Banner
আমাদের পররাষ্ট্রনীতি ও প্রাসঙ্গিক ভাবনা — মো. শহীদুল্লাহ

লিখেছেনঃ মো. শহীদুল্লাহ, আপডেটঃ November 25, 2024, 12:00 AM, Hits: 227

বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতির মূল কথা হচ্ছে- ‘সব দেশের সঙ্গে বন্ধুত্ব, কোনো দেশের সঙ্গেই বৈরিতা নয়।’ এ ধরনের রাষ্ট্রীয় পররাষ্ট্রনীতির মূল ভিত্তি হলো- গত শতাব্দীর ষাটের দশকের জোট নিরপেক্ষ আন্দোলন। পৃথিবী তখন দুই শিবিরে বিভক্ত। একদিকে সমাজতান্ত্রিক বলে পরিচিত সোভিয়েত ইউনিয়ন, অন্যদিকে আধুনিক ধনতান্ত্রিক যুক্তরাষ্ট্র। যুক্তরাষ্ট্র চিরাচরিতভাবেই সমাজতন্ত্রবিরোধী, বিশ্বের দেশে দেশে কমিউনিস্টরা সেসময় বেশ তরতাজা। অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্রের কাছে কমিউনিস্টরা খুব ঘৃণার ও চুক্ষশূল। সেই ধুন্দুমার শীতলযুদ্ধের সময় চীনের চৌ এন লাই, ভারতের প্রধানমন্ত্রী জওয়াহের লাল নেহরু, মিসরের প্রেসিডেন্ট গামাল আবদেল নাসের, তৎকালীন যুগোস্লাভিয়ার জোসেপ ব্রজ টিটো, ইন্দোনেশিয়ার সুকর্ণ এবং ঘানার কওয়ামি নক্রুমা ১৯৬১ সালে এই জোট গড়ে তুলেন। এই রাষ্ট্র-জোটটি এখনো টিকে আছে। খুঁড়িয়ে খঁড়িয়ে চলছে। আন্তর্জাতিক এই সংগঠনটির প্রথম সম্মেলন ওই বছরই যুগোস্লাভিয়ার রাজধানী বেলগ্রেডে অনুষ্ঠিত হয়। এই সংগঠনের মর্মবাণী হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রকেন্দ্রিক সামরিক জোট ন্যাটো এবং সোভিয়েতকেন্দ্রিক সামরিক জোট ওয়ারস জোটের বাইরে থেকে সমরাস্ত্র প্রতিযোগিতায় না জড়িয়ে শান্তি, উন্নয়ন, পারস্পরিক সহযোগিতা, অপর রাষ্ট্রের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বে আস্থা রাখা এবং জনগণের ভাগ্যের উন্নয়ন করা। জোট নিরপেক্ষ আন্দোলনের এই রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গিই প্রতিফলিত হয়েছিল ১৯৭১ সালে স্বাধীন হওয়া বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতিতে। আমাদের দেশ ১৯৭৩ সালে এই জোটে যুক্ত হয়।

ভেতরে যাই থাকুক না কেন, এখনো সেই জোট নিরপেক্ষ নীতিমালার আলোকেই চলছে আমাদের পররাষ্ট্রনীতি। কিন্তু সোভিয়েত ইউনিয়নের বিলুপ্তি, চীনের পুঁজিবাদী বিকাশ, যুক্তরাষ্ট্রের জঙ্গিবাদ ও সন্ত্রাস বিরোধী যুদ্ধ, বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ, যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের নেতৃত্বে মুক্তরাজার অর্থনীতি এবং মধ্যপ্রাচ্য ও আফ্রিকার কয়েকটি দেশে আরব বসন্তের প্রভাবে রাজনৈতিক পরিবর্তনের কারণে বিশ্ব পরিস্থিতিতে বর্তমানে বিরাট পরিবর্তন এসেছে। এর অভিঘাতে দুনিয়ার বিভিন্ন দেশের পররাষ্ট্রনীতি ঢেলে সাজানো হয়েছে। রাষ্ট্রে রাষ্ট্রে মিত্রতা ও বৈরিতার পুরোনো বয়ান, দৃষ্টিভঙ্গি ও কূটনীতি পাল্টে গেছে। মানুষের জীবনভাবনা ও মন-মানসিকতায় এসেছে লক্ষণীয় পরিবর্তন। তবে এখন পর্যন্ত বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতিতে তেমন কোনো পরিবর্তন আসেনি। আমাদের রাষ্ট্রিক কূটনীতির ভরকেন্দ্র পূর্বমুখী না পাশ্চাত্যমুখী হবে — এ বিষয়ে নানা ধাঁচের কথাবার্তা বুদ্ধিজীবী মহলে মাঝে মধ্যে শোনা যায়, কিন্তু বিষয়টি রাষ্ট্রের নীতিনির্ধারণী মহলে কোনো গুরুত্ব পায় বলে মনে হয় না। বাংলাদেশে এখন নতুন পরিস্থিতি। স্বৈরাচারী শাসক শেখ হাসিনা ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানের মুখে গদি ছেড়ে ভারতে আশ্রয় নিয়েছেন। এরপর অন্তর্বর্তী সরকার চালাচ্ছেন শান্তিতে নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ ড. মুহাম্মদ ইউনূস। তিনি প্রাজ্ঞ ব্যক্তি। বিশ্বসভায় সমাদৃত ব্যক্তিত্ব। তার নেতৃত্বে নিশ্চয়ই আমরা আশা করতে পারি নতুন ও দেশের মানুষের জন্য তুলনামূলক উপকারী পররাষ্ট্রনীতি। আমাদের চলমান পররাষ্ট্রনীতি ধরি মাছ না ছুঁই পানি গোছের। পুরনো ও বাত কি বাত। এটিতে এখন সমযোপযোগী বাঁক বদল হওয়া জরুরি। অন্তর্বর্তী সরকারের সেদিকে গুরুত্ব দেওয়া উচিত।

বর্তমানে এশিয়ার ভূরাজনীতিতে চীন-ভারত দ্বন্দ্ব এবং যুক্তরাষ্ট্রের চীনবিরোধী কট্টর মনোভাব বাংলাদেশের জোট নিরপেক্ষ পররাষ্ট্রনীতিকে নতুন চ্যালেঞ্জের মুখে ঠেলে দিয়েছে। আমি বলবো গত শতাব্দীর সত্তুরের দশকে সেই পুরনো রুশঘেঁষা বাম-রাজনীতির দৃষ্টিভঙ্গির আলোকে গৃহীত জোটনিরপেক্ষ পররাষ্ট্রনীতিটি এখন অকেজো। নয়াউদারবাদী বিশ্বে এর আর কোনো উপযোজ্যতা নেই। এখানে বলে রাখা ভালো, যুক্তরাষ্ট্র এর নৌশক্তির ৬০ শতাংশ ইতোমধ্যে এশিয়া প্যাসিফিক অঞ্চলে মোতায়েন করেছে। দেশটি এখন ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলে একটি রাষ্ট্রিক-জোট গঠন করেছে। যার নাম কোয়াড। ভারত, জাপান, অস্ট্রেলিয়া ও যুক্তরাষ্ট্র এই কৌশলগত জোটের সদস্য। বাংলাদেশের সুযোগ ছিল এ জোটে যোগ দেওয়ার। সে লক্ষ্যে যুক্তরাষ্ট্রের উপসহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী স্টিফেন ই বিগান ঢাকা সফর করেছিলেন। সফরকালে তিনি ইন্দো-প্যাসিফিক অ্যাগ্রিমেন্ট বা অ্যালায়েন্সের ব্যাপারে বাংলাদেশের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন এবং আশা ব্যক্ত করেন যে, বাংলাদেশ এই জোটে শরিক হোক। কিন্তু অপরিণামদর্শী শাসক শেখ হাসিনা চীনকে, খানিক ভারতকে, খুশি করার জন্য যুক্তরাষ্ট্রের এই বন্ধুসুলভ আহবানের গরুত্ব ও ভবিষ্যৎ মূল্য বুঝতে চরমভাবে ব্যর্থ হন।

মধ্যপ্রাচ্য বাদে এশিয়ায় যুক্তরাষ্ট্রের মিত্র দেশ ইন্দোনেশিয়া, ভারত, জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া, তাইওয়ান, পাকিস্তান, ফিলিপাইন ও ভিয়েতনাম। প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে অস্ট্রেলিয়া যুক্তরাষ্ট্রের দীর্ঘদিনের বন্ধু ও সামরিক মিত্র। তবে পাকিস্তানের সঙ্গে এখন যুক্তরাষ্ট্রের শীতল সম্পর্ক যাচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে এই ইন্দো-প্যাসিফিক জোটে পাকিস্তান যুক্তরাস্ট্রর জোটসঙ্গী হয়নি, দেশটি থেকেছে চীনের দিকে, পুতিনের ফ্যাসিবাদি রাশিয়ার দিকে। এ জন্য দেশটির প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানের ওপর নেমে আসা রাজনৈতিক ঝড় আমরা দেখেছি। শেষে পাকিস্তানের জনপ্রিয় ক্রিকেট স্টার ইমরান খানকে ক্ষমতা হারাতে হয়েছে। কারণ সৌদি আরব ও যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থন ছাড়া পাকিস্তানের কোনো শাসকই টিকতে পারবেন না। পাকিস্তান রাষ্ট্রের এখন পর্যন্ত যে তুরস্কপ্রীতি এবং পুরোনো প্যান-ইসলামিক ঝোঁক, তা দেশটিকে রাশিয়ার কাছেও গ্রহণযোগ্য করবে না। কারণ মধ্যপ্রাচ্যের রণাঙ্গনে রাশিয়া শিয়া-ইরান ও সিরিয়ার সমর্থক, সুন্নি তুরস্ক এ ক্ষেত্রে রাশিয়ার প্রতিপক্ষ। তাছাড়া পাকিস্তান একসময় যুক্তরাষ্ট্রের মিত্র হিসেবে আফগানিস্তানের মাটিতে রুশ সেনাদের মারাত্মক গ্যাঁড়াকলে ফেলে সামরিক পরাজয়ের মুখে ঠেলে দিয়েছিল। তাই এখনকার জবরদস্ত রুশ উগ্রজাতীয়তাবাদী ভ্লাদিমির পুতিনের প্রশাসন এবং রুশ সেনা-আমলাতন্ত্র ওই পরাজয়ের গ্লানি সহজে ভুলবে বলে মনে হয় না। এ ছাড়া ইসরায়েলকে স্বীকৃতি দেওয়া না-দেওয়ার প্রশ্নে পাকিস্তানের রাজনীতিতে নানমুখী মেরুকরণ চলছে। তবে ভারতের সঙ্গে রণনৈতিক ভারসাম্য আনতে পাকিস্তানের সেনাবাহিনী ইসরায়েলের সঙ্গে সুসম্পর্ক স্থাপনের পক্ষে। এ সব কারণে বলছি, ইন্দো-প্যাসিফিক অ্যাগ্রিমেন্ট বা অ্যালায়েন্সের ব্যাপারে পাকিস্তানকে পরাশক্তি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে থাকা ছাড়া উপায় থাকবে না। যুক্তরাষ্ট্রে আসন্ন ডোনাল ট্রাম্পের প্রশাসন কাজ করা মাত্রই পাকিস্তানের ওপর এ বিষয়ে কূটনৈতিক চাপ বহুলাংশে বাড়বে। 

জোট নিরপেক্ষ আন্দোলনের সময়ে দুর্বল সামরিক শক্তির দেশগুলোর নির্দোষ, নির্দন্ত ও নিরীহ পররাষ্ট্রনীতির কোনো উপযোজ্যতা বিশ্বরাজনীতিতে এখন কী আছে? আমার বিবেচনায় নেই। সে কারণে বিশ্বরাজনীতিতে এখন কূটনৈতিক পক্ষ নিতে হবে শক্ত-সমর্থ্ রাষ্ট্রের সঙ্গে। নিজে দুর্বল বলে অন্যসব দুর্বল রাষ্ট্রের অকেজো দঙ্গলের সঙ্গে জড়িয়ে থেকে কোনো লাভ হবে না। ব্যবসা-বাণিজ্য, সমরশক্তি, প্রতিবেশী অবিবেচক (ভারত ও মিয়ানমার) রাষ্ট্রের সঙ্গে সমস্যা সমাধান এবং নিজ দেশে উন্নয়নের ছক্কা মারতে হলে বিশ্বরাজনীতি এবং এশিয়া-প্যাসিফিক জোটের রাজনীতিতেও শক্তিধর রাষ্ট্রের সঙ্গে থাকতে হবে এবং সেটি যুক্তরাষ্ট্র। এ ক্ষেত্রে আমি বাংলাদেশ রাষ্ট্রের স্থপতি শেখ মুজিবুর রহমানের রাজনৈতিক দীক্ষাগুরু হোসেন শহীদ সোহ্রাওয়ার্দীর যুগোত্তীর্ণ কথাটি স্মরণ করব। পাকিস্তানের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রনীতি নির্ধারণ প্রশ্নে বামপন্থিদের বিরোধিতার জবাবে তিনি বলেছিলেন, ‘জিরো প্লাস জিরো, ইকুয়েল টু জিরো।’ তার এই বাণী বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতির বাঁক বদলের এই ক্রান্তিলগ্নে বিরাট মূল্য বহন করে বলে আমার বিশ্বাস। তার এই কথা বাংলাদেশের বর্তমান ও ভবিষ্যৎ সরকারকে আগামী দিনে পররাষ্ট্রনীতি নবায়নের ক্ষেত্রে দিশারি হিসেবে পথ দেখাবে বললে অত্যুক্তি হবে না।

বাংলাদেশ নানামুখী সমস্যায় জর্জরিত দেশ। জনসংখ্যার চাপে দেশটি এখন ডুবন্ত নৌকার মতো। এই জনসংখ্যার বিরাট অংশ অদক্ষ ও আধুনিক শিক্ষাহীন। সমাজ মনন এখনো ইউরোপীয় রেনেসাঁর তুলনায় প্রায় মধ্যযুগে আছে। সাম্প্রদায়িক, মৌলবাদী ও নানা ধরনের আদিভৌতিক চিন্তা-চেতনায় আকীর্ণ আমাদের সমাজ। এই সমাজের যারা উচ্চশিক্ষিত ও ক্ষমতাবান তারাও ব্যস্ত থাকেন নানাবিধ দৃষ্টিকটু কর্মকাণ্ডে। এর ব্যতিক্রম নেই বলছি না, কিন্তু সমাজ ও রাষ্ট্রের দেহে যেখানে এত সমস্যা এবং অন্ধকারের কারসাজি সেখানে ব্যতিক্রমী আলোকশিখা ঘন কুয়াশায় ঢাকা পড়ে যায়, অন্ধ জনে আলো দেয় না। এমনি এক পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের ঘাড়ে সিন্ধাবাদের দৈত্যের মতো চেপে বসে আছে রোহিঙ্গা সমস্যা। মিয়ানমারের রাখাইন প্রদেশে জাতিগত ও ধর্মীয় হিংসার শিকার হয়ে দুই দফায় বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে কমবেশি ১২ লাখ রোহিঙ্গা। এই রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধান করা শেখ হাসিনা সরকারের কাছে আশু করণীয় বিষয় বলে গুরুত্ব পায়নি। দেশের এই মরা-বাঁচার সমস্যাকেও শেখ হাসিনার সরকার দেখেছে ভারত ও চীনের চোখে। এদিকে বাংলাদেশের উন্নয়ন ঠিকাদার চীন রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে আশার বাণী শুনাচ্ছে বারবার, কিন্তু এ ব্যাপারে বাস্তব সুফল কিছু দেখছি না। এ ছাড়া আমাদের মিত্র দেশ ভারত মিয়ানমারের ফ্যাসিবাদী শাসকদের কাছে ব্যবসা-বাণিজ্যের দরকষাকষি নিয়েই ব্যস্ত। রোহিঙ্গা-সমস্যা ইস্যুতে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের ভোটাভুটিতে রাশিয়া ও চীন মিয়ানমারের ফ্যাসিবাদী সেনাশাসকদের পক্ষে উকালতি করে আছে গোড়া থেকেই। মিয়ানমারের রাখাইনে রাষ্ট্রীয় নিপীড়নের শিকার রোহিঙ্গাদের বিষয়ে গত ১৮ নভেম্বর জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদে প্রস্তাব পাস হয়েছে। তাতে বিপক্ষে ভোট দিয়েছে চীন। ভোট দানে বিরত থেকেছে প্রতিবেশী দেশ ভারত। রোহিঙ্গা সমস্যার শুরু  থেকেই আমাদের বন্ধু বলে কথিত দেশ ভারত ও চীনের কাছ থেকে কোনো প্রকার কূটনৈতিক সমর্থন বা সহযোগিতা পায়নি বাংলাদেশ। এ অবস্থায় যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপের বিভিন্ন দেশ এবং অস্ট্রেলিয়া রোহিঙ্গা শরণার্থী সমস্যা নিয়ে জোর গলায় কথা বলেছে। রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশ থেকে মিয়ানমারে ফেরত নেওয়ার প্রশ্নে বলিষ্ঠ কূটনৈতিক ভূমিকা রেখেছে। গাম্বিয়ার মতো ছোট দেশ বাংলাদেশের রোহিঙ্গা ইস্যুকে যে আন্তর্জাতিক ন্যায়বিচার আদালতে (আইসিজে) নিয়ে গেছে, সেখানেও সাহস ও সমর্থন জুগিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র এবং এর আন্তর্জাতিক মিত্ররা।

চীন সুন্দর দেশ, কিন্তু দেশটির শাসকরা স্বৈরতান্ত্রিক। অন্যদিকে দেশটিতে স্বাধীন গণমাধ্যম, জনগণ ও বুদ্ধিজীবীদের বাকস্বাধীনতা বলতে কিছু নেই। অর্থনৈতিক আদর্শে চীন একটি বেনিয়া ও ঠিকাদারি চরিত্রের রাষ্ট্র, এর অর্থনীতির চরিত্র রাষ্ট্রীয় পুঁজিবাদী। আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে দেশটি ফ্যাসিবাদী শিয়া রাষ্ট্র ইরান, ফ্যাসিবাদী শাসক ভ্লাদিমির পুতিনের রাশিয়া এবং জঙ্গিপোষক পাকিস্তানের পরাণের বন্ধু। তাছাড়া বিশ্বের দেশে দেশে ইসলামি জঙ্গি ও মৌলবাদীদের সভ্যতা এবং মানবতাবিধ্বংসী যেসব কর্মকাণ্ড, সেগুলোর ব্যাপারে রহস্যজনকভাবে নীবর রয়েছে চীন। তাছাড়া বিশ্বের কোনো দেশে মানবাধিকার লঙ্ঘন এবং শ্রমিক অধিকারের প্রশ্নে টুঁ শব্দটি পর্যন্ত করেন না চীনের শাসক দল কাথিত কমিউনিস্ট পার্টির নেতারা। দেশটির সঙ্গে বাংলাদেশের বাণিজ্য ঘাটতি পাহাড় সমান। চীন বাংলাদেশে ব্যবসা করছে, কিন্তু বাংলাদেশকে চীনে ব্যবসা করার সুযোগ সহজ করছে না। এমন কূটচরিত্রের একটি রাষ্ট্রের সঙ্গে স্বাভাবিক কূটনৈতিক সম্পর্ক থাকাই বাঞ্ছনীয়। এরচেয়ে বেশি মাখামাখি আমাদের জন্য কল্যাণ বয়ে আনবে না। বরং আমরা নানাদিক থেকে ক্ষতিগ্রস্ত হব। যুক্তরাষ্ট্র এবং পাশ্চাত্য আমাদের দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নিলে আমাদের পোশাক-শিল্প এবং প্রবাসী-রেমিট্যান্সনির্ভর অর্থনীতি মুখ থুবড়ে পড়বে। সেই ক্ষতি পুষিয়ে দেওয়ার ক্ষমতা চীনের নেই। দেশটির সংকীর্ণ জাতীয় স্বার্থ এবং ব্যবসার বাইরে বন্ধু রাষ্ট্রের পাশে দঁড়ানোর মতাদর্শিক হৃদয় চীনা শাসকদের আছে বলে মনে হয় না।

ঢাকায় যুক্তরাষ্ট্র দূতাবাসের এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানা গেছে, ২০১৯-২০ শিক্ষাবর্ষে বাংলাদেশ থেকে সবচেয়ে বেশিসংখ্যক শিক্ষার্থী উচ্চ শিক্ষার জন্য যুক্তরাষ্ট্রে গেছেন। গত বছরের তুলনায় এই হার ৭ দশমিক ১ শতাংশ বেশি। এই হার ২০০৯ সালের তুলনায় তিন গুণ। নভেল করোনাভাইরাস (কোভিড-১৯) মহামারির সংকট কালেও এ বছর মোট ৮ হাজার ৮৩৮ জন শিক্ষার্থী উচ্চ শিক্ষার জন্য যুক্তরাষ্ট্রে পাড়ি জমিয়েছেন। ২০১৯ সালে এই সংখ্যা ছিল ৮ হাজার ২৪৯ জন। 

হ্যাঁ, পাশ্চাত্যের কথা বলছিলাম। অনেক বছর আগে ভারতীয় উপমহাদেশে আধুনিক শিক্ষাব্যবস্থা, যুক্তিবিদ্যা, বিজ্ঞান, গণতন্ত্র, মানবিক-ভালোবাসা, ন্যায়বিচার ও নারীমুক্তির ধারণা এসেছে পাশ্চাত্যের জ্ঞানভান্ডার থেকে, ঔপনিবেশিক শাসকদের হাত ধরে। যুক্তরাষ্ট্র এই পাশ্চাত্যের আধুনিক যুক্তিবাদী দর্শন ও বৈজ্ঞানিক কৃৎ-কৌশলের সাজানো বাগান, ফরাসি বিপ্লবের আধুনিক সন্তান। স্বীকার না করলে বড় বেঈমানি হবে যে, পাশ্চাত্য জ্ঞান-বিজ্ঞান-সাহিত্যের উত্তরাধিকার বহন করেই আমরা আজ বিশ্বের বুকে মাথা তুলে দাঁড়িয়েছি। এই যে শির উঁচু করে দাঁড়ানোর ব্যাপার, এখানে কিন্তু চীনের বিন্দুমাত্র অবদান নেই। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের সময় দেশটি ছিল পাকিস্তানের পক্ষে। আমার দেশের শিক্ষিত সমাজ চীনের পুরাকালের জ্ঞানী ব্যক্তি তাওবাদী লাও জু, কপালবাদী কনফুসিয়াস কিংবা আধুনিক কালের বস্তুবাদী সাহিত্যিক ল্যুসুনকে চিনে না। কিন্তু সক্রেটিস, অ্যারিস্টটল, শেকসপিয়র, বার্টার্ন্ড রাসেল, গেটিসবার্গ অ্যাড্রেসের আব্রাহাম লিংকন ও বর্ণবাদবিরোধী আন্দোলনের নেতা মার্টিন লুথার কিংকে ঠিকই চিনে। তবে আমাদের কমরেডরা এক দিন কণ্ঠে রক্ত তুলে চীনা নেতা মাও সেতুংয়ের পক্ষে স্লোগান দিয়ে ছিলেন, ‘চীনের চেয়ারম্যান আমাদের চেয়ারম্যান। চীনই হচ্ছে মহান সাম্যবাদী আন্দোলনের কেন্দ্র। চীনের পার্টি নিভুল ইত্যাদি।’ কিন্তু দেশের মানুষ সেই স্লোগান গ্রহণ করেনি। ওই চেয়ারম্যানওয়ালারা এখন দেশের রাজনীতিতে দেউলিয়া হয়ে আক্ষরিক অর্থেই সর্বহারায় পরিণত হয়েছেন।

বাংলাদেশের রেমিট্যান্স আয়, পোশাকশিল্পের ক্রেতা এবং অভিবাসন যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপ, কানাড়া ও অস্ট্রেলিয়াকেন্দ্রিক। যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে বাংলাদেশের রপ্তানি পণ্যের ৯৭ শতাংশ যায় বিনা শুল্কে। কানাডা ও অস্ট্রেলিয়া পাশ্চাত্য ভাবধারার দেশ, যুক্তরাষ্ট্রের আদর্শিক মিত্র। এসব দেশ ও মহাদেশে বাংলা-ভাষী এবং বাংলাদেশি বংশের অভিবাসীরা বাস করছেন অন্তত চার প্রজন্ম ধরে। এই অভিবাসীরা সেসব দেশের অর্থনীতিতে, বিচারালয়ে, আইনসভায় গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করে আছেন। প্রশংসনীয় অবদান রাখছেন। অনেকে আইনসভার সদস্য, স্থানীয় প্রশাসনে জনপ্রতিনিধি হয়েছেন। অনেকে কমিউনিটি পর্যায়ে নেতৃত্ব দিচ্ছেন, গণতন্ত্র ও মানবাধিকারহীন চীনে বিদেশি বংশের কারো জন্য এ ধরনের সামাজিক ক্ষমতায়ন এবং সুযোগ পাওয়ার কথা কি কল্পনা করা যায়! এ ছাড়া সৌদি আরব ও মধ্যপাচ্যের যেসব দেশে আমাদের দেশের শ্রমশক্তির বাজার রয়েছে, সেসব দেশও পাশ্চাত্যমুখী এবং যুক্তরাষ্ট্রের মিত্র। আমাদের বর্তমান প্রজন্মের কর্মঠ, মেধাবী ও কারিগরি কর্মকৌশলে দক্ষ এবং ইংরেজি জানা মানুষদের কর্মসংস্থান ও অভিবাসনের জন্য বেছে নিতে হবে যুক্তরাষ্ট্র এবং পাশ্চাত্যকে। অন্যদিকে আমাদের অর্থনৈতিক উন্নয়ন আরো গতিশীল করা, নারীর ক্ষমতায়নের চলমান ধারা অব্যাহত রাখা এবং মৌলবাদী-জঙ্গিদের সমাজ থেকে নির্মূল করতে বাংলাদেশকে যুক্তরাষ্ট্র ও পাশ্চাত্যের দেশগুলোর সঙ্গে একযোগে কাজ করতে হবে। সেজন্য পাশ্চাত্য সমাজ ও সংস্কৃতি সম্পর্কে আমাদের আরো অধিক জ্ঞান ও শিক্ষা দরকার। ঠিক তেমনই দরকার যুক্তরাষ্ট্র ও পাশ্চাত্য দেশগুলোর সঙ্গে আরো গভীর ক‚টনৈতিক সম্পর্ক এবং সাংস্কৃতিক বিনিময় ও মেলবন্ধন। সে সম্পর্কের সোনালি দুয়ার উন্মুক্ত করতে ইন্দো-প্যাসিফিক অ্যাগ্রিমেন্ট বা অ্যালায়েন্সে শরিক হওয়ার ব্যাপার দ্বিধা থাকা উচিত নয় আমাদের। 

যুক্তরাষ্ট্রে আবারো নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প এশিয়া-প্যাসিফিক অঞ্চলে এই জোটের মিত্র বাড়ানোর জোর তৎপরতা চালাবেন, বরং তার প্রশাসন এই জোটকে আরো সুসংহত করার কাজ জোরদার করবে। তাইওয়ানের স্বাধীনতা সুরক্ষায় বলিষ্ঠ কূটনৈতিক ও সামরিক মহড়া চালাবে। সে কারণে বাংলাদেশকে এই সুযোগ কাজে লাগাতে হবে। ইন্দো-প্যাসিফিক অ্যাগ্রিমেন্ট বা অ্যালায়েন্সে যুক্ত হতে হবে।

## লেখক: সাংবাদিক ও রাজনীতি বিশ্লেষক, ইমেইল: shahidullahjd@gmail.com, phone: 01552445897, 01576610021  --- 25.11.2024.

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
Archive
 
সাম্প্রতিক পোষ্টসমূহ