Banner
নবম অধ্যায় - আর্য অভিগমন, সম্প্রসারণ ও ঐতিহ্য

লিখেছেনঃ শামসুজ্জোহা মানিক এবং শামসুল আলম চঞ্চল, আপডেটঃ September 28, 2012, 6:00 AM, Hits: 3697

সম্ভবত সিন্ধু সভ্যতার জনগোষ্ঠীগুলি নিজেদেরকে আর্য হিসাবে পরিচিত করত। কিছু অভিন্নতা সত্ত্বেও যে সেখানে বহু সংখ্যক ভাষা ও সংস্কৃতি বিদ্যমান ছিল তা আমরা সহজে অনুমান করতে পারি। সিন্ধু সভ্যতার বেশীর ভাগ অংশ জুড়ে অবস্থিত পাকিস্তানে একটি মাত্র ধর্ম ইসলাম থাকা সত্ত্বেও সেখানে আজও কয়েকটি ভাষা রয়েছে, যেমন পাঞ্জাবী, সিন্ধী, পশতু, বালুচ, উর্দূ ইত্যাদি। সুতরাং আজ থেকে প্রায় চার হাজার বছর আগে যে সিন্ধু সভ্যতার বিশাল অঞ্চলে একটি মাত্র ভাষা ছিল না তা অনুমান করা কঠিন নয়। তবে সেখানকার রাষ্ট্রভাষা যে সংস্কৃতের প্রাচীনতর রূপ বৈদিক ছিল তা বোধগম্য; নতুবা এই ভাষায় শিক্ষিত ঋষিদের দ্বারা মন্ত্র রচিত হত না যারা মূলত সিন্ধু সভ্যতার পুরোহিত শ্রেণী থেকে আগত বলে অনুমান করা যায়। বৈদিক ভাষা সভ্যতার সরকারী এবং প্রধান ভাষাই শুধু ছিল না, সেটি ব্যাপক অঞ্চলের বিভিন্ন ভাষাভাষী জনগোষ্ঠীসমূহের যোগাযোগের প্রধান মাধ্যম বা Lingua franca ছিল বলে অনুমান করা চলে। এই কারণে দূর বিস্তারী সভ্যতার বিভিন্ন অঞ্চলের ঋষিরা এই ভাষায় বৈদিক মন্ত্রসমূহ রচনা করেছিলেন। কারণ এটা মনে রাখা দরকার যে, এই মন্ত্রগুলি যদি জনসাধারণের একটি উল্লেখযোগ্য অংশের নিকট বোধগম্য না হত তবে বৈদিক আন্দোলন গণভিত্তি পেত না বলে তা দাঁড়াতে পারত না।
বস্তুত বৈদিক ভাষার ব্যাপক বিস্তার নদীনিয়ন্ত্রণভিত্তিক সভ্যতার শক্তির একটি ফল। এর ফলে সকলে বৈদিক ভাষাভাষী না হলেও বৈদিক বা সংস্কৃতের প্রভাব অন্যান্য জনগোষ্ঠীর ভাষার উপরেও পড়েছে। বিশেষত এর ফলে বিপুল পরিমাণ বৈদিক বা সংস্কৃত শব্দসম্ভার বিভিন্ন ভাষার অন্তর্ভুক্ত হয়েছে।
বর্তমান কালের ইংরাজী ভাষার অভিজ্ঞতার আলোয় বিষয়টাকে দেখলে অনেকটা বোঝা যাবে। ইংরাজী ভাষীদের বিশ্বব্যাপী আধিপত্য বা প্রাধান্যের ফলে এবং সেই সঙ্গে বিজ্ঞান-প্রযুক্তি ও জ্ঞানচর্চা সহ অন্যান্য নিত্যদিনের প্রয়োজনে আমরা যেমন বাংলাভাষায় বিপুল সংখ্যক ইংরাজী শব্দকে অন্তর্ভুক্ত করছি সেদিনও ব্যাপারটা অনেকটা তেমন ছিল। তবে এক রাষ্ট্রভুক্ত হওয়ায় অন্যান্য ভাষার উপর বৈদিক বা সংস্কৃতের প্রভাব ছিল অনেক বেশী। বিশেষত সেই সঙ্গে সরকারী ধর্মের প্রভাবের দিকটাও ভাবতে হবে। কারণ এই ধর্ম যে সেদিন সমগ্র সভ্যতার সাধারণ ধর্মে পরিণত হয়েছিল তা বোঝা যায় বৈদিক সংস্কারের মূলত অভিন্ন বৈশিষ্ট্য থেকে এবং সেই সঙ্গে সমগ্র সিন্ধু সভ্যতার অন্তত উপর তলায় মূর্তিপূজক কোন ধর্মাচারের প্রত্নতাত্ত্বিক চিহ্ন না থাকা থেকে।
যাইহোক, এটা অনুমান করা চলে যে, সিন্ধু সভ্যতা থেকে একটি অভিন্ন আর্য ভাষা,

পাতা: ১৯৭


সংস্কৃতি ও ধর্মের উত্তরাধিকার নিয়ে যেমন বিভিন্ন জনগোষ্ঠী অভিগমন করেছে তেমন নিজ নিজ স্বতন্ত্র ভাষা, সংস্কৃতি ও ধর্মাচারের সঙ্গে অভিন্ন আর্য ভাষা-সংস্কৃতি-ধর্মেরও কম বা বেশী প্রভাব নিয়ে অন্যান্য জনগোষ্ঠী অভিগমন করেছে। আর এইভাবে পৃথিবীর বিস্তীর্ণ ভূভাগে অভিগমন ও বসতি স্থাপনের সঙ্গে সিন্ধু সভ্যতার মানুষেরা সেখানে অভিন্ন ভাষা, সংস্কৃতি কিংবা ধর্মের এমন কিছু উপকরণ ছড়িয়ে দিয়েছে যা থেকে আমরা আর্য এবং সেই সঙ্গে সিন্ধু সভ্যতা ও সংস্কৃতির ঐতিহ্যের যোগসূত্র এবং প্রভাবের স্বরূপ সম্পর্কে একটা মোটামুটি ধারণা করতে পারি।
উপমহাদেশের বাইরে আমরা যে সব স্থানে ইন্দো-ইউরোপীয় নামে কথিত আর্য যোগসূত্র খুঁজে পাই তা সবচেয়ে স্পষ্ট ইরানে। ইরান যেমন সিন্ধু সভ্যতা অঞ্চলের সন্নিকটে তেমন সেখানে কালপ্রেক্ষিতে সিন্ধুর সমতুল্য না হলেও পরবর্তীতে একটি উন্নত সভ্যতা গড়ে উঠেছিল এবং সেখানে একটি ভাষা এবং ধর্মমত বহুকাল পর্যন্ত প্রচলিত ছিল যার সঙ্গে বৈদিক ভাষার বহু শব্দ এবং ঋগ্বেদের বহু বিষয়ের অনেক মিল দেখতে পাওয়া যায়।
খ্রীষ্টীয় সপ্তম শতাব্দী পর্যন্ত সেখানে আমাদের নিকট পার্সী ধর্ম নামে পরিচিত একটি ধর্ম বিদ্যমান ছিল। সপ্তম শতাব্দীতে মুসলিম আরব অভিযানের পর সাসানীয় রাজবংশের পতন এবং ইরানের স্বাধীনতা অবসানের পর পার্সী ধর্মও সেখান থেকে উচ্ছেদ হয়। কিছু সংখ্যক পার্সী ভারতবর্ষের পশ্চিম উপকূলে পালিয়ে আসে এবং তাদের ধর্ম রক্ষা করে। তাদের ধর্ম-গ্রন্থের নাম আবেস্তা (Avesta)।
আবেস্তার মূল গ্রন্থ এবং ভাষা কোনটাই নেই। আবেস্তার মূল রচয়িতা জরথুস্ত্র-এর সময়কার ভাষা যেমন বহুকাল আগে অচল হয়েছে তেমন মূল আবেস্তা গ্রন্থও একাধিক রাজনৈতিক বিপর্যয়ে বিনষ্ট হয়েছে। প্রথম বিপর্যয় ঘটে গ্রীক রাজা আলেকজান্ডারের হাতে ইরানীদের পরাজয়ের পর। তখন তিনি আবেস্তা গ্রন্থের অনুলিপিসমূহ ধ্বংস করেন। দ্বিতীয় বড় রকম বিপর্যয় ঘটে মুসলিম আক্রমণ ও বিজয়ের পর। বর্তমান গ্রন্থটি প্রাচীন ধর্মগ্রন্থের বিভিন্ন ছড়ানো অংশের পরবর্তী সংকলন এবং এটা পরবর্তী কালের ভাষায় অনূদিত কিংবা রচিত হয়ে বর্তমান রূপ নিয়েছে।
সুতরাং পাঠকদের কাছে জরথুস্ত্রের যে ধর্মগ্রন্থ এসে পৌঁছেছে তা দিয়ে তার মূল ভাষা, শব্দগত উচ্চারণ এবং বিষয়বস্তুকেও অনেক সময় ধারণা করা কঠিন হয়। তবে একটু মনোযোগ দিয়ে পাঠ করলেই আবেস্তাকে চেনা যায় সিন্ধু-হরপ্পান সংস্কৃতি ও ধর্মের উৎসজাতরূপে।
আবেস্তা পড়লে বোঝা যায় যে, সিন্ধু সভ্যতার শাসক কিংবা বৈদিক-বিরোধী শক্তি নূতন ও দৃঢ় অবস্থান নিয়ে দাঁড়াতে সক্ষম হয়েছিল। তবে সময়ের সঙ্গে, পরিবেশ ও পরিস্থিতির সঙ্গে তাল মিলিয়ে প্রাচীন ধর্মে বড় রকম সংস্কার ঘটানো হয়েছিল। জরথুস্ত্র হলেন এই সংস্কারক।
আবেস্তা আমাদের জন্য সিন্ধু-হরপ্পান ধর্ম ও সংস্কৃতির বিষয়সমূহ এবং ঋগ্বেদেরও অনেক বিষয় বোঝার জন্য এক অসাধারণ গুরুত্বপূর্ণ সূত্র। তবে এখানে আমরা খুব সংক্ষেপে

পাতা: ১৯৮


কয়েকটি বিষয়ের উপর মাত্র আলোচনা করব।
আবেস্তা পড়লে বোঝা যায় বৈদিক আন্দোলনের প্রতি প্রচণ্ড ঘৃণা এবং আক্রোশ নিয়ে তার জন্ম। ঋগ্বেদের দেব শব্দ (আবেস্তান উচ্চারণে দয়েব বা Daeva) এখানে অত্যন্ত ঘৃণ্য। দেব বা দয়েব অর্থ শয়তান বা দানব বা অশুভ শক্তি। শুভ এবং উপাস্য শক্তি বা দেবতা হল অহুর। আবেস্তান ভাষায় ‘স’ এর উচ্চারণ ‘হ’ হওয়ায় অসুর এখানে অহুর হয়েছে।
আমরা জানি প্রাচীন হিন্দু ঐতিহ্যে অসুর হচ্ছে দানব বা অশুভ শক্তি। এইভাবে সিন্ধু সভ্যতার নদীনিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থার পক্ষ-বিপক্ষের সংঘাত হিন্দু শাস্ত্র এবং পুরাণে অসুর এবং দেবতাদের মধ্যকার সংঘাতে রূপ নিয়েছে। সমস্ত হিন্দু পুরাণ দেব এবং অসুর বা সুর এবং অসুরের সংঘাতের বিবরণে পূর্ণ। অথচ ঋগ্বেদে ইন্দ্র সহ বিভিন্ন দেবতাকে বহুবার অসুর বলা হয়েছে। আবার দেবও বলা হয়েছে। কিন্তু প্রথম দিকের মন্ত্রগুলিতে অসুর শব্দ বেশী ব্যবহার করা হলেও পরবর্তী সময়ের মন্ত্রগুলিতে দেব শব্দ দেবতাদের জন্য বেশী ব্যবহার করা হচ্ছে এবং প্রতিপক্ষের উদ্দেশ্যে অসুর শব্দ ব্যবহার করা হচ্ছে। বোঝা যায় যে, বৈদিক সংস্কারকগণ সংস্কার প্রক্রিয়ায় বহুল প্রচলিত পুরাতন অসুর শব্দ ক্রমে বাদ দিয়ে উপাস্যদের জন্য পুরাতন ধর্মে কম ব্যবহৃত অথবা অপ্রচলিত দেব বা দেবতা শব্দ গ্রহণ করে সনাতন ধর্মের অনুসারী প্রতিপক্ষের ঐতিহ্য থেকে নিজেদেরকে আলাদা করে নিচ্ছিল। ঋগ্বেদ রচনার পরবর্তী কালে হিন্দু সংস্কৃতিতে এই বিভাজন দৃঢ়বদ্ধ হয়ে অসুর শব্দ শুধুমাত্র দেববিরোধী দানবের জন্য নির্দিষ্ট হল। আবেস্তানদের ক্ষেত্রে ঘটেছিল এর উল্টোটা। তারা বৈদিকদের উপাস্য ‘দেবদেরকে’ দানব হিসাবে চিহ্নিত করে নিন্দা করল। এই একটি ঘটনা থেকেও প্রমাণিত হয় যে, আবেস্তানরা সিন্ধু সভ্যতার মূল ধর্ম-সংস্কৃতির প্রত্যক্ষ উত্তরাধিকারী।
আবেস্তার ঈশ্বর বা সর্বোচ্চ দেবতা হলেন অহুর ময্দা (Ahura Mazda)। বরুণ হলেন এই অহুর ময্দা। এটা অনুমান করা যায় যে, সপ্তসিন্ধুতে নদীনিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থায় যে সংকট ও ধ্বংস ঘটে তার ফলে ঐ ব্যবস্থার উপর নির্ভরশীল সভ্যতার বিপর্যয়ের কারণে সর্বোচ্চ দেবতা বরুণের মর্যাদাও ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এই জন্য তার একটা ভিন্ন নামের প্রয়োজন ছিল। তাছাড়া পুরাতন ধর্মকাঠামোতে ইন্দ্র প্রভৃতি বৈদিক দেবতার সঙ্গে বরুণের নাম ঘনিষ্ঠভাবে সংযুক্ত থাকায় পুরাতন ধর্মের সংস্কারের প্রয়োজনে বরুণকে বরুণ নামে অভিহিত না করে শুধু অহুর ময্দা নামে অভিহিত করা হল। এইভাবে আবেস্তানরা বৈদিকদের মত বরুণের মর্যাদা না নামিয়ে তাকে ভিন্ন নামে রক্ষা করল। অহুর ময্দা সম্ভবত অসুর মস্তক শব্দ থেকে আগত যার অর্থ হতে পারে অসুর শ্রেষ্ঠ বা দেবশ্রেষ্ঠ কিংবা সর্বোচ্চ অসুর।
আবেস্তায় ইন্দ্র ঘৃণিত অপশক্তি বা শয়তান মাত্র। দয়েব ইন্দ্র অহুর ময্দার অন্যান্য সৃষ্টির মত অশ বহিস্ট (Asha Vahista)-এর বিরোধিতা করে এবং মানুষকে দুষ্কর্মে প্ররোচিত করে।

পাতা: ১৯৯


অশ বহিস্ট যে, সিন্ধু সভ্যতায় বসিষ্ঠ গোত্রের একজন গুরুত্বপূর্ণ পুরোহিত ছিলেন তেমন মনে হয়। এই সঙ্গে অনুমান করা চলে যে, পুরাতন সমাজ-ধর্মে বসিষ্ঠ গোত্রের যে উচ্চ মর্যাদা ছিল রাজা সুদাস তাকে ব্যবহার করার উদ্দেশ্যে ঋষি বিশ্বামিত্রকে বাদ দিয়ে বসিষ্ঠকে তাঁর পুরোহিত হিসাবে নিয়োগ করেছিলেন। এবং এই বসিষ্ঠ বরুণের উদ্দেশ্যে যেসব আর্ত মন্ত্র রচনা করেছিলেন সেগুলির তাৎপর্যও অধিকতর স্পষ্ট হয়। অর্থাৎ বসিষ্ঠ গোত্র বিভক্ত হয়েছিল। সম্ভবত গোত্রের প্রধান অংশ ছিল বৈদিক সংস্কার-বিরোধী। আবেস্তায় হয়ত দলত্যাগী বা প্রতিপক্ষের বসিষ্ঠকে বোঝাতে ঘৃণিত অপশক্তি হিসাবে উল্লেখ করা হয়েছে হরিৎ বা পীত বুশিয়াস্ট (Yellow Bushiasta) এই নামে।
তবে আবেস্তায় অহুর ময্দার প্রধান শত্রু এবং সর্বপ্রধান দয়েব (Daeva) বা অপশক্তি হচ্ছে অঙ্গ্রা মইন্যু (Angra Mainyu)।
এটা স্পষ্ট যে, বৈদিক আন্দোলনের উদ্গাতা অঙ্গিরা ঋষিগণ কিংবা তাদের প্রধান ব্যক্তি আবেস্তায় অহুর ময্দা বা বরুণের প্রধান প্রতিপক্ষ হিসাবে রূপ নিয়েছে। সুতরাং আবেস্তার সবচেয়ে বড় শয়তান হচ্ছে অঙ্গ্রা মইন্যু।
অঙ্গিরা থেকে অঙ্গ্রা। আর মইন্যু শব্দ সম্ভবত বৈদিক মন্যু থেকে। ঋগ্বেদে মন্যু অর্থ দেবতা বা অপদেবতা দুই-ই হতে পারে বলে মনে হয়। ৭/৮৬/৬ ঋকে ঋষি বসিষ্ঠ বলছেন : ‘হে বরুণ ! সে পাপ নিজের দোষে নয়। এ ভ্রম বা সুরা বা মন্যু বা দ্যূতক্রীড়া বা অবিবেকবশত ঘটেছে। কনিষ্ঠকে জ্যেষ্ঠেও বিপথে নিয়ে যায়, স্বপ্নেও পাপ উৎপন্ন হয়’ (৭/৮৬/৬)। ১০ মণ্ডলে আমরা মন্যু দেবতার উদ্দেশ্যে রচিত ৮৩ ও ৮৪ এই দুইটি সূক্ত পাই। ১০/৮৩/১ ঋকে মন্যুর উদ্দেশ্যে বলা হচ্ছে, ‘হে মন্যু অর্থাৎ ক্রোধের অধিষ্ঠাত্রী দেবতা।’ এবং তার উদ্দেশ্যে এমনভাবে স্তুতি করা হয়েছে যে, তাকে ইন্দ্রের সমার্থক মনে হয়। মন্যু শব্দের যে সব অর্থ সংস্কৃত অভিধানে দেওয়া আছে সেগুলির কয়েকটি হচ্ছে : মূলনীতি, মন, ভাব, আত্মা, ভূত-প্রেত, ক্রোধ, ঘৃণা, তেজ। মইন্যু সম্ভবত অসৎ নীতি এবং ভাব অথবা অশুভ মন-আত্মা ইত্যাদি বোঝাতে ব্যবহার করা হয়েছে। কারণ অহুর ময্দার যাবতীয় শুভ কর্মের বিরোধিতা করা এবং জগতের অমঙ্গল সাধন করাই দয়েবদের দয়েব তথা সর্বোচ্চ দয়েব অঙ্গ্রা মইন্যুর কাজ।
যাইহোক, জরথুস্ত্র পুরাতন সিন্ধু-হরপ্পান ধর্মের সংস্কার দ্বারা যে নূতন ধর্ম প্রবর্তন করেন তাতে অহুর ময্দার প্রধান বিরোধী শক্তি হিসাবে আমরা পাই অঙ্গ্রা মইন্যুকে। এই উভয়ের মধ্যে দ্বন্দ্ব এবং তাতে শেষ পর্যন্ত অহুর ময্দার বিজয়ের অনিবার্যতা হল জরথুস্ত্রের ধর্মের একটি মূল বার্তা।
আর আবেস্তা আমাদেরকে দেয় আর্য সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য। বস্তুত আবেস্তা শুরু হয়েছে ঈশ্বর অহুর ময্দা কর্তৃক সর্বশ্রেষ্ঠ মানবভূমি হিসাবে আর্যভূমি সৃষ্টির বর্ণনা দিয়ে। আবেস্তার প্রথম পর্ব ভেন্দিদাদ-এ আমরা প্রথমে পাই অহুর ময্দার সবচেয়ে প্রিয় জাতি আর্য জাতির জন্য আর্যভূমি সৃষ্টির বর্ণনা।

_________________________________________________________________________________
আমরা সংস্কৃত বা বৈদিক শব্দের অর্থের জন্য Sir Monier Monier-Williams-Gk Axhcwd A Sanskrit-English Dictionary ব্যবহার করেছি। বইটির প্রকাশক Motilal Banarsidass Publishers Private Limited, Delhi, পুনর্মুদ্রণ : ১৯৯৫
_________________________________________________________________________________

পাতা: ২০০


আবেস্তায় আর্যভূমির নাম বলা হয়েছে আইরিয়ান বয়েজ (Airyana Vaeja) কিংবা ইরান্ বেজ্ (Eran Vej)„ সম্ভবত এটি আর্য ব্রজ শব্দের রূপান্তর যার মূল অর্থ আর্যদেশ বা আর্যভূমি হওয়া সঙ্গত। অবশ্য ব্রজের সংস্কৃত অর্থ গোষ্ঠ, গোযুথ, বাথান, পথ ইত্যাদি বলা হয়েছে। আবার ধামও ব্রজ। সুতরাং আর্যব্রজ অর্থ আর্যদেশ হতে পারে।
আবেস্তা আর্য গৌরবে ঋগ্বেদের তুলনায় অনেক বেশী সোচ্চার। ঈশ্বরের মনোনীত জাতির এই স্বরের প্রতিধ্বনি আমরা শুনতে পাই বাইবেলের পুরাতন নিয়মে যেখানে ইহুদীদেরকে সদাপ্রভু ঈশ্বরের মনোনীত এবং প্রিয় জাতি বলা হয়েছে।
আবেস্তায় আমরা অহুর ময্দার অত্যন্ত প্রিয় সৃষ্টি এবং শক্তিশালী দেবতা হিসাবে মিথ্রকে পাই। মিথ্র বা মিথ্র (Mithra)  হলেন ঋগ্বেদের মিত্রের সামান্য রূপান্তর মাত্র।
ঋগ্বেদে মিত্রকে লোকপতি বলা হয়েছে। ৮/২৫ সূক্তে মিত্র সম্পর্কে যা বলা হয়েছে তার কিছুটা হলেও উল্লেখ করা যায় :
‘১৬। লোকপতি মিত্র বহুসংখ্যক প্রধান দ্রব্য এ প্রকারে দর্শন করেন। মিত্র ও বরুণের মধ্যে আমরা তোমাদের জন্য তাঁরই ব্রত পালন করব। ১৭। পরে সাম্রাজ্যবিশিষ্ট বরুণের পুরাতন গৃহ প্রাপ্ত হব, অতিশয় প্রসিদ্ধ মিত্রের ব্রতও লাভ করব।’
ঋগ্বেদের মিত্রের পাশে আবেস্তার মিথ্রকে মেলানো যাক :
‘৬। আমরা মিথ্রের উদ্দেশ্যে আহুতি দিই। তিনি বিস্তীর্ণ চারণভূমির অধিপতি, সত্যবাদী, সভাসমূহে প্রধান। সহস্র কর্ণ, সুন্দর আকৃতি, দশ সহস্র চক্ষু ও পূর্ণ জ্ঞান বিশিষ্ট এ মিথ্র বলবান, নিদ্রাহীন ও চিরজাগ্রত।
৭। সকল দেবতার মধ্যে যাঁকে অহুর ময্দা সবচেয়ে গৌরবান্বিত করে সৃষ্টি করেছেন সকল দেশের প্রভু সেই মিথ্রের উদ্দেশ্যে আমরা আহুতি দিই। সুতরাং মিথ্র এবং অহুর এই দুই মহান দেবতা আমাদের সাহায্যার্থে আগমন করুন।’ (নিয়াইস। ২ : মিহির নিয়াইস)
ঋগ্বেদের এক গুরুত্বপূর্ণ দেবতা বায়ুর অনেক বেশী গুরুত্ব দেখা যায় আবেস্তায়। বায়ু অহুর ময্দার অধীন প্রধান অসুর সেনাপতি বলে অনুভব করা যায়। সম্ভবত বায়ু ছিলেন সিন্ধু সভ্যতার প্রধান যুদ্ধ দেবতা। ফলে ঋগ্বেদে তাকে দেবতা হিসাবে স্বীকৃতি দেওয়া হলেও তার মর্যাদা ও গুরুত্ব অনেক হ্রাস করা হয়েছে। আবেস্তায় বায়ু ঘোষণা করছেন :
আমার নাম সে যে ধ্বংস করে
আমার নাম সে যে কেড়ে নেয়
............ ............. .............

_________________________________________________________________________________
এই গ্রন্থে আবেস্তার সকল উদ্ধৃতির উৎস : The Zend-Avesta. Translated by James Darmesteter, Sacred Books of the East. series, Vol. IV and XIII, Second Edition ; (Oxford ; 1895). ইংরাজী থেকে বাংলা ভাষান্তর আমাদের করা।
_________________________________________________________________________________


পাতা: ২০১


আমার নাম সাহসী ; আমার নাম সবচেয়ে সাহসী
............ ............. .............
আমার নাম সে যে এক আঘাতে চূর্ণ করে
............ ............. .............
আমার নাম সে যে দয়েবদের বিরুদ্ধে কাজ করে। (রাম ইয়াস্ত্)
আমরা আবেস্তাতেও সোমলতার সন্ধান পাই। সোমকে আবেস্তায় বলা হচ্ছে হওম (Haoma)। হওমের রস পবিত্র। দেবতাদের উদ্দেশ্যে তা অগ্নিতে আহুতি দেওয়া হয়। আবেস্তা থেকে আমরা জানছি যে, সোমলতা সোনালী এবং দিঘল বা লম্বা। সিরোযাহ্-২, ৩০ অনেরান-এ বলা হচ্ছে : ‘আমরা সোনালী ও দিঘল হওমের উদ্দেশ্যে আহুতি দিই ; আমরা সঞ্জীবনী হওমের উদ্দেশ্যে আহুতি দিই, তিনি জগতের বৃদ্ধি ঘটান ; আমরা হওমের উদ্দেশ্যে আহুতি দিই, তিনি মৃত্যুকে দূর করেন।’
সুতরাং সোমলতা যে ইক্ষু বা আখ গাছ মাত্র আমাদের এই ধারণার সমর্থনে আরও সাক্ষ্য পাওয়া যাচ্ছে।
দয়েবদের বিরুদ্ধে অহুরের সংগ্রাম অর্থাৎ বৈদিকদের বিরুদ্ধে সিন্ধু-হরপ্পান শাসক শক্তির সংগ্রামের স্মৃতি আবেস্তায় যে কতটা জীবন্ত তা সামান্য আর কিছু উদাহরণ দিলে স্পষ্ট হবে :
‘আমরা পবিত্র জরথুস্ত্রের ধর্মানুরাগ এবং ফ্রবাশি (Fravashi)-কে পূজা করি ;
.................. ..................... ....................
৮৯। যে প্রথম ঋষি ছিল, প্রথম যোদ্ধা ছিল, মাটিতে প্রথম লাঙ্গলচালক ছিল; যে প্রথম দয়েব (Daeva) ও শীতল হৃদয় মানুষের হাত থেকে চক্রের ঘূর্ণন কেড়ে নিয়েছিল; যে বাস্তব পৃথিবীতে প্রথম অশ (Asha)-এর প্রশংসা উচ্চারণ করেছিল, এভাবে দয়েবদের ধ্বংস করেছিল, এবং নিজে ময্দার পূজারী হিসাবে, জরথুস্ত্রের অনুসারী হিসাবে, যে দয়েবদের ঘৃণা করে -- সেই হিসাবে স্বীকার করেছিল এবং অহুরের আইন পালন করে।’ (যেন্দ্-আবেস্তা ; ২য় অংশ ; ১৩। ফরবারদিন ইয়াস্ত্ ; ২৪)
‘হে জরথুস্ত্র! সেই কথাটি ঘোষণা কর, যে কথা বলতে হবে, যখন তুমি মূর্তিপূজারী এবং চোর এবং দয়েবদেরকে তীব্র আক্রমণ করেছিলে। তখন দয়েবদের, যাতুদের এবং তাদের অনুসারীদের, পৈরিকদের এবং তাদের অনুসারীদের, পাপী পূজারীগণের বিদ্বেষ আতঙ্কিত হবে ও পলায়ন করবে। দয়েবরা ধ্বংস হোক ! দয়েবপূজারীরা ধ্বংস হোক, এবং তারা তাদের মুখ কামড় থেকে ফিরিয়ে নেয়।’ (যেন্দ-আবেস্তা; ২য় অংশ; ১১। স্রোশ ইয়াস্ত্ হাধোখ্ত্; ১)
‘৯ (১৬)। তুমি তিনবার থ্রিসামরুতগুলো বলার পর, তুমি এই বিজয়ী অত্যন্ত আরোগ্যকর কথাগুলো উচ্চৈ:স্বরে বলবে : আমি ইন্দ্রকে বিতাড়ন করি, আমি সৌরুকে

পাতা: ২০২


বিতাড়ন করি, আমি দয়েব নৌন্ঘৈথিয় (Naunghaithya)-কে বিতাড়ন করি, এই গৃহ থেকে, এই স্বশাসিত নগর থেকে, এই শহর থেকে, এই দেশ থেকে; ............’ (যেন্দ-আবেস্তা ; ১ম অংশ ভেনদিদাদ ; ফারগার্দ ১০।)
ঋগ্বেদের মত আবেস্তা থেকেও আমরা জলের জন্য যুদ্ধের কথা জানতে পারি :
‘৬৪। আমরা বিশ্বাসীদের ফ্রবাশিকে পূজা করি যারা ভাল, শক্তিশালী, উপকারী, যারা মহৎ, যারা শক্তিশালী, যারা দ্রুতগামী, যারা বেশী ক্ষমতাশালী, যারা বেশী বিজয়ী, যারা আরও বেশী আরোগ্যকারী, যারা এত কর্মক্ষম যে কথায় প্রকাশ করা যায় না ; যারা মিয়াযদাদের মধ্যে দশ সহস্র করে ছুটে যায়।
৬৫। এবং যখন জলগণ বৌরু-কশ সাগর থেকে উপরে উঠে আসে, হে স্পিতম জরথুস্ত্র! ময্দার গৌরবের সাথে, তখন সামনে ভীতিজনক ফ্রবাশিরা আসে, বহু শত, বহু সহস্র, বহু অযুত।  
৬৬। তাদের নিজেদের আত্নীয়দের জন্য, তাদের নিজেদের স্বায়ত্তশাসিত নগরের জন্য, নিজেদের শহরের জন্য, তাদের নিজেদের দেশের জন্য জল অন্বেষণ করতে থাকল এবং এভাবে বলতে থাকল : আমাদের দেশ জলের উত্তম সঞ্চয় এবং পূর্ণ আনন্দে ভরে উঠুক।
৬৭। তারা যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ল তাদের নিজেদের স্থানে ও ভূমিতে, প্রত্যেকে তার নিজের স্থান ও বাসগৃহে যেখানে সে থাকত (অতীত কালে); তারা সাহসী যোদ্ধার মত দেখতে, তারা সজ্জিত ও সতর্ক, যে সম্পদ সে সঞ্চিত করেছিল তার জন্য যুদ্ধ করে।
৬৮। এবং তাদের মধ্যে যারা জল আনতে বিজয়ী হয়েছিল, তাদের নিজেদের আত্মীয়দের জন্য, তাদের নিজেদের স্বায়ত্তশাসিত নগরের জন্য, তাদের নিজেদের শহরে, তাদের নিজেদের দেশে, এরূপ বলে : আমাদের ভূমি উন্নত ও বর্ধিত হোক।’ (১৩। ফারবারদিন ইয়াস্ত: ২২)
বৃহত্তর সিন্ধু-সরস্বতী উপত্যকার কতকগুলি নদী এবং স্থানের নাম আবেস্তায় পাওয়া যায়। যেমন অহুর মযদা যে ষোলটি ভাল দেশ সৃষ্টি করেছিলেন সেগুলির মধ্যে প্রথম হচ্ছে আইরিয়ান বয়েজ (Airyana Vaeja), ষষ্ঠ হচ্ছে হরয়ো (Horoyo),  দশম হচ্ছে হরহ্বৈতি (Harahvaiti) এবং পঞ্চদশ হচ্ছে হপ্ত হিন্দব (Hapta Hindava)  বা হপ্ত হিন্দু। আইরিয়ান বয়েজ যে আর্য ব্রজের রূপান্তর হতে পারে তা আমরা ইতিপূর্বে বলেছি। হরয়ো যে সরযু এবং হরহ্বৈতি যে সরস্বতী থেকে হয়েছে সেটা স্পষ্ট। এই দুইটি সপ্তসিন্ধু বা সাত নদীর দুই নদীর নাম। হপ্ত হিন্দু বা সপ্তসিন্ধু আমাদের একান্ত পরিচিত। সপ্তসিন্ধু দ্বারা যেমন সাতটি নদীকে বোঝানো হয় তেমন সাতনদী বিধৌত বিশাল অঞ্চলকেও বোঝানো হয় যার মধ্যে সিন্ধু-হরপ্পান সভ্যতার অধিকাংশ অঞ্চল পড়ে। আর আবেস্তার ভাল দেশ মানে যেসব দেশ নদীবিধৌত।
আবেস্তানরা যে সিন্ধু সভ্যতা থেকে ইরানে গিয়েছিল তার সবচেয়ে বড় প্রমাণ উপরে বর্ণিত নদী কয়টির নাম। তাছাড়া আবেস্তা থেকেও সেটা স্পষ্ট হয়। পণ্ডিতদের সাধারণ

পাতা: ২০৩


অভিমত হল ভারতবর্ষে আসার পথে আর্য বা ইন্দো-ইউরোপীয় জনগোষ্ঠীর মধ্যে বিবাদ হয়, ফলে তারা দুই ভাগ হয়ে যায়। একভাগ ইরানে প্রবেশ ও বসতি করে এবং অপর ভাগ ভারতবর্ষে প্রবেশ করে। ইরানে যারা বসতি করে তারা পরবর্তী কালে আবেস্তা রচনা করে এবং ভারতবর্ষে যারা বসতি করে তারা ঋগ্বেদ রচনা করে। তাদের মতে এই কারণে ঋগ্বেদ এবং আবেস্তায় এত মিল এবং উভয় পক্ষের সংঘাতের বিবরণ রয়েছে।
আমরা এই পণ্ডিতদের যাযাবর আর্য অভিযান ও আক্রমণের সমস্ত তত্ত্বকে প্রত্যাখ্যান করেছি এবং এই আলোচনায় এটা স্পষ্ট করেছি যে, আর্যরা ছিল স্থিতিশীল এবং সভ্য জীবনের অধিকারী এবং তারাই সিন্ধু সভ্যতার সংগঠক ও নির্মাতা। সিন্ধু সভ্যতার পতনকালে নদীনিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা তথা জলকে কেন্দ্র করে তাদের মধ্যে যে গৃহবিবাদ ঘটে তার সাক্ষ্য আমরা পাই ঋগ্বেদ থেকে। এবং এখন আমরা আবেস্তা থেকেও সেই গৃহবিবাদেরই সাক্ষ্য পাচ্ছি।
পার্সী বা আবেস্তান ধর্মের প্রবর্তক জরথুস্ত্রের সময় নিয়ে লেখকদের মধ্যে বিভিন্ন মত আছে। অনেকে তাঁকে পঞ্চম বা ষষ্ঠ খ্রী:পূ:-এর দিকের মানুষ মনে করেন। কারও মতে তাঁর সময় খ্রীষ্টের এক হাজার বছর আগে। কেউ কেউ তাঁকে আরও প্রাচীন মনে করেন। এই সবশেষ মত আমাদের নিকট গ্রহণযোগ্য।
কারণ এটা স্পষ্ট যে, জরথুস্ত্রের ধর্ম মূল সিন্ধু-হরপ্পান ধর্মের একেশ্বরবাদী ভাবপ্রেরণাকে বৈদিক ধর্মের তুলনায় অধিকতর পরিমাণে রক্ষা করেছে। এ থেকে এবং সেই সঙ্গে ঋগ্বেদে উল্লিখিত বহু দেবতা ও বিষয়বস্তু এবং উপাখ্যানের সঙ্গে আবেস্তার আশ্চর্য রকম মিল থেকে এটা স্পষ্টভাবে বোঝা যায় যে, জরথুস্ত্রের মূল সংস্কার কিংবা মূল আবেস্তার রচনা কাল বৈদিক আন্দোলনের সমসাময়িক অথবা তা বেশী পরেরকার নয়। আমাদের এই ধারণা আর একটি ঘটনা থেকে জোরালো হয়, তা হল বৈদিক সংস্কার আন্দোলনের প্রতি আবেস্তার প্রচণ্ড ঘৃণা এবং ক্রোধ। আবেস্তা রচনা যে, বেশী কাল পরের নয় সেটা তা থেকেও বোঝা যায়। অনেক কাল পরের প্রজন্মসমূহ যাদের নিকট ভিন্ন এক পরিত্যক্ত দেশ এবং অনেক প্রজন্ম পূর্বের তিক্ততার স্মৃতি নেই তারা ধর্ম সংস্কারের সময় এভাবে ঘৃণায় আবেগতাড়িত হতে পারে না। উপরন্তু বহুকাল পর ভিন্ন দেশ ও পরিস্থিতিতে সিন্ধু সভ্যতার স্মৃতি অনেকাংশে হারিয়ে যেত বলে নূতন সংস্কার দ্বারা রচিত ধর্মগ্রন্থ আবেস্তার সঙ্গে ঋগ্বেদের এত বেশী মিলও খুঁজে পাওয়া যেত না।
এমন কি এই সম্ভাবনাও আমরা দেখি যে, আবেস্তান সংস্কারও হয় সিন্ধু উপত্যকাতেই গৃহযুদ্ধের একটা পর্যায়ে। কারণ বৈদিক পক্ষ যখন ধর্মসংস্কার করে যুদ্ধ শুরু করে তখন মূলত অহিংসানির্ভর পুরাতন ধর্মের কারণে সভ্যতার মূল অধিকারী অবৈদিক শাসক শ্রেণীর পক্ষে বিদ্রোহী বৈদিক শক্তির বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা কঠিন হবার কথা। বিশেষ করে সংকটগ্রস্ত নদীনিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা বৈদিক শক্তির আঘাতে যখন ধ্বংস হচ্ছিল তখন শুধু সভ্যতা নয় সেই সঙ্গে পুরাতন ধর্মের ভিত্তিও ভেঙ্গে পড়ছিল। এমন অবস্থায় চূড়ান্ত পরাজয় এবং ধ্বংস

পাতা: ২০৪


এড়াবার এবং নিজেদের স্বাতন্ত্র্য ও স্বাধীনতা রক্ষার জন্য শাসক শ্রেণীও যে অপর একটি ধর্ম সংস্কার করে বৈদিক ধর্মের পাল্টা ধর্ম জন্ম দিবে সেটা খুব স্বাভাবিক এবং যৌক্তিক মনে হয়।
আমাদের এই অনুমানকে শক্তি যোগায় আবেস্তার একটি বিশেষ সুর, সেটি শুধু বৈদিক পক্ষের বিরুদ্ধে ঘৃণা এবং আক্রোশ নয় সেই সঙ্গে বিজয়েরও সুর। এই সুর কিছু পূর্র্বে উদ্ধৃত আবেস্তার কয়টি মন্ত্র থেকেও ভালভাবে বোঝা যায়। সর্বোপরি আবেস্তায় দয়েব তথা বৈদিক শত্রুশক্তির বিরুদ্ধে চলমান যুদ্ধের যেসব জীবন্ত বিবরণ আছে সেগুলিকে কিভাবে ভিন্ন দেশ দূরের কথা এমন কি পরবর্তী কালেরও রচনা বলা যাবে ? যেমন :
‘৫৫ (১৩৭) হে বিশ্বস্রষ্টা ! হে পবিত্র এক! দয়েবরা কোথায়? কোথায় তারা যারা দয়েবদের উপাসনা করে? কোথায় সেই স্থান যার উপর দিয়ে দয়েবদের সৈন্যদলগুলি একত্রে ছুটে যায় ? কোন স্থানের উপর দিয়ে দয়েবদের সৈন্যদলগুলি সম্মুখ বরাবর ছুটে আসে ?
কোথায় সেই স্থান যার উপর তারা দলে দলে ছুটে যায় তাদেরকে হত্যা করতে, তাদের পঞ্চাশ পঞ্চাশ, শত শত, সহস্র সহস্র, অযুত অযুত এবং তাদের অগণন সংখ্যককে হত্যা করতে ?’ (ফার্গার্ড্ ৭)
এই একটি মন্ত্র কি এ কথা প্রমাণের জন্য যথেষ্ট নয় যে, আবেস্তা রচনা হয়েছে বৃহত্তর সিন্ধু-সরস্বতী উপত্যকায় বৈদিক শক্তির বিরুদ্ধে যুদ্ধরত অবস্থায়? এই ধরনের আরও অনেক দৃষ্টান্ত আবেস্তা থেকে পাওয়া যাবে। কিন্তু আমাদের পক্ষে এ গ্রন্থে এই বিষয়ে দীর্ঘ আলোচনার সুযোগ নেই বলে আমরা এখানে একান্ত প্রাথমিক এবং সংক্ষিপ্ত আলোচনার মধ্যে বিষয়টিকে সীমাবদ্ধ রাখছি। যাইহোক, এই বিষয় আমাদের কাছে ক্রমে স্পষ্ট হয়েছে যে, আবেস্তা এবং ঋগ্বেদ পাশাপাশি দুই ধর্মসংস্কারের দুইটি দলিল। তবে ঋগ্বেদের অন্তত এক বৃহৎ অংশ যেভাবে মূলত অপরিবর্তিতভাবে কাল পরিক্রমায় রক্ষা পেয়েছে, আবেস্তার পক্ষে সেটা সম্ভব হয় নি। তবু তার ভিতর একটা যুগান্তকারী ঐতিহাসিক সময়কে ধরার মত অনেক উপাদানই লুকিয়ে আছে।
একটা বিষয় আমাদের নিকট স্পষ্ট যে, আবেস্তা পরাজিত হয়ে হাল ছেড়ে দেওয়া মানুষের ধর্ম নয়। বস্তুত সম্পূর্ণরূপে পরাজিতরা নূতন ধর্ম সৃষ্টি করতে পারে না। তারা পুরাতন ধর্মকে আঁকড়ে ধরে থাকে অথবা ভিন্ন কারও দ্বারা ভিন্ন কোথায়ও সৃষ্টি হওয়া ধর্মকে গ্রহণ করে। সকল ধর্মের উথান প্রক্রিয়ার দিকে দৃষ্টি দিলে প্রতিটি নূতন ধর্মের উথানের সঙ্গে সমাজে সঞ্চিত ও বিকাশমান প্রবল শক্তির জাগরণ বা উথানের চিহ্ন দেখতে পাওয়া যায় যা কোন ক্ষয়িষ্ণু সমাজের পক্ষে ঘটানো সম্ভব নয়। এই কারণে মিসর বা মেসোপটেমিয়া ধ্বংস হলেও তা নূতন কোন ধর্ম জন্ম দিতে পারে নি। ইহুদী ধর্ম মিসরীয় সভ্যতার মূল ধারা থেকে আসে নি। এমন কি গ্রীস বা রোমও কোন নূতন ধর্ম জন্ম দিতে পারে নি।

_________________________________________________________________________________
অহুর ময্দা।
_________________________________________________________________________________

পাতা: ২০৫


প্রাচীন সভ্যতাগুলিতে সাধারণভাবে ক্ষয়ের সময় অথবা পর সেগুলির প্রান্তদেশে আধুনিক কালের বৃহৎ ধর্মগুলিকে জন্ম নিতে দেখা গেছে। প্রান্তস্খ জায়গায় ক্ষয়িষ্ণু সভ্যতার নিয়ন্ত্রণ এবং সেই হেতু তার ক্ষয় এবং অবসাদ প্রবল হয় না বলে এটা সম্ভব হয়। এ যেন বস্তুগত সভ্যতার নিভন্ত আলোর ভাবজগতে জ্বলে ওঠা। সভ্যতার ক্রিয়া এবং প্রতিক্রিয়া উভয়কে ধারণ করেই। তবে প্রতিক্রিয়ার দিকটিই প্রধান হয় বলে আর একটি নূতন সভ্যতার পুনরাবৃত্তি ঘটাতে তা দিতে চায় না বা তাতে বাধা দেয়।
যাইহোক, এটি স্পষ্ট যে, নূতন ধর্মের উথান নূতন সামাজিক শক্তিসমূহের উথানের সঙ্গে জড়িত যা ক্ষয়প্রাপ্ত বা অনুর্বর সমাজজমিতে নয় বরং কিছু পরিমাণে হলেও উর্বর সমাজজমিতেই ঘটতে পারে। আপাত দৃষ্টিতে পুরাতন এলাকা থেকেও এটা ঘটতে পারে। যেমন আমরা প্রায় আধুনিক কালে এসে পাঞ্জাবে একটি নূতন ধর্ম হিসাবে শিখ ধর্মের উত্থান দেখি। কিন্তু এর জন্য প্রয়োজন ছিল পুরাতন ক্ষয়প্রাপ্ত ঐতিহ্য থেকে দীর্ঘ বিচ্ছেদ এবং বিকাশমুখী সামাজিক গতিশীলতা। এই বিকাশমুখী সামাজিক গতিশীলতা যেমন প্রতিটি ধর্মের উথান সম্ভব করেছে তেমন ইসলামেরও করেছে। আমরা ইসলামপূর্ব আরবেও দেখি যে, উপজাতীয় সমাজ ভেঙ্গে একটা নূতন সমাজ এবং বিশেষত রাষ্ট্রের অভ্যুদয়ের প্রায় সব শর্ত পূর্ণ হয়েছিল। সেই অবস্থায় ইসলামের আগমন নূতন সামাজিক ও রাষ্ট্রিক অভ্যুদয়কে একটা বিশেষ গতিপথ এবং অভিমুখ দেয়।
আমরা অনুমান করতে পারি যে, সিন্ধু সভ্যতার প্রান্তস্থ উর্বর সমাজজমি তথা বিকাশমান সামাজিক শক্তিগুলি বৈদিক পক্ষকে নূতন ধর্ম প্রতিষ্ঠার শক্তি যুগিয়েছিল বলে তার পক্ষে একটা নূতন ধর্ম প্রতিষ্ঠা সম্ভব হয়েছিল। কিন্তু এই সঙ্গে এই প্রশ্নও উদিত হয় যে, যদি সভ্যতার কেন্দ্র থেকে মূল বৈদিক নেতৃত্ব এসে থাকে তবে তার ভিতরে প্রান্তের বিকাশমান শক্তিকে ধারণ করার মত তেজ বা শক্তি না থাকলে তা কি করে একটা নূতন ধর্ম আন্দোলন এবং ধর্ম প্রতিষ্ঠা করেছে বা তাতে নেতৃত্ব দিয়েছে ? এবং এটা খুব বিস্ময়কর যে, আধুনিক যুগে বিদ্যমান প্রধান ধর্মগুলি যেখানে বৈরাগ্য অথবা পরলোকের ধ্যানকে সবচেয়ে গুরুত্ব দিয়েছে এবং পৃথিবীর চাকচিক্য এবং বস্তুগত উন্নয়নকে নাকচ অথবা একেবারে গৌণ করেছে সেখানে বৈদিক ধর্মে পার্থিব জীবনের সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য এবং ভোগ কামনা প্রবলভাবে প্রধান। এই ঘটনা কিন্তু মোটেই সভ্যতার শক্তির নি:শেষ হওয়া বা ফুরিয়ে যাওয়ার ইঙ্গিত দেয় না।
এ থেকে আমরা ধারণা করতে পারি যে, বৈদিক আন্দোলনের সময় সিন্ধু সভ্যতার সমস্ত শক্তি নি:শেষ হয় নি। তার বিকাশ সম্ভাবনা তখনও ছিল। কিন্তু প্রধানত সরস্বতী নদী-উপত্যকার মরুকরণ প্রক্রিয়ায় সেখানকার ক্ষুব্ধ জনগোষ্ঠী নদীনিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থাকে ধ্বংস করে সভ্যতাকে রক্ষা বা পুনর্নির্মাণ করতে চেয়েছিল। ফলে তার সকল কর্মকাণ্ডে বাঁধ বা নদীনিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা ধ্বংস খুব বেশী প্রাধান্য পেয়েছে। অথচ নদীনিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা ধ্বংস হলে এই সভ্যতার ভিত্তি টিকে না বলে বৈদিক আন্দোলনের ফলে এই ব্যবস্থার ধ্বংসের সঙ্গে সভ্যতাও ধ্বংস হয়েছে। একবারে না হলেও ক্রমশ। একবারে বা হঠাৎ করে সভ্যতার মৃত্যু হয় নি বলে আমরা পরিণত হরপ্পান পর্যায়ের পর বিদায়ী হরপ্পান পর্যায় নামে একটি দীর্ঘস্থায়ী পর্যায় পাই।

পাতা: ২০৬


এখন আমরা যদি আবেস্তার পুনর্বিচার করি তবে দেখতে পাব যে, আবেস্তায় শুধু জয়ের সুর নেই, শুধু দয়েবদের বিরুদ্ধে প্রচণ্ড ঘৃণা এবং বিদ্বেষের প্রকাশ নেই, শুধু আর্যদের জয়ের ঘোষণা এবং অনার্যদের ধ্বংস কামনার জোরালো উচ্চারণ নেই উপরন্তু আছে ইহলৌকিক জীবনের সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য এবং সাফল্যের জোরালো কামনা। এইখানে তা ঋগ্বেদের সমগোত্রীয়। বিশেষ করে কৃষি এবং পশুপালনকে আবেস্তায় অত্যন্ত উচ্চমূল্য দেওয়া হয়েছে যা উৎপাদনমূলক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে এই ধর্মের অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ সম্পর্ককে প্রকাশ করে। আমাদের মনে রাখতে হবে যে, মূল আবেস্তা নেই। কাল পরিক্রমায় আবেস্তানদের অনেক তিক্ততা, ব্যর্থতা ও আশাভঙ্গের স্মৃতি যে পরবর্তী কালে আবেস্তার বিভিন্ন পুনর্লিখিত এবং সংকলিত রচনায় ছাপ ফেলেছে তা সহজবোধ্য। সুতরাং বর্তমান আবেস্তায় যেটুকু তেজস্বী উদ্দীপনা এবং জীবনবাদ প্রতিফলিত তা থেকে আমরা মূল ধর্মসংস্কারকের শক্তি এবং জীবনবাদ যে আরও অনেক বেশী প্রবল ছিল সেটা অনুমান করতে পারি।
সুতরাং বিভিন্ন দিক বিচার করে আমরা এই অনুমানকে যুক্তি সঙ্গত মনে করি যে, আবেস্তার দয়েব-বিরোধী প্রতিরোধ সংগ্রাম এবং বিজয়ের সুর সিন্ধু উপত্যকার দক্ষিণাঞ্চলে একটি দীর্ঘস্থায়ী সফল প্রতিরোধ এবং সেই সঙ্গে একটি পাল্টা ধর্মসংস্কারের প্রকাশ। আমরা অনুমান করি দক্ষিণাঞ্চলে মহেঞ্জোদাড়োকে কেন্দ্র করে হরপ্পান রাষ্ট্র এবং সভ্যতা আরও কিছু কাল টিকে ছিল। সম্ভবত বৈদিক শক্তি সেখানে সামরিক বিজয় অর্জন করতে পারে নি। এই প্রসঙ্গে আমরা বৈদিক ঋষি বিশ্বামিত্রের একটি মন্ত্রের উদ্ধৃতি দিতে পারি যেখানে তিনি বলছেন : ‘হে কুশিকগণ ! তোমরা অশ্বের সমীপে যাও, অশ্বকে উত্তেজিত কর, ধনের জন্য সুদাসের অশ্বকে ছেড়ে দাও। রাজা ইন্দ্র বৃত্রকে পূর্ব, পশ্চিম ও উত্তর দেশে বধ করেছেন, অতএব সুদাস রাজা পৃথিবীর উত্তম স্থানে যজ্ঞ করুন’ (৩/৫৩/১১)। এর অর্থ হল ইন্দ্র দক্ষিণে বৃত্র বধ করেন নি। অর্থাৎ বৈদিক শক্তি দক্ষিণে বাঁধ ধ্বংস করে নি। অবশ্য উত্তরের বাঁধগুলি ধ্বংস হলে দক্ষিণেও বাঁধ টেকার কথা নয়। সুতরাং বৈদিক শক্তির মূল লক্ষ্য অর্জিত হয়েছিল। সেক্ষেত্রে তার সামরিক বিজয়ের উৎসাহও থাকার কথা নয়। অন্যদিকে সিন্ধু সভ্যতার শক্তিকে আমাদের খাটো করে দেখা ঠিক নয়। তার ভিতর থেকে বৈদিক সংস্কার আন্দোলনের উত্থান তার প্রমাণ। এখন আমরা আবেস্তান ধর্মের উত্থানও পাচ্ছি তার ভিতর থেকে।
সিন্ধু সভ্যতায় আবেস্তান ধর্মের উত্থান সম্ভাবনা বিচারের সময় সভ্যতার অভ্যন্তরীণ শক্তির গতিশীলতা এবং সজীবতা ছাড়াও চারপাশের বিশাল অঞ্চলব্যাপী তার উপনিবেশ এবং বাণিজ্য কেন্দ্রগুলিকে বিবেচনায় নেওয়া উচিত। প্রত্নতাত্ত্বিক আবিষ্কার থেকে আমরা জানি যে, সিন্ধু সভ্যতা শুধু কৃষি নির্ভর ছিল না। বরং তার বাণিজ্য ও শিল্প এতই বিকশিত ছিল যে অনেক পণ্ডিত এর ফলে তার কৃষির গুরুত্বকে অবহেলা করেন। নদীনিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থার সংকট এবং অভ্যন্তরীণ গোলযোগ এবং যুদ্ধের কারণে যদি উত্তর এবং

পাতা: ২০৭


পূর্ব দিকের স্থলপথ বিপজ্জনক কিংবা বন্ধ হয়েও থাকে তবু মহেঞ্জোদাড়োকে কেন্দ্র করে সিন্ধু উপত্যকার দক্ষিণাঞ্চলে অবস্থিত রাষ্ট্রের পক্ষে দক্ষিণের আরব সাগর দিয়ে প্রচুর সম্পদ এবং জনবল সংগ্রহ করে বৈদিক শক্তিকে যে বহুকাল প্রতিরোধ করা সম্ভব ছিল তা অনুমেয়। আমরা কিছু পূর্বে আবেস্তার একটি মন্ত্র উদ্ধৃত করেছি যেখানে ‘বিশ্বাসীদের ফ্রবাশিদের’ প্রশংসা করা হয়েছে এবং বলা হয়েছে : ‘এবং জলগণ বৌরু-কশ সাগর থেকে উপরে উঠে আসে, হে স্পিতম জরথুস্ত্র! ময্দার গৌরবের সাথে, তখন সামনে ভীতিজনক ফ্রবাশিরা আসে, বহু শত, বহু সহস্র, বহু অযুত।’    
জলগণ বৌরু-কশ সাগর থেকে উঠে আসাকে সাগর থেকে জাহাজে করে ফ্রবাশিদের উপকূলে উঠে আসার আলংকারিক বর্ণনা বোঝা যায়। সম্ভবত বৌরু-কশ সাগর আরব সাগরের নাম। আর ফ্রবাশি সংস্কৃত প্রবাসিন-এর সামান্য রূপান্তর হওয়া সম্ভব, যার বাংলা অর্থ হচ্ছে প্রবাসী অর্থাৎ বিদেশে অবস্থানকারী দেশের লোক। বস্তুত আবেস্তায় ফ্রবাশিদের সম্পর্কে বহুবার যেভাবে উচ্চ প্রশংসা এবং স্তুতি প্রকাশ করা হয়েছে তাতে এই সম্ভাবনা চিন্তায় আসে যে, বিশাল আরব সাগরের উপকূলে অবস্থিত দক্ষিণ আরবের উপকূল এলাকা, পারস্য উপসাগরীয় এলাকাসমূহ, দক্ষিণ ইরাক, দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব ইরান এবং গুজরাট, মহারাষ্ট্র ইত্যাদি বিশাল উপকূলীয় ভূভাগের উপনিবেশ এবং বাণিজ্য কেন্দ্রগুলি থেকে সিন্ধু সভ্যতার প্রবাসীরা রাষ্ট্রশক্তির আহ্বানে সাড়া দিয়ে বিদ্রোহী বৈদিক শক্তির বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে দক্ষিণ দিকে তার অগ্রাভিযান রোধ করেছিল। এ ক্ষেত্রে নিকটবর্তী পশ্চিমে ইরানের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা থাকতে পারে। পরবর্তী কালে আবেস্তান আর্যরা ইরানে বসতি স্থাপন করে। হতে পারে যে, শুধু নিকটবর্তী হওয়ায় নয় বরং সেখানে পূর্ব থেকে দৃঢ় অবস্থান থাকায় সিন্ধু সভ্যতার শাসক শ্রেণী পরবর্তী সময়ে ইরানে অভিগমন করে।
সিন্ধু উপত্যকাতেই পাল্টা একটি ধর্মসংস্কার এবং সফল প্রতিরোধের বিষয়টি বিবেচনার সময় জরথুস্ত্র-প্রবর্তিত অগ্নিতে আহুতি দানের রীতিও আমাদের কাছে খুব তাৎপর্যপূর্ণ মনে হয়। আমরা ইতিপূর্বে বলেছি যে, অগ্নিবেদির চিহ্ন সিন্ধু সভ্যতার মাত্র তিনটি শহরে এ পর্যন্ত পাওয়া গেছে, যেমন কালিবঙ্গান, লোথাল এবং বনওয়ালী। আমরা আরও বলেছি যে, বৈদিক শক্তি যুদ্ধ এবং ব্যারেজ ধ্বংসের প্রয়োজনে আগুনের উপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার আকাঙ্ক্ষা থেকে কতকগুলো স্থানে সীমাবদ্ধ অগ্নিপূজাকে সর্বজনীন রূপ দেয়।
অবশ্য অগ্নিপূজা বললে ভুল ধারণা হতে পারে। আগুন একটি দেবতা মাত্র। তবে তাতে অন্য দেবতাদের উদ্দেশ্যে হব্য আহুতি দেওয়া হত। এই জন্য অগ্নিকে দেবতাদের দূত কিংবা জিহ্বা বলা হয়েছে। অর্থাৎ অগ্নির মাধ্যমে দেবতাদের নিকট হব্য বা খাদ্য পৌঁছানো হত। আবার অগ্নি যেহেতু দেবতা সেহেতু তার উদ্দেশ্যে হব্য দিতে হলে সেটা ভিন্নভাবে মন্ত্রে বলতে হত। অর্থাৎ সেক্ষেত্রে শুধু তার উদ্দেশ্যেই আহুতি দেওয়া এবং স্তোত্র পাঠ করা হত। তখন সেই হব্য অগ্নি দেবতা গ্রহণ করেন নিজের জন্য এমনটা মনে করা হত।
আবেস্তান বা পার্সী ধর্মাবলম্বীদের ব্যাপারটাও ঠিক তাই। অথচ তাদের সম্পর্কে এই

পাতা: ২০৮


ভুল ধারণা প্রচারিত রয়েছে যে, তারা অগ্নি উপাসক। এটা তাদের একটা দিক মাত্র। তারা মূলত অহুর ময্দার উপাসক। অগ্নিতে আহুতি দেওয়া হয় অহুর ময্দা কিংবা অন্যান্য দেবতার উদ্দেশ্যে বৈদিক প্রথার মতই। আবার অগ্নির উদ্দেশ্যেও আহুতি দেওয়া যায়।
যাইহোক, এমনটা মনে হয় যে, যুদ্ধে বৈদিক প্রতিপক্ষের অগ্নিকাণ্ড দ্বারা বিশেষ করে নদীনিয়ন্ত্রণের স্থাপনাগুলিকে ধ্বংস করার ক্ষমতা বিনষ্ট করার জন্য এবং সেই সঙ্গে বৈদিক প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে ব্যবহারেরও প্রয়োজনে অবৈদিক শাসক পক্ষ পাল্টা একটি ধর্মসংস্কার দ্বারা অগ্নিপূজা এবং অহুর ময্দা সহ অন্যান্য দেবতার উদ্দেশ্যে অগ্নিতে আহুতি দান প্রবর্তন করে। সুতরাং এই বিচারেও আবেস্তান ধর্মের উৎস সিন্ধু নদী-উপত্যকার দক্ষিণাঞ্চল হয়।
এই প্রসঙ্গে এটিও গুরুত্বপূর্ণ যে, আমরা ঋগ্বেদের তিনটি সূক্তে জরুথ নামে এক দানব বা অপশক্তির উল্লেখ পাচ্ছি যাকে ইন্দ্র নয়, বরং অগ্নি বধ করেছেন বলা হচ্ছে অথবা অগ্নির নিকট তাকে বধের জন্য প্রার্থনা করা হচ্ছে। ৭/১/৭ ঋকে অগ্নি যে জরুথকে বধ করে থাকেন তা বলা হচ্ছে। ৭/৯/৬ ঋকে অগ্নির প্রতি জরুথকে বধ করার আহ্বান জানানো হচ্ছে। ১০/৮০/৩ ঋকে বলা হচ্ছে : ‘অগ্নিই জরুথ নামক শত্রুকে জলের মধ্য হতে নির্গত করে দগ্ধ করেছেন।’
১০ম মণ্ডলের সূক্তগুলি যে সাধারণভাবে ঋগ্বেদ রচনার শেষ পর্যায়ের এ বিষয়ে বেদপণ্ডিতগণ একমত। সুতরাং আমরা অনুমান করতে পারি যে, বৈদিক আন্দোলনের শেষ পর্যায়ে জরুথকে হত্যা করা হয়েছিল। তবে এই জরুথ মানুষ না হয়ে জলকপাটও হতে পারে। তার জলকপাট হবার সম্ভাবনা এই কারণে বেশী যে, অগ্নি তাকে ‘জলের মধ্য হতে নির্গত করে দগ্ধ করেছেন’ বলা হয়েছে।
অবশ্য ইতিপূর্বে আমরা এই সম্ভাবনার কথা বলেছিলাম যে, বৈদিক পক্ষ কোন একজন বিশিষ্ট শত্রুনেতার নামেও একটি বিশেষ ব্যারেজ বা জলকপাটের নামকরণ করে থাকতে পারে।
তবে জরথুস্ত্রের মৃত্যু সম্পর্কে আবেস্তানদের সূত্র থেকে এটুকু জানা যায় যে, তিনি শত্রুদের আক্রমণে অগ্নিবেদির নিকট কয়েকজন পুরোহিত সহ নিহত হন। যাইহোক, জরথুস্ত্র প্রসঙ্গে আমাদের আলোচনাকে সংক্ষিপ্ত করার প্রয়োজনে এখানে এইটুকু উল্লেখ করা যথেষ্ট হবে যে, জরুথ স্তোত্র অর্থাৎ জরুথের স্তোত্র থেকে পরবর্তী কালে আবেস্তান প্রফেটের জরথুস্ত্র নামকরণ হতে পারে। অনেক লেখক অবশ্য মনে করেন যে, জরথ উষ্ট্র থেকে জরথুস্ত্র হয়েছে।
আবেস্তান সংস্কার প্রসঙ্গে এখন আমরা একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নের উত্তর পেতে চেষ্টা করব। সেটা হচ্ছে বরুণ নামকে সম্পূর্ণরূপে উহ্য বা গোপন করে অথবা বাদ দিয়ে কেন শুধু অহুর ময্দা রাখা হল ? বৈদিক পক্ষ যেখানে তাকে গৌণ করলেও বর্জন করে নি সেখানে কেন বরুণকেন্দ্রিক ধর্মের মূল অনুসারীরা তার মূল নাম বাদ দিয়ে প্রায় বর্জনের অনুরূপ কাজ করেছে ? আমাদের ধারণা এই প্রশ্নের উত্তর লাভ একটি সভ্যতার গতিপ্রকৃতি বোঝায়ও গুরুত্বপূর্ণ সূত্র হতে পারে।

পাতা: ২০৯


এটা স্পষ্ট যে, বৈদিক পক্ষের একমাত্র বা খুব বেশী গুরুত্বপূর্ণ লক্ষ্যবস্তু ছিল নদীনিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থাকে ধ্বংস করা। সুতরাং তার জন্য তারা ইন্দ্র এবং অগ্নিকে প্রাধান্যে নিয়ে এসেছে। বরুণকে তারা আঘাত না করে পাশ কাটিয়ে তার ভিত্তিস্বরূপ নদীনিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থার সঙ্গে সরাসরি সম্পর্কিত দেবতাদেরকে আঘাত এবং বর্জন করেছে। সুতরাং বিশ্বরূপকে বধ বা বর্জন করা হয়েছে। ত্বষ্টাকে প্রায় গুরুত্বহীন করা হয়েছে।
কিন্তু বরুণকেন্দ্রিক সরকারী ধর্মের অনুসারীদের পক্ষে বরুণকে কেন্দ্র করে সংস্কার করা সম্ভব ছিল না শান্তিপূর্ণ, নম্র এবং গণতান্ত্রিক সভ্যতার প্রধান দেবতা বা ঈশ্বর হিসাবে তার অবস্থানের কারণে। নদীনিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থার পতন এবং সেই সঙ্গে প্রধানত অহিংস সভ্যতার পতনের ফলে সমাজে সহিংসতা এবং একনায়কী স্বৈরতন্ত্রের প্রাধান্যের অনুকূল যে পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছিল তাতে করে সেখানে বরুণকে কেন্দ্র করে ঐ পরিস্থিতির উপযোগী আমূল সংস্কার করা সম্ভব ছিল না বলে বরুণকে নীচে না নামিয়ে আবার তাকে স্পষ্টত নাকচও না করে ভিন্ন পদবী বা নামে তাকে রাখা হল। কিন্তু তা হলেও নাম পরিবর্তনের সঙ্গে তার অতীত ভূমিকাও পরিবর্তিত হল। এ যেন শান্তিপূর্ণভাবে উত্তরাধিকারীর হাতে ক্ষমতার হস্তান্তর।   
বস্তুত আবেস্তান সংস্কার সমাজ ও রাষ্ট্রের পুরাতন ক্ষমতা কাঠামোর পরিবর্তন সম্পর্কেও আমাদের নিশ্চিত করে। অর্থাৎ বৈদিক ও আবেস্তান উভয় সংস্কার থেকে এ বিষয় স্পষ্ট যে, সিন্ধু সভ্যতার ঐতিহ্যিক গণতান্ত্রিক ও অহিংস ধারারই শুধু অবসান হয় নি সেই সঙ্গে ঐ ধারার সঙ্গে সংযুক্ত মূল এবং ঐতিহ্যিক শাসকদেরও পতন ঘটেছিল।
বরুণ ছিলেন পুরাতন গণতান্ত্রিক, নম্র ও অহিংস রাষ্ট্রব্যবস্থার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ। কিন্তু অহুর ময্দা তুলনামূলকভাবে একটা একনায়কী স্বৈরতন্ত্র এবং সহিংস বা সামরিক রাষ্ট্রব্যবস্থার অনুকূল। পরবর্তী কালে আমরা ইরানে আবেস্তান ধর্মকে স্বৈরাচারী এবং সমরবাদী রাজতন্ত্রের সহযোগী হয়ে এই ভূমিকা পালন করতে দেখি। এইভাবে বরুণের নাম পরিবর্তন সমাজ ও সভ্যতার চরিত্র বা গতিপ্রকৃতি পরিবর্তনের সঙ্গে সম্পর্কিত। বাস্তবতার পরিবর্তনের সঙ্গে কিভাবে বরুণের প্রাধান্য ক্রমে একটি মাত্র দেবতার নিরংকুশ একনায়কতন্ত্রের দিকে অগ্রসর হয়েছে সেটা আমরা পরবর্তী কালের সেমিটিক ধর্মসংস্কারগুলিতে বিশেষত ইহুদী এবং ইসলাম ধর্মে দেখতে পাই। এ সম্পর্কে আমরা কিছু পরেই আলোচনা করব।
সমাজ বাস্তবতার উপরে দেবতাদের ভাগ্য কিভাবে নির্ভরশীল তার আরও প্রমাণ হচ্ছে ত্বষ্টা এবং বিশ্বরূপ। ঋগ্বেদ বিশ্বরূপকে বধ করেছে। আবেস্তাও তাকে বর্জন করেছে বলে মনে হয়। অন্তত আমরা তাকে চিহ্নিত করতে পারি নি। ত্বষ্টাকে ঋগ্বেদ গৌণ করে রেখেছে। আবেস্তাও তা করেছে। নদীনিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থার জন্য প্রয়োজনীয় উন্নত প্রযুক্তি ও প্রকৌশল বিদ্যার সঙ্গে সম্পর্কিত ত্বষ্টা আবেস্তায় ‘উজ্জ্বল এবং গৌরবময় নক্ষত্র’, ‘বৃষ্টির নক্ষত্র’ (তিস্ট্রিয় Tistrya)। আবেস্তান ও ঋগ্বেদ উভয়ের তুলনামূলক বিশ্লেষণ থেকে আমরা আর একটি বিষয় লক্ষ্য করি তা হল উভয় ধর্ম কিভাবে একই ধর্ম ও সংস্কৃতির বিভিন্ন পৌরাণিক উপাখ্যান বা

পাতা: ২১০


মিথগুলিকে নিজ নিজ প্রয়োজন ও স্বার্থ অনুযায়ী ব্যবহার এবং ব্যাখ্যা করেছে। এই কারণে আমরা উভয় ধর্মের উপাখ্যানে আরও বহু কিছুর মত অহি এবং বৃত্রঘ্নের উপস্থিতি পাই। আবেস্তায়ও অহি ঘৃণিত অপশক্তি। তাকে বলা হচ্ছে অযি। আর বৃত্র বধকারী হিসাবে ঋগ্বেদে যেখানে ইন্দ্রকে বলা হচ্ছে বৃত্রঘ্ন  সেখানে আবেস্তায় বেরেথ্রঘ্ন (Verethraghna) হচ্ছে অহুর ময্দা কর্তৃক সৃষ্ট। বেরেথ্রঘ্ন হচ্ছে বৃত্রঘ্ন-এর সামান্য বিকৃতি।
অন্যদিকে বৈদিক পক্ষ যে সিন্ধু উপত্যকার উত্তর দিক নিয়ন্ত্রণ করে সেখানে থেকে দক্ষিণ দিকে অভিযান চালিয়েছিল সেটা বোঝা যায় আবেস্তার এক বর্ণনা থেকে যেখানে বলা হচ্ছে : ‘১। উত্তরের অঞ্চল থেকে, উত্তরের অঞ্চল থেকে দয়েবদের দয়েব, মারাত্মক অঙ্গ্রা মইন্যু তীব্র গতিতে ছুটে এসেছিল।’ (ফার্গার্ড ১৯)
ইরান ও আবেস্তা বিষয়ক আলোচনা শেষ করার পূর্বে আর একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় উল্লেখ করা দরকার যে, ভারতবর্ষের পশ্চিমাংশ যা বর্তমানে প্রধানত পাকিস্তানভুক্ত অঞ্চল তা মৌর্য শাসনের পূর্ব পর্যন্ত দীর্ঘকাল ইরান বা পারস্যের সাম্রাজ্যভুক্ত ছিল। এই কারণে ইরান-গ্রীসের মধ্যে দীর্ঘস্থায়ী যুদ্ধ ও দ্বন্দ্ব চূড়ান্তভাবে নিষ্পত্তি করার জন্য গ্রীক রাজা আলেকজান্ডার যখন ইরানের বিরুদ্ধে যুদ্ধাভিযান করেন তখন তিনি ইরান সাম্রাজ্যভুক্ত সকল অঞ্চল আক্রমণ ও অধিকার করার পর ৩২৬ খ্রীষ্টপূর্বাব্দে হিন্দুকুশ পর্বত পার হয়ে পাঞ্জাব ও সিন্ধু অঞ্চলে অভিযান করেন। সেখানকার অম্ভী, পুরু এঁরা কেউ স্বাধীন রাজা ছিলেন না। তাঁরা ছিলেন পারসিক সম্রাটের করদ বা অধীনস্থ রাজা। সিন্ধু উপত্যকার পর উত্তর এবং পূর্ব ভারতে পারস্য সাম্রাজ্যের অধিকার ছিল না বলে পারস্য সাম্রাজ্যের সবটা জয়ের পর আলেকজান্ডার তাঁর সেনাবাহিনীকে পূর্ব ভারতের দিকে আক্রমণ অভিযানে রাজী করাতে ব্যর্থ হয়ে ৩২৫ খ্রীষ্টপূর্বাব্দে সেখান থেকে পারস্যে ফিরে যেতে বাধ্য হন।
অর্থাৎ আলেকজান্ডারের আক্রমণ তথা সোয়া তিনশত খ্রীষ্টপূর্বাব্দ কাল পর্যন্ত এক অজ্ঞাত কাল সিন্ধু উপত্যকা ছিল ইরান সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত। সরস্বতী উপত্যকার অধিকাংশ তখন মরুভূমিতে পরিণত যা আজ অবধি বিদ্যমান। এটাও লক্ষণীয় যে, বৈদিক এবং হিন্দু ধর্ম সিন্ধু উপত্যকায় জনপ্রিয় ছিল না। বৌদ্ধ ধর্মের উথানের পর ঐ অঞ্চলে তা ব্যাপক বিস্তৃত হয়। অবশ্য পরবর্তী ঐতিহাসিক কালে হিন্দু ধর্মকে ঐ অঞ্চলে বিস্তৃত হতে দেখা যায়। মধ্যযুগে মুসলিম আক্রমণ শুরু হলে ঐ অঞ্চলে রাজা দাহির সহ হিন্দু রাজাদের সঙ্গে আমরা যুদ্ধগুলো হতে দেখি। মুসলিম বিজয়ের পর আমরা ঐ অঞ্চলের দ্রুত ইসলামীকরণ দেখি।
ঐতিহাসিক গতিধারার এই সাধারণ প্রবণতা থেকে মনে হয় বৈদিক আন্দোলনের সভ্যতাধ্বংসী ফলাফলের কারণে ঐ অঞ্চলের অধিবাসীদের মধ্যে যে মোহভঙ্গ অথবা বিরূপ প্রতিক্রিয়া হয়েছিল তার ফলে বৈদিক এবং তার উত্তরাধিকারী হিন্দু ধর্ম আর কখনও ঐ অঞ্চলে তেমন একটা জনপ্রিয় হয় নি বলে ঐ অঞ্চলের জনগণের মধ্যে বৈদিক এবং হিন্দু ধর্ম বিরোধী ধর্ম গ্রহণের প্রবণতা প্রবল হয়েছে। বিশেষ করে মৌর্য বিজয়ের পূর্ব পর্যন্ত ঐ অঞ্চলের উপর উত্তর ভারতের তুলনায় ইরান বা পারস্যের রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক প্রভাব অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। এই ঘটনা সিন্ধু সভ্যতার শাসক শ্রেণীর অন্তত প্রধান অংশের ইরানে অভিগমনের ইঙ্গিত দেয়।

পাতা: ২১১


এখানে একটা প্রশ্ন উঠতে পারে যে, সিন্ধু সভ্যতার মূল বা প্রধান শাসকরা যদি ইরানে অভিগমন ও অভিবাসন করে থাকে তবে সেখানে তারা নূতন করে আর একটি নদীনিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা গড়ে তুলল না কেন ? এর সহজ উত্তর হচ্ছে এই ব্যবস্থার নিদারুণ সমস্যা এবং শেষ পর্যন্ত পতন বা চরম ব্যর্থতা দেখা হয়েছে। যা তার ভূমিকা শেষ করে ব্যর্থ অথবা ধ্বংস হয় তথা মৃত্যুবরণ করে মানুষ আর সেখানে ফিরে যায় না। এই কারণে একটা সভ্যতা একবার ধ্বংস হলে তার কিছু মূল বৈশিষ্ট্য আর কখনই ফিরে আসে না। তাই মিসরে দ্বিতীয়বার আর কোন পিরামিড ভিত্তিক সভ্যতা গড়ে ওঠে না যেমন মেসোপটেমিয়ায়ও দ্বিতীয় কোন জিগ্গুরাট নির্মিত হয় না। এই কারণে সপ্তসিন্ধু ধর্মেরও অনেক কিছু আবেস্তায় নেই। যেমন নদীনিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থার সঙ্গে সরাসরি সম্পর্কিত দেবতাদের অস্তিত্ব হয় নেই অথবা ক্ষীণ হয়েছে।
আমরা পূর্বে বলেছি যে, ঋগ্বেদে আঞ্চলিকতার সুর স্পষ্ট নয় অথবা নেই। আবেস্তাতেও প্রায় এক অবস্থা। কিন্তু এখন আমরা অনুমান করতে পারি যে, বাস্তবে সংগ্রামটা মূলত দুইটি ভিন্ন নদীকেন্দ্রিক দুই অঞ্চলেরও সংগ্রামে পরিণত হয়েছিল। মূলত নদীনিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থার কারণে হোক আর এই ব্যবস্থা-নিরপেক্ষ ভূতাত্ত্বিক কারণে হোক সরস্বতী নদীখাতপরিবর্তন যখন সরস্বতী উপত্যকায় বিপর্যয় সৃষ্টি করে তখন সেখানকার অধিবাসীদের বৃহত্তর অংশ যে পূর্ব দিকের নিকটবর্তী গাঙ্গেয় উপত্যকার দিকে ক্রমবর্ধমান হারে অভিগমন করতে বাধ্য হয় এবং তাদের এক ক্ষুব্ধ অংশ যে নদীনিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা ধ্বংস করে নদীর পূর্বাবস্থা ফিরিয়ে আনতে সচেষ্ট হয় সেই বিষয়ে আমরা পূর্বে আলোচনা করেছি।
কিন্তু আমরা আরও অনুমান করি যে, শুধু সরস্বতী উপত্যকা নয় উপরন্তু তার সন্নিহিত বিস্তীর্ণ অঞ্চলের অধিবাসীরা যারা সরস্বতী উপত্যকায় গড়ে ওঠা সিন্ধু সভ্যতার উপর বাণিজ্য সহ বিভিন্ন কারণে নির্ভরশীল ছিল তারাও ঐ অঞ্চল থেকে আগত জনসংখ্যার ক্রমবর্ধমান চাপ এবং শিল্পবাণিজ্যের অবনতির কারণে নদীনিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থার প্রতি ক্ষুব্ধ ছিল। আমরা অনুমান করি গুজরাটের বাণিজ্য কেন্দ্র এবং বন্দরগুলি, যেমন লোথাল, সরস্বতী উপত্যকার মরুকরণে দারুণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল তাদের মূল পশ্চাৎভূমি হারাবার ফলে। ফলে সরস্বতীর পূর্ব এবং দক্ষিণ-পূর্ব দিকের এলাকাগুলি মূলত বৈদিক আন্দোলনের সঙ্গে সংযুক্ত হয়ে থাকতে পারে। তবে এ ক্ষেত্রে সিন্ধু-সরস্বতী উপত্যকার উত্তরাংশে তাদের প্রতি সমর্থন বিভক্ত ছিল বলে আমরা অনুমান করতে পারি। কারণ, বিশেষ করে উত্তরে সিন্ধু এবং তার উপনদীগুলিতে বাঁধ দেবার ফলে অন্যান্য সমস্যা হলেও অন্তত জলহীনতার সমস্যা অতটা প্রকট হবার কথা নয়। অথচ এই অঞ্চলে বাঁধগুলি ধ্বংস না করলে সামরিক বিজয় ছাড়া দক্ষিণের নদীনিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা ধ্বংস করা সম্ভব নয়। তাছাড়া সরস্বতী নদীকে পুনরুজ্জীবিত করার জন্য উত্তরের সমস্ত বাঁধ বা ব্যারেজ ধ্বংসের প্রয়োজনবোধ কাজ করতে পারে। সেই হেতু সিন্ধু-সরস্বতী নদী উপত্যকার উত্তরাংশে আমরা বৈদিক আন্দোলনের

পাতা: ২১২


একটা কেন্দ্রীভবন দেখতে পাই ঋগ্বেদের বিবরণগুলি থেকে। অর্থাৎ যুদ্ধ এবং বাঁধ ধ্বংস প্রধানত উত্তরাঞ্চলে সীমাবদ্ধ ছিল বলে অনুমেয়। আর যে কথা ইতিপূর্বে বলেছি উত্তরে নদীরোধক বাঁধ বা ব্যারেজগুলি ধ্বংস হলে দক্ষিণে এমনিতেও ব্যারেজ রক্ষা করা সম্ভব ছিল না বিপুল জলস্রোতের প্রচণ্ড চাপের কারণে। অন্যদিকে এতে সিন্ধু নদীর জলপ্রবাহে ভাটা পড়ে নি। ফলে নদীনিয়ন্ত্রণের উপর নির্ভরশীল সভ্যতা দ্রুত ধ্বংস বা অবসানের দিকে এগিয়ে গেলেও সিন্ধু তীরবর্তী সভ্যতা আরও কিছু কাল টিকে ছিল বলে অনুমান করা চলে এবং বিশেষ করে দক্ষিণাঞ্চলে আমরা তার সপক্ষে কিছু প্রত্নতাত্ত্বিক সাক্ষ্যও পাই। কিন্তু সরস্বতীর জন্য শেষ বিচারে কোন লাভ হয় নি। কারণ উত্তরে সরস্বতীর মূল উপনদীগুলির খাত পরিবর্তনের ফলে নদীনিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা ধ্বংস দ্বারা সিন্ধু উপত্যকারও ক্ষয়িষ্ণু সভ্যতার ধ্বংসকে ত্বরান্বিতই করা হল মাত্র, কিন্তু সরস্বতী উপত্যকার সভ্যতা দূরে থাক জনজীবনকেও রক্ষা করা গেল না।
এই রকম পরিস্থিতিতে আমরা দেখি নদীনিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থার পক্ষে বিপক্ষে দুই নদীকে ঘিরে দুই বৃহৎ বিভাজন। পূর্ব দিকের সরস্বতী নদীতীরের লোকজনের প্রায় সকলে অথবা অধিকাংশ গাঙ্গেয় উপত্যকাসহ ভারতবর্ষের ভিতরের দিকে সরে এসেছে, অন্যদিকে সিন্ধু উপত্যকা অঞ্চলের লোকজন বেশীর ভাগ পশ্চিমে উপমহাদেশের বাইরে বিভিন্ন দিকে চলে গেছে। আমরা অনুমান করি তারা প্রায় সকলে ছিল বৈদিক শক্তি-বিরোধী। এবং পূর্ব দিকে যারা এসেছিল তাদেরও অনেকে তা-ই ছিল। বুদ্ধের সময় উত্তর ভারতে বিভিন্ন অবৈদিক উপজাতি বা গোত্রের গণরাজ্য বা প্রজাতন্ত্রগুলির অস্তিত্ব থেকে আমরা এ বিষয়ে নিশ্চিত হতে পারি।
যাইহোক, আমাদের আলোচনায় আমরা আবেস্তান ধর্মের সঙ্গে বৈদিক ধর্মের দ্বন্দ্বের যোগসূত্র এবং উৎস সম্পর্কে একটা ধারণা দাঁড় করাতে চেষ্টা করেছি। এবং এই উভয় ধর্মের বহু ভিন্নতা ও অভিন্নতার মধ্যে একটি বিশিষ্ট অভিন্ন লক্ষণ অগ্নিপূজার তাৎপর্য সম্পর্কেও আমরা কিছু আলোচনা করেছি। বিশেষত পণ্ডিতগণ সাধারণভাবে অগ্নিতে আহুতিদান বা অগ্নিপূজাকে আর্য তথা ইন্দো-ইউরোপীয় ধর্মাচারের একটি মূল বৈশিষ্ট্য হিসাবে গণ্য করেন। সুতরাং আমরা সেই সূত্র ধরে প্রাচীন আর একটি ধর্মের দিকে দৃষ্টি দিতে পারি। সেটি হল ইহুদী ধর্ম।
ইহুদী ধর্মেও আমরা দেখতে পাই যে, সদাপ্রভু ঈশ্বরের উদ্দেশ্যে আহুতি দিতে হয় বেদির অগ্নিতে। অন্তত এক কালে এটা ছিল এই ধর্মের প্রথা। বাইবেল (পুরাতন নিয়ম)-এর ‘হোমবলির নিয়ম’ থেকে কিছুটা উদ্ধৃতি দিলে বিষয়টি স্পষ্ট হবে :
‘পরে সদাপ্রভু মোশিকে ডাকিয়া সমাগম-তাম্বু হইতে এই কথা কহিলেন, তুমি

_________________________________________________________________________________
এদেরকে ক্ষত্রিয় বলা হলেও এরা ছিল প্রকৃতপক্ষে অব্রাহ্মণ্যবাদী। এটা তাদের অবৈদিক ধর্মীয় ঐতিহ্যকে নিশ্চিত করে।
_________________________________________________________________________________

পাতা: ২১৩


ইস্রায়েল-সন্তানগণকে কহ, তাহাদিগকে বল, তোমাদের কেহ যদি সদাপ্রভুর উদ্দেশ্যে উপহার উৎসর্গ করে, তবে সে পশুপাল হইতে অর্থাৎ গরু কিংবা মেষপাল হইতে আপন উপহার লইয়া উৎসর্গ করুক।
‘সে যদি গোপাল হইতে হোমবলির উপহার দেয়, তবে নির্দোষ এক পুংপশু আনিবে; সদাপ্রভুর সম্মুখে গ্রাহ্য হইবার জন্য সমাগম-তাম্বুর দ্বারসমীপে আনয়ন করিবে। পরে হোমবলির মস্তকে হস্তার্পণ করিবে; আর তাহা তাহার প্রায়শ্চিত্যরূপে তাহার পক্ষে গ্রাহ্য হইবে। পরে সে সদাপ্রভুর সম্মুখে সেই গোবৎস হনন করিবে, ও হারোণের পুত্র যাজকগণ তাহার রক্ত নিকটে আনিবে, এবং সমাগম-তাম্বুর দ্বারসমীপে স্থিত বেদির উপরে সেই রক্ত চারিদিকে প্রক্ষেপ করিবে। আর সে ঐ হোমবলির চর্ম খুলিয়া তাহাকে খণ্ড খণ্ড করিবে। পরে হারোণ যাজকের পুত্রগণ বেদির উপরে অগ্নি রাখিবে, ও অগ্নির উপরে কাষ্ঠ সাজাইবে। আর হারোণের পুত্র যাজকেরা সেই বেদির উপরিস্থ অগ্নির ও কাষ্ঠের উপরে তাহার খণ্ড সকল এবং মস্তক ও মেদ রাখিবে। কিন্তু তাহার অন্ত্র ও পদ জলে ধৌত করিবে ; পরে যাজক বেদির উপরে সে সমস্ত দগ্ধ করিবে; ইহা হোমবলি, সদাপ্রভুর উদ্দেশ্যে সৌরভার্থক অগ্নিকৃত উপহার।’ (বাইবেল। পুরাতন নিয়ম। লেবীয় পুস্তক। হোমবলির নিয়ম। ১;১-৯)
আরও কিছু উদ্ধৃতি দেওয়া যায় :
‘আর কেহ যখন সদাপ্রভুর উদ্দেশ্যে ভক্ষ্য-নৈবেদ্য উপহার দেয়, তখন সূক্ষ্ম সূজি তাহার উপহার হইবে, এবং সে তাহার উপরে তৈল ঢালিবে ও কুন্দুরু দিবে ; আর হারোণের পুত্র যাজকদের নিকটে সে তাহা আনিবে, এবং সে তাহা হইতে এক মুষ্টি সূক্ষ্ম সূজি ও তৈল এবং সমস্ত কুন্দুরু লইবে; পরে যাজক সেই নৈবেদ্যের স্মরণার্থক অংশ বলিয়া তাহা বেদির উপরে দগ্ধ করিবে ; তাহা সদাপ্রভুর উদ্দেশ্যে সৌরভার্থক অগ্নিকৃত উপহার। এই ভক্ষ্য-নৈবেদ্যের অবশিষ্ট অংশ হারোণের ও তাহার পুত্রগণের হইবে; সদাপ্রভুর অগ্নিকৃত উপহার বলিয়া ইহা অতি পবিত্র।’ (বাইবেল। পুরাতন নিয়ম। লেবীয় পুস্তক। ভক্ষ্য-নৈবেদ্যের নিয়ম। ২;১-৩)
সুতরাং পূজা পদ্ধতির ক্ষেত্রে সিন্ধু-ধর্মের সঙ্গে ইহুদী ধর্মের এই মিল তাৎপর্যপূর্ণ। অন্যদিকে ইহুদী ধর্মও নিরাকার ঈশ্বরের পূজারী। এইখানেও তার মিল সিন্ধু-ধর্মের সঙ্গে। তবে সিন্ধু-হরপ্পান ধর্মে একেশ্বরবাদী বৈশিষ্ট্য প্রবল হলেও তা নিরংকুশ একেশ্বরবাদী নয়। কিন্তু ইহুদী ধর্ম নিরংকুশ একেশ্বরবাদী। সেখানে দ্বিতীয় কোন দেবতা নেই।
ইহুদী বা হিব্রু ধর্মের সময় সিন্ধু সভ্যতা ধ্বংসের অনেক পর। মোশি আনুমানিক খ্রীষ্টপূর্ব ১২ শতকের কোন সময়ের মানুষ। মিসরে ইসরাইলীয়দের আগমনের বিষয়টা রহস্যাবৃত হয়ে আছে। তবে অনুমান করা হয় মিসরে বহিরাগত হিক্সসদের সঙ্গে ইসরাইলীয়দের প্রবেশের সম্পর্ক থাকতে পারে।
হিক্সস্ নামে এক যাযাবর জাতি আনুমানিক ১৬৭০ খ্রীষ্টপূর্বাব্দে মিসর দেশ জয় করে এবং একশত বৎসরের কাছাকাছি সময় মিসর শাসন করে। মিসরে যাদেরকে হিক্সস্ বলা হয়েছে তারা কারা এবং কোথা থেকে এসেছে এই সমস্ত বিষয় অজ্ঞাত রয়েছে। তবে মিসরে তারাই প্রথম ঘোড়ার ব্যবহার প্রচলন করে।

পাতা: ২১৪


অশ্বারোহী হিক্সসদেরকে আর্য কিংবা আর্য অভিগামীদের সঙ্গে সম্পর্কিত জনগোষ্ঠী ধারণা করার কারণ আছে। হিক্সসদের পর ২২ এবং ২৩তম রাজবংশের ফারাওদের মধ্যে (খ্রী:পূর্ব ৯৪৫-এর পর থেকে) শশঙ্ক নাম খুব বেশী দেখা যেত। শশঙ্ক স্পষ্টতই আর্য বা সংস্কৃত শশাঙ্ক শব্দের প্রকারভেদ।
এটা লক্ষণীয় যে, হিক্সসদের শাসন অবসানের পরবর্তী কালে ইখ্নাটন নামে একজন মিসরীয় ফারাও যিনি আনুমানিক ১৩৮০ থেকে ১৩৬২ খ্রীষ্টপূর্বাব্দ কাল পর্যন্ত শাসন করেছিলেন তিনি মিসরে প্রথম একেশ্বরবাদী ধর্ম প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করেন। অনুমান করা যায় যে, এর পিছনে ছিল বরুণকেন্দ্রিক ধর্মের অনুসারী হরপ্পান বা আর্যদের মধ্যকার মূলত একেশ্বরবাদী চেতনার প্রভাব। তাঁর সময়ের প্রায় শতাব্দী কাল পর মোশির আবির্ভাব ঘটে আনুমানিক খ্রী: পূ: ১২ শতকে।  
মোশি মিসরে দাসত্বে আবদ্ধ ইসরাইলীদেরকে তাঁর নেতৃত্বে সংগঠিত করেন এবং তাদেরকে সেখান থেকে মুক্ত করে প্যালেস্টাইনে নিয়ে আসেন। বাইবেলে বলা হয়েছে তারা সেখানে চারশত ত্রিশ বৎসর বাস করেছিল। সেই হিসাবে তারা হিক্সসদের সঙ্গে মিসরে প্রবেশ করেছিল কিংবা তারাই হিক্সস বা হিক্সসদের বংশধর। অবশ্য একইভাবে হিক্সসদের অল্প পরে অভিগামী আর্যদের অপর একটি শাখা হিসাবে তাদের মিসরে প্রবেশের সম্ভাবনাকে অস্বীকার করা যায় না। হিক্সস শাসন পতনের পর এইসব বহিরাগত উপজাতি দাসে পরিণত হয়।
বাইবেলের আদিপর্বের পূজা পদ্ধতি, বিভিন্ন কাহিনী এবং নাম থেকে আমরা ইসরাইলীয়দেরকে সিন্ধু সভ্যতা থেকে অভিগামী জনগোষ্ঠীর বংশধর হিসাবে চিনতে পারি।
আমরা শুধু ইহুদী একেশ্বরবাদের উৎস হরপ্পান ধর্মে দেখি না উপরন্তু কতকগুলি গুরুত্বপূর্ণ কাহিনীও সেখান থেকে আগত বলে মনে করি। যেমন বাইবেলে আদম ও ঈভ বা হাওয়া অর্থাৎ আদি মানব-মানবীর এদন থেকে পতনের জন্য সর্প বা অহিকে দায়ী করা হয়েছে। এটা বোঝা যায় অহি সম্পর্কে যে প্রাচীন উপাখ্যান সপ্তসিন্ধুতে জনপ্রিয় ছিল তার ছায়া পরবর্তী বিভিন্ন ধর্মে বিভিন্নভাবে পড়েছে। বৈদিক ঋষিরা এটাকে ব্যবহার করেছেন তাঁদের নদীনিয়ন্ত্রণ-বিরোধী আন্দোলনকে যৌক্তিকতা, উদ্দীপনা ও জনগ্রাহ্যতা দিতে। আবেস্তায়ও আমরা অহি উপাখ্যান ভিন্নভাবে পাই। পুরাতন নিয়ম বাইবেলে আদি মানবীকে ঈশ্বর সদাপ্রভুর নির্দেশ অমান্য করে নিষিদ্ধ বৃক্ষের ফল খাওয়ার প্ররোচনা দিয়ে আদি মানব-মানবী উভয়ের এদন থেকে বহিষ্কারের জন্য অহি বা সর্পকে দায়ী করা হয়েছে। এটাও সম্ভব যে, বাঁধধ্বংসের পরবর্তী কালে উভয় পক্ষই বাঁধের ব্যর্থতা এবং তজ্জনিত সংকট-কষ্ট এবং সর্বোপরি তার জন্য সৃষ্ট সমস্যার কারণে সংঘটিত গৃহযুদ্ধ ও সভ্যতা ধ্বংসের জন্য বাঁধের উপরেও ক্ষুব্ধ হয়েছিল। ফলে পুরাতন অহি মিথ বা উপাখ্যান নূতন তাৎপর্য ও আবেদন নিয়ে সব পক্ষেরই পৌরাণিক সাহিত্যের অন্তর্ভুক্ত হয়েছে।
বাইবেলের কিছু নামও সংস্কৃত নাম বা শব্দের কাছাকাছি।

পাতা: ২১৫


যেমন বাইবেলের এদন (Eden < Edn) সংস্কৃত উদ্যানের রূপান্তর হওয়া সম্ভব। সংস্কৃত উদ্যান শুধু বাগিচা নয়। রাজকীয় বাগিচাকেও উদ্যান বলা হয় অর্থাৎ রাজ-বাগিচা। বাইবেল অনুসারে আদম-হাওয়া সৃষ্টির পর ঈশ্বর প্রথমে তাঁদেরকে এদনে স্থান দিয়েছিলেন। সংস্কৃত মৎস্য শব্দের সঙ্গে মোশি নামের সম্পর্ক থাকতে পারে। মোশির ভাই এবং তাঁর অধীনে প্রধান যাজক হারোণ নামকে বরুণ-এর রূপান্তর হিসাবে অনুমান করা যায়। বাইবেলে আব্রাহাম (আরবী ইব্রাহিম)-এর পূর্ব নাম অব্রাম বলা হয়েছে। এটা সংস্কৃত অপরাম থেকে হওয়া সম্ভব। সংস্কৃত অপ মানে জল। এই অপ থেকে আবার ফার্সী শব্দ আব্- এর উৎপত্তি। আব্ অর্থ জল। আদমও প্রথম মানুষকে বোঝাতে আদি মনু থেকে আসতে পারে। ভারতবর্ষের পুরাণ কথায় মনু বিশিষ্ট স্থান অধিকার করে আছেন। মহাপ্লাবনের সময় মনু তাঁর নৌকায় রক্ষা লাভ করেছিলেন। আমরা অনুমান করি এই মনু উপাখ্যান থেকে বাইবেলের নোয়া উপাখ্যানের উৎপত্তি। সম্ভবত মনুর নৌ হিব্রু উপাখ্যানে নোহ-তে (নোয়া) পরিণত হয়েছে।
যাইহোক, এই বিষয় সহজবোধ্য যে, নিরাকার দেবতা এবং ঈশ্বর ধারণা কোন পশ্চাৎপদ এবং যাযাবর উপজাতির পক্ষে সৃষ্টি করা সম্ভব না। আমরা ইতিপূর্বে বৃহত্তর সিন্ধু-সরস্বতী উপত্যকায় নিরাকার দেবতার ধারণার বিকাশ প্রক্রিয়া সম্পর্কে আলোচনা করতে গিয়ে দেখেছি কোন পরিস্থিতিতে কিভাবে এই ধারণা জন্ম নিয়েছিল। বস্তুত এটা একটা সভ্যতার বিশেষ পরিস্থিতিতে বিশেষ ধারায় উদ্ভব ও বিকাশের ফল মাত্র। ফলে এটা অন্য সমাজ তার প্রয়োজন হলে গ্রহণ করতে পারে, কিন্তু এর সৃষ্টি আর কারও পক্ষে করা সম্ভব ছিল না এর জন্য প্রয়োজনীয় মূর্ত পরিস্থিতি না থাকায়। ফলে মানব সমাজের আর কোনখানে যেখানে সিন্ধু সভ্যতার কোন না কোন ধরনের যোগসূত্র এবং গভীর প্রভাব ছিল না এমন কোন প্রাচীন সমাজে নিরাকারের উপাসনা জন্ম নিতে পারে নি।  
বস্তুত এই বিষয় আমাদের কাছে স্পষ্ট যে, পরবর্তী কালে উদ্ভূত বা বিকশিত সকল নিরাকার এবং একেশ্বরবাদী ধর্মের প্রত্যক্ষ অথবা পরোক্ষ উৎস সপ্তসিন্ধু তথা সিন্ধু সভ্যতা। অনেকে এখান থেকে সশরীরে এই ধারণার মূল কাঠামো নিয়ে বাইরে গেছে। আবার কেউ কেউ এই ধারণা দেখে তাকে সুবিধাজনক মনে করে অথবা বাধ্য হয়ে গ্রহণ করেছে।
এই সঙ্গে এই বিষয়ও বোঝা দরকার যে, সামাজিক ভিত্তি না থাকলে কোন একজন ব্যক্তি চাইলেও একেশ্বরবাদ কিংবা নিরাকার দেবতার ধারণা প্রবর্তন করতে পারে না। সামাজিক ভিত্তি না থাকায় মিসরের ফারাও ইখ্নাটন সূর্য বা আটন দেবকে একমাত্র উপাস্য হিসাবে প্রবর্তন করে তাঁর নূতন ধর্মমত প্রচার করলেও তিনি সেটা তাঁর প্রজাদেরকে গ্রহণ করাতে পারেন নি। অবশেষে ব্যর্থতা নিয়ে তিনি মৃত্যু বরণ করেন।
সুতরাং আমরা ধারণা করতে পারি যে, মোশি যে ইসরাইলীয়দের মধ্যে তাঁর নিরংকুশ এবং নিরাকার একেশ্বরবাদী ধর্ম প্রবর্তন করেন তাদের মধ্যে এই ধর্মের উপাদান পূর্ব থেকেই ভালভাবে বিদ্যমান ছিল। তবে পূর্বে এক প্রধান দেবতার অধীনে আরও দেবতা ছিল যেমন ছিল বরুণের অধীনে আরও অনেক দেবতা। সেটা বর্জন করে একমাত্র দেবতাকে উপাস্য করা হল। এটা অনুমানযোগ্য যে, ইসরাইলীয়দের প্রধান দেবতাকেই একমাত্র উপাস্য করা হয়।

পাতা: ২১৬


এই প্রসঙ্গে আমরা ইহুদী ধর্মে ঈশ্বরের হিব্রু নাম ইয়াহ্ ওয়েহ্-এর উৎপত্তি সম্পর্কে কিছু আলোচনা করতে পারি। এ নিয়ে প্রচুর জল্পনা-কল্পনা এবং আলোচনা আছে। প্যালেস্টাইন অঞ্চল বা আশপাশের কোন উপজাতির দেবতা থেকে তার উৎপত্তি এমন অনুমানও কোন কোন লেখক করেন। তবে আমরা এই নামকে সরাসরি সপ্তসিন্ধুর প্রধান দেবতা বা ঈশ্বর বরুণের সঙ্গে সম্পর্কিত বলে অনুমান করি। সম্ভবত আবেস্তান ‘অহুর ময্দা’র মত এটি বরুণের প্রতি শ্রদ্ধাসূচক একটি শব্দের রূপান্তর। এবং সম্ভবত শব্দটি হচ্ছে আর্য। সংস্কৃত কিংবা বৈদিক ভাষায় আর্য শব্দের উচ্চারণ বাংলা আর্য নয়, বরং তা হবে  ‘আরিয়’ যাকে ইংরাজীতে Arya লেখা হয়। সম্ভবত আরিয় ভেঙ্গে ইয়াহ্ ওয়েহ্ শব্দের উৎপত্তি।
আর্য শব্দ শ্রেষ্ঠ বা প্রভু অর্থেও ব্যবহৃত হয়। ঋগ্বেদে দেবতাদেরকেও আর্য বলা হয়েছে। বিশেষ করে তাদের শ্রেষ্ঠত্ব বোঝাবার জন্য এই শব্দের ব্যবহার। যেমন ঋগ্বেদে মিত্র ও বরুণ সম্পর্কে বলা হয়েছে : ‘ তাঁরা দেবগণের মধ্যে অসুর। তাঁরা আর্য ......’
(৭/৬৫/২)। কিংবা বলা হচ্ছে : ‘ আর্য ইন্দ্র যাঁকে ইচ্ছা করেন, তাঁর নিকট গাভী প্রেরণ করেন’ (১/৩৩/৩)। অথবা ‘বিভ্বা, ঋভুক্ষ ও বাজ ও ইন্দ্র আর্য হয়ে মথন দ্বারা শত্রুবল বিকৃত করেন’ (৭/৪৮/৩)। আমরা এই অনুমান করি পশ্চিমে অভিগামী কোন কোন জনগোষ্ঠী তাদের প্রধান দেবতা হিসাবে বরুণকে আর্য নামে অভিহিত করত। যাইহোক, ইহুদী একেশ্বরবাদ প্রতিষ্ঠা প্রসঙ্গে বলতে হয় যে, মোশির সংস্কার দ্বারা প্রাচীনতর ধর্মের নমনীয়তা দূর করে নিরংকুশ, কঠোর ও আক্রমণাত্মক একেশ্বরবাদ প্রতিষ্ঠার পিছনে বিশেষ সামাজিক অভিজ্ঞতা এবং প্রেক্ষিত কাজ করেছিল। বস্তুত এর পিছনে আছে দৃঢ় সামাজিক ঐক্য এবং কঠোর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার তাগিদ বা প্রয়োজনবোধ। এটাও সভ্যতার অবক্ষয়ের একটা ফল। পূর্বে যখন সভ্যতা বিকাশ লাভ করছিল তখন বৃহত্তর সামাজিক ঐক্য প্রতিষ্ঠায় সভ্যতার বস্তুগত শক্তি ধর্মের ভাবাদর্শিক শক্তির তুলনায় অনেক বেশী প্রবল ছিল। ফলে সমাজকে ঐক্যবদ্ধ এবং নিয়ন্ত্রণ করার জন্য সভ্যতার বস্তুগত শক্তি অনেকখানি যথেষ্ট ছিল। এ ক্ষেত্রে ধর্মের ভূমিকা সহায়ক হলেও সামাজিক ঐক্যের জন্য তার ভূমিকা সভ্যতার বস্তুগত ভূমিকার তুলনায় প্রবল ছিল না। ফলে ধর্মে বহু দেবতাবাদ, মূর্তিপূজা ইত্যাদি প্রচলিত ছিল হরপ্পান ধর্ম বাদে আর সব ধর্মে। তবে হরপ্পান ধর্মে মূর্তিপূজা না থাকলেও বহুদেবতাবাদ ছিল যদিও তার মধ্যে মূর্তিপূজা না থাকায় একেশ্বরবাদের একটি শক্তিশালী প্রবণতা ছিল যে বিষয়ে আমরা পূর্বে আলোচনা করেছি। তা সত্ত্বেও তার এক দেবতার অধীনে বহু দেবতার অস্তিত্ব ভাবাদর্শিক ক্ষেত্রে ক্ষমতার নিরংকুশ কেন্দ্রীভবনের অভাবকে প্রকাশ করে।
কিন্তু প্রাচীন সভ্যতাগুলির পতনের পর সামগ্রিকভাবে সভ্যতার বস্তুগত শক্তি যখন কমে এল তখন বৃহত্তর সামাজিক ঐক্য এবং নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার দায়িত্ব নিতে ধর্ম এগিয়ে এল। সুতরাং নিরাকার একেশ্বরবাদের প্রাধান্যও সূচিত হল। সভ্যতা তথা সমাজের বস্তুগত শক্তির অবক্ষয়ের সঙ্গে সর্বত্র বিস্তার লাভ করতে থাকল একেশ্বরবাদী ধর্মগুলো যেগুলো পূর্বের তুলনায় অনেক বেশী পরিমাণে নিরংকুশ একত্ব এবং একনায়কী স্বৈরতার সহায়ক হল।

পাতা: ২১৭


অনুমান করা চলে যে, সিন্ধু সভ্যতার নদীনিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা ধ্বংসের মাধ্যমে সভ্যতা ধ্বংসের জন্য অবৈদিক পক্ষ বৈদিক প্রতিপক্ষের ধর্মসংস্কারকে দায়ী করেছিল। কারণ ধর্ম সংস্কারের ফলে বৈদিক শক্তির পক্ষে যুদ্ধ করা এবং নদীনিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থাকে ধ্বংস করা সম্ভব হয়েছিল। সুতরাং বিভিন্ন অবৈদিক জনগোষ্ঠী যখন বাধ্য হয়ে দেশ ত্যাগ করে বিদেশের মাটিতে অপরিমেয় দু:খ-কষ্ট-লাঞ্ছনা এবং বিভিন্ন দুর্বিপাকে পড়েছিল তখন তাদের অনেকের মনে বরুণকেন্দ্রিক ধর্মের নমনীয়তা ও গণতান্ত্রিকতার বিরুদ্ধে প্রতিক্রিয়া ঘটতে পারে। হয়ত তারা ভেবেছিল আরও দেবতা ছিল বলে বরুণের ধর্মের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করা সম্ভব হয়েছিল ঐসব দেবতাকে অবলম্বন করে। অর্থাৎ সামাজিক ঐক্য রক্ষার নিরংকুশ এবং নিশ্ছিদ্র ব্যবস্থা হিসাবে নিরংকুশ ঈশ্বর ধারণা প্রতিষ্ঠার প্রয়োজনবোধ দূর দেশে অভিগামীদের মধ্যে অন্তত কারও কারও মনে প্রবল হয়ে উঠতে পারে। এর একটা প্রকাশ আমরা দেখি মোশির সংস্কারে।
আমরা ইসলামেও একই প্রেরণাকে কাজ করতে দেখি। বিভক্তির বিরুদ্ধে সামাজিক ঐক্যের প্রশ্নটিকে সামনে এনে নিরংকুশ একেশ্বরবাদের সপক্ষে যুক্তি উপস্থিত করতে দেখা গেছে। কোরআনে যুক্তি দেওয়া হচ্ছে : ‘যদি আল্লাহ্ ব্যতীত বহু ইলাহ্ থাকিত আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবীতে, তবে উভয়ই ধ্বংস হইয়া যাইত’ (২১ সূরা আম্বিয়া : ২২ আয়াত)। কিংবা ‘আল্লাহ্ কোন সন্তান গ্রহণ করেন নাই এবং তাঁহার সহিত অপর কোন ইলাহ্ নাই; যদি থাকিত তবে প্রত্যেক ইলাহ্ স্বীয় সৃষ্টি লইয়া পৃথক হইয়া যাইত এবং একে অপরের উপর প্রাধান্য বিস্তার করিত’ (২৩- সূরা মুমিনূন : ৯১ আয়াত)।  
ইসলামেও আমরা সপ্তসিন্ধুর বরুণকেন্দ্রিক নিরাকারবাদী ধর্মের প্রভাব দেখি। ইহুদী ধর্মের মত নিরংকুশ একেশ্বরবাদ এখানে প্রবল রূপ নিয়েছে। আবেস্তান ধর্মের অহুর ময্দা এবং অঙ্গ্রা মইন্যুর দ্বন্দ্বতত্ত্ব ইসলামে অনেকাংশে প্রতিফলিত হয়েছে আল্লাহ্ ও শয়তানের দ্বন্দ্বে। আল্লাহ্ শব্দের উৎস নিয়েও জিজ্ঞাসা এবং বির্তক আছে। আমাদের অনুমান তা আর্য-এর রূপান্তর হওয়া সম্ভব। কারণ অনেক ভাষায় র-এর উচ্চারণ বহু ক্ষেত্রে ল হয়। সেক্ষেত্রে আরইয় হবে আল্ইয় এবং তা থেকে পরবর্তী কালে আল্লাহ্ শব্দ রূপ নিতে পারে।
আমাদের অনুমান কোরাইশরা পশ্চাৎপদ কোন গোত্র ছিল না। তারা যথেষ্ট উন্নত পটভূমি থেকে আগত। আমরা অনুমান করি তারা সিন্ধু সভ্যতার কোন অঞ্চল থেকে আরবে আগমন করে। তাদের কোরাইশ্ নামটিও তাৎপর্যপূর্ণ। সংস্কৃত কৃষ্ বা কৃষি থেকে এই শব্দের উদ্ভব হওয়া সম্ভব। কৃষ্ শব্দের কিছু সংখ্যক অর্থ আছে। তার মধ্যে হলকর্ষণ
_________________________________________________________________________________

আরবী ইলাহ্ অর্থ উপাস্য।
_________________________________________________________________________________

পাতা: ২১৮


করা এবং অভিভব করা, অর্জন বা লাভ করা, পরিচালনা করা (যেমন সেনাবাহিনী) এখানে উল্লেখ্য। আর কৃষি হচ্ছে চাষ। হয়ত মরুময় আরবের কোন এলাকায় কৃষি প্রবর্তন করার কারণে তাদের এই নামকরণ হয়েছিল। কিংবা ক্ষমতা অথবা বাণিজ্যে অর্থ লাভের সঙ্গে তাদের গোত্রের নামকরণ সম্পর্কিত। মক্কার উদ্ভব হতে পারে মোক্ষ শব্দ থেকে। ইসলামে মূল স্বর্গ সাতটি। নরকও সাতটি। আকাশ সাতটি। এই সাত শব্দের প্রভাব খুব তাৎপর্যপূর্ণ। এটা সহজবোধ্য যে, সপ্তসিন্ধু বা সাত নদীর দেশ থেকে আগত মানুষদের মনে সাত সংখ্যার প্রতি গভীর আকর্ষণ থেকে গিয়েছিল।
এখন আমরা যুক্তিসঙ্গতভাবে সিদ্ধান্ত নিতে পারি যে, মধ্যপ্রাচ্যে সেমিটিক ভাষা এবং ধর্মের উথান ও বিকাশে সপ্তসিন্ধুর জনগোষ্ঠীর যোগাযোগ ও অভিগমন প্রধান ভূমিকা পালন করেছে। কারণ প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনাদি থেকে এখন জানা গেছে যে, সিন্ধু সভ্যতা তার আদি হরপ্পান পর্যায় থেকেই দক্ষিণ ইরান, দক্ষিণ মেসোপটেমিয়া, আরব উপদ্বীপের দক্ষিণ সমুদ্রোপকূল এবং পারস্য উপসাগর সহ বিস্তীর্ণ অঞ্চলে যোগাযোগ এবং প্রভাব গড়ে তুলেছিল। সিন্ধু সভ্যতার এই সাগরপারের বিস্তীর্ণ যোগাযোগ সম্পর্কে অবশ্য আমরা চতুর্থ অধ্যায়ে আলোচনা করেছি। বস্তুত আরব সাগরের সুদীর্ঘ উপকূল জুড়ে আদি হরপ্পান পর্যায় থেকেই সিন্ধু সভ্যতার বহু সংখ্যক বাণিজ্য কেন্দ্র এবং বসতি বা উপনিবেশ গড়ে উঠেছিল। বিশেষত ৩০০০ খ্রী:পূ: কাল অথবা তারও পূর্ব থেকে সুদূর আরব উপকূল ও পারস্য উপসাগরীয় অঞ্চলে সিন্ধু সভ্যতার বাণিজ্যকেন্দ্র ও উপনিবেশসমূহ স্থাপনের প্রমাণ থেকে উদীয়মান সিন্ধু বা হরপ্পান সভ্যতার শক্তির পরিমাণ সম্পর্কে কিছুটা হলেও ধারণা করা যায়। এবং সেই সঙ্গে অনুমান করা যায় শিল্পোৎপাদন ও বাণিজ্যের উপর তাদের নির্ভরতা সম্পর্কে।
আমরা অনুমান করি এই প্রবাসীরা যে শুধু তাদের ধর্মকে বাইরে নিয়ে গিয়েছিল তা-ই নয় সেই সঙ্গে তাদের ভাষা ও সংস্কৃতিকেও নিয়ে গিয়েছিল। বিশেষ করে ভাষার প্রশ্নে বলতে হয় সকলে এক ভাষা-ভাষী ছিল না, যদিও পরিণত হরপ্পান পর্যায় থেকে সংস্কৃত কিংবা কথিত বৈদিক ভাষা যোগাযোগের জন্য তাদের প্রধান ভাষা হয়ে থাকতে পারে। কিন্তু আরব সাগরের দূরবর্তী উপকূলের বসতিগুলি থেকে আরও পশ্চিম এবং উত্তরের সঙ্গে বাণিজ্য ও যোগাযোগের প্রয়োজনে স্বাভাবিকভাবে তাদের নূতন একটি ভাষা গড়ে তুলতে হয়েছিল। একেবারে নিকটে ছিল উন্নত মেসোপটেমীয় সভ্যতা, এবং মিসরীয় সভ্যতার অবস্থানও বেশী দূরে ছিল না। ফলে মূলভূমি থেকে এতদূরে দুইটি উন্নত সভ্যতার ভাষা ও সংস্কৃতির প্রভাবকে অস্বীকার করা সম্ভব ছিল না। বিশেষ করে সপ্তসিন্ধুর ভাষা এখানে যে পরিবর্তিত হবে সেটা স্বাভাবিক। মূলভূমির দূরত্বের কারণে এখানে বিভিন্ন ভাষার মিশ্রণে একটি নূতন ভাষার উদ্ভব ঘটেছে বলে অনুমান করা চলে যা থেকে ক্রমে সেমিটিক ভাষাগোষ্ঠীর বিকাশ ঘটেছে।
এটা স্বাভাবিক যে, সিন্ধু-সরস্বতী উপত্যকার আরব সমুদ্রোপকূলবর্তী লোকজন দূর পশ্চিমে সাগরপারের উপনিবেশ ও বাণিজ্য কেন্দ্রগুলি গড়ে তোলে। যখন সরস্বতী নদী

পাতা: ২১৯


শুকাতে থাকে তখন জনসংখ্যার একটা অংশ ঐ সব দূর কেন্দ্রে যোগাযোগের পূর্ব সূত্র ধরে চলে গিয়ে থাকতে পারে। এইভাবে তারা সেখানে বসতিগুলির প্রসার ঘটায় । এবং সেখান থেকে অভিবাসীরা আরও দূর পশ্চিম এশিয়া, উত্তর আফিন্সকা এবং দক্ষিণ ইউরোপের ভূমধ্যসাগরীয় উপকূল অঞ্চলে বাণিজ্য কেন্দ্র এবং বসতি স্থাপন করতে থাকে। বিশেষ করে যে সব জায়গায় মিসর বা মেসোটেমিয়ার মত উন্নত সভ্যতার উপর প্রতিষ্ঠিত রাষ্ট্র ছিল না সেই সব জায়গায় তাদের পক্ষে বসতি স্থাপন সহজতর ছিল।
মধ্যপ্রাচ্যে সেমিটিক জনগোষ্ঠীর উথানের বিষয়টি আজ অবধি ইতিহাসের একটি অমীমাংসিত ও রহস্যময় বিষয় হয়ে আছে। এদের সম্পর্কে প্রথম জানা যাচ্ছে খ্রী:পূ: তৃতীয় সহস্রাব্দে মেসোপটেমিয়ার নদী উপত্যকার দিকে সেমিটিক জনগোষ্ঠীর অভিগমন সংক্রান্ত তথ্য থেকে। এরপর তারা বিভিন্ন সময় সেখানে শক্তিশালী এবং বৃহৎ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করে। ২৩৫০ খ্রীষ্টপূর্বাব্দের দিকে উম্মার একজন সুমেরীয় রাজাকে পরাজিত করে একটি সেমিটিক রাজবংশ প্রতিষ্ঠিত হয়।
এরপর ২০০০ খ্রীষ্টপূর্বাব্দের দিক থেকে প্যালেস্টাইন, সিরিয়া এবং মেসোপটেমিয়ায় নূতন সেমিটিক জনগোষ্ঠীকে দেখা যাচ্ছে। অ্যামোরাইট নামে পরিচিত সেমিটিক জনগোষ্ঠী পরপর অনেকগুলি রাষ্ট্র এবং রাজবংশের শাসন প্রতিষ্ঠিত করে। সবশেষে একটি অ্যামোরাইট রাজবংশ মেসোপটেমিয়ায় কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করে। এটি ব্যাবিলনের প্রথম রাজবংশ (প্রায় ১৮৩০-১৫৩০ খ্রীষ্টপূর্বাব্দ ) নামে পরিচিত।
খ্রী:পূ: দ্বিতীয় সহস্রাব্দের প্রথমার্ধ জুড়ে সেমিটিক ভাষার জনগোষ্ঠীসমূহকে মেসোপটেমিয়া, সিরিয়া, প্যালেস্টাইন সহ পশ্চিম এশিয়া বা মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন অঞ্চলে সম্প্রসারণ এবং প্রাধান্য বিস্তার করতে দেখা যায়। এই সময়ে ইসরাইলীয় নামে পরিচিত একটি সেমিটিক গোষ্ঠী মিসরে অভিগমন করে সেখানে কয়েক শতাব্দী বাস করে।
আমরা অনুমান করি আদি হরপ্পান পর্যায় থেকে যখন দক্ষিণ আরব, পারস্যোপসাগরীয় অঞ্চল এবং দক্ষিণ মেসোপটেমিয়ার সমুদ্রকূল বরাবর সিন্ধু সভ্যতার যোগাযোগ, বাণিজ্য এবং বসতি গড়ে উঠেছিল তখন থেকেই সেমিটিক ভাষার উদ্ভব ঘটতে থাকে। শক্তিশালী হরপ্পান রাষ্ট্র গঠনের পূর্বে সভ্যতার বিকেন্দ্রায়িত অবস্থায় সাগরপারের উপনিবেশ ও বাণিজ্য কেন্দ্রগুলির তুলনামূলক স্বাতন্ত্র্য ও বিচিছন্নতা কিংবা কেন্দ্রিকতার অভাব সম্ভবত বাণিজ্যিক প্রয়োজনে সেমিটিক ভাষার মত একটি নূতন ভাষার অথবা কতকগুলি সমধর্মী নূতন ভাষার উদ্ভব সহজতর করেছিল।
এরপর সিন্ধু সভ্যতার পতন কালে সেখান থেকে অভিগামী বিভিন্ন জনগোষ্ঠী ঐ সব অঞ্চলে গিয়ে বৃহত্তর সেমিটিক ভাষা কাঠামোর অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। স্বদেশ থেকে দূরত্ব, ভিন্ন দেশ ও পরিস্থিতি, সভ্যতার মূল কেন্দ্রের পতন , অনিশ্চিত যাযাবর ও কঠোর জীবনের অভিজ্ঞতা ইত্যাদি অভিগামী জনগোষ্ঠীগুলির ভাষা ও সংস্কৃতিতে সহজে ব্যাপক পরিবর্তন ঘটিয়েছে।
তবে ধর্মের ক্ষেত্রে পরিবর্তন অন্তত কিছু ক্ষেত্রে বেশী একটা হয় নি বলে বোঝা যায়। বিশেষত

পাতা: ২২০


দূর দেশের বৈরী পরিস্থিতিতে কিছু জনগোষ্ঠী বা উপজাতি অথবা গোত্র নিজেদের স্বতন্ত্র সত্তা রক্ষার জন্য অনেক কিছু হারিয়েও অতীতের ধর্মকে আঁকড়ে থাকার চেষ্টা করেছে। এই রকম একটা গোষ্ঠী ইসরাইলীয়রা। অবশ্য তাদের মধ্যেও পৌত্তলিকতা প্রবেশ করেছিল যার বিরুদ্ধে মোশির সংস্কার ছিল আপোসহীন এবং সফল। কুরাইশদেরকেও মনে হয় উত্তর দিকে মূল আরব অঞ্চলে সপ্তসিন্ধুর অভিগামী । কিন্তু তারা কালক্রমে সেই অঞ্চলে বিদ্যমান পৌত্তলিকতাকে গ্রহণ করে নিজেদের প্রাধান্য ও নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে ক্রমশ একটা স্থিতিশীল সমাজ ও সভ্যতা গড়ে তোলার পথ বেছে নিয়েছিল বলে মনে হয়। মোহাম্মদের ধর্মসংস্কার পৌত্তলিকতার সঙ্গে আপোসের অবসান ঘটিয়ে নিরংকুশ ও নিরাকার একেশ্বরবাদ প্রতিষ্ঠা করে।
ইহুদী, খ্রীষ্টান ও ইসলাম এই তিনটি প্রধান বিদ্যমান একেশ্বরবাদী ধর্মের উদ্ভব ঘটেছে সেমিটিক ভাষাভাষী জনগোষ্ঠীর ভিতর থেকে। বর্ণমালা উদ্ভাবনেও তাদের নামই সর্বাগ্রে আসে। বর্ণমালার উদ্ভাবক হিসাবে পশ্চিম এশিয়ার ভূমধ্যসাগর তীরবর্তী এলাকার ফিনিশীয়রা বিখ্যাত। ফিনিশীয়রা হরপ্পান সভ্যতার পতনকালে কিংবা বিদায়ী হরপ্পান পর্যায়ে সপ্তসিন্ধু অঞ্চল থেকে লিপি নিয়ে গিয়ে তাকে উন্নত করে বর্ণমালার উদ্ভব ঘটাতে পারে। তবে তারা আর্য বা ইন্দো- ইউরোপীয় ভাষাগোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত নয়। এটা সম্ভব যে, যে অঞ্চলে তারা অভিগমন করেছিল সেখানকার অধিবাসীদের সঙ্গে দীর্ঘ মিথষ্ক্রিয়ার মাধ্যমে তাদের ভাষার পরিবর্তন ঘটে এবং তারা সেমিটিক ভাষা গ্রহণ করে। সামুদ্রিক বাণিজ্যে তারা ছিল অত্যন্ত গতিশীল এবং দু:সাহসী। যাইহোক, এই ধারণা প্রতিষ্ঠিত হয়ে আছে যে, ফিনিশীয় ভাষা কেনানের পুরাতন সেমিটিক কথ্য ভাষা থেকে এসেছে এবং তারা একটি কেনানীয় সেমিটিক জনগোষ্ঠীর উত্তরসূরি। মনে করা হয়, ঐ ভাষা মোয়াবীয় এবং ইসরাইলীয়দের হিব্রু ভাষার সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে সংযুক্ত ছিল।
আমরা মধ্যপ্রাচ্যে সেমিটিক প্রভাব ও তার সম্ভাব্য উৎস সম্পর্কে আলোচনা করলাম। কিন্তু মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন অঞ্চলে আর্য অভিগমনের যে সব প্রত্নতাত্ত্বিক প্রমাণ পাওয়া গেছে সেগুলি সম্পর্কে বিশেষ কোন আলোচনা করি নি। অথচ বিস্তীর্ণ অঞ্চলে আর্যদের চলাচল সম্পর্কে জানা যাচ্ছে।
১৯০০ খ্রীষ্টপূর্বাব্দের আগে এশিয়া মাইনরের মধ্য অঞ্চলে আর্যদের (ইন্দো-ইউরোপীয়) উপস্থিতির কথা জানা যায়। অ্যাসিরীয় বণিকদের নথিতে স্থানীয় হিটাইট (Hittite)  রাজপুত্রদের নাম উল্লেখ আছে যারা তাদের নগর রাষ্ট্রগুলোতে শাসন করত। এই ব্যক্তি-নামগুলো আর্য হতে পারে। কিছু ট্যাবলেটে হুরিয়ান ও অ্যামোরাইট নামেরও উল্লেখ আছে। এইসব নামের মধ্যে পিৎখন (Pitkhana) ও তাঁর পুত্র অনিত্ত (Anitta)-এর নাম আর্য ভাষা থেকে উদ্ভূত বলে অনুমান করা হয়। একই নাম পাওয়া যায় বোঘাজকোয় (Boghazkoi)-এ প্রাপ্ত হিটাইট বিবরণীতে কুশ্শর (Kushshar) নগরের দুই রাজা পিৎখনশ ও অনিত্তশ নামে। এখানে বলা হয়েছে যে পিৎখন নেশা (Nesha)  বা কনেশ (Kanesh) দখল করেছিলেন এবং অনিত্ত হত্তুশ (Hattusha) এবং অন্যান্য স্থান ধ্বংস করেন।

পাতা: ২২১


বোঘাজকোয় সহ অনেক স্থানে হিটাইট বিবরণী পাওয়া গেছে। এগুলো আদি হিটাইট রাজ্যকালে (১৭০০-১৫০০ খ্রীষ্টপূর্বাব্দের মধ্যে) পড়েছে। এখানে এবং অন্যান্য জায়গায় প্রাপ্ত হিটাইট ভাষা আর্য ভাষার সাথে ঘনিষ্টভাবে সম্পর্কিত। এগুলি কিউনিফর্ম লিপিতে (মেসোপটেমিয়া থেকে গৃহীত বলে মনে হয়) এবং হায়ারোগ্লিফিক চিহ্নে (যেগুলোর সাথে আদি সুমেরীয় চিত্রলিপি অথবা মিসরের হায়ারোগ্লিফিকের সম্পর্ক নেই বলে মনে হয়) লিখিত।
মিটানী রাজ্যের জনসাধারণ প্রধানত হুরিয়ান হলেও এখানকার পরবর্তীকালের রাজাদের নাম আর্য ভাষার ছিল। এর কালপর্ব হল ১৫০০ খ্রী:পূ: থেকে ১৪৫০ খ্রী:পূ: পর্যন্ত। এই নামগুলোর মধ্যে তুশরত্ত (Tushratta) ও তাঁর পুত্র মত্তিওয়াযা (Mattiwaza) উল্লেখযোগ্য। মিটানীদের মধ্যে আর্যদের দেবতা মিত্র, বরুণ, ইন্দ্র ও নাসত্যদ্বয়ের নাম প্রচলিত থাকায় অনুমান করা যায় তারা বৃহত্তর সিন্ধু-সরস্বতী উপত্যকা থেকে যাওয়া আর্যদের উত্তর পুরুষ।
তবে ইউরোপে আর্য অভিগমন ও অভিবাসনের ভাষা ও সংস্কৃতিগত প্রভাব যেমন ব্যাপকভাবে দেখা যায় পশ্চিম এশিয়ার ক্ষেত্রে তেমনটা হয় নি। নিকটবর্তী পশ্চিম এশিয়ার তুলনায় অনেক দূরবর্তী ইউরোপের বিস্তীর্ণ ভূভাগে আর্য বা সংস্কৃত ভাষার ব্যাপক বিস্তার ও গভীর প্রভাব বিস্ময়কর বটে। তবে এর কারণ হিসাবে আমরা অনুমান করি প্রাচীন মেসোপটেমিয়ার সভ্যতার সঙ্গে মিথষ্ক্রিয়ায় গড়ে ওঠা সেমিটিক ভাষার প্রবল প্রভাবের ফলে সেখানে অভিগামীরা তার ভিতর বিলীন হয়েছে। তাছাড়া শক্তিশালী মেসোপটেমীয় সভ্যতা এবং রাষ্ট্রের অবস্থান অভিগামী আর্য প্রবাহকে যথেষ্ট পরিমাণে বাধাগ্রস্ত করেছিল বলেও মনে হয়। মেসোপটেমীয়দের দ্বারা অধিকৃত ইউফ্রেটিস-টাইগ্রিস নদী দুইটির উর্বর উপত্যকাকে পাশ কাটিয়ে অধিকাংশ অভিগামীকে পশ্চিম এশিয়ার বিভিন্ন দিকে যেতে হয়েছে যেখানে অধিকাংশ ক্ষেত্রে তারা কালক্রমে সেমিটিক ভাষাগোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত হয়েছে এবং বাকীরা সমুদ্রপথে এবং স্থলপথে দক্ষিণ, পশ্চিম, উত্তর ও পূর্ব ইউরোপের বিভিন্ন স্থানের দিকে অভিগমন করেছে। ইউরোপে আর্যদের অভিগমন এবং প্রভাব রোধ কিংবা আত্মস্থ  করার মত কোন উন্নত ও শক্তিশালী সভ্যতা না থাকায় ইউরোপ সহজে আর্যকৃত হয়েছে।
হয়ত কালক্রমে সেখানে কয়েক লক্ষ অভিগামী পৌঁছেছিল। অবশ্য আজকের ইউরোপের ভাষাগুলির আর্যকরণ দেখে মনে হওয়া স্বাভাবিক যে, ইউরোপে অভিগামী আর্যরা বিপুল সংখ্যায় গিয়ে সংখ্যাগরিষ্ঠ জনসংখ্যায় পরিণত হয়েছিল। কিন্তু বিষয়টিকে তেমন মনে হয় না। মনে হয় সপ্তসিন্ধুর উন্নত সভ্যতা ও সংস্কৃতির অধিকারী আর্যরা স্থানীয় সংখ্যাগুরু জনগোষ্ঠীগুলির সঙ্গে বিভিন্ন ধরনের মিশ্রণ ও মিথষ্ক্রিয়ার মাধ্যমে তাদেরকে আর্য ভাষা ও সংস্কৃতির বৃহত্তর কাঠামোর অন্তর্ভুক্ত করে নেয়। এটা ঠিক যে, দেশ ও কালের দূরত্ব, দীর্ঘ যাযাবর জীবন কিংবা ভিন্ন জীবন যাত্রা ইত্যাদির কারণে ইউরোপে

পাতা: ২২২


অভিবাসী আর্যরা তাদের আদি জীবন ও বাসভূমির অনেক স্মৃতিই হারিয়ে ফেলেছিল। তাদের সংস্কৃতি, ধর্ম বিশ্বাস এবং ভাষায়ও অনেক পরিবর্তন ঘটেছিল। কিন্তু তা সত্ত্বেও সবকিছু যে তাদের হারায় নি তার প্রমাণ ইউরোপব্যাপী আর্য বা সংস্কৃত ভাষার প্রভাব। তাছাড়া প্রাচীন গ্রীস এবং রোমের দেব-দেবীদের নামগুলি থেকেও আমরা তার প্রমাণ পাই। সিন্ধু-সরস্বতী সভ্যতার উত্তরাধিকারীরা পরবর্তীকালে ইউরোপের গ্রীসে একটি উন্নত সভ্যতা গড়ে তোলে। তারও পরে তারা রোমে আর একটি উন্নত নগর সভ্যতা গড়ে তোলে। গ্রীস এবং রোমের প্রজাতন্ত্র এবং গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক ব্যবস্থা যে সিন্ধু সভ্যতার একটি উত্তরাধিকার তা আজ আমরা সহজেই অনুমান করতে পারি। তবে সিন্ধু সভ্যতার অহিংসা ও নম্রতা এখন একটা অতীত স্মৃতি মাত্র।
এ দিকে আমরা আর্যদের ব্যাপক অভিগমন ঘটতে দেখি ভারতবর্ষের পূর্ব ও উত্তর দিকে। বিশেষত গাঙ্গেয় উপত্যকা যা এতকাল জঙ্গল ও জলা অবস্থায় পড়েছিল সেখানে ব্যাপক বসতি স্থাপন এবং কৃষিকাজ শুরু হল। ক্রমে বসবাসের অযোগ্য জলা ও অস্বাস্থ্যকর জায়গাগুলো বদলে গেল।
কিন্তু আর একটি নগর সভ্যতা গড়তে হরপ্পানদের উত্তরাধিকারীদেরকে বহুকাল অপেক্ষা করতে হল। বলতে গেলে সিন্ধু সভ্যতার পতনের পর সাহিত্য এবং প্রত্নতত্ত্ব কোন দিকে থেকেই বহুকাল পর্যন্ত ভারতবর্ষের সামাজিক অবস্থা সম্পর্কে তেমন কিছু জানা যায় না। প্রকৃতপক্ষে বহু শতাব্দীর জন্য, সহস্রাধিক অথবা দেড় সহস্র বৎসরের জন্য সভ্যতা প্রায় হারিয়ে গিয়েছিল। হরপ্পানরা ফিরে গিয়েছিল কৃষি ও গ্রাম্যতায়। নগর থাকলেও সেগুলো উল্লেখযোগ্য কিছু ছিল না। খ্রী:পূর্ব ৬ বা ৫ শতকের দিক থেকে আমরা আবার নগর সভ্যতার উথান ঘটতে দেখি মূলত গাঙ্গেয় উপত্যকায়। ঐ সময় বৌদ্ধ, জৈন ইত্যাদি ধর্মীয় আন্দোলন শুরু হয় বৈদিক ধর্মের বিপরীতে। অন্যদিকে বৈদিক ধর্মের ঐতিহ্যকে অনেকখানি রক্ষা করে আর একটি ধর্মসংস্কার ঘটতে থাকে যার একটি মূল বৈশিষ্ট্য ছিল ব্রাহ্মণের আধিপত্যাধীন বর্ণজাতি প্রথা। একটা দীর্ঘকাল জুড়ে ব্রাহ্মণ্যবাদ এবং বৌদ্ধ ধর্মে প্রতিযোগিতা চলল। কিন্তু ভারতবর্ষে শেষ পর্যন্ত ব্রাহ্মণ্যবাদ জয়ী হল এবং বৌদ্ধধর্মকে বিদায় নিতে হল। ব্রাহ্মণ্যবাদ এখন আমাদের কাছে পরিচিত হিন্দুধর্ম নামে। ভারতবর্ষ থেকে বৌদ্ধধর্ম বিদায় নিলেও শ্রীলংকা, মিয়ানমার, থাইল্যান্ড, তিব্বত, চীন সহ দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার এক বিস্তীর্ণ ভূভাগে তা বিস্তার লাভ করল।
ইতিহাসের পথ ধরে আমরা অনেকটা এগিয়ে এসেছি। এখন আমরা পুনরায় পিছনের দিকে ফিরব পরিণত হরপ্পান পর্যায়ে উত্তরণকালে সিন্ধু-সরস্বতী উপত্যকায় যে যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছিল বলে আমরা সন্দেহ প্রকাশ করেছি তার কোন সাহিত্য সূত্র খুঁজে পাওয়া যায় কিনা সেই বিষয় বুঝতে।
আমরা ঋগ্বেদকে দেখতে পেয়েছি মূলত পরিণত হরপ্পান পর্যায় যখন সমাপ্ত হচ্ছে তখনকার একটি ঐতিহাসিক ঘটনার দলিল হিসাবে। ধর্মগ্রন্থ হওয়ায় তার কিছু অসুবিধা এবং সুবিধা দুই-ই আছে। ধর্মগ্রন্থ হওয়ায় তার মধ্যে অনেক সমাজ বাস্তবতা ধর্মীয় রূপ নিয়ে দেখা

পাতা: ২২৩


দিয়েছে। পৃথিবীর বাস্তব রূপ অনেক ক্ষেত্রে বিশ্বাস বা কল্পনার দৃষ্টির আলোয় উল্টাভাবে উপস্থিত হয়েছে। ফলে ঐতিহাসিক ও সামাজিক ঘটনাগুলিকে বাস্তবের আদলে পুনর্বিন্যস্ত করা অনেক সময় কঠিন এমনকি অসম্ভবও হতে পারে। কিন্তু এও ঠিক যে, ধর্মগ্রন্থ হওয়ায় এবং তাকে অবিকৃতভাবে রক্ষা করার মত সামাজিক বা প্রাতিষ্ঠানিক শক্তি ও ব্যবস্থা থাকায় অন্তত রক্ষিত মন্ত্রগুলি মূলত অপরিবর্তিতভাবে প্রায় চার হাজার বছর কাল রক্ষা পেয়ে আমাদের কাছে এসেছে। এই সুবিধা অন্য কোন সাহিত্যের থাকার কথা নয়। ঋগ্বেদ ছাড়া সিন্ধু সভ্যতার আর কোন লিখিত সাহিত্য আমাদের কাছে প্রকৃত অর্থে নেই। পোড়ানো মৃৎ ফলকে লেখার কারণে হোক আর প্যাপিরাস পত্রে লেখা হলেও মরুভূমির শুষ্কতায় অবস্থিত পিরামিডের রক্ষাব্যবস্থার ভিতরে থাকার কারণে হোক মেসোপটেমিয়া এবং মিসরের অনেক সাহিত্য বা লিখিত দলিল রক্ষা পেয়েছে। তার উপর ঐ দুই সভ্যতার ভাষার লিপির পাঠোদ্ধার হওয়ায় ঐ দুই সভ্যতার ইতিহাসের অনেক তথ্য জানা গেছে। দুর্ভাগ্যক্রমে সিন্ধু সভ্যতার সিল, মৃৎপাত্র ইত্যাদিতে লিপির পরিমাণ যেমন কম তেমন সেগুলির পাঠোদ্ধারও হয় নি আজ অবধি। ফলে সিন্ধু সভ্যতা নিয়ে রহস্যের শেষ নেই।
অবশ্য সিলের মত স্থায়ী কিছুতে লিপির অপ্রাচুর্য থেকে সিন্ধু সভ্যতায় শিক্ষাচর্চা কম ছিল এটা মনে করার কারণ নেই। বরং আমরা মনে করি শিক্ষাচর্চার ব্যাপক প্রসারের ফলে জ্ঞানের হারিয়ে যাবার ভয় ছিল না। ফলে পাথর বা পোড়া মাটির ফলক জাতীয় স্থায়ী কিছুতে জ্ঞান বা তথ্য সংরক্ষণের সামাজিক তাগিদ জন্ম নিতে পারে নি। এটা বোঝা যায় যে, গাছের পাতা, ছাল, চামড়া ইত্যাদি বিভিন্ন অস্থায়ী জিনিসের উপর লেখা হত। লেখাপড়ার চর্চা কতটা ছিল তা বোঝার জন্য সভ্যতার মান ও ব্যাপকতার দিকে দৃষ্টি দেওয়া যেমন যথেষ্ট তেমন শুধু ঋগ্বেদের সাহিত্য থেকেও আমরা সহজেই অনুমান করতে পারি সমাজে শিক্ষা কতটা বিস্তৃত হলে এমন একটি সাহিত্য রচনা করা সম্ভব। শুধু ঋগ্বেদ নয় উপরন্তু তার ধারায় রচিত সামবেদ, যজুর্বেদ এবং অথর্ববেদ সহ সমগ্র বৈদিক সাহিত্য এবং উপনিষদগুলি একটি সভ্যতার কালে এবং তার পরবর্তী অবক্ষয়ের কালেও জ্ঞান চর্চার ধারাটির শক্তিমত্তাকে অনুভব করতে বাধ্য করে। এই শক্তির উৎস যে সিন্ধু সভ্যতায় এটা বোঝা কঠিন কোন ব্যাপার নয়।
যাইহোক, ধর্মগ্রন্থ না হলেও ভারতবর্ষে আমরা দুইটি কালজয়ী সাহিত্যকে মহাকাব্যের আকারে দেখি যেগুলি স্মরণাতীত কাল থেকে উপমহাদেশের ব্যাপক জনগণের মনকে জয় করে আছে। এই দুই মহাকাব্য হল রামায়ণ এবং মহাভারত। ধর্মগ্রন্থ না হওয়ায় এগুলি কালে কালে এমন অনেক পরিবর্তন ও পরিবর্ধনের মধ্য দিয়ে এসেছে যার ফলে ঐতিহাসিক দলিল হিসাবে এগুলির গুরুত্ব ঋগ্বেদের তুলনায় অনেক কম। তা সত্ত্বেও আমরা মনে করি যে, এই দুই মহাকাব্যের পিছনে কালপ্রেক্ষিতে এমন দুইটি কালান্তরকারী ঘটনার অভিঘাত থাকা উচিত যা এই দুই মহাকাব্যকে বিপুলভাবে জনপ্রিয় এবং কালজয়ী হবার শক্তি দিয়েছে। সুতরাং আমরা রামায়ণ এবং মহাভারতের উপর একটা সংক্ষিপ্ত আলোচনা করব এই দুইয়ের সৃষ্টির মূল অভিঘাতের ঘটনাটিকে খুঁজে বের করার জন্য এবং এই দুইয়ের কোনটির সঙ্গে সিন্ধু সভ্যতার বিশেষত তার আদি হরপ্পান পর্যায় থেকে পরিণত হরপ্পান পর্যায়ে উত্তরণ কালীন কোন ঘটনার যোগসূত্র আছে কিনা সেটি বোঝার জন্য। এটা স্বাভাবিক যে, পরিণত হরপ্পান পর্যায়ের সূচনা তথা নগর সভ্যতার সূচনা পর্বে একটি বিরাট সামাজিক ওলটপালট বা পালাবদল হয়েছিল যা অন্তত একটি মহাকাব্য সৃষ্টির বীজ হিসাবে কাজ করে থাকতে পারে।
প্রথমে আমরা মহাভারতের উপর আলোচনা করব একটি বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ কারণে। তা হল মহাভারতে আমরা পঞ্চপাণ্ডবের একজন মাত্র স্ত্রীকে দেখতে পাই। অর্থাৎ এক নারীর বহু পতিত্বের যে সাক্ষ্য রয়েছে তা তাকে প্রাক-নগর সভ্যতার ঘটনার সঙ্গে সম্পর্কিত করে। এই হিসাবে আদি হরপ্পান থেকে হরপ্পান পর্যায়ে উত্তরণকালীন যুগান্তকারী অভিঘাতের ঘটনা মহাভারতে প্রতিফলিত হতে পারে কিনা সেটা বিশ্লেষণের জন্য আমরা এখন তার উপর দৃষ্টি দিব।

পাতা: ২২৪

সাম্প্রতিক পোষ্টসমূহ