লিখেছেনঃ শামসুজ্জোহা মানিক, আপডেটঃ October 31, 2024, 12:00 AM, Hits: 73
(১) বিএনপি-এর ব্যর্থতার তাৎপর্য
মানুষের চিন্তার গতিধারায় অভিজ্ঞতার মূল্য খুব বেশী। সুতরাং এ দেশে রাজনীতিতে নূতন ও প্রগতিশীল শক্তির উত্থান সম্ভাবনার কথা ভাবতে গিয়ে অতীতে আমি বিএনপি-এর কথা বাধ্য হয়ে ভাবতাম। অভিজ্ঞতা থেকে দেখতাম যে, প্রচলিত ও প্রতিষ্ঠিত মূলধারার রাজনৈতিক দল থেকে এ দেশে নূতন ও প্রগতিশীল রাজনীতির শক্তি বেরিয়ে আসে। যেমন ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর মওলানা ভাসানীর নেতৃত্বে মুসলিম বাঙ্গালীরা মুসলিম লীগ পরিত্যাগ করে ১৯৪৯ সালে গঠন করে প্রথমে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ। অসাম্প্রদায়িক রূপ দিতে চেয়ে ১৯৫৫ সালে আওয়ামী মুসলিম লীগ থেকে মুসলিম শব্দ বাদ দিয়ে দলের নামকরণ হল আওয়ামী লীগ। সেটাও হল মওলানা ভাসানীর উদ্যোগে। ১৯৫৬ সালে পাকিস্তানের রাষ্ট্র ক্ষমতায় যাবার পর আওয়ামী লীগের নেতা সোহরাওয়ার্দী ও শেখ মুজিব ক্ষমতার লোভে আওয়ামী লীগের কর্মসূচীর বিরুদ্ধে ভূমিকা নিলে এবং কর্মসূচীর প্রতি অঙ্গীকারের প্রশ্নে নিজ দলে সংখ্যালঘু হলে দলের প্রতিষ্ঠাতা ও সভাপতি মওলানা ভাসানী ১৯৫৭ সালে দলের সৎ ও আদর্শনিষ্ঠ লোকদের নিয়ে আওয়ামী লীগ পরিত্যাগ করে গঠন করেন ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি বা সংক্ষেপে ন্যাপ। এরপর সমগ্র পাকিস্তান কালে এ দেশে প্রগতিশীল, অসাম্প্রদায়িক ও সমাজতান্ত্রিক রাজনীতির বিকাশ ও বিস্তারে ভাসানীর নেতৃত্বে ন্যাপের ভূমিকা ছিল অতুলনীয়।
বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার পর এবং ভাসানীর মৃত্যুর পর ন্যাপের মূলধারা বিএনপি-তে যোগ দিলে ন্যাপের ভূমিকা ফুরালো। ১৯৫৭ পরবর্তী আওয়ামী লীগের কাছ থেকে আমার প্রত্যাশা ছিল না। বরং এটাকে সাধারণভাবে মনে হত অর্থ ও ক্ষমতা লোভী, প্রতারক ও বিশ্বাসঘাতকদের দল। সুতরাং জাতীয় রাজনীতির অন্যতম প্রধান দল হিসাবে বিএনপি-এর দিকে একটা প্রত্যাশা নিয়ে দৃষ্টি দিতাম। ভাবতাম যদি কোনও দিন এই দলের ভিতর থেকে নূতন ও প্রগতিশীল কোনও শক্তি ধর্মমুক্ত, বাঙ্গালী জাতীয়তাবাদী ও একই সাথে গণতান্ত্রিক বিপ্লবের চেতনা নিয়ে বেরিয়ে আসতে পারে তবে হয়ত আমি আমার প্রত্যাশিত রাজনৈতিক শক্তির আর কিছু না হোক তার সূচনাকে খুঁজে পাব। অবশ্য বিএনপি-এর মূল কাঠামো থেকে প্রত্যাশা ছিল না। কারণ এর রাজনৈতিক আদর্শ ও চর্চাকে আমি সমর্থন করতাম না। কিন্তু এর বাইরে আর কোথা থেকে কীভাবে শক্তি আসবে তা ভেবে পেতাম না।
এভাবে ২০২৩ সালের ২৮ অক্টোবর এল। আওয়ামী লীগীয় দুঃশাসন ও অপরাজনীতির বিরুদ্ধে সমগ্র জাতিকে নিয়ে দাঁড়াবার প্রত্যাশাকে নিদারুণভাবে হতাশ ক’রে আওয়ামী লীগ সরকারের হামলার মুখে বিএনপি বিনা-প্রতিরোধে পশ্চাদপসরণ করল। আসলে ঐ দিনটা ছিল আওয়ামী লীগের বিকল্প রাজনৈতিক শক্তি হিসাবে বিএনপি-এর উত্থান সম্ভাবনার মৃত্যুর দিন।
বিগত ২৮ অক্টোবর তারিখে যদি বিএনপি আওয়ামী লীগের হামলায় ভয় না পেত তাহলে কী হত? আন্দোলনে হয়ত কয়েকশত মানুষের মৃত্যু হত। আপাতদৃষ্টিতে বিএনপি-এর বিরাট ক্ষতি হত। কিন্তু নৈতিকতা ও জনসমর্থনের বিচারে বিএনপি-এর যে বিরাট লাভ হত সেটা হতে পারত অতুলনীয়। ছাত্র-জনতার আন্দোলনকে হাসিনা সরকার রক্তের বন্যায় ভাসিয়ে দিতে চেয়েছিল। কিন্তু ফল কী হয়েছে? ছাত্র-জনতার রক্তের বন্যায় হাসিনা ও তার দলবল নিজেরাই ভেসে গেছে।
গত আন্দোলনের এক অর্থে অসংগঠিত ছাত্রদের মতো সাহস যে বিএনপি-এর নেতৃত্ব দেখাতে পারে নাই তার কারণ বুঝার জন্য বিএনপি-এর গঠন প্রক্রিয়ার দিকে দৃষ্টি দেওয়া উচিত বলে মনে হয়। আসলে দলটা গঠিত হয়েছিল সামরিক শাসকের আশ্রয়ে এবং এর গঠনের মূল শক্তি ছিল পরাজিত, ব্যর্থ ও হতাশ সাবেক বামপন্থীরা, যারা তাদের মূল গণ-রাজনৈতিক দল ন্যাপ ত্যাগ বা বিলুপ্ত করেছিল। প্রকৃতপক্ষে ক্ষমতার সঙ্গে যেতে চেয়ে তারা তাদের মূল আদর্শও পরিত্যাগ করেছিল। তাদের এই অন্তর্গত দুর্বলতা তাদের রাজনৈতিক কর্মধারাকে ভিতর থেকেও অধিকার করে থেকেছে বলে লীগ বিরোধী দীর্ঘকালের আন্দোলনে এত ত্যাগ ও কষ্ট করার পরেও আন্দোলনের চূড়ান্ত মুহূর্তে সাহসী সিদ্ধান্তের অমন অভাব।
এটা ঠিক যে, বিএনপি-এর সব নেতা আওয়ামী লীগ নেতাদের মতো চোর-বাটপাড়-লুঠেরা না। কিন্তু সাহসীও না। আওয়ামী লীগের মতো একটা দানবের মোকাবিলায় দাঁড়াবার জন্য সাহসের প্রয়োজন ছিল সবচেয়ে বেশী। সেটা যে তার নাই সেটা প্রমাণিত। এবং সামরিক শাসকের আশ্রয়ে গঠিত বিএনপি-এর সামগ্রিক চরিত্র যে আওয়ামী লীগের চেয়ে খুব একটা উন্নত না সেটা তার ক্ষমতায় থাকাকালীন সময়ে তা প্রমাণ করেছে। আওয়ামী লীগের পতন পরবর্তী কালেও এখন বিএনপি-এর সবাই না হলেও অনেক নেতা-কর্মী সাম্প্রতিক দিনগুলিতে সেটা প্রমাণ করছে। দলের হাইকম্যান্ড অনেক চেষ্টা করেও তাদেরকে সামলাতে পারছে না। এখনই এই অবস্থা!
এই দল ক্ষমতায় গেলে কী করবে? বিগত ৫৩ বৎসর ধরে বাংলাদেশে যে দুর্বৃত্তায়নের ব্যবস্থা গড়ে উঠেছে সেটাকে কি ভাঙ্গবার ক্ষমতা বিএনপি-এর আছে বা হবে? হাসিনা সরকারের পতনের পর নির্বাচনের জন্য বিএনপি-এর অস্থিরতা থেকে এটা স্পষ্ট যে, লুটপাটের যে ব্যবস্থা সারাদেশে গড়ে উঠেছে সেটার উচ্ছেদ তার নিকট মোটেই বিবেচ্য নয়। বিশেষ করে আওয়ামী লীগের বিগত ১৬ বৎসরের শাসনকালে সমগ্র রাষ্ট্র ও সমাজের যে ভয়ঙ্কর দুর্বৃত্তায়ন হয়েছে তার ফলে এ দেশে আমূল সামাজিক ও রাষ্ট্রিক পরিবর্তন ছাড়া যে গতানুগতিক নির্বাচন প্রক্রিয়ায় কোনও ন্যায়-নীতিনিষ্ঠ ও দেশপ্রেমিক শক্তির পক্ষে ক্ষমতায় যাবার প্রশ্ন উঠে না এই সহজ সত্য বুঝবার মন বা ইচ্ছা বিএনপি ও তার সমমনা দলগুলির নাই। আমাদের মতো দেশগুলিতে নির্বাচন মানে টাকার খেলা। একটা নির্বাচন-নির্ভর দলকে টিকিয়ে রাখতে যে বিপুল অর্থের প্রয়োজন হয় তা যোগান দিতে পারে কারা? আমাদের সহজ বুদ্ধি ও অভিজ্ঞতা কী বলে? সুতরাং যতই সদিচ্ছা নিয়ে যাত্রা শুরু করা যাক জনপ্রিয় ও বৃহৎ দলগুলা হয়ে পড়ে দুর্নীতিবাজ ধনী বা অর্থ-বিত্তবানদের খেলার পুতুল। এইসব দলের নেতৃত্বের কাঠামো যাদের আর্থিক সমর্থনপুষ্ট হয় তাদের স্বার্থ রক্ষায় বাধ্য হয়।
আসলে বিএনপি-এর ব্যর্থতার মূলে রয়েছে এ দেশে দুর্নীতির মাধ্যমে যে বিত্তবান শ্রেণী গড়ে উঠেছে নীতিনৈতিকতা বিহীন সেই শ্রেণীর উপর বিএনপি-এর নিজেরও নির্ভরতা। হয়ত বলা হবে লীগের তুলনায় বিএনপি কিছু কম লুঠেরা ও কিছু কম সন্ত্রাসী। কিন্তু সুযোগ ও পরিস্থিতির আনুকূ্ল্য বিএনপি-কেও আওয়ামী লীগের মতো দুর্বৃত্ত ও লুঠেরা করে তুলতে পারে মূলত একই ধরনের শ্রেণীভিত্তির উপর এই উভয় দল প্রতিষ্ঠিত থাকায়। এই ধরনের অনৈতিক শ্রেণীর উপর বিএনপি-এর অস্তিত্ব প্রতিষ্ঠিত বলে এত বিপুল জনসমর্থনের ভিত্তি সত্ত্বেও সময়ের চাহিদা পূরণে ২০২৩ সালের ২৮ অক্টোবরে বিএনপি-এর অমন নিদারুণ ব্যর্থতা। এরপর আর বিএনপি-এর পক্ষে ঘুরে দাঁড়ানো সম্ভব হয় নাই।
ইতিহাসের লগ্ন হাতছাড়া করতে নাই। তাহলে সবকিছু হারাতে হয়। বিএনপি সেই কাজ করেছিল। এর ফলে এ দেশের রাজনীতিতে যে চূড়ান্ত রকম শূন্যতা সৃষ্টি হয়েছিল সেটা পূরণে সমর্থ হয়েছিল বলতে গেলে বিদ্যমান রাজনীতির বলয় বহির্ভূত ও অপরিচিত এবং আপাতদৃষ্টিতে সম্পূর্ণ অসংগঠিত ছাত্র ও তরুণ সমাজ। এই ছাত্র আন্দোলন শেষ পর্যন্ত বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন নাম নিয়ে প্রায় ঝড়ের গতি ও শক্তি নিয়ে দাঁড়িয়ে যায় এবং লক্ষ লক্ষ জনতার অংশগ্রহণে এক প্রলয়ঙ্করী ঝড়ের শক্তি নিয়ে শেখ হাসিনার ১৬ বছরের দুঃশাসনের সাজানো বাগানকে তছনছ করে দিয়ে গেছে।
কিন্তু আওয়ামী লীগ গেলে কী হবে? যে আর্থ-সামাজিক ব্যবস্থার উপর তা প্রতিষ্ঠিত ছিল এবং রাষ্ট্রক্ষমতায় থেকে যেটাকে তা আরও পুষ্ট ও শক্তিশালী করেছিল সেটা রয়েছে অক্ষত ও অপরিবর্তিত। সেটা শুধু রাষ্ট্রের প্রশাসনিক কাঠামো নয়, অধিকন্তু সমগ্র আর্থ-সামাজিক ব্যবস্থাও। এটা এখন সুস্পষ্ট যে, বাংলাদেশের বিদ্যমান দুর্নীতিগ্রস্ত আর্থ-সামাজিক ব্যবস্থা পরিবর্তন করতে চাইলে বিদ্যমান ধনিক ও বিত্তবান শ্রেণীকে উচ্ছেদ করা ছাড়া উপায় নাই। এর অর্থ হল আমূল পরিবর্তনের লক্ষ্যাভিমুখী সামাজিক বিপ্লবের কর্মসূচী নিয়ে আজ এ দেশকে এগিয়ে যেতে হবে। এখন প্রশ্ন হল কাজটা করবে কে বা কারা? বিএনপি-কে দিয়ে কাজটা হবার প্রশ্ন উঠে না। তাহলে কারা করবে?
এই প্রশ্নের উত্তর পাওয়াটা অবশ্য এখন আর কঠিন কিছু না। যারা দানবীয় হাসিনা সরকারের পতন ঘটাতে সক্ষম হয়েছে কাজটা মূলত তারাই করবে। হাসিনার পতন ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থান দ্বারা হলেও এই অভুত্থানের কেন্দ্রীয় শক্তি কিন্তু ছাত্র ও শিক্ষিত তরুণ সম্প্রদায়। সমগ্র জনতার ভূমিকা থাকলেও বিশেষ করে ছাত্রদের সাহসী সংগ্রাম ও আত্মদান জনতাকে এভাবে উদ্বুদ্ধ করেছিল। অতীতেও এ দেশে স্বৈরাচার অবসানে মূলত ছাত্র সমাজ বারবার সাহসী ও আত্মদান মূলক ভূমিকা পালন করলেও সেগুলির সঙ্গে এবারকার আন্দোলনের একটা গুরুতর পার্থক্য রয়েছে। অতীতের ঐ সকল আন্দোলনে প্রতিষ্ঠিত রাজনৈতিক দল বা নেতৃত্ব শেষ পর্যন্ত আন্দোলনের নিয়ন্ত্রণ নিজেদের হাতে নিতে পেরেছিল। আরও সঠিকভাবে বললে বলতে হয় ছাত্রদের ঐসব আন্দোলন প্রতিষ্ঠিত রাজনৈতিক নেতৃত্বের ছত্রছায়ায় পরিচালিত হয়েছিল। ’৫২-এর ভাষা আন্দোলন, ’৬৯-এর গণ-অভ্যুত্থান, ’৭১-এর স্বাধীনতা যুদ্ধ কিংবা ’৯০-এর গণ-অভ্যুত্থান কোনওটিই এর ব্যতিক্রম নয়। ছাত্র-তরুণদের জয়ের ফসল পুরাতন ও প্রতিষ্ঠিত নেতৃত্বের হাতে চলে যায় এবং পুরাতন ও প্রতিষ্ঠিত নেতৃত্ব তাদের বোধ-বুদ্ধি অনুযায়ী শেষ পর্যন্ত পুরাতন ধারায় রাজনীতিকে নিয়ে যায়। সুতরাং সমাজের বিপ্লবী রূপান্তর ঘটে না এবং কোনও পরিবর্তনই সমাজকে তার কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে নিতে পারে না।
(২) ছাত্ররা কি বিপ্লবী শক্তি?
এখন আমরা যে প্রশ্নের উত্তর খুঁজব সেটা হল ছাত্র সমাজ কি আমাদের দেশে বিপ্লবী শক্তির ভূমিকা পালন করতে পারে আর সেটা পারলে কেন তা পারে? আমাদের দেশের বাস্তব অভিজ্ঞতা থেকে ছাত্রদের যতই প্রগতিশীল কিংবা বিপ্লবী ভূমিকা দেখা যাক না কেন অতীতে সর্বদা দেখতাম যারা এ দেশে প্রগতিশীল ও বাম আন্দোলনের ধারক-বাহক হবার দাবীদার হত তারা আমাদের দেশে শ্রমিক ও কৃষকের কাল্পনিক বিপ্লবী চরিত্রের স্বপ্নে বিভোর হয়ে বাস্তবের আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত ছাত্র-যুব সমাজের প্রগতিশীল ও বিপ্লবী ভূমিকাকে দোদুল্যমান পেটিবুর্জোয়া, সুবিধাবাদী ও অনির্ভরযোগ্য ছাত্র-যুব সমাজের ভূমিকা বলে উড়িয়ে দিত। ছাত্র শব্দ ছিল তাদের অনেকের কাছে ঘৃণা ও তাচ্ছিল্য প্রকাশের শব্দ, যা তারা প্রায়শ ব্যবহার করত। ষাটের দশকে আমি যতদিন কমিউনিস্ট রাজনীতির সঙ্গে ছিলাম ততদিন আমি দেখেছিলাম এই নেতারা ছাত্রদের ছাড়া অক্ষম হলেও নিজেরা ছাত্রদেরকে কী পরিমাণে ঘৃণা বা অবজ্ঞা করত।
আসলে এই ঘৃণা এসেছিল নিজেদের হীনমন্যতা থেকে, সাহসের অভাব বা ভীরুতা থেকে, এমনকি লেখাপড়া বা জ্ঞানেরও স্বল্পতা থেকে। তুলনায় পশ্চাৎপদ শ্রমিক ও কৃষকদের মধ্যে দীর্ঘ অবস্থান ও তাদের নিয়ে নিরন্তর সাংগঠনিক কর্মব্যস্ততা তাদেরকে প্রকৃতপক্ষে লেখাপড়া-বিমুখ পশ্চাৎপদ মানুষে পরিণত করত। সেই সঙ্গে তাদের অনেকের দীর্ঘকাল আত্মগোপনে থাকবার ফলে সমাজজীবন থেকে দীর্ঘ বিচ্ছিন্নতা তাদেরকে প্রকৃতপক্ষে নেতৃত্বদানে অক্ষম করত। এই পশ্চাৎপদ ও অক্ষম মানুষরা যখন ছাত্রদের উপর খবরদারি করত তখন তার পরিণতি কী হতে পারত তা সহজেই অনুমেয়। বামপন্থী নেতা ও কর্মীদের ত্যাগ ও আদর্শনিষ্ঠাকে খাটো না করেই তাদের এই সীমাবদ্ধতাকে আমাদের বুঝতে হবে।
২০২৪-এর জুলাই-আগস্টে ছাত্রদের বিপ্লবী অভ্যুত্থানের পরেও আমরা একই ধরনের না হলেও কাছাকাছি ভাবনার প্রকাশ অনেকের কাছ থেকেই দেখতে পাচ্ছি। কেউ কেউ এমন বলছেন যে, ছাত্রদের যা করার ছিল তারা তা করেছে; এখন তারা নিজেদের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ফিরে গিয়ে লেখাপড়ায় মনোনিবেশ করুক। তার মানে আন্দোলনের নেতৃত্ব ও ফল বা গতিধারা ছেড়ে দিবে পুরাতন বয়স্ক ও অভিজ্ঞ লোকদের তথা নেতাদের হাতে। আসলে এখনকার এই বয়স্ক লোকরাই এক সময় ছাত্র বা তরুণ ছিল। তখন তারা চিন্তায় বা আকাঙ্ক্ষায় যা-ই থাক সময়ের পরিক্রমায় এবং এই অধঃপতিত সমাজের সঙ্গে তাল মিলিয়ে বাঁচতে গিয়ে তাদের অনেকেরই নৈতিক অবস্থান যে আর সেই তরুণ বয়সের মতো নাই সেটা বুঝতে হবে। এরা বিপ্লবী হওয়া তো দূরের কথা তার ধারেকাছেও যাবার ক্ষমতা রাখে না।
হয়ত বলা হবে ছাত্ররা বিপ্লব করবে কীভাবে? তাদের বয়স কতটুকু, বুদ্ধি ও অভিজ্ঞতা কোথায়, পড়াশুনা কতটা যে তারা বিপ্লব করবে? তারা বিপ্লবের সূচনা ঘটিয়েছে তো কী হয়েছে? এখন তারা পাঠকক্ষে ফিরে গিয়ে অধ্যয়নে মনোনিবেশ করবে! এখন অনেকে ছাত্রদেরকে তারস্বরে সেই পরামর্শ দিয়েও চলেছেন। অথচ রাষ্ট্র পরিচালনা কিংবা বিপ্লব করার জন্য বয়স যে তেমন কোনও বিষয় না এমন দৃষ্টান্ত পৃথিবীতে বহু আছে। আসল বিষয় হল ক্ষমতা। ক্ষমতা হাতে থাকলে বুদ্ধি, পরামর্শ সবই হাজির হয়। মোগল সম্রাট হুমায়ুনের মৃত্যু হলে সম্রাট আকবর মাত্র ১৩ বৎসর বয়সে সিংহাসনে আরোহণ করেছিলেন। একটা অনভিজ্ঞ কিশোর কীভাবে এক বৃহৎ রাষ্ট্র পরিচালনা করেছিলেন? তার কী ছিল? সেই অর্থে জ্ঞান, অভিজ্ঞতা, বুদ্ধি, পুঁথিগত বিদ্যা — কিছুই ছিল না। কিন্তু হাতে ছিল রাষ্ট্র ক্ষমতা। সেটা যে সূত্রেই আসুক।
ঠিক আছে, এই উদাহরণে হয়ত অনেকে আপত্তি জানাবেন। আর সম্রাট আকবরের ব্যাপারটা বংশগত রাজতন্ত্রের সঙ্গে যুক্ত। কিন্তু একালের এক বিপ্লবী নেতা ফিদেল ক্যাস্ট্রোকে কীভাবে উড়িয়ে দেওয়া যাবে? কিউবার দুর্নীতিগ্রস্ত ও অত্যাচারী একনায়ক বাতিস্তার বিরুদ্ধে তিনি প্রথম অস্ত্র ধরেন তার বয়স যখন ২৪ বৎসর সেই সময়। তখন তিনি অল্পদিন হল লেখাপড়া শেষ করে আইনজীবী হিসাবে কাজ করছিলেন। সেই সময় কিছু সংখ্যক তরুণকে সঙ্গে নিয়ে কিউবার মনকাদার ব্যারাক আক্রমণ করে পরাজিত ও বন্দী হন। তার প্রথম চেষ্টা ব্যর্থ হলেও তিনি থেমে থাকেন নাই। আসলে বাতিস্তার নিষ্ঠুর লুঠেরা শাসনের বিরুদ্ধে সশস্ত্র বিদ্রোহ ছিল কিউবায় সময়ের দাবী। সুতরাং বিদ্রোহের প্রথম প্রচেষ্টায় ব্যর্থ হলেও এই বিদ্রোহের মাধ্যমে সাহসী তরুণ ক্যাস্ট্রো কিউবার জননন্দিত বীর নায়কে পরিণত হন।
এরপর তিনি ১৯৫৬ সালে ২৬ বৎসর বয়সে যখন দ্বিতীয় বার সশস্ত্র যুদ্ধ শুরু করেন তখন সমগ্র কিউবার লক্ষ লক্ষ মানুষ তার সমর্থনে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে। মাত্র আড়াই বৎসর যুদ্ধ করে ক্যাস্ট্রো পরাক্রমশালী বাতিস্তা সরকারকে উৎখাত করে ক্ষমতা দখল করেন। ক্যাস্ট্রো যখন ক্ষমতা দখল করেন তখন তার বয়স মাত্র ২৯ বৎসর। না, তিনি রাষ্ট্র বিপ্লবের শিক্ষা নিবার জন্য বিশ্ববিদ্যালয় বা আইন পেশায় ফিরে যান নাই। অভিজ্ঞতা, জ্ঞান, বুদ্ধি? ক্ষমতার কেন্দ্রে থাকলে ওসব এসে যায়। চাইলে আসে। ক্যাস্ট্রোর ক্ষেত্রে কীভাবে এসেছিল সেটা যারা কিউবা বিপ্লবের ইতিহাস সম্পর্কে কিছু জানেন তাদেরকে বলে দিতে হবে না।
তবু এটুকু বলি যে, সে সময় কিউবায় একটা সমাজতান্ত্রিক দল ছিল যেটা ক্যাস্ট্রোর বিপ্লবের সঙ্গে না থাকলেও তাদের ছিল প্রগতিশীল আন্দোলনের দীর্ঘ অভিজ্ঞতা ও ঐতিহ্য। তারা যখন ক্যাস্ট্রোর বিপ্লবকে সমর্থন জানালো তখন ক্যাস্ট্রো বিপ্লবকে রক্ষার প্রয়োজনে তাদেরকে সঙ্গে নিয়ে গঠন করলেন বর্তমান কিউবার কমিউনিস্ট পার্টি। তিনি কিন্তু নেতৃত্বকে ছাত্র ও তরুণ প্রজন্মের হাতছাড়া করেন নাই। কিউবা বিপ্লব সম্পর্কে যাদের কিছু ধারণা আছে তারা জানেন যে, এই বিপ্লব মূলত ছাত্র ও তরুণ তথা তরুণ প্রজন্মের বিপ্লব। এই বিপ্লবে পরবর্তী কালে যারা আসুক তারা সবাই মূলত তরুণদের নেতৃত্বকে মেনে নিয়েই এই বিপ্লবের হাল ধরেছিলেন। অর্থাৎ মূল নেতৃত্ব ছিল ফিদেল ক্যাস্ট্রো ও তার সঙ্গী তরুণ যোদ্ধাদের হাতে।
বাংলাদেশে অন্তর্বর্তী সরকার গঠন করতে গিয়ে সাম্প্রতিক ছাত্র-জনতার আন্দোলনের মূল বা কেন্দ্রীয় শক্তি স্বরূপ ছাত্ররা নেতৃত্বের অনেকটাই হাতছাড়া করেছে। হয়ত পরিস্থিতি তাদেরকে এ ধরনের আপোস করতে বা ছাড় দিতে বাধ্য করেছে। বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের যেসব দুর্বলতা আমরা এখন দেখছি তার কারণ হল এই সরকারের মূল শক্তিভিত্তি ছাত্ররা হলেও তারা এর নেতৃত্বের মূল অংশ হতে পারে নাই। যে কথা বললাম হয়ত সেই সময়কার পরিস্থিতি ছাত্রদের দিক থেকে এই ছাড় দিতে বাধ্য করেছিল। সেই পরিস্থিতির জন্য ডঃ ইউনূসের নেতৃত্ব হয়ত যথাযথ ছিল। কিন্তু পরিস্থিতি দ্রুত বদলাচ্ছে, আরও বদলাবে। এবং শেখ হাসিনার পতনের পর দেশের বিপ্লবের অবরুদ্ধ গতিধারা মুক্ত হয়েছে। এটাই স্বাভাবিক যে, বিপ্লবের একটা পর্যায়ের চাহিদা পূরণের জন্য ইউনূসের মত ব্যক্তির প্রয়োজন হলেও পরবর্তী সময়ের চাহিদা পূরণ করতে না পারলে নূতন কারও হাতে বিপ্লবকে এগিয়ে নিবার দায়িত্ব দিয়ে তাকে বিদায় নিতে হবে। এবং এটাই স্বাভাবিক হবে যে, এখনকার ছাত্র বা তরুণদের মধ্য থেকে কেউ উঠে আসবে সেই দায়িত্ব নিতে।
ভবিষ্যতের গতিধারা সম্পর্কে সবটা বলা না গেলেও এটা বলা যায় যে, ১৯৭১-এর বিপ্লবের পর এবার অর্থাৎ ২০২৪-এর জুলাই-আগস্টে এ দেশে প্রকৃতপক্ষে দ্বিতীয় বিপ্লবের সূচনা হয়েছে। ১৯৭১-এর সাফল্যের কোনও কারণ ছিল না, প্রথমত, আওয়ামী লীগের নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হওয়ায়, দ্বিতীয়ত, আওয়ামী লীগের মাধ্যমে যুদ্ধের উপর ভারতের সর্বাত্মক নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠিত হওয়ায়। কিন্তু এবার ৫৩ বৎসর পর যে বিপ্লবের সূচনা হয়েছে তা হয়েছে আওয়ামী লীগীয় শাসন উৎখাতের স্বাধীন আন্দোলন হওয়ায়, যেখানে কোনও বহিঃশক্তির নিয়ন্ত্রণ ছিল না।
এই আন্দোলন এখনও পরিণত রূপ নিয়েছে সে কথা বলা যাবে না। বস্তুত এটা একটা বিপ্লবের সূচনা মাত্র; ৫৩ বৎসর ধরে বাংলাদেশে যে আপাদমস্তক দুর্নীতিগ্রস্ত ও নির্যাতনমূলক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে তা থেকে মুক্তির একটা বিপ্লবের সূচনা বলা যায় এটাকে। এই বিপ্লবে দুর্বৃত্ত ও মাফিয়াদের দল আওয়ামী লীগীয় বলয়ের বাইরে সমগ্র জাতি ও জনগণের অংশগ্রহণ থাকলেও নেতৃত্বটা যে মূলত ছাত্র-যুব সমাজ দিয়েছে সেটাই নির্ভেজাল সত্য। ছাত্রদের আন্দোলনে সমগ্র জনগণ অংশ নিয়েছে এটা সত্য। কিন্তু এটা এভাবে একটা বিপ্লবী অভ্যুত্থানে পরিণত হতে পেরেছে ছাত্র ও তরুণদের নেতৃত্বমূলক ভূমিকা এবং অকাতরে ও নির্ভয়ে আত্মদানের কারণে। এ থেকেই উৎসারিত হয়েছে সমাজ ও জাতির ভিতর থেকে গণ-অভ্যুত্থানের শক্তি। সুতরাং সূচিত বিপ্লবের নেতৃত্ব সেদিনই পূর্ণতা পাবে যেদিন ছাত্র ও তরুণরা তাদের দৃঢ়তা ও সাহস নিয়ে বিপ্লবের বলগা মূলত নিজেদের হাতে তুলে নিবে। প্রবীণরাও তাদের অভিজ্ঞতা, জ্ঞান ও বুদ্ধি নিয়ে থাকবে। তবে তাদের মূল ভূমিকা হবে বিপ্লবের সহায়কের, বিপ্লবের সাথীর। যার যেটা প্রাপ্য তাকে সেটা দিতে হয়। সাহস ও দৃঢ়তার অধিকারী যে ছাত্র ও তরুণরা, যারা তাদের অভিভাবক ও বয়স্কদের মতো এখনও প্রচলিত ব্যবস্থার অংশ হয়ে উঠে নাই, এই ব্যবস্থার সঙ্গে প্রতিমুহূর্তে আপোস করে বাঁচতে বা টিকে থাকতে শিখে নাই, ফলে নষ্ট ব্যবস্থার প্রতি যাদের মনে কোনও দুর্বলতা নাই, অথচ যাদের আছে আধুনিক যুগের শিক্ষাজনিত যুগমনস্কতা, এবং শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে বিরাট সংখ্যায় একত্রে অবস্থানের কারণে যুথবদ্ধতা প্রবল শক্তিমান সেই ছাত্র ও তরুণদেরকেই আজ জাতিকে নেতৃত্ব দিতে এগিয়ে আসতে হবে। নূতন বিপ্লবের সূচনার পর দেশ পুনর্গঠনের প্রধান দায়িত্ব ছাত্র ও তরুণদের হাতে অর্পণ এখন সময়ের দাবী। তারা এখনও যতই অসংগঠিত হোক হাসিনা সরকারকে উচ্ছেদ ও বিতাড়নের মাধ্যমে তারাই এখন নূতন ক্ষমতার প্রকৃত কেন্দ্র গঠন করেছে। বস্তুর বিকাশের নিয়মে এই ক্ষমতা কেন্দ্রের ক্রমবিকাশ ও সংগঠিত রূপ গ্রহণ এখন অপ্রতিরোধ্য গতিতে এগিয়ে যাবে। ক্ষমতা সবকিছুকেই আকৃষ্ট করতে পারে — শুধু অর্থ নয়, উপরন্তু জ্ঞান, অভিজ্ঞতা ও বুদ্ধিও অর্থাৎ এসব যাদের থাকে তাদেরকেও। সুতরাং আজকের ছাত্ররাও চাইলে এইসব কিছুই পাবে। শুধু পাবার ইচ্ছা বা আকাঙ্ক্ষা থাকতে হবে। সেটা তাদের আছে অথবা এখনও কিছু সীমাবদ্ধভাবে থাকলেও সেটা এখন মুক্ত হতে বাধ্য। কারণ তারা তাদের বিপ্লবী ভূমিকা দ্বারা শুধু সমাজে বিপ্লবী আকাঙ্ক্ষাকে জন্ম দেয় নাই, অধিকন্তু বিপ্লবের কেন্দ্রীয় শক্তি হিসাবে নিজেরাও মুক্ত হয়েছে।
এই অধ্যায়ের সূচনা যে প্রশ্ন দিয়ে করেছিলাম তার উত্তরে এখন বলি যে আমাদের দেশে ছাত্ররাই সর্বদা সবচেয়ে বেশী বিপ্লবী ভূমিকা পালন করেছে। তবে অতীতে বিদ্যমান পুরাতন নেতৃত্বের চাপে তাদের ভূমিকা কখনও সেভাবে সামনে আসতে পারে নাই। তারা যেমন তলিয়ে গেছে তেমন এ দেশে বিপ্লবের সম্ভাবনাও তলিয়ে গেছে। এবারও যেন তেমন না হয়। ডঃ ইউনূসের সরকার নিয়ে আমি যেমন হতাশ নই তেমন খুব আশাবাদীও নই। বিপ্লবের চলমান গতিধারায় আমি এটাকে একটা পর্যায় হিসাবে দেখি। আমার মনে হয়েছে জুলাই-আগস্টে যে বিপ্লব ঘটেছে বা আরও সঠিকভাবে বললে সূচিত হয়েছে সেই বিপ্লবকে এগিয়ে নিতে ইউনূস নেতৃত্বাধীন সরকারের ভূমিকায় যে দুর্বলতা আমরা দেখছি সেটা সময়ের সাথে আরও স্পষ্ট হবে। ফলে সামনে আরও পরিবর্তন আমাদের জন্য অপেক্ষা করছে।
তবে আমার ধারণা বিপ্লব ব্যর্থ হবে না। কেননা আগামীতে ছাত্র ও তরুণ প্রজন্মের বিপ্লবী ভূমিকা আরও অনেক বেশী প্রবল ও মূর্ত রূপ নিয়ে জাতির সামনে উপস্থিত হবে। যে বিপ্লব তারা ঘটিয়েছে তাতে করে তাদের পক্ষে ব্যর্থ হবার কোনও অবকাশ নাই। তখন হয়ত ডঃ ইউনূস নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকারকে বিবেচনা করা হবে একটা বিপ্লবী সরকারের পূর্ববর্তী অন্তর্বর্তী সরকারের পর্যায় হিসাবে।
২৮-৩১ অক্টোবর, ২০২৪