Banner
আসিফ নজরুল এবং প্রাসঙ্গিক কিছু প্রশ্ন, কিছু ভাবনা — শামসুজ্জোহা মানিক

লিখেছেনঃ শামসুজ্জোহা মানিক, আপডেটঃ October 22, 2024, 12:00 AM, Hits: 184

অনেক দিন ধরে আসিফ নজরুল সম্পর্কে একটা ঘটনার কথা বলার খুব প্রয়োজন বোধ করছি। বেশ কিছুকাল আগের ঘটনা। সবটা ভালো মনে নাই। তবে মূল বিষয়টা মনে আছে। রাজধানী ঢাকার ভিকারুন্নিসা নুন স্কুল ও কলেজের এক ছাত্রী অরিত্রী অধিকারী। বয়স ১৫। ক্লাস নাইনের পরীক্ষার্থী। পরীক্ষার হলে তার মোবাইল ফোন নিয়ে এসেছিল। এই অপরাধে স্কুলের ভারপ্রাপ্ত মহিলা অধ্যক্ষ নাজনীন ফেরদৌস ও শাখাপ্রধান জিনাত আক্তার তার পরীক্ষা দেওয়ার সুযোগ বাতিল করে তাকে ডেকে ভর্ৎসনা করেন। শুধু তাই নয় তার বাবা-মাকে দেখা করবার নির্দেশ দেন। অভিযোগ আছে যে, বাবা-মা দেখা করতে এলে তিনজনকেই তীব্রভাবে ভর্ৎসনা এবং বিশেষ করে তার বাবা-মাকে অপমান করা হয়। অভিযোগ আছে যে আরও শিক্ষিকার তাতে ভূমিকা ছিল। এর পরিণতিতে বাড়ী ফিরেই সেই ছাত্রী গলায় ফাঁসি দিয়ে আত্মহত্যা করে। ঘটনাটা ২০১৮ সালের ডিসেম্বর মাসের। 

সেই সময় এই ঘটনা নিয়ে সংবাদপত্রে ব্যাপক আলোচনা হয় এবং আমার যতদূর মনে আছে স্কুলের অধ্যক্ষসহ সংশ্লিষ্ট শিক্ষিকাদের এমন নির্মম আচরণের বিরুদ্ধে কঠোর সমালোচনার ঝড় উঠে। পিতার অভিযোগের প্রেক্ষিতে আত্মহত্যায় প্ররোচনার দায়ে আদালতে মামলাও হয়। তবে শেষ পর্যন্ত মামলায় দুইজনকে আসামি করা হয়: স্কুলের সাময়িক বরখাস্ত ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ নাজনীন ফেরদৌস ও শাখাপ্রধান জিনাত আক্তার। ঘটনাটা আমাকেও খুব নাড়া দিয়েছিল। বাচ্চা মেয়েটার জন্য আমার কষ্ট হয়েছিল। একটা কোমলমতি স্কুলবালিকা ও তার অভিভাবকদের সঙ্গে এমন আচরণের কোনও যৌক্তিকতা আমি খুঁজে পাই নাই।

এখানে বলা যেতে পারে যে, আমি আমার জীবনে দুইটা বিদ্যালয়ে প্রধান শিক্ষক হিসাবে কাজ করেছিলাম। একটা পাকিস্তান কালে। অপরটা বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার বেশ কিছুকাল পরে। পাকিস্তান কাল ১৯৬৭ থেকে ’৬৮ পর্যন্ত। আমি যখন বর্তমান পঞ্চগড় জেলার সীমান্তবর্তী এক গ্রামে স্কুলটিতে যোগ দিই তখন সেটা ছিল জুনিয়র স্কুল। আমি যখন স্কুল ছাড়ি তখন সেটা হাই স্কুলে পরিণত হয়। কৃষক আন্দোলন গড়বার প্রয়োজনে সেকালে আমার গ্রামে যাওয়া। তার প্রয়োজনেও আমার স্কুলের দায়িত্ব ছাড়া। ’৬৯-এর গণ-অভ্যুত্থানের জোয়ারে তখন সারাদেশ উত্তাল। সুতরাং আমার শিক্ষকতা করবার পরিস্থিতিও ছিল না। সেই সময় আমি পুরাপুরি কৃষক ও গণ-আন্দোলনে আত্মনিয়োগ করি।

দ্বিতীয় দফায় প্রধান শিক্ষক হিসাবে দায়িত্ব পালনের অভিজ্ঞতা হয় ১৯৮৭ সালে যখন বর্তমান দিনাজপুর জেলায় আমার পৈত্রিক গ্রামে একটা উচ্চবিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করে তার প্রধান শিক্ষক হিসাবে দায়িত্ব পালন করি কিছু কাল।

এই দুই দফায় শিক্ষকতা কিংবা প্রধান শিক্ষকতার অভিজ্ঞতা থেকে আমার মনে হয়েছে শিক্ষকতা ও আরও বিশেষত প্রধান শিক্ষকতার দায়িত্ব আর দশটা প্রশাসনিক প্রধানের দায়িত্ব থেকে অনেক ভিন্ন। আসলে কোমলমতি শিক্ষার্থীদের কাছে তাদের স্থান অনেকটাই স্নেহময় ও দরদী পিতা বা মাতার মতো। কখনও কঠোরতার প্রযোজন হলেও সেটার ভিতরে রাখতে হয় স্নেহ বা ভালবাসার মন। সুতরাং যারা থানার দারোগার মতো আচরণ করতে চান তাদের জন্য এ পেশায় না আসাই উচিত। আমার কাছে ভিকারুন্নিসা নুন স্কুল ও কলেজের অধ্যক্ষসহ শিক্ষিকাদের আচরণকে মনে হযেছিল একজন উপনিবেশিক আমলের থানাদার বা দারোগা ও পুলিশের মতো। অতবড় প্রতিষ্ঠান চালাবার অভিজ্ঞতা আমার নাই বলে হয়ত আমার এই অভিমতকে তাচ্ছিল্য করা হতে পারে। কিন্তু বিবেচনার ভিত্তি প্রতিষ্ঠানের চাকচিক্য, খ্যাতি কিংবা আয়তন হওয়া উচিত নয়। কারবারটা কাদের নিয়ে করা হচ্ছে সেটাই হওয়া উচিত বিবেচনার মূল ভিত্তি। সন্তানসম কোমলমতি বাচ্চা বা শিশু অন্য কোনও পেশার বয়স্ক মানুষ নয় যে তাদের সঙ্গে আচরণে যান্ত্রিক হবার কোনও সুযোগ আছে।

ঐ কিশোরীর আত্মহত্যার প্ররোচনাকারী হিসাবে সংশ্লিষ্ট শিক্ষিকাদের বিরুদ্ধে দ্রুত তদন্ত ও বিচার হওয়া উচিত ছিল বলে আমি মনে করি। বিচার শুরুও হয়েছিল। যখন জনমত যথাযথভাবে বিচারের দাবীতে সংগঠিত হচ্ছিল তখন হঠাৎ তাদের রক্ষায় আবির্ভূত হলেন আসিফ নজরুল। তিনি বলে উঠলেন অধ্যক্ষ ও সংশ্লিষ্ট শিক্ষিকার বিরুদ্ধে যে প্রচার হচ্ছে সেটা হল ‘মিডিয়া ট্রায়াল’। আমি অবাক হয়ে গেলাম এ দেশের গণ-মাধ্যমের ভূমিকা দেখে। তার এক হুংকারেই সংবাদপত্রে সমস্ত আলোচনা-সমালোচনা প্রায় বন্ধ হয়ে গেল। তারপর কী হয়েছে তা আমি আর সেভাবে জানি নাই বা জানতে পারি নাই। শুধু এইটুকু জানি যে, এখন পর্যন্ত এই মামলার রায় দেওয়া হয় নাই। বিচার চলছেই। বুঝাই যায় এ দেশে বিচার চলে গরুর গাড়ীতে চড়ে। কিন্তু এত বড় অন্যায় তার কি কোনও বিচার হবে না? নাকি হবে মৃত্যুর পরবর্তী কাল বলে যদি কিছু থাকে তবে সেখানে? আসলে তো এ দেশে চাপ না হলে বিচারও হতে চায় না। সংবাদপত্রের চাপ বন্ধ হলে আদালতের উপর চাপ থাকবে কী করে?

বস্তুত এত বড় একটা অন্যায় যেটা প্রায় একটা হত্যাকাণ্ডের কাছাকাছি সেটাকে নীরবতার চাদরে ঢেকে ফেলা হয়েছে। যে কোনও সভ্য সমাজ হলে ঐ আত্মহত্যার প্ররোচনাদাতা হিসাবে মহিলা প্রিন্সিপালসহ শিক্ষিকার বিচার অনেক আগেই সম্পন্ন হত। কিন্তু এ সমাজকে সভ্য সমাজ হিসাবে গণ্য করবার কারণ তো নাই। সুতরাং এই মৃত্যুকেও মেনে নিয়ে চুপ করে থাকতে হয়। যদিও সেটা উচিত নয়। কিন্তু আমার আজও ঐ বাচ্চা অভিমানী মেয়েটার কথা মনে হয় এবং মনে হলে কষ্ট হয়। কষ্ট হয় তার বাবা-মার জন্যও।

কিন্তু আমার মনে সর্বদা যে প্রশ্ন ঘুরে সেটা হল আসিফ নজরুল কেন ঐ নির্দয় শিক্ষকদের সপক্ষে ওভাবে নেমেছিলেন। যেহেতু বাচ্চা মেয়েটা হিন্দু আর প্রিন্সিপাল ও শিক্ষক মুসলিম সেই জন্য কি তার অমন ভূমিকা? অর্থাৎ হিন্দু বিদ্বেষী অন্ধ ধর্মীয় সাম্প্রদায়িকতা থেকে কি তার এমন ভূমিকা?

নাকি এখানে তার আরও অনেকের মতো আর্থিক লাভালাভের যোগ আছে? আমার জানবার উপায় নাই। তবে প্রশ্নটা তুলে রাখলাম। ভিকারুন্নিসার সঙ্গে যে, কারও কারও আর্থিক আয়ের যোগ থাকে সেটা আমি অনেক আগেই শুনেছিলাম। যেমন বর্তমানে কারাবন্দী কমিউনিস্ট নেতা রাশেদ খান মেননের নাম বলতে পারি। তার বলয়ের লোকদের কাছেই শুনেছিলাম যে, স্কুল কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগসাজশে ভিকারুন্নিসায় ভর্তি বাণিজ্য থেকে তার বেশ আয় হয়। যেহেতু আমি একটা কালে বামধারার কমিউনিস্ট রাজনীতির সঙ্গে ছিলাম সেহেতু তাদের সঙ্গে বহুকাল ধরে না থাকলেও তাদের ভিতরের বহু খবরই জানবার সুযোগ আমার বিভিন্ন সময়ে হয়েছে।

রাশেদ খান মেনন সম্পর্কে অতীতে অনেক কিছু জানতাম বলে তার এই অধঃপতন সম্পর্কে বিশ্বাস করবারও কারণ আমার আছে। সর্বোপরি মাফিয়াতান্ত্রিক এক ভয়ঙ্কর নিষ্ঠুর শাসক শেখ হাসিনার লুটপাটের অনুচর ও সহযোগী হিসাবে তার ভূমিকার মূল্য কিছু করে হলেও তো তিনি এখন পরিশোধ করছেন কারাগারের ভিতরে থেকে। তার এই অধঃপতন অবশ্য আমাকে অবাক করে না।

বিদ্যালয় বা স্কুল যে অবৈধ উপার্জনের হাতিয়ার হতে পারে সেটা জেনেছি আমার নিজের অভিজ্ঞতা থেকে। ১৯৯৩-’৯৪ সালের মধ্যবর্তী কালে আমি কিছু সময়ের জন্য পুনরায় আমার পৈত্রিক গ্রামে যাই। সেই সময় আমার প্রতিষ্ঠিত উচ্চবিদ্যালয়টি একটি শক্ত ভিত্তির উপর দাঁড়িয়েছিল। বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক তখন এক হিন্দু ভদ্রলোক ছিলেন। তাকে জিম্মি করে কিছু সংখ্যক লোক বিদ্যালয়টিকে অর্থ লুঠের যন্ত্রে পরিণত করেছিল। এই লুটপাটের কেন্দ্রে ছিল তখন ক্ষমতাসীন বিএনপি-এর এক নেতা আশরাফুল আলম, যে ছিল তখন বিএনপি-এর দিনাজপুর জেলা কমিটির দফতর সম্পাদক। বিদ্যালয়ের জন্য সরকারী বরাদ্দ টিন, গম ইত্যাদি তো ছিলই, এছাড়া আরও বহুবিধ উপায়ে তারা লুঠ শুরু করে। আমি বিস্তারিততে যাব না। কারণ সেটার এখানে প্রয়োজন নাই। গ্রামের একটা উচ্চবিদ্যালয় যে লুঠের এমন যন্ত্র হতে পারে তা এর আগে আমার জানা ছিল না। এখন জানলাম প্রধান শিক্ষক এই অবস্থা প্রতিকারের জন্য আমার সাহায্য চাইলে। তিনি এমন লুটপাট ও অনিয়ম চাইছিলেন না।

আমি তার সাহায্যে এগিয়ে এলে বহু ঘটনা ঘটে। এখন সেসবে যাব না। তবে এটুকু বুঝলাম যে, গ্রামের সদ্য প্রতিষ্ঠিত একটা উচ্চবিদ্যালয়ও কীভাবে লুটপাটের যন্ত্র হতে পারে। তখন বাংলাদেশের প্রধান মন্ত্রী খালেদা জিয়া এবং তার বড় বোন খুরশীদ জাহান হক চকলেট দিনাজপুরের অন্তর্ভুক্ত ফুলবাড়ী এলাকার বিএনপি দলীয় সাংসদ, ‍যিনি একটা উল্রেখ্য সময় দিনাজপুর শহরে থাকতেন। আমি পত্র মারফৎ ঘটনা জানিয়ে তার সাহায্য চাইলে বরং উল্টা ফল হল। বলা যায় আমিসহ যারা দুর্নীতির বিরুদ্ধে ও প্রধান শিক্ষকের সাহায্যে এগিয়ে গিয়েছিল তাদের বিরুদ্ধে আশরাফুল আলমকে লেলিয়ে দিলেন। প্রধান মন্ত্রী খালেদা জিয়াকে আমি ব্যক্তিগতভাবে পত্র দিয়ে তার হস্তক্ষেপের আবেদন জানালেও বুঝা গেল যে, এ ধরনের দুর্নীতি ও দুর্বৃত্তায়নে তার বা তার কার্যালয়ের কোনও আপত্তি নাই।

অনেক দিন পর তখনকার সাবেক প্রধান মন্ত্রী খালেদা জিয়ার সাবেক একান্ত সচিব (পিএস) সাবিহ্ উদ্দীনের (বর্তমানে প্রয়াত) সঙ্গে হঠাৎ এক জায়গায় আমার দেখা হলে তিনি সেই সময় আমার জন্য যে কিছু করতে পারেন নাই তার জন্য আবেগের সাথে দুঃখ প্রকাশ করেন। তাতে বুঝলাম যে, আমার পত্র বা অন্তত তার বিষয়বস্তু প্রধান মন্ত্রী ও তার কার্যালয় পর্যন্ত পৌঁছেছিল। এখানে এটুকুও বলি যে, আমি বিএনপি না করলেও খালেদা জিয়া যেমন এক সময় এরশাদ-বিরোধী আন্দোলন সংগঠিত করার সুবাদে আমাকে চিনতেন তেমন বা তার চেয়ে অনেক বেশী চিনতেন সাবিহ্ উদ্দীন। বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে তিনি ছিলেন আমার তিন বছরের জুনিয়র বা কনিষ্ঠ এবং তিনি আমাদের ছাত্র সংগঠন পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়ন করতেন। আমি যে হলে থাকতাম তিনিও সেই এসএম হলে উঠেছিলেন। ছাত্র জীবনে নম্র আচরণ ও ছাত্র ইউনিয়নের উৎসাহী সমর্থক ও কর্মী হবার কারণে তিনি আমার স্নেহভাজনও ছিলেন। আমার এ ধরনের অতীত পটভূমি নিয়েও বিএনপি-এর শাসনকালে ঐ দলের ভূমিকা সম্পর্কে আমাকে তিক্ত অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হতে হয়েছে। হ্যাঁ, বিএনপি-এর স্বরূপ বুঝার জন্য আমার নিজ ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতাই যথেষ্ট।  

যাইহোক, বিবরণ সংক্ষিপ্ত করে মূল প্রসঙ্গে আসি। মূলত যে হিন্দু পল্লীর সমর্থন নিয়ে আমি এই বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠায় উদ্যোগ নিয়েছিলাম সেই পল্লীর হিন্দু অধিবাসীদের উপর বিএনপি-এর গুণ্ডা বাহিনীর হামলা হল। হামলার শিকার আমি নিজেও হলাম। এই সময় মাহমুদুল হাসান মানিকের নেতৃত্বে দিনাজপুরের ওয়ার্কার্স পার্টি আমাদের সমর্থনে এগিয়ে আসে, যেটা ছিল আমাদের জন্য বিরাটভাবে সহায়ক ঘটনা। তৎকালে জেলায় ওয়ার্কার্স  পার্টির মোটামুটি শক্ত অবস্থান ও বলিষ্ঠ ভূমিকা বিএনপি-এর আক্রমণাত্মক ভূমিকাকে অনেকাংশে প্রতিহত করে। এই অবস্থায় আমি বিশেষ করে হিন্দু পল্লীকে রক্ষার প্রয়োজনে একটা পর্যায়ে হিন্দু পল্লীর নিরাপত্তার দায়িত্ব ওয়ার্কার্স পার্টির হাতে তুলে দিয়ে এলাকা ছেড়ে ঢাকায় আসি।*

--------------------------

*এই সমগ্র ঘটনার একটা বিবরণ আমি ‘হিন্দু সমাজ এবং একটি কেস-স্টাডি’ নামক নিবন্ধে কিছু বিস্তারিতভাবে দিয়েছি। এটা ‘বঙ্গরাষ্ট্র’-এ দেওয়া আছে। লিংক : http://bangarashtra.net/article/1398.html

--------------------------

প্রায় অজপাড়াগাঁর একটা স্কুল যদি লুটপাটের জন্য এমন লোভনীয় জায়গা হতে পারে তবে দেশের রাজধানীর একটা বিখ্যাত স্কুল কেন তার চেয়ে বহুগুণ বেশী লোভনীয় হবে না? কে জানে, আসিফ নজরুলের মতো ব্যক্তির নিকট একজন পিতা-মাতার শোকাশ্রুও এই কারণে এমন মূল্যহীন হয়েছিল কিনা! কম দুঃখে কি কবি জীবনানন্দ লিখেছিলেন, ‘যাদের হৃদয়ে কোনো প্রেম নেই, প্রীতি নেই, করুণার আলোড়ন নেই/ পৃথিবী অচল আজ তাদের সুপরামর্শ ছাড়া’!

সুতরাং সুপরামর্শের জন্য আজ বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারে এমন এক ব্যক্তির গুরুত্বপূর্ণ উপাদেষ্টা হিসাবে প্রয়োজন হয়। তার অন্তর্ভুক্তির জন্য আমি ডঃ ইউনূস নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকারের ভূমিকাকে নাকচ করতে রাজী নই। তবে এই সরকারের যে সকল দুর্বলতা সকলের নিকট দৃশ্যমান হচ্ছে তার একটা বড় উৎস হচ্ছে আসিফ নজরুলের বিভিন্ন সময়ের বক্তব্য ও ভূমিকা। অন্য আরও অনেক উপদেষ্টার ভূমিকাও সন্তোষজনক নয়। এই বিষয়টাই হয়ত অনেক উপদেষ্টা বুঝতে পারছেন না যে, তারা বিগত তেপ্পান্ন বছরের বিভ্রান্তি ও ষোলো বছরের দাসত্বের উত্তরাধিকারের শৃঙ্খল ভেঙ্গে এক নব জাগরণের পথে বাংলাদেশের যাত্রার কাণ্ডারী হয়েছেন। এই যাত্রা মূলত ঝড়ের পথে যাত্রার মতো। যারা শক্তভাবে, বুদ্ধিমত্তা ও সাহসের সাথে এই ঝড়ের অনিশ্চিত পথে চলতে পারবেন তারা টিকবেন, বাকীরা ঝরে যাবেন। তবে আমি মনে করি পরিপূর্ণ বিজয় অর্জনের আগে এই যাত্রা অপ্রতিহত গতিতে এগিয়ে যাবে।

আসলে যে নামেই অভিহিত করা হোক বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার ছাত্র-জনতার বিপ্লবী অভ্যুত্থানের সৃষ্টি। যার নেতৃত্বে ও যেভাবেই পরিচালিত হোক এই সরকার তার স্রষ্টা ছাত্র-জনতার বিপ্লবী অভ্যুত্থানের প্রতি দায়বদ্ধতা থেকে মুক্ত হতে পারেবে না। নূতন বিপ্লবের পথে যাত্রা কেবল শুরু হয়েছে। সামনে পাড়ি দিতে হবে আরও অনেক পথ। কিন্তু তাতে দমে যাবার কোনও কারণ নাই। সব ঝড়-ঝঞ্ঝা, চড়াই-উৎরাই পার হয়ে বিজয়ী আমাদের হতেই হবে, বিপ্লবকে আমাদের সম্পূর্ণ করতেই হবে। তবে আমার নিজের ধারণা এই বিপ্লবের পথযাত্রায় সাফল্যের সাথে এগিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় পূর্বশর্ত হল বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারে ছাত্র-জনতার বিপ্লবী অভ্যুত্থানের কেন্দ্রীয় শক্তি স্বরূপ ছাত্র ও তরুণদের আরও অনেক বেশী সংখ্যায় অন্তর্ভুক্তিকরণ।

তবে এইটুকুই যথেষ্ট নয়। বরং এটা বুঝতে হবে যে, বিশেষ করে নির্বাচন প্রক্রিয়ায় যারা ক্ষমতায় যায় তারা কেন দুর্নীতিগ্রস্ত হয়। আমার অভিজ্ঞতা থেকে আমি যেটা বুঝেছি সেটা হচ্ছে দুর্নীতি হচ্ছে বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় সমস্যা। এ ক্ষেত্রে আওয়ামী লীগের ভূমিকা অতীব কদর্য হলেও বিএনপিও তার ঊর্ধ্বে খুব একটা উঠতে পারে নাই। আগামী পথযাত্রায় নির্বাচনের প্রশ্নের তুলনায় এই প্রশ্নগুলির সদুত্তর খুঁজাটাই সবচেয়ে বড় করণীয় বলে মনে হয়। তাহলে আমরা আমাদের সঠিক কর্মনীতিও নির্ধারণ করতে পারব।

২১ অক্টোবর, ২০২৪

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
Archive
 
সাম্প্রতিক পোষ্টসমূহ