লিখেছেনঃ শামসুজ্জোহা মানিক, আপডেটঃ June 22, 2015, 12:00 AM, Hits: 864
(বিভিন্ন সময় বিভিন্ন চিন্তা মনে উঁকি দিয়ে যায়। মনে হল ধারাবাহিকভাবে সেগুলিকে লিখলে মন্দ হয় না। লেখাগুলি হয়ত বড় হবে না। বেশী যুক্তি ও তথ্য নির্ভর বড় প্রবন্ধের মত এগুলি হবে না। কিন্তু এগুলি পাঠকদের কাছে হয়ত আমার কিছু চিন্তাকে সংক্ষিপ্ত আকারে পৌঁছে দিবে। আসলে ‘টুকরা কথা’র লেখাগুলি হবে আমার চিন্তার সংক্ষিপ্ত লিপিবদ্ধ রূপ। যেহেতু ছোট করে লেখা তাই পড়তে বেশী সময়ও লাগবে না, যা আজকের এই ব্যস্ত সময়ে অনেকের কাছে অপছন্দের নাও হতে পারে। লেখার বিষয়বস্তু অনুযায়ী লেখার শিরোনাম হবে। − লেখক)
যারা ইসলামকে বুঝতে চান তাদের এটা বুঝা অত্যাবশ্যক যে ইসলাম হচ্ছে রাজনীতির ধর্ম। এটা ধর্মের আবরণে রাজনীতি। ধর্মের আবরণ থাকায় অনেকেই ইসলামকে বুঝতে পারেন না। মনে করেন এটা ধর্ম। ধর্ম তো অবশ্যই, অলোকবাদী তথা যুক্তি-প্রমাণহীন ও অন্ধবিশ্বাস নির্ভর ধর্ম। অন্যান্য ধর্মের মতই কিছু অন্ধ বিশ্বাস ও আচার-অনুষ্ঠান নির্ভর ধর্ম। কিন্তু প্রধান অন্য কয়েকটি অলোকবাদী ধর্মের সঙ্গে ইসলাম ধর্মের গুরুতর পার্থক্যের জায়গাকে যদি বুঝা না যায় তবে ইসলামের কোনও কিছুকেই বুঝা যাবে না। ইসলামে একটা বিশেষ ধরনের রাজনীতি তথা রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জন্য মানুষের অন্ধ ও অলোকবাদী বিশ্বাসকে ব্যবহার করা হয়েছে। এটা বুদ্ধ বা যীশুর সঙ্গে মুহাম্মদের একটা মৌল পার্থক্যের জায়গা। তারা রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জন্য ধর্ম প্রতিষ্ঠা করেন নাই। তারা শান্তিপূর্ণভাবে বৃহত্তর সমাজ গঠনের জন্য ধর্ম প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। অর্থাৎ ধর্ম বা ধর্ম বিশ্বাস ছিল তাদের বৃহত্তর ও শান্তিপূর্ণ সমাজ প্রতিষ্ঠার হাতিয়ার।
ধর্ম ছিল মুহাম্মদের নিকট শুধু সমাজ নয়, উপরন্তু একই সঙ্গে রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠারও হাতিয়ার। এবং সেই রাষ্ট্রটা হচ্ছে জিহাদী তথা যুদ্ধ নির্ভর। ধর্মকে ব্যবহার করে রাষ্ট্র গঠনের কাজটা মুহাম্মদ আজ থেকে চৌদ্দশত বৎসর পূর্বে আরবে করেছিলেন। তখন মূল আরবে রাষ্ট্র ছিল না। কুরাইশদের উদ্যোগে ও নেতৃত্বে উপজাতীয় সমাজে বিভক্ত আরবের বিদ্যমান উপজাতীয় ধর্মবিশ্বাসকে অবলম্বন করে শান্তিপূর্ণভাবে একটা ঐক্যবদ্ধ সমাজ গঠনের প্রক্রিয়া সেই সময় অনেকটা এগিয়েছিল। স্বাভাবিকভাবে এই প্রক্রিয়ার পরিণতি ছিল একটা রাষ্ট্র গঠন।
কুরাইশ বংশোদ্ভূত মুহাম্মদ এই রাষ্ট্র গঠনের কাজটাই করলেন, তবে ভিন্নভাবে। কুরাইশদের প্রধান দেবতা আল্লাহর ধারণা এবং তৎকালীন আরবে বিদ্যমান ইহুদী ও খ্রীষ্টানসহ বিভিন্ন ধর্মকে ব্যবহার করে তিনি এমন একটি নূতন ধর্ম প্রতিষ্ঠা করলেন যা তাকে দিল একটি রাষ্ট্র, যা আত্মপ্রতিষ্ঠা ও আত্মপ্রসারের জন্য যুদ্ধের পথ বেছে নিল। এ ক্ষেত্রে ধর্ম হল তার যুদ্ধ নির্ভর রাষ্ট্র গঠনের হাতিয়ার। এবং রাষ্ট্রটা যে শুধু নিরঙ্কুশভাবে একনায়কী হল তা-ই নয় সেই সঙ্গে হল অন্যান্য সমাজ ও রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে আক্রমণকারী, আগ্রাসী ও লুণ্ঠনবাদী। অর্থাৎ ইসলামকে শুধু রাজনীতির ধর্ম বললে যথার্থ বলা হয় না, এটাকে একই সঙ্গে বলতে হয় আগ্রাসী সামরিক রাজনীতির ধর্ম। সুতরাং নিয়মিত নামায বা প্রার্থনাসহ তার বিভিন্ন ধর্মীয় অনুষ্ঠানেও প্রকাশ ঘটে সামরিক শৃঙ্খলা ও দলবদ্ধতার এবং সেই সঙ্গে আক্রমণাত্মক ভঙ্গী বা জঙ্গীপনার।
সেই সময় আরবের নিকটবর্তী সভ্যতাসমূহে চলছিল ভয়ানক সঙ্কট। সভ্যতার সঙ্কট দীর্ঘ কাল ধরেই চলছিল। হাজার হাজার বৎসর ধরে চাষাবাদে ভূমির উর্বরতা হ্রাস, নদীর গতিপথ পরিবর্তন, ভূমির লবণাক্ততা বৃদ্ধির ফলে ফলন হ্রাস ইত্যাদি বিভিন্ন কারণে বৃদ্ধিপ্রাপ্ত জনসংখ্যাকে সভ্যতা আর ধারণ করতে পারছিল না। যুদ্ধ, মারী ইত্যাদি সভ্যতাগুলির সঙ্কটকে আরও ঘনীভূত করে। সিন্ধু, মেসোপটেমিয়া, মিসরের সভ্যতা বহুকাল আগেই মৃত। গ্রীক ও রোমান সভ্যতার গৌরবও তখন অতীতের বিষয়। আরবের পার্শ্ববর্তী তৎকালীন পৃথিবীর দুই পরাশক্তি বাইজেন্টাইন এবং পারস্য সাম্রাজ্য তখন ক্ষয়িষ্ণু। এই রকম সময়ে বর্বর ও যাযাবর বেদুইন অধ্যুষিত মরুময় আরবের বুকে বিশ্বজয়ের উচ্চাভিলাষ নিয়ে মুহাম্মদ তার ধর্ম প্রতিষ্ঠা করেন। চীন বাদে পৃথিবীর বিস্তীর্ণ অঞ্চল ব্যাপী সভ্যতার এমন ক্ষয় ও সঙ্কটের পরিস্থিতিতে যে কোনও বর্বরতার উত্থানের জন্য সেটা ছিল একটা উপযুক্ত সময়। সুতরাং এই ধর্মের অনুসারীদের জন্য ইহকালে যুদ্ধজয়, লুণ্ঠন, বিধর্মীদের নারী ধর্ষণ ও পরাজিতদের দাসকরণ এবং পরকালে মদ, মেয়েমানুষ আর বালক সরবরাহের লোভ দেখিয়ে আর এই ধর্ম প্রত্যাখ্যানকারীদের জন্য ইহকালে ত্রাসের যাবতীয় বন্দোবস্ত করে এবং পরকালে মর্মন্তুদ শাস্তির ভয় দেখিয়ে মুহাম্মদ তার ধর্ম প্রতিষ্ঠায় সফল হলেন। ধর্মকে ব্যবহার করে তিনি হলেন নিরঙ্কুশভাবে একনায়কী এবং আগ্রাসী যুদ্ধবাদী সমাজ ও রাষ্ট্রের অধিপতি।
মুহাম্মদ তার জিহাদী তথা যুদ্ধবাদী ধর্ম, সমাজ ও রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে যে ঐতিহ্য সৃষ্টি করে গেছেন একটা ধর্মের আবরণে সেই ঐতিহ্যই আজ অবধি বহমান। ইসলাম যেখানে গেছে, যেখানে যাবে সেখানে নিয়ে গেছে, সেখানে নিয়ে যাবে এই ঐতিহ্যকে। সুতরাং যারা ইসলামের সমস্যাকে বুঝতে চান তাদেরকে অবশ্যই ইসলামের রাজনীতি ও রাষ্ট্রকে বুঝতে হবে। যারা শুধুমাত্র বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চা দ্বারা অথবা রাজনীতি বিবর্জিত দৃষ্টি থেকে ইসলামকে মোকাবিলা করতে চাইবেন তারা ইসলামী চেতনায় কোনও ধরনের আবেদনই সৃষ্টি করতে পারবেন না। কারণ রাজনীতিকে বা রাষ্ট্রচিন্তাকে রাজনীতি বর্জিত দর্শন দিয়ে অপসারণ করা যায় না। ইসলামকে মোকাবিলা করতে চাই দর্শনের পাশাপাশি বিকল্প রাজনীতি ও বিকল্প রাষ্ট্রচিন্তা।