাম্বে উপসাগরে নিমজ্জিত নগর সম্পর্কে সংক্ষেপে বিবরণ দিব।
মহেঞ্জোদাড়ো পাকিস্তানের সিন্ধু প্রদেশের লারকানা জেলায় অবস্থিত। এখানকার নগরদুর্গে সবচেয়ে বিখ্যাত হল গ্রেট বাথ নামে পরিচিত চৌবাচ্চাটি। এর মাপ উত্তর পশ্চিমে ১২ মিটার, ৭ মি: চওড়া এবং ২.৫ মি: গভীরতা। এর উত্তর ও দক্ষিণ দিকের ঘাট থেকে সিঁড়ি নীচে নেমে গেছে। জিপসাম ও বিটুমিন দিয়ে এই চৌবাচ্চার তলদেশ জলরোধী করা হয়েছিল। এই স্নানাগারটি ধর্মীয় উদ্দেশ্যে ব্যবহার করা হত বলে মনে করা হয়। এই স্নানাগারের ঠিক পশ্চিম দিকে শস্যাগার ছিল। নগরদুর্গে উল্লেখ করার মত অন্য যে সব ভবনের কাঠামো পাওয়া গেছে সেগুলোর মধ্যে একজন উঁচু পদমর্যাদার প্রশাসকের বাড়ী (অথবা পুরোহিতদের প্রতিষ্ঠানও হতে পারে) এবং একটি গণমিলনায়তন। পূর্ব দিকে নীচু নগরে সকল স্তরের জনসাধারণের বসতি ছিল।
হরপ্পার অবস্থান পাঞ্জাবে রাবি নদীর কাছে। এর নগরদুর্গ উত্তর-দক্ষিণ বরাবর অনেকটা সমান্তরিকের মত। নগরদুর্গের উত্তর দিকে ব্যারাকের মত বাসগৃহ ও বৃত্তাকার কাজ করার মঞ্চ দেখা গেছে। এর বাইরে শস্যাগারের অবস্থান ছিল।
হরপ্পার নীচু নগরটিতে বাড়ীঘর ও রাস্তায় যথেষ্ট মিল দেখতে পাওয়া যায়। প্রায় সব বড় বাড়ীতে নিজস্ব কুয়ো আছে। অনেক ক্ষেত্রে ইটের তৈরী সিঁড়ি চলে গেছে দোতলায় বা ঘরের ছাদে। প্রত্যেক বাড়ীতে স্নানাগার ছিল এবং কিছু কিছু ক্ষেত্রে ঘরের দ্বিতীয় তলাতেও স্নানাগার দেখা গেছে। স্নানাগার থেকে জল নালীপথের মাধ্যমে রাস্তার মূল নর্দমায় যেত। জল নিষ্কাশনের জন্য কিছু সংখ্যক পোড়ামাটির পাইপ দেখা গেছে। এই ধরনের নিষ্কাশন ব্যবস্থা শৌচাগার থেকে রাস্তার নর্দমা পর্যন্তও ছিল। শহরের অনেক গলিতেও নর্দমা ছিল। এগুলো ইট বা পাথর দিয়ে ঢাকা থাকত। এই নর্দমাগুলোতে ম্যানহোল ছিল এবং রাস্তার মোড়ে যেখানে অন্য আরও নর্দমা মিলত সেখানে বড় গর্ত বা পিট ছিল। শেষ পর্যন্ত নর্দমাগুলো শহরের বাইরে গিয়ে পড়ত।
হরপ্পায় প্রাচীর ঘেরা এলাকাগুলো একটি মধ্যবর্তী নীচু জায়গার চারদিকে ছড়িয়ে আছে। এই নীচু জায়গাটি বড় পুকুর বা জলাধার হতে পারে। প্রতিটি টিবি কাঁচা ইটের ভারী দেয়াল দিয়ে ঘেরা; এতে ইটের তৈরী প্রবেশ পথ ও কিছু দূর পর পর বুরুজ আছে। একটি বড় গেট ছিল প্রাচীরের দক্ষিণ অংশে। এটিতে অতিরিক্ত বুরুজ ছিল। ভিতরের গেটে সিঁড়ি ছিল উপরে উঠে যাবার জন্য। গেটের খোলা অংশ ২.৮ মি: প্রশস্ত যাতে একটি গরুর গাড়ী যেতে পারে। গেটের ভিতরের অংশে বড় খোলা জায়গা ছিল যা বাজার কিংবা নগরে ঢোকা ও বের হবার সময়ে ব্যবসা সামগ্রীর চেকপয়েন্ট ছিল বলে মনে করা হয়। গেটের পূর্বে যে বড় রাস্তা দেখা যায় তা নগরের কেন্দ্রস্থল পর্যন্ত গেছে।

_________________________________________________________________________________
ধোলাভিরা নগরে দু’টি স্টেডিয়াম পাওয়া গেছে। কাজেই হরপ্পার বর্ণিত এই এলাকাটি স্টেডিয়াম বা জনসমাবেশের জন্য উন্মুক্ত স্থান হওয়াও বিচিত্র নয়।
_________________________________________________________________________________

পাতা: ৬৫


এখানে খোলার (শামুক, ঝিনুক, কচ্ছপের) এবং আকীক পাথরের কারখানা ছিল। পশ্চিম দিকে কাছাকাছি এলাকায় তামার কারখানা থাকার প্রমাণ পাওয়া গেছে। নগর প্রাচীরের বাইরে একগুচ্ছ ঘর আছে। এগুলোতে নর্দমা ও স্নানের ব্যবস্থা আছে। এগুলো নগরে আসা ভ্রমণকারী বা ব্যবসার উদ্দেশ্যে আসা যাত্রীদলের জন্য অস্থায়ী থাকার জায়গা বা সরাইখানা ছিল বলে মনে হয়। ঐতিহাসিক যুগে ভারতবর্ষে এই ধরনের সরাইখানা প্রধান নগরগুলোর বাইরে অথবা প্রধান বাণিজ্যিক পথের ধারে তৈরী করা হত।
উপরের আলোচনা সমগ্র হরপ্পার নয়। নগর ব্যবস্থার একটি চিত্র বোঝার জন্য নগরের কিছু অংশের বিবরণ দেওয়া হয়েছে।
কালিবঙ্গান নগরটি পশ্চিম দিকে তুলনামূলক ছোট ঢিবির উপর নগরদুর্গ ও পূর্ব দিকে কিছু বড় ঢিবির উপর নীচু নগর নিয়ে গঠিত। নগরের উভয় অংশই প্রাচীর ঘেরা ছিল। নগরদুর্গটি আবার মাঝ বরাবর প্রাচীর দিয়ে উত্তর ও দক্ষিণ সমানভাবে ভাগ করা। নগরদুর্গের দক্ষিণ অংশটি খুবই ভারী দেয়াল ঘেরা। এখানে পাঁচ থেকে ছয়টি বড় মঞ্চ ছিল যেগুলোর উপর অগ্নি-বেদি, ইট দিয়ে বাঁধানো গর্ত যার মধ্যে গবাদি পশুর হাড় ও বারশিঙ্গা হরিণের শিঙ পাওয়া গিয়েছিল। পাশে কুয়ো ও নর্দমাও ছিল। নগরদুর্গের উত্তরের অংশে ঘরবাড়ী ছিল, যেগুলো সম্ভবত উচ্চ শ্রেণী বা শাসকশ্রেণীর ছিল। দু’টি অংশেরই পরস্পরের যোগাযোগের জন্য প্রবেশপথ ছিল। বাড়ী-ঘরগুলো কাঁচা ইটের ছিল, যার মাপ ছিল ৩০×১৫×৭.৫ সে:মি:। নগরের রাস্তায় কোন নর্দমা দেখা যায় না। তবে ঘরের নর্দমাগুলো থেকে ময়লা রাস্তার নীচে প্রথিত শুষে নেবার গর্তে (soakage jar) গিয়ে পড়ত। নগরের প্রধান দু’টি অংশ ছাড়াও নীচু নগরের পূর্ব দিকে কিছু কাঠামো পাওয়া গেছে যেগুলো পূজায় ব্যবহৃত হত।
লোথাল ক্যাম্বে উপসাগরের উপকূলীয় সমভূমিতে অবস্থিত। এখানে পাঁচটি স্তরে ধারাবাহিক বসতি পাওয়া গেছে। এই বসতিটি মাটি ও কাঁচা ইটের প্রাচীর ঘেরা ছিল। এর দক্ষিণ-পূর্ব অংশটি নগরের অন্যান্য অংশ থেকে ৭ মি: উঁচু ছিল। এর উপর কাঠামোগুলোকে শাসকদের বাসস্থান, ইটের মেঝেবিশিষ্ট স্নানাগার এবং গুদামঘর বা শস্যাগার বলে মনে করা হয়। নগরের পূর্ব পাশে একটি ডকইয়ার্ড আছে যা প্রাচীনকালে কৃত্রিম খাল দিয়ে নদীর সাথে সংযুক্ত ছিল। ডকইয়ার্ডের পাশে ইটের তৈরী জাহাজঘাট শহরের গোটা পূর্ব পাশ জুড়ে ছিল। ডকইয়ার্ডে অতিরিক্ত জল নিষ্কাশন করার জন্য স্পীলওয়ে এবং এর নিষ্কাশন দ্বার বন্ধ করার জন্য ব্যবস্থাও ছিল। এর ফলে জোয়ারের জল প্রবেশে নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখা এবং স্বয়ংক্রিয়ভাবে খালের পলি পরিষ্কার করা সম্ভব হত। এই ডকের প্রান্তে অনেক পাথর পাওয়া গিয়েছিল যেগুলো নোঙর হিসাবে ব্যবহৃত হত।

পাতা: ৬৬


ধোলাভিরা (বা কোটাডা) গুজরাটে কচ্ছের রানে অবস্থিত। এটি নগরদুর্গ, মধ্যবর্তী নগর, নীচু শহর এবং দু’টি স্টেডিয়াম নিয়ে গঠিত। এখানে নগরদুর্গটি শহরের দক্ষিণ দিকে অবস্থিত। কালিবঙ্গান ও সুরকোটডার মত এর দু’টি সংযুক্ত উপবিভাগ আছে। নগরদুর্গের উত্তর দিকে চওড়া ও দীর্ঘ ভূমিখণ্ড আছে যেটা উৎসব বা বিশেষ অনুষ্ঠানের জন্য সর্ব সাধারণের মিলনস্থান হিসাবে, স্টেডিয়াম হিসাবে এবং বাৎসরিক মেলার সময় কেনাকাটার স্থান হিসাবে ব্যবহৃত হত বলে মনে করা হয়। এই স্থানে দুই পাশে জনসাধারণের বসার জায়গা ছিল। আরও উত্তরে প্রাচীর ঘেরা মধ্য নগর এবং পূর্ব দিকে নীচু নগর ছিল। নীচু নগর আলাদাভাবে প্রাচীর দিয়ে ঘেরা না থেকে সমগ্র নগর ব্যাপীই সীমানা প্রাচীর ছিল। নগরের উত্তর দরজার পাশের দু’টি কক্ষের একটিতে বড় আকৃতির দশটি সিন্ধু লিপি বা চিহ্ন পাওয়া গেছে। এটি ধসে পড়া সাইনবোর্ড বলে মনে করা হয়। কাঠের তক্তার উপর লিপিগুলো খোদাই করে জিপসাম দিয়ে ভরাট করা হয়েছিল। এই লেখাগুলো এত বড় যে (প্রায় ৩৭ সে:মি: উচ্চতা ও ২৫ থেকে ২৭ সে: মি: প্রশস্ত), সমস্ত নগর থেকে দেখা যেত। এটিকে এ পর্যন্ত প্রাপ্ত হিসাবে পৃথিবীর প্রথম সাইনবোর্ড বলা যায়।
এই নগরের নর্দমাব্যবস্থা খুবই উন্নত ছিল। আর, এস, বিশ্ট্ উল্লেখ করেছেন যে, নগরদুর্গ থেকে বৃষ্টির জল জলাধারে সংরক্ষণের জন্য খুবই কার্যকর ব্যবস্থা গড়ে তোলা হয়েছিল। সমস্ত নর্দমা সতর্কতার সাথে তৈরী করা হয়েছিল। পাথরের তৈরী মসৃণ মেঝে, দুই পাশের দেয়াল ও ছাদ এবং অল্প দূর পর পর ছাদের উপর ছোট ছিদ্রের ব্যবস্থা ছিল। এগুলো যদিও বেশ সংকীর্ণ তবু সাধারণ উচ্চতার একজন মানুষ এই সব ছিদ্র দিয়ে নীচে নেমে যেতে পারে এবং নর্দমা পরিষ্কার করতে পারে। হরপ্পান পর্যায়ে সেখানকার অধিবাসীরা নগর প্রাচীরের ভিতর বিভিন্ন মাপের ষোল বা ততোধিক জলাধার তৈরী করেছিল। এই সব জলাধার থেকে নগরবাসীরা একদিকে তাদের ব্যবহার্য জলের সরবরাহ পেত আর অন্য দিকে কৃষিকাজে সেচের জন্য জল সরবরাহ হত। সাম্প্রতিক খননে দু’টি জলাধারের চমৎকার নিদর্শন পাওয়া গেছে। এর একটির উত্তর দিকে অবস্থিত বাঁধ থেকে ৩১টি সিঁড়ির ধাপ নীচে তলদেশ পর্যন্ত চলে গেছে। এখানকার বাঁধ ও সিঁড়িগুলো পাথরের তৈরী এবং এগুলো অত্যন্ত উঁচু মানের কারিগরী দক্ষতার পরিচয় দেয়।
মধ্যবর্তী নগর, নীচু নগর এবং সংযুক্ত স্থানে ঘরের ময়লা নিষ্কাশন করার জন্য রাস্তার পাশে চাড়ি বা চৌবাচ্চা বসানোর প্রমাণ পাওয়া গেছে, যা সমসাময়িক অনেক হরপ্পান নগরীতে ছিল। তবে এখন পর্যন্ত খনন কার্যের সর্বশেষ তথ্যাদি আমাদের হাতে না থাকায় নগরদুর্গে নর্দমা বা গৃহের নিষ্কাশন ব্যবস্থা সম্পর্কে বিবরণ দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না।

_________________________________________________________________________________
আর, এস, বিশ্ট্ ধোলাভিরায় খনন কাজ পরিচালনা করছেন। তিনি এটিকে পৃথিবীর প্রথম স্টেডিয়াম হিসাবে উল্লেখ করেছেন। বিস্তারিত জানার জন্য দেখুন :
R.S. Bisht, ‘Dholavira and Banawali : Two different Paradigms of the Harappan Urbis Forma,’ in, Puratattva (1999), No. 29.
দেখুন : প্রাগুক্ত গ্রন্থ।
_________________________________________________________________________________

পাতা: ৬৭


রাখিগাড়ির অবস্থান ভারতের হরিয়ানা প্রদেশে, দিল্লী থেকে ১৫০ কিলোমিটার দূরে। এখানে মাটি খুঁড়ে সভ্যতার তিনটি স্তর পাওয়া গেছে­ এগুলো হল আদি, পরিণত ও বিদায়ী হরপ্পান। এখানে হাকরা মৃৎ-সংস্কৃতির হরপ্পান পর্যায়ের ইটের পুরু স্তর এবং নির্মাণ সামগ্রী পাওয়া গেছে। আগে এখানে প্রাচীন যুগের লোকসংখ্যা ৫০,০০০ এর নীচে বলে মনে করা হত। কিন্তু খননের অধীনে ২২৪ হেক্টর এলাকা আনার পর মনে করা হচ্ছে যে, এর লোকসংখ্যা ৫০,০০০-এর যথেষ্ট উপরে ছিল। অন্যান্য হরপ্পান সংস্কৃতির নগরের মত এখানেও প্রধান রাস্তা, গলি ও ঢাকনাযুক্ত পয়:নিষ্কাশন ব্যবস্থা ছিল। এছাড়াও পাওয়া গেছে মাটির মেঝেতে বৃত্তাকার ও ত্রিকোণাকার আগুনের চুল্লী বা বেদি, কাঁচা ইটের আস্তরণ দেওয়া পশুবলির গর্ত ও খোলা পুড়িয়ে চুন তৈরী করার জন্য নির্মিত চুল্লী।
ধাতব জিনিসপত্রের মধ্যে পাওয়া গেছে সোনার পুতি, সোনার তৈরী মাথার ব্যান্ড, একটি সাদা ধাতুর বালা (সম্ভবত রূপার) ও তামার বালা এবং তামার বড়শি। এছাড়াও এখানে বিপুল পরিমাণ সিন্ধু সিল ও লিপি পাওয়া গেছে। একটি সিলিন্ডারাকৃতির সিলের একদিকে পাঁচটি হরপ্পান লিপি এবং অন্যদিকে আছে একটি কুমিরের ছবি­ যা রাখিগাড়িতে প্রাপ্ত হরপ্পান যুগের জিনিসপত্রের মধ্যে অনন্য। তবে প্রাপ্ত পোড়ামাটির পশুর মূর্তি সংখ্যায় অন্য সবগুলোকে ছাড়িয়ে গেছে। এগুলোর মধ্যে গবাদিপশু, গলবন্ধনীসহ কুকুর, ইত্যাদি আছে। প্রত্নতাত্ত্বিকরা কাঁচা হাতে তৈরী একটি মানুষের মূর্তিও পেয়েছেন। এছাড়াও আদি হরপ্পান যুগের বিপুল পরিমাণ স্টীয়েটাইট পাথরের পুতি ও অলংকার আবিষ্কৃত হয়েছে।
সম্প্রতি (২০০১ সালে) গুজরাটের সুরাট উপকূল থেকে ৩০ কিলোমিটার দূরে ক্যাম্বে উপসাগরের ৩০-৪০ মিটার গভীরে একটি প্রাচীন নগরের ধ্বংসাবশেষ পাওয়া গেছে। এই নগরটি একটি প্রাচীন নদী খাতের দু’পাশে ৫ মাইল দীর্ঘ ও ২ মাইল প্রশস্ত এলাকা জুড়ে বিস্তৃত। প্রাচীন কালে এই নদীটি পূর্ব-পশ্চিম বরাবর প্রবাহিত হত। এই স্থানে সমুদ্রগর্ভে ড্রেজিং করে কাদা থেকে পাওয়া গেছে বেশ কিছু সংখ্যক জিনিসপত্র যেগুলোর মধ্যে আছে পাথরের যন্ত্রপাতি, অলংকার ও মানুষের চোয়ালের হাড় ও দাঁত।
সমুদ্রের নীচে শব্দ ব্যবহার করে প্রাপ্ত প্রতিচ্ছবি (Sonar image) থেকে পাওয়া গেছে মহেঞ্জোদাড়োর গ্রেট বাথ-এর চেয়ে বিশালতর ও ধাপ বিশিষ্ট গ্রেট বাথ (আকার ও আয়তন অলিম্পিক সুইমিং পুলের অনুরূপ)। এখানকার কিছু কাঠামোর মধ্যে রয়েছে ৪০ মি:× ৪০ মি: এবং ৪৫ মি:× ২০মি: মাপের জলাধার। এছাড়াও কিছু কিছু নির্মাণ কাঠামো ৯৭ মি:× ২৪ মি: মাপের। আরো পাওয়া গেছে ১৭৩ মি: দীর্ঘ শস্যাগার এবং একটি আয়তাকার মঞ্চ যা ২০০ মি: দীর্ঘ এবং ৪৫ মি: প্রশস্ত যা হরপ্পার নগরদুর্গের সাথে তুলনীয়। এই সব বিশাল কাঠামোর অদূরে আয়তাকার ভিত্তি ছিল যেগুলো ধ্বংসপ্রাপ্ত বাড়ি ঘরের চিহ্ন যার বাইরে কাঁচা রাস্তা ও পয়:নিষ্কাশন ব্যবস্থা। এখানে বহুতল ভবনের কিছু কাঠামো চিহ্নিত করা গেছে যেগুলোকে মহেঞ্জোদাড়োর একই ধরনের কাঠামোর সাথে তুলনা করা যায়।

_________________________________________________________________________________
১৯৯৭ সাল থেকে অমরেন্দ্র নাথের পরিচালনায় রাখিগাড়িতে খনন কাজ চলছে।
তথ্যসূত্র : ইন্টারনেট।
_________________________________________________________________________________

পাতা: ৬৮


এখানকার চমকপ্রদ আবিষ্কারগুলোর একটি হল এই নগরের পাশে প্রাচীন নদীখাতে মানুষ নির্মিত আড়াআড়ি বাঁধ বা গবরবন্দ্। এই ধরনের বাঁধ প্রাচীনকালে বালুচিস্তান ও সিন্ধু প্রদেশে ছোট ছোট নদীতে দেওয়া হত জল ও পলি সঞ্চয় করে চাষাবাদ করার জন্য। এছাড়াও অনুসন্ধানে দেখা গেছে যে, ঐ প্রাচীন নদীখাত থেকে অনেক নদী উৎপন্ন হয়েছে। যে নদীর তীরে এই নগর অবস্থিত তাকে সরস্বতী নদী বলে ধারণা করছেন পণ্ডিতদের কেউ কেউ।
আরো কিছু আশ্চর্যজনক আবিষ্কারের মধ্যে পাওয়া গেছে চুল্লীতে পোড়ানো মৃৎপাত্রের ভাঙ্গা অংশ, সূক্ষ্মভাবে ছিদ্র করা গোলাকার ও ত্রিভুজাকার পোড়া মাটির কেক, ২ ইঞ্চি দীর্ঘ সিলিন্ডারাকৃতির পুতি যার অক্ষ বরাবর ছিদ্র করা দু’টি ট্যাবলেট খোদাই চিত্রযুক্ত ও লিপিযুক্ত যেগুলো হরপ্পান সংস্কৃতির, মূর্তি, অলংকার, পাথরের যন্ত্রপাতি, বিভিন্ন ধরনের ফসিলীভূত হাড়, হাতির দাঁত, ইত্যাদি। তবে প্রাপ্ত জিনিসপত্রের অনেকগুলোই আদি হরপ্পান পর্যায়ের।
নিমজ্জিত এই নগর থেকে পাওয়া ফসিলীভূত একটি কাঠের টুকরোর রেডিও কার্বন পরীক্ষায় দু’টি সময় পাওয়া গেছে -- একটি ৫৫০০ খ্রী:পূ: অপরটি ৭৫০০ খ্রী:পূ:। তবে ৭৫০০ খ্রী:পূ:-এর হিসাব অধিক জোরালো বলে মনে করা হচ্ছে। আরো অনুসন্ধান চালিয়ে ঐ স্থান থেকে বিভিন্ন জিনিসের ভগ্নাবশেষ যেমন -- নির্মাণ সামগ্রী, মৃৎপাত্র, দেয়ালের অংশ, পুতি, ভাস্কর্য, মানুষের হাড় ও দাঁত বিভিন্ন গবেষণাগারে কার্বন পরীক্ষা করা হচ্ছে এবং সেখানকার চূড়ান্ত প্রতিবেদনের জন্য আমরা অপেক্ষা করছি।
ক্যাম্বে উপসাগরে (খাম্বাট উপসাগর) পাওয়া ভূতাত্ত্বিক কারণে সাগর গর্ভে নিমজ্জিত এই নগরের আবিষ্কার পণ্ডিত সমাজে ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি করেছে। কারণ এখন পর্যন্ত মনে করা হয় পৃথিবীর সবচেয়ে প্রাচীন নগর সমাজ মেসোপটেমিয়াতে গড়ে ওঠে প্রায় ৩০০০-৩৫০০ খ্রী:পূ:- এর দিকে। এর পর প্রাচীন মিসরে নগর বসতি গড়ে উঠতে দেখা যায় ৩০০০ খ্রী:পূ:-এ। অন্যদিকে সিন্ধু বা হরপ্পান সভ্যতার নগর বসতি গড়ে ওঠে আরো পরে খ্রীষ্টপূর্ব তৃতীয় সহস্রাব্দের প্রথম দিকে। কাজেই এই নিমজ্জিত নগরের প্রাচীনত্ব প্রমাণিত হলে সমগ্র মানব সভ্যতার ইতিহাসই বদলে যাবে।১

অর্থনীতি ও বাণিজ্য
হরপ্পান পর্যায়ের অর্থনৈতিক ভিত্তি ছিল কৃষি ও পশুপালন এবং বৃহত্তর সিন্ধু-সরস্বতী উপত্যকার ভিতর এবং বাইরে কাঁচামাল ও উৎপাদিত পণ্যের সংগ্রহ ও বিনিময়। প্রত্নতাত্ত্বিকভাবে প্রমাণ হয়েছে যে, এখানে হরপ্পান পর্যায়ে প্রচুর গবাদিপশু পালন হত।
_________________________________________________________________________________
তথ্যসূত্র : ইন্টারনেট।
_________________________________________________________________________________

 

পাতা: ৬৯


দ্বিতীয় সহস্রাব্দের শুরু থেকে গৃহপালিত উট, ঘোড়া এবং গাধা থাকার কথা জানা গেছে। বছরে দুইবার ফসল উৎপাদন হত। দানাদার শস্যের মধ্যে পাঁচ জাতের গম, তিন জাতের ছয় সারি-বিশিষ্ট যব, বিভিন্ন ধরনের কলাই (field peas, chick peas), মসুর, তিসি, বদরী ফল (jujube) এবং সর্ষে। খেজুর (dates), তুলো এবং আঙ্গুরও চাষ করা হত। ধান উৎপাদনের প্রমাণ পাওয়া গেছে লোথাল, রংপুর ও পিরকে। চোলিস্তান অঞ্চলে ও বনওয়ালীতে যে সব পোড়ামাটির লাঙ্গল পাওয়া গেছে সেগুলো আজকের ব্যবহৃত লাঙ্গলের খুব কাছাকাছি। তামা, টিন, সোনা, রূপা, চুনাপাথর, অ্যালাব্যাস্টার, ব্যাসল্ট পাথর, গ্রানাইট পাথর, মার্বেল পাথর, স্লেট পাথর, স্টীয়েটাইট পাথর, জিপসাম, বিটুমিন, লাপিস লাজুলি, কার্নেলিয়ান এবং অন্যান্য পাথরের মধ্যে জেড পাথর, নীলকান্তমণি ও আমাজোনাইট পাথর সিন্ধু সভ্যতায় পাওয়া গেছে। এসবের অনেকগুলোরই উৎস বৃহত্তর সিন্ধু-সরস্বতী উপত্যকার বাইরে এবং কিছু ক্ষেত্রে অনেক দূরে। এসব কাঁচামাল সংগ্রহের জন্য এখানকার অধিবাসীদের আফগানিস্তান, বালুচিস্তান, মধ্য এশিয়া, উত্তর-পূর্ব ইরান ও দক্ষিণ ভারতের সাথে বাণিজ্য করতে হত। এছাড়া এখানকার নগর-শহরগুলোর কারখানায় তৈরী বিভিন্ন ধরনের ধাতু, পাথর ও খোলার জিনিস মেসোপটেমীয় সভ্যতার নগরগুলোতে যেত। সমুদ্র পথে পূর্ব আরব সহ পারস্য উপসাগরীয় অঞ্চলের সাথে সিন্ধু সভ্যতার বাণিজ্য গড়ে উঠার প্রমাণ পাওয়া গেছে।
সিন্ধু সভ্যতার আদি হরপ্পান থেকে পরিণত হরপ্পান পর্যায়ে আসার পর দেখা যায় যে, বালুচিস্তানের মাকরান থেকে গুজরাট পর্যন্ত সমুদ্র উপকূলব্যাপী এর বসতিসমূহ বিস্তার লাভ করেছে। এটি হরপ্পান পর্যায়ে সমুদ্র বাণিজ্যের উপর গুরুত্ব দান ও তুলনামূলক নির্ভরশীলতা বোঝায়। জর্জ এফ, ডেল্স এমন সম্ভাবনার কথা উল্লেখ করেছেন যে, সিন্ধু সভ্যতার কাঁচামাল ও অন্যান্য উৎপাদিত পণ্যের উপর মেসোপটেমিয়ার তৎকালীন আক্কাদীয় সভ্যতা এতটা নির্ভরশীল হয়ে পড়েছিল যে, হরপ্পান সভ্যতায় ক্ষয় শুরু হলে সেখানেও এর ব্যাপক প্রভাব পড়ে এবং সিন্ধু সভ্যতা থেকে সেখানে পণ্য রপ্তানী বন্ধ হয়ে গেলে আক্কাদীয় সভ্যতার পতন হয়। একটি বিষয় লক্ষণীয় যে, মেসোপটেমিয়ায় সিন্ধু সভ্যতার বেশ কিছু পরিমাণ সিল ও অন্যান্য জিনিসপত্র পাওয়া গেলেও, বিপরীতভাবে এখানে মেসোপটেমিয়ার সামান্য কয়েকটি সিল পাওয়া গেছে। এ থেকে মেসোপটেমিয়া ও সিন্ধু সভ্যতার বাণিজ্যে সিন্ধুর বণিকদের প্রাধান্য ও পণ্য রপ্তানীতে নিয়ন্ত্রণ বোঝা যায়।
_________________________________________________________________________________
সাম্প্রতিক দশকগুলোতে ব্যাপক খনন কাজের ফলে পরিণত হরপ্পান এমন কি আদি হরপ্পান পর্যায়েও ঘোড়া থাকার প্রমাণ পাওয়া গেছে। আদি হরপ্পান এবং পরিণত হরপ্পান পর্যায়ে অন্যান্য অনেক প্রাণীর হাড়ের সাথে ঘোড়ার হাড় পান রিচার্ড মিডো। এ সম্পর্কে জানার জন্য দেখুন : George F. Dales and J. Mark Kenoyer, ‘The Harappa Project 1986-1989: New Investigation at an Ancient Indus City,’ in, Harappan Civilization: A Recent Perspective, ed. Gregory L. Possehl (1993), p. 513. বি,কে, থাপার ও রফিক মুঘল গৃহপালিত ঘোড়ার উপস্থিতির কথা জানাচ্ছেন : ‘......By the beginning of the second millennium BC, however, the domestic camel, horse and donkey were also present, while the onager wild boar, gazelle and rhinoceros were hunted ......’ B.K. Thapar and M. Rafique Mughal ‘The Indus Valley (3000-1500 BC),’ in, History of Humanity : Scientific and Cultural Development, (1996), vol, II. p. 257.
এ বিষয়ে ডেলস্ তাঁর লেখায় বিস্তারিত আলোচনা করেছেন। দেখুন : George F. Dales, 'Of Dice and Men', in, Ancient Cities of the Indus (1979), pp. 143-144.
_________________________________________________________________________________

পাতা: ৭০


সিন্ধু লিপি

পরিণত হরপ্পান পর্যায়ের শুরু থেকেই সিন্ধু লিপিকে তার পরিণত রূপে দেখা যায়। এই লিপিকে চিত্রলিপি (Pictographic) হিসাবে পণ্ডিতরা বলেন। এই লিপির সাথে সমসাময়িক মিসর বা মেসোপটেমিয়ার লিপির কোন মিল নেই। এই লেখাগুলো প্রধানত সিলে পাওয়া যায়। এছাড়া মৃৎপাত্র, হাতির দাঁতের দণ্ড, তামার জিনিস এবং ট্যাবলেটেও লিপি পাওয়া গেছে। এই লিপিগুলোতে ৪০০টি নির্দিষ্ট প্রতীক বা চিহ্ন আছে। এই লেখাগুলো ডান থেকে বামে এবং দ্বিতীয় লাইনে লেখার ক্ষেত্রে বাম থেকে ডানে লেখা হত, যাকে boustrophedon mode বলে। সিন্ধু লিপি পাঠোদ্ধারের অনেক চেষ্টা চলছে, কিন্তু তা এখনও সফল হয় নি।
সিলের উপর লিপি ছাড়াও বিভিন্ন ছবি উৎকীর্ণ থাকত, যেগুলোর মধ্যে গরুর সংখ্যা প্রচুর ছিল। কিছু সিলে স্বস্তিকা চিহ্ন পাওয়া গেছে। পরবর্তীকালে ভারতবর্ষে ধর্মীয় ও পবিত্র চিহ্ন হিসাবে স্বস্তিকার ব্যবহার দেখা যায়। জার্মানীতে নাজীরা তাদের পতাকায় আর্যত্বের প্রতীক হিসাবে এই চিহ্ন ব্যবহার করত।

বিদায়ী হরপ্পান পর্যায় (প্রায় ১৯০০-১০০০ খ্রী:পূ:)
পরিণত হরপ্পান সভ্যতার সমাপ্তি এবং বিদায়ী হরপ্পান পর্যায়ের (Late Harappan Phase) শুরু সব জায়গায় একই সময়ে হয় নি। তবে এটি মনে করা হয় যে, কেন্দ্রীয় অঞ্চলে ক্ষয় শুরু হয়েছিল সবার আগে। এখানকার বসতিগুলো থেকে পাওয়া সময়ের হিসাব বিভিন্ন রকম হওয়ায় সরস্বতী (হাকরা-ঘাগর) নদীর গতিপথ পরিবর্তনের সময়ের সাথে বিদায়ী হরপ্পান পর্যায়ের সেমেট্রি এইচ সম্পর্কিত বসতির শুরুর সময়কে মেলালে এই পর্যায়ের শুরুর সময় ২২০০ থেকে ২১০০ খ্রী:পূ: হবার সম্ভাবনা থাকে। অন্যদিকে

_________________________________________________________________________________
দেখুন : Asko Parpola, ‘Interpreting the Indus Script,’ in, Frontiers of the Indus Civilization, ed. B.B. Lal and S.P. Gupta (Published by Books and Books, New Delhi, 1984), p. 180.
দেখুন : Iravatham Mahadevon, The Indus Script (Archaeological Survey of India, New Delhi, 1977), p. 11.
বৃহত্তর সিন্ধু-সরস্বতী উপত্যকায় পরিণত হরপ্পান পর্যায়ের সমাপ্তি সাধারণভাবে ১৯০০ খ্রী:পূ: ধরলেও এর কেন্দ্রীয় অঞ্চলে ক্ষয়ের শুরু সম্পর্কে রফিক মুঘল তাঁর দুটি লেখায় (১৯৮৯ ও ১৯৯০) ২১০০/২০০০ খ্রী:পূ: এবং ২২০০ ও ২১০০ খ্রী:পূ:-এর মধ্যে- এই দুই ধরনের সময়ের কথা বলেছেন। পরবর্তী লেখায় তিনি যে সময় উল্লেখ করেছেন আমরা সেটিকে গ্রহণ করেছি। বিস্তারিত জানার জন্য দেখুন : M. Rafique Mughal, ‘Jhukar and the Late Harappan Cultural Mosaic of the Greater Indus Valley,’ in, South Asian Archaeology 1989, ed. Catherine Jarrige (Prehistory Press, Madison, Wisconsin, 1992), p. 217. M. Rafique Mughal, ‘The Decline of the Indus Civilization and the Late Harappan Period in the Indus Valley,’ in, Lathore Museum Bulletin (Off Print Vol. III, No. 2, July-Dec. 1990), p. 8.
_________________________________________________________________________________

পাতা: ৭১


পাকিস্তান ও ভারতের অনেক বসতির প্রত্নতাত্ত্বিক সাক্ষ্য থেকে জানা যায় যে, এই পর্যায়ের শুরুর সময় প্রায় ২০০০ খ্রী:পূ: থেকে আরম্ভ করে ১৭০০ খ্রী:পূ: পর্যন্ত হয়। বৃহত্তর সিন্ধু-সরস্বতী উপত্যকায় বিদায়ী হরপ্পান পর্যায় তিনটি ভিন্ন অঞ্চলে হরপ্পান ঐতিহ্য রক্ষা করে টিকেছিল। এগুলোর মধ্যে সেমেট্রি এইচ ধারা অবিভক্ত পাঞ্জাব, উত্তর রাজস্থান, হরিয়ানা এবং পশ্চিম উত্তর-প্রদেশে অব্যাহত ছিল। দ্বিতীয় ধারাটি ছিল নিম্ন সিন্ধু উপত্যকায় যা ঝুকর ও উত্তর কুল্লি ধারা নামে পরিচিত। তৃতীয় ধারাটি রংপুর স্তর ২খ-২গ নামে পরিচিত। এটি গুজরাট অঞ্চলে রংপুর, লোথাল, সুরকোটডা, প্রভৃতি বসতিতে দেখা যায়। এই তিনটি অঞ্চলে বিদায়ী হরপ্পান পর্যায় খ্রীষ্টপূর্ব প্রায় প্রথম সহস্রাব্দ পর্যন্ত টিকে ছিল।
চিত্রিত ধূসর মৃৎশিল্পের যুগ (প্রায় ১২০০-৮০০ খ্রী:পূ:) নামে বিদায়ী হরপ্পান পর্যায়ের একটি সাংস্কৃতিক ধারাকে গাঙ্গেয় উপত্যকার দিকে সম্প্রসারিত হতে দেখা যায়।
উপরের আলোচনা থেকে একটি বিষয় স্পষ্ট যে, হরপ্পান নগর সভ্যতা দীর্ঘকাল ধরে ক্ষয় হয়েছে। এরপর এই বসতিগুলো পরিত্যক্ত হতে দেখা যায় এবং সেখানকার অধিবাসীরা গাঙ্গেয় উপত্যকার দিকে বসতি স্থাপন করতে শুরু করে। বিদায়ী হরপ্পান পর্যায়ে আর নগর গড়ে ওঠে নি। সিলের ব্যবহার বাতিল হয়ে যায়। তবে এ সময় লিপির ব্যবহার দেখা যায় মৃৎপাত্রের গায়ে। পরিণত হরপ্পান পর্যায়ের ওজন এই পর্যায়েও টিকে ছিল। আগের পর্যায়ের অত্যন্ত সংগঠিত দীর্ঘ পথের নৌ ও স্থল বাণিজ্য আর এ পর্যায়ে দেখা যায় না। ধাতুর ব্যবহারও অনেক কমে যায়। হরপ্পান সামাজিক ও ধর্মীয় অনেক প্রথাও এ পর্যায়ে টিকে ছিল। মৃতদেহকে আগের মতই কবর দেওয়া ও দাহ করা হত। হরপ্পান নগর পর্যায়ের পোড়ামাটির বিভিন্ন ধরনের মূর্তি, যাকে প্রত্নতাত্ত্বিকরা ‘মাতৃ-দেবী’র মূর্তি বলেন, সেগুলোকে এই পর্যায়ে কোথায়ও দেখা যায় না।
সিন্ধু সভ্যতার প্রাথমিক পর্যায় থেকে নগর সভ্যতার যুগ ও তার বিদায়ী পর্যায় পর্যন্ত ধারাবাহিক বিকাশের বৈশিষ্ট্য বোঝার জন্য পাকিস্তানের চোলিস্তান অঞ্চল থেকে প্রাপ্ত একটি তালিকা দেওয়া হল।

_________________________________________________________________________________
প্রাগুক্ত গ্রন্থ, p. 8.
দেখুন : M. Rafique Mughal, ‘The Decline of the Indus Civilization and the Late Harappan Period in the Indus Valley,’ in, Lahore Museum Bulletin, (off-print Vol. III, No. 2, July-Dec. 1990).
দেখুন : :S.R. Rao, ‘New Light on the Post-Urban/Late Harappan Phase of the Indus Civilization in India,’ in, Harappan Civilization : A Contemporary Perspective, ed. Gregory L. Possehl (Oxford & IBH Publishing Co, New Delhi, 1982), p. 358.
দেখুন : M. Rafique Mughal, ‘The Protohistoric Settlement Pattern in the Cholistan Desert’, in South Asia Archaeology 1987, (1990), p 143.
_________________________________________________________________________________

পাতা: ৭২


সংস্কৃতির পর্যায় সময়কাল বসতির সংখ্যা
হাকরা মৃৎশিল্প খ্রী:পূ: ৪র্থ সহস্রাব্দ ৯৯
আদি হরপ্পান ৩১০০/৩০০০-২৫০০ খ্রী:পূ: ৪০
হরপ্পান (বা পরিণত হরপ্পান) ২৫০০-২০০০/১৯০০ খ্রী:পূ: ১৭৪
বিদায়ী হরপ্পান ১৯০০-১৫০০ খ্রী:পূ: ৫০
চিত্রিত ধূসর মৃৎশিল্প ১১০০/১০০০-৫০০ খ্রী:পূ: ১৪

চোলিস্তান হল রাজস্থানের থর মরুভূমির সম্প্রসারণ। প্রাচীনকালে এর উপর দিয়েই হাকরা-ঘাগর (প্রাচীন সরস্বতী নদীর একাংশ) নদী বয়ে যেত সারা বছর। এখানে সিন্ধু সভ্যতায় বসতির ঘনত্ব সবচেয়ে বেশী পাওয়া গেছে। কাজেই উপরের তালিকাটি সিন্ধু সভ্যতার বৈশিষ্ট্য বোঝার জন্য গুরুত্বপূর্ণ।

সিন্ধু সভ্যতার কিছু বৈশিষ্ট্য
খ্রীষ্টপূর্ব অষ্টম সহস্রাব্দ থেকে খ্রীষ্টপূর্ব প্রথম সহস্রাব্দ পর্যন্ত প্রায় সাড়ে ছয় হাজার বছরের সাংস্কৃতিক ধারাবাহিকতা রক্ষা করতে মিসর, মেসোপটেমিয়া, চীন সহ কোন সভ্যতাকে দেখা যায় না। পণ্ডিতরা এখন নিশ্চিত হয়েছেন যে, সিন্ধু সভ্যতার নির্মাণে বাইরের সভ্যতাগুলোর সাথে বিনিময় এবং যোগাযোগের ভূমিকা থাকলেও সম্পূর্ণ নিজস্ব উদ্যোগে ও স্বাধীনভাবে তা গড়ে উঠেছিল। সিন্ধু উপত্যকায় নরকংকালের উপর গবেষণা চালিয়ে সেখানকার নৃতাত্ত্বিক জনগোষ্ঠী সম্পর্কে আরো যে চমকপ্রদ তথ্য পাওয়া গেছে তাতে জানা যাচ্ছে যে, সুপ্রাচীনকালে এই অঞ্চলের জনগোষ্ঠীতে দু’টি ছেদ দেখা যায়­ প্রথমটি হল মেহরগড়ে নবপ্রস্তর যুগ থেকে তাম্রযুগে উত্তরণের পর্যায়ে (অর্থাৎ প্রায় ৫০০০ খ্রীষ্টপূর্বাব্দের দিকে) এবং দ্বিতীয়টি হল ৮০০ খ্রীষ্টপূর্বাব্দের পরে। মাঝখানে এই দীর্ঘ সময়ে এই অঞ্চলের নৃগোষ্ঠীগত বৈশিষ্ট্যে স্পষ্ট ধারাবাহিকতা বজায় ছিল। অর্থাৎ একাধারে সাংস্কৃতিক ও নৃগোষ্ঠীগত ধারাবাহিকতা থাকায় এখানে প্রাগৈতিহাসিককালে বহিরাগত জনগোষ্ঠী হিসাবে আর্যদের আগমনের কোন পথ থাকে না। সিন্ধু সভ্যতার আরেকটি

_________________________________________________________________________________
দেখুন : Jim G. Shaffer & Diane A. Lichtenstein ‘Migration, Philology and South Asian Archaeology.’ in, Aryan and Non-Aryan in South Asia, (1999), pp. 247-257.
দেহগত নৃবিজ্ঞানী কেনেথ কেনেডি এই বিষয়ে বলছেন : ‘Our multivariate approach does not define the biological identity of an ancient Aryan population, but it does indicate that the Indus Valley and Gandhara peoples shared a number of craniometric, odontometric and discrete traits that point to a high degree of biological affinity. Evidence of demographic discontinuities is present in our study, but the first occurs between 6000 and 4500 B.C (a separation between the Neolithic and Chalcolithic populations of Mehrgarh) and the second is after 800 B.C., the discontinuity being between the peoples of Harappa, Chalcolithic Mehrgarh and post-Harappan Timargarha on the one hand and the late Bronze Age and early Iron Age inhabitants of Sarai Khola on the other. In short, there is no evidence of demographic disruptions in the northwestern sector of the subcontinent during and immediately after the decline of the Harappan culture.’
Kenneth A.R. Kennedy, ‘Have Aryans been identified in the prehistoric skeletal record from South Asia? Biological anthropology and concepts of ancient races,’ in, The Indo-Aryans of Ancient South Asia; Language, Material Culture and Ethnicity, ed. George Erdosy (Munshiram Manoharlal Publishers Pvt. Ltd., New Delhi, 1997), pp. 49-60.
এছাড়াও অন্য একটি লেখায় কেনেডি বলেন : ‘The important message for archaeologists from this example is that whatever the racial origins of the Harappans may have been they were a relatively stable population inhabiting the northern and northwestern sectors of the Subcontinent for several millenia prior to their climatic moment of urbanization and commercial influence ....’
Kenneth A.R. Kennedy. ‘Skulls, Aryans and Flowing Drains:The Interface of Archaeology and Skeletal Biology in the Study of the Harappan Civilization’, in, Harappan Civilization: A Contemporary Perspective, (1982), p. 290.

_________________________________________________________________________________

পাতা: ৭৩


গুরুত্বপূর্ণ দিকের উপর লেখকরা আলোকপাত করেছেন, সেটা হল সভ্যতা নির্মাণে যুদ্ধ ও বলপ্রয়োগ এখানে অপ্রধান ভূমিকা পালন করেছে। যুদ্ধে ব্যবহৃত জিনিসপত্র যেমন বড় তরবারী, বর্ম, ঢাল, শিরস্ত্রাণ, ইত্যাদি সিন্ধু সভ্যতার বসতিগুলিতে এমন কি যাকে নগরদুর্গ বলা হয় সেখানেও পাওয়া যায়নি। কিছু ছোট অস্ত্র পাওয়া গেছে যেগুলিকে কোন কোন প্রত্নতাত্ত্বিক যুদ্ধাস্ত্র বলেছেন সেগুলি সংখ্যায় কম ও নিম্ন মানের। বেশ কিছু সংখ্যক হরপ্পান নগর ও শহর উঁচু প্রাচীর দিয়ে ঘেরা ছিল। এসব প্রাচীরে বড় প্রবেশ-দ্বার থাকত। তাছাড়া লোকজনের ভিতরে প্রবেশের জন্য সিঁড়িও থাকত আলাদাভাবে। নগর প্রাচীরের বিভিন্ন বৈশিষ্ট্য পর্যবেক্ষণ করে পণ্ডিতরা নিশ্চিত হয়েছেন যে, এসব নগর প্রাচীর মূলত যুদ্ধে প্রতিরক্ষার জন্য তৈরী করা হয় নি। এগুলি তৈরীর একটি প্রধান উদ্দেশ্য ছিল বন্যা প্রতিরোধ করা।
অন্য দিকে মেসোপটেমিয়া ও মিসরে সভ্যতা নির্মাণে যুদ্ধ একটি প্রধান দিক ছিল। এখানকার পাওয়া অস্ত্র পরিমাণে বেশী ও উন্নতমানের। তাছাড়া এখন পর্যন্ত পাওয়া সিন্ধু সভ্যতার সমস্ত সিল ও চিত্রাঙ্কিত বিভিন্ন ফলকের মধ্যে কেবলমাত্র একটিতে যুদ্ধের ছবি দেখা যায়। মেসোপটেমিয়া ও মিসরের নগরগুলিতে যে প্রাচীর ছিল তা যুদ্ধে প্রতিরক্ষার জন্য তৈরী করা হয়েছিল। এই দুই সভ্যতার বিভিন্ন যুগে বিভিন্ন ফলকে যে সব ছবি পাওয়া গেছে তার মধ্যে বেশ কিছু ছবিই যুদ্ধ বা যুদ্ধ জয়ের সাথে সম্পর্কিত। যুদ্ধে সুমেরীয়রা ছিল খুবই নিষ্ঠুর। বেশীর ভাগ যুদ্ধবন্দীদের তারা সাথে সাথে হত্যা করত এবং বাকীদের আজীবনের জন্য দাস করে রাখত। শত্রুদের অধিকৃত শহরগুলো শুধু লুঠ করা হত না, বাড়ীঘর পোড়ানো হত বা মাটির সাথে মিশিয়ে ফেলা হত এবং যারা বেঁচে থাকত তারা


_________________________________________________________________________________
দেখুন : B.B. Lal, ‘Some Reflections on the Structural Remains at Kalibangan’, in, Frontiers of the Indus Civilization (1984), p. 55.
_________________________________________________________________________________

 

পাতা: ৭৪


বিভিন্ন জায়গায় পালাত। মিসরে রাষ্ট্র নির্মাণের সূচনা থেকেই যুদ্ধ ও বল প্রয়োগের প্রমাণ পাওয়া গেছে। খ্রীষ্টপূর্ব চতুর্থ সহস্রাব্দে ঊর্ধ ও নিম্ন মিসর একত্রীকরণ এবং মিসরে আদি রাষ্ট্র গঠনের সময়ে হায়ারাকোনপোলিসে (Hierakonpolis) রাজা নরমারের ফলকে কিছু ছবি আঁকা আছে। সেখানে মৃত শত্রুদের এবং লোকজন অথবা বসতিসমূহের পরাভূত অবস্থা দেখানো হয়েছে। এই রাজার রাজদণ্ডের মাথায় কিছু ছবি ও চিহ্নে যুদ্ধবন্দী ও যুদ্ধে লুণ্ঠিত দ্রব্য দেখানো হয়েছে। রাজা স্করপিয়ানের রাজদণ্ডের মাথায়ও বিজিত মানুষদের ছবি ছিল। যদিও যুদ্ধে ধ্বংসপ্রাপ্ত কোন স্তর সেসময় পাওয়া যায় নি তবু এ বিষয়ে প্রত্নতাত্ত্বিকরা নিশ্চিত যে, যুদ্ধের মাধ্যমে মিসরে আদি রাজবংশের সুদৃঢ়করণ এবং প্রথম রাজবংশের আদিতে নিম্ন নুবিয়া ও দক্ষিণ প্যালেস্টাইনে মিসরীয় রাষ্ট্রশক্তির সম্পসারণ হয়। এরপর সমগ্র মিসরীয় সভ্যতার নানা সময়ে যুদ্ধের সাথে সম্পর্কিত প্রচুর ছবি এবং হায়ারোগ্লিফিক লিপিতে এসবের বর্ণনা পাওয়া যায়।
কিন্তু সিন্ধু সভ্যতার কোন পর্যায়েই যুদ্ধের কারণে এই ধরনের ধ্বংসকাণ্ড বা ব্যাপক গণহত্যার প্রমাণ পাওয়া যায় না। এখন পর্যন্ত প্রাপ্ত তথ্যে কেবলমাত্র কোট দিজি, আমরি ও গুমলাতে আদি হরপ্পান থেকে হরপ্পান স্তরের মাঝখানে আগুনে পোড়ানো চিহ্ন পাওয়া গেছে। এগুলো যুদ্ধের কারণে বলে মনে হয়। তাছাড়া কালিবঙ্গানে এই দুই স্তরের মাঝে ঘরের দেয়ালে ফাটলের চিহ্ন দেখা গেছে। এগুলো ভূমিকম্পের কারণে হয়েছিল বলে প্রত্নতাত্ত্বিকরা মনে করেন। বনওয়ালীতে বিভিন্ন ভবনে ফাটলের চিহ্ন এবং গুমলাতে ধ্বংসের প্রমাণ পাওয়া গেছে। এসব উদাহরণ থেকে সেখানে আদি হরপ্পান ও হরপ্পান পর্যায়ের মাঝখানে যুদ্ধের কারণে ধ্বংস হবার বিষয়টি নাকচ করা যায় না। এছাড়া মহেঞ্জোদাড়োতে কিছু হত্যাকাণ্ডের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। প্রত্নতাত্ত্বিক মর্টিমার হুইলার একে ‘গণহত্যা’ বললেও সম্প্রতি আরও গবেষণার ফলে এই মত প্রশ্নের সম্মুখীন হয়েছে। সমগ্র সিন্ধু সভ্যতার ব্যাপ্তি ও বসতির সংখ্যার তুলনায় এইসব দৃষ্টান্ত খুবই কম এবং এগুলো এই সভ্যতার সামগ্রিক প্রবণতাকে প্রকাশ করে না। কারণ কোন ফলক ও সিলে অথবা অন্য কোন কিছুতে এমন কোন ছবি পাওয়া যায় না যা সিন্ধু সভ্যতায় বল প্রয়োগ বা যুদ্ধের উপস্থিতিকে প্রকাশ করে (একটি ব্যতিক্রম ছাড়া)।
যদিও সুমেরীয়রা শিল্পকলায় সিন্ধু সভ্যতার তুলনায় দক্ষ ছিল, তবু বিভিন্ন তথ্য থেকে তাদের এক নিষ্ঠুর ও নির্মম সভ্যতা সম্পর্কে জানা যায়। প্রত্নতাত্ত্বিকরা কিছু গুরুত্বপূর্ণ মানুষের, সম্ভবত রাজা বা রাজপুত্রদের কবর থেকে বিপুল সংখ্যক মানুষের কংকাল পেয়েছিলেন। এই কবরগুলোতে এ সমস্ত নারী-পুরুষকে সেখানেই হত্যা করা হয়েছিল বলে অনুমান করা হয়। সম্ভবত তারা রাজার দাস-দাসী ছিল। এধরনের একটি কবরের
_________________________________________________________________________________
দেখুন : Kathryn A. Bard, 'The Emergence of the Egyptian State (C.3200-2686 BC)' in, The Oxford Histry of Ancient Egypt. ed., Ian Shaw (Oxford University Press, Oxford, 2000), pp-61-88.
_________________________________________________________________________________

পাতা: ৭৫


প্রবেশপথে তামার শিরস্ত্রাণ ও বল্লম সজ্জিত পাহারারত ভঙ্গিতে মৃতদেহ রাখা হয়েছিল। একজন রাণীর সমাধিতে তার সামনে সম্ভবত রাজপ্রাসাদের পরিচারিকা বা দাসীদের কবর দেওয়া হয়েছিল। এখানে আরও ছিল হার্পসহ একজন হার্পবাদক এবং আনত অবস্থানে দু’জন পরিচারকের দেহ। এসব বিবরণ থেকে যে কেউ রাজা বা রাণীর মৃত্যুর পর তাদের সেবক-সেবিকা বা দাস-দাসীদের ভয়ংকর পরিণতি কল্পনা করতে পারবেন। মৃত্যু পরবর্তী জগতে শাসকদের সেবা করবার জন্য যে তাদের হত্যা করার ধর্মীয় প্রথা ছিল তাতে কোন সন্দেহ নেই। প্রাচীন চীনেও বিভিন্ন সময়ে এই ধরনের প্রথা থাকার প্রমাণ পাওয়া গেছে। সেখানে রাজার সমাধিতে শতাধিক দাসদাসী হত্যা করে কবর দেবার ঘটনাও জানা গেছে। এই ধরনের কোন নিষ্ঠুর প্রথার প্রচলন বৃহত্তর সিন্ধু-সরস্বতী উপত্যকায় দেখা যায় না। যুদ্ধ ও বলপ্রয়োগের প্রাধান্য ছাড়া সমাজে এরকম প্রথার প্রচলন সম্ভব নয়।
ধর্মীয় ক্ষেত্রে সুমেরীয়দের মধ্যে সাকার দেবতার পূজা (অর্থাৎ প্রতিমা পূজা) এবং বহুদেবতাবাদ প্রচলিত ছিল। রাষ্ট্রীয় দেবতার মূর্তি হত বৃহদাকার। এছাড়া প্রায় বাড়ীগুলোতেই ছোট মূর্তি পাওয়া গেছে, যেগুলো গৃহদেবতা বা বিভিন্ন গোষ্ঠীর নিজস্ব দেবতার প্রতিমা বলে মনে হয়। সিন্ধু সভ্যতায়ও মূর্তি পাওয়া গেছে। কিন্তু সেগুলো কোনটাই খুব বড় আকৃতির নয়। এমনকি এখন পর্যন্ত আবিষ্কৃত সবচেয়ে বড় নগর মহেঞ্জোদাড়োতেও বড় ভবনের সাথে সংশ্লিষ্ট যে সব মূর্তি পাওয়া গেছে সেগুলোর কোনটাকেই দেবতার মূর্তি বলে চিহ্নিত করা যায় নি। এছাড়া মাথায় অলংকারযুক্ত খুবই ছোট পোড়া মাটির নারী মূর্তি সিন্ধু সভ্যতার বিভিন্ন জায়গায় পাওয়া গেলেও সেগুলোর সাথে রাষ্ট্রীয় দেবতা বা শাসক শ্রেণীর ধর্মের কোন সংশ্লিষ্টতা দেখা যায় না।
সিন্ধু সভ্যতায় প্রত্নতাত্ত্বিকরা কোন রাজার সমাধি, মন্দির বা রাজপ্রাসাদ খুঁজে পান নি। যেসব বড় ভবনের কাঠামো পাওয়া গেছে সেগুলো ধনীদের বাসস্থান বা গণমিলনায়তন বা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বলে মনে করা হয়। কিন্তু এককভাবে কোন ভবনই তত বড় ও জাঁকজমকপূর্ণ ছিল না যাতে করে তাকে রাজপ্রাসাদ বা মন্দির বলে চিহ্নিত করা যায়। যে সব কবর পাওয়া গেছে সেগুলির মধ্যে কিছু সংখ্যককে অন্যগুলির তুলনায় বেশী বা উন্নতমানের জিনিসপত্র, যেমন মৃৎপাত্র, অলংকার, পাথর বা ব্রোঞ্জের অস্ত্র ইত্যাদি থেকে ধনীর সমাধি বলে চিহ্নিত করা যায়, কিন্তু রাজার সমাধি হিসাবে কোনটিকে নির্দিষ্ট করা যায় না। বড় বাড়ীগুলো নগরের এক জায়গায় কেন্দ্রীভূত না হয়ে সমস্ত নগর বা শহরব্যাপী সমভাবে ছড়ানো ছিল। একইভাবে ধাতুর তৈরী জিনিসপত্র, যা সে যুগে ধনীদেরই কেবল ব্যবহার করার কথা, নগরের কোন বিশেষ স্থানে না থেকে সমস্ত শহরব্যাপী পাওয়া গেছে।

_________________________________________________________________________________
দেখুন : John Elder., Archaeology and the Bible (Robert Hale Limited, London, 1961), p. 39.
এ বিষয়ে জিম শেফার তাঁর লেখায় বিস্তারিত আলোচনা করেছেন। দেখুন : Jim G. Shaffer, ‘Harappan Culture: A Reconsideration,’ in, Harappan Civilization : A Recent Perspective, ed. Gregory L. Possehl, (Oxford & IBH Publishing Co. Pvt. Ltd., New Delhi, 1993) pp. 41-50.
_________________________________________________________________________________

পাতা: ৭৬


এ থেকে বোঝা যায় যে, নগরে শাসক থাকলেও তাকে কেন্দ্র করে ধনীরা অবস্থান করে না বরং সমস্ত নগরে ছড়িয়ে থাকে, এমনকি নগরের নীচু স্তরের মানুষদের বাড়ীর কাছেও। এগুলো হরপ্পান সভ্যতায় তুলনামূলক সাম্য ও গণতন্ত্র থাকার সম্ভাবনাকে প্রকাশ করে। ধনী ও দরিদ্রের তুলনামূলক পার্থক্যহীনতার প্রমাণ পাওয়া গেছে হরপ্পান যুগের নরকংকালের উপর গবেষণা চালিয়ে। অন্যান্য সভ্যতায় এটি একটি সাধারণ বৈশিষ্ট্য যে একই সমাজের উঁচু শ্রেণীর মানুষেরা নীচু শ্রেণীর মানুষের তুলনায় অপুষ্টিজনিত সমস্যায় কম ভোগে ও দৈর্ঘ্যে অধিকতর লম্বা হয়। খুবই আশ্চর্য হবার মত বিষয় যে, হরপ্পান সভ্যতায় এই ধরনের পার্থক্য দেখা যায় নি। বিপুল জন-অধ্যুষিত এই সভ্যতায় এই ঘটনা সমাজের সর্বস্তরে সমৃদ্ধিকে নির্দেশ করে।
অন্যদিকে, মিসরে ও মেসোপটেমিয়ায় সব যুগেই রাজার সমাধি চিহ্নিত করা গেছে অন্যান্য সমাধি থেকে এর বৃহদাকার নির্মাণ ও মূল্যবান সামগ্রী থেকে। মিসরের রাজারা, যাদেরকে ফারাও বলা হত, সমগ্র সভ্যতার শক্তিকে নিয়োজিত করেছিল তাদের মৃত্যু পরবর্তী জীবনের সুখের জন্য বিশাল বিশাল পিরামিড তৈরী করায়। মেসোপটেমিয়ায় রাজপ্রাসাদ হত বড়। মন্দিরগুলো প্রথম দিকের তুলনায় পরের যুগগুলোতে সমাজের শক্তি ও সম্পদ বৃদ্ধির সাথে বড় হতে থাকে। সে সময়ে মন্দির বা জিগগুরাটগুলো তৈরী করা হত বিশালায়তনে। সিন্ধু সভ্যতায় ধনী-দরিদ্র সবাই নগর বা শহরে দালান-বাড়ীতে বসবাস করত এবং এখানে কোন বস্তি ছিল না। প্রত্নতাত্ত্বিকভাবে এর প্রমাণ পাওয়া গেছে। কিন্তু মেসোপটেমিয়ার নগরগুলোতে দরিদ্ররা থাকতে পারত না বলে ধারণা করা হয়। খুব সম্প্রতি
_________________________________________________________________________________
এ প্রসঙ্গে কেনেথ কেনেডি বলেছেন : ‘... ... .. High ranking individuals enjoy a greater potential to attain their full ontogenetic development, hence are taller in stature, and tend to suffer less from abnormalities of nutritional stress than do individuals of subordinate social status within the same society. However, observations of Harappan skeletal series from five major sites, which comprise about 350 individuals, have not revealed significant differences in patterns of growth and development as would be recognized by lines of arrested growth in long bones and hyper-palsia or dental enamel. Osseons malformations suggestive of nutritional stress are absent as well. Nor are there any striking differences in incidences of dental attrition and common dental pathologies such as caries, abscess, malocclusion and ante-mortem tooth loss in Harappan skeletons. In short, the Harappan skeletal series is aberrant when compared with series from other archaeological sites for which archaeological data suggest a significant development of social stratification. This negative evidence from the Harappan sample should not be interpreted to mean that a social hierarchy was absent in Harappan culture. Rather, biological observations suggest that social control may have been exercised by the Harappan elite in a way that did not evoke the usual dietary stresses so often imposed elswhere upon an urban proletariat. The absence of royal tombs in Harappan centers may be significant in this connection.’ Kenneth A.R. Kennedy, ‘Skulls, Aryans and Flowing Drains : The Interface of Archaeology and Skeletal Biology in the Study of the Harappan Civilization,’ in, Harappan Civilization: A Contemporary Perspective, (1982), P. 290.
_________________________________________________________________________________

 

পাতা: ৭৭


প্রত্নতাত্ত্বিক খননগুলো থেকে এ বিষয়ে আলোকপাত করা হয়েছে। মনে করা হচ্ছে যে, নগরের বাইরে তারা ঝুপড়ি বা কাঁচা বাড়ীঘর তৈরী করে থাকত। মিসর বা মেসোপটেমিয়া উভয় সভ্যতায় রাজা ও ধনীদের বাড়ীঘরগুলো নগরের নির্দিষ্ট স্থানে কেন্দ্রীভূত হত। তুলনামূলক কম ধনীদেরগুলো দূরে নগরের প্রান্তীয় এলাকায় অবস্থান করত। তাছাড়া ধাতুর তৈরী জিনিসপত্রও ধনীদের বাড়ীঘরগুলোতেই কেন্দ্রীভূত থাকত। এসব প্রত্নতাত্ত্বিক প্রমাণ থেকে এই সিদ্ধান্তে আসা যায় যে, এইসব সভ্যতায় ক্ষমতা ও সম্পদ একটি কেন্দ্রে কেন্দ্রীভূত থাকত এবং সমাজে ব্যাপক অসাম্য ছিল।
মেসোপটেমীয় সভ্যতায় যে সামাজিক-অর্থনৈতিক বিপুল বৈষম্য ছিল তার প্রমাণ পাওয়া যায় সেখানকার উর নগরে রাজকীয় কবরখানা থেকে প্রাপ্ত তথ্যে :

রাজকীয় কবর ৫টি অত্যন্ত বড়, সম্পদে পূর্ণ, উৎসর্গীকৃত (নিহত) দাস-দাসীসহ
ধনী, রাজকীয় নয় ২০টি পর্যাপ্ত ধাতুর জিনিসপত্র, মূল্যবান পাথর, অন্যান্য সম্পদ
ধনী সাধারণ ৪৩৫টি কিছু ধাতব জিনিসপত্র
সাধারণ ৮২৫টি মৃৎপাত্র

পাঠক কল্পনা করুন রাজকীয় কবরখানায় ‘সাধারণ’ স্তরের মানুষের কবরে যদি শুধুমাত্র মৃৎপাত্র পাওয়া যায়, তাহলে যারা একেবারে দরিদ্র এবং যাদের কবর দেবার সুযোগ রাজকীয় কবরখানায় হত না তাদের কী অবস্থা হতে পারে!
সিন্ধু সভ্যতায় দেখা যায় বড় নগরগুলো কাছাকাছি আয়তনের। যেমন মহেঞ্জোদাড়ো (৮৩ হে:), গানেরিওয়ালা (৮১.৫ হে:), হরপ্পা (৭৬ হে:) ও রাখিগাড়ি (৮০ হে:)। হরপ্পান যুগে বৃহত্তর সিন্ধু-সরস্বতী উপত্যকায় বিভিন্ন ক্ষেত্রে মিল থাকাতে একটি কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রণের অস্তিত্ব থাকার প্রমাণ মেলে। তার মানে প্রচলিত ধারণায় এখানে একটি রাজধানী থাকতে হবে যেখান থেকে সমগ্র অঞ্চল শাসন করা যায়। সম্প্রতি আবিষ্কৃত ক্যাম্বে উপসাগরে নিমজ্জিত নগর ছাড়া মহেঞ্জোদাড়ো সবচেয়ে বড় হলেও অন্য বড় নগরগুলো এর কাছাকাছি আয়তনের। সাধারণত দেখা যায় রাজধানী অন্যান্য নগরের চেয়ে অনেক বড় হয়। এক্ষেত্রেও সিন্ধু সভ্যতা ব্যতিক্রম। মহেঞ্জোদাড়ো অথবা ক্যাম্বে নগর যেটাই রাজধানী হয়ে থাকুক কোনটাই সাধারণভাবে সাম্রাজ্যে ক্ষমতার অতিরিক্ত কেন্দ্রীভবনের প্রতি ইঙ্গিত করে না।
অথচ মিসরে ফারাও-এর অধীনে কেন্দ্রীভূত রাষ্ট্র উদ্ভূত হতে দেখা যায়। একেবারে প্রথম থেকেই রাজা ও তার সভাসদদের কেন্দ্র করে রাজধানী থেকে এই শাসন ব্যবস্থা প্রদেশ ও গ্রাম পর্যন্ত প্রসারিত ছিল। বিপুল সম্পদ রাজপ্রাসাদে কেন্দ্রীভূত হত। রাজধানী, ঘর-বাড়ী, জন-বসতি সবকিছুর বিন্যাসে ক্ষমতা ও সম্পদের চূড়ান্ত রকম অসম বন্টন প্রতিফলিত হতে দেখা যায়।

_________________________________________________________________________________
বিস্তারিত আলোচনার জন্য দেখুন : Susan Pollock, Ancient Mesopotamia, (Cambridge University Press, Cambridge, 1999), pp. 46-52.
দেখুন : C.C. Lamberg- Karlovsky and R. Wrigth, ‘The Tigris and Euphrates Valley (3000-1500 BC),’ in, History of Humanity: Scientifc and Cultural Development, (1996), vol. II, p. 174.
_________________________________________________________________________________

পাতা: ৭৮

pic-7
পাতা: ৭৯

pic-8
পাতা: ৮০

pic-9
পাতা: ৮১

pic-10
পাতা: ৮২

pic-11
পাতা: ৮৩

pic-12
পাতা: ৮৪

pic-13
পাতা: ৮৫

pic-14
পাতা: ৮৬

pic-15
পাতা: ৮৭

pic-16
পাতা: ৮৮

pic-17
পাতা: ৮৯

pic-19
পাতা: ৯০

pic-21
পাতা: ৯১

pic-22
পাতা: ৯২

pic-23-25
পাতা: ৯৩

pic-26&27
পাতা: ৯৪

pic-28&29
পাতা: ৯৫

pic-30
পাতা: ৯৬

pic-31&32
পাতা: ৯৭

pic-33&34
পাতা: ৯৮

pic-35&36
পাতা: ৯৯

pic-37
পাতা: ১০০

pic-38
পাতা: ১০১

pic-39
পাতা: ১০২

pic-40
পাতা: ১০৩

pic-41
পাতা: ১০৪

pic-42
পাতা: ১০৫

pic-43&44
পাতা: ১০৬

সাম্প্রতিক পোষ্টসমূহ