লিখেছেনঃ শামসুজ্জোহা মানিক এবং শামসুল আলম চঞ্চল, আপডেটঃ September 28, 2012, 3:00 AM, Hits: 1639
এই বিষয়ে সন্দেহের কোন কারণ নেই যে, সিন্ধু সভ্যতার ধ্বংসের সময় নিকটবর্তী হয়েছিল। কালক্রমে নদীনিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থার বিকলতা ও সংকট, নদীর গতিপথ পরিবর্তনে সরস্বতী উপত্যকায় মরুকরণ, কোথায়ও জলাবদ্ধতা, কোথায়ও মরুকরণ বা জলাভাব, সর্বত্র নদীখাতে পলি সঞ্চয় এবং তার ফলে ঘন ঘন নদীর গতিপথ পরিবর্তনজনিত বহুমুখী সমস্যা, ভূমিতে লবণাক্ততা বৃদ্ধির ফলে উৎপাদন হ্রাস, সমাজ ও রাষ্ট্রের স্থবিরতা বা রক্ষণশীলতা এবং সভ্যতার দুর্বলতা ও সংকট বৃদ্ধির সঙ্গে সামাজিক দ্বন্দ্বগুলিরও তীব্রতা বৃদ্ধি ইত্যাদি কারণে সিন্ধু সভ্যতা ধ্বংসের দিকে এগিয়ে চলেছিল। তবে বৈদিক শক্তি নদীনিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থাকে ধ্বংস করে সভ্যতার পতনকে ত্বরান্বিত করেছে।
নদীনিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থার বিরুদ্ধে বৈদিক উথান যে, যথেষ্ট স্বত:স্ফূর্ত এবং হরপ্পান সমাজের অন্তত এক বৃহৎ অংশের প্রবল আকাঙ্ক্ষার মূর্ত প্রকাশ তার প্রমাণ বৈদিক আন্দোলনের কোন নির্দিষ্ট কেন্দ্র না থাকা। কোন এক ব্যক্তি কিংবা সংগঠনের নেতৃত্বে এই বিদ্রোহী আন্দোলন এগিয়ে যায় নি। অঙ্গিরাগণ ধর্মসংস্কারের ঐতিহ্য সৃষ্টি করে গেলেও কোন সংগঠন দিয়ে যান নি। যার ফলে আমরা ঋগ্বেদে শত শত ঋষির মন্ত্র পাই, কিন্তু কোন প্রধান ব্যক্তি বা নেতার নাম পাই না। হয়ত বৈদিক মন্ত্র রচয়িতা কবি বা ঋষিদের সংখ্যা ছিল আরও অনেক বেশী যাদের মন্ত্র এবং নাম কালগর্ভে হারিয়ে গেছে। কিন্তু রক্ষাপ্রাপ্ত বা সংকলিত মন্ত্রসমূহের রচয়িতাদের সংখ্যা থেকে এই আন্দোলনের পিছনে জনসমর্থনের ব্যাপ্তি, তীব্রতা এবং স্বত:স্ফূর্ততা বোঝা যায়। হয়ত এটা প্রধানত সরস্বতী নদী উপত্যকাতে কেন্দ্রীভূত ছিল। কিন্তু যতদূর বোঝা যায় সেটা ছিল সভ্যতার মূলভূমি, এবং জনসংখ্যার বৃহত্তর না হলেও এক বৃহৎ অংশ নিশ্চয় সেখানে ছিল। উপরন্তু ঋগ্বেদ এবং আবেস্তা থেকেও অনুমান করা যায় বৃহত্তর সিন্ধু-সরস্বতী উপত্যকার উত্তরাঞ্চলে বৈদিক আন্দোলনের উল্লেখযোগ্য পরিমাণ শক্তি এবং জনসমর্থন ছিল।
সুতরাং নদীনিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থার প্রশ্নে বিভক্ত সমাজের এক বৃহৎ অংশের সমর্থন নিয়ে বৈদিক আন্দোলন ও গৃহযুদ্ধ এগিয়ে গেছে। নদীর গতিপরিবর্তন, অনিয়ম এবং মরুকরণ সমস্যা মীমাংসা করতে গিয়ে বাঁধ ধ্বংস করে সভ্যতার ক্ষয় ও পতনকে আরও দ্রুত করা হয়েছে এবং অবশেষে সভ্যতার নগর, শহর ও গ্রামগুলি ক্রমবর্ধমান জলাভাব ও অন্যান্য সমস্যায় ক্রমশ পরিত্যক্ত হয়েছে।
সিন্ধু সভ্যতার পতনের পর বহু শতাব্দীর জন্য, হয়ত এক থেকে দেড় সহস্র বৎসরাধিক কালের জন্য ভারতবর্ষ কৃষি এবং গ্রাম জীবনে ফিরে গিয়েছিল। এটা বিস্ময়কর যে, যারা এত বড় একটা সভ্যতা নির্মাণ করেছিল তাদের উত্তরসূরিরা বহুকাল যাবৎ একটা উল্লেখযোগ্য নগর নির্মাণেও ব্যর্থ হয়েছে।
পাতা: ২৫৬
আমরা অনুমান করি এর পিছনে কাজ করেছে নদীনিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থার তিক্ত স্মৃতি। শত শত বৎসর ধরে তা যেমন সভ্যতার বিকাশে ভূমিকা রেখেছিল তেমন তা ব্যাপক জনসংখ্যার কাছ থেকে বিপুল শ্রম ও সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য নিংড়ে নিয়েছিল। অনুমান করা যায় যে, বিশেষত শেষ দিকে বহুকাল ধরে তা হয়ে পড়েছিল এক আতংকজনক বস্তু অন্তত এক বৃহৎ জনসংখ্যার নিকট। এবং এই অবস্থা যদি কয়েক শত বৎসর থাকে তবে তার পতনের পর স্বাভাবিকভাবে সেই ধরনের আর কিছু সাধারণ মানুষ গড়তে চাইবে না। বিশেষ করে যারা এটাকে ধ্বংস করবে তারা এটাকে দ্বিতীয় বার গড়তে দিবে না।
যে সংস্কৃতি এবং সামাজিক সংস্থা বা সংগঠন গড়ে তুলতে পারলে নদী নিয়ন্ত্রণ- নির্ভর সভ্যতা গড়া সম্ভব, নদী নিয়ন্ত্রণের সংকট এবং বৈদিক শক্তির আঘাতের ফলে যখন নদীনিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা ও তার উপর নির্ভরশীল সভ্যতা দুই-ই ধ্বংস হয়েছে তখন ঐ সংস্কৃতি এবং সমাজ-সংগঠনও ধ্বংস হয়েছে। অন্যদিকে এই ব্যবস্থাকে ধ্বংস করতে গিয়ে বৈদিক শক্তিকে এমন একটি সংস্কৃতি ও সমাজ-সংগঠন গড়তে হয়েছে যা যে কোন ধরনের উন্নত নগর সভ্যতা গড়ারও প্রতিবন্ধক হয়েছে।
এর ফলে আর একটি উল্লেখযোগ্য নগর সভ্যতা নির্মাণ করতে ভারতবর্ষের গঙ্গা উপত্যকায় অভিবাসী আর্যদের উত্তরাধিকারীদেরকে এক থেকে দেড় হাজার বছর অপেক্ষা করতে হয়েছে। কিন্তু কালপ্রেক্ষিতে এবং নাগরিকতার বিচারে লৌহ যুগের এই সভ্যতা তাম্র ও ব্রোঞ্জ যুগের সিন্ধু সভ্যতার সমতুল্য নয়। সিন্ধু সভ্যতার সুউন্নত নাগরিকতা, উপযোগবাদ, সামাজিক ভারসাম্য এসব উপমহাদেশে বিস্মৃত অতীতের বিষয় হয়ে রইল। অনেক ক্ষেত্রে নগরগুলো হল বৃহৎ গ্রামাঞ্চলের কেন্দ্র স্বরূপ বৃহৎ গ্রাম। সেখানে প্রাসাদ হল, বৃহৎ মন্দির হল, কিন্তু নগর সভ্যতার সেই সুশৃঙ্খল পরিকল্পনা এবং অত্যুন্নত মান আর ফিরে আসে নি। এমন কি উপমহাদেশ পার্শ্ববর্তী চীনের মত অপর একটি সভ্যতা নির্মাণ করতে ব্যর্থ হল। গ্রীস বা রোমের মতও আর কোন সভ্যতা তা নির্মাণ করে নি। অবশ্য তার মানে এই নয় যে, ভারতবর্ষ আর মান সম্মত কিছু নির্মাণ করতে পারে নি। কিন্তু যখন সিন্ধু সভ্যতার সঙ্গে তুলনা করা যায় কিংবা তুলনা করা যায় চীন এবং অন্যান্য সভ্যতার সঙ্গে তখন বহু ক্ষেত্রেই উপমহাদেশের পশ্চাৎপদতা ধরা পড়ে। যেমন ইতিহাস চর্চা, জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চা এবং প্রশাসনের বিভিন্ন ক্ষেত্রেও ভারতবর্ষের পরবর্তী বিকাশকে সেভাবে স্বচ্ছন্দ এবং সুশৃঙ্খল বলা যায় না।
বৈদিক আন্দোলনের ঐতিহ্য ভারতবর্ষের এই গতিরোধের সবচেয়ে বড় শক্তি হয়েছে। সিন্ধু সভ্যতার অবসানের পর বৈদিক পুরোহিত নেতৃত্ব উপমহাদেশের পশ্চাৎপদ উপজাতিগুলির সঙ্গে আপোসের ভিত্তিতে বর্ণজাতিভেদ-ভিত্তিক সমাজ গড়ে তুলল।
এই ধরনের সমাজব্যবস্থা যে সিন্ধু সভ্যতায় ছিল না তা স্পষ্ট। কারণ এই ব্যবস্থা কোন উন্নত নগর সভ্যতা নির্মাণ-বিরোধী। সুতরাং বর্ণজাতিভেদ-মূলক ব্যবস্থাকে ভিত্তি করে সিন্ধু সভ্যতা গড়ার প্রশ্নই ওঠে না। সভ্যতার ভিত্তি যে, এই ধরনের ব্যবস্থার উপর দাঁড়িয়ে
পাতা: ২৫৭
ছিল না তার সুস্পষ্ট প্রমাণ হচ্ছে নগর ও বসতিগুলির অভ্যন্তরীণ সুষম বিন্যাস। অন্যদিকে ঋগ্বেদও আমাদের সিদ্ধান্তকে সমর্থন করে। ঋগ্বেদের ১০ম মণ্ডলের ৯০তম সূক্ত যা পুরুষ সূক্ত নামে পরিচিত সেখানে ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য ও শূদ্র এই চতুর্বর্ণে সমাজের ভাগের কথা বলা হলেও সূক্তটি যে অনেক পরবর্তী কালের সংযোজন মাত্র সে বিষয়ে আমরা ইতিপূর্বে আলোচনা করেছি। বরং ঋগ্বেদের এক ঋষি স্পষ্টভাবে জানাচ্ছেন বর্ণজাতিভেদহীন সমাজের কথা : ‘দেখ আমি স্তোত্রকার, পুত্র চিকিৎসক ও কন্যা প্রস্তরের উপর যব-ভর্জনকারিণী। আমরা সকলে ভিন্ন ভিন্ন কর্ম করছি’ (৯/১১২/৩)।
আমরা অনুমান করি সিন্ধু সভ্যতায় বিভিন্ন বৃত্তি বা পেশার যে বিকাশ ঘটেছিল তা পশ্চাৎপদ এবং আদিম উপজাতি-সমাজের স্বাতন্ত্র্য ও বিচ্ছিন্নতার সঙ্গে মিলিত হয়ে পুরোহিত নেতৃত্বে বর্ণজাতির কাঠামো গড়ে তোলে। আদিম উপজাতিগুলি নিজেদের স্বাতন্ত্র্য রক্ষার জন্য ভিন্ন উপজাতির সঙ্গে বিবাহ এবং একত্র আহার এড়িয়ে চলত। এ ছাড়া ছিল ভিন্ন উপজাতির প্রতি ঘৃণা। বৈদিক পুরোহিত নেতৃত্ব যখন পূর্ব দিকে অভিগমন করে বসতি স্থাপন করল তখন চারপাশের সংখ্যাগরিষ্ঠ আদিম উপজাতিসমূহের স্বাতন্ত্র্য মেনে নিয়ে তাদেরকে ধীর গতিতে নিজেদের নেতৃত্বে কৃষি ব্যবস্থার অন্তর্ভুক্ত করার পদ্ধতি নেয়। সুতরাং তারা তাদের ধর্মবিশ্বাস, দেবতা এবং পূজা-পদ্ধতিরও অনেক কিছু গ্রহণ করে।
বস্তুত ভারতবর্ষের বৈচিত্র্যময় ভূপ্রকৃতি উপজাতীয় স্বাতন্ত্র্য রক্ষার অনুকূলও ছিল। ফলে বৈদিক পুরোহিত নেতৃত্বে একটা পশ্চাৎপদ ধরনের এবং ধীর গতিসম্পন্ন কৃষি সমাজ গড়ে উঠল। এতে পুরাতন উপজাতীয় সমাজও ভেঙ্গে গেল, কিন্তু তা পুনর্বিন্যস্ত হল বৈদিক পুরোহিত শ্রেণীর নেতৃত্বে উপজাতি-গোত্র ব্যবস্থার প্রায় অনুরূপ বর্ণজাতি কাঠামোতে, যেখানে থাকল এক বর্ণজাতির সঙ্গে অপর বর্ণজাতির প্রায় অনতিক্রম্য ব্যবধান। প্রতিটি ক্ষুদ্র বা বৃহৎ বর্ণজাতি নামক গোষ্ঠী নিদিষ্ট পেশা বা কাজ এবং জন্মগত অপরিবর্তনীয় পবিত্রতার মর্যাদার কাঠামোতে আবদ্ধ হল। সবার উপরে রইল পুরোহিত শ্রেণীর একচ্ছত্র আধিপত্য। তারাও নিজেদেরকে উপজাতির অনুরূপ একটি বৃহত্তর বর্ণজাতিতে সংগঠিত করল। এই সংগঠন ও বিভাজনের ভিত্তি হল জন্মগত পবিত্রতা ও অপবিত্রতা। ব্রাহ্মণ হল সবচেয়ে পবিত্র। তার নীচে রইল পবিত্রতার স্তরভেদে যথাক্রমে ক্ষত্রিয়, বৈশ্য এবং শূদ্র। সবার নীচে এবং সবচেয়ে কম পবিত্র বা সবচেয়ে বেশী অপবিত্র হল শূদ্র। তবে সমাজের বাইরে সম্পূর্ণ অপবিত্র হিসাবে রইল অস্পৃশ্য বা অচ্ছুৎ জনগোষ্ঠী। সমাজকে ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য ও শূদ্র এই চার বর্ণে ভাগ করা হলেও এটা মূলত একটি তত্ত্বগত ভাগ। বাস্তবে সমাজ শত শত কিংবা হাজার হাজার বর্ণজাতিতে ভাগ হল। এইভাবে ক্রমে বর্ণজাতিহীন এবং নিরাকার পূজারী বৈদিক সমাজ পরিণত হল ব্রাহ্মণ্য বর্ণজাতিভেদ-ভিত্তিক এবং মূর্তি পূজারী সমাজে।
এবং এই বিচিত্র ব্যবস্থায় ব্রাহ্মণও একটা অখণ্ড শ্রেণী বা বর্ণজাতি হল না। সেখানেও ঘটল অসংখ্য বিভাজন ও পবিত্রতার স্তরবিন্যাস। কেউ বেশী পবিত্র, কেউ কম পবিত্র, কেউ বেশী শ্রেষ্ঠ, কেউ কম শ্রেষ্ঠ। কোন ব্রাহ্মণের সঙ্গে আর এক ব্রাহ্মণের বৈবাহিক সম্পর্ক এবং একত্র আহার চলবে আবার কারও সঙ্গে চলবে না।
পাতা: ২৫৮
এইভাবে সিন্ধু সভ্যতার পতনের পর ভারতবর্ষে সামাজিক বিভক্তির অনুকূলে যে ভূপ্রকৃতি এবং উপজাতীয় শক্তি ছিল ব্রাহ্মণ বর্ণ তাকে কাজে লাগিয়ে একটি বহুবিচ্ছিন্ন দ্বীপসমষ্টির মত একটি বহুবিচ্ছিন্ন সমাজসমষ্টি গড়ে তুলল যার বহু বিভক্তি, বিচ্ছিন্নতা এবং বৈপরীত্যের মধ্যে কিছু অভিন্ন আচার ও প্রথার মাধ্যমে একটি ঐক্যও গড়ে উঠল।
ব্রাহ্মণ নিজের হাতে রাখল ধর্মচর্চা ও জ্ঞানচর্চার নিয়ন্ত্রণ। বিশেষত যে ধর্মের সাহায্যে তা নিজের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করেছিল সেই ধর্মচর্চার অধিকার নিজের একচেটিয়া করে ফেলল। যুদ্ধচর্চার দায়িত্ব দিল ক্ষত্রিয়কে। কিন্তু সমাজে যুদ্ধশক্তি প্রবল হলে ব্রাহ্মণের আধিপত্য দুর্বল হবে। সুতরাং ব্রাহ্মণ ক্ষত্রিয়কে সংযত করার প্রয়োজনে ইন্দ্রকে পরবর্তী কালে এক তুচ্ছ দেবতায় পরিণত করেছে। তাকে পুরাণ কাহিনীগুলিতে শুধু স্বর্গের রাজা করে রাখা হয়েছে। সেখানেও তার মর্যাদা ও ক্ষমতা খুব সীমিত।
অবশ্য এই পুরাণগুলি পরবর্তী কালে ধর্মীয় প্রয়োজনও পূরণ করেছে। বেদ আর লেখা যাবে না। সবচেয়ে বড় কথা তাতে সমাজের সবার অধিকার নেই। বিশেষত শূদ্রের জন্য তা নিষিদ্ধ। এই অবস্থায় গতিশীল সমাজের প্রয়োজন পূরণের জন্য ব্রাহ্মণ শ্রেণী পুরাণ রচনা করে আমজনতাকে তার নিয়ন্ত্রণে রেখেছে। সর্বত্র, সমস্ত ধর্মীয় এবং পৌরাণিক সাহিত্যে ব্রাহ্মণের প্রাধান্য প্রতিষ্ঠার সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালানো হয়েছে। মহাভারতে কৃষ্ণের মুখ দিয়ে বলানো হচ্ছে :
‘সত্য অপেক্ষা ধর্ম, মাতার তুল্য গুরু এবং ব্রাহ্মণের তুল্য উৎকৃষ্ট জীব আর কেহই নাই। ..... ব্রাহ্মণ হইতে অন্যান্য বর্ণসমুদয় উৎপন্ন হইয়াছে। ব্রাহ্মণই দেবাসুরগণের সৃষ্টিকর্তা। .........
‘ব্রাহ্মণের প্রভাব অতি আশ্চর্য। দেখ, দেবরাজ ইন্দ্র অহল্যার সতীত্ব ভ্রংশ করিয়াছিলেন বলিয়া গৌতমের শাপে তাঁহার মুখমণ্ডল হরিদ্বর্ণ শ্মশ্রুজালে সমাকীর্ণ এবং মহর্ষি কৌণিকের অভিশাপে তাঁহার মুষ্ক নিপতিত ও পরিশেষে মেষবৃষণ দ্বারা তাঁহার বৃষণ নির্মিত হয়। সর্জ্জাতি রাজার যজ্ঞে মহর্ষি চ্যবন অশ্বিনীকুমারদ্বয়কে যজ্ঞভাগ প্রদানে কৃতসংকল্প হইলে, ইন্দ্র তাঁহার প্রতি বজ্র নিক্ষেপে সমুদ্যত হইয়া তাঁহার শাপপ্রভাবে স্তম্ভিত হইয়াছিলেন।’ (শান্তি পর্ব। মোক্ষধর্ম পর্ব। মহাভারত)
ব্রাহ্মণের হাতে ঋগ্বেদের ইন্দ্রের কী করুণ পরিণতি! বোঝা যায় যে, ইন্দ্রের সঙ্গে যে যুদ্ধশক্তির সম্পর্ক সেই যুদ্ধশক্তি তথা ক্ষত্রিয়ের শক্তি হরণের উদ্দেশ্যে ব্রাহ্মণ ইন্দ্রের এই পরিণতি ঘটিয়েছে। তবে ব্রাহ্মণের সত্য ভাষণের প্রশংসা করতে হয় যখন দম্ভোক্তি করা হয় : ‘ব্রাহ্মণই দেবাসুরগণের সৃষ্টিকর্তা।’
ইতিপূর্বে আমরা বলেছি যে, উপমহাদেশের ভিতরেও বৈদিক শক্তি একচ্ছত্র ছিল না। এর ফলে ব্রাহ্মণ্য সংস্কারের বাইরে জৈন এবং বৌদ্ধ ধর্ম বিস্তার লাভ করার মত অনুকূল ভিত্তি পায়। বোঝা যায় যে, সিন্ধু সভ্যতার অবসানের পর সুদীর্ঘ কাল বৈদিক এবং পুরাতন সিন্ধু হরপ্পান ধর্মীয় ধারার মধ্যে দ্বন্দ্ব এবং সম্ভবত এক ধরনের সহাবস্থানও ছিল। সেই সঙ্গে ছিল আরও বিভিন্ন ধর্মীয় এবং মতাদর্শিক ধারার অবস্থান। আমাদের অনুমান সিন্ধু সভ্যতার গণতন্ত্র এবং অহিংসার ঐতিহ্য বৌদ্ধ ধর্মের মাধ্যমে নূতন রূপ নিয়ে পুনরুজ্জীবিত হয়।
পাতা: ২৫৯
পাতা: ২৬০
পাতা: ২৬১
খ্রী:পূ: ষষ্ঠ-সপ্তম শতাব্দীর দিকে যখন গঙ্গা, যমুনা উপত্যকায় আর একটি নগর সভ্যতার উদ্ভবের এবং বৃহৎ রাষ্ট্র বা সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠার অবস্থা সৃষ্টি হচ্ছিল তখন আনুমানিক খ্রী:পূ: ষষ্ঠ শতাব্দীতে বুদ্ধের আবির্ভাব ঘটে। উদীয়মান নাগরিক বৃত্তিজীবী, বণিক এবং ক্ষত্রিয়দের এক বৃহৎ অংশ বৌদ্ধ ধর্মকে গ্রহণ করে ব্রাহ্মণের প্রভাব হ্রাস এবং বৃহত্তর রাষ্ট্র ও নগর সভ্যতা নির্মাণের চেষ্টা করছিল। পরিণতিতে আমরা দেখি ভারতবর্ষব্যাপী সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠার পর সম্রাট অশোককে বৌদ্ধ ধর্ম গ্রহণ করতে এবং তাকে পৃষ্ঠপোষকতা দিতে। পরবর্তীতে আরও অনেক কাল বৌদ্ধ ধর্ম বিভিন্ন রাষ্ট্রের পৃষ্টপোষকতা লাভ করে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত ব্রাহ্মণ কর্তৃক রক্ষিত চরম সামাজিক অসাম্য এবং নিম্নবর্ণের প্রতি স্তরবিন্যস্ত ঘৃণার উপর প্রতিষ্ঠিত বর্ণজাতিভেদভিত্তিক সমাজব্যবস্থার বিরুদ্ধে সংগ্রামে বৌদ্ধধর্ম পরাজিত হয়। বস্তুত সিন্ধু সভ্যতা ধ্বংসের পর উপমহাদেশের সমাজ ও সভ্যতার মূল নিয়ন্ত্রণ যেখানে চলে গিয়েছিল সেটা হল প্রায় আদিম সমাজের মন-মানসিকতা ও সংগঠনের মধ্যে পড়ে থাকা পশ্চাৎপদ ও নিদারুণভাবে কুসংস্কারাচ্ছন্ন কৃষকের গ্রাম যার ভাবাদর্শিক ও সামাজিক প্রতিনিধি হয়ে ব্রাহ্মণ সমস্ত সমাজের নিয়ামক হয়ে থেকেছে।
বোঝা যায় কেন ব্রাহ্মণের নিরংকুশ আধিপত্য প্রতিষ্ঠার পর বিদেশী হানাদারদের বিরুদ্ধে কোন প্রতিরোধ বেশী কাল দাঁড়িয়ে থাকতে পারে নি। আসলে উপমহাদেশে ব্রাহ্মণ-চেতনা মানে কেন্দ্রীয় শক্তির দুর্বলতা, গ্রাম্যতা, সঙ্কীর্ণতা, বিভেদ-বিচ্ছিন্নতা-খণ্ডবিখণ্ডতা এবং ক্ষুদ্র গোষ্ঠীগত দলাদলি হয়ে দেখা দিয়েছে। ব্রাহ্মণের নিজের কোন সুসংহত কেন্দ্রীয় সামাজিক সংগঠন নেই। তা নিজেকে উন্নত সমাজের সামাজিক সংগঠনের পরিবর্তে উপজাতীয় ধরনের বংশধারায় বিভিন্ন বিচ্ছিন্ন ও স্বতন্ত্র গোত্রে সংগঠিত করে। তত্ত্বগতভাবে এইসব গোত্রে বাইরের কারও তথা অব্রাহ্মণের প্রবেশাধিকার নেই। সুতরাং তার ভিত্তিমূলেই আছে আদিমতা এবং বিভক্তি ও খণ্ড-বিখণ্ডতা। এই রক্ত ও বংশসম্পর্কগত আদিমতা এবং নিজেরও বিভিন্ন Caste বা বর্ণজাতিসম গোত্রে বিভক্তির ফলে ব্রাহ্মণ যেমন সমাজের অগ্রগতির পথে বাধা হয় তেমন সমাজের ঐক্য তথা বৃহত্তর সমাজ গঠনেরও পথে বাধা হয়। তা নিজে যেমন বিভক্ত তেমন সমাজকে বিভক্ত রাখার মধ্যে তার শক্তি।
এমন অবস্থায় শক ও হুনদের পর পরাক্রান্ত বহিরাগত মুসলিম শক্তির বিজয় ও আধিপত্য অনিবার্য ছিল। ব্রাহ্মণ তাকেও পূর্বের আক্রমণকারীদের মত আত্মস্থ করার চেষ্টা করেছে। কিন্তু পারে নি। কারণ তার উৎস উপমহাদেশের ভিতরে নয়, বরং বাইরে ছিল। একদিকে তার ধর্মকেন্দ্র বাইরে, অপর দিকে শত শত বৎসর ধরে অব্যাহতভাবে বাইরে থেকে ইসলামী যোদ্ধা বাহিনী এসে এখানে বহিরাগত শাসনকে স্থায়ী রেখেছে। কালক্রমে স্থানীয় অধিবাসীদেরও একটা উল্লেখযোগ্য অংশ ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেছে।
লক্ষণীয় যে, এই বহিরাগত শাসন কালের একটা মোটামুটি লিখিত ইতিহাস আমাদের চোখের সামনে আছে। অর্থাৎ মুসলমানরা অন্তত কিছু পরিমাণে ইতিহাস চর্চা করত। বাবর, জাহাঙ্গীরের মত শাসকরা আত্মজীবনী পর্যন্ত লিখে গেছেন।
পাতা: ২৬২
কিন্তু মুসলিম-পূর্ব যুগে ইতিহাস চর্চা প্রায় হয় নি। এটাও ব্রাহ্মণ প্রভাবের এক ফল। এই প্রভাবে শিক্ষিত শ্রেণী রাজবংশের ইতিহাস বা ঘটনাবলি বর্ণনার নামে যেসব লিখেছেন সেগুলি অধিকাংশ ক্ষেত্রে পুরাণকাহিনী ছাড়া আর কিছু নয়।
ব্রাহ্মণ নিয়ন্ত্রিত সমাজে ইতিহাসচর্চা হতে পারে না। কারণ ইতিহাসচর্চাও আর সব বিদ্যার মত মূলত সমাজের শাসক কিংবা নেতৃত্বদানকারী শক্তির প্রয়োজনে গড়ে ওঠে। যেখানে সবকিছুকে জন্মগত বা কুলগত পবিত্রতা ও অপবিত্রতার সঙ্গে সংযুক্ত দেখাতে হয়, যেখানে শ্রেষ্ঠ সবকিছুকে প্রাচীন শ্রেষ্ঠ ও পবিত্র ঐতিহ্যের সঙ্গে সংযুক্ত প্রমাণ করতে হয় সেখানে ইতিহাসের লিখিত দলিল শাসক বা নেতৃত্বের জন্য এক অতি বিপজ্জনক বিষয় নয় কি? ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়কে দেখাতে হবে যে, তাদের রক্ত বা বংশ আদি কাল থেকে অমিশ্রিত বা শুদ্ধ আছে। সুতরাং ব্রাহ্মণরা তাদের নিজেদের বংশ বা কুলের ইতিহাসকে ঠেলে নিয়ে যাবে বিশ্বামিত্র, ভরদ্বাজ, ভৃগু, বসিষ্ঠ ইত্যাদি সব প্রাচীন ঋষির উৎস পর্যন্ত। তা না হলে সমাজের স্বীকৃতি বা মর্যাদা পাওয়া যাবে না।
অন্যদিকে যখন চণ্ডাল, শূদ্র, ম্লেচ্ছ, যবন ইত্যাদি নামে কথিত বিভিন্ন উপজাতি কিংবা নিম্নবর্ণের কেউ কিংবা বহিরাগত শক্তি বা ব্যক্তি রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করেছে তখন তাদেরকে ক্ষত্রিয়ত্ব অর্জনের জন্য ব্রাহ্মণের দ্বারস্থ হতে হয়েছে। কারণ ক্ষমতা দখল করলেও সেটাকে রক্ষা করা সম্ভব হয় না যদি তার জন্য সামাজিক সমর্থন বা ভিত্তি পাওয়া না যায়। সুতরাং ক্ষমতা দখলের পর রাজাদের শাসক বর্ণ হিসাবে সামাজিক স্বীকৃতি ও মর্যাদা লাভের প্রয়োজন হত। কারণ রাষ্ট্রশাসন ও যুদ্ধ করা ক্ষত্রিয় বর্ণের জন্য নির্দিষ্ট। এই মর্যাদা দান করার ক্ষমতা ছিল ব্রাহ্মণের হাতে যেহেতু তারা সমাজে ঐতিহ্যের ধারক-বাহক।
ব্রাহ্মণদেরও এইভাবে বিভিন্ন শক্তিকে ক্ষত্রিয় বর্ণে আরোহণ না করিয়ে উপায় ছিল না। কারণ তা না করলে বিজয়ী রাষ্ট্রশাসকরা ব্রাহ্মণদের সামাজিক কর্তৃত্বকে অস্বীকার করবে এবং শেষে বর্ণজাতি ব্যবস্থাকেই আঘাত করবে। তাতে উভয়েরই ক্ষতি। সুতরাং ব্রাহ্মণ ও ক্ষত্রিয় উভয়ে পরস্পরের স্বার্থের সংরক্ষক হয়েছে। আর ব্রাহ্মণরা সদ্য ক্ষমতারোহীদের বংশগত ক্ষত্রিয় ঐতিহ্য প্রমাণ করার জন্য তাদের মনগড়া পূর্বপুরুষদের কাহিনী রচনা করে তাদের ক্ষত্রিয় ঐতিহ্যের অকাট্য প্রমাণ তৈরী করেছে!
সুতরাং এমন অবস্থায় ইতিহাস রচনা কিভাবে হবে? সত্য ও মিথ্যা, বাস্তব ও কল্পনার অদ্ভুত ও উদ্ভট মিশাল দিয়ে গাদা গাদা যেসব কাহিনী লেখা হয়েছে সেগুলিকে আর যা-ই হোক ইতিহাস বলা যায় না।
অবশ্য ব্রাহ্মণের ভূমিকা বিচারের সময় তার সামাজিক ও ঐতিহাসিক পটভূমিকে ভোলা উচিত হবে না। উপমহাদেশের সামাজিক ও ভূপ্রাকৃতিক বাস্তবতার প্রেক্ষিতে সিন্ধু সভ্যতার অবসানের পর আর একটি সমমানের বা উন্নততর সভ্যতা নির্মাণ করা সম্ভব ছিল না। সিন্ধু সভ্যতার উত্তরাধিকারীরা উপমহাদেশের বহুবিচিত্র ভূপ্রাকৃতিক ও আদিম জনগোষ্ঠীগত আবেষ্টনের মধ্যে থেকে আর কি এমন একটি নূতন সভ্যতা গড়তে পারত যা হতে পারত
পাতা: ২৬৩
চীন কিংবা গ্রীস-রোমের সমতুল্য? সেটা অসম্ভব ছিল। বরং ব্রাহ্মণের নিয়ন্ত্রণে ও নেতৃত্বে এমন এক সমাজ গড়ে উঠেছিল যা মূলত বলপ্রয়োগ ছাড়া এবং অহিংস উপায়ে এবং ধীর পদ্ধতিতে চারপাশের আদিম উপজাতিগুলির অধিকাংশ কিংবা এক বৃহৎ অংশকে কৃষি-সমাজের অন্তর্ভুক্ত করে নিয়েছে।
চীন বা সমকালীন অন্য অনেক সভ্যতার গতির তুলনায় এই গতিকে অনেক ধীর মনে হতে পারে। ঐসব সভ্যতার বিরাট বিরাট স্থাপত্য ও অন্যান্য নির্মাণের তুলনায় উপমহাদেশের সভ্যতাকে ম্লান মনে হতে পারে। এখানে শাসক এবং নেতৃত্বকারী শ্রেণীগুলির জৌলুস ও আড়ম্বরও অনেক কম মনে হতে পারে। চোখ ধাঁধানো রাজপ্রাসাদ, সমাধি সৌধ, মুষ্টিমেয়ের ভোগ ও সম্ভোগের জমকালো আয়োজন এখানে না থাকতে পারে। কিন্তু এই ধরনের সমকালীন সভ্যতা ও রাষ্ট্র নির্মাণের জন্য অন্য সমাজগুলি যে ভয়ংকর বর্বরতা ও নির্দয়তার আশ্রয় নিয়েছে তার তুলনায় উপমহাদেশের প্রাচীন সভ্যতা এবং রাষ্ট্রগুলি অনেক কম নির্দয় ও বর্বর হয়েছে।
এই কৃতিত্ব অনেকাংশে ব্রাহ্মণ্য ধর্মের। বলা যায় সিন্ধু সভ্যতার অহিংস ধারাকে বৌদ্ধদের মত করে না হলেও ভিন্নভাবে ব্রাহ্মণরাও অনেকাংশে রক্ষা করেছে। এর ফলে সভ্যতা সম্পর্কে বাইরে থেকে অর্জিত আমাদের প্রথাগত ধারণা দিয়ে আমরা উপমহাদেশের সভ্যতাকে অনেক সময় অবমূল্যায়ন করলেও তার যথার্থতা নিয়ে অনেক সময়ই প্রশ্ন তোলা যায়। বরং খোলা মন নিয়ে দেখলে এবং মানবিক দৃষ্টি থেকে বিচার করলে উপমহাদেশের প্রাচীন সভ্যতাকে বাইরের যে কোন সমকালীন সভ্যতার তুলনায় বহুদিক থেকেই শ্রেষ্ঠ মনে হবে। এমন কি প্রযুক্তি বিদ্যা বা কৃৎকৌশলের দিক থেকেও যে তা অন্য যে কোন সভ্যতার তুলনায় সামগ্রিক বিচারে খুব বেশী পিছিয়ে ছিল তা নয়।
যুদ্ধ-ধর্ষণ-নারী নিগ্রহ, কথায় কথায় প্রহার এবং হত্যা, গণহত্যা, পাইকারীভাবে মুক্ত মানুষকে দাস করা, দাস অথবা শ্রমজীবী মানুষের উপর ভয়ংকর পীড়ন -- এই হচ্ছে ঐসব সভ্যতার প্রায় সর্বজনীন চিত্র। সেই হিসাবে উপমহাদেশ অনেক বেশী মহত্ত্ব, সহনশীলতা, সামাজিক সম্প্রীতি, স্থিতিশীলতা এবং পারস্পরিক দায়িত্ববোধের উপর দাঁড়িয়েছিল প্রায় মধ্য যুগ পর্যন্ত। চাবুক আর তলোয়ারের জোরে লক্ষ লক্ষ মানুষের শ্রম আর রক্তে রাজাদের বিশাল প্রাসাদ অথবা সমাধি সৌধ নির্মাণের আড়ম্বর এখানে না থাকতে পারে, কিন্তু সামগ্রিক জ্ঞানচর্চা, ব্যবসা-বাণিজ্য, জনকল্যাণমুখী বিভিন্ন আয়োজন, একটা মোটামুটি সচ্ছল এবং শিক্ষিত নাগরিক সমাজের উপস্থিতি, রাস্তা-শহর-নগর-গ্রাম নির্মাণ -- এগুলোকে আমরা কি করে খাটো করে দেখব?
উপমহাদেশে মুসলিম যুগের মত রাজপ্রাসাদ প্রাচীন যুগে পাওয়া যায় না। রাজাদের বিরাট সমাধি সৌধ নির্মাণের ঐতিহ্য প্রাক-ইসলামী যুগে এখানে ছিল না। কিন্তু এগুলি ক্ষমতার অতিকেন্দ্রীভবনের প্রকাশ। অথচ এখানে বৃহৎ রাষ্ট্র এবং সাম্রাজ্যও গড়ে উঠেছিল। এ থেকে আমরা এই সিদ্ধান্তে পৌঁছতে পারি যে, সিন্ধু সভ্যতার অনেক বৈশিষ্ট্যের মত উপযোগবাদ পরবর্তী সময়েও এখানে একেবারে বিলুপ্ত হয় নি এবং মুষ্টিমেয়ের ভোগ-বিলাস-আড়ম্বর ও অপচয়ের তুলনায় সমাজের সর্বাধিক সংখ্যক মানুষের ব্যবহারিক প্রয়োজন পূরণের উপর যথেষ্ট গুরুত্ব দেওয়া হত।
পাতা: ২৬৪
এখানে ব্রাহ্মণের নেতৃত্ব বা নিয়ন্ত্রণে থেকে জন-সমাজ পঞ্চায়েতমূলক স্বশাসিত প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলে অথবা রক্ষা করে। বস্তুত এই পঞ্চায়েত ব্যবস্থা রাষ্ট্রশক্তির স্বৈরতার বিকাশের পথে প্রবল বাধা ছিল। রাষ্ট্র ছিল অনেকাংশে উপর তলায় এবং শহরে বা নগরে সীমাবদ্ধ। মুসলিম যুগেও আমরা রাষ্ট্রের খর্ব দশা অনেকটা থাকতে দেখি।
এটা ঠিক যে, বর্ণজাতিভেদ প্রথা এক অত্যন্ত নিকৃষ্ট ব্যবস্থা। এর অন্যতম ভিত্তি হচ্ছে অন্যের প্রতি ঘৃণা। শ্রমজীবী মানুষের প্রতি, নিম্নতর ও দুর্বলতর মানুষের প্রতি এবং নারীর প্রতি ঘৃণা। কিন্তু গ্রীস বা রোমের দাস বা অন্য সব সভ্যতার নারী ও শ্রমজীবী মানুষের দিকে যদি দৃষ্টি দেওয়া যায় তবে আর অভিযোগ করার বিশেষ কিছু থাকে না।
প্রায় সব সভ্যতায় প্রচণ্ড গণবিদ্রোহ হয়েছে। লক্ষ লক্ষ বা কোটি কোটি মানুষ এসবে বিনাশ প্রাপ্ত হয়েছে। আমরা অনেকে রোমের বীর দাসনেতা স্পার্টাকাসের বিদ্রোহের কাহিনী জানি। কিন্তু কোন্ বৃহৎ সাম্রাজ্য অথবা সভ্যতায় এমন সব বিদ্রোহ হয় নি? প্রাচীন চীন, আরব সাম্রাজ্য কিংবা মধ্য এশিয়া ভয়ংকর সব রক্তাক্ত যুদ্ধ, নির্দয় গণহত্যা, প্রজাবিদ্রোহ এসবে বারবার তছনছ হয়েছে। সেই তুলনায় ভারতবর্ষ থেকেছে অনেকখানি শান্ত, স্থির। সাধারণত রক্তগঙ্গা প্রবাহিত করেছে বহিরাগত হানাদাররা। উপমহাদেশের প্রাচীন রাজারা নিজেদের মধ্যে যুদ্ধ করেছে; রাজ্য বিস্তারের প্রতিযোগিতা করেছে। কিন্তু সেইসব যুদ্ধ ও প্রতিযোগিতার যেমন নির্দিষ্ট নিয়ম ছিল তেমন প্রজাদের সেসব নিয়ে অধিকাংশ ক্ষেত্রে মাথা না ঘামালেও চলত।
অন্যদিকে বর্ণজাতি প্রথা এবং পঞ্চায়েত এই দুই ধর্মীয় এবং সামাজিক ব্যবস্থা সম্পদ ও ক্ষমতায় এমন এক ভারসাম্য রক্ষা করতে সক্ষম হয়েছিল যে, সাধারণ পরিস্খিতিতে কারও বাঁচার পথ সহজে রুদ্ধ হত না। শুধু ধর্মের প্রভাবে মানুষের বিদ্রোহ রোধ করা যায় না। মানুষের বাঁচার সব পথ যখন রুদ্ধ করা হয় এবং নিপীড়ন যখন সহ্যের মাত্রা অতিক্রম করে তখন মানুষ বিদ্রোহ করতে বাধ্য হয়। কিন্তু উপমহাদেশে শূদ্র এমন কি অস্পৃশ্যরাও সচরাচর অস্ত্র হাতে বিদ্রোহ করে নি। কারণ তাদের বিরুদ্ধে সমাজ ও রাষ্ট্র শাসকরা অস্ত্রের ব্যবহারে ছিল সতর্ক। অন্তত সমাজ ও সভ্যতার সাধারণ বৈশিষ্ট্য ছিল ধর্মের মাধ্যমে এবং শান্তিপূর্ণভাবে জনগণকে নিয়ন্ত্রণ করা। সুতরাং যখন ব্যাপক আয়তনে গণবিদ্রোহ ঘটেছে তখন সেগুলিও সাধারণত রূপ নিয়েছে শান্তিপূর্ণ ধর্মীয় বা সামাজিক আন্দোলনের। বস্তুত বর্ণজাতিভেদ ভিত্তিক সমাজে সবচেয়ে নীচের, সবচেয়ে ঘৃণিত মানুষও তার জীবন ও জীবিকা সম্পর্কে মোটামুটি নিশ্চিত ছিল, একইভাবে সে নিশ্চিত ছিল তার নিজস্ব এলাকা বা গণ্ডীর ভিতর তার অধিকার ও মর্যাদা সম্পর্কে। পঞ্চায়েত এবং বর্ণজাতির কাঠামো ব্যাপক সংখ্যক মানুষকে কিছু মৌল বিষয়ে নিরাপত্তা দিয়েছিল। শুধু জোর করে বর্ণজাতিভেদ প্রথা হাজার হাজার বছর টিকে থেকেছে এ কথা ভাবা ভুল হবে।
ব্রাহ্মণের ভূমিকার মূল্যায়নের সময় তার নেতিবাচক দিকের পাশে ইতিবাচক দিকগুলিও হিসাব করা
পাতা: ২৬৫
উচিত। বিশেষ কাল এবং সমাজ পরিস্থিতির প্রেক্ষিতে সেগুলিও খুব কম নয়। বস্তুত উপমহাদেশের সভ্যতার সুপ্রাচীন ধারাকে যতটা সম্ভব রক্ষা করার কৃতিত্ব ব্রাহ্মণেরই সর্বাধিক। সভ্যতার সংকটের প্রেক্ষিতে তার উদ্ভব হওয়ায় তা নূতন পরিস্থিতিতে নিম্ন মাত্রায় হলেও সভ্যতার ধারাকে রক্ষা করার উপযোগী ছিল। তার বিভক্তি, বিশৃঙ্খলা বা নৈরাজ্য, বিচ্ছিন্নতা ও সংকীর্ণ রক্ষণশীলতা এবং অগণতান্ত্রিকতা যত দু:খজনক কিংবা ক্ষতিকর মনে হোক সভ্যতার সংকট ও বিপর্যয় কালে ব্রাহ্মণের নেতৃত্বে বংশধারায় জ্ঞানচর্চাকে প্রবাহিত করা গিয়েছিল বলেই সম্ভবত ভারতবর্ষের সংস্কৃতি ও সভ্যতার ধারাবাহিকতা পরিবর্তিত রূপের মধ্যেও রক্ষা পেয়েছে।
ইরানে ধর্মীয় ও রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান উভয়ই ছিল কেন্দ্রীভূত। রাষ্ট্রের পাশে ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের এই সমান্তরাল ও কেন্দ্রীভূত বা সংগঠিত ধারা থাকায় বহিরাক্রমণ দ্বারা রাষ্ট্রের পতন ঘটাবার পর ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানকেও ধ্বংস করা সম্ভব হয়েছে। এইভাবে ধর্মের সঙ্গে ইরানের সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকারকে অনেকাংশে ধ্বংস করা সম্ভব হয়েছে। এমনকি ভারতবর্ষেও আমরা দেখেছি কিভাবে মুসলিম তুর্কী আক্রমণকারীরা বিহারের অবশিষ্ট বৌদ্ধ ধর্ম ও জ্ঞান সাধনার কেন্দ্রগুলিকে আগুন ও তলোয়ারের মুখে নির্মূল করেছে। এইভাবে বহিরাগত মুসলিম আক্রমণ বৌদ্ধদের দ্বারা কেন্দ্রীভূতভাবে সংরক্ষিত জ্ঞানচর্চা ও সংস্কৃতির ঐতিহ্যকে চূর্ণ-বিচূর্ণ করেছে। কিন্তু ব্রাহ্মণদের অসংখ্য মন্দির-মঠ ধ্বংস করেও জ্ঞানচর্চার ধারাকে ধ্বংস করা সম্ভব হয় নি। ব্রাহ্মণরা সারা দেশে ছড়িয়ে থেকে বংশগত ধারায় জ্ঞানচর্চাকে রক্ষা করতে পেরেছে। এই ধরনের জ্ঞানচর্চার অসংখ্য ক্ষুদ্র কেন্দ্রে পৌঁছবার ক্ষমতা কিংবা উৎসাহ আক্রমণকারীদের হয় নি। সীমিত হলেও জ্ঞানচর্চার এই ধারা রক্ষার জন্য রাষ্ট্র বা বৃহৎ সামাজিক প্রতিষ্ঠানের লালনের প্রয়োজন হয় নি। গ্রাম ও ছোট শহরগুলির ক্ষুদ্র আবেষ্টনে থাকা স্থানীয় জনসমাজ ব্রাহ্মণদের লালনের মাধ্যমে জ্ঞানচর্চার অবশিষ্ট ধারাকে রক্ষা করেছে।
এ কথা আমরা কিভাবে অস্বীকার করব যে, উপমহাদেশ পৃথিবীর একমাত্র অঞ্চল যেখানে সুদীর্ঘ মুসলিম শাসনের পরও সমাজের ইসলামীকরণ হয়েছে সবচেয়ে কম? স্পেন অবশ্য অপর একটি উদাহরণ হতে পারে। কিন্তু স্পেনে অনেক পূর্বে ইসলাম উৎখাত হয়েছে খ্রীষ্টান শক্তির সামরিক বিজয় দ্বারা। ভারতবর্ষের ক্ষেত্রে ঘটনা ভিন্নভাবে ঘটেছে। ব্রাহ্মণের নেতৃত্বে সমাজ মূলত শান্তিপূর্ণভাবে ইসলামকে প্রতিহত করেছে। অবশ্য সমাজের স্বশাসনমূলক ব্যবস্থা হিসাবে পঞ্চায়েত ছিল এক্ষেত্রে অন্যতম দুর্ভেদ্য রক্ষাব্যূহ। একদিকে বর্ণজাতি প্রথা, অন্যদিকে পঞ্চায়েত এই দুইটি সমন্বিতভাবে যে রক্ষাব্যূহ নির্মাণ করেছিল কোন আঘাতে শেষ পর্যন্ত তা একেবারে ভেঙ্গে পড়ে নি।
অবশ্য এই সঙ্গে এ কথাও ঠিক যে, ব্রাহ্মণের নিষ্ক্রিয় প্রতিরোধ অনেক ক্ষেত্রেই অকার্যকর প্রমাণিত হয়েছিল। বিকল্প একটি সামাজিক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করে ইসলামের আবেদনকে প্রতিহত করার জন্য বর্ণজাতিভেদের বিরুদ্ধে মুসলিম শাসনকালে বিভিন্ন সামাজিক ও ধর্মীয় আন্দোলন গড়ে উঠেছিল। খ্রীষ্টীয় পঞ্চদশ-ষোড়শ শতাব্দীতে ভারতবর্ষের বিভিন্ন স্থানে সমাজ সংস্কারের লক্ষ্যে ভক্তি আন্দোলনের যে জোয়ার সৃষ্টি হয় তা যেমন ব্রাহ্মণ-নিয়ন্ত্রিত হিন্দু সমাজে অনেক সংস্কার ঘটায় তেমন ভারতবর্ষের বিভিন্ন অঞ্চলের জনগণের জাতীয় স্বাধিকার আন্দোলন ও সামাজিক জাগরণের ক্ষেত্রে বিরাট ভূমিকা রাখে। এর ফলে মহারাষ্ট্রে যেমন মারাঠা জাতির উথান ঘটে তেমন পাঞ্জাবে ঘটে শিখ ধর্মের তথা ধর্ম-সম্প্রদায়ের উথান।
এটা ঠিক যে, ব্রাহ্মণ্য ধর্ম এবং বর্ণজাতি প্রথা বহুকাল পূর্বে তার সামাজিক উপযোগ হারালেও আজ অবধি উপমহাদেশে প্রবল প্রভাব বিস্তার করে আছে। বিশেষ করে ভারত-রাষ্ট্রের হিন্দু সমাজে এই বাস্তবতা এখনও রয়েছে। এটা শুধু ব্রাহ্মণের সাফল্য নয় উপরন্তু যে পশ্চাৎপদ এবং আদিম সমাজের শক্তিকে ব্যবহার করে ব্রাহ্মণ এমন একটি সমাজ ব্যবস্থা নির্মাণে সক্ষম হয়েছিল সেই পশ্চাৎপদতা ও আদিমতার শক্তিরও এটা একটা সাফল্য। তবে কোন কিছু পূর্ব রূপে থাকতে পারছে না সেখানে। অস্পৃশ্য ও নিম্নবর্ণের মানুষ এবং নারীর জাগরণ ক্রমবর্ধমানভাবে সমাজকে পরিবর্তনের দিকে নিচ্ছে। আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বর্ণজাতিভেদ প্রথা এবং সেই সঙ্গে সমগ্র ব্রাহ্মণ্য ব্যবস্থারও অবসান ঘটাতে বাধ্য। সেটা কিভাবে ঘটবে সেই প্রশ্নের উত্তর সময় দিবে। তবে এই প্রসঙ্গে এই কথাও বলা দরকার যে, ব্রাহ্মণের নেতৃত্বে যে বর্ণজাতিভেদমূলক সমাজ গড়ে উঠেছিল তার ভিত্তিমূলে বলপ্রয়োগের তুলনায় স্বেচ্ছাসম্মতি এবং সামাজিক ঐক্যমত মূল বা প্রধান নির্ধারক শক্তি হিসাবে ভূমিকা পালন করায় সামাজিক পরিবর্তনও যে আসবে মূলত সেই এক পথ ধরে সেটাই যুক্তিসঙ্গত মনে হয়।
পাতা: ২৬৬