লিখেছেনঃ শামসুজ্জোহা মানিক এবং শামসুল আলম চঞ্চল, আপডেটঃ September 28, 2012, 12:00 PM, Hits: 1942
প্রকৃতপক্ষে কোন ধর্ম বহিরাক্রমণকারীদের হস্তক্ষেপে কিংবা সমাজের অভ্যন্তরীণ ধর্মীয় কিংবা সামাজিক ঐতিহ্যকে সম্পূর্ণ অস্বীকার করে জন্ম নিতে এবং বিকাশ লাভ করতে পারে না। বরং সমাজের ঐতিহ্য বিশেষত বিদ্যমান ধর্মীয় ঐতিহ্যকে আত্মস্থ কিংবা ব্যবহার করেই ধর্ম সংস্কারকগণ নূতন ধর্ম প্রতিষ্ঠা করেছেন, যার ব্যতিক্রম বৈদিক ঋষিরাও নন।
ইহুদী ধর্মের প্রবর্তক মোশি (মুসা) আনুমানিক খ্রীষ্টপূর্ব দ্বাদশ শতাব্দীতে মিসরের ফারাও রামেসিসের রাজত্বকালে তাঁর ধর্ম সংস্কার শুরু করেন। বাইবেলের বক্তব্য অনুযায়ী প্রায় ৪৩০ বৎসর পূর্বে মিসরে ১২টি ইসরাইলী উপজাতি নীল নদের উত্তর অববাহিকায় গোশেন নামক জায়গায় বসতি স্থাপন করেছিল এবং মিসরের ফারাওরা তাদেরকে দাসে পরিণত করেছিলেন। মিসরে দাসত্বে আবদ্ধ বহিরাগত এই উপজাতিগুলির মধ্যে একেশ্বরবাদের ঐতিহ্য ছিল। তাদের মিসরে অবস্থানের শেষ পর্যায়ে ইসরাইলীয়দের জনসংখ্যা ও শক্তি বৃদ্ধি পাচ্ছিল। তাদের মধ্যে ক্রমবর্ধমান মুক্তির আকাঙ্ক্ষাকে রূপ দেন মোশি ইহুদীদের ঈশ্বর ইয়াহ্ ওয়েহ্ বা যিহোবার নামে। তবে ‘যিহোবা’ নামে দেবতা ইসরাইলীয়দের কাছে সেই সময় অল্প পরিচিত কিংবা সাধারণভাবে অপরিচিত ছিল বলে মনে হয়। ইহুদীদের ধর্মীয় গ্রন্থ, যা বাইবেলের ওল্ড টেস্টামেন্ট বা পুরাতন নিয়ম১ নামে পরিচিত, সেখান থেকে কিছু অংশ উদ্ধৃত করলে নূতন ধর্ম প্রতিষ্ঠার বিষয়টি বোঝা যায় :
‘পরে সদাপ্রভু কহিলেন, সত্যিই আমি মিসরস্থ আপন প্রজাদের কষ্ট দেখিয়াছি, এবং কার্যশাসকদের সমক্ষে তাহাদের ক্রন্দনও শুনিয়াছি; ফলত আমি তাহাদের দু:খ জানি। আর মিস্রীয়দের হস্ত হইতে তাহাদিগকে উদ্ধার করিবার জন্য, এবং সেই দেশ হইতে উঠাইয়া লইয়া উত্তম ও প্রশস্ত এক দেশে, অর্থাৎ কনানীয়, হিত্তীয়, ইমোরীয়, পরিষীয়, হিব্বীয় ও যিবুষীয় লোকেরা যে স্থানে থাকে, সেই দুগ্ধমধুপ্রবাহী দেশে তাহাদিগকে আনিবার জন্য নামিয়া আসিয়াছি। এখন দেখ, ইস্রায়েল-সন্তানগণের ক্রন্দন আমার নিকট উপস্থিত হইয়াছে, এবং মিস্রীয়েরা তাহাদের প্রতি যে দৌরাত্ম্য করে, তাহা আমি দেখিয়াছি। অতএব এখন আইস, আমি তোমাকে ফরৌণের নিকটে প্রেরণ করি, তুমি মিসর হইতে আমার প্রজা ইস্রায়েল-সন্তানদিগকে বাহির করিও। মোশি ঈশ্বরকে কহিলেন, আমি কে, যে ফরৌণের নিকটে যাই, ও মিসর হইতে ইস্রায়েল-সন্তানদিগকে বাহির করি? তিনি কহিলেন, নিশ্চয় আমি তোমার সহবর্তী হইব; এবং আমি যে তোমাকে প্রেরণ করিলাম, তোমার পক্ষে তাহার এই চিহ্ন হইবে; তুমি মিসর হইতে লোকসমূহকে বাহির করিয়া আনিলে পর তোমরা এই পর্বতে ঈশ্বরের সেবা করিবে।
_________________________________________________________________________________
১ গ্রীক biblion শব্দ থেকে Bible শব্দের উৎপত্তি। biblion মানে গ্রন্থ। সুতরাং বাইবেল অর্থ গ্রন্থ। বাইবেল প্রকৃতপক্ষে খ্রীষ্টানদের দেওয়া নাম। বাইবেলের নূতন নিয়ম, পুরাতন নিয়মের ভাগও তাদের করা। ইহুদীরা যেহেতু যীশুর সংস্কার বা নূতন নিয়মকে মানে না সেহেতু তারা তাদের ধর্মগ্রন্থকে পুরাতন নিয়ম বাইবেল বলে না। ইহুদীরা তাদের ধর্মগ্রন্থকে হিব্রু ভাষায় বলে তনখ (Tanakh)। এই নাম তাদের ধর্মগ্রন্থের তিনটি বিভাগের প্রতিটির হিব্রু ভাষার আদ্যক্ষর নিয়ে গঠিত। বিভাগ তিনটির হিব্রু নাম হচ্ছে : তোরাহ্ ((torah),), নেবিইম (Nebiim) এবং কেতুবিম (Ketubim)।
_________________________________________________________________________________
পাতা: ৩৬
পরে মোশি ঈশ্বরকে কহিলেন, দেখ, আমি যখন ইস্রায়েল-সন্তানদের নিকটে গিয়া বলিব, তোমাদের পিতৃপুরুষদের ঈশ্বর তোমাদের নিকটে আমাকে প্রেরণ করিয়াছেন, তখন যদি তাহারা জিজ্ঞাসা করে, তাঁহার নাম কি? তবে তাহাদিগকে কি বলিব? ঈশ্বর মোশিকে কহিলেন, “আমি যে আছি সেই আছি”; আরও কহিলেন,ইস্রায়েল-সন্তানদিগকে এইরূপ বলিও, “আছি” তোমাদের নিকটে আমাকে প্রেরণ করিয়াছেন। ঈশ্বর মোশিকে আরও কহিলেন,তুমি ইস্রায়েল-সন্তানদিগকে এই কথা বলিও, যিহোবা (সদাপ্রভু), তোমাদের পিতৃপুরুষদের ঈশ্বর, অব্রাহামের ঈশ্বর, ইস্হাকের ঈশ্বর ও যাকবের ঈশ্বর তোমাদের নিকটে আমাকে পাঠাইয়াছেন; আমার এই নাম অনন্তকাল স্থায়ী, এবং এতদ্বারা আমি পুরুষে পুরুষে স্মরণীয়।’ (বাইবেল, পুরাতন নিয়ম; যাত্রাপুস্তক, ৩:৭-১৫)১
উপরের উদ্ধৃতি থেকে একটি বিষয় স্পষ্ট যে, মোশি তার গোত্রসমূহের কাছে তাদের অতীত পিতৃপুরুষদের ঈশ্বর বা দেবতার উল্লেখ করেছেন তাদের প্রাচীন ধর্মীয় ঐতিহ্যকে ধারণ করার জন্য। সমাজমানস গ্রহণ করতে পারে এমন ধারণাকে নূতনভাবে প্রতিষ্ঠিত করতে হয় নূতন যুগের ধর্মনেতাদের। তাই তাদের পুরাতন ঐতিহ্য ও ধারাকে ব্যবহার করতে হয় সাধারণ মানুষের কাছে পৌঁছাবার জন্য। সমাজে প্রচলিত পৌরাণিক কাহিনী বা মিথসমূহকেও ব্যবহার করতে হয়। নিশ্চয় ইসরাইলীয় উপজাতিগুলি জানত যে, তাদের প্রাচীন ও বিখ্যাত পূর্বপুরুষরা হলেন আব্রাহাম, ইসহাক, যাকব প্রভৃতি। সম্ভবত এই প্রাচীন গোত্রপতিরা এক ঈশ্বরের কিংবা বহু দেবতার কাঠামোর মধ্যে এক প্রধান ও সর্বোচ্চ ক্ষমতাধর দেবতার ধারণার অনুসারী ছিলেন। ফলে মোশির পক্ষে মিসরে ইসরাইলীয়দের মধ্যে যিহোবা বা ইয়াহ্ ওয়েহ্-এর একেশ্বরবাদ প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব হয়েছিল। প্রয়োজনীয় ধর্মীয় সংস্কারের মাধ্যমে মোশির পক্ষে যেমন বিশৃঙ্খল, নেতৃত্বহীন এবং দাসত্ববন্ধনে আবদ্ধ অসহায় ইসরাইলীয়দের উপর নিজ নিয়ন্ত্রণ ও নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব হয়েছিল তেমন তাঁর পক্ষে দাস ইসরাইলীয়দেরকে মুক্তির লক্ষ্যে অনুপ্রাণিত এক সুসংহত ও অজেয় সামাজিক শক্তিতে পরিণত করা সম্ভব হয়েছিল। এইভাবে ধর্মসংস্কার দ্বারা প্রকৃতপক্ষে একটি নূতন স্বাধীন জাতি জন্ম নিল, যা মোশির নেতৃত্বে মিসর থেকে বের হয়ে এসে প্যালেস্টাইনে একটি স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করে।
ধর্মসংস্কার আন্দোলনের পদ্ধতি আরও স্পষ্টভাবে বোঝা যায় যীশু খ্রীষ্টের ধর্ম প্রচারের দিকে দৃষ্টি দিলে। যীশু নিজে একজন ইহুদী ছিলেন। কিন্তু তিনি ইহুদী ধর্মের সংস্কার সাধন
_________________________________________________________________________________
১ এই গ্রন্থে বাইবেলের সকল উদ্ধৃতির উৎস : পবিত্র বাইবেল, পুরাতন ও নতুন নিয়ম, বাংলাদেশ বাইবেল সোসাইটি, ঢাকা-১৯৮৭।
_________________________________________________________________________________
পাতা: ৩৭
করে ভিন্ন মত প্রচার করেন। তিনি প্যালেস্টাইনে তাঁর মত প্রচারের সময় ইহুদী ধর্মীয় নেতাদের সমালোচনা করতেন। নিজেকে তিনি দাবী করতেন ইহুদী ধর্মের প্রতিষ্ঠাতা মোশির প্রকৃত অনুসারী হিসাবে। এভাবেই তিনি প্যালেস্টাইনে ইহুদী সমাজের মধ্যে একটি নূতন ও ভিন্ন ধর্মমত প্রতিষ্ঠা করেন। তাঁর মৃত্যুর পর তাঁর অনুসারীরা খ্রীষ্ট ধর্ম হিসাবে একটি স্বতন্ত্র ধর্ম গড়ে তোলে যা প্যালেস্টাইন থেকে গ্রীস ও রোমে বিস্তৃত হয়। তাঁর অনুসারীরা যীশুর শিক্ষাকে অবলম্বন করে ইহুদীদের বাইবেল থেকে ভিন্ন এক বাইবেল প্রতিষ্ঠা করে যা বাইবেল নূতন নিয়ম বা New Testament হিসাবে পরিচিত। যীশু খ্রীষ্টের ধর্ম সংস্কার বাইবেল পুরাতন নিয়ম বা Old Testament - কে বর্জন করে নি। কিন্তু সেক্ষত্রে তাঁর মত বা বিধানের সঙ্গে পুরাতন নিয়মের মত বা বিধান যেগুলি মিলবে না সেগুলি বাতিল হবে। এইভাবে পুরাতন ঐতিহ্য ধারণ করেই একটি নূতন ধর্মমত প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। ইহুদীরা কিন্তু বাইবেলের নূতন ও পুরাতন নিয়মের বিভাজন মানে না। কারণ তাদের কাছে বাইবেল একটাই সেটা হল খ্রীষ্টানদের ভাষায় পুরাতন নিয়ম।
এ কথাও আমরা জানি যে, যিশু খ্রীষ্ট তাঁর নূতন ধর্মমত প্রচার করতে গিয়ে প্রাচীন ধর্মীয় ঐতিহ্য ব্যবহার করলেও তাঁকে ভিন্ন মত প্রচারের কারণে ক্রুশবিদ্ধ হয়ে প্রাণ দিতে হয়েছিল এবং তাঁর অনুসারীরা দীর্ঘকাল প্রতিপক্ষের নির্যাতনের শিকার হয়েছিল।
যাইহোক, বাইবেল নূতন নিয়ম থেকে কিছু উদ্ধৃতি দিলে ধর্মীয় সংস্কার আন্দোলনের রূপ বা পদ্ধতি আমাদের কাছে আরও স্পষ্ট হবে। ইহুদী ধর্মনেতা ‘ফরীশী’ ও ‘অধ্যাপকদের’ প্রতি যীশুর আক্রমণ তাঁর নিজ মত প্রতিষ্ঠার পথ প্রশস্ত করে :
‘১,২,৩ তখন যীশু লোকসমূহকে ও নিজ শিষ্যদিগকে কহিলেন, অধ্যাপক ও ফরীশীরা মোশির আসনে বসে। অতএব তাহারা তোমাদিগকে যাহা কিছু বলে, তাহা পালন করিও, মানিও, কিন্তু তাহাদের কর্মের মত কর্ম করিও না; কেননা তাহারা বলে. কিন্তু করে না।
৪ তাহারা ভারী দুর্বহ বোঝা বাঁধিয়া লোকদের কাঁধে চাপাইয়া দেয়, কিন্তু আপনারা অঙ্গুলি দিয়াও তাহা সরাইতে চাহে না।
৫,৬,৭ তাহারা লোককে দেখাইবার জন্যই তাহাদের সমস্ত কর্ম করে; কেননা তাহারা আপনাদের কবচ প্রশস্ত করে, এবং বস্ত্রের থোপ বড় করে, আর ভোজে প্রধান স্থান, সমাজগৃহে প্রধান প্রধান আসন, হাটে বাজারে মঙ্গলবাদ, এবং লোকের কাছে রব্বি (গুরু) বলিয়া সম্ভাষণ, এ সকল ভালবাসে।
........................... ........................ ........................ ............................
১৩,১৪ কিন্তু, হা অধ্যাপক ও ফরীশীগণ, কপটীরা, ধিক্ তোমাদিগকে! কারণ তোমরা মনুষ্যদের সম্মুখে স্বর্গরাজ্য রুদ্ধ করিয়া থাক ; আপনারাও তাহাতে প্রবেশ কর না, এবং যাহারা প্রবেশ করিতে আইসে, তাহাদিগকেও প্রবেশ করিতে দেও না।
১৫ হা অধ্যাপক ও ফরীশীগণ, কপটীরা, ধিক্ তোমাদিগকে! কারণ এক জনকে যিহূদী-ধর্মাবলম্বী করিবার জন্য তোমরা সমুদ্রে ও স্থলে পরিভ্রমণ করিয়া থাক ; আর যখন কেহ হয়, তখন তাহাকে তোমাদের অপেক্ষা দ্বিগুণ নারকী করিয়া তুল।’(বাইবেল, নতুন নিয়ম ; মথি লিখিত সুসমাচার : ২৩)
পাতা: ৩৮
যীশু তাঁর অনুসারীদের নিয়ে জেরুজালেমে ইহুদীদের মন্দিরে গেলেন ও প্রাচীন গ্রন্থের উল্লেখ করে তৎকালীন অবস্থাকে আঘাত করলেন :
‘১৫ পরে তাহারা যিরুশালেমে আসিলেন, আর তিনি ধর্মধামের মধ্যে গিয়া, যাহারা ধর্মধামের মধ্যে ক্রয় বিক্রয় করিতেছিল, তাহাদিগকে বাহির করিয়া দিতে লাগিলেন, এবং পোদ্দারদের মেজ, ও যাহারা কপোত বিক্রয় করিতেছিল, তাহাদের আসন সকল উল্টাইয়া ফেলিলেন।
১৬ আর ধর্মধামের মধ্য দিয়া কাহাকেও কোন পাত্র লইয়া যাইতে দিলেন না।
১৭ আর তিনি উপদেশ দিয়া তাহাদিগকে বলিলেন, ইহা কি লেখা নাই, “আমার গৃহকে সর্বজাতির প্রার্থনা-গৃহ বলা যাইবে”? কিন্তু তোমরা ইহা “দস্যুগণের গহ্বর” করিয়াছ।
১৮ একথা শুনিয়া প্রধান যাজক ও অধ্যাপকেরা, কিরূপে তাঁহাকে বিনষ্ট করিবে, তাহারই চেষ্টা দেখিতে লাগিল; কেননা তাহারা তাঁহাকে ভয় করিত, কারণ তাঁহার উপদেশে সমস্ত লোক চমৎকৃত হইয়াছিল।’ (বাইবেল, নতুন নিয়ম; মার্ক লিখিত সুসমাচার; ১১)
যীশুর শিষ্য যোহনের একটি চমৎকার বর্ণনা আছে, যা থেকে ধর্মসংস্কার আন্দোলনের একটি দিক বোঝা যায়:
‘পর্বের মধ্য সময়ে যীশু ধর্মধামে গেলেন, এবং উপদেশ দিতে লাগিলেন। তাহাতে যিহূদীরা আশ্চর্য জ্ঞান করিয়া কহিল, এ ব্যক্তি শিক্ষা না করিয়া কি প্রকারে শাস্ত্রজ্ঞ হইয়া উঠিল? যীশু তাহাদিগকে উত্তর করিয়া কহিলেন, আমার উপদেশ আমার নহে, কিন্তু যিনি আমাকে পাঠাইয়াছেন, তাঁহার। যদি কেহ তাঁহার ইচ্ছা পালন করিতে ইচ্ছা করে, সে এই উপদেশের বিষয়ে জানিতে পারিবে, ইহা ঈশ্বর হইতে হইয়াছে, না আমি আপনা হইতে বলি। যে আপনা হইতে বলে, সে আপনারই গৌরব চেষ্টা করে; কিন্তু যিনি আপন প্রেরণকর্তার গৌরব চেষ্টা করেন, তিনি সত্যবাদী, আর তাঁহাতে কোন অধর্ম নাই। মোশি তোমাদিগকে কি ব্যবস্থা দেন নাই? তথাপি তোমাদের মধ্যে কেহই সেই ব্যবস্থা পালন করে না।’ (বাইবেল, নতুন নিয়ম, ৭:১৪-১৯)
বিদ্যমান সমাজ ব্যবস্থার সংকটের কালে যখন সাধারণ মানুষ মুক্তির জন্য নূতন কিছু চায় তখন নূতন ধর্মমতের আবির্ভাব ঘটতে পারে। মানুষ সম্পূর্ণ অচেনা-অজানা কিছুকে সহজে গ্রহণ করতে পারে না। সুতরাং বিদ্যমান সমাজের ভিতর থেকে ধর্মসংস্কারকগণকে আসতে হয় যারা পুরাতন ঐতিহ্যকে স্বীকৃতি দিয়ে নূতন প্রথা বা ব্যবস্থা গড়ে তোলে। ফলে তাতে পুরাতন অনেক কিছু থাকলেও আবার অনেক কিছুই থাকে না। বরং তা ক্রমেই হয়ে ওঠে সম্পূর্ণ নূতন এবং স্বতন্ত্র।
বুদ্ধকে তাঁর ধর্মমত প্রচার করতে হয়েছে ব্রাহ্মণকেন্দ্রিক ভারতীয় সমাজে। তবে তখনও ভারতবর্ষের পশ্চিম ও উত্তর অংশে কিছু ক্ষত্রিয় উপজাতি ছিল যাদের মধ্যে ব্রাহ্মণ্য বা বৈদিক ধর্ম এবং ব্রাহ্মণদের প্রভাব ছিল না। কাজেই সমগ্র সমাজে তখনও ব্রাহ্মণ্যবাদ দৃঢ়মূল হয় নি। এর পরও তাঁকে ব্রাহ্মণদের কাছে প্রাচীন ব্রাহ্মণ কিংবা ঋষিদের কথা বলে
পাতা: ৩৯
নিজের বক্তব্য যুক্তিগ্রাহ্য ও গ্রহণযোগ্য করতে হয়েছে। ত্রিপিটকের দ্বিতীয় অংশের অন্তর্গত ‘সুত্ত নিপাত’ থেকে নীচের উদ্ধৃতাংশটি পড়লে বিষয়টি জানা যায় :
‘............... তারপরে ঐ ধনী ব্রাহ্মণগণ ভগবানকে বলিলেন, “হে গৌতম, বর্তমান দিনের ব্রাহ্মণগণ কি প্রাচীন ব্রাহ্মণদের নিয়ম অনুসরণ করিয়া থাকেন?”
“না, ব্রাহ্মণগণ, বর্তমান দিনের ব্রাহ্মণেরা প্রাচীন ব্রাহ্মণদের নিয়ম অনুসরণ করেন না।”
‘ব্রাহ্মণেরা কহিলেন, “মাননীয় গৌতম, যদি বিশেষ কোন অসুবিধা না থাকে তাহা হইলে আমাদের নিকট প্রাচীন ব্রাহ্মণদের বিষয় বর্ণনা
করুন।”
‘ভগবান বলিলেন, “ব্রাহ্মণগণ, তাহা হইলে শ্রবণ কর, উত্তমরূপে মনোনিবেশ কর, আমি বলিতেছি।” “হা ভবৎ গৌতম” বলিয়া সেই ব্রাহ্মণ মহাশালগণ ভগবানকে প্রত্যুত্তর জানাইলেন। ভগবান এইরূপ বলিলেন, “২৮৬। পূর্বকালের ঋষিরা সংযতাত্মা ও তপস্বী ছিলেন; পঞ্চ কামগুণ ত্যাগ করিয়া তাঁহারা নিজের মঙ্গলের অন্বেষণে রত থাকিতেন।
২৮৭। ব্রাহ্মণদের গবাদি পশু ছিল না। হিরণ্য বা ধান্য ছিল না; সাধনাই ছিল তাঁহাদের ধনধান্য, তাঁহারা সবচেয়ে উত্তম নিধিকে অতিযত্নে পালন করিতেন।
............................ ............................ ............................
২৯৪। তাঁহারা ব্রহ্মচর্য, শীল, সরলতা, নম্রতা, তপ, কোমলতা, অবিহিংসা (করুণা), ও ক্ষান্তির প্রশংসা করিতেন।”
(সুত্ত নিপাত; ৭-ব্রাহ্মণ ধম্মিক সুত্ত)
জৈন ধর্মের প্রবর্তক মহাবীর বা জিন প্রাচীন ঐতিহ্যের ধারক হিসাবে নিজের অবস্থান দৃঢ় করার জন্য ২৪ জন তীর্থংকরের কথা বলেন। ঋষভদেব প্রথম তীর্থংকর এবং এভাবে ক্রমান্বয়ে চতুর্বিংশতিতম বা ২৪তম তীর্থংকর হলেন তিনি নিজে। এ ধরনের প্রচারের ফলে জনমানসে তাঁর প্রতিষ্ঠা তুলনামূলকভাবে সহজ হয়। তাতে সাধারণ মানুষ মনে করে এই ব্যক্তি যে কথা বলছেন তা তাদের প্রাচীনদের ঐতিহ্যের কথা, যা থেকে তারা এখন সরে গেছে। সেই পুরাতন পথে ফিরলে তাদের মুক্তি আসবে। আসলে এই পদ্ধতিতে ধর্মপ্রবর্তকরা নূতন পথ সৃষ্টি করেন আমজনতার জন্য।
এটা লক্ষণীয় যে, বর্তমানে বিদ্যমান সকল প্রধান বা উল্লেখযোগ্য ধর্মই প্রাচীন সভ্যতাসমূহের অবক্ষয় কিংবা সংকটের কালে অথবা ধ্বংসের পর সৃষ্টি হয়েছে। যখন মিসরীয় সভ্যতা তার গৌরবময় কাল অতিক্রম করছে এবং ইতিমধ্যে তার দুর্বলতা ও ক্ষয় প্রকাশ পেয়েছে তখন খ্রীষ্টপূর্ব দ্বাদশ শতকে মিসরে মোশির নেতৃত্বে একেশ্বরবাদী ইহুদী ধর্মের উদ্ভব হয়। যখন রোমান সাম্রাজ্যের চরম বিকাশের পর তার ক্ষয়ের সময় নিকটবর্তী হল তখন রোমান সাম্রাজ্যের অধীনস্থ প্যালেস্টাইনে ইহুদী ধর্মের তুলনায় নমনীয় একেশ্বরবাদী ধর্ম খ্রীষ্ট মতবাদের উদ্ভব ঘটে এবং রোমান সাম্রাজ্যের সংকট বৃদ্ধির সঙ্গে
পাতা: ৪০
এই ধর্মীয় মতবাদ একটি প্রবল ও স্বয়ংসম্পূর্ণ ধর্ম হিসাবে সমগ্র রোমান সাম্রাজ্যভুক্ত বিশাল অঞ্চলে বিস্তার লাভ করতে থাকে। সিন্ধু সভ্যতার পতনের পর ভারতবর্ষ যখন নগর সভ্যতা হারিয়ে পশ্চাৎপদ কৃষি সমাজে ফিরে গেছে এবং গাঙ্গেয় উপত্যকায় নূতন সমাজ ও সভ্যতার বিকাশের প্রস্তুতি চলছে তেমন এক প্রবল সামাজিক সংকট ও দ্বন্দ্বক্ষুব্ধ সময়ে উত্তর ভারতে বৌদ্ধ ধর্ম জন্ম নেয় এবং তা ক্রমে বিস্তার লাভ করে প্রাচীন পৃথিবীর বিস্তীর্ণ ভূভাগে।
ইসলামের ক্ষেত্রে আমরা দেখি সভ্যতার অবক্ষয় ও ধ্বংসের এক ব্যাপক পরিপ্রেক্ষিতের উপস্থিতি। সিন্ধু, মেসোপটেমিয়া, মিসর এই তিন সর্বপ্রাচীন সভ্যতার আলো বহুকাল আগে নিভে গেছে। গ্রীক, রোমান সভ্যতাও মৃত। বর্বরদের হাতে রোমান সাম্রাজ্যের রাজধানী রোমের পতন হয়েছে ৪১০ খ্রীষ্টাব্দে। অতীতের জের হিসাবে রোমান বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্য ধ্বংসের দিকে এগিয়ে চলছে। পারস্য বা ইরানের অবস্থাও তাই। চারদিকে প্রাচীন সভ্যতায় রাত্রি নেমেছে। একমাত্র বহু দূরে এক কোণে অবস্থিত চীন ব্যতিক্রম। পৃথিবীর বিশাল অঞ্চলব্যাপী এমন এক সংকট ও সংঘাত-ক্ষুব্ধ সময়ে সপ্তম শতাব্দীতে আরবের এক গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্য কেন্দ্র মক্কাকে কেন্দ্র করে ইসলাম ধর্ম প্রথম মাথা তোলে। তারপর তা মদীনাকে কেন্দ্র করে আরব সহ বিশাল ভূভাগে আত্মপ্রতিষ্ঠা ও বিস্তার লাভ করে।
এতক্ষণ আমরা যেসব ধর্মীয় আন্দোলনের বিকাশের বৈশিষ্ট্যসমূহ আলোচনা করেছি আরবে ইসলাম ধর্মের প্রতিষ্ঠাতা মোহাম্মদের ধর্মসংস্কারের উদ্যোগও তা থেকে ভিন্ন নয়। মক্কায় অবস্থিত কাবা নামক মন্দিরের পৌরোহিত্যের অধিকারী কোরাইশ উপজাতি হলেও সেখানে আরবের অন্যান্য উপজাতির অবাধ প্রবেশাধিকার ছিল। কাবা ছিল আরবের সামাজিক-ধর্মীয় ঐক্যের প্রতীক এবং মিলন কেন্দ্র। তাই অন্যান্য উপজাতি বা গোত্রের দেবতাদের প্রতিমা বা প্রতীক সেখানে থাকত এবং তারা তাদের পূজা করত সেখানে।
ইসলামের প্রতিষ্ঠাতা মোহাম্মদের নিজ উপজাতি কোরাইশরা বহুদেবতাবাদী ছিল। তবে কাবার প্রধান দেবতা ছিল আল্লাহ্। কাবাগৃহে তার মূর্তি ছিল বলে জানা যায়। অন্য সকল উপজাতি কাবাতে এসে তাদের নিজ নিজ দেবতার পাশপাশি আল্লাহরও পূজা করত বলে অনুমান করা চলে। মোহাম্মদ তাঁর ধর্মসংস্কার আন্দোলনে নিরাকার আল্লাহকেই একমাত্র দেবতা বা উপাস্য হিসাবে প্রতিষ্ঠা করতে চাইলেন। তিনি নিজে মোশি বা খ্রীষ্টের মত একেশ্বরবাদী সমাজ থেকে উদ্ভূত না হলেও সে সময়ে বহু ইহুদী ও খ্রীষ্টান মক্কা, মদীনা ও আশপাশে বসবাস করায় তাদের ধর্মমত এবং প্রাচীন উপকথা বা পৌরাণিক গল্পসমূহ তাঁর কাছে অজানা ছিল না। তিনি আরেকটি নূতন একেশ্বরবাদী ধর্ম প্রতিষ্ঠার জন্য ইহুদী ও খ্রীষ্টান ধর্মের ঐতিহ্যকে গ্রহণ করেন।
অবশ্য মোহাম্মদের ধর্ম সংস্কারের গতি-প্রকৃতিকে মনোযোগ সহকারে নিরীক্ষণ করলে কোরাইশরাও অতীতে নিরাকার ঈশ্বরের পূজারী ছিল বলে মনে হয়। পৌত্তলিক আরবদের প্রভাবে কিংবা পৌত্তলিক আরব উপজাতিগুলিকে নিজেদের নিয়ন্ত্রণে আনার প্রয়োজনে
পাতা: ৪১
কোরাইশদের মধ্যে কালক্রমে বহুদেবতার মূর্তি পূজা প্রবেশ করেছিল এমন অনুমান করা যায়। আমরা অনুমান করতে পারি যে, মোহাম্মদ তাঁর আল্লাহকেন্দ্রিক নিরাকার একেশ্বরবাদী ধর্ম প্রবর্তনের সময় মক্কা-মদীনা এবং চারপাশের অঞ্চলের ইহুদী, খ্রীষ্টান এবং কোরাইশ সহ আরবদের ঐতিহ্যকে আত্মস্থ করেন। এইভাবে তাঁর ধর্ম সংস্কারের মাধ্যমে কোরাইশ এবং পৌত্তলিক আরবদের মধ্যে বিদ্যমান প্রধান দেবতা ‘আল্লাহ্’কে কেন্দ্র করে একটি নিরংকুশ একেশ্বরবাদী নূতন ধর্মমত গড়ে ওঠে।
কোরআন থেকেও আমরা ধর্মসংস্কারের সাহায্যে নূতন ধর্ম প্রতিষ্ঠার পদ্ধতি অনুধাবন করতে পারি। বহু দেবতাবাদ এবং পৌত্তলিকতার বিরুদ্ধে ইসলাম প্রচণ্ডভাবে সোচ্চার। আল্লাহকে একমাত্র এবং নিরাকার উপাস্য হিসাবে ঘোষণা করে আর সকল উপাস্যকে নাকচ করা হয়েছে। সুতরাং আল্লাহ্ সম্পর্কে তৎকালীন আরবে বিদ্যমান ধারণা নাকচ করে তাঁর নিরংকুশ একত্ব ও শ্রেষ্ঠত্ব ঘোষণা করা হয়েছে১ :
১৯। তোমরা কি ভাবিয়া দেখিয়াছ ‘লাত’ ও ‘উয্যা’ সম্বন্ধে
২০। এবং তৃতীয় আরেকটি ‘মানাত’ সম্বন্ধে?
২১। তবে কি পুত্র সন্তান তোমাদিগের জন্য এবং কন্যা সন্তান আল্লাহ্ র জন্য?
২২। এই প্রকার বন্টন তো অসঙ্গত। (৫৩-সূরা নাজ্ম)
অসংখ্য বক্তব্য দ্বারা কোরআনে আল্লাহর নিরংকুশ সার্বভৌমত্ব ও একত্বের ধারণা ঘোষণা করা হয়েছে :
২। যিনি আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবীর সার্বভৌমত্বের অধিকারী; তিনি কোন সন্তান গ্রহণ করেন নাই; সার্বভৌমত্বে তাঁহার কোন শরীক নাই। তিনি সমস্ত কিছু সৃষ্টি করিয়াছেন এবং প্রত্যেককে পরিমিত করিয়াছেন যথাযথ অনুপাতে।
৩। আর তাহারা (কাফের অর্থাৎ সত্য প্রত্যাখ্যানকারীরা) তাঁহার পরিবর্তে ইলাহ্ রূপে (উপাস্য রূপে) গ্রহণ করিয়াছে অপরকে, যাহারা কিছুই সৃষ্টি করে না, বরং উহারা নিজেরাই সৃষ্ট এবং উহারা নিজদিগের অপকার অথবা উপকার করিবার ক্ষমতা রাখে না এবং জীবন, মৃত্যু ও পুনরুত্থানের উপরও কোন ক্ষমতা রাখে না। (২৫-সূরা ফুরকান)
৩০। ..... সুতরাং তোমরা বর্জন কর মূর্তিপূজার অপবিত্রতা এবং দূরে থাক মিথ্যা-কথন হইতে,
৩১। আল্লাহর প্রতি একনিষ্ঠ হইয়া এবং তাঁহার কোন শরীক না করিয়া; যে-কেহ আল্লাহর শরীক করে সে যেন আকাশ হইতে পড়িল, অত:পর পাখী তাহাকে ছোঁ মারিয়া লইয়া গেল, কিংবা বায়ু তাহাকে উড়াইয়া লইয়া গিয়া এক দূরবর্তী স্থানে নিক্ষেপ করিল। (২২-সূরা হাজ্জ)
৪৮। আল্লাহ্ তাঁহার শরীক করার অপরাধ ক্ষমা করেন না। ইহা ব্যতীত অন্যান্য অপরাধ যাহাকে ইচ্ছা ক্ষমা করেন; এবং যে-কেহ আল্লাহর শরীক করে সে এক মহাপাপ করে। (৪-সূরা নি সা)
_________________________________________________________________________________
১ এই গ্রন্থে উদ্ধৃত কোরআনের বঙ্গানুবাদগুলির উৎস : আল-কুরআনুল করীম, ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ কর্তৃক অনূদিত ও প্রকাশিত, একাদশ মুদ্রণ : ডিসেম্বর ১৯৮৭
_________________________________________________________________________________
পাতা: ৪২
কিন্তু ইসলামের সর্বজনীনতা প্রতিষ্ঠার জন্য আরবে বিদ্যমান একেশ্বরবাদী ধর্ম হিসাবে ইহুদী ও খ্রীষ্টান ধর্মের ঐতিহ্যকে গ্রহণ করা হল। কোরআনে বলা হচ্ছে :
৪৪। তাওরাত (বাইবেল পুরাতন নিয়ম) অবতীর্ণ করিয়াছিলাম; উহাতে ছিল পথ-নির্দেশ ও আলো; নবীগণ, যাহারা আল্লাহর অনুগত ছিল তাহারা য়াহূদীদিগকে তদনুসারে বিধান দিত, আরও বিধান দিত রাব্বানীগণ এবং বিদ্বানগণ, কারণ তাহাদিগকে আল্লাহর কিতাবের রক্ষক করা হইয়াছিল এবং তাহারা ছিল উহার সাক্ষী। সুতরাং মানুষকে ভয় করিও না, আমাকেই ভয় কর এবং আমার আয়াত তুচ্ছ মূল্যে বিক্রয় করিও না। আল্লাহ্ যাহা অবতীর্ণ করিয়াছেন তদনুসারে যাহারা বিধান দেয় না, তাহারাই সত্য প্রত্যাখ্যানকারী। (৫-সূরা মায়িদা) ৪৬। মারইয়াম-তনয় ঈসাকে (যীশু) তাহার পূর্বে অবতীর্ণ তাওরাতের সমর্থকরূপে উহাদের পশ্চাতে প্রেরণ করিয়াছিলাম এবং তাহার পূর্বে অবতীর্ণ তাওরাতের সমর্থকরূপে এবং মুত্তাকীদের (ধর্মভীরু) জন্য পথের নির্দেশ ও উপদেশরূপে তাহাকে ইন্জীল (বাইবেল নূতন নিয়ম) দিয়াছিলাম; উহাতে ছিল পথের নির্দেশ ও আলো। (৫-সূরা মায়িদা)
কিন্তু কোরআনে বলা হচ্ছে যে, ইহুদী ও খ্রীষ্টানগণ ধর্মের পথ থেকে সরে গেছে :
৬৫। কিতাবীগণ যদি ঈমান আনিত ও ভয় করিত তাহা হইলে তাহাদের দোষ অপনোদন করিতাম এবং তাহাদিগকে সুখদায়ক জান্নাতে দাখিল করিতাম।
৬৬। তাহারা যদি তাওরাত, ইন্জীল ও তাহাদের প্রতিপালকের নিকট হইতে তাহাদের প্রতি যাহা অবতীর্ণ হইয়াছে তাহা প্রতিষ্ঠিত করিত তাহা হইলে তাহারা তাহাদের উপর ও পদতল হইতে আহার্য লাভ করিত। তাহাদের মধ্যে একদল রহিয়াছে যাহারা মধ্যপন্থী; কিন্তু তাহাদের অধিকাংশ যাহা করে তাহা নিকৃষ্ট। (৫-সূরা মায়িদা)
কোরআনের যুক্তিতে পুরাতন ধর্মের পথ থেকে অন্যরা বিচ্যুত হবার কারণে নূতন ধর্মপ্রতিষ্ঠার প্রয়োজন দেখা দিয়েছে। সুতরাং আল্লাহ্ তাঁর রাসূল রূপে সত্যের পথ প্রতিষ্ঠার জন্য মোহাম্মদকে পাঠিয়েছেন :
৩০। য়াহূদী বলে, ‘উযায়র আল্লাহর পুত্র’, এবং খ্রীষ্টান বলে, ‘মসীহ্ (যীশু) আল্লাহর পুত্র।’ উহা তাহাদিগের মুখের কথা। পূর্বে যাহারা কুফরী করিয়াছিল উহারা তাহাদিগের মত কথা বলে। আল্লাহ্ উহাদিগকে ধ্বংস করুন। উহারা কেমন করিয়া সত্য-বিমুখ হয়!
৩১। তাহারা আল্লাহ্ ব্যতীত তাহাদিগের পণ্ডিতগণকে ও সংসার-বিরাগীগণকে তাহাদিগের আরবাবরূপে (হুকুমের মালিক রূপে) গ্রহণ করিয়াছে এবং মারইয়াম-তনয় মসীহকেও। কিন্তু উহারা এক ইলাহের (উপাস্য) ইবাদত করিবার জন্য আদিষ্ট হইয়াছিল। তিনি ব্যতীত অন্য কোন ইলাহ্ নাই। তাহারা যাহাকে শরীক করে তাহা হইতে তিনি কত পবিত্র!
৩২। তাহারা তাহাদিগের মুখের ফুৎকারে আল্লাহর জ্যোতি নির্বাপিত করিতে চাহে। কাফিরগণ অপ্রীতিকর মনে করিলেও আল্লাহ্ তাঁহার জ্যোতির পূর্ণ উদ্ভাসন ব্যতীত অন্য কিছু চাহেন না।
পাতা: ৪৩
৩৩। মুশরিকগণ (আল্লাহর ক্ষমতার অংশীদারিত্বে বা বহু দেবতায় বিশ্বাসীগণ) অপ্রীতিকর মনে করিলেও অপর সমস্ত দীনের উপর জয়যুক্ত করিবার জন্য তিনিই পথনির্দেশ ও সত্য দীনসহ (সত্য ধর্মসহ) তাঁহার রাসূল প্রেরণ করিয়াছেন। (৯-সূরা তাওবা)
কিন্তু কোরআন-নির্দেশিত পথ কাফের বা সত্যপ্রত্যাখ্যানকারীরা গ্রহণ করে না :
৬। যাহারা কুফরী করিয়াছে তুমি তাহাদিগকে সতর্ক কর বা না কর, তাহাদের পক্ষে উভয়ই সমান; তাহারা ঈমান আনিবে না।
৭। আল্লাহ্ তাহাদের হৃদয় ও কর্ণ মোহর (সীল করে বন্ধ) করিয়া দিয়াছেন, তাহাদের চক্ষুর উপর আবরণ রহিয়াছে এবং তাহাদের জন্য রহিয়াছে মহাশাস্তি। (২-সূরা বাকারা)
ইসলাম প্রচারের এক পর্যায়ে মক্কা থেকে মদীনায় গমন করে সেখানে ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পর মোহাম্মদ ইসলাম ধর্ম বিস্তারের জন্য যুদ্ধ বা জিহাদের (ধর্মযুদ্ধের) পথ গ্রহণ করেন। কোরআনে যুদ্ধের জন্য অনুমোদন ও নির্দেশ দেওয়া হল :
২১৬। তোমাদের জন্য যুদ্ধের বিধান দেওয়া হইল যদিও তোমাদের নিকট ইহা অপ্রিয়; কিন্তু তোমরা যাহা পছন্দ কর না সম্ভবত তাহা তোমাদের জন্য কল্যাণকর এবং যাহা পছন্দ কর সম্ভবত তাহা তোমাদের জন্য অকল্যাণকর। আল্লাহ্ জানেন ; তোমরা জান না। (সূরা-২ বাকারা)
এইভাবে ইসলাম প্রবেশ করল শান্তিপূর্ণ প্রচারের স্তর থেকে যুদ্ধের স্তরে। এই ধর্মের উদ্ভব ও বিকাশের জীবন্ত চিত্র যেমন আমরা ইতিহাস থেকে পাই তেমন পাই ইসলামের মূল ধর্মগ্রন্থ কোরআন থেকে। এ ছাড়া মোহাম্মদের অনুমোদন, নির্দেশ, বক্তব্য, কর্ম ইত্যাদি যেগুলিকে হাদীস বলা হয় সেগুলি যেসব হাদীস গ্রন্থে লিপিবদ্ধ হয়েছে সেগুলি থেকেও ইসলামের বিকাশ প্রক্রিয়া সম্পর্কে একটা স্বচ্ছ ধারণা পাওয়া যেতে পারে।
ইসলাম আরবকে শুধু একটা নূতন ধর্ম দেয় নি সেই সঙ্গে দিয়েছে আরবের উপজাতীয় ও গোত্রগত স্বাতন্ত্র্য, বিচ্ছিন্নতা ও বিভক্তিকে সবলে চূর্ণ করে একটা নিরংকুশভাবে এককেন্দ্রিক ও দৃঢ়বদ্ধ ধর্মীয় সামরিক রাষ্ট্র।
আমাদের মতে ধর্মীয় আন্দোলনের উন্মেষের সমকালীন দলিল হিসাবে কোরআন এবং ঋগ্বেদের গুরুত্ব সর্বাধিক। কারণ আর সকল প্রধান ধর্মগ্রন্থ ধর্ম প্রতিষ্ঠাতাদের মৃত্যুর অনেক পরে তাঁদের অনুসারীদের দ্বারা লিখিত এবং সংকলিত হয়েছে। মূল ধর্ম সংস্কারকগণ সমাজের সংঘাতক্ষুব্ধ মুহূর্তে দাঁড়িয়ে যেভাবে সমাজের বেদনা ও মুক্তির আর্তিকে তাঁদের আবেগ, উদ্দীপনা, কল্পনা ও তেজ দিয়ে বাঙময় ও জীবন্ত করে তোলেন সেটা পরবর্তী কালের কোন সংকলক বা ভাষ্যকারের পক্ষে করা সম্ভব নয়। কিন্তু কোরআন এবং ঋগ্বেদের ক্ষেত্রে তেমন কোনও পরিবর্তন ঘটে নি। ফলে এই দুইটি স্ব স্ব সমকালীন সমাজের অত্যন্ত জীবন্ত ও নির্ভরযোগ্য দলিল। তবে সময়ের ব্যবধান খুব বেশী হওয়ায় এবং আদি কিংবা মূল বৈদিক ধর্ম অনেক কাল আগে মৃত হওয়ায় ঋগ্বেদের অর্থ বোঝার ক্ষেত্রে অনেক সময় সমস্যা হতে পারে। বর্তমান হিন্দু ধর্ম বৈদিক ঐতিহ্যকে ধারণ করলেও বৈদিক ধর্মের সঙ্গে তার বিরাট ব্যবধান রয়েছে।
পাতা: ৪৪
যাইহোক, ইসলামের সঙ্গে বৈদিক ধর্মের একটি গুরুত্বপূর্ণ পার্থক্য মনে রাখতে হবে। তাহল ইসলাম প্রচার বা প্রতিষ্ঠা হয়েছে একজন ধর্মনেতা দ্বারা। কিন্তু বৈদিক ধর্ম গড়ে উঠেছে বহু সংখ্যক ব্যক্তি দ্বারা। ঋগ্বেদের মন্ত্র রচনা করেছেন যে ঋষিরা তাদের যেসব নাম দেওয়া আছে সেগুলির সংখ্যা প্রায় ৩৮১ জন। যতদূর জানা যায় ঋগ্বেদের আরও শাখা এবং অনেক মন্ত্র ছিল যেগুলি সময়ের ব্যবধানে হারিয়ে গেছে। দীর্ঘ সময়ব্যাপী যে ধর্মীয় সংস্কার আন্দোলন চলেছিল বলে অনুমান করা যায় তার সব ঋষির মন্ত্র যে সংকলিত হয়েছিল তেমনও মনে হয় না। ফলে বৈদিক আন্দোলনের ব্যাপ্তি এবং বৈচিত্র্যও অনুমেয়, এবং সেই সঙ্গে তার মধ্যকার অসঙ্গতি ও দ্বন্দ্বও।
কিন্তু তা সত্ত্বেও ধর্মীয় আন্দোলনের অভিন্ন কিছু বৈশিষ্ট্য বৈদিক আন্দোলন বা ঋগ্বেদও বহন করে। যুদ্ধের যে গুরুত্ব ঋগ্বেদে রয়েছে তার জন্য তার ভুল ব্যাখ্যা হতে পারে না। যে কোন ধর্মীয় আন্দোলনের পটভূমি বুঝলে বৈদিক ধর্মের উথান বিচারে আমাদের ভুল হওয়া উচিত নয়। ইতিপূর্বে আমরা বলেছি যে, আক্রমণ অভিযানে ব্যস্ত থাকার সময় কোন ধর্মেরই উথান সম্ভব নয়। তার জন্য সেই প্রেরণাই থাকে না। তখন সামরিক ফরমান জারী হতে পারে; কিন্তু মুক্তির আর্তিতে পরিপূর্ণ, জীবন-জিজ্ঞাসা সঞ্জাত ও ধর্মীয় আবেগ-অনুভূতি দ্বারা অনুপ্রাণিত মন্ত্র রচনা সম্ভব নয়। এমন কি ইসলামের মত সামরিক বৈশিষ্ট্যপূর্ণ ধর্মের দিকেও যদি আমরা দৃষ্টি দিই তাহলে দেখতে পাব তা প্রথমে মক্কায় উদ্ভূত হয়েছে শান্তিপূর্ণ পরিস্থিতিতে একটা ধর্মীয়-সামাজিক আন্দোলন হিসাবে। মদীনায় গিয়ে তা সামরিক ভিত্তি ও শক্তি পেলেও এটা একটা ধর্মের সম্প্রসারণের হাতিয়ার হয়ে দেখা দিয়েছে। ধর্ম প্রচারের এই পর্যায়ে যুদ্ধ প্রবণতা বৃদ্ধি পেলেও যে সামাজিক উদ্দেশ্য সাধনের জন্য ইসলামের আর্বিভাব ও বিকাশ হয়েছে তার পরিপূর্ণ ছাপ রয়েছে তার সমস্ত শরীরে। এটা যে আরব সমাজ জীবন থেকে উদ্ভূত ধর্ম তা বুঝতে কষ্ট হয় না। অর্থাৎ যতই সামরিক রূপ গ্রহণ করুক ইসলাম আরব সমাজের জন্য ছিল মূলত একটি ধর্মকেন্দ্রিক সামাজিক-রাজনৈতিক আন্দোলন।
বস্তুত বিদ্যমান সমাজ ব্যবস্থা এবং নেতৃত্বের বিরুদ্ধে কোন না কোন ধরনের বিদ্রোহের বহি:প্রকাশ হিসাবে প্রতিটি নূতন ধর্মের উথান ঘটে। এবং নূতন ধর্ম আসে পুরাতন ধর্মের সংস্কারের প্রয়াস হিসাবে যা পুরাতন ধর্মের ঐতিহ্যকে সম্পূর্ণ বর্জন না করে বরং অন্তর্ভুক্ত করেই ঘটে যা পূর্বের আলোচনায় দেখেছি। বিদ্যমান সমাজ এবং ধর্ম যখন সমাজসংকটকে মোকাবিলা করতে পারে না, সমাজের সাধারণ মানুষের অন্তত বৃহৎ অংশের সমস্যার সমাধান দিতে পারে না এবং সমাজ ও ধর্ম-নেতৃত্ব সার্বিকভাবে অবক্ষয়, সংকট ও ব্যর্থতার কারণে সমাজের উপর তাদের নিয়ন্ত্রণ হারাতে থাকে তখন জন্ম নিতে পারে যে কোন সমাজ অথবা ধর্ম সংস্কারের বড় ধরনের প্রচেষ্টাগুলি। তবে এ ক্ষেত্রেও থাকতে হয় ক্ষয়িষ্ণু সমাজ ও নেতৃত্বের পাশাপাশি সমাজের কোথাও বিকাশমান শক্তির অস্তিত্ব। নতুবা সমাজ ধ্বংস হলেও বড় ধরনের সংস্কার ঘটে না। কারণ এ ধরনের সংস্কার যে নূতন ব্যবস্থার উদ্ভব ঘটায় তার জন্য প্রয়োজন নূতন ও উদীয়মান সমাজশক্তির উপস্থিতি। এ বিষয়ে আমরা পরবর্তী সময়ে আলোচনা করব।
পাতা: ৪৫
যাইহোক, এ ধরনের মৌল সংস্কার সম্পূর্ণরূপে অভ্যন্তরীণ সমাজ নেতৃত্বের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘটাতে পারে যেখানে বাহিরের সমাজনেতৃত্ব বা ভিন্ন সমাজশাসন না থাকায় তার বিরুদ্ধে কোন ভূমিকার প্রয়োজনও হয় না, যেমনটা আমরা ইসলামের ক্ষেত্রে দেখি। আবার বাহিরের বা ভিন্ন সমাজ ও ধর্মের শাসনের হাত থেকে মুক্তির আকাঙ্ক্ষা থেকে সমাজের অভ্যন্তরীণ অক্ষম ও ব্যর্থ নেতৃত্ব ও ধর্মের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ হিসাবেও এই সংস্কার ঘটতে পারে।
মিসরে ইসরাইলীয়রা সেখানকার সমাজের অন্তর্ভুক্ত হলেও তাদের মধ্যে সেখানে একটা স্বতন্ত্র ধর্ম-সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য তখনও টিকে ছিল, যা তারা সেখানে দীর্ঘ অবস্থানেও সম্পূর্ণ ভোলে নি এবং তারা ছিল দাসত্বে আবদ্ধ এবং একটি স্বতন্ত্র ও বিজাতীয় জাতিসত্তা হিসাবে নিগৃহীত। স্বতন্ত্র জাতিসত্তা হিসাবে তাদের মুক্তির আকাঙ্ক্ষাকে রূপ দেবার জন্য সে কাল ও সমাজ-প্রেক্ষিতে একটি ধর্মসংস্কার ঘটা সম্ভব ছিল, যা মোশির নেতৃত্বে ঘটে। মোশি এই ধর্ম সংস্কারের জন্য ইসরাইলীয়দের পুরাতন ধর্মীয়-সামাজিক ঐতিহ্যকে ব্যবহার করেন। দীর্ঘকাল মিসরে বাস করার ফলে স্বাভাবিকভাবে তাঁর সংস্কারে অন্তর্ভুক্ত হয় মিসরীয় সমাজের কিছু উপাদানও, যেমন ত্বকচ্ছেদ।
একইভাবে প্যালেস্টাইনে ইহুদী বা ইসরাইলীয় জনগোষ্ঠী ছিল রোমান সাম্রাজ্যের অধীনস্থ এবং রোমানদের দ্বারা নির্যাতিত। ইহুদী ধর্ম ছিল কঠোরভাবে রক্ষণশীল, অনমনীয় এবং সামরিক প্রবণতা বিশিষ্ট। ফলে স্বাভাবিকভাবে তা বারবার সামরিকভাবে রোমের বিরুদ্ধে দাঁড়াতে চেয়েছিল। বস্তুত প্যালেস্টাইনে রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করলেও ইহুদীদের ভাগ্যে শান্তি ও স্বাধীনতা বেশী কাল থাকে নি। তারা বারবার বিভিন্ন বৈদেশিক শক্তির হাতে পরাজিত, বিপর্যস্ত ও নিগৃহীত হয়। কখনও কখনও তাদের প্যালেস্টাইন থেকে সার্বিক উৎসাদনের চেষ্টাও হয়েছে। তাদের দৃঢ় ধর্মীয়-জাতীয় স্বাতন্ত্র্যবোধ ও অনমনীয়তার কারণে তারা যেমন শেষ পর্যন্ত তাদের অস্তিত্ব রক্ষায় সমর্থ হয় তেমন এটাই আবার তাদের অশেষ দুর্গতির কারণ হয়। এমন একটি অবস্থার পটভূমিতে দুই হাজার বৎসর পূর্বে প্যালেস্টাইনে যীশুর উথান ঘটে। যীশুর সংস্কার ছিল সামরিক প্রবণতা বিশিষ্ট ইহুদী ধর্মকে নমনীয় ও অহিংস করার প্রয়াস। সেই সঙ্গে তা সশস্ত্র প্রতিরোধের পরিবর্তে শক্তিমানের শাসনকে নম্র বশ্যতা ও আবেদন দ্বারা নমনীয় ও সদয় করার চেষ্টা করে। ঐতিহ্যিক ইহুদী ধর্মীয় ও সামাজিক-রাজনৈতিক নেতৃত্বের ক্রমাগত ব্যর্থতা, পরাজয় ও সংকট থেকে যীশুর উথান ঘটে যা একটি স্বতন্ত্র ধর্মের জন্ম দেয়। ইহুদীদের মধ্যে এই ধর্ম ব্যাপক বিস্তার লাভ না করলেও পরবর্তী কালে সমগ্র রোমান সাম্রাজ্যের পরাজিত, অধীনস্থ মানুষ এবং দাসদের মধ্যে এবং অনেক স্বাধীন মানুষের মধ্যেও যীশুর প্রেম, সৌভ্রাতৃত্ব ও অহিংসার আবেদন তুমুল আলোড়ন সৃষ্টি করে। ভয়ংকর সহিংসতা, নির্দয়তা, যুদ্ধ ও বর্বর পীড়নের ব্যবস্থার উপর প্রতিষ্ঠিত রোমান সভ্যতার অধীনে প্রায় সকলেই ঐ ব্যবস্থার প্রতি বীতশ্রদ্ধ হয়ে পড়ছিল। ফলে যীশু হয়ে দাঁড়ান শেষ পর্যন্ত সকলের নিকট ত্রাতা। খ্রীষ্টানদের উপর প্রথম পর্যায়ে রোমান শাসকরা ভয়ানক অত্যাচার করলেও শেষ পর্যন্ত তারাও খ্রীষ্ট ধর্মের প্রতি নমনীয় হয় এবং রোমান সভ্যতা ধ্বংস হলে যীশুর ধর্ম পূর্বতন রোমান সাম্রাজ্যভুক্ত সকল অঞ্চলের একমাত্র ধর্ম হয়ে পড়ে এবং তা ক্রমে সমগ্র ইউরোপে বিস্তার লাভ করে।
পাতা: ৪৬
ইসলামের আবির্ভাবের পটভূমিতে ছিল উপজাতীয় আরব সমাজ যা ছিল বহু সংখ্যক উপজাতিতে বিভক্ত এবং তখন পর্যন্ত রাষ্ট্র ব্যবস্থা বহির্ভূত। মক্কায় কোরাইশদের নেতৃত্বে পৌত্তলিক ধর্মকে কেন্দ্র করে আরব ঐক্যের একটা প্রক্রিয়া চালু থাকলেও উপজাতীয় বিভক্তি ও স্বাতন্ত্র্য এবং উপজাতি-সমাজব্যবস্থার শক্তি সেখানে কোন রাষ্ট্র গড়ে তোলার পথে বাধা হয়ে ছিল। অথচ বাণিজ্য এবং সভ্যতার বিকাশ সেখানকার পুরাতন উপজাতীয় সমাজকে ভেঙ্গে ফেলছিল। একই উপজাতি বা গোত্রের ভিতর ধনী-দরিদ্রে বিস্তর ব্যবধান যে হচ্ছিল শুধু তাই নয় উপরন্তু ঋণদায়গ্রস্ত হয়ে বহুসংখ্যক মানুষ দাস হয়ে পড়ছিল একই উপজাতির ধনীদের। অর্থাৎ সমাজের জন্য সেটা ছিল ক্রান্তিলগ্ন। পুরাতন ভেঙ্গে পড়ছে। নূতন আসছে, কিন্তু ভালভাবে আসতেও পারছে না। অথচ আরবের পার্শ্ববর্তী বিশাল অঞ্চলের সমাজ ও সভ্যতায় ক্ষয় ও ধ্বংস চলছে। ফলে চারপাশে শূন্যতা। এই অবস্থায় শূন্যতা পূরণের জন্য সেটা ছিল একটা উপযুক্ত মুহূর্ত। কিন্তু তার জন্য প্রয়োজন ছিল একটা ঐক্যবদ্ধ, শক্তিশালী ও কেন্দ্রীভূত আরব রাষ্ট্র। ইসলাম একদিকে ধনবৈষম্য হ্রাস করে তুলনামূলকভাবে সামাজিক সমতা বিধান করে সমাজের ভিতরে স্থিতিশীলতা আনল, অপর দিকে সবলে উপজাতীয় স্বাতন্ত্র্যকে ধ্বংস করে আরবকে এই রাষ্ট্র দিল।
বৌদ্ধ ধর্মের আবির্ভাব কাল আনুমানিক খ্রীষ্টপূর্ব ষষ্ঠ শতাব্দী। পুরাতন বৈদিক ধর্মের দুর্বলতা ও সংকট তখন স্পষ্ট হয়েছে। ব্রাহ্মণ্য প্রভাব এবং বর্ণজাতিভেদ তখন বিস্তার লাভ করছে। আমাদের এটা বোঝা দরকার যে, আদি বৈদিক ধর্মে বর্ণজাতিভেদ ছিল না। সেটা ঋগ্বেদ থেকেও স্পষ্ট হয়। তবে বৈদিক আন্দোলনের বিজয়ের পর বর্ণজাতি প্রথা যে প্রসার লাভ করতে শুরু করে তা অনুমান করা যায় ঋগ্বেদ থেকে। ঋগ্বেদের ১০ম মণ্ডলে পুরুষ সূক্ত নামে প্রসিদ্ধ ৯০তম সূক্ত থেকে এই অনুমান করা যায়। তবে এটা যে পরবর্তীকালের রচনা সে বিষয়ে পণ্ডিতরা একমত১। আমাদের অনুমান এই মন্ত্রটিকে ঋগ্বেদের অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে বৈদিক আন্দোলনের অনেক পরবর্তীকালে সৃষ্ট ব্রাহ্মণ-নিয়ন্ত্রিত বর্ণজাতিভেদ-ভিত্তিক সমাজ ব্যবস্থাকে বৈদিক ধর্মীয় ঐতিহ্যগত অনুমোদন দেবার উদ্দেশ্যে।
যাইহোক, এটা স্পষ্ট যে, বৌদ্ধ আন্দোলনের উথান ও সাফল্যের মূলে ছিল প্রতিষ্ঠিত বৈদিক ধর্মীয় নেতৃত্বের সংকট ও দুর্বলতা। বৈদিক ধর্ম প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল ব্যাপক বিস্তৃত ও সুদীর্ঘ কালব্যাপী গৃহযুদ্ধের মাধ্যমে, যে বিষয়ে আমরা কিছু পরে আলোচনা করব।
_________________________________________________________________________________
১ ১০ মণ্ডল ৯০ সূক্ত সম্পর্কে ঋগ্বেদ-সংহিতার (দ্বিতীয় খণ্ড) টীকায় বলা হয়েছে : ‘ঋগ্বেদের অন্য কোনও অংশে ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য, শূদ্র এ চারি জাতির উল্লেখ নেই। ঋগ্বেদ রচনাকালে আর্যদের মধ্যে জাতি বিভাগ ছিল না। ব্যাকরণবিৎ পণ্ডিতগণ প্রমাণ করেছেন যে, এ পুরুষ সূক্তের ভাষা বৈদিক ভাষা নয়, অপেক্ষাকৃত আধুনিক সংস্কৃত।’ পৃ: ৫৮৭
_________________________________________________________________________________
পাতা: ৪৭
ফলে এটা একটা যুদ্ধপ্রবণ ধর্ম ও সমাজ প্রতিষ্ঠা করেছিল যার ভার ভারতবর্ষের সমাজ বহন করতে পারছিল না। স্থিতিশীল, ঐক্যবদ্ধ এবং সংহত সমাজ ও রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পথে তা ছিল বাধা। এমন অবস্থায় বৈদিক ধর্মের ঐতিহ্যকে ধারণ ও ব্যবহার করে তাকে শান্তিপূর্ণ ও স্থিতিশীল সমাজের উপযোগী করার যে প্রচেষ্টা চলছিল তার ফলে বর্ণজাতিভেদভিত্তিক হিন্দু সমাজ ও ধর্মের বিকাশ ঘটছিল। এর বিপরীতে বৈদিক ঐতিহ্যকে মূলত বর্জন করে অথচ ভারতবর্ষের সমাজ-ঐতিহ্যের অনেক কিছুকে ধারণ করে যে সব সংস্কার প্রয়াস চলে সেগুলির মধ্যে বৌদ্ধধর্ম সর্বাপেক্ষা সাফল্য লাভ করে। একদিকে বৈদিক ধর্মের ব্রাহ্মণ্য সংস্কারের মাধ্যমে ক্রমপ্রসারমান বর্ণজাতি প্রথার পবিত্রতা ও অপবিত্রতা ভিত্তিক সামাজিক খণ্ড-বিখণ্ডতা ও অসাম্যকে প্রত্যাখ্যান করে তা সামাজিক ঐক্য ও সাম্যের বাণী প্রচার করে, অপর দিকে বৈদিক ধর্মের যুদ্ধ ও সহিংসতাকে প্রত্যাখ্যান করে তা অহিংসা ও শান্তি ভিত্তিক সমাজ প্রতিষ্ঠার পথ তুলে ধরে।
তুলনায় সাম্প্রতিক কালের শিখ ধর্মের উদ্ভব ও বিকাশ থেকেও আমরা জানতে পারি কিভাবে সমাজের অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব, সংকট ও তা থেকে মুক্তির আকাঙ্ক্ষা ও প্রয়াস পুরাতন ধর্মের সংস্কারের মাধ্যমে একটা নূতন ধর্মের উদ্ভব ঘটায়। মোগল যুগে পাঞ্জাবের ব্যাপক সংখ্যক হিন্দু জনগণ বহিরাগত ও ভিন্ন ধর্মের মুসলিম শাসকদের নির্যাতন ও শোষণ থেকে মুক্তির জন্য সচেষ্ট ছিল। কিন্তু হিন্দু ধর্ম ও সমাজনেতৃত্বের দুর্বলতার কারণে তারা ব্যর্থ হচ্ছিল। অবশেষে হিন্দু সমাজে নানকের সংস্কার দ্বারা হিন্দু ধর্মের পরিবর্তে একটা নূতন ধর্মের বিকাশ ঘটে যেখানে বহু দেবতা, মূর্তি পূজা এবং বর্ণজাতিভেদ ইত্যাদি হিন্দু ধর্মের সকল মূল বৈশিষ্ট্য দূরীভূত হয়। অবশ্য শিখ ধর্মের স্বাতন্ত্র্য একদিনে প্রতিষ্ঠিত হয় নি। নানকের অনুসারী গুরু গোবিন্দ পরবর্তী কালে শিখ ধর্ম ও সমাজকে সামরিক শৃঙ্খলা ও বৈশিষ্ট্য এবং একটি সুসংহত রূপ দান করেন। এটা হিন্দু ধর্ম থেকে শিখ ধর্মকে পরিপূর্ণ স্বাতন্ত্র্য দান করে।
এমন কি বাংলায়ও আমরা এই ধরনের মৌল ধর্মসংস্কার প্রয়াসের সঙ্গে পরিচিত। ত্রয়োদশ শতাব্দীতে বাংলায় তুর্কী মুসলিম আক্রমণকারীদের শাসন প্রতিষ্ঠার পর ব্যাপক হিন্দু ও দেশজ জনগোষ্ঠীর ধর্মান্তরণ প্রতিহত করার জন্য পঞ্চদশ-ষোড়শ শতাব্দীতে চৈতন্য বৈষ্ণব ধর্মের নামে যে ধর্মসংস্কার করেন তা মূলত একটি নূতন ধর্ম প্রতিষ্ঠা করছিল। কিন্তু উপযুক্ত সামাজিক ভিত্তিভূমির অভাবে চৈতন্যের প্রয়াস ব্যর্থ হয়। তাঁর অনুসারীরা শেষ পর্যন্ত হিন্দু সমাজের মূল স্রোতে হারিয়ে যায়।
তা সত্ত্বেও চৈতন্যের সংস্কার থেকে আমরা ধর্ম প্রতিষ্ঠার চিরাচরিত ও ব্যতিক্রমহীন নিয়মটাকে দেখতে পাই। তাহল কোন ধর্ম ভিন্ন দেশ আক্রমণের সময় সৃষ্টি হয় না, বরং প্রতিটি ধর্মের উদ্ভব ঘটে সমাজের অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব থেকে, কিংবা ভিন্ন সমাজ ও ধর্মের শাসনের বিরুদ্ধে সফল প্রতিরোধ গড়ে তোলায় বিদ্যমান নেতৃত্বের ব্যর্থতা ও দুর্বলতা জনিত সংকট নিরসনের তাগিদ থেকে এবং প্রতিটি ধর্ম সৃষ্টি হয় কোন না কোন অর্থে মূলত সমাজ অভ্যন্তরের মানুষ দিয়ে, বাইরের সমাজ থেকে আসা অচেনা ও অবাঞ্ছিত মানুষ দিয়ে নয়। উপরন্তু সমাজের ঐতিহ্যকে ধারণ করে প্রতিটি নূতন ও ভিন্ন ধর্মের উদ্ভব হলেও শেষ পর্যন্ত এই ঐতিহ্যের সঙ্গে তার একটা ছেদও ঘটে। এই ছেদ যে সব ধর্মে এক রকমের হয় তা নয়। কিন্তু তা হতে হয়। তা না হলে ধর্মসংস্কার থেকে নূতন ধর্ম জন্ম নিতে পারে না।
পাতা: ৪৮
আমাদের আলোচনা থেকে যে সত্যটি বেরিয়ে এসেছে তা হল ঋগ্বেদকে চিনতে হবে সমাজের অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব থেকে উদ্ভূত এবং সমাজের প্রয়োজন পূরণের তাড়না সম্ভূত একটা ধর্মসংস্কার আন্দোলনের ফল রূপে; তার সঙ্গে বৈদেশিক আক্রমণ, যাযাবরবৃত্তি, শ্বেতাঙ্গ জাতির অভিযান ইত্যাদি কল্পকাহিনীর কোন সম্পর্কই নেই। আমরা নি:সংশয়ে এবং নির্দ্বিধায় এ কথা বলতে পারি যে, বৈদিক আন্দোলন দক্ষিণ এশিয়া তথা ভারতীয় উপমহাদেশের সপ্তসিন্ধু নামে ঋগ্বেদ কথিত বিশাল অঞ্চলে দীর্ঘকাল যাবৎ বসবাসকারী সভ্য জনগোষ্ঠী বা জনগোষ্ঠীসমূহের ভিতর থেকে গড়ে উঠে একটি যুগান্তকারী গৃহযুদ্ধের দিকে সমগ্র অঞ্চলের জনসমাজকে নিয়ে যায়। এই যুদ্ধে বিজয়ী পক্ষের যে ধর্মীয় গ্রন্থ আমরা পাচ্ছি তা হচ্ছে ঋগ্বেদ। এবং আমরা অনুমান করতে পারি যে, এই ঋগ্বেদের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট হয়ে পরবর্তী নিকট ও দূর সময়ে অন্য বেদ গ্রন্থগুলি রচিত হয়েছে।
সুতরাং এই বিষয়ে আর কোন দ্বিধা বা সংশয়ের অবকাশ থাকে না যে ঋগ্বেদ যেমন বহিরাগত কোন যাযাবর জনগোষ্ঠীর সৃষ্টি নয় তেমন আর্যরাও ভারতবর্ষে বহিরাগত, আক্রমণকারী জনগোষ্ঠী নয়। তারা এই উপমহাদেশেরই অধিবাসী যারা এখানে বহুপ্রাচীনকাল থেকে একটি সুউন্নত সমাজ ও সভ্যতা গড়ে তুলেছিল।
এখন আমরা যে প্রশ্নের সম্মুখীন হই তা হল বৈদিক আন্দোলন এবং যুদ্ধের মূল কারণ কোনটি, তার গতিপ্রকৃতি কি এবং ঋগ্বেদ কোন সমাজের চিত্র দেয় এবং ঋগ্বেদের পটভূমিতে আছে কোন সভ্যতা?
বৈদিক আন্দোলনের মূল কারণ বা উৎস এবং সংশ্লিষ্ট বিষয়াদি সন্ধান করতে যাবার পূর্বে ঋগ্বেদের পটভূমি হিসাবে আমরা সিন্ধু সভ্যতার দিকে দৃষ্টি দিতে পারি। কারণ বিংশ শতাব্দীর ২০-এর দশক থেকে প্রত্নতাত্ত্বিক আবিষ্কারের মাধ্যমে যে নিদর্শনাদি আমাদের সামনে উপস্থিত হয়েছে তা থেকে সিন্ধু কিংবা হরপ্পা সভ্যতা নামে পরিচিত এক বিশাল ও সুউন্নত প্রাচীন সভ্যতা সম্পর্কে আমরা অনেক কিছু জানতে পারছি। বস্তুত সিন্ধু সভ্যতা আবিষ্কারের পর বৈদিক আন্দোলনের উদ্ভব ও বিকাশের পটভূমির প্রমাণ খুঁজে পাওয়া কোনও সমস্যা হয় না। অবশ্য এর জন্য চাই সংস্কারমুক্ত মন। তা হলে আমরা সহজে ঋগ্বেদের সামাজিক পটভূমি হিসাবে সিন্ধু সভ্যতাকে চিনতে পারব। সুতরাং আমরা বৈদিক আন্দোলনের কারণ, উদ্ভব ও বিকাশের গতিপ্রকৃতি, ফলাফল ইত্যাদি সংক্রান্ত আলোচনায় যাবার পূর্বে সিন্ধু সভ্যতা সম্পর্কে একটা সংক্ষিপ্ত আলোচনা করব। তাতে করে এটা স্পষ্ট হবে যে, ঋগ্বেদ এবং সিন্ধু সভ্যতার মধ্যে প্রকৃত সম্পর্ক আছে কিনা, আর থাকলে তা কি ধরনের। তাহলে সিন্ধু সভ্যতার সঙ্গে আর্যদের সম্পর্ক কি ধরনের ছিল সেই প্রশ্নের উত্তরও পাব।
পাতা: ৪৯