লিখেছেনঃ শামসুজ্জোহা মানিক এবং শামসুল আলম চঞ্চল, আপডেটঃ September 28, 2012, 5:00 AM, Hits: 10847
মহাভারত কাহিনী মূলত পাণ্ডু ও ধৃতরাষ্ট্র এই দুই ভাইয়ের পুত্রদের মধ্যকার যুদ্ধকে কেন্দ্র করে রচিত। পাণ্ডুর পাঁচ পুত্রের মধ্যে যুধিষ্ঠির জ্যেষ্ঠ। অন্যদিকে ধৃতরাষ্ট্রের স্ত্রী গান্ধারীর গর্ভজাত দুর্যোধন, দু:শাসন, দু:সহ, দুর্মুখ ইত্যাদি নামীয় শত পুত্র। পঞ্চপাণ্ডব ভ্রাতাদের স্ত্রী দ্রৌপদী। রাজা পাণ্ডুর মৃত্যুর পর অন্ধ ধৃতরাষ্ট্রের পুত্র দুর্যোধন অন্যান্য ভ্রাতা সহযোগে পঞ্চপাণ্ডবকে রাজ্যচ্যুত করার জন্য বিভিন্ন ষড়যন্ত্র করেন। তিনি যুধিষ্ঠিরকে দ্যূতক্রীড়া বা জুয়া খেলায় পরাজিত করে রাজ্যচ্যুত করেন এবং এরপর সর্বসমক্ষে রাজসভায় দ্রৌপদীর বস্ত্র হরণ করেন। পঞ্চপাণ্ডব দেশত্যাগ করেন। অবশেষে উভয় পক্ষের মধ্যে যুদ্ধ হয় যাতে বহু সংখ্যক রাজা এবং সেনাবাহিনী যোগদান করে। এই যুদ্ধে দুর্যোধন পক্ষ পরাজিত ও ধ্বংস হয়। পঞ্চপাণ্ডব রাজ্য ফিরে পান এবং যুধিষ্ঠির সিংহাসনে আরোহণ করেন। কিন্তু জ্ঞাতিহত্যা ও বিপুল রক্তক্ষয়ে যুধিষ্ঠিরের মন অশান্ত ছিল। ছত্রিশ বৎসর রাজ্য শাসন করার পর তিনি তার ছোট ভাই অর্জুনের পৌত্র পরীক্ষিৎকে রাজ্যভার দিয়ে মহাপ্রস্থানে গমন করলে দ্রৌপদী এবং বাকী চার ভাই তাঁকে অনুসরণ করেন। তাঁরা সকলে স্বর্গলাভ করেন। তবে ধর্মপুত্র যুধিষ্ঠির স্বশরীরে স্বর্গে প্রবেশ করেন।
এই কাহিনীকে কেন্দ্র করে রচিত হয়েছে এক মহাকায় মহাকাব্য। বস্তুত মহাভারত এমন এক বিশাল মহাকাব্য যার ভিতর রয়েছে হাজার হাজার বৎসর ধরে সৃষ্টি হওয়া উপমহাদেশের বিপুল সংখ্যক গল্পের জাল বিস্তার। বহু গল্পের পিছনে যেমন আছে ঘটনার অভিঘাত তেমন নিছক কল্পিত ঘটনার জাল বিস্তারও হয়েছে হয়ত বিশেষ একটি সামাজিক চাহিদা পূরণের তাগিদ থেকে। অনেক উদ্ভট ও অসম্ভব বা অবাস্তব কাহিনীর সন্নিবেশ এই গ্রন্থের ভিত্তিকে অনেক সময় প্রশ্নসাপেক্ষ করে।
কিন্তু এটা সুস্পষ্ট যে, একটি ঐতিহাসিক ঘটনার প্রেক্ষিতে জন্ম নেওয়া একটি মূল বা বীজ কাহিনীকে অবলম্বন করে যেমন এক মহাকাব্যের সৌধ রচিত হয়েছে তেমন অজস্র কাহিনীর জাল বিস্তার হয়েছে যার অনেকগুলির সত্যতা বা অসত্যতা নিয়ে আমাদের মাথা না ঘামালেও চলে। মহাকাব্যের মূল তাৎপর্য বোঝার জন্য আমাদের সমগ্র মহাকাব্যের সবকিছুকে তন্ন তন্ন করে পর্যালোচনা ও বিশ্লেষণ করার প্রয়োজন হয় না যদি আমরা তার মূল কাহিনীর অন্তরালের ঘটনাটিকে বোঝার চেষ্টা করি এবং বোঝার চেষ্টা করি এই ঘটনা জন্ম নিতে পারে কোন সামাজিক সংঘাত থেকে যে সংঘাত থেকে সৃষ্ট অভিঘাত শেষ পর্যন্ত এমন একটি ঘটনার জন্ম দিয়েছিল যে ঘটনাকে অবলম্বন করে কালক্রমে গল্প-গাথা রচনার মাধ্যমে ক্রমে একটি ক্ষুদ্র গীতিকাব্যের অংকুর থেকে বেড়ে উঠে মহাকাব্যের মহীরুহ দাঁড়িয়েছে। সুতরাং আমরা প্রথমে পঞ্চপাণ্ডব এবং সাধারণভাবে কৌরব হিসাবে পরিচিত ধৃতরাষ্ট্র পুত্রদের মধ্যকার সংঘাতের দিকে দৃষ্টি দিব মহাভারতের মূল সূত্রটিকে খুঁজে বের করার জন্য।
পাতা: ২২৫
মহাভারত অপরিমেয় ঐতিহাসিক তাৎপর্য নিয়ে ধরা দিবে যদি আমরা মহাকাব্যের প্রধান নায়ক পাঁচ ভাই পঞ্চপাণ্ডব কর্তৃক আচরিত এক নারীর বহু পতিত্বমূলক সামাজিক প্রথাকে নগর সভ্যতার পূর্বাবস্খার সঙ্গে সম্পর্কিত করতে পারি এবং মহাকাব্যের মূল নায়ক পঞ্চপাণ্ডবকে বৃহত্তর সিন্ধু-সরস্বতী উপত্যকার সঙ্গে সম্পর্কিত করতে পারি।
পাণ্ডুর পুত্র হিসাবে পরিচিত পঞ্চপাণ্ডবের কেউই তাঁর ঔরসজাত পুত্র নয়। এরা সবাই পাণ্ডুর দুই স্ত্রীর গর্ভে বিভিন্ন দেবতা কর্তৃক জন্মপ্রাপ্ত। যেমন পাণ্ডুর প্রথম স্ত্রী কুন্তীর গর্ভে যথাক্রমে ধর্ম, বায়ু এবং ইন্দ্রের অংশে জন্ম নেন যথাক্রমে যুধিষ্ঠির, ভীমসেন এবং অর্জুন। অপর দিকে, পাণ্ডুর দ্বিতীয় স্ত্রী মাদ্রীর গর্ভে জন্ম নেন অশ্বিনীকুমারদ্বয় নামে যুগ্ম বা যমজ দেবতার অংশে নকুল ও সহদেব নামে দুই পাণ্ডব ভাই। এই হল মহাকাব্য অনুযায়ী পঞ্চপাণ্ডবের জন্ম কাহিনী। এই পাঁচ ভাই আবার একত্রে বিয়ে করেন দ্রৌপদী নামে একজন নারীকে।
বস্তুত পঞ্চপাণ্ডবের জন্ম বৃত্তান্ত, তাঁদের বিবাহ এমন কি তাঁদের পিতা পাণ্ডু এবং দুই পিতৃব্য ধৃতরাষ্ট্র এবং বিদুরের জন্ম বৃত্তান্ত মূলত বিবাহ-পূর্ব সমাজের চিত্র অঙ্কন করে। এটা সহজে অনুমান করা চলে যে, মহাভারতের মূল চরিত্রগুলো যে কালের সেই কালে সমাজে পরবর্তী কালের এক স্বামী-ভিত্তিক বিবাহ প্রথা এবং নারীর সতীত্ব সম্পর্কিত মূল্যবোধ ছিল না অথবা কোন শক্ত ভিত্তির উপর দাঁড়ায় নি। অনুমান করা যায় যে, সমাজ কৃষি ও বাণিজ্যের বিকাশের মধ্য দিয়ে রাষ্ট্র গঠন ও নগর সৃষ্টির পথে অনেকটা অগ্রসর হলেও নগর সভ্যতা যেমন পূর্ণরূপ নেয় নি তেমন পুরুষ প্রধান পরিবার প্রথা, এক নারীর এক পতিত্ব ইত্যাদি দৃঢ়বদ্ধ হয় নি।
অবশ্য এই ধরনের পরিবার প্রথা এবং মূল্যবোধ নগর সভ্যতার পূর্বে কৃষির বিকাশের সঙ্গেও সম্পর্কিত। কারণ লাঙ্গল-ভিত্তিক কৃষির বিকাশ জমিতে যেমন কোন না কোন ধরনের ব্যক্তিগত মালিকানা অপরিহার্য করে তেমন লাঙ্গল-নির্ভর কৃষিতে পুরুষের প্রাধান্য প্রতিষ্ঠাও অনিবার্য হয়। এই অবস্থায় জমির মালিকানায়ও পুরুষ প্রাধান্য সৃষ্টি হয়। ফলে তা পুরুষ কর্তৃত্বাধীন পরিবার গঠনের দিকে সমাজকে নেয় যেখানে এক পুরুষের এক স্ত্রী বা বহু স্ত্রী যা-ই থাকুক না কেন একজন নারীর মাত্র একজন স্বামী থাকবে।
সম্ভবত মহাভারতের মূল চরিত্রগুলি বিশেষত পঞ্চপাণ্ডব যাঁদেরকে প্রতিনিধিত্ব করছেন তাঁরা কৃষি সমাজে কিছু পরবর্তী কালে প্রবেশ করায় আদিম সমাজের কিছু মৌল বৈশিষ্ট্য তাঁদের জীবনে ধারণ করেছেন। সম্ভবত তাঁরা তুলনায় অনেক পশ্চাৎপদ সমাজ থেকে এলেও বিশেষ কতকগুলি ঘটনার মধ্য দিয়ে নগর সভ্যতা শুরুর সময় গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করেন। তখনও পুরুষতন্ত্রের মূল্যবোধগুলি দৃঢ়বদ্ধ না হওয়ায় তাঁদের পক্ষে সেটা সম্ভব হয়েছে।
আর একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় আমাদের বিবেচনায় রাখা দরকার যে, যদি পঞ্চপাণ্ডব
পাতা: ২২৬
সিন্ধু সভ্যতার আদি হরপ্পান পর্যায়ের শেষ দিকের সঙ্গে সম্পর্কিত থাকেন তবে এই সভ্যতার অহিংস বা শান্তিপূর্ণ বিকাশ ধারার ফলে আদিম সমাজের অনেক বৈশিষ্ট্য ও প্রথার জের বহুকাল রইবে। প্রধানত যুদ্ধ-নির্ভর না হওয়ায় পুরুষতান্ত্রিক পরিবার প্রথা দৃঢ়বদ্ধ হতে অনেক সময় লাগবে। কারণ সমাজে নারীর তুলনায় পুরুষের প্রাধান্য প্রতিষ্ঠার অন্যতম প্রধান পথ হচ্ছে যুদ্ধ। সুতরাং সিন্ধু সভ্যতার সমাজে পুরুষের নিরংকুশ প্রাধান্য প্রতিষ্ঠার জন্য অপেক্ষা করতে হয়েছে পূর্ণ নগর সভ্যতার বিকাশ এবং বৃহৎ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা পর্যন্ত, যখন বৃহৎ ও জটিল সামাজিক জীবনের গতিশীলতার মুখে নারীর ক্ষুদ্র এলাকা-ভিত্তিক এবং গৃহ-কেন্দ্রিক শ্রম ও সামাজিক ভূমিকা তুচ্ছ হয়ে দেখা দিয়েছে।
যাইহোক, পঞ্চপাণ্ডবের কথিত পিতার এবং তাদের নিজেদের জন্ম কাহিনী এবং তাদের বিবাহ সংক্রান্ত কাহিনী থেকে সিদ্ধান্ত নেওয়া যায় যে, নগর সভ্যতার যুগে এমন ঘটনা ঘটলে তাদের সামাজিক গ্রহণযোগ্যতা থাকত না বলে তারা কোন মহাকাব্যের নায়ক হতে পারতেন না। সুতরাং এটা এমন এক কালের ঘটনা যখন রাষ্ট্র এবং সেই সঙ্গে নগর সভ্যতাও পরিপূর্ণ রূপ নিয়ে দাঁড়ায় নি। পুরুষের নেতৃত্বে রাষ্ট্র এবং সভ্যতা যখন সুসম্বদ্ধ রূপ নিয়ে দাঁড়িয়েছে তখন তা দাঁড়িয়েছে আংশিকভাবে হলেও এই রকম সামাজিক পটভূমির উপর শুধু নয় উপরন্তু যাদের নেতৃত্বে দাঁড়িয়েছে তারাও অনেকটাই প্রাক-বিবাহ সমাজের মধ্যে ছিল। ফলে পরবর্তী কালের সমাজ তাদের যুগান্তকারী কীর্তি স্মরণ করতে গিয়ে তাদেরকেও স্মরণ করতে বাধ্য হয়েছে। তাদের কাজের মধ্য দিয়ে নূতন এমন এক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে যখন বিবাহ-বহির্ভূত নারীর পুত্রদের পক্ষে আর সহজে সমাজে গ্রহণযোগ্যতা পাওয়া সম্ভব নয় বলে তাদের পক্ষে তেমন কোন ঘটনা ঘটানোও যেমন সহজ বা স্বাভাবিক নয় তেমন তারা আর কোন কাহিনীর বীর নায়ক হবার সুযোগও সহজে পাবে না। এটা যারা পাবে তারা হবে একান্তই ব্যতিক্রম। এবং সেসব ক্ষেত্রেও কাহিনী সৃষ্টি করতে হবে তাদের জন্মবৃত্তান্ত কিংবা ব্যক্তি জীবনকে সামাজিক বৈধতা বা গ্রহণযোগ্যতা দেবার জন্য। যেমন আমরা এটা ঘটতে দেখি যীশুর ক্ষেত্রে। কুমারী মাতার গর্ভজাত যীশুকে ঈশ্বরপুত্র বলা হয়েছে।
অবশ্য পঞ্চপাণ্ডবের ব্যাপারও তাই। এবং সিন্ধু সভ্যতার সঙ্গে পঞ্চপাণ্ডবের যোগসূত্র বের করার জন্য তাদের জন্মবৃত্তান্ত অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কারণ এ দিয়ে আমরা যেমন সভ্যতার পর্যায় বিচারে একটা মোটামুটি সময় ধরতে পারছি তেমন তাদের প্রকৃত জনক হিসাবে যে দেবতাদের নাম পাওয়া যাচ্ছে তা দিয়ে তাদের তথা মহাকাব্য মহাভারতের জন্মবীজ যে ঘটনার অভিঘাতে সৃষ্টি হয়েছে সেই ঘটনার স্থানটিকেও চিহ্নিত করতে পারছি।
আমরা প্রধান ও জ্যেষ্ঠ পাণ্ডব যুধিষ্ঠিরের জনক ধর্মের নাম ঋগ্বেদে না পেলেও বায়ু, ইন্দ্র এবং অশ্বিদ্বয় দেবতার নাম পেয়েছি। আমরা পূর্বের অধ্যায়ে বরুণকেন্দ্রিক ধর্মে বায়ুর উচ্চ মর্যাদা থাকার সম্ভাবনা উল্লেখ করেছি। ঋগ্বেদ এবং আবেস্তা এই দুইটিকে মেলালে তেমন মনে হয়। বায়ুর ঔরসে জন্ম মহাবীর ভীমসেন তথা ভীমের। সুতরাং সিন্ধু সভ্যতার একজন গুরুত্বপূর্ণ দেবতার নাম পাওয়া গেল। অর্জুন ইন্দ্রের ঔরসজাত। ইন্দ্র সম্পর্কে আমাদের ধারণা স্পষ্ট। অশ্বিনীকুমারদ্বয় যে অশ্বিদ্বয় দেবতার সামান্য রূপান্তর তা সহজবোধ্য। নকুল এবং সহদেব তাদের ঔরসজাত।
পাতা: ২২৭
এই জন্মবৃত্তান্তের অর্থ কিন্তু প্রকৃতপক্ষে এই হওয়া উচিত যে, পঞ্চপাণ্ডবের পাঁচজন দেবতা ছিল। নকুল ও সহদেবের দেবতা একত্র দুই যমজ বা যুগ্ম দেবতা। আর বাকী তিন ভাইয়ের প্রত্যেকের আলাদা দেবতা। বস্তুত পঞ্চপাণ্ডবকে যদি পাঁচ ভাই না ধরে পাঁচ উপজাতি ধরি তাহলে এই জন্মবৃত্তান্ত বাস্তব অর্থপূর্ণ হবে। আমাদের অনুমান পাঁচ উপজাতির এক কনফেডারেসির পাঁচ দেবতাকে জনক হিসাবে মহাকাব্যে উপস্থিত করা হয়েছে। পঞ্চপাণ্ডব পাঁচ উপজাতির পাঁচ নেতা।
তবে যুধিষ্ঠির যার ঔরসজাত বলা হয়েছে সেই ধর্ম নামে কোন দেবতা ঋগ্বেদে নেই। এই নামে পরবর্তী কালেও কোন গুরুত্বপূর্ণ দেবতা জন্ম নেয় নি। অথচ মহাভারতে সকল দেবতার ঊর্ধে ধর্মের স্থান। প্রথমত, সবচেয়ে মর্যাদাবান এবং প্রধান পাণ্ডবের তিনি জনয়িতা। দ্বিতীয়ত, তাঁকে শুধু সুরশ্রেষ্ঠ বা শ্রেষ্ঠ দেব বলা হয় নি তাঁর নামই হচ্ছে ধর্ম। সংস্কৃত ভাষায় ধর্মের অনেক কয়টি অর্থ আছে, যেমন, প্রতিষ্ঠিত অথবা দৃঢ়, আইন, কর্তব্য, ন্যায়, গুণ, রীতি, নৈতিকতা ইত্যাদি। বুঝতে অসুবিধা হয় না ধর্ম হচ্ছে বরুণ। অর্থাৎ বরুণ নামের তাৎপর্য গোপন করার জন্য মহাকাব্যে তার নাম দেওয়া হয়েছে ধর্ম। সম্ভবত এটা পরবর্তী কালের ব্রাহ্মণ্যবাদী রচয়িতা বা গ্রন্থ সংস্কারকরা ঘটিয়েছে। কারণ তাদের একটা লক্ষ্য ছিল বরুণের পূর্ব অবস্থানকে ধ্বংস করা।
সুতরাং এখন আমরা যে ঘটনার অভিঘাতে মহাভারতের মূল কাহিনীর বীজ সৃষ্টি হয়েছে সেই ঘটনার স্থান এবং কাল দুই-ই পাচ্ছি। স্থান হচ্ছে বৃহত্তর সিন্ধু-সরস্বতী উপত্যকা এবং কাল হচ্ছে আদি হরপ্পান পর্যায় থেকে পরিণত হরপ্পান পর্যায়ে সভ্যতার উত্তরণকালীন যে কোন একটি সময়। আমরা চতুর্থ অধ্যায়ে আদি হরপ্পান পর্যায় থেকে পরিণত হরপ্পান পর্যায়ে উত্তরণকালে আমরি, কোট দিজি ও গুমলার মত কয়েকটি বসতিতে অগ্নিকাণ্ড বা ধ্বংসের চিহ্ন থেকে যুদ্ধের সম্ভাবনার কথা বলেছিলাম। অষ্টম অধ্যায়েও এই সম্ভাবনার কথা উল্লেখ করেছিলাম। আমরা মহাভারত কাহিনী থেকে সেই সম্ভাবনাকে মূর্ত রূপে দেখতে পাই।
বস্তুত এটা আমাদের কাছে যৌক্তিকভাবে স্পষ্ট যে, মহাভারতের যুদ্ধ দুইটি উপজাতি জোটের মধ্যকার যুদ্ধের পরিবর্তিত পৌরাণিক এবং মহাকাব্যিক রূপ। তবে এই দুই জোট বা পক্ষের প্রধান চরিত্রদের যে নামগুলি দেওয়া হয়েছে সেগুলির সমস্ত না হলেও অধিকাংশ পরবর্তী কালে দেওয়া বলে বোঝা যায়। কারণ কয়েকটি প্রধান দেবতার নাম আমরা ঋগ্বেদে পেলেও পাণ্ডব (যুধিষ্ঠির, ভীম ইত্যাদি) এবং কৌরবদের (দুর্যোধন, দু:শাসন ইত্যাদি) নামগুলি আমরা পাই না। অনুমান করা যায় কালক্রমে তাদের নাম বদলে গেছে অথবা উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে বদলানো হয়েছে কিংবা নূতন বিভিন্ন নাম এবং চরিত্র সৃষ্টি করা হয়েছে।
এটা স্পষ্ট যে, মহাভারত যুদ্ধের ঘটনার সঙ্গে ঐক্যবদ্ধ এবং বৃহত্তর হরপ্পান রাষ্ট্র এবং
পাতা: ২২৮
বরুণকেন্দ্রিক ধর্ম প্রতিষ্ঠার একটি ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক আছে। সুতরাং পরবর্তী কালে এই ঘটনার মূল স্মৃতি যতটা সম্ভব মুছে ফেলা বা বিলুপ্ত করা বৈদিক কিংবা ব্রাহ্মণদের জন্য প্রয়োজন ছিল। তাছাড়া ধর্মগ্রন্থের অলংঘনীয়তা না থাকায় কালে কালে বিভিন্ন রচনাকারের হাতে পড়ে মহাভারতের বহু সংস্কার এবং পরিবর্তন হয়েছে। একটি ধর্মসংস্কারের ফলে ঋগ্বেদে বরুণের নাম ঠিক থাকলেও তার পূর্ব মর্যাদা হ্রাস করা হয়েছে আর আবেস্তায় তার নামটাকেই বদলে দেওয়া হয়েছে। মহাভারতের ক্ষেত্রে সেটা কি পরিমাণে ঘটতে পারে সহজে অনুমেয়। তবে মূল ঘটনার সবটা পাল্টানো বা মুছে ফেলা সম্ভব ছিল না তার আবেদন বিনষ্ট হত বলে। ফলে ঐ ধরনের কোন সংস্কার জনপ্রিয়তা বা জনগ্রাহ্যতার অভাবে দাঁড়াতে পারত না। তাতে সংস্কারকদের মূল উদ্দেশ্যই ব্যর্থ হত।
আমাদের অনুমান মহাভারতের আদি কাহিনী গাথা বা কাব্য আকারে পরিণত হরপ্পান পর্যায়ে জনপ্রিয় ছিল। হরপ্পান সভ্যতার অবসান হলে সেখানকার জনগোষ্ঠী এই কাহিনী নিয়ে বিভিন্ন অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ে। তবে ভারতবর্ষের ভিতরে এই কাহিনী টিকে থাকে বা রক্ষা পায়। বৈদিক শক্তি এই জনপ্রিয় কাহিনীটিকে তাদের সামাজিক-রাজনৈতিক প্রয়োজন থেকে ব্যবহার করে। এখানে এটাও স্পষ্ট যে, বৈদিক শক্তি সামরিকভাবে বৃহত্তর সিন্ধু-সরস্বতী উপত্যকায় সম্পূর্ণ বিজয় অর্জন করে নি। তার একটি প্রমাণ পরবর্তী কালে ভারতবর্ষের উত্তর ও পশ্চিমে বিভিন্ন অবৈদিক প্রজাতন্ত্রের অস্তিত্ব। প্রথমত বৈদিক পক্ষের যুদ্ধবিজয় মূলত বাঁধ ধ্বংসের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল। সেক্ষেত্রে তারা সফল। কিন্তু এর ফলে তাদের একটি বড় রকম নৈতিক পরাজয়ও ঘটেছিল যার প্রভাব তাদেরকে যথেষ্ট উদার এবং সহনশীল হতে বাধ্য করেছিল। বস্তুত বাঁধ ধ্বংসের ফলে সভ্যতার ধ্বংস এবং সমগ্র সপ্তসিন্ধুর ব্যাপক মরুকরণ বৈদিক ধর্মের মর্যাদায় একটা বড় রকম আঘাত হানে বলে আমরা অনুমান করি। ফলে বৈদিক পুরোহিত নেতৃত্ব এবং তাদের উত্তরাধিকারী ব্রাহ্মণরা যথেষ্ট রকম আপোসকামী হতে বাধ্য হয়। তাছাড়া বৈদিক আন্দোলনের কোন দৃঢ়বদ্ধ কেন্দ্র না থাকায় অর্থাৎ কোন একজন ব্যক্তির নেতৃত্বে আন্দোলন ও ধর্মসংস্কার না হওয়ায় তার মধ্যে বাধ্য করার ক্ষমতাও কম ছিল। এটা অনেকটা ঐক্যমতের উপর প্রতিষ্ঠিত ছিল। সম্ভবত বৈদিক পুরোহিত শ্রেণীর এই অন্তর্গত দুর্বলতা তাদেরকে পূর্ব দিকের পশ্চাৎপদ ও আদিম উপজাতিগুলির সঙ্গে আপোসের মাধ্যমে বর্ণজাতিভেদ-ভিত্তিক সমাজ গড়ে তোলার দিকে অগ্রসর হতে এবং সেই সঙ্গে তাদের ধর্মবিশ্বাস ও পূজা পদ্ধতির সঙ্গে আপোসের মাধ্যমে নিরাকার দেবতার পরিবর্তে সাকার দেবতার দিকে অগ্রসর হতে বাধ্য করে। আবেস্তায় শুধু দয়েবদের বিরুদ্ধে বলা হয় নি উপরন্তু বিভিন্ন সময় একই নি:শ্বাসে মূর্তি পূজা এবং মূর্তি পূজকদের বিরুদ্ধে যেভাবে ঘৃণা প্রকাশ এবং আক্রমণ করা হয়েছে তাতে সন্দেহ হয় যে, বৈদিকরা সেই সময়ই এই ধরনের কিছু আপোস করেছিল বিশেষত পূর্ব দিকের বিভিন্ন উপজাতিকে পক্ষে পাবার জন্য।
যাইহোক, এটা বোধগম্য যে, ভারতবর্ষের বিস্তীর্ণ অঞ্চলে ছড়িয়ে থাকা হরপ্পানদের মধ্যে যে প্রচুর সংখ্যক অবৈদিক কিংবা বৈদিক শক্তি-বিরোধী ছিল তাদেরকে বৈদিক এবং
পাতা: ২২৯
পরবর্তী ব্রাহ্মণ্য ধর্মের অন্তর্ভুক্ত করার জন্য পুরাতন বিভিন্ন সাহিত্যে হাত দেওয়া হয়েছে। কিছু ধ্বংস করা হয়েছে অথবা পৃষ্ঠপোষকতা ও রক্ষার অভাবে হারিয়ে গেছে বা নষ্ট হয়েছে। যেগুলির খুব বেশী জনপ্রিয়তা ও প্রভাব থেকেছে সেগুলিকে সংস্কার বা পরিবর্তন করে ব্রাহ্মণ্য ব্যবস্থার উপযোগী করা হয়েছে। এটাকে আমরা বলতে পারি মানসিক সম্পদ দখল ও ভোগ করা।
মহাভারতের প্রশ্নে আর একটি বিষয় আমরা ধারণা করতে পারি। তাহল মহাভারত হিসাবে যে মহাকায় গ্রন্থটি আমরা দেখি তা যে শুধু একটি সময়ের রচনা নয় তাই নয়, অধিকন্তু বহু কালের অসংখ্য পরিবর্তন ও পরিবর্ধনের পর এটির বিভিন্ন ভাষ্য বা সংস্করণকে কোন শক্তিশালী রাষ্ট্রশক্তির প্রত্যক্ষ সহায়তায় এবং অর্থানুকূল্যে ব্রাহ্মণ পণ্ডিতরা পুনর্লিখন ও সংকলন করে একটা মোটামুটি চূড়ান্ত এবং সর্বজনীন রূপ দিয়েছেন। স্বাভাবিকভাবে শক্তিশালী রাষ্ট্র বা রাজশক্তির সমর্থনে একটি মাত্র গ্রন্থ নির্দিষ্ট হবার পর বাকীগুলো পৃষ্ঠপোষকতার অভাবে বিনষ্ট হয়েছে অথবা চূড়ান্তভাবে রচিত গ্রন্থের ভিতর কালক্রমে প্রবিষ্ট হয়ে এর আয়তন আরও বৃদ্ধি করেছে। এর পরেও হয়ত আরও কিছু করে সংযোজন হয়েছে। এবং সবশেষে বর্তমান রূপ নিয়ে আমাদের কাছে পৌঁছেছে।
যদি মহাভারতের আদি বা প্রাথমিক কাহিনী হরপ্পান রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার সঙ্গে সম্পর্কিত হয় তবে অন্ততপক্ষে ২৬০০ খ্রীষ্টপূর্বাব্দের দিকে তা প্রথম রচিত হওয়া উচিত। স্বাভাবিকভাবে সাড়ে চার হাজার বছরেরও বেশী সময়ে একটি জনপ্রিয় মহাকাব্য তার আদি রূপ নিয়ে বর্তমান থাকবে না। হয়ত আদিতে তার নামও ছিল ভিন্ন।
এখন আমরা অনুমান করি সপ্তসিন্ধুতে আদি হরপ্পান পর্যায়ের শেষ দিকে সমগ্র অঞ্চলকে নদীনিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থার অন্তর্ভুক্ত করার প্রয়োজনে এক অখণ্ড বা ঐক্যবদ্ধ রাষ্ট্রভুক্ত করার প্রশ্নে বিভিন্ন উপজাতি এবং তাদের কনফেডারেসিগুলির মধ্যে মতপার্থক্য ঘটে। শেষ পর্যন্ত এই প্রশ্নে সমগ্র অঞ্চলের জনগোষ্ঠী দুই ভাগে ভাগ হয়ে যায় এবং যুদ্ধের মাধ্যমে এর চূড়ান্ত নিষ্পত্তি ঘটে। এই যুদ্ধে বৃহত্তর এবং তুলনামূলকভাবে কেন্দ্রীভূত রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার শক্তি বিজয়ী হয় এবং বিরোধী শক্তি পরাজিত হয়। এর ফলে আদি হরপ্পান পর্যায় শেষ হয়ে পরিণত হরপ্পান পর্যায় শুরু হয় এবং বিস্ফোরণের শক্তি নিয়ে নগর সভ্যতা অত্যন্ত দ্রুতগতিতে বিশাল অঞ্চলে প্রায় অভিন্ন রূপ নিয়ে বিস্তার লাভ করে।
এটা সহজেই অনুমেয় যে, মহাকাব্যে এই যুদ্ধকে যত বিশালত্ব ও প্রচণ্ডতাই দেওয়া হোক না কেন মিসর, মেসোপটেমিয়া বা পরবর্তী কালের অন্যান্য সভ্যতার বৃহৎ যুদ্ধগুলির আয়তন, রক্তপাত, ধ্বংস ও নিষ্ঠুরতার তুলনায় তা মোটেই উল্লেখ্য নয়। কিন্তু আমাদেরকে যুদ্ধটিকে দেখতে হবে একটি মূলত অহিংস ও যুদ্ধ বিমুখ সমাজের পটভূমিতে এবং তার যুগান্তকারী ফলাফল দিয়ে।
এই যুদ্ধ সমগ্র জনমানসে এক প্রচণ্ড অভিঘাত হেনেছিল এবং এই যুদ্ধের পরিণতিতে বৃহত্তর হরপ্পান রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার ফলে সভ্যতা দ্রুত গতিতে ব্যাপ্ত হওয়ায় যুদ্ধজয়ী শক্তি বিরাট সামাজিক মর্যাদা ও প্রতিষ্ঠা পায়। কিন্তু হরপ্পান জনগণ যুদ্ধকে নৈতিকভাবে গ্রহণ না করলে
পাতা: ২৩০
যেমন এই নূতন শাসক শক্তি সামাজিক বৈধতা পেত না তেমন যুদ্ধকে যদি সমাজে আদর্শায়িত করা হত তবে অহিংসা-নির্ভর নদীনিয়ন্ত্রণমূলক সমাজ গঠনের ভিত্তি ভেঙ্গে পড়ায় ঐ পথে সভ্যতারও অগ্রগমন সম্ভব হত না। সুতরাং শুধুমাত্র ঐ একটি যুদ্ধকে বিশেষ যুক্তিতে আদর্শায়িত করতে হয়েছে, কিন্তু একই সঙ্গে যুদ্ধের বিরুদ্ধে আদর্শ প্রতিষ্ঠা করতে হয়েছে এবং এই প্রয়োজন থেকে যুদ্ধের ফলাফলের বিয়োগান্তক বা ট্রাজিক দিককেও সুস্পষ্ট করতে হয়েছে। অর্থাৎ যেন ঐ যুদ্ধই শেষ যুদ্ধ। সুতরাং এই প্রয়োজনেও রাষ্ট্র থেকে গাথা, নাটক ইত্যাদি রচনাকে উৎসাহ দিতে হয়েছে। অন্য দিকে এই সব প্রয়াসের সহযোগী হিসাবে একটি নূতন ধর্ম প্রতিষ্ঠা কিংবা তার প্রসারকে পৃষ্ঠপোষকতা ও সহায়তা দিতে
হয়েছে।
সুতরাং আমরা মহাকাব্যে কৃষ্ণের ভূমিকার যৌক্তিকতা খুঁজে পাই। পঞ্চপাণ্ডবের একজন অর্জুন যখন জ্ঞাতিধ্বংসী যুদ্ধের প্রতি অনীহা প্রদর্শন করেন তখন ধর্মগুরু বা অবতার কৃষ্ণ তাঁকে যুদ্ধের পক্ষে নৈতিক যুক্তি প্রদর্শন করেন। মহাভারতে কৃষ্ণের উপদেশগুলি নিয়ে গীতা গঠিত। তা নিজেও একটি ধর্মগ্রন্থ।
রহস্যপুরুষ কৃষ্ণকে এতকাল কোন ঐতিহাসিক কালে ফেলা যায় নি। কারণ তিনি ঐতিহাসিক কালের কোন পুরুষ নন। বস্তুত সিন্ধু সভ্যতার বৃহত্তর ও সংহত রাষ্ট্র গঠনের সময়ের সঙ্গে তাঁর একেশ্বরবাদী ধর্মতত্ত্বকে মেলানো সম্ভব। সুতরাং আমরা তাঁকে বরুণকেন্দ্রিক ধর্ম প্রতিষ্ঠার নায়কের প্রতিফলন মনে করতে পারি। এবং এ ক্ষেত্রেও আমাদের সমস্যা হয় ঋগ্বেদে কৃষ্ণ নামে কোন ধর্মনেতা কিংবা দেবতার নাম না পাওয়ায়। স্বাভাবিকভাবে কৃষ্ণ নাম বা চরিত্রের আড়ালে যদি বরুণকেন্দ্রিক ধর্মের মূল প্রতিষ্ঠাতা লুকিয়ে থাকেন তবে ঋগ্বেদ থেকেই তাঁকে খুঁজে বের করা যাবে। কারণ ঋগ্বেদ তাঁর প্রতিষ্ঠিত ধর্মের ঐতিহ্য থেকে আসায় সেখানে তাঁর সূত্র থাকবে। সুতরাং কৃষ্ণ চরিত্রের উৎস খুঁজতে গিয়ে আমাদেরকে দৃষ্টি দিতে হয় দেবতা বরুণের সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ যে দেবতা সেই মিত্রের দিকে। আর তখন আমরা আমাদের উত্তর পাই। তিনি হলেন বরুণকেন্দ্রিক ধর্মের প্রতিষ্ঠাতা। এই কারণে আবেস্তাও মিত্র বা মিথ্রকে উচ্চ মর্যাদা দিয়েছে। আবেস্তার মিহির ইয়াস্ত্-এ বলা হচ্ছে : ‘মিথ্র এবং অহুর এই দুই মহান, অক্ষয়, পবিত্র দেবতার উদ্দেশ্যে আমরা আহুতি দিই।’ এবং জম্ইয়াদ্ ইয়াস্ত্-এ বলা হচ্ছে : ‘সকল দেশের প্রভু মিথ্র, যাঁকে অহুর ময্দা স্বর্গের সকল দেবতার চেয়েও সবচেয়ে বেশী গৌরবান্বিত করে সৃষ্টি করেছেন, আমরা সেই মিথ্রের উদ্দেশ্যে আহুতি দিই।’ স্বাভাবিকভাবে আমরা এখন ধারণা করতে পারি, যে কারণে বরুণের নাম মহাভারতে পরিবর্তন করে ধর্ম করা হয়েছে সেই একই কারণে মিত্রের নাম পরিবর্তন করে কৃষ্ণ করা হয়েছে। হয়ত মিত্রের গাত্রবর্ণ থেকে এই নামকরণ সহজ হয়েছে। হয়ত হরপ্পান পর্যায়েও তাঁর দ্বিতীয় নাম ছিল কৃষ্ণ যা আমজনতার কাছে পরিচিত ছিল।
যাইহোক, প্রফেট বা ধর্ম প্রতিষ্ঠাতা কিভাবে দেবতায় পরিণত হতে পারে সেটা আমরা আলোচনা করতে পারি।
পাতা: ২৩১
আমরা ইতিপূর্বে উল্লেখ করেছি যে, ঋগ্বেদে বরুণ ও মিত্রকে বহু সময় একত্রে উল্লেখ করা হয়েছে। মিত্র ও বরুণকে একত্রে স্তুতি করতে গিয়ে মিত্রাবরুণ বলা হয়েছে। মিত্র ও বরুণের উদ্দেশ্যে রচিত কিছু ঋক মিত্রের গুরুত্ব এবং বরুণের সঙ্গে তাঁর সংযুক্তি বা ঘনিষ্ঠতা স্পষ্ট করে। যেমন :
‘হে ঋত্বিকগণ ! চিরন্তন মিত্রাবরুণের উদ্দেশ্যে প্রশংসনীয় ও প্রবৃদ্ধ পরিচর্যা কর এবং হব্য প্রদানে কৃতনিশ্চয় হও। মিত্রাবরুণ যজমানদের সুখদানের কারণ এবং সুস্বাদু হব্য ভক্ষণ করেন। এঁরা সম্রাট, এঁদের জন্য ঘৃত গৃহীত হয়। প্রতি যজ্ঞেই এঁদের স্তব হয়। এঁদের শক্তি কেউ অতিক্রম করতে পারে না এবং এঁদের দেবত্বে কেউ সন্দেহ করে না’ (১/১৩৬/১),
‘হে স্থূল মিত্র ও বরুণ ! তোমরা (তেজরূপ) বস্ত্র ধারণ কর, তোমাদের সৃষ্টি সুন্দর ও দোষ রহিত। তোমরা সমস্ত অনৃত১ বিনাশ কর এবং ঋতের সাথে যুক্ত হও’ (১/১৫২/১), ‘....... তোমাদের সন্তান আদিত্য ঋতের পূরণ ও অনৃতের বিনাশ করে সমস্ত জগতের ভার বহন করেন’ (১/১৫২/৩)।
‘হে মিত্র ও বরুণ ! স্তোতৃগণ তোমাদের অনুগ্রহে রাজপদ লাভ করে’ (৫/৬২/৩)।
রাষ্ট্রক্ষমতার সঙ্গে মিত্র ও বরুণের গভীর সম্পর্ক প্রকাশ করছে উপরোক্ত ঋকটি।
‘হে মিত্র ও বরুণ ! তোমরা যজ্ঞভূমিতে যে যজমানকে রক্ষা কর, শোভন স্তুতিকারী সে যজমানের প্রতি দানশীল হও ও তাকে রক্ষা কর। কারণ তোমরা উভয়ে রাজা ও ক্রোধহীন হয়ে ধন ও সহস্র স্তম্ভ সমন্বিত সৌধ ধারণ কর’ (৫/৬২/৬)।
উপরোক্ত ঋকে উভয় দেবতাকে রাজা বলা হচ্ছে এবং এখানে আমরা সহস্র স্তম্ভ সমন্বিত সৌধের বিবরণ পাচ্ছি।
‘মিত্র পাপিষ্ঠ স্তবকারীকেও বিশাল গৃহে গমনের উপায় প্রদান করেন, হিংসাকারী সেবকও দেব মিত্রের অনুগ্রহ লাভ করে (৫/৬৫/৪), আমরা যেন সর্বদা মিত্রের প্রশস্ত রক্ষার ভাজন হই, হে মিত্র ! আমরা তোমা কর্তৃক রক্ষিত ও নিষ্পাপ হয়ে যেন যুগপৎ বরুণের পুত্র স্বরূপ হই (৫/৬৫/৫), হে মিত্র ও বরুণ ! ..... আমাদের পরিত্যাগ করো না’ (৫/৬৫/৬)।
বরুণ কিংবা মিত্র প্রসঙ্গে আমরা কয়েকবার সহস্র স্তম্ভবিশিষ্ট কিংবা সহস্রদ্বারবিশিষ্ট গৃহ, স্থান বা সৌধের উল্লেখ পাই। উপরের ঋকে পাচ্ছি বিশাল গৃহের উল্লেখ। এই ঋকে মিত্রের অনুগ্রহের মাধ্যমে বরুণের অনুগ্রহ লাভের প্রার্থনা লক্ষণীয়।
‘যে মিত্র বরুণ উভয়েই সকলের অধীশ্বর, বারিবর্ষণকারী, দীপ্তিমান ও দেবগণের মধ্যে সমধিক স্তবার্হ’ (৫/৬৮/২)।
‘হে স্বর্গীয় আদিত্যদ্বয় ! তোমরা স্বর্গলোক ও ভূলোকের ধারণকারী, আমি তোমাদের উভয়কে পূজা করছি। হে মিত্র ও বরুণ ! অমর দেবগণও তোমাদের স্থায়ীকার্যের উচ্ছেদ সাধন করতে পারেন না’ (৫/৬৯/৪)।
_________________________________________________________________________________
১ অসত্য বা মিথ্যা।
_________________________________________________________________________________
পাতা: ২৩২
‘মিত্র ও দাতা বরুণকে হোমের দ্রব্য নিবেদন কর। তাঁরা দুজন রাজার রাজা, তাঁরা কখন অমনোযোগী হন না, তাঁদের ধাম উত্তমরূপে সংধারিত হয়ে অত্যন্ত দীপ্তি পাচ্ছে। দ্যাবাপৃথিবী তাঁদের নিকট যাচকের ভাবে অবস্থিত আছেন’ (১০/৬৫/৫)।
উপরের মন্ত্রগুলি দ্বারা হরপ্পান সভ্যতায় বরুণ ও মিত্র এই উভয় দেবতার সর্বোচ্চ অবস্থান সম্পর্কে সন্দেহ থাকে না। এখন স্বাভাবিকভাবে মনে প্রশ্ন আসে যে, বরুণ ও মিত্র এই উভয়কে একসঙ্গে এমনভাবে উপস্থিত করা হচ্ছে যেন তারা দুইজন এক দেবতার দুই নাম কিংবা দুই ভিন্ন দেবতা যাদের মধ্যে বরুণ প্রধান হলেও অপরজন মিত্র অত্যন্ত শক্তিশালী এবং বরুণের অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ এবং এই উভয় দেবতা অবিচ্ছেদ্য। সুতরাং এখানে আমরা কিভাবে প্রফেট মিত্র কিংবা কৃষ্ণকে খুঁজে পাব?
এই প্রশ্নের উত্তরের জন্য আমরা অন্যান্য ধর্মের দিকে দৃষ্টি দিতে পারি। ইহুদী ধর্মের ঈশ্বর ইয়াহ্ওয়েহ্-এর (ইংরাজীতে যিহোবা) প্রত্যক্ষ সম্পর্ক শুধু মুসা বা মোশির সঙ্গে। ঈশ্বর তাঁর সঙ্গে সরাসরি কথা বলে তাঁর বিধান দিয়েছেন। সুতরাং ইয়াহ্ওয়েহ্-এর প্রতি আনুগত্যের অর্থ হল মোশির প্রতিও আনুগত্য।
খ্রীষ্ট ধর্মে আমরা ঈশ্বর ও প্রফেটের সম্পর্ক আরও ঘনিষ্ঠ দেখতে পাই। বস্তুত ঈশ্বরের প্রতি আনুগত্যের মাধ্যম হলেন যীশু। বাইবেল থেকে কিছু উদ্ধৃতি দিলে ঈশ্বর ও যীশুর সম্পর্কের ঘনিষ্ঠতা এবং যীশুর গুরুত্ব স্পষ্ট হবে।
‘খ্রীষ্ট যীশুতে যে ভাব ছিল, তাহা তোমাদিগেতেও হউক। ঈশ্বরের স্বরূপবিশিষ্ট থাকিতে তিনি ঈশ্বরের সহিত সমান থাকা ধরিয়া লইবার বিষয় জ্ঞান করিলেন না, কিন্তু আপনাকে শূন্য করিলেন, দাসের রূপ ধারণ করিলেন, মনুষ্যদের সাদৃশ্যে জন্মিলেন ; এবং আকার প্রকারে মনুষ্যবৎ প্রত্যক্ষ হইয়া আপনাকে অবনত করিলেন ; মৃত্যু পর্যন্ত, এমন কি, ক্রুশীয় মৃত্যু পর্যন্ত আজ্ঞাবহ হইলেন। এই কারণে ঈশ্বর তাঁহাকে অতিশয় উচ্চপদান্বিতও করিলেন, এবং তাঁহাকে সেই নাম দান করিলেন, যাহা সমুদয় নাম অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ ; যেন যীশুর নামে স্বর্গ মর্ত্য পাতালনিবাসীদের “সমুদয় জানু পাতিত হয়, এবং সমুদয় জিহ্বা যেন স্বীকার করে” যে, যীশু খ্রীষ্টই প্রভু, এইরূপে পিতা ঈশ্বর যেন মহিমান্বিত হন।’ (ফিলিপীয়দের প্রতি প্রেরিত পৌলের পত্র। ২ : ৫-১১)
‘আর আমরা দেখিয়াছি ও সাক্ষ্য দিতেছি যে, পিতা পুত্রকে জগতের ত্রাণকর্তা করিয়া প্রেরণ করিয়াছেন। যে কেহ স্বীকার করিবে যে, যীশু ঈশ্বরের পুত্র, ঈশ্বর তাহাতে থাকেন, এবং সে ঈশ্বরে থাকে। আর ঈশ্বরের যে প্রেম আমাদিগেতে আছে, তাহা আমরা জানি, ও বিশ্বাস করিয়াছি। ঈশ্বর প্রেম ; আর প্রেমে যে থাকে, সে ঈশ্বরে থাকে, এবং ঈশ্বর তাহাতে থাকেন।’ (যোহনের প্রথম পত্র। ৪ ; ১৪-১৬)
‘তখন যীশু নিকটে আসিয়া তাঁহাদের সহিত কথা কহিলেন, বলিলেন, স্বর্গে ও পৃথিবীতে সমস্ত কর্তৃত্ব আমাকে দত্ত হইয়াছে।’ (মথি। ২৮;১৮)
পাতা: ২৩৩
ইসলামে আল্লাহকে সমস্ত ক্ষমতার অধিকারী বলা হলেও শুধু বিমূর্ত আল্লাহ্র প্রতি আনুগত্য প্রদান করতে নির্দেশ দেওয়া হয় নি, একই সঙ্গে তাঁর রাসূল বা প্রতিনিধি স্বরূপ মোহাম্মদের প্রতিও আনুগত্য প্রদান করতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে :
‘মুমিনদিগের১ উক্তি তো এই যখন তাহাদিগের মধ্যে ফয়সালা করিয়া দিবার জন্য আল্লাহ্ এবং তাঁহার রাসূলের দিকে আহ্বান করা হয় তখন তাহারা বলে, “ আমরা শ্রবণ করিলাম ও মান্য করিলাম।” আর উহারাই তো সফলকাম। যাহারা আল্লাহ্ ও তাঁহার রাসূলের আনুগত্য করে, আল্লাহকে ভয় করে ও তাঁহার অবাধ্যতা হইতে সাবধান থাকে তাহারাই সফলকাম।’ (২৪-সূরা নূর : ৫১,৫২ আয়াত)
‘উহারা কি জানে না যে, যে ব্যক্তি আল্লাহ্ ও তাঁহার রাসূলের বিরোধিতা করে তাহার জন্য আছে জাহান্নামের২ অগ্নি, যেথায় সে স্থায়ী হইবে ?’ (৯- সূরা তাওবা : ৬৩ আয়াত)
বুদ্ধ ঈশ্বরবাদী ছিলেন না। তিনি মানুষকে দিয়েছেন জন্মান্তরের জীবন চক্র থেকে মুক্তির পথ নির্বাণের পথ। কিন্তু এই নির্বাণ লাভের পথ হল তাঁর ধর্মমত গ্রহণ করা। এবং পরবর্তীতে তাঁর অনুসারীগণ মানুষ বুদ্ধকে ঈশ্বরের স্থানে আরোপ করেছেন।
বস্তুত সব ধর্মই কম বা বেশী দ্বৈত পূজারী হয়। দৈব এবং মানবিক, অমূর্ত এবং মূর্ত এই উভয় রূপ নিয়ে এক ঈশ্বর তাঁর ভক্তের কাছে ধরা দেন। এভাবেও বলা যায় যে, ভক্তের দুই ঈশ্বর এক ঈশ্বর অজানা, অদেখা, অমূর্ত কল্পনার ঈশ্বর, অপর এক ঈশ্বর জানা, দেখা, মূর্ত প্রফেট। ভক্ত অনেক সময় এই দুইজনকে পৃথক করতে পারে না এবং পৃথক করলেও প্রফেটের মধ্যে ঈশ্বরকে মূর্ত দেখতে পায়। এই দিক থেকে অবতার শব্দটি অধিকতর সঠিক অর্থ বহন করে। ঈশ্বর যে রূপ নিয়ে মানুষের নিকট অবতরণ করেন সেই রূপ হলেন অবতার। তাই সব প্রফেটই অবতার যাঁকে বাদ দিলে ঈশ্বরের কোন নির্দিষ্ট বা সামাজিক রূপ থাকে না।
বিশেষত গীতায় কৃষ্ণের অবতার রূপ খুব স্পষ্ট। তিনি নিজেই নিজেকে ঈশ্বর অর্থাৎ ঈশ্বরের মানবিক প্রকাশ বলছেন এবং তাঁর প্রতি মানুষের আনুগত্য দাবী করছেন। গীতার এই বক্তব্যগুলি থেকে কৃষ্ণের তত্ত্ব কিছুটা বোঝা যায় :
‘কৃষ্ণ কহিলেন, “হে অর্জুন ! আমি অনেকবার জন্মগ্রহণ করিয়াছি; তোমারও বহু জন্ম অতীত হইয়াছে; তুমি তাহার কিছুই জান না; কিন্তু আমি তৎসমুদয়ই অবগত আছি। আমি জন্মরহিত, অনশ্বর স্বভাব ও সকলের ঈশ্বর হইয়াও স্বীয় প্রকৃতিকে আশ্রয় করিয়া আত্মমায়ায় (আত্মশক্তিতে) জন্মগ্রহণ করি। যে যে সময়ে ধর্মের বিপ্লব ও অধর্মের প্রাদুর্ভাব হয়, সেই সেই সময়ে আমি আত্মাকে সৃষ্টি করিয়া থাকি। সাধুগণের পরিত্রাণ, অসাধুগণের বিনাশ ও ধর্মের সংস্খাপনের নিমিত্ত যুগে যুগে জন্মগ্রহণ করি।’
_________________________________________________________________________________
১ মুমিন শব্দের অর্থ বিশ্বাসী।
২ জাহান্নাম শব্দের অর্থ নরক।
_________________________________________________________________________________
পাতা: ২৩৪
(মহাভারত। ভীষ্মপর্ব। অষ্টবিংশতিতম অধ্যায়। চতুর্থ অধ্যায়-জ্ঞানযোগ)১
‘..... আমি কর্মফল, ভর্তা, প্রভু, সাক্ষী, নিবাস, শরণ, সুহৃদ, প্রভব, প্রলয়, আধার, লয়স্থান, ও অব্যয় বীজ; হে অর্জুন ! আমি তাপ প্রদান এবং বৃষ্টি রোধ ও বৃষ্টি প্রদান করি। আমিই অমৃত, মৃত্যু, সৎ ও অসৎ।’ (মহাভারত। ভীষ্মপর্ব। ত্রয়স্ত্রিশত্তম অধ্যায়। নবম অধ্যায় - রাজবিদ্যা - রাজগুহ্যযোগ)
‘যে ব্যক্তি আমাকে অন্ত:করণ সমর্পণ করিয়া শ্রদ্ধাপূর্বক আমাকে ভজনা করেন, তিনি আমার মতে সকল যোগী অপেক্ষা শ্রেষ্ঠতম।’
(মহাভারত। ভীষ্মপর্ব। ত্রিংশত্তম অধ্যায়। ষষ্ঠ অধ্যায় - ধ্যানযোগ)
‘হে অর্জুন ! যে ব্যক্তি আমার কর্মানুষ্ঠান করে, যে আমার ভক্ত ও একান্ত অনুরক্ত, যে পুত্রকলত্র প্রভৃতি পরিবারের প্রতি আসক্তিরহিত, যাহার কাহারও সহিত বিরোধ নাই এবং আমিই যাহার পরম পুরুষার্থ, সেই ব্যক্তিই আমাকে প্রাপ্ত হইয়া থাকে।’
(মহাভারত। ভীষ্মপর্ব। পঞ্চত্রিংশত্তম অধ্যায়। একাদশ অধ্যায় - বিশ্বরূপ দর্শন)
এটা ঠিক যে, আমরা গীতার যে রূপ দেখছি সেটা অপরিবর্তিত আছে এমন মনে করার কারণ নেই। বৈদিক শক্তি তার বিজয়ের পর পুরাতন ধর্মের অবসান ঘটাবার জন্য যে সর্বাত্মক প্রয়াস নেয় তার ফলে গীতা এবং মহাভারতের আদি কাহিনীকে যে অনেক পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে আসতে হয়েছে তা আমরা মহাভারতে বরুণের পরিণতি থেকেও সহজেই অনুমান করতে পারি। যে দেবতাকে ঋগ্বেদেও বলা হয়েছে ‘সমস্ত বিশ্বের অধিপতি’ (৪/৪২/১), ‘সমস্ত ভুবনের সম্রাট’ (৮/৪২/১), ‘সপ্তসিন্ধুর ঈশ্বর’ (৮/৪১/৯) তাকে কিভাবে নীচে নামানো হয়েছে তার এক প্রমাণ মহাভারত।
মহাভারতের অনুশাসন পর্বে (চতু:পঞ্চাশদধিকশততম অধ্যায়) বরুণ সম্পর্কে একটি কাহিনী বলা হয়েছে। এই কাহিনী অনুযায়ী জলাধিপতি (জলদেবতা) বরুণ অঙ্গিরার পুত্র মহর্ষি উতথ্যের ভার্যা (ভগবান চন্দ্রের কন্যা) -কে হরণ করেন। দেবতা বরুণ উতথ্যের ভার্যাকে প্রদান করতে অস্বীকার করলে মহর্ষি উতথ্য বরুণের ছয় লক্ষ হ্রদযুক্ত এবং বিবিধ প্রাসাদে সমাকীর্ণ পুরের সলিল সমুদয় স্তম্ভনপূর্বক পান করে তাকে জলশূন্য ঊষর ভূমিতে পরিণত করেন। ফলে বরুণ বাধ্য হয়ে ঋষিকে ভার্যা প্রত্যর্পণ করেন।
ছয় লক্ষ হ্রদ এবং বিবিধ প্রাসাদ সমাকীর্ণ পুর যে হরপ্পান সভ্যতার স্মৃতির প্রতিফলন মাত্র তা বুঝতে অসুবিধা হয় না।
যাইহোক, আমরা এই সিদ্ধান্তে পৌঁছতে পারি যে, ঋগ্বেদের মিত্র এবং মহাভারতের কৃষ্ণ মূলত একই চরিত্র এবং মিত্র সিন্ধু-হরপ্পান সভ্যতায় বরুণকেন্দ্রিক ধর্ম প্রবর্তন করেছিলেন। ঋগ্বেদে এই কারণে অনেক সময়ই তাঁকে বরুণ থেকে পৃথক করা যায় না এবং তাঁকে দেবতা হিসাবে স্তুতি করা হয়েছে।
_________________________________________________________________________________
১ এই গ্রন্থে মহাভারতের সকল উদ্ধৃতির উৎস : বেদব্যাস বিরচিত কালীপ্রসন্ন সিংহ অনূদিত ‘মহাভারত’। প্রকাশক তুলি-কলম, ১, কলেজ রো, কলকাতা-৯, জুন ১৯৮৭।
_________________________________________________________________________________
পাতা: ২৩৫
তাছাড়া ঋগ্বেদ থেকে আমরা যেটুকু বুঝি তাহল অসুর বা দেবতা শব্দ দ্বারা সর্বদা অলৌকিক শক্তিও বোঝায় না। যে কোন শক্তিমান ব্যক্তি বোঝাতে অসুর শব্দের ব্যবহার লক্ষণীয়। আমরা দাস ও পণিদের সম্পর্কেও কয়েকবার অসুর শব্দ ব্যবহার করতে দেখেছি : ‘তাঁর (ইন্দ্রের) সহায়তায় আমাদের পূর্বপুরুষ অঙ্গিরাগণ, পদচিহ্ন দেখে পূজা করত: পণি অসুর দ্বারা অপহৃত গাভী উদ্ধার করেছিলেন’ (১/৬২/২); ‘হে ইন্দ্র ও বিষ্ণু ! ....... তোমরা বর্চ্চি নামক অসুরের শত ও সহস্র সংখ্যক বীরকে যাতে তারা আর প্রতিদ্বন্দ্বী হতে না পারে, এরূপ করে নাশ করেছ’ (৭/৯৯/৫); ইত্যাদি। তাছাড়া সাধারণ শত্রু-সৈনিকদেরকেও অসুর বলা হয়েছে : ‘হে অধ্বর্যুগণ ! শত্রু হননকারী যে ইন্দ্র ভূমির ক্রোড়ে শত সহস্র অসুরকে পাতিত করেছিলেন এবং যে ইন্দ্র কুৎস, আয়ু ও অতিথিগ্বের১ প্রতিদ্বন্দ্বীদের বধ করেছিলেন, সে ইন্দ্রের জন্য সোম আহরণ কর’ (২/১৪/৭) ; ইত্যাদি।
সুতরাং অসুর অর্থ শক্তিমান। তাই ইন্দ্রকে বলা হচ্ছে, ‘হে অসুর ! তুমি আমাদের রক্ষা কর’ (১/১৭৪/১)। আবার এই ইন্দ্রকেই বলা হচ্ছে, ‘তুমি অসুর নিহন্তা’ (৬/২২/৪)।
আমরা ইতিপূর্বে বলেছি যে, দেব শব্দ পরবর্তীকালে ব্যবহৃত হলেও দেবতা বোঝাতে পূর্ব কালে মূলত অসুর শব্দ ব্যবহার করা হত। অর্থাৎ মূল হরপ্পান ধর্মে অসুর শব্দই সর্বাধিক ব্যবহৃত ও মর্যাদাজনক শব্দ ছিল। যে কারণে পুরাতন ধর্মের সম্মানিত বরুণ ও মিত্রের প্রতি অসুর শব্দের প্রয়োগ ঋগ্বেদে বেশী দেখা যায়। ঋগ্বেদে মিত্র ও বরুণ সম্পর্কে বলা হচ্ছে, ‘তাঁরা দেবগণের মধ্যে অসুর’ (৭/৬৫/২)।
কিন্তু পরবর্তী কালে বৈদিক শক্তি মূল হরপ্পান ধর্ম থেকে নিজেদের পৃথক করলে নিজেদের ধর্মের স্বাতন্ত্র্য প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যে অসুর শব্দের পরিবর্তে দেব শব্দ গ্রহণ করে।
যাইহোক, বেদপূর্ব কিংবা বৈদিক ধর্মে দেবতা ও মানুষ উভয়কে শক্তির বিভিন্ন প্রকাশ হিসাবে চিন্তা করার প্রবণতা থেকে মিত্রকে দেবতায় রূপায়িত করা হতে পারে এবং বিশেষত বরুণের প্রতিনিধি বা অবতার হিসাবে ভক্তদের কাছে চিহ্নিত হওয়ায় তাঁর নাম বরুণের সঙ্গে দেবতা রূপে সংযুক্ত হয়েছে বলে আমরা ধারণা করতে পারি।
এখন আমরা এই প্রশ্ন করতে পারি মিত্র কিভাবে কৃষ্ণে রূপান্তরিত হতে পারে? কারণ যোগসূত্র ছাড়া কিংবা ভিত্তিহীনভাবে এত গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তির নাম পরিবর্তন হবার কথা নয়। এই পরিবর্তনের একটা সূত্র কোথায়ও থাকা উচিত। যেমন আমরা দেখেছি যে, বরুণের নাম ধর্ম করায় তাতে কৌশল থাকলেও সম্পূর্ণ মিথ্যা কিংবা ভিত্তিহীনতা নেই। যেহেতু বরুণের ধর্মই ধর্ম কিংবা বরুণ ধর্মের ঈশ্বর সেহেতু সেই অর্থের সঙ্গে সঙ্গতি দেখিয়ে বরুণের নাম ধর্ম করা সম্ভব।
কিছু পূর্বে আমরা বলেছি যে, হয়ত মিত্রের অপর নাম কৃষ্ণ ছিল। কিংবা তাঁর গাত্রবর্ণ ছিল কৃষ্ণ। মহাভারতের রচয়িতা বেদব্যাসের অপর নাম কৃষ্ণদ্বৈপায়ন। মহাভারতে বলা হচ্ছে যে, বেদব্যাসের জন্ম যমুনা নদীর দ্বীপে হওয়ায় তার এক নাম হয়েছে দ্বৈপায়ন এবং তাঁর গাত্রবর্ণ অসিত হওয়ায় তাঁকে কৃষ্ণদ্বৈপায়নও বলা হয়। অসিত বর্ণ অর্থ কৃষ্ণ, নীল, শ্যাম।
_________________________________________________________________________________
১ দিবোদাস।
_________________________________________________________________________________
পাতা: ২৩৬
কৃষ্ণের বর্ণ যে কৃষ্ণ বা শ্যাম তা আমরা জানি। তবে কি মিত্র, কৃষ্ণ এবং বেদব্যাস বা কৃষ্ণদ্বৈপায়ন একজনেরই নাম ?
এইবার আমরা মহাভারতে সত্যবতী বা মৎস্যগন্ধার গর্ভজাত বেদব্যাস সম্পর্কে যা বলা হচ্ছে তার দিকে দৃষ্টি দিব। বেদব্যাসের মাতা সত্যবতী কুমারী অবস্থায় পরাশর ঋষির ঔরসে বেদব্যাসকে গর্ভে ধারণ করেন।
বেদব্যাস দ্বীপে অবতীর্ণ হয়েছিলেন বলে তাঁর নাম দ্বৈপায়ন হয় ; চতুর্বেদের বিভাগকর্তা বলে তাঁর নাম বেদব্যাস হয় এবং অসিতবর্ণ বলে তাঁর নাম কৃষ্ণদ্বৈপায়ন হয়। কৃষ্ণদ্বৈপায়নকে বেদ প্রণেতাও বলা হয়েছে।
মহাভারতে বেদব্যাসকে বেদপ্রণেতা, বেদের বিভাগকর্তা বলা হয়েছে। কিন্তু কেন? আমরা কি বেদের ইতিহাসে তেমন কোন বিবরণ পাই? চতুর্বেদের বিভাগকর্তারূপে বেদব্যাসের নাম মহাভারত বা পুরাণ ছাড়া আর কোথায়ও আছে কি ? এবং মহাভারত প্রাক-বৈদিক যুগের রচনা হলে তখন তো চার বেদ দূরের কথা ঋগ্বেদও থাকবার কথা নয়। আমরা জানি দীর্ঘকাল পর্যন্ত ঋক, সাম ও যজু: বেদের এই তিনটি বিভাগ ছিল এবং অনেক পরে অথর্ববেদ রচিত হয়। সুতরাং নি:সন্দেহে চতুর্বেদের বিভাগকর্তা রূপে বেদব্যাসের নামোল্লেখ মহাভারতের পরবর্তী সংশোধনকারীদের উদ্ভাবন মাত্র।
কিন্তু বেদব্যাসকে ‘বেদপ্রণেতা’ বলবার কি অর্থ ? তার অর্থ কি এই যে, হরপ্পা সভ্যতার মূল ধর্মগ্রন্থের নাম ছিল বেদ যার প্রণেতা হলেন মিত্র? আমরা সেই সম্ভাবনা বেশী দেখি।
আমাদের সন্দেহ যে, ধর্মগ্রন্থ ‘আবেস্তা’ও ‘বেদ’ শব্দ থেকে উদ্ভূত। সম্ভবত বেদস্তোত্র পরিবর্তিত হয়ে আবেস্তা হয়েছে।
মহাভারতের সঙ্গে ধর্মগ্রন্থ বা ধর্মের সম্পর্কের সম্ভাবনা বোঝার জন্য আমরা কালীপ্রসন্ন সিংহ অনূদিত মহাভারত থেকে আরও কিছু উদ্ধৃতি দিব :
‘সত্যবতীপুত্র ভগবান ব্যাসদেব এই গ্রন্থে এক লক্ষ শ্লোক রচনা করিয়াছেন। যে সকল ব্যক্তি ইহা শ্রবণ করাইবেন এবং যাঁহারা শ্রদ্ধা ও ভক্তি সহকারে শ্রবণ করিবেন, তাঁহারা ব্রহ্মলোকে গমন করিয়া দেবতুল্য হইবেন। .......... মহর্ষি বেদব্যাস রচিত এই মহাভারতই পবিত্র ধর্মশাস্ত্র, অর্থশাস্ত্র ও মোক্ষশাস্ত্র। এক ব্যক্তি বক্তা ও অন্যে ইহার শ্রোতা হয়েন। .......... যে নর মহাভারত শ্রবণ করেন, তিনি কায়িক, বাচিক ও মানসিক ত্রিবিধ পাপরাশি হইতে বিমুক্ত হয়েন। যাঁহারা বিদ্বেষবুদ্ধিশূন্য হইয়া এই ভারতবংশীয়
পাতা: ২৩৭
ইতিহাস শ্রবণ করেন, তাঁহাদিগের ব্যাধিভয় ও পরলোকভয় নিবারণ হয়। ...... যদি বেদপারগ ব্রাহ্মণ ব্রতানুষ্ঠানপরতন্ত্র হইয়া চারি বৎসর ও চারি মাস মহাভারত অধ্যয়ন করেন, তিনি সকল পাপ হইতে মুক্ত হইতে পারেন। ....... এই মহাভারত নিখিল বেদের সমষ্টিস্বরূপ। অতএব ধর্মবুদ্ধি লোকদিগের ইহা সর্বদা শ্রবণ করা কর্তব্য। ....... মন ও ইন্দ্রিয় দ্বারা অহোরাত্রে জ্ঞানাজ্ঞানকৃত যে সকল পাপ সঞ্চিত হয়, মহাভারত শ্রবণ করিলে তাহা তৎক্ষণাৎ নষ্ট হয়।’ (আদিপর্ব। দ্বিষষ্টিতম অধ্যায়। মহাভারত মাহাত্ম্য)
মহাভারতের পবিত্রতা ও ধর্মীয় শক্তি সম্পর্কে এই ধরনের অনেক কথা আছে। সুতরাং আমরা এমন একটি সম্ভাবনাকে খাটো করে দেখতে পারি না যে, যেটিকে এখন আমরা মহাকাব্য রূপে দেখতে পাচ্ছি তার মূল উৎস হরপ্পান সভ্যতার ধর্মগ্রন্থ এবং ধর্মগ্রন্থের কাহিনী, এবং এই ধর্মগ্রন্থের নাম বেদ।
লক্ষণীয় ব্যাপার হল যে, পৌরাণিক কাহিনীতে কৃষ্ণকে যেমন সুন্দর বলা হয় ঋগ্বেদে মিত্রকেও কিন্তু তাই বলা হয়েছে। বিশ্বামিত্র ঋষি বরুণের উপর কোন সূক্ত রচনা না করলেও মিত্রের স্তুতিতে একটি সম্পূর্ণ সূক্ত রচনা করেছেন। তাতে তিনি বলছেন, ‘এ মিত্র প্রাদুর্ভূত হয়েছেন, ইনি নমস্কারযোগ্য সুন্দর মুখবিশিষ্ট রাজা ও অত্যন্ত বলবিশিষ্ট এবং সকলের বিধাতা। ইনি যজ্ঞার্হ, আমরা যেন এঁর অনুগ্রহ ও কল্যাণকর বাৎসল্য লাভ করতে পারি’ (৩/৫৯/৪)। মিত্র প্রাদুর্ভূত হয়েছেন বলবার অর্থ কি ? এটা কি অবতারের আবির্ভাব অর্থে বলা হয়েছে যা কৃষ্ণ সম্পর্কে বলা হয় ?
কৃষ্ণকে যেমন কর্ম, প্রেম, ক্ষমা, সত্য এবং কল্যাণের ধারণার সঙ্গে খুব বেশী যুক্ত করা হয় তেমন দেখা যায় মিত্রের ক্ষেত্রেও। গীতার কর্মবাদী কৃষ্ণের সঙ্গে এই মন্ত্রের মিত্রের মিল লক্ষণীয় : ‘মিত্র স্তুত হয়ে লোক সকলকে কার্যে প্রবর্তিত করছেন। মিত্র পৃথিবী এবং দ্যুলোক ধারণ করে আছেন, মিত্র অনিমেষ নেত্রে লোক সকলের দিকে চেয়ে আছেন’ (৩/৫৯/১)।
বৈষ্ণব আন্দোলনের প্রেমিক ও কল্যাণী কৃষ্ণের সঙ্গে ঋগ্বেদের মন্ত্রের মিত্রকে মেলাতে অসুবিধা হয় না : ‘যেন আমি সদ্গতি লাভ করি, যেন আমি মিত্র প্রদর্শিত পথে যাই। সে হিংসাবর্জিত প্রিয় দেবের কল্যাণ যেন আমরা প্রাপ্ত হই’ (৫/৬৪/৩)।
রাধাকৃষ্ণ উপাখ্যানের কৃষ্ণ সম্ভবত ভিন্ন কোন উৎসজাত। একটি শক্তিশালী ও জনপ্রিয় উপাখ্যানের নায়কের সঙ্গে অপর একটি উপাখ্যানের নায়কের মিলে যাওয়া মিথ বা পৌরাণিক কাহিনীর জন্য খুব স্বাভাবিক।
আর একটি বিষয় বেশ তাৎপর্যপূর্ণ মনে হয়। তা হল কৃষ্ণের জন্মস্থান বলা হয় মথুরা। এটি মিত্র নাম থেকেও আসা সম্ভব।
মিত্রের উচ্চ মর্যাদা শুধু ভারতবর্ষ বা ইরানে সীমিত ছিল না। ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলে প্রাচীন কালে মিথ্রবাদ (Mithraism) বা মিথ্র উপাসনা ব্যাপকভাবে জনপ্রিয় ছিল। রোমান সেনাবাহিনীতে মিথ্রের অনেক উপাসক ছিল। খ্রীষ্টধর্মের প্রসার ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চল থেকে জনপ্রিয় মিথ্র উপাসনাকে অপসারিত এবং বিলুপ্ত করে। এটা খুব তাৎপর্যপূর্ণ যে, বিষ্ণু-কৃষ্ণ মিথ এবং মূর্তির কিছু লক্ষণ যেমন গলার হার, কৌস্তুভ (বক্ষস্থ মণি) এবং ঈগল (গরুড়) মিথ্রের ক্ষেত্রেও দেখা যায়।
পাতা: ২৩৮
যাইহোক, মিত্রের ভূমিকার গুরুত্ব যে তাঁকে এতটা জনপ্রিয় করেছিল তা অনুমান করা যায়। এখন আমাদের কাছে মহাভারতে তাঁকে আড়াল করার কারণ সহজবোধ্য।
অবশ্য মহাভারতের প্রধান চরিত্রগুলির নামের আদৌ কোন ঐতিহাসিকতা আছে কি না সন্দেহ। অর্থাৎ চরিত্রের পিছনে বাস্তবতা থাকলেও নামের পিছনে আছে বলে মনে হয় না। এগুলি পরিবর্তিত নাম, অথবা কাহিনীর প্রয়োজনে তাদের ভূমিকা বোঝাতে অনেক ক্ষেত্রে নাম দেওয়া হয়েছে বলে মনে হয়। যেমন যুদ্ধে দৃঢ় বা স্থির এই অর্থে যুধিষ্ঠির নামকরণ হতে পারে। অন্যদিকে কৌরবপক্ষের অনেকের নামকরণেও আমরা এই ব্যাপার দেখি। যেমন দুর্যোধন। ‘দু:’ সাধারণত কু বা মন্দ অর্থে ব্যবহার হয়। আর যোধন হচ্ছে লড়াই, সংগ্রাম, যুদ্ধ ইত্যাদি। সুতরাং মন্দ লড়াইকারী বা অন্যায় যুদ্ধের সংগঠক হিসাবে দুর্যোধন নাম দেওয়া হতে পারে। দুর্যোধনের ভাইদের অনেকের নামের ব্যাপারটা স্পষ্ট। যেমন দু:শাসন, দুর্মুখ ইত্যাদি নামও গুণবাচক মাত্র।
মহাভারত ইতিহাস না হলেও তার পিছনে আছে ইতিহাসের অভিঘাত। সুতরাং আমরা হরপ্পান বা আর্য রাষ্ট্র গঠনে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বা প্রধান ভূমিকা রেখেছিলেন যিনি তাঁর প্রকৃত নাম খুঁজে বের করার চেষ্টা করতে পারি যার ছায়া রূপে সৃষ্টি হয়েছে যুধিষ্ঠির চরিত্র এবং তার নাম।
এর জন্য আমরা আবেস্তার দিকে দৃষ্টি দিতে পারি যেখানে হুস্রবাহ্ (Husravah)-এর কথা অনেকবার বলা হয়েছে আর্য জাতিগুলিকে ঐক্যবদ্ধ করার জন্য। ‘অকুতোভয় হুস্রবাহ্ যিনি আর্য জাতিগুলিকে একটি রাজ্যে ঐক্যবদ্ধ করেছিলেন তিনি অনুগ্রহ লাভ করেছিলেন’ (১৯। জম্ইয়াদ্ ইয়াস্ত্)। হুস্রবাহ্ (Husravah) যে প্রতিমা-মন্দিরসমূহ ধ্বংস করেছিলেন আবেস্তায় সে কথাও বলা হয়েছে (বুন্দাহিস, ১৭, ৭)।
ঋগ্বেদেও আমরা একজন বীর রাজা হিসাবে সুশ্রবার উল্লেখ পাই। সেখানে তার সম্পর্কে বলা হচ্ছে : ‘সহায় রহিত সুশ্রবা নামক রাজার সাথে যুদ্ধ করবার জন্য যে বিংশ নরপতি ও ৬০,০৯৯ অনুচর এসেছিল, হে প্রসিদ্ধ ইন্দ্র ! তুমি শত্রুদের অলঙ্ঘ্য রথচক্র দ্বারা তাদের পরাজিত করেছিলে’ (১/৫৩/৯)।
কিন্তু আবেস্তা যেভাবে সুশ্রবা বা হুস্রবাহ্-এর কীর্তি তুলে ধরেছে ঋগ্বেদ সেভাবে তা করে নি। বোঝা যায় হরপ্পান রাষ্ট্রীয় ঐক্য ধ্বংসকারী বৈদিক ঋষিরা তাঁর সম্পর্কে যতটা সম্ভব কম বলবেন। তবু ঐতিহ্যকে ব্যবহারের প্রয়োজনে পুরাতন ধর্মে হয়ত সুশ্রবাকে সাহায্য করার জন্য বরুণ বা তাঁর অধীনস্থ আর কোন দেবতাকে যে কৃতিত্ব দেওয়া হয়েছিল সেটা ইন্দ্রের উপর আরোপ করা হয়েছে।
মহাভারত থেকে আমরা আর একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় অনুমান করতে পারি তাহল পাঁচ পাণ্ডব ভাইয়ের সঙ্গে ঋগ্বেদে বহুকথিত পঞ্চজন, পঞ্চকৃষ্টি বা পঞ্চক্ষিতির কোন সম্পর্ক বা যোগসূত্র থাকতে পারে। অর্থাৎ এমন একটা সম্ভাবনা আমরা দেখি যে, বৃহত্তর হরপ্পান রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পর তাকে পাঁচটি অঞ্চল বা প্রদেশে বিভক্ত করে শাসনভার পাঁচজন নেতার হাতে দেওয়া হয়েছিল যাদের মধ্যে প্রধান জনের অধীনে আবার বাকী চারটি অঞ্চলের
পাতা: ২৩৯
প্রধানরাও ছিল। কিন্তু মহাকাব্য থেকে আমরা জানতে পারি যে, যুদ্ধ জয়ের অনেক কাল পর যুধিষ্ঠির সিংহাসন ত্যাগ করে মহাপ্রস্থানে গমন করলে বাকী চার ভাইও দ্রেীপদী সহ তাঁকে অনুসরণ করেন। সম্ভবত এটা গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থার একটা প্রতিফলন। যেহেতু তখন পর্যন্ত রাজা বংশানুক্রমিক ছিল না সেহেতু যুদ্ধের পর নির্বাচিত রাজা বা রাজারা পরবর্তী সময়ে তাদের নির্বাচিত উত্তরসূরিদের হাতে ক্ষমতা ছেড়ে দিয়ে চলে যান। অনেক পরবর্তী কালে বংশগত রাজতন্ত্রের যুগে যখন এই ঘটনা সাধারণ মানুষের নিকট আর বোধগম্য ছিল না তখন হয়ত পঞ্চ নেতার ক্ষমতা ত্যাগের ঘটনাকে বোধগম্যতা বা যৌক্তিকতা দেবার জন্য যদু বংশ ধ্বংস, কৃষ্ণের মৃত্যু এবং বিপুল রক্তপাত ও জ্ঞাতি হত্যার শোকের কারণে তাদের মহাপ্রস্থানে যাবার কাহিনী তৈরী করতে হয়েছে। একই সঙ্গে বংশগত রাজতন্ত্রের স্বার্থের অনুকূলে মহাভারতকে ব্যবহারের প্রয়োজনেও এমন কাহিনী তৈরীর প্রয়োজন ছিল।
মহাভারত বিচারের সময় আমাদের মনে রাখা দরকার যে, এটা এমন একটা পৌরাণিক কাহিনী যার মূল কাঠামোর ভিতর সংকলিত হয়েছে আরও অসংখ্য পৌরাণিক উপাখ্যান। পুরাণ এবং ইতিহাস যেহেতু এক নয় সেহেতু এর ভিতরে আমাদের ইতিহাস খোঁজা উচিত নয়। তবে এর ভিতরে আছে ইতিহাসের কিছু উপাদান এবং সূত্র। কারণ গালগল্প বেশী সময় টেকে না বলে তা কোন মিথ বা পুরাণ কথাও জন্ম দিতে পারে না। সুতরাং ভারতবর্ষের বিস্মৃত এবং বহু দূর অতীতের একটি যুগান্তকারী ঘটনাকে চিহ্নিত করতে মহাভারত একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ সূত্র হয়ে উঠতে পারে যদি আমরা সংস্কারমুক্ত এবং বিজ্ঞান মনস্ক দৃষ্টি দিয়ে তাকে বিশ্লেষণ করতে পারি। তাতে হয়ত বিশাল মহাকাব্যের বিপুল উপকরণ আপাত দৃষ্টিতে অপ্রয়োজনীয় ও জঞ্জাল মাত্র মনে হবে; তবু পাওয়া যাবে এমন কিছু যুগান্তকারী ঘটনার সূত্র যেমনটা আমরা ধারণা করছি কিছু চরিত্র এবং ঘটনার বর্ণনা থেকে যে এর মূল কাহিনীর উৎপত্তি সিন্ধু সভ্যতার এক ক্রান্তিকালীন ঘটনার অভিঘাতে। আমরা অনুমান করি আরও অনেক পূর্বের নূতন প্রস্তর যুগ থেকে অনেক পরবর্তী কালের মধ্য যুগ পর্যন্ত সৃষ্ট উপমহাদেশের বহু সংখ্যক মিথ মহাভারতের অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। ফলে তার মধ্যে একটা বিশাল ভূভাগের বহুমুখী সভ্যতার বহু বিচিত্র গতি-প্রকৃতি কোন না কোন ভাবে ছায়া ফেলেছে।
পুনরায় বলি যে কোন মিথ বিশ্লেষণের সময় তার বিস্তারিত বর্ণনা বোঝার চেয়ে অনেক বেশী গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে তার সৃষ্টির পিছনে যে সামাজিক সংঘাত ক্রিয়াশীল ছিল তার স্বরূপ বোঝার চেষ্টা করা। এ ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশী সাহায্য করে তার কেন্দ্রীয় ঘটনা কিংবা কেন্দ্রীয় চরিত্রের মধ্যকার কোন সূত্র যাকে ধরে মিথের পিছনের বাস্তবতাকে ধরা যেতে পারে। এখন আমরা একই পদ্ধতি অবলম্বন করে রামায়ণ সৃষ্টির পিছনের অভিঘাতকারী উৎস-ঘটনাটিকে বোঝার চেষ্টা করব।
পাতা: ২৪০