Banner
বাঙালির দাস মনোবৃত্তি, রোগের নাম পাকিফিলিয়া -- ফ. র. আল-সিদ্দিক

লিখেছেনঃ ফ. র. আল-সিদ্দিক, আপডেটঃ May 19, 2011, 4:56 AM, Hits: 37667

 

ব্যক্তিগত জীবনে আমি যদি হই একজন অধম নগণ্য ব্যক্তি আর আপনি যদি হন স্বনামধন্য একজন উত্তম মানুষ, সেক্ষেত্রে আমি যদি এতরফাভাবে আপনাকে সম্মান দেখাই, তাহলে তা তেমন বিসদৃশ দেখায় না। কিন' আমার সমান মানের একজন লোক যদি আমাকে তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করে, নীচ প্রকৃতির মানুষ বলে মনে করে এবং তার বদলে আমি যদি সেই লোকটির প্রতি সর্বদা খুব বেশি সম্মান দেখাই, তাকে নিয়ে সর্বদা গর্ববোধ করি, পারি তো তাকে নিয়ে মাথায় তুলে নাচি, তাহলে বুঝতে হবে যে, আমার চিন্তা ও চেতনায় কিছু একটা গণ্ডগোল আছে। এটা তখন হয়ে পড়ে এক ধরনের পাগলামির নামান্তর। এ কথাটা ব্যক্তিগত জীবনেও যেমন সত্যি, জাতিগত জীবনেও তেমনি সত্যি।

 

অহেতুক দুর্বলতা :
 

অন্য জাতির প্রতি অহেতুক দুর্বলতা, শুধু বাঙালিদের মধ্যেই নয়, অন্য অনেক জাতির মধ্যেও আছে। প্রায়ই একটা জাতি অন্য একটা জাতিকে নিয়ে এই ধরনের মাতলামি করে থাকে। ফরাসি জাতিকে নিয়ে ইংরেজদের মধ্যে এই রকম একটা মাতলামি রয়েছে। ফ্রান্সের নরমাণ্ডির ডিউক দ্বিতীয় উইলিয়াম ১০৬৬ খৃস্টাব্দে ইংল্যাণ্ড জয় করে প্রথম উইলিয়াম নাম গ্রহণ করে সে দেশ শাসন করতে থাকে। তখন থেকে অনেক দিন পর্যন্ত ইংরেজরা এই নরমান্ডীয় ফরাসিদের অধীনে ছিল। এই সময়কার সম্রাটগণ শিক্ষা ও সংস্কৃতির ক্ষেত্রে ইংরেজির বদলে ফরাসি ভাষা চালু করে। ফলে স্বভাবতই সেযুগের রাজ অনুগত সভাসদ এবং দেশের শিক্ষিত উচ্চ বিত্তের মানুষেরা ফরাসি ভাষায় কথা বলতে এবং ফরাসি সাহিত্য ও সংস্কৃতি সম্বন্ধে তাদের যে ভাল জ্ঞান আছে, সে কথা প্রকাশ করতে গর্ববোধ করতো। এই ভাবে ইংরেজদের মধ্যে ফরাসি ভাষা ও সংস্কৃতির প্রতি যে আকর্ষণ ও প্রবণতা গড়ে ওঠে, তা এখনো অনেকটা বেঁচে আছে।

 

উল্টো দিকে ফরাসিরা ইংরেজদেরকে একটু নীচ জাত বলেই মনে করে। ইংরেজরা সাধারণত ফরাসি ভাষায় কথা বলতে পারলে নিজেকে ধন্য মনে করে। অথচ ফরাসিরা ইংরেজি ভাষা জানলেও সে ভাষায় সহজে কথা বলতে চায় না। আমি ইংরেজদের এই ফরাসি পছন্দ মাতলামি রোগটির নাম দিয়েছি ফ্রাঙ্কোফিলিয়া।

 

ইংরেজদের ফ্রাঙ্কোফিলিয়ার মতন আমাদের মধ্যেও একটা মাতলামির রোগ আছে। সেই রোগটার নাম দেয়া যাক পাকিফিলিয়া। বাংলাদেশ পাকিস্তানের পাকিস্তানের কলোনি থাকাকালীন সময়ে, সে দেশের প্রতি এক ধরনের দামনোবৃত্তি থেকে আমাদের দেশের অনেকের মধ্যেই একটা প্রভুভক্তি গড়ে ওঠে। সেটাই পাকিফিলিয়া রূপে আমাদের মধ্যে এখনো বেঁচে আছে। আমরা আজো পাকিস্তানকে নিয়ে গর্ব করি। সে দেশের লোকদেরকে এতো বেশি ভালোবাসি যে তাদের কাছে যে আমাদের কোটি কোটি টাকা পাওনা আছে, সে টাকা যে তারা আমাদেরকে ফিরিয়ে দেবার নামও করছে না, এটা যে তাদের অন্যায়, এ কথা আমাদের দেশের অনেক মানুষ ভাবতেও চায় না।

 

অথচ যদি সভ্য জগতের দিকে তাকাই, তাহলে আমরা দেখতে পাবো যে, দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময় যে সব নাৎসি নরপশু ইহুদিদের ওপর অত্যাচার করেছে, তাদেরকে হত্যা করেছে, সেই যুদ্ধ অবসানের পর সেই নাৎসি অপরাধীরা বিশ্বের কোন অল্প পরিচিত দেশে পালিয়ে গিয়েও আত্মগোপন করে থাকতে পারে নাই। ইহুদিরা তাদেরকে ধরে এনে বিচার করেছে, তাদেরকে শাস্তি দিয়েছে।

 

জাপানিরা যে সব কোরিয়ান রমণীদের জোর করে যৌন সেবাদাসী হিসেবে মহাযুদ্ধের সময় ব্যবহার করেছিল, তারা এখন তাদের ওপর সেই অত্যাচারের বিচার চেয়ে তার ক্ষতিপূরণ আদায় করে নিচ্ছে।

 

দ্বিতীয় মহাযুদ্ধে নাৎসিরা জার্মান্ত ইহুদিদের কাছ থেকে যে সব সোনাদানা লুট করেছিল, এ যুগের ইহুদিরা সেগুলো ফেরত চাচ্ছে এবং খুব সম্ভবত তারা তা ফেরত পেয়েও যাবে।

 

আমাদের মুক্তিযুদ্ধের সময় পশ্চিম পাকিস্তানিরা বাঙালিদের ওপর যে আত্যাচার করেছে, যতো শিশু, বৃদ্ধ, যুবক ও কিশোরকে হত্যা করেছে ডাকাতি, লুটপাট, নারী ধর্ষণ ও নির্যাতন করেছে, তার ক্ষতিপূরণ চাওয়া তো দূরের কথা তখনকার পাকিস্তান ভেঙ্গে যখন দুই ভাগ হলো তখন সেই ভাগ বাটোয়ারা থেকে আমাদের যা প্রাপ্য, পাকিস্তানিদের কাছে সেই টাকাটা ফেরত চাওয়ার আগ্রহও আমাদের অনেকের মধ্যে নেই। আমরা এতাই উদার পাকিস্তানের প্রতি। শুধু কি তাই, তাদের সেই পৈশাচিক কার্মকান্ডগুলি যে ছিল মানবতার বিরুদ্ধে যঘন্য অপরাধ সে কথাও আমাদের দেশের অনেকে উপলব্ধি করতে চায় না, অথবা মানতে চায় না।

 

পাকিস্তা নিদের প্রতি আমদের দরদ এতোই বেশি যে, কোন আন্তর্জাতিক খেলায় পাকিস্তান জিতলে আমাদের দেশের অনেকেরই বুক গর্বে ভরে ওঠে, তারা খুশিতে আত্মহারা হয়ে যায়, কেউ কেউ তো খুশির চোটে মিষ্টিও বিলাতে শুরু করে দেয়, এমনকি গরু জবাই করে, ডেকচি ডেকচি বিরিয়ানী রান্না করে, উৎসবে মত্ত হয়ে পড়ে।

 

কথায় বলে : আপনি যদি আমাদে হাজি বলেন, তাহলেই শুধু আমি আপনাকে গাজি বলবো! তাই পাকিস্তা ন ও পাকিস্তা নিদের নিয়ে আমাদের অহেতুক দুর্বলতা দেখানো কতোটুকু সম্মানজনক তা বুঝতে হলে পাকিস্তা নিরা আমাদের জাতি, মানুষ ও ভাষা সম্বন্ধে কি রকম ধারণা পোষণ করে, সেটা আমাদের জানার দরকার রয়েছে।

 

 

নির্বোধ অহঙ্কার :

 

১৯৬৩-৬৪ সালে আমি বছর খানেক লাহোরে কাটিয়েছি। আমি তখন লক্ষ্য করেছি যে, সেখানকার অনেকের মনেই এমন ধারণা রয়েছে যে, আমরা বাঙালিরা একটা যাদুটোনার দেশের মানুষ। মোটামুটি কামরুপ কামাক্ষ্যার লোকদের প্রতি আমাদের দেশের মানুষের যে রকম ধারণা, আমাদের প্রতি পাঞ্জাবিদের ধারণাও অনেকটা সেই রকম, তার চেয়ে কোন উঁচু রের নয়।

 

সে যুগে রেডিও পাকিস্তা নের ঢাকা স্টেশন থেকে প্রায় শতকরা ৩০ থেকে ৩৫ ভাগ গান, উর্দু ভাষায় সমপ্রচরিত হতো। তার বিপরীতে ১৯৬২ সালের আগ পর্যন্ত পশ্চিম পাকিস্তা নের রেডিও স্টেশনগুলো থেকে বাংলা ভাষায় কোন গান সমপ্রচার করা হতো না। আমি যখন লাহোরে পৌছি তখন পশ্চিম পাকিস্তানি রেডিও স্টেশনগুলোতে বাংলা গানের প্রতি এই রকম বিমাতাসূলভ আচরণের জন্য বাঙালিদের কাছ থেকে প্রবল সমালোচনার মুখে সেখানকার স্টেশনগুলো থেকে দৈনিক দু’একটা করে বাংলা গান সমপ্রচার করা শুরু হয়।

 

কি আমি যতোদিন পশ্চিম পাকিস্তা নে ছিলাম, ততোদিন কখনোই ওখানকার লোকদেরকে রেডিও থেকে সমপ্রচারিত পুরো একটা বাংলা গান শুনতে দেখিনি। পান বিড়ির দোকান, কিংবা চায়ের দোকানে, হোটেল-রেসে-ারায় বা অন্য কোনখানে দেখতাম, যখনই রেডিওতে কোন একটা বাংলা গান সমপ্রচারিত হচ্ছে, তখনই তারা রেডিওর নব ঘুরিয়ে অন্য একটা স্টেশন টিউন করে, সেখান থেকে সমপ্রচারিত উর্দু কিংবা পাঞ্জাবি গান শুনছে। পশ্চিম পাকিস্তা নে অনেকগুলো রেডিও স্টেশন থাকায় ওই অঞ্চলের লোকদের পক্ষে এইভাবে বাঙলা গানের বদলে অন্য গান শুনতে পারা সম্ভব হলেও, আমাদের পূর্ব পাকিস্তা নের মানুষদের জন্য উর্দু গানের বদলে বাংলা গান শোনার সে রকম কোন বিকল্প সুযোগ ছিল না। ঢাকা রেডিও থেকে যখন উর্দু গান সমপ্রচারিত হতো তখন সেটা আমাদের শুনতেই হতো। কারণ প্রধানত বাঙলা ভাষায় সমপ্রচারিত রেডিও স্টেশন, সে যুগের পাকিস্তা নে একটাই ছিল।

 

তবে শুনেছি, মুক্তিযুদ্ধের সময় লণ্ডন প্রবাসী বাঙালিদের মধ্যে মুক্তিযুদ্ধ বিরোধী প্রচারণা চালাবার জন্য পশ্চিম পাকিস্তা নের কোন একটা রেডিও স্টেশন থেকে একটা বাংলা প্রোগ্রাম নিয়মিত সমপ্রচার করা হতো। তবে সেটাও প্রমিত বাংলায় নয়, শ্রীহট্টের আঞ্চলিক উপভাষায়। একেই বলে, ‘ঠেলার নাম বাবাজি।’

 

 

 

এইতো গেলো বাঙালিদের প্রতি পাকিস্তা নের সাধারণ মানুষদের মনোভাব। ও দেশের শিক্ষিত মানুষদেরও মাঝে মধ্যে দেখেছি, পথে ঘাটে থেকে অজানা অচেনা কেউ হয়তো, আচমকা, অনেকটা যেন ভুঁইফুড়ে উঠে এসে, আমাদের সাথে, আলাপ করার জন্য এগিয়ে এসে বলতো, ‘আপতো হামারে মাসরেকি পাকি স্তা নকা ভাই হো,  হামারে কলিজাকা টুকরা হো’। এই রকম এক গাদা মন ভোলানো কথাবার্তা বলার পর, শেষে তার মানের আসল কথাটা প্রকাশ করেই ফেলতো, ‘মাগার এক বাৎ হামারা সমঝ মে নেহি আতা, বাঙালি লোগও কা দেমাগ (বুদ্ধি) এতনা কম কিউ। ও লোক এতনা বুজদিল (ছাগলের হৃদয়, মানে, কাপুরুষ) কিউ। হামকো মাআলুম হোতা, ও লোগ মাছলি, (মাছ) খাতা উছি লিয়ে ও মছলিকা মাফিক বুজদিল ও কমতি দেমাগ (বুদ্ধি) ওয়ালা হোতা। আপ এক কাম কিজিয়ে, চাওল (ভাত) আওর মছলি খানা ছোড় দিজিয়ে। হামারা মাফিক রোটি আরও গোস্ত খানেছে সব কুছ ঠিক হো যায়ে গা।’

 

দেখুন, ব্যাটাদের স্পর্ধার বাড়াবাড়ি (তখন পর্য ন্ত) এই বাঙালি জাতির একজন লোক নোবেল প্রাইজ পেয়েছিল, যা তাদের মধ্য থেকে কেউ তখনো পায়নি। সারা বিশ্বব্রহ্মান্ডের সমস্ত বনিচয় যতো ধরনের পরম কণিকা দিয়ে তৈরি, সেগুলোকে প্রাথমিকভাবে যে দুটি ভাগে ভাগ করা হয়েছে, তার একটি ভাগের নামকরণ করা হয়েছে একজন বাঙালি বিজ্ঞানীর নামে, বিজ্ঞানে সেই বিজ্ঞানীটির অবদানের স্বীকৃতি হিসেবে। অথচ এই অর্বাচীন পাকিস্তা নিরা সেই বাঙালি জাতিকেই বলছে কিনা নির্বোধ! দিল্লির সুলতানাত সারা ভারতের অধিকারী হয়ে, এই উপমহাদেশের বিীর্ণ অঞ্চল থেকে আহরিত ধন্তসম্পদ ও সৈন্য বলের মালিক হয়েও, যে দেশকে প্রায়ই দখল করে রাখতে পারতো না,জ্জ দুদিন পরে পাকি স্তা নের সুসজ্জিত এবং ভালোভাবে প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত এত বড় সেনাবাহিনী, যে দেশের প্রায় নিরস্ত্র এবং প্রশিক্ষণহীন মুক্তিবাহিনীর হাতে মার খেয়ে কুপোকাত হয়ে যাবে,জ্জ সেই বাঙালি জাতিকে এরা বলে কিনা ভীরু, কাপুরুষ! নির্বোধ অহঙ্কার আর কাকে বলে?

 

উচিত ছিল বাঙালিদের প্রতি কৃতজ্ঞ থাকা :

পাকিস্তানের সাধারণ লোকদের কথা না হয় বাদই দেয়া যাক! সে দেশের এককালীন প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খানকে নিয়ে পূর্ব পাকিস্তানের অনেকে এক সময় কম নাচানাচি করেনি। তার বিখ্যাত পুকের নাম ‘ফ্রেইণ্ডস, নট মাস্টারস (প্রভু নয়, বন্ধু!)’ এই পুকটিও আমাদের কাউকে কাউকে এতোই অভিভূত করেছে যে, বর্তমানে এ দেশের একটি রাজনৈতিক দল, এই বইয়ের নামটিকেই একটুখানি পরিবর্তিত করে এক সময় তাদের দলীয শ্লোগান বানিয়েছিল। ‘বিদেশে আমাদের বন্ধু আছে; কোন প্রভু নেই’, এই কথাটি লিখে লিখে এক সময় তারা বাংলাদেশের দেয়ালের পর দেয়াল ভরে ফেলে দিয়েছিল। সেই ‘ফ্রেইণ্ডস নট মাস্টার’ নামক বইটির ২৭ পৃষ্ঠায় আইয়ুব খান বাংলা সঙ্গীতের প্রশংসার ছদ্মবেশে বাঙালির মাধুর্য নিয়ে কি রকম কটাক্ষ করেছে, তা একটু দেখা যাক! সেখানে উনি লিখেছেন : I told an East Pakistani friend once, ‘You have such a sweet music, I wish to God, you were half as sweet yourself.’ কথাগুলোর ভাবানুবাদ করলে দাঁড়ায়- ‘আমি একদিন পূর্ব পাকি স্তা নি এক বন্ধুকে বলেছিলাম, তোমাদের সঙ্গীত এতো মধুর। আমি আল্লাহকে বলি, তোমাদের যদি এর অর্ধেক মাধুর্যও থাকতো।’

 

আমাদের দুর্ভাগ্য যে বাঙালির মেয়ে সুম্মিতা সেন যেদিন মিস ইউনিভার্স হলো, সেদিন আইয়ুব খান বেঁচেছিলেন না। সেদিন তিনি বেঁচে থাকলে, বাঙালি জাতির মাধুর্য নিয়ে তার সেই কটাক্ষ করা যে, কতটা বাড়াবাড়ি হয়ে গিয়েছিল, তা হয়তো তিনি বুঝতে পারতেন।

 

বিশ্বসুন্দরী প্রতিযোগিতার তেমন একটা সমর্থক কোন দিনই আমি ছিলাম না। তবুও ষাটের দশকে কেমব্রিজের মিউনিসিপালিটি লাইব্রেরি থেকে ধার নিয়ে যখন আইয়ুব খানের বইটি থেকে এই কথাগুলো পড়ছিলাম তখন রাগের চোটে আমার মনে হচ্ছিল যে, বাঙালিদের মাধুর্য সম্বন্ধে আইয়ুব খান তথা পাকিস্তানিদের এই ভ্রান্ত ধারণা ভুল বলে প্রামাণ করার জন্যই বাঙালি মেয়েদের বিশ্বসুন্দরী প্রতিযোগিতায় যোগ দেয়া দরকার।

 

শের-এ-বাংলা ফজলুল হক কর্তৃক উত্থাপিত লাহোর প্র স্তা বের নীতি অনুসারে ভারত বিভক্ত হলে, বাংলাদেশ তখন থেকেই একটি স্বাধীন এবং সার্বভৌম দেশ হিসেবে আবির্ভূত হতো। সেটা তখন পাকি স্তা নের অংশ হতো না।

 

আমাদের তৎকালীন নেতৃত্বের অনেকেই পাকি স্তা নিদের বিশ্বাস করে বেশি আপনজন ভেবেছিল বলেই তাদের সঙ্গে মিলে ‘একদেশ একজাতি’ গড়ার বৃথা চেষ্টা করেছিল। ফলে আইয়ুব খান পশ্চিম পাকি স্তা নিদের সঙ্গে সঙ্গে বাঙালিদেরও প্রেসিডেন্ট হবার সুযোগ পেয়েছিলেন। তার জন্য আইয়ুব খানের উচিত ছিল বাঙালিদের প্রতি কৃতজ্ঞ থাকা।

 

 

কি তাতো হবার নয়। উপনিবেশের শাসকরা সেই উপনিবেশের বাসিন্দাদের প্রতি কখনো কৃতজ্ঞ হয় না, বরং তাদেরকে নিয়ে বিদ্রুপ করে। বাংলাদেশ ছিল পাকি স্তা নের উপনিবেশ মাত্র। তাই পাকিস্তানি প্রভুদের কাছে বাঙালিরা বিদ্রুপই শুধু পেতো।

 

পাকি স্তা নিদের সেদিনকার সেই অত্যাচার, অনাচার ও নিষ্ঠুরতা ভুলে গিয়ে আমরা বুক চিতিয়ে যতোই না বলি যে, ‘বিদেশে আমাদের প্রভু নেই, বন্ধু আছে’ সেই বন্ধুদের কাছে আমরা আমাদের পাওনা টাকা ফেরত চাইলে এবং তাদের কাছে এ দেশে আটকে পড়া পাকি স্তা নিদের ফেরত নেবার অুনরোধ করতে গেলেই আমরা বুঝতে পারবো, তারা আমাদের কত এবং কেমন বন্ধু!

 

 

মুখেই শুধু ‘কলিজা কা টুকরা’ :

 

এখন পাকি স্তা নের উঁচু তলার মানুষদের বাংলা ভাষা সম্বন্ধে জ্ঞান কি রকম গভীর, তার একটা উদাহরণ দেয়া যাক! আমাদের মুক্তিযুদ্ধ শুরু হবার বছর দুই আগে, তখন আমি কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণা করছিলাম। তখনকার এক সন্ধ্যায় সেখানকার ইন্টান্যাশনাল ক্লাবে আমাদের উপমহাদেশীয় সংস্কৃতির ওপর একটা আলোচনার অনুষ্ঠান হচ্ছিল। তাতে বেশ কিছু পশ্চিম পাকি স্তা নি ছাত্র-ছাত্রীও উপসি'ত ছিল। তারা সবাই পাকিস্তানের সমাজের উঁচু তলার ছেলেমেয়ে।

 

এই সভায় প্রদর্শনের জন্য আমি বেশ কয়েকটি বাংলা বই সঙ্গে নিয়ে গিয়েছিলাম। সে সময়ের থেকে বেশ কিছু বছর আগেই বাংলা ভাষাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া হয়েছিল। তাই এতো দিনের মধ্যে আমাদের মাগরেবী পাকিস্তানের প্রাণপ্রতিম ভাইদের উচ্চ শিক্ষিত ও মেধাবী ছেলেমেয়েরা বাংলা ভাষা সম্বন্ধে কতোটুকু ওয়াকিবহাল তা জানার জন্য তাদের একটু পরীক্ষা করে জানতে পারলাম যে, তাদের মধ্যে কেউ এই বইগুলো পড়তে পারা তো দূরের কথা, সেগুলো কোন ভাষায় লেখা তাও তারা বলতে পারলো না। শেষ পর্যন্ত তাদের মধ্য থেকে সাহস করে একজন বলে উঠলো, ‘তকরিবান, ইয়ে কেতাব কো জবান স্যাংস্কৃট ল্যাঙ্গুয়েজ হো ছ্যাকে।’ যে ছেলেটি এই কথা বলেছিল, সে যেমন তেমন ঘরের ছেলে নয়। সে ছিল পূর্ব পাকিস্তানের কোটা থেকে মনোনিত সংসদ সদস্য এবং পাকি স্তা নের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী নবাব জাদা লিয়াকত আলী খানের ভ্রাতুষ্পুত্র।

 

এ কথা শুনে আমার মনের অবস্থা যে কি রকম হয়েছিল, তা বুঝতেই পারছেন। যে ‘মাসরেকি পাকি স্তা ন কো ভাই’ তাদের ‘কলিজাকা টুকরা’, ‘দিল কি তামান্না’, সেই ‘বাঙালি’ ভাইদের ভাষার বর্ণমালা দেখে চিনতে পারে, এমন একজন লোকও পাওয়া গেল না এতোগুলো পশ্চিম পাকিস্তানি শিক্ষিত পরিবারের মেধাবী ছাত্র-ছাত্রীদের মধ্যে। অথচ এদের মধ্যে বেশ কয়েকজন কেমব্রিজে আসার আগে কলেজ অথবা বিশ্ববিদ্যালয়ে বিভিন্ন ভাষা বা সাহিত্যে শিক্ষকতা করে এসেছে।

 

পাঞ্জাব রিলিজিয়াস বুক সোসাইটির প্রকাশনা সংা, ‘মির্জা বুক এজেন্সি’ (মতান্তরে ফিরোজ সন্স), লাহোর থেকে যে উর্দু অভিধান প্রকাশ করেছিল, তাতে বাঙালি শব্দের মানে বোঝাতে গিয়ে যে উদাহরণটি দেয়া হয়েছিল সেটি হলো, ‘বাঙালি, আগার আদমী হো তো প্রেত কঁহু কিসকো?’ এটা সর্বজন বিদিত যে, একটা বাক্যকে তখনই একটি দেশের বইতে এ ধরনের উদাহরণ হিসেবে ব্যবহার করা হয়, যখন সেটা সে দেশে বহুলভাবে প্রচলিত। ফলে বোঝাই যাচ্ছে যে, সে দেশের লোকেরা বাঙালিদের কি রকম সম্মানের চোখে দেখে থাকে।

 

পরমাণু শক্তি কমিশনে কর্মরত যে বিজ্ঞানীটি লাহোর থেকে এর প্রতিবাদ জানিয়েছিলো, তার নাম এখলাস উদ্দিন আহমেদ (পরবর্তী জীবনে তিনি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থ বিদ্যার প্রফেসর হয়েছিলেন)। সেদিন ঢাকার পত্রিকাগুলোতে তার এই প্রতিবাদের সংবাদ ছাপা হয়েছিল। এ ব্যাপারে প্রতিবাদ করার মত দৃঢ়তা দেখানোর জন্য সেদিন পাকি স্তা ন সরকার এখলাসুর রহমানের বিরুদ্ধে কোন রকম শাসি-মূলক ব্যবা গ্রহণ করতে সাহস পায়নি। কারণ, তখন সে রকম কিছু করতে গেলে সারা পূর্ব পাকি স্তা নে প্রতিবাদের ঝড় উঠতো। বাঙালির ন্যায্য অধিকারের কথা বললেই তাকে ইণ্ডিয়ান এজেন্ট বলে সহজেই কাউকে জেলে পুরে দিতে পারার স্বর্ণযুগ তখন প্রায় সি-মিত হয়ে এসেছে এবং বাঙালি পরিচয়টা সেদিন বেশিরভাগ বাঙালির কাছে গর্বের ব বলে পরিগণিত হয়ে গিয়েছিল। তাই সেই বইটির প্রকাশক সেদিন শান্ত ছেলের মতো তাদের অভিধানের পরবর্তী সংস্করণ থেকে এই বাক্যটি প্রত্যাহার করে নিয়েছিল।

 

বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর থেকে একদল লোক বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতির প্রতি বাঙালির আকর্ষণকে নিসে-জ করে দেয়ার জন্য ভীষণভাবে চেষ্টা করতে থাকে। এ ব্যাপারে উর্দু-পছন্দ ও পাকি-পছন্দ রাজনৈতিক দলগুলোই প্রধান ভূমিকা নেয়। এ ব্যাপারে যে তারা কতটা সফল হয়েছে, তা আমরা এদেশের ইলেকশনের ফলাফলগুলোর দিকে তাকালেই বুঝতে পারবো।

 

আত্মপরিচয়ের সমস্যা :

 

এ থেকে বুঝা যায় যে, আমাদের দেশের জনগোষ্ঠীর মধ্যে উল্লেখ্যযোগ্য একটা অংশের মনে নিজ দেশ, জাতি, ভাষা ও সংস্কৃতির চেয়ে অন্য একটা দেশ, জাতি, ভাষা ও সংস্কৃতির প্রতি বেশি আকর্ষণ ও মমত্ববোধ রয়েছে। ফলে এই জাতিটি একটি মারাত্মক ‘আইডেন্টিটি ক্রাইসি বা আত্মপরিচয়ের সমস্যায় ভুগছে। আমাদের এই সমস্যাটি নিয়ে একটা পূর্ণাঙ্গ আলোচনা হওয়া উচিত। আপাতত এ বিষয়ে একটি সংক্ষিপ্ত আলোচনা করা যাক!

 

নানা কারণে কোন একটা দেশের মানুষ নিজের দেশ, ভাষা ও সংস্কৃতির চেয়ে অন্য একটি দেশ, সে দেশের মানুষ, ভাষা ও সংস্কৃতির প্রতি বিশেষভাবে আকৃষ্ট, এমনকি আসক্ত হয়ে পড়ে। বাঙালিদের মনে নিজ ভাষার প্রতি বীতরাগ ও অন্য ভাষার প্রতি অনুরাগের উপসি'ততি আজ নতুন নয়। নিজ ভাষার প্রতি বাঙালির এই বীতরাগের প্রতিবাদে বাঙালি কবি আবদুল হাকিমকে (১৬২০-১৬৯০ খৃষ্টাব্দে) সপ্তদশ শতাব্দীতেই মনের দুঃখে লিখতে হয়েছিল ঃ

‘যে সবে বঙ্গতে জন্মি হিংসে বঙ্গবাণী

সে সবার কিবা রীতি নির্ণয় ন জানি॥

মাতা-পিতাসহ ক্রমে বঙ্গতে বসতি

দেশীভাষা উপদেশ মনে হিত অতি॥

দেশীয় ভাষা বিদ্যা যার মনে ন জুয়ায়,

নিজ (দেশ) তেয়াগী (কেন) বিদেশে ন যায়’॥

 

নিজ দেশের চেয়ে পরদেশকে বেশি আপন মনে করার জন্য অনেক সময় যে কি মারত্মক পরিসি'তির সৃষ্টি হতে পারে, তার একটা উদাহরণ পাওয়া যাবে বিংশ শতাব্দীর প্রথম দিকে। আমাদের উপমহাদেশ তখন ইংরেজদের অধিকারে। সে হিসেবে আমাদের উচিত ছিল এদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনকে সর্বতোভাবে সাহায্য ও সহযোগিতা করা। তার বদলে ১৯১৯ থেকে ১৯২৪ সাল পর্যন্ত সময় ধরে, এই উপমহাদেশের মুসলমান নেতৃবৃন্দের প্রধান অংশ, নিজেদের দেশের স্বাধীনতা আন্দোলনে অংশ গ্রহণ না করে, তুরস্কের প্রতিক্রিয়াশীল সুলতানের সমর্থনে, খেলাফত আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়েন। এই আন্দোলনের এক পর্যায়ে তারা এই উপমহাদেশকে মুসলমানদের জন্য বাস করার অনুপযুক্ত ভেবে, এ দেশকে ‘দার-উল-হরব’ ঘোষণা করে, অন্য স্বাধীন মুসলিম দেশগুলোকে নিজেদের দেশ মনে করে, এই গোলামির দেশে আর থাকবো না বলে, প্রচুর সংখ্যক লোক তাদের ঘরবাড়ি ছেড়ে, দলে দলে আফগানি স্তা নে গিয়ে বসবাস করার জন্য রওনা হয়ে যায়। কিন' দুঃখের বিষয় এই যে, আফগান সরকার তাদের সে দেশে বাস করতে দেয়া তো দূরের কথা, প্রবেশ করারও অনুমতি দেয় নাই। ফলে স্বভাবতই নিজের দেশ বলে মনে করা, এত সাধের আফগানি স্তা নের সীমান্ত পর্যন্ত গিয়ে তাদেরকে হতাশ হৃদয়ে ফিরে আসতে হয়েছিল। এই সুদীর্ঘ পথে যেতে এবং হতাশ হৃদয়ে ফিরে আসতে গিয়ে পথক্লেশ, অনাহার, অর্ধাহার, রোগ ও মহামারিতে ভুগে, তাদের মধ্যে বিপুল সংখ্যক লোক মারা গিয়েছিল। পরের দেশকে নিজের দেশ ভেবে কল্পনা বিলাসে মগ্ন হলেই যে, সে দেশটি আমাদের নিজের দেশ হয়ে যায় না, সে কথা সেদিন এই উপমহাদেশের মুসলিম নেতৃত্বের একটা অংশের প্ররোচনায় বিভ্রান্ত একটা জনগোষ্ঠী, অনেক প্রাণের বিনিময়ে বুঝতে পেরেছিল।

 

কি এই বুঝতে পারাটা আমাদের জাতীয় জীবনে চিরায়ী হয়নি। কারণ আমাদের স্কুলের ইতিহাস বইতে কোথাও এই হৃদয় বিদারক ঘটনার উল্লেখ পর্যন্ত নেই। আমিও এই ঘটনা জানতে পারতাম না, যদি আমার বাবার কাছ থেকে এটি না শুনতাম। ইতিহাসের যে সব ঘটনা থেকে শিক্ষা লাভ করা সম্ভব, সে ঘটনাগুলো আমাদের দেশের ছাত্র-ছাত্রীদের কাছ থেকে আড়াল করে রাখা একটা মারাত্মক অপরাধ। আর এই ধরনের অপরাধের জন্যই একটা স্বাধীন দেশের অধিবাসী হয়েও আমাদের আনুগত্য চলে যায় অন্য দেশের প্রতি। তাইতো এদেশের পথভ্রান্ত ধর্মান্ধদের মুখে আজো শ্লোগান শোনা যায়, “আমরা সবাই তালেবান, বাংলা হবে আফগান।”

 

ফার্সিফিলিয়া :

 

আমাদের দেশের অনেকেরই যেমন উর্দু-ফিলিয়া বা উর্দু-পছন্দ রোগ আছে, পশ্চিম পাকিস্তানিদের তেমনি ফার্সি পছন্দ রোগ রয়েছে। তাই ইকবাল নিজে পাঞ্জাবের অধিবাসী হয়েও, পাঞ্জাবিতে তো সাহিত্য রচনা করেনই নাই, উর্দুতেও তুলনামুলকভাবে কম রচনা করেছেন। ফার্সিতেই নাকি তিনি তার বেশিরভাগ বই লিখেছেন।

 

ওদিকে ইরান ছিল ফ্রাঙ্কোফিলিয়া (ফরাসী পছন্দ) রোগে আক্রান্ত। ভাগ্যের কি নির্মম পরিহাস! আমরা পাকি স্তা নিরা যখন ফার্সিফিলিয়ায় ভুগছিলাম, তখন ফার্সি ভাষার উৎপত্তিল ইরান দেশের লোকেরা আক্রান্ত হয়েছিল ফ্রাঙ্কোফিলিয়ায়। কারণ রেজা শাহ পাহলবীর আমলে এবং তার ছেলে মোহাম্মদ রেজা শাহের রাজত্বের প্রথম দিকে, ইরানিরা স্কুলে দ্বিতীয় ভাষা হিসেবে ফরাসি ভাষা শিক্ষা করতো, এবং উচ্চ শিক্ষার জন্য তাদের দেশের মেধাবী ছাত্র-ছাত্রীদের বেশির ভাগই ফরাসি দেশের বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতো। আমরা যখন ইরানে গিয়েছি তখন ইরানিরা ফরাসির বদলে ইংরাজি ভাষা শিক্ষার দিকে ঝুঁকে পড়ছিল। তাই আমাদের সঙ্গে ইংরেজিতে কথা বলে এই ভাষাটিকে ভালোভাবে আয়াত্তে আনার উদ্দেশ্যে অনেক ইরানি ছেলেমেয়ে আমার সঙ্গে হয় সামনা-সামনি এসে চাক্ষুষ, না হয় টেলিফোনের মাধ্যমে বন্ধুত্ব াপন করার চেষ্টা করতো।

 

আমরা তখন পাকিস্তানের অধিবাসী। পশ্চিম পাকি স্তা নিদের মতো আমি নিজেও ফার্সি পছন্দ রোগে আক্রান্ত ছিলাম। কারণ আমার জন্ম হয়েছিল এক ফার্সিপছন্দ পরিবারে। তাই আর পাঁচটি পাকি স্তা নির মতো আমিও আমার ইরানি বন্ধুবান্ধবদের সঙ্গে প্রথম পরিচয়ের দিনগুলোতেই গর্ব করেই বলতাম যে, আমাদের ভাষায় প্রচুর ফার্সি শব্দ ব্যবহৃত হয় এবং আমাদের সাহিত্যিকরা, বিশেষ করে কাজী নজরুল ইসলাম তো তার কবিতা ও অন্যান্য রচনায় প্রচুর আরবি ফার্সি শব্দ ব্যবহার করেছেন। কবি ইকবাল উর্দুর চেয়ে ফার্সিতেই বেশি কবিতা লিখেছেন। আমাদের (পাকি স্তা নের) জাতীয় সঙ্গীত তো পুরোটাই ফার্সি ভাষায় রচিত ইত্যাদি ইত্যাদি।

 

এখানে উল্লেখ করা যায় যে, পাকি স্তা নের জাতীয় সঙ্গীতটি ফার্সি ভাষায় রচিত হলেও এটি রচনার সময়, এর মধ্যে দু’একটা (কারকের) উর্দু বিভক্তি ছিল, পরবর্তীকালে এই গানটির রচয়িতা আবদুল হাফিজ জলন্ধরী সেই কয়টিকেও বদলিয়ে ফার্সি বিভক্তিতে রূপান্তরিত করেন। ফলে শেষ পর্যন্ত পাকি স্তা নের জাতীয় সঙ্গীতে উর্দু ভাষার কোন নাম নিশানাই থাকে না। সেটা পুরোপুরি ফার্সি ভাষায় লিখিত সঙ্গীত হয়ে যায়।

 

পরে বুঝতে পেরেছিলাম যে, আমাদের ফার্সিফিলিয়া নিয়ে ইরানিদের কাছে এতোটা গর্ব প্রকাশ করা খুবই বেমানান হয়েছে। কারণ ওদের সঙ্গে বন্ধুত্বের ঘনিষ্ঠতা বৃদ্ধির এক পর্যায়ে এসে, ওরা যখন আমাদের সঙ্গে সহজ ও সপ্রতিভ হয়ে উঠতো, বিশেষ করে ওদের সঙ্গে সম্বোধন যখন সম্মানজনক ‘আপনি’ থেকে বন্ধুত্বের পরিচায়ক ‘তুই তোকারিতে’ নেমে আসতো, তখন ওদের প্রায় সবাই কোন না কোন সময়ে কতগুলো প্রশ্ন করে আমাদেরকে বিব্রতকর অবায় ফেলে দিতো।

 

ওরা আমাদেরকে জিজ্ঞেস করতো,  তোমাদের ভাষা কি এতোই দুর্বল যে, যথেষ্ট আরবি ফার্সি শব্দের সাহায্য না নিয়ে সে ভাষায় মনের ভাব প্রকাশ করা যায় না? না’ হলে তোমাদের ভাষায় এত আরবি ফার্সি শব্দ ব্যবহার কর কেন?

 

কিংবা তোমাদের কবি নিজস্ব মাতৃভাষা বাদ দিয়ে, ফার্সিতে কবিতা লিখতে যান কেন? সবচেয়ে বড় কথা হলো, তোমাদের কি নিজস্ব কোন উন্নত মাতৃভাষা নেই যে, শেষ পর্যন্ত ফার্সি তেই তোমাদের জাতীয় সঙ্গীত লিখতে হয়?

 

এসব প্রশ্নের সম্মুখীন হয়ে, আমরা বাঙালিরা এতোই লজ্জা পেতাম যে, এরপর থেকে আমাদের ফার্সিফিলিয়া নিয়ে ওদের কাছে আর কোনদিন গর্ব করি নাই।

 

এইসব ঘটনার পরই আমার খেয়াল হলো যে, পাকি স্তা নিদের উর্দুভাষায় আরবি ফার্সি শব্দ ব্যবহার করার প্রচণ্ড প্রবণতার ফলে এমন অবা হয়েছে যে, রেডিও  পাকিস্তানে ব্যবহৃত উর্দু শুনলে সেটাকে এই উপমহাদেশের কোন ভাষা বলে মনেই হয় না। এই ভাষার শুধুমাত্র ব্যাকরণ ও শব্দের ডেক্লেনেশন (বিভক্তি) ছাড়া প্রায় অন্য কিছুই এই উপমহাদেশীয় নয়, এবং একমাত্র ‘হাম, হো, থা, থি’ ছাড়া এই ভাষায় আর কোন উপমহাদেশীয় শব্দ খুব কমই ব্যবহৃত হয়।

 

ইকবাল ফার্সিতে কবিতা লিখতেন বলে ইরানিদের মধ্যে তার কিছুটা পরিচিতি রয়েছে। তার সেই বিখ্যাত কবিতা, যার মধ্যে আছে যে, একটা ঢেউ সমুদ্র সৈকতে পাগলপারা হয়ে হুমড়ি খেয়ে পড়তে পড়তে বলছেঃ

 

 

‘হাস্তাম আগার মীরাভাম

গায়ের নীরাভাম নী স্তা ম।’

যার মানে হলোঃ

 

‘ততোক্ষণ বেঁচে আছি, যতোক্ষণ গতি আছে ভাই,

যে মুহূর্তে গতিহীন, সে মুহূর্তে আমি আর নাই।’

 

কবিতাটি ইরানের বেশিরভাগ শিক্ষিত মানুষের কণ্ঠ। তাই উৎসাহিত হয়ে অনেকে সংস্কৃতিবান ইরানি বন্ধুবান্ধবের কাছে প্রশ্ন রেখেছিলাম যে,জ্জ তারা কবি হিসেবে ইকবালকে কতোটা উঁচু দরের বলে মনে করে? আমার প্রশ্নের উত্তরে তাদের প্রায় সবাই বলেছে যে, ‘দার্শনিক হিসেবে ইকবাল হয়তো অনেক বড়। তবে ফেরদৌসী, হাফিজ, ওমর খৈয়ামের ভাষায় কবিতা লিখে তার পক্ষে তেমন সুনাম অর্জন করা সম্ভব হয়নি। তার উচিত ছিল তার নিজের মাতৃভাষায় কবিতা লিখে সে ভাষা ও সাহিত্যকে সম্পদশালী করা।’

 

পাকিফিলিয়া এবং মুক্তিযুদ্ধের রণধ্বনিঃ

 

এসব কথা শুনে স্বভাবতই আমাদের আরেক বিখ্যাত কবি মাইকেল মধুসুদন দত্তের কথা মনে পড়তো। মাইকেল প্রথম জীবনে ইংরেজি ভাষায় সাহিত্য রচনায় মনোনিবেশ করেছিলেন। শেষ পর্যন্ত সৌভাগ্যবশত রামনারায়ণ তর্করত্নের রত্নাবলী নাটকের ইংরেজি অনুবাদ করতে গিয়েই বাংলা ভাষার সম্পদের (‘মাতৃ কোষে রতনের রাজি’র) সন্ধান পান, এবং এই ভাষায় সাহিত্য রচনায় মনোনিবেশ করে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের অনেক উন্নতি সাধন করেন। ভাগ্যিস অ্যাংলোফিলিয়া রোগ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও মধুসূদন দত্তকে অন্ধ করে দিয়ে ইংরেজি ভাষার কবি, এবং ফার্সিফিলিয়া রোগ কাজী নজরুল ইসলামকে অন্ধ করে দিয়ে ফার্সি ভাষার কবিতে রূপান্তরিত করে নাই, তাই এদের কাছ থেকে আমাদের ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতির অভূতপূর্ব উৎকর্ষতাকে আমরা উপহার হিসেবে পেয়েছি।

 

তবে, এটা আমাদের কাছে বড়োই দুঃখের বিষয় এই যে, পাকিফিলিয়ার জন্য আমাদের জাতীয় জয়ধ্বনি ও মুক্তিযুদ্ধের রণধ্বনি জয়বাংলাকে আমরা হারিয়ে ফেলতে যাচ্ছি। এখন (জানুয়ারি ১৯৯৬) জয়বাংলা তো দূর ান, মুক্তিযুদ্ধের সময় স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে সমপ্রচারিত ‘জয় বাংলা, বাংলার জয়’ গানটি, এমনকি মুক্তিযুদ্ধে ব্যবহৃত অন্য গানগুলোও বিগত একুশ বছর ধরে, তথাকথিত ‘গণতন্ত্রের ঝর্ণাধারায় বিধৌত’ এবং ‘অর্থনৈতিক জোয়ারে প্লাবিত’ এই বাংলাদেশের রেডিও ও টেলিভিশন থেকে আমরা শুনতে পাই নাই। কোন বেতার মাধ্যম থেকে সেদিনএই গানগুলো শুনতে চাইলে আমাদের অপেক্ষা করতে হতো, কবে বিবিসি অথবা ভয়েস অফ আমেরিকা থেকে এই গানটি সমপ্রচারিত হবে, তার আশায়। পাকিফিলিয়া রোগ থেকে মুক্ত হতে না পারলে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা এবং দেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব নিয়ে আমাদের আর গৌরব করার কিছুই থাকবে না।

 

আমরা যে পাকিফিলিয়া নামের একটা রোগে আক্রান্ত হয়েছি, এটা নিশ্চয়ই এতক্ষণে উপরোক্ত আলোচনা থেকে প্রমাণিত হয়েছে। তাই এখন আমাদেরকে বুঝতে হবে যে, এই রোগটি যখন নির্ণীত হয়েছে রোগটির চিকিৎসা করতে হবে। রোগের সুচিকিৎসা করতে হলে সর্বাগ্রে রোগটির কারণ নির্ণয় করতে হবে। এই রোগটি সম্বন্ধে আমি যতটা ভেবেছি তাতে এই রোগটি আমাদের মধ্যে বিরাজ করার পিছনে  দুটো কারণ রয়েছে বলে আমার মনে হয়েছে। এর মধ্যে একটা হলো মর্ষকামিতা, আর একটি হলো হীনমন্যতা বোধ। মর্ষকামিতা বা (mesochism) হলো একটা মানসিক রোগ। এই রোগে আক্রান্ত রোগী যে লোকের হাতে যত বেশি ধর্ষিত হবে, অত্যাচারিত হবে, নিপীড়িত হবে, নিগৃহীত হবে, তার প্রতি তত বেশী আকর্ষণ অনুভব করবে। খোঁজ নিলে দেখা যাবে যে, মুক্তিযুদ্ধের সময় বর্বর পাকি স্তা নিরা যাদের ঘর বাড়ির জ্বালিয়ে পুড়িয়ে দিয়েছিল কিং বা অন্য কোনভাবে তাদেরকে নির্যাতিত করেছে তাদের কারো কারো মধ্যে এই পাকিফিলিয়া রোগটি এখানো সদম্ভে বিরাজ করে চলেছে। এই ধরনের রোগীরা এই উপমহাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনে এবং পাকিস্তান আন্দোলনের সময় অত্যাচারী ইংরেজদের পক্ষ নিয়ে এই দুটো আন্দোলনেরই বিরোধিতা করেছে। আবার তারাই আমাদের বাঙালিদের স্বাধীকার আন্দোলনের সময়, আমাদের মুক্তিযুদ্ধের সময়, বাঙালির স্বার্থের বিরুদ্ধে অত্যাচারী পশ্চিম পাকিস্তানিদের পক্ষ নিয়ে নিজেদের মা-বোনকে ধর্ষিত হবার জন্য, নিজেদের বাপ ভাইকে নিহত হবার জন্য, জল্লাদ  পাকিস্তানিদের হাতে তুলে দিয়েছে। এদেশে এমন রাজনৈতিক দল রয়েছে যারা ইংরেজ আমল থেকে এখন পর্যন্ত এই কাজই করে চলেছে। এদের চিকিৎসা করা আমাদের মত সাধারণ মানুষের আয়ত্তের বাইরে। কারণ, তাদের হৃদয় আকর্ষণ করার জন্য পাকি স্তা নি জল্লাদরা যেসব নাফরমানি কাজ করেছে, তাতো আমরা করতে পারবো না। কারণ আমরা বাঙালিরা একটি সুসভ্য জাতি। তাই এদের, মানে এইসব মর্ষকামীদের চিকিৎসা করতে হলে মনোচিকিৎসকের দরকার।

 

এইসব মর্ষকামীদেরই পাকি স্তা নিরা বেশি করে চিনতো। কারণ এইসব বাঙালি মর্ষকামীরা ইংরেজ আমলে ইংরেজদের চারপাশে এবং পাকি স্তা ন আমলে পশ্চিম পাকিস্তানিদের চারপাশেই ঘুর ঘুর করতো। ফলে, পাকিস্তানিরা এই সব মর্ষকামীদের দ্বারাই পরিবেষ্টিত থাকতো। তাই তারা ভেবেছিল যে, সব বাঙালিই বুঝি এদের মত। তাইতো তারা ডাণ্ডা পিটিয়েই সবাইকে ঠাণ্ডা করে দেবার হিম্মৎ দেখিয়েছিল এবং সেই উদ্দেশ্যেই একাত্তরের ছাব্বিশে মার্চে তারা শুরু করেছিল তাদের অমানুষিক বর্বরতা।

 

দ্বিতীয় কারণটিতে যারা পাকিফিলিয়া রোগে আক্রান্ত হয়েছে, তাদের চিকিৎসা হয়তো অপেক্ষাকৃত সহজ। আমরা আমাদের বাঙালি জাতির ক্ষমতা, গৌরব, সম্পদ, সম্ভাবনা ও বিজয়কে সঠিকভাবে তুলে ধরতে পারিনি। তাই স্বভাবতই জাতি হিসাবে আমাদের মনে একটা হীনমন্যতা বোধের জন্ম নিয়েছে। ওদিকে পাকি স্তা নিদের বীর্যবত্তা এমন ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে প্রচার করা হয়েছে, যার ফলে এইসব পাকিফিলিয়া আক্রান্ত রোগীদের কাছে পাকি স্তা নিদেরকে অপরাজেয় এবং দুর্ধর্ষ বলে মনে হয়েছে। তাইতো মুক্তিযুদ্ধের সময় অনেক রাজাকার আলবদরের মুখে বলতে শোনা যতো (এবং কারো কারোর মুখ থেকে আমি নিজ কানে শুনেছি) যে, পাঞ্জাব রেজিমেন্টের লোকদের যদি পশ্চিম পাকিস্তানের সীমানেন্ত নিয়ে গিয়ে ঢাকার দিকে মার্চ করে এগিয়ে যাবার জন্য হুকুম দেয়া হয়, তাহলে তারা ইণ্ডিয়ার ভিতরে দিয়ে ঠিকই ঢাকায় এসে পৌছে যাবে। ভারতীয় সৈন্যরা শত গোলাগুলি করেও এদেরকে একটুও হেলাতে পারবে না।

 

বাংলাদেশ যখন পাকিস্তানের কলোনী ছিল, সে আমলে এরাই বিশ্বাস করতো যে পূর্ব পাকিস্তানকে রক্ষা করার জন্য এ অঞ্চলে কোন সৈন্য বাহিনী রাখার দরকার নেই। ভারত যদি কোনদিন পূর্ব পাকি স্তা নকে আক্রমণ করার স্পর্ধা দেখায়, তাহলে তারা ঢাকা দখল করার আগেই দুর্ধর্ষ পাকি স্তা নি সেনা বাহিনী পশ্চিম পাকিস্তান থেকে ভারত আক্রমণ করে দিল্লী দখল করে নেবে।

 

সে যুগে পাকিস্তান আর্মিকে এদেশের অনেক মানুষ এত ক্ষমতা সম্পন্ন বলে মনে করতো যে, সে সব কথা বললে এ যুগের মানুষেরা হয়তো বিশ্বাসই করবে না। তাই ভবিষ্যত প্রজন্মের জন্য এই ব্যাপারে আমার জানা কাহিনীগুলির মধ্যে শুধু একটি ঘটনার উল্লেখ করছি।

 

আমি তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রথম বর্ষের ছাত্র (১৯৫৭)। একদিন চাটগা থেকে ঢাকা ফেরার পথে ট্রেনে কশবার পাশ দিয়ে যাচ্ছিলাম। সহযাত্রীদের একজন রেললাইনের অদূরে পাহাড়গুলো দেখিয়ে বললো,-জানেন ঐ যে পাহাড়গুলো দেখছেন, ওগুলো ভারতের অংশ। এ কথা শুনে আমি তাকিয়ে দেখলাম যে, পাহাড়গুলি রেললাইন থেকে মাত্র কয়েক’শ ফিট দূরে।

 

তাই আমি অবাক হয়ে বললাম যে,- ইস, পাকিস্তান সরকার কি রকম বোকা! বর্ডারের এত কাছে থেকে রেইল লাইনটাকে তারা এখনো দূরে সরিয়ে নেয় নাই। ভারতীয় সৈন্যরা তো ইচ্ছা করলে যে কোন সময় কয়েক মিনিটের মধ্যে এই রেইল লাইন থেকে রেইলগুলি খুলে নিয়ে, পূর্ব পাকি স্তা নের প্রধান বন্দরটি থেকে এই প্রদেশটির বাকি অংশকে এদের মধ্যকার একমাত্র রেল সংযোগ থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন করে ফেলতে পারবে। এইটুক কথা বোঝার শক্তিও কি পাকিস্তান সরকারের নেই?

 

এ কথা শুনে আমার পাশে বসা এবং উর্দুভাষী মহাজের তো আমার উপর ক্ষুব্ধ হয়ে পারে তো আমার গলা টিপে ধরে। সে আমাকে ধমকের সূরে বললেন,- “তুম বেওয়াকুফ জানতে নেহি যে,- ইন্ডিয়ান আর্মি কেতনা বুজদিল হায়? ওলোক রেল লাইন তোর লেকো কোসেস করেগা তো, ও রেল লাইন তক পৌহুসনেকো আগেই, হামারা পাকি স্তা নী আর্মি আগরতলা কব্জা করলে যায়ে গা। একথা শুনে হাসবো কি কাদবো তা বুঝতে না পালেও এই ধরনের আজগুবি ধারণা অনেকেই সে যুগে তাদের মনে ধারণ করতো।

 

এদেশে বাঙালিদের উপর পাকিস্তানিদের অত্যাচার অবিচারের কথা কিছুটা প্রচারিত হলেও মুক্তিযুদ্ধের সময় তারা যে, কত কাপুরুষতার পরিচয় দিয়েছে, এবং সারা ইতিহাস জুড়ে বেশিরভাগ সময়ই যে, বিদেশীদের কাছে তারা কাপুষের মত পরাজয়ই বরণ করেছে, যুদ্ধে জয়লাভ করার ইতিহাস যে তাদের খুব একটা বেশি নেই, এ কথা তেমন একটা প্রচারিত হয় নাই।

 

অপরদিকে বাঙালির বিজয় এবং বাঙালির বীরত্বের কথা খুব একটা প্রচারিত না হওয়ায় আমাদের মধ্যে অনেকে পাকিস্তানের বিজয়ের মধ্যে নিজেদের সান্ত্বনা খুঁজে বেড়ায়। ফলে এমনি করেই তারা ধীরে ধীরে পাকিফিলিয়া রোগে আক্রান্ত হয়ে পড়ে।

 

এই রোগের প্রকোপ হতে বাঙালি জাতিকে বাঁচাতে হলে, একদিকে যেমন আমাদের স্কুল পাঠ্যবইয়ে, ইতিহাস জুড়ে বাঙালি জাতির বীরত্ব ও অর্জনগুলির কথা উল্লেখ করতে হবে, অপরদিকে, বিভিন্ন আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায় আমাদের জয় লাভ করতে হবে। তাহলেই শুধু আমাদের মধ্যে জাত্যাভিমানের জন্ম নিবে, আমরা আমাদের হীনমন্যতা রোগ থেকে মুক্ত হতে পারবো।

 

এক একটি জয় যে বাঙালি জাতির জাত্যাভিমানকে কতটা চাঙ্গা করে তুলে, তা আমরা বারবার দেখিছি।

 

১৯৯৭ সালের ১৩ই এপ্রিল কুয়ালালামপুরের কিলাত ক্লাব মাঠে বাঙালিরা যখন ক্রিকেটে আইসিসি চ্যাম্পিয়ান হয়, ১৯৯৯ সালে ৩১শে মে ব্রিটেনের নর্দাম্পটনে ক্রিকেটের বিশ্বকাপে পাকিস্তানকে নাকানি চুবানি খাইয়ে বাঙালিরা যখন ৬২ রানে জয় লাভ করে, এবং একই বৎসর (১৯৯৯) সাফ গেমসের ফুটবলে যখন বাংলাদেশ চ্যাম্পিয়ান হবার গৌরব অর্জন করে, তখন টেকনাফ থেকে তেতুলিয়া পর্যন্ত এদেশের জনগণ যেভাবে গর্বে, উল্লাসে ফেটে পড়েছিল, তাতে স্পষ্টই বুঝা যায় যে, আরো কিছূ বিজয় যদি আমরা অর্জন করতে পারি, তাহলে জাতি হিসাবে আমরা যে হীনমন্যতায় ভুগছি, তা আমরা কাটিয়ে উঠতে পারবো। তখন আর পাকিস্তানের বিজয়কে নিজের বিজয় ভেবে কোন বাঙালিকে মিথ্যা আত্মপ্রসাদ খুঁজে বেড়াতে হবে না।

 

তবে এক্ষেত্রে বাঙালি জাতির উদ্যোগ শুধুমাত্র ফুটবল ও ক্রিকেটের মধ্যে সীমাবদ্ধ না রেখে, রাইফেল-শুটিং, সাঁতার, দাবা, জ্ঞান্তবিজ্ঞান, প্রযুক্তি, সংস্কৃতি, শিল্পকলাসহ সবগুলো ক্ষেত্রেই বাঙালির প্রতিভা, বাঙালির মনীষা ফুটিয়ে তোলার প্রচেষ্টা সমান তালে চালিয়ে যেতে হবে।

 

খুবই দুঃখের বিষয়, ফুটবল ও ক্রিকেট এদেশে যতটা পৃষ্ঠপোষকতা পেয়েছে, রাইফের-শূটিং, সাঁতার, দাবা ইত্যাদি বাঙালি জাতির জন্য সম্ভাবনাময় খেলাধুলাগুলো, এদেশের সরকারের কাছ থেকে, সে তুলনায় খুব কমই সহযোগিতা পেয়েছে।

 

১৯৯৯ সালের কাঠমুণ্ডুতে অনুষ্ঠিত সাফ গেমসে দু’দুটো ব্রোঞ্জ পদক পাওয়া প্রমীলা সাঁতারু কমলা আক্তার তো সরকারি পৃষ্ঠপোষকতার অভাবে এবং অর্থনৈতিক অনটনের তাড়নায়, মনের দুঃখে সাঁতার ছেড়ে দিয়ে, গার্মেন্টস ফ্যাক্টরীতে চাকরি নেবার পরিকল্পনা করেছে।

 

১৯৯১ সালে সাফ গেমসে শুটিং অন্তর্ভুক্ত হবার পর থেকে আজ পর্যন্ত কোনদিন বাংলাদেশ শূটিং দল এই গেমস থেকে স্বর্ণপদক না নিয়ে দেশে ফেরেনি। তারপরও তারা এদেশের সরকারের কাছ থেকে সব সময় বিমাতাসুলভ ব্যবহারই পেয়ে এসেছে।

 

এই পাকিফিলিয়া রোগটি থেকে মুক্তি পেতে হলে আমাদের সংবাদপত্র গুলোকেও একটা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে হবে। ফুটবল ও ক্রিকেটের মত বাঙালি জাতির অন্যান্য ক্ষেত্রের অর্জন ও বিজয়গুলিকেও সমান উৎসাহ ও উদ্দীপনা নিয়ে জনগণের কাছে তুলে ধরতে হবে।

 

বর্তমান প্রবন্ধটি হালনাগাদ করতে গিয়ে যখন এই পর্যন্ত লিখেছি, তখনই সংবাদ পেলাম বাঙালির কাছে যেটা বেদনা ও অহঙ্কারের দিন, তার কাছে যে দিনটি সত্য ও ন্যায়ের অধিকার আদায়ের জন্য উৎসাহ, উদ্দীপনা ও অনুপ্রেরণার প্রতীক, বাঙালির অপরাজেয় দৃঢ়তার পরিচয়বাহী সেই মহান একুশে ফেব্রুয়ারিকে জাতিসংঘের শিক্ষা, বিজ্ঞান ও সংস্কৃতি বিষয়ক সংা ইউনেস্কোর এক সভায়, সর্বসম্মতিক্রমে সারা বিশ্বের সম ভাষাভাষীদের জন্য বিশ্ব মাতৃভাষা দিবস হিসাবে পালন করার প্রস্তাব গ্রহণ করেছে। এ কথাটির মানে হলো, তৃতীয় সহস্রাব্দীর প্রথম বছরটি থেকেই ভবিষ্যতের প্রতিটি বৎসরে ২১শে ফেব্রুয়ারি তারিখটিকে, সারা বিশ্বের মানুষেরা তাদের মাতৃভাষা দিবস হিসাবে পালন করবে।

 

এটা যে বাঙালি জাতির জন্য কতবড় গৌরবের মহাবিজয়, তা শুধু সারা বিশ্বের শ্রমিক অধিকারের জন্য প্রতিপালিত মে দিবসের কথা চিন্তা করলেই সত্যিকারভাবে উপলব্ধি করা যাবে।

 

১৮৭৭ সাল থেকে, ন্যায্য মজুরি, ৮ ঘণ্টা কাজ ও অন্যান্য দাবি আদায়ের জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বামপন'ীদের নেতৃত্বে একটা শ্রমিক আন্দোলন শুরু হয়। ১৮৮৪ সাল পর্যন্ত প্রায় ৩০০ শ্রমিক এই দাবি আদায়ের জন্য প্রাণ বিসর্জন করে। এরই মধ্যে এক সময় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের শ্রমিক ফেডারেশন, ১৮৮৬ সালের ১লা মে থেকে ৮ ঘণ্টা কাজের দিন হিসাবে ধরা হবে বলে ঘোষণা করে।

 

১৮৮৬ সালের সেই ঐতিহাসিক ১লা মে’র পরেও শ্রমিকদেরকে সেই আন্দোলনটি চালিয়ে যেতে হয়। শত অত্যাচার, নিপীড়ন এবং হত্যা উপেক্ষা করেও তারা আন্দোলন চালিয়ে যায়। আন্দোলনের নেতাদের ফাঁসি দিয়েও শ্রমিকদেরকে সেই দাবি থেকে সরানো যায় নাই। শেষ পর্যন্ত তারা তাদের সেই দাবি আদায় করে নিয়ে ক্ষান্ত হয়।

 

১৮৮৯ সালে দ্বিতীয় সেসিয়ালিস্ট ইন্টারন্যাশনাল ১লা মে’কে বিপ্লবী শ্রমিকদের ছুটির দিন বলে ঘোষণা করে। সেই থেকে ধীরে ধীরে সারা বিশ্বে ১লা মে তারিখটি আন্তর্জাতিক শ্রমিক অধিকার দিবস হিসাবে স্বীকৃতি লাভ করে।

 

১৮৮৬ সালের চৌঠা মে তারিখে শিকাগো শহরের হে-মার্কেট স্কোয়ারে আন্দোলনরত শ্রমিক সমাবেশে পুলিশ হামলা চালালে যে ৪ জন শ্রমিক নিহত হন, সেই মৃত্যুঞ্জয়ী শ্রমিকদের রক্তরঞ্জিত জামা থেকেই বিপ্লবের প্রতীক হিসাবে লাল পতাকার উদ্ভব হয়।

 

শ্রমিকদের ন্যায্য দাবির জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিপ্লবীদের আত্মদানের মতই, মাতৃভাষার জন্য বাঙালি জাতির আত্মদান যে, সমান গৌরবের অধিকারী, তারই স্বীকৃতি হলো ইউনেস্কো কর্তৃক ২১শে ফেব্রুয়ারিকে সারা বিশ্বের মাতৃভাষা দিবস বলে ঘোষণাটি।

 

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের শ্রমিক আন্দোলনের মত আমাদের ভাষা আন্দোলনটাও শুরু হয়েছিল ন্যায্য অীধকারের আন্দোলন হিসাবেই। ১৯৪৮ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি তারিখে (তমুদ্দুন মজলিশ আরো আগে থেকেই ভাষা আন্দোলন শুরু করেছিল) পাকি স্তা নের গণপরিষদের প্রথম অধিবেশনে পূর্ব বাঙলার প্রতিনিধি, নাগরিক অধিকার সচেতন, বাঙালি জাতির অমৃতের সন্তান, ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত, বাঙালির অধিকার রক্ষার জন্য দুটি খুবই নিরীহ দাবি উত্থাপন করেছিলেন :

 

১)  বৎসরে অন্তত একবার ঢাকায় পাকি স্তা ন গণপরিষদের অধিবেশন অনুষ্ঠিত হবে।

 

২)  উর্দু ও ইংরেজির সাথে বাংলাকে গণপরিষদের অন্যতম ভাষা হিসাবে ব্যবহার করতে হবে।

 

তখনকার দিনে সমগ্র পাকিস্তানের ৬ কোটি ৯০ লক্ষ অধিবাসীদের মধ্যে, ৪ কোটি ৪০ লাখ মানুষই ছিল বাংলা ভাষাভাষী। তাই এই দাবি দুটি মেনে না নেবার কথা কোন ন্যায় নীতির প্রেক্ষিতেই ভাবা সম্ভব ছিল না। তবুও তাইই হয়েছিল। পাকি স্তা নিরা তো সেদিন এই দাবি দুটি মেনে নিতে পারেইনি, এমনকি নবাবজাদা লিয়াকত আলী খান, পূর্ব বাংলার কোটা থেকে মনোনীত গণপরিষদ সদস্য হিসাবে যার উপর নৈতিক দায়িত্ব ছিল, বাঙালিদের এই ন্যায্য দাবিটি সমর্থন করে, সেই দাবি অর্জন ও বাবায়ন করতে বাঙালিদের সর্বপ্রকার সাহায্য করা,------ অথচ তা না করে, তিনি তার সেই পবিত্র দায়িত্বের প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা করে, সেদিন ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের প্রতি অন্যায় ও অশালীন উক্তি করেছিলেন।

 

পাকিস্তানিরা সেদিন বাঙালিদের এই ন্যায্য দাবিটি মেনে নিতে পারেনি বলেই আমাদেরকে এই জন্য আন্দোলন করতে হয়েছে। সেই আন্দোলন করতে গিয়ে  পাকিস্তানিদের নিপীড়নের মুখে বাঙালিরা শুধু শহিদই হয়নি, শেষ পর্যন্ত তারা তাদের সেই দাবিটি আদায় করে গাজীও হয়েছিল। ফলে শেষ বিচারে পাকিস্তানি নমরুদরাই পরাজিত হয়েছিল। কিন' দুর্জনেরা কোনদিন তাদের পরাজয়ের কথা ভুলতে পারে না। তাই পাকিস্তানি হায়েনারা আমাদের মুক্তিযুদ্ধের সময়, ২৬শে মার্চের সেই কালো রাত্রির প্রায় পরপরই, ২৯শে মার্চ তারিখে, ধীরেন্দ্রনাথ দত্তকে তার পুত্রসহ ধরে ক্যান্টনমেন্টে নিয়ে গিয়ে গুলি করে হত্যা করে।

 

পাকিস্তানি সেই নমরুদ আর তাঁদের বাংলাদেশী দোসর রাজাকার, আলবদর এবং আল শামসদের ভাগ্যের কী নির্মম পরিহাস, ইউনেস্কো কর্তৃক আমাদের ভাষা শহীদ দিবসকে সারা বিশ্বের মাতৃভাষা দিবস হিসাবে স্বীকৃতি দানের ফলে কেবল আজই নয়, এই পৃথিবীতে ‘হোমো সেপিয়ান সেপিয়ান’, মানে, ‘অতীব জ্ঞানী মানব প্রজাতি’, যতিদিন টিকে থাকবে, ততদিন পর্যন্ত প্রতি বৎসর এই দিনটি এলে, সারা পৃথিবীর মানুষেরা শুধু আমাদের ভাষা-শহীদদের আত্মদানের কথাই স্মরণ করবে না, সেই সাথে সাথে পাকি স্তা নি হায়েনাদের সেই পৈশাচিক হত্যাকাণ্ডের কথাও এক বুক ঘৃণার সাথে স্মরণ করবে।

 

ইউনেস্কোর সভায় যে ২৮টি জাতি মিলে এই প্র স্তা বটি পেশ করেছিল, তার মধ্যে দশটি দেশই ছিল মুসলমান্তপ্রধান। এগুলোর নাম হলো : সউদি আরব, ওমান, মিশর, ইন্দোনেশিয়া, কমরো, পাকিস্তা ন, ইরানিয় ইসলামী প্রজাতন্ত্র, সিরিয়া, মালয়েশিয়া ও বাংলাদেশ।

 

এতগুলো মুসলমান প্রধান দেশ যখন ২১শে ফেব্রুয়ারিকে সারা বিশ্বের মাতৃভাষা দিবস হিসাবে পালন করার জন্য প্রস্তাব করেছে, তার মানে হলো এই যে, মাতৃভাষার অীধকারের জন্য সেদিনকার বাঙালি জাতি, যে দাবিটি করেছিল, সে দাবিটি যে ন্যায্য ছিল, তা তারা সবাই এখন মেনে নিয়েছে।

 

ইউনেস্কোর বিশ্বসভায় এই দাবিটি সর্বসম্মতিক্রমে গৃহীত হয়েছে। তার মানে দাঁড়ালো এই যে, সারা বিশ্বে একটিও দেশ ছিল না, একটিও জাতি ছিল না, যারা এই প্র স্তা বটি সম্বন্ধে দ্বিমত পোষণ করে। তাইতো এই কথাটি শোনার সঙ্গে সঙ্গে আমার মনের অজানে-ই আমার মুখ দিয়ে গান হয়ে বের হয়ে এসেছিল :

‘বলো, বলো বলো সবে,

শত বীণা বেণু রবে,

বাংলা আবার জগৎ সভায়

শ্রেষ্ঠ আসন লবে।’

 

এই কথাটি লেখার আগে আমাদের প্রতিবেশী দেশের নাগরিকদের কাছে এই বলে মাফ চেয়ে নিচ্ছি যে, তাদের দেশাত্মবোধক গানটির মধ্যকার ভারত শব্দটিকে বদলিয়ে বাংলা শব্দটিকে বসিয়ে দিয়ে আমি তাদের এই গানটিকে কেড়ে নিতে চাইছি না। এই গানটির মধ্যে শব্দের পরিবর্তনও সর্বপ্রথমে আমি করিনি। সেকালের কেমব্রীজ বিশ্ববিদ্যালয়ের টেবিল টেনিস চ্যাম্পিয়ান এক পাঞ্জাবি ছাত্রকে, সেখানে বেড়াতে আসা এক ইরানি তরুণী, নিতান্ত অবহেলে নিল-গেইমে হারিয়ে দিয়েছিল বলে, আমি তার প্রতি সেদিন ভীষণভাবে গুণমুদ্ধ হয়ে পড়েছিলাম। সে তার ইরানি উচ্চারণে, একদিন আমাকে এই গানটি, এই ভার্সনেই শুনিয়েছিল। তাই তার প্রতি, কিংবা বাঙালি জাতির প্রতি, আমার স্বাভাবিক দুর্বলতার জন্য, আমাদের জাতির এই বিজয়ের ক্ষণে, আমার অবেচেতন মন থেকে যদি সেই গানটি তার এই পরিবর্তিত ভার্সনেই সুর হয়ে বের হয়ে এসে থাকে, তাহলে আমার প্রতিবেশী দেশের অধিবাসীরা  নিশ্চয়ই আমার এই অপরাধটি ক্ষমা করে দিবেন।

 

বাঙালি জাতির গর্বের, বাঙালি জাতির গৌরবের এই ঘটনাটির সাথে পাকিস্তানি জাতিরও একটা বিজয় যুক্ত হয়ে গেল। যতদিন পাকিস্তানিরা জাতি হিসাবে বাঙালি জাতির ন্যায্য অধিকারের প্রতি বৈরিতা প্রকাশ করেছে, বিরুপতা প্রকাশ করেছে, ততদিন পাকি স্তা ন ছিল নমরুদ, সাদ্দাদ আর ফেরাউনদের অধীনে। আর আজ বাঙালি জাতির এই গৌরবময় অর্জনটিকে শুধু স্বীকৃতিই নয়, আগ বাড়িয়ে এর খসড়া প্রস্তাবটি পেশ করার ব্যাপারে বিশ্বের আঠাশটি জাতির সাথে একাত্মতা প্রকাশ করে, কো-স্পনসর হয়ে তারা প্রমাণ করলো যে, পাকিস্তান আজ ধীরে ধীরে নমরুদদের অধিকার থেকে মানুষদের অধিকারে চলে আসছে। পাকিস্তানিরা আজ ধর্মান্ধতার পরিবর্তে মানবতার দিকে এগিয়ে চলেছে। তাই প্রগতির পথে, মুক্তির পথে, পাকিস্তানিদের এই সফল অগ্রগতির জন্য, তাদের প্রতি আমার আন্তরিক মোবারকবাদ রইল।

 

জাতি হিসেবে বাঙালি বলে গর্ব করার কিছু নেই মনে করে যারা পাকিফিলিয়া রোগে আক্রান্ত, তাদের জন্য উপরোক্ত সংবাদটি একটি সুখবর। কারণ বাঙালি জাতি যতই বিজয় অর্জন করবে, বাঙালি জাতি সারা বিশ্বের যতই স্বীকৃতি পাবে, ততই তাদেরকে বাঙালি বলে পরিচয় দিতে কম সঙ্কোচিত হতে হবে। তাই তাদেরকে আর পাকিস্তানিদের বিজয়ের মধ্যে নিজেদের বিজয়ের মেকি আত্মপ্রসাদ খুঁজে বেড়াতে হবে না। ফলে তারা পাকিফিলিয়া রোগ থেকে ধীরে ধীরে আরোগ্য লাভ করে একটা সু মন নিয়ে বাকি জীবনটা অতিবাহিত করতে পারবে।

 

আর মর্ষকামিতার প্রকোপ আক্রান্ত হয়ে যে সব মীর জাফরেরা পলাশির যুদ্ধের সময়, উপমহাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের সময় এবং পাকিস্তান আন্দোলনের সময় ইংরেজদের পক্ষ নিয়েছিল, যারা বাঙালি জাতির স্বাধিকারের আন্দোলনের সময় এবং আমাদের মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানের পক্ষ নিয়েছিল বলে, এখনো পাকিফিলিয়া রোগের গভীর কর্দমের মধ্যে নিমজ্জিত হয়ে আছে, তাদেরকে এই অপমানকর রোগ হতে মুক্ত করার ব্যাপারে, আমাদের একটা জাতীয় কর্তব্য রয়েছে। পাকিস্তানের মুক্তমনা মানুষেরা, পাকিস্তানের প্রগতিশীল মানুষেরা, যারা পাকিস্তানকে নমরুদদের হাত থেকে মুক্ত করতে চাইছে, যারা নমরুদি মানসিকতার হাত থেকে তাদের জাতিকে মুক্ত করতে চাইছে, আমাদের উচিত হবে সহমর্মিতা নিয়ে তাদেরকে উৎসাহ দিয়ে, তাদের বিজয়কে এগিয়ে নিয়ে যেতে সাহায্য করা। পাকিস্তানিরা যতই মুক্তমনা হবে, আমাদের দেশের মীরজাফর, রাজাকার, আলবদর, আলসামসরা পাকিফিলিয়ার মত আমাদের জাতির প্রতি অবমাননাকর এই হীনমন্যতা রোগটি থেকে ততই মুক্তি পাবে। কারণ তারা তখন দেখতে পাবে যে, পাকিস্তানেও তাদের কোন সমর্থক নেই। পাকিস্তানিরাও তাদের দেখলে ঘৃণার মুখ ফিরিয়ে নেয়।

 

বাঙালি জাতির এতবড় একটা বিজয়ে যে, এদেশের সবাই খুশি হয়নি, বরং কেউ কেউ অখুশিও হয়েছে, সে কথাও আজ বুঝা গেল। বাংলাদেশের রাজাকার মালিকানায় প্রকাশিত দৈনিক পত্রিকাটির কথা না হয় বাদই দিলাম, এদেশের একটি উচ্চ সংখ্যায় প্রচারিত ইংরেজি দৈনিকের ১৮ই নভেম্বর সংখ্যায়ও দেখলাম, মাত্র ২৫ কলাম লাইনে, তাও দুই পাতায় ভাগ করে, ছোট্ট করে এই সংবাদটি প্রকাশ করেছে। সংবাদটি যে সেদিন প্রকাশিত হবে তা কয়েক দিন ধরেই সবাই জানতো। তাই শেষ মুহূর্তে সংবাদ পেয়েছিল বলে সবিস্তারে প্রকাশ করতে পারেনি, এই ধরনের অজুহাত দেখিয়ে তারা পার পাবে না। ইচ্ছে করেই তারা সংবাদটিকে সি-মিত করে দিয়েছে। এবং সেই সঙ্গে, এই সংবাদটি পেয়ে যে তারা খুশি হয়নি, সে কথাটি প্রকারান্তরে প্রকাশ হয়ে পড়েছে।

 

বর্তমান প্রবন্ধটি লেখার পর আজ (২০০৮) দীর্ঘ দিন অতিবাহিত হয়েছে। এতদিনে বাংলাদেশে খেলাধুলার ক্ষেত্রে আরো বেশ কয়েকটি বিজয় অর্জন করেছে এবং তার ফলশ্রুতি হিসেবে বাংলাদেশের মানুষের মধ্যে পাকিফিলিয়ায় আক্রান্ত মানুষের সংখ্যা বেশ কমে গিয়েছে বলে আমার মনে হচ্ছে। এতে আমি আরো নিশ্চিত হয়েছি যে জানি হিসেবে আমরা বাঙালিরা খেলাধুলা, বিজ্ঞান, সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক অঙ্গনে আমাদের সক্ষমতাকে আরো পরিস্ফুটো করে বিশ্বসভায় যতই স্থান করে নিতে পারবো, আমাদের মন থেকে পাকিফিলিয়া রোগটির প্রকোপ ততই কমে যাবে।

 

চলতিপত্র ১(২৪), ২রা জুন (১৯৯৭), ১(১৫), ৯ই জুন (১৯৯৭), সমন্বয় (১৯৯৬)  

(নিবন্ধটি ফ, র,আল সিদ্দিক-এর গ্রন্থ বাঙালির জয় বাঙালির ব্যর্থতা, হাক্কানী পাবলিশার্স মমতাজ প্লাজা, বাড়ি # ৭, রোড # ৪ ধানমন্ডি, ঢাকা-১২০৫, ফোন : ৯৬৬১১৪১-৩, প্রথম প্রকাশ : ২০০৭, দ্বিতীয় সংস্কারণ : ২০০৮ থেকে সংগৃহীত)

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
Archive
 
সাম্প্রতিক পোষ্টসমূহ