Banner
ত্রয়োদশ অধ্যায় - মিথ ও মিথ্যা বনাম ইতিহাস

লিখেছেনঃ শামসুজ্জোহা মানিক এবং শামসুল আলম চঞ্চল, আপডেটঃ September 28, 2012, 2:00 AM, Hits: 1548

আমরা এই গ্রন্থে আর্য ও সিন্ধু সভ্যতার উপর আলোচনা করতে গিয়ে ঋগ্বেদ ও প্রত্নতাত্ত্বিক আবিষ্কারের উপর আমাদের আলোচনাকে কেন্দ্রীভূত করলেও প্রাসঙ্গিকভাবে ইতিহাসের আরও অনেকগুলি প্রশ্নের উত্তর খুঁজেছি। ভারতবর্ষে আর্য আক্রমণ তত্ত্বের যৌক্তিকতা সম্পর্কে আলোচনা করতে গিয়ে আমরা দেখেছি কিভাবে ঋগ্বেদের ভ্রান্ত ব্যাখ্যা দিয়ে ইতিহাসের চরম বিকৃতি ঘটানো হতে পারে। ভারতবর্ষে বহিরাগত, যাযাবর আর্য আক্রমণ তত্ত্ব একটি মিথ বা অতিকথা মাত্র যা রচনা করেছেন মূলত পাশ্চাত্য পণ্ডিতরা এবং তাতে সুর মিলিয়েছেন উপমহাদেশে তাঁদের অন্ধ অনুগত পণ্ডিতরা। সব মিথ বা পুরাণকথার মত আর্য আক্রমণ তত্ত্বের পিছনেও ঘটনার অভিঘাত আছে মাত্র। তবে সেটাকে উল্টাভাবে এবং ভ্রান্তভাবে উপস্থিত করা হয়েছে যেমনটা মিথে ঘটতে পারে। যেমন আক্রমণ বা অভিগমন হলে সেটা ইউরোপে হয়েছিল ভারতবর্ষ থেকেই। কিন্তু সেটা প্রকৃতপক্ষে কোন পশুচারী এবং যাযাবর উপজাতিদের দ্বারা নয়, বরং সিন্ধু সভ্যতার সুসভ্য অভিগামীদের দ্বারা। এবং এটাকে হুন, মোঙ্গল, গথ, ভিসিগথ ইত্যাদি বর্বর উপজাতিগুলোর আক্রমণের মতও বলা যাবে না। তারা ইউরোপে সভ্যতা ধ্বংস করে নি, বরং নির্মাণ করেছে। প্রকৃতপক্ষে এটা ছিল একটা সভ্য জনগোষ্ঠীর নূতন দেশে অভিগমন ও অভিবাসন।
তবে এটা ঠিক যে, পরিবর্তিত পরিস্থিতি আর্য চরিত্রে অনেক পরিবর্তন ঘটিয়েছিল। একটা মূলত অহিংস জনগোষ্ঠী সহিংস ও যোদ্ধা জনগোষ্ঠীতে রূপান্তরিত হয়েছিল। ইতিহাসে এমন অনেক পরিবর্তনই ঘটে। সুতরাং অহিংস সিন্ধু সভ্যতার উত্তরাধিকারীরা গ্রীস এবং বিশেষত রোমে ভয়ানক সহিংসতা ও বলপ্রয়োগের সাহায্যে নূতন সভ্যতা গড়ে তোলে।
সিন্ধু সভ্যতা ব্যতিরেকে পৃথিবীর সর্বত্র কমবেশী এই সহিংসতা, যুদ্ধ ও বলপ্রয়োগ সভ্যতা নির্মাণে প্রধান একটি পদ্ধতি হয়েছে। এই অভিজ্ঞতা সিন্ধু সভ্যতার সঙ্গে মিলে না বলে অনেক সময় এর স্বরূপ উপলব্ধি করা কঠিন হয়। কোন কোন লেখক সিন্ধু সভ্যতায় রাষ্ট্রের অস্তিত্ব নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন। কিন্তু রাষ্ট্রের অস্তিত্ব ছাড়া যে সভ্যতা নির্মাণ সম্ভব নয় এটা সহজবোধ্য। বস্তুত বাইরে প্রায় সর্বত্র রাষ্ট্রের যে সহিংস, সন্ত্রাসী এবং আক্রমণাত্মক রূপ দেখা যায় সেটাই যে রাষ্ট্রের একমাত্র রূপ সেটা কেন আমরা মনে করব?
এটা ঠিক যে, সমাজ নির্মাণে যেমন সভ্যতা নির্মাণেও তেমন বাধ্যতার প্রয়োজন হয়। কিন্তু তার রূপ সর্বত্র এক রকম হবে এমন নয়। এবং রাষ্ট্র বা সমাজেরও


_________________________________________________________________________________
দেখুন : Jim G. Shaffer and Diane A. Lichtenstein, ‘The concepts of “cultural tradition” and “palaeoethnicity” in South Asian archaeology,’ in, The Indo-Aryans in Ancient South Asia : Language, Material Culture and Ethnicity (1997), pp.134-137.
_________________________________________________________________________________

পাতা: ২৬৭


সর্বত্র এক রূপ হবে এমন নয়। এমনকি আমরা যদি ধর্মের দিকে দৃষ্টি দিই তবে দেখতে পাব এই ক্ষেত্রে বিভিন্ন ধর্মের মধ্যে ধারণাগত পার্থক্য কতখানি। ধর্মের অর্থ এবং তাৎপর্য সর্বত্র হুবহু এক নয়। বিশেষত ভারতবর্ষ এক্ষেত্রে আর সবার থেকে ভিন্ন। সেমিটিক ধর্মগুলি যথা ইহুদী, খ্রীষ্টান ও ইসলামের সঙ্গে হিন্দু ধর্মের ধারণাগত পার্থক্যও খুব বড়। সেমিটিক ধর্মগুলিতে ঈশ্বর এবং তার প্রতিনিধিতে বিশ্বাস সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। এক্ষেত্রে ইসলাম সবচেয়ে জোরালো। সেই সঙ্গে আছে কিছু বাধ্যতামূলক আচার-অনুষ্ঠান। কিন্তু ব্রাহ্মণ্য বা হিন্দু ধর্মে ঈশ্বর বা দেবতা বিশ্বাস গৌণ বিষয়। মুখ্য হচ্ছে বেদের অভ্রান্ততা ও ব্রাহ্মণের শ্রেষ্ঠত্বের প্রতি নৈতিক স্বীকৃতি প্রদান এবং কতগুলি নির্দিষ্ট সামাজিক কর্তব্য পালন। বিশেষ করে বর্ণজাতি প্রথার নিয়মগুলি মেনে চলাই এখানে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। এর পরে কেউ যদি ঈশ্বর বা দেবতায়ও অবিশ্বাস পোষণ করে তাতে তেমন কিছু ক্ষতি নেই।
এভাবে আমরা দেখতে পাব বহুকিছুর অর্থ এবং তাৎপর্য ভারতবর্ষের সমাজ ও জনমানসে ভিন্ন। সমস্যা তখন হয় যখন এই বিষয় না বুঝে পাশ্চাত্য কিংবা বাইরের দৃষ্টিতে এখানকার বিষয়গুলিকে দেখতে ও ব্যাখ্যা করতে চাওয়া হয়। তখন তার ভ্রান্ত বা বিকৃত মূল্যায়ন অস্বাভাবিক নয়। বিশেষত সুদীর্ঘ পরাধীনতা ও পরশাসনে উপমহাদেশের জনসমাজের নিজস্ব দৃষ্টিও ঝাপসা হয়ে গেছে। সর্বোপরি পাশ্চাত্যের দুইশত বৎসর প্রত্যক্ষ আধিপত্য এবং তার পরেও বিগত অর্ধশতাব্দীর অধিককাল যাবৎ তার সামাজিক, প্রাতিষ্ঠানিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক ধারাবাহিকতা উপমহাদেশের জ্ঞানজগতে উপনিবেশবাদকে অব্যাহত রেখেছে। সুতরাং অনেক ভ্রান্ত ব্যাখ্যার মত উপমহাদেশের আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত ইতিহাসকার বা বেদ-পণ্ডিতদেরও প্রায় সকলে পাশ্চাত্য পণ্ডিতদের উদ্ভাবিত যাযাবর আর্য আক্রমণ তত্ত্বকে মেনে চলেছেন। অথচ যে কোন মনোযোগী পাঠক মুক্ত মন ও দৃষ্টি নিয়ে ঋগ্বেদ পড়লে এমন ভুল করতে পারেন না। ঋগ্বেদের ব্যাখ্যা নিয়ে বিতর্ক থাকতে পারে, তার ব্যাখ্যায় অনেক ভুল হতে পারে। কিন্তু ঋগ্বেদ একদল বহিরাগত, পশুপালক ও যাযাবর আক্রমণকারীদের রচনা এ কথা যখন বেদ-পণ্ডিতগণ বিশ্বাস করেন কিংবা অন্যদের বিশ্বাস করতে বলেন তখন তাঁদের উপলব্ধির দৈন্যের পরিমাণ ভেবে বিস্ময়ে হতবাক হতে হয়।
পাশ্চাত্যের পণ্ডিতদের না হয় বোঝার ভুল হতে পারে কিংবা তাদের মনের ভিতর অপ-রাজনীতি কাজ করতে পারে, কারণ ঋগ্বেদের সঠিক ব্যাখ্যা থেকে যে ইতিহাস বেরিয়ে আসবে তা পাশ্চাত্যের শ্বেতবর্ণবাদ কিংবা গোপন দম্ভে আঘাত করতে পারে। এটা অস্বাভাবিক নয়। কারণ তাহলে বহুকাল উপনিবেশ হয়ে থাকা ভারতবর্ষের কাছে ইউরোপের সভ্যতার ঋণ স্বীকার করতে হয়। কিন্তু ভারতবর্ষের পণ্ডিত মহল তথা জ্ঞানজগতে এতকাল যাবৎ বিদ্যমান এহেন দৈন্য সত্যি নিদারুণ দু:খজনক।
অবশ্য এ কথা ঠিক যে, উপমহাদেশের প্রাচীনপন্থী বেদপণ্ডিতদের ভিতর পাশ্চাত্য আর্য আক্রমণ তত্ত্ব কখনই তেমন একটা গ্রাহ্য হয় নি। তার কারণও নেই। কারণ হাজার হাজার বছর ধরে ব্রাহ্মণ এবং বেদপণ্ডিতদের মতে এই উপমহাদেশই ছিল

পাতা: ২৬৮


আর্যভূমি। পাশ্চাত্য পণ্ডিতদের আবির্ভাবের পূর্ব পর্যন্ত এই মতই এখানে ছিল সর্বজনগ্রাহ্য। কিন্তু ব্রিটিশ আধিপত্য প্রতিষ্ঠার পর যখন ব্রিটিশ এবং অন্য ইউরোপীয় পণ্ডিতরা তাঁদের ভাষার সঙ্গে সংস্কৃতের গভীর মিল দেখতে পেলেন তখন তাঁরা ঋগ্বেদের মনগড়া ও ভিত্তিহীন ব্যাখ্যা দিয়ে ভারতবর্ষে আর্যরা বহিরাগত আক্রমণকারী এবং তারা বাইরে থেকে এসে ভারতবর্ষ দখল করে এখানে বলপূর্বক আর্য (ইন্দো-ইউরোপীয়) ভাষা প্রতিষ্ঠা করেছে এই তত্ত্ব হাজির করলেন। বিদেশীদের চাপানো বহু কিছুর মত এটাই এ উপমহাদেশের ইংরাজী ভাষায় ও কেতায় শিক্ষিত মহলে সর্বজনগ্রাহ্য হল।
এটা ঠিক যে, ঋগ্বেদের সঠিক ব্যাখ্যা প্রাচীনপন্থী বা ঐতিহ্যিক বেদপণ্ডিতরাও দিতে পারেন নি। এর জন্য যে বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গির প্রয়োজন সেটা তাঁদের নেই বলে তাঁদের ব্যাখ্যায় প্রভূত দুর্বলতা রয়েছে। কিন্তু তা সত্ত্বেও বৈদিক আর্যরা যে বহিরাগত যাযাবর অনুপ্রবেশকারী নয় এইটুকু বোঝার মত প্রাথমিক জ্ঞান ও বুদ্ধিটুকু তাঁদের আছে।
অবশ্য আধুনিক বেদপণ্ডিতদের মধ্যেও মুষ্টিমেয় কিছু সংখ্যক ব্যক্তি মনে করেছেন যে, বহিরাগত আর্যরা ঋগ্বেদ রচনা করে নি এবং তারা (ঋগ্বেদ রচয়িতা আর্যরা) উপমহাদেশ বিশেষত সপ্তসিন্ধুর অধিবাসী। কিন্তু কে শুনবে তাঁদের কথা! সহজ যুক্তির চেয়েও বড় সত্য পাশ্চাত্য লেখকদের কথা। উপমহাদেশের গোটা জ্ঞানতত্ত্ব যাদের কাছে বাঁধা পড়ে আছে সেই পাশ্চাত্য পণ্ডিতদের মতামতই হল শেষ কথা। প্রকৃতপক্ষে আর্য প্রশ্নে যে, একটা ভিন্ন মত আছে সেটাই ইতিহাসের সাধারণ পাঠকরা কখনই জানতে পারেন নি।
জ্ঞানের জগতে যে এ কালেও অনেক হাস্যকর কাণ্ড ঘটতে পারে তার প্রমাণ হচ্ছে ইউরোপীয় লেখকদের তৈরী বহিরাগত আর্য আক্রমণ তত্ত্ব্। অবশ্য ইউরোপীয়দের মধ্যে অনেকে আর্যতত্ত্ব নিয়ে এমন কিছু করেছে যা রীতিমত বালখিল্যতার পর্যায়ে পড়ে। যেমন ঋগ্বেদ থেকে তারা ধারণা করল যে, আর্যরা শ্বেতবর্ণ একটি জাতি। এই ধারণার প্রসাদগুণে পুষ্ট হয়ে হিটলার জার্মান জাতিকে একমাত্র বিশুদ্ধ আর্য রক্তের জাতি হিসাবে ঘোষণা করলেন এবং এই বিশুদ্ধ আর্য জাতির পৃথিবীব্যাপী প্রভুত্ব প্রতিষ্ঠার জন্য দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ বাধালেন। তাঁর এই তত্ত্বের সহায়ক হল জার্মান পণ্ডিত ও বিজ্ঞানীদের এক বিরাট অংশ। হাস্যকর এবং অবিশ্বাস্য মনে হলেও এটা সত্য যে, জার্মান বিজ্ঞানীরাও হিটলারের বিশুদ্ধ রক্ত তত্ত্বে বিশ্বাস করলেন। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধে ধ্বংসযজ্ঞের শিক্ষার পর ইউরোপীয়রা আর্য বর্ণবাদ নিয়ে আর বেশী মাতামাতির সাহস পায় নি। কিন্তু ভারতবর্ষের জন্য তারা তাদের আর্য আক্রমণ তত্ত্ব বহাল রাখল। যেহেতু সকল ইউরোপীয় এক সুরে বলেছে যে, আর্যরা বাইরে থেকে এসে ভারতবর্ষ দখল করে এখানে তাদের ভাষা, ধর্ম ও সংস্কৃতি প্রতিষ্ঠা করেছে সেহেতু সেটাই সত্য হয়ে রইল।
আধুনিক বিভিন্ন ভাষায় যাঁরা ঋগ্বেদ অনুবাদ করেছেন এবং আধুনিক কালে এর চর্চা করেছেন তাঁদের কাছ থেকে এমন বুদ্ধিভ্রংশতা আশা করা যায় না। প্রাচীন অনেক বিস্মৃত অথবা মুষ্টিমেয়ের ভিতর গোপন কিংবা সীমাবদ্ধ বিদ্যাকে ব্যাপক সংখ্যক শিক্ষিত মানুষের কাছে পৌঁছাবার কৃতিত্ব তাঁদের আছে। ঋগ্বেদকেও আধুনিক কালের ভাষাগুলিতে অনুবাদের

পাতা: ২৬৯


মাধ্যমে তাঁরা তার জ্ঞানকে ক্ষুদ্র ব্রাহ্মণ্য স্বার্থগোষ্ঠীর নিয়ন্ত্রণমুক্ত করে তার উপর সবার অধিকার প্রতিষ্ঠা করেছেন। বস্তুত প্রাচীন অমূল্য জ্ঞানভাণ্ডারের দ্বার উন্মোচনের জন্য পাশ্চাত্য লেখক-পণ্ডিতদের কৃতিত্ব সর্বাধিক। কিন্তু ঋগ্বেদের অনুবাদের সঙ্গে তাঁরা আর একটি এমন কাজ করেছেন যাকে মোটেই শ্রদ্ধার্হ বলা যায় না। তাঁদের কারণে আগাগোড়া ভ্রান্ত একটা ধারণা ইতিহাসের নামে পৃথিবীব্যাপী প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। দীর্ঘকালের একতরফা প্রচারে এই মিথ্যা তত্ত্ব সত্যরূপে এমনইভাবে শিক্ষিত জনমানসে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে যে, এই মেকি তত্ত্বের বিরুদ্ধে দাঁড়ানো এত কিছু প্রত্নতাত্ত্বিক আবিষ্কারের পরেও দুরূহ হয়ে আছে। এসব দেখেশুনে পোশাকপাগল রাজার সেই গল্পের কথা মনে না করে উপায় থাকে না।
অনেকে হয়ত গল্পটা জানেন যে, কিভাবে এক পোশাকপাগল রাজাকে কয়েকজন প্রতারক ঠকিয়েছিল; শুধু রাজাকে নয় সেই সঙ্গে প্রচারের গুণে সমস্ত প্রাপ্তবয়স্ক ও জ্ঞানসম্পন্ন্ নাগরিককে। রাজা যখন প্রজাদেরকে তাঁর অতি সূক্ষ্ম পোশাকের মাহাত্ম্য প্রদর্শনের জন্য সেই অদৃশ্য পোশাক পরে রাজধানীতে আড়ম্বরপূর্ণ শোভাযাত্রা করলেন তখন নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সব নাগরিক রাজার উলঙ্গ শরীর দেখে পোশাকের সূক্ষ্মতার প্রশংসায় উচ্ছ্বসিত হল।
জ্ঞানের জগতেও এমনই এক হতভম্বকর মিথ্যাকে এ যাবৎ সত্য বলে চালানো গেছে শুধু দুনিয়াব্যাপী প্রতিষ্ঠিত ও শক্তিমানদের প্রচারের গুণে। তাতে কোন বাস্তব প্রমাণ এবং শক্তিশালী যুক্তির প্রয়োজন হয় নি। এমনকি ঋগ্বেদের ঋষিরা বারবার সপ্তসিন্ধুকে নিজেদের আবাসভূমি বলার পরেও সেটাকে অগ্রাহ্য করে যাবতীয় ইতিহাস গ্রন্থে তাদেরকে সদ্য বহিরাগত বানানো হয়েছে। এই সঙ্গে যাযাবর, পশুপালক ইত্যাদি অভিধা তো আছেই। এইসব কিছুই করা হয়েছে ঋগ্বেদের নামে, অথচ ঋগ্বেদেরই সমস্ত তথ্য ও প্রমাণকে অস্বীকার করে। এসব করা গেছে। কারণ পাশ্চাত্যের কয়েকজন শক্তিশালী বা প্রতিষ্ঠিত পণ্ডিত বলেছেন ; সুতরাং সেটাই সত্য। বেদ যাঁরা পড়েছেন এই প্রচারের গুণে তাঁদের দৃষ্টিও আচ্ছন্ন হয়েছে, অথবা সত্যটাকে বলতে ভয় পেয়েছেন পাছে না তাঁদেরকে অন্যরা বোকা ভাবে।
এটা ঠিক যে, বিগত তিন চার দশক ধরে সিন্ধু সভ্যতার ক্রমবর্ধমান প্রত্নতাত্ত্বিক আবিষ্কার ইউরোপীয়দের উদ্ভাবিত আর্যতত্ত্বকে ক্রমেই বিপন্ন করছিল। কালিবঙ্গান, লোথাল এবং বনওয়ালীতে পরিণত হরপ্পান পর্যায়ের সূচনা কাল (২,৬০০ খ্রীষ্টপূর্বাব্দ) থেকেই অগ্নিবেদি পাওয়ায় আর্যরা যে সেই অঞ্চলে কমপক্ষে সাড়ে চার হাজার বছর আগে ছিল সে কথাও প্রত্নতাত্ত্বিকভাবে প্রমাণিত হয়েছিল। স্বস্তিকা চিহ্ন সম্বলিত বিভিন্ন সিলও পাওয়া গেছে সিন্ধু সভ্যতায়, যা তার সঙ্গে আর্যদের যোগসূত্রকে অধিকতর দৃঢ়তার সঙ্গে প্রতিষ্ঠিত করেছিল। ক্রমে এটা স্পষ্ট হয়েছিল যে, ভারতবর্ষের সভ্যতার সেই প্রাচীন কালে বহিরাক্রমণ জাতীয় ঘটনা যেমন ঘটে নি তেমন সেই ঘটনার কারণে সভ্যতার ধারাবাহিকতায় কোন ছেদও ঘটে নি। বিশেষত আশির দশক থেকে এমন আরও কিছু আবিষ্কার ভারতবর্ষে বহিরাগত আর্য আক্রমণ তত্ত্বের পুরো ভিত্তিকেই নির্মূল করে দিয়েছে।

পাতা: ২৭০


আর্য আক্রমণ তত্ত্ব এখন প্রকৃত প্রস্তাবে একটি মৃত তত্ত্ব্। সুতরাং যাঁরা এতকাল এই তত্ত্ব নিয়ে উচ্চকিত ছিলেন তাঁরা এখন গলার স্বর কিছুটা নামাচ্ছেন। তার মানে এই নয় যে, সত্যটাকে তাঁরা স্বীকার করছেন।
এখন আর্য আক্রমণ তত্ত্ববাদীরা হয়ত বলবেন যে, ঋগ্বেদ সাহিত্য মাত্র। সুতরাং তার উপর নির্ভর করে কোন সিদ্ধান্ত নেওয়া যায় না। এর জন্য প্রয়োজন সিন্ধু সভ্যতার লিপির পাঠোদ্ধার।
এক্ষেত্রে আমাদের জিজ্ঞাসা হবে প্রত্নতাত্ত্বিক আবিষ্কারের অনেক পূর্বে যখন শুধু ঋগ্বেদ এবং ভাষাতত্ত্বের উপর নির্ভর করে ভারতবর্ষে আর্য আক্রমণ তত্ত্বের মত একটা উদ্ভট তত্ত্বকে ইতিহাস হিসাবে দাঁড় করানো হয়েছিল তখন তাঁদের এই সাহিত্য তত্ত্ব কোথায় ছিল? নিশ্চয় ঋগ্বেদই সমস্ত আর্যতত্ত্বের মূল ভিত্তি। এটাই যাত্রাবিন্দু। সকল মিথ্যারও। এবং এতদসংক্রান্ত সকল সত্যেরও এটাই যাত্রাবিন্দু।
প্রকৃতপক্ষে ঋগ্বেদ একেবারে দুর্বোধ্য কোন গ্রন্থ নয়, তার ভাষার অর্থ সম্পূর্ণ অজানা নয়। সুতরাং একটা কালে একটা সমাজে উদ্ভূত ধর্মগ্রন্থ হিসাবে তার মধ্য দিয়ে অবশ্যই আমরা সেই সমাজ-বাস্তবতার অনেকখানিই দেখতে পাব। তবে পূর্বে আমরা বলেছি যে, ঋগ্বেদ সিন্ধু সভ্যতার সবকিছুকে এমন কি বহুকিছুকে প্রতিফলিত করে না। কারণ তা বিশেষ একটা সময়ে একটা বিশেষ পরিস্থিতির তাড়নায় সৃষ্ট। কাজেই তাকে আমাদের দেখতে হবে সেই পরিস্থিতির প্রেক্ষিতে।
আমরা এই গ্রন্থে আর্য প্রশ্ন এবং সিন্ধু সভ্যতার উপর আলোচনা করতে গিয়ে সমাজ, সভ্যতা ও ইতিহাসের কিছু অমীমাংসিত বিষয়ের উপরও আলোচনা করেছি। ঋগ্বেদের পাশাপাশি আমরা আবেস্তাকেও নূতন দৃষ্টিতে দেখার চেষ্টা করেছি। এবং ভিন্নভাবে ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করেছি সেমিটিক ধর্ম ও ভাষার উদ্ভবের বিষয়টিও। সিন্ধু সভ্যতার সঙ্গে সম্পর্কিত কিংবা প্রাসঙ্গিক হিসাবে আমরা মহাভারতের উপরও সংক্ষিপ্ত আলোচনা করেছি। অবশ্য মিথ হওয়ায় এর উপর আলোচনায় খুব সতর্ক থাকার প্রয়োজন। তবু আমরা মহাভারত সৃষ্টির পিছনে কারণ হিসাবে ক্রিয়াশীল ইতিহাসের অভিঘাতটিকে উদঘাটন করার চেষ্টা করেছি। আর তা থেকে তাকে আমরা সিন্ধু সভ্যতার একটা পর্যায়ের সঙ্গে সম্পর্কিত দেখতে পেয়েছি।
অপর একটি পৌরাণিক মহাকাব্য রামায়ণকেও আমরা নূতন আলোয় দেখার চেষ্টা করেছি। এবং তাকে আমরা দেখতে পেয়েছি কৃষি-বিপ্লবের অভিঘাতে সৃষ্ট মহাকাব্যরূপে। এইভাবে আমরা ভারতবর্ষের বহুদূর এবং বিস্মৃত অতীতের সঙ্গে তার সম্পর্ক দেখতে পেয়েছি।
এই গ্রন্থে আমরা আর্যতত্ত্বের সঙ্গে সংযুক্ত কিছু বিষয়ের উপরে আলোচনাকে বেশী গুরুত্ব দিয়েছি। সুতরাং আমাদের আলোচনা মূলত ঋগ্বেদ এবং সিন্ধু সভ্যতাকে কেন্দ্র করে আবর্তিত হয়েছে। তবে আমরা প্রাসঙ্গিক আরও কিছু প্রশ্নে সংক্ষিপ্ত আলোচনার মাধ্যমে নূতন দৃষ্টিতে ইতিহাসের অনেক কিছু পুনর্ব্যাখ্যা ও পুনর্বিচারের প্রয়োজন তুলে ধরতে চেষ্টা করেছি।

পাতা: ২৭১


ইতিহাস ও ঐতিহ্যের সন্ধানকে আমরা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ মনে করি। কিন্তু সেটা অতীতে ফেরার জন্য নয়। বরং উন্নত ভবিষ্যৎকে নির্মাণ করার জন্য। আমরা মনে করি অতীতকে না জানলে বর্তমান অবস্থায় সঠিকভাবে পরিবর্তন ঘটানো যায় না। সুতরাং ইতিহাস বা অতীত তাদের না জানলে চলতে পারে যারা বর্তমান নিয়ে সন্তুষ্ট।
পৃথিবীর সভ্যতা ও অগ্রগতির যাত্রাপথ নির্মাণে ভারতবর্ষ তথা দক্ষিণ এশিয়ার এক বিরাট ভূমিকাকে আমাদের আলোচনায় আমরা তুলে ধরতে চেষ্টা করেছি। কিন্তু এতে পরিতৃপ্ত থাকার যেমন কারণ নেই তেমন উপমহাদেশের মানুষ হিসাবে আমাদের অন্যদেরকে অবজ্ঞা করারও কারণ নেই। কেননা মানুষ এবং তার সভ্যতা কোন একটি দেশ বা সমাজের বিচ্ছিন্ন বা একক সৃষ্টি নয়। তা সারা পৃথিবীর। মানুষ চিরকাল চলমান ও পরিবর্তনশীল থেকেছে, চিরকাল তা থাকবে। তার অবস্থান, পরিস্থিতি, পরিচিতি, চরিত্র, ভূমিকা, আদর্শ, দৃষ্টিভঙ্গি, সমাজ-সংগঠনের রূপ বার বার পাল্টাবে। ভারতবর্ষে কালে কালে যারা সভ্যতা গড়েছিল তারাও নানান দেশ থেকে কালে কালে এসেছিল। তাদের অনেকে আবার নানান দেশে কালে কালে চলে গেছে।
সুতরাং ইতিহাসের সত্য উদঘাটনের সময় আমাদের সমাজ ও সভ্যতার অগ্রগমনের ভিতর এই সর্বজনীনতার দিকটিকে দেখতে পারা দরকার।
কিন্তু ইতিহাস প্রতিটি মানুষ, জাতি ও জনগোষ্ঠীর জন্য যে আবার ভিন্ন কিছু শিক্ষা এবং প্রেরণা উপস্থিত করে সেই বিষয় ভোলাও হবে ক্ষতিকর। বস্তুত ইতিহাসবোধ ও চেতনা ভিন্ন ভিন্ন মানুষ, জাতি এবং জনগোষ্ঠীর ভিন্ন ভিন্ন সমাজ, রাষ্ট্র এবং সভ্যতা নির্মাণের জন্য এক অতিপ্রয়োজনীয় এবং অত্যন্ত শক্তিশালী উপাদান। এই কারণেও উপনিবেশবাদের প্রয়োজন ছিল ঋগ্বেদের যে দিকটি একান্ত সহজবোধ্য তার একটি দুর্বোধ্য ও বিকৃত ব্যাখ্যা দানের মাধ্যমে ভ্রান্ত ইতিহাস রচনা করে উপমহাদেশের বিভিন্ন জাতি ও জনগোষ্ঠীর জন্য একটি ভ্রান্ত ইতিহাসবোধ সৃষ্টি করা যা তাদেরকে সহজেই ভুল পথে চালিত করতে পারে। সুতরাং বিপরীতক্রমে একইভাবে উপমহাদেশের বিভিন্ন জাতি, জনগোষ্ঠী এবং রাষ্ট্রের ভবিষ্যৎ গঠন-পুনর্গঠনের জন্যও তার সঠিক ইতিহাস রচনার প্রয়োজন সর্বাধিক। আর সঠিক ইতিহাস রচনার পথে একটি প্রধান বাধা হয়ে আছে ভারতবর্ষে আর্যরা বহিরাক্রমণকারী এই ভ্রান্ত তত্ত্ব।
এটি ভারতবর্ষের জন্য ভয়ানক ক্ষতির কারণ হয়েছে। কারণ উপমহাদেশের সমাজ, সভ্যতা ও সংস্কৃতির মূল স্রোত, কিংবা আরও সঠিকভাবে বললে মূল স্রোতসমষ্টি, নির্মিত হয়েছে বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর সমন্বয়ে গড়ে ওঠা আর্যদের দ্বারা। সুতরাং বহিরাগত আর্য আক্রমণের ভ্রান্ত তত্ত্ব ভারতবর্ষের যে কোন জাতির আত্মবিশ্বাস ও গৌরববোধ জাগ্রত করার পথে সবচেয়ে গভীর মনস্তাত্ত্বিক এবং সবচেয়ে প্রবল ভাবাদর্শিক প্রতিবন্ধক হিসাবে কাজ করেছে এবং করছে।
আর্য আক্রমণ তত্ত্ব শুধু একটি মিথ নয়, এটি একটি মিথ্যাও। এই মিথ্যার অবসান ছাড়া এই উপমহাদেশের কোন অঞ্চল কিংবা জাতিরই সঠিক ইতিহাস রচনা করা সম্ভব নয়। ফলত সম্ভব নয় ভবিষ্যতের সঠিক গতিপথ নির্মাণ করাও। সুতরাং ইতিহাসের নামে বিদ্যমান এই নির্জলা মিথ্যার অবসান ঘটিয়ে সত্যকে প্রতিষ্ঠিত করতে হবে।

পাতা: ২৭২

সাম্প্রতিক পোষ্টসমূহ